১. প্রতিদিনকার রুটিন

থ্রি টোয়েন্টিওয়ান এএম
জনপ্রিয় ‘হেনরি বিনস সিরিজ’-এর তৃতীয় বই
মূল : নিক পিরোগ / অনুবাদ : সালমান হক

অধ্যায় ১

১৮ই জুন। আলেক্সান্দ্রিয়া, ভার্জিনিয়া

ব্যাপারটা আমার প্রতিদিনকার রুটিনের অংশেই পরিণত হয়ে গেছে বলতে গেলে। মাঝে মাঝে শুধু নজর বুলাই, কিন্তু প্রায়ই খোলর উদ্দেশ্যে হাতে নিয়ে বসে থাকি। এভাবেই দুই তিন মিনিট চলে যায় প্রতিদিন। কিন্তু আমার জন্যে ঐ দুই তিন মিনিটই বিশাল ব্যাপার। কারণটা জানেন বোধহয়, প্রতিদিন আমার জন্যে মাত্র ষাট মিনিট বরাদ্দ থাকে। এই সময়টা হয়ত আমি ইনগ্রিডের সাথে কাটাতে পারতাম কিংবা ল্যাসির পেটে একটু হাত বুলিয়ে দিতে পারতাম। বাবার সাথে কার্ড খেলেও পার করা যেত সময়টা। মোটকথা আমার দৈনন্দিন জীবন থেকে মহামূল্যবান দুই-তিন মিনিট নষ্ট করছি প্রতিদিন।

কিন্তু খামটা খোলার সাহস হয় না। তাই এমুহূর্তে ভেতরের লেখা আর ছবিগুলো কল্পনা করা ছাড়া আর উপায় নেই কোন।

“আমাদের বেরুতে হবে এখন। এয়ারপোর্টে যেতে বিশ মিনিট লাগবে,” ইনগ্রিডের গলার আওয়াজ ভেসে এলো লিভিং রুম থেকে।

ফোনের দিকে একবার তাকালাম।

তিনটা বত্রিশ।

পটোম্যাক এয়ারফিল্ড এখান থেকে দশ মাইলের মতন দূরে হবে, নদীর ওপারে। আমরা যদি চারটা বাজার আগেই ওখানে পৌঁছাই, তাহলে সবার জন্যেই সুবিধা। যদিও আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত, ইনগ্রিড আগে থেকেই একটা হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছে।

যদি দরকার পড়ে!

“আসছি আমি,” জবাব দিলাম। আমার দৃষ্টি এখনও লম্বা লাল খামটার ওপর। আলমারির মাঝখানের তাকে রাখা ওটা।

প্রায় আট মাস হয়ে গেছে প্রেসিডেন্ট সুলিভান আমাকে খামটা দিয়েছেন। দেবার সময় আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “খামটা খোলার আগেই আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, ওখানে কিন্তু বেশ স্পর্শকাতর কিছু ব্যাপার বলা আছে। একবার দেখে ফেললে আর মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না ওগুলো।”

তিনি পড়েছেন ভেতরের লেখাগুলো। তিনি জানেন। জানেন, আমার মা আমাকে নিয়ে কি করেছেন।

কিন্তু আমি আসলে মা’কে নিয়ে চিন্তিত নই। আমার সব ভয় বাবাকে নিয়ে।

যদি সিআইএ’র প্রাক্তন পরিচালক লে হাইয়ের কথা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমার মা একজন নামকরা টর্চার স্পেশালিস্ট। জিজ্ঞাসাবাদের ধরণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি অত্যাচারের মাধ্যমে। আর তার কারণেই আমার এই অদ্ভুত অসুখ (আমি হেনরি বিনস, আর আমি হেনরি বিনসে ভুগছি)। মাত্র ষাট মিনিট পাই আমি প্রতিদিন। তিনটা থেকে চারটা। আমার মা যখন আমার এই হাল করছিলেন তখন বাবা কোথায় ছিলেন?

আমি এখন জানি, আমার মা জীবিত। কিন্তু গত ত্রিশ বছর ধরে আমার সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। ভবিষ্যতে যোগাযোগ হবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বাবা হচ্ছেন আমার জীবনের সবকিছু। তার জন্যেই আজকের এই আমি। এমন যদি হয়, বাবাও মা’কে ওকাজে সাহায্য করেছেন? গত ত্রিশ বছর ধরে কি ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাচ্ছেন তিনি আমাকে?

“ওটা সঙ্গে নিও না।”

ঘুরে দাঁড়ালাম আমি।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ইনগ্রিড। ওকে দেখে একটুও ক্লান্ত মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি জানি, গত সাতাশ ঘন্টায় সে একটুও ঘুমায়নি। নীল জিন্স আর ম্যারিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির একটা টিশার্ট পরে আছে ও। পায়ে সাদা নীল নাইকি। আমাকে গত রাতে প্যাকিঙে সাহায্য করার পরপরই ইনগ্রিড অফিসে চলে গেছিল। এর পরবর্তি বিশ ঘন্টায় সে দুটো কেস নিয়ে কাজ করেছে যাতে আগামি এক সপ্তাহের ছুটিটা নির্বিঘ্নে আমার সাথে কাটাতে পারে সে।

“সামনের সপ্তাহটা শুধু তোমার আর আমার, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ও।

মাথা নাড়লাম। ঠিকই বলেছে ইনগ্রিড।

গত সাত মাস ধরে আমরা একসাথে থাকলেও প্রতি সপ্তাহে মাত্র তিন থেকে চারঘন্টা দেখা হয় আমাদের। ডিউটির সময়ের প্রতি ওর নিজের কোন হাত নেই। যেকোন সময়ে ছুটে যেতে হয়ে অফিসে। মাঝে মাঝে একটানা তিনদিন চলে যায়, কিন্তু আমাদের দেখা সাক্ষাত হয় না। শুনতে যতটা কঠিন মনে হয় বাস্তবে আমাদের সম্পর্কটাতে পরস্পরের সাথে মানিয়ে চলা অনেক বেশি কঠিন। আর গত পনের মাসে আমাদের জীবনে যা ঘটেছে, জেসি ক্যালোমেটিক্সের খুনের রহস্য, সিআইএ পরিচালকের ষড়যন্ত্র, এসব কিছুর কারণে আমরা নিজেদের একান্ত সময় বলে কিছু পাইনি বলতে গেলে।

আলমারির পাল্লাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে দিলাম। “ঠিক বলেছ।”

“ভিভা মেক্সিকো,” জবাবে হেসে বলল ও।

“আমরা আলাস্কা যাচ্ছি।”

“ওহ্! ভিভা আলাস্কা।”

ওকে কাছে টেনে নিয়ে লম্বা একটা চুমু খেলাম।

“চল এখন,” আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ও। “তোমাকে ঠেলে ঠেলে প্লেনে ওঠানোর ইচ্ছে নেই আমার।”

হেসে দরজার দিকে রওনা দিলাম আমরা।

“ল্যাসি কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম।

“বেচারাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল তখন। মনে হয় না সে যেতে চায় আমাদের সাথে। বরং তোমার বাবার ওখানে গিয়ে মারডকের সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছে তার।”

ল্যাসির অবস্থা আসলেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। ব্যাটা এখন রান্নাঘরের টেবিলের ওপর ঘাপটি মেরে বসে আছে। চোখ অর্ধেক বন্ধ।

“কীরে, কি সমস্যা তোর?”

মিয়াও।

“তোকে তো আগেই বললাম, মারডক অসুস্থ। ওকে সাথে নিলে কোন মজাই হবে না।” আসলে মারডক অসুস্থ না, কিন্তু আগামিকাল ওর অপারেশন। কিসের অপারেশন? শুনলে মজা পাবেন। গত কয়েকমাস ধরে ওর জ্বালায় বাবার বাসার আশেপাশের কুকুরগুলোর নাজেহাল অবস্থা (বিপরীত লিঙ্গের কুকুরের কথা বলছি)। অনেকেই অভিযোগ করেছে বাবার কাছে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে মারডকের ওপর ছুরি চালানো হবে। সোজা কথা, ওকে খোঁজা করা হবে। এ মুহূর্তে ল্যাসি সেখানে থাকলে তা কোনভাবেই সেটা সম্ভব না।

মিয়াও

“আমি জানি না কি অসুখ। সর্দি হতে পারে। আমরা ফিরে আসার পরে বাবার ওখানে এক মাস থাকিস, যাহ।”

চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকাল ব্যাটা।

“আলাস্কায় গিয়ে আমরা অনেক মজা করব।”

মিয়াও।

“না, কোন ইগলু ঘরে থাকতে যাচ্ছি না আমরা। ওখানেও এখন গ্রীষ্মকাল। খুব সুন্দর আবহাওয়া।”

মিয়াও।

“হরিণের পিঠে? যদি চড়তে পারিস তাহলে চড়বি! আমি বাধা দিব না। কিন্তু ফেয়ারব্যাঙ্কসে হরিণ আছে কিনা সন্দেহ।”

জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলল ও জবাবে।

“কিন্তু ওখানে কি আছে জানিস…” ল্যাপটপ খুলে একটা ফোল্ডার ওপেন করলাম। এর ভেতরেই গত এক মাস ধরে আলাস্কার বিভিন্ন জিনিসের ছবি জামাচ্ছি আমি। যেটা খুঁজছিলাম সেটা পেতে বেশি দেরি হল । ওটায় ক্লিক করে মনিটরটা ওর দিকে ঘুরিয়ে দিলাম। “মেরু শিয়াল।”

আগ্রহে চোখটা বড় বড় হয়ে গেল হারামিটার।

“যাহ্ এখন, গুছিয়ে ফেল সবকিছু।”

দশ সেকেন্ড পর ওর ঝুনঝুনি লাগানো বলটা মুখে নিয়ে দরজার সামনে তৈরি ল্যাসি।

.

“আলাস্কা দেখার আগেই মরার শখ নেই আমার।”

ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেও পর মুহূর্তে হেসে ফেলল ইনগ্রিড। গাড়ির গতি কমিয়ে দিল অনেকটা। এতক্ষন ঝড়ের বেগে চালাচ্ছিল। তারপরও অতিরিক্ত তিন মিনিট হাতে থাকতে থাকতেই পটোম্যাক এয়ারফিন্ডে পৌঁছে গেলাম আমরা।

একটা লোক গলফ কার্ট নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ব্যাগগুলো কার্টে উঠিয়েই টারমাকে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনটার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

এখন তিনটা আটান্ন বাজছে।

এই চার্টার্ড প্লেন আর ফেয়ারব্যাঙ্কসের সবচেয়ে বিলাসবহুল ক্যাবিনটা ভাড়া করতে কম খরচ হয়নি। কিন্তু স্টক মার্কেটে আমার বেশ ভালো সময় গেছে গত কয়েক মাসে। তাই গায়ে লাগেনি অতটা।

প্লেনটার পাশে রাখা হুইলচেয়ারটা এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি।

কিন্তু লাগবে না ওটা।

কাঁটায় কাঁটায় তিনটা উনষাটে প্লেনের দরজার কাছে পৌঁছে গেল গলফ কার্টটা। আমরা তিনজন লাফিয়ে নেমে প্লেনের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। মালপত্রগুলোর ব্যবস্থা লোকটা করবে। পাইলট আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ল্যাসিকে একবার আদর করে দিল।

তাড়াতাড়ি প্লেনের ভেতরের বড় দুটো সিটে বসে পড়লাম আমরা। সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবার আগে ল্যাসি আমার কোলে উঠে পড়ল আর ইনগ্রিড আমার কপালে চুমু খেল একবার।

এরপর চোখ খুলব একদম আলাস্কায় গিয়ে।

সেই সঙ্গে তিনটা বেজে সাত মিনিটে জীবনে প্রথমবারের মত দেখব আমি।

*

অধ্যায় ২

১৯ শে জুন
সূর্যোদয় : সকাল ৩:০৭
ফেয়ারব্যাঙ্কস, আলাস্কা

আর্কটিক সার্কেল থেকে ফেয়ারব্যাঙ্কস ২০০ মাইল দক্ষিণে। আর্কটিক সার্কেল মূলত একটি কাল্পনিক রেখা যার দক্ষিণে সূর্য খুব বেশি সময়ের জন্যে অস্ত যায় না। বাইশ ঘন্টার মত দিনের আলো থাকে এখানে। বাকি দু-ঘন্টা সূর্য দেখা যায় না, কিছুটা অন্ধকার ভাব থাকে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছি। পুরো গা ঘামে ভিজে গেছে।

দুঃস্বপ্নের রেশটা এখনও পুরোপুরি কাটেনি।

একটা সাদা ঘর।

নীল অ্যাপ্রন পরিহিত একজন ডাক্তার।

আমার বাহুতে একটা আইভি লাগানো।

কোথায় ওটা?

আমি জানি না।

কোথায় ওটা?

কি কোথায়?

ফ্ল্যাশড্রাইভভটা।

কিসের ফ্ল্যাশড্রাইভভ?

গোলাপি রঙের তরলে ভরা একটা সিরিঞ্জ।

আমি বাধা দেয়ার চেষ্টা করলাম।

নলের মধ্যে সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে চাপ দিল লোকটা।

আমি চিৎকার করে উঠলাম।

ঠিক এই সময়টাতেই ঘুম ভেঙে গেছে।

প্রায় এক মিনিট সময় নিলাম স্বাভাবিক হতে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলাম না। কারণ এরকম অচেনা এক বিছানায়, অচেনা এক ঘরে স্বাভাবিক হওয়া অতটা সহজ নয়। আমি এর আগে ইন্টারনেটে অবশ্য ঘরের ছবিটা দেখে রেখেছিলাম। কিন্তু তবুও মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে মনে হচ্ছে। এই মাস্টার বেডরুমটাতে আছে বিশাল দামি কাঠের বিছানা। জানালাগুলো ভারি পর্দায় ঢাকা। পর্দাগুলো বাইরের সূর্যের আলো থেকে অতিথিদের রক্ষা করবে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠবে সূর্য। এই ঘরটা ছাড়াও আরো দুটো ঘর আছে এই বিলাসবহুল কেবিনে। এখানে যখন পৌঁছুতে পেরেছি তার মানে সব কিছু নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়েছে। এগার ঘন্টার ফ্লাইট, এরপরে একটা হুইলচেয়ারে করে ভ্যানে ওঠা, সেইনা নদীর পার ধরে বিশ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিয়ে আমাকে এখানে এই বিছানায় শুইয়ে দেয়া-কোন কিছুতে ঝামেলা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

বিছানা থেকে নেমে জিন্স আর টি-শার্ট পরে নিলাম, ইনগ্রিড আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল এগুলো আমার জন্যে। এরপর বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলাম। কিছুটা স্বস্তি লাগছে এখন। বাথরুম থেকে বের হয়ে জুতোটা পরে নিলাম।

ব্যাকনের সুস্বাদু গন্ধ এসে নাকে লাগল। পা বাড়ালাম ওদিকে।

“ঘুম ভাঙল তাহলে,” রান্নাঘর থেকে আমার উদ্দেশ্যে বলল ইনগ্রিড।

“শুভ সকাল,” জবাব দিলাম।

“ঠিক আছ তুমি?” ঘাড়টা একদিকে কাত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল সে।

“হ্যাঁ, একদম।”

দুঃস্বপ্নটার ব্যাপারে ওকে বলতে চাই না আমি। এটা জানাতে চাচ্ছি না যে, গত কয়েকমাস ধরেই প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি। আমাকে ওভাবে বেধে রেখে টর্চার করার পর থেকে শুরু এই ঘটনা।

ল্যাসি একটা মার্বেলের টেবিলের ওপর বসে বসে ইনগ্রিডের তৈরি করা ব্যাকন আর ডিম খাচ্ছে। ওকে একটু আদর করে ইনগ্রিডকে কাছে টেনে নিলাম। কিছুক্ষণ আমার চেহারার দিকে একটানা তাকিয়ে থাকল ও, আমি মিথ্যা বলছি নাকি পরীক্ষা করে দেখছে। একটু পর গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নাও এবার।”

একটা ব্যাকন মুখে পুরে আশেপাশে নজর বোলাতে লাগলাম। আসলেও অনেক বড় কেবিনটা। জায়গায় জায়গায় দামি কাঠ দিয়ে নকশা করা। একটা বিলাসবহুল কেবিন, যার সাপ্তাহিক ভাড়া চার হাজার ডলার হিসেবে যা থাকা দরকার, তার সবই আছে। ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি, অ্যান্টিক ছবি, ক্রিস্টালের ফুলদানি-কোনকিছুরই কমতি নেই। চারটা জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ দেখা যাচ্ছে।

সূর্য উঠতে আর চার মিনিট বাকি।

ল্যাসি তার নিজের ভাগের নাস্তা শেষ করে কাতর চোখে আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ব্যাকন ওর প্লেটের দিকে ছুঁড়ে দিতেই লাফিয়ে পড়ল ওটার ওপর।

“কি করলে তোমরা দুজন এতক্ষন?” জিজ্ঞেস করলাম।

জবাবে ইনগ্রিড কালকে আমি ঘুমিয়ে যাবার পর থেকে সব কিছু খুলে বলা শুরু করল। ফেয়ারব্যাঙ্কস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আমরা ল্যান্ড করেছি এখানকার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে এগারোটায়। ভার্জিনিয়ায় তখন বাজছিল সাড়ে তিনটার মত। প্রায় এগার ঘন্টার ফ্লাইট। এর চল্লিশ মিনিট পরে আমরা এই কেবিনে পৌঁছাই। আমাকে এখানে শুইয়ে রেখে ইনগ্রিড আর ল্যাসি বের হয়েছিল ফেয়ারব্যাঙ্কসের মূল শহরতলি ঘুরে দেখতে। এখান থেকে মাত্র এক মাইলের মত দূরে হবে জায়গাটা। ওখান থেকে বাজার করে কেবিনে ফিরে রান্না সেরে সাড়ে নয়টার দিকে ঘুমুতে যায় দুজনই। এই এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠেছে ইনগ্রিড।

“তো, আজকের মেনুতে আর কি আছে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“ওটা সারপ্রাইজ,” মাথা নেড়ে জবাব দিল সে।

ফ্রিজের উদ্দেশ্যে আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু সব জায়গায় খালি মোটা ওক কাঠের নকশা। ইনগ্রিড ওরকম একটা কাঠের পাল্লা খুলতেই জিনিসপত্রে ঠাসা ফ্রিজটা চোখে পড়ল। ওখান থেকে একটা জুসের বোতল নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারল ও।

“এটার রঙ সবুজ কেন?” বোতলটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“ইসাবেলের রেসিপির সাথে অল্প একটু বাঁধাকপি যোগ করে দিয়েছি আমি।”

ইসাবেল হচ্ছে আমার বাসার কেয়ারটেকার-কাম-রাঁধুনি। আমার জন্যে জুস বানানো বাদেও আমি অন্য যা যা খাই সবই তৈরি করে রাখে সে। আমার একঘন্টা সময়টাকে যেন সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারি সেদিকেও তার সমান খেয়াল। এই যেমন ঘুম থেকেই উঠেই দেখব, ব্রাশে টুথপেস্ট লাগানো আছে, কিংবা দৌড়ানোর জুতোজোড়া দরজার সামনে করে রাখা আছে মোজাসহ।

জুসের বোতলে এক চুমুক দিয়েই নাক কুঁচকে ফেললাম।

“এই তোমার ‘অল্প একটু’?”

“আচ্ছা বাবা, একটু না-হয় বেশিই যোগ করেছি। কিন্তু তোমার শরীরের জন্যে ওটুকু দরকার আছে।”

গত প্রায় এক মাস ধরে ইনগ্রিড আমার শরীরের প্রতি একটু বেশিই নজর রাখছে। যেহেতু আমি দিনে তেইশ ঘন্টার মত ঘুমাই, তাই তার ধারণা আমি দরকারের চেয়ে অনেক কম পরিমাণে পানি পান করি। খাওয়াদাওয়ার পরিমাণও নাকি যথেষ্ট কম। ইদানিং তাই ঘুম থেকে উঠেই এক বোতল পানি (সাথে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর কিছু মেশানো থাকে), একটা এনার্জি বার আর ভিটামিন ট্যাবলেট গিলতে হয় আমাকে।

এত দিন এই ‘মধুর অত্যাচার চোখ বুজেই সহ্য করেছি, কিন্তু আজকে বাঁধাকপির জুসটা একটু অতিরিক্তই হয়ে গেছে।

“লক্ষ্মি ছেলের মত তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলল ওটা,” হাতঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল ইনগ্রিড, “যেতে হবে আমাদের।”

নাক বন্ধ করে গিলে ফেললাম জিনিসটা। এরপর বোতলটা সিঙ্কে রেখে দিলাম।

“এবার আসো আমার সাথে, একটু জোরেই বলল কথাটা ইনগ্রিড।

তিনটা পাঁচ বাজছে এখন।

ওকে অনুসরণ করে পাশের ঘরটাতে ঢুকে পড়লাম। একটা স্প্রে ক্যান হাতে নিয়ে আমার সারা শরীরে স্প্রে করল ইনগ্রিড। মশাদের দূরে রাখবে এটা। গ্রীষ্মকালে আলাস্কায় মশার উৎপাত বেড়ে যায় বহুগুণে। আমিও ওর গায়ে স্প্রে করে দিলাম।

এরপর আমাকে নিয়ে লিভিংরুমে চলে এলো সে। একটা কাঁচের স্লাইডিং দরজা খুলে বারান্দায় ঢুকে পড়লাম আমরা।

ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

বারান্দাটা সেইনা নদীর একদম পাশেই। সামনে তাকালে প্রায় দুইশ ফিট চওড়া নদীটা একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। নদীর তীর ঘেঁষে হাজার হাজার সবুজ রঙের গাছের সমারোহ। আর সেই সবুজের সমুদ্রের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে লাল আর কমলা রঙের আকাশ।

বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি।

দীর্ঘ একটা মিনিট ওভাবেই কেটে গেল।

“সময় হয়ে গেছে,” আমাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল ইনগ্রিড।

আর তারপরই চোখে পড়ল ওটা।

এক টুকরা ছোট্ট তীব্র সাদার ঝলকানি।

সূর্য।

“কখনো ভাবিনি এই দৃশ্য দেখব আমি,” প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বললাম কথাগুলো।

এরপরের বিশ মিনিট এক রকম ঘোরের মধ্যে থেকে জীবনে প্রথমবারের মত সূর্যোদয় দেখলাম। ইঞ্চি ইঞ্চি করে দিগন্তে বেরিয়ে এল সেটা। একসময় নদীর পানির একদম সমান্তরালে এসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে দিলাম ওদিকে। রশ্মিগুলো যেন অনুভব করতে পারছি।

“আসো, বসো এখানে।”

আমি এতক্ষণে খেয়ালই করিনি, ইনগ্রিড মাঝে কিছু সময়ের জন্যে উধাও হয়ে গিয়েছিল এখান থেকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি দুটো চেয়ার আর প্লেটভর্তি খাবার সাজিয়ে ফেলেছে সে।

আমার চোখের কোণে পানি ওর নজরে পড়লেও সেটা নিয়ে কোন মন্তব্য করল না।

একটা ছোট প্লেটে ল্যাসির জন্যে খাবার বেড়ে দিল ইনগ্রিড। এরপর তিনজনই চুপচাপ খেতে লাগলাম।

তিনটা আটান্নর সময় ইনগ্রিডের ক্রিসমাসে উপহার দেয়া হাতঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে উঠল।

“ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়া উচিত তোমার এখন।”

“আজকে এখানেই ঘুমাব আমি,” ওর উদ্দেশ্যে বললাম আমি। “সূর্যের আলোয়।”

*

অধ্যায়

২০ শে জুন
সূর্যোদয়-৩:০৭

“আউচ,” চিৎকার করে উঠলাম, একদম জ্বলে যাচ্ছে জায়গাটা।

“বাচ্চা না তুমি, চেঁচানো বন্ধ করো,” আমার মুখের চারপাশে আর ঘাড়ে আরেক পরত অ্যালোভেরা জেল লাগাতে লাগাতে বলল ইনগ্রিড।

“আমার জায়গায় তুমি হলে বুঝতে, তোমার চেহারা তো আর জ্বলে যায়নি।”

“আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, তুমি কোন সানস্ক্রিম লাগানো ছাড়াই বারান্দায় গিয়েছিলে।”

“আর আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না তোমার মাথায় এটা আসলো না যে ছয়ঘন্টা ওভাবে বাইরে বসে থাকলে আমার চেহারা টমেটোর মতো লাল হয়ে যাবে।”

“বললামই তো, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর তাপমাত্রা যে পঁচাশি ডিগ্রিতে উঠে যাবে এটাও জানা ছিল না আমার। হাজার হোক এটা আলাস্কা! এখানে তো ঠান্ডা হবার কথা!”

“আমি তো আগেই সাবধান করেছিলাম গরমের ব্যাপারে,” এখানে আসার আগের দিন আবহাওয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছিলাম আমি। ঐ বার্তায় বলা হয়েছিল আগামি দশদিন তাপামাত্রা থাকবে আশির ঘরে।

“আমি তো ভেবেছিলাম এখানকার গরম মানে চল্লিশ ডিগ্রির আশেপাশে।”

“এক মিনিট!” ওকে থামিয়ে বললাম আমি, “তুমিও যদি বাইরে ঘুমিয়ে পড়ো, তাহলে তোমার চেহারা এমন বহাল তবিয়তে আছে কিভাবে?”

“আমি সানস্ক্রিম লাগিয়ে নিয়েছিলাম,” চোরের মত গলায় বলল ও।

হতাশ হয়ে মাথা নাড়লাম আমি। আসলেই বোকার মত কাজ হয়েছে সানস্ক্রিম না লাগিয়ে।

“তোমাকে একটা ভেজা তোয়ালে এনে দিচ্ছি আমি,” এই বলে ভেতরে উধাও হয়ে গেল ইনগ্রিড।

কিছুক্ষণ পরে ল্যাসি হেলে-দুলে ঢুকল বাথরুমে। কিন্তু আমাকে দেখেই পিছিয়ে গেল।

“আরে, এটা সানবার্ন।”

মিয়াও।

“না, ইবোলা না এটা।”

মিয়াও।

“কারণ গত কয়েকমাসে আফ্রিকায় যাইনি আমি।”

মিয়াও।

“বললাম না সানবার্ন! সূর্যের নিচে অনেকক্ষণ থাকলে এমনটা হয়!”

মিয়াও।

“তোর হয়নি কারণ তোর গায়ে লোম ভর্তি।”

মিয়াও।

“কারণ মানুষের বুদ্ধি বিড়ালের চেয়ে বেশি। আর বেশি বুদ্ধির প্রাণীদের শরীরে লোম একটু কমই থাকে।”

মিয়াও।

“আমাকে কার মত দেখা যাচ্ছে?”

মিয়াও।

“এই ফ্রেডি জুগারটা আবার কে?”

“চলে আসো,” ভেতর থেকে ইনগ্রিড বলল। “খাবার তৈরি।”

ল্যাসি একলাফে বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ফোনটা হাতে নিয়ে বাবাকে একটা মেসেজ করে বলে দিলাম, এখানে সব কিছু ঠিকঠাক আছে। আমার কল্পনার চেয়েও আসল সূর্য অনেক বেশি সুন্দর। মারডক কেমন আছে সেটাও জিজ্ঞেস করলাম।

কিছুক্ষণ পরে আমার ফোনে মারডকের একটা ছবি পাঠাল বাবা। কাউচে শুয়ে ক্যামেরার দিকে ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। ছবির নিচে লিখে দিয়েছে বাবা “ও জানে ওর সাথে কি করা হয়েছে।”

একবার ভাবলাম ছবিটা ল্যাসিকে দেখাই, কিন্তু পরমুহূর্তেই বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা।

আয়নায় তাকিয়ে একবার নিজের চেহারায় না নজর বুলিয়ে পারলাম না। আমার বাদামি চোখের চারপাশটা গাঢ় লাল হয়ে আছে। তার ওপরে সবুজ সবুজ জেলের পরত। মাথা নেড়ে বারান্দার উদ্দ্যেশ্যে হাটা শুরু করলাম।

একটা বড় প্লেটে স্যান্ডউইচ সাজিয়ে রেখেছে ইনগ্রিড। সাথে সবুজ রঙের জুস, লেমোনেড আর ক্যারামেল কর্ন। এসবকিছুই একটা সুন্দর পিকনিক টেবিলের ওপর রাখা। ছাতাও জুড়ে দিয়েছে ও।

“তোমার উচিত সূর্যের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা, আমার ঘাড়ের চারপাশে একটা ভেজা কাপড় জড়িয়ে দিতে দিতে বলল ইনগ্রিড।

“টমেটো মানব।”

দুজনেই হেসে উঠলাম আমরা। “ফ্রেডি ক্রুগারটা কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কেন?”

“ল্যাসি বলল আমাকে নাকি ফ্রেডি ক্রুগারের মত দেখাচ্ছে।”

“তাই নাকি?” এই বলে ল্যাসির দিকে একবার নজর দিল ইনগ্রিড। সে এখন সকালের নাস্তা পরবর্তি ন্দ্রিায় মগ্ন। “ফ্রেডি ক্রুগার হচ্ছে নাইটমেয়ার অন এম স্ট্রিট নামের হরর মুভির একটি চরিত্র। তার চেহারা পুরোপুরি ঝলসে যাওয়া। স্বপ্নে হানা দেয় সে, আর ওখানে যদি তার হাতে তোমার ন্টমৃত্যু হয়, তাহলে বাস্তবেও মৃত্যু হবে।”

“তার মানে, ওসব সিনেমায় সহজে কেউ ঘুমোতে চায় না?”

“না।”

“আমার মত।”

“ফ্রেডি ক্রুগারের কিন্তু কোন সুন্দরি গার্লফ্রেন্ড নেই।”

“ওহ, তাও ঠিক,” হেসে বললাম আমি।

দীর্ঘ একটা চুমুর পর দু’জনে হাত ধরে সূর্যোদয় উপভোগ করতে লাগলাম।

.

পনের মিনিট পরে আমাদের সামনে দিয়ে দুটো ক্যানো আর তিনটা কায়াক নৌকা ভেসে গেল। ওগুলোর আরোহিরা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লে আমরাও পাল্টা হাত নাড়লাম।

“আমাদেরও ওরকম একটা ক্যানো নিয়ে নদীতে নেমে পড়া উচিত আগামিকাল,” ইনগ্রিড বলল।

“আমি ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা করে রেখেছি,” হেসে জবাব দিলাম। “নদীতে অন্তত তিন থেকে চার জায়গায় ক্যানো নিয়ে নামা যায়। এখানে সচরাচর এরকম গরম পড়ে না, কিন্তু যখন পড়ে তখন নদীতে নেমে পড়ে সবাই ক্যানো নিয়ে। পুরো জায়গাটা ক্যানোতে করে ঘুরে দেখতে চারঘন্টার মত সময় লাগে। কিন্তু আমরা কেবল শেষ দু’মাইল ঘুরব।

“আমি সানস্ক্রিম আগে থেকেই ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখব,” আমার পায়ে আলতো চাপড় মেরে বলল ও। “ফ্রেডি।”

এরকম হালকা খুনসুটি আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে গেলাম আমরা।

তিনটা পঞ্চান্নর সময় আমার মনে হল, একটা ছোট সারপ্রাইজের বন্দোবস্ত করেছিলাম আমি।

“এখনই আসছি, দাঁড়াও,” ইনগ্রিডের মাথায় হালকা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। “ডিনারের পরে ডেজার্টের ব্যবস্থা করেছি আমি।”

এখানে আসার আগে দামি এক বোতল স্কচ হুইস্কি উপহার দিয়েছে বাবা। স্যুটকেস হাতড়িয়ে বেয়াল্লিশ বছরের পুরনো গ্লেনফিডিচ-এর বোতলটা বের করলাম। রান্নাঘর থেকে দুটো টাম্বলার গ্লাস নিয়ে বারান্দায় ফেরত আসলাম আমি।

গ্লাস দুটোতে অল্প করে হুইস্কি ঢেলে একটা ইনগ্রিডের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু ওটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সে। এসময় আমার হাতের ঘড়িটা বেজে উঠল। আর দু’মিনিট আছে।

“কি হল?” জিজ্ঞেস করলাম। “তোমার স্কচ ভালো লাগে না?”

এবার আস্তে করে গ্লাসটা নিল ও।

“ইচ্ছে না করলে জোর করে খাওয়ার দরকার নেই।”

জবাবে মাথা ঝাঁকালো ও। এরপরে যখন আমার দিকে তাকালো তখন দুই চোখে পানি টলমল করছে।

“হেনরি,” মৃদু স্বরে বলল ও, “আমি প্রেগন্যান্ট।”

*

অধ্যায়

সূর্যোদয়-৩:০৭

আমি যখন রান্নাঘরে ঢুকলাম তখন ঘড়িতে বাজছে তিনটা দুই। ইনগ্রিড টেবিলের ওপর বসে, হাতে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। আমার দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আমি কি বলি শোনার অপেক্ষায়।

“তুমি তো বলেছিলে বাৰ্থকন্ট্রোল পিল নিচ্ছো।”

“নিচ্ছি,” সায় জানিয়ে বলল ও।

“আসলেই নিচ্ছিলে?”

“প্রায় প্রতিদিনই।”

“প্ৰায়?”

“মাঝে মাঝে কাজের চাপে ভুলে গেছি।”

“কতদিন? কতদিন ধরে জানো তুমি ব্যাপারটা?”

“এক মাস।”

“এক মাস?”

“আমি একদম নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম।”

“আর এখন তুমি নিশ্চিত?”

ফুঁপিয়ে উঠে মাথা নেড়ে সায় জানালো ও।

লম্বা করে একবার শ্বাস নিলাম, এরপর বললাম, “আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি বাচ্চাকাচ্চা চাই না। বলেছিলাম না আমাদের খুবই সাবধান থাকতে হবে এ ব্যাপারে?” আসলে ব্যাপারটা এমন না যে, আমি বাচ্চাকাচ্চা চাই না। বাচ্চাকাচ্চা ভালোই লাগে আমার কিংবা বলা যায় ওদের ব্যাপারে ভাবতে খারাপ লাগে না। কিন্তু আমি আমার এই অবস্থায় বাবা হতে চাই না। একটা বাচ্চাকে কিভাবে বড় করবো আমি, যেখানে আমার জন্যে সারাদিনে মাত্র এক ঘন্টা বরাদ্দ থাকে? “আমি দিনে মাত্র এক ঘন্টা জাগি!” চিৎকার করে বললাম। “এটা কি মাথায় ঢোকে না তোমার? মাত্র ষাট মিনিট! আর এখন আমাকে একটা বাচ্চার ভরণপোষণ করতে হবে?”

ঘুরে দাঁড়ালাম। ওর চেহারাও দেখতে চাই না আমি। আসলে চাই না আমার কথাগুলো শুনে ওর কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা দেখতে। বেডরুমে ঢুকে জিন্সের প্যান্টটা খুলে একটা ট্রাউজার পরে নিলাম। একটা হুডি গায়ে চাপিয়ে দৌড়ানোর জুতোজোড়া খুঁজে বের করলাম।

জুতোর ফিতে বাধা ল্যাসিকে হাত গিয়ে গুঁতো দিলাম। এখনও ঘুমোচ্ছে ও।

“ওই ওঠ! চল্ আমার সাথে।”

দ্রুত একবার আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে গেল ও।

এক মিনিট পরে, সূর্যের আলোয় গাছগাছালির ভেতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম আমি আর ল্যাসি। গন্তব্য ফেয়ারব্যাঙ্কস এর শহরতলী।

.

জগিং ট্রেইলটা আমাদের ফেয়ারব্যাঙ্কসের একটা ছোট রাস্তায় নিয়ে আসলো। মূল শহরতলী থেকে দুই ব্লক দূরে। শক্ত কংক্রিটের রাস্তা ধরে সামনে এগোতে লাগলাম। পাশে ল্যাসি।

আমার চেহারায় যেন আগুন ধরে গেছে। রাগে আর কালকের সানবার্নের কল্যাণে। শেষ কবে এতটা রেগে গিয়েছিলাম মনে পড়ছে না। আমার সাথে কিভাবে করতে পারল ও এটা? এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হল কিভাবে?

প্রেগন্যান্ট!

এখন কি আমাকে আমার প্রতিদিনের একঘন্টা ডায়পার বদলাতে বদলাতে কাটাতে হবে?

সেইনা নদীর পার ধরে শহরতলীর দিকে এগোতে লাগলাম। ছবিতে জায়গাটা যতটা সুন্দর লেগেছিল এখন আর অতটা ভালো লাগছে না। কেমন যেন শিল্পাঞ্চল বলে মনে হচ্ছে। চারিদিকে কেবল লম্বা লম্বা বিল্ডিং। একটা ষাট ফুট লম্বা চৌকোণো বিল্ডিং পাশ কাটালাম। ওটায় সোনালি রঙের একটা ব্যানার ঝুলছে। ব্যানারে একটা মেরু ভাল্লুক আর ছয়টা রিং।

প্রতি গ্রীষ্মে ফেয়ারব্যাঙ্কসে অলিম্পিক আয়োজন করা হয়।

এস্কিমো-ইন্ডিয়ান অলিম্পিকস।

প্রতিবছর প্রায় দু’হাজার লোক জমা হয় এখানে অলিম্পিক উপলক্ষে। খেলাগুলোও অদ্ভুত। কান টানা প্রতিযোগিতা, সিল মাছ ধরা, কম্বল ছোঁড়া প্রতিযোগিতা, এগুলো হচ্ছে তুলনামূলক স্বাভাবিকগুলোর নাম। কাল ভোরে সূর্যোদয়ের সময় উদ্বোধনি অনুষ্ঠান। আমি দ্বিতীয় দিনের টিকেট কিনে রেখেছিলাম। আশা করেছিলাম ইনগ্রিডের সাথে কোন একটা খেলা হয়ত একসাথে উপভোগ করব।

প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনের একটা দল বাইরে খেলার বুথের কাজ করছে।

দুই ব্লক পার হয়ে কুশম্যান ব্রিজের কাছে পৌঁছে গেলাম। এখানে নদীটা চওড়ায় আমাদের কেবিনের বাইরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ব্রিজটা সোয়া মাইলের মত লম্বা। পটোম্যাক নদীর ব্রিজটার উপরে দাঁড়িয়ে যেদিন আমার মায়ের মৃত্যুর কথা ভেবেছিলাম তার পরে এটাই আমার দেখা প্রথম ব্রিজ। মনে আছে সেদিন কল্পনা করেছিলাম মা ব্রিজ থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ভেবেছিলাম হয়ত আমাকে ওভাবে একা ফেলে চলে যাওয়ার অনুতাপ থেকেই কাজটা করেছেন তিনি। বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল।

“ক্ষতি ওরই হয়েছে, আমাদের না।”

আমার বর্তমান অবস্থা কি ‘র থেকে খুব একটা ভিন্ন। হ্যাঁ, আমার বাচ্চাটার আকার এখন হয়ত আমার আঙুলের নখের সমান। কিন্তু আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে ইনগ্রিড হয়ত আমাদের বাচ্চাকে বলবে, “ক্ষতি ওরই হয়েছে, আমাদের না।”

অবশ্য নদী থেকে যার লাশ পাওয়া গেছিল সেটা আমার মার ছিল না। তিনি এখনো জীবিত। বরং গত কয়েকমাসের ঘটনা থেকে যা বুঝতে পেরেছি, আমাদের ফেলে চলে যাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু এখনকার ব্যাপারটার সাথে আমার মা জড়িত নন। এটা আমার আর ইনগ্রিডের ব্যাপার। আর আমাদের সন্তানের।

ল্যাসি আর আমি বিজের উপর উঠে মাঝামাঝি পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এখান থেকে ফেয়ারব্যাঙ্কসকে অনেকটা বেশি রঙিন মনে হচ্ছে। পুরো ব্রিজটা রূপালি রঙের লাঠি দিয়ে সাজানো হয়েছে। লাঠিগুলোর মাথায় অলিম্পিকের চিহ্ন আঁকানো হলুদ রঙের পতাকা। একেকটা পতাকা একেকটা খেলার প্রতীক। আমার সবচেয়ে কাছে যেটা আছে সেটায় দু’জন লোককে দেখা যাচ্ছে। একটা রাবার ব্যান্ড দুজনের কানে জড়ানো। এটাই বোধহয় বিখ্যাত কান টানা প্রতিযোগিতা।

ব্রিজের রেলিং থেকে অনেকগুলো ফুলদানি ঝুলছে। নানা রঙের ফুলে ভর্তি ওগুলো। ব্রিজটা যেখানে শেষ হয়েছে তার সামনের মোড়ে দুটো বহুতল হোটেল। একটার নাম হোটেল র‍্যাডিসন, তবে ওটার প্রতিযোগি হোটেলের নামটা বুঝতে পারলাম না। পার্কিংলটগুলো গাড়িতে ভর্তি। অলিম্পিকের কারণে হয়ত।

নদীর পাড়ে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সূর্য দেখা যাচ্ছে। পানিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওটার প্রতিফলনের আকার বাড়ছে।

ল্যাসি আমার পাশে কংক্রিটের ওপরেই শুয়ে পড়ল। ও জানে কখন আমাকে থাকতে দিতে হয়।

ইনগ্রিডের কথা ভাবছি, কেবিনে ওর এখনকার অবস্থার কথা। একা, ভীত আর অবশ্যই হৃদয় ভেঙে চৌচিড়।

“আমি একটা গাধা, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম। মনে হল এক মিনিটের মধ্যে ইনগ্রিডের পাশে ছুটে যাই। ওকে বলি কতটা দুঃখিত আমি।

ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা একুশ বাজে।

“চল,” ল্যাসির দিকে তাকিয়ে বললাম। কিন্তু ও মাথা নেড়ে না করে দিল, বেশি ক্লান্ত। আমি নিচু হয়ে তুলে নিলাম ওকে।

পায়ের নিচে কংক্রিটে কাঁপুনি অনুভব করাতে পেছনের দিকে ঘুরে তাকালাম। ভেবেছিলাম বড়সড় কোনট্রাকের দেখা পাব কিন্তু একটা গাড়িও চোখে পড়ল না।

আবার কেঁপে উঠল ব্রিজটা। এবার বেশ জোরে। এতটা জোরে যে রেলিং ধরে ভারসাম্য রক্ষা করতে বাধ্য হলাম।

“কি হল এটা!” ল্যাসিকে এক হাতে শক্ত করে ধরে আর আরেক হাতে রেলিং ধরে জিজ্ঞেস করলাম।

মিয়াও।

“আমিও জানি না।”

এরপর আরো ভয়ঙ্করভাবে দুলে উঠলো ব্রিজটা। তাল সামলাতে না পেরে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লাম। রেলিং থেকে একটা ফুলের টব বিশ ফিট নিচে পানিতে পড়ে গেল। রাস্তার মাঝামাঝি চলে গেলাম।

“ভূমিকম্প! ভূমিকম্প!”

এখানে আসার আগে আলাস্কা সম্পর্কে রিসার্চ করার সময় একটা পরিসংখ্যান চোখে পড়েছিল। আমেরিকায় প্রতি বছর যতগুলো ভূমিকম্প সংঘটিত হয় তার অন্তত অর্ধেক হয় এই আলাস্কায়। কিন্তু আলাস্কার জনসংখ্যা একদমই কম হওয়াতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সব সময়ই নগণ্য হয়ে থাকে।

আমার বামপাশে র‍্যাডিসন হোটেলটা বিপজ্জনকভাবে দুলছে। এটা যদি ভেঙে পড়ে তবে ফলাফল ভয়ঙ্কর হবে, অনেক লোক মারা যাবে।

আবার দুলে উঠল ব্রিজটা। ল্যাসিকে এখন ধরে রেখেছি এক হাতে। তীরের অনেকগুলো গাছ শিকড়সুদ্ধ উপড়ে নদীতে পড়ে গেল।

উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে কে যেন পায়ের নিচের কংক্রিটের রাস্তাটাকে প্রচন্ড জোরে ঝাঁকাচ্ছে। ভয়ানক একটা আওয়াজ ভেসে আসল এসময় আমার পঞ্চাশ ফিট পেছন থেকে। ঘুরে দেখি ব্রিজের বড় একটা অংশ ভেঙে নদীতে পড়ে যাচ্ছে। সদ্য তৈরি হওয়া ত্রিশ ফিটের ফাঁকা জায়গাটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলাম।

খুব সাবধানে উঠে দাঁড়ালাম। যেভাবেই হোক ব্রিজ থেকে নেমে যেতে হবে। আমার একদম ডানপাশের খুঁটিটা এসময় পতাকাসমেত পানিতে পড়ে গেল ভেঙে। গড়ান দিয়ে ওখান থেকে সরে গেলাম। তাড়াহুড়োয় হাত থেকে ছুটে লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ে উঠে গেল ল্যাসি। হুডির ওপর দিয়েও ওর নখের আঁচড় বুঝতে পারলাম। আরেকটা খুঁটি পড়ে গেল। মনে হচ্ছে যেকোন সময় পুরো ব্রিজটাই ধ্বসে পড়বে।

এসময় শহরের দিক থেকে একটা ধুলোর কুণ্ডলি উড়তে দেখলাম, সাথে ভয়ানক আওয়াজ। একটা বিল্ডিং ধ্বসে পড়েছে। ভেতরে কতজন মানুষ আছে, কতজন মানুষ মারা গেল কে জানে।

ঐ ধুলোর কুণ্ডলির দিকেই রওনা দিলাম। কিন্তু আমার সামনের ব্রিজের অংশটুকুও ধ্বসে পড়ল এ সময়। লাফিয়ে পেছনে সরে এলাম। পাশের রেলিঙটা কোনমতে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এখন দুটো বড় ফাঁকা জায়গার একদম মাঝখানে, যেখানে দ্বীপের মত টিকে আছে ব্রিজের ভাঙা অংশটুকু।

আমার ঠিক নিচে নদীতে বড় বড় ঢেউ চোখে পড়ল। কাঁপুনি থেমে গেলে এসময়। বড় করে একবার শ্বাস নিলাম।

“ল্যাসি!”

মিয়াও।

ও আমার দু’পায়ের মাঝে কাঁপছে থরথর করে। তুলে নিলাম ওকে। একহাত রেলিঙে রেখে সাবধানে চারপাশে তাকালাম। বিশ কদম পেছনে একটা ত্রিশ ফিটের ফাঁটল সৃষ্টি হয়েছে, যেখানকার অংশটুকু নদীতে তলিয়ে গেছে। দশ কদম সামনেও ব্রিজের বড় একটা অংশ উধাও। যে বিশটি খুঁটি লাগানো হয়েছিল সমগ্র ব্রিজ জুড়ে, ওগুলোর মধ্যে কেবল দুটো টিকে আছে। এখন। কোনটার মাথাতেই পতাকা লাগানো নেই। ধুলোর কুণ্ডলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটো হোটেলই মাটির সাথে মিশে গেছে। সাথে আশেপাশের বিল্ডিংগুলোও।

কেবল একটা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। আর কতগুলো বিল্ডিং ধ্বসে পড়েছে চিন্তা করলাম। মৃতের সংখ্যা নিশ্চয়ই কয়েকশো ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে কেবল একজনের কথাই মাথায় ঘুরছে আমার।

ইনগ্রিড।

আমাদের কেবিনটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে তো? ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ও কি যথেষ্ট দূরে ছিল? যদি কেবিনটা ধ্বসে পড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ও কি চাপা পড়েছে? অসহায়ভাবে আমাকে ডাকছে?

ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা একুশ বাজছে। প্রায় দুমিনিট ধরে ভূমিকম্প হয়েছে।

আমি সামনের দিকে এগোলাম, ভেবেছিলাম যেখানে ত্রিশ ফিটের ফাঁটল সৃষ্টি হয়েছে তার নিচের দিকে কিছুটা অংশ হলেও ঝুলে থাকবে, যার ওপর লাফিয়ে নামব। কিন্তু ফুলে ফেপে ওঠা নদীর স্রোত ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না।

পেছনে গিয়ে দেখি সেখানেও একই অবস্থা। মিয়াও।

“না, লাফ দিতে পারব না আমি।”

মিয়াও।

“আমি কার্ল লুইস না!”

আবার নদীর দিকে তাকালাম। ভূমিকম্পে কোন বাধ ভেঙে গেছে কিনা কে জানে, না-হলে স্রোত এত বেড়ে গেল কিভাবে? মনে হচ্ছে যেন নদীতেই সুনামি ঘটছে। যদি এমন কিছুটা হওয়া আদৌ সম্ভব হয় আর কি। কিন্তু খয়েরি রঙের পানির স্রোত বাড়ছে তো বাড়ছেই। সেই সাথে ঢেউগুলো বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে। দুই তীর ছাপিয়ে পানি ওপরে উঠে গেছে। তীরবর্তি সবগুলো গাছ উপড়ে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। ঐ গাছগুলো এসে আমি ব্রিজের যে ছোট অংশটুকুতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে জোরে জোরে গুতো দিতে লাগল। এসময় একটা আস্ত কেবিন ভেসে এসে নিচের ব্রিজের পিলারে ধাক্কা দিল।

কেঁপে উঠল সম্পূর্ণটা। বড় একটা অংশ তলিয়ে গেল নিচে। এই দ্বীপের মত জায়গাটাও ভেঙে যাবে যখন তখন। পিলারের একদম ওপরে গিয়ে দাঁড়ালাম রেলিং ধরে। সাহায্য না আসা পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করব।

আবার ঘড়ি দেখলাম। তিনটা আটাশ।

উদ্ধারকারি ট্রাকগুলো কোথায়। হেলিকপ্টারগুলোই বা কোথায়?

ব্রিজটা ঝাঁকুনি খেল এই সময়। নিচের দিকে তাকালাম।

পানিতে ভেসে আসা ভারি জিনিসের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গাছের পর গাছ, একটা নৌকা, গাড়ি। আশেপাশের সব জিনিস টেনে এনেছে বেপানি। ব্রিজের এই অংশটুকুতেও ফাঁটল ধরছে বুঝতে পারলাম। আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না।

ব্রিজের অন্যপাশে এসে নিচে তাকালাম। এদিকে পানিতে বেশি জিনিস নেই, তবে অনেক ভেসে আসা জিনিস ব্রিজের সাথে আটকে আছে। চাপ সৃষ্টি করছে পিলারে, যেন একটা হাতি হেলান দিয়ে আছে বেড়ার গায়ে। যেকোন সময় ছিটকে যাবে।

মিয়াও।

“আমাদের পারতেই হবে।”

মিয়াও।

“না-হলে এসবের সাথে আমরাও ধ্বসে যাব।”

মিয়া—

আবার কেঁপে উঠল ব্রিজটা। ভূমিকম্পের আফটারশক।

ল্যাসি কলার ধরে আর কিছু না ভেবে নিচে লাফ দিলাম।

.

মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে বরফশীতল পানির ওয়াশিং মেশিনে ছেড়ে দিয়েছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। তুমি একটা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছ মাত্র, এক সময় না এক সময় ভেসে উঠবেই।

কিন্তু শান্ত থাকতে পারলাম না। শ্বাস নিতে হবে আমাকে। এখনই! মোচড় দিলাম পানিতেই। পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উপরে ভেসে ওঠার চেষ্টা করলাম। পাগলের মত হাত ছুঁড়তে লাগলাম দু’পাশে। একসময় হাতদুটো ভেসে উঠল পানির ওপর, হাপড়ের মত শ্বাস নিতে লাগলাম।

আমার বাম হাতে ল্যাসির কলারটা এখন শক্ত করে ধরে রাখা। ওকেও পানি থেকে উঁচু করে ধরলাম। বেচারার হলুদ চোখ দুটো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে। জোরে জোরে বাতাস টানতে লাগল ও।

পেছনে ব্রিজের বেঁচে যাওয়া অংশটুকুর দিকে তাকালাম।

কিন্তু কিছুই নেই ওখানটাতে। খালি।

এই শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি পানিতে আমি কতক্ষন টিকতে পারব জানি, কিন্তু কয়েক মিনিটের বেশি হবে বলে মনে হয় না। তবে ওতে কিছু যায় আসে না, কারণ তার আগেই যদি আমার ঘুম এসে পড়ে তবে সব জঞ্জালের চাপে পিষে ভর্তা হয়ে যাব আমরা।

ল্যাসিকে ডান কাঁধের ওপর রেখে তীরের দিকে সাঁতরানোর চেষ্টা করলাম। দীর্ঘ দশ সেকেন্ড পরে বুঝতে পারলাম আমাদের পক্ষে সম্ভব না ওখানে পৌঁছানো। আমরা এখন পুরোপুরি স্রোতের মর্জির ওপর। সেটা আমাদের কোনদিকে নিয়ে যাবে তার ওপর আমাদের কোন হাত নেই। তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কেবল একদিকেই যাওয়া সম্ভব। নিশ্চিত মৃত্যু! ‘ আবার তলিয়ে গেলাম পানিতে, কষ্ট করে ভেসে উঠলাম। ল্যাসিকে ঘাড়ের ওপর রেখে স্বাভাবিকভাবে সাঁতার কাটাও কষ্টের। এসময় ওগুলো চোখে পড়ল আমার।

নদীর তীরের সাথে সমান্তরাল করে একটা ডকের সাথে অনেকগুলো ক্যানো আর কায়াক বাঁধা। একেকটার সাইজ একেকরকম। নিশ্চয়ই এখান থেকে ক্যানোগুলো ভাড়া দেয়া হয়। কতগুলো কায়াক আর ক্যানো এরমধ্যেই নদীতে ভেসে গেছে কে জানে। বাকিগুলোও ভেসে যাবে নিশ্চিত।

একটা সবুজ ক্যানোকে বাদামি রঙের পানিতে ভেসে যেতে দেখলাম এসময়। নৌকাগুলো দৃষ্টিসীমার মধ্যে রেখে ভেসে থাকার চেষ্টা করলাম। আমার পেশিগুলোতে টান লাগছে এখন। মনে হচ্ছে যেকোন সময় খিচুনি ধরে যাবে। কাপড়চোপড় ভিজে ভারি হয়ে গেছে।

স্রোত নিচের দিকে টানছে আমাকে।

শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করলাম।

ল্যাসি নিঃশ্বাসের জন্যে হাঁসফাঁস করছে।

আর সম্ভব না। সব কিছুর সমাপ্তি এখানেই।

কিছু একটা হুশ করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল এ সময়।

আরো দশ ফিট সামনে চলে যাওয়ার পরে বুঝতে পারলাম ওটা একটা ক্যানো।

ঘুরে তাকালাম। আরেকটা ক্যানো চলে গেল। মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাঁপটা এসে লাগল।

দুটো কায়াক নৌকা উজানের দিকে ভেসে চলেছে। দুটোই নীল। আমার পঞ্চাশ ফিট বাম দিয়ে চলে গেল ওগুলো।

আরেকটা কায়াক। লাল রঙের। উপুড় হয়ে ভেসে ভেসে আমাদের দিকেই আসছে।

হাত বাড়িয়ে ওটাকে আটকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার আঙুলগুলো জমে গেছে একদম। ধরতে পারলাম না। মনে হচ্ছে যেন বক্সিং গ্লাভস পরে টুথপিক ধরার চেষ্টা করছি।

লাল রঙের কায়াকটাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে হারিয়ে যেতে দেখলাম।

বাল!

আবার ঘুরে তাকালাম। চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল।

এবার সবগুলো নৌকা একসাথে ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই যেখানটাতে ওগুলো বাধা ছিল ওটুকু ভাসিয়ে নিয়েছে পানি।

একটা নীল কায়াক ধরার উদ্দ্যেশ্যে হাত বাড়ালাম। বাম হাত দিয়ে ওল্টানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু পিছলে বেরিয়ে গেল ওটা। আর আমি পানিতেই ভাসতেই লাগলাম।

আরো আটটা নৌকা ভেসে গেল। কোনটাই দশ ফিটের মধ্যে না। এরপর সবগুলোই চলে গেল।

না! না! না!

আমার বাম পা প্রায় অবশ হয়ে গেছে। খুব কষ্ট করে ভাসিয়ে রেখেছি আমাদের।

মিয়াও।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম।

একটা ক্যানো। সবুজ রঙের। ঠিক আমাদের দিকেই আসছে, যেন আমাদের জন্যেই নদীতে ভাসানো হয়েছে ওটাকে।

আমাদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায়।

দাঁত দাঁত চেপে ধরলাম।

পঞ্চাশ ফিট।

চল্লিশ।

ত্রিশ।

বিশ।

দশ।

পাঁচ।

দুই।

পা দিয়ে জোরে পানিতে ধাক্কা মেরে সামনে এগোলাম। প্রথমে বাম হাত এরপর ডানহাত ওটার ওপর তুলে দিলাম। ল্যাসিকে ভেতরে ফেলে দিলাম। আমার ওজনে ক্যানোটা দুলছে। ভালোমত চড়ে বসার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। পুরো শরীর জমে গেছে।

বাম হাতটা ছুটে গেল।

যদি ডানহাতটাও ছুটে যায় তবে নিশ্চিত মৃত্যু।

ইনগ্রিডের কথা ভাবলাম। ওর পেটে আমাদের সন্তানের কথা ভাবলাম।

বাম হাতটা আবার ক্যানোর ওপরে তুলে দিলাম। আমার ওজনে ক্যানোটা দুলছে, আমিও দুলছি ওটার সাথে। এরপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ওপরে চড়ার চেষ্টা করলাম। অর্ধেকটা শরীর উঠে গেল নৌকায়। দাঁতে দাঁত চেপে আবার ধাক্কা দিলাম পানিতে সর্বশক্তি দিয়ে। এবারে কাজ হল। উঠে পড়লাম নৌকাটাতে।

কোনমতে ল্যাসির পাশে গিয়ে ওর কলারটা শক্ত করে হাতের সাথে পেঁচিয়ে নিলাম। চিত হয়ে শুয়ে আছি। ফুসফুস কাজ করে যাচ্ছে পাগলের মত।

ওভাবেই শুয়ে থাকলাম প্রায় তিন মিনিট। ঘড়িটা চোখের সামনে নিয়ে আসলাম। অবাক হয়ে গেলাম।

তিনটা সাইত্রিশ।

ষোল মিনিট আগে ভূমিকম্পটা হয়েছে। এত কিছু! মাত্র ষোল মিনিটের ব্যবধানে।

যেটুকু শক্তি বাকি ছিল ওগুলো জড়ো করে উঠে বসলাম। কিছু একটা করতে হবে আমাকে। এভাবে এখানে পড়ে থাকলে হাইপোথার্মিয়ায় মরে যাব। আগামি তেইশ মিনিটের মধ্যে আমাকে তীরে পৌঁছুতে হবে। যেভাবেই হোক।

কিন্তু পরক্ষণেই পড়ে গেলাম।

একটুকুও শক্তি অবশিষ্ট নেই আর আমার মধ্যে।

*

অধ্যায় ৫

সূর্যোদয়-৩:০৭
আলাস্কার কোথাও

ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলাম। মনে হচ্ছে যেন আবার পানির নিচে আমি, ডুবে যাচ্ছি। হাঁসফাঁস করছি শ্বাস নেবার জন্যে। পাক্কা এক মিনিট লাগল। স্বাভাবিক হতে। এরপরে আরো এক মিনিট লাগল কি ঘটেছিল তা মনে করতে। ভূমিকম্প। ব্রিজ। নদী। ক্যানো।

সারা শরীরের প্রতিটা মাংসপেশিতে যেন আগুন ধরে গেছে।

কিভাবে এখনও জীবিত আছি তা মাথায় ঢুকল না। হাইপোথার্মিয়ায় আমার অবস্থা তো এতক্ষণে করুণ হবার কথা। এর একমাত্র ব্যাখা হচ্ছে এই দাবদাহ। এই তাপমাত্রাই আমাকে ঐ ছয় মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড বরফ শীতল পানিতে ডুবে থাকার পরবর্তি প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচিয়েছে।

সোজা হয়ে দু-হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলাম। আকাশটা কেমন হলদেটে হয়ে আছে। শান্তভাবে পানির ওপর ভাসছে ক্যানোটা। নদীর প্রস্থও আগে যেটুকু দেখেছিলাম তার তুলনায় দ্বিগুণ বলে মনে হচ্ছে। তীরবর্তি এলাকাগুলোতে দেখা যাচ্ছে বালুতট আর লম্বা লম্বা ঘাস।

এবার ক্যানোটার দিকে মনোযোগ দিলাম। প্রায় পনের ফিটের মত লম্বা এটা। তিন ফিট চওড়া। বসার জন্যে দুটো জায়গা আছে, তবে ঠাসাঠাসি করে তিনজন বসতে পারবে।

“ল্যাসি?”

দু-হাতে ভর দিয়ে পা-দানির ওপর চড়ে বসলাম।

“ল্যাসি?” অন্য পাশটাতে খুঁজলাম এবার। ও নেই।

পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। খুব কষ্ট করে সবকিছু উগড়ে দেয়া থেকে নিজেকে ঠেকিয়ে রাখলাম।

কি আশা করেছিলাম আমি? ঘুম থেকে উঠে দেখব ব্যাটা আমার বুকের ওপর শুয়ে আছে? ওর ওজন মাত্র পাঁচ পাউন্ড। কোন সন্দেহ নেই আমার, ও জমে মারা গেছে এতক্ষণে। হয়ত উঁচু কোন ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছিল আমাদের নৌকা, তখন ভসিয়ে নিয়ে গেছে ওকে।

নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম, ও একটা বিড়াল ব্যতীত কিছু নয়। তেমন একটা যায় আসবে না ওর অনুপস্থিতিতে।

লম্বা করে শ্বাস নিলাম। চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।

“ধুর!”

হয়ত বেঁচে আছে ও। নৌকাটা হয়ত তীরের কাছাকাছি গেছিল তখন লাফ দিয়ে নেমে গেছে। ব্যাপারটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাইলাম। কিন্তু ভেতরটা সায় জানাল না।

ল্যাসির মৃত্যুতে যতটা না খারাপ লাগছে, তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে ইনগ্রিডের কথা ভেবে। পেটে আমাদের বাচ্চাটা নিয়ে কেবিনে চাপা পড়ে আছে নিশ্চয়ই মেয়েটা। ওকে খুঁজে বের করতে হবে । বাঁচাতে হবে।

মনে মনে কিছু হিসাব কষে নিলাম। সেইনা নদীতে যদি চার ঘন্টায় বারো মাইল পাড়ি দেয়া যায়, তবে প্রতি ঘন্টায় তিন মাইল করে ভেসে এসেছে নৌকাটা। তবে ভূমিকম্পের কারণে স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যেতে দেখেছিলাম, তখন নিশ্চয়ই নৌকার গতিও দ্বিগুণ হয়ে গেছিল। এরপরে আবার নৌকাটা কোথাও আটকেও থাকতে পারে অনেক সময়। এখন আবার অনেক আস্তে আস্তে চলছে। ঘন্টায় দু’মাইলের মত করে। সব কিছু মাথায় রেখে নৌকার গড় গতিবেগ ঠিক করলাম ঘন্টায় চার মাইল। আর প্রায় তেইশ ঘন্টার মত ভেসে চলেছে নৌকাটা। তারমানে, প্রায় একশ মাইলের কাছাকাছি।

যদি আমার কাছে সময় থাকত তবে এক সপ্তাহে এই দূরত্ব পারি দিতে পারতাম আমি। ট্রেডমিলে প্রায় দশ মাইল প্রতি ঘন্টা বেগে দৌড়াই আমি। কিন্তু এই দুর্গম জায়গায় ঘন্টায় চার মাইল যেতে পারব কিনা সন্দেহ। প্রতি ঘন্টায় যে পরিমাণ ভেসে এসেছে ক্যানোটা, সেটুকু পাড়ি দিতে আমার এক দিন করে লাগবে।

তেইশ দিন।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা চার।

সূর্য উঠবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর এতক্ষণে শীতের তীব্রতা টের পেলাম। আশা করি সূর্য ওঠার পর তাপমাত্রা কিছুটা হলেও বাড়বে।

.

নদীর গভীরতা প্রায় কোমর সমান। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বরফ শীতল পানির মধ্যে দিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম। ডান হাত দিয়ে ক্যানোটা ধরে রেখেছি। এখন পানির গভীরতা কম। আমার হাঁটু অবধি। বালুর ওপর উঠে এসে হুডি আর ট্রাউজারটা খুলে ফেললাম। জুতো আর মোজাজোড়া আগেই খুলে ফেলেছি। বালুতে শুকোতে দিলাম ওগুলো। এসব করতে করতে পাশের পাহাড়গুলোর আড়াল থেকে সূর্য বের হয়ে আসল।

শান্ত হয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। আমার উদ্ধার হবার সম্ভাবনা কতটুকু? আমি নিশ্চিত, ঘটনার পরের দিন প্লেন আর হেলিকপ্টারে ছেয়ে ছিল ফেয়ারব্যাঙ্কসের আশেপাশের আকাশ। রেড ক্রস, ন্যাশনাল গার্ড এসব উদ্ধারকারি দলও এসে গেছে এতক্ষণে, সাথে করে নিয়ে এসেছে ত্রাণ সামগ্রি, পানি আর সৈন্য। ধ্বংসস্তূপের ওপরে নিশ্চয়ই খবরের চ্যানেলের হেলিকপ্টারগুলো চক্কর দিচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর কোন একটা আমি যেখানে আছি সেদিকে আসার সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে।

বরং পানিপথে উদ্ধার হবার ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা আছে। গ্রীষ্মকালে এখানে ক্যানো আর কায়াকের অবাধ চলাচল থাকে। ওগুলোর কোন একটা যেকোন সময় আমার পাশ দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখানেও একটা ব্যাপার আছে। নৌকা নিয়ে যারা নদীতে নামে তাদের বেশিরভাগই পর্যটক না-হলে স্থানীয় অতি উৎসাহি কিছু লোক, যাদের সবার আবাসস্থল ফেয়ারব্যাঙ্কস। এরকম ভূমিকম্পের পর তারা এখন হয়ত মৃত, আহত কিংবা অন্যের সাহায্যে ব্যস্ত। কেউ কেউ নিশ্চয়ই পরবর্তি প্রথম ফ্লাইটেই উড়াল দিয়েছে টাম্পার উদ্দেশ্যে। আর নদীর অবস্থাও সুবিধার নয়। দুনিয়ার জঞ্জাল ভাসছে ওটার ওপরে। সেগুলোর মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে সামনে এগোনো একরকম অসম্ভব।

একমাত্র ব্যক্তি যে আমার খোঁজ করবে সে হচ্ছে ইনগ্রিড। যদি সে আদৌ বেঁচে থাকে। ভূমিকম্পের পরবর্তি একঘন্টায় ও যদি আমার খোঁজ না পায় তাহলে সব আশা ছেড়ে দেবে। কল্পনায় দেখতে পেলাম উদ্ধারকারি দলকে আমার অবস্থা বোঝাচ্ছে ইনগ্রিড। আমি হয়ত যেকোন জায়গায় ঘুমিয়ে আছি।

“হেনরি বিনস আবার কি?” তারা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে। “কখনো শুনিনি তো আগে।” এরপরে নিশ্চয়ই আমার ব্যতিক্রমি মেডিকেল কন্ডিশনটার কথা বুঝিয়ে বলবে ও। বলবে, দিনে মাত্র এক ঘন্টা জেগে থাকি আমি। আর তাই হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সূর্য দেখতে এসেছি এখানে।

নাহ, কোন আশা নেই। প্রথম বিল্ডিঙটা ভেঙে পড়েছিল প্রায় চব্বিশ ঘন্টা আগে। আর এর আটচল্লিশ ঘন্টা পর, অর্থাৎ কালকে আমাকে মৃত বলে ধরে নেবে সবাই।

আমাকে আমার নিজেই উদ্ধার করতে হবে।

.

পেটের ভেতর থেকে ডাক দিয়ে ওঠায় সম্বিৎ ফিরে এলো আমার। শেষ খাবার খেয়েছিলাম চব্বিশ ঘন্টা আগে। স্যান্ডউইচ আর সবুজ রঙের জুস।

হ দীর্ঘক্ষণ খাবার না পেয়ে আমার স্ত্রীর অভ্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম কতটা ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত আমি। আরো এক সপ্তাহ হয়ত খাবার ছাড়া থাকতে পারব, কিন্তু পানি দরকার এখনই।

নদীর দিকে তাকালাম। টলটলে পরিস্কার পানি। হাত দিয়ে এক আঁজলা পানি উঠিয়ে মুখের সামনে নিলাম। কেমন যেন একটা গন্ধ। অবশ্য দেখে মনে হচ্ছে না আমার ভার্জিনিয়ার বাসার কলের পানির সাথে কোন পার্থক্য আছে। কিন্তু তার মানে এ নয়, পানিতে ব্যাক্টেরিয়া গিজগিজ করছে না। ফেলে দিলাম হাতের পানিটুকু। ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা তের বাজছে।

বালুতীরে রাখা ক্যানোটার দিকে তাকালাম। নদী বেয়ে আরো সামনে এগোলে কি হবে? স্রোতে ভাসতে ভাসতে হয়ত তীরবর্তি কোন জনবসতির দেখা পাব। অন্য কোথাও হলে হয়ত সুযোগ নিয়ে দেখা যেত। কিন্তু আলাস্কা, যেখানে একটা জনবসতি আরেকটা জনবসতির দূরত্ব কয়েকশো মাইল সেখানে এটা অনেক বড় ঝুঁকি হয়ে যাবে।

কাছাকাছি তিনটা বড়সড় পাথর চোখে পড়ল। ওগুলোর দুটোতে মেলে দিলাম আমার কাপড়চোপড়গুলো। তিন নম্বর পাথরটার ওপরে দাঁড়িয়ে আশেপাশে নজর বোলাতে লাগলাম। সব দিকেই পাহাড়।

“বালের একটা জায়গায় ফেঁসে গেছি,” পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নিজেই নিজেকে বললাম।

একটা গাছের চিকন ডাল পড়ে থাকতে দেখে ওটা তুলে নিয়ে আগাটা চোখা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। সারাজীবনে আমি মোেটমাট ষোলটা সিনেমা দেখেছি। এর মধ্যে একটা হচ্ছে কাস্ট অ্যাওয়ে।

আসলে পুরোপুরি শেষ করিনি সিনেমাটা। লোকটা যখন উইলসনকে হারিয়ে ফেলে তখন বন্ধ করে দেই। অবশ্য তার আগেই দু’একটা জিনিস শিখে নিয়েছিলাম।

আমার পক্ষে খাবার ছাড়া অনেকক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব। এরকম পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়া কঠিন হবে না আমার জন্যে।

এরপরের বিশ মিনিট ধরে বালুতটে বড় বড় করে সাহায্য চাই’ কথাটা লিখলাম।

তিনটা পঞ্চাশের সময় আমার কাপড়চোপড়গুলো হাতে নিয়ে দেখলাম হুডিটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। পরে নিলাম ওটা। অন্য সব কিছু এখনও ভেজা। কিন্তু পাথরগুলো গরম হতে শুরু করেছে সূর্যের তাপে। কাল নাগাদ শুকিয়ে যাবে।

আমার হৃৎপিণ্ডটা দৌড়াচ্ছে এখন।

পানিশূন্যতার ফলাফল।

আরেকদিন পানি ছাড়া থাকা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। নদীর পানি খেলে হয়ত অসুস্থ হব, কিন্তু না খেলে মারা যাব। এক আঁজলা পানি নিয়ে মুখে দিলাম। দুধ খাবার পরে আবার ঐ গ্লাসেই পানি খেলে যেমন লাগে পানির স্বাদ ওরকম ঠেকল আমার কাছে। পেট পুরে পানি খেলাম। নাকেমুখে ছিটা দিলাম।

তিনটা চুয়ান্নর সময় ক্যানোটাকে তিন নম্বর পাথরের দিকে নিয়ে আসলাম।

আগামি তেইশ ঘন্টা একটানা সূর্যের নিচে থাকা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাই ওটাকে উল্টে নিচে ছায়ায় ঘুমানোর প্ল্যান আমার।

উল্টে দিতে লাগলাম ওটাকে। টুপ করে কিছু একটা নিচে পড়ল ভেতর থেকে। নৌকার সামনের দিকে কুঠুরির মত একটা জায়গা আছে। ওখানটায় নিশ্চয়ই গরম, এজন্যেই ওখানে ছিল ও।

ক্যানো ফেলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম।

“ল্যাসি!” চোখ পিটপিট করে অর্ধেক খুলল।

নদীর তীরে ওকে নিয়ে যেয়ে হাতে করে পানি নিয়ে ওর মুখের কাছে। ধরলাম। পুরোটুকু শুষে নিল একবারে।

এক মিনিট পরে ক্যানোর তলায় ঢুকে গেলাম। ল্যাসি আমার বুকের ওপর। আমার ঘুমে তলিয়ে যাবার আগেই ও ঘুমিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *