১. একা এবং অন্ধকার

ব্লাডলাইন (রক্তরেখা) –  সিডনি সেলডন
প্রথম পর্ব

০১.

ইস্তানবুল। শনিবার, ৫ই সেপ্টেম্বর। রাত দশটা।

হাজিব কাফির-এর ডেস্কের পেছনে সে বসেছিল–একা এবং অন্ধকারে। অফিসের জানলায় ধুলো পড়েছে। নগরীর প্রাচীন মিনারগুলির দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। পৃথিবীর বহু দেশ সে ঘুরেছে। তবে ইস্তানবুলের মতো আর কোনো শহরকে সে ভালোবাসতে পারেনি। সাধারণত ট্যুরিস্টরা ইস্তানবুলে আসে, বেইওলগু স্ট্রিটে ঘোরাফেরা করে, হিলটন হোটেলের ঝকঝকে লালেজার বারে যায়। কিন্তু সে সেইসব জায়গায় ভ্রমণ করে যার অবস্থান কেবল মুসলমানরাই জানে। সে যায় ইয়ালিতে, স্যুকের পেছনে সেই ছোটো বাজারে। হয়তো বা ঘুরে বেড়ায় গোরস্থানে, যেখানে তেল্লিবাবার নামে সমাধিস্থল আছে, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে। যেখানে প্রার্থনা জানায়।

সে বসে আছে ধৈর্য সহকারে, ঠিক যেন একটি শিকারি, শিকারের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে আছে। তার দেহ ও মন দুটিই শান্ত। ওয়েলসে তার জন্ম হয়েছে। শ্যামলা সুন্দর চেহারা তার, ঝড়ের মতো গতিময় আচরণ। মাথা ভর্তি কালো চুল। শক্ত ও কঠিন মুখ। ঘন নীল রঙের দুটি চোখ। সেখানে তীক্ষ্ণতা ও বুদ্ধির আভাস খেলা করছে। লম্বায় সে ছ-ফুটের বেশি। সে রোগা, তবে দেহের কোথাও মাংসের অভাব ঘটেনি।

 অফিসময় হাজিব কাফিরের উপস্থিতি ছড়িয়ে রয়েছে। তামাকের মিষ্টি অথচ দুর্গন্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুর্কি কফির চড়া গন্ধ, তার মোটা তৈলাক্ত শরীরের গন্ধও ভাসছে। অথচ সে অর্থাৎ রিস্ উইলিয়ামস এসব গন্ধ-টন্ধ টের পায় না।

 খানিক আগে একটা টেলিফোন পেয়েছে সে শ্যামনিজ থেকে। অ্যাক্সিডেন্টের খবর।

মিঃ উইলিয়ামস, অভাবিতভাবে ঘটনাটা ঘটে গেল। আমরা আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি! মিস্টার রফের মৃত্যু ঘটেছে। নিমেষের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। বিশ্বাস করুন, আমরা ওঁকে সাহায্য করার মতো একটু ফুরসত পেলাম না।

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা রফ অ্যান্ড সন্স। স্যাম রফ ছিলেন ওই সংস্থার প্রেসিডেন্ট। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এই ব্যবসা লাভ করেছেন। পেয়েছেন বহু মিলিয়ন ডলার মূলধন। বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা, অফিস ও কারখানা।

রিস, বিশ্বাস করতে পারছে না যে, স্যাম রফ আর বেঁচে নেই। অথচ রফের মধ্যে প্রাণশক্তির অভাব ছিল না। বিশ্বের নানা দেশে তাকে প্লেনে চেপে যেতে হত। কোম্পানির অফিস এবং ফ্যাক্টরিগুলো ঘুরে দেখতে হত। যে-কোনো সমস্যার চটজলদি সমাধান করতে পারত সে। সে বিবাহিত। একটি সন্তান আছে তার। তবে সংসারের থেকে ব্যবসার প্রতি তার আকর্ষণ বেশী ছিল। এককথায় অসাধারণ ও বুদ্ধিমান পুরুষ ছিল স্যাম। মাত্র বাহান্ন বছরে সে পরপারের যাত্রী হল। এবার এই বিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার কে গ্রহণ করবে?

 হঠাৎ অফিসের আলো জ্বলে উঠল। রিসের চমক ভাঙল। চোখ ঝলসে গেল।

মিস্টার উইলিয়ামস, আপনি! আমি জানতাম না আপনি এখানে আছেন। সোফি, রিস্ উইলিয়ামসের সেক্রেটারি, ইস্তানবুলে এলে সোফিই তার দেখভাল করে। সোফি জাতে তুর্কি। পঁচিশ বছরের সুন্দর, স্লিম ও সেক্সি চেহারা।

সে বহুবার রিসকে তার শয্যাসঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। অবশ্য রিসের যদি আপত্তি না থাকে। রিস এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায় না।

 সে বলল–সোফি, মিস্টার কাফিরের খোঁজ লাগাও। ক্যারাভান সরাই, নতুবা মারমারায় খুঁজে দেখো।

কাফিরের রক্ষিতা জনৈকা বেলি ড্যান্সার থাকে ক্যারাভান সরাইতে। রিস্ ভাবল, ওখানেই তার সন্ধান মিলতে পারে। তবে স্ত্রীর কাছে চলে যাওয়াও কাফিরের পক্ষে বিচিত্র কিছু নয়।

–আমি দেখছি।

–ও যেন এক ঘন্টার মধ্যে অফিসে এসে হাজির হয়। ওকে বলে দিও, নয়তো চাকরি থেকে কাট হতে হবে।

–ঠিক আছে, মিস্টার উইলিয়ামস।

আলো দরকার নেই। নিভিয়ে দাও।

.

অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থেকে চিন্তা করতে ভালোবাসে রিস্। স্যাম ব্লাংকের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা এর আগেও কয়েকবার করেছে। বছরের এই সময় ওখানে ওঠা তেমন শক্ত কাজ নয়। স্যাম নিশ্চয় পারত। যদি না তাকে ঝড়ের কবলে পড়তে হত।

স্যাম বলেছিল, মন্ট ব্ল্যাংকের মাথায় এবার কোম্পানির পতাকা পুঁতে দিয়ে আসবে। হেসে উঠেছিল সে।

একটু আগে আসা ফোনের কথা ভাবল রিস্।

অভিযাত্রীরা হিমবাহের ওপর দিয়ে উঠছিল। হঠাৎ পা ফসকে অতল খাদে পড়ে যান মিস্টার স্যাম রফ।

রিসের চোখের সামনে যেন সেই দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ওঠে–তুষারে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পড়ে যাচ্ছে স্যামের দেহ। গুহার দিকে নেমে যাচ্ছে। রফের শরীর তখন অতলস্পর্শী।

না, এখন মৃত স্যামের কথা ভেবে লাভ নেই। পৃথিবীর এখানে-সেখানে তার পরিবারের লোজনরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের কাছে খবরটা পৌঁছে দেওয়া দরকার। খবরের কাগজে সংবাদটা ছাপাতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চক্রগুলোতে এই খবর শকওয়েভ হয়ে দেখা দেবে। কোম্পানিতে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় স্যামের মৃত্যুসংবাদটা যেন তাদের কাছেও ভয়ঙ্কর না হয়ে ওঠে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে রিকে।

আজ থেকে ন বছর আগে স্যাম রফের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয়। তখন রিস্ পঁচিশ বছরের যুবক। একটা ছোটো ওষুধের ফার্মে সেলস ম্যানেজারের কাজ করত। তার বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী শক্তির বলে কোম্পানির ওষুধ বিক্রি উত্তরোত্তর বেড়ে যায়। রিসের প্রশংসা করে সকলে। ব্যাপারটা স্যাম রফের নজরেও পড়ে। সে রিকে নিজের কোম্পানিতে যোগ দেবার আহ্বান জানায়। কিন্তু রিস্ তাতে রাজি হয় না। তখন স্যাম ওই কোম্পানিটাই  কিনে নেয়। ফলে রিস্ হল স্যামের কোম্পানির কর্মচারী। সেই দিনটার কথা রিস্ জীবনে ভুলতে পারবে না। আর ভুলতে পারবে না স্যাম রফের অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারাটি, যা তাকে প্রথম দর্শনে প্রভাবিত করেছিল।

 স্যাম রফ বলেছিল–আমি চাই না, তুমি একটা ফালতু কোম্পানিতে কাজ করো। তাই এই কোম্পানিটা আমি কিনে নিলাম।

যদি এই চাকরি আমি না করি?

 স্যাম স্মিত হেসে জবাব দিল,–না, সেটা তুমি পারবে না। কারণ তোমার-আমার মধ্যে একটা সাধারণ গুণ আছে। আমরা দুজনেই বড্ড উচ্চাশা পোষণ করি। আমরা পৃথিবীর মালিক হতে চাই। কীভাবে তা হওয়া সম্ভব, সে কৌশল তোমাকে আমি শিখিয়ে দেব।

 স্যাম রফের সেদিনের সেই কথাগুলো রিস্ মোহাবিষ্টের মতো শুনেছিল। কিন্তু সেই আশু তৃপ্তির সম্ভাবনার কথা শুনে সে আত্মহারা হয়নি। নিজেকে আরও বেশি আগ্রাসী করে তুলেছে। রফকে বলতে পারেনি, আসলে রিস্ উইলিয়ামস বলে কেউ নেই–আসলে সে হল তীব্র হতাশা এবং দারিদ্র্য থেকে সৃষ্ট একটা স্বপ্নের প্রতীক।

.

রিসের দেশ ওয়েলস লাইমস্টোন ও কয়লাখনির দেশ। রক্তাভ, ক্ষয়ে যাওয়া উপত্যকার সবুজ মাটিতেই সে জন্ম নিয়েছে। এ হল রূপকথার এক আশ্চর্য দেশ! এখানে প্রত্যেকটা জায়গার নামের সঙ্গে বিখ্যাত সব কবিতার স্মৃতি মিলেমিশে একটা কোলাজ তৈরি করেছে–ব্রেকন, পেনীয়ফ্যান, পেনডারিন, গ্লিনকরগ, মিস্টেগ। দুহাজার আটশো লক্ষ বছর আগের অরণ্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে এখানকার কয়লাখনিগুলো। তখন এই দেশের মানচিত্র এমন ছিল যে, ব্রেকন বীকনস থেকে সমুদ্রে যেতে কাঠবিড়ালিকেও মাটি স্পর্শ করতে হত না। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের যুগে সবুজের ধ্বংস শুরু হল। গাছ কেটে কাঠ সংগৃহীত হল। সেই কাঠে জ্বলবে আগুন। লৌহ ব্যবসায়ের যে লোভ তৃপ্ত হবার নয়, যে লোভর আগুন লেলিহান অনির্বাণ।

একদা ওয়েলসে ঘটেছিল সেই দুঃখজনক ঘটনা। রবার্ট ফ্যারার, যে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিতে রাজি হয়নি। তাই তাকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিচারে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল। দশম শতাব্দীতে আইনের শাসন এনেছিলেন রাজা হাইওয়েন দ্য গুড়। এসেছিলেন বীর যোদ্ধা ব্রাইচেন, যিনি বারোটি পুত্র ও চব্বিশটি কন্যার পিতা হয়েছিলেন। যিনি তার শত্রুদের সঙ্গে জবরদস্ত মোকাবিলা করেছিলেন।

এসব আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। সবই অতীত। কিন্তু বর্তমানের বেদনার জ্বালা অসহনীয়।রিসের বাপ-ঠাকুরদা বংশপরম্পরায় কয়লাখনির শ্রমিক। মাঝে মাঝে কয়লাখনির মালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। খনিগুলোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা দরিদ্রতার শিকার হয়। খাবার জোটে না। তাদের মানবিক অহংকার ও শক্তি বিধ্বস্ত হয়। তারা আত্মসমর্পণ করে। তাদের মৃত্যু ঘটে। কেউ বা কয়লাখনির অন্ধকারে মরে পড়ে থাকে। কেউ বা দিনের পর দিন ফুসফুঁসের অসুখে ভোগে। কাশতে কাশতে একদিন তার মরণ। ঘনিয়ে আসে। বেশির ভাগ কয়লাখনি শ্রমিক তিরিশ বছর আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসে।

 রিস্ শুনেছে খনিশ্রমিকদের দিনপাতের কাহিনী। শুনেছে ধর্মঘটের গল্প। শুনেছে খনি ধ্বসে পড়ে কত শত শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। রিস্ কয়লাখনির শ্রমিক হতে চায়নি। তাই সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। তখন সে মাত্র বারো বছরের এক কিশোর।

 সে চলে এসেছিল সমুদ্র উপকূলে। সেখানে অনেক ট্যুরিস্টদের আসা-যাওয়া ছিল। রিস তাদের কাজ করে দিত। ফাইফরমাস খাটত, মাল ঘাড়ে করে নিয়ে যেত। উঁচু পাহাড় থেকে ধনী মহিলাদের হাত ধরে নামিয়ে দিত। ধনী রমণীদের দেখে তার মনে হত রানি। স্মার্ট ও সুন্দর চেহারার পুরুষদের দেখে তার ইচ্ছা জাগত, ওদের মতো হতে।

দু বছর বাদে রিস্ এল লন্ডনে। পশমি কাপড়ের দোকানে কাজ জুটিয়ে নিল। মাল ডেলিভারি করার কাজ। তার অদ্ভুত ও খাপছাড়া পেপাশাক এবং অপরিশীলিত কথাবার্তা শুনে দোকানের কর্মচারীরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত।

তাদের মধ্যে গ্লাডিস বিমসন নামে একটি মেয়েও ছিল। সে-ও ওই দোকানে কাজ করত।

একদিন গ্লাডিস তাকে তার বাড়িতে চা খাওয়ায় নিমন্ত্রণ জানাল।

জীবনে প্রথম যৌন মিলনের অভিজ্ঞতা লাভের আশায় রিস্ তার গলা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে বাধা পেল।

মেয়েটি বলল–থামো-থামো! আগে জীবনে বড়ো হও, দেখবে সব পাবে। পড়াশোনা করে, ভালো পোশাক পরতে শেখো। ভদ্রসমাজে মিশতে শেখো। তবেই তো জীবনে বড়ো হওয়া যায়।

.

শুরু হল রিসের বড়ো হওয়ার সাধনা। সেদিনের সেই অশিক্ষিত, দরিদ্র, অত্যন্ত সাধারণ ঘরের ছেলেটা কল্পনা শক্তি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর দুরন্ত উচ্চাশাকে পায়ে করে নতুন এক রিকে জন্ম দিতে স্থির সংকল্প হয়ে উঠল। নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াত। একটু একটু করে রিস্ পাল্টে গেল। রোজ রাতে সে স্কুলে যেত। ছুটির দিনে ছবির গ্যালারিতে মাঝে মধ্যে লাইব্রেরি আর থিয়েটার হলে। রোজের খাবারের পয়সা বাঁচিয়ে সে সপ্তাহে একদিন নামিদামি হোটেলে গিয়ে ঢুকত। সুসভ্য মানুষেরা কীভাবে টেবিলে বসে খায়, তা লক্ষ্য করত।

এক বছরের মধ্যেই রিস্ অনেক কিছু শিখে নিল। বুঝতে পারল, গ্লাডিস তাকে ঠিক রাস্তাই দেখিয়েছিল, সেই লন্ডনের সেই অনভিজাত এলাকার সস্তা মেয়েটা!

সে ড্রেসারের দোকানের চাকরিটা ছেড়ে দিল। এল কেমিস্টের দোকানে। তখন তার বয়স মাত্র ষোলো। কিন্তু বয়সের তুলনায় চেহারাটা তার বরাবরই ভারী। আগের চেয়ে লম্বাতেও বেড়েছে। শ্যামলা সুন্দর চেহারার অধিকারী রিস, মেয়েদের সঙ্গে তোষামোদ করে কথা বলার ভঙ্গিটি শিখেছিল খুব যত্ন করে। তাই তার কাউন্টারেই মেয়েদের ভিড় উপচে পড়ত। দু-বছর যেতে না যেতেই রিসের পদোন্নতি হল। সে হল ম্যানেজার। এইভাবে উন্নত জীবনের লক্ষ্যে কিছুটা পথ পেরিয়ে এসেছে সে। তাকে আরও–আরও বড় হতে হবে।

একদিন এক ওষুধের কোম্পানির সেলসম্যান তার দোকানে ঢুকল। তখন রিসের কাউন্টারে মহিলাদের ভিড়। লোকটি দেখল মহিলাদের মধ্যে কতকগুলি অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রির জন্য রিস্ কথার জাল সৃষ্টি করে চলেছে।

লোকটি বলল–তুমি এখানে বাজে সময় খরচ করছ। আমার বসকে তোমার কথা জানাব।

এর পনেরো দিন পরে রিস্ ওষুধের কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি পেল। সেখানে সে ছাড়া আরও পঞ্চাশ জন সেলসম্যান আছে। কিন্তু কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। এখনও সে আয়নায় দেখে, মনে মনে যা কিছু সে কল্পনা করেছে, বাস্তবে তার কতটা ঘটেছে। সে এখন বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, ভদ্র ও আকর্ষণীয় পুরুষে পরিণত হয়েছে। |||||||||| দেশে দেশে ঘুরেছে সে। ওষুধ বিক্রি করেছে। সে কথা শুনেছে। কথা বলেছে। তারপর লন্ডনে ফিরে গেছে। কোম্পানিকে নানা বাস্তবসম্মত ব্যবসার কৌশল বলে দিয়েছে। এতদিনে কোম্পানির পাশাপাশি রিও সাফল্যের চূড়ায় উঠতে শুরু করেছে।

কেটে গেছে আরও তিনটি বছর। রিস্ জেনারেল সেলসম্যানেজারের পদে উন্নীত হল। তার চতুর পরিচালনায় কোম্পানির বিক্রি কয়েক গুণ বেড় গেল।

এর ঠিক চার বছর পর স্যাম রফের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল।

–আমাদের দুজনের মধ্যে একটা সাধারণ মিল আছে। স্যাম বলেছিল, পৃথিবীকে আমরা হাতের মুঠোয় নিতে চাই। কেমনভাবে তা সম্ভব, তোমাকে আমি শিখিয়ে দেব।

স্যাম তার কথার খেলাপ করেনি।

স্যামের সুচতুর পরিচালনায় ন-বছরের মধ্যে রিস্ উইলিয়ামস কোম্পানির অবিচ্ছেদ্য ও বহুমূল্য অংশ হয়ে উঠল। এখন তার ওপর কোম্পানি ভরসা করতে পারে। তার দায়িত্বের সীমানা বেড়ে গেছে। এসব কিছু একদিনে হয়নি। ক্রমশ তাকে বেশি দায়িত্বের কাজ দেওয়া হয়েছে। প্রথমে রফ অ্যান্ড সন্সের বিভিন্ন শাখার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার গুরুভার তার ওপর ন্যস্ত হল। নতুন ভাবে শাখা গড়ে তোলার জন্য রিসূকে সেই স্থানে পাঠানো হত। কোনো শাখায় ঝামেলা দেখা দিলে রিসকে পাঠানো হত সমাধানের জন্য। এমনকি কোম্পানি কী ভাবে চালাতে হয়, তাও স্যাম রফ তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, যা স্যাম রফকে বাদ দিলে সে ছাড়া আর কেউ জানে না।

একদিন সকালে কোম্পানির বোয়িং বিমানে চড়ে তারা ক্যারাকাস থেকে ফিরছিল। সেবার ভেনেজুয়েলা সরকারের লাভজনক একটা টেন্ডারের ব্যাপারে রিস্ অভাবনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

স্যাম তার কাজের প্রশংসা করে বলেছিল–তুমি মোটা অঙ্কের একটা বোনাস পাবে।

 রিস বলেছিল–বোনাস আমার প্রয়োজন নেই স্যাম। আমি কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এর একজন হতে চাই। কোম্পানির কিছু শেয়ার পেতে চাই।

–দুঃখিত রিস্। তুমি তো জানো, রফ পরিবারের বাইরের কেউ এই সংস্থার ডিরেক্টর পদে আসতে পারে না, এটা নিয়ম বহির্ভূত। এমনকি বাইরের কেউ শেয়ার হোল্ডারও হতে পারে না। আমি তোমার কথা রাখতে পারছি না।

 রিস্ জানে, রফ অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট কোম্পানি রফ পরিবারের বাইরের লোককে বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করে না। আজ পর্যন্ত সেই বাইরের লোক হিসেবে অর্থাৎ ব্লাডলাইন অতিক্রম করে বোর্ড মিটিং-এ উপস্থিত থেকেছে।

 এই কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে শেষ পুরুষ হিসেবে স্যামই ছিল। এছাড়া সবাই মহিলা-স্যামের মেয়ে, আর মাসতুতো, খুড়তুতো, মামাতো বোনেরা। তাদের স্বামীরাই এখন ডিরেক্টর পদগুলো অলংকৃত করে আছে। একমাত্র অ্যালেক বাদে।

ওয়ালথার গ্যাসনার, যে অ্যানা রফকে বিয়ে করেছে।

সিমনেস্তা রফের স্বামী ইভো পালাজজি। হেলেন রফ বিয়ে করেছে শার্ল মারতেইলেকে।

আর স্যার অ্যালেক নিকলস, যার মা রফ পরিবারের মেয়ে।

রিস্ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। এ গুণটা সে স্যামের কাছ থেকেই পেয়েছে। সে জানে, একদিন পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। কিন্তু তার আগেই স্যাম মারা গেল।

.

ইতিমধ্যে অফিস আবার আলোকিত হয়ে উঠেছে।

হাজিব কাফির দরজার গোড়ায় এসে পা রেখেছে। কোম্পানির তুরস্ক শাখার সেলসম্যানেজার সে। বেটে ও মোটা চেহারা, আঙুলে হীরের আংটি। তার পোশাক অবিন্যস্ত। খুব সম্ভবত স্যামের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে খুব তাড়াতাড়িতে পোশাক পরেছে সে। হয়তো বা যৌন মিলন অসমাপ্ত রেখে উঠে এসেছে।

–এসো হাজিব। চারটি দেশে কেবল পাঠাতে হবে। কোম্পানির সাংকেতিক কোডে কেবল যাবে আর সেগুলো কোম্পানির পত্রবাহকেরা হাতে হাতে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

মণিবন্ধে বাঁধা সোনার তৈরি ব্যম অ্যান্ড মারসিয়ার রিস্টওয়াচে চোখ বুলিয়ে নিয়ে রিস্ বলল–ন্যু সিটি পোস্ট অফিস এখন খোলা নেই। ইয়েনি পোস্টানে ক্যাড থেকে কেবল পাঠাও। এই নাও কেবলের কপিটা। আধঘন্টার মধ্যে যেন সব পৌঁছে যায়। আর এ ব্যাপারে কেউ বেশি কথা বাড়ালে চাকরি থেকে তাকে খারিজ করে দেওয়া হবে।

–মাই গড! কেবলটা পড়ে হাজিব রিসের দিকে তাকাল, কীভাবে হল?

দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় স্যাম রফের প্রাণ গেছে।

এই মুহূর্তে রিসের চেতনায় দেখা গেল এলিজাবেথ রফকে। এতক্ষণ রিস্ এদিকের ঝামেলায় তার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এলিজাবেথ রফকে সে যখন প্রথম দেখেছিল, তখন সে পনেরো বছরের এক কিশোরী। দাঁত উঁচু বলে ব্রেস লাগিয়ে ঘুরছে। সে এখন বড়ো হয়ে আরও সুন্দরী হয়েছে। মায়ের সৌন্দর্য আর বাবার বুদ্ধিমত্তা, দুটোই সে লাভ করেছে। সে লাজুক, মোটা, নিঃসঙ্গ ও বিদ্রোহিণী। রিসের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক। বাবার মৃত্যুসংবাদে মেয়েটা খুব ভেঙে পড়বে। রিস্ ঠিক করল, সে নিজেই এই দুঃসংবাদটা তাকে দেবে।

 ঘন্টা দুই পরে রিস্ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। তাকে নিয়ে কোম্পানির জেট বিমান তখন উড়ে চলেছে নিউ ইয়র্কের দিকে।

.

০২.

বার্লিন। সোমবার, ৭ই সেপ্টেম্বর, বেলা দশটা।

শোবার ঘরের এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে অ্যানা রফ গ্যাসনার। সে ভয়ে কুঁকড়ে আছে। সে জানে, আর্তচিৎকার করলেই স্বামী ওয়ালথারের হাতে তাকে মরতে হবে। তার সর্বাঙ্গ ভয়ে কাঁপছে। অথচ সুন্দর এক রূপকথার মতো তাদের প্রেম শুরু হয়েছিল। এখন সেই প্রেমের এমন আতঙ্কিত পরিসমাপ্তি তাকে কঠিন সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে–সে উন্মাদ, খুনিকে বিয়ে করেছে।

.

ওয়ালথার গ্যাসনার–অ্যানার প্রথম ও শেষ প্রেম। অ্যানা কাউকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। এমনকি নিজের ওপরেও তার ছিল তীব্র বিতৃষ্ণা। ছোটো থেকেই অসুখে ভুগত। রোগা চেহারা। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাত। তাই তার বেশির ভাগ সময় কেটে গেছে হাসপাতালে, নার্স এবং ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে। তার বাবা আন্তন রফ ছিলেন রফ অ্যান্ড সন্সের অন্যতম অংশীদার। তাই মেয়ের চিকিৎসার জন্য দূরদেশ থেকে প্লেনে করে মেডিক্যাল স্পেশ্যালিস্টরা এসে অ্যানাকে দেখত, ওষুধ দিত, চলে যেত। কিন্তু কেউ অ্যানার অসুখ সারাতে পারেনি।

অ্যানা তাই স্কুলে যেতে পারেনি। সে সর্বদা আপন মনে স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করত। তার ফ্যান্টাসির জগতে অন্য কারো প্রবেশের অধিকার ছিল না। বাস্তবের চড়া রং তার পছন্দ নয়। কল্পনার রঙে সে নিজের জীবনের ছবি আঁকত।

 আঠারো বছর বয়েসে পা দিল অ্যানা। হঠাৎ একদিন সে সুস্থ হয়ে উঠল। তার ফিটের অসুখ সেরে গেল। পঁচিশ বছর বয়স থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আশা শুরু হল। উত্তরাধিকার সূত্রে অ্যানা পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংস্থার অন্যতম মালিক হবে। তাই পাত্রদের ভিড় লেগে গেল। এল সুইডেনের এক কাউন্ট, ইতালির এক কবি। আফ্রো এশিয়ান দেশগুলোর প্রায় সাত জন রাজপুত্র তার পাণিপ্রার্থী হল। কিন্তু অ্যানা রাজি হল না। এতে আন্তন রফ মনে মনে দুঃখ পেল। মেয়ের তিরিশতম জন্মদিনে আন্তন বলল নাতির মুখ দেখা বোধহয় আমার ভাগ্যে নেই।

অ্যানা পঁয়ত্রিশ বছরে পা রেখে অস্ট্রিয়ায় বেড়াতে গেল। বরফের ওপর স্কি খেলতে লাগল। দেখা হল ওয়ালথারের সঙ্গে। ওয়ালথার গ্যাসনার। সে স্কি খেলায় এক্সপার্ট। প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটাতে বরফে ঢাকা পাহাড়ি উতরাই বেয়ে সে নেমে আসছিল। অ্যানা তার থেকে তেরো বছরের বড়ো।

ওদের কথা হল। ওয়ালথার বলল–তুমি স্কি খেলো না! চল আজ আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করব।

অ্যানা ভয় পেয়েছ। স্কুলের মেয়ের মতো লাজুক ভঙ্গিতে সে সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু ওয়ালথার তার পেছু ছাড়েনি।

 অ্যানা সুন্দরী নয়, অ্যানার বুদ্ধি কম, তবে সে বোকা নয়। সে জানে, তার এমন কোনো সম্পদ নেই যার লোভে পুরুষ তার চারপাশে ঘুরঘুর করবে। তবে হ্যাঁ, তার নামের গুরুত্ব আছে। অ্যানার মধ্যে একটা সংবেদনশীল মন আছে, যেখানে সযত্নে রক্ষিত আছে প্রেম, গান, কবিতা। সেই মনের অস্তিত্বের কথা বাইরের কেউ জানে না।

 অ্যানা নিজে সুন্দরী নয় বটে, কিন্তু সে সুন্দরের পুজো করতে জানে। সৌন্দর্যকে শ্রদ্ধা করে, মিউজিয়ামে যায়। অপলক চোখে বিখ্যাত পেইন্টিং ও স্ট্যাচুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওয়ালথার গ্যাসনারকে সে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। এত সুন্দর তার মুখের অবয়ব, যেন স্বর্গ থেকে কোনো দেবদূত নেমে এসেছে পৃথিবীতে! তার সুন্দর সাজানো দাঁত, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, মাথা ভর্তি সোনালি চুল, শ্লেট-ধূসর চোখের মণি, স্কি খেলার পোশাকের নীচে বাইসেপস ও উরুর মাংসপেশির স্বচ্ছন্দ গতি দেখে আনার গোপন অঙ্গ থিরথিরিয়ে ওঠে। অ্যানা অনেকবার চেষ্টা করেছে স্কি খেলার, কিন্তু পারেনি। তুষারের ওপর আছড়ে পড়েছে। ওয়ালথার তাকে তুলে ধরেছে।

এইভাবে পাঁচদিন কেটে গেছে। একদিন ওয়ালথার তার হাতে হাত রেখে বলেছে–অ্যানা, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই।

স্বপ্নের রূপকথার জগৎ থেকে অ্যানা বুঝি বাস্তবে ফিরে এল। সে সুন্দরী নয়। পঁয়ত্রিশ বছরের কুমারী যুবতী। তার দিকে এগিয়ে আসে সেইসব পুরুষেরা, যারা বড়োলোক হতে চায়।

অ্যানা ওয়ালথারকে এড়িয়ে যেতে গিয়ে বাধা পড়ল। ওয়ালথার তার হাত চেপে ধরে বলল–তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি অ্যানা। তুমিই আমার প্রথম ভালোবাসা!

ওয়ালথার বলতে থাকে তার জীবনের গল্পকথা। সে এক জারজ সন্তান। অনাথ আশ্রমে তার শৈশব কেটেছে। তেরো বছর বয়েস থেকে অরফানেজের মেয়েরা তাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেত। তাকে কাজে লাগাত। আনন্দ দিতে শেখাতো। বিনিময়ে সে পেত কেক বা মাংসের টুকরো। ভালোবাসা পায়নি। বড়ো হয়ে কিন্তু সে অনাথালয় থেকে চলে এসেছে। তার সুন্দর চেহারা দেখে মেয়েরা মুগ্ধ হয়েছে। তাকে ডেকেছে, তার সঙ্গ নিয়েছে। তার সঙ্গে যৌন মিলন ঘটিয়েছে। সে হাত ভরে পেয়েছে জুয়েলারি দ্রব্য, পোশাক–আরো কতরকমের উপহার! কিন্তু প্রেম? প্রেম তারা তাকে দিতে পারেনি।

অ্যানা ওয়ালথারের রূপকথা শুনেছিল, বিশ্বাসও করেছিল।

 তার মনে হল, ওয়ালথার বুঝি তার হৃদয়ের সম্রাট।

শেষ পর্যন্ত টাউনহলে ছোট্ট একটি পার্টি দেওয়া হল। ওদের বিয়ে হল।

.

বাড়িটা আমার ভালো লেগেছে।

 দেওয়ালের পুরোনো পেইন্টিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে ওয়ালথার বলেছে।

-হ্যাঁ, অনাথ আশ্রম থেকে ভালো। আন্তন রফ বলেছে।

–কিছু বলছেন?

–তুমি ভুল করেছ। আমার মেয়ের অর্থ নেই। রফ অ্যান্ড সন্সের শেয়ারহোল্ডার হলে কী হবে, তা বিক্রি করা যায় না। আমরা স্বচ্ছন্দে থাকি। এছাড়া আর কিছু নয়। তোমাকে কুড়ি হাজার মার্ক দিতে পারি। এটা নিয়ে বার্লিন ছেড়ে চলে যাও। কাল সকাল ছটার পর তোমাকে যেন আর না দেখি। কথা দাও, অ্যানার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না।

–আপনি সম্ভবত ভুল বলছেন। অ্যানাকে আমি সত্যি সত্যি ভালোবেসেছি।

না, কথাটা তুমি ঠিক বলছ না।

.

