২. টমির ঘরে

০৬.

 সারারাতে কেউ আর টমির ঘরে ঢুকল না। টেনে ঘুমোলা সে। একসময় দরজার চাবি খোলার শব্দ হতে জেগে উঠে বসল। সময় দেখল, সকাল আটটা।

একটা মেয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখল। গ্যাসের অস্পষ্ট আলোয় মেয়েটিকে অসাধারণ সুন্দরী মনে হলো। মাথায় সোনালী চুলের স্তূপ। উজ্জ্বল গায়ের রঙ।

–তুমি জেন ফিন? জিজ্ঞেস করল টমি।

আমার নাম অ্যানেট, মঁসিয়ে।

 –তুমি ফরাসী? ট্রেতে কি প্রাতঃরাশ?

–হ্যাঁ।

মেয়েটি দরজার দিকে এগোল। টমি বলল, যেও না, তোমাকে দুটো কথা জিজ্ঞেস করব।

ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটি।

-এখানে তুমি কাজ কর? প্রশ্ন করল টমি।

 –হ্যাঁ, আমি কাজের লোক।

–মেয়েটি কোথায় জান? জেন ফিন?

–সে এ বাড়িতে নেই। ওরা অপেক্ষা করছে, আমি যাই।

 দরজায় তালা দিয়ে চলে গেল মেয়েটি।

বেলা একটায় লাঞ্চ পেল টমি। সেই সময় মেয়েটির সঙ্গে কনরাডও ঢুকল। কাজেই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল না।

রাত আটটায় মেয়েটি দরজা খুলল। একাই ঘরে ঢুকল।

–তোমার সঙ্গে কথা আছে অ্যানেট। আমাকে পালাতে সাহায্য করবে?

 –সম্ভব নয়। নিচে ওরা তিনজন রয়েছে। আমি ওদের ভয় পাই।

–আমায় যদি সাহায্য কর, অনেক টাকা দেব, তোমারই বয়সী আরেকটি মেয়ের জন্য আমাকে সাহায্য করতে পার না?

–জেন ফিন? আপনি তার জন্য এসেছেন?

 –হ্যাঁ, ঠিক।

–জেন ফিন নামটা চেনা।

–ওর কথা তুমি যা জান আমায় বলল।

অ্যানেট কথার জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

কনরাড আর অ্যানেটের সাহচর্যে তিনদিন একইভাবে কেটে গেল। কনরাড টমিকে জানিয়েছে, ওরা সকলে মিঃ ব্রাউনের হুকুমের অপেক্ষা করছে।

সেই প্রতীক্ষা শেষ হল তৃতীয় দিন সন্ধ্যা সাতটায়। কনরাড আর একটা লোক হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকল। ওরা দড়ি দিয়ে টমিকে বেঁধে ফেলল।

-তোমার দিন শেষ। ধাপ্পা ধরা পড়ে গেছে–কিছুই জানো না তুমি। কাল সকালেই গাড়ি করে তোমাকে পাচার করা হবে। বলল কনরাড।

–আমাকে খুন করবে না? জানতে চাইল টমি।

–তাতে সন্দেহ কি? তবে এখানে নয়। তাহলে পুলিস খবর পেয়ে যাবে।

দুজনে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

আধঘণ্টা পরেই অ্যানেট ঢুকল।

বাইরে থেকে কনরাডের গলা শোনা গেল।

-আজ ওর খাবারের দরকার হবে না অ্যানেট, বেরিয়ে এসো।

–ঠিক আছে। আমি ট্রে নিতে এসেছি।

–ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো।

অ্যানেট ট্রেটা তুলে নিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে টমি টের পেল, ছোট্ট ঠান্ডা কি একটা চকিতে অ্যানেট তার হাতে গুঁজে দিল।

দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা আমায় দাও। কনরাডের গলা শোনা গেল।

 অ্যানেট একটা পেন্সিল কাটা ছুরি টমির হাতে দিয়েছিল। সেটা সে তৎক্ষণাৎ কাজে লাগাল। অনেক কষ্টে দড়ির বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করল।

এবারে বেরুবার উপায় করতে হবে…

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঝট করে উঠে টমি দেয়াল থেকে একটা ছবি নামিয়ে হাতে নিল।

দরজা খুলে ঢুকেই গ্যাসের আলো জ্বালতে গেল কনরাড। তার পেছনেই দেখা গেল একজনকে।

লোকটা একটু এগোতেই টমি ছবিটা তুলে সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্বিতীয় লোকটার মাথায় আঘাত করল। কাচ ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দ…অস্ফুট আর্তনাদ…লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

পলকের মধ্যে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ত্রস্ত হাতে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল টমি। কনরাড দরজায় আঘাত করে চিৎকার করতে লাগল।

নিচে থেকে জার্মান লোকটার চিৎকার শোনা গেল–কি ব্যাপার কনরাড

দোতলায় অন্ধকারে টমিকে কে পাশে টানল–অ্যানেট…পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা চিলেকোঠায় ঠেলে দিল।

-চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন।

নিচে বন্ধ দরজায় দমাদম শব্দ হচ্ছে। জার্মান নোকটা চেঁচাচ্ছে। দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা চলছে।

অ্যানেট একটা জগের হাতলে একটুকরো দড়ি বাঁধল। টমিকে বলল, দরজার চাবিটা আমাকে দিন। দরজা বন্ধ, ভাঙ্গতে দেরি হবে। আমি নিচে যাচ্ছি–এই সুতোটা ধরে থাকুন…আমি দরজা খুলছি। ওরা বেরলেই দড়িটা ধরে টান মারবেন।

টমি কিছু বলার সুযোগ পেল না। অ্যানেট নিচে নেমে গেল। একটু পরেই সশব্দে দরজা খোলার শব্দ। কনরাডের চিৎকার–সে কোথায়?

-কেউ তো যায়নি, জার্মান লোকটা বলল।

–সে পালিয়েছে–

ঠিক এই সময় টমি দড়ি ধরে টানল। সঙ্গে সঙ্গে কাচের বাসন ভাঙ্গার শব্দ হল। লোক তিনটে দৈত্যের মত শব্দ তুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠল।

টমি বেরিয়ে এসে নিচে ছুটল। অ্যানেটকে দেখতে পেল। কিন্তু পলকের মধ্যে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

–লোকটা পালিয়েছে…কি করে হল?

জার্মান লোকটার গলা। অ্যানেটেরও গলা পাওয়া গেল–এ বাড়িতে আর নয়–আমি মার্গারেটের কাছেই চলে যাব

অ্যানেট আবার ফিরে গেছে। তার সঙ্গে যাবার ইচ্ছে নেই, টমি বুঝতে পারল…ওরা সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে আসছে…হলঘর পার হয়ে সে দৌড়ে রাস্তায় নেমে এল…

সকাল সাড়ে পাঁচটা। রেস্তোরাঁয় ঢুকে টমি প্রাতঃরাশ সারতে সারতে কাগজটা দেখল। প্রথম পাতাতেই ছবি দিয়ে ক্রেমেলিন সম্পর্কে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এই লোকটাই রুশ বিপ্লবের নায়ক, বলা হয়েছে। কদিন আগেই সে লন্ডনে এসেছে।

টমি মনে মনে বলল, এই লোকই তো সবার শেষে ঘরে ঢোকে, অন্য রকম অভ্যর্থনা পায়। তাহলে তুমিই একনম্বর।

বিল মিটিয়ে হোয়াইট হ্রলে এসে চিরকুট পাঠিয়ে মিঃ কার্টারের সঙ্গে দেখা করল সে। সব কথা খুলে বলল।

মিঃ কার্টার, টেলিফোনে কিছু জরুরী নির্দেশ দিলেন। টমিকে বললেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে, ওরা এতক্ষণে সরে পড়েছে নিশ্চয়। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ, তারিখটা ২৯ শে, আর ক্রেমলিন উপস্থিত। সাধারণ ধর্মঘট সামলানো কষ্ট হবে না। কিন্তু চুক্তির খসড়ার ব্যাপার হলে ইংলন্ডকে বাঁচানো যাবে না। চল সোহোর বাড়িটা ঘুরে আসা যাক।

.

পাখি আগেই পালিয়েছিল। বাড়িতে কিছুই পাওয়া গেল না।

–মেয়েটাকে ওদের দলের বলে মনে হল না স্যার।

-ও ইচ্ছে করেই ফিরে যায় বলছ? তোমার মৃত্যু সে দেখতে চায়নি সম্ভবতঃ। কিন্তু কেমন খাপছাড়া লাগছে।

ওখানে আর কিছু করার ছিল না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে টমি রিজে রওনা হল। সে ভাবল, টুপেনস হয়তো রিটাকে নিয়েই লেগে রয়েছে। অ্যানেট বোধহয় তাকেই মার্গারেট বলছিল।

.

হোটেলের অফিসে খবর নিয়ে জানা গেল, টুপেনস পনেরো মিনিট আগেই বেরিয়ে গেছে।

 রেস্তোরাঁয় এসে খাবার নিয়ে বসল টমি।

–হ্যাল্লো টমি। ওহ, কী ভাবনায় ফেলেছিলে।

 পাশে এসে বসল পার্সিভেল-কোথায় ছিলে এতদিন?

টমি তার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী শোনাল।

–একেবারে যেন সিনেমা।

–টুপেনস নেই দেখলাম। তোমাদের কথা শোনাও। বলল টমি।

–অ্যাডভেঞ্চার আমরাও কম করিনি।

হার্সিমার, মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত সমস্ত কথা বলল।

–সব ক্ষেত্রেই দেখছি মিঃ ব্রাউন, অবাক হয়ে বলল টমি, লোকটার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। খানিক পরে ওপরে উঠে এলো টমি। একটা বাচ্চা ছেলে এসে খবর দিল, মিস ট্যাক্সি করে বেরিয়ে গেছে।

এরপর তার কাছ থেকেই সাংঘাতিক খবরটা জানতে পেল টমি। সাড়ে বারোটা নাগাদ একটা টেলিগ্রাম সে এনে দিয়েছিল। সেটা পড়ার পরেই টুপেনস ঝপপট ট্যাক্সি ডাকিয়ে চেয়ারিংক্রশ যাচ্ছে বলে চলে গেছে।

টেলিগ্রামটা টুপেনস সঙ্গে নেয়নি। সেটা পাকিয়ে চুল্লীর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। টমি আর হার্সিমার সেটা খুঁজে বার করল। টেলিগ্রামটা এরকম :

এখনই এসো। মোটহাউস, এবারি, ইয়র্কশায়ার। টমি।

–সর্বনাশ। এ টেলিগ্রাম আমি পাঠাইনি।

 –তুমি পাঠাওনি, হার্সিমার আঁৎকে উঠল, টুপেনসকে ওরা ফাঁদে ফেলেছে নির্ঘাৎ।

ওরা আর সময় নষ্ট করল না। ব্রাডশ দেখে ট্রেনের সময় খুঁজে বার করল।

-এই তো, এবারি, ইয়ার্কশায়ার, বলল টমি, কিন্তু ট্রেন তো চেয়ারিংক্রশ থেকে নয়। ছেলেটা ভুল শুনেছে। বারোটা পঞ্চাশের ট্রেনই টুপেনস ধরেছে। কিংক্রশ বা সেন্ট প্যানক্রাশ থেকে।

–আমরা তিনটা কুড়ির ট্রেনই ধরব। বলল হার্সিমার।

.

জনশূন্য এবারি স্টেশনে নেমে মোটহাউস খুঁজে বার করতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজল ওদের।

শ্যাওলা ধরা পুরনো একটা বাড়ি।

দরজা জানালা বন্ধ।

ঘন্টা বাজিয়ে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

বাড়িটার চারপাশ ঘুরেও ভেতরে কাউকে দেখা গেল না।

একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, মোটহাউস, বহুবছর খালি পড়ে আছে।

বাধ্য হয়ে ইয়র্কশায়ার আর্মস বলে কাছাকাছি একটা জায়গায় ছোট্ট সরাইতে রাতটা কাটাল তারা।

পরদিন সকাল থেকেই তারা এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। বাড়ির ভেতরে ধুলোর আস্তরণের ওপরে টুপেনসের একটা সোনার ব্রোচ খুঁজে পাওয়া গেল। ওরা নিশ্চিত হল, টুপেনস এখানে এসেছিল। তাকে কেউ জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।

গ্রামের কেউ নিশ্চয় ওকে দেখে থাকবে। ওকে যেভাবেই হোক খুঁজে বার করব। বিচলিত কণ্ঠে বলল টমি। টুপেনসের বর্ণনা দিয়ে গ্রামের সবজায়গায় খোঁজ করা হল। কিন্তু তার কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না।

দুজনের সাতটা দিন এখানেই কেটে গেল।

 হঠাৎই ২৯শের কথা মনে পড়ে গেল টমির।

–এখানে এতদিন থেকে আমাদের ভুল হয়েছে, হার্সিমার। সামনের রবিবারেই ২৯শে। তার আগেই টুপেনসকে বার করে আনতে হবে।

শেষ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করাই স্থির হলো। টমি রয়ে গেল। হার্সিমার লন্ডন রওনা হয়ে গেল।

কিন্তু বিকেলের দিকেই হার্সিমারের টেলিগ্রাম পেল টমি :

ম্যাঞ্চেস্টারে মিডল্যান্ড হোটেলে দেখা কর। জরুরী। জুলিয়াস।

.

সাতটা তিরিশে প্ল্যাটফর্মে নেমেই হার্সিমারের সঙ্গে টমির দেখা হল।

-টুপেনসের খবর পেয়েছ? জানতে চাইল সে।

–না। কিছু আগেই এই টেলিগ্রামটা পেলাম। এখনই ম্যাঞ্চেস্টারে মিডল্যাণ্ড হোটেলে আসুন। পিল এজারটন।

.

রাত আটটায় টমিকে নিয়ে স্যার জেমসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল হার্সিমার।

টমিকে তিনি প্রথম দেখলেন। খুশি হয়ে বললেন, টুপেনসের কাছে আপনার কথা শুনেছি।

প্রাথমিক সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর স্যার জেমস ওদের বিস্মিত করে জানালেন, শেষ পর্যন্ত তিনি জেন ফিনকে খুঁজে বার করেছেন।

হার্সিমার উল্লসিত হয়ে তাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল।

স্যার জেমস জানালেন, পথদুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়ে মেয়েটি হাসপাতালে ছিল। জ্ঞান ফিরে এলে নিজের নাম জেন ফিন বলেছে। আমার বন্ধু এক ডাক্তারের কাছে তাকে সরিয়ে দিয়েছি। তারপরই আপনাকে খবর পাঠাই।

–আঘাত কি গুরুতর? জানতে চায় হাসিমার।

–আঘাত সামান্য। তবে ডাক্তার বলেছেন তার স্মৃতিশক্তি ফিরে আসছে।

–তাহলে ডিনারের পর জেনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে পারব?

 স্যার জেমস বললেন, আজ রাতে আর তার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না। কাল সকাল দশটায় যাওয়াই ভালো।

স্যার জেমসের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে টমি চমকে উঠল। হার্সিমারের সমস্ত আগ্রহে জল পড়ল।

এরপর টমির সমস্ত ঘটনা শুনে তাকে তার বুদ্ধি ও সাহসিকতার জন্য অভিনন্দন জানালেন।

-ওই মেয়েটাই আসলে আমাকে বাঁচিয়েছে–অ্যানেট। বলল টমি।

 –আপনার সৌভাগ্য। না হলে ওই দলের মেয়ে হয়ে

–কিন্তু ওর ব্যবহার অন্যরকম ছিল। পালাবার সময়ে শুনলাম ও বলছে, মার্গারেটের কাছে চলে যাবে। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের কথাই মেয়েটি বলতে চেয়েছিল আমার ধারণা।

–আশ্চর্য যে, সে যখন ওই কথা বলছে, ঠিক সেই সময়েই মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার মারা গিয়েছেন। তা সেই বাড়িটা পরীক্ষা করা হয়েছিল?

–হ্যাঁ। কাউকে পাওয়া যায়নি। ভালোকথা, আপনাকে তো টুপেনসের কথা জানাতেই ভুলে গেছি স্যার।

এরপরে গত একসপ্তাহের ঘটনা টমি বলল। সব শুনে স্যার জেমস বললেন, আপনার নামে ভুয়ো তার পাঠিয়েছিল, বোঝা যাচ্ছে ওরা সবই জানে। আচ্ছা, আপনার পরিচয় কি জানিয়েছিলেন?

–কোনোভাবেই না। বলল টমি।

–অন্য কেউ নিশ্চয় জানিয়েছে

–কে জানিয়ে থাকতে পারে? বলল টমি।

 –সর্বশক্তিমান সেই মিঃ ব্রাউনই হবে। বললেন স্যার জেমস।

–ওসব সবই ভাওতা। সেই রুশ ক্রেমলিনই সব কলকাঠি নাড়ছে, বলল টমি, তিনটে দেশে বিপ্লব ঘটাবার ক্ষমতা ধরে লোকটা। ইংলন্ডের দায়িত্বে আছে হুইটিংটন।

–যাই ভাবুন, মিঃ ব্রাউন আছেন। যাইহোক, জেন ফিনের এদিকটা সামলেই মিস টুপেনসকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করব। জেন ফিনের কথা আপাততঃ গোপন রাখাই ভালো হবে।

.

পরদিন সকালে স্যার জেমস নির্দিষ্ট জায়গায় ওদের দুজনকে ডাক্তার রয়ল্যান্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ডাক্তার সকলকে নিয়ে ওপরে রোগীর ঘরে এলেন। ধবধবে বিছানায় মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা একটি মেয়ে শায়িত।

টমির মাথায় টুপেনসের চিন্তাই চেপে ছিল। স্যার জেমস ওকে খুঁজে বার করবেন বলেছেন। কিন্তু মিঃ ব্রাউনের অদৃশ্য হাত যদি তার আগেই..

বিছানায় শায়িত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চকিতে তার মনে হল, সবকিছু সাজানো নয় তো?

হার্সিমারের প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি যখন বলল, আপনি সত্যিই হিরাম মামার ছেলে? টমির মনে হল, কণ্ঠস্বর যেন আগে কোথায় শুনেছে।

মেয়েটি আবার বলল, কাগজে হিরাম মামার কথা পড়তাম। মা বলতেন, তার ভাইয়ের রাগ কোনোদিনই পড়বে না।

-বুড়োদের যুগ বদলে গেছে। তাই যুদ্ধ থামতেই তোমার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি। বলল হার্সিমার।

–আমার নাকি স্মৃতি মুছে গেছে–আগের কোনো কথা মনে পড়বে না

 –তুমি নিজে কিছু বুঝতে পারছ?

–মনে হয় না। জোর করে আমাদের বোটে তুলে দেওয়া হল এপর্যন্ত কেবল মনে করতে পারছি।

এবারে ঠিক সেরে উঠবে। আচ্ছা জেন, একটা কথা বলতে পারবে, জাহাজে একজন লোক তোমাকে কিছু জরুরী কাগজপত্র দিয়েছিলেন।

মেয়েটি ওদের দিকে তাকিয়ে ইতস্ততঃ করল। হার্সিমার টমিকে দেখিয়ে বলল মিঃ–বেরেসফোর্ড, ব্রিটিশ সরকারের হয়ে ওই কাগজ উদ্ধারের কাজ করছেন। আর স্যার জেমস খোদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। তুমি নির্ভয়ে সব বলতে পার।

-উনি বলেছিলেন, বলল মেয়েটি, কাগজগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ–কিন্তু যুদ্ধ তো থেমে গেছে, এখন আবার

-সেই কাগজ ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এখন আবার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সেগুলো আমাদের হাতে তুলে দিতে পারবে?

এরপর জেন ফিন জানালো, হোলিহেড হয়েই এসেছিলেন। আর ওখানেই সব ঘটেছিল। জেটির ওপর গণ্ডগোল বেঁধেছিল। আমি সেখান থেকে পালিয়ে গাড়ি নিয়ে শহরের বাইরে চলে যাই।

একটা পাহাড়ের কাছে, ঝোপের মধ্যে ঢুকে কুকুর আকৃতির একটা পাথরের গায়ে গর্ত পেলাম। তেলা কাগজের প্যাকেটটা তার মধ্যেই রেখে দিলাম। ঘাসলতাপাতা দিয়ে গর্তের মুখটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

জায়গাটাকে ভালো করে চিনে নিলাম। তারপর গাড়িতে ফিরে এসে ট্রেন ধরলাম।

আমার পাশের সহযাত্রী ভদ্রলোক এক মহিলাকে চোখের ইশারা করলেন। আমার ভয় হল। করিডরে গেলাম। আচমকা মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। তারপর জেগে দেখি এই হাসপাতালে শুয়ে আছি।

নিশ্চয় আপনার ক্লান্তিবোধ হচ্ছে, ধন্যবাদ মিস ফিন।

উঠে দাঁড়ালেন স্যার জেমস।

–বিদায় জেন। কাগজগুলোর খোঁজে বেরতে হবে এখন। তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ। ফিরে এসে আমরা আমেরিকায় ফিরে যাব।

.

স্যার জেমস বললেন, এখনই রওনা হলে চেস্টারে বারোটা চল্লিশের হোলিহেডগামী ট্রেন পেয়ে যাবেন। সতর্ক থাকবেন–মিঃ ব্রাউনের দৃষ্টি সর্বত্রগামী। যদি বোঝেন কেউ অনুসরণ করছে, কাগজগুলো নষ্ট করে ফেলবেন।

একরকম তাড়া দিয়েই যেন স্যার জেমস তাদের পাঠিয়ে দিলেন। হার্সিমার ও টমি চেস্টারে পৌঁছে প্রথম শ্রেণীর একটি কামরায় উঠে বসল।

হোলিহেডে পৌঁছে, মানচিত্র ধরে ট্রেভুর উপসাগরের দিকে এগিয়ে জেন ফিনের বর্ণনা মতো কুকুর আকৃতির পাথর–তার গায়ে গর্ত–গর্তের ভেতরে তেলা কাগজে মোড়া প্যাকেটটি উদ্ধার করল ওরা।

কিন্তু প্যাকেট খুলতেই সাদা কাগজ–তার বুকে লেখা–মিঃ ব্রাউনের শুভেচ্ছা সহ—

হতভম্ব হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল টমি আর হার্সিমার।

–আমরা ব্যর্থ, বলল টমি, তবে একটা কাজ এখুনি আমাকে করতে হবে। কাগজগুলোর ব্যাপারে মিঃ কার্টারকে সাবধান করে দিতে হবে। নইলে সর্বনাশ হতে আর বাকি থাকবে না।

হার্সিমার হোলিহেডেই থেকে গেল। টমি মাঝরাতেই লন্ডনের মেল ধরল।

.

–আমার ব্যর্থতার কথাই জানাতে এলাম স্যার, বলল টমি, চুক্তির সেই খসড়া মিঃ ব্রাউনের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারলাম না।

তুমি ভেবো না, শান্ত কণ্ঠে বললেন মিঃ কার্টার, তুমি যথাসাধ্য করেছ, প্রায় সফলও হয়েছিলে। আমি অন্য খবরটা নিয়ে চিন্তিত।

টেবিলের খবরের কাগজটার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি।

–খবরটা পড়ে দেখ।

…এবারির কাছে ইয়র্কশায়ারের তীরে একটা মৃতদেহ ভেসে আসে…তার গায়ের সবুজ কোট, পি. এল. সি. লেখা রুমাল থেকে মৃতদেহ সনাক্ত করা হয়েছে…

–হ্যায় ভগবান। আর্তনাদ করে উঠে ব্যথাতুর চোখে মিঃ কার্টারের দিকে তাকাল টমি।

–ওরা টুপেনসকে খুন করেছে স্যার, ওদের শায়েস্তা না করে আমি শান্তি পাব না।

-তোমার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। অনভিপ্রেত অনেক কিছুই আমাদের মেনে নিতে হয়। মেয়েটার জন্য আমি দুঃখিত।

.

বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছিল। তীব্র বেদনায় যেন পাঁজরা গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সবকিছুই দুঃস্বপ্ন হচ্ছিল টমির।

রিজে ফিরে সুটকেস গুছিয়ে নিল। ঘণ্টা বাজিয়ে বয়কে হুকুম করল ট্যাক্সি ডাকার জন্য।

মিঃ ব্রাউন যতই রহস্যময় অস্তিত্ব হোক, তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে হবে–টুপেনসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে।

স্যার জেমসের একটা চিঠি সে পেল। কাগজের খবরটা পড়ে সহানুভূতি জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে কৃপা পরবশ আর্জেন্টিনায় একটা চাকরির প্রস্তাবও পাঠিয়েছেন।

স্যার জেমসকে একটা চিঠি লিখবে ভেবে টমি খাম কাগজ খুঁজল। না পেয়ে হার্সিমারের ঘরে খুঁজতে গেল। ঘর খালি। টমি টেবিলের ড্রয়ার টানল।

একটি মেয়ের ছবি চোখের পড়ল। চিনতে ভুল হল না। সেই ফরাসি মেয়ে অ্যানেট।

 টমির ভ্রু কুঞ্চিত হল। এই মেয়ের ছবি হাসিঁমারের ড্রয়ারে এল কি করে?

.

০৭.

প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি ঠিক দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছি না। ছেলেটির চিঠিটা আর একবার দেখা

মিঃ কার্টার চিঠিঠা পড়ে শোনালেন, সেটা তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লেখা।

প্রিয় মিঃ কার্টার,
একটা আকস্মিক আবিষ্কার আমাকে চমকে দিয়েছে। আমি একরকম নিশ্চিত যে ম্যাঞ্চেস্টারের ওই মেয়েটি আসল নয়, সম্পূর্ণ সাজানো। আমাদের পথ থেকে সরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই ওই নকল আয়োজন করা হয়েছিল। আমরা যে ঠিক পথে চলেছি, তাতে সন্দেহ নেই।

আসল জেন ফিন কে আমি তা জেনেছি। কাগজগুলোর হদিশও পেয়েছি। সমস্ত কিছু লিখে একটা আলাদা খামে আমি পাঠালাম। ওটা একেবারে শেষ মুহূর্তে, ২৪ তারিখ মধ্যরাতে খুলবেন। আমার একথা বলার কারণ একটু পরেই বুঝতে পারবেন।

টুপেনস ডুবে মরেছে, তার যেসব জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে, সবই স্রেফ ধাপ্পা। এসবের কারণটাও আমি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি। শেষ অস্ত্র হিসেবেই ওরা জেন ফিনকে পালাবার সুযোগ দেবে যাতে সে আসল জিনিসের কাছে চলে যায়। জেন ওদের সবকিছু জানে, ওকে মুক্তি দেওয়া তাই তাদের পক্ষে মস্ত ঝুঁকির কাজ। তবু ওই চুক্তির খসড়াটার তারা এই ঝুঁকি নেবে।

কিন্তু ওই কাগজপত্র আমরা উদ্ধার করেছি, যদি একথা ওরা জানতে পারে, তাহলে ওই দুটি মেয়ের জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়বে তাদের কাছে। কাজেই, বুঝতে পারছেন, জেন পালাবার আগেই আমাকে টুপেনসকে উদ্ধার করতে হবে।

রিজে টুপেনসকে যে তারবার্তা পাঠিয়েছিলাম, সেটা আবার পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার পক্ষে সেটা অসম্ভব হবে না বলে স্যার জেমস জানিয়েছেন।

আর একটা কথা, সোহোর সেই বাড়িতে পাহারা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করবেন।
আপনার বিশ্বস্ত
টমাস বেরেসফোর্ড

–খামের সেই চিঠিটা তাহলে।

কথা অসমাপ্ত রেখে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।

–আমাদের চারপাশেই চর। কাজেই কোনো ঝুঁকি নেই নি। ওটা ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিয়েছি।

-ওটা এখনই খোলা উচিত মনে করছেন না?

–মেয়েটির জীবনমরণের প্রশ্ন তার সঙ্গে জড়ানো। ছেলেটি আমাদের বিশ্বাস করেছে

–বেশ তাই হোক। ছেলেটিকে কিরকম মনে করেন?

ইংরেজ ছেলেদের মতোই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তবে বুদ্ধি কিঞ্চিৎ মোটা। কোনোক্রমেই বিপথগামী হবার নয়। মেয়েটির বুদ্ধি যাইহোক, সহজাত প্রেরণায় ভরপুর। ওরা দুজনে পরিপূরক বলা যায়।

–ছেলেটিকে বাহাদুরি দিতে হচ্ছে, এ সময়ের সেরা অপরাধীর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে। বললেন প্রধানমন্ত্রী।

–তা, ঠিক। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয় ওর পেছনে একটা অদৃশ্য চালিকা শক্তি রয়েছে।

–চালিকা শক্তি?

-হ্যাঁ, পিল এজারটন। সবকিছুতে তারই হাত রয়েছে। আড়ালে থেকে তিনি গোপনে কাজ করে চলেছেন। মিঃ ব্রাউনকে যদি কেউ কজা করতে পারে, সে হল পিল এজারটান। বলতে ভুলে গেছি, কদিন আগে তার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত অনুরোধ পেয়েছি।

–অদ্ভুত কেন? আগ্রহের সঙ্গে বললেন প্রধানমন্ত্রী।

–আমেরিকার কোনো কাগজের একটা কাটা অংশ পাঠিয়েছেন। খবরটা হল, নিউইয়র্কের একটা ডকের কাছে এক তরুণের মৃতদেহ আবিষ্কার প্রসঙ্গে। লোকটাকে সনাক্ত করা যায়নি। তিনি এ সম্পর্কে খোঁজ করতে বলেছেন।

–দুটো ব্যাপারের মধ্যে যোগসূত্র আছে আপনি মনে করেন?

–অসম্ভব নয়। বিষয়টা আরও পরিষ্কার করার জন্য আমি তাকে আসতে বলেছি। বেরেসফোর্ডের চিঠির ব্যাপারে তিনি কিছু জানতে পারেন।

একমিনিট পরেই স্যার জেমস উপস্থিত হলেন। তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন। প্রধানমন্ত্রী জানেন, আগামী দিনে তিনিই তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।

স্যার জেমস বললেন, বেরে ফোর্ড আমাকে ফোন করেছিল।

আপনাদের কি বিষয়ে কথাবার্তা হল, আমাদের জানাতে আপত্তি আছে? জানতে চাইলেন মিঃ কার্টার।

–কিছুমাত্র না। আমি তাকে একটা চাকরির প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখেছিলাম, তাই ধন্যবাদ জানিয়েছিল। আর ম্যাঞ্চেস্টারের একটা ঘটনার কথা জানিয়ে বলে একটা ভুয়ো টেলিগ্রাম করে মিস কার্ডলকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আরও জানায় হার্সিমারের ঘরে একটা ফটো সে আবিষ্কার করে; ফটোটা সেই ফরাসি মেয়ে অ্যানেটের। এই মেয়েটিই তার প্রাণ বাঁচায়।

-তাই কি!

–হ্যাঁ। ফটোটা দেখার পর সে খুবই ধাঁধার পড়ে যায়। অবশ্য ফটোটা যথাস্থানেই রেখে দিয়েছে। ম্যাঞ্চেস্টারের মেয়েটি যে জাল তা সে বুঝতে পেরেছে। তবে টেলিগ্রাম পেয়ে মিস কার্ডলের যেখানে যাবার কথা, সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। টেলিগ্রামের কথাটা আপনাকে জানাবার কথা আমি তাকে বলি।

কার্টার সব জানিয়ে একখণ্ড কাগজ বার করে পড়লেন, শিগগির এসো, অ্যাসলে প্রিয়রস, গেট হাউস, কেন্ট, টমি।

–মিস কার্ডল সম্ভবতঃ টেলিগ্রামটা পড়ার পর ঘরেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ওরা অনুসন্ধানকারীকে ভুল পথে চালনা করার জন্য ওটার দু-একটা শব্দ বদলে দিয়েছিল। যেমন, ছোকরা চাকরের কথা। সে বলেছিল যে মিস কার্ডল চেয়ারিংক্রশ গেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটা ওরা লক্ষ্য করেনি, ভেবেছে ছোকরা ভুল শুনেছে।

বেরেসফোর্ড তাহলে এখন কোথায়?

–সম্ভবতঃ কেন্টের গেট হাউসেই রয়েছে।

–মনে হয়, আপনারও সেখানে যাওয়া দরকার ছিল, পিল এজারটন।

–উপায় ছিল না। একটা মামলার কাজে ব্যাস্ততা রয়েছে। ভালোকথা, ওই আমেরিকান সম্বন্ধে কোনো খবর আছে?

-এখনো জানা যায়নি। লোকটির পরিচয় জানা আবশ্যক।

স্যার জেমস বললেন, আমি জানি, কিন্তু এখনই প্রমাণ করা যাচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী আচমকা বলে উঠলেন, ব্যাপারটা খুবই রহস্যময় ঠেকছে। মিঃ হার্সিমারের। ড্রয়ারে ফটোটা এলো কিভাবে?

-ওটা সম্ভবতঃ যথাস্থানেই ছিল।

–তাহলে সেই জাল ইনসপেক্টর ব্রাউন

.

দুদিন পরে জুলিয়াস ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ফিরল। টমির পাঠানো একটা চিরকূট টেবিলের ওপরে পেল।

প্রিয় হার্সিমার,
আর্জেন্টিনায় একটা চাকরির প্রস্তাব পেয়েছি। নেব ভাবছি। যদি আর দেখা না হয় তাই বিদায় জানাচ্ছি।
তোমার
টমি বেরেসফোর্ড

কাগজটা মুড়ে সে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল।

.

স্যার জেমসকে ফোনটা করে সাউথ অ্যাসলে ম্যানসনে উপস্থিত হল টমি। অ্যালবার্টের কাছে নিজেকে টুপেনসের বন্ধু বলে পরিচয় দিল।

-স্যার, মিস ভালো আছেন তো?

–ডাকাতরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে, অ্যালবার্ট। তাকে খুঁজতে যেতে হবে। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।

অ্যালবার্টকে সঙ্গে করে টমি গেট হাউস সরাইখানায় আশ্রয় নিল। টমি অ্যালবার্টকে খবর সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দিল।

সুন্দর লাল ইটের বাড়ি অ্যাসলে প্রিয়রস। বাগান ঘেরা বাড়ি। বাইরে থেকে কিছুই চোখে পড়ে না।

সরাইখানার মালিকের কাছ থেকে জানা গেল মিঃ অ্যাডামস নামের একজন ডাক্তার হলেন অ্যাসলে প্রিয়রসের মালিক। এখন তিনি আর ডাক্তারি করেন না। বছর দশেক এখানে আছেন। পয়সাওয়ালা দেখে কিছু রোগীকে বেসরকারীভাবে এখানে রাখেন। খুব আমুদে মানুষ এই ডাক্তার। গ্রামে খেলাধূলায় দরাজ হাতে চাঁদা দেন। তাছাড়া বিজ্ঞানচর্চা করেন। বাইরে থেকে অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসে।

প্রথম দিন সন্ধ্যায় টমি, অ্যালবার্টকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে থেকে বাড়িটাকে দেখার চেষ্টা করল। ডাইনিং কামরায় টেবিলে কয়েকজনকে পান করতে দেখতে পেল তারা।

দ্বিতীয় দিনটাও আশপাশের দু-একজনের সঙ্গে সতর্কভাবে কথাবার্তা বলে টুপেনসের উপস্থিতির আভাস পাবার চেষ্টা করল।

তৃতীয় দিনে চটপটে অ্যালবার্ট মোক্ষম খবর নিয়ে এলো। ওই বাড়িতে একজন ফরাসি তরুণী বাস করে বলে জানা গেল।

রাতে টমির ঘুম হল না। আজ ২৮ শে। ২৯ তারিখ শ্রমিক দিবস। শ্রমিক দল ক্ষমতা দখল করবে এই ইঙ্গিত দিয়ে খবরকাগজগুলো দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। সরকার পক্ষে আলোচনার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক দলকে বিভ্রান্ত করে চলেছে অন্তরালবর্তী কিছু মতলবী

মিঃ কার্টার তার অনুরোধ রক্ষা করেছেন, মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানাল কার্টার। ওই। দলিল মিঃ ব্রাউনের হস্তগত হলে শ্রমিক দল আর চরমপন্থীদের দিকেই জনমতের হাওয়া বইবে। ওই খসড়া দলিলই সেই অদৃশ্য দলপতির মুখোশ খোলার অনিবার্য অস্ত্র। সেই কারণেই সে খামটা না খোলার জন্য মিঃ কার্টারকে অনুরোধ জানিয়েছে।

পরদিন সন্ধ্যাবেলা দুজনে মিলে আবার অনুসন্ধানে বেরলো। আচমকা অ্যাসলে প্রিয়রসের তিন তলার জানালার পর্দায় একটা ছায়া টমির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওই ছায়া যে টুপেনসের তাতে নিঃসন্দেহ হল সে।

জানালা বরাবর খানিকটা দূরে অ্যালবার্টকে দাঁড় করিয়ে দিল সে। বলল, আমি বাগানে গান গাইতে থাকলে জানালার দিকে লক্ষ্য রাখবে।

বাগানের রাস্তা দিয়ে টমি চড়া গলায় বেসুরো গান ধরল।

হাসপাতালে থাকার সময় রেকর্ডের যে গানটা টুপেনস খুব পছন্দ করত সেই গানের কলি মস্ত বাড়িটার দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল।

সেই সাংঘাতিক আওয়াজ শুনে সঙ্গে সঙ্গেই একজন চাপরাশি আর বাটলার ছুটে বেরিয়ে এলো। টমি ঘাবড়ালো না। তার গানের গলা ওদের দেখে আরও চড়ল।

হৈ হৈ করে বাটলার চেপে ধরল তাকে। টমির চিনতে ভুল হল না। লোকটা স্বয়ং হুইটিংটন। পুলিসের ভয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা টমিকে নিরস্ত করল।

.

সরাইখানায় ফিরে টমি অ্যালবার্টের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অনেক পরে সে এসে পৌঁছল।

–কি খবর অ্যালবার্ট।

–খবর ভালো স্যার। ওরা যখন আপনাকে বাগান থেকে বরে করে দিচ্ছিল, সেই সময় জানালা থেকে কেউ এটা ছুঁড়ে দেয়।

অ্যালবার্ট একটুকরো পাকানো কাগজ পকেট থেকে বের করে দিল। তাতে লেখা ছিল : আগামীকাল ঠিক এই সময়।

–সাবাস অ্যালবার্ট। আমরা ঠিক জায়গায় এসে গেছি।

-আমিও একটা কাজ করেছি স্যার, অ্যালবার্ট উৎসাহের সঙ্গে বলল, একটা কাগজ লিখে পাথর জড়িয়ে জানালায় ছুঁড়ে দিয়েছি।

-কি লিখেছ? জানতে চাইল টমি।

লিখেছি, আমরা সরাইখানায় আছি, উনি বাইরে আসতে পারলে যেন ওখানে গিয়ে ব্যাঙের ডাক ডাকেন।

-দারুণ হয়েছে। শোন, ওই বাটলার আমার চেনা। কিন্তু আমাকে বুঝতে দেইনি। নিশ্চয় কোনো মতলব আছে ওদের। সতর্ক থাকতে হবে।

সে-রাতে বেশ খুশি মনেই ঘুমোতে গেল টমি। রাত বারোটায় গাড়োয়ান চেহারার একজন দেখা করতে এলো টমির সঙ্গে। ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ তাকে দেখাল। টুপেনসের হাতের লেখা, চিনতে পারল সে।

টমি সরাইখানায় ছদ্মনামে থাকতে পারে ভেবে কোনো নাম উল্লেখ না করে টুপেনস বলেছে, আসলে প্রিয়রসের কাছে সরাইখানার ভদ্রলোকের কাছে এটা দিলে তিনি তোমাকে দশ শিলিং দেবেন।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটার হাতে দশ শিলিং গুঁজে দিয়ে টমি ভাজ করা কাগজটা তার কাছ থেকে নিয়ে নিল।

প্রিয় টমি,
গতরাতে, তোমার গলা শুনে চিনতে পেরেছি। আজ সন্ধ্যায় যেও না। ওদের ফাঁদে পড়তে হবে। আজ সকালেই আমাদের সরিয়ে দিচ্ছে। ওয়েলস–হোলিহেড বলে শুনেছি।

সুযোগ পেলে রাস্তায় চিঠি ফেলে যাব। অ্যানেটের কাছে তোমার বাহাদুরির গল্প শুনেছি।
তোমার টুপেনস

.

অ্যালবার্টকে ডেকে তুলল টমি।–শিগগির ব্যাগ গোছাও। যেতে হবে।

চিঠিটা আরো দুবার পড়ল টমি। আচমকা চোখ বড় হয়ে উঠল তার। মহামূর্খ আমি, নিজের মনে বলে উঠল সে, তুমিও তাই, তোমার পরিচয় আমি এবারে জেনে ফেলেছি।

অ্যালবার্টকে আবার ডাকল টমি।

-ব্যাগ খুলে ফেল। সময় হয়নি।

–হ্যাঁ স্যার। ঘাড় কাত করে সায় জানাল অ্যালবার্ট।

.

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে সেক্রেটারি ইভান তার মনিবকে জানাল, স্যার, জুলিয়াস পি. হার্সিমার নামে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। বিশেষ জরুরী কাজে একাকী কথা বলতে চায়।

–লোকটা কে? জানতে চাইলেন ক্রেমেলিন।

–এই তরুণ অগাধ সম্পত্তির মালিক। ওর বাবা আমেরিকার ইস্পাত জগতের মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন।

-তাহলে ওকে নিয়ে এসো।

 কিছুক্ষণ পরেই সেক্রেটারি হার্সিমারকে নিচে থেকে নিয়ে এলো।

–মঁসিয়ে ক্ৰেমেলিন, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাকে জানাবার আছে। দ্বিতীয় কেউ উপস্থিত থাকবে না। বলল হার্সিমার।

–আমার সেক্রেটারি তাহলে পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুক। আপনার কাজের কথা শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে?

-সেটা আপনার ওপর। তবে, আমি চাই সুইটে আপনি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না।

শেষ পর্যন্ত সেক্রেটারিকে সন্ধ্যাটা ছুটি দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ক্রেমলিন।

দরজা নিজে হাতে বন্ধ করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল হার্সিমার। চকিতে পোশাকের ভেতর থেকে রিভলবার বার করে উঁচিয়ে ধরল সে।

-হাত তুলুন, নইলে গুলি করব।

–এসব কি হচ্ছে? কি চান আপনি?

–আমার কথা মেনে চললে কোনো ভয় নেই আপনার। নইলে

–কিন্তু আপনি কি চান? টাকা?

–আমি চাই জেন ফিনকে।

–ও নাম আমি জীবনে শুনিনি।

–আমার এই ছোট্ট উইলি কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে না।

বিভ্রান্ত বিপর্যন্ত ক্ৰেমেলিনের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। শুষ্ককণ্ঠে বললেন, জেন ফিনের খোঁজ করছেন কেন?

-সোজা পথে আসুন। এই মুহূর্তে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?

–অসম্ভব কথা! আমার বলার সাহস নেই।

-মিঃ ব্রাউনের ভয়ে? ওরকম নামে সত্যিই কি কেউ আছে, যে আপনার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে?

–আছে, আমি তাকে দেখেছি, ভিড়ের মধ্যে, ভয় করার মতোই মানুষ তিনি।

–আপনি মুখ খুলুন, তিনি জানতে পাবেন না।

–তার কানকে ফাঁকি দেওয়া যায় না–প্রতিশোধ নেমে আসে দ্রুত। আমি ক্রেমলিনও রেহাই পাব না।

–তাহলে আমি যা জানতে চাইছি আপনি বলবেন না?

কঠিন স্বরে উচ্চারণ করল হার্সিমার। রিভলবার তুলে ধরল।

-গুলি করবেন না, আমি বলছি।

–মেয়েটি কোথায়?

 –গেট হাউস, কেন্টে। জায়গাটার নাম অ্যাসলে প্রিয়রস।

–সেখানে সে বন্দী?

 –মেয়েটা স্মৃতি হারিয়েছে।

 –এক সপ্তাহ আগে যে মেয়েটাকে ভুয়া টেলিগ্রাম করে গায়েব করেছেন সে কোথায়?

–সে-ও ওখানে।

-তাহলে এই রাতেই চলুন কেন্টে গেট হাউসে। আমার সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে। কোনো বেচাল করবেন না, পোশাক পাল্টে সোজা নিচে গিয়ে গাড়িতে উঠবেন। পেছনে উইলিকে নিয়ে আমি আছি।

.

সোফারকে লক্ষ্য করে হাসিমার হুকুম করল, জর্জ, কেন্টে গেট হাউসে যেতে হবে। রাস্তা চেনো?

–হ্যাঁ স্যার। দেড়ঘণ্টা লাগবে।

সময়টা একঘন্টা করবে।

 হার্সিমার স্বনামখ্যাত রুশ বলশেভিক নেতার পাশে বসল। গাড়ি ছুটে চলল ঝড়ের বেগে।

একঘণ্টার মধ্যেই বাড়ির বারান্দার তলায় এসে পৌঁছল গাড়ি।

–জর্জ ইঞ্জিন বন্ধ করো না। বাড়ির ঘণ্টা বাজিয়ে তৈরি থাকো। ইঙ্গিত করলেই গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চলবে।

ক্ৰেমেলিনের পাঁজরায় রিভলবার ঠেকিয়ে বসল হার্সিমার। ঘণ্টা শুনে বাটলার হুইটিংটন দরজা খুলল। ক্রেমলিন গলা বাড়িয়ে বললেন, আমি ক্রেমলিন, মেয়ে দুটোকে নিয়ে এসো সময় নষ্ট করো না।

-তুমি এসময়ে? কিন্তু পরিকল্পনা তো

পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।

–তার আদেশ পেয়েছ?

–আমি এসেছি, বুঝতে পারছ? শিগগির ওদের গাড়িতে তুলে দাও।

হুইটিংটন ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই কোট জড়ানো দুটি মেয়েকে নিয়ে এসে গাড়িতে তুলে দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে একঝলক আলো এসে হাসিঁমারের মুখে পড়ল। আর সিঁড়ির ওপর থেকে একজন চিৎকার করে উঠল।

–জর্জ

গাড়ি স্টার্ট দেওয়াই ছিল। ঝড়ের বেগে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।

এলোপাথাড়ি গুলি ছুটে এলো পেছন থেকে। হার্সিমার পেছন ফিরে রিভলবার তুলে ঘোড়া টিপল।

টমি কোথয়া জুলিয়াস, বলল টুপেনস, ওই ভদ্রলোক কে?

-ইনি মঁসিয়ে ক্ৰেমেলিন। টমি আর্জেন্টিনা রওনা হয়েছে। জর্জ, ওরা আমাদের তাড়া করতে পারে, অন্য রাস্তা ধর।

-ওরা আমাদের ছেড়ে দিল কেন? বলল টুপেনস।

–সেই কৃতিত্ব মঁসিয়ে ক্রেমলিনের।

–আমার জীবনের দাম কানাকড়িও রইল না, হতাশকণ্ঠে বললেন ক্রেমলিন। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি আমাকে পেতে হবে।

-আপনাকে এখানে নামিয়ে দিচ্ছি, এখনই রাশিয়ায় পাড়ি দিন। জর্জ গাড়ি থামাও।

গাড়ির গতি মন্দিভূত হতেই রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে অদৃশ্য হলেন ক্রেমলিন।

-ওরা আমাদের নাগাল ধরতে পারেনি, ধন্যবাদ জর্জ, টুপেনস, এবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসো।

টুপেনস বলল, আমি বুঝতেই পারিনি, অ্যানেট আর আমাকে ওরা কোথায় পাঠাতে চাইছে।

–ওকে অ্যানেট বলেই ডাকো?

–ওটাই তো ওর নাম

–ফুঃ, আমরা যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, ও-ই তো সেই জেন ফিন–আসল জেন ফিন।

–কি বলছ। তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠল টুপেনস।

ঠিক এই সময় সকলকে আঁৎকে দিয়ে একটা গুলি এসে বিঁধে গেল গাড়ির গদিতে।

–জর্জ দ্রুত চালাও, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল হার্সিমার, ওরা আক্রমণ করেছে, তোমরা মাথা নামাও

গাড়ি ছুটেছে প্রচণ্ড গতিতে। এরই মধ্যে আরও তিনটি গুলি পরপর পাশ কেটে বেরিয়ে গেল। একটা সামান্য আঁচড় রেখে গেল হাসিঁমারের গালে।

রিভলবার বাগিয়ে ধরে পেছন ফিরে তাকাল সে। কিন্তু গুলি করার মতো কাউকে দেখতে পেল না।

আপনার গালে লেগেছে? বলল অ্যানেট।

–ও কিছু না, সামান্য ছড়ে গেছে। বলল হার্সিমার।

-ওহ, ওরা ধেয়ে আসছে, আমাকে ছেড়ে দিন। আমার জন্য আপনারা মারা যাবেন। আমাকে ছেড়ে দিন।

অ্যানেট গাড়ি থেকে নেমে যাবার জন্য দরজা খোলার চেষ্টা করে। হার্সিমার তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, অধীর হয়ো না। চুপ করে বসে থাক।

একটু চুপ করে থেকেই সে আবার বলে, তোমার খোঁজেই আমি ইউরোপে এসেছি। আমি তোমার আত্মীয় জুলিয়াস হার্সিমার।

একটা ক্রসিং-এর মুখে এসে গাড়ির গতি মন্থর হল।

জর্জ বলল, ডানে বাঁয়ে রাস্তা গেছে স্যার, কোনো দিকে যাব?

 এই সময় আচমকা বাইরে থেকে একটা মূর্তি হুড়মুড় করে ওদের মধ্যে পড়ল।

সকলে দেখল টমি। ওকে ধরে তুলে সিটে বসিয়ে দিল।

–তুমি ছিলে কোথায়? হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল টুপেনস।

-বাগানে, বলল টমি, ঝোপের আড়ালে। সেখান থেকেই গাড়ির পেছনে উঠে পড়ি। গাড়ি যে গতিতে ছুটেছে–জানাব কি করে। এবারে মেয়েদের নামিয়ে দাও।

-নামিয়ে দাও মানে?

–সামনেই একটা স্টেশন আছে, কয়েক মিনিট পরেই ট্রেন আছে।

হার্সিৰ্মার উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, এভাবে ওদের ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তাছাড়া মেয়েদের একা ছেড়ে দেবার কথা তুমি ভাবছ কি করে?

–টুপেনস, ওকে সঙ্গে নিয়ে শিগগির বেরিয়ে পড়, আমি বলছি, নিরাপদে লন্ডনে পৌঁছতে পারবে। মিঃ কার্টার শহরে নেই। তোমরা সোজা স্যার জেমসের কাছে চলে যাবে।

-তোমার মাথার ঠিক নেই। উন্মাদের মতো বকছ। জেন, গাড়ি থেকে নামবে না।

টমি পলকের মধ্যে ছোঁ মেরে হার্সিমারের হাত থেকে রিভলভারটা নিজের হাতে নিয়ে তাকে তাক করল।

–আমরা গাড়িতেই থেকে যাব, কেবল মেয়েরা নেমে যাবে। একটাও কথা বলবে না। তোমরা দুজনে এখুনি নেমে পড়–নইলে আমার হাতেই মরতে হবে।

গাড়ি থেকে জোর করে সে টুপেনসকে নামিয়ে দিল। অনেটের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল টুপেনস, নেমে এসো, টমি যখন বলছে, কোনো চিন্তা নেই।

গাড়ি থেকে নেমেই রাস্তার ধার ধরে তারা ছুটল। হার্সিমার কি বলতে যাচ্ছিল, টমি তার দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলার আছে আমার মিঃ হার্সিমার।

.

অ্যানেটের হাত ধরে স্টেশনে পৌঁছেই এক মিনিট পরে ট্রেন পেয়ে গেল টুপেনস। দুজনে একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠে পড়ল।

টমি বলে দিয়েছে সোজা স্যার জেমসের কাছে চলে যেতে। সেখানে ওরা নিরাপদ। কিন্তু মিঃ ব্রাউনের অদৃশ্য চক্ষু কি ওদের লক্ষ্য করছে? চোখ কান সজাগ রেখে অ্যানেটকে পাশে নিয়ে বসে রইল টুপেনস।

–কিন্তু ওরা বড় ভয়ানক, বলল অ্যানেট, পাঁচ পাঁচটা বছর যে কি ভাবে আমি কাটিয়েছি

–ওসব এখন ভেবে কাজ নেই। বলল টুপেনস।

চেয়ারিংক্ৰশে পৌঁছে ওরা ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। একটা ট্যাক্সি ধরে কিংক্ৰশের দিকে চলল ওর।

হার্বোনের মুখে জ্যামে আটকে গেল ট্যাক্সি। ওরা দরজা খুলে রাস্তার ওপর লাফিয়ে পড়ল।

ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ফাঁকায় সরে এসে আবার ট্যাক্সি ধরল। টুপেনস হুকুম করল কার্লটন হাউস।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল ওরা। কিন্তু কার্লটন হাউসে ঢোকার মুখেই বাধা পেল। বিশাল চেহারার একটা লোক পথ আটকাল।

দয়া করে সরে দাঁড়ান। তীব্রস্বরে বলে উঠল টুপেনস।

হিংস্র হাসি হাসল লোকটা। হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে টুপেনসকে বলল, আপনার বান্ধবীর সঙ্গে দুটো কথা বলব কেবল।

লোকটা খপ করে অ্যানেটের কাঁধ চেপে ধরল। টুপেনস তৈরি হয়েই ছিল। এক পা পিছিয়ে এসে বিদ্যুৎবেগে মাথা দিয়ে লোকটার পেটে ঢু মারল।

আঁক শব্দ করে দশাসই চেহারার লোকটা ফুটপাতে গড়িয়ে পড়ল। সেই ফাঁকে টুপেনস আর অ্যানেট ছুটে এসে স্যার জেমসের দরজায় ঘণ্টা বাজাল।

ততক্ষণে সেই লোকটা সামলে উঠে ছুটে প্রায় সিঁড়ির কাছে চলে এলো। দরজা খুলতেই ভেতরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজন। শব্দ পেয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলেন স্যার জেমস।

-আরে, কি ব্যাপার?

 ওদের লাইব্রেরির সোফায় নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হল। দুজনেই হাঁপাতে লাগল।

-আর ভয় নেই। তুমি নিরাপদ।

 টুপেনসের দিকে তাকিয়ে বললেন স্যার জেমস, তোমার বন্ধু টমির মতোই তুমিও তাহলে বেঁচে আছ? এই মেয়েটি

-আমি জেন ফিন, বলল অ্যানেট, আপনাকে অনেক কথা বলার আছে।

 –সবই শোনা যাবে, আর একটু সুস্থ হও।

দরকার পড়বে না, এখনই সব বলে আমি নিরাপদ হতে চাই।

–বেশ, তোমার যখন ইচ্ছে

–জেন তখন তার কাহিনী বলতে শুরু করল :

 যুদ্ধ লাগলে আমিও সাহায্য করব বলে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। আমি ফরাসি শিখলাম। এক শিক্ষিকার কাছে শুনলাম, প্যারীর হ্যাঁসপাতালে তোক নিচ্ছে। আবেদন করে কাজও পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে লুসিটোনিয়ায় চড়ে প্যারীতে রওনা হলাম।

আমাদের জাহাজে টর্পেডো যখন আঘাত করল, জাহাজ ডুবছে, সেই সময় আমার কাছে এক ভদ্রলোক এলেন।

জাহাজে কয়েকবার তাকে চোখে পড়েছিল। আমি দেশকে ভালোবাসি জেনে তিনি আমাকে বললেন, মিত্রশক্তির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু কাগজপত্র তিনি সঙ্গে নিয়ে চলেছেন। মেয়েদের আর শিশুদেরই বাঁচার সম্ভাবনা ছিল। তিনি কাগজগুলো আমাকে সঙ্গে নেবার জন্য দিলেন।

টাইমস কাগজে বিজ্ঞাপন লক্ষ্য করতে বললেন। তিন দিনের মধ্যে কোনো বিজ্ঞাপন দেখতে না পেলে কাগজগুলো আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের হাতে পৌঁছে দিতে বললেন।

কাগজগুলো দেবার সময় মিঃ ডেনভারস বলেছিলেন, তাকে হয়তো অনুসরণ করা হচ্ছে। আমি তাই সতর্ক হয়েই ছিলাম। হোলিহেডে যখন বোটে উঠলাম, তখন থেকেই শুরু হল অস্বস্তি। জাহাজে থাকতেই মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার নামে এক মহিলা আমার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন।

প্রথমে বুঝতে পারিনি তাই কৃতজ্ঞ বোধ করি। আমার কাছাকাছিই ছিলেন তিনি। ডেনভারসের সঙ্গে দু-একবার আলাপ করতে চেয়েছিলেন।

আইরিশ বোটে ওঠার পর চোখে পড়ল, ভদ্রমহিলা অদ্ভুতদর্শন একজনের সঙ্গে আমার সম্পর্কে আলোচনা করছেন। আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না।

ইতিমধ্যে আমি একটা কাজ করেছিলাম। তেলাকাগজের প্যাকেটটা কেটে তাতে সাদা কাগজ ভরে সেলাই করে নিয়েছিলাম।

ভেতরে দুটো মাত্র কাগজ ছিল। সেগুলো একটা সাময়িকপত্রের দুটো পাতার মাঝখানে রেখে আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছিলাম। আর পত্রিকাটা হেলা ভরে পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।

বোট থেকে নেমে হোলিহেডে গাড়িতে উঠলাম। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারকেও আমার কামরায় দেখতে পেলাম। কামরায় আরও লোক ছিল, তাই ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। আমার উল্টো দিকেই বসেছিলেন, মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী।

ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সম্ভবতঃ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভাঙ্গতেই চোখ খুলে দেখতে পেলাম–সেই ভদ্রলোক মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের হাতে কিছু কাগজ তুলে দিচ্ছেন। দুজনের মুখেই কেমন অদ্ভুত হাসি।

আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। উঠবার উদ্যোগ করতেই মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার আচমকা আমার নাকে মুখে কি চেপে ধরলেন। আমি হাত ছাড়াতে চেষ্টা করি, আর আমার মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত লাগল।

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি, একটা নোংরা বিছানায় শুয়ে আছি। চারদিকে পর্দা। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের গলা পেলাম। কারো সঙ্গে কথা বলছেন।

কান পেতে শুনে বুঝতে পারলাম, তারা তেলাকাগজের প্যাকেটে কিছু পায়নি বলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। আমার ওপর অত্যাচার করে আসল কাগজগুলোর সন্ধান করবে। ভয়ে আঁৎকে উঠলাম।

ওরা দুজন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি চোখবুজে অচেতন হবার ভান করে রইলাম, আর ভাবতে লাগলাম, কি করে এদের উৎপীড়ন এড়ানো যায়।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, স্মৃতি লোপের কথা বইতে পড়েছিলাম, আমিও সেই অভিনয় করতে পারি। তখনই ফরাসিতে কথা বলতে শুরু করলাম।

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার কেমন হকচকিয়ে গেলেন। তার সঙ্গের লোকটি এগিয়ে এসে আমার হাত মুচড়ে ধরল। আমি ফরাসিতেই চেঁচাতে লাগলাম।

যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালাম। ওদের শেষ কথাটা কেবল মনে আছে, না, এটা ধাপ্পা হতে পারে না।

ওরা আমাকে সোহোর সেই বাড়িতেই নিয়ে গিয়েছিল। ওখানেই মিঃ বেরেসফোর্ডকে আটকে রাখা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরলে চোখে পড়ল, চেয়ারে আমার কোটটা রয়েছে, আর পকেটে সেই পত্রিকাটাও।

অবহেলায় ওটা ফেলে রাখায় কিছু সন্দেহ করেনি, তাই নিশ্চিন্ত হলাম। বিছানাতেই শুয়েছিলাম। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার লক্ষ্য রাখছিলেন। আমার সামনে তেলাকাগজটা ধরে জানতে চাইলেন, আমি চিনি কিনা।

হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম, চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু মনে করতে পারলাম না।

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার বললেন, তীব্র মানসিক আঘাতে সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, শিগগিরই স্মৃতি ফিরে আসবে। আমাকে বললেন, তাকে রিটা পিসী বলে ডাকতে।

সে রাতটা যে কিভাবে কেটেছে, বলে বোঝাতে পারব না। কেবলই ভয় হচ্ছিল, যদি সাময়িকপত্রটা ফেলে দেয় তাহলেই তো সর্বনাশ। মাথা দপদপ করছিল।

রাত দুটোয়, নিঃশব্দে উঠে দেয়াল থেকে একটা ছবি নামালাম। সেটা ছিল গয়নাপরা মার্গারেটের ছবি।

ছবির পেছনের বাদামি কাগজটা খুলে পত্রিকা থেকে কাগজদুটো বের করে ছবির পেছনে রেখে দিলাম। বাদামীকাগজটা এঁটে ছবিটা আবার টাঙিয়ে রাখলাম।

এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম, ওরা নিশ্চয় ভাববে, ডেনভারস সাদা কাগজই নিয়ে আসছিল।

ওরা আমাকে হয়ত মেরেই ফেলতো। কিন্তু দলের একনম্বরের জন্যই পারেনি। আমাকে আয়ার্ল্যান্ডে নিয়ে এলো। সকলে জানল, আমি মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের ভাইঝি। কিন্তু বুঝতে পারতাম অনেকেই আমাকে দেখে এসব বিশ্বাস করতে চাইত না।

এরপর বোর্নমাউথে এক স্যানাটরিয়ামে আমাকে পাঠানো হল। যে নার্স আমার দেখাশোনা করত সে-ও ছিল ওই দলের লোক। সে গোপনে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত।

আমি যে জেন ফিন একথাটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করতাম প্রাণপণে। জেনেট ভ্যান্ডেমেয়ার হয়েই অভিনয় করে চললাম।

এখানে ডাক্তার আর মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন একাধিকবার। কিন্তু আমি ভেঙ্গে পড়িনি।

সেই স্যানাটরিয়াম থেকে এক রাতের মধ্যে আমাকে সোহোর বাড়িতে নিয়ে আসা হল। ওরা আমাকে এবারে অদ্ভুত একটা কাজে লাগিয়ে দিল। মিঃ বেরেসফোর্ডের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপরে।

রবিবার বিকেলে ওদের ফিসফাস কথাবার্তা কানে এলো। বুঝতে পারলাম, মিঃ বেরেসফোর্ডকে মেরে ফেলার হুকুম এসেছে। এর পরের ঘটনা তো আপনারা জানেন।

আমি ফটোর পেছনে লুকিয়ে রাখা কাগজটা উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে যাই। তখনই চিৎকার করে বলি আমি মার্গারেটের কাছে যাব। যাতে ওরা বোঝে আমি মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের কথা বলছি।

জেন তার কাহিনী শেষ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

কাগজগুলো তাহলে সেই ছবির পেছনেই রয়ে গেছে? স্যার জেমস বললেন।

–হ্যাঁ।

স্যার জেমস তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এখুনি যাওয়া যাক তাহলে চল।

–এই রাতে? অবাক হয়ে বলল টুপেনস।

-হ্যাঁ। দেরি করা ঠিক হবে না। তাছাড়া রাতে গেলে নাটের গুরু মিঃ ব্রাউনকেও হাতে নাতে ধরা যেতে পারে। তোমাদের কোনো ভয় নেই, পথে কোনো বিপদ হবার সম্ভাবনা নেই। মিঃ ব্রাউনের মতলব হল, জেনকে আমরা আসল জায়গায় নিয়ে যাবো। সে জন্য সে ওঁৎ পেতে থাকবে। সোহোর বাড়ি পুলিসের নজরে রয়েছে। তৎসত্ত্বেও মিঃ ব্রাউন সেখানে ঢোকার চেষ্টা করবেন–হয়তো বন্ধুর ছদ্মবেশ নিয়েই।

টুপেনস ইতস্তঃ করে বলল, আপনি জানেন, মিঃ ব্রাউন কে?

আমি জানি। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের রহস্যময় মৃত্যুর রাত থেকেই আমি জেনেছি।

-আশ্চর্য!

-হ্যাঁ, তার মৃত্যুর দুটো কারণ আমি যুক্তিসঙ্গত মনে করছি। হয় তিনি নিজে ক্লোরাল খেয়েছিলেন অথবা

–অথবা বলুন?

-তুমি যে ব্র্যাণ্ডি দিয়েছিলে, তাতে কেউ গোপনে মিশিয়ে দিয়েছিল। আর ওই ব্যাণ্ডিতে হাত দিয়েছিলাম কেবল আমরা তিনজন, আমি, তুমি আর মিঃ হার্সিমার।

–কি বলছেন, উত্তেজিত স্বরে বলল টুপেনস, জুলিয়াস একজন অতিবিখ্যাত লক্ষপতির ছেলে, সেই লোক মিঃ ব্রাউন হবে ভাবা যায় না। তবে এটা ঠিক, আপনাদের দেখে মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার আতঙ্কে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

-হ্যাঁ, তুমি যুক্তি ধরতে পেরেছ। মিঃ বেরেসফোর্ডের টেলিফোন আমি পেয়েছিলাম। তারপরেই বুঝতে পারি জেন ফিনের ছবি তার কাছেই ছিল–কেউ ধাপ্পা দিয়ে নিয়ে যায়নি। সে কাল্পনিক গল্প শুনিয়েছিল।

জেন তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, এসব কি বলছেন? জুলিয়াস আমার নিজের মামাতো ভাই, সে মিঃ ব্রাউন হতে যাবে কেন?

–না মিস ফিন, এই জুলিয়াস তোমার কেউ নয়।

 ওরা দুজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল স্যার জেমসের দিকে। তারা যেন তার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না।

স্যার জেমস, খবরের কাগজের একটা কাটিং এনে জেনের হাতে দিলেন। টুপেনস চোখ বোলাল, নিউইয়র্কে পাওয়া রহস্যময় মৃতব্যক্তির সেই খবর।

স্যার জেমস বলতে শুরু করলেন, আসলে যা ঘটেছিল, তা হল, মিঃ জুলিয়াস হার্সিমার তার মামাতো বোনের খবর জানার জন্য, তার একটা ফটো সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে রওনা হয়েছিল।

তাকে অনুসরণ করা হয়েছিল। পথে তাকে হত্যা করে, মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয় যাতে সনাক্ত করা না যায়।

এরপর হার্সিমার নাম নিয়ে মিঃ ব্রাউন ইংলন্ড রওনা হন। নিখুঁত ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে আশ্চর্য হল যে যারা তাকে খোঁজ করছিল, তাদের সঙ্গেই তিনি ভিড়ে গিয়েছিলেন।

ফলে আগে থেকে সব সূত্রই তার জানা হয়ে যেত। একমাত্র মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারই গোড়া থেকে তার রহস্য জানতেন। সম্ভবতঃ মোটা টাকার ঘুষের লোভ দেখিয়ে তার মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।

কিন্তু সেই রাতে মিস টুপেনস যে কাণ্ড ঘটালে, তাতে মিঃ ব্রাউনের আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। মিস টুপেনস তার আভাসও পেয়ে গিয়েছিল।

–আমার সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। কিন্তু হার্সিমারই যদি মিঃ ব্রাউন হবে তাহলে সে আমাদের উদ্ধার করল কেন?

–হার্সিমার এত ভালো, জেন বলল, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

–বিশ্বাস না হবারই কথা, বললেন স্যার জেমস, জুলিয়াস হার্সিমার একজন দক্ষ অভিনেতা। কিন্তু, মিস টুপেনস, তোমাদের উদ্ধার করেছে, একথা বলছ কেন?

টুপেনস তখন সন্ধ্যাবেলার সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।

–এই ব্যাপার, বললেন স্যার জেমস, বুঝতে পারছি।

–কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হচ্ছে। বলল টুপেনস।

–আমি তোমায় বুঝিয়ে দিচ্ছি। জেন ফিনকে ওরা ইচ্ছে করেই পালাতে দিয়েছে। মিঃ বেরেসফোর্ডকে ওরা হিসেবের মধ্যে আনেনি। যথাসময়ে তাকে সরিয়ে দিত। হার্সিমার জেনকে নিয়ে সোজা হাজির হত সোহোর বাড়িতে। খসড়া কাগজটা তার হাতেই পড়ত।

–কিন্তু টমি যে তার সঙ্গেই রয়ে গেল। উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইল টুপেনস।

–শুনে এখন আমারও উদ্বেগ হচ্ছে। মিঃ হার্সিমারই হল মিঃ ব্রাউন। একটামাত্র রিভলভার নিয়ে তাকে সামলান অসম্ভব।

-তাহলে এখন আমরা কি করতে পারি?

–প্রথম কর্তব্য হবে সোহোর সেই বাড়িতে যাওয়া। শত্রুকে আমরা হাতের মুঠোয় পেয়ে যাব, আশা করছি।

স্যার জেমস ড্রয়ার থেকে একটা রিভলভার তুলে নিয়ে কোটের পকেটে ঢোকালেন।

-মিস ফিন খুবই ক্লান্ত, আমার মনে হয় তার এখানে থাকাই ভালো। সম্পূর্ণ নিরাপদ।

-না, আমি যাব, জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করল জেন, কাগজগুলো আমি নিজে দেখতে চাই–ওগুলো বিশ্বাস করে আমার কাছে দেওয়া হয়েছিল।

.

সাদা পোশাকের পুলিস বাড়িটার ওপর নজর রাখছিল। গাড়ি থেকে নেমে স্যার জেমস ওদের কিছু হুকুম করলেন।

তারপর মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, এখনো পর্যন্ত বাড়িতে কেউ ঢোকেনি। আমাদের পর কেউ ঢুকতে এলেই গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়ে এলাম। চল, ভেতরে ঢোকা যাক।

–স্যার জেমসকে পুলিস চেনে। তাই একজন এগিয়ে এসে দরজার তালা খুলে দিল। তিনজনেই বাড়ির ভেতরে ঢুকলে আবার দরজা বন্ধ করে দিল।

জেন সরাসরি ওপরের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। মার্গারেটের ছবিটা দেয়াল থেকে নামিয়ে আনল। স্যার জেমস তার হাতে একটা ছুরি এগিয়ে দিলেন। ছবির পেছনের কাগজটা সরিয়ে জেন ভেতর থেকে লেখায় ভরা দুটো কাগজ বের করে আনল।

-এটাই সেই আসল খসড়া, বলল জেন, আমাদের সব দুর্ভাগ্যের মূল।

–শেষ পর্যন্ত আমরাই জিতেছি, বলল টুপেনস।

স্যার জেমস কাগজ দুটো ভাঁজ করে নিজের কোটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।

–কী ভয়ানক একটা ঘর দেখ, কোনো জানালা নেই, দরজাও পোক্ত। ভাবতেও শরীর শিহরিত হয়, এই ঘরেই আমাদের তরুণ বন্ধু বেরেসফোর্ডকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এই ঘরে কিছু ঘটলে বাইরে থেকে কেউই টের পাবে না।

টুপেনস শিউরে উঠল। এখন যদি কেউ দরজাটা বন্ধ করে দেয়, তাহলেই তো খাঁচায় আটকানো ইঁদুরের মতো মরতে হবে সকলকে। কে জানে ভেতরে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা?

ভয়ার্ত চোখে সে তাকাল স্যার জেমসের দিকে।

–ভয় হচ্ছে, তাই না মিস টুপেনস, রহস্যময় কণ্ঠে বললেন স্যার জেমস, আমিও মনে হচ্ছে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। মিস ফিনও নিশ্চয় পাচ্ছ?

-সত্যিই, কেমন মনে হচ্ছে। অস্ফুটে বলল জেন!

–স্বাভাবিক, মিঃ ব্রাউন উপস্থিত রয়েছেন যে।

 –উপস্থিত রয়েছেন? এই বাড়িতে?

–তোমাদের সামনেই…আমিই মিঃ ব্রাউন। নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল স্যার জেমসের ঠোঁটে।

অবিশ্বাস আর শঙ্কা নিয়ে মেয়ে দুটি তাকিয়ে রইল খ্যাতনামা আইন বিশেষজ্ঞের দিকে।

-মিস টুপেনস, নিশ্চয় বুঝতে পারছ, সফল তোমরা নও, আমি মিঃ ব্রাউন। কেননা তোমরা কেউই আর এঘর থেকে কোনোদিন বাইরে বেরতে পারবে না। খসড়া চুক্তিটা এখন আমারই হাতে।

টুপেনসের চোখ জ্বলে উঠল। বিস্ফারিত চোখে সে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল সামনে দণ্ডায়মান লোকটিকে।

–তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছিলে, আর পারবে না।

স্যার জেমস কোটের পকেট থেকে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা বার করে হাতে নিলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে একটা হাত শক্ত মুঠিতে তার হাতে চেপে ধরল। জুলিয়াস হার্সিমার। আর টমি। অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে হার্সিমার বলল, এবারে ধোঁকা দিতে পারছেন না আপনি।

কিন্তু পলকের মধ্যে তাদের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে আইনবিদ স্যার জেমস তার পাথর বসানো বাঁ হাতের আংটি জিবে চেপে ধরলেন।

বিদায় বন্ধুগণ—

বলতে বলতে তার বিরাট শরীরটা মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল। দুবার হিক্কা উঠল। নিশ্চল হয়ে গেল শরীরটা। অদ্ভুত একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।

.

.

পরদিন টমিই সকলকে সমস্ত গল্পটা শোনাল। হোটেল স্যাভয়ে তখন উপস্থিত ছিলেন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত, মিঃ কার্টার, আর্চডিকন কার্ডলে এবং ডঃ হল। আর ছিল জেন ফিন, জুলিয়াস হার্সিমার আর টুপেনস।

টমি বলল, নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। আমাকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে দিয়ে যখন সরে পড়ল তখনই বুঝতে পারলাম, অ্যানেটই জেন ফিন। ও মার্গারেট বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়েই ছবির রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল।

মিসেস ভ্যাণ্ডেমেয়ারের মৃত্যুটা ঘটিয়েছিলেন স্যার জেমসই। তিনিই নকল জেন ফিনকে আবিষ্কার করেন।

ছবিটা কি করে পাওয়া যায় তাই নিয়েই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। হার্সিমারকেও নির্ভর করতে পারছিলাম না। মিঃ কার্টারকে একটা চিঠি লিখলাম।

আর স্যার জেমসের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাকেও টেলিফোনে জানালাম সব ঘটনা। কেবল কাগজের কথাটা বাদ দিলাম।

আমি যাতে ফাঁদে গিয়ে পড়ি সেভাবেই জেমস টুপেনস আর জেনের হদিশ আমাকে জানালেন। মাথা ঠান্ডা রেখে আমি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হলাম। এরপর টুপেনসের চিঠি হাতে পড়তেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। হার্সিমারের ওপর থেকেও সন্দেহ দূর হয়ে গেল।

–চিঠি পেয়ে কিভাবে বুঝলে?

টমি একটা চিরকূট এগিয়ে দিল। হাতে হাতে নিয়ে সকলেই সেটা দেখলেন।

–চিঠিটা টুপেনসেরই লেখা, কিন্তু সইটা জাল। টুপেনস কখনো টি ডব্লিও লেখে না। হার্সিমার আসল বানানটা জানে। কিন্তু স্যার জেমস ব্যাপারটা জানতেন না। অ্যালবার্টকে মিঃ কার্টারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আমি চলে যাবার নাম করেও গোপনে রয়ে গেলাম। কেন না, স্যার জেমসকে বামাল ধরতে না পারলে কেউই আমার কথা বিশ্বাস করবে না।

–আমার পক্ষেও কষ্টকর হত। বললেন মিঃ কার্টার।

–সেই কারণেই জবরদস্তি করেই একরকম আমি মেয়েদের স্যার জেমসের কাছে পাঠিয়ে দিই। জেনকে হাতে পেয়ে সে তাকে নিয়ে সোহোর বাড়িতে যাবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

স্যার জেমস যাতে কোনো রকম সন্দেহ না করেন সেই জন্যই আমি রিভলবার তুলে হার্সিমারকে ভয় দেখিয়েছিলাম।

মেয়েরা চলে গেলে হার্সিমারকে সব ঘটনা বলি। সোহোর বাড়িতে গিয়ে আমরা মিঃ কার্টারের দেখা পাই। তাঁর নির্দেশে সব ব্যবস্থা হয়ে যায়। পুলিসকে সব জানানো হয়। আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকি।

হার্সিমার বলল, জেনের ছবিটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পরে সেটা আবার ফিরে পাই।

টুপেনস জানতে চাইল, কোথায়?

মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের ঘরে।

-দেয়াল সিন্দুকে কিছু একটা যে তুমি পেয়েছিলে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বলল টমি, তুমি আমায় বলনি, এজন্যই তোমার ওপর সন্দেহ হয়েছিল।

মিঃ কার্টার তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট ডায়েরী বার করলেন।

-মৃতব্যক্তির পকেটে এটা পাওয়া গিয়েছিল। সমস্ত ষড়যন্ত্রের খসড়া এর মধ্যে রয়েছে। আমরা এখন চাই শান্তি, যুদ্ধ নয়। তাই দুর্ভাগ্যজনক সেই খসড়া চুক্তি পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা। হয়েছে।

স্যার জেমসের প্রতিপত্তির কথা ভেবেই ডায়েরীর কোনো লেখা প্রকাশ করা হবে না। এটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হেফাজতেই থাকবে।

আমি কেবল খানিকটা অংশ পড়ে আপনাদের শোনাব যাতে ওই সুখ্যাত মানুষটির অবস্থা আপনারা বুঝতে পারেন।

মিঃ কার্টার পড়তে লাগলেন।

এই ডায়েরীতেই আমার সব কথা ধরে রাখছি। যদিও জানি কোনো সময় আমার বিরুদ্ধে এই লেখাগুলোই বড় প্রমাণ বলে সাব্যস্ত হতে পারে। তবে, আমার মৃত্যুর আগে কেউ এ বই হাতে পাবে না।

…বাল্যবয়স থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সাধারণ মানুষের চেয়ে আমার মস্তিষ্কের ক্ষমতা অনেক বেশি।

ছেলেবেলায় একটা বিখ্যাত খুনের মামলায় আমি উপস্থিত ছিলাম। আসামীপক্ষের আইনবিদের বক্তব্য ও যুক্তিজাল আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এই সঙ্গে আসামীর কথাও আমি ভাবি। লক্ষ্য করি, লোকটা নিছকই বোকা।

অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারেনি। জানি না কেন, মাথায় ঢুকে গেল, অপরাধের পথই সবচেয়ে সহজ পথ।

এরপর আমি অপরাধ আর অপরাধীদের নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করলাম। আমার মানসিকতার অদ্ভুত পরিবর্তন হল।

আইনবিদ হিসেবে সর্বোচ্চ পদ কিংবা একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাও ক্ষমতার চূড়ান্ত বলে মনে হল না আমার। আমি চাইলাম এমন একজন হতে, যে হবে সর্বক্ষমতার অধীশ্বর–একনায়ক।

আমার ভবিষ্যতের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। আইনবহির্ভূত পথেই আমাকে দেশের সর্বসেরা হতে হবে।

আমি একই সঙ্গে দুটো জীবন গ্রহণ করলাম। একদিকে হয়ে উঠলাম দেশের সবার সেরা আইনবিদ, খ্যাতিমান কে. সি। এটা ছিল আমার বাইরের খোলসমাত্র।

কোনো ছদ্মবেশ, নকল দাড়ি গোঁফের তোয়াক্কা করলাম না। কেবল ব্যক্তিত্ব পাল্টে নাম নিলাম মিঃ ব্রাউন। শুরু হল আমার দ্বৈত জীবন।

সমধর্মীদের রক্ষা করবার জন্য আমি অপরাধীদের হয়ে মামলা লড়তাম। সফলতা ছিল আমার হাতের মুঠোয়।

যুদ্ধের সময় আমার লক্ষ্যপূরণ করব স্থির করলাম। জার্মানদের গুপ্তচর পদ্ধতি আমাকে আকৃষ্ট করল।…

…আমার মতলব সুন্দর কাজ করছে…একটা মেয়ে জড়িয়ে পড়েছে। তবে সে কিছুই জানে মনে হলো না। কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেওয়া চলবে না…এস্থোনিয়া বন্ধ করতে হবে…

..মেয়েটার স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে…না, এটা ধাপ্পা নয় মোটে।…আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কোনো মেয়ের সম্ভব নয়।

এই পর্যন্ত পড়া হলে মিঃ কার্টার থামলেন। বললেন, আর একটু আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি।

…মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। তবে মেয়েটা বিপজ্জনক। তার সহজাত প্রবৃত্তি আমাকে বিপদে ফেলতে পারে।…ওকে শেষ করে দেওয়াই নিরাপদ। আমেরিকান ছোকরা আমাকে অপছন্দ করে…সন্দেহ করে।

তবে কিছুই জানতে পারবে না। অন্য ছেলেটিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে…তাকেও নজরে রাখা উচিত…

নোটবই বন্ধ করে মিঃ কার্টার বললেন, বিপথগামী প্রতিভা–এছাড়া আর কি বলা যায়। অমন বিরাট মানুষ। তবে তাকেও টেক্কা দিল আমাদের দুই তরুণ অ্যাডভেঞ্চারার। সাফল্যের জন্য তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

সকলেই সমস্বরে মিঃ কার্টারকে সমর্থন জানাল।