১. মিলচেস্টারগামী ট্রেনটা

৪-৫০ ফ্রম প্যাডিংটন (১৯৫৭) / আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

ঘটনাটা ছিল এরকম–মিলচেস্টারগামী ট্রেনটা ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের আগে একটা বাঁক অতিক্রম করছে, গতি ধীর মন্থর, সেই মুহূর্তে আর একটা গাড়ি অন্য লাইন থেকে বেঁকে সমান দূরত্বে আগের গাড়ির সমান্তরাল হয়ে চলতে লাগল।

মিসেস এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডি ক্রিসমাসের বাজারে সওদা শেষ করে বন্ধুর বাড়ি রওনা–হয়েছেন। তিনি নিজের কামরায় জানলার ধারে বসে পাশের গাড়ির সমান্তরাল বগিটির জানলা দেখতে লাগলেন।

বেশির ভাগ কামরারই জানলার শার্সি নামানো। কোনো কোনো কামরার যাত্রীদের দেখা যাচ্ছিল।

সমান বেগে চলেছে গাড়ি দুটো। মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি দেখতে পেলেন, হঠাৎ একটা কামরার শার্সি উঠে গেল।

প্রথম শ্রেণীর কামরাটার আলোকিত অভ্যন্তরে যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল, উত্তেজনায় দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল।

.

জানলার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল একজন পুরুষ, তার মুখোমুখি দাঁড়ানো একটি মেয়ের গলা হিংস্রভাবে আঁকড়ে ধরেছে তার দুই হাত। মেয়েটির ঠিকরনো চোখজোড়া ঠেলে বেরিয়ে আসার অবস্থা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মেয়েটির নিপ্রাণ দেহ পুরুষটির দুই হাতের মধ্যে এলিয়ে পড়ল।

এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। যখন হুঁশ ফিরে এল, তিনি বুঝতে পারলেন অপর পাশের গাড়িটির গতিবেগ বেড়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

বিপদ জ্ঞাপক চেন টেনে কোনো লাভ নেই। ঘটনা তো ভিন্ন গাড়িতে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু একটা করতে না পারলে তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।

কি করা যায় ভাবছেন, এমন সময় একজন টিকিট কালেক্টর কামরার দরজায় এসে দাঁড়াল।

মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি অসাধারণ সেই অপরাধমূলক কথা ভদ্রলোককে জানালেন।

টিকিট কালেক্টর জানাল, আর মিনিট সাত পরেই আমরা ব্র্যাকহ্যাম্পটন পৌঁছচ্ছি। আপনি যা বললেন আমি যথাস্থানে রিপোর্ট করব।

লোকটি তার নাম, স্কটল্যান্ডের বাড়ির ঠিকানা টুকে নিল যথারীতি।

এতেও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। তিনি একটা বাতিল বিলের উল্টোপিঠে দ্রুত হাতে একটা চিরকুট লিখে ফেললেন।

গাড়ি ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলে একজন কুলিকে ডেকে তার হাতে চিরকুটের খাম সেই সঙ্গে একটা সিলিং গুঁজে দিয়ে বললেন, খামখানা এখুনি স্টেশন মাস্টারের অফিসে পৌঁছে দেবে।

এর পর পঁয়ষট্টি মিনিটের মাথায় গাড়ি এসে থামল মিলচেস্টার স্টেশনে।

ট্রেন থেকে নেমে সেন্টমেরী মিডে যাবার জন্য একটা ট্যাক্সি ধরলেন। নমাইল পথ যেতে হবে। কিন্তু তাঁর যেন সবুর সইছিল না।

সেই সাংঘাতিক দৃশ্যটা যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলছিল। তখনো তিনি থেকে থেকে শিউরে উঠছিলেন।

.

ট্যাক্সি ড্রাইভার মালপত্রগুলো ঘরের ভেতরে পৌঁছে দিয়ে গেল। মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি হলঘর পার হয়ে সোজা বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। মিস মারপল উষ্ণ চুম্বনে বন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন।

মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি কোনো রকমে আসন নিয়ে বলে উঠলেন, জেন, সাংঘাতিক কাণ্ড। এই মাত্র একটা হত্যাকাণ্ড দেখে এলাম।

সমস্ত ঘটনা শোনার পর বৃদ্ধা মিস মারপল, বললেন, এলসপেথ, যা দেখেছ বলছ, হঠাৎ শুনলে বিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। তবে ঘটনাটা অসাধারণ হলেও অসম্ভব নয়। এটা যে সত্যি আমার তাতে সন্দেহ নেই।

-সেই লোকটার মুখ নিশ্চয়ই তুমি দেখতে পাওনি?

–সম্ভব ছিল না, লোকটার পিঠ ছিল আমার দিকে।

–স্ত্রীলোকটিকে কতটা দেখেছ? যুবতী না বয়স্কা?

–মাত্র কয়েক ফুট দূরত্ব থেকে দেখা, তাতে মনে হল মেয়েটির বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে।

-সুন্দরী?

–বোঝার উপায় ছিল না। সাঁড়াশীর মতো আঙুলের চাপে তার মুখখানা সম্পূর্ণ বিকৃত দেখাচ্ছিল।

-তাই স্বাভাবিক, বললেন মিস মারপল, পোশাক কি ছিল?

ফ্যাকাসে রঙের ফারকোট, মাথায় টুপি ছিল না। একমাথা সোনালী চুল

 –লোকটার চেহারা সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পার–

একমুহূর্ত চিন্তা করলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। পরে বললেন, বেশ লম্বা শরীর লোকটার, কালো। গায়ে ছিল ভারি কোট। এই সামান্য বিবরণ দিয়ে তাকে চেনা যাবে বলে মনে হয় না।

-না-কিছু থেকে এটুকুও ভালো। কাল সকালে এবিষয়ে আরো কিছু জানা যাবে আশা করছি।

–এরকম একটা ঘটনা খবরের কাগজে বেরুবে নিশ্চয়ই। আচ্ছা ভালো কথা, কামরাটা কি করিডরযুক্ত ছিল?