সেদিন সন্ধ্যায় আন্তন রফ বাড়ি ফিরতেই অ্যানা ছুটে এল। তার চোখে জল।

আন্তন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–শান্ত হও অ্যানা, সব ঠিক হয়ে যাবে।

 আন্তন দরজার দিকে তাকাল–ওয়ালথার দাঁড়িয়ে আছে।

–ওয়ালথার আমাকে কী সুন্দর আংটি দিয়েছে দেখো বাবা! অ্যানা বলতে থাকে এটার দাম কুড়ি হাজার মার্ক!

.

 এরপরে আন্তন আর অরাজী থাকতে পারল না। তারা ওয়ালথারকে জামাই হিসেবে মেনে নিল। নবদম্পতির ঘরদোর সাজিয়ে দিল ফরাসি আসবাবপত্রে, কৌচে, ইজিচেয়ারে। বিয়ের যৌতুক হিসেবে দেওয়া হল ডেনমার্ক ও সুইডেনের অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্যের * নিদর্শন সমেত সুন্দর একটা বাড়ি।

–অ্যানা, আমি তোমার কাছ থেকে কোনো উপহার নিতে চাই না। কিন্তু আমি চাই, তোমাকে সুন্দর সুন্দর উপহার দিতে। কিন্তু অ্যানা, আমার তো অত টাকা নেই।

ওয়ালথার, কেন মন খারাপ করছ? আমার যা কিছু, সবই তো তোমার। আমার ট্রাস্ট ফান্ডে যা টাকা আছে, তাতে আমাদের দিব্যি সুখে কেটে যাবে। কিন্তু ডিরেক্টররা সম্মতি দিলে তবেই আমি শেয়ার বিক্রি করতে পারি, নতুবা নয়।

–ওগুলোর দাম কত?

 ওয়ালথারের প্রশ্নে অ্যানা সেই অবিশ্বাস্য অঙ্কটা বলল, একবার নয়–দুবার।

–কিন্তু বিক্রি করা যাবে না কেন?

–না, মানে, আমার দূর সম্পর্কের ভাই স্যাম এই ধরনের নিয়ম জারি রেখেছে। হয়তো একদিন… 

ওয়ালথার রফ অ্যান্ড সন্স-এ যোগ দিতে চাইল। আন্তন রাজি হল না।

-তুমি স্কি খেলার এক্সপার্ট, ব্যবসার কী বুঝবে?

 কিন্তু মেয়ে অ্যানা নাছোড়বান্দা। শেষপর্যন্ত কোম্পানির অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে একটা পদ ওয়ালথারকে দেওয়া হল। সে খুব দ্রুত উন্নতি করতে থাকল। কেটে গেল দশটি বছর। আন্তনের মৃত্যু হল। ওয়ালথার হল বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্ এর এক জন। স্বামীর কাজকর্মে অ্যানা খুব খুশি। ওকে নিয়ে গর্ববোধ করে সে। স্বামী ও প্রেমিক হিসেবে ওয়ালথার আদর্শ। অ্যানার জন্য সে প্রায়সই ফুল আনে। ছোটো ছোটো উপহার আনে। সন্ধ্যেটা তারা বাড়িতেই কাটায়।

অ্যানার জীবনে সুখ উপচে পড়েছে। সুখ তার প্রতিটি অঙ্গকে সিক্ত করছে। ওয়ালথারের পছন্দ মতো রান্না করে সে।

 বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি তুমি! ওয়ালথার প্রশংসা করে।

অ্যানা লজ্জায় আর অহংকারে রক্তিম হয়ে ওঠে।

বিয়ের পর দু-বছর কেটে গেল। অ্যানা গর্ভবতী হল। তার মনে তখন অদ্ভুত শিহরণ।

দেখতে দেখতে আট মাস কেটে গেছে। ভাবী সন্তানের মুখ চেয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে সে। ইতিমধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।

একদিন দুপুরবেলা, লাঞ্চের পর অ্যানা সোয়েটার বুনছে–ওয়ালথারের জন্য। বুনছিল, ভাবছিল, দিবাস্বপ্ন দেখছিল।

কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। ওয়ালথারের গলার স্বরে তার চমক ভাঙে। সোয়েটার একটুও বোনা হয়নি।

মাঝে মাঝেই অ্যানা ভাবনার জগতে চলে যেত। সে ভাবল, এসব আসন্ন মৃত্যুর অশুভ ইঙ্গিত। মৃত্যুকে সে ভয় পায় না। কিন্তু ওয়ালথারকে ছেড়ে যাওয়া…

অ্যানার বাচ্চা হতে আর মাত্র এক মাস বাকি। একদিন দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল অ্যানা।

জ্ঞান ফিরল যখন, তখন সে হাসপাতালে।

ওয়ালথার তার হাত চেপে ধরেছে–তুমি যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল অ্যানা!

–আমার বাচ্চা?

ডাক্তার বলল–যমজ, মিসেস গ্যাসনার।

–একটা ছেলে, একটা মেয়ে, ওয়ালথার বলল।

অ্যানা তখন সুখসাগরে ভাসছে–ওঃ, কবে যে ওদের দেখব, কোলে নেব, আদর করব!

 ডাক্তার বলল–আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন।

.

হাসপাতাল থেকে ফিরে অ্যানা বাচ্চাদের খোঁজ করল।

–আমি বাচ্চাদের কাছে যাব।

না, ডার্লিং, তুমি এখনও অসুস্থ।

অ্যানা নার্সারির দিকে ছুটে গেল। জানালা বন্ধ। ওয়ালথার তাকে কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করল।

অ্যানা দেখল, দোলনায় দুটি শিশু শুয়ে আছে। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। ছেলেটির মাথায় সোনালি চুল, ঠিক যেন ছোট্ট ওয়ালথার। আর মেয়েটি? সুন্দর সোনালি নরম চুলের একটা পুতুল বুঝি!

কত সুন্দর আমার বাচ্চারা! আমার সুখের অন্ত নেই!

চলো অ্যানা। ওয়ালথার অ্যানাকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যায়। তার আলিঙ্গনে শরীরে কামনার ছোঁয়া। অ্যানা ভাবে, ওয়ালথার ঠিকই বলেছে, বাচ্চাদের দেখার অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু এই মুহূর্ত আর ফিরে আসবে না। কতদিন তারা শরীরে শরীর মেলায়নি। সেই মুহূর্তে অ্যানা আর কিছু ভাবতে পারে না।

ছেলের নাম দেওয়া হল পিটার আর মেয়ে বারজিত্তা। অ্যানা সারাক্ষণ কাটিয়ে দেয় বাচ্চাদের সঙ্গে। তাদের অপরূপ সৃষ্টির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ওদের সাথে কথা বলে, খেলা করে। বাচ্চারা কথা বলতে পারে না। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা ওরা ঠিক বুঝতে পারে। এইভাবে সারাদিন কেটে যায়। ওয়ালথার ফিরে এলে সে বলে–এসো, আমাদের সঙ্গে খেলবে এসো।

ওয়ালথার কথা ঘোরায়।

রান্নাবান্না করেছ? খাবার তৈরি?

ইস্, রান্না করার কথা অ্যানা ভুলেই গেছে! নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। না, গ্যাসনারের দিকে ওর নজর দেওয়া উচিত। বাচ্চাদের নিয়ে এত বেশি মাতামাতি আর সে করবে না।

কিন্তু পরের দিনও একই রকম। ওয়ালথার মাঝরাতে নার্সারিতে গিয়ে ঢোকে।

-তুমি এখানে কী করছ অ্যানা?

 –কিছু নয়।

যাও, নিজের বিছানায় চলে যাও।

ওয়ালথারের কঠিন কণ্ঠস্বর এই প্রথম শুনল অ্যানা।

সকাল হল।

 ওয়ালথার বলল–আমরা ছুটিতে বেড়াতে যাব।

–এত ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে…

–ওরা নয়, শুধু তুমি আর আমি।

ওদের ফেলে রেখে আমি কোথাও যাব না।

 –অ্যানা, ওদের কথা তোমায় ভুলতে হবে।

 –কেন?

 –তুমি আমাদের সেই যুগলবন্দি দিনগুলির কথা মনে করো। কী সুন্দর আমরা দুজন

 ও, ওয়ালথার বাচ্চাদের হিংসে করে, অ্যানা ভাবে।

.

বছর কেটে গেল। ওয়ালথার কখনোই বাচ্চাদের কাছে যায় না। ওদের জন্মদিনে ওয়ালথার কাজের অজুহাতে বাইরে কাটায়। অবশ্য অ্যানা ওদের নানারকম উপহার কিনে দেয়। বাচ্চাদের প্রতি অ্যানার টান বেশি, তাই বোধহয় ওয়ালথার তাদের এড়িয়ে চলে।

ওয়ালথার ডাক্তার ডাকে। অ্যানা নাকি অবসাদে ভুগছে। অ্যানা দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে। ডাক্তার পরে আসবে বলে বিদায় নেয়।

ওয়ালথার বাচ্চাদের সম্পর্কে কোনো কথা শুনতে চায় না। অ্যানা বলেও না।

ইতিমধ্যে তিন বছর কেটে গেছে। পিটার ঠিক তার বাবার মতো দেখতে হয়েছে। অ্যাথলিটের মতো পেটানো চেহারা। রাগী, মাঝে মধ্যে সেজন্য মার খায়। বড়ো হলে মেয়েরা ওর চীনে মাটির মতো শরীরের ওপর হামলে পড়বে। আর বারজিত্তাও ভারি সুন্দর দেখতে হয়েছে!

ওয়ালথারের অনুপস্থিতিতে অ্যানা বচ্চাদের সঙ্গে খেলা করে, গান শোনায়, গল্প বলে। ঘুমপাড়ানি সুর তোলে।

ওয়ালথার বাচ্চাদের দুচোখে দেখতে পারে না। বাবা ঠিকই বলেছিল, ও টাকার লোভে তাকে বিয়ে করেছে। ওয়ালথার ওই পথের কাঁটা দুটোকে সরাতে চাইছে, কিন্তু কীভাবে?

–অ্যানা, ওয়ালথার বলল, স্যামের নিয়ম আমরা মানব না। শেয়ার বিক্রি করে ওই টাকা নিয়ে আমরা অন্য কোথাও চলে যাব।

–আর ছেলেমেয়েরা?

ওদের সরিয়ে দেব। আমাদের দুজনের মাঝখানে ওরা কখনোই থাকবে না।

 ওয়ালথার নিশ্চয়ই পাগল। অ্যানা ভয়ে আঁতকে ওঠে। বাড়িতে কোনো কাজের লোক রাখেনি ওয়ালথার। সপ্তাহে একদিন একটা ঝাড়ুদারনি আসে। অ্যানা ভাবে, ওয়ালথারের মাথার চিকিৎসা করা দরকার। পঞ্চদশ শতাব্দীতে পাগলদের শিপ অফ ফুলস নামে হাউসবোটে বন্দি করে রাখা হত। আধুনিক চিকিৎসা উন্নত। ওয়ালথার নিশ্চয়ই সুস্থ হবে।

.

এবং আজ-৭ই সেপ্টেম্বর। অ্যানা ঘাপটি মেরে বসে আছে। ওয়ালথার নেই। দরজা বন্ধ বাইরে থেকে। এবং অ্যানা একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে।

রিসিভার তুলে নিল অ্যানা। ডায়াল করল, পুলিশ এমারজেন্সি নম্বর ১১০।

-হ্যালো, পুলিশ স্টেশন। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?

 –হ্যাঁ, মানে… ।

হঠাৎ ওপর থেকে একটা হাত ঝপ করে নেমে এল। রিসিভার কেড়ে নিল।

–ওয়ালথার, দয়া করে আমাকে মেরো না।

ওয়ালথারের চোখ দুটো জ্বলছে, কিন্তু নরম কণ্ঠ–ডার্লিং, আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমাকে মারতে আমি চাই না। আবার পুলিশ আসুক আমি তাও চাই না। আসলে বাচ্চারাই ঝামেলা পাকাচ্ছে। ওদের আমি বাঁচিয়ে রাখব না।

হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শোনা যায়।

ওয়ালথার বেরিয়ে গেল। আবার বাইরে থেকে তালা দিল। অ্যানা বেডরুমের ভেতরে পাথরের মতো বসে থাকে।

পিওন একটা খাম এগিয়ে দিল–মিস্টার ও মিসেস গ্যাসনারের জন্য।

–দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গিয়ে স্যাম রফ মারা গেছে। জুরিখে আগামী বোর্ড অফ ডাইরেক্টরসূদের মিটিং-এ উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।রিস্ উইলিয়ামস।

.

০৩.

রোম। ৭ই সেপ্টেম্বর, সোমবার, সন্ধ্যা ৬ টা।

ইভো পালাজজি। বেডরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। সে চিৎকার করছে।

–আমার এ কি সর্বনাশ হল!

 –এখনই সর্বনাশের কী দেখলে? দোনাতেল্লার চিৎকার।

ভায়া মঁতেমিগ্যাঁও-র ফ্ল্যাট। মস্ত বড়ো বেডরুম। নারী-পুরুষ দুজনেই উলঙ্গ।

দোনাতেল্লা সেক্সি, কামনা জাগানো রমণী, ইভো পালাজজি এমন শরীর আগে কখনও দেখেনি।

যদিও দোনাতেল্লা তাকে এইমাত্র আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে, তবু এখনও নিজের পুরুষাঙ্গে কামনার পরিচিত জাগরণ ইভো যেন টের পাচ্ছে।

 যুবতী নিঃসন্দেহে সুন্দরী, দোনাতেল্লার নগ্ন শরীর ইভোর প্রতিটি আকাঙ্খী স্নায়ুতে উন্মাদ কামনা জাগায়। অথচ সে যেন বাঘিনীর মুখ, গালের হাড় উঁচু, বাঁকা চোখ, ভরাট দুটো ঠোঁট–যে ঠোঁট দুটো চুমু খেতো, শুষে নিতে তার পুরুষাঙ্গের…না, এসব ভাবার অবকাশ নেই।

সে চট করে চেয়ার থেকে একটা কাপড় তুলে নিল। খানিকক্ষণ পর খেয়াল হল নিজের শার্টটাই সে রক্তাক্ত মুখের ওপর চেপে ধরেছে।

ল্যাংটো দোনাতেল্লা তখন গলা ফাটাচ্ছেমরে যা, তুই নিপাত যা! বেশ্যাবাজ পুরুষ কোথাকার। আমি যখন তোকে ছেড়ে দেব, আর কোনো বেশ্যা আসবে না তোর সঙ্গে ইয়ে করতে।

ইভো অনেক ভেবেছে। কী করে ওই নোংরা বিশ্রি ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। সে ফুর্তিবাজ, বেপরোয়া। ইতালির পুরুষেরা তাকে হিংসে করত। মেয়েমানুষের সঙ্গে ফুর্তি করাকে সে সম্মানজনক মহৎ কাজ বলে মনে করে। এটাই তার জীবনদর্শন। তাই তাকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হত। সুন্দরী মেয়েরা তাকে ঘিরে থাকত। পুরোনো প্রেমকে সরিয়ে রেখে সে নতুন প্রেমের সন্ধানে ছুটে যেত। বলা ভালো, নতুন প্রেম তাকে পুরোনো সহবাসের কথা ভুলিয়ে দিত।

তার তালিকায় ভায়া অ্যাপপিয়ার সাধারণ বেশ্যা থেকে কনদোত্তির হাইফ্যাশন মডেল কেউ বাদ নেই।

কিন্তু আমেরিকান মেয়ে না, ওরা বড্ড বেশী স্বাধীন। তাছাড়া ওদের ভাষা বড্ড নীরস। যেমন গিসেপে ভারদিকে ওরা বলে জো গ্রীন। ওদের কাছে কিছু পাওয়ার আশা করা যায় না।

সাধারণত এক ডজন মেয়েকে ইভো একসঙ্গে নাচায়। সে ধাপে ধাপে প্রেমের শেষ পর্যায়ে পৌঁছোয়।

প্রথম ধাপে সে মেয়েটির সঙ্গে আলাপ জমায়। ফুল পাঠায়, ফোন করে, কামনা জাগানো কবিতার পাতলা বই উপহার দেয়। এইভাবে দুটো ধাপ উঠে আসে। গয়নাকাপড় উপহার দেয়। ডিনার খাওয়ায়। এরপরে আসে সেই আকাঙ্ক্ষিত ধাপটি। মেয়েটির সঙ্গে সে মিলনে প্রবৃত্ত হয়।

 এই মুহূর্তটি ইভোর কাছে চলচ্চিত্রের ছবির মতো। ওইদিন তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে মেয়েটির পছন্দ মতো মিউজিক বাজানো হয়। নয়তো অপেরার আয়োজন হয়। মেয়েটির পছন্দ মতো খাবার ইতভা নিজে হাতে রান্না করে। ডিনারের পর বিছানায় শুয়ে উলঙ্গ নারী-পুরুষ শ্যাম্পেন খাবে, এমন ব্যবস্থাও রাখে। প্রেমের এই চতুর্থ স্তরটি ইভোর খুব। পছন্দের।

এরপরে আসে পঞ্চম ধাপ। মেয়েটিকে বিদায় জানাতে হবে। ভালো ভালো উপহার তার হাতে তুলে দিতে হয়। হৃদয়বিদারক বক্তৃতা শোনাতে হয়। কান্নাকাটি করতে হয়।

.

কিন্তু এসব পুরোনো কথা। আয়নায় নিজের মুখ দেখল ইভা। রক্তাক্ত, আঁচড়ানো, কামড়ানো। নিজেকে দেখে নিজেরই ভয় হয় তার।

–ডার্লিং, দেখো কী হাল করেছ?

জড়িয়ে ধরতে গিয়ে বাধা পায় ইভো। তার পিঠে দোনাতেল্লার নখ বুনো জন্তুর মতো আঁচড় দেয়। ইভো যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে।

–নে, কত চেঁচাবি, চেঁচা। দোনাতেল্লার তীক্ষ্ণ গলা। একটা ছুরি হাতের সামনে পেলে তোর ওটা কেটে মুখে ঢুকিয়ে দিতাম। আর চেঁচাতে পারতিস না।

–কী হচ্ছে? আস্তে বলো। বাচ্চারা শুনতে পাবে।

বাচ্চারা শুনুক। তাদের জানা দরকার, তাদের বাবা নরকের একটা কীট।

 –তুমি আমার বাচ্চাদের মা। তোমার মুখের এমন নোংরা কথা?

 –ও, নোংরা কথা শুনতে ভালো লাগছে না! তাহলে আমি যা চাইছি, তাই দে।

দশ লাখ টাকা চাইলেই তো পাওয়া যায় না। সময় লাগে জোগাড় করতে। আমি দেখছি কী করা যায়। ইভোর জামা রক্তে ভিজে গেছে।

দোনাতেল্লা বাঁদরের মত লাফাচ্ছে…সেই ছন্দে দুলছে তার বৃহৎ স্তনদুটো।

সত্যি কী রমণীয়! এ মেয়ের তুলনা হয় না!

অথচ আয়নায় দেখতে পাচ্ছে ইভো। রক্তাক্ত মুখে দোনাতেল্লার নখের আঁচড়।

–হে ঈশ্বর, একে কী করে বোঝাই! ইভোর গলায় আক্ষেপ।

 রফ পরিবারের ইতালিয়ান শাখার একমাত্র উত্তরাধিকারী সিমনেত্তা রফ, ইভ পালাজজি তার স্বামী।

ইভো তখন যুবক এক স্থপতি। সিমনেত্তার সঙ্গে প্রথম আলাপ থেকেই ওরা গভীরভাবে মেলামেশা করল। প্রথম রাতেই প্রেমের চতুর্থ ধাপে পৌঁছে গেল ওরা। বিয়ে হল। ইভো স্থপতির চাকরি ছেড়ে দিল। যোগ দিল রফ অ্যান্ড সন্স-এ।

 রোমের যে এলাকাটা হতভাগ্য মুসোলিনি অনেক আশা নিয়ে গড়ে তুলেছিল, সেখানেই ওদের কোম্পানির অফিস।

 ইভা বুদ্ধিমান। তাকে সবাই পছন্দ করে। সে সবসময় খুশমেজাজে থাকে। বন্ধুরা তার এই স্বভাবেঈর্ষান্বিত হয়। এজন্যই সে সহজে সফলতা লাভ করে। কিন্তু সে যে আবেগপ্রবণ, একটুতেই চটে যায়, মানুষ খুন করা তার কাছে কোনো ব্যাপার নয়–তার চেহারার এই কুৎসিত রূপটা সে কারো কাছে প্রকাশ করে না।

 বেশ সুখেই তাদের দাম্পত্য জীবন কাটছিল। ইভোর মনে আশঙ্কা ছিল, স্ত্রীর বাহুবন্ধনে ধরা পড়ে হয়তো বা তার পৌরুষের অপমৃত্যু ঘটবে। কিন্তু সেসব কিছু হল না।

সিমনেত্তার বাবা মেয়ে-জামাইকে একটা বাড়ি উপহার দিয়েছিল। রোমের পঁচিশ মাইল উত্তরে প্রাচীর ঘেরা বিরাট প্রাসাদ। দরজায় ইউনিফর্ম পরা প্রহরী।

সিমনেস্তা ঘরনী হিসেবে দারুণ। স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করে ঠিক ঠিক। কিন্তু কোনো কারণে রেগে গেলে আর রক্ষে নেই।

একবার সিমনো তার স্বামীকে সন্দেহ করল, ইভো নাকি ফার্মের মাল কিনতে যাওয়ার অজুহাতে এক মহিলার সঙ্গে ব্রাজিলে গেছে।

ইভো জানাল, অভিযোগটা মিথ্যে। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। ভাঙচুর, ঘর তছনছ। একটা পেয়ালা পিরিচ পর্যন্ত গোটা রইল না। আসবাবগুলো অভ্রান্ত লক্ষ্যে এসে পড়ল ইভোর মাথায়।

সিমনেত্তা মাংস কাটার ছুরি হাতে তেড়ে এল–তোমাকে খুন করে ফেলব, তারপর নিজেকে।

কোনোরকমে সে যাত্রা ইভো বউকে সামাল দিল। মারামারি করতে করতে দুজনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ইভো বউয়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে দিল। সিমনেত্তা তখন উদোম উলঙ্গ। ওরা সব রাগ দ্বেষ ভুলে গিয়ে শরীরের খেলায় মেতে উঠল।

এরপর থেকে ইভো খুব সতর্ক হয়ে গেল। গার্লফ্রেন্ডকে জানিয়ে দিল, তাকে নিয়ে আর কখনও বাইরে বেড়াতে যাবে না। বউ সন্দেহ করবে, নিজের কাজে এমন কোনো ফাঁক রাখে না সে।

 সিমনেত্তা যুবতী। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং ধনী। তাদের দুজনের পছন্দও এক। তারা এমনিতে সুখী দম্পতি। অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন ইভো ভাবে বউয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করাটা ত্যাগ করতে হবে। কথাটা মনে পড়লে দার্শনিকের মতো কাঁধ ঝাঁকায়–এই সব রমণীদের সুখ দেওয়ার জন্যও তো পুরুষকে চাই।

তিন বছর কেটে গেছে। ব্যবসার ব্যাপারে ইভো সিসিলিতে এল। দেখা হল দোনাতেল্লা স্পলিনির সঙ্গে। ইভোর চোখে সিমনেস্তা যেন মানজু-র তৈরি স্লিম ও মিষ্টি মেয়ের যুবতী শরীর। আর দোনাতেল্লা চিত্রকর ব্যুরেনস-এর আঁকা ছবি, ভরাট সেক্স তার। ইভো সেই কামনার আগুনে জ্বলে ওঠে।

প্রথম পরিচয়ের পরের দিনই ওরা বিছানায় গেছে। ইভোর নিজের পৌরুষের ওপর দারুণ আস্থা ছিল। কিন্তু বিছানায় দেখা গেল, দোনাতেল্লা শিক্ষয়িত্ৰী আর ইভো তার ছাত্র। কামনার চূড়ায় ইভোকে তুলে দিয়ে এমন সব খেলা করে যা ইভো কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। প্রেমের, সেইসব অনুভূতি উপভোগ করতে করতে ইভো ভাবে, দোনাতেল্লাকে ছেড়ে যাওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা।

দোনাতেল্লা হল ইভোর রক্ষিতা। স্ত্রী ও রক্ষিতা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে বিছানা ভাগ করতে পারবে না ইভো–এমনই শর্ত ছিল তার। ইভো সে শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। দু-দুটো কামনাতুর মেয়েকে সে ভোগ করছে। ক্লান্তি নেই এতটুকু। দোনাতেল্লার সঙ্গে শুলে ভাবে সিমনেত্তার কথা। ওর মিষ্টি সেক্সি শরীরের কথা ভেবে ইভোর শরীরে কামনা জাগে। আবার সিমনেত্তার সঙ্গে যখন সে মিলিত হয় তখন দোনাতেল্লার উদ্ধত দুটি স্তন ও স্ত্রী অঙ্গ তাকে বুনো জানোয়ার করে তোলে। একজনকে ভোগ করলে অন্যজনকে সে যেন কাছে পায়। এই ব্যাপারটা ইভোর খুব ভালো লাগে।

ইভো দোনাতেল্লাকে একটা সুন্দর ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছে। অবসর সময়ে সে সেখানে চলে যায়। ট্যুরে যাবার নাম করে, অফিসে যাওয়ার পথে বা কাজে ফাঁকি দিয়ে সে দোনাতেল্লার সঙ্গে মিলিত হয়।

 সমুদ্র যাত্রার সেই পাঁচটা দিন ইভাকে দারুণ সুখ দিয়েছিল। জাহাজে করে স্ত্রীকে নিয়ে ইভো ইয়র্ক যাচ্ছিল। সেবার নীচের তলার কেবিনে সে তার রক্ষিতাকে রেখেছিল।

.

 সন্ধ্যাবেলা। ইভ শুনল, সিমনেত্তা গর্ভবতী। এর এক সপ্তাহ পরে দোনাতেল্লা জানাল, তার বাচ্চা হবে। আনন্দের সাগরে ভেসেছে ইভো। সে মাঝে মাঝে কাম দেবতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়–কেন তোমরা আমার প্রতি এত সদয় হয়ে উঠেছ?

যথাসময়ে সিমনেত্তা একটি মেয়ে উপহার দিল ইভোকে আর দোনাতেল্লা একটি ছেলে। দেবতাদের দয়ার সীমা নেই। কয়েক মাস কেটে গেল। ওরা আবার গর্ভবতী হল। ন-মাস পরে দোনাতেল্লার আবার একটি ছেলে আর সিমনেত্তার একটি মেয়ে হল।

চারমাস পরে আবার দুজনে একই সঙ্গে গর্ভবতী হল। এবার একই দিনে দুজনের বাচ্চা হল। সিমনেত্তা রয়েছে সালভাতোর মানজিতে আর দোনাতেল্লা সান্তা সিয়ারা ক্লিনিকে। ইভোকে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। একবার সালভাতোর পরক্ষণেই সান্তা সিয়ারা।

র‍্যাকোর্দো অ্যানুলায় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বেশ্যাদের দিকে হাত নাড়ে ইভো। অবশ্য তাদের দেখার মতো ফুরসত পায় না। তবুও, ওদের সে ভালোবেসে ফেলেছে।

এবারেও সিমনেত্তা মেয়ে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরল। আর দোনাতেল্লা ছেলে। ইভো ভাবল, ছেলেগুলো যদি সিমনেত্তার হত, তাহলে তারা আইনগতভাবে বাবার পরিচয় লাভ করত। অবশ্য এর জন্য ইভোর সুখে কোনো ভাটা পড়ে না। ওদের জন্মদিন, যে সন্তের কাছে ওদের উৎসর্গ করা হয়েছে, তার নামে চিহ্নিত। ইভ কিছু ভোলে না। সে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে। ছেলেদের নাম ফ্রানসেসকো, কালো ও লুকা। আর মেয়েরা হল ইসাবেল্লা, বেনেদেত্তা ও ক্যামিল্লা।

ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে বড়ো হয়। ইভোর দায়িত্ব এখন বেড়ে গেছে। দু-দুটো সংসার সামলায়। ভায়া কার্সিয়ায় সন্ত দোমিনিকের কনভেন্টে সে মেয়েদের ভর্তি করে দিল। ছেলেরা তার থেকে অনেক দূরের স্কুলে ম্যাসিমোর জেসুইট স্কুলে। বউ, রক্ষিতা, ছটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ইভোর সংসার। সে এলেমদার বটে! আদর্শ স্বামী, প্রেমিক ও পিতা। বউ ও মেয়েদের সঙ্গে সে এক্সমাসের দিনটা কাটায়। বাইরে যায় না। ছেলেদের জন্য সে রেখেছে বেফানা উৎসবের দিনটা অর্থাৎ ৬ই জানুয়ারি। সে সেদিন ছেলেদের হাতে ব্ল্যাক রক ক্যান্ডি উপহার তুলে দেয়।

সুন্দরী বউ আর রক্ষিতা, মিষ্টি হাসিখুশি আর চালাক ছেলেমেয়ে নিয়ে গর্ববোধ করে ইভো।

কিন্তু…

কিন্তু একদিন সেই সুখের জীবনে আগুন লাগল।

ইভো

যেমন কোনো বড়ো দুর্ঘটনা হয়, সাবধান হওয়ার সামান্যতম সুযোগও পাওয়া যায়নি।

ব্রেকফাস্ট খাওয়া শুরুর আগে সিমনেত্তার শরীর নিয়ে খেলেছে ইভো। তারপর অফিসে গেছে। সিমনেত্তার হুকুমে অফিসে পুরুষ সেক্রেটারি রাখতে হয়েছে। ইভো তাকে জানাল, বিকেলে সে অফিসে থাকবে না।

খুশমেজাজে পথ হাঁটছে ইভো। বিকেলটা কীভাবে কাটাবে, তাই ভাবছে। লুনগো তেভেরের রাস্তা দিয়ে চলেছে সে। গত সতেরো বছর ধরে এখানে নির্মাণের কাজ চলছে। করসো ফ্রসিয়ার মতেমিগাও সেতু পেরোল সে। সেখান থেকে ভিয়ার গ্যারেজে পা রাখল ঠিক তিরিশ মিনিট পর।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই ভুরু কোঁচকাল ইভো। কী হয়েছে? দোনাতেল্লাকে ঘিরে। তিন ছেলে বসে আছে কেন?

ইভো সামনে এসে দাঁড়াল। দোনাতেল্লা মুখ তুলে তাকাল। সেখানে ঘেন্নার বীভৎস ছবি। ইভো কি তবে ভুল ঘরে ঢুকে পড়েছে!

কী হয়েছে? তোমরা এমন করছ কেন?

 দোনাতেল্লা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুঁড়ে দিল ওরজি ম্যাগাজিনের কপি–দেখো, তোমার কীর্তি।

ইভো ম্যাগাজিনটা হাতে তুলে নিল। চোখ রাখল কভারের ওপর। ফটো–তার এবং সিমনেত্তা ও তিন মেয়ে। বড়ো বড়ো করে ছবির নীচে লেখা-সুখী পরিবার। :

ইভোর চোখ কপালে। আরে সে তো ভুলেই গিয়েছিল। কয়েক মাস আগে তার সম্বন্ধে কিছু লিখতে চেয়েছিল। ইভো রাজি হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে এত বড়ো হয়ে উঠবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

ইভো রক্ষিতা ও ছেলেদের কান্না থামাতে বলল–শোনো, আমার কথা তোমরা শোনো।

-তোমার কথা আর কী শুনব? আমার ছেলেররা স্কুল থেকেই সব বুঝে শিখে এসেছে। বেজন্মা বলে ওদের সবাই বিদ্রূপ করেছে। ওরা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসেছে। আমার বাড়িওলা, প্রতিবেশীরা আমাদের কাছ পর্যন্ত ঘেঁষছে না। যেন আমরা সংক্রামক ব্যাধিগ্রস্ত। এখানে আর আমাদের থাকা চলবে না। মান-সম্মান সব গেল।

-কী বলছ?

 –আমার ছেলেদের নিয়ে আমি রোম ছেড়ে চলে যাব।

তোমার ছেলে? আমার নয়?

 –আমাকে নতুন করে তুমি কিছু বোঝাতে এসো না, তাহলে খুন হয়ে যাবে। হায় ঈশ্বর, একী হল! ইভো ভাবতে থাকে, আমার ভাগ্যে এসব ঘটতে পারে না। দোনাতো তখনও বলে চলেছে–যাওয়ার আগে দশ লাখ নগদ টাকা আমার চাই।

দশ লাখ! ইভোর ঠোঁটে অবিশ্বাসের হাসি।

 –হয় টাকা দেবে, নয়তো তোমার বউকে ফোন করে সব জানিয়ে দেব।

.

এরপর কেটে গেছে দু-দুটো মাস। দোনাতেল্লা এখনও টাকা পায়নি। অবশ্য মুখে যা বলেছিল, কাজে তা করেনি। কিন্তু চাপ দিচ্ছে। অফিসে ফোন করছে, বলছে, ইভো কীভাবে টাকা পাবে, তা তার জানার দরকার নেই। কিন্তু দশ লাখ টাকা তার চাই।

ইভো ভাবে–রফ অ্যান্ড সন্সের শেয়ার বিক্রি করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বাদ সেধেছে ওই স্যাম রফ। ওর জন্যই ইভোর জীবনে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। স্যাম রফের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত লোকেদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে হবে।

 দোনাতেল্লা এই ঘটনার পর থেকে নিজেকে ইভোর কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সে তার শরীর ছুঁতে দেয় না। এ যে কী চরম ব্যথা ইভোর কাছে। তবে হ্যাঁ, ইভো ছেলেদের সঙ্গে প্রত্যেক দিন দেখা করার অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু দোনাতেল্লা শুনিয়ে দিয়েছে, যেদিন সে টাকা দিতে পারবে ঠিক সেদিনই সে তার বেডরুমে ঢোকার অনুমতি পাবে।

ইভো ভেবেছিল, দোনাতেল্লার শরীরে শরীর মিলিয়ে তার রাগ ভাঙাবে। তাই সে একদিন জানালো টাকার জোগাড় হয়ে গেছে। এক্ষুনি আসছি!

দোনাতেল্লাকে নিয়ে ইভো শোবার ঘরে ঢুকল। দোনাতেল্লা পোশাক ছেড়ে তৈরি। ইভোও কাপড়জামা ছেড়ে ফেলেছে। ঠিক সেই সময় সে বলল–ডার্লিং, টাকাটা রেডি হয়নি, তবে খুব তাড়াতাড়ি….

দোনাতেল্লা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেছে। ইভোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে।

.

ভিয়া ক্যাসিয়ার জনাকীর্ণ রাজপথ দিয়ে ইভো গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছে। যেতে হবে ওলগিয়াতায়, তার বাড়ি সেখানে। আয়নার মুখ দেখল ইভে। রক্ত ঝরা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আঁচড়ানোর দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। শার্টটা রক্তে ভেজা।

 সিমনেত্তার সামনে দাঁড়াবে কী ভাবে? কী জবাব দেবে? বলবে কী? একটা মেয়ের সঙ্গে শুয়েছিল, সে গর্ভবতী হয়েছে। কিন্তু তিনটে ছেলে? না, এসব বলা চলবে না। তাহলে? এদিকে বাড়িতে তাকে ফিরতেই হবে। কয়েকজন অতিথি আসার কথা। ডিনারে যোগ দিতে হবে। কে তাকে এই বিপন্ন অবস্থা থেকে বাঁচাবে? বাঁচাতে পারেন একমাত্র সন্ত জোররা। তিনি অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন।

ভিয়া ক্যাসিয়ার ধারে একটা সাইনবোর্ড দেখে সে গাড়ি থামাল।

আধঘন্টা পরে বাড়ি ফিরে এল ইভে। প্রহরীরা তার দিকে অবাক চোখে তাকাল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যেতেই থমকে দাঁড়াল। সিমনেত্তা আর বড়ো মেয়ে ইসবেলা তার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

সিমনেত্তা আঁতকে উঠে বলল–ডার্লিং, তোমার এ দুর্দশা হল কীভাবে?

 ইভো কোনোরকমে উত্তর দিল,আমার বোকামির ফল।

সিমনেত্তা মুখের আঁচড়ের দাগ লক্ষ করল। তার চোখ ছোটো হয়ে গেল। নিস্তেজ গলায় বলল–আঁচড়ের দাগ মুখে? কে এসব করেছে?

–তাইবেরিও।

পিঠ থেকে একটা বিশ্রী কুৎসিত ধূসর রঙের বেড়াল তুলে আনল ইভো। বেড়ালটা লাফিয়ে চলে গেল অন্যদিকে।

-বেড়ালটা কিনে নিয়ে এলাম ইসাবেলার জন্য। বাস্কেটে পুরতে গিয়ে আঁচড়ে কামড়ে দিল।

–আহা, বেচারা! চলো, ওপরে চলো। শুয়ে পড়ো। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। দাঁড়াও আগে আয়োডিন লাগিয়ে দিই।

না-না, ওসব কিছু লাগবে না।

সিমনেত্তা ওকে জড়িয়ে ধরতে গেল।

 ইভো মুখ বিকৃত করে বলল–সাবধানে, পিঠেও আঁচড়ে দিয়েছে।

-সত্যি, তোমার ভীষণ লেগেছে, তাই না। কষ্ট হচ্ছে?

আমি ভালো আছি। আমার কোনো ব্যথা নেই।

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল।

–আমি দেখছি, ইভো বিছানা থেকে নামল, অফিস থেকেও আসতে পারে, কাগজপত্র পাঠাবার কথা।

দরজা খুলে দাঁড়াল ইভো।

–সিনর পালাজজি?

 –হ্যাঁ, আমি।

ধূসর রঙের ইউনিফর্ম পরা পিওন ওর হাতে একটা খাম তুলে দেয়।

খাম খোলে ইভো, রিস্ উইলিয়ামস পাঠিয়েছে। খবরটা পড়ে সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওপরের ঘরে উঠে যায়। সেখানে অতিথিরা তার জন্য অপেক্ষা করছে।

.

০৪.

বুয়েনস আইরেস। সোমবার। ৭ই সেপ্টেম্বর। বিকেল ৩টা।

আর্জেন্টিনার রাজধানী। ধূসর শহরতলি। চার মাইল সারকিট আর একশো পনেরো ল্যাপ-এর মোটর রেস চ্যাম্পিয়ানশিপ-এর আয়োজন হয়েছে। পঞ্চাশ হাজার দর্শক ভিড় জমিয়েছে। কিংবদন্তির নায়করা এই চ্যাম্পিয়ানশিপে যোগ দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রিস অ্যামন, ল্যাঙ্কাশায়ারের ব্রায়ান রেডম্যান, আলফা-রোমিও টিপো ৩৩ গাড়িতে ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়ান আদ্রিয়া দি অ্যাদ, মিসিমের মার্ট ফরমুলা ওয়ানে ব্রেজিলের কারলোস মার্কো। বেলজিয়াম চ্যাম্পিয়ান জ্যাকি ইক এবং বি আর এম গাড়িতে সুইডেনের রেইনে উইজেল।

ট্র্যাকটা দেখলে মনে হয় রামধনুর সাত রঙলাল, সবুজ, কালো, সাদা, সোনালি।

 ফেরারি, ব্রাভাম, ম্যাকলারেন এম ১৯-এ এস এবং লোটাস ফরমুলা ৩ এস।

ক্রিস অ্যামন চতুর্থ স্থানে ছিল। তার থ্রটল জ্যাম হয়ে গেছে। ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থামাতে গিয়েও বাধা। ব্রায়ান রেডম্যানের গাড়ি এসে তার সামনে দাঁড়াল। ব্যাস দুজনেরই জেতার আশা ধ্বংস হল।

 রেইনে উইজেল ছিল প্রথমে। বাঁয়ে ঘুরতে যেতে বিকল হল তার বি আর এম-এর গিয়ার বক্স। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে আগুন লেগে গেছে। গাড়িটা পাক খেতে শুরু করেছে। তার ঠিক পেছনে ছিল জ্যাকি ইকস। ফলে তাদের দুজনকেই সেখানেই প্রতিযোগিতায় সমাপ্তি জানাতে হল।

জনতার উল্লাস শোনা যাচ্ছে।

পরপর তিনটি গাড়ি এগিয়ে চলেছে। প্রথমে আর্জেন্টিনার জোর্জে আমানদারিস্। সে সুরতিস ড্রাইভ করছে। পেছনে লাল-সাদা মার্কা গাড়ি। সুইডেনের নিস নিলসনের। তার পেছনে যাচ্ছে ফ্রান্সের মারতেইল-এর ফেরারি ৩১২ বি-২। জোর্জে আমানদারিস আর্জেন্টিনার বাসিন্দা। তাই, জনতা তার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সমর্থন জানাচ্ছে।

 পেছনে ছুটে আসছে একটা রেস ট্র্যাক। ফরাসি ড্রাইভার। প্রথম কেউ লক্ষ করেনি। অবশেষে সকলের নজরে এল। সেটা দশম থেকে সপ্তম তারপর পঞ্চমে চলে এল। প্রথম তিনটে গাড়ি ঘণ্টায় ১৮০ মাইল গতির চেয়েও বেশি জোরে ছুটছে। পেছন থেকে তাদের দিকে বিপজ্জনক ভাবে ছুটে আসছে ব্রানডস হ্যাঁচ বা ওয়াটকিনস স্লেনের রেস ট্র্যাক। আর্জেন্টিনার এবড়ো থেবড়ো রেস ট্র্যাকে ওটা আত্মহত্যার সমান। ট্র্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে রেফারি, পরনে লাল কোট পরা, সাইনবোর্ড তুলে ধরেছে–আরও পাঁচটা ল্যাপ বাকি আছে।

ফরাসি ড্রাইভার সোনালি-কালো ফেরারি গাড়ি নিয়ে তৃতীয় গাড়িটাকে পেছনে ফেলে নিলসনের মাত্রা গাড়ির পাশাপাশি চলে এল। নিলসন ওর পথ রুখে দেওয়ার চেষ্টা করল। পেছনে আসছে একটা জার্মান কার। ফরাসি গাড়িটা আচমকা পিছিয়ে গেল। এসে পড়ল নিলসনের মাত্রা ও জার্মান গাড়ির মাঝখানে। তারপর হঠাৎ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। দুটো গাড়ির মাঝখানের খালি জায়গা ধরে সেটি এগিয়ে গেল। ফরাসি ড্রাইভারের গাড়ি এখন দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। ড্রাইভারের বাহাদুরি দেখে জনতা হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করল।

 তিনটে গাড়ি পরপর চলেছে–আমানদারিস, মারতেইল, নিলসন। এখনও তিনটে ল্যাপ বাকি। যেভাবেই হোক আমানদারিসকে জিততেই হবে। ফরাসি ড্রাইভার ভালো, কিন্তু তাকে হারাতে পারবে না। আমানদারিস দেখল, ফরাসি ড্রাইভার মারতেইলের কালো ফেরারি গাড়িটা ওর পাশে এগিয়ে আসছে। মারতেইলের চোখে গগলস। কাঁচে ধুলো পড়েছে। তার নীচে দেখা যাচ্ছে কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখ। আমানদারিস একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। স্পোর্টসম্যানের পক্ষে নীতিবিরুদ্ধ এমন কাজই এখন সে করবে। জেতাটাই তার কাছে এখন বড়ো কথা।

 একপাশে উঁচু পাড়। গাড়ি বাঁক নিচ্ছে। এই জায়গাতেই বেশির ভাগ গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটায়। ফেরারি গাড়ির ড্রাইভারের দিকে তাকালো আমানদারিস। হঠাৎ অ্যাকসিলারেটর থেকে পা সরিয়ে নিল। আচমকা গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। ঠিক সেই সময় ফরাসি ড্রাইভার তার গাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুরতিসের পাশ দিয়ে। ঠিক তখনই আমানদারিস তার গাড়ি ডানদিকে ঘোরালো, ঠিক ফেরারির লাইনে। বাঁচতে হলে ফরাসি ড্রাইভারকে ট্রাকের মায়া ত্যাগ করে পাড়ে উঠতে হবে।

ফরাসি ড্রাইভার আচমকা কোণঠাসা হয়ে গিয়ে ঘাবড়ে গেল।

আমানদারিস আপন মনে বলল সালুদ!

পরক্ষণেই মারতেইল তার গাড়ি ঘোরালো আমানদারিসের দিকে। আর মাত্র তিন ফুট। তখন দুটো গাড়ি পাশাপাশি এসে পড়েছে। সংকট এড়াতে আমানদারিস গাড়ি বাঁদিকে ঘুরিয়ে ব্রেক কষল। অথচ তাকে একটুও না ছুঁয়ে ফরাসি ড্রাইভার মারতেইলের ফেরারি সীমানায় পৌঁছে গেল। জিতে গেল। জনতা উল্লসিত। আর্জেন্টিনাবাসীদের তখন আর আমানদারিসের দিকে নজর নেই। সবাই এসে ভিড় করেছে ফরাসি ড্রাইভারকে ঘিরে সংবর্ধনা জানাবে বলে। ড্রাইভার চোখ থেকে কালো গগলস আর মাথা থেকে হেলমেট খুলে ফেলল।

আরে, এ যে মহিলা!

 গমের মতো চুলের রং। ছোটো করে ছাঁটা। নিটোল প্রতিমার মতো মুখ। শক্ত, ধারালো, ক্লাসিক, হিমশীতল, কিন্তু সুন্দর। তার শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। মৃত্যুপথযাত্রী আমানদারিসের দিকে তাকাল সে। লোকটাকে সে মরতে পাঠিয়েছে।

 এদিকে শোনা গেল লাউডস্পিকারে ঘোষিত হচ্ছে ফেরারি গাড়ির ড্রাইভার, ফ্রান্সের হেলেন রফ মারতেইল আজকের রেসের বিজয়ী!

***

স্থান : বুয়েন্স আইরেস রি হোটেল। ফায়ারপ্লেসের সামনে কার্পেটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে শার্ল। হেলেনের শরীরে পোশাক নেই। সে স্বামীর ওপর শুয়ে পড়ে। যৌনসঙ্গমের বিপরীত ও ক্লাসিক পোজে।

-প্লিজ, ওহ্, ক্রাইস্ট! শার্ল বলে ওঠে, ওরকম কোরো না।

তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য শার্ল পীড়াপীড়ি করে, কিন্তু হেলেনের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তার কামনার পারদ তখন চড়চড় করে বাড়ছে। সে চাপের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। শার্লের চোখে জল এসে গেল।

 শার্ল মনে মনে বলে আজ বিনা দোষে শুধু-শুধু আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমি কী অপরাধ করেছি, হেলেন তা জানে না। জানতে পারলে কী যে হবে, শার্ল সে কথা ভেবে এখন থেকেই ভয় পায়।

***

হেলেনের টাকা ও নাম আছে। শার্ল তাই তাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু সে ভুল করে। টাকা তো পায়ইনি, স্বামীর মর্যাদাও পায়নি। কেবল ওর পদবীটা হেলেন নিয়ে নিল। সে এখন হেলেন রফ মারতেইল।

 প্যারীর নামকরা এক ল ফার্মে জুনিয়র অ্যাটর্নি হিসেবে তখন শার্ল কাজ করছিল। কনফারেন্স রুমে মিটিং চলছে। ফার্মের চারজন সিনিয়র পার্টনার আর হেলেন সেই মিটিং এ ছিল।

 শার্ল হেলেনের সম্পর্কে কিছু ভাসা ভাসা কথা শুনেছিল। সে শুনেছিল হেলেন রফ ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানের একজন অংশীদার। বন্য ও উত্তেজনা পূর্ণ জীবনযাপন করে, স্কি খেলায় চ্যাম্পিয়ান। নিজের লিয়ার জেট নিজেই চালায়। নেপালে পর্বতারোহণে অংশ গ্রহণ করেছে। কার রেসিং-এ চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। ঘন ঘন প্রেমিক বদলায় সে, যেন পোশাক বদলাচ্ছে ।

হেলেনের ফটো শার্ল দেখেছে প্যারী ম্যাচ আর জ্বর দ্য ফ্রান্স পত্রিকায়। ডিভোর্সের মামলার জন্য আজ সে ওই ফার্মে এসেছে। তবে শার্ল জানে না, এটা তার কত নম্বর বিবাহবিচ্ছেদ। শালও ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। তার ওপর ওরারফ ফ্যামিলি, তার আয়ত্তের বাইরে।

কিছু ডকুমেন্ট নিয়ে শার্ল ঢুকেছিল কনফারেন্স রুমে। সিনিয়ররা বসে আছেন। তাই সে কুণ্ঠিত ভাবেই ভেতরে ঢুকল। সাধারণত শার্ল একা থাকতেই ভালোবাসে। প্যারীর ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্টে তার সুখের নীড়।

 শার্ল পাকা অ্যাটর্নি হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তার ওপর ভরসা করা যায়। কর্মঠ লোক। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই শার্লকে দেখতে মোটামুটি আকর্ষণহীন। ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নেই। ঠিক যেন ভিজে বালি।

 পরের দিন ফার্মের সিনিয়র পার্টনার মসিয় মিচেল সাকাদ তাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন।

–হেলেন রফ তার মামলার দেখাশোনার দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে দিতে চাইছেন।

শার্ল অবাক আমাকে কেন মসিহঁ?

-সেটা আমি বলতে পারব না। তবে ওঁর কাজ ঠিকমতো যেন হয় লক্ষ রেখো। শার্ল হেলেনের ডিভোর্স কেসটা হাতে নিয়েছিল। সেই সুবাদে কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে, এবং ঘন ঘন।

হেলেন ফোন করেছে। তার ভিলায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছে। অপেরায় নিয়ে গেছে।

শার্ল বোঝাবার চেষ্টা করেছে, কেসটা সামান্য। ডিভোর্স পেতে দেরি হবে না।

কিন্তু হেলেন বলেছে, শার্ল কাছে থাকলে তার সাহস বেড়ে যায়।

দেখা হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে শার্লের প্রথম সন্দেহ হল। হেলেন রফ অভিজাত পরিবারের মেয়ে। আর শার্ল সাধারণ মানুষ। তবে কেন সে তাকে সব ব্যাপারে জড়াতে চাইছে! নিশ্চয়ই ও কোনো রোমান্টিক সম্পর্ক গড়তে চাইছে।

একদিন হেলেন জানালো-শার্ল, তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।

এ তো অবিশ্বাস্য কথা! মেয়েদের সঙ্গ শার্ল পছন্দ করে না। হেলেনের প্রতি তার কোনো  ভালোবাসা নেই। পছন্দ করে কিনা, তাও নিজের জানা নেই। আর বিয়ে?

হেলেন ফ্যাশানের আর-এক নাম, গ্ল্যামার কুইন। সেখান শার্ল মারতেইল একজন সাধারণ মাঝবয়সী উকিল। দুজনের মধ্যে অনেক তফাত। তার মধ্যে কী আছে, যা হেলেনকে আকৃষ্ট করছে? শার্ল বুঝে পায় না।

 হেলেন নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক। নির্দ্বিধায় বিপজ্জনক স্পোর্টসে অংশ নেয়, যেগুলো একমাত্র পুরুষদেরই ব্যাপার। বরং পুরুষ কেন, মেয়েমানুষেরা সমান অধিকার পাবে, এ নিয়ে হেলেন জোরদার আন্দোলন করে।

হেলেনের মতে, পুরুষ হল পোষা জানোয়ার, তাদের পোষ মানাও। ওরা ফাই-ফরমাস খাটবে, সিগারেট ধরিয়ে দেবে, বিছানায় আনন্দ দেবে। এটাই যথেষ্ট।

 শার্ল মারতেইল তার কাছে এক বিস্ময়! গ্ল্যামার বয়, কোটিপতি, ডেয়ার ডেভিল, প্লেবয়–অনেক রকম পুরুষ দেখেছে হেলেন। কিন্তু শার্ল? শার্ল তাদের থেকে আলাদা। ও একতাল কাদা মাটির মতো। হেলেন ওকে নিজের মনের মতো গড়ে নেবে।

অতএব শার্লের আইবুড়ো নাম ঘুচল। স্বপ্ন হারিয়ে গেল। নলীতে তাদের বিয়ে হল। মন্টেকার্লোয় হনিমুন করল। শার্ল ওর ফার্মের কাজে ফিরে যেতে চাইল, কিন্তু হেলেন বেঁকে বসল। শেষ পর্যন্ত শার্ল রফ অ্যান্ড সন্সের প্যারী ব্রাঞ্চের দায়িত্বে এল।

অফিসের খুঁটিনাটি সে এসে বউকে বলত। বউয়ের উপদেশ, পরামর্শ ও সাহায্যে সে দ্রুত উন্নতি করল। ফলে অল্প দিনের মধ্যে প্যারী শাখার ইনচার্জ হল, বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস এর সদস্য হল। বলা যায় সামান্য এক উকিল বউয়ের কৃপায় পৃথিবীর বহুজাতিক এক বিশালতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছে এখন। কিন্তু এর জন্য সে আনন্দিত নয়। বরং দুঃখ জাগে শার্লের মনে।

 শার্ল এখন হেলেনের হাতের মুঠোয়। বউয়ের কথা মতো তাকে চলতে হয়। মাইনে পেয়ে সব বউয়ের হাতে তুলে দিতে হয়। পরিবর্তে হেলেন তাকে কিছু মাসোহারা দেয়। বেশি দরকার পড়লে তার কাছে হাত পাততে হয়।

স্বামীকে অপমান করে হেলেন সুখ পায়। হঠাৎ হঠাৎ অফিসে ফোন করে বলে–ম্যাসেজ ক্রিম কিনে নিয়ে আসবে।

শার্ল অফিস থেকে ক্রিম কিনে ফিরে এসে দেখে হেলেন উলঙ্গ একটা কুক্কুরির মতো পড়ে আছে। ও যেন সব সময় কামনার জ্বালায় জ্বলছে।

শার্লের মা ক্যান্সারে মারা গেছে। তখন তার বয়স বত্রিশ বছর। শার্ল যথাসাধ্য মায়ের সেবা শুশ্রূষা করেছে, কিন্তু বাঁচাতে পারেনি।

মায়ের মৃত্যুর পর নিজের জীবনে এক আশ্চর্য শূন্যতা বোধ করেছে শার্ল। কিন্তু সেক্সের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। এটা সে হেলেনকে বলেওছিল।

হেলেন হেসে বলেছিল–ওসব নিয়ে চিন্তা কেরো না। কেমন সুখ দেব, দেখে নিও।

এখন যৌনসঙ্গমের ব্যাপারটাকে শার্ল ঘেন্না করে। হেলেনের সঙ্গে সে পেরে ওঠে না। হেলেন যেন তার দুর্বলতায় বেশি খুশি হয়। স্বামীর পুরুষাঙ্গ নিয়ে এমন সব খেলা খেলে শার্লের গা গুলিয়ে ওঠে। একবার যৌন পুলকের চরম মুহূর্তে তার অন্ডকোষে হেলেন বরফের গুঁড়ো লাগিয়ে দিয়েছিল। আর একবার ইলেকট্রিক তার দিয়ে তার পায়ুতে শক দিয়েছিল। কী প্রচণ্ড কামোন্মত্তা!

 মনে হয় শার্ল হেলেনের বউ, আর হেলেন তার স্বামী। এমন কোনো ব্যাপার নেই, যার সাহায্যে হেলেনকে শার্ল খাটো করতে পারে। হেলেনের মতো বুদ্ধি ধরে না সে। আইন? সে হেলেনও জানে। শার্লের থেকে ভালো ব্যবসা বোঝে। শার্লকে বসিয়ে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলে।

শার্ল, ভেবে দেখো, রফ অ্যান্ড সন্সের কী ভীষণ ক্ষমতা! পৃথিবীর অর্ধেক দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ আমরা গড়তে যেমন পারি, তেমন ভাঙতে পারি। এই কোম্পানি আমারই চালানো উচিত। আমারই পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠান

এসব কথা বলতে বলতে হেলেন শার্লকে বিছানায় টেনে নিয়ে যায়। এসব মুহূর্তে তার যৌন কামনা অদ্ভুতভাবে বেড়ে ওঠে। শার্ল এসব ঘেন্না করে, হেলেনকেও সে পছন্দ করে না। তাকে ত্যাগ করতে পারলে বাঁচে। কিন্তু তার জন্য তো টাকার প্রয়োজন।

একদিন লাঞ্চের সময় শার্লের বন্ধু রেইনে দীশাপ শার্লকে একটা প্রস্তাব দিল–আমার কাকার বারগানজিতে একটা আঙুর খেত আছে। দশ হাজার একর। আমরা দুজনে মিলে সেটা কিনে নেব। আমরা প্রত্যেকে বিশ লাখ ফ্রা দেব। প্রথম বছরেই ডবল লাভ পাওয়া যাবে।

তার মানে চল্লিশ লাখ ফ্রাঁ। শার্ল ভাবল, হেলেনের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে তাকে এমন কোনো জায়গায় যেতে হবে যেখান থেকে সে আর তাকে খুঁজে পাবে না।

 শার্ল বলল–ভেবে দেখছি।

কিন্তু টাকা জোগাড় হবে কীভাবে? বেডরুমের সিন্দুকে অনেক অব্যবহৃত গয়না আছে। শার্ল ঠিক করল, ওগুলোর সস্তা কপি করিয়ে সিন্দুকের ভেতরে রেখে, আসল জুয়েলারি বাঁধা দিয়ে টাকা জোগাড় করবে। তারপর লাভ হলে গয়নাগুলি ছাড়িয়ে নিয়ে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেবে। তারপরেই সে বেপাত্তা হয়ে যাবে।

কিন্তু এরপর থেকে সে যেন সত্যি সত্যি এক পোষা জন্তু হয়ে গেল। হেলেনের মুখোমুখি হলেই তার হাত-পা কাঁপতে থাকে, ঘাম হয়।

হেলেন চিন্তিত। ডাক্তার এল।

স্নায়বিক উত্তেজনা। বিশ্রামের প্রয়োজন। ঠিক হয়ে যাবে।

বিছানায় শুয়ে থাকা উলঙ্গ শার্লের দিকে তাকিয়ে হেলেন হেসে ওঠে।

ডাক্তার চলে গেলে সে পোশাক ছেড়ে শার্লের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শার্লের কোনো  আপত্তি সে শুনতে রাজি নয়।

***

পরের সপ্তাহে হেলেন স্কি করতে গেল গারমিশ-পার্তেনকিরশেন-এ। যাওয়ার সময় স্বামীকে বলল রোজ রাতে বাড়িতে থেকো। আমি ফোন করব।

 শার্ল বুঝি এই দিনটার প্রতীক্ষায় ছিল। তার আমন্ত্রণে জুয়েলার পিয়েরে রিচুদ বাড়িতে এল। জুয়েলারি কপি করতে সে ওস্তাদ।

সে বলল–মসিয়, এখন অনেকেই ডুপ্লিকেট জুয়েলারি তৈরি করাচ্ছে। আসল গয়না পরে রাস্তায় কেউ আজকাল বেরোয় না।

সমস্ত গয়নার নকল তৈরি হল। সেগুলো সিন্দুকে তুলে রাখা হল। আসলগুলো নিয়ে শার্ল জমা রাখল সরকারি সংস্থা ক্রেদিৎ মনিসিপালে। টাকা এনে বন্ধুকে দিল। আঙুর খেতের একজন অংশীদার হল শার্ল। হেলেন এসব কিছুই জানল না।

শার্ল তখন আঙুর চাষ সংক্রান্ত পড়াশোনা করছে। কতরকমের আঙুর আছে। কোন জমিতে ভালো আঙুর জন্মায়। মদ তৈরি হয় কীভাবে ইত্যাদি।

বন্ধু বলেছে–মদের দাম বাড়ছে। আমরা প্রথমে বছরেই ভালো লাভ পাব। শার্লের স্বপ্নে লাল সোনালি আঙুর এসে দেখা দেয়। ইতিমধ্যে ভ্রমণ সংক্রান্ত প্যামফ্লেটগুলো হাতে পেয়েছে শার্ল। সাউথ সী আইল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা, ব্রেজিল। সে পালাবে। চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু রফ অ্যান্ড সন্সের অফিস আছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে। যদি হেলেন তাকে খুঁজে পায়, তাহলে আর প্রাণে বাঁচিয়ে রাখবে না। তার আগে হেলেনকে খুন করতে হবে। কীভাবে? হাজার রকম ফন্দি আঁটে সে।

 শার্লের এখন কোনো কিছুই অসহ্য লাগে না। হেলেনের অসভ্যতা, খারাপ ব্যবহার সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে শার্ল। এমনকি তার শরীর নিয়ে হেলেনের পাশবিক খেলাও। সব–সব মুখ বুজে মেনে নিয়েছে শার্ল। মনে মনে এই ভেবে হেসে ওঠে সে–আর কতদিন আমায় নিয়ে খেলবি। বেশ্যা কোথাকার! তোর টাকা দিয়েই বড়োলোক হব। তারপর আমার টিকিও পাবি না।

 হেলেন অর্ডার দেয়

–জোরে। আরো জোরে।

শক্ত করে ধরো।

 –আঃ, থামছো কেন? শার্ল যেন সুবোধ বালক। ভেতরে ভেতরে হেসে ওঠে।

শার্ল বই পড়ে জেনেছে, বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতু আঙুর ফলার মোক্ষম সময়। সেপ্টেম্বরে আঙুর তোলার উপযোগী হয়ে ওঠে। তবে সমানভাবে রোদ-বৃষ্টি প্রয়োজন। তা নাহলে ভালো ফলন হয় না। বেশি রোদে আঙুরের সুগন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। আর অতি বৃষ্টি আঙুরের স্বাদ নষ্ট করে দেয়। জুন মাস। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রতীক্ষা। শার্লের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে। বারগানজির আবহাওয়ার খোঁজ নেয় শার্ল। দিনে অন্তত দুবার।

শার্ল ঠিক করল। জামাইকায় যাবে। ওখানে রফ অ্যান্ড সন্সের কোনো অফিস নেই। রাউন্ড হিল বা অকোরিয়সে গেলে হেলেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাই সে মনে মনে ঠিক করল, পাহাড়ি অঞ্চলে ছোটো একটা বাড়ি কিনবে। কাজের জন্য লোক রেখে দেবে। মজায় দিন কাটিয়ে দেবে।

আগামী দিনগুলির কথা চিন্তা করে শার্ল অতীত বা বর্তমানকে ভুলে যায়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সূর্য-ধোয়া হাওয়া-লাগা গ্রীষ্মপ্রধান দ্বীপে সে জীবন কাটাবে। যেখানে হেলেন নেই, সে কেবল একা।

জুন মাসের প্রথম দিক। রোদ-বৃষ্টি সমানভাবেই ছিল। ছোটো আঙুর বড়ো হয়ে উঠছে।

জুনের মাঝামাঝি শুরু হল বৃষ্টি। দিনের পর দিন মুষলধারে বৃষ্টি হল বারগানজি অঞ্চলে। এখন আবহাওয়া রিপোর্ট শুনতেও ভয় পায় শার্ল।

রেইনে দীশাপের ফোন পেয়ে সে বুঝি একটু আশার আলো দেখতে পায়।

জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ বৃষ্টি কমে গেলে আঙুরের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু বৃষ্টি থামল না। জুলাই মাসে রেকর্ড বৃষ্টি হল। সমস্ত আঙুর নষ্ট হল। শার্ল ব্যবসায় যে টাকা খাঁটিয়ে ছিল সব জলাঞ্জলি হল। এবার? এবার শার্ল কী করবে? সে আরো ভীত হয়ে পড়ল।

***

 হেলেন খবর পাঠাল আগামী মাসে সে কার রেসে যোগ দিতে আর্জেন্টিনা যাচ্ছে।

 শার্লের চোখের সামনে ভেসে উঠল–হেলেন স্পিডে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। তারপরই গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট। হেলেন মরে গেছে।

 হেলেন মরে গেলে সে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে। কিন্তু হেলেন হারতে জানে না। ও মরবে না। মরতে হলে শার্লকেই মরতে হবে।

 রেসে জিতে এক শরীর কামোন্মাদনা নিয়ে ফিরে এসেছে হেলেন। ঝাঁপিয়ে পড়েছে শার্লের শরীরের ওপর।

এমন সময় দরজায় টোকা।

হেলেন বলল তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি দেখছি।

আঁটসাট শরীরে সিল্কের পোশাক জড়িয়ে হেলেন দরজা খুলে দিল।

 ধূসর রঙের পোশাক পরা পিওন দাঁড়িয়ে। একটা খাম এগিয়ে দিয়ে পিওন বলল–সিনর ও সিনরা মারতেইলের জন্য। স্পেশ্যাল ডেলিভারি।

পিওনকে বিদায় দিয়ে হেলেন ঘরে এসে ঢোকে। দরজা বন্ধ করে দেয়। খাম খুলে। মনে মনে বেশ কয়েকবার পড়ে নিল সে।

কী খবর?

শার্লের প্রশ্নের জবাবে সে জানালো, স্যাম রফ মারা গেছে। তার ঠোঁটে হাসির রেখা।

.

০৫.

লন্ডন। ৭ই সেপ্টেম্বর। বেলা দুটো।

পিকডিলি। সেন্ট জেমস স্ট্রিট। হোয়াইটস ক্লাব। এটা অষ্টাদশ শতাব্দীর জুয়া খেলার ক্লাব। বর্তমানে যা অভিজাত ইংরাজদের কাছে প্রথম শ্রেণীর ক্লাব হিসেবে বিবেচিত।

এই ক্লাবের সদস্য হতে চাইলে তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়। মেম্বার ও তাদের অতিথি ছাড়া অন্য কেউ এই ক্লাবে ঢুকতে পারে না।

 বড়ো বড়ো ঘর। পুরোনো আসবাবপত্রে সাজানো। এমন সব আর্ম চেয়ার, যেখানে কম করে দুজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বসেছেন। আছে পুরোনো কালের টেবিল, চামড়ায় মোড়া কৌচ। ওপর তলায় উঠে গেছে বাঁকানো সিঁড়ি। ডাইনিং রুমে মস্ত বড় ডাইনিং টেবিল। একসঙ্গে তিরিশ জন মেম্বার বসতে পারে। এছাড়াও পাঁচটা সাইড টেবিল রাখা আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আগমন ঘটেছে এখানে। লাঞ্চ বা ডিনার সেরে গেছে।

 স্যার অ্যালেক নিকলস। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। ওর বাবা ক্যারন ছিলেন অভিজাত। ওদের বংশের সকলেই এই ক্লাবের সদস্য। পরনে তার টুইড স্পোর্টস জ্যাকেট। আর স্ন্যাকস। রোগাটে চেহারা। মুখে অমায়িক হাসি আর আভিজাত্যের প্রকাশ। গ্লাউসেস্টারশায়ারের এস্টেট থেকে গাড়িতে চেপে এখানে এসেছে একটু আগে।

তার অতিথি জোন সুইনটন। পরনে তার পিন স্ট্রাইপ স্যুট। বড়ো বড়ো ডোরাকাটা শার্ট, টকটকে লালটাই ঝুলছে। এই শান্ত পরিবেশে এটা একেবারেই বেমানান।

ওরা বসেছে ঘরের এক কোণে একটা ছোটো টেবিলে।

 মস্তো বড়ো ভীল চপের পড়ে থাকা টুকরোটা মুখে দিতে দিতে জোন সুইনটন বলল সত্যি, এখানকার খাবারটা ভালো।

-হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে শিখেছে। অবশ্য ভলতেয়ার বলেছিলেন, ইংরেজদের ধর্ম একশোটা হলে কী হবে, সস মাত্র একটা।

–ভলতেয়ার? কে সে?

একজন ফরাসি।

–ও, এবার কাজের কথা বলা যাক।

খানাপিনা শেষ করে কাঁটা চামচ সরিয়ে রেখে ন্যাপকিনে মুখ মুছল জোন।

–দু সপ্তাহের মধ্যে টাকা দেব বলেছিলাম। তা হচ্ছে না দেখছি। আরও সময় লাগবে। ওয়েটার কাঁচের বাক্স ভর্তি চুরুট দিয়ে গেল টেবিলে। অনেকগুলো পকেটে ভরে একটা চুরুট ধরালো জোন।

–স্যার অ্যালেক, আপনি আমার মনিবদের চেনেন না। ওরা আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না। ক্ষেপে গেলে কী যে করে বসবেন, তা আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনি কি ঝামেলা চান?

–সত্যি, আমার কাছে টাকা নেই।

–আপনি কি গরিব? আপনার বিষয় আছে। রফ পরিবারের মেয়ে আপনার মা। হাজার একরের ফার্ম আছে আপনার। টাউনব্রিজে মস্ত বড়ো বাড়ি। রোলস রয়েস আর লাল বেন্টলি গাড়ি আছে আপনার।

–ওগুলো বিক্রি করা যাবে না।

সুন্দরী বউ ভিভিয়ান?

স্যার অ্যালেকের মুখ রক্তিম হল। সে চায় না, এই লোকটা তার বউয়ের নাম মুখে আনুক। ওরা এক বাড়িতে বাস করে বটে, কিন্তু তাদের শোবার ঘর আলাদা। কখনো সখনো ভোরবেলা ঘুম থেকে সে যায় বউয়ের বেডরুমে। চাদর জড়ানো নরম শরীরটার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওর মাথায় সোনালি চুল, বড়ো বড়ো হাল্কা নীল রঙের চোখ, চামড়া ক্রিমের মতো মোলায়েম।

 এক চ্যারিটি হলে ভিভিয়ানের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয়েছিল। থিয়েটারে ছোটোখাটো : পার্ট করত ভিভিয়ান।

 দু সপ্তাহ পরে অ্যালেক মনে সাহস সঞ্চয় করে ভিভিয়ানকে থিয়েটার দেখতে আর ডিনার খেতে আমন্ত্রণ জানাল। নটিং হিলের এক তলার ফ্ল্যাটে ভিভিয়ান থাকত। তারা বিয়ে করল। ভিভিয়ানের ফ্ল্যাটে প্রথম রাত দুজনে জড়াজড়ি করে কাটিয়ে দিল। ভেলভেটের মতো জিভ, সোনালি চুল এবং গোপন গভীরে এক ভিজে, স্পন্দিত কামনার দাবি, অ্যালেকের জীবন দর্শন পাল্টে দিল।

অ্যালেক লাজুক। তার চেহারা মোটা। ভিভিয়ান এই নিয়ে কত মজা করে। সে রাগ করে না। বরং খুশি হয়। পার্টিতে ভিভিয়ানকে ঘিরে পুরুষদের ভিড়। অ্যালেক গর্ব ও ঈর্ষা রোধ করে। ওদের কতজন যে ভিভিয়ানের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে, তা অ্যালেক জানে না।

অ্যালেক ব্যারন পার্লামেন্টের সদস্য। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ধনী ও অভিজাত রফ পরিবারের সন্তান। রফ অ্যান্ড সন্স-এর বোর্ড অফ ডাইরেক্টরদের সদস্য।

ভিভিয়ান অশিক্ষিত, দুশ্চরিত্রা, মন অগভীর। তার বাবা-মা, মিউজিক দলের সঙ্গে যুক্ত আর্টিস্ট। অথচ ওই মেয়েকেই স্যার অ্যালেক নিকলস বিয়ে করল। গ্লাউসেস্টারশায়ারের পুরোনো বাড়িতে নিয়ে এল।

জর্জিয়ান স্থাপত্য, ডোরিক স্তম্ভ, হাজার একর বিস্তৃত ফার্ম, কাছেই নদীতে মাছ ধরা যায়, বাড়ির পেছনে আছে পার্ক আর বন, চাইলে শিকার করা যায়।

 ভেতরে পাথরের মেঝে, কাঠের দেওয়াল রং করা, শ্বেত পাথরের টেবিল, পুরোনো ঝাড়লণ্ঠন, মেহগিনির চেয়ার, লাইব্রেরিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর বুক কেস, হেনরি হল্যান্ডের ডিজাইন করা টেবিল, আছে টমাস হোপের ডিজাইন করা চেয়ার। ড্রেসিংরুমের মেঝেতে উইলটন কার্পেট, ছাদ থেকে ওয়াটারফোর্ড কাঁচের ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। মস্ত বড়ো ডাইনিং রুম। চল্লিশ জন অতিথি একসঙ্গে বসতে পারে। ছটা বেডরুম দোতলায়। তিনতলায় চাকরদের থাকার ঘর।

ছ সপ্তাহ এখানে কেটে গেল তাদের।

একদিন ভিভিয়ান বলল–অ্যালেক, চলো আমরা লন্ডনে চলে যাই। এখানে আর নয়।

–কেন ভিভিয়ান! এত সুন্দর শান্তিপূর্ণ

–না, এসব আমার সহ্য হয় না।

অতএব লন্ডনের নাইটসব্রিজে এল তারা। মস্ত বড়ো চারতলা বাড়ি। সব কিছু আছে ড্রয়িং রুম, পড়ার ঘর, মস্ত বড়ো ডাইনিং রুম, ওপর তলায় একটা বড়ো আর চারটে ছোটো বেডরুম। আর আছে ঝরনা, স্ট্যাচু, সুন্দর বাগান, সেখানে সাদা বেঞ্চ আছে।

স্যার অ্যালেক আর ভিভিয়ান দুসপ্তাহ বড়ো বেডরুমে পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটাল।

একদিন ভিভিয়ান বলল–অ্যালেক, তুমি কাল থেকে অন্য ঘরে শোবে। তোমাকে আমি ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু তোমার নাক ডাকাকে নয়। কিছু মনে কোরো না সোনা।

ভিভিয়ানের নরম তপ্ত শরীর অ্যালেকের ভালো লাগে। কিন্তু ভিভিয়ানকে যৌনতৃপ্তি দিতে অক্ষম সে। সে বুঝতে পারল, ভিভিয়ান সেজন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

সেদিন থেকে ভিভিয়ান বড়ো বেডরুমে আর স্যার অ্যালেক ছোটো বেডরুমে আশ্রয় নিল।

হাউস অফ কমনস-এ স্যার অ্যালেক বক্তৃতা দিচ্ছে। ভিভিয়ান ভিজিটর্স গ্যালারিতে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বক্তৃতা শুনছে। দৃশ্যটা দেখে সুন্দরী বউয়ের প্রতি স্যার অ্যালেকের অন্তর গর্বে ভরে যেত। একদিন লক্ষ করল, ভিভিয়ান চেয়ারে বসে নেই।

নিজের বন্ধুরা ভিভিয়ানের চেয়ে বয়সে বড়। ওদের সঙ্গ ভালো নাও লাগাতে পারে ভিভিয়ানের। একথা চিন্তা করে স্যার অ্যালেক বউকে বলল, যুবক সঙ্গীদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। এতেই বাধল কেলেঙ্কারি।

 অ্যালেক নিজেকে বোঝাতো, ভিভিয়ানের বয়স কম, চঞ্চলতা তো থাকবেই। সন্তান হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কার সঙ্গে শুয়ে যে ভিভিয়ান যৌন ব্যাধি বাধাল, তা স্যার অ্যালেক জানে না। শেষ পর্যন্ত অপারেশন হল। ভিভিয়ানের জরায়ু বাদ গেল। সন্তান লাভের আশাটুকুও বিনষ্ট হল।

অ্যালেকের মন খারাপ। ভিভিয়ানের কোনো দুঃখ নেই। সে উল্টে বলল–ডার্লিং, মন খারাপ কোরো না। নার্সারিটা কাটা গেলে কী হবে, খেলার জায়গাটা তো আছে।

ভিভিয়ানের চাহিদা প্রচুর। নিত্যনতুন দামি পোশাক, গয়না, গাড়ি তার চাই। অত টাকা অ্যালেক কোথায় পাবে? তাছাড়া রফ অ্যান্ড সন্সের শেয়ার বাইরে বিক্রি করাও যাবে না। কিন্তু, ভিভিয়ান কোনো কথা বুঝতে চায় না।

 জুয়ার আড্ডায় যায় ভিভিয়ান। অ্যালেক জানতে পারল, জুয়ায় হেরে গিয়ে ভিভিয়ান এক হাজার পাউন্ড দেনায় পড়েছে। অ্যালেক দেনা শোধ করে দিল। বউকে নিষেধ করল উচ্চুঙ্খল জীবন যাপন করতে।

 কিন্তু কে কার কথা শোনে! একমাসের মধ্যে সে আবার জুয়ায় আচ্ছায় পাঁচশ হাজার পাউন্ড দেনা করল। সপ্তাহে শতকরা দশ পাউন্ড সুদ। টড ক্লাবের টড মাইকেলসের পোষা গুণ্ডারা বারবার ধার শোধের জন্য চাপ দিচ্ছে।

 জোন সুইনটন তাদেরই একজন। যার সামনে একই টেবিলে এই মুহূর্তে বসে আছে স্যার আলেক।

–যা ধার হয়েছিল, সুদে তো তার থেকে বেশি দিয়েছি।

 –তাতে কী হয়েছে? ধার তো শোধ হয়নি।

–এ কী মগের মুলুক।

 –তবে বসকে গিয়ে বলি।

 –আরে বসো, বসো।

–এসব বাজে কথা একবারও বলবেন না। এসব কথা যারা বলে তাদের পায়ের হাঁটু পেরেক দিয়ে মেঝেতে গেঁথে ফেলা হয়। ক্রে ব্রাদার্স এই শাস্তিই ঠিক করেছে।

সত্যি বলছি, আমার অত টাকা নেই।

 –কেন রফ অ্যান্ড সন্সের শেয়ার-এ আছে, ওগুলো বেচে তো–

সম্ভব নয়। বিক্রি করা বা দেওয়া কোনোটাই যাবে না। কোম্পানিটা যদি পাবলিক ফার্ম হত, তাহলে দেখা যেত।

কবে হবে পাবলিক কোম্পানি?

  স্যাম রফকে তোবোঝাচ্ছি।

 –ভালো করে বোঝাও।

মিস্টার মাইকেলসকে বলো, তার টাকা মার যাবে না কিন্তু আমার পেছনে এভাবে

-পেছনে? যদি সত্যিই আমরা তোমার পেছনে লাগি তাহলে তোমার ঘোড়া আস্তাবল, বাড়ি, এমনকি তোমার বউও বাদ যাবে না। সব পুড়ে মরবে।

 প্লিজ, শান্ত হও।

–আরে, আমি মজা করছি। টড মাইকেলস তোমার বন্ধু। বন্ধু বন্ধুকে সাহায্য করে, তুমি তো জানো। তুমি যদি বসের একটা কাজ করে দাও, তাহলে দেনা মুক্ত হয়ে যাবে। বস বলেছে।

কী কাজ?

 –পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে তোমাদের ওষুধ কোম্পানি আছে। ওষুধের সঙ্গে কোকেন পাচার করতে পারো।

–তুমি কি পাগল হলে?

প্রস্তাবটা দিলাম, ভেবে দেখো। কোকেন পাচার, নতুবা দেনা শোধ। ভিভিয়ানকে আমার শুভেচ্ছা জানিও। শুভরাত্রি।

সুইনটন চলে গেল। স্যার অ্যালেক একা বসে আছে তার অত্যন্ত পরিচিত ও আরামদায়ক পরিবেশের মধ্যে। অ্যালেক ভাবতে থাকে। সে গুণ্ডাদের ফাঁদে পড়েছে। অসভ্য, অভদ্র, গুণ্ডা। নীচুতলার মানুষ। এদের কেন সে নিজের জীবনে আসতে দিল? ওসব টাকা-ফাঁকা কিছু নয়। ওদের আসল উদ্দেশ্য হল অ্যালেককে শিখন্ডী করে ওরা ওষুধের সঙ্গে কোকেন পাচার করতে চাইছে। যদি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায় যে, গুণ্ডা মস্তানদের সঙ্গে তার আঁতাত আছে, তাহলে বিরোধী পক্ষের সদস্যরা ব্যাপারটা নিয়ে জলঘোলা করবে। সে সরকার পক্ষের সদস্য। তাকে সদস্যপদ ত্যাগ করার জন্য চাপ দিবে। এমনকি শিলটারন হানড্রেডস পদে যোগদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করাও হতে পারে। তার মানে বছরে সে মাত্র একশো পাউন্ড মাইনে পাবে! পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। কারণটা গোপন রাখা হলেও স্যার অ্যালেককে অপমানিত হতে হবে। যদি না সে গুণ্ডাদের টাকা ফেরত দিতে পারে।

 কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানি করার জন্য বারবার স্যাম রফকে বলেছে সে।

 স্যাম রফ তার কথায় কান দেয়নি। সে বলেছে- পাবলিক কোম্পানি কাকে বলে জানো? পরিবারের বাইরের লোকেরা আমাদের অর্ডার দেবে, কীভাবে ওষুধ কোম্পানি চালাতে হবে। শেষ পর্যন্ত ওদের হাতেই সব কিছু চলে যাবে। তোমার এত টাকার কীসের প্রয়োজন জানি না! মাইনে তো ভালোই পাও। তাছাড়া তোমার এক্সপেনস অ্যাকাউন্টস আছে। তাহলে?

অ্যালেক ভাবল, টাকার প্রয়োজনের কথাটা স্যামকে বুঝিয়ে বলবে। পরক্ষণেই তার মনে হল, না, বলে কিছু লাভ নেই। স্যাম কাঠখোট্টা মানুষ। ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। উল্টে অ্যালেককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবে।

অতএব স্যার অ্যালেক এখন সত্যিই ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে।

***

হোয়াইটস ক্লাবের রিসেপশন পোর্টার এগিয়ে এল, পেছনে একজন পিওন।

-স্যার অ্যালেক, বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। পিওন চিঠি দিতে এসেছে। এটা নাকি দারুণ জরুরি।

পিওন একটা সীল করা বড় খাম অ্যালেকের হাতে তুলে দিল।

-ধন্যবাদ, স্যার অ্যালেক।

 অ্যালেক খামটি হাতে নিয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর খামটা ছিঁড়ে ফেলল–স্যাম রফ মারা গেছে!–

চিঠিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে অ্যালেক বসে রইল। চোখে জল।

.

০৬.

নিউইয়র্ক। সোমবার, ৭ই সেপ্টেম্বর। বেলা ১১টা।

কেনেডি এয়ারপোর্ট। প্রাইভেট বোয়িং ৭০৭-৩২০ নামল। এই প্লেনে অনেকবার রিস উইলিয়ামস আসা-যাওয়া করেছে। সঙ্গে ছিল স্যাম রফ। কিন্তু আজ সে নেই। তার অস্তিত্ব টের পায় রিস।

 ছোট্ট লাগেজ। কাস্টমসে দেরি হল না। বাইরে বেরিয়ে এল রিস্। ধূসর আকাশ। বাতাসে শীতের পূর্বাভাস। লিমুজিন গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে উঠে বসল সে। এলিজাবেথকে কী বলবে ভেবে নিল। লং আইল্যান্ড এস্টেটে গাড়ি এসে থামল। স্যাম রফের বাড়ি।

এলিজাবেথ দরজা খুলে দিল।

সুন্দরী এলিজাবেথ, মায়ের মতোই। মধ্যরাতের মতো কালো দুটি চোখ, ভারী আঁখি পল্লব। ফর্সা। তার পরনে গলাখোলা ক্রিম রঙের সিল্কের ব্লাউজ, ধূসর ফ্লানেলের স্কার্ট পরেছে।

রিস্ তাকিয়ে থাকে। ন বছর আগে দেখা সেই লাজুক মেয়েটি আজ পূর্ণ যুবতী।

–এসো রিস, বাবা এল না।

সাজানো কথাটা হারিয়ে গেছে। রিস বলল তোমার বাবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।

এলিজাবেথের মুখ বিবর্ণ।

 –স্যাম মারা গেছে।

এলিজাবেথ নীরব। খানিক বাদে বলে কী করে?

পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায় অতল গহ্বরে।

 –মৃতদেহ?

খাদের অতল গভীরে…

–বাবা খুব ভালো অ্যাথলিট ছিল।…

ঘোরের মধ্যে বলে চলেছে এলিজাবেথ। চোখের মণি স্থির। বরং অস্বাভাবিক উজ্জ্বল।

…স্যাম আগেও পাহাড়ে চড়েছে।

ডাক্তার ডাকব, ওষুধ খেলে মনটা হয়তো–

না, আমি ঠিক আছি রিস। এখন শুতে যাব।

 –আমি কি থাকব?

ধন্যবাদ, প্রয়োজন নেই। রিস্ গাড়িতে উঠে বসল। লিজ হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, রি। জেসাস ক্রাইস্ট।

***

 রিস্ উইলিয়ামস চলে গেছে। বিছানায় শুয়ে আছে এলিজাবেথ রফ। সিলিং-এর দিকে দৃষ্টি। সেপ্টেম্বরের সূর্যের মলিন আলো এসে পড়েছে সেখানে, বিচিত্র নক্সার খেলা।

 তারপরেই শুরু হল যন্ত্রণা। সেই সঙ্গে চলল হাসি-কান্না। যেন হিস্টিরিয়া রোগী। মাঝরাতে উঠে সে খেল। বমি করল। ভোর হল। ফোন এল। স্যাম! না, বাবা তো নেই।

 বাবা তার হারিয়ে গেছে চিরদিনের মতো অতল গহ্বরে আর কোনোদিন তাকে । কাছে পাবে না অতীতের স্মৃতি এসে হানা দেয় লিজের মনে।

.

০৭.

এলিজাবেথ রোয়ানে রফের জন্মইতিহাস অত্যন্ত দুঃখজনক। দুভাবে। ডেলিভারি টেবিলে মারা গেল তার মা। এর থেকে বড়ো অঘটন হল, সে ছেলে নয়, মেয়ে।

মাল্টিবিলিয়ন ডলার মাল্টিন্যাশনাল রফ অ্যান্ড সন্স ছেলের জন্য, উত্তরাধিকারীর জন্য অপেক্ষা করেছে, গত ন মাস।

প্যাট্রিসিয়া। স্যাম রফের বউ। অসাধারণ সুন্দরী। স্যাম রফের টাকা আর নামডাকের জন্য অনেক মেয়েই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্যাম প্যাট্রিসিয়াকেই বিয়ে করেছিল, কারণ সে ভালোবাসতে জানে। অবশ্য স্যাম ভালোবাসার তোয়াক্কা করে না। রফ অ্যান্ড সন্সই তার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তবে প্যাট্রিসিয়া সুন্দরী বলে স্যামের কাছে গুরুত্ব পেত। মানে বউয়ের সৌন্দর্যকেই সে বেশি গুরুত্ব দিত।

রফ অ্যান্ড সন্স নামের আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, প্রাণপুরুষ স্যাম রফ। যদিও স্যাম প্যাট্রিসিয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। প্যাট্রিসিয়ার কাজ ছিল অতিথি অ্যাপায়ন করা। চেহারা সুন্দর রাখার জন্য তদারকি করা। তাকে নিয়মিত ডায়েটিং করতে হত। স্যাম চাইত, তার বউ হবে গ্ল্যামার কুইন। তার জন্য আনা হত সেরা পোশাক নির্মাতাদের তৈরি পোশাক লন্ডন, প্যারী, নিউইয়র্ক, ডাবলিন থেকে। সে জাঁ শ্লীমবার্গার ও বুলগারির তৈরি অলংকার ব্যবহার করত। তার জীবন ছিল ব্যস্ততায় ভরা, কিন্তু শূন্য ও নিরানন্দ।

অবশেষে প্যাট্রিসিয়া গর্ভবতী হল। রফ পরিবারের শেষ পুরুষ উত্তরাধিকারী স্যাম রফ। তাই শুরু হল প্রতীক্ষার পালা। ছেলে সন্তান চাই। প্যাট্রিসিয়াকে রানির মতো সেবাযত্নে রাখা হল।

 নমাস পর প্যাট্রিসিয়াকে ডেলিভারিরুমে নিয়ে যাওয়া হল। স্যাম তার শুভ কামনা করল। কেটে গেল তিরিশ মিনিট। দুর্ভাগ্য, কন্যাসন্তান প্রসব করল এবং শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে মারা গেল। স্বামীর আশা পূরণ সে করতে পারেনি, বেচারি এই দুঃসংবাদ জানবার অবকাশ পর্যন্ত পেল না।

প্যাট্রিসিয়ার মৃতদেহ কবর দেওয়া হল। ছোট্ট মেয়ের দেখাশোনার জন্য আয়া রাখা হল। বিভিন্ন আয়ার তত্ত্বাবধানে এলিজাবেথের শৈশবের পাঁচটা বছর কেটে গেল। বাবাকে খুব বেশি কাছে পেত না সে।

 আজ লং আইল্যান্ড বোলিং-এর মাঠ, টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল এবং স্কোয়াশ খেলার কোর্টে আছে; কাল বিয়ারিজ-এর ভিলায় আয়ার সঙ্গে, প্লেনে করে। এখানে তিরিশ একর জমি আর পঞ্চাশটা ঘর আছে। লিজ সেখানে একা একা ঘুরে বেড়াত। আপন মনে থাকত। কখনও সে গেছে বীকম্যান প্লে-র সেই মস্ত বড়ড়া বাড়িতে, অথবা সার্ডিনিয়ার কোস্টা স্পোরিলডার সমুদ্র উপকূলের সেই সুন্দর ভিলায়। লিজের মনে হত, সে যেন এক অজানা অচেনা পুরীতে ভুল করে ঢুকে পড়েছে।

 ছোট্ট লিজ ছবি আঁকত, অ্যাশট্রে তৈরি করত, সবই বাবাকে দেখাবে বলে। বাবা একপলক দেখে নিয়ে বলত–তুমি কখনোই আর্টিস্ট হতে পারবে না, তাই না?

মধ্যরাত। পাচানো সিঁড়ি বেয়ে লিজ চলে এসেছে বাবার পড়ার ঘরে। লিজের কাছে এটা এক পবিত্র জায়গা। এখানে বসে তার বাবা পড়াশোনা করে। কাগজপত্র সই করে, পৃথিবী শাসন করে। কল্পনায় সে বাবার সঙ্গে কথা বলে।

 অন্ধকার রাত। লিজ ডেস্কে একা বসে আছে। বাবা সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নেয়। শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। রিসেপশন হলে প্যাট্রিসিয়ার ছবি। লিজ তাকিয়ে থাকে। কী সুন্দর! আর সে? বিশ্রী, বাবা তাই তাকে পছন্দ করে না।

 লিজের বয়স বারো। ম্যানহাটানের পূর্ব দিকে একটা প্রাইভেট স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। বছর ঘুরে গেল। কিন্তু এলিজাবেথ রফের পড়াশোনায় কোনো উন্নতি দেখা গেল না। রিপোর্ট এল স্কুল থেকে একা একা থাকতে ভালোবাসে, বন্ধুবান্ধব পছন্দ করে না, পড়াশোনায় ভালো নয়, উন্নতির কোনো চেষ্টা নেই। ওর বাবা ওই স্কুলের পেট্রন। নয়তো স্কুল থেকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হত।

 বাস্তব রিপোর্টের আড়ালে আছে এলিজাবেথের কল্পনাপ্রবণ মন। সে একা থাকতে চায়, সহজে কথা বলে না কারো সাথে। জবাব জানা, অথচ মুখ খুলবে না। রোলস রয়েসে চেপে স্কুলে যেতে তার ভীষণ লজ্জা।

স্বপ্নে ভেসে ওঠে তার বাবার মুখ। প্যারীতে ঘোড়ার গাড়িতে তারা দুজন। সুইজারল্যান্ডে তারা বাবা আর মেয়ে স্কি করছে। বাবার পা ভেঙে গেছে। বাবার সেবা করছে সে। কোথা থেকে মৃত মা জ্যান্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকল। বাবা মাকে চলে যেতে বলল–আমি এখন। এলিজাবেথের সঙ্গে কথা বলছি।

আবার সে স্বপ্নে দেখে, সার্ডিনিয়ার সেই সুন্দর ভিলা। লিজ রান্না করেছে। বাবা ডিনারে বসে বলল এলিজাবেথ, তোমার রান্নার হাত খুব ভালো। তোমার মায়ের থেকেও।

দীঘল চেহারার কোনো যুবক এলিজাবেথকে বিয়ে করতে চাইছে। তার বাবা বলে উঠল নানা, এলিজাবেথ, আমাকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ।

না, এলিজাবেথ তার বাবাকে ছেড়ে কখনও যাবে না।

 ইতালীর সমুদ্র উপকূল। ১৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড় আর সমুদ্র ঘেরা এক দ্বীপ। বাবার এই ভিলাটা এলিজাবেথের মনের মতো। আদিম সাগরের গভীর থেকে আদিম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে লাভার স্রোত ছড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছে এই দ্বীপ। চারদিকে পাহাড় আর সমুদ্রের নীল জলরাশি। হাওয়ায় সমুদ্রের গন্ধ। মাশিয়া ফুলের সুবাস। সম্রাট নেপোলিয়ানের প্রিয় এই সাদা আর হলুদ ফুল। করবেকোলার ঝোঁপ, প্রায় দুফুট উঁচু। সেখান থেকে স্ট্রবেরির মতো লাল ফল ঝুলছে। ওক গাছ পাথুরে ও প্রকাণ্ড। এই গাছের ছাল দিয়ে মদের বোতলের ছিপি তৈরি হয়। বড়ো বড়ো পাথরে অদ্ভুত গোছের গর্ত। সেই গর্তে হাওয়া ঢুকে এক মিষ্টি সুরের সৃষ্টি করে। যেন পাহাড় গান গাইছে। ঝড় বইলে অন্য শব্দ। যেন অসুখী আত্মার কান্না। কখনও হাল্কা হাওয়া বয়। কখনও আবার সাহারা মরুভূমি থেকে ছুটে আসে ভয়ংকর গরম হাওয়া।

পোর্টো কার্ভোয় সমুদ্রের তীরে পাহাড়ের মাথায় রফভিলা। সেখানে জুনিফার ঝোঁপ আছে। সার্ডিনিয়ার বুনো জলপাইয়ের তিতো ফল। নীচে বন্দর চোখে পড়ে, চোখে পড়ে পাথুরে ঘরবাড়ি, সবুজ গাছপালা যেন বাচ্চা ছেলের হাতে আঁকা রং-বেরঙের ক্রেয়ন

ভিলাটি পাথরের। আছে ফায়ার প্লেস ও ঝুলবারান্দা। লিভিংরুম ও ডাইনিং রুমে দাঁড়ালে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য নজরে পড়ে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে আসবাবপত্রগুলি। রুক্ষ কাঠের টেবিল, বেঞ্চি, নরম ইজিচেয়ার। জানালায় ঝুলছে সাদা পশমের পর্দা, হাতে বোনা। মেঝেতে সার্ডিনিয়ার টিলা রং-বেরঙের। ওপর তলায় চারটে বেডরুম। সেখানে শোভা পাচ্ছে স্থানীয়, ইতালিয়ান এবং আদিম সার্ডিনিয়ার শিল্পকলা। হলঘরে রয়েছে রফ অ্যান্ড সন্স নামের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল রফ ও তার স্ত্রী টেরেনিয়া রফের পোর্ট্রেট।

টাওয়ার রুম, ঢালু টালির ছাদের নীচে। তেতলা থেকে সরু সিঁড়ি ওদিকে উঠে গেছে। দেয়ালে বুককেস ও ম্যাপ। ঘরের ভেতরে আছে বিরাট বড়ো ডেস্ক আর নরম সুইভেল চেয়ার। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

তখন এলিজাবেথ তেরো বছরের কিশোরী। জানতে পারল অনেক কিছু। নিজের পরিবার সম্পর্কে। নিজের কাছে নিজের গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে গেল।

***

টাওয়ার রুমের বুককেসে বিভিন্ন ধরনের বই। ফার্মাকোলজি, আন্তর্জাতিক আইন ও মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশন সংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যা বেশি। কাঁচের শেলফে কতগুলি দুষ্প্রাপ্য বইও রয়েছে চিকিৎসা সংক্রান্ত। লাতিন ভাষায় লেখা-সারকাইনস্ট্যানস এবং অন্য বইটি মেটিরিয়া মেডিকা। এলিজাবেথ লাতিন জানে। তাই সে একটা বই টেনে নিল। পিছনে নজরে পড়ল আর একটি পুঁথি। একশো বছর বা তার বেশি পুরোনো হবে। পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গেছে। ইংরাজি ভাষায় লেখা। লেখকের নাম সে খুঁজে পেল না। এটা ছিল আত্মজীবনী এলিজাবেথের পূর্বপুরুষ এবং রফ অ্যান্ড সন্স-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল রফের জীবনকাহিনী।

 লিজ দেখে স্যামুয়েল ও তার বউ টেরিনিয়াকে। অবশ্য ছবিতে। তাদের পরনে পুরোনো ফ্যাশানের পোশাক। সাদা চুলের স্যামুয়েলের গালের হাড় উঁচু, চোখে নীলের উজ্জ্বলতা, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ ও শক্তিশালী চেহারা তাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। টেরিনিয়া সুন্দরী। পরনে সাদা সিল্কের পোশাক, ব্রোকেডের বডিজ, কালো চুল ও চোখ।

টাওয়ার রুমে বসে এলিজাবেথ বইটার পাতা ওল্টাতে থাকে। ধীরে ধীরে মৃত স্যামুয়েল ও টেরিনিয়া রফ জীবন্ত হয়ে ওঠে তার চোখের সামনে।

সময়টা ১৮৫৫। ইহুদি বিদ্বেষীরা তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। স্যামুয়েল রফ ইহুদি, রোমান্টিক, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় এবং খুনি–