০৮. আলো-আঁধারীর পথ

৩৬.

আলো-আঁধারীর পথ শেষ হয় কলতলায় এসে। বড়ো আমগাছটা গোলাকার অনেকটা জায়গাকে ছায়া দেয়, হলুদ আমপাতা মাঝে মধ্যেই বিছিয়ে দেয় ঘাস উঠে যাওয়া মাটির বুকে। দুপুরবেলা এই আমতলা বড়ো লোভনীয়। শুভ এখানে কাচের গুলি খেলতে আসত। প্রায়ই ঝগড়া লেগে যেত পাড়ার ছেলেগুলোর সঙ্গে। হাতাহাতিতে সবুজের জোড়া মেলা ভার। চোর-চোট্টামী সে একদম সহ্য করতে পারে না। খুব অসহ্য লাগলে বিল-চড়-ঘুষি চালিয়ে দেয়। একবার ডাংগুলি খেলায় সে চোখ ফাটিয়ে দিয়েছিল পাড়ার একটি ছেলের। সেই নিয়ে কত অশান্তি আর বিচার সভা। টিকেদারবাবু নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল সবুজের কর্মকাণ্ডে। পাড়ার ছেলেটার সম্পূর্ণ চিকিৎসার খরচ বহন করতে হয়েছিল টিকেদারবাবুকে। আজ আমতলায় এসে বিনা কারণে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল শুভ আর সবুজ। আর তখনই এক ঝাঁক জোনাকপোকা টিপিরটিপির আলো জ্বেলে উড়ে গেল খেজুরঝোপের দিকে।

হাত উঠিয়ে সবুজ বলল, রঘুটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না। ও এতদূর এল, আর কোয়ার্টার অব্দি যেতে পারল না। এত জড়োসড়ো হয়ে থাকলে আজকের দিনে কি চলে?

শুভ অন্ধকারেই হাসল, আসলে তা নয়। রঘু খুব সাদা মনের ছেলে। আমরা ওর বন্ধু, তবু ও আমাদের সঙ্গে মিশতে দ্বিধাবোধ করে।

জন্মগত জড়তা একদিনে কাটবে না। এগুলো দূর হতে সময় লাগবে। ততদিন আমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে। বন্ধুর জন্য এটুকু ত্যাগ তো আমাদের করতেই হবে।

সবুজ আর কথা বাড়াল না, চুপচাপ হেঁটে এল ফুটবল মাঠের শেষ প্রান্তে। মাঠ যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু হয়েছে সরকারি পাঁচিল। পাঁচিলের হাত পাঁচেক দুরেই পচা জলের ডোবা। দিনরাত মশা ভনভন করে সেখানে। একটু হাওয়া দিলেই দুর্গন্ধ ছোটে চারদিকে।

সবুজ জোনাক-জুলা মাঠের দিকে তাকিয়ে নাক টিপে ধরল জামা দিয়ে। শুভ সেসব কিছু করল না তবে রঘুনাথের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, অসময়ে তোর না আসলেও চলত। বল কিসের জন্য এসেছিস? কিছু বলার আগে রঘুনাথ হাতকাটা জামার পকেট থেকে বের করে আনল বিড়ির ডিবা, একটা নিজে ধরিয়ে শুভকে জিজ্ঞেস করল, চলবে নাকি?

শুভ কপাল কুঁচকে বলল, এগুলা তুই আবার কবে থেকে খাওয়া ধরলি?

–খাই লেংটো কাল থিকে, তবে তোর সামনে খেতাম না। রঘুনাথ ফিচেল চোরের মতো হাসল, তুই ভালো ছেলে। জীবনে এসব খুঁবি না। কিন্তু আমার মতো ছেলে-ছোকরাদের এসব না খেলে পেট চলে না। জন খাটতে গেলে বিড়ির ধোঁয়া সালসার কাজ করে।

-তুই যে বিড়ি খাস, তোর বাবা তোকে বকে না।

–আগে বকঝকা করত–ফুসফুসটা ঝাঁঝরা হয়ে যাবে রে। খাওয়ার বয়স কি পেলিয়ে যাচ্ছে নাকি? রঘুনাথ বড়ো করে শ্বাস টেনে নিয়ে তাকাল, মজুর খাটতে গেলে জলখাবার মুড়ি না দিলে চলবে, কিন্তু বিড়ি না দিলে পেট ফুলে যাবে নেশায়। এই দেখ, আমি এট্টা পাথরপোরা খ্যাচাকল কিনেছি। দেখ কেমন আগুন উগলায়।

বুড়ো আঙুলে চাপ দিয়ে রূপো রঙের লাইটারে আগুন বের করে দেখাল রঘুনাথ। শুভ অবাক করা চোখে দেখছিল। লাইটার সে এর আগেও দেখেছে, তার বাবার আছে।

বিড়ির গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছে বাতাসের ঘ্রাণ। হঠাৎ শুভর মনে হয় রঘুনাথ যেন পচা ডোবা। যতই আতর ছেটানো যাক–এর দুর্গন্ধ যাবে না। মিতে’ পাতিয়ে তার সম্বন্ধে এ কী ভাবছে সে? এ তো অপরাধ। বন্ধুর দোষ-ত্রুটি সামনাসামনি বলে দেওয়া ভালো। এতে ভুল বোঝাবোঝি কমে। সম্পর্ক ভালো থাকে।

শুভ হঠাৎ হাত ধরল রঘুনাথের, কিছু বলতে যাওয়ার আগে সবুজ আগ্রহ ভরে বলল, জানিস রঘু, আজ আমাদের রেজাল্ট বের হয়েছে। আমরা পাশ করেছি। পাশ করার জন্য আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। ফেল করা ছেলে যদি ভালভাবে পাশ করে যায়, তাহলে আনন্দ হবে না বল?

রঘু ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল।

সবুজ সময় নষ্ট না করে বলল, আজ এই আনন্দের দিনে বিষ দিলেও আমি খেয়ে নেব। দে, আমাকে একটা বিড়ি দে। বিড়ি খেলে কেউ খারাপ ছেলে হয়ে যায় না। খাওয়ার জিনিস খাবো, তাতে দোষ কোথায়?

রঘুনাথ শুভর দিকে কাঁপা চোখে তাকাল, তোরা বাবু ঘরের ছেলে। বিড়ি খেলে, নেশা করলে তোদের বদনাম হবে।

–লোকের কথায় আমার কি এসে যায়? সবুজ রঘুর জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল, জোর করে বিড়ির ডিবাটা বের করে এনে বলল, বাঃ, সুন্দর তো বিড়ির কৌটোটা; এটা তো নস্যির কৌটো। তুই কোথায় পেলি?

বিড়িটা কায়দা করে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে নেশাখোর মানুষের মতো সবুজ বলল, দে, তোর লাইটারটা দে। বিড়ি টানা আমার অভ্যেস আছে। আগে কুমড়োর শুকনো লতা কেটে বিড়ির মতো ধরিয়ে টান দিতাম। তাতে গলগল করে ধোঁয়া বেরত। আর কি আনন্দই না হত।

হাওয়ায় লাইটার জ্বালতে অসুবিধা হচ্ছিল সবুজের, বিরক্ত রঘুনাথ তার হাত থেকে লাইটারটা কেড়ে নিয়ে বলল, বিড়ি খাওয়া যে সে লোকের দ্বারা হয় না। বিড়ি খেতে গেলে বুকের ছাতিতে দম থাকা দরকার। তোর তো চড়ুইপাখির মতো ছাতি। এতে আর কতটুকু দম পাবি?

রঘুনাথের কথায় হীনমন্যতায় ডুবে গেল সবুজ, গলার রগ টানটান করে বলল, অত কথা না বলে বিড়িটা ধরিয়ে দে।

আমগাছের আড়ালে গিয়ে হাওয়া আটকাল রঘুনাথ। ফস ফস করে বার দুই-বিড়িটা টেনে সে ধরিয়ে দিল সবুজের হাতে, সতর্ক করে বলল, ধীরে ধীরে টান দিবি। তাড়াহুড়ো করতে গেলে শ্বাসনালীতে ধোঁয়া আটকে মরবি। তখন আর কাশি থামবে না।

সবুজের সতর্কবাণী শোনার সময় নেই। আজ তার জীবনে এক অন্য অভিজ্ঞতার সূচনা হতে চলেছে। ভারী কথায় এই মুহূর্তটাকে সে নষ্ট হতে দেবে না।

বার দুই বিড়িতে টান দেবার পর কাশি ঠেলে উঠল সবুজের গলায়। ঝ্যানঝ্যান করে আওয়াজ হল বুকের পাঁজরায়।

আমগাছের গোড়ায় মুখোমুখি বসেছে ওরা তিনজন।

শুভ তুষের চাদরটা রঘুনাথকে দিয়ে বলল, এটা আমি তোর জন্য এনেছি। পুরনো চাদর। তবু তুই নে। না করিস না।

-কেন দিতে গেলি? গলা কেঁপে উঠল রঘুনাথের।

–যা শীত পড়েছে, এই ভয়ানক শীতে আমার শুধু তোর কথা মনে পড়ে। পৃথিবীতে কত গরম পোষাক, অথচ তোর একটাও নেই। শুভ রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা খসে পড়া দেখল। অমনি হ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। রঘুনাথ কেমন কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে। বিড়বিড় করে বলল, মনে আছে তো বাঁশির মোট ছ’টা ফুটো, ফুঃ দেওয়ার জন্য আর একটা ফুটো। মোট সাতটা ফুটো না হলে সুর বেরয় না। প্রতিটি ফুটোয় এক সমুদ্র সুর। আমার গুরু বলে সাতটা ছিদ্রে সাত সমুদ্রের সুর। যে বাঁশি বাজায়, সে পানকৌড়ি পাখির মতো ডুব দেয় সুরের গঙ্গায়। তবে না বাতাস ভরে সুর ওঠে। সুর না উঠলে সব দুধ জল হয়ে যায়। বাঁশি শেখানোর দক্ষিণা আমি মিতের কাছ থেকে নিতে পারিনে। তুই এটা ঘুরোন নে–

-না নিলে অনেক কষ্ট পাবো।

-এত করে বলছিস যখন দে। তিতকুড়ো ঠোক গিলে ঠোঁট কামড়ে ধরল রঘুনাথ। কিসের কষ্টে সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছিল না। যা কঠিন সময় এসেছে, একটা মাস কেন, একটা দিনও কাটতে চায় না। সোনার বাংলায় এখন ভাতের বড়ো আকাল। গাঁয়ের মানুষ আটা খাচ্ছে-স্বপ্নেও ভাবা যায় না এমন দৃশ্য। ট্রাক বোঝাই হয়ে মাইলো আসছে। বগলাহাটের খিচুড়ি দিচ্ছে ইস্কুলে। গমচুর খেয়ে মানুষের তলপেটে দরকচা মেরে গেল। গুয়ারাম এসব দেখে দুঃখ করে বলে, গাঁ ঘরে গরীবগুরবো মানুষ আর বাঁচবে নি গো! সেঁড়িগুগলি থেকে বনকচু কিছুই পাওয়া যায় না যে সিজিয়ে খাবে। এমন চললে মানুষ আর কদিন বাঁচবে?

বেশিদিনের কথা নয়, তখনও গোরুপালন প্রথা চালু ছিল গাঁয়ের ঘরে। গোরু চরানোর জন্য দিনভর ব্যস্ত থাকতে হত গুয়ারামকে। রঘুনাথও তার বাবার সঙ্গে মাঠে যেত গোরুর পাল নিয়ে। গ্রামের যত গোরু ঘর ঘর গিয়ে গোয়াল থেকে খুলে আনত গুয়ারাম। সকাল থেকে এ কাজে তার ব্যস্ততার শেষ নেই। পঞ্চাশ-ষাট ঘর থেকে গোরু আনা কি মুখের কথা! গোরুর পাল খেদিয়ে জঙ্গলের ধারের মাঠটাতে হাজির হত তারা। দুর্গামণি প্রতি ঘর থেকে মুড়ি গুড় চিড়ে চেয়ে আনত সারাদিনের খাওয়ার জন্য। কেউ দিত, কেউ আবার দিত না। কেউ বলত, কাল নিও… ইত্যাদি। দশ জনের দয়ায় দিন চলছিল হাওয়ার মুখে পানসির মত তরতরিয়ে। গোর চরানোর মজাটাই তখন আলাদা। এ এক নেশা। এই নেশার জন্য স্কুলের পথে বেশি দুর পা বাড়াল না রঘুনাথ। মোষের পিঠে চড়ে, সবুজ ঘন বনের দিকে তাকিয়ে বাঁশি বাজানোর যে আনন্দ-সেই আনন্দ কি স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে পাওয়া যায়? তাই স্কুলের কথা শুনলে হাঁপিয়ে উঠত সে। দুর্গামণির কাছ ঘেঁষে বসে থাকত চুপচাপ। গোরুর পাল-এ যাওয়ার অর্থ রোজ বনভোজন। মাটির ঠিলিতে পাল পুকুরের টলটল জল ভরে নিয়ে যেত দুর্গামণি। বেতের ধামা ভর্তি মুড়ি। সঙ্গে আখের গুড়। তিন জনে মিলে, জল দিয়ে মুড়ি ভিজিয়ে গুড় সহযোগে খাওয়া চলত ভর পেট। রোদ ঢাললে গোরু মোষ গুণে নিয়ে ঘরে ফেরার তাড়া। যার গোর তার তার গোয়ালে পৌঁছে না দিলে দশটা কথা শোনায় গোরুর মালিক। লোকের মুখ ঝামটা দেওয়া কথা ফোস্কা পড়ায় গুয়ারামের মনে। মাঝে মধ্যে সে আক্ষেপ করে রঘুনাথকে বলে, লেখাপড়াটা শিখে লে ব্যাটা। আজকাল যুগ পাল্টেছে। পড়া লিখা শিখলে টুক করে চাকরিটা পেয়ে যাবি।

বামুনে মন্ত্র পড়ে, পাঁঠার চামড়া শোনে। রঘুনাথ এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দিত কথাগুলো। একদম ভালো লাগত না গুয়ারামের ঘ্যানরঘ্যানর ভাষণবাজি।

সবুজের বিড়িটা টানের জোরে হাতে ছ্যাক লাগার মতো অবস্থা। অন্ধকারে বিড়ির সুতো ছোঁয়া আগুনে ছ্যাঁকা খেল সে। উঃ শব্দ বাতাসে মিশতেই হাসি পেল রঘুনাথের, দেখে-শুনে খা। অমন হাভাতের মতো নেশা করলে মরবি কেশে কেশে।

সবুজ তর্কে না গিয়ে বলল, বিড়িতে যে এত দম লাগে আগে জানতাম না। শুভ বলল, চল, এবার আমরা ফিরে যাই। রঘুকে পাকা রাস্তা অব্দি এগিয়ে দিয়ে ঘর ফিরে যাব।

রঘুর সায় ছিল না, সে নিমতেতো স্বরে বলল, আমাকে নিয়ে ভাবিস না। আঁধারে বেড়ালের মতো আমার চোখ জ্বলে।

শুভ মজা করে বলল, তুই কি চোর নাকি?

মনোক্ষুণ্ণ রঘুনাথ সামলে নিল নিজেকে, চোর হলে তো বেঁচে যেতাম। দু-বেলা দুমুঠো খেতে পেতাম। সাধু হয়ে যত ঝামেলা হয়েছে। এক পা জলে, এক পা ডাঙায়, এভাবে কি মানুষ বাঁচবে? রঘুনাথ নিজেকেই যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, এত অভাবে নিয়ে বাঁচা যায় বলত? বুড়া দাদুটা টাইমে খেতে না পেলে চেল্লায়। বাপ-মা তুলে গাল দেয়।

অভাবের ধারালো নখ শুভ দেখেছে তাই সে চুপ করে থাকল। রঘুনাথ উসখুসিয়ে বলল, তুই ঘরে গেছিলিস, কোনো কথা আছে নাকি?

সকালের কথাগুলো এখন আর রঘুর কাছে বলতে ইচ্ছে করল না শুভর। উপর দিকে থুতু ছুঁড়লে নিজের গায়ে পড়ে। সেটা কি ভালো দেখায়? ঢোঁক গিলে শুভ বলল, আজ রেজাল্ট বেরল। তাই তোর কাছে গিয়েচিলাম সুখবর দিতে। দেখা হলে ভালো লাগত। কিছু সময় হয়ত বাঁশিটা শিখে নেওয়া যেত।

–দুর বোকা, বাঁশি যখন তখন শেখা যায় না। রঘুনাথ সতর্কগলায় বলল, আমাকে গুরু মানা করেছে–দুপুরবেলায় বাঁশিতে যেন ফুঃ না দিই। দুপুরে ফুঃ দিলে সুরের ছাতি ফাটে। বাঁশি কাঁদে।

এসব গুঢ় কথা কিছুই বুঝতে চায় না শুভ।

সবুজ ঠাট্টা করে বলল, গাঁ-ঘোরা সন্ন্যাসীদের মতো কথা বলিস নে! কথায় যদি হেঁয়ালি থাকে সে কথা তো পাথরচাপা।

–তর্ক থামা। শুভ দু’জনকেই থামিয়ে দিতে চাইল, তোরা চুপ করবি?

কিছু দূরে শুয়ে আছে ঝোপঝাড়। হাড়মটমটি আর পুটুসের ছড়াছড়ি। একটা শেয়াল আড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত ঢুকে গেল বাঁশবাগানে। রঘুর মনে পড়ে গেল ধানমাঠে শেয়ালের বাচ্চা ধরার কথা। ফুটফুটে রোদে বাচ্চাটা গর্ত থেকে বাইরে এসে বিপদে পড়ে গিয়েছিল। দূর থেকে তার নরম শরীরটাকে দেখে ফেলে রঘুনাথ। ছুটে গিয়ে দখল নেয় শেয়ালছানার। খুশি আর ধরে তার চোখে-মুখে। ভয়ে জড়োসড়ো শেয়ালের বাচ্চা নিয়ে সে ছুটে এসেছিল ঘরে। মায়ের কোলের কাছে শেয়ালের বাচ্চাটা নামিয়ে রেখে বলেছিল, হ্যাঁ দেখ মা, কী সোন্দর শেয়ালের ছা! এটা আমি পুষব।

ঠোঁট ভরিয়ে হেসে দুর্গামণি বলেছিল, ছা, শেয়ালের ছা আবার কেউ পোষে নাকি? যা এটারে যেখান থিকে ধরে এনেচিস, সিখানে ছেড়ে আয়। ঘরে শেয়াল পুষেচি শুনলে এ টিপেয় আর কেউ পা দিবেনি।

পায়ের চড়া পড়া দাগে পাশাপাশি হাঁটছিল ওরা তিনজন।

চাদর বিছানোর মতো হিম পড়ছে সর্বত্র। অল্প হাঁটলেই মাথার চুল স্যাঁতসেতে হয়ে ওঠে। টুপটুপিয়ে হিম ঝরে গাছের পাতা চুঁইয়ে। কদিন হল ঠাণ্ডাটায় শুলোনী ভাব আছে। রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না রঘুনাথের। পাতলা কথাকানিতে ঘুমের বারোটা বেজে যায়। তবু কাউকে বলা যায় না এই দুঃখের কথা, মুখ বুজে পড়ে থাকতে হয়। হঠাৎ তারা খসে পড়ল মাঝ আকাশ থেকে।

তারা খসে পড়ার সংকেত শুভ নয়।

 কিছুটা আসার পর ওদের পথ আটকে দিলেন এই হাসপাতালের স্টাফ অরূপবাবু। ভালো করে তিনজনকে জরিপ করে অরূপবাবু বললেন, এটাকে তো চিনলাম না। কোথায় বাড়ি ছেলেটার? রাতের বেলায় হাসপাতাল চত্বরে কেন এসেছে? ডাক্তারবাবু জানলে রাগারাগি করবেন।

অরূপবাবুর পোশাক-আশাক বড়োই বিচিত্র। ফিনফিনে ধুতির সঙ্গে ফুল-পাঞ্জাবী পরেন তিনি। সেই পাঞ্জাবীর বুক পকেটে আটকান থাকে সোনালী মুখখাঁটির দামী একটা কলম। শুধু দামী কলম নয়, অরূপবাবুর চশমাখানাও খাসা, সোনালী ফ্রেমের উপর বিদেশী কাচ তার চোখজোড়াকে দিয়েছে আলাদা এক দর্শন ক্ষমতা। ধুতির কোঁচা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে অরূপবাবু কবির চোখে তাকালেন, তোমরা আমার সন্তানের মতো, তোমাদের একটা কথা বলি–অল্প বয়সে নেশা-ভাঙ করা অনুচিত। এতে দৈহিক মানসিক-দুদিক থেকেই শরীরের প্রভূত ক্ষতি হয়। তোমরা এ দেশের ভবিষ্যৎ। তোমরা যদি বিপথগামী হও, তাহলে এত বড়ো দেশটা চালাবে কে?

সবুজ বাহাদুরী নেবার জন্য এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল, এ কথা কেন বলছেন, কাকু? আমরা কি কোনো অপরাধ করেছি?

-করছে তো! অরূপবাবু বেশ ক্রোধের সঙ্গে গর্জে উঠলেন, তোমার বয়স কত, কোন ক্লাসে পড়ো? বলো–এই বয়স থেকে তোমাদের কি ধূমপান করা উচিত? তোমরা হয়ত বুঝতে পারছ না–যে তোমাদের মুখ দিয়ে বিড়ির দুর্গন্ধ বেরচ্ছে। সেই দুর্গন্ধে যে কোনো ভদ্রলোকের নাসিকা কুঁচকে যেতে বাধ্য।

অপ্রস্তুত শুভ মুখ নামিয়ে নিল মাটির দিকে।

অরূপবাবু এই হাসপাতালের সুপারভাইজার। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তার হৃদ্যতা এখানকার সব স্টাফই লক্ষ্য করেছেন। ইংরেজিতে অনার্স এই ভদ্রলোক একটু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে ভালোবাসেন। ইংরেজি তাঁর প্রিয় বিষয় হলেও বাংলায় আধিপত্য কম নেই, সুযোগ এবং অবসর সময় পেলে তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসে যান কাব্যসাধনা করতে। তাঁর কবিতায় সমস্যার চাইতে প্রকৃতি বন্দনা বেশি, আকাশ জল মাটি ফুল নদী এসবই তাঁর কাব্যভাবনাকে ঋদ্ধ করে।

এই মানুষটির উপর অবনীর শ্রদ্ধা অসীম, সে প্রায়ই আলোচনার সময় বলে, অরূপবাবুর মতো গুণী মানুষ এ হাসপাতালে আর দুটি নেই। যখন কোনো দরখাস্ত লেখার প্রয়োজন হয়, ডাক্তারবাবুর মতো মানুষও এই মানুষটার দ্বারস্থ হন।

জ্ঞানের প্রাচুর্য মানুষকে সরল দেবদারু গাছের চেয়েও সুন্দর করে তোলে। অরূপবাবু চশমার ফাঁক দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে সবুজের দিকে তাকালেন, তুমি তো টিকেদারবাবুর ছেলে, তাই না? কী যেন নাম তোমার? বড় পিকিউলার তোমার নামটা। এই মুহূর্তে মনে পড়েছে না!

–ওর নাম সবুজ। ঝটপট জবাব দিল শুভ।

এই ফাঁদ থেকে ওরা তিনজনই চাইছিল মুক্তি পেতে। কিন্তু মুক্তি কি অত সহজ নাকি? মুক্তি তো ছেলের হাতের নাড়ু নয় যে চাইলেই পাওয়া যাবে।

অরূপবাবু কোঁচা দুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, কয়েকটা কথা বলছি মন দিয়ে শোন। ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা হল পড়াশোনা করা। যারা জেলে-তাদের তপস্যা হল মাছধরা। যারা চোর–তাদের চুরিবিদ্যায় পারঙ্গম হতে হয়। না হলে মানবজীবনে সফলতা আসে না। তাই বলছিলাম-নেশা-ভাঙ ছেড়ে দিয়ে মন দিয়ে বিদ্যাভ্যাস করো। মা সরস্বতীর আরাধনা করবে, মা সরস্বতী তাহলে তোমার জ্ঞানের ভাণ্ডার পূর্ণ করে দেবেন। আমি প্রতি বছর বাগদেবীর শ্রীচরণ বন্দনা করি। আমার বিশ্বাস-এর দ্বারা আমার জ্ঞানের গভীরতা, স্মৃতিশক্তি এই বয়সেও পুর্বের ন্যায় উজ্জ্বল আছে। আর একটি কথা–মা সরস্বতীকে পূজা অন্তে কখনই বিসর্জন দেবে না। এতে মা মনদুঃখে ভোগেন। আশীর্বাদের বদলে তার দীর্ঘশ্বাস আমাদের উপর বর্ষিত হলে এই মনুষ্যজীবনে আমাদের পক্ষে একা একা কতদূর যাওয়া সম্ভব? কথা সমাপ্ত করে অরূপবাবু থানার দারোগার মতো বললেন, তোমরা আমাকে অনুসরণ করো নাহলে আজ তোমরা এই বয়সন্ধিক্ষণে যে পাপ করেছে–তার শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে। আমার কথার অবাধ্য হলে আমি তোমাদের পিতা-মাতার কাছে তোমাদের যাবতীয় গুণাবলী বিশদভাবে বলব। এতে ফলাফল কী হবে তা তোমাদের অজ্ঞাত নয়।

শুধু শুভ কেন, সবুজের মুখ শুকিয়ে পাটের দড়ির মতো বিবর্ণ দেখায়। ভাষাহীন, বাক্যরহিত রঘুনাথ ভাবছিল–এ কী ফ্যাসাদে পড়া গেল! এর থেকে সহজে উদ্ধার পাওয়া যাবে তেমন কোনো অলৌকিক আলো সে দেখতে পেল না।

পাঁচিলের ধারে একেবারে শেষ কোয়ার্টারটি অরূপবাবুর। এদিকে মানুষজন কম আসেন। সামনের মাঠটাতে বেশির ভাগ সময় গোরু-মোষ চরে, রাখালরা ডাংগুলি খেলার উপযুক্ত জায়গা পেয়ে সব সময় হৈ-চৈ বাঁধিয়ে রাখে। বিরক্ত অরূপবাবুর কাব্যচর্চায় ওইসব হই-হট্টগোলের শব্দ কোনো নতুন কবিতার জন্ম দিতে পারে না। ফলে তিনি এই কোয়ার্টার পেয়ে দুঃখী। নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য মনের মতো পরিবেশ তিনি আজ পর্যন্ত পেলেন না। এই আক্ষেপে–তিনি স্ব-উদ্যোগে, স্ব-হস্তে তৈরি করেছেন একটি অভিনব পুষ্প-উদ্যান। এই পুষ্প-উদ্যানের তিনি নাম রেখেছেন–মনোরমা।

মনোরমা তার প্রথমপক্ষের স্ত্রী, অকালে তার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়, সেই শোকে অধীর অরূপবাবু তাঁর জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন, সেই কাব্যগ্রন্থের নাম রাখেন, মনোরমা। লাখুরিয়া ইস্কুলের বাংলার শিক্ষক তমালবাবু মনোমা’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই উদ্যানে চেয়ার সাজিয়ে, হ্যারিকেনের আলোয় চলত কাব্য-সাধনার নিরলস মহড়া। হরিনাথপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফজলু শেখ আসতেন এই মহতী সান্ধ্যবাসরে যোগ দিতে। তার একটি মার্ড-গার্ড খোলা সাইকেল, সঙ্গের থলিতে পাম্পার, টায়ার-লিভার, সলিউশন ডিবা, ধার কচি ইত্যাদি যন্ত্রপাতি মজুত থাকত। কোনো কারণে টিউব লিক হয়ে সাইকেল তার ভার বহন করতে অক্ষম হলে ফজলু মাস্টারমশাই তার যন্ত্রপাতি সহযোগে অসুস্থ সাইকেলের রোগ সারিয়ে চাঙ্গা করে তুলতেন। নিজের হাতে এসব কাজ করার জন্য গর্ববোধ করতেন ফজলু শেখ। মহাত্মা গান্ধীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলতেন, পরমুখাপেক্ষী হয়ে জীবনধারণ করা পাপের। মহাত্মা গান্ধীর মতন মহামানবও নিজের ঘরদোর নিজেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতেন। আমি সেই মহাত্মাকে শ্রদ্ধা করি বলেই–নিজের সব কিছু নিজের হাতে করার চেষ্টা করি। এতে আমার আত্মবিশ্বাস মজবুত হয়। আমি আল্লার প্রতি আরও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে পড়ি।

এদের তিন জনের কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে শুভর। সে ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে–তিনজন আলাদা মানুষ হয়েও কোথাও একটা মিল রয়েছে এঁদের মধ্যে। এঁরা তিনজনই সাহিত্যমনস্ক এবং সাহিত্যপ্রেমী। এঁদের আলোচনার অধিকাংশ সময় জুড়ে থাকে বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্যের দিকপালদের নিয়ে বিশদ আলোচনা।

ফজলু শেখ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ., পি. এইচ ডি করেছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর চেহারা, সাজ-পোশাক দেখে অনেকেই হয়ত ভাববেন তিনি বড়ো জোর বি ডি ও অফিসের একজন কেরানী নয়ত কোনো ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যকর্মী। যে যাই ভাবুক–ফজলু শেখ এসব নিয়ে আদৌ মাথা ঘামান না, তিনি তাঁর মৌলিক লেখালেখি আর পড়াশোনা নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন, তাই কলেজের শিক্ষকতার প্রস্তাবও হাসি মুখে ফিরিয়ে দেন। বিনীতভাবে বলেন, সৃজনশীল কাজ করতে গেলে টাকার পেছনে দৌড়ালে চলবে না। দু-বেলা ভাতের যোগাড় হয়ে গেলে মানুষের আর বিশেষ কিছু দরকার হয় না। প্রাইমারি স্কুলে আমি ভালো আছি। এখানে কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই, শিশুদের সঙ্গে মিশে মনটাকে শিশুদের মতন করার চেষ্টায় আছি। মনের পাঁকে যদি পদ্মফুল না ফোঁটাতে পারি তাহলে আমি কিসের শিক্ষক হলাম?

ফজলু শেখের পরিচিতির শেষ নেই, তিনি ছ’ফুট দুই ইঞ্চি লম্বায়, মাথায় সাদা টুপি পরেন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়। তার চেহারা অনেকটা তরলা বাঁশের মতো সাদাসিধে, ছাত্ররা তাকে আড়ালে আবডালে বলে লগা মাস্টার। লগা মাস্টারের অনেক গুণের মধ্যে নির্ভুল রবীন্দ্র-সংগীত গাওয়া অবশ্যই পড়বে। তার তেমন বোদ্ধা শ্রোতার প্রয়োজন হয় না। ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি গান গেয়ে শোনান, তার মানে বুঝিয়ে দেন। আর উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন, নজরুল আছেন। তোমরা বড়ো হয়ে বড়ো মানুষদের কথা পড়বে।

তিন মাথা যেখানে মিলিত হয় সেটাই বুঝি ত্রিবেণী!

.

৩৭.

অরূপবাবুর মনোরমা উদ্যানের প্রবেশপথটি ইট বিছানো, তার দু-পাশে শীতের ফুল সুগন্ধ ঢালছে বাতাসে। বেশ গর্বিত মেজাজে অরূপবাবু বললেন, ফুল আর শিশু যারা ভালোবাসেন না তারা মানুষ নন। ঐ দেখ, পাড় বাঁধানো জলাধার। ওখানে পদ্মগাছ এনে লাগিয়েচি। ভালো করে দেখ-কুড়ি এসেছে। আজকালের মধ্যে ফুল ফুটবে।

শুভ দেখল পদ্মপাতা টলটল করছে চার হাত ব্যাসের জলাধারের মধ্যে। অতি আগ্রহে মাথা তুলে দেখার মতো দুটি কুঁড়ি জলশয্যা ছেড়ে মুখ তুলে তাকিয়েছে বাইরের আলোয়।

অরূপবাবু আফসোস করে বললেন, রাতেরবেলায় বাগানের আর কী শোভা দেখবে? দিনেরবেলায় এসো-সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। ইট-বিছানো পথ যেখানে শেষ তার হাত দুয়েক দুরে সবুজ ঘাসের জঙ্গল। ঘাসগুলো লম্বা লম্বা, অনেকটা ধান গাছের পাতার মতো খসখসে। অরূপবাবু একটা পাতা ছিঁড়ে এনে শুধোলেন, বলো তো এটা কি পাতা?

শুভ পাতাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নাম জানে না ফলে ওটা সবুজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চাইল সে।

সবুজ চোখ কাচের গুলির মতো শক্ত করে বলল, দেখতে তো ধানপাতার মতো, তবে এর নাম জানি না।

সব শেষে রঘুনাথের কাছে হাত মাপের পাতাটা গিয়ে পৌঁছল। রঘুনাথ পাতার ডগাটা দু-আঙুলে চাপ দিয়ে গন্ধ শুকল। তারপর আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, এটা স্বরভঙ্গ গাছের পাতা। কারোর গলা বসে গেলে এই পাতার রস গরম জলে ফুটিয়ে খেলে গলা চাঙ্গা হতে বেশি সময় নেয় না।

অরূপবাবুর আবেশী গলা, ভেরি গুড! যথার্থ বলেছ। কী নাম তোমার?

ভ্যাবাচেকা খেয়ে রঘুনাথ বলল, আজ্ঞে, আমার নাম রঘুনাথ।

-বাড়ি কোথায়?

-বাধের ধারে থাকি! ধাওড়াপাড়ায়। রঘুনাথ বেশি কথা বলতে চাইছিল না। শুভ তার পক্ষ নিয়ে বলল, কাকু, এবার আমাদের ফিরতে হবে। রাত হয়েছে। ঘরে না গেলে মা চিন্তা করবে?

ভেবেছিলাম তোমাদের দু-চারটে কবিতা শোনাব। ঠিক আছে, সময় যখন নেই তা পরে হবে। অরূপবাবুর গলায় আফসোেস ধ্বনিত হল, তোমরা কেউ কিছু লিখলে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি মন দিয়ে শুনব। প্রয়োজন হলে কারেকশান করে দেব। শুভর মনে পড়ে গেল তার নিজের কথা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে সে লিখেছিল জীবনের প্রথম কবিতা। হেড-মাস্টারমশাই সেই সৃষ্টিটাকে বাতিল করে দিলেন। উৎসাহের বদলে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, কার দেখে টুকে মেরেছ? এটা কি ক্লাস এইটের ছেলের ভাষা? আবার কোনোদিন যদি দেখি অন্যের কবিতা টুকে এনে আওড়াচ্ছ তাহলে প্লেয়ারের সময় নীল ডাউন করে রেখে দেব।

হেডমাস্টারমশাইয়ের সেই রুদ্র মূর্তি, অঙ্গার ভরা চোখ এখনও ভুলতে পারেনি শুভ। সেদিন ভীষণ অপমানিতবোধ হয়েছিল নিজেকে। নির্দোষ প্রমাণ করার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল সে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার প্রিয়তম কবিদের একজন। তাঁর কবিতা পড়ে শুভ অনুপ্রাণিত হয় বারবার, তার মনে হয় বেশিরভাগ কবিতা বুঝি তাদের মতো মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে লেখা। তমালবাবু বাংলার ক্লাসে এই কবিকে নিয়ে অনেক অজানা কথা বলেছেন-যা শুনে চোখের জল আটকে রাখতে পারেনি শুভ।

তমালবাবু তাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, তোমার আবেগটাকে কাজে লাগাও। আজকাল মানুষের হৃদয় থেকে আবেগ নামক শব্দটি মুছে যাচ্ছে। তোমাদের মতো নরম মনের ছেলেরাই পারবে–মাতৃভাষার কমনীয়তা রক্ষা করতে। তমালবাবু আরও বলেছিলেন, ভেবেছি, একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করব। তোমরা সবাই লেখা দিলে কাজটা আমার পক্ষে সহজ হবে।

কিছু লিখতে বসলেই বাংলার মাস্টার তমালবাবুর মুখটা মনে পড়ে যায় শুভর। এ পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁদের বুকের গভীরে ঝর্না নদী এবং সমুদ্র আছে। তমালবাবু সেই মানুষ যাঁর মনে পাঁক নেই, কেবলই পলিমাটি।

-কী ভাবছ? শুভ’র কাঁধের উপর আলতো হাত রাখলেন অরূপবাবু। তোমার কথা আমি তমালবাবুর মুখে শুনেছি। এত বড়ো ইস্কুলে তোমরা ক’জন মাত্র লেখালেখি কর–সে খবর আমার জানা। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা শুনে যাও। যারা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করেন। তারা আমার প্রাণ, আত্মার আত্মীয়। তাই তোমাকে বলছি–যখন খুশি চলে এসো। আমার দরজা তোমার জন্য খোলা থাকবে।

সবুজ যেন গেট পেরতে পারলে বাঁচে এমন লম্বা লম্বা পা ফেলে সে হেঁটে এল কিচেনের সামনে। আর তখনি ছাদের উপর উড়ে এসে বসল একটা পেঁচা। পালক ফুলিয়ে শস্বরে ডেকে উঠল পেঁচাটা। শুভ ভয় পেল সেই ডাক শুনে।

মাঠের দিকে তাকাতেই তার চোখের সামনে ছায়া শরীর নিয়ে ঝাঁকড়া মাথা দুলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠল সারিবদ্ধ খেজুরগাছ। গিয়াস জিরেন কাট রসের জন্য গাছ কেটে বেঁধে দিয়ে গিয়েছে মাটির কলসী। সারারাত রস চুঁইয়ে অর্ধেকের উপর ভরে যাবে কলসীগুলো। সকালবেলায় শিশির চুবানো ঘাসে পা দিয়ে খেজুরগাছের কাছে এসে দাঁড়াবে গিয়াস। তার পরনে চেক লুঙ্গি, এই তীব্র শীতে পাতলা ফিনফিনে একটা জামা। শীতে কম্পমান শরীর নিয়ে তবু সে স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি। রাতভর তার পরিশ্রমের অন্ত নেই। রসের ঠিলি চুরি করার লোকের অভাব হয় না। ওরা রস খায়, ঠিলি ভাঙে। গাছের গোড়ায় ভাঙা হাঁড়ির চিহ্নগুলো যেন তার স্বপ্নকে পা দিয়ে থেতলে দিয়ে চলে যায়। এই শত্রুতার কবে যে শেষ হবে–জানা নেই গিয়াসের। হাতে বাঁশের লাঠি, গিয়াস এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ায় গাছ পাহারা দেবার জন্য।

তিন জনকে এক সাথে দাঁড়াতে দেখে লাঠি হাতে এগিয়ে এল গিয়াস। শুভ আর সবুজকে দেখে ভুল ভেঙে গেল তার, কী ব্যপার, রাত করে যে বাইরে আছো? হিম পড়ছে। চটজলদি ঘর যাও, ঠাণ্ডা লেগে গেলে ভোগান্তির আর শেষ থাকবে না।

গিয়াসের কথায় আন্তরিকতার ছোঁয়া পায় সবুজ। মনে মনে সে ভাবে দুটো পয়সার জন্য মানুষটা সারারাত ঘুমাতে পারে না। দুরের গাঁয়ে তার বউ-বাচ্চা আছে। তাদের কাছে যে যাবে–সময় কোথায়? মাথায় কাজের চিন্তা থাকলে ঘরও অনেক ক্ষেত্রে জেলখানা হয়ে যায়। হাসপাতালের গাছগুলো ঠিকে নেবার জন্য এবারও মকবুল এসেছিল কথা বলার জন্য। গাছ পিছু চার কেজি নয়, পাঁচ কেজি গুড় দেবে–এমন কথা জোর গলায় বলেছিল ডাক্তারবাবুকে। সেই কথার ফাঁদে পা দেননি ডাক্তারবাবু। সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মকবুলকে, গিয়াসের সঙ্গে অনেক আগে থেকে কথা হয়ে আছে। তাছাড়া প্রতিবছর ও গাছগুলো ঝুড়ে দেয় যত্ন নিয়ে। ও রস ভালোবাসলেও, গাছকে কম ভালোবাসে না। ওর হাতের ছোঁয়ায় কী যাদু আছে তাই প্রতি বছর খেজুরগাছগুলো তরতরিয়ে বাড়ছে।

–তাহলে ফি-বছর গিয়াস-ই গাছ ঝুরবে? আমরা কি তাহলে আঙুল চুষব, ডাক্তারবাবু? মকবুলের চোখের তারায় আগুন ঠিকরায়, ঠিক আছে, আমিও দেখে নেব। আপনি গাছ না দিলে কী হবে, খোদাই আমাকে গাছ পাইয়ে দেবে। সবুর করুন, নিজের চোখে সব দেখতে পাবেন।

নতুন কলসী কিনে গাছে বেঁধেছিল গিয়াস। সাতদিনের মাথায় কলসী সব ভেঙে খোলামকুচি বানিয়ে দিল কেউ। গিয়াস সেই দুঃখ ভুলতে পারেনি, হাউ হাউ করে কেঁদেছে। হাসপাতালে সেদিন ছেলে কাঁখে করে ওষুধ আনতে এসেছিল–তার বিবি নাফিজা। মানুষটার কান্না দেখে সেও কাঁদল গলা ফাড়িয়ে। সেদিন পাশে দাঁড়িয়ে মকবুল দেখছিল সব প্যাটপেটিয়ে। অবশেষে সান্তনা দিয়ে বলেছিল, আজকাল মানুষের চেয়ে পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের মন সব পাথর হয়ে গিয়েছে। নাহলে লোতুন ঠিলিগুলো কেউ ওভাবে ভাঙতে পারে? আমি যদি জানতে পারি কে ভেঙেছে, আল্লা- কসম আমি তার ঠ্যাং ভেঙে রোদে শুকাতে দেব। মকবুলের এই আস্ফালন ভালো চোখে নেয়নি গিয়াস। লোকে যে বলে চোরের মায়ের বড়ো গলা–এক্ষেত্রে সেই হিসাব বুঝি কড়ায় গণ্ডায় মিলে যায়। মানুষকে বিশ্বাস করে এত পথ হেঁটেছে গিয়াস। অবিশ্বাস তার জীবনধারায় খুবই কম।

নানাকারণে মকবুলকে তার অবিশ্বাস করতে মন চাইল। চোখে মুখে যে মানুষটি মিথ্যা কথা বলে তার ছায়া মাড়ানোও উচিত নয়। গাঁয়ে ঘরে বদ মানুষ হিসাবে মকবুলের দুর্নাম আছে। হাসপাতালের গাছগুলোকে দখল নেবার জন্য সে সবরকম চেষ্টা করেছিল। ব্যর্থ হতেই বেড়ে যায় তার প্রতিহিংসা। গিয়াসকে সে বেইজ্জত না করে ছাড়বে না। তাতে যা হয় হোক। অতি সন্তর্পণে সে গিয়াসের বুকে থাবা মারার জন্য এগোচ্ছে। তার নিখুঁত অভিনয় সবাই বুঝতে পারে না সহজে।

গিয়াসকে কব্জা করতে না পেরে নাফিজার সঙ্গে গায়ে গা মিলিয়ে মিশতে চাইছে মকবুল। নাফিজাকে হাত করতে পারলে মকবুলের অভিযান অনেকটাই সফল হবে।

গ্রামের মেয়ে নাফিজা মকবুলের চোখা কথায় মজেছে। ছেলেকে আড়ালে দুধ ধরিয়ে দিয়ে নাফিজা লাজুক চোখে চেয়ে থাকে মকবুলের দিকে। লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট-জামা পরলে মকবুলের বয়স অর্ধেক কমে যায়। গোঁফ-দাড়ি কামালে সে যেন এ গাঁয়ের নবাব। নাফিজা তাকে দুধ-চা বানিয়ে দেয়। দাওয়ায় বসতে বলে। মকবুল মিঠে মিঠে কথায় তার মন ভেজানোর চেষ্টা করে, একা থাকার দুঃখটা আমি বুঝি গো ভাবী। কি করবে, উপায় তো নেই।

নাফিজা চুপ করে থাকলে, আনমনে একটা সিগারেট ধরায় মকবুল, গলগলিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলে, না খাটলে বিড়ি-সিগারেটের পয়সাই উঠবেনি। এই আমার কথা ধরো। দিনরাত সাইকেল নিয়ে ঘুরছি টো-টো করে, দুটো পয়সার জন্য। কোনোদিন ব্যবসা জমে, কোনোদিন আবার জমে না। যাইহোক না কেন বেরতে তো হয় ঘর ছেড়ে।

নাফিজা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।

মকবুল উৎসাহিত হয়, যতদিন এই হাত দুটো আছে ততদিন পেটের ভাতের চিন্তা করি না আমি। গিয়াসভাই যে বিদ্যা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে সেই বিদ্যা দিয়ে আমি সারা জীবন ভাত-কাপড়ের যোগাড় করে নেব। জানলে ভাবী, একটা মেয়েমানুষকে পটানো সহজ কিন্তু কাটা বোঝাই খেজুরগাছ থেকে মিঠা রস বের করা অত সহজ কথা নয়। গিয়াস ভাই খোদার আপন-বান্দা। তাই তার হাতের ছোঁয়ায় খেজুরগাছে রস বেশি ছুঁয়ায়। মকবুলের মন পটানো কথায় ভালো লাগার তিরতিরে তে নাফিজার মনের উঠোন ভিজিয়ে সেখানে ভালোবাসার বীজ বপন করে দেয়। গিয়াসের অনুপস্থিতিতে মকবুল হয়ে ওঠে তার অন্তরঙ্গ-জন।

যা রটে তা কিছু না কিছু বটে। খবরটা গিয়াসের কানে গিয়েছিল। ঝিমিয়ে যাওয়া গিয়াস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল নাফিজাকে। বউটার পরিবর্তন এসেছে কথাবার্তায়, চোখেমুখে। মিথ্যার আশ্রয় নিতে শিখেছে সে।

গিয়াস বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আমি তুমাকে সিখানে লিতে এয়েচি, চলো। সিথায় আমার বড়ো ঝামেলা। সময়মত দানাপানি জোটে না। তুমি গেলে দুটা চাল ফুটিয়ে দিতে পারবে। আমার কাজে হাত লাগাতে পারবে।

–তা তো বটে! নাফিজার শুকনো হাসি, কিন্তু সিখানে যে যাবো–আমার এই ঘর সনসার কে দেখবে? দু-চারটা হাঁস-মুরগি পুষেছি, তারা আন্ডা দেয়। আমি গেলে পরে তাদের কে দেখভাল করবে।

-ও নিয়ে ভেবো না, ওগুলা জবাই করে খেয়ে লিবো। গিয়াস কথাগুলো বলে নাফিজার অস্বস্তিভরা মুখের দিকে তাকাল। নাফিজা উদ্ধার পাবার জন্য বলল, কঁখের ছেলেটারে কে দেখবে। হাসপাতালে সাতজাতের মড়া এক হয়। বাতাসে জিন-পরী ঘোরে। সিখানে বদ-হাওয়ার ছড়াছড়ি। বাছার আমার গায়ে যদি কু-বাতাস লাগে

বিরক্ত হল গিয়াস, যদির কথা নদীতে ফেলে দাও।

-তুমার কি হয়েছে বলদিনি?

-কিছু হয় নাই। তুমাকে আমার সাথে যেতে হবে। আমার মাথার ঠিক নাই। বেশি কথা কইতে পারবোনি। খপখপ তৈয়ার হয়ে নাও। গিয়াস নাফিজার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড়িয়ে টেনে নিয়ে যায় মাটির ঘরের ভেতরে। চ্যাংদোলা করে শুইয়ে দেয় মেঝেয়। আবছা

আলো আঁধারিতে নাফিজা ড্যাম ড্যাম করে তাকায়, একটা রহস্যভরা হাসি তার পাতলা ঠোঁট নাড়িয়ে বেরিয়ে আসে, মাথায় খুন চড়েচে আগে বলবা তো! তারপর বিড়বিড়িয়ে বলল, খুন তো চড়ার কথা, কদিন ঘরে আসো নি বল তো? আমারও ভাল লাগে না ।

গিয়াস তার মুখে হাত চাপা দেয়, রাগে-উত্তেজনায় গরম বাষ্প বেরয় নাক-মুখ দিয়ে, নাফিজার ভরন্ত বুকের উপর ঝুঁকে হা করে দেখতে থাকে নাফিজাকে, মানুষ কত বদলে যায় গো। আজ শীতকাল তো পরশু বসন্তকাল। চোখের ছিমুতে কত কী যে দেখলাম। পুরুষের গাঢ় দীর্ঘশ্বাস নারীর বুক কাঁপিয়ে দেয় সহসা। শুধু বুক কাঁপে না, শরীরের জমিও কাঁপে। জোয়ার আসা খালের মতো নাফিজা ভিজিয়ে দিতে চায় গিয়াসকে। কাঁপা কাঁপা স্বরে সে আউড়ায়, গাছি জিরেনকাট রসের কারবারি। গাছে নলি না গুঁজে দিলে টাটকা রস যে ঠিলিতে পড়ে গাছের শরীল ভিজিয়ে দেবে।

সতর্ক গিয়াসের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়, বিড়ি ছোপ ধরা দাঁত দিয়ে সে ঠোঁট বুক থাই…. এমনকি সারা শরীর কামড়াতে থাকে জলাতঙ্ক রুগীর মতো। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা নদীর মতো বাক্যহীন পড়ে থাকে নাফিজা। দাঁড় বেয়ে জল কেটে শরীরের নদীতে নৌকো ভাসায় গিয়াস। নাফিজা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে খুঁড়ে দেয় ঘরের মাটি। হাত-পা এলিয়ে সে যখন কামারশালায় ক্লান্ত হাঁপর তখন গিয়াস তার ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল হাতের চেটোয় মুছে নিয়ে শুধায়, এট্টা সত্যি কথা বলবে, আমার কী নেই যা মকবুলের আচে?

আকাশ থেকে পড়ে নাফিজা। দম ধরে থাকে। কাপড় সরে যাওয়া পিঠের ঘামে বিশ্বাসের মাটি উঠে আসে। বিষণ্ণ ঝিঁঝি পোকার মতো সে বলল, সন্দেহ রোগটা একবার যদি মনে ঢোকে তাহলে হাজার কবিরাজেরও সাধ্যি নেই–সেই শেকড়কে তুলে হিঁচড়ে বের করে আনে। মনে যা এসেছে, তা ঠিক নয়। ওসব মুছে ফেল।

মন তো সিলেট নয় যে জল-তেলায় মুছে দেব। লাল চোখ মেলে তাকাল গিয়াস, গাঁ-ঘরের লোক যা বলে সব কি মিছা? আমার কাচা খোকাটার গায়ে হাত দিয়ে কিরা কাটো তো? অপ্রস্তুত নাফিজা দ্বিধা দ্বন্দ্বের মায়াবী পথে উদাসীন ঘোরে। কাঁচা খোকার মাথায় হাত দিয়ে কিরা’ কাটা কি ঠিক হবে। ছেলেটা জন্মাবার পর থেকে ভুগছে। একদিন ভালো থাকে তো দশ দিন ভোগে। হাতটা কাঁচা খোকার দিকে নিয়ে যেতে গেলে তীব্র গতিতে নাফিজার হাতটাকে সরিয়ে দেয় গিয়াস, দোজকের কীট, তা না হলে কেউ ঝুটমুট পেটে ধরা ছেলের মাথায় হাত দেয়। বুঝেছি, আমি সব বুঝেছি। তুমার সারা শরীলে যে মকবুলের ঘ্রাণ সেটা আমি আগেই টের পেয়েছি। আজ একেবারে নিশ্চিত হলাম।

নাফিজা ফুঁপিয়ে ওঠে।

গিয়াস একটা বিড়ি ধরিয়ে লুঙ্গিতে গিট মেরে বেরিয়ে আসে বাইরে, নিজেকে না শুধরালে মরবে গো। আমার কি! আমি তো তিনবার তালাক বলে দিয়ে পিছুপানে আর তাকাব না। নাফিজার কথা বলার ক্ষমতা নেই, সে শুকনো গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বেড়া থেকে সাইকেলটা টেনে নিয়ে গিয়াস ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে ধুলোর পথে নেমে আসে। ধুলোর ঝড় তার বুকের তুফানকে সামাল দিতে পারে না।

পেট-পাতলা নাফিজা ছেলে কাঁখে নিয়ে হাটের দিকে চলে যায় মকবুলকে খবর দিতে। ঘরের মানুষটা সব জেনে গিয়েছে, তাকে আর শরীরের নাড়ু দেখিয়ে ভুলিয়ে রাখা যাবে না। পাগলা ষাঁড় কখন যে কি করে বোঝা যায় না তো! চোট খাওয়া পুরুষ তো দাওলি দিয়ে কোপ মারা ষাঁড়ের মতো। মকবুলকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভীতু ডাহুকির মতো কেঁপে ওঠে নাফিজা, আমার বেপদ ঘটে গেছে গো! হাঁড়ি ফুটা করে সে ভাতে ধুলো মাখিয়ে চলে গেল গো। এখন আমার কি হবে?

কি আর হবে? মকবুল দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুমি যা চাও তাই হবে। যদি বলল-পাগলা যাঁড়কে খোয়াড়ে ঢোকাতে হবে–সেই ব্যবস্থাও আমি করে দেব। আমার সবরকম ওষুধ-মলম জানা আচে।

-যা ভালো বোঝ কর। নাফিজা আঁচলে চোখের জল মুছে নিল, আমি দুকুল চাই। আমি চাই–দুজন আমাকে বাঁধ দিক। সুখ দিক। ওর ভিটে ছেড়ে আমি কুতায় যাবো গো। সারা গাঁয়ে যে টি-টি পড়ে যাবে।

সে তুমাকে ভাবতে হবে না। আমি লোগ বুঝে ওষুধ দেব। মকবুল চুরুক দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসি ছুঁড়ে দিল নাফিজার দিকে, ঘর যাও। খাওয়া-দাওয়া কর। রাতে কবাটটা খুলে রেখো। আমি আসব। হিসাব যা হবার তখনই হবে। নাফিজার গালে টুসকি মেরে মকবুল সিগারেট ধরিয়ে চলে গেল।

রঘুনাথকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে এল শুভ আর সবুজ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পাশাপাশি হাঁটছিল ওরা। শুধু ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া এখন আর কিছু শোনা যায় না চরাচরে। হাসপাতালটাও ডুবে আছে অন্ধকারে, ওর আবছা চেহারাটা দূর থেকে শুধু অনুমান করা যায়। গ্রামের হাসপাতাল, রাত ন’টার পরে যেন আর বসতে পারে না, অপেক্ষায় ঝাঁপ বন্ধ করে তুলতে থাকে।

সবুজ বলল, মড়িঘরের রাস্তাটা ধরে গেলে ভালো হবে। বরাত ভালো থাকলে দু-চারটে গোলাপায়রা ধরা যাবে। এবছর তো আর ফিস্ট হল না!

-এখনও সময় পেরিয়ে যায় নি। শুভ অন্ধকারে সবুজের মুখের দিকে তাকাল, গোলা-পায়রা ধরতে পারলে ভালো হবে। কাল তাহলে তুই-আমি ফিস্ট করে খাবো।

মড়িঘরে জ্ঞানত কোনোদিন মড়া থেকেছে একথা মনে করতে পারল না শুভ। তবু ঐ ঘরটার দিকে তাকালে বুকটা কেমন ভয়ে মোচড় দিয়ে ওঠে। হাসপাতালের একেবারে শেষপ্রান্তে ঘরটার যে কী প্রয়োজন এখনও তা ভালোভাবে জানে না শুভ। তবে মড়িঘরের পেছনে ময়লা-আবর্জনা, নোংরা গজ-ব্যাণ্ডেজ তুলো ফেলে অবনী। ওগুলো যাতে হাওয়ায় উড়ে গিয়ে মাঠ নষ্ট না করে তার জন্য মাঝে মধ্যেই দেশলাই জ্বেলে আগুন ধরিয়ে দেয় সে। সেই বিষাক্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ধারে-কাছে কাউকেই যেতে দেয় না সে। পাশেই কোদাল দিয়ে গর্ত করেছে অবনী। পোড় ছাই সেই গর্তে ফেলে দিয়ে দায়িত্ব সারে সে। মড়িঘড়ের চারপাশটা ঘন জঙ্গলে ভরা। এখনও মাঝে মধ্যে গভীর রাতে শেয়ালের ডাক শোনা যায়, আর তখনি ভয়ে পাশ ফিরে শোয় শুভ। মনে মনে সে ভাবে মড়িঘরটা না থাকলে ভীষণ ভালো হত। ভয় বলে কোনো জিনিস থাকত না তার মনে। তবে একটা অসুবিধা হত। গোলাপায়রা কোথায় পেত তখন? পায়রাদের সাহস কি মানুষের চেয়ে বেশি? তা না হলে ওরা মড়িঘরে থাকতে ভয় পায় না কেন? ওরা দল বেঁধে থাকে–সেজন্যই বুঝি ভয়ডর ওদের শরীরে কম। তাছাড়া ওরা শুধুমুধু ভয় পাবে কেন, ওদের ডানায় তো আকাশ ছোঁয়ায় ক্ষমতা আছে। ভূত-পেত্নী যাই আসুক ওরা ডানা ঝাঁপটিয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে নিতে পারবে। মানুষের সেই ক্ষমতা কোথায়? শুভ ভাবল। সবুজ বলল, পায়রার মাংস কী ভীষণ লাল। একেবারে জবাফুলের মতো। সেবার অতসীপিসি মাংস বেঁধে দিয়েছিল। ভারী চমৎকার সেই রান্না। এখনও মনে পড়লে জিভে জল চলে আসে। ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল সবুজ, আজ যদি দুটো পায়রা ধরতে পারি তাহলে কাল সারা দিনটা আনন্দ করা যাবে। অতসীপিসির কি ডিউটি থাকবে কে জানে। মর্নিং ডিউটি থাকলে রান্না করে দেবার সময় পাবে না।

তারও উপায় আছে। শুভ হাসল, তখন রাতে পায়রার মাংস খাবো। তবে একটা কথা কি জানিস? পিসি পায়রার মাংস খায় না–সেইজন্য তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না।

এছাড়া আর উপায় কি বল? সবুজ কনুই দিয়ে ঠেলা মারল শুভকে, ফিসফিসিয়ে বলল, একটা ছোট টর্চ লাইট থাকলে ভালো হত। পায়রাগুলো লাইট ফেলে দেখে নেওয়া যেত। তখন আর অন্ধকারে পাগলের মতো হাতড়ে বেড়াতে হত না। সবুজ বলল, টর্চ যখন নেই তখন আর চিন্তা করে কী হবে? চল তো আগে চেষ্টা করি। ধরতে পারলে ভালো, না ধরতে পারলেও কোনো ক্ষতি নেই।

মড়িঘরের ঘুপচিগুলোয় বাসা বেঁধেছে পায়রা। ওরা সকাল-সন্ধেয় ওখানে বম বম সুর তোলে। তবে ওখানে যে সাপ থাকে এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। মড়িঘরের ফণা তোলা সাপের কথা সে বাবার কাছ থেকে শুনেছে। সেই গল্পকথা সবুজও জানে। ভয় যে করছে না তা নয়। তবু ভয়কে জয় করে এগোতে হয়। নাহলে শুধু হার-ই হার। কেন হারবে সে, কেন?

অন্ধকারে ডুবে আছে চারপাশ। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশবনের শনশন শব্দ। এই অন্ধকার বুঝি সব কিছু গিলে খাবে। ভয়ে ভয়ে ঢোঁক গিলে কাঠচোখে তাকিয়ে থাকল শুভ। রঘুর কাছে তার অনেক কিছু শেখার আছে।

মড়িঘর ছাড়িয়ে এলে ঘাসে ভরা মাঠ।

সবুজের মতিগতি বুঝতে পারল না শুভ। শুধু বিস্ময়ে মুখ ফাঁক করে বলল, পায়রা ধরবি না? তাহলে এত দূর যে এলি

–মন চাইছে না। চল ফিরি।

–তোর আবার কী হল? সবুজ শুধোল, ভয় করছে বুঝি? দুর, ভয় আবার কিসের! আমি ভূত-প্রেত মানি না।

-আমিও। কেমন আত্মপ্রত্যয়ী চোখে তাকাল শুভ। এক কঠিন প্রতিজ্ঞা তার চোখের তারায়। রঘুনাথকে মনে হল এই ঘাসে ভরা সহিষ্ণু মাঠ। অন্ধকার, আললা, ঝড়, বৃষ্টি, খরা-বন্যা… সব তার কাছে এক। এই ঘাসমাঠ বুঝি হারতে শেখেনি। আহা, সবাই মাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়, আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় ঘাসের সংসার।

কুচকুচে অন্ধকারে শুভ দেখল অদ্ভুত এক দৃশ্য। অন্ধকার ছাপিয়ে পাশাপাশি ফুটে থাকা ঘাসফুলগুলো হাসছে। ঘাসফুলের আলোয় আবার নতুন করে জেগে উঠছে পৃথিবী। চিকচিকিয়ে উঠছে শুভর চোখের তারা। ওই ফুলগুলোর মতো আলো ছড়িয়ে দিতে চায় সে, অন্ধকারে, টুটি টিপে সে প্রকাশ্যে বের করে আনতে চায় আলোর ভোর। ঘাসফুলের হাসি।

.

৩৮.

মানুষের স্বভাব হল নদীর মতো বদলে যাওয়া।

অবনী সরস্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবল কথাগুলো। খুব দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলেছে সরস্বতী। সে এখন বাবুদের বউগুলোর সঙ্গে নিজের তুলনা টেনে আনে। গাঁয়ের হংসী স্বভাব, লাজুক ভাবখানা তার মধ্যে এখন আর নেই। এখানে আসার পর অনেকটাই বদলে গেছে সে। সেই পাল্টে যাওয়াটা আজ বেশি করে চোখে পড়ছে অবনীর।

শুধু কি সরস্বতী বদলে গেছে, সে বদলায় নি? প্রশ্নটা মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। বামুনবুড়ির ছেলে বিমল ডাক্তার না থাকলে তার আজ এখানে আসা হত না। মানুষ বান-বন্যার জলের মতো। কোথাও এক ছটাক জল রেখে যায় কারোর জন্য। সেই জলটুকুই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কিংবা মমতা। কেউ তাকে যদি আশ্রয় বলে তাতে ভুল কি। যদিও ভুলে ভরা এই জীবন। তবু জীবন ঘুরঘুর করে ভুলের চারধারে। এক কাপ চায়ের আব্দার করা কি ভুল হয়েছে অবনীর? হাজারবার প্রশ্ন করেও বুঝতে পারে না সে। তবু দাঁত মুখ বিকৃত করে ঝাঁঝিয়ে ওঠে সরস্বতী, দুপুরবেলায় চা করে দিতে পারব না। চা খেতে মন চায় তো হাসপাতালের গেটে চলে যাও। এখনও দোকান খোলা আছে।

আশাহত অবনী নিরুত্তর চোখে তাকাল। এক কাপ চায়ের ভাগ্য করে সে আসেনি। সরস্বতীর কঠোর শাসন মাঝে মাঝে তার অসহ্য লাগে, তবু বোবা হয়ে থাকতে হয় নাহলে অশান্তির আগুন দাউদাউ জ্বলে উঠবে সংসারে। বোকার মতো দুদণ্ড সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে থেকে গা-হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল অবনী। শীতের বেলা ছাগল বাঁধার দড়ির চেয়েও ছোট হয়।

এ সময় হাওয়ায় থাকে ক্ষুর। সারা শরীর বাতাস চাটতে থাকে তার খসখসে জিভ দিয়ে। তেল না মাখলে গায়ের খড়ি ফোঁটা চিহ্নগুলো আর মুছতে চায় না। ঘর থেকে বেরিয়ে অবনী ভাবল শীতকালটা কেন আসে। ওটা না এলেই বুঝি ভালো হত। রোদ ঢালছে পৃথিবী তবু শীত হাওয়া এর মধ্যে চালের কাকরের মতো লুকিয়ে থাকে। চা দেয়নি বলে সরস্বতীর উপর রাগে গজগজ করে সে। বউটা নিজেকে যে কী ভাবে কে জানে। একটু দেখতে ভালো-এর জন্য দেমাকে বুঝি পা পড়ে না। হাসপাতালের অনেকেই চোখ নাচিয়ে বলে, অবনীর বউ ভাগ্য ভালো। তবে বউটা বড়ো মুখরা। ভালো কি মন্দ’ হাড়ে হাড়ে তা এখন টের পাচ্ছে অবনী। এর চাইতে বিয়ে না হলেই বুঝি ভালো হত। ভাগ্য চিরকাল তার সঙ্গে শত্রুতা করেছে। কখনও হাত ধরে বলেনি, মন খারাপ করো না, আমি তোমার সঙ্গে আছি।

কেউ সঙ্গে থাকে না, সঙ্গ ছেড়ে যায় পুরনো পলেস্তারা খসে যাওয়ার মতো। যে যেদিকে যায় যাক। আর কারোর কাছে হারবে না সে। প্রথমপক্ষ কুমকুম গত হল, সেই দুঃখ কি এখনও বুকে বেঁধে না তার! কদিনেরই বা জীবন তবু অনেক কিছু দিয়ে গেছে সে। তার ঋণ এ জীবনে শোধ করা যাবে না। দাউদপুরের কথা মনে পড়লেই কুমকুমের হাসি মুখটা মনে পড়বেই। মনের আর কী দোষ। মন তো হাওয়ার বেগে দৌড়োয়। সরস্বতী কি এসব অভিসন্ধির কথা টের পায়? কুমকুমের কথা সে বিয়ের পরে শুনেছে। সব জেনেশুনে বিয়ের পিড়িতে বসেছে সে। এখন পোকা চেবানোর মতো মুখ করলে কেউ তাকে সমবেদনা জানাতে আসবে না। বরং লোকে বলবে, সরস্বতী, তুমি ভাগ্যবতী। চাকরি করা বর পেয়েছ–এ যুগে কটা মেয়ের ভাগ্যে এমন সুখ জোটে বলো। ওর দিদিও সেই একই কথা বলে, দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নে, না হলে পরে কাঁদবি। সংসারে সঙ সাজ ক্ষতি নেই, কিন্তু সাজতে গিয়ে নিজের আসল রূপটাই ভুলে যাবি তা যেন না হয়। অবনীর মতো ছেলে হয় না, একথা আমি দশজনের মাঝে জোর গলায় বলতে পারি। তুই ঠকে যাসনি, তোর জিতই হয়েছে।

হার-জিত বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল সুখ।

অবনীর খাঁকি প্যান্টের ফুপি বেরনো সুতোগুলো উড়ছে শীতের হাওয়ায। এক কাপ চা না পাওয়ার দুঃখ ভীষণভাবে বুকে বিঁধছে। কী এমন রাজকাজে ব্যস্ত ছিল যারজন্য এক কাপ চা করে দেওয়া যেত না। আসলে সরস্বতী ভালোবাসে না তাকে। অবজ্ঞা, অবহেলা যতদিন যাচ্ছে গাঢ় হচ্ছে তার মনে। ঘা-মন নিয়ে অবনী একা একা আর কত পথ হাঁটবে। এ জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে তার। মাঝে মধ্যে মনে হয় সংসার ছেড়ে দিয়ে কোথাও চলে যেতে। তখন সরস্বতী বুঝবে কত ধানে কত চাল হয়।

হাসপাতালের মাঠে দল বেঁধে চরছিল গোর। প্রতি বছর শীতের সময় মাঠের ঘাস বিক্রি করে দেন ডাক্তারবাবু। গোরু চরানোর জন্য এত বড়ো সবুজ মাঠ আর এ গাঁয়ে কোথাও নেই। এবারের ঘাসমাঠ কিনে নিয়েছে পাল-কোম্পানীর মালিক, ওদের হড়েগড়ে খানত্রিশেক গোরু।

খুব দ্রুত অবনী হাসপাতালের মাঠ পেরিয়ে এল। রাগ কেটে কুচিকুচি করতে চাইছে মনের মাংস। চোখের সাদা জমি লাল হয়ে উঠছে উত্তেজনায়। ফলে ঘামের বিন্দুগুলো মাছের ডিমের চেয়ে বড়ো হয়ে মিহিদানার মতো ফুটে উঠছে শরীরে। তার কেন এমন হয়? কেন সে মানিয়ে নিতে পারছে না সরস্বতীকে? এক হাতে কি তালি বাজে? কখনও নয়। দোষী তাহলে সে একা নয়? ঝগড়ার কলকাঠি নাড়ছে বউটা। বিয়ের পর থেকে একদিনও সে ভালোভাবে কথা বলেনি। তার প্রতিটি শব্দে থাকে কাঠ-পিঁপড়ের জ্বলন। বিষমাখা দৃষ্টিতে থাকে বর্শার খোঁচা। এত সব অগ্রাহ্য করে জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়া বড়ো কষ্টের। এই কষ্টের কথা কি কোনোদিনও বুঝবে সরস্বতী? তাহলে কি চায় সে? ভাবতে ভাবতে হাঁপিয়ে ওঠে অবনী।

এ যেন এক কঠিন অঙ্ক। কিছুতেই উত্তর মিলতে চায় না। ঝুরঝুর করে ঝরে যাচ্ছে বিশ্বাসের মাটি। রগরগে বালি আঁকড়ে জীবনযাপনের চাষ-আবাদ হবে কী ভাবে। এক সময় অবনীর মনে হয় এই চেনা মাঠ মাটি গাছপালা কোনোকিছুই তার নিজের নয়। এমন কি শুভ সরস্বতী কেউ নয়।

লম্বা লম্বা পা ফেলে সে যেন পালিয়ে আসতে চাইল তার চেনা পৃথিবী ছেড়ে। চা-দোকানের কানু তার ঘাবড়ে যাওয়া চোখ-মুখ দেখে বলল, অবনীদা বসো। কোথা থেকে এলে গো? মনে হচ্ছে খুব চিন্তায় আছে।

অবনী কিছু না বলে নিরুত্তাপ চোখে তাকাল। হাঁপিয়ে ওঠা শরীরটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে, এ পৃথিবীটা বড়ো কঠিন জায়গা ভাই। গায়ের রক্ত দিলেও কারোর তুমি মন পাবে না।

-তা যা বলেচ। কানু মন বোঝার চেষ্টা করল অবনীর, চা বানাই।

–হ্যাঁ, কড়া করে বানাও।

টাটকা পাউরুটি আছে। সেঁকে দেব?

খিদেটা অনেকক্ষণ ধরে জানান দিচ্ছিল পেটে, অবনী ঘাড় নাড়তেই গোটা পাউরুটি আধফালা করে সেঁকতে বসে গেল কানু। সামান্য জিরিয়ে নিয়ে একটা বিড়ি ধরাল অবনী। ফসফস করে ধোঁয়া ছেড়ে সে ভাবল, আজ আর ঘরে ফিরে যাবে না। যে ঘরে কোনো টান নেই সে ঘর তো শুধু চুন-সুরকির ঘর। ছাদ একটা। মন হাজারটা। এরকম তো চলতে পারে না। যা হবার আজ ফায়সাল্লা হয়ে যাক।

বিড়িটা যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল।

হতাশ গলায় অবনী বলল, চা-টা তাড়াতাড়ি দাও। বাজারের দিকে যাব ভাবছি। অনেক কাজ পড়ে আছে।

কানু কাচের গ্লাসে তাড়াতাড়ি চামচ দিয়ে চিনি গুলে কড়া লিকার দিয়ে ধরিয়ে দিল অবনীর হাতে, নাও অবনীদা, দেখ সব ঠিকঠাক আছে কিনা!

গ্লাসে চুমুক দিয়ে অবনী বলল, পাউরুটি দাও। চায়ে ডুবিয়ে খাই। আজ যে কখন ভাত জুটবে কে জানে!

কোনোদিনও সময়মতো ভাত জোটে না অবনীর। প্রতিদিন কোনো না কোনো অশান্তি তার নাওয়া-খাওয়া ভেস্তে দেয়। বিষণ্ণ মনে সে তখন পাগলের মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। কোনোকিছু ভালো লাগে না। ভালো কথাও তেতো মনে হয়।

চা-পাউরুটির দাম মিটিয়ে অবনী আর সময় ব্যয় করল না। আজ সরস্বতীকে উচিত শিক্ষা দেবে। রোজকার ঝামেলা আজ সে মিটিয়ে নেবে। যদি না পারে সিধা চলে যাবে রঘুনাথদের দোরে। ওখানে দিনদুয়েক কাটিয়ে সে অন্য কোথাও চলে যাবে।

পাকা রাস্তায় উঠে এসে অবনী একবার বাজারের দিকে তাকাল। ভরা দুপুর খাঁ-খাঁ করে গরম শ্বাস ছাড়ছে। এসময় শুভ কোথায় আছে ভাববার চেষ্টা করল সে। পরপর তিন দিন তার স্কুল ছুটি। ছেলেটা এখন তিন দিনের রাজা। এই মায়ের জন্য একসময় সে কান্নাকাটি করত। মায়ের কথা ভেবে-ভেবে বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। ওর মামা গড়ার একদম মত ছিল না শুভ নদীয়ায় যাক। সেই মতো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল তাকে। কিন্তু শুভই বাধ সাধল এ সবে। তেলবুড়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, যার ছেলে তার কাছে দিয়ে আয়। এক গাছের ছাল আরেক গাছে লাগে না।

কথাটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি পার্বতী। শুভ আর কেতোর মধ্যে সে কোনো ফারাক দেখে না। তবু একরকম বাধ্য হয়ে সেজ-কর্তাকে চিঠি লিখতে হয়েছিল তাকে। চিঠি পেয়েই দেশ গিয়েছিল অবনী। সরস্বতীই তাকে জোর করে পাঠাল।

-আমি জানতাম ও ছেলে থাকবার নয়। দেখতে হবে তো কার ছেলে?

খোঁচাটা অবনীকে উদ্দেশ্য করে। এ কথায় ঝগড়া বাঁধতে পারত, আগুন জ্বলতে পারত তবু অবনী সব কিছুকে নিভিয়ে দিয়েছে তার সহজাত সহ্য ক্ষমতায়। নিজের ছেলেকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করা ভালো। দুরে থাকলে হাজার চিন্তার ডালপালা ক্ষত-বিক্ষত করে সহজ-সরল মন।

অবনীর সঙ্গে কেতোও এল ক’দিন। আসার পর থেকে ছেলেটা শুধু ভুগছে। জল-হাওয়ার পরিবর্তন মানিয়ে নিতে পারছে না। মানিয়ে নিতে সময় লাগে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ছেলেটাকে খুব সাবধানে রেখো অবনী। জ্বর হলে ওর আর ছাড়তেই চায় না।

সরস্বতীও নিজের কানে শুনেছে সব। অবনীর উপর বিরক্ত হয়ে বলেছে, ছেলে যা বলবে তাই এনে দেবে! গোছ গোছ বরফ খেলে জ্বর না হয়ে যাবে কোথায়? এখানকার জল-বাতাস নতুন। চোখে চোখে না রাখলে বিপদ ঘটে যেতে কতক্ষণ।

শুভ একটু চঞ্চল প্রকৃতির। দামাল ছেলেকে সামলে রাখা সহজ নয়। এ বয়সে সব ছেলেরাই দুরন্ত হয়। এটাই স্বাভাবিক। ৩৪ সরস্বতী তার দোষ ধরবেই। কাঠগোড়ায় দাঁড় করাতে পারলে তার যে তৃপ্তি হয় তা বুঝি অন্য আর কোনো কিছুতে খুঁজে পায় না সে।

রাগে চিনচিন করে অবনীর শরীর। কিছুতেই নিজেকে সে ঝতে পারে না তার দোষটা কোথায়। দোষ যাই হোক, সরস্বতী তাকে উসকে দেবার জন্য মুখি আছে। এটা তার কেমন বিচার কিছুতেই বুঝতে পারে না এবনী। রাগে উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে অবনীর, কানের গহ্বরে অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছে শিস-হাওয়া। খেজুরগাছের কাটা যেন বিধছে . .র ভেতর। কই এত যন্ত্রণা তো আগে ছিল না। আগে অভাব ছিল কিন্তু সামান্য হলেও শান্তি স্থল। এখন চষা জমির মতো এবড়ো-খেবড়ো মন দুজনার। যেন শত্রুশিবির, শত্রুপক্ষ। কাল নাইট ডিউটিটা ভালো যায়নি। বি-খাওয়া রোগী এসেছিল। বউয়ের উপর রাগ করে ব্যাটাছেলেটা পাটে দেওয়ার বিষ খেয়েছে। সাত তাড়াতাড়ি পাইপ ঢুকিয়ে বমি করাতে না পারলে লোকটা বাঁচত না। ঘরের সব লোক এসেছে হাসপাতালে কিন্তু যার আসার কথা সে আসেনি। বউটা গুম ধরে পড়ে আছে। ঘরে। সে কি ভাবছিল তা যেন স্পষ্ট অনুমান করতে পারে অবনী। বউটা কি তার স্বামীর মৃত্যু প্রার্থনা করেছে? সে কি মনে মনে কামনা করেছে লোকটা যেন আর ঘরে না ফিরে আসুক। সে শাঁখা ভেঙে, সিঁদুর তুলে বিধবা হয়ে বাঁচবে। একা বাঁচায় কি সুখ অনেক?

এসব ভাবনার সঠিক কোনো উত্তর অবনীর জানা নেই। সারা রাত ধরে যমে-মানুষের টানাটানিতে লোকটা শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল। ধাতস্থ হতেই তাকে শুধিয়েছিল অবনী, মরতে যদি মন চায় তাহলে কড়া বিষতেল খেলে না কেন? এমন বিষ খেয়েছে যাতে নিজের কষ্ট আরও দ্বিগুণ হল। তোমার মতো বোকা মানুষ আমি আর দুটি দেখিনি। ডলি দিদিমণি কত বোঝাচ্ছিলেন লোকটাকে, সব কথা হয়ত বুঝতে পারেনি সে, তবু যে কটা শব্দ তার কানে গিয়েছিল তাতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল লোকটা, দিদিমণি গো, আমার বউ চায় না আমি বাঁচি।

বেঁচে গেলে, এবার কি হবে? দিদিমণির চোখের বিস্ময় জোড়া ঠোঁটে, মরে যাওয়া সহজ, কিন্তু সংঘর্ষ করে বেঁচে থাকা কঠিন।

আমি যে বউয়ের বিষকথা সহ্য করতে পারিনে। ও আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। কঁকড়াবিছার বিষে আমি পুড়ি গো। তখন আর বাঁচতে মন চায় না, মনে হয় মরে যাই।

বিষ খাওয়া রোগী এলে রাতভর দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না অবনী। অন-ডিউটি দিদিমণিরও তাই অবস্থা। ওই অত রাতে কল-বুক পাঠিয়ে ডাক্তারবাবুকে কোয়ার্টার থেকে ডেকে আনতে হয় অবনীকে। সেরকম সিরিয়াস হলে খবর পাঠাতে হয় থানায়। পুলিশ আসে। চলে তদন্তের কাজ। মাঝরাত হয়ে ওঠে কোর্টচত্বর।

কাল রাতে এত সব হ্যাঁপায় যাননি ডাক্তারবাবু।

 রুগীর চোখ দেখে বলেছিলেন, এখন থানায় মেমো দেওয়ার দরকার নেই। দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়। আমার মন বলছে ট্রিটমেন্টে সাড়া দেবে। এখনও চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়নি। নানান কাজের ফাঁক-ফোকরে একটুও দম নেবার ফুরসত পায়নি অবনী। যে রাতটা খারাপ যায় তার পরের দিনটাও ভালো যায় না। সকালে ঘরে কিছু কাজ থাকে। সেগুলো তাকে করতেই হয়। তার কাজ অন্য কারোর দ্বারা হবার নয়। সংসারের জন্য এত করেও তার কোনো নাম নেই। শুধু ওই একজন মহিলা, যাকে সে সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তুলেছিল বউ হিসাবে, তার কাছে হেরে যেতে বাস্তবিক কষ্ট হয়। এ যে কী কষ্ট তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

অনেকক্ষণ পরে চড়া রোদে অবনীর বুকের ভেতরটা ডুকরে উঠল। কপাল ভিজিয়ে ঘাম নামছিল দ্রুত। আর তাতেই অস্বস্তি বাড়ছিল অবনীর। মাথা হেঁট করে সে কদমগাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল। হলুদ পাতা ছড়িয়ে আছে কদমতলায়, হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছে সেই পাতা যেন কোনো হলুদ মাছ ডাঙায় লাফিয়ে পড়ে ছড়ছড় করছে। টালি কারখানার পোড়ের কাঠ ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। একটা বড়ো গাছের কাটা গুঁড়ির উপর গিয়ে বসল অবনী। এখান থেকে। হাসপাতালের মাঠ, কোয়ার্টার, মড়ার-ঘর সব দেখা যায়। এখানে বসে থাকা নিরাপদ নয় ভাবল সে। কেন না সরস্বতীর কানে সংবাদটা কেউ পৌঁছে দিলে মায়ের হাত ধরে শুভ এখানে আসবেই। আসবে। সরস্বতী রাগের ঘোরে কারোর কথা শুনবে না। গলা ফাড়িয়ে গালমন্দ করবে, প্রয়োজন হলে সে ডাক্তারবাবুর বাসায় গিয়ে নালিশ জানিয়ে আসবে অবনীর নামে।

ঘাম শুকিয়ে আর সময় ব্যয় করল না অবনী। তবে সে বাজারের দিকে গেল না এত বেলায়। পাল-পুকুরের পাড় ধরে সে চলে গেল সোজা দাসপাড়ায়। এমন হতছিন্ন জনবসতি যা দেখে। প্রতিবারই মন খারাপ হয়ে যায় অবনীর। দাসপাড়ায় এসে তার নিজের গ্রাম নানকাহাতিদার কথা মনে পড়ে। রাজ্যের অভাব বুঝি তাদের ছোট্ট গ্রামটাতে। বর্ষার সময় পুরুষমানুষরা মুনিষ খাটতে যায়। অন্যসময় হাতে কাজ থাকে না, অভাব খুবলে খায় বেকার মন। সময় আর পেরতে চায় না, কঠিন পাথরের মতো চেপে বসে বুকের উপর। চেনা মানুষগুলোর মুখ মনে পড়ে অবনীর। বিশেষ করে ব্যাঙা আর সঁপড়ির কথা সে ভুলতে পারে না। ওদের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু তার মতো সামান্য মানুষের কী বা করার আছে অন্যের জন্য। তবু সে ডাক্তারবাবুকে বলেছে হাসপাতালে ব্যাঙার একটা চাকরি করিয়ে দেবার জন্য। ডাক্তারবাবু মুচকি হেসেছেন। অবনীর সরলতা মুগ্ধ করেছে তাকে।

পাল পুকুরের পাড় ছাড়িয়ে এলে শুরু হয় ঘন বাঁশবন। এত ঠাসাঠাসি বাঁশগাছ যে রোদ ঢোকে কম। আগে প্রায় বিকালে ডাহুক মারতে আসত শুভ, তার হাতে থাকত চামগুলতি আর পকেটভর্তি পোড়ান ভেঁটুল। ওর হাতে এম আছে। প্রায়ই এটা সেটা মেরে আনে।

দুপুরের আলোয় একটা মোহনী মনোমুগ্ধকর লুকোচুরি খেলা চলে প্রকৃতিতে। সেই আমেজটুকু ধরার চেষ্টায় ছিল অবনী। কিন্তু ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে সে হতাশ চোখে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকাল। এত আলোেছায়ার খেলা এ তল্লাটে আর কোথাও নেই। দুপুরবেলায় বাঁশঝাড় যেন বিছানা পেতে রাখে ঘুমানোর জন্য। অনেকদিন পরে অবনীর বামুনবুড়ির কথা মনে পড়ল। তার স্নেহ যেন বাঁশতলার ছায়া। অথচ সরস্বতী বামুনবুড়িকে সহ্য করতে পারে না, দাঁত বের করে বলে, ভারি তো একটা চাকরি করে দিয়েছে তার জন্য অত! তোমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে। ও নিয়ে অত ভেবে মাথা ফাটিয়ে কি লাভ? যার কাজ সে করে এতে আবার বাহাদুরি কী!

কথা বাড়ায় না অবনী। কথা তো আগুনের হলকা। পুড়ে যাবে, ছারখার হয়ে যাবে। তাই বোবার শত্রু নেই। মুখে তার কুলুপ আঁটা। হাঁটতে হাঁটতে ঢেলায় হোঁচট খায় অবনী। আর একটু জোরে লাগলে বুড়ো আঙুলের ডগা ফেটে রক্ত ঝরত। এখন নীলচে হয়ে আছে জায়গাটা। বেশ টন টন করছে ব্যথায়। রক্ত জমে গেলে অমন হয়। ঠাণ্ডা জল দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু ঠাণ্ডা জল পাবে কোথায়? পুকুরের জল তেতে আছে রোদে। পুকুরের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই, তার চেয়ে পদ্মর কাছে যাওয়া ঢের ভালো। পদ্ম নামটায় বুঝি সুবাস ছড়িয়ে যায়, পাখনা নাড়িয়ে উড়ে আসে মৌমাছি। অবনীর চোখে বাড়তি একটা রঙ ধরে। নিজেকে সে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। তার যে এত দুঃখ আছে ভুলে যায় নিমেষে। পুরনো সব জ্বালা-যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে সে নতুন অবনী হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। সময় তো সব কিছু বদলে দেয়। মাত্র ক’বছরে কত কি পাল্টে গেল। আগে সে ধুতি ছাড়া পরত না। এখন খাকী প্যান্ট পরা একজন মানুষ। যার মাথায় কোঁকড়া চুল, হাসি ভরা মুখ। অদ্ভুত এক ছেলেমানুষী সারল্য। এই সারল্যটুকুই তার সম্পদ, মাধুর্য।

কঞ্চির বেড়া ঘেরা বাগানটা পেরিয়ে এলেই পদ্মর খড়ের ঘরখানা চোখে পড়ে। চালের উপর একটা কাক ডাকছে কা-কা। বড়ো বিশ্রী সেই আওয়াজ। একেবারে বিষিয়ে দিচ্ছে দুপুরের সরপড়া শান্ত পরিবেশ। আর থাকতে পারে না অবনী। রাগে গা রি-রি করে। পায়ের কাছ থেকে একটা মাটির ঢেলা তুলে নিয়ে তাক করে মারে কাক-এর উদ্দেশ্যে। এলোমেলো ঢিল খড়ের চাল ছাড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে বহুদুরে। ঢিল গুঁড়ো হয়ে ধুলো উড়ছে। ওগুলো যেন ধুলো নয়, অবনীর হতাশা। আজ অব্দি কোনো কাজে সে সফল হল না। সব কাজে পিছু টান, হেরে যাওয়া।

পদ্ম খুঁটিবাঁশ ধরে খিলখিল করে হাসছে তাকে দেখে। হাসি নয় তো যেন জুইফুল ফুটেছে জ্যোৎস্নারাতে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সুগন্ধ। চোখ ভরে এ দৃশ্য দেখতে থাকে অবনী। দেখতে দেখতে সে ভাবে পদ্ম নয়-খুঁটি বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সরস্বতী। ঠোঁট নাড়িয়ে আদর করে বলছে, আসো, অনেকদিন পরে এলে! রোদ মাথায় এলে যে-বসো, বসো। কসার গ্লাসে জল এগিয়ে দেয় পদ্ম। মেঝেয় হা করে তাকিয়ে বসে আছে তার পাঁচ বছরের ছেলে রকেট। সারা গায়ে ছোপ ছোপ ময়লা। গায়ে কোন জামা নেই। এমন কি উদোম পেছন।

এদিকে কোনো খেয়াল নেই পদ্মর। সে পেটের ভাতের যোগাড় নিয়ে ব্যস্ত। না খাটলে চলবে কি করে? কেউ তো তার চাঁদমুখ দেখে পয়সা দেবে না। স্বামী খেদিয়ে দিয়েছে ঘর থেকে, নিজের দাদা-বৌদিরাও দেখে না, এ অবস্থায় তার চলবে কি করে? একার পেট তো নয় যে চালিয়ে নেবে। দু-দুটো পেট ভরানো কি মুখের কথা! পদ্ম ঘামছিল। ওর ড্যামা-ড্যামা চোখে বিস্ময়। হা-করে দেখছে অবনীকে। মনে মনে কি ভাবছে তা নিজেই জানে। দেশী মদ বেচতে গিয়ে তার আবার নেশা হল না তো! ঘোর কাটাতে ছেলের হাত ধরে বলল, যা কলপাড় থেকে চান করে আয়। আমি তোকে ভিজে ভাত আর পেঁয়াজ কেটে দেব।

ছেলেটা কি বুঝল খুশি হয়ে চলে গেল টিউবকলটার দিকে। কেউ না কেউ পাম্প করে দেবে জল। আহা, ছোটছেলে বলে কথা। পদ্মর সেসবে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সামান্য গলা চড়িয়ে সে বলল, দাঁড়িয়ে থাকবে, বসবে না চাকুরিয়া?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসব। বসার জন্য তো এসেছি। অবনী ঘোর কাটিয়ে বাঁশবাতার বেঞ্চিটায় গিয়ে বসল, পা নাচাতে নাচাতে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল সে, এদিকটায় অনেকদিন আসিনি। আজ যখন এসেছি, ভালো করে দাও, খাই

-খাবে? কাকে?

যেন হুঁশ ফিরল অবনীর, ভুল শুধরে বলল, প্রথমে এক গ্লাস। পরে পারলে আরো খাবো। আজ খাওয়ার মন নিয়ে এসেছি।

সে তো ভালো কথা। পদ্ম চোখ নাচিয়ে নদী হয়ে গেল, ভেসে যাবে, সাঁতার জানো তো? বৌদি যদি টের পায়, তাহলে তোমাকে আর ঘরে ঢুকতে দেবে না।

আমি আর ওসব নিয়ে ভাবি না। অবনী অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, ঘর কাকে বলে জানো? ঘর না তো কবর। সারাদিন খালি ঘ্যানর ঘ্যানর, আমি আর পারি না। এর চেয়ে কাঁটার বনে। বাস করা ঢের ভালো।

বৌদি জানতে পারলে রাগ করবে। পদ্মর ভাটা পড়া গলা। তেতে উঠছে অবনী, কেউ রাগ করলে আমার করার কি আছে? যেমন কর্ম তেমন ফল। দাও দেরি করিয়ে দিও না।

পদ্ম গ্লাসে দেশী মদ ঢালে, নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে অবনী। পৃথিবীতে এমন সুখের দৃশ্য বুঝি ম দেখা যায়। এমন সুন্দর মেয়েমানুষটাকে কী ভাবে খেদিয়ে দিল তার বর? সে কি মানুষ না পশু? তার কি চোখ নেই, মন নেই? শরীরে কোনো তাপ নেই? পদ্মর কালোজাম চোখের তারায় ফঁদে লটকান ঘুঘু পাখির মতো ছটফট করতে থাকে অবনী। সে আর তাকাতে পারছে না, বুজে আসছে চোখ। পদ্মর ঠোঁটে লেপটে থাকা মিহি হাসি ধার চাকুর মতো কাটছে তার মন। আজ কি হল? কেন এই দুর্বলতা, বাঁধ ছাপানো আবেগ। এ সবের জন্য দায়ী সরস্বতী। একটা দিনের জন্য তাকে ভালোবাসা দিল না। শুধু ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারল শক্ত কথার ইট-পাথর।

কাচের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আনমনা হয়ে গেল অবনী। পদ্মকে প্রথম কোথায় দেখেছিল মনে করার চেষ্টা করল সে। হাসপাতালই তার বৃন্দাবন। ভিড়ের মাঝে পদ্মকে দেখে তার চোখ ফসকে যায় নি। আউটডোরে শ্লিপ হাতে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল পদ্ম। অবনী আগ বাড়িয়ে বলল, ওষুধ নেবে? পদ্মর হাত থেকে ডাক্তারবাবুর লেখা শ্লিপটা কেড়ে নিয়ে সে এগিয়ে গিয়েছিল ওষুধ আনার জন্য।

একথা সে কথায় ভাব আলাপ। ঘনিষ্ঠতা।

–কোথায় থাকো?

দাসপাড়ায়।

–তোমার ঘরের মানুষ? অবনীর প্রশ্নে হা-করে তাকিয়েছিল পদ্ম।

–সে নেই। মরেচে। কথাগুলো শেষ না হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল পদ্ম।

ছিঃ, তার সিঁদুর পরে অমন কথা বলতে নেই। অবনীর গলা বুজে এসেছিল, তোমার অনেক দুঃখ আছে। দুঃখকে সামলে রাখতে হয় নাহলে দুঃখরা ডিম ফুটে আরো দুঃখের জন্ম দেয়। আমার কথাটা মনে রেখো।

–আমি নিজেই দুঃখের পুকুর। পানসে হাসিতে পদ্মর ঠোঁট নড়ে উঠল।

–আমিও। অবনী মন খারাপ করা চোখে তাকাল।

-কেন, তুমি তো চাকুরিয়া, মাস গেলে মাহিনা পাও, তোমার আবার দুঃখ কিসের? পদ্মর প্রশ্নে চালাকি ছিল না, ছিল সমবেদনা।

সেই প্রথম আলাপ। তারপর এখানে সেখানে দেখা হত পদ্মর সাথে। রোদের মতো ওর চেহারার আকর্ষণ। সময়ের সাথে সাথে বদলায়। এই চড়া, এই কড়া, আবার কখনও মিয়ানো।

একদিন পদ্ম কোয়ার্টারে এল ঝুড়ি মাথায়। ঝুড়িতে পাকা কলা। কাতর হয়ে বলল, সারাদিন ঘুরে ঘুরে হাঁপিয়ে গেলাম তবু কাজের কাজ কিছু হল না। কলাগুলো রাখো গো, কম করে দেব।

–এত কলা নিয়ে কী করব? পচে যাবে যে!

–পচার আগে খেয়ে নিও।

তার আদিখ্যেতা ভালো চোখে দেখেনি সরস্বতী। কলাগুলো কিনে নিয়ে বিদেয় করেছিল তাকে। পদ্মর ছায়া সরে যেতেই সরস্বতী মুখ ঝামটে বলেছিল, মেয়ে দেখলে লুলিয়ে ওঠো দেখছি। খবরদার ওই বউটার সাথে যদি কথা বলেছ–তোমার চোখ আমি গেলে দেব। মনে থাকে যেন কথাটা।

-কথা বললে কি মানুষ খারাপ হয়ে যায়?

–সে আমি জানি নে। তবে তুমি ওর সাথে কথা বলবে না। সরস্বতীর গলা শক্ত হয়ে এল, বউটার স্বভাব ভালো নয় দেখে মনে হচ্ছে। ভাতার খেদানো মেয়েমানুষ আর কত ভালো হবে। দেখছিলে না চোখ দুটোতে খালি খাই খাই ভাব।

হাসপাতাল চত্বরে পদ্ম এলেই সতর্ক হয়ে যেত সরস্বতী। তার চিল-নজর পরিমাপ করতে চাইত কাল্পনিক এক সম্পর্কের গভীরতা। ভুল ভেঙে যেত তার। অবনী ওসবের সাতযোজন দূরে। কারোর চোখের দিকে তাকিয়ে তার কথা বলার সাহস নেই। এমন ভীতু মানুষ সম্পর্কের সেতু গড়বে। আপনমনে হেসে উঠেছে সরস্বতী। বোকা, বোকার হদ্দ!

এক গ্লাস পেটে পড়তেই অবনী আচমকাই চেপে ধরল পদ্মর নরম হাত, গলা বুজে এল কথা বলতে গিয়ে, তোমার কাছে এসেছি অনেক দুঃখ নিয়ে। গত-জন্মে তুমি আমার কেউ ছিলে গো! বোঝাতে পারব না, তোমার জন্য আমার কেন কষ্ট হয়। সেই প্রথম যেদিন দেখলাম, সেদিন থেকে। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারে না পদ্ম। অবনীর দু-চোখ বেয়ে টসটসিয়ে জল ঝরছে। এই অশ্রদানার নাম বুঝি ভালোবাসা। পদ্মর বুকটা চিতল মাছের পাখনার মতো থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। ঘামছে সে। শরীর বুঝি দিঘি হয়ে যাবে ঘামে-ঘামে। এই স্পর্শ, উষ্ণতা সেও তো জীবনে পায়নি। এই প্রথম সে বুঝতে পারে-তারও কারোর জন্য বেঁচে থাকার দরকার আছে। পরপর তিন গ্লাস মদ টেনে ধুলো পথে শুয়ে পড়েছে অবনী। এমন বেহেড মাতাল এর আগে সে হয় নি। আজ যেন সব ছাপিয়ে গিয়েছে। আজ যেন ভেঙে গেছে জগৎখালির বাঁধ। হু-হু করে ঢুকছে ঘোলা জল। বিড়বিড় করে সে বলছে, কেউ ভালোবাসেনি আমাকে। শুধু ঘেন্না করেছে। ভেবেছে-আমি একটা কুকুর। আমার মন নেই, দুঃখ নেই। কিসসু নেই। কিসসু নেই যখন, তখন এ দুনিয়ায় আমার কোনো দরকার নেই।

-তুমি চুপ করো, চাকুরিয়া। পদ্ম তার মাথার কাছে গিয়ে বসল।

–আমার ঘুম পাচ্ছে। তোমার মদে কি ঘুমের বড়ি মেশানো ছিল, নাকি তুমিই নিজে ঘুমের বড়ি?

পদ্ম ধমক দিতে পারে না, শুধু বলে, চুপ করো।

ভারী পুরুষ-শরীরটাকে সে কোনোমতে শুইয়ে দেয় চাটাই পেতে রাখা তক্তপোষে। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে থরথরিয়ে, একটা অজানা ভয় বুকের ভেতর শুরু করে হামা দিতে। চাকুরিয়া তার কাছে কেন আসে, কি চায় সে? পদ্মর কি ক্ষমতা আছে তাকে সব দেওয়ার। অথচ ধরা দিতে মন চায়। এক পা এগোতে গেলে শ’ পা পিছিয়ে আসে কেন? এ কেমন অসুখ। বুকের ভেতর খলখল করে কান্না। কথা আটকে যায় গলায়। কোনোমতে উবু হয়ে সে তার মুখটা নামিয়ে নিয়ে যায় অবনীর বুকের কাছে। হাতটা বুকের কাছে রাখতেই চমকে ওঠে অবনী। এ কার ছোঁয়া, এত শিহরণময়? সরস্বতীর ঘৃণা আজ পদ্মর ছোঁয়ায় ভালোবাসা হয়ে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। আঃ; কী শান্তি! অবনীর মনে হয় সে মরে যাবে আনন্দে। নেশা করলে এত আনন্দ হয়-কই আগে তো সে টের পায়নি। গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে বাতাসে। অবনী হাতবাড়িয়ে পদ্মকে ফুলের ডাল নামানোর মতো নামিয়ে আনে বুকের উপর। পদ্ম কুঁকড়ে গিয়ে সরে যায়, যেন তার মনে কুঠ ফুটেছে, এই মন দিয়ে কাউকে ছুঁতে নেই। ছুঁলেই বাঁধ ভেঙে যাবে। পাপের না প্রেমের না পরাজয়ের?

.

৩৯.

শীতের বেলা তাড়াতাড়ি ফুরোয়।

খিদেয় আনচান করছিল সরস্বতীর শরীর। নদীয়ায় এসে তার মনোকষ্ট আরও বেড়েছে। তবে হারবে না সে, হারতে শেখেনি। মানুষটা ভেবেছে’টা কি? বোবা হয়ে ঘুরবে সারাদিন। শুধু ডিউটিটুকু ছাড়া সে আর কি করে? দিদিমনির বাসায় বসে চা খায় কুঁড়ের মতো। এর-ওর ফাইফরমাস খাটে। বিরক্তিতে শরীর জ্বলে সরস্বতীর। গাঁয়ে থাকতে বামুনড়ির পেছন ছাড়ত না সে। বাইরে এসে সে-স্বভাব আর গেল না। না যাক। এতে সরস্বতীর কোনো কিছু আসে যায় না। সে ভেবে রেখেছে এবার দেশ-গাঁয়ে গিয়ে আর ফিরে আসবে না। কেন আসবে? দুবেলা, দুমুঠো খাওয়ার জন্য কি জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখা। এর বাইরে বুঝি জীবনটার কোনো আলাদা মানে নেই? সরস্বতী ঘেমে উঠছিল, টনটন করছিল তার কপালের শিরা।

সেই কখন বাবার খোঁজে ঘর ছেড়েছিল শুভ। ঘণ্টা দেড়েক পার করে ফিরে এল শূন্য মনে। বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ে বলল, বাবাকে কোথাও দেখতে পেলাম না মা। মনে হচ্ছে বাবা শেরপুরের দিকে চলে গেছে। হলদিপোঁতা ধাওড়া যেতে তার ভালো লাগে। আমি কি একবার রঘুদের ঘর থেকে ঘুরে আসব?

-ওখানে কি ওর বাপ-ঠাকুরদা থাকে? চকিতে ঝাঁঝিয়ে উঠল স্বরস্বতী, চোখের কোণ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বলল, আমাকে জ্বালিয়ে মারল লোকটা। এভাবে বেশিদিন বাঁচা যায় না। তোর বাবা মনে হয় আমার মরা-মুখ না দেখে শাস নেবে না। শুভ হত- চকিত। তার কিছু বলার নেই। সে কথা শুনে থরথর করে কাঁপছে। একটা ভয় খামচে ধরছে তার মন। এ সময় অবনী কোথায় থাকতে পারে এটা তার অজানা। পুরো কালীগঞ্জ বাজার খুঁজেছে সে, কোথাও তার দেখা নেই। বারোয়ারীতলায় মাঝে মাঝে শুয়ে থাকে মনের দুঃখে, আজ বারোয়ারীতলাও ফাঁকা। শুধু দুটো পথের কুকুর শুয়ে আছে বিক্ষিপ্ত ভাবে।

সরস্বতী হার মানার মেয়ে নয়, সে দম না নিয়ে বলল, তুই ঘরে থাক, আমি আসছি। যাব আর আসব। ভয় পাবি না।

-কোথায় যাবে মা?

-মরতে। সরস্বতীর চোখ ছলছলিয়ে উঠল, আমি মরলে তোর বাবার শান্তি হয়। দেখবি, আমি একদিন ঠিক মরব। মরে ওকে শিক্ষা দিয়ে যাব। ভেবেছে টো-টো করে ঘুরে বেড়াবে। আমাকে জব্দ করবে। তা আমি হতে দেব না।

গজগজ করতে চলে গেল সরস্বতী।

হাসপাতালের মাঠ পেরলেই পাকা রাস্তা। দুটোর বাস সেই কখন চলে গেছে দেবগ্রামের দিকে। এখন মরা সাপের মতো শুয়ে আছে শীর্ণ কালো পথ। দু-পাশের ধুলো ছড়ছড় করছে হাওয়ায়। চা-দোকানটাও অবেলায় বন্ধ। না হলে চা-দোকানীকে শুধাতে পারত সে।

ফাঁকা রাস্তায় দুটো গোয় হেলতে দুলতে চলে গেল। শীতের বেলায় আর ঘাসে মুখ দিতে মন করছে না ওদের। আলিস্যি ভর করে আছে হাওয়ায়।

সরস্বতীর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে হাঁটছে তো হাঁটছে।

 মনে ভয় ঢুকেছে তার। কেউ যদি হারিয়ে দেয় তাকে। যদি ছিনিয়ে নেয় অবনীকে?

এত অবহেলা নিয়ে যে মানুষটা বেঁচে আছে তার অন্য দিকে ঢলে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। ঠিকঠাক আশ্রয় পেলে মাথা গুঁজে দেবে-এ আর নতুন কি। সরস্বতীর চোখের তারা কেঁপে উঠল। দূর থেকে সে দেখতে পেল সনাতন মুদি-দোকানীকে ব্রহ্মানীতলার পাশ দিয়ে আসতে। চাপড়া গাঁয়ে ঢোকার ওই একটাই রাস্তা। সনাতন মুদি দোকানীকে দু-চার বার সে দেখেছে। মানুষটা ভালো। কালীগঞ্জের কেউ যখন সাহস করে ধারে ভুষিমালপত্তর দিল না, তখন ঐ মানুষটাই বলেছিল, মাসকাবারী আমার দোকান থেকে নিও, তবে বেতন পেয়ে মাসে-মাসে সব মিটিয়ে দিও। আমার পুঁজি অল্প। ধার-দেনা রাখলে ডুবে যাবো।

অবনীর হাত ধরে শুভ যেত চাপড়ায় মাসকাবারি বাজার করতে। হিসাবের খাতায় যোগ ঠিক আছে কিনা দেখতো সে। অবনী তখন গর্বিত চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত অপলক। ছেলে শিক্ষিত হলে আর কেউ ঠকিয়ে নিতে পারবে না। দিন বদলের ইংগিতটা তখনই ধরা দিত তার চোখে।

সনাতন মুদি সরস্বতীকে দেখতে পেয়ে সাইকেলের ব্রেক মেরে দাঁড়াল। টানা সাইকেল চালিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কিছুক্ষণ দম নিয়ে বলল, অবেলায় কোথায় যাচ্ছ গো শুভ’র মা? তা খবরাখবর সব ভালো তো?

সরস্বতী অপ্রস্তুত। কিছুটা লজ্জিত। কপালের কুঁচো চুলগুলো সরিয়ে সহজ ভাবে তাকাল, শুভর বাবা ঘরে আসেনি। তাই খুঁজতে বেরিয়েছি।

সনাতন মুদি দম ধরে থাকল কিছু সময়। অবনীকে সে দেখেছে পদ্মর দাওয়ায় তক্তপোষে শুয়ে থাকতে। ভর পেট নেশা করেছে সে, দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এই অপ্রিয় সত্যটি কি সরস্বতীর কাছে বলা যাবে? বলার পরে কী প্রতিক্রিয়া হবে বউটার বোঝার চেষ্টা করল সে। দোনো-মোনো দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে আছে সরস্বতীর দিকে। একই দৃষ্টিতে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে সরস্বতী। তার ডাগর চোখে সব সময় যেন কাজল পরানো। সব চাইতে ওর চুলের বাহার দেখার মতো। একেবারে কালো কুচকুচে কোঁকড়ান চুল। সিঁথিতে গুঁড়ো সিঁদুর পরলে দেবীর মতো দেখায়। এক নজরে সবাই তাকে বলে সুন্দরী। যেমন গায়ের রঙ তেমন চোখ-মুখের গড়ন। ভগবান ওর চেহারায় আভিজাত্যের বার্নিশ লাগিয়ে পাঠিয়েছে।

সনাতন মুদি চোখ কুঁকড়ে তাকাল। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, অবনীকে দাস পাড়ায় দেখে এলাম। বেশ নেশা করেছে মনে হল। তবে এর আগে ওকে আমি নেশা করতে দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম।

আঁচলটা তর্জনীতে জড়াতে জড়াতে পাথরের মূর্তি হয়ে গেল সরস্বতী, গলার কাছে ঢেলার মতো জমতে থাকল কান্না। এসব দুঃখ ক্ষোভের কথা কাকে বলবে সে। কে শুনবে তার জ্বালা-যন্ত্রণার ইতিহাস। উপর দিকে থুতু ছুঁড়লে নিজের গায়ে পড়ে। তবু শরীর জুড়ে জোয়ার আসা কাঁপুনীকে প্রতিহত করতে চাইল সে। পরপুরুষের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়লে কী ভাববে লোকে? অবনী যে বিপথগামী হচ্ছিল তার আঁচ পেয়েছিল সে। পদ্মর স্বভাব ভালো নয়। সে তো টোপ দিয়ে মাছ ধরবে। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দাঁতে দাঁত টিপে সরস্বতী আগুন চোখে তাকাল। আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। সবাই দেখুক ভালো মানুষটার পরিণতি! আজ খুলে যাক মুখোশ…মানুষটাকে চিনুক সবাই।

হেঁটে নয়, একরকম দৌড়ে দাসপাড়ায় এল সরস্বতী। হাঁপাচ্ছিল সে। ভিতরটা কাঁপছিল রাগে। পদ্মকে দেখতে পেলে নখ বসিয়ে দেবে তার বুকে। পাপড়ি ছিঁড়ে উড়িয়ে দেবে বাতাসে। ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দেবে তাকে। এতদূর স্পর্ধা স্বামী খেদানো বউটার? কলপাড়েই পদ্মর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সরস্বতীর।

চোখে চোখ পড়তেই পদ্ম বলল, দিদি, তুমি!

–হ্যাঁ, আমি। সে কোথায়?

–কে? কার কথা বলছ?

–ন্যাকামী করো না। বলল, শুভর বাবা কোথায়?

-কে কোথায় যায় আসে আমাকে কি বলে যায়? পদ্মর মোটা ঠোঁটে চলকে উঠল পাতলা হাসি, ঘরের মানুষটাকে মদের ঠেক অব্দি পৌঁছে দিয়েছ, কাজটা ভালো করনি, দিদি। এর ফল তোমাকে ভুগতে হবে। আমাকে ভুল বুঝো না, তোমাকে জানিয়ে দিলাম।

পদ্ম যেন শিক্ষা দিতে চাইল সরস্বতীকে।

কিছুটা বিপর্যস্ত সরস্বতী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, পুরুষমানুষকে তো আর আঁচলের চাবি গোছর মতো বেঁধে রাখা যায় না। ওরা খাঁচার পাখি নয়, বনের পাখি। যেখানে দানা পাবে সেখানে স্থিতু হবে।

তা হলে তোমার এত চিন্তা কিসের? পদ্ম ঝুঁকে পড়ল সরস্বতীর মুখের উপর। তার তাতা নিঃশ্বাস কাঁপিয়ে দিল সরস্বতীর চটকে যাওয়া কলিজাটাকে। কাঁদবে না ভেঙে পড়বে কিছুই বুঝতে পারল না সে। শুধু নিজের প্রতি চরম ক্ষোভে গাছের মতো নীরব হয়ে গেল সে। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে সরস্বতী বলল, ও এলে ওকে আর মদ দেবে না।

কেন দেব না? খদ্দের আমার কাছে লক্ষ্মী। পদ্ম কঠিন চোখে তাকাল। তার সেই চাহনিতে মাথা নীচু হয়ে এল সরস্বতীর। তার গোছানো শরীরের উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেল এমন বিধ্বস্ত দেখাল তাকে।

পদ্ম বুক নাচিয়ে বেপরওয়াভাবে বলল, মদ না বেচলে আমার দিন চলবে না। যে আসবে সেই আমার খদ্দের। বুঝলে? পদ্ম জল নিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে বলল, একটা কথা বলি দিদি যদি কিছু মনে না করো। তোমার ঘরের মানুষটা হল কাঁচা সোনা, তাকে যেমন খুশি গড়া যায়। সোনাকে কাদার তাল ভেবে দুরে ঠেলে দিলে একদিন ধুলো পথে বসে তোমাকে কাঁদতে হবে। সেদিন আমি কেন, কেউ তোমার চোখের জল মুছিয়ে দিতে আসবে না। আজ ইচ্ছে করলে আমি ওকে হারিয়ে দিতাম, কিংবা নিজেই হেরে বসে থাকতাম। শুধু তোমার মুখ চেয়ে আমি ও-পথে পা বাড়াই নি। এর পর যদি তোমার পাখি বুকের খাঁচায় না আটকে রাখতে পারো তাহলে কোনো অঘটন ঘটে গেলে আমাকে দোষ দিও না। তোমার রূপের দেমাগ আছে শুনেছি। রূপ দিয়ে অন্যকে পোড়াও। নিজেই যদি নিজের রূপের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাও তাহলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে নি। এখনও সময় আছে চোখ জোড়া থেকে ঘেন্নার পাঁকমাটিগুলো সরিয়ে ফেল। নিজের মানুষকে নিজের করে কাছে টেনে নাও।

পদ্মর মুখের উপর কোনো কথা বলার ছিল না, শুধু বুকের ভেতরটা তছনছ হয়ে গেল সরস্বতীর। নিজেকে বদলে ফেলার সময় এসেছে তার, না হলে সে হেরে যাবে। পায়ের তলার মাটি সরে গেলে সে দাঁড়াবে কোথায়? মাটি হারানো মানুষের যে কোথাও জায়গা হয় না। মাতাল অবনীর হাত ধরতে আর ঘেন্না হল না তার।

অনেকদিন পরে গভীর রাতে তক্তপোষ থেকে নেমে এল সে। শুভ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, কোনো সাড়া নেই।

সরস্বতী নিশূপ পায়ে অবনীর মাথার কাছে গিয়ে বসল। শরীর টানটান হয়ে আছে উত্তেজনায়। বাইরে হিম পড়ছে টুপটাপ। হিম নয় যেন ফুল ঝরে পড়ছে। ঝি-ঝি পোকার মিহি সুরে আজ এক অন্য উন্মাদনা। সরস্বতীর চোখের তারা কাঁপছিল নতুন বউয়ের মতন। বহু সংকোচে অবনীর খসখসে কপালে হাত রাখল। হয়ত জেগে ছিল অবনী। হঠাৎ সে চোখ মেলে তাকাল।

সরস্বতী অভিমান ভরা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি আমাকে এত বড়ো শাস্তি দিতে পারলে? তোমার হাত ধরে এতদূর এসেছি। এবার যমের দুয়ার অব্দি ঠিক পৌঁছে যাবো। আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বলল অবনী। কাঁপা হাতে সরস্বতীকে টেনে আনতে চাইল নিজের নিঃশ্বাসের আওতায়।

স্বর্ণলতার মতো বহুদিন পরে সরস্বতী নিজেকে ভেঙে ছড়িয়ে দিল বিছানায়।

একটা ভোরের জন্য মুখিয়ে ছিল শুভ। শীতকালটা তার কোনো সময়ে প্রিয় সময় নয়। এ সময় খসখস করে গায়ের চামড়া, খড়ি ফোটে শরীরের। সকালে ঘুম ভাঙলেও কাঁথার বাইরে বেরতে মন করে না। একটু রোদ উঠুক তারপর বিছানা ছেড়ে উঠবে সে। এই আলিস্যি তার চিরদিনের। সরস্বতী বলল, আর শুয়ে থাকিস নে। এবার চোখ-মুখ ধুয়ে পড়তে বস। যারা শুয়ে থাকে, তাদের ভাগ্যও শুয়ে থাকে।

মায়ের কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে শুভ। সাত- সকালে পড়ার কথা শুনতে কার ভালো লাগে? এখন বাঁধের ধারের মাঠগুলোয় ছোলার গাছ ভর্তি। এ সময় ফল আসে গাছগুলোয়। শিশিরে ভিজে কেমন আদুরে দেখায় ওদের। ফলগুলোকে ছুঁতেও মায়া হয়। তবু না ছুঁয়ে তো উপায় নেই। হোড়া-পোড়া করে খেতে হবে যে!

হোড়া পোড়ায় ছোলা সমেত গাছ তুলে এনে আগুনে ঝলসে নিতে হয়। এতে ফলগুলো সেদ্ধ হয়ে যায়, খেতে মিষ্টি লাগে-এটা এমন মিষ্টি যা কোনো দোকানে পাওয়া যাবে না। শুভ শুয়ে শুয়ে ভাবল।

আমগাছতলায় আগুন ধরিয়েছে কারা। শুকনো পাতা পুড়ছে পড়পড়িয়ে। আমের পাতাগুলোয় বুঝি তেল থাকে। সবুজ তাকিয়ে ছিল একদৃষ্টিতে। শুভ গিয়ে একটা শুকনো পাতা ছুঁড়ে দিল সেই আগুনের উপর। খেজুরের ডাল ভেঙে উসকে দিল আগুন। যা শীত, উত্তাপের প্রয়োজন।

কাল বাঁধের ধার থেকে ছোলার গাছ তুলে এনেছিল সবুজ। রোজই আনে সে। ছোলার গাছ তুলে আনা মুখের কথা নয়। জমির মালিক দেখতে পেলে আর রক্ষে থাকবে না। গালমন্দ করে ভূত ভাগিয়ে দেবে। এসবে সবুজের কোনো ভয় নেই। যা করতে হবে তা তো যেমন করেই হোক করতে হবে। ছোলার গাছগুলো সে না বলে নিয়ে এসেছে। বললে একদিন দেবে, রোজ রোজ তো আর দেবে না?

ধুঁয়োর মধ্যে ছোট-ছোট ফুলিঙ্গ উড়ছে আগুনের। সাত সকালে শীত হাওয়ার বুঝি দাপাদাপি খেলা চলছে। উত্তাপ পেতে আগুনের কাছাকাছি সরে বসল শুভ। ঘুমের ভাবটা এখন ছেড়ে গেছে শরীর থেকে। বেশিক্ষণ এখানে আর বসে থাকা যাবে না। সরস্বতী কোয়ার্টার থেকেই ডাক ছাড়বে পড়ার জন্য। সবাই শুনতে পাবে তার চিৎকার। শুভর বাজে লাগে এসব। এখন বড়ো হচ্ছে সে। এখন কি চামচে দুধ খাওয়ার সময়। তবু মা বুঝতে চায় না। চোখে চোখে রাখতে চায়।

হাত দুটো গনগনে আগুনের দিকে ঠেলে দিয়ে আবার গালের কাছে চেপে ধরল শুভ। বেশ আরাম লাগছিল এতে। হাতের তালুর উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছিল পুরো শরীরে। ছোলার সবুজ গাছটাকে চেনা যায় না এখন। আগুন ঝলসে দিয়েছে তার শরীর। সবুজতা হারিয়ে গিয়ে তার এখন পোড়া কালচে রঙ।

সবুজ শুভর চোখের দিকে তাকাল। আর বেশিক্ষণ ওরা আগুন পোহাবে না। ছোলার গাছগুলো ঝুলিয়ে নিয়ে ওরা চলে যাবে হাসপাতালের মাঠটায়। ওদিকটায় বেশ নির্জন। শুধু পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু শব্দ কানে আসে না। ওখানে আরাম করে বসে ছোলার ফল ছাড়িয়ে খাবে। আধসেদ্ধ ফলগুলো খেতে তো মন্দ লাগে না। আমতলায় বড্ড বেশি ভিড়। এখানে দিতে দিতেই সব শেষ, নিজেদের জন্য কিছু থাকে না।

সবুজ খেজুরগাছের পাশ দিয়ে চলে এল মাঠটাতে। সবুজ ঘাসের উপর তখনও হীরে দানার মতো চকচক করছে শিশির কণা। সকালের রোদের সঙ্গে ওদের এত সখ্যতাকে জানত।

পড়ে থাকা বাবলা গাছের গুঁড়িটায় গিয়ে বসল শুভ। তার পাশে গিয়ে বসল সবুজ। তারপর স্বভাবসুলভ গলায় বলল, আমি আর ছোলর গাছ তুলতে যেতে পারব না। খেতের মালিকটা আমাকে চিনে গিয়েছে। কাল তত তাড়া করেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। শুভ চুপ করে থাকল। ছোলার গাছ না পেলে হোড়া পোড়া’ আর হবে না। না হোক। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তবে কারোর ক্ষতি করে নিজেদের আনন্দ কেনা, এটা না-পছন্দ শুভর। সে এমনিতে চুপচাপ। সহজ সরল। ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। আত্মসম্মান বোধ তার তীব্র।

সবুজ থমথমে পরিবেশকে সহজ করার জন্য বলল, খাচ্ছিস না কেন? কী হল তোর? শুভ সেঁক গিলে বলল, কাল শুধু আগুন পোহাব। কাল আর হোড়া পোড়া’ করে লাভ নেই।

তার মিনমিনে কথা শুনে হা-হা করে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল সবুজ, অত ভয় পেলে চলবে? হোড়া-পোড়া হবে না, এটা ভাবলি কি করে? আমি থাকলে সব হবে। ছোলার ফল ছাড়িয়ে খাচ্ছিল সবুজ, একটু ভেবে নিয়ে বলল, কাল অন্য খেত থেকে ছোলার গাছ তুলব। রোজ রোজ একই খেতে তুলতে গেলে ঝামেলা অনেক। সবার নজরে পড়ে যায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবারই ক্ষতি করা ভালো, এতে কারোর উপর চাপ পড়বে না।

পোড়ানো ছোলা খেয়ে ওরা যখন কোয়ার্টারে ফিরছিল তখন বাঁশ বাগানের খুপচি আঁধারে খেলা করছিল আলোর ঘোড়া। একটা ডাহুক পাঁচিল ঘেঁষে ছুটে পালাতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ডাহুকটা আবার উড়ে গেল কককিয়ে ডাকতে ডাকতে।

সবুজের হাত নিশপিশিয়ে উঠল, শুন্য চোখে তাকিয়ে সে বলল, হাতে গুলতি নেই, থাকলে মজা দেখিয়ে ছেড়ে দিতাম। জানিস শুভ অনেকদিন ডাহুকের মাংস খাইনি।

প্রায়ই পাখি শিকারে বেরয় ওরা। বাঁধের ধারের ঝোপঝাড়ে পাখির কোনো অভাব নেই। সেখানে কত যে নাম না জানা পাখি আছে দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় ওদের। পাখি মারতে যাওয়া একটা নেশার মতো দাঁড়িয়ে গেছে ওদের। নিরীহ পাখিগুলো ওদের বুঝি চিনে গেছে। দূর থেকে দেখলেই ওরা উড়ে পালায়। হয়ত গা ঢাকা দেয় ঝোপঝাড়ে।

পাখি যেমন চালাক-চতুর, ওরাও কম যায় না পাখির চাইতে। রোজ রোজ একই ঝোপ-জঙ্গলে ঘোরাফেরা করে না শুভ। শিকারের জন্য মাঝেমধ্যে সব কিছু বদলে ফেলতে হয় ওদের। আজ চাপড়ার বিল তো, পরশু দোয়েমের চর।

হাতের ঝলকালি ঝেড়ে শুভ বলল, আজ স্কুল নেই। আজ কি শিকারে যাবি, সবুজ? সবুজ ভাবল, শিকারে যেতে এখন আর মন চায় না। সেদিন খরগোসটা মারতে গিয়েও পারলাম না! বাঘাটা বেইমানী করল, নাহলে ওটা জব্দ করতে পারতাম।

শুভ আক্ষেপের সঙ্গে বলল, দূর, বাঘাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেদিন বাঘার কিছু করার ছিল না। ভাব তো খরগোসের পায়ে কতো ছুট। কুকুর কি খরগোসের সঙ্গে দৌড়ে জিতেছে কোনোদিন?

ছোট্ট কপালে ভাঁজ পড়ল সবুজের, সে যাই হোক, এবার কিন্তু জবরদস্ত ফিস্ট করতে হবে। শীত পড়েছে। এবার আর ছাড়াছাড়ি নয়। অতসীপিসিকে আগে থেকে বলে রাখতে হবে। না হলে সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

শুভ বলল, শুনেছি পিসি এবার ডিসেম্বর মাসে দেশ-বাড়িতে যাবে। বাঘা তখন আমাদের বাড়িতে থাকবে। মা তার জন্য ভাত বেঁধে দেবে। পিসি চাল আর নগদ টাকা দিয়ে যাবে মাকে।

মন খারাপ হয়ে গেল সবুজের।

শুভ বলল, ফিস্ট নিয়ে আগাম ভেবে লাভ নেই। এখনও অনেক দেরি আছে। বড়োরা সবাই এক না হলে ফিস্ট হবে কী করে। তার চেয়ে বরং একটা কাজ করি। আমরা ছোটরা মিলে একটা বনভোজন করি। বেশি দূরে যাব না, হাসপাতালের মাঠেই করব। দরকার হলে মাকে বলব বেঁধে দিতে।

-তার আর দরকার হবে না। সবুজ বড়োদের সান্নিধ্য এড়িয়ে যেতে চাইল, ডাক্তারবাবুর মেয়ে মাধুরী আছে। শুনেছি ও ভালো রাঁধতে পারে। চল, মাধুরীকে গিয়ে সব বলি। ও যা মেয়ে, রাজি হয়ে যাবে।

উঠল বাই তো কটক যাই।

 সবার আগে সবুজ, পেছনে শুভ। ওদের গন্তব্য বদলে গিয়েছে।

মাধুরীকে গিয়ে বলতেই রাজি হয়ে গেল সে।

সবুজ বাহবা নেবার জন্য বলল, আমি জানতাম ও রাজি হয়ে যাবে। এবার তাহলে বনভোজনের আয়োজন করা যাক কি বলিস?

শুভ ঘাড় নাড়ল।

বেলা বাড়ছে। এবার ঘরে ফিরে গিয়ে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসা দরকার। না হলে মা রাগারাগি করবে, পাড়া মাথায় তুলে চেঁচাবে। সরস্বতীর বাজখাই গলা বিখ্যাত। সবাই জেনে গিয়েছে। সবুজের এসব চিন্তা নেই। ওর বাবা ভোরের বাসে চলে গিয়েছে দেবগ্রাম। দুপুরের আগে ফিরবে না। ফলে দুপুর পর্যন্ত সে রাজা। তাকে কেউ শাসন করার নেই। সে টো-টো করে ঘুরবে। খুব বেশি হলে সাইকেল নিয়ে একবার বাজার থেকে ঘুরে আসবে।

সরস্বতী সবুজের এই লাগাম ছাড়া ঘুরে বেড়ানোর স্বভাবটাকে পছন্দ করে না। তার মতে পড়ার সময় পড়ো। খেলার সময় খেলো। পড়া নষ্ট করে খেলে বেড়ান তার পছন্দ নয়। কিচেনের কাছে রোদ্দুর ঝকঝক করে হাসছে। শেয়ালকাঁটা গাছে হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে। ভারী চমৎকার দেখতে ফুলগুলো। অথচ ঐ ফুলগুলোর দিকে কেউ তাকায় না। শুভ উঁচু হয়ে বসল দেড় হাত মাপের কাঁটাওলা গাছটার সামনে। সবুজ দুর থেকে চিৎকার করে বলল, খবরদার, হাত দিসনে। যা সরু সরু কাঁটা, ঢুকে গেলে একেবারে রক্তে চলে যাবে। তখন মরবি।

ভয় পেলেও অতি সাবধানে খানচারেক ফুল তুলল শুভ। সে জানে, এই ফুল ঠাকুর পুজোয় দেওয়া যাবে না। কেন যাবে না, তার কারণ সে জানে না। সবুজকে প্রশ্ন করতেই সে-ও না-সূচক ঘাড় নাড়ল।

হাসপাতালের এই কিচেনটা’ শুভ আর সবুজের কাছে সপ্তম আশ্চর্যের একটা। এখানকার ছাইটিপির উপর থেকে সে একটা বেড়ালছানা ধরে নিয়ে গিয়েছিল ঘরে। সরস্বতী বেড়ালছানাটাকে দেখে সাথে সাথে বিদায় করেছে তাকে। মায়ের চোখে এত ঘেন্না ভালো লাগেনি শুভর। বেড়ালছানা তো কোনো দোষ করেনি তবু তার কেন ঘরে জায়গা হবে না? শুধু সরস্বতী নয় অবনীও এ নিয়ে তার পক্ষে একটাও সাওয়াল-জবাব করে নি।

মনের দুঃখে সেই বেড়ালছানাটাকে আবার কিচেন-এ রেখে এসেছিল শুভ। সবুজ তাকে জ্ঞান দিয়ে বলল, বেড়াল থেকে ডিপথেরিয়া রোগের সৃষ্টি হয়। বেড়ালের লালা আর লোম পেটে গেলে মানুষের ভীষণ ক্ষতি হয়।

সবুজ এ বয়সে অনেক কিছু জানে যা শুভ জানে না। এর জন্য মন খারাপ হয়ে যায় তার। ব্যস্ত হয়ে বলে, আজ কপালে দুঃখ আছে। মাকে তো জানিস কেমন বদরাগী। পড়তে না বসলে শুধু আমাকে নয়, বাবাকেও বকে।

সবুজ মজা পেরে হা-হা করে হেসে উঠল। আর ঠিক তখনই একটা ম্যাটাডোর হর্ন বাজাতে বাজাতে ঢুকে এল হাসপাতালের মাঠে। দূর থেকে ওরা দেখল সেই চার চাকার ছোট-লরিটার মধ্যে পেল বাঁশ আরও কত কি যে আছে।

শুভ উৎফুল্ল হয়ে বলল, মনে হচ্ছে গ্রামে সার্কাস এসেছে। দারুণ মজা হবে তাই না? সবুজ ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল তাকে, সার্কাস যদি আসবে তত বাস-স্ট্যান্ডের মাঠে প্রথমে যাবে। এখানে কেন আসবে? এটা তো হাসপাতাল।

ঘাড় চুলকে শুভ বলল, কেউ হয়ত অসুস্থ হয়েছে–সেইজন্য। চল, আমরা কাছে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসি। ভাব জমাতে পারলে পরে আমাদের লাভ হবে।

সবুজ আর শুভ পাশাপাশি ছুটছে। ওদের আর আনন্দ যেন ধরে না।

গাড়িটার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল শুভ। ততক্ষণে ড্রাইভার সিট থেকে নেমে পড়েছে বছর পঁচিশের একজন যুবক। সবুজ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গলা ঝেড়ে নিয়ে শুধোল, এটা কি সার্কাসের গাড়ি?

যুবকটি থতমত খাওয়া চোখে তাকাল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হা-হা হাসিতে গলা ভরিয়ে বলল, এ গ্রামে মনে হয় বহুদিন সার্কাসের দল আসেনি?

ঘাড় নাড়ল সবুজ।

যুবক ড্রাইভার বলল, আমরা এই হাসপাতালে কাজ করতে এসেছি। আমরা কনট্রাক্টরের লোক। হাসপাতাল, কোয়ার্টার সব চুনকাম করা হবে। সেই সঙ্গে ছোটোমোটো সিমেন্টের কাজও করব আমরা। কথা থামিয়ে ঢোঁক গিলল ছোকরা-ড্রাইভার, আচ্ছা,খোকা, ডাক্তারবাবুকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে? ওর পারমিশন ছাড়া তো মালপত্তর আমরা নামতে পারি না।

সবুজ হাত তুলে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দিল।

একজন মাঝবয়েসী, বছর পঞ্চাশের মানুষ একটা খাম হাতে এগিয়ে গেল ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের দিকে। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে সে ফিরে এল মিনিট দশেকের মধ্যে। তার হাসি মুখ। পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে বলল, বাবলু, মাল নামা। ঘন্টা খানিকের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। তুই যদি কৃষ্ণনগর চলে যেতে চাস তো যেতে পারিস। কাল সকালে এলে হাজিরা ঠিক হয়ে যাবে।

বাবলু কোনো কিছু না বলে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকল। নতুন জায়গাটা যে তার ভালো লেগেছে-এটা তার বিস্মিত চোখ-মুখই বলে দিল।

.

৪০.

বয়স্ক লোকটার নাম এরফান।

বাবলু অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, না বাবা, আমি আর কৃষ্ণনগর যাব না। এখানে আসতে হবে বলে ভোর উঠেছি। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। একটু শুতে পারলে ভালো হত।

ক্লান্তি-অবসাদে চোখ বুজে আসতে চাইছে বাবলুর। তবু তার ছিমছাম চেহারা এক ঝলক সবার নজর কাড়বে। কত বয়স হবে বাবলুর? বড়োজোর উনিশ-কুড়ি। টাইট সাদা প্যান্টের সঙ্গে মাঞ্জা দেওয়া জামা পরেছে সে। গলায় রূপোর চেনে একটা তাবিজ।

এরফান বলল, যা, কল থেকে হাত-পা ধুয়ে আয়। চোখে-মুখে ভালো করে জল দিবি। লাট্টুকে বলছি ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে ভাত বসাতে। আজ আর বাজারে যাব না। সঙ্গে যা এনেছি, তা সেদ্ধ দিয়ে দেব।

কালো রঙের রোগা ছিপছিপে লাট্টু দাঁড়িয়েছিল আদেশের অপেক্ষায়। ভাত রাঁধতে হবে শুনে সে আর দাঁড়াল না, হাসপাতালের দিকে চলে গেল থান ইটের জন্য। শুধু এই হাসপাতাল নয়, আরো অনেক হাসপাতালের কাজ সেরে তাদের এখানে আসা। এসে ভালোই করেছে। এখানে মাথা গোঁজার জন্য তাবু টাঙ্গাতে হবে না। সব শোনার পর ডাক্তারবাবু নিজেই বললেন, একটা কোয়ার্টার ফাঁকা পড়ে আছে, ওখানে আপাতত থাকতে পারো। কেউ এলে তখন কিন্তু চলে যেতে হবে।

খুশিতে ঘাড় নেড়েছিল এরফান। নাহলে এতক্ষণে তাবু টাঙ্গানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। তাঁবু টাঙ্গাতে সময় বেশি লাগে না। তাবুতে থেকেও আরাম। তবে সাপখোপ ঝড়-ঝঞ্জার ভয় আছে। তাবু উড়ে গেলে মাথা বাঁচানো দায় হয়। নানা

অভিজ্ঞতার সাক্ষীবট এরফান।

লাট্টু ইট খুঁজে এনে চুলা বানিয়েছে জব্বর। বাবলু রান্নার বিরোধী। মুখ কাঁচুমাচু করে সে বলল, আজ হোটেলে খেয়ে নিলে হত না? তার কথা শুনে পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে হেসে উঠল এরফান, এখানে পাউরুটি পাওয়া যায় না আর ভাত পাওয়া যাবে। রাত আটটার পরে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায় বাজারের। বাইরের লোক আসে না বললেই চলে। বাইরের লোক ছাড়া ভাতের হোটেল চলবে কি করে? গাঁয়ের মানুষ তো সখ করে হোটেলে খেতে যাবে না। তারা পয়সা চেনে। টাকাকে ভালোবাসে।

বাবার কথা শুনে বেশ অবাক হল বাবলু। এখানে আসার আগে সব খোঁজখবর নিয়ে এসেছে মানুষটা। নাহলে সঙ্গে করে আলু চাল পেঁয়াজ কেউ বয়ে আনে।

কাঠ ফাড়িয়ে জ্বাল দিচ্ছে লাট্টু। বড়ো হাঁড়িতে ভাত ফুটছে চড়বড়িয়ে। সেই ফুটন্ত ভাতের দিকে তাকিয়ে বড়ো আনমনা হয়ে গেল এরফান। ঘরে নতুন বউ নুরিকে রেখে এসেছে। সারা রাত ধরে নুরি কত অনুনয়, বিনয় করল তার বুড়ো শরীর আঁকড়ে। যতটুকু পেরেছে নুরিকে সুখ দেবার চেষ্টা করেছে এরফান। নুরি কাতর হয়ে বলেছে, কিরে কেটে বলল, তুমি ঐ বুড়ি ধেমড়িটার কাছে যাবে না।

এরফানের মুখে কুলুপ আঁটা।

নুরি সুর করে বলেছে, যা টাকা-পয়সা সব আমাকে দেবে। আমি টাকা জমিয়ে একটা সোন্দর পারা কোঠা দালান বানাব। ওটা হবে তোমার আমার তাজমহল।

এরফানও স্বপ্ন দেখেছে–তাকে কিছু করতে হবে। খয়রা বিবি বছরের মধ্যে ছমাস তো রোগে ভোগে। শরীরও টসকে গেছে বহুদিন আগে। এখন কাছে এসে বসলে বয়সের ছায়ায় বুড়ি দেখায়। সেই আগের মতো গালে আর টোল পড়ে না, চোখে আর বিদ্যৎ খেলে না। এখন সে ভাটার নদী। কিছু নেই, শুধু চ্যাটচেটে কাদা। এরফান কেন যাবে তার কাছে। মৌচাকে মধু না থাকলে মৌমাছি কি সেখানে আশ্রয় নেয়?

ফোঁটা ভাতের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের উপর ঠোঁট চেপে ধরল এরফান। রাজমিস্ত্রির কাজে শরীর ক্ষয় হয় সাত তাড়াতাড়ি। সা শদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় তাকে। বাবলুও রাজমিস্ত্রির কাজটা শিখে নিয়েছে। ওর হাতের কার্নিক যাদুকাঠির মতো নড়ে। আর কি নিখুঁত কাজ। এরফান জানে-খয়রা বিবির ছেলের কোনোদিন ভাত কাপড়ের অভাব হবে না। যেখানে যাবে কাজের গুণে বিশ্বজয় করে ফিরবে।

ছেলের জন্য মনে মনে গর্ব অনুভব করে এরফান। তবে সে বাবলুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। গলা বুজে আসে। এই বয়সে শাদী করে কাজটা ভালো করেনি এরফান। লাট্টু বুঝিয়েছিল অনেক। কাকুতি-মিনতি করে বলেছিল, বড়ভাই, ও ভুল করো না। ঘরে তোমার সোমত্ত ছেলে। নিজে না বিয়ে করে তার বিয়ে দাও। লোক হাসিয়ে কি লাভ হবে বলো তো!

লাট্টুর কথা কানে তোলেনি এরফান। তার তখন বুড়ো গাঙে ছলাৎছলাৎ ঢেউ। নুরী রোজ হাসপাতালের চাপাকলে জল নিতে আসত। এরফান কলপাড়ে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলত তার সঙ্গে। অভাবী নুরির টাকার ভীষণ দরকার। মুঠো মুঠো টাকা ছড়িয়ে নায়ক হয়ে গেল এরফান। একদিন ঝোঁকের মাথায় নিকেও করে ফেলল।

নতুন বউ থাকবে কোথায়? পুরনো ঘরে তাকে মানায় না। এরফানও চাইল না নুরি খয়রা বিবির সঙ্গে থাকুক। এক সাথে থাকলে ঝামেলার শেষ নেই। রাতদিন চুলোচুলি লেগে থাকবে। তার চেয়ে আলাদা থাকা ভালো।

বস্তিতে ঘর ভাড়া নিল এরফান। নুরিকে নিয়ে উঠল সে নতুন ঘরে।

খয়রা বিবি তার প্রতীক্ষায় থাকে। রাত ভোর হয়ে যায়। এরফান তবু আসে না। বাবলুর চোখে ঘুম আসে না। উত্তেজিত হয়ে সে তার মাকে বলে, এতবড়ো অন্যায় আমি সহ্য করব না, মা। তোমাকে যে কাঁদাবে তার চোখই আমি উপড়ে নেব।

-না বাপ, চুপ যা। খয়রা বিবি বোঝাত, তোর বাপের শরীরের বদ রক্ত যাবে কোথায়? কয়লা যতই ঘো ময়লা তার যায় নারে! ওকে ওর মতো সুখী হতে দে। আমি ঠিক তোর মা হয়ে বেঁচে থাকব।

পয়সা ছাড়া কি বাঁচা যায়? ভরণ-পোষণ আসবে কোথা থেকে? খয়রা বিবি খেয়ে থাকে, দু-বেলা উপোস দেয়–তবু মুখ ফুটিয়ে সে কারোর কাছে কিছু বলতে পারে না। সবার কাছে কি সব কথা বলা যায়? তবে বাবলু কি ভাবে সব বুঝে ফেলে। গলার রগ ফুলিয়ে বলে, ও যদি আমারে জন্ম না দিত কবে ওর গলা টিপে খতম করে দিতাম। শুধু বাপ বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে বেশিদিন এমন চলবে না। যেদিন আমার মাথায় খুন চড়ে যাবে–সেদিন কেউ আর পার। পাবে না।

ধোঁয়া ওঠা ভাত কলাই করা থালায় বেড়ে দিয়েছে লাট্টু। আজ আর তরকারি নেই, শুধু সেদ্ধ। এরকম তো প্রায় দিনই হয়।

খেতে বসে বাবলুর দিকে আড়চোখে তাকাল এরফান, ছেলের চোখে রাগ আছে কি না বোঝার চেষ্টা করল সে। বাবলু ঘাড় না তুলে খেয়ে যাচ্ছে। এরফানের মনে হল যেন খেপা ষাঁড়। সব তছনছ করে দেবে। ভয়ে ভাত আটকে গেল তার গলায়।

টিনের গ্লাসে জল ভরে এগিয়ে দিল লাট্টু, সাবধান করে বলল, এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে, আজ তো আর কাজ হবে না! দেখে-শুনে খাও। শ্বাসনালীতে ভাত আটকে গেলে বিপদে পড়ে যাবে যে।

এরফান ঘামছিল কথা শুনে।

খেয়ে দেয়ে এঁটো থালা নিয়ে কলতলায় চলে গেল বাবলু। এরফান গলা উঁচিয়ে বলল, কলপাড়ে এঁটো ধুবি নে, বাবুরা রাগ করবে। বালতিটা নিয়ে যা। বালতিতে জল ভরে দূরে কোথাও ধুয়ে নে।

ভাতের গন্ধে দুটো কুকুর এসে হাজির হয়েছে কলতলায়। বাবলু কঠিন চোখে কুকুর দুটোর দিকে তাকাল। ওরা পিছু হটছিল। লাট্টু দুর থেকে বলল, খেদাস নে ওদের। অনেক ভাত বেঁচেছে, দিয়ে দেব।

রোজই কত ভাত বাঁচে। অথচ খয়রা বিবির দুটো ভাত জোটে না সময়মতো। কী কপাল করে এসেছে মেয়েমানুষটা!

বাবলুর চোখের কোণ চিকচিকিয়ে উঠল। মার জন্য ভেবে ভেবে তার নিজের জীবনটাই বুঝি শেষ হয়ে যাবে। ওই বুড়োটাকে দেখলে তার রক্তের ইবলিশ নড়ে চড়ে ওঠে।

বিকেলবেলায় রোদ মরে গেলে শান্ত হয়ে আসে চারপাশ। পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যায় মন। খাওয়া-দাওয়ার পর এরফান বস্তা বিছিয়ে গড়িয়ে নিয়েছে কিছু সময়। এমন যাযাবরের জীবন-যাপনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। বাবলুকে নিয়ে তার চিন্তা। ছেলেটা রগচটা। সারাক্ষণ শ্রাবণের মেঘের মতো গুম ধরে আছে, যে কোনোসময় বৃষ্টি নামতে পারে। এখানে কিছুতেই সে কাজে আসতে চায়নি। খয়রা বিবির শরীর ভালো যাচ্ছে না। কৃষ্ণনগরে ডাক্তার দেখিয়েছে বহু। আসলে রোগ তার শরীরে না, মনে। সর্বক্ষণ পুড়ছে সে। নুরিকে সে মেনে নেবে কি ভাবে। মেয়ের বয়সী মেয়েটা তার প্রতিদ্বন্দ্বী। দুম করে যে কাণ্ড করল এরফান–তার কোনো ক্ষমা নেই। খবরটা শোনার পর প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি খয়রা বিবি। পরে খবরের সত্যতা যাচাই করে লাজে-ঘেন্নায় এ পৃথিবী থেকে সরে যেতে চেয়েছিল সে। শুধু বাবলুর জন্য পারেনি। বাবলুই তাকে মরতে দিল না। ছেলেটার জন্য বুঝি যমে তাকে নিচ্ছে না, নাহলে কবে কবরে চলে যেত সে।

এবারে বাবলু আসতে চায়নি এরফানের সাথে। কেন চায়নি তার কারণটা এরফান ভালো মতন জানে। বাবলু রাগ করে বলেছিল, আমি খিদিরপুর চলে যাব। ওখানে কাজের খোঁজ পেয়েছি। তোমার সাথে ঘুরে আমার কোনো ফায়দা নেই। হতবাক এরফান প্রথমে কিছু বলতে পারেনি, পরে ঘোর কাটিয়ে বলেছে, তুই চলে গেলে আমার ঠিকেদারী দলটার কি হবে? দলটা যে ভেঙে যাবে, বাপ!

–ভাত ছিটালে কাকের অভাব হবে না। বাবলু মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে চাপা রাগে।

–তোর মাকে কে দেখবে? সে তো রুগী মানুষ। এরফানের চোখে-মুখে চিন্তা প্রকট হল।

–যার দেখার সে যখন দেখল না তখন আল্লা দেখবে। বাবলুর প্রতিটা কথায় অভিমান মাখানো।

এরপরে এরফানের মুখে কোনো কথা বেরয় না। বাপ-ছেলের সম্পর্কটাকে সে নিজেই জবাই করে দিয়েছে। এর জন্যও বাবলুর কোনো দায় নেই, যত দোষ সব তার। বিয়ের বয়স হয়েছে ছেলেটার। একটা ভালো মেয়ে দেখে তার শাদীটা চুকিয়ে দিলেই সংসারে বাঁধা পড়ে যেত ছেলেটা। খয়রা বিবিও স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বাঁচত। তা যখন হয়নি তখন আর কপাল ফাটিয়ে কি হবে?

এরফান যা করেছে তার জন্য সে অনুতপ্ত নয়। মানুষ মনের দাস। ইচ্ছে শক্তি তাকে চালিত করে। নুরিকে দেখে ভালো লেগে যাওয়াটাই কাল হল। মেয়েটার বয়সের কথা তখন মাথায় আসেনি। আর মেয়েটাও বয়স নিয়ে কোনো কথার ঢেউ তোলেনি। সত্যিই সে ভালোবেসেছে তাকে। ভালোবাসা বুঝি একেই বলে। প্রথম রাতের কথা মনে পড়ছে এরফানের। ভয়-সংকোচে জড়িয়ে গেছে তার শরীর। ফণা তোলার জো নেই। নুরিই রাতভর খেলালো তাকে। এক সময় হাঁপিয়ে গিয়ে বলেছিল, আমার কোনো ভুল হয়নি গো! তোমার বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখে আমার গতরে শিহরণ আসে। তুমি যে সে মানুষ নও, যাদুকর।

যাদুকর! মনে মনে হেসে উঠল এরফান। এই বয়সে প্রেম চিটে ধানের মতো আবার নষ্ট না হয়ে যায়। পৃথিবীর আর কাউকে সে ভয় করে না, শুধু বাবলুকে ছাড়া। এই ছেলেটাই জন্মাবার সময় জান কেড়ে নিচ্ছিল খয়রা বিবির। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, কেন্স ক্রিটিক্যাল। হয় বেবি নয়ত মা দুজনের একজনকে হারাতে হবে। তবু আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখব না।

মসজিদে গিয়ে এরফান দোওয়া মেজেছিল আল্লার। মা-ছেলে দুজনেই বিপদ কাটিয়ে ঘরে ফিরে এল। সেদিন এরফানের আর আনন্দ ধরছিল না। বস্তিতে জনে জনে ডেকে মিঠাই বিলিয়েছিল সে। সেদিনের সেই সুখ আজও চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পায় সে। মনে হয় যেন সেদিনের কথা। সময় কী ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু বুঝি মানুষের আয়ত্তের মধ্যে নেই। এখন।

ব্যাগ হাতে লাট্টু এসে দাঁড়িয়েছে এরফানের সামনে।

ঘোর কাটিয়ে সামনের দিকে তাকাল এরফান, কিছু বলবি?

লাট্টু ঘাড় নাড়ল, রাতে তো খেতে হবে। যা সঙ্গে করে এনেছিলাম তা তো দুপুরে ঠেকা দিতে চলে গেছে। টাকা দাও। বাজার থেকে ঘুরে আসি।

এরফান অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল, বাজার তুই চিনিস?

-না চিনলেও জিজ্ঞেস করে চলে যাব। লাট্টু বলল, এখানে মাস দুয়েক থাকতে হবে। ঠিকেদারবাবু বলেছিল–এ হাসপাতালে অনেকদিন কোনো কাজ হয়নি। শুধু চুনকাম নয়, জানলা-দরজার কাজও এখানে হবে। সিমেন্টের কাজ তো আছেই।

এরফান ঘাড় নাড়ল। একটা কাপড়ের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে লাট্টুকে দিল। ভাইয়ের প্রতি তার বিশ্বাস অটুট। এই ভাইজান তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। জ্ঞান পড়ার পর থেকে এই ভাই তার সঙ্গ ছেড়ে যায়নি। তবু এরফান সতর্ক গলায় বলল, বুঝে-শুনে খরচাপাতি করবি। ঠিকেদারবাবুর আসতে সময় লাগবে। সে না আসা পর্যন্ত একটা ফুটা কড়িও পাবো না। এছাড়া হপ্তায়-হপ্তায় ঘরে টাকা পাঠাতে হবে। টাকা না পাঠালে ওরাই বা খাবে কি? ওরা তো আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

অনেক কথা ভিড় করে আসছিল লাট্টুর মনে। বড়দার সামনে সব কথা কি বলা যায়? তবু সে রেখে ঢেকে বলল, ভাবীকে অনেকদিন তুমি টাকা দাও নি। টাকা না দিলে তারই বা চলে কি করে? বাবলু রাগারাগি করছিল। ও তোমার ছিমুতে কিছু বলতে পারে না। যা বলার আমাকে সব বলে। আমি তোমাকে জানিয়ে দিলাম। এবার তুমি যা ভালো বোঝ করো।

এরফানের মুখে মেঘ নেমে এল সহসা, হ্যাঁ, আমি সব বুঝতে পারি। সে তার নতুন মাকে মেনে নেয়নি। মেনে নেওয়া না নেওয়া সব তার ব্যাপার। আমি আর কারোর পায়ে তেল মাখাতে যাব না। আমি যা ভালো বুঝেছি, করেছি।

এরফান চুপ করে গেল।

ব্যাগ নিয়ে লাট্টু চলে গেল পাকা সড়কে। ধীরে ধীরে হাওয়া বইছিল, আর তাতেই উড়ে যাচ্ছিল রাস্তার দু-ধারের খড়কুটো, ধুলোবালি। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এখানকার রাস্তাঘাট। জায়গাটা মনে ধরেছে লাট্টুর। কৃষ্ণনগর থেকে আসার সময় হাটগাছায় গাড়িটা থেমেছিল একবারের জন্য। একটা হাঁস প্যাক প্যাক ডাকতে ডাকতে চাকার সামনে এসে গিয়েছিল। পাকা ড্রাইভার ছিল, ঘ্যাস করে ব্রেক কষে দাঁড়াল, নাহলে কি যে হত কে জানে। দোকানে বসে থাকা লোকগুলো ছুটে এসেছিল সামনে। ততক্ষণে হাঁসটা রাস্তা পেরিয়ে নেমে গেছে ডোবায়। অন্য কোথাও হলে গালাগালির বান ডাকত। এখানকার মানুষরা বড়ো আশ্চর্য, তারা টু শব্দটিও করল না। বরং ড্রাইভারকে সাবাসী দিয়ে বলল, তোমার জন্য হাঁসটা বেঁচে গেল ভাই। ড্রাইভার হতে গেলে চোখ-কান সতর্ক থাকা দরকার। তোমার দেখছি সব কিছু ঠিকঠাক আছে।

লাট্টু পথ চেনে না বাজারে যাওয়ার। একটা গোরুর গাড়ি কাচকোচ শব্দ তুলে যাচ্ছিল কদমতলার পাশ দিয়ে। গাড়োয়ানের গায়ে গামছা জড়ানো, তবু তার স্মৃতির যেন শেষ নেই, মেঠোয়ানিসুর থামিয়ে সে নতুন মানুষ দেখে তাকাল, বাজারে যাবে তো দেরি কেন আমার গাড়িতে চেপে বসো। আমি বাজার হয়ে কুলবেড়িয়া গাঁয়ে যাব। টালি নিয়ে ফিরতে হবে বুঝলে?

যেন কত দিনের চেনা এমন অমায়িক তার গলার স্বর।

লাট্টু গোরুর গাড়ির পেছনে গিয়ে বসল। আর মনে করার চেষ্টা করল জীবনে এর আগে সে গোরুর গাড়ি চড়েছে কি না! না, এই প্রথম গোরুর গাড়ি চড়ল সে। প্রথম গোরুর গাড়ি চড়ার আনন্দটা ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। খালি গায়ের গাড়োয়ান বলল, তা বাপু, কোথা থেকে আসা হয়েছে তোমার? এর আগে তো এ গাঁয়ে তোমাকে দেখিনি? তুমি বুঝি হাসপাতালে কাজ করো?

লাট্টু হা-করে শুনছিল প্রশ্নগুলো। লোকটা থামতেই সে বলল, আমরা ঠিকেদারের লোক। এ হাসপাতালে চুনকামের কাজ হবে। তাই আজই এসেছি সকালে। বাজার যাওয়ার পথ চিনি না। তোমার সাথে দেখা হল

-ওঃ, এই কথা। লোকটা গাল ভরিয়ে হাসল, গাঁয়ের পথ আর চেনা না চেনার কি আছে। আঁধার হলে গাঁয়ের পথে ভয় শুয়ে থাকে। তুমি তো দিনের বেলায় যাচ্ছে। তোমার আবার ভয় কি!

বাজার আসতেই লোকটা বলল, এইখানে নেমে পড়ো। আমি এখান থেকে চলে যাবো অন্য রাস্তায়। ঠিক আছে ভাই, চলি। তোমার সাথে আবার পরে দেখা হবে।

গোরুর গাড়িটা চলে যাবার পর পথের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকল লাট্টু। সেই অর্থে জমজমাট বাজার যাকে বলে–এখানে তেমন কোনোকিছু নেই। দু-একটা দোকান চোখে পড়ল বটে তবে সেগুলো জৌলুষহীন। মিষ্টির দোকানটায় থরে থরে রসকদম্ব সাজান। দেখে লোভ হল লাট্টুর। এক এক জায়গার মিষ্টি ভালো। বিশেষ কোনো মিষ্টির কদর আছে। এখানকার সেই কদরওলা মিষ্টিটার কী নাম জানতে চাইল লাট্টু।

ব্যাগ হাতে মিষ্টির দোকানে নয়–সে এগিয়ে গেল ভুষিমাল দোকানে। ফর্দ অনুযায়ী দরকারী জিনিসপত্তর কিনল সে। টাকার কথা মাথায় রেখে কেনাকাটি সারল সে।

ফিরে আসার সময় গড়িয়ে গেল বেলা।

হাসপাতালের মাঠে ঢুকে লাট্টু দেখল বাবলু ভাব জমিয়ে ফেলেছে স্টাফ-কোয়ার্টারের ছেলেগুলোর সঙ্গে। সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ওর প্রচুর। সবাইকে মানিয়েও নিতে পারে।

বিদেশ বিভূঁইয়ে এই গুণটুকু না থাকলে চলে না।

এরফান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল অবনীর সঙ্গে। কথার ফাঁকে-ফাঁকে গাল ভরিয়ে হাসছিল সে।

অবনী শুধোল, এখানে তাহলে কতদিন থাকা হবে?

এরফান বলল, যত তাড়াতাড়ি পারি কাজ শেষ করে চলে যাব। কাজ তো একটা নয়, অনেক বাকি আছে। সারা জেলা ঘুরে ঘুরে কাজ হয় আমাদের। ঠিকেদারবাবু সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়েছে।

–তা তো দেবেই। যোগ্য মানুষকে দায়িত্ব দেয় সবাই। অবনী এরফানের মুখের দিকে তাকাল। রোগা প্যাংলা চেহারা নয়-ছিমছিমে গতর। বয়স হয়েছে–এক নজর দেখলে অনুমান করা যায়। বয়স হলেও শ্রী হারায়নি চেহারা। চোখের দৃষ্টি এখনও ঠিক আছে।

এরফান বলল, একটু চা বানাই। সন্ধে নেমে এল। এদিকে মনে হয় ভালো শীত পড়ে।

অবনী বলল, শীতকালে শীত তো পড়বেই। তবে খুব বেশি শীত পড়ে না এদিকে। যেটুকু শীত পড়ে তা সহ্য করা যায়।

চা খেল না অবনী। তার মন পড়ে আছে হাসপাতালে। ডিউটি চলছে। ডিউটিতে ফাঁকি দেওয়া অপরাধ। তাছাড়া অতসী দিদিমণি রাগ করেন। গাল ফুলিয়ে বলেন, যারা ডিউটিতে ফাঁকি দেয় তাদের আমি দেখতে পারি না। কই তারা তো মাইনে নেবার সময় কম নেয় না।

অতসী দিদিমণির সঙ্গে ডিউটি থাকলে অবনী বেশি বেরতে পারে না। আবার এক জায়গায় বসে থাকতেও তার মন করে না। ঘুরে বেড়ানো স্বভাব তার সাথ দিল না। ডিউটি রুমে গিয়ে সে শুনল, পেসেন্ট এসেছে গায়ে পকস নিয়ে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, রোগীটাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে। বসন্ত ছোঁয়াচে রোগ। এ রোগী ওয়ার্ডে রাখা যাবে না।

হাসপাতালের বারান্দায় কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়েছিল বউটা। শাড়িটাই চাদরের মতো ঢাকা দিতে চাইছে জ্বরে কাতর শরীর। অবনী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বারান্দায়, বউটার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার গায়ের লোম। সুন্দর মুখটা ছেয়ে গিয়েছে জলবসন্তে। শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে জলঠোসা পড়েনি। ঘায়ে জ্যাবজ্যাব করছে পুরো দেহ। বউটা এমনভাবে পড়েছিল যে ওর নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। বোঝা গেল প্রচণ্ড জ্বরে ধুঁকছিল সে।

অতসী দিদিমণি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি যখন ওর কাছে গিয়েছ তখন ওর নামটা জেনে নাও। বাড়ি কোথায়, ঠিকানা কি এসব তো জানা দরকার। এসব না জানলে আমি হাসপাতালের ফর্ম ভরব কি করে?

আশ্চর্য ভরা চোখ মেলে তাকাল অবনী, অতসী দিদিমণিকে শুধাল, এর বাড়ির লোক কোথায়? কারা এনেছে একে?

-কে যে এনে রেখে গিয়েছে কিছুই জানি না। শীত হাওয়া ঢুকছিল বলে দরজাটা ভেজানো ছিল। আমি ডিউটি রুমে বসেছিলাম। হঠাৎ কাতরানীর শব্দ কানে যেতেই বাইরে এসে দেখি এই বউটা শুয়ে আছে। তখনও বুঝতে পারিনি স্মল পকসের রোগী। দিদিমণি হাঁফ ছাড়লেন, আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি। কে কোন ফাঁকে একে নামিয়ে রেখে চলে গেছে। ভাব তো মানুষ কেমন শয়তান!

রাগে-ক্ষোভে লালচে হয়ে উঠেছে অতসী দিদিমণির মুখখানা।

অবনী বলল, যেই আসুক, গোরুর গাড়ি ছাড়া একে এখানে আনা যাবে না। এ রোগী সাইকেলে বসে আসতে পারবে না।

–তুমি ঠিক বলেছ। অতসী দিদিমণি বললেন, সেই থেকে আমি আর ডাক্তারবাবু অনেক ভেবেছি, কিন্তু কোনো কূল-কিনারা করতে পারিনি। এ যে কাদের ঘরের বউ বোঝা দায়। যেভাবে মায়ের দয়া হয়েছে দেখলেই ভয় লাগে। দিদিমণি নির্দেশ দিলেন, আর দেরী না করে একে আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে যাও। রোগটা তো ভালো নয়। ছোঁয়াচে।

ইতস্তত করছিল অবনী। কিন্তু ইতস্তত করে কোনো ফল হবে না বুঝতে পেরে সে দুহাত বাড়িয়ে বউটাকে তুলে আনল বুকের কাছে। বেশ ভারী শরীর। হাত কাঁপছিল তার। এ সময় কেউ যদি সাহায্য করত ভীষণ ভালো হত। কিন্তু সে পথ বন্ধ। নাইটের লোক আসবে আটটার পরে। ততক্ষণ শীত হাওয়ায় যুঝতে পারবে বউটা? অবস্থা দেখেশুনে ভালো ঠেকে না অবনীর।

হাঁটতে হাঁটতে সে দিদিমণির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ডাক্তারবাবু কি বলছেন? বউটা বাঁচবে তো, দিদি?

তা আমি কি করে বলব! হাসপাতালে যখন এসেছে তখন আমাদের সবরকম চেষ্টা করে দেখতে হবে। রোগীকে তো আমরা ফেলে দিতে পারি না। অতসী দিদিমণির কথা শেষ হল না একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পৌঁছে গেল অবনী। ছোটবেলায় তার একবার বসন্ত হয়েছিল–সেই ভয় তাড়া করছে তাকে। অতসী দিদিমণি বললেন, একে একেবারে ভেতরের ঘরে ঢুকিয়ে দাও। বারান্দায় রাখলে শীতে কষ্ট পাবে। মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তার উপর একটা সাদা চাদর পেতে দিল অবনী। বউটাকে শুইয়ে দিয়ে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

অতসী দিদিমণি বললেন, যা করার তাড়াতাড়ি করো। ডিউটি রুমে কেউ নেই। আমাকে আবার যেতে হবে। তবে যাওয়ার আগে ওষুধগুলো তোমাকে দিয়ে যাই। তুমি একটু যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিও।

তাড়াহুড়ো করছিলেন অতসী দিদিমণি। তার তাড়াহুড়োর কোনো কারণ বুঝতে পারল না অবনী। হাত বাড়িয়ে কাগজে মোড়ানো ওষুধগুলো নিয়ে নিল সে। এখানে জলের কোনো ব্যবস্থা নেই। ওষুধ তো হাওয়া দিয়ে গেলানো যাবে না। বিরক্ত অবনী দিদিমণিকে বলল, একটু জলের ব্যবস্থা করে দিন। ওষুধগুলো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

-ঠিক আছে আমি জল নিয়ে আসছি। তুমি দাঁড়াও। ফুল তোলা রুমালে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছলেন অতসী দিদিমণি, তারপর ব্যস্ত হয়ে বললেন, আমি যাব আর আসব। তুমি কোথাও যেও না অবনী। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, কী ফ্যাসাদ! কী যে হবে–ভগবানই জানে!

কাচের বড়ো গ্লাসে জল নিয়ে এলেন দিদিমণি। চোখ-মুখ তার শুকিয়ে গিয়েছে ভয়ে। বেশি কথা বলতে চাচ্ছেন না ইচ্ছে করে। কথা বললে দুর্বলতা যদি ধরা পড়ে যায় অবনীর কাছে, তাহলে সেবার নাম করে মহান সাজবেন কি করে?

অবনী বহু কষ্টে ওষুধ খাওয়াল বউটাকে, অতসী দিদিমণি তাকে ছুঁয়েও দেখলেন না। এমন কি কাছেও গেলেন না তিনি। শুধু আপন মনে বিড়বিড়িয়ে বললেন, কার কপালে যে কি লেখা আছে কে জানে! যা ছোঁয়াচে রোগ! ভাবতেই পারছি না।

অতসী দিদিমণি চলে যাওয়ার পর একা হয়ে গেল অবনী। দুর থেকে বউটার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথায় বুক ভেঙে গেল তার। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে? কিসের জন্য তাহলে এই পৃথিবীতে আসা। মানুষ না হয়ে পাথর হলে বুঝি ভালো হত। এত কষ্ট পেতে হত না। রোগ জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরতে হত না। দেখে-শুনে যা মনে হয় বউটা নিশ্চয় কোনো বড়ো ঘরের। যারা তাকে ফেলে পালিয়েছে তারাও নিশ্চয়ই বড়োঘরের। অসুখ-বিসুখ কি ঘর বুঝে আসে!

মনে একদলা ঘেন্না নিয়ে অবনী ডিউটি রুমের কাছে এসে দাঁড়াল।

অতসী দিদিমণি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কোয়ার্টারে যাও। এখানে আর দাঁড়িও না। তোমার গা দিয়ে পচা-দুর্গন্ধ বেরচ্ছে। তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় ছেড়ে স্নান করে নাও। না হলে কী হয় বলা যায় না তো! যা দেখলাম-চোখও এর আগে এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেনি। হায় ভগবান, কেন দেখলাম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *