২. বেরিয়ে এল লুসি

০৬.

প্রবল উত্তেজনায় ত্রস্ত পায়ে বড় গুদোম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল লুসি। তার হাত কাঁপছিল। তালা বন্ধ করে চাবিটা আগের জায়গায় রাখল। একরকম দৌড়েই যেন সে আস্তাবলে নিজের গাড়ির কাছে চলে এল।

বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরে পোস্ট অফিসের সামনে থামল। টেলিফোন তুলে মিস মারপলের সঙ্গে যোগাযোগ করল।

-কি বলছ লুসি? ওপ্রান্ত থেকে জানতে চাইলেন মিস মারপল।

–আমি জিনিসটা পেয়েছি। হ্যাঁ স্ত্রীলোকের…ফারকোট পরা…একটা পাথরের কফিনের মধ্যে…হ্যাঁ, বাড়ির বাইরের দিকে একটা গুদোম ঘরের মধ্যে। এখন আমি কি পুলিসে খবর দেব?

-এক্ষুনি পুলিসে খবর দাও।

–আনুষঙ্গিক কথাগুলো কি পুলিসকে বলব?

–হ্যাঁ। কোনো কথা গোপন করার দরকার নেই। সত্যকথাটাই তুমি তাদের বলবে।

–আপনার সম্পর্কে?

লুসি রিসিভার নামিয়ে রাখল। একমিনিট অপেক্ষা করে আবার রিসিভার তুলে পুলিস দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করল।

.

এতক্ষণে উত্তেজনা থিতিয়েছে। গাড়ি নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো লুসি। কোনোরকম ভূমিকা না করেই সে এমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে জানাল। সে যে পুলিসেও খবরটা জানিয়েছে সেকথাও বাদ দিল না।

এমা ভয়ে বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলেছিল। পরে সামলে নিয়ে অনুযোগের স্বরে বলল, পুলিসকে খবর দেবার আগে আমাকে জানানো তোমার উচিত ছিল।

ঠিক এই সময়েই বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ হল।

পরক্ষণেই দরজার ঘন্টা সশব্দে বেজে উঠল।

.

ইনসপেক্টর বেকনের হাত ধরে বড় গুদোমঘর থেকে বেরিয়ে এলো এমা ক্রাকেনথর্প। তার মুখ ফ্যাকাসে। চোখে উভ্রান্ত দৃষ্টি।

-না, ইনসপেক্টর, মেয়েটিকে চিনি না, জীবনে কখনো আগে দেখিনি।

–ধন্যবাদ মিস।

হলঘর অতিক্রম করে তারা পড়ার ঘরে ঢুকল। সেই সময় ডাক্তার কুইম্পার পড়ার ঘর ছেড়ে বেরচ্ছিলেন। ইনসপেক্টর মুখোমুখি হলে তারা পরস্পরকে অভিবাদন জানালেন।

এমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, তুমি শক্ত মনের মেয়ে, সবকিছু সহজভাবে মেনে নেবে। তোমার বাবা সুস্থ আছেন। ভেতরে তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলল।

এমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, এমা একা এই পরিবার সামাল দিচ্ছে। ওর আগেরটি আগেই সরে পড়েছে। এমা এখনো অবিবাহিতা।

–বোধহয় খুবই পিতৃভক্ত। ইনসপেক্টর বললেন।

–ঠিক ততটা নয়, যতটা আপনি ভাবছেন। বাড়ির মেয়েদের সুখী করার দায়িত্ব যে মেয়েদের একথা সে জানে।

.

ইনসপেক্টর বেকন লুসির সঙ্গে গিয়ে আগে পাথরের কফিনে মৃতদেহটি দেখলেন। পরে দেখা দিল সনাক্তকরণের প্রশ্ন।

এমা ক্রাকেনথর্প আর মিঃ ক্রাকেনথর্প বাড়িতে আপাততঃ এই দুজনই মানুষ উপস্থিত। এমার টেলিফোন পেয়ে ডাঃ কুইম্পারও উপস্থিত হয়েছেন।

এমা মৃতদেহটি দেখল। সে পরিষ্কার জানাল, এর আগে মেয়েটিকে আমি জীবনে কখনো দেখিনি।

বৃদ্ধ মিঃ ক্রাকেনথর্পকে ডাঃ নিজে ওপর থেকে নিচে নিয়ে এলেন। বাড়ির কর্তা, তার মতামত স্বভাবতই ইনসপেক্টর বেকনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিন্তু তিনিও বড় গুদোমঘর থেকে ঘুরে এসে জানালেন, জীবনে এ মেয়ের মুখ আমি দেখিনি। কফিনটা আমি নেপলস কি ফ্লোরেন্স থেকে এনেছিলাম এখন আর ঠিক মনে নেই। কিন্তু এ কিরকম কথা কোথাকার কোনো মেয়ে এর ভেতরে খুন হয়ে পড়ে থাকবে?

ইতিপূর্বে পুলিসের সার্জন জনস্টেন মৃতদেহ দেখে রায় দিয়ে গেছেন, স্ত্রীলোকটি দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে মারা গেছে। ডাঃ কুইম্পার ইনসপেক্টর বেকনের কাছে এই বিবরণ জানতে পেরে নিজেই প্রস্তাব করলেন, আমিও একবার মৃতদেহটা দেখতে চাই।

আপনার মতামত জানতে পেলে আমি খুব খুশি সব স্যার। বললেন বেকন, স্ত্রীলোকটির পরিচয় আমাদের জানা দরকার।

কিন্তু পাথরের কফিনটার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের মৃতদেহটা তিনি দেখলেন। পরে জানালেন, এ মেয়েকে কখনো আগে দেখিনি। আমার রোগীদের কেউ নয়। বোঝা যাচ্ছে একসময় বেশ সুন্দরী ছিল। কিন্তু ওরকম একটা জায়গায় কফিনটার ভেতরে ওটা আবিষ্কার হল কি করে?

–মিস আইলেসব্যারো আবিষ্কার করেছেন। বললেন বেকন।

–বাড়ির নতুন কাজের মেয়েটি? তা পাথরের কফিনের ভেতরে দেখার কি দরকার পড়েছিল ওর?

–একটু পরেই আমিও একথা তার কাছে জানতে চাইব।

 এই সময় আলেকজান্ডার আর তার বন্ধু স্টডার্ড ওয়েস্ট সেখানে উপস্থিত হল।

–স্যার, দয়া করে, আমাদের মৃতদেহটা একবার দেখতে দেবেন?

আলেকজান্ডারের অনুরোধ শুনে ইনসপেক্টর বেকনের ভ্রু কুঞ্চিত হল।

দুই কিশোরের পরিচয় জেনে নিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, এই অঞ্চলে তোমরা কখনো সোনালী চুলের কোনো মেয়েকে দেখেছ? তার গায়ে একটা হালকা রঙের ফারকোট?

-এখুনি ঠিক মনে করতে পারছি না স্যার, বলল আলেকজান্ডার, সেজন্যই তো একবার দেখতে চাইছি-দয়া করে আমাদের আবেদনটা বিবেচনা করুন স্যার।

ইনসপেক্টর বেকন কি ভাবলেন। পরে বড় গুদামঘরের সামনে প্রহরারত কনস্টেবলকে ডেকে তিনি নির্দেশ দিলেন, কিশোরদুটিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতে।

রান্নাঘরে সন্ধ্যার জন্য চিপস তৈরি করছিল লুসি। এমন সময় একজন কনস্টেবল এসে জানাল, ইনসপেক্টর লুসির সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন।

সামনে থেকে আলুর কুচির বাটিটা সরিয়ে রেখে লুসি বার্তাবাহকের পেছন পেছন এসে একটি ঘরে ঢুকল।

লুসি আসন গ্রহণ করলে ইনসপেক্টর প্রথমে তার নাম এবং লন্ডনের ঠিকানা জেনে নিলেন।

পরে জিজ্ঞেস করলেন, মিস আইলেসব্যারো, আপনি বড় গুদোমঘরে ছেলেদের জন্য রঙের খোঁজে গিয়েছিলেন, তাইতো?

-হ্যাঁ। লুসি জবাব দিল।

-রঙ খুঁজে পাওয়ার পর আপনি একটা ক্রোবার সংগ্রহ করে চাড় দিয়ে পাথরের কফিনটার ঢাকনা তুলে ফেলে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেন?

–হ্যাঁ, তাই।

–আচ্ছা, পাথরের কফিনটার মধ্যে আপনি কি খোঁজ করছিলেন?

–একটা মৃতদেহ খোঁজ করছিলাম।

–আপনি মৃতদেহ খোঁজ করছিলেন? এই কাহিনী আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?

–অদ্ভুত শোনালেও কাহিনীটা সত্যি। আমাকে ব্যাখ্যা করবার সুযোগ দেবেন আশাকরি।

–অবশ্যই। আপনার বক্তব্য আপনি বিস্তারিত ভাবে বলুন।

লুসি তার অদ্ভুত আবিষ্কারের পূর্ববর্তী সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে যথাযথ পেশ করল।

–একটা মৃতদেহ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে আপনি এই বাড়িতে চাকরি নিয়েছিলেন, আর আপনাকে একাজে নিয়োগ করেছিলেন এক বৃদ্ধ মহিলা–তা এই মহিলাটি কে?

–তার নাম মিস মারপল। বর্তমানে তিনি চার নম্বর ম্যাডিসন রোডে বাস করছেন।

ইনসপেক্টর প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো লিখে নিলেন।

-কিন্তু, মিস আইলেসব্যারো, আপনার এই কাহিনীটা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না কি?

-কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার জন্য আপনি স্বচ্ছন্দে মিস মারপলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। শান্ত কণ্ঠে বলল লুসি।

–হ্যাঁ, মহিলার সঙ্গে আমি দেখা করব।

–তাহলে মিস ক্রাকেনথর্পকে আমার বিষয়ে কি বলবেন?

–আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারা গেল না।

–আমার বক্তব্য হল, মিস মারপলের সঙ্গে আমার কাজের যে চুক্তি ছিল তা শেষ হয়েছে। অর্থাৎ একটা মৃতদেহ খুঁজে বার করার জন্য তিনি আমাকে নিযুক্ত করেছিলেন, আমি তা করেছি। কিন্তু মিস ক্রাকেনথর্পের কাজে আমি এখনো নিযুক্ত রয়েছি। বর্তমানে বাড়িতে দুজন তরুণ অতিথি রয়েছে।

যে ঘটনা ঘটল, তাতে আরো কিছু লোকের আগমনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থায় বাড়িতে গৃহস্থালির কাজে আমার সহযোগিতা অপরিহার্য।

এখন আপনি যদি মিস ক্রাকেনথর্পকে জানান যে মৃতদেহ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য আমি তার কাছে চাকরি নিয়েছি, তাহলে তিনি হয়তো আমাকে জবাব দিতে পারেন। তা না হলে আমি তাদের প্রয়োজনে লাগতে পারি।

ইনসপেক্টর মনোযোগ দিয়ে লুসির কথা শুনলেন। বললেন, আপনার বক্তব্যের সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত আমি সত্যাসত্য নিরূপণ করতে পারছি না। তাই আপাততঃ কারো কাছেই কিছু আমি বলছি না। আপনি আপনার কাজ আগের মতই চালিয়ে যেতে পারেন।

-ধন্যবাদ। তাই করব আমি।

.

ইনসপেক্টর বেকন বললেন, স্যার, মেয়েটি স্থানীয় বাসিন্দা ছিল না। আমার ধারণা সে বিদেশী।

করোনারের জিজ্ঞাসাবাদ যা হবার তোক, এব্যাপারে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য চেয়ে পাঠানো যেতে পারে। বললেন চিফ কনস্টেবল।

–আগামীকালই করোনারের আদালত বসবে। ক্রাকেনথর্প পরিবারের সকল সদস্যই শুনেছি উপস্থিত হবে। এদের মধ্যে কোনো একজন মেয়েটিকে সনাক্ত করতে পারবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

–ক্রাকেনথর্প পরিবারের কজন উপস্থিত হচ্ছে?

নামের একটা তালিকা ইনসপেক্টরের হাতে ছিল। সেটা দেখে তিনি পড়ে শোনালেন–উপস্থিত থাকছে হারল্ড ক্রাকেনথর্প-ইনি লন্ডনের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কেড্রিক–এ হচ্ছে সেই ছবি আঁকিয়ে, বিদেশে থাকে। আর একজন আলফ্রেড–তার কাজকর্ম বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি।

তালিকাটা শোনানো হলে ইনসপেক্টর বেকন বললেন, কিন্তু ট্রেনের সেই অদ্ভুত কাহিনীটা কেন প্রচার করা হল এখনো বুঝতে পারছি না।

–কাজটা তো সেই বৃদ্ধ মহিলার–মিস মারপল না কি নাম, তাঁর সঙ্গে তুমি দেখা করেছিলে? জানতে চাইলেন চিফ কনস্টেবল।

-দেখা করেছিলাম স্যার। ট্রেনে যে হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল, এবিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত। আর স্পষ্টই স্বীকার করলেন, মৃতদেহটি খুঁজে বার করার জন্য তিনিই সেই তরুণী আইলেসব্যারোকে নিযুক্ত করেছিলেন।

-খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। বললেন চিফ কনস্টেবল, ওই মিস জেন মারপল, নামটা আগে শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো জানা যাবে।

.

করোনারের বিচার অনুষ্ঠানে লুসির সাক্ষ্য নেওয়া হল। ডাক্তারের রিপোর্টও হাজির করা। হল। কিন্তু কেউ মৃত মেয়েটিকে সনাক্ত করতে পারল না।

ক্রাকেনথর্প পরিবারের মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিল। এমা, কেড্রিক, হারল্ড, আলফ্রেড এবং ব্রায়ান ইস্টালি।

এই পরিবারের মৃতকন্যা এডিথের স্বামী ব্রায়ান ইস্টালি। এদের সঙ্গে ছিলেন, পরিবারের আইন সংক্রান্ত উপদেষ্টা সলিসিটর ফার্মের প্রধান মিঃ উইমবোর্ন।

সমস্ত ব্যাপারটা ক্রাকেনথর্প পরিবারের কাছে খুবই দুঃখজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনতিবিলম্বেই এর ঝামেলা মেটাবার জন্য মিঃ উইমবোর্ন বাড়িতে ইনসপেক্টরের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন।

করোনারের বিচার সভা থেকে ফিরে সকলে পড়ার ঘরে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইনসপেক্টর বেকন এবং স্কটল্যান্ডইয়ার্ড থেকে আগত ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডক।

পরিচয় পর্ব সম্পূর্ণ হলে ক্রাডক মিঃ উইমবোর্নকে বললেন, শুনেছি আপনি ক্রাকেনথর্প পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাই আপনাকে জানানো উচিত বলে মনে করছি। মৃত স্ত্রীলোকটিকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা সে স্থানীয় বাসিন্দা ছিল না।   সে এসেছিল লন্ডন থেকে, আর আমরা অনুমান করছি, সে এসেছিল ফ্রান্স থেকে।

মিঃ উইমবোর্ন বললেন, ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের পক্ষে খুবই দুর্ভাগ্যজনক হয়ে উঠেছে। অথচ পরিবারের কেউই ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত নয়।

তবুও পরিবারের প্রত্যেক সদস্যোর সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। আর আশা করছি, এই বাড়ি এবং পরিবারের সম্পর্কে আপনি আমাদের ওয়াকিবহাল করতে পারবেন।

মিঃ উইমবোর্ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে লাগলেন, এই বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন লব্ধ প্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী জোসিয়া ক্রাকেনথর্প, ১৮৮৪ সালে। ব্যবসার সূত্রে প্রচুর বিত্ত সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তার বড় ছেলে লুথার ক্রাকেনথর্প এই বাড়িতে বাস করছেন।

–শুনেছি মিঃ লুথার ক্রাকেনথর্পের আরেক ভাই ছিল?

–হ্যাঁ। তিনি ১৯১১ সালে মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান।

–এই বাড়ি এবং সম্পদের বিষয়ে কোনো উইলপত্র নিশ্চয়ই আছে।

-তা আছে। মিঃ জোসিয়া ক্রাকেনথর্প তার বিশাল সম্পত্তি ট্রাস্টের হাতে দিয়ে গেছেন। উইলের শর্ত অনুযায়ী, লুথার যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন সঞ্চিত বিত্ত থেকে অর্জিত আয় তিনি পাবেন। লুথারের মৃত্যুর পর সমস্ত বিত্ত তার সন্তানদের অর্থাৎ এডমান্ড, কেড্রিক, হারল্ড, আলফ্রেড, এমা এবং এডিথের মধ্যে সমান ভাবে বণ্টন করা হবে। এডমান্ড যুদ্ধে মারা গেছে। সম্পত্তির ভাগিদার বর্তমানে কেড্রিক, হারল্ড, আলফ্রেড, এমা এবং এডিথের ছেলে আলেকজান্ডার। বাড়িটার বিষয়ে শর্ত হল, এটা পাবে লুথারের জীবিত ছেলেদের মধ্যে যে জ্যেষ্ঠ অথবা তার সন্তান।

–এডমান্ড ক্রাকেনথপই তো মিঃ লুথারের জ্যেষ্ঠপুত্র, তাই তো?

–হ্যাঁ।

 –তিনি কি বিবাহিত ছিলেন?

–না।

–তাহলে বাড়িটা পাচ্ছে দ্বিতীয় ছেলে কেড্রিক?

–হ্যাঁ।

মিঃ লুথার ক্রাকেনথর্প এবাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না?

-না। কেবল তাই নয়, উইল অনুযায়ী, মূলধনের ওপরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বললেন মিঃ উইমবোর্ন।

-বাপ ছেলের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না বোঝা যাচ্ছে। বললেন ক্রাডক।

-আপনার অনুমান ঠিক। পারিবারিক ব্যবসায়ে জ্যেষ্ঠ পুত্রের অনাগ্রহ লক্ষ্য করে বৃদ্ধ জোসিয়া হতাশ হয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর বিত্ত পরবর্তী বংশধরদের জন্য ট্রাস্টের হাতে তুলে দেন।

–কিন্তু লুথার যতদিন জীবিত থাকছেন, ততদিন জীবিত বংশধররা সম্পত্তি থেকে কিছুই পাচ্ছেন না। নিজেদের রোজগারের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।

–কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, বিরস কণ্ঠে বললেন মিঃ উইমবোর্ন, একজন অজানা বিদেশী মহিলার মৃত্যুর সঙ্গে ক্রাকেনথর্প পরিবারের এসব বিবরণের কি সম্পর্ক থাকতে পারে।

–আপাততঃ সম্পর্ক নেই বলেই মনে হচ্ছে, সতর্ক কণ্ঠে বললেন ক্রাডক, তবে কথাগুলো অনাবশ্যক নয়। যাইহোক, মিঃ উইমবোর্ন, আপনাকে ধন্যবাদ। আপাততঃ আর কিছু জানার নেই। লাঞ্চের পরে ধরুন দুটো পনেরো নাগাদ, ইনসপেক্টর বেকন এবং আমি আবার আসব। পরিবারের সকল সদস্যোর সঙ্গে আলাদাভাবে কিছুক্ষণ কথা বলব। মৃত স্ত্রীলোকটিকে সনাক্তকরণের বিষয়ে কারো কাছ থেকে হয়তো কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে।

.

করোনারের বিচার সভা থেকে ফিরে এসে লুসি লাঞ্চের রান্না ইত্যাদি প্রস্তুতির কাজে মনোযোগ দিয়েছিল।

সেই সময় বিপত্নীক ব্রায়ান ইস্টালি রান্নাঘরে এসে তার সঙ্গে গল্প জুড়ল।

 নিঃসঙ্গ এই মানুষটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সে কিশোর আলেকজান্ডারের পিতা। কর্মক্ষেত্রে বিমানচালনার দক্ষতার জন্য ডি এফ সি মেডেল দ্বারা সম্মানিত।

লুসি কাজের ফাঁকে গল্প করতে করতে লোকটিকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করল। যথাসময়ে লুসির চমৎকার রান্নার প্রশংসার মধ্য দিয়ে লাঞ্চপর্ব সমাধা হল।

পুলিস অফিসার দুজন নির্দিষ্ট সময়েই ফিরে এলেন। কাজেই লাঞ্চের অব্যবহিত পরেই লাইব্রেরি ঘরে পরিবারের সকল সদস্যকে একে একে তাদের সামনে বসতে হল।

ইনসপেক্টর ক্রাডক প্রথমে কথা বললেন কেড্রিক ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে।

ভদ্রলোক বেলিয়ারিকমের ইডিজাতে বিগত ছবছর ধরে আছেন। পেশায় চিত্রশিল্পী। ক্রিসমাস উপলক্ষে দিন কয়েক আগেই তিনি একবার দেশে এসেছিলেন। এবারে এমির তার পেয়ে আবার চলে এসেছেন। খুনের ঘটনার ব্যাপারে পুলিসি হাঙ্গামার সময় এমিকে পাশে থেকে সহযোগিতা করার জন্য।

কেড্রিক জানাল, মৃত স্ত্রীলোকটিকে সে আগে কখনো দেখেনি। এবাড়ির সঙ্গেও কোনোকালে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।

কেড্রিকের পরে ডাক পড়ল হারল্ড ক্রাকেনথর্পের। ভদ্রলোক লন্ডনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।

ইনসপেক্টরের জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে সে-ও জানাল মেয়েটির কোনো পরিচয় বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। ব্যাপারটাকে সে পরিবারের পক্ষে অপ্রীতিকর এবং দুর্ভাগ্যজনক মনে করে।

তৃতীয় ব্যক্তি আলফ্রেড ঘরে ঢুকলে তাকে দেখে ক্রাডকের সন্দেহ হল, পত্রিকায় তার ছবি কোনো সময় তার চোখে পড়ে অথবা কোথাও দেখেছেন।

যাইহোক, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো লাভ হল না।

এরপর এমা এবং লুথার ক্রাকেনথপের সাক্ষাৎকারও শেষ হল।

ইনসপেক্টর বেকন বললেন, বোঝা যাচ্ছে যাদের সঙ্গে আমরা কথা বললাম, এদের কারও সঙ্গেই খুনের কোনো সম্পর্কে নেই। যদি থাকত, তাহলে এভাবে নিজেদের বাড়ির চৌহদ্দিতে মৃতদেহটা রেখে দিত না।

ইনসপেক্টর ক্রাডক বললেন, তাহলে আপাততঃ হ্যাঁম্পটনেই ফেরা যাক।

তিনি অবশ্য মনে মনে ভাবলেন, তার পুরনো পরিচিত মানুষটির সঙ্গে একবার দেখা করবেন।

.

০৭.

 ইনসপেক্টর ক্রাডককে দেখে মিস মারপল বললেন, আপনি এ কেসের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছেন বলে আমি খুশি হয়েছি। আপনার ধর্মপিতা স্যার হেনরি ক্লিদারিং আমার হিতৈষী বন্ধু। এখন কতটা কি জানতে পারলেন শোনা যাক।

-আপনার বন্ধু মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডির বিবৃতি, রেলের টিকিট কালেক্টার এবং ব্র্যাকহ্যাম্পটনের নোট সবই আমি পেয়েছি। রেলওয়ে ও পুলিস অনুসন্ধান চালিয়েও কাহিনীর কোনো সমর্থন পায়নি।

তাই সকলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঘটনাটা এক বয়স্কা মহিলার কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আপনার অনুমান পদ্ধতি সকলের বুদ্ধিকেই টেক্কা দিয়েছে।

একটু থেমে ক্রাডক আবার বললেন, আপনার অভাবনীয় কল্পনাকে আর একটু প্রসারিত করলেই তো আমার মনে হয় হত্যাকারীরও একটা হদিস মিলে যেতে পারে।

-তা যদি পারতাম, বললেন মিস মারপল, তাহলে অবশ্যই বলতাম। তবে এব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ যে রাদারফোর্ড হলে বসবাসকারী কেউ একজন হত্যাকারী অথবা খুনের পেছনের সব ঘটনা জানে।

-যে গুদামঘরটায় কফিনে মৃতদেহ রাখা হয়েছিল, সেটা সকলেই চেনে, কোথায় চাবি রাখা হয় তাও জানে। আর রাদারফোর্ড হলের সঙ্গে যুক্ত লোকের সংখ্যাও অনেক। বেশ কিছু বহিরাগত নারী ওখানে ঠিকে কাজ করেছে। তাছাড়া উইমেন্স ইনসটিটিউট ও এ. আর. পি. ওয়ার্ডেন কর্মীরাও হয়েছে। যে কেউই জায়গাটাকে উদ্দেশ্যপূরণের ক্ষেত্রে উপযোগী ভাবতে পারে। বললেন ক্রাডক।

–আপনার অসুবিধা আমি বুঝতে পারি। মৃতদেহ সনাক্ত করতে না পারলে আপনাদের পক্ষে এগনোও সম্ভব হচ্ছে না।

–আমরা নানাভাবেই মেয়েটির পরিচয় জানবার চেষ্টা করছি। ওই বয়সের এবং ওরকম চেহারার নিরুদ্দিষ্ট মেয়েদের খবরও অনুসন্ধান করে দেখছি। পুলিস সার্জন বলেছেন, মেয়েটির বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, স্বাস্থ্যবতী এবং সম্ভবত বিবাহিতা, কমপক্ষে একটি সন্তান তার থাকা উচিত। তার গায়ের সস্তা দামের ফারকোটটি লন্ডনের কোনো দোকান থেকে কেনা নয়, তা-ও জানা গেছে।

–অন্য পোশাক–অন্তর্বাস ইত্যাদি

-হ্যাঁ, ওগুলো বিদেশি, বেশির ভাগই প্যারিস থেকে কেনা। আমরা প্যারিসের পুলিসকে লীর চিহ্ন পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করছি কোনো একটা খবর পাওয়া যাবে।

–সেই পাউডার প্যাকটা

-ওটা খুবই সস্তা জিনিস। কোনো কাজে আসেনি। তবে ওই জিনিসটা সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে

মিস মারপল বাধা দিয়ে বললেন, আসলে মৃতদেহটা খুঁজে বার করার ব্যাপারেই আমি বিশেষ আগ্রহী ছিলাম।

–আপনি নিঃসন্দেহ হলেন কি করে যে মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া যাবে?

-ওই মেয়েটির অভাবিত কর্মদক্ষতা দেখে। ও এক অন্য জাতের মেয়ে। তা রাদারফোর্ড হলে কাজকর্ম কেমন করছে?

–দেখে মনে হলো বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই তার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমরা অবশ্য তার সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কথা গোপন রেখেছি।

-আমার সঙ্গে অবশ্য তার কাজের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে।

–তাহলে বলছেন, সে মনে করলে যথারীতি ওখানকার কাজ ছেড়ে দিতে পারে?

 –স্বচ্ছন্দে।

–কিন্তু সে তো কাজ আগের মতই করে চলেছে।

–মেয়েটি বুদ্ধিমতী, কোনো বিষয়ে আগ্রহ জাগা অসম্ভব নয়।

যাইহোক, আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।

 –লেগে থাকলে কার্যসিদ্ধি হবে। বললেন মিস মারপল।

–কিন্তু আপনার কিছু প্রেরণা না পেলে কিছু চিন্তালব্ধ সূত্র

জলজ্যান্ত একটি মেয়ে নিপাত্তা হয়ে গেল অথচ নিরুদ্দিষ্ট আত্মীয় বা বন্ধুর সন্ধান কেউ করছে না এটাই আমার প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই কোনো থিয়েটার পার্টি, যারা একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায় তাদের কথা ভাবছি। ওরকম পার্টির মেয়েদের বাড়ির সঙ্গেও বন্ধন বলতে কিছু থাকে না। কোনো মেয়ে হারিয়ে গেলে সাধারণতঃ তার খোঁজ নেবারও তাই কেউ থাকে না।

ক্রাডক হেসে বললেন, আপনার এই কল্পনার বাস্তব ভিত্তি অস্বীকার করা যায় না। বিষয়টা আমরা মাথায় রাখব।

.

মিস মারপল পরদিনই তার বন্ধু মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডিকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি লিখলেন। ব্র্যাকহ্যাম্পটনের রাদারফোর্ড হলের একটি পাথরের কফিনের মধ্যে ট্রেনে গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করা মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া গেছে–এই সংবাদ জানতে পেরে মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি যে পরিতৃপ্তির হাসি হাসছেন চিঠি লিখতে লিখতে মানসচক্ষে তার সেই দৃশ্য ফুটে উঠল।

.

০৮.

 বাসন মাজার জন্য পার্সলে গাছ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে লুসি সবজি বাগানে ঢুকেছিল। কেড্রিক ক্রাকেনথপও এই সময় এসে জুটল।

–আপনার এই কাজ আমার একদম পছন্দ নয়।

–কোন কাজ? অবাক হল লুসি।

–এই যে বাড়ির ঝিয়ের কাজ।

-আপার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করা গেল না। আমি গৃহস্থালীর কাজের সাহায্যকারিণী।

হ্যাঁ, এতেই আপনার অদ্ভুত স্বভাবটা ধরা পড়ে।

-অদ্ভুত

–অদ্ভুত না হলে আর ওই গুদামঘরের ভেতরে একটা সেকেলে কফিনের ভেতরে আপনার চোখ পড়ে?

লুসি হাসল

–বাবার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

–এসব নিয়ে চিন্তা করার অবসর পাইনি।

–আমি জানি এমা বাদে আমাদের সকলকে তিনি ঘৃণা করেন। নিজে স্বভাবদোষে ঠাকুর্দার কোপে পড়েছিলেন। তিনি তার সমস্ত বিষয়আশয় নাতিনাতনিদের জন্য ট্রাস্টের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন।

আর এমন ব্যবস্থা করে গেলেন যে সঞ্চিত অর্থ থেকে যা আয় হবে কেবল সেটুকু তিনি নিজে ভোগ করতে পারবেন, মূলধন ছুঁতে পারবেন না। আর আমাদের পিতৃদেব করলেন কি, না, এখানে এসে কেবল টাকা জমিয়ে টাকার পাহাড় বানালেন।

ঠাকুর্দার বিত্তের এক কপর্দকও আমরা ভাইবোনেরা কেউ পেলাম না। আমি একজন শিল্পী, বিদেশে পড়ে থেকে মার খাচ্ছি। হারল্ড নিজের উদ্যোগে ব্যবসা করে গণ্যমান্য হয়েছে। তবে বাজারে তার সম্পর্কে নিন্দনীয় গুজব শোনা যায়। আর আলফ্রেড বেচারা, সে হলো পরিবারের কালো ভেড়া, কুলাঙ্গার যাকে বলে। ছোটখাট নানা কাজ ও বিভিন্ন সময় করেছে, আর সবেতেই সন্দেহজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। অনেক ভাগ্য যে এখনো জেলখানায় ঢোকেনি।

–একজন অপরিচিত লোককে এসবকথা বলা আপনার কি উচিত কাজ হচ্ছে?

 –কেন, তুমি কি পুলিসের ইনফর্মার?

–বিচিত্র কি?

এই সময় দেখা গেল, এমি বাগানের দরজা দিয়ে আসছে।

–না, আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।

 লুসি সবজি বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

–কেড্রিক, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল এমা।

–মেয়েটাকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম। ওর আসল পরিচয়টা কি?

–মিস আইলেসব্যারোর প্রসঙ্গ এখন থাক কেড্রিক, অন্য বিষয় নিয়ে আমি ভয়ানক। চিন্তিত।

-তোমার চিন্তার কারণটা কি জানতে পারি?

–দেখ, মৃত স্ত্রীলোকটির পরিচয় পুলিস এখনো জানতে পারেনি। তবে তারা তাকে ফরাসি বলে সন্দেহ করছে। আচ্ছা কেড্রিক, মেয়েটি কি মার্টিন হতে পারে?

–সেই মার্টিন? স্থির দৃষ্টিতে এমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল কেড্রিক, মৃত মেয়েটি মার্টিন হতে যাবে কেন?

-তার টেলিগ্রামটা তো আমরা ঘটনার সময়েই পেয়েছিলাম। এর পর সে এখানে এসেছিল বলে তোমার মনে হয়?

-ওই গুদামঘরে মরে পড়ে থাকতে? একদম অসম্ভব কল্পনা।

–মার্টিন একটা চিঠিও তো আমাকে লিখেছিল, এসব কথা পুলিসকে জানানো ঠিক হবে মনে কর?

-ওসব চিঠির কোনো ভিত্তি নেই। বাবা তো মনে করেন আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ফন্দি। যাইহোক, আগ বাড়িয়ে পুলিসকে এসব বলতে যাওয়া কেন? তারা তাদের কাজ করুক না। তুমি চুপচাপ বসে থাক।

-তুমি ঠিক বলছ কিনা বুঝতে পারছি না। চিন্তিত ভাবে মাথা নেড়ে এমা বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

রাস্তায় উঠে ডাঃ এম্পার সঙ্গে দেখা হল। •

-তোমার বাবাকে দেখে এলাম। চমৎকার আছেন। কি ব্যাপার, মনে হচ্ছে তুমি কোনো বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত?

ডাঃ এম্পার কেবল এই পরিবারের চিকিৎসকই নন, একজন পারিবারিক বন্ধুও। বিপদআপদে নির্ভরশীল সঙ্গী।

এমা ইতস্ততঃ করলেও তাকে তার ভাবনার বিষয়টা খুলে জানাবে ভাবল।

–আমার ভাই যুদ্ধে মারা গিয়েছে, আপনি তো জানেন–

–হ্যাঁ, শুনেছিলাম সে একটা ফরাসি মেয়েকে বিয়ে করে থাকবে। তা এখন কি

বিয়ের মনোভাবের কথা জানিয়ে আমাকে লেখা চিঠিটা পাবার কদিন পরেই সে যুদ্ধে নিহত হয়। মেয়েটি সম্পর্কে কেবল তার ধর্মীয় নামটা ছাড়া আমরা আর কিছুই জানতাম না। তবে তার একটা চিঠি অন্ততঃ আমরা আশা করেছিলাম। ঠিক মাসখানেক আগে, ক্রিসমাসের সময় আমরা এতদিন পরে মেয়েটির একটা চিঠি পাই।

–হ্যাঁ আমি শুনেছি।

–সে লিখেছিল, ইংলন্ডে এসেছে, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমরা প্রস্তুত হলাম, এমনি সময়ে সে একটা তারবার্তা পাঠিয়ে জানায়, অনিবার্য কারণে তাকে ফ্রান্সে ফিরে যেতে হচ্ছে।

-বুঝতে পেরেছি, পুলিস মৃত স্ত্রীলোকটিকে ফরাসি বলে ধারণা করছে–আর তোমার আশঙ্কা হচ্ছে নিহত স্ত্রীলোকটি তোমার ভাইয়ের

–হ্যাঁ। পুলিসকে ব্যাপারটা জানানো উচিত কিনা তাই আমি ভাবছি।

-বুঝতে পেরেছি। তোমার ভাইদের সমর্থন তুমি পাবে না, আমি জানি। আমার পরামর্শ যদি চাও, আমি বলব, পরিবারের যে যা খুশি ভাবুক, যা উচিত বলে মনে হচ্ছে, তা অবশ্যই করবে।

আমি হলে অনেক আগেই একথা ওদের জানাতাম। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, যে কোনো অবস্থায় তোমার বিচারবুদ্ধিকে আমি সবার আগে সমর্থন জানাব।

.

–আমাকে ডাকছেন মিঃ ক্রাকেনথপ?

 –আস্তে কথা বল মেয়ে, একটা জিনিস দেখাব তোমাকে, এসো।

বৃদ্ধ এগিয়ে এসে দরজা বন্ধ করলেন।

লুসি দেখল ঘরটার চারপাশে কাগজপত্রের স্তূপ জমে আছে। দেয়ালের কোণায় কোণায় ঝুল। তার ধারণা হল, বৃদ্ধ ঘরটা পরিষ্কার করার কথা বলবে নিশ্চয়ই।

কিন্তু সেসব কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে মিঃ ক্রাকেনথর্প, কিছু মসৃণ অমসৃণ ডেলারমত পাথরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, এসব আমি সকলকে দেখাই না। ভূ-বিদ্যা বিষয়ের নমুনা। আরো দেখাব এসো।

দেয়ালে ঝোলানো পূর্বপুরুষদের কিছু ছবি ও বংশপরিচয়ের তালিকা দেখিয়ে তিনি বললেন, আমার মায়ের দিকের সকলেই ছিলেন রাজা। আমি মায়ের ধারাটা পেয়েছিলাম। শিল্পকলা, প্রাচীন ভাস্কর্য, এসব বিষয়ে ঝোঁক ছিল। অথচ আমার বাবা ছিলেন নিতান্তই স্কুল রুচির মানুষ। দুর্ভাগ্য আমার দুবছর বয়সে আমি মাকে হারাই। মায়ের পূর্বপুরুষদের পরিচয় থেকেই বুঝতে পারবে আমাদের বংশধারা কত প্রাচীন।

লুসি হতভম্ব হলেও বুঝতে পারছিল, বৃদ্ধ তার কোনো আপত্তি বা কাজের কথা এখন কানে তুলবার অবস্থায় নেই।

লুসিকে শক্ত হাতে টেনে একটা বিরাট আকারের কাঠের আলমারির সামনে নিয়ে এলেন বৃদ্ধ। তার হাতের আঙ্গুলের চাপে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল লুসির। তার শারীরিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল।

–এটা হল এলিজাবেথের যুগের নিদর্শন। তারপর দেখ—

চাবি দিয়ে আলমারি খুলে একটা কাঠের বাক্স বার করে নিয়ে এলেন তিনি। তার ভেতর থেকে কাগজে মোড়ানো একরাশ সোনার মুদ্রা সামনে ঢেলে দিয়ে বললেন, এ হলো মহামূল্য জিনিস, সোভোরেন বলে এগুলোকে। ইংলন্ডেশ্বরের নামাঙ্কিত। এমনি আরো অনেক জিনিস আছে যা এমা জানে, অন্য কেউ জানে না। এসবই হল আমার আর তোমার

এসব তোমাকে কেন দেখিয়ে রাখছি জান মেয়ে। আমি চাই না তুমি আমাকে অসুস্থ আর বুড়ো বলে ভাবো। ওরা আমাকে বুড়ো সাজিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু এখনো অনেক বছর বহাল তবিয়তে টিকে থাকব আমি। ওদের অনুগ্রহ করার জন্য অত সহজে মরছি না।

তোমার বুদ্ধি আছে, তেজ আছে, সেজন্য তোমাকে একটা উপদেশ দিতে চাই–কোনো অল্পবয়সী যুবকের পাল্লায় পড়ে নিজের ভবিষ্যতটা লোপাট করো না। নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নিতে হলে সবুর করো

বৃদ্ধ লুসির কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, বলছি সবুর কর–

এরপর লুসির বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, আমি কি বললাম বুঝতে পারলে তো? আমার এ প্রস্তাব নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে–সত্যি কথা বল–

ঠিক এই সময় দরজার বাইরে থেকে এমার ডাক শুনতে পেয়ে লুসি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

–মিস ক্রাকেনথর্প আমাকে ডাকছেন।

লুসি যখন দ্রুতপায়ে হলঘরে প্রবেশ করল, সে উপলব্ধি করল, বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প তাকে একটি শর্ত সামনে ধরে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন।

.

০৯.

 নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসঘরে বসেছিলেন ডারমট ক্রাডক। ইতিপূর্বেই তিনি প্যারিসের পুলিস হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন। মৃত মেয়েটির কিছু ফটোগ্রাফ আগেই তাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এখন জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছেন, সেখানকার পুলিস ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দলগুলোর মধ্যে অনুসন্ধান কাজ চালিয়েছে।

এমনি সময়ে একজন কনস্টেবলের নিয়ে আসা একটা স্লিপ থেকে জানতে পারলেন এমা ক্রাকেনথর্প দর্শনপ্রার্থী। তার নির্দেশ পেয়ে কয়েক মুহূর্ত পরেই কনস্টেবল এমাকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল।

যথারীতি সৌজন্য বিনিময়ের পর আসন গ্রহণ করে প্রাসঙ্গিক দু-চার কথার পরে এমা সরাসরি বলল, আমার তিন ভাইকে তো আপনি দেখেছেন। তাছাড়া আর এক ভাই এডমান্ড যুদ্ধে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে আমাকে একটা চিঠি লেখে।

ব্যাগ থেকে চিঠিটা বার করে এমা পড়ে শোনাল।

প্রিয় এমা,
তুমি মনে আঘাত পাবে না এই বিশ্বাস নিয়েই জানাচ্ছি, একটি ফরাসি মেয়েকে আমি বিয়ে করছি।হঠাই যোগাযোগ হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মার্টিনকে তোমার পছন্দ হবে। আমি সৈনিক মানুষ, আমার যদি কিছু হয়, মার্টিনকে দেখবে। আশা করছি পরের চিঠিতে আমাদের বিবাহের খবর বিস্তারিত তোমাকে জানাতে পারব। বৃদ্ধ পিতাকে এসব কথা জানিয়ে তার অশান্তি বাড়িয়ে কাজ নেই।
এডমান্ড

ইনসপেক্টর ক্রাডক হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন।

-তারপর বলুন।

এমা বলে চলল, এ চিঠি পাওয়ার দুদিন পরেই একটা তারবার্তায় যুদ্ধে এডমান্ডের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। আমি পরে জানতে পেরেছি, সামরিক বিভাগের রেকর্ডে এডমান্ডের বিবাহের উল্লেখ ছিল না।

এরপর মেয়েটির কাছ থেকেও কোনো চিঠিপত্র পাইনি। আমিও অবশ্য খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ নাম জানা ছিল না বলে কোনো ফল হয়নি। তখন ধারণা করে নিই, শেষ পর্যন্ত হয়তো। আমার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়েটা হয়নি।

এতদিন পরে মাসখানেক আগে আমি একটা চিঠি পাই। চিঠির তলায় নাম ছিল মার্টিন ক্রাকেনথর্প।

–চিঠিটা আপনার কাছে আছে? আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন ক্রাডক।

এমা হাতব্যাগ থেকে চিঠিটা বার করে দিল। ফরাসি হরফে লেখা চিঠিটা পড়লেন ক্রাডক।

প্রিয় মাদমোয়াজেল,
আমার এ চিঠি হয়তো আপনার বেদনার কারণ হবে। আপনার ভাই, আমাদের বিয়ের সংবাদ আপনাকে জানিয়েছিল কিনা আমি জানি না। বলেছিল জানাবে। আমাদের বিয়ের মাত্র কদিন পরেই সে মারা যায়। আর সেই সময়েই আমাদের গ্রামও জার্মানদের অধিকারে চলে যায়।

যুদ্ধের পর এক নতুন ধরনের জীবনযাত্রায় জড়িয়ে যাবার ফলে ভেবেছিলাম, আপনাদের সঙ্গে আর যোগাযোগের চেষ্টা করব না। অবশ্য আপনার ভাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগের কথাই বলেছিলেন।

বর্তমানে আমার ছেলের কথা ভেবেই এই চিঠি লিখছি। আমার ছেলে মানে আপনার ভাইয়ের ছেলে। তার উপযুক্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা আমার সাধ্যে কুলিয়ে উঠছে না।

আগামী সপ্তাহে আমি ইংলন্ড যাচ্ছি। আপনার সম্মতিজ্ঞাপক চিঠি পেলে আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। আমার ঠিকানা, ১২৬ এলাবার্স ক্রেসেন্ট, এন, ১০। আশা করব, আমার চিঠি পেয়ে আপনি মর্মাহত হবেন না। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আপনার
মার্টিন ক্রাকেনথর্প

ক্রাডক দুবার চিঠিটা পড়ে ফিরিয়ে দিলেন।

–চিঠিটা পাবার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল মিস ক্রাকেনথর্প।

-বুঝতেই পারছেন, চিঠি পাবার পর আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার মনে হয়েছিল, যদি মহিলা সত্যিই মার্টিন হয়, তবে তাকে উপযুক্ত সম্বর্ধনা জানানো উচিত। অবশ্য এবিষয়ে আমি আমার ভাই হারল্ড আর ভগ্নীপতি ব্রায়ান ইস্টলির সঙ্গেও পরামর্শ করেছিলাম। কিন্তু তারা অবিশ্বাস করে আমাকে সতর্ক হবার পরামর্শ দিয়েছিল।

যাইহোক, আমি চিঠিতে উল্লিখিত ঠিকানায় চিঠি লিখে তাকে রাদারফোর্ড হলে আসার আমন্ত্রণ জানাই।

দিন কয়েক পরেই লন্ডন থেকে একটি তারবার্তা পাঠিয়ে মার্টিন আমাকে জানায় অপ্রত্যাশিত কারণে সে ফ্রান্সে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এর পর এখন পর্যন্ত আর কোনো খবর পাইনি।

–ক্রিসমাসের কত দিন আগে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে?

–ক্রিসমাসের অল্প কদিনই বাকি ছিল তখন তার তারবার্তা আমি পেয়েছিলাম। আমি জানিয়েছিলাম, ক্রিসমাসের পরের সপ্তাহে আসার জন্য। কেননা সেই সময় সকলেই বাড়িতে উপস্থিত থাকবে।

-তাহলে আপনার কি ধারণা, পাথরের কফিনে আবিষ্কার করা মৃতদেহটা মার্টিনের হতে পারে?

-না, একথা আমার কখনো মনে হয়নি। স্ত্রীলোকটি বিদেশিনী বলে আপনারা যখন অনুমান করলেন, তখন মার্টিনের কথা আমার খেয়াল হয়।

 –ঠিক আছে মিস ক্রাকেনথর্প, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি। ব্যাপারটা আমাদের নজরে এনে উচিত কাজ করেছেন। পুলিস সার্জনের বক্তব্য হল, স্ত্রীলোকটির মৃত্যু হয়েছিল, মৃতদেহ আবিষ্কার হওয়ার দিন থেকে তিন-চার সপ্তাহ আগে। এখন আমাদের দেখতে হবে যে স্ত্রীলোকটি আপনাকে চিঠি লিখেছিল সে সত্যিই ফ্রান্সে গিয়েছিল কি না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এবারে যা করার আমরাই করছি।

ভালোকথা, আপনি বলেছেন আপনার ভাই হারল্ড ও আপনার ভগ্নীপতির সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আপনার বাবা ও অন্যভাইদের এবিষয়ে মনেভাব কি ছিল তাতে বললেন না।

-বাবাকে জানিয়েছিলাম। চিঠিটাকে তিনি দুষ্ট লোকের টাকা আদায়ের ফিকির বলেই মনে করেছিলেন। অন্য দুই ভাই বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতে চায়নি। তবে আমরা মোটামুটি এরকম স্থির করে রেখেছিলাম যে মার্টিনকে আমরা অভ্যর্থনা জানাব এবং আমাদের পরিবারের আইনগত উপদেষ্টা মিঃ উইমবোর্নকে উপস্থিত থাকতে বলব।

–মিঃ উইমবোর্নের পরামর্শ কি ছিল?

 –তাকে জানাবার আগেই তারবার্তাটা পেয়েছিলাম।

–আচ্ছা, চিঠির কথা আপনার সত্যি বলে মনে হয়েছিল?

-সত্যিকথা বলতে, স্নেহার্দ কণ্ঠে বলল এমা, ভাইদের মধ্যে এডমান্ডকেই আমি বেশি ভালোবাসতাম। তাই চিঠিটা আমার কাছে অস্বাভাবিক বা সত্যি বলেই মনে হয়েছিল। আমার ধারণা হয়েছিল, এডমন্ডের মৃত্যুর পর হয়তো অন্য কোনো পুরুষ তার আর তার ছেলের ভার নিয়েছিল।

পরে সেই পুরুষটির মৃত্যু হয়, আর সে এডমান্ডের ছেলের কথা ভেবেই তার পরিবারের কাছে আবেদন করার কথা ভাবে। এডমান্ড নিজেই তাকে সে পরামর্শ দিয়েছিল বলে সে চিঠিতে উল্লেখ করেছিল। এটা সত্যিকথা যে এডমান্ডের পুত্রসন্তানের কথা শুনে আমি খুব খুশি ও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম।

ক্রাডক চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন। পরে বললেন, চিঠিটা সত্যি বলে মনে হবার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু মার্টিন ক্রাকেনথর্প এতদূর এগিয়ে এসেও হঠাৎ কেন প্যারিস ফিরে গেলেন এটাই ধাঁধা হয়ে উঠেছে। এরপর আর কোনো চিঠিও কেন আপনি পেলেন না? তবে একটা সম্ভাবনা এমন হতে পারে, আপনার কোনো ভাই-এর পক্ষে তদন্তের ব্যবস্থা করা অসম্ভব নয়। কেননা, এডমান্ডের সত্যিকার বংশধর তার ঠাকুর্দার সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী। কেবল তাই নয়, উইলের যে শর্তের কথা আমি শুনেছি, তাতে এডমান্ডের ছেলেই রাদারফোর্ড হল এবং সংলগ্ন জমির মালিক হবার কথা।

এই মার্টিন হয়তো প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি যে তাকে ছেলের দাবি নিয়ে উপস্থিত হলে একদল কঠিনহৃদয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্মুখ সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হবে। আইনগত কঠিন পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই হয়তো সে নীরব থাকাই সঙ্গত মনে করেছে।

এমা চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল।

যাইহোক, আমরা উপযুক্ত তদন্তের ব্যবস্থা করছি।

–আপনার সহৃদয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

 এমা বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।

মিনিট দুয়েক বসে চিন্তা করলেন ক্রাডক। পরে ফোনে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ওয়েদারবলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন এখুনি ১২৬, এলভার্স ক্রেসেন্ট, নম্বর টেন এই ঠিকানায় গিয়ে মিসেস মার্টিন ক্রাকেনথর্প নামে মহিলার খোঁজখবর জানার চেষ্টা করেন।

-আরো শোন বব, বললেন ক্রাডক, রাদারফোর্ড হলে পাওয়া মৃতদেহের ফটোও সঙ্গে নেবে। আমার ধারণা ওই নামের মহিলা ওই ঠিকানায় বাস করতো কিংবা চিঠিপত্রের খোঁজে আসত।

বিকেলের দিকে একজন থিয়েটার দলের এজেন্টের সঙ্গে তিনি দেখা করলেন। অফিসে ফিরে এসেই পেলেন প্যারিসের একটি টেলিফোন।

 এখানে ব্যালে মারিটাক্সি দলের আন্না স্ট্রাভিনস্কা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার পাঠানো বিবরণের মিল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের প্রস্তাব, এখানে চলে আসুন। ডেসিল, প্যারিস পুলিস হেড কোয়ার্টাস।

ক্রাডক সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন। রাতের স্টিমারেই প্যারিস রওনা হবেন।

.

লুসি আইলেসব্যারো এমির কাছে জানতে চেয়েছিল, সে তার মাসীকে এদিন রাদারফোর্ড হলে তার কর্মস্থল দেখাতে নিয়ে আসতে পারে কিনা। এমি সানন্দে সম্মতি জানিয়েছিল। সেই মত লুসি আজ বিকেলে গিয়ে মিস মারপলকে চায়ের আসরে নিয়ে এসেছে। তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে চুল্লির সামনে বসানো হয়েছে।

-আপনি যে আসতে পেরেছেন এজন্য আমরা আনন্দিত।

 কোমল কণ্ঠে বলল এমি।

 মিস মারপলের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হল। চায়ের নিমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন।

হ্যারল্ড ক্রাকেনথর্প পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আলফ্রেড একমুখ হাসি নিয়ে তার দিকে স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিচ্ছিল, তাকে দেখে তিনিও হাসলেন। কেড্রিক একটা পুরনো জ্যাকেট পরে চুল্লির বেষ্টনীর কাছে দাঁড়িয়েছিল।

বৃদ্ধার সন্ধানী চোখ সকলকেই গভীরভাবে নিরীক্ষণ করল।

মিস মারপলের আগমনটাকে প্রসন্ন মনে মেনে নিতে না পারলেও কেড্রিক ও হারল্ড মেনে নিয়েছিল, তাদের চোখে রহস্যময় মেয়ে লুসি সম্পর্কে আরও কিছু খোঁজখবর তার মাসীর কাছ থেকে জানা যাবে এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে।

মিস মারপল, এমাকে তাদের বাড়ির প্রশংসা শোনালেন, ঘরের বিভিন্ন শিল্পকর্মের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

এমি আলোচনা প্রসঙ্গে জানাল, তার দুভাই লন্ডনে বাস করে। এক ভাই চিত্রশিল্পী। বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে ইডিজাতে থাকে।

–এটা খুবই আনন্দের যে ভাইরা তোমার সঙ্গে রয়েছে। আজকাল তো পরিবারগুলো সব ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বললেন মিস মারপল।

কেড্রিক বলল, আপনার কাছ থেকে আজ লুসির ছেলেবেলার কথা শুনব। ও আমাদের সকলকে জয় করে নিয়েছে।

মুখে খুশির হাসি নিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকালেন মিস মারপল। তারপর এইভাবে শুরু করলেন, লুসি বরাবরই খুব বুদ্ধিমতী আর মেধাবী। পাটীগণিতে তার ছিল অসাধারণ দখল

এভাবে তিনি লুসির ছেলেবেলার অনেক মজাদার গল্প উৎসাহের সঙ্গে শুনিয়ে গেলেন। পরে নিজের গ্রামের জীবনের স্মৃতিচারণও করলেন।

এমনি সময় ব্রায়ানের সঙ্গে দুই কিশোর ঘরে ঢুকল। খুনের রহস্য মোচনের সূত্র সন্ধান করে তারা গলদঘর্ম হয়ে এসেছে।

চা পরিবেশিত হবার খানিক পরেই ডাঃ কুইম্পার ঘরে প্রবেশ করলেন।

 মিস মারপলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল।

–ডাক্তারের জীবন আমাকে মুগ্ধ করে। সমাজের জন্য তাদের কত ত্যাগ আর তারা কত মহৎ।

ডাঃ কুইম্পার হেসে বললেন, এককালে ডাক্তারদের বলা হত জোঁক। অবশ্য জোঁক জাতীয় ডাক্তার অনেক আছে।

কথা বলতে বলতেই তিনি একরাশ স্যান্ডউইচের সঙ্গে কেক ও কফির সদ্ব্যবহার করলেন।

–তোমার বাবাকে একবার দেখে আসি চল।

 এমা ডাক্তারকে নিয়ে ভেতরে চল গেল। মিস মারপল তাদের দুজনকে লক্ষ্য করলেন।

-মিস ক্রাকেনথর্প খুবই পিতৃভক্ত মেয়ে। মুগ্ধস্বরে বললেন তিনি।

–ওই বুড়োকে কি করে যে সহ্য করে

কেড্রিকের কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল হারল্ড, এমার জন্যই পরিবারটা সজীব রয়েছে। বাবাও স্নেহ করেন।

এমনি আরও দুচার কথার পর মিস মারপল উঠে পড়লেন। ওঠার সময় তাঁর স্কার্ফ ও হাতব্যাগখানা ফেলে দিলেন।

তিন ভাইই অতিথির সৌজন্যে তৎপরতার সঙ্গে জিনিসগুলো তুলে দিল।

–তোমরা অনেক ভালো। বড় ভালো লাগল। হ্যাঁ, আমার ওই নীল মাফলারটা তুলে দাও। আমার প্রিয় লুসি কোথায় আছে ভেবে চিন্তা হত। এখন আমি নিশ্চিন্ত। আমাকে যে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছে এ তোমাদের বদান্যতার পরিচয়।

–আমাদের আনন্দের পরিবেশে বিঘ্ন ঘটাল কেবল একটা হত্যার ঘটনা।

–কেড্রিক।

হারল্ড ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ভাইকে সতর্ক করে দিল।

কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে মিস মারপল হাসলেন। বললেন, তোমাকে দেখে আমার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ছেলেটির কথা মনে পড়ে। মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলার অভ্যাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ছিল। বাপের মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে এসে বাপের সঞ্চিত টাকা দেদার ওড়াচ্ছে।

.

মিস মারপলকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে লুসি বাড়ির আস্তাবলে গাড়ি ঢোকাল।

এমন সময় অন্ধকার কুঁড়ে তার সামনে উপস্থিত হল আলফ্রেড।

এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল লুসির। সুদর্শন আলফ্রেড ঘনিষ্ঠ হয়ে আবেগমিশ্রিত স্বরে বলল, পরিচারিকার বৃত্তিতে তুমি বড় বেমানান লুসি।

–আমি অখুশি নই।

–তুমি যথেষ্ট চালাকচতুর, রূপ আছে, সহজেই লোকের আস্থা অর্জন করতে পার–এ যে কতবড় মূলধন যদি বুঝতে চেষ্টা করতে!

–এই মূলধন নিয়ে আপনার সঙ্গে সোনার ইট বিক্রির ব্যবসায় নামতে বলছেন?

–অতটা ঝুঁকি নিতে বলছি না আমি–যেসব বিরক্তিকর নিয়মকানুন আর আইন স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে, এসবের সামান্য পাশ কাটিয়ে অনেক উন্নতি করা চলে। তোমাকে অংশীদার হিসেবে পেলে খুশি হই।

-শুনে ভালো লাগছে।

–দেখ, আমার বুড়ো বাপ বেশিদিন বাঁচবে না। তিনি মারা গেলেই আমার হাতে মোটা অঙ্কের অর্থ এসে যাচ্ছে; তখন তোমাকে নিয়ে

-ব্যবসা কাঁদবেন। কিন্তু শর্ত কি?

বিবাহ, অবশ্য যদি তোমার পছন্দ হয়। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ লুসি, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।

লুসিকে দুহাতে বেষ্টন করল আলফ্রেড।

খিলখিল করে হেসে উঠে নিজেকে মুক্ত করে নিল লুসি।

-এখন ওসব কথা থাক। ডিনারের সময় হয়েছে চলুন।

 –তোমার রান্না সত্যিই চমৎকার।

দুজনে বাড়িতে প্রবেশ করল। লুসি ঢুকে গেল রান্নাঘরে।

কিন্তু ডিনার প্রস্তুত করতে গিয়েই আবার বাধা পড়ল।

মিস আইলেসব্যারো, আপনাকে একটা কথা বলব ভেবেছিলাম।

 হারল্ড ক্রাকেনথর্প এগিয়ে এলো।

-ডিনারের পরে শুনলে দেরি হয়ে যাবে ভাবছেন?

–মোটেও না। বেশ তাই হবে।

যথারীতি আনন্দময় পরিবেশেই ডিনার পর্ব সমাধা হল। ধোয়ামোছার কাজ শেষ করে লুসি হলঘরে এল।

হ্যারল্ড অপেক্ষায় ছিল। এগিয়ে এসে লুসিকে নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।

–তোমার কাজের দক্ষতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কালই আমি চলে যাচ্ছি। তাই তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

-ধন্যবাদ।

-তোমার যোগ্যতা বাজে কাজে অপচয় হচ্ছে। এরকম চলতে পারে না। তোমাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। এখানকার সঙ্কট কেটে গেলে তুমি লন্ডনে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

সেক্রেটারিকে আমার নির্দেশ দেওয়া থাকবে। তোমার মত কর্মদক্ষ কর্মী আমাদের প্রতিষ্ঠানে দরকার। যথেষ্ট ভালো টাকা তুমি পাবে। তাছাড়া ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনার কথা শুনলে তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে।

লুসি মনে মনে বলল, বাঁচা গেল, বিবাহিত বলেই হয়তো হারল্ড বিবাহের প্রস্তাব দিল না।

 মুখে বিনীতভাবে বলল, ধন্যবাদ মিঃ ক্রাকেনথর্প। আপনার প্রস্তাব আমি মনে রাখব।

-হ্যাঁ, শোন মেয়ে, শুভ কাজে দেরি করতে নেই। জীবনে উন্নতির সুযোগ সবসময় আসে না।

শুভরাত্রি জানিয়ে হারল্ড ক্রাকেনথর্প ভেতরে চলে গেল।

শোওয়ার ঘরে যাওয়ার পথেই সিঁড়িতে কেড্রিকের মুখোমুখি হল লুসি।

–শোন, লুসি, তোমাকে একটা কথা বলব।

 –আপনাকে বিয়ে করে ইডিজিতে যেতে চাই কিনা, একথা নিশ্চয়ই?

–ওরকম কথা একদম ভাবিনি।

ভুলের জন্য দুঃখিত।

–একটা টাইম টেবল বাড়িতে পাওয়া যাবে কিনা, জানতে চাইছিলাম।

–ওহ, হলঘরের টেবিলেই রয়েছে একখানা।

–শোন লুসি, নিজেকে তুমি সুন্দরী ভাবত পার, কিন্তু সকলেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে এরকম ধারণা রেখো না। এধরনের কথা রটনা হলে ফল ভালো হয় না। জেনে রেখো, আমি যেসব মেয়েকে বিয়ের জন্য বিবেচনা করতে পারি তাদের তালিকায় স্থান পাবার কোনো যোগ্যতা তোমার নেই।

-বটে। খুব অহঙ্কার দেখছি। তবে সম্মা হিসেবে দেখলে অন্য কথা বলবেন।

–একথার অর্থ? কেড্রিকের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।

 –অর্থ ভালোই বুঝতে পেরেছেন। লুসি তার শোবার ঘরে ঢুকে গেল।

.

১০.

 প্যারিসের পুলিস হেড কোয়ার্টার্সের অফিসার আর্মড ডারমট ক্রাডকের মধ্যে যোগাযোগ হলে ডেসিল একটি গ্রুপ ফটো দেখালেন।

-বাঁদিক থেকে চতুর্থজন হল আন্না ট্রাভিনস্কি। সে কাজ করত ব্যালে ম্যারিটস্কি দলে। নিতান্ত অনামী গুরুত্বহীন দল। মাঝে মাঝে বাইরে সফরেও যায়। দলটি পরিচালনা করেন মাদাম জোলিয়ে। মেয়েটির বিশদ খোঁজখবর পাওয়া যাবে এর কাছে গেলেই।

.

–আপনার দলের আন্না ট্রাভিনস্কি নামের মেয়েটির সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর দরকার আমাদের।

-বলুন কি জানতে চান?

–মেয়েটি রুশ দেশীয়?

–নাম শুনে ওরকমই মনে হয়। ওটা ছদ্মনাম। দলে মেয়েটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। ভালো নাচতে পারত না।

–মেয়েটি কি ফরাসি?

-তা হতে পারে। ফরাসি পাসপোর্ট ছিল তার। একবার বলেছিল তার স্বামী একজন ইংরাজ।

স্বামী ইংরাজ বলেছে? জীবিত না মৃত?

 –সেটা ভালো জানা নেই। মৃত হতে পারে, আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকতে পারে।

–মেয়েটিকে শেষ কবে আপনি দেখেছিলেন?

–শেষ কবে…শুনুন বলছি। ছ সপ্তাহ আগে দল নিয়ে আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকটি জায়গায় আমরা শো দেখাই। হ্যাঁমারস্মিথে শেষ শো করে আমরা ফ্রান্সে ফিরে আসি। শেষ শোর আগেই হঠাৎ করে মেয়েটি দল ছেড়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে ফ্রান্সে ফেরেনি।

–দল ছাড়ার কারণ কিছু জানিয়েছিল?

-হ্যাঁ। খবর পাঠিয়ে জানিয়েছিল, সে তার স্বামীর পরিবারের সঙ্গে বাস করবে। সত্যি বলেছিল কি মিথ্যা, তা বলতে পারব না। এ লাইনের মেয়েরা কখন কোনো পুরুষকে পাকড়াও করে বোঝা যায় না।

-তারিখটা আপনার মনে আছে?

-তা বলতে পারব। ক্রিসমাসের আগের রবিবার আমরা ফ্রান্সে ফিরে আসি। তার দুতিন দিন আগে আন্না চলে যায়। হ্যাঁমারস্মিথে তাকে বাদ দিয়েই শো করতে হয়েছিল আমাদের।

একটানা প্রশ্নগুলো করে গেলেন ক্রাডক। তিনি যেন খানিকটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন।

–মেয়েটির এত খোঁজখবর করছেন কেন বলুন তো? কি করেছে সে?

জানতে চাইলেন মাদাম জোলিয়ে।

-না, করার ব্যাপার নয়, বললেন ক্রাডক, আমরা সন্দেহ করছি, মেয়েটি খুন হয়েছে। প্রতি রবিবার গির্জায় যেত।

–আচ্ছা, মাদাম, তার একটি ছেলে আছে এরকম কথা আপনাকে কখনো বলেছিল?

সন্তানের কথা বলছেন? এসব মেয়েরা ওরকম ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

–এমন তো হতে পারে, আগে তার একটি বাচ্চা হয়েছিল, পরে সে রঙ্গমঞ্চের জীবন গ্রহণ করে।

-হ্যাঁ, এরকম হতে পারে। তবে আমি তার ব্যাপারে কিছু জানি না।

দলের মেয়েদের মধ্যে তার বন্ধু কে কে ছিল?

বন্ধু বলতে দু-তিন জনের সঙ্গে মিশত। তাদের নাম দিতে পারি।

পাউডারের কৌটোটা ক্রাডকের সঙ্গেই ছিল। সেটা দেখান হলে, মাদাম বললেন, এরকম একটা আন্নার ছিল। ফারকোটের কথা অবশ্য কিছু বলতে পারলেন না।

মাদামের সঙ্গে কথা শেষ করে যে কটি মেয়ের নাম তিনি দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বললেন ক্রাডক এবং ডেসিল।

মেয়েদের কয়েকজন আন্নাকে ভালোই চিনত জানাল। কিন্তু তার সম্পর্কে সঠিকভাবে কোনো কথা বলতে পারল না। মেয়েটি নাকি তার নিজের কথা বিশেষ কিছুই বলত না। তবে যা বলত সবই তার বানানো আজগুবি কথাবার্তা। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে ক্রাডক বিশ্বাস করতে পারলেন না যে আন্না নামের এই মেয়েটিরই দেহ রাদারফোর্ড হলের একটা পাথরের কফিনে পাওয়া গেছে।

ফটোর দেহটা দেখে মাদাম ও মেয়েরা জানাল চেহারার সঙ্গে আন্নার কিছুটা মিল রয়েছে। তবে ওরকম ফুলে ওঠা দেহ দেখে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কি সম্ভব?

তবে তারিখের হিসেব থেকে প্রামাণ্য তথ্য একটাই পাওয়া গেল। আন্না ট্রাভিনস্কি ফ্রান্সে ফিরে যাবে না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিসেম্বরের উনিশ তারিখ। আর কুড়ি ডিসেম্বর তারিখে চারটে তিরিশের গাড়িতে ব্র্যাকহ্যাম্পটন যাওয়ার পথে যে মেয়েটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছিল, তার সঙ্গে আন্নার চেহারার মিল ছিল।

আর একটি সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায় আন্নার কথা থেকে। সে মাদামকে বলেছিল, তার এক ইংরাজ স্বামী ছিল। এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের কথা সে বলে থাকতে পারে।

রাদারফোর্ড হলের মৃতদেহটি যদি আন্না ট্রাভিনস্কি না হয়, তাহলে আন্না ফ্রান্সে ফিরে না এসে কোথায় যেতে পারে? সে কি অন্য কোথাও কোনো পুরুষের সঙ্গে গৃহজীবন শুরু করেছে?

.

লন্ডনে রওনা হওয়ার আগে প্যারিসে ক্রাডক মার্টিন নামে স্ত্রীলোকটির বিষয়ে ডেসিলের সঙ্গে আলোচনা করলেন।

ডেসিল জানালেন, চতুর্থ সাউথশায়ার রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে মার্টিন নামে কোনো ফরাসি মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কিনা তার নথিভুক্ত প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করবেন।

নিজের অফিসে ফিরে এসেই ক্রাডক সার্জেন্ট ওয়েদারবলের রিপোর্ট পেলেন।

১২৬ এলভার্স ক্রেসেন্ট হল ছাত্রদের বোর্ডিং হাউস। চিঠিপত্রের জন্য অনেক লোকই জায়গাটাতে ব্যবহার করে। মার্টিন নামের কোনো মেয়ের কথা ওখানে কেউ মনে করতে পারেনি। ফটো দেখেও সনাক্ত করতে পারেনি।

ওয়েদারলি বলল, আমরা হোটেলগুলোতেও অনুসন্ধান করেছি স্যার। আন্না ট্রাভিনস্কির একটা সন্ধান পাওয়া গেছে রুক গ্রীনের পরে একটা সস্তা হোটেলে। সেখানে থিয়েটারের লোকেরাই বেশি থাকে। আন্না দলের অন্যান্যদের সঙ্গে সেখানে উঠেছিল। ১৯ ডিসেম্বরের রাত্রে শোয়ের শেষে সে সেখান থেকে চলে যায়।

এরপরে ক্রাডক দেখা করলেন ক্রাকেনথর্প পরিবারের আইন উপদেষ্টা উইমবোর্ন হেন্ডারসন অ্যান্ড কার্সস্টেয়ার্স নামক সংস্থার মিঃ উইমবোর্নের সঙ্গে।

ক্রাডকের জিজ্ঞাসার উত্তরে মিঃ উইমবোর্ন জানালেন, ক্রাকেনথর্প পরিবারের বিষয়গুলো বাবাই দেখাশোনা করতেন। ছ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। একডমান্ডের বিবাহের কথা বাবা শুনে থাকলেও এর কোনো গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে হয় না। কাল সকালেই একটা চিঠিতে এমা আমাকে তার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাওয়ার কথা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খবর জানিয়েছে। এডমান্ড বিবাহ করেছিল কখনো এমন কথা উঠেছিল বলে মনে হয় না। তাই এই মুহূর্তে এতবছর পরে কেউ এসে এডমান্ডের একটি পুত্রসন্তান আছে দাবি জানালে ব্যাপারটা গোলমেলে বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বৈধ কোনো প্রমাণ কি ছিল মেয়েটির?

ধরুন যদি মেয়েটি তার দাবি প্রমাণ করতে পারতো তাহলে তার ছেলের প্রাপ্য সম্পত্তি কতটা হত?

–দেখুন, যতক্ষণ না মেয়েটি প্রমাণ করতে পারছে তার ছেলে এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের আইনসিদ্ধ বিবাহজাত পুত্র ততক্ষণ ওরা কোনো কিছুরই অধিকারী নয়। যদি তা প্রমাণ করতে পারে, তবে লুথার ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুর পর এডমান্ডের ছেলে তার ঠাকুর্দার ট্রাস্ট সম্পত্তির ন্যায্য অংশের অধিকারী হবে। কেবল তাই নয় লুথার ক্রাকেনথর্পের জ্যেষ্ঠ পুত্রের ছেলে বলে রাদারফোর্ড হল ও সংলগ্ন জমিরও সে মালিক হত। বর্তমানে এটা খুবই উল্লেখযোগ্য উত্তরাধিকার।

-উইল অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে লুথার ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুর পর রাদারফোর্ড হলের মালিক হবে কেড্রিক।

-হ্যাঁ, জীবিত সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বলে।

–একটা চিঠি পাবার পরে শুনেছি হারল্ড ও আলফ্রেড খুব বিচলিত হয়েছে।

–অসম্ভব। কেন?

–তাদের উত্তরাধিকারের পরিমাণ কমে যাবার আশঙ্কায়?

–নিশ্চয়ই। কেননা, এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের ছেলে সম্পত্তির একপঞ্চমাংশের অধিকারী।

–আমার ধারণা ওরা দুভাই খুবই আর্থিক কষ্টে রয়েছে।

–আপনারা দেখছি খোঁজখবর নিচ্ছেন। আলফ্রেড প্রায় সব সময়েই বলতে গেলে যে টানাটানির মধ্যে থাকে। হারল্ড, যতদূর জানি, এখন তার অস্বচ্ছল অবস্থা। তার বাণিজ্যিক সংস্থা খুবই অভাবের মধ্য দিয়ে চলছে।

ইনসপেক্টর, আপনি বিষয়টাকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছেন, বলব তা সঙ্গত হত যদি লুথার ক্রাকেনথর্পকে হত্যা করা হত। ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে হত্যা করে আর্থিক সংকট কতটা সুরাহা হবে?

.

গোপন সূত্রের খবর থেকে যা জানা গেল তাতে ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডকের অনুমান হল বাইরে ব্যবসার ঠাটবাট যতই থাক হারল্ড যে কোনো মুহূর্তে নিরুদ্দেশ হতে পারে। তাই তিনি তড়িঘড়ি তার অফিসেই হারল্ডের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলেন।

নির্দিষ্ট সময়ে সার্জেন্ট ওয়েদারবলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শহরের অফিসপাড়ায় বিরাট এক বাড়ির পাঁচতলায় উপস্থিত হলেন।

একটি সুবেশা সুশ্রী তরুণী সসম্ভ্রমে তাকে অভ্যর্থনা করে হারল্ড ক্রাকেনথর্পের নিজস্ব অফিস ঘরে পৌঁছে দিল।

সাজানো গোছানো ঘর। সর্বত্র সমৃদ্ধির ছাপ। চামড়ায় মোড়া মস্ত একটা টেবিলের পেছনে নিখুঁত পোশাকে পরিপাটি হারল্ড বসেছিলেন।

 প্রাসঙ্গিক সৌজন্য বিনিময়ের পর ক্রাডক কোনোরকম ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, একটা ব্যাপার আমি জানতে এসেছি মিঃ ক্রাকেনথর্প, ডিসেম্বরের ২০ তারিখ, শুক্রবার বেলা তিনটে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? অবশ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।

–আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমি সর্বদাই প্রস্তুত।

-এরপর তিনি টেলিফোন তুলে তার সেক্রেটারী মিস এলিসের কাছে অফিসের কর্মতালিকা চেয়ে পাঠালেন। কর্মলিকার বিবরণ থেকে জানা গেল ২০ ডিসেম্বর বেলা ৩টার পরে তিনি সোথেবির বিক্রয় কেন্দ্রে যান। সেখানে কিছু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছিল।

–মনে পড়েছে বলছি শুনুন, বলল হারল্ড, এরপর জারমাইন স্ট্রিটের একটা ছোট রেস্টুরেন্ট বাসেলস–সেখানে চা খাই। পরে ঘণ্টা খানেক একটা থিয়েটারে কাটিয়ে আমি ৪৩, কার্ডিগান গার্ডেনসের বাড়িতে ফিরি। সাড়ে সাতটায় কেটারার্স হলে ডিনার সারি এবং বাড়ি ফিরি।

–আপনি ডিনারে বেরন কটায়?

–সম্ভবতঃ ছটায়।

–ডিনারের পরে বাড়ি ফেরেন কটায়?

রাত সাড়ে এগারোটায়।

–দরজা খুলে দিয়েছিলেন আপনার স্ত্রী না গৃহভৃত্য?

-আমার স্ত্রী এলিস ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই রয়েছেন দক্ষিণ ফ্রান্সে। বাইরে থেকে দরজা খোলবার চাবি আমার কাছেই ছিল।

–আপনার বাড়ি ফেরার সময়টা সমর্থন করার মতো দ্বিতীয় কাউকে পাওয়া সম্ভব নয় বলছেন?

-ভৃত্যরা আমার ঢোকার শব্দ পেয়ে থাকতে পারে।

–আর একটা প্রশ্ন, আপনার কি নিজস্ব গাড়ি আছে?

–হ্যাঁ। নিজেই ড্রাইভ করি। বড় একটা ব্যবহার করি না।

–গাড়িটা কোথায় রাখেন?

কার্ডিগান গার্ডেনসের পেছনে একটা গ্যারেজ ভাড়া করা আছে। আপনার আর কিছু জানার আছে?

–আপাততঃ এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ।

 বাইরে বেরিয়ে এসে ক্রাডক বললেন, তুমি কয়েকটা জায়গায় খোঁজ নেবে। সোথথবির বিক্রয়কেন্দ্রে আর সেই চায়ের দোকানে। যা বলল, তাতে ওই সামান্য সময়ের মধ্যে চারটে তেত্রিশের গাড়ি ধরে গিয়ে ট্রেন ধরা, ট্রেনের কামরায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ট্রেনে ফিরে এসে আবার ডিনারে যোগ দেওয়া সম্ভবপর বলে মনে হয় না। আর শোন গাড়ি রাখার গ্যারেজেও খোঁজ নেবে।

–খোঁজ নেব স্যার।

.

আলফ্রেড ক্রাকেনথর্পের বাড়ি পশ্চিম হ্যাঁম্পস্টেডে। আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ি।

 সাদর অভ্যর্থনা জানালেও ক্রাডকের মনে হল আলফ্রেড কিছুটা বিচলিত হয়েছে।

ক্রাডক যথারীতি ক্রাকেনথর্পদের এই ভাইয়ের কাছেও ২০ ডিসেম্বরের বিষয়ে জানতে চাইলেন।

–সে তো একমাস আগের কথা। ২০ ডিসেম্বর বিকেলে এবং সন্ধ্যায় আমি কি করেছিলাম এখন আপনাকে মনে করে বলা কি সম্ভব?

বিশেষভাবে চিহ্নিত না হলে স্থানকালের প্রসঙ্গ আমার মনে থাকে না। ক্রিসমাসের দিনটির। কথা মনে করতে পারব। ওই দিনটা বরাবর বাবার সঙ্গে থাকি।

–হ্যাঁ, এবছরেও আপনারা গিয়েছিলেন।

–হ্যাঁ।

–আপনার বাবা শুনেছি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?

-হ্যাঁ। সারা বছর খরচের ভয়ে পেটে কিছু দেবেন না, সেই অবস্থায় একদিন হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিমাণ ভোজ্য পানীয় সহ্য হতে চাইবে কেন?

–এটাই অসুস্থতার কারণ বলছেন?

এছাড়া আর কি হবে?

–ডাক্তারও খুব চিন্তিত ছিলেন।

–ওই একজন জুটেছেন। সেদিন তো তার জিজ্ঞাসাবাদের চোটে অস্থির করে মেরেছিলেন। বাবা কি খেয়েছেন, কি পান করেছেন, কে রান্না করেছে–এই সব আজেবাজে যত প্রশ্ন–কুইম্পারের জন্যই বাবার মন দুর্বল হয়ে পড়ে, নইলে বাবা মোটেই অথর্ব হয়ে পড়েন নি।

ভালো কথা, মৃত স্ত্রীলোকটির বিষয়ে আর কিছু জানতে পেরেছেন কি?

–খানিকটা এগিয়েছি।

-আমার বোনের যত উদ্ভট চিন্তাভাবনা, কোথাকার কে তাকে আমার ভাই এডমান্ডের বিধবা স্ত্রী ভেবে–আপনি আশাকরি বিভ্রান্ত হননি ইনসপেক্টর।

–সেই মার্টিন নামে মেয়েটি আপনাকে কখনো চিঠি লিখেছিল?

আমাকে? রক্ষে করুন মশাই।

-তাহলে ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার আপনি কি করেছিলেন মনে করতে পারছেন না? ক্রিসমাসের আগের শুক্রবার

সেদিন আমি কি করেছিলাম বলতে না পারলেও এটা বলতে পারছি, গুদামঘরে কোনো স্ত্রীলোককে হত্যা করিনি।

-একথা বলছেন কেন মিঃ ক্রাকেনথর্প?

–আপনার জানার আসল কথাটা তো তাই। নির্দিষ্ট দিন ও নির্দিষ্ট সময়টার ওপরে জোর দিচ্ছেন–তার মানেই সন্দেহের এলাকাকে সংকুচিত করে আনা। যাইহোক শুনুন, আমি ওই দিন লিডসে গিয়েছিলাম। টাউনহলের কাছে একটা হোটেলে ছিলাম–এই মুহূর্তে নামটা মনে করতে না পারলেও খুঁজে বার করতে আপনাদের কষ্ট হবে না।

-দেখব আমরা খোঁজ নিয়ে।

–আপনাদের মাথায় কি করে এমন একটা বাপার ঢুকল বুঝতে পারছি না। মৃতদেহটি সত্যই যদি এডমান্ডের বিধবা স্ত্রীরই হয়, আমরা তাকে খুন করতে যাব কেন? এরকম ক্ষেত্রে আমরা তো বাবাকে বলে তার মাসোহারা ও ছেলেটির স্কুলের খরচের ব্যবস্থা করার জন্যই এগিয়ে আসব।

তা যাক ইনসপেক্টর আমি দুঃখিত, এর বেশি সহযোগিতা করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না।

 বাইরে এসে সার্জেন্ট উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, স্যার, আমি ওকে চিনতে পেরেছি। লোকটি সেই কুখ্যাত ডিকি রজার্সের সঙ্গী, সংরক্ষিত খাদ্যের কেলেঙ্কারীতে জড়িত ছিল। তাছাড়া ঘড়ি আর ইতালির স্বর্ণমুদ্রার কেসেও সোজোর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে-খুব সেয়ানা তোক।

–ঠিকই বলেছ, মুখটা এজন্যই আমার পরিচিত লাগছিল। কিন্তু এ তো মহাঘুঘু। নানান সন্দেহজনক কারবারের সঙ্গেই এর যোগাযোগ পাওয়া গেছে, কিন্তু বরাবরই সুকৌশলে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। এই কারণেই বর্তমান ঘটনায় কোনো অ্যালিবি উপস্থিত করতে চায়নি।

–আপনার কি মনে হয় ও-ই আসল খুনী?

–এখনও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আরও তদন্ত দরকার।

অফিসে ফিরে এসে গোটা ব্যাপারটা পর্যালোচনা করতে বসলেন ক্রাডক। পরে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাগুলোকে দেখার চেষ্টা করলেন।

গভীরভাবে চিন্তা করেও হত্যার কারণ সম্পর্কে কোনো সূত্র দাঁড় করাতে পারলেন না। অজ্ঞাত হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। সমস্যার কোনো কিনারা করা সম্ভব হল না।

শেষ পর্যন্ত ভাবলেন, আপাততঃ যে কাজ শুরু করেছিলেন তা সম্পূর্ণ করা যাক। কেড্রিককে জিজ্ঞাসাবাদ বাকি।

চিন্তাক্লিষ্ট মুখে উঠে দাঁড়ালেন ক্রাডক। ঘটনার সর্বশেষ অগ্রগতি মিস মারপলকে জানানো হয়নি। তার সঙ্গে আলোচনায় বসলে অগ্রসর হওয়ার মতো একটা পথ পাওয়া যেতে পারে।