০৯. সুন্দর মানুষ

৯. সুন্দর মানুষ

(প্রথম প্রকাশ ১৯৩১)

সুন্দর মানুষ যারা তাদের প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা হল। কিন্তু পাঠক একথা জানতে চাইতেই পারে ঠিক কেমন ধরণের মানুষকে আমি সুন্দর মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি। তাদের প্রয়োজনীয় গুণের উপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচন করাটা কিছুটা জটিল হয়ে যাবে। তাই আমি নির্দিষ্ট ধরণের কিছু মানুষের কথা আলোচনা করব যারা সুন্দর মানুষের আয়তায় পড়ে। সুন্দরী অল্পবয়স্কা অবিবাহিতা মাসি বা পিসি অবশ্যই সুন্দর মানুষ, বিশেষত যদি তারা ধনী হয়। ধর্মযাজকরা খুব সুন্দর, একমাত্র সেই ধরণের ঘটনা ছাড়া যে ঘটনার ফলে তারা আত্মহত্যার ভান করে কীর্তন দলে ভিড়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় পালায়। আমার বলতে দুঃখ হচ্ছে যে, যুবতী মেয়েরা বর্তমানে কদাচিৎ সুন্দর হয়। যখন আমি যুবক ছিলাম, তখন যুবতী মেয়েরা খুব সুন্দর ছিল– অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি তখন যে-কোন বিষয় শুধু নয়, যে-কোন ব্যক্তি, এমন কি যুবকদের কোন উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে মায়েদের মতামতকে তারা মূল্য দিত। তারা ঠিক সময় মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলত “হ্যাঁ মা’ এবং না মা। তারা তাদের বাবাকে ভালোবাসত কেননা সেটাকে কর্তব্য বলে মনে করত, এবং মাকে ভালোবাসত এই কারণে যে তাদের সামান্য ভুল কাজ করা থেকে রক্ষা করত। যখন তারা বাগদত্তা হত তখন তারা নিজেদের আধুনিকা করে সাজাতে ভালোবাসত এবং বিবাহের পর তারা নিজেদের সুন্দর করে সাজিয়ে রাখাটাকে স্বামীকে ভালোবাসা জনিত কর্তব্য বলে মনে করত, কিন্তু অন্যান্য মহিলাদের তারা বোঝাত যে এটা এমন একটা কর্তব্য যা তারা অতিকষ্টে সম্পাদন করে। তারা তাদের শ্বশুর ও শাশুড়ীর সঙ্গে খুব সুন্দর ব্যবহার করত, কিন্তু কোন কর্তব্যহীন ব্যক্তি যে এরকম ব্যবহার করতে পারে না তা যদি আমরা আগে বুঝে নিতে পারি তবে এই মেয়েদের আমরা ভালো করে বুঝতে পারব। তারা অন্যান্য মহিলা সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণভাবে কথা বলত না, কিন্তু যখন তারা মুখ খুলত এবং কথা খরচ করত তখন তা একজন দেবদূতীর মহানুভবতার সঙ্গেই করত। এই ধরণের মহিলাদের শুদ্ধ ও মহান মহিলা বলা যায়। কিন্তু হায়, এই ধরনের মহিলা কেবলমাত্র বৃদ্ধাদের মধ্যে ছাড়া এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

কৃপাবশত আজও যারা বেঁচে আছেন তাঁদের প্রবল ক্ষমতা। তারা শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত করেন। তাঁরা ভিক্টোরীয় ধরণের ভণ্ডামিকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা যেখানে করেছেন সেখানে খুব অসফলতা পাননি। তাঁরা আইনসভাকে ‘নৈতিক প্রেক্ষাপটে’ আজও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এবং পায়ে তেল মাখানো ধরণের জীবিকার সৃষ্টি করেন। তারা কাগজের হয়ে লেখে এমন সব যুবকদের বৃদ্ধা রমণীদের সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করবার জন্য উৎসাহিত করেন যাতে তারা যুব মানসের বিচিত্র ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কল্পনা ও শৈলীকে ধরতে পারেন। তারা বহু আনন্দকে বাঁচিয়ে রেখেছে, না হলে অন্যান্যরা তা বুভুক্ষুর মতো খেয়ে শেষ করে ফেলত। উদাহরণস্বরূপ, মঞ্চে উঠে আজেবাজে কথা শোনার আনন্দ কিংবা প্রথাগত রীতির বাইরে একটু বেশি খালি গা দেখার আনন্দ। সর্বোপরি তারা এখনও পর্যন্ত শিকার করার আনন্দকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইংল্যান্ডের শায়ার বা জেলাগুলোতে শেয়াল শিকারের জন্য লোকদের অভিযুক্ত করা হয়। এই ধরণের শিকার যেমন খরচ সাপেক্ষ, অন্যদিকে কিছু কিছু সময় তেমন ভয়ঙ্কর। এছাড়াও একটা শেয়াল কোনভাবেই পরিষ্কার করে বোঝাতে পারে না যে শিকার হওয়াটাকে সে কতটা অপছন্দ করে। এই সমস্ত ব্যাপারে মানুষ-শিকার করাটা বেশ মজার খেলা হতে পারত। যদি খেলাটা সুন্দর মানুষদের জন্য না হত তবে বিবেকবান মানুষদের জন্য খেলাটা মুস্কিলের হত। যে খেলাগুলোকে এইসব সুন্দর মানুষগুলো দোষারোপ করে সেই খেলাগুলো মানবিক, কিন্তু যখন তারা খেলবে এসো’ বলে ডাক ছাড়ে তখন শিকারীরা একত্র হয় এবং শিকারের পেছনে ছুটে তারা শিকারকে বন্দী করে অথবা তাকে মেরে ফেলে। বিশেষত খেলাটা তখন বেশি করে জমে ওঠে যখন শিকার হিসেবে কোন মহিলাকে ধরা হয়। এই খেলাটা মহিলাদের হিংসা বা পুরুষদের ধর্ষকাম থেকে ঘটে। এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডে থাকেন এমন এক বিদেশিনী মহিলাকে আমি জানি যিনি তার স্বামী ছাড়াও আরও একজন পুরুষের সঙ্গে সুখে শান্তিতেই আছেন যাকে তিনি ভালোবাসেন, আবার সেই পুরুষটিও তাকে ভালোবাসে। দুর্ভাগ্যক্রমে তার রাজনৈতিক মতামত যতটা রক্ষণশীল হওয়া দরকার ছিল ততটা রক্ষণশীল হয়নি। যদিও সেই মতামতগুলো কেবল মতামতই, তবুও বলা যায় যে তিনি সেই মতামতগুলোকে মানতে কিছুই করেননি। সুন্দর মানুষেরা এই ঘটনার সত্যাসত্য জানবার জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে কাজে লাগালো এবং সেই মহিলাকে তার নিজের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল যাতে তিনি না খেতে পেয়ে মরেন। ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় বিদেশীরা নৈতিকভাবে অপমানজনক কাজকর্ম করে বেড়ায়। এইজন্য আমরা পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা বিদেশীদের এই মর্যাদাহানিকর কাজকে সামলে বেড়ায় এবং যাতে আমাদের মধ্যে কেবলমাত্র ধার্মিক বিদেশীরাই থাকতে পারে তার দিকে চোখ রাখে।

এটা মনে করা আমাদের অবশ্যই উচিত নয় যেসব সুন্দর মানুষই মহিলা। যদিও বলা যায় যে পুরুষের থেকে মহিলারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুন্দর মানুষ হয়ে থাকে। ধর্মের সেবিকারা ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় আরও অনেক সুন্দর মানুষ আছে। এইসব মানুষ হল তারা যারা নিজেদের জন্য বিরাট সৌভাগ্যকে তৈরি করেছে এবং যারা এখন তাদের ব্যবসা থেকে অবসর নিয়ে তাদের সৌভাগ্যকে দানশীলতার পেছনে খরচ করছে। ম্যাজিষ্ট্রেটরাও প্রায় অনিবার্যভাবে সুন্দর মানুষ। যদিও এটা বলা যেতে পারে না যে তারা আইন আদালতকে সমর্থন করে তারাই সুন্দর মানুষ। মনে আছে যখন আমি যুবক ছিলাম যখন চরম শাস্তি সম্পর্কে আগে থেকেই একজন সুন্দর মহিলা আমাকে শুনিয়ে রেখেছিলেন যে এধরনের শাস্তি ভালো নয় এবং একজন ফাঁসুড়ে কখনই একজন ভালো মানুষ হতে পারে না। কোন ফাঁসুড়েকে ব্যক্তিগতভাবে কখনও জানিনি তাই তার সম্পর্কে সেই মহিলার যুক্তিকে পরীক্ষা করে দেখে নেবার সুযোগ কখনও পাইনি। আমি একজন মহিলাকে জানি যিনি একদিন ট্রেনের মধ্যে একজন ফাঁসুড়ের সাক্ষাৎ পান একথা না জেনে যে সেই লোকটি একজন ফাঁসুড়ে। আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা থাকার জন্য সেই ভদ্রমহিলা যখন তাকে একটি কম্বল দিতে যান তখন সেই লোকটি বলে ওঠে, ‘ম্যাডাম, যদি জানতেন আমি কে তা হলে আপনি একাজ করতেন না, ফাঁসুড়ে ব্যক্তিটির এই ধরণের আচরণ ও কথাবার্তা প্রমাণ করে যে সেও একজন সুন্দর মানুষ। যদিও এধরণের ঘটনা একটি ব্যতিক্রম। ডিকেন্সের বারনাবি রাজ’ গ্রন্থে যে ফাঁসুড়েটির কথা বলা হয়েছে, জোর দিয়ে বলা যায় যে সে কখনই সুন্দর মানুষ নয়, সম্ভবত এক অদ্ভুত ধরণের মানুষ।

যেহেতু ফাঁসুড়েরা সুন্দর মানুষ নয় সেহেতু চরম শাস্তি (ফসি) ভালো নয়, এই ধরণের যে যুক্তি সেই মহিলার কাছ থেকে আমরা পাই, আমি মনে করি তার সঙ্গে একমত হওয়া যায় না। কেননা একজন সুন্দর মানুষ হতে গেলে যে কোন রকম নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বাস্তবে রক্ষিত হতে হয় এবং যারা রক্ষা করবার কাজটি করে তারা কখনও সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন, সমুদ্রতীরবর্তী একটি ডুবন্ত জাহাজ, যে জাহাজটিতে করে অনেক বর্ণের শ্রমিকদের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মহিলা যাত্রীও ছিল। যাদের মধ্যে ধরেই নেওয়া যায় যে সবাই সুন্দরী মহিলা ছিল। তাই তাদের আগে বাঁচানো হল। যে-সব মানুষ এই বহু বর্ণের শ্রমিকদের নিয়ে যাচ্ছিল তাদের বড় সুন্দর পদ্ধতিতে বাঁচবার সুযোগ মিলল সেইসব শ্রমিকদের দ্বারাই। সেই সুন্দর মহিলারা যখনই বুঝল যে তারা রক্ষিত তখনই তারা সেইসব ডুবে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু তাদের কোমল হৃদয় কার্যকরী হয়ে উঠলো সেইসব শ্রমিকদের দ্বারা রক্ষিত হবার পর।

সাধারণত সুন্দর মানুষেরা সমগ্র জগতের খবরদারি করার ভারটি বেতনভুক কর্মচারীদের হাতে দিয়ে রেখেছে। কারণ তারা বুঝেছে যে যারা সত্যই সুন্দর মানুষ তাদের পক্ষে এই খবরদারি করা সম্ভব নয়। তবে একটা জায়গা আছে যেখানে তারা কোন রকম অংশগ্রহণ করে না আর তা হল পেছনে কামড়ানো বা কোনরকম কেলেঙ্কারীজনিত ঘটনায়। কেবলমাত্র নিজের ক্ষমতার দ্বারা মানুষ সৌন্দর্যের যাজক সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে। যদি ক খ-এর বিরুদ্ধে কথা বলে এবং খ ক-এর বিরুদ্ধে বলে তবে যে সমাজে তারা বাস করে সেই সমাজ অনুযায়ী একজন তার কর্তব্য করছে আর একজন ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু যে ব্যক্তিটি জনগণের হয়ে কর্তব্য করছে সে ওই দুই ব্যক্তির থেকে অনেক বেশি সুন্দর। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্কুলের অন্যান্য শিক্ষিকাদের চেয়ে সুন্দর কিন্তু যে মহিলাটি স্কুল পরিচালনার বোর্ডে আছেন তিনি প্রধান শিক্ষিকা ও অন্যান্য শিক্ষিকাদের চেয়ে অনেক সুন্দর। নামী দামী পদবী-টদবিগুলোর বলি নারী বা পুরুষ প্রথমেই তাদের জীবনের অস্তিত্বকে হারায়। আবার যারা এই পদবীগুলোতে পৌঁছতে পারে না, তারা অধৈর্য ছোটলোকেও পরিণত হতে পারে। এইজন্য আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হয় যে মঙ্গলের খাতিরে এই বিষয়টি বেশ শক্তিশালী এবং আমাদের অবশ্যই সেইসব সুন্দর মানুষদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা উচিত যারা এই ধরণের ব্যবস্থা প্রদান করেছেন।

সুন্দর মানুষদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিজ সত্তা নির্ভর উন্নতির সশব্দ সাধনা। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সুন্দর মানুষেরা মনে করেন যে তারা এই কাজটি আরও ভালোভাবে করতে পারতেন, কিন্তু স্বর্গীয় হস্তকর্মের অধীনে বহু বিষয় ও কাজ আছে, তাই সেই ধরণের কোন কাজ করবার ইচ্ছা অবশ্যই ঈশ্বর নিন্দাজনক। এবং তার উল্লেখ করাও কোন রকমভাবে সুন্দর নয়। স্বর্গীয় মানুষেরা বলে থাকেন যে যদি আমাদের প্রথম জনক জননী আপেলটি না খেতেন তবে মানবজাতি অন্যান্য নিষ্পাপ ধরণের ফলে পূর্ণ হয়ে যেত–গিবন এরকম ধরণের কথাই বলেছেন। এই বিষয়ে স্বর্গীয় পরিকল্পনা সত্যই রহস্যজনক। স্বর্গীয় মানুষদের মতে পাপের শাস্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যথার্থ, অর্থাৎ আপেল খেয়েছে তার ফল ভোগ কর। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যে সমস্যাটা দাঁড়ায় তা হল সুন্দর মানুষের ক্ষেত্রে যেটা শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়, দুঃখজনকভাবে সেই একই শাস্তি অন্যান্য মানুষদের ক্ষেত্রে আনন্দজনক হয়ে ওঠে। মনে হয় যে, শাস্তি ব্যাপারটি তৈরি হয়েছে কিছু ভুল লোকদের ঘাড়ে পড়বার জন্য। সুন্দর মানুষদের বহু উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি উদ্দেশ্য হল নিঃসন্দেহে এই অনিচ্ছাকৃত অন্যায়ের প্রতিকার করা। তারা এটাই নিশ্চিত করতে সর্বদা প্রচেষ্টা করতে থাকে যে জীববিদ্যা অনুযায়ী ফল প্রদানের সাধন উর্বর অথবা শীতল এই দুভাবে করা যায়, এবং যারা উর্বরভাবে সাধন করে, দেখা যায় তারাই সুন্দর মানুষদের মধ্যে ক্ষমতায় আসীন হয় এবং তারা এই ক্ষমতায় আসীন হয় কেলেঙ্কারীর দ্বারা তাদের চরিত্র কলঙ্কিত হবার পর। তারা কেলেঙ্কারীর ব্যাপারটিকেও খুব সুন্দর করে আড়াল করে রাখার প্রচেষ্টা করে থাকে। তারা সেন্সরকে নিজেদের হাতে পাবার চেষ্টা করে যাতে গোপনে ঘটে যাওয়া কুৎসিত নোংরামীর চেয়ে সেইসব গ্রন্থ ও নাটককে বাতিল করে দিতে পারে যেখানে কেলেঙ্কারীর কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারে তারা সব জায়গায় প্রায় সরল হয় এবং আইন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ঈশ্বর কেন যে মানবশরীরটি তৈরি করেছেন তা জানা যায় না, কিন্তু যে কোন ব্যক্তি এটা মনে করে নিতে পারে যে সর্বময় ঈশ্বর মানবশরীরকে এইভাবে তৈরি করেছেন এই জন্য যাতে সুন্দর মানুষেরা কোনরকম আঘাত না পায়। সম্ভবত এর পেছনে সঠিক কোন কারণ আছে। ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারে যতদিন বয়নশিল্প গড়ে উঠেছে ততদিন ধরে দেখা যাচ্ছে যে বয়ন-শিল্পের সঙ্গে মিশনারীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মিশনারীরা বর্বরদের শেখাচ্ছে কিভাবে মানব শরীরকে আচ্ছাদিত করতে হয় এবং তার ফলে বস্ত্রশিল্পের চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে। যদি মানব শরীর সম্পর্কে লজ্জার কোন কিছু না থাকত, তবে বয়নশিল্প তার লাভের উৎসমুখ হারাত। এই দৃষ্টান্ত আমাদের যে ঘটনাটি দেখায় তা হল, পাছে পুণ্যের প্রচার আমাদের লাভ কমিয়ে দেয় তাতে আমাদের ভীত হবার কোন প্রয়োজন নেই।

‘নগ্ন সত্য’ এই শব্দগুচ্ছটি যিনিই আবিষ্কার করে থাকুন না কেন তিনি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নগ্নতা যে-কোন সঠিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের কাছে একরম ধাক্কা এবং ঠিক এই কারণেই তা সত্য। কি ধরণের বিভাগে আপনি যুক্ত আছেন তাতে কিছু আসে যায় না, আপনি খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন যে সত্য এমন একটি বস্তু যা সুন্দর মানুষ তাদের চেতনায় স্বীকার করেন না। এটাই আমার দুর্ভাগ্য যে এমন একটি মামলার শুনানীর জন্য আদালতে উপস্থিত থাকতে হয় যে ঘটনাটি সম্পর্কে আমার প্রথম শারীরজ্ঞান ছিল, কিন্তু আমি দেখে আঘাত পেয়েছিলাম যে সেইসব শ্রদ্ধার বেড়াজালে আবদ্ধ প্রবেশদ্বার ভেদ করবার জন্য কোন সত্যই সেখানে অনুমোদন পায় না। যে সত্য আইন আদালতে প্রবেশের সুযোগ পায় তা নগ্ন নয়, কিন্তু আদালতের পোশাকের অপেক্ষাকৃত কম সুন্দর অংশে যে সত্য লুকিয়ে থাকে তা নগ্ন সত্য। সরাসরি খুন, চুরিমূলক অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে তা সত্য সে কথা আমি বলিনি, আমি বলেছি সেই সব মামলা মোকদ্দমার কথা যেখানে সংস্কারের উপাদান থাকে, যেমন–রাজনৈতিক মামলা, বা অশ্লীলতার মামলা। আমি বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে আমেরিকার থেকে ইংল্যান্ড অনেক বেশি হীন পর্যায় পড়ে। কেননা ইংল্যান্ড তার সৌন্দর্যের অনুভবের দ্বারা সব অসুন্দর বস্তুর অদৃশ্যে ও আধা-সচেতন নিয়ন্ত্রণকে একটা উৎকর্ষে নিয়ে যেতে পারছে। যদি আপনি আইন আদালতে কোন অপরিপক্ক ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চান তবে আপনি দেখবেন যে সেরকম কাজ করতে চাওয়াটা সাক্ষ্যপ্রমাণজাত আইনের বিরুদ্ধ এবং কেবলমাত্র বিচারক ও বিরুদ্ধ আইনজীবীই নয়, আপনার পক্ষে যিনি আইনজীবী হবেন তিনিও ওই ধরণের ঘটনার কথা বলতে বাধা দেবেন।

এই একই ধরণের অবাস্তবতা রাজনীতিতে প্রবেশ করে থাকে সুন্দর মানুষদের অনুভবের ফলস্বরূপ। যদি আপনি কোন সুন্দর মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করেন তিনি যে দলের সমর্থক সেই দলের কোন রাজনীতিবিদ সাধারণ একজন মরণশীল ব্যক্তি এবং যিনি রাশি রাশি মানুষের থেকে কোন অংশে বড় নন তবে দেখবেন সেই সুন্দর মানুষটি রুষ্ট হয়ে আপনার উপদেশটি অস্বীকার করবেন। ফলস্বরূপ রাজনীতিবিদদের নিষ্কলঙ্ক হয়ে সামনে আসাটা একান্ত প্রয়োজন। বেশিরভাগ সময় সমস্ত দলের রাজনীতিবিদরা তাদের পরিচিত হয়ে ওঠবার পেশায় কোনরকম ক্ষতির আশঙ্কা দেখলে মৌনভাবে একত্র হন তাকে বাধা দেবার জন্য। রাজনীতিবিদদের পেশাগত অভিন্নতা যতটা তাদের একত্র করে তার চেয়ে দলের স্বতন্ত্রতা অনেক কম তাদের বিভক্ত করে থাকে। এইভাবে সুন্দর মানুষেরা জাতীয় মহান মানুষদের সম্পর্কে কল্পনাময় ছবি সংরক্ষণে সমর্থ হন। বিদ্যালয়ের শিশুদের ভাবতে বাধ্য করানো যে, খ্যাতি কেবলমাত্র উচ্চ-ধর্ম বা গুণের দ্বারাই অর্জিত হতে পারে। এটা সত্য যে কিছু কিছু অসাধারণ সময়ে রাজনীতিবিদরা বাস্তবে অসহ্য হয়ে উঠেছে এবং সর্বদা সেইসব রাজনীতিবিদরা যথার্থ সম্মানের জন্য বিবেচিত হন না যারা শিষ্টাচারবর্জিত ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, পারনেল প্রথমে খুনীদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রাখার জন্য সফলতার সঙ্গে অভিযুক্ত হন এবং তারপর তাকে এমন অনৈতিকতার অভিযোগে সফলতার সঙ্গে অভিযুক্ত করা হয় যে অভিযোগের কথা কোন অভিযোগকারী স্বপ্নেও ভাবতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের কালে ইউরোপের ক্যুনিস্ট এবং আমেরিকার চরমপন্থী দল ও শ্রমিক আন্দোলনকারীরা সীমার বাইরে অবস্থান করত। কোন সুন্দর মানুষদের বিরাট দল তাদের প্রশংসা করত না এবং যদি তাদের মধ্যে কেউ প্রথাগত আইনের বিপক্ষে যেত তবে তার কপালে কোনরকম ক্ষমা জুটত না। এইভাবে সুন্দর মানুষদের গতিহীন নৈতিক প্রথাসমূহ তাদের সম্পত্তির প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এইভাবেই তাদের অপরিমেয় যোগ্যতা আর একবার প্রমাণ করা যায়।

সুন্দর মানুষ যখনই কোন আনন্দ দেখে তখনই খুব সঠিকভাবে তাকে সন্দেহ করতে পারে। তারা জানে যে, সে যতটা প্রজ্ঞা (Wisdom) বাড়ায় ততটা দুঃখও বাড়ে এবং তারা অনুমান করে যে, সে যতটা দুঃখকে বাড়ায় ততটাই প্রজ্ঞাকে বাড়াতে পারে। এই কারণে তারা অনুভব করে যে দুঃখের প্রসারণে প্রজ্ঞার প্রসারণ হচ্ছে। কেননা প্রজ্ঞা চুনীর থেকেও বেশি মূল্যবান। তারা মনে করে যে এইরকম কাজ করে তারা সুবিচার করছে কেননা তা আখেরে লাভজনক হবে। উদাহরণস্বরূপ, তারা শিশুদের খেলার জন্য মাঠ তৈরি করে দেয় এই কারণে যাতে তারা নিজেদেরকে মানবপ্রেমিক মনে করতে পারে। তারপর সেখানে খেলবার জন্য এত শর্ত চাপায় যে কোন শিশুই সেখানে খেলে সুখী হয় না যতটা তারা সুখী হয় রাস্তায় খেলে। শিশুরা সেই খেলার মাঠ ও রঙ্গালয় কেবলমাত্র রবিবার দিনটি ছাড়া বাদবাকি দিনে পরিহার করে চলে, কেননা সেই দিনে সেগুলো সবার জন্য খোলা থাকে বলে তারা সেখানে আনন্দ করতে পারে। কর্মস্থলে যুবতী মহিলাদের যতদূর সম্ভব বাধা দেওয়া হয়ে থাকে যুবক পুরুষদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে। যতজন সুন্দর মানুষকে আমি চিনি তারা তাদের পরিবারের প্রিয়জন সম্পর্কে এই ধরণের আচরণই করে থাকে এবং তাদের শিশুদের তারা কেবলমাত্র নির্দেশিত কিছু খেলা খেলতে বাধ্য করে। যদিও আমি একথা বলতে দুঃখবোধ করছি যে সৌন্দর্যের এই ধরণের মাত্রা আগে যতটা ছিল এখন তা খুবই কম। পুরোনো যুগে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হত :

ঈশ্বরের দণ্ডের একটি আঘাত হলে, ছোট্ট পাপী নরকে শীঘ্র যায় চলে। এর থেকে এটা বোঝা যায় যে শিশুরা খুব গোলমাল করলে বা যে কাজ তাদের জন্য মন্ত্রকেরা নির্দিষ্ট করে দেয়নি সেই রকম কাজে অতি প্রশ্রয় পেলে তাদের কপালে ওইরকম ঘটবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর শিক্ষা যা ‘দ্য ফেয়ারী চাইল্ড ফ্যামিলি’তে দেওয়া হচ্ছে তা সুন্দর মানুষ তৈরির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। আমি কতিপয় পিতামাতাকে জানি যারা বর্তমানে এই ধরণের উচ্চ মাপের জীবনযাপন করে থাকেন। এটা খুব সাধারণ ধারণা হয়ে গেছে যে শিশুরা নিজেরাই আনন্দ করতে পারে এবং এটা খুব ভয়ের ব্যাপার যে যেসব শিশুরা এই ধরণের কোমল আদর্শের উপর শিক্ষিত হচ্ছে তারা যখন বড় হবে তখন আনন্দ পাবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভয়ঙ্কর ব্যাপার যে ঘটাবে না এমন নয়।

এটাই আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার যে সুন্দর মানুষদের সময়টা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। দুটো বিষয় এই সময়টাকে শেষ করছে। প্রথম বিষয় হল এই ধরণের বিশ্বাস পোষণ করা যে সুখী হবার জন্য কোন কষ্ট বা ক্ষতিকে স্বীকার করতে হয় না এবং সুখী হবার ক্ষেত্রে কেউ কম যোগ্য নয়। দ্বিতীয় বিষয়টি হল বড় বড় কথা বলাকে অপছন্দ করা। এই অপছন্দটি নীতির মতোই সুন্দর। যুদ্ধের দ্বারা এই দুই ধরণের বিদ্রোহকে উৎসাহিত করা হয়েছিল তখন যখন সমস্ত দেশের সুন্দর মানুষেরা নিয়ন্ত্রিত নিশ্চয়তার মধ্যে ছিল এবং উচ্চ নৈতিকতার নামে তারা যুবক মানুষদের একে অন্যকে হত্যা করতে প্ররোচিত করেছিল। এসব মিটে গেলে পরে যারা বেঁচে রইল তারা এই ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেল যে, উচ্চ-ধর্ম তৈরি করে সেই ধরণের বিদ্বেষ যা মিথ্যা ও দুর্দশাকে প্রেরণা দেয়। আমি এই ভেবে ভীত হই যে এইসব যুবক মানুষেরা সময় আসার আগেই না তাদের এই ধরণের বাস্তব ও উচ্চ ধরণের নীতিজনিত মৌলিক মতাদর্শকে গ্রহণ করতে প্রবৃত্ত হয়ে ওঠে।

সুন্দর মানুষদের মূল বিষয়টি হল যে তারা সহযোগিতা মূলক ভাবে জীবনকে গড়ে তোলার প্রবণতা সম্পন্ন জীবনকে ঘৃণা করে। শিশুর গোলমাল এবং সর্বোপরি যৌনতা প্রভৃতি নিয়ে তাদের চিন্তা তাদের মর্যাদা আবিষ্ট করে রাখে। সংক্ষেপে সুন্দর মানুষ সর্বদাই সেই ধরণের মানুষ যাদের মন নোংরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *