১০. নতুন প্রজন্ম

০. নতুন প্রজন্ম

[বর্তমান প্রবন্ধটি রাসেল The new generation নামক একটি গ্রন্থের ভূমিকা রূপে লেখেন, যে গ্রন্থে বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদরা ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্ররাও লেখেন। রাশিয়া একমাত্র ‘রাষ্ট্র যা পুরোনো নীতি ও ধর্মীয় সংস্কারের অধীনে নেই’- রাসেলের এই ধরণের মন্তব্য লক্ষ করে বলা যায় এই প্রবন্ধটি অবশ্যই ১৯৩০ সালের দিকে রচিত। পরবর্তীকালে স্ট্যালিনের রাজত্বে যৌনতা সম্পর্কীয় নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠার সমস্ত চেষ্টাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় এবং এই বিষয়ে যে-সব আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাতে দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে সেখানে বেশি গোঁড়া বা অবদানমূলক ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। ১৯২০ সালে রাসেল নিজেই সেখানকার এই উন্নতির সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।]

এই গ্রন্থের পরবর্তী পাতাগুলোতে শিশুদের মঙ্গল করা ও তাদের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ লেখকেরা তাদের মতো প্রদান করেছেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে আমি সেই পথ সম্পর্কে আলোচনা করতে প্রস্তাব করি যে পথে নব্য জ্ঞান রূপান্তরিত হয়েছে এবং এখনও রূপান্তরিত হয়ে চলেছে অর্থাৎ ঐতিহ্যময় জীববিদ্যাগত সম্পর্কের পথ। আমি কখনই জ্ঞানের অভিপ্রায়মূলক ও উদ্দেশ্যমূলক প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করছি না। আমি সেই ধরণের জ্ঞানের প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করছি প্রাকৃতিক শক্তি হিসেবে যে জ্ঞান ভীষণভাবে কৌতূহলোদ্দীপক ও আশাতীত ধরণের ফল প্রদান করতে পারে। আমি নিশ্চিত যে জেমস ওয়াটের কখনই মাতৃতান্ত্রিক ধরণের পরিবার প্রতিষ্ঠা করবার ইচ্ছা ছিল না। যদিও এই বিষয়টিকে সম্ভবপর করে তুলে পুরুষ নিজের কাজের জায়গা থেকে বহু দূরে গিয়ে ঘুমোতে ভালোবাসে। গ্রামের জনসাধারণের মধ্যে এই রকম ঘটনাই দেখা যায়। শহরতলির পরিবারগুলোতে পিতার স্থান খুবই কম–বিশেষত তিনি যদি গলফ খেলেন যা তারা সাধারণত খেলে থাকেন তার শিশুর জন্য মূল্য প্রদান করে তিনি শিশুর জন্য কি কিনছেন তা দেখা কিছুটা কষ্টকর এবং কেবলমাত্র ঐতিহ্যের দিক থেকে তিনি তার শিশুকে দর-কষাকষির বস্তু ভাবছেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ করা যায়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার তার স্বর্ণযুগে পুরুষ মানুষকে প্রচুর সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। এই পরিবার তাকে পুত্র দিয়েছে যে পুত্র তাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখাশুনা করবে এবং তাকে বহু শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এখন যে শ্রেণীর অন্তর্গত হয়ে মানুষ বসবাস করে সেখানে তারা বিনিয়োগ করে অথবা তাদের উপার্জিত সঞ্চয়ের উপর নির্ভর করে বাঁচে, তাই এখন পিতা-পুত্র যতদিনই এক সঙ্গে থাকুক না কেন পুত্র এখন আর পিতার পক্ষে লাভজনক বা সুবিধাজনক নয়।

অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে যে নব্য জ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের যুগটিকে হঠাত্র যেমন জটিল করে তুলেছে অন্যদিকে তেমন কৌতূহলজনকও করে তুলেছে। পুরোনো যুগগুলোতে মানুষ প্রকৃতির অধীনে ছিল। সে দু’ধরনের প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল আবহাওয়া ও ফসলের উর্বরতা ইত্যাদি জড় প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল। আবহাওয়া ও ফসলের উর্বরতা ইত্যাদি জড় প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল, অন্যদিকে সে অন্ধ উত্তেজনাকর মানবিক প্রকৃতির অধীনস্থ ছিল যা তাকে জন্ম দিত ও যুদ্ধ করাত। পুরুষত্বহীনতা বা অক্ষমতার ফলজনিত বোধ ধর্মের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। কর্তব্যের মধ্যে ভয়কে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে এবং নৈতিক উল্কর্ষ বা ধর্মের (Virtue) মধ্যে বিতৃষ্ণাকে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে ধর্ম তার কাজ করত। কতিপয় নমুনা হিসেবে এখনো যারা বিদ্যমান সেইসব আধুনিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র। বস্তুজগৎ তাদের কাছে এখন কোন স্বীকৃত বিষয় নয় যা ধন্যবাদের সঙ্গে ও প্রার্থনাপূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে তাদের গ্রহণ করতে হবে। বস্তুত জগৎ তাদের কাছে বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের জন্য একপ্রকার কাঁচামালের মতো। মরুভূমি এমন একটি স্থান যেখানে জলকে অবশ্যই আনতে হয়, কিন্তু ম্যালেরিয়া জলাভূমি এমন একটা জায়গা যেখান থেকে জলকে সরাতে হয়। মানুষ এমন কিছুকে অনুমোদন করে না যা তার সঙ্গে প্রাকৃতিক শক্রতা চালিয়ে যেতে পারে। সুতরাং পদার্থগত প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের লড়াইতে শয়তানের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করবার জন্য ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন নেই। যে বিষয়টি সম্ভবত এখনও পর্যন্ত কম প্রশংসিত হয়েছে তা হল একই ধরণের অনিবার্য পরিবর্তন যা মানবপ্রকৃতির মধ্যে হতে শুরু করেছে। এটা এখন পরিষ্কার যে যখন ব্যক্তি তার চরিত্র উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পাল্টাতে অসুবিধা বোধ করতে পারে, তখন যদি বৈজ্ঞানিক মনস্তাত্ত্বিকদের শিশুদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয় তবে তারা ঠিক সেইরকম ভাবে শিশুদের সুবিধাজনক অবস্থায় আনবার কার্যকলাপ করতে পারে যেরকম ভাবে ক্যালিফোর্নিয়রা মরুভূমিকে সুবিধাজনক অবস্থায় আনবার জন্য কাজ করে থাকে। যে শয়তান কেবল পাপ করে সেই শয়তানের খেলা আর রইল না, বিষয়টি আজ (শরীরের) দূষিত গ্রন্থিসমূহ ও অজ্ঞাতমূলক অবস্থাজাত হয়ে পড়েছে।

সম্ভবত পাঠক এই প্রসঙ্গে পাপের ব্যাখ্যা শোনবার আশা করবেন। যদিও এতে কোনরকম অসুবিধা নেই। পাপ হল তাই যা সেই সব মানুষদের অপছন্দের যারা শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে (Sin is what is disliked by those control education)।

এটা অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে এই অবস্থা বৈজ্ঞানিক ক্ষমতার ধারকদের অর্পণ করা হয় যা এক নতুন ও গভীর দায়িত্ব। এখনো মনুষ্যজাতি বেঁচে আছে এই কারণে যে সে তার উদ্দেশ্যসমূহকে অর্জন করবার জন্য যতই বোকার মতো ছুটুক না কেন তাদের এমন কোন অর্জিত জ্ঞান নেই যা দিয়ে সে উদ্দেশ্যসমূহকে অর্জন করতে পারে। এখন, যখন এই জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তখন জীবনের লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে প্রজ্ঞার একটি বিরাট মাত্রা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের বিল যুগে এই প্রজ্ঞা কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে?

উপরোক্ত প্রতিফলনগুলি এই নির্দেশ করে যে আমাদের সমস্ত প্রথা, এমনকি যেগুলো আমাদের প্রবৃত্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সেগুলো আগে যেমন ছিল বা এখন যেমন আছে তার চেয়ে নিকট ভবিষ্যতে অনেক বেশি সুচিন্তিত ও সজাগ হয়ে উঠবে এবং তার বিশেষ প্রয়োগে শিশুদের ফিরে পাওয়া যাবে ও লালনপালন করা যাবে। নতুন পথ পুরোনো পথের থেকে অনেক বেশি ভালো হবে; আবার তা খুব সহজে খারাপও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের যুগের নব্য জ্ঞান ঐতিহ্যমূলক আচরণের যান্ত্রিকতাকে এমন কঠিন আঘাত দিয়েছে যে পুরোনো ধরণের প্যাটার্ন বা আদল আর টিকে থাকতে পারেনি এবং ফলে নতুন ধরণের আদল ভালো বা মন্দ যে-কোন কিছুর জন্য অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।

মানুষ তার অবিশেষজ্ঞ অতীতেও বেঁচে ছিল, যখন একটি মানুষ তার নিজের জুতো নিজে তৈরি করত আবার তাকেই নিজের কেকটি বানাতে হত। পুরুষ মানুষের কার্যকারিতা এর বাইরে চলে গেল, কিন্তু নৈতিকতার জের টেনে মহিলাদের কার্যকারিতায় অনুরূপ পরিবর্তন এলো না। শিশুদের লালনপালন করা একটা বিশেষজ্ঞতার কাজ যা করতে গেলে দরকার বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান ও মানানসই পরিবেশ। ঘরে শিশুদের মানুষ করাটা যেন একটা ঘুরন্ত চাকার কাজ এবং তা কোনভাবেই অর্থনৈতিক নয়। জ্ঞান বিকাশের সাথে সাথে শিশু-প্রকৃতির বেশিরভাগ দিকগুলোকে ঘরের থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। এমনকি ঘরে শিশুর জন্ম হওয়ার প্রথাটিও আর রইল না। শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে আর সেই প্রাচীন ধারায় টোটকা চিকিৎসার ব্যবস্থা টিকে থাকল না যা আমাদের পূর্বপুরুষদের বহু শিশুকেই হত্যা করেছে। নিজের মায়ের হাঁটুর সামনে বসে আর প্রার্থনা করার প্রথা রইল না, সে জায়গায় এলো সানডে স্কুলে গিয়ে প্রার্থনার রেওয়াজ। জোর করে দাঁত তুলে ফেলার অথবা দাঁতে তার বাঁধার রেওয়াজ আর রইল না যা আমার যুবক বয়স পর্যন্ত টিকে ছিল। কিংবা দরজায় হাতল লাগানো বা দরজায় খিল লাগানো ব্যাপারটাও আর থাকল না। শিশুর জীবন সম্পর্কে প্রথম অংশটি চিকিৎসাবিদ্যাজনিত জ্ঞানের আওতায় পড়ে, দ্বিতীয়টি পড়ে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানজনিত জ্ঞানের আওতায় এবং তৃতীয়টি পড়ে শিশু-মনস্তত্ত্বের আওতায়। কিন্তু শেষে বিভ্রান্ত মা এসব কিছু বাজে কাজ ভেবে পরিত্যাগ করে এবং ইডিপাস কমপ্লেক্সের শাসানি শুনে তার প্রাকৃতিক স্নেহটি পাপের গন্ধে ভরে যায়।

এই পরিবর্তনের প্রধান কারণটি হল জন্ম ও মৃত্যুর হ্রাসপ্রাপ্তি। সৌভাগ্যবশত এই দুটি একই সঙ্গে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ যদি একটির পরিবর্তনে আর একটির হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটত তবে ফল হত মারাত্মক। জগতের সব সরকার সেই গীর্জাগুলোর সঙ্গে মিলে এই ধ্বংসাত্মক কার্য করতে তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে যে গীর্জাগুলোর প্রভাব মানুষের দুর্দশা ও কাপুরুষতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। তারা উভয়ে মিলে জন্মের হার হ্রাসকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যা মৃত্যুর হার হ্রাসের সঙ্গে সমানভাবে যুক্ত। এই বিষয়ে মানবজাতির জন্য সৌভাগ্যবশত ব্যক্তির স্বার্থপরতা তাদের সম্মিলিত নির্বুদ্ধিতার চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণিত হতে পেরেছে। আধুনিক পরিবারের ছোট্ট আকার পিতামাতাকে তাদের শিশুর সম্পর্কে এক নতুন মূল্য চেতনা দিয়েছে। যেসব পিতামাতার দুটি শিশু আছে তারা চায় না তাদের শিশুদের মধ্যে যে-কোন একটি শিশু মারা যাক, কিন্তু পুরোনো ধাচের পরিবারে যেখানে দশটা পনেরোটা ছেলেমেয়ে জন্মাতো সেখানে যত্নের অভাবে অর্ধেক সংখ্যক ছেলেমেয়েকে বলি চড়ানোটা কোন ব্যাপারই ছিল না। শিশুদের উপর আধুনিক বৈজ্ঞানিক যত্নের বিষয়টি আধুনিক ছোট আকারসম্পন্ন পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

একই সঙ্গে এই পরিবর্তন পরিবারকে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশের দিক থেকে কম মানানসই করে তুলেছে এবং মহিলাদের কর্মে ডুবে থাকার দিক থেকে কম সুবিধাজনক করে তুলেছে। পরিবারের পনেরোটা শিশুর মধ্যে অর্ধেক করে মরে যাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি নিরানন্দজনক জীবনকার্য। কিন্তু যে কোনভাবেই হোক সেখানে নিজেকে জানবার জন্য কিছুটা অবসর মিলত, অন্যদিকে দুটো কি তিনটে ছেলেমেয়ের পরিবারে জীবন-কার্যকে যথেষ্ট বলে ভাবা যাচ্ছে না, কিন্তু যতদিন পুরোনো ধরণের পরিবারকে ধরে রাখা হবে ততদিন জীবনের অন্যান্য দিকগুলোতে তা গভীরভাবে হস্তক্ষেপ করবে। অন্যদিকে, কতিপয় শিশুর পরিবারে মানুষ শিশুকে আরও বেশি বোঝা মনে করবে।

বর্তমানে যখন মানুষ উচ্চ-ভাড়ার দরুন নগরগুলো ঘিঞ্জি পরিবেশের বাস করে তখন দৈহিক নিয়ম অনুযায়ী গৃহটি শিশুদের পরিবেশের জন্য একেবারেই বাজে। যে মানুষ নার্সারির বাগানে চারাগাছকে লালনপালন করে সে সেই গাছদের জন্য ঠিক মাটি, ঠিক পরিমাণ আলো ও বাতাস, ঠিক পরিমাণ জায়গা ও ঠিক প্রতিবেশীদের বন্দোবস্ত করে থাকে। সে গাছগুলোকে আলাদা আলাদা টবে রেখে একের পর এক করে লালনপালন করার চেষ্টা করে না। শহরতলীয় গৃহগুলোতে শিশুরা যতদিন থাকবে ততদিন এইরকমভাবেই শিশুদের লালনপালন করবার চেষ্টা করা হবে। শিশুরা চারাগাছের মতো। তাদের ঠিক ভাবে বেড়ে ওঠবার জন্য চাই ঠিক পরিমাণ জমি, আলো, বাতাস এবং তাদের নিজেদের মতো প্রতিবেশী। শিশুদের সেই জায়গাতেই বড় হওয়া উচিত যেখানে কোনরকম উত্তেজনা ছাড়াই তারা পাবে স্বাধীনতা। গৃহগুলির মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ সেখানকার দৈহিক পরিবেশের মতোই বাজে। চিৎকার চেঁচামেচিকেও একটি অন্যতম বিষয় হিসেবে মনে করা যেতে পারে। বড় হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েরা তাদের চারপাশে নিরবচ্ছিন্ন টেসি খেলার শব্দকে সহ্য করবে এরকম আশা তাদের কাছ থেকে করা যেতে পারে না, কিন্তু একটি শিশুকে চিৎকার চেঁচামেচি করতে না দেওয়াটা এমন একটা নিষ্ঠুরতা যা তার মধ্যে ক্রোধের জন্ম দেয় যা তাকে গভীর নৈতিক দোষে দুষ্ট করে তোলে। এই একই রকম ঘটনা ঘটে যদি তাদের কোন জিনিস ভাঙতে বাধা দেওয়া হয়। যখন একটি বালক রান্নাঘরের তাকে উঠে কাঁচের কাপ-ডিস ভেঙে ফেলে তখন তার পিতামাতা কদাচিৎ আনন্দিত হতে পারে। অথচ তার এই ধরণের কার্যকলাপ তার দৈহিক বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়োজন। যে পরিবেশ শিশুর জন্য তৈরি সেখানে এই রকম প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর ভাবাবেগকে করাবার কোন প্রয়োজন নেই।

পিতামাতার দৃষ্টিকোণে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন অনিবার্যভাবে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনেতিক বিবর্তনের জন্য ঘটেছে যা পরিবারকে প্রভাবিত করে। নিশ্চয়তার চেতনার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্য প্রমাণিত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার দক্ষতা বারবার সংগঠিত ও হিংস্র যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে তুলবে বাড়তি জনসংখ্যাকে কমিয়ে আনবার উপায় হিসেবে।

এই কারণে, যদি রাষ্ট্রকে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হতে হয় তবে রাষ্ট্রের আলোকিত হওয়াটা একান্তভাবে প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র একা এই কাজটি করতে পারবে না, তবে বেশিরভাগ মানুষ যখন পুরোনো কুসংস্কারগুলোকে সংরক্ষণ করা জোর করে বন্ধ করে তখন ব্যাপারটি সম্ভব হবে। সব থেকে বেশি আলোকিত মানুষেরা একটি অবাস্তব জগতে বাস করে এবং সেই জগৎ তাদের সীমিত বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আবদ্ধ। তারা কল্পনা করে নেয় যে জগতের সবটাই প্রায় আলোকিত তবে কতিপয় অবাস্তব মানুষ এখনও অনালোকিত রয়ে গেছে। যেখানে তথাকথিত নৈতিক বিষয়গুলো যুক্ত সেখানে বাস্তব রাজনীতি ও আইন পরিচালনা সম্পর্কে অল্প অভিজ্ঞতা সেইসব মানুষের জন্য যথেষ্ট লাভজনক হতে পারে যেসব মানুষ শিশুপ্রকৃতি সম্পর্কে বা অন্যান্য বিষয়ে যৌক্তিক মতামত পোষণ করে থাকেন। আমি সাহসের সঙ্গে বলতে পারি যে রাশিয়ার বেশিরভাগ যুক্তিবাদীদের চেয়ে যুক্তিবাদের বিস্তৃত জনপ্রিয় প্রচারকার্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ধরে নেওয়া যাক পরিবারপ্রথা এবং শিশুদের জন্য যুক্তিগতভাবে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ভেঙে গেছে, তাহলে তখনও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য অন্য কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়বে। যেসব মহিলারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অভ্যস্ত এবং যারা নিজেদের জন্য কোন সন্তান ধারণ করতে চান না তারা গর্ভধারণ কালের অস্বস্তি এবং শিশুর জন্ম দেওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করার ইচ্ছা খুবই কম রাখেন। ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে জনসাধারণকে ধরে রাখতে গর্ভধারণের বিষয়টি একটি খরচসাপেক্ষ পেশায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনিবার্যভাবেই এসে যাবে। যদিও এই পেশাটি সব মহিলা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলারা গ্রহণ করবে না, কেবলমাত্র নির্দিষ্ট শতাংশ মহিলারা জন্ম দেওয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণ উপযুক্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ উক্ত পেশা গ্রহণ করবে। কিন্তু এই বিষয়ে তাদের কাছে কি ধরণের উপযুক্ততার পরীক্ষায় পিতাকে উত্তীর্ণ হতে হবে এবং তারা কত শতাংশ পুরুষ জনতা গঠন করতে চাইবে সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের এখন ডাকা হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি উপযুক্ত পরিমাণ জন্ম নিশ্চিত করাটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে, যেহেতু জন্মের হার হ্রাসের দিকে এগোলে, জনসংখ্যার বাড়ও কমবে। অন্যদিকে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনগণ মনুষ্যগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সমস্যাকর হয়ে উঠবে। যদি চিকিৎসাবিদ্যা ও ওষুধপত্র মানুষকে একশত বছর বাঁচিয়ে রাখতে সফল হত তবে গোষ্ঠীগুলি লাভের বদলে সমস্যাকাতর হয়ে উঠত।

শিশুদের গড়ে তোলার বিষয়ে যৌক্তিক মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে মনুষ্যজাতির যে লাভ আশা করা যেতে পারে তা অসীম। যৌনতার বিষয়টি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের শরীরের বিশেষ কিছু অংশ সম্পর্কে তাদের শিশুদের কুসংস্কারগত আচরণ শেখানো হয়ে থাকে এবং বিশেষ কিছু কথাবার্তা বা চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে তাদের এই ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে এবং ওই একই ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয় কিছু বিশেষ খেলা সম্পর্কে যা প্রকৃতি তাদের খেলতে উৎসাহিত করে থাকে। এর ফলে যে কারণটি ঘটে তা হল যখন শিশুটি বড় হয় তখন সে প্রমের কোন ব্যাপারে কঠিন ও কদর্য হয়ে দাঁড়ায়। সমগ্র ইংরেজি ভাষাভাষী লোকেরা তাদের নার্সারি থেকেই সুখী বিবাহে অসমর্থ হতে শেখে। সেখানে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের অন্য কোন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করবার সুযোগ পায় না বা পর্যবেক্ষণ করে তারা সেই রকম কার্যকলাপ করবার চেষ্টা করবে এবং তা করবার ক্ষেত্রে বাধা পাবে। এর ফলে পরবর্তীকালে তারা পরম ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার থেকে যথার্থ প্রতিযোগিতায় যে হঠাত্র স্থানান্তরিত হবে তা সহজেই অনুমেয়।

পাপের ধারণা বহু শিশু ও যুবক-যুবতাঁকে আঁকড়ে বসে থাকে এবং প্রায়শই পরবর্তী জীবনে তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে এবং সেইসব বিকৃতির উৎস হয়ে ওঠে যা তাদের জীবনে কোন ধরণের কার্যকরী উদ্দেশ্যকে সংঘটিত করে না। এই ধরণের ঘটনা ঘটে সম্পূর্ণভাবে যৌনতার বিষয়ে প্রথাগত নৈতিক শিক্ষার জন্যে। যৌনতা একটি খারাপবস্তু যা সুখী প্রেমকে অসম্ভব করে তোলে এই ধরণের মনোভাবসম্পন্ন পুরুষ যে-সব মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে সেইসব মহিলাদের ঘৃণা করতে শেখায় এবং কখনও কখনও তাদের সঙ্গে তারা নিষ্ঠুর আচরণও করে ফেলে। অধিকন্তু যখন যৌনতাকে রোধ করা হয় তখন সে জটিলতা যৌনভাবাবেগেরে উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় তা মানুষকে ভাবপ্রবণ বন্ধুত্ব, ধর্মীয় উদ্দীপনা, উচিত অনুচিত প্রভৃতির দিকে ঠেলে দেয় যা বুদ্ধিগত আন্তরিকতার অভাব ঘটায় এবং যা বাস্তব বোধও বুদ্ধির দিক থেকে অনিষ্টকর। শৈশবে যে নৈতিক শিক্ষার অত্যাচার সহ্য করতে হয় তার থেকেই পরবর্তীকালে নিষ্ঠুরতা, বোকামি, অসমর্থতা প্রভৃতির জন্ম হয় যা সংগতিকর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনিষ্টকর। এছাড়াও অন্যান্য আরও অনেক ধরণের গোলমাল এর থেকে জন্ম নেয় খুব সহজ সরল ভাষায় বলা যেতে পারে যে যৌনতায় কোনরকম নোংরামি নেই এবং এই বিষয়ে প্রথাগত আচরণ কোন অর্থই রাখে না। আমি বিশ্বাস করি যে আর কোন বিষয় মানুষের দুর্দশা ঘটাবার ক্ষেত্রে এতটা বেশি শক্তিশালী নয়, এই বিষয়টি সরাসরি নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক অনিষ্টসাধন করে। শুধু তাই নয়, এটি মানুষের মমতাবোধ, স্নেহ প্রভৃতির পথকে রুদ্ধ করে দাঁড়ায় যার দ্বারা সে মানুষের উপর বিভিন্ন প্রতিকারযোগ্য অশুভ কর্মের প্রভাব অর্থাৎ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতিভিত্তিক অত্যাচারের হাত থেকে মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারে যেগুলোর দ্বারা মানবতা অত্যাচারিত। এইসব কারণে শিশু-মনস্তত্ত্ব বিষয়ক সেইসব গ্রন্থসমূহের খুবই প্রয়োজন যা উক্ত জ্ঞানের প্রসার ঘটাবে এবং উক্ত বিষয়ে যৌক্তিক আচরণের শিক্ষা দিতে পারবে। আমাদের এই সময়টাতে এক ধরণের দৌড়-প্রতিযোগিতা চলছে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান শক্তির বৃদ্ধি ও কুসংস্কারের শক্তির ক্রমবর্ধমান হ্রাসের মধ্যে। শিশুর সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসমূহ যে বেড়েছে তা অনিবার্য ছিল। কিন্তু যদি এই ক্ষমতা সীমার বাইরে চলে যায় তবে কুসংস্কার সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কুসংস্কারহীন সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রচারকার্যের দ্বারা চুপসে যাবে, ফলে যে-কোন গণতান্ত্রিক দেশে নতুন করে কোন প্রতিবাদ গড়ে উঠবে না। আমাদের সমাজ ক্রমশই সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছে, ফলে যে-কোন দিকে কোনরকম সংস্কার অন্যান্য দিকেও পরিবর্তন আনতে বাধ্য এবং কোন সংস্কারই আর বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আমি মনে করি যে কোন যুগের থেকে আমাদের যুগটা শিশুকে নিয়ে অনেক বেশি কাজ করতে সহৃদয়ভাবে ইচ্ছুক এবং আমরা যদি বুঝতে পারি যে প্রথাগত নৈতিক শিক্ষা যুব মানসের পক্ষে যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে আমরা সেইরকম চাহিদার আশা করতে পারি যে চাহিদার ফলে খুব তাড়াতাড়ি যন্ত্রণাদায়ক কারণের স্থানে বৈজ্ঞানিক ও সহৃদয়কর কোন প্রতিকার করা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *