০৭. চোখের জলের মূল্য

৩১.

এক ফোঁটা চোখের জলের মূল্য বুঝতে পারে না অবনী, মন কেমন করা চোখে সে তাকিয়ে থাকে দুরের দিকে যেন সে কিছু দেখছে না, তাকে দিয়ে জোর করে কেউ কিছু দেখিয়ে নিচ্ছে। ইচ্ছে না থাকলেও অনেককেই অনেক কিছু দেখতে হয়, চিনতে হয় পৃথিবীর ধুলো মাটি, আলো-আঁধার, ঘাসফুল অথবা বিছুটিলতার জ্বলন। জ্বলার বুঝি শেষ নেই! জ্বলতে জ্বলতে ওড়ে অঙ্গার, ছাই ওড়া দুপুরের মতো মন একবার হাহাকার করে ওঠে, হয়ত বা হাট্রি-ট্রি পাখির মতো গলা ফাটায়, ফিরে আয় রে, যাস নে, বাছা। এ ঘর ছেড়ে কোথায় যাবি? ফেরার জন্য পথে পা বাড়ায়নি শুভ। একথা অবনী ভালো মতন জানে। চৌদ্দ বছরে পা দেওয়া ছেলেটা এই টুটাফাটা হাড়জিরজিরে সংসারটাকে মনে করে বুড়ো ঘোড়া, যে দৌড়োতে পারে না, আর দৌড়ালেও কিছুটা গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে, লাল ঝরায় মুখ দিয়ে, ড্যামা ড্যামা দু-চোখে ফুটিয়ে তোলে খরায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের দুঃখ-দীনতা। অবনী তবু আনমনে বলে, যে দিনটা যায়, সে দিনটাই ভালো। দিনকে ভালো না বেসে উপায় কি। সে এক অক্ষম মানুষ। তার আর কিছু করার নেই। দু-মুখো সাপের মতো মনটা শুধু মোড়া মারে, ধড়ফড় করে। একটা ভয় এসে খামচে ধরে বুক। শুকিয়ে আসে গলা। বারবার সেঁক গিলেও স্বস্তি মেলে না। ক’দিন ধরে অবনীর যে কী হয়েছে তা সে বুঝে উঠতে পারে না। সব কিছু হচ্ছে, তবু না হওয়ার একটা বোধ বা অনুভূতি কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। মন বসছে না কাজে-কর্মে। ঝাট দিতে গিয়ে ময়লা ফেলে ভুল করে চলে যাচ্ছিল, ডলি দিদিমণি রুক্ষ স্বরে বললেন, অবনী কাজটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। কাজ যখন করবে মন দিয়ে করবে। কাজে ফাঁকি দিলে তুমি আমার সঙ্গে ডিউটি নিও না।

অতসী দিদিমণি সহজে কঠিন কথা বলেন না। রাগেনও না চট করে। তবে রেগে গেলে আর রক্ষে নেই। যতক্ষণ না রাগ পড়ছে-ততক্ষণ কেবল মনের ভেতর গজ গজ। আসলে সাদা মনের মানুষগুলোই এইরকম। অবনী চুপ করে থাকলেও তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ভালো মানুষদের চটিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া এই বয়সে আর রাগঝাল মানায় না। রাগ করবে কার উপর? দায়ের উপর কুমড়ো পড়লে কুমড়োই কেটে দু-ফাঁক হয়ে যায়। কোথায় দিদিমণি আর কোথায় সে! আসমান জমিন ফারাক। অবনী হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এল হাসপাতালের মাঠটা। এই সময় চাড় বেঁধে আছে ঘাস। ঘাসমুখে ফুল এসেছে নাকছাবির মতো। কত অজস্র ফুটে আছে। কেউ দেখে, কেউ দেখে না। কিন্তু এসব চোখ এড়ায় না অবনীর। ঘাসকে মনে হয় লতায়-পাতায় আত্মীয়। কত বছর ধরে এরা বেঁচে আছে সাক্ষী থাকছে মানুষের বেঁচে থাকার। আহা, কি মমতায় মাটি আঁকড়ে রেখেছে তাদের। দেখলে আর চোখ ফেরান যায় না। কী ভেবে মাথা নীচু করে অবনী মাটির দিকে তাকাল। শুয়ে থাকা মাটি যেন উঠে বসল, বলো, ডাকছ কেন?

শুভটা কোথায় গেল বলো তো? অবনীর চোখের কোণ আর্দ্র হয়ে উঠল। বেলা তখন কত হবে, বড়ো জোর বারোটা। শীতের রোদ দুধদাঁতের কামড় ছেড়ে রাগী কুকুরের দাঁতের মতো কামড়াচ্ছে গতর। আজ যে বাতাসে কি ছিল কে জানে-অবনীর মনে হল আজ বড়ো আনন্দের দিন। সকালে কলতলায় ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে গিয়ে সে দেখেছিল দুটো শালিক ঘুরঘুর করছিল হেলেঞ্চা ঝোপের পোকা খাওয়ার জন্য। রোজই আসে শালিক দুটো। খুব ভাব ওদের মধ্যে। সামনের ছোট্ট মাঠটাতে চরে বেড়ায়, কখনও উড়ে যায় পালপুকুরের পাড়ে। ওদের দেখলে শুভর শরীরে খুশির দেবতা বুঝি ভর করে। হাত নেড়ে, চোখ নাচিয়ে গলা ফাটিয়ে সে বলবে, মা, দেখে যাও দুই শালিক।

সরস্বতী বাইরে বারান্দায় এসে টুকি মেরে দেখবে সত্যিই তো দুটো শালিক পাশাপাশি চরছে। ওরা কত সুখী। তারা কেন শালিক পাখি দুটোর মতো পাশাপাশি থাকতে পারে না। অবনী এমনিতে শান্ত, হাবাগোবা। তার শরীরে রাগ বলে যে কোনো বস্তু আছে এটা খুব কমই টের পায় সে। তবে যারা রাগে না, হঠাৎ রেগে গেলে তাদের রাগ আর চট করে নামানো যায় না। এ-ও এক অসুখ। সরস্বতী ছেলের আবদার মেটাতে ড্যাবডেবানো চোখে দেখে জোড়া শালিক। জোড়া শালিকের মাহাত্ম তার মগজে ঢোকে না। সে মুখ মানুষ। পড়া লেখা শেখেনি। নাম সই করতে পারে না। শুভ তাকে হাজার চেষ্টা করেও নাম লেখা শেখাতে পারেনি। হাল ছেড়ে দিয়ে সে বলেছে, মাত্র তো কটা অক্ষর, তাও ঠিক করে লিখতে পার না?

-লেখা কি মুখের কথারে, বাবা! এর চেয়ে নকসা বড়ি দেওয়া আর জিলিপি ভাজা সহজ।

কী যে সহজ কী যে কঠিন–তা বোঝার বয়স হয়নি শুভর। সে শুধু পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু জানে না। মনের মধ্যে একটা জেদ এসেছে, জেদটা উইটিপির মতো নয়, একেবারে পাথরের মতো শক্ত। সে হারবে না। মন দিয়ে লেখাপড়া শিখবে। তাকে বড়ো হতে হবে। মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। এই এক অস্ত্র যার সঙ্গে সে যেতে পারবে অনেক দূর। ভয় পেলে, ঘাবড়ে গেলে চলবে না। লেখাপড়া শিখে যে করেই হোক তাকে একটা ভালো চাকরি পেতেই হবে। যাদের টাকা-পয়সা নেই, গরীব মানুষ–তাদের এ ছাড়া আর কী থাকতে পারে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য। পাতলা গোঁফের রেখা ফুটলেও শুভ বুঝে গিয়েছে–লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই তার জীবনে। খুব অল্প বয়স থেকেই দারিদ্রের দাঁত খিচুনি তার ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে সে। এই তো, মাত্র কদিন আগে, বাবা তাকে অঙ্ক খাতা কিনে দিতে পারেনি। পারেনি তারজন্য কোনো আক্ষেপ নেই মানুষটার। শুভ লক্ষ্য করেছে–তার বাবার মুখখানা। কোনো আক্ষেপ বা দুঃশিন্তা নেই। বরং গলা উঁচিয়ে বলেছে, দাঁড়া, হাসপাতাল থেকে সাদা কাগজ এনে দেব। তখন লিখবি।

-এনে দেবো বলো। দাও না তো? শুভর মুখের দিকে তাকাতে পারে না অবনী, নিজের ছায়াকে যেন ভয় পায় সে। বুঝতে পারে–লেখাপড়া শেখা চোখ আগুনে তাতানো তীরের চেয়েও মারাত্মক। স্যাট করে মাথা নামিয়ে নেয় সে। শুভও এই সুযোগটা নিতে কোনো কসুর করে না, ধাতব শব্দ বের করে দেয় গলা থেকে, সুবীরকাকুর সঙ্গে তুমি বারান্দায় বসে কি খাচ্ছিলে আমি সব দেখেছি।

কি দেখেছিস তুই? অবনী ফুঁসে উঠতে চাইল। সে ভেবেছিল তার গলার জোরে ভয় পাবে শুভ, এবং চুপ করে থাকবে। কিন্তু তা হল না। শুভই যেন ছিটিয়ে দিল কাদা, বোতলে কী ছিল ভাবছ কেউ বুঝি জানে না। আমি মাকে সব বলেছি। মা বলেছে ডাক্তারকাকুকে বলবে। তখন দেখবে তোমার কি হয়! ছেলেকে খাতা কিনে দিতে পার না, আর বসে বসে মদ খাও, তোমার লজ্জা করে না?

-মারব তোকে। ফুঁসে ওঠে অবনী।

 শুভ হার মানতে শেখেনি। মুখ বাড়িয়ে দেয় সে, মারো। মেরে শেষ করে দাও। আমি একটুও কাঁদব না। আমি মরে যাব। আমি আর বাঁচতে চাইনে।

শুভর চোখের জল আজ কী করে সব উথলে উঠছে অবনীর চোখে। দুপুরবেলায় এমন কাণ্ড না ঘটালেই তো পারত। সেই কবে থেকে শুনছে–সোমবার রেজাল্ট বেরবে। রেজাল্ট বেরনোর পর আবার দশদিনের জন্য ছুটি হয়ে যাবে স্কুল। ছোলাগাছে ফল এসেছে এখন। আর শীতটাও আছে জব্বর। খড়কুটো জড়ো করে গাছছোলা পুড়িয়ে খাবে বন্ধুরা মিলে। অবনী বলেছে, রেজাল্ট বেরলে দেশ যাব।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সরস্বতী প্রতিবাদ করেছে, দেশ যাব বললে তো আর যাওয়া হয় না! দেশ তো তোমার দেবগ্রাম নয় যে বাসে চড়লেই পৌঁছে দেবে! দেশ যাওয়ার জন্য গাড়ি-গাড়ি টাকা দরকার। কোথায় পাবে তুমি?

হাওয়া খুলে দেওয়া সাইকেল টিউবের মত চুপসে যায় মুখ, মিনমিনে গলায় অবনী যুক্তি দেখিয়েছিল, পয়লা তারিখ বেতন হয়ে যাবে। বাবু বলেছে! বেতন হয়ে গেলে আর চিন্তা কি!

বেতন কি ঘর অব্দি আসবে? সরস্বতীর গলায় ঠেলে ওঠে বিদ্রূপ, তোমাকে আমি চিনি নে। তুমি হলে ধার মাস্টার। চালের দোকান থেকে নিয়ে একেবারে মাছ-দোকান…সবখানে তোমার ধার।

–ধার কার নেই বলো তো? ধার আছে বলেই তো পৃথিবী সবার। কেমন বোকার মতো হাসতে থাকে অবনী। সরস্বতীর বদ্ধমূল ধারণা হয়–মানুষটা বোকার বোকা। ঘটে একফোঁটা বুদ্ধি নেই। ওর থেকে ছেলেটার বুদ্ধি হাজার গুণ ভালো। ভালো হলে কি হবে, ও তো কারোর কথা শুনবে না। মুখ মানুষের গোঁ শিং উচানো মহিষের গোঁ-এর চেয়েও মারাত্মক। কালিদাসের গল্প শুনেছে সরস্বতী। সেই লোকটা যে ডালে বসে আছে, সেই ডাল নাকি কাটছিল। আঃ, মরণ! অনেকদিন পরে জোড় মিলেছে মানুষটার। সরস্বতী বুঝে পেল না সে কাঁদবে না হাসবে! শুধু কপালে করাঘাত করে ডুকরে উঠল, এর পাল্লায় পড়লে আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। আমাকে কিছু করতেই হবে। না হলে নিস্তার নেই।

খাকি ফুলপ্যান্টের উপর অবনীর হাতকাটা সাদা জামা। নীল বড়ি ছোপ ছোপ লেগে আছে তাতে। সরস্বতী কলপাড়ে গিয়ে বল সাবানে ঘষে ঘষে ধুয়েছে। এসব কাজে তার জুড়ি মেলা ভার, শুধু মুখটুকু যদি একটু মিঠে হত। মিষ্টি কথায় আজকাল কি না হয়। আসলে সরস্বতীর মুখের ভাষাটাই বুঝি নিম-তেত। জন্মের সময় ওর মা-বাবা বুঝি ওর মুখে নিমপাতার রস ঢেলে দিয়েছে, নাহলে অমন হবে কেন? বউটার শরীরে তার জন্য একটুও কি দয়া-মায়া নেই। কী নিষ্ঠুর বাপরে, বাপ! পারলে যেন গলা টিপে ধরে, দম আটকে মারে। আজই তো হয়ে যাচ্ছিল দফারফা। প্রোগ্রেস কার্ডটা নিয়ে শুভ যখন খুশিতে টগবগিয়ে ঘরে ঢুকল তখন হাসপাতাল থেকে ফিরে মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়েছিল অবনী। খোলা জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছিল তার পিঠের উপর। মন্দ লাগছিল না। আরামে জুড়ে এসেছিল চোখ। ঠিক সেই সময়, শুভ এল বিশ্ব জয় করে, খুশিতে ডগমগিয়ে বলল, বাবা, ওঠো। এই দেখ আমি সেকেন্ড হয়েছি।

মুখের পাশটা হাতে রগড়ে নিয়ে উঠে বসেছিল অবনী, চোখ ডলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল সে। আসলে জড়িয়ে যাওয়া ঘুম, আর জড়িয়ে যাওয়া শুয়োফল চট করে শরীর থেকে বিদেয় হতে চায় না। তবু অবনী আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, কই দেখি, তোর রেজাল্ট দেখি।

ভাঁজ করা রিপোর্ট কার্ডটা এগিয়ে দিল শুভ, বাবা, আমি বলেছিলাম ফাস্ট সেকেন্ড থার্ডের মধ্যে হবো–হয়েছি। তুমি বলেছিলে যদি স্ট্যান্ড করতে পারি সাইকেল কিনে দেবে। এবার কিন্তু তোমাকে কিনে দিতেই হবে। আমি আর কোনো কথা শুনব না।

বাইরের কুলগাছে বসে কাক ডাকছিল তারস্বরে। বাঁধের ওদিকে ঝগড়া বেঁধেছে বুড়িগাঙে মাছ ধরা নিয়ে। কড়া এবং অশ্লীল শব্দ বয়ে আনছিল বাতাস। অবনীর ম্যাজমেজানি স্বভাবটা শুধু শরীরে নয়, মনেও স্থায়ী তাঁবু গেড়েছে। অকারণে হাসপাতালে ডিউটি গিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে গালিগালাজ শুনতে হল। দোষটা তার নয়, দোষটা যে নাইট ডিউটি করেছে তার। প্রমথ পাশের গ্রাম কুলবেড়িয়া থেকে আসে সাইকেল নিয়ে। তার জমিজমা আছে ফলে ব্যস্ততার শেষ নেই। মন দিয়ে ডিউটি করাটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় নাহলে প্রায় সে ভুলে যায়। দু-নৌকোয় পা দেওয়া মন আজও ভুল করেছে কাজ। কথা ছিল আউটডোরটা ঝাট দিয়ে ময়লাগুলো ফেলে আসবে পাঁচিলের ওপিঠে। সেটা সে করেনি। রাউন্ড দিতে এসে প্রথমেই এটা লক্ষ্য করেন ডাক্তারবাবু, তাঁর মাথায় তখন রাগের কাঁকড়াবিছে কামড়ে দেয়। এ হাসপাতালের সর্বময় কর্তা তিনি। তার কথার অবাধ্য হওয়া মানে নিয়মশৃঙ্খলা রসাতলে যাওয়া। এটা কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না। বেতন নেবার সময় কেউ এক পয়সা কম নেয় না। পয়সা যখন কেউ কম নেবে না-তখন কাজ বুঝে নিতেই হবে। কাজে অবহেলা একটা মহা-অপরাধ। ধারেকাছে কাউকে না পেয়ে ডাক্তারবাবু অবনীকেই ডাকলেন হাতের ইশারায়। বেশ চড়া স্বরে বললেন, আউটডোরের সামনেটা ঝাট দিতে বলেছিলাম, ওটা আজও হল না কেন? সামান্য ঘাবড়ে গিয়ে অবনী বলেছিল, নাইট ডিউটির স্টাফ ঝাট দিয়ে যায়, বাবু। প্রথম বলেছিল ঝাট দিয়ে যাবে, হয়ত ভুলে গেছে। ঠিক আছে আমিই দিয়ে দিচ্ছি।

সব কাজে তোমাদের একটা অজুহাত তৈরিই থাকে। যত সব রাবিশ। গট-মট কবে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে চলে গিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। তার রাগটা যে কার উপর সেটা সঠিকভাবে বুঝতে পারে না অবনী। তবে তার মন খারাপ হয়ে গেল। রাগও হল প্রমথর উপর প্রচণ্ড। বড্ড কামচোর ছেলে। খালি ঘর যাবার ধান্দা। চাকরিটা ওর কাছে খেতের শাক তুলতে আসার মত। এ নিয়ে অনেকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে ওদের। অন-ডিউটির দিদিমণিরাই আবার মিটমাট করে দিয়েছেন। এক জায়গায় কাজ করতে গেলে ঠোকাঠুকি তো লাগবেই।

আউটডোরের সামনের দিকটা শান বাঁধানো। রোগীদের বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চি আছে দু-পাশে। রবিবার ছাড়া সপ্তাহের বাদবাকি দিন গ্রামের মানুষের ভিড় লেগে থাকে। কালীগঞ্জ ছাড়া আশেপাশের দশটা গ্রামে কোনো হাসপাতাল নেই। রুগীর চাপ তো থাকবেই। একা কুম্ভের মতো ডাক্তারবাবু একাই যেন একশ। টিকিটের উপর ঘ্যাসঘ্যাস করে ওষুধ লেখেন। ট্যাবলেট। মিক্সচার, ইনজেকশন আরও কত কী! ডিউটিতে এসে সব দেখেছে অবনী। মানুষটার ধৈর্যের কাছে মাথা নত করে সে। আসলে ধৈর্যটাই বড়ো কথা। ধৈর্য না থাকলে মানুষ বড়ো হতে পারে না। শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মধ্যে সে এমন স্বপ্ন দেখে বইকি। শুভই তার স্বপ্ন দেখা উসকে দিয়েছে। কুঁজোরও তো মন হয় চিৎ হয়ে শোওয়ার জন্য। এমন সখের মধ্যে দোষের কোনো গন্ধ নেই।

সকালের ঝামেলাটা মাথা থেকে যায় নি তখনও। শুধু শুধু কেউ কথা শোনালে এ বয়সেও রাগ হয়। সরস্বতী ঘর সামলাতে ব্যস্ত। সে এসবের ধার ধারে না’ এক কাপ চা চেয়েছিল সরস্বতীর কাছে, মাথা ধরেছে বলে। সে দেয়নি। উল্টে মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছে, ছেলেটা না খেয়ে ইস্কুলে গেল। ঘরে দুটো বিস্কুটও তো আনো না।

–আনব কি করে, এ সংসারে আগুন লেগেছে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পশুর মতো হাঁপাচ্ছিল অবনী। সরস্বতী তার রাগের পারদ চড়িয়ে দিল, অমন কাছা খোলা মানুষ জীবনে আমি দেখিনি, বাপু। হাড়-মাস জ্বালিয়ে খেল।

-চুপ কর। শুয়োরের মতো চেল্লালে দাঁত ভেঙে দেব।

-কই ভাঙো? এক বাপে জন্ম হলে ভাঙো। তোমার মায়ের দিব্যি রইল। ভাঙো। ধেয়ে আসা ঝড়ের মতো সরস্বতী আছড়ে পড়ল অবনীর নিঃশ্বাসের এলাকায়। চুলের মুঠি ধরতে চেয়েছিল অবনী, কিন্তু ধরল না। এ তো রোজকার নাটক। অভাবের সংসারে এর চেয়ে আরও কত কী ঘটে যায়। খুনখারাপি যে ঘটে না তা নয়। মেজাজ তেতো হয়ে গেলে হাতের সামনে যা পায় তাই দিয়ে রাগ শান্ত করতে চায় অনেকেই। অবনী সে পথে হাঁটল না। শুধু ঢোঁক গিলে বলল, আমার সংসারের ভাত তোমার কাছে তেতো লাগছে বুঝতে পারছি।

ঠোঁট মুখ বেঁকিয়ে সরস্বতী বলল, শুধু তেতো নয়, গলা দিয়ে বমি ঠেলে উঠছে। দাঁড়াও আর বেশিদিন নেই, যেদিন তোমার সংসারে লাথ মেরে চলে যাব।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ যাও। তুমি গেলে আমি মা বুড়োমার কাছে পুজো দেব। অবনী কথাগুলো বলল বটে, কিন্তু বলতে গিয়ে বুকের কাছে তার খচ্‌ করে উঠল। সরস্বতী চলে যাওয়ার অর্থ এ সংসারের প্রদীপ নিভে যাওয়া। এর আগে একবার ঝগড়ার জের ধরে ফলিডল খেয়েছিল সে। সে যাত্রায় ডাক্তারবাবু তাকে বাঁচিয়ে দেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে সরস্বতী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, বাবু, আমি বাঁচতে চাইনে। আমাকে এমন ওষুধ দিন যা খেয়ে আমি মরে যাই।

তোমার ছেলে আছে। তার মুখ চেয়ে তোমাকে বাঁচতে হবে। ধমকের সুরে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, যে ভুল করেছ তা আর দ্বিতীয়বার করতে যেও না। স্টমাক-ওয়াশ করার ঝামেলা কত তা তো নিজের চোখে দেখলে। প্রায় দশ-দিন হাসপাতালে কাটিয়ে সরস্বতী যেদিন ছাড়া পেল, সেদিন ডাক্তারবাবু অবনীকে ডেকে বলেছিলেন, দাঁত থাকতে যারা দাঁতের মর্ম বোঝে না তাদের আমি কী করে বোঝাব। মেয়েমানুষ ছাড়া ঘর-সংসার অচল। বুঝলে অবনী, মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে না পারো তবু অবহেলা করো না। এবারের মতো সরস্বতী বেঁচে গেল ভাগ্যের জোরে। মনে রেখো-ভাগ্য সবসময় সঙ্গ দেয় না। তখন কিন্তু সারাজীবন কপাল চাপড়াতে হবে।

কোন সংসারে অশান্তি নেই। ভাত যখন ফোটে তখন আগুন আর উত্তাপ তো থাকবেই। তবু মানিয়ে নেওয়াই মানুষের ধর্ম। সরস্বতী মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে বারবার হেরে গেছে। অবনীর মন কুকুরের লেজের মতো কখনও সোজা হতে চায় না, সোজা করলে কখন যে আবার বেঁকে বসে বোঝার সময়ও দেয় না। এসব কোনো কিছুই চোখ এড়ায় না শুভর। জ্ঞান হবার পর থেকে সে যেন ঘোরের মধ্যে ঘুরছে। হাসপাতালের টাইপ-ওয়ান কোয়ার্টারটাকে তার মনে হয় জেলখানা। এখানে ঢুকে এলেই তার যাবতীয় উৎসাহ, উদ্যম শাসকষ্টের রোগীর মতো ছটফট করে। সরস্বতী সব বুঝেও চুপ করে থাকে। ছেলের মাথায় স্নেহের স্পর্শ দিয়ে বলে, বড়ো হ। বড়ো হওয়ার আগে মনটাকে সবার আগে বড়ো কর। ব্যাঙাচির কাজে নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। শুভ বুঝতে পারে মায়ের এই কথাগুলোয় খুবই সূক্ষ্মভাবে হলেও বাবার প্রতি একটা কটাক্ষ লুকিয়ে আছে। এটা কতটা প্রয়োজনীয় বা আবশ্যিক তা জানা নেই শুভর। এ সম্বন্ধে সে জানতেও চায় না। বড়োদের মাঝখানে তার উপস্থিতি খুব প্রয়োজন আছে?

দুপুরে শুভ যখন এল তখন ঝগড়াটা থিতিয়ে গেছে। অবনী মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল সব কিছু। কিন্তু এসব তো আর শ্লেটের ওপর দাগ নয় যে জল ন্যাকড়ার সাহায্যে তা মুছে যাবে সহজে। মনের দাগ কলার কষের চাইতেও ভয়ানক। সেই টানা- পোড়নে কিছুট ধ্বস্ত অবনী। ডাক্তারবাবুর ধমক তাকে বেশি দুঃখ দিয়েছে। কেন হঠাৎ এত নিষ্ঠুর হতে গেলেন ডাক্তারবাবু। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? কারণ কোনো কিছুই নেই সেটা বারবার নিজেকে বোঝাতে চাইল অবনী। শুভ ঘরে ঢুকে এল মাথা উঁচু করে, আনন্দ আর গর্বে চকচক করছে তার কচি-কিশোর শ্যামলা মুখখানা। মুহূর্তে অবনীর মনে হয়েছিল ঐ মুখ যেন আঁটি না হওয়া কাঁচা হিমসাগর আম। ভালো লেগেছিল তার। শুভ যখন বলছিল, বাবা, আমি সেকেন্ড হয়েছি। এবার আমি ডাক্তারকাকুর মেয়েকেও হারিয়ে দিয়েছি। মাধুরীর চেয়ে আমি ছাব্বিশ নাম্বার বেশি পেয়ে সেকেন্ড হয়েছি।

যে সাড়া, আবেগ ও উত্তাপ অবনীর কাছ থেকে আশা করেছিল শুভ তা না পেয়ে বেশ কিছুটা বিমর্ষ দেখাল তাকে। অবনীর নীরব থাকার কারণ তার কাছে রহস্যময় ঠেকল। অবনী ভাবছিল সে যা কোনোদিনও পারবে না, শুভ ঠিক সেই কাজটা করে ঘরে এসেছে। ডাক্তারবাবুর মেয়েকে হারিয়ে দেওয়া মানে ডাক্তারবাবুকে কিছুটা হলেও হারিয়ে দেওয়া। মাথার উপর সব সময় যার ছড়ি ঘোরানোর অভ্যাস তিনি কি এই পরাজয় মেনে নেবেন? পরীক্ষার ফলাফলের খবর ডাক্তারবাবু কি আগে থেকে জানতে পেরেছিলেন? হতেই পারে। বড়ো মানুষদের লম্বা হাত। এ গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষই তো ডাক্তারবাবুর জানাশোনা। তার পক্ষে আগেভাগে রেজাল্ট জানা কোনো কঠিন কাজ নয়।

.

৩২.

খাঁচা ভাঙা পাখির মতো চোখ মেলে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিল সরস্বতী, যা শুনেছে তা মেনে নিতে কোথায় যেন বাধ বাধো ঠেকে। ডাক্তারবাবুর মেয়েকে হারিয়ে দেওয়া মুখের কথা নয়। মেয়েটা শুধু পড়াশোনাতেই নয়–দেখতেও চমৎকার। সপ্তাহে একবার হলেও সে এখানে আসবেই। ডাক্তারবাবুই বলেছেন, লেখাপড়া কনসাল্ট করে পড়লে ব্রেন খোলে। একা না থোকা।

মাধুরী আসত। শুভও যেত। মাধুরীর সব বই কেনা আছে। শুভ পাঠ্যপুস্তক কিনলেও মানে বইগুলো কিনতে পারেনি। মাধুরীই বলেছে, তুই আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়বি যখন যা দরকার নিয়ে যাবি।

অবনী পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে হাত চেপে ধরল শুভর, ভালো করে পড়। সেকেন্ড হয়েছিস, এবার তোকে ফার্স্ট হতে হবে।

–সে আমি হবোখন। শুভর কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস, স্ট্যান্ড করলে আমাকে সাইকেল কিনে দেবে বলেছিলে। কথাটা মনে আছে তো?

কেমন ভ্যাবাচেকা খাওয়া চোখে তাকাল অবনী, ঢাক গিলে বলল, স্ট্যান্ড করা মানে?

-ফাস্ট সেকেন্ড থার্ডের মধ্যে হওয়া। আমি হয়েছি। এবার তুমি আমাকে সাইকেল কিনে দাও। আমি আর পরের সাইকেল চালাব না। শুভ আশার চোখে তাকাল।

অবনী ছেলেকে আশ্বস্ত করতে পারল না, বরং ভোল পাল্টে গেল তার, বললাম তো ফার্স্ট হ, ফার্স্ট হলে কিনে দেব। এখন সাইকেল চালাতে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে। তোর আর পড়া হবে না তখন।

–তাহলে দেবে না?

–বললাম তো দেব।

-মিথ্যুক। শুভর চোখ জলে ভরে এল অভিমানে। সরস্বতী নীরব দর্শক। ঘরে চাল নেই সেদিকে খেয়াল নেই অবনীর। অথচ কথা ছিল চাল এনে দিয়ে সে বাজারে যাবে। পরীক্ষার ফল বেরবে, আজ মাছের ঝোল খেয়ে যাবে শুভ। মনে মনে এমনই একটা ইচ্ছে ছেলেটারও ছিল। কিন্তু যে এসব করবে–সেই মানুষটি যে নির্বিকার। তার নিঃস্পৃহতায় মনে মনে দুঃখ পেয়েছে সরস্বতী। অভাবের ঘরে টাকা হল চাঁদের আলো। যার টাকা আছে, তার জ্যোৎস্না আছে। কোনো কিছুই ব্যবস্থা করতে পারেনি সরস্বতী। সময় নষ্ট না করে ইস্কুলে চলে গিয়েছিল শুভ।

অবনী হাঁ করে তাকিয়ে আছে শুভর মুখের দিকে, কি বললি তুই, আমি মিথ্যুক?

মাথায় রক্ত উঠে যাওয়া শুভ বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ তুমি মিথ্যুক। তোমার কথার কোনো দাম নেই। কথার দাম থাকলে আমাকে ঠিক সাইকেল কিনে দিতে।

শুভর হাতটা ধরে রাগের ঘোরে মুচড়ে দিল অবনী। ঠেলা মেরে বলল, বেরো আমার ঘর থেকে। মার রক্ত পেয়েছিস, তাই অমন জানোয়ার হচ্ছিস। বাঁচতে চাস তো পালা। নাহলে মেরে তোর হাড় সার বানিয়ে দেব।

কি বলছ তুমি? পাগল হলে নাকি? সরস্বতী ছেলের সমর্থনে রুখে দাঁড়াল, লজ্জা করে না শিক্ষিত ছেলের গায়ে হাত তুলতে?

-আহা রে, কী আমার শিক্ষিত। ঠোঁট-মুখ উল্টে অবনী বলল, ক লিখতে কলম ভাঙে সে আবার শিক্ষিত। ছ্যা!

কঠিন শব্দগুলো বোলতার মতো তাড়া করে শুভকে। কালবিলম্ব না করে শুভ প্রোগ্রেস রিপোটটা দল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ে দেয় তক্তপোষের উপর। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এক ঝলক সে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর তীরের মতো ছুটতে লাগল বাঁধের দিকে।

জগৎখালির বাঁধ কোথায় যে গিয়ে শেষ হয়েছে তার শেষমুড়ো আর দেখা হয়ে ওঠেনি শুভর। তবে ভূগোলের মাস্টারমশাই সুদামবাবু একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, জগৎখালির বাঁধ যদি কোনোদিন ভেঙে যায় তাহলে নদীয়া বর্ধমান আর মুর্শিদাবাদ জেলার বহু গ্রাম ভাগীরথীর জলে তলিয়ে যাবে। সে দৃশ্য চোখে দেখা যাবে না। মানুষের হাহাকার চাপা দিয়ে দেবে পাখির কলকাকলি।

কথাগুলো শুনতে শুনতে চোখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল শুভর। বুনোপাড়ার রঘুনাথের সঙ্গে তার এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। রঘুনাথ বলেছে, দাঁড়া, একটা সাইকেল কিনি তারপর তোকে সাইকেলে চাপিয়ে বাঁধের কোথায শেষ দেখিয়ে নিয়ে আসব। তবে আমি এই বাঁধ ধরে পলাশী মনুমেন্টের কাছ অব্দি গিয়েচি। আঃ, কি সুন্দর জায়গা রে, দেখলে চোখ ভরে যায়। তুই যদি যেতে চাস তোকেও নিয়ে যেতে পারি।

রঘুনাথের কথাগুলোয় খোঁচা ছিল কিনা, তা বুঝতে পারে না শুভ। তবে একটা সরল বিশ্বাস থেকে সে যে এই কথাগুলো বলেছে তা অনুভব করতে পারে সে। যতদূর তার ধারণা রঘুনাথের মনে এত মার প্যাঁচ নেই, সে দেবদারু গাছের মতো সহজ-সিধা। কোনো উপর চালাকি নেই বলেই সে বোমভোলা শিবের মতো দেখতে। শিবঠাকুরের থানে মানত করে ছিল দুর্গামণি, ব্যাটাছেলে হলে ঢাকঢোল বাজিয়ে ঘটা করে পুজো দেবে। মানত করার বছর না ঘুরতেই রঘু পেটে এল। শুকিয়ে যাওয়া সংসারে আবার নতুন করে প্রাণ এল, রোদে পোড়া গাছগুলো বর্ষার জল পেয়ে যেমন তরতাজা হয়ে ওঠে তেমনই চনমনে আর ফুর্তিবাজ হয়ে উঠল গুয়ারাম। হাসি মস্কারা মেরে বলেছিল, মরা ডালে ফুল এয়েচে গো, এবার নের্ঘাৎ ফল হবে।

.

আপদে-বিপদে যে বাঁশি সাথ দেয় রঘুনাথের সেই বাঁশিকে চালে গুঁজে রেখে এসে সে শান্তি পায় না। মন খারাপের সময় এই বাঁশি তাকে সান্ত্বনার সুর শোনায়। চুনারাম যেন সুর হয়ে তার সারা অঙ্গে অদ্ভুত একটা যাদুছোঁয়া দিয়ে যায় যা ভাষায় সে প্রকাশ করতে অক্ষম। জ্যোৎস্না থকথকে রাত রঘুনাথের বাঁশির সুর হাওয়ায় ভর দিয়ে পৌঁছে যায় শুভর কানে। এত ভালো বাঁশির সুর সে রেডিও ছাড়া আর কোথাও শোনেনি। পড়া থামিয়ে বাইরে এসেছিল শুভ। সুরের টানে পৌঁছে গিয়েছিল হাসপাতালের বারান্দায়। যেখানে পনেরই আগস্ট, ২৬শে জানুয়ারি পতাকা তোলা হয় সেই সিমেন্ট বাঁধানো বেদিতে বসে বাঁশিতে এক নাগাড়ে ফুঁ দিয়ে চলেছে রঘুনাথ। জ্যোৎস্নার আলোর মতো সুর যেন গড়িয়ে নামছে ঘাসের পালঙ্কে। শুভ গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, রঘুনাথের তা খেয়াল নেই। বাঁশি থামতেই চোখাচোখি হল ওদের। শুভ দেখল রঘুনাথ তার চাইতে বছর দু-তিনেকের বড়া হবে। তবে তার পেটা চেহারায় মেহনতী মানুষের সব লক্ষণগুলো পরিস্ফুট। শুভই প্রথম বলেছিল, ভারী চমৎকার বাঁশি বাজাও তো তুমি। রঘুনাথ এ কথাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বলেছিল, আমি বাঁশিতে গান বাজাতে পারি। শুনবে?

সেদিন একটা শ্যামা সংগীত শুনিয়েছিল রঘুনাথ। সব শোনার পর শুভর মুখে কোনো কথা নেই। আবেগতাড়িত স্বরে সে বলেছিল, একটা কথা বলব, রাখবে?

-বলে ফেলো।

–আমাকে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দেবে।

-বাঁশি বাজানো শেখানো যায় না, রঘুনাথ নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে বলেছিল, রক্তে যদি সুর থাকে তাহলে তা বাঁশি বা গলা ফুঁড়ে বেরবে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না। তবে সবার আগে তোমার একটা বাঁশি থাকা দরকার। আগে জানলে তোমার জন্য একটা বাঁশি সংগ্রহ করে রাখতাম। তা যখন হয়নি, তখন একটা কাজ করতে পারো।

-কি কাজ?

 –তোমার বাবার বেতের বাঁটের ছাতা থাকলে নিয়ে এসো, আমি বাঁশি বানিয়ে দেবো।

সত্যি সত্যি বাঁশি বানিয়ে দিয়েছিল রঘুনাথ। বাঁশিতে ফুঁ দেওয়াও শিখিয়ে দিয়েছিল তাকে। শুভ চারা আনা আটআনা যখন যা পারত রঘুনাথকে দিত। রঘুনাথ ইতস্তত করলে সে বলত, আমি তো তোমার বন্ধু। বন্ধু কিছু দিলে নিতে হয়। না করতে নেই।

নেব, কিন্তু তার আগে চলো সই পাতাই। রঘুনাথ জোর করে হাত ধরে ছিল শুভর, চলো, আমরা জুড়ানপুরের মা কালীকে সাক্ষী রেখে মিতে হই। তাহলে আমাদের সম্পর্ক কেউ জ্বালিয়ে দিতে পারবে না। কান ভারি করতে গেলে সবাই ভয় পাবে।

সই পাতানোর পরে এ-ওর হাত ধরে ঘুরেছিল মন্দির চাতালে। শুভ বলেছিল, আজ থেকে আমাদের তুই-তোকারির সম্পর্ক। চল, আজ আর ঘরে যাবো না। তোর সাথে ঘুরব। যেখানে মন চায় যাব।

-তোর মা যদি খোঁজে।

-খুঁজুক। কিছু হবে না। শুভর কণ্ঠস্বরে জেদ। এ পৃথিবীকে সে যেন নতুনভাবে দেখতে চায়। রঘুনাথ তার চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়িয়ে দেয়। শক্ত মুঠোর মধ্যে শুভর হাতটা চেপে ধরে বলে, এতদিন তুই একা ছিলিস। এবার আমি তোর পাশে থাকব। কিছু হলে আমাকে তুই ডাক পাড়বি। আমি ঠিক চলে আসব।

-তোকেও বলা থাকল। তোর আপদে-বিপদে যেন দৌড়ে যেতে পারি। সেই সুযোগ যেন ভগবান আমাকে দেয়।

শুভর কথাগুলোয় আবেগ থাকলেও এ তার মনের কথা। রঘুনাথকে তার মনে ধরেছে। এ গাঁয়ে তার বন্ধুর অভাব নেই, তবু রঘুনাথ যেন সবার চাইতে আলাদা। বছর পাঁচেক আগে তার সাথে আলাপ হলে কী ভালোই যে হত। রঘুনাথ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সে গাছে উঠে পাখির বাচ্চা ধরে আনতে পারে, দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া হেলেসাপের লেজ বনবন ঘুরিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। এক নিঃশ্বাসে ডুব দিয়ে সে মাটি তুলে আনতে পারে পালপুকুরের। খেপা শেয়ালকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গ্রামের বাইরে বের করে দিয়ে আসে। এত যার সাহস, সেই রঘুনাথের নাম রঘুবীর’ হওয়া উচিত ছিল। গত দু-বছরে রঘুনাথ শুভর অনেক কাছাকাছি। সময় পেলে শুভ হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ওদের বাড়ি। কিন্তু হাজার ডাকলেও রঘুনাথ আসতে চায় না তাদের কোয়ার্টারে। একটা ভয়, সঙ্কোচ তার ভেতরে সবসময় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু রঘুনাথ কেন, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এই একই রোগে আক্রান্ত। শুভ বুঝিয়ে বললেও কথাগুলো বুঝি বোধগম্য হয় না।

এত দূরে চলে এসেছে সে। এখান থেকে হাসপাতালের কোয়ার্টারগুলো ধোঁয়ায় ডুবে থাকা ছবির মতো দেখা যায়। আজ যেন পাগল হয়ে গিয়েছে হাওয়া। গাঙ-পালানো বাতাস যেন ভরপেট মদ খেয়ে মাতলামি করছে রোদেব সংসারে ঢুকে। ওই টালমাটাল বাতাস ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে খেজুরগাছের ঝাঁকড়া মাথা। যতবারই এদিকটাতে এসেছে ততবারই আনন্দে মন ভরে গেছে। শুভর। কোনোবারই তার মনে হয় না একই দৃশ্য দেখছে। পট পরিবর্তন ঘটেছে ঋতু আর দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে। এবছর আমের শাখায় মুকুল এসেছে সাত তাড়াতাড়ি, ফলে সুগন্ধে ম-ম করছে বাঁধের চারধার। আর সেই সুগন্ধ ধীরে ধীরে শরীরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে তিরতিরে স্রোতের মৌরলা মাছের মতো রূপো চকচকে জলের বুড়িগাঙ।

শুভ কী করবে ভাবছিল, চেনা-জানা কারোর সঙ্গে এসময় দেখা হলে সে যে সমস্যায় পড়ে যাবে এই ভাবনা কিছুটা হলেও তাকে কাবু করে ফেলেছে। আজ ইস্কুলে রেজাল্ট আউট হবার পর সবাই কেমন তার দিকে ভ্যালভ্যাল করে দেখছিল। সে তত পড়াশোনায় ভালো, তবু, অমন করে ড্যামাড্যামা চোখে তাকে দেখার কি আছে–বুঝতে পারেনি সে। তবে একটা কথা তার আনন্দের প্রদীপটাকে ফুঃ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে। সুপ্রিয় পোদ্দার তাদের ক্লাসেই পড়ে, সে পড়াশোনাতে ভালো, ওর বাবার রেশন-দোকান আছে বাজারে। অবস্থা ভালো বলে একটা প্রস্ফুটিত অহঙ্কার তাকে শিমুলফুলের মতো রাঙা করে রাখে। মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা তাকে বিশেষভাবে তোয়াজ করেন কেননা শিবশঙ্কর পোদ্দার এই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার। সেই সুপ্রিয় মাধুরীকে বলছিল, একটা মেথরের ছেলের কাছে হেরে গেলাম। ও কি করে এত নাম্বার পেল জানি না। নিশ্চয়ই কিছু লণ্ডভণ্ড হয়েছে।

কথাটা শোনার পর মাধুরীর মুখের রঙটাই পাল্টে গিয়েছিল সহসা, কী উত্তর দেবে ভেবে পায়নি সে। অস্বস্তিতে ঘেমে উঠেছিল মাধুরী। নখ খুঁটে পায়ের দিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট কামড়ে ধরল অজান্তে। কিছু শোনার জন্য সুপ্রিয় মাধুরীর ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়াল। মাধুরী নিজেকে সামলে নিয়ে সেঁক গিলে বলেছিল, তোর এত ছোট মন, আমার জানা ছিল না। ভালো জামা কাপড় পরলেই মানুষ যে ভালো হয় তা নয় দেখছি! শুভ আমাদের বন্ধু। ও পড়াশোনা করে সেকেন্ড হয়েছে। ওকে হিংসে করলে আমরা কেউই মহান হয়ে যাব না।

সুপ্রিয় হার মানার পাত্র নয়, এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মাধুরীকে সে উচ্চ কণ্ঠে বলল, তোর থেকে কেউ বেশি নাম্বার পাক এটা আমি সহ্য করতে পারি না। আমার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি তোকে একশোর মধ্যে একশ দিয়ে ফার্স্ট করিয়ে দিতাম।

–এতে তোর কি লাভ হোত?

মাধুরীর প্রশ্নে সুপ্রিয় ঢোঁক গিলে বলল, সে তুই বুঝবি না। কথাগুলো বলে মুখ নীচু করে দাঁড়াল সুপ্রিয়। সেও ঘামছিল কোনও কারণে, মনে মনে চাইছিল মাধুরী তাকে সমর্থন করুক। মুখ ফুটিয়ে না যোক অন্তত চাহুনিতে তা প্রকাশ পাক। তেমন কোনো কিছু প্রতিক্রিয়া পরিস্ফুট হল না মাধুরীর হাবভাবে। সে গভীর কুয়োর মতো দৃষ্টি মেলে চলে যেতে চাইল ক্লাস রুমে। সুপ্রিয় তাকে বাধা দিল, এখন যাস না, একটু থাক। তুই কাছে থাকলে আমি শক্তি পাই।

–আজেবাজে বকিস না। বিন্দু দিদিমণিকে বলে দেব তাহলে। যা, সরে যা। আমাকে যেতে দে। বিরক্তি উথলে উঠল মাধুরীর চোখে। সুপ্রিয়কে পাশ কাটিয়ে সে দেখল থামের আড়ালে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। সব কথা শুনেছে হয়ত, নাহলে কেন ছলছল করছে ওর চোখ জোড়া। এইরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে মাধুরীর কি করা উচিত ভেবে পেল না। ক্লাসরুম থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি বাইরে ছুটে আসছে। এখনও রেজাল্ট হাতে পায়নি কেউ। ঘন্টা পড়লে ক্লাস-টিচাররা প্রোগ্রেস-কার্ড নিয়ে যে যার ক্লাসে ঢুকে যাবেন। প্রথানুযায়ী প্রেয়ারের লাইনে। হেডমাস্টারমশাই যারা ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হয়েছে তাদের নাম ঘোষণা করে দিয়েছেন। তার সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ হবার পরেই জনগণমন’। এই সোরগোলের পিছনে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া প্রচ্ছন্নভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে যা আজকের দিনে স্বাভাবিক।

ক্লাস এইটের ক্লাস-টিচার মাথুরবাবুর আসার সময় হয়ে গেল। মাধুরী কিছু ভেবে না পেয়ে বোকার মত শুভর মুখোমুখি দাঁড়াল। সে কিছু বলার আগে শুভ চোখ রগড়ে নিয়ে বলল, আমি সব শুনেছি। যা সত্যি সুপ্রিয় তো তাই বলেছে। অমন কথা শুনে শুনে আমার আর এখন কোনো কষ্ট হয় না। আসলে কি জানিস, এত কষ্ট পেয়েছি–এগুলো আর কোনো কষ্ট বলে মনে হয় না। শুভ’র চোখ চঞ্চল হয়ে উঠল সামনের দিকে তাকিয়ে, চল, মাথুর স্যার আসছেন।

মাধুরী ফ্যাকাসে চোখে শুভকে দেখছিল, তুই এত মনের জোর কোথায় পাস?

–অভাবই আমাকে বলবান করেছে। তুই দেখিস–আমি হারব না। আমাকে বড়ো হতেই হবে। শুভ লম্বা লম্বা পা ফেলে ক্লাস-রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই মাধুরী তাকে অনুসরণ করল।

যার মনে এত জেদ, এত সহজে তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলা কি উচিত হয়েছে? সব ঘরেই কিছু না কিছু অশান্তি লেগেই থাকে। সবার মন-মেজাজ সব সময় এক থাকে না। বাবার সামান্য কথায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলা উচিত হয়নি শুভ’র। এমন ব্যবহার যাদের পেটে বিদ্যে-বুদ্ধি নেই তারা করলেই শোভা পায়। লগি ঠেলে ঠেলে, পাকমাটি ঘেঁটে শিক্ষার নৌকো নিয়ে এগোচ্ছে শুভ। এ সময় এত উতলা হলে, আত্মকেন্দ্রিক ভাবনায় মগ্ন হলে চলবে না। লোকে তাহলে বলবে স্বার্থপর। অবনীর দুঃখটা ছেলে হয়ে সবার আগে তার বোঝা উচিত ছিল। সেকেন্ড হয়েছে বলে তো সে সুন্দরবন থেকে বাঘ মেরে আসেনি! সে শুধু একটা ভালো ছাত্রের দায়িত্ব পালন করেছে। অভাব কারোর কোনোদিন মাদুলি-তাবিজ হতে পারে না। বাবার প্রতি অভিমানে ঘর ছেড়ে এসে সে যে খুব বাহাদুরির কাজ করেনি–যত সময় যায় তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পায় সে। মার দুঃখী মুখখানা চোখের তারায় ভেসে ওঠে। তারও তো দুঃখ কম নেই। সকাল থেকেই কথার বাণ সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। যেন ক্লাসে সেকেন্ড হয়ে সে অপরাধ করে ফেলেছে। আজ তার এই সাফল্যের পেছনে বিন্দু দিদিমণির হাত আছে। শুভ স্কুলে টেরি কেটে ইস্কুলে গিয়েছিল। খারাপ বখাটে ছেলেগুলোর চাইতেও তাকে বাজে দেখাচ্ছিল। বিন্দু দিদিমণির ক্লাসে পড়া পারেনি সে। ডাস্টার দিয়ে ফোলানো টেরি ইস্ত্রি করে দিয়েছিলেন তিনি। সাবধান করে বলেছিলেন, সব ছেলের যা মানায় তোকে তা মানায় না। তোকে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ হয়ে উঠতে হবে। লেখাপড়া শিখে তোর বাবার হাতের ঝাড়ুটা তোকে কেড়ে নিতে হবে। এরজন্য কঠোর সাধনার দরকার। চুলের টেরি কেটে সময় নষ্ট করা তোর চলবে না।

কথাগুলোর বুঝি আত্মশুদ্ধির অ্যাসিড ছিল, পুড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল খাঁটি সোনা। সেদিনের পর থেকে সম্পূর্ণভাবে বদলে গেল শুভ। পড়া ছাড়া তার মনে আর কোনো চিন্তা নেই। কটা তো মাত্র বই, বারবার পড়ে আত্মস্থ হতে হবে। হাঁপিয়ে গেলে চলবে না। দম ধরে আরো ছুটতে হবে, আরো…আরো।

পরিশ্রমের ফল হাতেনাতে পেয়েছে সে। বিন্দু দিদিমণির কথা সে রাখতে পেরে খুশি। রেজাল্ট হাতে পেয়ে সে সবার আগে বিন্দু দিদিমণির কাছে গিয়েছিল। দিদিমণির পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই, তিনি আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, এই শুরু হল। আমি এর চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু দেখতে চাইছি। তোর চোখ বলছে, তুই তা পারবি।

বিন্দু দিদিমণি কথা শেষ করে শুভ’র হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটা নতুন জ্যামিতি বক্স।

সাইকেলের প্রতি শুভ’র ঝোঁক জ্ঞানপড়ার পর থেকে। অতসীপিসির ফুলবাগানে জল দিয়ে দিলে পেসেন্ট-পার্টিকে বলে সাইকেলের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। সাধারণত বিকেলবেলায় সাইকেল চালাতে শুভর খু-উ-ব মজা লাগে। তখন রোদ পড়ে আসে, পাখির ক্লান্ত ডানায় ঘরে ফেরার আকুতি। এই সময়টাতে জোরে সাইকেল চালালেও হাঁপিয়ে পড়ে না শুভ। যার সাইকেল তিনিও বিরক্তিবোধ করেন না। অতসীপিসিকে তোয়াজ করে চললে তার রুগীর যত্নআত্তি ভালো হবে। তাছাড়া অতসীপিসির ব্যবহারটাই ব্যতিক্রমী। তার পোষা কুকুরের নাম বাঘা। অবিকল বাঘের মতো দেখতে। পিসি একা থাকেন বলেই তাকে পাহারা দেয় বাঘা বাঘা বাগানের ফুল ছিঁড়তে দেয় না কাউকে। সে সব সময়ের পাহারাদার। রোজ বিকেলে মনটা চনমনিয়ে ওঠে শুভর। যেন শান্ত নির্জন পুকুরে কেউ ঢিল ছুঁড়ে পালিয়েছে, ঢেউ…ক্রমাগত ঢেউ..এমন অনুভূতিময় মনের অবস্থা। কেউ যেন তাকে জোর করে টেনে আনে হাসপাতালের সামনে। অতসীপিসির ইভিনিং ডিউটি থাকলে একেবারে সোনায় সোহাগা। ডিউটি রুমের সামনে শুভ গিয়ে দাঁড়ালে পিসির যতই কাজ থাক, প্রচ্ছন্ন স্বরে বলবেন, আয় বোস। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া করেছিস তো?

শুভ ঘাড় নাড়লে অতসী পিসি বলবেন, আর একটু পরে পেসেন্ট-পার্টির সবাই চলে আসবে। তখন তোর ঠিক সাইকেলের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

.

৩৩.

এমন কোনোদিন যায়নি যেদিন হাসপাতালে এসে সাইকেল না চালিয়ে ফিরে গেছে শুভ। আজ যে কত কথা মনে ভিড় করে আসছে কে জানে। শুভ ভাবল ওভাবে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা তার উচিত হয়নি। বাবা কিছু বললেও মা তো তাকে কিছু বলেনি। সে তো রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছিল ছেলের গর্বিত মুখখানা দেখবে বলে। কিন্তু তা আর হল কই? সব কিছু মুহূর্তের মধ্যে কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। সরস্বতীর কিছু করার ছিল না, সে শুধু কাঠের পুতুলের মতো হা-করে দাঁড়িয়ে থাকল এক পাশে। একটা ঝড়ো হাওয়ার মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শুভ। ছেলের এমন অপ্রত্যাশিত ব্যবহার তাকে সামান্য হলেও ধাক্কা দিয়েছে। কই এর আগে শুভ এমন ব্যবহার তো করেনি।

রঘুনাথদের ঘরখানা শুভর মনে হয় ঠাকুরমার ঝুলির ঘরগুলোর মতো। বাঁধের পা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া নদীটাকে মনে হয় স্বপ্নে দেখা কোনো এক শান্ত নিরীহ নদীর মতো। নদী আছে বলে বাতাসও কত ভদ্র। এক রাশ শীতল বাতাস মানুষের ক্লান্তি দূর করার জন্য সব সময় বুঝি মুখিয়ে আছে। শুভ চোখ মেলে তাকাল দুরের দিকে। নদীর জল ডিঙিয়ে তার দৃষ্টি চলে গেল আখ খেতে। এত আখ চাষ এ এলাকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো প্রান্তে হয় কি? জানা নেই শুভর। সে শুধু ভাবল–আর ক’দিনের মধ্যে আখ কাটা শেষ হয়ে যাবে। আখগাছে ফুল এলে হালকা হয়ে যায় আখ, অনেক সময় কমে যায় তার মিষ্টতা।

রঘুনাথদের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে শুভ ডাকল, এই রঘু, রঘু।

ভরদুপুরে চেনা কণ্ঠস্বর শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুর্গামণি। তার পরনে এক ফেরত শাড়ি, গায়ে ব্লাউজ নেই, খোলা চুল পেঁপে রঙের পিঠের উপর টেকির পাড় দিচ্ছে হাওয়ায়। সে এসে অবাক করা চোখে শুভর মুখের দিকে তাকাল। মা-মন নিয়ে আঁচ করতে চাইল এ সময় আসার কারণটা কি। কিছু অনুমান করতে না পেরে অমায়িক আত্মীয়তার গলায় বলল, বসো বাবা, বসো। রঘু তো ঘরে নাই। দুর্গামণি শুভর চিন্তাভরা মুখের ভাষা পড়তে চাইল। কী বুঝে বলল, তুমি বসো। আমি তুমার জন্য টুকে ঠাণ্ডা জল নিয়ে আসি।

ঠাণ্ডা জল আনতে গেলে চাপা কলের জল আনতে হবে। চাপকল আছে সেই অশ্বখতলায়। যেতে আসতে কিছু সময় তো যাবেই। শুকনো ঢোঁক গিলে শুভ বলল, দরকার নেই, মা। ঘরে যা জল আছে তাই দাও। আমি বেশিক্ষণ বসব না। ফিরে যাবো।

-সে কি গো, বাছা! দুফুরবেলায় এলে। না খেয়ে গেলে রঘু যে আমার মাথা খেয়ে নেবে। দুর্গামণি পেতলের গ্লাসে জল ভরে এনে শুভর পাশে বসল।

সই-পাতানোর পর থেকে শুভ তাকে মা বলে ডাকে। আর এই মা ডাক শুনলে তার বুকের ভেতরটা গর্বে ভরে যায়। শুভর গায়ে মাথায় পিঠে জললাগা হাত বুলিয়ে দুর্গমণি বলল, এসেছে যখন না খাইয়ে যেতে দেব না। তুমাদের ঘরে গেলে রঘু আমার কত কি খেয়ে আসে। তা বাছা, তুমরা হলে গিয়ে বড়োলোক মানুষ। মাস গেলে তুমার বাবা কত্তো টাকা মাহিনা পায়। আর আমাদের কথা বলোনি গো, কুনদিন হাঁড়ি চড়ে, কুনদিন আবার আঁখা জ্বলেনি।

শুভ সব জানে, এসব কথা তার কাছে কোনো নতুন নয়। তবু সে দুঃখী চোখ মেলে তাকায় দুর্গামণির দিকে, সরলতায় ভরা এ মুখখানার দিকে তাকিয়ে সে শুধায়, মা, রঘু কোথায় গিয়েছে?

জনমজুর খাটতে গিয়েছে, বাছা। বেলা না গড়ালে সে তো ফিরবে নি

–অতক্ষণ আমি থাকতে পারব না। আমাকে যেতে হবে। ঘরে অনেক কাজ। শুভ আরো কিছু অজুহাত খাড়া করতে যাচ্ছিল দুর্গামণি তাকে থামিয়ে দিল, হাজার কাজ থাকলেও মায়ের কাছে এসে ছেলে কি খালি পেটে ফিরে যায় বাছা! আমি তেল-গামছা দিই। তুমি ভুস করে ডুব দিয়ে আসো লদী থেকে। ততক্ষণে রঘু, রঘুর বাপ-সব্বাই এসে যাবে। রোদ মাথায় তো এলে। রোদ না গড়লে আমি তুমাকে যেতে দিবোনি।…

কী অদ্ভুত মমতায় দুর্গামণি তাকিয়ে আছে শুভর কুচকুচে মণির দিকে। শুভর সারা শরীরে অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধার শহর বয়ে গেল, মা, আজ আমার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। আমি পাশ করেছি।

কার্পাস তুলোর মতো খুশিতে উথলে উঠল দুর্গামণি, আমার ছেলে পাশ হবে নি তো কি ফেল হবে? তারপরই কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল তার চোখ জোড়া, আমার ঘরের রঘুটা শুধু চার ক্লাস অব্দি পড়ল, তারপর আর ইস্কুলে গেল না। ওর বাপ বলল–পড়া- লিখা শিখে আর কাজ নেই। জনমজুরের কাজে লেগে যা। আমি আর একা সনসারের হাল টানতে পারচি নে। তুই আমার সঙ্গে কাঁধ দে। ব্যস, পড়া ছেড়ে গেল রঘুটার! গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ছুঁয়ে বেরিয়ে এল দুর্গামণির। তবু তার দুঃখে ভরে ওঠা চোখ দুটো শুভর মধ্যে যেন খুঁজে পেতে চাইল রঘুনাথের সার্থক পরিণতি। খিদে ছিল তবু খাওয়ার প্রতি কোনো মন ছিল না শুভর। দুপুর তাতছে শীতের রোদে। বাতাস ভারী হয়ে আছে এখনও। ক’পা হাঁটলেই তো বুড়িগাঙ। বিঘার পর বিঘা আখ খেতের দিকে তাকিয়ে আখের খসখসে পাতার মতো তার বুকের ভেতরটাও জ্বালাপোড়া করে ওঠে। রঘুনাথ তার চেয়ে ক’বছরেরই বা বড়ো হবে, তবু সামান্য জ্ঞানপড়ার পর থেকে তাকে উপার্জনের পথে হাঁটতে হচ্ছে। সেদিক থেকে শুভ অনেক ভাগ্যবান। দেশ-গাঁয়ে থাকলে তার অবস্থাও রঘুনাথের মতো হত। হাসপাতালের কোয়ার্টারগুলোয় বিদ্যা অর্জনের একটা চাপা প্রতিযোগিতা আছে। এদের স্বচ্ছলতা না থাকলেও শিক্ষার প্রতি আগ্রহটা অনেক বেশি। সরস্বতী মনে প্রাণে চায় শুভ লেখাপড়া শিখে বড়ো হোক। তার জন্য যত কষ্ট স্বীকার করতে হয় সে করবে।

না খেয়েই বাঁধের উপর উঠে এল শুভ। রঘুনাথের সঙ্গে দেখা হলে হাল্কা হত মনটা। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে বারোয়ারি তলার বাজারে রঘুনাথের দেখা পেয়ে যায় সে। মেহনতী শরীরের প্রায় সবখানেই লেগে থাকে ধুলোমাটির চিহ্ন। শুভ কিছু জিজ্ঞাসা করলে পায়ের কাছে হাতের কোদালটা নামিয়ে রেখে রঘুনাথ বলত, বিলমাঠে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান তুলতে গিয়েচিলাম। জানিস মিতে, আজ বরাত মন্দ তাই বেশি ধান পাইনি। তবে আজ একটা ধেড়ে ইঁদুর ধরেচি। ঘরে গিয়ে ভাবচি পুড়িয়ে চাখনা করে খাবো।

ঘেন্নায় শিটকে ওঠে শুভ, কী বলিসরে, ইঁদুরও খাবি? কোনো কিছু বাদ দিবি না বুঝি?

-ইঁদুর আমরা আজ থেকে নয়, বহুকাল আগে থেকে খাই। রঘুনাথের সরল হাসির মধ্যে কোনো পাপ নেই। এখানে জাতিতে জাতিতে খাদ্যাভাস বদলে যায়। শুভ ঘাড় তুলে বেলা পরখ করার চেষ্টা করে। দুটোর বাসটা ছাড়ার সময় হয়ে এল। বাসের হর্ন বাজাচ্ছে সিটে বসে থাকা ড্রাইভার। যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার এই এক ফন্দি।

যত বেলা বাড়ছিল ততই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে হাঁপিয়ে উঠছিল অবনী। মুহূর্তের ভুলের জন্য তার এই হেনস্থা। হাসপাতালের মাঠটা কম বড়ো নয়, গাছগাছালিতে ভরা। বিশেষ করে খেজুরগাছগুলো ঝাঁকড়া মাথার পাহারাদারদের মতো দাঁড়িয়ে। এই শীতে এখনও ঘাসগুলো সতেজ। তবে রোদ উঠলে ঘাসফুলগুলো মুড়ি মিয়াননার মতো মিইয়ে যায়। তখন মনে হয় ওদের বুঝি অসুখ করেছে।

এতক্ষণ যা করেনি, শেষ পর্যন্ত তাই করল অবনী। গলা ফাড়িয়ে সে ডেকে উঠল। মাঠ ফিরিয়ে দিল প্রতিধ্বনি। এবড়ো-খেবড়ো চেহারার খেজুরগাছগুলো যেন দাঁত বের করে বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ল।

বার দশেক ডাকার পরেও সাড়া পেল না অবনী। টিকাদারবাবুর কোয়ার্টারের কাছে সরকারি কল। সেখানে এসে অবনী গো-হাঁপান হাঁপায়। বালতিতে জল ঢেলে স্নান করছিলেন টিকেদারবাবু। তার বেঁটেখাটো চেহারাটা গোল করে কাটা মাখনের মতো। তিনি যে চোখে লাগার মতো বেঁটে এখন আর কাউকে বলে দিতে হয় না। সবুজ তার ছেলে। শুভর সঙ্গে পড়ে। খেলা পেলে সে শুভর ধারে কাছে যায় না, তখন পড়াশোনা সব শিকেয় তুলে দিব্যি টো-টো করে ঘোরে। এই ফালতু ঘুরে বেড়ানো পছন্দ করেন না টিকেদারবাবু। গলা সপ্তমে তুলে বলেন, যে সময়ের হিসাব বুঝে নেয় না তার জীবনে কষ্ট আছে। সময় হল ভগবান। তাকে প্রতিক্ষণে স্মরণ করা উচিত।

অবনী জল খাবার জন্য কলপাড়ে দাঁড়াতেই গায়ে জল ঢালা অবস্থায় সরে দাঁড়ালেন টিকেদারবাবু, জল খাবে? আসো। আমি কল টিপে দিচ্ছি।

জল খাওয়া শেষ হলে টিকেদারবাবু অবনীর মুখের দিকে তাকালেন। হালকা হাসিতে ঠোঁট ভরিয়ে বললেন, তোমার ছেলে তো মারভেলাস রেজাল্ট করেছে অবনী। ক্লাসের মধ্যে সেকেন্ড হয়েছে, এ কী কম কথা।

ফার্স্ট-সেকেন্ডের কিছু বোঝে না অবনী, তবু টিকেদারবাবুর কথাগুলো তার ভালো লাগল। টিকেদারবাবু বললেন, ছেলেটা যতদূর পড়তে চায়, পড়িও। ওর পড়াশোনা বন্ধ করে দিও না। আমার মন বলছে এই ছেলে তোমার দশজনের একজন হবে। জলভরা বালতিতে মগ ডুবিয়ে গায়ে ঢালছিলেন টিকেদারবাবু, তা সত্ত্বেও তার কথাগুলো যে বানানো নয় তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল অবনী। এক ধরনের অপরাধবোধ বিপন্ন করে তুলল তাকে। ঝোঁকের মাথায় ছেলেটা আবার। কিছু করে বসল না তো। এই ভাবনাটা মনে আসতেই আঁতকে উঠল সে।

কলপাড় থেকে অবনীর কোয়ার্টারটা ছবির মতো দেখা যায়। সরস্বতী পেঁপেগাছটার পাশে এসে হাঁ করে তাকাল অবনীর দিকে। কথা বলারও ইচ্ছে নেই, কেমন একটা বিতৃষ্ণা। একটা ঘৃণার স্রোত ঠেলে উঠছিল তার চোখে-মুখে। আপাত শান্ত এই মানুষটাকে সে কি বুঝতে পেরেছে এখনও? হঠাৎ এমন সব কাণ্ড করে বসে লোকটা যা মেনে নেওয়া যায় না। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে মুখ নীচু করে হেঁটে এল কলতলায়। আজকের আনন্দের দিনটা মাটি করে দিয়েছে ওই লোকটা। ওর জন্য শুভ না খেয়ে ঘর থেকে চলে গেল। কথা ছিল পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করলে সার্কাস দেখার পয়সা দেবে সরস্বতী। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল অবনীর উপর, তোমার কি কোনোকালে বিবেক বুদ্ধি হবে না? ছেলেটাকে ওভাবে কেউ দুপুরবেলায় তাড়িয়ে দেয়? অবনী শুধু একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তার মুখে কোনো উত্তর নেই। সে জানে আগুনে ঘি ঢাললে আরও আগুন বাড়বে।

সরস্বতী কথার সূত্র ধরে বলল, যাও, যেখান থেকে পার শুভকে খুঁজে আন। ওকে সঙ্গে না নিয়ে এলে আমি তোমাকে ঘরে ঢুকতে দেব না। জেদে ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে সরস্বতীর শ্যামলা মুখখানা। ভেতরে ভেতরে সে যে কতটা উত্তেজিত তা টের পাওয়া যাচ্ছে।

টিকেদারবাবু গায়ে জল ঢালা থামিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকালেন, কি হয়েছে, তোমরা ঝগড়া করছ কেন? শুভ কোথায় গিয়েছে? তবে যেখানেই যাক, খাওয়ার সময় ঠিক ফিরে আসবে।

পেটে টান ধরলে তখন দেখবে সব মান-অভিমান কর্পুরের মতো উবে গেছে।

অবনী একথায় কান দিল না, সে শুধোল, বাবু আপনাদের ঘরের সবুজ কোথায়?

টিকেদারবাবু তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বললেন, ও আর যাবে কোথায়? ঘরে গিয়ে দেখো-খাচ্ছে। যতক্ষণ ঘরে থাকে শুধু খা-খা করে বেড়ায় ছেলেটা। আগের জন্মে বুঝি রাক্ষস ছিল। টিকেদারবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাঁর মনের কথাটা বললেন, ছেলেটার উপর অনেক আশা ছিল। ছেলে আমার সব আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। শুধু ভয় হয়, পড়াশোনা না করলে ওদের ভবিষ্যৎ জীবন চলবে কি করে? আমি তো আর চিরদিন থাকব না। এখন থেকে নিজেই যদি নিজেরটা না বোঝে তাহলে অন্ধকারের মধ্যে পড়ে যাবে। তখন আর পথ খুঁজে পাবে না।

অবনী শুভর ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। টিকেদারবাবুর মুখের উপর সে কোনো কথা বলার সাহস পায় না। মানুষটা রাশভারী। রেগে গেলে আর রক্ষে থাকে না। সেই ডাকাবুকো মানুষটি খেদের সঙ্গে বললেন, দুটো ভালো মাস্টার দিলাম তবু দেখো কেমন বিশ্রি রেজাল্ট করল। বলতে গেলে টেনেটুনে পাশ। হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বাজারে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি সাবধান করে বললেন, ছেলেটার দিকে নজর দিতে। ওর একদম পড়াশোনায় মন নেই। ওর মাকে বললে ছেলেটাকে শাসন করে না। শুধু বলে, বয়স হলে ঠিক হয়ে যাবে দেখা যাক কি হয়?

বেলার দিকে তাকিয়ে অস্থির হচ্ছিল সরস্বতী, অবনীকে কনুই দিয়ে ঠেলা মেরে বলল, শীতের বেলা ঝটপট ফুরিয়ে যাবে। যাও একবার ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। বলা যায় না, ওখানেও যেতে পারে। আজ যেন রোদের ভীষণ চড়া মেজাজ। পায়ের চড়া পড়া পথে রোদ হাওয়ার সে কি চিরন্তনী খেলা। হাসপাতালের মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোরু চরছে, রাখালের গলা শোনা যাচ্ছে মাঠের কোণ থেকে। অবনী দ্রুত পায়ে হাঁটছিল। ডাক্তারবাবুর বাড়িটা বাসরাস্তার কাছাকাছি। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে প্রশ্ন করল অবাক মাধুরী, কাকু, বাবাকে কি ডেকে দেব?

না। আমি শুভকে খুঁজতে এসেছি।

-কেন শুভ আবার গেল কোথায়? মাধুরীর বিস্ময়ভরা গলা, এক সাথে তো ঘরে ফিরলাম। সঙ্গে আরো অনেকেই ছিল। জান কাকু, আজ শুভ আমাদের হাসপাতালের নাম বাড়িয়ে দিয়েছে। হেডমাস্টার মশাই ওর প্রশংসা করছিলেন। আমার এত ভালো লাগছিল যে তোমাকে ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। মাধুরীর লাবণ্য ভরা মুখখানা কথা বলার সাথে সাথে ভোরের শিউলি ফুলের মতো তরতাজা হয়ে উঠল। হা-করে তাকেই দেখছিল অবনী। তার মনে হল মা দুর্গার জীবন্ত কিশোরী ছায়া তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বনশ্রী ভেতর থেকে শুনছিলেন তাদের কথাবার্তা। ঘরের ভেতর থেকে তিনি মাধুরীকে প্রশ্ন করলেন, কে এসেছে রে, মাধুরী?

–অবনী কাকু।

-বসতে বল, আমি যাচ্ছি।

ঘর গুছিয়ে বনশ্রী যখন বাইরে এলেন, তখন অবনীর বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছিল শুভর জন্য চিন্তা করে। শুভকে খুঁজে না নিয়ে গেলে সরস্বতী যে পাড়া মাথায় তুলে তার সঙ্গে ঝগড়া করবে এ বিষয়ে সে একশ ভাগ নিশ্চিত।

বনশ্রীর নজর এড়াল না অবনীর অস্থিরতা, কি ভাবছ অবনী? কোনো সমস্যায় পড়েছ নাকি?

-না, তেমন কিছু নয়। আমি বাবুর কাছে এসেছিলাম একটা দরকারে। অবনী হাত কচলে গদগদ চোখে তাকাল।

বনশ্রী বললেন, তোমার ছেলের রেজাল্টে আমরা গর্বিত। তোমার বাবু বলছিলেন, ওর মধ্যে ট্যালেন্ট আছে। একটু নজর রেখো।

একটা কাঠের টুলের উপর বসেছিল অবনী।

বনশ্রী বললেন, তুমি বসে বসে মাধুরীর সঙ্গে গল্প করো। আমি গিয়ে ওকে ডেকে দিচ্ছি। আর একটা কথা। আজ বিকেলে তোমাদের কোয়ার্টারের দিকে যেতে পারি। সরস্বতীকে বলে–

মিনিট দশেক পরে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে বারান্দায় এলেন ডাক্তারবাবু। ফর্সা, টুকটুকে চেহারা। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। ডাক্তারবাবুকে দেখে টুল থেকে উঠে দাঁড়াল অবনী। মাধুরী সঙ্গে সঙ্গে বলল, কাকু, এবার তুমি বাবার সাথে কথা বলো। আমি যাই। মাধুরী ঘরে ঢোকার আগেই তুলে রাখা পর্দাটা নামিয়ে দিল।

একটা চেয়ার টেনে আরাম করে বসলেন ডাক্তারবাবু। সিগারেট ধরিয়ে বললেন, কি ব্যাপার, কোনো দরকারে এসেছ বুঝি?

অবনী ঢোঁক গিলে ইতস্তত স্বরে বলল, ছেলেটার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমার শ’পাঁচেক টাকা ধার চাই। তিন মাসে শোধ করে দেব।

ডাক্তারবাবু সিগারেটে টান দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন, এতগুলো টাকা নিয়ে কি করবে, বই কিনবে বুঝি?

অবনী প্রশ্রয় পেয়ে সত্যি কথাটা বলল, না বাবু বই আমি পরে কিনব, আগে ওর একটা সাইকেল কেনার দরকার।

কেন এত আর্জেন্ট কিসের? ডাক্তারবাবু বাঁকা চোখে তাকলেন। অবনী পানসে হেসে বলল, ছেলেকে কথা দিয়েছিলাম, ভালোভাবে পাশ করলে একটা সাইকেল কিনে দেব। ছেলে তো শুধু পাশ করেনি, সেকেন হয়েছে। সেইজন্য টাকাটা দরকার। বাজারের সাইকেল দোকানী নিখিল পোন্দারকে বলেছি, সে বলেছে কমসম করে একটা নতুন সাইকেল দিয়ে দেবে।

বেশ ভালো কথা। ডাক্তারবাবু বাক্যহারা চোখে তাকালেন, তার মনের গভীরে যে ঝড় উঠছে, সেই ঝড়কে সামাল দিতে তিনি অপারগ। সামান্য ঝাড়ুদারের ছেলের কাছে মাধুরী এমনভাবে হার স্বীকার করে নেবে যা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। এ গ্রাম কেন, আশেপাশের দশটা গ্রামে তাঁর একটা মানসম্মান আছে। সেই মানসম্মানে সামান্য হলেও টোল খেল। পরীক্ষার ফলাফল তিনি দু-দিন আগেই শুনেছেন। মাথুর স্যার হাসপাতালে ওষুধ নিতে এসে ক্লাস এইটের রেজাল্ট সব বলে গিয়েছেন। মাধুরী মাত্র চার নাম্বার কম পেয়েছে শুভর থেকে। শুভ এই চার নাম্বার বেশি পেয়েছে অঙ্কতে। শুভ কেন বেশি পাবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না ডাক্তারবাবু। তাই একথা সে কথার পর তিনি একটা অনুরোধ রেখেছিলেন মাথুর স্যারের কাছে। বড়ো আজব আর স্পর্শকাতর সেই অনুরোধ। ডাক্তারবাবু খুব অসহায় স্বরে বলেছিলেন, মাস্টারমশাই, একটা অনুরোধ আছে। আমি এই হাসপাতালের ডাক্তার। অবনী এই হাসপাতালের ঝাড়ুদার। শুভর কাছে মাধুরী যদি পিছিয়ে পড়ে সেটা কখনও ভালো দেখায় না। আমার মান সম্মান নিয়ে টানা হিচড়া হয় তাহলে। তাই বলছিলাম–একটু যদি এদিক ওদিক করা যেত, তাহলে মনে হয় সাপও মরত, আর লাঠিও ভাঙত না।

–আমি ঠিক বুঝলাম না ডাক্তারবাবু? মাথুর স্যার বিস্মিত চোখে তাকালেন।

এটা খুব সিম্পল ব্যাপার। ডাক্তারবাবু জোর করে হাসলেন, আপনি ওদের ক্লাস-টিচার। শুধু ক্লাস-টিচার নন, অঙ্কেরও স্যার। আপনি চাইলে মাধুরীর পাঁচটা নাম্বার বাড়িয়ে দিতে পারেন। এতে কোনো রিক্স নেই, লিক হবারও চান্স নেই।

-তার মানে? কঠিন চোখে তাকালেন মাথুর স্যার, আপনি যা বলছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। আর তাছাড়া, এভাবে মেয়েকে স্ট্যান্ড করিয়ে আপনার কি লাভ হবে? মাধুরী যেমন আপনার মেয়ে, তেমনি শুভও আপনার ছেলের মতো। ওর বাবা আজ ভাগ্যদোষে ঝাড়ুদার পোস্টে এসেছে। তাছাড়া, ঝাড়ুদারের ছেলে যে কোনোদিন স্ট্যান্ড করতে পারবে না এমন কথা কোথাও কিন্তু লেখা নেই।

-না, আমি তা বলছি না। আমি জাস্ট বলছিলাম..যদি..

–যদির কথা নদীতে ফেলে দিন ডাক্তারবাবু। আগে পয়সা দিয়ে ডাক্তারীতে ভর্তি হওয়া যেত, এখন আর তা যায় না। এখন বুদ্ধি আর মেধার দরকার। মাথুর স্যার বললেন, আমি আপনার অন্যায় অনুরোধ রাখতে পারলাম না বলে দুঃখিত। তবে যাওয়ার আগে আমি একটা কথা বলে যাই। যুগ বদলাচ্ছে। যুগের সাথে আপনার মনটাকেও বদলান। দেখবেন-এসব সমস্যা কোথায় চলে গিয়েছে। মাথুরবাবু হনহনিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে এসে বললেন, যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই। আমি কেন, কোনো শিক্ষকই আপনার এই প্রস্তাব মেনে নেবেন না। আর যদি কোনো শিক্ষক লোভে পড়ে মেনে নেন, তাহলে সেটা হবে তাঁর আত্মহত্যার সমান। তবে আপনার এই প্রস্তাবটি আমি হেড মাস্টারমশাইয়ের কানে তুলে রাখব। তাতে তাঁর মানুষ চিনতে সুবিধে হবে।

অবনীর মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয় ডাক্তারবাবুর। তিনি শ্লেষের সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, শুনেছি তোমার ছেলে সেকেন্ড হয়েছে। বেশ আনন্দের কথা। গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে যাচ্ছে। তোমারও অনেক গর্ব হচ্ছে বুঝতে পারছি। তবে মনে কিছু করো না, একটা কথা বলি। সেকেন্ড হয়েছে বলেই যে তাকে সাইকেল কিনে দিতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। আজ সাইকেল চাইছে, কাল হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে বলবে, বাবা, এরোপ্লেন কিনে দাও–তখন পারবে তো ছেলের সখ মেটাতে?

এমন কঠিন উত্তর প্রত্যাশায় ছিল না অবনীর, তবু সে জোরের সঙ্গে বলল, যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে অবশ্যই এরোপ্লেন কিনে দেব। ছেলের জন্য কিনব–এতে তো আমার গর্ব হওয়া উচিত।

-এত যখন গর্ব বুকে তখন আমার কাছে হাত পাতছ কেন?

–আপনি বড়োলোক। জানতাম-দয়ালু। সেইজন্য

-ঠিক আছে সন্ধেবেলায় এসে টাকাটা নিয়ে যেও। ডাক্তারবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আর আমি বকবক করতে পারছিনে। এবার তুমি যাও। ফিরে আসার সময় অবনী দেখল, ঈষৎ পর্দা ফাঁক করে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মাধুরী। তার জোড়া চোখে সহানুভূতির বান ডেকেছে। বোবা থেকে সে যেন অনেক না বলা কথা বলে দেয়। অবনী কার উপর অভিমান করবে? একটা ডাল শুকিয়ে গেলেও অন্য ডালে তো ফুল এসেছে। ফুল এসেছে যখন সুগন্ধ তো ছড়াবেই।

ফেরার সময় ডলি দিদিমণির সঙ্গে দেখা হল কিচেন ঘরের সামনে। অবনী দেখল তার পরনে এখনও ডিউটির পোষাক। ক্লান্ত পায়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন ঘরের দিকে। অবনীকে দেখে তিনি থামলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন হাওয়ায়, দুপুরবেলায় কোথা থেকে ফিরলে গো অবনী? বড়ো ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে! কি হয়েছে?

-কই, কিছু হয়নি তো? গলা ঝেড়ে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল সে। ডলি দিদিমণি মিষ্টি করে হাসলেন, তোমার কাছে একটা খাওয়া পাওনা থাকল। শুভ সেকেন্ড হয়েছে শুনেছি। ওকে বলো পরের বছর ওকে ফার্স্ট হয়ে দেখাতে হবে।

 ভগবানের যা ইচ্ছে তাই হবে। অবনী আকাশের দিকে মুখ করে তাকাল, তারপর মুখ নামিয়ে এনে বলল, আপনাদের সবার আশীর্বাদ থাকলে ও ঠিক পারবে। আমি তো মুখ মানুষ। ক-লিখতে কলম ভাঙে।

–গাদা গাদা বই পড়ে কি শিক্ষিত হওয়া যায় নাকি? ডলি দিদিমণি বললেন, মানুষ হতে গেলে কেতাবী শিক্ষা না থাকলেও চলে। মানবতা যে পাঠশালায় পড়ানো হয়, তার নাম হৃদয়। হৃদয় শুধুমাত্র পাঠশালা নয়, সেখানে ফুলের বাগানও থাকে। সুগন্ধে ম-ম করে মনের উঠোন।

কদবেল তলার পাশ দিয়ে বাজারে যাওয়ার পথ। আশে পাশের টালিখোলায় কাজ চলছে পুরোদমে। দু-একটা কুকুর ছন্নছাড়া মনোভাব নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। বাঁশবাগানে হাওয়ার শনশনানী। শুকনো পাতাগুলো শুন্যে ঘুরপাক খেতে খেতে নেমে আসছে মাটিতে। এ সময় সব থেকে বেশি পাখি ডাকে মনে হয় অবনীর। দুপুরবেলায় ঘুঘুর ডাক তার ক্লান্তিকে আরও যেন প্রকট করে তোলে।

বারোয়ারিতলা শুনশান। একটা কুকুর পেট থেবড়িয়ে শুয়ে আছে। তার গায়ে মিহি রোদ এসে পড়েছে। চারধার খুঁজে ক্লান্ত অবনীকে হতাশ দেখাচ্ছিল খুবই, বুকের ভেতরটা জ্বালাপোড়া করছিল অস্থিরতায়। বুক হালকা করে যে কথা বলবে–তেমন কাউকে খুঁজে পেল না। উল্টে একটা ভয় এসে ছোবল মারতে লাগল তাকে। শুভ যেন কিছু না করে বসে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে। আর এখানে দেরি করা উচিত হবে না। বেলা ক্রমশ বাড়ছে। এবার ঘরে ফেরা দরকার।

পিচ রাস্তায় ধুলোর পুরু আস্তরণ, যেন কেউ মেটে রঙের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কালীগঞ্জ থেকে হরিনাথপুর। একটু হাওয়া দিলেই ধুলোগুলো সব প্রাণ পেয়ে উড়তে শুরু করে। সেইরকম একটি ঘূর্ণায়মান ধুলোর বৃত্তে অকস্মাৎ ঢুকে গিয়ে আঁকুপাকু করে অবনী। সর্বাঙ্গে ধুলোর স্পর্শ তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তবু হাঁটতে হাঁটতে তার মনে পড়ে ডাক্তারবাবুর নিষ্ঠুর কথাগুলো। মানুষটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে মনে মনে তিনি এত বিষ ধরে রাখেন। সকালে আউটডোর ঝাড়ু করার ঘটনাটাও অন্যায়। অন্যের পাপ তাকে কেন খণ্ডন করতে হবে? শুভকে নিয়ে ঈর্ষার আগুন ডাক্তারবাবুর চোখে ধিকিধিকি করে জ্বলছে। ছেলেটার সাফল্য তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এত বড় মাপের একজন মানুষকে হঠাৎ করে এমন বেঁটে দেখাবে–একথা স্বপ্নেও যে ভাবা যায় না।

পথ শেষ হয়ে আসে কোয়ার্টারের সামনে।

অবনীর পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সরস্বতী। মানুষটার বিধ্বস্ত, ক্লান্ত চেহারা দেখে তার দয়া হল। সরস্বতী কাছে এসে নীচু স্বরে বলল, শুভ ঘরে এসেছে। তুমি যাও চাপা কল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসো। আসার সময় এক বালতি জল এনেনা।

–ও কোথায় গিয়েছিল? অবনী ঝুঁকে পড়ল সরস্বতীর দিকে।

–ওসব আমি পরে বলছি। এড়িয়ে যেতে চাইল সরস্বতী।

কথা না বাড়িয়ে বালতি নিয়ে চলে গেল অবনী। কিছু পরে সরস্বতীও চলে এল কলতলায়। চারপাশ দেখে নিয়ে বলল, সবুজ আমাকে খবর দিল শুভ আমতলায় শুয়ে আছে। আমি গিয়ে দেখি আমগাছের ছায়ায় দুহাত মাথায় দিয়ে ও ঘুমাচ্ছে। কিছুতেই আসবে না। জোর করতেই কেঁদে ফেলল। তার সে কী কান্না, আমিও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।

-যা হয়েছে সব ভুলে যাও। অবনীর গলা কেঁপে উঠল অনুশোচনায়। সেই কখন থেকে সে পুড়ছে, আর পোড়াতে চায় না নিজেকে। এবার মলমপট্টি করা দরকার।

শান বাঁধানো মেঝেতে পাশাপাশি খেতে দিয়েছে সরস্বতী। ছ্যালার উপর ফুল ভোলা আসন। সুতো দিয়ে আঁকা লাল ফুলগুলো যেন সুগন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরের ভেতর। খেতে বসেও শান্তি পায় না অবনী। আজ নানা কারণে তার বাজারে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ঘরে কি ছিল কে জানে!

অভাবের সংসার তো তলা ফুটো নৌশে, কখন ভুস করে ডুবে যাবে কে জানে। আজকের এই বিশেষ দিনে পোয়াখানিক মাছ আনা তার উচিত ছিল। তা যখন হয়নি তখন আর কি করা যাবে! মুখ নীচু করে সে সরস্বতীর জন্য অপেক্ষা করছিল। রান্নাঘর থেকে দুটো থালায় ভাত বেড়ে আনল সরস্বতী। কাঁসার থালায় তরকারি সে সাজিয়ে দিয়েছে। শুধু ডালের বাটিটা পাতের গোড়ায় বসিয়ে সরস্বতী বলল, খাও, বেলা অনেক হল।

পাশাপাশি বসে খাওয়া শুরু করল ওরা। খেতে খেতে আড়চোখে ছেলের দিকে তাকাচ্ছিল অবনী। এত কাছে আছে তবু যেন মনে হয় কত দূরের সম্পর্ক! তার যেন ভয় করছে ছেলের দিকে তাকাতে। ছেলের জন্য যে গর্ববোধ এতক্ষণ তার বুকে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো বয়ে যাচ্ছিল তা হঠাৎ এক জায়গায় থেমে যেতে সে কেমন অসহায় চোখ-মুখ করে তাকাল।

আজ ডাল দিয়ে খাওয়া সাঙ্গ করতে হবে এমন যখন ভাবছে অবনী তখন ডিমের ঝোল নিয়ে এল সরস্বতী। ডিমগুলো বেশ বড়ো বড়ো। বোঝা গেল হাঁসের ডিম। অন্যদিন হলে এই হাঁসের ডিমের জন্য সে ঝগড়া বাধিয়ে বসত, আজ তার ঐ ডিমটাকে মনে হল আকাশের তারা। হাঁসের ডিম খেলে নাকি বাতের ব্যথা বেড়ে যায়, শরীরের গাঁটগুলোয় যন্ত্রণা শুরু হয়। আজ আর কোনো যন্ত্রণা বা ভয় নয়–অবনী আলতো আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল ডিমটা, আর সঙ্গে সঙ্গে ভালো লাগার অনুভূতিগুলো বসন্তের হাওয়া লাগা পলাশগাছের মতো তাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। খেতে খেতে অবনী শুধাল, ডিম কোথায় পেলে, ঘরে ছিল বুঝি?

সরস্বতী জানত অবনী এই প্রশ্নটা করবে, তাই বিনা সঙ্কোচে বলল, পাশের কোয়ার্টার থেকে চেয়ে এনেছি। শুভ যে আমিষ ছাড়া খেতে পারে না।

বুক ভরে একটা শ্বাস নিল অবনী। বুকের ভেতর একটা তিরতিরে সুখের স্রোত বয়ে যাচ্ছে টের পেল সে।

খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় সরস্বতী বলল, শোন, ডাক্তারবাবুর মেয়ে মাধুরী এসে পাঁচশ টাকা দিয়ে গেছে। দুপুরবেলায় এসেছিল সে। বসতে বললাম এত করে, বসল না। চলে গেল।

পর্দার আড়ালে সেই ছলছলে চোখ দুটোর কথা মনে ভেসে উঠল অবনীর। সত্যি, এ পৃথিবীতে কত কি যে খেলা চলে বোঝা মুশকিল।

শীতের রোদ যতই নম্র হোক তবু তারও একটা জ্বলন আছে। জানলা খোলা থাকলে এ ঘরে রোদ্দুর সরাসরি এসে হা-ডুডু খেলে বেড়ায় মেঝেয়। নানা ধরনের চিহ্ন, প্রতিকৃতি তৈরি হয় এই রোদ খেলায়। তক্তপোষে শুয়ে হা-করে সেই সবই দেখছিল শুভ। সরস্বতী কথায় ফেঁড় তুলতে যাওয়ার সময় বলেছে, খেয়েছিস দেয়েছিস, এবার একটু ঘুমো। বিকেলে একবার মাধুরীদের ওখানে যাস। কেন পাঁচশ টাকা দিয়ে গেল-সেটা জিজ্ঞেস করা দরকার।

শুয়ে শুয়ে ঘাড় নাড়ল শুভ। এ ঘরে তেমন দামী কোনো আসবাবপত্র নেই, কমা কাঠের তক্তপোষের উপর ছেঁড়া কাঁথাগুলো যত্ন নিয়ে পেতে দিয়েছে সরস্বতী। একটা তোষক কেনার কথা ভাবলে স্বপ্ন বলে মনে হয় শুভর। সরস্বতীর এতে কোনো আক্ষেপ নেই। সে জোর গলায় বলে, যা আছে তা নিয়ে মানুষকে সুখে থাকতে হয়। যতটুকু সুখ আমার প্রাপ্য ততটুকু আমি তো পাবই। আমার ভাগেরটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

.

৩৪.

সুখ কাকে বলে জানে না শুভ। জানার চেষ্টাও করেনি কোনোদিন। তবে তাদের ক্লাসের সুপ্রিয় পোদ্দারকে দেখে তার মাঝে মধ্যে ভীষণ মন খারাপ করে। ওদের টাকা-পয়সার অভাব নেই, তবু ব্যবহারে ওকে কেমন গরীব বলে মনে হয়। ডাক্তারবাবুর মেয়ে মাধুরী ওকে একটু ভয় পায়, তাই সাবধানে এড়িয়ে চলে। সেদিন ইস্কুলে সুপ্রিয় বলেছিল, শুধু পয়সা থাকলে হয় না, তা খরচ করার মতো মনও থাকতে হয়।

তার এই হালকা কথায় অহঙ্কারের ছোঁয়া ছিল। তিলের খাজা বিক্রি করতে আসা সহদেব ওই অতটুকু ছেলের কথা শুনে তাজ্জব। পরে সুপ্রিয় চলে যাবার পর সহদেব সতর্ক গলায় বলেছিল, এ ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যার বাবা কেরসিন তেল ব্ল্যাক করে তার ছেলে আর কত ভালো হবে। কাটা বাঁশের কঞ্চিতেও বিষকাটা থাকে।

সুপ্রিয় পোদ্দার যে গ্রামের ছেলে এটা তার চেহারায় কথাবার্তায় বোঝা যায় না। সে রোজই আলাদা-আলাদা জামা-প্যান্ট পরে ইস্কুলে আসে। এসব জামা কাপড় তার মা বহরমপুর, কাটোয়া বা কৃষ্ণনগর থেকে কিনে আনে। ফলে, সে যে ব্যতিক্রমী তা তার চেহারায় ফুটে ওঠে। মাধুরী একেবারেই পছন্দ করে না সুপ্রিয়কে। এই বয়সে এত উপর চালাকি কার-ই বা ভালো লাগে। তবু সুপ্রিয় গায়ে পড়ে বলবে, আজ আমাদের বাড়ি গেলে তোকে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাব।

আগ্রহ প্রকাশ পায় না মাধুরীর কণ্ঠস্বরে, তবু সে বলে, কি দেখাবি কি?

–আমার দাদুর আমলের একটা হাতির দাঁত আছে। আহা, কী সাদা ধবধবে। একবার দেখলে আর চোখ ফেরাতে পারবি না। সুপ্রিয়র কথায় মাধুরীর চোখের তারা কালো আঙুরের মতো চকচকিয়ে ওঠে না। সে বরং অমনোযোগী শ্রোতার মতো চুপ করে থাকে। বেশি বিরক্ত করলে সে সরাসরি সুপ্রিয়কে ধমকায়, আমাকে নিয়ে তোর এত না ভাবলেও চলবে। তুই নিজের চরকায় তেল দে।

তক্তপোষে শুয়ে থাকলে পুরনো রেডিওটার সুইচ অন করে দেয় শুভ। রেডিও শোনা তার কাছে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছে। কখনও সখনও তা বাড়াবাড়ি মনে হয় সরস্বতীর কাছে। সে নানা ধরনের গান শুনতে পছন্দ করে। প্রতি রবিবার যে নাটকটা হয়–সেই রেডিও-নাটক শোনার জন্য সারা সপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সে। এখানে সময় কাটতে চায় না কিছুতেই। সব কোয়ার্টারে রেডিও ছিল, শুধু তাদেরই ছিল না। হাজারবার বলার পর অবনী এটি কিনে এনেছে কালীগঞ্জ বাজার থেকে। এ সংসারের কোনো জিনিসই তার কিস্তি ছাড়া কেনা হয়নি। কটাকাই বা মাইনে পায় সে। যা পায় তা ধার মেটাতেই চলে যায়। ফলে টানাটানি লেগেই থাকে। নিজের চোখে সব দেখে দেখে শুভর কেমন বিতৃষ্ণা জন্মায় এই বেঁচে থাকার উপর। স্বচ্ছলতা শব্দটার সঙ্গে তার এখনও পরিচয় হল না–এটাই আক্ষেপ।

রেডিওতে খেয়াল শুরু হতেই সুইচ অফ করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল শুভ। খেয়ালের সে কিছু বোঝে না, তাই শুনতেও ভালো লাগে না।

এক গাদা পুরনো কাপড়ের পোঁটলা বগলদাবা করে ঘরে ঢুকল সরস্বতী। শুভ তখন পারা চটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। বাবার সঙ্গে সেই থেকে কোনো কথাবার্তা হয়নি, সে নিজেই ইচ্ছে করে কথা বলেনি। বাবা তার কাছে দুর্বলতম জায়গা–এটা বুঝতে পারে সে। বাবার প্রতি অভিমান হলেও তা যেন ঝড়ো মেঘের মতো অপসৃয়মান হয় যে কোনোসময়।

সরস্বতী পুরনো কাপড়গুলো তক্তপোষের নীচে নামিয়ে রেখে বলল, কোথায় যাচ্ছিস? যেখানেই যাস না কেন, আগে মাধুরীর সঙ্গে দেখা করে যাবি। সে বেচারি দুপুরবেলায় এসে টাকা দিয়ে চলে গেল। বসতে বললাম, বসল না। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব চাপের মধ্যে আছে।

এতটুকু মেয়ের আর কী চাপ থাকতে পারে? মনে মনে ভাবল শুভ। যাদের কোনো অভাব নেই, অর্থকড়ি আছে–তারা সবরকমের চাপ মানিয়ে নিতে পারে। শুভর ঠোঁটে নিশুপ হাসির আভা ফুটে উঠল, সরস্বতী ছেলের হাবভাব লক্ষ্য করে বলল, সন্ধে লাগার আগে ঘরে ঢুকে যাবি। যদি সময় পাস তাহলে তোর অতসী পিসির বাগানের কাজগুলো আজ করে দিস। দিদি বারবার করে বলছিল

শুভ ঘাড় নেড়ে বাইরে এল।

শীতের বিকেল বেশ রমণীয় হয়ে উঠেছে মোহনী আলোয়। এ এলাকায় সন্ধে নামার আগে শীত চলে আসে। একটা হাফ হাতা সোয়েটারে সেই শীত কাটতে চায় না। অবনী বলেছে, একটা তুষের চাদর কিনে দেবে বেতন পেয়ে। পুরনো মাফলারটার রঙ উঠে গিয়ে এখন কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে দেখায়। গলায় জড়াতে ভালো লাগে না শুভর।

মাধুরী হয়ত তার অপেক্ষায় ঘুরঘুর করছিল বারান্দায়। লম্বা বারান্দায় ঠিক মাঝখানে চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন ডাক্তারবাবু। কলার মোচার মতো মুখটা ঝুঁকে আছে সেন্টার টেবিলের দিকে। ডাক্তারবাবু ঘরে থাকলে শুভর গলার স্বরে ভয়জনিত জড়তা প্রকাশ পায়। ওই রাশভারি মানুষটার কাছে সে সহজ হতে পারে না। যা বলার নয়, মুখের উপর তাই বলে দেন ডাক্তারবাবু। মনে কষ্ট পেলেও চুপ করে থাকতে হয় তাকে। মা তাকে বলেছে, বড়োদের মুখের উপর তর্ক করতে নেই। বড়োরা যা বলে তা বুঝে-শুনেই বলে।

ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎবেগে চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় শুভ। মাধুরী তার অস্বস্তির কথা জানত। সহজ হেসে বলল, চল, আমরা ঘরে গিয়ে বসি। এখানে বকবক করলে বাবার অসুবিধা হবে।

খবরের কাগজ সরিয়ে বাঁকা চোখে তাকালেন ডাক্তারবাবু, গল্প করে তো আজ এত নীচে নেমে গেছে। বেশি গল্পগুজব করলে পড়ার ক্ষতি হয়। রেজাল্ট যাতে আরো ভালো হয় সেই চেষ্টা করা উচিত।

মাধুরী খুশি হল না বাবার কথায়, সব সময় যে স্ট্যান্ড করতে হবে তার কোনো মানে নেই। তাছাড়া পরীক্ষার সময় আমার জ্বর হয়েছিল। আমি ঠিক মতো পড়তে পারিনি।

-ঠিক আছে, আর কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। সশব্দে পেপার ভাঁজ করে ডাক্তারবাবু শুভর দিকে তাকালেন, কীভাবে পড়তে হয় শুভর কাছে থেকে জেনে নে। ওর টিউশনির মাস্টার নেই, তবু তোকে ডাউন দিয়ে ছেড়ে দিল।

মাধুরীকে তর্ক করার নেশা পেয়ে বসেছে, মাস্টার না থাকল তো কি আছে, ব্রেন তো আছে। ও একবার পড়লেই মনে রাখতে পারে সব। ওর সঙ্গে আমার কোনো তুলনা চলে না। প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রম মিশলে শুভর মতো রেজাল্ট হয়।

তর্ক না করে চেষ্টা কর। বিরক্তিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবু, শুভ যদি পারে, তুই কেন পারবি না? ওকি তোর মতো ভালো-মন্দ খেতে পায়? ওর বাবার সামর্থ কোথায় কিনে দেবে?

শুভর কান ঝাঁ-ঝাঁ করছিল এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়। মনে মনে ভাবল টেনেটুনে পাশ করলেই বুঝি ঠিক হত। সেকেন্ড হয়ে সে অনেকের বিষনজরে পড়ে গিয়েছে।

মাধুরী শুভকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শুধাল, তুই কি ঘর থেকে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলি কথা বলবি না বলে, তাহলে এলি কেন?

মাধুরীর চোখে অভিমান। আশাপ্রদ ফলাফল না করার জন্য তার উপরে কম ঝড় বয়ে যায়নি। মা ছাড়া আজকের দিনে তার পাশে কেউ নেই। শুভ’সব বোঝে। ধীর গলায় সে বলল, রেজাল্ট নিয়ে এত ভাবনার কি আছে? এখনও নাইন-টেন-ইলেভেন পড়ে আছে। আসল লড়াই তো সেখানে।

-তুই সায়েন্স না আর্টস নিবি? মাধুরী ঝুঁকে পড়ল শুভর দিকে।

–আমার ইচ্ছে সায়েন্স পড়ার। বায়োলজি ফোর্থ সাবজেক্ট রাখব। হেডমাস্টারমশাই বলেছেন, যারা অঙ্ক আর বিজ্ঞানে এইটটি পারসেন্ট পেয়েছে কেবল তাদেরই সায়েন্স দেবেন।

মাধুরী মুখ শুকিয়ে বলল, তাহলে তো মাত্র পাঁচজন সায়েন্স পাবে। ধ্যাৎ তা হতে পারে । সায়েন্স যদি ইস্কুলে রাখতে হয় তাহলে অন্তত কুড়ি জনকে তো সায়েন্স দিতে হবে। আর তাই যদি হয় তাহলে দেখবি আশি থেকে শতকরা পঞ্চাশে নেমে এসেছে নাম্বার।

শুভ অনেক ভেবে ঘাড় নাড়ল, তা ঠিক। তবে সায়েন্স পড়তে গেলে খরচ আছে। আমি ভাবছি-বাবা কি পারবে আমাকে পড়াতে? যা বইয়ের দাম। বই-ই কিনে দিতে পারবে না।

তুই এত ভাবছিস কেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। মাধুরীর চোখে বিশ্বাসের রেণু। শুভর কপালে ভাঁজ পড়ল, সব মানুষ যদি তোর মতো হত তাহলে আমার পড়াটা ঠিক হয়ে যেত। সত্যি বলছি–আমিও তোর মতন এত সুন্দর মন পাইনি।

লজ্জায় রাঙা গালে টোল পড়ল মাধুরীর, আমরা কটাই বা মানুষ দেখেছি। আমাদের বয়সই বা কত! ভালোমানুষ সব যুগে ছিল, এখনও আছে।

হয়ত আছে।

আমি এখন আসি। উঠে দাঁড়াল শুভ।

মাধুরী হাত ধরে বসাল তাকে, বস না, কোথায় যাবি? মাকে বলি আচারের তেল আর মটরশুটি দিয়ে মুড়ি মেখে দিতে। পিঁয়াজ কুচি দিতে বলব তো?

শুভ কোনো উত্তর না দিয়ে মাধুরীর মুখের দিকে তাকাল। নিষ্পাপ সরল মুখখানা মেঘহীন নীল আকাশের মতো।

বনশ্রী মুড়ি মেখে নিয়ে এলেন দুটি বাটিতে। শুভকে দেখে হাসলেন, এবার তোর রেজাল্ট শুনে খুশি হয়েছি। এর থেকেও ভালো রেজাল্ট করতে হবে। ভাব তো তোর বাবা কত কষ্ট করে পড়াচ্ছে। আমরা তো সবার কাছে তোর কথা বলি।

শুভ মনে মনে ভাবল, কাকিমা বললেও ডাক্তারকাকু নিশ্চয়ই তার কথা কারোর কাছে বলে না। আত্মগরিমার আঁচে যে মানুষটা সবসময় পুড়ে আছে-তার কাছ থেকে এসব সৌজন্যতা আশা করা ভুল।

শুভ জোর করে হাসবার চেষ্টা করল। মাধুরী বলল, মায়ের কথাটা মনে রাখিস। মা তোকে ভীষণ ভালোবাসে।

-সেটা আমি জানি।

–জানিস যখন তখন এলেই পালাই পালাই করিস কেন? আসবি চুপচাপ বসে থাকবি। আমি না বলা পর্যন্ত কোথাও যাওয়ার নাম করবি না।

শুভ অন্যমনস্ক চোখে তাকাল, একটা কথা সত্যি করে বলবি?

-কি কথা শুনি?

 –আগে বুড়োমা ঠাকুরের দিব্যি দে, তারপর বলব।

 –আমি চট করে বুড়োমার দিব্যি কাটি না।

–তাহলে থাক।

–না তোকে বলতেই হবে। জোর করল মাধুরী।

শুভ নিস্তেজ গলায় বলল, মায়ের কাছে যে পাঁচশ টাকা দিয়ে এলি ওটা কার টাকা, কিসের টাকা?

–টাকাটা কাকুকে দিয়েছি আমি। মাধুরী বলল, কাকুর দরকার। বাবার কাছে ধার চাইছিল। বাবা হয়ত দিত। কিন্তু আমার মনে হল কাকুর ওটা আজকালের মধ্যে দরকার। তাই আমার কাছে ছিল দিয়ে এলাম।

-কাজটা কিন্তু ভালো করিসনি। শুভ বোঝাতে চাইল, বাবা-মাকে না জানিয়ে তোর এতগুলো টাকা দিয়ে আসা উচিত হয়নি। তাছাড়া, এত টাকা তুই কোথায় পেলি? কাকু জানলে–আমাদের ভুল বুঝবে। ভাববে–আমরা পটিয়ে পাটিয়ে তোর থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিয়েছি।

তুই বাবাকে এত খারাপ ভাবতে পারলি? মাধুরীর চোখ ছলছলিয়ে উঠল, বাইরে থেকে বাবাকে যতটা কঠিন বলে মনে হয়–আসলে বাবা তা নয়। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা অনেকটাই ফন্তু নদীর মতো।

শুভ আর কথা বাড়াল ।

মাধুরী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, টাকাটা আমি চুরিচামারি করে দিই নি। আমার জমানো টাকা থেকে দিয়েছি।

–তাহলে ফেরত দিলে নিতে হবে।

–সে আমি নেব। অত চিন্তা করিস না তো। তোদের এখন টাকার দরকার।

তবু যেন মন থেকে মেনে নিতে পারে না শুভ। সেঁক গিলে বলল, আমি বাবাকে বলব-কাকুকে সব বলতে।

-খবরদার, তা যেন করতে যাস না। আমি তাহলে অসুবিধায় পড়ে যাবে। মাধুরী কাঁচুমাচু চোখে তাকাল।

শুভ বলল, ঠিক আছে, আজ আমি আসছি। স্কুল খুললে বুক-লিস্ট দেবে। বাবার মাইনে হলে আমি বই কিনতে কৃষ্ণনগর যাবো।

-হাসপাতালের গাড়ি যাবে, তখনই যেতে পারিস। মাধুরী বুঝিয়ে বলল, আসা-যাওয়ার ভাড়াটা বেঁচে যাবে। বাবা বলছিল–আমাকেও সঙ্গে করে বই কিনতে নিয়ে যাবে। ক্লাস নাইনের বই, বুক-লিস্ট না থাকলেও কেনা যায়। সিলেবাস তো সব এক।

গাড়ি কবে যাবে, জানাস তাহলে? শুভ দূরের দিকে তাকাল, বই কেনাও হবে, খোড়ো নদীও দেখা হবে। জানিস, খোছড়া নদীর যা রূপ, একবার দেখলে নাকি চোখ ফেরানো যায় না। রেল-ব্রিজ আর বাস-রাস্তা পাশাপাশি। লালগোলা ট্রেন যখন যায় ঝমঝম শব্দ হয়। রেল-কামরার জানলা দিয়ে তাকালে কত নীচে জল, বুক হিম হয়ে যায় ভয়ে।

-তুই অনেক কিছুই জানিস। আমি তো কিছুই জানি না এসব। মাধুরী নিজের দোষ খণ্ডন করে নিয়ে বলল, আমার বাইরে বেরনো হয় না। দাদুর বাড়িতে যাওয়ার সময় ব্রিজটাকে আমি দেখেছি। খোড়ে নদীর বুকের হাড়-পাঁজরার মতো মনে হয়।

শুভর মনে পড়ে যায় কত কথা।

দেশ বাড়িতে যাওয়ার সময় অবনীর মাথাটা বুঝি খারাপ হয়ে যায়।

কোথাও যেতে গেলে অন্তত একমাস আগে থেকে তার প্রস্তুতি শুরু হয়। সবার মাথা খারাপ করে দেবার মতো অবস্থা, ব্যাগ গোছানো শুরু হয় ডাক্তারবাবুর সম্মতি পাওয়ার পর থেকে। ছুটি মঞ্জুর হলে মন আর তখন কালীগঞ্জে থাকে না তার। ঐ অজ পাড়াগাঁয়ে কী মধু যে রাখা আছে তার জন্য সরস্বতীও বুঝতে পারে না। গড়িমসি করলে অবনীর কাছে বকা খায় সে। বিড়ি থেকে গামছা–সব নেওয়া চাই সঙ্গে। নদীয়া-নবদ্বীপ বলে কথা। দেশের মাটিতে পা দিলেই আতিকুটুমরা বলবেন, কই গো মুরুব্বি, গটে লদীয়ার বিড়ি দাও। পুণ্যধামের বিড়ির নেশা হয়ত বহুত জোর হবে।

বান্ডিল খুলে সবাইকে একটা-একটা করে বিড়ি ধরিয়ে দেয় অবনী। নিজে আর নদীয়ার বিড়ি খায় না। ওসব বিড়ি খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেল। সেও হাত বাড়িয়ে দেয় আত্মীয়তার, দাও গো, আমাকে একটা এগরার বিড়ি দাও। আমিও মুখ বদল করি।

শুধু বিড়ি নয়, চা পাতা গুঁড়ো দুধ আর চিনি সঙ্গে করে নিয়ে যেত অবনী। গাঁ- ঘরে এসব জিনিস চট করে পাওয়া যায় না। চিনি পাওয়া গেলেও চা আর গুড়ো দুধ তখন বিলাসিতার সামগ্রী। সকালে চা না খেলে তার পেট খোল হবে না, মাথা ধরে যাবে গ্যাসে, পেটের ভেতর ভুটভাট আওয়াজ আর অস্বস্তি। বড়ো জামবাটিতে চা ফুটছে টগবগিয়ে। সবাইকে চা-করা শেখাচ্ছে অবনী। গর্বে বুকের ভেতরে খোল করতাল বাজছে সরস্বতীর। গ্লাসে গ্লাসে বিলি হয়ে যায় ধোঁয়া ওঠা চা। গরম চায়ে চুমুক মেরে আঃ’ শব্দের যে অলৌকিক উচ্চারণ তা যেন দেশ-গাঁয়ের একঘেয়ে বাতাসকে ধনী করে তোলে। ছুটির দশ-পনেরটা দিন অবনীর যেন দম ফেলবার ফুরসত নেই। গা-ভর্তি আত্মীয়কুটুম। সবার বাড়িতে একদিন করে গেলে আরও যে কত ঘর বাকি থেকে যায়, তার কোনো গোনাগুনতি নেই। সময়হীনতার অজুহাতে অভিমানের পারদ বাড়ে। কেউ আবার আক্ষেপের সঙ্গে বলে, মোর ঘরে কেনে যাবা গো দাদা, মোর মেনে গরীব মানুষ। খাইতে পরতে দিতে পারবানি। তুমি চাকুরিয়া মানুষ। তোমাদের সম্মান কি আমি রাখতে পারি। যা হউক, ভালা থাক সব। গাঁয়ের ধুলো বুঝি ধুলো নয়–সোনা। যে ভাষায় নদীয়ায় কথা বলে অবনী সে ভাষা আমূল বদলে যায় মেদিনীপুরের মাটিতে পা ছোঁয়ালে। শুধু অবনী একা নয়, সরস্বতীও তখন সঙ্গ দেয় ও ভাষায়। নদীয়া-মেদিনীপুরের হৃদয়ের শব্দ মিলেমিশে হয় একাকার।

এত আনন্দ তবু এর ভেতরেও শীতকালের বিষাক্ত সাপের মতো চুপচাপ শুয়ে থাকে দুঃখ আর হতাশা। ফি-বছর দেশ আসার সময় অবনীর পকেট মার হবেই হবে। শিয়ালদা থেকে হাওড়া-এই পথটা কিছুতেই যেন শেষ হয় না। সবাই যেন ওঁৎ পেতে বসে থাকে অবনীর জন্য। অবনীরও সতর্কতার শেষ নেই। টাকাগুলো সে কোমরে বেঁধে রাখে শক্ত করে যাতে কেউ কেটে নিতে না পারে। ট্রামে-বাসে যেখানেই যাক অবনীর টাকা হারাবেই হারাবে। বাস থেকে নেমে টাকার শোকে বুক চাপড়ানো কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। আর তখনই গালিগালাজ শুরু করবে সরস্বতী, মর মর, মুখে রক্ত উঠে মর। গরীবের টাকাগুলান কেড়ে নিলি-তোদের ভালো হবে না। যে হাত দিয়ে টাকা উঠালি, সেই হাতে তোর কুষ্ট হবে। মা বুড়োমা, যে নিয়েছে সে যেন ধড়ফড়িয়ে মরে। তার গায়ে যেন পোকা হয়।

দেশ যাওয়া আর আসা নিয়ে এরকম গল্প শুভর স্মৃতিতে ভরে আছে। বছরে অন্তত দু-বার মেদিনীপুরের মাটিতে পা না দিলে অবনী হাঁপিয়ে ওঠে, একেবারে পাগলের মতো ব্যবহার করে সে।

অতসীপিসি অবনীকে বোঝালে অবনী ডায়ে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়িয়ে বলবে, আপনি জানেন না দিদি, দেশের টান যে কী টান! এদেশে খেতে-পরতে পাই, তবু যেখানে জন্মেছি সেখানকার কথা কি ভোলা যায়? চোখ বুজলে রোজ আমি আমার গায়ে যাই। এগরা পার করে মাঠে মাঠে আমি যেন পৌঁছে যাই রুক্মিনীপুরে। পুকুরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। মাছের ঘাই মারা দেখি। চেনা মানুষগুলো আমার বুকের পাথরটা সরিয়ে দেয়।

অবনী যে আত্মীয়তা তার দেশ-গায়ের জন্য অনুভব করে তার সিকি ভাগও শুভর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার ঝড় তোলে না। এর পেছনে কারণটা যে কি তার সূক্ষ্ম হিসাব বা সূত্র টের পায় না সে।

অবনী গম্ভীর হয়ে বলে, বড়ো হ, তারপর বুঝবি? দেশের মাটি না হলে জীবনের কোনো পুজোই তো ঠিক মতো হয় না।

বই কেনা হয়ে গেলে এবারও দেশে যাওয়ার তোড়জোড় করবে অবনী। সে কথা সে শুনিয়ে রেখেছে সরস্বতীকে। কেউ বাধা দিলে তুমুল অশান্তি বাঁধবে ঘরে। একরোখা অবনী তখন কারোর কথা শুনবে না।

কিচেন অব্দি শুভকে এগিয়ে দিয়ে গেল মাধুরী। এ সময় প্রতিদিন হাসপাতালের মাঠজুড়ে নরম আলো খেলা করে। ঝরাপাতা বিছিয়ে যায় ঘাসের বিছানায়। রসকাটা গাছি তার মাটির হাঁড়িগুলো নিয়ে গুছিয়ে রাখছে কাঁঠালগাছটার গোড়ায়। খেজুরের গাছ কেটে ঠিলি বেঁধে সে তার কুঁড়ে ঘরে ফিরে যাবে সাঁঝবেলায়। শুভকে দেখতে পেয়ে গিয়াস বলল, আজ কই সাইকেল চালাতে দেখলাম না তো?

শুভ হাসল।

-পিসির আজ ডিউটি নেই।

-তাতে কী হয়েছে। তুমি আমার সাইকেলটা নিয়ে চালাতে পার। গিয়াস বলল, আমি জানি-সাইকেল চালানোর নেশাটা কী রকম।

শুভ বলল, আজ আর চালাব না। পিসির বাড়ি যেতে হবে। ওখানে বাগানের কাজ আছে।

–ঠিক আছে যাও। রস খেতে মন হলে কাল ভোরে চলে এসো। জিরেন কাট রস খাওয়াতে পারব। গিয়াস তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে দূরের দিকে তাকাল, এবছর তেমন আর শীত পড়ল কই? শীত না পড়লে খেজুরগাছ রস ঝরাতে চায় না।

মাধুরী পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। খেজুরের রস খাওয়ার থেকে তার গন্ধটা ভালো লাগে তার। গিয়াস দু-একবার যে তাদের বাড়িতে রস পৌঁছায়নি এমন নয়। তার মা খেজুরের রস খেতে ভালোবাসে। ডাক্তারবাবুকে রস খাইয়ে হাতে রাখতে চায় গিয়াস কেন না আগামী বছরও সে যদি গাছকাটার চুক্তিটা পায় তাহলে তার অভাবের সংসারে একটু গুছিয়ে নিতে পারে। তবে গিয়াসের ব্যবহার ভালো, সে এই হাসপাতালের সবার মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে।

গিয়াস মাধুরীকে তুষ্ট করার জন্য বলল, কাল সকালে তোমাদের ঘরে রস দিয়ে আসব। ভোর ভোর ওঠো তো তোমরা?

মাধুরী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতেই গিয়াস খুশি হয়ে বলল, অত বড়ো মানুষের মেয়ে, দেখো মনে কোনো অহঙ্কার নেই। আসলে শিক্ষা, শিক্ষাই মানুষকে মানুষ করে তোলে।

হাতে কাজের কোনো কমতি নেই, গিয়াস হড়বড়িয়ে চলে গেল। আজ বছর দুয়েক থেকে এই মানুষটাকে দেখছে শুভ। কাজের মধ্যেই ডুবে থাকে সারাক্ষণ, কাজই যেন তার আল্লা। গেল বছর গাছঝোড়ার সময় একটা ক্ষরিস সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়েছিল খেজুরগাছের মাথায়। আর একটু হলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত গিয়াসের, সে যাত্রায় বুদ্ধির জোরে সে বেঁচে গেল। হাতের ধার ঘেঁসো দিয়ে সজোরে একটা কোপ মেরেছিল সাপের শরীর লক্ষ্য করে। এতেই কাজ হয় মোম। দ্বিখণ্ডিত সাপটি রক্তশরীর নিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। নিজে বেঁচে কিন্তু সাপটার জন্য সে হা-হুতোশ করে কাঁদছিল কপাল চাপড়িয়ে। বারবার করে বলেছিল, আল্লা রহিমের কী খেলা! একটা জান বাঁচাবার জন্য আর একটা জানকে কুরবানী দিতে হল!

সেই কাটা সাপটা দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিল হাসপাতালের ছেলে-মেয়েরা। ভয়ে দশ হাত পিছিয়ে গিয়ে তারা মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিল যে যার মতো। অবনী গিয়াসের কাছে গিয়ে তার ঘর্মাক্ত পিঠে হাত রেখে বলেছিল, শোক করে কি হবে ভাই? যা হবার তা হবেই। যা হয়েছে তা তো তোমার ইচ্ছায় হয়নি। এসব আগে থেকে উপরওয়ালার কাছে লেখা ছিল।

গিয়াসের স্বাভাবিক হতে সময় লাগছিল, গামছায় মুখের ঘাম মুছে সে আতঙ্কিত গলায় বলেছিল, তুমি ঠিকই বলেছে দাদা, এসব আগে থিকে লেখা থাকে। নাহলে এত গাছ ঝড়ছি-বই কোনো গাছে তো সাপ বেরয় নি!

সেদিন একটা বিড়ি দিয়েছিল অবনী, তারপর পাথরপোরা লাইটারটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, মন খারাপ করো না। বেঁচে থাকতে গেলে এরকম কত ঘটনার সাক্ষী হতে হবে। ভেঙে পড়ো না ভাই। নিজের কাজ নিজে করে যাও। তার মধ্যে সব শান্তি তুমি খুঁজে পাবে।

শুকনো পাতা, খড়কুটো জোগাড় করে আগুন ধরিয়েছিল অবনী। সেই দাউ দাউ আগুনে সাপটাকে লাঠিতে করে ছুঁড়ে দিয়েছিল সে। ধোঁয়ারকুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতেই হঠাৎ একটা শব্দ হল। ভয়ে পিছিয়ে গেল বাচ্চাকাচ্চার ভিড়। অবনী সবাইকে সতর্ক করে বলল, তোরা সব সরে দাঁড়া। বিষের থলি ফেটে গিয়ে ছড়িয়ে যেতে পারে, আর কারোর যদি গায়ে লাগে তাহলে আর রক্ষে নেই!

শীতের বিকেলে অভিমান বড়ো তীব্র হয়।

শুভ হাঁটতে হাঁটতে কিচেন পেরিয়ে চলে এসেছে অনেকটা। এই হাসপাতালের চেনা পরিমণ্ডল তাকে যেন পাগল করে দেয়। অভাব আছে এখানে, ক্ষতি নেই। ভালোলাগা যা আছে তার দাম কি পয়সা দিয়ে মেটানো যায়? আজ হঠাৎ তার মনে পড়ছে রঘুনাথের কথা। রঘুনাথ তার চেয়ে বয়সে বড়ো তবু বন্ধুত্ব গড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। ছেলেটার মন জলের মতো সরল। রঘুনাথকে দেখলে শুভর বুঝি আকাশ দেখা হয়ে যায়। এই বয়সে কত কি জেনেছে সে। সে যত পাখির নাম জানে তার অর্ধেক নাম এ গাঁয়ের অনেকেই জানে না। রঘুনাথের বাঁশি শুধু সুর তোলে না, চোখে জল এনে দেয়। বাঁশিটা ওর কাছ থেকে শিখতেই হবে। বাংলার মাস্টারমশাই বলেছেন, কথা সাহিত্যিক শরচ্চন্দ্ৰ ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। রঘুনাথ বলেছে, মিতে, তোর জন্য বাঁশি কেন আমি আমার কলিজা উপড়ে দিতে পারব। তোকে একটা কথা বলি–আমি বড়ো ভালোবাসার কাঙালরে! এ গাঁয়ের কেউ আমাদের ভালো চোখে দেখে না। সবাই ভাবে কী গরীব হলে বুঝি চোর হয়।

রঘুনাথের বুকের ভেতরটা জ্বালাপোড়া করছিল কথাগুলোকে উগরে দেবার জন্য। বাবুসমাজে তাদের সেরকম ঠাঁই নেই। আবার তাদের সেবা না নিলে বাবুদের চলেও না। ওরা গাঁয়ের একধারে পড়ে আছে, ওদের যে কেউ দেখেও দেখে না। শুধু ভোটের সময় খাতির বেড়ে যায় ওদের। টিন টিন গুড় পচানো মদ এনে বুনোপাড়ায় বিলানো হয়। কেউ তখন একটা প্রতিবাদও করে না। আসলে মানুষগুলোর প্রতিবাদ করার মতো ভাষা নেই, ভাষা থাকলেও সাহস নেই। কেউ যে মাজা সোজা করে দাঁড়াবে, দু-চারটে কথা বলবে-তেমন মানুষও পাওয়া ভার। রঘুনাথ হাতের মুঠি পাকিয়ে বলে, তোদের হাসপাতালের অতসী নার্স ছাড়া আর কেউ তেমন একটা ভালো নয়। সবাই দেখছি গা এড়িয়ে ডিপটি করছে। উগীদের উপর কারোর কোনো দায় নেই। সব আসে যায় মাহিনা পায়, ব্যাস!

গুয়ারাম যখন ভর্তি ছিল তখন পরপর বেশ কয়েকদিন রাত জেগেছে সে। কারা যে গুয়ারামের মাথাটা ফাটিয়ে দিল সে রহস্য এখনো আলোয় আসেনি। তবে রঘুনাথ তক্কে তক্কে আছে, নামটা জানতে পারলে তার বাপের শ্রাদ্ধ দেখিয়ে ছেড়ে দেবে।

আউটডোরের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে রঘুনাথ সুর তুলত আড়বাঁশির, আর সেই সুরে আকৃষ্ট হয়ে আগুন পোকার মতো হাজির হত শুভ। চোখে মুখে ছড়িয়ে যেত অদ্ভুত জ্যোৎস্না মাখা সারল্য। আন্তরিকতা বাড়ার পর শুভই বলেছিল, আমাকে বাঁশিটা শিখিয়ে দিতেই হবে।

-বাঁশি যে শিখবি, তোর বাঁশি কোথায়? রঘুনাথের মোটা ঠোঁটে রোদ লাগা বনআলু পাতার মতো হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল।

অপেক্ষা শেষ হতেই সে দেখতে পেয়েছিল বাঁশি হাতের রঘুনাথকে। সদ্য তৈরি করা বাঁশিটা শুভর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, এই নে তোর বাঁশি। এই বাঁশি বানাতে গিয়ে আমি পুড়ে গেলাম। গনগনে লোহার শিকের ছ্যাঁকা খেলাম।

শুভ হা-করে তাকাল রঘুনাথের দিকে, বাঁশি তৈরি করতে গেলে বুঝি ছ্যাঁকা খেতে হয়?

রঘুনাথ তার সন্দেহ কাটিয়ে দেবার জন্য বলেছিল, আগুন আর লোহা না হলে বাঁশিতে ফুটো হবে কি করে? কাঠ কয়লার আগুনে লোহার শিক ফেলে রেখে তাতাতে হয়। শিক লাল হলে সাঁড়াশিতে ধরে ছাতার বাঁটে গুঁজে দাও। সামান্য ধোঁয়া বেরনোর পরে ছিদ্র হয়ে যাবে। এভাবে ছটা ছ্যাদার দরকার। নাহলি যে সুর খেলবে নি। আর হ্যাঁ, ফুঃ দেবার জন্য আর এট্টা বড় ছাদা চাই। মোট সাতটা ছ্যাদা না হলে বাঁশি যে বাজে না। রঘুনাথ তৃপ্তির হাসি হাসল। শুভর হাত থেকে বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে উদাসী ফুঁ দিয়ে সুর ভাসাল বাতাসে। মুহূর্তে পাল্টে গেল হাসপাতালের রূপ ও চেহারা। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল বাতাস। কোথা থেকে ছুটে এল। সুগন্ধ ঘ্রাণ। আকাশের চাঁদ বুঝি ঝরিয়ে দিল জ্যোৎস্নাস্রোত।

মুগ্ধ বিস্ময়ে শুভ চেয়ে থাকল রঘুনাথের দিকে। সাধারণ চেহারায় কী অসাধারণ জ্যোতি বের হয় তখন। ঝাঁকড়া চুলের রঘুনাথ যেন কৃষ্ণ অবতার। তার পেশীবহুল চেহারায় কদমের কচি পাতার লাবণ্য। কালো কুচকুচে চোখ দুটো যেন আভা ছড়িয়ে দেয়। জোড়া জ্বর নীচে কিছুটা চ্যাপ্টা নাক তাকে জেদি করে তোলে আজন্ম।

খুশিতে টগবগ করে শুভর হৃদয়, বড়ো পকেটের ভেতর থেকে সে বের করে আনে মুঠো মুঠো মুড়ি। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মুড়িগুলো পকেটে ভরে নিয়েছে সে। মা জানতে পারলে কোনো ক্ষতি ছিল না। ধরা পড়ে গেলে সে বলত, রাস্তায় যেতে যেতে খাবো।

মুড়ি আর পাটালি গুড় পেয়ে রঘুনাথের খুশি আর ধরে না। সারাদিন তার খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। গুয়ারাম হাসপাতালে ভর্তি হবার পর চাল আসেনি ঘরে। চুনারাম জ্বর শরীর নিয়ে ভিক্ষে করতে গিয়েছিল গ্রামের ভেতর। ভিক্ষার চালগুলোতে এতগুলো লোকের পেট ভরেনি। তবু দুর্গামণি নিজে না খেয়ে এক জাম বাটি ফেনভাত দিয়েছিল তাকে। রঘুনাথ মায়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝে যেন খেল না। দুর্গামণি খাওয়ার জন্য জোর করলে রঘুনাথ আত্মবিশ্বাসী গলায় বলেছিল, আমার খাওয়ার জন্য তুই ভাববি নে, মা। আমার জন্যি খাওয়া নিয়ে হাসপাতালের লোক বসে আছে। হাসপাতাল থিকে যা ভাত দেয়, বাপ অত ভাত খেতি পারে না। বাপের খাওয়া হয়ে গেলে সেই ভাতগুলো আমি খেয়ে নিই। এছাড়া বাড়তি ভাতও ঠাকুরমশাই আমাকে দিয়ে দেয়। একটা তো পেট। কত আর খাবো মা!

.

৩৫.

গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলে তৃপ্তি পায় রঘুনাথ। এত সরল, সাদাসিধে গেয়ো মেয়েমানুষকে বুঝিয়ে শান্ত করে দিতে বেশি সময় লাগে না রঘুনাথের। ছেলের প্রতি এত বিশ্বাস যা বলবে তা মেনে নেবে দুর্গামণি।

মুড়ি আর পাটালি গুড়ের আলাদা গন্ধ আছে। খাওয়ার শব্দও আলাদা। তবু শুভর মনে হয়–মুড়ি চিবানোর শব্দের সঙ্গে কলিজার ধক ধকাস শব্দের বহু মিল আছে।

রঘুনাথ মুখ ভরে মুড়ি খায় আর প্রতি কামড়ে ভেঙে নেয় পাটালি গুড়। শুভ চেয়ে চেয়ে দেখে।

রঘুনাথ বলে, এ বছর এই প্রথম পাটালি গুড় খেলাম। এখন যা পাটালির দাম–তুই না আনলে কবে যে খেতাম কে জানে।

রঘুনাথ জল খাওয়ার জন্য মাঠের কলটার কাছে হেঁটে গেল। রোগীদের জল খাওয়ার জন্য সরকার থেকে কলটা বসিয়ে দিয়ে গেছে। হাসপাতালের এই চাপা কলটার জল ভীষণ ঠাণ্ডা।

হ্যান্ডেল দাবিয়ে জল বের করে আনছিল শুভ, ঈষৎ ঝুঁকে আঁজলা ভরে জল খাচ্ছিল রঘুনাথ। এ সময় যে অতসীপিসি ডিউটি ছেড়ে বাইরে এসে যাবে ভাবেনি তারা। শুভ আর রঘুনাথ দুজনেই ভ্যাবাচেকা খাওয়া চোখে তাকাল। অতসীপিসি হাসি ছড়িয়ে দিলেন ঠোঁটে, শুভকে শুধোলেন, কি ব্যাপার, এত রাতে কি করছিস এখানে? তোর পড়াশোনা নেই?

শুভ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলেছিল, রঘুনাথের বাবা ভর্তি আছে হাসপাতালে। জান, পিসি রঘুনাথ ভালো বাঁশি বাজায়। এই দেখ–এই বাঁশিটা ও আমার জন্য তৈরি করে এনেছে।

অতসীপিসি বাঁশিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন, খুশি হলেন তিনি। ঘাড় তুলে রঘুনাথের দিতে তাকালেন, কী নাম তোমার?

-আজ্ঞে, রঘুনাথ!

থাকো কোথায়?

–হলদিপোঁতা ধাওড়ায়।

 অতসী পিসি উৎসাহিত হলেন, তুমি বাঁশি বাজাতে জানো বুঝি? বাঃ, ভীষণ গুণী ছেলে দেখছি। আচ্ছা, এখন একটু বাঁশি বাজাও না, আমার শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।

জড়তা কাটিয়ে রঘুনাথ বাঁশি তুলে নিল হাতে, ফুঁ দিয়ে মনের মতো সুর না ওঠায় বাঁশিটাকে ভিজিয়ে নিল জলে। বাড়তি জলটুকু ঝেড়ে সে আবার ফুঃ দিল বাঁশির মুখে। ভারী হয়ে সুর উঠল বাতাস পেঁচিয়ে। শুভর মনে হল সুর যেন আর কিছু নয়, কঞ্চি বেড়ায় পেঁচিয়ে ওঠা শিমলতা, যাকে ছোঁয়া যায়, ধরা যায় আর আদর করা যায়। শুভ মনে মনে ভাবল বাঁশি তাকে যে করেই হোক শিখতে হবে। বাঁশি শেখায় তেমন কোনো খরচ নেই। সাঁঝবেলায় রঘুনাথের ঘরে চলে গেলেই হল। সে গেলে রঘুনাথ খুশিই হবে।

অতসী পিসি ডিউটি রুমে চলে যাবার পর, পকেট থেকে দু-টাকার একটা নোট বার করে আনল শুভ। রঘুনাথের হাতে দিয়ে বলল, নে। এটা তোর।

–তোরা খুব বড়োলোক, তাই না? রঘুনাথ বোকার মতো প্রশ্ন করল। হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না শুভ। এই পৃথিবীতে অন্তত একটা মানুষের চোখে সে বড়োলোক–এই ভেবে তার গর্ববোধ হল। আসল সত্যটা আড়াল করে শুভ বলল, আমার কাছে দু-টাকা যোগাড় করা কোনো ব্যাপার নয়। শুভ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, অতসীপিসির বাগানে কাজ করে দিলে টাকার কোনো অভাব হয় না। অতসীপিসি দু-হাত ভরে টাকা দেন। ওরকম মনের মানুষ এ হাসপাতালে আর দুটি নেই।

রঘুনাথ ঝিম ধরে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর দুঃখী গলায় বলল, এত বড়ো গাঁ, কেউ দুটা পয়সা ভিখ দিতে চায় না। অথচ, দেখ-সবার কত কি আছে?

-দুঃখ করিস না। দুঃখ করলে দুঃখ বাড়ে। শুভ বোঝাতে চাইল, সব ঠিক হয়ে যাবে। যারা সৎ পথে চলে, ভগবান তাদের ফেরায় না। আমার মা কী বলে জানিস–এই কষ্ট পাওয়ার মধ্যে কোথাও সুখ আছে।

তোর এই কথাগুলো আমি মানি না। রাগে গর্জন করে উঠল রঘুনাথ, ভগমান বড়োলোকর ঘরে পাত পেড়ে বসেছে, আমাদের ঘরে সে কী পাবে-খুদকুঁড়া ছাড়া তো কিছু জুটবে না তার কপালে।

আজ আর বাগানে কাজ করতে দিল না অতসীপিসি।

মন খারাপ করে শুভ যখন ফিরে যাবার কথা ভাবছে তখন অতসীপিসি তাকে বলল, ঘরে এসে বস। দরকার আছে।

পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে এল শুভ। এ ঘরে তার কোনো বাধা নিষেধ নেই, যেখানে খুশি সে যেতে পারে। অতসীপিসির যখন নাইট ডিউটি থাকে তখন সবুজকে নিয়ে বড়ো খাটটাতে ঘুমায় সে। আবার সকাল হলে যে যার বাড়িতে চলে যায়। সবুজ সঙ্গে থাকলে তার পড়াশোনা একদম হয় না। বড়ো ফাঁকিবাজ ছেলে সবুজ। শুভ তাকে বুঝিয়েও পারেনি। সবুজ সব কিছুকে হালকা করার জন্য বলে, গাছের পাতা কি লেখাপড়া শেখে? শেখে না তো! তাহলে আমি সবুজ হয়ে কেন পড়ব? দিনরাত পড়তে আমার বয়ে গেছে। ছোটখাটো সবুজ রাতদিন খালি বাঘার পেছনে লেগে আছে। ওদের কোয়ার্টার পাশাপাশি, তাই বাঘা কুকুর আর সবুজের দেখা হয় ঘন ঘন। অতসীপিসি ডিউটিতে চলে গেলে বাঘা ছাড়া থাকে, কেউ বাগানের ফুল বা বেড়া ভাঙতে এলে বাঘা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাবে বলখেলার মাঠ পর্যন্ত। দেশী কুকুর যে এত বিক্রমশালী হয় তা বাঘাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। পলাশী হাসপাতাল চত্বরে ছোট্ট বাঘাকে প্রথম দেখেন তিনি। উলের বলের মতো নরম তুলতুলে তাঁর শরীর। কী সুন্দর, ফুটফুটে চেহারা। মায়ের পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিল সে। আর ঠিক তখনই তার মনে হয় একটা কুকুর পুষলে মন্দ হয় না। তাঁর একাকিত্ব ঘুচবে। বাঘার সঙ্গে অন্তত কিছুটা সময় কাটানো যাবে।

সেদিনের বাঘাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি। ড্রাইভার চিত্রভানু দিদিমণিকে কুকুরের বাচ্চাকে এত ভালোবাসায় কোলে নিতে দেখে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, কোলে যখন নিয়েছেন তখন এটাকে নিয়ে কোয়ার্টারে চলুন। আপনি তো একা থাকেন, পুষবেন। আপনার একঘেয়েমি দুর হবে। পোর ইচ্ছা প্রবল, কিন্তু মা কুকুরটা হাসপাতালের গাড়ির কাছাকাছি চলে এসে এমন ছলছলে চোখে তাকাচ্ছে, যা দেখে অতসী দিদিমণির মনটা বেজায় খারাপ হয়ে যায়। তিনি ভাবছিলেন বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দেবেন অন্তত মা কুকুরটার মুখ চেয়ে।

কী মায়ায় বাধ্য বালিকার মতো গাড়িতে উঠে বসেছিলেন অতসী দিদিমণি। ডিউটিতে এসে এই প্রথম তার অন্যধরনের অনুভূতি। সেই অনুভূতি এখন অনেকটাই তার অন্তর জুড়ে ছেয়ে আছে। বাঘা বড়ো হয়েছে, ওকে না দেখলে অতসী দিদিমণির বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। বাঘা-বাঘা’ ডাকতে ডাকতে গ্রামে চলে যান খুঁজতে। পেয়েও যান। বকাঝকা করে ফিরিয়ে আনেন বাঘাকে। তিনি যেভাবে, যে ভঙ্গিতে বাঘার সঙ্গে কথা বলেন, অনেকে ভাবেন–বাঘা বুঝি তার সন্তান।

বিকেলের আলো যত কমে আসছিল ততই শীত পড়ছিল জাঁকিয়ে। শেষ ডিসেম্বরের এই সময়টাতে কুয়াশারা হামাগুড়ি দেওয়া ভেড়ার বাচ্চার মতো ধীরে ধীরে ঘাস মাটি আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের জলীয় মুখে শুধু শীতবন্দনা।

শীত শীত অনুভূত হচ্ছিল শুভর, তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাবার ইচ্ছাটা তাই প্রবল হচ্ছিল মনের ভেতর। অতসীপিসি চুল আঁচড়াচ্ছিলেন বড়ো আয়নার সামনে বসে। হাঁটু অব্দি লম্বা চুল বাগে আনতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। বেশির ভাগ দিন চুল বাঁধার জন্য হাঁক পেড়ে ডেকে নেন সরস্বতীকে। ছুটি কিংবা রেস্ট-ডে থাকলে অতসীদিদিমণি কেশ চর্চার দিকে লক্ষ্য দেন। আজ অবেলায় চুল বাঁধতে দেখে কিছুটা অবাক হয় শুভ, মাকে কি ডেকে দেব পিসি?

-না থাক। অতসী পিসি অজান্তে হাসলেন, শুভ তার সুন্দর চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকল অপলক, জান পিসি, তোমার মতো এত ভালো চোখ এ হাসপাতালে আর কারোর নেই। তুমি যেমন দেখতে ভালো, তেমনি তোমার মনটাও ভালো। আমার মা বলে, তুমি না থাকলে আমাদের সংসারটা ভেসে যেত।

অতসীপিসি অবাক হয়ে শুনলেন শুভর কথা, নারে বোকা, তা নয়। তোর মায়ের মধ্যে এখনও গ্রামের সদ্গুণগুলো হারিয়ে যায়নি। আর তাছাড়া, তোদের যেখানে দেশের বাড়ি-তার মাত্র মাইল খানিক দুরে আমার বাপের বাড়ি। তোর বাবাকে আমার বাবা-দাদা সবাই আগে থেকে চিনত। আমিও হয়ত তোর বাবাকে দেখেছি ছোটবেলায়। এখন ঠিক মনে করতে পারি না। অবনী দেশে গেলে হাজার কাজ থাকলেও একবার সে আমাদের বাড়িতে যাবেই যাবে। আমার দাদা ওকে ভীষণ ভালোবাসে। কী বলে জানিস? বলে অবনীর মতো ভালো মনের মানুষ সারা দেশ-গাঁ ঘুরে এলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

শুভ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে অতসীপিসির সামনে। সারা ঘরে ভুরভুর করছে নারকেল তেলের গন্ধ। ঘরও যে মন্দির হয়ে ওঠে এটাই বুঝি তার উৎকৃষ্ট নমুনা। চুল বেঁধে খুবই সুখী ভঙ্গিমায় গা-হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অতসীদিদিমণি। শুভর দিকে স্নেহের চোখে তাকালেন, আর তাতেই শুভ যেন টের পেল একটা অদৃশ্য শক্তি তার শরীরে ঢুকে তাকে বলবান আর জেদী করে তুলছে।

-পিসি, এবার আমি যাই। সন্ধে হয়ে এল বলে।

অতসীদিদিমণি শুভর মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তোর রেজাল্টের খবর আমি শুনেছি। এই হাসপাতালের প্রত্যেককেই আমি তোর উদাহরণ দিই। যারা পড়াশোনা করে না, ফঁকি মারে তাদেরকে বলি তোর মতো হওয়ার জন্য। কেন বলি–জানিস? তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে। অতসীদিদিমণির চোখের তারা চকচকিয়ে উঠল কিসের ভরসায়, ঈষৎ কণ্ঠস্বর দুলে উঠল তার, মোহাবিষ্ট স্বরে বললেন, তুই আমার দেশের ছেলে। তোকে প্রমাণ করে দিতে হবে–তুই মাধুরীর চাইতে কোন অংশে কম নয়। সেদিন কথায় কথায় ডাক্তারবাবু অনেক বাজে কথা শোনালেন আমাকে। আমি সেসব কথার প্রতিবাদ করেছি। বলেছি–প্রতিভা আর পরিশ্রমের কাছে প্রাচুর্য মাথা নত করতে বাধ্য। ডাক্তারবাবু আমার কথাটা মানেনি। তোকে সেটা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে হবে। আমি যদি না মরে যাই হঠাৎ করে তাহলে তুই আমার স্বপ্নটাকে সত্যি করে দেখাস। আমার তো ছেলেপুলে নেই। তোরাই আমার সব।

অতসীপিসি উবু হয়ে খাটের তলা থেকে বের করে আনলেন একটা কাপড়ের প্যাকেট। একটা লাল রঙের সোয়েটার সেই প্যাকেট থেকে বের করে অতসীপিসি বললেন, এটা তোর জন্য কৃষ্ণনগর থেকে কিনে এনেছি। হাসপাতালের গাড়ি গিয়েছিল, আমিও গিয়েচিলাম সেই গাড়িতে। ওখানে গিয়ে মনে হল–তোর জন্য একটা সোয়েটার কেনার দরকার। তোর তো ভালো সোয়েটার নেই। এবার থেকে এটা পরবি

আমি নেব না। মা যদি কিছু বলে। সোয়েটারটা হাতে ধরে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল শুভ।

শুভ বলল, পিসি, এটা থাক।

–কেন থাকবে? আমি বুঝি তোদের কেউ নই? অতসীপিসি কোনো কথা শুনলেন না, বরং জোরের সঙ্গে বললেন, ক্লাস নাইনের বই কেনার ক্ষমতা তোর বাবার নেই। ঘরে থাকলে তোর বাবাকে একবার পাঠিয়ে দিবি তো?

শুভ ঘাড় নেড়ে বাইরে আসার চেষ্টা করলে অতসীপিসি তার হাত ধরল, যাবি তো, এত তাড়া কেন? মিষ্টি এনেছিলাম, খেয়ে যা।

অতসী পিসির আন্তরিকতার কোনো সীমা নেই।

শুভ টেবিলের উপর কাচ বাঁধানো একটা পুরুষালি ফটো দেখে বলল, এটা কার ফটো পিসি?

–আমার এক আত্মীয়ের।

–এখানে কোনোদিন আসেননি তো?

-খুব ব্যস্ত মানুষ। আসার একদম সময় পায় না। অতসীপিসির গলা বুজে এল আবেগে। কিছু একটা ঘটনা তিনি লুকাতে চাইছেন সযত্নে। শুভ শুধালো, পিসি, ওঁর বাড়ি কোথায়?

শুভর অতিরিক্ত কৌতূহল দেখে বিরক্ত হলেন অতসীপিসি, তোর এত খোঁজ খবর নিয়ে কি লাভ? তুই কি সেখানে যাবি নাকি?

বিব্রত শুভ মুখ নামিয়ে নিল লজ্জায়।

খোলা জানলা দিয়ে অন্ধকারের রেণু ঢুকে আসছে গুঁড়ি গুঁড়ি। সন্ধে নামতে আর বেশি বাকি নেই। শুভ দেখল সবুজ পর্দা সরিয়ে চোখের ইশারায় ডাকছে তাকে।

শুভ বাইরে এসে বড়ো করে শ্বাস নিল।

সবুজ চাপা গলায় বলল, রঘুনাথ এসেছে। তাড়াতাড়ি চল। অনেক কথা আছে। সবুজের চোখ-মুখ বলছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। এ সময় বাঘা থাকলে তার ঘরে ঢোকার সাহস-ই হত না।

হাতের সোয়েটারটা নিয়ে সমস্যায় পড়ল শুভ। এত কিছু নিয়ে রঘুনাথের সঙ্গে দেখা করতে ভালো লাগবে না। রঘুনাথ তার কাছে যত হম্বিতম্বি করুক এমনিতে সে মুখচোরা।

শীতের দাপটে চারপাশ মাথা ধরা রুগীর মতো বেজার হয়ে আছে। আজ সারাদিন শুভরও কম ধকল গেল না। এখনও বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। অভিমানের পাঁচিলটা এখনও কোনো তরফে কেউ ভেঙে দেয়নি।

শুভ আর সবুজ রাস্তায় এসে দাঁড়াল। হামাগুড়ি দেওয়া অন্ধকার এবার যেন মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। শনশনানো হাওয়ায় শীত খামচে দিয়ে যায় গায়ের চামড়া। সবুজ শীত সামলাতে তৎপর। হাফহাতা সোয়েটারের উপর সে চাপিয়েছে ফুল-হাতা সোয়েটার। গলায় হাতে বোনা মাফলার। তবু সে জড়োসড়ো হয়ে বলল, যতদিন না বুক-লিস্ট বেরয় ততদিন আমি বই ছোঁব না। বাবা আমার কি করবে? আমার পাশ করা নিয়ে কথা। প্রতিবছর আমি ঠিক পাশ করব।

শুভ এ কথার কী উত্তর দেবে বুঝে পেল না।

গা জড়াজড়ি কোয়ার্টারগুলো থেকে হ্যারিকেনের আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। রাস্তার দু-ধারের ঘাসগুলো শিশির জলে মুখ ধুয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে।

শুভ অতসীপিসির বেড়ার শেষ প্রান্তে এসে বলল, তুই এখানে দাঁড়া, আমি অনেকক্ষণ ঘর থেকে বেরিয়েছি। মার সঙ্গে দেখা করে আসি।

–চল, আমিও তোর সঙ্গে যাব।

ইচ্ছে না থাকলেও সবুজকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এল শুভ।

সরস্বতী খুশি হল না সবুজকে দেখে, তুই আবার শুভর সঙ্গে মিশছিস, তোর বাবা দেখতে পেলে আমাদেরই গালিগালাজ দেবে।

–তুমি থাম তো কাকিমা। সবুজ কিছুটা উত্তেজিত, তোমাদের কি ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে যে আমি তোমাদের সঙ্গে মিশব না। শুভ আর আমি এক ক্লাসে পড়ি। এক জায়গায় থাকি। বাবা বললেই কি আমাদের মেলামেশা বন্ধ করে দিতে পারবে। এ ব্যাপারে বাবা যদি জোর করে, গালমন্দ দেয় তাহলে দেখবে তোমরা-একদিন আমি ঠিক ঘর ছেড়ে পালাব। ওরা তো আমাকে চেনে না, যেদিন চিনতে পারবে, সেদিন কপাল চাপড়াবে।

এত কথার পরেও সরস্বতীর মুখখানা কেমন বিবর্ণ দেখায়। চাপা গলায় সে বলল, তোর মনে কোনো ঘোলা জল নেই, তুই তো সাফসুতরো কলের জল। কিন্তু তোর বাবা-মুখের উপর যা না আসে তাই সবার সামনে বলে দেয়। তখন মনে হয় বেঁচে থেকে আমাদের আর কোনো লাভ নেই, এর চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। সবুজের ফর্সা মুখ রাঙা হয়ে ওঠে লজ্জা আর অস্বস্তিতে। সে কাঁচুমাচু গলায় বলে, কাকিমা, আর কিছু বলল না। এসব শুনতে কার ভালো লাগে বলো। তবে আমি যতটুকু বুঝি-বাবার এসব বলা উচিত নয়। লেখা-পড়া জেনেও বাবা যদি মুখের মতো ব্যবহার করে তাহলে কার আর কি করার থাকতে পারে?

সোয়েটারটা তক্তপোষের উপর রেখে শুভ যখন বেরিয়ে আসবে ঘর থেকে তখন তার পথ আগলে দাঁড়াল সরস্বতী, রাত হচ্ছে, এখন যাবি কোথায়? ঘরে থাক। যা ঠাণ্ডা পড়েছে

শুভ এসব কথা কানে নিল না, মা, বাবা কোথায়?

-সে কোথায় যায়, আমাকে কি বলে যায়! সরস্বতীর গলায় অভিমান ধরা পড়ল, মানুষটা চিরকালই বাহিরমুখী। আমাকে কোনোকালেই সে পাত্তা দিল না। আজ যদি সে আমার কথামতো চলত তাহলে এ সংসারের হাল আজ এমন হত না।

সরস্বতীর চোখ হঠাৎ চিকচিকি কাগজে মোড়ান নতুন সোয়েটারটার উপর পড়ল, উবু হয়ে সোয়েটারটা হাতে নিয়ে সে দেখল, পছন্দ হল তার, এটা কোথায় পেলি রে, শুভ?

-পিসি দিয়েছে।

সরস্বতীর চোখ-মুখের চেহারা বদলে গেল নিমেষে, গদগদ গলায় সে বলল, তোর পিসির দেখছি সব দিকে নজর আছে। শুভ ব্যস্ত হয়ে উঠছিল রঘুনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য, মা, আমাকে যেতে হবে। রঘুনাথ এসেছে। সে একা আছে হাসপাতালের মাঠে।

তাকে এখানে আনতে পারতিস।

দরজার কাছে এসে আবার থমকে দাঁড়াল শুভ, মা, মুড়ি আর পাটালি গুড় এই চিকচিকি কাগজে ভরে দাও। রঘু সারাদিন খেয়েছে কিনা কে জানে। ওর সঙ্গে দেখা হলে ভীষণ মন খারাপ করে শুভর। সে এতদিন জানত–তারাই সব চাইতে গরীব কিন্তু তার থেকেও আরও অনেক গরীব মানুষ আছে এ সমাজে এটা তার বিশ্বাসই হত না। রঘুর সঙ্গে আলাপ হবার পর তার ধারণাটাই বদলে গিয়েছে। এই শীতে রঘুর গায়ে দেবার মতো গরম-পোষাক নেই। একটা পাতলা ফিনফিনে গেঞ্জির উপর গামছা জড়িয়ে সে চলে আসে হাসপাতালে।

ভাঁজ করা দু-হাত মুখের কাছে ধরা। উত্তরের হাওয়ায় সে ঠকঠক করে কাঁপে। তাকে দেখে মায়া হয় শুভর।

সরস্বতীকে বলল, মা আমার তুষের চাদরটা খুঁজে দাও তো।

গায়ে দিবি নাকি?

–না ওটা আমি রঘুকে দেব।

–দিবি মানে? তুই তাহলে কি গায়ে দিবি? অসন্তুষ্ট চোখে তাকাল সরস্বতী, আগে নিজে বাঁচ, তারপর অন্যের কথা ভাববি।

–একথা তুমি আমার মা হয়ে বলছো? শুভ তীরবিদ্ধ চোখে তাকাল। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠতেই সবুজ বলল, তোর আর চাদর দিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং আমি একটা ঘর থেকে এনে দিচ্ছি। আমার দিদি তো পুরনো চাদর গায়ে দেয় না। আমি বরং দিদির চাদরটা চুপচাপ নিয়ে চলে আসি, কেউ টেরই পাবে না।

-সেটা ঠিক নয়। শুভ বোঝাল, যদি কিছু দিতে হয় তাহলে সবাইকে বলে তুই দিবি। নাহলে দেওয়ার কথা ভুলে যা….

শুভর জেদের কথা সরস্বতী সব জানে না। বেশি সময় ব্যয় না করে সে কাপড়ের পুটলিটা নামাল তাক থেকে। পুঁটলি খুলে বের করে দিল মেটে রঙের তুষের চাদর। হাসির ঢেউ থেকে গেল শুভর চোখে, যাওয়ার আগে সে বলল, বাবাকে কিছু বলবে না। বাবা শুধালে বলবে, আমি মাধুবীদের বাড়ি গিয়েচি।

এখনও বিদ্যুৎ-এর আলো আসেনি এ হাসপাতালে। শুধু হাসপাতাল কেন, সারা গ্রাম ডুবে আছে অন্ধকারে। এখন কেরোসিন তেলের আকাল চলছে। ডিলাররা ব্ল্যাকে চড়া দামে বেচে দিচ্ছে তেল। ধরা পড়ে হেনস্থা হচ্ছে কেউ কেউ। তবু শিক্ষা হচ্ছে না কারোরই। খবরের কাগজ পড়ে কত জেনেছে শুভ। এই হাসপাতালে ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই খবরের কাগজ আসে। তাও এ গ্রামে পৌঁছতে দশটা-এগারটা বেজে যায়। শুভ সময় পেলেই ডাক্তারবাবুর বাড়িতে এসে খবরের কাগজ পড়ে যায়। প্রথম পৃষ্ঠায় যে কার্টুনটা ছাপা হয় সেটাই তার প্রিয়। শুভ তার বোর্ড বাঁধানো সাদা খাতায় রোজকার ব্যঙ্গচিত্রটি টুকে রাখে। এভাবেই ব্যঙ্গচিত্র এঁকে তার তিনটে খাতা শেষ হয়ে গেছে, আগের তুলনায় রেখাগুলো আরও জোরালো হয়েছে, আরও ভালো হয়েছে তার উপস্থাপন ক্ষম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *