৪. সাধারণ একটা পোস্টকার্ড

কালো কালিতে লেখা সাধারণ একটা পোস্টকার্ড। এটাই মিসেস ব্লেনকিনসপের পাওয়া সর্বশেষ চিঠি। ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে চিঠিটা মুখের সামনে তুলে ধরল।

প্রিয় প্যাট্রিসিয়া,
কাকিমার শরীরের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। ডাক্তাররা সর্বক্ষণ নজরে রেখেছেন। তবে আশা নেই। তাকে শেষ দেখা দেখতে হলে চলে এসো। ১০টা ২০মিঃ ট্রেন ধরে এরোতে আসবে। আমার এক বন্ধু তোমাকে আনতে গাড়ি নিয়ে যাবেন। কাকিমার অসুস্থতা উপলক্ষে অনেকখানি পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে আশা করে ভালো লাগছে।
ইতি
তোমার পেনিলোপ প্লেনি

টুপেনস তার অন্তর্বেদনা যথাসাধ্য মুখভাবে ধরে রাখবার চেষ্টা করে। তবে মনে মনে আশান্বিত হয় এন্টনি মার্সড়নের ইঙ্গিতপূর্ণ চিঠিটি পেয়ে।

অবশ্য খুব বেশি পরিচয় নেই তার এন্টনির সঙ্গে। তাই পুরোপুরি ভরসাও করতে পারছে না। ভাবল, দেখাই যাক না কী হয়–মিঃ গ্রান্ট তো রয়েইছেন পেছনে।

টেবিলে উপস্থিত অনেকেই সহানুভূতি জানালেন মিসেস ব্লেনকিনসপকে। এরোর উদ্দেশ্যে রওনা হবে বলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়াল টুপেনস। তারপর এলো মিসেস পেরিনার ঘরে।

সেখানে শীলা আর দিনিমের ব্যাপার নিয়ে মিসেস পেরিনার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলল টুপেনস।

মিসেস পেরিনার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে আসতে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল টুপেনস।

ছোট্ট বেটি টুকটুক করে ক্লে দম্পতির ফাঁকা ঘরে ঢুকছে। তার হাতে একখানা ছড়ার বই।

টুপেনস এগিয়ে এসে মজা করে দরজার আড়ালে দাঁড়াল। দেখল বেটি বইখানা এই ঘরের বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখছে আর আপন মনে বলছে–লুকিয়ে রাখি…লুকিয়ে রাখি।

ঘাড় ঘোরাতেই দরজায় দাঁড়ানো টুপেনসকে দেখতে পেল বেটি। অমনি খিল খিল হেসে উঠে ছুটে এলো তার কাছে।

টুপেনস ওকে হাত ধরে বাইরে আনল। জিজ্ঞেস করল ছড়া কেটে–ওরে বোকা চললে কোথা—

দুষ্টুমিভরা মুখে হেসে ওঠে বেটি, বলে লুকিয়ে রাখি–লুকিয়ে রাখি–ওই-

-ঠিক এই সময় মিসেস স্প্রট ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন, ছোঁ মেরে তুলে বেটিকে কোলে নিলেন।

বেটি তখনও বলছে–খোঁজ-খোঁজ-লুকিয়ে রাখি–

-না, এখন লুকোচুরি খেলতে হবে না–ঘরে চল।

.

বেটিকে নিয়ে মিসেস স্প্রট ঘরে ঢুকে গেলেন।

টুপেনস নিজের ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ায়। টুপিটা আগের জায়গায় নেই। কেউ ঢুকেছিল তার ঘরে। কে ঢুকল আবার?

কার্ল ভন দিনিম তো এখন হাজতে। মিসেস পেরিনা তার ঘরে। মিসেস ওরুরকিও সেখানে গল্পগুজব করছেন বসে। তাহলে এ কাজ করল কে?

আপন মনে হাসল টুপেনস। চলুক, চলতে থাকুক। মন্দ কী…

 টুপেনস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা। এখনও যথেষ্ট সময় আছে।

পেনিলোপ প্লেনির চিঠিটা ড্রেসিং টেবিলের ওপরে চোখে পড়ার মতো করে ফেলে রাখল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ছোট্ট রেল স্টেশন এরো। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মার্সর্ডন তার জন্য নিকটবর্তী গ্রামে অপেক্ষা করে আছে। সরাসরি হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে বসল সে।

সুদর্শন এক যুবক বসেছিল চালকের সিটে। মাথা দুলিয়ে টুপেনসকে অভিবাদন জানাল।

 গাড়ি স্টার্ট নিল।

.

ঘন গাছপালায় ঢাকা একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। এন্টনি মার্সডনকে এগিয়ে আসতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল টুপেনস।

–গতকালই আমরা মিঃ বেরেসফোর্ডের সন্ধান পেয়েছি, জানাল মাসর্ডন, তিনি ভালো আছেন। তবে শত্রু শিবিরে আরও ঘণ্টা বারো তাকে বন্দি অবস্থায় থাকতে হবে। একটা নির্দিষ্ট স্থানে গেস্টাপোদের একটা বোট আসবে, মিঃ বেরেসফোর্ডকে খুন করে নাকি ওই বোটেই পাচার করা হবে।

আমরা তার আগেই বোট সমেত সবকিছু দখল করে নেব। তাই শেষ মুহূর্তটি না আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

টুপেনস জিজ্ঞেস করল, পারবে তো?

–নিশ্চয়, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার কোনো বিপদ হবে না। জবাব দিল মার্সডন।

কাছেই স্তূপ করে রাখা ছিল একটা প্যারাস্যুট, কিছু জামাকাপড় আর এক খণ্ড ক্যানভাস। ওগুলোর দিকে আঙুল তুলে টুপেনস জিজ্ঞেস করল, এসব কী?

প্যারাসুট আর নার্সের পোশাক।

–এসব এখানে কেন?

–প্যারাসুট করে নেমে এসেছিল এক জার্মান নার্স। সে আপাতত আমাদের হাতে বন্দি। স্থানীয় এক চিকিৎসক ডাঃ বিনিয়নের চেম্বারে উপস্থিত হবার কথা ছিল তার।

–সাংঘাতিক ব্যাপার! তারপর?

–ডাঃ বিনিয়ন শত্রুপক্ষের লোক। আপনাকে নার্স সেজে তার চেম্বারে যেতে হবে।

–খাসা পরিকল্পনা। তাহলে মেকআপ

–সব বন্দোবস্ত আমরা করে রেখেছি–তবে খুবই ঝুঁকির কাজ।

–কিছু যায় আসে না, তোমরা প্রস্তুত থাকবে।

–আপনার নির্দেশ পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। বলল মার্সডন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখুঁত জার্মান নারীর ছদ্মবেশ নিয়ে নিল টুপেনস। এখন তার নাক সামান্য চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু। কিছু চুল কপালের ওপর আলগা হয়ে আছে।

মেকআপ শেষ করে নার্সের পোশাক পরে নিল টুপেনস। তারপর ঠিকানা নিয়ে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল। নির্জন রাস্তায় এভাবে পাঁচ মাইল পথ যেতে হবে তাকে।

১৪ নং এলসফা রোডে ডাঃ বিনিয়নের চেম্বার। বাড়ির সামনে পৌঁছে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল টুপেনস। তারপর কলিংবেল টিপল।

মধ্যবয়স্ক এক মহিলা দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখেই বোঝা যায় ইংরেজ নয়।

–ডাঃ বিনিয়ন? বলল টুপেনস।

–তুমি নার্স এন্টন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তাহলে অপারেশন থিয়েটারে চল।

মহিলা দরজা বন্ধ করে টুপেনসকে সঙ্গে করে দোতলায় উঠে এলো। ছোট্ট সার্জিকেল চেম্বার। স্ত্রীলোকটি টুপেনসকে বলল, এখানে বসো, ডাক্তার বিনিয়ন আসছেন।

টুপেনস অপেক্ষা করে থাকে। কাকে দেখতে পাবে বুঝতে পারছে না।

এক মিনিট পরেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়েই টুপেনসের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

কমাণ্ডার হেডক।

.

ছদ্মবেশী টুপেনসকে চিনতেও এক মুহূর্ত বিলম্ব হল না কমাণ্ডার হেডকের। কিন্তু অটল তার গাম্ভীর্য। জার্মান কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে ইংরাজিতে বললেন, তুমি তাহলে এসে গেছ?

-হ্যাঁ, স্যার, অকম্পিত কণ্ঠে বলল টুপেনস, আমি নার্স এন্টনি।

–নার্স, সকৌতুক হাসি ফুটল হেডকের ঠোঁটে, হ্যাঁ, এই পোশাকে নিখুঁত মানিয়েছে, তোমাকে। দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো।

টুপেনস সসম্ভ্রমে আসন নিল। অপেক্ষা করতে লাগল।

-তাহলে আমাদের এদিককার খবর তুমি জান সব…আঁ…আক্রমণের তারিখ কবে স্থির হয়েছে বলো তো?

–চার তারিখ।

সর্বসত্তায় কেঁপে উঠলেন হেডক। কপালের রেখায় দ্রুত ভাজ পড়ে।

–তাহলে দেখছি জেনে গেছ?

এক মুহূর্ত নীরব থেকে টুপেনস বলে, বলুন, আমাকে কী করতে হবে?

ভেতরের প্রচণ্ড উত্তেজনা চাপতে গিয়ে মুখ বিকৃত হয়ে উঠছিল হেডকের। কোনো রকমে বললেন, যথাসময়ে সবই জানতে পাবে। সান্স সৌচির নাম নিশ্চয় জানা আছে তোমার?

–ওই নাম আগে কখনও শুনিনি।

–শোননি বলছ?

–না। তীব্র স্বরে বলল টুপেনস।

হিংস্র হাসিতে মুখ বিকৃত হল হেডকের। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলেন, আশ্চর্য কাণ্ড, সান্স সৌচির নামই তুমি বলছ আগে শোননি। অথচ আমি জানি, গত একমাস ধরে ওখানেই তুমি আস্তানা গেড়ে আছ।

টুপেনসের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে।

বিদ্রুপের স্বরে হেডক বলে ওঠেন, মিসেস ব্লেনকিনসপ, তাহলে ভালোই আছে বলা যায়, কী বলে?

সংযতকণ্ঠে জবাব দেয় টুপেনস, ডাঃ বিনিয়ন, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজই সকালে আমি এখানে প্যারাসুটে করে নেমেছি।

হা-হা অট্টহাসি হেসে উঠলেন হেডক।

–কত বোকা তোমরা ভেবে দেখ। ছেঁড়াফাটা একটা প্যারাস্যুট আর ক্যানভাসে কিছু জার্মান হরফ দেখেই ফাঁদে পা দিয়ে বসলে। হা-হা-শোন, আমি ডাঃ বিনিয়ন নই। বিনিয়ন হলেন আমার দাঁতের ডাক্তার। তার চেম্বারটি আমি কেবল মাঝে মাঝে নিজের কাজে ব্যবহার করে থাকি।

-তাই বুঝি! টুপেনসও সকৌতুকে মন্তব্য করে।

-হ্যাঁ, মিসেস ব্লেনকিনসপ। না, আমি তোমাকে আসল নাম মিসেস বেরেসফোর্ড বলেই বরং সম্বোধন করব।

এবারে আর চঞ্চল হল না টুপেনস। নিজেকে সে প্রস্তুত করে নিয়েছে। পরিণতি তার জানা। সে এখন মাকড়সার জালে বন্দি।

কোটের পকেট থেকে রিভলবার বার করে আনেন হেডক।

–কাজের কথা শোন। এখানে চেঁচামেচি জুড়বার চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। তোমাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না।

টুপেনস নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দেয়, আপনাকে জানিয়ে দিই, আমরা বন্ধুরা এ বাড়ির আশপাশেই ওঁত পেতে আছে।

আর এক দফা অট্টহাসি হেডকের। উল্লাসে ফেটে পড়ছেন যেন।

–তোমার পুরোনো দোস্ত মার্সড়নের ওপর দেখছি অগাধ আস্থা তোমার। আমি দুঃখিত মিসেস বেরোসফোর্ড, এন্টনি মার্সডন আমাদেরই লোক।

তোমাদের সিক্রেট সার্ভিসে ঢুকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে…তোমার এই সাহসিকতার প্রশংসা করলেও পরিণতির জন্য সত্যিই আমার আক্ষেপ হচ্ছে। যাইহোক, এবার বলো, সান্স সৌচি থেকে কতটা কী আবিষ্কার করলে?

টুপেনস নীরব। চোখে পলকহীন দৃষ্টি।

হেডক আবার বললেন, বুঝতে পারছি অনেক কিছুই জেনে গেছ। …বাকি অর্ধেকের খবর কী?

–একথার অর্থ?

-বুঝলে না, টমাস বেরেসফোর্ডের কথা জানতে চাইছি। সে-ও তো সান্স সৌচিতে ছিল। এখন অবশ্য আমার ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি যাচ্ছে।

-টমি–

-হ্যাঁ, টমি, উল্লাসে ফেটে পড়েন হেডক, সে এখন আমার থাবার মধ্যে। তবে তোমার ওপরেই নির্ভর করছে তার ভাগ্য। উলটো-পালটা কিছু বললেই টমির মাথা আঁঝরা হয়ে যাবে বুলেটে

চোখ নত করল টুপেনস। এক মিনিট নীরব রইল। পরে বলল, বলুন, কী জানতে চান?

–পথে এসো। আমাকে আগে বলল, এখানে তোমাদের নিয়োগ করেছে কে? তার সঙ্গে। তোমরা যোগাযোগ রাখ কীভাবে?

মৃদু হাসল টুপেনস। বলল, এসব কথার জবাব তো আমি মিথ্যাও বলতে পারি।

-তোমার প্রতিটি কথার সত্যতা আমি যাচাই করে দেখব।

এক মুহূর্ত নীরব থাকেন হেডক। তারপর চেয়ারটা টেনে টুপেনসের কাছাকাছি এনে বসলেন। তার মুখভাবের পরিবর্তন হল। নরম সুরে বলতে লাগলেন, তুমি কী ভাবছ আমি। জানি। শোন, সত্যিকথা বলতে, কর্মী হিসেবে তোমাকে ও তোমার স্বামীকে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাদের মতো সাহসী নরনারী যে কোনো রাষ্ট্রের সম্পদ। আগামী দিনে আমরা যে নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলব, সেখানে তোমাদের খুবই প্রয়োজন।

যাইহোক, আমাদের নেতার আদৌ ইচ্ছে নেই এ দেশকে তার সাম্রাজ্যভুক্ত করা। তিনি চান, জার্মান শাসনের বাইরে থেকেই নিজের বলে বলীয়ান হয়ে উঠুক ব্রিটেন।

এই দেশেরই মহান সন্তানদের দ্বারা পরিচালিত হোক। দূর হোক সমস্ত দুর্নীতি, ঘুষ, নোংরামি ও মানসিক ব্যাধির।

দেশে দেশে এই পরিবর্তন আমরা আনতে চাই–গড়ে তুলতে চাই এক নতুন ইউরোপ। সেখানে বিরাজ করবে অবিচ্ছিন্ন শান্তি ও প্রগতি। মিসেস বেরেসফোর্ড, আমার অনুরোধ, তুমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের বিচার করে দেখো।

কমাণ্ডার হেডকের আবেগতপ্ত কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল টুপেনস। তার মনে হচ্ছিল, উষ্ণ আদর্শে উদ্বুদ্ধ যেন একজন খাঁটি ব্রিটিশ নাবিকের যাদুময় কথা শুনছে। মনে মনে হেডকের প্রশংসা করল সে।

একটা ফুরফুরে আবেগ যেন চঞ্চল হয়ে উঠল ভেতরে। কিছু না ভেবেই মনের খেয়ালে হালকা কণ্ঠে আবৃত্তি করে উঠল টুপেনস–

ওরে বোকা, চললে কোথা
সর, ওপাশে সর,
 উঁচু নিচু ধাপ পেরিয়ে
ঢুকলে রানির ঘর।

শিশুপাঠ্য কৌতুক-ছড়ার এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যে হেডকের মধ্যে ঘটতে পারে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি টুপেনস।

সে হতভম্ব হয়ে দেখল, মুহূর্তের মধ্যে হেডকের কোমল মুখভাব পালটে গেল। চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন হেডক, দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলেন, বটে! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।

গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন, অ্যান?

যে জার্মান মহিলা টুপেনসকে দরজা খুলে দিয়েছিল, ডাক শুনে সে ঘরে ঢুকল। হেডক তার হাতে পিস্তলটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি ভেতর থেকে আসছি–তুমি একটু নজর রাখো। দরকার মনে করলে গুলি করবে।

কথা শেষ করে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন হেডক।

টুপেনস নির্বিকার। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতে থাকে সামনের মহিলাটিকে।

–কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করো না, টুপেনসকে উদ্দেশ্য করে বলল জার্মান মহিলাটি, ইংরাজদের আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি।

গত যুদ্ধে আমার একমাত্র ছেলে ইংরেজদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। পুত্রশোকের আগুন আমার বুকে দিনরাত জ্বলছে।

সেই পোলিশ মহিলাটির কথা মনে পড়ে গেল টুপেনসের। আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে বেটিকে বুকের সঙ্গে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল।

গুলির মুখে প্রস্তুত তবু বেটিকে কোলছাড়া করবে না। এই অকৃত্রিম মাতৃস্নেহই সে দেখতে পাচ্ছে এখানেও।

চমকে ওঠে টুপেনস। অদ্ভুত এক আলো যেন সে দেখতে পায় চোখের সামনে। মাতৃস্নেহের সেই চিরন্তন আলোতে যেন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অভাবিতভাবে।

…মিসেস স্প্রট ইতস্তত করলেন না গুলি ছুঁড়তে আর বেটিকে আড়াল করে ধরে সেই গুলিতে প্রাণ দিলেন পোলিশ মহিলা। এ যেন রাজা সলেমানের সেই বিখ্যাত বিচার-কাহিনি। টুপেনসের মনে হল, সেই পোলিশ মহিলার মুখে সেদিন সে চিরন্তন মায়ের মুখের ছবিই দেখতে পেয়েছিল।

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন হেডক। উদ্ভ্রান্তের মতো গর্জন করে উঠলেন, কোথায় লুকিয়েছ সেটা, কোথায়, বলো।

টুপেনস হতবাক। কী লুকোবার কথা বলছেন হেডক সে বুঝতে পারছে না।

-তুমি এখন যাও।

অ্যানের হাত থেকে রিভলবারটা নিজের হাতে নিয়ে হুকুম করলেন হেডক।

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন হেডক। চেয়ারে বসে পড়লেন থপ করে।

–আমার হাত থেকে পার পাবে না তুমি, তোমার স্বামীও। আমি জানি কীভাবে কথা বার করতে হয়। বলো, কোথায় রেখেছ সেই বইটা?

চমকে ওঠে টুপেনস। হেডক তাহলে একটা বইয়ের সন্ধান করছেন। তাহলে একটা অস্ত্র পাওয়া গেল। খেলানো যাবে অন্তত কিছুক্ষণ।

টুপেনস ধীরে ধীরে বলল, সেটা যে আমি পেয়েছি জানলেন কী করে?

–আমাকে বোকা বানাবার বৃথা চেষ্টা করো না। ছড়াটা শিখলে কোত্থেকে?

-কিন্তু ভাবলেন কী করে সেটা আমি এখনও গোয়েন্দা দপ্তরে পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি?

-না তুমি পাঠাওনি। গতকাল থেকে যা যা ডাকঘরে দিয়েছ, সবই আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। আর বইটা তো পাওয়া যাচ্ছে না আজই। আমি বুঝতে পারছি, সকালে সান্স সৌচি থেকে বেরুবার আগে ওখানেই তুমি সেটা কোথাও লুকিয়ে রেখে এসেছ। আমাকে এত সহজে ফাঁকি দিতে পারবে না তুমি।

তিন মিনিট সময় আমি তোমাকে দিলাম। এর মধ্যে তোমাকে বলতে হবে বইটা কোথায় রেখেছ?

কথা শেষ করে হাতঘড়িটা খুলে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন হেডক।

-মিসেস বেরেসফোর্ড, মাত্র তিন মিনিট সময়

টুপেনসের মুখে অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির হাসির আভা। সমস্ত অঙ্কের হিসেব মিলে গেছে তার–মুহূর্তের ভাবনায় সকলের পরিচয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে তার কাছে।

এক দুই তিন চার করে মুহূর্ত গুণে চলেছেন হেডক। কিন্তু আট অবধি গুনে আর এগুতে পারলেন না।

একটা পিস্তলের শব্দের সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল হেডকের বিশাল দেহ। একরাশ বিস্ময় তার মৃত্যুকাতর দৃষ্টিতে।

হেডক নিজের হিসেবে এমনই তন্ময় হয়ে ছিলেন যে, পেছনের খোলা দরজা দিয়ে সাক্ষাৎ শমন এসে কখন এই ঘরে পা দিয়েছে, বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি।

বিভ্রান্ত টুপেনস চোখ তুলেই দেখতে পায় পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে মিঃ গ্রান্ট। পরক্ষণেই দু-জনে ঘর ছেড়ে লাফিয়ে বাইরে নেমে আসে। লাফিয়ে উঠে পড়ে অপেক্ষামান পুলিশের গাড়িতে।

এখুনি সান্স সৌচিতে পৌঁছতে হবে–একটা মুহূর্ত যেন নষ্ট না হয়। ওখানে একবার খবর পৌঁছে গেলে চক্রান্তের নায়িকাকে আর পাওয়া যাবে না। বলে উঠলেন গ্রান্ট।

মত্ত বেগে গাড়ি ছুটিয়েছেন মিঃ গ্রান্ট। একটা গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই একসময় টুপেনস প্রশ্ন করল, টমি কোথায়?

–মুক্ত। আধঘণ্টা আগে তাকে উদ্ধার করেছি।

উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে ঝড়ের গতিতে ছুটছে গাড়ি। ওই তো সান্স সৌচি দেখা যাচ্ছে বাগানের প্রবেশ পথ

গাড়ি থামতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল টুপেনস। তাকে অনুসরণ করলেন মিঃ গ্রান্ট।

হলঘরের দরজা যেমন থাকে বরাবর তেমনিই খোলা। ঘর জনশূন্য।

নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে থাকে টুপেনস। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে একপলক তাকাল নিজের ঘরের দিকে।

সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড। বিছানা বালিশ, ফালা ফালা কাগজপত্রে ছয়লাপ-ড্রয়ারগুলো খোলা। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে ঘরের ভেতরে।

টুপেনস ঝট করে ক্লে দম্পতির খালি ঘরে ঢুকে পড়ল। একটানে বিছানার চাদর সরিয়ে ফেলতেই বাচ্চাদের পুরোনো ছড়ার বইটা বেরিয়ে পড়ল। ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিল টুপেনস। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিল মিঃ গ্রান্টের দিকে।

-এটাই খুঁজছিল হেডক-এরই মধ্যে সব আছে। অদৃশ্য কালিতে লেখা। সামান্য অসাবধানতার সুযোগে বাচ্চাটা খেলতে খেলতে বইটা ওখানে রেখে যায়–

হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ। ঝট করে ঘুরে তাকায় টুপেনস। দরজার সামনে দণ্ডায়মান মিসেস স্প্রট।

–কি ব্যাপার–আপনারা এখানে–

–মিঃ গ্রান্ট, টুপেনস আঙুল তুলে বলতে থাকে, ওই যে–আপনি যাকে খুঁজছিলেন বিখ্যাত নাৎসী-মহিলা স্পাই M–সান্স সৌচিতে ইনিই মিসেস স্প্রট।

.

টেবিল ঘিরে বসেছেন মিঃ গ্রান্ট, টমি এবং অ্যালবার্ট। সকলেরই সাগ্রহ দৃষ্টি টুপেনসের দিকে।

টুপেনস নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিয়েছে আগেই। সে-ও সবকিছু খুলে বলতে উৎসুক।

–নাও, এবার শুরু করো।

 টমি অনুরোধ জানাল।

–তুমিই শুরু করো না, আমি পরে বলছি। বলল টুপেনস।

-আমার কথা তো যৎসামান্য। নেহাত দৈবক্রমেই বলা যায় আমি হেডকের ঘরের ট্রান্সমিটারের সন্ধান জেনে গিয়েছিলাম।

ওই সময় যেভাবে হেডক বাথরুমের দরজা ফাঁক করে তাকিয়ে ছিল, ভয় হয়েছিল, বুঝি এবারই আমাকে শেষ করে দেবে।

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, হেডক নিপুণ অভিনেতার মতো নিজেকে সংযত করে রাখল–আমাকে তার অভিসন্ধির আভাস মাত্র পেতে দেয়নি।

–ওই অভিনয় করেই তো সে সময়টা কাজে লাগিয়েছিল। একটু দেরি না করে সে ফোনে মিসেস টকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল।

আর মিসেস স্প্রটও সঙ্গে সঙ্গেই বাগানে ঢুকে তোমার অপেক্ষা করতে থাকে। তোমার মাথায় হাতুড়িটা ঠুকেছিল সেই।

ব্রিজ খেলার আসর ছেড়ে এসে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই সে কাজ হাসিল করেছিল। সে যখন ফিরে এলো, তাকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ ছিল না। তাকে কেবল ঘন ঘন শ্বাস নিতে দেখা গিয়েছিল।

–আমার বন্দিত্ব মোচনের কৃতিত্বটুকু অ্যালবার্টের প্রাপ্য। বলল টমি।

–হ্যাঁ, বললেন মিঃ গ্রান্ট, যথাসময়েই সে আমাকে খবরটা পৌঁছে দেয়।

আমরা যখন স্মাগলার্স রেস্টে পৌঁছই, তখন হেডক সেখানে ছিল না, কিছুক্ষণ আগেই গলফ ময়দানে বেরিয়ে গিয়েছিল। কটেজের দখল নিতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। পরে নৌকোটাও আমরা কবজা করে নিই।

-তোমার কথা এবারে বলো, টুপেনস। বলল টমি।

–আমার কথা বলতে হলে স্বীকার করতেই হয়, টুপেনস বলতে শুরু করে, আমার সামনে কোনো আলো ছিল না।

সকলকেই সন্দেহ করছি–সকলের চলন বলন অর্থপূর্ণ মনে হচ্ছে। তবে মিসেস স্প্রট ছিল বরাবরই আমার সন্দেহের বাইরে।

সেদিন দুপুরে আকস্মিকভাবেই টেলিফোনে আড়ি পাতার সুযোগ পেয়েছিলাম। ওই চতুর্থ, শব্দটা শুনেই খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

দুপুরে সান্স সৌচি ছিল একেবারে ফাঁকা। কেবল মিসেস ওরুরকি আর মিসেস স্প্রট এই দু-জনই উপস্থিত ছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার, মিসেস স্প্রটকে বাদ রেখে আমার সন্দেহ পড়ল মিসেস পেরিনা আর মিসেস ওরুরকির ওপর।

ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে সবকিছুর নায়িকা হচ্ছে মিসেস স্প্রট।

মহিলা এত সাদাসিদে থাকত যে সে এমন একটা চক্রান্তের মধ্যে থাকতে পারে সন্দেহ করবার কোনো অবকাশই ছিল না।

আমার চিন্তাধারা, কাজের অগ্রগতি সবই টমিকে জানিয়েছি। আমাদের আলোচনা থেকে মিসেস স্প্রট বরাবরই বাদ থেকেছে। টমি অপহৃত হবার আগে পর্যন্ত মিসেস স্প্রট সম্পর্কে আমার মন ছিল খোলা।

টমির অনুসন্ধানের ব্যাপারে অ্যালবার্টের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সেই সময়ই দারুণ চটপটে যুবক এন্টনি মার্সর্ডনের সঙ্গে আলাপ হল। সে জানায় একসময় টমির কিছু কাজও করে দিয়েছে।

অবশ্য মার্সডন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও আমি তাকে কখনওই পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি।

–কেন, বিশ্বাস করনি কেন? জানতে চাইল টমি।

–কারণ, মিঃ গ্রান্টের কাছে শুনেছিলাম, পঞ্চমবাহিনীর লোক সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের সার্ভিসেও যে তারা অনুপস্থিত নেই এ-বিষয়ে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

মার্সর্ডনকে আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করবার আগে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। ফল পেতেও দেরি হল না। সে একটা সঙ্কেতপূর্ণ চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিল। খবরটা যথাসময়েই আমি মিঃ গ্রান্টকে জানিয়ে দিলাম, তারপর মার্সডনের কৌশলে গিয়ে পড়লাম হেডকের আরেক আস্তানায়।

-কাজটা হয়েছিল দারুণ, হেসে বলে উঠলেন মিঃ গ্রান্ট, শত্রুরা ভাবতেই পারেনি আপনি যখন গ্রামের ভেতর দিয়ে পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে চলেছেন, তখন আমরাও আপনাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছি।

–তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, আপনি আসবেন। তাই ঝুঁকিটা নিতে ইতস্তত করিনি। যতক্ষণ পারা যায় আমি হেডকের সঙ্গে দরকষাকষি চালাতাম।

কিন্তু অদ্ভুত ঘটনাটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত রহস্যটাই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

–কী ঘটনা? উৎসুক হল টমি।

-বাচ্চাদের একটা ছড়া, বলল টুপেনস, ওরে বোকা চললে কোথা–কি জানি কেন মনে এলো, আমিও আবৃত্তি করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গেই দেখি ছিটকে লাফিয়ে উঠল হেডক। প্রবল ক্রোধে তার চেহারাটাই সম্পূর্ণ পালটে গেল।

অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা শিশু পাঠ্য ছড়া বলে তাকে উপহাস করেছি–এই ভেবে একটা লোক এতটা ক্রুদ্ধ কখনওই হতে পারে না। বিশেষ করে হেডক সেই সময় আবেগমথিত গলায় কথা বলে আমাকে ভজাবার চেষ্টা করছিল।

স্বভাবতই ছড়ার বইটার কথা আমার মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম, বইটার মধ্যেই এর রহস্য লুকিয়ে আছে।

এর পরের ব্যাপারটা পুরোপুরি হৃদয়বৃত্তি ঘটিত বলা যায়। হেডক অ্যানকে আমার প্রহরায় রেখে গিয়েছিল। তার মুখে আমি নিখাদ মাতৃত্বের ছায়া দেখতে পেলাম, যা দেখেছিলাম সেই পোলিশ স্ত্রীলোকটির মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল রাজা সলোমনের কথা বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না।

হঠাৎ এর মধ্যে আবার রাজা সলোমনকে টানলে কেন?

বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল টমি।

অনুকম্পার হাসি হাসল টুপেনস। একে একে অন্য দু-জনের মুখের ওপরেও তার দৃষ্টি ঘুরে গেল। সকলেই উগ্রীব নির্বাক।

টুপেনস বলল, কেন মনে পড়ল? মনে আছে সেই কাহিনি? একটি শিশুপুত্র নিয়ে দুই রমণী রাজার দরবারে উপস্থিত হয়েছিল। শিশুটির মাতৃত্বের দাবি জানিয়েছিল দু-জনেই।

রাজা সলোমন হুকুম করলেন, শিশুটিকে দুখণ্ড করে দু-জনকে দিয়ে দেওয়া হবে।

আসল মা আঁতকে উঠল। কিন্তু নকল মা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল।

 আসল মা রাজাকে বলল, শিশুটিকে কেটো না। ওই রমণীকেই শিশুটি দিয়ে দাও।

এ হল সেই চিরন্তন মায়ের বুলি। সে কখনওই নিজের সন্তানের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না।

এবারে সেদিনের পাহাড়ের সেই ঘটনার কথা মনে করে রেখো।

হেডক গুলি ছুঁড়বার হুমকি দিতেই পোলিশ স্ত্রীলোকটি বেটিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরল–পাছে না তার গায়ে গুলি লাগে।

কিন্তু মিসেস স্প্রট একটুও ইতস্তত না করে ট্রিগার টিপে বসলেন। স্ত্রীলোকটি নিহত হল। কিন্তু ভেবে দেখো, ওই গুলিতে ছোট্ট বেটিও বিদ্ধ হতে পারত। মিসেস স্প্রটের মনে তেমন আশঙ্কা থাকলে কখনওই সে এভাবে গুলি করতে পারত না–আর তার শঙ্কিত না হওয়ার কারণ হল, সে শিশুটির গর্ভধারিণী নয়।

আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য হল, ওই শিশুটি মিসেস স্প্রটের মেয়ে নয়, তবুও কেন সে অমনভাবে গুলি করে পোলিশ রমণীটিকে হত্যা করল?

টুপেনস এক মুহূর্ত নীরব রইল। পরে ভারি গলায় বলল, কারণ ওই মহিলাই ছিল বেটির জন্মদায়িনী মা।

সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু মা কেবল তার সন্তান বেঁচে থাকবে, ভালো থাকবে এই আশায় তার সন্তানকে দত্তক দিয়েছিল। এমন ঘটনা-হৃদয় বিদীর্ণ করে।

–শিশুটিকে মিসেস স্প্রট দত্তক নিয়েছিল কেন? টমি জানতে চাইল।

–নিজের গুপ্তচরবৃত্তির কাজের সুবিধার জন্য–সান্স সৌচিতে নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য। এমনটা কখনওই সম্ভব নয় যে একজন প্রথম শ্রেণির গুপ্তচরও তার শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপজ্জনক খেলায় নামবে।

আমিও এই ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। শিশুটি সঙ্গে ছিল বলেই আমার সন্দেহের দৃষ্টি কখনও পড়েনি তার ওপরে।

কিন্তু দত্তক দিয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি বেটির জননী। যেভাবেই হোক সে মিসেস স্প্রটের ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল আর ঘুরে ঘুরে আসত যদি মেয়েটিকে একপলক দেখতে পায়।

এভাবেই একদিন সুযোগ পেয়ে সে বেটিকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। আমরা সকলেই শিশুটির কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লাম।

মিসেস স্প্রট কিন্তু সেই অবস্থাতেও পুলিশে খবর দেবার ব্যাপারে প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকে। এমনকি পুলিশে খবর দেবার পথ বন্ধ করার জন্য নিজের হাতে ভুয়ো হুঁশিয়ারিপত্র লিখে সকলকে ধোঁকা দেয়। পরে হেডককে খবর দেয় সাহায্যের জন্য।

পোলিশ মহিলাটিকে যে আবিষ্কার করা যাবে–এমনটা নিশ্চয় ভাবতে পারেনি তারা। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন আমরা সেই হতভাগিনীর নাগাল পেয়ে গেলাম–স্পট হুঁশিয়ার হয়ে গেল। সে আর ঝুঁকি নিতে চায়নি।

অব্যর্থ গুলিতে লক্ষ্যভেদ করে সে। এমন নির্ভুল লক্ষ্যভেদ কি কখনও এমন কারো দ্বারা সম্ভব–যে কোনো দিন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি।

অথচ আনাড়ি হাতে লক্ষ্যভেদ করেছে বলে আমরা বাহবা দিলাম মিসেস স্প্রটকে। সামান্য সহানুভূতিও পেল না হতভাগিনী। ভান্দা পলোনস্কা।

একটু থামল টুপেনস। পরে আবার বলতে শুরু করল, বেটির একটা ছেলেমানুষি খেলার মধ্যেও রহস্যের ইঙ্গিত ছিল। ব্যাপারটা আমাকে খুবই ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল।

উল লেস নিয়ে বেটি জলের গ্লাসে ঘোরাচ্ছিল। আসলে ওরকম একটা ব্যাপার বারবার তার চোখে পড়েছিল। তাই অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিল।

সে রাসায়নিকের সাহায্যে অদৃশ্য লেখা উদ্ধার করতে দেখেছিল মিসেস টকে-কার্ল ভন দিনিমকে কিন্তু নয়।

কার্ল এসবের সঙ্গে জড়িত নয় জেনে আমার আনন্দ হচ্ছে। ওকে আমি পছন্দ করি। বলল টমি।

টুপেনস আকুল স্বরে জানতে চাইল, দিনিমের কী খবর? তাকে নিশ্চয় গুলি করে মারা হয়নি?

মৃদু হেসে মিঃ গ্রান্ট জানালেন, না, সে নিরাপদেই আছে। আমার আশ্চর্য লাগছে, তার জন্য আপনারা এতটাই আগ্রহী ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।

টুপেনসের মুখে ভারমুক্ত উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল। বলল, শীলার কথা ভেবে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। …নিজেদের বোকামির জন্য এখন লজ্জা হচ্ছে, মিসেস পেরিনাকেই আমরা চক্রের নায়িকা ভেবে নাকাল হয়েছি।

মিসেস ওরুরকি এবং নিরীহ ক্লে দম্পতিকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছি বোকার মতন।

টমি সশব্দে হেসে উঠল। বলল, আর মেজর ব্লেচলিকে তো আমি নজরের বাইরে যেতে দিতাম না।

–অথচ অতি সাদামাটা অস্থিরমতি এক মহিলার অভিনয় করে বেটির তথাকথিত মা আমাদের চোখের আড়ালে নিজের কাজ করে গেছে, ভাবা যায়? বলল টুপেনস।

–নিপুণ অভিনেত্রী বলতে হবে, বললেন গ্রান্ট, কিন্তু লজ্জা ও অনুতাপের ব্যাপার হল, এই ভয়ঙ্কর স্ত্রলোকটি জন্মসূত্রে ইংরেজ।

-একজন দেশপ্রেমী–সে যে জাতেরই হোক না কেন, সে শ্রদ্ধার পাত্র। এই মহিলা জার্মান হলে আমি তাকে সম্মান জানাতাম। কিন্তু এই দেশদ্রোহিণীর প্রাপ্য একমাত্র ঘৃণা।

-ভালো কথা, মিঃ গ্রান্টকে উদ্দেশ্য করে বলল টুপেনস, আপনি যা খুঁজছিলেন, সেটা পাওয়া গেছে?

–হ্যাঁ। বললেন মিঃ গ্রান্ট, সেই পুরোনো ছড়ার বইটাতেই ছিল।

–পুরোনো বই নোংরা বলে ধরতে চাইত না বেটি। মিসেস স্প্রট তাকে ওই ভাবে শিখিয়েছিল। ওই ভাবেই সে আসল জিনিস শিশুটির নাগালের বাইরে রাখতে চেয়েছে।

-বইটা সত্যিই সাংঘাতিক, বললেন মিঃ গ্রান্ট, আমাদের সামরিক পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা হুবহু ছক আঁকা রয়েছে ওই ছড়ার বইয়ের পাতায় পাতায়। সব অদৃশ্য কালিতে লেখা।

শুনে খুশি হবেন যে পঞ্চমবাহিনীর দায়িত্ব পালন করছিল যে-সব ব্যক্তি, তাদের প্রত্যেকের নাম আমরা উদ্ধার করেছি ওই বই থেকে। বহু জাঁদরেল ব্যক্তিও রয়েছে তাদের মধ্যে। এরা কাজ করে গেছে আমাদের সামরিক বিভাগ, গোয়েন্দা দপ্তর, ডাক বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে থেকে।

টুপেনস উজ্জ্বল চোখে তাকাল মিঃ গ্রান্টের দিকে। বলল, ওরা তাহলে আসবে

–হ্যাঁ, এবারে আসতে দিন, মৃদু হাসলেন মিঃ গ্রান্ট।

আসরে উপস্থিত হল টমি ও টুপেনসের দুই ছেলেমেয়ে ড্রেক ও ডেরক।

 তাদের সঙ্গে এসেছে কাল ভন দিনিম ও শীলা পেরিনা।

কার্লকে কাছে পেয়ে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে শীলা, আমি জানতাম তুমি কোনো অন্যায় কাজ করতে পার না। কিন্তু ওরা কি তোমাকে এখনও নজরবন্দি করে রেখেছে?

কার্ল ভন দিনিম হেসে বলল, আমাকে কেন বন্দি থাকতে হবে?

একটু থেমে আবার বলল, শীলা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার কাছে আমার পরিচয় গোপন করেছিলাম। কার্ল ভন দিনিম আমার আসল নাম নয়-কাজের প্রয়োজনে ওই নামটা নিতে হয়েছিল।

টুপেনসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় দিনিম।

 টুপেনস হেসে বলে, থামলে কেন, ওকে সবকথা এখন খুলে বল।

-কার্ল ভন দিনিম আমার এক বন্ধুর নাম, বলে দিনিম, বছর কয়েক আগে ইংলন্ডে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন আগে তার সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়েছিল জার্মানিতে। সেই সময় দেশের হয়ে কাজ করার জন্য আমাকে জার্মানিতেই থাকতে হয়েছিল।

তার মানে–তার মানে তুমিও ব্রিটিশ গোয়েন্দা।

বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলে শীলা।

-হ্যাঁ, শীলা, জন্মভূমির স্বার্থে। ওই সময় অনেক ঝড় গেছে আমার ওপর দিয়ে। দুবার আমাকে খুনের চেষ্টা হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।

তখন বুঝতে পারি, আমাদেরই গোয়েন্দা দপ্তরের কোনো কর্মী নাৎসীদের আমার আসল পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে।

কার্ল আর আমার চেহারার মধ্যে কিছুটা মিল ছিল। তার কারণও অবশ্য ছিল। আমার ঠাকুমা ছিলেন জার্মান। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ এই চেহারার সুবিধা বিবেচনা করেই আমাকে জার্মানিতে পাঠিয়েছিল।

কার্ল জার্মান হলেও নাত্সী ছিল না। বরং অত্যাচারী গেস্টাপোদের অন্তর থেকে ঘৃণা করত সে। নাৎসীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় কার্লের বাবাকে তারা খুন করেছিল, দুই ভাইকে কারাগারে পাঠিয়েছে। কার্লেরও অব্যাহতি পাবার কথা নয়। একই পরিবারের লোকের প্রতি তাদের ব্যবহারে ব্যতিক্রম ঘটবে কেন? দেশ ছেড়ে ইংলন্ডে পালিয়ে আসার কোনো সুযোগই কার্লের ছিল না।

কিন্তু কার্লের মুখ থেকেই একদিন শুনতে পেলাম, ইংলন্ডে পালিয়ে আসার ব্যাপারে নাৎসীরা কোনোরকম বাধার সৃষ্টিই করেনি। প্রয়োজনীয় সবরকম নথিপত্রই সে অনায়াসে হাতের কাছে পেয়ে গেছে।

সরলভাবেই এসব কথা আমার কাছে স্বীকার করেছিল কার্ল। তখনই আমার সন্দেহ হয়, নাৎসীদের এত সদয় হবার একটাই উদ্দেশ্য, তারা তাকে ইংলন্ডের মাটিতে ব্যবহার করতে চায়।

কালের প্রিয় বিষয় রসায়ন–সেই নিয়েই গবেষণায় ডুবে ছিল সে। ওই বিষয়ে আমারও যৎসামান্য দখল থাকায় বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়েছিল।

ওই সময়ে আমরা দুজনে একই বাড়িতে থাকতাম। সেখানেই একদিন ভোরে দেখতে পেলাম, নিজের বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে কাল। হাতে ধরা রিভলবার। অনুমান করলাম প্রচণ্ড মানসিক চাপ সইতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছে সে।

কার্লের লেখা একটা চিরকুট পড়েছিল পাশে। সেটা আমি গায়েব করলাম।

আমার তখন খুবই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। প্রাণ বাঁচাতে হলে আসু জার্মানি থেকে পালানো দরকার। ওই পরিস্থিতিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকেই সাজতে হবে কার্ল ভন দিনিম। এভাবে আত্মগোপন করার আর একটা উদ্দেশ্য আমার ছিল। কার্লকে ইংলন্ডে পাঠানো হচ্ছিল কেন, তা জানার সুযোগ পাব আমি।

কার্লের মৃতদেহে আমার নিজের পোশাক পরিয়ে দিয়ে আমি কার্ল সাজলাম। মাথার খুলি উড়ে যাওয়ায় কার্লের রক্তাপ্লুত মুখ সনাক্ত করার উপায় ছিল না। তাছাড়া বাড়ির মালকিনীও চোখে ভালো দেখতে পেত না। তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম।

কার্লের নথিপত্র যা ছিল সঙ্গে করে পাড়ি দিলাম ইংলন্ডে। কার্লকে যেতে বলা হয়েছিল লিহাম্পটনের সান্স সৌচিতে। তাই আমিও উপস্থিত হলাম সেখানে।

নির্ভেজাল কার্ল ভান দিনিম আমি। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে আমার কাজের বন্দোবস্ত করা  ছিল। যোগ দিলাম সেখানে।

ওখানে নিযুক্ত হবার পরে সন্দেহ হল, আমাকে নাৎসীদের জন্য নিশ্চয় কিছু করতে হবে। সতর্ক থাকলাম। পরে পরিষ্কার হয়ে গেল, আমার কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করা তাদের উদ্দেশ্য।

হলও তাই। সন্দেহবশত গ্রেপ্তার করা হল আমাকে। আমি অবশ্য নিজের আসল পরিচয় গোপনই রাখলাম।

ঠিক করেছিলাম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুখ খুলব না–দেখি ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। কিন্তু মাত্র দিন কয়েক আগে আমাদের বিভাগের একজন আমাকে চিনতে পারলেন।

শীলা অনুযোগের স্বরে বলল, আমাকে তো বলতে পারতে।

–আমি দুঃখিত শীলা।

ইতিমধ্যে নাচের আসরে যোগ দিয়েছিল ডেরক ও ড্রেক। গভীর অনুরাগে শীলার হাত জড়িয়ে ধরে কার্ল বলল, চলো শীলা, আমরাও নাচি

.

টমি ধীরে ধীরে টুপেনসের দিকে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, টুপেনস, শিশুটির কী হবে? সে কি আমাদের মধ্যে থাকবে?

টুপেনস আকুতি মাখা দৃষ্টি তুলে ধরে টমির দিকে। ধীরে ধীরে বলে, বেটি–তার কথা, তুমি মনে রেখেছ-তুমি বড়ো সহৃদয় টমি। আমি মা-বেটিরও মা

-তাই হবে টুপেনস-বেটিকে আমরা দত্তক নেব। ও আমাদেরই একজন হয়ে বড়ো হবে

-ও টমি।

গভীর আবেগে টমিকে জড়িয়ে ধরে টুপেনস।