০৩. আমি কী বিশ্বাস করি

৩. আমি কী বিশ্বাস করি

(‘আমি কী বিশ্বাস করি’ প্রবন্ধটি ১৯২৫ সালে একটি ছোট্ট গ্রন্থে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধের ভূমিকায় রাসেল লেখেন, ‘আমি বলবার চেষ্টা করেছি বিশ্বে মানুষের স্থান সম্পর্কে এবং মঙ্গলময় জীবন অর্জনের জন্য তার সম্ভাবনাগুলোর সম্পর্কে আমি কী ভাবি… মানবিক ঘটনাগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে এমন কিছু শক্তি আছে যেগুলো সুখকে তৈরি করে এবং অন্য আর এক রকম কিছু শক্তি আছে যেগুলো দুর্দশাকে তৈরি করে। আমরা জানি না কোনটা জয়লাভ করবে, কিন্তু ঠিক মতো বিচার করে আমাদের এই দুটি বিষয় সম্পর্কে সজাগ হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৮ সালে নিউইয়র্ক কোর্টের মামলায় বলা হয়, আমি কী বিশ্বাস করি’ প্রবন্ধটি অনেকগুলো প্রবন্ধের মধ্যে একটি যাকে সামনে রেখে এই মত প্রকাশ করা যায় যে রাসেল সিটি কলেজে অধ্যাপনা করার ক্ষেত্রে অযোগ্য। সংবাদপত্রগুলি প্রবন্ধটির থেকে এমন সমস্ত বাক্য বেছে বেছে তুলে প্রকাশ করে যাতে রাসেলের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি হয়।)

(১) প্রকৃতি ও মানুষ

মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ, প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোন কিছু নয়। তার চিন্তা, তার শারীরিক গতিপ্রকৃতি সেই একই আইনের বশবর্তী যে আইনের বশবর্তী হয়ে নক্ষত্র ও পরমাণুগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। বস্তুগত পৃথিবী মানুষের সঙ্গে এতটাই তুল্য যে, দান্তের সময় প্রকৃতিকে মানুষের সঙ্গে যতটা তুলনা করা হত তার থেকেও বেশি, কিন্তু এতটাও বেশি ছিল না যা আজ থেকে একশ বছর আগে ভাবা হত। উচ্চের দিকেই হ’ক বা নিম্নের দিকেই হ’ক, কিংবা বৃহৎ বা ক্ষুদ্রের দিকেই হ’ক, উভয় ক্ষেত্রেই মনে হয় বিজ্ঞান কতকগুলি সীমার দিকে পৌঁছেছে। মনে করা হয় বিশ্ব অনন্তের সীমিত বিস্তারিত ফল। এইজন্যই আলো বিশ্বের চারদিকে কয়েক লক্ষ বছর পরিভ্রমণ করতে পারে। বস্তু ইলেকট্রন ও প্রোটনের দ্বারা তৈরি, যেগুলোর একটি সীমিত আকার আছে এবং জগতে তাদের সংখ্যা সীমিত। সাধারণত মনে করা হত যে সম্ভবত তাদের পরিবর্তন নিরবচ্ছিন্ন নয়, কিন্তু তাদের পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে কতকগুলি ধাক্কার (Jerks) ফলে, যে ধাক্কাগুলো ক্ষুদ্র যে-কোন ধাক্কার থেকে কখনই খুব ক্ষুদ্র নয়। পরিবর্তনের এইসব নিয়মগুলোকে স্পষ্টতই যে-কোন সাধারণ গাণিতিক পদ্ধতির দ্বারা যোগ করে এক জায়গায় করা যেতে পারে এবং যখনই জগতের কোন ক্ষুদ্র অংশের ইতিহাসকে জানা যাবে তখন এই সমস্ত যোগফলের সমষ্টি সামনে রেখে জগতের অতীত ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যাবে।

পদার্থবিজ্ঞান এই ভাবেই সেই স্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে পৌঁছে সে একদিন শেষ হয়ে যাবে। এই কারণেই তা আগ্রহোদ্দীপক নয়। সেই সমস্ত নিয়মগুলো আবিষ্কার করা হল যেগুলো ইলেকট্রন ও প্রোটনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে। এবার পড়ে থাকলো ভূগোলের দিকটি যে বিষয়টি বিশেষরূপে সেই সমস্ত ঘটনার সগ্রহ যা জগতেরই ইতিহাসে কিছু কিছু অংশে কিভাবে তারা বন্টিত হল তার কথা বলে। জগতের ইতিহাস জানতে ভূগোলের যে সমগ্র ঘটনাগুলির সংখ্যা সমষ্টির প্রয়োজন তাও সম্ভবত সীমিত। তত্ত্বগতভাবে তাদের সবগুলোকে সমারসেট হাউসের বৃহৎ গ্রন্থে লিখে রাখা যেতে পারে এবং তার সঙ্গে রাখা যেতে পারে একটি গণক যন্ত্র, যার হাতল ঘোরালেই কোন জিজ্ঞাসু সেই সব ঘটনাগুলোর সম্পর্কে জানতে পারবে সেই সময়, যে সময়টা ঘটনা গুলোর ঘটার নথিভুক্ত সময় থেকে অন্য। কোনোকিছু কম আগ্রহোদ্দীপক বস্তু সম্পর্কে কল্পনা করাটা শক্ত ব্যাপার অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে, কোনো অসম্পূর্ণ আবিষ্কারজাত আবেগপ্রবণ আনন্দের থেকে তা স্বতন্ত্র। এটা অনেকটা খুব উচ্চ পাহাড়ে ওঠার মতো, যেখানে গিয়ে দেখা গেল যে, একেবারে শীর্ষদেশে একটা রেস্তোরাঁ ছাড়া কিছুই নেই এবং সেই রেস্তোরাঁয় তারা আদা থেকে তৈরি বীয়ার বিক্রি করছে এবং যে স্থানটি সম্পূর্ণ কুয়াশায় ঘেরা কিন্তু স্থানটি বেতার তরঙ্গের দ্বারা সজ্জিত। অ্যামস-এর (Ahmes) সময়ে ধারাপাতটি ছিল খুব উত্তেজক।

বস্তুগত জগৎ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সে নিজে অনাগ্রহোদ্দীপক এবং মানুষ হল তার একটা অংশ, তার শরীরটা অন্যান্য বস্তুর মতোই ইলেকট্রন ও প্রোটন সমষ্টি দ্বারা তৈরি, যতদূর আমরা জানি, যা একই ধরণের নিয়ম বা আইনকে অনুসরণ করে যেগুলি জীবজন্তু ও গাছপালার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করে না। এমন কিছু ব্যক্তিকে পাওয়া যায় যারা বলে থাকেন শারীরবিদ্যা কখনই পদার্থবিজ্ঞানের স্তরে নেমে আসতে পারে না, কিন্তু তাদের এই ধরণের যুক্তি খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং এটা ভাবাটাও এক ধরনের গর্বের ব্যাপার হয়ে যাবে যে তারা ভুল করে থাকে। যখন আমরা এরকম বলে থাকি যে, সড়কপথ এবং রেলপথের উপর নির্ভর করে আমরা যেমন ভ্রমণ করে থাকি, কিছুটা একই ভাবে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলি মস্তিষ্কের বহু পথ (Tracks) ভ্রমণ করে থাকে। চিন্তা করার জন্য যে শক্তি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর উৎস মূলত রসায়ন এমনই ভাবা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আয়োডিনের অভাবে একটি চালাক মানুষ বোকা মানুষে পরিণত হয়। মানসিক ঘটনাগুলি সম্পর্কে মনে করা হয় যে, এগুলি বস্তুগত কাঠামোর সঙ্গে আবদ্ধ। যদি তাই হয়, আমরা এটা মনে করতে পারি না যে, একটি সঙ্গ-বিবর্জিত ইলেকট্রন অথবা প্রোটন চিন্তা করতে পারে, যেমন ভাবে আমরা চিন্তা করতে পারি না একজন সঙ্গ-বিবর্জিত ব্যক্তি বা সঙ্গহীন ব্যক্তি একটি ফুটবল ম্যাচ খেলতে পারে। আমরা এটাও মনে করতে পারি না যে, দৈহিক মৃত্যুর পর একজন ব্যক্তির চিন্তা বেঁচে থাকতে পারে, যেহেতু মৃত্যু মস্তিষ্কের সংগঠনকে ধ্বংস করে এবং সেই শক্তিকে নষ্ট করে ফেলে যে শক্তি মস্তিষ্কের পথগুলিকে ব্যবহার করে থাকে।

ভগবান এবং অমরত্ব, যা খ্রীষ্টীয় ধর্মের কেন্দ্রীয় নীতি, তা বিজ্ঞানের কোনো সমর্থন পায় না। এটা বলা যেতে পারে না যে, যেহেতু বুদ্ধবাদে কিছুই পাওয়া যায় না সেহেতু ধর্মের জন্য অন্য আরেকটি মতবাদ একান্তই প্রয়োজন। (অমরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা মনে রাখতে হবে যে, অনুপযুক্ত আকারে এই ধরণের বিবৃতি ভুলপথে চালিত করতে পারে, কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে সেটার সার্থকতা বোঝা যাবে।) কিন্তু আমরা যারা পশ্চিমা দেশের লোক তারা প্রাচ্য দেশের লোকেদের সম্পর্কে ভাবি যে তারা অটুট ঈশ্বরীয় বিদ্যার অধিকারী। নিঃসন্দেহে সেখানকার লোকেরা এই ধরণের বিশ্বাসকে বজায় রাখবে, কারণ এতে তারা আনন্দিত হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম যেমন আমরা নিজেদেরকে প্রফুল্ল এবং শত্রুকে বদমাস ভাবতে ভালোবাসি। কিন্তু আমার দিক থেকে আমি উভয় দিকেই কোন ভিত্তি দেখতে পাই না। আমি এই রকম কোনো ভান করতে চাই না যার দ্বারা বোঝাবে যে আমার প্রমাণ করবার সামর্থ্য আছে যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। একই ভাবে আমি এটাও প্রমাণ করতে পারব না যে শয়তান মানেই হল কল্পিত কাহিনী। খ্রীষ্টীয় ঈশ্বর থাকতেই পারে এবং ঠিক একইভাবে অলিম্পাসের ঈশ্বর, অথবা প্রাচীন ইজিপ্টের ঈশ্বর অথবা ব্যাবিলনের ঈশ্বর থাকতেই পারে। কিন্তু এদের মধ্যে কোন প্রকল্পই (hypothesis) একে অন্যের চেয়ে অধিক সম্ভাব্য নয় এমন কি এই সমস্ত প্রকল্পগুলি বা অনুমানগুলি সম্ভাব্য জ্ঞানের অঞ্চলের বাইরে অবস্থান করে থাকে। এই জন্যেই তাদের কোনটাকেই বিবেচনা করে দেখার কোন কারণ নেই। এই প্রশ্নের উপর আমার বক্তব্যকে আমি আর বিস্তৃত করতে চাই না, কেননা এই প্রশ্নের উপর আলোচনা আমি অন্য জায়গায় করেছি (আমার ‘লাইনিজের দর্শন’ গ্রন্থটি দেখুন, পরিচ্ছেদ ১৫)।

ব্যক্তিগত অমরত্বের প্রশ্নটি যার উপর দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত্তি কিছুটা অন্যরকম। দুভাবেই এর প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। ব্যক্তিসকল প্রতিদিনের জগতের একটি অংশ এবং যে জগতের সঙ্গে বিজ্ঞান অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, এবং যে অবস্থা তাদের অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে থাকে তা আবিষ্কারযোগ্য। একটি জলের বিন্দু অমর নয়, কেননা এটিকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে ভাগ করা যেতে পারে এইজন্য একবিন্দু জলের ক্ষেত্রে এইরকম ধারণা করা হয় যে এইরূপ বিভক্ত করার পরও যদি তার জলত্বের গুণটি বজায় থাকে তাহলে আমরা অবশ্য সন্দেহ করব একই ভাবে আমরা জানি যে মস্তিষ্ক অমর নয় এবং জীবিত শরীরের সংগঠিত শক্তি মৃত্যুতে নিঃসাড় হয়ে পরে, এইজন্য সে আর সমষ্টিগত ক্রিয়ায় যোগদান করতে পারে না। এই সমস্ত প্রমাণগুলি আমাদের এই সত্য প্রদর্শন করে থাকে যে যেটাকে আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবন বলে থাকি তা আসলে মস্তিষ্কের কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত এবং তা সংগঠিত শারীরিক শক্তি। এইজন্য এটা মনে করা যুক্তিযুক্ত যে মানসিক জীবন বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক জীবনও বন্ধ হয়ে যায় । যুক্তিটি কেবলমাত্র সম্ভাবতা সম্পর্কিত, কিন্তু এটি এতটাই জোরালো যে যার উপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলো গড়ে উঠেছে।

এখানে এমন অনেক পথ আছে যে পথে এই সিদ্ধান্তটিকে আক্রমণ করা যেতে পারে। মানসিক গবেষণা এই রকম শিক্ষা দিয়ে থাকে যার দ্বারা বেঁচে থাকার প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে এবং নিঃসন্দেহে এর পদ্ধতিটি আদর্শগত দিক দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক। এই ধরনের প্রমাণগুলিই এমন প্রচণ্ড হয়ে থাকে যে কোন বৈজ্ঞানিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষই তাকে পরিহার করতে পারে না। প্রমাণের উপর যে ওজনটি যোগ করতে হবে তা অবশ্যই বেঁচে থাকার পূর্ববর্তী সম্ভাব্য অনুমানের উপর নির্ভরশীল হবে। যে-কোন ঘটনাগুচ্ছকে সর্বদা বিভিন্ন পথে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করা যায় এবং এদের মধ্যে আমরা একটিকে পছন্দ করে নিতে পারি যা পূর্ববর্তীমূলক ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে খুব কম অসম্ভাব্য। যারা ঠিক এইরকম ভাবেই ভেবে নিয়েছে যে মৃত্যুর পরেও আমরা বেঁচে থাকতে পারি তারা অবশ্যই প্রস্তুত থাকবে এইরকম ভাবে দেখতে যে এই তত্ত্বটি মানস সম্বন্ধীয় ঘটনার সম্পর্কে সব থেকে উত্তম ব্যাখ্যা প্রদান করে। অন্যদিকে যারা এই তত্ত্বটিকে অসত্য বলে ভাবে তারা অন্য ধরণের ব্যাখ্যা খুঁজবে। আমার দিক থেকে বলতে গেলে আমি মনে করি যে মানস সম্বন্ধীয় গবেষণা যতটা প্রমাণ উদাহরণস্বরূপ দিতে পারে তার থেকে অনেক বেশি প্রমাণ দিতে পারে শারীরতত্ত্ব সম্বন্ধীয় গবেষণা। কিন্তু আমি এ কথা হলফ করে বলতে পারি যে কোন সময় এই তত্ত্বটি জোরালো হয়ে উঠতে পারে এবং যদি এরকম ঘটে তখন বেঁচে থাকার ব্যাপারটিকে অবিশ্বাস করাটা অবৈজ্ঞানিক হয়ে দাঁড়াবে।

শারীরিক মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার ঘটনাটি যদিও অমরত্বের থেকে একটি স্বতন্ত্র ঘটনা। এই ধরণের ঘটনা কেবল এই অর্থ বহন করে যে মানসিক মৃত্যু হয়নি বা তা রহিত হয়ে গেছে। আর এটাকেই লোকে অমরত্ব বলে ভাবতে চায়। অমরত্বে বিশ্বাসী লোক কেবলমাত্র শারীরবিদ্যামূলক যুক্তির উপর নির্ভর করে এগোয়। আমি এ বিষয়ে আগেই বলেছি, যে আত্মা এবং শরীর সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্য দিয়ে আত্মার বিকাশের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে তার থেকে সে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। আমি বিশ্বাস করি যে এটা একটা অধিবিদ্যাগত কুসংস্কার। কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে মন এবং বস্তু অনেকটা একই অর্থ বহন করে থাকে, কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রগুলো চরম বাস্তব নয়। আত্মার মতোই ইলেকট্রন ও প্রোটন কণার সমষ্টি, এক ধরণের যৌক্তিক কল্পকাহিনী, প্রত্যেকটিই একটি বাস্তব ইতিহাস ও একগুচ্ছ ঘটনাবলী কিন্তু কোনটারই শক্তিশালী কোন অস্তিত্ব নেই। আত্মার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়, তা হল বৃদ্ধির ঘটনাবলী থেকে আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট। এমন কে আছে যে ভাবতে পারে যে, কল্পনায় হক ‘গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় হক’ কিংবা শৈশবেই হক, কেউ এটা বিশ্বাস করে উঠতে পারে না যে আত্মা অবিভক্ত কিছু একটা, যা উক্ত অবস্থাগুলোর মধ্যে দিয়ে চলার সময় যথার্থ ও সম্পূর্ণ থাকে। এটা প্রমাণ করা যায় যে আত্মা শরীরের মতোই বেড়ে ওঠে, এর উদ্ভব শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে, এর ফলে এটি বিভক্ত হতে পারে না। এটা কোন বস্তুবাদ নয়, এটা কেবলমাত্র একটা স্বীকৃতি যে প্রতিটি আগ্রহোদ্দীপক বস্তু মাত্রই সংগঠনমূলক সত্ত্বার বিষয়, কখনই প্রাথমিক সারসত্ত্বামূলক বিষয় নয়।

অধিবিদ্যাবিদরা আত্মা যে অবশ্যই অমর তা প্রমাণ করতে বহু যুক্তি প্রদান করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একটি সরল পরীক্ষার দ্বারা এই সমস্ত যুক্তি গুলোকে নস্যাৎ করা যেতে পারে। সমস্ত অধিবিদ্যাবিদরা সমানভাবে প্রমাণ করেছেন যে আত্মা সমগ্র অনন্ত জুড়ে ব্যাপ্ত রয়েছে। অনেক দিন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যেমন মোটা হতে হবে এমন কোন আগ্রহ থাকে না, সেই রকমই কোন অধিবিদ্যাবিদরা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তাদের যুক্তিগুলোকে প্রয়োগ করার দিকে লক্ষ্য করেন। এটা অন্ধ হয়ে থাকার আকাক্ষার এক আশ্চর্য ক্ষমতা যা অতি সমর্থ মানুষকেও ভুল যুক্তির পথে পরিচালিত করে থাকে যেটা না হলে সবকিছুই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যেতো। যদি আমরা মৃত্যুকে ভয় না পেতাম, তাহলে আমি বিশ্বাস করি না যে কখনও অমরত্বের ধারণা গড়ে উঠতে পারত।

ধর্মীয় মতের ভিত্তি হল ভয়, যা মানবজীবনে রাজত্ব করে চলেছে। মানব জাতির মধ্যে ভয় বস্তুটি, সে ব্যক্তিগত হ’ক কিংবা সমষ্টিগত হক, আমাদের সামাজিক জীবনের উপর বেশি প্রভুত্ব করে থাকে। মন ও জড় বস্তুর মধ্যে বৈষম্য বা দ্বন্দ্ব (antithesis) কম বা বেশি ভ্রমাত্মক। কিন্তু আর একটি বৈষমন্ত দেখা যায় যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা হল বস্তুদ্বয়ের মধ্যে যে অন্য ধরণের বৈষম্য আমরা দেখি তা আমাদের আকাক্ষার দ্বারা প্রভাবিত এবং কিছু বস্তুর ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আমাদের আকাঙ্ক্ষার দ্বারা ততটা প্রভাবিত নয়। এই দুই বস্তুর মধ্যে যে রেখাচিত্রটি আঁকা যায় তা যেমন স্পষ্টও নয় তেমনি অপরিবর্তনীয়ও নয়। বিজ্ঞান যত এগিয়েছে, ততই বহু বহু বস্তু মানুষের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অধিকন্তু এখনো অনেক বস্তুই অনিবার্যভাবে অন্যদিকে রয়ে গেছে। এই বস্তুগুলোর মধ্যে আমাদের জগতের সব থেকে বড় বড় ঘটনাগুলো রয়ে গেছে। এই ধরণের বড় বড় ঘটনাগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের দ্বারাই ঘটেছে। পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠে বা পৃথিবীর নিকটে ঘটে যাওয়া এই সব ঘটনাগুলো, অন্তত কিছুটা দূর অবধি, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে দমিয়ে মানানসই করে তুলতে পারে। আমরা জানি যে পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠে আমাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। সর্বোপরি, আমরা মৃত্যুকে থামাতে পারি না, যদিও মৃত হওয়ার দিক থেকে কিছুটা বিলম্ব ঘটাতে পারি।

ধর্ম এই ধরণের বৈষম্যকে অতিক্রম করবার চেষ্টা করছে। যদি জগৎ ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ঈশ্বরকে যদি প্রার্থনা দ্বারা চালিত করতে পারা যায়, তাহলে আমরা সর্বময়তা অর্জন করব। পূর্বের দিনগুলোতে, প্রার্থনার উত্তরে দৈব ঘটনা ঘটে যেত। ক্যাথলিক চার্চে এখনো এই ধরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রোটেস্টান্ট চার্চগুলো এই ধরণের ক্ষমতা হারিয়েছে। যদিও, দৈব ঘটনাগুলোকে ত্যাগ করে কাজ চালান সম্ভব, যেহেতু বিধাতা এই বিধান জারি করেছেন যে প্রাকৃতিক নিয়মসমূহের কার্য সম্ভাব্য উত্তম ফল উৎপাদন করতে পারে। যেমন ঈশ্বরে বিশ্বাস এখনও পর্যন্ত প্রাকৃতিক জগৎকে মানবীয় করে রাখে, এবং মানুষকে এই অনুভব করায় যে পদার্থগত শক্তি বাস্তবে তাদের বন্ধু। একইভাবে অমরত্ব মৃত্যু থেকে মৃত্যুর ভয়াবহতাকে মুছে দেয়। যে-সব লোক এই বিশ্বাস করে যে যখন তারা মরবে তখন তারা উত্তরাধিকারসূত্রে অনন্ত আশীর্বাদের বা আনন্দের ধারক হবে, তারা এটাও আশা করতে পারে যে, তাদের মৃত্যু হবে মৃত্যুর ভয়াবহতার অনুভব ছাড়াই, যদিও, সৌভাগ্যক্রমে চিকিৎসাবিদরা এই ধরণের ঘটনা কখনই ঘটতে পারে না বলে মনে করেন। যদিও, এটা মানুষের ভয়কে কিছুটা পরিমাণ কমিয়ে দেয়, কিন্তু এত করেও মানুষের ভেতরে উক্ত ভয়কে একেবারে উপশম করতে পারে না।

ভয়াবহতাই ধর্মের মূল উৎস। সে কিছু কিছু ধরণের ভীতিকে মর্যাদা প্রদান করেছে এবং মানুষকে তাদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা করতে কখনও শেখায়নি। এই পথেই সে মানুষের জন্য সব থেকে বড় অকাজটি করেছে। সমস্ত রকম ভীতিই খারাপ (all fear is bad)। আমি বিশ্বাস করি, যখন আমি মরব তখন আমি পচব এবং আমার কোন রকম অহঙ্কারই বেঁচে থাকবে না। আমি যুবক নই, এবং আমি জীবনকে ভালবাসি। কিন্তু মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঁপাটাকে আমার অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত। সুখ বস্তুটি কোন সত্য সুখের থেকে কম সত্য নয়। কারণ তার অবশ্যই একটা শেষ আছে। কিন্তু এরকম ভাবে ভাবা হয় না। প্রেম তার মূল্য হারাচ্ছে, কারণ তাও চিরস্থায়ী নয়। অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদেরকে মাচার উপর বহন করতে ভালবাসে। অবশ্য এই একই ধরণের গর্ব জগতে মানুষের স্থান সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করতে শেখায়। প্রথমে আরামদায়ক অন্দরমহলের ঐতিহ্যবাহী উষ্ণ মানবীয় পুরাণের পরিবেশে বিজ্ঞানের জানালা খুলে দিলে ঠান্ডা বাতাস আমাদের কাঁপিয়ে দেয়, কিন্তু পরিশেষে সেই বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসে উৎসাহ এবং জানালা দিয়ে দেখা যায় অসীম অনন্তকে যা আপন মহিমায় দীপ্ত।

প্রকৃতির দর্শন এক, বস্তুমূল্যের দর্শন একেবারেই ভিন্ন। এই দুই দর্শনের মধ্যে বিলতার সৃষ্টি করাটা একটা বিরাট ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যা ভাল ভাবি, আমরা যা পছন্দ করি, তা সেই বস্তুটির প্রকৃত স্বরূপের উপর নির্ভর করে না, যে স্বরূপটি প্রকৃতির দর্শনের প্রশ্ন। অন্যদিকে, অমানবিক জগৎ কোনটাকে মূল্য দেয়নি তার উপর নির্ভর করে মূল্য প্রদানের ক্ষেত্রে এটা না ওটা করে কোন ভুল করতে পারি না আমরা, না আমরা বাধ্য কোন কিছুকে প্রশংসা করতে এই ভিত্তির উপর যে সেটি প্রাকৃতিক নিয়ম। নিঃসন্দেহে আমরা প্রকৃতির অংশ, যা আমাদের মধ্যে বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষা উৎপাদন করেছে। উৎপাদন করেছে আশা ও ভীতিসমূহ এবং সেই সব নিয়মসমূহ অনুযায়ী নিয়মগুলোকে পদার্থবিদরা সবে মাত্র আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন। এই অর্থে আমরা প্রকৃতির বশবর্তী, প্রাকৃতিক নিয়মজাত ফলস্বরূপ এবং অনেক পরে এই সব নিয়মের কাছেই বলি স্বরূপ (…….. we are part of nature, we are subordinated to nature, the outcome of natural laws, and their victims in the long run.)

প্রকৃতির দর্শন অবশ্য অনুচিতভাবে পার্থিব নয়, কেননা, পৃথিবী ছায়াপথের একটি ক্ষুদ্র নক্ষত্রমালার মধ্যে একটি ছোট্ট গ্রহ। তাই এই অকিঞ্চিত্বর গ্রহের ক্ষুদ্র পরজীবীদের আনন্দের খাতিরে প্রকৃতির দর্শনকে মুছে ফেলাটা একটা হাস্যাস্পদ ব্যাপার হবে। প্রাণবাদ (vitalism) এবং বিবর্তনবাদ এই প্রসঙ্গে যে সত্যটা আমাদের কাছে তুলে ধরে তা হল, এগুলো সামঞ্জস্যমূলক চেতনাহীন এবং যৌক্তিক সঙ্গতিহীন। এইসব মতবাদগুলি সেই সমস্ত ঘটনাগুলোকে সমাদর করে থাকে, যে ঘটনাগুলি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কাছে আগ্রহোদ্দীপক, কেননা তাদের একটা জাগতিক তাৎপর্য আছে বলে, তাদের পার্থিব তাৎপর্যের জন্য নয়। জাগতিক দর্শন হিসাবে, আশাবাদ ও দুঃখবাদ সেই একই সরল মানবতাবাদকে প্রদর্শন করে থাকে। এই জগৎ বিশাল, প্রকৃতির দর্শন থেকে যতদূর পর্যন্ত আমরা এই বিশাল জগৎ জেনেছি তা না মঙ্গলময় না অমঙ্গলময়, এবং তা আমাদের সুখী বা অসুখী করবার সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। এই ধরণের সমস্ত দর্শনগুলো আত্ম গুরুত্ব থেকে নির্গত এবং তাদের আরও শুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে নক্ষত্র বিজ্ঞানের উপর এক ছটাক জ্ঞানের দ্বারা।

কিন্তু মূল্যের দশনের ক্ষেত্রে অবস্থাটা একেবারেই উল্টো। আমরা যতটা কল্পনা করতে পারি প্রকৃতি তারই একটা অংশ। বাস্তব বা কল্পিত প্রতিটি বস্ততুই আমাদের দ্বারা প্রশংসিত হতে পারে, এবং এখানে এমন কোন বহির্মূল্যায়ন (out side standard) নেই যার দ্বারা দেখানো যেতে পারে যে আমাদের মূল্যায়ন ভুল। আমরা নিজেরাই সেখনে চরম এবং মূল্য প্রদানের ক্ষেত্রে অখণ্ডনীয় মধ্যস্থতাকারী এবং মূল্যের জগতে প্রকৃতি একটি অংশ মাত্র। এইভাবেই এই জগতে আমরা প্রকৃতির থেকে অনেক বড়। মূল্যের জগতে প্রকৃতি নিজেই নিরপেক্ষ। সে ভালও নয়, খারাপও নয়, সে প্রশংসারও যোগ্য নয়, নিন্দারও যোগ্য নয়। আমরাই মূল্য সৃষ্টি করি এবং সেই ধরণের আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করি যা মূল্য প্রদান করে থেকে। এই রাজত্বে আমরা রাজা এবং আমরা তখন আমাদের রাজত্বকে নিকৃষ্ট করে তুলি যখন আমরা প্রকৃতির কাছে অবনত হই। আমাদের জন্যই মঙ্গলময় জীবনকে নির্ধারণ করতে হবে, প্রকৃতির জন্য নয়– এমনকি সেই প্রকৃতির জন্যও নয় যাকে আমরা ঈশ্বরে পরিণত করেছি।

(২) মঙ্গলময় জীবন

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষদের মধ্যে মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে ধারণা বিভিন্ন রকম। এই বিভিন্নতাই বিভিন্ন যুক্তির জন্য কিছুটা পরিমাণে দায়ী। এই ঘটনা তখনই ঘটেছে যখন মানুষ তাদের নিজের নিজের ধারণা অনুযায়ী উক্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। কেউ কেউ মনে করেছে কারাগার হল সেই মঙ্গলময় পথ যে পথে অপরাধকে আটকানো যেতে পারে। অন্যজনে এই ধারণা পোষণ করে থাকে যে শিক্ষাই উক্ত পথের থেকে অনেক বেশি মঙ্গলময়। এই ধরণের বিভিন্নতাগুলোকে যথেষ্ট প্রমাণ দর্শিয়ে সিদ্ধান্তের আঙিনায় নিয়ে আসা যায়। তলস্তয় সমস্ত রকম যুদ্ধকেই নিন্দা করেছেন। অন্যরা যোদ্ধার জীবনকে গ্রহণ করে সঠিককে মহান করবার জন্য যুদ্ধ করে। এক্ষেত্রে বাস্তব পার্থক্য জড়িত এবং লক্ষ্যগুলির মধ্যে পাথক্য দ্রষ্টব্য। যারা যোদ্ধাকে প্রশংসা করে থাকে তারা সাধারণত পাপীর শাস্তিকে মঙ্গলজনক পথ বলে মনে করে। তলস্তয় কিন্তু এরকম চিন্তা করেননি। এ ব্যাপারে কোনরকম যুক্তি প্রদর্শন অসম্ভব। এইজন্যই, আমি প্রমাণ করে বলতে পারি না যে মঙ্গলজনক জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক। আমি কেবলমাত্র আমার দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বলতে পারি এবং আশা করতে পারি যে যতদূর সম্ভব তা সমর্থিত হবে। এই ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হল :

‘মঙ্গলময় জীবন হল সেই জীবন যা প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত’ (The good life is one inspired by love and guided by knowledge)

জ্ঞান এবং প্রেম উভয়ই অর্নিদিষ্টভাবে প্রসারণক্ষম। এইজন্য একটি জীবন যতই মঙ্গলময় হ’ক না কেন, তার থেকেও অনেক বেশি উন্নত জীবন কল্পনা করা যায়। জ্ঞান ব্যতীত প্রেম, বা প্রেম ব্যতীত জ্ঞান, কোনটাই মঙ্গলময় জীবন সৃষ্টি করতে পারে না। মধ্য যুগগুলোতে, যখন কোন দেশে মহামারী উপস্থিত হত তখন সাধু মানুষেরা জনগণকে গীর্জায় সমবেত হয়ে উদ্ধার পাবার জন্য প্রার্থনা করতে উপদেশ দিতেন। এর ফল দাঁড়াত এই যে বিনীতভাবে প্রার্থনাকারী মানুষের ভিড়ে অতি দ্রুত রোগটি ছড়িয়ে পড়ত। জ্ঞানহীন প্রেমের নজির এই ধরণের ঘটনা এবং পরেরটি প্রেমহীন জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই, ফল হত বিরাট আকারে মৃত্যু।

যদিও প্রেম এবং জ্ঞান উভয়ই প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রেম হল সব থেকে মৌলিক, যেহেতু এটি বুদ্ধিমান মানুষকে জ্ঞান অন্বেষণে প্রবৃত্ত করে সে যাদের ভালবাসে তাদের কিসে ভাল হয় তার জন্য। কিন্তু যদি জনগণ বুদ্ধিমান না হয়, তবে তাদের যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা শুনেই তারা সন্তুষ্ট থাকে, ভালো করার থেকে ক্ষতি করে বেশি। আমি যা বলতে চাইছি সে ব্যাপারে চিকিৎসাবিদ্যা খুব ভালো উদাহরণ। একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু অপেক্ষা একজন দক্ষ চিকিৎসাবিদ অনেক বেশি কার্যকরী। চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানের অগ্রগতি মনুষ্যগোষ্ঠীর সাধারণ স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য একজন অজ্ঞানী মানবদরদী অপেক্ষা অনেক বেশি কাজ করতে পারে। অধিকন্তু, যদি ধনিক শ্রেণী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করিয়ে তার থেকেও লাভ সগ্রহ করতে চায় তা হলেও ভালো, কেননা যে-কোন রকম ভাবে উপকারের ইচ্ছাটাই প্রয়োজনীয়।

প্রেম এমন একটি শব্দ যা বহু বিচিত্র অনুভবকে ঢেকে রাখে। আমি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই এই শব্দটি ব্যবহার করেছি সেই সব বিচিত্র অনুভবগুলো ধরতে চাওয়ার জন্য। আবেগ হিসেবে প্রেম– আমি যা বলতে চাইছি তা হল, প্রেমের জন্য কোন আদর্শ আমার কাছে খাঁটি মনে হয় না এটি দুটি মেরুর মধ্যে চলাচল করে থাকে। একটি দিকে প্রশান্তিমূলক শুদ্ধ আনন্দ এবং অন্যদিকে শুদ্ধ বদান্যতা বা উপকার করবার ইচ্ছা। যেখানে প্রাণহীন বস্তু সম্পর্কিত, সেখানে কেবল আনন্দ প্রবেশ করতে পারে। আমরা ছবিতে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখে বা সোনাটা (SONATA) শুনে বদান্যতা অনুভব করতে পারি না। স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে যে এই ধরণের আনন্দই শিল্পকলার উৎস। নিয়ম অনুযায়ী এই ধরণের আনন্দ পূর্ণবয়স্ক শিশু অপেক্ষা কমবয়সের শিশুর মধ্যে বেশি থাকে, যারা উপযোগিতামূলক অনুপ্রেরণায় কোন বস্তুকে দেখতে সমর্থ। মানব জাতির অভিমুখে আমাদের এই ধরনের অনুভব খুব বড় কাজ করে। কেউ কেউ মুগ্ধতা অনুভব করে, আবার কেউ কেউ যখন কেবলমাত্র সৌন্দর্যতত্ত্বমূলক সন্তুষ্টির বস্তু হিসেবে তাকে দেখে তখন সে উল্টো অনুভব করে।

প্রেমের বিপরীত মেরুটি হল শুদ্ধ বদান্যতা। কুষ্ঠরোগীদের সাহায্য করতে গিয়ে বহু মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। এই ধরণের ঘটনায় যে ধরনের প্রেম তারা অনুভব করেছে তা সৌন্দর্যতত্ত্বমূলক কোন আনন্দ থেকে নয়। বাৎসল্য, নিয়ম অনুযায়ী, শিশুর উপস্থিতিজাত আনন্দ থেকে উদ্ভূত। কিন্তু এই স্নেহ আরও বেড়ে যায় যখন উপকরণটি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে। অসুস্থ শিশু সন্তানের প্রতি মায়ের আগ্রহকেই বদান্যতা বলাটা বিষম হয়ে দাঁড়াবে, কারণ নয় ছয় পনের মার্কা প্রবঞ্চনাকর ধূসর আবেগকে আমরা এই ধরণের শব্দে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত। কিন্তু অন্য ব্যক্তির মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষাকে অন্য কোন শব্দে বর্ণনা করা দুরূহ। বাস্তবে পিতৃমাতৃ অনুভবের ক্ষেত্রে এই ধরনের আকাঙ্ক্ষা শক্তির যে-কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটা অনেক কম তীব্র, বরঞ্চ এটা মনে করাটা অনেক সহজসাধ্য হবে যে, সব ধরণের পরোপকারের ধারণা মূলত পিতৃমাতৃমূলক অনুভবের প্রবাহ, অথবা কখনও তা এই ধরণের অনুভবের মঙ্গলজনক পথে পরিচালন বোঝায়। অপেক্ষাকৃত ভাল শব্দের চাহিদায়, আমি এই আবেগকে বদান্যতা বলে অভিহিত করব। কিন্তু এটা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আমি একটি আবেগ সম্পর্কে কথা বলছি, কোন আদর্শ সম্পর্কে নয়, এবং তার ফলে আমি এই শব্দের সঙ্গে জড়িত কোন মহানতার অনুভবকে অন্তর্ভুক্ত করিনি। সমবেদনা (sympathy) শব্দটিকে আমি যা বুঝি তা তার কিছুটা অংশ। শব্দটির থেকে যে-সব কার্যকরী অংশ বাদ দেওয়া হয় আমি সেই অংশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই।

প্রেম (Love) শব্দটি চরম অর্থে দুটি উপকরণের অদ্রবীভূত মিশ্রণ, আনন্দ এবং শুভ-ইচ্ছা। সুন্দর ও সার্থক শিশুর পিতামাতার আনন্দের ক্ষেত্রে এই দুই ধরণের উপকরণ কাজ করে। যৌন প্রেমের ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব ঐ একই ঘটনা ঘটে। কিন্তু যৌন প্রেমের ক্ষেত্রে বদান্যতা ব্যাপারটি তখনি দেখা যায় যখন অধিকারের নিশ্চয়তা দেখা যায়, তা না হলে হিংসা তাকে ধ্বংস করে থাকে, যখন সম্ভবত প্রশান্তিজাত আনন্দ বাড়তে থাকে। শুভ-ইচ্ছা ব্যতীত আনন্দ নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হতে পারে। আনন্দ ব্যতীত শুভ-ইচ্ছা শীতল ও একটু বেশি শ্ৰেষ্ঠতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। একজন ব্যক্তি যে প্রেম চায় সে আসলে প্রেমের সেই বিষয় হতে চায় যেখানে এই দুটি উপকরণই থাকবে, একমাত্র প্রবল দুর্বলতা ছাড়া, যেমন শৈশব এবং মারাত্মক অসুস্থতার বেলায় বদান্যতাকেই বেশি করে আকাঙ্ক্ষা করা হয়। বিপরীতভাবে, প্রবল শক্তির ক্ষেত্রে, বদান্যতার চেয়ে প্রশংসা অনেক বেশি আকাক্ষিত। এই ধরণের মানসিক অবস্থা দেখা যায় প্রসিদ্ধ রাজা বা সম্রাট ও বিখ্যাত সুন্দরীদের ক্ষেত্রে। এই অনুভব করে আমরা মানুষের মঙ্গলময়-ইচ্ছা ততটা পরিমাণেই চেয়ে থাকি যতটা পরিমাণ সাহায্যের প্রয়োজনে ও বিপদের সময় আমরা নিজেরা তাদের কাছে চাই। ব্যাপারটিকে অন্তত অবস্থার (Situation) জীববিদ্যাগত যুক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমরা স্নেহ আকাক্ষা করে থাকি একাকিত্বের অনুভব থেকে মুক্তি পেতে, যে ব্যাপারটি আমাদের কাছে উহ্য থাকে। সমবেদনার (sympathy) এটাই হল বিষয় যে তা কেবলমাত্র বদান্যতা নয়। যে ব্যক্তির স্নেহ আমাদের কাছে সন্তুষ্টিমূলক জায়গায় পৌঁছতে পারে, সেই স্নেহ কেবলমাত্র আমাদের মঙ্গল কামনাই করে না সে জানে ঠিক কোথায় আমাদের সুখ লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই ধরণের অনুভব মঙ্গলময় জীবনের অন্য আর একটি অনুভব, যাকে আমরা জ্ঞান বলতে পারি।

একটি সঠিক জগতে প্রতিটি সচেতন সত্ত্বা প্রতিটি সত্ত্বার জন্য পূর্ণ প্রেমের বিষয়, যে প্রেম আনন্দ, বদান্যতা ও বোঝাঁপড়ার সমাধানযোগ্য মিশ্রণ। তা বলে এটা এরকম বোঝায় না যে, এই বাস্তব জগতে, যে সব মানুষের সঙ্গে লড়াই করে চলেছি তাদের প্রতি আমাদের এই ধরণের অনুভব অর্জন করা উচিত। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের ব্যাপারে আমরা আনন্দ অনুভব করি না, কারণ তারা বিরক্তজনক। যদি আমরা এই ধরণের মানুষের ভেতরে সৌন্দর্য দেখবার চেষ্টা করতে গিয়ে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাতাম তবে আমরা স্বাভাবিকভাবে যেসব বস্তুকে সুন্দর দেখি তাদের সেইভাবে দেখবার সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা করে ফেলতাম। এই ধরণের মানুষের প্রসঙ্গে মানবজাতির কথা উল্লেখ করবেন না, কেননা তারা মাছি, ছারপোকা এবং উকুনের মতো। এই ধরণের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে আনন্দবোধ করবার আগে আমাদের এসিয়েন্ট মেরিনার মতো দৃঢ়ভাবে রস নিঙড়ানোর ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। এটা সত্য যে কিছু সাধু মানুষ এদেরকে ঈশ্বরের মুক্তো বলে ডেকে থাকেন, কিন্তু এই কথা বলে সেই সাধু মানুষরা যে আনন্দ পেয়ে থাকেন তা তাঁদের নিজেদের গুণের প্রদর্শন মাত্র।

পরোপকারকে সহজেই ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা যায়, কিন্তু তার একটি সীমা আছে। যদি কোন ব্যক্তি কোন মহিলাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক হয় এবং সে যদি দেখে যে অন্য আর একজন ব্যক্তিও সেই মহিলাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তবে আমাদের এইরকম ভাবা উচিত হবে না যে তার পক্ষে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়াটাই ভালো হবে। এই ব্যাপারটিকে আমরা তখন ধরে নেব প্রতিযোগিতার উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে। এক্ষেত্রে বিরুদ্ধ পক্ষের উপর তার অনুভব পূর্ণরূপে পরোপকারমূলক হতে পারে না। আমি মনে করি যে পৃথিবীর উপর মঙ্গলময় জীবনের সব রকমের বর্ণনাতে কোন-না-কোন জান্তব প্রাণবন্ততা ও প্রবৃত্তিকে ভিত্তিরূপে আমরা অবশ্যই অনুধাবন করতে পারি। এ ছাড়া, জীবন অবদমিত ও অনাগ্রহোদ্দীপক হয়ে ওঠে। সভ্যতা অবশ্যই এর সঙ্গে সংযুক্ত কিছু একটা, অবশ্যই তা এই ব্যাপারটির উল্টো কিছু নয়। এই জন্যেই কৃচ্ছ্বতাসম্পন্ন সন্ন্যাসী ও বিচ্ছিন্ন সাধু পূর্ণ মানব হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ। মুষ্টিমেয় সংখ্যায় তারা কোন গোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে, কিন্তু যে জগৎ তাদের নিয়েই রচিত সেই জগৎ অবশ্যই নৈরাশ্যে মরবে।

এই সমস্ত বিবেচনাগুলি উত্তম প্রেমের উপাদান হিসেবে আনন্দের উপকরণের উপর বিশেষ জোর দেওয়ার দিকে পরিচালিত হয়। আনন্দ, এই বাস্তব জগতে, অবশ্যম্ভাবী রূপে নির্যাতনমূলক এবং যা আমাদের বাধা দিয়ে থাকে সমগ্র মনুষ্য জাতির প্রতি একই রকম অনুভব পোষণ করার ক্ষেত্রে। যখন আনন্দ ও বদান্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, নিয়ম অনুযায়ী, তখন বোঝাঁপড়ার মধ্য দিয়ে একটা সিদ্ধান্তে অবশ্যই আসতে হয়, কিন্তু কখনই যে-কোন দুটির একটিকে পূর্ণ সমর্পণ করার দ্বারা তা হয় না। প্রবৃত্তির নিজস্ব কিছু অধিকার আছে কিন্তু সীমার বাইরে গিয়ে যদি আমরা তার প্রতি হিংসা প্রদর্শন করে থাকি তবে তা সূক্ষ্ম পথে তার প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। এইজন্য মঙ্গলময় জীবনের লক্ষ্যে মানবিক সম্ভাব্যতার সীমা মনে অবশ্যই জন্ম নেবে। আবার বলতে হয়, যদিও, জ্ঞানের প্রয়োজনে আমাদের ফিরে আসতে হয়।

যখন আমি মঙ্গলময় জীবনের উপাদান হিসেবে জ্ঞানের কথা বলে থাকি, তখন আমি নৈতিক জ্ঞানের কথা ভাবি না, বরং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও বিশেষ ঘটনাগুলি সম্পর্কিত জ্ঞানের কথা ভাবি। সত্য করে বলতে গেলে আমি মনে করি না যে নৈতিক জ্ঞান বলে কোন কিছু আছে। আমরা যদি কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, জ্ঞান আমাদের দেখাতে পারে তার উপায়গুলি এবং এই জ্ঞান হাল্কাভাবে নৈতিক জ্ঞান হিসেবে আমাদের সামনে দিয়ে বয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে সেই নৈতিক জ্ঞানগুলির সম্ভাব্য ফল প্রদর্শন ছাড়াই আমরা তাদের মধ্যে কোনটা ঠিক বা ভুল তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। একটি লক্ষ্যকে অর্জন করবার জন্য দেওয়া হ’ক, দেখা যাবে যে কিভাবে তা অর্জন করা যায় তা আবিষ্কারের জন্য সেটি বিজ্ঞানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের কামনাপ্রসূত লক্ষ্যগুলিকে ঠিক মতো অনুধাবন করবার ক্ষমতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করার মাধ্যমে আমরা সমস্ত নৈতিক সূত্রগুলির যোগ্যতা প্রমাণ করে নিতে পারি। আমি সেই লক্ষ্যগুলির প্রসঙ্গে বলেছি যেগুলি আমরা কামনা করে থাকি, কিন্তু সেই সব লক্ষ্যগুলির কথা বলিনি যেগুলি আমাদের কামনা করা উচিত। কামনা করার ক্ষেত্রে যা আমাদের উচিত বলে বিবেচিত সেই সব কামনাগুলি অপর কারুর ইচ্ছাপ্রসূত। সাধারণত এগুলি এরকমই যা কর্তৃপক্ষ আমাদের কামনা করতে শেখান। বাবা-মা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ এবং বিচার করা। যদি আপনি আমাকে বলেন, আপনার উচিত এটা কি সেটা করা’, তবে আপনার মন্তব্যের চালক-শক্তি আপনার অনুমোদনের দিকে আমার কামনাকে চালিত করবে তা উভয় প্রকার সম্ভাব্য অনুমোদনের দিকে চালিত হতে পারে এবং তা আপনার অনুমোদন ও অননুমোদন সাপেক্ষে পুরস্কারমূলক বা শাস্তিমূলক হতে পারে। যেহেতু সমস্ত রকমের আচরণ কামনা থেকেই উত্থিত, সুতরাং এটা পরিষ্কার যে নৈতিক মতো কখনই কোন গুরুত্ব নিতে পারে না যতক্ষণ না তারা কামনাকে প্রভাবিত করতে পারে। অনুমোদনের কামনা এবং অননুমোদনের ভীতির মাধ্যমেই তারা তাদের এই কাজ করতে পারে। এইগুলি ক্ষমতাসম্পন্ন সামাজিক বল। আমাদের সাপেক্ষে আমরা সেগুলি সাধারণভাবে জয় করবার চেষ্টা করি তখনই, যখন আমরা কোন সামাজিক উদ্দেশ্যকে মেটাতে ইচ্ছা করে থাকি। যখন আমি বলে থাকি যে নির্দেশিত আচরণের নৈতিকতাকে বিচার করে নিতে হবে তার। সম্ভাব্য ফলের দ্বারা, তখন আমি এই বলতে চাই যে সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণার্থে করণীয় আচরণগুলির অনুমোদন আমি দেখার কামনা করি এবং বিপরীত আচরণের ক্ষেত্রে অননুমোদন দেখার কামনা করে থাকি। বর্তমানে এটি ঘটে না। এখানে এমন কিছু ঐতিহ্যবাহী নিয়ম আছে যে নিয়মগুলি অনুযায়ী ফলসমূহকে অগ্রাহ্য করেই অনুমোদন এবং অননুমোদন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই বিষয়টির উপর আলোচনা আমরা পরবর্তী ভাগে করব।

সাধারণ ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক নৈতিকতার আধিক্য স্পষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ মনে করা যাক, আপনার শিশুটি অসুস্থ। আপনার প্রেম আপনাকে শিশুটিকে সারিয়ে তুলতে ইচ্ছা করাবে এবং বিজ্ঞান বলবে কেমন ভাবে আপনি শিশুটিকে সারিয়ে তুলতে পারেন। নৈতিক তত্ত্বের মধ্যে এমন কোন মধ্যবর্তী স্থান নেই যেখানে দাঁড়িয়ে একথা বলা যেতে পারে যে আপনার শিশুটিকে আরও ভালোভাবে সারিয়ে তোলা যেত। একটি লক্ষ্য পূরণের আকাক্ষা থেকে আপনার কার্যটি সরাসরি উঠে আসে বিভিন্ন রকম উপায়ের জ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে। সব কার্যের ক্ষেত্রেই এটা সমান সত্য, সে কার্য ভালো মন্দ যাই হক না কেন। লক্ষ্যগুলি পরস্পর স্বতন্ত্র এবং কিছু কিছু লক্ষ্যের ক্ষেত্রে জ্ঞান অপর্যাপ্ত হতে পারে আবার কিছুর ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। কিন্তু মানুষ যে কাজ করতে ইচ্ছুক নয় তাকে সেই কাজ করাবার জন্য কোন বোধগম উপায় নেই। যেটা সম্ভব সেটা হল পুরস্কার এবং শাস্তির ব্যবস্থার দ্বারা তাদের কামনাকে পরিবর্তিত করা। এক্ষেত্রে সামাজিক অনুমোদন এবং অননুমোদন খুব একটা কম বলশালী নয়। এই কারণেই বিধান সম্বন্ধীয় নীতিবিদদের জন্য যে প্রশ্নটি জাগে তা হল, কিভাবে এই পুরস্কার ও শাস্তিসমূহের ব্যবস্থাকে সাজালে বিধান সম্বন্ধীয় কর্তৃত্বদের কামনার সব থেকে বেশি সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা যায়? যদি আমি এমন বলি যে, বিধান সম্বন্ধীয় কর্তৃত্বদের কামনাগুলি ভালো নয়, তখন আমি কেবলমাত্র এই কথাই বলতে চাই যে তাদের কামনা বা ইচ্ছাগুলি গোষ্ঠীর কিছু কিছু অংশের সঙ্গে দ্বন্দরত থাকে যে অংশগুলিতে আমি বা আমার মতো লোকজন জড়িত থাকে। মানবিক কামনা বাসনার বাইরে কোনরকম নৈতিক মান নেই (outside hauman desire there is no moral standard.)

তাই বলা যেতে পারে যা নীতিবিদ্যার থেকে বিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র করেছে তা কোন বিশেষ ধরণের জ্ঞান নয়, তা হল কামনা বা আকাঙ্ক্ষা। যে-কোন ক্ষেত্রে যেভাবে জ্ঞান অর্জন করা হয়ে থাকে সেরকমই নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে ঘটে। যে ঘটনাটা অদ্ভুত তা হল কিছু লক্ষ্যকে কামনা করা হয়ে থাকে এবং সেইসব লক্ষ্যের সহায়ক আচরণকে যথার্থ বলে ধরা হয়। সুতরাং বলা যায়, যদি ব্যাখ্যাটি যথার্থ আচরণ সম্পৰ্কীয় হয়ে থাকে তা হলে তার আবেদনের পরিধিও ব্যাপক। মনুষ্যজাতির বেশিরভাগ অংশের কামনা বাসনার উপরই লক্ষ্যগুলি গড়ে ওঠে। যথার্থ আচরণগুলিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করলে আমার অর্থ উপার্জন ভালো হবে, পাঠক তা কোনভাবেই মেনে নেবে না। যে কোন কার্যকরী নৈতিক যুক্তি তার বৈজ্ঞানিক অংশে নিহিত থাকে, তা হল, অন্যান্য কিছু আচরণের চেয়ে বিশেষ এক ধরণের আচরণ যা সেই লক্ষ্য পূরণের উপায় যে লক্ষ্য ব্যাপকভাবে আকাক্ষিত। যদিও আমি নৈতিক যুক্তি এবং নৈতিক শিক্ষাকে স্বতন্ত্রভাবে দেখি। নৈতিক শিক্ষা কিছু আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং তা করতে গিয়ে সে কিছু আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে তোলে। এটা সম্পূর্ণভাবে একটি ভিন্ন ধরণের পদ্ধতি, যা শেষের দিকে স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হবে।

এখন আমরা সেই মঙ্গলময় জীবনের সংজ্ঞার তাৎপর্য আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি যে বিষয়টি নিয়ে এই পরিচ্ছেদটি শুরু হয়েছিল। যখন আমি বলেছিলাম যে মঙ্গলময় জীবন প্রেমের দ্বারা গঠিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত, তখন যে কামনা আমাকে এই কথা বলতে তৎপর করেছিল তা ছিল যতদূর সম্ভব এমন একটা জীবন বাঁচার কামনা এবং অন্যকে তার জীবনে এই রকম ভাবে বাঁচতে দেখার কামনা। এই বিবৃতির অন্তর্নিহিত যুক্তিটি হল যে, একটি গোষ্ঠীতে যেখানে মানুষ এইভাবে বসবাস করে, সেখানে কামনাগুলির অনেক বেশি সন্তুষ্টি সাধন হয়ে থাকে তাদের চেয়ে যারা অপেক্ষাকৃত কম প্রেম ও জ্ঞানের পরিবেশে বসবাস করে। আমি এই অর্থ করছি না যে এই ধরনের জীবন ‘পুণ্যবান’ অথবা এর বিপরীতটি হল ‘পাপময়’, কেননা এই রকম কল্পনা আমার কাছে কোন বৈজ্ঞানিক গ্রাহ্যতা রাখে না।

() নৈতিক নিয়মসমূহ

নৈতিক উপদেশগুলির বাস্তব প্রয়োজনীয়তা কামনার দ্বন্দ্ব থেকে উঠে আসে এবং সে দ্বন্দ্ব ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মধ্যে হতে পারে অথবা ভিন্ন সময়ে একই মানুষের মধ্যে হতে পারে, এমনকি একই সময়ে একই মানুষের মধ্যেও হতে পারে। একজন মানুষ মদ্যপানের আকাক্ষা করতে পারে এবং পরের দিন সকালে তার কাজ করবার জন্য সে সুস্থ থাকার আকাক্ষাও করতে পারে। আমরা তখনই তাকে অনৈতিক বলব যদি সে বেছে নেয় সেই রাস্তা যে পথ তার সমগ্র আকাক্ষার অতি সামান্যই পূরণ করতে পারে। আমরা সেইসব মানুষ সম্পর্কে বাজে ভাবি যারা অতিরঞ্জিত ও বেপরোয়া। এমনকি যারা নিজের ক্ষতি ছাড়া অন্যের ক্ষতি করে না তাদের সম্বন্ধেও ওই একই কথা ভাবা হয়। বেন্থাম মনে করতেন যে ‘আলোকিত আত্ম-স্বার্থ’ থেকেই নৈতিকতার সবকিছুর জন্ম এবং একজন ব্যক্তি যে সর্বদা তার নিজের সর্বাধিক সন্তুষ্টির দিকে নজর রেখে কাজ করে, পরবর্তীকালে সে যা কাজ করে তাই সর্বদা সঠিক হয়। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি না। স্বৈরাচারীরা তাদের মধ্যেই বিদ্যমান যারা শাস্তিপ্রসূত অত্যাচার পর্যবেক্ষণ করে তীব্র আনন্দ পেয়ে থাকে। আমি সেই ধরণের মানুষকে কখনই প্রশংসা করতে পারি না যারা মিতব্যয়িতার সঙ্গে তাদের কাছে বলিস্বরূপ প্রদত্ত মানুষদের জীবনকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে তারা অন্য কোন দিন আরও অত্যাচারিত হবে। অন্যান্য বস্তু বা দিকগুলি সমান হলে, মিতব্যয়িতা মঙ্গলময় জীবনের একটি অংশ। এমনকি রবিনসন ক্রুশোকেও প্রাসঙ্গিক কারণে পরিশ্রম, আত্ম-সংযম এবং দূরদর্শিতার সাধনাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল যাকে অবশ্যই নৈতিক গুণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, কেননা তারা বিপরীত ভারসাম্যকে বজায় রাখতে গিয়ে অপরকে কোনরকম আঘাত না করে তাদের সমষ্টিগত পরিতৃপ্তিকে বাড়াতে পেরেছিল। নৈতিক গাথাগুলির এই অংশ সেই সব কিশোর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে খুব বড় ভূমিকা পালন করে, যাদের ভবিষ্যতের চিন্তার দিকে ঝোঁক আছে। যদি পরবর্তীকালে জীবনে এগুলোকে খুব বেশি সাধনা করা যেত তবে জগৎটা খুব তাড়াতাড়ি স্বর্গ হয়ে যেত, কারণ তা সেই যুদ্ধগুলিকে বন্ধ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হত, যে যুদ্ধগুলি ভাবাবেগ জাতীয় কার্য নয়। তথাপি, মিতব্যয়িতার গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও নৈতিক গাথাগুলিতে এটি খুব আগ্রহোদ্দীপক অংশ নয়। এটি এমনও কোন অংশ হয়ে উঠতে পারেনি যা বৌদ্ধিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, সেহেতু এটি আত্মকেন্দ্রিক উদ্দেশ্যের বাইরে কোন আবেদন রাখতে পারে না।

নৈতিকতার যে অংশ পরিণাম দর্শিতা বা মিতব্যয়িতার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা, প্রকৃতপক্ষে আইনসদৃশ অথবা মুগুরের শাসন। একটি গোষ্ঠীতে একসঙ্গে থাকতে সমর্থ করে তোলে এই সম্ভাবনা সত্ত্বেও যে সেখানে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা গুলি পরস্পর-বিবাদী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখানে দুটি ভিন্ন ধরণের পদ্ধতি সম্ভব। একটি হল অপরাধমূলক আইনের পদ্ধতি, যে আইনের লক্ষ্য সেই সমস্ত কার্যরত বিরক্তিকর ঘটনা গুলিকে যোগ করে কেবলমাত্র বাহ্যিক সংগতি রক্ষা করা যে ঘটনাগুলি অন্যান্য মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কোন-না-কোন ভাবে আঘাত করে। এটাকে সামাজিক নিন্দার পদ্ধতিও বলা যায়। কেউ তার নিজের সমাজের দ্বারা বাজে ভাবে চিহ্নিত বা ভাবিত হলেও তা এক ধরণের শাস্তি। নিজেদের সংবিধান লঙ্ঘন করছে জেনেও বেশির ভাগ মানুষ এই ধরণের শাস্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু এখানে আরও একটি পদ্ধতি আছে, যা আরও বেশি মৌলিক এবং অনেক বেশি সন্তুষ্টিজনক যখন এটি সফল হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিটি হল মানুষের চরিত্র ও কামনা গুলিকে সেই পথে পরিবর্তিত করা যে পথে একটি মানুষের কামনা গুলিকে অন্যান্য মানুষের কামনার সঙ্গে সঙ্গতিকর করে তুলে বিবাদের উপলক্ষ গুলিকে কমিয়ে দেওয়া যায়। এই জন্য ঘৃণার থেকে প্রেম ভালো, কেননা উল্লেখিত ব্যক্তির কামনাগুলিতে প্রেম বিবাদের পরিবর্তে সঙ্গতি fara opcy (That is why, love is better than hate, because it brings har mony instead of conflict into the desire of the person concerned) i to মানুষ, যাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম আছে, তারা উভয়ে সমানভাবে সফল বা ব্যর্থ হয়। কিন্তু যখন দুটি মানুষ পরস্পরকে ঘৃণা করে, তখন সফল একজন হয় আর অন্যজন বিফল হয়।

যদি আমরা এ কথা বলে ঠিক কাজ করি যে মঙ্গলময় জীবন প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এটা পরিষ্কার যে, কোন গোষ্ঠীর সংহিতা কখনই চরম এবং যথেষ্ট নয়। কিন্তু তাকে এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরীক্ষা করে অবশ্যই দেখতে হবে যে সেখানে কোন প্রজ্ঞা এবং বদান্যতাকে রায় হিসেবে জারি করা হয়েছে কিনা। নৈতিক সংহিতা সর্বদা দোষমুক্ত নয়। সূর্যের আলো কমে যাবে এই ভয়ে মানুষের মাংস খেয়ে অ্যাটেক জাতিরা মনে করে যে এটা তাদের একটা যন্ত্রণাদায়ক কর্তব্য। তারা ভুল করে থাকে তাদের বিজ্ঞান বোধে এবং সম্ভত যদি তারা প্রদত্ত বলিকে ভালবাসতে পারত তবে তারা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক ভুলটিকে অনুভব করতে পারত। কোন কোন উপজাতি ১০ থেকে ১৭ বছর বয়স্ক মেয়েদের অন্ধকারে কয়েদ করে রাখে। তারা এই কাজ করে এই ভয়ে যে, সূর্যরশ্মির দ্বারা তারা গর্ভবতী হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অবশ্যই আমাদের আধুনিক নৈতিক সংহিতায় এইরকম আইনের সদৃশ কোন আইন পাওয়া যাবে না যে আইনগুলি অসভ্য জাতিরা ব্যবহার করে থাকে। নিশ্চয়ই আমরা শুধুমাত্র সেই সব আইনকে নিষিদ্ধ করব যারা সত্যই ক্ষতিকারক, অথবা এতটাই জঘন্য যা কোন সুন্দর মানুষ সমর্থন করতে পারে না? আমি অবশ্য এ ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত নই।

বর্তমান নৈতিকতা উপযোগবাদ ও কুসংস্কারের অদ্ভুত মিশ্রণ কিন্তু কুসংস্কারের অংশটি শক্তিশালী। এটাই স্বাভাবিক, যেহেতু কুসংস্কার নৈতিক শাসনের উৎস (….. superstition is the origin of moral rules.)। প্রকৃতপক্ষে কোন কোন কার্যকে এমন কার্যরূপে ভাবা হয়েছিল যা ভগবানের কাছে নিরানন্দজনক এবং সেইসব কাজকে আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ করা হল কারণ স্বর্গীয় ক্রোধ কেবলমাত্র অপরাধী ব্যক্তিদের জন্যই নামবে না, তা সমগ্র গোষ্ঠীর উপরই নেমে আসবে। এখান থেকেই পাপের ধারণার উন্মেষ এবং পাপ ভগবানের কাছে নিরানন্দজনক। কোনরকম যুক্তিকে স্থির করা যায়নি যে কেন কোন কোন বিশেষ কার্য এরকম নিরানন্দজনক হবে। উদাহরণস্বরূপ, এটা বলা খুব সত্যি যে কেন ছাগল-মায়ের দুধে ছাগলছানাকে ফোঁটানোটা নিরানন্দজনক। কিন্তু বাইবেলের শেষ গ্রন্থে এরকম ধরণের ঘটনার কথাই বলা হয়েছে। কখনও কখনও স্বর্গীয় আদেশসমূহকে অদ্ভুতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শনিবার আমাদের কাজ না করতে বলা হয়েছে এবং প্রোটেস্টান্টরা তার অর্থ করে নিলো যে রবিবারগুলোতে আমাদের খেলা করা উচিত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও পুরোনো নিষেধাজ্ঞার মতোই সেই একই মহান কর্তৃত্ব নব্য নিষেধাজ্ঞায় অর্পিত হল।

প্রমাণ করা যায় যে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন একজন ব্যক্তি শাস্ত্রের উপদেশ অথবা চার্চের শিক্ষাকে ভয় পেয়ে চলবার অনুমতি নিজেকে প্রদান করে না। সে এ ধরণের কথা বলে প্রশান্তি লাভ করে না যে, ‘এই-এই ধরণের কাজ পাপমূলক এবং তা মৃত্যুকে ডেকে আনবে।’ সে খোঁজ করবে আদৌ এই ধরণের কাজ কোন ক্ষতি করবে কিনা অথবা, একটু ঘুরিয়ে বলতে গেলে বলা যায়, সে খোঁজ চালাবে যেটিকে পাপ বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে সেটি আদৌই ক্ষতিকারক কিনা। সে দেখায় যে, বিশেষত যে-সব বিশ্বাসগুলি যৌনতার সঙ্গে জড়িত, সেগুলি আমাদের বর্তমান নৈতিকতার বেশিরভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে এবং তার বেশিরভাগ অংশের উৎসই হল পুরোপুরি ভাবে কুসংস্কার। সে এ-ও দেখতে পাবে যে অ্যাজটেকদের কুসংস্কারের মতো যে-সব কুসংস্কার অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হয় সেগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করা যায় যদি জনসাধারণ তাদের প্রতিবেশীদের প্রতি দয়ার্দ্র অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু ঐতিহ্যমূলক নৈতিকতা রক্ষা করা। কদাচিৎ উষ্ণ হৃদয়সম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়, যার প্রমাণ গীর্জার উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সৈন্যবাদের প্রদর্শনের প্রতি ভালোবাসা। একজন এটা ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে যে তারা নৈতিক নিয়মগুলোকে মূল্য দেয় এই কারণে যে তা যন্ত্রণাকে আরোপ করার জন্য তাদের আকাক্ষার বাইরে বেরিয়ে আসার বৈধ উপায়। পাপী-পাপী খেলাটা বড় সুন্দর যাকে সহ্যশক্তির দ্বারা ধরে রাখা যায়।

আসুন কবরের কল্পনা থেকে সাধারণ মানুষের জীবনকে আমরা বোঝায় চেষ্টা করি। আমরা লক্ষ্য রাখবো সেইসব দিকগুলোতে যেখানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নৈতিক নিয়মগুলো প্রতিকারমূলক যন্ত্রণাকে আরো করে। যে কারণে আমি কল্পনা দিয়ে শুরু করেছি তা হল, এখানে কুসংস্কারের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদি বাবা-মা বিবাহিত না হয় তবে তা শিশুর কলঙ্ক, এ ধরণের মনোভাব সম্পূর্ণ অমূলক। যদি বাবা বা মায়ের যে-কোন কারুর যৌন রোগ থাকে, তাহলে শিশুর মধ্যেও সেই রোগের সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি তাদের বহু সন্তান থাকে তবে সেখানে অনাহার, দারিদ্র্য, অতিজনসংখ্যাজাত ভার এবং সেই অনুযায়ী অজাচার থাকবে। অতএব বেশির ভাগ নীতিবাদীরাই এই মত সমর্থন করে থাকেন যে বাবা-মায়েদের যা জানাই ভালো কিভাবে প্রতিকারমূলক কল্পনার দ্বারা এই শোচনীয় অবস্থাকে প্রতিরোধ করা যায় (এটা সৌভাগ্যক্রমে বেশিদিন সত্য থাকেনি। প্রোটেস্টান্ট এবং ইহুদিদের বেশিরভাগ নেতারা এখন জন্মনিয়ন্ত্রণে। আপত্তি করে না। ১৯২৫ সালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাসেলের বিবৃতি যথার্থভাবে নিখুঁত বর্ণনা। এটা অবশ্যই তাৎপর্যমূলক যে, একটি কিংবা দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া, জন্মনিয়ন্ত্রণের বেশিরভাগ প্রধান প্রচারকরা, যেমন– ফ্রান্সিস প্লেস, রিচার্ড কারলাইল, চালর্স নলটোন, চালর্স ব্র্যাডলাফ এবং মারগারেট স্যাঙ্গার– এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বাধীন চিন্তাবিদ–সম্পাদকীয় টীকা)। এইসব নীতিবিদদের খুশী করতে গিয়ে অত্যাচারিত জীবনে সংগ্রাম লক্ষ লক্ষ মানবের উপর আরোপিত হয়েছে যাদের কখনও বেঁচে থাকা উচিত নয়, শুধুমাত্র এই কারণে যে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া যে-কোন রকম যৌন সঙ্গম একটা পাপ। কিন্তু সেই সব সন্তানদের হতভাগ্য বানাবার জন্য যে যৌন আকাঙ্ক্ষা বর্তমানে নির্বিচারে চলছে তা পাপের নয়। কারুকে হঠাৎ খুন করো এবং তারপর খাও, যা অ্যাজটেকদের বলি-প্রদত্ত ব্যক্তির ভাগ্য ঘটে, তা সেই শিশুর উপর আরোপিত অত্যাচারের থেকে অনেক কম যে শিশুটি এই শোচনীয় পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যৌন রোগের দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে। অতএব নৈতিকতার নামে রাজনীতিবিদ ও বিশপদের দ্বারা আরোপিত অনবরত অত্যাচার আরও ভয়ঙ্কর। যদি শিশুদের জন্য তাদের ভেতরে এতটুকুও প্রেমের বিচ্ছুরণ থাকত, থাকত করুণা, তবে তারা সেইসব নৈতিক আইনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারতেন না, যে আইনগুলো জঘন্য নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যুক্ত।

জন্মের সময় এবং শৈশবে, গড়ে সব শিশুই কুসংস্কারের চেয়ে অর্থনৈতিক কষ্টে বেশি ভোগে। যখন সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলাদের সন্তান হয়, তখন থেকে তাদের জন্য থাকে অনেক ভালো ডাক্তার, ভালো নার্স, ভালো পথ্য, ভালো বিশ্রাম এবং ভালো ব্যায়াম। কিন্তু শ্রমজীবী মহিলারা এই ধরণের সুযোগ-সুবিধা পায় না এবং তাদের শিশুরা মারা যায় ওই সব সুযোগ-সুবিধার অভাবে। জনগণের কর্তৃপক্ষ মায়েদের যত্ন নেবার ক্ষেত্রে খুবই কম কাজ করে এবং যাও বা করে তা নিতান্তই ক্রোধান্বিত হয়েই করে। একই সময়ে খরচ কমাতে যখন তারা মায়েদের সেবার জন্য বরাদ্দ্য দুধের যোগান বন্ধ করে দেয়, তখন কম গাড়ি ঘোড়ার ভীড়সম্পন্ন স্থানে বিলাসবহুল বাড়িতে থাকবার জন্য তারা বিরাট পরিমাণ টাকা খরচ করে থাকে। এটা তারা অবশ্যই জানে যে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তারা শ্রমজীবী শ্রেণীর বেশকিছু সংখ্যক শিশুকে দারিদ্রের অপরাধের নামে মৃত্যুদণ্ডে অভিযুক্ত করে থাকে। এই জন্যেই আমরা দেখি শাসক দল প্রচুর পরিমাণ ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের দ্বারা সমর্থিত হয়ে থাকে, যারা তাদের মাথার উপর পোপকে রেখে সামাজিক অবিচারকে সমর্থন করতে জগতের সমস্ত কুসংস্কারের বিরাট ক্ষমতার পক্ষে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে।

শিক্ষার সমস্ত স্তরেই কুসংস্কারের প্রভাব ধ্বংসাত্মক। কিছু শতাংশ শিশুর স্বভাব চিন্তা করা। শিক্ষার অনেকগুলি লক্ষ্যের মধ্যে একটি লক্ষ্য হল তাদেরকে এই ধরণের চিন্তার রোগ থেকে সারিয়ে তোলা। অসুবিধাজনক প্রশ্ন তাদের চুপ চুপ করে কিংবা শাস্তি পেয়ে করতে হয়। সমষ্টিগত আবেগকে ধীরে ধীরে এক বিশেষ ধরণের বিশ্বাসে পরিণত করার কাজে লাগানো হয়, বেশি কাজে লাগানো হয় জাতীয়তা ধরণের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্রের পুঁজিপতি, সেনাবাদী ও গীর্জার পুরোহিতরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে সমবায় গড়ে তুলেছে। কেননা ক্ষমতার জন্য এদের সবাই আবেগবাদের ব্যাপকতা ও চুলচেরা বিচারের অপ্রতুলতার উপর নির্ভর করে থাকে। মানবিক প্রকৃতির সাহায্যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরণের প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলা ও তাদেরকে তীব্র করে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা সফলতা পেয়ে থাকে।

অন্য যে পথে কুসংস্কার শিক্ষার ক্ষতি করে থাকে সেটা হল শিক্ষক নির্বাচনের– উপর এদের প্রভাব। অর্থনৈতিক কারণের জন্য একজন মহিলা-শিক্ষক অবশ্যই বিবাহিত হবেন না এবং নৈতিক কারণের জন্য তাঁর বিবাহিত জীবনের বাইরে কোন অতিরিক্ত যৌন সম্পর্ক গড়ে অবশ্যই উঠবে না। এইজন্য যারা বিষণ্ণ তার মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করার কষ্ট স্বীকার করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, নিয়ম হিসেবে একটি দীর্ঘকুমারীত্ব একজন মহিলার পক্ষে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর এবং এটা এতটাই ক্ষতিকর যে কোন সুস্থ সমাজে শিক্ষকদের এই ব্যাপারে বারবার নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ যত বেশি হয়ে ওঠে ততই উদ্যোগী ও প্রাণবন্ত মহিলারা শিক্ষকের পেশায় ঢুকতে অস্বীকার করে। এটা ঘটে থাকে কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন কৃতাবাদের বিরক্তিজনক প্রভাবে।

মধ্য এবং উচ্চ শ্রেণীর বিদ্যালয়গুলিতে ব্যাপারটি আরও বাজে আকার ধারণ করে। সেখানে দেখা যায় ভজনালয়ের কার্য এবং যাজক শ্রেণীর হাতে নৈতিক চরিত্রের প্রতি দৃষ্টি রাখার ক্ষমতা। নৈতিকতার শিক্ষকদের মতোই যাজক শ্ৰেণীও প্রায় অবশ্যম্ভাবীরূপে এই দুই দিক থেকেই ব্যর্থ হয়ে থাকে। তারা সেইসব কাজকে নিন্দা করে যে কাজগুলো কোন ক্ষতি করে না এবং তারা সেইসব কাজকে ক্ষমা করে থাকে, যে কাজগুলো বিরাট ক্ষতি করে। তারা সবাই সেইসব, অবিবাহিত মানুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে নিন্দা করে থাকে যারা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত কিন্তু এমন নিশ্চিত নয় যে তারা সারা জীবন পরস্পর একসঙ্গে থাকতে চাইবে। তাদের বেশিরভাগ অংশই জন্মনিয়ন্ত্রণকে নিন্দা করে থাকে। কিন্তু তাদের কেউই সেই স্বামীর পশুত্বকে নিন্দা করে না যে তার স্ত্রীকে বারবার গর্ভবতী করে তার মৃত্যুর কারণ হয়। আমি বাতিকগ্রস্ত একজন যাজককে চিনতাম যার স্ত্রীর ন’বছরে নটি সন্তান হয়েছিল। ডাক্তাররা তাকে বলেছিল যদি তার আর একটি সন্তান হয় তবে সে মারা যাবে। পরের বছর তার আর একটি সন্তান হল এবং সে মারা গেল। কারুর কোন নিন্দা হল না, এবং সেই যাজক তার বৃত্তিতে রয়ে গেল এবং আবার বিয়ে করল। যতদিন এই ধরণের যাজকরা নিষ্ঠুরতাকে ক্ষমা প্রদর্শন করবে এবং নিষ্পাপ আনন্দকে করবে নিন্দা, ততদিন তারা যুবজনতার নৈতিকতার অভিভাবক হিসেবে কেবল ক্ষতিই করতে পারবে।

শিক্ষার উপর কুসংস্কারের অন্য আর একটি মন্দ প্রভাব হল যৌন ঘটনা সম্পর্কে নির্দেশের অনুপস্থিতি। বয়ঃসন্ধি আসার আগে যখন তারা উত্তেজিত অবস্থায় থাকে না তখন এ বিষয়ে তাদের সহজ ও স্বাভাবিকভাবে প্রধান মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাগুলোকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। বয়ঃসন্ধিকালে, কুসংস্কারমুক্ত যৌন নৈতিকতার উপকরণ গুলিকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। ছেলেমেয়েদের এই বলে শিক্ষা দেওয়া উচিত যে যদি পরস্পরের বন্ধুত্বমূলক আগ্রহ না থাকে তবে কোনরকম যৌন সঙ্গমকে সুবিচার বলা যেতে পারে না। এই ধরণের চিন্তা গীর্জাগুলোর শিক্ষার বিপরীত। তারা এই মত পোষণ করে যে, যদি দুজন বিবাহিত হয় এবং পুরুষমানুষটি যদি অন্য আরও একটি সন্তান চায়, তবে স্ত্রীর শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যৌন সঙ্গম বৈধ। ছেলেমেয়েদের অবশ্যই পরস্পরের স্বাধীনতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়া উচিত। তাদের অবশ্য এই অনুভব করতে সমর্থ করে তোলা উচিত যে হিংসা ও সংকীর্ণ অধিকারবোধ প্রেমকে হত্যা করে। শিক্ষা দেওয়া উচিত যে, অপর একটি মানুষকে পৃথিবীতে নিয়ে আসাটা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং তখনি তাকে নিয়ে আসার কথা ভাবা যেতে পারে যখন শিশুটির জন্য যৌক্তিক ভবিষ্যৎ, সুস্থ পরিবেশ এবং বাবা-মায়ের তাকে যত্ন করার ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া উচিত এটা নিশ্চিত করতে যে শিশু কেবলমাত্র তখনি আসবে যখন তারা কাক্ষিত হবে। পরিশেষে, তাদেরকে যৌন রোগ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত এবং সেই সঙ্গে তার প্রতিকার ও আরোগ্যের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত। এইভাবে যৌন শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানবিক সুখকে বাড়িয়ে তোলার সম্ভাবনা প্রচুর।

যেখানে শিশু জন্ম নেবে না এই রকম বিষয়ে বা পরিস্থিতিতে যৌন সম্পর্ককে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, যা রাষ্ট্র কিংবা প্রতিবেশী কারুরই ভাববার বিষয় নয়। এমন কিছু যৌন ক্রিয়াকলাপ আছে যেগুলো কখনই শিশুর জন্ম দেয় না, সেগুলো বর্তমানে অপরাধের আইনের দ্বারা দণ্ডিত। এই ধরণের ঘটনা সম্পূর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কেননা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দু’জন মানুষ ছাড়া ব্যাপারটা কারুকেই প্রভাবিত করে না। যে ক্ষেত্রে শিশুরা থাকে, সেখানে এটা মনে করাটা ভুল হবে যে তাদেরই প্রয়োজনে বিবাহ-বিচ্ছেদ করাটাকে প্রয়োজনীয় ভাবা খুবই কষ্টকর। আচরণগত অন্ধকার, নিষ্ঠুরতা, পাগলামি প্রভৃতির উপর নির্ভর করে শিশুদের জন্যেই স্বামী কিংবা স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এব্যাপারে ব্যভিচারের উপর যে অদ্ভুত ধরণের গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটা পরিষ্কার যে বিবাহিত জীবনের সুখ সম্পর্কে যে-কোন ধরণের অন্যায় আচরণ সাধারণ ছোটখাট ব্যভিচারের থেকে বিরাটভাবে ক্ষতিকর। বছরে একটি করে শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য পুরুষের জোর খাটানো প্রথাগত ভাবে অন্যায় আচরণ নয় কিংবা নিষ্ঠুরতা নয়, কিন্তু সব থেকে বড় ক্ষতিকারক।

নৈতিক নিয়মগুলো এমন হওয়া উচিত নয় যেখানে প্রবৃত্তিমূলক সুখ অসম্ভব হয়ে ওঠে। যেমন–যে গোষ্ঠীতে একবিবাহ নীতির প্রভোব দৃঢ়ভাবে আছে সেখানে দুটি যৌন সম্পর্ক খুবই অসমানুপাতিক। যদিও এই পরিবেশের অধীনেই নৈতিক নিয়মগুলো লজ্জিত হয়ে থাকে। কিন্তু নিয়মগুলি এমনি যে তারা কেবল মান্যতা লাভ করতে পারে গোষ্ঠীর অবনতিসম্পন্ন সুখের থেকে এবং যখন তাদেরকে মেনে চলার থেকে লঙ্ন করাটাই শুভ হয়ে থাকে তখন বুঝে নিতে হবে যে এটাই নিশ্চিতভাবে সেই সময় যখন নিয়মগুলোর পরিবর্তন ঘটে গেছে। যদি এটা না ঘটে, তবে এটা বুঝতে হবে বহু মানুষ যারা জনগণের আগ্রহের বিপরীত পথে তাদের কাজ চালাচ্ছেন তারা ভণ্ডামি বা তেরছা পথের বিকল্প স্বরূপ অযৌক্তিক পথের সম্মুখীন হচ্ছেন। ভণ্ডামিকে গীর্জা কিছু মনে করে না, কেননা তা গীর্জার ক্ষমতার সমীপে ছিনাল অঞ্জলি। কিন্তু অন্যান্য জায়গায় এটাকে অশুভ বলে প্রতিপন্ন করা হয় যাকে হাল্কাভাবে ধরা উচিত নয়।

ঈশ্বরভিত্তিক কুসংস্কারগুলির চাইতেও জাতীয়তা ভিত্তিক কুসংস্কারগুলি আরও বেশি ক্ষতিকর। এই কুসংস্কারগুলি এরকম কথা বলে থাকে, যে কর্তব্য কেবল নিজের দেশের জন্যই কর, অন্য কোন দেশের জন্য কর না। কিন্তু একজনের স্বাদেশিকতার সীমার বাইরে আঙুল তুলে আমি এই আলোচনা করার প্রস্তাব করব না যে স্বাদেশিকতা প্রেমের আদর্শের ঠিক বিপরীত, যে আদর্শকে আমরা মঙ্গলময় জীবন গঠনের জন্য স্বীকার করে নিয়েছি। যদিও এটা আলোকিত আত্ম-স্বার্থের বিপরীত, যেহেতু একটিও গোঁড়া জাতীয়তাবাদ বিজয়ী জাতিগুলিকেও ছাড়ে না।

অন্য আর একটি দিকে যেখানে আমাদের সমাজ ‘পাপ’-এর শাস্ত্রীয় ধারণার দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে থাকে সেটি হল অপরাধীর প্রতি আচরণ। অপরাধীরা দুষ্ট এবং শাস্তির যোগ্য। এটা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না যাকে যৌক্তিক নৈতিকতা সমর্থন করতে পারে। নিঃসন্দেহে কিছু পরিমাণ মানুষ সেই সমস্ত কাজ করে থাকে যে কাজগুলোকে সমাজ বাধা দিতে চায় এবং সমাজ তাদের যতদূর সম্ভব বাধা দিয়ে সঠিক কাজই করে। সহজ উদাহরণস্বরূপ আমরা কোন খুনের ঘটনাকে নিতে পারি। স্পষ্টতই যদি একটি গোষ্ঠী পরস্পরের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং যদি সেই বন্ধনযুক্ত আবদ্ধিত গোষ্ঠী থেকে আমাদের আনন্দ ও সুযোগ সুবিধা। নিতে হয় তবে আমরা পরস্পরকে খুন করার অনুমতি জনগণকে দিতে পারি না, কিন্তু তারা এই ধরণের কাজ করবার তাড়নাই অনুভব করে থাকে। কিন্তু এই ধরণের সমস্যাকে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক চেতনার দ্বারা দেখা উচিত। সহজভাবে আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত : খুন বন্ধ করবার সব থেকে উত্তম পদ্ধতিটি কী? দুটি পদ্ধতির মধ্যে দুটিই খুন বন্ধ করার ক্ষেত্রে সমান ফলপ্রসূ। এদের মধ্যে যেটি খুনীর জন্য খুব কম ক্ষতিকারক সেটিকে বেছে নিতে হবে। খুনীর ক্ষতি করাটা শল্যচিকিৎসা প্রসূত যন্ত্রণার মতোই সম্পূর্ণভাবে দুঃখজনক। তা দু’ক্ষেত্রেই সম্ভবত সমানভাবে প্রয়োজনীয় হলেও এটা কোন আনন্দের বিষয় নয়। যে নিষ্ঠুর অনুভূতিকে ‘নৈতিক অবিচারজনিত রাগ বলা হয় তা শুধুমাত্র এক প্রকার নিষ্ঠুরতা কেবলমাত্র নিষ্ঠুর শাস্তির দ্বারাই অপরাধীকে কষ্ট দেওয়াটা কখনও কোন সুবিচার হতে পারে না। যদি শিক্ষা কোমলতার সঙ্গে মেশে তবে তা সমানভাবে কার্যকরী এবং এটাকেই বাঞ্ছনীয় বলা যায়। এটা যদি আরও কার্যকরী হয়ে ওঠে তবে তা আরও বেশি বাঞ্ছনীয় হয়ে উঠবে। যদিও অপরাধের প্রতিকার ও অপরাধের শাস্তি দুটি ভিন্ন ধরণের প্রশ্ন। অপরাধীকে যন্ত্রণা প্রদানের কারণ অনুমান সাপেক্ষে প্রতিকারমূলক। যদি কয়েদখানাকে এতটাই মানবিকীকরণ করে তোলা যেত যে সেখানে কয়েদিরা শুধুই শুভ শিক্ষা পেত তবে মানুষ সেই কয়েদখানায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্যই কেবল অন্যায় করত। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার চেয়ে কয়েদখানা অবশ্যই নিরানন্দজনক। কিন্তু ফলাফলকে নিশ্চিত করবার জন্য সব থেকে উত্তম পথটি হল স্বাধীনতাকে আরও বেশি আনন্দজনক করে তোলা সেই স্বাধীনতার চেয়ে যে স্বাধীনতা বর্তমানে কখনও কখনও মেলে। দণ্ডমূলক আইনের সংস্কার সাধন বিষয়ে আমি আমার জাহাজ ভেড়াতে চাই না। আমি শুধু এই উপদেশ দিতে চাই যে আমরা প্লেগ রোগে আক্রান্ত রুগিকে যেমন ভাবে দেখি তেমন ভাবেই একজন অপরাধীকে আমাদের দেখা উচিত। এরা দুজনেই জনগণের পক্ষে বিপজ্জনক এবং যতদিন পর্যন্ত বিপজ্জনক থাকবে ততদিন পর্যন্ত তাদের স্বাধীনতাকে অবশ্যই খর্ব করে রাখা দরকার। কিন্তু যে মানুষটি প্লেগ রোগে আক্রান্ত সে সহানুভূতি ও অনুকম্পার বিষয় এবং সেখানে। অপরাধী অভিশাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এটা হয়ে থাকে আচরণগত বিভেদের জন্য। যেখানে আমাদের কয়েদখানা গুলো অপরাধীদের প্রবণতাকে সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ সেখানে আমাদের হাসপাতাল রোগকে সারিয়ে তুলছে।

(৪) মুক্তি : ব্যক্তিগত ও সামাজিক

ঐতিহ্যবাহী ধর্মের অনেকগুলি ত্রুটির মধ্যে একটি হল তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নৈতিকতার সঙ্গে এই ক্রটি যুক্ত। ঐতিহ্যবাহিকতার দিক দিয়ে, ধার্মিক জীবন পূর্বের বর্ণনা অনুযায়ী, আত্মা ও ঈশ্বরের কথোপকথন ছিল। ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে চলাটাই ছিল পুণ্যের এবং গোষ্ঠীর অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ব্যক্তির পক্ষেই এটা সম্ভবপর ছিল। প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠী মুক্তির উপায়-এর ধারণার বিকাশ ঘটিয়েছিল কিন্তু খ্রীষ্টীয় শিক্ষায় এই ব্যাপারটি সর্বদাই বিদ্যমান ছিল। স্বতন্ত্র আত্মার এই ধরণের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ইতিহাসের বিশেষ স্তবগুলোতে মূল্য পেয়েছিল কিন্তু আধুনিক জগতে আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মঙ্গলের ধারণার থেকে সামাজিক মঙ্গলের ধারণা করা অনেক বেশি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমি এই বিবেচনা করে দেখাতে চাই যে কিভাবে এই বিষয়টি মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রভাবিত করে থাকে।

রোম সাম্রাজ্যে সেই সমস্ত জনগণের মধ্যে খ্রীষ্টীয়বাদ জেগে ওঠে যারা তাদের সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে বসেছিল, যাদের জাতীয় রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং এক বিরাট ব্যক্তিত্বহীন সমষ্টিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। খ্রীষ্টীয় যুগে প্রথম তিন শতাব্দী ধরে যে-সব ব্যক্তি খ্রীষ্টীয়বাদকে গ্রহণ করেছিল তারা তৎকালীন যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বাস করত, সেইসব রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ফুটোফাটাগুলোকে পরিবর্তন করতে পারেনি, যদিও তারা তাদের বাজে দিকটির সম্পর্কে মৌলিকভাবে স্বীকার করে গেছে। এই পরিবেশ গুলোতে এটা খুবই স্বাভাবিক যে তারা এই ধরণের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে ছিল যে একটি অযথার্থ জগতে একজন ব্যক্তি যথার্থ হয়ে উঠতে পারে এবং এই জন্যেই একটি মঙ্গলময় জীবনের এই জগতের সঙ্গে কোন কাজ থাকতে পারে না। যা আমি বলতে চাইছি তা প্লেটোর ‘রিপাব্লিক’ গ্রন্থের তুলনায় সরল। যখন প্লেটো মঙ্গলময় জীবনের বর্ণনা করতে চেয়েছেন, তখন তিনি সমগ্র গোষ্ঠীকে বর্ণনা করেছেন, কখনই একজন ব্যক্তিকে বর্ণনা করেননি। তিনি এটা করেছিলেন ন্যায় বিচারকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। তিনি প্রজাতন্ত্রের নাগরিকত্বে অভ্যস্ত ছিলেন এবং নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণকে সমর্থেন করেছিলেন গ্রীস স্বাধীনতা হারাবার সঙ্গে সঙ্গে স্টোয়িকবাদের উন্মেষ হয় যেটা অনেকটা খ্ৰীষ্টীয়বাদের মতোই এবং প্লেটোর আদর্শের সঙ্গে যার মিল নেই, কেননা তারা মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতামূলক ধারণা গ্রহণ করেছিল।

আমরা যারা বিরাট গণতন্ত্রগুলোতে বসবাস করি তাদের দেখা উচিত যে স্বেচ্ছাচারী সাম্রাজ্যবাদী রোমের তুলনায় স্বাধীন এথেন্সে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত নৈতিকতা ছিল। ভারতবর্ষে, যেখানে রাজনৈতিক পরিবেশ খ্রীষ্টের সময় জুডিয়ার দেশগুলোর মতো সমানুপাতিক ছিল, সেখানে আমরা দেখবো গান্ধী খ্রীষ্টের নৈতিকতার মতোই সমনৈতিকতা প্রচার করছেন এবং এইজন্য তাঁকে পন্টিয়াস পাইলেটের খ্ৰীষ্টধর্মে দীক্ষিত উত্তরাধিকারদের হাতে শাস্তি পেতে হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ব্যক্তির মুক্তিতেই সন্তুষ্ট ছিল না, তারা চেয়েছিল জাতীয় মুক্তি, এর জন্য তারা পাশ্চাত্যের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি এই পরামর্শ দিতে চাই যে এইসব ক্ষেত্রগুলোতে এই দৃষ্টিভঙ্গী খ্রীষ্টীয়বাদের প্রভাবে এখনো আত্ম-সচেতন ও সাহসী হয়ে উঠতে পারেনি, এবং এখনো তা ব্যক্তির মুক্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য বিঘ্নিত হচ্ছে।

মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে আমরা যেমন ধারণা করি, তা বহু সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে এবং এগুলো ছাড়া এই ধারণাকে বুঝে ওঠা যায় না। আমরা আগেই বলেছি যে মঙ্গলময় জীবন প্রেম ও জ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত। অর্জিত জ্ঞান সেখানেই বিদ্যমান থাকতে পারে যেখানে সরকার ও কোটিপতিরা এই ধারণার আবিষ্কার ও তার সম্প্রসারণের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সারের প্রসারণ আশঙ্কাজনক আমাদের এ সম্পর্কে কি করা দরকার? এক মুহূর্তে কেউ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না কেবলমাত্র জ্ঞানের অভাবে। বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে গবেষণা ছাড়া এই জ্ঞানের উন্মেষ সম্ভব নয়। আবার, সেইসব মানুষ যারা এর উত্তর চাইছে তাদের বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য এবং কলা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন। এরজন্য জনগণের কর্তৃপক্ষসমূহের বিশদ বিন্যাসের প্রয়োজন। কেবলমাত্র ধর্মীয় কথোপকথনের দ্বারা অর্জনের বিষয় এটি নয়। এছাড়াও বিদেশ ব্যবসা আছে যেটা ছাড়া গ্রেট ব্রিটেনের অর্ধসংখ্যক অধিবাসী অনাহারে থাকবে এবং যদি আমরা অনাহারে থাকি তবে আমাদের মধ্যে কতিপয় মানুষ মঙ্গলময় জীবন কাটাতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে আরও অনেক দৃষ্টান্ত অপ্রয়োজনীয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যে, সমস্ত ক্ষেত্রে যা মঙ্গলময় জীবনের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করে, সেখানে সমগ্র জগৎ একটি ঐক্যরূপ লাভ করে। কিন্তু সেই মানুষ যে স্বাধীন জীবনের ভান করে ঘুরে বেড়ায় সে সচেতন অথবা অসচেতন পরজীবী ছাড়া আর কিছুই নয়।

ব্যক্তিমুক্তির ধারণা, যাকে সঙ্গে নিয়ে পুরাতন খ্রীষ্টীয়বাদীরা তাদের রাজনৈতিক পরাধীনতার জন্য নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে রাখতো, তা সত্বর অসম্ভব হয়ে উঠলো যেই আমরা মঙ্গলময় জীবন সম্পর্কে খুব সংকীর্ণ ধারণা থেকে উঠে আসতে পারলাম। গোঁড়া খ্রীষ্টীয় ধারণা অনুযায়ী মঙ্গলময় জীবন হল পুণ্যবান জীবন। পুণ্য নির্ভর করে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে মেনে চলার উপর এবং প্রতিটি ব্যক্তির কাছে ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যক্ত হয়ে থাকে তাদের বিবেকের কণ্ঠস্বরের দ্বারা। মানুষ সম্পর্কে এই ধরণের ধারণা একটি বিদেশী স্বৈরাচারবাদের বিষয়ে। একটি মঙ্গলময় জীবন ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে বেশি যুক্ত উদাহরণস্বরূপ, বুদ্ধি। বিবেক সব থেকে বেশি ভ্রান্ত পথনির্দেশক, যেহেতু এটি অতি যুবক বয়সের শোনা উপদেশগুলির অস্পষ্ট স্মরণ, অতএব বিবেক কখনই পালনকারিণী মা বা ধাত্রীর জ্ঞানের থেকে বড় নয়। সঠিকভাবে একটি মঙ্গলময় জীবন কাটাতে গেলে মানুষের অবশ্যই ভালো শিক্ষা থাকা আবশ্যক, বন্ধুবান্ধব, প্রেম, সন্তানাদি (যদি সে তাদের আকাঙ্ক্ষা করে) আবশ্যক। চাহিদা ও গভীর উদ্বেগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চাই যথেষ্ট উপার্জন, উন্নত স্বাস্থ্য এবং কর্ম। এই সমস্ত জিনিস, বিভিন্ন মাত্রায় গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে এবং রাজনৈতিক ঘটনার দ্বারা বাধা পায় কিংবা সাহায্য পায়। একটি মঙ্গলময় জীবন একটি মঙ্গলময় সমাজেই কাটানো যায়, অন্যথায় আর অন্য কোন জায়গায় সম্ভব নয়।

সম্ভ্রান্তশ্রেণীর আদর্শে এটাই একটা মৌলিক ক্রটি। কিছু কিছু মঙ্গলময় বস্তু, যেমন কলা বিজ্ঞান এবং বন্ধুত্ব সম্ভ্রান্ত সমাজে খুব ভালোভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে । দাসত্বের উপর ভিত্তি করে সম্ভ্রান্ত শ্রেণী গ্রীসে বিদ্যমান ছিল, শোষণের উপর নির্ভর করে তারা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান আছে। কিন্তু প্রেম, সহানুভূতির আকারে, অথবা বদান্যতার আকারে, সম্ভ্রান্ত সমাজে বেঁচে থাকতে পারে না। সম্ভ্রান্তরা নিজেদেরকে এই বলে প্ররোচিত করে যে দাস অথবা সর্বহারা অথবা কালা আদমিরা কাদামাটির দ্বারা তৈরি, তাদের দুঃখ-কষ্ট কোন ব্যাপারই নয়। বর্তমান মুহূর্তে, সম্ভ্রান্ত ইংরেজ ভদ্রলোকরা আফ্রিকানদের এতবার চাবুক মারে যে তারা অব্যক্ত মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় কয়েক ঘন্টার পরেই মারা যায়। এমনকি যদি এই ভদ্রলোকেরা উচ্চশিক্ষিতও হয়ে থাকে, কিংবা তারা শিল্পীসুলভ এবং প্রশংসনীয় বাগ্মীও হয়, তা হলেও আমি এটা স্বীকার করে নিতে পারি না যে তারা কোন মঙ্গলময় জীবন অতিবাহিত করছে। মানবিক প্রকৃতি সহানুভূতির ক্ষেত্রে কিছু সীমা আরোপ করেছে, কিন্তু সংকুচিত করেনি। গণতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন সমাজে, কেবলমাত্র পাগলই এইভাবে আচরণ করতে পারে। সম্ভ্রান্তদের আদর্শে সহানুভূতির যে সীমাটি দেখা যায় সেটি হল দণ্ড। মুক্তি সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর একটি আদর্শ, কেননা এটি একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা। এই কারণে ব্যক্তিগত মুক্তির ধারণা, যাকে যতই ব্যাখ্যা করা হ’ক কিংবা প্রসারিত করা হ’ক না কেন, কখনও মঙ্গলময় জীবনের কোন ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে না।

মুক্তির অন্য বৈশিষ্ট্যটি হল যে এটি সাধু পলের কথোপকথনের মতোই মহা আকস্মিক পরিবর্তনে পর্যবসিত হয়। শেলীর কবিতাগুলোতে সমাজের উপর আরোপিত এই রকম ধারণার ছবি পাওয়া যায়–সময় যখন এসেছিল তখন প্রত্যেকেই পরিবর্তিত হয়ে পড়েছিল ও নৈরাশ্য ছেয়ে ফেলেছিল চারদিক এবং ‘জগতের সেই বিরাট যুগ নতুন হতে শুরু করেছিল। বলা যেতেই পারে যে একজন কবি গুরুত্বহীন মানুষ এবং যার ধারণাগুলো কোন ঘটনাই নয়। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে বৈপ্লবিক নেতাদের একটি বিরাট অংশ শেলীর মতোই ধারণা পোষণ করতেন। তারা মনে করতেন যে স্বৈরাচারী, পুরোহিত অথবা পুঁজিপতি অথবা জার্মানরা যতরকম নিষ্ঠুরতা, যাতনা এবং হীনতা প্রাপ্তির জন্য দায়ী ছিল। এই কারণে এইসব দুষ্ট প্রভাবের উৎসগুলোকে যদি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় তবে হৃদয়ের একটি সাধারণ পরিবর্তন হবে এবং আমরা সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারব। এই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে তাঁরা যুদ্ধের দ্বারা যুদ্ধকে শেষ করার ইচ্ছা পোষণ করে এসেছিলেন। তুলনামূলকভাবে তারাই সৌভাগ্যবান যারা পরাজয় বা মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পেরেছিলেন এবং তারাই দুর্ভাগা ছিলেন যারা জয়ের তিলক কপালে পরার পর বৈরাগী হয়ে পড়েছিলেন। এবং তাদের সমস্ত উজ্জ্বল আশাকে হারিয়ে হতাশার শিকার হয়েছিলেন। এই সমস্ত আশা গুলির উৎস ছিল খ্রীষ্টীয় মুক্তির পথ হিসেবে আকস্মিক মহা পরিবর্তনের তত্ত্ব।

আমি এই পরামর্শ দিতে ইচ্ছা করি না যে বিপ্লব গুলি আর কখনই প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু আমি অবশ্যই এই পরামর্শ দেব যে সহস্রাব্দের মধ্যে বিপ্লবগুলি ঘটানো সোজা হবে না। মঙ্গলময় জীবন কোন সোজা পথ নয়, তা ব্যক্তিগত বা সামাজিক যাই হক না কেন। মঙ্গলময় জীবন গড়তে গেলে, আমাদের অবশ্যই বুদ্ধিকে গড়ে তুলতে হবে, গড়ে তুলতে হবে আত্ম-সংযম ও সহানুভূতিকে। এটা একটা পরিমাণগত বিষয় এবং একটি ক্রম-উন্নতির বিষয়, শৈশব শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়। কেবলমাত্র অধৈর্যই হঠাৎ উন্নতির সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাসকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলে। ক্রম-উন্নতি সম্ভব এবং যে পদ্ধতির দ্বারা এটি অর্জন করা সম্ভব তা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের বিষয়। এ সম্পর্কে যা বলা যেতে পারে তা আমি একদম শেষে আলোচনা করবার চেষ্টা করব।

(৫) বিজ্ঞান এবং সুখ

নীতিবিদদের উদ্দেশ্য হল মানুষের স্বভাবের উন্নতি ঘটানো। এটা একটি প্রশংসনীয় উচ্চাশা, যেহেতু তাদের স্বভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোচনীয়। কিন্তু আমি নীতিবিদদের কোন দিক থেকেই প্রশংসা করতে পারি না, সে তিনি একটি বিশেষ উন্নতিই চান কিংবা সেই বিশেষ উন্নতি অর্জন করবার জন্য যেসব পদ্ধতি তিনি গ্রহণ করেছেন তার জন্য। তাঁদের কৃত্রিম পদ্ধতি হল নৈতিক উপদেশ। তাদের বাস্তব পদ্ধতি (যদি তিনি গোঁড়া ধর্মাবলম্বী হন) একটি অর্থনৈতিক পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা। পূর্বেরটি স্থায়ী বা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে না। সাভোনারোলা থেকে আজ পর্যন্ত পুনরুত্থানবাদীদের প্রভাব সর্বদাই ক্ষণস্থায়ী হয়ে এসেছে। কিন্তু পরেরটি অর্থাৎ পুরস্কার ও শাস্তি–উল্লেখযোগ্য প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, এই ব্যবস্থা একটি মানুষকে অস্থায়ী গৃহকত্রী অপেক্ষা পতিতাকে বেশি পছন্দ করতে বাধ্য করেছে, কারণ এমন একটি পদ্ধতিকে গ্রহণ করাই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে যে পদ্ধতিকে অতি সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায়। এইভাবেই তারা বহুসংখ্যক সাংঘাতিক পেশা গ্রহণ করেছে এবং যৌন রোগের ব্যাপকতাকে নিশ্চিত করেছে। নীতিবিদরা অবশ্যই এই ধরণের ঘটনা ঘটুক তা আশা করেননি। কিন্তু তারা ঘটনাটিকে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ অবৈজ্ঞানিক, কেননা উক্ত ঘটনাগুলি হল তাই যা সে বাস্তবে অর্জন করেছে।

ধর্ম প্রচার ও উৎকোচ গ্রহণের বৈজ্ঞানিক মিশ্রণের কোন প্রতিভূ আছে কি? আমি মনে করি আছে।

অজ্ঞতা বা মন্দ কামনাগুলি থেকেই মানুষের কর্মগুলি মন্দ হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যখন আমরা মন্দ’ কামনাগুলির কথা বলি, তখন সেই কামনাগুলিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে সেগুলো অপরের কামনাগুলোকে বাধা দিতে চায় অথবা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, মন্দ কামনা বলতে সেই কামনাগুলিকে বোঝায় যেগুলো অনেক কামনাকে সাহায্য করার পরিবর্তে বাধা দিয়ে থাকে। অজ্ঞতা থেকে যে অনিষ্টকারী প্রভাবের সৃষ্টি হয় তাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। এখন একথা বলতে হয় যে জ্ঞানের সমৃদ্ধিই হল একমাত্র প্রয়োজনীয়। অতএব আরও বেশি শিক্ষা ও গবেষণার মধ্যেই উন্নতির রাস্তা নিহিত আছে। কিন্তু অনিষ্টকারী প্রভাব যা মন্দ কামনাগুলির থেকে উত্থিত হয় তা বেশ দুরবগাহ বিষয়।

সাধারণ নারী ও পুরুষের মধ্যে কিছু পরিমাণ সক্রিয় অপকার করবার ইচ্ছা থাকে। উভয়ের বিশেষ ধরণের অশুভ ইচ্ছা নির্দিষ্ট শত্রুদের দিকে পরিচালিত হয় এবং অপরের দুর্ভাগ্যকে দেখে তাদের সাধারণ নৈর্ব্যক্তিক আনন্দ বোধ হয়। সুন্দর সুন্দর শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে এই ঘটনাগুলিকে ঢেকে রাখাটা প্রচলিত প্রথা। প্রথাগত নৈতিকতার অর্ধেকটাই উক্ত ঘটনাগুলিকে ঢেকে রাখার বোরখা। যদি নীতিবিদদের লক্ষ্য অনুযায়ী আমাদের আচরণকে উন্নত করে তাকে বাস্তবায়িক করতে চাই তবে আমাদের সমস্যার সম্মুখীন হতেই হবে। এগুলোকে ছোট এবং বড় হাজার পথে দেখানো যেতে পারে। মানুষ বারবার কুৎসা রটাতে কিংবা তাকে বিশ্বাস করতে এক রকম আনন্দ পায়। অপরাধীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে তাকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা যায় এটা জানা সত্ত্বেও তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। সাদা চামড়ার জাতেরা নিগ্রোদের প্রতি অবিশ্বাস্য বর্বরতা সুলভ আচরণ করে থাকে। যেমন মহান আনন্দের সঙ্গে প্রজা, বৃদ্ধ, মহিলা এবং পুরোহিতরা যুদ্ধের সময় যুব জনতার সামরিক কর্তব্য কি হবে তা নির্দেশ করে। এমনকি শিশুরাও স্বৈরাচারী নিষ্ঠুরতার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ডেভিড কপারফিল্ড এবং অলিভার টুইস্ট কোনভাবেই কাল্পনিক নয়। এরকম সক্রিয় অনিষ্ট করার ইচ্ছা মানবিক চরিত্রের জঘন্য বৈশিষ্ট্য এবং জগৎকে যদি সত্যই সুখী করে তুলতে হয় তবে মানুষের এই জঘন্য বৈশিষ্ট্যকে অবশ্যই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সম্ভবত যুদ্ধের এটাই বড় কারণ। সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোকে এক সঙ্গে করলেও এত বড় কারণ হবে না।

অনিষ্ট করবার ইচ্ছাকে বাধা দেওয়ার সমস্যা তো দেখানো গেল এখন আমরা কিভাবে এর সঙ্গে আচরণ করব? প্রথমে এর কারণগুলিকে আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করতে হবে। আমি মনে করি এগুলি হল আংশিকভাবে সামাজিক ও আংশিকভাবে শারীরবিদ্যা সম্বন্ধীয়। জগৎ আগের মতো এখনও জীবন-রণ। প্রতিযোগিতার উপর নির্ভর করে আছে। যুদ্ধের সময় যে প্রশ্নটি উঠেছিল সেটি হল অভাব ও উপবাসের হাতে মরবার জন্য কোন শিশুদের ছেড়ে দেওয়া উচিত জার্মান শিশুদের না মিত্রপক্ষের শিশুদের? (অনিষ্টের পেছনে দুপক্ষই সমান অথচ জীবিত থাকার সময় দুপক্ষের সমান অধিকার থাকবে না কেন তার কোন যুক্তি নেই।) বেশিরভাগ মানুষের মনের পেছনে ধ্বংসের ভীষণ ভীতি তাড়া করে ফেরে এবং এই ভয় সেই সব মানুষদের সব থেকে বেশি হয় যাদের বাচ্চাকাচ্চা থাকে। ধনীরা ভয় পায় যে বলশেভিকরা তাদের বিনিয়োগকে বাজেয়াপ্ত করে নেবে। দরিদ্র মানুষের ভয় যে তারা তাদের কর্ম হারাবে অথবা তাদের স্বাস্থ্য যাবে । প্রত্যেকেই নিশ্চয়তার পেছনে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়ে ভেবে নেয় যে প্রচ্ছন্ন শত্রুকে পদানত করে রাখলেই সমস্যার সমাধান হয়। আতঙ্কের মুহূর্তগুলোতে নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা সব থেকে বেশি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। যে-কোন জায়গায় প্রগতি বিরোধী ব্যক্তিরা ভীতিকে উস্কে দেয়। ইংল্যান্ডে বলশেভিকবাদকে ভয় করা, ফ্রান্সে জার্মানিকে ভয় করা, জার্মানিতে ফ্রান্সকে ভয় করা। তাদের এই ধরণের ভীতির ফলে তারা যার বিরুদ্ধে নিজেদেরকে রক্ষা করতে চায় সেই বিপদটাই আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

এই জন্য বৈজ্ঞানিক নীতিবিদদের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত, কিভাবে এই ভীতিকে রোধ করা যায়। এটি দুটো পথে সম্ভব। একটি হল নিশ্চয়তাকে ক্রমশ বাড়িয়ে এবং অপরটি হল সাহসকে বাড়িয়ে তুলে। আমি সেই ভীতির কথা বলছি যেটি একটি অযৌক্তিক ভাবাবেগ, কিন্তু কখনো একটি সম্ভাব্য দুর্ভাগ্যের যুক্তিপূর্ণ জ্ঞান সম্পর্কে কথা বলছি না। যখন কোন থিয়েটারে আগুন লাগে তখন একজন আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের মতো এক পূর্ণ যৌক্তিক মানুষ ধ্বংসকে আরো বেশি খুঁচিয়ে দেয়, কিন্তু সে একই সঙ্গে ধ্বংসলীলাকে কমিয়ে আনার পদ্ধতিগুলি আয়ত্ত করে। কিন্তু সেখানে শুধুমাত্র একজন আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯১৪ সালে ইউরোপে একটি নাট্যমঞ্চে আগুন ধরলে দর্শকমণ্ডলী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে কিন্তু তখন প্রয়োজন ছিল শান্ত থাকার। কর্তৃপক্ষের চেষ্টা ছিল কিভাবে দর্শকমণ্ডলী একে অপরকে পদদলিত করে পিষে না দিয়ে পরস্পর উদ্ধার পেতে পারে। ভিক্টোরিয়ার যুগে, হাজার বঞ্চনা সত্ত্বেও, মানুষ খুব দ্রুত অগ্রগতির দিকে পৌঁছেছিল। এর কারণ ছিল মানুষ তখন ভীতির থেকে আশার দ্বারা বেশি পরিচালিত হয়েছিল। যদি আমরা আবার সেই ধরণের অগ্রগতি ফিরে পেতে চাই তবে আবার আমাদের আশার দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।

যুদ্ধ প্রতিরোধের বেলাতেও ওই একই কথা খাটে, সে সম্মিলিত জাতিসংঘের মধ্যস্থতার দ্বারাই হক, অথবা অভাব-দারিদ্র মুছে ফেলার চেষ্টার মধ্য দিয়েই হ’ক। ওষুধপত্রের উন্নতির মধ্য দিয়ে সুপরিবেশের সৃষ্টি করে,স্বাস্থ্যকর স্থান সৃষ্টির দ্বারা আরও সুস্থ স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা তৈরি করার মধ্যে দিয়েও তা হতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য সেই সব ধরণের পদ্ধতির দ্বারাও মানুষের মনের অতল গভীরে লুকিয়ে থাকা ভীতি, যা যখন তারা ঘুমোতে যায় তখন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাদের কাছে উঠে আসে, তা হ্রাসপ্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু মনুষ্যজাতির একটি অংশ অপর অংশকে শোষণ করে যেভাবে নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে তার থেকে বড় নিশ্চয়তা পাবার চেষ্টা আর কিছুই হতে পারে না। যেমন–জার্মানদের খরচে ফরাসী মানুষের চলে। মজদুরদের খরচে পুঁজিপতিরা চলে। হলুদ’ মানুষদের খরচের উপর সাদা মানুষেরা চলে। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। পদদলিত গোষ্ঠীর কাছে এই রকম পদ্ধতি কেবল আতঙ্কের সৃষ্টি করে। পাছে পদদলিত গোষ্ঠী বিদ্রোহ করে উঠতে না পারে তার জন্য তাদেরকে আতঙ্কের মধ্যে রাখতেই হয়। কেবলমাত্র ন্যায়বিচার নিশ্চয়তা দিতে পারে। কেবল ন্যায়বিচার দ্বারাই, আমি মনে করি, মানবজাতির জন্য সমদাবী স্বীকৃত হতে পারে।

আরও বলা যেতে পারে, যে সামাজিক পরিবর্তনগুলিতে নিশ্চয়তা আনার চেষ্টা করা হয় সেখানে ভীতিকে সরাসরি হ্রাস করার জন্য সাহসকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যুদ্ধে সাহসের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে পেরে, প্রাচীন যুগে মানুষ শিক্ষা ও ভালো খাদ্যের বন্দোবস্তের মাধ্যমে সাহসকে বাড়িয়ে তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ মানুষের মাংস খাওয়াকে এই ব্যাপারে কার্যকরী ভাবা হত। সামরিক সাহসকে শাসক শ্রেণীর এক বিশেষ অধিকার বলে ভাবা হয়ে থাকে। হেলদের থেকে স্পার্টানরা বেশি সাহসী ছিল। ভারতীয় রাজাদের সেনাদের থেকে ব্রিটিশ অফিসাররা বেশি সাহসী ছিল। নারীর থেকে পুরুষেরা বেশি সাহসী এবং এরকম আরও অনেক আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহসকে অভিজাতদের বিশেষ অধিকার বলে ভাবা হত। শাসক শ্রেণীর সাহসের প্রতিটি বৃদ্ধি প্রধানত পদদলিত জাতির উপর বোঝার বৃদ্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই জন্যই শাসক শ্রেণীর ব্যবহারের জন্য আতঙ্কের পরিবেশের সৃষ্টি হল এবং একই কারণে সেখানে নিষ্ঠুরতার কারণগুলিকে না দমিয়ে সেগুলোকে উস্কে দেওয়া হল। মানুষকে মানবিক করে তুলতে পারার আগেই সাহসের গণতন্ত্রীকরণ করে তোলা আবশ্যক।

বিশদ করে বলতে গেলে, সাহস এখনি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দ্বারা গণতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। ভোটাধিকারের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে তারা অতি বীর মানুষদের মতো সাহসী হয়ে উঠেছে। ভোটে জেতার জন্য তাদের এই ধরণের সাহসের প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধে একজন সাধারণ যোদ্ধার ক্যাপটেন বা লেফটেন্যান্টের মতোই সাহসের প্রয়োজন হয়। জেনারেলের থেকে অনেক বেশি সাহসের প্রয়োজন হয় সাধারণ যোদ্ধাদের। সৈন্যদল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাদের দাসত্বহীন মনোভাব অনেক কিছুই করতে পারে। বলশেভিক, যারা নিজেদেরকে সর্বহারাদের চ্যাম্পিয়ন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাহসের অভাব নেই, সে তাদের সম্বন্ধে যা খুশি বলা হ’ক না কেন। কেননা বিপ্লব-পূর্ব সময়ের নথিপত্রের দ্বারাই তাদের সাহসের প্রমাণ মেলে। জাপানে সামুরাইরা সামরিক উদ্দীপনার একচেটিয়া অধিকারী ছিল কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে স্থল- সন্য বা নৌ সেনাদলে নাম লেখানোর জন্য সেখানে সমগ্র পুরুষ জনতার মধ্যে সাহসের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এই ভাবেই সব শক্তিশালী দেশগুলোতে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে সাহসকে অভিজাত শ্রেণীর একচেটিয়া অধিকারে আর বেশি দিন রাখা হয়নি। যদি এটা না ঘটত তবে গণতন্ত্রের পক্ষে তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। যুদ্ধে সাহস একমাত্র বিষয় নয়। কিন্তু যুদ্ধে সাহস সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়। দারিদ্র্যের মোকাবিলা করার জন্য সাহসের প্রয়োজন। বিদ্রুপের মোকাবিলা করার জন্য সাহসের প্রয়োজন। নিজের সম্প্রদায়ের শত্রুতার মোকাবিলা করার জন্য সাহসের প্রয়োজন। এই সব ব্যাপারে কখনও কখনও অতি বীর যোদ্ধাও শোচনীয় ভাবে অসমর্থ হয়। সর্বোপরি বিপদের মোকাবিলা করার জন্য শান্তভাবে ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার মধ্যেও একটা সাহস লুকিয়ে থাকে। উৎকণ্ঠাজনিত ভয় বা রাগের ভাবাবেগকে সংযত করার মধ্যেও সাহস থাকে। এগুলো নিশ্চিতভাবে সেইসব বিষয় যে বিষয়গুলোর উপর শিক্ষা মানুষকে কিছু দিতে সাহায্য করতে পারে। সুন্দর স্বাস্থ্য, সুগঠিত দেহ, পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি এবং মৌলিক প্রাণোচ্ছল ভাবাবেগের স্বাধীন প্রবাহের দ্বারা যে-কোন ধরনের সাহসের শিক্ষা ভালোভাবে সম্পাদিত হতে পারে। সম্ভবত সাহসের শারীরবিদ্যামূলক উৎস আবিষ্কার করা যেতে পারে ইঁদুরের রক্তের সঙ্গে বিড়ালের রক্তের তুলনা করলে। সব কিছুর মতোই সাহসকে বাড়িয়ে তুলতে বিজ্ঞান যা কিছু করতে পারে তা অসীম। উদাহরণস্বরূপ, বিপদের অভিজ্ঞতা, একটি বলিষ্ঠ জীবন এবং পুষ্টিজনক খাদ্য। এই সমস্ত জিনিসগুলো আমাদের উচ্চ শ্রেণীর বালকেরা সাধারণভাবে ভোগ করে থাকে। তার কারণ, তারা সম্পদের বিশেষ অধিকারী। মনুষ্য গোষ্ঠীর গরীব মানুষের মধ্যে সাহস উৎসাহিত করে শৃঙ্খলার অধীনস্থ সাহসকে। কিন্তু সেই ধরণের সাহসকে কখনই উৎসাহিত করে না যা নেতৃত্ব ও প্রথম প্রয়াসের বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে। যখন সেই সব গুণসমূহ যা সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে তা সার্বজনীন হয়ে উঠবে, তখন আর কোন নেতা বা অনুসরণকারীর প্রয়োজন হবে না এবং তখনই গণতন্ত্রকে উপলব্ধি করা যাবে।

ভীতিই অনিষ্টের একমাত্র উৎস নয়। হিংসা এবং অসন্তোষও তার উৎসের অংশ হিসেবে গণ্য। অনিষ্টের মহা উৎস হিসেবে প্রবাদ বাক্যের রূপ নিয়েছে। তাদের চেয়ে অন্যান্যদের দুর্ভাগ্য একই ফল প্রদান করে। একজন পুরুষ বা নারী, যে যৌনতার ক্ষেত্রে আঘাত পেয়েছে, সে হিংসায় পূর্ণ হবার যোগ্য। এই ব্যাপারে অতি সৌভাগ্য বানদের কপালেই নৈতিক দোষারোপ জোটে। বিপ্লবের সময় থেকে বেশি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ধনিক শ্রেণীর হিংসা। ঈর্ষা হিংসার একটি বিশেষ ধরন–প্রেমের হিংসা। বৃদ্ধরা যুবকদের প্রায়শই হিংসা করে থাকে। যখন তারা সুযোগ পায়, তখন তারা তাদের উপর নিষ্ঠুর ব্যবহার করার যোগ্যতা দেখিয়ে ছাড়ে।

যতদূর আমি জানি হিংসুটে মানুষকে সুখী ও পূর্ণ করে তোলা ছাড়া হিংসার সঙ্গে এঁটে ওঠার আর কোন পদ্ধতি নেই। যুবকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার চেয়ে সম্মিলিত উদ্যোগের ধারণা গড়ে তোলার থেকে ভালো কোন পদ্ধতি নেই। হিংসার সব থেকে বাজে প্রকাশ দেখা যায় তাদের মধ্যে যারা তাদের বিবাহিত জীবনে, বা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিংবা তাদের কর্মজীবনে পূর্ণ হতে পারেনি। এই ধরণের দুর্ভাগ্যকে বেশিরভাগ সব ক্ষেত্রে ভালোভাবে দূর করা যেতে পারে অপেক্ষাকৃত উত্তম সামাজিক প্রথাসমূহের মধ্য দিয়ে। এটা আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে যে হিংসার আবেশটি প্রায়শই থেকে যায়। ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে যেখানে দেখা যায় যে কোন সর্বাধিনায়ক অপর কোন সর্বাধিনায়ককে এতটাই হিংসা করত যে তারা একে অপরের খ্যাতির বৃদ্ধি যাতে না হয় তার জন্য ইচ্ছে করে হেরে যাওয়াটাই পছন্দ করত। একই দলের দুজন রাজনীতিবিদ, কিংবা একই ঘরানার দুজন শিল্পী অবশ্যই একে অপরের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে প্রতিটি প্রতিযোগী একে অপরের ক্ষতি করতে সক্ষম না হয়। তারা যেন কেবলমাত্র তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী জয়লাভ করে। সাধারণত একজন শিল্পীর তার শত্রুর প্রতি ঈর্ষা খুব কমই ক্ষতি করতে পারে। কারণ সেই শিল্পী তার ঈর্ষাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে এই কারণে যে সে তার শত্রুর অপেক্ষা আরও ভালো ছবি আঁকবে বলে। কেননা তার শত্রুর ছবিগুলোকে ধ্বংস করে ফেলার পথ তার কাছে উন্মুক্ত নয়। যেখানে হিংসাকে কোন ভাবে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয় সেখানে তাকে একে অপরের জন্য উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করা চলে, কিন্তু কখনই শক্রর প্রচেষ্টাকে আঘাত করে নয়।

মানুষের সুখকে বৃদ্ধি করার জন্য বিজ্ঞানের সম্ভাবনাগুলি মানুষের প্রকৃতির সেইসব দিকগুলোকে কিছুতেই হ্রাস করতে পারে না যে প্রকৃতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা পরস্পর বোঝাঁপড়ার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় হারে এবং যে প্রকৃতিটিকে আমরা অবশ্যই মন্দ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। ধনাত্মক যোগ্যতা বৃদ্ধিতে বিজ্ঞান যা করতে পারে তার কোন সীমা নেই। স্বাস্থ্য এখনই অনেক উন্নত হতে পেরেছে। অতীতের আদেশ গ্রহণকারীদের বিলোপ সত্ত্বেও আমরা আজ আগের থেকে অনেক বেশিদিন বাঁচি। অষ্টাদশ শতকের যে-কোন শ্রেণী বা জাতির থেকে আমরা অনেক কম অসুস্থতায় ভুগি। আমরা যে জ্ঞান এখনই অর্জন করেছি সেই জ্ঞানের একটু বেশি প্রয়োগ করলে এখন আমরা যেমন আছি তার থেকেও অনেক বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকতে পারবো এবং ভবিষ্যতে যে আবিষ্কারগুলো হবে তা দিয়ে উন্নতির পদ্ধতি আরও বেশি দ্রুত হয়ে উঠবে।

পদার্থবিজ্ঞান আমাদের জীবনে উপর যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে মনস্তত্ত্ব এবং শারীরবিদ্যা আরও বেশি ফলদায়ক হয়ে উঠবে। যখন এখনি আমরা আবিষ্কার করতে পেরেছি কিভাবে চরিত্র শারীরবিদ্যার উপর নির্ভর করে, তখন আমরা যদি চাই তবে আমরা ভবিষ্যতে সেই রকম অনেক মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হব যে মানুষদের আমরা প্রশংসা করে থাকি। বুদ্ধি, শৈল্পিক পারদর্শিতা, বদান্যতা –এই সমস্ত জিনিসগুলি বিজ্ঞানের দ্বারা আরও বৃদ্ধি করা যাবে। যদি আমরা বিজ্ঞানকে বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহার করি তবে মঙ্গলময় জগৎ তৈরি করতে যা করা যাবে তার কোন সীমা পরিসীমা থাকবে না। কিন্তু আমি কোন এক জায়গায় এই অভিমত প্রকাশ করেছিলাম যে মানুষ সম্ভবত সেই ক্ষমতাকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারবে না যে ক্ষমতা সে বিজ্ঞান থেকে অর্জন করতে পেরেছে (ইকারুস দেখুন)। বর্তমানে আমি সেই মঙ্গলের সম্পর্কে কথা বলছি যে মঙ্গল মানুষই করতে পারে যদি তারা চায়, আমি কোন বিষয় সম্পর্কে কথা বলছি না যেখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে তারা মঙ্গল অপেক্ষা অমঙ্গল করাটা বেশি পছন্দ করবে কিনা।

মানবজীবনের উপর বিজ্ঞানের একটি বিশেষ আচরণ দেখা যায় যে সম্পর্কে আমার একটা সহানুভূতি আছে, যদিও শেষ বিশ্লেষণে আমি তার সঙ্গে একমত হইনি। এই আচরণটি তাদের যারা যা কিছু ‘অপ্রাকৃতিক’ তাকেই ভয় পায়। রুশো, ইউরোপে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান নায়ক। এশিয়াতে, লাওৎসে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে তা বিশ্বাস উৎপাদন করতে সক্ষম। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৪০০ বছর খুব তাড়াতাড়ি গড়িয়ে গেছে। আমি মনে করি ‘প্রকৃতি’কে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে সত্য এবং মিথ্যা মিশ্রভাবে মিশে আছে, যার জট খোলাটা গুরুত্বপূর্ণ। শুরু করতে হবে প্রাকৃতিক’ বলতে কি বোঝায় সেই প্রশ্ন দিয়েই। মোটামুটিভাবে বলা যায় প্রাকৃতিক বলতে সেই সমস্ত বস্তুকে বোঝায় যে বস্তুগুলির সঙ্গে বক্তা শিশুর মতোই যুক্ত হতে অভ্যস্ত। লাওৎসে রাজপথ এবং যানবাহন ও নৌকার সম্পর্কে আপত্তি করেছেন যেগুলো সম্ভবত তিনি যে গ্রামে জন্মান সেখানে অপরিচিত ছিল। রুশো এই সমস্ত জিনিসগুলো ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি সেগুলোকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলেননি। কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি বেঁচে থাকতে যদি রেলপথ দেখতেন তবে কেটে পড়তেন। পোশাক পরা এবং রান্না করাটা বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রকৃতির ধর্মপ্রচারকদের বেশির ভাগের দ্বারা প্রকাশ্যে নিন্দিত হয়ে এসেছে, যদিও তারা সবাই যে-কোন নতুন ধরনকে নিন্দা করতে অভ্যস্ত। যারা কৌমার্যের যন্ত্রণা সহ্য করেছিল তারা জন্মনিয়ন্ত্রণকে শয়তানের ইচ্ছা বলে মনে করত, কারণ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়টি প্রকৃতিকে নতুনভাবে এক অস্বীকার ছিল এবং সৌন্দর্যের যন্ত্রণা সহ্য করাটা ছিল প্রকৃতিকে অস্বীকার করার প্রাচীনতম প্রথা। এইসব পথ দিয়ে যারা প্রকৃতিকে প্রচার করেছে তারা অসঙ্গতিকর ছিল এবং কেউ কেউ যারা তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করতে উগ্র হয়ে উঠেছিল তারা ছিল রক্ষণশীল।

অধিকন্তু, তাদের পক্ষে কিছু বলা যেতে পারে। ভিটামিনের উদাহরণটি নেওয়া যাক, যার আবিষ্কার প্রাকৃতিক খাদ্যের সমর্থনে একটি বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। তবে মনে করা হয়েছিল যে ভিটামিনগুলি সরবরাহ করা যেতে পারে কডলিভার অয়েল এবং বৈদ্যুতিক আলোর দ্বারা, যা নিশ্চিতভাবেই মানুষের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই ঘটনা এই ব্যাখ্যাই করে যে, জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে, প্রকৃতি থেকে কোন নতুনভাবে অপসরণ আশাতীত ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু যখন ক্ষতিটিকে বুঝতে পারা যায় তখন নতুন কোন কৃত্রিমতা দিয়ে তাকে সাধারণত সারাবার চেষ্টা হয়ে থাকে। আমাদের ভৌতিক পরিবেশ ও আমাদের আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির জন্য ভৌতিক উপাদানগুলি সম্পর্কে বলতে গেলে, আমি মনে করি না যে প্রকৃতি’ মতবাদটি নতুন কোন সুবিধা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গবেষণামূলক সাবধানতা নেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ জামা কাপড়ের কথাই ধরা যাক, যেটি প্রকৃতি বিরোধী এবং যেটাকে পূরণ করবার চেষ্টা হয়েছে অপ্রাকৃতিক কার্যাবলীর দ্বারা, অর্থাৎ জামাকাপড় ধোয়ার মাধ্যমে, কেন না নোংরা জামাকাপড় রোগ ডেকে আনবে। কিন্তু দুটি কাজ যা বর্বর মানুষদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েছিল তা আজ মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান করে তুলেছে।

মানুষের আকাক্ষার রাজত্বে ‘প্রকৃতি’ সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যাবে। পুরুষ নারী ও শিশুর শক্তিশালী ভাবাবেগকে ধাক্কা মেরে তার উপর কোন জীবনকে বলপূর্বক চাপিয়ে দিলে তা যেমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে তেমনি ভয়ঙ্করও হবে। এই অর্থে ‘প্রকৃতি অনুযায়ী একটি জীবন কোন স্থিরীকৃত শর্তসমূহের প্রতি সমর্পিত। ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক রেলপথের চেয়ে আর কোন কিছুই ততটা কৃত্রিম নয়, কিন্তু সে যখন কোন শিশুকে নিয়ে যাত্রা করে তখন সে শিশুটির প্রকৃতিকে মোটেই লঙ্ঘন করে না। বিপরীতভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে এই অভিজ্ঞতাটি সব শিশুই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। অন্যান্য জিনিসগুলি সমানুপাতিক হলে যে কৃত্রিমতা সাধারণ মানুষের কামনাকে পরিতৃপ্ত করে তা মঙ্গলজনক। কিন্তু জীবনের যে পথসমূহকে কৃত্রিম বলা যায় তা অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কর্তৃত্বের দ্বারা নির্মিত, তাই সেই সব পথ সম্পর্কে কিছুই বলার নেই। জীবনের এই ধরণের পথ, নিঃসন্দেহে, কিছুদূর পর্যন্ত এখন প্রয়োজনীয়। সাগরে যাত্রা করাটা একটা দুরবগাহ ব্যাপার হয়ে উঠবে যদি স্টিমারের অগ্নিকুণ্ডে কয়লা ঠেলে দেওয়ার কেউ না থাকে। এই ধরণের প্রয়োজনীয়তাগুলো দুঃখজনক এবং তাদের এড়িয়ে চলবার পথ আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্ম করা অভিযোগের বিষয় নয়, বরঞ্চ দশের মধ্যে নটি ঘটনাতেই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় জীবন কাটানোর থেকে কর্মই মানুষকে বেশি সুখী করে। বর্তমানে মানুষ যে ধরণের কার্য যে পরিমাণ করতে বাধ্য হয় তা গভীরভাবে অশুভ। বিশেষত নিত্যকর্মের দাসত্বের বাঁধা জীবন মন্দ। জীবন কখনই কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয় অথবা তা অতিরিক্ত প্রণালীসংগত হওয়া উচিত নয়। আমাদের ভাবাবেগগুলো যদি ধনাত্মকভাবে ধ্বংসাত্মক না হয়, কিংবা তা অপরের ক্ষতিকারক না হয়, তবে সম্ভব হলে তাকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া উচিত এবং দুঃসাহসিক কাজের জন্য সুযোগ দেওয়া উচিত। মানবিক প্রকৃতিকে আমাদের সম্মান করা উচিত, কারণ আমাদের ভাবাবেগগুলো এবং কামনাগুলো সেই মোড়কের ভেতর থেকে বার হয়ে আসে যেখানে আমাদের সুখ তৈরি করা যায়। মানুষকে এমন কিছু দেওয়া অনর্থক যাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে মঙ্গলময় ধরে নিতে হবে। আমাদের মানুষকে আকাক্ষিত এবং প্রয়োজনীয় এমন কিছু দেওয়া অবশ্য দরকার যা মানুষের সুখের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। বিজ্ঞান এই শিক্ষা ঠিক সময় মতো অর্জন করে আমাদের কামনাগুলোকে সেই পথে ঘোরাতে পারে যাতে আজকের মতো তা অপর মানুষের সাথে বিবাদের কারণ হয়ে উঠবে না এবং তখনই আমরা আমাদের কামনাগুলোর বেশিরভাগ অংশটিকে আজকের চেয়ে অনেক বেশি পরিতৃপ্ত করতে পারব। কেবলমাত্র সেই অর্থেই, তখন আমাদের কামনাগুলো মঙ্গলতর হয়ে উঠবে। একটি কামনার না থাকে মঙ্গলময় দিক, না থাকে মন্দের দিক। তাকে অন্যান্যদের চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছন্ন একাকী হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু একটি কামনাপুঞ্জ অন্য পুঞ্জটির থেকে মঙ্গলদায়ক যদি প্রথম পুঞ্জটির সবাই একই সঙ্গে পরিতৃপ্ত হতে পারে তখন দ্বিতীয় পুঞ্জটির অনেকেই অন্যান্যদের থেকে অসঙ্গতিকর হয়ে থাকে। এই জন্যই প্রেম বিদ্বেষের চেয়ে মঙ্গলজনক।

ভৌতিক প্রকৃতিকে সম্মান করাটা বোকামি। ভৌতিক প্রকৃতিকে অধ্যয়ন করা ভাল বা মন্দ কোনটাই নেই। যখন ভৌত প্রকৃতি ও মানবিক প্রকৃতি পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে, বিশেষত জনসংখ্যার প্রশ্নের দিক দিয়ে, তখন পূজার ভঙ্গিতে দু’হাত জোড় করে বসে বুদ্ধকে মেনে নিলে চলবে না। মহামারী ও দুর্ভিক্ষের একটি সম্ভাব্য যোগসূত্র আছে। স্বর্গ বলে : এটা মহা পাপ। যদি তাই হয় তবে সমস্যার কেবল ভৌতিক দিকটিতেই বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করা হ’ক। আমরা অবশ্যই (তারা বলে থাকে) মানবিক দিকে নৈতিকতাগুলো প্রয়োগ করব এবং সংযম পালন করব। ঘটনা স্বরূপ প্রত্যেকেই, এমনকি স্বর্গের অনুগামীরাও জানে যে তাদের উপদেশগুলোকে মেনে নেওয়া হবে না। গর্ভধারণের প্রতিকার স্বরূপ ভৌত উপায়কে গ্রহণ করে জনসংখ্যার প্রশ্নটিকে সমাধান করাটা কেন পাপের হবে? একমাত্র সেকেলে ধর্মমত ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে কোন উত্তর সামনে উঠে আসবে না। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে প্রকৃতিকে খণ্ডন করার ব্যাপারে স্বর্গের যে উপদেশগুলি আছে তা অন্তত জন্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত উপদেশগুলির মতোই মহান। স্বর্গ মানবিক প্রকৃতির লঙ্ঘনকেই পছন্দ করে। সেই লঙ্ঘনকে সফলভাবে সান করার ক্ষেত্রে অসুখ, হিংসা, নির্যাতন প্রবণতা এবং প্রায়শই পাগলামি জড়িত। আমি ভৌত প্রকৃতির লঙ্ন’ পছন্দ করি যা একইভাবে স্টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে অথবা ছাতা ব্যবহারের সঙ্গেও জড়িত। এই উদাহরণে দেখা যায় যে সেই আদর্শের প্রয়োগ কতটা দ্ব্যর্থক ও অনিশ্চিত যাকে আমরা ‘প্রকৃতি’ বলে অনুসরণ করে থাকি।

প্রকৃতি ও মানবিক প্রকৃতি পরম স্বীকৃত বিষয়সমূহ থেকে ক্রমশই বেশি করে ক্ষান্ত হয়ে আসছে। বৈজ্ঞানিক বোঝাঁপড়ার মধ্য দিয়ে তাকে যত সুবিধাজনক জায়গায় আনা হচ্ছে ততই সে বেশি করে ক্ষান্ত হয়ে পড়ছে। যদি বিজ্ঞান চায়, তবে আমাদের প্রপৌত্রদের মঙ্গলময় জীবন কাটাতে সমর্থ করে তুলবে, তাদেরকে জ্ঞান প্রদান করে, আত্ম-সংযমী করে এবং বিবাদ উৎপাদনকারী চরিত্রের বদলে সংগতি উৎপাদনকারী চরিত্র প্রদান করে। বর্তমানে আমাদের শিশুদের পরস্পরকে হত্যা করবার শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। কেননা বিজ্ঞানের বহু মানুষই মানুষের ভবিষ্যৎকে তাদের নিজেদের মুহূর্তের সমৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলি দিতে ইচ্ছুক কিন্তু এই সময় অতিক্রান্ত হবে তখন যখন মানুষ যে ভাবে বাহ্যিক জগতের ভৌত বলের উপর প্রভুত্ব করতে পেরেছে ঠিক তেমনি সে তার নিজের ভাবাবেগের উপর প্রভুত্ব করতে পারবে। আর তখনই শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *