৩. চোখ মেলে তাকালো ইনগ্রিড

অধ্যায় ৬

“উঠে পড়ো।”

চোখ মেলে তাকালো ইনগ্রিড।

তাশা রিভস দাঁড়িয়ে আছেন ওর পাশে, হাতে একটা কফির মগ। উঠে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা মগটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ও।

“ধন্যবাদ,” বললো রিভসের উদ্দেশ্যে।

কাপটা পেছনে সরিয়ে নিলেন রিভস, “তোমার জন্যে না এটা।”

ইনগ্রিড বোকার মত একটা হাসি দিলে রিভস ঘুরে কফি মেশিনের দিকে ইঙ্গিত করলেন। বোধহয় ওদের বিশ্রামের মধ্যবর্তি কোন এক সময়ে জেসিকা সেটা নিয়ে এসেছে এখানে।

অন্যদের ডাকার জন্যে ওর সামনে থেকে সরে গেলেন রিভস। ওয়েডস কে পা দিয়ে আস্তে করে খোঁচা মেরে উঠে পড়তে বললেন তিনি। একবার উঠে বসে আবার শুয়ে পড়লো ওয়েডস।

পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো ইনগ্রিড-আসলে, হেনরির ফোন এটা। স্ক্রিন চালু করে সময় দেখলো।

চারটা আটান্ন।

একটা মিসকল দেখা যাচ্ছে। হেনরি হয়তো কল করেছিল বনির ল্যান্ড লাইন থেকে। হাসিমুখে ভয়েসমেইলটা একবার শুনলো ও, আপনমনেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো মুখ থেকে। ওকে একটা ফোন করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখন ঘুমিয়ে পড়েছে ও।

অনেক দিন পর হেনরির অসুখটার কথা ভেবে মনটা একটু খারাপ হলো ওর। কিন্তু প্রতিবারের মতই দূর করে দিলো ভাবনাটা। হেনরির সাথে কাটানো এক ঘন্টা ব্র্যাড পিটের সাথে সারা জীবন কাটানোর চেয়ে ভালো।

আসে আস্তে সবাই জেগে উঠে ইনগ্রিডের যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে আসা শুরু করলো।

বন্দর কর্তৃপক্ষের ডোনাল্ড চোখ কচলে বলে উঠলেন, “আমি লেন্স পড়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”

সিক্রেট সার্ভসের সুসান তার হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে চেয়ারের ওপর থেকে নিজের পার্সটা তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একটা ছোট আই ড্রপ বের করে ডোনাল্ডের দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি, “এটা কাজে আসবে।”

“ওহ, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে,” এই বলে তার হাত থেকে ড্রপটা নিয়ে সাথে সাথে চোখে কয়েক ফোঁটা ঢেলে দিলেন ডোনাল্ড। “ভালো লাগছে এখন,” কিছুক্ষণ পর বললেন।

ওরা ছয়জন-কুপারকে কোথাও দেখলো না ইনগ্রিড-কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে এটা সেটা নিয়ে আলাপ করতে লাগল থাকা পিৎজার বক্সগুলোর একটা খুলে এক স্লাইস ঠান্ডা পিজ্জা তুলে নিলো।

ওকে অনুসরণ করলো সবাই।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে,” ফরেনসিকের ন্যাটালি বললেন।

“ঠান্ডা পিৎজার তুলনা হয় না,” ইনগ্রিড সম্মতি জানিয়ে বললো।

“হ্যাংওভারের পর আরো বেশি ভালো লাগতো,” রিভস বললেন।

হাসির রোল উঠলো।

এরপরে সবাই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলে আসা স্মৃতিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।

ন্যাটালি মিশিগান বিশ্যবিদ্যালয়ে পড়েছেন।

সুসান গ্রেগটাউনে।

রিভস, ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি।

ইনগ্রিডের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে ম্যারিল্যান্ডে।

খেলোয়াড় কোঠায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ওয়েডস।

আর ডোনাল্ড পড়েছেন ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথে।

“আর কুপার?” জিজ্ঞেস করলেন সুসান, “তিনি কোথায় পড়েছেন?”

“টেম্পল,” কুপারের গলার স্বর শুনতে পেলো ওরা। কখন ভেতরে এসেছেন সেটা টের পায়নি কেউ। এক মিনিটের জন্যেও ঘুমোননি, যদিও সেটা তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। চুল এখনও সুন্দর ভাবে আঁচড়ানো অবস্থায় আছে, গলার স্বরও একদম স্বাভাবিক, “ওদের রাগবি দলের ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি।”

“তাই নাকি!” সমীহের সুরে বলে উঠলেন ওয়েডস।

এক স্লাইস ঠান্ডা পিজা তুলে নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের কথা ওদের শোনালেন তিনি। একটুর জন্যে বিগ ইস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের। এরপরেই কাজের কথায় ফেরত আসলেন, “জেসিকা পাশের একটা হোটেল থেকে টয়লেট্রিজের ব্যবস্থা করেছে, বাথরুমে রাখা আছে ওগুলো। সবাই হাতমুখ ধুয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসো এখানে।”

কথা মানলো ওরা।

ইনগ্রিড একটা ছোট ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে নিলো।

ফোনে সময় দেখলো।

পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে।

হেনরির কথা মনে হলো।

ওর পুরো জীবনটাই এমন।

ফোনটা না ধরতে পারার জন্যে গাল দিলো নিজেকে মনে মনে।

.

কুপার গত কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছেন হোয়াইট হাউজের মিটিং রুমে। সেখান থেকে যা যা জেনেছেন সবকিছু খুলে বললেন ওদের।

সারাদেশের এফবিআই এজেন্টরা তাদের রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের লোক বেশি যে অঞ্চলগুলোতে সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেশি। কিন্তু কিছুই জানা যায়নি।

ইনগ্রিডের একটু অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো।

না জানি কত নিরপরাধ আরব লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আর সেটা ওর দেয়া বর্ণনার কারণেই।

সিআইএ’র হাতেও এখন পর্যন্ত সূত্র আসেনি। পুরো বিশ্বে প্রায় আড়াই লাখ সার্ভেইলেন্স ক্যামেরার নেটওয়ার্ক হ্যাঁক করেও কোন লাভ হয়নি।

পঞ্চাশ লক্ষ ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে প্রেসিডেন্টেকে খুঁজে বের করার জন্যে।

টিএসএ গত তিন মাসে দেশে আগত প্রত্যেক পর্যটকের তথ্য খুঁটিয়ে দেখছে। মেক্সিকো আর কানাডার এজেন্সিগুলোর সাথেও কাজ করছে তারা।

সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত তাদের প্রত্যেক গুপ্তচরকে কাজে লাগিয়ে রেখেছে এই কেসে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট লেডির সাথে একটা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করার কথা ভাবছেন। পঁচিশতম সংশোধনি অনুযায়ি তিনিই এখন দেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট।

“আটচল্লিশ ঘন্টাও হয়নি সুলিভানের অপহরণের ঘটনার,” মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন সুসান, “আর কোর্টনির হাতে ক্ষমতা চলে গেছে।”

“তোমরা যদি তাকে চোখের আড়াল হতে না দিতে…” কথাটা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকালেন ওয়েডস।

ভাইস প্রেসিডেন্ট টেড কোর্টনিকে ইনগ্রিডেরও প্রথম পছন্দ না। সুলিভানের বিরুদ্ধে যখন মনোনয়নের জন্যে লড়েছিলেন তিনি, অষ্টম হয়েছিলেন বেসরকারি পোলগুলোতে। কিন্তু সুলিভান সুযোগ দেন তাকে। ইনগ্রিডের কাছে লোকটাকে বরাবরই একটু নাটুকে মনে হয়েছে। মধ্যরাতের টক-শোগুলোতে কথা বলার জন্যে হয়তো ঠিক লোক তিনি, কিন্তু দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির পদের জন্যেই মোটেও ঠিক নন।

“কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে কাউকে না কাউকে তো দরকার আমার,” ডোনাল্ড বলে উঠলেন,

“কোথাও যদি পারমাণবিক আক্রমন করতে হয়, সুইচে চাপ দেয়ার জন্যে কাউকে থাকতে হবে।”

কথাটা আমলে নিলো না ইনগ্রিড, “অপহরণকারিদের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়েছে?”

“না এখনও,” কুপার বললেন।

এ সময় ফোন বেজে উঠলে ওদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন তিনি।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, “বোধহয় বেশি তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে ফেলেছি আমি।”

.

ল্যাপটপ বের করে একটা ভিডিও চালু করলেন কুপার। “এটা কিছুক্ষণ আগে ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে,” বললেন তিনি।

মধ্যপ্রাচ্যেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টকে।

ইনগ্রিডের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্যে, তারপর আবার ঠিক হয়ে গেলো।

কুপার আবার শুরু থেকে চালালেন ভিডিওটা।

পর্দায় দু-জন অপহরণকারিকে দেখা যাচ্ছে। পুরো দেহে কালো পোশাক তাদের। বিলি আর প্রেসিডেন্ট সুলিভানকেও দেখতে পেলো ওরা। মুখ টেপ পেঁচিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তাদের।

চেপে রাখা একটা শ্বাস ছাড়লো ইনগ্রিড।

“ধুর,” রিভস বলে উঠলেন, “তাদের মধ্য প্রাচ্যে নিয়ে গেছে ওরা।”

অপহরণকারি দু-জন হাটু গেড়ে বসতে বাধ্য করলো প্রেসিডেন্ট এবং বিলিকে।

একটু ভয় ভয় হতে লাগলো ইনগ্রিডের।

তৃতীয় আরেকজন অপহরণকারি প্রবেশ করলো পর্দায়। তার গালে দাড়ি আছে, পরনে কালো পোশাক।

আরবি ভাষায় কথা বলা শুরু করলো সে।

ওয়েডস সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাতে লাগলেন ওদের।

“আমরা আরএসই, আইসিসের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করছি। আমেরিকাকার প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করেছি আমরা

এটুকু বলে প্রেসিডেন্ট আর বিলির দিকে তাকালো লোকটা।

তাদের দুজনের চেহারায় ভয়ের ছাপ চোখ এড়ালো না ইনগ্রিডের।

তারা জানে তাদের জীবনের কাটা এখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে।

এ সময় কিছু একটা ফেঁটে পড়ার আওয়াজে জমে গেলো পর্দার সবাই।

“ওখানে স্বাভাবিক এরকম শব্দ,” ওয়েডস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “সরকারের পক্ষ থেকে করা কোন মিসাইল স্ট্রাইকের আওয়াজ হয়তো।”

আবার ক্যামেরার দিকে চোখ ফেরালো লোকটা, বললো, “তোমাদের প্রেসিডেন্টকে আর এই লোকটাকে বাঁচাতে হলে, আমেরিকাকাকে দু-দিনের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সব সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। ইরাকি স্থানীয় সময়ে বেলা দুটোর মধ্যে। তাহলে প্রেসিডেন্টকে সহি সালামতে ফেরত পাঠাবো আমরা। আর আমাদের কথা না মানলে প্রেসিডেন্ট জ্যান্ত ফিরবে না।”

ভিডিওটা বন্ধ হয়ে গেলো।

.

“দু-দিন পর, ইরাকি স্থানীয় সময় দুটোর মধ্যে?” ন্যাটালি জিজ্ঞেস করলেন। “আমাদের ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ি সেটা কখন?”

“ওখানের সময় আমাদের চেয়ে আট ঘন্টা এগিয়ে, ওয়েডস উত্তর দিলেন।

“তারমানে দুদিন পর ভোররাত চারটার মধ্যে, ন্যাটালি হিসেব করে বললেন। “সেদিন বুধবার।”

ইনগ্রিড ফোনের দিকে তাকালো।

পাঁচটা ছাপ্পান্ন।

“আমাদের হাতে ছেচল্লিশ ঘন্টা আছে এখনও,” বললো সে।

“কিসের জন্যে?” ওয়েডস জিজ্ঞেস করলেন। “মধ্যপ্রাচ্য থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবার জন্যে? সেটা চাইলেও সম্ভব না। আর আমাদের সরকার কারও সাথে চুক্তি করে না।”

“আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম…” ইনগ্রিড বললো, “…আমাদের হাতে ছেচল্লিশ ঘন্টা আছে প্রেসিডেন্ট আর বিলিকে খুঁজে বের করার জন্যে।”

.

বিলি দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়লো নাক দিয়ে। মুখ বন্ধ অবস্থায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। এখনও যে বেঁচে আছে সেটাই অনেক, দু-ঘন্টা আগেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না ও। ভিডিওটা যখন করা হচ্ছিল ভেবেছিল তখনই হয়তো মেরে ফেলা হবে তাকে।

মনে মনে প্রার্থনা করাও শুরু করেছিলো। ছোটবেলায় এই প্রার্থনাটা করতো ও।

ঘরের অন্য পাশে থাকা প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালো। কোথায় আছে। ওরা এটা বুঝতে পারছে না এখনও।

হেনরির বাবার বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পরে রেড আর ওর ক্যাপ্টেন মার্শালকে গুলি করেছে লোকগুলো। ভেবেছিলো ওকেও গুলি করবে।

কিন্তু সেটা হয়নি।

এমন না যে, সব চুপচাপ সহ্য করছিল ও। হাত বাঁধার সময়ে একজনের কোমরে গোজা বন্দুকের বাট ধরে টান দিয়েছিলো, কিন্তু লাথি মেরে ওকে সরিয়ে দেয়া হয়।

ভেবেছিল তখন গুলি করবে।

কিন্তু সেটাও হয়নি।

এরপর ইনগ্রিড, তার বাবা-মা আর অন্য সবাইকে বেজমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। বিলি ভেবেছিলো তাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সেটা না করে এক অপহরণকারি তার নাকে একটা কাপড় চেপে ধরে।

ওটাতে ক্লোরোফর্ম ছিল বোধহয়।

কয়েকবার জ্ঞান ফিরেছিল ওর, কিন্তু চোখ বাঁধা ছিল। একবার ময়ে হয়েছিল গাড়িতে আছে ও, পরে একবার প্লেনে। কিন্তু প্রতিবার একটু নড়ে ওঠার সাথে সাথে আবার কাপড়টা চেপে ধরা হয়েছে ওর নাকে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।

অবশেষে এখানে জেগে ওঠে ও।

ঘরটা একদম ছোট, ঠিকমতো দাঁড়ানোও যায় না। চারপাশে ময়লা।

দরজার নিচ দিয়ে মৃদু আলোর রেখা ভেতরে প্রবেশ করছে। বিলি প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালো।

“আপনি ঠিক আছেন?” জিজ্ঞেস করলো ও। যদিও মুখ বন্ধ অবস্থায় একটা দুর্বোধ্য আওয়াজের মত শোনালো শব্দটা।

প্রেসিডেন্টও ওর মত করেই জবাব দিলেন।

বিলি হাতের বাঁধনগুলো ছোটানোর চেষ্টা করলো আরেকবার। পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়েছে ওকে। এক চুলও ঢিল করতে পারেনি, খুব শক্ত করে বাঁধা হয়েছে।

মুখের টেপটা অসহ্য ঠেকছে এখন ওর কাছে। পুরনো একটা স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। অবশ্য সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ঘটনা।

কিছুক্ষণ আগের ভিডিও করার ঘটনার সময় বলা একটা কথাও বুঝতে পারেনি বিলি। কিন্তু এটক বুঝেছে যে ওদের মুক্তিপণ হিসেবে কিছু চাওয়া হচ্ছে। আর সেজন্যেই এখনও বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তবে খুব সহজে মুক্তি পাবে বলে মনে হচ্ছে না। লোকগুলো কারা সে সম্পর্কে কোন ধারণা নেই ওর, তবে কেন যেন আচার ব্যবহারে তাদের অনারব বলে মনে হচ্ছিল ওর।

যাইহোক, এখান থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে হবে ওকে।

এসময় দরজা খুলে একজন অপহরণকারি প্রবেশ করলো ভেতরে। প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে তাকে দাঁড় করালো। এ সুযোগে বাইরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলো বিলি, কিন্তু কিছু চোখে পড়লো না। সুলিভানকে দরজার দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলো লোকটা। ঘাড় ফিরিয়ে বিলির দিকে তাকালেন তিনি। দৃষ্টিতে সাহায্যের আকুতি।

কিন্তু কিছুই করার নেই বিলির।

.

অধ্যায় ৭

ভিডিওটা ইউটিউবে বিশ লক্ষ বার দেখা হয়ে গেছে এর মধ্যে।

এর মধ্যে আমিই দেখেছি সাতবার।

আট নম্বর বারের মত দেখছি এখন। প্রতিবারই নতুন কিছুর প্রতি মনোযোগ দেই-বিলির মুখের ভাবভঙ্গি, প্রেসিডেন্ট সুলিভানের আচরণ, অপহরণকারির চোখ। এছাড়া নিচে ভেসে বেড়ানো কথাগুলো তো আছেই।

‘তোমাদের প্রেসিডেন্ট আমাদের কাছে…’

বাবা আমার কাঁধের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছেন। তিনি নিজে কতবার দেখেছেন ভিডিওটা চিন্তা করলাম। সব টিভি চ্যানেলেও নিশ্চয়ই এখন দেখানো হচ্ছে এটা।

… আমেরিকাকাকে দু-দিনের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সব সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে।

ভিডিও চলাকালীন সময়ে পেছনের আওয়াজের প্রতি মনোযোগ দিলাম। অপহরণকারিরাও জমে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে।

ওখানকার নিয়মিত ঘটনা এটা।

‘তাহলে প্রেসিডেন্টকে সহি সালামতে ফেরত পাঠাবো আমরা। আর আমাদের কথা না মানলে প্রেসিডেন্ট জ্যান্ত ফিরবে না।’

আমার মনে হয় না বেঁচে ফিরবেন তিনি।

“ইরাকে আমাদের কতজন সৈন্য আছে?” বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি সারাদিন নিশ্চয়ই এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছেন।

“কোথাও লেখা সাড়ে তিন হাজার আবার কোথাও কোথাও দেখলাম প্রায় চার হাজার।”

“এটা কি সম্ভব?” জিজ্ঞেস করলাম, “চার হাজার সৈন্যকে এ সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে?”

“না।”

“কোনভাবেই কি সম্ভব না?”

“হয়তো সম্ভব,” কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন তিনি। কিন্তু সরকার সেরকম কিছু করবে বলে মনে হয় না।”

একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলাম। ইরাক আমাদের এখান থেকে আট ঘন্টা এগিয়ে। কালকে এখানে যখন দুপুর তখন ইরাকে বিকেল চারটা বাজবে। সময়সীমা যখন শেষ হবে ঠিক তার আগ দিয়েই ঘুমিয়ে পড়বো আমি।

“পুলিশের লোকজন কি এখনও আছে বাইরে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“নাহ, কাল রাতে চলে গেছে ওরা।”

“আপনি গিয়েছিলেন নাকি বাসায়?”

“দুই মিনিটের জন্যে গিয়ে কিছু জামা-কাপড় নিয়ে এসেছি। এখনও রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছ সেখানে।”

কার্পেট পরিস্কারের লোকজন আসতে দেরি আছে। আমার ধারণা কার্পেটটাই সরিয়ে ফেলবেন বাবা। নতুন কিছু লাগাবেন সে জায়গায়।

জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

“হ্যাঁ, কিন্তু হার্ডওয়্যারের দোকান খুলতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।”

“জর্জ সাহায্য করবে নিশ্চয়ই আপনাকে। অন্তত পুরনোটা সরিয়ে ফেলতে।”

জর্জ এখনও ওর পিকআপটা তুষারের ভেতর থেকে বের করতে পারেনি। অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে আছে তুষারে।

“ভালো বলেছে,” বাবা বললেন, “ওকে জিজ্ঞেস করে দেখবো আমি।”

তাকে জানালাম যে কিছুক্ষণের জন্যে বাসায় যাবো আমি।

তিনটা তের বাজছে এখন।

.

মারডক, ল্যাসি আর আর্চি যোগ দিলো আমার সাথে।

আর্চিকে এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে সামনের দরজাটা খুলে ফেললাম।

ওকে নিচে নামিয়ে রেখে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম।

প্রথমেই কার্পেটের ওপর রক্তের দাগ চোখে পড়লো আমার।

“ওগুলোর কাছে যাবি না,” তিন মাস্তানের উদ্দেশ্যে বললাম। এরইমধ্যে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেছে ওরা।

বাবার লিভিংরুমে একবার নজর বোলালাম। শেষবার যেমন দেখেছিলাম সেরকমই আছে সব কিছু। এফবিআই’র লোকজন নাড়াচাড়া করেনি কিছু। করলেও আগের জায়গায় রেখে দিয়েছে সব জিনিস।

বেদিটার দিকে তাকালাম।

তিন দিন আগে এখানে দাঁড়িয়েই ইনগ্রিডকে বিয়ে করি আমি।

মনে হচ্ছে সেটা কয়েক মাস আগের ঘটনা।

বাবার এখানে ল্যান্ডফোন নেই। বনির বাসা থেকে ইনগ্রিডকে ফোন না দেয়ার জন্যে মনে মনে নিজেকে গালি দিলাম।

ওকে একটা ইমেইল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

দুই সেকেন্ড লাগলে ল্যাপটপটা খুঁজে বের করতে।

রান্নাঘরের টেবিলের ওপর ওটা। স্ক্রিন কালো হয়ে আছে ওটার। কয়েকটা বাটনে চাপ দিলাম। চার্জ শেষ, ল্যাপটপের ব্যাটারি তো চার দিন টিকবে না।

দৌড়ে আমার ঘরে গিয়ে চার্জার খুঁজে বের করলাম। বাবার ঘরে উঁকি দিলাম একবার। আর্চি আর ল্যাসি দু-জনেই বিছানার নিচে ঢুকে আছে আর মারডক ওর বিশাল থাবা বাড়িয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করছে।

দেখে মনে হচ্ছে মজায় আছে তারা।

গর্দভের দল।

নিচে এসে ল্যাপটপে চার্জারের তার লাগালাম।

ঘুম থেকে ওঠার পর বনির তৈরি করে রাখা গ্রিলড চিজ স্যান্ডউইচ খেয়েছিলাম, তবুও আবার ক্ষিধে পেয়ে গেলো। দুটো এনার্জি বার আর এক বোতল গ্যাটোরেড বের করে নিলাম ফ্রিজ থেকে।

দাঁড়িয়ে থেকেই ইমেইল অ্যাড্রেসে লগইন করলাম।

এখনও কোন ইমেইল আসেনি ইনগ্রিডের পক্ষ থেকে।

ওর উদ্দেশ্যে একটা ইমেইল টাইপ করা শুরু করে জমে গেলাম।

আমি এত বড় গর্দভ কেন?

ভিডিও রেকর্ডিংগুলো বের করার সময় আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেলো।

আমার ল্যাপটপটা রান্নঘরের টেবিলে রাখার উদ্দেশ্য ছিল বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানটা ভিডিও করা।

একটা সফটওয়্যার ইন্সটল করেছিলাম যেটা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভিডিও করা যায়। আমি শুরুর সময় দিয়েছিলাম ২:৪৫ আর শেষ হবার সময় দিয়েছিলাম ৫:০০ টায়। প্রথমে অবশ্য ৪:০০ টা ঠিক করেছিলাম, পরে এক ঘন্টা বাড়িয়ে দেই। আমি ঘুমানোর সাথে সাথে তো আর অনুষ্ঠান শেষ হবে না।

সর্বশেষ ভিডিওটায় ক্লিক করলাম।

দুই ঘন্টা পনের মিনিটের ওটা।

অপহরণের সময়টুকুও নিশ্চয়ই রেকর্ড হয়েছে।

ভিডিওটা টেনে সাড়ে চারটার সময় আনলাম। সবাই নাচছে।

অন্য সময় হলে ইনগ্রিড আর ওর বান্ধবিদের এরকম একটা গানে নাচতে দেখে হেসে উঠতাম। অন্য সবাই ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর তালি দিচ্ছে। তিরিশ সেকেন্ড পর ব্যাপারটা ঘটলো, যেটার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। গানের কারণে দরজা ভাঙার শব্দ অতটা জোরে শোনা হগেলো না। সবার দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে গিয়েছে।

অপহরণকারিদের দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবাইকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিচ্ছিল নিশ্চয়ই, কারণ হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছে ওরা। ইনগ্রিড আর বিলি একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। একদম শান্ত ওরা দু-জন। অন্য সবাই কাঁপছে ভয়ে। রেবেকা তো কেঁদেই দিয়েছে।

রেড আর মার্শালকে দেখা যাচ্ছে না। তারা নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্টের সামনে।

কি ঘটছে বুঝতে পারছি না। কিন্তু কিছুক্ষণের পর দুটো আওয়াজ শুনলাম। এরপর খানিক বিরতি দিয়ে আবার একই রকম শব্দ।

“ধুর,” বলে উঠলাম।

কেন বাহাদুরি দেখাতে গিয়েছিল মার্শাল?

ওদের কথা শুনলে কি হতো?

কিন্তু আমি জানি কেন।

প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচানোর এটাই একমাত্র উপায় ছিল। ওরা দুজন বুঝতে পেরেছিলো কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিল লোকগুলো। তারা বাঁধা না দিলে প্রেসিডেন্টকে হয়তো মেরেই ফেলতো ওরা।

ইনগ্রিড দু-হাত দিয়ে চেপে রেখেছে মুখ।

এসময় অপহরণকারিদের পর্দায় দেখা গেলো। ইনগ্রিড যেমনটা বর্ণনা করেছিলো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো কাপড় পরনে। কালো মুখোশের ফাঁক দিয়ে শুধু চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। দু-জন সবার দিকে বন্দুক তাক করে রাখলো আর আরেকজন সবার কাছ থেকে ফোন, আঙটি এসব খুলে নিয়ে ব্যাগে ভরে। কাজ শেষে প্রত্যেককে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো দড়ি দিয়ে। ডাক্ট টেপ দিয়ে মুখও আটকে দিলো।

সুলিভানকে দিয়ে শুরু করলো তারা।

চিবুক ধরে তার চেহারা উঁচু করে ধরলো একজন।

তাদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বললেন তিনি কিন্তু গানের আওয়াজের কারণে শোনা গেলো না। সুলিভানকে বাঁধা শেষ করে ইনগ্রিডের বাবার দিকে এগিয়ে গেলো তারা। এরপর ওর মা, ইসাবেল, মিনিস্টার রবার্ট।

ইনগ্রিডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা।

হাত আপনা-আপনি মুঠো হয়ে গেলো আমার। নখ বসে যাচ্ছে। তালুতে।

ওকে তল্লাশি করে ফোন না পেয়ে হাত থেকে আঙটিটা খুলে নিয়ে অন্য সব কিছুর সাথে রেখে দিলো। ইনগ্রিডের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে হাত খোলা থাকলে অবস্থা খারাপ করে দিতো লোকগুলোর, কিন্তু সে মুহূর্তে মুখে কিছু বললো না ও।

এরপরে বিলির দিকে এগিয়ে গেলো লোকগুলো।

ওদের একজনের বন্দুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। বন্দুকের বাট ধরে প্রায় বেরও করে ফেলেছিল কিন্তু আরেকজন অপহরণকারি এসে লাথি মেরে সরিয়ে দিলো ওকে। এরপর এলোপাথাড়ি কয়েকটা লাথি কষাল পেট বরাবর।

মাটিতে পড়ে গেলো বিলি। শক্ত করে ওকে বেঁধে ফেললো একজন।

সবাইকে বাঁধা হয়ে গেলে একজন একজন করে তাদেরকে বেজমেন্টে নিয়ে যেতে লাগলো অপহরণকারিরা। ওখানে নিয়ে নিশ্চয়ই পাও বেঁধে ফেলা হচ্ছে সবার।

বিলি আর সুলিভানের পালা আসলে তাদের মুখের ওপর দুটো কাপড় চেপে ধরলো অপহরণকারিরা। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেল দু জনই।

এরপর দু-জন অপহরণকারি উধাও হয়ে গেল।

আমি জানি কোথায় গিয়েছে তারা।

ওপর তলায়।

কেউ লুকিয়ে আছে কিনা দেখতে।

আমাকে নিশ্চয়ই ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়েছিলো তারা। হয়তো জাগাবার চেষ্টাও করেছিলো। আবার এমনটাও হতে পারে, আগে থেকেই আমার অসুখটা সম্পর্কে জানতো লোকগুলো। আমাকে আমার ঘরে রেখে নিশ্চয়ই এর পরে বাবার ঘরে গিয়েছিল তারা, সেখানে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায় দুই আসামিকে।

মারডককে প্রথমে দেখা গেল পর্দায়। ওপর থেকে নেমে এসে শান্তভাবেই বেইজমেন্টের দিকে হেঁটে গেলো ও।

“ভীতুর ডিম,” বলে উঠলাম।

ল্যাসি অত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। একজন অপহরণকারির মুখ বরাবর থাবা বসালো ও।

“সাব্বাশ।”

স্ক্রিনের নিচে তাকিয়ে দেখলাম আর কতক্ষন বাকি আছে ভিডিওটার।

তিন মিনিট।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো মুখ থেকে। তেমন কিছুই জানা গেলো ভিডিওটা থেকে। ইনগ্রিড যা যা বলেছে সেরকমটাই দেখা গেছে ভিডিওটাতে।

এরপরেই ঘটনাটা ঘটলো।

অপহরণকারিদের একজন পেছনের টেবিলের দিকে হেঁটে গেলো।

কেকটা ওখানেই রাখা।

এক হাতে অনেকটুকু কেক তুলে নিয়ে আরেকহাত দিয়ে মুখোশটা উঁচু করে ধরলো।

বিস্ময়ে মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হয়ে আসলো আমার।

লোকটা আরবিয় নয়।

শ্বেতাঙ্গ।

আর তার গলার ট্যাটুটা দেখে মনে হচ্ছে সে রাশিয়ান!

.

কয়েক বছর আগে রাশিয়ান একটা কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলাম আমি। এর আগে অবশ্য ভালোমতো অনুসন্ধান চালিয়ে নিয়েছি। প্রায় বিশ মিনিট ধরে-আমার জন্যে সেটাই অনেক সময়। তখন কয়েকটা ওয়েবসাইটে রাশিয়ান অক্ষর চোখে পড়েছিলো আমার। ওদের ‘B’ অক্ষরটা একটু অন্যরকম।

কিছুক্ষণ পর রাশিয়ান লোকটার গলায় আকানো ট্যাটুটার অর্থ বের করলাম।

পাপে বসবাস, পাপেই মৃত্যু।

দার্শনিক উক্তি।

কোন মুসলমানের গায়ে আর যাই হোক ট্যাটু থাকবে না। তারমানে রাশিয়ানরা চাচ্ছে যাতে সবাই ভাবে, কোন জঙ্গি সংগঠন অপহরণ করেছে প্রেসিডেন্ট সুলিভানকে।

দৌড়ে উপরে গিয়ে আমার সাঙ্গপাঙ্গদের উদ্দেশ্যে বললাম, “তাড়াতাড়ি আয় সবাই, এখনি বনির বাসায় ফিরতে হবে।”

দ্রুত রাস্তা পার হলাম আমরা। এক হাত দিয়ে চেপে রেখেছি ল্যাপটপ।

“কি ব্যাপার?” দৌড়ে বাবার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে তার উদ্দেশ্যে বললাম, “আপনাদের জানাইনি আমি, কিন্তু আমার ল্যাপটপের ওয়েবক্যাম দিয়ে পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানটা ভিডিও করে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম।”

“কিন্তু তোমাকে তো আমি বলেছিলাম যে বনি আছে সে দায়িত্বে।”

“আমি জানি, তাকে থামিয়ে বললাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল যেন আমার ল্যাপটপেও ভিডিওটা থাকে। এরপরে এটা দিয়ে ইনগ্রিডের জন্যে কিছু একটা বানাতাম। কিন্তু সেটা বিষয় না, অপহরণকারিদের আক্রমনের ঘটনাও রেকর্ড হয়ে গিয়েছে ল্যাপটপে।

চোয়াল ঝুলে গেলো বাবার।

“শুধু তাই নয়, একজন অপহরণকারি কেক খাওয়ার জন্যে মুখোশ উঁচু করে ধরেছিল। তার গলা আর মুখের অর্ধেকটা দেখা যায় সে সময়। আমার ধারণা লোকটা রাশিয়ান।”

“রাশিয়ান?”

তাকে ট্যাটুর ব্যাপারটা খুলে বললাম।

“ভিডিওটা ইনগ্রিডকে পাঠাও এখনি।”

“ইমেইল করে দিয়েছি আমি,” এই বলে ফোনটা তুলে নিলাম।

আমার নম্বরে ফোন দিলাম।

কেউ ধরলো না।

আবার ফোন দিলাম।

কেউ ধরলো না।

আবার।

অবশেষে ওপাশ থেকে ইনগ্রিডের গলার স্বর ভেসে এলো।

ওকে ভিডিওটার ব্যাপারে খুলে বললাম।

“ওহ ঈশ্বর!” এটুকুই বলা সম্ভব হলো ওর পক্ষে।

*

অধ্যায় ৮

“ওহ্ ঈশ্বর!” ফোনটা কানে চেপে রেখেছে ইনগ্রিড। হেনরি যা যা বললো সেগুলো হজম করার চেষ্টা করছে।

হেনরির সাথে আরও পাঁচ মিনিট কথা বলতে ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু সেটা সম্ভব না।

কাজে লেগে পড়তে হবে ওকে।

“তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে ভীষণ,” ফোনে বললো ইনগ্রিড, “বাসায় এসে আলাপ করবো।”

“আমি অপেক্ষায় থাকবো,” হেনরি জবাব দিলো, “আগে বিলিকে খুঁজে বের করো তোমরা।”

“আর প্রেসিডেন্টকে।”

“হ্যাঁ, তাকেও।”

ফোনটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও। মিটিং রুমের হালকা আলোতে অন্য ছয়জনকে দেখা যাচ্ছে। কুপারও ঘুমিয়ে নিচ্ছেন কিছুক্ষণের জন্যে। সবাই মেঝেতে ঘুমালেও কুপার ঘুমোচ্ছেন একটা চেয়ারে।

দীর্ঘ, ক্লান্তিকর একটা দিন কেটেছে সবার।

পুরো বিশ্বজুড়ে এখন খোঁজ চলছে প্রেসিডেন্টের আর টাস্কফোর্সের কাজ ছিল সব এজেন্সির পাঠানো রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান-সব ধরণের এজেন্সিই তাদের নিজ নিজ গোয়েন্দা বিভাগের সাহায্যে আরোহিত তথ্য ওদের কাছে পর্যালোচনার জন্যে পাঠিয়েছে। এরকম দাপ্তরিক কাজ করে অভ্যেস নেই ইনগ্রিডের, ক্রাইম-সিনে কাজ করে অভ্যস্ত ও। অনেককে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে, কিন্তু কিছু জানা যায়নি এখন পর্যন্ত।

ইনগ্রিড জানে যে ওরাই এফবিআই’র একমাত্র টাস্ক ফোর্স নয়। আরও কয়েকটা, এমনকি পুরো আমেরিকাকা জুড়ে হাজারটা টাস্ক ফোর্স কাজ করছে এই কেসে, কিন্তু ওর মনে হচ্ছে যে প্রেসিডেন্টকে আর বিলিকে উদ্ধারের সব দায়িত্ব ওদের এই সাতজনের দলটার।

আর এই দু-দিনে সেরকম কোন তথ্যই হাতে আসেনি ওদের।

অবশেষে কিছু একটা জানতে পেরেছে ও।

টেবিলে রাখা একটা ল্যাপটপ তুলে নিয়ে নিজের ইমেইল আইডিতে লগইন করলো ইনগ্রিড। হেনরির পাঠানো ভিডিওটা ডাউনলোড করে নিলো। সামনে এগিয়ে ব্রাইডস মেইডদের সাথে নাচার মুহূর্তে নিয়ে এলো ভিডিওটাকে। এরপর চালু করে দিলে সেদিনের ঘটনাটা আরেকবার চোখের সামনে ঘটতে দেখলো ও। ভিডিওর একদম শেষদিকে হেনরির বর্ণনা মত একজন অপহরণকারি মুখোশ উঁচু করে খানিকটা কেক মুখে দিলো।

ওর বিয়ের কেক।

“হারামি,” বললো ও।

দুই আঙুল মুখে পুরে যত জোরে সম্ভব শিস বাজালো যাতে সবার কানে যায় সেটা।

“কি হলো!” লাফিয়ে উঠলেন ওয়েডস।

“সবাই উঠে পড়ুন,” ইনগ্রিড চিল্লিয়ে বললো।

প্রত্যকের চোখ ওর দিকে ঘুরে গেলে সব কিছু খুলে বললো ও।

.

“প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করে রাশিয়ার কি লাভ?” সুসান জিজ্ঞেস করলেন।

ভিডিওটা ওরা তিনবার দেখেছে।

“আমাদের দেখতে পারে না ওরা,” ওয়েডস বললেন, “আর পুতিন তো সুলিভানকে সহ্যই করতে পারে না।”

ইনগ্রিড জানে তাদের দুজনের মধ্যকার দ্বন্দের কথা। সুলিভান আর পুতিন পুরো উল্টো স্বভাবের মানুষ। পুতিন ভালুক হলে সুলিভান শেয়াল।

আমেরিকাকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে পুতিন সুলিভানের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। তার খুব কাছের একজন কর্মি টুইটারে লিখেছে (যদিও সবার ধারণা এটা পুতিন নিজেই টাইপ করেছে)-সুলিভান একটা ‘টুজিক’( এক ধরণের রাশিয়ান কুকুর)।

“আমরা আরেকটা স্নায়ু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে,” ওয়েডস বললেন, “গত দু’বছরে পুতিন রাশিয়াকে অন্য একটা অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে। পোল্যান্ডকে হুমকি দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার সম্প্রসারণের কথা ভাবছে বোধহয়।”

“সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় কিস্তি?” ডোনাল্ড জিজ্ঞেস করলেন।

“সেরকমই,” সায় জানিয়ে বললেন ওয়েডস।

“তা বুঝলাম,” কুপার বললেন, “কিন্তু আরএসই প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করেছে, এমনটা সাজিয়ে রাশিয়ানদের কি লাভ?”

“ইরাকের নিয়ন্ত্রন চাই ওদের,” ওয়েডস বললেন।

সবাই তার দিকে তাকালো।

“সিরিয়াতে রাশিয়ার অনেক সৈন্য আছে,” ওয়েডস জানালেন, “এমনকি একটা বিমানঘাঁটিও বানিয়েছে। কিন্তু শুধু সিরিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না ওরা। ইরাককেও করায়ত্ত করতে চায় এখন।”

“আর আমরা এই কাজে বাধা দিচ্ছি ওদের?”

“হ্যাঁ,” ওয়েডস বললেন।

“বুঝিয়ে বলল,” ন্যাটালি নির্দেশের সুরে বললেন।

“এই অপহরণের ঘটনা সাজিয়ে ইরাক থেকে আমেরিকাকান সৈন্য সরিয়ে নিতে বলেছে ওরা। এমনটা যদি আদৌ করা হয় তাহলে চার হাজার আমেরিকাকান সৈন্যদের সাথে কোন প্রকার লড়াই করতে হবে না ওদের। কিন্তু আমাদের সরকার কখনোই কারও সাথে নেগোসিয়েশন’ করে না, মুক্তিপণ দেয়া দূরে থাক। যখন সৈন্যদের ফেরত আনার জন্যে বেঁধে দেয়া সময় পেরিয়ে যাবে তখন রাশিয়ানরা প্রেসিডেন্ট সুলিভানকে মেরে ফেলবে আর আমেরিকাকা আইসিসসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

তাশা বললেন, “তখন তো আরও কয়েক হাজার সৈন্য পাঠানো হবে এদেশ থেকে। একদম মুছে ফেলা না পর্যন্ত যুদ্ধ চলবেই। যেমনটা ঘটেছিল আল-কায়েদা আর বিন লাদেনের সময়।”

“হ্যাঁ এবং না,” ওয়েডস বললেন, “যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে এটা ঠিক, কিন্তু আরও সৈন্য পাঠানো হবে না। আমরা আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইরাকে যা যা করেছিলাম সেগুলো থেকে এখনও সামলে ওঠেনি তারা। আমাদের আরও সৈন্য সেখানে প্রবশ করতে দেবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে রাশিয়া একটু সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আর ইরাকের সাথে তাদের সম্পর্ক আমাদের চেয়ে কিছুটা ভালো এখন, অন্তত কাগজে কলমে। আমেরিকাকার প্রেসিডেন্ট নিহত হবার ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে ওদের নিজেদের সৈন্য পাঠাবে ইরাকে। এরচেয়ে ভালো অজুহাত আর কিছু হতে পারে না। তখন পুরো পৃথিবীই তাদের সমর্থন দেবে, আমেরিকাকানরাও সেটা মেনে নিতে বাধ্য। এরপর কয়েক দিনের মধ্যে দেখা যাবে ইরান, তুরস্কসহ অন্য সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে রাশিয়ানরা।

“আর এটা যদি ফাঁস হয়, প্রেসিডেন্টকে রাশিয়ানরা অপহরণ করেছে তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে,” ডোনাল্ড বললেন।

“পারমাণবিক যুদ্ধ, ন্যাটালিও সম্মতি জানালেন।

সবাই কিছুক্ষণ বসে থাকলে কিছু না বলে।

“এই ভিডিওটার ব্যাপারে কাউকে কিছু না বললেই ভালো,” কুপার বললেন সবার উদ্দেশ্যে।

তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো ইনগ্রিড, “তাহলে বিলি আর প্রেসিডেন্টকে উদ্ধার করবো কিভাবে আমরা? সবাইকে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লাগতে হলে ভিডিওটা দেখা জরুরি।”

আবারো নিরীহ আরবিয় লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদের কথাটা মনে হলো ওর। অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো মন।

“আমরা কিন্তু এখনও জানি না যে লোকটা আসলেও রাশিয়ান কিনা,” রিভস বললেন। “আর সে আরবিতে কথা বলছিলো।”

“মাত্র একজন,” মনে করিয়ে দিলো ইনগ্রিড। “পরের ভিডিওতেও সেই কথা বলেছে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে।”

“রাশিয়ানরা হয়তো আরবিয় কাউকে ভাড়া করেছে এই কাজের জন্যে,” রিভস মাথা দুলিয়ে বললেন।

“অথবা রাশিয়ানদের কেউই হয়তো আরবি শিখেছে,” ওয়েডস বললেন, “আমার মতো।”

“তাছাড়া, ন্যাটালি বললেন কিছুক্ষণ পর, “লোকটার গলার ট্যাটু মুসলমানদের সাথে যায় না।”

ডোনাল্ড হেসে উঠলেন কথাটা শুনে, “আমিও একসময় আমার উরুতে নাইকির চিহ্নটা ট্যাটু করিয়েছিলাম।”

“গলাতে তো আর করাননি,” ইনগ্রিড বললো।

কিছুক্ষণ ভাবলেন ডোনাল্ড, “তা ঠিক।”

“আর ইন্টারনেটের ভিডিওটা? আরএসই’র একটা ওয়েবসাইটেই ওটা দেখা গিয়েছিলো প্রথমে,” সুসান বললেন।

“সেটা খুব সহজেই হ্যাঁকিং করে করা সম্ভব, ন্যাটালি জবাব দিলেন, “আমি নিজেও সেটা করতে পারবো।”

“তোমার কি ধারণা, গ্রেগ?” কুপারকে জিজ্ঞেস করলেন রিভস।

“মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এক কথা আর রাশিয়ার মত দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা আরেক কথা,” এক নিঃশ্বাসে জবাব দিলেন তিনি।

“বিশেষ করে আট হাজার পারমাণবিক বোমা আছে যাদের কাছে, বললেন ওয়েডস।

“আমি মনে হয় ভুল শুনেছি। আট হাজার’?” ন্যাটালি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ, আমেরিকাকার চেয়েও বেশি।”

ইনগ্রিড জানে কুপার আর ওয়েডস ঠিক কথাই বলছেন। এটাও জানে, রাশিয়া কর্তৃক প্রেসিডেন্টের অপহরণের ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে কি ঘটবে।

যুদ্ধ।

অশান্তি।

ধ্বংস।

জনসমক্ষে রাশিয়াকে দোষারোপ করার আগে আরও তদন্ত করতে হবে ওদের।

“যদি রাশিয়াই এই কাজ করে থাকে, রিভস বললেন, “তাহলে প্রেসিডেন্ট পুতিনের অগোচরে ঘটানো হয়েছে ব্যাপারটা-এর সম্ভাবনা কিরকম?”

“খুবই কম,” ভ্রূ কুঁচকে জবাব দিলেন ওয়েডস।

“পুতিন কালকেই একটা সংবাদ সম্মেলন করেছে,” কুপার বললেন, “সেখানে সে বলেছে রাশিয়ান সরকার সার্বিক সহযোগিতা করবে প্রেসিডেন্টকে উদ্ধারের জন্যে।”

“যেমনটা বলছিলাম,” ওয়েডস বলে উঠলেন, “এরইমধ্যে ইরাকে সৈন্য পাঠানোর জন্যে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।”

দীর্ঘ একটা সময় কেউ কিছু বললো না।

অবশেষে ইনগ্রিডের দিকে তাকালেন কুপার, বললেন, “আর কাকে ভিডিওটা পাঠিয়েছে হেনরি?”

“যতদূর জানি, শুধু আমাকেই, ইনগ্রিড বললো।

“তারমানে এই ঘরে উপস্থিত সাতজন ছাড়া অন্য কেউ দেখেনি ভিডিওটা,” যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন কুপার।

আবার ইনগ্রিডের দিকে তাকালেন তিনি, “রাশিয়ানরা যদি এই কাজ করে থাকে তাহলে বুঝতেই পারছো কি রকম আলোড়ন তুলবে বিষয়টা। ব্যাপারটা কূটনৈতিকভাবে সামলাতে হবে আমাদের।”

ইনগ্রিড মাথা নেড়ে বললো, “বুঝতে পারছি।”

“সিআইএতে আমার পরিচিত এক বন্ধু আছে,” কুপার বলতে থাকলেন, “আমি ওকে এই লোকটার ট্যাটুর ছবি পাঠাচ্ছি। দেখা যাক কিছু পাওয়া যায় কিনা। আমাদের ডাটাবেজের কোন অপরাধির সাথে সেটা মিলে গেলে সাথে সাথে কাজে লেগে পড়বো আমরা, কথা দিচ্ছি।”

এর চেয়ে বেশি কিছু এই মুহূর্তে ইনগ্রিডও আশা করছে না, “ঠিক আছে।”

.

ওকে যে পানির বোতলটা দেয়া হয়েছে সেটার গায়ে কিছু লেখা আছে। কিন্তু ভাষাটা বুঝতে পারলো না বিলি। পানিটাতে কেমন যেন একটা তেতো স্বাদ। বোধহয় কোন ঝর্ণা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে সেটা, কিংবা হ্রদ থেকে। কিন্তু যে স্যান্ডউইচটা দেয়া হয়েছিল সেটার স্বাদে কোন পার্থক্য ছিলো না। একদম ওর অফিসের পাশের স্যান্ডউইচের দোকানটার মতনই।

ওর খাবার পুরোটা সময় একজন অপহরণকারি বন্দুক হাতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। খাবার সেরে ঘরের কোণায় রাখা একটা বালতির কাছে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে। সেখানে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সেরে উঠলে আবার মুখ বেঁধে ফেলা হয় ওর।

সেটাও প্রায় ছয় ঘন্টা আগেকার কথা। অন্তত ওর কাছে ছয় ঘন্টাই মনে হচ্ছে। আরো বেশিও হতে পারে সময়টা কিংবা কম।

একাই আছে ও।

নাকি সেটা দু’দিন আগের কথা?

ওসবে কিছু যায় আসেনা এখন।

কব্জি উপরে নিচে মোচড়ালো ও।

ছিলে গেছে জায়গাটা।

টেপের নিচ দিয়ে ছড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা অনুভব করতে পারছে ও।

অপহরণকারিদের নিশ্চয়ই দড়ি শেষ হয়ে গেছে। এখন ডাক্ট টেপ দিয়েই কাজ সারছে তারা। বেশ খানিকক্ষণ ধরেই কব্জিটা নাড়াচাড়া করছে ও। কিছুটা ঢিল করতে পেরেছে বাঁধন। এই কাজের এক পর্যায়ে দেয়ালে একটা ফাঁটল চোখে পড়ে ওর। সেখানেই হাতটা ঘষছে ও। হাত বাঁধা অবস্থায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে কাজটা করা মোটেও সহজ নয়। প্রথম দিকে তেমন অসুবিধা না হলেও তিন ঘন্টা পর পুরো শরীরের সব পেশি ব্যথা করছে। বিশেষ করে পায়ের পেশিতে মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে।

কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে কষ্ট করে আবার উঠে বসলো বিলি।

ওপর নিচ করতে শুরু করলো হাতটা।

যেভাবেই হোক নিজেকে মুক্ত করতে হবে।

এটাই ওর বাঁচার একমাত্র আশা।

ওদের বাঁচার একমাত্র আশা।

.

সিআইএ’র বন্ধুর কাছ থেকে বেলা এগারোটার সময় ফোন পায় কুপার। এ পাশ থেকে শুনছিলো ইনগ্রিড, বুঝতে পেরেছে ভালো খবর নয়।

ফোন রেখে দিয়ে জানালেন তিনি, “আমার বন্ধু রাশিয়ার একটা ডাটাবেজ আর এখানকার ছয়টা ডাটাবেজে ছবিটা মিলিয়ে দেখেছে। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।”

দীর্ঘ একটা সময় কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকলো ওরা।

“তাহলে এখন কি করবো আমরা?” রিভস বললেন অবশেষে, “আর সতের ঘন্টা আছে আমাদের হাতে, কিন্তু তাদের টিকিটারও খোঁজ নেই।”

ইনগ্রিড রিভসের দিকে তাকিয়ে হাসলো একবার।

‘তাদের’ বলেছেন তিনি।

কিছুক্ষণ ভাবলো ইনগ্রিড।

একটা মাত্র উপায়েই খোঁজ পাওয়া যেতে পারে তাদের।

একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলো, “রাশিয়া, ইরাক কিংবা অ্যান্টার্কটিকা-যেখানেই থাকুক না কেন, ওদের খুঁজে বের করার একটা উপায়ই আছে। আমাদের জানতে হবে যে প্রেসিডেন্টের আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আসার ঘটনা কে কে জানতো।”

“আর সেটা রাশিয়ানদের কে জানিয়েছে,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন ওয়েডস।

“এরপর তাদের পেট থেকে কথা বের করতে হবে আমাদের, ইনগ্রিড সায় জানিয়ে বললো।

.

রাত নটার মত বাজছে।

আর সাত ঘন্টা আছে হাতে।

এখন পর্যন্ত কেবল অর্ধেক রাস্তা তুষার মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাও শুধু একপাশে কোন মতে জড়ো করে রাখা হয়েছে বরফ। তবে হোয়াইট হাউজ, সিনেট, কংগ্রেস এসবের কার্যক্রম চলবে।

অন্যান্য দিনের মতই।

এবার চালকের আসনে থাকবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কোর্টনি।

কারণ প্রেসিডেন্ট সুলিভাব বেঁচে থাকবেন না কাল পর্যন্ত।

বিলিরও একই পরিণতি।

“কারও কাছে রিপোর্ট করার মত কিছু আছে?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

ওরা সাতজন গত দশ ঘন্টা কাটিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ না বলে পুনঃজিজ্ঞাসাবাদ বলাই ভালো হবে। কারণ যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাদের সবাইকে এর আগেও অন্তত দু-বার আনা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে। ইনগ্রিড জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছে ষাটজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট, হোয়াইট হাউজের ইন্টার্ন আর সিনেটরদের ওপর। অনেককে বাসা থেকে হামার গাড়ি করে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে এ কাজের জন্যে।

“টেনেসির রালফ নামের এক কংগ্রেস সদস্য স্বীকার করেছেন তিনি গতবারের নির্বাচনী ফান্ড থেকে এক হাজার ডলার সরিয়েছিলেন,” রিভস বললেন, “এছাড়া অন্য কোন কিছু জানতে পারিনি আমি।”

“আমিও না,” ন্যাটালি বললেন।

ইনগ্রিড ওর মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আমি যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তারাও কোন সন্দেহজনক আচরণ করেননি।”

“আমার মনে হয় না বাইরে যাবার ব্যাপারটা কাউকে বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট, ওয়েডস বললেন, “এটুকু বুদ্ধি আছে তার মাথায়।”

ইনগ্রিড সম্মতি জানালো।

ওয়েডস ঠিকই বলেছেন, কাউকে জানাবার কথা নয় প্রেসিডেন্টের।

একজন বাদে।

“কি ভাবছো?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

ইনগ্রিড বুঝতে পারলো ছয় জোড়া চোখ ঘুরে গেছে ওর দিকে। সে রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছিলো ও। বোধহয় সেটা ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে সবাই।

“একটা কথা মাথায় ঘুরছে আমার, বিড়বিড় করে বললো ও।

“ঝেড়ে কাশো,” ওয়েডস তাগাদা দিলেন।

লম্বা করে একটা শ্বাস নিলো ও, এরপর বললো, “বিয়ের দিন, আমার মনে হচ্ছিল, তিনি বারবার জানালার দিকে তাকাচ্ছেন।”

“কে?” টেবিলের এক পাশ থেকে প্রশ্ন করলেন রিভিস।

একবার ঢোক গিললো ইনগ্রিড।

“রেড।”

.

সিক্রেট সার্ভিসের সুসান গম্ভীর মুখে ভেতরে প্রবেশ করলেন। হাতের ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, “রেডের আসল নাম টেরি ফ্রেইল। ওর অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাই করে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেও কোন সন্দেহজনক লেনদেন চোখে পড়েনি। তবে প্রথমে একটা ব্যাপার চোখ এড়িয়ে গেলেও পড়ে সেটা ধরা পড়ে-ওর দুটো বাড়িই বন্ধক রাখা ছিলো। আর সেগুলোর সময়সীমা এই মাসেই পার হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কিছুদিন আগে পুরোপুরি পরিশোধ করে দেয়া হয় বন্ধকির টাকা।”

“কত ডলার?” রিভস জিজ্ঞেস করলেন।

“ষোল লক্ষ।”

“বাড়িগুলো কোথায়?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

“একটা এখানে অ্যাডামস মর্গানে, আর আরেকটা ব্রাইটন বিচে।”

“ব্রাইটন বিচ?” চিল্লিয়ে উঠলেন ওয়েডস।

মুখ কালো হয়ে গেলো ইনগ্রিডের।

সেই সাথে অন্য সবার।

ব্রাইটন বিচ।

নিউ ইয়র্কে।

রাশিয়ানদের এলাকা।

.

রেডের অ্যাডাম মর্গানের বাসাটায় পৌঁছুতে বিশ মিনিট লাগলো ওদের। এখানকার সব রাস্তা তুষার মুক্ত করা হয়েছে আগেই। অনেক উচ্চবিত্তের বসবাস এখানে, এরকমটা হওয়াই স্বাভাবিক।

“এত বড় একটা বাড়ির কি দরকার ছিল ওর?” ন্যাটালি জিজ্ঞেস করলেন। “বিয়ে-শাদি করেনি সে। একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনলেই তো হতো।”

“বোধহয় বিয়ের কথা ভাবছিলেন,” ইনগ্রিড বললো, “অদূর ভবিষ্যতে।”

হেনরির অ্যাপার্টমেন্টটার কথা না ভেবে পারলো না ও। ওদের যখন নিজেদের ছোট্ট একটা পরিবার হবে তখনও কি হেনরি সেখানেই থাকতে চাইবে? বাচ্চা নেবার জন্য তৈরি ও নিজে, কিন্তু হেনরির সে ব্যাপারে কি ধারণা? এসব নিয়ে কথা হয়নি ওদের মধ্যে, যদিও ওর এখন বত্রিশ বছর চলছে।

আসলেও কি তৈরি ও?

“সব ঠিকঠাক,” সামনের দরজাটা খুলে বললেন কুপার। রিভস আর তিনি প্রথমে ভেতরে ঢুকলেন। অবশ্য ভেতরে সন্দেহজনক কিছু আছে বলে মনে হয় না।

টাস্ক ফোর্সের অন্য সদস্যদের মধ্যে ওয়েডস এখন তার পরিচিত সব রাশিয়ান মিত্রের সাথে কথা বলে দেখছে। ডোনাল্ড রাশিয়ান চোরাচালানিদের কাছ থেকে রেড সম্পর্কে কিছু জানা যায় কিনা সেটা খতিয়ে দেখায় ব্যস্ত। আর সুসান হোয়াইট হাউজে রেডের লকার তল্লাশি করতে গিয়েছে।

ব্রাইটন বিচে এফবিআই’র নিউ ইয়র্ক শাখার একদল অফিসার রেডের বাসায় তল্লাশির প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ন্যাটালি আর ইনগ্রিড কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে কুপার আর রিভসের সাথে পুরো বাসায় চিরুনি অভিযান চালালো পরের এক ঘন্টা।

ইনগ্রিড রেডের প্রত্যেকটা ড্রয়ার খুলে পরীক্ষা করে দেখেছে। কোন আলমারিও বাদ দেয় নি। কিন্তু কিছু পায়নি কোথাও। ও এখনও মনে মনে আশা করছে, রেডের কাছ থেকে ফাঁস হয়নি কথাটা। ব্রাইটন বিচের বাড়ি আর বন্ধকির টাকার হয়তো সহজ কোন ব্যাখা আছে। পরিবারের কেউ হয়তো দিয়েছিল টাকাটা। ব্রাইটন বিচের বাড়িটা শুধুমাত্র বিনিয়োগের জন্যেও কেনা হতে পারে।

ইনগ্রিড চাচ্ছে না, এসবের সাথে রেডের কোন সম্পর্ক থাকুক। লোকটাকে খুবই পছন্দ করতো ওরা। আর প্রেসিডেন্ট সুলিভানের সাথে তার তিরিশ বছরে সম্পর্ক, ভাইয়ের মতন।

কথা যদি ফাঁস করেই থাকেন, তাহলে মেরে ফেলা হলো কেন?

“এদিকে আসুন সবাই,” ন্যাটালির গলার স্বর শোনা গেলো লিভিং রুম থেকে।

বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিংরুমে একটা কাউচের ওপর ন্যাটালিকে বসে থাকতে দেখলো ইনগ্রিড। কুপার আর রিভস এরমধ্যেই এসে পড়েছেন সেখানে।

“দেখে মনে হচ্ছে, রেড ফ্যান্টাসি ফুটবলের খুব বড় ভক্ত ছিল,” ন্যাটালি বললো, “এই মৌসুমে প্রায় ষাট হাজার ডলার এখানে খরচ করেছে সে।”

“ষাট হাজার?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

“আর পোকারে বিশ হাজার,” মাথা নেড়ে বললেন ন্যাটালি।

“এই তথ্য আগে পেলাম না কেন আমরা?” রিভস জিজ্ঞেস করলেন।

ন্যাটালি অ্যাকাউন্টের মূল পেজে ক্লিক করে ক্রেডিট কার্ডের শেষ চার ডিজিট মিলিয়ে দেখলেন। “সুসান যে কার্ড সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে সেটার সাথে এটার কোন মিল নেই।”

“এটা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যাবে না?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন, “আর কি কি কাজে টাকা খরচ করা হয়েছে সেটা জানা যেত তাহলে।”

“আমি দেখছি,” এই বলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে কল দিলেন ন্যাটালি।

ঠিক এই সময়ে কুপারের ফোন বেজে ওঠায় ওখান থেকে সরে গেলেন তিনি।

ইনগ্রিড ওর নিজের ফোনটা বের করলো।

প্রায় বারোটা।

কুপার ফিরে এসে বললেন, “নিউ ইয়র্কের অফিস থেকে ফোন করেছিল। ব্রাইটন বিচের বাড়িটাতে কাউকে পাওয়া যায় নি। এখনও তল্লাশি চালাচ্ছে ওরা। কিন্তু কিছু পাবে বলে মনে হয় না।”

ইনগ্রিড মাথা দুলিয়ে বললো, “কিছু পাওয়া গেলে সেটা একটু বেশি কাকতালীয় হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এটা ছাড়া অন্য কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে।”

”হয়তো ওয়েডস কিছু জানাতে পারবে আমাদের,” রিভস বললেন, “রাশিয়ার মধ্যে কোন জায়গার ঠিকানা।”

“বেশি ভরসা করো না,” এই বলে আবার তল্লাশির কাজে ফিরে গেলেন কুপার।

*

অধ্যায় ৯

সবাই চলে গেছে।

জর্জ অবশেষে নিজের গাড়িটা বরফের ভেতর থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর সারাদিন ধরে সবাইকে যার যার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছে। ইনগ্রিডের বাবা, মা, বোন আর বান্ধবিদের হোটেলে প্রথমে হোটেলে নিয়ে এরপর বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়েছে ও।

রাস্তায় কিছু দূর পর পর চেকপোস্ট বসার কারণে আর পিচ্ছিল রাস্তার দরুণ এই বিশ মাইলের মধ্যে আসা যাওয়া করতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লেগেছে বেচারার।

আসার পথে একটা সুপার শপ থেকে বনির জন্যে কিছু সদাইপাতিও করেছে। আর এসবই আমার বাবাকে মেঝে থেকে কার্পেট তুলে ফেলতে সাহায্য করার পরে।

“জর্জের কাছে শুনলাম সেইফওয়ে পার্কিংলটে নাকি তিরিশ ফিট উঁচু বরফের দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে,” বাবা বললেন।

“তিরিশ ফিট?”

“হ্যাঁ, সব স্নো প্লেয়ারগুলো ওখানেই বরফ জমা করে। খালি পার্কিংলটগুলোই বরফ জমা করার প্রধান জায়গা। ফেডেক্স ফিল্ডের পার্কিংলটের অবস্থা দেখলে হা হয়ে যেতে।”

ওয়াশিংটন রেডস্কিনসের খেলা ফেডেক্স ফিল্ডেই হয়। ম্যারিল্যান্ডে অবস্থিত ওটা।

“খবরে কি বলছে?” জিজ্ঞেস করলাম, “রাশিয়ানদের ব্যাপারটা ফাঁস হয়েছে?”

বাবা মাথা নেড়ে না করে দিলেন।

অবাক হলাম না।

পৃথিবীর তৃতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রকে প্রেসিডেন্ট অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত করা কোন সহজ কাজ নয়। তা-ও শুধুমাত্র একটা ট্যাটুর ভিত্তিতে।

বাবা বললেন, “ভাইস প্রেসিডেন্ট আর ফার্স্ট লেডি একটা সংবাদ সম্মেলন করেছে অবশ্য।”

“ফার্স্ট লেডির কি অবস্থা?”

কিম সুলিভানের সাথে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি আমার কিন্তু কয়েক বছর আগে প্রেসিডেন্টকে নির্দোষ প্রমাণের জন্যে যখন গবেষণা চালিয়েছিলাম তখন তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। সুলিভানের সাথে ওহাইওতে প্রথম দেখা হয় তার। এরপর একসাথে দু-জন ভার্জিনিয়াতে চলে আসেন। এখানেই প্রথমে গভর্নর নির্বাচিত হন সুলিভান। সবাই বেশ পছন্দ করেন মহিলাকে।

“বেশ ভালোভাবেই নিজেকে সামলাচ্ছেন তিনি, তবে কয়েকবার ধরে এসেছিল তার গলা কথা বলার সময়ে। বেশি সময়ও নেননি তিনি। সবাইকে ধৈর্য ধরে প্রার্থনা করতে বলেছেন।”

“আর ভাইস প্রেসিডেন্ট? তিনি কি বললেন?”

বাবা কোর্টনির কথা পুনরাবৃত্তি করলেন। যদি ব্যাপারটা তার একান্ত সিদ্ধান্ত হতো তাহলে কালক্ষেপণ না করেই ইরাক থেকে সব সৈন্য ফিরিয়ে নিতেন তিনি। কিন্তু আমেরিকাকান প্রশাসন অপরাধিদের সাথে মধ্যস্থতা করে না। তিনি বলেন, অপহরণকারি কারা এ সম্পর্কে তথ্য আছে তাদের কাছে। আর প্রেসিডেন্টের ক্ষতি হোক আর না হোক তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সকল জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে ঘোষণা করবেন।”

“কিন্তু এর পেছনে তো ওসব কোন সংগঠনের হাত নেই!”

বাবা আমাকে বনির কম্পিউটার যে ঘরে রাখা সেখানে নিয়ে আসলেন। সেখানে দেখলাম বেশ কয়েকটা জঙ্গি সংগঠন প্রেসিডেন্টকে অপহরণের

তবুও আমার বিশ্বাস হলো না ব্যাপারটা।

অবশ্যই তারা এসবের কৃতিত্ব নিতে চাইবে। আমেরিকাকার প্রেসিডেন্টকে অপহরণের ঘটনা তো আর অহরহ ঘটে না।

ভিডিওগুলো দেখা শেষ হলে খাবার নিয়ে আসার জন্যে উঠে গেলেন বাবা। জর্জ যখন আমার বিয়ের অতিথিদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছিল ইসাবেল ততক্ষণে স্প্যাগেটি রান্না করে রেখেছে আমাদের জন্যে।

কম্পিউটারের ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা এগারো বাজছে।

আর উনপঞ্চাশ মিনিট আছে।

আমার নিজের জন্যে গুণছি না এবার।

বিলি আর সুলিভানের জন্যে গুণছি।

.

হুটোপুটির আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকালাম।

ল্যাসি ঘরে ঢুকে প্রথমে লাফ দিয়ে কম্পিউটার টেবিলের ওপর উঠে শেষে আমার কোলে আশ্রয় নিলো।

“কি খবর?” এই বলে ওর কানের পেছনটা চুলকে দিলাম। মিয়াও।

“কি করলি তোরা সারাদিন?”

মিয়াও।

“মজা করলি? এর মধ্যে কি চেস্টারকে ভয় দেখনোও পড়ে?”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, ঐ কঙ্কালের মত কুকুরটার কথাই বলছি।”

মিয়াও।

“গ্ৰেচেন? ওর কার কাছ থেকে দূরে থাকার কথা তোর, মনে আছে তো?”

মিয়াও।

“তাই নাকি? কিন্তু বনি আমার উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখেছেন সকাল বেলা,” এই বলে নীল রঙের কাগজের টুকরোটা ওকে দেখালাম, “তুই কথা রাখিসনি।”

ল্যাসি লাফ দিয়ে আমার কোল থেকে পালিয়ে যাবার আগেই ক্যাঁক করে চেপে ধরলাম ওকে। এরপর গলা পরিস্কার করে পড়া শুরু করলাম :

‘প্রিয় হেনরি, দয়া করে তোমার বদ বিড়ালটাকে গ্ৰেচেনের কাছ থেকে দূরে রাখবে। এমন অবস্থায় ওকে পেয়েছি আমি যেটা লেখার রুচি হচ্ছে না। বনি।‘

“আমার বদ বিড়াল? লেখার রুচি হচ্ছে না?” ওর মাথায় একটা বাড়ি দিলাম, “তুই কথা দিয়েছিলি!” আরেকটা বাড়ি দিলাম। “গ্ৰেচেনের বয়স একশ তেত্রিশ বছর।”

যদি একটা বিড়ালের চেহারা লাল হয়ে যাওয়া সম্ভব তাহলে তাই হলো ল্যাসির সাথে।

মিয়াও।

“হ্যাঁ, একশ তেত্রিশ বছর!”

মিয়াও।

“না, তোর চামড়াও এখন ওরকম ঝুলে যাবে না।”

এ সময় বাবা খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সেখান থেকে কিছুটা নিয়ে ওকে খাওয়ালাম। এরপর প্রথম ভিডিওটা বের করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে আমার দেখার ইচ্ছে কতবার ইউটিউবে দেখা হয়েছে ওটা। নিরানব্বই লক্ষ বার।

এই ভিডিওটাই ইন্টারনেটের সর্বকালের সবচেয়ে বেশিবার দেখা ভিডিও কিনা সেটা জানতে গুগলে সার্চ দিলাম।

পঁচিশতম এটা। সবচেয়ে বেশিবার দেখা ভিডিওটার নাম দেখলাম ‘গ্যাংনাম স্টাইল।

ক্লিক করলাম সেটাতে।

মজার ভিডিওটা!

এমনকি ল্যাসিও ওটা থেকে চোখ সরাতে পারছে না।

মিয়াও।

“হ্যাঁ, এশিয়ান টিম্বারলেক লোকটা!”

আমার দিনের পাঁচ মিনিট দুই সেকেন্ড নষ্ট করে আবার আগের ভিডিওটা দেখায় ফিরে গেলাম।

ভিডিওটার মাঝখানে একটা শব্দের কারণে অপহরণকারিরা কিছুক্ষণের জন্যে জমে গিয়েছিল। ল্যাসিকেও দেখলাম ঠিক সেই মুহূর্তেই জমে যেতে। ওড় কান খাড়া হয়ে উঠেছে।

মিয়াও।

দশ সেকেন্ড পেছনে টানলাম।

চালু করলাম।

আবার কান খাড়া হয়ে গেলো ওর।

আবার একই কাজ করলাম।

একই ফল, প্রতিবারই কান আপনা আপনি খাড়া হয়ে যাচ্ছে ওর।

“কি হয়েছে?”

মিয়াও।

“কি বলছিস এসব?”

মিয়াও।

আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে স্পিকারের কাছে কান নিয়ে গেলাম।

আমার কুঁজোড়া উঁচু হয়ে গেলো।

“ঠিক বলেছিস,” ওকে বললাম।

পেছনের কিছু ফেঁটে পড়ার আওয়াজের পর আবছা ভাবে একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।

কিন্তু ল্যাসির মতে ওটা অন্য কোন কুকুর নয়।

মারডকের আওয়াজ ওটা।

.

নিশ্চিত হবার জন্যে আরও তিনবার শুনলাম।

আওয়াজটা কোন মিসাইল কিংবা এয়ার স্ট্রাইকের নয়, বরফের চাই ভেঙে পড়ার কারণে ওরকম বিকট শব্দ হয়েছিল।

ভিডিওটা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা রাশিয়াতে নয়, বাবার বাসা থেকে দশটা বাসা দূরে ধারণ করা হয়েছে।

.

“দাঁড়াও,” বাবা বললেন, “আবার সবকিছু খুলে বলো আমাকে।”

লম্বা করে শ্বাস নিলাম একবার, “ঘটনার পরের দিন তিন মাস্তানকে বাইরে তুষারে খেলার জন্যে বের হয়েছিলাম আমি। রাস্তার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছিলাম আমরা। সেখানে একটা বাসার ছাদ থেকে বরফের চাই ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম। বেশ জোরে শব্দ হয়েছিল। মারডক ভয় পেয়ে ডেকে ওঠে সে সময়। ভিডিওটাতে বরফের পতনের শব্দ আর মারডকের ডাক, দুটোই কানে আসবে আপনার।”

“মানে,” চশমাটা নাকের ওপরে ঠেলে দিয়ে বাবা বললেন, “সুলিভান আর বিলিকে এই রাস্তার একটা বাসাতে আটকে রাখা হয়েছে এটা বলতে চাচ্ছো তুমি?”

মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

“গোটা কাজটা দীর্ঘ পরিকল্পনা করে করা হয়েছে,” বললাম, “এক রাতের সিদ্ধান্তে করা হয়নি কিছু। কোনভাবে রাশিয়ানরা জানতে পেরেছিল, সুলিভাব আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আসবেন। কিভাবে সেটা জানি না আমি, কিন্তু হোয়াইট হাউজের উদ্দেশ্যে একটা বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছিলাম আমরা, সেখান থেকে হয়তো। যাইহোক, তারা কোনভাবে এই এলাকায় একটা বাসা ভাড়া নেয় এয়ার বিএনবি’র মাধ্যমে। কিংবা কিনেই নেয় হয়তো। এরপর সেখানে থেকে নজর রাখা শুরু করে। বিয়ের রাতে সুলিভান আর বিলিকে অপহরণ করে হয়তো শহর থেকে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল তাদের, কিন্তু তুষার ঝড়ের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। তাই সেই বাসাটাতেই ফেরত যায় তারা।”

“কথাটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু তোমার এটা মনে হচ্ছে কেন, এখনও সেখানে আছে তারা? রাস্তা পরিস্কারের পর তো এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কথা।”

“অসম্ভব। এফবিআই’র লোকজন প্রতিটা রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়েছে একটু পর পর। শহর থেকে বের হবার আর ঢোকার রাস্তায় কড়া তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এছাড়া আমাদের বাসার বাইরে তো ফেয়ারফ্যাক্স পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গাড়ি পাহারা দিয়েছে ঘটনার পরের দু-দিন। তাদের একমাত্র সুযোগ ছিল গতকাল, কিন্তু সেটাও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।”

“কিন্তু এফবিআই’র লোকজন এই এলাকার প্রতিটা বাড়িতে কড়া নেড়ে দেখেছে। কেউ যদি এয়ার বিএনবি’র মাধ্যমে বাসা ভাড়া দেয় তাহলে সেটাও তো জানতে পারার কথা তাদের।”

“যদি কেউ দরজা না খুলে তাহলে তো আর তাদের জানার কোন উপায় থাকবে না। তারা হয়তো ধারণা করেছে যে সেখানকার বাসিন্দারা ঝড়ের কারণে আটকা পড়েছে কোথাও।”

“হতে পারে।” বাসার বর্ণনাটা দিলাম তাকে, “আপনি বুঝতে পারছেন কোন বাসার

“মনে হয়।”

“জানেন কে থাকে সেখানে?”

“ওখানে যে পরিবারটা থাকতো তাদের চিনতাম আমি, কিন্তু গত বছর চলে গেছে তারা। নতুন মালিকদের সম্পর্কে ধারণা নেই। এত বেশি বাসা বদল হয় এই এলাকায় যে সবার সাথে যোগাযোগ রাখা অসম্ভব।”

তাছাড়া খুব বেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখার মত মানুষ নন। তিনি। মারডকের সাথেই দিন চলে যায় তার।

ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা একত্রিশ বাজছে।

ইনগ্রিডকে জানাতে হবে।

এ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা উচিৎ ওদের। ভুলও হতে পারে আমার, তবুও।

বনির ল্যান্ডফোনটা কানে ঠেকালাম।

কোন ডায়াল টোন নেই।

দৌড়ে কম্পিউটার ঘরে ফিরে এসে বাবাকে বললাম, “ফোনে লাইন নেই।”

বাবা মুখ কালো হয়ে গেলো। বললেন, “ওহ্! তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। বরফ জমে ভারি হয়ে যাওয়ায় কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে বৈদ্যুতিক তার। আজ অর্ধেক বেলা বিদ্যুৎ পাইনি আমরা।”

“কারো মোবাইল ফোন আছে?”

কিছুক্ষণ ভাবলেন বাবা, এরপর মাথা নেড়ে না করে দিলেন। “মিনিস্টার রবার্ট বাদে অন্য সবার ফোন নিয়ে গিয়েছে অপহরণকারিরা। আর ওরটাও গাড়িতে ছিলো। তাছাড়া অর্ধেকের মত ফোন টাওয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিদ্যুৎ স্বল্পতার কারণে। নেটওয়ার্ক নেই ওর ফোনে।”

“তাহলে আমাদের পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে এখন।”

“সে সময় নেই আমাদের হাতে। দশ মিনিট লাগবে এখান থেকে পুলিশ স্টেশনে যেতে আর সেটাও যদি গাড়ি জোরে চালাই তাহলে। এরপর আরো দশ মিনিট লাগবে পুলিশের এখানে আসতে। ততক্ষণে প্রেসিডেন্ট আর বিলির সময় শেষ হয়ে যাবে।”

“কি বলতে চাচ্ছেন?”

লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লেন তিনি, বললেন, “যা করার আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।”

.

ইনগ্রিড আর ফেয়ারফ্যাক্স পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে ইমেইল পাঠালাম আমরা। গুগল ফোনের সহায়তায় একবার চেষ্টা করলাম ইনগ্রিডের সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু সেজন্যে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফোন দেয়ার নিশ্চয়ই আরো মাধ্যম আছে, কিন্তু সেগুলো খুঁজে বের করতে করতে সুলিভান আর বিলি দু-জনের সময়ই শেষ হয়ে যাবে।

বাবার বেজমেন্টে যখন আমরা ঢুকি তখন তিনিটা আটত্রিশ বাজছে।

“আমি ভেবেছিলাম আপনার একটা বন্দুক আছে,” বললাম।

“আছে তো,” এই বলে বন্দুকের মত দেখতে একটা যন্ত্র আমাকে দেখালেন তিনি।

“ওটা একটা নেইল গান (পেরেক বসানোর যন্ত্র)।”

“বন্দুকের মতোই।”

“না, মোটেও না,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।

মিয়াও।

ঘুরে দাঁড়ালাম।

ল্যাসিম, মারডক আর আর্চি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও অংশ নিতে চায় অভিযানে।

মিয়াও।

“তোর কি আসলেও ধারণা, খুঁজলে একটা তলোয়ার পাওয়া যাবে এখানে?”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, একটা তলোয়ার থাকলে তো ভালোই হতো।”

মিয়াও।

“কিংবা মেশিন গান।”

কিন্তু একটা অ্যান্টিকাটার ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পেলাম না। দেয়ালের এক পাশ থেকে লোহার রেঞ্চটা তুলে নিলাম।

আর বাবাকেও নেইল গানটা সঙ্গে নিতে বললাম।

একেবারে খালি হাতে যাওয়ার চেয়ে এগুলো সাথে থাকা ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *