৪. অপহরণ

অধ্যায় ১৬

আমাকে যখন অপহরণ করা হয়েছিল তখন হয়ত মা কিংবা তার দলের অন্য কারো মুখে বিল্ডিংয়ের নামটা শুনেছিলাম ঘুমন্ত অবস্থায়। নিশ্চয়ই তারা কোম্পানির পুরো নামটা সংক্ষেপ করে নিয়েছে সুবিধার জন্যে।

একে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা? ওপিক।

অবচেতন মনে সেই নামটা নিয়ে ভাবার কোন এক পর্যায়ে স্বপ্নে ছোট ছেলেটার দেখা পাই আমি। আর তাকে সেই নামেই ডাকি আমি। যদিও স্বপ্নে পুরো ব্যাপারটা অন্যভাবে ঘটেছিল। ওপিকই ওর নিজের নামটা আমাকে বলেছিল। তবে গোটাটাই আমার মস্তিষ্কের কারসাজি।

যাই হোক, সেই স্বপ্নের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি না আমি এখন। আমার মাথায় ঘুরছে এর চেয়েও জরুরি একটা কথা।

সাদা ঘরটা এই ওয়াশিংটনেই!

এখন সব কিছু মিলে যাচ্ছে। মা এবং ডেভিড সুলিভানের অবৈধ সম্পর্কটাকে জেনিফার কেন ‘এস অ্যান্ড ম্যান’ নাম দিয়েছিল তা বুঝতে পারছি। ওপিক বিল্ডিঙটা সেই আমলেও ছিল এবং ওটা এস স্ট্রিট এবং ম্যানচেস্টার অ্যাভিনিউয়ের মাঝঝানে অবস্থিত।

তাছাড়া মা’র পছন্দের গানটা হচ্ছে মেটালিকার ‘এন্টার স্যান্ডম্যান। ওখান থেকেই বোধহয় স্যান্ডম্যান চরিত্রটার নাম পেয়েছিলেন তিনি। আর যেহেতু সিআইএ তাদের প্রত্যেকটা প্রোগ্রামের নামের আগে প্রজেক্ট জুড়ে দেয়, তাই তিনি গোটা প্রোগ্রামটার নাম রেখেছিলেন প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান।

ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা একচল্লিশ বাজছে।

লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। এরপর ফ্রিজ থেকে দুটো স্যান্ডউইচ বের করে একটা ক্যারিয়ারে ভরে নিলাম। বড় একটা আইসপ্যাক রেখে দিলাম ওগুলোর ওপরে। চব্বিশ ঘন্টা হয়ত ঠাণ্ডা থাকবে না, কিন্তু নষ্ট হবে না অন্তত। দুই বোতল পানি ক্যারিয়ারে রেখে দেয়ালে ঝোলনো বাবার গাড়ির চাবিটা নিয়ে নিলাম।

গ্যারেজে ঢুকব এমন সময় আবার ফেরত এসে বাবার হলুদ প্যাডটার একটা পাতা ছিঁড়ে ছোট একটা মেসেজ লিখলাম ইনগ্রিড এবং তার উদ্দেশ্যে।

এক মিনিট পরে গ্যারেজের দরজা খুলে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে আসলাম বাসা থেকে।

এরপরের পনের মিনিট যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালালাম। ওপিক বিল্ডিঙটার তিন ব্লক দূরে নিরিবিলি একটা রাস্তায় পার্ক করে রাখলাম ওটাকে। উইন্ডশিল্ড বাদে বাবার গাড়ির সবগুলো জানালার কাঁচই টিন্টেড। ওদিক দিয়ে ভেতরে কেউ কিছু দেখতে পাবে না। আর সামনে দিয়ে অতি আগ্রহি কেউ যদি উঁকি দেয় তাহলে আমাকে পেছনের সিটে ঘুমন্ত অবস্থায় পাবে। তবে আশা করছি অমনটা হবে না।

তিনটা উনষাটের সময় আমার ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। আগামিকাল ওপিক বিল্ডিঙটার ভেতরে ঢুকতে চলেছি আমি। আর আমার কল্পনা যদি ঠিক হয়। সাদা ঘরটার দেখা পাব আমি।

আর দেখা পাব আমার মার।

.

রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা গাড়িটা কারো মনে কোন সন্দেহের সৃষ্টি করেনি। আর কেউ যদি ভেতরে উঁকিও দিয়ে থাকে তাহলে ভেবেছে, একজন ক্লান্ত রাজনীতিবিদ হয়ত ঘুমিয়ে নিচ্ছেন কিছুক্ষণের জন্যে। এই এলাকায় এটা একদমই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

ক্যারিয়ার থেকে স্যান্ডউইচ দুটো বের করলাম, এখনও বেশ ঠাণ্ডাই আছে ওগুলো। তাড়াতাড়ি ওদুটো শেষ করে বোতল বের করে পানি খেয়ে নিলাম।

ফোন চালু করতে ভয় পাচ্ছি।

আমি নিশ্চিত বাবা আর ইনগ্রিড মিলে অন্তত পঞ্চাশবার কল করেছে আমাকে এতক্ষণে। আমার লেখা মেসেজটা পড়া সত্ত্বেও (যেখানে আমি লিখেছি, একটা ব্যক্তিগত কাজে দু-দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি আমি) তারা সব কাজ বাদ দিয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিশ্চয়ই।

কিন্তু ওদের দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখার অপরাধবোধটা হেরে যাচ্ছে মা’কে খুঁজে বের করে তাকে প্রশ্ন করার অদম্য ইচ্ছেটার কাছে। আমি এটা প্রমাণ করতে চাই, তাকে খুঁজে পেতে অন্য কারো সাহায্য প্রয়োজন হয়নি আমার।

নিজের লড়াই নিজেই লড়তে জানি আমি।

ছয় মিনিট পরে এস স্ট্রিট এবং ম্যানচেস্টার অ্যাভিনিউয়ের মোড়টার কাছে এসে রাস্তার পাশেই গাড়িটা পার্ক করে রাখলাম।

আমার পরনে জিন্স এবং গাঢ় নীল রঙের একটা টি-শার্ট। অন্ধকারে সহজে কারো চোখে পড়ব না, তাছাড়া আমার চেহারা দেখে চোর বলেও মনে হয় না।

এক মিনিট হেঁটে দোতলা বিল্ডিংটার সামনে পৌঁছে গেলাম। একটা পাথুড়ে সিঁড়ি কাঠের দরজার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হ্যাঁন্ডেল ধরে টান দিলাম।

তালা দেয়া।

হেঁটে বিল্ডিঙটার অন্যপাশে চলে আসলাম। একটা কাঁচের জানালা আছে এদিকটাতে। ভেতরে উঁকি দিলাম। এর আগে কখনো একটা ইনভেস্টমেন্ট ফার্মে যায়নি আমি। কিন্তু ওগুলোতেও নিশ্চয়ই ভেতরের মতই সারি সারি টেবিল আর চেয়ার পাতা থাকে। এই বিল্ডিংটাকে নিশ্চয়ই এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখে সন্দেহ না করতে পারে। কিন্তু বিল্ডিঙের মাটির নিচে আরো কয়তলা আছে কে জানে!

জানালাটা ধরে নাড়াচাড়া করলাম। কিন্তু এটা ভেতর থেকে বন্ধ। একটু দূরে আরেকটা জানালার কাছে গিয়ে দেখলাম ওটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ভেতর থেকে।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা এগারো।

এবার ঘুরে বিল্ডিঙের পেছনের দিকে চলে আসলাম। এদিকে আরেকটা দরজা আছে। কিন্তু দরজার হ্যাঁন্ডেলের নিচে একটা প্যানেল বসানো।

ওখানে ১২৩৪ চাপলাম। কাজ হল না।

আমাকে ভেতরে ঢুকতেই হবে। এই বিল্ডিংটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতটা শক্তিশালী হবার কথা নয়। অন্তত পুলিশের কাছে রিপোর্ট যাবে এমন কোন সিস্টেম বসানো নেই। কারণ তারা চাইবে না চোর ধরতে এসে পুলিশ আসল সত্যটা আবিষ্কার করে বসুক। তবুও কোন একটা ব্যবস্থা তো আছেই, হাজার হলেও সিআইএ’র একটা প্রোগ্রামের হেড কোয়ার্টার এটা। আমি যদি জোর জবরদস্তি করে কোনভাবে ভেতরে ঢুকি তাহলে কিছু মানুষের কাছে খবর যাবেই। আর তাদের একজন হচ্ছেন আমার মা।

একটা ভারি জিনিস খুঁজে পেতে তিরিশ সেকেন্ড সময় লাগল আমার। ওটা ছুঁড়ে মারব এমন সময় মনে হল পুলিশের কাছে হয়ত সরাসরি খবর যাবে না কিন্তু কেউ যদি কাঁচ ভাঙার আওয়াজ পায় তবে পুলিশে ফোন দিতে পারে। তাহলে সমস্যায় পড়ে যাব। পাশেই দুটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, তোক থাকতে পারে ওগুলোর ভেতর।

রাস্তায় গিয়ে পার্ক করে রাখা বড়সড় একটা গাড়ি বেছে নিয়ে জোরে জোরে ঝাঁকালাম।

তীব্র স্বরে অ্যালার্ম বেজে উঠল।

দৌড়িয়ে ওপিক বিল্ডিঙের পাশে এসে জোরে ঢিল ছুঁড়ে জানালাটা ভেঙে ফেললাম।

গাড়ির অ্যালার্মের ওপর দিয়ে কাঁচ ভাঙার আওয়াজ শুনতে আমার নিজেরই কষ্ট হল। তবে এই অ্যালার্ম খুব বেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করবে না। পুরো শহর জুড়ে প্রায় সারাক্ষনই এরকম আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। আমার একঘন্টার জ্ঞানেও এই কথা ভালোমতই জানি আমি।

চোখা কাঁচগুলো সরিয়ে জানালা গলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

পকেট থেকে ছোট ফ্ল্যাশলাইটটা বের করে জ্বালিয়ে নিলাম। কয়েকটা ডেস্ক ড্রয়ার আর দুটো ফাইল ক্যাবিনেট খুলে দেখলাম ভেতরে কি আছে। একটা স্বাভাবিক অফিসে যা থাকার কথা, ওগুলোই চোখে পড়ল। চারটা ছোট অফিস রুম আছে এই তলায়। সবগুলোতে ঢুকে প্রাথমিক তল্লাশি চালালাম। অস্বাভাবিক কোন কিছু চোখে পড়ল না। এমনকি প্রিন্টারগুলোতেও কালির কার্টিজ আছে দেখলাম।

ওপর তলায় যাওয়ার একটা সিঁড়ি দেখে ওটা বেয়ে উপরে উঠে এলাম। এখানকার অবস্থাও একদম নিচের তলার মতই।

“ধুর।”

আমার ধারণা ভুল মনে হচ্ছে। এটা বোধহয় আসলেই একটা ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম। যার মানে, এখানে চুরি করে ঢোকার পরপরই রিপোর্ট চলে গেছে পুলিশের কাছে। আর পুলিশের গাড়িগুলো নিশ্চয়ই এখন তীরবেগে এদিকে ছুটছে।

তারা চলে আসার আগেই ভাবলাম পালিয়ে যাই। এখনও বাবার বাসায় পৌঁছোনোর মত সময় আছে আমার হাতে। যেকোন একটা গল্প বানিয়ে না হয় বলে দেয়া যাবে। কারণ সত্য কথাটা বলতে লজ্জাই লাগবে : আমি ভেবেছিলাম, সাদা ঘরটার অবস্থান বের করে ফেলেছি আর ওখানে গিয়ে মা’র সাথে দেখা হবে আমার। তখন তাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করব আমি। আর তিনি সব উত্তর বলতে দেবেন আমাকে। বলবেন, কিভাবে এই হেনরি বিনস কন্ডিশন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

গোটা ব্যাপারটার অবাস্তবতায় হেসে উঠলাম। নিচে নামতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে। প্রায় অর্ধেকটুকু নেমেছি এমন সময় গাড়ির অ্যালার্মটা বন্ধ হয়ে গেল। আমার জানামতে বেশিরভাগ গাড়ির অ্যালার্ম পাঁচ মিনিট পর বন্ধ হয়। হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে।

ভাঙা জানালাটার কাছে গিয়ে মাথা বাইরে বের করলাম পুলিশের সাইরেন শোনার জন্যে। কিন্তু কোন আওয়াজ কানে আসল না। নাকি রাতের বেলা সাইরেন বাজায় না?

“ধুর, হেনরি,” নিজেকেই বললাম আমি। লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লাম। “তোমার হাতে এখনও তেতাল্লিশ মিনিট আছে, পুলিশ আসার কথা থাকলে এতক্ষণে এসে পড়ত।”

“ঠিক বলেছ,” একটা গলার আওয়াজ ভেসে আসল অন্ধকারের বুক চিড়ে। “আসার কথা থাকলে ঠিকই এসে পড়ত।”

ঘুরে তাকালাম।

ঘরের মাঝখানে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে।

তার ওপর ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললাম।

সিডনি ওয়েন।

.

হেঁটে ওনার কাছে গেলাম।

কুজো ভঙ্গিটা নেই হয়ে গেছে তার। হাতের ছড়িও উধাও। গতবারের তুলনায় অন্তত বিশ বছর কম মনে হচ্ছে এখন তার বয়স।

“আপনি?” আমি বললাম।

একবার কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি, এরপর বললেন, “আর কাকে আশা করেছিলে?”

“যাকেই আশা করি না কেন, অন্তত আপনাকে করিনি।”

“তোমার মাকে?”

“হতে পারে,” শীতল স্বরে বললাম।

“এলেনা কয়েকদিন আগেও এখানে ছিল। সেটা তো তুমি ভালোমতই জানো। দুঃখের ব্যাপার হল, তুমি ছাড়া পাওয়ার পর এখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে ও।”

“এখন কোথায় তিনি?”

“যতদূর জানি বারমুডায়, কিন্তু এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না ও।”

“দেখান আমাকে,” মাথা নেড়ে বললাম আমি।

উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

“সাদা ঘরটা দেখতে চাই আমি।”

“ওহ্, সাদা ঘর? ওটাকে তো ঐ নামে ডাকি না আমরা,” হেসে বললেন তিনি।

“তাহলে কি নামে ডাকেন?”

“কোন নাম নেই। শুধুই একটা ঘর।”

“কিন্তু এখানে তো এটা?”

তিনি মাথা নাড়লেন।

“দেখান আমাকে।”

“বেশ, আসো আমার সাথে।”

তাকে অনুসরণ করে একটা অফিস ঘরে চলে এলাম আমি। ভেতর ঢুকে পর্দাগুলো নামিয়ে দিলেন প্রথমে, এরপর একটা ফ্যান চালু করলেন। অবশেষে একটা পেপারওয়েট তুলে ডেস্কের বিপরীত দিকে সরালেন ওটা। আস্তে করে একটা আওয়াজ হয়ে ডেস্কটা তিন ফিট সামনে সরে আসল। একটা ধাতব ঢাকনা ছিল ওটার নিচে।

ম্যানহোলের ঢাকনা। নিচু হয়ে ওটা সরাতে লাগলেন। তার বয়সি একজন লোকের জন্যে অনেক খাটুনির একটা কাজ। কিন্তু খুব সহজেই ওটা করলেন তিনি। অথচ প্রথমবার তাকে দেখার পর মনে হয়েছিল খুব বেশিদিন দুনিয়ার আলো দেখার সৌভাগ্য হবে না তার।

একটা মই দেখা যাচ্ছে। নিচের ধূসর অন্ধকার চিড়ে নেমে গেছে ওটা।

“ম্যানহোল?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“তুমি কি আশা করেছিলে? আরো আধুনিক কিছু?”

“সেরকমই কিছু।”

হেসে মই বেয়ে নামতে লাগলেন তিনি। আমি অনুসরণ করলাম তাকে। আমাকে বললেন ঢাকনাটা চাপিয়ে দিতে। দিলাম, কিন্তু অর্ধেক। বলা তো যায় না, যদি পালানোর দরকার পড়ে?

মই বেয়ে দশ ফিট নিচে নেমে শক্ত কংক্রিটের ওপর লাফিয়ে পড়লাম। মৃদু আলোতে বেশ পরিস্কারই লাগল জায়গাটা।

“এটা একটা পুরনো ড্রেনেজ লাইন,” তিনি ব্যাখা করলেন। ষাটের দশকে ওয়াশিংটনের পুরো ড্রেনেজ ব্যবস্থা আবার নতুন করে সংস্কার করা হয়। তখন এই সোয়া মাইলের মত জায়গাটুকু বাদ দিয়ে দেয়া হয়।”

“এজন্যেই ১৯৭৩ সালে ওপিক বিল্ডিঙটা কিনে নেন আপনারা। নিচের পরিত্যক্ত ড্রেনেজ লাইনের জন্যে।”

“সেরকমই বলতে পারো।”

“ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারকর্মিরা এখানে আসতে পারে না?”

“না, দু-পাশেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একমাত্র ঢোকার রাস্তাটা ওপরে।”

“এরপর পুরো জায়গাটা পরিস্কার করে নেন আপনরা?”

“অবশ্যই, না-হলে কাজ করব কিভাবে? তবে এখনও গন্ধের একটা রেশ পাওয়া যায়, খেয়াল করেছ বোধহয়?”

আসলেই পাওয়া যাচ্ছে। পচা শ্যাওলার গন্ধ।

কয়েক কদম হেঁটে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সিকিউরিটি প্যানেল বক্সে পাসওয়ার্ড চেপে ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভেতরে একটা করিডোর।

আমিও তার পেছন পেছন ভেতরে ঢোকার সময় দরজার কাছে হোঁচট খেলাম।

“সাবধানে,” তিনি বললেন।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। তবে তার আগে ফ্ল্যাশলাইটটা দরজার চৌকাঠের কাছে রেখে দিলাম যাতে পুরোপুরি বন্ধ না হয় ওটা। ব্যাপারটা চোখে পড়ল না মি, ওয়েনের।

করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ধাতব দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশাল ল্যাবরেটরি। কম্পিউটার, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট আর মেডিক্যাল যন্ত্রপাতিতে ভর্তি ওটা। অবশ্য বেশিরভাগ মেডিক্যাল যন্ত্রপাতিই আমার চেনা, এমআরআই, সিটি, ইসিজি। জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ওগুলোর ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। আমাকে একবার করে।

কোণার দিকে একটা বিছানা আর ফ্রিজ রাখা। তার মানে, আমার সাথে দেখা করার পর থেকে এখানেই থাকছিলেন সিডনি ওয়েন। অপেক্ষায় ছিলেন কখন ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করব আমি আর অ্যালার্ম বেজে উঠবে।

বিপরীত দিকের দেয়ালে একটা স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি বিশাল জানালা। জানালা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। একদম সাদা ওটুকু।

এটাই সেই সাদা ঘর। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল বুক চিড়ে।

অবশেষে খুঁজে পেয়েছি।

ঘুরে দাঁড়ালাম। ওয়েন একটা ডেস্কের পেছনে চেয়ারে বসে আছেন।

তারদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, “আপনি বলেছিলেন, আমার মার সাথে আপনার তের বছর আগে শেষ কথা হয়েছে। মিথ্যে বলেছিলেন আপনি।”

মাথা নেড়ে সায় জানালেন তিনি, “হ্যাঁ, মিথ্যে বলেছিলাম।”

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললাম, “আপনি কি তার আর ডেভিড সুলিভানের সম্পর্কের ব্যাপারটা জানতেন?”

“হ্যাঁ, জানতাম।”

“আর এটাও জানতেন, আমার মা জেনিফার নিউবারকে খুন করেছেন?”

একটা বাঁকা হাসি দিলেন তিনি।

জানতেন।

“খুলে বলুন আমাকে,” বললাম।

“৯/১১-এর ঘটনার পরে, মানে ডেভিড সুলিভানের মৃত্যুর কিছুদিন পরে এলেনা আমার সাথে যোগাযোগ করে জানতে চায়, ডেভিড আমার কাছে কিছু পাঠিয়েছে কিনা। একটা প্রজেক্টের নাম বলে ও, প্রজেক্ট স্যান্ডমান।”

হাসলাম আমি। ঠিক ধারণা করেছিলাম।

“ডেভিডের সাথে আমার অনেক দিন ধরে কোন যোগাযোগ নেই। সে রাশিয়ান ক্যাম্পটা থেকে পালানোর পর কোন কথাই বলিনি আমরা। তোমার মাকে সেটা জানাই আমি। বলি যে, আমাকে কিছু পাঠায়নি সে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে একটা কুরিয়ার পাই আমি।”

“একটা ফ্ল্যাশড্রাইভভ ছিল ওটার ভেতরে,” আমি বললাম।

মাথা নাড়লেন তিনি।

“হ্যাঁ, একটা ফ্ল্যাশড্রাইভভ। প্রজেক্ট স্যান্ডমান লেখা কেবল একটা ফাইলই ছিল ওটার ভেতরে।”

“জেনিফার নিউবারকে খুন করার ব্যাপারে আমার মা’র স্বীকারোক্তি।”

তাকে দেখে মনে হল অবাক হয়েছেন কথাটা শুনে। বললেন, “ঠিক ধরেছ।”

“ওটা কি লিখিত স্বীকারোক্তি নাকি একটা ভিডিও?”

“একটা ভিডিও।”

“আর ওটাতে তিনি স্বীকার করেছেন, তিনিই খুন করেছেন জেনিফারকে?”

মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিলেন মি. ওয়েন, “দেখবে তুমি ওটা?”

.

“আমার নাম এলেনা জানেভ,” আমার মা বললেন। “আজ ১৯৮৫ সালের জানুয়ারির ১৫ তারিখ,” একটা খবরের কাগজ ক্যামেরার সামনে ধরে তার প্রমাণ দেখালেন তিনি।

আমার স্মৃতিতে তার চেহারাটা যেরকম একদম সেরকমই দেখাচ্ছে তাকে। এটাই স্বাভাবিক, কারণ তাকে আমি শেষবারের মত দেখেছিলাম এই ভিডিওটা তৈরি হবার তিন সপ্তাহ আগে। তার বাদামি চুলগুলো পনিটেইল করে পেছনের দিকে বাঁধা। চোখদুটো উজ্জ্বল সবুজ।

তার গলার কাছটাতে খামচির দাগ আর কপালে একটা ক্ষত। এটা প্রমাণ করে, জেনিফার নিউবার তাকে বাঁধা দিয়েছিল মারা যাবার আগে।

“তিনদিন আগে জেনিফার নিউবার নামের ষোল বছরের এক মেয়েকে খুন করি আমি। তাকে খুন করার কারণ হচ্ছে সে আমাকে অন্য একজন লোকের সাথে সম্পর্করত অবস্থায় দেখে ফেলে, তার কিছু ছবি তুলে আমাকে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টাও করে। এটা আপনারা জানতে পারবেন ক্রাইম সিনের চারপাশে ছড়িয়ে রাখা তার ডায়রির পাতাগুলো পড়ে। ব্ল্যাকমেইল করা জেনিফারের শখ ছিল। দু-সপ্তাহ আগে আমার কাছে এসে ছবিগুলো দেখিয়ে দশ হাজার ডলার দাবি করে সে। অন্যথায় সেগুলো আমার স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেবার হুমকি দেয়।”

আমি ঘুরে ওয়েনের দিকে তাকালাম।

মাথা নাড়লেন তিনি। যেন বলছেন-হ্যাঁ, তোমার মা এতটাই খারাপ।

আর সেটা সত্যিও বটে।

তিনি ওয়েনের চেয়েও খারাপ। ওয়েন মানুষ মেরেছেন আমেরিকার বৃহত্তর স্বার্থে। কিন্তু আমার মা খুন করেছেন নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যে।

মা বলতে থাকলেন : “পাঁচদিন আগে টাকা দেয়ার নাম করে জেনিফারের সাথে দেখা করি আমি। এরপর তার শরীরে চেতনানাশক ইনজেক্ট করে আমার গাড়িতে উঠিয়ে একটা মোটেলে নিয়ে যাই।”

মিথ্যেবাদি।

তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন আপনি। এই সাদা ঘরটাতে।

“ছবিগুলোর ব্যাপারে দু-দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেও ব্যর্থ হই আমি। এক পর্যায়ে রাগের চোটে একটা টেবিল ল্যাম্প দিয়ে মেয়েটার মাথায় জোরে বাড়ি দেই। এতেই মৃত্যু হয় তার। এরপর তার মৃতদেহ ম্যাককেইন পার্কে রেখে ওখান থেকে কেটে পড়ি।”

ভিডিওটা শেষ হয়ে গেল।

এক মিনিট চুপচাপ বসে থাকলাম।

আমার অর্ধেক ডিএনএ এসেছে এক মানুষরূপি এক দানবের কাছ থেকে।

কিন্তু বাকি অর্ধেকটুকু এসেছে কার কাছ থেকে?

দাঁড়িয়ে ওয়েনের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম, “ডেভিড সুলিভান কি আমার বাবা?”

“কিভাবে বুঝলে তুমি?” হেসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

আমি তাকে বললাম কিভাবে আমার মনে এ ব্যাপারে সন্দেহ জাগে, আমার বাবা আসলে আমার জন্মগত বাবা নন। আর এজন্যে তার চুল নিয়ে ডিএনএ ল্যাবে পরীক্ষার জন্যে পাঠাই আমি। ফলাফলে আমার ধারণাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

“যদি চাও তাহলে আমি এখনই বলে দিতে পারব তোমার আসল বাবা কে,” ওয়েন বললেন।

“আপনি পারবেন?” প্রশ্নটা করলেও ভেতরে ভেতরে জানি, কাজটা আসলেও পারবেন তিনি। ডেভিড সুলিভানের ডিএনএ স্যাম্পল আছে নিশ্চয়ই তার কাছে।

“শুধু তোমার রক্ত নিয়ে একটু পরীক্ষা করে দেখা লাগবে। আমাদের ডিএনএ ডাটাবেজ অনেক উন্নত।”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালে তিনি একটা ড্রয়ার খুলে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বের করে নিলেন। হাতে একটা গ্লোভস পরে আমার দিকে এগিয়ে এলেন রক্ত নেয়ার জন্যে।

তিরিশ সেকেন্ড পর তার হাতের ছোট্ট ভায়াল ভর্তি আমার রক্ত।

“দশ মিনিটের মত লাগবে,” বললেন তিনি।

আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা বত্রিশ।

তিনটা পঞ্চানের ভেতরে গাড়ির কাছে ফেরত যেতে হবে আমাকে। তাহলে ঘুমিয়ে পড়ার আগে অন্তত দুয়েক মাইল এগোতে পারব।

ওয়েন একটা মেশিনের কাছে গিয়ে ভায়ালটা ঢুকিয়ে দিলেন। একটা সুইচে চাপ দিলে তীব্র বেগে ঘুরতে লাগল ওটা।

তিনি ডেস্কটার কাছে ফেরত আসলে বললাম, “একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না আমি, আপনার কাছেই যদি ফ্ল্যাশড্রাইভটা থেকে থাকে, তাহলে মা এটা ভাবলেন কেন, ওটা আমার কাছে আছে?”

মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন তিনি।

“আপনিই এটা বলেছেন তাকে!”

“ডেভিডের কাছ থেকে প্রথম যখন ফ্ল্যাশড্রাইভটা পাই আমি, তখন একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা ধরতে বেশি সময় লাগেনি। সে এলেনার স্বীকারোক্তিটা ভিডিও করে যাতে জেনিফার নিউবারের খুনের সত্যটা কখনো ফাঁস হলে কেউ যেন তাকে না দোষ দিতে পারে। যদিও আমার ধারণা জেনিফারকে জিজ্ঞাসাবাদ আর তার মতদেহ পার্কে ফেলে রেখে আসার ব্যাপারে সাহায্য করেছিল সে। আগে থেকেই এমন একটা ব্যবস্থা করে রেখেছিল যাতে তার মৃত্যুর পরে ফ্ল্যাশড্রাইভটা আমার হাতে এসে পড়ে। এর মানে সবসময়ই একটা ভয় কাজ করত তার মনের ভেতর। সে হয়ত ভাবত, তোমার মা তাকে ফ্ল্যাশড্রাইভটার জন্যে খুনও করে ফেলতে পারেন।

“এলেনা আমার সব কুকর্ম সম্পর্কে জানে। ও যদি কোনদিন এসব ব্যাপারে মুখ খোলে, তাহলে বাকি জীবনটা জেলখানায় কাটাতে হবে আমাকে। তাই ভিডিওটা রেখে দেই আমি যাতে বিপদের সময় তার বিরুদ্ধে। কাজে লাগাতে পারি।

“ফ্ল্যাশড্রাইভভটা পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর এলেনাকে ফোন করে জানাই, ভিডিওটা দেখেছি আমি। কিন্তু ওটা রাখার কোন ইচ্ছে নেই আমার। তাই ডেভিডের ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি ফ্ল্যাশড্রাইভভটা।”

“কনর সুলিভান?”

“ঠিক।”

এবার সব পরিস্কার হতে শুরু করেছে আমার কাছে, “আসলে সেটা তাকে দেননি আপনি, তাই না?”

“না, দেইনি।”

“কিন্তু এতে আপনার লাভট কি? প্রেসিডেন্টকে এর সাথে জড়িয়ে? মিথ্যে কথা বলে?”

“সেই সময় কনর প্রেসিডেন্ট ছিল না। ভার্জিনিয়ার গভর্নর ছিল ও। কিন্তু সে-কথা বাদ, আমি কাজটা করেছিলাম যাতে তোমার মা ভাবে, ভিডিওটার দুটো কপি আছে। তাহলে কোন প্রকার চুক্তি করা সম্ভব হবে না তার পক্ষে।”

“কিসের চুক্তি? আমার মাকে দেশের সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থা হন্য হয়ে খুঁজছে। কি এমন থাকতে পারে তার কাছে যে, চুক্তি করতে রাজি হবে সরকার?”

“ফাইলগুলো।”

কিছুক্ষণ ভাবার পরে বুঝতে পারলাম কিসের কথা বলছেন তিনি। ধারণা করা হয়, এমকে আলট্রার সব ফাইল নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়।

“মা’র কাছে নিশ্চয়ই ফাইলগুলোর কপি আছে?”

“হ্যাঁ।”

“আর ওগুলো প্রমাণ করবে, কতটা অমানবিক কাজ করা হয়েছে প্রজেক্ট এমকে আলট্রার এক্সপেরিমেন্টগুলোতে।”

“ভাগ্যজোড়ে যদি মৃত্যুদণ্ড না-ও পাই, বাকি জীবনটা জেলখানাতেই কাটাতে হবে।”

“ঠিক আছে। কিন্তু এসবের সাথে আমার সম্পর্কটা কি?”

“ছয় মাস আগে আমি এলেনাকে ফোন করে বলি, আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে, আমাকে বোঝানো শুরু করলেন ওয়েন।

“যেটা অবশ্যই আরেকটা মিথ্যে কথা।”

“হ্যাঁ, এখনও দিব্যি সুস্থ আমি,” হেসে বললেন তিনি।

“তাকে এটাও বলি, প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ হয়েছে আমার আর তখন তাকে ফ্ল্যাশড্রাইভটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি আমি। জবাবে কনর আমাকে জানায়, এটাও আমার বানানো কথা অবশ্যই, ওটা নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করছিলেন না তিনি। কারণ তার সরকার ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে স্বচ্ছতা। এজন্যে ফ্ল্যাশড্রাইভটা অন্য কাউকে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন একজন লোকের নামই মাথায় আসে

তার।”

“আমি।”

“ঠিক।”

“কিন্তু এত সব কিছু কিসের জন্যে?”

একটা গভীর শ্বাস ফেলে বললেন, “তোমার মা ভেবেছিলেন ছয়মাসের ভেতরেই মারা যাব আমি, সেই সাথে আমার কাছে থাকা তার স্বীকারোক্তির ভিডিওটাও হারিয়ে যাবে। তখন সেটার একমাত্র কপি থাকবে তোমার কাছে। ওটা যদি হাতিয়ে নিতে পারেন তিনি তাহলে সিআইএ’র সাথে চুক্তি করা থেকে কেউ আটকাতে পারবে না তাকে। আর সিআইএ-ও লুফে নিবে সুযোগটা। এমকে আলট্রার ফাইলগুলো পাওয়ার জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি তারা। তোমার মার বিরদ্ধে আনা সব অভিযোগ খারিজ করে দেয়া হবে।”

“আমাকে অপহরণ করেন তিনি। টর্চার করে। কম্পাউন্ড-২৩ ব্যবহার করেন এই আশায় যে, সব উগড়ে দেব,” বললাম আমি।

“কিন্তু তুমি তো ফ্ল্যাশড্রাইভের ব্যাপারে কিছুই জানো না, কারণ ওরকম কিছু দেয়নি তোমাকে প্রেসিডেন্ট।”

“বাল,” মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখটা। এই লোকটার অসুস্থ একট খেলার গুটি আমি।

“আমি জানতাম তোমাকে এলেনা ছেড়ে দেয়ার পর আমার কাছে উত্তরের জন্যে আসবে তুমি। এরপর যখন আমার সাথে দেখা করলে তখন তোমাকে এমন কিছু কথা বলি আমি যাতে করে গোটা ব্যাপারটা নিজে থেকেই ধরতে পার।”

“কিন্তু সেটা কখনোই সম্ভব হত না, যদি না আমি জেনিফার নিউবারের কেসটা নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ-”

হাসলেন তিনি, “মৃত্যুপথযাত্রি ব্যক্তির আরেকটা শেষ ইচ্ছে।”

“প্রেসিডেন্টকে কি বলেছিলেন আপনি? কিভাবে তাকে দিয়ে ভার্জিনিয়ার পুলিশ কমিশনারের কাছে ফোন করালেন? কিভাবে একদম

“একদম সহজ। কনরকে গত ত্রিশ বছর ধরে চিনি আমি। আমাকে আঙ্কেল সিডনি বলে ডাকে সে। তাকে ফোন করে বলি, জেনিফার নিউবারের মা আমার পুরনো বন্ধু। আর আমাকে সে অনুরোধ করেছে যাতে তার মেয়ের কেসটা একবার পুনঃতদন্ত করা হয়। এ-ও বলে দেই, কেসটা যাতে ওয়াশিংটনের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বদলে আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্ট সামলায় এবার। ইনগ্রিডের নামটাও উল্লেখ করে দেই, কারণ এটা জানতাম, সে তোমার সাথেই থাকছে বেশ কিছুদিন ধরে।”

“সব বুঝলাম। কিন্তু এতসব করার কি দরকার ছিল? এর উদ্দেশ্যটা কি? আপনি কি একটা পাগল?”

পুরো জীবন সিআইএ’র সাথে কাজ করে একটা ব্যাপারে দক্ষতা লাভ করেছি আমি।”

কিছুক্ষণ ভাবলাম। এরপর বললাম, “মানুষকে নিয়ন্ত্রন।”

“একদম ঠিক।” তার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলাম আমি।

“আমি চাইছিলাম যাতে এখানে আস তুমি,” তিনি বললেন। “চাইছিলাম যাতে এটা ভাব, এখানে আসলে তোমার মার দেখা পাবে।”

“কেন?”

“কারণ আমি জানতাম, একা আসবে তুমি।”

মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোতের ধারা নেমে গেল।

দরজার দিকে তাকালাম। তিরিশ ফিট দূরে ওটা।

ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা বিয়াল্লিশ।

একবার ভাবলাম, দৌড় দেই। কিন্তু কেন যেন ওয়েনের প্রচ্ছন্ন। হুমকিটার পরও তেমন ভয় পাচ্ছি না আমি। হাজার হলেও, নব্বই বছরের একজন বুড়ো উনি।

কি এমন করা সম্ভব তার পক্ষে?

এ সময় মেশিনটা শব্দ করে উঠলে ওয়েন উঠে গেলেন ওটার দিকে। একটু পরে ফেরত আসলে হাতে একটা কাগজ নিয়ে। ওটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “একদম মিলে গেছে।”

কাগজটা হাতে নিয়ে ফলাফলগুলো দেখে বললাম, “তাহলে ডেভিড সুলিভানই আমার বাবা।”

ওয়েন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “ডেভিড সুলিভানের ডিএনএ স্যাম্পলের সাথে তোমার ডিএনএ স্যাম্পল ম্যাচ করিনি আমি।”

নিঃশ্বাস আটকে গেল।

“আমারটার সাথে করেছি।”

*

অধ্যায় ১৭

এতটা সহ্য করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

এই লোকটা আমার বাবা!

সামনে ঝুঁকে একটু আগে যা খেয়েছিলাম সব উগড়ে দিলাম কংক্রিটের মেঝেতে। “আপনি আমার বাবা!” হাত দিয়ে ঠোঁটের চারপাশটা মুছে জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল যেদিন আমি নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে লেকচার দিয়েছিলাম সেদিন। ঐ রাতটা একসাথে

ওর ব্যারাকে কাটাই আমরা।”

“আর কবে শেষ হয়েছিল ওটা?”

“যখন সে বুঝতে পারল, তুমি ওর পেটে তখনই সম্পর্কটা চুকিয়ে ফেলে। ও চায়নি আমি তার সন্তানের পিতা হই।”

“আপনি কি জানতেন, আপনিই আমার জন্মগত পিতা?”

“হ্যাঁ।”

“আর তিনিও জানতেন?”

“ও একবার পিতৃত্ব পরীক্ষা করেছিল যখন তুমি ছোট ছিলে,” জবাব দিলেন তিনি।

“আপনিও আমার জীবনের অংশ হতে চাননি?”

“সেরকম কোন ইচ্ছে ছিল না আমার,” মা’র মত শীতল স্বরেই জবাব দিলেন তিনি। কিন্তু আমার মনে হয় ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম আমি। রিচার্ড আমার চেয়ে অনেক ভালো একজন বাবা।”

“সেটা আপনাকে বলে দিতে হবে না!” চিৎকার করে উঠলাম।

এসময় তার হুমকিটার কথা মনে পড়ল। “তো, আমাকে এখানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য কি? আমার জন্যে দরদ উথলে পড়ছে এখন? বাবার দায়িত্ব পালন করতে চান?”

“না,” তিনি বললেন, “তোমার সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চাই

“কি? কি জানতে চান আপনি? আমার বাবা-মা দু-জনেই খুনি এটা জানতে পেরে আমার কেমন লাগছে সেটা? আমার ইচ্ছে করছে এখন আপনাকে খুন করতে।”

খুব কষ্ট করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে সামলালাম।

“আমি সাইক্রিয়াট্রিস্ট নই,” হেসে বললেন তিনি। তাই তোমার এখন কেমন লাগছে সেটা শোনার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নেই। আমি জানতে চাই তোমার মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে।”

সবগুলো মেশিনের দিকে ইশারা করে দেখালেন তিনি।

“আমার গায়ে একটা টোকাও দিতে পারবেন না আপনি,” এই বলে আমাদের মাঝের দূরত্বটা কমিয়ে আনতে লাগলাম। আর একটা কথা বললে তার টেকো মাথাটা মেঝের সাথে ঠুকে দেব সর্বশক্তিতে।

কিছুই বললেন না তিনি। শুধু একটা পিস্তল বের করে আমার দিকে তাক করে ওনার ঘড়ির দিকে তাকালেন।

আমি আমারটার দিকে তাকালাম।

তিনটা উনপঞ্চাশ।

আর এগারো মিনিট, এরপর আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারবেন তিনি।

.

জেগে উঠলাম।

একটা টেবিলের সাথে বেধে রাখা হয়েছে আমাকে।

সাদা ঘরটাতে।

চিৎকার করতে লাগলাম। দরজা খুলে গেল। ওদিকে তাকালাম।

“শুভ সকাল,” ওয়েন বললেন।

“হারামির বাচ্চা।”

“খুব খারাপ মুডে আছ দেখছি। ঘুম হয়নি ঠিক মত, নাকি?”

ওয়েন হাসল কেবল, এরপর যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন দ্রুত।

তিনবার লম্বা শ্বাস নিলাম। সৌভাগ্যবশত কাল রাতে আমার শরীরে কম্পাউন্ড-২৩ ইনজেক্ট করে হয়নি। যার কারণে দুঃস্বপ্নও দেখিনি আমি। তবে আরেকটা রাত সেভাবে যাবে কিনা সন্দেহ আছে আমার।

বামদিকের দেয়ালের দিকে তাকালাম, আসলে ওটা একটা আয়না।

সেদিকে তাকিয়ে বললাম, “কাপুরুষের বাচ্চা, সাহস থাকলে সামনে আয়।”

মোচড়ামোচড়ি করতে লাগলাম আমি।

আমার মনে হচ্ছে, এই বুঝি মা হাতুড়িটা নিয়ে ভেতরে ঢুকে ফ্ল্যাশড্রাইভভটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে।

এবার উত্তর আছে আমার কাছে। তাকে বলব তার এক সময়ের প্রশিক্ষক, প্রেমিক আর তার একমাত্র সন্তানের বাবার কাছে আছে ওটা। আরো বলব, তিনি একজন খুনি। ষোল বছরের একটা মেয়েকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছেন। তবে ফ্ল্যাশড্রাইভভটার অবস্থান জানাবোনা তাকে। হাতের যতগুলো হাড্ডিই ভাঙুক না কেন, সে ব্যাপারে টু শব্দটিও করব না।

দরজা খুলে ওয়েন ভেতরে ঢুকলেন আবার। তার হাতে একটা আইপ্যাড।

আমার যে টেবিলটায় শুয়ে আছি তার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “তোমার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা অসাধারণ।”

আইপ্যাডটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন তিনি।

“স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তোমার মস্তিষ্কের সিন্যান্সগুলো প্রতি মিলিসেকেন্ডে বারো গুণ বেশি তাড়াতাড়ি কাজ করে। এমনকি আমার মস্তিষ্কের তুলনায়ও অনেক অনেক বেশি!”

আমার পায়ের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি কখনও জানতে ইচ্ছে করেনি? জানতে ইচ্ছে করেনি কেন এত বুদ্ধিমান তুমি? কিভাবে এত কম সময় জেগে থেকেও অন্য মানুষের তুলনায় তোমার বুদ্ধি এতটা বেশি?”

সত্যি কথা বলতে আমার মনে ঠিক একই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেয়েছে অনেকবার। মাঝেই মাঝেই এটা নিয়ে ভাবি আমি।

“ভালো লাগল শুনে,” এই বলে আইপ্যাডটার স্ক্রিনের ওপর থুতু ছিটিয়ে দিলাম।

একটা টিস্যু দিয়ে স্ক্রিনটা পরিস্কার করে বললেন তিনি, “আসল মজা তো আজ রাতে শুরু হবে। যখন আমি দেখব তোমার মস্তিষ্ক কম্পাউন্ড-২৩ এর উপস্থিতিতে কিভাবে কাজ করছে।”

আরেকবার ২৩ ঘন্টার দুঃস্বপ্নের কথা ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠল।

“না…না…দয়া করে অমন করবেন না…” অনুনয় করতে লাগলাম কাতর স্বরে।

হেসে আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি, বললেন, “চিন্তা কর না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এরপর চলে গেলেন তিনি দশ মিনিটের জন্যে। নানারকম চিন্তা ঘুরতে লাগল আমার মাথায়।

ওয়েন আগে বলেছিলেন দুঃস্বপ্ন তৈরি করা অনেকটা কৃত্রিমভাবে টর্নেডো সৃষ্টি করার মতই। একটা অশান্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে মনের মধ্যে। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক যেহেতু স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক ভালো কাজ করে তাই সেটাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারা সম্ভব আমার নিজের পক্ষেই। শান্ত থাকতে হবে। কোন প্রকারের অশান্তি সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না।

আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। আমার বাবা-আমার আসল, পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা বাবা, ল্যাসি, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, মারডক, বোকা কিন্তু বিশ্বস্ত এক অনুচর; আর ইনগ্রিড। এখান থেকে যদি বেঁচে ফিরতে পারি আমি তাহলে ওকে দেখা মাত্র বিয়ের প্রস্তাব দেব। বলব, ওকে ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমাদের বাকি জীবনটা একসাথে কাটাতে চাই।

কল্পনা করতে লাগলাম, আমি, ইনগ্রিড, ল্যাসি আর ছোট্ট একটা ছেলে-সবাই শুয়ে আছি এক বিছানায়। সময় নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করছে না, আমিও না।

দরজা খুলে গেলে কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম।

“এখনই কাজ শুরু করতে চাই আমি,” ওয়েন বললেন। গোলাপি রঙের তরল ভর্তি একটা সিরিঞ্জ তার হাতে। “আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

হেঁটে আমার একদম পাশে চলে এলেন তিনি।

“ওহ্, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি,” তিনি বললেন। “আমার পিচেস ওর বার্ষিক চেক-আপের জন্যে ডাক্তারের কাছে গেছিল গত সপ্তাহে। বল তো কি ঘটেছে?”

আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করলেন না তিনি।

“ও প্রেগন্যান্ট,” বললেন তিনি। “তোমার বিশ্বাস হয় এটা? আমার পিচেস কিনা প্রেগন্যান্ট? তোমার ঐ হতচ্ছাড়া বিড়ালটার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই তো?”

এই রকম পরিস্থিতিতেও না হেসে পারলাম না, “হ্যাঁ, ওরই কাজ এটা,” হাসতেই থাকলাম। “আপনার ঐ হোঁতকা বিড়ালটার এই অবস্থার জন্যে ও-ই দায়ি।”

চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল তার। এই প্রথম তাকে একটু রেগে উঠতে দেখলাম।

“এখন পিচেস আরো মোটা হয়ে যাবে,” হিস্টেরিয়াগ্রস্তের মত কথাটা বললাম।

সিরিঞ্জটা নিচে নামিয়ে আনতে লাগলেন তিনি।

একবার চিৎকার করে উঠে বাম হাতে জোরে উপরে উঠিয়ে আনলাম।

দুঃস্বপ্নে আমার দু-হাতই অনেক শক্ত করে বাঁধা ছিল, কিন্তু ওয়েন আমার ডান হাতে তুলনায় বাম হাতটা একটু ঢিল করে বেঁধেছেন।

গত দশ মিনিট করে একটু একটু করে ঐ হাতটা বাঁধন থেকে বের করে আনছিলাম আমি। অর্ধেকটুকু বের করার পর মনে হচ্ছিল আমার কোণার আঙুলটা বুঝি ভেঙেই যাবে। হাল ছেড়েই দিচ্ছিলাম প্রায়, কিন্তু সিরিঞ্জটা নেমে আসতে দেখতে হ্যাঁচকা টান লাগাই। বুড়ো আঙুলে অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করে হাতটা বের করে আনতে সক্ষম হই।

বাড়ি মেরে সিরিঞ্জটা তার হাত থেকে ফেলে দিয়ে ওয়েনের শার্টের নিচের দিকটা ধরে জোরে টান দিলাম। বাম হাতটা বাদে শরীরের বাকি অংশ এখনও বাঁধা আমার। কিন্তু ঐ হাতেই যেন শরীরের সব শক্তি ভর করেছে।

টেবিলের দিকে টানতে শুরু করলাম আমি তাকে। আমাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকলেন তিনি, হাতে থাপ্পড় দিলেন কয়াকটা। কিন্তু একটা বাচ্চার চেয়েও কম শক্তি তার গায়ে।

টেনে আমার গায়ের ওপর ফেলে দিলাম তাকে। এবার শার্টের নিচের দিক ছেড়ে কলারটা ধরলাম শক্ত করে। ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করলেন একবার। কিন্তু পারলেন না। কলার ধরে তার মাথাটা উপরে উঠিয়ে জোরে নিচে নিয়ে আসলাম। আমার কপাল বরাবর। তার মুখটা জোরে গুতো খেল ওখানে। হাড্ডি ভাঙার শব্দ পেলাম।

আমার নিজেরও মাথা ঘুরতে লাগল।

মাথা ঝাঁকিয়ে যখন স্বাভাবিক হলাম, ওয়েন অচেতনভাবে পড়ে আছেন আমার ওপর। বাম হাত দিয়ে তাকে গায়ের ওপর থেকে সরিয়ে দিলাম। চার ফিট নিচে কংক্রিটের ওপর পড়ে গেলেন। গলার বাধনটা খুললাম আগে, এরপর ডান হাত, এরপর দুই পা। লাফিয়ে নেমে গেলাম টেবিল থেকে।

ওয়েন চিত হয়ে পড়ে আছেন। নাক ভেঙে এক দিকে বেঁকে আছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে ওখান থেকে। এসময় একটু নড়ে উঠলে তার শরীর হাতিয়ে দেখলাম যে বন্দুকটা আছে কিনা। নেই ওটা তার সাথে।

“আ…” গুঙিয়ে উঠলেন তিনি।

তাকে উঠিয়ে টেবিলটার ওপর শুইয়ে দিলাম। এরপর বেধে ফেললাম শক্ত করে।

সাদা ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।

মেডিক্যাল সাপ্লাই ক্যাবিনেটে কিছু গজ আর টেপ খুঁজে পেলাম। ওগুলো দিয়ে বেধে নিলাম বাম হাতটা। বন্দুকটা কম্পিউটার টেবিলের ওপর রাখা। কোমরে গুঁজে নিলাম ওটা।

তিনটা উনিশের সময় আবার সাদা ঘরটাতে প্রবেশ করলাম।

ওয়েনের জ্ঞান ফিরে এসেছে এতক্ষণে।

“কি করছ তুমি!” আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

“টেবিলে বাঁধা অবস্থায় থাকতে একটু অন্যরকম লাগছে, তাই না? সবসময় তো উল্টোটাই ঘটে,” আমি বললাম।

মেঝে থেকে সিরিঞ্জটা তুলে নিয়ে তার উপর ঝুঁকলাম।

“মা’র সাহস ছিল নিজের ওপর এটা পরীক্ষা করে দেখার। কিন্তু আমার ধারণা আপনি কখনোই অতটা সাহসি ছিলেন না। এবার সময় এসেছে, দেখি কতটা সহ্য করতে পারেন আপনি। আপনার এত বছরের সিআইএ’র ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার দরুন দুঃস্বপ্নে কি সব দেখবেন তা ভাবতেই ভালো লাগছে।”

“দয়া করে ইনজেক্ট কোরো না ওটা, দোহাই লাগে তোমার,” অনুনয় করতে লাগলেন তিনি।

আমি সিরিঞ্জ নামিয়ে আনলাম। চিৎকার করে ছয়টা শব্দ বললেন তিনি।

শুনে থমকে গেলাম। “কি?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

“তোমাকে সুস্থ করে তুলতে পারব আমি,” তিনি বললেন।

*

অধ্যায় ১৮

“সুস্থ করে তুলবেন?” জিজ্ঞেস করলাম। “সুস্থ করে তুলবেন মানে কি?”

হাপরের মত নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। সেই ফাঁকে কোনমতে চি-চি করে বললেন, “তোমার ঘুম আর জাগরণের চক্র ঠিক করে দিতে পারব আমি।”

“আপনি তো বলেছিলেন একমাত্র আমার মা ছাড়া আর কেউ জানে না আমাকে ঠিক করে তোলা সম্ভব কিনা।”

মাথা ঝাঁকালেন তিনি। বললেন, “তোমার মস্তিষ্ক অনেকটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মত। শুধু সব কিছু মুছে ফেলতে হবে স্মৃতি থেকে।”

তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এরপর সিরঞ্জটার দিকে তাকিয়ে ইনগ্রিডের কথা ভাবতে লাগলাম। আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলাম। যেখানে চাইলেও ওর সাথে প্রতিদিন এক ঘন্টার বেশি কাটানো সম্ভব না আমার পক্ষে।

“সত্যি কাজ করবে ওটা,” তিনি বললেন।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সাবধানে সিরিঞ্জটা পকেটে পুরে রাখলাম ক্যাপ লাগিয়ে। তার কথা পুরোটা শুনতে তো সমস্যা নেই।

“এমন কিছু আগে করেছেন আপনি?” জিজ্ঞেস করলাম।

গলাটা উঁচু করলেন তিনি। এরপর বাঁধা থাকা অবস্থাতেই যতটা সম্ভব মাথা নেড়ে বললেন, “এমকে আট্রার কিছু সাবজেক্টে আমরা বেশ কয়েকজন সাবজেক্টের স্মৃতি মুছে দিয়েছি। এদের অনেকেরই অবসেসিভ কম্পালসিভ-ডিজঅর্ডার, কিংবা মাল্টিপাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ছিল। কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক যখন একদম আগের অবস্থায় ফিরে গেল, তখন ওসব কন্ডিশনও দূর হয়ে গেছিল।”

“কিন্তু আমার কন্ডিশনের সাথে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের অনেক তফাৎ।”

“না, আসলে অতটা তফাৎ নেই। তোমার কন্ডিশনটা অনেকটা অবসেসিভ-কম্পালসিভ-ডিজঅর্ডারের মতনই। মস্তিষ্ককে শিখতে হয় ওটাকে। আর তোমার মস্তিষ্ক শিখেছে, রাতে কেবল এক ঘন্টার জন্যে জেগে উঠতে হবে। ওটা কোন জিনগত বৈশিষ্ট্য না, যেমনটা তোমার। চোখের মণির রং একটা জিনগত বৈশিষ্ট্য।”

“কিন্তু মা যখন কম্পাউন্ড-২৩ নিজের শরীরে প্রয়োগ করেন তখন আমি তার পেটে ছিলাম।”

“সেটা কোন ব্যাপার না। তোমার কন্ডিশনটা তবুও শিখতে হয়েছে তোমার মস্তিষ্ককে। কম্পাউন্ড-২৩ শিখিয়েছে সেটা, ওটারই প্রভাবে এমনটা হয়েছে।”

“তো, এখন কোনভাবে সব স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে? আপনি কি আমাকে ইলেক্টো-শক-থেরাপি দেয়ার কথা ভাবছেন? আগেই বলে রাখি, ছোটবেলায় অনেকবার ওভাবে চেষ্টা করে দেখা হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি।”

“না,” একবার কেশে উঠে বললেন তিনি। “ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দরকার এ ক্ষেত্রে।”

কিছু না বুঝে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

লম্বা একটা শ্বাস নিলেন তিনি, “ব্যাপারটা ব্যাখা করা বেশ জটিল, কিন্তু সংক্ষেপে বলছি। রেডিও তরঙ্গ আর আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ দুটোই একধরণে ইলেক্টো-ম্যাগনেটিক-রেডিয়েশন। একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য।”

“এরপর? বলতে থাকুন।”

“আমাদের মস্তিষ্ক যখন পূর্বের কোন স্মৃতি মনে করে তখন হাজারটা নিউরন একসাথে কাজ করে, তোমার ক্ষেত্রে হয়ত কয়েক লক্ষ। ফলে বেশ শক্তিশালী একটা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। আমরা এমন একটা যন্ত্র বানিয়েছি যেটা সেই তরঙ্গকে নকল করবে। এরপর ঘনীভূত তরঙ্গ মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু জায়গায় আঘাত করলে ফলাফল স্বরূপ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ব্যাহত হয়। এই পদ্ধতিকে বলে ট্রান্সক্র্যানিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন।”

“ট্রান্সক্র্যানিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন,” ওনার কথাটার পুণরাবৃত্তি করলাম। জীবনে অনেক মেডিক্যাল টার্ম শুনেছি আমি, এটা ওগুলোর মধ্যে নয়।

“আমরা মস্তিষ্ককে লক্ষ লক্ষ ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গ দিয়ে আঘাত করে উদ্দীপ্ত করতে থাকবো। এক পর্যায়ে ওটা আর নিতে পারবে না মস্তিষ্ক। তখন অনেকটা নিজেকে বাঁচানোর জন্যে যত স্মৃতি আছে সব মুছে ফেলবে। তারপর সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে কিছুক্ষণের জন্যে। এরপর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কিন্তু কোন স্মৃতি থাকবে না।”

“সব স্মৃতি মুছে ফেলবে বলতে?”

“যা যা শিখেছিল তোমার মস্তিষ্ক, যা স্মৃতি জড়ো করেছিল, সব।”

“তারমানে, আবার একটা বাচ্চার মত আচরণ করা শুরু করব আমি?”

“হ্যাঁ এবং না।”

“মানে?”

“এটা ঠিক, তোমার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ খালি হয়ে যাবে, সম্ভবত একটা বাচ্চার চেয়েও খালি, কিন্তু সেটার গঠন কিন্তু আগের মতই থাকবে। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের যেমন থাকে।”

“তারমানে আমার মস্তিষ্ক খালি থাকলেও অনেক দ্রুত সবকিছু আবার শিখতে পারব আমি?”

“হ্যাঁ। যাদের ওপর এই এক্সপেরিমেন্টগুলো করা হয়েছিল তারা দু মাসেরও কম সময়ে কথা বলতে শিখেছে। আর চারমাসের মধ্যে লিখতে শিখেছে। তিন বছরের মধ্যে বেশিরভাগের মস্তিষ্কই আগের মত কর্মক্ষম হয়ে উঠেছিল।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আবার কথা বলা শিখতে হবে, লেখা শিখতে হবে, দাঁত ব্রাশ করা শিখতে হবে, ভাবতে কেমন যেন লাগছে। কিন্তু অন্যদিকে হাতে সময়ের অভাব থাকবে না আমার। একটা স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্ক আবার আগের মত কর্মক্ষম হতে যদি তিন বছর সময় লাগে আমার ক্ষেত্রে হয়ত সময় লাগবে দুই বছর। সেই দুই বছর অবশ্যই কষ্ট করতে হবে আমাকে কিন্তু এর পরে যত বছর বেঁচে থাকব একজন স্বাভাবিক মানুষের মত জীবন যাপন করতে পারব।

২০,০০০ ঘন্টার বিপরীতে ৩০০,০০০ ঘন্টা।

কিন্তু কথা বলা আর হাঁটতে শেখার চেয়েও বড় ব্যাপার আছে এখানে।

“আমার সব স্মৃতি চলে যাবে?”

মাথা নেড়ে সায় জানালেন তিনি।

ইনগ্রিড।

বাবা।

ল্যাসি।

মারডক।

তাদের সবার কথা ভুলে যাব আমি। ভুলে যাব যে, তাদের চিনতাম একসময়। কান্না পেতে লাগল এই কথা ভেবে। আমি কি স্বার্থপরের মত আচরণ করছি ওয়েনের প্রস্তাবটা ভেবে দেখে?

না, অবশ্যই না।

ইনগ্রিড আর বাবা ভালোবাসেন আমাকে। তারা চাইবেন আমি যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠি। চাইবেন আমি যেন এক ঘন্টার বদলে ষোল ঘন্টা কাটাই তাদের সাথে প্রতিদিন।

তাছাড়া আমি একজন বাবা হতে চাই, নিজের জন্যে না হলেও, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে কাজটা করতেই হবে আমাকে।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা ছাব্বিশ।

“ঠিক আছে, তার উদ্দেশ্যে বললাম, “রাজি আমি।”

.

বাম হাতের দুটো আঙুল ভেঙে গেছে আমার। তাই এক হাত দিয়ে তিনটা ইমেইল লিখতে প্রায় বিশ মিনিট সময় লাগল।

প্রথম দুটো বাবা আর ইনগ্রিডের উদ্দেশ্যে। সেখানে তাদের ব্যাখা করলাম কেন এবং কি করতে চলেছি আমি। প্রথম দিকে আমার সাথে মানিয়ে নেয়া হয়ত কঠিন হবে কিন্তু তাদের ধৈর্য ধরতে হবে, আর আমার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। কথা দিলাম, তাদের দুজনকে আগের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসতে শিখব আমি। ধন্যবাদ জানালাম এত সুন্দর সুন্দর সব স্মৃতি উপহার দেয়ার জন্যে। কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষের মত জীবন যাপন করতে চাই আমি।

তিন নম্বর ইমেইলটা আমার উদ্দেশ্যে লেখা।

সেগুলো পাঠিয়ে দিয়ে সাদা ঘরটায় ফিরে আসলাম।

তিনটা ছেচল্লিশ বাজছে।

ওয়েনের বাঁধনগুলো খুলে দিলাম। তার দিকে পিস্তল তাক করে বললাম, “উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করলেই গুলি খাবেন।”

ল্যাবে এসে আমাকে একটা মেশিনের দিকে যেতে ইশারা করলেন ওয়েন। অনেকটা এমআরআই মেশিনের মতন দেখতে ওটা।

“পিস্তলটা সরিয়ে রাখতে হবে তোমাকে। মেশিনের ভেতরে ধাতব কোন কিছু নেয়া যাবে না।”

তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, কিন্তু করলাম। ব্যক্তি ওয়েনকে নয়, বিজ্ঞানী ওয়েনকে। তার চোখের কৌতূহলটা ধরতে পারছি আমি। আমাকে নিয়ে যে কোন কিছু করতে পারেন তিনি, কিন্তু এ মুহূর্তে তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, আমাকে ঠিক করে তুলতে পারবেন কিনা।

বন্দুকটা কাউন্টারের ওপর নামিয়ে রাখলাম।

“ঘড়িটাও খুলে ফেলতে হবে,” তিনি বললেন।

ওটা খুলে বন্দুকটার পাশে রেখে দিলাম আমি।

তিনটা পঞ্চাশ বাজছে এখন।

এই ভেবে হেসে উঠলাম, এটাই বোধহয় আমার জীবনের শেষবারের মত সময় দেখা। জেগে ওঠার পর সময়ের কোন কমতি থাকবে না আমার কাছে।

“শুয়ে পড়,” আদেশ দিলেন তিনি।

শুয়ে পড়লাম।

জীবন্ত হয়ে উঠল মেশিনটা।

“ঠিক আছে,” ওয়েন বললেন। “শুরু করলাম।”

“বিদায়, হেনরি বিনস,” নিজেকেই ফিসফিস করে বললাম আমি।

.

চোখ খুললাম।

আমাকে ঘিরে অনেকগুলো অবয়ব আর শব্দ।

কিছু একটা ঝুঁকল আমার ওপর।

কিছু একটা স্পর্শ করল আমাকে।

“হেনরি।”

এই শব্দটার কোন অর্থ নেই আমার কাছে।

“হেনরি।”

কি হচ্ছে এসব?

কোথায় আমি?

“হেনরি?”

শব্দের উৎসটা আমাকে ধরে নাড়াতে লাগল।

“তোমাকে চিনতে পারছে না ও,” একটা গলার স্বর বলে উঠল।

“ওকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে আমাদের, আরেকটা গলার আওয়াজ।

আমি নড়ছি।

উপরের দিকে।

মাথা ঝাঁকালাম।

নিচের দিকে তাকালাম।

আমাকে যে দু-জন ধরে তোলার চেষ্টা করছে তাদের দেখলাম।

“তুমি কি জান আমরা কে?” তাদের একজন জিজ্ঞেস করল।

মাথা ওপরে নিচে নাড়ালাম আমি। জানি আমি। “হ্যাঁ,” বললাম।

ইনগ্রিড আর বাবা অবাক হয়ে গেলেন।

সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। গতরাতে মেশিনটার ভেতরে তিরিশ সেকেন্ড কাটানোর জন্যে এমন হচ্ছে।

আস্তে আস্তে কালকের ঘটনা সব মনে পড়তে লাগল। মেশিনে শুয়ে আছি আমি। অনেক জোরে শব্দ হচ্ছে।

আমি আমার সব স্মৃতির কথা ভাবছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চিরতরে মুছে যাবে ওগুলো : বাবা আমাকে শিখাচ্ছেন কিভাবে পোকার খেলতে হয়, আমাকে ম্যাকডোনাল্ডসে নিয়ে খাওয়াচ্ছেন, গাড়ি চালানো শেখাচ্ছেন। প্রথম যেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠে ল্যাসিকে আমার বুকের ওপর আবিষ্কার করলাম, ওকে পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, মারডকের সাথে খেলছি। যখন ও একটা ছোট্ট কুকুর ছানা ছিল। ইনগ্রিড, ওর সাথে প্রথম দেখা, প্রথম চুমু, সব ভাসতে লাগল চোখের সামনে।

নাহ, এই স্মৃতিগুলো ভোলা কোনভাবেই সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তার জন্যে যত কষ্টই করতে হোক না কেন আমার সারাজীবন।

লাফিয়ে মেশিনটা থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি।

“কি করছ?” ওয়েন চিৎকার করে উঠলেন।

“আমি যেমন আছি, ঠিক আছি,” বললাম।

“না, আবার ওখানে যাও তুমি। আমাদের দেখতে হবে, পদ্ধতিটা কাজ করে কিনা।”

“আমি কোন এক্সপেরিমেন্ট নই,” এই বলে তার চেহারা বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দিলাম।

এরপর বন্দুকটা নিয়ে তার দিকে তাক করলাম।

“মেশিনের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন,” আদেশ দিলাম।

“অসম্ভব।”

তার মাথার একদম পাশ ঘেঁষে গুলি করলাম।

“আরেকবার বলব না আমি।”

চুপচাপ মেশিনের ভেতর ঢুকে গেলেন তিনি।

পরবর্তি সাত মিনিট তার দিকে বন্দুক তাক করে রাখলাম।

তিনটা উনষাটের সময় হলওয়েতে এসে শুয়ে পড়লাম। এখানেই কিছুক্ষণ আগে আমাকে খুঁজে পেয়েছে ইনগ্রিড আর বাবা।

“কাজটা করিনি আমি,” ওদের বললাম।

“ধন্যবাদ ঈশ্বর,” উপরের দিকে তাকিয়ে এই কথা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা।

“হয়ত অনেকগুলো বাড়তি ঘন্টা পেতাম কিন্তু সেগুলোর জন্যে সারাজীবনের স্মৃতিগুলোকে বিসর্জন দেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমার পছন্দের মানুষগুলোকে ভুলে যেতে পারব না।”

তিনজন তিনজনকে শক্ত করে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ।

এরপর চোখ মুছে ইনগ্রিডকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই জায়গাটা খুঁজে পেতে কি কষ্ট হয়েছে?”

দু-বার নাক টানল ও, এরপর বলল, “না, তোমার নির্দেশনাটা অনেক সহজ ছিল।”

ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পেছনের অফিসটাতে চলে যাবে। ম্যানহোলের ঢাকনাটা খুলে নিচে নামবে। একটা দরজা খুঁজে পাবে যার চৌকাঠে ফ্ল্যাশলাইট রাখা আছে।

এরপরের পনের মিনিটে ওদের সব খুলে বললাম আমি : ওপিকের ব্যাপারটা কিভাবে মাথায় আসল, কিভাবে ভেতরে ঢুকলাম, এরপর ওয়েনের সাথে সাক্ষাত, কিভাবে সব কিছু পূর্ব পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন তিনি, এমনকি ইনগ্রিড যাতে জেনিফার নিউবারের কেসটা পায় সেটাও, আর পুরোটাই আমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্টের জন্যে।

বললাম কিভাবে আমাকে বেধে রেখেছিলেন তিনি, কিভাবে মুক্তি পেলাম।

“তোমার হাত, ইনগ্রিড বলল।

“হ্যাঁ, গজ কাপড়ের নিচে আঙুলগুলো কি অবস্থায় আছে সেটা জানতেও চাই না এমুহূর্তে। বুড়ো আঙুলটা ভেঙে গেছে এটুকু নিশ্চিত আমি।”

“তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।”

মাথা নাড়লাম, এরপর আবার বলা শুরু করলাম আমার কাহিনী। ওদের বললাম কিভাবে একদম শেষ মুহূর্তে ওয়েন বলেন, আমাকে ঠিক করে তুলতে পারবেন তিনি, কিভাবে ওদের ইমেইলগুলো পাঠালাম যাতে ওরা এটা জানতে পারে, কোথায় আছি আমি আর আমার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু মেশিনে ঢুকে আবার সবকিছু পুনর্বিবেচনা করি আমি। এরপর কিভাবে ওয়েনকে মেশিনের ভেতর ঢুকতে বাধ্য করি।

“ওয়েনের কি অবস্থা?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল।

“ভালো প্রশ্ন।”

দরজা খুলে ল্যাবে প্রবেশ করলাম আমরা।

ওয়েন সেখানে বাচ্চাদের মত গোল হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছেন। টাক মাথার কারণে তাকে একদম নবজাতক শিশুর মতনই দেখাচ্ছে।

“বেনজামিন বাটন,” বাবা বললেন।

আমি সিনেমাটা দেখিনি, কিন্তু তিনি বুঝিয়ে দিলেন আমাকে, ওতে একটা বাচ্চা জন্ম নেয় বুড়ো মানুষের আদলে। এরপর সময়ের সাথে বয়স কমতে থাকে তার।

“অনেকটা ওরকমই অবস্থা,” ইনগ্রিড তার কথা শেষ হবার পর বলল।

তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।

“সিডনি?”

নীল চোখগুলো বড় করে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ভীত। বিভ্রান্ত। মুখ দিয়ে দুর্বোধ্য শব্দ করলেন একবার।

“একে নিয়ে এখন কি করব আমরা?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল। “তাকে তো এখানে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারি না।”

“তাকে কি আপনি বাসায় নিয়ে যেতে চান বাবা?” জিজ্ঞেস করলাম। “আমি আর ইনগ্রিড চলে যাবার পর মারডক আর আপনি নতুন একটা সঙ্গ পাবে তাহলে।”

“এই এক জীবনে যথেষ্ট ডায়পার বদল করেছি আমি,” হেসে বললেন তিনি।

এসময় একবার মনে হল, মেঝেতে শুয়ে থাকা নব্বই বছরের বাচ্চাটা আমার জন্মগত পিতা।

কিন্তু সেটা কখনোই মানতে পারব না আমি।

আমার পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি ছোটবেলায় আমার সব ডায়পার বদলে দিয়েছেন…তিনিই আমার বাবা।

*

অধ্যায় ১৯

“এই নে, মাস্তান,” বিছানার ওপর ল্যাসির দিকে চারটা বল ছুঁড়ে দিয়ে বললাম আমি।

খুশিতে ডগমগ হয়ে লাফাতে লাগল ও। কোনটা নিয়ে আগে খেলবে বুঝতে পারছে না।

হেসে উঠলাম শব্দ করে। গত তিন দিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

ওপিক বিল্ডিংটা থেকে বের হয়ে আমি বাবার কাছে থেকে এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছিলাম ইনগ্রিডের সাথে একান্তে কিছু কথা বলার জন্যে।

ওকে বলেছিলাম, আমার হাতে সামনের দিনগুলোতে আর যতগুলো ঘন্টাই থাকুক না কেন ওগুলোর প্রত্যেকটা ওর সাথে কাটাতে চাই আমি। জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাকে বিয়ে করবে কিনা।

শুনে প্রথমে কেঁদে দিয়েছিল ও। এরপর হ্যাঁ বলে আবার কান্না।

আমরা যখন গাড়ির কাছে পৌঁছলাম তখন বাবা ডাইভিং সিটে এবং ল্যাসি আর মারডক পেছনের সিটে। দু-জনেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাকে দেখে আর ল্যাসি বারবার আমার চোখের সামনে ওর থাবা মেলে ধরে জিজ্ঞেস করছিল কয়টা আঙুল আছে ওখানে।

ইনগ্রিড আর আমি আমাদের এনগেজমেন্টের কথা বললে সবাই আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে উদযাপন করি আমরা। আমি অর্ডার করেছিলাম একটা চিজ বার্গার, লার্জ ফ্রাইস,বড় একটা কোক আর চকলেট মিল্কশেক। ল্যাসি, বাবা আর ইনগ্রিডও একই জিনিস অর্ডার করেছিল।

মারডক নিয়েছিল আটটা ম্যাকবার্গার।

ওগুলো খেতে খেতেই চারটা বেজে গেছিল, আমি ঘুমিয়ে যাবার পরে বাবা আমাকে হাসপাতালের জরুরি বভাগে নিয়ে যান। এরপরের বিশ ঘন্টায় আমার বাম হাতে সার্জারি করে বুড়ো আঙুলের ছিঁড়ে যাওয়া পেশিগুলো আগের অবস্থানে নিয়ে আসা হয়। এরপর আরেকটা সার্জারি করে আমার কোণার আঙুলে দুই জায়গায় পিন বসানো হয়, দুই জায়গায় ভেঙে গেছিল ওটা।

ডাক্তাররা বলেছেন আমার বাম হাত হয়ত একদম আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না, কিন্তু দু-মাসের মধ্যে আগের মত কাজ করতে পারব।

হাসপাতালে দ্বিতীয় দিনে রাত তিনটা দশ মিনিটে আমার ফোন বেজে উঠেছিল।

প্রেসিডেন্ট সুলিভান কল করেছিলেন।

প্রথমেই তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ব্যস্ততার কারণে ফোন করতে পারেননি আমাকে। তবে রাশিয়ার ব্যাপারটা খুবই জটিল অবস্থায় থাকার কারণে দম ফেলার ফুরসতও পাচ্ছিলেন না।

কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নেই আমি। তাকে জানাইনি, তার বাবা এবং আমার মায়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিল একসময় আর তার আঙ্কেল সিডনি, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষদের মধ্যে একজন। পুতিন নামের লোকটা তাকে এমনিতেও যথেষ্ট দুশ্চিন্তার মধ্যে রেখেছে।

সুলিভান বলেছিলেন, সিডনি ওয়েন তাকে ফোন করে জেনিফার নিউবারের কেসটা পুনঃতদন্তের আহ্বান জানান। মৃত্যুপথযাত্রি লোকটার কথা ফেলতে পারেননি তিনি। তবে একটু অবাক হয়েছিলেন ইনগ্রিডের নাম শুনে, কিন্তু পরে ভেবে দেখেছিলেন, ইনগ্রিডের চেয়ে ভালোমত কেসটা নিয়ে কেউ কাজ করতে পারবে না, তাই ভার্জিনিয়া পুলিশ কমিশনারকে ওর নাম বলে দেন। আরো বলেছিলেন ওয়েনকে আসলে অত ভালো চোখে দেখতেন না তিনি, কারণ লোকটা একসময় এমকে আট্রা প্রোগ্রামের প্রধান ছিলেন। কিন্তু তার বাবার ঐ মানুষটার জন্যে একটা আলাদা ধরণের সম্মানবোধ ছিল তাই তিনিও হৃদ্যতা বজায় রাখতেন তার সাথে।

আমি তাকে আমার এবং ইনগ্রিডের এনগেজমেন্টের ব্যাপারে জানালে কথা দেন, বিয়েতে আসবেন তিনি। আর সিডনি ওয়েন ওরফে বেনজামিন বাটনকে হাসপাতালে যাবার পথে একটা ফায়ার স্টেশনের সামনে রেখে আসি আমরা।

আমার বুদ্ধি।

স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম এবং ওপিক বিল্ডিংটার ব্যাপারে সিআইএ’র বর্তমান পরিচালকের কাছে সবকিছু খুলে বলেছে ইনগ্রিড। প্রেসিডেন্টকে সব খুলে বলা না বলা এখন তার ব্যাপার, অবশ্য ইনগ্রিড তাকে বলেছে, ব্যাপারটা যত কম লোক জানবে তত ভালো।

গত রাতে আমি আর ইনগ্রিড মিলে বাসাটাকে আগের মত করে সাজিয়ে তুলেছি, মানে এক ঘন্টায় যতটুকু সম্ভব আর কি। কিন্তু আজ থেকে আবার পুরোদমে ডিউটিতে ফিরে যেতে হয়েছে ওকে। বিলিকেও নির্ধারিত সময়ের দু-দিন আগেই নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে অফিস থেকে। ওরা দু জন এখন নতুন একটা খুনের কেস সামলাতে ব্যস্ত।

আর জেনিফার নিউবারের কেসটার ব্যাপারে আমরা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেই যে ওটাকে আগের অবস্থাতেই রেখে দেয়া ভালো হবে। কেস ফাইলগুলো আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে, তবে ডায়রির পাতাগুলো হারিয়ে গেছে। ওগুলো হয়ত কেউ ডেলওয়ারের ঠিকানায় কুরিয়ার করে দিয়েছে।

আরো দুই মিনিট ল্যাসিকে ওর বলগুলো নিয়ে খেলতে দেখলাম। এরপর বললাম, “তুই না-হয় একটা দিয়ে খেল আর বাকি তিনটা আলমারিতে তুলে রাখি পরে খেলার জন্যে।”

মিয়াও।

“হলুদটা রাখবি? তুই নিশ্চিত সে-ব্যাপারে?”

মিয়াও।

“সবুজ? এটাই তোর শেষ উত্তর?”

মিয়াও।

“আচ্ছা আমি পছন্দ করে দিচ্ছি একটা।”

ডান হাত দিয়ে লাল, সবুজ আর হলুদ বলটা তুলে নিলাম, নীলটা রেখে দিলাম ওর কাছে। বাম হাত এখনও ব্যান্ডেজ করা আমার। বলগুলো আলমারির সেইফে তুলে রাখলাম। সেইফটাতে আরো দুটো জিনিস আছে এ মুহূর্তে, আমার মা’র ফাইলটা আর একটা ফ্ল্যাশড্রাইভভ। ওপিক বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসার আগে ফ্ল্যাশড্রাইভভটা কম্পিউটার থেকে খুলে নিয়েছিলাম আমি। ব্যাপারটা অদ্ভুত যে, এই ফ্ল্যাশড়াইভের জন্যেই আমার অ্যাপার্টমেন্টটা পুরো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।

“ফ্ল্যাশড্রাইভভটা কোথায়?” মা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

“আমার সেইফে!” এখন যদি প্রশ্ন করতেন তাহলে এই উত্তরটাই পেতেন। আরো বলতাম, “পারলে এসে নিয়ে যান!”

আমার অ্যাপার্টমেন্টটাতে এখন সর্বাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা লাগানো হয়েছে। ওগুলো সাধারণ মার্কেট থেকে কিনতে পারবেন না আপনি। কিন্তু আমার চেনা পরিচিতদের মাঝে প্রেসিডেন্ট একজন হওয়াতে সমস্যা হয়নি কোন। এরপর যদি মার লোকেরা আবার আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করে তাহলে খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না।

সেইফটা বন্ধ করে আবার বিছানার কাছে ফিরে আসলাম। ল্যাসিকে দেখে মনে হল কী যেন একটা বলতে চাই আমি ওকে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম। তখন নীল বলটা হাতে তুলে নিলাম। ওর মনোযোগ আকর্ষণের এটাই একমাত্র উপায়।

মিয়াও।

“এক সেকেন্ড,” বললাম আমি। “তোকে একটা খবর জানানো হয়নি।”

মিয়াও।

“ওয়েনের বাসার কমলা রঙের বিড়ালটার কথা মনে আছে তোর? বড় একটা ট্যাবি বেড়াল?”

মিয়াও।

“না, বার্থা না ওর নাম। পিচেস।”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, তার আরেকটু কম খাওয়াদাওয়া করা উচিত,” বললাম। “জানিস? ও প্রেগন্যান্ট।”

ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

“তুই বাবা হতে যাচ্ছিস।”

কেশে উঠল ও। যেন ওর পিতৃত্বের সংবাদটা আটকে গেছে গলার মধ্যে। এরপর কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকল। অবশেষে আমার দিকে তাকাল।

মিয়াও।

“বিয়ে? না, তোকে বিয়ে করতে হবে না ওকে।”

মিয়াও।

“আমি আর ইনগ্রিড বিয়ে করব কারণ একে ওপরকে ভালোবাসি আমরা আর একসাথে সংসার করতে চাই।”

মিয়াও।

“তুই একটা বিড়াল। বিড়ালরা বিয়ে করে না।”

মিয়াও।

“জানি না বাচ্চাগুলোর কি হবে। মনে হয় ওদেরকে বিলিয়ে দেয়া হবে।”

মিয়াও।

“তোর একটা চাই? তুই তো নিজের খেয়ালই রাখতে পারিস না ঠিকমত। আমি না থাকলে তিরিশ মিনিটই টিকতে পারতি না দুনিয়ায়।”

মিয়াও।

“তুই কি এটা আসলেও জিজ্ঞেস করছিস আমাকে? আরেকটা বিড়াল চাই কিনা আমার? না, একটাকে সামলাতেই জান বের হয়ে যায়।”

মিয়াও।

“ছেলে চাই। কেন, ছেলে কেন?”

মিয়াও।

“জাস্টিন টিম্বারলেকের মত করে বড় করে তুলতে চাস ওকে?”

মিয়াও।

“তুই আর জাস্টিন টিম্বারলেক একদম একই স্বভাবের? বিশ্বাস কর, তোদের মধ্যে অনেক তফাৎ।”

মিয়াও।

“ওটা কি নাচ ছিল নাকি? আমি তো ভাবলাম মৃগি রোগিদের মত কাঁপছিস।”

মিয়াও।

“আর্চিবল্ড? আমি তোর ছেলের নাম মোটেও আর্চিবল্ড রাখতে দেব না। শহরের সব বেড়াল ওকে নাম নিয়ে খেপাবে পরে।”

মিয়াও।

“আচ্ছা দুই সপ্তাহ পরে ওয়েনের কেয়ারটেকারকে ফোন করে দেখব কি ব্যবস্থা করা যায়।”

মিয়াও।

“না, পিচেসকে বিয়ের প্রস্তাব দিবি না তুই।”

মিয়াও।

“ম্যাকডোনাল্ডসে যেতে বিয়ের প্রস্তাবের দরকার হয় না। চাইলে এখনই নিয়ে যেতে পারি আমি তোকে ওখানে।”

মিয়াও।

“মজা করছিলাম। ঠিক আছে, সামনের সপ্তাহে।”

মিয়াও।

“আচ্ছা, বাবা আচ্ছা! আমরা যাব ওয়েনের বাসায়। জিজ্ঞেস করে দেখব তোকে একটা দেবে কিনা।”

মিয়াও।

“বললাম তো আর্চিবল্ড রাখতে দেব না বাচ্চাটার নাম।”

মিয়াও।

“আর্চি? এটা খারাপ না।”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, এখন তোর বলটা ফেরত দিতে পারি আমি।”

মেঝেতে ছুঁড়ে মারলে লাফিয়ে পড়ল ও বলটার ওপর।

শোবার ঘর থেকে বের হয়ে খেয়াল করলাম রান্নাঘরে একটা বিশাল ঝুড়ি রাখা। প্রায় তিনফিট লম্বা এবং প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে পুরোটা। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম কি আছে : এক বোতল শ্যাম্পেইন, কিছু দামি চিজ (ওগুলোর নাম উচ্চারণ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে), স্ট্রবেরি, সুইস চকোলেট, এক টিন ক্যাভিয়ার আর কিছু চিপস।

নিঃসন্দেহে, হাজার ডলারের ওপরে জিনিস আছে ঝুড়িটায়।

বাক্সটার সাথে লাগানো কার্ডটা তুলে নিলাম। সেখানে লেখা :

হেনরি এবং ইনগ্রিড,
তোমাদের এনগেজমেন্টের জন্যে অভিনন্দন। খুব খুশি হয়েছে শুনে। বিয়েতে অবশ্যই আসছি!

কনর।

বি:দ্র : বিয়ে কবে?

হেসে উঠলাম।

ইচ্ছে করছে ঝুড়িটা খুলে চিজ আর কয়েকটা চিপসের প্যাকেট এখনই সাবাড় করে দেই। কিন্তু ইনগ্রিড যখন ধৈর্য ধরতে পেরেছে আমারো তাই করা উচিত। তার বদলে ফ্রিজ থেকে গত দিনের বেঁচে যাওয়া থাই খাবার বের করে গরম করেতে দিলাম। ইসাবেল এখনো ওর জাদুময়ি খাবারগুলো দিয়ে ফ্রিজ ভরে তুলতে পারেনি।

ওগুলো গরম হতে হতে আমি ব্যায়াম করতে লাগলাম। আবার স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে আমার।

খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে এসে ল্যাপটপটার সামনে বসে পড়লাম। সেদিনের পর আর ল্যাপটপ খোলার সময় পাইনি।

স্টক মার্কেটে একবার ঢুকে সব ঠিক ঠাক করে আমার ইমেইল অ্যাড্রেস এ লগইন করলাম।

দুটো নতুন ইমেইল এসেছে।

তার মধ্যে একটা [email protected] থেকে। আমি যে নিজেকে একটা ইমেইল পাঠিয়েছিলাম সেটা ভুলেই গেছি।

ওটা খুলে পড়তে লাগলাম।

প্রিয় হেনরি,

তুমি নিজেই এই ইমেইলটা লিখেছ। আশা করি আবার পড়তে শিখতে তোমার খুব বেশি সময় লাগেনি। উপায় থাকলে পঞ্চাশ পাতার একটা ইমেইল লিখতাম, গত সাইত্রিশ বছরের সব স্মৃতি বর্ণনা করে। বোঝতাম কেন এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম আমরা, কিন্তু হাতে একদমই সময় নেই আমার। এক হাত দিয়ে লিখতে হচ্ছে আমাকে তাই সময়ও অনেক বেশি লাগছে।

একটা কাজ করবে প্রথমেই। গুগলে গিয়ে ‘হেনরি বিনস’ লিখে সার্চ দেবে। এটা তুমিই। তোমার নামেই এই কন্ডিশনটার নামকরণ করা হয়েছে। খুব অদ্ভুত, তাই না? এটা অসম্ভব মনে হচ্ছে না, একসময় কেবল এক ঘন্টা জেগে থাকতে তুমি? আর এখন তো তোমার হাতে অফুরন্ত সময়। আগে সারাদিনের সব কাজ কিন্তু তোমাকে এই এক ঘন্টার ভেতরেই করতে হত। তবুও শুধু বেঁচেই থাকোনি তুমি, বরং অন্য আরো অনেক ব্যক্তির চেয়ে ভালোমত উপভোগ করেছ জীবনটাকে। আর সেটা একজন মানুষকে ছাড়া কক্ষনোই সম্ভব হত না, তোমার বাবা।

সময় থাকলে তার অবদানের কথা সব খুলে বলতাম তাকে। তিনি তার সারা দিন ব্যয় করতেন কিভাবে তোমার একঘন্টাকে শিক্ষণীয় এবং একই সাথে মজার করে তুলবেন। তাকে সবসময় সম্মান করবে এবং ভালোবাসবে, একদম তোমার সর্বোচচটা দিয়ে। আর ইনগ্রিড? দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরি মেয়ে না ও? কিভাবে ওর মত একটা মেয়েকে পটিয়ে ফেলেছি আমরা সেটা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আমাদের জীবনের সবচেয়ে সেরা উপহার হচ্ছে ও। আমার ধারণা ও তোমাকে এতদিনে সব খুলে বলেছে কোথায় আর কিভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল আমাদের, কিভাবে একে অপরকে ভালোবেসে ফেলি আমরা। তাকে বিয়ে করবে তুমি, বাকি জীবনের প্রতিটা মুহত তার সাথে তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না নিশ্চয়ই?

আর ল্যাসির ব্যাপারে কি বলব? হ্যাঁ, কথা বলে ও। জানি, একটু অদ্ভুত ব্যাপারটা। বিড়ালটা একটু দুষ্ট স্বভাবের বটে কিন্তু তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। লাসানিয়া পছন্দ করে ও, গারফিল্ড কমিক্স পড়তে আর কার্টুন দেখতে ভালোবাসে। আর সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে পেট চুলকে দেয়া আর ঝনঝনি লাগানো বল। লাল রঙের একটা খাম রাখা আছে তোমার বাবার বাসায়। ওটার ভেতরে তোমার মা’র ফাইলটা রেখে দিয়েছি। তাকে খুঁজে বের করবে তুমি।

দ্বিতীয় আরেকটা ইমেইল এসেছে।

এটার প্রেরক [email protected]

ইসাবেলকে মাঝে মাঝে ‘ইজি’ বলে ডাকি আমি। এটা বোধহয় সেই পাঠিয়েছে। কিন্তু ওর এই ইমেইল অ্যাড্রেসটার দেখিনি কখনো আগে।

ইমেইলটা পুরো পড়ার পর বুঝতে পারলাম কেন এই ইমেইল অ্যাড্রসটা অতুন করে তৈরি করেছে সে। ও চায়নি কেউ ইমেইলটা ট্রেস করতে পারুক।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে আবার ইমেইলটা পড়লাম :

হেনরি…আমি ইসাবেল। গতকাল সুট পরা দু-জন লোক এসেছিল আমার বাসায় আর উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করছিল। তারা ঐ চুলের স্যাম্পলটার ব্যাপারে জানতে চাইছিল যেটা আমি টেস্টের জন্যে পাঠিয়েছিলাম ডিএনএ ল্যাবে। তাদের মতে ঐ চুলটা যে ব্যক্তির তাকে নাকি গত চল্লিশ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা। একটা কার্ড দিয়ে গেছে আমাকে। সিআইডি নামের একটা এজেন্সির কার্ড। গুগল করে দেখেছি আমি, ইউএস আর্মি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন কম্যান্ড এর একটা অংশ এটা।

হেনরি, আমার মনে হয় তোমার বাবাকে খুঁজছে ওরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *