০৭. জীবন তো খেলার জিনিস নয় মানুষের

রিণির জন্য সকলের গভীর সহানুভূতি জাগিয়াছে। খবর শুনিয়া মালতী তো একেবারে কাঁদিয়াই ফেলিয়াছিল। রিণিকে কে পছন্দ করিত না এখন আর জানিবার উপায় নাই। একেবারে পাগল হইয়া রিণি শক্ৰমিত্র সকলের জীবনে বিষাদের ছায়াপাত করিয়া ছাড়িয়াছে। দুঃখবোধ অনেকের আরো আন্তরিক হইয়াছে এইজন্য যে তাদের কেবলই মনে হইয়াছে, সকলের মন। টানিবার জন্য রিণি যেন ইচ্ছা করিয়া নিজেকে পাগল করিয়াছে। অহঙ্কারী আত্মসচেতন রিণিকে আর কেউ মনে রাখে না, ঈর্ষা ও বিদ্বেষ সকলে ভুলিয়া গিয়াছে। এখন শুধু মনে পড়ে কি তীব্ৰ অভিমান ছিল মেয়েটার, আঘাত গ্রহণের অনুভূতি তার চড়া সুরে বাধা সরু তারের মতো মৃদু একটু ছোঁয়াচেও কি ভাবে সাড়া দিত।

সরসী অত্যন্ত বিচলিতভাবে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করে, ও কেন পাগল হয়ে গেল রাজু?

রাজকুমার নির্বোধের মতো পুনরাবৃত্তি করে, কেন পাগল হয়ে গেল?

সরসী তখন নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, না, তুমিই বা জানবে কি করে!

রাজকুমার নড়িয়া চড়িয়া সোজা হইয়া বসে।

–কিছুদিন আগে হলে তোমার প্রশ্নের জবাবে কি বলতাম জান সরসী? বলতাম, রিণি কেন পাগল হয়েছে জানি, আমার জন্য।

তোমার জন্য?

আগে হলে তাই ভাবতাম। ওরকম ভাবার যুক্তি কি কম আছে আমার! তুমি সব জান না, জানলে তোমারও তাই বিশ্বাস হত।

সরসী চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। রাজকুমার অপেক্ষা করে, অনেকক্ষণ! সরসী কিন্তু মুখ খোলে না।

কি সব জান না, জানতে চাইলে না সরসী?

না।

বললে শুনবে না?

শুনব।

মালতীকে আমি পছন্দ করি ভেবে মালতীকে রিণি ইতিপূর্বে দুচোখে দেখতে পারত না। একদিন নিজে থেকে যেচে আমার দিকে প্রত্যাশা করে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিল। মাথা খারাপ হবার গোড়াতে স্যার কে. এল-এর কাছে আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে এমন সব কথা বলেছিল যে, পরদিন তিনি আমায় ডেকে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন, কেন তার মেয়েকে বিয়ে করব না। এখন রিণি পাগল হয়ে গেছে, কারো কথা শোনে না, আমি যা বলি তাই মেনে নেয়। শুধু তাই নয়, অন্য সময় পাগলামি করে, আমি যতক্ষণ কাছে থাকি শান্ত হয়ে থাকে। আমার জন্যে যে ও পাগল হয়েছে তার আর কত প্রমাণ চাও।

তোমার জন্য পাগল হওয়ার প্রমাণ ওগুলি নয় রাজু! শ্ৰদ্ধা ভয় বিশ্বাসের প্রমাণ, হয়তো ভালবাসারও প্রমাণ।

হয়তো কেন?

ভালবাসার কোনো ধরাবাঁধা লক্ষণ নেই রাজু।

রাজকুমার কৃতজ্ঞতা জানানোর মতো ব্যর্থ কণ্ঠে বলে, তুমি সত্যি আশ্চর্য মেয়ে সরসী। আমার বিবরণ শুনে অন্য কোনো মেয়ের এতটুকু সন্দেহ থাকত না রিণি আমায় ভালবাসত আর মাথাটা ওর খারাপ হওয়ার কারণও তাই।

রিণি তোমায় ভালবাসত কিনা জানি না রাজু, তবে সেজন্য ও যে পাগল হয় নি তা জানি। এক পক্ষের ভালবাসা কাউকে পাগল করে দিতে পারে না, যতই ভালবাসুক। রিণির পাগল হওয়ার অন্য কারণ ছিল। তোমায় যদি রিণি ভালবেসে থাকে, মনে জোরালো ঘা খেয়ে থাকে, অন্য কারণগুলিকে সেটা একটু সাহায্য করে থাকতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। তোমার মতো সাইকলজির জ্ঞান নেই, তবে এটা আমি জোর করে বলতে পারি। ডাক্তারও তো বলেছেন, ধীরে ধীরে ইনস্যানিটি আসছিল। তোমার দায়িত্ব কিসের? তুমি কেন নিজেকে দোষী ভেবে মন খারাপ করছ? তার কোন মানে হয় না।

ধীরে ধীরে কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া সরসী শেষের দিকে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। আবেগ ও উত্তেজনা চিরদিন সরসীর চোখে-মুখে অভিনব রূপান্তর আনিয়া দেয় এবং এই রূপান্তর তার ঘটে এত কদাচিৎ যে, আগে কয়েকবার চোখে পড়িয়া থাকিলেও রাজকুমারের মনে হয় হঠাৎ সরসীকে ঘিরিয়া অপরিচয়ের রহস্য নামিয়া আসিয়াছে।

আমি তো বললাম তোমায়, আমি জানি রিণি আমার জন্য পাগল হয় নি।

তবে তুমি এমন করছ কেন?

সরসীর প্রশ্নে রাজকুমার আশ্চর্য হইয়া গেল।

কেমন করছি?

একেবারে যেন ভেঙে পড়েছ তুমি। মুখ দেখে টের পাওয়া যায় ভয়ানক একটা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছ। সবাই বলাবলি করছে এই নিয়ে। তোমার কাছে এ দুর্বলতা আশা করি নি রাজু।

সত্যি কথা শুনবে সরসী? আমার মন ভেঙে গেছে।

কেন?

কেন তোমায় কি করে বুঝিয়ে বলব! আমি নিজেই ভালো করে বুঝতে পারি না। কেবল মনে হয় আমার জীবনের কোনো সম্ভাবনা নেই, সার্থকতা নেই, আমি একটা ফাঁকি দাঁড়িয়ে গেছি। চিরদিন যেন ভাঙাচোরা মানুষ ছিলাম মনে হয়, এখানে ওখানে সিমেন্ট করে বেঁধেৰ্ছেদে আস্ত মানুষের অভিনয় করছিলাম, এতদিনে ভেঙে পড়েছি। চব্বিশ ঘণ্টা নিজের কাছে লজ্জা বোধ করছি সরসী।

সরসী অস্কুটস্বরে কাতরভাবে বলে, আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে পার না রাজু? আমি যে কিছুই বুঝতে পারলাম না। অন্যভাবে ঘুরিয়ে বল।

রাজকুমার অনেকক্ষণ ভাবে। তার চোখ দেখিয়া সরসীর মনে হয়, মনের অন্ধকারে সে নিজের পরিচয় খুঁজিয়া ফিরিতেছে। চোখে তার আলোর এত অভাব সরসী কোনোদিন দেখে নাই, এ যেন মুমূর্ষর চোখ। সরসী শিহরিয়া ওঠে। হাতের মুঠি সে সজোরে চাপিয়া ধরে ঠোঁটে, চোখ তার জলে ভরিয়া যায়। রাজকুমার কথা বলিতে আরম্ভ করিলে প্রথম দিকের কথাগুলি সে শুনিতে পায় না।

রাজকুমার বলে, ঘুরিয়ে বলেও বোঝাতে পারব না সরসী। যদি বলি, ভেতর থেকে জুড়িয়ে যেন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছি, ঠিক বলা হবে না। যদি বলি, বহুকাল থেকে আমি যেন ধীরে ধীরে সুইসাইড করে আসছি, তাও ঠিক বলা হবে না। আমার এই কথাগুলি কি ভাবে নিতে হবে জান? গন্ধ বোঝাবার জন্য তোমায় যেন ফুল দেখাচ্ছি।

কি ভাব তুমি? মোটা কথায় তাই আমাকে বল।

কি ভাবি ভাবি যে আমি এমন সৃষ্টিছাড়া কেন। কারো সঙ্গে আমার বনে না, সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। অন্য সবাইকে দেখি, খুব যার সঙ্কীর্ণ জীবন, তারও কয়েকজনের সঙ্গে সাধারণ সহজ সম্পর্ক আছে, আত্মীয়তার বন্ধুত্বের, ঘৃণা বিদ্বেষের সম্পর্ক। কারো সঙ্গে আমার সে যোগাযোগ নেই। কি যেন বিকার আমার মধ্যে আছে সরসী, আর দশজন স্বাভাবিক মানুষ যে জগতে সুখে বিচরণ করে আমি সেখানে নিজের ঠাঁই খুঁজে নিতে পারি না। আমার যেন সব খাপছাড়া, উদ্ভট। নাড়ি দেখব বলে আমি গিরির সঙ্গে কেলেঙ্কারি করি, শুধু খেয়ালের বশে রিণি মুখ বাড়িয়ে দিলে আমার কাছে সেটা বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, সৌন্দর্যের বদলে মেয়েদের দেহে আমি খুঁজি আমার থিয়োরির সমর্থন। আমার যেন সব বাকা, সব জটিল। বুঝতে পার না সরসী তোমাদের সঙ্গেও আমার যোগাযোগটা কিরকম? তুমি কখনো আমার বিচার কর না, শুধু আমায় বুঝবার চেষ্টা কর, তোমার সঙ্গে তাই প্রাণ খুলে কথা বলি। শুধু ওইটুকু সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার। আমার সঙ্গে শুধু আমার কথা তুমি বলবে, তোমার যেন আর কাজ নেই। তোমার সম্বন্ধে কিছু জানবার কৌতূহল কোনোদিন দেখেছ আমার? তোমার সুখ দুঃখের ভাগ নেবার আগ্রহ দেখেছ কখনো? আমার প্রয়োজনে আমার জন্য তুমি একদিন আশ্চর্য সাহস আর উদারতা দেখালে তাই জানতে পারলাম তোমার দেহ মন কত সুন্দর। কিন্তু কৃতজ্ঞতা কই আমার?

কৃতজ্ঞতা চাই নি রাজু।

তুমি না চাও, আমার তো স্বাভাবিক নিয়মে কৃতজ্ঞতা বোধ করা উচিত ছিল? ওটা যেন আমার প্রাপ্য বলে ধরে নিয়েছি। তাহলেই দ্যাখ, তুমি যে আমার কাছে এসেছ, সেটা শুধু বিনা বিচারে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে আমাকে তোমার গ্রহণ করার চেষ্টার পথে, অন্তরঙ্গতার পথে নয়। অন্য কেউ হলে আপনা থেকে তোমাকে বোঝবার চেষ্টা করত, পরস্পরের জানাবোঝার চেষ্টায় সৃষ্টি হত সুন্দর স্বাভাবিক বন্ধুত্ব। আমার সেটা কোনোদিন খেয়াল পর্যন্ত হয় নি।

তুমি আমায় কখনো উপেক্ষা কর নি রাজু।

কেন করব? আয়নাকে কেউ উপেক্ষা করে না।

সরসী নতমুখে নিজের আঙুলের খেলা দেখিতে থাকে। আঁচলের প্রান্ত নয়, কোলের কাছে জড়ো করা কাপড়ের খানিকটা পাকাইয়া কখন সে যেন আঙুলে জড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে।

রাগ করলে সরসী? স্পষ্ট করে বললাম বলে?

সরসী মুখ তুলিয়া একটু হাসিল রাগ করেছিলাম। তুমি জিজ্ঞেস করলে বলে আর রাগ নেই। রাগ করি আর নাই করি তুমি স্পষ্ট করেই বলযত স্পষ্ট করে পার। রাজকুমার বলে, তোমার কথা আর বলব না। এবার মালতীর কথা বলি। মালতীর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে জান? শ্ৰদ্ধাকে ভালবাসা মনে করার সম্পর্ক। সোজাসুজি ভালবাসলে হয়তো ওকে কাছে আসতে দিতাম না, ভুলেই থাকতাম মালতী বলে একটা মেয়ে এ জগতে আছে। কিন্তু ভিত্তিটা যখন ভুলের, দুদিন পরে ভুল ভেঙে যাবে যখন জানি, জটিল একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হতে দিতে আমার বাকা মনের আপত্তি হবে কেন? তারপর ধর রিণি–

সরসী চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়াছিল, সোজা হইয়া বসে। বোঝা যায় মালতীর চেয়ে রিণির কথা শুনতেই তার আগ্রহ বেশি।

রিণি যতদিন সুস্থ ছিল, আমার সঙ্গে বনত না। আমি কাছে গেলেই যেন কঠিন হয়ে যেত। পাগল হয়ে এখন রিণি সকলকে ত্যাগ করে আমায় আশ্রয় করেছে, আমি ছাড়া ওর যেন কেউ নেই। আগে ওকে আমার পছন্দ হত না, এখন ওর জন্য আমার মন কাঁদে। বিশ্বাস করতে পার সরসী? এমন সৃষ্টিছাড়া কথা শুনেছ কোনোদিন? সাধারণ রিণির সঙ্গে নয়, পাগল রিণির সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠল।

সরসী বলে, সৃষ্টিছাড়া কথা বলছ কেন? পাগল হয়েছে বলেই তো রিণির জন্য তোমার মমতা জাগা স্বাভাবিক।

রাজকুমার বলে, আমার নয় মমতা জাগল। কিন্তু রিণি? আমি এমন খাপছাড়া মানুষ যে পাগল হয়ে তবে রিণি আমায় সইতে পারল! চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কথা বলে না? রিণি আমায় তাই দেখিয়েছে সরসী। সুস্থ মনে আমায় বন্ধু বলে গ্রহণ করতে পারে নি, বিকারে শুধু আমায় চিনেছে।

সরসী কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলে, তাও যদি হয়, কথাটা তুমি ওভাবে নিচ্ছ কেন? খাপছাড়া হওয়াটা সব সময় নিন্দনীয় হয় না রাজু। সাধারণ মানুষের সঙ্গে চিন্তাশীল প্রতিভাবান মানুষের খাপ না খাওয়াটাই বেশি স্বাভাবিক। সুস্থ অবস্থায় রিণি হয়তো তোমার নাগাল পেত না, তোমার ব্যক্তিত্ব ওকে পীড়ন করত, তাই ও তোমায় সহ্য করতে পারত না। পাগল হয়ে এখন আর ওসব অনুভূতি নেই, তোমায় তাই ওর ভালো লাগে, বিনা বাধায় তোমায় শ্রদ্ধা করতে পারে।

রাজকুমার ম্লানভাবে একটু হাসে। বলে, চিন্তাহীন প্রতিভাবান মানুষ। চিন্তাগ্ৰস্ত নিউরোটিক মানুষ বললে লাগসই হত সরসী! যত চেষ্টাই কর, আমার ট্র্যাজেডিকে আমার মহাপুরুষত্বের প্রমাণ বলে দাড় করাতে পারবে না, সরসী। নিজেকে আমি কিছু কিছু চিনতে পারছি।

সরসীর মধ্যে হঠাৎ উত্তেজনা দেখা দেয়, রাজকুমারের বাহুমূল চাপিয়া ধরিয়া সে বলে, পারছ? তাই হবে রাজু। তাই হওয়া সম্ভব। নিজেকে জানবার বুঝবার চেষ্টা আরম্ভ করে তুমি দিশেহারা হয়ে গেছ। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম তোমার কি হয়েছে।

সমুদ্রের সঙ্কেতে প্রতিবছর রাজকুমারের সালতামামি হয়! দূরের সমুদ্র শহরে তার কাছে। আসে। জীবনের কয়েকটা দিন ভরিয়া থাকে ভিজা স্পৰ্শ, আঁশটে গন্ধ আর বালিয়াড়ির স্বপ্ন। প্রতিমুহূর্তে তার মনে হয়, দীর্ঘকায়া চম্পকবর্ণা এক নারী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে মাঠ বন নদী গ্রাম নগর পার হইয়া আগাইয়া আসিতেছে, শ্ৰোণীভারে থমথম করিতেছে তার গগনচুম্বী রসটমুর দেহে স্তম্ভিত ছন্দের ঢেউ, কটিতটে সৃষ্টি হইয়াছে নূতন দিগন্তের বঙ্কিম রেখা, মুখ ফিরিয়া খেলা করিতেছে নিশ্বাসে আলোড়িত মেঘ। মনে হয়, আসিতেছে।

পাড়ার একটি ছেলে প্রায় প্রতি রাত্রে বাঁশি বাজায়, রাজকুমার শুধু শুনিতে পায় এই কয়েকটা দিন। একতলার রোয়াকে আর দোতলার বারান্দায় আস্ত ভাঙা কয়েকটি টবের ফুলগুলি চোখে পড়ে, খেয়াল হয় যে পাতার রং সত্যই সবুজ। তবু সে বিশ্বাস করে না, মানিতে চায় না যে প্রত্যেক জীবনে আশীর্বাদ থাকিবেই, আশীৰ্বাদ কখনো ধ্বংস হয় না। নিজেকে সে ধমক দিয়া বলে, আমি অভিশপ্ত। বলে আর তুড়ি উড়াইয়া দেয় সালতামামির সঙ্কেত ও নববর্ষের প্রেরণা।

ভাবিয়া রাখে, ঘনিষ্ঠভাবে কারো সংস্পর্শে সে আর আসিবে না, কারো জীবনে তার অভিশাপের ছায়া পড়িতে দিবে না। ভগবান জানেন তাকে কেন ওরা শ্ৰদ্ধা করে, তার প্রভাব ওদের জীবনে কাজ করে কেন। কিন্তু আর নয়। তার সঙ্গে মেলামেশা সহজ ও সহনীয় করিতে ওদের যখন বিকার আনিতে হয় নিজেদের মধ্যে, তার কাজ নাই মেলামেশায়। অন্য কারো সঙ্গে নয়, কালী মালতী আর সরসীর সঙ্গেও নয়।

মনোরমাকে সে বলে, কালীকে ওর মার কাছে পাঠিয়ে দাও দিদি।

খোকা পাশে ঘুমাইয়া আছে, মনোরমার কোনো অবলম্বন নাই। মাথা নিচু করিয়া পায়ের নখ খুঁটিতে খুঁটিতে মৃদুকণ্ঠে সে বলে, গোড়াতেই কেন বললে না রাজুভাই? একটা কচি মেয়ের সঙ্গে খেলা করতে মজা লাগছিল? বিয়ের যুগ্যি কনের জন্য একটা বর গাঁথতে তার মতলববাজ দিদি কেমন করে ফাঁদ পাতে সেই রগড় দেখছিলে?

না, দিদি। গোড়া থেকেই কালীকে আমার ভালো লেগেছিল।

মুখ তুলিয়া সাগ্রহে মনোরমা বলে, তবে?

রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে আগ্রহ তার আপনা হইতে ঝিমাইয়া যায়। আবার মুখ নিচু করিয়া খোকার বালিশ হইতে একটি পিঁপড়ে ঝাড়িয়া ফেলে, ধীরে ধীরে মেঝেতে আঁচড় কাটিতে কাটিতে বলে, তোমার দোষ নেই রাজুভাই, আমার বোকামি হয়েছে। নিজের ইচ্ছেটাই আমি বড় করে দেখছিলাম। যদি বলি কালীর বিয়ের ভাবনা আমাদের ছিল না, বিশ্বাস করবে রাজুভাই? তুমি তো দেখে এসেছ, ওর বাবার অবস্থা খারাপ নয়। মেয়েটাকে সস্তায় তোমার ঘাড়ে চাপানো যাবে বলে চেষ্টা করি নি ভাই।

তা জানি দিদি ও কথা আমার মনেও আসে নি।

ওর বয়সে আমিও ওর মতো হাবাগোবা মেয়ে ছিলাম রাজুভাই।

কালী হাবাগোবা মেয়ে নয় দিদি। বুদ্ধি যথেষ্ট আছে, পাকামি নেই বলে হাবাগোবা মনে হয়।

মনোরমা যেন শুনিয়াও শোনে না আপন মনে বলিতে থাকে, এমন ঝোঁক আমার কেন চাপল কে জানে! দিনরাত কেবল মনে হত, তোমার সঙ্গে ভাব হবে, বিয়ে হবে, কালীর জীবন সাৰ্থক হবে, আমারও সুখের সীমা থাকবে না। মস্ত একটা ভার যেন নেমে যাবে মনে হত।

মনোরমাকে দেখিলে চমক লাগিয়া যায়। বিষাদ ও হতাশার যন্ত্রণায় মুখ যেন তার কালো হইয়া বাঁকিয়া গিয়াছে। কালীর বদলে তাকেই যেন প্রত্যাখ্যান করিয়াছে রাজকুমার, বুক তার ভাঙিয়া গিয়াছে, হাড়-পাঁজর সমেত। মমতা বোধ করার বদলে তাকে রাজকুমারের আঘাত করিতে ইচ্ছা হয়। তার সংস্পর্শে আসিয়া তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়িয়া তুলিবার প্রয়োজনে কালীর কিশোর মনে বিকার আসিতেছে ভাবিয়া সে দুঃখ পাইতেছিল, কালীর মধ্যস্থতায় নিজের মনের আবছায়া গোপনতার অন্তরালবর্তিনী মনোরমা তার সঙ্গে কি অদ্ভুত যোগাযোগ সৃষ্টি করিয়াছে দ্যাখ।

কালীর আবির্ভাবের আগের ও পরের মনোরমার অনেক তুচ্ছ কথা, ভঙ্গি, ভাব ও চাহনি, অনেক ছোট বড় পরিবর্তন, রাজকুমারের মনে পড়িতে থাকে। মনে পড়িতে থাকে শেষের দিকে তার সমাদর ও অবহেলায় কালীর মুখে যে আনন্দ ও বিষাদের আবির্ভাব ঘটিত, কতবার মনোরমার মুখে তার প্রতিচ্ছায়া দেখিয়াছে। কালীর চেয়েও মনোরমার প্রত্যাশা ও উৎকণ্ঠা মনে হইয়াছে গভীর।

মনোরমা মরার মতো বলে, আমি ভাবছি ও ষ্টুড়ি না সারাটা জীবন জ্বলেপুড়ে মরে। আমি কি করলাম রাজুভাই?

মনোরমা পর্যন্ত বিকারের অৰ্ঘ্য দিয়া নিজের জীবনে তাকে অভ্যর্থনা করিয়াছে, এ জ্বালা রাজকুমার ভুলিতে পারিতেছিল না। অজলের ইতিহাস হয়তো আছে, নিপীড়িত বন্দি-মনের স্বপ্ন-পিপাসা হয়তো প্রেরণা দিয়াছে, তবু রাজকুমার মনোরমাকে ক্ষমা করতে পারে না, নিষ্ঠুরভাবে ধমক দিয়া বলে, কি বকছ পাগলের মতো? কালী তোমার মতো কাব্য জানে না দিদি। দিব্যি হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে দেবে, তোমার ভয় নেই।

মনোরমা বিস্ফারিত চোখে চাহিয়া থাকে। রাজকুমার আঘাত করিলেও সে বুঝি এতখানি আহত হইত না। দুদিন পরে নিজেই সে কালীকে তার মার কাছে রাখিয়া আসিতে যায়। আর ফিরিয়া আসে না। মাসকাবারে তার স্বামী বাসা তুলিয়া দিয়া সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয় বোর্ডিঙে।

রাজকুমার বুঝিতে পারে যে সোজাসুজি বাড়ি ছাড়িয়া অন্য বাড়িতে উঠিয়া যাইতে মনোরমা সঙ্কোচ বোধ করিয়াছে। বোর্ডিঙের ভাত খাইয়া স্বামী তার রোগা হইয়া যাইতেছে দেখিয়া দু-এক মাস পরেই মনোরমা শহরে অন্য বাড়িতে নীড় বাধিবে। হয়তো কালীর শুভবিবাহের পর। ইতিমধ্যে যদি কালীর বিবাহ না-ও হয়, কয়েক মাসের মধ্যে হইবে সন্দেহ নাই। মনোরমা তখন একদিন এ বাড়িতে আসিবে, কালীর বিবাহে তাকে নিমন্ত্ৰণ করিতে।

আঘাত করিতে আসিয়া মনোরমার চোখ যদি সেদিন ছলছল করিয়া ওঠে? বিষাদ ও হতাশায় আবার যদি মুখখানা তার কালো আর বাঁকা হইয়া যায়? রোমাঞ্চকর বিষাদের অনুভূতিতে রাজকুমারের সর্বাঙ্গে শিহরণ বহিয়া যায়।

মালতীর সঙ্গে তার প্রায় দেখাই হয় না। মালতীও সাড়াশব্দ দেয় না। সরসীর কাছে রাজকুমার তার খবর পায়। আপনা হইতে সব ঠিক হইয়া যাইবে জানিলেও মালতীর সম্বন্ধে রাজকুমারের ভাবনা ছিল। আপনা হইতে সব ঠিক হইয়া যাওয়ার প্রক্রিয়াটি তো সহজ বা সংক্ষিপ্ত হইবে না মালতীর পক্ষে, কষ্টকর দীর্ঘ মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে তাকে কতদিন কাটাইতে হইবে কে জানে? তার সাহায্য পাইলে এই দুঃখের দিনগুলি হয়তো মালতীর আরেকটু সহনীয় হইত কিন্তু সে সাহস আর রাজকুমারের নাই। নিজের সম্বন্ধে তার একটা আতঙ্ক জন্মিয়া গিয়াছে। কয়েকটা দিন অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে কাটাইয়া একদিন সে সরসীর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিয়াছিল। অকপটে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিয়া প্রায় করুণ সুরে প্রশ্ন করিয়াছিল, কি করি বল তো সরসী?

সরসী বলিয়াছিল, তোমার কিছু করতে হবে না। আমি সব ঠিক করে নেব।

রাজকুমার চিন্তিতভাবে বলিয়াছিল, সেটা কি ঠিক হবে সরসী? যা বলার আমার বলাই উচিত, আমার হয়ে তুমি কিছু বলতে গেলে হয়তো ক্ষেপে যাবে। এমনিই কি হয়েছে কে জানে, একদিন ফোন পর্যন্ত করল না। যখন তখন ফোনে কথা বলতে পারবে বলে জোর করে আমাকে বাড়িতে ফোন নিয়েছে। কিছু বুঝতে পারছি না, সরসী।

এমন অসহায় নম্ৰতার সঙ্গে রাজকুমারকে সরসী কোনোদিন কথা বলিতে শোনে নাই। ধরা গলার আওয়াজ রাজকুমারকে শোনাইতে না চাওয়ায় কিছুক্ষণ সে কথা বলিতে পারে নাই।

তুমি কিছু ভেব না রাজু। তোমার হয়ে মালতীকে বলতে যাব কেন? যা বলার আমি নিজে বলব, যা করার আমি নিজেই করব। এসব মেয়েদের কাজ মেয়েরাই ভালো পারে। আমায় বিশ্বাস কর, আমি বলছি, মালতীর জন্য তোমায় ভাবতে হবে না। মালতী চুপ করে গেছে কেন বুঝতে পার না? ওর ভয় হয়েছে।

কিসের ভয়?

তুমি যদি সত্যি সত্যি ওকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে চাও–এই ভয়। সেদিন নিজে থেকে তোমায় বলেছিল বটে, এখন কিন্তু ওর ভেতর থেকে উল্টো চাপ আসছে। যেতে বললে যাবে কিন্তু ওর উৎসাহ নিবে গেছে। সেদিন হোটেলের রুমে যেমন বুঝতে পারে নি হঠাৎ কেন অসুস্থ। হয়ে পড়ল, এখনো বেচারি সেইরকম বুঝতে পারছে না কি হয়েছে, অথচ তোমায় একবার ফোন করার সাহসও হচ্ছে না।

সরসী মালতীর ভার নেওয়ায় রাজকুমার নিশ্চিন্ত হইয়াছে। নিজের অজ্ঞাতসারেই সরসীর উপর সে নির্ভর করিতে শিখিতেছিল, সব বিষয়ে সরসীর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা ও পরামর্শ করার প্রেরণাও তার এই মনোভাব হইতে আসিতেছে। তাকে রিণির প্রয়োজন, তাই শুধু উন্মাদিনী। রিণির সাহচর্য স্বীকার করিয়া সকলের জীবন হইতে নিজেকে দূরে সরাইয়া লইয়াছে, বাদ পড়িয়াছে সরসী। সরসীকেও সে মুক্তি দিতে চাহিয়াছিল, মুক্তি পাইতে সরসী অস্বীকার করিয়াছে। রাজকুমার। তাকে ডাকে না, সরসী নিজেই তার কাছে আসে, বাড়িতে না পাইলে স্যার কে. এল-এর বাড়ি গিয়া তার খোঁজ করে। রিণি তাকে সহ্য করিতে পারে না, নিচে বসিয়া রাজকুমারের সঙ্গে সে কথা বলে। বার বার রিণি তাদের আলাপে বাধা দেয়, রাজকুমারকে উপরে ডাকিয়া অনেকক্ষণ আটকাইয়া রাখে, সরসী ধৈর্য হারায় না, বিরক্ত হয় না, অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকে। মাঝে মাঝে রাজকুমারের মনে হয়, সে যেন সকলকে রেহাই দেয় নাই, তাকেই সকলে পরিত্যাগ করিয়াছে, একমাত্র সরসী তাকে ছাটিয়া ফেলে নাই, আরো তার কাছে সরিয়া আসিয়াছে।

স্যার কে. এল-এর বাড়িতেই রাজকুমারের বেশিরভাগ সময় কাটে–রিণির কাছে। রাজকুমার না থাকিলে রিণি অস্থির হইয়া ওঠে, কাঁদিতে কাদিতে নিজের চুল ছেড়ে, রাগ করিয়া। আলমারির কাচ, চীনামাটির বাসন ভাঙে, বইয়ের পাতা ছিড়িয়া ফেলে, ধরিতে গেলে মানুষকে কামড়াইয়া দেয়, জামাকাপড় খুলিয়া ফেলিয়া নগ্ন দেহে রাজকুমারের খোজে বাহির হইয়া যাইতে চায় পথে। রাজকুমারকে দেখিলেই সে শান্ত হইয়া যায়, আশ্চর্যরকম শান্ত হইয়া যায়। প্রায় স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো কথা বলে ও শোনে, চলাফেরা করে, খাবার খায়, ঘুমায়। একটু তফাত। হইতে লক্ষ করিলে অজানা মানুষের তখন বুঝিবার উপায় থাকে না তার কিছু হইয়াছে। কোনো কোনো মুহুর্তে রাজকুমারের পর্যন্ত মনে হয় যে রিণি বুঝি সারিয়া উঠিয়াছে, একটা চমক দেওয়া উল্লাস জাগিতে না জাগিতে লয় পাইয়া যায়। রিণির চোখ রাজকুমার যত কাছেই থাক, যতই সুস্থ ও শান্ত মনে হোক রিণিকে, দুটি চোখের চাহনি রিণির ক্ষণিকের জন্যও স্বাভাবিক হয় না।

প্রথম দিকে রাত্রে রিণিকে ঘুম পাড়াইয়া রাজকুমার নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইত, কিন্তু দেখা গেল এ ব্যবস্থা বজায় রাখা অসম্ভব। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া রিণি হৈচৈ সৃষ্টি করিয়া দেয়, কেউ তাকে সামলাইতে পারে না, শেষ পর্যন্ত রাজকুমারকে ডাকিয়া আনিতে হয়। রাত্রে রাজকুমারকে তাই এ বাড়িতে শোয়ার ব্যবস্থা করিতে হইয়াছে।

স্যার কে. এল কিছু বলেন নাই। রাজকুমার নিজেই তার কাছে প্রস্তাব করিয়াছিল।

আপনার আপত্তি নেই তো?

না।

লোকে নানা কথা বলবে।

বলুক।

রাত্রে মাথার কাছে বিছানায় বসিয়া শিশুর মতো গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া রিণিকে সে ঘুম পাড়াইল, তারপর নিজের ঘরে যাওয়ার আগে কথাটা আরো পরিষ্কার করিয়া নেওয়ার জন্য আরেকবার গেল স্যার কে. এল-এর ঘরে।

আপনি যদি ভালো মনে করেন, রিণিকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।

কেন?

আপনি তো বুঝতে পারছেন, প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতোই আমাদের দিনরাত একত্রে থাকতে হবে–কতকাল ঠিক নেই।

রাজু, স্ত্রী পাগল হলে স্বামী তাকে ত্যাগ করে।

তবু আপনার মনে যদি–

আমার মনে কিছু হবে না রাজু। শুধু মনে হবে তুমি রিণিকে সুস্থ করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছ। সেদিন বলি নি তোমাকে, রিণিকে আমি তোমায় দিয়ে দিয়েছি? তোমাকে ছাড়া ওর এক মুহূর্ত চলবে না, আমার পাগল মেয়ের জন্য তুমি সব ত্যাগ করবে আর আমি নীতির হিসাব করতে বসব? তোমাকে আমি বাঁধতে চাই না রাজু। আমি চাই যখন খুশি তোমার চলে যাবার পথ ভোলা থাকবে। তুমি ভিন্ন ঘরে বিছানা করেছ, দরকার হলে রিণির ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক, আমাকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন নেই। আমার মেয়েকে তুমি ভালো করে দাও, আমি আর কিছু চাই না, রাজু।

সরসীও এই কথাই বলিল রাজকুমারকে। বলিল যে রিণির সঙ্গে রাজকুমারের এই ঘনিষ্ঠতা তার কাছেও যখন এতটুকু দোষের মনে হইতেছে না, রাজকুমারেরও সঙ্কোচ বোধ করার কারণ নাই। জীবন তো খেলার জিনিস নয় মানুষের।

Leave a Reply to Pappusona Gandhi Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *