৪. চেক অ্যান্ড চেকমেট

চেক অ্যান্ড চেকমেট

মার্গো যখন তার ঘরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত, বেনডাল ঘরে ঢোকে। জুলিয়া আমি…কথা শেষ না করে থমকে যায়। তারপর ফিরতি প্রশ্ন করে, এসব কী করছ তুমি? মার্গো ওর দিকে ফিরে তাকায়, আমি বাড়ী ফিরে যাচ্ছি। জুলিয়া বিস্ময়ের গলায় বলে এত তাড়াতাড়ি? কেন? এত তাড়া কিসের? এত বছর বাদে আমাদের দেখা হলো সবাই এক সাথে হলাম। তোমার সঙ্গে তো জীবনে প্রথম দেখা। ভেবেছিলাম ভাই বোনেরা একসঙ্গে কয়েক দিন থাকব। হৈ চৈ হুল্লোড় মজা করব। মার্গো মাথা নাড়ে,–নিশ্চয়ই। পরে কোন সময় নিশ্চয়ই আবার সুযোগ হবে। বেনডাল বিছানার পাশে গিয়ে বসে। সব কিছু কেমন স্বপ্নের মত ঘটে গেল তাই না? এত বছর পর আবার ভাই বোনেরা একসঙ্গে হলাম, দেখা হলো, বিরাট সম্পত্তির অংশ পেলাম। মার্গো নিজের কাজ সারতে সারতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বেনডাল হাসতে হাসতে বলে, আর তোমার কথা তো একেবারেই আলাদা। নিজেকে তোমার সিন্ডারেলা মনে হচ্ছে না? মানে এক মুহূর্ত আগে তুমি ছিলে একজন গড়পড়তা মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ। আর পরের মুহূর্তে…বিলিয়ন ডলারের চমকপ্রদ অবিশ্বাস্য অঙ্কের মালকিন, উত্তরাধিকারী, স্বপ্নও বোধহয় এতটা দুঃসাহসী হবার স্পর্ধা দেখাতে পারে না। তাই না? নিমেষে মার্গোর হাত থেমে যায়। মুখের ভাব বদলে যায়। কি? বিলিয়ন ডলার? বেনডাল হাসতে হাসতেই বলে, হ্যাঁ, বাবার উইল অনুযায়ী আমরা প্রত্যেকে মোটামুটি ভাবে বিলিয়ন সওয়া বিলিয়ন ডলার করে সম্পত্তির অংশীদারী হচ্ছি। কেন? তুমি একথা জানো না? মার্গোর মুখে উত্তেজনায় ঘাম চিক চিক করে। স্তম্ভিত মুখে সে বলে, তুমি বলতে চাও আমার ভাগেও বিলিয়ন ডলারের বেশি থাকছে? জুলিয়া দৃঢ় গলায় বলে, হ্যাঁ। নিশ্চিত ভাবেই। কেন ওরা তোমায় কিছু বলেনি। মার্গোর মুখে গভীর রহস্যের ছোঁয়ামাখা অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে, না, ওরা কেউ আমায় কিন্তু একথা জানায়নি। ওর মুখে অন্যরকম এক ছায়া খেলা করতে থাকে। বেনডালের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে সে বলে, বেনডাল, আমি ভেবে দেখলাম তুমি ঠিকই বলেছ। এত বছর পর, জীবনে প্রথমবার তোমাদের সঙ্গে দেখা পরিচয় হলো। এভাবে চলে যাওয়া উচিত নয়, আরো কটা দিন কাটিয়েই যাই।

প্রমোদতরণী কেনার ব্যাপারটা অনেকটা পাকাপাকি হয়ে গেছে। নিজের ঘরে বসে একটা ক্যাটালগে কিছু বাছাই করা ইয়টের ছবি দেখছিল। এর থেকে পছন্দ করে জানিয়ে দিলেই এজেন্সি দাম মিটিয়ে দেবার পর ওর নামে নথিবদ্ধ করে নেবে নৌকোটাকে। ঠিক এমন সময়ে ফোনটা বাজল। হ্য লো, টাইলার স্ট্যানফোর্ড বলছি। টাইলার শিকাগো থেকে কিথ পার্সি বলছি। শরীরের অসুস্থতার কারণে আমি কয়েক মাস আগেই অবসর নিচ্ছি। তুমি আমার পরে প্রধান বিচারপতি হতে রাজী আছে? কয়েক সেকেন্ড, দ্রুত ভেবে নেয় টাইলার। তার পর যথাসম্ভব আন্তরিকতার গলায় জবাব দেয়, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, কেন নয়? এতো দারুণ একটা সুযোগ। ঠিক আছে। তাহলে ঐ কথাই রইল, তুমি তাহলে পরের প্রধান বিচারপতির পদ পাচ্ছো। ফোনটা রেখে দিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে, হ্যাঁ, এটা ঠিক, একটা সময় ঐ চেয়ারটার দিকে তৃষ্ণার্ত চাতকের মত লোভী চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত সে। এখন ঐ ছোট্ট নোংরা চেয়ার বা পদটার দিকে তার কোন আগ্রহ নেই। সে আজ কোটিপতি। ঐ ঘিঞ্জি শিকাগো কোর্টঘরে মানায় কোন কোটিপতিকে? আহ সে তো সেই সময়গুলোয় বরং নিজের প্রমোদতরণীতে ভেসে বেড়াবে সমুদ্র থেকে সমুদ্রে স্বপ্নসফরে। সঙ্গে থাকবে লি, শুধু লি, স্বপ্ন সঙ্গিনী। এসব সুখস্বপ্ন থেকে তাকে এক ঝটিকায় বাস্তবের রুঢ় মাটিতে টেনে নামায় মার্গো। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে চমকে ওঠে সে। একি? তুমি এখনো রওনা হওনি? বিস্ময়ের গলায় বলে সে। মার্গোর ঠোঁটে এক বিচিত্র হাসি, কৌতুকের সঙ্গে। আরো কি যেন অজানা ইঙ্গিতের মিশ্রণ সে হাসিতে, নাহ। গোছগাছ খুলে রাখলাম। আমি এখন যাচ্ছি না। টাইলার আঁতকে ওঠে। সে কি? কেন? সেই আশ্চৰ্য্যতর হাসিটা মার্গোর ঠোঁটে আরও চওড়া হয়। এই নাটকটা করার কথা প্রথম যখন হয়, তুমি আমাকে বলেছিলে এটা করার প্রয়োজন একজনের সঙ্গে সামান্য একটা ঠাট্টা করার জন্য। হ্যাঁ তাই। সেই ঠাট্টাটা তুমি করেছ আমার সঙ্গে। আমি বিলিয়ন ডলার দামী, আর আমাকে সামনে রেখে তুমি সেটা আত্মসাৎ করেছ। কথাগুলো শুনতে শুনতে টাইলারের মুখের ভাব শক্ত হয়ে ওঠে। কঠিন গলায় সে বলে, বেরিয়ে যাও, এই মুহূর্তে তুমি এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবে। তুমি তাই ভাবছ বুঝি? আমি তখনই এ বাড়ী থেকে চলে যাবো যখন বুঝব উপযুক্ত সময় হয়েছে। যা এখন হয়নি। কঠিন প্রত্যয়ী গলায় বলে।

টাইলার ঠান্ডা ধীর চোখে কয়েক মুহূর্ত ওকে জরীপ করে। তারপর ধীর বরফ কাটা গলায় বলে, বেশ তুমি কি চাও? মার্গোর চোখের তারা ঝিলিক দিয়ে ওঠে, আহ, এই তো বুদ্ধিমানের মত কথা। বিলিয়ন ডলার, ওহু আমি ভাবতেই পারছি না। এসো টাইলার একটা রফায় আসা যাক।

.

পরদিন থেকেই রোজ হিলের বাড়ীতে বাক্সের পর বাক্স এসে পৌঁছাতে লাগল। বিখ্যাত সব পোশাক প্রস্তুতকারক সংস্থার দামী দামী পোশাকের বাক্স। কিন্তু টাইলার হুড়মুড় করে মার্গোর ঘরে ঢুকে এসে চাপা গলায় হিসহিস করে ধমকে ওঠে, কি ব্যাপার, নিজেকে ভেবেছ কি তুমি? মার্গো নিঃশব্দে হেসে, রাগ করছ কেন? যতই হোক তোমার বোন, স্ট্যানফোর্ড পরিবারের একজন যদি কমদামী সাধারণ পোশাক পরে থাকে, সম্মান থাকবে তোমাদের পরিবারের? একটু খরচ না হয় করলে নিজের বোনের জন্য। কথা শেষ করে সে কৌতুকের হাসিতে ভেঙে পড়ে। মার্গো… ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে চেঁচিয়ে ওঠে টাইলার। মার্গো হাসিটা ধরে রেখেই জ্বালা ধরানো গলায় বলে, উঁহু জুলিয়া, ভুল করছ। তারপর আচমকা চোখা গলায় মার্গো বলে, ভাল কথা, তোমার টেবিলে কতগুলো ইয়টের ছবি দেখলাম। তুমি কি কোন ইয়ট কিনবার পরিকল্পনা করছ? সেটা তোমার ভাবার বা মাথা গলানোর ব্যাপার নয়।

মার্গো দার্শনিকের গলায় বলে, নিশ্চিত করে কে বলতে পারে? হয়ত তুমি আর আমি সেই ইয়টে পৃথিবী ভ্রমণে বের হবো। নৌকোটার নাম দেবো আমরা মার্গো। নাকি জুলিয়া? স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দাঁতে দাঁত পিষে রাগ জর্জর গলায় টাইলার বলে, আমি তোমায় মাপতে ভুল করেছিলাম। কম হিসেব ধরেছিলাম তোমার বুদ্ধির, তুমি একজন চতুর, ধূর্ত মহিলা। মার্গো হাসে, এটাকে প্রশংসা হিসেবেই নিচ্ছি আমি।

স্থির পলকহীন চোখে বেশ খানিকটা সময় ধরে ওকে জরীপ করে টাইলার। তীব্রতর, প্রায় রুক্ষ্ম হয়ে ওঠা দৃষ্টিতে যেন মার্গোর বুদ্ধির গভীরতা মাপতে চায়। তারপর ধীরে ধীরে কেটে কেটে বলে, তুমি নিশ্চয়ই বুদ্ধিমতী, সঙ্গে বাস্তব বিচারবোধ সম্পন্নও কি? মার্গোও একই ভাবে কেটে কেটে বলে, সেটা নির্ভর করে আমার বাস্তব বিচার যুক্তিবোধকে কে কি দাম দেয় তার ওপর। ধরো একলক্ষ ডলার। মার্গোর হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুততর হয়ে ওঠে। এতখানি? না এতটা সত্যি সে আশা করেনি। নিজের উত্তেজনা প্রাণপণে চেপে রাখতে রাখতে, দমন করার চেষ্টা চালাতে চালাতে, নিজেকে স্বাভাবিক রাখবার প্রাণপণ চেষ্টায় সে উত্তর দেয়, মন্দ নয়। বেশ তাহলে ঐ কথাই রইল। টাইলার পকেট থেকে একটা চাবির রিঙ বের করে, পরের বিমানেই তুমি শিকাগো ফিরে যাও। এটা আমার শিকাগোর বাড়ীর চাবি। তুমি ঐ বাড়ীতে কয়েক দিন থাকো। দিন কয়েকের মধ্যে আমি শিকাগো আসছি, তোমার টাকা তুমি সে সময়ই হাতে পেয়ে যাবে। একটা দ্বিধার কাটা এ মুহূর্তে মার্গোর মনে খচখচ করতে থাকে। সে কি খুব সস্তা দরে রাজী হয়ে গেল? টাইলারের উদ্বেগহীন নিশ্চিন্ত অভিব্যক্তিই প্রমাণ করে দিচ্ছে মার্গো বোকামী করছে। কিছুটা দরাদরি করে তার আরো কিছুটা দর বাড়ানো উচিত ছিল। চাপ দিয়ে যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া গেছেই টাইলারকে, আরো কিছু বাড়তি অর্থ আদায় করে নেওয়া উচিত ছিল।

এবার আর কোন ভুল করল না টাইলার। নিজে সঙ্গে করে মার্গোকে শিকাগোগামী বিমানে তুলে দিলো। এবং ততক্ষণ অপেক্ষা করল যতক্ষণ না বিমান আকাশে উড়ছে। বাড়ী ফিরে প্রথম কাজ যেটা সে করল, শিকাগোতে কিথ পার্সিকে ফোন করল। হ্যালো টাইলার, তুমি কবে ফিরছ? আমরা প্রধান বিচারপতি হিসেবে তোমার স্বাগত বরণ উৎসবের আয়োজন করব ঠিক করে রেখেছি। টাইলার নিজেকে অনুত্তেজিত, আন্তরিক, স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে, খুব তাড়াতাড়ি আমি ফিরছি। কিথ, তার আগে একটা ঝামেলায় আমি তোমার সাহায্য পেতে পারি? কিথ পার্সি বলে, নিশ্চয়ই। কি ব্যাপার বলল তো? তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, মার্গো পসনার নামের এক প্রতারক দাগী ক্রিমিনালকে সংশোধন করার, সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেবার চেষ্টায় আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার জামিনের ব্যবস্থা করেছিলাম। হা হা মনে পড়েছে। মেয়েটা কি কোন সমস্যা করেছে? টাইলার একটা গভীর শ্বাস ফেলে শব্দ করে, ফোনেও যাতে ওর বিষণ্ণতার রেশ কিথের কাছে পৌঁছায়। মেয়েটা মারাত্মক, আমার পিছু তাড়া করে ও এখানে এসে পৌঁছেছে। নিজেকে ও আমার বোন বলে দাবী করেছে। আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে প্রচুর জিনিসপত্র কেনাকাটি করেছে। আমায় প্রায় সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। আমি প্রতিবাদ করলে, বাধা দিতে গেলে আমায় এবং আমার গোটা পরিবারকে খুন করতে গিয়েছিল। এখন আমার শিকাগোর বাড়ীর চাবি চুরি করে সেখানেই গেছে। জানিনা ওর কি উদেশ্য আছে। কিথ পার্সি ওপাশ থেকে আশ্বাস দেয় তুমি কোন চিন্তা করো না টাইলার। আমরা ওকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা করছি অবিলম্বে।

মেয়েটা ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ৩০৭ বি নম্বরের বিমানে রয়েছে, খুব সাবধান কিথ। মেয়েটা কিন্তু মারাত্মক। হিংস্র ধরনের পাগল। গ্রেফতারের পর ওকে রিড মানসিক হাসপাতাল-এ ভর্তি করে দেবে। ওর গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া মাত্রই আমি ফ্যাক্স করে মেয়েটার মানসিক চিকিৎসার আদেশ সই করে তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমি চাই বেশ কয়েক মাস ওকে মানসিক চিকিৎসকের অধীনে রিড মানসিক হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করা হোক। ওপাশ থেকে কিথ বলে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো টাইলার। তোমার কথা মতই কাজ হবে। মেয়েটাকে গ্রেফতার করার পরই তোমায় খবর পাঠাব। বিমান বন্দরেই ওকে জালে ফেলা হবে।

সে রাতের খাবার টেবিলে বেনডাল বলে, কি ব্যাপার, জুলিয়াকে দেখছি না? টাইলার খাবারের থালা থেকে মুখ তোলে, ও হ্যাঁ বলতেই ভুলে গেছি। জুলিয়াকে হঠাৎ আচমকা চলে যেতে হয়েছে। ও তোমাদের সবাইকে ওর হয়ে বিদায় জানাবার কথা বলে গিয়েছিল আমায়। ওর এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় ওকে একেবারেই হঠাৎ করে চলে যেতে হয়েছে। কাউকে কিছু জানাবার ফুরসতই করে উঠতে পারেনি। বেনডাল বিস্ময়ের গলায় বলে, কিন্তু উইলটা তো… টাইলার আশ্বাস দেবার গলায় বলে, চিন্তা করো না। ও আমায় ওর ভাগটা তুলে ওর নামে জমা করে দেবার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নী আর ব্যাঙ্ক অথরিটি লিখে দিয়ে গেছে।

ঘণ্টা কয়েক পরই খবরটা এসে পৌঁছল। বিমান বন্দর থেকেই তুলে নেওয়া হয়েছে মার্গোকে। মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। বিমান বন্দর থেকেই খবরটা পেয়েই সশব্দে হেসে ওঠে সে। লোভী কুত্তীটাকে এখন বাকি জীবন মানসিক হাসপাতালের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে কাটাতে হবে। বেচারি দুঃখী মেয়েটাকে আর খাওয়া পরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না। এতক্ষণে, এতক্ষণে সত্যিই খেল খতম। কিস্তিমাত। আহ, বুড়ো ভাম নিশ্চয়ই তার কবরে গড়াগড়ি দিচ্ছে যখন জানছে তার সাধের স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের কর্তৃত্ব মালিকানার দখল নিচ্ছে টাইলার। আনন্দের উচ্ছ্বাস থেকে ওর মনে এক তীব্রতর যৌনবোধ জেগে উঠল। সুটকেসের একেবারে নিচ থেকে একটা পত্রিকা বের করল। সারা দেশের সমকামী ক্লাবগুলোর ঠিকানা দেওয়া রয়েছে এতে। বস্টনের একটা ক্লাব বেছে নিলো সে। আজ রাতে…। শরীরে আচমকা জেগে ওঠা তীব্রতর যৌনবোধ চাহিদা থেকে মুক্ত হওয়া দরকার।

.

জুলিয়া আর স্যালি দুজনেই কাজে বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কাল হেনরির সঙ্গে সন্ধ্যেটা কেমন কাটল? স্যালির প্রশ্নে জুলিয়া কাঁধ ঝাঁকায়, ঐ একরকম। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারটা পাকাপাকি করছ না কেন? জুলিয়া নত মুখে কি যেন চিন্তা করে। নাহ, আসলে হেনরি বোধহয় আমার মত, আমরা জন্য নয়। স্যালি মাথা নাড়ে, হবে হয়ত। তবে এগুলো নিশ্চিত ভাবেই তোমার জন্য। পাঁচটা খাম এগিয়ে দেয় ও, জুলিয়া একটা একটা করে খামগুলো খোলে। সব কটাই ধার শোধ করার বিল বা নোটিশ। বেশ কয়েকটা লাল অক্ষরে ওভার ডিউ লেখা। দুটোতে মোটা মোটা অক্ষরে ছাপানোশেষ নোটিশ। অসহায় চোখে স্যালির দিকে তাকিয়ে সে বলে, আমায়…আমায় কিছু ধার দিতে পারো? স্যালি ওর দিকে অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। বিশ্বাস করা সত্যিই কষ্টকর। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজনের উত্তরাধিকারী এভাবে জীবন ধারনের মত ক্রীতদাসের মত পরিশ্রম করে? ধার দেনায় জড়িয়ে জর্জরিত হয়ে অসহ্যকর জীবন কাটাতে পারে? একজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক খারাপভাবে বাঁচতে পারে? যখন সে ইচ্ছে করলেই…। জুলিয়া শান্ত গলায় বলে, ভুলে যাও ওসব কথা। আমি তোমায় আগেই বলেছি, লোকটি আমার মায়ের সঙ্গে কি নিষ্ঠুর নিকৃষ্টতর ব্যবহার করেছে। আমার খোঁজও নেয়নি কোনদিন। বাবা হিসেবে যাকে স্বীকারই করি না, যার প্রতি কোনরকম ভালবাসা সহানুভূতিই নেই, তার সম্পত্তি টাকা-পয়সার প্রতি আগ্রহ বা দাবী আমার নেই।

স্যালি কেন যেন কিছুতেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলো না। এক রাজকন্যা, যে জানতই না যে সে একজন সত্যি রাজকন্যা। এবং যখন সে জানল তা, বোকা মেয়েটা তার ফাঁপা গুমোর, অর্থহীন এক অহঙ্কার আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছে। নাহ, ব্যাপারটা সত্যিই উচিত হচ্ছে না। সবাই, অন্যেরা যে যার ভাগ বুঝে নেবে শুধু বোকা মেয়েটা…। নাহ, কিছু একটা করা উচিত। মিথ্যে অহংকারের অসুখে ভুগতে থাকা মেয়েটা নিজে যদি কিছু না করে, তবে তাকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এবং পরে একদিন বোকা মেয়েটা নিশ্চয়ই এজন্য ধন্যবাদ দেবে তাকে।

সেই সন্ধ্যার দৈনিকপত্রে স্যালি দেখল, খবর রয়েছে, হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের উত্তরাধিকারীরা তাদের পারিবারিক বাড়ী রোজহিলেতে জড়ো হয়েছে তাদের বাবার অন্ত্যোষ্টিতে যোগ দিতে। (এবং অবশ্যই তাদের বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে)। স্যালি মনে মনে দাঁত কামড়ায়, বোকা মেয়েটা সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে খুন করতে চলেছে। না, এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। তাকেই ব্যবস্থা করতে হবে। জুলিয়া এখনো কাজ থেকে ফেরেনি। এই সুযোগেই তাকে কাজ সারতে হবে। কাগজ কমল টেনে নিয়ে একটা চিঠি লিখতে বসে। জজ টাইলার স্ট্যানফোর্ড, জুলিয়ার বড় দাদাকে উদ্দেশ্য করে।

.

২১.

 খেলার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সন্ধি সময়ে এসে দাঁড়িয়ে, আবার পুরো ব্যাপারটাকে একেবারে গোড়া থেকে খতিয়ে দেখে। পর্যালোচনা করে টাইলার স্ট্যানফোর্ড। না, এখনো পর্যন্ত কোন গলতি নেই। আলগা নেই কোন সুতো। দিমিত্রি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছে এবং জন অরণ্যে মিশে গেছে। মার্গো পসনার, বাকি জীবন ওকে উন্মাদ রোগী হিসেবে মানসিক হাসপাতলে কাটাতে হবে। একমাত্র বাকি রয়েছে একটাই গিঁট, হ্যাল বেকার। তবে ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন অবকাশই নেই। ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটার খোঁজ–সে পেয়ে গেছে। ওর পরিবার বেকার কখনোই মুখ খুলবে না। পরিবার থেকে দূরে, জেলে গিয়ে ঢুকতে আবার মোটেই চাইবে না সে। আর সে ভালই জানে, পুতুল নাচের সুতো বাঁধা আছে টাইলারের হাতের আঙুলে। বেচাল করলেই.. টাইলারের আঙুলের ইশারায় নাচতে বাধ্য সে। নাহ, ওকে নিয়ে ভয় পাবার একদমই কোন কারণ নেই। সব কিছু একেবারে ঠিকঠাক, তার পরিকল্পনা মতই ঘটে চলেছে। উইল প্রবেট হয়ে যাওয়ামাত্র সে লিকে নিয়ে সেন্ট ট্রপেজ দ্বীপে পাড়ি জমাবে। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে নিজের বিলাস বহুল চোখ ধাঁধানো প্রমোদতরণীতে। ভেনিস দেখার অনেক দিনের সুপ্ত বাসনা এবার পূর্ণ হবে। পসিটানো…কাপরি…রিও…কেনিয়া সাফারী…তাজমহল…সুইস আলপস এবং এসবের জন্য কাকে ধন্যবাদ দেবে সে? অবশ্যই তার বাবা, প্রিয়তম বাবাকে।

তুমি একটা অপদার্থ টাইলার। চিরজীবনই অপদার্থই থেকে যাবে। আমার ঔরসে যে কি করে তোমার মত একটা কুপমুণ্ডক জন্ম নিলো…। প্রিয়তম বাবা, শেষ হাসিটা কে হাসল। পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে দুপুরের খাওয়া খাচ্ছিল সে। অন্যদের মুখের দিকে গোপন চোখে তাকিয়ে নিয়ে কৌতুকে ভরে ওঠে ওর মন। নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ মুখগুলো। এখন ও যদি উঠে দাঁড়ায়, ঘোষণা করে..স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের কর্তৃত্ব মালিকানার দখল নিচ্ছি আমি। আমাদের বাবাকে আমিই খুন করিয়েছি। আমাদের সঙ্গে বোন সাজিয়ে এক প্রতারককে এনে…। চিন্তাটায় ওর পেটের মধ্যে হাসির রোল ওঠে। কথাগুলো শুনলে, এই নিরুদ্বিগ্ন নিশ্চিন্ত মুখগুলোর অবস্থা কেমন হবে? আহ, সত্যিই এরকম একটা গোপন খবর যেটা সে নিজের মনে লুকিয়ে রেখেছে, সেরকম কোন খবর লুকিয়ে গোপন রাখার মধ্যে কি এক তীব্র রোমাঞ্চকর আনন্দ আছে, অবর্ণনীয় সে আনন্দ।

দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে ফেরার পর পরিচালক ক্লার্ক ঘরে এলো। আপনার নামে একটা চিঠি আছে। বোধহয় কিথ পার্সির চিঠি। ধন্যবাদ ক্লার্ক। চিঠিটা হাতে নেয়। কানসাস ডাকঘরের ছাপমারা। অর্থাৎ কিথ পার্সির চিঠি নয়। খামটাকে খুলে সে চিঠিতে চোখ রাখে।

মাননীয় বিচারপতি স্ট্যানফোর্ড, আমার মনে হয়, আপনার জানা উচিত যে আপনার এক সৎ বোন আছে, জুলিয়া। সে আপনার বাবা এবং গভর্নের্স নোজমেরী নেলসনের কন্যা। সে কানসাস শহরে বাস করে। তার ঠিকানা-১৪২৫, মেটকালশ এভিনিউ। অ্যাপার্টমেন্ট-৩বি, কানসাস সিটি।
শুভেচ্ছাসহ।
এক জনৈক বন্ধু।

.

টাইলার তড়িতাহতর মত তীব্র বিস্ময়ের চোখে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিষাক্ত কোন মহাসর্প যেন হাতে ধরে রেখেছে। এমন আতঙ্ক ভরা দৃষ্টিতে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। একেবারে কিস্তিমাতের মুখে এসে পাশা উল্টে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, তীব্র বিপদ সঙ্কেতের মত এক বোধ কেন জানিনা তার মনে টিক টিক করে জানাতে থাকে যে এ মেয়েটা প্রতারক বা নকল নয়। কিছুতেই নয়, এ আসল। না, চাপা আর্তনাদের মত শব্দটা তার গলা চিরে বের হয়ে আসে। শেষ মুহূর্তে এসে এভাবে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে পারে না সে। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এবং খুব তাড়াতাড়ি। নিশ্চিত, ব্যর্থতা সম্ভাবনাহীন কিছু। টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ায় বিচারপতি টাইলার।

.

২২.

ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, নাহ আপনার রোগটা সত্যিই অদ্ভুত। আগে এরকম কোন কেস আমার নজরে আসেনি। হ্যাল বেকার হাত চুলকোতে চুলকোতে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার ভদ্রলোক আরো বলেন, দেখুন শ্রী বেকার, আমার সামনে এখন তিনটি সম্ভাবনা রয়েছে। আপনার চুলকানি ছত্রাকজনিত কারণে হতে পারে। এছাড়া অ্যালার্জী হতে পারে। অথবা আর একটি সম্ভাবনা হতে পারে নিউরোডারমা টাইটিস। কথা শেষ করে কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে কি যেন ভাবেন ডাক্তার। তারপর আবার বলেন, আপনার ক্ষত থেকে যে চেঁছে নেওয়া চামড়ার নমুনা মাইক্রোস্কোপের নিচে বায়োলজিক্যাল পরীক্ষা করার পর দেখা যাচ্ছে, এটি ছত্রাক জাতীয় সংক্রমণ নয়। সুতরাং আর দুটো সম্ভাবনা এখন হতে পারে। প্রথমত লিচেন সিমপ্লেক্স ক্ৰনিক্যাস অথবা হয়ত লোকালাইজড নিউরোডারমা টাইটিস।

বাড়ী ফেরা মাত্র, ওর স্ত্রী হেলেন জানালো, তোমার একটা ফোন এসেছিল। কে একজন মিঃ জোন্স। বলেন খুবই জরুরী। বেকারের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়ে ওঠে। সে কিছু অন্যায় কাজ করেছে। কিন্তু নিজের পরিবারের জন্যে তা করতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু এখন সে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফোনে এখন তাকে যা করতে বলা হচ্ছে, ঠান্ডা মাথায় খুন, যা সে করতে পছন্দ করে না। সে তার অপছন্দ জানায়ও, না, বিচারপতি টাইলার, এ কাজ আমি পারব না। অন্য কাউকে বাছুন আপনি। একটা লম্বা দীর্ঘতর নীরবতা ফোনে ছেয়ে থাকে। তারপর কঠোর গলায় ওপাশ থেকে শোনা যায়, তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে বেকার? জবাব দেবার আগেই বেকার তার মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে যাওয়া হিম বরফ স্রোতটা টের পায়। সে বোঝে হেরে যাচ্ছে।

.

কানসাস সিটিতে পৌঁছনটা ঘটনাহীন। জজ স্ট্যানফোর্ড তাকে বিস্তারিত ভাবে সব কিছু বলে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বাড়ীটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। মেয়েটার নাম জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড এবং একা থাকে সে। এক বান্ধবীর সঙ্গে। সুতরাং সহজ কাজ।

ঘন্টা খানেক পর একটা জনসাধারণের জন্য ফোনকেন্দ্র থেকে টাইলারকে ফোন করে, হা বিচারপতি টাইলার, আমি কানসাস থেকে বলছি। পাখী উড়ে গেছে। অন্য প্রান্ত থেকে টাইলার বিস্ময়ের গলায় বলে, মানে?

জুলিয়ার রুমমেট বলল, মেয়েটা কোথায় যেন চলে গেছে। রুমমেট মেয়েটিকেও কিছু বলে যায়নি। গতকালই সকালে রুমমেট মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে দেখে জুলিয়া নেই। নিজের জিনিষপত্র নিয়ে সে আচমকা কোথাও চলে গেছে।

ফোনের রিসিভারটি নামিয়ে রাখতে রাখতে টাইলারের সারা শরীরে ভূমিকম্প হতে শুরু করে। মেয়েটা নিশ্চয়ই এখানে আসবার উদ্দেশ্যেই রওনা হয়েছে। হে ভগবান! সব কিছু একদম ছবির মত নিখুঁত ভাবে ঘটে চলেছিল। হঠাৎ কোথা থেকে সব দান ওলোট পালোট হয়ে গেল। মেয়েটাকে থামাতেই হবে। নাহলে সে পথে বসবে। এই দ্বিতীয় জুলিয়ার কি ব্যাখ্যা দেবে সে অন্যদের কাছে? কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসবেই। স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইসের মালিকানার বদলে দুহাতে হাত কড়া এবং বাকি জীবন জেলখানা জুটবে তার ভাগ্যে। মেয়েটাকে থামাতেই হবে। সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? উদ্বেগে সারা মুখ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। হৃৎপিণ্ডের অতি দ্রুততর গতি নিজের কানেই যেন ধরা পড়ে। খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কিভাবে? এই চিন্তায় সে যখন উন্মত্ত প্রায় হয়ে উঠেছে, তখনি ক্লার্ক ঘরে ঢোকে। টাইলার প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? ক্লার্ককে বিমূঢ় সংশয়গ্রস্ত দেখায়। জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

.

২৩.

ওর মত পালটানোর জন্য বেনডালই দায়ী। একদিন সে একটা পোষাকের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। দোকানের বাইরের কাছে জানালার ভেতরে একটা দুর্দান্ত ঝলমলে পোষাক ঝুলছিল। ডিজাইনার হিসেবে পোষাকটায় বেনডালের নাম লাগানো ছিল। পোষাকটার দিকে তাকিয়ে জুলিয়া মনে মনে ভাবে আমার বোন কত সফল মানুষ। এবং সে মুহূর্তে নিজের মনে একটা তীব্র ওলোট-পালোট টের পায় সে। নিজের ভেতর আবেগের স্রোত তাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। বাবা আমার মায়ের সঙ্গে কি ব্যবহার করেছে, অথবা আমায় কেন মেয়ে হিসেবে মেনে নেয়নি, খোঁজ নেয়নি, তার জন্য আমার সৎ ভাইবোনদের দোষ দিতে অথবা দায়ী করতে পারি না। ওরা হয়ত আমায় ভালভাবেই গ্রহণ করবে। হয়ত ওরা আমারই জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ, হঠাত্র নিজের কোনদিন না দেখা ভাই বোনদের সঙ্গে দেখা করার, মিলিত হবার দুর্নিবার, অপ্রতিরোধ্য বাসনা–ইচ্ছে অনুভব করতে থাকে, যা প্রায় তাড়নার মত।

সেদিন, যখন সে বাড়ী ফিরল, স্যালি তখনো ফেরেনি। সে দ্রুত নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। স্যালি সকালে তাকে দেখতে না পেয়ে হয়ত অবাক হবে। কিন্তু কিছু করার নেই। স্যালিকে জানানোর জন্য দেরী করতে পারবে না সে। ততক্ষণে যদি তার এই আকাঙ্খ তাড়না আবার মরে যায়? এই যে অপ্রতিরোধ্য দুর্বলতা জন্মেছে তার মনে নিজের ভাই বোনদের দেখার জন্য, তাদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য, সেটা যদি নিস্তেজ হয়ে পড়ে? নাহ, সে সময় নষ্ট বা দেরী করতে পারবে না, সে রাতেই রওনা হয়ে পড়তে হবে তাকে। জুলিয়া তাই দেরী করেনি।

.

২৪.

টাইলার অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে থাকে। জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড…মানে কি? নিজের গল্পটা ওর নিজের কাছেই অপ্রকৃতিস্থ শোনায়। পরিচারকটি এ রহস্যের উত্তর কি করে জানবে? সে হতচকিত স্তম্ভিত প্রায় মুখে টাইলারের দিকেই তাকিয়ে থাকে এবং যোগ করে, ইনি কিন্তু আগের, যিনি এত দিন থেকে গেলেন সেই একই মিস স্ট্যানফোর্ড নন। জোর করে, হাসি ফুটিয়ে তোলা মুখে টাইলার বলে, নিশ্চিত ভাবেই নয়। তা হবেই বা কি করে। নিশ্চয়ই এ কোন জালিয়াত। ক্লার্ক বিস্মিত মুখে বলে, জালিয়াত! তাহলে কি পুলিশে খবর দেবো স্যার? সর্বনাশ। বলছে কি? টাইলার তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, না, না, আমিই ব্যাপারটা সামলে নিতে পারব। এত বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির গন্ধে গন্ধে এরকম দু-চারটে উটকো ঝামেলা তো এসে হাজির হবেই। কতবার এ নিয়ে তুমি পুলিশকে বিরক্ত করবে? তুমি বরং মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। ক্লার্ক বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। টাইলার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছে। কেলেঙ্কারীর একশেষ। ওর মনে ঝড়ের মত উখাল পাথাল ঘটতে থাকে চিন্তার ঢেউ। আসল জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড তাহলে দেখা দিলো? তবু ভালো এ মুহূর্তে অন্য ভাই বোনেদের কেউ একজনও বাড়ীতে নেই। এই ভগবানপ্রদত্ত অভাবিত সুযোগটাকে পুরোপুরি সদ্ব্যাবহার করতে হবে। কিছু একটা করতে হবে, এবং তা অতি দ্রুত।

ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় মেয়েটি, প্রথমেই তার চোখ চলে যায় ঘরের ডান দেওয়ালে ঝুলন্ত হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের বিশাল তৈলচিত্রের দিকে। ছবিটাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে, এক মনে খুঁটিয়ে দেখার পর সে ফেরে। টাইলারের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যালো, আপনি টাইলার? মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সে ফিরতি প্রশ্ন করে, কিন্তু আপনি কে? নিমেষে মেয়েটির মুখের হাসিটা ফিকে হয়ে আসে, আমাকে…? আমি জুলিয়া…স্ট্যানফোর্ড। এ ব্যাপারটা প্রমাণ করার মত কোন তথ্য আছে আপনার কাছে?

প্রমাণ? না…হয়ত সেভাবে কিছু…আসলে এসবের দরকার হবে… টাইলার মেয়েটির কাছে সরে গিয়ে দাঁড়ায়, কেন এসেছেন আপনি? আমার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে, আমার ভাই-বোনদের দেখতে। হঠাৎ করে? ছাব্বিশ বছর পর? মেয়েটি দৃঢ় গলায় বলে, হা। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলে টাইলারের মনে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। মেয়েটি নিশ্চিত ভাবেই আসল জুলিয়া। ভয়ঙ্কর। বিপজ্জনক। এর খুব তাড়াতাড়ি কোন একটা ব্যবস্থা করতে হবে। জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলে, এভাবে হঠাৎ করে, প্রায় শূন্য থেকে আপনার এই এসে পড়াটা, আমার পক্ষে যে কতটা অবাক করা, হতচকিত করে দেবার মত…।

জানি, দুঃখিত, আমার বোধহয় একটা ফোন করে আসা উচিত ছিলো। টাইলার খুব নির্বিকার গলায় সাধারণ প্রশ্ন করার মত জানতে চায়, এখানে আপনি কি একা এসেছেন? হ্যাঁ। আপনি বস্টন আসছেন কেউ জানে আর? না, সেভাবে কেউ নয়। শুধু আমার রুমমেট স্যালি, কানসাস সিটিতে।

এরপর কোন হোটেলে মেয়েটি উঠেছে তা জেনে নেয়। কপলে স্কোয়ার হোটেল, ঘর নম্বর–৪১৯। ঠিক আছে জুলিয়া, তুমি এখন হোটেলে ফিরে যাও, পরিবারের অন্যদের তোমার কথা জানাবো আমি। তারপর তোমায় ডেকে পাঠাব। এত বছর পর আমাদের আরো এক বোনকে পেয়ে ওরাও নিশ্চয়ই আমার মত খুশি হবে। আবেগে যেন গলা বুজে আসে টাইলারের।

হোটেলে ফিরেও বারবার স্যালির কথাটা ঘুরে ফিরে মনে হতে থাকে জুলিয়ার। ছুরি হাতে আততায়ী? ওকে খুন করতে এসেছিল? জুলিয়ার খোঁজ কেন করবে কোন আততায়ী? ছদ্ম পরিচয় দিয়ে একজন ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল…স্যালিকে জুলিয়া ভেবে…তার হাতে ছুরি ছিল…শেষ মুহূর্তে স্যালি জুলিয়া নয় বুঝতে পেরে,..জলের গ্লাস নিয়ে ফিরে দাঁড়াতেই লোকটার হাতের ছুরিটা স্যালি দেখতে পায়। জুলিয়া ভেবে কোন কুল কিনারা পায় না। স্যালির কল্পনা এত দীর্ঘতর হবে? এবং কল্পনা আজগুবি ভাবনা কখনো এত নিখুঁত। ছবির মত স্পষ্ট যুক্তিসম্মত হতে পারে? কিন্তু কে এবং কেন? জুলিয়ার মত এক অতি সাধারণ মেয়েকে খুন করতে কে চাইবে? তবে কি? হঠাৎ বিশাল বিত্তশালী স্ট্যানফোর্ড পরিবারের সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠায়, ঐ আততায়ীর আগমন? জুলিয়াকে খুনের চেষ্টার সঙ্গে সম্পূর্ণ যুক্ত? স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের উত্তরাধিকারী হিসেবে, স্ট্যানফোর্ড পরিবারের সদস্য হিসেবে কেউ কি জুলিয়াকে মেনে নিতে চায় না? মেনে নিতে পারছে না?

.

হ্যাল বেকার সবে ফিরেছে হোটেলের ঘরে। ফোনটা শব্দ করে সক্রিয় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। হ্যালো, সাড়া দিতেই অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে, হাল? আমি দুঃখিত বিচারক। না এখনো দেবার মত কোন খবর নেই। হাঁদারাম, ও এখানে, বস্টনে। কি? বেকারের বিস্ময় ভরা স্বরটাকে আর্ত চিৎকারের মত শোনায়। শোনো, মেয়েটা কপলে স্কোয়ার হোেটলের ৪১৯ নম্বর ঘরে উঠেছে। আশা করি কি করতে হবে… ইচ্ছে করেই কথা শেষ না করে থেমে যায়। আমি বুঝেছি স্যার। শোনো, আজ রাতেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলবে। একটা কথা মাথায় রেখো, বার বার ব্যর্থদের আমি ক্ষমা করি না। টেলিফোনের অন্য প্রান্তে বেকারের ঢোক গেলার শব্দ শুনতে পায় টাইলার, ইয়ে…মানে…গতবার…। তাড়াতাড়ি, কাজটা সারো৷ দড়াম করে ফোনটা রেখে দেয় টাইলার।

জুলিয়া রাতের খাবার খেতে রিইজ কার্লটন হোটেলে গিয়েছিল। সত্যি অসাধারণ সুন্দর হোটেল। মায়ের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে দৃশ্য। প্রতি রবিবার বাচ্চাদের নিয়ে আমি ঐ হোটেলে খেতে যেতাম। খাবার ঘরে বসে জুলিয়া যেন স্পষ্ট দেখতে পায় দৃশ্যটা। একটা টেবিল ঘিরে চেয়ারগুলোয় বসে মায়ের সাথে ছোট্ট টাইলার, উডি, বেনডাল। কত বছর ধরে মনে মনে খুব গোপনে সযত্নে যে ইচ্ছেটাকে সে লালিত করে এসেছে, আজ তা সত্যি হতে চলেছে, নিজের ভাইবোনদের সঙ্গে মিলিত হতে চলেছে সে। আজ সকালে টাইলারের সঙ্গে সাক্ষাৎটা মনে পড়ে। বড্ড বেশি শীতল আবেগহীন ছিল যেন টাইলার। হয়ত সেটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ করে আকাশ থেকে টুপ করে খসে পড়ার মত যার সঙ্গে দেখা হয়, নিজের বোন বলে তাকে মেনে নিতে একটু অসুবিধা হবার, একটু সময় লাগার কথাই। রাতের খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে বাইরে বের হয়েই সামনে একটা ট্যুর বাস দেখতে পায় সে। বাসটা ছাড়ব ছাড়ব করছে। কি এক খেয়ালে একটা টিকিট কিনে সে বাসটায় উঠে পড়ে। ফিরে যাবার আগে যতটা পারে শহরটাকে দেখে নিতে চায় সে। মায়ের শহরকে।

মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর কপলে স্কোয়ার হোটেলের ৪১৯ নম্বর ঘরের মাঝখানে অন্ধকারে হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল হ্যাল বেকারকে। হোটেলের ঘর, স্নানঘর সব তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে সে। অথচ মেয়েটা কোথাও নেই।

ভোররাতের দিকে, হালকা একটা পায়ের শব্দ পায় বেকার। টানটান হয়ে ওঠে ওর অপেক্ষায় থাকা সারা শরীরটা। ছিটকে উঠেছিল ছেঁড়া ধনুকের মত, পকেট থেকে ছুরিটা বের করে তৈরি হয়ে দাঁড়ায়। দরজা খুলে যায়। জুলিয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেকার। হাতের ছুরিটা মাথার ওপরে হাতসহ তুলে আঘাতে প্রস্তুত হয়। ঠিক তখনি আলো জ্বলে ওঠে। বেকার শোনে জুলিয়া বলছে, এবার আপনারা আসুন। হতবাক বেকারের স্তম্ভিত চোখের সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকে আসে দলে দলে রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারের ঝক।

.

২৫.

গর্ডন ওয়েলমান, কপলে স্কোয়ার হোটেলের রাতের শিফটের ম্যানেজারের জন্যই জুলিয়ার প্রাণটা বেঁচে গেল। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ তিনি হোটেলের দায়িত্ব বুঝে নেন। নিয়ম মত রেজিস্টার দেখতে গিয়ে তার চোখ আটকে যায় জ্বলিয়া স্ট্যানফোর্ডের নামে। উত্তেজনায় থমকে যায় ওয়েলমান। হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মৃত্যুর পর থেকেই খবরের কাগজগুলোতে ওর সম্পর্কে রোজই নানারকম লেখা পড়ছে। গোটা পরিবার সম্পর্কেই নিত্যনতুন তথ্য, মুখরোচক গল্পও জানতে পারা যাচ্ছে। গভর্নেসের সঙ্গে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের স্ক্যান্ডাল, অবৈধ সন্তান, তার নাম জুলিয়া সব জানত, পড়েছে ওয়েলমান। সেই জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড তাদের এই ছোট্ট হোটেলে। এর মানে কি বিশাল প্রচার, তা কি হোটেল কর্তৃপক্ষ জানে? মিনিট কয়েক পর থেকে সে ফোন করতে শুরু করে। নানা সংবাদপত্র টিভি চ্যানেলের অফিসে।

জুলিয়া যখন হোটেলে ফেরে দেখে, লবি ভরা সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, ক্যামেরাম্যান। মিস স্ট্যানফোর্ড আমি বোস্টন জার্নাল পত্রিকা থেকে…টেলিভিশন ক্যামেরাগুলোর একটা তার মুখের ওপর স্থির হয়। মুখের সামনে একটা মাইক্রোফোন, ম্যাডাম আমি এন সি ভি বি টি ভি তে একটা সাক্ষাৎকার চাইছি। ম্যাডাম, আমি বোস্টন গ্লোব দৈনিক পত্রিকা থেকে আসছি। আমরা শুনেছিলাম আপনি নাকি শহর থেকে… ব্যাপার স্যাপার দেখে জুলিয়া রীতিমত হকচকিয়ে যায়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ক্রমাগত ঝলসে উঠছে ওকে তাক করে। নানা প্রশ্ন, টিভি ক্যামেরার স্পষ্ট আলো, রীতিমত বিশৃঙ্খলা, হট্টগোলে ভরা এক বিপর্যস্ত পরিস্থিতি। দ্রুত পায়ে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে যায় সে। পেছনে পেছনে প্রায় তাড়া করে আসে সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, ফটোগ্রাফারের দল। চারতলায় নিজের ঘর পর্যন্ত ওকে তাড়া করে আসে ওরা। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জুলিয়া হাল ছেড়ে দেয়। দরজা খুলে আলো জ্বালে। তারপর বলে, এবার আপনারা আসুন।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বেকারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, ঘাম জমে ওঠে কপালে। দ্রুত হাত নামিয়ে ছুরিটাকে পকেটে পুরে ফেলে সে। জুলিয়া ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর সমবেত জটলাটার দিকে ফিরে তাকিয়ে। বলে,–ঠিক আছে, বলুন কি জানবার আছে আপনাদের? তবে একজন একজন করে, একসঙ্গে সবাই নয়। ভীড়ের পিছনে আড়ালে পড়ে যাওয়া বেকার প্রবলতর হতাশায় ক্ষোভে মাটিতে পা ঠোকে। বিরক্তিতে গজগজ করতে করতেই দরজা দিয়ে চট করে বের হয়ে যায়। বিচারক টাইলার মোটেই খুশি হবেন না। তাকে কি জবাব দেবে সে? এবং তাতে তার প্রতিক্রিয়া কতখানি কঠোর হবে ভেবেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

.

পরের দিন সকালের খবরের কাগজগুলোর সবকটার সচিত্র প্রতিবেদনে ছয়লাপ হয়ে থাকে জুলিয়া আর জুলিয়া। টেলিভিশন চ্যানেলের খবরেও একই ব্যাপার। টাইলার খবরের কাগজগুলো, টেলিভিশন দেখতে দেখতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। সারা পরিবারই এখন জেনে গেছে গতকাল রাতে এই মেয়েটা তাদের বাড়ীতে এসে হাজির হয়েছিল। আমি বুঝতে পারছি না এরকম একজন জালিয়াত কি করে ও নিজেকে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড বলে দাবী করছে? আর তুমি কাল ওকে হাতে পেয়ে কি করে ছেড়ে দিলে? টাইলার বিব্রত গলায় বলে, কাল সে এসেছিল। নিজেকে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড দাবী করে কিছু টাকা-পয়সা চাইছিলো। আমি ওকে ভাগিয়ে দিয়েছি। ও যে এরকম একটা সস্তা পাবলিসিটি স্ট্যান্ট এর খেলায় যাবে তা আমি বুঝিনি। যাক তোমরা ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। ব্যাপারটা আমি ঠিক সামলে নেবো। ভাইবোনেরা সরে যেতেই ফাঁক বুঝে সোজা সাইমন ফিজেরালন্ডকে ফোন করে। সকালের কাগজ দেখছেন তো? হ্যাঁ, আরো একজন জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের উদ্ভব হয়েছে। হ্যাঁ, এই নকল জুলিয়াকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। আমি কি পুলিশে খবর দেবো? না, তাতে একপ্রস্থ অবাঞ্চিত মিডিয়া স্ক্যান্ডাল ছড়াবে। আমরা সেটা চাই না। আপনি ওকে অন্যভাবে সামলান, ওকে শহরের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।

ফিৎজেরাল্ড উত্তর দেয়, ঠিক আছে স্যার, আমি দেখছি। ফোন ছেড়ে সাইমন ফিজেরাল্ড স্টিভ সোলানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, সমস্যা। গভীর সমস্যা। সোলানে সায় দেয়, জানি। সকালের কাগজে পড়েছি। স্ট্যানফোর্ড চান ব্যাপারটা আমরা দেখি। তুমি কি দায়িত্বটা নিতে পারবে? সানন্দে! স্টিভ চিন্তিত মুখে বলে।

ঘণ্টাখানেক বাদে স্টিভ সোলানকে জুলিয়ার হোটেলের ঘরের দরজায় দেখা গেল। দরজা খুলে তাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে জুলিয়া বলে, দুঃখিত। আমি আর কোন পত্রিকাতে সাক্ষাৎকার দেবো না। সোলানে মাথা নাড়ে, নাহ ম্যাডাম, আমি সাংবাদিক নই। সাক্ষাৎকারের জন্যও আসিনি। বিস্মিত চোখে জুলিয়া প্রশ্ন করে, তবে? কে আপনি? কি চান? ভেতরে আসতে পারি? সন্দিগ্ধ চোখে দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় জুলিয়া, স্টিভকে ঢুকতে দেয়। যদিও ওর অভিব্যক্তি জুড়ে সংশয়মেশা কৌতূহল ছড়িয়ে থাকে। আমি স্টিভ সোলানে। প্রয়াত হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের জমি সম্পত্তি বিষয়ক আইনজীবী। জুলিয়া মাথা নাড়ে, ওহ, তা আপনি আমার কাছে কি চান? স্টিভ তীব্র চোখে তাকায়। আপনি কেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে বলেছেন, যে আপনি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড? বিব্রত মুখে তাকিয়ে, সারা মুখে ফুটে ওঠে অস্বস্তি। জুলিয়া বলে, ইয়ে…মানে হঠাৎ করে এমন…ধরা পড়ে গেলাম…বিশ্বাস করুন আমি নিজে থেকে প্রেসের কাছে যাইনি। ওদের কিছু জানাতেও চাইনি। বলতে চাইনি। কিন্তু আপনি তো নিজেকে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মেয়ে বলে দাবী করছেন? জুলিয়া আরক্ত মুখে বলে, দাবী করছি মানে কি! আমি সত্যিই। নিশ্চিত ভাবেই তাই। এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ আপনার কাছে আছে? ওর মিথ্যের পেরেক দিয়েই ওকে বিদ্ধ করতে চায় সোলানে। প্রমাণ? জুলিয়া সামান্য ইতস্তত করে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, না, সেরকম কিছু সত্যিই নেই আমার কাছে। স্টিভ আণুবীক্ষনিক দৃষ্টিতে মেয়েটিকে যাচাই ও জরীপ করতে থাকে। যতই খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সে অবাক হয়। এখানে আসার আগে যেরকমটা আন্দাজ করে এসেছিল মেয়েটি আদৌও সেরকম নয়। মেয়েটিকে দেখে সরল স্পষ্টভাষী। বিদ্বেষহীন বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের মনে হচ্ছে। এবং বুদ্ধিমতী। এরকম চলে আসার মত অবিবেচক হঠকারী এবং চুড়ান্ত বুদ্ধিহীনতার কাজ করতে পারে।

স্টিভ কেশে গলা পরিষ্কার করে নেবার তালে নিজের বক্তব্যকে গুছিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃখের কথা। জজ টাইলারের নির্দেশ বা ইচ্ছে, আপনাকে এখনি এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। এভাবে পারিবারিক কুৎসা, বদনামের প্রচার তারা মেনে নেবেন না। জুলিয়া বিস্ফারিত চোখে বলে, সেকি? তাহলে যে জন্য এতদূর থেকে এতটা পথ অতিক্রম করে এলাম আমার ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করতে, তাদের কাউকেই তো এখনো দেখতেই পেলাম না। তাহলে এই মিথ্যচার মেয়েটি চালিয়েই যেতে চায়? চালিয়েই যাবে? স্টিভ তার পরের চালটা দেয়, দেখুন, আপনি ঠিক কে আমি জানি না। তবে আপনি যে খেলাটা চালাতে চাইছেন সেটা কিন্তু শেষ হচ্ছে জেলের কুঠুরীতে গিয়ে। আমরা আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাইছি। আপনি যা করছেন, সেটা সরাসরি আইন বিরুদ্ধ কাজ। এবার বেছে নিন, আপনি কি চান। হয় এই শহর ছেড়ে চলে যান। নাহলে আমরা আপনাকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবো।

জুলিয়া বিদ্যুতাহতের মতো বলে, গ্রেপ্তার? কি বলছেন আপনি? সোলানে ব্যক্তিত্ব ব্যাঞ্জক গলায় বলে, পছন্দটা আপনার হাতে। জুলিয়া বিষণ্ণ গলায় বলে, ওরা একবার আমাকে দেখতেও চায় না? এবার কোন জবাব সোলানের কাছে নেই, তাই নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করে সে। জুলিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, একরাশ বিষণ্ণতা মেশা হতাশা ঝরে পড়ে ওর উচ্চারণে, বেশ, আমার ভাই-বোনদের যদি তাই ইচ্ছে হয়, তাহলে আমি কানসাসে ফিরে যাচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন ওদের বিরক্ত করব না। কানসাস? এতদূর মেয়েটা ছুটে এসেছে এই প্রতারণা কেলেঙ্কারী ঘটাতে? স্টিভ চমকিত হয়।

.

সেদিনই, শেষ বিকেলে সাইমন ফিজেরাল্ডের অফিসে মুখোমুখি বসেছিল স্টিভ আর সাইমন। আমার একটা ব্যাপার ক্রমাগত কাঁটার মত খোঁচা দিয়ে চলেছে, সোলানে বলে। ফিজেরাল্ড ভুরু কুঁচকে তাকায়, সেটা কি? কুকুরটা কেন ডাকল না? সাইমন বিস্ময়ে বিষম খাওয়া গলায় বলে, মানে? কি বলছ কি? সোলানে হাসে, শার্লক হোমসের গল্পে। কুট ছিল যা ঘটেনি। স্টিভ কোথাকার জল কোথায় নিয়ে গড়াচ্ছো? কথা হচ্ছিল জালিয়াত মেয়েটার…। মেয়েটা এখানে এসেছিল কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই? স্টিভ সাইমনকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে। ধাঁধাগ্রস্ত মুখে সাইমন ফিৎজেরাল্ড বলে, আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। ওটাতেই তুমি বুঝেছ প্রমাণ পেয়েছ মেয়েটা প্রতারক। গোপনে গভীর চিন্তার ভাঁজময় কপালসহ মাথা নাড়ে। ঠিক উলটো। কেন মেয়েটা কানসাস সিটি থেকে এত দুর কয়েক হাজার মাইল পথ কোন প্রমাণ তথ্য সঙ্গে না নিয়েই নিজেকে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মেয়ে বলে দাবী করতে চলে এলো, কেন? মেয়েটিকে দেখে এতটা নির্বোধ বলে তো মনে হয় না। এবার ভুরু কুচকে যাবার পালা সাইমনের, ঠিকই তো। এদিকটা তো আমি ভেবে দেখিনি। কথা শেষ করে দু চোখ বুজে কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে। তার পর সাইমন । আবার বলতে শুরু করে, প্রথম থেকেই বেশ কয়েকটা ব্যাপার আমার কাছে দুর্বোধ্য। সত্যি বলতে কি রহস্যময়ই বলব, মনে হচ্ছে। স্টিভ সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, ঠিক, আমারও তাই। প্রথমতঃ হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহ। ওটা উধাও হয়ে গেল। কবর থেকে কফিনবন্দী মৃতদেহ কোথায় উধাও হয়ে গেল সে রহস্যের এখনো কোন কিনারা হল না। মৃতদেহটা কার এত দরকার হয়ে উঠল? তারপর স্ট্যানফোর্ডের মৃত্যুর ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ওনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দিমিত্রি কামিনস্কি। সে অস্ট্রেলিয়ায় কোন ঠিকানাহীন গন্তব্যে উধাও হয়ে গেল। এবং তাতেও শেষ নয়। যাকে আসলে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড বলা হচ্ছে, সেই প্রথম মেয়েটি, সে হঠাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল? সে এখন কোথায়? কেউ জানে না। এসব হচ্ছেটা কি?

সাইমন গভীর চিন্তান্বিত মুখে সন্দিগ্ধ গলায় বলে, তুমি কি ভাবছ? স্টিভ কপালের চিন্তার না। মেলানো ভাজসহ মাথাটা দ্রুত তালে কয়েকবার দুপাশে নাড়ায়, না সাইমন, ব্যাপারটা আমরা যত সহজ ভেবেছিলাম তা আদৌও নয়। কোথায় নিশ্চয়ই জল উঁচু নিচু আছে। সেই সুতোর আলগা মুখটা আমায় খুঁজে পেতেই হবে। তাহলেই রহস্যের জট পর্যন্ত পৌঁছতে পারার কাজটা সহজ হবে আমাদের পক্ষে।

স্টিভ সোলানে পরদিন একটু বেলার দিকে আবার কপলে স্কোয়ার হোটেলে হাজির হলেন। অভ্যর্থনা টেবিলে বসে থাকা কর্মীটিকে সে বলে, আমি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের সঙ্গে …ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কর্মীটি মাথা নাড়ে, দুঃখিত, আজ সকালেই উনি হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন। উনি কি ওনার কোন ঠিকানা দিয়েছেন? রেখে গেছেন? না স্যার। স্টিভ হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ে। তার আর কিছুই করার নেই। যাক, হয়ত আমিই ভুল করছিলাম। দার্শনিক ভাবে ব্যাপারটাকে ভাবতে চায়। হয়ত সত্যিই জালিয়াতই ছিল মেয়েটা। কোনটা সত্যি, কি সত্যি, যা আর কোনদিনই জানা যাবে না। হোটেলের দরজা ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই সামান্য বকশিসের প্রত্যাশায় দাবোয়ানটি বলে, আপনাকে ট্যাক্সী ধরে দেব স্যার? লোকটার দিকে চোখ পড়তেই, স্টিভের মাথায় একটা সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সকালে, মিস স্ট্যানফোর্ড যখন হোটেল ছেড়ে যান। তখন তুমিই কি ডিউটিতে ছিলে? সে প্রশ্ন করে। উত্তরে দারোয়ানটি বিনীতভাবে বলে, হ্যাঁ স্যার, আমিই তো ওনাকে ট্যাক্সি ধরে দিলাম। আমার খুবই অবাক লেগেছিল। এত বড়লোকের মেয়ে অথচ ট্যাক্সী… স্টিভ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, মিস স্ট্যানফোর্ড ট্যাক্সী চালককে গন্তব্যের জায়গার নাম কি বলেছিলেন শুনতে পেরেছিলে? হ্যাঁ স্যার। উনি গ্ৰেহাউন্ড বাস টার্মিনাসে যাবার জন্য বলেছিলেন চালককে। ধন্যবাদ। স্টিভ দারোয়ানের হাতে একটা পাঁচ ডলারের নোট খুঁজে দিয়ে বলে, আমাকে একটা ট্যাক্সী ধরে দাও, জলদি।

এর কিছুক্ষণ পরই গ্ৰেহাউন্ড বাস টার্মিনাসে দূর পাল্লার বাস ছাড়ার চত্বরে স্টিভকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অপেক্ষমান যাত্রীদের ভীড়ে সে দ্রুত ত্বরিত নজর বুলিয়ে যাচ্ছিল। সকালে বলতে নিশ্চয়ই ভোর রাতে হোটেল ছাড়েনি জুলিয়া? তাহলে, সে পৌঁছাবার এক দেড় ঘন্টার মধ্যে ও যদি হোটেল ছেড়ে বের হয়…।

ভাবতে ভাবতে, স্টিভ শুনতে পায় কানসাস সিটির বাস ১৬ নম্বর টারমিনাস… আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করে না সে। প্রায় চোখ নাক কান বুঝে, উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলে। জুলিয়াকে পেয়ে যায়, সে বাসে উঠতে যাচ্ছিল। দাঁড়ান, ডাক শুনে সে ফিরে তাকায়, অবাক ভঙ্গীতে তাকিয়েই থাকে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। জুলিয়া কঠোর চোখে তাকায়, রাগী গলায় বলে,–আপনার সঙ্গে আমার কোন কথা বলার নেই। সে ঘুরে দাঁড়ায়, বাসে উঠতে শুরু করে, স্টিভ দ্রুত ওর একটা হাত চেপে ধরে, এক মিনিট, সত্যি বলছি, আপনার সঙ্গে জরুরী কথা আছে, যা আপনার পক্ষেই যাবে। আমার বাস ছেড়ে যাচ্ছে। পরে আরও বাস আপনি পাবেন, পেতে পারেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে কথা হওয়াটা অনেক বেশি জরুরী। জুলিয়া বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই কি যেন ভাবে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। তারপর, যেন একটা সিদ্ধান্ত নেয়। সোলানের দিকে ফিরে বলে, আমার সুটকেস বাসের ভেতরে রয়েছে। সোলানে তাড়াতাড়ি সুটকেসটা নামিয়ে আনে। ওরা দুজন বাস টার্মিনাসের বাইরের দরজার দিকে হাঁটতে থাকে। ওরা একটা রেস্তোরাঁয় এসে বসে। জুলিয়ার অভিব্যক্তি ভঙ্গীতে এখনো তীব্র রাগের প্রকাশ। উলটো দিকের চেয়ারে সোলানের মুখোমুখি বসে। স্টিভ প্রাতরাশের অর্ডার দেয় বেয়ারাকে। তারপর জুলিয়ার দিকে ফিরে বলে, একটা অঙ্ক বা ধাঁধার উত্তর আমার কাছে কিছুতেই মিলছে না। আপনি কেন, কিভাবে, কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই নিজেকে জুলিয়া হিসেবে দাবী করে এত দূর চলে এলেন? আপনি কি করে, কিভাবে ভাবলেন কয়েকশো বিলিয়ন ডলারের মালিকানার উত্তরাধিকার, আপনার পরিচয়ের কোন প্রমাণপত্র ছাড়াই মেনে নিতে রাজী হবে স্ট্যানফোর্ড পরিবার? জুলিয়া সোজা স্পষ্ট চোখে তাকায়, দেখুন, একটা ব্যাপার আপনারা সবাই গোড়া থেকেই ভুল করছেন। আমি কোন দাবী প্রতিষ্ঠা করতে, সম্পত্তির মালিকানার দাবী নিয়ে আসিনি। বহু বছর পর, জীবনে প্রথমবার নিজের ভাইবোনদের দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। শুধুমাত্র ওদের দেখবার তীব্র বাসনা নিয়েই এতটা পথ ছুটে এসেছিলাম। কিন্তু ওরা কেউ তো আমার সঙ্গে দেখাই করতে চাইল না। স্টিভ স্থির চোখে ওর প্রতিটি কথা তীব্র মনোযোগ দিয়ে, শুনছিল। এবার সে প্রশ্ন করে, আপনার কাছে কোন তথ্য সূত্র কিছু নেই, যাকে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা যেতে পারে? না, কিছু নয়। মাথা নাড়ে সে। যাই হোক, একজন আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে বিশেষভাবে আগ্রহী।

ইনি হলেন সাইমন ফিৎজেরা…আর ইনি, ইয়ে… পরিচয় পর্বের মাঝপথেই হোঁচট খায় স্টিভ। জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড, পরিচয় পর্বটা জুলিয়াই শেষ করে। বলুন ম্যাডাম, সাইমন বললেন। একটা সোফার কোণের দিকে জুলিয়া এমনভাবে বসে যেন যে কোন মুহূর্তে উঠে দাঁড়াতে এবং বেরিয়ে যেতে পারে। ফিৎজেরা যেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ফেলে পরীক্ষা করছে এমন দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখছিল। সেই মার্কামারা ধূসর তারাওয়ালা স্ট্যানফোর্ড চোখ। কিন্তু তাতে কি? ওরকম চোখ তো লাখ লাখ মানুষের আছে। আপনি দাবী করছেন, আপনি রোজমেরী নেলসনের মেয়ে? আমি কিছুই দাবী করছি না, করতে চাই না, আমি রোজমেরীর মেয়েই। আপনার মা এখন কোথায়? বেশ কয়েক বছর হয় তিনি মারা গেছেন। সাইমন দুঃখের ভঙ্গীতে মাথা নাড়েন, ওহ, আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনি কি ওর ব্যাপারে আরো কিছু কথা জানাতে পারেন? নাহ, আমার নতুন করে কিছুই জানানোর প্রয়োজন নেই। আমি কি যেতে পারি? দ্রুত উঠে পড়ে দরজার দিকে এগিয়ে চলে সে। দেখুন মহোদয়া, আমরা কিন্তু আপনাকে সাহায্যই করতে চাই। নিমেষে ঘুরে দাঁড়ায় সে, তার মুখে ফুটে উঠে রাগের আগুন ছটা। তাই? সত্যি? আমার ভাইবোনেরা আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় না। আপনারা আমায় পুলিশে দিতে চেয়েছিলেন। আমার ওরকম সাহায্যের প্রয়োজন নেই। নমস্কার। দাঁড়ান। আপনি যা বলছেন, আপনি যদি সত্যি তাই হন তাহলে আপনার কাছে কিছু অদ্ভুত, যা হোক কিছু প্রমাণ তো থাকবেই, থাকা উচিত। আমি আপনাদের আগেই বলেছি। সেরকম কিছু আমি দেবো না। আমি আর আমার মা যারী স্ট্যানফোর্ডকে আমাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। ঠিক আছে ঠিক আছে। আপনার মা দেখতে ঠিক কেমন ছিলেন? সুন্দর। অসাধারণ সুন্দরী। জুলিয়ার গলার স্বর নরম হয়ে ওঠে, ঝকঝকে উত্তেজনার আঁচ লাগা চোখে হঠাৎ সে বলে ওঠে–আমার কাছে মায়ের একটা ছবি আছে।

নিজের গলার সোনার হারের সরু চেন থেকে ঝুলন্ত লকেটটায় দু আঙ্গুলের চাপ দিতেই সেটা মাঝখান থেকে ফাঁক হয়ে যায়। দুভাগে বিভক্ত লকেটটার একদিকে এক ছোট্ট ছবিতে অসাধারণ সুন্দরী এক মহিলা, ঠিক উল্টো দিকটার ছবিটা হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের। লকেটটার পেছনে সোনার খোদাই করা আর এন কে, ভালবাসা সহ, হ্যারী ১৯৬৯। সাইমন। ফিজেরাল্ড বিস্ফারিত চোখে অনেকক্ষণ দীর্ঘ সময় ধরে লকেটটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আবার যখন তিনি জুলিয়ার দিকে ফিরে তাকান তখন তার মুখের চেহারা বদলে গেছে, গলার স্বরে আত্মবিশ্বাসের গাম্ভীৰ্য্য। আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তারপর স্টিভের দিকে ফিরে তাকিয়ে তিনি গম্ভীর গলায় বলেন, আসল, সত্যি জুলিয়া স্ট্যান ফোর্ডকে আমরা পেয়ে গেছি।

.

২৬.

বেনডাল পেগির সঙ্গে তার কথোপকথনটা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। পেগির থেতলানো, কালশিটে দাগ লাগা মুখ। বাথরুমের পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। মিথ্যাচার, পরিস্থিতির সঙ্গে আপোষ করার, মেনে নেবার পেগির প্রাণান্তকর চেষ্টা। সব মিলে মিশে বেনডালের মনে এক তীব্র অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছিল। ওর সাহায্যের প্রয়োজন। প্রচুর সাহায্যের এবং ওর জন্য কিছু করতে হলে, প্রথমেই উডির সঙ্গে কথা বলা দরকার। মূল সমস্যা তো উডিই, এবং হয়ত, হয়ত কেন? নিশ্চিত ভাবেই সাহায্যের প্রয়োজন আসলে উডিরই। যতই হোক, ও আমার ভাই। আমি তো ওর সঙ্গে কথা বলতেই পারি। উডির ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে কেনডাল ডাকল, উডি। কোন সাড়া নেই। আরো দুবার ডাকার পরও কোন উত্তর না পেয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ে সে। কটু মিষ্টি এবং আমন্ড বাদাম পোড়ানো একটা ইষৎ ঝাঝালো গন্ধে ঘরটা ভরা। এবং ঘরে উড়ি নেই। বেনডাল বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। বাথরুমের দরজাটা খোলা হাট করে। উড়ি একটা অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলেতে হেরোইন গুড়ো গরম করতে ব্যস্ত। বেনডাল এসে দাঁড়ায়। উডি চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে বেনডালকে দেখে মাদকাচ্ছন্ন হাসে, হাই বেনডাল, কেমন আছো বোন? মাদক ছড়ানো পাতটার ওপর ঝুঁকে পড়ে গভীর নিশ্বাসের সঙ্গে তপ্ত মাদক গুঁড়ো ঘ্রাণসহ নাক দিয়ে টেনে নেয়, উডিবেনডালের বিস্ময় মিশ্রিত চিৎকার অগ্রাহ্য করে মাদক পাতে আরো একটি গভীর শ্বাস টানে। ভগবানের দোহাই উডি, বন্ধ করো এসব। বেনডালের ক্ষিপ্ত উত্তেজিত চিৎকারে সে ফিরে তাকায়, ঘুরে দাঁড়ায়। ওর চোখের পাতায় তীব্রতর মাদকের ঘনিয়ে ওঠা ভয়ঙ্কর ছায়া ছায়া নেশা ঘোর। কি ব্যাপার, কেন? তোমায় এত হতাশ দেখাচ্ছে কেন? আহ, আজকের দিনটা কি সুন্দর। ঝকঝকে, উজ্জ্বল রোদে ভরা এমন সুন্দর একটা দিনে তুমি এত মনমরা কেন বোন? উডি দয়া করে একটু চুপ করে বসবে? আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। উডি মাদকগ্রস্ততায় অপ্রকৃতিস্থ প্রায়। হাসে, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই বোন। বলল, কি তোমার সমস্যা? জান লড়িয়ে দেবে তোমার এই ভাই। তবে টাকা পয়সার কোন সমস্যা নিশ্চয়ই নয়? যতই হোক আমরা এখন স বাই কোটিপতি। তাই না? হা-হা-হা। বেনডাল তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকে। সহানুভূতি, আবেগে ওর মন ভরে ওঠে। উডি, পেগির সাথে আমার কথা হয়েছে। ও আমায় বলেছে কিভাবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকবার সময় এই সর্বনেশে মাদকের নেশা তোমাকে গ্রাস করেছিল। সৰ্ব্বনাশ! ও কথা কেন বলছ? আমার জীবনে সবচেয়ে সেরা ঘটনা, সবচেয়ে বড় পাওয়া এটা। না হ হ না, তীব্র গলায় ধমকে ওঠে বেনডাল। তোমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সর্বনাশ, ক্ষতি ওটা, তুমি তোমার নিজের জীবনকে এর ফলে কি করছ? তোমার কোন ধারণা আছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ। জীবনকে উপভোগ করছি আমি। বোন, বেঁচে থাকা তো একেই বলে। হতাশায় চোখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর যাবতীয় উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে শান্ত করে। দৃঢ় গলায় নিশ্চিত ভঙ্গীতে বিচারকের রায় ঘোষণার মত প্রত্যয়ী গলায় বলে, তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। খুব তাড়তাড়ি। না, আমি ভাল আছি, খুব ভাল। কোন সাহায্যেরই দরকার নেই আমার। উডি জেদী গলায় বলে। না, তুমি ভাল নেই। উডি, আমার কথা মন দিয়ে শোন। অন্য কিছু নয়, আমরা তোমার জীবন নিয়ে আলোচনা করছি, তোমার জীবন, আর শুধু তোমার একার জীবনই বা বলছি কেন? পেগি, তার কথা কেন ভাবছ না–ভাববে না তুমি? পেগির জীবনটাকে নরকতুল্য বানিয়ে তুলেছ তুমি, শুধুমাত্র মন প্রাণ দিয়ে তোমায় অন্ধভাবে, ভালবাসে বলে এখনো এই নরকযন্ত্রণা সহ্য করে মেনে নিয়েও তোমার সঙ্গে থাকছে সে। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামে। দম নেবার ফাঁকে উডির প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। তারপরই আবার বলতে শুরু করে, তুমি শুধু তোমার নিজের জীবনটাকেই নষ্ট, ধ্বংস করছ না, সঙ্গে সঙ্গে পেগির জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছো। উডি, এখনো সময় আছে উডি। খুব বেশি দেরী হয়ে যায়নি। এই ঘাতক সর্বনেশে মাদকের ফাঁদ থেকে বের হয়ে এসো। উডির মুখে ঝুলে থাকা মাদক প্রভাবিত হাসিটা এবার মুছে মিলিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ ওর মুখটাকে খুব করুণ, বিষণ্ণ হতাশ দেখায়। বেনডালের চোখের দিকে চোখ রেখে প্রায় স্বগতোক্তির মত বিড় বিড় করতে শুরু করে, বেনডাল…আমি জানি তুমি ঠিক বলছ…সত্যি, সব সত্যি বলছ… আমিও চাই বিশ্বাস করো, সত্যি বলছি আমিও চাই বন্ধ করতে..অনেক চেষ্টাও করেছি, ভগবানের দিব্যি সত্যি বলছি বিশ্বাস করো…চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। নিশ্চয়ই পারবে তুমি। বেনডাল জোরের সঙ্গে, প্রত্যয় মেশা গলায় বলে, তোমাকে পারতেই হবে। আমি আর পেগি এ লড়াইয়ে তোমার পাশে আছি। এখন বলো তো, তোমায় নিয়মিত এই সৰ্ব্বনেশে মাদক কোন শয়তান সরবরাহ করে? উডির চোখ এ প্রশ্নে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, হে ভগবান! তুমি তা জানো না? বেনডাল মাথা নাড়ে, না তো। আমি কি করে জানব? উডি ধীর গলায় বলে,

.

২৭.

 জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে সাইমন বলেন,–তোমার এখনকার মানসিক অবস্থানটা আমি বুঝতে পারছি। জুলিয়া জিজ্ঞাসু চোখে সাইমন ফিৎজেরান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ধাঁধার মত লাগছে। আমার ভাইবোনেরা কেন আমার সঙ্গে দেখা করতেই রাজী নয়? এবার সাইমন এবং স্টিভ নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। তারপর সাইমন মাথা নেড়ে বললেন,–আমি তোমাকে গোটা পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলছি। সে থামে, একটু ইতস্তত করে, সময় নিয়ে শব্দ বাছে, তারপর বলে–আসলে কিছু দিন আগে স্ট্যানফোর্ড পরিবারে নিজেকে জুলিয়া পরিচয় দিয়ে এক মহিলা হাজির হয়েছিলেন। তিনি নিজের দাবীর স্বপক্ষে বেশ কিছু প্রমাণও দিয়েছিলেন, এমনকি আসল জুলিয়ার সঙ্গে তার আঙুলের ছাপও নাকি হুবহু মিলে গেছে। জুলিয়া বিস্মিত গলায় প্রায় আর্ত চিৎকার করে ওঠে, সে কি? তা কি করে সম্ভব? আমিই… স্টিভ মাথা নাড়ে, জানি, এখন আমরা তা জানি। কিন্তু তখন আমাদের সামনে যে সত্যটা হাজির করা হয়েছিল, সেটাকেই সত্য বলে মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, তাই নয় কি? সাইমন যোগ করে, স্ট্যানফোর্ড পরিবারের তরফ থেকে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে রাখা হয়েছিল। সে বিস্তারিত তদন্ত করে নাকি জানায় ঐ মেয়েটিই আসল জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড। এরপর স্টিভ তাকে বিস্তারিত ভাবে জানায় পুরনো জুলিয়ার স্বপক্ষে কি কি প্রমাণ দেওয়া হয়েছিল। গাড়ী চালানোর লাইসেন্স প্রসঙ্গ উঠতেই জুলিয়া আঁতকে ওঠে। ক্যালিফোর্নিয়াতে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স? আমি জীবনে ক্যালিফোর্নিয়াতে কখনো যাইনি।

সাইমন ফিৎজেরাল্ড চিন্তিত মুখে মাথা নাড়েন। সুতরাং বুঝতে পারা যাচ্ছে স্ট্যানফোর্ড পরিবারকে ঘিরে একটা চক্রান্তের জাল, সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এবং যে এই ষড়যন্ত্রটার পেছনে থাকুক না কেন, দুজন জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড তার পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক, হয়ত বিপদজনক। এবার সোলানে মুখ খোলে এবং সেই দোটানা সংশয় থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায়, তোমায় সরিয়ে দেওয়া পথ থেকে। হে ভগবান, এখন বুঝতে পারছি। দুহাতে মুখ চাপা দেয় সে। সারা মুখে ভেসে ওঠে আতঙ্কের স্পষ্ট ছায়া। কি হয়েছে? ফিজেরাল্ড জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকেন। দুদিন আগে আমি কানসাসে আমার রুমমেটকে ফোন করেছিলাম। সে বলল, কে একজন, সেখানে আমার খোঁজে গিয়েছিল। স্যালি মানে আমার রুমমেটকে আমি ভেবে খুন করতে যায়। পরে অবশ্য, স্যালির পরিচয় জেনে সে পালায়, তার হাতে ঝকঝকে ছুরি দেখতে পেয়ে স্যালি চেঁচিয়ে উঠেছিল। কথা শেষ করে জুলিয়া আতঙ্কগ্রস্থ মুখে সাইমন ও স্টিভের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর যোগ করে, কে? এসব কে করছে? সোলানে বলে, আমায় অনুমান করতে বললে। আমি বাজী ধরতে রাজী আছি। নিশ্চিত ভাবেই পরিবারের কেউ। কিন্তু কেন? জুলিয়ার স্বরে আতঙ্ক স্পষ্ট। বিরাট অঙ্কের সম্পত্তির উত্তরাধিকার…মোটা টাকার লেনদেন…আর কে না জানে, অর্থই যত অনর্থের মূলে। কিন্তু এখন? আমি এখন কি করব? অপেক্ষা, তুমি এবং আমরা এখন শুধু অপেক্ষা করব তোমার যথার্থতা প্রমাণের। কেউ একজন, উত্তরাধিকার সূত্রে তোমার প্রাপ্য অংশটা হাতাবার জন্য গোটা চক্রান্তটা করছে। আমাদের কাজ হবে সেই ষড়যন্ত্র ভেঙ্গে, তোমার অংশের প্রাপ্য এক বিলিয়ন ডলার তোমার হাতে তুলে দেওয়া। চোখ কপালে তুলে থতমত খাওয়া গলায় জুলিয়া বলে, এক বিলিয়ন ডলার? আমার?

জুলিয়া চিন্তিত মুখে বলে, কিন্তু এখন আমি কি করব? স্টিভ সোলানে ধমকের গলায় বলে, বলছি না, তুমি কিছুই করবে না। যা করার আমরা করব। ফিৎজেরাল্ড চিন্তিত মুখে বলে, কিন্তু স্টিভ, ওর থাকার একটা জায়গা চাই। এমন একটা জায়গা সেখানে প্রেস, মিডিয়া এবং ওর শত্রুদের থেকে নিজেকে স্বচ্ছন্দে আড়াল করে, গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে। ওকে লুকিয়ে রাখবার এরকম একটা জায়গা চটপট খুঁজে বের করতে হবে। উনি আমার বাড়ীতে থাকতে পারেন। কেউ ভাবতেই পারবে না উনি আমার বাড়ীতে যে রয়েছেন বা থাকতে পারেন, স্টিভ পরামর্শ দেয়। পুরুষ দুজন জুলিয়ার দিকে তাকায়, আমার কোন আপত্তি নেই। এ ব্যাপারটার শেষ দেখতে চাই আমিও। জুলিয়া বলে।

স্টিভের বাড়ীটা নিউ বুরি স্ট্রীটে। সুন্দর করে সাজানো একটা দোতলা বাড়ী, বেশ পছন্দ। হয় জায়গাটা জুলিয়ার বাঃ, সুন্দর! স্টিভের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে। কেন জানি সদ্য আলাপ পরিচয়েই মানুষটিকে তার ভাল লাগতে শুরু করেছে। স্টিভ বলে, টি ভি সি ডি, ভিসিডি প্লেয়ার সবরকম আছে। স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতে পারেন। যখন যা ভাল লাগবে করতে পারেন। শুধু যতদিন না আমরা ঠিক বলে মনে করছি এ বাড়ীর বাইরে এক পাও দিতে পারবেন না। সেটা আপনার পক্ষে নিরাপদ হবে না। জুলিয়া ঘুরে ঘুরে বাড়ীটা দেখছিল। আপনি এখানে একা থাকেন। হ্যাঁ। কথাটা বলে স্টিভ একটু থামে, জুলিয়ার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। তারপর বলে, তাহলে আপনি একটু বিশ্রাম নিন। একটু বাজার করে আনি। ঘরে কিছু নেই। মানে আসলে, আমি খাওয়াটা সাধারণত বাইরেই সেরে নিই তো। স্টিভ বেরিয়ে যাবার মুখে জুলিয়া ডাকে, স্টিভ, আমি কি কানসাসে আমার রুমমেটকে একটা ফোন করতে পারি? স্টিভ দ্রুত বাধা দিয়ে, অসম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে, না। একদম না। এক দিনও আপনি এ বাড়ীর বাইরে বের হবেন না, এখান থেকে কোন ফোন করবেন না। আমার কোন ফোন এলে নিজে ধরবেন না। মনে রাখবেন আপনার বেঁচে থাকার জীবনের প্রশ্নে, এই ব্যাপারগুলো অত্যন্ত জরুরী।

.

২৮.

 মনে রাখবেন আমাদের এই কথাবার্তা কিন্তু টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখা হচ্ছে। ডাঃ ওয়েস্টিনের কথায় মার্গো মাথা নেড়ে সায় দেয়, হা ডাক্তারবাবু। আপনার মন শান্ত, মেজাজ ঠান্ডা হয়েছে? আমি শান্তই আছি। কিন্তু ভীষণ রেগে আছি। আপনার এই রাগের কারণ? টাইলার স্ট্যানফোর্ড। এবার ডাঃ ওয়েস্টিনের কপালে ভাঁজ পড়ে। চোখ কুঁচকে তিনি তাকান, মানে, জজ টাইলার স্ট্যানফোর্ড? আপনি তার কথা বলছেন? হ্যাঁ, অবিশ্বাসের স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে ডাঃ ওয়েস্টিন বলেন, জজ টাইলার কেন আপনার সঙ্গে এরকম করছেন? টাকা, প্রচুর টাকার জন্যে আপনার অনেক টাকা আছে, বলছেন? না…ইয়ে মানে…। আমার নাম মার্গো পসনার… এরপর সে ডাঃ ওয়েস্টিনকে বিস্তারিত ভাবে সব খুলে বলে। মার্গো থেকে জুলিয়া সাজা। টাইলারের প্রতিশ্রুতি, অথচ প্রতারণা, এয়ারপোর্টে নামার পর ওকে পাগল সাজানো, সবই বিস্তারিতভাবে গুছিয়ে বলে। সব শুনে ডাঃ ওয়েস্টিন বলেন, অথচ, এতক্ষণ এতদিন আপনি নিজেকে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড বলে দাবী করছিলেন। আর এখন যা বলছেন তার অর্থ বুঝতে পারছেন? জজ টাইলারের মত একজন মানুষের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনছেন। এর জল কোথায় গড়াবে বুঝতে পারছেন? জানি জানি, কিন্তু একজন বিচারক বলেই উনি যা খুশি করবেন আর আপনারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হয় না। ডাঃ ওয়েস্টিন চিন্তিত মুখে বলেন, আপনি কী চান? মার্গো ঠান্ডা মাথায়, ধীর চোখে, উত্তেজনাহীন গলায় বলে, চাই কাটা দিয়ে কাটা তুলতে। আমি চাই বেজন্মটাকে হাজাতে ঢোকাতে। আর আমি নিজে এই নরক থেকে বের হতে চাই। ঠিক আছে, আমি দেখছি, আপনার অভিযোগ যতই গুরুতর হোক, তার তদন্তের ব্যবস্থা করছি। তবে, তার আগে আপনার মানসিক সুস্থতার, আপনি যে পাগল নন তার প্রমাণ প্রয়োজন।

মার্গো অপেক্ষা করছিল ডাঃ গিফোর্ড-এর জন্য। ওর মানসিক সুস্থতার পরীক্ষা নেবেন তিনি। সমস্ত কিছু সব কিছু ওদের জানাতে হবে। জানাবে সে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু জানাবে। তারপর, ওরা শয়তানটাকে হাজতে পুরবে আর তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। মুক্ত জীবনে ফিরে যেতে দেওয়া হবে। তারপর? তারপর কী হবে মার্গো পসনার? মুক্ত জীবন নিয়ে কি সোনার ফসল ফলাবে তুমি? আবার সেই জোচ্চরের জালিয়াতের জীবন? ফিরে যাবে সেই নরকে? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো তার চেয়েও যে ভয়ঙ্কর। স্ট্যানফোর্ড এর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ করা হয়, তাহলে প্রতিশোধ নিতে যদি মার্গোর বিরুদ্ধে প্যারোল তুলে নেয়? সেক্ষেত্রে ওকে ফিরে যেতে হবে জেলে। ড্যাম, শয়তানের ছকে পা দিয়ে বসে আছে সে। এগোবার পথ নেই। পিছনেও অন্ধগলি। রাগ আর হতাশায় খাবার থালাটা দেওয়ালে ছুঁড়ে মারে। কাল পর্যন্ত সে ছিলো বিলিয়ন ডলারের মালকিন…আর আজ? ঠিক তখনি…দাঁড়াও, দাঁড়াও, চকিতে একটা চিন্তা ঝলসে ওঠে তার মস্তিষ্কে। উত্তেজনার তীব্র অথচ প্রচণ্ড ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে ওর সারা শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায়। হে যীশু, এ সে কি করতে যাচ্ছে? নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারতে যাচ্ছিল? আমি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড এটা তো ইতিমধ্যে প্রমাণিত। সারা পরিবারের সামনেই ডিটেকটিভ ফ্রাঙ্ক টিমমনস তাকে সত্যি আসল জুলিয়া বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। পরিবারের সবাই তা শুনেছিল, মেনেও নিয়েছিল, এমন কী ওর আঙুলের ছাপও মিলে গিয়েছিল। এর চেয়ে বড় প্রমাণ কি হতে পারে?

আহ, জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড হতে পারলে কেন আমি মার্গো পসনার হতে চাইছি? ওরা যে আমায় এখানে আটকে রেখেছে তাতে আশ্চর্যের কী আছে? আমার মন বোধ হয় মনের মধ্যে ছিল না। মার্গো দ্রুত হাতে বেল বাজায়। মেট্রন ছুটে আসে। আমি ডাঃ গিফোর্ড-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই। মেট্রন কড়া চোখে তাকায়, জানি। সাক্ষাৎকারের সময় ঠিক করা আছে। না, না, এখনি। আমি এখনি ডাঃ গিফোর্ডের সঙ্গে দেখা করতে চাই। এখনি। অসহিষ্ণু গলায় চিৎকার করে ওঠে মার্গো। ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি বলছি। মেট্রন চলে যায়। মিনিট দশেক পরই, ডাঃ ওয়েস্টিনের সঙ্গে একটু মজা করেছিলাম। মানে? ডাঃ গিফোর্ড বিস্ফারিত চোখে বলেন। খুব লজ্জা করছে এখন। আসলে টাইলারের ওপর ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড রাগ থেকেই ওসব কথা বলে টাইলারের ওপর শোধ নিতে ওকে ফাসাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন রাগ পড়ে গেছে আমি বুঝতে পারছি কী ছেলেমানুষের মত কাজ করেছি। যাইহোক ডাক্তার, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার রাগও কমে গেছে। আপনি আমার রোজ হিলের বাড়ীতে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন। ডাক্তার গিফোর্ড বড় বড় চোখে চরম বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলেন, তার মানে আপনি বলতে চান আপনি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড? মার্গো মাথা নাড়ে, বলতে চাই না, আমিই নিশ্চিত ভাবে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড। ডাঃ গিফোর্ড চোখ কুঁচকে বলেন, কিন্তু সকালে আপনার সঙ্গে ডাঃ ওয়েস্টিনের কথোপকথনের ক্যাসেটটা আমি শুনলাম। সেখানে তো আপনি নিজেকে জনৈকা মার্গো পসনার বলে দাবী করেছেন।

মার্গো এবার অসহিষ্ণু গলায় বলে,–ওফ ডাক্তার, একটু আগেই আপনাকে বললাম না, দাদার ওপর রাগ করে ওকে ফাঁসিয়ে রাগ মেটানোর জন্যই ওসব বলেছিলাম। মার্গো বলে কেউ নেই। আমি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড। এবার কথা বলেন ডাঃ ওয়েস্টিন, আপনি এটা প্রমাণ করতে পারবেন। মার্গো চতুর ভঙ্গীতে হাসে, নিশ্চয়ই। প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফ্রাঙ্ক টিমমনস-এর নাম শুনেছেন? তিনিই সাক্ষ্য দিতে পারেন এর স্বপক্ষে। তিনি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড-এর গাড়ী চালকের অনুমতি পত্রের আঙুলের ছাপের সঙ্গে, এমনকি আমার আঙুলের ছাপও মিলিয়ে দেখেছেন। নিশ্চিত ভাবেই তিনি আপনাদের বলতে পারবেন, আমি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড।

.

পরের দিন, সকাল দশটা। ডাঃ গিফোর্ড আবার মার্গোর ঘরে এলেন। সঙ্গে একজন চাপা রঙের পাতলা চেহারার দীর্ঘকায় মাঝবয়সী পুরুষ। সুপ্রভাত মার্গো হাসে। সুপ্রভাত ডাক্তার। আপনি কি ফ্রাঙ্ক টিমমনস-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন? হ্যাঁ, সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমি এসেছি। আমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নিতে চাই। আপনি বলছেন আপনি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড? আপনার দাদা বিচারক স্ট্যানফোর্ডের প্রতি রাগ করে আপনি ওসব কথা বলেছিলেন? আপনি যে আসল জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড তার প্রমাণ সাক্ষ্য দেবেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফ্রাঙ্ক টিমমনস? ঠিক তো? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এবার ডাঃ গিফোর্ড তার পাশের পুরুষটির দিকে তাকালেন। তিনি কয়েক পা এগিয়ে এলেন, হ্যালো, আমি ফ্রাঙ্ক টিমমনস।

মার্গো চমকে ওঠে। ফ্যাল ফ্যাল চোখে অপরিচিত মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

.

২৯.

ফ্যাশান শো-টা দারুণ চলছিল। প্রতিটি মডেল যে পোশাকগুলোই পরে মঞ্চে এসেছিলেন দর্শকেরা উচ্ছ্বাসভরা স্বতঃস্ফূর্ত হাততালিতে সেগুলোর প্রশংসায় প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়ে তুলছিলেন। বেনডাল ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা করছিলো। দর্শক সমালোচকদের প্রশংসার আনন্দে ওর বুকটা ফুলে উঠছিলো। এমন সময়ে দুজন পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে ওর হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল। মুখ ভয়ে ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। আপনি বেনডাল স্ট্যানফোর্ড রেনর? একজন পুলিশ ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। উর্দিধারীদের একজন বলে, মার্থা রায়ানকে খুন করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। না, না, দোহাই আপনাদের। আমায় ছেড়ে দিন, আমি খুন করিনি। বিশ্বাস করুন…প্লিজ…আমায় ছেড়ে দিন…।

ঘুমটা ভেঙে যায়। আতঙ্কে থর থর করে কাঁপছে গোটা শরীর, ঘামে ভিজে গেছে, দুঃস্বপ্নই। কিন্তু একেবারে যেন নির্মম বাস্তবের মত। আমার পরিণতি কি তাহলে এরকমই হতে চলেছে? বেনডাল ভাবে, না, কিছুতেই না। কিছু করতেই হবে। আমায় কিছু একটা করতেই হবে। মরীয়া হয়ে সে মার্কের সঙ্গে কথা বলতে চায়। সে নিউইয়র্কে ফিরে গেছে। অফিস থেকে ছুটি পাওয়া আর সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। বেনডাল তাকে বাধা দেয় নি। কারণ একটা ফ্যাশান শোয়ের জন্য ওকেও কয়েক দিন পরই নিউইয়র্কে ফিরতে হবে। বেনডাল ঠিক করে পরের দিন বিকেলেই রওনা হবে নিউইয়র্কে। কিন্তু তার আগে…কিছু একটা করে যেতে হবে। সেদিন উডির সাথে কথা বলার পর থেকেই বেনডাল খুবই বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে মানসিক ভাবে। উডি সব কিছুর জন্য পেগিকে দায়ী করছে, পেগি?

পেগিকে পরের দিন সকালে বাইরের বারান্দাতে পেয়ে গেল বেনডাল। সুপ্রভাত। পেগিও মিষ্টি হাসে, সুপ্রভাত বেনডাল। বেনডাল ওর পাশে এসে দাঁড়ায়, আমার তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে পেগি। হা নিশ্চয়ই, বলল। বেনডাল একটু ইতস্তত বোধ করে। এ কথাটা কিভাবে বলবে? সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। তারপর শব্দ সাজায়, আমি উডরোর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমায় বলল, তুমি..ইয়ে…মানে। ওকে হেরোইন নিয়মিত জোগান নাকি তুমি দাও? ও তোমায় একথা বলেছে? হ্যাঁ, একটা দীর্ঘ নীরবতার পর পেগি লম্বা শ্বাস ছাড়ে, কথাটা সত্যি। বেনডাল অবিশ্বাসের তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কি বলছ কি…তুমি…তুমি…। কথা খুঁজে পায় না সে। পেগি কোন কথা বলে না। বেনডাল আবার বলে–তুমি উডিকে নেশাগ্রস্ত করে রাখতে চাও? কেন পেগি, কেন?– বুঝতে পারছ না তুমি? তাই না? পেগি তেতো গলায় বলে। কি করে পারবে? তুমি তোমার নিজস্ব পরিমন্ডলে থাকো। তোমায় কয়েকটা কথা বলি শ্রীমতি বিখ্যাত ফ্যাশান ডিজাইনার মহোদয়া। যখন তোমার ভাই আমায় গর্ভবতী বানায় তখন আমি ছিলাম নিতান্তই মামুলি এক রেস্তোরাঁর পরিচারিকা। কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি উডরোও স্ট্যানফোর্ডের ঘরণী হতে পারব। আমি একটা অতি সাধারণ নগণ্য মেয়ে। তুমি জানো বেনডাল, কেন তোমার ভাই আমায় বিয়ে করেছিলো? সবাইকে দেখাতে বোঝাতে, প্রমাণ করতে, যে সে তার বাবার তুলনায় এক মহৎ মানুষ। উডি সেই মহত্ত্বের দেখুনবাজি হিসাবে আমার বিয়ে করল বটে। কিন্তু তোমাদের সভ্যতর–অভিজাত সমাজ আমাকে পুরোপুরি বহিরাগত হিসেবে নিলো। আমায় কেউ পাত্তা দিতো না। নোংরা কোন বস্তু বলে ভাবত, ঘৃণ্য চোখে দেখত।

একনাগাড়ে কথা বলে, পেগি থামে। বেনডাল ওর কাঁধে হাত রাখে। সহানুভূতির গলায় বলে, পেগি! আবার বলতে শুরু করে পেগি, একটা সত্যি কথা বলি তোমায়। আমি একেবারে হতবাক হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম, যখন তোমার ভাই আমায় বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। আমি বিয়ের পর মন-প্রাণ দিয়ে একজন আদর্শ স্ত্রী, উডির ভাল বৌ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের ঐ সমাজ আমায় সেই সুযোগটাই দিতে চাইল না, রাজী হলো না। ওদের চোখে তখনো আমি এক রেস্তোরাঁ পরিচারিকাই ছিলাম। কিন্তু শিশুটা আমি পেলাম না। গর্ভপাতের পর আমি ভেবেছিলাম উডি বোধহয় এবার বিবাহ বিচ্ছেদ করবে আমায়। কিন্তু তা করল না সে। আমি হয়ে উঠলাম ওর মহত্ব প্রদর্শনীর, লোককে মহৎ হিসেবে নিজেকে দেখানোর–এক চলমান জীবন্ত উদাহরণ। সহানুভূতির প্রতীক। অথচ আমার কিন্তু ওসব কিছুরই প্রয়োজন ছিল না। কারণ আমিও অন্য দশটা মেয়েরই মত ছিলাম। ভাল, সৎ,। প্রতিটি শব্দই যেন বেনডালের কাছে বিরাশি সিক্কার এক একটা চড় হয়ে আছড়ে পড়ছিলো। তুমি কখনো কি উডিকে ভালবাসোনি? পেগি কাঁধ ঝাঁকায়, ও সুন্দর দেখতে, আমুদে চরিত্রের। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস ওর এই চরিত্রটা ছিলোও। তারপরই ঘটল পোলো মাঠে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটা। সব কিছু সব বদলে গেল তারপরই। হাসপাতালে থাকার সময়ে ওরাই বেদনানাশক হিসেবে ওকে অল্প মাত্রায় মাদক দিতো, নিয়মিত। বাড়ীতে আসার পরই যখন বেদনা উঠত ও মাদকের জন্য ছটফট করতো। রীতিমত দাবী জানাতো ওকে মাদক দেবার জন্য। একদিন ওর অবস্থা দেখে ওকে বলতে বাধ্য হলাম, ঠিক আছে, আজ সামান্য। অল্প একটা শট দিচ্ছি। কিন্তু আজই আর কোনদিন নয় কিন্তু।

পেগি উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। গম্ভীর হয়ে ওঠে শ্বাস-প্রশ্বাস। যেন কোন এক ঘোরের মধ্যে পৌঁছে যায়। তারপর ঘোর ভেঙে জেগে ওঠা গলায় বলে, সেই শুরু। এরপর থেকে উডি প্রায়ই মাদকের জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করে। জেদ করতে, জবরদস্ত করতে শুরু করে। এবং আমাকে বাধ্য হয়েই হেরোইন সরবরাহ করতে হতো। এমন অবস্থা হয়ে উঠল পরে সে ব্যথা না থাকলেও, মাদক দিতে আমায় বাধ্য করত। নেশা, অভ্যাস, মাদক নেওয়ার ব্যাপারটা ওর শরীরে জাঁকিয়ে বসল। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো? যেহেতু এই নেশার বস্তুটি আমার কাছ থেকে পায়, ঘোর ঐ মাদক প্রয়োজনের তীব্রতম মুহূর্তটার জন্যই ওর জীবনে আমার গুরুত্ব অপরিসীম প্রয়োজন ছিলো। ঐ ঘোরের মুহূর্তগুলোয় ও আমার পায়ে পায়ে ঘুরত, আমার করুণা ভিক্ষা করতো। এবং আমি বুঝে গেলাম আমার শক্তি। উডিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পেয়ে গেলাম আমি। জেনে গেলাম, ঐ বস্তুটি যতক্ষণ আমার হাতে থাকবে আমি উডির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকব। উডিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আমার চাবিকাঠি হয়ে ওঠে হেরোইন। ওর ঐ মাদক নেশা সেই ক্ষমতা, যা আমি ব্যবহার করেছি মাত্র। বেনডাল আতঙ্কিত, অবিশ্বাস মেশানো বিস্ফারিত চোখে কয়েক মুহূর্ত পেগির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর রাগ ঘৃণা মেশানো তীব্র গলায় বলে, তুমি একটা নিষ্ঠুর শয়তান। আমার পরিবার তোমাকে বাড়ী, আমাদের পরিবার থেকে, উডির জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে, সোজা কথায় তাড়িয়ে দিতে চাইব, চাইছি। স্বচ্ছন্দে, আমিও চাই না মোটেই তোমাদের এই মেকি জীবন, দমবন্ধ করা পরিবেশে থাকতে। চলে যেতেই চাই। তবে একথা কিন্তু মোটেই ভেবো না, তোমরা বললেই পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ব। সেটা খুব সহজ, মসৃণ হবে যদি উপযুক্ত দাম পাই। কত পাবো আমি তোমার ভাইকে বিবাহ বিচ্ছেদ দেবার জন্য? তুমি যা দাবী করবে, তা যত বেশিই হোক দেওয়া হবে। এখন, যত তাড়াতাড়ি পারো, যত তাড়াতাড়ি পারো এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাও। ঠিক আছে। তাই হবে। পেগির গলায় প্রতিক্রিয়াজনিত উষ্ণতার ঝাঁঝ। আমার আইনজীবিই তাহলে তোমাদের আইনজীবির সঙ্গে দাবী, রফা বিষয়ে কথা বলবেন।

পেগি সত্যিই চলে গেছে? হ্যাঁ। তার মানে… বেনডাল শান্ত গলায় বলে, তার মানে কি, আমি জানি। উডি, আমার ভাই, তুমি কি তা সামলাতে পারবে না? উডি পলকহীন ধীর চোখে কিছুক্ষণ বেনডালের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে, হাসে, পারব, মনে হয় পারব। বেনডালও হাসে মনে হওয়া নয়। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস তুমি পারবে। উডি চওড়া হাসে, ধন্যবাদ বেনডাল, আমার বোধ হয় ওর খপ্পর থেকে বের হয়ে আসার এই সাহসটা কোনদিন হতো না। পারতাম না। বেনডাল খুশির ভঙ্গীতে হাসে বোন তাহলে কী করতে আছে?

সেই সন্ধ্যেতেই নিউইয়র্ক রওনা হয় বেনডাল। ফ্যাশান শোয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। এবং নিউইয়র্কে পা দেওয়া মাত্র সে ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়ল। নাওয়া খাওয়ার দম ফেলার ফুরসত রইল না বলতে গেলে। শোয়ের ঠিক তিনদিন আগে, ৫৫০ সেভেনথ এভিনিউতে নিজের অফিসে বেনডাল ঢুকতেই, তার ব্যক্তিগত সচিব নাদিন বলল, বেনডাল, ভাল খবর আছে। শোয়ের সব আসন পুরো বুকড হয়ে গেছে। বেনডাল অন্যমনস্কভাবে বলে, ধন্যবাদ। সে অন্য কয়েকটা জরুরী বিষয় নিয়ে ভাবছিল তখন। নিজের চেম্বারের দিকে সে যখন এগিয়ে যাচ্ছে, পেছন থেকে নাদিন বলে, তোমার একটা চিঠি এসেছে, জরুরী ছাপ মারা। একজন লোক এসে দিয়ে গেল। তোমার টেবিলে রেখেছি চিঠিটা। বেনডালের শরীর বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর থেকে চিঠিটা তুলে নেয়। খামের দিকে তাকাতেই প্রেরকের নামের জায়গায় দেখতে পায়–বন্য পশু ক্লেশ নিবারণ সংরক্ষণ সমিতি। ৩০০০ পার্ক এভিনিউ। ঠিকানাটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে বেনডাল। ও জানে ৩০০০ পার্ক এভিনিউ, আদৌ কোন ঠিকানাই নেই। কাঁপা কাঁপা আঙুলে চিঠিটা খোলে সে।

প্রিয় শ্রীমতি রেনর,
আমাদের সুইস ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন আপনাকে যে এক মিলিয়ন ডলার জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল এখনো জমা পড়েনি, আপনার এই অসহযোগিতা আমাদের ক্ষতি করেছে। যাই হোক, আপনাকে জানাই আমাদের আর্থিক প্রয়োজনটা এই মুহূর্তে খুবই বেড়ে গেছে। পাঁচ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। এই টাকাটা আপনি এককালীন দান হিসেবে দিয়ে দিলে আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর আপনাকে বিরক্ত করা হবে না, আর যদি টাকাটা দিতে অসমর্থ বা অমনোযোগী হন সে ক্ষেত্রে যথাযোগ্য জায়গায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাধ্য হবো আমরা।

চিঠির নিচে কোন নাম সই নেই, যথারীতি।

বেনডাল তীব্র আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে চিঠি পড়া শেষ হলে। বার বার করে চিঠিটা পড়তে থাকে। পাঁচ মিলিয়ন ডলার? এটা তার পক্ষে এ মুহূর্তে অসম্ভব। এত বিশাল অঙ্কের টাকা, এত তাড়াতাড়ি যোগাড় করা কোনভাবেই সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে রাতে মার্ক বাড়ী ফিরে এলে বেনডাল চিঠিটা ওকে দেখালো। পাঁচ মিলিয়ন ডলার? ইয়ার্কি নাকি? রাগে বিস্ফারিত হয় সে। ওরা তোমায় কিভাবে? বেনডাল অসহায় চোখে তাকায়, এখানেই তো মুশকিল। আমি কে তা জেনে ফেলেছে ওরা। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে কিছু টাকা, যোগাড় করতে হবে। কিন্তু কি ভাবে? আমি জানি না…হয়ত। তোমায় উত্তরাধিকার সূত্রের বিনিময়ে ব্যাঙ্ক তোমাকে ধার দেবে, দিতে পারে। কিন্তু যদিও…ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করছি না। মার্ক, এটা আমার জীবন মরণের প্রশ্ন, আমাদের গোটা জীবনের প্রশ্ন, যে করেই হোক আমাকে ধার পাবার চেষ্টা করতে হবেই।

জর্জ মেরিওয়েদার, ভাইস প্রেসিডেন্ট, নিউইয়র্ক ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। তিনি একজন উচ্চাকাঙ্খী, মধ্য চল্লিশ পুরুষ। জুনিয়র ক্লার্ক থেকে ধাপে ধাপে এত দূর এসে পৌঁছেছেন। একদিন আমি বোর্ড অফ ডাইরেকটরে জায়গা পাবো। তারপর…যদি ভাগ্য সহায় থাকে… তার দিবাস্বপ্নে বিস্ময় ঘটে হঠাৎ তার সেক্রেটারীর ডাকে, স্যার, মিস বেনডাল স্ট্যানফোর্ড এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। একটা সুখের আনন্দের ছোট্ট তরঙ্গ জর্জ মেরিওয়েদারের শরীরে খেলে যায়। একজন সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের মহিলা, সফল ফ্যাশান ব্যবসায়ী হিসেবে, মিস বেনডাল ব্যাঙ্কের একজন অতি উঁচু দরের গুরুত্বপূর্ণ কাস্টমার হতে পারেন। উনি বিশ্বের একজন অন্যতম ধনী মহিলা, বছরের পর বছর ধরে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের অ্যাকাউন্ট তার ব্যাঙ্কে খোলবার ব্যর্থ সাফল্যহীন চেষ্টা করে গেছেন তিনি। এবং এখন…. বেনডাল ঘরে ঢুকতেই সাদর উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান মেরিওয়েদার। করমর্দনের পর, তার পিতার মৃত্যুতে সান্ত্বনা প্রকাশের, সহানুভূতি প্রকাশের পর তিনি বলেন, বলুন মিস বেনডাল, আপনার জন্য কি করতে পারি? হা-হ্যাঁ, তিনি জানেন স্ট্যানফোর্ড কন্যা কি বলবেন। উনি নিজের বিলিয়ন ডলার তার ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখতে, অ্যাকাউন্ট খুলতে চান। আমি আপনার ব্যাঙ্ক থেকে কিছু টাকা ধার নিতে চাই। মেরিওয়েদার খাবি খেলেন। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। কি বললেন? আপনার ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার ধার চাই? মেরিওয়েদার দ্রুত চিন্তা করতে থাকেন। খবরের কাগজের রিপোর্ট, লেখালেখি অনুযায়ী স্ট্যানফোর্ড এস্টেটে ওর নিজস্ব অংশ প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের বেশিই হবে। সুতরাং…মনে মনে হাসেন তিনি।

আমার মনে হয় না তাতে কোন অসুবিধা হবে। মেরিওয়েদার জবাব দেন। আমি আমার বাবার উইলের অংশীদার। উত্তরাধিকারী হ্যাঁ, তা জানি। কাগজে পড়েছি। আমি টাকাটা নেবো আমার বাবার উইলের বিনিময়ে। জর্জ মেরিওয়েদার কিছুক্ষণ ভেবে নেন, তারপর বলেন, ব্যাঙ্কের নিয়ম কানুন খুবই কড়া, বোঝেনই তো। আচ্ছা আপনার নিজের সম্পত্তির অংশের মোট পরিমাণ কত হবে? বেনডাল অনিশ্চিত গলায় বলে, সে ব্যাপারে সত্যি বলতে কি আমার কোন ধারণাই নেই। তবে যা শুনছি তা এক বিলিয়নেরও অনেকটা বেশিই হবে। ঠিক আছে। আপনার বাবার উইল তো এখনো প্রবেট হয়নি। প্রবেটের পর উইলের একটা কপি নিয়ে ব্যাঙ্কে চলে আসবেন। প্রবেট? থমকে যাওয়া চোখে জর্জের দিকে তাকায় বেনডাল। এক নিঃশ্বাসে সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে, কিন্তু আমার তো টাকাটা এখনি চাই। খুব তাড়াতাড়ি। মরীয়া ভাব ফুটে ওঠে ওর বলার ভঙ্গীতে। চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে ওর। মাপ করবেন ম্যাডাম, ব্যাঙ্কের নিয়মের কাছে আমার হাত-পা বাঁধা। বেনডাল উঠে দাঁড়ায়, বুঝলাম। ধন্যবাদ। মেরিওয়েদার স্মিত মুখে বলে,–উইলটা হয়ে গেলেই…।

বেনডাল ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বের হয়ে চলে গেছে।

বেনডাল অফিসে ফিরতেই নাদিন উত্তেজিত গলায় বলে, বেনডাল, তোমার সঙ্গে কথা বলার আছে। নাদিনের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর মত মানসিক অবস্থা তখন বেনডালের ছিল না। অনুত্তেজিত প্রাণহীন গলায় সে বলে, কি ব্যাপার? আমার স্বামী ফোন করেছিল। ওর, অফিস থেকে ওকে প্যারিসে বদলি করে দিয়েছে। আমাকেও যেতে হচ্ছে। বেনডাল সারা শরীরে একটা বিদ্যুতের প্রবাহ টের পায় যেন। তুমি…তুমি চলে যাচ্ছো..প্যারিস… প্যরিসে চলে যাচ্ছো? নাদিন উচ্ছ্বাসের গলায় ঝুঁকে পড়ে, হ্যাঁ, দারুণ খবর তাই না? প্যারিস…আহ স্বপ্নের শহর। বেনডাল স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। নাদিন, তাহলে নাদিনই? কিন্তু প্রমাণ করার কোন উপায়ই নেই। প্রথমে মিঙ্ক কোট। তারপর প্যারিস। সঙ্গে পাঁচ মিলিয়ন ডলার থাকলে পৃথিবীর যে কোথাও গিয়ে থাকতেই পারে। যত দামী জায়গায়ই হোক। কিন্তু এখন? ব্যাপারটা সামলাবো কি করে? ওকে যদি বলি সব জানি, ও অস্বীকার করবে করবেই। হয়ত আরো বেশি দাবী করবে। মার্কের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

বেনডাল যখন অ্যাপার্টমেন্টে ফেরে, সেটা খালি। মার্ক অনেক রাত পর্যন্ত কাজকর্ম করে। ফিরতে রাত হয়। ঘরের, সারা ফ্ল্যাট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মূল্যবান এবং সুদৃশ্য নানা জিনিসের দিকে তাকিয়ে এক তীব্রতর বিষণ্ণতাবোধ ওকে তাড়িত করে। এসব কিছুই থাকবে না। একটা একটা করে সব কিছু কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত ওরা থামবে না। রক্ত চুষে চুষে ছিবড়ে না করে দেওয়া পর্যন্ত। হয়ত মার্ক ঠিকই বলেছিল। সে রাতে আমার পুলিশের কাছে যাওয়াই উচিত ছিলো। তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি, দীর্ঘ গত কয়েক মাসের চাপা উদ্বেগ দুঃশ্চিন্তা, এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হতো না আমাকে। এখন আমি একজন অপরাধী। তখন আমার স্বীকারোক্তি দিতে হবে। যদি কিছু বলতে চাই, যদি সেরকম কিছু করলে, তারপর কি ঘটতে পারে, তার মার্কের তার পরিবারের সঙ্গে? দীর্ঘ এক মামলা, আইনের কচকচি। কাগজে কাগজে শিরোনাম, টিভি চ্যানেলে ছবিসহ খবর। এবং তারপর? সম্ভবত জেল। তার ক্যারিয়ারে শেষ পেরেক, নাহ, কিছুতেই নয়। নিজের শেষ দৃশ্যটা এরকম হতে দিতে পারি না আমি। প্রায় এক ঘোরাচ্ছন্ন অবস্থায় মার্কের ঘরে প্রবেশ করে সে। তার মস্তিষ্কে একটা সিদ্ধান্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হয়ে শিকড় ছড়ায়, ছড়িয়েই চলে।

মার্কের ঘরের একটা ড্রয়ারে ছোট্ট বহনযোগ্য একটা টাইপরাইটার দেখেছিল সে। অল্প খুঁজতে সেটাকে পেয়েও গেল। ড্রয়ার থেকে টেনে বের করে টাইপরাইটারের মধ্যে একটা কাগজ ভরে, নিজেকে গুছিয়ে কথা শব্দ অক্ষরগুলোকে যাবতীয় আমোঘতাসহ সাজিয়ে নেয়। তারপর খুব শান্ত ভঙ্গীতে টাইপ করতে বসে–একটা চিঠি।

–To Whom May it Concern

আমার নাম বেনডাল স্ট্যানফোর্ড…

বেনডাল থেমে যায়, বিস্ফারিত চোখে নিজের টাইপ করা অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

সবকটা ই অক্ষর ভাঙ্গা।

.

৩০.

কেন, মার্ক কেন? বেনডালের গলায়, বলার ভঙ্গীতে তীব্র আশাহত বিষণ্ণতা, ক্ষোভ। এটার জন্য তুমিই দায়ী? না। আমি তো বলেছিলাম তোমায়, এটা নিতান্তই একট দুর্ঘটনা ছিলো। না, ওটার কথা বলছি না আমি। তোমার কথা বলছি আমি। সফল এক নারী, যে ভুলে যায় নিজের ব্যস্ত জীবনে, যে কারো একজনের স্ত্রীও সে। কথাটা নিছক যেন শব্দ নয়। সজোরে এক থাপ্পর হয়ে আছড়ে পরে যেন তা বেনডালের গালে। আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে, সে কথা মোটেই সত্যি নয়, আমি… হ্যাঁ, তুমি। সব সময় তুমি যা নিয়ে ভাবো, মশগুল থাকো তা নিজেকে নিয়ে বেনডাল। নিজের পেশাদারী জীবন নিয়ে। দুজনে এক সাথে কোথাও গেলেও সব জায়গায় তুমি একজন সফল নারী তারকা। তুমি যেন আমার পেছনেও একটা ট্যাগ লেবেল সেঁটে দাও, যেন আমি কোন গৃহপালিত পোয্য। এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না মার্ক। তাই? সত্যিই তাই? তুমি তোমার ফ্যাশানের প্রদর্শনী নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াও। কাগজে টিভিতে তোমায় দেখি, আর এই অন্ধকার ঘরে বসে তোমার ফেরার জন্য হা পিত্যেশ অপেক্ষা করি। তুমি কি কখনো ভেবেছ, এই বেঁচে থাকাটা আমি পছন্দ করছি কিনা? কি মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এটা? আমি তো একজন স্ত্রী চেয়েছিলাম, বেশি কিছু নয়। বেনডালের মুখ তখন বিবর্ণ ছাইয়ের মত হয়ে উঠেছে। তুমি চিন্তা করো না, তুমি যখন থাকবে না, চলে যাবে, আমি অন্য নারীতে সুখ খুঁজে নেবো। তবে, নিশ্চিত ভাবেই সে হবে রক্ত-মাংসের কোন নারী। যার থাকবে আমাকে দেখার মত সময়, কোন ফাঁকা অন্তসারশূন্য ঝিনুকের খালি খোলা নয়। কঠিন, ধারালো গলায় বলে কথাগুলো, কাটা কাটা। চুপ করো, চুপ করো, বেনডাল প্রায় ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রথম যখন তুমি দুর্ঘটনার কথাটা বললে, আমি তোমার হাত থেকে ছাড়া পাবার একটা পথ দেখতে পেলাম। চিঠিগুলো পড়ে তোমার উন্মাদনা, আতঙ্কগ্রস্ততার তীব্র তাড়নাময় চেহারা আমি উপভোগ করতাম। নিজের তীব্র মানসিক অস্থিরতা, হতাশা, বিষণ্ণতা যাবতীয় অপমান, অসম্মান যেন আমি ঐ ভাবে তোমাকে ফেরত দিতাম বলে মনে হতো আমার। এক আনন্দ তীব্র সুখবোধ হতো। যথেষ্ট হয়েছে। না আর নয়। এবার নিজের ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে নাও। আমি তোমার আর মুখ দর্শন করতেও চাই না। মার্ক হাসে, বিষণ্ণতা মেশা ধূসর হাসি। সেরকম কোন ইচ্ছে আমারও নেই। আমার শখ মিটে গেছে। যথেষ্ট হয়েছে, আমি প্যারিসে ফিরে যাচ্ছি।

এক ঘণ্টা পর মার্ক চলে যায়। সারাজীবনের জন্য।

সকাল নটা, বেনডাল বোস্টনে স্টিভ সোলানেকে ফোন করে, আজ বিকেলের উড়ানে বোস্টন ফিরছি। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আমার একটা স্বীকারোক্তি করার আছে।

সেই, সন্ধ্যেতে সোলানের উল্টো দিকে বসেছিল বেনডাল। প্রথম থেকে আগা গোড়া ঘটনাটা বিস্তারিত ভাবে সব বলে। আধঘণ্টা পর সোলানে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ যা শুনল, সেসব কথা মনের ভেতর নাড়াচাড়া করছিল। আপনি তাহলে পুলিশে যেতে চান? হা, প্রথমেই এটা করা উচিত ছিলো। যাই হোক, ওরা এখন আমায় কি করবে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। যা হবার হবে। স্টিভ চিন্তামগ্ন গলায় বলে,–নাহ, যেহেতু আপনি স্ব-ইচ্ছেতে সব স্বীকার করছেন এবং ব্যাপারটা নিছক এক মামুলি দুর্ঘটনা, তাই বিচারক আপনাকে কোন কড়া শাস্তি দেবেন বলে মনে হয় না। সে যাই হোক, মোট কথা ব্যাপারটা থেকে আমি মুক্ত হতে চাই। ছাড়া পেতে চাই। আর আপনার স্বামী? ব্ল্যাকমেইলের অপরাধে ওনার কড়া সাজা হবেই। বেনডাল হাত তোলে, নাহ, ওকে আমি ওর মত ছেড়ে দিতে চাই। ও এবার নিজের মত করে বাঁচুক। স্টিভ মাথা নাড়ে, ঠিক আছে, আপনি যা বলবেন। আমি আপনাকে পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাচ্ছি, হয়ত আজ রাতটা আপনাকে হাজতে কাটাতে হবে। কিন্তু কাল সকালেই আপনাকে জামিনে ছাড়িয়ে নেবো, আপনি নিশিন্ত থাকুন।

সোলানে যখন বাড়ীতে ফিরল, সব কথা জুলিয়াকে বলল। শুনে সে চোখ কপালে তুলে বলল, কি কাণ্ড? নিজের স্বামী ওকে ব্ল্যাকমেইল করত? ওর গলায় আতঙ্কের সুর। তারপর স্টিভের দিকে তাকিয়ে বলে, সারাটা দিন তুমি মানুষের সমস্যা দূর করে বেড়াচ্ছ, শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। ওর দিকে তাকিয়ে স্টিভ নিজের মনেই ভাবে, সমস্যা? আমি নিজেই তো এখন গভীরতর সমস্যায়।

.

স্টিভের চট্‌কা ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তাজা কফির সুবাসে। সঙ্গে মাংস সেঁকার সুস্বাদু গন্ধ। বিছানায় উঠে বসে চট করে, রান্নার লোকটা কি আজ এসেছে? কিন্তু ওকে তো আর আসতেই না করেছিল। তাহলে? কিন্তু রান্নাঘরে এসে স্টিভ অবাক হয়ে যায়। জুলিয়া, রান্নায় ব্যস্ত। রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে। স্টিভ হাসে, কি ব্যাপার? তোমার তো রান্না বান্না করার দরকারই নেই। একটা গোটা হোটেল কিনে নিতে অথবা পাঁচ তারা হোটলের বাছাই করা একশো রাধুনীকে ভাড়া করতে পারো। জুলিয়া অবিশ্বাসের গলায় বলে, স্টিভ, সত্যিই কি টাকাটার অংশ, সম্পত্তি আমি পাবো? অতগুলো টাকা?–নিশ্চয়ই পাবে, এক বিলিয়ানেরও অনেক বেশি টাকা। খাবারগুলো নিয়ে এক সময় ওরা টেবিলে এসে বসে, খেতে খেতে আচমকা জুলিয়া বলে, তোমার জন্য রান্না করার কেউ নেই? স্টিভ হাসে, মানে তুমি জানতে চাইছ, আমি কোন মেয়ের সঙ্গে… জুলিয়ার গাল লাল হয়ে ওঠে ইয়ে, মানে সেরকমই। নাহ, বছর দুয়েক একটা সম্পর্ক ছিল, তবে সেটা ফলপ্রসু হয়নি। জুলিয়া মাথা নাড়ে, দুঃখিত। সোলানে চোখ বড় করে তাকায় আর তোমার নিজের কথা তো কিছু বলছ না? জুলিয়ার মনে পড়ে হেনরি ওয়েসসন এবং অন্যদের কথা, ও হাসে, মাথা নাড়ে, নাহ, তেমন কিছু নয়। তোমার গলাটাও কিন্তু জোরালো অথবা আত্মবিশ্বাসী শোনালো না। জুলিয়া হাসে, সত্যিই ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা মুশকিল। বলা যায় একটা মরীয়া চেষ্টা, জোর করে সম্পর্ক তৈরির বোকা বোকা চেষ্টা।

–ওরা ওখানে বসে প্রায় ঘন্টা খানেকের বেশি সময় ধরে কথা বলে। স্টিভ ওকে গোটা ঘটনাটার সবটা ক্রমানুযায়ী পর পর শোনায়। আগে যা ঘটেছে-ঘটেছিল, প্রথম নকল জুলিয়ার আবির্ভাব, খালি কবর, দিমিত্রি কামিনস্কির উধাও হয়ে যাওয়া। সব শুনে জুলিয়া হতবাক গলায় বলে, অবিশ্বাস্য, কে করতে পারে এসব? আমি জানি না, সেটাই খুঁজে বেড়াচ্ছি। স্টিভ আশ্বস্ত হবার গলায় বলে, তবে তোমার কোন চিন্তা নেই, এখানে তুমি একেবারে নিরাপদ। জুলিয়া হাসে, আমি এখানে যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করি। ধন্যবাদ।

.

স্টিভ ফিৎজেরাল্ডের মুখোমুখি বসেছিল, কোন পথ পেয়েছ এগোনোর। ফিৎজেরাল্ডের প্রশ্নে মাথা নাড়ে স্টিভ, নাহ, এখনো পুরোটাই ধোঁয়াশা আমার কাছে। তবে গোটা রহস্যাটা যার মাথা থেকেই বের হোক, সেই পরিকল্পনাকারীকে একজন জিনিয়াস মানতেই হবে। দিমিত্রি কামিনস্কির ব্যাপারে সিডনি পুলিশ-এর সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা তো কামিনস্কি ও দেশে রয়েছে শুনে অবাক। ইন্টারপোলের সার্কুলার অনুযায়ী সে একজন ওয়ান্টেড ওরা জানে। যাই হোক ওরা আমাকে আশ্বস্ত করেছে। ওরা দিমিত্রির খোঁজ করবে, এবং সে ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেই আমায় জানাবে। একটু থেমে কি যেন ভেবে নিয়ে সে আবার যোগ করে, আমার মনে হয় কি জানোর হ্যারী স্ট্যানফোর্ড উইল পান্টানোর কথা, চিন্তা প্রকাশ করে নিজের মৃত্যুর পরোয়ানা নিজেই সই করে ছিলেন। কেউ একজন ওনাকে থামাতে চেয়েছিল। থামাবার প্রয়োজন বোধ করেছিল এবং পুরো খেলাটাই সেই ব্যক্তিই খেলে চলেছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সাইমন মাথা নাড়ে, ঠিকই বলেছ। আমাদের হাতে এখন যা আছে সবই পারিপার্শ্বিক তথ্য, প্রমাণ। যাইহোক, সেই ডিটেকটিভ ভদ্রলোকের কি হলো স্ট্যানফোর্ডরা যাকে ভাড়া করেছিল, এবং যিনি আঙুলের ছাপ পর্যন্ত মিলিয়ে দিয়ে নকল এক জনকে সত্যি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন? হ্যাঁ ফ্রাঙ্ক টিমমনস, ওনার সঙ্গেও আমি যোগাযোগ করেছি। আজ সন্ধ্যের মধ্যে আশা করি ভদ্রলোকের থেকে খবর পাবো কিছু। আর উনি যদি নিজে থেকে যোগাযোগ না করেন, আমি চলে যাবো শিকাগো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভদ্রলোক এই ঘটনায় বেশ ভাল রকম জড়িত। অনেক কিছু জানেন। তোমার কি মনে হয়? এস্টেটের কোম্পানীর শেয়ারগুলোর দখল নেবার জন্যই জালিয়াতটি, প্রতারকটি এসব করেছে? সোলানে মাথা নেড়ে সায় দেয়, অঙ্কের হিসাব তো তাই বলছে। কেউ একজন পুরো দখলটা, কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেবার জন্যই এতসব করছে, ঘটাচ্ছে।

সাইমন গভীর চিন্তার ভাজ পড়া কপাল নিয়ে তাকায়, তুমি কাউকে সন্দেহ করো? সোলানে চিন্তা করে করে শব্দ বাছাই করে যেন বলে, আমার সন্দেহ নিশ্চিত ভাবেই স্ট্যানফোর্ড পরিবারের ওপর। নাহ, বেনডালকে বোধহয় ব্যাপারটা থেকে বাদ রাখা যেতে পারে। কেনডালকে সন্দেহের উর্ধে রাখার কারণ হিসেবে গত সন্ধ্যের ঘটনাটা ফিৎজেরাল্ডকে জানায় সে। ও যদি এত সব করত, তাহলে নিশ্চয়ই এরকম একটা সময়ে ষড়যন্ত্র চালাবার মাঝপথে নিজের দুর্ঘটনা ঘটানোর কথাটা পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেবার কথা ভাবত না, চিন্তাই করত না, তাই নয় কি? আর ওর স্বামী মার্ক? ওর ব্যাপারে আমার যত দূর ধারণা গড়ে উঠেছে, ওর দ্বারা ছোটখাটো কোন ব্ল্যাকমেলিং হতে পারে। এত নিখুঁত ভাবে এত ব্যাপক কোন ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা করে সেটাকে ছবির মত স্পষ্টভাবে পরিচালনা করার ক্ষমতা আর যারই হোক, মার্ক-এর আছে বলে আমার মনে হয় না।

আর অন্যরা? তাদের ব্যাপারে তোমার কি মত? সাইমন চিন্তিত মুখেই প্রশ্নটা করে। জজ স্ট্যানফোর্ড-এর এক বন্ধু যে শিকাগো বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত, তার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। সেই বন্ধুটি বলেছে, সবাই তার সম্পর্কে উচ্চ ধারণাই পোষণ করে। আর সম্প্রতি সে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হতে চলেছে। আরো একটা জিনিষ, ব্যাপার ওর পক্ষে যাচ্ছে, বিচারক স্ট্যানফোর্ডই প্রথম জুলিয়ার আবির্ভাব ঘটার পর, এক মাত্র তিনিই ডি এন এ পরীক্ষা করানোর দাবী তুলে ছিলেন। তিনি এরকম কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, করতে পারেন সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। উডি! আমার ওকে আকর্ষণীয় চরিত্র মনে হয়েছে। এবং আমি নিশ্চিত মাদকের নেশা করে উডি। এবং কে না জানে, সেটা খরচা বহুল অভ্যাস। প্রশ্ন হলো খরচটা আসে কোথা থেকে। ওর স্ত্রী পেগি, খোঁজ নিয়ে এবং মেয়েটির চরিত্র স্বভাব বিশ্লেষণ করে যা মনে হয়েছে এত বড় জটিল, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চালনা করার সাধ্য ওর হবে না। তবে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি পেগির এক ভাই আছে। যে অসৎ সঙ্গে জড়িত, বদ পেশায় পরিচালিত। এই খটকার জায়গাটা সম্পর্কেই আরো ভালো করে খোঁজ নিচ্ছি।

পরের দিন সকালে অফিসে পৌঁছেই স্টিভ প্রথমে বস্টনে পুলিশের মাইকেল কেনেডীকে ফোন করে, সুপ্রভাত লেফটেন্যান্ট। আমি রেনকুইস্ট রেনকুইস্ট ফিৎজেরাল্ড থেকে সিনিয়ার অ্যাটর্নীস্টিভ সোলানে বলছি। হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের কেসটার ব্যাপারে একজনের সম্পর্কে কিছু তথ্য, খোঁজ খবর চাই। শ্যা নিশ্চয়ই। আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হব। বলুন কার সম্পর্কে খোঁজ খবর দরকার আপনার? শ্রীমতি উডরোও স্ট্যানফোর্ডের ভাই-এর সম্পর্কে, হোপ মালকোভিচ লোকটির নাম। বনস্ক-এর বেকারিতে কাজ করে কোন সমস্যা হবে না। আমি খোঁজ নিচ্ছি। কিছু জানতে পারা মাত্র আপনাকে জানাব। ফোন রাখতে না রাখতেই, ঘরে ঢোকে সাইমন, কি হলো? তদন্ত এগোল? তেমন কিছু নয়। যেই ষড়যন্ত্রটা পরিচালনা করে চলুক, প্রায় নিখুঁতভাবে সমস্ত প্রমাণগুলো মুছে দিচ্ছে সে। কোন তথ্য, সূত্র ছেড়ে যাচ্ছে না। সাইমন মাথা নাড়ে, দেখো, কি করতে পারো। তারপর জুলিয়া কেমন আছে? স্টিভ হাসে, দারুণ। কথাটা বলার ভঙ্গীতে কি যেন ছিল, যা ফিজেরাল্ডকে বাধ্য করল খুঁটিয়ে দেখা দৃষ্টিতে স্টিভের দিকে তাকাতে। উনি একজন আকর্ষণীয়া যুবতী মহিলা। তাই নয় কি? সাইমনের কথায় সোলানে মাথা নাড়ে, নিঃসন্দেহে। সত্যি কথা। উৎসাহী গলায় জবাব দেয়।

বিকেলেই ফোনটা এলো। শ্রী সোলানে? যা বলছি। সিডনি থেকে চিফ ইন্সপেক্টর ম্যাকফারসন বলছি। হ্যাঁ বলুন চিফ? আপনার লোকটিকে খুঁজে পেয়েছি। স্টিভের হৃৎপিন্ডটা যেন লাফ দিয়ে গলার কাছে উঠে এলো। দারুণ খবর ইন্সপেক্টর। যত দ্রুত সম্ভব ওকে এখানে নিয়ে আসার… দিমিত্রি কামিনস্কি মারা গেছে। এবার নিজের হৃৎস্পন্দন যেন ওর নিজের কানেই ধরা পড়ে না। কি? একটু আগেই, ছোট্ট একটা দুর গ্রামের পথের পাশে ওর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। কামিনস্কির দুহাতের আঙুলগুলো কেটে নেওয়া হয়েছে এবং একাধিকবার গুলি করে খুন করা হয়েছে। স্টিভ নিজের মনে মাথা নাড়ে, রাশিয়ান মাফিয়াদের মধ্যে প্রতিশোধ নেবার একটা আশ্চৰ্য্য অদ্ভুত প্রথা আছে। ওরা হাতের আঙুলগুলো কেটে নেয়। রক্তক্ষরণ হতে দেয়। তারপর রক্তক্ষরণে অবসন্ন হতভাগাটিকে গুলি করে খুন করে। ওর জানা ছিল।

অন্ধগলি, স্টিভ একা বসে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল। ফাঁকা মন, এগোবার প্রত্যেকটা পথের দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দিমিত্রি কামিনস্কির সাক্ষ্যর ওপর অনেকটা নির্ভর করেছিল। স্টিভের চিন্তার ঘন আচ্ছন্নভাব ওর সেক্রেটারীর ডাকে ভাঙ্গে। ফ্রাঞ্চ টিমমনস নামের এক ভদ্রলোক ফোন করেছেন। স্টিভ ফোনটা তোলে, যা বলুন শ্রী টিমমনস? আমি শহরের বাইরে গিয়েছিলাম, বাড়ী ফিরে ফোনের উত্তর দেওয়া যন্ত্রে আপনার বক্তব্য সংরক্ষিত পেলাম। তারপরই আপনাকে ফোন করছি। বলুন, কি করতে পারি আপনার জন্য? অনেক, অনেক কিছু। একটা প্রতারকের আঙুলের ছাপ কি করে আসলটির সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন?জালিয়াতটা কিভাবে, কেন করলেন জানাতে পারেন? মনে মনে ভাবতে ভাবতে স্টিভ বলে, খুব সতর্ক বিবেচনা করে শব্দ বাছে–আমি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের প্রসঙ্গে বলছি, আপনি যখন বস্টনে ওর আঙুলের ছাপ… সোলানে…, মাঝপথেই স্টিভের কথা থামিয়ে দিয়ে টিমমনস বলে ওঠে। বাধা পেয়ে স্টিভ বলে, হ্যাঁ বলুন, জীবনে কখনো আমি বস্টনে যাইনি। স্টিভ গভীর শ্বাস নেয়। শ্রী টিমমনস, হলিডে ইন-এর রেজিস্টার অনুসারে, আপনি সেখানে ছিলেন গত… শ্রী সোলানে, কেউ আমার নাম ব্যবহার করেছে। স্টিভ শোনে, চমকিত, হতবাক। তদন্তের কফিনে শেষ পেরেক। তবু যেন ক্ষীণ আশার কোন আলোর খোঁজে যে ভাবে ডুবন্ত মানুষ খোঁজে কাঠকুটো, সে ভঙ্গীতে বলে, কে এরকম করতে পারে বলে মনে হয়, আপনার?

টিমমনস কাশে, সে যদি বলেন, বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। এক মহিলা দাবী করছেন যে আমি নাকি বস্টনে তাকে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি, প্রমাণ দিয়েছি। কিন্তু চরম আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ঐ মহিলাকে আমি জীবনে কখনো দেখিইনি। সহসা এক বিদ্যুতের ঝিলিক বয়ে যায় স্টিভের শরীরে। নতুন আশার ঝলক। সেই মহিলা কে জানতে পেরেছেন? তার আসল পরিচয় কি? হ্যাঁ, তার আসল নাম পসনার। মার্গো পসনার। স্টিভ দ্রুত হাতে কাগজ কলম গুছিয়ে নেয়, উনি কোথায় থাকেন? মহিলা রিড মানসিক হাসপাতাল শিকাগোতে ভর্তি আছেন। ধন্যবাদ, শ্ৰী টিমমনস। আপনি আমায় অনেক সাহায্য করলেন। ঠিক আছে। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। কি ঘটছে জানতে চাই আমি, কেউ অন্যায় ভাবে আমার নাম ব্যবহার করবে নিজের কার্যসিদ্ধিতে তা মোটেই পছন্দ করছি না আমি। ঠিকই। স্টিভ রিসিভার নামিয়ে রাখে। মার্গো পসনার।

সে সন্ধ্যোতে স্টিভ যখন বাড়ী ফিরল জুলিয়া অপেক্ষা করছিল। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে পোষাক পাল্টে নাও। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে। তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে পৌঁছে স্টিভ একই সাথে অবাক ও মুগ্ধ হয়ে গেল। ফুল, মোমবাতিতে সাজানো টেবিল। লোভনীয় চিনে খাবারের একাধিক পদ। এক খুশির ঢেউ ওর মনকে সপ্তম আনন্দে তুলে ধরে। এভাবে খাবার বেড়ে, টেবিলে সাজিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করেনি কখনো কোন নারী। জুলিয়া বলে, কোন নতুন খবর আছে আজ? স্টিভ ওকে মার্গোর কথা, অন্যসব বিস্তারিত বলে। জুলিয়া মাথা নাড়ে, ব্যাপারটা মিটে গেলে বাঁচা যায়। আমি যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা মিটবে, ততো বেশি খুশি হবো। হ্যাঁ আমিও। স্টিভ বলে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? স্টিভ ভাবে, মেয়েটি একজন সত্যি স্ট্যানফোর্ড পরিবার সদস্য–স্টিভের ধরা ছোঁয়া নাগালের অনেক বাইরে।

রাতের খাওয়া সারতে সারতে দুঘণ্টা কেটে গেল। ওরা গল্প করছিল। কথা বলছিল। সব কিছু নিয়ে কথা বলছিলো। আবার হয়ত কোন কিছুই বলছিলো না। যেন যুগ যুগান্ত ধরে ওদের পরিচয়, চেনাজানা, ওরা অতীত নিয়ে কথা বলছিলো, বর্তমান নিয়ে আলোচনা করছিল। কিন্তু সতর্কভাবে দুজনেই এড়িয়ে যাচ্ছিল ভবিষ্যত বিষয়ে কথাবার্তা। আমাদের এ রাতের কোনই ভবিষ্যত নেই। চিন্তাটা স্টিভকে অসুখী করে তুলেছিল। এক সময় সে বলে,–চলো, এবার বিছানায় শুতে যাওয়া যাক। জুলিয়া ভুরু তুলে চোখ পাকিয়ে তাকায়। কৃত্রিম রাগের ভঙ্গী করে। না, মানে আমি বলতে চেয়েছি..তুমি কি বলতে চেয়েছ আমি ভালই বুঝতে পেরেছি। দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়ে।

.

৩১.

পরের দিন ভোরের উড়ান ধরেই শিকাগো পৌঁছায় স্টিভ। বিমান বন্দর থেকে ট্যাক্সী ধরে সোজা মানসিক হাসপাতালে পৌঁছায় সে। কিন্তু অভ্যর্থনা টেবিলের কর্মীটি ওকে প্রথমেই নিরাশ করে। মার্গো পসনার? হাসপাতাল কর্মী? স্টিভ মাথা নাড়ে, তা বলতে পারব না? লোকটি ড্রয়ার থেকে একটি খাতা বের করে, তাতে চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়ে, নাহ, ঐ নামে এখানে কেউ চাকরি করে না। তাহলে রোগী, সে হয়ত রোগী হতে পারে। লোকটি ভুরু কুঁচকে কিছুটা বিস্ময় মেশা দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর একটা কমপিউটার প্রিন্ট আউটের একটা শিট বের করে তাতে চোখ বুলোত বুলোতে মাঝপথে থেমে যায়, পসনার। হা মার্গো পসনার, রোগী। আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি কি ওনার আত্মীয়? নাহ। দুঃখিত। আত্মীয় না হলে, এখানকার রোগীদের সঙ্গে বাইরের লোকেরা দেখা করতে পারে না। এটা খুবই জরুরী গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখিত, আমার কিছু করার নেই। নিয়ম ভাঙতে পারার ক্ষমতা আমার নেই। বিরক্ত মুখে সোলানে বলে, এখানকার পূর্ণ দায়িত্বে কে আছেন? ডাঃ কিংসলে। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ডাঃ কিংসলের মুখোমুখি হলে স্টিভ বলে, নমস্কার। আমার নাম স্টিভ সোলানে। আমি একজন অ্যাটর্নি। আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন শ্রী সোলানে। আমি মার্গো পসনার এর সঙ্গে দেখা করতে চাই। ডাঃ কিংসলে একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে, আহ, কৌতূহল উদ্দীপক কেস বটে। আপনি কি ওর কোন আত্মীয়? না। আমি একটা খুনের তদন্ত করছি, এবং সেই বিষয়েই শ্রীমতি পসনারের সঙ্গে দেখা করাটা অত্যন্ত দরকারী, গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শ্রী সোলানে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। সাহায্য করতে আপনাকে হবেই। ডাঃ কিংসলে মাথা নাড়েন, ইচ্ছে থাকলেও আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। স্টিভ বিস্ময় মিশ্রিত চোখে তাকায়, কেন? উনি অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠেছেন, যে সামনে যাচ্ছে তাকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছেন। তাই একটা নির্জন সেলে ওকে হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে। আজ সকালেই এক নার্সকে প্রায় খুন করে ফেলেছিলেন। সে কি? বারবার নিজের পরিচয় বদল করছেন উনি। একবার মার্গো পসনার বলে হাঁক ডাক করছেন। আবার কিছুক্ষণ টাইলার, প্রমোদতরণী–এসব বলে চিৎকার করে উঠেছেন। তাকে শান্ত করার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘুমের ওষুধ, ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। হতাশ ভঙ্গীতে সোলানে বলে, কবে এই অসুখ থেকে সুস্থ হয়ে উঠবে মার্গো? ডাঃ কিংসলে মাথা নাড়ে, সেভাবে কিছু বলা যায় না। ওনাকে তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হচ্ছে…।

.

৩২.

ভোর ছটা। জলপুলিশের একটা টহলদার নৌকো চার্লস নদীর জলে নিয়ম মাফিক টহলদারী পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছিল। পুলিশ কর্মীদের একজন জলে কিছু ভাসতে লক্ষ্য করে। কাছাকাছি নৌকোটা এগিয়ে নিয়ে যেতেই দেখা যায়, সেটা একটা মানুষের দেহ। জলে ভাসমান দেহটাকে নৌকোয় তুলে আনার পর বুঝতে পারা যায় সেটা একটা মৃতদেহ।

লেফটেন্যান্ট মাইকেল কেনেডি বিস্ময় চমকিত গলায় বলেন, আপনি যা বলছেন নিশ্চিত, পুরোপুরি রকম নিশ্চিত হয়েই বলেছেন তো? করোনার দৃঢ় গলায় বলে, দুশো শতাংশ, এটা হ্যারী স্ট্যানফোর্ড এরই মৃতদেহ। আমি নিজে আগের বার মৃতদেহের ময়না তদন্ত করেছিলাম।

শিকাগো থেকে ফিরে স্টিভ সোজা অফিসে এসে হাজির হলো, তোমাকে হতোদ্যম নিরাশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সাইমন ফিৎজেরাল্ড বলে স্টিভের দিকে তাকিয়ে। স্টিভ একটা হতাশাচ্ছন্ন দীর্ঘতর খাস ছাড়ে, পুরো ব্যাপারটাই তছনছ হয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, ভেঙ্গে পড়ছে, সাইমন। এগোবার তিনটে দরজা খোলা ছিল। দিমিত্রি কামিনস্কি, ফ্রাঙ্ক টিমমনস, মার্গো পসনার। কামিনস্কি মারা গেছে। টিমমনস তো ভুল ব্যক্তি। আর মার্গো পসনার? উন্মাদ, পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মানসিক হাসপাতালের নির্জন অন্ধকার ঘরে হাত পা বাঁধা হয়ে, সিডেটিভাচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছে। আমরা একটা অন্ধগলির শেষ মাথায় এসে পৌঁছেছি সাইমন। ঠিক এমন সময়েই ফিজেরাল্ডের সেক্রেটারী ঘরে ঢোকে, লেফটেন্যান্ট কেনেডি দেখা করতে চান স্যার। সাইমন আর স্টিড অবাক চোখে দুজনে দুজনের দিকে তাকায়। শিকাগো পুলিশ কর্তা? কেন? পাঠিয়ে দাও, ফিৎজেরাল্ড বলেন। ঘরে ঢোকেন আক্ষরিক পরিভাষায় যাকে বলা যেতে পারে র্যাগেড লুকিং এক মধ্য চল্লিশের পুরুষ। ঘরে ঢুকে ঠিকঠাক, অব্যর্থভাবে সাইমনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি বলেন,–শ্রী ফিজেরাল্ড? করমর্দনের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাইমন বলেন, হ্যাঁ। কি ব্যাপার, লেফটেন্যান্ট? কোনরকম ভনিতা না করে সোফায় বসতে বসতে এক ঝলকে স্টিভ আর সাইমনের মুখটা দেখে নিয়ে তিনি বললেন, হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের দেহ পাওয়া গেছে। কি-ঈ-ঈ? প্রায় একই সঙ্গে চরম বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্নটা প্রায় আচমকা আর্তনাদের মত ছিটকে বের হয়ে আসে ওদের মুখ দিয়ে। তারপর আবার দুজনে প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করে, কোথায় পাওয়া গেল শ্রী স্ট্যানফোর্ডের মৃত দেহটাকে? চার্লস নদীর জলে সাঁতার কাটছিলেন প্রয়াত হ্যারী স্ট্যানফোর্ড। কি করে, জানতে চাইবেন না। কারণ সে প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে নেই। কোথায় আছে ওনার দেহটা এখন? মর্গে, যদি না এর মধ্যেই আবার উধাও হয়ে গিয়ে থাকে।

লেফটেন্যান্ট মাইকেল কেনেডি চলে যাবার পর গভীর দুশ্চিন্তার ভাঁজে ভরা কপালে আঙুল দিয়ে টোকা মারতে মারতে সাইমন ফিৎজেরান্ড চিন্তাগ্রস্ত গম্ভীর গলায় বললেন, কেসটা ক্রমেই উদঘট রকমের জটিলতর অথচ কৌতূহল উদ্দীপনার হয়ে উঠেছে। একটু চুপ করে থেকে তারপর স্টিভের দিকে তাকিয়ে আবার বলেন, জাল গোয়েন্দা টিমমনস কে সেজেছিল তার কোন পাত্তা লাগাতে পারলে? স্টিভ হতাশ ভঙ্গীতে বলে, নাহ, সে ব্যাপারে এখনো কিছুই জানতে পারি নি। সাইমন একটা শ্বাস ছাড়ে, একটাই ভাল খবর। স্ট্যানফোর্ড এর মৃতদেহ যখন পাওয়া গেছে জুলিয়ার দাবী প্রমাণ করা সহজ হবে। পেরী উইজারকে খবর দাও। ডি এন এ টেস্টের ব্যবস্থা করতে বলল।

স্টিভ যখন টাইলারকে ফোন করে তার বাবার মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার খবরটা দিলো, ওকে বিহ্বল চমকিত শোনালো, সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড তো? কে এরকম করতে পারে? আমরা সেটার খোঁজ করছি। মনে মনে রাগের ভিসুভিয়াস ফুটতে থাকে। হতভাগ্য অপদার্থ বেকার, ওকে এই ব্যর্থতার চরম দাম চোকাতে হবে। এমন দাম, যা কল্পনাও করতে পারছে না। অকম্মার ঢেঁকিটা স্টিভ-এর কথা শুনে…। টাইলার নির্বিকার শান্ত গলায় মনের ফুটন্ত ক্ষোভ, উত্তেজনাটাকে প্রাণপণে চেপে গোপন রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে, দেখুন শ্রী সোলানে, আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি। প্রচুর মামলা জমে উঠছে। এভাবে আর বেশিদিন ছুটি নিয়ে কাজকর্ম ফেলে রেখে অপেক্ষা করা, বসে থাকা সম্ভব হবে না, হচ্ছে না। আপনার প্রবেটের ব্যাপারটা যদি একটু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে পারেন তবে আমার খুবই উপকার হয়। স্টিভ সমর্থনের গলায় বলে, আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি স্ট্যানফোর্ড। চিন্তা করবেন না। আজ সকালেই আমি খোঁজ নিয়েছি। আর দিন তিনেক সময় লাগবে। তার মধ্যে ব্যাপারটা মিটে যাবে আশা করছি। টাইলার উৎসাহী গলায় বলে, বেশ।

ফাঁকা অফিস ঘরে একা বসে স্টিভ সোলানে আবার সমস্ত ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রম। অনুসারে সাজিয়ে সাজিয়ে কাটা ছেঁড়া করছিল। ওর মনে পড়ে চিফ ইন্সপেক্টর ম্যাকফারসন। কি বলেছিলেন–একটু আগে আমরা দিমিত্রি কামিনস্কির মৃতদেহ–এক মিনিট। এক মিনিট। নিমেষে একটা চিন্তা বিদ্যুত চমকের মত ওর মনের মধ্যে ঝলসে ওঠে। কি যেন একটা, পুরোটা যেন বলেননি চিফ ইন্সপেক্টর ম্যাকফারসন। দ্রুত ফোনটা তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করে সে, হালো, ইন্সপেক্টর ম্যাকফারসন? একটা প্রশ্ন হঠাৎ মনে পড়ল, তাই ফোন করছি। আচ্ছা চিফ ইন্সপেক্টর, দিমিত্রি কামিনস্কির মৃতদেহের মধ্যে, সঙ্গে কি কোন কাগজ পত্র ছিলো। পাওয়া গিয়েছিল? ও আচ্ছা..বুঝেছি…ঠিক আছে, ধন্যবাদ চিফ। অনেক ধন্যবাদ। ফোনটার লাইন কেটে রিসিভারটা ক্রেডালে রাখতে না রাখতেই, সেটা আবার সশব্দে মুখর হয়ে ওঠে। ফোনটা তুলতেই অন্য প্রান্তে লেফটেন্যান্ট কেনেডির গলা, হোপ মালকোভিচের সম্পর্কে কিছু তথ্য আমার হাতে এসেছে। যথেষ্ট পিচ্ছিল চরিত্রের মানুষ মালকোভিচ। ও যে বেকারিটিতে কাজ করে সেটা আসলে চোখে ধুলো দেবার ছল। ওটা আসলে একটা মাদক চক্রের ডেরা, তবে ওরা এত চতুর ভাবে কাজ করে যে পুলিশের পক্ষে কখনন ওদের ছোঁয়া সম্ভব হয়নি। বুঝেছি, আর কিছু? পুলিশ জানতে পেরেছে ওদের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ মাফিয়াদের যোগাযোগ আছে।

বাড়ী ফিরে স্টিভ জুলিয়াকে কোথাও দেখতে পেলো না। জুলিয়া জুলিয়া ডেকে ও কোন সাড়া না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আতঙ্কের স্রোত হয়ে যায়। ওকে কি অপহরণ করা হয়েছে, নাকি খুন? এসব যখন ভাবছে ঠিক তখন, ছাদের চিলে কোঠার ঘর থেকে জুলিয়াকে নামতে দেখে ওর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। জুলিয়া ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে, সব খবর ভাল তো। আমার ধারণা বোধহয় না। যাই হোক, ওসব কথা ছাড়ো। আগামী পরশুদিন আমি উইলটা খুলব। স্ট্যানফোর্ড পরিবারের সদস্যদের সামনে পড়ব। এসবের পেছনে যে আছে সে পরশুর পর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। করে লাভ হবে না। এই দুটো দিন তোমায় একটু সাবধানে থাকতে হবে। ঠিক এই সময়ে ফোনটা বেজে ওঠে। হালো, স্টিভ সোলানে কথা বলছি। ডাঃ টিকনার বলছি, ফ্লোরিডা থেকে। ডাঃ টিকনারের সঙ্গে কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে স্টিভ ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। হে ভগবান, অবিশ্বাস্য কাণ্ড। জুলিয়া সপ্রশ্ন কৌতূহলী চোখে তাকায়, কি ব্যাপার? কি হয়েছে? উডরোও স্ট্যানফোর্ড? দীর্ঘদিনের মাদক অভ্যাসে নেশাগ্রস্ত ছিলো। তারপর জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, বলছি বসো।

তিরিশ মিনিট পর, নিজের গাড়ীতে স্ট্যানফোর্ডদের রোজ হিলের বাড়ীর দিকে যেতে যেতে স্টিভ ভাবছিলো, ছেঁড়া টুকরোগুলো সব ঠিক ঠাক জোড়া লেগেছে এতদিনে। লোকটা সত্যি অসাধারণ। চতুরের শিরোমণি। দুরন্ত পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। প্রায় সফলভাবে তা রূপায়ণও করে ফেলেছিল। প্রায় বলছি কেন? এখনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি। লোকটা তার পরিকল্পনা সফল ভাবেই রূপায়িত করতে পারবে। শুধু, শুধু জুলিয়াকে রাস্তা থেকে হটিয়ে দিতে পারলেই, এখনো, অনায়াসে কেল্লা ফতে করতে পারবে সে।

রোজ হিলে পৌঁছে দরজার সামনে পরিচারক ক্লার্ককে দেখতে পেলো স্টিভ। ক্লার্ক মাথা ঝুঁকিয়ে বিনীত ভঙ্গীতে বলল, আসুন স্যার। বিচারপতি টাইলার আপনার জন্য পড়বার ঘরে অপেক্ষা করছেন। ধন্যবাদ ক্লার্ক, স্টিভ সোজা পড়বার ঘরে এসে হাজির হলো। একমনে একটা দাবার বোর্ড সামনে পেতে মনসংযোগ করছিলেন। চাল ভাবছিলেন। স্টিভ ঘরে ঢুকতেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন, বলুন, কি বলবেন শ্রী সোলানে? দেখুন বিচারপতি স্ট্যানফোর্ড, আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি। আমরা জানতে পেরেছি, প্রমাণও পেয়েছি, দ্বিতীয় যে মেয়েটি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, নিজেকে জুলিয়া বলে পরিচয় দিয়েছিল, তিনিই সত্যিকারের আসল জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড, আপনার সৎবোন। আর প্রথম যিনি, যাকে আমরা সবাই আসল বলে ভেবেছিলাম তিনিই নকল। জাল ঠক প্রতারক। ওর মুখের দিকে বিস্ময় জর্জরিত চোখে তাকিয়ে টাইলার বলেন, তা কি করে সম্ভব? কিন্তু হয়েছে তাই, এবং এসব চক্রান্তের পেছনে কে রয়েছেন তাও আমরা জানতে পেরে গেছি। সন্দেহ কৌতূহল মেশানো চোখে স্টিভের দিকে তাকিয়ে টাইলার বলে, কে? কে সে? আপনি হয়ত শুনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন। আপনার ভাই, উডরোও স্ট্যানফোর্ড। কয়েক মিনিট পিন পতন স্তব্ধতা। চরম বিস্ময়ের গলায় টাইলার বলে, তার মানে? আপনি বলছেন, এতদিন এতসব যা কিছু রহস্যময় ঘটনাগুলো যা যা ঘটেছে, সব কিছুর পেছনে ছিল উডি? ঠিক তাই। মাথায় হাত দেবার মত করে টাইলার বলে, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

সোলানে মাথা নাড়ে, প্রথমে আমারও এরকম অবস্থাই হয়েছিল। আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু, উনি মাদক নেশায় অভ্যস্ত, আর কে না জানে মাদকের নেশা অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ। তার ওপর উডির কোন চাকরী বাকরিও বর্তমানে নেই। নিশ্চিত ভাবেই টাকা রোজগারের জন্য তিনি এরকম কিছু একটা করার চিন্তা করতে পারেনই। নিজের শেয়ার ছাড়াও অন্যের শেয়ারের অঙ্ক যদি দখলে নেওয়া যায়, এ চেষ্টা, বর্তমান যে আর্থিক অবস্থা, তাতে উনি ভাবতেই পারেন। উনিই নকল জুলিয়াকে সে জন্য ভাড়া করেছিলেন, কিন্তু আপনি ডি এন এ টেস্ট করানোর দাবী তোলায় উনি হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে কবর খুঁড়ে আপনার বাবার মৃত দেহটাকে উধাও করে দিলেন। যে মৃতদেহ সম্প্রতি চার্লস নদীর জলে পাওয়া গেছে, সে কথা তো আপনাকে ফোনেই জানিয়েছি। এমন কি শুনে । অবাক হয়ে যাবেন, জুলিয়া অর্থাৎ নকল জুলিয়াকে আসল জুলিয়া প্রমাণ করতে উনি ফ্রাঙ্ক টিমমনস নামে যে গোয়েন্দাকে লাগিয়েছিলেন, আপনারা যাকে ফ্রাঞ্চ টিমমনস বলে জেনেছেন তিনিও নকল, জাল। কানসাস সিটিতে আসল জুলিয়াকে খুন করতে এমনকি তিনি ভাড়াটে খুনীও পাঠিয়েছিলেন। স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জজ টাইলার হিমশীতল গলায় বললেন, এসব সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত? পুরোপুরি, এবং সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন? আপনার বাবা ইয়ট থেকে পড়ে গিয়ে মারা যাননি। তাকেও ভাড়াটে খুনী লাগিয়ে উডি খুন করিয়েছিল।

টাইলার মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সোলানের কথা। ঐ খুনটা সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্যই আজ রাতে ইটালি যাচ্ছি আমি। বৃহস্পতিবারের মধ্যে ফিরব। তারপরই আপনার বাবার উইলটা খোলা হবে আপনাদের সামনে। টাইলার শান্ত উদাসীন গলায় বলে, আর আসল মেয়েটি? মানে জুলিয়া, সে কোথায় আছে?…আপনি নিশ্চিত তো সে যেখানে আছে, সেটা ওর পক্ষে যথেষ্ট নিরাপদ? স্টিভ হাসে, ও নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না, ও যেখানে আছে কেউ খুঁজে পাবে না। ও আমার বাড়ীতে আছে।

.

৩৩.

ভগবান আমার সহায়। নিজের সেই ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অবিশ্বাস্য ভাবে ভাগ্য সহায়তা করল তাকে। গত রাতে স্টিভ সোলানে নিজের হাতে জুলিয়াকে তার হাতে তুলে দিয়ে গেছে। হ্যাল বেকার, একটা অকম্মা, অপদার্থের ঢেঁকি। নাহ, আর কোন সুযোগ নেওয়া যাবে না। এবার সে নিজেই জুলিয়ার ব্যবস্থা করবে। ঠিক এমন সময় ক্লার্ক ঘরে এলো। স্যার আপনার একটা ফোন এসেছে। টাইলার ফোন তোলে। অন্য প্রান্তে কিথ পার্সি। হ্যালো, কি বলো? টাইলার, আমি তোমায় মার্গো পসনারের ব্যাপারে জানানোর জন্য ফোন করলাম। মেয়েটা একেবারে উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। যে কারণে ওকে হাত পা বেঁধে নির্জন সেলে বন্ধ করে আটকে রাখতে হচ্ছে। খবরটা শুনে একটা স্বস্তির ঢেউ বয়ে যায় ওর শরীর জুড়ে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আহা। বেচারা মেয়েটার কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছে। যাইহোক তুমি চিন্তা করো না। মেয়েটার দিক থেকে তোমার পরিবারের বদনাম হবার আর কোন সম্ভবনা নেই। ধন্যবাদ পার্সি।

নিজের ঘরে এসে টাইলার লিকে ফোন করে। দীর্ঘ সময় কেটে যাবার পর, লি ফোন তোলে। হালো? টাইলার ভেসে আসা প্রচুর কথার আওয়াজ, নানা মানুষের গলা শুনতে পায়। লি বলে, কে বলছেন? আমি টাইলার লি।

ওহ, তুমি। তোমার ফ্ল্যাটে কি পার্টি চলছে? লি হাসে তুমি কি পাটিতে যোগ দিতে চাও? যদি পারতাম সত্যি, যাই হোক যা বলার জন্য তোমায় ফোন করেছি। জিনিষপত্র  গুছিয়ে ইয়টের সফর যাবার জন্য তৈরি হয়ে থাকো। যে কোন দিন আমরা রওনা হয়ে পড়ব। লি আবার হাসে, তুমি সেই সাদা বিশাল প্রমোদ তরণীতে, সেন্ট ট্রপেজ দ্বীপে বেড়াতে যাবার কথা বলছ তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি তৈরি হয়ে থাকব, অবশ্যই। লি কৌতুকের গলায় বলে, বিদ্রূপ মেশানোও থাকে যেন ভঙ্গীতে, লি আমি কিন্ত সিরিয়াস। হ্যাঁ, হা, নিশ্চয়ই। টাইলার এবার আমায় যেতে হবে, পার্টির অতিথিরা অপেক্ষা করছে। আর বোর করো না, কোন বিচারপতি ইয়টের মালিক হয় না, হতে পারে না। টাইলার শোনে লি এবার ফোন ছেড়ে দিতে যাচ্ছে। মরীয়া হয়ে বলে, এক মিনিট, এক মিনিট দাঁড়াও। লি, তুমি কি জানো, আমি কে? হা নিশ্চয়ই। তুমি… আমি টাইলার স্ট্যানফোর্ড। বিজনেস টাইফুন সদস্য প্রয়াত স্যারী স্ট্যানফোর্ডের বড় ছেলে। নিমেষে ফোনের অন্য প্রান্তে নীরবতা নেমে আসে, কয়েক মুহূর্ত সময় নেয় যেন লি খবরটাকে হজম করতে। হে ভগবান। তুমিই সেই স্ট্যানফোর্ড। আমি জানতাম না, ইয়ে, আমি দুঃখিত টাইলার। কাগজপত্রে দেখছিলাম বটে। মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। তুমিই যে সেই কল্পনাই করতে পারিনি আমি। কিছু মনে করো না প্লিজ। –ঠিক আছে। আমি এখন এস্টেট সম্পত্তির উইল অনুযায়ী উত্তরাধিকার দখল নেবার জন্য বস্টনে রয়েছি।

তুমি সত্যিই আমায় সেন্ট ট্রপেজ দ্বীপে ভ্রমণে নিয়ে যেতে চাও? লি আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে। হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে। এখন থেকে আমরা এক সাথে অনেক কিছু করব। অনেক কিছু করার আছে। একটু থেমে সে আবার যোগ করে, অবশ্য, যদি তুমি চাও। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, ওহ, ভাবতেই আমার শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছে। কাটা দিচ্ছে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব টাইলার। লি-এর গলায় আগ্রহ। উত্তেজনা হঠাৎ যেন চমক দিয়ে ওঠে। ফোন রাখতে রাখতে টাইলার মনে মনে হেসে ওঠে। লির ব্যবস্থা করা শেষ। ও এখন পোষা বিড়ালী। এবার, এবার তার ছোট্ট মিষ্টি সৎ বোন জুলিয়ার ব্যবস্থা করার পালা।

টাইলার টেলিফোন ডাইরেক্টরীটা বের করে। স্টিভ সোলানে, খুঁজতে খুঁজতে সঠিক নামটা পেয়েও যায়। নামের পাশেই লেখা ঠিকানা–২৮০, নিউবুরি স্ট্রীট।

গাড়ী চালিয়ে স্টিভ সোলানের বাড়ীর দিকে যেতে যেতে টাইলার মনে মনে ভাবছিল, সে যা করতে চলেছে, সে ব্যাপারে। সে নিজে কখনো সরাসরি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকেনি। খুন করেনি। কিন্তু এ মুহূর্তে এ ছাড়া কোন অন্য পছন্দের সুবিধা সুযোগ তার সামনে নেই। জুলিয়া, তার এবং লক্ষ্যপূরণের মাঝখানে শেষ প্রতিবন্ধক। ওকে সরিয়ে দিতে পারলেই ওর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সমস্যাও দূর হয়ে যাবে টাইলারের, চিরতরে।

স্টিভ সোলানের বাড়ীটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ফুটপাথে বেশ কয়েকটা গাড়ী। দাঁড় করানো আছে। কিন্তু পথচারী লোকজন বিশেষ নেই। ওকে স্টিভের বাড়ীতে ঢুকতে কেউ দেখল না। ডোর বেল বাজাতে জুলিয়া সাড়া দিলো বাড়ীর ভেতর থেকে, কে?– জজ স্ট্যানফোর্ড। জুলিয়া দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়, আসুন, ভেতরে আসুন। টাইলার ঘরের ভেতর ঢুকে আসে। চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলে, তুমি কি বাড়ীতে একা, কেউ নেই আর? একাই আছি। বলুন, আপনি কি কথা বলতে এসেছেন। টাইলার মাথা নাড়ে, বেশ, বলছি। জুলিয়া আমি বলতে এসেছি যে তুমি আমায় ভীষণ হতাশ করেছ। জুলিয়া হতবাক চোখে তাকায়, হতাশ করেছি? নিশ্চয়ই, তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি। যা তোমার নয়, যার দাবীদার তুমি কখনোই ছিলে না, কেন তার দাবী নিয়ে এসে হাজির হলে জুলিয়া? জুলিয়া, এতগুলো দীর্ঘবছর, প্রতিনিয়ত আমরা যখন আমাদের স্বর্গতঃ পিতার হাতে নির্যাতিত লাঞ্ছিত, নিগৃহীত হতাম তুমি তখন কোথায় ছিলে? চরম হতাশার ঐ সব দিনগুলো, মরমে মরে যাবার দিনগুলো, গুমরে গুমরে মরার দিনগুলো। প্রতিটি পলে পলে চরম অপমান নিগ্রহের নরক যন্ত্রণার দিনগুলো যখন আমাদের সঙ্গে তুমি ভাগ করে নাওনি, সম্পত্তির অংশও আমরা, হ্যাঁনী স্ট্যানফোর্ডের সম্পত্তির যথার্থ উত্তরাধিকারী ভাইবোনেরা কেন তোমার সঙ্গে আমাদের পাওনা, যথার্থ প্রাপ্য তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেবো? নিতে চাইব?

–জুলিয়া স্থির পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। যা শুনছে, নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবশেষে ধীর গলায় বলে, তাহলে আমায় এখন কি করতে চান? কি করতে চাই? টাইলার হাসে, খুব সহজ ব্যাপার। পকেট থেকে গুলি ভরা রিভলবারটা বের করে সে। আতঙ্কিত চোখে বন্দুকটার দিকে তাকায় জুলিয়া। টাইলার হাসে,–তুমি উধাও হয়ে যাবে। নিছক হারিয়ে যাবে। জুলিয়া আতঙ্কের চোখে তাকায়, মানে? আমি বুঝতে পারছি না আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন? চুপ, কোন কথা নয়। টাইলার ধমকের সুরে বলে, তুমি আমার পাকা ঘুটি প্রায় কেঁচিয়ে দিতে বসেছিলে। আমার সমস্ত পরিকল্পনা প্রায় ব্যর্থ করে দিতে বসেছিলে, আর আমার চাল নষ্ট করো না। চলো, আমরা এখন একটু বেড়াতে যাবো। জুলিয়া শক্ত কাঠ কাঠ গলায় বলে, যদি না যাই? যেতে তোমায় হবেই। তবে জীবন্ত অবস্থায় যাবে, না মৃত অবস্থায় যাবে সেটা তোমার পছন্দ। এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপরই টাইলার শুনতে পায়, বিকট প্রতিধ্বনি তুলে জোরালো শব্দ তুলে ছড়িয়ে পড়ছে কয়েকটা শব্দ, যেতে তোমায়…হবেই…তবে..জীবন্ত… ওরই বলা কথাগুলো। চার দেওয়ালে, বাড়ীটায় শোনা গেল প্রতিধ্বনি? খুবই সঙ্গীন। টাইলার স্ট্যানফোর্ড কি বলে গেলেন মনে রেখো। আমরা যেসব অভিযোগ তুলেছি ওনার বিরুদ্ধে, যদি সেসব প্রমাণ করতে না পারি, উনি মানহানির মামলায় ফেলবেন আমাদের। সুতরাং আমাদের যা কিছু করার খুবই তাড়াতাড়ি করতে হবে।

.

সে রাতে জুলিয়া নিজের বিছানায় শুয়ে স্টিভের কথাই ভাবছিল। টাইলার স্ট্যানফোর্ড একটা শয়তান। তার হাত থেকে স্টিভের ধ্বংস হওয়াকে কিভাবে আটকাবে সে। আহ, সব কিছুর জন্য দায়ী আমি, আমিই। আমি যদি না আসতাম, স্টিভ এই বিপদে, ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়তই না। তার পরই, ওর মনে একটা বিচিত্র অনুভূতি ভেসে ওঠে। কিন্তু যদি এখানে না আসতাম, স্টিভের সঙ্গে তো কোনদিন দেখাই হতো না।

পাশের ঘরে, নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্টিভও ভাবছিল জুলিয়ার কথা। জুলিয়া আর তার মাঝখানে মাত্র একটা পাতলা দেওয়াল। ব্যাপারটা তার মনে এক চাপা হতাশার সৃষ্টি করছিল। ঐ দেওয়ালটা শুধু তাদের মাঝে। তারপরই তার মনে হয়, এসব কি ভাবছে সে? পাতলা দেওয়াল? এক বিলিয়ন ডলারের পুরু দেওয়াল বলে কথা।

বাড়ী ফিরতে ফিরতে টাইলার যেন আনন্দে ভাসছিল, একটু আগে যা ঘটল সেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল। সে কিভাবে ওদের সব কজনকে বুদ্ধ বানালো সেকথা ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছিল। ওরা বামনের দল, লড়তে এসেছিল দৈত্যের সঙ্গে। ও জানলও না, ঐ একই চিন্তা ভাবনাটা ছিল তার বাবারও। হুবহু ঐ ভাবনাই। রোজ হিলে পৌঁছনোর পর ক্লার্ক তাকে অভিবাদন জানালো, আশা করি সন্ধ্যেটা ভাল কেটেছে স্যার? চমৎকার ক্লার্ক, চমৎকার! এত সুন্দর সন্ধ্যা বহুদিন কাটাইনি। আপনার জন্য কিছু কি আনব স্যার? এক পাত্র শ্যাম্পেন। সেটাই চমৎকার হবে। ঘরের দিকে যেতে যেতে উচ্ছ্বসিত হয়ে সে তার জয়ের উৎসব পালনের কথা ভাবছিল। আগামী কাল, আগামী কাল সে দুই বিলিয়ন ডলারের মালিক হবে, তারপর ক্রমে ক্রমে পুরো স্ট্যানফোর্ড এস্টেট হবে তার, একা তার দখল নেবেই সে। দু বিলিয়ন…দু বিলিয়ন… যেন কোন গোপন মন্ত্র, এভাবে বিড় বিড় করতে করতে সে নিজের ঘরে এসে পৌঁছায়। তখনি লিকে একটা ফোন করার ইচ্ছে তার মথায় আসে। এবার, এখন লি তাকে একেবারে চিনে নেয়। উষ্ণ সাদর গলায় বলে, বলল টাইলার, কেমন আছো তুমি? ভাল, খুব ভাল। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম। লির কথাটা টাইলারের মনে একটা খুশির ঢেউ তোলে। তাই বুঝি? শোনো তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বস্টনে চলে আসতে পারবে? হ্যাঁ অবশ্যই। কিন্তু কেন টাইলার? আগামীকাল, আমাদের বাবার উইল পড়া হবে, উত্তরাধিকার সূত্রে দু বিলিয়ন ডলার পাবো আমি। দু.দুর্দান্ত খবর টাইলার। আমি ভাবতে পারছি না। লি এর গলায় অভাবনীয় চমকের শ্বাসরুদ্ধতা। তারপর আমরা দুজনে কোন ইয়টটা কিনব, পছন্দ করতে যাবো। দারুণ, দারুণ ব্যাপার টাইলার। তুমি তাহলে আসছ তো? অবশ্যই, নিশ্চয়ই। ফোনটা রেখে দিয়েও আদর-প্রেম মাখা গলায় বারবার সে বিড়বিড় করে চলে, দু বিলিয়ন…দু বিলিয়ন..দু..।

.

৩৪.

বেনডাল আর উডি স্টিভ সোলানের অফিসে বসেছিল। কি ব্যাপার বলুন তো? আমাদের কেন ডেকে আনলেন? আর উইল খোলার, পড়বার তারিখ একদিন পিছিয়েই বা কেন দেওয়া হলো? উডি অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন করে। আমি আপনাদের সঙ্গে একজনের দেখা করাতে চাই। স্টিভ বলে। কে? অবাক গলায় বেনডাল প্রশ্ন করে। আপনাদের বোন। স্টিভের কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দুই-ভাই বোন প্রায় একই সঙ্গে আর্তচিৎকারের মত বলে, কি-ঈ-ঈ? এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বেড়াল বলে, আমরা কি ইতিমধ্যে তার সঙ্গে মিলিত হইনি? স্টিভ ইনটারকমের বোম টিপল। বেনডাল আর উডি দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকায় ধাঁধাগ্রস্তের মত। কয়েক মুহূর্ত পরই দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে জুলিয়া। স্টিভ দাঁড়ায়, আপনাদের সৎ বোন জুলিয়ার সঙ্গে পরিচিত হন। উডি আর বেনডাল প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কি বলছেন কি আপনি? উডির গলায় স্পষ্ট বিরক্তি ও উত্মা। দয়া করে আমায় বলতে দিন, পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে দিন। এরপর পনের মিনিট স্টিভ সোলানে কথা বলে। নিশূপ স্তব্ধ হয়ে ওরা দু ভাইবোন শুনে যায়। স্টিভ কথা শেষ করে, পেরী উইঙ্গার জানাচ্ছেন, আপনার বাবার সঙ্গে এই মেয়েটির ডি এন এ পুরোপুরি ম্যাচ করে গেছে। এখন নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, নিঃসন্দেহে ইনিই আসল অকৃত্রিম জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড। স্টিভের কথা বলা শেষ হলে উডি মাথায় হাত রাখে, টাইলার শেষ পর্যন্ত! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণকে অবিশ্বাস করব কি করে? স্টিভ বলে। উডি তবু অবিশ্বাসীর গলায় বলে, আশ্চর্য, অন্য মেয়েটির আঙুলের ছাপ প্রমাণ করেছিল, সেই জুলিয়া? আঙুলের ছাপের কার্ডটা পর্যন্ত এখনো আমার কাছে রয়েছে। কথাটা শোনা মাত্র স্টিভের বুকটা উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল। শব্দটা স্টিভ যেন নিজের কানেই শুনতে পেলো। ওটা আপনি রেখে দিয়েছেন? হ্যাঁ, কেন, কি ভেবে তা আমি নিজেও জানি না। আপনাকে তাহলে আমার একটা উপকার করতে হবে।

.

পরদিন, সকাল দশটা, রেনকুইস্ট রেনকুইস্ট অ্যান্ড ফিৎজেরাল্ড-এর অফিসের কনফারেন্স রুমে সবাই জড়ো হয়েছিল। টেবিলের একদম শেষ প্রান্তে সাইমন ফিৎজেরাল্ড। এছাড়া ঘরে হাজির আছেন টাইলার, উডরোও, বেনডাল, জুলিয়া এবং স্টিভ। এছাড়া আরো কয়েক জন অচেনা মুখকে এ ঘরে হাজির দেখা গেল। টাইলার অধৈর্য ভঙ্গীতে বলল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে একটু ঘুরে বসেছিল। মনে মনে বলেন, আমি শুধু দুবিলিয়ন ডলারেই মালিক হতে যাচ্ছি না। বেজন্মার বাচ্চারা, তোদের সবকটাকে আমি ধ্বংস করব। সবকিছু একা আমার হবে। সাইমন মাথা নেড়ে সায় দেয়, অবশ্যই। তার আগে এই দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি, উইলিয়াম পার্কার আর উনি প্যাট্রিক ইভান্স। এনারাই স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের কাগজপত্র দেখা শোনা করেন। আমি শুরুটা করছি তারপর এঁরা দায়িত্ব নেবেন। ফিৎজেরাল্ডের সামনেই একটা ষাঁড়ের রক্তের মত ঘন রক্তবর্ণ ফাইল টেবিলে রাখা, যার ওপরে সোনালী রঙ দিয়ে লেখা, হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের শেষ ইচ্ছাপত্র। আমি আপনাদের সবাইকে উইলের একটা করে কপি দিচ্ছি। এতে উইলের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় বিস্তারিত ভাবে পড়তে জানাতে হবে না। আপনারা নিজেরাই প্রয়োজন মত যা দেখবার দেখে নিতে পারবেন। আর মূল কথাটা তো আপনারা সবাই জানেনই। প্রয়াত হ্যারী স্ট্যানফোর্ড-এর পুরো সম্পত্তির সমান ভাগীদার আপনারা চার ভাই-বোন।

জুলিয়া স্টিভের দিকে তাকায়। স্টিভ জুলিয়ার মুখে অত্যাশ্চর্য আনন্দের ঝলক লক্ষ্য করে। স্টিভকে ব্যাপারটা ভীষণই আনন্দ দেয়, যদিও জানে এই ব্যাপারটা জুলিয়াকে তার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। টাইলার ভেবে চলেছে লি আজ সন্ধ্যোতে এসে পড়বে। আমি চাই বিমান বন্দরে ওকে আনতে যেতে। ফিৎজেরাল্ড বলে চলে, উইলে ছোটখাটো যেসব শর্ত আছে সে সব বলছি না। স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের মোট সম্পত্তির পরিমাণ মোটামুটিভাবে ছয় বিলিয়ন ডলার-এর মত। কথা শেষ করে তিনি পার্কারের দিকে তাকান। এবার, এখন থেকে শ্রীপার্কার শুরু করবেন। উইলিয়াম পার্কার এগিয়ে আসেন, ফিজেরাল্ডের পাশে এসে দাঁড়ান। নিজের হাতের ছোট্ট ব্রিফকেসটা খুলে এক তাড়া কাগজপত্র বের করে লম্বা টেবিলটায় রাখেন। তার পর একটু কেশে গলা সাফ করার ছলে কিছুটা সময় বের করে নেন নিজের বক্তব্যকে শুরু করার জন্য গুছিয়ে সাজিয়ে নিতে। তারপর বলতে শুরু করেন, হ্যাঁ সাইমন যা বললেন…স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছয় বিলিয়ন ডলার। তারপর দীর্ঘ সময় জুড়ে…এক গভীর নীরবতা, এবং তারপর স্ট্যানফোর্ড পরিবারের সদস্যদের মুখগুলোর দিকে এক ব্যঞ্জনাবাহী দৃষ্টি হেনে পার্কার বলেন, উলটো দিকে বাজারে স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের ধার দেনার অঙ্কের পরিমাণ এ মুহূর্তে পনেরো বিলিয়ন ডলারের বেশি। ঘরে যেন একটা বোমা পড়ল। কয়েক মুহূর্ত শব্দহীন, ওরা যেন সবকজন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। যা শুনল বলে। ওদের মনে হচ্ছে, ঠিক তাই শুনল তো? তারপরই, বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে ধমকে ওঠে, কি আজেবাজে বকছেন? টাইলার দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে ওঠে, এটা কি কোন বিশেষ ধরনের রসিকতা? পার্কার মাথা নাড়েন, নাহ, নাহ, একদম বাস্তব রূঢ় কিন্তু সত্যি। একটু থেমে হাতের কাগজের তাড়াগুলো তুলে ধরেন তিনি। এগুলো সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের রিপোর্ট। এগুলোতে চোখ বুলোলেই আপনারা সব বুঝতে পারবেন। আসলে গত কয়েক বছর ধরেই কেন জানি প্রয়াত হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে সুদের লভ্যাংশের হার কমে যাবে। তাই তিনি লগ্নী করতে লোকসান খেলেও, নিজের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। নিজস্ব পুঁজি শেষ হয়ে যাবার পরও তিনি ব্যাঙ্ক থেকে সমানে টাকা ধার নিয়ে গেছেন।

ঘরের সব কজন স্তব্ধ নির্বাক বাকরুদ্ধ হয়ে উইলিয়াম পার্কার-এর কথা শুনছিল। এবার পার্কার থামতেই কথা বলেন প্যাট্রিক ইভান্স। এখন যা পরিস্থিতি তাতে ব্যাঙ্কগুলো নিজেদের দেনা আদায় করতে স্ট্যানফোর্ড এস্টেটের সব কিছুর দখল নেবে, যে যে ব্যাঙ্ক থেকে উনি বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা ধার করেছিলেন, তাদের দেনাপত্রে এরকম শর্তই দেওয়া আছে। দেনা শোধ না করা গেলে ওরা দখল নেবে স্ট্যানফোর্ড এস্টেটের অফিসগুলো, কোম্পানীগুলো, ঘর-বাড়ী, গাড়ী, হেলিকপ্টার, ইয়ট, ভিলাগুলো সব–সব কিছু। সত্যি বলতে কি ঐ উইল অনুযায়ী যারা প্রত্যেকে এক বিলিয়ন ডলার পাবার কথা, আসলে তারা কেউ একটা আধলা ইটও পাচ্ছেন না। ঘরের মানুষগুলো, বসে থাকে নির্বাক, চোখে ভাষা নেই যেন বজ্রাহত।

দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেলে টাইলার জড়ানো মাতাল পায়ে উঠে দাঁড়ায়, সে আর মাল্টি বিলিয়নিয়ার নয়। নিছক এক বিচারপতি ছিল, আছে, থাকবে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিমান বন্দরে পৌঁছতে হবে, লিকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু, কিন্তু লি কি বুঝবে, আদৌ বুঝতে চাইবে? সারা শরীরে জ্বরের কাপুনি, টাইলার উঠে দাঁড়ায়। তেতো গলায় বলে, এরপর আর তো কিছু… বলার কিছু নেই…থাকতে পারে না। যাই হোক, আমায় যেতে হবে। এক অথর্ব বৃদ্ধের ভঙ্গীতে দরজার দিকে এগোতে থাকে। স্টিভ বাধা দেয়, আরো একটা কথা ছিলো বিচারক টাইলার। হ্যাঁ, বলুন। টাইলার প্রাণহীন ভঙ্গীতে ঘুরে দাঁড়ায়। স্টিভ দরজার পাশে তাকায়, ইঙ্গিত করে, দরজা খুলে যায়, ঘরে ঢোকে হ্যাল বেকার। ঘটনার মোড় ঘুরে যায় উডির কাছে পাওয়া আঙুলের ছাপের কার্ডটাতে। স্টিভের অনুমানই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। কার্ডটায় মার্গো পসনারের আঙুলের ছাপের সঙ্গে পাওয়া যায় নকল গোয়েন্দা ফ্রাঙ্ক টিমমনসের প্রচুর আঙুলের ছাপও। পুলিশ বিভাগের কমপিউটার থেকে, আঙুলের ছাপের রেকর্ড থেকে, হ্যাল বেকারের পরিচয় বেরুতে তিরিশ মিনিট সময় লাগেনি। তারপর ওয়ারেন্ট বের করা, আর শিকাগোর বাড়ী থেকে বেকারকে গ্রেপ্তার করা। পুলিশ দফতরে ধরে আনার পর বেকার প্রথমে সবকিছুই অস্বীকার করছিল। আপনি বিচারক টাইলার স্ট্যানফোর্ডের হয়ে কাজ করছিলেন। কই ঐ নামে কাউকে চিনি বলে মনে করতে পারছি না তো? গোয়েন্দা অফিসার হাসেন, বেশ, আপনার স্মৃতিকে একটু উসকে দিই তাহলে? এই টাইলার স্ট্যানফোর্ড আপনাকে প্যারোলে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার সেই উপকারের বিনিময়ে আপনি তার হয়ে কাজ করেছিলেন। নকল গোয়েন্দা ফ্রাঙ্ক টিমমনস সেজেছিলেন, মার্গো পসনারকে…। তারপর জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডকে খুন করতে গিয়েছিলেন আপনি? বেকার অবাক চোখে তাকায় যেন রাজ্যের বিস্ময় তার দুচোখে। এসব আপনি কি বলছেন বলুন তো? কি বলছি? গোয়েন্দা অফিসার হাসেন আবার। কত বছরের জেলবাস পছন্দ আপনার বেকার? দশ না কুড়ি? আমি কিন্তু কেসটা এমনভাবে সাজাতে পারি, সাজাচ্ছি যে আপনার কুড়ি বছর জেলবাস কেউ ঠেকাতে পারবে না। না আপনি এরকম করতে পারেন না। আমার স্ত্রী…ছোট্ট ছোট্ট দুটো বাচ্চা…।

গোয়েন্দাটি মাথা নাড়েন, কেসটা আমি খুব হালকা ভাবে সাজাতে পারি। যাতে আপনার বিশেষ কোন সাজাই হবে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে…। গোয়েন্দা অফিসার প্রখর চোখে তাকান। বেকার বলে, কি করতে…আমায় কি করতে হবে? কথা, আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। গোয়েন্দা অফিসারের কথায় নাচার উঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকায় হ্যাল বেকার।

এই মুহূর্তে রেনকুইস্ট, রেনকুইস্ট অ্যান্ড ফিৎজেরাল্ডের অফিসের কনফারেন্স ঘরে মুখোমুখি বেকার এবং টাইলার। হ্যালোে বিচারপতি? কেমন আছেন? উডি প্রায় লাফিয়ে ওঠে, এই তো ফ্রাঙ্ক টিমমনস। স্টিভ মাথা নাড়ে, না উডরাও ইনি হচ্ছেন দাগী অপরাধী শ্ৰীযুক্ত হ্যাল বেকার। তারপর স্টিভ ফিরে তাকায় টাইলারের দিকে। এই হচ্ছে সেই লোক যাকে আপনি ব্যবহার করেছিলেন। আমাদের অফিসের তালা ভেঙ্গে আপনার বাবার উইলের ফটোকপি চুরি করেছিল। আপনার বাবার মৃতদেহ কবর খুঁড়ে চুরি করেছে ইনিই। নকল ফ্রাঙ্ক টিমমনস সাজিয়ে ছিলেন একে, জুলিয়াকে খুন করতেও একেই পাঠিয়েছিলেন আপনি। টাইলার ছিটকে ওঠে। ক্ষিপ্ত ভঙ্গীতে বলে, আপনারা পাগল হয়েছেন? একটা দাগী আসামী প্রতারক, ওর কথা বিশ্বাস করছেন? আমার বিরুদ্ধে ওর কথার কেউ দাম দেবে, কান দেবে? কাউকে কিছু শুনতে, কান দিতে হবে না। কথা বলবে বাস্তব। সত্যি। স্টিভ প্রত্যয়ী গলায় বলে। মানে? টাইলার যেন সময় নেয়। স্টিভ বলে, এই নোকটাকে আপনি আগে কখনো দেখেছেন? নিশ্চয়ই। আমার কোর্টে ওর বিচার হয়েছিল। ওর নাম কি? এ প্রশ্নে টাইলার থমকে যায়। বিছিয়ে রাখা ফাঁদটার গন্ধ টের পায়। নিজেকে সতর্ক করে, নাম? কত অপরাধী আসে আমার কোর্টে। সবার নাম কি মনে রাখা সম্ভব? তাছাড়া ঐ লোকটার অনেক নকল ছদ্মনাম আছে। স্টিভ সহানুভূতির মত মাথা নাড়ে, বেশ বিচারপতি, আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনার কোর্টে বিচারের সময় ওর নাম ছিলো বেকার। হ্যাল বেকার। টাইলার কপালে হাত দেয়, চুলকায়, চিন্তা করার ভঙ্গী করে। তারপর স্টিভের দিকে তাকিয়ে কিছুটা যেন অনন্যোপায় হয়েই (কারণ, অনেক সাক্ষী রয়েছে ওর কোর্টে। বিচার চলার সময় বহুবার অপরাধীকে নাম ধরে ডেকেছে। নাম জানে না একেবারেই, বলা অস্বীকার করার উপায় নেই) বলে, ইয়ে…মানে, হ্যাঁ মনে পড়েছে।

স্টিভ হাসে, মনে পড়েছে? বেশ, কিন্তু বেকার যখন বস্টনে আপনাদের বাড়ীতে এলো আপনি ওকে ফ্রাঙ্ক টিমমনস বলে কিভাবে, কেন, সবার সঙ্গে পরিচয় করালেন? টাইলার থতমত খেয়ে যায়, উত্তর খুঁজে পায় না এ প্রশ্নের। ইয়ে…মানে…আমি…ইয়ে…। স্টিভ মাথা নাড়ে, বেশ থাক। আপনি একে মুক্তি দিয়েছিলেন প্রমাণাভাবে বিতর্কিত সিদ্ধান্তে। তারপর একে আপনি ব্যবহার করলেন। মার্গো পসনারকে আসল জুলিয়া বলে প্রমাণিত করার কাজে। না, সেই ব্যাপারে আমি কিছু জানতামই না। মেয়েটি এখানে এসে পৌঁছবার আগে, কখনো কোনদিন দেখিইনি তাকে। স্টিভ ঘুরে তাকায় লেফটেন্যান্ট কেনেডির দিকে, লেফটেন্যান্ট আপনি শুনলেন তো? কেনেডি সায় দেবার ভঙ্গীতে মাথা নাড়েন, হ্যাঁ শুনলাম। স্টিভ আবার ফিরে তাকায় টাইলারের দিকে হা, যা বলছিলাম। আপনি তাহলে মার্গো পসনারকে কোনদিন দেখেনইনি, সে বস্টনে এসে হাজির হওয়ার আগে। তাই তো বিচারপতি টাইলার? টাইলার মাথা হেলিয়ে সায় দেয়, হা। স্টিভ ঘরে হাজির সবার মুখের ওপর দিয়ে এক ঝলক নজর বুলোয়। তারপর টাইলারের দিকে স্থির দৃষ্টি রাখে, অথচ আমরা খতিয়ে দেখেছি, প্রমাণ পেয়েছি যে আপনার কোর্টেই বিচার হয়েছিল মার্গো পসনারের। আপনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ওকে প্যারোলে ছাড়িয়ে নিয়ে ছিলেন। অথচ আপনি বলছেন…। আরো একটা ব্যাপার, জেলা আদালতের অনুমতি নিয়ে শিকাগো পুলিশ একটা ওয়ারেন্ট বের করেছে, তল্লাসীর ওয়ারেন্ট। আপনার বাড়ী এবং ব্যাঙ্কের লকার, সব তল্লাসী করা হয়েছে। শিকাগোর একটা ব্যাঙ্কে, আপনার লকার থেকে পাওয়া গেছে। একটা কোর্ট পেপার। যাতে জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড আপনাকে তার শেয়ার, সম্পত্তির অংশ হস্তান্তর করেছেন। আশ্চর্যের, ঐ কাগজে জুলিয়া যে তারিখে সই করেছেন, দেখা যাচ্ছে, সেটা তার বস্টনে পৌঁছাবার, যে তারিখে তিনি বস্টনে পৌঁছেছিলেন, তার পাঁচ দিন আগের তারিখ দিয়ে ঐ হস্তান্তর পত্রটি সই করা হয়েছে। এর কি ব্যাখ্যা আপনি দেবেন বিচারপতি স্ট্যানফোর্ড?

টাইলার কিছু বলার চেষ্টা করে। তারপর যেন কথা খুঁজে না পেয়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে স্টিভের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর দুহাতে মাথা চেপে ধরে। ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের মত বসে পড়ে পাশের চেয়ারটায়। লেফটেন্যান্ট কেনেডি এগিয়ে আসেন, আইনের নামে আপনাকে গ্রেপ্তার করছি বিচারপতি টাইলার। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। হতাশায় চূর্ণ-বিচুর্ণ এক ভেঙে পড়া মানুষ। তারই মধ্যে টাইলারের ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি। কেউ তা খেয়াল করল না। কি করে এদের হারিয়ে দিতে হয় তা সে জানে। শেষ হাসিটা সেই হাসবে। আমি কি একবার রোজ হিলের বাড়ীতে ফিরে যেতে পারি? জিনিসপত্র নিতে হবে কিছু। কেনেডি সায় দেন, হা নিশ্চয়ই। তবে আপনার সঙ্গে আমার দুজন অফিসার যাবেন। টাইলার শান্ত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ায়, দরজার দিকে হেঁটে চলে। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে আচমকা ঘুরে দাঁড়ায়, ঘৃণাঝরা আগুন বর্ষিত চোখে কয়েক পলক তাকায় জুলিয়ার দিকে। সেই দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যায়, কেঁপে ওঠে জুলিয়া।

আধঘন্টা পর, দুজন পুলিশকর্মীকে নিয়ে রোজ হিলের বাড়ীতে ফিরে আসে। বাইরের একতলার বসবার ঘরে ঢুকে পুলিশকর্মী দুজনকে টাইলার বলে,–আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন। আমি দোতলার ঘর থেকে সব নিয়ে আসছি। পুলিশকর্মী দুজনের একজন বলে, তাড়াতাড়ি করবেন, দেরী না হয়। টাইলার রহস্যময় হাসে। দু মিনিটের বেশি লাগবে না। পুলিশ দুজন তাকিয়ে দেখে টাইলার তার ঘরে ঢুকে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে টাইলার আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। দেরাজ টেনে বার করে একটা গুলি ভরা রিভলবার। গুলির শব্দটা সারা বাড়ী কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনি তুলল, যার অনুরণন প্রতিধ্বনিত হয়েই চলল।

.

৩৫.

উডি আর বেনডাল ড্রয়িং রুমে বসেছিল। একদল সাদা পোশাকের লোক বাড়ীর সব জিনিসপত্র খুলে বার করে নিয়ে বিশাল বিশাল ট্রাকে তুলছে। বাড়ী থেকে এসব যাচ্ছে নিলামে বিক্রি হতে। একে একে সব, স্ট্যানফোর্ড নামের মোহর লাগা সব কিছুই দখল হয়ে যাবে। বিক্রি হয়ে যাবে। একটা যুগের অবসান ঘটল। বেনডাল আনমনা গলায় বলে। অথবা, হয়ত শুরু, অন্য কিছুর। উডি হাসিমুখে বলে। তারপর যোগ্য করে, আমার এই ভাগ্য বদলের কথা জেনে, শুনতে পেয়ে, তার ভাগের অঙ্কটা জেনে, পেগির মুখের অবস্থাটা কেমন হবে? তারপর সে বোনের হাতটা নিজের মুঠোয় তুলে নেয়, তোমার কি খবর? মার্কের ব্যাপারে বলছি। সে মাথা নাড়ে, আঘাতটা কাটিয়ে ফোন করতে হবে। সে উঠে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে চলে। মিমিকে সব কিছু জানাতে হবে এখানকার খবর, সব কথা।

ফোনের অন্য প্রান্তে মিমির সাড়া পাওয়া মাত্র, কিছুটা ক্ষমা চাইবার ভঙ্গীতে বলতে থাকে, মিমি, আমার মনে হয় আমাকে আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে। আমি যে রকম ভেবেছিলাম, আশা করেছিলাম, এখানকার ব্যাপারটা সেরকম ঘটল না। পাশার দান সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। মিমি অন্য প্রান্ত থেকে বলে, উডি, উডি, তুমি ঠিক আছে তো? ভালো আছে তো? না, মিমি, এখানে অনেক-অনেক কিছু ঘটে গেছে। আমি শেষ হয়ে গেছি। একটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠা নীরবতার পর মিমি বলে, উডি, তুমি কি হোব সাউন্ডে ফিরে আসছ? উডির নিরাশা জড়ানো হতাশ গলা ভেসে আসে, সত্যি বলতে কি, আমি নিজেই জানি না কি করব।– উডি? হ্যাঁ বলল। মিমির গলা নরম শোনায়, উডি, ফিরে এসো, প্লিজ, ফিরে এসো।

জুলিয়া আর স্টিভ বারান্দায় হাঁটছিলো, আমি দুঃখিত। ঘটনাটা এভাবে হঠাৎ ঘুরে যাবে, পট পরিবর্তন হবে কেউ ভাবেনি। তোমার টাকার কথাটা মানে না পাওয়ার…। জুলিয়া হাসে। ছাড়ো ওসব কথা। আমার একশো জন পাঁচতারা হোটেলের রাঁধুনীর প্রয়োজন নেই। আমি যা, আমার যতটুকু আছে, তাতেই আমার চলে যাবে বেশ। তোমার হতাশ লাগছে না, তোমার এই বস্টনে আসা? এই সফরটা পুরো অনর্থক, বেকার সময় নষ্ট হলো অকাজে। জুলিয়া বড় বড় চোখে তাকায়। স্টিভের চোখে চোখ রেখে বলে, সত্যিই কি অনর্থ অকাজে সময় নষ্ট হলো সবটা, স্টিভ? ওরা কেউ বুঝল না, জানলা না, কে প্রথম এগিয়ে ছিল। পা বাড়ালো। কিন্তু একসময় দেখা গেল জুলিয়া স্টিভের বুকে মাথা রেখেছে, স্টিভ দুহাতে ওকে জড়িয়ে আছে। জুলিয়া প্রথমবার, প্রথম দিন যেদিন তোমায় দেখেছিলাম, আমার মনে তীব্র বাসনা ইচ্ছে হয়েছিল। প্রথম যেদিন দেখেছিলে, তুমি আমায় এ শহর ছেড়ে চলে যেতে বলে ভীষণ চাপ দিয়েছিলে। ওরা দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। স্টিভ জুলিয়াকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে, বিশ্বাস করো, কখনো আমি চাইনি। একবারের জন্যও চাইনি আমার চোখের সামনে থেকে তুমি চলে যাও, দূরে সরে যাও। ঠিক তখনি জুলিয়ার মনে পড়ে স্যালির প্রশ্নটি–পুরুষ কি করে প্রস্তাব দেয় তুমি জানোনা না? বুঝতে পারো না?: সে ফিস ফিস করে বলে, এটা কি প্রস্তাব? স্টিভ ওকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে, বাজী রাখতে পারো। তুমি কি আমায় বিয়ে করবে?

উডি, বেনডাল, জুলিয়া আর স্টিভ বাইরের বসবার ঘরে বসেছিল। ওদের ঘিরে ব্যস্ততা। সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চেয়ার, টেবিল, আলমারি, আয়না, সোফা, বিছানা। সব বরাবরের জন্য এ বাড়ী থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই কাজেই ব্যস্ত পরিবহন সংস্থার কর্মীরা। স্টিভ উডির দিকে তাকায়, আপনি তাহলে কি করবেন ঠিক করলেন? উডি মাথা নাড়ে, আমি আবার হোব সাউন্ডে ফিরে যাচ্ছি। ওখানে হারিয়ে ফেলা দিনগুলো আবার খুঁজব। পোলো খেলোয়াড় হিসাবে নতুন করে ভবিষ্যত তৈরি করার চেষ্টা করব। বেনডাল জুলিয়ার দিকে তাকায়, তুমি তাহলে কানসাস সিটিতে ফিরে যাচ্ছো? যখন আমি এক বালিকা ছিলাম, জুলিয়া ভাবে, আমি স্বপ্ন দেখতাম, এক স্বপ্নের রাজকুমার আসবে, যে আমাকে কানসাস সিটির বাইরে বের করে নিয়ে যাবে। ও বেনডালের দিকে তাকিয়ে হাসে, না, আমি আর কানসাসে ফিরে যাচ্ছি না।

ওরা তাকিয়ে দেখে, পরিবহন সংস্থার কর্মীরা, হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের বিশাল একটা প্রতিকৃতি, তৈলচিত্র খুলে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কখনো ঐ ছবিটাকে পছন্দ করিনি। উডি বলে।