-না।

–তাহলে গাড়িটা দূরগামী নয়। সম্ভবতঃ ব্র্যাকহ্যাম্পটনেই যাত্রা শেষ হয়েছে।

সকালের খবরের কাগজ দেখে দুই বন্ধুই হতাশ হলেন। খবরটা প্রকাশিত হয়নি। চিন্তামগ্ন অবস্থায় দুজনেই প্রাতঃরাশ সারলেন।

কিছুক্ষণ পরে মিস মারপল বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় থানার সার্জেন্ট ফ্রাঙ্ক কার্নিশের সঙ্গে দেখা করলেন।

ঘটনার বিবরণ শুনে সার্জেন্ট কার্নিশ অন্তরঙ্গতা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে জানালেন, আমি সমস্তই নথিবদ্ধ করে নিলাম। আমি যথাযোগ্য তদন্তের ব্যবস্থা করব। রেলওয়ে অফিসারও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবেন বলেই আমি আশা করি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, নতুন কোনো খবর পেলেই আপনাকে জানাব। ঘটনাটা অনাবিষ্কৃত থাকতে পারে না, আগামীকাল খবরের কাগজেই হয়তো খবরটা পাওয়া যাবে।

কিন্তু পরের দিনেও কোনো খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যা নাগাদ মিস মারপল সার্জেন্ট কার্নিশের পাঠানো একটা চিরকূট পেলেন। তিনি জানিয়েছেন, আগের দিনে রিপোর্ট করা ঘটনা সম্পর্কে হাসপাতাল ইত্যাদি সহ সকল সম্ভাব্য স্থানেই তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মহিলার দেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

.

০২.

চিরকুটটা পড়ে চিন্তিত হলেন মিস মারপল। বন্ধুর বিমর্ষ চিন্তাভারাক্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার যা করার ছিল সবই করেছ এলসপেথ। রেল কর্মচারীর কাছে, পুলিসের কাছে রিপোর্ট করেছ। আর কিছু করার নেই।

-যথাযথ তদন্ত হয়েছে, এটুকু আমার সান্ত্বনা। কিন্তু মৃতদেহটা এভাবে সকলের চোখে আড়াল হল কি করে সেটাই বুঝতে পারছি না। ক্রিসমাসের পরেই আমি সিংহলে রোডারিকের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। এদিকের প্রয়োজন বুঝলে ভ্রমণসূচী না হয় পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা যেত। কিন্তু রওনা হয়ে যাবার পর

তুমি আর কি করবে। মৃতদেহটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব পুলিসের। তারা যখন ব্যর্থ হয়েছে; বোঝা যাচ্ছে লোকটা চতুরতার সঙ্গেই কাজটা সামাল দিয়েছে। কাজটার পেছনে পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল।

হঠাৎ করে উত্তেজনার বশে ঘটনাটা ঘটে যায়নি। ট্রেনের সিটে মৃতদেহটা পড়ে থাকলে সকলেরই নজরে পড়ত। একটা গাড়ি যখন স্টেশনে ঢোকার মুখে সেই সময় ঠান্ডা মাথায় স্ত্রীলোকটিকে খুন করা হয়েছিল এবং ট্রেন থেকে এমন কোনো জায়গায় ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল–যেখানে লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া বিকল্প সম্ভাবনাও ছিল।

–জেন, বললেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি, আগামীকাল বিকেলের ট্রেনে আমাকে লন্ডনে ফিরতে হবে।

মিস মারপল বললেন, ঘটনাস্থল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা নিজের চোখে একবার দেখব ভাবছি। আমিও তোমার সঙ্গে রওনা হব তাহলে।

–তুমি কি করতে চাইছ বলতো?

-তোমার সঙ্গে আমিও লন্ডন অবধি যাব। তারপর সেদিন তুমি যেই ট্রেনে ব্র্যাকহ্যাম্পটন এসেছিলে আমরাও সেই ট্রেন ধরে ব্র্যাকহ্যাম্পটন ফিরে আসব। সেখান থেকে তুমি ফের লন্ডন ফিরে যাবে, আর আমি এখানে ফিরে আসব।

মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি বললেন, এতে তুমি কতটা কি আর বুঝতে পারবে। বেশ তাই করা যাবে চল।

.

পরদিন লন্ডন থেকে চারটে পঞ্চাশের ট্রেনের একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় চেপে বসলেন মিস মারপল আর মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।

ক্রিসমাসের আর দুদিন মাত্র বাকি। গাড়িতে ভিড়ের চাপ প্রচণ্ড।

আগের শুক্রবারেই সেই ভয়ঙ্কর অপরাধের দৃশটা দেখেছিলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। আজ কিন্তু ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশন অবধি পৌঁছনো পর্যন্ত কোনো গাড়ি সমদূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি যেতে দেখা গেল না।

-কোনো লাভ হল না জেন। হতাশ ভাবে বললেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।

অন্যমনস্কভাবে মিস মারপল জবাব দিলেন, তাই তো দেখছি।

কিন্তু তিনি তখন ভাবছিলেন, একটা মৃতদেহ কখনো শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে না। কোথাও না কোথাও অবশ্যই থাকবে।

মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। বারো মিনিট পরেই লন্ডনে যাবার ট্রেন তাকে এখান থেকে ধরতে হবে। জানলা দিয়ে দুই বন্ধু শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।

বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। গাড়ির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস মারপল গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

স্বভাবতই অদ্ভুত ঘটনাটা তাকে খুবই আগ্রহান্বিত করে তুলেছিল। তাই অবিলম্বেই তিনি তাঁর সন্ধানকর্ম শুরু করার জন্য মনস্থির করে নিলেন।

প্রস্তুতি হিসেবে আপাততঃ যে কাজগুলো তাকে করতে হবে, তার একটা তালিকাও তিনি মনে মনে ছকে নিলেন।

১. তাঁর বিশেষ বন্ধু স্যার হেনরি ক্লিদারিং ও তার ধর্মপুত্র ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা দুজনেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে রয়েছে।

 ২. মিস মারপলের ভাগ্নের দ্বিতীয় ছেলে ডেভিড ব্রিটিশ রেলওয়েতে কাজ করে। তারও সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

৩. তাঁর বান্ধবী গ্রিসলডার ছেলে লেনার্ড মানচিত্রের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। তার কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।

৪. প্রাক্তন পরিচারিকা ফ্লোরেন্সের সাহায্যও চাওয়া যেতে পার। সে বর্তমানে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের বাড়িতেই আছে।

মিস মারপল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, তার বয়স হয়েছে, ছুটোছুটি করা আগের মতো সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু যোগাযযাগগুলো ঠিক ভাবে কার্যকর করা গেলে প্রয়োজনীয় সূত্র আবিষ্কার অসম্ভব হবে না।

ইতিপূর্বে অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত তিনি করেছেন। সেগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ঘটনাটার অনুসন্ধান কার্য স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি। অনিশ্চিত জেনেও কেন এমন একটা উদ্যোগ তিনি নিতে চলেছেন, নিজেই জানেন না।

.

পরদিন সকাল থেকেই তাঁর পরিকল্পিত কাজে নেমে পড়লেন মিস মারপল।

প্রথমেই ভাগ্নের ছেলে ডেভিডকে চিঠি লিখলেন। ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বিশেষ সংবাদ জানবার অনুরোধ জানিয়েছেন সেই চিঠিতে।

প্রতি বছরের মতো তিনি ভিকারের বাড়িতে ডিনারে অংশগ্রহণ করলেন। সেখানে লেনার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ হল। তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় অঞ্চলের মানচিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন।

লেনার্ড তার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সুন্দরভাবে বলে বুঝিয়ে বেশ আগ্রহ সহকারে লিখেও দিল। পরে তার সংগ্রহ থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটা মানচিত্র মিস মারপলকে ধার দিল।

.

ডেভিডের কাছে লেখা চিঠির জবাবও যথাসময়ে এসে পৌঁছল। অন্যান্য আনুষঙ্গিক কথার পর তার জরুরী বিষয়টা সম্পর্কে সে লিখেছে–দুটি ট্রেন সমদূরত্বে পাশাপাশি একই দিকে চলবে–মাত্র দুটি ট্রেনের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। চারটে তেত্রিশ এবং পাঁচটার গাড়ি। প্রথম ট্রেনটা মার্কেট বেসিং অবধি যাত্রায় হেলিংব্রডওয়ে বারওয়েল, হীথ, ব্র্যাকহ্যাম্পটন প্রভৃতি স্টেশনে থামে।

এই ট্রেনটা ধীরগামী।

পাঁচটার গাড়িটা ওয়েলস এক্সপ্রেস। এই গাড়িতে কারণ্ডিফ নিউপোর্ট এবং সোয়ানসি যাওয়া যায়।

চারটে পঞ্চাশের গাড়িটা প্রথম গাড়িকে ব্র্যাকহ্যাম্পটন পৌঁছবার আগে যে কোনো জায়গায় ধরে ফেলতে পারে। পরের গাড়িটা চারটে পঞ্চাশের গাড়িকে ছাড়িয়ে যায় ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের ঠিক আগে।

ডেভিডের পাঠানো খবরগুলো পর্যালোচনা করে মিস মারপল বুঝতে পারলেন, ম্যাকগিলিকার্ডি যে গাড়ির কথা বলেছে সেটা সোয়ানসি এক্সপ্রেস নয়। কেননা, সে বলেছিল গাড়িতে করিডর ছিল না। চারটে তেত্রিশের গাড়িতেই খুনের ঘটনাটা ঘটে থাকবে।

নির্দিষ্ট অঞ্চলের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হলে আরও দু-একবার যাওয়া-আসা করা দরকার।

এজন্য সময় নষ্ট করলেন না তিনি। বারোটা পনেরোর গাড়িতেই লন্ডন রওয়ানা হয়ে গেলেন।

এবারে ভ্রমণের সময় কিছু খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করতে পারলেন। ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের কাছাকাছি এসে ট্রেনটা একটা দীর্ঘ বাঁক ঘুরল। গতিবেগও কমল। রাতের অন্ধকার থাকায় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারলেন না।

দিনের আলোতে জায়গাটা দেখার উদ্দেশ্যে পরদিন ভোরেই তিনি লন্ডনের ট্রেনে প্রথম শ্রেণীর কামরায় চেপে বসলেন।

লেনার্ডের কাছ থেকে চেয়ে আনা মানচিত্রটা সঙ্গেই এনেছিলেন। ট্রেন ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনে পৌঁছবার পনেরো মিনিট আগে তিনি সেটা খুলে বসলেন।

সেই দীর্ঘ বাঁকটা এল। গাড়ির গতিবেগ কমে এলো। সঙ্গে তিনি গাড়ির সঠিক অবস্থান স্থানটি মানচিত্র চিহ্নিত করলেন।

গাড়িটা বেশ উঁচু একটা বাঁধের ওপর দিয়ে চলেছে তখন। নিচে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দৃশ্যের সঙ্গে মানচিত্র মিলিয়ে তাঁর ধারণা পরিষ্কার করে নিলেন।

পর্যবেক্ষণ শেষ করে বাড়ি ফিরে এলেন মিস মারপল। রাতে ফ্লোরেন্স হিলের কাছে একটা চিঠি লিখলেন। সে থাকে ৪, ম্যাসিডন রোড, ব্র্যাকহ্যাম্পটন।

পরদিন কাউন্টি লাইব্রেরীতে গিয়ে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের আঞ্চলিক গেজেটিয়ার ইত্যাদি ঘেঁটে ইতিহাস জেনে নিলেন।

এভাবে তার অনুসন্ধান কার্যের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন।

ঘটনার বিষয়ে ইতিমধ্যেই একটা থিওরি ছকে নিয়েছিলেন। এবারে তার সত্যতা নিরূপণের ব্যবস্থা করতে হবে। এব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারে এমন একজনের কথা ভাবতে বসলেন তিনি। বুদ্ধি এবং সাহস দুই দরকার কাজটার জন্য। কে হলে ভালো হয়?

লুসি আইলেসব্যারোর কথা মনে পড়ে মিস মারপলের।

.

০৩.

 মহিলা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। বর্তমানে বয়স বত্রিশ। অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী। শিক্ষাজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে স্বেচ্ছায় অদ্ভুত এক পেশা বেছে নিয়েছিল।

লুসি লক্ষ্য করেছিল, গৃহস্থালীর সবরকম কাজে দক্ষ কর্মীর চাহিদা খুবই বেশি। উপযুক্ত কর্মীর খুবই অভাব। সকলকে আশ্চর্য করে এই ক্ষেত্রটাকেই তিনি তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন এবং অদ্ভুত কর্মদক্ষতা গুণে অল্পসময়ের মধ্যেই সাফল্য অর্জন করল। কাজের সুবাদে কোনো কোনো মহলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সে।

সাধারণতঃ ছুটিছাটায় কেউ বাইরে গেলে, বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে কিংবা বাচ্চার দেখাশোনার দরকার হলে লুসির ডাক পড়ে।

যে বাড়ির কাজ সে হাতে নেবে, সেখানে কোথায় কখন কি দরকার সব সে বুঝে নেয় এবং কঠোর পরিশ্রমের তোয়াক্কা না করে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সে সমস্ত সম্পন্ন করে। ঘরের শান্তি স্বস্তি ফিরে আসে।

এই কারণে পারিশ্রমিক তুলনায় বেশ মোটা রকমের গুণতে হলেও নির্দ্বিধায় এবং নির্ভাবনায় লুসির কথাই লোকে ভাবে।

তার কাজের খুব চাহিদা হওয়ার ফলে কাজ গ্রহণের ক্ষেত্রে তার কিছু স্বাধীনতা ছিল। পছন্দ হলে সে কাজ সে নিত না। দীর্ঘমেয়াদী কাজ সে গ্রহণ করত না। তার মেয়াদ ছিল দুই সপ্তাহ। বিশেষ ক্ষেত্রে সময়টা বাড়িয়ে একমাস পর্যন্ত করা চলত।

.

মিস মারপলের চিঠিটা পেয়ে বারকয়েক মনোযোগ দিয়ে পড়ল লুসি। দুবছর আগে উপন্যাস লেখক রেমন্ট ওয়েস্টের কাছে একটা কাজ নিয়েছিল সে। সেই সময় মিস মারপলের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। মহিলাকে তার খুব ভালো লেগেছিল। সেণ্টমেরী মিডে তার বাড়িতেও সে গিয়েছিল।

মিস মারপল লিখেছিলেন বিশেষ ধরনের একটা জরুরী কাজের ব্যাপারে তিনি লন্ডনের কোনো জায়গায় তার সঙ্গে আলোচনা করতে চান।

লুসি তখুনি টেলিফোন তুলে মিস মারপলের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরদিন তার ক্লাবেই সাক্ষাৎকারের সময় জানিয়ে দিল সে।

পরদিন যথাস্থানে একটা নিরিবিলি কক্ষে দুজনে আলোচনায় বসল।

মিস মারপল বললেন, আমি বলেছি কাজটা একটু অন্য ধরনের। আসলে একটা মৃতদেহ খুঁজে বার করার জন্য তোমার সাহায্য আমার দরকার হয়ে পড়েছে।

অন্য সাধারণ বয়স্কা কল্পনাপ্রবণ মহিলাদের মতো মিস মারপলকে মনে করে না লুসি। সে জানে তিনি পরিপূর্ণ সুস্থবুদ্ধির মহিলা। একারণে যথেষ্ট সম্মান শ্রদ্ধার মধ্যে তিনি বাস করেন।

লুসি শান্তভাবেই বলল, কোনো ধরনের মৃতদেহের কথা আপনি বলছেন?

–একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। একটা ট্রেনের কামরায় তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। তারপর মিস মারপল ঘটনাটা খুলে বললেন। লুসি আগ্রহ নিয়ে শুনল।

-কাহিনীটাকে সত্য বলে ভাবতে অসুবিধা হয়, বলল লুসি, খুবই অসাধারণ। তবে অসম্ভব মনে করি না। তা এর মধ্যে আমার ভূমিকাটা কি হবে?

–মৃতদেহটা আমি খুঁজে বার করতে চাই। বুঝতেই পারছ, আমার বয়স হয়েছে, দৌড়ঝাঁপ করব, তেমন সামর্থ্য নেই। তোমাকে কাজের মেয়ে বলে মনে করি।

–অর্থাৎ আপনি চাইছেন আমি অনুসন্ধান করি। কিন্তু একাজটা পুলিস করছে না কেন?

–পুলিস যথাসাধ্য করে ব্যর্থ হয়েছে। বুঝতেই পারছ, আমি নিজের মতো করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছি। মৃতদেহটা ট্রেনের মধ্যে পাওয়া যায়নি। বোঝা যাচ্ছে ওটা ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু রেললাইনের আশপাশে অনুসন্ধান করে কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, লাইনের ধারে মৃতদেহটা ট্রেন থেকে ফেলে দিলে পরে সেটা সরিয়ে ফেলা যায়। ওই পথ ধরে আমি কয়েকবার ট্রেনে যাতায়াত করে এরকম একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি।

ব্র্যাকহ্যাম্পটনে পৌঁছবার আগে একটা বড় বাঁধের কিনার ঘেঁষে ট্রেনটা বাঁক নেয়। সেই সময় একটা জায়গায় ট্রেনটা বেশ ঝাঁকুনি খায়, ঠিক সেই জায়গায় যদি মৃতদেহটা ঠেলে ফলে দেওয়া যায় তাহলে সেটা বাঁধের ঢালে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে।

দেহটা সেখান থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকবে। জায়গাটা বোঝাবার জন্য আমি মানচিত্র নিয়ে এসেছি, তুমি সেটা দেখ।

মানচিত্রের যে জায়গাটা মিস মারপল চিহ্নিত করেছিলেন, লুসি আগ্রহ সহকারে সে জায়গাটা দেখল।

জায়গাটা ব্র্যাকহ্যাম্পটনের শহরতলীর অংশ, বললেন মিস মারপল, এখানে আছে একটা পুরনো বাড়ি, সঙ্গে বিস্তৃত মাঠ ও পার্ক। আশপাশে অবশ্য বর্তমানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাড়ি, বড় বড় হাউসিং এস্টেট।

পুরনো যে গাড়িটা রয়েছে, তার নাম রাদারফোর্ড হল। ক্রাকেনথর্প নামে একজন শিল্পপতি বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সেটা ১৮৮২ সালের কথা।

বর্তমানে সেই ক্রাকেনথর্পের এক ছেলে তার এক মেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতে বাস করে।

–এখানে দেখছি রেললাইন ওই বাড়ির সংলগ্ন জমির একটা অংশ বেস্টন করে চলে গেছে। এখানে তাহলে আমার কাজটা কি?

মিস মারপল বললেন, ওই বাড়িটাই আমার লক্ষ্য। আমি চাইছি তুমি ওখানে একটা চাকরি নাও। গৃহস্থালীর কাজে তোমার খুবই নাম যশ। চাহিদাও খুব। আমার ধারণা, একটা কাজ তুমি ঠিক জোগাড় করে নিতে পারবে।

আমি কিছুটা খোঁজখবর নিয়েছি। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প একটু কৃপণ স্বভাবের লোক। তোমাকে উপযুক্ত মাইনে দিতে না-ও চাইতে পারেন।

তবে আমার কাছ থেকে যে টাকার অঙ্কটা তুমি পাবে সেটা তোমার প্রচলিত মাইনের চেয়ে অনেক বেশিই হবে।

-তাহলে কাজটা কঠিনই বলছেন আপনি।

–কেবল কঠিনই নয়, বিপজ্জনকও। বুঝতেই পারছ, আগে থেকেই ইঙ্গিতটা তোমাকে আমি দিয়ে রাখছি।

–বিপদকে আমি ভয় পাই না–তবে আপনি কি মনে করছেন কাজটায় বিপদের সম্ভাবনা আছে?

–আছে তো বটেই। নিঃশব্দে একটা অপরাধ ঘটে গেছে। কেউ কিছু জানতে পারেনি, কোনো সন্দেহ না। কেবল আমাদের দুই বন্ধুর কাছেই পুলিস অদ্ভুত ঘটনাটার কথা শুনেছে। কর্তব্যের খাতিরে অনুসন্ধান করেছে পুলিস, কিন্তু কোনো সূত্রের হদিশ পায়নি। যে লোকটি অপরাধটি করল, সে যেই হোক, নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে রয়েছে। এই অবস্থায় তোমাকে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করতে দেখলে সে তা করতে দেবে কেন?

-বুঝতে পারছি, বলল লুসি, তাহলে আমি কী অনুসন্ধান করব?

–আপাততঃ খুনের সূত্র। বাঁধের ধারেকাছে ঝোপঝাড়ে ভাঙাচোরা ডালপালা কিংবা কাটায় আটকে থাকা একটুকরো কাপড় এই ধরনের সন্দেহজনক কিছু তোমার নজরে পড়ে যেতে পারে।

–এরকম কিছু যদি সত্যিই পেয়ে যাই তাহলে আমি কি করব?

-আমাকে জানাবে। আমি তোমার নাগালের মধ্যেই থাকব। ব্র্যাকহ্যাম্পটনে আমার এক পুরনো পরিচারিকা থাকে। তার বাড়িতেই আমি থাকার ব্যবস্থা করেছি।

তুমি তোমার মনিবদের বলবে, এই বুড়ী মাসীমা কাছাকাছি থাকেন। তার দেখাশোনা করতে পারবে সেই কারণেই বলবে তুমি এমন জায়গায় কাজ চাইছ। আর আমার সঙ্গে যাতে দেখাসাক্ষাৎ করতে পার সেই মত একটা অবসর সময় রেখে দেবে।

-কিন্তু আমি তো একাজে তিন সপ্তাহের বেশি সময় দিতে পারব না। তারপর চুক্তিবদ্ধ।

-তিন সপ্তাহ যথেষ্ট সময়। এরমধ্যে যদি কিছু পাওয়া যায় ভালো, না পাওয়া গেলে মিছিমিছি ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করব না।

লুসির সঙ্গে কথা পাকা করে মিস মারপল বিদায় নিলেন।

সে কিছুক্ষণ একা বসে সমস্ত ব্যাপারটা ভাবল। তারপর ব্র্যাকহ্যাম্পটনে তার এক পরিচিত রেজেস্ট্রি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে মহিলা ম্যানেজারকে জানাল, কাছাকাছি অঞ্চলে তার একটা কাজের দরকার। তার এক বৃদ্ধা মাসীমাকে তাহলে দেখাশোনা করার সুবিধা হয়।

মহিলাটি উৎসাহিত হয়ে অনেকগুলি পরিবারের নাম করল। তার মধ্যে রাদারফোর্ড হলের ক্রাকেনথর্প পরিবারের নামও ছিল।

মিনিট দশেকের মধ্যেই রাদারফোর্ড হলের মিস ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে লুসির টেলিফোনে যোগাযোগ ঘটে গেল। কাজের কথাবার্তাও পাকা হয়ে গেল।

দুদিন পর লুসি লন্ডন থেকে ব্রাহ্যাম্পটন রওনা হল।

.

০৪.

 বিরাট গেট পার হয়ে আঁকাবাঁকা পথ, দুপাশে রডোডেনড্রন ফুলের ঝাড়। তারপর সেই ছোট্ট বাড়িটি। সময়ের ভারে বিধ্বস্ত। বসবাসের জন্য তৈরি করা বাড়িটি এখন পোড়ো দুর্গের চেহারা নিয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে লুসি বেল বাজাল। একটি স্ত্রীলোক বসার ঘরে নিয়ে বসাল তাকে। চমৎকার সাজানো ঘর। সেলফ ভর্তি বইয়ের সারি।

-তোমারই তো আসার কথা, বস খবর দিচ্ছি।

স্ত্রীলোকটি চলে যাবার কয়েক মিনিট পরে এমা ক্রাকেনথর্প দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

বাড়ির মালিকের কনিষ্ঠা কন্যা সে। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে গেল লুসির। বয়স ত্রিশ ছাড়িয়েছে। সুশ্রী, কালো চুল, কটা চোখ।

পরিচয় পর্ব, করমর্দন শেষ হলে এমা তাদের বাড়ির কাজের একটা সংক্ষিপ্ত আভাস লুসিকে দিল। সে জানাল, বাড়িটা বড় হলেও স্থায়ী বাসিন্দা বলতে সে আর তার বৃদ্ধ অথর্ব বাবা। তার ভাইয়েরা বাইরে থাকে। অবশ্য প্রায়ই এখানে আসে। বাইরে থেকে দুজন মহিলা ঠিকে কাজ করতে আসেন। মিসেস কিডার আসেন সকালবেলা। মিসেস হার্ট সপ্তাহে তিনদিন আসেন, পুরনো জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে।

কাজের ধরনটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল লুসি। সব কাজই তার ধারণার মধ্যে রয়েছে।

লুসি বলল, আমার এক বৃদ্ধা মাসী কাছেই থাকেন। তার যাতে দেখাশোনা করতে পারি সেজন্য ব্র্যাকহ্যাম্পটনেই আমি থাকতে চাই। তাই টাকার অঙ্ক নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি। যাইহোক, মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য আমার ছুটি পেলেই যথেষ্ট।

বিকেলের দিকে ছটা অবধি প্রতিদিনই তোমার ছুটি থাকবে। বলল এমা।

–আমি খুশি। লুসি বলল।

–একটা বিষয় কেবল তোমাকে বিশেষ ভাবে বলার আছে, সেটা হল, আমার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কষ্ট হলেও তোমাকে তার সঙ্গে একটু মানিয়ে চলতে হবে।

-ওটা কোনো ব্যাপার নয়, সব বয়সের মানুষের সঙ্গে মিশতে আমি অভ্যস্ত।

লুসিকে তার থাকার ঘরটা দেখিয়ে দেওয়া হল। নিয়ে আসা হল বৃদ্ধ লুথার ক্রাকেনথর্পের ঘরে। তারপরে রান্নাঘর। বাড়ির লোকের খাওয়াদাওয়ার সময়টা জেনে নিল লুসি।

বলল, মোটামুটি সবকিছুই জেনে নিলাম আমি। এবার থেকে আমিই সবদিক সামাল দেব। ভাববেন না।

.

পরদিন সকাল ছটা থেকেই কাজে হাত লাগাল লুসি। বাড়িঘর পরিষ্কার করা, আনাজ কাটাকুটি, রান্নার আয়োজন সংগ্রহ ইত্যাদি সব সেরে নিয়ে ক্ষিপ্রহাতে প্রাতঃরাশ সরবরাহ করল।

বেলা এগারোটা নাগাদ একটু অবকাশ মিলল। এই সুযোগে মিসেস কিডারের সঙ্গে গল্পচ্ছলে কিছু মূল্যবান তথ্য জেনে নিল সে।

ভালো একজন শ্রোতা পাওয়া গেছে বুঝতে পেরে মিসেস কিন্ডার গড়গড় করে বলে গেলেন, বাড়িটা যেমন মস্ত, পরিবারটিও তেমনি। এনতার লোকজন। বড় ছেলে এডমান্ড লড়াইতে মারা গেছে, তার পরে কেড্রিক, কি সব ছবিটবি আঁকে। এখনো বে-থা করেনি।

তৃতীয় ছেলে হারল্ড, লন্ডনে থাকে। বনেদী ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছে-ব্যবসা করে নামডাক হয়েছে।

ছোট ছেলে আলফ্রেড–বিশেষ সুবিধার নয়। নানান অপকর্ম করে বেড়ায়। পুরুষ মানুষ আর একজন আছে।

কর্তার বড় মেয়ে এডিথের স্বামী ব্রায়ান ইস্টালি। কয়েক বছর আগে এডিথ মারা গেছে। কিন্তু ব্রায়ান এখনো এবাড়ির ছেলের মতোই যাওয়া-আসা করে।

তাদের একটি বাচ্চা ছেলে আলেকজান্ডার-স্কুলে পড়ে। ছুটিছাটায় এবাড়িতে আসে। এমাকে খুব ভালোবাসে।

যথাসময়ে লাঞ্চের খাবার রান্নার কাজও চুকল। ধোয়ামোছা শেষ করে, রান্নাবান্না যথাস্থানে পৌঁছে দিল। দুটো ত্রিশের মধ্যে কাজকর্ম চুকিয়ে লুসি তার আসল কাজ আরম্ভ করতে পারল।

কারোর চোখে অস্বাভাবিক না ঠেকে সেভাবে সে প্রথম বাগানের চারপাশে ঘুরল, শাকসবজি দেখল। পথগুলো আগাছায় ঢেকে ফেলেছে। সর্বত্র অযত্নের ছাপ।

বাড়ির পাশেই আস্তাবল। বৃদ্ধ মালিটি আস্তাবলের উঠোনের পাশে একটা কুঁড়ে ঘরে থাকে। আস্তাবল পাশ কাটিয়ে লুসি ধীরে ধীরে বাড়ি সংলগ্ন পার্কে চলে এল। পার্কের দুদিকেই প্রাচীর ঘেরা। সেখান থেকে রেলপথের খিলানের নিচে দিয়ে গিয়ে একটা সরু গলিতে এসে পড়ল।

মেন লাইনের গাড়ি অনবরত খিলানের ওপর দিয়ে ঝমাঝম শব্দে ছুটে যাচ্ছে। লুসি লক্ষ্য করল, ক্রাকেনথর্পের বাড়ির সীমানা ঘিরে বেঁকে যাওয়া রেলের ওপর দিয়ে চলার সময় গাড়িগুলোর গতি বেশ কমে যায়।

ছোট্ট গলিটার একপাশে রেলের বাঁধ, অন্য পাশে উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের ওপাশে কয়েকটা কারখানা বাড়ি।

গলিপথে এগিয়ে গিয়ে লুসি একটা অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তা পেল। অল্পদূরে ছোট ছোট বাড়িঘর।

একজন মহিলাকে আসতে দেখা গেল। লুসি তার কাছ থেকে পোস্ট অফিসটা কোথায় জেনে নিল। সেখানে গিয়ে মিস মারপলকে টেলিফোন করল। তিনি বিশ্রাম করছিলেন, ফ্লোরেন্স টেলিফোন ধরল।

লুসি তাকে নিজের পরিচয় জানিয়ে বলে দিল, সে নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হয়ে যথানিয়মে কাজ শুরু করেছে, এই খবরটা যেন মিস মারপলকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে লুসি রাদারফোর্ড হলে ফিরে এল।

.

০৫.

 কর্মস্থলে আসার আগেই নিজের ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেছিল লুসি আইলেসব্যারো। দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করে সে একসেট গলফ ক্লাব ছড়ি সঙ্গে এনেছিল। মিস মাথার অনুমতি নিয়ে সে পার্কের মধ্যে পরদিন থেকে গলফ ক্লাব দিয়ে বল মারা অনুশীলন শুরু করল।

পর পর কয়েকটা বল সে হিট করল। একটা বল রেলবাঁধের পাশে গিয়ে পড়ল। কয়েকটা পড়ল এপাশ ওপাশে ঘাসের মধ্যে।

বল খোঁজার অছিলায় বাঁধের অনেকটা অংশ অনুসন্ধান করার সুযোগ পেল লুসি। তবে সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ল না।

পরদিনও একই কৌশলে সে বাঁধের নিচে খোঁজাখুঁজি করল। কাঁটাঝোপের মাথায় ফারের একটা ছেঁড়া টুকরো তার নজরে পড়ল। রঙটা ফ্যাকাসে বাদামী। পকেটে ছোট্ট কাঁচি নিয়ে এসেছিল। ফারের টুকরোটার অর্ধেকটা কাঁচি দিয়ে কেটে পকেটে পুরে নিল।

বাঁধের ঢাল বেয়ে নামার সময় নিচে লম্বা ঘাসের মধ্য দিয়ে একটা অস্পষ্ট পথের রেখা নজরে পড়ল। কিছুদিন আগে কেউ ঘাসের ওপর দিয়ে যাওয়ায় এমনটা হতে পারে, সে ভাবল।

বাঁধের নিচে এসে আর একটা জিনিস আবিষ্কার করল সে। এনামেলে জড়ানো খানিকটা জমানো পাউডার। জিনিসটা রুমালে জড়িয়ে পকেটে ঢোকাল সে।

উৎসাহিত হয়ে আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল লুসি। কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেল না।

পরদিন বিকেলে মাসীমাকে দেখতে যাচ্ছে বলে গাড়ি নিয়ে বেরলো লুসি। মাসিডন রোডের পাশে চার নম্বর বাড়িটার সামনে এসে বেল বাজাল।

দীর্ঘাঙ্গী বিষণ্ণ চেহারা, মাথায় পাকা চুলের স্তূপ এক মহিলা দরজা খুলে তাকে মিস মারপলের ঘরে পৌঁছে দিল।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা চেয়ারে বসল লুসি। কিছু জিনিস পেয়েছি। মনে হচ্ছে আপনার অনুমান ঠিক।

বলতে বলতে লুসি পকেট থেকে আবিষ্কৃত জিনিসগুলো বার করল। কিভাবে এগুলো পাওয়া গেল সেই বিবরণ শোনাল।

ফারের টুকরোটা হাতে নিয়ে মিস মারপল বললেন, মেয়েটির গায়ে হালকা রঙের ফারকোট ছিল, বলেছিল এলসপেথ। সস্তা পাউডারের কৌটোটা সম্ভবত কোটের পকেটে ছিল। বাঁধের ঢালে দেহটা গড়িয়ে পড়ার সময় পকেট থেকে ছিটকে গিয়েছিল। সাধারণ জিনিস, তবে পরে কাজে লাগতে পারে। সবটুকু ফারই কি তুমি তুলে এনেছ?

–না, কাঁচি দিয়ে অর্ধেকটা কেটে এনেছি।

–বুদ্ধিমতী মেয়ে। প্রমাণ চাইলে পুলিসকে দেখানো যাবে।

–এই সূত্রগুলো নিয়ে পুলিসে যাবেন ভাবছেন?

–এখনই নয়। দেহটা খুঁজে বার করা দরকার।

-কিন্তু সেটা পাওয়া কি সম্ভব হবে? বোঝা যাচ্ছে দেহটা ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আর লোকটা ব্র্যাকহ্যাম্পটনে নেমে পড়েছিল। পরে সেই রাত্রেই ঘটনাস্থলে ফিরে এসে মৃতদেহটা সে সরিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সে তো দেহটা যে কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে?

-না, মিস আইলেসব্যারো, অন্য কোথাও নিয়ে যায়নি। সেরকম উদ্দেশ্য থাকলে খুনটা সে যে কোনো নির্জন জায়গায়ই করতে পারত।

-তাহলে বলছেন এটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?

–নিশ্চয়ই। হঠাৎ করে উত্তেজনার বশে খুনের ঘটনাটা ঘটে গিয়ে থাকলে দেহটা এমন কোনো জায়গায় ধাক্কা দিয়ে ফেলা হত না, যেখান থেকে সেটা পরে সরিয়ে ফেল যায়। খুব সুকৌশল পরিকল্পনা বর্তমান অপরাধের পেছনে কাজ করেছে।

রাদারফোর্ড হলের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়, রেলের ধারে তার অবস্থান, সবকিছু লোকটির জানা ছিল। বাড়িটার অবস্থানই এমন যে বাইরের লোকজনের আনাগোনা থেকেও একরকম বিচ্ছিন্ন।

–ঠিকই বলেছেন, বলল লুসি, সকালের দিকে ব্যবসায়ীরা মালপত্র পৌঁছে দিয়ে যায়। ওইটুকুই যা শহরের সঙ্গে এবাড়ির সম্পর্ক। খুনী স্বচ্ছন্দেই রাদারফোর্ড হলে ফিরে এসে থাকতে পারে। মৃতদেহটা পরদিন সকালের আগে কারো নজরে পড়ার সম্ভাবনা ছিল না। সেটা সরিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট সময় পায়।

-হ্যাঁ। কোনো এক পথে খুনী রাদারফোর্ড হলেই ফিরে এসেছিল। তারপর দেহটা উদ্ধার করে একটা পূর্ব নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা রাদারফোর্ড হলের খুব কাছাকাছি কোথাও নিয়ে গিয়ে কবরস্থ করা হয়েছে। মনে রেখো, পার্কের মধ্যে কাজটা করার ঝুঁকি ছিল। সহজেই কারো চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কবরটা সে আগেই খুঁড়ে রেখে থাকবে–আচ্ছা বাড়িতে কি কুকুর আছে?

–না।

-তাহলে তোমার কি মনে হয় কোনো আস্তাবলে কিংবা অব্যবহৃত কোনো ঘরে কবর দিতে পারে? দ্রুত কাজ শেষ করার পক্ষে জায়গাগুলো নিরাপদ। অনেক পুরনো বাড়ি, অব্যবহৃত অনেক ঘর পড়ে আছে, শুয়োরের আস্তানা, কারখানা ঘর–এসব জায়গায় সচরাচর কেউ যায় না। এছাড়া কোনো রডোডেনড্রনের ঝোপ কিংবা অন্য কোনো ঝোপের মধ্যেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে।

.

পরদিন বিকেলে লুসি খুব সতর্কতার সঙ্গে তার অনুসন্ধান কাজ শুরু করল। কিন্তু বিশেষ কিছু সংগ্রহ করতে পারেনি পরিবারের কিছু পুরনো সংবাদ ছাড়া।

বাগানের বৃদ্ধশালী হিলম্যানের সঙ্গে বাগানে দেখা হয়েছিল লুসির। বয়স হয়েছে বলে অনর্গল বকবক করে। কথা বলতে পেলে খুব খুশি হয়। লুসি এটা, ওটা প্রসঙ্গ তুলে তাকে বকবক করার সুযোগ দেয়।

হিলম্যান একসময় অনুযোগের সুরে বলতে থাকে, কর্তা তো টাকার পাহাড়ের ওপরে বসে আছেন। কিন্তু এক কানা কড়িও তার নিজের রোজগার না। সম্পত্তি করেছিলেন মিঃ ক্রাকেনথর্পের বাবা। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়েছিলেন তিনি। এই বাড়িও তিনিই করেন। খরচের হাতও ছিল দরার। দুই ছেলের কোনোটিই তার মত করিৎকর্মা ছিল না। কিন্তু অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের। কিন্তু তারা কেউ বাপের ব্যবসার ধার দিয়েও গেল না। ছোটছেলে এক সুন্দরী অভিনেত্রীকে বিয়ে করেছিল। সারাক্ষণ মদে চুর হয়ে থাকত। পরে একদিন ওই অবস্থাতেই গাড়ির তলায় চাপা পড়ে কেঁসে গেল।

আমাদের কর্তা হলেন বড় ছেলে। বাপ বিশেষ পছন্দ করতেন না। তিনি বিদেশে বিদেশেই ঘুরে কাটাতেন আর নানান মূর্তি কিনে দেশে পাঠাতেন।

যুদ্ধের আগে বুড়ো বাপ মারা গেলে মিঃ ক্রাকেনথর্প এই বাড়িতে সপরিবারে এসে থিতু হলেন। ততদিনে ছেলেরা সবাই বড়সড় হয়ে গেছে।

সংবাদগুলো খুবই মূল্যবান বলে মনে হয়েছিল লুসির। তাই ধৈর্য ধরে সব শুনেছিল।

 বাড়ি ফিরে এসে দেখতে পেয়েছিল বিকেলের ডাকে আসা একটা চিঠি পড়ছে এমা।

–আমার ভাইপো আলেকজান্ডার তার এক সহপাঠী বন্ধুকে নিয়ে কাল আসছে। ছেলেটির নাম জেমস স্টডার্ড। গাড়ি বারান্দার দোতলার পাশাপাশি ঘর দুটোতে ওরা থাকতে পারবে।

.

টগবগে কিশোর দুটি পরদিন সকালেই এলো। সুন্দর দেবদূতের মতো চেহারা তাদের। আলেকজান্ডার ইস্টালির কটা চুল, নীল চোখ। স্টান্ডার্ড ওয়েস্টের রঙ চাপা, চোখে চশমা। ওরা এসে হৈ হট্টগোলে বাড়ি মাতিয়ে তুলল।

লাঞ্চের পরে ধোয়ামোছার কাজ শেষ করে যথানিয়মে লুসি বেরিয়ে পড়ল। ছেলে দুটি তখন দূরের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছিল।

লুসির হাতে গলফ ক্লাবের ছড়ি। আজ বিপরীত দিকের রাস্তায় এগিয়ে গিয়ে সে। একজায়গায় রডোডেনড্রন ঝোপ ফঁক করে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল।

লুসির হাতে গলফ ক্লাব দেখে ছেলেরাও উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। তারাও বাড়ির বাগানে গলফ সেট বসানোর কাজে মেতে উঠল।

ঘোরাঘুরি শেষ করে লুসি যখন বাড়িতে ফিরে আসছে, তখন গর্তের সংখ্যা লেখা ফলকগুলো নিয়ে দুই বন্ধুতে সমস্যায় পড়েছে দেখতে পেল।

মরচে ধরে সংখ্যাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। লুসি সমাধান বাতলে দিল–তুলি দিয়ে সাদা রং বুলিয়ে দিলেই হবে। কাল খানিকটা রং সংগ্রহ করে নিও।

আলেকজান্ডার খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল, বড় গুদামঘরে রঙের পাত্র আছে আমি জানি। আগের ঈস্টারের আগে রঙের মিস্ত্রীরা কাজ করেছিল। ওখানে একবার দেখলে হয়।

বড় গুদোম ঘর কোনটা জানতে চাইলে আলেকজান্ডার তাকে বাড়ির পেছনে দিকের রাস্তার ধারে একটা বড় দালান দেখিয়ে দিল।

–ওই ঘরটায় বৃদ্ধের সংগ্রহ করা অনেক জিনিস ফেলে রাখা আছে। তিনি সব বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। চলো না দেখবে।

কৌতূহলী হয়ে লুসি তার সঙ্গে চলল। বড় গুদোম ঘরে ঢোকার কাঠের দরজায় লোহার কাটা বসানো। দরজার মাথায় আইভি লতার ঝাড়। তার নিচে লোহার সঙ্গে চাবি ঝোলানো ছিল। আলেকজান্ডার চাবি নিয়ে তালা খুলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তার পেছনে অন্য দুজন ঢুকল।

লুসি একনজরে চারপাশটা দেখে নিল। নানান ধরনের পাথরের মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। প্রাচীন শিল্প কর্মের নিদর্শন হলেও অবহেলা অযত্নে নিতান্ত বাজে জিনিসের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।

এসবের সঙ্গে রয়েছে অজস্র ভাঙ্গা টেবিল চেয়ার, ঘাসকাটার যত্ন, মোটর গাড়ির বাতিল আসন, মরচে ধরা বালতি, এমনি নানান টুকিটাকি।

আলেকজান্ডার কোণের দিকে এগিয়ে পর্দার ঢাকা সরিয়ে গুটি কয়েক রঙের টিন আর কয়েকটা ব্রাশ বার করে আনল।

লুসি দেখে বলল, রঙ গুলবার জন্য কিছু তারপিন তেল এবারে দরকার।

গুদোমঘরে তারপিন তেল খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু দুই কিশোর আনন্দের সঙ্গে জানাল এখুনি সাইকেলে গিয়ে তারা তারপিন তেল সংগ্রহ করে আনবে। প্রবল উৎসাহে তারা ব্রাশ আর রঙের কৌটো নিয়ে বেরিয়ে গেল।

লুসি একা গুদোমঘরে, সতর্ক দৃষ্টি ফেলে চারপাশ তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঘরের বাতাস বেশ ভারি। বাইরের হাওয়া চলাচলের অভাবে এমনটা হয়েছে। কেমন একটা পচা গন্ধের আভাস পেল পুসি। নাক টেনে গন্ধটা চিনবার চেষ্টা করতে লাগল।

হঠাৎ বিরাট একটা পাথরের কফিনের ওপরে তার চোখ পড়ল। পায়ে পায়ে সেটার কাছে এগিয়ে গেল। কফিনের ঢাকানাটা ভারি আর আঁট করে লাগানো। লুসির কেমন সন্দেহ হল। চাড় দেওয়ার শক্ত কিছু পাওয়া গেলে ডালাটা খুলে ভেতরটা দেখা যেত।

গুদোমঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে এলো লুসি। একটা ভারি ক্রোবার নিয়ে আবার গুদোমঘরের ফিরে এলো। কিন্তু চেষ্টা করে বুঝতে পারল শক্তি দরকার।

জেদ চেপে গেল তার। ক্রোবার দিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে ডালার ফাঁকে ক্রোবারে চাপ দিতে লাগল।

চেষ্টা ব্যর্থ হল না। ভারি ঢাকনাটা অবশেষে ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। খানিকটা ফাঁক হলেই লুসি উবু হয়ে দেখতে পেল—কফিনের ভেতরে কি আছে।