২. দড়িগুলো কাটার মত

অধ্যায় ৩

দড়িগুলো কাটার মত কিছু খুঁজে পেতে তিরিশ সেকেন্ডের মত সময় লাগলো আমার। একটা বক্স কাটার নিয়ে এসে ইনগ্রিডের পা আর হাতের বাঁধন কেটে ফেললাম। এরপর হাত ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম।

ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো ও। দীর্ঘ সময় এভাবে বেকায়দা অবস্থানে থাকার জন্যে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। বাধ্য হয়ে দেয়ালে হেলান দিতে হলো ওকে।

“বিলিকেও নিয়ে গেছে ওরা,” একটু ধাতস্থ হয়ে বললো সে।

“বলো কি!”

আমার জানতে ইচ্ছে করছে কারা ধরে নিয়ে গেছে ওকে, কিন্তু প্রশ্নটা করলাম না এখন। তার জন্যে সামনে অনেক সময় পাওয়া যাবে।

“তোমার ফোনটা দাও আমাকে,” ব্যথার মাঝেই আস্তে আস্তে আমার উদ্দেশ্যে বললো ও।

আমার ফোনটা ওকে দিয়ে দ্রুত ও পরেরজনের কাছে চলে গেলাম।

ইসাবেল।

টেপটা তুলে ফেললাম ওর মুখ থেকে, “গ্রাসিয়াস আ’দিওস,” স্প্যানিশে বলে উঠলো সে।

ওর বাঁধনও কেটে ফেললাম আমি, এরপর চেষ্টা করলাম দাঁড়াতে সাহায্য করতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। ইনগ্রিডের চেয়ে খারাপ অবস্থা ওর। এখানকার এগারোজন মানুষই নিশ্চয়ই চেষ্টা করেছিলো বন্দি থাকা অবস্থায় রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে, কিন্তু সেটার জন্যে পর্যাপ্ত জায়গা নেই এখানে।

এরপর মিনিস্টার রবার্টের বাঁধন খুলে দিলাম, তারপর একজন ব্রাইডসমেইড-মেগান বোধহয়। এদের দুজনের পর বাবার কাছে। আসলাম।

বাবার সাইনাসের সমস্যা আছে। তিনি যখন নাক ডাকেন তখন মনে হয় যেন বুলডোজার চালাচ্ছে কেউ। শুধু নাক দিয়ে গত তেইশ ঘন্টা যাবত নিঃশ্বাস নিতে হয়েছে তাকে, একটা সরু স্ট্র দিয়ে শ্বাস নেবার সমান ওটা। তার মুখের টেপটা খুলে ফেলার সাথে সাথে হা করে শ্বাস নিতে শুরু করলেন।

তার চশমাটা ঠেলে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিলাম।

জোর করে একবার হাসার চেষ্টা করলেন তিনি, চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন।

“আমি ঠিক আছি,” এই বলে তার হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দিলাম।

তার হাতে বক্স কাটারটা দিয়ে বললাম অন্যদের সাহায্য করতে, নিজের জন্যে অন্য কিছু খুঁজতে লাগলাম।

“ড্রয়ারে কেঁচি আছি দেখো,” বললেন তিনি।

দৌড়ে গিয়ে কেঁচিটা খুঁজে বের করলাম। বেজমেন্টে ফেরত আসার পথে রান্নাঘরে ফ্রিজটার কাছে চলে গেলাম। চব্বিশ ঘন্টা পানি না খেয়ে থাকলে কেউ হয়তো মারা যায় না তবে ভীষণ কষ্ট হয়। যতগুলো সম্ভব ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে নিলাম।

ফিরে দেখি ইনগ্রিড তখনও ফোনে কথা বলছে। ওকে এক বোতল পানি দিলাম। কানে ফোনটা ধরে রেখেই বোতলটা সাবাড় করে ফেললো ও। বোতলটা পাশে ফেলে দিয়ে বিয়ের পোশাক দেখিয়ে বললো, “এটা থেকে বেরুতে হবে আমার।”

আমাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল ও। এখনও খোঁড়াচ্ছে একটু একটু।

বাবা ইনগ্রিডের মা-বাবার বাঁধন খুলে ফেলেছেন এতক্ষণে। এখন বনিকে মুক্ত করছেন। তাদের দুজনের হাতেই দু’বোতল পানি ধরিয়ে দিলাম। এরপর হাঁটু গেঁড়ে বসে বাবাকে সাহায্য করা শুরু করলাম। রেবেকার পায়ের বাঁধনগুলো ছিঁড়ে ফেললাম মুহূর্তেই। লাল হয়ে গিয়েছে মেয়েটার চেহারা।

বাবা এখন অন্যদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করছেন। বাকি তিন বন্দিকে মুক্ত করার দায়িত্ব আমার।

জর্জ, মারডক আর ল্যাসি।

জর্জের মুখ থেকে টেপটা খুলে ফেললাম।

“ওদের মুক্ত করুন আগে,” বললেন তিনি।

“ঠিক আছে,” তার মানবিক বোধ নাড়া দিয়ে গেল আমাকে।

মারডক আর ল্যাসির দিকে তাকালাম।

মারডকের মুখের চারপাশটা কয়েকবার টেপ পেঁচিয়ে বাঁধা হয়েছে। আর ওর চার পা একসাথে বাঁধা হয়েছে দড়ি দিয়ে। ল্যাসিকে অবশ্য বড় হুমকি মনে করেনি হামলাকারিরা। একটা দড়ি দিয়ে মারডকের পেছনের পায়ের সাথে বাঁধা হয়েছে ওকে। দড়িটা গিয়েছে ওর গলার কাছ দিয়ে।

দড়িটা কেটে ল্যাসিকে তুলে নিলাম।

মিয়াও।

“ঠিক আছে ও। লন্ড্রি ঘরে লুকিয়ে ছিল।”

দ্রুত একবার আমা নাক চেটে দিল ও। ওকে নিচে নামিয়ে রাখার সাথে সাথে আর্চির খোঁজে চলে গেলো।

এরপর সাবধানে মারডকের নাকের চারপাশ থেকে টেপ খুলতে লাগলাম। একেবারের শেষ প্যাঁচটা খোলার সময় বেচারার ব্যথা লাগবেই, যত আস্তেই খুলি না কেন।

“আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজ খোলার মত করে এটা খুলবো আমি, ঠিক আছে?”

টান দিয়ে খুলে ফেললাম বাকি টেপটুকু। গুঙিয়ে উঠলো মারডক। তবে খুব দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আমার মুখ চেটে দিল একবার। ওর পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম এই ফাঁকে।

সবার শেষে জর্জকে মুক্ত করলাম।

তিনটা চোদ্দ বাজছে এখন।

.

বনিকে কোলে নিয়ে ওপরে ওঠার সময় ইনগ্রিডের গলার আওয়াজ কানে আসলো, “এটা একটা ক্রাইম-সিন। কেউ কিছু ধরবেন না আর খুব সাবধানে পা ফেলবেন।”

“সবদিকে দেখি চারফুট তুষার জমে গেছে। আমি বাসায় কিভাবে যাবো?” মিনিস্টার রবার্টের স্বর শুনতে পেলাম।

“অল্প সময়েই পুলিশের লোকজন এসে পড়বে,” ইনগ্রিড বললো।

“স্নো প্লেয়ার ছাড়া এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া অসম্ভব,” বাবা বললেন, “গত তিরিশ বছরে এমন তুষারপাত হতে দেখিনি আমি।”

“আমরা কোথায় যাবো এখন?” ইনগ্রিডের বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

বনিকে নিয়ে আমি সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে গিয়েছি। আমার কানের মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন তিনি, “সবাই আমার বাসায় আসতে পারে।” একটু থেমে আবার বললেন, “মনোপোলি আছে ওখানে।”

অন্য সময় হলে হেসে ফেলতাম কিন্তু এখন সে শক্তিটুকুও নেই। বনিকে দেয়ালের পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।

সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এক হাতে পানির বোতল আরেক হাতে এনার্জি বার। চব্বিশ ঘন্টা পর পানি আর ক্যালোরি পেয়ে একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।

ইচ্ছে করে গলা পরিস্কার করলাম দু-বার।

সবার মনোযোগ আমার দিকে ঘুরে গেলো। বললাম, “যেমনটা ইনগ্রিড বললো, এটা একটা ক্রাইম-সিন, এখানে থাকা চলবে না আমাদের আর তুষারঝড়ের কারণে বেশি দূরে কোথাও যাওয়াও যাবে না,” এটুকু বলে বনির দিকে ইঙ্গিত করে দেখালাম, “মিস বনি প্রস্তাব দিয়েছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত তার বাসায় গিয়ে থাকতে পারি আমরা।”

ইনগ্রিডের দিকে তাকালাম।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ও।

বাবার দিকে ঘুরে বললাম, “অবশিষ্ট যা লাসানিয়া আছে একটা বক্সে নিয়ে নিন। সাথে অন্য খাবার যা আছে সেগুলোও প্যাক করে ফেলুন। কে

জানে কতদিন লাগবে এই ঝামেলা মিটতে।”

মাথা নেড়ে কাজে লেগে পড়লেন তিনি।

সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “বনির বাসা উল্টোপাশের রাস্তাটাতেই। জর্জ, আমি আর ডন গিয়ে বরফ পরিস্কারের চেষ্টা করি আগে।”

“আরেকটা কথা,” বললাম, “বনির বাসাতে মনোপোলি খেলার সুযোগও পাওয়া যাবে।”

.

তিনটা ছাব্বিশের ভেতরে সবাই বনির বাসায় এসে পড়লো।

আমি আবার বরফ মাড়িয়ে বাবার বাসায় ফেরত গেলাম। এখনও তুষারপাত কমেনি।

“ইনগ্রিড,” ডাক দিলাম।

“এই তো আমি,” সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে জবাব দিলো ও। বিয়ের পোশাক পাল্টে জিন্স আর একটা সোয়েটার পরেছে ও। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচিয়ে বললো, “বাথরুম যে এত শান্তির জায়গা সেটা আগে কখনো বুঝিনি!”

“জানি আমি,” এই বলে জড়ীয়ে ধরলাম ওকে।

দীর্ঘ একটা সময় একে অপরকে ছাড়লাম না। এরপর বললাম, “ভেবেছিলাম তোমাকে আর দেখতে পাবো না।”

আবার আমার কাঁধে মুখ গুঁজে দিল ও।

বন্দি থাকা অবস্থায় ওই সাহস যুগিয়েছে সবাইকে, আশ্বাস দিয়েছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না।

“সময়ের ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না ওখানে,” একবার নাক টেনে বললো ও। “আমার মনে হচ্ছিল, রাত তিনটা অনেক আগেই পার হয়ে গিয়েছে আর তোমাকে হয়তো ওরা-”

থেমে গেল ও। চোখের পানি মুছে দিলাম হাত দিয়ে। এরপর বললো, “অবশেষে তোমার পায়ের আওয়াজ পাই আমরা।”

আর দুই মিনিট জড়িয়ে ধরে রাখলাম ওকে। এরপর আমাদের দৃষ্টি গেলো মেঝেতে পড়ে থাকা মার্শালের মৃতদেহের দিকে।

“বেচারা লিন্ডা, আস্তে আস্তে বললো ও, “ওকে ফোন করতে হবে আমারই। বিলির মা’কেও জানাতে হবে। উফ!”

পকেট থেকে ফোন বের করে ও বুঝতে পারলো ওটা আমার। ওদের নম্বর নেই এটাতে।

রেডের দিকে তাকালাম।

আমি জানি না ওর কোন পরিবার আছে কিনা।

ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করলো আমার দৃষ্টি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছিল?”

লম্বা করে একবার শ্বাস নিল ইনগ্রিড, এরপর বললো, “তোমাকে শুইয়ে দিয়ে নিচে নেমে আসি আমি। বাইরের তুষারপাতের কারণে কারও যাওয়ার তাড়াহুড়ো ছিল না। নাচতেই থাকি আমরা।”

“সুলিভানও? আমি তো ভেবেছিলাম তিনি হয়তো ঠিক চারটার সময় চলে যাবেন।”

“হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছিল অন্যদের মত তিনিও উপভোগ করছেন সবকিছু। মার্শালের সাথে বেশ খানিকটা সময় কোণায় বসে আলাপ করেছিলেন, দুটো গানে সবার সাথে নেচেছেনও।”

“রেড যে তাকে তাড়া দেয়নি এটা শুনে অবাক হচ্ছি।”

“অতটা চিন্তা করছিলেন না তারা। রেঞ্জ রোভারটা ছিল তো সাথে। তাছাড়া রেড কিছুক্ষণ পর পর জানালা দিয়ে বাইরে নজর রাখছিল।”

রাস্তার পাশে এখনও রেঞ্জ রোভারটা আছে নাকি? ওটা ট্র্যাক করা যায়? পারার সম্ভাবনাই বেশি। প্রেসিডেন্ট সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এসেছিলেন এখানে, নিশ্চয়ই গাড়িটা অন্য কোনভাবে জোগাড় করা হয়েছিল।

আরেকবার লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলো ইনগ্রিড, “সাড়ে চারটার দিকে মেগান অনেক আগের একটা গান ছাড়লে তিন বান্ধবি মিলে নাচা শুরু করি আমরা। সবাই হাসছিল আর উপভোগ করছিলো দৃশ্যটা। এসময় হঠাৎ দরজা খুলে যায়। তিনজন লোক চিল্লাতে চিল্লাতে ভেতরে ঢোকে।”

“সন্ত্রাসি?”

“হ্যাঁ। কালো প্যান্ট শার্ট পরনে। মাথায় কালো রঙের হুডি। শুধু চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না ওদের। একজনের বোধহয় দাড়ি ছিল।”

প্রতিদিন হয়তো এক ঘন্টা জেগে থাকি আমি। খুব বেশি খবরও দেখি । কিন্তু বর্ণনা শুনে এটুকু বুঝতে পারলাম, কোন জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল হয়তো লোকগুলো।

“নেতা জাতীয় লোকটা আরবিতে সবাইকে নির্দেশ দিতে শুরু করে আর মেঝেতে শুয়ে পড়ার ইঙ্গিত করে,” ইনগ্রিড বলতে থাকলো, “মার্শাল আর রেড তাদের কথা শুনতে অস্বীকৃতি জানায়। মার্শাল একজনের দিকে তেড়ে যেতে নেয়…রেড ওকে থামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দেরি হয়ে যায় ততক্ষণে। মার্শালের বুকে দু-বার গুলি করে ওরা, এরপর রেডকেও। সাইলেন্সর লাগানো ছিল, প্রতিবেশিরাও নিশ্চয়ই কিছু শুনতে পায়নি। এরপর সবার মুখে ডাক্ট টেপ পেঁচায় আর হাত পা বেঁধে ফেলে ওরা। ফোন, ঘড়ি এসব কেড়ে নেয় আগেই। এমনকি ভিডিও ক্যামেরাটাও নিয়ে গেছে। এরপর সবাইকে বয়লার ঘরে নিয়ে আটকে ফেলে।”

ওর হাতের দিকে তাকালাম। চার ক্যারেটের যে হিরের আঙটিটা দিয়েছিলাম ওকে সেটা নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়েছে গোলমালের সময়। ওখানটা খালি এখন।

মাথা নেড়ে ভাবনাটা দূর করে জিজ্ঞেস করলাম, “বিলি আর সুলিভান নিচে আসেনি?”

“না।”

বিলি আর ইনগ্রিডের মধ্যে সম্পর্কটা গত দেড় বছরে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ওর ছোট ভাইয়ের মত ছেলেটা। প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও আমাকে বিলি কার সাথে প্রেম করছে সেটা জানাতো ও। পাকা খেলোয়াড় বিলি, এরইমধ্যে আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সব মহিলা অফিসারের সাথে একবার করে ডেট করা হয়ে গিয়েছে ওর। বিলি থাকলে এখন ইনগ্রিডকে সামলাতে পারতো আমার অবর্তমানে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “ঝড়ের কারণে কেউ খোঁজও করেনি তোমাদের।”

মাথা নেড়ে সায় জানালো ও। বললো, “ইসাবেল আর জর্জ বাসায় একজন বেবিসিটার রেখে এসেছে। কিন্তু সে-ও নিশ্চয়ই ভেবেছে ঝড়ে আটকা পড়ে গেছে ওরা। অন্যদের কারও পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও একই কথা ভাববে। অন্তত এরকম বিপদের কথা কারও মাথাতেই আসার কথা না। কাউকে নিশ্চয়ই খোঁজাও শুরু হয়নি এখনও।”

“সুলিভান বাদে।”

চুপচাপ কম্বলের নিচে ফেরত চলে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। পরদিন ঘুম থেকে উঠে তাকে না পেয়ে ফার্স্ট লেডির মাথায় বাজ পড়ার কথা।

“ঠিক,” ইনগ্রিড বললো, “সুলিভান বাদে।”

ইনগ্রিড ওর পকেট থেকে আমার স্যামস্যাং গ্যালাক্সিটা বের করে প্রধান শিরোনাম দেখালো।

প্রেসিডেন্ট সুলিভান নিখোঁজ!

প্রধান শিরোনামের নিচে আরেকটা শিরোনাম : তুষার ঝড়ে আক্রান্ত ওয়াশিংটন!

অবিশ্বাসে মাথা দোলালাম আমি, এরপর বললাম, “এখানকার খবর জানার পর শিরোনাম হবে : প্রেসিডেন্ট সুলিভান সন্ত্রাসিদের হাতে বন্দি।”

“চিন্তা করতে পারছো, কি হবে ফলাফল?”

ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হতে যাচ্ছে এটা।

“আর্মির লোকজন আসতে আর কতক্ষণ?” জিজ্ঞেস করলাম।

তিনটা চল্লিশের মত বাজছে এখন।

“এফবিআই’র লোককে ফোন দিয়েছি আমি। যা করার তারাই করবে।”

পরিস্থিতি কতটা জটিল হয়ে উঠতে পারে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করলো ও। আমলাতান্ত্রিক পরিস্থিতি, বলাই বাহুল্য। বাবার বাসা অ্যানাডেলে, ফেয়ারফ্যাক্স পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আওতাধীন এখানটা। তাই প্রথমেই তাদের খবর দেয়া উচিৎ আর জোড়া খুনের কেসটা আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদেরই পরিচালনা করার কথা। কিন্তু এখানে যেহেতু অপহরণ করা হয়েছে, তাও আবার প্রেসিডেন্টকে, এফবিআই সব কিছুর নেতৃত্ব দেবে। আর যেহেতু জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা আছে সেহেতু সিআইএ, হোমল্যান্ড সিকিউরিটিও জড়িয়ে পড়বে এর সাথে। সাথে রেডের সিক্রেট সার্ভিস তো আছেই।”

“আমার এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না, এখানে এখনও পৌঁছায়নি কেউ,” বিড়বিড় করলো ইনগ্রিড, “ফালতু ঝড়!”

.

তিনটা পঞ্চাশের সময় বনির বাসাতে ফিরলাম আমি।

পাঁচটা স্নো প্লেয়ার এসেছে বাবার বাসার বাইরে। রাস্তার বরফ বেপরিস্কার করতে ব্যস্ত এখন ওগুলো। সামনের ঘন্টাগুলোতে নরক গুলজার বয়ে যাবে এখানটাতে।

ভেবেছিলাম এখানটাতে সবাই ঝিমাচ্ছে, কিন্তু সবাইকে দেখলাম উত্তেজিত সুরে কথা বলছে যা ঘটে গেছে তা নিয়ে। কিন্তু ক্লান্ত, এটা বোঝ। যাচ্ছে, কয়েকজন এরই মধ্যে বিছানায় উঠে পড়েছে।

মনোপোলি খেলার মত অবস্থা নেই কারও।

ইনগ্রিডের বাবা হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে লিভিংরুমে বসে আছেন। তার স্ত্রী কাউচে গভির ঘুমে। ইনগ্রিডের খবর জানতে চাইলে বললাম বেশ সামলে নিয়েছে ও। এখন তৈরি হচ্ছে সামনের কর্মযজ্ঞের জন্যে। আগামি আটচল্লিশ ঘন্টায় ঘুমোতে পারবে বলে মনে হয় না।

গম্ভির ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন তিনি।

অন্য সবার মত তার অনুভূতিও ভোতা হয়ে গিয়েছে গত চব্বিশ ঘন্টার অমানসিক ধকলের পর।

ইসাবেল আর বনি রান্নাঘরে বাসন ধুচ্ছে। দু-জনকেই একবার করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম এখন কেমন লাগছে তাদের। ইসাবেল তার বোনের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে, সে-ই নজর রাখছে ওর। বাচ্চাদের। তাই কিছুটা শান্ত ও এখন। বনির অবস্থাও ভালো মনে হচ্ছে দেখে। বোধহয় এখনও শকে আছে সে। তিন সপ্তাহ পর ঘোর ভেঙে জেগে উঠে বুঝতে পারবেন পরিস্থিতির ভয়াবহতা। আমাকে বসতে বললেন তিনি। খাবার সাজিয়ে দিবেন নিজেই।

জর্জ, মিনিস্টার রবার্ট আর বাবার সাথে রান্নাঘরের টেবিলটায় বসলাম আমি। প্রত্যেকের সামনেই খালি প্লেট। খাবার শেষ এর মধ্যে।

“আপনাদের কি খবর?” জিজ্ঞেস করলাম।

“এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার,” মিনিস্টার রবার্ট বললেন। কব্জি ঘষছেন এখনও। ওখানটাতেই বাঁধা হয়েছিল দড়ি দিয়ে।

“সেটাই স্বাভাবিক, বাবা বললেন, “ছেলের বিয়েতে সন্ত্রাসিদের হামলা আর প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া, ভাবা যায় না!”

“হ্যাঁ,” জর্জও সায় জানালো।

বনি আর ইসাবেল আমার সামনে খাবার নামিয়ে রাখলো। লাসানিয়ার বড় দুটো টুকরো, একটা বড় মগ ভর্তি দুধ, কয়েকটা ওরিও বিস্কুত, একটা আপেল আর গোলাপি একট ধরণের জুস।

লাসানিয়া মুখে দিয়ে দুধের গ্লাসে এক চুমুক দিলাম। ওটুকু গিলে ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, “মাস্তানগুলো কোথায়?”

বাবা জবাব দিলেন, “নিচে। চেস্টার আর গ্ৰেচেনের সাথে খেলছে।”

চেস্টার?

গ্ৰেচেন?

“চেস্টার আর গ্ৰেচেনের কথা মনে আছে তোমার?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন। “বনির কুকুর দুটো।”

চোয়াল ঝুলে গেল আমার।

“চেস্টার আর গ্ৰেচেন বেঁচে আছে এখনও!”

চেস্টার আর গ্ৰেচেন ইয়োর্কি জাতের ছোট দুটো কুকুর। আমার দেখভাল করার সময় মাঝে মাঝে ওদের নিয়ে আসতো বনি। চেস্টারের সাথে ফ্রিসবি খেলার চেষ্টা করতাম আমি। কিন্তু সেদিকে কখনোই আগ্রহ ছিল না ওর। আমার পা ধরে বসে থাকতো পুরোটা সময়। আর গ্রেচেন সবসময় বনির পায়ে পায়ে ঘুরতো। আমার কাছে খুব একটা আসতো না।

“এটা কিভাবে সম্ভব!”

“সম্ভব, মাথা নেড়ে বললেন বাবা। “চেস্টারের বয়স ষোল বছর আর গ্ৰেচেনের সামনে উনিশ হবে।”

উনিশ!

কুকুরদের হিসেবে এটা কত বছর?

দ্রুত হিসেব করে ফেললাম। গ্ৰেচেনের বয়স একশ তেত্রিশ বছর!

“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না,” বললাম।

জবাবে শুধু কাঁধ নাচালেন বাবা।

“মানে, ওরা কি এখনও চলাফেরা করতে পারে?”

“আহ,” এই বলে মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি।

“এটার মানে কি?”

তিনি বললেন আমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে সেটা। এরপর হেলান দিয়ে বসলেন চেয়ারে।

দেখলাম ভ্রূ’জোড়া কুঁচকে আছে তার।

বাবার পিঠের ব্যথাটার কথা একবারও মাথায় আসেনি আমার। কয়েক বছর আগে সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, আমাকে নিয়ে তিনতলা ওঠার সময়। এরপর থেকে আর স্বাভাবিক হতে পারেননি।

বয়লার ঘরে ওরকম বেকায়দা ভঙ্গিতে আটকে থাকার পর হাঁটতে যে পারছেন এটাই অনেক।

“আপনার ঔষধগুলো নিয়ে আসা উচিৎ ছিল আমার,” তাকে বললাম আমি।

“আমি নিজে গিয়েই নিয়ে আসবো একটু পরে।”

“তাড়াতাড়িই যাওয়া উচিৎ আপনার। কিছুক্ষণের মধ্যেই এফবিআই’র লোকজন এসে যাবে। তখন মনে হয় না আপনাকে কিছু নড়তে দেবে ওরা।”

মাথা দোলালেন তিনি, কিন্তু আমি জানি আগামি ছয় মিনিট এখানেই বসে থাকবেন তিনি। আমার না ঘুমানো পর্যন্ত।

জর্জ ওগুলো নিয়ে আসার প্রস্তাব দিলে বাবা তাকে বলে দিলেন কোথায় খুঁজতে হবে।

“বাসাটার ব্যাপারে কি করবেন আপনি?” জিজ্ঞেস করলাম।

“সেটা নিয়ে এখনও ভাবিনি আমি।”

“আপনার কি মনে হয়? লিভিংরুমে দু-জনকে খুন করা হয়েছে এটা জানার পরেও ঘুমাতে পারবেন সেখানে?”

“বাড়ির দাম বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে,” মিনিস্টার রবার্ট বললেন।

“আমার মনে হয় না,” পাল্টা বললাম আমি। “এমন লোক বেশি পাওয়া যাবে না যারা কেউ খুন হয়েছে এমন বাসা কিনতে আগ্রহি হবে।”

“অবশ্যই না,” রবার্ট বললেন, “কিন্তু আমেরিকাকার প্রেসিডেন্ট অপহৃত হয়েছেন! এমন বাসা কোথায় পাওয়া যাবে? কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে রাজি হবে লোকজন।”

মাথা নাড়লাম।

ঠিকই বলেছেন তিনি।

পরের দু’মিনিটে সামনের খাবারটুকু শেষ করে ফেললাম। এরপর বললাম, “ঘুমানোর জায়গা খোঁজা উচিৎ আমার।”

“বেইজমেন্টে তোমার জন্যে একটা কাউচ গুছিয়ে রেখেছে বনি,” বাবা বললেন।

“ধন্যবাদ, বনি,” বললাম।

হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলেন তিনি ব্যাপারটা।

আমি উঠে দাঁড়ালে আমার সাথে সাথে বাবাও উঠে দাঁড়ালেন। তাকে একবার আলিঙ্গন করে বললাম, “আপনাকে বিয়ের এত ধকল সহ্যের জন্যে ধন্যবাদ দেবার সুযোগ পাইনি।”

“কোন সমস্যা ছাড়াই হয়েছে সবকিছু,” বললেন তিনি। “শেষের ব্যাপারটুকু ছাড়া!”

.

বনির বেইজমেন্টের অবস্থা বাবার মতো অগোছালো । উনার স্বামী মারা গেছেন দশ বছর আগে। একজন কন্ট্রাক্টর ছিলেন তিনি। নিজেই ঠিকঠাক করেছিলেন নিচের সবকিছু। একটা সোফা সেট, টিভি আর বিলিয়ার্ড টেবিল আছে এখানে। পাশেই কাউচটা, বেশ কয়েকটা বালিশ রাখা ওটায়।

মারডক, ল্যাসি আর আর্চি বিলিয়ার্ড টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ওটার নিচের জায়গাটায়। তিনজনই তাদের পরনের স্যুটগুলো খুলে ফেলেছে।

আমিও নিচু হয়ে তাকালাম ওদের মনোযোগের জায়গাটায়। একটা প্রানী শুয়ে আছে ওখানে। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম ওটা একটা কুকুর।

বেচারা চেস্টার; ওর শরীরের অর্ধেক লোম ঝরেই গিয়েছে। চোখগুলো বের হয়ে এসেছে কোটর থেকে, এক কান নেই। জিহ্বা বের হয়ে আছে। মুখের এক পাশে।

দেখলাম হাঁটছে ও। বিলিয়ার্ড টেবিলটার একটা পায়ার সাথে ধাক্কা লেগে উল্টো ঘুরে যায়। আবার ধাক্কা লেগে সোজা হয়।

খারাপ লাগলো ওর জন্যে।

“তোরা ওর দিকে তাকিয়ে আছিস কেন ওভাবে?” জিজ্ঞেস করলাম।

মিয়াও।

“তোরা একটা খেলা খেলছিস? তা কি খেলছিস শুনি?”

মিয়াও।

“চোর-পুলিশ?”

মিয়াও।

“চেস্টার হচ্ছে পুলিশ?”

মিয়াও।

“তোদের ধরতে পারছে না ও? কেন যে পারছে না! আমার মনে হয় ওর কিছু না দেখতে পাওয়া আর না শুনতে পাওয়ার সাথে সম্পর্ক আছে ব্যাপারটার।”

মিয়াও।

“মোটেও ওর নিজের বুদ্ধি না এটা।”

ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “ওর সাথে উলটাপালটা কিছু করবি না। তোরা। এখানে আমরা মেহমান।”

মারডক ডেকে উঠলো একবার।

“জানি আমি। তুই সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করিস।”

ওর কান চুলকে দিলাম একবার। এতক্ষণে খেয়াল করলাম বেচারার নাকের কাছটা লাল হয়ে আছে। “তোর নাকের জন্যে দুঃখিত,” এই বলে সেখানে একটা চুমু দিলাম। খুশিতে লেজ নাড়তে লাগলো ও।

“ঠিক আছে। গ্ৰেচেন কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম।

ল্যাসি আমাকে ঘরের পেছন দিকে নিয়ে গেল। দুটো বিছানা পাতা ওখানে। একটাতে শুয়ে আছে গ্রেচেন। চেস্টারের মতনই অবস্থা ওর। একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে একটা ডায়পার পরিয়ে রাখা হয়েছে ওকে।

মিয়াও।

“না, তোর এসব পরতে হবে না।”

মিয়াও।

“নিজের পেটের ওপর নিয়ন্ত্রন নেই বেচারার। কিন্তু তুই একটা আলসের ধাড়ি ছাড়া কিছু না।”

মিয়াও।

“না, বলেছি না একবার!” ওকে সাবধান করে দিলাম যাতে গ্ৰেচেনের বিশ ফিটের মধ্যে না যায়।

কথা দিতে বললাম।

দিল ও।

*

অধ্যায় ৪

“প্রেসিডেন্ট এখানে কি করছিলেন?” এফবিআই’র নির্বাহি পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন। “সেটার উত্তর চাই আমার।”

সকাল ন’টার মত বাজছে এখন। প্রায় চল্লিশ ঘন্টা ধরে জেগে আছে। ইনগ্রিড, কিন্তু তেমন সমস্যা হচ্ছে না। গত কয়েক ঘন্টা বনির বাসায় শার্লট আর নিজের বোনকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছে ওকে। দু-জনেই ভেঙে পড়েছে। ইনগ্রিড তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শি ওরা আর এফবিআই কিছুক্ষণের মাঝেই জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করবে। এছাড়া বিলির মাকে ফোন করে দুঃসংবাদটাও দিতে হয়েছে ওকে। কথা দিয়েছে যে করেই হোক খুঁজে বের করবে বিলিকে। এরপর সেই ফোনকলটা, যেটার জন্যে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছিল ও। মার্শালের স্ত্রী লিন্ডার কাছে। প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে কোনরকমে কাজটা শেষ করেছে। সে, অপরাধবোধে ভুগছিল গোটা সময়। খবরটা শোনামাত্র ভেঙে পড়েছে লিন্ডা। তখনই ঘটনাস্থলে আসবে বলছিল সে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই তুষারপাতের কারণে আসতে পারেনি।

এ মুহূর্তে এফবিআই’র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথে কথা বলছে ও। লোকটা ওর চেয়ে প্রায় দুই ইঞ্চি খাটো। “আমার স্বামী প্রেসিডেন্ট সুলিভানের বন্ধু।”

স্বামী শব্দটা কেমন যেন শোনাল ওর মুখে। এই প্রথম এমন কিছু বললো ও। অবাক হয়ে খেয়াল করলো ভালো লাগছে সেটা শুনতে।

“বন্ধু?” তিনি বললেন, চেহারা লাল হয়ে গিয়েছে। “আমিও প্রেসিডেন্ট সাহেবের বন্ধু। আমার ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তো আসেননি তিনি!”

ইনগ্রিডের সন্দেহ আছে, এফবিআই’র নির্বাহি পরিচালক জোনাথান বেক আর প্রেসিডেন্ট আসলেও বন্ধু কিনা। কারণ সুলিভান একবার তেলবাজ আর মতলববাজ অভিহিত করেছিলেন লোকটাকে।

“রেড আর প্রেসিডেন্ট সুলিভানকে দেখে আমরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম,” ইনগ্রিড বললো।

“তাই হবার কথা,” বেক বললেন উত্তরে।

এফবিআই’র একটা ভ্রাম্যমান কমান্ড সেন্টারে ওরা এখন। বড় এই কার্গো ভ্যানটার ওয়াশিংটন থেকে মাত্র বারো মাইল দূরে এখানে আসতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লেগে যায়। তিনটা স্নো প্লেয়ার সামনে বরফ সরাতে সরাতে আসছিল ওটার।

ওর শ্বশুরের বাসার সামনে বেশ কয়েকটা স্নো প্লেয়ার গত রাত থেকে অনবরত বরফ পরিস্কার করে চলেছে। আশেপাশে পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে একমাত্র এখানকার রাস্তাগুলোই চলাচলের উপযোগি।

তুষারপাত অবশেষে এক ঘন্টা আগে বন্ধ হয়েছে। যেখানে আবহাওয়াবিদরা ধারণা করেছিল যে মাত্র কয়েক ইঞ্চি তুষার জমবে সেখানে এখন গড়ে তিন ফিট করে তুষার জমে আছে সব জায়গায়। ওয়াশিংটন ডিসিসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটা রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

ডিসির মেয়রের মতে সবকিছু স্বাভাবিক হতে এক সপ্তাহের মত সময় লাগবে।

“আর প্রেসিডেন্ট কিভাবে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে বের হলেন?” কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন বেক।

“সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই,” ইনগ্রিড জবাব দিলো। “তবে এর আগে বেশ কয়েকবার এমনটা হয়েছে।” সে ব্যাখা করে বললো আগে আরও তিন-চারবার এভাবে হেনরির বাসায় উপস্থিত হয়েছেন তারা, সবার নাকের ডগা দিয়ে। “আপনি সিক্রেট সার্ভিসের ওদের সাথে কথা বলছেন না কেন?”

“সেটা তো আমার মাথায় আসেনি আগে,” মুখ বাঁকালেন বেক। এরপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন “সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন গতকাল সকাল নটা থেকে খুঁজছে তাকে। একটা মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত হননি দেখে আমাদের খবর দেয়া হয়।”

আর প্রেসিডেন্টের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে তারা কোন সূত্রই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রায় বিশ ঘন্টা পর ইনগ্রিডের ফোনে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।

“এফবিআই এতক্ষণ কি কি করেছে আমাকে বলতে পারবেন?”

অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরের দশ মিনিটে বেক ব্যাখা করলেন, প্রেসিডেন্টের নিখোঁজ হবার খবর পাবার পর থেকে তারা কি কি করেছেন। আমেরিকাকার সব এফবিআই এজেন্ট এখন এই কেসে নিয়োজিত, সাথে বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় বিশ হাজার কর্মি। আশেপাশের একশ মাইলের মধ্যে সব আন্তঃরাজ্য বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমেরিকাকার সকল বিমানবন্দর সর্বোচ্চ নজরদারিতে আছে আর সব প্যাসেঞ্জারদের বলা হচ্ছে তারা যেন যাত্রার ন্যনতম পাঁচ ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছান। প্রতিটা হাইওয়েতে একটু পর পর চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। সব বর্ডারে কড়া পাহারা দিচ্ছে সেনাবাহিনীর লোকজন।

প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করা এক কথা আর তাকে নিয়ে দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া আরেক কথা।

সকাল ছটার মধ্যে তিন অজ্ঞাতনামা আরবে নামে গ্রেফতার আদেশ জারি করা হয়েছে। প্রায় পাঁচশো জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে।

এসময় ভ্যানের দরজা খুলে একজন ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। লোকটার পরনে কালোর রঙের স্যুট আর মহিলার পরনে জিনস এবং হুডি।

“অবশেষে,” বললেন বেক।

“একটু দেরি হয়ে গেল, মহিলা জবাব দিলেন। তার বয়স তিরিশের ঘরে হবে। তিনি দেখতে অনেকটা অলিভিয়া পোপের মত, ইনগ্রিডের পছন্দের এক সিনেমার নায়িকা। “আমার বোধহয় গাড়ি পাল্টানোর সময় এসে গেছে।”

নিজের পরিচয় দিলেন মহিলা।

তাশা রিভস।

আর লোকটার নাম গ্রেগ কুপার।

ইনগ্রিড তাদের কাউকেই আগে কখনো দেখেনি কিন্তু নাম শুনেছে অনেকবার। কুপার এফবিআই’র ডিসি অফিসের ফিল্ড শাখার প্রধান। আর তাশা বাল্টিমোরে অবস্থিত ভায়োলেন্ট ক্রাইম ইউনিটের দায়িত্বে আছেন।

“ক্রাইম-সিনে কেউ গিয়েছে এখন পর্যন্ত?” দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন কুপার। চুলের মত দাড়িও বাদামি তার।

তাকে দেখে ইনগ্রিডের ক্যালের কথা মনে পড়ে গেলো। ক্যাল ছিলো ওর আগের পার্টনার। দেড় বছর আগে রেডের গুলিতে মৃত্যু হয় তার।

রেডের কথা মনে হলো ওর।

মেঝেতে পড়ে আছে। বুকি দুটো গুলির ছিদ্র।

এরপর বিলির কথা ভাবতে লাগলো ও।

কোথায় ছেলেটা?

এখনও বেঁচে আছে?

“এখনও ভেতরে যায়নি কেউ,” বেক বললেন, “খুব সাবধানে সব কিছু করতে হবে। আমি চাইনা কেউ বোকার মত কোন আলামত নষ্ট করুক।

একটা বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল ওখানে গত রাতে।”

“সেজন্যে দুঃখিত, ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললো ইনগ্রিড।

রিভস এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এতে। “অভিনন্দন,” বললেন তিনি।

স্বভাবতই ইনগ্রিডের বামহাতের দিকে তাকালেন এরপর।

“আঙটিটা নিয়ে গেছে ওরা,” হাত দেখিয়ে বললো ইনগ্রিড।

“গর্দভের দল,” অসন্তোষের সাথে মাথা নাড়িয়ে বললেন রিভস।

“তোমাদের কথা যদি শেষ হয়ে থাকে,” বেক বলে উঠলেন, “আমাদের একটা জোড়া খুন আর প্রেসিডেন্টের অপহরণের কেসের মীমাংসা করতে হবে।”

“আর বিলি,” মাথা দোলালো ইনগ্রিড।

“বিলি?”

“বিলি টরেল্লি। আলেক্সান্দ্রিয়া হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে আমার পার্টনার।”

বেক নাক দিয়ে এমন একটা শব্দ করলেন যেন বিলির ব্যাপারটার কোন গুরুত্বই নেই।

ইনগ্রিডের ইচ্ছে হল তার দু-পায়ের মাঝ বরাবর একটা লাথি কষানোর। কিন্তু খুব কষ্টে নিজেকে সামলালো।

“রাস্তাগুলো পরিস্কার করার ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন বেক, “আশেপাশে দুশো মাইলের মধ্যে যতগুলো স্নো প্লেয়ার আছে সবগুলো একযোগে কাজ করছে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকেও ভাড়া করা করা হয়েছে। কিন্তু সময় লাগবে এতে।”

“গণমাধ্যম?”

“এখনও কিছু জানে না ওরা,” বেক জবাব দিলেন “কিন্তু এক ঘন্টার মধ্যে একটা প্রেস কনফারেন্সে যেতে হবে আমাকে। জনগণের সাহায্য দরকার আমাদের এই কেসে। কোনভাবেই ওদের সুলিভানকে নিয়ে দেশের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না।”

“হয়তো এরই মধ্যে চলে গেছে ওরা,” কুপার বললেন। ইনগ্রিডের ধারণা গতকাল সকাল থেকেই তিনি প্রেসিডেন্টের নিখোঁজ হবার ঘটনার তদন্ত করছেন। প্রায় তিরিশ ঘন্টা হতে চললো তাকে অপহরণ করা হয়েছে। এতক্ষণে হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছেও গেছে।”

“মধ্যপ্রাচ্য?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করলো, “কেউ কি দায় স্বীকার করেছে নাকি এখন পর্যন্ত?”

“অনেকগুলো সংগঠন থাকতে পারে এই ঘটনার পেছনে। এখনই কোন উপসংহারে পৌঁছুনো ঠিক হবে না,” কুপার বললো।

“এখনও কিছু জানা যায়নি,” বললেন বেক। “তবে আমরা নজর রাখছি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে।”

“এনএসএ কিছু পেয়েছে?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

“গত বাহাত্তর ঘন্টা যাবত তাদের অর্ধেকের বেশি কর্মি লেগে আছে এই কাজে। কিন্তু কিছুই জানা সম্ভব হয়নি।”

“তার মানে আমরা কিছুই জানি না কারা প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করেছে আর তারা কিভাবে দেশের ভেতরে ঢুকলো?” রিভস জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা নেড়ে না করে দিলেন বেক। জানালেন যে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হচ্ছে ।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকলো। এরপর বেক ইনগ্রিডকে বললেন, “তুমি ওনাদের আরেকবার সবকিছু খুলে বলো।”

পরের বিশ মিনিট ধরে ইনগ্রিড সবকিছু আবার ব্যাখা করলো। তার বিয়ে, অপহরণকারিদের আক্রমন, রেড আর ক্যাপ্টেন মার্শালের মৃত্যু, হেনরির তাদেরকে উদ্ধার করা-কিছুই বাদ দিলো না। প্রতিটা ঘটনার সম্ভাব্য সময়কালও নিখুঁত ভাবে বলার চেষ্টা করলো। অপহরণকারিদের চেহারার বর্ণনা অবশ্য দিতে পারলো না, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ছিল তাদের। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে হাজারটা প্রশ্ন করতো তাকে কথা বলার মাঝে। কিন্তু বেক, কুপার আর রিভসের কেউই তাকে এক বারের জন্যেও থামালেন না। বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করার দরকারও নেই, কারণ ইনগ্রিড জানে যে তারা ঠিক কি কি শুনতে চাচ্ছেন।

“মোবাইল ফোনগুলো ট্র্যাক করার চেষ্টা করেছেন?” কুপার জিজ্ঞেস করলেন।

ইনগ্রিড আগেই বেককে বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে উপস্থিত সবার নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছে।

মাথা নেড়ে সায় জানালেন বেক, “হ্যাঁ, সবগুলোকেই ট্র্যাক করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেবল একটার সিগন্যাল পাওয়া গিয়েছিল। বাসার সামনের একটা গাড়ি থেকে আসছিলো ওটা।”

মিনিস্টার রবার্টের গাড়ি।

একমাত্র তিনিই ফোন ভেতরে নিয়ে আসেননি। কারণ ছবি তোলার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি।

“অন্য ফোনগুলো নিশ্চয়ই বন্ধ করে দিয়েছে ওরা।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কুপার, এরপর বললেন, “তাহলে বাসার। ভেতরটা একবার দেখা যাক, নাকি?”

রিভস আর কুপার ভ্যানের দরজার দিকে যাওয়া শুরু করলে ইনগ্রিডও তাদের পিছু নিলো।

“দাঁড়াও,” বেক বললেন পেছন থেকে, ইনগ্রিডের সোয়েটার আকড়ে ধরেছেন তিনি “তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

ইনগ্রিডের চোখ বড় বড় করে তার হাতের দিকে তাকালে সেটা সোয়েটার থেকে সরিয়ে নিলেন তিনি। এক পা পেছনে সরে গেলেন।

“আমি একজন হোমিসাইড ডিটেকটিভ,” চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিলো ইনগ্রিড, “আর ঘটনার সময় সেখানে ছিলাম আমি। আমার পার্টনারকে ধরে নিয়ে গিয়েছে ওরা। তাই আমিও যাবো ভেতরে।”

“না,” হাসিমুখে বললেন বেক, “তোমার যা যা করার ছিল, করেছে। এখন না হয় হানিমুনে যাও কয়েকদিনের জন্যে?”

লোকটার পায়ের মাঝখানে লাথি দেয়ার ইচ্ছেটা আবার ফেরত আসলো ইনগ্রিডের। এবার আরও কষ্ট হচ্ছে নিজেকে সামলাতে।

“ঠিকই বলেছে ইনগ্রিড,” কুপার ভ্যানের বাইরে থেকেই জবাব দিলেন, “ওকে দরকার হতে পারে আমাদের।”

ভ্রু কুঁচকে ফেললেন বেক। ইনগ্রিড এটা আগেও অনেকবার শুনেছে, স্থানীয় আইন প্রয়োগকারি সংস্থাগুলোর সাথে এফবিআই’র সম্পর্ক বেশ খারাপ। এখন মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটা সত্যি।

তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরালো না ইনগ্রিড।

দুই সেকেন্ড।

তিন।

“ঠিক আছে,” অবশেষে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন তিনি, “কিন্তু এখনাকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে যদি কিছু জানাও তুমি, তাহলে সেটা ভালো হবে না।”

.

বারো ঘন্টা পর, এফবিআই হেডকোয়ার্টারে একটা কনফারেন্স টেবিলে বসে আছে ইনগ্রিড। হোয়াইট হাউজ থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। এখানে আসার পথে একটা গাড়িও চোখে পড়েনি ওদের। স্নো প্লেয়ারগুলো রাস্তার দুপাশে প্রায় দশ ফুট উঁচু বরফের দেয়াল সৃষ্টি করে রেখেছে ওগুলো চলাচলের উপযোগি করার জন্যে।

“এরচেয়ে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে, একজন কম বয়সী এফবিআই অফিসার বললো, টেবিলে মাফিন, কেক আর কলা সাজিয়ে রাখতে রাখতে।

ইনগ্রিড আর টাস্ক ফোর্সের অন্য সদস্যরা অবাক দৃষ্টিতে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার তরুণ অফিসারটার দিকে তাকালো।

“এগুলা কি?” টি ওয়েডস জিজ্ঞেস করলেন। পেটানো শরীর, ছোট করে ছাটা চুল-হোমল্যান্ড সিকিউরিটির একজন সদস্য তিনি।

“কিছুই খোলেনি,” জবাব আসল, “একটাও দোকান, সুপারমার্কেট কিংবা রেস্টুরেন্ট খোলা নেই। এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ শতাংশ রাস্তাঘাট পরিস্কার করা সম্ভব হয়েছে। কেউই বাসা থেকে বাইরে বের হতে পারছে না।”

“হোয়াইট হাউজে কাউকে নিশ্চয়ই এইসব ছাইপাঁশ খেতে হচ্ছে না,” একটা শুকনো মাফিন তুলে নিয়ে বললেন ওয়েডস। গন্ধ শুঁকে সেটা আবার টেবিলের ওপর রেখে দিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে আমাদের জন্যে ভালো কিছু নিয়ে আসছে না কেন?”

হোয়াইট হাউজের মিটিংরুমে এমুহূর্তে অবস্থান করছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, ডিফেন্স সেক্রেটারি, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার, এফবিআই, সিআইএ এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মহাপরিচালকেরা। এছাড়াও সেনাবাহিনীর বড় বড় অফিসাররা তো আছেনই। এফবিআই’র নির্বাহি পরিচালক বেকেরও সেখানে থাকার কথা।

ইনগ্রিড খুশি যে তাকে আর বেককে সহ্য করতে হচ্ছে না এখানে। গত বারো ঘন্টায় তার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো ও।

“আমাকে যে হেলিকপ্টারে করে এখানে নিয়ে এসেছো তোমরা,” ওয়েডস বললেন, “সেটাতে করে যাও।”

“ইয়ে,” তোতলাতে লাগলো তরুণ অফিসার, “আ-আমার মনে হয় না–”

“বেককে বলো কিছু না খেলে কাজ করা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে। এখানকার অর্ধেক মানুষের পেটে সারাদিনে কিছু পড়েনি।”

সম্মতির জন্যে একবার পুরো চোখ ঘোরালেন ওয়েডস।

ইনগ্রিড, কুপার, রিভস আর ওয়েডস ছাড়াও আরও তিনজন উপস্থিত আছেন এখানে :

ন্যাটালি ক্যামব্রিজ, এফবিআই’র ফরেনসিক এক্সপার্ট।

ডোনাল্ড রস, চিজাপিক বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মি।

সুসান উইলহেম, সিক্রেট সার্ভিসের প্রতিনিধি।

তিনজন পুরুষ, চারজন মহিলা।

বিশ বছর আগে হলে ঘরের সাতজনই যে পুরুষ হতো সে-ব্যাপারে সন্দেহ নেই ইনগ্রিডের। এমনকি দশ বছর আগেও ভেতরে একজন মহিলার উপস্থিতিই অনেক বড় কিছু বলে মনে হতো।

অন্য কেউই খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে ওয়েডসের মতো এতটা উত্তেজিত না। টেবিলের জিনিসগুলোর ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা।

গত ছত্রিশ ঘন্টায় একটা এনার্জি বার ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি ইনগ্রিডের। মাফিন আর কলা তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো সে।

“আমি জানতে চাই,” কুপার কথা বলে উঠলে সবার দৃষ্টি তার দিকে ঘুরে গেলো, “লোকগুলো জানলো কিভাবে যে প্রেসিডেন্ট তখন ঠিক কোথায় থাকবেন?” ইনগ্রিডের দিকে তাকালেন তিনি, “মানে, তোমরাও তো এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলে না তিনি আসবেন অনুষ্ঠানে, তাই না?”

মুখের মাফিনটুকু গিলে ফেললো ইনগ্রিড, বললো, “দুই মাস আগে তাকে একটা কার্ড পাঠাই আমরা। কিন্তু সেটার জবাব আসেনি। আমার তো সন্দেহ ছিল সেটা আদৌ তিনি পেয়েছিলেন কিনা।”

“কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার স্বামীর সাথে প্রায়ই ফোনে যোগাযোগ হতো প্রেসিডেন্টের।”

“হ্যাঁ, সেটা হতো নিয়মিতই। এই সুপার বোউলের দু-রাত আগেও তার সাথে কথা হয় হেনরির। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গে কোন কথা হয়নি।

“অন্য কোন অতিথিও কি জানতো না তিনি আসছেন? এ নিয়ে কেউ ফেসবুক কিংবা টুইটারে পোস্ট দেয়নি?”

কুপার আর রিভস গত বারো ঘন্টার মধ্যে বিয়েতে উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন একবার করে। ইনগ্রিড জানে, সবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোও যাচাই করে দেখা হয়েছে। কিন্তু কেউ বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কেই কোন পোস্ট দেয়নি, প্রেসিডেন্টের ব্যাপার তো দূরের কথা। তবুও কুপারের বলার ভঙ্গিতে একটা দ্বিধাবোধ লক্ষ্য করলো ইনগ্রিড।

মাথা নেড়ে না করে দিলো ও।

“তুমি কি তোমার বাব-মা কিংবা বন্ধুবান্ধবকেও বলেনি তোমার সাথে যোগাযোগ আছে প্রেসিডেন্টের?” জিজ্ঞেস করলেন কুপার।

লাল হয়ে গেলো ইনগ্রিডের চেহারা। ওর বাবা-মাকে বলেছে ও। মা’কে এটাও জানিয়েছে, হেনরিকে নিজের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। সেটা শুনে চোয়াল ঝুলে গিয়েছিল তার।

“হ্যাঁ, আমার বাবা-মাকে বলেছি। আর কাউকে না।”

“তোমার স্বামী? সে কতজনকে বলেছে?”

হেনরির অসুখটার কথা সংক্ষেপে একবার দলের সবাইকে ব্যাখা করেছে ইনগ্রিড, কিন্তু অতটা বিস্তারিতভাবে কিছু বলেনি। “আসলে, দিনে মাত্র এক ঘন্টা জেগে থাকায় বাইরের কারও সাথে ওর তেমন একটা যোগাযোগ হয় না। একমাত্র ইসাবেল ছাড়া আর কাউকে বলার কথা না অথবা ওর” এটুকু বলে চুপ করে গেলো ও।

“অথবা ওর কি?” জিজ্ঞেস করলেন কুপার।

“অথবা ওর বিড়ালকে,” হাসি সামলিয়ে বললো ইনগ্রিড, “ওর বিড়ালটার সাথে কথা বলে ও।”

ন্যাটালি হেসে ফেললো কথাটা শুনে। “সেটা তো আমিও করি,” বললো সে।

ইনগ্রিড মাথা ঝাঁকালো। “ওর মত না। বিড়ালটার সাথে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ভঙ্গিতে কথা বলে ও,” মুখটা হাসি হাসি হয়ে উঠলো ওর ঘটনাটার কথা বলতে গিয়ে। আর্চির কথাও মনে পড়ে গেলো।

“বিয়েতে উপস্থিত সবার জবানবন্দি নেয়া হয়েছে?” ওয়েডস জিজ্ঞেস করলেন।

কুপার একটা ফাইল ঠেলে দিলো তার দিকে, “এখানে বিয়েতে উপস্থিত সবার জবানবন্দি আছে। সেই সাথে পুরো ব্লকের সব বাসিন্দাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।”

ইনগ্রিডের পুরো বিকেল কেটেছে তুষার মাড়িয়ে এক বাসা থেকে অন্য বাসায় গিয়ে প্রশ্ন করতে করতে। ওর শ্বশুরের বাসা যে ব্লকে সেখানে আরও প্রায় বিশটা বাসা আছে।

“ওখানকার কারও চোখে কিছু পড়েছে?” ফাইলটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলেন ওয়েডস।

মাথা নাড়লেন কুপার, বললেন, “পাশের বাসার একজন মহিলা জানিয়েছে বিয়ের সময়টাতে গানের আওয়াজ শুনতে পেয়ছিলেন তিনি। এর বেশি কিছু না। কিছুক্ষণ পর যোগ করলেন, “পাঁচটা বাসায় দরজা ধাক্কিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি।”

“তুষারপাতের কারণে হয়তো অন্য কোথাও আটকা পড়েছে তারা,” ন্যাটালি বললো।

মাথা নেড়ে সায় জানালেন কুপার, এরপর বললেন, “যাইহোক, সবার জন্যে আলাদা আলাদা ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। দূর্ভাগ্যবশত বেশি জনবল নেই এ মুহূর্তে। জেসিকা, যে মেয়েটা খাবার দাবার এনে দিলো আর জ্যাক না জেক নামের এক ইন্টার্ন এজেন্ট। এই দু-জনই বের হতে পেরেছে। তাদের বাসা থেকে।”

“যত দ্রুত সম্ভব এখানে আরও লোক চাই আমাদের, ডোনাল্ড বললেন। এই প্রথম তাকে কিছু বলতে শুনলো ইনগ্রিড।

“সেটার চেষ্টাই করছেন বেক,” কুপার বললেন। “বাড়ি বাড়ি স্নো প্লোয়ার আর গাড়ি পাঠাচ্ছেন জনবলের জন্যে। আমার কোম্পানির গাড়িগুলোকেও রাস্তায় নামানো হয়েছে।”

ইনগ্রিড মনে করার চেষ্টা করলো শেষ কবে ওরকম একটা গাড়ি দেখেছিল ও।

ছয় মাসের মতন হবে।

“আর আমদের জন্যে পিজ্জার ব্যবস্থা করতে পারছে না,” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ওয়েডস।

“আশেপাশে কয়েকশো মাইলের মধ্যে কোন পিজার দোকান খোলা নেই এই অবস্থার মধ্যে,” রিভস জবাব দিলেন। বাচ্চাদের মত প্যান প্যান না করে মাফিন দিয়েই কাজ চালাও এখন।”

গালের ভেতর দিক কামড়ে ধরে হাসি চাপলো ইনগ্রিড।

ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে রিভসের সাথে আড্ডা দেয়া গেলে মন্দ হবে না। তখন নিশ্চয়ই দেখার মত হবে তার আচরণ।

“ঠিক আছে তাহলে,” একবার গলা পরিস্কার করে নিয়ে বললেন। কুপার, সাতজনের দলটার দলপতি হিসেবে বেশ মানিয়ে গেছে তাকে, “আমাদের হাতে যে তথ্যগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি এক এক করে।” ডোনাল্ডের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি, “তুমি শুরু করো।”

ডোনাল্ড চিজাপিক বন্দর কর্তৃপক্ষের হয়ে কাজ করে। দেশের প্রধান নদী বন্দর আর সমুদ্র বন্দরগুলোর সার্বক্ষনিক তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব তাদের। ডেলাওয়ার, মেরিল্যান্ড আর ভার্জিনিয়ার বন্দরগুলোর দেখাশোনাও এর মধ্যে পড়ে। পরের পাঁচ মিনিট সে ধরে যা বর্ণনা করলে সেটা কেবল দুটো শব্দ দিয়েই শেষ করা যেত : “সবকিছু বন্ধ।”

এরপরে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের ন্যাটালি।

সে বিশ মিনিট ধরে ব্যাখা করলো তার লোকেরা কি পেয়েছে ঘটনাস্থল থেকে।

হেনরির বাবার বাসা থেকে বারোজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে বিয়েতে উপস্থিত এগারোজন ছাপও ছিল। বাকি আঙুলের ছাপটা পাওয়া গিয়েছে একটা ছেঁড়া ডাক্ট টেপের ওপর থেকে। কোন অপহরণকারি হাতে দস্তানা পরার আগে সেটা ধরেছিল হয়তো। কিন্তু ন্যাশনাল ডাটাবেজের সাথে সেটাকে মিলিয়ে কাউকে সনাক্ত করা সম্ভব ঝয়নি। ক্যাপ্টেন জেমস মার্শাল আর রেডের মৃতদেহে যে গুলিগুলো পাওয়া গিয়েছে সেগুলো কালাশনিকভ রাইফেলের। ব্যালিস্টিকস ডিপার্টমেন্টের লোকেরা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে আগের কোন ঘটনার সাথে গুলিগুলোর মিল আছে। কিনা খুঁজে বের করতে, কিন্তু সেরকম কিছু পাওয়া যাবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের রেঞ্জ রোভারটা বাসার সামনেই পার্ক করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। গাড়িটার লাইসেন্স প্লেট মিলিয়ে দেখা গেছে সেটা জন লেজেন্ড নামের একজনের নামে নিবন্ধন করা। প্রেসিডেন্টের পছন্দের সঙ্গিতশিল্পী।

“অন্তত ডাক্ট টেপটা থেকে একজনের আঙুলের ছাপ তো পাওয়া গিয়েছে। সেটা থেকে কিছু জানা যেতে পারে,” সিক্রেট সার্ভিসের সুসান বললেন।

জবাবে কাঁধ ঝাঁকালো ন্যাটালি, “কোন অপহরণকারির হতে পারে সেটা কিংবা যে দোকান থেকে কেনা হয়েছে সেখানকার কোন কর্মিরও হতে পারে।”

কুপার মাথা দোলালেন চিন্তিত ভঙ্গিতে, এরপর বললেন, “তোমার কি খবর সুসান? রিপোর্ট করার মত কিছু আছে তোমাদের কাছে?”

“এই যেমন প্রেসিডেন্ট কিভাবে তোমাদের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন?” ওয়েডস বললেন মাঝখান থেকে।

“আহ্, বন্ধ করো, টিম,” কুপার বললেন, “সুসান তো আর প্রেসিডেন্টের হারিয়ে যাওয়ার সাথে জড়িত নয়। তিনি স্বেচ্ছাতেই করেছেন যা করার। কেউ তাকে বলেনি রাতের অন্ধকারে হোয়াইট হাউজ থেকে বেরিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে।”

“তোমরা কি বের করতে পেরেছে কিভাবে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি?” ডোনাল্ড জিজ্ঞেস করলেন।

সুসান মাথা নাড়লেন জবাবে, “নাহ পারিনি। আমরা জানি, হোয়াইট হাউজ থেকে বের হবার বেশ কয়েকটা গোপন পথ আছে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকে তল্লাশি করা ছাড়া সেটা বের করা সম্ভব হবে না।”

“তাহলে হাতুড়ি নিয়ে কাজে লেগে পড়ো,” বললেন ওয়েডস।

“তুমি বলতে চাচ্ছো যেন হোয়াইট হাউজের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করি আমরা?” সুসান জিজ্ঞেস করলো। “এটা কোন ছাত্র হোস্টেল না, টিম। প্রেসিডেন্টের বাসভবন।”

তাদের দুজনের কথা শুনে হেসে ফেললো ইনগ্রিড। সুসান আর টিম নিশ্চয়ই আগে থেকে চেনে একে অপরকে। আর ওর কাছে মনে হচ্ছে কাজের বাইরেও আলাদা কোন সম্পর্ক আছে তাদের মাঝে।

“কোন ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে?” রিভস জিজ্ঞেস করলেন।

“ব্যক্তিগত বাসভবনে নজরদারি করা নিষিদ্ধ। প্রেসিডেন্ট সুলিভানের নির্দেশ। দরজার বাইরে অনেক এজেন্ট পাহারা দিলেও দেয়, কিন্তু কোন ক্যামেরা নেই।”

ডোনাল্ড বললেন, “তারমানে হোয়াইট হাউজ থেকে গোপনে নিচের সুড়ঙ্গগুলোতে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, এ কথা সত্য-”

“এতে কিছু আসে যায় না,” ইনগ্রিড বলে উঠলো অবশেষে। “কিভাবে বের হয়েছে সেটা জেনে কি হবে? তিনি বেরিয়েছেন এটাই গুরুত্বপূর্ণ।”

“হুহ্, আসে যায় না আবার, বিড়বিড় করে বললেন ওয়েডস, “পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত বাসভবন থেকে সিক্রেট সার্ভিসের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন প্রেসিডেন্ট।”

সুসান বলা শুরু করল, “আমরা ইচ্ছে—”

“ইনগ্রিড ঠিকই বলেছে,” কুপার বললেন। “কিভাবে বের হয়েছেন তিনি সেটা জেনে আমাদের কোন লাভ নেই। অপহরণের ব্যাপারটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।”

ওয়েডসের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি, “তোমার পালা।”

ওয়েডস লোকটা একটু বিরক্তিকর হতে পারে কিন্তু পুরো পৃথিবীর সন্ত্রাসি আর জঙ্গি সংগঠনগুলো সম্পর্কে তার জ্ঞান সমীহ করার মত। অনেকগুলো সংগঠনের একটা তালিকাও বানিয়েছেন তিনি। তার নিজের ধারণা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দল এই কাজের সাথে জড়িত। তবে ইনগ্রিডের কেন যেন মনে হল সেটা একটু অতি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বললেন, “আমি আশা করছি অপহরণকারি যে-ই হোক, দেশ থেকে এখনও বের করতে পারেনি প্রেসিডেন্টকে। কারণ সেরকম কিছু হলে হতাকে জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা কম।”

“শুধু প্রেসিডেন্ট না,” ইনগ্রিড বললো, “আমার পার্টনারকেও ধরে নিয়ে গেছে তারা।”

“হ্যাঁ, তাকেও,” ওয়েড বললেন, “দুঃখিত, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”

এসময় দরজা খোলার শব্দে সবার দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে গেলো। কিছুক্ষণ আগে জেসিকা নামের যে তরুণ অফিসার খাবার দিয়ে গিয়েছিলো সে। কয়েকটা পিজার বাক্স নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।

খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন ওয়েডস।

এর পরের এক ঘন্টা পেট পুরে খেলো সবাই।

একটার দিকে রিভস আর সুসানের মত মেঝের এক পাশে খালি জায়গায় শুয়ে পড়লো ইনগ্রিড।

*

অধ্যায় ৫

বেশিরভাগ মানুষের কাছে ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ সাধারণ আরেকটা দিন। কিন্তু আমার কাছে সেটা একটা উৎসবের মত।

বছরের বাড়তি এই দিনটা আমার জীবনে অতিরিক্ত ষাট মিনিট নিয়ে আসে।

খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে।

আসলে আটান্ন মিনিট, আজ তিনটা দুইয়ে ঘুম ভেঙেছে আমার।

উঠে বসলাম বিছানায়।

বেইজমেন্টে আমি একা।

অন্তত প্রথমে সেরকমই মনে হয়েছিলো।

ল্যাসি রাতে কোন এক সময় কম্বলের নিচে এসে ঢুকেছিলো। আমার দু পায়ের মাঝখানে ওর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। বেশি ঠান্ডা লাগলে এমনটাই করে ও।

কম্বলটা উঠালাম।

এহহে।

ল্যাসি না এটা।

চেস্টার।

ছোট্ট কুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর ওজন বড়জোর আট কেজির মত হবে। একদম চুপচাপ শুয়ে আছে, বুক ওঠা নামা করছে না নিঃশ্বাসের তালে তালে।

এক সেকেন্ড কেটে গেলো।

দুই।

তিন।

চার।

নড়ে উঠলো ও।

এখনও বেঁচে আছে।

আপাতত।

কম্বলটা সরিয়ে নেমে গেলাম বিছানা থেকে। চেস্টারকে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে ওপর তলায় চলে আসলাম। লিভিং রুমের সোফায় ঘুমোচ্ছেন বাবা। মারডক সোফার পাশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, বাবার হাত ওর পিঠে।

ল্যাসি আর আর্চি কোথায়?

হলওয়ে বরাবর গিয়ে প্রথম বেডরুমটায় উঁকি দিলাম। ইনগ্রিডের বাবা মা আর বোন ঘুমোচ্ছেন ওখানে।

মাস্টার বেডরুমে বনি, ইসাবেল আর জর্জকে পেলাম। বিছানার অর্ধেকটা জুড়ে শুয়ে আছেন বনি আর বাকি অর্ধেকে ইসাবেল আর জর্জ।

আর্চিকেও দেখলাম।

ইসাবেলের হাতের মাঝে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে।

চুপচাপ কিছুক্ষণ ওর ঘুমিয়ে থাকা উপভোগ করলাম। ছোট্ট বুকটা নিঃশ্বাসের তালে তালে উঠছে আর নামছে। এক মিনিট পর ইসাবেলের হাতের ওপর থেকে সাবধানে ওকে তুলে নিলাম।

“কি খবর বাচ্চা,” ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওর কানে।

আমাকে থাবা মারার চেষ্টা করলো ও। ছোট্ট গোফটা তিরতির করে কাঁপছে। আঙুল দিয়ে ওর পেটে হাত বুলিয়ে দিলে আয়েশে চোখ বন্ধ করে ফেললো আর্চি।

খুশি বিড়াল ছানা!

“চল্, তোর বাপকে খুঁজে বের করি,” এই বলে বেরিয়ে আসলাম ঘর থেকে।

তিন নম্বর বেডরুমে উঁকি দিলাম।

আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল।

ইনগ্রিডের তিন ব্রাইডসমেইড-শার্লট, মেগান আর রেবেকা শুয়ে আছে। এই ঘরে। আর ল্যাসি শুয়ে আছে রেবেকা আর মেগানের বুকের ওপর।

“তোর বাপ একটা বদ,” আর্চির কানে কানে বলে সাবধানে বেরিয়ে গেলাম।

মিনিস্টার রবার্ট বাদে আর সবাই এখনও আছেন এখানেই। তার বাসা এখান থেকে এক মাইল দূরে, বোধহয় হেঁটেই চলে গেছেন।

আর্চিকে নিয়ে সামনে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম।

রাস্তাগুলো পরিস্কার করা হয়েছে। তবে তাড়াহুড়োর কারণে স্নো প্লেয়ারগুলো সব বরফ রাস্তার দু-পাশে চাপিয়ে রেখেছে কোনমতে। এতে সেখানে পার্ক করে রাখা গাড়িগুলো সব অতিরিক্ত বরফের নিচে চাপা পড়ে গেছে। বরফের বিশাল চুড়ার মত দেখাচ্ছে।

সেরকমই একটা চূড়ার পেছেনে আমার শৈশবের বাসভবন দেখতে পাচ্ছি। পুলিশের ক্রাইম-সিন টেপ দিয়ে ঘেরা এখনও। রাস্তার ওপর ফেয়ারফক্স কাউন্টি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কতগুলো গাড়ি পার্ক করা আছে। ফেয়ারফক্স পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে এই কেসে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে দেখে একটু অবাকই হলাম। মনে হয় এফবিআই পাহারা দেয়ার কাজের জন্যে তাদের থাকতে দিয়েছে। কিছু না করার চেয়ে অন্তত এটা ভালো।

কেসের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে হলে ইনগ্রিডকে ফোন দিতে হবে। ও নিশ্চয়ই এখন এই তদন্তের সাথে জড়িয়ে গেছে।

প্যান্টের পকেটে হাতড়িয়ে ফোন না পেয়ে মনে পড়লো ওটা ইনগ্রিড নিয়ে গেছে।

বনির ল্যান্ডফোনটা খুঁজে বের করতে এক মিনিট সময় লাগলো। আমার নিজের নম্বরেই কল দিলাম। কিন্তু সরাসরি ভয়েস মেইলে চলে গেল কলটা। আমার নিজের গলা শুনতে পেলাম ওপাশ থেকে। রেকর্ড করে রাখা মেসেজ।

আমার সাথে যোগাযোগ করার আর কোন উপায় নেই ওর, ইমেইল ছাড়া। আর ইমেইল দেখতে হলে ল্যাপটপটা লাগবে। গতকাল তাড়াহুড়োর মধ্যে ওটা নেয়ার কথা মাথায় আসেনি। ভাবলাম একবার দৌড়ে গিয়ে বাবার বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসি। কিন্তু পরক্ষনেই বাদ দিয়ে দিলাম সে চিন্তা।

কাল দেখা যাবে।

তাছাড়া, বনির এখানেও নিশ্চয়ই কম্পিউটার আছে।

তার আগে হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিতে হবে আমার।

বাথরুমে গিয়ে চাপমুক্ত হলাম আগে। এরপর হাত মুখ ধুতে গিয়ে দেখি আঙুলগুলো কালো কালির দাগ।

আমার হাতের ছাপ নেয়া হয়েছে।

ঘুমন্ত অবস্থাতেই।

সেটা নিশ্চয়ই জরুরি ছিল তদন্তের জন্যে। আমার হাতের ছাপ না নিলে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া হাতের ছাপগুলোর সাথে মেলাতে পারতো না। তবুও ঘুমন্ত অবস্থাতেই করা হয়েছে দেখে একটু কেমন জানি লাগলো। এরপরে আমার চোখে পড়লো ওটা, হাতের উল্টো পিঠে একটা ছোট হৃদয়। আঁকা।

নিশ্চয়ই আমার হাতের ছাপ নেবার পুরোটা সময় এখানে ছিল ইনগ্রিড। হয়তো ও নিজের হাতেই করেছে কাজটা।

হাসি হাসি হয়ে উঠলো আমার মুখ। ও আমার স্ত্রী, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।

দ্রুত হাত থেকে কালি উঠিয়ে ফেললাম। এরপর একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে পুরো শরীর মুছে নিলাম। বনির মাস্টার বাথরুমে ঢুকে মাউথ ওয়াশ মুখে নিয়ে কুলি করলাম কয়েকবার। এতক্ষনে একটু মানুষ মানুষ মনে হচ্ছে। নিজেকে। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুললাম ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে।

একটা কাঁচের বক্সের গায়ে গোলাপি রঙের টেপ সাঁটা আছে, যেখানে লেখা : হেনরির খাবার, কেউ ছোঁবে না।

বনি, ইসাবেলের সাহায্য নিয়ে এক বক্স ভর্তি পাস্তা রান্না করে রেখেছেন আমার জন্যে।

ওটা মাইক্রোওয়েভে গরম করতে দিয়ে একটা কলা আর দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। এরপরে বক্সটা নিয়ে বনি যে ঘরে কম্পিউটারটা রাখেন। সেখানে চলে আসলাম।

তিনটা নয় বাজছে।

ঘরে ঢুকে দেখি ডেস্কের ওপর একটা ল্যাপটপ রাখা।

আমার ইমেইল অ্যাকাউন্টে লগইন করে ইনগ্রিডের পক্ষ থেকে কোন নতুন মেইল দেখলাম না। এরপর খবরের পোর্টালগুলোতে ঢু মারলাম।

ঝড় বয়ে যাচ্ছে এখানে।

একমাত্র ৯/১১-এর ঘটনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে একে।

প্রেসিডেন্ট সুলিভান অপহৃত!!

দেশজুড়ে আলোচনার ঝড়!

সিক্রেট সার্ভিস বলে কিছু আছে দেশে?!

শতাধিক গ্রেফতার।

এখনও সংবাদমাধ্যমের কাছে তেমন কোন খবর নেই। রেড, ক্যাপ্টেন মার্শাল, বিলি কিংবা আমার বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে কোথাও কিছু লেখা দেখলাম না।

আমার ধারণা আমি বাদে বিয়েতে উপস্থিত অন্য সবাইকে এফবিআই’র কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শিদের জবানবন্দি নেবার সময় এফবিআই’র লোকজন সবসময় জাতীয় নিরাপত্তা, জাতির বৃহত্তর স্বার্থ-এ ধরণের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া বাইরের কারও কাছে যেন কোন তথ্য না যায় সেদিকেও দৃষ্টি রাখে কঠোরভাবে।

যাইহোক, তুষারঝড়টার ব্যাপারে একটা প্রতিবেদন পড়লাম। ওয়াশিংটনে এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় ঝড় এটা। পুরো আমেরিকাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম। ডিসির সব রাস্তা তিন ফিট তুষারে ঢেকে গেছে। অ্যানানডেলে চল্লিশ ইঞ্চি আর মানাসাসে প্রায় উনপঞ্চাশ। আবহাওয়াবিদরা ধারণা করেছিলেন বড়জোড় তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি তুষার জমবে, সেজন্যে কারোরই তেমন কোন প্রস্তুতি ছিল না। শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়ে অবিরতভাবে তুষার ঝড়েছে তো ঝড়েছেই। প্রথমে আস্তে আস্তে তুষার পড়ছিল, এরপর সকাল ছটার দিকে পূর্ণশক্তিতে আঘাত হানে ঝড়। প্রতি ঘন্টায় দুই থেকে তিন ইঞ্চি হারে তুষারপাত হচ্ছিল। দুপুর নাগাদ দেড়ফুট বরফ জমে গিয়েছিলো রাস্তাগুলোতে। হামার ছাড়া রাস্তাগুলো আর কোন। গাড়ি চলাচলের উপযোগি ছিল। কারও বাসায় যদি ততক্ষনে খাবার না জমা করা হয় তাহলে ঘোর বিপদে পড়তে হয়েছে তাদের।

এরপরে আরও বিশ ঘন্টা ধরে একই হারে তুষারপাত হয়েছে, এত বেশি তুষার আগে কখনো দেখেনি এ শহরের মানুষ।

তুষারঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে এমন জায়গাগুলোর মধ্যে চল্লিশ শতাংশ এখন বিদ্যুহীন। পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানি পেপকোর মতে, ঝড়ের কারণে জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে বৈদ্যুতিক তার। এক সপ্তাহের আগে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়া অসম্ভব। সেসব অঞ্চলের ফোন টাওয়ারগুলোও বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করেছে। জেনারেটর দিয়ে সর্বোচ্চ আঠারো ঘন্টা ব্যাকআপ দেয়া যায়।

ভাগ্যিস আমাদের এখানে সব ঠিকঠাক আছে।

অন্তত এখন পর্যন্ত।

এক চামচ ভর্তি পাস্তা মুখে দিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম যে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারতো। এরপর আমার বিয়ের দিনের সব ঘটনার কথা চিন্তা করতে লাগলাম।

ঘুম থেকে জাগি দুটো ঊনষাটের সময়।

দুই থেকে তিন ইঞ্চি তুষার জমে থাকতে দেখেছি বাইরে এ সময়।

এরপর স্যুট পরা/বিয়ের অনুষ্ঠানকেক কাটা/নাচ/ ঘুম।

সাড়ে চারটার দিকে অপহরণকারিরা বাবার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ইনগ্রিডের মতে ওদের বন্দি করে বেইজমেন্টের বয়লার রুমে নিয়ে আটকে রাখতে পনের মিনিট সময় লাগে তাদের।

চারটা পঞ্চাশ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে নাগাদ বাসা থেকে বের হয়ে যায় তারা।

এই সময়ের মধ্যে বাইরে অন্তত পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি তুষার জমার কথা।

গাড়িতে করে এরপর নিশ্চয়ই খুব বেশি দূরে যেতে পারেনি তারা। আর গাড়ির ধরণের ওপরও নির্ভর করবে অনেক কিছু। বরফের রাস্তায় টয়োটা গাড়ি একরকম চলবে আর ফোর্ড আরেকরকম।

অবশ্য এখান থেকে সরাসরি একটা এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেনে উঠে বসতে পারে তারা। কিন্তু সেটা খুব সহজেই ধরে ফেলবে এফবিআই’র লোকজন। তাছাড়া যেরকম তুষারপাত হয়েছে, আমার মনে হয় না এই পরিস্থিতিতে ওড়া সম্ভব।

নাহ, গাড়িতে করেই এই শহর থেকে বাইরে বের হতে হয়েছে তাদের, সেটা তারা চাক কিংবা না চাক। কিন্তু এরকম ঝড়ের মাঝে সেটাও খুব সহজ কোন কাজ না।

ডেলাওয়ার থেকে নর্থ ক্যারোলিনা পর্যন্ত পুরো এলাকায় আঘাত হেনেছে তুষার ঝড়। তাই উত্তর কিংবা দক্ষিণে যাওয়া সম্ভব না কারও পক্ষে। পূর্বদিকে আটলান্টিক। একমাত্র পশ্চিমে গেলেই এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব। বোধহয় ভার্জিনিয়ার দিকে গেছে অপহরণকারিরা।

সকাল ন’টায় প্রাত্যাহিক মিটিঙে উপস্থিত থাকতে পারেননি সুলিভান। তখন তাকে নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়। এরপরেই নিশ্চয়ই পুরো দেশে সতর্ক অবস্থায় চলে যায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিটা রাস্তায় রাস্তায় বসানো হয় চেকপোস্ট। আন্তঃরাজ্য হাইওয়েগুলোতে টহল দেয়া শুরু করে সেনাবাহিনী।

এই সময়ের মাঝেই কোথাও লুকাতে হয়েছে অপহরণকারিদের।

“কিন্তু কোথায়?” জোরে বলে উঠলাম।

কিন্তু কিছুই মাথায় আসলো না।

আমি যদি ঘটনার সময় উপস্থিত থাকতাম তাহলে কি করতাম? রেড আর মার্শাল যেমন প্রেসিডেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, আমিও কি তেমনি ইনগ্রিডের সামনে দাঁড়াতাম?

সেটাই করতাম বোধহয়।

কিন্তু যে প্রশ্নটা আমাকে বিচলিত করছে সেটা হলো, লোকগুলো জানলো কিভাবে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন সুলিভান? যেখানে আমি নিজেই নিশ্চিত ছিলাম না এ ব্যাপারে।

কাদের জানিয়েছিলেন সুলিভান?

তারা কাকে জানিয়েছিল?

কোনভাবে এই তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই।

আর সেটা অবশ্যই আগের দিন নয়।

কারণ এই কাজ করতে দীর্ঘ পরিকল্পনার দরকার।

আমার মাথা ব্যথা করতে শুরু করায় ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলাম।

তিনটা চৌত্রিশ বাজছে।

.

চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে শুভ্র তুষার। জর্জ মনে হয় বাসার দরজা থেকে রাস্তা পর্যন্ত বরফ পরিস্কার করেছে দিনের বেলা। একটা চিকন পায়ে হাঁটা পথ দেখতে পেলাম। মারডক কংক্রিটের ওপর দিয়ে দু’পা হেঁটে পাশের বরফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

আর্চি কাঁপা কাঁপা পায়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বরফের দেয়ালে আঁচড়াতে লাগলো।

হেসে ফেললাম।

ওর কাছে নিশ্চয়ই এই তিন ফিট উঁচু বরফের দেয়ালকেই অনেক লম্বা মনে হচ্ছে।

আরেক পা সামনে এগিয়ে একটা লাফ দিলো ও।

হারিয়ে গেলো তুষারের মাঝে।

সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে ওর মারডক আঙ্কেল খুঁজতে লাগলো ওকে। কিছুক্ষণ পর বরফ খুড়ে ওর গলার বেল্ট কামড়ে ধরে উদ্ধার করলো ব্যাটাকে।

পুরো সাদা হয়ে গেছে আর্চি।

দেখে মনে হচ্ছে হাসছে।

অপেক্ষাকৃত কম বরফ আছে এমন জায়গায় নামিয়ে দিলো ওকে মারডক। আমি ল্যাসির দিকে তাকিয়ে বললাম, “মনে হয় তুষার পছন্দ ওর।”

মিয়াও।

“তুষার ফালতু জিনিস?”

ল্যাসি আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে যে মুখ ভার।

“তুই কি এখনও রেগে আছিস নাকি?”

আমাকে পাত্তাই দিলো না।

“কি এমন ব্যস্ত ছিলি তুই?”

আমার দিকে ঘুরলো ও।

মিয়াও।

“তোর জীবনের সবচেয়ে সেরা ঘুম? তুই তো সবসময়ই ইনগ্রিডের বুকের ওপর ঘুমাস।”

মিয়াও।

“কিন্তু আজ দু-জনের কাছে ঘুমোচ্ছিলি? সেটাও কথা।”

মিয়াও।

“তোকে পুষিয়ে দিতে হবে আমাকে?”

মিয়াও।

“এক হাজারটা বল? তোর তো প্রায় পনেরোটার মত বল আছে।”

মিয়াও।

“ঘন্টা লাগানো বল চাই এখন তোর!”

তুষার তুলে নিয়ে হাতে ছোট একটা বল বানিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে মারলাম।

থপ করে ওর গায়ে লাগলো ওটা।

চোখ বড় করে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালো ও।

মিয়াও!

“কারণ একটা বাচ্চার মত আচরণ করছিস তুই,” এরপর আর্চি আর মারডকের দিকে দেখিয়ে বললাম, “ওদের দেখো, কী সুন্দর মজা করছে। তুইও খেল যা।”

আমার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে ব্যাটা।

“যা ছেলের সাথে খেল।”

একবার বড় করে শ্বাস নিয়ে বরফে ঝাঁপ দিলো ও। তিনজন মিলে গড়াগড়ি খেতে লাগলো বরফে।

এক মিনিট পর, আমিও যোগ দিলাম ওদের সাথে।

ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে বাসার দিকে রওনা দিলাম আমরা।

“তোরা কি শুনতে পাচ্ছিস শব্দটা?” হঠাৎ থেমে বললাম।

কিছু একটা ফাঁটার আওয়াজ।

মারডকের দৃষ্টি ওপরের দিকে উঠে গেলো। ওকে অনুসরণ করে ছাদের দিকে তাকালাম।

ছাদের কিনারায় বিশাল এক বরফের চাই জমে আছে। আস্তে আস্তে সেখান থেকে নেমে আসছে সেটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে পড়ে যাবে।

আরও এক মিনিট লাগলো ওটার একদম ছাদের কিনারায় আসতে। এরপরেই ঘটলো ঘটনাটা। বিকট শব্দ করে পুরো বরফের চাই ঝড়ে পড়তে লাগলো নিচে।

অসাধারণ!

মারডক ডেকে উঠলো জোরে, শব্দে ভয় পেয়েছে।

“সমস্যা নেই,” ওকে বললাম, “শুধু বরফ।”

ও শান্ত হয়ে আসলে বনির বাসায় ঢুকে পড়লাম।

বিছানায় উঠছি এমন সময় ল্যাসি বললো এক হাজারটার বদলে পঞ্চাশটা বল দিলেও চলবে। আর এখন ওর কাছে মনে হচ্ছে তুষার জিনিসটা অতটাও খারাপ না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *