২. স্যামুয়েল রফের জীবনকাহিনী

০৮.

স্যামুয়েল রফের জীবনকাহিনী

সময় ১৮৫৫।

ইহুদি-বিদ্বেষী জনতা ইহুদিদের বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

যুগ যুগ ধরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচার চলেছে- ইহুদিদের হত্যা করো। ইওরোপের প্রতিটি দেশ, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পশ্চিম ও পূর্ব ইওরোপ এবং রাশিয়ার খ্রিস্টান পাদ্রিরাও এই হত্যাকাণ্ডে সামিল হয়েছে।

কিন্তু কেন? কী অপরাধ ওদের?

দোষ করেছে ওদের পূর্বপুরুষ। যিশুকে ওরা পরিত্রাতা বা ঈশ্বরের পুত্ররূপে গণ্য করেনি। ওরা তাকে ক্রশ বিদ্ধ করে হত্যা করেছে। তাই বদলা নিতে হবে।

ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বলে আসছে ইহুদিদের হত্যা করো। দাঙ্গা লাগাও। ওদের খুন করো।

সেক্সপিয়ার বলেছেন–ইহুদি শাইলক এক নির্মম জল্লাদ। সে সুদখোর শয়তান। সে বলে, টাকা নাও, মানুষের মাংস দাও।

ইহুদিদের খুন করো–ওরা সুদখোর, নোংরা বজ্জাত, স্পাই, মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করছে। ওরা নিজেদের ধার্মিক মনে করে। ওরা কারো সঙ্গে মিশতে চায় না। অর্থাৎ বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল।

সবাই ওদের হত্যা করতে বলেছে। সবাই–পাদ্রি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, রাজা, পত্রিকা। বলেছে হিটলার, মুসোলিনি, গোয়েবেলস, হিমলার।

–ওদের হত্যা করো!

মিশরের আরব জাতীয়তাবাদী এবং সৌদি আরবের শেখ বলেছে ওরা মুসলমান নয়। ওদের তাই হত্যা করো।

এবং ওই বছর ক্রাকোর ইহুদি বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে চলল ইহুদি নিধন যজ্ঞ। ওরা পুড়ছে, মরছে, বাঁচছে, কাঁদছে। স্যামুয়েল রফ তখন পাঁচ বছরের। মৃত্যুভয়ে গিয়ে লুকিয়েছিল কয়লার কুঠুরিতে। একসময় দাঙ্গা থামল। সে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। ঘেটোর রাস্তা। তখনও কাঠের বাড়িগুলো পুড়ছে, ধোঁয়া উঠছে। চারপাশ লালে লাল। যারা বেঁচে ছিল তারা তাদের নিকটজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে। তারা গরিব। তারা ধনী নয়, তারা শাইলক নয়। আছে সামান্য কিছু। ব্যবসা ও ঘরবাড়ি। তবু তাদের মরতে হবে। কারণ তারা ইহুদি।

ফ্রায়ার ব্রিগেড এল না। ওরা ইহুদিদের ঘরের আগুন নেভাতে আসে না। খ্রিস্টানদের দাস ওরা।

 ইহুদিরাই ছুটে এসেছে। কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল ভোলা হচ্ছে। আগুন নেভানোর চেষ্টা। পড়ে আছে মৃত মানুষ। কেউ বা আধপোড়া হয়ে বেঁচে আছে তখনও। বীভৎস চিত্র উলঙ্গ, ধর্ষিতা, কিশোরী, যুবতী, প্রৌঢ়া। ছোটো ছেলেমেয়েরাও আগুনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারা কাঁদছে। শোনা যায় আর্ত আবেদন। চাই সাহায্য।

 স্যামুয়েল থমকে দাঁড়াল। মা পড়ে আছে রাস্তার ওপর। রক্তে মুখ ঢেকে গেছে। হাঁটু ভাজ করে বসে পড়ল সে।

মা–

চোখ খুলল। কিছু বলার চেষ্টা করল।

স্যামুয়েল জানে, তার মা আর বাঁচবে না। তবু তাকে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তার কতখানি শক্তি? সে পরম যত্নে মায়ের রক্ত মুছে দিল। খানিক বাদেই সব শেষ।

 মাকে কবর দিল সে। ইহুদি শাস্ত্রানুসারে শবের নীচের মাটিও কবরের নীচে চাপা দিতে হল।

 ছোট্ট স্যামুয়েল চোয়াল শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করল-যেভাবেই হোক। সে ডাক্তার হবে।

***

স্যামুয়েলদের বাড়িতে রফ বংশের আটটা পরিবার থাকে। তিনতলা সরু কাঠের বাড়ি। ছোট্ট একটা ঘরে থাকে স্যামুয়েল আর তার বাবা ও পিসি। সে একা থাকতে ভালোবাসে না। যেখানে হৈ-চৈ মানুষের ভিড় সেখানেই স্যামুয়েল।

সন্ধ্যা হলেই ইহুদিদের বস্তিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তারপর গেটে মস্ত বড়ো তালা দিয়ে দেয় খ্রিস্টানরা। সকালে চাবি খুলে দেয়। ইহুদিরা পিলপিল করে খ্রিস্টানদের শহরে ঢুকে পড়ে। সন্ধ্যার আগেই শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়, নতুবা সেদিনের মতো বস্তিতে ফেরার পথ বন্ধ।

 স্যামুয়েলের বাবা গাড়ি ঠেলে ঠেলে বাসন বিক্রি করে। ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, ধূসর চুল। মুখে ক্লান্তির ছাপ। মুখের চামড়া কোঁচকানো। রাশিয়ার কিয়েভ শহরে আগে থাকত। বাবা ইহুদিনিধন যজ্ঞের সময় পালিয়ে আসে এখানে।

রাস্তা দিয়ে চলেছে স্যামুয়েল। কত কিছু বিক্রি হচ্ছে! রাস্তার দুধারে ফেরিওয়ালাদের ভিড়। লিনেন ও লেস কাপড়, সুতো, চামড়া ও মাংস, সঁচ, সাবান, মোমবাতি, বোম, সিরাপ, জুতো, মুরগির মাংস কত কী। বাতাসে ভাসছে সদ্য সেঁকা রুটি, শুকনো মাছ, পানীয় ফল, কাঠের গুড়ো আর চামড়ার গন্ধ। স্যামুয়েল নাক টেনে ঘ্রাণ নেয়।

 তখন তার মাত্র বারো বছর বয়স। খ্রিস্টানদের শহরে সে প্রথম পা রেখেছিল, সঙ্গে ছিল বাবা। ভোর হতে না হতেই ইহুদিরা ঠেলা নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে এসে ভিড় করে। স্যামুয়েলের পরনে ভেড়ার লোমের পাতলা কোট। তবুও ঠান্ডা শীতালী হাওয়ায় কাঁপছে সে।

কখন গেট খুলবে, সেই প্রত্যাশায় সবাই অপেক্ষা করছে। পুব আকাশে কমলা রঙের সূর্য দেখা দিল। কাঠের বিশাল দরজা খুলে গেল। পিলপিল করে সবাই ঢুকে পড়ল ভেতরে।

 ইহুদিদের ঘাতক খ্রিস্টানরা এখানে বাস করে। স্যামুয়েল ভয়ে ভয়ে পথ হাঁটছে। চার দিকে ওর নজর। ওদের দাড়ি নেই। লম্বা কালো কোট পরে। দেখে, চার্চ অফ সেন্ট মেরীর বিশাল গির্জা। দুটো মিনার আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে। সকলের বাড়ির সামনে বাগান আছে। অবাক হয়ে স্যামুয়েল ভাবে, এখানকার লোকেরা নিশ্চয়ই খুব বোলোক।

প্রায় ছ-সাতটা দোকান ঘুরে তারা সওদা করল। ঠেলায় চাপিয়ে আবার তারা রওনা দিল। ফিরতে হবে।

স্যামুয়েলের ফিরে আসতে মন চায় না। বাবা জানালো, সন্ধের আগেই আমাদের এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে নয়তো গেট বন্ধ হয়ে যাবে।

ওহ, স্যামুয়েলের যদি ওই পরিচ্ছন্ন স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দপূর্ণ স্বাধীন পরিবেশে জন্ম হত। নাঃ তাকে এই পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পেতেই হবে।

***

স্যামুয়েল রফ, গরিব ইহুদি বাবার ছেলে, উচ্চাশা ডাক্তার হবে।

স্যামুয়েল লক্ষ করেছে, ইহুদি বস্তিতে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বড়ো বেশি। সেই তুলনায় এখানে ডাক্তারের সংখ্যা অত্যন্ত কম। মাত্র তিনজন ইহুদি ডাক্তার। এদের মধ্যে ডাক্তার জেনোওয়ালের পসার বেশি। বস্তির ছোটো ছোটো কুঁড়েঘরের মাঝখানে তার তিনতলা বড়ো বাড়ি। স্যামুয়েল হাঁ করে ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদা লেসের ঝকঝকে পর্দা ঝুলছে জানালায়। পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে নজরে পড়ে আসবাবগুলি–ঝকঝকে চকচকে।

স্যামুয়েল ভাবে, যদি এরকম একজন ডাক্তারের সান্নিধ্য সে লাভ করতে পারত…কিন্তু গরিবের ছেলেকে কে পাত্তা দেবে?

স্যামুয়েল দেখল, একদিন ডক্টর জেনোওয়াল ও তার মেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। মেয়েটি তার বয়সী, কিন্তু অপূর্ব সুন্দরী। স্যামুয়েল মনে মনে উচ্চারণ করল আমি ওকে বিয়ে করব। কিন্তু কীভাবে? তা সে জানে না।

এরপর থেকে স্যামুয়েলের কাজ হল ডাক্তারের বাড়ির সামনে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। ডাক্তারের মেয়েকে চোখের দেখা দেখবে একবার।

এক সন্ধ্যা। ভেতর থেকে পিয়ানোর সুর ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই ডাক্তারের মেয়ে বাজাচ্ছে। আজ তাকে ওর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। জানালায় উঠে দাঁড়াল সে, অতি সন্তর্পণে-সোনালি-সাদা রঙের পিয়ানো বাজাচ্ছে ডাক্তারের মেয়ে। আর ডাক্তার একটু দূরে আর্মচেয়ারে বসে বই পড়ছে।

 স্যামুয়েল ওই মেয়েটাকে ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটাকে সে কথা জানাবে কী করে? বীরত্বপূর্ণ কিছু করে। জানালার রড ধরে সে তখন দিবাস্বপ্নে বিভোর। সে যে জানালার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেকথা বেমালুম ভুলে গেছে। একসময় টুক করে হাত ফসকে সে পড়ে গেল নীচে। দুটো আতঙ্কিত মুখ চিৎকার করে উঠল।

তাকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হল। জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার জেনোওয়াল জানতে চাইলেন- তুমি ওখানে চুরি করতে গিয়েছিলে?

না।

 –তোমার নাম কী?

 –স্যামুয়েল রফ।

–তোমার মণিবন্ধের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। অপারেশন করে সেটা সেট করে দেওয়া হয়েছে। আমি লক্ষ করেছি, তুমি আমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করো। কিন্তু কেন?

–আমি আপনার সাহায্য চাই। আমি ডাক্তার হব।

ডাক্তারের বিস্ফারিত দুটি চোখ।

 স্যামুয়েল শোনান, তার উচ্চাশার কথা। মা মারা গেছে। অসহায় দর্শকের মতো সে মায়ের মৃত্যু দেখেছে। খ্রিস্টানরা তাদের পরাধীন করে রেখেছে। স্যামুয়েল স্বাধীন হতে চায়। সে ডাক্তারের মেয়েকে ভালোবাসে। তারপর সে বলল–স্যার, আমি দুঃখিত।

–আমিও দুঃখিত। আমরা সবাই বন্দি জীবনযাপন করছি। তুমি, আমি, আমরা সবাই। তোমার হাত ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য আমি দুঃখ পাইনি। সেটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি স্বপ্ন দেখো। একটা নয়, দুটো। আমি তোমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে দেব, যা সারাতে পারবে না। প্রথমত, তুমি ডাক্তার হতে চাও, যা আমাদের দুনিয়ায় অসম্ভব। এখানে তিনজন বাদে অনেক শিক্ষিত ট্রেনড ডাক্তার আছেন, যারা খ্রিস্টানদের কাছ থেকে প্র্যাকটিস করার অনুমতি পায়নি। আমাদের তিনজনের মধ্যে একজন মরলে তাদেরই একজন ডাক্তার হওয়ার সুযোগ পাবে। অতএব, তুমি কোনোদিন ডাক্তার হতে পারবে না। এবার দ্বিতীয় স্বপ্নের কথা বলি। তোমার পরিবার, তোমার ঐতিহ্য, তোমার সামাজিক স্তর, কোনোটাই আমাদের সমান নয়। আমার মেয়ে টেরেনিয়ার পক্ষে তুমি অযোগ্য, উকিল ডাক্তার বা ইহুদি ধর্মপ্রচারক হবে তার স্বামী। ওর আশা তোমাকে ত্যাগ করতে হবে। আর হ্যাঁ, ব্যান্ডেজটা ময়লা কোরো না যেন। এখন চলি, স্যামুয়েল রফ।

***

স্যামুয়েল রফ কিন্তু হার মানেনি। সে পরের দিনই বিকেলে ডাক্তারের বাড়িতে এসেছে। ডাক্তার তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি। সে ডাক্তারের ফাইফরমাস খাটে, তার বিনিময়ে ডাক্তার তাকে অপারেশনের সময় বা ওষুধ তৈরির সময় দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে দেয়। স্যামুয়েল দেখে আর মনে রাখে। ডাক্তার ভাবে, ছেলেটাকে শুধু শুধু আশা দিচ্ছি। অথচ ওকে চলে যেতেও বলতে পারি না।

একদিন টেরেনিয়ার আর স্যামুয়েলের চোখের মিলন হল।

 সে রাতে স্যামুয়েল ঘুমোতে পারল না। সে স্বপ্ন দেখে–সে টেরেনিয়াকে বিয়ে করেছে, এই ঘিঞ্জি ইহুদি বস্তি, এই পরাধীনতা ছেড়ে সে চলে গেছে অন্য কোথাও। স্যামুয়েল টেরিনিয়াকে তার সাফল্যের অংশীদার করেছে।

.

এবং এই ঘটনার পর স্যামুয়েল ল্যাবোরেটারিতে বেশি সময় কাটাতে লাগল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে মলম আর মিক্সচার তৈরি করল নিজের হাতে। অন্যদিকে রয়েছে। সুন্দরী টেরেনিয়া, তার ভালোমানুষ বাবা আর বজ্জাত মা। স্যামুয়েল ওই খাণ্ডারনি মহিলাকে সম্ভব মতো এড়িয়ে চলে।

বইয়ের পর বই পড়ছে স্যামুয়েল রফ।

 খ্রিস্টের জন্মের ১৫৫০ বছর আগেকার কথা। প্রাচীন মিশরবাসীরা প্যাপিরাসের পাতায় ৮১১ টা প্রেসক্রিপশন লিখেছিল। তখন মানুষের আয়ু ছিল অত্যন্ত কম। স্যামুয়েল বুঝল, কেন মানুষ ওই সময় মাত্র পনেরো বছর বাঁচত। প্রেসক্রিপশনগুলো পড়ল সে। লেখা আছে কুমিরের মল, গিরগিটির মাংস, বাদুড়ের রক্ত, উটের থুথু, সিংহের যকৃৎ এবং ব্যাঙের পা।

কিন্তু আজ? আজ প্রেসক্রিপশনের ওপরে একটা R ও X লেখা হয়। তার মানে মিশরীয় দেবতা হোরীর উদ্দেশে প্রার্থনা জানানো হয়।

মিশরের প্রাচীন নাম কেমি বা কাহমি। এর থেকেই কেমিস্ট্রি শব্দটির উৎপত্তি। প্রথম কেমিস্ট ও প্রথম চিকিৎসক হলেন প্রাচীনকালের ধর্মযাজকরা।

ফার্মেসির বোতলে বা শিশিতে ভরা থাকে ক্যাস্টর অয়েল, আয়োডিন, কোডিন, ইপিকাক, ক্যালোমেল, রুবাব। হুপিং কাশি, টাইফয়েড হলে এই সব ওষুধ দেওয়া হত। যদিও রোগীর অসুখ সারাতে পারত না। মলমে পাওয়া যেত মরা পোকা আর গার্গল করার ওষুধে মিলত ইঁদুর নাদি। অসুখে নয়তো ওষুধের বিষক্রিয়ার মৃত্যু ঘটত রোগীর।

প্রত্যেক রোগের যথাযথ চিকিংসা থাকা প্রয়োজন। স্যামুয়েলের দৃঢ় বিশ্বাস, স্বাস্থ্যই স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক হল রোগ।

হবে হয়তো। ডাক্তার বলতে থাকে, তবে আমার রোগীরা চট করে নতুন ওষুধ ব্যবহার করতে নারাজ।

ডাক্তার ওয়ালের লাইব্রেরি। স্যামুয়েল সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ে। স্যামুয়েল জেনেছে জীবাণু ঘটিত রোগের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরের এক স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করলে রোগ সারে। বিজ্ঞানীরা ঠিক করেছেন, সেরাম ও ভ্যাকসিন দিয়ে জীবাণু ঘটিত রোগের চিকিৎসা করবেন।

ডাক্তার ওয়াল একবার এ চেষ্টা করেছিলেন।

ডিপথিরিয়া রোগীর রক্ত নিয়ে ঘোড়ার দেহে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। ঠিক করেছিলেন, পরে ওই ঘোড়ার রক্তের জলীয় অংশ নিয়ে ওই রোগীর দেহে ইনজেক্ট করবেন।

কিন্তু ডাক্তারের এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ঘোড়টি মরে গিয়েছিল।

তবে স্যামুয়েল রফের গভীর বিশ্বাস, এ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে একদিন না একদিন সফলতা আসবেই।

 ডাক্তার বলে-স্যামুয়েল, তুমি ছেলেমানুষ। অভিজ্ঞতা কম। তাই এসব উদ্ভব চিন্তা করছ। ওসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।

কিন্তু স্যামুয়েল হারবার পাত্র নয়। জীবাণু ঘটিত রোগের রোগীর রক্ত ইনজেকশন করার জন্য চাই বড়ো কোনো জানোয়ার গোরু বা ঘোড়া জাতীয়। ইঁদুর-বেড়াল দিয়ে কাজ হবে না। যত কম ডোজই দেওয়া হোক না কেন, ওরা মরে যায়।

বাড়ি ফিরে এসে স্যামুয়েল দেখল, তার বাবা ঠেলাগাড়িতে রোগা হাড় জিরজিরে একটা ঘোড়াকে জুড়ে দিয়ে সামনে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে–রফ অ্যান্ড সন্স।

 স্যামুয়েল স্থির করল, ওই ঘোড়া অর্থাৎ ফার্ডকে সে তার পরীক্ষার কাজে লাগাবে। বাবা টেরও পাবে না।

স্যামুয়েলের ল্যাবোরেটরি আস্তাবলের এক কোণে। ডিপথিরিয়া জীবাণুর ব্রথ কালচার। ব্ৰথটা ঘোলাটে হল। সে কিছুটা ঘোলাটে ব্রথ নিয়ে অন্য জায়গায় রাখল। জল মিশিয়ে গরম করল, এতে জীবাণুরা আধমরা হবে। সিরিঞ্জে ব্রথ ভরে স্যামুয়েল ফার্ডের ঘাড়ে ইনজেকশন দিল, ডাক্তার ওয়াল যেভাবে দিয়েছিল।

 এবার প্রতীক্ষার পালা। বাহাত্তর ঘণ্টা পর একটা বড়ো ডোজের ইনজেকশন দিতে হবে। অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি তত্ত্ব নির্ভুল হলে প্রত্যেকটি ইনজেকশনের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। তাহলে ঘোড়ার রক্তের জলীয় অংশ হবে–ডিপথিরিয়া সারানোর ওষুধ। যদি

যদি ঘোড়া বেঁচে থাকে, তবেই।

স্যামুয়েল ঘোড়র কাছাকাছি থাকতে শুরু করল। যখনই দেখ জেগে বসে আছে।

বাবা বলল–ঘোড়াটা তোর খুব পছন্দ, তাই না?

 এইভাবে কেটে গেল দুটি দিন। তৃতীয় দিন সকালে বাবার চিৎকারে স্যামুয়েলের ঘুম ভাঙল।

 ফার্ড আর বেঁচে নেই। কিন্তু আমি তো ওকে চাবুক মারিনি, এমনকি ঠেলাঠেলি পর্যন্ত করিনি। অথচ মরে গেল। ওই ব্যাপারীকে হাতের কাছে পেলে দেখে নিতাম আমরা। ঘোড়া দিয়ে ঠকিয়ে গেল।

ঘোড়া মরে গেল। স্যামুয়েল রফের চোখের রঙিন স্বপ্নেরা বিবর্ণ হয়ে গেল।

.

স্যামুয়েল খবর পেল, বুড়ো ইহুদি ধর্মযাজকের সঙ্গে ডাক্তার তার মেয়ে টেরেনিয়ার বিয়ে ঠিক করেছে। তার মাথায় বাজ পড়ল যেন। সে ছুটে গেল।

বুড়ো র‍্যাবির সঙ্গে টেরেনিয়ার বিয়ে হতে পারে না। আমি ওকে বিয়ে করব।

বেরোও এখান থেকে।

 ডাক্তারের বউ বুঝি হার্টফেল করে আর কী।

সেদিন রাতে ঈশ্বরকে প্রথম ভাবল তরুণ স্যামুয়েল-ঈশ্বর, তুমি কি জেগে আছো? দেখতে পাচ্ছো? তুমিই তো টেরেনিয়াকে আমার সামনে এনে দিয়েছিলে। তাহলে কেন তুমি তাকে আমার বউ করে দিচ্ছো না? তোমার কি কোনো মায়া-মমতা নেই? শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?

-স্যামুয়েল, দোহাই তোমার। থামো। আমরা সব শুনতে পাচ্ছি। এখন, ঘুমোতে দাও।

 পরের দিন বিকেল বেলা, ডাক্তারের বাড়িতে ডাক পড়ল স্যামুয়েলের। ডাক্তার তার বউ আর মেয়েকে নিয়ে বসে আছে।

–শোনো স্যামুয়েল, ডাক্তার বলতে থাকে, আমার মেয়ে র‍্যাবিনোউইচকে বিয়ে করতে চাইছে না। ও বড্ড জেদি। ও তোমাকে বিয়ে করবে বলছে। তুমি কি ওকে ভালোবাসো?

–ইয়েস, স্যার।

 –তুমি নিশ্চয়ই চাও না, একটা ফেরিওয়ালার সঙ্গে টেরেনিয়ার বিয়ে হোক।

 –নো, স্যার।

কিন্তু তুমি? তোমার বাবা ফেরিওয়ালা। তার মানে তুমিও তত ফেরিওয়ালা।

আমি ফেরিওয়ালা থাকব না চিরদিন।

–বেশ, তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের দিতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে। তোমার কথার প্রমাণ করতে হবে। সময় ছ মাস।

–ছ মাস। ইয়েস স্যার।

সম্ভব হবে না। গরিব ইহুদি বস্তির ছেলে ছমাসে সফল হতে পারে না। যদি না অলৌকিক কিছু ঘটে। আইনত তাকে ডাক্তার বলা যাবে না।

আর র‍্যাবি? ইহুদি ধর্মযাজক। তেরো বছর থেকে ধর্ম সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে হয়। স্যামুয়েলের সে বয়স নেই।

বড়োলোক? চব্বিশ ঘণ্টা ফেরিগিরি করলেও নব্বই বছর বয়সে বড়োলোক হতে পারবে না।

তবে টেরেনিয়ার বিশ্বাস, ছমাসের মধ্যেই স্যামুয়েল তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দেবেই। ও বুঝি স্যামুয়েলের থেকেও পাগল!

.

সারাদিন বাবার সাথে ফেরির কাজে ব্যস্ত থাকে স্যামুয়েল। রাতে সে ল্যাবরেটরিতে যায়। শত শত ম্যাচ ডিপথিরিয়া সেরাম তৈরি করছে। বেড়াল, খরগোশ, পাখিকে ইনজেকশন দিচ্ছে। ওরা মরে যাচ্ছে। তার চাই ঘোড়া। কিন্তু ঘোড়া কোথায় পাবে?

কিন্তু?

কিন্তু দিন একটা একটা করে চলে যাচ্ছে।

সকালে খ্রিস্টান শহরের তালা খোলামাত্রই স্যামুয়েল ঠেলাগাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ে। একটু দেরি হলে খ্রিস্টান প্রহরী গর্জে ওঠে। সবুজ পিস্তল নিয়ে তেড়ে আসে–এই ব্যাটা জু। এগিয়ে যা।

ওর কোমরে চেন বাঁধা, সেখানে লটকানো থাকে গেটের বড়ো চাবিটা। বস্তির পরে নদী, নদীর ওপর ব্রিজ। ব্রিজ ধরে পুলিশ স্টেশন বা থানাতে যাওয়া যায়। সন্ধ্যার আগে কোনো ইহুদি শহর থেকে বেরোতে না পারলে, তাকে শাস্তি পেতে হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ স্টেশনে, সেখান থেকে লেবার ক্যাম্প।

 –দুজন করে গার্ড রাতে পাহারায় থাকে। তবে দুজনকে কখনো একসঙ্গে দেখা যায় না। একজন ডিউটি দিলে, অন্যজন ফুর্তি করতে চলে যায়। গেট খোলর পূর্ব মুহূর্তে। আবার এসে সহকর্মীর সঙ্গে কাজে যোগ দেয়।

পল আর আরাম গেটরক্ষক। পল ভালো ছেলে। হাসিখুশি, কিন্তু আরাম? একটা জন্তু, ইহুদিরা ওর চোখে বিষ। মোটাসোটা গাট্টাগোট্টা চেহারা। এখন ওই আরামই স্যামুয়েল রফের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে আছে।

এদিকে দিন কাটতে কাটতে ছ-মাসের জায়গায় একুশ দিনে এসে ঠেকেছে। মাত্র তিন সপ্তাহ হাতে। টেরিনিয়া এল একরাতে, চুপিচুপি।

দুহাতে জড়িয়ে ধরল স্যামুয়েলকে–চলো, আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই।

–তা কী করে সম্ভব? অন্য জায়গায় গেলে কি আমার ফেরিগিরি ঘুচবে? আমি সেই ফেরিওয়ালাই থেকে যাব।

–তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই।

টেরেনিয়ার নেই বদনামের ভয়, সে চায় না অর্থের বৈভব, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু স্যামুয়েল?

–টেরেনিয়া, আমি তা চাই না। 

.

পরের দিন সকালবেলা।

আইজ্যাক, স্যামুয়েলের স্কুলের বন্ধু, একটা ঘোড়াকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়াটা যেমন রোগা, তেমনি কালো আর বেতো। ওর নাম লটি।

স্যামুয়েলকে দেখে আইজ্যাক বলল–আটা তৈরির কারখানায় লটিকে নিয়ে যাচ্ছি। ওর বিনিময়ে যদি দু ফ্লোরিন পাই, তাহলে একটা ঠেলা গাড়ি কিনব।

  স্যামুয়েলের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল–আমি তোমায় ঠেলাগাড়ি দেব, আমাকে তোমার ঘোড়াটা দাও।

ফার্ডের বদলে এল লটি। স্যামুয়েল নতুন গাড়ি বানিয়ে নিল। এবার লটির ওপর শুরু হল তার পরীক্ষা।

-লটি, চিকিৎসাবিজ্ঞানে তুমি এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।

.

অপরিচ্ছন্ন আর ঘিঞ্জি ইহুদি বস্তি। ভয়ংকর সব বাজে বাজে সংক্রামক রোগ লেগেই আছে বস্তিতে। কারও বিশ্রী কাশি হচ্ছে, গ্ল্যান্ড ফুলে উঠছে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মরে যাচ্ছে। কী কারণ? ডাক্তারদের কাছে উত্তর নেই।

আইজ্যাকের বাবারও ওই অসুখ করেছে। স্যামুয়েল ছুটে গেল তাদের বাড়িতে। ওর বাবা খুব কাশছে।

 কাঁদতে কাঁদতে আইজ্যাক বলল–ডাক্তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে।

শোনো আইজ্যাক, তোমার বাবা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে কাশবে। ওই রুমালটা তুমি আমাকে দেবে। তবে সাবধান, ওতে অনেক জীবাণু থাকে।

এক ঘন্টা পরে রোগীর রুমাল থেকে স্যামুয়েল শুকনো থুথু গয়ের চেঁছে তুলল। ব্ৰথভর্তি একটা প্লেটে তা রাখল। শুরু হল অজানা জীবাণুর ব্রথ কালচার। সেই ব্ৰথ সে লটির শরীরে ইনজেকশন দিল। তবে ডোজ কম ছিল। পরপর দুদিন। তারপর ডোজ বাড়িয়ে দিল।

স্যামুয়েলের সাধনা বুঝি সার্থক হল। লটি বেতো, কানা, শুটকো হলে কী হবে, ইনজেকশনে সে মরল না। স্যামুয়েল ওর রক্তের জলীয় অংশ থেকে তৈরি করল অ্যান্টি টক্সিন।

 এল সে আইজ্যাকের বাড়িতে। ওর বাবা বিছানায় শুয়ে আছে, দারুণ কাশছে। কাশির দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাড়িতে লোক গিজগিজ করছে। সবাই বলছে বুড়ো এবার মারা যাবে। ডাক্তারও শেষ কথা বলে গেছে।

স্যামুয়েল বন্ধু ও তার মাকে বলল, যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ চেষ্টা করতে দোষ কী। সিরিঞ্জ দেখিয়ে বলল, এটাতে কাজ হতে পারে।

আইজ্যাকের বাবাকে ইনজেকশন দেওয়া হল। কাশির দমক বাড়ছে বৈ কমছে না। আইজ্যাকের চোখ ছলছল। স্যামুয়েল সেখানে ঘণ্টা তিনেক থেকে বাড়ি ফিরে এল।

পরের দিন সকালে ঠেলাগাড়ি নিয়ে স্যামুয়েল বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হল। সেদিন বাজারে যেন মানুষের ঢল নেমেছে। তাই কেনাকাটা করতে দেরি হয়ে গেল স্যামুয়েলের। সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ইহুদি বস্তির কাঠের গেট থেকে দু মাইল দূরে সে তখন, গাড়ির চাকা গেল খুলে। খ্রিস্টান পুলিশম্যান এগিয়ে এল। তাকে সাহায্য করল, কামারশালা থেকে চাকা জোগাড় করে নিয়ে এল স্যামুয়েল। চাকা গাড়িতে লাগাতে হবে। স্যামুয়েলকে অবাক করে দিয়ে পুলিশম্যান তাকে এই কাজে সাহায্য করল। কেটে গেল প্রায় তিরিশ মিনিট। স্যামুয়েলের মাথায় তখন একটা চিন্তা-আইজ্যাকের বাবা কি মরে গেল? নাকি বেঁচে আছে?

সূর্য ঢলে পড়ল পশ্চিম দিগন্তে। আর মাত্র এক মাইল দূরে ইহুদি বস্তি, বস্তির গেট বন্ধ হয়ে গেল।

স্যামুয়েল তালাবন্ধ গেটের সামনে এসে পৌঁছোল। গার্ড আরাম তখন পাহারা দিচ্ছে।

স্যামুয়েল বলল–স্যার, গাড়ির চাকা খুলে যাওয়ায়–

–বোকা ইহুদি কুত্তার বাচ্চা। প্রহরী খপাৎ করে তার কলার চেপে ধরল।

-সন্ধ্যার পর গেটের বাইরে যাবার হুকুম নেই জানিস না। চল্ থানায়। তোকে জাহাজে তুলে দেওয়া হবে। চলে যাবি সাইলেসিয়ায়। দশ বছর জেলের ঘানি টানবি। সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবি। সাইলেসিয়ায় এখন ভীষণ ঠান্ডা। তুই কয়লার খনির গরমে একা কাজ করবি। কয়লার গুঁড়া ফুসফুঁসে ঢুকবে। তুই কাশবি। ওরা তোকে ধরে এনে বরফের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ব্যাস, তুই অক্কা যাবি।

–স্যার, দোহাই আপনার, আমার বাড়িতে একটা খবর

ইহুদি জানোয়ার। কথা বাড়াবি তো তোর বীচিটা ফাটিয়ে দেব। চল থানায়। সরু ব্রিজের ওপর দিয়ে তখন স্যামুয়েলকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে আরাম। নীচে ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর স্রোত। হঠাৎ পকেট থেকে ব্যাগ বের করে দড়ি খুলে দিল স্যামুয়েল। ঝনঝন শব্দে খুচরো টাকা নীচে পড়ল। আরাম ছুটে এল। টাকা তুলতে ব্যস্ত। স্যামুয়েল এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। একটা বড়ো পাথর তুলে সজোরে মেরে দিল আরামের চোয়াল লক্ষ্য করে। আবার–আবার আঘাত। আরামের মুখ চোখ ফেটে রক্ত ঝরছে। একসময় সে পড়ে গেল এবং মরে গেল।

মৃত প্রহরীর শরীরের দিকে তাকিয়ে রইল স্যামুয়েল। অবাক দৃষ্টি। সে কি সত্যিই ওকে হত্যা করল! বিশ্বাসই হচ্ছে না। পুলিশ ব্যারাক খুব কাছে। প্রহরীদের গলার স্বর অবধি শোনা যাচ্ছে। ওরা যদি টের পায় স্যামুয়েল আরামকে হত্যা করেছে তাহলে তাকে আর সাইলেসিয়ায় পাঠাবে না এখানেই রেখে দেবে। চাবুক মারবে। তারপর টাউন স্কোয়ারে তার ফাঁসি দেবে। পুলিশম্যান, যদি সে হয় খ্রিস্টান পুলিশম্যান, তার গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত বসাতে পারবে না কোনো ইহুদি। তাহলে তার হবে প্রাণদণ্ড। আর এ তো মানুষ খুন! কী করবে সে এখন? দেশ ছেড়ে পালাবে? না, জীবনে আর তাহলে এমুখো হতে পারবে না। মাথায় একটা বুদ্ধি এল স্যামুয়েলের।

মৃত প্রহরীর কাছ থেকে গেট খোলার চাবিটা নিয়ে নিল সে। তারপর ভারী মৃতদেহটা টানতে টানতে ব্রিজের ওপর থেকে নদীর জলে ফেলে দিল।

স্রোতের টানে সেটা অনেক দূরে চলে গেল। যে পাথরটা দিয়ে আরামকে মেরেছিল, সেটাও সে জলে ফেলে দিল। অচিরেই তলিয়ে গেল সেটা অতল গহ্বরে। তারপর লাগালো ছুট, ব্রিজ পার হয়ে গেটের সামনে এল। গেট খুলে ঠেলা নিয়ে ভিতরে ঢুকল। দরজাটা আলগা করে বন্ধ করে দিল। তারপর বাড়ি ফিরে এল।

বাড়িতে সবাই তখন চিন্তিত মুখে বসে আছে। স্যামুয়েলকে দেখে তারা হতভম্ব হয়ে। গেল, যেন ভূত দেখছে।

ওর বাবা বলল–তোমায় ওরা আসতে দিল? আমি তো ভেবেছিলাম

স্যামুয়েল সংক্ষেপে সব কথা গড়গড়িয়ে বলে গেল।

 বাবা আঁতকে উঠল–হ্যায় যিশু, এবার আমাদের প্রাণ যাবে!

আমার কথা শোনো, দেখবে কিছু হবে না।

মিনিট পনেরো পরে স্যামুয়েল তার বাবা আর দুজন ইহুদি প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে গেটের কাছে এল। অন্য গার্ড তখনও ফিরে আসেনি বলে রক্ষে। স্যামুয়েল বাইরে গিয়ে। তালা লাগিয়ে দিল। তারপর দড়ি বেয়ে গেট টপকে ভিতরে চলে এল।

–ভোর হলে কী হবে? স্যামুয়েলের বাবা আতঙ্কিত।

 –আমরা গেটে ধাক্কা দেব। চিৎকার করে বলব, গেট খোলো, গেট খোলো

ভোর হতে না হতেই ইহুদি ব্যবসায়ীরা গেটের সামনে এসে জড়ো হয়েছে। গেট খোলার জন্য শোরগোল করছে। দেখা গেল সেখানে পালে পালে ইউনিফর্ম পরা সৈনিক ও পুলিশ এসে জড়ো হয়েছে। কিন্তু চাবি কোথায়? বিশেষ একটা চাবি খুঁজে পাওয়া গেল। দরজা খোলা হল। রাতের প্রহরী পলকে জেরা করা হল। সে স্বীকার করল, রাতে সে ডিউটিতে ফাঁকি দিয়ে ফুর্তি করতে গিয়েছিল। তাকে জেলে পাঠানো হল। কিন্তু আরাম? দেখো গিয়ে কোন্ গার্লফ্রেন্ডের পাল্লায় পড়েছে। আর চাবি? নিশ্চয়ই কোথাও ফেলে দিয়েছে। আসল চাবিটা স্যামুয়েল পুঁতে রেখেছে–এ খবর কেউ জানল না।

সারাদিন-রাত অনেক ধকল গেছে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। গভীর ঘুমে ডুবে গেল স্যামুয়েল।

 আইজ্যাক তার ঘুম ভাঙানোর জন্য ঠেলাঠেলি করছে। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল স্যামুয়েলের। ভাবল, নিশ্চয়ই আরামের ডেডবডি পাওয়া গেছে। তাই পুলিশ এসেছে তাকে ধরে নিয়ে যেতে।

চোখ মেলে দেখে আইজ্যাক হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চেঁচাচ্ছে–স্যামুয়েল, ওঠো। শিগগির এসো। আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেছে! বাবার কাশি সেরে গেছে।

 আইজ্যকের বাবা বিছানায় উঠে বসেছে। তার জ্বর, কাশি কিছুই নেই। মুরগির সুপ খাবার ইচ্ছা জেগেছে তার।

 স্যামুয়েল ভাবল, আজ সে একটা জীবন নিয়েছে বটে, কিন্তু একটা জীবন দানও করেছে। তার দুচোখ জলে ভরে গেল।

 ইহুদি বস্তির মধ্যে খবরটা অতি দ্রুত রটে গেল–আইজ্যাকের বাবাকে আশ্চর্য এক ওষুধে স্যামুয়েল রফ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে।

ফলে মৃতপ্রায় প্রিয়জনকে বাঁচাতে ছুটে এল আত্মীয়রা। সবাই বলছে, আমাদের রোগীকে বাঁচান। ওই ম্যাজিক সেরাম দিন। কিন্তু অত সেরাম কোথায়? তৈরি করার লোকও তো দরকার।

 স্যামুয়েল ছুটে গেল ডক্টর ওয়ালের কাছে। সব ঘটনা তাকে বলল। ডাক্তার সন্দিগ্ধ। নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর–আগে নিজের রোগীদের ওপর প্রয়োগ করে দেখি।

বারোজন রোগীর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া হল। তার শারীরিক অবস্থা সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। তাকে সেরাম দেওয়া হল। রোগীর শারীরিক উন্নতি চোখে পড়ল।

 স্যামুয়েল রফ তার ল্যাবরেটরিতে বসে আছে, আস্তাবলের পাশে।

ডাক্তার এল সেখানে স্যামুয়েল, তুমি তোমার শর্ত পূরণ করেছ। তোমার সেরামে কাজ হয়েছে। তোমাকে আমি একটা উপহার দিতে চাই। যৌতুকে কী নেবে বলো?

স্যামুয়েলের তরুণ চোখে ক্লান্তির ছাপ উপহার? একটা ঘোড়া।

.

০৯.

শুরু হল রফ অ্যান্ড সন্স-এর পথ চলা। আজ যা আন্তর্জাতিক মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।

১৮৬৮-স্যামুয়েল টেরেনিয়াকে বিয়ে করল।

শশুর ডাক্তার জামাইকে যৌতুক দিল ছটা ঘোড়া একটা ল্যাবোরেটরি আর কাজ করার জন্য ভালো কিছু যন্ত্রপাতি।

 গাছগাছড়া থেকে স্যামুয়েল ওষুধ বানালো। প্রতিবেশীরা সেই ওষুধ ব্যবহার করে সুফল পেল। ধীরে ধীরে স্যামুয়েলের নাম ছড়িয়ে পড়ল।

গরিব মানুষদের স্যামুয়েল এমনিতেই ওষুধ দিয়ে দিত। পয়সা নিত না।

বউকে সে বলল–ওষুধ আসলে অসুখ সারানোর জন্য, লাভের জন্য নয়।

 দিনে দিনে স্যামুয়েলের ব্যবসা বাড়তে থাকল। একটা দোকান খোলা হল। সেখানে মলম, পাউডার এবং প্রেসক্রিপশন ছাড়া অন্যান্য ওষুধও রাখা হল।

এখন স্যামুয়েলের কদর বেড়ে গেছে, ওই সব বড়োলোক ইহুদিদের কাছে। তারা স্যামুয়েলের ব্যবসার অংশীদার হতে চাইল। কিন্তু সে রাজি নয়।

কারণ?

শ্বশুর ডাক্তার ওয়ালের জবাবে সে বলল–শেয়ালকে মুরগির ঘরে ঢুকতে দিলেই একদিন না একদিন তার খিদে পাবে।

 স্যামুয়েলের ব্যবসা ও সংসার–দুটোরই শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। আব্রাহাম, জোসেফ, আন্তন, জান ও পিতোর–তাদের পাঁচ ছেলে।

 স্যামুয়েল ছেলেদের নামে নামে একটা করে ওষুধের দোকান খুলল।

ইতিমধ্যে ইহুদিদের ওপর থেকে অনেক বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। ক্রাকো শহরের খ্রিস্টান এলাকায় ওষুধের দোকান খোলার অনুমতি পেল সে।

আজ স্যামুয়েল সত্যিই স্বাধীন। তার নাম-প্রতিপত্তি-খ্যাতি বেড়েছে। বস্তির নোংরা এলাকা সে ত্যাগ করল। শহরে সে নতুন তিনতলা বাড়ি তৈরি করল।

স্যামুয়েলের স্বপ্নের শেষ নেই।

ছেলেরা বড় হয়ে উঠছে। তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে গৃহ শিক্ষকের ব্যবস্থা করেছে বাবা স্যামুয়েল। ওদের জন্য তার পরিকল্পনার অন্ত নেই। লোকে অত কিছু ভাবে না। তার কাজকর্ম দেখে হাসাহাসি করে।

ওর শাশুড়িও বলে জামাইয়ের কাণ্ডকারখানা দেখো, পাগল।

 আব্রাহাম ও জান শিখছে ইংরাজি। জোসেফ জামান, আন্তন ফরাসি আর পিতোর । ইতালিয়ান ভাষা শেখার প্রয়াস চালাচ্ছে।

এসব ভাষা শিখে কী যে লাভ! এখানে কেউ কোনোদিন ওই ভাষা জানে না। ছেলেরা পরস্পরের মধ্যে কথা বলতে পারবে না।

স্যামুয়েল হাসে–এটা ওদের শিক্ষার অঙ্গ।

 সে জানে, তাদের ছেলেরা বড়ো হলে এই ভাষাজ্ঞান কোন্ কাজে লাগবে।

স্যামুয়েল ছেলেদের বিদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করল। ওরা সেখানকার শিক্ষাদীক্ষায় তৈরি হবে। এই সুযোগে ব্যবসার কিছু ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের ব্যবস্থাও করে ফেলল সে।

আব্রাহাম এখন একুশ বছরের যুবক। তাকে আমেরিকায় পাঠানো হবে।

আব্রাহামের দিদিমা এ কথা শুনে আঁতকে ওঠে–সেকি? ওখানে তো জংলিদের বাস! নিরাপত্তার অভাব। ও কখনো আমেরিকায় যাবে না।

 স্যামুয়েল মনে মনে বলল–নিরাপত্তা? ইহুদিদের নিরাপত্তা? পৃথিবীর কোথাও নেই। ইহুদি নিধন যজ্ঞ সর্বত্র চলে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের আগুনে ঝলসে যাওয়ার মৃত্যু দৃশ্য।

ছেলেরা কে কোথায় যাবে, নতুন শাখা খুলবে রফ অ্যান্ড সন্সের সেগুলো স্যামুয়েল ঠিক করে ফেলেছে। আব্রাহাম ইয়র্কে নতুন শাখা খুলবে। একুশ বছর বয়সের জোসেফ যাবে বার্লিনে, সেখানে রফ অ্যান্ড সন্সের ফ্যাক্টরির দায়িত্ব নেবে। আন্তন যাবে ফ্রান্সে, জান ইংল্যান্ডে আর পিতোর যাবে ইতালিতে।

পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবীর পাঁচটি নামকরা দেশে রফ অ্যান্ড সন্স-এর নতুন শাখা প্রতিষ্ঠিত হল।

উকিল ডাকা হল। আন্তর্জাতিক বহুজাতিক এই সংস্থার আইনকানুন বেঁধে দেওয়া হল।

–পরিবারের বাইরের কেউ এই কোম্পানির পরিচালনার দায়িত্ব পাবে না। কোম্পানির শেয়ার কেউ বিক্রি করতে পারবে না। শেয়ার বেচতে হলে প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডারদের একমত হতে হবে। প্রত্যেক অংশীদার সুন্দর ভালো বাড়িতে বাস করবে। মোটা অঙ্কের মাইনে পাবে। বড়ো ছেলে ও তার উত্তরাধিকারীদের হাতে থাকবে কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ার। আমেরিকার ধনকুবের রথসচাইল্ডের চেয়েও বড়ো হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে চায় । রফ অ্যান্ড সন্স।

.

স্যামুয়েল ও টেরেনিয়ার এখন সুখের সংসার। দিন কাটছে। ব্যবসার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। জন্মদিনে ও ছুটিতে ছেলেরা বাড়িতে আসে। আনন্দ করে। তার ফাঁকে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা হয়।

কোনো ভাই ওষুধ সংক্রান্ত কোনো গবেষণার খবর পেলেই অন্য দেশে অন্য ভাইয়ের কাছে সঙ্গে সঙ্গে তা জানিয়ে দেয়। প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে তখন রফ অ্যান্ড সন্স ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে।

শতাব্দীর চাকা ঘুরল।

 স্যামুয়েল রফের ছেলেরা ঘরে বউ আনল। সংসার বাড়ল।

আব্রাহাম বিয়ে করল আমেরিকান তরুণীকে। তার ছেলে.উড্রো, নাতি স্যাম। এই হল এলিজাবেথের বাবা, স্যাম রফ। জোসেফের বউ এক জার্মান তনয়া। নাতনির নাম অ্যানা, ওয়ালথার গ্যাসনার যার স্বামী। আন্তন রফ বিয়ে করল এক ফরাসি মেয়েকে। তার ছেলের একমাত্র মেয়ের নাম হেলেন। সে বহুবার বিয়ে করেছে। কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। জান  রফের স্ত্রী ইংল্যান্ডবাসী এক মেয়ে। তার নাতির নাম স্যার অ্যালেক রফ। পিলের বিয়ে করেছে এক ইতালিয়ান তনয়াকে। তার নাতনি সিমনেত্তা, বিয়ে করেছে ইভো পালাজজিকে।

অর্থাৎ স্যামুয়েল ও টেরেনিয়া রফের বংশধর হল এলিজাবেথ, অ্যানা, হেলেন, স্যার অ্যালেক ও সিমনেত্তা পালাজজি।

স্যামুয়েল তখন বেঁচে আছে। মারকনি বেতার যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় প্রথম উড়োজাহাজ আকাশে ওড়াল কিটি হকে। স্যামুয়েল দেখেছে। দ্র্যে মামলা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করল। ফরাসি কথাসাহিত্যিক এমিল জোলা সহায়তা করেছিলেন। অ্যাডমিরাল পিয়ারি প্রথম উত্তর মেরুতে পৌঁছেছিল। তখন পৃথিবীর বুকে কতরকম পরিবর্তন ঘটে চলেছে। স্যামুয়েল দেখল লাখে লাখে ফোর্ডের মডেল টি গাড়ি পথে চলছে। মানুষ বিজলিবাতি ও টেলিফোন ব্যবহার করতে শিখল। চিকিৎসাবিজ্ঞানও পিছিয়ে নেই। কী কারণে টিউবারকুলোসিস, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ হয় তাও জানা গেল।

গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে রফ অ্যান্ড সন্স আন্তর্জাতিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের রূপ ধারণ করল।

 এসবের মূলে কে? কেন? স্যামুয়েল রফ আর তার বেতো রোগা ঘোড়া লটি। যে স্যামুয়েল গরিব ইহুদি বংশজাত, যাদের ওপর খ্রিস্টানরা পৈশাচিক অত্যাচার করে, যে স্যামুয়েল পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে স্বাধীনতার মুখ দেখতে চেয়েছিল। ইহুদি শুধু মরে আর মার খায়। কারণ তারা গরিব। গরিব মরে ও মার খায়। কোনো কোনো গরিব ইহুদি অবশ্য : সাহস দেখায়, লড়াই করে এবং জয়ী হয়।

.

এলিজাবেথ বেশ কয়েকবার বইটা পড়ল। বইটা তার অস্তিত্বের অংশ। শুধু তার কেন, তাদের সকলের। সে বইটা জায়গা মতো রেখে দিল।

এই সে প্রথম জানল, তার বংশ পরিচয়।

স্কুলে ব্যাল নাচের ক্লাসটা এলিজাবেথের মোটেও ভালো লাগে না। সে তখন চোদ্দো বছরের। ড্যান্স টিচার মাদাম নেতুরো ক্লাসে বলল–আর কিছুদিন পরে ব্যাল নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ছেলে মেয়েদের গার্জেনদের নেমতন্ন করা হবে সেই অনুষ্ঠানে।

 যেদিন নাচের অনুষ্ঠান সেদিন স্যাম রফ বাড়ি ফিরল দশদিন পর।

মেয়ে বলল–আজ আমার নাচের স্কুলে ব্যালের অনুষ্ঠান। তুমি নিশ্চয়ই যেতে পারবে না?

–নিশ্চয়ই যাব।

 এলিজাবেথ অবাক।

.

 অডিটোরিয়াম ভরে গেছে। ছেলেমেয়েদের বন্ধুরা, মা-বাবারা এসেছে। স্টেজের দু-পাশে রাখা গ্র্যান্ড পিয়ানো। কোপপেলিয়া, সিনডরেলা এবং সোয়ান লেকের অনুষ্ঠান।

 প্রত্যেক মেয়ে একবার করে একা নাচবে। এলিজাবেথও নেচেছিল। ওর সময় ছিল মাত্র এক মিনিট। অন্যান্যরা কী সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করছে, যেন মারকোভা বা ম্যাকসিমোভা!

 এলিজাবেথ স্টেজে এল। নাচতে লাগল। নাচ শেষে ভদ্রতার খাতিরে সকলে হাততালি দিল। বাবা মুচকি হাসল। এলিজাবেথ খুশি। বাজনা থেমে গেছে। এলিজাবেথ আবার নাচতে শুরু করল। অগত্যা পিয়ানোবাদক বাধ্য হয়ে আবার বাজাতে শুরু করল। স্টেজের আড়ালে দাঁড়িয়ে তখন মাদাম রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে।

নাচের প্রোগ্রাম শেষ হল। স্যাম রফকে নাচের দিদিমণি বলল–যে মেয়ে কথা শোনে না, তাকে সহ্য করা যায় না। ও নেচেই যাচ্ছিল। যেন কোনো নাম করা নাচিয়ে হয়ে গেছে।

-ঠিকই বলেছেন। আমি ওকে শাস্তি দেব।

 –ধন্যবাদ, মিস্টার রফ দেখুন কী করতে পারেন।

মাদাম চলে গেল।

স্যাম রফ বলল–লিজা, চকোলেট সোডা তোমার কেমন লাগে।

এলিজাবেথের চোখে জল।

বাবার কাছে সে গল্প শুনেছে। তখন বাবা টোকিওতে। জাপানিরা চকোলেটের সঙ্গে গঙ্গা ফড়িং খেতে দিয়েছিল। বাবা খেয়েছিল।

–তুমি আমার ওপর রাগ করোনি?

বাবার চোখে-মুখে খুশির হাসি–কেন? তুমি তো সবাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলে। তুমি তোমার বংশধারা অনুযায়ী কাজ করেছ। এটাই রফ পরিবারের বৈশিষ্ট্য।

পরের দিন বিকেলে বাবার সেক্রেটারি এসে জানাল-তোমাকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। সেখানে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

.

সুইজারল্যান্ড। গ্রাম্য পরিবেশে বোর্ডিং স্কুলটা। বিখ্যাত স্কুল। মেয়েদের ও ছেলেদের আলাদা স্কুল। মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তারা ছেলেদের শরীরের সমস্ত কিছু। জানে। কোন্ ছেলের পুরুষাঙ্গ কত বড়ো, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করে। ওরা সর্বদা যৌন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। ওরা জানে, একটা মেয়ে উলঙ্গ হয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে, তার নিতম্ব থেকে বুক অব্দি আঙুলের চাপ দিয়ে কীভাবে যৌন উন্মাদনা জাগিয়ে তুলতে হয়। যে মেয়েটি এই পুলক জাগানোর কাজটি করে তাকে ওরা একটা প্যাস্ট্রি দেয়। বাথরুমেও ওরা একটা খেলা খেলে। মস্ত বড়ো বাথটবে শুয়ে মেয়েরা হ্যান্ড, শাওয়ারের মুখটা দু পায়ের ফাঁকে রেখে গরম জলের ধারা দেয়। যৌন পুলক জাগে দেহে ও মনে। এলিজাবেথ এসব পছন্দ করে না।

.

পনেরো বছরের জন্মদিন। এলিজাবেথ রফের। যথারীতি বাবা আসতে পারেনি। এসেছিল রিস্ উইলিয়ামস। ওদের মধ্যে এই প্রথম পরিচয়। বাবার হয়ে সে একটা উপহার দিয়েছিল লিজাকে।

বাবা আসেনি, মেয়ের মুখ ভার।

 রিস্ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল–চলো, ডিনার খাওয়া যাক।

রিস্ সুন্দর, সুদর্শন চেহারা। এলিজাবেথ তার ডাকে সাড়া দিল না। তাকে ওর সাথে মানাবে না ভেবে।

কিন্তু রিস ছাড়ল না।

তার গাড়িতে উঠে লিজা বলল–তুমি উল্টো দিকে গাড়ি ড্রাইভ করছ।

–আমরা এখন প্যারীতে যাচ্ছি। কারণ পনেরোর তরুণীদের প্যারীর ম্যাক্সিমে ডিনার। খেতে হয়।

প্রাইভেট জেটে প্যারী গিয়েছিল তারা ডিনার খেতে।

তারা খেয়েছিল লবস্টার, ডাক আলা অরেঞ্জ, ম্যাকসিমের স্পেশ্যাল স্যালাড, শ্যাম্পেন আর বার্থডে কেক।

এলিজাবেথ রফের জীবনের সুন্দরতম সন্ধ্যা।

রিস্ তাকে আবার স্কুলে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। সে বলেছিল–তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব।

ওটা তোমার বাবার পাওনা। রিস হেসেছিল।

কিন্তু এলিজাবেথ জানে, রিস মিথ্যে বলছে। কী আকর্ষণীয়, কী সুন্দর দেহ!

রাতে ঘুম এল না এলিজাবেথের চোখের তারায়। সে টেবিলে বসল। লিখল-মিসেস রিস উইলিয়ামস। তারপর আপন মনে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

 লিজার জন্মদিনের দিন এক চিত্রতারকার সঙ্গে রিস্ উইলিয়ামসের সাক্ষাৎ করার কথা ছিল। কিন্তু লিজের জন্য সেটা বাতিল করে পরের দিন করা হয়েছিল। ম্যাকসিমের রেস্তোরাঁয় সেই চিত্রতারকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে রিসের মনে হয়েছিল, ওর চেয়ে লিজাই ভালো।

লিজার মনে এখন একটা অহংবোধ জেগেছে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে সচেতন। হয়তো স্যামুয়েল রফের সংঘাতময় জীবনের ইতিবৃত্ত জেনে তার মধ্যে এই পরিবর্তন দেখা দিল। রিস্ উইলিয়ামস নামে এক সুদর্শন সপ্রতিভ যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বলেও হতে পারে।

 এলিজাবেথ নিজেকে আর গুটিয়ে রাখল না। সে খেলাধুলায় অংশ নিল। দেখা গেল, শরীরের প্রতিও সে যত্নশীল হয়ে উঠেছে। মেয়েদের পাজামা পার্টিতে যোগ দিচ্ছে। সেখানে পাজামাপরা মেয়েরা মারিজুয়ানা বা চরসের সিগারেট খেয়ে নেশা করে।

রেনী টোকা, এক ফরাসি মেয়ে, এগিয়ে এল লিজ, তুমি স্মোক করো?

করি। ডাহা মিথ্যে বলল এলিজাবেথ।

 লিজ শুনেছে, গাঁজা, হাসিস, মারিজুয়ানার নেশা করলে মানুষের সংযমের বাঁধ ভেঙে যায়। সে তার অস্তিত্বের কথা ভুলে যায়।

রেনী তার হাতে বাদামি রঙের সিগারেট তুলে দিল। টান দিল এলিজাবেথ–কোথায় যেন, দূরে ভেসে যাচ্ছে সে। দূর থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের গলার আওয়াজ। সে উড়ে যাচ্ছে আল্পসের মাথার ওপর দিয়ে, সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে।

ফরাসি মেয়েটি তাকে ধাক্কা দিল–কেমন লাগছে, রফ?

দারুণ! এলিজাবেথ নেতিয়ে পড়া চোখদুটো কোনোরকমে খুলল, মারিজুয়ানার নেশা এই প্রথম।

–মারিজুয়ানা? এটা একটা সাধারণ সিগারেট!

.

মেয়েদের সুইস স্কুল। ফরাসি ভাষা ও ফ্যাশান শেখানো হয়। নামডাক আছে স্কুলটার।

ফ্যাশান টিচার মাদামোয়াজেল শাতাল হ্যারিয়ৎ। অল্প বয়স। মেয়েদের তিনি বলেন, ড্রেস যতই স্মার্ট হোক না কেন, ব্রা-প্যান্টি ঠিক না হলে বিশ্রী দেখায়।

এলিজাবেথের নানা সমস্যার কথা তিনি শুনেছেন। ওকে অনেক সহানুভূতি দেখান তিনি। কেক ও গরম চকোলেট খেতে দেন। ওর স্তন ছুঁয়ে আদর করেন।

মাদামোয়াজেলের সুডৌল স্তন, লম্বা পা। এলিজাবেথ তার উলঙ্গ চেহারার কথা চিন্তা করে।

আচমকা তার মনে একটা প্রশ্ন জাগে–আমি কি সমকামী?

সমকামী লেসবিয়ান মেয়েদের কথা লিজা বইয়ে পড়েছে। সমাজের চোখে এটা নিন্দনীয়। পুরুষের সঙ্গে প্রেমহীন বিয়ের থেকে মেয়েমানুষের সঙ্গে সমকামিতা কি এতই খারাপ? লিজা জানে, তার বাবা একথা জানলে কষ্ট পাবে। মেয়ে সমাজের বাইরে অচ্ছুতের মতো দিনযাপন করবে, বিয়ে করবে না, সংসার করবে না, ছেলেমেয়ে হবে না এটা তার ভালো লাগার কথা নয়। তবু সে মাদামোয়াজেল হ্যারিয়ৎকে নিয়ে তার পেইন্টিং করা সুন্দর ছোট্ট ঘরে বসবাস করবে।

 এলিজাবেথ রফের স্বপ্নে তখন মাদমোয়াজেল বিচরণ করছে। তারা একসঙ্গে ডিনারে বসেছে-স্যালাড, লবস্টার, বরফ আর ফরাসি মদ। চুল্লিতে আগুন জ্বলছে। কার্পেটের ওপর মুখোমুখি বসে আছে তারা। কবিতা পড়ছে–টি এস এলিয়ট, অথবা ভি জে রাজাধন

ভালোবাসার শত্রু।

সময়-সোনালি মুহূর্তগুলো তাড়াতাড়ি কেড়ে নেয়। আমি কখনও বুঝিনি কেন প্রেমিকের সুখের পরিমাপ।

দিন রাত মাস বছর,
ভালোবাসা যখন মাপা যায়।
আমাদের দুঃখ সুখে, হাসি-কান্নায়

কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ল এলিজাবেথ রফ। ঘুম ভাঙল যখন, চাঁদের আলোয় দেখল, মাদমোয়াজেলের নগ্ন শরীর। ছোটো আপেলের মতো দুটি বুক, একটু ঝুলে গেছে। ভুড়ি আছে সামান্য। পাছাল্যাপাপোছা।

মাদমোয়াজেল এলিজাবেথের কাছে এল, ওকে চুমু দিল, স্তন টিপে ধরল। তার হাত এবার উরুর দিকে নামতে শুরু করেছে। লিজের মোটেও ভালো লাগল না।

 একেই কি বলে সমকামিতা? লেসবিয়ান রমণীরা এই সুখ ভোগ করে?

আমি ও তুমি শরীরে শরীরে রাখলে।

আকাশ ও নক্ষত্র কেঁপে ওঠে–এই সেই ক্ষণ!

 কোথায় গেল সেই মুহূর্ত, মোমবাতি ডিনারের, একসাথে, দুই মেয়েমানুষের জীবন কাটানোর সুখস্বপ্ন?

এলিজাবেথের ভালো লাগছে না, মাদমোয়াজেলের চুমু, আদর, আঙুলের ছোঁয়া, কেমন। বিশ্রী লাগছে তার।

–সোনামণি, এবার তোমাকে আমি করব। মাদমোয়াজেল বলে ওঠে।

 –কিন্তু তোমার বা আমার সেই সব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নেই।

এলিজাবেথ হাসছে, কাঁদছে। সে যেন হিস্টিরিয়া রোগী। সে বুঝল, সে একটা স্বাভাবিক মেয়ে, সমকামী নয়।

কিন্তু যৌন তৃপ্তি মেটাতে হবে। সে বাথরুমে ঢুকে হ্যান্ড শাওয়ারের নল ঢুকিয়ে দিয়ে রতি তৃপ্তি লাভ করল।

.

১০.

সার্ডিনিয়ার ভিলা। এলিজাবেথ রফ এসেছে ইস্টার ছুটিতে। দশদিন থাকবে। এখন তার বয়স আঠারো। এ বছর স্কুল ফাইনাল দেবে। সে গাড়ি চালাতে জানে। এই প্রথম দ্বীপটা একা ঘুরে বেড়াবার অনুমতি পেল। ভূমধ্যসাগর, তপ্ত রোদের আলো, জলের বুকে গা ভাসানো, রাতে বিছানায় শুয়ে পাথরের গান, বিষাদের সুর শোনা, যা এখানে পাথরের ফুটোতে হাওয়া ঢুকে এক অদ্ভুত সুরের সৃষ্টি হয়। টেমপিও-য় ক্যার্নিভ্যালে সারা গায়ের লোক জাতীয় পোশাকে সেজে উঠেছে। ডোমিনো মুখোশের আড়ালে চলেছে নাচ, অথবা দেহ মিলন। পরের দিন সকালে তারা আর বলতে পারবে না, কোন্ ছেলে বা মেয়ে কোন্ ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে শরীর শরীর খেলা খেলেছে।

এলিজাবেথ ভাবে, গাঁয়ের সবাই যেন দ্য গার্ডসম্যান নাটকে অভিনয় করে চলেছে। পানট মুরায় স্থানীয় লোকেরা খোলা আকাশের নীচে বসে আগুন জ্বেলে ভেড়ার মাংস ঝলসে নিচ্ছে।

ওরা তাকে উপহার দিল-সীড়া ময়দায় ঢাকা ছাগলের দুধের পানীয়, ওপরে গরম মধু এবং সেলিমে এক ধরনের সাদা মদ। এই মদ কোথাও পাঠানো যায় না, নষ্ট হয়ে যায়। তাই পৃথিবীর আর কোথাও এটা পাওয়া যায় না।

বড়োলোকের ছেলেরা আসে পোরটো সারভোর রেড লায়ন সরাইখানায়। তারা লিজাকে আমন্ত্রণ জানায়। সাঁতার ও ঘোড়ায় চড়ার পার্টিতে আসতে বলে। লিজার বাবা বলে, পাত্র হিসেবে ওরা ভালো। তবে লিজা ওদের পছন্দ করে না। ওরা মদ খায় বেশি, বড্ড বেশি কথা বলে, শরীরে শরীর ছোঁয়াতে চায়। তারা জানে, রফ পরিবারের উত্তরাধিকারিনী সে। তাই তারা তার সঙ্গ কামনা করে, তাকে মদ ও ডিনার খাওয়ায়, বিছানায় তুলতে চায়। ওদের ধারণা, লিজার কুমারীত্ব এখনও অটুট আছে। তারা তার কৌমার্য হরণ করে ভালোবাসা পেতে চায়। ওরা চেষ্টা চালিয়ে যায়, লিজা ওদের আশাভঙ্গ করে না।

সন্ধ্যা শেষে

–চলো, আমরা বিছানায় যাই।

না। লিজা জবাব দেয়।

ওরা লিজাকে বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েটা সুন্দরী এবং নিশ্চয়ই বোকা। কিন্তু ওরা জানে না, সুন্দরী মেয়েরাও বুদ্ধিমতী হয়। ওদের সঙ্গে মিশতে লিজার ভালো লাগে না, একঘেয়ে লাগে। তবু বাবাকে খুশি রাখার জন্য তাকে ওদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে হয়।

একদিন রিস উইলিয়ামস এল সার্ডিনিয়ার ভিলাতে।

বাঃ, ভারী সুন্দরী হয়ে উঠেছে তো মেয়েটা!

স্যাম, রিস বলে, দিন দিন যা সুন্দরী হয়ে উঠছে লিজা, কোনদিন না আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অবশ্য ছেলেরা যদি বোবা কালা বা অন্ধ না হয় ।

স্যাম ও রিস্ নতুন ফ্যাক্টরিতে কোন্ ওষুধটা বেশি বিক্রি হচ্ছে, কোন্টা কম, অন্য কোম্পানি কোথায় খোলা হবে, নতুন প্ল্যান চাই ইত্যাদি ব্যবসায়িক কথাবার্তা বলে, যা লিজার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়।

স্যাম টাওয়ার রুমে কাজে ব্যস্ত। লিজাকে সঙ্গী করে রিস্ রেড লায়ন রেস্তোরাঁয় এল। সেখানে ছেলেদের সঙ্গে ওকে তীর ছোঁড়া প্র্যাকটিস করতে দেখে লিজা ভাবল, যে-কোনো জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে রিস্ উইলিয়ামস।

স্কুলের ব্যাপার নিয়ে ওদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হল।

রিস বলল–স্কুলের পালা শেষ করে কী করবে ভেবেছ? বিয়ে? না–

–ভেবে দেখিনি।

.

অবশেষে লিজা কৌমার্য হারাল। এর জন্য দায়ী রিস উইলিয়ামস।

শনিবার সন্ধ্যাবেলা, বড়ো পার্টির আয়োজন করেছে তার বাবা। সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটা পরতে রিস্ তাকে অনুরোধ করেছিল। বলেছিল, একজনকে দেখাব।

লিজা খুশি হয়েছিল। আজ সন্ধ্যায় ওর সঙ্গিনী হব।

অথচ রিস্ এক সুন্দরী ইতালিয়ান মেয়েকে সঙ্গিনী করেছে। লিজা রেগে গেল–রিস তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে মাঝরাতে পার্টি ছেড়ে চলে গেল। বাকি রাতটা ভ্যাসিলভ নামের এক দাড়িওলা মাতাল রাশিয়ান পেন্টারের সঙ্গে এক বিছানায় কাটালো।

তবে মিলনটা সুখের হয়নি। এলিজাবেথ ভীতু। আর মাতাল ভ্যাসিলভ? সে আদরের তোয়াক্কা করে না। উলঙ্গ  হয়ে শুয়ে পড়ল এলিজাবেথের নগ্ন শরীরের ওপর। কেটে গেল একটি ক্ষণ। তখন ভ্যাসিলভের লম্বা পুরুষাঙ্গ ঢুকে গেছে লিজার গোপন ত্রিকোণ সুড়ঙ্গের ভেতরে। আঃ, কী দারুণ অনুভূতি! ভালোই লাগল। লিজা ভাবল, এর মতো আশ্চর্য আনন্দ দানকারী জিনিস আর নেই।

 মিলনের চরম মুহূর্তে মাতাল ভ্যাসিলভ একটু কেঁপে উঠল-শিহরণে। তারপরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। তার নাক ডাকা শোনা গেল।

নিজের প্রতি কেমন ঘেন্না হয় এলিজাবেথের। একেই কি যৌন সঙ্গম বলে? একে কেন্দ্র করেই গান, কবিতা, গল্প লেখা হয়? রিসকে মনে পড়ে। কান্না উঠে আসে। পোশাক পরে সে বাড়ি ফিরে যায়।

পরের দিন ভ্যাসিলভ আবার ফোন করল। লিজা রফ হাউসকিপারকে বলল, বলে দাও আমি বাড়ি নেই।

লিজার স্কুলে ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে এল। স্যাম রফ ও রিস্ উইলিয়ামস তাকে স্কুলে ফিরিয়ে দিয়ে এল। স্যাম রফের প্রাইভেট প্লেন-বড়ো বড়ো দুটো বেডরুম, সাজানো গোছানো, বাথরুম, অফিসঘর, বসার ঘরদামি দামি ছবি ঝুলছে, সামনে একটা গ্যালি। লিজার মনে হয়, এ যেন সিন্দাবাদের ম্যাজিক কার্পেট, প্লেন নয়।

রিস্ ও লিজা দাবা খেলল। খেলা ড্র হল।

রিস্ বলল–আমি অভিভূত!

লিজা খুশি হল।

.

স্কুলের শেষ কয়েকটা মাস খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেল। এলিজাবেথ ঠিক করল, পূর্ব পুরুষ স্যামুয়েল রফের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবে, ঠিক তার মায়ের মতো। তার। মা অতিথিদের দেখাশোনা করত। সে তার মায়ের স্থান নেবে হোস্টেসের ভূমিকায়।

এইভাবে শুরু হবে।

.

১১.

লিজা নাচছিল। কে যেন তার পাছায় চিমটি কাটল। সুইডিশ রাষ্ট্রদূত। তক্ষুনি সে যেন নাচের স্টেপ ফেলতে ভুল করেছে, এমন ভঙ্গিমাতে তার জুতোর ধারালো হিলের খোঁচা দিল রাষ্টদূতের পায়ে। লোকটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল।

-সরি অ্যামবাসাডর। আপনার জন্য ড্রিঙ্কস নিয়ে আসছি।

 এখন লিজের দায়িত্ব–রফ অ্যান্ড সন্সের প্রত্যেকটি পার্টিতে অতিথিদের আপ্যায়ন করা। রাষ্ট্রদূত, সিনেটর, মন্ত্রী, ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। কোটি কোটি ডলারের লেনদেন। ভাঙা গড়ার খেলা। কনফারেন্সে, হোটেলে, অ্যামব্যাসিতে, রাজপ্রাসাদে। আশ্চর্য এই জগৎ সম্রাট স্যাম রফ। সে সবসময় কোম্পানির স্বার্থের কথা চিন্তা করে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।

.

আঠারো বছর বয়সে লিজা গ্র্যাজুয়েট হয়ে ফিরে এল। বীকম্যান প্লেসে।

তখন স্যাম আর রিস্ ব্যবসায়িক আলোচনায় ব্যস্ত।

বাবা বলল–স্কুলের পাট চুকে গেল? ভাল।

 রিস বলল–গ্র্যাজুয়েশনের উৎসবে স্যামের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সময় পায়নি। 

এলিজাবেথ বুঝল, বাবার যা বলার, রিস্ তা বলে দিচ্ছে। তার মানে বাবা তাকে ভালোবাসে না। সে যদি ছেলে হত, তাহলে বাবা তাকে গুরুত্ব দিত।

রিস বলল–স্যাম, শনিবার রাতের পার্টিতে লিজা হোস্টেস হবে।

স্যামের চোখে উৎসাহের ঝিলিক। উঠতি যুবতী সুন্দরী মেয়ে অতিথিদের ঠিকমতো.. দেখভাল করতে পারলে কোম্পানির লাভ।

স্যাম মুখে বলল তোমার পার্টির পোশাক আছে? না থাকলে কিনে নাও। পার্টি দিতে জানো?

-হ্যাঁ, এলিজাবেথ আমতা আমতা করে বলল, স্কুলে শিখেছি।

 –ঠিক আছে। সৌদি আরবের কিছু শেখ আসবে।

কত জন রিস?

 –চল্লিশ জন। দু-একজন এদিক-ওদিক হতে পারে।

 রিস্ হাসছিল।

–আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। লিজার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।

.

এবং ঘটে গেল এক বিশ্রী কাণ্ড।

ডিনারের মেনুতে লিজা রেখেছিল কাঁকড়ার ককটেল, শুয়োরের মাংসের ক্যাসুলেট আর দামি মদ।

 লিজা জানত না, সৌদি আরবের মুসলমান শেখরা কাঁকড়া বা শুয়োর কোনোটাই স্পর্শ করে না।

সে যাত্রা রিস্ লিজাকে বাঁচাল। সে টেলিফোন করল কাকে যেন। তারপর অতিথিদের সঙ্গে গল্পে মেতে রইল।

 টেবিল পাতা হল। দেখা গেল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকটা ক্যাটারিং ট্রাক বাড়ির সামনে হাজির।

 ভেড়ার মাংস, ভাত, রোস্ট চিকেন, মাছ, মিষ্টি, পনির, টাটকা ফল। সবাই তৃপ্তি করে খেল। লিজা রিসের দিকে তাকাচ্ছে আর একটু একটু খাবার মুখে দিচ্ছে।

পার্টি শেষ হল।

 লিজা বলল–বাবা, আমারই ভুল। দুঃখিত। রিস্ না থাকলে

–আশা করি, আর ভুল হবে না। স্যাম সরাসরি বলল।

 সত্যি, তারপর থেকে লিজার আর ভুল হয়নি। সে অতিথিদের প্রত্যেকের ব্যাপারে ফাইল কার্ড রাখত নিজের কাছে। তাদের পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিত। অতিথিরা পছন্দসই ব্রান্ডের মদ বা হুইস্কি বা চুরুট পেয়ে খুশি হত।

সুদর্শন যুবক রিস উইলিয়ামস বেশির ভাগ পার্টিতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করে। সুন্দরী যুবতী মেয়েরা সঙ্গে থাকে। ওরা কী সুন্দর চুল বাঁধে, সুন্দর সাজে। লিজা পারে না। রিস কিন্তু এসব ব্যাপারে নজর দেয় না।

.

সেদিন লিজার জন্মদিন, কুড়ি বছর পূর্ণ হল তার।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে তার বাবা বলল রাতে থিয়েটারের টিকিট কাটা আছে। তারপর আমরা ডিনার পার্টিতে যাব।

লিজা খুশি। তাহলে তার জন্মদিনের কথা বাবার মনে আছে।

পরক্ষণেই সে শুনল, বাবা বলছে–মোট বারোজন। বলিভিয়ার কনট্রাক্টের ব্যাপারে আলোচনা আছে।

লিজা দুঃখ পেল, জন্মদিনের কথা বাবা কিছু বলল না।

 সন্ধ্যা ছটা। লিজার হাতে মস্ত বড়ো ফুলের তোড়া নিশ্চয়ই বাবা পাঠিয়েছে।

 ফুলের তোড়ার সঙ্গে একটা কার্ড বাঁধা সুন্দরী মেয়ের জন্য কী সুন্দর দিন! রিস্।

সন্ধ্যা সাতটা। বাবা থিয়েটারে যাচ্ছে। তার আগে ফুলের তোড়াটা দেখে বলল নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড পাঠিয়েছে?

লিজা বলতে চেয়েছিল, জন্মদিনের উপহার। কিন্তু সে চুপ করে রইল। মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে বাবা নিশ্চয়ই তার জন্মদিনটা উপভোগ করত।

বাড়িতে লিজা একা। যন্ত্রণা ও নৈরাশ্য তার সঙ্গী।

দশটা বাজে। রিস্ এল, বলল–হ্যাপি বার্থডে। পোশাক পরে নাও। আমরা ডিনারে যাব।

ওরা লং আইল্যান্ডের একটা রেস্তোরাঁয় এল–ফ্রেঞ্জ ফ্রাই পিঁয়াজ, রুট বিয়ার। রিস্ শুধু মেয়েদের পছন্দ করে না। ওর সঙ্গে যখন যে থাকে, মনে হয় সে বুঝি রিসের আপনজন, আত্মার আত্মীয়, বিশেষ কেউ।

 লিজা শুনেছে, রিসের ফেলে আসা দিনযাপনের গল্প। অদ্ভুত, সুন্দর, আনন্দপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারের গল্প।

 রিস্ বলেছে–ছোটো থেকে সবকিছু দেখার, জানার একটা প্রবল ইচ্ছা ছিল। তাই একদিন বাড়ি থেকে পালালাম। ওয়েলসের পার্কে আর বীচে কাজ করতাম। গ্রীষ্মকালে কোর্যাল-এ করে রোসিলির বুকে ট্যুরিস্টদের নিয়ে যেতাম।

–রোসিলি? কোর‍্যাকল?

–হ্যাঁ, রোসিলি হল একটি খরস্রোতা নদী। কোর্যাকল হল প্রাক-রোমান যুগের ডিঙি নৌকো; কাঠ ও চামড়ার তৈরি। ওয়েলসে গেলে তোমারও ভালো লাগবে। সেখানে আছে। ভেল অফ নীথ-এ পাগলাঝোরা, অ্যাবরেডডি, ক্যায়েরবডি, পোর্থক্লেজ, বিলগেট্টি, ল্যাংগওম উচাফ।

কী সুন্দর জায়গার নাম! যেন সংগীতের এক-একটি মূৰ্ছনা।

বন্য এক দেশ। ওখানে আছে জাদু, আছে বিস্ময়।

 –তা হলে তুমি ওয়েলস ছাড়লে কেন?

 –ছোট্ট বাসনা। পৃথিবীর অধীশ্বর হওয়ার বাসনা।

আজও রিস্ উইলিয়ামস একই ক্ষুধার তাড়নায় ছুটে বেড়াচ্ছে।

.

লিজা লক্ষ করেছে, লক্ষ-কোটি ডলারের লাভ-লোকসান, হাজার হাজার মানুষের জীবন নির্ভর করছে তার বাবার একটা সিদ্ধান্তের ওপর। নানা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানরা ছুটে আসে তার বাবার কাছে নতুন কারখানা খুলতে হবে, পুরোনো কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

-বাবা, এ তো অবিশ্বাস্য! তুমি যেন গোটা দেশের শাসনকর্তা!

 বাবার ঠোঁটে হাসিরফ অ্যান্ড সন্সের আয় পৃথিবীর শতকরা পঁচাত্তর ভাগ দেশের প্রত্যেকটির জাতীয় আয়ের থেকেও বেশি।

রফ অ্যান্ড সন্সের বোর্ড অফ ডাইরেক্টরদের সঙ্গে লিজের পরিচয় হয়েছে।

 রোমে সিমনেস্তা ও ইভো পালাজজি। রফ অ্যান্ড সন্সের ইতালীয় শাখার পরিচালনার দায়িত্বে আছে সুপুরুষ হাসিখুশি ইভো পালাজজি। উন্নতি করেছে যথেষ্ট। খোলামেলা মনের।

 –প্যারীতে আছে হেলেন রফ মারতেইল আর তার স্বামী শার্ল মারতেইল। রফ অ্যান্ড সন্সের প্যারী শাখার দায়িত্বে আছে শার্ল।

 বাবার মুখে শুনেছে, শার্ল কর্মঠ, কিন্তু উদ্যোগী নয়।

লিজের ধারণা, ব্যবসা চালানোর ব্যাপারে স্ত্রী হেলেন তাকে উপদেশ দেয়।

জার্মানিতে আছে অ্যানা রফ ও তার স্বামী ওয়ালথার গ্যাসনার। অ্যানা বেশি কথা বলে না। জীবন সম্পর্কে ভীতি আছে তার। ওয়ালথার সুপুরষ, সুদর্শন। লিজা ভাবে, নিশ্চয়ই ও ওর বউকে খুব ভালোবাসে।

সবথেকে ভালো রফ পরিবারের মেয়ে স্যার অ্যালেক নিকলসের মা। ওর বাবার নাম স্যার জর্জ নিকলস্। অ্যালেক খুব ভালো ও ভদ্র।.ওর একটা নরম মন আছে। লিজাকে–সে উপদেশ দেয়। লিজা তা গ্রহণ করে।

 একবার চূড়ান্ত হতাশায় বাড়ি ছেড়ে পালাবে ঠিক করল লিজা। না, তার আগে অ্যালেকের সঙ্গে কথা বলা দরকার। একঘন্টা ধরে তারা ফোনে কথা বলেছিল। পরিণতি মনে মনে লিজা তার বাবাকে ক্ষমা করে দিল।

 অ্যালেকের বউ ভিভিয়ান। সে সুন্দরী, কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক। গ্লাউসেস্টারশায়ারে ওরা গিয়েছিল উইকএন্ডে পিকনিক করতে। ফিরে এসে ভিভিয়ান তার স্বামীকে বলল–আমি আর পারছি না তোমার ওই দূর সম্পর্কের বোনের দেখাশোনা করতে। আমি বড়োই ক্লান্ত। লন্ডনে একটা এনগেজমেন্ট আছে সেখানে যাচ্ছি।

লিজা শুনেছে সব।

–তুমি এটা বাতিল করতে পারো না! ও তো সারা জীবন এখানে থাকবে না। আর মাত্র একটা দিন। প্লিজ, ভিভ।

-সরি, অ্যালেক। আমার পেষণ চাই, জবরদস্ত পেষণ। ওখানে আজ রাতেই তা পেয়ে যাব।

–যিশুর দোহাই।

অ্যালেক, ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও। আমাকে আমার মতো চলতে দাও।

 এলিজাবেথের আতঙ্কিত মুখ।

ভিভিয়ান বলল–এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? তারপর সে ওপরের ঘরে চলে গেল।

পাইপে অগ্নি সংযোগ করতে করতে অ্যালেক বলল–ভিভিয়ানকে ভুল বুঝো না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক চাহিদা নিয়ে কত ঝামেলা হয়। আমি ওর সঙ্গে পেরে উঠি না। ও বেচারীর কোনো দোষ নেই। আমি জানি, ও অন্য পুরুষকে বিছানায় নিয়ে যায়। তবু ওকে আমি ত্যাগ করতে পারি না। ওকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি!

 সেই মুহূর্তে অ্যালেককে খুব ভালো লাগছিল এলিজাবেথের।

.

কিছুদিন ধরে স্যাম রফ খুব চিন্তিত। কারণ কী?

–ছোট্ট একটা সমস্যা মেটাতে হবে আমাকে। তুমি পরে জানতে পারবে।

লিজা লক্ষ করেছে তার বাবাকে, চিন্তিত ফ্যাকাশে মুখ। রোগা হয়ে গেছে।

বাবা সুইজারল্যান্ডে যাবে পাহাড়ে চড়তে-খবরটা শুনে লিজা সত্যিই খুশি হয়েছিল।

–তোমার রিজারভেশন?

হয়ে গেছে।

এটাও অস্বাভাবিক। পরের দিন বাবা সুইজারল্যান্ডে চলে গেল। আর ফিরে এল না। ওই শেষ দেখা। আর জীবনে–

.

অন্ধকার ঘর। বেডরুমে শুয়ে আছে এলিজাবেথ। অতীতের কত কথাই স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠছে। বাবা মারা গেছে। অবিশ্বাস্য! স্যাম রফের কোনো পুত্রসন্তান নেই। এখন কী হবে?

 তখনই উকিলের চিঠি পায় লিজা

 তোমার বাবার সব সম্পত্তি এবং রফ অ্যান্ড সন্সের বেশির ভাগ শেয়ারের একমাত্র মালিক তুমি। তোমার বাবা সেইভাবেই উইল করে গেছে। স্যাম আশা করেছিল, সে অন্তত আরও পনেরো দিন বাঁচবে। না হলে সে অন্য কাউকে তার জায়গায় কোম্পানির ডাইরেক্টর করে উইল করে যেত হয়তো। বর্তমানে স্যামের পরিবর্তে তুমিই রফ অ্যান্ড সন্সের ডাইরেক্টর। তুমিই এই কোম্পানির প্রথম মহিলা ডাইরেক্টর। শুক্রবার জুরিখে বোর্ড মিটিং আছে। তোমাকে আসতে হবে।

-হ্যাঁ, আমি যাব। এলিজাবেথ মনে মনে বলে।