৩. রাত্রি

রাত্রি

১৫.

 গোটা ব্যাপারটাকে সে প্রায় শিল্পীতুল্য দক্ষতায়, ছবির মত পরিকল্পনা করে, একজন মাস্টার দাবা খেলুড়ের মত খেলেছিল। সম্ভবত, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দামী দাবাচাল, বিলিয়ন ডলারের অনেক অনেক বেশি সে দাবা চালটির দাম। এবং সে জিতেছে। জিতে গেছে। এক অপরাজেয় বোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। বাবা, একটা বিরাট বড় ব্যবসায়িক সাফল্যময় চুক্তি করার পরে তোমার মনেও কি এই রকম কোন বোধ হত? অনুভব? যদি তোমার জীবনের যে কোন বড় ব্যবসায়িক ডিল-এর সবচেয়ে বড়টির চেয়েও অনেক-অনেক বড় আমার এই ডিলটি। আমি শতাব্দীর সেরা ক্রাইমটি ঘটাতে চেয়েছিলাম এবং সাফল্যের সঙ্গে সেটা করে বেরিয়ে গেছি।

এটা শুরু হয়েছিল লিকে দিয়ে, অসাধারণ সুন্দরী লি। যাকে সে এই পার্থিব জগতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। লি-এর সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়েছিল বার্লিন, জার্মানীতে। পৃথিবীতে টাইলারের দেখা সবচেয়ে সুন্দরী শ্রেষ্ঠ নারী। যাকে প্রথম দর্শনে দেখা মাত্রই টাইলার মোহিত, মন্ত্রমুগ্ধ চুম্বকের মত আকর্ষিত হয়েছিল, তাদের আলাপ এর শুরুটা ছিল এরকম–আমরা কি এক সঙ্গে এক পাত্র পান করতে পারি। লি ওর দীঘল চোখ তুলে তাকিয়ে এক ঝলক ওকে লক্ষ্য করে। স্মিত হাসে, কেন নয়? প্রথম পাত্র পান করার পর টাইলার প্রস্তাব দেয়, পরের পাত্রটা আমার বাড়িতে গিয়ে পান করলে কেমন হয়? লি ওর দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কিন্তু দামী, মহার্ঘ। কথাটা শুনে টাইলার নিজের সীমিত আর্থিক ক্ষমতার কথা ভেবে একটু থমকে যায়। কতোখানি দামী? পাঁচশ ডলার এক রাতের জন্য। টাইলার প্রাথমিক ভাবে ইতস্তত করে, পাঁচশ ডলার? কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিকে দেখার পর তার মধ্যে জ্বলে ওঠা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ, দাউদাউ কামনার আগুনেরই জয় হয়। নিজের ইতস্ততঃ ভাব দ্রুত কাটিয়ে টাইলার বলে, চল যাওয়া যাক। এবং সে রাতটা টাইলারের জীবনের একটা স্মরণীয় রাত। সারাটা রাত লি টাইলারের বাড়িতে কাটিয়েছিল। পরদিন সকালে, বলা ভাল ভোর রাতে লি চলে যাবার পর থেকেই টাইলার বুঝেছিল লি-এর আকর্ষণে প্রায় মাকড়সার জালে জড়িয়ে পড়া এক পতঙ্গের মতই আটকে পড়েছে। পাগলের মত অন্ধভাবে লি-কে ভালবাসে সে।

অথচ নারীর শরীর, নারীর যৌন আকর্ষণের প্রতি কোন দিনই তার কোন আগ্রহ ছিলো । প্রতিরাতে, বিভিন্ন সমকামী আড্ডা থেকে সঙ্গী যোগাড় করে আনত সে। কিন্তু লিকে দেখার পরই সে বুঝেছিল যে, জীবন ও পুরনো অভ্যাস, নিজের বিগত যৌনজীবন সব কিছু বদলে যেতে চলেছে। লি, শুধু লিই তখন তার জীবন জুড়ে। এবং তাই থাকবে। পরদিন সন্ধ্যেতে লি-এর সঙ্গে যখন আবার তার দেখা হলো, আজ রাতে তুমি কী করছ লি? প্রশ্নটা শুনে লি ক্রু কুঁচকে তাকায়। আজ রাতে? আমার একজনের সঙ্গে ডেট আছে। টাইলার কথাটা শুনে কেঁপে ওঠে। ওর তলপেটে কে যেন বিরাশি সিক্কার ঘুষি মারল। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। চরম বিস্ময়ের গলায় সে বলে, কিন্তু…কিন্তু…লি। আমি…আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমায় অথবা দুজনে…। লি উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, টাইলার সোনা, বোকার মত কথা বলল না। আমি হচ্ছি অত্যন্ত দামী বস্তু। যে নিলামের সর্বোচ্চ দর হাঁকে আমি তারই হই। তোমায় আমি পছন্দ করি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাকে পোষবার মত ক্ষমতা তোমার নেই। মোঙ্কুম্বকের তীব্র আবেগ তাড়নায় টাইলার ডুকরে ওঠে। ওকথা, বলল না লি। তুমি যা চাও আমি তাই দিতে পারি। যা চাইবে। লি আবার উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, এবার তাতে বিদ্রূপ মেশানো, বেশ, আমি চাই সেন্ট ট্রপেজ দ্বীপে বেড়াতে যেতে, দুধসাদা এক বিলাসবহুল ইয়টে করে সমুদ্র যাত্রায় যেতে চাই। তুমি কি পারবে? নিয়ে চলো তাহলে আমায়। সেই শুরু টাকা। এক অবসেশান হয়ে উঠল টাইলারের কাছে টাকা। লিকে তার চাই-ই আর লিকে পেতে গেলে টাকা চাই। প্রচুর টাকা। কিন্তু কিভাবে? লিকে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে দেখার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না সে। লিকে তার চাই সম্পূর্ণ নিজের জন্য এককভাবে। আর তার জন্য তার টাকা চাই। যে ভাবেই হোক প্রচুর অর্থ রোজগার করতেই হবে তাকে।

বারো বছর বয়স থেকে সে জানত, বুঝে গিয়েছিল যে সে সমকামী। একদিন, তখন সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। ক্লাসেরই একটা ছেলের সঙ্গে যখন…। বাবার কাছে হাতে নাতে ধরা পড়ে যায়। আমি ভাবতে পারছি না, আমার ছেলে একজন… ঘৃণামেশা অন্ধ রাগের দাপট আছড়ে পড়েছিল টাইলারের শরীরে। কিন্তু কিছু তাকে থামাতে পারেনি। অভ্যাস আরো তীব্রতায়, এক নেশার মত পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে।

ওর বিয়েটা ছিল একটা জঘন্যতর কৌতুক, আমি তোমাকে একজনের সঙ্গে দেখা করাতে চাই। বাবা একদিন ওকে বললেন, সেটা ছিল বড়দিনের ছুটি। অন্য ভাইবোনেরা ফিরে গেছে ছুটি কাটিয়ে। সে তখন একা, বোমাটা বাবা তখনি ফাটালেন। তোমার বিয়ে দিতে চাই আমি। টাইলার আকাশ থেকে পড়েছিল। সে জানত তা সম্ভব নয়। নিজের অনিচ্ছা বাবাকে জানাতেই তিনি বললেন, শোনো, লোকে তোমার নামে নানা কথা বলছে। আমার সামাজিক সম্মানের পক্ষে তা মোটেই উপযুক্ত নয়। তখন তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে দৃঢ় প্রতিবাদের গলায় সে বলেছিল, লোকে কী বলে, বলেছে, তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাই না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হ্যারী স্ট্যানফোর্ড বলেন, বেশ তুমি তাহলে তোমার নিজের ইচ্ছেতেই চলল। আমি ভেবে ঠিক করে রেখেছিলাম তোমার জন্য একটা ধনী জীবন, প্রচুর পয়সা, আমার বয়স হয়ে আসছে। আর কতদিন.. গাজর আর প্রলোভনের সেই পুরনো গপপো। সুতরাং নাওমি শিওলারের সঙ্গে ওর বিয়েটা হয়েই গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নাওমির কাছে জীবনকে আরো উন্নততর বিলাসবহুল করে তোলার প্রয়োজনে স্ট্যানফোর্ড পরিবারের একজন হয়ে ওঠা একটা জ্বলন্ত স্বপ্ন। আসলে নাওমি যারী স্ট্যানফোর্ডের কয়েক রাতের অঙ্কশায়িনী হয়েছিল। দ্রুতই নাওমি একঘেঁয়ে হয়ে উঠল তার কাছে। এবং ওকে টাইলারের জন্য উপযুক্ত ঠিক করে ফেললেন তিনি।

খুবই সাধারণ একটা বিয়ে, সামান্য কয়েকজন নিমন্ত্রিত অতিথি। বিয়ের পরের রাত গুলোতেই ওর উদ্যোগহীনতায় হতবাক নাওমি মুগ্ধস্বরে বলে, কেমন ধরনের পুরুষ মানুষ তুমি? নিজের পুরুষত্বটা কী জন্য তোমার? টাইলার ঠান্ডা গলায় বলেছিল, আমাদের জীবনে, যৌনতার কোন জায়গা নেই। তুমি তোমার মত থাকো, আমি আমার মত। নাওমি প্রতিশোধটা নিয়েছিল অন্যভাবে। প্রচুর খরচ করতে শুরু করে সে। দামী বহুমূল্য জামাকাপড়, সুগন্ধী, গহনা কিনে ওকে ফতুর করে চলে। এ নিয়ে কোনরকম অভিযোগ করলে সে বলে, আমি তোমার স্ত্রী, তোমার অর্থ খরচ করার অধিকার আমার আছে। কিন্তু এত খরচ, বিলাসবহুল জীবনের সামর্থ আমার নেই। অত অর্থ আমি রোজগার করি না। তাহলে সেটাকে বাড়াও, সাফ জবাব দিলো নাওমি। এ ব্যাপারে বাবার কাছে অভিযোগ জানিয়ে, তারও সোজা স্পষ্ট কথা শুনেছিল, নারী সব সময়ই দামী বহুমূল্য এবং খরচ প্রবণ। পুরুষের তা সামলানোর ক্ষমতা রাখা উচিত। এভাবেই তাকে রিক্ত প্রায় ফতুর করে দেবার পর, বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল নাওমি।

.

একবার সে তখন একটা জরুরী মামলা নিয়ে ব্যস্ত, বাবা তাকে ডেকে পাঠান। আমার পক্ষে এখন কী করে যাওয়া সম্ভব? আমি একটা জরুরী বিচারের কাজে ব্যস্ত। ফোনে বাবার অন্য রকম গলার আওয়াজ ভেসে এসেছিল। তুমি আমায় হতাশ করছ টাইলার, দেখি আগামী কাল তাহলে ফিৎজেরান্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমার উইলে কিছু পরিবর্তন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। সেই গাজর প্রলোভনের ঝোলা। টাইলার, ভীষণ রকম অসহায় বোধ করেছিল। সারাজীবন ধরে বাবা ওর সঙ্গে এরকম ব্যবহারই করে যাচ্ছেন। সে অবশেষে ইতস্তত করে নিম রাজি হয়ে বলে, তুমি কি তাহলে তোমার ব্যক্তিগত বিমানটা পাঠাবে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে? না, বিচারক টাইলার, এই বিমান, আমার সমস্ত সম্পত্তি সবই একদিন তোমারই হবে। যদি তুমি তোমার দানগুলো ঠিকঠাক মত দিয়ে যেতে পারো। কিন্তু এখন তোমাকে আসতে হবে সাধারণ মানুষের মত, যাত্রী বিমানে।

সে এসে পৌঁছানোর পর বাবা তাকে যা বলেছিল তাতে সে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। আমার কর্মচারীরা প্রত্যেকটা চোর। লুটেপুটে শেষ করে দিচ্ছে আমায়। এই সামান্য কারণের জন্য এত হাজার মাইল দূর থেকে উড়িয়ে আনা হলো তাকে। বিশেষ করে সে যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারে ব্যস্ত। তখন এই অর্থহীন ব্যাপারটা করে বাবা কী প্রমাণ করতে চাইলেন? টাইলারের পেশাটার কোন গুরুত্বই নেই, অন্তত বাবার কাছে। তুমি এ ব্যাপারটা পুলিশকে জানাচ্ছ না কেন? অথবা কোন বেসরকারী গোয়েন্দা? কারণ তুমি তো আছো তাই। তুমি তো বিচারক। এ ঘটনাটার বিচার করো। এসে যখন পড়েছে, বাবার অভিযোগটাকে খতিয়ে দেখল টাইলার। যা বুঝল, কোথাও আপত্তিকর কিছু বা কোন গণ্ডগোলই নেই। বাবার নিছক কল্পনাই প্রায় পুরোটা। ব্যতিক্রম দিমিত্রি কামিনস্কি। রাশিয়ান এই পুরুষটিকে বাবা দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। বিচারকের আসনে বসে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মানুষের মন চরিত্র বুঝতে পারার একটা আশ্চর্য সহজাত বোধ বা ক্ষমতা টাইলারের জন্মে গিয়েছিল। যে বোধ বা ক্ষমতার সাহায্যেই, দিমিত্রিকে নিয়ে কোথায় যেন একটা অবিশ্বাস বা সন্দেহের খটকা তার মনে টিক টিক করে চলল। বিনা কারণেই হেনরি স্ট্যানফোর্ডের আগের দেহরক্ষী চাকরি ছেড়ে দেয় এবং সেই কামিনস্কিকে সুপারশি করে যায়। একদিন নিজের খটকা নিয়েই সে দিমিত্রির মুখোমুখি হয়। প্রায় কুড়ি মিনিট দুজনের নানা বিষয়ে কথা হয়। রাশিয়া ছেড়ে আমেরিকায় কেন এলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গী করে সে বলে, আরো ভাল সুযোগের জন্য? ভাল সুযোগ? কিসের? ঐ সাক্ষাতকারের পর, নিজের সন্দেহ আরো দৃঢ় তো হয়ই, দিমিত্রি যে কিছু গোপন করছে সে ব্যাপারেও টাইলার নিঃসন্দেহ হয়।

সে ফ্রেড মাস্টারসন নামে এফ বি আই দফতরের এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফ্রেড আমি তোমার কাছে একটা খোঁজ চাই।কী ব্যাপারে? দিমিত্রি কামিনস্কি নামের একজন রুশীর। মাস দুয়েক আগে সে আমেরিকায় এসেছে। মাস্টারসন আশ্বস্ত করে, ঠিক আছে টাইলার। একজন আছে রাশিয়ান এমবাসিতে আমার পরিচিত। তার মাধ্যমে সি আই এ থেকে ব্যাপারটা খোঁজ করে দেখছি। ধন্যবাদ বন্ধু। পরের দিন রাতে মাস্টারসনের ফোন এলো। ওহে বন্ধু তুমি তো বড় মাপের বিরাট মাছ শিকার ধরেছ।– টাইলার আগ্রহের গলায় বলে, কেন? কী ব্যাপার? আমায় সব কিছু বিস্তারিত খুলে বলল। বলছি দোস্ত, বলছি। দিমিত্রি কামিনস্কি পোলগোপুরু নেনস্কায়া-র একজন পেশাদার খুনে, হিটম্যান। ঐ বদখত রুশী শব্দটা, ওটার মানেটা কি? বলছি, আটটা শক্তিশালী অপরাধ চক্র এখন মস্কোতে শাসন কায়েম করেছে। তোমার ঐ কামিনস্কি দ্বিতীয় দলের হয়ে কাজ করে। তিনমাস আগে ওকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়। একজন শীর্ষ স্থানীয় চেচেন গোষ্ঠীর নেতাকে খুন করার। কিন্তু দিমিত্রি দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আরো বেশি টাকার বিনিময়ে সে খুন না করে শিকারকে ছেড়ে দেয়। ঘটনাটা জানতে পারার পর দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে পোলগোপুরু নেনস্কায়া-র খতম তালিকায় দিমিত্রির নাম ওঠে। দলের সদস্যরা হন্যে হয়ে ওকে পৃথিবী জুড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটা খুনের অপরাধী হিসেবে রাশিয়ান পুলিশও ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ও কোথায় যদি তোমার জানা থাকে তবে ওর পুরনো দল বা পুলিশ যে কোন এক পক্ষকে মোটা দামে সে খবর বেচতে পারো তুমি অনায়াসে।

সেরকম কোন ইচ্ছেই তার নেই। মাফিয়া চক্রের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ একজন বিচারক হিসেবে পেশার পক্ষে বিপজনক। আর পুলিশ? তার মানেই তো সাক্ষ্য দেওয়া, আদালত হাজিরা নিয়মিত। না নষ্ট করার মত অত সময় তার নেই। তাছাড়া…

দিমিত্রিকে তার ঘরেই পেয়ে গেল সে। একটা যৌন পত্রিকায় মুখ ডুবিয়েছিল। তুমি, আজ চলে যাবে এ বাড়ী ছেড়ে। কোন ভনিতা না করে টাইলার সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে। অবাক চোখ তুলে তাকিয়ে দিমিত্রি প্রশ্ন করে, কি ব্যাপারটা কি? টাইলার আরো খোলসা হয়। সোজা, তীব্র চোখে তাকায়, আমি তোমাকে দুটো পছন্দ দিচ্ছি। হয় আজ বিকেলের মধ্যে এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাও, নাহলে কাকে খবর দিলে তুমি পছন্দ করবে? তোমার পুরনো দল নাকি রাশিয়ার পুলিশ? নিমেষে দিমিত্রির মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। –ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি চলে যাবো। দিমিত্রি ঘর থেকে বের হয়ে বাবার ঘরে আসে। মনটা খুশি, ফুরফুরে মেজাজ, বাবার জন্য একটা বড় কাজ করেছে। বড়। বিপদ থেকে তাকে বাঁচিয়েছে। বাবা, আমি তোমার সমস্ত কর্মচারীদের পরীক্ষা করেছি। আমি দেখলাম…–তাই নাকি? আমি প্রভাবিত। তা কোন শিশুকে খুঁজে পেলে? যাকে নিয়ে তুমি বিছানায় যেতে পারো? আচমকা আক্রমণে (এবং বিনা কারণে) থতমত খেয়ে যায় টাইলার। ওর মুখ অপমানে লাল হয়ে যায়। বাবা… কোন রকমে ধরা গলায় বলে। এধরনের বদমেজাজ, হঠাৎ রাগ, জন্ম থেকেই দেখছে, তাই অবাক হয় না। তুমি একটি অপদার্থ। চিরকালই তুমি একটি অপদার্থ। যাও শিকাগোতে ফিরে যাও এখনি। তোমার নর্দমার পাকের মত দুর্গন্ধী বন্ধু-বান্ধবদের খোঁয়াড়ে ফিরে যাও। আমার ঔরসে যে কী করে এরকম নিষ্কর্মার জন্ম হয়। হতে পারে, তা এক রহস্য আমার কাছে। টাইলার দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের রাগকে দমন করতে চেষ্টা করে। তারপর নিজেকে সংযত করে নিয়ে শীতল কাটা কাটা গলায় বলে, বেশ, আমি চলেই যাচ্ছি। সে যখন ঘুরে চলে যাচ্ছে। বাবার ধারালো গলা শুনতে পায়, আমার কর্মচারীদের সম্পর্কে তুমি যেসব তথ্য আবিষ্কার করেছ তার মধ্যে কি এমন কিছু আছে যা আমার শোনা উচিত? জানা প্রয়োজন? এক তীব্রতর বিবমিষা ওকে তাড়িত করে। তিক্ত গলায় ও বলে, না তেমন কিছুই নয়।

ও যখন ঘরে ঢোকে কামিনস্কির জিনিসপত্র গোছানো শেষ। আমি চলে যাচ্ছি, ধীর গলায় বলে সে। না, যেতে হচ্ছে না তোমায়। আমি মত বদল করেছি। কি? হতভম্ব ধাঁধাগ্রস্ত চোখে তাকায় কামিনস্কি। তুমি কোথাও যাচ্ছে না। আমি চাই তুমি আমার বাবার দেহরক্ষী হিসেবেই বহাল থাকে। তাহলে…ঐ ব্যাপারগুলো…যেগুলো তুমি জানো আমার সম্পর্কে? যদি তুমি আমার কথা মত কাজ করতে রাজী থাকো। কামিনস্কি স্থির চোখে কয়েক পলক ওকে লক্ষ্য করে, আমাকে কি করতে হবে? আমি চাই আমার চোখ এবং কান এখানে থাকুক। কেউ একজন সারাক্ষণ আমার বাবাকে নজরে রাখবে, আমার হয়ে তোমাকে সেই কাজ করতে হবে। কী ঘটছে না ঘটছে তার বিস্তারিত বর্ণনা তুমি আমাকে জানাবে। সহসা এক আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কামিনস্কির দুচোখ, যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেল। বেশ, আমি থাকছি। ওটাই ছিল তার প্রথম দান। এক গভীর খননের প্রথম ধাপ।

ওটা ছিলো দুবছর আগের ঘটনা। গত দুবছর ধরে দিমিত্রি তাকে নানা খবর দিয়ে গেছে। যার বেশির ভাগ তার বাবার নিত্যনতুন নারীসঙ্গ বিষয়ে। দিনের পর দিন এসব খবর পেতে পেতে টাইলার বিরক্তি বোধ শুরু করেছিল। কবে আসবে সময়? দিমিত্রিকে কাজে লাগিয়ে কি তবে সে ভুল করল? অবশেষে, তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। সৌভাগ্য-সূচক ফোনটা এলো একদিন অবশেষে। সারদানিয়ার ঘটনার খবর পেলো সে। তার আগে দিমিত্রি অবশ্য তাকে সবই জানিয়ে ছিল। জানাচ্ছিলো। আপনার বাবার ইয়টে সমুদ্র যাত্রায় আমি সঙ্গী হয়েছি। এবং তারপর, উনি এই মাত্র ওনার নিজস্ব অ্যাটনীকে ফোন করলেন। সোমবার বস্টনে দেখা করতে বলেছেন তাকে। উইলে পরিবর্তন করবেন কিছু একটা। উইল পরিবর্তন? এত বছর ধরে অপেক্ষায় জল ঢেলে দিতে চলেছে কি বাবা? এত বছর ধরে বাবার লাঞ্ছনা অত্যাচার নীরব প্রতিবাদহীনভাবে সহ্য করার তাহলে তো কোন দামই পাবে না সে। ঐ একটি আশাতেই তো দিনের পর দিন মুখ বুজে সব সহ্য করেছে। নাহ, বাবাকে থামতে হবে। থামাতেই হবে। দিমিত্রি, তুমি শনিবার অবশ্যই আমাকে ফোন করবে। অবশ্যই। ফোন ছেড়ে দিয়ে টাইলার গভীর চিন্তায় ডুবে যায় ভবিষ্যত পরিকল্পনায়।

এটাই বোডের চালটা দেবার যথার্থ, উপযুক্ত সময় এসেছে।

.

১৬.

বিচারক টাইলারের ঘরে একটা মামলা এসেছিল যেটা একটু অন্য ধরনের। হ্যাল বেকার মামলা। বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে বেকার কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, মহামান্য বিচারপতি মহোদয়, আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি যা করেছি আমার পরিবারের জন্য করেছি। আমার অল্প বয়সী স্ত্রী, চারটি ছোট্ট বাচ্চা ছেলেমেয়ে। মহামান্য বিচারপতি, আমি যা করেছি ওদের জন্য করেছি। এই বস্তাপচা আবেগের প্যানপ্যানানি বিচারকের মন ভেজাবে, শাস্তি কমবে? বিরক্ত মনে ভাবছিলো নিজের বিচারকের আসনে বসে টাইলার। ঠিক তখনি বেকার বলে, আমার অন্যায় আমি স্বীকার করছি হুজুর। কিন্তু নিজের স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আমি যে অপরাধ করেছি, আপনি যদি আমার ভুল শোধরানোর সুযোগ দেন, তাহলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আপনি যা করতে বলবেন তাই করব মাননীয় বিচারপতি। শেষের কথাগুলো টাইলারের কান পার হয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করে। আপনি যা করতে বলবেন আমি তাই করব। প্রায় তাৎক্ষণিক ভাবেই ওর মনে একটা বোধ জন্ম নেয়। সেটা প্রথমবার দিমিত্রি কামিনস্কিকে দেখার পরেও তার হয়েছিল। এই মানুষটি কোন একদিন হয়ত তার ভীষণ রকম কাজেদরকারে লাগবে।

–সবাই, আদালতে যে কজন উপস্থিত ছিলেন নিশ্চিত ছিলো যে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছরের জেল হবে হ্যাল বেকারের। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিচারক টাইলার তার রায়ে বললেন–অপরাধী শ্রী বেকারকে, যদিও এটা তার দ্বিতীয়বার ধরা পড়ার ঘটনা এবং অপরাধ যথেষ্টই গুরুতর, তবু অপরাধী বেকারের নিজেকে শুধরানোর তীব্র আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিয়ে, আমি ওকে পাঁচ বছরের প্রবেশন দিলাম। এই পাঁচ বছর ওকে মোট একশো ঘণ্টা নানারকম জনসেবামূলক কাজে অংশ নিতে সময় দিতে হবে। এবং এই পাঁচ বছরে সে যদি কোনরকম অপরাধমূলক কাজ করে তাহলে সে আদালতের থেকে দ্বিগুণ কঠোর সাজা পাবে। প্রবেশনের শর্তাবলী আলোচনার জন্য আসামীকে আমার ব্যক্তিগত ঘরে আসতে বলা হচ্ছে।

এবং সেই ব্যক্তিগত ঘরের আলোচনায় বিচারক টাইলার অপরাধী বেকারকে সোজা সাপটা স্পষ্টই বলে দেন যে, বেশ কয়েক বছর নিশ্চিত জেলের হাত থেকে তিনি যে ওকে বাঁচিয়ে দিলেন তার কৃতজ্ঞতাবশত প্রতিদান সে কিভাবে দিতে পারে। যদি কখনন তিনি সেরকম কোন প্রতিদানের প্রয়োজন বা আশা বেকারের থেকে করেন? কি করতে হবে আপনি শুধু সেটুকু বলবেন, এবং ধরে নেবেন সে কাজ হয়ে গেছে। ঠিক আছে, সে রকম কোন প্রয়োজনে আমি নিশ্চয়ই তোমাকে বলব। ততদিন পর্যন্ত চিরজীবন আজ এ ঘরে যে কথাবার্তা হলো, তা তুমি গোপন রাখবে। আমি আমার সন্তানদের নামে প্রতিজ্ঞা করছি।

এই ঘটনাটার দিন কয়েক পরই দিমিত্রির ফোনটা এসেছিল। আপনার বাবা অ্যাটর্নীকে ফোন করলেন। সোমবার বস্টনে…। টাইলার বুঝেছিল। এই মুহূর্তে প্রথম প্রয়োজন বাবার উইলটাতে চোখ বোলানো। এবং হ্যাল বেকারকে তলব করার যথার্থ সময় এসেছে।…অ্যাটর্নী ফার্মের নাম রেনকুইস্ট। রেনকুইস্ট এবং ফিৎজেরাল্ডরা উইলটার এবং নতুন যে উইলটা হবে, দুটোরই ফটোকপি চাই আমার। কোন অসুবিধা নেই বিচারপতি মহাশয়, আমি ব্যবস্থা করছি।

বারো ঘন্টা পর। দুটো উইলের কপিই তার হাতে পৌঁছে গেল। প্রথম উইলে দেখা গেল হ্যারী স্ট্যানফোর্ড সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে গেছেন তার তিন ছেলেমেয়েকে। এবং সোমবার বাবা যে পরিবর্তিত উইল করতে চলেছেন, সেটার খসড়া তিনি আগেই ছকে রেখে গেছেন। সেটা পড়ে রাগের আগুন জ্বলে উঠল টাইলারের সারা শরীরে। বেজন্মা কয়েকশো বিলিয়ন ডলারের পরম সৌভাগ্য ওদের হাত থেকে কেড়ে নেবার উদ্যোগ করেছেন তিনি। অথচ যা ওদের, ওদেরই। শুধুই ওদের প্রাপ্য, তিক্ত কষাটে স্বাদে মুখটা ভরে ওঠে। বেজন্মা ভীমরতি ধরা বুড়োটাকে থামানোর একটাই উপায় আছে। টাইলার চরম সিদ্ধান্তটা তাৎক্ষণিক ভাবেই নিয়ে ফেলে। অপেক্ষা করতে থাকে দিমিত্রির পরের টেলিফোনের এবং শনিবার সেটা আসামাত্র সে চরম নির্দেশটা দিয়ে দেয়। আজ রাতে ওকে খুন করবে, তুমি। দীর্ঘ নীরবতার পর দিমিত্রি কথা বলে, যদি, আমি ধরা পড়ে যাই?..গলায় সামান্য অনিশ্চয়তার কাঁপুনি। ধরা পড়বে না। তোমরা তো এখন সমুদ্রে। আর সমুদ্রের জলে তো কত কিছুই ঘটে। ঘটতে পারে। তাই না? আবার এক দীর্ঘ নীরবতা এবং ঠিক আছে। কিন্তু কাজটা হয়ে যাবার পর? অস্ট্রেলিয়ার বিমান টিকিট আর প্রাপ্য। টাকা দুটোই তোমার হাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে।

তারপর, সেই সুসংবাদবাহী ফোনটি। রাতের তখন ভোরে পা রাখা। কাজটা সেরে ফেলেছি। খুব সহজে হয়ে গেল দিমিত্রির গলায় খুশির ছোঁয়া। না, না, অত সংক্ষেপে নয়। আমায় সব কিছু নিখুঁত ভাবে বিস্তারিত জানাও। কিছু বাদ দিও না। আজ এই সুন্দর খবরটা শোনবার জন্য সে কত বছর জীবনের দীর্ঘসময় অপেক্ষায় রয়েছে। দিমিত্রির বলে চলা বর্ণনা, কথাগুলো তার চোখের সামনে যেন জীবন্ত দৃশ্যায়নে ফুটে ওঠে। ঘন রাত, । আমরা প্রবল ঝড়ের মধ্যে দিয়ে করসিকার দিকে এগোচ্ছিলাম।

ঢেউয়ের দোলায় প্রচণ্ড জল স্রোতে ইয়টটা যেন কাগজের নৌকোর মত উথাল পাতাল করছিলো। স্ট্যানফোর্ড একটা ব্যথায় মালিশ করে দেবার জন্য দিমিত্রিকে ডেকেছেন। স্ট্যানফোর্ডের কেবিনের দিকে হেঁটে যেতে যেতে নৌকোর প্রবল দুলুনিতে টাল সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দিমিত্রি কেবিনে ঢুকে দেখল হ্যারী স্ট্যানফোর্ড মালিশের টেবিলে উপুড় হয়ে শুয়ে তারই প্রতীক্ষা করছেন। ব্যথায় কাতর মুখে তিনি বলেন, এটা কোমরের নিচের দিকে। চিন্তা করবেন না আমি দেখছি। দিমিত্রির সক্ষম নিপুণ আঙুল দ্রুত কাজে নেমে যায়। আরামে চোখ বুজে আসে স্ট্যানফোর্ডের। প্রায় ঘন্টা খানেক মালিশ নেবার পর, স্ট্যানফোর্ড প্রায় অলসতা জড়ানো ঘুমের ঘোরে, দিমিত্রি বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। টাব ভরে দেয় ঠান্ডা গরম জলের নিখুঁত মিশ্রণে। তারপর ঘরে ফিরে এসে বলে, আপনার স্নানের জল তৈরি। স্ট্যানফোর্ড উঠে দাঁড়ান। দিমিত্রির কাঁধে ভর রেখে তিনি বাথরুমে এসে দাঁড়ান। দিমিত্রি ওঁর জলের ভেতর ক্রমশ ডুবে যেতে থাকা শরীরটাকে লক্ষ্য করতে থাকে। স্ট্যানফোর্ড তাকালেন, ঠিক এই সময়েই, দিমিত্রির শীতল চোখের সঙ্গে তার চোখ মেলে। তাৎক্ষণিকতায়, সহজাত প্রবৃত্তির বোধ ওঁকে বলে দেয় কী ঘটতে চলেছে। দিমিত্রির চোখে খুনীর শীতল ছায়া নড়তে দেখেন তিনি। না, না, কাতর মিনতি করে, দ্রুত বাথটব থেকে উঠে পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দৈত্যকায় প্রবল শক্তিশালী দিমিত্রির সঙ্গে তার শক্তির কোন প্রতিরোধই দেওয়া সম্ভব ছিল না।

বাথটবের জলে বলিষ্ঠ শক্ত হাতে সে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মাথাটাকে চেপে ধরে। যতক্ষণ পর্যন্ত না, ফুসফুস ভরে ওঠে হাওয়ার বদলে সমুদ্রের লবণাক্ত জলে। প্রবল ভাবে, হাত পা ছুঁড়ে বাধা দেবার আপ্রাণ প্রতিরোধে মৃত্যুর কবল থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টাটা এক সময় নিথর হয়ে পড়ে। সব সঞ্চালন চেষ্টা, প্রাণের স্পন্দন মুছে যাবার পর দিমিত্রি, হাত গুটিয়ে নেয়। ভেতরের ঘরে ফিরে আসে। দেরাজ খুলে কিছু কাগজপত্র বের করে এবং সেগুলো হাহাকার তোলা সশব্দ ঝড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। তারপর স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহটাকে বাথরোবে জড়িয়ে নেয়। তারপর তাঁকে কাঁধে তুলে ইয়টের বারান্দাতে নিয়ে আসে। চোখের পলকে রেলিং টপকে শরীরটাকে জলের গভীর অতলতায় ছুঁড়ে দেয়। ডুবন্ত দেহটার দিকে তাকিয়ে সে একটা নিঃশ্বাস টানে।

দিমিত্রির মুখে খুনের বর্ণনা শুনতে শুনতে, টাইলার যেন তীব্র যৌন আনন্দের মত সুখ উপভোগ করে। বাবার ফুসফুস ভরে উঠছে সমুদ্র জলে। নিশ্বাসের জন্যে আপ্রাণ ছটফটানি, আতঙ্ক জমে ওঠা, তারপর এক চিরনৈশব্দ। সব কিছু নিখুঁত অনুভবে ধরা দেয় টাইলারের মনোযাক সব কিছু চুকে গেছে, মিটে গেছে, শেষ হয়ে গেছে। তারপরই নিজেকে সংশোধন করে নেয় সে। না, না খেলা তো সবে শুরু হলো, শুরু।

এবার, সময় এসেছে, রানীর চাল এগিয়ে দেবার, কিস্তিমাতের দিকে।

.

 ১৭.

বেনডাল এবং উডরোও ওরই সমান মাপে সম্পত্তির ভাগীদার হবে। ব্যাপারটা মন থেকে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না টাইলার। একটা তীব্র বিরাগ তৈরি হচ্ছিল ওর মনে। টাইলারই এত কাণ্ড করল আর দুধের সরটুকু খাবে ওরাও সমান পরিমাণে? তা কেন হবে? টাইলার যদি দাবার চাল খেলে না চলত, ওরা তো স্ট্যানফোর্ড সম্পত্তির কানাকড়িও পেতো না। সুতরাং…না, যা ঘটছে মোটেই যথার্থ, উচিত কাজ হচ্ছে না। ওর মনে পড়ে, মায়ের একটা শেয়ার ওর দখলে আছে। এও মনে পড়ে মা সেই শেয়ারটা ওকে দিয়ে দিয়েছে জেনে বাবার ব্যঙ্গভরা বক্রোক্তি। ঐ শেয়ারটা দিয়ে হতচ্ছাড়াটা কি করবেটা কি? কোম্পানির দখল নেবে? এক সাথে, উডি আর বেনডালের দখলে থাকছে বাবার স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের দুই তৃতীয়াংশ শেয়ার। নিজের একভাগ শেয়ার নিয়ে কোম্পানি সমূহের কর্তৃত্বের দখল সে কিভাবে নিতে পারে–পারবে? মাত্র একটি অতিরিক্ত শেয়ার তার দখলে থাকছে যেক্ষেত্রে। এবং তখনি প্রায় আচমকা ওর মনে উত্তরটা ভেসে উঠল। চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্র নিজের উদ্ভাবনী শক্তিতে সে নিজেই মোহিত হতবাক হয়ে পড়ল।

এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি আপনারা তিন ভাই বোন ছাড়াও আপনার বাবার সম্পত্তির আরো একজন উত্তরাধিকারী রয়েছে…একজন গভর্নের্স যিনি এবাড়ীতে বাস করতেন…তার সন্তান…ভবিষ্যতে তিনি যদি কখনো এসে হাজির হন…সমান সম্পত্তির অধিকারী হিসেবে আইন তাকে মেনে নেবে…

যদি জুলিয়া দেখা দেয় তাহলে আমরা চারজন, প্রত্যেকের ভাগে তেত্রিশ শতাংশের বদলে পঁচিশ শতাংশ শেয়ার থাকবে। এবং যদি জুলিয়ার শেয়ারের দখল তার হাতে চলে আসে? একান্ন শতাংশ শেয়ার। যা অনায়াসেই স্ট্যানফোর্ড এন্টারপ্রাইজের দখল তার হাতে। তুলে দেবে। বাবার চেয়ারে বসতে আর কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। তাৎক্ষণিকভাবেই তার মাথায় চিন্তাটার বা পরিকল্পনাটার পরের স্তর ভেসে উঠল। রোজমেরি নিশ্চয়ই তার মেয়েকে জানায়নি বাবার পরিচয়? এবং এখন রোজমেরি মৃত, সুতরাং কে আসল, সত্যি জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড কে…তাহলে কে?

উত্তরটা তৈরিই ছিল টাইলারের কাছে, মার্গো পসনার।

.

প্রথমবার, টাইলার তাকে দেখেছিল নিজের আদালত কক্ষে। দুটোর পর সেদিনই আবার আদালত শুরু হয়েছিল। প্রথম মামলাটিই ছিলো ইলোয়িনিস রাজ্য প্রশাসন বনাম মার্গো পসনার। অভিযোগ–খুনের চেষ্টা, নিগ্রহ, গন্ডগোল বাঁধানো। সরকারী উকিলের বক্তব্য থেকে জানা গেল, মাননীয় বিচারপতি মহোদয়, অভিযুক্ত একজন দাগী অপরাধী। এবং সমাজে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর পক্ষে অযোগ্যই শুধু নয়, বিপজ্জনক। শিকাগোতে নানা ধরনের গণ্ডগোল বাঁধানন, দোকানে চুরি করা, ছিনতাই, এসবের জন্য বেশ কয়েকবার ধরাও পড়েছিল। ও ঠান্ডা মাথায় তার দুই পুরুষ সঙ্গী খদ্দেরকে গুলি করে। দুজনেই কি মারা গেছে ঐ ঘটনায়? বিচারক টাইলার প্রশ্ন করে। না বিচারপতি মহোদয়, গুরুতর আহত অবস্থায় তারা হাসপাতালে ভর্তি। যে বন্দুকটি দিয়ে গুলি করা হয়েছিল মেরি পসনারের কাছ থেকেই সেটি পাওয়া যায়। এবং সেটি ছিল বেআইনি অস্ত্র। টাইলার অভিযুক্তার দিকে তাকাল এবং এক বিস্ময় ঝলক তাকে ছুঁয়ে গেল। এতক্ষণ যা সে শুনল অভিযুক্তার চেহারার, প্রতিচ্ছবির সঙ্গে তা মোটেই মিল খায় না। সুন্দর পোষাক পরা, সুসজ্জিত, রুচিশীল, ভদ্রসভ্য চেহারার একজন আকর্ষণীয়া সুন্দরী যুবতী আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর চেহারার শালীন রুচিময় নমনীয়তা যেন ওর বিরুদ্ধে করা সমস্ত অভিযোগকেই টাইলারের মন মিথ্যে বলে ঘোষণা করতে চাইছে। টাইলারের মন, বিচারক নিরপেক্ষ সত্ত্বা বিদ্রোহ করতে চাইল। সমস্ত তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য অস্বীকার করতে চাইল।

বাকী প্রতিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়াল জবাব সে শুনছিল। কিন্তু তার চোখ স্থির নিবদ্ধ ছিলো মেয়েটির প্রতি। দুপক্ষের আইনবিদদের সওয়াল জবাব শেষ হলো। বিচারকের পক্ষে মামলা হিসেবে অত্যন্ত সহজ মামলা ছিলো। আমি উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ বিচারের পর অপরাধী মার্গো পসনারকে পাঁচ বছর ডিওয়াইট সংশোধনাগারে কাটাবার আদেশ দিচ্ছি। টাইলার নিজের রায়ে জানিয়েছিল। মেয়েটিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরও বারবার তার চেহারাটা টাইলারের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বেনডালের সঙ্গে মেয়েটির প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। এই মেয়েটিও তার বোনেরই মত ধূসররঙা চোখ। স্ট্যানফোর্ড চোখ।

মার্গো পসনারের কথা সে তারপর ভুলেই গিয়েছিল। আবার তার মনে পড়ল দিমিত্রির ফোনের পর। দাবার প্রাথমিক চালগুলো পরিকল্পনা মাফিক নিখুঁত ভাবে চমৎকার দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী চাল, দানগুলোও নিখুঁতভাবে ছকে পরিকল্পনা করে রেখেছিল সে। এবার রানীর চাল দেবার আগে মিডল, গেমে দান দেবার সময় হয়েছে। টাইলারের মনে ভেসে উঠেছিল মার্গো (আসলে ওর মনের অবচেতনে সব সময়েই মার্গো পসনার, বিশেষ করে তার ধূসর রঙা স্ট্যানফোর্ড চোখ, হাজির ছিল ঝাঁপ বন্ধ অবস্থায়)। টাইলার সোজা মহিলা সংশোধনাগারে গিয়ে হাজির হলো। মার্গো পসনারের মুখোমুখি। আমায় চিনতে পারছ? কি করে ভুলব? আমার এখানে আসার জন্য তো আপনিই। ভুল কথা। নিজের কর্মফলের কারণে তুমি আজ এখানে। থাক, সেসব নিয়ে তর্ক করতে আমি এখানে আসিনি। তুমি এখানে কেমন আছো? আপনি কি ঠাট্টা করছেন? এটা একটা নরকের মত? আমি যদি এখান থেকে তোমায় বের হবার ব্যবস্থা করি? মার্গো সন্দিহান চোখে তাকায়, কী করে? আপনি ঠাট্টা করছেন নাকি? টাইলার তার বিচারক সুলভ দাপুটে গলার ভঙ্গীতে বলে, না, আমি ঠাট্টা করছি না। তোমাকে আমি সত্যিই বের করে নিয়ে যেতে পারি। যদি তুমিও আমার জন্য কিছু করতে রাজী থাকো। মার্গো হেসে ওঠে। তার চোখে ঝিলিক মারে চাপা যৌনতার ছায়া। যৌন উত্তেজক ভঙ্গী শরীরে ফুটিয়ে সে বলে,–ওহ এই ব্যাপার? ঠিক আছে বিচারক মহোদয়, আপনি যদি সত্যিই আমায় এখান থেকে বের করে নিয়ে যান তাহলে আমি আপনার জন্য সব কিছু করতে অবশ্যই রাজি আছি। কথা শেষ করেও নিঃশব্দে হেসে চলে মার্গো।

টাইলার বিরক্ত ভঙ্গীতে বলে। তুমি যা ভাবছ তা নয়। আমি তোমার থেকে অন্য কিছু চাই। খুবই সিরিয়াস ব্যাপারটা। নিমেষে ভঙ্গী বদলে ফেলে আগ্রহের কৌতূহলের গলায় ভাব-গম্ভীর ভঙ্গীতে বলে, তাহলে? আমাকে দিয়ে আপনি কী করাতে চান? তোমাকে একজনকে নকল করতে হবে। আমি একজনের সঙ্গে একটা খেলা খেলতে চাই। তোমায় তাতে সাহায্য করতে হবে। মার্গো অবাক গলায় বলে, নকল করতে হবে? কাকে? সেসব তোমায় যথা সময়ে জানিয়ে বুঝিয়ে দেবো। এখন শুধু এইটুকুই জেনে রাখো, কাজটা যদি ঠিকঠাক ভাবে করতে পার, উতরে দিতে পার, পঁচিশ হাজার ডলার পাবে। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ হয়ে ওঠে মার্গোর। গলা দিয়ে কথাগুলো আর্তচিৎকারের মত বের হয়ে আসে ছিটকে ছিটকে।

এরপর টাইলার জেলা আদালতের প্রধান বিচারপতি কিথ পারসির সঙ্গে দেখা করে। তাকে বোঝায়, নিজের যুক্তির জালে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করায়। আমি জানতে পেরেছি, মেয়েটি একজন দক্ষ শিল্পী। আর সে সভাবে সাধারণ জীবন যাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমাদের কি উচিত নয় এ ধরনের অনুতাপ জর্জরিত অপরাধীদের নতুন ভাবে বাঁচাবার, নতুন করে সঞ্জীবন শুরু করার সুযোগ করে দেওয়া? টাইলারের তার্কিক যুক্তির জালে অভিভূত প্রধান বিচারপতি বললেন,–নিশ্চয়ই। তোমার এই অসাধারণ সৃজনমুখী সমাজ উন্নয়নশীল চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমি অবশ্যই একমত। সুতরাং মার্গোর জামিনে ছাড়া পেতে দেরী হলো না। টাইলার খুব গোপনে তাকে এনে তুলল নিজের বাড়ীতে। সবার চোখের আড়ালে রেখে, কাক পক্ষীকেও জানতে না দিয়ে শুরু হলো তার প্রশিক্ষণ। স্ট্যানফোর্ড পরিবারের মানচিত্রকে তার যাবতীয় খুটিনাটিসহ চেনানো, পাখি পড়ানো। প্রায়। নিমর্ম ভাবেই কোনরকম মায়াদয়াহীন ভাবে চলল এই প্রশিক্ষণ পর্ব। যতক্ষণ পর্যন্ত না টাইলারের মনে নিশ্চিত ধারণা জন্মালো মার্গো পসনার নয়, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের অবৈধ সন্তান জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড। হ্যাঁ তুমি এবার তৈরি, তার আগে অবশ্য মার্গোকে দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সই সাবুদ করিয়ে রাখল। যাতে, আইনগত ভাবে জুলিয়া তার অংশের শেয়ার হস্তান্তর করছে টাইলারকে। একশো বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি নিয়ে কোনরকম ঝুঁকি নেওয়া যায় না। যদি শেয়ার দখল নেবার পর মার্গো তা টাইলারের হাতে তুলে দিতে রাজী না হয়? ঐ বিশাল পরিমাণ সম্পত্তি কোন মূর্খ ছেড়ে দিতে চায়? তাই আগে ভাগই জুলিয়ারূপী মার্গো সম্পত্তির দখল পাবার আগেই আইনত তা টাইলারের দখলে চলে এলো। এরপর তৈরি হলো জাল কাগজ পত্র, জুলিয়ার আত্মপরিচয়ের জাল প্রমাণ তথ্য। সেসবও নিখুঁত ভাবে তৈরি হয়ে যাবার পর টাইলার। মার্গোকে বলল, এবার রওনা হবার জন্য তুমি পুরোপুরি তৈরি। পাঁচ হাজার ডলার ওর হাতে দিয়ে সে বলল,–এটা আগাম, বাকিটা পাবে কাজ সফল ভাবে শেষ করতে পারলে, যদি তুমি ওদের বিশ্বাস করাতে পারো তুমিই জুলিয়া স্ট্যানফোর্ড।

যে মুহূর্তে মার্গো জুলিয়া হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করল, রোজ হিলের বাড়ীতে হাজির হলো, টাইলার তার নিখুঁতভাবে ডেভিলস অ্যাডভোকেট-এর ভূমিকা পালন করতে শুরু করল। নিখুঁত এক দাবার মস্তিষ্ক যুদ্ধ। একদিকে ভাইবোনদের পক্ষে, জুলিয়া বিরোধী হিংস্রভাবে, অন্য দিকে মার্গোর প্রতিটি পদক্ষেপই নিয়ন্ত্রিত তারই অঙ্গুলি হেলনে, ইশারায়। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন মিস…ইয়ে…কোন যথার্থ বাস্তব প্রমাণ ছাড়া আমরা… আমার মনে হয় মেয়েটি জালিয়াত…আমরা যখন শিশু, এ বাড়ীতে কতজন চাকর বাকর কাজ করত?…ওদেরই কেউ যে এসব ঘটনা মেয়েটিকে বলেনি…ঐ ছবিটাও, তাদেরই কেউ হয়ত চুরি করেছিল, যা এখন সে মেয়েটিকে দিয়েছে…ভুললে চলবে না যে অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা জড়িয়ে আছে এই ঘটনার সঙ্গে…

ওর রাজার চাল ছিল ডি এন এ টেস্ট-এর দাবী। যদিও তার আগেই হ্যাল বেকারকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের দেহটা খুঁড়ে তুলে যেন নষ্ট করে ফেলে। যাতে ডি এন এ পরীক্ষা সম্ভবই হবে না। তারপর, আরো একটা বোড়ের চাল। অন্য ভাইবোনদের সামনে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জেলা অ্যাটর্নীর দফতরে ফোন করা, বেসরকারী গোয়েন্দা ফ্রাঙ্ক টিমমনস-এর ফোন নম্বর নেওয়া, তাকে ফোন করা এবং জুলিয়ার পূর্ব জীবনের খোঁজ বের করতে লাগানো। ফ্রাঙ্ক টিমমনস নামে যাকে সে ভাইবোনদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে আর কেউ নয়। হাল বেকার, তদন্তের নামে, টাইলারের আগেই তৈরি করে রাখা যাবতীয় জাল নথিপত্রগুলোকেই (আঙ্গুলের ছাপও) সত্যি প্রমাণ হিসেবে দাখিল করে বেকার। অনন্যরা যাকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। মার্গোও তার কাজ নিখুঁত ভাবে করে। পুরো পরিকল্পনা (অথবা ষড়যন্ত্র) বিস্ময়হীন, নিখুঁত ভাবে উতরে যায়।

মার্গোকে সবাই জুলিয়া হিসেবে মেনে নেবার পর, মার্গোর আঙ্গুলের ছাপই জুলিয়ারূপী মার্গোর আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে মিলে যাবার পর, সবাই দ্বিধাহীন মনে ওকে তাদের সৎ বোন মেনে নেবার পর, ছোট্ট ঘরোয়া মিলনোৎসবের পর সবাই যখন শুয়ে পড়েছে, একশো মিলিয়ন ডলার এবং নিজেদের উজ্জ্বল সুখস্বপ্ন দেখছে টাইলার। সবার চোখ এড়িয়ে গোপনে দোতলায় উঠে যায়। জুলিয়ার ঘরের দরজায় ঠেলা দেয়। ভেজান দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকে আসে। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল মার্গো অথবা জুলিয়া। টাইলার দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। দুজনে দুজনকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে, নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ে। আমরা পেরেছি মার্গো, আমরা পেরেছি।

.

১৮.

রেনকুইস্ট, রেনকুইস্ট এবং ফিৎজেরাল্ড এর অ্যাটর্নী অফিস। দুজন মুখোমুখি কফি পান করছিলেন। সাইমন ফিৎজেরাল্ড প্রশ্ন করেন, কী ভাবছ? সোলানে মাথা নাড়ে,–স্ট্যানফোর্ড পরিবার। আমি নিশ্চন্ত নই, তবে কোথাও যেন একটা গন্ডগোল আছে। একটা বাধা। ফিৎজেরাল্ড প্রশ্ন করেন, যেমন? একটি প্রশ্ন বারবার মনে ফিরে ফিরে আসছে। ফিজেরাল্ড-এর চোখে কৌতূহল তীব্রতর হলো, কী প্রশ্ন? স্টিভ সোলানে নিজের কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নেয়। তারপর বলে, স্ট্যানফোর্ডরা নতুন মেয়েটির ডি এন এ পরীক্ষা করার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সুতরাং হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহকে উধাও করে দেবার একটাই মাত্র কারণ থাকতে পারে। মহিলাটির ডি এন এ পরীক্ষা হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের কোষের সঙ্গে তা মেলানো হতে না দেওয়া এবং তাতে লাভ সবচেয়ে কার বেশি? ঐ জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের। যদি সে একজন প্রতারক জালিয়াত হয়। একমাত্র মেয়েটিরই মোটিভ থাকতে পারে। উদ্দেশ্য লাভ থাকতে পারে হ্যারীর মৃতদেহ গায়েব করে দেওয়ায়। গম্ভীর চিন্তাশীল মুখে ফিৎজেরাল্ড মাথা নাড়েন, ঠিক বলেছ। এখন দেখো বেসরকারী গোয়েন্দাটি ফ্রাঙ্ক টিমমনস। আমি জেলা অ্যাটনীর অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি লোকটির যথেষ্ট সুনাম রয়েছে গোয়েন্দা হিসেবে। সে যাচাই করে যখন বলেছে আঙুলের ছাপ মিলে গেছে তাহলে তার কথার ওপর ভরসা রাখাই যায়। আমার প্রশ্ন হলো তাই যদি হয় অর্থাৎ ঐ জুলিয়া মেয়েটি যদি জালিয়াত, না হয়, সত্যি জুলিয়াই হয়, তাহলে মৃতদেহটাকে কে এবং কেন গায়েব করল? কার লাভ এতে? তীব্র গলায় প্রশ্ন করে সোলানে।

ফিৎজেরাল্ড চিন্তামগ্ন কুঞ্চিত কপালসহ উত্তর দেন, লাখ ডলারের প্রশ্ন। যদি… ঠিক তখনি ফোনটা বেজে ওঠে। সোলানেই ফোনটা তোলে। হালো জজ টাইলার বলছি। আপনি কি একবার রোজ হিলের বাড়িতে আসতে পারবেন? সোলানে আড় চোখে ফিৎজেরাল্ডের দিকে তাকায়। কখন? ফিৎজেরাল্ড প্রশ্নাতুর চোখে ওদের কথোপকথন বোঝার চেষ্টা করছে। টাইলার অন্য প্রান্তে বলে, ধরুন ঘণ্টা খানেক পরে?–ঠিক আছে, আমি পৌঁছে যাব। ধন্যবাদ সোলানে। রিসিভার নামিয়ে রেখে ফিৎজেরাল্ডের দিকে তাকিয়ে সোলানে বলে, ডাক এসেছে। স্ট্যানফোর্ডদের বাড়ীতে হাজির হতে হবে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ফিৎজেরাল্ড বলে, এখন আবার কী চায় ওরা? সোলানে হাসে, বাজী ধরতে রাজি আছি। উইলের প্রবেটটা যাতে তাড়াতাড়ি সারা হয় সে ব্যাপারে তাড়া দেবার জন্যে। দ্রুত প্রবেট পেয়ে ওরা যাতে নিজেদের ভাগ বুঝে নিতে পারে।

লি, আমি টাইলার বলছি, কেমন আছো তুমি? ধন্যবাদ। আমি ভালই আছি। সোনা আমি তোমায় খুব মিস করছি। এক নীরব দীর্ঘ বিরতি। তারপর, আমিও তোমায় মিস করছি টাইলার। কথাগুলো ওর শরীরে রোমাঞ্চের কাটা তোলে। উৎসাহের আতিশয্যে ভরা গলায় সে বলে, শোনো লি, একটা দারুণ ভাল খবর আছে। কিন্তু ফোনে সেকথা বলা যাবে না। তুমি কথাটা শুনলে ভীষণ…। টাইলার আমি একটু ব্যস্ত। একজন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ফোনটা সশব্দে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।

রোজ হিলের বাড়ীর বসবার ঘরে সবাই হাজির ছিলো। সোলানে ওদের মুখগুলো খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল। জজ টাইলারকে বেশ খোশমেজাজ, দুশ্চিন্তাহীন দেখাচ্ছিল। বেনডালকে কিছুটা উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তুলনায়। কেমন অস্বাভাবিক রকম যেন সেই নার্ভাসনেস। ওর স্বামী মার্ক সে তুলনায় বেশ শান্ত, সংযত এবং জুলিয়া? সে এই পরিবারে অবশেষে। আচমকা সদ্য এক বিলিয়ন ডলারের উত্তরাধিকারী হয়েছে। সে আর একটু উত্তেজিত অস্থির হলেই কি ব্যাপারটা মানানসই বেশি হতো না? সোলানে প্রশ্ন করে নিজের বোধকেই। এই ঘরে অনুপস্থিতের তালিকায় উডরোও এবং তার স্ত্রী পেগি। স্টিভ সবার মুখগুলো আবার ভাল করে নিরীক্ষণ করে। এদেরই মধ্যে কেউ, কোন একজন হ্যারী স্ট্যানফোর্ডের মৃতদেহ গায়েব করেছে। কে সে, এবং কেন? ফিৎজেরাল্ড-এর মতে বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। হয়ত সত্যিই তাই। টাইলার কথা বলে, সোলানে, একজন বিচারক হিসেবে প্রবেট আইনের ব্যাপারে আমি কিছুটা ওয়াকিবহাল। কার্যধারা পদ্ধতিটাকে কি আর একটু দ্রুতগামী করা যায় না? সোলানে মনে মনে ভাবে ফিজেরাল্ডকে বাজিটা গ্রহণ করতে রাজি করানো উচিত ছিল তার। ভাবনাটা মনে চেপে রেখে সে জবাব দেয়, আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি, অনেকটা এগিয়েও গেছি। টাইলার বলে। দেখুন আমরা চাই ব্যাপারটা যতো তাড়াতাড়ি হয় মিটে যাক। কোন চিন্তা করবেন না, আমরা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়িই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলবার চেষ্টা করছি।

ঠিক এই সময়েই ঘরের বাইরে থেকে, সিঁড়ির দিক থেকে শোনা গেল একটা তীব্র আস্ফালন যুক্ত চিৎকার, চুপ, একদম চুপ। নোংরা কুত্তী, আর একটা কথা বললে আমি মেরে তোর হাড় গুড়ো গুড়ো করে দেব। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে উডি আর পেগি। উডি হাসবার চেষ্টা করে। আশা করি কথাবার্তা সব শেষ হয়ে যায়নি? ঘরের সবাই পেগিকে দেখে চমকে ওঠে। মুখটা ফুলে উঠেছে। চোখের পাশে রক্ত জমা কালসিটে। বেনডাল শিউরে ওঠা গলায় প্রশ্ন করে, তোমার কী হয়েছে? কিছু না, পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। সামান্য চোট লেগেছে। উডি বসে, পেগি গিয়ে তার পাশেই বসে। উডি স্ত্রীয়ের হাতে সামান্য চাপ দেয়। এখন তুমি ঠিক আছে তো সোনা? পেগি মাথা নেড়ে সায় দেয়। হয়ত কথা বলার মত আত্মবিশ্বাস পায় না। উডি বলে, তাঁ, তাহলে কী নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল? টাইলার বলে,–আমি ওনাকে বলছিলাম, প্রবেটের ব্যাপারটাকে যতটা দ্রুত মিটিয়ে ফেলা যায়। সোলানে উঠে দাঁড়ায়, ঠিক আছে ভদ্রমহোদয়েরা, তাহলে ঐ কথাই রইল। আমাদের ফার্ম আপনাদের সম্পত্তির দখল দানের ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে ফেলে আপনাদের জানাবে। কথা শেষ করেই দ্রুত পায়ে ঘরের থেকে বেরিয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কী এই অর্থ লোলুপতা স্বার্থসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশের গুমোট হাওয়ায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাইরের মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিল।

পেগি বাথরুমের কল খুলে তার মুখের ফোলা জায়গাটায় ঠান্ডা জল ছিটোচ্ছিল। বেনডাল লঘু পায়ে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে চমকে ঘুরে তাকায়। পেগি, তুমি ঠিক আছো? চমক ধরা ভঙ্গীতে পেগি উত্তর দেয়, হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ। বেনডাল ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর বরফ কাটা গলায় বলে, এই মারধোর কতদিন ধরে চলেছে? পেগি বিব্রত গলায় বলে, আমায় মারেনি। আমি পা পিছলে পড়ে… বেনডাল বাধা দিয়ে বলে ওঠে,–কেন? কেন পেগি, এসব কেন মুখ বুজে সহ্য করে চলেছ? প্রতিবাদ করো না, রাগে ফেটে পড়ো না কেন? ঝুলে পড়া মাথাটা তুলে পেগি তাকায়। শান্ত চোখ দুটো নীরব কান্নায় ভিজে উঠেছে। কারণ, কারণ আমি ওকে ভালবাসি, ভীষণরকম ভালবাসি। চোখে মুখে জলের কয়েকটা ঝাঁপটা দিয়ে সে আবার বেনডালের দিকে ফিরে তাকায়। বিশ্বাস করো, ও নিজেও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। সব সময় এরকম ব্যবহার ও করে না। শুধু মাঝে মাঝে… পেগির গলায় ইতস্ততা, কী বলবে যথার্থ শব্দ যেন খুঁজে পায় না। বেনডাল ধীর শান্ত গলায় বলে, বিশেষ সময়…যখন মাদক নেয়। তাই না?

পেগি কথাটা শুনে আঁতকে ওঠে, তুমি…তুমি…জানলে কী করে। থতমত খেয়ে তোতলাতে থাকে সে। সেটা কি খুব জরুরী প্রশ্ন? এসব কতদিন ধরে চলছে? বেনডাল ঠান্ডা ধীর ভাবটা বজায় রেখে প্রশ্ন করে, পেগি প্রথমটায় ইতস্তত করে বলে, আমাদের বিয়ের পর থেকেই। তারপর একটু থেমে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যোগ করে, ওর একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিল। সে সময় হাসপাতালে ওরা ব্যথা কমানোর জন্য মাদক জাতীয় ওষুধ দিতো…সুতরাং…দোষটা ওর নয়। বেনডাল বিস্ময় সূচক শব্দ করে, পেগি, পেগি, এটা সাফাই গাইবার সময় নয়। তুমি কি বুঝতে পারছ না, উডির সাহায্য প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। কী নেয় ও, কোকেন? না, হেরোইন। হে ভগবান, বেনডালের মুখ দিয়ে আর্তনাদের মত বের হয়ে আসে শব্দটা। যতরকম ভাবে পারা যায় চেষ্টা করেছি আমি। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে দীর্ঘদিন রেখেছি পর্যন্ত। কোনরকম চেষ্টাই বাদ দিইনি। জলভরা চোখে বেনডালের দিকে তাকিয়ে বলে পেগি।

বেনডাল ওর হাতটা চেপে ধরে আলতো চাপ দেয়, ঠিক আছে পেগি। শান্ত হও, শান্ত হও। আমরা বরং পরে আবার এ বিষয়ে আলোচনা করব। কথা বলব। পেগি মাথা নাড়ে। নিজের ঘরের দিকে ফিরে আসতে আসতে বেড়ালের মনে পড়ে–তুই হবি পৃথিবীর অন্যতম সেরা ফ্যাশান ডিজাইনার। আর আমি হবো বিখ্যাত খেলোয়াড়, অ্যাথলিট। কিশোর বয়সের এই স্বপ্ন দেখা উডির একি শোচনীয় পরিণতি? যদিও এ মুহূর্তে উডি না পেগি, কার জন্যে বেশি দুঃখিতবোধ করা উচিত, বুঝে উঠতে পারছিল না। সিঁড়ির মুখেই তার । দেখা হলো ক্লার্কের সঙ্গে। হাতের ট্রে-এর উপর একটা খাম। ট্রে সহ খামটাকে এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনার চিঠি। এই মাত্র বাইরে একজন এসে দিয়ে গেলো। বেনডাল খামটা তুলে নেয়, ধন্যবাদ ক্লার্ক। খামটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ওর মুখে একই সঙ্গে পর পর বিস্ময় চিন্তা-সন্দেহের রেখা ফুটে ওঠে। চিঠিটা খুলে পড়তে পড়তে ওর মুখ আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। না, চাপা আর্তচিৎকার ছিটকে বের হয় ওর মুখ দিয়ে। হন্তদন্ত হয়ে নিজেদের ঘরে এসে হাজির হয় সে। মার্কও ততক্ষণে ফিরে এসেছে। আতঙ্কিত মুখে চিঠিটা মার্কের দিকে এগিয়ে দেয় সে। খামটা খুলে মার্ক চিঠিটা পড়তে শুরু করে।

প্রিয় শ্রীমতি রেগনর,
 অভিনন্দন, আমাদের বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমিতির ভবন থেকে আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনার ভাগ্যের উজ্জ্বল পরিবর্তনের সুসংবাদ পেয়ে আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আশা করি আগেও যেমন আমাদের সমিতি আপনার উষ্ণতম সাহায্য পেয়েছে ভবিষ্যতেও পাবে।

সেইমত আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে, আমাদের সমিতির সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বরে এক লক্ষ ডলার সাহায্য বাবদ অর্থ জমা দিতে, দশদিনের মধ্যে।

প্রতিটি, অন্য এই চিঠিগুলোর মতই, এ চিঠিতেও টাইপ করা অক্ষরগুলোর মধ্যে E অক্ষরটা ভাঙা। চিঠিটা পড়ে মার্ক দাঁতে দাঁত পিষে বলে, বেজন্মার বাচ্চাগুলো। বেনডাল আতঙ্কিত মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফাঁসফেঁসে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে ওরা জানল কী করে, আমি যে এখানে? মার্ক তেতো গলায় বলে, কী করে? যে কোন একটা খবরের কাগজ তুলে নাও, তাহলেই উত্তরটা পেয়ে যাবে। চিঠিটা আবার পড়ে সে, ক্ষোভে মাথা নাড়ে। নাহ, এবার দেখছি পুলিশকে জানাতেই হবে। না, চাপা আর্তচিৎকার করে ওঠে বেনডাল। বড় দেরী হয়ে গেছে। এখন আর সে উপায় নেই। তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে, আমি ধ্বংস হয়ে যাবো। মার্ক স্ত্রীয়ের হাতটাকে নিজের মুঠোয় নেয়। শক্ত করে চেপে ধরে, ঠিক আছে সোনা, আমরা এ সমস্যা সমাধানের অন্য কোন একটা উপায় খুঁজে বের করব। কিন্তু বেনডাল জানে, কোন পথই নেই বের হবার।

এটার শুরু বেশ কয়েক মাস আগে। এক উজ্জ্বল বসন্ত দিনে বেনডাল রিডেজ ফিলড কানেকটিকাটে এক জন্মদিনের উৎসবে গিয়েছিল। সেটা একটা দারুণ উৎসব। পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা, গল্পগুজব হয়েছিল। সময় যে কোনখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল ওর খেয়ালই ছিল না। একসময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। হে ভগবান অনেক দেরী হয়ে গেছে যে, মার্ক আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। সবার থেকে দ্রুত বিদায় নিয়ে বেনডাল গাড়ীতে উঠে বসেছিল নিউইয়র্কে ফিরে আসার জন্য। সে তাড়াতাড়ি করার জন্য হাইওয়ে ছেড়ে আই ৬৪৮-এর সরু গ্রাম্য পথ ধরেছিল। এতে সময় অনেক বাঁচবে। প্রায় ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল গতিতে গাড়ী ছুটছিল। একটা বাঁকের মুখে আচমকা তার গাড়ীর সামনে এসে পড়ে এক গ্রাম্য মহিলা। বেনডাল প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল গাড়ীটাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে, দুর্ঘটনা এড়াতে। কিন্তু পারেনি, চোখের পলক পড়ারও কম সময়ের মধ্যে যেন ঘটে গেল ব্যাপারটা। ভদ্রমহিলা,ছিটকে পড়লেন। বেনডালের সারা শরীর বিশ্রীভাবে কাঁপছিল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। বেশ কিছুটা এগিয়ে যাবার পর গাড়ীটাকে থামাতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ীতে বসেই থরথর করে কাঁপে। তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ফিরে আসে ঘটনাস্থলে। সেখানে রক্তে মাখামাখি হয়ে ভদ্রমহিলা পড়েছিলেন, ওর স্থির পলকহীন চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল শরীরে প্রাণ নেই।হে ভগবান, ওর গলা দিয়ে চাপা আর্তনাদটা বের হয়ে আসে। ওর গলায় যেন একটা পাথর আটকে রয়েছে। কী করবে? এ মুহূর্তে কী করা উচিত বুঝে উঠতে না পেরে অসহায়ের মত সে চার পাশে তাকাতে থাকে। না, কেউ তাকে দেখেনি এখনো, পালাতে হবে। না এটা ওর দোষ নয়। কিন্তু ওরা যদি তাকে ধরে অভিযুক্ত করবেই। তার নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের গন্ধ পাবেই। মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া গাড়ী চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানো, মানুষ খুন করার অভিযোগে জেল হবে।

সে দ্রুত গাড়ীতে ফিরে আসে। সামনের বাঁ দিকের ফেনডারটি তুবড়ে গেছে। রক্তের দাগও লেগেছে। সে দ্রুত গাড়ী চালিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে আসার পুরো পথটা ভিউ মিরারে বারবার আতঙ্কিত চোখ রাখছিল। পেছনে পুলিশের গাড়ী তাড়া করে আসছে কিনা। শহরে ফিরেই তার প্রথম কাজ গাড়ীটাকে সারানো কোন গ্যারেজে দিয়ে। পুলিশ নিশ্চয়ই খুঁজবে এই গাড়ীটাকে। ৯৬তম স্ট্রীটের একটা ছোট্ট গ্যারেজে গাড়ীটাকে সারাই করতে ঢোকাল। দুজন কর্মচারী এগিয়ে এলো, আহ বেশ ভালই তো চোট লেগেছে বাঁ দিকের সামনের ফেনডারটাতে। ওদের মধ্যে লালচুলো লোকটি বলে। ধূসর চোখের অন্য মেকানিকটি বলে, রক্তের দাগ লেগেছে দেখছি। বেনডাল দাঁতে দাঁত চেপে ঢেকুর খাওয়া সামলে প্রাণপণ সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করে হাসে, হ্যাঁ, আসবার পথে একটা হরিণকে জঙ্গলের পথে ধাক্কা দিয়েছিলাম। লালচুলো হাসে সে তুলনায় গাড়ীতে চোট খুবই কম লেগেছে বলতে হবে। আমার এক বন্ধু একবার একটা হরিণকে ধাক্কা মেরেছিল। পুরো গাড়ীটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বেনডাল গাড়ীটা রেখে বের হয়ে আসার সময় পিছন ফিরে দেখে মিস্ত্রি দুজন সন্দেহজনক মনোযোগের সঙ্গে ওর গাড়ীর ফেনডারটির দিকে তাকিয়ে আছে।

যখন বাড়ী ফিরে মার্ককে সে এই সাংঘাতিক ঘটনাটার কথা বলল, মার্ক আঁতকে উঠল। সে কী? মার্ক সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ঠিক আছে সোনা, এতে তোমার কোন দোষ নেই, এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। চলো পুলিশে ঘটনাটার রিপোর্ট করে আসি। বেনডাল একথার উত্তরে দীর্ঘসময় নীরব হয়ে থাকে। তারপর বলে, ব্যাপারটা কি পুলিশকে জানাতেই হবে? মার্ক অবাক গলায় বলে, মানে? বেনডাল যেন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, দেখো মার্ক, যা হবার হয়ে গেছে, তাই না? কোন কিছুই তো আর ভদ্রমহিলাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না, তাই না? সুতরাং সব কিছু ভুলে গেলেই তো হয়। ধরেই নাও না ব্যাপারটা ঘটেনি। মার্ক স্থির চোখে তাকায়। বেনডাল, ওরা যদি কোনদিন কখনো তোমার খোঁজ পায়…। কি করে মার্ক? কি করে? ঘটনার সময় ধারে কাছে কেউ ছিল না। কোন সাক্ষী নেই। কি করে পুলিশ আমার খোঁজ পাবে? দেখো, এখন যদি আমি ঘটনার রির্পোট করি, পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করবে। আমার জেল হবে, কিসের জন্য? যা ঘটে গেছে, যাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। অন্য দিকে ওরা যদি আমায় গ্রেপ্তার করে, আমার ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে। এত বছর ধরে গড়ে তোলা স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মার্ক ওর কাছে সরে আসবে। শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে–ঠিক আছে, সোনা, তুমি যা চাও তাই হবে।

পরদিন, সবকটা খবরের কাগজেই ব্যাপারটা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হলো। ঘটনাটার মধ্যে বাড়তি নাটকীয়তা যেটা ফেলা হলো, সেই তথ্যটি হল মৃত মেয়েটি ম্যানহাটান যাচ্ছিল বিয়ে করতে। সবকটি কাগজেই ঘটনাটাকে যতটা পারা যায় মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক কাহিনী বানিয়ে ছাপল। প্রায় প্রতিটি কাগজেরই একটা করে সংখ্যা বেনডাল কিনে আনল। লেখাগুলো পড়ে আরো ভেঙ্গে পড়ল সে নিজের কৃতকর্মের জন্য। মহিলাটির প্রতি, তার বাগদত্তাটির প্রতি কী অন্যায় করেছে সে ভেবে রীতমত অসুস্থ বোধ করতে লাগল। কাগজেই পড়ল এই দুর্ঘটনাটির ব্যাপার কেউ কোন তথ্য দিতে পারে কিনা পুলিশ জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছে, ওরা কোনভাবেই আমার খোঁজ পাবে না। বেনডাল ভাবে, আমায় শুধু এমন ভাব করে যেতে হবে যেন ব্যাপারটা ঘটেইনি। ঘটনার পরের দিন দুপুরে বেনডাল যখন গাড়ীটাকে আনতে গ্যারেজে গেল সেখানে তখন শুধু লালচুলো নিজের নাম বলেছিল রেড (চুলের জন্যই কি?)। সে একাই ছিলো, রক্তের দাগগুলো আমি তুলে মুছে দিয়েছি। সামনের দোমড়ানোটাও সারাই করে দিয়েছি। তবে আরো কিছু টুকটাক কাজ করতে হবে। তার কৌতূহলে ভরা স্থির চোখ বেড়ালের ওপর স্থির হয়। একটু আগেই, আমার সহকর্মী স্যামের সঙ্গে তোমার গাড়ীটা নিয়ে কথা বলছিলাম। একটা হরিণের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে আরো বড় ক্ষতি হওয়ার কথা। তোমার কপাল ভাল। রেড অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। নাকি সবটাই ওর কল্পনা? ওর হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে। গলাটা এত শুকিয়ে যায় যে কথা বলতেই অসুবিধা হয়। হাসবার চেষ্টা করে ব্যাপারটা হালকা করে দিয়ে। উড়িয়ে দেবার মত গুরুত্বহীন বোঝাবার চেষ্টা করে শুকনো গলা দিয়ে কোনরকমে বলতে পারে, হরিণটা ছোট ছিল। রেড মাথা নাড়ে, হা, খুবই ছোট হবে, না হলে ক্ষয়ক্ষতি আরো অনেক বেশি হবার কথা। বেনডাল গ্যারেজ ছেড়ে বের হয়ে আসবার সময়, দুটো কৌতূহল সন্দেহ সংশয় ভরা চোখ পেছন থেকে ওর ওপর স্থির হয়ে রয়েছে, অনুমান করতে পারে।

ঐ দুর্ঘটনা ঘটবার ঠিক তিন দিনের দিনে প্রথম চিঠিটা এসেছিল।

প্রিয় শ্রীমতী রেগনর
আমি পশুক্লেশ নিবারণ সমিতির সভাপতি। বর্তমানে আমরা অত্যন্ত আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে চলেছি। আমরা জানি, আপনি আমাদের সংগঠনকে সাহায্য করতে আপত্তি করবেন না। সংগঠনের বণ্য প্রাণী নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের কাজে সাহায্য করতে পঞ্চাশ হাজার ডলার আর্থিক সাহায্য অতি অবশ্যই পাঠাতে দ্বিধা করবেন না। টাকাটা জুরিখের ক্রেডিট সুইস ব্যাঙ্ক-এর অ্যাকাউন্ট নম্বর ৮০৪০৭২-এ তে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে পৌঁছে দেবার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

চিঠির শেষে কোন নাম নেই। সই বিহীন। আর একটা লক্ষ্যণীয় ব্যাপার, টাইপ করা চিঠিটার সবকটি অ শব্দ ভাঙ্গা, মানে ঐ টাইপের অ অক্ষরটি ক্ষতিগ্রস্ত। চিঠিটার সঙ্গে কাগজে প্রকাশিত তিন দিন আগে বেনডালের গাড়ীতে হওয়া, এখনো পুলিশের অজানা দুর্ঘটনার খবরটার কেটে নেওয়া অংশ জুড়ে দেওয়া। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বেনডাল বার কয়েক আগাগোড়া চিঠিটাকে পড়ে। নাহ, ভুল হবার কোন সুযোগই নেই। এখন, তার মনে হতে থাকে, মার্ক ঠিকই বলেছিল। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করাই বুদ্ধিমানের মত কাজ হতো। এখনো তো সে পুলিশকে সব জানাতে পারে? পর মুহূর্তেই তার মনে হয়, না, তা হয় না। অনেক দেরী হয়ে গেছে। আইনের চোখে এখন সে একজন পলাতক। এখন তার নিরপরাধতা বিশ্বাস করবে না পুলিশ। দুর্ঘটনাটা অনিচ্ছাকৃত, সে যে মাতাল হয়ে গাড়ী চালাচ্ছিল, এসব প্রমাণই বা এখন কি করে করবে সে? অতএব, এখন একমাত্র যে কাজটা করার আছে সেটাই করে বেনডাল। তার ব্যাঙ্কে ফোন করে, আমার অ্যাকাউন্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার হস্তান্তর হবে। জুরিখের সুইস ক্রেডিট ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বরে…

সে রাতে বাড়ীতে ফিরে বেনডাল চিঠিটা মার্ককে দেখাল। হে ভগবান, চিঠিটা আগাগোড়া পড়বার পরে মার্কের প্রতিক্রিয়া, কে পাঠাতে পারে চিঠিটা? কে দেখেছে, জানে ঘটনাটা? আর্তস্বরে প্রশ্ন করে সে। কেউ না বিশ্বাস করো। তখন ধারে কাছে জন প্রাণী ছিল না। অসহায় গলায় কেঁদে ওঠে বেনডাল। অথচ, কেউ কেউ তো নিশ্চয়ই জানে। মার্ক আমি জোর গলায় বলতে পারি সে সময় ওখানে একজনও কেউ ছিল না। মার্ক কি যেন ভেবে নেয়, এক মিনিট। ঘটনার পর ঠিক ঠিক কি কি ঘটেছিল। তুমি কি কি করেছিল, বিস্তারিত ভাবে বলতো। সব খুলে বলবে মনে করে। কিছু ভুলে না গিয়ে বাদ না দিয়ে বলবে। বেনডাল সমস্ত ঘটনা শহরে ফেরার পর থেকে গুছিয়ে বলে মার্ককে। গ্যারেজ, রেড আর স্যাম, ওদের কথাবার্তা সংশয়। অফিসে তার সেক্রেটারী নাদিনকেও বলেছিল, ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা হয়েছে গত রাতে যখন ওর চেহারা বিপর্যস্ত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে বলে নাদিন জানিয়েছিল। এই তিন জনের মধ্যে কেউ কি? মার্ক গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। তারপর মুখ তোলে, হতে পারে ঐ তিন জনেরই কেউ একজন। আবার এমনও হতে পারে তোমার প্রতি সন্দেহ হওয়ায় ঘটনাটা সে অন্য কাউকে বলেছিল। সে কাগজে দুর্ঘটনাটার খবর পড়ে, তারপর দুই আর দুইতে চার করেছে। আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে চিঠিটা ভাওতা। তোমায় পরীক্ষা করার জন্য চিঠিটা পাঠান হয়েছিল। কথা শেষ করে সজোরে নিজের তালুতে ঘুষি মারে মার্ক, উফ বেনডাল। সেক্ষেত্রে টাকাটা চট করে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি চরম বোকামির কাজ করেছে। কেন? বেনডাল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। কারণ তুমি টাকাটা পাঠিয়ে ওদের মনে যে দ্বিধা সন্দেহ ছিল তোমার অপরাধ সম্পর্কে তা কাটিয়ে দিয়েছে। নিজের অপরাধ স্বীকার করে ওদের হাতে প্রমাণ তুলে দিয়েছে। বেনডাল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, এখন তাহলে আমি কি করব? মার্ক গভীরভাবে কী যেন চিন্তা করার পরে বলে, ঐ নোংরা লোকটাকে খুঁজে বের করার একটা পরিকল্পনা আমার মাথায় এসেছে।

পরের দিন সকাল দশটা, বেনডাল আর মার্ক রাসেল গিবসনের অফিসে তার মুখোমুখি বসেছিল। গিবসন ম্যানহাটান ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাঙ্ক এর সহঅধিকর্তা। বলুন, আপনাদের জন্য কি করতে পারি? গিবসন হাসি খুশি ভাবে প্রশ্ন করেন। মার্ক উত্তর দেয়,–দেখুন, শ্ৰীযুক্ত গিবসন, আমরা সুইস ক্রেডিট ব্যাঙ্কের একটা বিশেষ নাম্বার, জুরিখ শাখার ঐ নাম্বারটার আসল মালিক কে, সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছি। কথাগুলো শুনেই রাসেল গিবসনের কপাল কুঁচকে যায়। এটা কি অপরাধ সংক্রান্ত কোন তদন্ত? মার্ক চট জলদি উত্তর দেয়, না, না, সেরকম কিছু নয়। মুহূর্তে গিবসনকে দুশ্চিন্তামুক্ত শান্ত দেখায়। সেক্ষেত্রে আমি দুঃখিত। আমি আপনাদের কোন সাহায্যই করতে পারব না। সুইস ব্যাঙ্কগুলো, তাদের সদস্যদের নাম পরিচয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত গোপনীয়তা পালন করে। একমাত্র অপরাধজনিত অথবা প্রতারণা তদন্তের ক্ষেত্র ছাড়া ওরা ওদের ক্লায়েন্টদের ব্যাপারে কোন কথাই দেয় না, দেবে না। মার্ক ঝুঁকে পড়ে উদগ্রীব গলায় বলে, কোন পথই কি নেই তবে? কোন উপায়? ব্যাপারটা খুবই জরুরী। মরণ বাঁচন সমস্যা ভাবতে পারেন। গিবসন হাত উলটোয়, অন্য পথ? দুঃখিত, আমার মনে হয় না সেরকম কিছু সম্ভব বলে। বেনডাল ও মার্ক দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকায়। বেনডালের মুখ ছাপিয়ে উঠেছে। তীব্র হতাশার ছায়ামেঘ।

গাড়ীটাকে নিয়ে আসতে রেড-এর গ্যারেজে গিয়েছিল। তখন সন্ধ্যে। ধারে কাছে স্যাম অথবা রেড কাউকেই দেখতে পেলো না। অফিস ঘরে উঁকি মারল। না, সেটাও ফাঁকা। আর তখনি অফিস ঘরের টেবিলটায় টাইপ রাইটারের ওপর তার নজর পড়ল। নিমেষে একটা দোলায় তীব্র একটা সম্ভাবনায় দুলে ওঠে ওর মন। সতর্ক ভঙ্গীতে আশেপাশে নজর বুলিয়ে নেয়। না, ধারে কাছ কেউ নেই। দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। টাইপরাইটারটাতে একটা কাগজ ভরে অ অক্ষরটায় কয়েকবার আঙুলে টোকা দিতে যায়। ঠিক এই সময়েই বাইরে পায়ের শব্দ হয়। দ্রুত টাইপরাইটারটার সামনে থেকে সরে আসে। স্যাম ঘরে ঢোকে। টাইপরাইটারের অ অক্ষরটা ভাঙ্গা কিনা জানবার সুযোগ হয় না। স্যাম ওকে দেখে বলে, কী ব্যাপার ম্যাডাম? –আমি গাড়ীটাকে ফেরত নিতে এসেছি। স্যাম একবার ওকে আর একবার টাইপরাইটারের দিকে সন্দেহ কুটিল চোখে তাকায়। তারপর মাথা নাড়ে, এখন তো হবে না। আরো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। পরের দিন বিকেলে যখন আবার সে গ্যারেজে যায় অফিস ঘরে রেড় বসেছিল। বেনডাল সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে টেবিলের ওপর পুরনো টাইপরাইটারটা নেই। সেখানে ঝকঝক করছে একটা নতুন আধুনিক কম্পিউটার। একটা চাপা শ্বাস ছাড়ে বেনডাল। তাহলে, এখন কম্পিউটারও? ভাঙ্গা, লঝরে খদ্দেরহীন একটা গ্যারেজের মালিকের আচমকা এতখানি সক্ষমতা কী করে হয়, হলে, হতে পারে?

রাতে ব্যাপারটা মার্ককে বলতে সে মাথা নাড়ে। চিন্তান্বিত ভঙ্গীতে, ব্যাপারটা শুধুই একটা সম্ভাবনা। নিশ্চিত প্রমাণ কিছু নেই, যা আমাদের প্রয়োজন। পরের দিন অফিসে গিয়ে নাদিনকে দেখে বেনডাল চমকে উঠল, নাদিনের গায়ের মহার্ঘ্য কোটটা ওর নজর কেড়ে নিলো। এর আগে নাদিনকে কখনো এত দামী জামাকাপড় পরতে দেখেনি সে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নাদিন হাসে, গর্বমাখা গলায় বলে, কাল আমার জন্মদিন ছিলো। আমার স্বামী আমাকে এই দারুণ কোটটা উপহার দিয়েছে। বেনডাল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কোটটার দাম কমপক্ষে দু থেকে আড়াই হাজার ডলার।

.

১৯.

জুলিয়া স্ট্যানফোর্ডের রুমমেট ছিলো স্যালি। হাসিখুশি প্রাণবন্ত, ফুর্তিবাজ স্যালিকে জুলিয়া পছন্দই করত। ওর একটা খারাপ বিয়ের অভিজ্ঞতা ছিল। যে কারণে স্যালি আর কখনোই কোন পুরুষের সঙ্গে নিজেকে জড়াবে না। যদিও এ প্রতিজ্ঞা স্যালি কতদিন রক্ষা করতে পারবে সে ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ ছিল জুলিয়ার মনে। কারণ পুরুষসঙ্গ স্যালি অত্যন্ত পছন্দ করত। এবং পছন্দের ব্যাপারটায় সে অটল থাকত না। প্রতি সপ্তাহেই তাকে নতুন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে সপ্তাহান্তের ডেটিংয়ে যেতে দেখত জুলিয়া। ব্যাপারটা ওর মনে মজা জোগাত। তবে স্যালি পুরুষ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে, পছন্দের সিদ্ধান্তে একটি ক্ষেত্রে সবিশেষ কঠোর থাকত। তার নিত্যনতুন প্রেমিকেরা সবাই হতো বিবাহিত পুরুষ। বিবাহিত পুরুষেরাই নিরাপদ। দার্শনিকভাবে স্যালি উত্তর দিতো। ওরা সব সময় অপরাধবোধে ভোগে। ফলে, সঙ্গিনীকে তোয়াজে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া ওরা তোমাকে বিয়ে করবে বলে ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্তও করবে না। স্যালি, জুলিয়া কেন কোন পুরুষের সঙ্গে মেশে না এ ব্যাপারে মাঝে মাঝেই অনুরোধই করত। জুলিয়া মনে মনে হাসত, তাকে নিয়ে ডেটিং-য়ে যেতে চাইবে কোন পুরুষ? তাছাড়া জুলিয়া শুধু ডেট করার জন্যই কোনো পুরুষের সঙ্গে মিশবার পক্ষপাতি ছিল না। ওর বিশ্বাস ছিল ভালবাসায়। ও মিশবে এমন কোন পুরুষের সঙ্গে যে সত্যি সত্যি জুলিয়াকে মন দিয়ে ভালবাসবে। জুলিয়ার জন্যে যার আন্তরিকতা, সহানুভূতি আবেগ, যত্ন থাকবে।

স্যালি মাঝে মাঝেই তার পুরুষ বন্ধুদের কারো কারো সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিত। ডেটিং করতে পাঠানোর জন্য উদগ্রীব হতো। সচেষ্ট তৎপর হতো। কিন্তু জুলিয়া আমল দেয়নি। রাজী হয়নি। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অন্যভাবে। হেনরি ওয়েসসনের সঙ্গে তার দেখা হতো প্রায়ই অফিসের লিফটে। একই বাড়ীর চারতলায় ছিলো জুলিয়ার অফিস। আর সাততলায় ছিলো হেনরির অফিস। মাঝে মধ্যেই দেখা হতো। তাই একদিন হেনরি মৃদু হেসে সুপ্রভাত জানায়। উত্তরে জুলিয়াও সু-প্রভাত বলে। এভাবেই সাত-আট মাস পর লিফটে সেদিন আর কেউ ছিলো না। একান্তে জুলিয়াকে হেনরি বলে, সন্ধ্যেতে কী করছেন? আমরা কি একসাথে আজ রাতের খাবারটা খেতে পারি? কী জানি কী ভেবে, হয়ত হেনরি ওয়েসসনকে ততদিনে মনে মনে পছন্দ করতেও শুরু করেছিল জুলিয়া। রাজী হয়ে যায়। সেই সন্ধ্যেতে জুলিয়াকে ইবিটি, কানসাসসিটির অন্যতম সেরা রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সে। মহার্ঘ্য বিশাল পরিবেশে দুর্দান্ত রান্না খাবার খেতে খেতে হেনরি ওয়েসসন নিজের ব্যাপারে সব কিছু জানায়। এই শহরেই তার বড় হওয়া, জন্ম থেকে যুবক হওয়া। নিজের একার চেষ্টাতেই আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণভাবেই আত্মপ্রতিষ্ঠিত মানুষ সে। আজ সে নিজের চাটার্ড ফার্ম খুলেছে। নিজস্ব ফার্ম। সব কথা জানিয়ে মৃদু হেসে জুলিয়ার দিকে তাকায়। এবার তোমার কথা বলো, জুলিয়া স্থির চোখে হেনরির দিকে তাকায়। নিজের কথা? পৃথিবীর অন্যতম ধনী পুরুষের, সারা আমেরিকা, পৃথিবী যাকে এক ডাকে চেনে তার অবৈধ সন্তান আমি। প্রেমিকা, অথবা রক্ষিতার সন্তান। তার বিপুল বিশাল সীমাহীন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এসব বলবে? বলা যায়?

হেনরি আগ্রহী চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল, সুতরাং যতটুকু যা বলা যায়। আমার জন্ম মিলাউঁকি শহরে, ছোটবেলায় আমার বাবা মারা যান… সব কথা শুনে হেনরি ওর হাতটাকে আলতো করে চেপে ধরে। তার মানে, তোমার জীবনে কোন পুরুষ মানুষ আসেনি। কখনন, যে তোমায় আগলে রাখবে। সব দায়িত্ব নেবে তোমার। একটু থেমে দ্রুততর কয়েকটা শ্বাসের পর হেনরি যোগ করে, আমি এবার সারা জীবনের জন্য তোমার দায়িত্ব নিতে চাই। তোমায় আগলে রাখতে, ভালবাসতে চাই। জুলিয়া তুমি কি আমায় সে সুযোগটা দেবে?

সেদিন ছিল শনিবার, গত চারমাস ধরেই শনি-রবিবার হেনরি তাকে নিয়ে বের হচ্ছে। আজও সে সেজেগুজে তৈরি হচ্ছে, বিছানায় আধশোয়া হয়ে স্যালি তাকে লক্ষ্য করছিল। এবার কৌতুক জড়ানো গলায় সে বলল, হু, তাহলে আরো একটা দারুণ দুর্দান্ত হেনরি রাতে যাচ্ছো তুমি? তো আজ তোমরা কোথায় যাবে? জুলিয়া লাজুক ভঙ্গীতে হাসে, আজ সিমফনি হলে যাবো আমরা। ক্লিও লেইনির বাজনা শুনতে। তারপর স্যালির দিকে তাকিয়ে বলে, আর তুমি? তুমি কখন বের হবে? স্যালি আড়মোড়া ভাঙ্গে, হ্যাঁ এবার আমারও তৈরি হবার সময় এসে গেল। বিছানায় উঠে বসে সে, তারপর মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গীতে জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে সে বলে, আমি আজ কালো পোষাকটা পরছি, তোমার কালো উঁচু হিলের জুতোটা কি আজ রাতের জন্য ধার নিতে পারি? জুলিয়া হাসে, স্বচ্ছন্দে, দেখো কাঠের আলমারীতে আছে নিয়ে নাও। আমি তবে আসি? শুভরাত্রি। জুলিয়া বের হয় যায়। স্যালি উঠে জুলিয়ার কাঠের আলমারিটা খোলে, যে জুতোটা খুঁজছে সেটার মাথার ওপর তাকটার রয়েছে। স্যালি হাত বাড়ায় জুতো দুটো ধরে টান মারে। জুতো দুটোর সঙ্গে সঙ্গে একটা কার্ড বোর্ডের বাক্স নেমে আসে এবং মেঝেতে আছড়ে পড়ে। মেঝেতে পড়ার পরই ডালাটা খুলে গিয়ে বাক্সটা থেকে একরাশ নানা আকারের টুকরো কাগজ সারা ঘরময় ছড়িয়ে যায়। ধুত্তোরি। বিরক্তিতে মেঝেতে পা ঠোকে স্যালি। তারপর নিচু হয়ে কাগজগুলো তুলে বাক্সটায় গুছিয়ে রাখতে থাকে। ঠিক এই সময়ে ওর পেছনে দরজাটা আবার খুলে যায়। স্যালি মাথা ঘুরিয়ে দেখে জুলিয়া ঢুকছে, কি ব্যাপার, তুমি? সবিস্ময় প্রশ্ন করতে জুলিয়া হাসে,–আরে পার্সটা ফেলে গেছি। তারপরই তার নজর পড়ে বাক্সটার দিকে। নজর পড়তেই রুক্ষ্ম গলায় সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, তুমি ওটা নিয়ে কী করছ?

জুলিয়ার প্রতিক্রিয়ায় স্যালি অবাক হয়, অপরাধীর গলায় বলে,দুঃখিত, জুতোটা টানতে গিয়ে বাক্সটা… জুলিয়া ততক্ষণে নিচু হয়ে বসে পড়েছে। স্যালিকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত হাতে কাগজগুলোকে বাক্সে তুলে ভরে রাখছে। ওর মুখে গালে রক্তাভা। স্যালি একটু সরে বসে জুলিয়ার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিল। বিস্ময় জড়ানো কিছুটা ধাঁধাগ্রস্ত গলায় সে বলে, তুমি যে বড়লোকদের নিয়ে, তাদের বাপারে এতটা আগ্রহী, জানতাম না। জুলিয়া নীরবে কাগজগুলো গুছিয়ে সাজিয়ে রাখছিল। ওগুলো আসলে নানা খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া খবরের ছবির কাটা অংশ। ছবিসহ খবরগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে বাক্সে রাখার পর, সে যত্ন করে জামায় ঘষে ঘষে মুছে বাক্সে ভরল হৃদয় আকৃতির লকেট লাগানো সোনার চেনটাকে। মা এটা ওকে দিয়ে গেছেন। স্যালি হঠাৎ নিচু চাপা স্বরে প্রশ্ন করে, জুলিয়া তুমি হ্যারী স্ট্যানফোর্ড-এর ব্যাপারে এত উৎসাহী কেন? আমি নই… আমার মা। এসব তিনিই আমায় দিয়ে গেছেন। স্যালিকে স্থির, অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে থাকতে  দেখে জুলিয়া দুঃখ মেশানো মৃদু হাসে। খুব কৌতূহল হচ্ছে তাই না? কাগজের দঙ্গল থেকে সে একটা মাঝামাঝি আকারের কাটা টুকরো বের করে স্যালির দিকে এগিয়ে দেয়। একটা কেচ্ছা কেলেঙ্কারী প্রধান পত্রিকার প্রথম পাতা। বড় বড় শিরোনাম বিখ্যাত শিল্পপতির বাড়ীর গভর্নেস অন্তসত্ত্বা, কন্যা শিশুর জন্ম। মা, শিশু কোথায়?

কাগজটা, খবরের কাটা টুকরোটা পড়া শেষ হলে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে স্যালি চেঁচিয়ে ওঠে। উত্তেজনায় ঠাসা গলা, তুমি, তুমি কোটিপতি ব্যবসায়ী, তিনি দিন কয়েক আগে জলে ডুবে মারা গেছেন তার মেয়ে। জুলিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকে। স্যালি মাথা ঝাঁকায়, কী হলো? কথা বলছ না কেন? জুলিয়া দাঁতে দাঁত পিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে, দয়া করে অন্য কথা বলো স্যালি। এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চাই না আমি, প্লিজ। সালি প্রায় আঁতকে ওঠে-এ বিষয়ে কথা বলতে চাও না তুমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বদ্ধ উন্মাদ নাকি তুমি?

জুলিয়া ধমকের সুরে বলে, স্যালি। তুমি জানো, তুমি যদি সত্যিই ওর সন্তান হও, তার অর্থ কত বিলিয়ন ডলার? আমার তাতে কিছু যায় আসে না। হ্যারী স্ট্যানফোর্ড একজন অতি ভয়ঙ্কর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার মাকে তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন। তাছাড়া, ঐ পরিবার, ওরা আমাকে ঘৃণা করে। আমিও হ্যারী স্ট্যানফোর্ডকে ঘৃণা করি। যেভাবে তিনি ঘৃণা করতেন আমার মাকে ও আমাকেও। এত টাকা যেখানে জড়িত, ঐ ঘৃণা মান অভিমান এসব খুবই তুচ্ছ জুলিয়া, খুবই তুচ্ছ। ওরা জানেই না যে আমি বেঁচে আছি। তুমি ওদের বলবে, জানাবে। জুলিয়া তিতিবিরক্ত ভঙ্গীতে বলে, স্যালি, এবার এ প্রসঙ্গ টাকে বাদ দাও, ছাড়ো।

স্যালি দীর্ঘক্ষণ স্থির চোখে জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা নেড়ে একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে। প্রবল হতাশার।

.

২০.

টাইলার প্রায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। দিশেহারাও। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সে না হোক কম করেও কুড়ি বার লি-এর ফ্ল্যাটে ফোন করেছে। অথচ এক ঘেয়ে উত্তর যন্ত্র বেজেই চলেছে। টাইলার কুল কিনারা পায় না। ও কার সাথে এতক্ষণ ধরে কী করছে? আবার আরো একবার লি-এর নম্বর ঘোরায় সে। দীর্ঘক্ষণ রিং বাজবার পর টাইলার যখন আবার মনে মনে উত্তর যন্ত্রের নিরস জবাব শোনবার জন্য তৈরি হচ্ছে, ফোন তোলে লি, হালো? লি তুমি কেমন আছো? আপনি কে বলছেন? লি-এর গলায় একরাশ বিরক্তি। আমি, আমি টাইলার সোনামনি। টাইলার। অন্যপ্রান্তে এবার বেশ লম্বা বিরতি, তারপর আবার লি বলে, হ্যাঁ বলল। তুমি কেমন আছছ সোনা? খুব ভালো। মনে আছে লি সোনা, অমি তোমায় বলেছিলাম তুমি যা চাও চাইবে, একদিন সেসব তোমায় আমি দেবো, দিতে পারব। অন্য প্রান্তে লি শব্দহীন, নিঃশ্বাসের শব্দও পায় না। টাইলার বলে চলে, তুমি একদিন বলেছিলে, বিলাসবহুল প্রমোদ তরণীতে সওয়ার হয়ে সেন্ট ট্রপেজ দ্বীপে বেড়াতে যাবার ইচ্ছের কথা। কবে যেতে চাও? নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দের সঙ্গে মিশে যায় লি-এর বিস্ময় অবিশ্বাস মাখা কথাগুলো। তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ না? নিশ্চিত ভাবেই না। এবার শব্দ করে হেসে ওঠে, না ওসব ভাবনা ফেলে দাও। আমি নিজেই একটা ইয়ট কিনছি। তুমি…ইয়ট…। টানা কয়েক মুহর্তের নীরবতার পর লি-এর বিরক্তি মাখা গলা ভেসে আসে, তুমি নিশ্চয়ই নেশা করেছ। তাই না? নেশা? টাইলার আবার সশব্দে হেসে ওঠে, না লি সোনা। তুমি যা ভাবছ সেসব কিছুই নয়। আসলে আমি হঠাৎ করেই কিছু টাকা হাতে পেয়েছি। অনেক টাকা। এবার লি-এর গলায় আগ্রহ ফুটে ওঠে,–বেশ। আমি রাজী তোমার সঙ্গে যেতে।

টাইলার একটা হাফ ছাড়ার তীব্র অনুভুতি বোধ করে। ঠিক আছে। তুমি আমায়…নাহ… ভুলেও এ কাজটা করার কথা মাথায় আনতেই পারে না সে। দ্রুত নিজেকে সংশোধন করে নেয়, ঠিক আছে, আমি তাহলে সময় মত তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবো। ফোন ছেড়ে দিয়ে যথা স্থানে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে, বিছানার নরম গদিতে শরীর ছেড়ে দেয়। আমি তোমার সঙ্গে যেতে রাজী আছি। পরপর দৃশ্যগুলোকে যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখতে পায় টাইলার। তারা দুজনে বিলাসবহুল একটা প্রমোতরণীতে করে ভেসে বেড়াচ্ছে ফেনিল, সগর্জন, ঢেউ তোলা, সমুদ্রের বুকে। তারা দুজনে শুধু এক সাথে।

.

উডি পোলো পনির বিষয়ে ভাবছিল। এতদিন তাকে পোলো মাঠে নামতে হতো অন্যের পনিতে চড়ে। বন্ধুদের কারো। আহ এতদিনে, এতদিন এবার সে মাঠে নামবে নিজস্ব পনিতে সওয়ার হয়ে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা পনি, হ্যাঁ এখন সে, উডরোও স্ট্যানফোর্ড সে ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা রাখে। সে ফোনটা তুলে মিমি কারসনের নম্বর ঘোরায়। অন্য দিকে মিমির সাড়া পাওয়া মাত্র কোন ভনিতা না করে সরাসরি কাজের কথা বলে–আমি তোমার পনিগুলো কিনে নিতে চাই। ওর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় টগবগ করে ওঠে। অন্যদিকে মিমির গলায় কিছুটা দ্বিধা সংশয়। উডি জোর আনে নিজের দাবীতে, আমি কিন্তু একেবারেই দৃঢ় সিদ্ধান্ত। স্থির প্রতিজ্ঞ হয়েই কথাগুলো বলছি। এরপর প্রায় আধঘণ্টা দুজনের মধ্যে বাক্যালাপ চলে। কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রাখবার পর উডিকে খুশিতে উজ্জ্বল দেখায়। পেগি কোথায়? ওকে কথাটা বলা দরকার। খুঁজতে খুঁজতে ওকে বারান্দায় পায়। একা দাঁড়িয়ে আছে নির্জন বারান্দাটাতে, দূর থেকেই পেগির মুখের ক্ষতচিহ্নগুলোফোলা, দাগ, কালশিটে, দেখতে পায়। ওর হাতে মার খাবার স্মারক। উডি পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। নরম গলায় ডাকে, পেগি? চমকে ফিরে তাকায় পেগি, তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটে যেন। কোন ঘুম ঘোর থেকে জেগে ওঠা পেগি তাকায়। উডি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে, পেগি, আমার তোমায় কিছু কথা বলার আছে, জানি না কি ভাবে বলব… কোনখান থেকে শুরু করব। পেগি তাকিয়ে থাকে, ওর মুখে সাবধানী ছাপ। সে অপেক্ষা করতে থাকে। উডি শুরু করে, দেখো পেগি, জানি আমি স্বামী হিসেবে অত্যন্ত খারাপ। এমন কিছু কিছু ব্যবহার তোমার সঙ্গে আমি করেছি যার কোন ক্ষমা নেই। কিন্তু প্রিয়তমা এখন সব কিছু বদলে গেছে। এখন সুসময় এসেছে। আমাদের হাতে এখন প্রচুর টাকা। স্ত্রীয়ের হাতটাকে নিজের হাতে তুলে নেয় সে, আলতো চাপ দেয়। পেগি আমি কথা দিচ্ছি, আমিও বদলে ফেলব নিজেকে। মাদক নেশা ছেড়ে দেবো। তুমি যদি চাও কোন মাদকাস থেকে চিকিৎসা করাতেও রাজী আছি আমি। এবার জীবন বদলে যাবে পেগি, অন্যরকম হয়ে উঠবে।

প্রখর অথচ শান্ত গভীর চোখে উডির চোখে চোখ রাখে। নির্মোহ গলায় বলে, সত্যি কি তা হবে উডি? উডি আগ্রহে ঝুঁকে পড়ে, জোরালো গলায় বলে, হ্যাঁ প্রিয়তমা, আমি কথা দিচ্ছি। সব বদলে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর গলায় ভেসে ওঠে মরীয়া বেপরোয়া জেদের ভাব। পেগি দীর্ঘক্ষণ ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর স্বামীর হাতটাকে চেপে ধরে। বিশ্বাস জোগানোর গলায় বলে, আঁ উডি সোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি সেরে উঠবে। আমাদের জীবন আবার..আমি তোমার সঙ্গে আছি, থাকব একাজে।

মার্গো পসনারের বিদায় নেবার সময় এসে পড়ল। বসবার ঘরে টাইলার ওকে পেলো। দরজাটা বন্ধ করে সে মার্গোর সামনে এসে দাঁড়ালো, অনেক ধন্যবাদ মার্গো। আমার জন্য তুমি যা করলে তা আমি কখনো ভুলব না। মার্গো হাসে, কাজটায় বেশ উত্তেজনা রোমাঞ্চ ছিল। আমি বেশ মজা পেয়েছি। কথা শেষ করে কৌতুকের গলায় সে আবার যোগ করে, হয়ত আমার অভিনেত্রী হওয়া উচিত ছিলো। জীবনটা হয়ত অন্যরকম হতো তাহলে। টাইলার রাত পোশাকের পকেট থেকে একটা চেক বের করে এগিয়ে দেয়, এই নাও। বাকি টাকাটা। তারপর অন্য পকেট থেকে আর একটা খাম বার করে। আর এই যে তোমার শিকাগো ফিরে যাবার বিমান টিকিট। নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, আর দেরী করা উচিত নয়। তুমি এবার রওনা হও। পসনার মাথা নাড়ে, ধন্যবাদ, আমায় জেল থেকে বের করার এবং অন্য সব কিছুর জন্য, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে জজ টাইলার। টাইলার হাসে। সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, তোমার যাত্রা শুভ হোক। টাইলার মার্গোকে নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করে নেবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে। ওর মুখে ফুটে ওঠে একটা বিচিত্র হাসি।

খেলা শেষ।