১.৩ টবি টেম্পলের বিয়ে

১১.

দারুণ জাঁকজমক হল টবি টেম্পলের বিয়েতে। মরক্কো হোটেলের বলরুম। লাস ভেগাসের অর্ধেক লোক হাজির হয়েছে। কমেডিয়ান হোটেল মালিক থেকে শো-গার্ল, আল ক্যারুসো এবং তার নির্বাচিত কয়েকজন মাফিয়া বন্ধু। গ্যাংস্টাররা রক্ষণশীল রুচির পোশাক পরে এসেছে। ওরা মদ ছোঁয় না। চারপাশে ফুল আর ফুলের সীমাহীন বাহার। অর্কেস্ট্রা বাজছে। শ্যাম্পেনের ফোয়ারা। সব ব্যবস্থা ক্যারুসো নিজের হাতে করেছে।

সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বরের হাত ভেঙেছে। সবাই শুনেছে, জিভে চুকচুক শব্দ তুলেছে। বর-বউকে কী সুন্দর মানিয়েছে–সবাই বলাবলি করছে।

ডাক্তার মরফিন ইনজেকশন দিয়েছে। টবি এখনো ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ওষুধের ঘোর কাটলে আবার প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়। যন্ত্রণার সঙ্গে চাপা ক্রোধ আর ঘৃণা। যে ভাবে তাকে অপমান করা হচ্ছে, টবির ইচ্ছা সবাইকে সে খবর শুনিয়ে দেয়।

হবু কনের দিকে তাকায় টবি। এই বুঝি মিলি?

 এত কেলেঙ্কারির পর মিলিকে সে চিনতে পারে। কুড়ি-পঁচিশ বছর বয়সের এক সুন্দরী যুবতী। অন্য মেয়েদের চেয়ে বেশী হেসেছিল মিলি। অন্য মেয়েরা টবির সঙ্গে শেয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করে। কিন্তু মিলির মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিল না। তাতেই উৎসাহ জেগেছিল টবির মনে।

টবি বলেছিল–আমি তোমার জন্য পাগল। তুমি আমাকে পছন্দ করো না?

করি বৈকি টবি। কিন্তু আমার একজন পুরুষ বন্ধু আছে।

 মেয়েটার কথায় টবি কান দেয়নি। জোর করে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিল। মদ খেতে খেতে টবি মজার মজার কথা বলছিল। হাসতে হাসতে মেয়েটার অজ্ঞান হবার জোগাড়। টবি যখন তার পোশাক খুলে তাকে বিছানায় তুলল, মেয়েটা বুঝতেই পারেনি, টবি তার কী করতে চলেছে।

ও বলল প্লিজ টবি, এসব করো না। আমার বয়ফ্রেন্ড চটে যাবে।

–ওর কথা ভুলে যাও। পরে ওর কথা ভাবা যাবে। এখন আমার কথা ভাবো। সমস্ত রাত ধরে বিছানাতে শরীরে শরীর মিশে গিয়েছিল। বন্য উন্মাদনা জেগেছিল দুজনের মনে। তবে মিলিকে দেখে টবির মনে হয়েছিল, মিলির দেহটা এখানে আছে সত্যি, কিন্তু মন অন্য কোথাও পড়ে আছে। সব শেষ হলে ক্লান্তিতে টবি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে সে দেখে মিলি কাঁদছে।

তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য টবি বলে–হাই বেবি, ব্যাপারটা কী? এসব কি তোমার ভালো লাগেনি?

–লেগেছে। তুমি তা জানো। কিন্তু–

ওসব কথা ভুলে যাও। আমি তোমায় ভালোবাসি।

 –সত্যি টবি, তুমি সত্যি বলছো?

হ্যাঁ, সত্যি ।

 মেয়েদের শরীরে শরীর মেশানোর আগে পুরুষ এমন কত কথা বানিয়ে বলে। এসব কথার কোনো মানে নেই।

সাওয়ারে স্নান করে ফিরে তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে গানের সুর ভাবছিল টবি।

মিলি বলল–টবি, তোমাকে দেখার পর থেকেই আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।

ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লাগছে, তাই না মিলি? এসো, ব্রেকফাস্টের অর্ডার দেওয়া যাক।

ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। টবি নিয়ম মতো মিলিকে ভুলে যায়। কিন্তু আজ?

একটা রাত সে ওই মেয়েটার সঙ্গে শুয়েছিল, এই অপরাধে তার বাকি জীবনটা লন্ড ভন্ড হয়ে গেল।

এখন টবি দেখল…দীঘল সাদা ওয়েডিং গাউন পরা মিলি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

 মিলিকে সে অভিশাপ দিল। অভিশাপ দিল তার দীর্ঘ পুরুষাঙ্গটাকে। এমন কী যেদিন সে পৃথিবীর আলো দেখেছিল, সেই দিনটাকেও অভিশাপ দিল।

.

লিমুজিনের সামনের সিটে বসেছিল মাফিয়া সঙ্গীটি, সে বলল–তোমার জবাব নেই। ব, বেজন্মাটা জানল না, কী ভাবে ও ফাঁদে পড়েছে।

 ক্যারুসো হাসল। প্ল্যানটা দারুণ কাজে লেগেছে।

ক্যারুসোর বউ দারুণ দজ্জাল। সে জেনে গেছে রূপসী যুবতীর সঙ্গে ক্যারুসো ফস্টি নস্টি করে। তাই বউ চটে গেছে। বাঁচতে হলে…মাফিয়া সর্দার ক্যারুসোর রক্ষিতা এবং শয্যাসঙ্গিনী সোনালী চুল এই শো-গালের কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার ছিল।

টবি মিলিকে বিয়ে করল। সব ঝামেলা শেষ হয়ে গেল। এখন আর কেউ মিলি আর ক্যারুসোকে নিয়ে সন্দেহ করতে পারবে না।

নরম গলায় ক্যারুসো বলল–ও যেন মিলির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে, সেটা দেখতে হবে।

.

বেনেডিক্ট ক্যানিয়নের একটা ছোট্ট বাড়িতে টবি আর মিলি উঠল। প্রথম প্রথম টবি প্ল্যান করত, কীভাবে এই বিয়েটা শেষ করা যায়। মিলির সঙ্গে সে খুব খারাপ ব্যবহার করবে। তখন মিলি রেগে গিয়ে ডির্ভোস করবে। অথবা মিলির সঙ্গে অন্য কোনো পুরুষের নাম জুড়ে দিয়ে সে ডিভোর্স সুট ফাইল করবে অথবা মিলি ও ক্যারুসোকে ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়বে।

 কিন্তু পরিচালক ডিক ল্যানড্রির সঙ্গে আলোচনার পর মত বদলাতে বাধ্য হল টবি টেম্পল।

বিয়ের কয়েক হপ্তা কেটে গেছে। বেল এয়ার হোটেলে সে ডিক ল্যানড্রির সঙ্গে লাঞ্চ খাচ্ছিল।

ডিক বলল–আল ক্যারুসোকে তুমি কতটা চেনো?

-কেন?

-ওর সঙ্গে জড়িও না, লোকটা খুনী, একটা ঘটনার কথা জানি। ক্যারুসোর ছোটো। ভাই উনিশ বছরের একটা কচি মেয়েকে বিয়ে করে। পরে সে একদিন নিজের চোখে দেখে, তার বউ প্রেমিকের সঙ্গে বিছানাতে শুয়ে আছে। খবরটা সে দাদাকে জানায়।

তারপর কী হল?

ক্যারুসোর মাফিয়া গুন্ডারা সেই প্রেমিককে হাতেনাতে ধরল। মাংস কাটার ছুরি দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া হল। লোকটার চোখের সামনের সেটা পেট্রলে পোড়ানো হল। গুন্ডারা চলে গেল। রক্তপাতের দরুণ বেচারী মারা গেল।

টবির মনে পড়ল, ক্যারুসো বলেছিল, ওর প্যান্টের বোতামটা খোলো।

টবি ঘেমে ওঠে। ঠান্ডা ঘাম। ওর ভয় লাগে।

ও বুঝতে পারে, নিশ্চিত বুঝতে পারে, এই বিবাহিত জীবন থেকে ওর পরিত্রাণ নেই।

এবং তখনই…

.

১২.

এক-একদিন ফিল্ম প্রযোজক স্যাম উইনটার্সের মনে হয়, হলিউড কোনো ফিল্ম স্টুডিও নয়, এটা নেহাতই একটা পাগলা গারদ। সব কটা উন্মাদ তার পেছনে লেগেছে। সমস্যাগুলো পাহাড় ছুঁয়েছে। আগের রাতে স্টুডিওতে আবার আগুন লেগেছিল। এই নিয়ে মোট চারবার। মাই ম্যান ফ্রাইডে টিভি সিরিজের নায়ক টনি এই টিভি সিরিজের স্পনসরকে মুখ খিস্তি করেছিল। ওরা শো ক্যানসেল করতে চায়। বার্ট ফায়ারস্টোন কিন্তু এক অসাধারণ প্রতিভাবান ফিল্ম ডাইরেক্টর। পঞ্চাশ লাখ ডলার বাজেটের ফিল্মের শুটিং মাঝপথে বন্ধ করে দিয়েছে। কদিন বাদে আর একটা ফিল্মের শুটিং-ও বন্ধ করে দেওয়ার কথা। নায়িকা টেসি ব্র্যান্ড অভিনয় করতে রাজী হচ্ছে না।

 প্রথমে আগুনের ব্যাপারটা বলা যাক। স্টুডিও কনট্রোলার জানিয়েছিল, পনেরো নম্বর স্টেজটা একেবারে পুড়ে গেছে। স্টেজ ষোলো নম্বরের যা ক্ষতি হয়েছে, সেটা সারাতে তিনমাস সময় লাগবে। স্যাম ওকে গোল্ডউইনের স্টুডিওতে জায়গা ভাড়া নিয়ে নতুন করে স্টেজ তৈরী করতে বলল। ফায়ার মার্শাল রেইলি দেখতে ঠিক ফিল্মস্টার জর্জ ক্যানক্রফটের মতো। সে বলল, কোনো একটা বদমাইস লোক এই স্টুডিওর নানা জায়গাতে আগুন লাগাচ্ছে। টাইমিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। লোকটা নিশ্চয়ই একজন ইলেট্রিসিয়ান অথবা মেকানিক, ইলেকট্রিকের ব্যাপার-স্যাপারগুলো যার ভালোই জানা।

স্যাম বলল–ধন্যবাদ, খবরটা শুনে খুশী হলাম।

-এবার মাই ম্যান ফ্রাইডে।

তাহিতি থেকে টিভি প্রোডিউসার রজার ট্যাপ ফোন করছে–যে কোম্পানি টিভি সিরিজ স্পনসর করছে, তারই বোর্ডের চেয়ারম্যান ফিলিপ হেলার-বউকে নিয়ে সেটে এসেছে। আমাদের নায়ক টনি ফ্লেচার তাকে গালাগাল দিয়েছিল।

–জেসাস, তুমি এখুনি হেলারের কাছে ক্ষমা চাও, ফুল পাঠাও ওর বউকে। ওদের দুজনকে ডিনারে নেমতন্ন করো। টনির মাথায় গোলমাল হয়েছে। আমি নিজেই টনিকে ফোন করছি।

টনিকে গালগাল দিল স্যাম। আধঘন্টা বাদে সে বললটনি, আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। ঈশ্বরের দোহাই, মিসেস হেলারের সঙ্গে শোওয়ার চেষ্টা করো না।

এরপর সমস্যা হল বার্ট ফায়ারস্টোনকে নিয়ে। বার্ট এক প্রতিভাবান ফিল্ম ডাইরেক্টর। স্যাম উইন্টার্সের প্যানপ্যাসিফিক স্টুডিও উঠে যাবার জোগাড় এই বার্টের জ্বালায়। ফায়ার স্টোন দেয়ার ইজ অলওয়েজ টুমরো নামে একটি ফিল্ম শুটিং করছে একশো দশ দিন ধরে। বাজেটের ওপর দশ লক্ষ ডলার খরচ হয়ে গেছে। হঠাৎ শুটিং বন্ধ করে দিয়েছে ফায়ারস্টোন। অভিনেতা-অভিনেত্রী আর দেড়শো জন এক্সট্রা চুপ করে বসে আছে।

বার্ট ফায়ারস্টোনের বয়স বছর তিরিশ। শিকাগোয় একটা টিভি শো পরিচালনা করে পুরস্কার পেয়েছিল। তার নাম চারদিকে ছাড়িয়ে পড়ে। হলিউডে এসে, সে তিনটে ছবি পরিচালনা করে। তিনটেই মোটামুটি ভালো চলে। চার নম্বর ছবিটা হিট হয়। সব স্টুডিও এখন ওকে নিতে চাইছে।

 স্যাম দেখেছিল, লোকটা রোগা, লাজুক আর চোখে চশমা। দেয়ার ইজ অলওয়েজ টুমরো ছবিটা নিয়ে স্যামের সঙ্গে তার অনেক আলোচনা হয়। সে স্যামকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছিল। বলেছিল, স্যামের অজ্ঞিতার ওপর সে নির্ভর করবে।

কনট্রাক্ট সই হবার পর দেখা গেল, ফায়ারস্টোন হিটলারের মতো স্বৈরাচারী।

 অভিনয়ের জন্য যাদের নেওয়া হবে সে ব্যাপারে স্যামের বক্তব্য পাত্তাই পেল না। স্যামের তৈরী করা চিত্রনাট্য বাতিল করা হল। ফিল্মের লোকেশনও বদলে গেল।

 তখনই স্যাম উইনটার্স চেয়েছিল, ফায়ারস্টোনকে ছাঁটাই করতে, কিন্তু কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বুডলফ হেরগারশন রাজী হয়নি। সে ফায়ারস্টোনের একটা ফিল্ম দেখে খুবই খুশী হয়েছিল। বলা হল, স্যামকে এখন ধৈর্য ধরতে হবে।

–প্রোডাকসন মিটিং-এ তার বক্তব্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল ফায়ারস্টোন। স্যাম দাঁতে দাঁত চেপে সব কিছু সহ্য করতে বাধ্য হল। এছাড়া সে বেচারী করবে কী?

এখন আবার ফিল্মের শুটিং বন্ধ করে দিচ্ছে পরিচালক ফায়ারস্টোন। আর্ট ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান ডেভলিন শেলিকে ফায়ারস্টোন ফোন করল।

কী হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলো।

 –কিড প্রিক অর্ডার দিন।

 –কাট দ্যাট আউট। উনি মিস্টার ফায়ারস্টোন।

-সরি, মিস্টার ফায়ারস্টোন অর্ডার দিলেন দুর্গের সেট তৈরী করতে হবে। উনি স্কেচ আঁকলেন। ওগুলো পছন্দ হল।

স্কেচগুলো ভালোই ছিল। তারপর কী হল?

–ওনার কথা মতো আমরা দুর্গের সেট তৈরী করলাম। উনি কাল হঠাৎ বললেন, এই সেট চলবে না। ভেবে দেখুন, পাঁচ লাখ ডলারের সেট বাতিল হল।

–আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলছি।

.

ফায়ারস্টোন বাস্কেট বল খেলছিল। স্টেজ টোয়েন্টি থ্রিতে টেকনিক্যাল কর্মীদের সঙ্গে।

স্যাম দেখল। ভাবল, এই খেলার জন্য ঘন্টায় দু-হাজার ডলার জলে যাচ্ছে।

–বার্ট। বার্ট হাসল। হাত নাড়ল। ড্রিবল করল। বল বাস্কেটে ফেলে নিশ্চিন্ত মেজাজে খেলা ছেড়ে এল।

-কেমন চলছে স্যাম?

ছোকরার হাসি খুশী মুখের দিকে তাকিয়ে–স্যামের মনে হল, ছোকরা পাগল, প্রতিভাবান হতে পারে। কিন্তু উন্মাদ। ওকে পাগলা গারদে ভরা উচিত। কোম্পানির পঞ্চাশ লাখ টাকার ছবি ওর হাতে।

–শুনলাম, নতুন সেট নিয়ে নাকি সমস্যা হয়েছে, বার্ট? কী করা যায়?

 –কিছু করা যাবে না। ও সেট চলবে না।

তার মানে, তোমার অর্ডারে তোমারই দেওয়া স্কেচ অনুযায়ী সেট তৈরী হয়েছে। ভুলটা কোথায় হয়েছে?

 চোখ পিট পিট করে বার্ট বলল–কোনো ভুল হয়নি। আমিই মত বদলেছি। দুর্গের সেট লাগবে না। নায়িকা এলেন আর নায়ক মাইকের বিদায় দৃশ্য অভিনীত হবে, জাহাজের পটভূমি দরকার। মাইক এলেনকে বিদায় জানাতে এসেছে। জাহাজ সমুদ্রযাত্রা শুরু করবে।

–আমাদের জাহাজের সেট নেই।

নিরদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে বার্ট বলল–সেট তৈরী করো, স্যাম।

লং ডিসট্যান্স ফোনে প্রেডিডেন্ট বললেন–স্যাম, এই ফিল্মে কোনো বড় স্টার নেই। ফায়ারস্টোন শুধু পরিচালক নয়, সে মুখ্য তারকা। তার নামেই ফিল্ম চলবে।

-বাজেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

-গোল্ডউইন এমনি এক জনের সম্বন্ধে বলেছিল, দরকার না হলে এই কুত্তির বাচ্চাকে আর কখনও নেব না। এই ফিল্ম শেষ করার জন্য ওকে দরকার।

–এটা ভুল হচ্ছে।

 –স্যাম, এ পর্যন্ত ফায়ারস্টোন যতটা ফিল্ম শুটিং করল, দেখেছ? কেমন হয়েছে?

চমৎকার।

 –তাহলে জাহাজের সেট তৈরী করো।

 সে বছর বক্স অফিসে সবথেকে বড়ো হিট হল ফায়ারস্টোনের ফিল্ম।

অভিনেত্রী টেসি ব্র্যান্ডকে নিয়েও একটা শুকনো সমস্যা দেখা দিল।

টেসি ব্র্যান্ড একজন বিখ্যাত গায়িকা। যখন ওর এজেন্টের সঙ্গে কথা বলেছে অন্য স্টুডিওর লোকেরা, তখন নিজে নিউইয়র্কে গিয়ে টেসির শো দেখে। ওকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করে কাজের কাজ করেছিল স্যাম উইন্টার্স। প্যান প্যাসিফিক স্টুডিও তিনটে ফিল্মের কনট্রাক্টে সই করেছে টেসি। 

 টেসিকে দেখতে খুব একটা সুন্দর নয়। এমন কুৎসিত চেহারার মেয়ে স্যাম এর আগে কখনও দেখেনি। তবে টেসির প্রতিভার কোনো তুলনা নেই। ব্রুকলিনের এক সাধারণ দরজির মেয়ে, ছোটো বেলায় ওকে গান শেখানো হয়নি। তবে স্টেজে দাঁড়িয়ে গান গাইলে শ্রোতারা পাগল হয়ে যায়।

একটা ফ্লপ ব্রডওয়ে মিউজিক্যালে বিকল্প গায়িকা হিসেবে টেসিকে রাখা হয়েছিল। এই নাটকটা মাত্র দুসপ্তাহ চলে ছিল। শেষ দিনে গায়িকা-অভিনেত্রী ফোন করে জানাল, হঠাৎ তার জ্বর হয়েছে। তাই টেসিকে স্টেজে নামতে হল। সামান্য কয়েকজন শ্রোতা ছিল। তাদের একজন ব্রডওয়ের নাট্য পরিচালক পল ভারিক। পলের পরবর্তী নাটকে নায়িকা হল টেসি। শো-টা টপ হিট হল। টেসির প্রথম রেকর্ড মাসে বিশ লাখ বিক্রি হল। তারপর থেকে টেসি যা ছুঁয়েছে, তাই সোনা হয়েছে। হলিউডের সকলের নজর গেল তার দিকে। কিন্তু টেসির কুৎসিত মুখ দেখে তারা অবাক হয়ে গেল।

টেসি স্যামকে বলল–ফিল্মে আমাকে কুৎসিত দেখাবে। সব স্টুডিও বলছে, আমাকে ওরা সুন্দরী সাজাবে। তা কি সম্ভব?

–প্লাস্টিক সার্জারি করে তোমার মুখটা পাল্টানো যেতে পারে। কিন্তু সেটা উচিত হবে না।আমি চাই, তুমি যেমন, দর্শকরা সেভাবেই তোমাকে দেখুক।

ইয়া। ।

–মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার্স যখন অভিনেতা ড্যানি টমাসের সঙ্গে কনট্রাক্ট সই করে, ল মেয়ার বলেছিল, ড্যানির নাকটা খুব খারাপ। প্লাস্টিক সার্জারি করে ওটা বদলাতে হবে। ড্যানি ওদের স্টুডিও ছেড়ে চলে গেল। কারণ সে জানে, দর্শক তার আসল মুখটা দেখুক। টেসি, আমিও বলছি, দর্শক তোমাকে চায়, তোমার গান শুনতে চায়। প্লাস্টিক সার্জারি করে কোন অপরিচিতা চোখের সামনে এলে তারা এই পরিবর্তনটা মেনে নেবে না।

–তুমি প্রথম মানুষ যে সত্যি কথাটা আমার মুখের ওপর সাহস করে বলতে পারলে। তোমার কি বিয়ে হয়েছে?

-না।

 –তুমি কি মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াও?

 –গাইয়ে মেয়েদের সঙ্গে নয়। আমি গান বুঝি না।

দরকার নেই। আমি তোমায় পছন্দ করি।

তাহলে আমার স্টুডিওর ফিল্মে তুমি কাজ করবে?

 –হ্যাঁ।

 –তোমার এজেন্টের সঙ্গে কথা বলব?

 –তুমি সত্যিই মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াও না, তাই তো?

.

টেসি ব্র্যান্ডের প্রথম দুটো ফিল্ম বক্স-অফিস হিট। প্রথম বইতে সে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেল। দ্বিতীয় ফিলে পেল অস্কার।

টেসিকে দেখতে লোক পাগলের মতো ভিড় করে। তার গান শুনতে সকলে জমা হয় এক জায়গাতে। টেসি মানুষকে হাসাতে পারে। যে কোনো গান গাইতে পারে। অভিনয় জানে। এই কুৎসিত চেহারাটা তার একটা সম্পদ। কেননা দর্শক নিজেকে তার সঙ্গে একাত্ম করে রাখে। টেসি ব্র্যান্ড একটা প্রতীক। সে প্রতীক হল সেই সব মানুষদের, যাদের জীবনের কোনো আশা নেই। যাদের মুখের ওপর একটা কুৎসিত আবরণ আছে।

টেসি প্রথমে একটা ফিল্মের নায়ককে বিয়ে করেছিল। তারপর ডিভোর্স। দ্বিতীয়বার আবার ফিল্মের নায়কের সঙ্গে বিয়ে। আবার নাকি ডিভোর্স হতে চলেছে। এ ব্যাপারে স্যাম উইন্টার্স মাথা ঘামায় না। কোনো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সে নাক গলাবে কেন।

টেসির এজেন্ট ব্যারি হারম্যান বলছে নতুন ফিল্মটার ব্যাপারে টেসি মোটেই খুশী নয়।

থামো। সে কনট্রাক্টে সই করেছে। তার পছন্দমতো প্রোডিউসার আর ডাইরেক্টার নেওয়া হয়েছে। এমন কী চিত্রনাট্যও সে পছন্দ করেছে। সেট তৈরী হয়ে গেছে। টেসি সেখানে অভিনয় করবে।

–সে ছেড়ে যেতে চাইছে না।

 –তবে সে কী চায়?

–ও চায় ফিল্মের প্রোডিউসারকে বদলানো হোক।

কী বলছো? র‍্যালফ ড্যাসটিন সেরা প্রোডিউসার। টেসির ভাগ্য ভালো যে সে র‍্যালফের ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।

–আমি তোমার সঙ্গে এক মত স্যাম। কিন্তু ড্যাসটিন এই ফন্মে থাকলে টেসি এখানে কাজ করবে না, এ আমি বলে দিচ্ছি।

.

স্যাম র‍্যালফ ড্যাসটিনকে ডেকে পাঠাল। এক সময় সে ছিল বিখ্যাত চিত্রনাট্য লেখক। এখন প্রাযযাজক হিসেবে নাম করেছে। ওর প্রত্যেকটা ফিল্মে রুচিবোধের ছাপ আছে।

র‍্যালফ।

বলতে হবে না স্যাম। আমি নিজেই ছেড়ে দিচ্ছি।

ব্যাপারটা কি?

–জেসাস! তুমি কোথায় থাকো? মঙ্গল গ্রহে? নতুন প্রোডিউসার পছন্দ করে ফেলেছে টেসি।

–লোকটা কে? টেসির নতুন প্রেমিক?

 –না, প্রেমিকা।

কী বললে?

 –তার প্রেমিকার নাম বারবারা কার্টার। টেসির কসটিউম ডিজাইনার।

 –টেসি তো পুরুষদের সঙ্গে শোয় বলে জানতাম।

-স্যাম, জীবনটা কাফে রেস্তোরাঁর মতো। খিদে পেলে মানুষ কত কী খায়। বাছ বিচার করে কী? সেরও খিদে পেয়েছে। শোওয়ার জন্য খিদে–কখনও পুরুষের সঙ্গে শোয় । কখনও মেয়ে-মানুষের সঙ্গে। টেসি বলেছে ফিল্মে মেয়েদের ঠিকমতো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তাই বারবারাকে প্রোডিউসার করতে হবে।

ব্যারি হারম্যানকে স্যাম ফোন করল-টেসিকে বলল, র‍্যালফ ড্যাসটিন ওর ফিল্মের প্রোডিউসারের কাজ ছেড়ে দিয়েছে। আশা করি, এবার টেসির কোনো অসুবিধা হবে না।

টেসি হয়তো এটা শুনে খুশীই হবে। বারবারা কার্টারকে সে নতুন প্রোডিউসার হিসেবে নির্বাচিত করেছে।

 বারবারা বেশ সুন্দরী। অফিসের কৌচে তার সুন্দর পা দুটো দুলছে। হাসতে হাসতে সে বলল কী করব বলুন? আমি পোডিউসার না হলে টেসি কাজ করবে না।

-তোমার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?

 –হ্যাঁ, অনেক ফিল্ম দেখেছি।

 –কিন্তু প্রযোজনা?

 –পুরুষেরা মেয়েদের সমস্যা বোঝে না। মেয়েরা বোঝে। তাই টেসি চাইছে।

 শেষ পর্যন্ত স্যামকে রাজী হতে হল। টেসি ব্র্যান্ডের একটা ফিল্মে তিন কোটি ডলার লাভ হয়।

বারবারা কার্টার এই ফিল্মের প্রযোজক। তাই সে এই ফিল্মের বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না। শুটিং শুরু হতে চলেছে। বড়ো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

স্যাম বলল–তুমি প্রোডিউসারের চাকরীটা পেলে, তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

পরের দিন সকালে হলিউড রিপোর্টার আর ভ্যারটি ম্যাগাজিনের প্রথম পাতায় এই খবরটা প্রকাশিত হল। টেসি ব্র্যান্ডের প্রথম ফিল্মের প্রোডিউসার বারবারা কার্টার। প্রথম পাতার নীচে ছোট্ট একটা খবর–তাহো হোটেলে শো দেখাবে কমেডিয়ান টবি টেম্পল।

টবি টেম্পল। আর্মির ইউনিফর্ম পরা তরুণ কমেডিয়ান টবির মুখটা মনে পড়তেই স্যামের মুখে হাসি ফুটল। ও এ শহরে শো দেখালে তা দেখতে হবে। স্যাম ভাবল, টবি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল না কেন?

.

১৩.

এক হিসেবে টবির সাফল্যের জন্য মিলিই দায়ী। বিয়ের আগে সে ছিল এক উঠতি কমেডিয়ান। এখন সাফল্যের একটা নতুন প্রেরণা দেখা দিয়েছে। সেই প্রেরণাকে আমরা ঘৃণা বলে ডাকতে পারি। যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে তাকে সে ভালোবাসে না। মিলির গলা টিপে মারতে ইচ্ছা করে। ভয়ে সে কিছু করতে পারে না।

ঘরের বউ হিসেবে মিলি কিন্তু চমৎকার। স্বামীকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। টবি তাকে ঘেন্না করে। মুখে কখনও অভদ্র ব্যবহার করে না। খারাপ কিছু বললে মিলি হয়তো আল ক্যারুসোকে জানাবে। তখন কী হবে? লোহার ঘায়ে তার হাত ভেঙে গিয়েছিল, সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল যন্ত্রণা। আল ক্যারুসোর মুখটা দেখতে পায় সে। ক্যারুসো বলেছিল, তুমি যদি কখনও মিলিকে কষ্ট দাও…

কথাটা সে শেষ করেনি তাই এখন কেমন যেন হয়ে গেছে টবি। দর্শক আর শ্রোতার ওপর সমস্ত আক্রোশ মেটাতে চাইছে। তার শোর মাঝখানে কেউ কথা বললে সে তীব্র বিদ্রূপ করে। মুখে একটা নিষ্পাপ সরল ভঙ্গি ফুটিয়ে রাখে। নিষ্পাপ মুখ আর বিদ্রূপাত্মক কথাবার্তা–এই দুয়ের সংমিশ্রণে সে একজন সত্যিকারের স্টার হয়ে ওঠে। তাই এখন । টবিকে সকলে নতুন তারকা নামে ডাকছে।

ইওরোপ থেকে ফিরে ক্লিফটন লরেন্স অবাক হয়ে শুনল তার ক্লায়েন্ট টবি টেম্পল এক শো-গার্লকে বিয়ে করেছে।

 একদিন সে টবির কাছে প্রস্তাব ছুঁড়ে দিল-ব্যাপারটা কী, টবি?

টবি অবাক হবার ভান করে বলল–বলার কিছুই নেই। মিলির সঙ্গে দেখা হল, ওকে ভালোবাসলাম আর বিয়ে করলাম।

–তোমার জনপ্রিয়তা বাড়ছে, সে খবর রাখো? থান্ডার বার্ড হোটেলে চার সপ্তাহ শো, সপ্তাহে দুহাজার ডলার পাবে। 

ট্যুরের কী হল?

 –যেতে হবে না, লাস ভেগাসের হোটেল দশ গুন বেশী টাকা দেয়।

লাস ভেগাসের এনগেজমেন্ট ক্যানসেল করো। আমি ট্যুরে যাব।

বদমেজাজ নয়, টবির আচরণে একটা চাপা রাগের প্রকাশ। ক্লিফটন তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।

ট্যুরের পর ট্যুর। নাইট ক্লাব থেকে থিয়েটার, অডিটোরিয়াম, এমন কী কলেজেও শো দেখাচ্ছে টবি। সে কোনো বাছ-বিচার করছে না। তার জীবনে এক মুহূর্ত অবসর থাকবে না। মিলির কাছ থেকে তাকে অনেক অনেক দূরে সরে যেতে হবে।

 রুপসী যুবতীরা ড্রেসিং রুমে ভিড় করছে। তারা টবির শয্যাসঙ্গিনী হতে চায়। টবি রাজী হয় না।

 ক্যারুসো একজন লোকের পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছিল। পেট্রল জ্বেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ক্যারুসোর কথা সবসময় মনে পড়ে টবির–তোমার এটা সত্যিই বড়ো, যতক্ষণ তুমি এটা দিয়ে মিলিকে খুশী করবে, আমরা কিছু বলব না। কিন্তু যদি…

 তাই রূপসী যুবতীদের ফিরিয়ে দেয় টবি। বলে, আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি। কথাটা চারপাশে ছড়িয়ে যায়। টবি একজন ফ্যামিলি ম্যান, মেয়েদের সাথে অযথা ফস্টিনস্টি করতে ভালোবাসে না।

কিন্তু অতৃপ্ত যৌনবাসনা তাকে অস্থির করে তোলে। কল্পনা করতে করতে ভাবে কত রূপসী যুবতী তার শয্যাসঙ্গিনী হতে চাইত। কিন্তু সে কারো আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারছে না, এমনই দুর্ভাগ্য তার।

ট্যুর শেষ হল। বাড়ি ফিরল। মিলি তার যুবতী শরীর সাগ্রহে মেলে ধরল। টবির মনে যৌন কামনা নেই। জেগেছে ঘৃণা আর রাগ। আল ক্যারুসোকে খুশী করতে হবে বলে সে নিয়ম করে মিলির সাথে মিলিত হচ্ছে। মিলনের শেষে মিলির নগ্ন দেহে কাঁপুনি জাগে। মিলি আর্তনাদ করে ওঠে। টবি জানে, এটা শীৎকার।

কিন্তু সে? সে কি আর কখনও প্রেমের জগতে ফিরতে পারবে?

১৯৫০ সালের জুন মাস, উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢুকতে চাইল। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রম্যান কোরিয়ায় সৈন্য পাঠালেন। টবি ভেবেছিল, এই যুদ্ধে সে কোরিয়াতে যাবে। তাহলে মিলির থেকে অনেক দূরে যাবার সুযোগ পাবে।

 ডিসেম্বরের শুরুতে ডেইলি ভ্যারাইটি পত্রিকাতে সেই খবরটা প্রকাশিত হল। কমেডিয়ান বৰ হোপ এবারে বড়োদিনে কোরিয়ায় মার্কিন সৈন্যদের শো দেখাবে। আধ মিনিট পরে ক্লিফটন লরেন্সকে ফোন করল টবি। সে বলল–ক্লিফ, আমি বব হোপের গ্রুপের সঙ্গে কোরিয়ায় যেতে চাইছি।

কী লাভ? তোমার বয়স মাত্র তিরিশ বছর। এই ট্যুর খুবই কষ্টসাধ্য।

 –তা আমি জানতে চাই না। আমার দেশের সৈনিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওখানে লড়াই করছে। আমি ওদের গোমড়া মুখে হাসি ফোঁটাতে চাইছি।

টবির কথা শুনে খুশী হল ক্লিফটন লরেন্স। সে বলল–ও. কে, দেখছি। কী করা যায়।

ঘন্টা খানেক বাদে ক্লিফ টবিকে ফোন করলবব হোপ তোমাকে সঙ্গে পেলে খুশী হবে। তবে তুমি যদি মত বদলাও।

 প্রত্যয়ের সঙ্গে টবি জবাব দিল–সে রকম কোনো সম্ভবনা নেই।

.

তেগু, পুসান, শোনজু। টবি অনগর্ল কথা বলছে, সৈনিকরা হাসছে। টবির মন থেকে অনেক দূরে চলে গেছে মিলি। পুরোনো অপমান আর তার মনে থাকে না।

এক্সমাসের পর গুয়ামে গেল টবি টেম্পল। হাসপাতালে আহত সৈনিকদের মুখে হাসি ফোঁটাল সে। কিন্তু? ঘরে ফেরার দিন, আবার মিলির সাথে মিলল, আবার আপমান এবং ঘৃণা।

এপ্রিল মাসে দশ সপ্তাহের ট্যুর সেরে প্লেনে বাড়ি ফিরল টবি টেম্পল। এয়ারপোর্টে মিলি তার জন্য অপেক্ষা করছিল।

মিলি বলল–ডার্লিং, এবার আমাদের বাচ্চা হবে।

কথাটা শুনে টবি স্তম্ভিত। তার মনের কোণে একটুখানি আশা জেগেছিল, আজি অথবা আগামীকাল সে মিলির হাত থেকে মুক্তি পাবে।

কিন্তু এখন? সে বুঝতে পারল, মিলি তাকে কোনদিনই মুক্তি দেবে না।

.

এক্সমাসে বাচ্চা হবার কথা। টবি গুয়ামে যাবার ব্যবস্থা করেছিল।

আল ক্যারুসো যদি রাগ করে? মিলি মা হতে চলেছে, আর টবি চলে যাচ্ছে।

আল ক্যারুসোকে ফোন করল সে। ক্যারুসোর পরিচিত স্বর ভেসে এল-হাই কিড, তোমার গলার স্বর আমার ভালো লাগবে। তুমি নাকি শিগগিরই বাবা হচ্ছে। তোমাকে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখছি। এখন কেমন লাগছে?

–সেই জন্যই তোমাকে ফোন করছি। এক্স মাসে মিলির বাচ্চা হবে। কিন্তু আমাকে গুয়াম আর কোরিয়াতে যেতে হবে। কী করব বলো তো?

-সত্যিই এক সমস্যা।

–আমি সৈনিকদের মনে দুঃখ দিতে চাই না। আবার মিলিকেও নয়। এখন উভয় সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়েছি।

–সত্যি আমরা সবাই আমেরিকাকে ভালোবাসি। ওই সৈনিকরাও তো আমাদের জন্য যুদ্ধ করছে, তাই না? তুমি কোরিয়াতে যাও। মিলির কোনো কষ্ট হবে না। বাচ্চা হওয়ার ব্যাপারটা মেয়েদের কাছে কোনো নতুন কিছু নয়।

.

ছ-সপ্তাহ কেটে গেছে। এক্সমাসের ঠিক আগে পুসানের আর্মি পোস্টে অ্যামেরিকান, সৈনিকদের মুখে টবি হাসি ফুটিয়েছে। প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে স্টেজ থেকে নেমে আসছে

 কে যেন তার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে দিল।

সন্তান প্রসবের সময় মা আর ছেলে দুজনেই মারা গেছে। তার মানে? মিলি নেই।

আমি এখন স্বাধীন!

.

১৪.

 দিনটা আজ স্যামের ভালোই যাচ্ছে। টেসি ব্র্যান্ডের নতুন ফিল্মের রাশ দেখেছে সে। দারুণ হয়েছে। টেসি ব্র্যান্ড দারুণ গান গেয়েছে। নতুন অভিনয়ের চেষ্টা করেছে। প্রোডিউসার হিসেবে বারবারা কার্টারের বেশ নাম হবে। শুধু তাই নয়, ফিল্মটা হিট হবে এ বিষয়ে স্যাম নিঃসন্দেহ। এ ব্যাপারে তার অনুমান কখনও ভুল হয় না। কসটিউম ডিজাইনারদের কাছেও এটা একটা দারুণ বছর।

প্যান প্যাসিফিক স্টুডিও টিভি শো ম্যাই ম্যান ফ্রাইডে দর্শকরা নিয়েছে। পাঁচ বছরের জন্য নতুন কনট্রাক্টের কথা হচ্ছে। লাঞ্চ খেতে যাবে সে, লুসিল বাধা দিল।

–যে লোকটা স্টুডিওতে বারবার আগুন লাগাত, তাকে ধরা সম্ভব হয়েছে। ওরা তাকে এখানে নিয়ে আসছে।

 পেছনে দুজন প্রহরী। লোকটা চেয়ারে বসেছিল। কে সে? বিখ্যাত ফিল্ম ডাইরেক্টের ড্যালাস বার্ক!

স্যাম বলল–ঈশ্বরের দোহাই, কেন?

ড্যালাস বার্ক বলল–আমি তোমার করুণা চাইনি। আমি তোমাকে ঘেন্না করি। তোমাকে, এই স্টুডিওকে, এই ব্যবসাকে। আমার প্রতিভায় এই ব্যবসা চলেছে। আমার প্রতিভার দরুণ তোমরা কোটি কোটি ডলার আয় করেছ। অথচ, আমাকে এখন আর ডাকো না। তোমরা আমার কাছে বাজে গল্পের চিত্রসত্ত্ব কেনো। আমি জানি সেই গল্প নিয়ে তোমরা ফিল্ম করবে না। এভাবে তোমরা আমাকে করুণা দেখাতে চাইছ। স্যাম, আমি করুণা চাই না। আমি কাজ চাই। কিন্তু তোমরা আমাকে কাজ দিচ্ছ না কেন?

প্রহরীরা ড্যালাস বার্ককে নিয়ে গেল।

 স্যাম ভাবছিল, সেইসব অসাধারণ ছবির কথা, একসময় ড্যালাস যা তৈরী করেছিল।

 –অন্য কোন ব্যবসা হলে লোকটা সম্মান পেত, চেয়ারম্যান হত। সারা জীবন পেনশন পেত।  

এটা ফিল্মি দুনিয়া। এখানে ওপরে জাঁকজমক আছে। ভেতরটা একেবারে অন্তঃসার শূন্য। এখানে মানুষ গতকালকে মানে রাখে না। সবাই বর্তমানের পূজারী।

.

১৫.

কমেডিয়ান টবি টেম্পল ধীরে ধীরে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে।

১৯৫১ সাল। একটির পর একটি নাইট ক্লাব। শিকাগোর শেজ, প্যারী, ল্যাটিন ক্যাসিনোর ফিলাডেলফিয়া। নিউইয়র্কের কোপাকাবানা, ছোটেদের হাসপাতালের জন্য বেনিফিট শো।

যেখানে মানুষ, সেখানইে টবি ছুটে চলে। টবি কথা বলে, সবাই তন্ময় হয়ে তার কথা শোনে। টবি নাচে, সবাই অবাক হয়ে তার নাচের ভঙ্গিমার দিকে তাকিয়ে থাকে। টবি গান গায়, সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই গান শোনে। মানুষ হাততালি দেয়। এই হাসি টবিকে প্রেরণা দেয়।

পৃথিবীতে ইতিমধ্যে অনেক বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। টবি প্রত্যেকটি ঘটনা থেকে কমেডির প্রেরণা লাভ করেছে।

১৯৫১ সালে জেনারেল ম্যাক আর্থারের চাকরী গেল।

উনি বলেছিলেন, পুরোনো সৈনিকেরা মরে না। শুধু রং ছুট হয়ে যায়।

টবি বলল কমেডিয়ান ও সৈনিকেরা একই লন্ড্রি ব্যবহার করে।

 ১৯৫২ সালে হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণ হল।

টবি বলল–আটলান্টাতে আমার শো শুরু হলে ঠিক এই রকম ঘটনা ঘটেছিল।

আইজেন হাওয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন। জোসেফ স্তালিন মারা গেলেন।

সমসাময়িক সব ঘটনাকে নিয়ে টবি অসাধারণ কমিক করল। শ্রোতারা হাসল। কিন্তু এর অন্তরালে টবি একদম একা আর নিঃসঙ্গ। আরও–আরও বেশী শ্রোতা চাই তার। আরও বেশী সুন্দরী শয্যাসঙ্গিনী। শো বিজনেসের একেবারে চূড়ায় তাকে উঠতে হবে।

 মায়ের ভবিষ্যৎবাণী অনেকটা সত্যি হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মা তা দেখে যেতে পারল না। মা নেই, তবে বাবা তো আছে।

 ডেট্রয়েটের নার্সিংহোমে টবির বাবাকে ভর্তি করা হয়েছে। স্ট্রোকের পর থেকে সেখানেই তাকে থাকতে হয়। নার্স আর অন্য রোগীরা টবিকে দেখে ভিড় জমায়।

টবি, হারল্ড হবসন শো-তে তুমি দারুণ করেছে। এত মজার মজার কথা মনে আসে কী ভাবে?

–লেখকরা আমাকে বলে দেয়।

ওর বিনয়ে মানুষজন হেসে ওঠে। ওর বাবাকে হুইলচেয়ারে আনা হল।

বাবা, তোমারই তো উচিত নার্সকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ঘোরানো।

এমন একটা বিষয় নিয়েও টবি অনায়াসে কমিক শো করতে পারে। এমন কী নার্সদের যৌন-জীবন নিয়ে রসিকতা করে। তারা রাগ করে না। তারা হেসে গড়িয়ে পড়ে।

-তোমাদের মতো ভালো শ্রোতা আমি জীবনে পাব না, আসলে বাবার সঙ্গে একটু সময় কাটাতে চাই। নতুন রসিকতা বাবার কানে শোনাব আমি।

ওরা আরও হেসে ওঠে।

 টবির বাবা বলছে–একটা ভালো খবর আছে। বুড়ো আর্ট রাইলী কাল মরেছে।

–ভালো খবর কেন?

–ওর ঘরটা আমি পাব।

 বুড়ো হওয়া মানে কী? বেঁচে থাকার জন্য আরও প্রচণ্ড ইচ্ছা। এই জীবনের থেকে মৃত্যু ভালো। কিন্তু তবু তো জীবন। টবি নিয়মিত বাবাকে টাকা দেয়। নার্স আর অ্যাটেনডেন্টদের হাতে মোটা টাকা টিপস তুলে দেয়।

কিন্তু ওখান থেকে বের হলে শো ছাড়া আর কিছুই মনে থাকে না তার।

.

১৬.

জোসেফাইন জিনস্কির বয়স এখন সতেরো। সোনালী রঙের তনুবাহার তার। দীঘল কালো চুল। বাদামী চোখের তারায় একটু সোনালী ছোঁয়া। ভারী দুটি স্তন। সরু কোমর। নিটোল নিতম্ব। দীঘল এবং সুঠাম পা।

স্কুলের পর গোল্ডেন ডেরিক নামের রেস্তোরাঁতে ওয়েট্রেসের চাকরী করে। মারী ল আর সিসি টপিং-এর মতো পুরোনো বান্ধবীরা যখন আসে, তখন তাদের সঙ্গে হেসে কথা বলে। কিন্তু তার আচরণের মধ্যে অন্তরঙ্গতা নেই। জোসেফাইনের মনের আড়ালে অদ্ভুত একটা চঞ্চলতা দেখা দিয়েছে। এই নোংরা শহর থেকে আজ অথবা আগামীকাল সে অন্য কোথাও যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে, কিছুই সে জানে না। মাথার যন্ত্রণা আজও সারেনি। একডজন পুরুষের সঙ্গে তার ভাব ভালোবাসা। তার মধ্যে ওয়ারেন হফম্যানকে খুব পছন্দ করেছে জোসেফাইনের মা।

–ওয়ারেন নিয়মিত গির্জায় যায়। প্লাম্বিং-এর ব্যবসাতে ভালো টাকা আয় করে। ও তোকে ভালোবাসে।

–লোকটার বয়স পঁচিশ, লোকটা মোটা বিশ্রী।

 –টেকসাসে গরীব মেয়ের জন্য রাজপুত্র জোটে না।

সিনেমা হলে বসে ওয়ারেন হফম্যান জোসেফাইনের হাত ধরে থাকে। জোসেফাইন ওকে পাত্তা দেয় না। মোটেই ভালো লাগে না। সিনেমার পর্দায় সৌন্দর্য, হাসি আর সুখের এক অপরূপ জগত। জোসেফাইন স্বপ্ন দেখে। কোনো একদিন সে হলিউডে যাবে। এক ধনী পুরুষকে বিয়ে করবে। জীবনটাকে একেবারে পাল্টে ফেলবে সে।

 এখানকার ধনী যুবকদের মধ্যে ডেভিড কেনিয়নের বিয়ে হয়নি। ওর একটা ফটো বান্ধবীর কাছ থেকে জোগাড় করেছে জোসেফাইন, নিজের খাতায় সেটা লুকিয়ে রাখে। যখন তার মনে খুব দুঃখ হয় আনমনে ওই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।

 ডেভিড কেনিয়ন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করছে। চার-চারটি বছর কেটে গেছে। এইটুকুই একমাত্র জানে জোসেফাইন। জুলাই মাসের এক শনিবার, স্পোর্টস কারের আরোহীদের রিপোর্ট নিতে গিয়ে সে শুনল–হ্যালো, স্ট্রেনজার।

ডেভিড কেনিয়ন কথা বলছে। ওর পাশে বসে আছে সিসি টপিং। পরের দিন সকালে ডেভিডের ফোন–তুমি আরও সুন্দরী হয়েছ জোসেফাইন।

সেদিন ওরা ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁতে বসেছিল। ওদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। জোসেফাইনের শরীরে কামনার দংশন ভাঙতে চাইছে না ডেভিড। জোসেফাইনের হাত ছুঁলেই তার শরীরে চাঞ্চল্য জেগে ওঠে। অথচ, অন্য পুরুষ যখন কঠিন হাতে তার স্তন নিষ্পেষন করে, তখন সে বিরক্ত হয়। কেউ স্কার্ট তুলে তার উরুতে হাত দিলে সে চটে যায়।

তার মানে? আমি কি সত্যি সত্যি ডেভিডকে ভালোবেসে ফেলেছি? ডেভিড বড়োলোকর ছেলে, কিন্তু তার বড়োলোকি চাল মেই।

রেস্তোরাঁয় মেক্সিকান পাঁচক প্যাকো খুব ভালো লোক। একদিন রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। ডেভিড বাইরে গাড়িতে জোসেফাইনের জন্য অপেক্ষা করছে।

রান্না ঘরে প্যাকো বলল–প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপার?

-কী করে বুঝলে?

–তোমার সুন্দর মুখ ওকে দেখে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। ওকে বলল, ও একজন সৌভাগ্যবান পুরুষ।

নিশ্চয়ই বলব।

প্যাকোর গালে চুমু খেল জোসেফাইন।

সেই মুহূর্তে জানলার বাইরে গাড়িতে কে যেন বসে আছে।

এই হল টবির নতুন চিত্রনাট্য। অথচ চোখ বন্ধ করলে সে বাবাকে দেখতে পায়। হাসপাতালের পরিবেশ। অসহায় বৃদ্ধরোগী আর রোগিনীরা। নার্স ও অ্যাটেনড্যান্টদের দল।