০৫. পার্টির মিটিং

২১.

তিনদিন পরে পার্টির মিটিং কালীগঞ্জ বাজারে, দেবগ্রাম থেকে মীর মহম্মদ আসবেন ভাষণ দিতে–এসব নানা কারণে কপোতাক্ষবাবুর আর সময় নেই সংসারের দিকে নজর দেওয়ার। দিন রাত ঝোলা কাঁধে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন পার্টির চাঁদা তোলার জন্য। মাইক-লাইট-মঞ্চের পেছনে খরচ আছে। এত টাকা জোগাড় হবে কোথা থেকে? চিন্তায় কপোতাক্ষবাবুর মুখমণ্ডল ভার হয়ে আছে।

ঘর থেকে বেরনোর সময় মীনাক্ষী বেজার গলায় বলেছিলেন, যাচ্ছ যাও, তবে দুপুরে খাবে কী না বলে যেও। রোজ রোজ ভাত নষ্ট করতে গায়ে লাগে। ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে কপোতাক্ষ বলেছিলেন, দশের কাজে গেলে কখন ফিরব আমার সে খেয়াল থাকে না। কাজের সময় খাওয়ার কথাও মনে থাকে না।

এত দৌড়ঝাঁপ করে কি পাচ্ছ তুমি? গ্রামের মানুষ তো তোমাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। বড়দাও তোমার ওপর অসন্তুষ্ট। তিনি তো মুখের ওপর বলেন ছোট ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে।

-দাদার কথা বাদ দাও। কপোতাক্ষ সহজ হবার চেষ্টা করলেন, দাদা কি বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মানুষ হয়ে জন্মেছি যখন তখন আমার কিছু করণীয় আছে। আমি আমার কর্তব্য করতে চাই।

বেশ ভালো কথা। তবে তোমার সংসার করা উচিত হয়নি। ঘরে এক পা, আর পাটি অফিসে আর এক পা এভাবে সংসার চলতে পারে না। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। তুমি আমাকে কৃষ্ণনগরে রেখে আসবে চল। মীনাক্ষী দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে বললেন কথাগুলো।

কপোতাক্ষ ধাক্কা খেলেন। মীনাক্ষীকে এত কঠোর হয়ে উঠতে তিনি কখনো দেখেননি। পার্টির কাজে ডুবে থাকলে সংসারের দিকে আর ফিরে তাকানো সম্ভব হয় না। মীনাক্ষীর দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ আজ প্রকাশ্যে চলে এসেছে নানা কারণে।

কপোতাক্ষ এই উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কীভাবে সামাল দেবেন ভাবলেন। ঘর থেকে যদি বিদ্রোহ শুরু হয় তাহলে তার কিছু করার নেই। অবশ্য মীনাক্ষী একগুয়ে নন। সমঝোতার পথে হাঁটতে তাঁর আপত্তি নেই। তবে ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলে সেই প্রতিবাদকে সামাল দেওয়া যাবে কীভাবে?

কপোতা মাথা নেড়ে বললেন, তুমি খামোখা রাগ করছ। আমাদের পার্টি-লাইনের নির্দেশ আছে বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।

–তুমি পার্টির জন্য তোমার স্ত্রী-পুত্র সব কিছুকে ত্যাগ করেছ। এই ত্যাগ যদি তোমার কাছে ক্ষুদ্রতর ত্যাগ হয় তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। গোঁজ হয়ে বসে মীনাক্ষী রাগে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

মীনা, লক্ষ্মীটি, আমার কথা শোন….।

-তোমার অনেক কথা আমি শুনেছি, আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে মীনাক্ষী তাকালেন, দয়া করে এবার যাও। তুমি আর তোমার ছেলেকে নিয়ে আমি আর পারছি না।

-কেন, সূর্যকে নিয়ে তোমার আবার কি সমস্যা হল? কপোতাক্ষ শুধোলেন।

মীনাক্ষী সহজ হতে পারলেন না, ছেলেটাও তোমার মতো ভবঘুরে হয়েছে। তুমি দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছো, সে দেশ থেকে কুসংস্কার তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের একজন মাস্টারমশাই, কী যেন নাম- তিনি এই দলের পাণ্ডা। শুনলাম কাল প্রাইমারী ইস্কুলে ওদের বিজ্ঞান-সচেতনতার ওপর সভা হবে। কাল মাস্টারমশাই এখানে খাবেন। সূর্য বলে গেল।

এখন পরীক্ষার সময় এসব ব্যাপারে নাক না গলালে ভালো হত। কপোতাক্ষ বিচলিত চোখে তাকালেন।

মীনাক্ষীর কণ্ঠস্বরে অবজ্ঞা উথলে উঠল, তোমারই তো ছেলে, বাপের সব গুণই পেয়েছে। আমি বোঝালে সে বুঝবে কেন? তার এখন নিজস্ব মতামত দেবার অধিকার জন্মেছে। আমি কিছু প্রতিবাদ করলে সে আমাকে থামিয়ে দেয়। বলে চুপ করো।

-আশ্চর্য তো!

–আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক। মীনাক্ষীর ঠোঁট শক্ত হয়ে উঠল। কপোতাক্ষ আর কথা বাড়ালেন না, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। হরিনাথপুরের কদবেলতলায় যেতে হবে তাকে। রোদ উঠে গেলে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে কষ্ট হয়। হাঁটু দুটোয় ব্যথা হয়। দিনরাত সাইকেল চালানোর দায়ভার হাঁটু দুটো বুঝি নিতে পারছে না।

কপোতাক্ষ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। প্রতিদিনের মতো আজ আর মীনাক্ষী গেট খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন না। কপোতাক্ষ একবার পেছন ফিরে তাকালেন। মাটির রাস্তায় গাছের জড়াজড়ি ছায়া ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।

হরিনাথপুরের ব্ৰহ্মণীতলা সব সময় জমজমাট। পুরনো বটগাছের ছায়ায় জায়গাটা শীতল হয়ে থাকে। এখন বটের পাকা ফল নজরে না পড়লেও দল বেঁধে টিয়া আর হরিয়াল পাখি এসে বসেছে গাছের ঝাঁকড়া ডালে। বিশেষ করে দুপুরবেলায় ওদের কিচিরমিচির হাট বসে।

সাইকেল চালিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন কপোতাক্ষ। শীতের রোদ নরম হলেও মেজাজ ধানী লঙ্কার মতো। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে কপোতাক্ষ গোবিন্দর চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালেন

গোবিন্দর অদ্ভুত গড়ন, ওর চেহারা সার্কাস দলের জোকারদের মতন। লম্বায় সে চারফুট দুই ইঞ্চি, হাত-পা ছোট ছোট, অনেকটা শিলনোড়ার মতো। এ এলাকায় তার চলতি নাম হল ঘুঁটে। গোবিন্দ খুঁটে।

গোবিন্দ ঘুঁটের চায়ের দোকান ব্ৰহ্মাণীতলার গর্ব। শুধু চা নয়, সঙ্গে টায়েরও ব্যবস্থা রেখেছে গোবিন্দ। সকালে ঘুঘনি, বিকেলে গরম-গরম চপ-পিঁয়াজি হরিনাথপুরের মানুষকে সামান্য হলেও শহুরি ছোঁয়া পাইয়ে দেয়। গোবিন্দ গর্ব করে বলে, আমার চায়ের সাথে পিঁয়াজি সোনার সাথে সোহাগা। ঘুঘনি-মুড়ি হল গিয়ে খাঁটি সোনা, কোনো ছল-চাতুরী ভেজাল পাবে না।

কপোতাক্ষ গোবিন্দর চায়ের দোকানের বেঞ্চিটায় গিয়ে বসল। কিছু দূরে কদমগাছের পাতায় শীতের রোদ এসে গায়ে পড়া মেয়েছেলের মতো ঢলে পড়ছে। কপোতাক্ষ দোকানীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন, আজ কাগজ আসেনি?

–আজ্ঞে না বাবু। গোবিন্দ জড়োসড়ো চোখে তাকাল। এত ছোট দোকান। ফলে খবরের কাগজ রাখার কোনো মানে হয় না। তবু লোক এসে তার দোকানে খবরের কাগজের খোঁজ করে।

বাঁধের ধারে সুনীতি ডাক্তারের চেম্বার। ডাক্তারবাবুর খবরের কাগজটা বাসওয়ালা এখানেই সুতলি বেঁধে ফেলে দিয়ে যায়। সেই কাগজ কুড়িয়ে এনে মন দিয়ে পড়ে গোবিন্দ। তার অবশ্য বিদ্যাবুদ্ধি বেশি নেই তবু সে রাজনীতিটা মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।

খাদ্য-আন্দোলনের রেশ শুকিয়ে গেলেও এখনও তার রেশ ছেয়ে আছে দেশগাঁয়ে। এক জেলার চাল আর এক জেলায় যাবে না। জোর কর্ডনিং। পুলিশী হুজ্জোতির কথা প্রায় শোনা যাচ্ছে। হরিনাথপুরে বসে শহর এবং শহরতলির খবর পেয়ে যাচ্ছে গোবিন্দ। তবু এত কড়াকড়ির মধ্যে সন্ধের আঁধারে বস্তা ভর্তি চাল পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। মুর্শিদাবাদের চাল লালগোলা ট্রেনের সিটের তলায় বস্তাবন্দী হয়ে চলে যাচ্ছে শিয়ালদা-কোলকাতায়। রোজ কত নতুন নতুন গল্প জন্ম হচ্ছে খবরের কাগজের পাতায়।

গোবিন্দর চায়ের স্বাদ মন্দ নয়।

সার্কাস দলের জোকার চা-বানানোটা শিখেছে ভালো। চামচ দিয়ে ওর চিনি গোলার কায়দাটা ভারী আজব। যতক্ষণ না ফেনা উঠছে গ্লাসে–ততক্ষণ রেহাই নেই কারোর।

চা-খেয়ে দাম মিটিয়ে কপোতাক্ষ বললেন, আচ্ছা গোবিন্দ, বিদুর রাজোয়ারকে দেখেছো নাকি?

-না বাবু, সকাল থেকে তার দর্শন তো পাই নি! গোবিন্দ অনুগত তাকাল।

কপোতাক্ষ কী ভেবে বললেন, আমি ওর বাড়ি যাচ্ছি। যদি বিদুর রাজোয়ারের সঙ্গে তোমার দেখা হয় তাহলে আমার কথা বলো। বিশেষ কাজ আছে। ও যেন সত্বর বাড়ি ফিরে যায়।

চা-দোকানের এই এক ঝামেলা। গোবিন্দ মনে মনে বিরক্ত হলেও তার প্রকাশ বাইরে প্রতিফলিত হয় না। তথ্যকেন্দ্র না বলে মানুষ কেন যে চা-দোকান বলে একথা গোবিন্দর মাথায় ঢোকে না।

রাস্তা দিয়ে হাজার মানুষ যায়, তাদের হাজার কথা। দোকানেরও নিজস্ব কিছু কথা থাকে। সব কথা এক সাথে মিলেমিশে খিচুড়ির আকার ধারণ করে। তখন আসল কথাটাই ভুলে যায় গোবিন্দ। ভুলে যাওয়ার একটাই অর্থ-ঝগড়া অশান্তি বিবাদ।

গোবিন্দ জ্ঞানত এখন আর কোনো ঝুট ঝামেলায় জড়াতে চায় না। ঝামেলা মনের শান্তি কমায়। আর শান্তি কমলে আয়ু কমে যায় মানুষের।

চারফুট দশ ইঞ্চির খেলায় হায়ার যেত গোবিন্দ। দশ-বারো বছরের বালকদের বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ বছরের বুড়ো ভাম খেলতে নামত। ওর পায়ে বল পড়লেই গোল। পঁয়ত্রিশ বছরের হাড়ের সঙ্গে বারো বছরের কচি হাড় কি পারে কখনো? ফলে ফুটবল ম্যাচ নিয়ে তীব্র অশান্তি। গ্রামে গ্রামে কাজিয়া-মারামারি। সব শেষে থানা-পুলিশ- হাসপাতাল। এসব শুকনো অশান্তির মূলে গোবিন্দ খুঁটে।

পুরঞ্জন ভট্টাচার্যের টালির ঘরটা ব্রহ্মাণীতলায়। তার শ্যাওলা ধরা টালির চালে মাধবীলতার বংশ আরাম করে শুয়ে আছে। বাতাস এসে মাঝে মাঝে তাকে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়।

কপোতাক্ষ পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে পুরঞ্জনের চোখে ধরা পড়ে গেলেন।

-কী হে নেতা, আমাকে যে না দেখেই চলে যাচ্ছো! পুরঞ্জন ভট্টাচার্য সরল হাসিতে কপোতাক্ষর পথ আটকে দাঁড়ালেন, চলো, আমার টালির ঘরে সামান্য জিরিয়ে যাবে। কতদিন এদিকে তো আসো নি। এবার পঞ্চায়েত ভোটে তোমরা নিশ্চয়ই প্রার্থী দেবে?

অমায়িক হাসলেন কপোতাক্ষ, এখনও জেলা পার্টির কোনো সিদ্ধান্ত আমরা জানতে পারি নি। যদি জানতে পারি আপনাকে এসে জানিয়ে যাবো।

পুরঞ্জন বললেন, তোমাদের পার্টি খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ। আমার বিশ্বাস তোমরা এবার যোগ্য প্রার্থী পঞ্চায়েতে দাঁড় করাবে। আমি চাই লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হোক। অনেকদিন তো হল–একঘেয়ে ডাল-ভাত খেয়ে চলেছি। এবার একটু মুখ বদলানর দরকার।

পুরঞ্জন ভট্টাচার্য এ এলাকার বিশিষ্ট মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব, সততা, মানবপ্রীতি কারোর নজর এড়িয়ে যায় না। এমন দরাজ মনের মানুষ প্রতিদিন সন্ধেবেলায় সিন্সিল রিডের হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন সংগীত সাধনায়। শ্যামাসংগীত তার কণ্ঠে বেড়ার উপর লতিয়ে যাওয়া ঝিঙেলতার চেয়েও সুন্দর। সন্ধেবেলায় ব্রহ্মাণীতলায় পরিচ্ছন্ন এক আধ্যাত্মিক-ভাবের জন্ম হয়, যার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং পুরঞ্জন ভট্টাচার্য। কপোতাক্ষর তাড়া ছিল। পুরঞ্জন ভট্টাচার্যের হাতে চাঁদার রসিদটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, দাদা, কালীগঞ্জ বাজারে মিটিং আছে, বাইরে থেকে ডেলিগেট আসবেন, আপনার কিছু সাহায্য দরকার।

–অবশ্যই, অবশ্যই। চাঁদার রসিদটি ধরে তিনি টাকার অঙ্কে চোখ বোলালেন, তুমি একটু বসো। আমি ঘর থেকে টাকাটা এনে দিচ্ছি। তোমাকে চাদা কেন দেব জানো? তোমার অ্যাক্টিভিটি আমার ভালো লাগে। আমি পার্টি দেখি না। যে পার্টি মানুষের কল্যাণ কামনা করে, মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ায়–আমি সেই দলকে সমর্থন করি। তুমি একটা নতুন ধারা, নতুন আদর্শের আবির্ভাব ঘটাচ্ছ এই গ্রামে। আমি জানি না-তুমি কতদুর সফল হবে। তবে আমার পূর্ণ সমর্থন তোমার উপর রইল। ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গাদেবীকে এনেছিলেন, তুমি আমাদের গ্রামে এই নতুন আন্দোলনের ভগীরথ। ভাবীকাল নিশ্চয়ই তোমাকে মনে রাখবে।

পুরঞ্জন ভটচার্যের সঙ্গে কথা বলে উৎসাহিত হন কপোতাক্ষ। এমন উদার মনের মানুষ গ্রামসমাজে খুব কমই চোখে পড়ে। এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা হলেও এরা যে যে-কোন গ্রামের মেরুদণ্ড এবং মানদণ্ড এ বিষয়ে কপোতাক্ষর কোনো সন্দেহ নেই।

কদবেলতলা চায়ের দোকানে বিদুর রাজোয়ারের দেখা পেলেন কপোতাক্ষ। সাইকেল ঠেলে সোজা তিনি পাড়ার মধ্যে ঢুকে গেলেন। জগৎখালি বাঁধের ধারে ছোট ছোট ঘরগুলোয় হাজার বিক্ষোভ অবজ্ঞা বঞ্চনা যেন শুকনো বারুদের মতো জমে আছে। বিদুর রাজোয়ারের মতো মানুষ এই বারুদে দেশলাই ঠুকে দিলে যে কোনো মুহূর্তে আগুন ধরে যেতে পারে। তবে আন্দোলনের কাজে বিদুরের সাহসিকতা এবং সংযম সম্ভ্রমের দাবীদার। সে সহসা কারণ ছাড়া উত্তেজিত হয় না, আর উত্তেজিত হলে সহজে তা ঠাণ্ডা হতে চায় না।

ছোট থেকেই বিদুর অভাব, অসাম্য আর বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ছে। তার এ লড়াই এখনও শেষ হয় নি। নিজের জীবনকে এই লড়াইয়ে বাজি রেখেছে সে। বিদুরের বাবা রামায়ণ ছিল খেতমজুর। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও তার সংসার খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলত। আসলে খেতমালিকরা দিনভর খাটিয়ে নিয়ে পারিশ্রমিক দিতে চাইত না। গরিবের হাতে পয়সা তুলে দেওয়ার অর্থ কিছুটা হলেও তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতার এত বছর পরে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এসব ভেক কথায় মন গলত না রামায়ণের। সে কাজের বিনিময়ে নগদ অর্থ আশা করত। বাবুরা এই সহজ শর্তে রাজী নয়, ফলে তাদের ধানাই-পানাইয়ের শেষ নেই। ন্যায্যপ্রাপ্তি না হলে সে বাবুদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নেমে যেত। একটা খেতমজুরের এত সাহস আসে কোথা থেকে? পেটে মারলে মাথা ঝিমাতে বাধ্য। আর ঝিমধরা শরীর নিয়ে মাঠের কাজ হয় না।

হতাশা রামায়ণকে কুরেকুরে খাচ্ছিল। গণেশি তাকে বোঝাল, ওভাবে ঝিম ধরে বসে থেকো না। কুঠিয়া গতর উইয়ে খায়। বসা দেহে ধসা হয়। কাজের মধ্যি ডুবে যাও গো.. দেখবা কতো আরাম, কতত শান্তি।

-কাজ দিলে তো কাজে যাব! রামায়ণের গলায় হতাশা, বাবুরা সব যুক্তি করে আমাকে হেঁটে দিয়েছে। আমি কি করব? সব আমার পোকাড়ে ভাগ্য।

-যাও, বাবুদের কাছ থেকে মাফি মেঙে আসো।

-না। উটি আমার দ্বারা হবে নি। গণেশির প্রস্তাবে প্রতিবাদে ভেঙে পড়ে রামায়ণ, না খেয়ে মরব সে-ও ভালো তবু যে ছেপ ফেলে দিয়েছি তা আবার লোতুন করে চাটব না। আমি এক বাপের বাচ্চা….।

ঘরে বসে ভাবনা হয় কিন্তু পেটের দানা জোটে না।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস-ঘরে বেকার বসে থাকে রামায়ণ। তার বিড়ির নেশা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে গাঁজার কলকে তার জামার পকেট থেকে খুঁজে পায় গণেশি। বুক ছ্যাৎ করে ওঠে ভয়ে। মাঠের কাজ হারিয়ে মানুষটা এখন পাগলপারা। দিন-রাত শুধু খাক-খ্যাক করে কাশে। দলা দলা কফ ছুঁড়ে দেয় ধুলোয়। একবার কাশি শুরু হলে আর থামতে চায় না। ভ্যাসভেসে আওয়াজ ওঠে বুক কাঁপিয়ে।

কালীগঞ্জ হাসপাতালের ডাক্তার বললেন, কাশিটা ভালো মনে হচ্ছে না। বুকের এক্স-রে করা দরকার।

কালীগঞ্জে এক্স-রে মেশিন নেই ফলে বুকের ফটো তোলা যাবে না। ফটো তুলতে গেলে কৃষ্ণনগরে যেতে হবে। কৃষ্ণনগরে যেতে গেলে টাকার দরকার। ফটো তোলার পয়সা, বাসভাড়া আসবে কোথা থেকে? চিন্তায় গণেশির মুখ শুকিয়ে গেল। অবশেষে গলার হার, হাতের কলি স্যাকরা-দোকানে বেচে দিল সে।

সদরে গিয়ে ফটো তুলল রামায়ণ। বুকের দোষ হয়েছে তার। ফুসফুসটা কেটে দিয়েছে যক্ষা পোকায়। রোগটা ভালো নয়। ওষুধ খেতে হবে, সেই সঙ্গে পথ্য। ডিম-দুধ-মাছ-মাংস আরও কত কি! খেতে মন চায় কিন্তু টাকা কোথায়? ফলে দিনে দিনে নেতিয়ে গেল রামায়ণ। ফি-কাশিতে কফের সঙ্গে উঠে এল রক্ত। শেষে কোয়াশের দু’পাশে জড়িয়ে গেল চাপচাপ রক্ত।

একদিন দুপুরবেলায় শ্বাস আটকে গেল রামায়ণের। একটা প্রতিবাদের মৃত্যু হল খড়ের ঘরে। বিদুরের তখন জ্ঞান পড়েছে, সে বুক চাপড়ে কাঁদল গণেশির সঙ্গে গলা মিলিয়ে।

যে যায় সে কিছু না কিছু রেখে যায়।

 বিদুর আট ক্লাস অব্দি পড়ে আর ইস্কুলের চৌকাঠ মাড়াল না। মা মুড়ি ভাজবে, তালাই বুনবে, পরের দোরে কাঁথা সেলাই করবে–এসব পছন্দ হত না তার। সে গলা ফাড়িয়ে বলত, কেনে যাবি পরের দোরে? খেজুর পাতার ঝাড়ু বানা। আমি হাটে নিয়ে গিয়ে বেচব।

রামায়ণ রেগে গেলে বলত, পেট কি ঘরে রেখে আসব বাবু: মজুর খাটাবেন, আর মজুরদের পেটের কতা ভাববেন না-তা কি হয়? বিড়ি-মুড়ি দুটোই চাই জলখাবারে। যদি না দেন তাহলে এই আমরা হাত গুটিয়ে আলের উপর বসে রইলাম।

কোদাল চালাতে গিয়ে একবার পা কেটে গিয়েছিল রামায়ণের, বাবু তার চিকিৎসার খরচাপাতি দেবেন না-রামায়ণ এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। পরের দিন বাবুর লেঠেল এসে মাথা ফাটিয়ে দিল তার, বিদুর কাঁপা কাঁপা চোখে সব দেখল। বাবু জাতটা তার রক্তে উঁচ হয়ে ঢুকে গেল।

গণেশি কাতর হয়ে তার ঘরের মানুষটাকে বলত, ওগো, তুমার দুটা পায়ে ধরি ছেলেটার মাথা আর খেও না। নিজের তো সব্বোনাশ করেচো–ওর আর সব্বোনাশ করো না।

ততদিনে বিদুরের মনের ভেতর ভূমিকম্প ঘটে গিয়েছে। লাঙল যার জমি তার কথাগুলো উড়ে এল বিভিন্ন গ্রাম থেকে। পৃথিবীর সংগ্রামী মানুষ সব এক হও। জোতদারের কালো হাত ভেঙে দাও খুঁড়িয়ে দাও। ইন কিলাব জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ! বাসের হেল্পারি করে বিদুর ভেবেছিল অভাবের রথটাকে থামিয়ে দেবে কিন্তু হল না। অভাবের হাজার থাবা। সে থাবাও বেড়ালের থাবার মতো লুকানো এবং রহস্যে ভরা।

বিদুরের মনে পড়ত বাবার হাতে ধরে নীলকুঠির ধারে বেড়াতে যাওয়ার কথা। বাঁধের একপাশে ইতিহাসের কঙ্কাল হয়ে, দাঁড়িয়েছিল জঙ্গলে ঘেরা নীলকুঠি। রামায়ণ তর্জনী তুলে বলত, ওই দেখ, ওই কুঠিটায় লালমুখো সাহেবরা তোর ঠাকুরদাকে বেঁধে চাবুক মারত। তুই বড়ো হয়ে এই নীলকুঠি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিস। ওর হাওয়া-বাতাসে পাপ মিশে আচে, সাবধান।

বাপের কথাগুলো ওই বয়সে সঠিক বুঝতে পারত না বিদুর, সে শুধু ভ্যালভ্যাল করে তাকাত, তার চোখে ছড়িয়ে পড়ত ক্রোধের আগুন, সে পাগলের মতো হাঁপাত, আর খোঁচা খাওয়া জন্তুর মতো ধুকত ক্রমাগত।

রামায়ণ ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেত, কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলত, নিজেকে সামলা। নিজেকে সামলানো বড়ো কঠিন রে! আমি পারিনি, তুই যেন পারিস বাপ।

হরিনাথপুরের আবহাওয়ায় হাঁপিয়ে উঠেছিল বিদুর, কৃষ্ণনগরের বাস-লাইনের বন্ধু তাকে পরামর্শ দিল কোলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার। প্রথমে প্রস্তাবটা শুনে বিরক্ত হল বিদুর, পরে মন শান্ত হতে সে ভেবে দেখল-কালীগঞ্জের মজুরখাটা জীবন তার জন্য নয়। সবার দ্বারা সব কাজ হয় না। রামায়ণ পারে নি এই সমাজের কিছু মানুষকে মেনে নিতে। ওদের শক্তি ছিল, সামর্থ্য ছিল কিন্তু সর্বোপরি ওদের কোনো মনুষ্যত্ব ছিল না। মনুষ্যত্বহীন মানুষের সঙ্গে বিবেকবান মানুষের যে সংঘাত, দ্বন্দ্ব থাকবে এ নিয়ে তার কোনো মতান্তর ছিল না। শেষ পর্যন্ত সমাজের যাঁতাকলের কাছে হার স্বীকার করতে হয়েছিল রামায়ণকে। বাবার এই পরাজয় বিদুর মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। সে দু-একবার প্রতিবাদে মুখর হয়েছে কিন্তু তার সেই প্রতিবাদকে ভোঁতা করে দিয়েছে সমাজযন্ত্র।

গণেশিও ছেলের উপর বিরক্ত। ঘরের মানুষটার মৃত্যু তাকে অসহায় করে তুলেছে দিনকে দিন। কাতর হয়ে সে বিদুরকে বুঝিয়েছে, জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াইয়ে নেমে তুই পারবি নে, বাপ। তুর বাপ অসময়ে যেত নি, তার জেদ তাকে শ্মশানঘাট অব্দি নিয়ে গেল।

আট-ক্লাস পড়া বিদুর মায়ের মুখের উপর কোনো কথা বলে না। সে জানে মাকে বোঝনো এ জীবনে তার পক্ষে সম্ভব নয়। যে মহিলা সারাদিন মুড়ি ভেজে, ফাইফরমাশ খেটে বেড়ায় পরের দোরে তার পক্ষে স্বাধীনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কিছু কিছু রক্ত থাকে যেখানে বশ্যতাকে ভাবা হয় অন্ধকার।

বিদুর তর্কের পথে হাঁটল না, কৃষ্ণনগরের বন্ধুর সাথে সে চলে গেল কোলকাতায়। আর যাইহোক কোলকাতায় তাকে ভিক্ষে করে খেতে হবে না। বড়ো শহরের বড়ো বুক। তার মন সংকীর্ণ নয়, খোলা মাঠ।

একটা চামড়ার কারখানায় বিদুর তার রুজি-রোজগারের সন্ধান পেল। সারা দিন কাজে ডুবে থাকা, সন্ধে হলে বস্তির ঝুপড়ি ঘরে ফিরে আসা। সময় চতুর হরিণের মতো পালিয়ে যেত কোথায়। ট্রামের ঘড়ঘড় আওয়াজ যেন বাঘের গোঁ-গোঁ আর্তনাদ, মানুষের সমুদ্রজোয়ার কোলাহল বিদুরকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত কালীগঞ্জ-হরিনাথপুর-ব্ৰহ্মণীতলার রাস্তায়। প্রায়ই মনে পড়ত বাবার কথা। শোষণের কালো হাত, বৈষম্যের চোখ রাঙানী তাকে সরাসরি যুক্ত করে দিল শ্রমিক-আন্দোলনের সঙ্গে। বিদুর কোথায় থামতে হয় জানত না, তার আবেগই তাকে শেষ করে দিল। পুলিশের ফাঁদে তাকে ধরা দিতে হল শেষে। জেলের মোটা চালের ভাত যে তার জন্য নয়–এটা বুঝতে পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে পালিয়ে এল কালীগঞ্জে। কোলকাতায় থাকলে মালিকপক্ষের পোষা গুণ্ডারা তার প্রাণপাখিকে যে কোনো সময় লুটিয়ে দিত রাজপথে।

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গিয়ে জু’নেওয়া ছাড়া কোনো কাজ রইল না বিদুরের। পুরো নদীয়ায় তখন আন্দোলনের হাওয়া দমকা বাতাসের রূপ নিয়ে এদিক সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। এই অবস্থায় কুশল মাস্টারের সাথে আলাপ হল বিদুরের। মানুষটাকে প্রথম দর্শনেই মনে ধরে গেল তার। তার মূর্খ বাবা যে ঢঙে কথা বলত, শিক্ষিত কুশল মাস্টার সেই কথাগুলোকে অন্যভাবে প্রকাশ করল। ভাষার মানে এক, শুধু পরিবেশন ভঙ্গিটাই যা আলাদা।

পার্টির মিটিং-এ কপোতাক্ষর সঙ্গে পরিচয় হল বিদুরের। মানুষটার মন গঙ্গার জলের চাইতেও পবিত্র। কারোর কাছে মাথা নত করা নয়, বুক ফুলিয়ে মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়াই তার আসল উদ্দেশ্য। তর্ক এবং তথ্যের কচকচানী দূরে সরিয়ে বিদুর নিজের মতো কবে পার্টির ভাষাকে বোঝার চেষ্টা করল। পার্টির ভাষাকে শ্ৰম-শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যে সে করে ফেলল হৃদয়ের ভাষা। আর হৃদয়ের ভাষা, যুক্তির স্রোতকে বাইরের কঠিন সমাজ মেনে নেবে কেন? শুরু হল আবেগহীন মানুষের সঙ্গে হৃদয়বান মানুষের সংঘাত।

সেই সংঘাত, দ্বন্দ্ব এখনও অব্যাহত। বিদুর এখন আর একা নেই, তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লাবণি। লাবণি তার শ্বাস-প্রশ্বাস, আন্দোলনের ইনকিলাব ধ্বনি। নিঃসন্তান লাবণি এই গণ-আন্দোলনকে ধরে নিয়েছে তার সন্তান।

বাঁধের ধারে এই মাটির ঘরখানায় আলো-বাতাস আসে যথেষ্ট। বর্ষায় এই ঘরের দাওয়ায় শুয়ে শোনা যায় ছাড়াগাঙের হুঙ্কার। এখন জল সরে গিয়ে পুরো মাঠ হিল- হিল করছে হাওয়ায়। পুরুষ্ট আখগাছ তার ছিপছিপে শরীর নিয়ে কোমর দোলাতে ব্যস্ত।

শীতের এই সময় ধুঁধুঁলগাছে ফুল আসে। তিতা ধুঁধুঁলের ফুলগুলো গাঢ় হলুদ রঙের। ঘরের চালে ওরা সংসার বিছিয়েছে পরম মমতায়। খরানীকালে এই লতাগাছ শুকিয়ে একেবারে নিপ্রাণ বাবুইদড়ি। এখন হলুদ ফুলে সেজে উঠেছে ওর সবুজ দেহ। সেদিকে তাকিয়ে লাবণি আর চোখ ফেরাতে পারে না। কচি-কচি ধুধুলগুলো তার মনে লাভের জন্ম দেয়।

মিঠে ধুঁধুঁলের তরকারি খেতে বড়ো সুস্বাদু। ঝিঙের যেমন পোস্ত দরকার ধুধুলের শুধু আলু হলেই কিস্তিমাত। কিন্তু অত সাধ করে রাধা রান্নাটা মাঠে মারা গেল। যাকে ভেবেছিল মিঠে ধুপুঁল সেগুলো একেবারে তিতার তিতা। ফলে দুপুরবেলা পুরো তরকারিটাকে ফেলে দিতে হল লাবণির।

ওই সুন্দর ধুঁধুঁল গাছটার উপর তার বেশ অভিমান হল। যে গাছ মানুষের উপকারে লাগে তার কি দাম? মাকালফলে চোখ ভরে কিন্তু মন ভরে না। বিদুর বলেছিল, আহা, গাছটাকে দোষ দিয়ে কী হবে? প্রকৃতি সবাইকে একরকম সাজ পরায় না। এখানে লঙ্কা গাছের পাশে তেঁতুলগাছও থাকবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

লাবণি কি যেন বলতে যাবে ভাবছিল, হঠাৎ সাইকেলের ঘটাং-ঘটাং শব্দ পেয়ে সে মুখ তুলে দেখল কপোতাক্ষ ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে নেমে আসছেন বাঁধের নিচে। হঠাৎ লাবণির কী হল, সে চিৎকার করে বলল, ওগো শুনছো, দেখো কে আসছে! কপোতাক্ষ এগিয়ে এলেন ঘরের কাছাকাছি, সাইকেলটা আমড়াগাছে হেলান দিয়ে বিদুরের দিকে তাকালেন, কেমন আছো বিদুর? অনেক দিন তোমার কোনো খবর পাইনি। তাই আজ কাজ পড়তেই চলে এলাম।

স্বভাব সুলভ হেলে উঠল বিদুর, আপনি এসেছেন ভালোই হল। এ তো আমার কাছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টির সমান। তা দাদা বলুন। একটু লাল চা হয়ে যাক। চায়ের অনুরোধে ইতস্ততবোধ করলেন কপোতাক্ষ, এই মাত্র গোবিন্দর দোকান থেকে চা খেয়ে এলাম। তবে তোমার যদি খেতে মন হয় করতে বলো। চায়ে আমার অরুচি নেই। কপোতাক্ষ থামলেন, লাবণিকে বলো ও যেন একটু বাইরে আসে। আমার হাতে সময় কম। কালীগঞ্জে কয়েকটা কাজ সেরে আমি মানিকডিহি ফিরব।

লাবণী এল। পরনের শাড়িটা সে বদলে এসেছে। বাইরের লোকের সামনে অমন ছেঁড়াফাটা শাড়ি পরে আসা যায় না। সঙ্কোচবোধ হয়। কপোতাক্ষ তার অনেক দিনের পরিচিত। তখন প্রায় হরিনাথপুরে আসতেন। লাবণির বাবার সঙ্গে ওঁর আলাপ ছিল। বাবার মৃত্যুর পর কপোতাক্ষ আর লাবণিদের বাড়িতে আসেন নি। আসতে ভালো লাগত না।

খাটিয়ায় বসে কপোতাক্ষ আগামী মিটিংয়ের কথা ওদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। একটা ছাপানো রসিদ বই বিদুরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চাঁদা না উঠলে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে হবে না। আমি পুরঞ্জন ভটচাযের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছি। তোমার উপর পুরো হরিনাথপুর কালীগঞ্জ কামারী আর অনন্তপুরের দায়িত্ব থাকল। ঘরে বসে থাকলে পার্টির কাজ এগোবে না। আমাদের মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে। সবাই যে আমাদের আদর্শকে গ্রহণ করবে এমন নয়। দশজনের কাছে গিয়ে যদি একজন আমাদের আদর্শকে গ্রহণ করে তাহলে সেটাই হবে আমাদের চরম লাভ। বিদুর সঙ্কোচ কাটিয়ে বলল, দাদা, সবই তো বুঝলাম কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনতে চায় না। মানুষের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতার অভাব। সামাজিক বৈষম্য কুরে কুরে খাচ্ছে তবু ওরা নীরব।

কপোতাক্ষ নীরব হাসলেন, ওদের ঘা মেরে বাঁচাতে হবে। ওদের জাগাতে হবে। মানুষকে যদি আমরা সচেতন করতে না পারি তাহলে আমাদের আন্দোলন বৃথা হয়ে যাবে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের তাদের মতো করে কথা বলা শিখতে হবে। এরা মাকর্স লেনিন বোঝে না। এরা মানুষের ভাষা ও মন বোঝে। এদের মনে একবার ঠাঁই করে নিলে আমাদের আন্দোলন আয়ুস্মান হবে।

-আমি আপনার কথা বুঝি কিন্তু। বিদুর আশার দৃষ্টি মেলে কপোতাক্ষ দিকে তাকাল, সবাই এখন কিছু কাজের বিনিময়ে প্রাপ্তিযোগ আশা করে। আমাদের দল তাদের কিছু পাইয়ে দিতে পারবে না। সমস্যাটা এখানে বেশি দেখা দিচ্ছে।

–আমি তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। কপোতাক্ষ থমথমে গলায় বললেন, পাইয়ে দেবার দল করলে সেই দলের আয়ু বেশি দিন হয় না। আমরা ওপথে হাঁটব না। আমাদের পথ ভিন্ন।

লাবণি বলল, আমি আপনার কথাকে সমর্থন করি। আমরা কাকে কী দিতে পারব, আমাদের সামর্থ্য বা কোথায়? তবু আমরা খাসজমি দখলের লড়াইয়ে নেমেছি। পুলিশ প্রশাসন আমাদের সমর্থন করেনি। ওরা আমাদের গ্রেফতার করেছে, চালান দিয়েছে। শারীরিক অত্যাচার সত্ত্বেও আমাদের আন্দোলন থেমে নেই। আমরা মালিকপক্ষকে টলিয়ে দিতে পেরেছি–এটাই আমাদের সফলতা। এটাকে খাটো করে দেখা উচিত নয়।

আলোচনার মাঝখানে সূর্য উঠে গেল মাথার উপর। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কপোতাক্ষ, এবার আমাকে উঠতে হবে। বেলা অনেক হল।

-সে কী এই দুপুরবেলায় আপনি কোথায় যাবেন? লাবণি আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, আজ দুটো ডাল-ভাত এখানেই খেয়ে নেবেন। আমি আপনাকে আসতে দেখে হাঁড়িতে চাল দিয়ে দিয়েছি।

-সেই ভালো, অনেকদিন আপনি এই গরীব বাড়িতে খাননি। বিদুরের হাসির মধ্যে সূক্ষ্ম রসিকতা মিশে ছিল।

কপোতাক্ষ বললেন, খাওয়ার দিন কি পালিয়ে যাচ্ছে? আসা-যাওয়া চলতেই থাকবে। আজ আমাকে যেতে দাও। তোমাদের বৌদি সকালে খুব মাথা গরম করল। আজ আমি যাই, পরে একদিন শান্তিমতো খাবো।

লাবণি আশাহত হলেও তার ব্যবহারে তা প্রকাশ পায় না। কপোতাক্ষর মতো মানুষ এ গ্রামে পাওয়া খুব দুষ্কর। তিনি গরীব মানুষদের কাছে জ্যান্ত ভগবান। তাঁর ব্যবহার ধনী-দরিদ্র সবার জন্য একরকম।

লাবণি এই মানুষটার কাছে চির ঋণী। সে দিনের ঘটনাটা লাবণি কি এই জীবনে ভুলতে পারবে নাকি তা ভোলা সম্ভব? কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে ফিরতে সেদিন দেরী হয়েছিল অনেকটা। লালগোলা ট্রেন লেট করল দেবগ্রাম পৌঁছাতে। শেষ বাস চলে গিয়েছে কালীগঞ্জে। চৌমাথার কাছে চলে এসে দিশেহারা লাবণি কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়। মহিষবর্ণ মেঘের ভেতর বিদ্যুৎ-এর সাপ ফণা তুলে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে।

দু’বছর কলেজ যাতাযাত হল লাবণির কোনোদিন সে এমন বিপদে পড়ে নি। বাবা বেঁচে থাকলে ঠিক সাইকেল নিয়ে দেবগ্রামে হাজির হত। সেদিন বাবার অনুপস্থিতি সে মর্মে মর্মে টের পায়।

দেবগ্রামে থেকে যাবে তেমন কোনো জানাশোনা নেই। এত বড়ো শীতের রাত সে পার করবে কীভাবে? এদিকে আকাশের হুঙ্কারে বিদ্যুৎ-এর মধ্যে ঝরে যাচ্ছে অহঙ্কার। বৃষ্টি আজ পাগল হয়ে নাচবে। তার উন্মাদ নৃত্যে ছারখার হয়ে যাবে এ অঞ্চল। এখন একটাই উপায় দেবগ্রাম স্টেশনে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া। স্টেশনমাস্টার তার মুখ চেনা। নিশ্চয়ই তিনি সাহায্য করবেন এই বিপদের কথা শুনে।

ভূত আর অন্ধকারকে ভয় পেত না লাবণি। তার ভয় শুধু বদমানুষকে। হেন কাজ নেই যা মানুষ পারে না।

লাবণি স্টেশনে যাবে কী না ভাবছিল, ঠিক তখনই একটা ভ্যান-রিকশা এসে দাঁড়াল তার সামনে। পাকা দাড়ির বয়স্ক মানুষটাকে লাবণি চিনত আগে থেকে।

ফকির মোল্লা কালীগঞ্জের পাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলল, দিদিমণি, যাবে নাকি?

-যাব তো, কিন্তু ভাড়া কত দিতে হবে?

–তুমার কাচ থিকে বেশি লিব না গো। যা সবাই দেয় তুমিও তাই দিও।

-কাকা, অত টাকা তো আমার কাছে নেই। এখন যা আছে দিয়ে দেব, বাদবাকিটা পরে দিয়ে দেব।

-ও তুমি উঠো তো, ভাড়া নিয়ে ভেবো না। ফকির মোলা অভিভাবকের গলায় বলল, তুমি আমার বড় মেয়ের মতুন গো। তুমাকে আগে ভালো মতুন পৌঁছে দিই, ওতে আমার ধর্ম হবে।

রাত বেশি হয়নি। অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছিল ফকির মোল্লার ভ্যান-রিকশাটা। হাটগাছা ছাড়িয়ে ভ্যান-রিকশাটা কামারীর দিকে চলেছে, হঠাৎ বাঁ-দিকের আখখেত চিরে যমদুতের মতো উঠে এল দু’জন যুবক। ওদের নেশায় জড়ানো চোখ, পেশিবহুল শরীরে কামরস টগবগ করে ফুটছিল।

ভ্যান-রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে ওরা ফকির মোল্লাকে খিস্তি দিয়ে বলল, এ রাস্তা কি তোমার বাপের রাস্তা? যখন খুশি আসবে-যাবে অথচ ট্যাকসো দেবে না–এ হতে পারে না। নামো শালা, আজ হিসাব সব চুকিয়ে নেব।

ফকির মোল্লা কাতর হয়ে বলেছিল, ছেড়ে দাও গো, মেয়েটারে পৌঁছে আসি। আহা দেখছ না–বেচারির মুখ কেমুন শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে!

আমসি! আ হা-হা! এই আমসিই আমরা চুষে খাবো। ভ্যানের উপর ঝুঁকে পড়েছিল একজন। তার মুখে ভকভকানো দেশি মদের গন্ধ পেল লাবণি। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে সে কী করবে ভাবছিল। তখনই দ্বিতীয়জন তার মুখের উপর তিন ব্যাটারির টর্চ মারল, বাঃ, মালটা তো খাসা! কই এর আগে লায়লাকে কোথাও দেখিনি তো।

-আজ ফিস্টি হবে। বলল অন্যজন।

ফকির মোল্লা বুঝতে পেরেছে ছেলে দুটির মতিগতি ভালো নয়। এতদিন রাত-বেরাতে রিকশা নিয়ে যায় আসে কই এমন ইবলিশের দেখা তো সে পায়নি। তবে এরা কারা? ওরা যে-ই হোক ফকির মোল্লা এদের ছেড়ে দেবে না। জান থাকতে এদের হাতে লাবণিকে সে তুলে দিতে পারে না।

লাবণি ভয়ে কাঁপছিল। টর্চের আলোটা চোখে অসহ্য লাগতেই সে প্রতিবাদ করে বলল, অভদ্রের মতো মুখে লাইট মারছো কেন? তোমরা কে, কি চাও?

–তোমাকে চাই। সুর করে কথাগুলো বলে ওদেরই একজন খপ করে চেপে ধরল লাবণির নরম হাতটা। হ্যাঁচকা টান দিয়ে লাবণিকে জোর করে টেনে আনল নিজের কাছে। লাবণি মোড়া মারছিল মাজায় বাড়ি খাওয়া খরিস সাপের মতো।

এই নক্কারজনক দৃশ্য সহ্য হল না ফকির মোল্লার। সে হুঙ্কার দিয়ে বলল, ছেড়ে দে কাফের, নাহলে তুদের আজ খতম করে দেব। কী ভেবেছিস কী তোরা? বুড়া হয়েছি বলেই কি ইমানটা আমার বুড়া হয়ে গেছে। ভ্যান-রিকশা গড়িয়ে দিয়ে বুনো মোষের গোঁ নিয়ে তেড়ে গেল ফকির মোল্লা। ছেলে দুটো লাবণিকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে এল সক্রোধে। নিমেষে ওদের একত্রিত পাশবিক শক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল ফকির মোলার উপর। এক সময় রাস্তার উপর শুইয়ে দিল ওকে। বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখানোর শেষ ইচ্ছেটুকু মুখ থুবড়ে পড়ল নির্জন পিচ রাস্তার উপর। গঙিয়ে উঠে বলল, বেটিরে পালা, যেদিকে মন চায় আঁধারে তুই পালা।

লাবণি পালাল না, মাথা সোজা করে দাঁড়াল। ফকির মোল্লার ডান কাঁধে ধারালো চাকু ঢুকিয়ে দিয়েছে ওদের একজন। রক্তে ভিজে গিয়েছে ওর ছেঁড়া গেঞ্জিটা। লাবণি ফকির মোল্লার কাছে ছুটে যেতে গেলে তার পথ আটকে দেয়। শেষে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় রাস্তার পাশের খেতটায়। শুকনো আলসের বিছানায় তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে শুইয়ে দেওয়া হয় কালো আকাশের নিচে। তারপর পর্যায়ক্রমে শুরু হয় ধর্ষণের মহড়া। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল ততক্ষণ দাঁতে দাঁত টিপে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল লাবণি। পরের দিকে নেতিয়ে যাওয়া শালুকফুলের মতো গা-হাত-পা এলিয়ে পড়ে রইল সে। তার সংজ্ঞাহীন শরীরে পর্যায়ক্রমে বিষ ঢেলে দিল সময়।

.

২২.

পরের দিন যখন জ্ঞান ফেরে লাবণির তখন সে দেখে হাসপাতালের সাদা চাদরে জ্বলজ্বল করছে তার শরীরের রক্তদাগ। অসহ্য যন্ত্রণায় থাইয়ের কাছে হাত নিয়ে যেতে পারছে না সে। শরীরের সংযোগস্থল অবশ আর ভার হয়ে আছে। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তার মা তখন চোখের জলে ভাসছে। কপোতাক্ষ নিচুগলায় কথা বলছেন পুলিশ অফিসার আর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে।

চারদিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গেল লাবণির। সে তখন আর বাড়ির বাইরে বেরতে পারে না। তার ফর্সা মুখ কালি হয়ে আছে কলঙ্ক দাগে। গ্রামের বউরা তাকে এসে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। কেউ চাপা গলায় বলছে, ভয় নেই। বিষগুলো সব ওয়াশ করে বের করে দিয়েছে।

কেউ তার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, মেয়েটাকে এবার পরের ঘরে পাঠিয়ে দাও বৌদি। ওর যখন বাবা নেই কতদিন তুমি আর পুষবে!

পুরোপুরি সুস্থ হতে লাবণির লেগে যায় ছমাস। এই ছ’মাসে অন্তত তিনজন পাত্র তাকে দেখে পছন্দ করে গেল। কিন্তু তারা যখন কানাঘুষোয় শুনল লাবণি ধর্ষিতা, তখন তারা আর ওদের ঘরের ছায়া মাড়াল না।

ধীরে ধীরে মন ভেঙে গিয়ে ধুলোয় লুটিয়ে গিযেছিল লাবণির। মায়ের মুখের দিকে সে তাকাতে পারত না, কষ্ট হত। তার মা আক্ষেপ করে বলত, কেন বেঁচে রইলি, মরে গেলেই বুঝি ভালো হত তোর! তুই চলে গেলে আমিও তোর পিছু নিতাম। এ জ্বালা আর সহ্য হয় না মা-বুড়োমা। দয়া করো গো, দয়া করো।

কৃষ্ণনগরে চেক-আপ-এ গিয়েছিল লাবণি। লেডি-ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বললেন, সরি, তোমার গর্ভধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইডিয়েটগুলো শুধু তোমার সতীত্ব নয়, মাতৃত্বও কেড়ে নিল!

বাস থেকে নামতে গিয়ে পা-টলে গিয়েছিল লাবণির, সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধ করেছে সে। এই কঠিন কথাগুলো সে মায়ের কাছে কিছুতেই বলবে না। ভেঙে পড়া মানুষকে টুকরো-টুকরো করে কী লাভ হবে তার? পরাজয় অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়। মৃত্যুই হতে পারে যন্ত্রণা মুক্তির সিঁড়ি।

ব্ৰহ্মণীতলায় না নেমে কী ভেবে সে নেমে পড়ল আগের স্টপেজ কদবেলতলায়। এখান থেকে সামান্য পথ হাঁটলেই জগৎখালির বাঁধ। বাঁধের নীচে বুড়িগাঙের ক্ষীণ ধারা। সেই ধারা শেষ হলে শুরু হয় দিগন্ত সবুজ করা আখের খেত। সাহেবদের ভগ্নপ্রায় নীলকুঠিটার চারধারে বুনো আগাছার ঝোপ। সাপখোপ, পোকামাকড়ের রাজত্ব। আজ আর ঘরে না গিয়ে বিষতেলটা ওখানেই খেয়ে নেবে সে। মরবার জন্য এমন উত্তম জায়গা সে আর কোথায় পেত?

হাঁটতে-হাঁটতে নীলকুঠীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল লাবণি। বিদুর বিড়ি খেতে এসে দূর থেকে তাকে দেখে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে ছোট পাকায় সন্দেহ। ভর-সন্ধ্যায় এ পথে তো কোন মেয়ে হাঁটে না। এ পথ দিনের বেলাতেও মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। তাহলে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটি? কাদের ঘরের মেয়ে, কী নাম ওর? বিদুর আগ্রহকে সামাল দিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াল।

লাবণি ঝোপের পাশ দিয়ে সোজা ভয়হীন চিত্তে চলে গেল নীলকুঠীর পেছনে। ওর সাহসকে বাহবা না দিয়ে পারল না বিদুর। পা টিপেটিপে সেও লাবণিকে অনুসরণ করল।

কিছু দূর এগিয়ে লাবণি চারপাশ দেখে নিয়ে হাতের ব্যাগটা অবজ্ঞা ভরে ছুঁড়ে দিল ঘাসের উপর। তারপর ঝাঁকুনি দেওয়া শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল ব্যাগের কাছাকাছি। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সে, দু’হাত বিছিয়ে শরীরের ভার আলগা করে বসে পড়ল ঘাসের উপর। ব্যাগ খুলে নতুন একটা কৌটো হাতে নিয়ে সে কাঁদল অনেকক্ষণ। প্রথমে ফুঁপিয়ে, তারপর সশব্দে। অন্ধকার চিরে বাতাস বয়ে আনল তার কান্না। বিদুরের যুবক হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠল নিমেষে। এবার সে স্পষ্ট বুঝতে পারল মেয়েটির নিরালায় আসার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী।

বিষকৌটোর ঢাকনা খুলে মেয়েটি যখন চরম সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে তখনই বিদুর ছোঁ মেরে কৌটোটা কেড়ে নিয়ে ভৎর্সনার গলায় বলল, তোমাকে আমি গাঁয়ের সব চাইতে ভালো মেয়ে বলে জানতাম। আজ বুঝতে পারলাম-তোমার যা কিছু ছিল সব লোক দেখানো। আসলে একটা উইপোকার যা সাহস আছে–তোমার তা নেই। তুমি একটা ভীতুর ডিম।

–বিদুরদা, তুমি সব জানো না। জানলে একথা বলতে না। চোখের জলে গলার স্বরও আর্দ্র হয়ে উঠল লাবণির।

আমি সব জানি। দাদা আমাকে সব বলেছেন। বিদুর রাগে উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল, তোমার কী হয়েছে যে তুমি মরবে? তোমার যা ঘটেছে, এমন ঘটনা সারা দেশে হাজার হাজার মেয়ের ঘটছে। তা বলে তাদের সবাই তোমার মতো মরতে যায় না। ছিঃ!

লাবণি এই তোড়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। সে ঘাসের দিকে মুখ করে নীরবে চোখের জল ফেলে যায়। নিজের স্বপক্ষে তার একটা কথাও বিদুরের ক্ষুরধার যুক্তির কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।

বিদুর আদেশ করা গলায় বলে, চলো, আমি তোমাকে ঘর অবধি পৌঁছে আসি। আজ যা পাগলামি করলে আর কোনোদিন যেন না শুনি এমনকথা।

-আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তুমি কেন আমাকে বাঁচাতে চাইছ, বিদুরদা?

–মরার মধ্যে এমন কী বাহাদুরী আছে? বিদুর উষ্ণ চোখে তাকাল সেই উত্তাপে কুঁকড়ে গেল লাবণি, আমি আর ঘরে ফিরতে চাই না।

-কোথায় যাবে তুমি?

–আমি জানি না।

–আর পাগলামী করো না। রাত হচ্ছে। চলো বলছি। বিদুর ওর হাত ধরে টানল। লাবণি ম্প্রিংয়ের পুতুলের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার ধপাস করে বসে পড়ল মাটিতে। চোখের জলে গাল ভিজে যাচ্ছিল ওর।

বিদুর ব্যথিত। অবশেষে নিরুৎসাহিত হয়ে বলল, তুমি যা ভালো বোঝ কর। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি ঘরে চললাম

দাঁড়াও। কান্নায় গলা বুজে এলেও কোনমতে লাবণি। বলল, আমি তোমার সাথে যাব। আমাকে নিয়ে চলো।

–আমার সাথে যাবে?

–কেন তোমার সাথে গেলে আমার কি হবে?

-তোমার জাত চলে যাবে। সারা হরিনাথপুরে ঢিঢি পড়ে যাবে। বিদুর তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তখন পারবে তো সহ্য করতে?

লাবণির বেতের মতো ছিপছিপে শরীরে একটা ঢেউ উঠল, ঘৃণায় বেঁকেচুরে গেল ওর গোলাপী ঠোঁট, চোখের মোলায়েম ভাবটা সরিয়ে সে রুক্ষু গলায় বলে উঠল, বেঁচে উঠেছি যখন তখন আর আমি মরার কথা ভাবব না। তুমি আমাকে আশ্রয় দাও।

চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না, লাবণি। তুমি বড় হয়েছ। সব কিছু বুঝতে শিখেছে। এমন পাগলামী করো না। ঘরে চল। নিজের ঘরে ফিরে গেলে তোমাকে আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। বিদুর সাধ্যমতো চেষ্টা করল বোঝাবার। কিন্তু লাবণির কোনো কথা মাথায় ঢুকল না। এক অস্থির অবুঝ পাগলামী তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালো।

অবশেষে লাবণির জেদের কাছে হার-মানতে বাধ্য হল বিদুর। সে রাতটা লাবণি বিদুরের ঘরে কাটিয়ে ফিরে গেল তার নিজের বাড়িতে। মাকে সবকিছু বলল সে। তারপর নিজের জিনিসপত্র নিয়ে চিরদিনের জন্য ঘর ছেড়ে চলে এল সে। তার মা সুর করে কাঁদল। সেই ছোঁয়াচে সুর মন গলাতে পারল না লাবণির। জীবনে অনেক ভুল হয়েছে তার। আর সে ভুলের পথে হাঁটতে চায় না। জাতপাতের পাঁচিলকে সে উপড়ে ফেলবে।

কপোতাক্ষর সামনে বিয়ে হয়ে গেল ওদের। কোনো মন্দির বা দেবালয় সাক্ষী থাকল না এই বিয়েতে, কেননা ছোটবেলা থেকে বিদুর এসব লোক-লৌকিকতার বাইরে।

লাবণিও সমর্থন করল তাকে।

লাবণি ঘোষ থেকে লাবণি রাজোয়ার হতে ওর সময় লাগে মাত্র দশ মিনিট। কপোতাক্ষ ওদের আশীর্বাদ করেন, সুখী হও তোমরা। সার্থক হোক–তোমাদের যৌথ প্রচেষ্টা।

.

ব্ৰহ্মণীতলার পঞ্চায়েত অফিসে বিদুর প্রায়ই যায় দলবল নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে। সেই দলের একেবারে অগ্রভাগে থাকে লাবণি। দাবী আদায়ের ক্ষেত্রে তার জঙ্গি মনোভাব গ্রাম-প্রধান ডাঃ সত্যপ্রিয় সান্যালকে বেশ সমস্যায় ফেলে দেয়। তিনি বাধ্য হন মেহনতী মানুষের দাবিকে শ্রদ্ধা জানাতে।

খুব দ্রুত না হলেও একটা চাপা সমর্থন বিদুরের পক্ষে গড়ে উঠেছে। খাসজমি দখলের লড়াইয়ের সময়ে এই সত্যটা আরও বেশি করে প্রমাণিত হল।

সত্যপ্রিয়বাবু সেই প্রথম বিদুরকে চেয়ারে বসার অনুমতি দিয়ে বললেন, এই পঞ্চায়েত আমাদের সবার। এর সম্মান অটুট রাখার দায়িত্বও আমাদের। কোনরকম হঠকারিতায় আমরা যাব না। আমাদের সমস্যা আমরা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেব।

সত্যপ্রকাশবাবু ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। বিহার থেকে তিনি তার ডাক্তারি পাশের রেজিস্ট্রেশন জোগাড় করেছিলেন অধিক অর্থের বিনিময়ে। তা সত্ত্বেও তার চিকিৎসা ব্যবস্থায় গ্রামের সাধারণ অভাবী মানুষ উপকার পেত। তারা দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করত সত্যপ্ৰকাশবাবুকে। এইভাবেই তার জনপ্রিয়তা সেবার মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল শিখরে। সহজে তার আসন টলানোর ক্ষমতা ছিল না বিদুরের। রাজ্য-রাজনীতিতে তখন এক চরম সঙ্কটময় অবস্থা। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার ধুকছে। শুরু হয়ে গিয়েছে পতনের পর্ব। জাল-জুয়াচুরি আর সন্ত্রাস থাবা মারছে রাজ্যের গ্রাম-শহরে। আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের হানায় ব্যতিব্যস্ত সর্ব শ্রেণীর মানুষ। কপোতাক্ষবাবু এই সময়টিকে বেছে নিলেন লড়াই করার জন্য। দুর্নীতি আর শাসক দলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল তার কণ্ঠস্বর। একটা পরিবর্তনের আলো চারদিক থেকে প্রতিফলিত হল আন্দোলনকারীদের চোখে-মুখে। গ্রাম-প্রধান সত্যপ্রিয়বাবু ভয় পেলেন না। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, আমি চাই সত্য এবং প্রকৃত ধর্মের জয় হোক। রাজনীতির উর্ধ্বে গুরুত্ব পাক মানুষ। আমি থাকব না, হয়ত আমার দলও থাকবে না, তা সত্ত্বেও আমি চাই এই পঞ্চায়েত-ব্যবস্থা বেঁচে থাকুক। গ্রামের মানুষের স্বার্থে এর প্রয়োজন আছে। আমার বিশ্বাস এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাই পারবে গ্রামকে কুসংস্কারমুক্ত করতে। এবং সুখের কথা একাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। বিদুর সেই দলের অগ্রণী নেতা।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে বিদুর তাকিয়ে ছিল অধীর আগ্রহে। কপোতাক্ষও আশা করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফল তাদের অনুকূলে যাবে। কিন্তু গ্রামসমাজের শম্বুক-গতি পরিবর্তন তাদের ব্যথিত করল।

লাবণি বিদুরকে বোঝাল, মন খারাপ করো না। আমাদের আরও মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে গেলে আমাদের হতে হবে তাদেরই লোক। নিজের মানুষ না হলে তাদের সমর্থন আমরা পাব কি করে?

.

ধুঁধুল গাছটা উঠে গিয়েছে কাঁটায় ভরা কুলগাছে। হলুদ আলোর ফুল ফুটেছে সবুজ ঘিরে। বাজারের একদিকটা সব সময় জমজমাট। বাঁধের কাছ থেকে ভেসে আসছে সব সময় গম-পিষানো মেসিনের শব্দ। চরসুজাপুর দোয়েমের মানুষরা ভিড় করে আসে গম পিষাতে। গম-পিষাতে এসে বাজার করে চলে যায়। কালীগঞ্জের মাটির হাঁড়ি-সরা-পাতনা সস্তা। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। দশ-গাঁয়ের মানুষ আসে শাক-সবজি নিয়ে বেচতে। দামেও কম, পাওয়াও যায় টাটকা। এছাড়া সোম-শুক্র দেবগ্রামের ব্যাপারীরা দোকান দেয় ভূষিমালের। কেউ আবার কাপড়ের গাঁট খুলে ছড়িয়ে দেয় বাজারে। রেডিমেড পোশাকও পাওয়া যায় সেখানে। দরদাম করে দেখে-শুনে কেনা যায়।

হাটবারে বাঁধের কাছ থেকে ভিড় লেগে থাকে। বিদুর একটা জলচৌকির উপর দাঁড়িয়ে খালি গলায় বক্তব্য রাখে সেখানে। হাটের মানুষ বক্তব্য শুনতে চায় না, তবু কানে যতটুকু ঢেকে সেটুকুই বা কম কি। রাম একদিনে লঙ্কায় যাবার সেতু বাঁধতে পারেনি। বানরসেনার ভূমিকা সেখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্যতার দাবি রাখে। শোনা যায় কাঠবেড়ালিও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল সেতু বাঁধায়। বিদুরও সেইরকম কিছু একটা করে দেখাতে চায়।

লাবণি সবসময় তার সঙ্গে গাছের ছালের মতো আটকে আছে। অভাব-অনটন তাকে প্রতিজ্ঞা থেকে সরাতে পারে না। সংগঠনের কাজের জন্য সে নিবেদিত প্রাণ। ঘরে বসে খবরের কাগজের উপর আলতা দিয়ে সে স্লোগান লেখে যত্ন সহকারে। জেলা শহর কৃষ্ণনগরে সম্মেলন থাকলে তারা বুকে ব্যাচ লাগিয়ে লালগোলা ট্রেনে চেপে বসে। ট্রেনে গেলে যাওয়া-আসার ভাড়াটা বেঁচে যায়, সেই সামান্য অর্থটুকু বেঁচে থাকার জন্য কাজে লেগে যায়।

বিদুর লাবণির কষ্ট দেখে বোঝয়, সব মিটিংয়ে তোমার না গেলেও চলবে। আমি মিটিং থেকে ফিরে এলে তার সারাংশটা বলে দেব।

লাবণি মৃদু হাসলেও এই প্রস্তাব তার মনে ধরে না, তুমি খেলে আমার যদি পেট ভরে যেত তাহলে পৃথিবীতে হাঁড়ির সাইজ আরও ছোট হয়ে যেত। মিটিং মিছিল সম্মেলনে যে যাই-এতে আমার স্বার্থ থাকে। শীতের দিনে মানুষ আগুন পোহায় শীত লাগে বলে। সব মানুষেরই নিজেকে তাতিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন। ঠাণ্ডা মানুষ মানে তো মৃত মানুষ। এই মিটিং মিছিল আমার কাছে আগুন পোহানো।

সেদিন কালীগঞ্জ বাজারে বিদুরের সঙ্গে তর্ক বেঁধে গেল শিবনাথবাবুর। তার কাছে চাঁদা চাইতে গিয়েছিল বিদুর। শিবনাথবাবু স্পষ্ট মুখের উপর বলে দিলেন, কোনো ভিখারী পার্টির উপর আমার কোনো সহানুভূতি নেই। তোমরা কি ভেবেছ বলো তো বিদুর? কৌটো ঝাঁকিয়ে চাঁদা তুলে পুরো দেশটাকে কি ভিখারি সাজিয়ে দেবে? যাও ভাই, আমার মাথা গরম করে দিও না।

বিদুর রাগল না, দয়ার চোখে তাকাল, শিবনাথদা, একটা কথা বলি, খারাপভাবে নেবেন না। আমাদের দেশটা তো অনেক আগে থেকেই বিদেশের কাছে ভিখারি সেজে বসে আছে। ফলে আপনি আমি সবাই যে যার মতো ট্রেন্ড-ভিখারি। আমার কৌটো নাড়ানোতে আপনার যদি এত আপত্তি তাহলে নিজের জমিদারীটাকে সামলে রাখার জন্য সচেষ্ট হোন। নাহলে সরকারী নীতির মুখোশ খসে পড়লে আপনারা বিশেষত অসংশোধনবাদী সামন্তপ্রভুরা বিপাদ পড়বেন।

-সে যখন বিপদে পড়ব তখন দেখা যাবে। আগে মরি, তারপর তো ভূত হবার প্রশ্ন।

–আপনার বাঁধের ধারে যে জমিগুলো আছে–সেগুলোর দলিল সম্ভবত আপনার কাছে নেই। আমরা ভূমি ও রাজস্ব দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি। জেলা স্তরে এ নিয়ে আমাদের আলোচনাও হয়েছে। খুব শিঘ্রি আমরা খাসজমি দখলের অভিযানে নামব। আমরা কৃষিজমির সুবণ্টন এবং সমবণ্টন দাবী করেছি সরকারের কাছে। সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে আমাদের আন্দোলন লাগাতর চলতে থাকবে। বিদুরের কথা শুনে শিবনাথবাবুর মুখের গোলাপী আভা নিমেষে কাশফুলের আকার ধারণ করল। অতিরিক্ত চিন্তায় ধড়ফড়িয়ে উঠল তার বুক, কোনোমতে ঢোক গিলে বললেন, পুলিশ-প্রশাসন সব আমাদের দখলে। একটা ফোন ঘোরালে সব এসে পোষা পাখির মতো শিস দেবে। জানো তো টাকায় আজকাল কি না হয়? টাকায় এমন যাদুশক্তি আছে যা দিয়ে এ দুনিয়ার সব কিছু কেনা যায়।

–সব কিছু কেনা গেলেও মানুষ কেনা যায় না।

–যায় বিদুর যায়। তুমি ছেলেমানুষ। নতুন রাজনীতি করছ। কিছু বোঝ না। যখন রাজনীতিটাকে হজম করবে তখন তোমার ভেতরে একটা নিজস্ব নীতির জন্ম হবে। সেই নীতি তোমাকে বানের জলে ভাসা কচুরিপানার গাছের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তখন তোমার মিথ্যা আদর্শবোধ ঠাঁই পাবে না। তুমিও ভেসে যাবে। শিবনাথবাবুর কণ্ঠস্বরে জেদ স্পষ্ট হয়ে উঠল।

আর কথা বাড়ায়নি বিদুর, চাঁদা না নিয়ে সে সোজা চলে এসেছিল পার্টি অফিসে। কালীগঞ্জ বাজারে শিবনাথের বন্ধকী কারবার, এছাড়া আছে সোনা-রূপার ব্যবসা। গ্রামের গরীব মানুষরা দায়ে পড়লে তার দারস্থ হয়, চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে চিন্তায় বুড়িয়ে যায় দ্রুত।

শিবনাথের প্রভাব প্রতিপত্তি এ গাঁয়ের অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। টাকার অহংকারে সে এখন মানুষকে মানুষ বলে ভাবে না। সবাইকে ভাবে তার দাসানুদাস। হাসপাতালের টিকেদারবাবুকে কী কথায় একটা চড় কসিয়ে দিলেন সজোরে। অপমানে লাল হয়ে গিয়েছিল টিকেদারবাবুর মুখখানা। চোখে জল এসে গিয়েছিল তার। জলভরা চোখে সে দেখেছিল ফোলা ফোলা গাল নড়িয়ে শিবনাথ বলছেন, চাকরি করে খেতে এসেছ, রাজনীতির কি বোঝে হে। খারাপ ভাল যা বলার আমরা জনগণ বলব। তোমরা সরকারী চাকুরে, সব সময় মাথা ঝুঁকিয়ে জনগণের সেবা করবে। সেবায় গাফিলতি দেখলে পাছায় লাথি মেরে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ভাগিয়ে দেব।

শুভ সেদিন একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল ব্যাগ হাতে নিয়ে, সরস্বতী তাকে বাজার করার জন্য পাঠিয়েছে। এমন মর্মান্তিক দৃশ্যের সাক্ষী না থাকলে বুঝি ভালো হত। এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য যত তাড়াতাড়ি মন থেকে মুছে যায় ততই ভাল। যে দৃশ্য মনের মধ্যে ভয়ের পেরেক পুঁতে দেয়, সেই দৃশ্য না দেখাই ভালো।

বাজার পাড়ার শিবনাথের সঙ্গে থানার বড়বাবুর ভীষণ জানা-শোনা। প্রায়ই থানার জিপটা এসে তার দোকানের সামনে দাঁড়ায়। বড়বাবু কাঠের চেয়ারে বসে চা খান। চা খাওয়া শেষ হলে লম্বা সিগারেট ধরিয়ে টান দেন। সিগারেট টানা শেষ হলে একটা চটের ব্যাগে খানকতক মদের বোতল ঢুকিয়ে জিপে তুলে দেয় শিবনাথের ছোকরা চাকরটা। আড়চোখে বোতলগুলো দেখে নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট দেন বড়বাবু। গাড়িটা ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাওয়ার পরেও হাঁ-করে তাকিয়ে থাকেন শিবনাথ। মানুষটার কোনো জবাব নেই। আশ্বিনের মেঘের মতো স্বভাব। এই রোদ এই বৃষ্টি, ওই মেঘ উতলা হাওয়া।

.

শিবনাথের চোখে মুখে বর্ষার ছাতুর মতো ফুটে ওঠে চতুরতা। কারোর সঙ্গে কথা বলার সময় সে নিজেকে বর্ণচোরা গিরগিটি অথবা ধূর্ত শেয়াল ভাবে। এই ভাবনাটা তার অন্যায় নয়। বুদ্ধি হবার পর থেকে তিনি মানুষকে ঠকিয়ে চলেছেন ধারাবাহিকভাবে। একাজে তার শরীরে কোন মায়াদয়ার জোয়ার-ভাটা খেলে না। আপে বাঁচলে বাপের নাম এই সিদ্ধান্তে অচল অনড়। পরের জন্য কাদা কিংবা কপাল ফাটানো তার স্বভাবে নেই। বরং আপনা হাত জগন্নাথকে বেশি সমীহ করতে ভালোবাসেন। ফলে কথা বলায় যে তিনি বাজারের এক নাম্বার এই তথ্য ঠারেবারে বুঝিয়ে দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেন না।

এত বড়ো বাজারটা তার কথায় ওঠে, বসে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তার উপস্থিতি আশু প্রয়োজন। তাকে এড়িয়ে বা গোপন করে বাজার কমিটির কোনো কাজ করার সাধ্য নেই।

মাছওয়ালি মাসিটা প্রতিদিন তাকে বাছাই করা মাছটা দিয়ে যায়, যদিও তাকে দাম মিটিয়ে দেন শিবনাথ, তবু প্রায় কথায় মাছের প্রসঙ্গ তুলে তিনি এক বিকৃত অনুভূতির আবেশ নিতে চান। বাজারের সেরা মাছটা ফলটা চালটা তার ঘরে না গেলে তিনি বেজায় রেগে যাবেন।

কালীগঞ্জ বাজারে শিবনাথের কথাটাই শেষকথা।

শুধু বাজার নয়, স্কুলেও তার আধিপত্য যথেষ্ট। অকৃতদার শিবনাথ ভাইয়ের ছেলেকে নিজের ছেলে বলে কোর্ট থেকে লিখিয়ে নিয়েছেন। তাতে কালীগঞ্জ বাজারের বিশিষ্ট দু’জন ব্যক্তির সই আছে।

শুধু সইয়ের জোরে দাদার বড় ছেলে তার নিজের ছেলে হয়ে গেল। ইস্কুলের ভোটে দাঁড়াতে গেলে বেশ কিছু শর্ত তাকে পালন করতে হবে লোকলজ্জার ভয়ে। ব্যাপক ভোটে জিতেছেন শিবনাথ। তিনি জেতা মানে সেক্রেটারির পদটা একেবারে তার পাকা।

তিনি ছাড়া অমন রাশভারি পদে মানাবে কাকে? এমনিতে তার পঁচাশি কে.জির শরীরটা বয়ে নিয়ে যেতে কষ্ট হয় ভীষণ। বুকের কাছে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়, হাঁপিয়ে ওঠেন, ঘাম ফুটে ওঠে সারা শরীরে।

এই ইস্কুলে তার পড়াশোনা ফলে এই ইস্কুলের উপর তার আত্মিক টান বেঁচে আছে এখনও। ভাইয়ের ছেলের কাছে প্রতিদিন স্কুলের খবর পেয়ে যান তিনি। সে ছেলে ধানী লঙ্কা। পুটপুট করে হেড়মাস্টারের বিরুদ্ধে লাগায় জ্যাঠার কাছে। দুর্নীতির চাপা অভিযোগ হেডমাস্টারের বিরুদ্ধে ঠেলে ওঠে। সব জেনেও না বোঝার ভান করে পড়ে থাকেন কৃপানাথ। যে ছেলেকে হাতে ধরে পড়িয়েছেন শিখিয়েছেন সেই ছেলে এখন একাই একশো। হেডমাস্টার মশাই প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার শিবনাথ, হঠাৎ যে তোমার ইস্কুল চত্বরে আসা হল? কোনো কাজ আছে বুঝি?

না, তেমন কোন কাজ নয়। আমি স্কুলের সেক্রেটারি। মাঝেমধ্যে স্কুলে না আসলে আমার চলবে কি করে। শিবনাথ হেড-স্যারের দিকে বিরক্তির চোখে তাকালেন, আপনাদের হাজিরা খাতাটা একবার আনুন, আমি দেখতে চাই।

হেড-মাস্টারমশাই বাধ্য হন অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারটা এগিয়ে দিতে।

হাজিরা খাতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে শিবনাথ কপাল কুঁচকে তাকালেন, অমলকান্তিবাবুর হাজিরা খাতায় দুদিন সই নেই। কি ব্যাপার?

-উনি দু’দিন ছুটি নিয়েছেন। হেড মাস্টারমশাই বললেন।

–তাহলে আপনার লিভ মার্ক করা উচিত ছিল। শিবনাথবাবু কড়া গলায় বললেন কথাগুলো। হেডমাস্টারমশাই ঢোক গিললেন, উনি তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছেন। ওঁর বাবা নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। বাইপাস সার্জারি হবে।

–সব ঠিক আছে। তা বলে লিভ অ্যাপলিকেশন না দিয়ে চলে যাবেন? এত সাহস কোথা থেকে পান। আপনি দেখছি সবাইকে মাথায় তুলে রেখেছেন। ভেরি ব্যাডঃ শিবনাথ তিরস্কার করলেন, এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। এরপরে যদি এমনটা দেখি তাহলে দুজনকেই আমি অ্যাবসেন্ট করে দেব।

হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা বলার ক্ষমতা ছিল না, তিনি ক্ষুব্ধ, অপমানিত। শিবনাথের ব্যবহার তাকে পীড়া দিয়েছে। গায়ে গতরে বড়ো হয়ে শিবনাথ নিজেকে ভাবছেটা কি?

শিবনাথ সেদিনের মতো চলে গেলেও আবার ফিরে এলেন এক সপ্তাহ পরে। প্রথমে স্কুলের নাইট-গার্ডকে দেখতে পেয়ে মুখে যা না আসে তাই বলে অপমান করলেন। নাইট-গার্ড রামদুলাল তার সামনে থেকে চলে যেতে চাইলে শিবনাথ তাকে বজ্রগলায় ধমকে উঠলেন, দাঁড়াও। পালাচ্ছো কোথায়? আচ্ছা রামদুলাল, তুমি কি ভেবেছ বল তো? স্কুলটা কি তোমার মামার বাড়ি?

–এসব কথা কেন বলছেন বাবু? রামদুলাল বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করল।

শিবনাথবাবু আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, তুমি এই ইস্কুলের নাইটগার্ড। রাতে ঘুমিয়ে দিনের বেলায় নিজের কাজ করে বেড়াচ্ছো! বাঃ, তুমি তো দেখছি মহা ধূর্ত মানুষ।

শিবনাথ রামদুলালকে সতর্ক করল, এভাবে ফাঁকি দিলে আমি তোমাকে কাজে রাখতে পারব বলে দিচ্ছি। নাইট গার্ডের কাজ শুয়ে-বসে কাটানোর জন্য নয়। তুমি যদি মনে করো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাইনে নিয়ে চলে যাবে–তাহলে মস্ত বড় ভুল করবে। আমার নজর সবখানে। আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না।

দ্বীপী আর সূর্যাক্ষ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সূর্যাক্ষ দূর থেকে শিবনাথবাবুর গলা পেয়ে দ্বীপীকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বলল, এই রে, শেয়ালটা আজ আবার ইস্কুলে এসেছে। আজ আবার হেড স্যারের ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাবে।

দ্বীপী হাসল না, কেমন গম্ভীর চোখে তাকাল, এসব মানুষ আমার পাল্লায় পড়লে আমি একেবারে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিতাম।

সূর্যাক্ষ বলল, মানুষ এত শয়তান হয় কী করে বলত? এত সুন্দর মাথায় মানুষ গু-গোবর ভরে নিয়ে কি করে হাঁটা চলা করে বলত?

দ্বীপী আশ্চর্য হল না, এরা হল জন্ম শয়তান। জানিস সূর্য, আমাদের এই সেক্রেটারি হেড-স্যারের ছাত্র ছিলেন। এখন এমন ব্যবহার করেন যে চেনেন না!

–যাদের চোখের পাতা থাকে না কেবল তারাই এমন ব্যবহার করতে পারে। সূর্যাক্ষ বলল।

দ্বীপী ভাবল, কোন জীবের চোখে পাতা নেই বলতো?

-কেন তিমি মাছ। যে সব মাছকে খায়। রাক্ষস! সূর্যাক্ষর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। দ্বীপী এবার আর হাসল না, ঠোঁট কঠিন হয়ে উঠল ওর, তিমিমাছ শুধু মাছই খায় না, মানুষও খায়। ওদের থেকে সাবধান থাকা দরকার। চল, আমরা কেটে পড়ি।

দোতলার করিডোর লাগোয়া সায়েন্স ল্যাব। অমলকান্তিবাবু ব্যস্ত হয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসছিলেন হাতে একটা অ্যাপারাটাস নিয়ে। শিবনাথবাবু দোতলা বেয়ে তরতরিয়ে উঠে এসে অমলকান্তিবাবুকে দেখে হাত উঁচিয়ে ডেকে উঠলেন, এই যে মাস্টারমশাই, এদিকে একটু

অমলকান্তিবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন, মুখমণ্ডলে সৌজন্যতার সূক্ষ্ম প্রলেপ, নমস্কার।

-হ্যাঁ, নমস্কার! শিবনাথবাবু মুখ বিকৃত করে তাকালেন, আপনার ছুটির দরকার মানছি কিন্তু তা বলে দরখাস্ত না দিয়ে হুটহাট করে চলে যাবেন? ভেরি ব্যাড! আপনাদের দেখে ছাত্ররা শিখবে।

অমলকান্তিবাবুর মুখে ভুসোকালি বিছিয়ে গেল নিমেষে, সরি, হঠাৎ টেলিগ্রাম পেয়ে আমাকে চলে যেতে হল। বাবা ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল। বুঝতেই তো পারছেন–আমি বাড়ির বড়ো ছেলে।

-না, আমার বোঝার কোনো দরকার নেই। গমগমিয়ে উঠল শিবনাথবাবুর কণ্ঠস্বর। আপনার মামলা আপনিই সামলান। আপনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার আমার কোনো আগ্রহ নেই। তবে শুধু এইটুকু বলি–কাজটা আপনি ঠিক করেন নি।

–আপনি কি বলতে চাইছেন তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! অমলকান্তিবাবুর মৃদু গলায় বিস্ময়।

-ন্যাকামী করবেন না। সব বুঝতে পেরেছেন। শিবনাথবাবু টানাটানা গলায় বললেন, মাসখানিক আগের কথা। কালীগঞ্জ বাজারে…সেই যে আপনার সঙ্গে দেখা হল, আপনি হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে বোঝাচ্ছিলেন সাপে কামড়ালে মন্ত্র পড়ে রোগী বাঁচানো যায় না…আরও কত কী। এবার মনে পড়ছে? রুমাল বের করে শিবনাথবাবু কলাগাছের মতো মোটা গলার ঘাম মুছলেন।

মুখ ফাঁক করে শ্বাস নিয়ে অমলকান্তিবাবু সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বলুন কি বলতে চাইছেন?

-একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে গ্রামে এসব ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া কি আপনার উচিত হচ্ছে? গ্রামের সহজ সরল মানুষ সাদা কালোর ফারাক বোঝে না, তারা আপনার এসব মহান কথার অর্থ বুঝবে কি করে? শিবনাথবাবুর খোঁচা দেওয়া কথায় অমলকান্তিবাবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালেন। প্রসঙ্গটাকে আর বাড়ানো উচিত হবে কিনা ভাবলেন। শিবনাথবাবু মানুষটি সাপের চেয়েও ক্ষিপ্র এবং ধূর্ত। তার সঙ্গে সরাসরি তর্ক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া অনুচিত হবে। অমলকান্তিবাবু নিজেকে সংযমের বেড়ায় আটকে রাখতে চাইলেন, ওসব পুরনো কথা ছেড়ে দিন। বলুন আর কি বলতে চান?

ছেড়ে দেব মানে? শিবনাথবাবুর চোখ থেকে যেন আগুনের গোলা ঠিকরে এল, আপনি আগুন নিয়ে খেলতে চাইছেন, আর আমি সেখানে হাওয়া দেব–এটা আপনি ভাবলেন কি করে? আপনার স্পর্ধা তো কম নয়।

এবার আত্মসম্মানের দরজায় টোকা নয়, কেউ যেন কুঠারাঘাত করল, অমলকান্তিবাবু শিরদাঁড়া সোজা করে দীপ্ত স্বরে বললেন, সত্যি কথা বলাটা নিশ্চয়ই কারোর স্পর্ধার মধ্যে পড়ে না। আপনার কাছে যা মিথ্যে বা অবান্তর বলে মনে হয় তা যদি আমার কাছে সত্যি হয় তাহলে আপনার আপত্তি কোথায়?

এই ইস্কুলের মাস্টার হয়ে আপনি এসব প্রচার করতে পারেন না। শিবনাথবাবু গলা চড়ালেন, মনে রাখবেন আপনি একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষকের এই সমাজের উপর অনেক দায়িত্ব থাকে।

–আমি আমার সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি।

-ঘোড়ার ডিম করছেন। শিবনাথবাবু দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, আপনি যা করছেন সেটা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। গ্রামের মানুষ আপনার উপরে অসন্তুষ্ট। সেইজন্যই ওরা আপনাকে পণ্ডিত বিলে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। নিশ্চয়ই ভুলে যান নি

-ভুলব কেন? মানুষকে বিজ্ঞান-সচেতনতার আলো দিতে চাই। তার বিনিময়ে এরকম কিছু তো আশা করা যেতে পারে। সবাই তো মানুষ হয় না। মানুষের মাঝখানে অনেক ভদ্রবেশী পশুও থাকে। অমলকান্তিবাবু কথা শেষ করে শিবনাথবাবুর দিকে তাকালেন।

রাগে ফেটে পড়লেন শিবনাথবাবু, আপনি আমাকে আকারে-ইঙ্গিতে পশু বললেন, আপনার সাহস তো কম নয়।

-আপনাকে পশু বলার আমি কে? দয়া করে ভুল বুঝবেন না!

-কলকাতার প্যাঁচ মারছেন? আপনাদের বিজ্ঞান মঞ্চ এখানে আর বাঁধার চেষ্টা করবেন না। শিবনাথবাবু হুঁশিয়ার করলেন, বিজ্ঞানের জয়গান করতে সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের বদনাম করবেন না। এখনও গায়ে-গঞ্জে মানুষকে ভূত-প্রেত ধরে। এখনও মানুষ পেতলের ঘড়া ভর্তি জল দাঁতে করে নিয়ে ছুটতে পারে।

–এরও বিজ্ঞান নির্ভর ব্যাখ্যা আছে। আসলে ভূতে ধরাটা একটা সাইকো-ডিজিজ। অমলকান্তিবাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, শিবনাথবাবু বাঘের মতো হুঙ্কার ছেড়ে তাকে আচমকা থামিয়ে দিলেন, চুপ করুন, আর বেশি বাড়বেন না। অনেক হয়েছে, এবার হিরোগিরিটা একটু কমান। এখানকার মানুষদের তো চেনেন না।

–এখানকার মানুষদের আমি চিনি। শুধু আপনাকেই আমি চিনতে পারিনি।

–তার মানে?

–মানেটা সহজ। সাপকে চেনা যায়, কেননা খোলস ছাড়ালেও সে সাপ থাকে। কিন্তু আপনি? অমলকান্তিবাবুর ঠোঁট জুড়ে বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল। রাগে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হল শিবনাথবাবুর, ডান হাত উঠিয়ে তীব্র গতিতে তিনি থাপ্পড় কসিয়ে দিতে চাইলেন অমলকান্তিবাবুর গালে।

এমনটা আগে থেকেই আঁচ পেয়েছিলেন অমলকান্তিবাবু, তিনি হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেললেন লোমশ ভারী হাতটা। সজোরে মুচড়ে দিয়ে বললেন, এখন যদি এই হাতটা আমি মুচড়ে ভেঙে দিই তাহলে তিনমাস ছুটি লাগবে আপনার। কিন্তু আমি তা করব না। বরং সাবান দিয়ে আমার এই হাতটা ধুয়ে ফেলব কেননা এর আগে এমন ভয়ঙ্কর পাপী মানুষের হাত আমি কখনো ধরিনি।

কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সায়েন্স সেকশনের ছাত্র-ছাত্রীরা অমলকান্তিবাবুর দুঃসাহস দেখে হাততালি দিয়ে উঠল সজোরে। সেই হাততালির শব্দ কানে এল শিবনাথবাবুর। তার মনে হল এগুলো কোন শব্দ নয় যেন পাহাড়ী মৌমাছির আক্রমণের শব্দ। শুভ, মাধুরী লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছিল, ওরা থেমে গিয়ে উত্তেজিত অমলকান্তিবাবুর মুখের দিকে তাকাল, পরিস্থিতির ভয়াবহতার আঁচ করে মাধুরী নীচু স্বরে শুভকে বলল, এই, চল, এখান থেকে সরে যাই। যা ঝামেলা হচ্ছে-এক্ষুনি হেড-স্যার এসে পড়বেন। আমাদের একসঙ্গে দেখলে খুব বকবেন।

দেখতে-দেখতে ভিড় জমে গেল চারপাশে। একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল সমস্ত ইস্কুলে। বিজ্ঞানের স্যার অমলকান্তিবাবু শিবনাথবাবুর হাত মুচড়ে দিয়েছেন। অনেকে আবার আক্ষেপ করে বলল, মুচড়ে না দিয়ে যদি ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো হাতটা খুলে দিত তাহলে ভীষণ ভালো হোত।

সবুজ অনেক জানে বলে সবাই তাকে নিউটন বলে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এল ছাদের উপর, শুভকে দেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আজ যা হলো না ফার্স্ট ক্লাস। ওই বদমাশটা আমার বাবার গায়ে হাত তুলে ছিল। অথচ জানিস বাবার কোন দোষ ছিল না। লোকটার টাকা আছে বলে নিজেকে ভাবে শেরশাহ। আজ বুঝতে পারল বাবারও বাবা থাকে।

সবুজ কচি গোঁফের ঘাম মুছে নিয়ে শুভর দিকে তাকাল, জানিস শুভ, ভগবান ওকে ক্ষমা করে দিলেও আমি ওকে কোনোদিনও ক্ষমা করতাম না। আমি ভেবে রেখেছিলাম– চাকরি পেয়ে যে জিনিসটা প্রথমে কিনব তার নাম রিভলভার। আর সেই রিভলভার দিয়ে প্রথম যে গুলিটা বেরত সেটা শিবনাথবাবুর বুক এফোঁড় ওফোড় করে দিত। যাক আজ আমার রাগটা কিছুটা হলেও শান্ত হলো।

টিচার্স-রুম থেকে একে একে সবাই এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন দোতলার করিডোরে। ঘটনার আকস্মিকতার তারা সবাই হতভম্ব। শুধু বিস্মিত নয় শিবনাথবাবু, তিনি ধুতির কোঁচা সামলে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, অমলকান্তিবাবু, ইস্কুল প্রেমিসেসে আপনি আমার হাতটা ধরে ভালো করলেন না। এর ফল দেরিতে হলেও আপনাকে পেতে হবে। আমি টাকা-পয়সা সোনাদানার লেন-দেন সব ভুলে যাই কিন্তু অপমানের বদলা নিতে ভুলি না।

মাঠের একপাশে রাখা ছিল শিবনাথবাবু কালো রঙের রাজদূত মোটর সাইকেল। এলোমেলো লাথি মেরে মোটর সাইকেলটা স্টার্ট দিলেন তিনি। পোড়া ধোঁয়ায় ভরে গেল সবুজমহল।

ধুলো আর ধুঁয়ো উড়িয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন অপমানিত শিবনাথ।

.

২৩.

স্কুলের উল্টো পিঠে জগতখালির বাঁধ, পোদ্দারদের আখের ভুঁই পেরলে শুরু হবে চর সুজাপুর-দোয়েম। গুয়েবাবলা গাছের মতো বাঁধের উল্টোদিকের গ্রামগুলো ম্যাড়মেড়ে ছড়ানো ছিটানো। নিত্য অভাব গিলে নিয়েছে ওদের আভিজাত্যের রসদ। তবু এই খাপছাড়া সৌন্দর্যের মধ্যে বিশাল প্রাণ শক্তি খুঁজে পান অমলকান্তিবাবু। প্রায়দিনই অবসর সময়ে তিনি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের ধুলোয়।

মানুষের কাছে গেলে মানুষের মন চওড়া হয়। গাছের ছায়ায় গাছের বাড়বাড়ন্ত না হলেও মানুষের ছায়া ভিন্ন মানুষের উন্নতি কোনোদিন সম্ভব নয়। অমলকান্তিবাবুকে লাখুরিয়া হাইস্কুলের সবাই ভালোবাসে। শিবনাথবাবু চলে যাবার পর ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল। সবার উদ্বেগ তাকে ঘিরে।

কেউ বললেন, কাজটা ঠিক হল না মাস্টারমশাই। জাতসাপের লেজে পা দেওয়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা।

হেড-স্যার বললেন, যা হবার তা তো হয়েছে। এখন গবেষণা করে কোনো লাভ আছে কি? আপনারা যে যার কাজে যান। ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দিন।

সহ-শিক্ষকরা টিচার্স রুমে ফিরে গেলেন। দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে বাঁধের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অমলকান্তিবাবু। সবুজ অনেক সময় মনের অস্থিরতায় সর ফেলে দেয়। সর পড়া দুধের মতো মনকে স্থিতু হতে সাহায্য করে। একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে ভুলবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন তিনি। হয়ত ভুলেও যেতেন কিন্তু দ্বীপী, সূর্য, মাধুরী, শুভ আর সবুজ তার প্রতিবাদী মনটাকে জিইয়ে রাখল অনেকক্ষণ।

সবার আগে সবুজ বলল, স্যার, আজ আপনি যা করলেন তা ইতিহাস হয়ে যাবে। যে মানুষটাকে সবাই ভয় পেত আপনি আজ তাকে ভয় পাইয়ে দিলেন।

অনেকক্ষণ পরে অমলকান্তিবাবু বললেন, কাউকে ভয় দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। উনি ক্ষমতার অপব্যবহার করছিলেন, আমি শুধু ওকে থামিয়েছি।

–এটাই বা ক’জন মানুষ করে? শুভর প্রশ্নে অমলকান্তিবাবু স্মিত হাসলেন, তোমরা নিজেদের এইভাবে তৈরি করার চেষ্টা করো। যেখানে অন্যায় দেখবে সেখানেই প্রতিবাদ করবে। প্রতিবাদ না হলে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না। শুধু তত্ত্বের কচকচানি দিয়ে জীবনটাকে ভরিয়ে দিও না। তাতে জীবনের সমস্যা বাড়ে, জীবন সঠিক পথ খুঁজে পায় না।

সূর্য কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে দিল মাধুরী, সূর্যদা, স্যার যেটা বলেছেন সেটা সবার আগে আমাদের বোঝার দরকার। আমাদের এই গ্রামে এখনও সুফল ওঝা, চৈতন্যর মা কিংবা শিবনাথবাবুর মতো মানুষ আছে। তাদের সাথে পেরে ওঠা কোনো মানুষের একার কাজ নয়। স্যার কাজটা শুরু করেছেন। তার পাশে আমাদের থাকার দরকার।

মাধুরী কপাল কুঁচকে বলল, সব মানুষের মধ্যে শিবনাথবাবুর মতো একটা মন লুকিয়ে থাকে। আমরা সবাই ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব চাই। হিসাব এক চুল না মিললে আমরা বিদ্রোহী হয়ে উঠি। যেন তেন প্রকারেণ কাজটা হাসিল করার জন্য লেগে পড়ি। কথার যোত অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছিল। শুভ খুব সতর্ক হয়ে বলল, স্যারের মতো সবাই কি হতে পারে? আমড়াগাছে খেজুর ফলবে আমরা কেউ আশা করি না। প্রতিবাদ আমাদের সবার মধ্যেই আছে কিন্তু আমরা অনেকেই তার প্রয়োগ করতে দ্বিধা করি। অবশ্য এর মধ্যে অনেক কারণ থাকে। ভয় তার মধ্যে একটা।

শুধু ভয় নয় সংকোচও অনেক সময় প্রতিবাদের মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। শুভর মনে পড়ে বছর খানিকের আগেকার কথা। সময়টা শীতকাল। শুভর গায়ে তুষের চাদর। অবনী তাকে সোয়েটার কিনে দেবে বলেও কিনে দিতে পারেনি। অভাব তার সেই ইচ্ছেটাকে গিলে নিয়েছে।

মাস্টারদের মেসে টিউশনি পড়তে এসে শুভর চাদরের কোণাটা সরলামাসীর গায়ে লেগে যায়। এই সরলামাসী মাস্টারদের মেসে কাজ করত। বাসনমাজা থেকে রামা অবধি সব কাজ করতে হত তাকে। ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায় সরলামাসী নোংরা থাকতে পছন্দ করত। ফলে তার পরিধানের কাপড়চোপড় আধময়লা, নোংরা ছেঁড়াফাটা। সেই সরলামাসী শুভর চাদরের কোণা লাগাটাকে মেনে নিতে পারে না। জাত চলে যাবার ভয়ে গর্জে ওঠে সে, দিলি তো আমাকে ছুঁয়ে, যত্তো সব।

শুভর সপ্রতিভ মুখ তখন আঁধার ঢাকা। অপমানের শব্দওলোয় সব সময় সুঁচ লুকিয়ে থাকে। দাঁতে দাঁত টিপে মুখ নামিয়ে নেয় শুভ মাটির দিকে। সকালবেলায় তার পৃথিবীটা আঁধার হয়ে আসে হঠাৎ।

সরলামাসী একই কথা বারবার আউড়ে গজগজ করতে করতে চলে যাচ্ছিল। অমলকান্তিবাবু ওই অত জনের মাঝখানে তাকে থামালেন, মাসী, তোমার কিন্তু এটা উচিত হল না। শুভকে তুমি বকলে, ও কি দোষ করেছে?

কী করেনি বলো? সরলামাসী দোক্তা খাওয়া দাঁত দেখিয়ে বলল, সাত সকালে দিলো তো ছুঁয়ে, এই শীতে আমি ঘাটে যাবো কি করে? এটা অত্যাচার নয়?

–যাকে তুমি অত্যাচার বলছে সেটা তোমার পাপ মনের পরিচয়। অমলকান্তিবাবুর কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, মানুষকে ছুঁলে মানুষকে যদি স্নান করতে হয় তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে!

–ও তুমি সব বুঝবে না বাবা, পরে আমি সব তোমাকে বুঝিয়ে বলব। সরলামাসীর গলার স্বর নীচু হয়ে এল, আসলে জানো কী বাবা, ওই…তোমাদের ওই শুভ…মানে ওর বাবা..এই হাসপাতালের…।

-চুপ করো মাসী, আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। তবে একটা কথা শুনে রাখো…মানুষকে ছুঁলে মানুষের কোনদিন জাত চলে যায় না।

-তুমি বিদ্বান ছেলে, মাস্টার হয়েছে, এ তোমার কেমন কথা?

–এটাই আমার মনের কথা।

-তাবলে হাঁড়ি মুচি মেথর যে পারে সে আসবে? সরলামাসীর বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন জেগে উঠল।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ সবাই আসবে। শুধু ব্রাহ্মণদের ছেলে-মেয়েরা আমার ছাত্র নয়, আমার ছাত্র সবাই। সবাই আমাকে ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। অমলকান্তিবাবু থামলেন, ঢোক গিলে বললেন, তোমার যদি কোনো অসুবিধা থাকে তাহলে তুমি কাজে আসবে না। কাল থেকে আমি আলাদা লোক দেখে নেব

শুভ সেদিন দেখেছিল সরলামাসীর ফণা তোলা মাথা কাজ হারানোর ভয়ে ঝুঁকে গিয়েছে মাটির দিকে, তার মুখে টুঁ শব্দটিও নেই। সরলামাসীর ছেলে চৈতন্য শুভদের সঙ্গে পড়ে। কিন্তু বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও চৈতন্য কোনোদিন ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়নি। কেন নিয়ে যায়নি, কারণটা খুবই স্পষ্ট। শুভ গেলে ওদের কুঁড়েঘরের পবিত্রতা নষ্ট হবে। ছোঁয়াছুঁয়িতে খোয়া যাবে ওদের এতদিনের আগলেরাখা জাত্যাভিমান। তাই বন্ধু হয়েও শুভ এখন ওদের বন্ধু নয়।

বিজয়া দশমীর দিন চৈতন্য ঠোঙ্গায় করে নাড়ু নিয়ে আসে। বন্ধুদের দেয়। শুভ সেই নারকেলের নাড়ু ছুঁয়েও দেখে না। কেন ছোঁবে সে? যারা তাকে ঘৃণা করে তাদেরও সে ঘৃণা করবে। মারের বদলে সে ফিরিয়ে দেবে মার। কারোর দয়া নিয়ে বাঁচবে না। এ ব্যাপারে সে দলে পেয়েছে সবুজ আর রঘুনাথকে। ওই দু’জন তার পাশে থাকলে সে শিবনাথবাবু কেন যে কোন বাবুকেই রুখে দেবে।

প্রতিবাদ সবার দ্বারা হয় না। প্রতিবাদ রক্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিলিমাছ। আর তা যদি না হত তাহলে শুধু অমলকান্তিবাবু কেন সেদিন তার বন্ধুরা রুখে দাঁড়াতে পারত সরলামাসীর বিরুদ্ধে। ওরা কেউ ত করেনি, করার প্রয়োজনও বোধ করেনি।

.

শিবনাথবাবুর মোটর সাইকেলটা সোজা এসে থামল থানার নিমগাছটার গোড়ায়। অন-ডিউটি পুলিশটা তাকে স্যালুট করে বলল, স্যার চেম্বারেই আছেন। যান দেখা হয়ে যাবে।

থানার সঙ্গে শিবনাথবাবুর সম্পর্ক অনেকটা মামা আর ভাগ্নের মতো। থানার বড়োবাবু সুপ্রিয় চাকলাদার প্রায়ই শিবনাথবাবুর বাগানবাড়িতে গিয়ে নৈশভোজ সেরে আসেন। সেই ভোজে মাছমাংস ছাড়াও থাকে তরল পানীয়। দেশী তরলে এখন মন ভরে না সুপ্রিয়বাবুর। তার জন্য কৃষ্ণনগর থেকে গাড়ি পাঠিয়ে বিদেশী ছাপ্পার পানীয় আনতে হয় শিবনাথবাবুকে। এমন সেবা করার সুযোগ পেয়ে তিনি ধন্য। কেননা বেআইনী সুদের কারবার চালাতে গেলে থানার সঙ্গে হাত রাখার প্রয়োজন। এসব ব্যবসায় সোজা আঙুলে কারবার বাঁচে না, প্রায়ই আঙুল বেঁকিয়ে ঘি তুলতে হয়। লাঠালাঠির চাইতে থানার শাসানীটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ। সহজে কেউ শিবনাথবাবুকে ঘাঁটাতে চায় না। গ্রামের সবাই জেনে গেছে থানা মানে বাঘের গুহা। আর বাঘের ছোঁয়া মানে আঠারো আঁচড়, আঠারো ঘা।

অপমানটা মাথার ভেতর বিষপোকার মতো কুটকুট করে কামড়াচ্ছিল, আর তার দংশনে দগ্ধে-দগ্ধে মরছিলেন শিবনাথবাবু, যার কবল থেকে পরিপূর্ণভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া মুখের কথা নয়। অমলকান্তি সেদিনের ছোকরা। এম. এস. সি. পাশ করে তার নিশ্চয়ই ডানা গজায়নি। তা যদি না হয় তাহলে সবার সামনে এমন ঔদ্ধত্য তিনি দেখালেন কোন সাহসে? তবে কি পিঁপড়ের পাখা গজায় মরবার জন্য? হতে পারে। প্রচণ্ড রাগে মাথা ঝাঁকালেন শিবনাথবাবু। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে হালকাবোধ করতে চাইলেন তিনি। সব হালকা হয় কিন্তু অপমানের তীরটা নোঙরের ধাতব ফ্যাকড়ার মতো মনের নরম জমিতে গিঁথে থাকে। অতি বাড় বেড়েছে মাস্টারটার। ওর বাড়বাড়ন্ত একটু ছেঁটে দিতে হবে। তবে এ কাজ নিজের হাতে করবেন না শিবনাথ। সুপ্রিয়বাবুই তার হয়ে বাকি কাজটা করে দেবেন। এতদিন পুকুরের মাছ, গাছের কচি ডাব খাইয়েছেন, এখন তার বিনিময়ে নিশ্চয়ই এটুকু আশা করা যেতেই পারে। এ তো এমন কিছু বেশি চাওয়া নয়, এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।

ভারী পর্দা হাওয়ায় অল্প-অল্প নড়ছিল, এই পদাও শিবনাথবাবুর কিনে দেওয়া। নিজের কিনে দেওয়া পর্দা সরিয়ে বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকে এলেন তিনি। তাকে দেখে সুপ্রিয়বাবু ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি বুলিয়ে বললেন, আরে কি সৌভাগ্য! এ যে দেখছি মেঘ না চাইতে জল।

শিবনাথবাবু দাঁত ঠেলে বেরিয়ে এল হাসি, দায়ে না পড়লে কেউ কি থানায় আসে, স্যার?

-আরে বসুন, বসুন। কথা পরে হবে। আগে বসুন তো শিবনাথবাবু তার বিশাল চেহারা নিয়ে একটা চেয়ার জুড়ে বসলেন, তারপর দু-দিকে দুই হাত ছড়িয়ে কাতলা মাছের মতো দম নিয়ে বললেন, আপনি তো আমার বাগানবাড়ির রাস্তাটা ভুলে গেছেন। তা আপনার দৌলতে মাঝে মাঝে আমারও ঢুকুঢুকু হোত, গলা ভিজত, আপনার দয়ায় প্রায় মাসের উপর সেটাও বন্ধ।

-হ্যাঁ, একদম টাইম বের করতে পারছি না। জানেনই তো আমাদের বারো মাসে তের পার্বণ লেগে আছে। সুপ্রিয়বাবু টেবিলের কাচে ভর দিয়ে তাকালেন, তা বলুন, আপনার কি সমস্যা। কাউকে ওঠাতে হবে বুঝি?

শিবনাথবাবু আভিজাত্যে ভরা সিগারেটের পেকেটটা এগিয়ে দিলেন বড়ো-দারোগার দিকে, অমলকান্তি মাস্টারকে চেনেন মনে হয়?

–কে অমলকান্তি? সুপ্রিয়বাবু চোখ কুঁচকালেন, এনি প্রবলেম?

-হ্যাঁ, প্রবলেম একটু আছে বইকি। কলকাতার চ্যাংড়া, গ্রামে এসে বড়ো বেশি ফুটুর ফুটুর করছে।

-ওঃ, এই কথা! যে ফুটুরফুটুর করছে, তাকে ফুটুরডুম করে দিলেই হলো। সুপ্রিয়বাবু বিশ্রী গলায় হেসে উঠে নোংরা চোখে তাকালেন, ওকে চেষ্টা করে মেয়েছেলে কেসে ফাঁসিয়ে দিন। তারপর বলটা আমার কোর্টে ছেড়ে দিলে ঘুঘুকে ধান খাইয়ে কেসনগর কোর্টে চালান করে দিতে আমার কোনো ঝামেলাই হবে না।

-মেয়েছেলে কেস ছাড়া আর অন্য কোনো কেসে ফাঁসানো যায় না?

 –যায়। তবে এটা সব চাইতে সহজ মেথড। সুপ্রিয়বাবু হাসলেন।

 শিবনাথবাবু অনেক ভেবে দ্বিধার সঙ্গে বললেন, একটু চমকে দিলে হয় না? বড্ড উড়ছে, একটু ডানাটা মুচড়ে দেওয়া আর কি…

–ডানা মুচড়াব কেন, দরকার হলে ডানা ভেঙে দেব। সুপ্রিয়বাবুর গলা পুলিশী কায়দায় ঝ্যানঝেনিয়ে উঠল।

শিবনাথবাবু বললেন, যাই হোক কিছু একটা করুন। জানেন ও আমার হাত ভেঙে দিতে চেয়েছিল, তা-ও আবার ইস্কুলে।

–তাহলে এফ. আই. আর করছেন না কেন? একবার থানার খাতায় কমপ্লেন লেখান, তারপর দেখুন ওর অবস্থা কি করি? চোখ কটমট করে সুপ্রিয়বাবু ফুঁসছিলেন।

শিবনাথবাবু তাকে শান্ত করলেন, লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিতে আমি চাই না।

–আপনাকে নিয়ে মশাই আর পারা গেল না। শরীরে এত দয়া পুষে রাখলে চলবে? আপনি মশাই বড়ো আজব মানুষ! আপনার ডান দিকে মহাত্মা গান্ধী, বাঁ-দিকে সুভাষচন্দ্র। দেখুন, যেটা ভালো হয় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে বলুন। আমি প্রশাসনের লোক। কীভাবে দুষ্টকে শাসনে রাখতে হয় তার ট্রেনিং আমার নেওয়া আছে। সুপ্রিয়বাবু গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে উড়িয়ে দিলেন ঘরের ভেতর।

ইতিমধ্যে চা-বিস্কুট এসে গিয়েছে শিবনাথবাবুর জন্য। চায়ে চুমুক দিয়ে সুপ্রিয়বাবু বললেন, আপনি বাড়ি যান। কোনো চিন্তা করবেন না। অমলকান্তি আপনার হাত ধরে ভালো কাজ করেনি। আমার এলাকায় কেউ খারাপ কাজ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে, দু-দিন আগে আর পরে।

–সে আমি জানি। সেইজন্য তো ছুটে আসা। শিবনাথবাবু গায়েপড়া হাসি হেসে উঠলেন, তাহলে এবার আমি যাই। আপনার জন্য গরীবের দরজা খোলা রইল। যেদিন মন হবে সেদিন নিজের মনে করে বিনাসংকোচে চলে আসবেন, প্লিজ।

.

কৃষ্ণনগর থেকে কুশলবাবু এসেছিলেন পরশু। উনি বেশিরভাগ সময় রাতের বাসে আসেন, ব্রহ্মাণীতলায় নেমে কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে যান–এ সংবাদ কেউ রাখে না। মাঝে বেশ কয়েকবার রঘুনাথ তাকে মানিকডিহির দিকে যেতে দেখেছে। মানুষটার কোনো ভয় ডর নেই প্রাণে।

একদিন রঘুনাথ ঘুরঘুট্টি আঁধারে তাকে বাঁধের উপর আটকালো। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, মাস্টর, কবে এলে গো?

প্রথমে তাকে চিনতে পারেননি কুশলমাস্টার, তারপর টর্চের সুইচ টিপে রঘুনাথের মুখর উপর ফেলে বললেন, আরে, তুমি?

–আমি তো ইখানেই থাকি মাস্টর।

–ওঃ,বেশ ভালো কথা। তা তোমাদের পাড়াটার নাম কি?

–আজ্ঞে, হলদিপোঁতা ধাওড়া।

–বাঃ, বেশ ভালো নাম তো!

 –ভালো-মন্দ বুঝি নে বাবু তবে এ গাঁয়ে আমার বাপও জন্মেছিল।

ওঃ, তাই বুঝি? কুশলমাস্টারের আগ্রহ বাড়ছিল ক্রমশ। এই ছেলেটাকে পার্টির কাজে লাগানো যায়। এদের বিদ্যে-বুদ্ধি নেই। একেবারে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীভুক্ত শ্রমজীবী মানুষের একজন প্রতিনিধি এই রঘুনাথ। বার চারেক এর সঙ্গে দেখা হয়েছে কুশল মাস্টারের।

রঘুনাথ প্রথম দিকে বুঝত না এরা কি চায়, এদের গ্রামে আসার কী উদ্দেশ্য।

সূর্যাক্ষ তাকে বুঝিয়ে দেয়, জানিস রঘু, এরা হলে গিয়ে এসময়ের বিপ্লবী।

তার মানে? রঘুনাথের সবিস্ময় প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় সূর্যাক্ষ, বিপ্লবী মানে বুঝলি না? আরে যারা যুদ্ধ করে। ধুর, যুদ্ধ নয়…যারা লড়াই করে। আরে, ওই যে ক্ষুদিরাম, ক্ষুদিরাম বসু। তুই সেই গানটা শুনিসনি বুঝি? হাসি হাসি…একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।

রঘুনাথ ঘাড় নাড়লে সূর্যাক্ষ খুশি হয়, ওই যে যারা দেশের জন্য গলায় ফাঁসি ঝুলিয়ে নিয়েছিল স্বেচ্ছায়। এরাও তাদের মতন। এরা বুর্জোয়াদের খতম করে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে বিপ্লবী রাষ্ট্রযন্ত্রকে তুলে দেবে। এরা সর্বহারাদের সরকার গড়বে-বুঝলি?

রঘুনাথের মুখ আরও বিস্ফারিত হয়, তার কানের পাশ দিয়ে শব্দগুলো ঝাঁ-ঝাঁ করে উড়ে যায়।

সূর্যাক্ষ হার মেনে বলে, তোকে বোঝানো বড় কঠিন। আচ্ছা বলতো ইন্দিরা গান্ধী কে? তুই ওর নাম শুনেছিস?

রঘুনাথ এবার আকাশ থেকে পড়ল। সে তার ঠাকুরমার নামটা কদিন আগে শুনেছে। লাজবতী। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী নামটা তো শোনেনি। কমলার সঙ্গে দেখা হলে তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে। কমলা অনেক খোঁজখবর রাখে। কাশীনাথ ম্যাট্রিক ফেল। সে নিশ্চয়ই ইন্দিরা গান্ধীর নাম শুনেছে।

সূর্যাক্ষ বলল, জানিস রঘু, কুশল মাস্টারের কাছে সব সময় চেম্বার থাকে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। সেদিন চান করতে বাথরুমে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখি প্যান্টের পকেট থেকে কালো মতো কী একটা টুকি মারছে। হাত দিয়ে দেখি কী শক্ত। আর ঠিক তখনই আমার জ্যাঠার ছেলে রুদ্রদা এসে আমাকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলে। রেখে দে-বলে কী ধমক দিল। আমার পিলে চমকে গিয়েছিল। ওই দিন রুদ্রদাই বলল-এটাকে চেম্বার বলে। নিজের সেফটির জন্য কুশল মাস্টার ওটা সব সময় কাছে রাখেন। বলা যায় না কোথায় কখন পুলিশের লোকের সাথে দেখা হয়ে যায়।

-ওটা দিয়ে বন্দুকের মতো মানুষ মারা যায়? রঘুনাথ বোকার মতো শুধোল।

সূর্যাক্ষ হা-হা করে হাসল, মানুষ কেন রে, বাঘও মারা যাবে।

–অমনটা আমাকে একটা যোগাড় করে দিবি?

–ওটা দিয়ে তোর কি হবে?

রঘুনাথ উত্তেজিত হয়ে বলল, আগে কাশীকে ধসিয়ে দেব। ও ব্যাটা সবসময় আমার পিছে লেগে আচে। আমার এক নাম্বার শত্তুর।

-মাথা গরম করিস নে, শোন। সূর্যাক্ষ গলা নামিয়ে বলল, দেশের সময় এখন ভাল নয়। রুদ্রদা কলেজ থেকে চলে এসেছে। আর কলকাতায় যাবে না। ওখানে নাকি পুলিশ হোস্টেল ঘিরে রাতেরবেলায় ছেলেদের তুলে নিয়ে গিয়ে আলিপুরের জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেই ভয়ে সেন্ট-জেভিয়ার্স থেকে পালিয়ে এসেছে রুদ্রদা। একথা গাঁয়ের কেউ জানে না। তোকে শুধু বললাম।

–লোক জানলে পরে কী হোত কী? রঘুনাথের কৌতূহল জেগে উঠল।

আরে, কি বোকা বলতো তুই! দশ কান হলে পুলিশ সব জেনে যাবে। এখন সাদা পোশাকের পুলিশ গাঁয়ে-গঞ্জে ঘুরছে। ওরা যদি জানতে পারে তাহলে আর রুদ্রদার নিস্তার নেই। পুলিশের জিপ এসে তুলে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণনগরের জেলে পাঠিয়ে দেবে। রুদ্রদা বলছিল–ওর চারজন বন্ধুকে পুলিশ গুলি করে মেরে দিয়েছে। সূর্যাক্ষর গলা ভার হয়ে এল, সেদিক থেকে আমাদের কালীগঞ্জ থানা অনেক ভালো। এখানকার পুলিশ বাড়াবাড়ি করে না। ওরা শুধু ডাকাত ধরে বেড়ায়, ছাত্রদের গায়ে হাত তোলে না।

কুশল মাস্টারের সঙ্গে সে রাতে অনেকটা পথ হেঁটে গিয়েছিল রঘুনাথ। বেলগাছটার কাছে আসতেই সে দেখতে পেল অন্ধকার কুঁড়ে ঝোপের ভেতর থেকে উঠে এল রুদ্রাক্ষ। হাত উঁচিয়ে অদ্ভুত কায়দায় শরীর ঝাঁকিয়ে সে বলল, কমরেড, লাল সেলাম।

কুশল মাস্টারও হাত উঁচিয়ে একই কায়দায় বললেন, লাল সেলাম। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

রঘুনাথ ফিরে যেতে চাইলে রুদ্রাক্ষই বলল, ফিরে যাবে কেন, আমাদের মিটিংয়ে চলল। ঘাসুরিডাঙা, কামারী, কুলবেড়িয়া, কালীগঞ্জ, শেরপুর থেকে আরও কমরেডরা আসবেন। আজ আমরা পার্টির ভবিষ্যৎ গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করব। সেই সঙ্গে আমাদের পার্টির ভবিষ্যৎ কর্মসূচী গঠিত হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য তৈরি হয়ে যাবো। শ্রমিক এবং মেহনতী মানুষের জন্য আমরা পুঁজিপতি শ্রেণীর বিনাশ চাইছি, সেই সঙ্গে চাইব-দুনিয়ার শ্রমিক-কৃষক এক হোক।

রঘুনাথের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তবু রুদ্রাক্ষর মুখের উপর সে না বলতে পারল না। নীলাক্ষবাবুর এই ছেলেটি পড়াশোনায় বরাবর ফার্স্ট। তার এই জনদরদী মনের কথা জানত না রঘুনাথ। শুধু কপোতাক্ষবাবু নয় রুদ্রাক্ষও মানুষের সেবায় নেমেছে। তবে সূর্যাক্ষর ভাষায়, কাকা ভাইপোর পথ ও মত সবই আলাদা। ওদেরও নিজেদের মধ্যে লড়াই আছে, সে লড়াই আদর্শের লড়াই। সে লড়াই কোনোদিন মিটবে বলে মনে হয় না।

কুশল মাস্টারের নেতৃত্বে জনা ত্রিশেক মানুষ চাপা গলায় স্লোগান দিল–দুনিয়ার কৃষক এক হও। দুনিয়ার শ্রমিক এক হও। দুনিয়ার মজদুর এক হও। প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। একনায়কতন্ত্রী স্বৈরাচারী এই সরকার আমরা মানছি না, মানব না। দুনিয়ার কমরেড এক হও। বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র ধ্বংস হোক।

সভায় সিদ্ধান্ত হল আজ রাত থেকেই কালীগঞ্জ বাজারে পোস্টার আর স্লোগানে ভরিয়ে দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে দেওয়ালে দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে আঁকা হবে মাও সে তুঙ-এর মুখ। গোটা গোটা করে লেখা হবে চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান, মাও সে তুঙ জিন্দাবাদ ইত্যাদি।

সেইমতো আলকাতরা কেনার জন্য রুদ্রাক্ষ রঘুনাথকে সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে নিয়ে গেল কালীগঞ্জের বাজারে। দোকান আর একটু হলে বন্ধ হয়ে যেত। গণেশ বিশ্বাস বিরক্ত হয়ে বলল, বাবু, আলকাতরা নেবে তো, দিনের বেলায় এলে না কেন? রাতের বেলায় কি রঙের কাজ হয়? ঠিক আছে–এসেছ যখন দিয়ে দিচ্ছি। আর কিন্তু এসময় এসো না।

-ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি করো। আবার ফিরতে হবে তো–রুদ্রাক্ষ ব্যস্ত হয়ে বলল।

সারারাত ধরে চলল তাণ্ডব। খবরের কাগজে লেখা হল স্লোগান। ছাঁচে আলকাতরা বুলিয়ে ফুটিয়ে তোলা হল মাও সেতুঙের মাথা। সাদা দেওয়াল ভরিয়ে দেওয়া হল কালো অক্ষরে। শিবনাথবাবুর দোকানের তালায় কাঠিতে বিষ্ঠা নিয়ে এসে ভরিয়ে দিল। শুধু শিবনাথবাবুর তালা নয় যারা যারা অত্যাচারী, হৃদয়হীন বলে ইতিমধ্যে কুখ্যাতির অংশীদার হয়েছেন তাদের একটা তালাও অক্ষত রইল না। বহু সময় ধরে ব্যস্ত শিল্পের ছাপ রেখে বাঁধের ধারে ফিরে গেল ওরা। আখখেতের পাশ দিয়ে দিঘিতে যাওয়ার পথ।

দিঘির পাড়ে এসে ওরা শরীর এলিয়ে দিল ঘাসের বিছানায়।

কুশল মাস্টারের সারারাত খাওয়া হল না। রুদ্রাক্ষ সবার জন্য পাঁউরুটিও এনেছে থলি ভরে। দিঘির জলে হাত ধুয়ে ওরা যখন খেতে বসল তখন শেষরাত। মরা চাঁদ ঝিমুচ্ছে আকাশে। বাবলাগাছের ফুলের মতো হলুদ হয়ে এসেছে তার দৃষ্টি। সেই চাঁদের দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে আছে একটা হুতোমপ্যাঁচা।

পাউরুটির কাগজগুলো এক জায়গায় রাখতে বলে রুদ্রাক্ষ বলল, আমাদের আজকের এই অপারেশনের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। কুশলদা ভোরের বাসে কৃষ্ণনগর চলে যাবেন। এখানে থাকা ওর পক্ষে রিস্ক হয়ে যাবে। কাল কি রিঅ্যাকশন হবে এখন ঠিক বোঝা যাবে না। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শিবনাথবাবু আমাদের টার্গেট। ও বুর্জোয়া। সুদখোর, মানববিদ্বেষী। আমাদের এই মহান বিপ্লবের শত্রু। গ্রামে গ্রামে এদের চিহ্নিত করতে হবে। তারপর হাইকমান্ডের নির্দেশমতো সাফাই অভিযান চালাতে হবে। পুঁজিপতি শ্রেণীর বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই সশস্ত্র রক্তাক্ত বিপ্লব চলবে।

রঘুনাথের জীবনে এ এক অন্য অভিজ্ঞতা, দিঘির জলে আলকাতরার দাগ মুছে সে ফিরে এসেছে ঘরে। তখনও আলো ফোটেনি, পোকরাতারা জ্বলজ্বল করছে আকাশে। রঘুনাথ ভেবেছিল চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়বে তালাইপেতে। কিন্তু শীতকাল বলে যত ঝামেলা। শুধু তালাইয়ে শীত যাবে না, ভোরের দিকে শীতের দাঁত উঁচলো হয়ে ওঠে, কাঁথা-কম্বল ছাড়া এ শীত সহজে যাবার নয়।

কাঁথা নামাতে গিয়ে বেকায়দায় হাত থেকে খসে পড়ল ইটের চেয়েও শক্ত তেলচিটে বালিশটা। দুর্গামণি ছেলের চিন্তায় ঘুমায়নি, তার তন্দ্রামতো এসে ছিল, বালিশ পড়ার শব্দে সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল বিছানায়, কে, কে? কে উখানে?

–আমি রঘু গো মা।

–সারারাত কুথায় ছিলি রে?

–মাঝের গাঁয়ে যাত্রা দেখতে গেছিলাম।

–যাত্রা! দুর্গামণির চোখে বিস্ময়, এখুন আবার কিসের যাত্রা? কেনে মিচে কতা বলছিস বাপ। তুকে না হাজারবার মানা করেচি, কমলার কাছে যাবিনে। ওর দাদাটা এট্টা আক্ষস। ওর বাপ এট্টা চামার। দেখে ফেললে তুর চোখের ডিমা উপড়ে লিবে।

কেনে মিচিমিচি ভাবচো বল তো? রঘুনাথ বিরক্ত হল, আচ নিয়ে মেলা দিন হলো কমলার সাথে আমার দেকা নেই গো তাকে তো মামার ঘর পেঠিয়ে দিয়েছে ওর বাপ-মা। আমার কথা বিশ্বেস না হলে দিনমানে খোঁজ লিও।

এবার মন কিছু নরম হয় দুর্গামণির, তা গেলি যখন খেয়ে যাবি না? এত বড়ো রাত, না খেয়ে থাকলে কী হয় জানিসনে বুঝি? কেনে বলে গেলে আমি কি তুকে এটকুতাম। দুর্গামণি ছেলের কাছে সরে এল, তুর ভোখ লাগেনি, কিছু খাবি?

–খেয়ে এসেচি মা।

-হুঁ, খেয়ে এয়েচি? দুর্গামণি ভেংচে উঠল, বলি,কে তুর জন্যি ভাত রেধে পাখার বাতাস করছিল শুনি?

–তুমি জানো না, সূর্যর মা আমাকে কত ভালো পায়।

অঃ। মন উদাস হয়ে গেল দুর্গামণির, বড়ো গাছে ঢিলি বাঁধা ভাল, তবে দেখিস বাবা-সেই ঢিলি যেন ফুটা না হয়ে যায়। আমার বড়ো ভয় হয় রে! এ জীবনে বড়ো মানুষের কত্তো ছোট কাজ দেখেছি।

 সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায় রঘুনাথের, দুর্গামণি তাকে ঠেলা মেরে জাগিয়ে দিয়ে বলে, আর কত্তো শুবি রে বাপ? রোদ চড়ে গেল মাথার উপর। ইবার চোখে-মুখে জল দিয়ে টুকে বাজারে যা। মনে নেই তুর, আজ সোমবার, হাটবার।

মায়ের কথাগুলো বুকে ঢেঁকির পাড় দেয় রঘুনাথের। কালীগঞ্জ বাজারে আজ না যাওয়া ঢের ভালো। রুদ্রাক্ষ বারবার নিষেধ করেছে। বিপদ কোথায়, কখন ওৎ পেতে থাকে বোঝা যায় না। তাছাড়া শিবনাথবাবুর শকুনের চোখ। বাজারের লোকে বলে, মানুষটা সুদ খেয়ে খেয়ে রাজশকুন হয়ে গিয়েছে। মানুষের চোখের চামড়া যে গণ্ডারের চামড়া হয় কে জানত।

অনেকে শিবনাথবাবুকে বলে, বাঘের ফেউ, বড়বাবুর লেজুড়। এই মানুষটা থানা বগলদাবা করে জলে আগুন লাগিয়ে দেবে। এর কথায় মধু নেই, শুধু বিষ আছে।

তবু মায়ের কথাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না রঘুনাথ। চটের থলিটা নিয়ে সে উঠে আসে বাঁধে। সামান্য হলেও তার পা কেঁপে ওঠে। মনের ভেতর ভয় সুষনিপাতার মতো কাঁপতে থাকে।

থানায় খবরটা পৌঁছে দেয় শিবনাথবাবু নিজে। রাগে তার সারা শরীর রি-রি করে উঠছিল। তিনি কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। এমন কান্ড কে ঘটাতে পারে, কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে?

শিবনাথবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আপনি কিছু ব্যবস্থা করুন বড়োবাবু, নাহলে আমাদের এই শান্তির গ্রাম কৃষ্ণনগর রানাঘাট হয়ে যাবে। আগুন একবার জ্বলে উঠলে সহজে তা নেভানো যাবে না। এ দেশটা আলসের দেশ। আখের আলসেয় একবার আগুন লাগলে সহজে তা নিভতে চায় না। কথাটা মাথায় রাখলে সবার মঙ্গল হবে।

আপনি প্রেসারের রুগি। এসব নিয়ে ভাববেন না। সুপ্রিয়বাবু নাক খুঁটতে খুটতে বললেন, যে-ই করে থাকুক, তাকে আমরা ধরবই। পেছনে হুড়কো দিয়ে ওর বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেব।

-যা করার আড়াতাড়ি করুন। পাখি উড়ে গেলে তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। শিবনাথবাবুর কণ্ঠস্বরে উদ্বিগ্নতার ছাপ।

বড়বাবু সিগ্রেট ধরিয়ে বললেন, আপনার কাকে সন্দেহ হয়?

–বিদুর রাজোয়ারকে চাঁদা দিইনি। ও করলেও করতে পারে।

–ওর অত সাহস হবে? বড়োবাবুর যেন কথাটা বিশ্বাস হলো না। আড়চোখে তাকিয়ে শিবনাথবাবু বললেন, এছাড়া মানিকডিহির কপোতাক্ষর নামটাও আমার মনে আসছে। ওরা গ্রামটাকে নষ্ট করার চক্রান্তে লেগে পড়েছে। আমি সহজে তা হতে দেব না। ওরা যতই লাফাক, ঝাঁপাক, আমি আমার আদর্শে স্থির থাকব।

-স্থির থাকলে হবে মশাই, যুগ পাল্টাচ্ছে। তিক্ত গলায় বলল বড়োবাবু, জানেন গোয়াড়ী বাজারের কাছে একজন ও.সির পেটে ভোজালি ঢুকিয়ে দিয়েছে। শক্তিনগর সদর হাসপাতালে ভর্তি আছে। খুব সিরিয়াস। ওয়ারলেসে ম্যাসেজটা পেলাম। আমাদেরও এলার্ট থাকা দরকার। কখন কি হয় বলা যায় না তো?

–তা তো বটে। শিবনাথবাবু জোর করে হাসলেন, ওরা আমাকেও শাসিয়েছে। বুর্জোয়া বলে গাল দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি ওদের নেক্সট টার্গেট।

সেই ছোকরা মাস্টারকে সন্দেহ হয় না? বড়ো দারোগার কথায় নড়েচড়ে বসলেন শিবনাথবাবু।

–ও হারামিটাকে জীবনে আমি কোনদিন ভুলব না। জানেন মশাই আজ অব্দি কেউ আমার হাত ধরার সাহস পায়নি, ও শালা আমার হাত ধরে মুচড়ে দিল। সবাই না এগিয়ে এলে হয়ত ভেঙে দিত। শিবনাথবাবুর গলা শুকিয়ে গেল। অভিযোগের আঙুল তুলে তিনি বললেন, এই সুযোগ বড়োবাবু, এবার ছোকরা মাস্টারকে হাজত ঘরে পাঠাবাব ব্যবস্থা করুন। এমন কেস দিন যাতে জেল থেকে বেরতে দাড়ি পেকে যায়।

-চুপ করে বসুন। দেখছি আমি কী করা যায়।

 বড়োবাবুর নির্দেশে চারজন পুলিশ ছুটল চারদিকে।

কদবেল তলা থেকে ধরে আনা হল বিদুর রাজোয়ারকে। লাবণি এল তার পেছন পেছন। সঙ্গে এল হরিনাথপুর আর দাসপাড়া সাধারণ মানুষ। তারা থানায় গিয়ে নিমগাছের তলায় স্লোগান দিতে লাগল। তাদের পুরোভাগে লাবণি।

পুলিশের জুলুমবাজি সইব না, সইব না।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।

ভিড়ের মধ্যে থানায় ঢুকলেন কপোতাক্ষ। বড়বাবুর ঘরে শিবনাথকে দেখে তার মাথায় যেন বিছে কামড়ে দিল। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে দিলেন শূন্যে, চোয়াল নাড়িয়ে বললেন, কমরেড বিদুর রাজোয়ার জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

বড়োবাবুর ঘরে টানা জিজ্ঞাসাবাদ চলল ওদের। শেষ পর্যন্ত কোন ক্লু না পেয়ে ওদের নিঃশর্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন বড়োবাবু।

থানার ছোট দারোগা চন্দবাবু বললেন, স্যার, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

বলব? বড়োবাবু ওর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন, বলে ফেলো। দেরি করছ কেন?

ছোটবাবু বললেন, স্যার, কালীগঞ্জে সব মিলিয়ে দুটো লোহা-লক্কড়ের দোকান। ওই দুটো হার্ডওয়ার্সের মালিকদের ডেকে পাঠালে কেমন হয়। কাল কারা ওদের দোকান থেকে আলকাতরা কিনেছে তাদের নাম জেনে নিলে ইনকুয়ারির সুবিধা হবে।

-ইটস অ্যা গুড আইডিয়া। ইমিডিয়েট জিপ নিয়ে চলে যাও।

বড়বাবুর নির্দেশে ছোটদারোগা জিপ নিয়ে চলে গেলেন। ফিরে এলেন হাসি-হাসি মুখ করে।

বড়োবাবু জিজ্ঞেস করলেন, শেষ পর্যন্ত কি হলো?

-কেস সলভ করে ফেলেছি, স্যার। কাল মোট দুজন আলকাতরা কিনেছে। একজন কুলবেড়িয়ার, একজন মানিকডিহির। ওদের একজনের বয়স আনুমানিক আটান্ন, অন্যজনের বয়স বাইশ। তবে যার বাইশ বছর বয়স তার নাম দোকানদার বলতে পারল না। শুধু বলল মুখ চেনা। দেখলে চিনতে পারবে।

–ওয়েল। তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই। এক্ষুনি গাড়ি নিয়ে মানিকডিহি চলে যাও। ওরা সতর্ক হওয়ার আগে ফাঁদ পেতে ওদের ধরে ফেল। বড়োবাবু প্রাপ্তির উত্তেজনায় ফুটছিলেন।

রঘুনাথের কানে খবরটা পৌঁছাতে সে আর দেরি করল না। বাজার না করে সে ঘুরপথে ছুটল মানিকডিহির দিকে। থানার গাড়ি পৌঁছনোর আগে সে পৌঁছে গেল রুদ্রাক্ষর কাছে। হড়বড় করে বলল, দাদা গো, পালাও। তুমাকে ধরতে পুলিশ আসছে। দোকানদার তুমার নাম বলে দিয়েছে। দোকানদারও গাড়িতে আছে।

ঘরে ঢুকে টুকিটাকি কিছু নিয়ে ঝোলা কাঁধে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল রুদ্রাক্ষ। বাঁধ পেরিয়ে সে সোজা চলে গেল বড়গঙ্গার ঘাটে। ঘাট পেরিয়ে নয়াগ্রাম হয়ে সে পৌঁছে গেল সালারের কাছাকাছি। এখানকার গ্রামগুলো তারা চেনা। তবু এসব গ্রামে তার থাকা নিরাপদ নয়। যে কোন মুহূর্তে হামলা হতে পারে পুলিশের।

রুদ্রাক্ষ ভাবলসে আবার কলকাতায় ফিরে যাবে। কোলকাতা ছাড়া নিজেকে লুকোবার তার আর জায়গা নেই। তবে সবার আগে কুশল মাস্টারকে খবর পাঠানোর দরকার। তিনি যদি ধরা পড়ে যান তাহলে পুরো আন্দোলনটাই মুখ থুবড়ে পড়বে তাদের জেলায়। এল. সি. কলেজের ছাত্রদের জাগাবার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত। এ কাজে তার বিপ্লবী মনোভাব অনেকটা কাজে দিয়েছে। ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠছে আন্দোলন। এবার শুধু জোয়ারের অপেক্ষা। সশস্ত্র বিপ্লবের অপেক্ষা।

মনের জ্বালা মেটাবার এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। শিবনাথবাবু বড়ো দারোগার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, সবাইকে যখন থানার দর্শন দিলেন তাহলে ছোকরা মাস্টারটাই বা বাদ যায় কেন? এই সুযোগ। দেওয়াল লেখার জন্য রাষ্ট্র-বিরোধী কে দিয়ে ফাঁসিয়ে দিন মশাই। সবই তো আপনার হাতে।

ভ্রূ-কুঁচকে সুপ্রিয়বাবু বললেন, ভালো কথা বলেছেন। দেখি কী করা যায়।

কলিং বেল টিপতেই একজন পুলিশ এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালো বড়ো দারোগা বললেন, এক্ষুনি মাস্টারদের মেসে যাও। অমলকান্তিবাবুকে থানায় ডেকে আনো। বলবে–আমি ডেকেছি। আরজেন্ট।

পুলিশটা বেরিয়ে যেতেই শিবনাথবাবু আর সময় ব্যয় করলেন না। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে স্যার, আসি। আবার দেখা হবে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলেন তিনি, ওঃ, একটা কথা ভুলে গিয়েচিলাম। ছোকরা মাস্টারের ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন। কাল আটটার বাসে যাতে চালান যায় সেই ব্যবস্থা করবেন।

থানা শব্দটায় সামান্য হলেও এলার্জি ছিল অমলকান্তিবাবুর। তবু ইচ্ছে না থাকলেও তাকে আসতে হল থানায়। চৈতন্যর-মা তার থানায় যাওয়ার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, হেই মা গো, এ আবার কি অলুক্ষুণে কথা! মাস্টার তো ইস্কুলে যাবে, সে আবার কোন দুঃখে থানায় যাবে? কালে কালে আর কত কি যে দেখবো–তা কৃষ্ণ জানে।

বড়ো দারোগা চশমার কাচ মুছে বললেন, বসুন।

অমলকান্তিবাবু তবু বসলেন না, দাঁড়িয়ে থাকলেন।

এবার চোখ পাকিয়ে বড়ো দারোগাবাবু ধমকে উঠলেন, কথাটা কানে গেল না বুঝি? বড়ো বেয়াড়া তো আপনি?

গায়ে পোকা বসার মতো কথাগুলোকে ঝেড়ে দিয়ে অমলকান্তিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে ডেকেছেন কেন?

–বিনা প্রয়োজনে কাউকে কি থানায় ডাকা হয়?

–বলুন কি দরকার?

-এত তাড়াহুড়োর কি আছে। সব জানতে পারবেন। গোঁফ নাচিয়ে হেসে উঠলেন বড় দারোগা, আপনার নামে কমপ্লেন আছে।

–আমার নামে?

-হ্যাঁ, আপনার নামে। বড়ো দারোগাবাবু থামলেন, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এই যে এত নাটক করলেন ছেলেদের নিয়ে এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল?

–কি বলছেন, কিসের নাটক? আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না। বিস্ময়ে অমলকান্তিবাবুর চোখ কুঁকড়ে গেল।

-ন্যাকামী করবেন না, আপনি সব জানেন। আমার কাছে রিপোর্ট আছে। টেবিলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বড়ো-দারোগা, কাজটা ভালো করেন নি। মানুষ খেপিয়ে আপনার কি লাভ হল মশাই। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। চলুন

-কোথায়?

-শ্রীঘরে। বড়ো দারোগা মুখ বিকৃত করে হেসে উঠলেন, ছিঃছিঃ, আপনাকে মাস্টার বলে ভাবতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। যখন ভেবেছেন জঙ্গি আন্দোলন করবেন, তখন দেশসেবায় এলেন কেন? এসেছেন যখন তখন এর পুরস্কার তো আপনাকে নিতেই হবে, মশাই। গলা ধাক্কা দিয়ে অমলকান্তিবাবুকে ঠেলে ফেলে দিলেন বড়ো দারোগা, টাল সামলাতে না পেরে কঠিন দেওয়ালে মাথা ঠুকে গেল তার।

অসহায় চোখে অমলকান্তিবাবু তাকালেন, আমার অপরাধটা কি জানতে পারি?

-দেওয়ালগুলো আলকাতরা দিয়ে ভরালেন তখন মনে ছিল না? যান কদিন জেলের ভাত খেয়ে আসুন, তখন ঠিক মনে পড়ে যাবে। বড়ো দারোগা হাজতঘরের চাবির বান্ডিলটা একটা পুলিশের দিকে ছুঁড়ে দিলেন, রায়, এটাকে ঢুকিয়ে দাও। মেজবাবুকে বলো পেপার রেডি করতে। কাল যেন সদরে চালান করে দেয়।

ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা থানা ঘেরাও করেও কোনো ফল হল না। হেডমাস্টারমশাই নিজে এলেন বড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। বড়ো বাবু দক্ষ রাজনীতিবিদের মতো বললেন, সরি মাস্টারমশাই, কিছু করা যাবে না। এরা চিনের চেয়ারম্যানকে নিজের চেয়ারম্যান বানিয়ে দিচ্ছে, এদের হয়ে আপনি আর ওকালতি করবেন না। তাছাড়া আমারও চাকরির রিস্ক হয়ে যাবে। ওপরওলার নির্দেশ, আমি তো অমান্য করতে পারি না।

.

২৪.

পরের দিন সকাল আটটার বাসে চালান গেলেন অমলকান্তিবাবু।

খবরটা শুনে সূর্য এসেছিল বাসস্ট্যান্ডে। তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে রঘুনাথ ফিসফিসিয়ে বলল, হায় ভগমান, কার দোষে কে জেল যায় দেখোদিনি। সূর্যাক্ষ চমকে উঠেছিল কথা শুনে, তুই কি বলতে চাইছিস?

রঘুনাথ হাসল, মুহূর্তে টানটান হয়ে দাঁড়াল, ডান হাতের আঙুলগুলো সুর্যাক্ষের সামনে মেলে ধরে বলল, এই দেখ, আমার নখের ভেতর এখুনো আলকাতরার রঙ লেগে আচে। ব্রেতের বেলায় কুশল মাস্টুরের কথা মতন ফটোর মাথাগুলোয় আমি লিজের হাতে আলকাতরা বুলিয়েচি। হা দেখ, ভালো করে দেখ, এখনও শুঁকলে ঘেরাণ পাবি।

সূর্যাক্ষের মুখে কোনো কথা নেই, রঘুনাথের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল চুনারীদের কয়লা-ডিপোর বেড়ার কাছে, চুপ কর। মরবি নাকি? এখানেও টিকটিকি ঘুরছে।

-টিকটিকি? রঘুনাথ নির্বোধ চোখে তাকাল।

সূর্যাক্ষ তাকে সাবধান করে বলল, যা বলেছিস, আর যেন কোনোদিন না শুনতে পাই। এসব কথা বলা মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। জানিস, রুদ্রদা পালিয়েছে। জেঠিমা কত কাঁদছিল। জেঠুকে আমি কোনোদিন এত গম্ভীর দেখিনি।

-তুর দাদা কুথায় গিয়েচে আমি জানি। কথাগুলো বলে রঘুনাথ বোকার মতো হাসল, তুর দাদা গাঙ পেরিয়ে সালারপানে চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা হয়েছিল।

সূর্যাক্ষর মাথাটা যেন কাজ করছিল না এমন ভাবে তাকাল, সেকি রে এর আগে আমাকে তো এসব কথা বলিসনি তুই!

-বলব কী করে? রঘুনাথ প্রশ্নভরা চোখে তাকাল, সেদিন রাত থেকে আমারও কী ছাই মাথার ঠিক আচে? আমিও তো পেলিয়ে পেলিয়ে বেড়াচ্চি। বলা যায় না কখুন কী হয়। এমনিতে কাকার জন্যি আমাদের কতো বদনাম। শেষে আমার জন্যি বদনাম হলে আর কিছু না হোক মা তো গলায় ফাঁস নেবেই নেবে। মাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না বলে দিচ্চি।

সূর্যাক্ষের সাইকেলের পেছনে বসে হলদিপোঁতা অব্দি বাঁধে বাঁধে চলে এল রঘুনাথ। অশোথতলায় এসে সে সূর্যাকে বলল, তোকে যা বললাম-এসব কথা কাউকে যেন বলবি নে ভুল করে। তবে এট্টা কথা সূর্য, তুর দাদাকে আমার বড়ো ভালো লেগেছে। কত জ্ঞানবুদ্ধি ওর। এক এট্টা কথা বলে হাঁ করে তেকিয়ে থাকতে মন চায়। ওর সব কথায় আগুনপোরা।

-রুদ্রদা আর আসবে না। জেঠিমা বলছিল ধরা পড়লে পুলিশ নাকি তাকে গুলি করে মেরে ফেলবে। সূর্যাক্ষের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল।

রঘুনাথ কি বুঝে বলল, এ হতেই পারে না। এটা কি মগের মুলুক নাকি?

-আমি জানি না, তবে সূর্যাক্ষ কথা বলতে পারছিল না। তার দু-চোখ ভরে উঠল জলে, জানিস, অমলকান্তি স্যারের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। স্যারকে থানায় খুব মেরেছে। দেখলি না কেমন চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে। খবরটা শুনে দ্বীপী তো শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। সামনে আমাদের পরীক্ষা। কী ক্ষতি হয়ে গেল বল তো।

–মাস্টুরকে ওরা ধরল কেনে? মাস্টুর তো ওসব দলে ছিলো নি।

–তাহলেই বোঝ, কেমন বিচার। সূর্যাক্ষ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

 রঘুনাথ ওর হাত আঁকড়ে ধরে বলল, তুই বললে আমি এর বদলা নিয়ে ছাড়ব। আমি কাউকে ডরাই না।

-কী করতে পারবি তুই? ভয়ে শুধোল সূর্যাক্ষে।

-খুন করে দিব। রঘুনাথের চোখের তারা কেঁপে উঠল, ভালো মানুষের জন্যি এট্টা-দুটা খুন করতে আমার হাত কাপবে না। তবে খুন করলে জেলে যেতে হবে। মা’টা বড়ো একা হয়ে যাবে। দিনরাত কেনদে কেনদে আমার মাটা মরে যাবে।

পনের দিনের মাথায় পুলিশের জিপ গিয়েছিল কুলবেড়িয়ায়। বড়োবাবুর সঙ্গে ছিল রাইফেলধারী আরও দু-জন পুলিশ। কেসের তদন্ত সেরে ফেরার সময় অঘটনটা ঘটে গেল। মাঝ পথে গাছের গুঁড়ি ফেলে জিপ থামাল কারা। ঝোপের আড়াল থেকে আচমকা শুরু হল গুলির বৃষ্টি। প্রতিরোধের কোনও সময় পেলেন না বড়ো দারোগ। পর পর চারটে গুলি তার ইউনিফর্ম ভেদ করে বুক ফুড়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গের পুলিশ দুটো গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল ঘাসে। প্রতিরোধের সব চেষ্টাই বিফলে গেল হামলাকারীদের অতর্কিত আক্রমণে। দুটো রাইফেল আরে সার্ভিস রিভলভার নিয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল ওরা।

থানা-চত্বরে তিনটে লাশ পৌঁছাতেই ওয়ারলেশে খবরটা ছড়িয়ে গেল চতুদির্কে। এস.পি. এলেন কৃষ্ণনগর থেকে সেই রাতে, সঙ্গে বিশাল পুলিশ বাহিনী। একটা আতঙ্কের পরিবেশ চারদিক জুড়ে।

গুজবের হাজার ডানা।

বাজারে রাষ্ট্র হল মন্ত্রী আসছেন কলকাতা থেকে। খবরটা শোনার পর শিবনাথবাবুর মনের অবস্থা ভালো নেই। একটা ভয় তার ভেতরে কুয়াশার মতো জমতে শুরু করেছে। সেই ভয়ের কথা তিনি মুখফুটিয়ে কাউকে বলতে পারেন না, ভয়টা মাথার ভেতর ঘুঘরো পোকার মতো ঘুরছে। চোখ বুজলেই বিদুর আর কপোতাক্ষবাবুর মুখটা ভেসে উঠছে। ওরা রাহু-কেতুর মতো তার মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে বসে আছে। যদি কোনো বিপদ আসে এদের কাছ থেকেই আসবে। এখন তার মনে হয় অমলকান্তিবাবুকে জেলে পাঠিয়ে তার কোনো ভালো হয়নি, বরং মৃত্যুভয় সর্বদা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কে বলতে পারে দারোগাবাবুর মৃত্যুর পিছনে অমলকান্তিবাবুর কোনো হাত নেই।

এই গ্রামকে তিনি কি আগে চিনতেন? ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলেন শিবনাথবাবু। গলা শুকিয়ে এল তার। হাওয়া বদলের গন্ধটা তিনি টের পাচ্ছেন। এই গ্রামে যদি তাকে টিকে থাকতে হয় তাহলে তার হাবভাব স্বভাব এমন কী কথা বলার ধরন তাকে পাল্টাতে হবে। নাহলে সমূহ বিপদ।

তিনটে ফুলের মালা অসময়ে জোগাড় করতে হিমসিম খেয়ে গেলেন শিবনাথবাবু। বড়োবাবু তার নিকট আত্মীয়র মতো ছিলেন। দায়ে-অদায়ে তার কাছে ছুটে গেলে তিনি খালি হাতে ফেরাতেন না। বড়োবাবুর দাপটের জোরে আজ শিবনাথ বাবুর এত রমরমা।

মন্ত্রী আসার খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছে পুরো গ্রামে। থানার মাঠে ঢল নেমেছে মানুষের, ঠিক যেন চড়কমেলার অবস্থা। সবুজ আর শুভর হাসপাতালে মন ধরল না। অবনীর সঙ্গে ওরাও চলেছে মন্ত্রী দেখতে।

মাধুরী হাসপাতালের গেটের কাছে বলল, তোরা ছেলে। তোরা কত স্বাধীন। বাবা আমাকে যেতেই দিল না। যা রাগ হচ্ছে না বাবার উপর।

শুভ মন খারাপ করে বলল, মন্ত্রী তো রাস্তা দিয়ে যাবে, তখন তুই দেখে নিবি। আমরা ভাষণ শুনে আসব। এসে তোকে সব বলব।

মাধুরী মিষ্টি করে হাসল, সেই ভালো। তোরা তাড়াতাড়ি যা। না হলে দাঁড়াবার জায়গা পাবি না।

সবুজ কষ্ট পাওয়া থেকে বলল, বড় দারোগার ছেলেটা আমাদের ক্লাসে পড়ে। ভাব তো ওর আজ কী হচ্ছে। এ সময় ওর পাশে আমাদের দাঁড়ানো দরকার।

সবুজ ঘাড় নাড়ল। মাধুরী বলল, বিপদের দিনে কেউ পাশে দাঁড়ালে বিপদ অনেকটা হালকা হয়ে যায়। তবে এ তো তুলোচাপা বিপদ নয়, এ হলো পাথরচাপা বিপদ।

-মানুষ নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনে। সবুজ বিজ্ঞের গলায় বলল, বাজারের লোকে বলে বড়োবাবুর মেজাজ ভালো ছিল না। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। খারাপ মানুষরা বেশি দিন বাঁচে না, তাই না?

কোনো উত্তর না দিয়ে মাধুরী ঘাসের দিকে তাকাল।

.

সালার থেকে নতুনগ্রাম পৌঁছাতে বেলা গড়ে গেল। তবু ধানমাঠে চুপ করে বসে ছিল একটা হাঁড়িচাঁচা পাখি। ওর জুড়িটাকে আশেপাশে দেখতে পেল না গুয়ারাম। মন খারাপ হয়ে গেল তার। পথ যত ছোট হচ্ছে ততই দুর্গামণির জন্য মনটা টনটনিয়ে উঠছে তার। ছেলের কথা মনে পড়ছে, বাপের কথা মাঝে মাঝে ঝিলিক মেরে উঠলেও দুর্গামণি যেন মাঝ গঙ্গায় ভেসে ওঠা শুশুক। ওই মুখটা মনে পড়লেই গুয়ারামের হাঁটার গতি ঢিমে হয়ে আসে আপসেই।

ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল, কচার বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে যে শুধোল, গুয়াদা, কী হলো গো তুমার, পায়ে বুঝি বিদনা লাগে?

গুয়ারাম অপ্রস্তুত হাসল, না রে ভাই, পায়ের বিদনা-ফিদনা কিছু না। সত্যি কতা বলতে কি ভাই–আজ তুর বউদির কতা বড্ড মনে পড়ছে। ভাব তো কৎদিন পরে আচ তুর বউদির পাশে গিয়ে শুবো।

-ওঃ! দুলাল হাসতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, তা বটে। উপোসী শরীল বড়ো গঙ্গার বান গো। সব ভেসিয়ে লিয়ে যাবে। তা দাদা, রয়ে-সয়ে খেও। গলায় গাবের বিচি এটকে গেলে বিপদে পড়বে।

–না রে ভাই, সেদিন কি আর আচে? গুয়ারাম রসিকতা করে বলল, কাঠের আগুন এখুন। ধিকিধিকি তুষের আগুন। শরীল যে তেজ দেখাবে তেমন খাদ্যখাবার জোটে কুথায়? শুধু মনের জোরে এ সব কাজ হয় না রে, এর জন্য জোর চাই।

-তা যা বলেচো! দুলাল এগিয়ে এসে বিড়ির ডিবা খুলে গুয়ারামকে একটা বিড়ি আর দেশলাই বাকস এগিয়ে দিল, নাও, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দাও। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া না দিলে মনে তুমার স্ফুর্তি আসবে কোথা থেকে। তা দাদা, বউদি রে বলো-আজ রাতে যেন মুরগি মারে।

গুয়ারাম এবার বিড়ি খাওয়া দাঁত বের করে হাসল। বাবলা গাছের হলুদফুলগুলো তার চোখে মনে হল হলুদগোলাপ। সত্যি, কতদিন পরে আজ দুর্গামণির সঙ্গে তার দেখা হবে। ছেলেটা বড়ো হয়েছে, এখন কি আর এত রঙ্গরস মানাবে তাকে? চুনারামের পাতলা ঘুম। খুট করে শব্দ হলে জেগে ওঠে। গলা খেঁকারি দেয়। তার গলা খেঁকারি জোরে ঘরের কেন পাড়ার লোকেও জেগে ওঠে।

পুরো বিশ জনের দলটা আলপথ ধরে ফেরিঘাটের দিকে চলেছে। আর একটু দেরি হলে মাঝি-মল্লাররা গাঁয়ে ঢুকে যাবে। ডাকাডাকি না করলে তারা আর গঙ্গার ঘাটে ফিরবে না। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনিতে তারা বিধ্বস্ত, ক্লান্ত।

দুলাল এসব কাজে দলের সেরা। পুরো দলটা তার নির্দেশমত পাঁচ মাস চলেছে। যাওয়ার আগে ভূষণীবুড়ি তাকে বলে দিয়েছিল, মিলে জ্বলে থাকবি। বিদেশে পরকে আপন না ভাবলে জান বাঁচে না। বিদেশের ছোট বিপদ ফেঁড়া নয় রে বাপ, কারবল। সামলে না চললে সেই বিপদ তুর মাথায় চড়ে বসবে।

দুলালের বিচার-বুদ্ধি মন্দ নয়। মন্দ না হবারই কথা। দুলাল যে নীলকণ্ঠবাবুর ছেলে একথা কারোর জানতে আজ আর বাকি নেই। তার যে বিচার-বুদ্ধি নজরকাড়া, হৃদয়স্পর্শী হবে এ নিয়ে কারোর কোনো দ্বিমত নেই। এবার চাষের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বৃষ্টি। দুলাল দলের প্রত্যেককে বুঝিয়ে বলেছে, বাবুদের খুশি করা হলো আমাদের কাজ। একাজ তো একদিনের নয়, বাবুদের মন জুগিয়ে চললে একাজ আমরা ফি-বছর পেয়ে যাবো। একটা কথা মনে রেখো-মানুষ থাকে না কিন্তু মানুষের কাজটা থেকে যায় বছরের পর বছর। ফলে তোমাদের উপর হলদিপোঁতা ধাওড়ার সুনাম নির্ভর করছে।

ইন্দুবালার সঙ্গে পুকুয়াড়িতে কুঁড়ে বেঁধে ছিল দুলাল। রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে দিনের আলো ফুটলে চলে যেতে হোত খেতে। মাটি কাজে শরীর মাটি না হলে সোনার ফসল ফলে না।

সত্যসাধনবাবুর ঘরদোর বেশ ছিমছাম এবং গোছানো। এ বাড়ির গিন্নি যে লক্ষ্মীময়ী এ ব্যাপারে কারোর মনে কোন দ্বিধা বা জড়তা নেই। মুনিষদের সঙ্গেও গৃহকর্ত্রীর যোগাযোগ ছিল সব সময়। অন্য জেলা থেকে খাটতে আসা মানুষগুলোর উপর তার টান কিছু মাত্রায় কম ছিল না। প্রায়ই ইন্দুকে ডেকে এটা-সেটা বাড়তি অনেক কিছু ধরিয়ে দিতেন তিনি। নিকট-আত্মীয়ের মতো বলতেন, কিছু দরকার হলে চেয়ে নিও। আমি সব দিন হয়ত খোঁজ নেওয়ার সময় পাব না, তুমি প্রতিদিন এসে তোমাদের ভালো-মন্দ শুনিয়ে যেও।

গরীবদের উপর যার এত টান তার উপর শ্রদ্ধা যে প্রগাঢ় হবে এই তো জানা কথা। একদিন বিকেলবেলায় ঝমঝমিয়ে শুরু হল বৃষ্টি। সত্যসাধনবাবু তখন ঘরে নেই ব্যবসার কাজে গিয়েছেন সালার বাজারে। কালো রঙের মোটর সাইকেলটা তার নিত্যসঙ্গী।

এমন সময় গৃহকর্ত্রী ডেকে পাঠালেন দুলালকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারলেন তিনি। এ কী দেখছেন অবেলায়? মাঠবাবুর জলজ্যান্ত ছবিটা যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ কী চোখের ভুল না কি আলেয়া ধাঁধা? তবু সাহস করে সেই প্রবীণা শুধোলেন, কী নাম গো তোমার?

–আজ্ঞে মা, আমার নাম শ্রী দুলাল চন্দ্র রাজোয়ার।

–কোথায় বাড়ি?

দুলাল নিঃসংকোচে বলল, হলদিপোঁতা ধাওড়ার নাম শুনেছেন, সেখানে। ইটা কালীগঞ্জ থানার মধ্যে।

প্রবীণার চোখের পাতা পড়তে চায় না। শরীর কাঁপছে ঝনঝনিয়ে। ঈশ্বরের কী অপূর্ব লীলা বোঝ দায়। ত্রিশ বছর আগের ঘটনা হুবহু দেখতে পান সুবর্ণা। তখন নীলকণ্ঠবাবুর কণ্ঠলগ্ন ছিলেন তিনি। সুন্দরী হিসাবে মাটিতে পা পড়ত না তার। আর নীলকণ্ঠবাবুও তাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্য বাইরে গিয়ে শান্তি পেতেন না।

সাহেব মাঠে ভূষণীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল নীলকণ্ঠবাবুর। ভূষণী সেদিন থেকে তার নিজের মেঠো-রূপটাকে নীলকণ্ঠবাবুর চোখের ভেতর প্রেম-সোহাগে যত্ন নিয়ে এঁকে দেয়। ছবি আঁকা শেষ হলে ভূষণীর জোয়ার আসা বুকে ঢেউ ভাঙে প্রেমকাতর নীলকণ্ঠবাবু। দয়াল তাকে যা দেয়নি, সেই অমৃতসুখ তার শরীরে রোপণ করে দিলেন নীলকণ্ঠবাবু।

সুবর্ণার এখন পড়ন্ত বেলা। তবু পশ্চিমের রোদ্দুর তাকে উদ্ভাসিত করে তোলে আজও। অস্তমিত যৌবনের অন্তিমচ্ছটা তাকে আলোকিত করে কখনো-সখনো। এখন তার কণ্ঠস্বরে সেই উন্মাদনা নেই, ঢিলেঢালা শরীরে বার্ধক্যের শেকড় ঢুকে গিয়েছে। স্থিতু হওয়া মনটা এখন পিছন ফিরে তাকায় বারবার।

সত্যসাধনবাবুকে তখন ব্যবসার কাজে প্রায় যেতে হত কৃষ্ণনগরে। সুবর্ণার দাদাদের সঙ্গে ছিল তার ব্যবসায়িক আত্মীয়তা। বাজার থেকে সম্পর্কটা একদিন ঘরে এসে নোঙর করল।

কথায় কথায় সুবর্ণা জানতে পারলেন প্রায় দু-বছর অতিক্রান্ত হয়েছে সত্যসাধনবাবুর পত্নীবিয়োগ। প্রসবের সময় চিকিৎসা বিভ্রাটের জন্য স্ত্রী এবং তার পেটের সন্তানকে হারালেন সত্যসাধনবাবু। চলতি ব্যবসা মাথায় উঠল শোকে। সেই শোক কাটাতে দু’বছর কোথা দিয়ে যে পালিয়ে গেল! সত্যসাধনবাবুকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেল সুবর্ণার। তার পুরুষালী চেহারার মাদকীয় আকর্ষণ পুরুষ্টো সেগুনকাঠের চেয়েও আভিজাত্যময়। নীলকণ্ঠবাবু তখনও ফেরার, তিনি যে আর ফিরবেন না এ বিষয়ে একরকম নিশ্চিত ছিল সুবর্ণা।

দাদাদের অনুমতি নিয়ে তাদের ভাঙা জীবন আবার বিয়ের পিঁড়িতে পূর্ণতার আস্বাদন পেল। বিগত বত্রিশ বছর সালারের এই বাড়িটাতে আগলে কিসের মোহে পড়ে আছেন তিনি। সত্যসাধনবাবু তার কোন সুখের অভাব রাখেননি, শুধু সন্তানসুখ ছাড়া আর সব কিছু কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন সুবর্ণা বয়স্কাদের দলে। তবু তার মনটা সেই প্রথম যৌবনের কথা ভেবে প্রায়ই কঁকিয়ে ওঠে।

সময় চলে যায় কিন্তু স্মৃতি কেন পিছু ছাড়ে না! নীলকণ্ঠবাবুকে আজও, এই বয়সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পান তিনি। ভূষণীর সঙ্গে তার শুধু একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। সেদিনের সেই ভূষণীর মুখটা এখনও কি দেখতে পাচ্ছেন তিনি? সুবর্ণার চোখের তারা কেঁপে উঠল। চোখের উঠোন জলবাহী মেঘের হঠাৎ বৃষ্টিতে স্নাত হলো যেন।

দুলালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন তিনি। তার মাথা টলছে, হারিয়ে যাচ্ছে পায়ের জোর। আর একটু হলে গোড়াকাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়তেন তিনি, দুলাল গিয়ে তাকে দু-হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল।

-মা, আপনার কি শরীল খারাপ করচে? বাবুরে কি খপর পাঠাব? ও মা, কথা বলুন গো। আমার ভেষণ ভয় করছে। দুলালের আকুলতায় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন সুবর্ণা। অস্ফুটে বললেন, বাবা দুলাল, আমি তোমার মা হই গো, তোমার এই মাকে মনে না থাকারই কথা। তুমি তখন ছোট, আমি তোমাকে দেখতে গিয়েচিলাম হলদিপোঁতায়। সেদিনের কথা তোমার মনে থাকার নয়, তবে বাবা তোমার আসল মায়ের এসব কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। সে আমার সতীন, তবু তার জন্য আমার মন বড়ো কাঁদে। আমরা কেউ-ই মানুষটাকে পেলাম না! শুধু কামড়াকামড়ি করে মরলাম। আজ শেষবেলায় এসে বুঝতে পারছি–যৌবন সব নয়, যৌবনের ওপরে বুঝি সম্পর্ক।

ইন্দুকে দুলাল কথাগুলো বলতেই মুখ শুকিয়ে গেল ওর। অনেক ভেবে বলল, আত্মীয়ঘরে খাটবা, তুমার লাজ লাগবে না? তাছাড়া ওরাও তো তুমার কাছে কুঁকড়ে থাকবে। এভাবে কি কাজ হবে গো? লোক জানাজানি হওয়ার আগে আমাদের এ গা ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার।

–মেয়েমানুষটা বড়ো ভালো গো! দুলালের চোখে থৈ-থৈ করে শ্রদ্ধা।

–সে তো সব বুঝলাম। কিন্তু ইন্দুবালার মন সায় দিচ্ছিল না।

দুলাল বলল, তুমার মন না চাইলে আমি ইখানে ভাগাড়ের শকুনের মতো পড়ে রইবোনি। দু’জনা একসাথে এসেছি, যিখানে যাবো একসাথে যাবো। সারারাত ঘুমাতে পারেনি দুলাল। প্রথম মোরগ ডাকার আগে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। ইন্দুবালাকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, চলো গো, আর দেরি করা যাবে না। যা আচে-তল্পিতল্পা সব বেনধে নাও। এখানে সুখের ভাত গলায় কাঁটার মতন বিধবে। চলো, সময় থাকতে পালাই…।

বাঁকের দু-দিকে পুরো সংসার। দুলাল আগে, ইন্দুবালা তার পিছু পিছু হাঁটে। একসময় হাঁপিয়ে উঠে বাঁকটা নামায় দুলাল, ঘষটে যাওয়া কাঁধ রগড়ে নিয়ে বলল, সম্পর্ক হলে গিয়ে এমন লতা যারা কুনো মরণ নাই গো! কত সম্পর্ক মরে যায়, সেগুলো কি ঠিক মরে গো?

দুলালের চোখে সংসারের আলো চিকুর কেটে গেল।

গুয়ারাম পোড়া বিড়িটা ফাঁকা ধানমাঠে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, কী রে দুলাল, নেতিয়ে গেলি যে, তুর পা বুঝি আর চলচে না।

দুলাল থতমত খেয়ে তাকাল, তার চোখে তখনও তার দ্বিতীয় মায়ের ছবি শচীমাতার মতো পুত্ৰবিরহে আকুল হয়ে কাঁদছে। কে তাকে সান্ত্বনা দেবে? দুলালের এত মনের জোর কোথায়? সে তার বাপের মতো বরাবরই আবেগী। অন্যমন সহজে তার মন ছুঁয়ে যায়। এ-ও এক জীবনজোড়া রোগ। এ রোগ যার ভিতরে রয়েছে তার আর বাঁচা নেই।

ফেরিঘাটে এসে নৌকোর উপর বাঁক নামাল দুলাল। আসার সময় মায়ের পা ছুঁয়ে এলে মনের ভারটা নির্ঘাৎ কমত। তা যখন হয়নি তখন তাকে স্মরণ করে একবার অনন্ত প্রণাম করা দরকার।

দুলাল নৌকা থেকে বড়ো গঙ্গার বুকে হাত রাখল। এমনি একটা আনন্দঘন শিরশিরে ভাব উঠে এল তার শরীরে। এত বছর আগের কথা স্পষ্ট তার মনে পড়ে না। তবে ভূষণীবুড়ির মুখে বারবার শুনেছে মাঠবাবুর নামটা। ওই নামটা আউড়ানোর সময় ভূষণীবুড়ি নিমেষে হয়ে যেত মানিকডিহির বড়ো গাঙ। হাজারবার নীলকণ্ঠবাবুর কথা বললেও ভূষণীবুড়ি একবারও সুবর্ণার কথা বলেনি। তবে কি মায়ের কোনো গোপন রাগ আছে তার উপর?

রাগের কথা মাঠও জানে না, আকাশও জানে না।

নৌকো দুলে ওঠে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ জল-সোহাগের শব্দে। এই শব্দ যেন জাগিয়ে তোলে নীলকণ্ঠবাবুর হাসি। সাহেবমাঠে মাঠবাবু মাজা সোজা করে হেঁটে যাচ্ছেন। জমিতে তার সচলছায়া। সেই ছায়ার ভেতর দুলাল খুঁজতে থাকে নিজেকে।

গত পাঁচমাসে শুধু বুড়িগাঙের জলছাড়া আর সবকিছু যেন বদলে গিয়েছে গুয়ারামের চোখে। সাহেব মাঠের আখগাছগুলো হিলহিল করে নড়ছে, এ বছর আখের চাষ এত বেশি যে টাইম মতো আখ পৌঁছানোর শিপ পাচ্ছে না চাষীরা। গুয়ারামের সব চাইতে ভালো লাগে অশ্বত্থতলায় দাঁড়ালে। খোলা হাওয়ায় অশ্বত্থের ঢ্যাঙ্গা পাতা কোমর দুলিয়ে নাচছে।

ঘরে ফেরার আনন্দটা কাউকে বুঝি বলে বোঝানো যায় না। ঘরের মানুষটাকে দেখার পর মুখভার করে আছে দুর্গামণি। সে তার খুশিটাকে জিইয়ে রেখেছে বুকের ভেতর। চুনারাম তখন থেকেই ফটর ফটর করছে। ওর যেন কথার শেষ নেই। পুরো পাঁচমাসের জমানো কথা একেবারে উগরে দিয়ে নিস্তের পেতে চায়।

দুর্গামণি অনেকক্ষণ পরে লাল চা নিয়ে এল কাচের গ্লাসে, নাও, খেয়ে নাও। চা খেলে গা-হাত-পায়ের বিদনা কমবে।

গুয়ারাম দীর্ঘসময় ধরে বউয়ের দিকে তাকাল, পুরনো বউ তবু মনে হল এই সবে দুর্গামণি বউ হয়ে ঘরে এল। চোখের পাতা জুড়ে গুনগুনিয়ে উঠল ভ্রমর। দুর্গামণি লজ্জা পেল কেননা সে এই চাহনির অর্থ বোঝে। আজ সারারাত মানুষটা তাকে ঘুমোতে দেবে না। এই ভাবনায় সুখের পানসিটা দাঁড় বেয়ে চলে গেল বহু দুরে। দুর্গামণির সারা গা শিরশিরিয়ে উঠল, বুক দুটো যেন কুঁকড়ে কুঁচকে শামুকের মতো লুকাতে চাইল নিজেকে। ভেতরের এই বাঁধ ভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাস দুর্গামণি কারোর কাছে প্রকাশ করবে না। এমনিতে তার চাপা স্বভাব। গুয়ারামের তালে তাল মিলিয়ে সে চলতে পারে না।

গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ জোরে রসনাতৃপ্তির শব্দ করল গুয়ারাম, তারপর মুখ তুলে মুগ্ধ গলায় শুধোল, ছেলেটা কুথায়, তারে তো দেখচি নে?

-সে কি ঘরে থাকার ছেলে? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল দুর্গামণি, ভূষণীবুড়ির জ্বর যে ছাড়ছে না, তারে লিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে।

ভূষণীবুড়ির অসুখের খবর শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল গুয়ারামের, বয়স হলে মানুষের আর রোগজ্বালা ছাড়তে চায় না। দুলাল এয়েচে এদদিন পরে, মাকে ঘরে না দেখলে তার মনটা কি হবে বলো তো?

-সে তো বুঝচি কিন্তু? দুর্গামণি কিছু বলতে গিয়ে থামল।

 গুয়ারাম তাড়া লাগিয়ে বলল, থামলে যে, কি বলছিলে বলো?

-দুলালের মায়ের মনে হয় কঠিন অসুখ হয়েচে। দুর্গামণি আমতা আমতা করে বলল, জ্বর সেই কবে থিকে হয়েছে, আর ছাড়ছে না। রঘু বলল, দরকার হলে কেসনগর লিয়ে যাবে। গোস্বামীপাড়ার কপোবাবু চাঁদা উঠিয়েচে।

–তাহলে তো আমার সিখানে একবার যাওয়া দরকার।

দুর্গামণি তাকে বাধা দিয়ে বলল, যা করার রঘুই করবে, তুমার আর গিয়ে কাজ নেই। ডাল-ভাত বেঁধে দিচ্ছি, খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ো।

আলুমাখা, কলাইডাল আর বড়িভাজা করেছে দুর্গামণি।কাঁচা সরষে তেলের গন্ধটা জড়িয়ে গেছে গরম ভাতে। ঘরে লঙ্কা ছিল না, দুর্গামণি ডিবরি নিয়ে গিয়ে বেড়ার ধারের গাছটা থেকে লঙ্কা তুলে নিয়ে এল। কাঁচা লঙ্কা চটকে গরম ভাত খাওয়ার অভ্যাস গুয়ারামের দীর্ঘদিনের। ভাতের সঙ্গে বিরিডাল জড়িয়ে গেলে স্বপ্নের এক সুষমখাদ্য তৈরি হয়। দুর্গামণি আগে থেকে সব যেন জানত, তাই ব্যবস্থা করে রেখেছিল আগাম।

খাওয়ার পরে বাপ আর ছেলে মুখোমুখি বসে বিড়ি ফুঁকল তারিয়ে-তারিয়ে। বিড়ির সুতোর কাছে আগুন আসতেই হাই তুলে চুনারাম বলল, নিদ লাগচে, ইবার আমি শুয়ে পড়ব।

গুয়ারাম বলল, তুমি দোক্তা খেতে ভালোবাসো, তুমার জন্যি দোক্তাগুণ্ডি এনেচি-লিবা না?

 চুনারাম হাসল, রেখে দে, কাল সকালে নিব।

শীত হাওয়ায় অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল চুনারামের। ফিসফিস কথাগুলো কানে ভেসে এল বুড়ার। দুর্গামণি খিলখিল করে হাসছে। গুয়ারাম টিয়াপাখির মতো কি যেন বলছে বউটার বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে। ডিবরির আলো এসে পড়েছে মাটির দাওয়ায়। দুর্গামণি অনেকক্ষণ পরে মুখের ঘাম মুছে বলল, এবার শীত লাগচে, কপাটটা ভেজিয়ে দাও।

গুয়ারাম আবার হুমড়ে পড়ল দুর্গামণির খোলা বুকে, থুতনি ঠুসে ধরে বলল, আমার কাছে জাড় খেদাবার মেসিন আছে।

-সে আমি জানি। আর বাহাদুরী করো না। এবার ঘুমোও। দুর্গামণির সতর্ক কথায় জেদ বেড়ে গেল গুয়ারামের, দু-হাত বাড়িয়ে দুর্গামণিকে বুকের কাছে টেনে এনে বলল, জাড়ের দিন শেষ হল বলে, ইবার তুর-আমার দিন শুরু হবে।

কথার ওমে বয়স বাড়ে রাতের।

.

২৫.

লাইন থেকে ফিরে এলে দুলুর শরীর আর চলতে চায় না। পা দুটো ভারী হয়ে থাকে সব সময়। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে তখন কথা বলার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেই বুঝি ভালো হত।

বাস স্ট্যান্ডে নেমে সরাসরি বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল দুলু। স্যাকরা দোকানে মানোয়ারাকে দেখতে পেয়ে তার যে কী হল সে যেন হাঁটাচলার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলল। বুকের গভীর থেকে কুয়োর জল চুয়ানোর মতো চুয়াতে লাগল দুঃখ।

এখন মানোয়ারাকে দেখলে তার পুরো দুনিয়াটা ফাঁকা লাগে। কোনো মতে হিসাব মেলে না কেন এমন হল তার জীবনে। এ পাড়ায় সাদাত আছে বহুদিন, অথচ কোনোদিন মানোয়ারা তার দিকে তাকায়নি। হাত কাটার পর তার যে কী হল সেই জটিল হিসাবটা মেলাতে পারছে না দুলু। বারবার ভার হয়ে আসে চোখ, টলটল করে জল।

বাজারের দিকে এগোতে গিয়ে আর এগোতে পারে না দুলু। কাপড় দোকানের পাশ থেকে সে দেখতে থাকে মানোয়ারার হাবভাব। সাদাত তাকে মনের মতো করে রেখেছে। মোকামপাড়ায় সাদাতের চাটাইয়ের ব্যবসা। প্রায় জনাকুড়ি মানুষ তার হয়ে চাটাই বানায় রোজ। বাঁশ-বাখারি সব সাদাতের। মানুষগুলো শুধু বুনে দিয়ে খালাস।

লরি ভর্তি হয়ে চাটাই যায় রানীগঞ্জ, আসানসোল, দুর্গাপুর, চিত্তরঞ্জন। ওদিকে বাঁশষ্ঠাচারির চাহিদা প্রচুর। মহাজনরা চাটাই কিনে খনি-অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়। এ ব্যবসায় ধার-বকি নেই, প্রথম থেকে নগদা-নগদি কারবার। ট্রাক বোঝাই চাটাই নিয়ে গেলে পকেট বোঝাই টাকা আনে সাদাত। এভাবেই প্রায় সাত বছর ধরে তার ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। মোটা টাকা ব্যাঙ্ক আর পোষ্টাপিসে সুদে বাড়ছে তার।

দুলু দূর থেকে দেখল মানোয়ারা সোনা দোকানে বসে আছে দেবী হয়ে। বিয়ের পরে ওর রূপ যেন ফেটে বেরচ্ছে। যৌবনপ্রভা রাধাচূড়া ফুলের চেয়েও উজ্জ্বল। তাকালে আর চোখ ফেরাতে পারে না দুলু। মানোয়ারাকে মনে হয় স্বপ্নদেশের রাজকন্যা। এই মেয়ের সঙ্গে একসময় তার জানাশোনা ছিল একথা এখন আর মানতে চায় না মানোয়ারা। তার ঠোঁটের হাসি সোনার হারের উপর গড়িয়ে পড়ে আরও উজ্জ্বল দেখায়। মানোয়ারার জন্য চা এনেছে দোকানদার। গোল বিস্কুটে কামড় দিয়ে মানোয়ারা দেবীর হাসি হাসছে। সে যত হাসছে তত বুক ভেঙে যাচ্ছে দুলুর। মনের ভেতর ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে হঠাৎ উদয় হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের মতো।

দুলু ভাবছিল অন্য কোনো ছেলে হলে মানোয়ারাকে খুন করে দিত। নিদেনপক্ষে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারত তার গালে। কুৎসিৎ করে দিত সুন্দর মুখের ভুগোল।

দুলু পারেনি। এই না পারাটা তার অক্ষমতা। দুর্বলতা। মানোয়ারাকে সে ইচ্ছে করেই জিতিয়ে দিয়েছে। প্রেমে জোর খাটেনা। প্রেম সেই আজব লেবু যা কচলালে তেতো হয়ে যায়।

দুলু বাঁ হাত দিয়ে চোখের কোণ মুখে নিল। এই স্যাকরা দোকান থেকে সে মানোয়ারাকে রূপোর হারছড়া কিনে দিয়েছিল। সেদিন খুশির ঈদের চাঁদের মতো জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছিল মানোয়ারার হাসি দুলু সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলেছিল, তুমার হাসিটার দামই লাখ টাকা। আল্লাতালা হাসি বিলোবার জন্যি তুমাকে পেঠিয়েছে।

গালে টোল পড়লে মানোয়ারা বেহেস্তের ফরিস্তা। দুলু তখন ওর মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। গলা কাঁপে আবেগ জ্বরে, তুমার জন্যি আমার এই জান বাজি রইল। কবে মরে যেতাম গো যদি না তুমি আমার পাশে থাকতে।

মানোয়ারা আহ্লাদী হয়ে উঠত কথা শুনে, স্ফুরিত অধর নাচিয়ে বলত, আমার জন্ম হয়েছে শুধু তুমার দেখভাল করার জন্যি। তুমি আমার আকাশ গো। তুমার ছায়া থিকে আমাকে খেদিয়ে দিও না কুনোদিন।

মানোয়ারাকে তাড়িয়ে দেয়নি দুলু, মানোয়ারাই চলে গেছে স্বেচ্ছায়। বড়োগাছে হাঁড়ি বেঁধেছে সে। রসে ভরে উঠছে তার ঠিলি। নুরি বেগমের বহুগামিতা স্বভাবটা কী করে যেন ঢুকে গিয়েছে মানোয়ারার ভেতর। শুধু রূপভাঙিয়ে শরীর দেখিয়ে দিন চলছে তার। চাঁদ মহম্মদের ঘরে মানোয়ারা এখন আর আসে না। কেন আসবে? দেখা হলে চাঁদ মহম্মদ টাকা চায়। সাদাতের কাছে মেয়েকে এক প্রকার বিক্রি করে দিয়েছে সে।

ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে এক গোছা টাকা দিয়ে সোনার দোকান থেকে বেরিয়ে এল মানোয়ারা। রূপোর হার খুলে সোনার হারটা পরে নিয়েছে সে। গায়ের রঙের সাথে মিশে গেছে সোনা। দুল তখনও হাল ছেড়ে দেয়নি। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে মানোয়ারার দিকে। চোখে চোখ পড়লে যদি হেসে ওঠে মানোয়ারা।

চোখে চোখ পড়ল কিন্তু হাসল না মানোয়ারা। বাসি মেটের মতো ঠোঁটের রঙ করে সে কটমটিয়ে তাকাল। ঘাবড়ে যাওয়া দুলু এই মানোয়ারাকে চিনতে পারে না। কত দ্রুত মানুষ বদলে যেতে পারে। এর ব্যাখ্যা তার জানা নেই। মানোয়ারা এখন সমস্ত ব্যাখ্যার উর্ধ্বে।

সাদাতের সঙ্গে হাজারদুয়ারী দেখতে গিয়েছিল সে লালগোলা ট্রেনে চেপে। ফেরার সময় বেলডাঙার কাছে মানোয়ারা আর সাদাতের সঙ্গে দেখা হল দুলুর। দুলুর হাতে তখন গুপিযন্ত্র, পায়ে বাঁধা ঘুঙুর তোড়া। দুলু গলা কাঁপিয়ে গাইছিল : পীরিতি চাল কুমড়োর বিচি/ও নারী কাদিস মিচিমিচি। ডালের বড়ি ঝোলে দিলে গলে গলে পড়ে। সে বড়ির সুয়াদ ভালো, রাতে খাটিয়া নড়ে। গানটার শেষের দিকের কথাগুলো কানে যেতে লজ্জা পায় মানোয়ারা। সাদাত ঠোঁট টিপে টিপে হাসে। যাত্রী চেঁচিয়ে বলে, ও ভাই, রসের গান আর এট্টা হোক। দুলুর উৎসাহে ভাটা পড়ে না, সে গায়; বনের মধ্যে সিংহ রাজা, বনের বাইরে আমি/যতই খাও বাইরে বাতাস, আমিই তুমার স্বামী। গান শেষ হল, পয়সাও পেল দুলু। কিন্তু যার জন্য গান গাওয়া, সে মুখ ফুটিয়ে টুঁ শব্দটিও করল না। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল তার। মানোয়ারা তবু প্রতিক্রিয়াহীন। হাঁ করে সে চেয়ে আছে বাইরের দিকে। ট্রেন চলছে শেয়ালদামুখো কু ঝিকঝিক।

সেদিন ট্রেন থেকে নেমে দেবগ্রামে দুলু দেখতে পেয়েছিল ভূষণীবুড়িকে। জ্বরে ভুগে কাঠি হয়ে গিয়েছে তার দেহ। কথা বলার ক্ষমতা নেই, শুধু চিঁ-চিঁ শব্দ। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দুলাল এগিয়ে এল তার সামনে। তার পেছনে দাঁড়িয়েছিল রঘু। সে সামনে এসে বলল, যাক, দুলালকাকা ফাড়া কেটে গেল। ঠিক সময়ে এসেছিল দুলাল, না হলে মাকে ফিরিয়ে আনা তারপক্ষে সম্ভব হত না।

রঘুনাথকে এ ব্যাপারে সাবাশ দেয় দুলাল। কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, যা কামিয়ে এনেছিলাম সালার থেকে তা সব চলে গেল।

-মা বেঁচে থাকলে অমন টাকা ঢের হবে। রঘুনাথ জোর গলায় বলল, মায়ের মতন সম্পত্তি আর আছে নাকি গো? ও পয়সা-কড়ি নিয়ে খামোখা ভেবো না। দুলাল চুপ করে কথা শুনছিল রঘুনাথের। শুধু লম্বায় বাড়েনি ছেলেটা, তার মগজও বেড়েছে শরীর বাড়ার সাথে সাথে।

কৃষ্ণনগর স্টেশনে সুবর্ণার সঙ্গে দুলালের যে দেখা হবে তা সে নিজেও জানত না। প্যান্ট-শার্ট পরা একজন এসে তাকে বলল, এ ভাই, তোমাকে ওই ভদ্রমহিলা ডাকছেন।

চোখ ঘোরাতেই ধাক্কা খেয়েছিল দুলাল। সুবর্ণা স্টেশনের শেডের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন লোক্যাল ট্রেন ধরার জন্য। দুলালের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি, কি ব্যাপার তুমি এখানে?

-মা হাসপাতালে ভর্তি ছিল, আজ তাকে ঘর লিয়ে যাচ্চি।

–কই তোমার মা? সুবর্ণা চঞ্চল হয়ে উঠলেন চোখের পলকে।

ভূষণীবুড়ি সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসেছিল। বসে থাকারও ক্ষমতা ছিল না তার। দুর্বলতায় চোখ ঢুকে গিয়েছে কোটরে। হনুহাড় জাগানো মুখ। বয়স শুধু যৌবন খায় না, আয়ুও খায়। তার প্রমাণ এখন সে।

ভূষণীবুড়িকে চিনতে সুবর্ণার প্রথমে কষ্ট হয়। সেই সুশ্রী মুখটাকে তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ান। সময়ের পলি জমেছে ভূষণীর চোখে মুখে। সে এখন আর শুধু মহিলা নেই, বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছে।

সুবর্ণা তার পাশে গিয়ে ফাঁকা জায়গাটায় বসল, আঙুল দিয়ে ঠেলা মেরে বলল, আমাকে চিনতে পারছো?

চোখ রগড়ে অনেকক্ষণ ধরে সুবর্ণাকে দেখল ভূষণী, শেষে চিনতে না পেরে আফসোসের সঙ্গে বলল, কে বটে গো তুমি?

-মাঠবাবুকে মনে আছে তোমার? সুবর্ণা ধার ছুরি ছুঁড়ে দেওয়ার মতো প্রশ্ন করল। চোখ রগড়ে নিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকাল ভূষণীবুড়ি, ফোকলা মাড়ি দেখিয়ে হাসতে গিয়ে সহসা গম্ভীর হয়ে গেল সে, এখুন আর চোখে ভালো দেখতে পাই না। চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে। ওপরওলা ইবার দয়া করলে বাঁচি গো!

সুবর্ণা ভূষণীবুড়ির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে এসে ধরে থাকলেন অনেকক্ষণ, তারপর বিড়বিড় করে বললেন, তোমার সাথে যে আবার দেখা হবে ভাবিনি। দুনিয়াটা গোল। তাই দেখা হয়ে গেল

ভূষণীবুড়ির কথা বলার ক্ষমতা নেই। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। দুলাল কথা শোনার জন্য ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। রঘুনাথ তাকে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলে হাঁ করে ওদের দু জনের দিকে তাকাল।

মানোয়ারাকে নিয়ে সাদাত লেবেল ক্রশিং গেট পেরিয়ে চলে গেল বটতলার দিকে। ওদের পেছন পেছন যাওয়ার কোনো ইচ্ছে হল না দুলুর। মানোয়ারা আজ তাকে যা দুঃখ দিল, সেই দুঃখের কথা সে কারোর কাছে মুখ ফুটিয়ে বলতে পারবে না। মানুষ এত বদলে ফেলে নিজেকে? নিজেকে বদলে ফেলা সহজ নয়। অথচ মানোয়ারা দিব্যি তা পেরে গেল। সাদাতকে সে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। না হলে সাদাতই বা কেন মুখে কুলুপ আঁটবে?

একই গায়ে ছোট থেকে মানুষ, অথচ কেউ কাউকে চিনল না–এই কষ্ট হাজার চেষ্টা করলেও মিলিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। দেবগ্রামের মোড় থেকে কালীগঞ্জে যাবার বাস ধরবে ওরা। বাসেও দেখা হবে ওদের সঙ্গে।

রাগে ক্ষোভে মাথাটা ঝিনঝিন করছিল দুলুর। বাপের জন্য তার একটা পাউরুটি কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা। এই সামান্য কাজটাও ভারী ঠেকছে তার কাছে। একটা মেয়ে তার জীবনটাকে এভাবে জ্বালিয়ে দেবে, ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দেবে সে ভাবতে পারছিল না।

নিজেকে শক্ত করার কোনো কৌশল দুলুর জানা নেই। যদি তা জানা থাকত তাহলে কঠিন বর্মের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলত সে। হাজার কষ্ট হলেও আর কখনো মানোয়ারার মুখের দিকে তাকাত না সে। কী আছে ওই হারিয়ে যাওয়া মুখে? হারিয়ে যাওয়া মনগুলো দুঃখের খনি, মুখগুলো দোজকের গুনাহ।

কদিন থেকে শরীরটা ভালো নেই দুলুর। শরীর ভালো না থাকলে ট্রেনের কামরায় গান গেয়ে বেড়ানো খুব ঝুঁকি হয়ে পড়ে। গেল রোববার রানিং-ট্রেনে উঠতে গিয়ে বাঁ হাতটা পিছলে যাচ্ছিল দুলুর। ভাগ্যিস পাশের হকারটা তাকে ধরে ফেলে না হলে সেদিনই তার শরীর ট্রেনের চাকায় পিষে গিয়ে অক্কা পেত। এই অন্যমনস্কতার পেছনে পরোক্ষভাবে মানোয়ারার হাত রয়েছে। ভুলব ভুলব করেও তাকে যে কিছুতেই ভুলতে পারছে না দুলু। ভোরবেলায় সাদাতের ট্রাক ছেড়ে গেল আসানসোলের দিকে। এখন চার-পাঁচ দিন গ্রাম ছাড়া হয়ে থাকবে সাদাত। চাটাই ব্যবসায় কাঁচা টাকার মুখ দেখা গেলেও বেশির ভাগ সময় থাকতে হয় ঘরছাড়া। মানোয়ারা মানিয়ে নিয়েছে এসব। পুরুষমানুষকে ঘরে আটকে রাখলে চলবে না। সংসারের উন্নতির জন্য টাকা চাই। তা ছাড়া মানোয়ারা এখন আর একা নেই। সাদাতের সন্তান তার গর্ভে বাড়ছে। আর ক’মাস পরে তারা দোকা থেকে হয়ে যাবে তিনজন। মানোয়ারার সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে তখন।

ভোরবেলায় চাটাইয়ের আড়ত অবধি এসেছিল মানোয়ারা। সাদাতের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল, সাবধানে যেওক্ষণ। টেইম মতন ধাবার হোটেলে খেয়ে নিও। তুমি না ফেরা পর্যন্ত আমার চোখে নিদ আসবে নি।

শাদীর পর থেকে রাতের ঘুম প্রায়ই চটকে যায় মানোয়ারার। সাদাতের কোনো সময় জ্ঞান নেই। ওর মন চাইলেই মানোয়ারাকে জাগিয়ে দিয়ে শরীরী খেলায় মেতে উঠবে। বাধা দিতে গিয়ে পলকা বাঁশের মতো ভেঙে পড়ে মানোয়ারা। এই আত্মসমর্পণের খেলায় এত যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে আগে জানত না মানোয়ারা, এখন ভালো লাগার রেণুগুলো তাকে সুখী মানুষের মতো তিল তিল যত্ন নিয়ে সাজায়। সাদাত ঘরে না থাকলে সময় কাটতে চায় না মানোয়ারার। কতক্ষণ আর রেডিও শুনে সময় কাটাবে সে। পাড়া ঘোরার অভ্যাস নেই তার।

সাদাতের পথ চেয়ে পাঁচটা দিন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়। শেষের দিনগুলো আর কাটতে চায় না মানোয়ারার। জামাই ঘরে না থাকলে মেয়ের টানে চাঁদ মহম্মদ দু-একবার দেখা দিয়ে যায় মানোয়ারাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে মানোয়ারার কোনো হেলদোল নেই। বাপের উপর পুরো আগ্রহটা হারিয়ে ফেলেছে সে।

চাঁদ মহম্মদ অভাবী মানুষ। সাদাতের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা সে বাগিয়ে নিয়েছে মানোয়ারাকে বাজী রেখে। এই খবরটা জানার পর মাথাটা গরম হয়ে আছে মানোয়ারার। বাপকে সে কথা শুনিয়েছে মনের ঝাল মেটাবার জন্য। সাদাতের টাকা তো এখন তার টাকা। এ টাকা নয়-ছয় করা যাবে না। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে সামলে রাখার জন্য টাকার যে কত প্রয়োজন সে এর আগে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ঘর খরচের জন্য রোজ তাকে যেতে হত পাল কোম্পানীর আটা চাকিতে। দুলু তাকে হাতে তুলে যা দিত তাতেই তার সংসার চলত কোনোমতে। সেই সব কষ্টের দিন আজও মনে পড়ে তার। বাপের উপর রাগটা তাই সে আর চেপে রাখতে পারে না। ওই কুঁড়ে মানুষটাকে দেখলে তার মাথায় যেন বিছে কামড়ে দেয়।

ভোর ভোর সাদাতের ট্রাক মোকামপাড়ায় ঢুকে যাওয়ার কথা। দু-এক ঘণ্টা দেরি হলে অস্থির হয়ে ওঠে মানোয়ারা। সে ঘর-বার করতে থাকে। মনে কতরকমের চিন্তা এসে উদয় হয়। আসানসোল অনেক দূরের পথ। দুর্গাপুর পেরিয়ে আরও যেতে হয় অনেকটা।

সাদাতের মুখে গল্প শুনেছে সে ওদিকটার পুরো খনি এলাকা। প্রায়ই ধস নামে গ্রামে। খনির ভিতর আগুন জ্বলে ওঠে কখনও বা। কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় ভরে থাকে আকাশ। জায়গাটা রুক্ষ্ম হলেও প্রাণের স্পন্দন আছে সেখানে।

আসানসোলের বাজার থেকে মানোয়ারার জন্য একটা গোলাপী রঙের শাড়ি কিনেছে সাদাত। এবার ঈদের শাড়িটা মানোয়ারার পছন্দ হয়নি তেমন একটা। দেবগ্রামের বাজারে ভালো শাড়ি খুব কম পাওয়া যায়। বহরমপুর মুর্শিদাবাদ গেলে হয়ত মনের মতো শাড়ি পাওয়া যেত। মানোয়ারার শরীর সাথ দিল না। ঈদের বাজার দেবগ্রাম থেকে সারতে হল তাকে। সেই থেকে সাদাতের মনে মনে একটা ইচ্ছে ছিল সুযোগ পেলে সে মানোয়ারার জন্য একটা ভালো শাড়ি কিনে আনবে। মেয়েদের মন পেতে গেলে শাড়ি গয়নার প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না।

পাকা গমের মতো মানোয়ারার গায়ের রঙ। হাসলে সেই রঙের সাথে মিশে যায় গোলাপী আভা। পুরো মুখটা তখন গোলাপের চেয়েও সুন্দর হয়ে ওঠে। মানোয়ারার এই রূপটাই দু’চোখে আঁকা হয়ে আছে সাদাতের। নুরি বেগমের পুরো মুখটাই যেন মানোয়ারার মুখে বসানো। যৌবনে নুরি বেগমের দিকে তাকালে অনেক হাজী-কাজীর বুকে শুরু হত ভূমিকম্প।

মানোয়ারা মায়ের স্বভাব পেয়েছে, তার চোখের তারায় মাঠ পালানো হাওয়ার যাদু-ছোঁয়া। সাদাতের ডর লাগে। বনের পাখি খাঁচার শাসন ভালোবাসে না। যার উড়ে বেড়ানো স্বভাব তার কি ঘরের চার দেওয়াল ভালো লাগে। সাদাতের চোখের সামনে এখনও দুলুর করুণ মুখের অসহায় ছবিটা ভেসে ওঠে। মানোয়ারা তাকে ধোঁকা দিয়েছে। সেই চোট এখনও সামলে উঠতে পারেনি। শরীরের ঘা দ্রুত সারলেও মনের ঘা সহজে শুকোয় না। দুলুর দীর্ঘশ্বাস সাদাতের উপর পড়ছে। কাউকে কাঁদিয়ে মানুষ যদি সুখের খোঁজ করে তাহলে সেই সুখের শরীরে ঘুন লাগতে কতক্ষণ?

রাত এগারটার পরে লাইনের হোটেল থেকে ট্রাক ছাড়ল সাদাতের। বিল মেটানোর সময় টাকার তোড়াটা বেরিয়ে এসেছিল পকেট থেকে। পাশে দাঁড়ানো ছোকরাটা জীবনে যেন টাকা দেখেনি এমন চোখে দেখছিল। তার চাহনি ভালো লাগল না সাদাতের। কিছু চোখ থাকে যার ভাষা পড়া খুব সহজ। সাদাতের মনে হল টাকাগুলো এত বে-সাবধানীতে না রাখলে ভালো হত। ড্রাইভার রহমান তাকে সাবধান করে বলেছিল, সাদাতভাই, এত কাছাঢিলা হয়ো না। দিনকাল খারাপ। নিজেকে গুছিয়ে রাখতে শেখো। নাহলে পথেঘাটে ঠকবে।

ট্রাক দাঁড়িয়েছিল মেন রোডের ওপর। রহমান হর্ন বাজাচ্ছিল ঘনঘন। হোটেলওয়ালা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, সাদাতভাই, আবার আসবেন গো। খোদা হাফেজ। টাকা গুনতে গুনতে হাতটা কপালে ছোঁয়ালো সে। সাদাত বলল, খোদা হাফেজ। আল্লার মর্জি হলে আবার দেখা হবে বড়ো ভাই। ট্রাকের কাছে সাদাত পৌঁছাতেই রহমান মুখ বেজার করে বলল, বড়ো দেরি হয়ে গেল মালিক। ভাবছি রাতটা এখানে কাটিয়ে ভোর ভোর গাড়ি ছাড়লে কেমন হয়?

সাদাত সজোরে ঘাড় নেড়ে উঠল অনীহায়, ভোর ভোর গেলে পৌঁছাতে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। মানোয়ারা বেগম আমার জন্যি ভেবে ভেবে শুকিয়ে তেনা হয়ে যাবে।

-তুমার কথা ভেবেই কথাটা বলেছিলাম। রহমান অসন্তুষ্ট হল। আকাশে চুন ফুটকির মতো তারা ফুটেছে। অসময়ে একটা কালো মেঘ এসে ভিড় করেছে পুব কোণে। এ মেঘে বৃষ্টি হবে না তবু ভয় দেখাতে দোষ কোথায়। সাদাত বলল, মেঘ দেখে কি ভয় পেয়ে গেলে রহমান! কয়লা তো কদমা নয় যে জল লাগলে গলে যাবে।

–আমি সে কথা বলচি নে। রহমান দাড়িতে হাত বুলিয়ে তাকাল, আমার চিন্তা অন্যখানে। তুমার কাছে হার্ড-ক্যাশ আছে। তুমি যে চাটাই বেচে ফিরচো একথা লাইনের সবাই জানে।

–জানবে না কেনে? সাদাত মাথা চুলকে বলল, অতো ভেবে লাভ নেই, ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তুমি গাড়ি স্টার্ট করো। ইনশাআল্লা। খোদা আমাদের সাথে সাথে চলবেন। আমরা যে খোদার বান্দা।

বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাতে সিগারেট ধরাল রহমান। ধোঁয়া ছেড়ে ভাবল মুসাফিরের বাছবিচার থাকতে নেই। যেখানে পানি সেখানে সবাই ওজু করে নেই। কার কোথায়, কখন এন্তেকাল কে জানে। তবু মনটা কু’গায় কেন সবসময়?

যে মেঘে বৃষ্টি হবার কথা নয়, সে মেঘে বৃষ্টি হল। রাস্তার ধারে লরি থামিয়ে গ্রেপলটা ভালো করে বিছিয়ে দিল রহমান। ফেরার সময় সাদাত কয়লা নিয়ে যায় ট্রাক ভরে। ওদিকে কয়লার চড়া দাম। আড়তখানায় সাপ্লাই দিলে লাভ নেহাত মন্দ হয় না। এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারার সমান। খালি ট্রাক ফিরে গেলে তারই ক্ষতি। ট্রাকের ভাড়া তো দিতেই হত। অতএব ট্রাক ভরে নিয়ে যেতে দোষ কোথায়?

বৃষ্টি থামলেও রাস্তা ছিল পিছল। খুব সাবধানে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে ছিল রহমান। বৃষ্টির পরে শীতের কনকনানি বেড়েছে, হাওয়া বইছিল এলোমেলো। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সাদাত দূরের দিকে তাকাল। ফাঁকা রাস্তায় হেড লাইটের আলো পড়ে সাপের পিঠের চেয়েও চকচক করছে পিচ। সাদাত রহমানকে বলল, স্পিড তোল। ভয় কি আমি তো আছি।

বেশি দূর নয়, একটা বাঁক পেরতেই লরি থামাতে বাধ্য হল রহমান। সামান্য তন্দ্রামতন এসেছিল সাদাতের। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সে দেখল রাস্তা জুড়ে পড়ে আছে একটা গাছের গুঁড়ি। কোনোভাবেই সেই গুঁড়ি পেরিয়ে সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্যাক-গিয়ারে গাড়ি কতদূর যেতে পারে।

সাদাত কপাল কুচকে বলল, গাড়ি থামাও।

রহমান গাড়ি থামানোর আগেই শুনতে পেল খিস্তি-খেউড়। শাবল হাতে এগিয়ে এল একজন ষণ্ডমার্কা লোক। এর আগে এই লাইনে মানুষটাকে কোনোদিন দেখেনি সাদাত। লোকটা এগিয়ে এসে শাবলটা মাথার উপর তুলে আঘাত করতে চাইল সাদাতকে। সাদাত সরে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, মারচো কেনে, কি চাও তুমরা?

–মালকড়ি যা আচে দিয়ে দাও।

 সাদাতের গা-হাত-পা কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা চোখে সে দেখল তার চার পাশে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আরও চার পাঁচজন। লাইন হোটেলের সেই ছেলেটাকে সে দেখতে পেল সবার পিছনে। দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁতের মাংস খুঁটছিল ছেলেটা। মুচকি মুচকি হাসছিল সে।

রহমানকে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে ওরা। চাবি কেড়ে নিয়ে নিজেরাই রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিল লরি। সাদাতের পাথর বসানো সোনার আংটি দুটো খুলে নিল ষণ্ডামার্কা লোকটা।

ফাঁকা রাস্তায় রাতের ট্রাক ছুটে যাচ্ছে সাঁইসাঁই। শীত হাওয়ার দাপটে বেশির ভাগ জানলা বন্ধ। বিপদ বুঝে সাদাত হাতজোড় করে বলল, টাকা পয়সা যা আছে, সব তো নিলে। এবার গাড়ির চাবিটা দিয়ে দাও। আমরা যাই। যাবি মানে? খিঁচিয়ে উঠল পাশে দাঁড়ানো লোকটা। গলায় মাফলার জড়িয়ে সে করে উঠল, আগে ট্রাক সার্চ হবে, তারপর

-কয়লাগুণ্ডি ছাড়া ট্রাকে আর কিচু পাবেনা। সাদাতের গলা শুকিয়ে আসছিল। প্রগাঢ় অন্ধকারে ভয় চেপে বসছিল ওর বুকের উপর।

তিন ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে ড্রাইভার কেবিনে ঢুকে গিয়েছে তিনজন। হন্যে হয়ে ওরা খুঁজচে কিছু পাওয়া যায় কিনা। শেষে মানোয়ারার গোলাপী রঙের শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে একজন খ্যাখ্যা করে হাসে। তার হাসিতে যেন বিষ ছিল, সাদাতের সারা শরীর জ্বলে উঠল রি-রি করে। দাঁত বের করে প্যাকেটটা নাচাতে নাচাতে ভুড়িওয়ালা লোকটা বলল, শালা হারামী, লুকিয়ে এটা ঘর নিয়ে যাচ্চিল, কী আছে এতে?

বউয়ের জন্য এট্টা শাড়ি কিনেছিলাম। সাদাত কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমরা গায়ে থাকি, ওখানে ভালো শাড়ি পাওয়া যায় না।

ভালো হয়েছে, এটা আমার বউ পরবে। ভুঁড়িওয়ালা লোকটা জানলা দিয়ে শাড়ির প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিল নীচে। সাদাতের কলজেটা মুচড়ে উঠল এক অসহনীয় ব্যথায়, ভাই গো তুমাদের পায়ে ধরি, শাড়িটা নিও না। ঈদে বউটারে ভালো শাড়ি দিতে পারিনি, মনে আমার দুঃখ রয়ে গেছে।

-তোর দুঃখ তুই বোঝ। আমরা তো কুলি নই যে তোর বোঝ বইব।

 সাদাতের কাকুতি-মিনতি সব ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মতো উড়ে গেল। মুহূর্তে খুন চড়ে গেল তার মাথায়। গাড়ির রডটা তুলে নিয়ে সে সজোরে আঘাত করল মোটা লোকটার মাথায়। ঠোঙ্গা ফাটানোর মতো শব্দ হল একটা, তারপর গোড়া কাটা গাছের মতো কেবিন থেকে লোকটা ঠিকরে পড়ল নিচে।

রে-রে করে ছুটে এল আর সবাই। ওদের কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।

-হায়রে, মেরে ফেলেচে গো! লাট্টুদারে মেরে ফেলেচে। কী আস্পর্ধা। ভুড়িওয়ালা লোকটাকে মেরে ফেলতে চায়নি সাদাত অথচ অঘটনটা ঘটে গেল চোখের নিমেষে। কী ভুল করল সে। এবার এদের হাত থেকে পার পাওয়া মুশকিল। সাদাতকে কেবিন থেকে টেনে নামাল ষণ্ডামার্কা লোকটা। অন্ধকারে চোখে আগুন উগরে সে বলল, তোর রক্তের বড়ো তেজ। যা, বাঁচতে চাস তো পালা। কথাটা যেন বিশ্বাস হয় না সাদাতের। আশেপাশের মাঠগুলোয় শুয়ে আছে নিকষ কালো অন্ধকার। দুধারে ফাঁকা ধানের ক্ষেত। মাঝে মাঝে অস্পষ্ট ঝোপঝাড়।

যণ্ডামাক লোকটা এবার গর্জে উঠল, যা পালা। বাঁচতে চাস তো পালা। ওয়ান-টু-থ্রি..! পালা।

সাদাত প্রাণ বাঁচানোর দৌড়ে শরীর সামান্য নড়াতেই পিছন থেকে গুলি এসে ফুটো করে দিল তার পাঁজরা। পরপর ছটা। সাদাত লুটিয়ে পড়ল মানোয়ারার গোলাপী রঙের শাড়ির উপর।

চোখ বোজার আগে সাদাতের গলা থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুট আর্তনাদ, হায় আল্লা…! তারপর দু-বার নড়ে নিথর হয়ে গেল তার দেহটা।

অন্ধকারে ডুবে রইল সাদাত, শুধু আলোর স্মৃতি হয়ে পড়ে রইল গোলাপী শাড়িখানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *