৩. পর্নো ফিল্মের শুটিং

দ্বিতীয় পর্ব

০১.

পর্তুগাল। বুধবার, ৯ই সেপ্টেম্বর, মধ্যরাত।

রুয়া দস রমবেইরস। বিপজ্জনক আঁকাবাঁকা গুলি। গলির ধারে ছোট্ট ফ্ল্যাট, ভাড়া করা। সেখানে পর্নো ফিল্মের শুটিং শুরু হয়েছে।

ঘরে চারজন লোক।

ক্যামেরাম্যান, অভিনেতা ও অভিনেত্রী এবং একজন দর্শক।

তরুণী অভিনেত্রী, মাথায় সোনালি চুল, চমৎকার চেহারা, গলায় লাল রিবন, পরনে একটা সুতোও নেই।

পুরুষ অর্থাৎ অভিনেতাও উলঙ্গ। বলিষ্ঠ চেহারা। চওড়া কাঁধ, বিশাল বুক, লোমহীন, মস্ত বড়ো পুরুষাঙ্গটা শিথিল হয়ে পড়ে আছে।

ওরা বিছানায়।

দর্শকটির চোখে মস্ত বড় সানগ্লাস, মাথায় ইয়া বড়ো একটা টুপি। ছায়ায় বসে আছে।

দর্শক ঘাড় নাড়ল। ক্যামেরাম্যান চালু করল তার পর্নোফিল্মের ক্যামেরা।

অভিনেতা অভিনেত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল–তবে শুটিং শুরু হোক।

পুরুষটি ঝুঁকল মেয়েটার ওপর।

এখন তার পুরুষাঙ্গ তরুণীর মুখের ভেতর। সে লজেন্সের মতো সেটা চোষে। সেটা শক্ত হয়ে ওঠে। সে মুখ সরায়–ওঃ জেসাস! সাইজ দেখো না!

ক্যামেরাম্যান হুকুম দিল–হীরা, এবার ওটা ঢোকাও।

 পুরুষটি মেয়েটির দিকে গড়িয়ে গেল। পুরুষাঙ্গ ওর দু পায়ের ফাঁকে রাখে।

মেয়েটা ক্ষেপে গেল–হনি, আস্তে।

-কেন তোমার ভালো লাগছে না?

কী করে ভালো লাগবে? লম্বায় চওড়ায় তোমার ওটা তো কম বড়ো নয়।

ছায়ায় বসে থাকার দরুন এবং টুপি ও রোদ চশমার জন্য পর্নোফিল্মের শ্যুটিং-এর দর্শককে চেনা যাচ্ছে না। নায়ক যখন নায়িকার গোপন ত্রিকোণের গভীরে পুরুষাঙ্গ দিয়ে চাপ দিল, তখন সে ঝুঁকে পড়ল। তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে উঠেছে।

 নায়িকা বলল–আঃ, দারুণ ভালো লাগছে। তবে বেবি, একটু সামলে।

দর্শক তখন ভাবছে, এই নিয়ে তিন-তিনটে মেয়েকে এই অবস্থায় দেখলাম। এই মেয়েটা ওই দুটোর থেকেও বেশি সুন্দরী।

শোনা গেল শীৎকারের আওয়াজ। পুরুষের কোমর জাপটে ধরে মেয়েটা নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। আর বলছে–আঃ, কী আরাম! প্লিজ, চালিয়ে যাও।

 পুরুষ আরো জোরে জোরে চাপ দিতে থাকল। কোমর দ্রুত হাঁপরের মতো ওঠা নামা করছে। মেয়েটার কোমরের ওঠানামার গতি তার চেয়েও বেশি। সে পুরুষের পিঠে নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে।

–ওহ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি শেষ হয়ে গেছি!

চরম পুলকের সেই ক্ষণে দর্শকের দিকে তাকাল ক্যামেরাম্যান। কালো চশমার আড়ালে দর্শকের চোখ দুটি জ্বলছে। ক্যামেরাম্যান ইঙ্গিত পেয়ে পুরুষটিকে বলল–এবার।

নায়িকা তখন চরম আনন্দে শিহরিত, চোখেমুখে উন্মাদনা।

এবার নায়ক তার শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল নায়িকার গলা। নায়িকার চোখে বিস্ফারিত আতঙ্ক আর বিস্ময়।

কালো চশমার আড়াল থেকে দর্শক মনে মনে এই দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে। জেসাস! মেয়েটির চোখদুটো কত বড় হয়ে উঠেছে! সাঁড়াশির মতো দুটি হাতকে সে ছাড়াতে চাইছে। তখন মেয়েটির চোখে যৌন মিলনের চরম মুহূর্তের চরম পুলক ও মৃত্যু যন্ত্রণার বিভীষিকা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দর্শক ঘামছে, পোশাক ভিজে গেছে। কী সুন্দর, কী উত্তেজক!

তারপরেই সব শেষ। দুঃসহ আনন্দে দর্শকের শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেয়েটাকে শাস্তি দিতে পেরেছে সে। সহসা সে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী ভাবল।

.

০২.

জুরিখ। শুক্রবার। ১১ই সেপ্টেম্বর। দুপুর।

জুরিখের পশ্চিম প্রান্ত। ষাট একর জায়গা জুড়ে রফ অ্যান্ড সন্সের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস। বারো তলা বিল্ডিং। রিসার্চ বিল্ডিং, এক্সপেরিমেন্টাল ল্যাবোরেটরি ছাড়াও আছে প্ল্যানিং ডিভিশন। আধুনিক ডেনিশ ফার্নিচার, সবুজ ও সাদা রঙের। কাঁচের ডেস্কের পেছনে রিসেপশন। লবির ডানদিকে লিফট, একসারি। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এক্সপ্রেস লিফট ব্যবহার করে। আজ প্রেসিডেন্ট বেঁচে নেই। ওই লিফট বোর্ড আফ ডাইরেক্টরস-এর সদস্যদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। প্লেন, ট্রেন, হেলিকপ্টার ও লিমুজিনে চড়ে তারা এসেছেন বিশ্বের নানা দেশ থেকে। আছেন স্যার অ্যালেক নিকলস, ওয়ালথার গ্যাসনার, ইভো পালাজজি ও শার্ল মারতেইল।

এখানে রিস উইলিয়ামসও উপস্থিত। অবশ্য সে বোর্ডের সদস্য নয়।

রিফ্রেসমেন্ট ও ড্রিঙ্কের অঢেল ব্যবস্থা। অবশ্য কেউ তাতে হাতও দিচ্ছে না। সবার মনে তখন টান টান উত্তেজনা। সকলেই চিন্তিত।

মৃত স্যাম রফের পারসোনাল সেক্রেটারি কেট আরলিং বলল–মিস রফ এসে গেছে।

 পেন, নোটপ্যাড, রুপোর ক্যারাফেয় জল, সিগার, সিগারেট, অ্যাশট্রে, দেশলাই সব ঠিক ঠিক জায়গায় আছে কিনা চকিত দৃষ্টিতে দেখে নিল আরলিং।

 এলিজাবেথ রফ গাড়ি থেকে নামল। পরনে কালো স্যুট, সাদা ব্লাউজ। তাকে ঘিরে ধরল টিভি, রেডিও, খবরের কাগজের রিপোর্টাররা। ফটোগ্রাফারের হাতে ক্যামেরা।

–মিস রফ, আমি লা ইউরোপের রিপোর্টার, এখন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন?

 মিস রফ, এদিকে তাকান আপনার মিষ্টি হাসি আমাদের পাঠকরা দেখতে চায়।

 –অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, প্লিজ মিস রফ, আপনার বাবার উইল সম্বন্ধে কিছু বলুন?

 –আমি নইয়র্ক ডেলি নিউজ থেকে আসছি। যতদূর শুনেছি আপনার বাবা একজন পাক্কা পবর্তারোহী ছিলেন। তাহলে কী ভাবে

–ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। বর্তমানে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন?

লন্ডন টাইমস। রফ অ্যান্ড সন্স সম্পর্কে আমরা কাগজে একটা প্রবন্ধ ছাপতে চাইছি।

আর একটা ফটো প্লিজ।

 তিনজন সিকিউরিটি গার্ড ছুটে এসেছে। ভিড় ভেদ করে এলিজাবেথ রফকে তারা লিফটে ভরে দিল।

বোর্ডরুমে পা রাখল এলিজাবেথ রফ।

–আমি দুঃখিত এলিজাবেথ। স্যার অ্যালেক নিকলস বলে উঠল।

 –তোমাকে ফোন করেছিলাম

 ইভো পালাজজি তার গালে দুটি চুমুর চিহ্ন এঁকে দিল–ভালো আছ?

হেলেন ও আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। শার্ল মারতেইল বলল।

এবং ওয়ালথার গ্যাসনার?

–অ্যানা ও আমিও সমবেদনা জানাচ্ছি।

 –তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

এই ঘরে স্যামের অস্তিত্ব সবখানে। মেয়েটা কান্নায় ভেঙে পড়তে পারে। একথা ভেবে রিস্ উইলিয়ামস হাত বাড়িয়ে দিল

–হ্যালো লিজ।

 –হ্যালো, রিস।

সবাই এসে গেছে। মিটিং শুরু হল।

 শার্ল অ্যালেককে শুরু করার নির্দেশ দিল।

বোতাম টিপল অ্যালেক। নোটবুক হাতে ঘরে এসে ঢুকল আরলিং, একটা চেয়ারে বসল।

অ্যালেক বলতে শুরু করল-স্যামের মৃত্যুতে আমাদের প্রত্যেকের ক্ষতি হয়েছে। জনসাধারণের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে দেওয়া যাবে না।

–ঠিক! শার্ল চাপা গর্জন করে উঠল, প্রেস আমাদের সম্বন্ধে ইদানিংকালে যা নয়, তাই লিখছে, বলছে।

কারণ? এলিজাবেথের প্রশ্ন।

–কোম্পানির সামনে এখন হাজারও সমস্যা। রিস্ তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল। মামলা, সরকারি তদন্ত, ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাঙ্কের চাপ। কোম্পানির ওপর পাবলিকের আস্থা আছে। তাই ওষুধ বিক্রি হয়। সেই বিশ্বাস বা আস্থা যদি নষ্ট হয়, তাহলে আমাদের প্রতিষ্ঠান ডুবে যাবে।

–সমস্যার সমাধান আছে, ইভো বলল।

 –শুনি, কেমন সমাধান।

–আমাদের স্টক আমরা পাবলিকের কাছে বিক্রি করব। ওয়ালথারের প্রস্তাব। তাহলেই ব্যাঙ্কের ঋণ পরিশোধ হবে। এর পরেও আমাদের হাতে প্রচুর টাকা থাকবে। বারোটি আন্তর্জাতিক ব্রোকেজ ফার্ম এই স্টক ইস্যু আনডাররাইট করতে রাজি আছে। আমরা স্টকের যে দাম চাইব, ওরা ওর গ্যারান্টার হবে। ব্যাঙ্ক ও ইনসিউরেন্স কোম্পানি বেশি শেয়ার কিনবে।

–তাহলে তো কোম্পানি ওদের পরিচালনাধীন হয়ে যাবে!

 –আমরাও বোর্ড অফ ডাইরেক্টরসে থাকব।

এলিজাবেথ বলে উঠল–তোমরা-সবাই দেখছি, পরিবারের বাইরে শেয়ার বিক্রি করতে রাজি। তাহলে আগে কেন এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি?

কয়েক মিনিটের নীরবতা।

–একাজ করতে গেলে সকলকে একমত হতে হয়। ইভো বলল।

 –কে মত দেয়নি?

 –স্যাম রফ। রিস্ জবাব দিল।

এলিজাবেথ বুঝল, স্যাম রফের মৃত্যুতে এরা সকলেই খুশি। শোক, দুঃখ, সমবেদনা, সহানুভূতি, এগুলো সব ভড়ং। কাগজপত্র সব তৈরি, কেবল লিজার সইয়ের অপেক্ষা।

মনে পড়ে গেল এলিজাবেথের, স্যামুয়েল রফের উক্তি-শেয়ালকে কখনও বিশ্বাস করতে নেই। একবার তাকে মুরগির ঘরে ঢুকতে দিলে আর রক্ষে নেই।

ইভো বলল–তুমি এসব বোঝো না। এটাই ভালো।

–স্টক বেশি হলে টাকা পাবে প্রচুর, জীবনে খরচ করে কূল পাবে না। ওয়ালথার। বলল।

শাল বলছে–এলিজাবেথ, খামোখা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এটা মেনে নাও। দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

পথ আছে, লিজ মনে মনে বলল।

–আমি এখন কিছু বলতে পারছি না। ভেবে দেখতে হবে।

কত দিন?

 –আমরা–

রিস্ বাধা দিল–কোম্পানির সমস্যাগুলো আগে ওকে বুঝতে দাও, তারপর মনস্থির করবে।

অ্যালেক দ্বিমত করল না।

 শার্ল নিস্পৃহ গলায় বলল–এলিজাবেথ যা বলবে তাই হবে।

 –ডারলিং, বেশি দেরি কোরো না। ইভো বলল।

সবাই যখন নিজের নিজের স্বার্থ সামলাতে ব্যস্ত, তখন কেবল একজন ভাবছিল–হায় জেসাস, এ মেয়েটাও আর বেশি দিন বাঁচবে না।

.

০৩.

জুরিখে রফ অ্যান্ড সন্সের সদর দপ্তর। অফিসে মিসেটের ল্যান্ডস্কেপ, রেনোয়া শাগাল, পল ক্লীর আঁকা পেন্টিং।

শ্যাময় চামড়ার কৌচ, কফি-বটবল, ইজিচেয়ার, ফায়ার প্লেস।

কালো মেহগনি কাঠের ডেস্ক।

কনসোল টেবিল, লাল ফোন, ইন্টারকম।

ডেস্কের পেছনে একটা পোর্ট্রেট, রফ অ্যান্ড সন্সের প্রতিষ্ঠাতা-স্যামুয়েল রফ।

ভেতরে ড্রেসিংরুম। এখন বাবার পোশাক ইত্যাদি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্যনা, জিমন্যাসিয়াম, সেলুন, ডাইনিং রুম।

তোমার ভাবমূর্তি দেখে মিটিং-এ সবাই চমকে গেছে। রিস্ বলতে থাকে, কাগজপত্র সই হবে বলে সকলে তৈরি, কিন্তু তুমি সই করলে না। কেন লিজা? স্যামুয়েল রফ অর্থাৎ তোমার পিতৃপুরুষ চেয়েছিলেন, এই প্রতিষ্ঠান যেন পাবলিক কোম্পানি না হয়ে যায়। কিন্তু তখন এই কোম্পানি খুবই ছোটো ছিল। তৈরি হত কেবল ওষুধ। অথচ আজ? আজ বিশ্বের নানা দেশে এর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে। ওষুধের পাশাপাশি রফ অ্যান্ড সন্স কেমিক্যাল, সুগন্ধি, ভিটামিন, হেয়ার স্প্রে, কীটনাশক ওষুধ, অ্যাডহেসিভ, কসমেটিক, বায়োইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক এক্সপ্লোজিভ, ডাক্তারদের জন্য মেডিকেল ম্যাগাজিন, বেবিফুড, পশুখাদ্য প্রস্তুত করছে। সমস্ত শাখা-অফিসগুলো রিপোর্ট পাঠায় এই অফিসে। একটা ঘোড়া আর গোটা কয়েক টেস্টটিউব নিয়ে রফ অ্যান্ড সন্সের পথ চলা শুরু হয়েছিল। আজ তা বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ষাটটা ফ্যাক্টরি, দশটা রিসার্চ সেন্টার, হাজার হাজার সেলসম্যান, সম সংখ্যক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। গত বছর শুধু আমেরিকাতে চোদ্দো বিলিয়ন ডলারের ওষুধ বিক্রি হয়েছিল। তার বেশির ভাগ ওষুধই এই কোম্পানির।

ওষুধ রিসার্চ ও বিজ্ঞাপনের জন্য যে ফিল্ম তৈরি হয় সেখানে গিয়ে রিস্ বলল আমরা যে সংখ্যায় ফিল্ম ব্যবহার করি, বড়ো বড়ো হলিউড স্টুডিওতেও তা দেখা যায় না।

 মলিকিউলার বায়লজি ডিপার্টমেন্ট। তারপর লিকুইড সেন্টার। সেখানে কাঁচের লাইনিং লাগানো স্টেনলেস স্টিলের মস্ত বড়ো বড়ো ট্যাংক, প্রায় পঞ্চাশটা। সেগুলো সিলিং থেকে ঝুলছে। তরল ওষুধ এখানে বোতল বন্দি করা হয়। পাউডার থেকে ট্যাবলেট তৈরি করার জন্য আছে ট্যাবলেট কমপ্রেম, রুম। প্রত্যেকটি ট্যাবলেটে রফ অ্যান্ড সন্স ছাপ মারা হয়।

বিজ্ঞানীদের জন্য ছোটো একটি বাড়ি। এখানে তিনশোজন বৈজ্ঞানিক কাজ করেন। আছেন অ্যানলিটিক্যাল কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, অরগ্যানিক কেমিস্ট, প্যাথোলোজিস্ট৷ তারা অধিকাংশই পি.এইচ.ডি. ডিগ্রিধারী।

 এরপর ওরা এল কোটি ডলারের ঘরে। রিস বলেছে, এখানে বন্দুকধারী পুলিশ প্রহরায় নিযুক্ত। সিকিউরিটি পাস ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। জানালাবিহীন ঘর। মেঝে থেকে শেলফগুলো উঠে গেছে সিলিং পর্যন্ত। থাকে থাকে বোতল, জার, টিউব সাজানো।

রিস্ বলল–এখানে সেইসব ওষুধ রাখা হয়, সেগুলো কাজের নয়। পাঁচ-দশ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বছরের পর বছর ধরে রিসার্চ করে ওষুধটি বের করার পর দেখা গেল, অন্য কোম্পানি ওটা আগেই বাজারে নিয়ে এসেছে। তাই এই ওষুধগুলোর কোনো নাম হয় না। কেবল নম্বর দিয়ে রেখে দেওয়া হয়। এগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে ভেবে ফেলে দেওয়া হয় না। হয়তো দেখা গেল, কোনো তরুণ বিজ্ঞানী এই ওষুধের ওপর আরও রিসার্চ করে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলল।

এবার পাশের ঘরে এল তারা।

–এটার নাম ক্ষতির ঘর। রিস বলল, অবশ্য এই ক্ষতি আমরা ইচ্ছে করে হতে দিই।

  –তার মানে?

–দেখো, বোতলের গায়ে লেখা বটলিজম। হ্যাম, সসেজ, টিনে রাখা খাবারে এক ধরনের জীবাণু মারাত্মক এক নিউরোটক্সিন তৈরি করে। ওই খাবার খেলে ফুড পয়জনিং বা পক্ষাঘাত হয়। একেই বলে বটলিজম। এর একটা ওষুধের পিছনে আমরা কয়েক মিলিয়ান ডলার খরচ করেছি। কিন্তু তুমি শুনে আশ্চর্য হবে যে, গতবছর সারা আমেরিকায় মাত্র পঁচিশ জন বটলিজম দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া এখানে জলাতঙ্কের, সাপের কামড়ের, বিষাক্ত গাছের ছোঁয়ায় বিষক্রিয়ার জন্য ওষুধ মজুত রাখা আছে। এগুলো বিক্রি হয় না। সেনাবাহিনী ও হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে পাঠানো হয়।

-বাঃ, খুব ভালো ব্যাপার। লিজা বলল। তার মনে পড়ল, বুড়ো স্যামুয়েলও তাই চাইত।

রিস্ লিজাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখাচ্ছে। কাঁচ গলানোর ফ্যাক্টরি, নতুন বাড়ি প্ল্যান করার স্থপতি কেন্দ্র, এস্টেট ডিভিশন। ছাপাখানায় অজস্র লোক কাজ করছে। প্রায় পঞ্চাশটি : ভাষায় প্যামফেট ছাপানো হচ্ছে।

 স্টেরাইল রুম। লিজার মনে পড়ে গেল জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ১৯৮৪ র কথা। ঘরে আন্ট্রাভায়োলেট আলো। এক-একটি ঘরের ছাদ ও দেয়াল এক-একরঙের সাদা, সবুজ, নীল। সেই একই রঙের পোশাক পরেছে কর্মীরাও। স্টেরাইল রুমে ঢোকার পর কর্মীরা যে যার ঘরে প্রবেশ করে।

 রিসার্চরুম। শত শত খাঁচা। বেড়াল, সাদা ইঁদুর, বাঁদর। কোনোটার মাথা ন্যাড়া, কোনোটার মাথায় ইলেকট্রোড বসানো হয়েছে। টিউমার ফুলে ফুলে আছে শরীরের এখানে সেখানে। কোনোটা ঘুমোচ্ছে, কোনোটা আবার চেঁচাচ্ছে। লিজা দেখল, একটা সাদা বেড়ালের বাচ্চার মগজ পাতলা প্লাস্টিকের আবরণে ঢেকে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ছটা তার বেরিয়ে আছে।

লিজা অবাক–এগুলো কী?

খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে একবুড়ো বৈজ্ঞানিক, লম্বা দাড়ি। হাতে নোটবুক। কীসব লিখছে–নতুন একটা ট্রাংকুইলাইজার নিয়ে পরীক্ষা চলছে।

কাজ হলে ভালো। রিস, এসব জন্তুগুলোকে এমন যন্ত্রণা দেওয়া কি ঠিক?

–এর ফলে কত মানুষের প্রাণ রক্ষা পায়। ১৯৫০-র পর যারা জন্মেছে, তাদের বেশির ভাগ টিকে আছে আধুনিক ওষুধের গুণে। কথাটা ভেবে দেখার।

একটা প্ল্যান্ট ঘুরে দেখতে লিজার দুদিন কেটে গেল। এরকম ডজন ডজন রফ প্ল্যান্ট আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ওরে বাবা! লিজার মাথা ঘুরছে।

নতুন একটা ওষুধ বের করতে দশ বছরের রিসার্চ লাগে।

দু-হাজারটা কম্পাউন্ড নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করলে কাজে লাগে হয়তো তিনটে।

কোয়ালিটি কনট্রোলে কর্মীর সংখ্যা প্রায় তিনশো।

 সারা বিশ্বে রফ অ্যান্ড সন্সের কর্মীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ।

এ এক বিরাট মহাযজ্ঞ। চট করে লিজার মগজে ঢুকবে না। ওরা যা চাইছে, বরং তাই হোক। পাবলিকের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়াই ভালো।

 পরের দিন মিস আরলিং একটি সুটকেস লিজার হাতে তুলে দিল–পুলিশ বিভাগ আপনার বাবার সুটকেসটা পাঠিয়ে দিয়েছে।

.

০৪.

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি ধরে লিজা সার্ডিনিয়ার ভিলায় ফিরে এল। ঘর ফাঁকা, বাবা নেই। ও বুঝি বাবার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল।

সে একটা কাগজে আপন মনে লিখল-মিসেস রিস্ উইলিয়ামস।

ট্রাংকল করল–অ্যালেক, উইক এন্ডে এখানে চলে এসো।

–ঠিক আছে।

 –ভিভিয়ানকে সঙ্গে আনবে।

–ও এখন লন্ডনে ব্যস্ত। আমি একাই যাব, সকালে।

ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ, অ্যালেক। লিজা বাবার সুটকেস খুলল। কার্ডবোর্ডের কভারে কাগজগুলো বাধা। ওপরে লেখা মিস্টার স্যাম রফ, কনফিডেনশিয়াল।

 কোনো কপি নেই।

রিপোর্টগুলো পড়তে থাকল সে। যত পড়ছে ততই আতঙ্কিত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া গোপন খবর।

চিলিতে রফ অ্যান্ড সন্সের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে বিস্ফোরণ ঘটে। বিষাক্ত গ্যাস দশ স্কোয়ার মাইল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বারোজন মারা যায়। একশোজন হাসপাতালে। একটা গৃহপালিত পশু পর্যন্ত বেঁচে নেই। এমনকি উদ্ভিদগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। এলাকাটা এখন শ্মশানপুরীতে পরিণত হয়েছে। চিলি সরকারের অনাগ্রহী মনোভাবের জন্য প্রমাণ করা গেল না, যে, এটা স্যাবোটাজ। কেউ ইচ্ছে করে এমন অমানবিক ঘটনা ঘটিয়েছে।

 আহত ও নিহতদের ছবি ছাপা হয়েছিল খবরের কাগজের পাতায়। হেডলাইনে লেখা হয়েছিল, মানুষের নিরাপত্তার কথা রফ অ্যান্ড সন্স ভাবে না। সেই প্রথম কোম্পানির ভাবমূর্তি সাধারণের কাছে নষ্ট হয়ে গেল।

পরের রিপোর্ট–চারটে গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ প্রোজেক্টের ওপর রফ অ্যান্ড সন্সের বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন। এর জন্য পাঁচ কোটি ডলার খরচ হল। কিন্তু কোম্পানি বাজারে ওষুধ ছাড়ার আগে দেখা গেল অন্য কোনো কোম্পানি সেই ওষুধ আগেই বের করে ফেলেছে। এটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে পরপর এরকম ঘটনা ঘটে যাওয়া সন্দেহ উদ্রেককারী। পৃথিবীর চারটি দেশে অত্যন্ত গোপনে রিসার্চের কাজ চলছিল। নিশ্চয়ই এর অন্তরালে কোনো চক্রান্ত আছে। কোম্পানির ওপর মহলের কোনো লোক এ ব্যাপারে অন্য কোম্পানিতে তথ্য সরবরাহ করছে।

তিন নম্বর রিপোর্ট–বিষাক্ত ওষুধ ভুল লেবেল মেরে বিদেশে সরবরাহ করা হয়। আবার লোক মরল কয়েকজন। কোম্পানির বদনাম হল। জানা গেল না, ভুল লেবেল, কীভাবে এল।

চার নম্বর রিপোর্ট–কঠিন প্রহরার ব্যবস্থা। তার মধ্যে থেকেও ল্যাবরেটরি থেকে মারাত্মক টক্সিন বাইরে চালান হয়ে গেল। খবরের কাগজে খবরটা ছাপা হলে সবাই আতঙ্কিত হল।

 এবার স্যাম রফের লেখা নোট–পাবলিকের কাছে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করার জন্য আমার ওপর বারবার চাপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি রাজি না হওয়ায় এই ধরনের জঘন্য চক্রান্ত করা হয়েছে। আমি ওই বেজন্মাটাকে ঠিক ধরব।

ঠিক এই ব্যাপারটা লিজের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছিল। ওরা সবাই লিজাকে চাপ দিচ্ছিল, কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করার প্রস্তাবে সে যেন সই করে।

ফোন বেজে উঠল–

–হ্যালো লিজা? আমি রিস্ বলছি।

 –রিস, মঙ্গলবার দুপুর দুটোয় বোর্ড মিটিং কল করো।

লিজা রিসিভার নামিয়ে রাখল। সে মনকে শক্ত করল।

লিজা ঘুমিয়ে পড়ল, স্বপ্ন দেখল। দড়ি বেয়ে তার বাবা পাহাড়ে উঠছে আর তাকে বলছে নীচে অতল গহ্বর, গভীর শূন্যতা। নীচে তাকিও না। হঠাৎ বাজের আগুনে স্যামের দড়ি পুড়ে গেল। স্যাম অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল। এলিজাবেথ আর্তনাদ করে উঠল। বাইরে বজ্রবিদ্যুতের শব্দে তা চাপা পড়ে গেল।

লিজা বিছানায় উঠে বসল। ঘামে সপসপ করছে সারা শরীর। বাইরে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি। সে তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিল।

 বিশ্রী আবহাওয়া। অ্যালেকের আসতে দেরি হতে পারে। গোপন জায়গায় রিপোর্টগুলো সরিয়ে রাখা দরকার। সে লাইব্রেরিতে ঢুকল। কিন্তু কোথায় রিপোর্ট।

.

০৫.

খোলা জানালা। ঝড়বৃষ্টির জন্যে কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। রিপোর্টর কয়েকটা কাগজ ভিজে কার্পেটের ওপর পড়ে, বাকিটা নেই। ঝড়ে উড়ে গেছে হয়তো। বাইরে? না, লনেও তো নেই। তাহলে কি পাহাড়ের উপর উঠে পড়েছে?

ওগুলোর কোনো নকল নেই।

স্যাম গোয়েন্দাকে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু কে সে? মিস আরলিং সম্ভবত জানে না।

ঘরে খাবার নেই। অ্যালেক আসার সময় হল। তার আগে কালা ডি ভোলপে বাজার সারা দরকার।

চুলে স্কার্ফ বেঁধে নিল লিজা। রেনকোট পড়ল। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গ্যারেজে ঢুকে গাড়িতে স্টার্ট দিল।

সরু ফাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, নীচে সমুদ্র। ঝড়ে উত্তাল। লিজা খুব ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিল। একটু এদিক-ওদিক হলেই খাদে বা সমুদ্রের তলায় গিয়ে ঠেকতে হবে।

উৎরাইয়ের মুখে বিপজ্জনক বাঁক। ফুটব্রেকে পা রাখল সে, গতি কমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কিছু লাভ হল না।

লিজ বরাবর চাপ দিল ফুটব্রেকে। কিন্তু স্পিড না কমে বেড়ে গেল। গাড়ি তখন বাঁক পেরিয়ে দুর্দান্ত গতিতে ছুটছে পাহাড়ি রাস্তার উত্রাই ধরে।

লিজা আবারও ব্রেকে চাপ দিল। কোনো লাভ হল না। নিশ্চয়ই ব্রেক খারাপ হয়ে গেছে।

 আবার একটা বাঁক। স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। লিজের হৃৎপিণ্ড কঁপছে। মুখেচোখে আতঙ্কের হিম শীতলতা। খাদের ধার দিয়ে স্কিট করল জীপ। আবার রাস্তা ধরে ছুটে চলল। ঢালু উত্রাই। কোনো ক্যারিয়ার বা কনট্রোল নেই। একটির পর একটি বিপজ্জনক বাঁক। গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? না, তা সম্ভব নয়। ঘন্টায় সত্তর মাইল গতি, একপাশে পাথরের দেয়াল, অন্যদিকে খাদ। মৃত্যু অনিবার্য।

মৃত্যু? না, মার্ডার?

 হ্যাঁ, মার্ডার। স্যাম রফকে খুন করা হয়েছে। সে শেয়ারগুলো পরিবারের বাইরে বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তাই নানাভাবে কোম্পানির ক্ষতি করে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। স্যাম বুঝতে পেরেছিল, অপরাধী কে? তাই সে গোয়েন্দা লাগিয়েছিল।

 কিন্তু, কিন্তু শেষপর্যন্ত স্যাম রফকে মরতে হল। তাকে খুন করা হল।

এখন লিজার পালা। শেয়ার বিক্রির ব্যাপারে সে বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। দোনামোনা করেছে। তাই তাকে খুন করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কিন্তু খুনী কে? অপরাধী কে? অ্যালেক? না ইভো? ওয়ালথার, না শার্ল? কে?

রিপোর্টে লেখা আছে–কোম্পানির উঁচু তলার কোনো লোক।

সবাই জানে, স্যাম রফ অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। একদিকে পাহাড়, অন্যপাশে খাদ। জীপ স্কিট করেছে। নীচের দিকে ছুটছে। স্পিডোমিটারে দেখা গেল, গাড়ির গতি তখন ঘন্টায় আশি মাইল। সামনে অসম্ভব সরু বাঁক।

বাবা বলছে লিজ, একা অন্ধকারে কী করছ?

লিজ স্টেজে নেচেই চলেছে। নাচের টিচার চেঁচিয়ে চলেছে। নাকি হাওয়ার গর্জন?

এবং রিস্ উইলিয়ামস বলছে–একুশতম জন্মদিন মেয়েদের জীবনে বারবার আসে না।

 একি আনন্দিত দুঃস্বপ্ন।

সরু বাঁক, দ্রুত গতিতে ছুটছে গাড়ি। এগিয়ে আসছে পাহাড়।

 ঠিক তখনই, লিজা লক্ষ করল, ওপর দিকে সংকীর্ণ একটা পাহাড়ি রাস্তা উঠে গেছে। অর্থাৎ গাড়ির স্পিড কমানো যেতে পারে। এটাই সুযোগ। সে জীপ ঘোরাল। দুপাশে গাছের সারি। ডালপালা, পাতা ঝাপটা মারছে জীপে।

সামনে–

নীচে অতল সমুদ্র।

হঠাৎ গাড়ি স্কিট করল। একটা গাছের সঙ্গে। একটা বিস্ফোরণ। সব কিছু চুরমার হয়ে গেল।

তারপর?

তারপর সবকিছু শান্ত নীরব হয়ে গেল।

.

০৬.

লিজা চোখ খুলল। হাসপাতালের বিছানায় সে। সামনে দাঁড়িয়ে স্যার অ্যালেক নিকলস।

অ্যালেক, লিজা কেঁদে ফেলল, ঘরে খাবার নেই।

অ্যালেকের চোখ ছলছল–লিজা শান্ত হও। দুদিন ধরে তোমার জ্ঞান নেই। বাঁচার কোনো আশা ছিল না। মাথায় চোট, কাটা ছেঁড়া, কিন্তু যিশু সহায়! বড়ো কিছু হয়নি। ওই সরু রাস্তায় গিয়েছিলে কেন?

–অ্যালেক, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। কেউ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। গাড়ির ব্রেক খারাপ করে রেখেছিল।

 কী জন্য?

তা আমি বলতে পারব না। ওলবিয়ার পুলিশ স্টেশনে অ্যালেক ফোনে কথা বলল। পুলিশ প্রধান তার দলবল নিয়ে হাজির হল। সে অ্যালেকের বয়েসী হবে। মস্ত বড়া হুঁড়ি। সে চিফ অফ পুলিশ লুইজি ফেরারো। গোয়েন্দা ব্রুনো ক্যামপানার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। পেশিবহুল চেহারা। কর্মঠ, দেখলেই বোঝা যায়।

লিজা পুলিশ গ্যারাজে গেল। যদিও ডাক্তারের নিষেধ ছিল। অ্যালেকও বারণ করল। তখন হাইড্রলিক হ্যাঁসেটে তুলে জীপ পরীক্ষা করছিল মেকানিক। বাঁদিকের ফেনডার ও রেডিয়েটর ভাঙা, গাছের পাতার রস লেগে আছে গাড়ির গায়ে।

 মেকানিক বলল–দারুণ মজবুত। আজকালকার গাড়ি হলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।

–ব্রেক?

 –ঠিক আছে।

 –অসম্ভব ব্রেক ধরছিল না।

মিস রফ ভাবছেন, চিফ লুইজি বলে, ওটা কেউ বিকল করে রেখেছিল।

না, স্যার। জীপের ব্রেক খারাপ করার দুটো উপায়। ব্রেক লিংক কাটা। তার মানে নাট আলগা করে ব্রেক ফ্লুইড লিক করার ব্যবস্থা। অথচ, লিংক কিছু হয়নি, ব্রেক ড্রাম ভর্তি।

–এমনও তো হতে পারে, অ্যালেক বাধা দিয়ে বলল, কেউ শূন্য ব্রেক-ড্রামে ব্রেক ফ্লুইড ভরে দিয়েছে।

তা সম্ভব নয় স্যার। এই নাট খুললে রেনচের দাগ দেখা যেত। দেখুন

হাইড্রলিক লিফটে গাড়িটা নামিয়ে আনা হল। মেকানিক গাড়ি চালু করল।

জীপ সে দাঁড় করাল গোয়েন্দা ব্রুনো ক্যামপানার সামনে।

ক্যামপানা বলল–যদি কেউ ব্রেকের লাইনিং ভিজিয়ে দেয়, ওটা যখন ড্রামে চাপ দেবে, কোনো ট্রাকশন না থাকায় তখনও তো জীপ থামবে না।

–আপনি ঠিক বলেছেন। মেকানিক বলল, কিন্তু মিস যখন গাড়ি স্টার্ট করেছিল, তখন কি ব্রেক কাজ করেছিল?

-হ্যাঁ।

 –তাহলে ব্রেক লাইনিং পরে জলে ভিজে গিয়েছে।

পাহাড়ি পথে বৃষ্টিতে এরকম হয়ে থাকে। চিফ লুইজি ফেরারো বলল।

.

 বাড়িতে ফিরে এল ওরা। অ্যালেক খাবার তৈরি করল। কোনোটার নুন বেশি, কোনোটা পুড়ে গেছে। লিজা তাই খেল। মুখে কিছু বলল না। সে অ্যালেককে দুঃখ দিতে চায় না।

 ফোন এল ইভো ও সিমনেত্তা। হেলেন ও শার্ল। ওয়ালথার। লন্ডন থেকে ভিভিয়ান। রিসের ফোনও পায়।

–তুমি কি গাড়ি চালানোয় হেলেনকে টেক্কা দিতে চাইছিলে?

-না, আমি চ্যাম্পিয়ান হতে চাই না। আমি কেবল পাহাড়ি উত্রাইয়ের পথে স্পিডে গাড়ি চালাই।

মনে মনে লিজা ভাবে, না-না, মিসেস রিস্ উইলিয়ামস।

 –তোমায় খুব পুলকিত লাগছে। অ্যালেক জানতে চাইল।

 –আমাদের জুরিখে যেতে হবে। বোর্ড মিটিংটা খুব জরুরি।

.

কনফারেন্স রুম। সিগারেটের ও চুরুটের ধোঁয়া। বাতাস ভারী।

 লিজা মাথায় যন্ত্রণা বোধ করল–আমি ঠিক করেছি, শেয়ার পাবলিকের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।

–আমাদের কোম্পানির জন্য একজন পাকা প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন। অ্যালেক বোঝাল, এব্যাপারে তোমার না থাকাই ভালো। এটা তোমার পক্ষেই মঙ্গল।

ইভো বলল–ডার্লিং, তুমি সুন্দরী, যুবতী। জীবন উপভোগ করো। ব্যবসা…

–একথা ঠিক, একটা দুঃখজনক দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ শেয়ার তুমি পেয়েছ, শার্লের বক্তব্য। কিন্তু ব্যাপারটা ত সহজ নয়, কোম্পানি চালাবার চেষ্টা করলে ঝামেলা বাড়বে।

–শেয়ার বেচার এটাই উপযুক্ত সময়। ওয়ালথারের স্পষ্ট কথা, এর পরে কিছু করা যাবে না।

 লিজা ভাবল, এদেরই মধ্যে কেউ একজন কোম্পানির ক্ষতি করতে চাইছে। শেয়ার বেচে দিলে, তাকে আর ধরা যাবে না।

অবশেষে রিস্ বলল–মিস রফ যা বলছে সকলের তা মেনে নেওয়া উচিত।

-ধন্যবাদ রিস্। আমার বাবা নেই। আমিই এখন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। সেটা ঘোষণা করে দাও।

কেউ আর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করল না।

.

কিন্তু

কিন্তু তখন একজন মনে মনে ভাবছে–প্রেসিডেন্টের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। কত প্রেসিডেন্ট মরল।

.

০৭.

–মিস আরলিং, একটা কনফিডেনসিয়াল রিপোর্ট আমি হাতে পেয়েছি। বাবার তৈরি, এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলতে পারেন?

-না, মিস রফ। আমি কিছু জানি না।

 –কে বলতে পারে বলে মনে হয়?

 –কোম্পানির সিকিউরিটি ভিভিয়ান।

হতে পারে না, লিজা মনে মনে বলল। একটু হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে সে চলে গেল।

.

উইলটন ক্ৰশ। অর্থকরী ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ।

ব্যাঙ্কের ছশো পঞ্চাশ মিলিয়ন ধার শোধ করা হয়নি কেন? লিজা জানতে চাইল।

 –মামলা, ক্ষতিপূরণ, ব্যর্থ রিসার্চ প্রোজেক্ট।

 –আমাদের প্রতিষ্ঠানকে কেন ব্যাঙ্ক টাকা শোধের জন্য চাপ দেবে?

–ওরা ওষুধের পাশাপাশি কোম্পানির সুনামের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। আমাদের সমস্যাগুলো কারো আর অজানা নেই। কোম্পানির বদনাম হয়েছে। আমাদের ব্যাঙ্কার আমাদের প্রতিযোগীদেরও ঋণ দিয়েছে। তাই ওরা চাপ দিচ্ছে। ব্যাঙ্কিং কনসার্টিয়ামের নেতা হের জুলিয়স বাদরাট অনেকবার ফোন করেছেন।

–আমি বর্তমান প্রেসিডেন্ট উনি কি তা জানেন?

 –তাহলে উনি আর ধার শোধের সময়টুকুও দেবেন না।

 –কফি খাবেন?

ধন্যবাদ।

 –এ সম্পর্কে আপনার উপদেশ কী?

সোজা ব্যাপার। কোম্পানির শেয়ার বাইরে বিক্রি করে দিন। ঋণ শোধের টাকা উঠে আসবে।

লিজা মনে মনে বলল, ইনিও শত্রুদের একজন।

.

০৮.

হামবুর্গ। শুক্রবার, ১লা অক্টোবর। রাত দুটো।

ঠান্ডা, ভিজে হাওয়া। সমুদ্রের দিক থেকে আসছে। হামবুর্গের রীপারবন অঞ্চল। পাপ নগরী, নিষিদ্ধ এলাকা। গলিখুঁজিতে উৎসুক মানুষের আনাগোনা। এখানে নেশার অঢেল আমদানি-কোকেন, মদ, মরফিয়া, হেরোইন, মেয়েমানুষ, ছোটো ছেলে–সব। শুধু চাই পয়সা। বড়ো রাস্তার ওপর বড়ো বার। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ঝলসে যায়। পাশেই একশ্যারানগ্ন ও অশ্লীল স্ট্রিপ শোর ব্যবস্থা। নারী মাংস পাওয়া যায়, কসাইখানার মতো। সব পাবে, শুধু দাম চাই। স্বাভাবিক লোকদের জন্য আছে সাধারণ সেক্স। মুখ-মৈথুন পছন্দ করে অস্বাভাবিক সেক্সিরা। চাইলে বারো বছরের ছেলে বা মেয়েকে বিছানায় নিয়ে লুটেপুটে ভোগ করতে পারো। মৈথুন দৃশ্য দেখবে-মস্ত বড়ো কুকুরের সঙ্গে মাদী মানুষের? পাবে। মর্ষকামী হলে ওরা চাবুকের ঘায়ে তোমার কামোন্মাদনা জাগিয়ে দেবে। আয়না লাগানো বেডরুম। যৌন উত্তেজনা জাগছে না? মেয়েমানুষ নাও। একজন-দুজন-তিনজনযত খুশি। খাটো ঝুলের স্কার্ট আর আঁটসাট খাটো ব্লাউজ পরে বেশ্যারা ঘুরে বেড়ায়। পেভমেন্টে ছেলেদের, মেয়েদের বা দম্পতিদের নানা বিশ্রী প্রস্তাব দেয়।

পর্নোফিল্মের ক্যামেরাম্যান এই রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। এক যুবতী, বয়স আঠারো, সোনালি চুল। বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করছিল। ক্যামেরাম্যান তার সামনে দাঁড়াল।

 মেয়েটা ফিক করে হাসল–তুমিও আমার বন্ধু। এসো, তুমি আমার কাছ থেকে অনেক আনন্দ পাবে।

-তোমার নাম?

 –হিলডা।

 –তুমি ফিল্মে অভিনয় করতে চাও?

 –ওসব ফালুত ফকিবাজি কারবার ছাড়ো।

পর্নোফিল্মে।

করব। অ্যাডভান্স চাই। পাঁচশো মার্ক।

 ক্যামেরাম্যান তার হাতে টাকা তুলে দিল।

হিলডা ভাবল, আরও বেশি চাইলেও পাওয়া যেত। যাকগে পরে বোনাস হিসেবে চেয়ে নেবে। কী করতে হবে জিজ্ঞেস করল–

.

হিলডা নার্ভাস।

ছোট্ট ঘর। কম দামের আসবাব।

হিলডা বিছানায়, উলঙ্গ। তাকিয়ে আছে উপস্থিত তিনটে লোকের দিকে। ভাবছে আর দেখছে। কেমন গোলমেলে ঠেকল তার। বার্লিন, মিউনিখ, হামবুর্গের রাস্তায় বেশ্যাবৃত্তি করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা বেড়েছে তার। সে বুঝল, এখানে অস্বাভাবিক কিছু ব্যাপার আছে। সে কি পালিয়ে যাবে? না, তা হবার নয়। পাঁচশো মার্ক অগ্রিম নিয়েছে, শুটিং শেষ হলে আরও পাঁচশো মার্ক পাবে। বেশ্যাগিরি করাই তার পেশা। ব্লু ফিল্মে সে ভালো কাজই করতে পারবে।

তার পাশে শুয়ে আছে পেশীবহুল চেহারার এক পুরুষ। নগ্ন, লোমহীন শরীর। মুখটা দেখে প্রথম ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। এই ধরনের ফিল্মের হিরো হওয়ার পক্ষে লোকটা ঠিক নয়।

ছায়ার আড়ালে যে লোকটা দর্শক হয়ে বসে আছে তাকে আরও বেশি অদ্ভুত ঠেকল। তার। চোখে গগলস, মাথায় মস্ত বড়ো টুপি। পুরুষ না মেয়েমানুষ, বোঝা যাচ্ছে না।

হিলডার গলায় রিবন বেঁধে দেওয়া হল।

–কেন? এটার কি দরকার?

 –তোমরা অ্যাকশন শুরু করো। ক্যামেরাম্যান বলল।

ক্যামেরা সক্রিয় হল।

বিছানায় পুরুষ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হিলডা লোকটার কান, ঘাড়, বুক ছুঁয়ে ঠোঁট ও জিভের ছোঁয়া দিল পেটে, তলপেটে, পায়ে, পায়ের আঙুলে।

 পুরুষের পুরুষাঙ্গটি খাড়া হয়ে উঠেছে। হিলডার জিভ ও ঠোঁট উঠে গেল পায়ের আঙুল থেকে পুরুষটির বিশেষ অঙ্গের দিকে। লোকটার দণ্ডটি প্রচণ্ড শক্ত ও লম্বা হয়ে উঠেছে।

নাও, স্টার্ট।

দণ্ডটা হিলডার ত্রিকোণে ঢুকছে বেরোচ্ছে। হিলডার নিতম্ব তালে তালে আন্দোলিত হচ্ছে। হিলডার আর ভয় করছে না। বরং পুলক জেগেছে মনে। চোখ বন্ধ করে আরাম উপভোগ করছে।

 দর্শক ঝুঁকে পড়ে এই দৃশ্য দেখছে। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠল–ওর চোখ।

–চোখ খোলল। ক্যামেরাম্যানের নির্দেশে হিলডা চোখ মেলল।

আরো জোরে জোরে লোকটা চাপ দিচ্ছে। হিলডা সাধারণত মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তি করে চরম মুহূর্তে পৌঁছোয়। পুরুষ মানুষটির সঙ্গে শুয়ে সে সেই চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারল না। কিন্তু অভিনয় করে শিৎকারের শব্দ করল সে। কারণ ক্যামেরাম্যান আগেই তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল, চরম পুলক লাভ না করলে বোনাসের টাকা পাবে না। অথচ ওই টাকা দিয়ে সে কী কী করবে, ভেবে রেখেছে।

এবার সত্যি সত্যি চরম পুলক উপস্থিত। হিলডা চিৎকার করে উঠল।

দর্শক খুশি।

ক্যামেরাম্যান হিরোকে বলল–এবার।

হিলডার গলার দিকে হিয়োর বলিষ্ঠ হাত দুটো উঠে এল। হিলডার শ্বাসনালীতে তার আঙুলের চাপ। লোকটার চোখে জিঘাংসার দৃষ্টি। মেয়েটি ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারল না। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শরীর ঝাপটা দিতে থাকল। তারপর কয়েক মুহূর্ত পরেই শরীরটা কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল।

.

০৯.

জুরিখ। সোমবার। ৪ঠা অক্টোবর। বেলা ১০টা।

বৈজ্ঞানিক এমিল জেপলি গোপন রিপোর্ট পাঠিয়েছে। রিপোর্টের গুরুত্ব বুঝে এলিজাবেথ নিজেই তার সঙ্গে দেখা করতে গেল।

বছর পঁয়ত্রিশের জেপলি রোগা ও লম্বা। মাথায় টাকের পাশে কিছুটা লাল চুল।

লিজকে দেখে সে হকচকিয়ে গেল।

রিসার্চের ব্যাপারে লিজা তার কাছে জানতে চাইল।

সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে সে বলল–কোলাজেন হল শরীরের যে-কোনো কানেকটিভ টিসুর মূল প্রোটিন উপাদান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রোটিনের যে পরিবর্তন আসে, আমি সেটা বন্ধ করার উপায় বের করতে চাইছি। এক্ষেত্রে মিউকোপলিস্যাকারাইড ও এনজাইমের ক্রিয়া বন্ধ করার প্রক্রিয়া ব্যবহার করব।

তার মানে বৈজ্ঞানিক জেপলি বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখার ওষুধ বের করার কাজ করছে। জেপলির ধারণা–এই ওষুধ খেয়ে মানুষ একশো-দেড়শো বছর পরমায়ু লাভ করবে। ক্যাপসুল খেলেই হবে, ইনজেকশনের প্রয়োজন নেই।

লিজা বুঝল, ওই ওষুধের সম্ভবনা কী বিরাট! এমনকি পঞ্চাশের ওপরে যাদের বয়স, তারাও এই ক্যাপসুল খাবে। তার মানে তাদের ব্যবসা কোটি কোটি ডলার বেড়ে যাবে।

গত চার বছর ধরে আমি এই পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। পশুপাখির ওপর প্রয়োগ করে ভালো ফল পেয়েছি। এবার মানুষের ক্লিপিক্যাল ট্রায়াল শুরু করলেই হয়।

আপনার এই গবেষণার কথা কে কে জানে?

–জানতেন আপনার বাবা স্যাম রফ। এটা রেড ফোল্ডার প্রোজেক্ট। তাই নিয়মানুযায়ী একজন বোর্ডসদস্যকেও রিপোর্ট পেশ করতে হয়।

–সে কে?

 –ওয়ালথার গ্যাসনার।

-শুনুন, গ্যাসনারকে আর রিপোর্ট পাঠানোর দরকার নেই। যা কিছু রিপোর্ট একমাত্র আমাকেই দেবেন। কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?

এক থেকে দেড় বছর।

টাকা, লোক, যন্ত্রপাতির জন্য চিন্তা করবেন না। যা দরকার হবে, আমাকে বলবেন। যত তাড়াতাড়ি পারেন কাজটা শেষ করুন।

-বেশ। আপনার বাবা স্যাম রফকে আমি খুব পছন্দ করতাম।

ধন্যবাদ।

যুগান্তকারী একটি ওষুধ রফ অ্যান্ড সন্সের ল্যাবোরেটরিতে আবিষ্কার করতে চলেছে এমিল জেপলি নামের এক প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক-খবরটা স্যাম রফ জানত। সম্ভবত সেই কারণে সে কোম্পানির শেয়ার বিক্রির ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল।

.

মিস আরলিং, রেড, ফোল্ডার প্রোজেক্টের নিয়মগুলো আমায় বলবেন?

–পঞ্চাশ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচে বিভাগীয় প্রধান অনুমতি দিতে পারেন। তার ওপরে হলে বোর্ডের অনুমতি নিতে হয়। যে রিসার্চ প্রোজেক্ট প্রাথমিক পরীক্ষায় সফলতা লাভ করে তাকেই রেড ফোল্ডার প্রোজেক্ট বলা হয়। তখন নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা আছে, এমন বিশেষ ঘরে কাজ হয়। কেবল তিন জনের কাছে রিপোর্ট থাকে। বিজ্ঞানী ইনচার্জ, প্রেসিডেন্ট এবং বোর্ডের একজন ডাইরেক্টর।

-কোন্ সদস্যের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?

 –সেটা আপনার বাবাই ঠিক করেছিলেন। ওয়ালথার গ্যাসনার।

কথাটা বলেই মিস আরলিং চুপ করে গেল। সম্ভবত নিজের ভুল বুঝতে পারল। মিস রফ এখনও বৈজ্ঞানিকের নামই বলেনি।

মিস আরলিং এই অত্যন্ত গোপন খবরটা জানল কী করে? স্যাম বলেছে? না কি অন্য কোনো উপায়ে?

এখন ওয়ালথার গ্যাসনারের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ফোনে? না, বার্লিনে যাওয়াই ভালো।

.

এক রেস্তোরাঁয় ডিনারে বসেছে ওরা। ওয়ালথার গ্যাসনারকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। তার মুখে অদ্ভুত সব দুশ্চিন্তার ছাপ, যা তাকে অসুন্দর করে তুলেছে।

–অ্যানা কোথায়?

ও বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে।

 –ফোনে ডাকব?

 –না, ওকে এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

লিজা এবার এমিল জেপলির কথা পাড়ল।

–ওর কাজটা সফল হলে

বিরাট কাজ।

 –ও তোমাকে আর রিপোর্ট দেবে না।

কারণ?

–ব্যক্তিগত কিছু নয়। অন্য কোনো বোর্ড মেম্বার হলেও আমি একাই ব্যাপারটা দেখতাম।

জানি, সে ক্ষমতা তোমার আছে। লিজা, অ্যানার অনেক শেয়ার আছে রফ অ্যান্ড সন্স-এ। যদি শেয়ার পারলিককে বিক্রি করার ব্যাপারে তুমি রাজি থাকো–

দুঃখিত। এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।

লিজা লক্ষ্য করল, কথা বলতে বলতে প্রচণ্ড উত্তেজনায় ওয়ালথারের হাত কাঁপছিল।

.

১০.

জুলিয়াস বাদরাট। ব্যাঙ্কার, রোগা, ভঙ্গুর ধরনের চেহারা। কাঠির মতো দুটি হাত। শুকনো পাতলা অসমাপ্ত মুখ। ওর সঙ্গে আরও পাঁচজন ব্যাঙ্কার এসেছে। তাদের পরনে কালো স্যুট, ওয়েস্টকোট, সাদা শার্ট ও কালো টাই।

কফি, প্যাস্ট্রি, লাঞ্চ-সবাই ওরা সবিনয়ে প্রত্যাখান করল। ওরা ঋণের টাকা ফেরতের ব্যাপারে এসেছে।

–আপনাদের কী দোষ বলুন? আমি এক অনভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট। ঋণ শোধের মেয়াদ বাড়ানোর আর্জি জানালে আপনারা শুনবেন কেন? আমার বাবা ছিলেন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। তবুও তিনি যখন প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন থেকে তার ওপর আপনারা চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন।…..

আপনাদের ব্যাঙ্কের নামডাক আছে পৃথিবীব্যাপী। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, বড়ো হতে হলে দূরদৃষ্টির প্রয়োজন। শুধু ডলার-সেন্টের হিসাব কষলেই হয় না। আপনারা নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমী নন। রফ অ্যান্ড সন্সের অবদান, মানুষের জীবন বাঁচাতে, মানুষের জীবিকার সুযোগ করে দিয়ে–

জুলিয়াস হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল–আপনাদের কোম্পানির শেয়ারগুলো বাইরে বিক্রি করে দিন। ধার শোধ হয়ে যাবে।

ধার শোধ হওয়াটাই কি মুখ্য ব্যাপার? টাকাটা কোথা থেকে এল…

–তা ব্যাঙ্কের ভাবনা নয়।

–রফ অ্যান্ড সন্স আপনাদের কাছে তিনমাস সময় চাইছে। বিশ্ববিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি। টাকাটা মার যাবে না।

…তাছাড়া, এটা অত্যন্ত সিক্রেট ব্যাপার, আশা করি, এটা আপনারা বাইরে ফাঁস করবেন না–খুব শীগগিরই একটা নতুন ওষুধ আমরা বাজারে ছাড়ছি। বলতে পারেন যুগান্তকারী অবদান।

জুলিয়াস বলল–এটা কীসের ওষুধ?

-সরি। আর বলা উচিত হবে না। তবে প্রোডাকসন বাড়াতে হবে, প্রায় তিনগুণ, ব্যাঙ্কের আরও লোন লাগবে।

ব্যাঙ্কাররা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

আপনাকে আগের ঋণ শোধ করার জন্য তিন মাস সময় দিলাম। জুলিয়াস বলতে থাকল, তবে সুদ বেশি লাগবে। আর আপনারা শুধু আমাদের কাছ থেকেই ঋণ নেৰ্বেন, এই শর্তে।

–নিশ্চয়ই!

.

কাজের চাপে এলিজাবেথ রফ একেবারে নাজেহাল। হেড কোয়ার্টারের নানা বিভাগ, বাইরের ফ্যাক্টরি থেকে, গ্রীনল্যান্ডের ল্যাবরেটরি থেকে, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ডের অফিস থেকে, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে খবর আসছে নতুন ওষুধ। বিক্রির হিসাব, স্ট্যাটিসটিক্স, বিজ্ঞাপন ও রিসার্চের পরিকল্পনা। নতুন বাড়ি কেনা, পুরোনো বাড়ি বিক্রি, অন্য কোম্পানি কিনে নেওয়া, পুরোনো অফিসারদের সরিয়ে দিয়ে নতুনদের বহাল করা। অবশ্য এইসব কাজের ব্যাপারে এক্সপার্টদের উপদেশ পাওয়া যায়। কিন্তু সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হল প্রেসিডেন্ট, তার মানে এলিজাবেথ রফ।

সারা বছর ধরে তাকে পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরতে হয়। রফ অ্যান্ড সন্সের বিভিন্ন শাখা-গুলিতে তাকে যেতে হয়।

একটা ব্যাপারে এলিজাবেথ অসুবিধা অনুভব করে। এটা পুরুষশাসিত সমাজ। মেয়েদের অর্থাৎ সুন্দরী যুবতীর কাছ থেকে তারা অর্ডার নিতে অভ্যস্ত নয়। অনেকে ভাবে, লিজাকে শয্যাসঙ্গিনী করতে পারলেই বুঝি সব কাজ সহজ হয়ে যাবে।

ওদের ধারণা ঠিক নয়। আসলে লিজার বুদ্ধি আছে, মন ও মনন আছে। তাই সে কর্তৃত্ব করতে পারছে।

এবং ব্লাডলাইন

এলিজাবেথের ধমনীতে রফ অ্যান্ড সন্সের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল রফের শোণিত বইছে। সে অসাধারণ গুণসম্পন্ন–দুর্দম ইচ্ছশক্তি, মনের প্রচণ্ড জোর এবং কর্তৃত্ব করার স্বাভাবিক ক্ষমতা। সে পুরুষের কথা শোনে, প্রশ্ন করে, খবর জেনে নেয় এবং কাজ শিখে নেয়।

 জুরিখে বোর্ড অফ ডাইরেক্টরদের মিটিং বসে সপ্তাহে একবার। লিজাকে সেখানে যেতে হয়। বোর্ডের ডাইরেক্টররা সবাই তার আত্মীয়, দূরসম্পর্কের ভাই বা ভগ্নীপতি।

এদের মধ্যেই একজন নিজের শাখা কোম্পানিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তার দোষেই অসহায় মানুষগুলি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে।

 সে-ই নিজের কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের ফর্মুলা সাপ্লাই করেছে অন্য কোম্পানিতে। রফ অ্যান্ড সন্সের বদনাম হয়েছে।

কিন্তু সে কে?

ইভো পালাজজি? সেই হাসিখুশি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষটি?

অ্যালেক নিকলস? অত্যন্ত ভালোমানুষ। ভদ্রলোক। প্রয়োজনে এলিজাবেথকে সাহায্য করার জন্য ছুটে এসেছে।

শার্ল মারতেইল? যে স্ত্রীর ভয়ে জুজু হয়ে থাকে? অবশ্য ভয়ে মানুষ অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

এবং ওয়ালথার গ্যাসনার? জার্মান প্লেবয়। সুদর্শন, মিষ্টি ব্যবহার, কিন্তু ওর ভেতরটা? অ্যানা ওর বউ, তেরো বছরের বড়ো। সে সুদর্শন ও সুপুরুষ। গ্যাসনার কি শুধু টাকার লোভে অ্যানাকে বিয়ে করেছে?

 এলিজাবেথ ওদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছিল আর তাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিল।

না, ঘাতক অত্যন্ত বুদ্ধি ধরে। সে সহজে ধরা দেবে না।

ক্রমশ ওষুধের ব্যবসার ভেতরের ব্যাপারগুলো বুঝে নিল লিজা। কোম্পানিতে কোম্পানিতে প্রতিযোগিতা চলছে। কে কাকে টেক্কা দেবে! কোনো কোম্পানির ওষুধ খেয়ে রোগী মরলেই প্রায় একডজন ওষুধ কোম্পানি সেই খবর পুরো পৃথিবীতে চাউর করে দেয়। কিন্তু ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই, যেন কত ভাব।

বিভিন্ন পার্টিতে ছোটো-বড়ো ফার্মের মাথারা আসে। নিজের সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলে।

এমনই এক পার্টিতে দেখা গেল একা এলিজাবেথ বাদে আর সবাই পুরুষ!

মস্ত বড়ো এক কোম্পানির মাঝবয়সী ও অহংকারী প্রেসিডেন্ট বলল, বর্তমানে নতুন ওষুধ বের করার ব্যাপারে সরকার কত নিয়মকানুন বের করেছে। যদি অ্যাসপিরিন এখন আবিষ্কৃত হত, তাহলে তাও বাজারে সহজে চালু করা যেত না। লিটল লেডি, অ্যাসপিরিন কতদিন আগে চালু হয়েছে বলতে পারো?

 লিটল লেডি, মানে এলিজাবেথ রফ।

–খ্রিস্টের জন্মের চারশো বছর আগে, সেই সময় হিপোক্রিটিস উইলো গাছের ছালে প্রথম স্যালিসিন খুঁজে পেয়েছিলেন।

-ঠিক বলেছ! বিদ্রূপাত্মক হাসিটা তার ঠোঁটে আর দেখা গেল না।

সপ্তাহে একবার প্লেনে পাড়ি দিতে হয় মিস রফকে। বোম্বাইয়ের মতো বড়ো শহরে, পুয়েরতো ভালোরর মতো সুন্দর এলাকায় ফ্যাক্টরি ম্যানেজারের সঙ্গে সে দেখা করে। এখন লিজের কাছে গুয়াতেমালা মানেই ম্যানেজার এমিল নুনোজ। তার বউটি খুব হাসি খুশি ও মোটা। একডজন ছেলেমেয়ে। কোপেনহাগেনে গেলে ম্যানেজার নিলস জর্ণ-এর সঙ্গে কথা বলে। নিলস তার পাঁচ মায়ের সঙ্গে থাকে এবং রিওডি জানেরো মানে আলেজান্দ্রো দুভাল ও তার সুন্দরী রক্ষিতা।

 এমিল জেপলির ফোন আসে।

–একটা ছোট্ট সমস্যা দেখা দিয়েছিল মিস রফ, এখন মিটে গেছে। তবে একটু দেরি হয়ে গেল।

–কিছু দরকার হলেই জানাবেন।

ব্যাঙ্কের ধার শোধ করার জন্য তিনমাস সময় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রোজেক্টের কাজ শেষ হবে বলে মনে হয় না লিজার। সে ঠিক করল, গোপনে ব্যাঙ্কার জুলিয়াসকে ল্যাবোরেটরিতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে। নিজে চোখে দেখলে ওর বিশ্বাস হবে। তখন আর ওরা চাপ সৃষ্টি করবে না।

.

. হেয়ার কনডিশনারের চাহিদা অত্যন্ত কমে গেছে। ড্রাগস্টোর থেকে সব মাল ফেরত আসছে।

সেলস এগজিকিউটিভের মতে, আরও বিজ্ঞাপন প্রয়োজন।

না, তা সম্ভব হবে না। রিসের কণ্ঠে আপত্তি, বিজ্ঞাপনের বাজেট অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে।

 ড্রাগস্টোর থেকে সব মাল তুলে নিয়ে এসো। এলিজাবেথ বলল, এখন থেকে এই হেয়ার কনডিশনার শুধু বিউটি পার্লার ও সেলুনে পাওয়া যাচ্ছে, এইভাবে বিজ্ঞাপন দাও। এই ধরনের প্রোডাক্ট সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। তাই বিক্রির হার কমে গেল। দুষ্প্রাপ্য, খুঁজতে হয়, এমন জিনিসই লোকে কিনবে।

 অতএব দেখা গেল কয়েক দিনের মধ্যেই হেয়ার কনডিশনারের বিক্রি বেড়ে গেছে।

–তোমার মুখ যেমন সুন্দর, বুদ্ধিও তেমন। রিস্ বলল।

 রিসের এত দিনে খেয়াল হল–মিসেস রিস্ উইলিয়ামস।

.

১১.

লন্ডন। শুক্রবার। ২রা নভেম্বর। বিকেল ৫টা।

ক্লাবের স্যানা বাথ জলীয় বাষ্পে ভরা। স্যার অ্যালেক নিকসের কোমরে তোয়ালে জড়ানো। হঠাৎ ঢুকল জন সুইনটন। বেঞ্চে বসল।

তুমি এখানে?

গুন্ডা সর্দারের ডানহাত জন সুইনটন চোখ টিপল–আমি তো জানি, তুমি আমার জন্যই অপেক্ষা করছ। তাই না?

না। ভিভিয়ানের জুয়ায় হেরে যাওয়া টাকা শোধের জন্য আমি সময় চেয়েছি।

–কিন্তু, তুমি তো বলেছিলে শেয়ার বিক্রি করার অনুমতি পাবে। শেয়ার বেচে টাকা শোধ করবে।

বলেছিলাম, কিন্তু এখন মত পাল্টেছে।

 –ওকে রাজি করাও।

 –চেষ্টা করছি। তবে–

তবে আবার কী? আর গ্যাসপট্টি খাইয়ো না।

 জন সুইনটন ক্রমশ স্যার অ্যালেকের দিকে একটু একটু করে এগোতে থাকে।

–দেখো, তোমার সাথে আমরা ঝামেলা চাই না। পার্লামেন্টে তোমার মতো একজন ভালো বন্ধু থাকা দরকার। তবে সব কিছুর একটা মাত্রা আছে। স্যার অ্যালেক, আমরা তোমার একটা উপকার করেছি। এবার তোমার পালা। জাহাজে করে রফ অ্যান্ড সন্সের ওষুধ যায়। ওই সঙ্গে কোকেন চালান করে দাও।

–অসম্ভব। আমি পারব না। কিছুতেই না–

পেছনে সরতে সরতে অ্যালেক তখন বেঞ্চের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে। ওখানেই গরম পাথরে ভর্তি ধাতুর তৈরি গরম পাত্রটা আছে।

সাবধানে! অ্যালেক বলে ওঠে–খুব গরম!

জন অ্যালেকের হাতটা ধরে মুচড়ে দিল। তাকে গরম পাথরের দিকে নিয়ে গেল।

-না! অ্যালেকের হাতের নোম পুড়ছে।

তারপরেই গরম পাথরের মধ্যে চাপা পড়ল তার হাত। যন্ত্রণায় সে চেঁচিয়ে উঠল। মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল।

–আমি আবার আসব। পথ বাতলে রেখো।

সুইনটন চলে গেল।

.

১২.

বার্লিন, শনিবার, ৩রা নভেম্বর। সন্ধ্যা ৬টা।

অ্যানা রফ গ্যাসনারের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। সে নিজের বাড়িতেই বন্দি। বাড়ি সাফ করার জন্য সপ্তাহে একদিন ঝি আসে। অন্য দিনগুলোতে সে ও তার বাচ্চারা ওয়ালথারের কৃপাপ্রার্থী হয়। বাচ্চাদের ওর বাবা পছন্দ করে না, ঘেন্না করে।

বাচ্চাদের ঘরে বসে অ্যানা তাদের গানের রেকর্ড বাজিয়ে শোনাচ্ছিল।

ওয়ালথার এসে রেকর্ডটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। চিৎকার করছে সে-বাচ্চাদের আমি আর বরদাস্ত করতে পারছি না। ওদেরকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আর সেইসঙ্গে এটাও আমি চাই না, ঘরের ব্যাপার বাইরের লোক জানুক।

গ্যাসনারের রুদ্র মূর্তি দেখে হঠাৎ অচৈতন্য হল অ্যান।

চেতনা ফিরলে সে দেখল, বিছানায় শুয়ে আছে। তখন সন্ধ্যা ছটা। ও বাচ্চাদের ঘরের দিকে তাকাল। তালা লাগানো। ওরা বেঁচে আছে, না মরে গেছে, বোঝা গেল না।

অ্যানা ফোন তুলে নিল–১১০। পুলিশ এমারজেন্সি! শিগগির এখানে আসুন।

ঝট করে ওয়ালথার তার থেকে রিসিভার কেড়ে নিল।

 –আমার বাচ্চারা কোথায়? তুমি ওদের কী করেছ?

 প্রশ্নের কোনো জবাব পেল না আনা।

.

বার্লিন ক্রিমিনাল পুলিশের সদরদপ্তরে এমারজেন্সি ফোনের সঙ্গে অটোমেটিক হোল্ড কানেকশন-এর ব্যবস্থা আছে। তাই ফোন কোথা থেকে আসছে, তা রেকর্ড হয়ে যায়।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে টেপ-রেকর্ডার নিয়ে ডিটেকটিভ পল ল্যানজ এল মেজর ওয়েজম্যানের অফিসে।

–ঠিক আছে।

 –তাহলে সমস্যা কী?

–ওখানে গাড়ি পাঠাও। মেজর ওয়েজম্যান আদেশ দিল।

 ওটা রফ অ্যান্ড সন্সের জার্মান শাখার প্রধান ওয়ালথার গ্যাসনারের বাড়ি। আপনার অনুমতি বিনা

একটু ভুল হলে তাদের দুজনকেই চাকরি থেকে বিদায় নিতে হবে, মেজর জানে।

–তুমি নিজেই যাও। তবে খুব হুঁশিয়ার।

.

দক্ষিণ-পশ্চিম বার্লিনের অভিজাত অঞ্চলে ওয়ালথার গ্যাসনারের বাস। নিরালা জায়গা। সুন্দর ঝকঝকে বাড়ি।

  গোয়েন্দা মনে মনে বলল, রফ পরিবারের ক্ষমতা প্রচুর। এই পরিবারকে ঠকানো মানে দেশের সরকারের পতন। মেজরের সাবধানতার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ জানালো।

অদ্ভুত অবিশ্বাস্য নৈঃশব্দ্য চারদিকে, কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে গেল। সামনে মাঝবয়সী মহিলা। সাধারণ চেহারা, পরনে ড্রেসিং গাউন, কোঁচকানো।

ডিটেকটিভ ল্যানজ ভাবল, বাড়ির কাজের লোক হয়তো।

আমি পুলিশ ডিটেকটিভ ল্যানজ। মিসেস গ্যাসনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

 –আমি মিসেস গ্যাসনার।

 –আপনি পুলিশে ফোন করেছিলেন?

 –হ্যাঁ, তবে ভুল করে।

তার মানে?

 –ভেবেছিলাম গয়না হারিয়েছে, আসলে হারায়নি।

অথচ এমারজেন্সি নম্বর হত্যা বা ধর্ষণের জন্য।

আই সী। ডিটেকটিভ বলল।

 –দুঃখিত।

ডিটেকটিভ বিদায় নিল।

 দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

ওয়ালথার এগিয়ে এল-খুব ভালো বলেছ তুমি। এবার ভেতরে এসো।

ওয়ালথার ওপর তলায় যাবার জন্য সিঁড়িতে পা রাখল।

আর ঠিক সেই সময়ে

ড্রেসিং গাউনের আড়ালে রাখা মস্ত বড়ো ধারালো কাঁচিটা বের করে অ্যানা বসিয়ে দিল ওয়ালথারের পিঠে।

.

১৩.

রোম। রবিবার, ৪ঠা নভেম্বর। দুপুর ১২টা।

বিখ্যাত তিভোলি উদ্যান। ইভো পালাজজি তখন বউ সিমনেত্তার হাতে হাত রেখে হাঁটছে। তিন মেয়ে ছোটাছুটি করে ফোয়ারা দেখে বেড়াচ্ছে।

আগে ইভো তার দ্বিতীয় পত্নী আর তিন ছেলেকে নিয়ে এখানে বেড়াতে আসত। কিন্তু এখন আর সে দোনাতেন্নার ছায়া মাড়ায় না। নিশ্চয়ই দোনাতেল্লা এজন্য অনুতপ্ত।

–ছেলেরা, এদিকে এসো।

পরিচিত কণ্ঠস্বর, ইভো পেছন ফিরে তাকাল। এবং আঁতকে উঠল। দোনাতেল্লা! ও সিমনেত্তার দিকে এগিয়ে আসছে। ও কি আজই সব কিছু বলে দেবে? সাংঘাতিক ব্যাপার! ছেলেরা যদি তাকে বাবা বলে ডেকে ফেলে, তাহলে ওকে ফোয়ারার জলে প্রাণ দিতে হবে।

-তাড়াতাড়ি চলো। আশ্চর্য একটা মজার জিনিস দেখা যাবে।

ইভো, সিমনেত্তা আর মেয়েরা ছুটছে।

এবার হাঁটি। সিমনেত্তা বলল।

-না, তাহলে মজাটাই হারিয়ে যাবে। কুইক।

 ছুটতে ছুটতে আমার বুঝি হার্ট অ্যাটাক হবে, ইভোর ভাবনা। আমার মৃত্যু হবে। গড় ড্যাম! মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। উলঙ্গ দোনাতো যখন তার ওপর চেপে বসত… ভাবতে গিয়ে এই বিপদের মধ্যেও তার দণ্ডটা শক্ত হয়ে উঠল।

ইভো, এবার দাঁড়াও।

 –না, থামা চলবে না।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

 –বাবা, আমরা তো এখুনি এখানে এলাম।

 –মেয়েরা কথা বোলো না। জোরে জোরে দৌড়োও।

ইভো তার পুরো পরিবারকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

এবার মজাটার কথা বলি। ইভো ধাতস্থ হয়েছে। আমরা হ্যাঁসলারে যাচ্ছি, ডিনার খেতে।

 সামনে পিকচার উইনডো, দূরে সেন্ট পিটারের গির্জা। ভালো ভালো খাবার সবাই তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে, ইভো ছাড়া। তার মনে হল সে যেন শুকনো চামড়া চিবোচ্ছে।

তার মন খারাপ। দোনাতেল্লার চাহিদা মতো টাকাটা মিটিয়ে না দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সিমনেত্তাকেও সব বলে দেবে।

অতএব, যেভাবে হোক টাকাটা তাকে জোগাড় করতেই হবে।

.

ঘরে ঢুকেই শার্ল মারতেইল ঘাবড়ে গেল। পিয়ের আর হেলেন মুখোমুখি বসে আছে। ওহ নো! পিয়েরকে দিয়েই শার্ল হেলেনের গয়নার কপিগুলো করিয়েছে।

-শার্ল এসো। মসিয় পিয়েরকে তুমি তো চেনো। উনিও তোমাকে জানেন। ওঁকে দিয়েই তুমি আমার গয়নাগুলোর নকল বানিয়েছিলে। আসলগুলো হাতিয়ে নিয়ে টাকাটা পকেটে পুরেছ।

শার্ল বড্ড ভয় পেয়ে গেছে। প্যান্ট তার ভিজে গেছে।

হেলেনের সামনে দাঁড়াতে তার লজ্জা হল। সে এখন পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কীভাবে? হেলেনের দয়ামায়া নেই। আরও যদি একবার জানতে পারে, ওকে ছেড়ে শার্ল চলে যাবার ধান্দা করেছিল তাহলে…

–মসিয় পিয়ের, আপনি এখন আসতে পারেন।

হেলেন এক নিষ্ঠুর বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে। এমন কোনো কাজ নেই, যা ও করতে পারে না।

শার্ল, আমার গয়না বিক্রি করে তুমি টাকা পেয়েছ। রসিদগুলো আমি রেখে দিচ্ছি। ফটোস্ট্যাট কপি। তুমি জানো, এর জন্য দশ বছর জেলের ঘানি তোমাকে ঘোরাতে পারি। জুয়েলার, আপনি একথা নিয়ে কানাকানি করবেন না। আমি ভেবে দেখি

–বেশ। আমি এখন যাচ্ছি।

– জুয়েলার চলে গেল।

হেলেন স্বামী শার্লের দিকে তাকাল। কী যেন গন্ধ! ভয়ের! ভয়ে শার্ল প্যান্টে পেচ্ছাপ। করে ফেলেছে?

হেলেন মনে মনে খুশি হয়েছে মনের মতো বর পেয়েছে সে। শার্লের নিজস্ব অস্তিত্ব কিছু নেই। হেলেন সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। শার্ল এখন বউয়ের চাকর। রফ অ্যান্ড সন্সের শাখা প্রধান শার্ল নামেই, চলে হেলেনের নির্দেশে।

ব্লাডলাইন!

হেলেন রফ-মারতেইলের রক্তে রফ পরিবারের আভিজাত্য। এমনিতেই ও টাকার পাহাড়। আগের ডিভোর্সের দরুন আরও টাকা তার হাতে এসেছে। কিন্তু টাকার ওপর তার লিপ্সা নেই। তার চাই ক্ষমতা। সে রফ অ্যান্ড সন্সের সর্বেসর্বা হতে চায়। সে ঠিক করেছে, নিজের শেয়ার বেচে দিয়ে, অন্যদের শেয়ার কিনে নেবে। কোম্পানিকে চালানোর জন্য সে নকশা তৈরি করবে। এব্যাপারে তার বন্ধুরা সাহায্য করবে।

 স্যাম রফ কোম্পানির শেয়ার বেচার বিরোধিতা করে এসেছে। আজ সে বেঁচে নেই। এখন এসেছে তার মেয়ে এলিজাবেথ রফ। সেও চায় না, শেয়ার বাইরে বিক্রি হোক। কিন্তু হেলেন রফ মারতেইল জীবনে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। কোনো বাধা তার পথ রোধ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে শার্লকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্ল্যানমাফিক কাজ না করলে শার্ল নিজেই বিপদে পড়বে।

অবশ্য এসব করার জন্য চাই শার্লের শক্তি ও উদ্যম।

-শার্ল, তুমি আমার গয়না চুরি করার অপরাধে দশবছর কারাদণ্ড ভোগ করতে পারো। যদি আমি চাই। তুমি কি বাঁচতে চাও?

হ্যাঁ।

হেলেন পোশাক খুলে উলঙ্গ হল।

ওহ ভগবান, এখন এই নোংরা মেয়েমানুষটার সঙ্গে বিছানায় যেতে হবে? বিকৃত রুচির মহিলা, পুরুষের ওপর নিষ্ঠুর পাশবিক অত্যাচার করে মজা পায় হেলেন।

-শার্ল, তোমায় বাঁচাব তো?

 –হ্যাঁ।

-তা হলে শোনো। রফ অ্যান্ড সন্স আমার কোম্পানি। এলিজাবেথের শেয়ারগুলো আমি কিনে নিতে চাই।

-তুমি তো জানো, ও শেয়ার বিক্রি করতে রাজি নয়।

হেলেন উঠে দাঁড়াল। স্লিম সুন্দর নগ্ন শরীর। তার বুকের বোঁটা দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে।

–এলিজাবেথের ব্যাপারে কিছু একটা করতে হবে এবং তোমাকেই। মনে রেখো, না হলে বিশ বছরের জেল। নার্ভাস হয়ো না। আমার নির্দেশ মতো সব কিছু করবে। আগে পোশাক খোলো।

.

১৪.

এমিল জেপলির ল্যাবরেটরিতে লিজা রফ ঢুকল।

একটা খাঁচায় চারটে খরগোশ লাফালাফি করছে।

অন্য একটি খাঁচায় চারটে খরগোশ চুপচাপ বসে আছে।

–এরা সুস্থ আছে? লিজ বলল, অবশ্য ওদের তুলনায় প্রাণশক্তি কম।

–এরা কনট্রোল। এরা ওষুধ পায়নি। এদের বয়স কম। আর যে খরগোসগুলো লাফাচ্ছে, ওদের বয়স বেশি, ওরা ওষুধ পেয়েছে।

লিজা অবাক!

যাদের ওষুধ দেওয়া হয়নি, তারা কেমন প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

মানুষের ওপর পরীক্ষা কবে হবে?

একমাস পর।

এমিল, একথা কারো কাছে প্রকাশ কোরো না।

 –মিস রফ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি একাই সব করছি।

.

ডিনার শেষ। বোর্ড সদস্যরা ছুটল ট্রেন ও জেট ধরতে।

রিস্ উইলিয়ামস লিজার ঘরে ঢুকল। ওর কাজে সাহায্য করতে লাগল।

 সময় এগিয়ে চলেছে তার নির্দিষ্ট গতিতে।

.

মাঝ রাত।

হঠাৎ রিস বলল–একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।

 লিজা জানে, ও একটা লাল চুলের সুন্দরী ব্রেনসার্জনকে ডেট করেছে।

-সরি রিস, তুমি এখন যাও, আমি আর মিস আরলিং পরে বেরোচ্ছি।

 –গুড নাইট। সকালে দেখা হবে। রিস্ বিদায় নিল।

এমিল জেপলির সাফল্যের কথা রিসকেও বলেনি লিজা।

রাত একটা, কাজ শেষ। কোট ও পার্স নিয়ে সে ঘর থেকে বেরোল। প্রাইভেট এক্সপ্রেস লিফটের দিকে হাঁটছে। সঙ্গে মিস আরলিং।

ঠিক সেই সময় অফিসের ফোন বেজে উঠল।

–আপনি এগিয়ে যান। আমি দেখছি। মিস আরলিং বলল।

.

নীচের তলার লবিতে রাতের প্রহরী লক্ষ করছিল, মিস লিজা রফের প্রাইভেট এক্সপ্রেস লিফট নীচের দিকে নেমে আসছে। কন্টোল বোর্ডের লাল আলোটা দেখল সে। আলোটা নামছে। এলিজাবেথের ড্রাইভার নীচে গাড়িতে বসে আছে।

ঠিক সেই সময়

ঠিক সেই সময় সজোরে বিপদসূচক ঘণ্টা বেজে উঠল।

কনট্রোল বোর্ডে দেখা যাচ্ছে, লাল আলোটা অতি দ্রুত নীচের দিকে নামছে।

অর্থাৎ কনট্রোল বিকল। লিফট খারাপ হয়ে গেছে।

প্রহরী ছুটে এল কনট্রোল বোর্ডের কাছে। এমারজেন্সি সুইচ টিপল। সেফটি ব্রেক চালু করার চেষ্টা করল। না, কোনো লাভ হল না। লাল আলো প্রচণ্ড গতিতে তখন নেমে আসছে।

কনট্রোল বোর্ডের সামনে এসে পড়েছে ড্রাইভার কী হয়েছে?

লিফট ভেঙে পড়বে সরে যাও।

]দুজনেই দূরে সরে গেল।

তখন লিফটের প্রচণ্ড গতির তাড়নায় লবি থরথরিয়ে উঠছে।

প্রহরী মনে মনে প্রার্থনা করল–মিস রফ যেন এই লিফটে না থাকেন।

মুহূর্তখানেক পরেই শোনা গেল বিকট আওয়াজ।

সঙ্গে মহিলার গলার আর্ত চিৎকার।

বাড়িটা কেঁপে উঠল, যেন ভূমিকম্প।

.

১৫.

জুরিখ ক্রিমিনাল পুলিশের চিফ ইন্সপেক্টর অটো স্মিয়েও চোখ বন্ধ করে ডেস্কের সামনে বসে আছেন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, যেন যোগাভ্যাস করছেন। আসলে তিনি প্রচণ্ড রেগে গেছেন।

পুলিশের কাজের ব্যাপারে কিছু নিয়ম এতই স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য যে ওগুলো পুলিশ ম্যানুয়েলে লিখে রাখার কথা কেউ ভাবেনি। এ যেন খাওয়া, ঘুম, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক।

 যেমন-পুলিশ খবর পেল, অ্যাক্সিডেন্টে কেউ মারা গেছে। ডিটেকটিভের কাজ কী? ডিটেকটিভ ঘটনাস্থলে যাবে। এটাই সহজ কথা। অথচ ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং রিপোর্টে লিখেছেন, এই সহজ কাজটা উনি করেননি।

হারম্যান মেলভিলের উপন্যাসের কথা মনে পড়ল তার। সেখানে নাবিকের কাছে যেমন আলবাট্রস, তেমনি চিফের কাছে ডিটেকটিভ ম্যাক্সও একইরকম ভীতিপ্রদ।

আবার জোরে নিঃশ্বাস নিলেন চিফ ইন্সপেক্টর। উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হল। ম্যাক্সের রিপোর্টটা মেলে ধরলেন চোখের সামনে–

ব্রানডটুর অফিসার রিপোর্ট

 বুধবার, ৭ই নভেম্বর। সময় : রাত ১টা ১৫ মিনিট।

বিষয় : রফ অ্যান্ড সন্সের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর সেন্ট্রাল সুইচ বোর্ড থেকে রিপোর্ট। দুঘর্টনার কারণ, ধরন, আহত ও নিহতের সংখ্যা লেখা হল না।

সময়–১টা বেজে ২৭ মিনিট। রফ অ্যান্ড সন্সের সুইচ বোর্ড থেকে দ্বিতীয় ফোন। লিফট ভেঙে পড়েছে। কারণ জানা যায়নি। নিহত–একজন, মহিলা।

 আমি অনুসন্ধান চালাতে শুরু করলাম সঙ্গে সঙ্গে। সময় : রাত ১টা ৩৫ মিনিট। বিল্ডিং এর প্রধান স্থপতির নাম আমি ওই অফিসের সুপারিন্টেডেন্টের কাছ থেকে ফোনে জেনে নিই।

 সময় : রাত ২টা ৩০ মিনিট। প্রধান স্থপতিকে ফোন করলাম। লা পুসে তিনি একটা জন্মদিনের উৎসবে ছিলেন। তিনি সেই লিফট কোম্পানির মালিকের নাম জানালেন রুডলফ শ্যাজ।

সময় : রাত ২টা ৪৫ মিনিট। রুডলফকে ফোন করলাম। লিফটের প্ল্যান, মাস্টার বাজেট শীট, ফাইনাল এস্টিমেট, ব্যবহৃত মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির তালিকা চাইলাম।

সময় : সকাল ৫টা ৪৫ মিনিট। রুডলফের স্ত্রী ওগুলো পুলিশ স্টেশনে দিয়ে গেলেন।

আমি ওগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি।

–লিফট তৈরিতে ভালো যন্ত্রপাতিই ব্যবহার করা হয়েছে।

 –বিখ্যাত নামজাদা কোম্পানি; অতএব কাজে কোনো গলতি থাকবে বলে মনে হয় না।

 লিফটের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। তাই বলা যায়, এটা দুর্ঘটনা নয়।

(সই)
ম্যাক্স হরনাং, সিআইডি

বিশেষ দ্রষ্টব্য-মাঝরাতে ও ভোরে ফোন করে বিরক্ত করা হয়েছে বলে অনেকে নালিশ করতে পারে।

.

অভিযোগ আসতে আর কী বাকি আছে! সারা সকাল ধরে ফোন আসছে, সুইস সরকারের অফিসারদের।

–এটা পুলিশ হেড কোয়ার্টার, নাকি গেস্টাপো অফিস?

–গভীর রাতে বিখ্যাত বিল্ডিং করপোরেশনের মালিককে ঘুম থেকে তুলে কাগজপত্র চাওয়ার অর্থ কী?

রুডলফ শ্যাজের মতো কোম্পানির মুখে চুনকালি ছেটাতে চাইছেন কেন?

আরও কত!

তার চেয়েও তাজ্জব ব্যাপার। চোদ্দো ঘন্টা পর ডিটেকটিভ ম্যাক্স ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছে। ততক্ষণে অন্য ডিটেকটিভরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলে গেছে। তারা সাক্ষীদের জেরা করেছে। ডেডবডি পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

রিপোর্টের ওপর আর একবার চোখ বোলান চিফ ইন্সপেক্টর। তারপর ম্যাক্সের তলব পড়ল।

চিফ ইন্সপেক্টর এই লোকটাকে একটুও সহ্য করতে পারে না। ডিমের মতো টেকো মাথা। মাথা অনুযায়ী কান দুটো বিশ্রী রকমের ছোটো। লাল ছোটো ঠোঁট দুটো যেন পুডিং এর মাঝখানে লাগানো কিসমিস। পুলিশদের দেহের উচ্চতা যতটা লাগে, তার থেকে দু ইঞ্চি বেঁটে। যতটা ওজন দরকার, তার থেকে ১৫ পাউন্ড কম। খালি চোখে দূরের জিনিস দেখতে পায় না। লোকটা অদ্ভুত মার্কা। উদ্ধত প্রকৃতির। চিফ ইন্সপেক্টর শুধু নয়, পুলিশ ফোর্সের কেউ তাকে দু চক্ষে দেখতে পারে না।

–ওকে চাকরি থেকে বসিয়ে দিচ্ছো না কেন?

জানতে চেয়েছিল চিফ ইন্সপেক্টরের বউ। সেদিন বউয়ের ভাগ্য ভালো ছিল, না হলে মারধোর খেয়ে যেত।

তা সত্ত্বেও পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ম্যাক্স চাকরি পেয়েছে। কারণ, ওর জন্যই সুইজারল্যান্ডের জাতীয় আয় অনেক বেড়ে গেছে। চকোলেট বা ঘড়ির কোম্পানিও এত লাভ করে না।

ম্যাক্স হরনাং, পেশায় হিসাবকক্ষক। অঙ্কশাস্ত্রে তার বিশেষ জ্ঞান আছে। কেউ বেআইনি । কাজ করে ওর হাত থেকে নিস্তার পায় না। আর যেটা হল অঢেল আছে তার–ধৈর্য। বাইবেলের জব নামের চরিত্রও বুঝি তার কাছে মাথা হেঁট করবে।

 একসময় ম্যাক্স সরকারি অফিসের কেরানি ছিল। সরকারকে যারা অর্থনৈতিক ব্যাপারে কঁকি দিচ্ছে, তাদের ব্যাপারে তদন্তকারী বিভাগে ম্যাক্স কাজ করত। এই বিভাগের কাজ হল শেয়ার বিক্রির ব্যাপারে ব্যাঙ্কের কাজকর্মে বা সুইজারল্যান্ড থেকে টাকা আনার ব্যাপারে কেউ ফেরেব্বাজি করছে কিনা, তা দেখা। ম্যাক্স তার অদ্ভুত প্রতিভায় সুইজারল্যান্ড থেকে অবৈধভাবে টাকা আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। কয়েক কোটি ডলারের বেআইনি ব্যবসা ধরা পড়ল। ইওরোপের দুজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী কারাদণ্ড ভোগ করল। ম্যাক্সের শকুনের চোখ। টাকাপয়সা লুকিয়ে, মিশিয়ে বা অস্তিত্বহীন করপোরেশনের নামে ট্রান্সফার করে যেভাবেই। আনা হোক না কেন, তার নজর কেউ এড়াতে পারবে না। সে হল সুইস ব্যবসায়ীদের ত্রাস।

 সুইসরা ব্যক্তিগতভাবে গোপনীয়তা পছন্দ করে। কিন্তু ম্যাক্স থাকলে, তা আর সম্ভব হয় না।

 কেরানিগিরি করে ম্যাক্স অত্যন্ত কম টাকা মাইনে পেত। সে ঘুষ নেয় না। করটিনা দ্য আমপেজজাতে বাগানবাড়ি, নয়তো প্রমোদপোত, অথবা ছ-ছটি রূপসী সুন্দরী শয্যা সঙ্গিনী ঘুষ হিসেবে দিতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ম্যাক্স তা গ্রহণ করেনি। সে উল্টে তার ওপরওয়ালাকে সব বলে দেয়।

তবে তার শখ আছে–দুটো।

প্রথম শখ-বেআইনি কাজ যারা করে, তাদের হাতে নাতে ধরা।

 দ্বিতীয় শখ-পুলিশ ডিটেকটিভ হতে চায় সে। সে পড়েছে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল ও জর্জ সিমের গোয়েন্দা উপন্যাস। সেখান থেকেই অপরাধীকে হাতেনাতে ধরার বুদ্ধি তার মাথায় চেপেছে।

ম্যাক্স-এর এই মনোবাসনার কথা জানতে পেরেছিল সুইজারল্যান্ডের এক ধনী ব্যবসায়ী, বন্ধুদের সহযোগিতায় সে ওপর মহলে এমন চাপ দিল, ম্যাক্স দু-দিনের মধ্যে ডিটেকটিভের চাকরি পেয়ে গেল। সুইস ব্যবসায়ীদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

এ ব্যাপারে চিফ ইন্সপেক্টরকে পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নির্দেশেই সে চাকরিটা পেয়েছে।

এবং শুরু হল চিফ ইন্সপেক্টরের দুঃখের দিন।

ডিটেকটিভের কাজে কোনো প্রশিক্ষণ নেওয়া নেই, অথচ ডিটেকটিভ করা হল। তা হোক, শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই হবে। কিন্তু ম্যাক্স এমন হামবড়া ভাব দেখাল, যেন, আমি এসে গেছি, তোমাদের আর কোনো চিন্তা নেই।

চিফ ইন্সপেক্টর চটে গিয়ে তাকে কোনো ডিপার্টমেন্টেই স্থায়ীভাবে রাখে না। তবুও কি নিস্তার আছে? ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন, হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ, যেখানেই থাক না কেন, কোনো না কোনো ছুতো করে ঠিক সে এসে হাজির হবে। বারো সপ্তাহের মধ্যে একটা রাত হয়তো এমারজেন্সি ডেস্ক ডিউটি পেয়েছে ম্যাক্স। তখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না কিছু ঘটবেই। রহস্য সমাধানের জন্য অন্য ডিটেকটিভরা যখন ছুটোছুটি করছে, তখন ম্যাক্স রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে।

পুলিশের কাজকর্মের ধারা, ক্রিমোনোলজি, ফরেন্সিক, স্ট্যাটিসটিক্স, ক্রিমিনাল সাইকোলজি কিছু জানে না ম্যাক্স। অন্যান্য ডিটেকটিভরা যখন ব্যর্থ, তখন সফল হয়ে ফিরে এসেছে ম্যাক্স। এ ব্যাপারে চিফ ইন্সপেক্টর ওর সৌভাগ্যকে দায়ী করে।

ভাগ্য টাগ্য বাজে কথা। ম্যাক্স যে স্কিমে ব্যাঙ্ক বা সরকারকে ঠক ব্যাপারগুলি ধরত, সেইভাবেই ক্রিমিনাল কেসের সমস্যা সমাধান করে।

ওর মন সোজা পথে কখনও হাঁটে না। সব সময় বাঁকা ও সংকীর্ণ পথ ধরে ছোটে। আর এতই অসম্ভব স্মৃতিশক্তি তার, ফটোগ্রাফিও লজ্জা পায়।

প্রথমদিন ম্যাক্সের এক্সপেন্স অ্যাকাউন্ট দেখে অফিসার বলেছিল, তোমার হিসেবে মনে হয় ভুল আছে।

দাবা খেলোয়াড় ক্যাসাব্ল্যাঙ্কাকে বলো, তার বোকামির জন্য দাবার রানি কুপোকাত হয়েছে আর ম্যাক্সকে বলল, সে হিসেবে ভুল করেছে, ওই একই ব্যাপার।

কুতকুতে চোখে তাকিয়ে ম্যাক্স বলে ওঠে–তাই নাকি?

-হ্যাঁ, যাতায়াত খরচ দেখিয়েছ যেতে আশি সেন্টিমে, এবং আসতেও তাই। অথচ একপিঠের ট্যাক্সি ভাড়া লাগে চৌত্রিশ ফ্রা।

 –হ্যাঁ, স্যার। তাই আমি বাস ধরেছি।

কী দরকার? অন্য ডিটেকটিভরা…এছাড়া তিন দিনের খরচ?

-সকালের ব্রেকফাস্ট কেবল কফি। লাঞ্চ তৈরি করে নিয়ে যাই। তাই শুধু ডিনারের খরচ লিখেছি।

তিনটে ডিনারে ষোলো ফ্রাঁ মাত্র খরচ। ম্যাক্স কি স্যালভেশন আর্মির কিচেনে খেতে যায়!

–ম্যাক্স, একশো বছর আগে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ছিল, একশো বছর পরেও থাকবে। এখানকার কতকগুলো ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য আছে। তাছাড়া সহকর্মীদের কথাও ভাবতে হবে। ধরো, এটা ঠিক করে ফেরত দাও।

-ইয়েস স্যার। যদি ভুল হয়ে থাকে..

–ঠিক আছে। তুমি তো নতুন ঠিক করে লেখো।

ম্যাক্স আধঘণ্টা পরে আবার এল। ভাউচার জমা দিল। দেখা গেল আগের থেকে শতকরা আরও তিনভাগ কমিয়ে দিয়েছে।

চিফ ইন্সপেক্টরের ঘরে ঢুকল, পরনে গাঢ় নীল স্যুট, পায়ে বাদামি রঙের জুতো আর সাদা মোজা।

অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তুমি ঘটনাস্থলে যাওনি কেন? চোদ্দো ঘণ্টা পর গেলে? এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের পুরো পুলিশ ফোর্স ঘটনাস্থলে এসে ফিরে যেত।

–সেটা হত না স্যার। প্লেনে জুরিখে আসতে নিউজিল্যান্ড থেকে সময় লাগে…: ।

–চোপ! এই ধরনের কাজ আমি মোটে পছন্দ করি না। অন্য ডিটেকটিভরা ঘটনাস্থলে গেল, বডি মর্গে চলে গেল, আর তুমি অফিসে বসে রাতদুপুরে ফোন করে করে সুইজারল্যান্ডের প্রভাবশালী লোকেদের ঘুম ভাঙালে, আর সারা সকাল ধরে তোমার অকর্মণ্যতার খেসারত দিতে হল আমাকে! ক্ষমা চাইতে হল!

–আমি জানতে চাইছিলাম…।

 –স্টপ! একটাও কথা নয়। গেট আউট!

 –ইয়েস স্যার। তবে জানতে চাইছিলাম মৃতদেহ কবরস্থ করার অনুষ্ঠানে যাব কি না?

-হ্যাঁ, যাবে।

 –থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

 চিফ ইন্সপেক্টর এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন।

.

১৬.

শিহলফেলডের কবরখানা।

 থিকথিক করছে ভিড়।

শ্বেতপাথরের পুরোনো বাড়ি।

দুজন অফিসার ও কর্মচারী–রফ অ্যান্ড সন্সের তরফে। এছাড়া বন্ধুবান্ধব ও সাংবাদিকরা।

 পেছনের সিটে বসে আছে ম্যাক্স। সে ভাবছে, এই মৃত্যুর কোনো যুক্তি নেই। যখন বেশি কিছু দেওয়ার, বেশি কিছুর জন্য পাওয়ার সময়, সেই যুবক বয়সে মৃত্যু কখনোই কাজের কথা নয়।

ফুলে ফুলে ঢাকা মেহগিনির কফিনের দিকে তাকাল ম্যাক্স। পয়সা ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয়। অ্যাক্সিডেন্টে মৃতদেহ তালগোল পাকিয়ে গেছে। তাই কফিন সীল করে দেওয়া হয়েছে।

 পাদ্রির কণ্ঠস্বর শোনা গেল–জীবনের উৎসভষ্ম; ভষ্মেই মিশে যায়–যিনি জীবন দেন, সেই ঈশ্বরই তা গ্রহণ করে।

মিস এলিজাবেথ রফ, ম্যাক্স বলল, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।

 –উনি এখন কোনো কথা বলতে পারবেন না। যা বলার পুলিশের কাছে বলে দিয়েছেন। রিস্ উইলিয়ামস আপত্তি জানাল।

–ঠিক আছে। বলুন, আপনি কী জানতে চাইছেন? লিজা বলল।

জীবনে এই প্রথম বোধ হয় ডিটেকটিভ ম্যাক্স কথা হারিয়ে ফেলেছে। মেয়েরা আবেগ বোঝে, যুক্তির ধার ধারে না। ওরা কম্পিউটারে ধরা পড়ে না, ম্যাক্স সেক্সের লজিক বোঝে। শরীরের চলন্ত অংশের মোগাযোগের ছন্দ তার কাছে ঠিক যেন কবিতা। কী অদ্ভুত ডাইন্যামিক্স! কবিরা আসল ব্যাপারের ধারেকাছেই যায়নি। আবেগ, ভালোবাসা ইত্যাদি কেবল শক্তির অপচয়। আবেগ এক কণা বালিও সরাতে পারে না, কিন্তু লজিক পারে।

এলিজাবেথকে এখন তার ভালো লাগছে। কারণ সে তাকে কুতসিৎ হাস্যকর বেঁটে বলে এড়িয়ে যাচ্ছে না।

–মিস রফ, আপনি তো অফিসে অনেক রাত পর্যন্ত থেকে কাজ করতেন। সকলেই তা জানে, তাই তো? দুর্ঘটনার দিন রাতেও আপনি ও মিস্টার উইলিয়ামস একসঙ্গে বেশি রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন। উনি আপনাকে একা রেখে চলে গেলেন কেন?

–একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। রিস্ জবাব দিল।

কতক্ষণ আগে বেরিয়েছিলেন?

 –এক ঘন্টা।

মিস রফ, আপনি আর মিস আরলিং একঘন্টা পর বেরিয়েছিলেন। তারপর?

তারপর স্পেশ্যাল এক্সপ্রেস লিফটে উঠতে যাব, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মিস আরলিং ফোনটা ধরতে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ওভারসীজ কলের আশায় নিজেই গেলাম। তারপরেই শুনলাম বীভৎস আর্তনাদ।

রিস জানতে চাইল–এত প্রশ্নের কী দরকার?

ম্যাক্স তখন ভাবছে–এটা একটা খুন, দুর্ঘটনা নয়। মিস এলিজাবেথকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল। গত দুদিন ধরে এই কোম্পানি সম্পর্কে সে অনেক খবর সংগ্রহ করেছে। কোম্পানির হাজার ঝামেলা-মামলা, অপপ্রচার, ব্যাঙ্কের ঋণ ইত্যাদি ইত্যাদি। মৃত প্রেসিডেন্ট স্যাম রফ অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ছিলেন। তবুও দড়ি ছিঁড়ে মারা গেলেন। এখন মেয়ে এলিজাবেথ বেশির ভাগ শেয়ার পেয়েছে।

প্রথমে সার্ডিনিয়ায় জীপ অ্যাকসিডেন্ট। দ্বিতীয় আক্রমণ, লিফট ভেঙে পড়া। কেউ ওকে খুন করার মারাত্মক খেলায় মেতে উঠেছে। এখন এলিজাবেথ রফ ওর কাছে কোনো নাম। নয়, কোনো অঙ্কের ধাঁধা নয়। ওকে বাঁচাতে ইচ্ছে করছে তার।

রিস্ আবার বলল–এসব প্রশ্ন কেন?

পুলিশের কঠিন নিয়ম, মিস্টার উইলিয়ামস। মাফ করবেন।

ম্যাক্স বিদায় নিল।

.

১৭.

প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে সকালটা কেটে গেল চিফ ইন্সপেক্টরের। সাইবেরিয়া এয়ারলাইন্সের সামনে গণবিক্ষোভ, তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্রুনাওয়ের কাগজকলে আগুন লেগেছে। সন্দেহজনক ঘটনা, খোঁজ নেওয়া চলেছে। প্ল্যাটসপিজ পার্কে বলাকার। গ্রিমা ও ওয়েবলিনে ছিনতাই।

 ম্যাক্স তার মধ্যেই বলল–লিফটে কেবল ড্রাম ফাটা ছিল। তাই সেফটি কনট্রোল খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এর পেছনে কারো…

রিপোর্ট দেখেছি। ওটা ক্ষয়ে গিয়েছিল। তাই…

না, ওটা পাঁচ বছর চলার কথা।

 –সাফ কথা বলো তো।

 –কেউ লিফট বিকল করে দিয়েছিল।

 –ওসব কিছু না, বাজে কথা। তাছাড়া কেউ এরকম কেন করবে?

 –সেটা আমারও প্রশ্ন।

 –বেশ তো রফ অ্যান্ড সন্সের অফিসে গিয়ে খোঁজ নাও।

না, ওখানে নয়, শ্যামনিকস-এ যাব।

.

শ্যামনিকস। জেনেভা থেকে চল্লিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।

ম্যাক্স হাঁটছে। সে যাবে পুলিশ স্টেশন। হাতে কার্ডবোর্ডের দোমড়ানো সুটকেস।

ম্যাক্স ফরাসি ভাষার কথা বলতে শুরু করল। ফরাসি সার্জেন্ট তাজ্জব! তার মাতৃভাষা ফরাসি অথচ…

–আপনি কোন্ ভাষায় কথা বলছেন?

ফরাসি।

ম্যাক্স তার আইডেনটিটি কার্ড দেখাল-ডিটেকটিভ! এই লোকটা! আশ্চর্য!

–বলুন, আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?

 –স্যাম রফের অ্যাক্সিডেন্ট সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে চাই।

–সোসাইতি শ্যামনিয়াদে সেস্যুর ঐ মানে, ফোন নম্বর ৫৩-১৬৮৯, ব্যু দী ভ্যালের ক্লিনিক, ফোন নম্বর ৫৩১১২। দাঁড়ান লিখে দিচ্ছি।

দরকার নেই।

পুরো ঠিকানা ও ফোন নম্বর গড়গড় করে বলে গেল ম্যাক। তারপর সে চলে গেল। ফরাসি সার্জেন্ট তার চলে যাওয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ।

.

সোসাইটির ডেস্কের পেছনে বসে আছে অ্যাথলেটিক টাইপের তরুণ।

–আমি ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং। স্যাম রফের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছি।

হ্যাঁ, উনি পর্বতে ওঠার সময় দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিলেন খাদে। ডেডবডি উদ্ধার করা যায়নি। ওই দলে চারজন ছিল, মিস্টার রফ ও তার গাইড সবার পেছনে ছিলেন। উনি হারনেস ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু দড়ি ছিঁড়ে যায়।

–গাইডের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

রেগুলার গাইড অসুস্থ ছিল। তাই ষাট মাইল দুরের লেজেটস গ্রাম থেকে তাকে আনা হয়েছিল। নাম হান্স বারজম্যান।

.

ক্লেইন শেইডস হোটেল।

 ডেস্কে বসে ক্লার্ক। ম্যাক্স জানতে চাইল মিস্টার রফ কি এখানে একা ছিলেন?

না, সঙ্গে একজন ছিল।

 –তার নাম?

 ক্লার্ক লেজার খুলে নামটা বলে দিল।

.

ভক্সওয়াগন গাড়ির ভাড়া সবথেকে কম। ম্যাক্স ওই গাড়ি করে এল লেজেটস-এ। আল্পসের গায়ে ছোট্ট একটি গ্রাম, ছোটো কয়েকটা লজ, কয়েকটা দোকান আর পেট্রল পাম্প দেখা গেল।

লজে ঢুকে পড়ল ম্যাক্স। চুল্লির সামনে বসে কয়েকজন লোক তখন গল্পগুজব করছিল।

–এক্সকিউজ মি। আমি হান্স বারজম্যানের খোঁজ করছি। পর্বতারোহণের গাইড। এই গ্রামে থাকে?

এক বুড়ো চুল্লিতে থুথু ফেলল। বলল–মিস্টার, কেউ হয়তো তোমার সঙ্গে মজা করেছে। এই গ্রামেই আমার জন্ম। হান্স বারজম্যান নামে কেউ এখানে থাকে না।

.

১৮.

রফ অ্যান্ড সন্সের অফিস। এলিজাবেথ রফের নামে চিঠি। খামের ভেতরে মনগোলয়েড বিকৃত মস্তিষ্কের বীভৎস ফটো। সঙ্গে একটি চিঠি লিখেছে এক অভাগিনী মা

–তোমাদের ওষুধ খাওয়ার ফলে আমার বাচ্চা জনের এই অবস্থা। তোমাদের আমি প্রাণে মারব। খুন করব।

–ওষুধের লেবেল ভুল লাগানো হয়েছিল। রিস্ বলতে থাকে, তার ফল। অথচ ঘটনাটা ঘটে গেছে চার বছর আগে। মানুষই তো ভুল করে। আমরা যথেষ্ট সাবধানী ছিলাম। তা সত্ত্বেও প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া আগামী দু-বছরের মধ্যে রফ অ্যান্ড সন্সের প্রায় গোটা বারো ফ্যাক্টরিতে তালা ঝুলিয়ে দিতে হবে। কেননা এফ. ডি. ও এরোসল স্প্রে বন্ধ করে দিচ্ছে।

 এলিজাবেথ রফ আপন মনে উচ্চারণ করল যদি যৌবনকে ধরে রাখার ওই অদ্ভুত ওষুধটা এখন বের হত

আরও খবর লিজাকে শোনানো হল–আজকের খবরের কাগজ জানিয়েছে, বেলজিয়ামে এক মন্ত্রীপত্নী মাদাম ভ্যানডেন লখ বেনেকসান ট্যাবলেট খেয়েছিলেন।

–আমাদের কোম্পানির?

–হ্যাঁ, আনটিহিটামিনিক। অ্যালার্জির ওষুধ। সতর্কতা হিসেবে লেবেলে লেখা আছে : ব্লাড প্রেসার বেশি এই ওষুধ খাওয়া নিষেধ হলো। অথচ ওই মহিলা নিষেধ অগ্রাহ্য করেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রাণের আশা কম। এ খবর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত ওষুধের অর্ডার ক্যানসেল হয়ে যাবে। দু-বছরের আগে এফডিএ ইনভেস্টিগেশন শুরু হবে না। এখন আপাতত ওষুধটা বাজারে থাক।

–ওই ওষুধে আর কোনো লোকের ক্ষতির খবর?

কোটি কোটি লোক উপকৃত। কেবল দু-একজনের…

–এখুনি ওই ওষুধ বাজার থেকে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা।

 –প্রচুর টাকা ক্ষতি হবে। অন্যভাবে…

–প্রয়োজন নেই।

 –এর থেকেও খারাপ খবর আছে, লিজ ব্যাঙ্কাররা লোনের টাকা এখনই ফেরত চাইছে। রিস্ চলে গেল।

লিজা ভাবছে–আমার বাচ্চা জনের এই অবস্থার জন্য তোমাদের ওষুধই দায়ী।

মাদাম ভ্যানডেন লখ বেনেকসান ওষুধ খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন, প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা।

 ব্যাঙ্কাররা লোনের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে।

দেওয়ালে বৃদ্ধ স্যামুয়েল রফের পোর্ট্রেট। আত্মবিশ্বাসী এবং কর্মদক্ষ। কিন্তু সংশয় বা হতাশা কখনও কি তাকে গ্রাস করেনি? তবু লড়ে গেছে। লিজাও লড়বে। ব্লাডলাইন! স্যাম রফের উত্তরাধিকারের ধারা তার রক্তে প্রবাহিত। 

পোর্ট্রেটটা একটু কাত হয়ে গেছে। লিজা সোজা করার চেষ্টা করতেই মেঝেতে পড়ে গেল। লিজার সেদিকে তাকাবার সময় নেই। পোর্ট্রেটের পেছনের দেওয়ালে টেপ দিয়ে আর্টকানো ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন তার চোখ এড়িয়ে গেল।

.

ভোর চারটে।

 বিজ্ঞানী এমিল জেপলি সমস্ত দিনরাত ল্যাবোরেটরিতে কাটাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওষুধটা বাজারে বের করতে হবে। এর জন সে মোটা টাকা মাইনে পায়। সে স্যাম রফকে খুব পছন্দ করত। লিজা রফও খুব ভালো। এই কোম্পানিকে সে ভালোবাসে। তাই তো তার উদয়াস্ত পরিশ্রম। এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট খুব ভালো–আশাই করা যায়নি। খাঁচা বন্ধ জানোয়ারদের শরীরের গন্ধ আর ভিজে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার মধ্যে কখন যে ভোর হয়েছে, বৈজ্ঞানিকের তা খেয়াল নেই।

 দরজায় পাহারায় আছে সেপ নোলান। সে দরজা খুলে জানতে চাইল–আর কতক্ষণ থাকবেন ডক?

-কিছু বলছ? ডক্টর এমিল জেপলি মাথা তুলল।

 –আমি রেস্তোরাঁয় যাচ্ছি। আপনি কি স্যান্ডউইচ খাবেন?

আমার জন্য কেবল কফি এনো।

 –ঠিক আছে। বাইরের দরজা তালাবন্ধ করে দিয়ে গেলাম। আমি এখুনি ফিরব। বিজ্ঞানী বোধহয় নোলানের শেষ কথাগুলো শুনতেও পায়নি। সে তখন রিসার্চ রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত।

দশ মিনিট কেটে গেছে। দরজা খুলে একজন ঢুকল–এখনও কাজ করছ এমিল?

এমিল চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়াল ইয়েস স্যার।

-ফাউনটেন অফ ইউথ প্রোজেক্ট, টপ সিক্রেট?

মিস রফ তাকে সব কিছু গোপন রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এঁনার ক্ষেত্রে এই নিষেধ নিশ্চয়ই খাটে না। ওই আগন্তুকের দয়াতেই জেপলি এই কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে।

সে স্মিত হেসে বলল–হ্যাঁ স্যার, অত্যন্ত গোপন।

–তা বেশ। কাজ কেমন এগোচ্ছে?

 –খুব ভালো।

আগন্তুক খরগোশের খাঁচার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খাবারের একটা ডিস মেঝের ওপর ফেলে দিল–সরি।

–আমি তুলে দিচ্ছি।

 এমিল ডিসটা তোলার জন্য মাথা নীচু করল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হল। মাথাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল এমিলের।

.

ভোর পাঁচটা। টেলিফোন সশব্দে বেজে উঠল।

এলিজাবেথ রফ ঘুম চোখে রিসিভার তুলে নিল।

ভেসে এল উত্তেজিত এক কণ্ঠস্বর–মিস রফ, ল্যাবোরেটরির সিকিউরিটি গার্ড বলছি। বিস্ফোরণে ল্যাবোরেটরি ধ্বংস হয়ে গেছে। একজন বিজ্ঞানী মারা গেছেন।

 বিজ্ঞানীর নাম না বললেও এলিজাবেথের বুঝতে দেরি হল না কে সে।

.

১৯.

 ডিটেকটিভ ম্যাক্স হরনাং একমনে মিস রফের কেসটা নিয়ে ভেবে চলেছে। ডিটেকটিভ ব্যুরোতে তখন নানা শব্দটাইপরাইটারের আওয়াজ, টেলিফোনের শব্দ, তর্কাতর্কি, আরো কত কী! ম্যাক্সের সেই একটা কম্পিউটার। সেই মন ডুবে আছে রফ অ্যান্ড সন্সের জটিলতার আবর্তে।

 প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল রফ চেয়েছিল, কোম্পানির শেয়ার যেন বাইরে বিক্রি না হয়। ব্যাপারটা বুদ্ধিমানের, কিন্তু বিপদ আছে পদে পদে। ১৬৯৫-এ ইতালিয়ান ব্যাঙ্কার লরেনজো টোনটি টোনটাইন নামের একটা ইনসিওরেন্স স্কিম চালু করেছিল। তাতে অনেকে মিলে ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম দেবে। একজন মরলে ভাগ পাবে অন্য সবাই। এর ফলে অন্য মেম্বারদের খুন করার ব্যাপারটা লাভজনক হয়ে উঠেছিল। রফ অ্যান্ড সন্সের বোর্ডমেম্বাররা প্রত্যেকে কোটি কোটি ডলারের শেয়ারের মালিক অথচ একজনের আপত্তিতে শেয়ার পাবলিককে বেচা যাচ্ছে না। এটাও সমান বিপজ্জনক।

স্যাম রফ শেয়ার বিক্রি করতে রাজি ছিল না। ফলে তার মৃত্যু হল।

এলিজাবেথ রফও শেয়ার পাবলিককে বিক্রি করার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছে। তাই দু-দুবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মরতে মরতে বেঁচে এসেছে। অ্যাক্সিডেন্ট-অ্যাক্সিডেন্ট আর অ্যাক্সিডেন্ট। সে এই শব্দটিকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না।

 সে চিফ ইন্সপেক্টরের ঘরে এসে ঢুকল।

-ম্যাক্স, চিফ ইন্সপেক্টর বলতে থাকে, স্যাম রফের গাইডের নামটা ভুল হয়েছে বলে স্যাম রফ খুন হয়েছে–পুলিশ ডিপার্টমেন্টে এ ধরনের অনুমানকে পাত্তা দেওয়া হয় না।

–রফ অ্যান্ড সন্সের ভেতরে নানারকম ঝামেলা, সমস্যা। স্যাম রফকে খুন করে কেউ হয়তো সমস্যার সমাধান চেয়েছিল।

চিফ ইন্সপেক্টর মনে মনে ভাবল, এসব ব্যাপারে ডিটেকটিভ ম্যাক্সের ব্যস্ত থাকা ভালো। ডিপার্টমেন্টের পক্ষে মঙ্গল। রফ পরিবারের ক্ষমতা সম্পর্কে সে অন্যান্য ডিটেকটিভদের সাবধান করে দিয়েছে। ম্যাক্স যদি ওদের পেছনে লেগে নিজের চাকরি খোয়ায়, তাতে চিফের কী দোষ? দরকার পড়লে সে বলে দেবে–ম্যাক্সকে জোর করে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এসব ভেবে চিফ বলল–ম্যাক্স, কেসটা তোমার, তাই যেমন খুশি সময় দিতে পারো।

ধন্যবাদ। খুশি মনে ম্যাক্স বিদায় নিল।

.

করিডরে দেখা হল করোনারের সঙ্গে রিভার পেট্রল নদী থেকে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। ম্যাক্স, তুমি একবার দেখে যাও।

মর্গ। ধাতুর ড্রয়ার। যুবতী মেয়ের লাশ। সোনালি চুল। বছর কুড়ি বয়স। নগ্ন শরীর, জলে ফুলে উঠেছে, গলায় লাল রিবন বাঁধা।

–মৃত্যুর আগে যৌন মিলন ঘটেছে, চিহ্ন আছে। করোনার বলতে থাকে, ফুসফুঁসে জল পাওয়া যায়নি। তার মানে কণ্ঠনালী টিপে খুন করা হয়েছে। অবশ্য কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। একে আগে এমন কখনও দেখেছ?

-না।

ম্যাক্স তাড়াহুড়ো করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিল।

.

২০.

সার্ডিনিয়া কস্টম্পেরালডা এয়ারপোর্ট। সস্তায় ফিয়াট ৫০০ মডেলের একটা গাড়ি ভাড়া করে ম্যাক্স শিল্পনগরী ওলিবিয়াতে পৌঁছোল। সভ্যতার নিদর্শন-মিল, ফ্যাক্টরি, ভাঙাচোরা গাড়ির স্তূপ।

 পুলিশ হেডকোয়াটার্সে চিফ অফ পুলিশ লুইজি ফেরাররা বসে। ম্যাক্স তার ওয়ারেন্ট কার্ড দেখাল। উল্টেপাল্টে দুবার দেখে নিয়ে চিফ ভাবল, সম্ভবত সুইজারল্যান্ডের পুলিশ বিভাগে ডিটেকটিভের অভাব লেগেছে।

-বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?

ম্যাক্সকে ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে দেখে চিফ বলল–ইংরাজিতে বলুন।

সব শুনে চিফ বলল–ও জীপ অ্যাক্সিডেন্ট। আমাদের মেকানিক গাড়িটা পরীক্ষা করেছে।

-আমি জীপটা একবার দেখতে চাই।

ডিটেকটিভ ব্রুনো ক্যামপানা ম্যাক্সকে নিয়ে গেল।

–আমরা তদন্ত করে দেখেছি, এটা দুর্ঘটনা।

 –না। তা কী করে সম্ভব?

জীপটা দেখিয়ে মেকানিক বলল–এই কাজে আমি পঁচিশ বছর আছি। ফ্যাক্টরি থেকে বেরোবার পর এই গাড়ির ওপর ব্রেক নিয়ে কোনো কারসাজি করা হয়নি।

করা হয়েছে। তবে কীভাবে, সেটা জানতে হবে।

.

পান্না রং সমুদ্রের উপকূল।

ম্যাক্স দাঁড়িয়ে, আকাশপাতাল ভাবছে। নিজেই প্রশ্ন করছে, উত্তর খুঁজছে। এক্সপার্ট মেকানিক বলছে ব্রেক নিয়ে কোনো কারচুপি হয়নি। না, জীপটির ব্রেক নিয়ে অবশ্যই কারচুপি করা হয়েছে। মিস রফ গাড়ি চালাচ্ছিল এবং তাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়।

পাথরের ওপর বসে চোখ বুজে ভাবছিল ম্যাক্স।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর লাফিয়ে উঠল ম্যাক্স। ক্রিমিনালের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।

ওলিবিয়ার বাইরে গেল ম্যাক্স। তারপর পাহাড়ি অঞ্চলে। তারপর বিকেলে প্লেনে চেপে জুরিখে ফিরে এল। তাও ইকনমি ক্লাসে!