১. ভারী মন খারাপ

আই উড র‍্যাদার স্টে পুওর – জেমস হেডলি চেজ
ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন

০১.

ভারী মন খারাপ, পিটসভিলের ডেপুটি শেরিফ কেন ট্রেভারস তার পাষাণ-চাপা কপাল নিয়ে নেহাৎ জেরবার। বহুল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শেরিফের পদে সে আর প্রমোশন পাচ্ছে না, যেহেতু বর্তমান শেরিফ বুড়ো-হাবড়া টমসন তার এন্তেকাল অব্দি ঐ পদ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস হয় না। শুধু কি তাই, যে খুবসুরৎ লেড়কি ইরিসের সঙ্গে ট্রেভারসের কিছুকাল যাবৎ ঠুকঠুক বাছুরে প্রেম চলছে সেখানেও যখন-তখন রীতিমতন বকরাক্ষস হয়ে দাঁড়াচ্ছে কারোর বায়নাক্কা, বহু পূর্বে নির্ধারিত রোমাঞ্চকর গোপন অথবা উদোম পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। আজ যেমনটি ঘটেছে। বিস্তর ভেবে-চিন্তে ট্রেভারস স্থির করেছিল আজই ইরিসকে বগলদাবা করে সমুদ্রতীরে যাবে। যৌবননিকুঞ্জে প্রেমানন্দে দুটিতে ঘুর ঘুর করবে। ঠিক এমন দিনেই বুড়ো শেরিফের হুকুমে বুকটা তার ছাঁৎকরে উঠলো। কেন, তোমাকে আজ পিটসভিলের ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মিঃ ল্যাম্ব গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে শয্যাশায়ী। দ্বিতীয় অফিসার মিস্ ক্রেগ আজকের এই ছুটির দিনে বসেবসেব্যাঙ্কে কিছু কাজ সারবেন এবং তাদের নতুন ম্যানেজারের জন্যে প্রতীক্ষা করবেন, নতুন ম্যানেজার এলে তোমার অবিশ্যি ছুটি।

বুকের মধ্যে যাবতীয় ঘণ্টাধ্বনি। সেই সকাল থেকে ট্রেভারসব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তো করছেই। ডকা হুঁড়ি ইরিস আর কিছুক্ষণ পরেই সমুদ্রের দিকে রওনা দেবে। শালা, দুনিয়া রসাতলে চলে যাক!

একটা প্রকাণ্ড গাড়ি এসে ব্যাঙ্কের দরজার সামনে থামলো। গাড়ি থেকে এক দশাসই চেহারার বৃষস্কন্ধ লোক নামলো, বড় বড় চরণে পথ পার হচ্ছে।

কেন ট্রেভারস তার পথ জুড়ে। আজ ব্যাঙ্ক বন্ধ।

সে করমর্দন করে হাসে, জানি। আমিই ব্যাঙ্কের নতুন ম্যানেজার ডেভ কলেভিন।

নতুন ম্যানেজার পুরনো ম্যানেজারের খোঁজ খবর নেয়, মিঃ ল্যাম্ব এখন কেমন আছেন?

একদম ভালো নয়।…যাক আপনি যখন এসে গেছেন, আমারও দায়িত্ব শেষ। ডেপুটি শেরিফ আপন মনে গুন্ গুন্ করতে করতে নিজস্ব তোফাখানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।

মিস্ ক্ৰেগের সঙ্গে পরিচিত হবার পর প্রেমের ব্যাপারে, কোন পুরুষ মনস্থির করতে পারে না। রূপ ও যৌবন থাকলেও কেমন যেন একটা শীত কাতুরে ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ডেভ কলেভিন প্রসন্ন হতে পারে না।

সে ম্যানেজারের সুসজ্জিত ঘরে ঢুকে আরামদায়ক চেয়ারে বসে মিস ক্ৰেগের দিকে নিজের সিগার কেসটা এগিয়ে দেন, নিন, সিগ্রেট নিন।

ধন্যবাদ স্যার। আমি ধূমপান করি না।–ক্রেগ অস্বস্তির সঙ্গে বলে, মনে হল দিন সাতেক মিঃ ল্যাম্বের বদলে সে-ই বিছানায় শুয়ে আছে, সে মুখ তুলে সরাসরি ম্যানেজারের দিকে তাকাতে পারছে না।

কলেভিন ভাবলো–এ রকম একটি নিষ্প্রাণ যুবতীর সঙ্গে কিভাবে কাজ করবো।

কলেভিন প্রশ্ন করে, অফিসের চাবিগুলো কার কাছে থাকবে?

ব্যাঙ্কে ঢুকবার চাবি, তার ভল্টের চাবি–সব দুসেট করে আছে। একটা আপনার কাছে, অন্যটা আমার কাছে থাকবে। দুজনের চাবি ব্যবহৃত না হলে ভল্টের কপাট খুলবে না।

কলেভিন হেসে বললো, তার মানে ভল্ট থেকে একাকী মাল সরাতে আমি পারছি না, আপনিও পারছেন না। বহুত আচ্ছা।

প্রাচীন জমিদারের আমেজ তার স্বরে। তার দেহের দুলুনিতে আরামদায়ক চেয়ারটা বজরার মত দোলে।

কলেভিন–মিঃ ল্যাম্বের ঠিকানাটা দিতে পারেন?

ক্রেগ–কনট অ্যাভিনিউ। ব্যাঙ্কের বাংলো।

কলেভিন ঠিকানাটা নোটবুকে লিখে আবার জিজ্ঞেস করল, এ শহরে থাকবার খাবার বন্দোবস্ত কেমন? কোথায় থাকা যায়?

এখানে থাকবার-খাবার ব্যবস্থা জঘন্য,যেন অথৈ জলে পড়ে ক্রেগ উপায় খুঁজছে–একমাত্র ম্যাকলিন ড্রাইভে মিসেস লোরিং-এর মেস বাড়িটা, মন্দের ভালো স্যার, আপনি ওখানেই উঠতে পারেন।

আপনি তাহলে আমার জন্য আগাম খবর পাঠান।

নিশ্চয় স্যার। আমি টেলিফোনটা ব্যবহার করছি।

কলেভিনের প্রত্যয় জন্মালো অসুস্থ মিঃ ল্যাম্বকে দেখে এ তো পটল তুললো বলে এবং আমাকে এই শহরতলীর ব্রাঞ্চে অনেকদিন ম্যানেজারি করতে হবে। তবে ম্যানেজারের বাংলোখানা খাসা। সামনে যেন মোগল বাগান। ল্যাম্ব মারা গেলেই এখানে উঠে আসবো আপন অধিকারে।

মিঃ ল্যাম্বের বাংলো থেকে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে কলেভিন এসে ম্যাকলিন ড্রাইভে পৌঁছলো। সমুদ্রের ধারে এ জায়গাটা সবচেয়ে জমজমাট। একটা দোকান থেকে এক গেলাস শরবৎ কিনে পপলার গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গলা ভেজালো কলেভিন…তারপর মিসেস লোরিং-এর শক্তপোক্ত থেবড়ে থাকা বাড়ি রুম হাউস-এ গেলো।

নিজের পরিচয় দিতেই সাদর অভ্যর্থনা। মিসেস লোরিং নিজে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এসেছে। লোরিং-এর চেহারা ও পোশাক একটু অন্য জাতের।বুকদুটো খুববড় কিন্তু ঝুলে পড়েনি। ভারী নিতম্ব কিন্তু কোমরে অতিরিক্ত চর্বি নেই। লম্বাটে মুখ ও দাঁত বড় বড়। পরণের স্কাটটা বেটপ, লম্বায় ঘোট বলে প্রায় জানু অব্দি নাঙ্গা। এই চেহারায় এমন কিছু আছে যা পুরুষকে তাতায় এবং জমজমাট যৌন ভাবনার কুয়াশা জমে…।

বাড়তি ঘর বলতে উপরতলায় মাত্র একখানা ঘরে তারা পৌঁছায়। আলো জ্বালতেই ঘরের মোলায়েম মাধুর্য দ্বিগুণ।

কলেভিন বলে, সুন্দর,কত দিতে হবে ম্যাডাম? মনে রাখবেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজাররা কিন্তু এমন কিছু আহামরি বেতন পায় না।

অনন্য ভঙ্গিমায় মিসেস লোরিং সরাসরি কলেভিনের দিকে তাকলো। কলেভিনের শিরদাঁড়া ও শারীরিক গাঁথুনিতে মৃদু কম্পন ওঠে।

মাসিক ত্রিশ ডলার খাওয়া-থাকা। অনেকদিন থাকলে রেট কমিয়ে দেবো।

বড় না হলেও ঘরটি বেশ সাজানো, ছিমছাম। সিঙ্গেলবেডের বদলে ডবল। ডান দিকে একটি বন্ধ দরজা! কলেভিন জানতে চায়, ওটা বাথরুমের দরজা?

না, এ দরজাটা ব্যবহার করা হয় না। বাথরুমে যেতে হবে বারান্দা দিয়ে।

লোরিং তীক্ষ্ণ চোরা দৃষ্টিতে তাকে নিরীক্ষণ করে বললো, এই দরজাটা আমার শোবার ঘরে যাবার। আমি পাশের ঘরেই থাকি।

অনাগত রোমাঞ্চকর কিছু ছবি চকিতে কল্পনা করে কলেভিন বেশ জোরের সঙ্গেই বললো, আমি এই ঘরটাতেই থাকতে চাই।

মিসেস লোরিংএর ঠোঁটে ভাঙ্গা হাসি।

.

০২.

কলেভিন থাকবার ও খাবার সংস্থানটি কম খরচে অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে গেছে সেটা যে বেশীর ভাগ সময় এই অন্ধকার শহরতলীর তুলনায় স্বর্গ, সকল আবাসিকেরই এই স্বীকারোক্তি। খাবার টেবিলে বসেও আত্মতৃপ্তি। মাত্র তিনজন আবাসিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কলেভিনের এবং সেই তিনজনের সঙ্গেই রাতের খাবার খেতে বসেছেন। মিস এলিস ক্রেগ, মিস পীয়ারসন এবং মেজর হার্ডি (বয়স সত্তরের ওপর)।

খাবার টেবিল ছিমছাম, সস্তা সরাইখানার হুলিগলিজমের নাম গন্ধ নেই। খাবার ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধ ম্যানেজার ল্যাম্বের আকস্মিক অপঘাত আলোচিত হলো। বক্তা এলিস ক্রেগ,…আমি তো সাহেবের ঘরে ঢুকেই থ। সাহেব পা হিঁচড়ে হিঁচড়ে বুক চেপে ধরে এগিয়ে আসবার খুব চেষ্টা করেও পারছেন না। কার্পেটের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন।

ফ্লো খাবার পরিবেশন করছে, আকর্ষণীয় উদ্ভাসিত চোখে লাজুক দৃষ্টি কলেভিনেরমনে ঈষৎ শূন্যতা–সে আশা করেছিল মিসেস লোরিং খাবার টেবিলে আসবে।…

মহিলারা আহার পর্ব শেষ হলে যার যার ঘরে চলে গেলেন। ডাইনিং রুম সংলগ্ন বারান্দায় কলেভিন ও মেজর হার্ডি দুটো আরামপ্রদ ডেকচেয়ারে,হাতে সিগ্রেট, ভোজনাস্তিক তৃপ্তিরস লেগে আছে থুতনির ডগায়। মেজর গাল্পিক, ঠিক মতন তাতিয়ে দিতে পারলে কইতে কইতে তিনি খ্যাপা হয়ে যান আর কি। বিষয় নিজের জীবন ও যুদ্ধের ইতিপূর্ব। অনেকক্ষণ শ্রোতা হিসেবে কলেভিন আদর্শ হয়ে থাকবার পর স্বয়ং মুখ খুললো, এই শহরে এই আমার প্রথম আসা। ভাগ্য ভালো যে, মিসেস লোরিং-এর হোটেলে জায়গা পেয়েছি। ভদ্রমহিলার ব্যবহার চমৎকার। আচ্ছা, ওর স্বামী কি করেন? মেজর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, বছর কয়েক আগে এক পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। আসলে কিট লোরিংয়ের জীবন বড় সংঘাতময়, দুঃখের। কিন্তু মনটা স্টিলের মতন শক্ত বলে সব বাধাই টপকাতে পারছে। স্বামীটার চরিত্র ভালো ছিল না। মদে মেয়েমানুষে একেবারে ঠাসা। যখন স্বামী মারা গেল, মিসেস লোরিংয়ের হাতে তখন কিছু টাকা আর তাদের একমাত্র কিশোরী মেয়ে ইরিস। এই বাড়িটা কিনে হোটেলের ব্যবসা শুরু করলো। এখানে হোটেলের ব্যবসায়ে পয়সা কম। তাই মা-বেটিতে লড়াই করে চলেছে। মেয়ে ইরিসকে যুবতীই বলা যায়, সুন্দরী, স্থানীয় সিনেমা হলের বুকিং ক্লার্ক। শহরের ডেপুটি শেরিফ কেন ট্রেভারস আবার ওর প্রেমে পড়েছে। সমুদ্রতীরে প্রায়ই দুজনকে দেখা যায়। ইরিসের দেখা পাওয়া দুষ্কর। রাতে হোটেলে ঢোকে। অনেক কাজ করে, রাত দুটোয় শোয় এবং ঘুম থেকে যখন উঠবে, তখন আপনি অফিসে।

মেজরের প্রত্যক্ষ দর্শনের বিবরণ শেষ হয়। কলেভিন উঠে দাঁড়িয়ে বলে শুভ রাত্রি।

শুভরাত্রি।

বেশীরাত না হলেও কোনরকম হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি আর শোনা যাচ্ছে না।কলেভিন বিছানায় শুয়ে সিগ্রেট টানছে। ঘুম নেই। সিগ্রেটের মতন তার মনের ভেতরটাও পুড়ছে। সময় বড় অবাঞ্ছিতভাবে বয়ে যাচ্ছে! কিছুই হলোনা তোমার হে কলেভিন। আটত্রিশ বছর বয়স্ক এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মাত্র। সঞ্চয় বলতে মাত্র পাঁচশ ডলার। এমন কিছু একটা করো যা তোমার জীবনের রং বদলে দিতে পারে–অজস্র ডলার উড়তে থাকে তোমার চারপাশে।….

পাশের ঘরে আওয়াজ।

মিসেস লোরিং নিশ্চয় ঢুকলো।বাথরুম যাচ্ছে। জলের তিরি তিরিরব।কলেভিন উঠেবসলো। বারান্দায় এসে দাঁড়ালো যেখান থেকে খোলা জানালা দিয়ে লোরিং-এর ঘরের ভেতরটা দেখা যায়।বিছানার ওপর পড়ে আছেসাদারংয়ের প্যান্টি, স্কার্ট। লেখবার টেবিল, সাধারণ চেয়ার, ছোট টিভি সেট, দেয়ালে পাবলো পিকাসোর তরুণ বয়সে আঁকা ছবির একটা প্রিন্ট।

 নিজের ঘরে ফিরে আসে কলেভিন। এই নিরানন্দময় শহরে মিসেস লোরিং কি তাকে উষ্ণ আনন্দ ও সুখ দিতে পারে না? হয়তো পারে, একটু এগিয়ে ঐ কপাটে টোকা মারলে…না, সাহস হয় না, কলেভিন নিজেকে সতর্ক করে। সে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম যদিও নিয়ে, এলো বিবিধ অতৃপ্তি ও বাসনার দুঃস্বপ্ন। ঘুমন্ত কলেভিন ঘেমে নেয়ে বিছানায় ওলট পালট খেতে থাকে।

.

০৩.

চারটে একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ দিন কেটে গেল ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। সকাল নটায় গাড়ি চালিয়ে কলেভিন অফিস যায়। পাশে জড়োসড়ো নিরাসক্ত মিস ক্ৰেগ। সন্ধ্যা সাতটা হয় ফিরে আসতে। ব্যাঙ্কের চাকুরি নিরস। অবশ্য ক্রেগের ঐ কাজেই খুব উৎসাহ, আগ্রহ। এখন কলেভিনের মনে হচ্ছে, মিস ক্ৰেগের মধ্যে যৌনচেতনা কম থাকাটা শাপেবর হয়েছে কারণ কলেভিন অফিসের বাইরে যা কিছুই করুকনা কেন, অফিসের মধ্যে কোন সহকর্মিনীর সঙ্গে ফস্টিনস্টিকরা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় না। তার এখন যাবতীয় যৌনকল্পনা মিসেস লোরিংকে নিয়ে। একখানা জবরদস্ত ফিগার বটে। যেমন বুক তেমনি পাছা। কদাচিৎ দেখা সাক্ষাৎ হয়। তবু যতবার সে তাকে কাছে বা দূরে থেকে দেখতে পেয়েছে ততবার মনে হয়েছে ঐ রকম যৌন আবেদনকারী নারী দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। রাতে বিছানায় শুয়ে বদ্ধ কপাটের দিকে চেয়েই থাকে।কখনো কোন উত্তেজক আহ্বানে ঐ বদ্ধ দুয়ার কি খুলে যেতে পারে না?

সেই হতাশা–জীবনে তার কিছুই হলো না। অনেক টাকা যার নেই, জীবন তো তার কুকুর বিড়ালের। জীবনকে বর্ণময়, তাৎপর্যময় করে তোলবার সুযোগ কোথায়? সীমিত মাসিক বেতন, একটা পয়সাও উপরি নেই, সঞ্চয়ের ভাণ্ডার ধূ ধূ। অথচ এই সেই কলেভিন যে প্রতিদিন কত হাজার হাজার টাকার লেনদেন করে চলেছে। সেই টাকার একটি আধলাতেও ভাগ বসাবার তার অধিকার নেই। আসলে চিনির বলদ বলতে কাদের বোঝায়, তার মতন ব্যাঙ্ক অফিসাররাই তার প্রমাণ।

মিস ক্রেগ পাঁচদিনের দিন, বুধবার বিকেলে একটি চমকপ্রদ সংবাদ দিলো। তখন কলেভিন তার চেম্বারে বসে লেজার চেকিং করছে। অফিসের একমেবাদ্বিতীয় দুনম্বর কর্মী মিস ক্রেগ কপাট ঠেলে মুখ বের করল। আসবো, স্যার?

আসুন।

পরশু এখানকার চারটে ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের সাপ্তাহিক বেতন দেবার দিন।

তাই নাকি? তা এ ব্যাপারে আমাদের ভূমিকাটি কি?

টাকাটা কাল সন্ধ্যায় এনে রাখা হবে আমাদের ব্যাঙ্কের একটি বড় ভল্টে। এর জন্য ব্যাঙ্ক মোটা টাকা ভাড়া পেয়ে থাকে।

আচ্ছা….কত টাকা?

তিনশ হাজার ডলার।

ডেভ কলেভিন কথাটা শুনে সোজা হয়ে বসে বলে, কত বললেন?

তিনশ হাজার ডলার।

কলেভিনের বুক ছম ছম করে উঠলো। সে কয়েক মুহূর্তের জন্য কাঠ হয়ে গেল। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে, শক্তি সঞ্চয় করে অপ্রতিভ অবস্থাটা কাটিয়ে বললো, সে তো অনেক টাকা।

হ্যাঁ। আর সেই জন্যেই তো স্বয়ং শেরিফ সাহেব উপস্থিত থাকেন ঐ টাকা ঢোকাবার সময়।

যদি ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়ে, ঐ টাকা লোপাট হয়ে যায়?

মিস ক্ৰেগের যান্ত্রিকস্বর, সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের কোন দায়িত্ব নেই। সিকিউরিটির দায়িত্ব তো শেরিফের। তবে এটা আমি আপনাকে হলফ করে বলতে পারি স্যার–কোন চোর বা ডাকাতের সাধ্যি নেই ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে ঐ টাকার বাক্স নিয়ে যায়।

আপনার এতটা প্রত্যয়ের কারণ?

বাক্সটা যেখানে রাখা হয়, তার সঙ্গে শেরিফ সাহেবের অফিস ঘরের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ওখানে একটা গোপন ইলেকট্রনিক চোখও রয়েছে। ঐ চোখ ভল্টের মধ্যে অনভিজ্ঞ কাউকে দেখতে পেলেই তা সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে জানিয়ে দেবে শেরিফ সাহেবকে।

মিস ক্ৰেগের কথাগুলি কলেভিন খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলো। মিস ক্রেগ চলে যাবার পর সে ভল্টে গিয়ে সন্ধান করে। কিন্তু কোন বিশেষ চোখ তার নজরে এলোনা। সেকুলকুল করে ঘামছে। না, সে এখন অনেক কিছুই জানে না। সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে সব কিছু জানবে। টাকা তো প্রতি সপ্তাহেই আসবে। সবুরে মেওয়া ফলে।…ব্যাঙ্কের বাইরে এসে দাঁড়ায় কলেভিন। মুখ তুলতেই নজরে এলো, রাস্তার ওপারেই ভয়ের জগৎ-শেরিফ সাহেবের অফিস। একটা বড় পুলিশী টুপিকে দেখতে পাচ্ছে কলেভিন। তার পেশী টান টান শরীর ঈষৎ কুঁজো হয়ে পড়ে।

হোটেলে ঢুকবার মুখেই আজ মিসেস লোরিং-এর মুখোমুখি; দুহাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঢুকছে। পরিশ্রমে-শ্রান্তিতে টকটকে মুখ-চোখ।

কলেভিন সহাস্যে বললো, আপনি কি আমাকে সাহায্যের সুযোগ দেবেন?

ঈষৎ হেসে লোরিং বললো, কেউ আমাকে সাহায্য করতে চাইলে, আমি তা গ্রহণে কখনন অস্বীকার করি না।

বাজারের থলে হাতে কলেভিন লোরিং-এর পিছন পিছন রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকল। লোরিং জানাল, আজ ডিনারে হবে,তরকারি, স্যুপ,বাছুরের জিভ দিয়ে ডালনা এবং কিডনি ভাজা। এর সঙ্গে থাকবে চর্বিতে ভাজা পরোটা।

কলেভিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, চমৎকার মাদাম, আমার কিন্তু রান্নার হাত খারাপ নয়।

আপনি কি রান্নাতেও আমাকে সাহায্য করতে চান না কি?

মন্দ কি? নিজের পুরোনো বিদ্যাটাকে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাবে।

কলেভিন অ্যাপ্রোন পরে সত্যিই লোরিং-এর সঙ্গে রান্নায় হাত লাগালো। লোরিং সখেদে বললো, এত পরিশ্রম করি মা ও মেয়েতে, তবু আমাদের সচ্ছলতা আসছে না।

কলেভিন মন্তব্য করলো, আপনার এখানে হোটেল খোলাটা উচিত হয় নি।

ঠিক বলেছেন। আমাকে পরামর্শ দেবার মতন কেউ ছিল না। বাড়িটা রাস্তার ওপর পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে খালি খাবি খাচ্ছি। আমি যদি আপনার মত কোন ব্যাঙ্কের অফিসার হতাম তবে এসব ব্যবসা কবে সিকেয় তুলে রাখতাম।

কলেভিন চুক চুক শব্দ করে বললো ব্যাঙ্কের মাইনেতে ধনী হওয়া যায় না।

জানি। কিন্তু ব্যাঙ্কের টাকা হাতিয়ে বিরাট ধনী হয়েছে, এমন লোকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

কলেভিন অবাক হয় এই মহিলাটি ক্রমান্বয়ে টাকা-পয়সার আক্ষেপই জানিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে এর মানসিক সমতা আছে। নিঃশব্দে হেসে সে বললো, ব্যাঙ্কের কর্মী এবং অফিসাররা সহজেই গোছ গোছ টাকা পকেটস্থ করতে পারে। কিন্তু ভোগ করতে পারবে না। নিয়ম কানুন এমনই যে ধরা পড়ে যাবেই।

হাতের চেটো থেকে ময়দার গুঁড়ো ফেলতে ফেলতে লোরিং বললো, ঠিক ঠিক বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারলে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। কথা বলতে বলতে ওরা রান্নার কাজ করছে। কলেভিনের দিকে পেছন ফিরে লোরিং দাঁড়িয়ে, মাঝে মধ্যে শরীরে শরীরে ঠেকে যায়। যে সব মেয়েদের দেহে বিদ্যুৎ আছে, লোরিং যে তাদেরই একজন কলেভিন তা অনুভব করে। সে সাহস সঞ্চয় করে লোরিং-এর চওড়া পিঠের ওপর আলতো হাত রাখে। লোরিং-এর দেহকাণ্ড শক্ত হয় কিন্তু সে বাধা দেয় না। তখন কলেভিন ওর পিঠে, কোমরে, ঘাড়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে স্বল্পায়াসেই মিসেস লোরিংকৈ তার দিকে মুখোমুখি করে নামিয়ে আনে মুখের ওপর মুখ, ঠোঁটের ওপর ঠোঁট। অমন দীর্ঘস্থায়ী উত্তপ্ত চুম্বন কলেভিন এর আগে কোনদিন উপভোগ করেনি। লোরিং নিজেকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে ঈষৎ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, ব্যাস আর নয়। তুমি নিশ্চয় ভুলে যাওনি এটা রান্নাঘর এবং আমরা সকলের জন্য রাতের খাবার তৈরি করতে। এসেছি।

আবার নিস্তব্ধ একটা রাত। কলেভিনের হাতে সিগ্রেট পুড়ছে। সে নিশ্চিত আজ ঐ বদ্ধ কপাট– খোলা আছেই। হাতল ধরে ঠেলা দিলেই খুলে যাবে। তারপর…মিসেস লোরিং-এর সঙ্গে সংসর্গ করবার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে কলেভিনের বুকের মধ্যে একটা আগ্নেয়গিরি জীবন্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু দরজার হাতল ধরতেই বিরাট হতাশা, ক্রোধ, অভিমান–লোরিং কপাট বন্ধই রেখেছে।

সেই প্রতীক্ষা! বুকের আগুন বুকের মধ্যে পুষে রাখো। হৃদয়ঙ্গম করো। এক মাঘে শীত যায় না।

.

০৪.

সেই কুবের-নিবাস, যেখানে আজ সাত রাজার ধন এনে রাখা হবে, চার চারটে কারখানার শ্রমিকদের সাপ্তাহিক বেতন–সাকুল্যে তিনশ হাজার ডলার।

কলেভিন মিস ক্রেগকে নিয়ে ভেতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। সারি সারি কেবিনেট, সংখ্যায় কয়েক শ, যাদের মধ্যে রক্ষিত আছে স্থানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কিছু মানুষের মূল্যবান কাগজপত্র, দলিল, গয়না। আর যে আধারটি তিনশ হাজার ডলারের বাসভূমি হবে তার হাঁ-মুখ-এর গভীরতা অনেক।

সন্ধান শেষে কলেভিন প্রশ্ন করে, কিন্তু সেই ইলেকট্রনিক চোখটা কোথায়?

ঐ যে ওখানে মিস ক্ৰেগের তর্জনিকে অনুসরণ করে কলেভিন দেখতে পেল অনেক উঁচু একটা বড় ভেন্টিলেটরকে গ্রিল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ঐ গ্রিলের মধ্যে ওটা রাখা রয়েছে।

কলেভিন কৃত্রিম সংশয় নিয়ে বলে, এমন কিছু আহামরি সুরক্ষা ব্যবস্থা নয়, চোর ডাকাতরা আগেই ওটার তার কেটে ফেলবে।

সঙ্গে সঙ্গে মিস ক্রেগ জানায়, তা পারবেনা স্যার। ওর তারটারগুলো সব দেয়ালের মধ্য দিয়ে। ফ্লোরের মধ্য দিয়ে, বাইরে রাস্তার তলা দিয়ে সোজা শেরিফ সাহেবের অফিসে চলে গেছে। কেউ দেয়াল বা মেঝে খুঁড়ে সেই তার বের করতে চাইলে ইলেকট্রনিক চোখটা অনেক আগেই চিৎকার করবে। চারিদিক থেকে পুলিশ ব্যাঙ্কটাকে ঘিরে ফেলবে। বেশ আনন্দের সঙ্গেই ব্যাঙ্ককর্মী মিস এলিস ক্রেগ বলল।

ভেতরে ভেতরে রাগ জমতে থাকে কলেভিনের। সে বলল, কিন্তু কেউ তো ব্যাঙ্কের মেইন সুইচটাই অফ করে কুকর্মে হাত দিতে পারে। এখনো মিস ক্রেগ আত্মপ্রত্যয়ী, কোন সুবিধে হবেনা তাতে, কারণ, ঐ চোখটাকে চালু রাখে একটি পৃথক জেনারেটর। সেটা এই ভল্টের মধ্যেই থাকে, ঐ দেখুন।

ছোট ঝকঝকে মোটরটা যেন কলেভিনের ঘর্মাক্ত মুখের দিকে চেয়ে চোখ টিপল। এ হল এক বিশেষ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র, যাকে চালু করলে দশ বারো ঘণ্টা একটানা নিঃশব্দে কাজ করে যাবে।

অমন সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনা থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ তার মাথায় মোক্ষম প্রশ্নটা এসে গেল, মিস ক্রেগ আমরা তো ঐ টাকার বাক্স রেখে যাবার পর জেনারেটর চালু হবার পরও একাধিকবার ভল্টের মধ্যে যাওয়া আসা করতে পারি। তখন কি প্রতিবারই ঐ ইলেকট্রনিক চোখ হুঁশিয়ার করে দেবে শেরিফকে?

মিস ক্রেগকে এই প্রথম বিচলিত মনে হচ্ছে। নিরেট পাষাণে বন্দিনী যেন। ধরা গলায় বলল, এটাই আসল গোপনীয় ব্যাপার। আমাকে শপথ নিতে হয়েছে, হাজার প্ররোচনা সত্ত্বেও আমি যেন ঐ গোপন তথ্য ফাস না করি। কিন্তু আপনি এই ব্রাঞ্চেরই ম্যানেজার, আমার বস। আপনাকে তো সবকিছু জানাতে আমি বাধ্য।

আপনি নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারেন।

আসলে কি জানেন স্যার। আমরা যখন এখানকার সব কটা আলো অফ করি একমাত্র তখনই ঐ ইলেকট্রনিক চোখটা সচল হয়ে ওঠে। ব্যবস্থা এই রকমই। আবার রাতে আমরা বা অন্য কেউ যদি ব্যাঙ্কে ঢুকে আলো জ্বালে, চোখটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু রাস্তার ওপারে শেরিফ সাহেব ঠিক দেখতে পাবেন ব্যাঙ্কের আলো। সদলে ছুটে আসবেন।

কলেভিন বিশ্লেষণ করে বুঝলো টাকাটা যদিও বা কখনো লোপাট করা যায়, ফেডারেল গোয়েন্দা দপ্তরের ঝনুকমীরা তাকে ছিঁড়ে খাবে। মাত্র দুজন শুধু টাকা সরাতে পারে–এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, দুই ব্যাঙ্কের হিসাবরক্ষক মিস ক্রেগ। কিন্তু নার্ভাস মিস ক্ৰেগের পক্ষে এটা অবাস্তব। সুতরাং…একটা বিস্বাদ ভীতি ও অসহায়তা কলেভিনের মনের মধ্যে চাগাড় দিয়ে ওঠে।

পুলিশী গাড়িতে পুলিশ প্রহরায় টাকার বাক্স সন্ধ্যা ঘনাবার আগেই এসে গেল। ব্যাঙ্কের ভল্টে সকলকে নিয়ে প্রৌঢ় শেরিফ ঢুকলেন। চোখের কোণে কলেভিন কে দেখে নিয়ে অনুমান করে, আমি গায়ের জোরে বুড়োকে গুড়ো করে দিতে পারলেও বুলেটের জোরে ও আমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। না, তাগদ দেখাবার তাগিদ আমার নেই। ভল্টের মধ্যে কুবেরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে জেনারেটারটা চালু করে শান্তিরক্ষকরা বেরিয়ে গেল। ব্যাঙ্কের আলো নিভিয়ে দিয়ে মিস ক্রেগ সহ মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলো কলেভিনও।

আজ সে আবার হোটেলে ফিরে হেঁসেলে গেল। মিসেস লোরিং চমৎকৃত, কি ব্যাপার, আজ আবার ম্যানেজার সাহেব রান্নায় হাত দেবেন না কি?

গম্ভীরভাবে বললে কলেভিন, না, তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।

এখানেই বলতে পারো, তৃতীয় কেউ নেই।

সেদিন তুমি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা হাতাবার কথা বলবার পর আমি অনেক ভেবেছি। তোমার কথাই ঠিক। বুদ্ধি আর সাহসের মিশেল ঘটাতে পারলে ব্যাপারটা সম্ভব হতে পারে।

তুমি কি এটা তোমার অন্তর থেকে বলছ?

নিশ্চয়, এই বিপর্যস্ত অভাবী দিনগুলির হাত থেকে রেহাই পেতে আমি তোমার সাহায্য চাই, কিট।

লোরিং-এর জবাবে কোন আবেদন নেই, উপযুক্ত ভাগ পেলে নিশ্চয় সাহায্য করবো।

তাহলে আজ রাতে আমার ঘরে এসো, আলোচনা করব। লোরিং-এর পর্যবেক্ষণীদৃষ্টি আয়োত হয়, ফিসফিসিয়ে বললো, ঠিক আছে, আমি যাবো।

এই সেই রাত, যখন কলেভিনের প্রত্যাশাব্যাকুল দৃষ্টির সামনে বদ্ধ দুয়ার খুলে গেল এবং মোহময়ী মিসেস লোরিং এসে ঢুকলো। চেয়ার টেনে কলেভিনের মুখোমুখি বসে, বলল।

তুমি যদি টাকাটা পাও কি করবে?

প্রথমেই এই বাজে জায়গাটা ছেড়ে পালাবো, তারপর বাকি জীবনটা ফুর্তি করে কাটাবো।

কিন্তু তোমার মেয়ে তো ডেপুটি শেরিফের প্রেমে পড়েছে। সে যদি যেতে রাজি না হয়?

ইরিস বয়সে প্রায় নাবালিকা। ভালমন্দ বোধ এখনো ওর হয়নি। জীবনের রঙিন দিকটা একবার দেখতে পেলে বোকা পুলিশটাকে ঘষা পয়সার মতন ত্যাগ করবে।

লোরিং-এর আলুথালুচুল ও যৌবন সমারোহ মুখের দিকে চেয়ে অনেকটা স্বলিত স্বরে বললো, কিভাবে মালটা সরানো যাবে, বলতো?

বাঃ! তুমি এখনো উপায়টা ভেবেই দেখনি।

কলেভিন হাসে, না। এখনো ভাবছি, তুমিও ভাবো। আমরা দুজনে, ভেবে চিন্তে উপায় একটা ঠিকই বের করবো।

লোরিং দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ায়, তার মুখে বিদায়ী সূর্যের বিষণ্ণতা, তা হলে নিজের ঘরে গিয়েই মাথা ঘামাই।

দরজার কাছে যাবার আগেই কলেভিন তড়াক করে লাফিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়, হাত ধরে বিছানার দিকে টেনে আনবার, চেষ্টা করে। লোরিং একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, ভুলকরছে ম্যানেজার। উপযুক্ত দাম না পাওয়া অব্দি আমি বাড়তি কিছুই তোমায় দেবোনা, যাও। শুয়ে শুয়ে ভাবো। আমিও ভাবি।

কলেভিনের মুখের ওপর কপাট বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, আজ তার মনে কোন মেদুরতা নেই অনেককাল পর আজই প্রথম নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারছে সে,আমি তো আর একা নই, আমার একজন অংশীদার রয়েছে।

.

০৫.

কিছুক্ষণ সবুজ মাঠে শিরা ফুলিয়ে গলফ খেলতে খেলতে কলেভিন দেখলো অন্ধকার ঘনিয়েছে, কুয়াশার জাল ঘন হচ্ছে। শিরদাঁড়া শক্ত করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সে হোটেলে ফিরলো। এই সেই সময়, যখন হলঘরে তিন মূর্তি–এলিস ক্রেগ, মিস পীয়ারসন ও মেজর হার্ডি। পীয়ারসন। ও হার্ডি গুজ গুজ, ফুস ফুস করছে রাজ্যের গুজব, সমস্যা ও তাদের নিরসন নিয়ে। ক্রেগ তার কোট ও টুপি চেয়ারের ওপর ঝুলিয়ে রেখে একমনে উল বুনে চলেছে। দৃশ্যটা আদৌ দৃষ্টিনন্দিত কলেভিনের কাছে। সে নীচু স্বরে ক্রেগের সঙ্গে দু চারটে কথা সেরে একসময় রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। সেখানে লোরিং, কলেভিন তাকে বললো, কিট, আজ রাতে আর একবার এসো। খুব জরুরী।

লোরিং-এর চাঁছাছোলা জিজ্ঞাসা, কোন বায়বীয় পরিকল্পনা নাকি?

কলেভিন, না। নিরেট এবং বিশেষ কার্যকরী।

শহরতলী যখন রাতের প্রভাবে মুমূর্য, তখন লোরিং এলো।

কলেভিন, আমার মাথায় একটা দারুণ পরিকল্পনা এসেছে। মন দিয়ে শুনবে।

 আমি মন দিয়েই শুনে থাকি।

কলেভিন, দেখো, ব্যাঙ্ক থেকে আমি টাকাটা সরাতে পারি। কিন্তু পুলিশের সমস্ত সন্দেহ হবে ব্যাঙ্কের দুই কর্মীর ওপর–আমি এবং মিস এলিস ক্রেগ।

লোরিং (দেওয়াল ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ ফিরিয়ে–সে গুড়ে বালি। তোমার ঘাড়েই গিয়ে পড়বে সন্দেহের সিংহভাগটা।

ঠিক কলেভিন বলে, দাবার চালটা ঠিক ঠিক দিতে পারলে তবে পুলিশের চৈতন্যে অন্য ছায়া খেলা করবে। তাদের সবটুকু সন্দেহ গিয়ে পড়বে মিস ক্রেগের ওপর।

লোরিং–হেঁয়ালি না করে খুলে বলল।

আমরা মানে তুমি আমি–প্রমাণ করবো, মিস ক্ৰেগের একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রেমিক আছে। এমন প্রেমিক যে মিস ক্রেগকে কাজে লাগিয়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখে।

কেউ বিশ্বাস করবে না, এলিসের কোন প্রেমিক নেই।

 নেই তো কি হয়েছে? আমরা প্রমাণ করবে, তার একজন পুরুষ বন্ধু আছে।

কি যে মাথামুণ্ডু বলছে বুঝছি না।

দু চোখ জ্বলতে থাকে কলেভিনের, মিস পীয়ারসন আর মেজর হার্ডি হচ্ছেন গুজববাজ ও গল্পবাজ মানুষ। এরা কেবল গল্প বানায় না, বানানো গল্পকে কপ করে গিলেও নেয়। কেচ্ছা ইত্যাদির প্রতিক্রিয়া ওদের ওপর দারুণ। তুমি ঐ বুড়োবুড়ির কাছে গিয়ে বলবে, মিস ক্রেগ গোপনে একটি যুবকের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছে। সেই বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এলিস সুযোগ পেলেই এখানে সেখানে ঘুর ঘুর করে। তুমি হয়তো খেয়াল করেছে, এলিস অফিস থেকে ফিরেই হলঘরে কোট ও টুপিটা খুলে রেখে ভাড়া বাথরুম ছাদে পায়চারি করতে যায়। তুমি ঐ সময় কোট ও টুপিটা কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রাখবে এবং বুড়ো বুড়িকে বলবে, এইমাত্র এলিস একটি যুবকের সঙ্গে কোথায় যেন বেড়াতে গেল। তারপর আবার এলিস ছাদ থেকে নামলে তার টুপিও কোট যথাস্থানে রাখবে। এই ধন্দময় কারবারটা তোমায় করতেই হবে, ডার্লিং।

এবার লোরিং ভীষণ অস্থির।বেশ, বেশ, তাই না হয় করলুম, কিন্তু এর সঙ্গে নিরাপদে ব্যাঙ্কের টাকা সরাবার কি সম্পর্ক? 

কলেভিন বলে সম্পর্ক অতীব নিগূঢ়, যদিও পৃথিবীর চতুরতম লোকটাও এখানে থৈ পাবে না। ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে শেরিফ সাহেবের অতন্ত্র হুশিয়ারী ও তদারকি সত্ত্বেও টাকা যেদিন লোপাট হবে, সেদিন থেকে মিস এলিসও বেপাত্তা হয়ে যাবে। পুলিশ জানবে, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা সরিয়ে মিস ক্রেগ তার প্রেমিকের সঙ্গে হাওয়া হয়ে গেছে। তার সেই প্রেমিকের গল্প আমি শোনাবো, তুমি শোনাবে। মিস পীয়ারসন শোনাবে। পুলিশ তখন অন্ধকারে হাতিয়ে বেড়াবে মিস ক্রেগ এবং তার বয়ফ্রেন্ডকে।

লোরিং কালেভিনের পরিকল্পনা শুনতে শুনতে বিচলিত হয়ে পড়ে। তার ঠোঁট শুকনো, হাত কাঁপছে, টোক গিলছে, কি ভাবছে লোরিং? পিছিয়ে যাবেনাকি? কিন্তু পিছিয়ে যাবো বললেই তো যাওয়া যাবে না। নিজের নিরাপত্তার খাতিরে লোরিংকে সেই সুযোগ কলেভিন দেবে না। হতে পারে সে আকৰ্ষক রমণী। কিন্তু বিপদ বুঝলে কলেভিন তার গলার হাড়টা মটু করে ভেঙ্গে দিতে পারে। টাকা আমার চাই-ই, চাই। মিসেস লোরিং কাঁপা স্বরে বললো, আমাকে একটু হুইস্কি খাওয়াবে?

নিশ্চয়। উঠে গিয়ে কলেভিন উত্তেজক পানীয় নিয়ে এলো।

হুইস্কিটুকু একসঙ্গে গলায় ঢেলেমিসেস লোরিংয়ের যেন আরো উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, মুখ চোখ লাল, ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসে তার বুক দুলছে।

 লোরিংয়ের কাধ ধরে ঝাঁকুনি দেয় কলেভিন। তুমি কি ঘাবড়ে গেলে?…কিন্তু এখন তো ভয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। তুমি আমার সমস্ত পরিকল্পনা জেনে গেছে। তোমাকে এ অভিযানের শরিক হতেই হবে।

 তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?

কলেভিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, তিন শ হাজার ডলারের জন্য একটা বা দুটো খুন এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। অন্ততঃ এ নিয়ে মাথা খারাপ করলে চলবে না। আর সত্যি কথা বলতে কি, এর আগেও আমি অনেক মানুষ খুন করেছি। ব্যাঙ্কে ঢুকবার আগে আমি মিলিটারিতে ছিলাম। উধ্বতনের হুকুম মানতে গিয়ে কত তরুণকে নির্বিচারে হত্যা করেছি। আর আজ দুর্দান্ত ভবিষ্যত গড়তে আর একবার এই হাতে রক্ত লাগাতে পারবো না? আমি অত গবেট ভীরু নই।

 দু হাতে মুখ ঢেকে লোরিং শুনছে। তারদিকে কলেভিন আর এক গ্লাস হুইস্কি এগিয়ে দেয়।

লোরিং চোঁ করে সবটা গিলে নিলো। কেমন যেন অস্বাভাবিক হেঁচকি উঠছে। লোভাতুর দৃষ্টিতে বোতলটার দিকে চেয়ে স্বলিত স্বরে বললো, আমাকে আর একটু ভাবতে দাও। মাইরি, একটুখানি সময়

ঠিক আছে। যা ভাববার আজকের রাতেই ভাববে। কাল সকালেই জবাব চাই।

 লোরিং টলতে টলতে নিজের ঘরে গিয়ে কপাটটা বন্ধ করে দিল।

সিগ্রেট ধরায় কলেভিন। সিগ্রেটটা শেষ হলে বাথরুমে ঢুকে বেশ খানিকটা জল শরীরের ওপর বইয়ে সে একটা তোয়ালে পরে নিজের ঘরে ফিরে আসে। আবার একটা সিগ্রেট বের করে আয়নায় নিজের বিপুল প্রতিবিম্বকে দেখে কেমন যেন কামার্ত হয়ে ওঠে সে। সে অনেকগুলো রাত এখানে পার করেছে অথচ পাশের ঘরে…। সে পায়ে পায়ে ঐ বদ্ধ কপাটের দিকে গিয়ে হাতলটা ধরে মোচড় দেয় এবং

 কী আশ্চর্য! বদ্ধ দুয়ার খুলে গেছে। কলেভিনের বুকের মধ্যে যে বন্দী বাঘ এতদিন ক্রুদ্ধ আর্তনাদ ছেড়েছে, আজ সে বেরিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ সে ঘরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে। মৃদুনীল আলো। স্বচ্ছ মশারির তলায় শুয়ে থাকা মিসেস লোরিংকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পরনে গোলাপি নাইটি। বুক দুটো উঁচু হয়ে আছে। কোমরের কাছ থেকে শরীরটা একটু বেঁকে আছে, একটা হাঁটু মাথা তুলে বুঝি জানিয়ে দিচ্ছে, যে কোন শক্তিমান পুরুষের সঙ্গে দ্বিমুখী দ্বন্দ্বের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে এই রমনী দেহ। লোরিং এবং কলেভিন-দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। কলেভিন ধীরে ধীরে বিছানায় পৌঁছে বসে পড়লো। কলেভিন মশারির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে লোরিংয়ের বাহু স্পর্শ করলো তারপর নাইটির তলায় ভরাট বুক অব্দি পৌঁছে গিয়েও কোন প্রতিরোধ না পেয়ে সত্যিই এক ক্ষুধার্ত বাঘের মতনমিসেস লোরিংয়ের দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।নাইটি ফাইটি কোথায় গুটিয়ে ফেলে নিজের তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কলেভিন লোরিংয়ের যাবতীয় গভীরতাকে ছিঁড়ে ফুড়ে তপ্ত তৃপ্তির সন্ধান করতে থাকে। তার প্রয়াসের, উদ্দীপনার অন্ত নেই। কিন্তু মিসেস লোরিং আশ্চর্য নিষ্ক্রিয়, নির্বাক। এ সময় কোন প্রেমিকা যেভাবে সাড়া দেয়, সুখ ও তৃপ্তিতে সমান ভাগ বসাতে চায়, মিসেস লোরিংয়ের মধ্যে তা দেখা গেলনা। স্থলন-লগ্নে কলেভিনের মনে হলো, তার চৈতন্যে দোলা দিয়ে গেল সেই বিরক্তির অনুভূতি; আমি এই মুহূর্তে যেন এক বেশ্যা সংসর্গ সমাপ্ত করছি। কোন সাড়া নেই, পুরস্কার নেই,….যাচ্ছে তাই…..।