পোষা পাখির বাগানে

পোষা পাখির বাগানে

হিতেশ কাপুর

রোমিলাকে আমি সঙ্গে নিতে চাইনি।

নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গা, সেই কারণেই একটু ইতস্তত করেছিলাম। এখন দেখছি মনের বাধায় সাড়া দিলেই ভালো হত। এই ভয়ঙ্কর পরিণতি আমার ভাগ্যে জুটত না। প্রতিটি পল-অনুপল কাটাতে হত না অন্ধ আশঙ্কায়। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্যে কাকে আমি দায়ী করব? কাহূরেইন-এর শেখ আবদুল অল হারিদকে? আমার বন্ধু মোহন খান্নাকে? আমার বোন রোমিলাকে? না দায়ী করব নিজেকেই?

প্রথমদিন থেকে ঘটনাগুলো যেন ছবির মতো মনে পড়ছে। ছোট্ট অ্যাভো প্লেনটায় আমরা তিনজন উড়ে চলেছিলাম কাহরেইন-এর দিকে। তিনজন বলতে আমি, মোহন আর রোমিলা। প্লেনে আর কোনও যাত্রী ছিল না। কারণ, শেখ হারিদ আমাদের জন্যেই পাঠিয়ে দিয়েছেন নিজস্ব ছোট প্লেনটি। তিনজনেই বেশ খোশমেজাজে ছিলাম। কাজের সূত্রে এরকম নতুন দেশ দেখার সুযোগ কজন পায়। কিন্তু…

শুরু থেকেই তা হলে শুরু করা যাক।

.

রোমিলা জানলা দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। নীচে, অনেক নীচে পার্শিয়ান গালফ সেখানে সূর্যের আলোয় নীল জল ঝিলিক মারছে। পথ ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু রোমিলাকে দেখে মনে হচ্ছে, নিজের সৌভাগ্যকে ও এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। কোনওদিন যে এরকম একটা দূর দেশে ও বেড়াতে আসবে সেকথা স্বপ্নেও ভাবেনি। ওকে খুশি দেখে আমার মনটা ভরে গেল। মা-বাপ মরা ওই একটা আদরের বোন আমার। আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। সারাটা জীবন ও ঘরকুনো হয়ে পড়ে রইল। জীবনের সাধ আহ্লাদ-আনন্দ কিছুই তেমন করে পেল না। এমনিতে ও খুব কম কথা বলে। নিঃশব্দে সাংসারিক কাজ সেরে দেয়। কিন্তু এখন ও একেবারে পালটে গেছে। সেই রওনা হওয়ার সময় থেকেই ছোট্ট মেয়েটির মতো খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছে।

সংক্ষেপে আমার পরিচয়টা এখানে সেরে নিই।

আমার নাম হিতেশ কাপুর। এখনও মনের মতো মেয়ে পাইনি, তাই কুমার হিতেশ কাপুর হয়েই রয়ে গেছি। ভারতের এক নামি তেল কোম্পানিতে আমি চাকরি করি। চাকরিসূত্রে প্রায়ই আমাকে হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াতে হয়, কিন্তু ভারতের বাইরে এই প্রথম। বিদেশি তেল কেনাবেচার ব্যাপারে হঠাৎই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল পার্শিয়ান গালফ-এ যাওয়ার।

কোম্পানির ডিরেক্টরের কাছ থেকে কথাটা শুনে যে আনন্দ হয়নি তা নয়, কিন্তু একই সঙ্গে আর একটা চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছে : রোমিলার কী হবে? কারণ পার্শিয়ান গালফ এ আমার সাতদিনও লাগতে পারে, আবার সাতাশদিনও লাগতে পারে। দু-চারদিনের ব্যাপার হলে রোমিলাকে একাই রেখে যেতাম। বাড়ির কাজের লোক ওর দেখাশোনা করত। কিন্তু এতগুলো দিন? তাছাড়া বেচারি মেয়েটা খুব মনমরা হয়ে পড়বে। সুতরাং সেদিনই বাড়ি ফিরে রোমিলাকে বললাম, অফিসের কাজে আমাকে মিডল ইস্ট যেতে হচ্ছে। সামনের সপ্তাহে।

ও ছোট্ট করে জিগ্যেস করল, ক-দিনের জন্যে, দাদা?

সাতদিনও লাগতে পারে, আবার এক মাসও লাগতে পারে।

রোমিলা গম্ভীর হয়ে গেল। ওর মুখটা বিষণ্ণ দেখাল। আমার মায়ের কথা মনে পড়ল। একটু চুপ করে থেকে বললাম, ভাবছি, তোকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।

সঙ্গে-সঙ্গে অবাক কাণ্ড ঘটল। রোমিলা মুখ নামিয়ে বসেছিল, চকিতে মুখ তুলে তাকাল। চোখেমুখে খুশির ফুল ফুটেছে। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অবিশ্বাসে ভরা মিষ্টি গলায় বলে উঠল, সত্যি!

আমি প্রাণখোলা হাসি হেসে বললাম, সত্যি। তোর বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

আমার বরাবরের দেখা মনমরা চুপচাপ মেয়েটা আনন্দে খুকি হয়ে গেল। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বিদেশ ঘোরা আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিল জানো? উফ, আমি ভাবতেই পারছি না দাদা, এই খবরটা সত্যি। যাই, টেলিফোনে বন্ধুদের খবর দিই।

ও ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হল, রোমিলার মনমরা চুপচাপ আচরণের জন্যে আমিই দায়ী। বাইরে ঘোরার নামে মেয়েটা এত খুশি হয়! ওকে খুশি রাখার জন্যে এবার থেকে মাঝে-মাঝে ওকে বেড়াতে নিয়ে যাব। নিজের ওপরে রাগ হল। এ কথাটা আমার আগে কেন খেয়াল হয়নি?

পরদিনই অফিসে সব ব্যবস্থা সেরে নিলাম।

অফিস থেকে পার্শিয়ান গালফ ট্যুরে আমি একা যাচ্ছি না। আমার সঙ্গী হচ্ছে সিনিয়র কমার্শিয়াল ম্যানেজার মোহন খান্না। মোহন আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড় হলেও সম্পর্কটা আমাদের বন্ধুর মতো। ওকে একান্তে নিয়ে রোমিলার কথা খুলে বললাম।

আমার সমস্যাটা শুনে ও রাজি তো হলই, তা ছাড়া নতুন বুদ্ধি দিল। বলল, হিতেশ, বোনকে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত খরচ তুমি করবে ঠিক করেছ জানি। কিন্তু তবুও একটা পরামর্শ দিই। আমরা দুজনেই অফিস থেকে ফার্স্ট ক্লাস এয়ার ফেয়ার পাই। যদি তা নিয়ে আমরা ইকনমি ক্লাসে ট্রাভেল করি তাহলে তোমার বোনের প্লেন ভাড়া তো উঠে যাবেই, তার ওপর হোটেল খরচও কিছুটা পাওয়া যাবে।

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু তুমি কেন ফার্স্ট ক্লাস ছেড়ে ইকনমি ক্লাসে ট্রাভেল করতে যাবে? তোমার অসুবিধে হতে পারে।

মোহন আমার পিঠে একটা প্রচণ্ড থাপ্পড় কষাল। তারপর হেসে বলল, নখরা ছোড়, ইয়ার। তোমার বোনকে সুখবরটা আজই ফাইনাল করে শুনিয়ে দাও, তারপর স্টার্ট প্যাকিং। সামনের মঙ্গলবার আমাদের ফ্লাই করতে হবে।

সেই মুহূর্তে মোহন খান্নাকে খুব ভাল লাগল আমার। বুকের ভেতরে খুশি উপচে পড়তে লাগল।

সেদিনই বাড়ি ফিরে হাঁকডাক করে রোমিলাকে ফাইনাল খবর জানিয়ে দিলাম। তারপর দু-ভাইবোন মিলে গোছগাছ শুরু করলাম। উৎসাহ কারও কম নয়। রোমিলাকে বললাম, ওখানে এক শেখের কাছ থেকে তেল আদায় করার জন্যে কোম্পানি আমাকে আর মোহন খান্নাকে পাঠাচ্ছে, বুঝলি? আমরা তিনজনে গিয়ে শেখকে নিংড়ে তেল বের করে ছাড়ব।

আমি আর রোমিলা গলা ছেড়ে হেসে উঠলাম। কাজের মেয়েটি, নাম কমলা, সেই হাসি শুনে ছুটে এল আমাদের ঘরে। হয়তো ভাবল, দাদা-দিদি পাগল হয়ে গেছে।

*

নিজের অবাক করা সৌভাগ্যে রোমিলা তখনও মশগুল। আমি ওর পাশে বসে গুগুন করে গানের সুর ভাঁজছি। আমাদের সামনের সিট থেকে মোহন খান্না ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। এয়ার হোস্টেসদের সুর নকল করে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল, লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।

রোমিলা খুশিতে ফিরে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। তারপর বলল, শেখ লোকটা কিন্তু দারুণ। তেহরান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজের এরোপ্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমি হাসলাম। কারণ এই প্লেনে ওঠার পর থেকে রোমিলা কমপক্ষে পাঁচবার শেখসাহেবের অতিথিপরায়ণতার প্রশংসা করেছে। এখন ও অবাক হয়ে প্লেনের বিলাসবহুল অঙ্গ সজ্জাগুলো আবার লক্ষ করছে। সত্যি, অ্যাভ্রো প্লেনটায় পেছনে বহু টাকা ও পরিশ্রম খরচ করেছেন শেষ আবদুল অল হারিদ।

একেই বলে কেতায় থাকা!–রোমিলা মুগ্ধ হয়ে বলল।

আমাদের তেল বেচুক আর না বেচুক, শেখের কখনও টাকার অভাব হবে না।

–মোহন ঠাট্টার হাসি হাসল। তারপর ছোট্ট করে মন্তব্য করল, তেল বেচাটা এই শেখগুলোর শখ!

রওনা হওয়ার আগে আমি শেখ হারিদ সম্বন্ধে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নিয়েছিলাম। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, তার ওপর মধ্য প্রাচ্যে ইদানীং রোজই গোলমাল লেগে রয়েছে। সেইসব খোঁজখবরের ভিত্তিতেই বললাম, শেখ হারিদের সম্পর্কে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে বোঝা যায় হারিদ অন্যান্য শেখের থেকে আলাদা। নিজের কাহূরেইনকে তিনি বেশ কড়া শাসনে রেখেছেন। আর কিছুটা স্বেচ্ছাচারী। শুনেছি রাজ্যের লোকজনদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচারও নাকি করে থাকেন।

সত্যি বলছ?রোমিলা অবাক হয়ে জানতে চাইল। ওর মুখে ভয়ের সংশয় দেখা দিয়েছে। ওকে সাহস দেওয়ার জন্যে বললাম, অবশ্য খবরগুলো পুরোপুরি সত্যি কিনা জানি না–।

কিন্তু রোমিলা ছাড়ল না। বলল, না দাদা, সত্যি করে বলো, খবরগুলো তুমি কোত্থেকে পেয়েছ?

অতএব বাধ্য হয়ে সব খুলে বললাম।

মিডল ইস্টের কয়েকটা খবরের কাগজ আমার হাতে এসেছিল। তাতেই জেনেছি, কাহরেইনকে ঠিক প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য বলা যায় না। গণতন্ত্র সেখানে পুরোপুরি নেই। বরং স্বৈরতন্ত্রই যেন বাসা বেঁধেছে। শেখ হারিদের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে এবং রাজ্যের যে-কোনও মানুষের তিনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

আমার কথা শুনে মোহন খান্না কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এতে নতুন কোনও ব্যাপার নেই, হিতেশ। মিডল ইস্টে এরকম রাজ্য আরও প্রায় একডজন আছে। সবই সেই মোগলাই ব্যাপার।

কিন্তু আমার মনের ভেতরে অন্য একটা কাটা খচখচ করছিল। সে কথাই মোহনকে বললাম, এরকম রাজ্য আরও আছে জানি, কিন্তু শেখ হারিদ-এর কুখ্যাতি সবার চেয়ে বেশি। রাজ্যের কয়েকটা বিদ্রোহ তিনি এমন নৃশংসভাবে দমন করেছেন যে, আমাদের সভ্য সমাজ ভাবতেও শিউরে উঠবে। খবরের কাগজের বক্তব্য হল, অহেতুক নৃশংসতার কোনও দরকার ছিল না। তাতেই মনে হয়, শেখ কিবা তার দলবল হয়তো স্বাভাবিক মেজাজের মানুষ নয়।

মোহন খান্না যৎসামান্য রাজনীতি চর্চা করে। শেখের বিরুদ্ধে আমার অসন্তোষ প্রকাশ পেতেই ও চড়া গলায় বলল, এ-যুগে কোন মানুষটা সুস্থ-স্বাভাবিক মেজাজের বলো দেখি? এ সবই হল কাগজের রিপোর্টারদের মনগড়া অভিযোগ। পৃথিবীর কোনও দেশকে এ-অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে বলতে পারো? হাঙ্গেরি আর চেকোস্লোভাকিয়ায় রাশিয়ার দাপট, তিব্বতের ওপর চিনদেশের অপশাসন, ভিয়েতনামে আমেরিকা আর আলজিয়ার্স-এ ফ্রেঞ্চ অত্যাচার। এমনকী সাইপ্রাসের ওপরে ব্রিটিশের অত্যাচার নিয়েও অভিযোগ তুলেছে রিপোর্টাররা। সুতরাং দোস্ত, কয়েকটা খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ে আমাদের বন্ধু শেখ হারিদকে সমালোচনা কোরো না। তা ছাড়া, সে আমাদের তেল দেবে এটা ভুলে যেয়ো না।

কিন্তু তবুও আমি মোহন খান্নাকে পুরোপুরি সমর্থন করতে পারলাম না। বললাম, হয়তো তোমার কথা ঠিক, মোহন। কিন্তু যখন সমস্ত অত্যাচারের ঘটনাগুলো নিজের দেশেই ঘটে, তখন? আসলে কাহরেইন হল এমন একটা…।

মোহন হাত তুলে আমাকে বাধা দিল : কাহূরেইন-এর শাসনব্যবস্থা নিয়ে তোমার মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই, হিতেশ। তোমার-আমার কাজ হল সস্তায় শেখ হারিদের কাছ থেকে তেল কেনা, ব্যস।

সে যাই হোক, শেখ হারিদের ভদ্রতার তুলনা নেই। আমাদের নেওয়ার জন্যে নিজের প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে।

এ নিয়ে রোমিলা ছ-বার বলল কথাটা।

ফলে আমিও কাহরেইন-এর প্রসঙ্গ পালটে বললাম, যে-প্লেনে আমরা এসেছি তার সঙ্গে এ-প্লেনটার কোনও তুলনা চলে না।

ঠিক বলেছ!–মোহন খান্না হেসে সায় দিল ও ও-প্লেনটার এরকম আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল না।

কথাটা বলে মোহন ইশারায় পাইলট কেবিনের দরজার কাছে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটির দিকে দেখাল। মধ্যপ্রাচ্যের এই রূপসী আমাদের বাতাস-বিনোদিনী। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় আহার-পানীয় ইত্যাদির ব্যবস্থা সে করে গেছে পরম যত্নে। রোমিলা হাজির থাকা সত্ত্বেও মোহন দু-একবার রসাল রসিকতা করতে ছাড়েনি। আমি বরং নিজেকে সামান্য সংযত রেখেছি।

হঠাৎই দেখি বাতাস-বিনোদিনী দু-পাশের সিটের মাঝখানের অলিপথ ধরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ঠোঁটের মধুর হাসিটা যেন কেউ তেহরান থেকেই ওর মুখে তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে।

ওকে আসতে দেখে মোহন শিস দিয়ে উঠল। চাপা গলায় বলল, হিতেশ, তোমার শেখ ভাই যতই নৃশংস হোক, তার পছন্দ আছে।

আমাদের সামনে এসে মেয়েটি মিষ্টি স্বরে ঘোষণা করল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা কাহরেইন-এ নামব। আপনারা দয়া করে সিট বেল্ট বেঁধে নিন, আর সিগারেট নিভিয়ে ফেলুন।

আমি সিগারেট ধরিয়েছিলাম। মেয়েটির কথায় সেটি অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলাম।

ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে সে নিজের সিটে ফিরে গেল। টের পেলাম, প্লেনটা একপাশে কাত হয়ে চক্কর দিয়ে নামতে শুরু করেছে।

.

হিতেশ কাপুর

কাহরেইন দাঁড়িয়ে আছে পার্শিয়ান গালফ আধাআধি পেরিয়ে। উপকূল বরাবর প্রায় দশ মাইল চওড়া এবং বিশাল ইরানের মধ্যে প্রায় বিশ মাইল ঢুকে পড়েছে ছোট এই রাজ্যটি। মাত্র দুশো বর্গমাইল এলাকা হলে কী হবে, এটাই বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জমি। কারণ গোটা দেশটাই ভাসছে তেলের ওপর। অথচ রোদে ঝিলিক তোলা সোনালি বালি দেখে তা বোঝার উপায় নেই।

কাহরেইন-এর রাজধানীর নামও ওই একই। ছোট্ট এয়ারপোর্টটা রাজধানীর পশ্চিম ঘেঁষে। ছোট, তবে নিখুঁতভাবে তৈরি।

দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা আশি ভাগ বসবাস করে রাজধানীতে। অন্য শহরগুলোয় রাজধানীর রমরমা নেই। সেগুলো সত্যিই যেন মরুভূমি। প্লেন থেকে নামতেই একটা কালো এয়ার কন্ডিশন্ড মার্সিডিজ গাড়ি আমাদের তুলে নিল। তারপর হাওয়ার গতিতে ছুটে চলল হারিদের প্রাসাদের দিকে। চলার পথে ড্রাইভার একটিও কথা বলল না।

মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই শেখের প্রাসাদে পৌঁছে গেলাম।

প্রকাণ্ড লোহার গেটের সামনে সশস্ত্র প্রহরা। গেট পেরিয়েই টানা নুড়ি-পথ। তার দু পাশে সবুজ গাছপালা। নুড়ি-পথটা অনেকটা পাহাড়ি রাস্তার মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেছে একটা বড়সড় টিলার ওপরে। সেখানেই বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেখ হারিদের সাদা ধবধবে বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের সামনে দাঁড়ালে চোখে পড়ে তিনদিকের ধূলিমলিন শহরগুলো নীচে, অস্পষ্ট ধোঁয়াশার আস্তরে যেন ঢাকা। আর প্রাসাদের মুখোমুখি গালফ-এর শীতল জল নীল, মাঝে-মাঝে সাদা ফেনার টুকরো। ছোট-ছোট ঢেউ তুলে নীল জলরাশি যেন চঞ্চল খেলায় মেতেছে।

গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল একটা বড় মাপের গাড়িবারান্দা। কেতাবি আরবি পোশাকে এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। রোদ পড়ে তার সাদা আলখাল্লা ঝকঝক করছে। আমাদের কাছাকাছি এসেই ভদ্রলোক নীচু হয়ে অভিবাদন জানালেন।

আমার নাম হাসান, আমি শেখ আবদুল অল হারিদের ব্যক্তিগত সচিব। কারেইন-এ আপনাদের স্বাগত জানাই।

হাসানের কণ্ঠস্বর ভরাট, মার্জিত বেশ সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলার মতো। মুখচোখের রেখা সজীব ও তীক্ষ্ণ। থুতনিতে মিশকালো দাড়ি।

আমার ও মোহনের সঙ্গে করমর্দন করার সময় হাসানের ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটল। তারপর রোমিলার দিকে মনোযোগ দিয়ে তিনি বললেন, এই সুন্দরীর পরিচয় জানতে পারি?

আমার বোন, রোমিলা।আমি সহজ গলায় বললাম। অথচ বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি জাগছিল।

স্বাগতম, মিস রোমিলা। হাসান রোমিলার হাত ধরলেন। তারপর অভিবাদনের ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ে হাতে চুমু খেলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন রোমিলাকে। তার কালো চোখ সম্মোহনের দৃষ্টিতে খেলে বেড়াতে লাগল রোমিলার সুন্দর মুখে।

রোমিলা হঠাৎই লজ্জা পেয়ে হাসল । ধন্যবাদ, মিস্টার হাসান। আমি একরকম জেদ করেই দাদার সঙ্গে এসেছি নতুন দেশ দেখব বলে। দাদা আর মিস্টার খান্না যখন ব্যবসায়িক কাজকর্ম সারবেন, সেই ফাঁকে আমি আপনাদের চমৎকার শহরগুলো দেখে বেড়াব।

আপনার বিদেশ ভ্রমণ নিশ্চয়ই সুখের হবে, মিস রোমিলা।

পরক্ষণেই হাসানের মুখ থেকে বিগলিত ভাবটা মিলিয়ে গেল। ভাবলেশহীন মুখে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে মাপা সুরে তিনি বললেন, আমাদের মাননীয় শেখের ইচ্ছে যে, কাহরেইন এ থাকাকালীন আপনারা তার প্রাসাদেই আতিথ্য গ্রহণ করেন।

কিন্তু আমি তো শুধু বেড়াতে এসেছি!–রোমিলা আপত্তি জানিয়ে বলল। তারপর আমার দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল, কী হল, তোমরাও কিছু বলো!

আমি ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে গেলাম, কিন্তু হাসান যেন রোমিলা বা আমার কথা শুনতেই পাননি। তিনি তখন শান্ত সুরে যান্ত্রিকভাবে বলে চলেছেন, যদি আপনারা মাননীয় শেখের আতিথ্য-আপ্যায়ন প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হবেন। অতএব আসুন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই। সঙ্গে নিয়ে আসা মালপত্রের জন্যে চিন্তা করবেন না। সেগুলো আপনাদের আগেই নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে যাবে।

হাসানের কথার সুরে ও ভঙ্গিতে এমন কিছু একটা ছিল যে, আমি বা মোহন কেউই তাঁর অনুরোধ বা আদেশের প্রতিবাদ করতে পারলাম না। আমরা তিনজনেই হাসানকে অনুসরণ করলাম।

প্রাসাদের ভেতরটা স্নিগ্ধ শান্ত। সাদা রং ছাড়া অন্য কোনও রং কোথাও নেই। কেন জানি না আমার তাজমহলের কথা মনে পড়ে গেল।

মার্বেল পাথরের মেঝেতে আমাদের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিভিন্ন দিকের দেওয়াল থেকে। অস্বাভাবিকরকম চওড়া অলিন্দ ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। মাথার অনেক ওপরে নকশাদার কারুকাজ করা সিলিং। কিছুদূর পরপরই সিলিং থেকে ঝুলে রয়েছে কাটগ্লাসের ঝকমকে ঝাড়লণ্ঠন। ডানদিকের দেওয়ালে সাজানো রয়েছে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা নানারকম অয়েল পেইন্টিং। আর বাঁদিকে একটানা ঘরের মিছিল। আমরা একের পর এক কালচে কাঠের নকশা কাটা দরজা পার হয়ে চলেছি। পর-পর দুটো দরজার মধ্যেকার দূরত্ব দেখে বোঝা যায় ঘরগুলো আকারে বিশাল। দুটো দরজার মাঝের ফাঁকা দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে নানা ধরনের শিল্পসামগ্রী।

পাশাপাশি তিনটে ঘরে আমাদের স্থান দিলেন হাসান।

প্রতিটি ঘরের আকার-প্রকার ও সাজসজ্জা যে-কোনও পাঁচতারা হোটেলকেও লজ্জা দেবে। অবশ্য ঘর না বলে সেটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ফ্ল্যাট বলাই ভালো।

আমি হতবাক হয়ে ঘরের সৌন্দর্য দেখতে লাগলাম। মনে পড়ল, প্লেনে বসে রোমিলাও ঠিক এইরকম অবাক হয়েছিল।

একটু পরেই মোহন আর রোমিলা আমার ঘরে এল। ওরা জামাকাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসেছে। ওদের দেখে আমি হেসে মন্তব্য করলাম, এই যদি শেখের অতিথিশালা হয় তাহলে শেখ নিজে যে-ঘরে থাকেন তার জাঁকজমক কীরকম কে জানে!

মোহন বলল, তুমি যতই খুঁতখুঁত করো না কেন, আমার কিন্তু এখানে বেশ লাগছে। হোটেলে এই আরাম পাওয়া যেত না।

সে তুমি ঠিকই বলেছ।আমিও মোহনের সঙ্গে একমত হলাম।

রোমিলা এখন আবার খুশি হয়ে উঠেছে। ও বলল, দাদা, আমি শুধু ভাবছি কোন ড্রেসটা পরে শেখের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

রোমিলা খুশি হয়েছে কারণ হাসান যাওয়ার সময়ে ওকে বলে গেছেন, মিস্টার কাপুর ও মিস্টার খান্না যখন মাননীয় শেখের সঙ্গে পরিচয় করতে যাবেন, তখন আপনিও অবশ্যই আসবেন, মিস রোমিলা।

রোমিলা খুশিতে ফুটছে। বলল, ও, বাড়ি ফিরে গিয়ে বন্ধুদের সব গল্প শোনাতে আমার আর তর সইছে না!

মোহন গম্ভীরভাবে বলল, সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কে না আলাপ করতে চায়! শেখ তো তার ব্যতিক্রম নয়।

আমি বললাম, ধ্যুৎ, শেখদের সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে আমাদের হারিদ সাহেবের হয়তো একটা গোটা হারেমই রয়েছে। এতগুলো মেয়ে একটা পুরুষ কখনও সামলাতে পারে!

মোহন খান্না বিজ্ঞের মতো বারদুয়েক ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, যাই বলো ভাই, এই হারিদ লোকটার রুচি আছে।

রোমিলা বলল, আমি যাই। চটপট বেছে ফেলি কোন ড্রেসটা পরে শেখের দরবারে যাব।

ও চলে যেতেই মোহন আমাকে লক্ষ করে চোখ টিপল। বলল, হিতেশবাবু, বলা যায় না, শেখ হয়তো তার হারেম থেকে দুজন রূপসীকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে রাতে সেবা করার জন্যে।

আমি ওর কাঁধে এক থাপ্পড় মেরে বললাম, তোমার সবসময় খালি এক চিন্তা।

আমার মনের ভেতরে একটা অস্বস্তির কাটা খচখচ করতে লাগল। কারণ, হাসানের নজর আমার একটুও ভালো লাগেনি। মোহনকে অবশ্য সে কথা বললাম না। আর বললেও ও সেটা হেসে উড়িয়ে দিত।

.

শেখ আবদুল হারিদের চেহারা বেঁটে, মোটা। চোখ দুটো কুতকুতে। থুতনিতে চুঁচলো দাড়ি। তার ধারালো নজরের সামনে রোমিলা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল। বিশেষ করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর শেখসাহেব যখন ওর হাত তুলে চুমু খেলেন।

এ সত্যিই আমার মহা সৌভাগ্য, মিস কাপুর।–শেখের কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল হাসানের ভদ্রতা ও মোলায়েম ভাব। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস্টার কাপুর, আপনার বোন অপরূপ সুন্দরী। সামান্য হাসলেন শেখ হারিদ : এখান থেকে খুব কাছেই আমার চেনা কয়েকজন উপজাতির সর্দার আছে যারা মিস কাপুরের বিনিময়ে অসংখ্য ছাগল দেবে। অবশ্য আমার ধারণা, উনি বিক্রির জন্যে নন।

শেখের কথায় ঠাট্টার সুর থাকলেও আমার কেমন খারাপ লাগল। মনে হল, তিনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। কিন্তু কোনও এক শঙ্কায় আমি নিজের উত্তেজনা সামলে নিয়ে ঠাট্টার মেজাজেই বললাম, রোমিলার বদলে আমি যদি একপাল ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরি তা হলে আমার বন্ধু বান্ধব-আত্মীয়রা ছেড়ে কথা বলবে না। তারপর গলা নামিয়ে বললাম, তা ছাড়া স্যার, আপনাদের এদিকটায় ছাগলের সংখ্যাই বোধহয় বেশি, তাই না!

আমার কথায় ব্যঙ্গের খোঁচাটা শেখ হারিদ বুঝতে পারলেন কিনা জানি না, তবে তার মেজাজটা বেশ গম্ভীর হয়ে গেল।

হারিদ বললেন, আমার দেশ আর আপনাদের দেশের মধ্যে অনেক ফারাক আছে। রাীতি নীতি, আদব-কায়দা, আইন-কানুন, সবাই আলাদা। বিংশ শতাব্দী অনেক এগিয়ে গেছে। সভ্যতাও থেমে নেই। অথচ কারেইন-এ আমরা আমাদের পুরোনো রীতি আর ঐতিহ্যের অনেকটাই এখনও ধরে রেখেছি। অবশ্য সভ্যতার অগ্রগতির সুফলগুলো আমরা এখানেও বেশ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করি।

শেখ কথা থামিয়ে আমাদের তিনজনের ওপর নজর বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, একমাত্র আল্লা ছাড়া আমাদের সবচেয়ে পবিত্র ঐতিহ্য হল আমন্ত্রিত অতিথির সেবা। আপনারা তো এখানে কয়েকদিন আছেন, আশা করি আমার অতিথিসেবার আন্তরিকতা ও নিদর্শন প্রমাণ করার সময় আমি পাব।

মোহন তাকে আশ্বস্ত করে বলল, আপনার আতিথেয়তা আর উদারতার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি, স্যার।

মোহনের কথায় হারিদ যেন সত্যিই খুশি হলেন। বললেন, শুনে আনন্দিত হলাম, মিস্টার খান্না, বড়ই আনন্দিত হলাম। আচ্ছা, এবারে আমাকে বিদায় নেওয়ার অনুমতি দিন। আগামীকাল সকালে, আমাদের ব্যাবসায়িক আলোচনা শুরুর আগে, আমার এই নগণ্য প্রাসাদের

কথাটা বলেই শেখ হারিদ ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে রোমিলার দিকে তাকালেন।

আমি দুঃখিত, মিস রোমিলা, আপনাকে আমাদের সঙ্গে নিতে পারব না। কারণ আমাদের রীতি অনুসারে প্রাসাদের বেশিরভাগ অংশই স্ত্রীলোকের কাছে নিষিদ্ধ।–শেখ হারিদ হাসলেন : বুঝতেই পারছেন, নারী প্রগতি আপনাদের দেশে যতটুকু এগিয়েছে আমাদের এখানে তার লক্ষ ভাগের এক ভাগও এগোয়নি। কোনওদিন আদৌ এগোবে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে পরশুদিন আপনার সম্মানার্থে আমি নৈশভোজের আয়োজন করেছি। আপনি সে-অনুষ্ঠানে দয়া করে যোগ দিলে আমি যথেষ্ট সম্মানিত বোধ করব। আপনি আমার দেশে নিছকই বেড়াতে এসেছেন। সে কথা চিন্তা করে আমি একটা গাড়ি আপনার ব্যবহারের জন্যে দিচ্ছি। যদি চান ড্রাইভারও থাকবে গাড়িতে। গাড়ি নিয়ে আমার এই ছোট রাজ্যে যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারেন। সোজা কথায়, এটাকে আপনি নিজের দেশ মনে করলেই আমি আন্তরিক খুশি হব। এবারে আমাকে অনুগ্রহ করে বিদায় দিন।

রাজসভা ভঙ্গ হল।

.

 রোমিলা কাপুর

ঘড়িতে এখনও নটা বাজেনি, অথচ সূর্যের তাপ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই। জোরালো আলোয় চিকচিক করছে পার্শিয়ান গালফ-এর পুঁতে রং জলের ঢেউ। জলের পাশ ঘেঁষে পিচের রাস্তা চলে গেছে আবাদানের দিকে। রাস্তা সামান্য উঁচু-নীচু। যেন এখানেও পার্শিয়ান গালফ-এর ঢেউয়ের ছোঁয়া লেগেছে।

কাহরেইন ও তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে একটা টুকটুকে লাল রঙের আলফা স্পোর্টস কার আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন শেখ হারিদ। আর তার বিশ্বস্ত অনুচর হাসান আমাকে উপহার দিয়েছেন কাহরেইন ও ইরানের রোড ম্যাপ। সেটা দেওয়ার সময় হেসে বলেছেন, যদি পথ ভুলে কোথাও হারিয়ে যান তাই এটা সঙ্গে দিলাম। বিপদে কাজে লাগতে পারে।

শেখ হারিদের অতিথিসেবায় হয়তো কোনও ত্রুটি নেই, কিন্তু তবুও আমি যেন স্বস্তি পাচ্ছি না। কোথায় যেন একটা সংশয়ের কাঁটা বিঁধে রয়েছে।

শেখ ড্রাইভার সঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি রাজি হইনি। কারণ আমি গাড়ি চালাতে জানি। তবে বিদেশি গাড়ি কখনও চালাইনি। তাই শেখকে অনুরোধ করলাম, ড্রাইভারকে উনি যেন নির্দেশ দেন আলফা চালানোর নিয়মকানুনগুলো আমাকে একটু শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে।

শেখ হাসলেন আমার কথায়। কিছুটা চতুর সে-হাসি। মুখে বললেন, যথা আজ্ঞা। সুন্দরীদের অনুরোধ রাখতে পারলে আমি খুশি হই!

তারপর দূরে দাঁড়ানো একজন রক্ষীকে ইশারা করলেন।

দাদা ও মোহনদা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের মুখে কেমন এক সতর্ক অভিব্যক্তি। কিছুতেই যেন সহজ হতে পারছে না। ওরা শেখের সঙ্গে চলে গেল মিটিং-এ বসবে বলে। যাওয়ার আগে শেখ বলে গেলেন, আপনার ভ্রমণ সুখের হোক, মিস কাপুর।

একটু পরেই সুপুরুষ চেহারার একজন যুবক এসে আমাকে আলফা চালানোর টুকটাক তালিম দিল। তারপর হেসে বিদায় নিল। এবং আমিও রওনা হলাম।

রওনা হওয়ার আগে একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম, গাড়িটার কোনও নাম্বার প্লেট নেই। তার বদলে সামনে ও পেছনে আঁকা রয়েছে দুটি রাজকীয় প্রতীকচিহ্ন।

দিলখুশ মেজাজে উদ্দাম বেগে গাড়ি ছুটিয়ে চলেছি। চুল উড়ে এসে পড়ছে নাকে, মুখে, চোখে। ড্রাইভারজাতীয় একটা অজানা-অচেনা লোক থাকলে হয়তো মন খোলসা করে ঘোরাঘুরি করতে পারতাম না।

এখানে এসে থেকেই মনে হচ্ছে আমার মনের সমস্ত ধোঁয়া আর কুয়াশা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। মা-বাবাকে হারিয়ে যে-দুঃসহ দুঃখটা বুকের মধ্যে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসেছিল, সেটা যেন কোনও জাদুকর হালকা করে দিয়েছে। দেশে ফিরে বন্ধুদের যে কতরকম গল্প কতদিন ধরে শোনাব তা ভাবতেও বেশ রোমাঞ্চ জাগছে।

রাস্তা থেকে উপকূলের কিনারা এখন আর চোখে পড়ছে না। দু-ধারেই ছোট-বড় গা ঘেঁষাঘেঁষি ঘরবাড়ি। আর থেকে-থেকেই চুড়াওয়ালা মসজিদ দেখতে পাচ্ছি। দাদার কাছে শুনেছি, এখানকার শতকরা নিরানব্বইজন মানুষই মুসলিম।

হঠাৎ সামনে একটা জটলা চোখে পড়ায় আমাকে ব্রেক কষতে হল। শব্দ করে নিশ্চল হল আলফার চাকা। একদল মানুষ নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় মত্ত। অন্তত তাদের হাত-পা নাড়া দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে।

আরও একটু লক্ষ করে যা বুঝলাম, একজন লোক কাঁধে করে কার্পেট ফিরি করছিল, তার সঙ্গেই দরাদরি অথবা অন্য কোনও কারণে কোনও খদ্দেরের ঝগড়া বেঁধেছে।

প্রথমে লোকগুলো আমার গাড়িটাকে ভ্রূক্ষেপ করেনি। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে ঝগড়াতেই ব্যস্ত। কিন্তু হঠাৎই একটি অল্পবয়েসি মেয়ে আঙুল তুলে আমার গাড়ির দিকে দেখাল। না, ঠিক গাড়ির দিকে নয়। বরং বলা যায় গাড়ির বনেটের ওপরে আঁকা রাজকীয় চিহ্নটার দিকে দেখাল।

চিহ্নটার দিকে অন্য সকলের চোখ পড়ামাত্রই মন্ত্রের মতো কাজ হল। নগ্ন আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মেয়ে-পুরুষের মুখে। তারা ঝগড়া থামিয়ে তড়িৎস্পৃষ্টের মতো পথ ছেড়ে ছিটকে গেল দু-পাশে।

আমি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলাম। বুঝলাম, শেখ হারিদকে তার প্রজারা অস্বাভাবিক ভয় করে। তা হলে কি প্লেনে আসতে-আসতে শেখ হারিদ ও কাহরেইন সম্পর্কে দাদা যে কথাগুলো বলছিল সেগুলো সব অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি?

হঠাৎই একটা নাম-না-জানা ভয় আমাকে পেয়ে বসল, আর তখনই টের পেলাম একটা গাড়ি আমাকে অনুসরণ করছে।

গাড়িটার রং আকাশি। চেহারা অনেকটা বেঁটেখাটো ভ্যানের মতো। উইন্ডশিল্ডের কাচটা সাধারণ স্বচ্ছ কাচ নয়–সানগ্লাসের মতো কালচে। কাচের পেছনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত সূর্যের প্রতিবিম্ব ঠিকরে পড়েছে উইন্ডশিল্ড থেকে।

গাড়িটা আমি রিয়ারভিউ মিরারে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাইনি পেছনে। এই রাস্তাটার গাড়ির সংখ্যা এমনিতে খুব বেশি নয়। সেইজন্যেই আকাশি ভ্যানটাকে আমি এত অল্প সময়ে সন্দেহ করতে পেরেছি। শেখ হারিদ তা হলে আমাকে একা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। ভয়ের সঙ্গে-সঙ্গে বিরক্তি ছাপ ফেলল আমার মনে। অ্যাক্সিলারেটারে চাপ দিয়ে আলফার গতি বাড়িয়ে দিলাম আচমকা।

রাস্তার অলিগলি পেরিয়ে একটা জমজমাট জায়গায় এসে পৌঁছলাম। গাড়ি থামালাম রাস্তার ধার ঘেঁষে। তারপর গাড়ি থেকে নামলাম।

জায়গাটা মনে হয় মার্কেটজাতীয় কিছু হবে। বিভিন্ন দোকানপাট-ফিরিওয়ালায় গিজগিজ করছে। ক্রেতা ও বিক্রেতার ভিড় দেখলে তাক লেগে যায়।

হঠাৎ আকাশি ভ্যানটার কথা খেয়াল হতেই পেছনে তাকালাম। আশ্চর্য! গাড়িটা সামান্য

দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ রাগ হল এবার। মন খুলে বেড়াতেও পারব না এদেশে! কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে দ্রুত পা পেলে ভ্যানটার কাছে গেলাম।

জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দুজন মানুষের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল। ঠান্ডা নিরুত্তাপ ওদের দৃষ্টি। আমাকে দেখে এতটুকু বিচলিত হল না ওরা।

কী মতলবে ফলো করছেন আমাকে?

এক সেকেন্ড দুজনে-দুজনের দিকে তাকাল। তারপর স্টিয়ারিংয়ে বসা লোকটি ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে যা বলল তার অর্থ হল, ওরা শেখ হারিদের লোক। ওরা আমাকে অনুসরণ করছে না, বরং আমার যাতে কোথাও কোনও অসুবিধে না হয় সেদিকে নজর রাখছে। সোজা কথায় দেহরক্ষী। এর কারণ আমি শেখ হারিদের অতিথি, অর্থাৎ ভি. আই. পি।

বুঝলাম, ভুমিকা ওদের যাই হোক উদ্দেশ্য ওদের একটাই–আমাকে নজরে-নজরে রাখা। ঠিক করলাম, যে করে হোক লেজ থেকে এদের ছাড়াবই। সুতরাং ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।

বাজারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চারপাশে দেখছিলাম।

পাথরের টুকরো দিয়ে গড়া বড়-বড় বাড়ি। কোনও-কোনও বাড়ির সামনে গাড়িবারান্দা। তার নীচেও বাজার বসে গেছে। বিক্রি হচ্ছে শুকনো ফল, সিগারেট, কার্পেট, খোদাই করা কাঠের কাজ, পেতলের কারুকাজ, নকশাছাপা কাপড়, আখরোট, আঙুর, বাদাম, আরও কত কী।

মুগ্ধ চোখে কতক্ষণ সব দেখছিলাম জানি না, হঠাৎই একটা মাঝবয়েসি লোক অসভ্যের মতো আমাকে ধাক্কা দিয়ে গা ছুঁয়ে গেল। আমি রেগে উঠে লোকটাকে ডেকে দুটো কড়া কথা বলতেই বিপদ হল। একগাদা লোক আমাকে ঘিরে ধরল। ওদের ভাষা আমি একটুও বুঝতে পারছি না। আর ওরা যে আমার কথা বুঝতে পারছে তাও মনে হল না।

অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছি, এমন সময় সুপুরুষ চেহারার একজন যুবক ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। না, সে আমার দেহরক্ষী নয়। আমার দেহরক্ষীরা এখন হয়তো গাড়িতে বসে হাই তুলছে আর মাছি মারছে।

যুবকটি অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ভিড় সরাতে লাগল। আর দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড, মিস! তারপর দেশজ ভাষায় ভিড় করা লোকজনকে কীসব বলে নিরুৎসাহ করতে লাগল। মিনিটকয়েক ধরে চলল তার অনর্গল কথা, দ্রুত হাত-পা নাড়া, তারপর একসময় লক্ষ করলাম জীবনযাত্রা আবার স্বাভাবিক। আর ঘটনাস্থলে আমি ও অচেনা যুবক দুজনে একা।

আপনি আমাদের দেশে নতুন মনে হচ্ছে?–যুবক বিশুদ্ধ ইংরেজিতে প্রশ্ন করল। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলল, আমার নাম ইলিয়াস মহম্মদ ইলিয়াস।

আমি ওর প্রশ্নের জবাবে ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে, আমি এদেশে নতুন। এবং ও নাম বলার পর ভদ্রতাবশত নিজের নামটা বললাম। সেইসঙ্গে ধন্যবাদও জানালাম ওকে।

ইলিয়াস বলল, ধন্যবাদের দরকার নেই। আসলে বিদেশি কেউ এলেই প্রথম-প্রথম এ জাতীয় অসুবিধেয় পড়তে হয়।

ইলিয়াসের গায়ের রং উজ্জ্বল সাদা। মাথায় কুচকুচে কালো ঢেউখেলানো চুল। প্রাণবন্ত কালো চোখের তারা। সুচারুভাবে তৈরি চওড়া পেন্সিল গোঁফ। দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো, তবে ফরসা গাল ও চোয়ালে নীলচে আভা। এছাড়া নাক-মুখ চোখের রেখা ধারাল।

সুদর্শন এই মানুষটার গায়ে লাল-নীল আড়াআড়ি ডোরা কাটা ব্যানলনের টি-শার্ট আর তার সঙ্গে মানানসই কর্ডের কালো প্যান্ট।

প্রখর রোদ আমাদের ঝলসে দিচ্ছিল। সামান্য ইতস্তত করে আমি বললাম, একটা ছায়া দেখে আশ্রয় নিলে হয় না?

ইলিয়াস দমফাটা হাসি হেসে উঠল হাটের মাঝে দাঁড়িয়ে।

ওর সুন্দর মুখ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। তারপর একসময় হাসি থামিয়ে চোখের কোণে জল মুছে বলল, দেখেছেন, আমি কী বোকা! আপনি আমার দেশে অতিথি। কোথায় আপনাকে আপ্যায়ন করব তা না, রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আসুন, ওই রেস্তোরাঁটায় ঢোকা যাক– অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

ইলিয়াস আঙুল তুলে কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁর দিকে দেখাল। আমি ক্ষণিকের দ্বিধা কাটিয়ে ওর অনুরোধে রাজি হলাম। এবং দুজনে এগিয়ে চললাম সেদিকে।

আমার মনের মধ্যে খুশির জলতরঙ্গ বাজছিল। মনে হচ্ছিল, ভারতের রোমিলার সঙ্গে এ-রোমিলার কোনও সম্পর্ক নেই। রেশমি খোলস কেটে গুটিপোকা যেন বেরিয়ে এসেছে। দাদা আর মোহনদা যেন দুই দেবদূত। পলকে মিলিয়ে দিয়েছে আমার মুক্তির ছাড়পত্র। তবু এত আনন্দের মধ্যেও শেখ হারিদের মিছরি মাখা আচরণ কেন জানি না সন্দেহের খোঁচা দিয়ে চলেছে ক্রমাগত।

রেস্তোরাঁর নাম কারনামা। সাজগোজে তার কোনও ত্রুটি নেই। বিশাল কাচের দরজায় আলপনা আঁকা। ভেতরটা আধুনিকভাবে, অনেকটা পাশ্চাত্য রীতিতে, সাজানো।

রেস্তোরাঁর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাতাস যেন চোখেমুখে ঠান্ডা চুম্বন এঁকে দিল। বাইরের গরম ও চোখে ধাঁধানো রোদ্দুরের পর ভেতরে ছায়াময় শীতল পরিবেশ এককথায় মরুভূমির মরূদ্যান।

কারুকাজ করা স্বচ্ছ পরদা ঝোলানো একটা বড় কাচের জানলার পাশে একটা টেবিল বেছে নিল ইলিয়াস। আমরা দুজনে মুখোমুখি বসলাম।

ইলিয়াস বলল, শুধু আমার নামটাই আপনাকে বলেছি, মিস কাপুর। একজন অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে শুধু নামটুকু বোধহয় যথেষ্ট নয়। আসলে আমি একজন। রিপোর্টার । এখানে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ আছে, তার জন্যে খবর জোগাড় করি। এই যে আমি হাটের মাঝে ঘুরছিলাম, তাও খবরের খোঁজে। এখন এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, সেটাও হয়তো আগামী সংখ্যায় ছাপা হয়ে যাবে বিশাল হেডিং দিয়ে ও ভারতীয় তরুণীর চোখে কাহরেইন। সুতরাং রেস্তোরাঁর আপ্যায়নের বিল যদি আমি মেটাই তাহলে আর ওজর আপত্তি তুলবেন না। ধরে নিন, আপনার ইন্টরভিউ নেওয়ার জন্যে আমি এত কসরত করছি।

আমি হেসে বললাম, আপনার কথায় আপত্তি করব সে মনের জোর আমার নেই। কারণ, যে-বিপদ থেকে একবার বাঁচিয়েছেন।

ইলিয়াস হাতের ভঙ্গি করে বলতে চাইল, ও কিছু নয়।

ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। মেনু কার্ড দেখে অর্ডার দিল ইলিয়াস। তারপর বলল, মিস কাপুর, এখান থেকে আর মাইলপাঁচেক পার হলেই আপনি কারেইন-এর সীমা ছাড়িয়ে ইরানে পা দেবেন। কাহূরেইন আসলে ইরানেরই অংশ, তবে এর শাসনব্যবস্থা স্বতন্ত্র।

দাদার কথাগুলো মনে পড়ল আমার। ইলিয়াস যখন রিপোর্টার তখন ও নিশ্চয়ই শেখ আবদুল অল হারিদ সম্পর্কে অনেক খবরই রাখে। তাই বললাম, আপনাদের কারেইন-এর রাজা শুনেছি সাঙ্ঘাতিক লোক!

স্পষ্ট লক্ষ করলাম, ইলিয়াস চমকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। তারপর থেমে-থেমে বলল, আপনি কোত্থেকে এ-খবর শুনলেন?

তখনই আমার খেয়াল হল, ইলিয়াসকে শুধু নামটা ছাড়া আর কোনও কথাই বলিনি আমি। অবশ্য ইলিয়াসও জানতে চায়নি। এখন প্রসঙ্গ ওঠায় ওকে বললাম, আমি বর্তমানে আপনাদের শেখসাহেবের গেস্ট, তারপর সংক্ষেপে সব খুলে জানালাম।

ওর নিষ্পাপ সুন্দর মুখ দেখে কেন যেন আমার মনে হল ওকে অকপটে সব খুলে বলা যায়। অনুসরণকারী আকাশি ভ্যানটার কথাও ওকে বললাম।

আমার কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেল ইলিয়াস। ফিনফিনে পরদাটা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। খুব গভীরভাবে কী যেন ভাবছে ও। ঠিকরে আসা আলোর ছটায় ওর চোখ চিকচিক করতে লাগল।

এমন সময় বেয়ারা এসে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল।

ইলিয়াস ঘোর কাটিয়ে সচেতন হল। তারপর অমলিন হাসি হাসল। বলল, ওসব কথা এখন থাক। লেট আস এনজয় দ্য মিল!

আমি সামান্য বিব্রত হয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও কথা বললাম না দুজনে। তারপর ইলিয়াস বলল, আপনাকে শেষে একটা দারুণ জিনিস খাওয়াই।

কী জিনিস?

খেয়েই দেখুন না–

ও বেয়ারাকে ডেকে স্বদেশি ভাষায় কী যেন বলল। বেয়ারা চলে গেল। তারপর আমাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করল, আপনারা শেখের ওখানে কতদিন আছেন?

জানি না, দাদার মিটিং যতদিন চলবে। তবে মনে হয়, সাত-দশ দিনের বেশি লাগবে না।

হতাশভাবে মাথা নাড়ল ইলিয়াস। বলল, সাত-দশ দিনে কি ইরান দেখা শেষ হবে? অন্তত দিনকুড়ি তো লাগবেই।

কেন, আপনি আমাকে ইরান ঘুরিয়ে দেখাবেন নাকি?

দেখাল ক্ষতি কী, মিস কাপুর! ইলিয়াস মুগ্ধ করা হাসি হাসল : ইরান আমার দেশ। আমার জন্ম তাবরিজ-এ। তেহরান-এর তুলনায় তাবরিজ অনেক ছোট শহর, কিন্তু আমার বড় প্রিয়। জানেন, তাবরিজ-এর খুব কাছেই রয়েছে উরমিয়া লেক! ইরানের সবচেয়ে বড় হ্রদ। আর তার ঠিক উলটোদিকে দুশো মাইলটাক পুবে রয়েছে বিখ্যাত কাস্পিয়ান সাগর। দেখলে আপনার তাক লেগে যেত।

বেয়ারা সুদৃশ্য কারুকাজ করা দুটো লম্বা ধাতব গ্লাস টেবিলে রেখে গেল। গ্লাসে উষ্ণ তরল রয়েছে।

আমি অবাক চোখে ইলিয়াসের দিকে তাকাতেই ও একটা গ্লাসে আমেজ-ভরা চুমুক দিল। তারপর দ্বিতীয় গ্লাসটা ইশারায় দেখিয়ে বলল, নিন, চুমুক দিন। এর নাম সবুজ চা, গ্রিন টি। মধ্যপ্রাচ্যে এই জিনিসটার দারুণ চল রয়েছে। আপনাদের ভারতে এটা তেমন জনপ্রিয় নয় বলেই শুনেছি।

আমি গ্লাসে চুমুক দিয়ে মাথা নেড়ে জানালাম যে, ও ঠিকই শুনেছে।

সবুজ চা শেষ করার পর ইলিয়াস বলল, নিন, এবারে বলুন, কাহরেইন কেমন লাগছে? আমি কিন্তু ইন্টারভিউটা সত্যিই নিচ্ছি…সিরিয়াসলি।

আমি থেমে-থেমে নিজের টুকরো মতামত জানালাম কাহরেইন সম্পর্কে। প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডায়েরি আর পেন বের করে কীসব টুকে নিতে লাগল ইলিয়াস। আর মাঝে মাঝে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

আমি বললাম, কী ব্যাপার, হাসছেন কেন?

ও হাসতে হাসতে বলল, আমি ভাবছি আমার খুশ নসীবের কথা। কত সহজে হাজার হাজার মাইল দূরের এক বিদেশিনীর ইন্টারভিউ পেয়ে যাচ্ছি। অন্যান্য রিপোর্টার বহু কাঠখড় পুড়িয়েও কোনও ভারতীয়ের ইন্টারভিউ জোগাড় করতে পারে না।

ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর ইলিয়াস বলল, চলুন এবারে ওঠা যাক।

ও ইশারায় বেয়ারাকে ডাকল। বলল বিল নিয়ে আসতে।

বিল এলে পর টাকা মিটিয়ে দিয়ে ইলিয়াস আমাকে জিগ্যেস করল, বলুন তো, এখানে কারেন্সির নাম কী?

তক্ষুনি আমার মনে পড়ল, ঘুরে বেড়ানো বা কেনাকাটার জন্যে কোনও টাকাপয়সা নিয়ে বেরোতে আমি ভুলে গেছি। তেহরান এয়ারপোর্টেই আমরা ভারত থেকে আনা মার্কিন ডলার ভাঙিয়ে ইরানি টাকা নিয়েছিলাম, কিন্তু এখন টাকা তো আনিনি, উপরন্তু তার নামটিও মনে করতে পারছি না। সে-কথা ইলিয়াসকে বলতেই ও হেসে বলল রিয়াল।–একটু থেমে আরও যোগ করল? তবে এখানে বহু দোকানেই মার্কিন ডলার নেয়। ও বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি তেমন নেই।

কারনামা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা।

প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইলিয়াস আমার পাশে-পাশে হাঁটছে। ধুলো উড়ছে রাস্তায়। কাছে-দূরের মসজিদ থেকে আজান শোনা গেল।

ইলিয়াস বলল, আপনার ফেরার তাড়া আছে? না থাকলে আশপাশটা একটু ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।

আমি হেসে বললাম, সেরকম কোনও তাড়া নেই। তা ছাড়া আমি তো দেশ দেখতেই বেরিয়েছি। আর আপনার মতো গাইড পেলে তো বর্তে যাব।

ইলিয়াস গলা নামিয়ে বলল, সো কাইন্ড অফ ইউ।

তারপর ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম দুজনে।

স্থানীয় লোকজন, তাদের জীবনযাত্রা, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি বহু ইতিহাসই শোনাল ইলিয়াস। সেইসঙ্গে শোনাল ওর নিজের কথা। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর ও ফিরে যায় তাবরিজ-এ। সেখানে ওর মা-বাবা দুজনেই অল্পদিনের ব্যবধানে মারা যায়। মা অসুখে, আর বাবা সন্ত্রাসবাদী ঘটনায়। তখন ইলিয়াস দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ভারী মন নিয়ে। ওর সঙ্গে ছোট দু-বোন। বড় বোন আলেয়া আর ছোট নাজমা। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একসময় ওরা এসে পড়ে কাহূরেইন-এ। ইলিয়াস চাকরি নেয় খবরের কাগজে। তখন থেকে ওরা তিনজনে এখানকারই বাসিন্দা।

বেলা ক্রমশ পড়ে আসতে লাগল। ইলিয়াস একটা দোকান থেকে আঙুরের শরবত খাওয়াল আমাকে। তারপর কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে চললাম আমার আলফা স্পোর্টস-এর দিকে।

গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি আকাশি ভ্যানটা ঠিক একইভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইলিয়াস অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল ভ্যানটার দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, সাবধানে থাকবেন, মিস কাপুর। শেখ হারিদ লোকটা স্যাডিস্ট। এ-দেশ ছেড়ে আমি কবে চলে যেতাম…কিন্তু এখন জড়িয়ে পড়েছি…আর ফেরার উপায় নেই।

একটা বাচ্চা ছেলে ঘুরে-ঘুরে গোলাপের তোড়া ফেরি করছিল। ইলিয়াস তাকে কাছে ডাকল। একটা ছোট গোলাপের তোড়া কিনে আলতো করে তুলে দিল আমার হাতে। বলল, টেক কেয়ার। যদি সম্ভব হয় তাহলে আল্লার কাছে প্রার্থনা করি এই গোলাপের গুচ্ছ সমস্ত বিপদ থেকে আপনাকে রক্ষা করুক।

আমি গাড়িতে উঠে বসতে যাচ্ছি, ইলিয়াস বলল, আবার আমাদের দেখা হবে এই আশা পোষণ করার মতো স্পর্ধা কি আমি দেখাতে পারি, মিস কাপুর?

আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ পারেন। কাল সকাল নটায় আবার আমাদের এখানেই দেখা হবে।

শুক্রিয়া। ইলিয়াস হেসে হাত নাড়ল ও ইন্টারভিটা ভালো করে লিখে কাল আপনাকে শোনাব।

বাই অল মিনস। বলে আমি গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। গোলাপের তোড়াটা নাকের কাছে নিয়ে বারকয়েক ঘ্রাণ নিলাম। তারপর গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ইলিয়াসের সুন্দর মুখটা উইন্ডশিল্ড এর ওপরে ভাসতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরেই লক্ষ করলাম, আকাশি ভ্যানটা। যথারীতি আবার আমার পিছু নিয়েছে।

ঠিক করলাম, প্রাসাদে ফিরে দাদা বা মোহনদাকে অনুসরণকারী ভ্যানটার কথা বলব না। বললে হয়তো মিছিমিছিই আশঙ্কায় ভুগবে।

আর ইলিয়াসের কথা? ওর কথা খুব বেশি বলে ফেললে দাদা নিশ্চয়ই আমাকে আজেবাজে ঠাট্টা করে খ্যাপাবে। তার চেয়ে কিছু না বলাই ভালো।

বাতাস চিরে লাল আলফা স্পোর্টস ছুটে চলেছে, আর আমার বুকের ভেতরে কাল সকাল নটার ঘণ্টা বাজছে : ঢং.ঢং…ঢং!

.

হিতেশ কাপুর

সকালে রোমিলা গাড়ি নিয়ে কারেইন দেখতে বেরোল। আর আমি ও মোহন খান্না গেলাম শেখ হারিদের দরবারে।

আমাদের অবাক করে দিয়ে শেখ হারিদ বললেন, আমি নিজেই আপনাদের প্রাসাদ ঘুরিয়ে দেখাব। আপনারা আমার গুরুত্বপূর্ণ অতিথি।

আমরা শেখকে অনুসরণ করলাম। আমাদের ঠিক পেছনেই বিশ্বস্ত সচিব হাসান। এবং কিছুটা দূরত্ব রেখে আমাদের সঙ্গী হয়েছে চারজন সশস্ত্র রক্ষী।

শিল্পকলা ও পুরাসামগ্রীর অমূল্য সংগ্রহ ছড়িয়ে রয়েছে সারা প্রাসাদ জুড়ে। শেখ এক নিপুণ গাইডের মতো প্রতিটি জিনিসের খুঁটিনাটি ইতিহাস শোনাতে লাগলেন আমাদের।

এইভাবে প্রায় একঘণ্টা প্রাসাদ পরিক্রমার পর একটা লুকোনো লিফটে চড়ে আমরা উঠে গেলাম প্রাসাদের গম্বুজে। গম্বুজের ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা নীচে, বহু নীচে, প্রাণচঞ্চল শহরগুলো দেখতে লাগলাম। এটাই কাহরেইন-এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা।

আমাদের মুখে ফোঁটা-ফেঁটা ঘাম জমছিল। ভোরের ঠান্ডা বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিল। মনে হল, আরব্য রজনীর রূপকথার কোনও গল্পে ঢুকে পড়েছি।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে শেখ হারিদ বললেন, এবারে আপনাদের এমন একটা জিনিস দেখাব যা বাইরের জগৎ কখনও চোখে দেখেনি। আশা করি আপনারা প্রাণভরে সে-দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।

লিফট আবার ফিরে এল নীচে। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো অলিন্দ ধরে।

চলতে-চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম প্রাসাদের পেছনের এক বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে। প্রাসাদের কাছাকাছি মাঠের একটি অংশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলগুলো পাথরের টুকরো গেঁথে তৈরি। তার গায়ে সবুজ লতানে গাছের ঝাড়। ঘেরা অংশে প্রবেশ করার পথ একটাই ও প্রকাণ্ড ভারী এক লোহার দরজা। দরজায় সশস্ত্র প্রহরা। প্রাসাদে ঢোকার মুখেও এত কড়া পাহারা দেখিনি।

আমরা ভেতরে ঢুকতেই লোহার গেট আবার সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। শেখ হারিদ অনুচ্চ অহঙ্কারী কণ্ঠে বললেন, এই বাগানে আমার পোষা পাখিরা থাকে।

তার ঠোঁটে সামান্য ধূর্ত হাসি খেলে গেল।

আমি আর মোহন পরস্পরের চোখে তাকালাম। পোষা পাখি? কিন্তু কই, কোনও খাঁচা তো নজরে পড়ছে না। মাথার ওপরে ভোলা নীল আকাশ। পাখিদের বন্দি করার ব্যবস্থা কই?

অবাক হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের নজর আটকে গেল। মুগ্ধ অপলক চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম। এবং আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।

নানান রঙের রূপসী ফুল ফুটে আছে বাগানে। তাদের বর্ণ গন্ধের তুলনা হয় না। সামনেই এক অগভীর দিঘি। আকাশ-নীল রঙের মার্বেলে বাঁধানো। নির্মল স্বচ্ছ তার জল। দিঘির মাঝে এক স্বপ্নিল ফোয়ারা। তার জলধারা শূন্যে বাঁক নিয়ে ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে টলটলে জলে। কুলকুল শব্দ হচ্ছে জলতরঙ্গের মতো। দিঘির পাড়ে সূর্যের খরতাপ আড়াল করে দাঁড়িয়ে সুদীর্ঘ দেবদারু ও চিনার গাছের সারি। ছায়া-ছায়া সবুজ পরিবেশ যেন মায়াময় এক মরূদ্যান।

সব মিলিয়ে অপরূপ এই উদ্যান।

না, উদ্যানের অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্য আমাদের অবাক করে দেয়নি, পা জোড়া গেঁথে দেয়নি নরম ঘাসের জমিতে। আমাদের হতবাক করেছে বাগানের পাখিরা।

স্বর্গের এই নন্দনকাননে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে সুন্দরী তরুণীর ঝক। সংখ্যায় তারা কুড়ি, কি তারও বেশি হবে। কেউ পায়চারি করছে, কেউ দিঘিতে সাঁতার কাটছে, কেউ শুয়ে আছে ঘন দেবদারুর ছায়ায়, আর কেউ বা ঘাসের ওপর শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে।

প্রতিটি মেয়েই অপরূপ রূপসী ও তীব্র যুবতী। সবচেয়ে অবাক করে দেওয়া বিষয় হল, তরুণীরা সকলেই সম্পূর্ণ নগ্ন! শেখ হারিদের নগ্ন পোষা পাখির আঁক!

আপনাদের মুখ দেখে বুঝতে পারছি আপনারা খুশিই হয়েছেন। আসুন, একটু ঘুরে দেখা যাক।–শেখ মেজাজি স্বরে বললেন।

আমরা বাগানে পায়চারি করতে থাকলাম।

তখনই একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম। চলার পথে যে-মেয়েটি আমাদের সামনাসামনি পড়ছে সে সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। তারপর আমরা তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ামাত্রই সে আবার নিজের সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ফিরে যাচ্ছে। যে কাজে মেতে ছিল সেই কাজেই আবার মেতে উঠছে।

এ এক অদ্ভুত সম্মান। আবার একই সঙ্গে আমার শরীরে দপদপ করে উঠছে কামনার শিরা। প্রতিটি নগ্ন নিখুঁত দেহসৌষ্ঠব যেন নতুন-নতুন বাসনার দীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে দেহের অন্ধকার কুঠরিতে।

চলতে-চলতে আমরা বাগানের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম।

মুখে সবজান্তা হাসি ফুটিয়ে শেখ হারিদ বললেন, ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি, আমার যে-কোনও অতিথি এই বাগানে আসামাত্রই নির্বাক হয়ে যায়। কথা হারিয়ে ফেলে কোন অজানা জাদুমন্ত্রে।

মোহন খান্নাই প্রথম ভাষা খুঁজে পেল। বলল, স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই স্যার, এই দুর্লভ সুন্দরীদের দেখার অনুমতি ও সুযোগ দিয়ে আপনি একইসঙ্গে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন এবং অবাক করেছেন।

শেখ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন : দয়া করে ভুল বুঝবেন না, মিস্টার খান্না, এটা আমার হারেম নয়। সেটা আছে প্রাসাদেরই অন্য আর এক অংশে। সেখানে আমি ও আমার বিশেষ কয়েকজন রক্ষী ছাড়া আর কারও ঢোকার অধিকার নেই। তা ছাড়া আমার বেগমরা নগ্ন দেহে কখনও আত্মপ্রকাশ করেন না, সেরকম অনুমতি তাদের দেওয়া হয়নি।–শেখ হারিদ একটু থেমে নগ্ন তরুণীদের দিকে ইশারা করে বললেন, না, মিস্টার খান্না, বেগম নয়, এই মেয়েরা আমার কয়েদি।

আপনার কয়েদি?–আমি ও মোহন বিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করে উঠলাম শেখের কথার।

হ্যাঁ, কয়েদি। কোনও-না-কোনও অন্যায় আচরণের জন্যে ওরা এখানে বন্দি। সে অন্যায় আমার বিরুদ্ধে, আমার রাজ্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু সত্যিই কি ওরা অপরাধী?–দু-পাশে হাত ছড়ালেন হারিদ : আমার বিচার কি সঠিক বিচার হবে? কী করে ন্যায়বিচার করব আমি? আমি ওদের, রাজা, কিন্তু রাজা হলেও আমি এক ক্ষুদ্র মানুষ। তাই ওদের বিচারের ভার আমি তুলে দিয়েছি মহান আল্লার হাতে। আল্লাই ওদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। আল্লা ওদের বিচার করে চলেছেন, আর সেই বিচারের রায় অনুযায়ী দণ্ড পাওয়া পর্যন্ত আমি ওদের সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে চেষ্টা করি। ওরা এই ঘেরা বাগানে বন্দি, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনওরকম অসুবিধে ওদের নেই। ওরা সম্মানিত অতিথির আপ্যায়ন পায়।

আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শেখ হারিদ। তারপর এক দুজ্ঞেয় হাসি হেসে বললেন, যাওয়ার আগে আর একটা কাজ বাকি আছে। আমার আতিথেয়তার নিদর্শনস্বরূপ আজ রাতে দুজন তরুণী আপনাদের শয্যা মধুময় করে তুলবে। ওদের মধ্যে থেকে আপনারা একজন করে বেছে নিন।

আমি একটু অস্বস্তি পেলাম। কী বলছেন শেখ হারিদ?

মোহনকে দেখে বেশ উল্লসিত মনে হল, কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। রোমিলার কথা মনে পড়ল। জানতে পারলে ও কী ভাববে?

সেই অস্বস্তির কথাই শেখকে বলতে গেলাম আমি।

কিন্তু আমার ছোট বোন সঙ্গে রয়েছে। ও যদি জানতে পারে…

শেখ হারিদ ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, আশা করি আমার আতিথেয়তাকে অসম্মান করার চেষ্টা আপনি করবেন না, মিস্টার কাপুর!

পরক্ষণেই হারিদের স্বর পালটে গেল। মেজাজি গলায় বললেন, ভয় নেই, আপনার সুন্দরী বোন কিছুই জানতে পারবে না।

আমি বুঝলাম, শেখ হারিদের ইচ্ছে বা অনুরোধ তার আদেশের চেয়েও শতগুণ ধারাল।

মোহন জিগ্যেস করল, যাকে খুশি বাছতে পারি?–সে যেন নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

যাকে আপনার খুশি!–শেখ মোহনকে আশ্বাস দিলেন : আপনিই প্রথমে পছন্দ করুন, মিস্টার খান্না।

শরীরে পোশাক থাকুক আর না থাকুক, ওদের মধ্যে যে-কেউই পুরুষের নজর টানে। কিন্তু মোহন একটু দ্বিধায় পড়ল। কিছুক্ষণ ঘুরে-ঘুরে দেখে ও শ্যামলা রঙের একটি মেয়েকে পছন্দ করল। আমরা যখন বাগানে ঢুকি তখন মেয়েটি দিঘির স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটছিল। আমাদের এগিয়ে আসতে দেখেই সে চটপট উঠে এসেছিল জল থেকে। তারপর নিশ্চল ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জলের অলস ধারা তার সুঠাম শরীরের স্তন, নাভি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। মাথার কালো চুল, সুন্দর মুখমন্ডল ও ডৌল স্তনের ওপর বিন্দু বিন্দু জলের মুক্তো চিকচিক করছিল। মেয়েটির বয়েস খুব বেশি হলে সতেরো কি আঠেরো, কিন্তু দেহের গঠনে কোথাও কোনও ঘাটতি নেই।

সুতরাং সুন্দরীদের সমাবেশে ওই মেয়েটিকেই সেরা সুন্দরী বলে মনে হল মোহনের।

এখানে সবাই দারুণ সুন্দরী, কিন্তু দিঘির ধারের ওই শ্যামবর্ণ মেয়েটিকেই আমার সবচেয়ে পছন্দ, স্যার।–একটু ইতস্তত করে মোহন বলল।

সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে আসা হল আমাদের কাছে। দু-হাত দু-পাশে ঝুলিয়ে রেখে সে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে–যেন মেহগনি কাঠে খোদাই করা মূর্তি।

তারপর শেখ হারিদের বিশ্বস্ত অনুচর হাসান ইশারা করতেই মেয়েটি আমাদের সামনে বারকয়েক পায়চারি করল, যাতে সবদিক থেকে আমরা তাকে খুঁটিয়ে দেখতে পারি।

পেছন থেকেও মেয়েটির যৌবনের আকর্ষণ কম নয়। তার ভারী নিতম্ব যেন চলার তালে তালে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমার মনে হল, মেয়েটি ইচ্ছে করেই আমাদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে।

আপনার মেয়ে দেখার জহুরি চোখ আছে, মিস্টার খান্না।–শেখ খুশির সুরে বললেন, তাঁর হাত অন্তরঙ্গভাবে খেলে বেড়াতে লাগল মেয়েটির মসৃণ ত্বকের ওপর। তারপর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, দারুণ পছন্দ! আজ রাতের জন্যে ও পুরোপুরি আপনার। তবে একটা কথা আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে : ওর শরীরের কোন অংশ আপনার চোখে সবচেয়ে লোভনীয়, মিস্টার খান্না?

ওর শরীরে কোনও খুঁত নেই। সবই সুন্দর।–মোহন স্বীকরা করল অকপটে।

 কিন্তু শেখ হারিদ নাছোড়বান্দা।

কিন্তু এমন একটা অংশ তো আছে যেটা আপনার সবচেয়ে পছন্দ?

মোহন বুঝল উত্তর না দিয়ে রেহাই নেই। ফলে ও বলল, ওর পায়ের গড়ন সত্যি একসেলেন্ট। এরকম নিখুঁত গড়ন কখনও আমার নজরে পড়েনি।

চমৎকার! হাততালি দিয়ে উঠলেন শেখ হারিদ। তারপর তিনি ধীরে ফিরে তাকালেন আমার দিকে মিস্টার কাপুর, এবারে আপনার পালা। আপনি আপনার শয্যাসঙ্গিনী বেছে নিন। লজ্জা করবেন না মোটেই।

আমি নিরুপায় হয়ে নগ্ন সুন্দরীদের খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম।

.

হিতেশ কাপুর

সারাদিন ঘুরে এসে রোমিলা খুশিতে টগবগ করে ফুটছিল। প্রচণ্ড উৎসাহে ও সারাদিনের ভ্রমণবৃত্তান্ত শোনাতে লাগল আমাদের।

সন্ধে গড়িয়ে রাত বাড়ছে। আমার মন ক্রমাগত উসখুস করে চলেছে। কারণ রাত আর একটু গাঢ় হলেই আমার ঘরে পৌঁছে যাবে আমার পছন্দ করা সুন্দরী। এই এক চিন্তা ও উৎকণ্ঠা আমাকে সারাক্ষণ অন্যমনস্ক করে রাখল।

তাকিয়ে দেখি মোহন খান্নার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। বারবার দরজায় দিকে তাকাচ্ছে।

আমরা রোমিলার ঘরে বসে ছিলাম। মোহন দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বারান্দার দিকে নজর রাখতে চাইছে।

কথা বলতে-বলতে রোমিলা একটু পরেই বুঝতে পারল আমরা কেউই ওর কথায় কান দিচ্ছি না। তখন অভিমানে আহত গলায় ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, তোমরা আমার একটা কথাও শুনছ না। ভেবেছিলাম, সারাদিনে আমি কোথায়-কোথায় ঘুরলাম সে কথা বলে তোমাদের তাক লাগিয়ে দেব, কিন্তু কোথায় কী! ধুৎ ছাই, মোহনদারও দেখছি এক অবস্থা।

হতাশায় হাত ছুড়ল রোমিলা।

কিছু মনে করিস না, রোমু।আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তারপর আড়চোখে দেখলাম মোহনের দিকে ও আসলে সারাটা দিন আমাদেরও কম খাটুনি যায়নি। ভাবছি ঘরে গিয়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।

আমারও একই অবস্থা, রোমিলা। ঘুমে চোখ বুজে আসছে।–মোহন চটপট বলে উঠল।

কিন্তু রোমিলা সন্দেহের চোখে আমাদের দিকে দেখল : কী হয়েছে বলো তো তোমাদের? এখনও তেমন রাত হয়নি! ভেবেছিলাম তোমাদের সঙ্গে রাতে বেড়াতে বেরোব, কাহরেইন এর রাতের জীবন দেখব।

প্লিজ রোমু, আজ নয়, কাল।আমি রীতিমতো অনুনয়ের সুরে বললাম, শরীরে আর কিছু নেই। নির্ঘাত গরমের জন্যে এমন কাহিল লাগছে।

একথা বলে রোমিলার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। স্পষ্ট টের পেলাম, রোমিলার নজর আমার পিঠে বিঁধছে।

শুনলাম, মোহন ওকে বলছে, আমিও চলি। গুড নাইট।

অবাক সুরে রোমিলা বলল, সত্যি, হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আপনারা শুধু নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে এসেছেন। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

আমি নীরবে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলাম।

ঘরে আসার মিনিটদশেক পরেই আমার পছন্দ করা মেয়েটি এল। আমি তখন অবাক হয়ে ভাবতে শুরু করেছি, আমাদের সকালে দেখা উদ্যান ও সেখানকার সমস্ত ঘটনা হয়তো নিছকই এক সুন্দর স্বপ্ন, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই ভাবনা থেমে গেল।

উপস্থিত শয্যাসঙ্গিনী এক সুন্দর স্বপ্ন তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু একই সঙ্গে সে মনোরম বাস্তবও বটে। পরনে তার আকাশ-নীল ম্যাক্সি। গলা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত বিছানো। অসংখ্য ভাঁজ তার শরীরের রূপরেখা স্পষ্ট অথচ রহস্যময় করে তুলেছে। সকালের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে।

পিঠ পর্যন্ত কালো চুলের ঝরনা। পাতলা টুকটুকে ঠোঁট। টানা-টানা ভুরু, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টানা কালো চোখ। গায়ের রং মার্বেল পাথরের মতো সাদা।

আমি কোনও কথা বলার আগেই গলায় বাঁধা পোশাকের ফঁসটা খুলে ফেলল সে। চাপা ফিসফিস শব্দ তুলে পোশাকটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ওর সুন্দর পায়ের পাতা ঘিরে যেন তৈরি হল এক সুনীল জলাশয়। এখনও ও সম্পূর্ণ নগ্ন। সকালে যে-নগ্ন রূপ দেখে আমি ওকে পছন্দ করেছি এখন তা যেন বিকশিত হয়েছে শতদল মেলে।

সকালে ওর সুতনু বাহুর প্রশংসা করেছি আমি। চাপার কলির মতো নিটোল প্রতিটি আঙুল। দীর্ঘ বাহু। নখ থেকে শুরু করে কাঁধ পর্যন্ত যে মোহময়ী রেখা বরাবর বাহুর গতি, তা যেন কোনও দক্ষ শিল্পীর সাবলীল তুলির টান।

ওর শরীরের কোন অংশ আপনাকে বেশি টানে, মিস্টার কাপুর!–শেখ হারিদ আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন।

আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছি, ওরকম সুঠাম দীর্ঘ বাহু কেবলমাত্র অপ্সরী কিন্নরীদের ছবিতেই দেখা যায়, স্যার। এই দুটো হাত বুকে জড়িয়ে আমি সারাজীবন বসে থাকতে পারি।

শেখ মুচকি হেসেছিলেন আমার কথা শুনে। অবশ্য কেন, তা বুঝতে পারিনি–অন্তত তখন।

ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে স্বপ্নচারিণী কথা বলল, তোমাকে আমি সুখী করতে চাই। সেরকমই আদেশ রয়েছে আমার ওপরে।

আমার অঙ্গের প্রতিটি শিরা দপদপ করে কাঁপতে লাগল। ওর অপরূপ হাত দুটো হাতে তুলে নিলাম। চোখের নজর যথেচ্ছ খেলে বেড়াতে লাগল ওর নিখাদ-নগ্ন শরীরে ফিসফিস করে বললাম, তোমার মতন সুন্দর কাউকে দেখিনি। শুধু তোমাকে দু-চোখ ভরে দেখতে চাই।

ও আলতো করে নমনীয় হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল আমার হাত থেকে। তারপর আরও কাছে এসে ধরা দিল আমার বাহুবন্ধনে।

দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমার মুখ নামিয়ে এনে গভীর চুম্বন এঁকে দিল আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে।

আমার শরীরের অভ্যন্তরে, পাগল করা বিস্ফোরণ ঘটে গেল সেই মুহূর্তে।

আমার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা সঙ্কোচ ছিল। কারণ অন্যের আদেশে এই মেয়েটি এসেছে আমাকে ভালোবাসতে। নিজের ইচ্ছেয় আসেনি। কিন্তু প্রথম স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উবে গেল আমার মন থেকে। ওর মোহময়ী যৌবন অনিবার্য নিয়তির মতো গ্রাস করল আমার নীতি আদর্শ-সহানুভূতি, সবকিছু। তা ছাড়া, দেখে মনে হল, একটি সুন্দর স্বপ্নময় সুখ-শয্যা রচনার ইচ্ছে আমার চেয়ে ওর কিছু কম নয়।

আমাদের মিলন হল একটি স্মরণীয় ঘটনা। দুজনেরই কৌমার্যব্রতের ইতি ঘটল সে-রাতে। তীব্র কামনা, আনকোরা অভিজ্ঞতার আনাড়িপনা, সবকিছু মিলে এক আশ্চর্য যুগলবন্দি সৃষ্টি করলাম আমরা দুজনে। ওর কামনার আবেগ যেন ওর সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায়।

উত্তাল ঢেউ তুলে ও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল কোন অজানায়। মনে হল, এর চেয়ে সুখের নীড় তিন ভুবনের কোথাও নেই।

অবশেষে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমরা পাশাপাশি শুয়ে আছি রাজকীয় শয্যায়। কথা বলছি নরম গলায়। জানলাম, ওর নাম আয়েষা। ছেলেবেলা থেকেই ও কারেইন-এ মানুষ। ইংরেজি শিখেছে ওর বাবার কাছে। তারপর…।

আমি ওর কানের কাছে মুখ এনে ছোট্ট করে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আয়েষা।

পলকে ওর নমনীয় শরীর শক্ত হয়ে গেল। আমি চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর কাজল কালো চোখে অন্তত দুঃখের ঢল নেমেছে, সঙ্গে আতঙ্কের জটিল স্রোত।

ওকথা বোলো না কখনও।–আয়েষা বিষণ্ণ স্বরে বলল।

কেন বলব না? আমাদের পরিচয় মাত্র একদিনের, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।

না হিতেশ, তা হয় না। আমি শেখ হারিদের কয়েদি। আজ রাতের পর আর আমাদের দেখা হবে না।

কিন্তু কোন অপরাধে শেখ তোমাকে বন্দি করেছেন?–অধৈর্য হয়ে আমি জানতে চাইলাম।

আয়েষার মুখ-চোখে অসহায় ভাব ফুটে উঠল। বলল, অপরাধ আমি করিনি, করেছেন আমার বাবা। বাবার একটা খবরের কাগজ আছে কারেইন থেকে বেরোয়। সেই কাগজে এমন কিছু লেখা বেরিয়েছিল যা শেখ হারিদ মনে করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে।

তাতে তোমার কী করার আছে? আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

তুমি শেখকে চেনো না। নৃশংসতায় তাঁর জুড়ি নেই। বাবার ওপরে কী-ইবা প্রতিশোধ নিত শেখের লোকেরা! বড়জোর বাবাকে ওরা মেরে ফেলত। কিন্তু বাবা তো এমনিতেই অসুস্থ, যে-কোনওদিন মারা যেতে পারেন। সুতরাং বাবার অপরাধে যদি আমাকে শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে বাবার ওপর ধাক্কাটা অনেক বেশি আসবে। তাই এই ব্যবস্থা। আজ সকালে যে-সব মেয়েদের তুমি বাগানে দেখেছ ওদের বেশিরভাগই নিরপরাধ। ওদের প্রাসাদে এনে বন্দি করে রাখা হয়েছে কারণ অন্যায়টা করেছে ওদের কোনও আত্মীয় অথবা বন্ধু। একের পাপের শাস্তি অন্যকে সইতে হচ্ছে।

কিন্তু এখন তোমাকে নিয়ে শেখ কী করবেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

আয়েষা মনমরা সুরে জবাব দিল, কেউ সঠিক জানে না। কিন্তু এমন সব কথা আমরা কানাঘুষোয় শুনেছি যে, সেগুলো উচ্চারণ করতেও ভয় হয়। তবে এটুকু জানি, এখানে কোনও মেয়েকে এক বছরের বেশি আটকে রাখা হয় না। আর কোনও মেয়েকে যদি শেখের অতিথির সঙ্গে রাত কাটাবার জন্যে বেছে নেওয়া হয় তাহলে তারপর তাকে আর ওই বাগানে দেখা যায় না।

তোমার সঙ্গে দেখা না করে আমি থাকতে পারব না। বুঝতে পারছিলাম, আবেগে আমার স্বর বুজে আসছে।

শুধু-শুধু দুঃখ পেয়ো না। ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথা বিশ্বাস করো।

আয়েষা আমার কথা বিশ্বাস করল কিনা জানি না, তবে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল ওর সুন্দর ঠোঁটে। বলল, হিতেশ, ওসব কথা ভুলে যাও। শুধু আজকের রাতটুকুই আমার কাছে সত্যি। এসো, এই সময়টুকু আমরা সবকিছু উজাড় করে ভালোবাসার খেলা খেলি।

সে-রাতে আরও কতবার যে আমরা একই খেলায় মেতে উঠেছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, শেষবারের পর আয়েষার ধনী বুকের ওপর মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওর শরীরের সোঁদা গন্ধ নাকের ভেতরে ঢুকে আমাকে মাতাল করে দিচ্ছিল।

ভোরবেলায় যখন ঘুম ভেঙেছে তখন আয়েষা চলে গেছে।

.

প্রাতরাশের টেবিলে রোমিলা হালকা গলায় মন্তব্য করল, দাদা কাল সাত-তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও তোমাদের শরীরের কোনও উন্নতি হয়নি। ঠিক ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে।

আমি কোনও জবাব দিলাম না। শুধু মোহন খান্নার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল।

রোমিলা টেবিল ছেড়ে চলে যেতেই মোহন জিগ্যেস করল, কী দোস্ত, এখানকার হাওয়া এখন স্যুট করছে তো? তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কাল রাতটা বেশ ভালোই কেটেছে।

আমি উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, তোমার?

একগাল হেসে মোহন বলল, দারুণ! শুধু খারাপ লাগছে এই কথা ভেবে যে, একটু পরেই শালা শেখের সঙ্গে তেলের দর নিয়ে মেছোবাজারের মতো দরাদরি করতে হবে। কিন্তু উপায় কী ব্রাদার, এর নাম চাকরি। চলো, তৈরি হয়ে নিই।

তেল নিয়ে কথাবার্তা সহজে মিটল না। চটপট কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেল না। শেখ হারিদের সঙ্গে হাজির ছিলেন তার মন্ত্রণা পরিষদ। হাসান হাজির ছিলেন নীরব সাক্ষীর মতো। আর মোতায়েন ছিল শেখের বিশ্বস্ত কয়েকজন রক্ষী।

অত্যন্ত ছোটখাটো ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে একরোখাভাবে জেদ ধরলেন কাহরেইন-এর বাণিজ্য মন্ত্রণা পরিষদের মুখপাত্ররা। সব দেখেশুনে মনে হল চটজলদি কোনও চুক্তি করতে তেলের কুমিররা রাজি নন।

সারাদিন ধকলের পর আমরা ঘরে ফিরে এলাম। মোহন বলল, ওরা মনে হয় অন্য কোনও পার্টির সঙ্গেও কথাবার্তা চালাচ্ছে।

হতে পারে।আমি ওর কথায় সায় দিলাম ও আমরা দরে যত পর্যন্ত উঠতে পারি সেই পর্যন্ত দেখব। তাতেও যদি ওরা রাজি না হয় তাহলে কোম্পানিতে টেলিগ্রাম করে ডিরেক্টরদের ডিসিশান জানতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

অগত্যা। বলল মোহন।

সারাদিনের মিটিংয়ে আমি কম বকবক করিনি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মোহনকে সাহায্য করার। কিন্তু তবু যেন মনে হচ্ছে মিটিংয়ে আমি একাত্মভাবে জড়িয়ে পড়তে পারিনি। আয়েষার কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল গত রাতের কথা। রাতের পুঙ্খানুপঙ্খ প্রতিটি স্মৃতি জুলজুল করছিল আমার চোখের সামনে, ভিড় করছিল আমার মনের ভেতরে। কেমন একটা অপরাধবোধ আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় আমি কোনও জালিয়াতি করে ফেলিনি তো? না কি আমাদের মনকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই ওই শয্যাবিলাসের আয়োজন করেছিলেন শেখ হারিদ? কিন্তু এতটা শয়তানি প্যাঁচ কি খেলবে কাহূরেইন-এর এই নির্লিপ্ত মানুষগুলো? তা ছাড়া আয়েষার কথাগুলো কি বানানো গল্প, মিথ্যে?

অনেক ভেবেও আয়েষার কথাগুলো মিথ্যে বলে মনে হল না।

 ওর বাবার অপরাধে ও শাস্তি ভোগ করছে।

 কী নৃশংস এই শেখের বিচার!

আয়েষার কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। ওর সুন্দর মুখ, ওর অপরূপ অতুলনীয় দুটি বাহু, ওর জাদুমন্ত্রে ছোঁয়া লাগানো নগ্ন যৌবন।

যে করেই হোক আয়েষার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। কোনও বাধা, কোনও বিপদ আমাকে রুখতে পারবে না।

.

রোমিলা কাপুর

নির্দিষ্ট জায়গায় যখন পৌঁছলাম তখন নটা বেজে দশ মিনিট। আজও আকাশি ভ্যান আমার অনুসারী। বহু চেষ্টা করেও লেজ থেকে তাকে ছাড়াতে পারিনি।

আলফা থামিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই মহম্মদ ইলিয়াসের হাসিমুখ। আমার হাতে নাম না–জানা হলুদ ফুলের তোড়া। শেখ হারিদের চোখ-ভোলানো বাগান থেকে নিজে হাতে তুলে এনেছি।

তোড়াটা ইলিয়াসের হাতে দিয়ে বললাম, গোলাপের বদলে।

ইলিয়াস দুহাত পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। ডান হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে ফুলের তোড়াটা গ্রহণ করল। তারপর লুকনো বাঁ-হাত সামনে নিয়ে আসতেই লজ্জা পেলাম। ওর হাতে সদ্য ফোঁটা গোলাপের তৈরি একটা নতুন গুচ্ছ।

তোড়া দুটিকে হাতবদল করে মাথা ঝুঁকিয়ে আদাবের ভঙ্গিতে ওর গোলাপের তোড়াটা আমার দিকে এগিয়ে দিল ইলিয়াস। বলল, ইতনি আসান নহী হ্যায় কর্জ চুকানা ইয়ে বান্দেকি। এ বান্দার ঋণ শোধ করা অত সহজ নয়, মিস কাপুর।

তারপর গতকালের মতোই ও হাটের মাঝখানে হো-হো করে হেসে উঠল। আশেপাশের লোকজন বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল আমাদের দিকে।

ইলিয়াসের পোশাক আজ অন্যরকম। ফিনফিনে গোলাপি কাপড়ে তৈরি ফুলহাতা কাফতান আর আঁটোসাঁটো ব্লু জিন্স। কাঁধে ঝোলানো একটা চামড়ার ব্যাগ।

চলুন, কারনামায় গিয়ে বসি। ইলিয়াস বলল, ইন্টারভিউটা সঙ্গে এনেছি। আপনাকে পড়ে শোনাব।

আমি ওর পাশে হাঁটছি। কারনামা-র সুদৃশ্য দরজা ক্রমেই আমাদের কাছে এগিয়ে আসছে। এই মুহূতে ভারতের কথা ভাবলে দেশটার স্মৃতি কেমন আবছা মনে হয়। মনে হয়, কাহরেইন সত্যি, বাকি সব মিথ্যে।

গতকাল দাদা ও মোহনদার আচরণ আমার কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছে। বারবার মনে হয়েছে, কী একটা যেন ওরা গোপন করতে চেষ্টা করছে আমার কাছ থেকে। কোথায় চিন্তায় ছিলাম আমার কাহরেইন বেড়ানোর কতটুকু ওদের বলব, আর কতটুকু বলব না, উলটে ওরা আমার বেড়ানোর গল্পকে মোটে পাত্তাই দিল না। সেই মুহূর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছিল ওদের ওপর।

আজ সকালেও দাদা আর মোহনদার মুখে অবসাদ ও ক্লান্তির ছাপ দেখেছি। সেই সঙ্গে যেন একটা আবছা অপরাধবোধও ছায়া ফেলেছিল ওদের মুখমণ্ডলে। দাদা এমনিতে মনের ভাব খুব একটা লুকিয়ে রাখতে পারে না। তাই ওকে দেখেই আমার সন্দেহটা গাঢ় হল। শেখ হারিদ কি ওদের দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করিয়ে নিতে চলেছেন?

ইরান কথাটার অর্থ জানেন?

 ইলিয়াসের আচমকা প্রশ্নে আমার চমক ভাঙল। দেখি কারনামা-র দরজায় পৌঁছে গেছি।

দরজা ঠেলে ভেতরের ঠান্ডা পরিবেশে ঢুকলাম দুজনে। আমি ছোট্ট করে বললাম, ইরান কথাটার আবার অর্থ আছে নাকি?

কাহরেইন-এর নেই, কিন্তু ইরানের আছে।

গতকালের টেবিলটার দিকে অজান্তেই চোখ চলে গেল আমাদের। টেবিলটা খালি। দুজনে চোখাচোখি হল। ইলিয়াসের কালো চোখের তারায় আশ্চর্য কৃতজ্ঞতার ইশারা। কিন্তু কেন, তা জানি না।

টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসলাম। তারপর আমি বললাম, আজ শুধু সবুজ চা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব।

ইলিয়াসের চোখ পলকের তরে সপ্রশ্ন হল। কিন্তু পরক্ষণেই বেয়ারাকে ডেকে সবুজ চা অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, এত তাড়া নিয়ে এলেন কেন?

আমি চুপ করে রইলাম। সত্যি-সত্যি আমার বাড়ি ফেরার কোনও তাড়া নেই। কিন্তু ইলিয়াসের সঙ্গে বেশিক্ষণ বসতে আমার ভয় হচ্ছিল। তা ছাড়া আমি জানি, রেস্তোরাঁর বিল কিছুতেই ও আমাকে মেটাতে দেবে না। সেইজন্যেই আরও বেশি খারাপ লাগছিল। সুতরাং প্রসঙ্গ পালটে ঠোঁটে হাসি টেনে ওকে প্রশ্ন করলাম, কী হল, ইরানের অর্থটা বললেন না তো!

ইলিয়াসের মুখ সামান্য গম্ভীর হল। বলল, ইরানের অর্থ হল, আর্যদের দেশ। কারণ প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়া থেকে দলে-দলে যেসব মানুষ ইরানে এসেছিল, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল আর্য। সেইজন্যেই ওই নাম। উত্তর ভারত আর ইউরোপের সঙ্গে সেইসব আর্যদের রক্তের সম্পর্ক ছিল। সেইজন্যে তাদের বংশধরদের সঙ্গে দক্ষিণ ইউরোপের মানুষদের মিল আছে। আর প্রায় খাঁটি আর্য বলতে ইরানে রয়ে গেছে কয়েকটি উপজাতি–যেমন, কুর্দ, সুর আর বখতিয়ারি।

আমি হেসে ওকে বললাম, আপনি যে একেবারে ইতিহাস মুখস্থ করে রেখেছেন দেখছি!

 ভুলে যাবেন না আমি রিপোর্টার। খবর বেচে খাই।

সবুজ চা টেবিলে এসে গেল। আমি ছোট্ট গোলাপের তোড়াটা নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। দেখাদেখি ইলিয়াসও আমার দেওয়া হলুদ ফুলের গুচ্ছ তুলে ধরল মুখের সামনে। বলল, আপনি গোলাপ ভালোবাসেন?

আমি হেসে বললাম, কে না বাসে!

ইলিয়াস আনমনা হয়ে গেল। থেমে-থেমে বলল, আলেয়া…আলেয়া গোলাপের নামে পাগল ছিল…।

আলেয়া! ইলিয়াসের বোন! কিন্তু ও এভাবে কথা বলছে কেন? আলেয়া গোলাপের নামে পাগল ছিল!

আমি ছোট্ট করে জিগ্যেস করলাম, আলেয়া এখন গোলাপ ভালোবাসে না?

একটা দীর্ঘশ্বাস ওর শরীরের গভীর অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এল বাইরে। পরদা ঢাকা জানলার দিকে তাকাল ইলিয়াস। অস্ফুট স্বরে বলল, এখন ও গোলাপ ভালোবাসে কিনা জানি না…

আমি চায়ের গ্লাসে চুমুক দিলাম। অখণ্ড নীরবতায় চুমুকের ক্ষীণ শব্দটা কটু হয়ে কানে বাজল।

ইলিয়াস এবার আমার দিকে চোখ ফেরাল। বলল, আলেয়া কাছে নেই। এখন তেরো বছরের নামাই আমার সব। ওকে সুখী রাখার জন্যে আমি যা খুশি করতে পারি। ও আমার চোখের মণি, রোমিলানা ভুল বললাম, তার চেয়েও বেশি।

ইলিয়াসের ফরসা মুখ লালচে হয়ে গেছে। এখুনি যেন রক্ত ফেটে বেরিয়ে ছিটকে পড়বে হলুদ ফুলের তোড়ার ওপর। ওর চোখ চকচক করছে কী এক অদ্ভুত আবেগে। আলেয়া ওর কাছে নেই কেন? আলেয়ার কি বিয়ে হয়ে গেছে? ইলিয়াসের চোখমুখ দেখে সে কথা জিগ্যেস করতে ভরসা হল না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইলিয়াস চায়ে চুমুক দিল। ফুলের তোড়াটা নামিয়ে রাখল পাশের চেয়ারে। একটু পরেই ওর মুখে হাসি ফুটল। বলল, ইন্টারভিউটা তোমাকে পড়ে শোনাই।

আমি আগ্রহে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম।

প্যান্টের পকেট থেকে ভাঁজকরা কয়েকটা কাগজ বের করল ইলিয়াস। সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে পড়বার জন্যে তৈরি হল। বলল, এটা পার্সি ভাষায় লেখা, কিন্তু আমি ইংরেজি অনুবাদ করে পড়ে শোনাচ্ছি। বোর করলে সঙ্গে-সঙ্গে জানাবে, লজ্জা করবে না।

ও হাসল। আমিও হাসলাম। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে ইলিয়াস ইন্টারভিউটা আমাকে পড়ে শোনাতে লাগল। পড়া এবং শোনার ফাঁকে ফাঁকে চলতে লাগল আমাদের চায়ের চুমুক।

চা এবং ইন্টারভিউ-পাঠ প্রায় একই সঙ্গে শেষ হল। তখন ইলিয়াস প্রশ্ন করল, কেমন লাগল?

দারুণ?–একটু থেমে আরও বললাম, এটা কিন্তু মোটেই মন-রাখা কথা নয়।

সত্যি, এত চমৎকার ও সাবলীলভাবে ইন্টারভিউটা ইলিয়াস লিখেছে যে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা বেরিয়ে আসে।

ওর নানান গুণ আমাকে বিপজ্জনকভাবে মুগ্ধ করে চলেছে।

প্রশংসার জন্যে নরম গলায় আমাকে পালটা ধন্যবাদ জানাল ইলিয়াস। তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, তোমার তো আবার বাড়ি ফেরার তাড়া রয়েছে, নইলে…

হঠাৎই চুপ করে গেল ও।

আমি জানতে চাইলাম, নইলে কী?

ইলিয়াস একরাশ কুণ্ঠা নিয়ে নীচু গলায় বলল, কাল নাজমাকে তোমার কথা গল্প করেছিলাম। ও ভীষণ জেদ ধরেছে তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। আসলে আমি চাকরিতে বেরিয়ে পড়ি। বাড়িতে ওর পিসির কাছে থাকে নাজমা। ফলে তেমন গল্পগুজব করার সঙ্গী পায় । তার ওপর তুমি ভারত থেকে এসেছ শুনে তো একেবারে আলাদীনের প্রদীপ হাতে পেয়েছে।

কথা বলতে বলতে একটা খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ছিল ইলিয়াসের চোখে-মুখে। হঠাৎই সেটা দপ করে নিভে গেল। অনেকটা সাফাই দেওয়ার সুরে বিড়বিড় করে ও বলতে লাগল, আসলে আমি নাজমাকে বলেছিলাম, বাড়িতে আনা যাবে না–হয়তো রাজি হবে না। অচেনা লোকের বাড়িতে হুট করে কে-ই বা আসতে রাজি হয়, বলো!

ইলিয়াস আমার কাছে ঝুঁকে এল, বলল, আমি অনেকভাবে ওকে নিরাশ করতে চেয়েছি, কিন্তু তবুও মেয়েটা আশা ছাড়েনি। বারবার একই কথা বলছিল..

আমি একটু দ্বিধায় পড়লাম। নাজমার প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার দুঃখ যে ইলিয়াসের কাছে কতখানি সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছিল, ইলিয়াসের বাড়িতে গেলে আমার কষ্ট বাড়বে। আমি যেদিন ভারতে ফিরব সেদিন আমার পা টেনে ধরবে কাহরেইন এর মাটি। বহুদিনের পোষা পাখির মতো আমার ডানা ভারী হয়ে যাবে। আর উড়তে পারব না আমি।

হঠাৎই আমরা মনে হল, নাজমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল না কেন ইলিয়াস? তা হলে ওরও আশ মিটত, আর আমাকেও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হত না।

এই চিন্তাটাই মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় বলে ফেললাম ইলিয়াসকে।

 নাজমাকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এলেই পারতে।

ইলিয়াস চোখ তুলে সরাসরি আমার দিকে তাকাল। বলল, সম্ভব হলে তো নিয়েই আসতাম, রোমিলা। ওর–ওর…।

আমি তীক্ষ্ণ নজরে ইলিয়াসকে জরিপ করছিলাম। হঠাৎই যেন অদ্ভুত এক বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে ওর চোখেমুখে।

আমি জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে নামার?

ইলিয়াস নীচু গলায় বলল, ও হাঁটতে পারে না। প্যারালিসিসে ওর দুটো পা বহুবছর ধরে অকেজো হয়ে গেছে।

সে কী! কী করে?

ইলিয়াসের বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তবুও সংক্ষেপে সব বলল আমাকে। নাজমার যখন তিন বছর বয়েস তখন কী একটা অসুখে হঠাৎ করেই ওর পায়ে প্যারালিসিস দেখা দেয়। তারপর সেটা ক্রমে বাড়তে থাকে। বহুরকম চিকিৎসা করেও কোনও কাজ হয়নি।

কথা বলতে বলতে ইলিয়াসের চোখে জল এসে গিয়েছিল।

আমি ভারী গলায় বললাম, সরি, ইলিয়াস। অজান্তে তোমাকে ব্যথা দিয়ে ফেলেছি। চলো, আমি তোমার বাড়িতে যাব–নাজমাকে দেখতে যাব।

ইলিয়াসের জলভরা চোখ পলকে আনন্দে চকচক করে উঠল। ও অবিশ্বাসের সুরে বলল, সত্যি?

আমি হেসে বললাম, ট্রুথ, নাথিং বাট দ্য ট্রুথ।

ইলিয়াস আচমকা আমার হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করে বলে উঠল, গ্রেট। কাম অন, লেন্স গো।

ইলিয়াস চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। সেইসঙ্গে আমিও।

ওর ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে আমার আনন্দ হচ্ছে। আমার একটা হাত কখন যেন ইলিয়াস বগলদাবা করে বন্দি করে ফেলেছে। গোলাপের তোড়াটা আমি আমার ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছি। ইলিয়াসও হলুদ ফুলের গুচ্ছটা ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছে আর পাকা গাইডের ভাবভঙ্গিতে ইরান, কাহরেইন ইত্যাদি সম্পর্কে লাগাতার বকবক করে চলেছে। যেন এক অদ্ভুত পাগলামি পেয়ে বসেছে ওকে।

বাজার এলাকাটা পেরিয়ে এসেই ইলিয়াস ইশারায় একটা ট্যাক্সি ডাকল। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, রোমিলা, আলফা আলফার জায়গায় পড়ে থাক। আলফা সঙ্গে নিলে পেছন পেছন ওই আকাশি ভ্যানও আসবে। না কি তোমার দেহরক্ষী চাই?

আমি প্রাণ খুলে হেসে উঠলাম। বললাম, একজনকেই সামলাতে পারছি না তার ওপর আরও দুজন এলে তো তুলকালাম কাণ্ড হবে। আমি ইশারায় ইলিয়াসের হাতে বন্দি আমার হাতটা দেখালাম।

ওঃ, সরি!–বলে ইলিয়াস চটপট হাতটা ফেরত দিল।

ইতিমধ্যে ট্যাক্সিটা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দরজা খুলে দিয়েছে ড্রাইভার। দুজনে চটপট উঠে বসলাম ভেতরে। ইলিয়াস দেশীয় ভাষায় কী যেন নির্দেশ দিল ড্রাইভারকে। তারপর আমাকে লক্ষ করে বলল, আমার বাড়ি একেবারে কাহরেইন-এর সীমানার কাছাকাছি। জায়গাটার নাম কানাম। তবে পৌঁছোতে মিনিট দশেকের বেশি লাগবে না।

ঠিক-ঠিক বলতে গেলে আট মিনিটের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম দুজনে।

জায়গাটা বেশ কিছুটা ঘিঞ্জি। দেখে মনে হয় এ-অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে নিম্নবিত্তের সংখ্যাই বেশি। ইলিয়াস বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েই বলে উঠল, গোটা কাহূরেইন তেলের ওপরে ভাসছে। অথচ সব পয়সাই ঢুকছে শেখ হারিদের পকেটে। দেশের লোক সব অভাবে ধুঁকছে।

ইলিয়াসের কথায় বেশ খানিকটা ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ পেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি শেখের অতিথি। তোমার সামনে এসব কথা বলে ফেললাম বলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু সত্যি কথাটা কি জানো? দেশের লোকের সহ্যের সীমা পার হয়ে যেতে চলেছে। ধস একদিন নামবেই।

আগামী সেই দিনটার আশায় ওর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

বাড়ির সদর দরজা পেরিয়েই হাঁকডাক শুরু করে দিল ইলিয়াস, নাজমা! নাজমা। দ্যাখ কাকে নিয়ে এসেছি।

সদর পেরিয়েই একটা খোলা উঠোন। তারপর বাড়ি।

একটু পরেই বাড়ির দোতলার বারান্দায় সাদা-চুল এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়ালেন। তার কাখে অপূর্ব রূপসী একটি মেয়ে। বয়েস বারো কি তেরো। নিশ্চয়ই নাজমা। আর বৃদ্ধা সম্ভবত ওর পিসিমা।

আমাদের দেখে মেয়েটা কোল থেকেই একেবারে হইহই শুরু করে দিল। ইলিয়াস ওর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলল, সবুর কর, এক্ষুনি আমরা ওপরে যাচ্ছি।

সেকেলে জীর্ণ ঢঙের সিঁড়ি ভেঙে ইলিয়াস আমাকে ওপরে নিয়ে গেল। চলতে-চলতে বলল, কোথায় শেখ হারিদের প্রাসাদ, আর কোথায় এই বাহাত্তরে বাড়ি।

আমি মাথা নীচু করে সিঁড়ি ভাঙছিলাম, চট করে মুখ তুলে ওকে দেখলাম। তারপর বললাম, তুমি তো অবুঝ নও। ওই প্রাসাদ কাদের কান্না-ঘাম-রক্তে তৈরি তা নিশ্চয়ই তুমি জানো, আমার চেয়ে ভালো করেই জানো!

ইলিয়াস হেসে বলল, ইন্টারভিউতে একটা কথা জুড়ে দেব, ভারতীয় তরুণীদের সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা মুশকিল।

দুজনেই চড়া গলায় হেসে ফেললাম।

অবশেষে নাজমার ঘরে এলাম।

ঘরটা আকারে মাঝারি। মেঝেতে রংচটা একটা পুরোনো কার্পেট পাতা। বড়-বড় দুটো জানলার জাফরি ঝোলানো। হয়তো রোদের তাত ও চোখ ঝলসানো আলো স্তিমিত করার জন্যে। ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটা খাটো বিছানায় নাজমা এখন আধশোয়া অবস্থায়। দুটো তাকিয়া ওর পিঠের কাছে গোঁজা। রঙিন সুতো দিয়ে কী একটা বোধহয় বুনছিল, সেটা বিছানার একপাশে রাখা। এখন মুগ্ধ একাগ্র চোখে ও শুধু আমাকে দেখছে।

নাজমা যেন কোনও স্বর্গীয় পুতুল। দুধে-আলতা ওর গায়ের রং। টানা-টানা কালো চোখ। ধারালো নাক ও চিবুক। পাতলা গোলাপি ঠোঁট। নাকে ছোট একটা লাল পাথর ঝিলিক মারছে। এছাড়া তেমন কোনও সাজগোজ বা প্রসাধন নেই। আমি থমকে দাঁড়িয়ে মেয়েটার অপরূপ সৌন্দর্য আশ মিটিয়ে দেখতে লাগলাম।

ইলিয়াস আমার কনুই স্পর্শ করল, বলল, বিছানাতেই বোসো। নাজমা তোমাকে কাছ ছাড়া করবে বলে মনে হয় না।

নাজমা হাততালি দিয়ে উঠল, তোমার কথা কাল দাদার কাছে কত শুনেছি। তুমি আজ আমাকে সারাদিন ধরে ইন্ডিয়ার গল্প শোনাবে। নানান দেশের গল্প শুনতে আমার দারুণ লাগে।

ইলিয়াস বলল, ব্যস, এবারে আমার ছুটি। তবে রোমিলা, আর-একটা রিকোয়েস্ট, আজ আমাদের এখানে খেয়ে যাবে তুমি–অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে।

আমি মুখ ফিরিয়ে ইলিয়াসকে দেখলাম। অপরূপ সৌন্দর্য ওদের জন্মগত অধিকার। একটু থেমে ওকে বললাম, ভদ্রতার জন্যে যদি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হত তাহলে সেটা তোমার হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না, ইলিয়াস।

আমরা তিনজনেই হালকা গলায় হেসে উঠলাম। ইলিয়াস ঘর ছেড়ে চলে গেল। আর আমি ফুটফুটে পুতুলটার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলাম।

ঘরের দেওয়ালে বাঁধানো বেশ কিছু ছবি রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি রঙিন পার্সিালপি। কিন্তু যে-ছবিটির প্রতি আমার নজর পড়ল সেটা তিনজনের একটি গ্রুপ ফটো। ইলিয়াস ও নাজমা দুপাশে। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে বছর কুড়ির এক যুবতী। নিশ্চয়ই আলেয়া। একেবারে নাজমার মুখটি অবিকল কেটে বসানো।

আমি সেদিকে আঙুল দেখিয়ে নাজমাকে জিগ্যেস করলাম, মাঝখানে কে? তোমার দিদি আলেয়া?

হ্যাঁ। ছবির দিকে না তাকিয়েই নাজমা বলল। একটা দুঃখ ছায়া ফেলল ওর কণ্ঠস্বরে।

তোমার দিদি এখন কোথায়?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, জানি না…একটু থেমে আরও বলল, দাদা জানে।

ঠিক এই সময়ে ওর পিসিমা এক গ্লাস শরবত হাতে ঘরে ঢুকলেন। আমাকে দিলেন। তারপর নীরবে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। নাজমা ছোট্ট করে বলল, আমার পিসিমা। খুব ভালো বাদামের শরবত তৈরি করে, খেয়ে দ্যাখো।

আমি সৌজন্যবশত গ্লাসটা ওর দিকে এগিয়ে ইশারা করতেই নাজমা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, আমি তো ওটা রোজই খাই, ডাক্তারবাবু খেতে বলেছেন। বাদামের শরবত খেলে আমার পা ধীরে-ধীরে সেরে উঠবে।

কথাটা বিশ্বাস করতেই মন চাইল, কিন্তু ইলিয়াসের মুখে যা শুনেছি তাতে মনে হয় নাজমাকে ভুলিয়ে রাখার জন্যেই হয়তো ওকথা বলা হয়েছে। শরবতটা রোজ খেলে ওর শরীরের পুষ্টি বাড়বে।

শরবত শেষ করতেই আবার গল্প।

আমি নাজমাকে ভারতের নানান কথা শোনাই। পরক্ষণেই ও হাত-পা নেড়ে আমাকে ইরান বা কাহরেইন সম্পর্কে সাতকাহন করে শুনিয়ে দেয়। রাজ্যের বিষয় নিয়ে গল্পেগুজবে ইরান ও ভারত দেশ দুটো ক্রমশ কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। ঘড়ির কাটার কথা একেবারে ভুলে গেলাম দুজনে।

দুপুর একটা নাগাদ গল্পের ঢেউ থামল। কারণ ইলিয়াস ঘরে এসে হাজির হল। আমাদের দিকে তাকিয়ে মজাদার মুখভঙ্গি করে বলল, আসুন মেমসাহেবরা, খানা তৈরি। তারপর আবার আড্ডা দেওয়া যাবে।

সুতরাং তখনকার মতো গল্প থামল। ওই ঘরেই খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম আমরা।

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে যাওয়ার পর ইলিয়াসও আমাদের আসরে যোগ দিল। সোজা কথায়, গুলতানি একেবারে জমে উঠল। এহেন বিষয় নেই যা আমাদের আলোচনায় জায়গা পেল না। ঘোড়ার পিঠে চড়ে সময় একেবারে হাওয়ার বেগে ছুটতে লাগল।

আকাশের আলো ম্লান হয়ে আসতেই আমি সচেতন হলাম। ইলিয়াসকে বললাম, এবারে আমি ফিরতে চাই। ও হেসে বলল, তোমার তো বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল।

বুঝলাম, ঠাট্টা করছে। তাই হেসে বললাম, তুমিও ইন্ডিয়াতে কখনও এসো, তখন মজা টের পাওয়াব।

আমরা দুজনে নাজমাকে ছেড়ে উঠলাম। ও হঠাৎই বলল, দিদি এক মিনিট। তোমাকে একটা জিনিস দিই।

তারপর তাকিয়ার নীচ থেকে রুমালের মতো একটা জিনিস বের করল। রুমালটা রঙচঙে সুতোয় বোনা।

নাজমা বলল, আমি বুনেছি।

আমি আলতো করে ওর কমনীয় গাল টিপে দিলাম। বললাম, ভাগ্যিস এসেছিলাম, তাই এমন সুন্দর জিনিসটা পেলাম।

ইলিয়াস আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, আমার গোলাপের তোড়ার চেয়েও সুন্দর?

 আমি কপট রাগে ওর দিকে কটমট করে একবার দেখলাম।

নাজমা বারবার বলল, আবার এসো! আবার এসো!

আমি হেসে বললাম, নিশ্চয়ই আসব। তারপর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি আর ইলিয়াস।

চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই। ইলিয়াস বলল।

 একশোবার। না পৌঁছে দিলে আমি যাব কেমন করে?

 ইলিয়াস বলল, সামনের বড় রাস্তায় পৌঁছলেই ট্যাক্সি পাওয়া যাবে।

কিন্তু তার আর দরকার হয়নি।

আমি হঠাৎ জিগ্যেস করলাম, আবার কবে দেখা হচ্ছে?

কেন, কাল নটায়!–চটপট বলে উঠল ইলিয়াস। শুনে আমার ভালো লাগল।

অবাক হয়ে ভাবলাম, মানুষের প্রত্যাশা কী দুরন্ত বেগেই না বাড়তে থাকে! বাড়তে বাড়তে যদি তা কখনও বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায় তখন?

আর কয়েক পা এগোতেই আলেয়ার কথা মনে পড়ল আমার। ক্ষণিকের দ্বিধা কাটিয়ে জানতে চাইলাম, আলেয়ার কী হয়েছে ইলিয়াস? ও এখন কোথায়?

একটা বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইলিয়াস বলল, আল্লা জানেন।

আমি কী বলব ভাবছি, এমন সময় হঠাৎই লাল রঙের আলফা স্পোর্টস কারটা আমার চোখ পড়ল। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা কে নিয়ে এল এখানে?

কিন্তু প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই আকাশি রঙের ভ্যানটা নজরে পড়ল। ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

আচমকা দুটো ছায়া আমার সামনে এসে হাজির হল।

আমরা চমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভয়ে বুক কাঁপছে।

ইলিয়াস আমার বাহু আঁকড়ে ধরল শক্ত হাতে।

ছায়ামূর্তি দুজনের একজন ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বলে উঠল, মিস কাপুর, আমরা আপনার দেহরক্ষী। আপনার গাড়িটা আমরা নিয়ে এসেছি। বাড়ি ফিরতে আপনার কোনও অসুবিধে হয়েছে শুনলে মাননীয় শেখ ভীষণ দুঃখ পাবেন।

আমি করুণ চোখে ইলিয়াসের দিকে একবার তাকালাম। ওর চোখে-মুখে ঘৃণা যন্ত্রণা ভয় আক্রোশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

ইলিয়াসকে ছেড়ে আমি দেহরক্ষী দুজনের সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। ইলিয়াস আচ্ছন্নের মতো আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল : বিদায়!

আলফায় উঠে যখন স্টার্ট দিলাম তখন আমার চোখ ঝাপসা হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হয়ে আসছে। ইলিয়াসের অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে একটু-একটু করে।

আকাশি ভ্যানটা আমার আগে-আগে যাচ্ছে, আর আমি সেটাকে অনুসরণ করে চলেছি।

এটুকু বুঝলাম, শেখ হারিদের অনুচরদের চোখে ধূলো দেওয়া নেহাত সহজ নয়। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের ট্যাক্সি অনুসরণ করে ইলিয়াসের বাড়ি পর্যন্ত এসেছে। সে-কথা ভাবতেই দুশ্চিন্তা জুড়ে বসল মাথায়। আগামীকাল ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা হবে তো?

ছুটন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখলাম, গাঢ় নীল আকাশে এক ফালি সুদৃশ্য চাঁদ আমার পাশে ছুটছে। পার্শিয়াল গালফ-এর নোনা বাতাস আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল। ভাবতে অবাক লাগল, আমি দেশছাড়া হয়ে হাজার-হাজার মাইল দূরের এক বিদেশি রাস্তায় গাড়ি ছুটিয়ে চলেছি।

.

হিতেশ কাপুর

সে-রাতে শেখ আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নৈশভোজে। সুতরাং অস্থির মন নিয়েই মোহন ও রোমিলার সঙ্গী হলাম। রোমিলা একটু আগেই বেড়িয়ে ফিরেছে। ভীষণ ক্লান্ত ছিল ও। নৈশভোজে যেতে রাজি হচ্ছিল না। আমিই বলেকয়ে ওকে রাজি করিয়েছি। বলা যায় না, ওকে অনুপস্থিত দেখলে শেখ হারিদ কী থেকে কী ভেবে বসবেন।

ভোজের আসরে উপস্থিত ছিলেন শেখ হারিদ নিজে, পাশে তার প্রিয় বেগমদের একজন, আর দুই ছেলে। ছেলে দুটি চেহারায় বাপের মতো, তবে অনেক রোগা। এখনও ওদের দাড়ি গজায়নি। অবশ্য একজন যে বাবার মতো চমকদার দাড়ি তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেটা তার গাল দেখলেই বোঝা যায়।

আসরে আরও হাজির ছিলেন কয়েকজন মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ অফিসার। তাদের মধ্যে দুজন সকালে তেলের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া পার্টির তদারকিতে শশব্যস্ত হয়ে যথারীতি হাজির রয়েছেন সদা উপস্থিত বিশ্বস্ত অনুচর হাসান।

শেখ হারিদ বেশ খোশমেজাজে গল্প করছেন সবার সঙ্গে। তিনি কথা বলার সময় অন্য সবাই চুপ করে শুনছেন। তার কথা যেন আর শেষ হতে চায় না। অতিথিসেবার দায়িত্ব তিনি যথাযথ পালন করে চললেন। বিশাল কারুকার্যময় ঘরে বেজে চলেছে দেশীয় সংগীতের সুর। স্বল্পবাস সুন্দরী মেয়েরা ঘুরেফিরে খাবার পরিবেশন করছে রুপোর পাত্রে। সব মিলিয়ে খাঁটি মধ্য প্রাচ্যের পরিবেশ।

ডাইনিং টেবিলে কাবাব, বিরিয়ানি, ফলসামগ্রীর আশ্চর্য সমাহার যে-কোনও খাদ্য-বিলাসীকে দিশেহারা করে দেওয়ার মতো। রোমিলা ও মোহন আনন্দের সঙ্গে এটা-ওটা চেখে চলল। প্রতিটি খাবারের পরই পরিবেশন করা হচ্ছে দেশি-বিদেশি পুরোনো-নতুন নানান রঙের নানান স্বাদের সুরা। সন্দেহ নেই ওই রাজকীয় নৈশভোজের স্মৃতি সহজে ভুলে যাওয়ার নয়।

আমার খাওয়ার ভঙ্গিতে হয়তো নির্লিপ্ত ভাব ধরা পড়েছিল। তা ছাড়া খেতেও যে তেমন আগ্রহ ছিল তা নয়। হয়তো সেই কারণেই হাসান বললেন, মিস্টার কাপুর, আপনি তো ঠিকমতো খাচ্ছেন না। আর তেমন কথাবার্তাও বলছেন না।

হাসান আমার পাশেই বসে ছিলেন।

মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে আমি মনস্থির করে ফেললাম। তারপর মনের বোঝা হালকা করার জন্যে নীচু গলায় বললাম, আপনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারেন, মিস্টার হাসান। গতকাল বাগানে যে-মেয়েটিকে আমি পছন্দ করেছিলাম মনে আছে?

নিশ্চয়ই মনে আছে। অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি। অবশ্য সুন্দরী ছাড়া কাউকেই মাননীয় শেখ তাঁর উদ্যানে স্থান দেন না। একটু থেমে হাসান বললেন, মেয়েটি আপনার মনোরঞ্জন করতে পেরেছে আশা করি?

তার অনেক বেশিই করেছে। আমি জবাব দিলাম।

 তা হলে আপনাকে অসুখী দেখাচ্ছে কেন, মিস্টার কাপুর?

শ্বাস টেনে বললাম, ওকে আমি আবার দেখতে চাই। শেখকে বলে তার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন না আপনি?

এই প্রথম শেখের একান্ত সচিবের ঠোঁটে হাসির আভাস দেখলাম। না, বন্ধুত্বের হাসি সেটা নয়, বরং তাকে ঠোঁটের বিকৃতি বলা যায়। এ-হাসি মন ছোঁয় না।

হাসান বললেন, আপনার অনুরোধ রক্ষা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব, মিস্টার কাপুর। আপনি ওকে এমনভাবে উপভোগ করেছেন যা কোনও পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সবই আল্লার ইচ্ছে, তাতেই আপনাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। ইচ্ছে করলেও আমি অথবা মাননীয় শেখ, কেউই এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। সবই আল্লার মরজি।

হাসান মুখ ফিরিয়ে নিলেন। স্পষ্ট বোঝা গেল, এ-বিষয়ে আর আলোচনা চালাতে তিনি নারাজ।

আমার অস্বস্তি ও অস্থিরতা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। খাওয়াদাওয়ার পর নিজের ঘরে এসেও হাসানের কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। যতই দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তি বাড়ছে ততই যেন এক জেদ চেপে বসছে মনের গভীরে, আয়েষার সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে।

এক সময় মন স্থির করে উঠে দাঁড়ালাম। তখন রাত কত জানি না, চুপিসারে বেরিয়ে এলাম ঘরের বাইরে।

অলিন্দে আবছা আলো জ্বলছে। হয়তো রাত বেড়ে ওঠায় এই ব্যবস্থা। ছায়ায়-ছায়ায় লুকিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম প্রাসাদের পেছন দিকে। প্রকাণ্ড অলিন্দ, বিশাল হলঘর, বারান্দা ইত্যাদি পেরিয়ে আসার সময় কেমন যেন গা-ছমছম করতে লাগল। লুকিয়ে চলার পথে যখনই শেখের কোনও ভৃত্য অথবা রক্ষী নজরে পড়ছে তখনই ঘন অন্ধকারের আড়ালে চকিতে আত্মগোপন করছি। অপেক্ষা করছি রুদ্ধশ্বাসে। তারপর পথ পরিষ্কার হলে আবার এগিয়ে চলি গোপন অভিসারে।

এক সময় পেছনের মাঠে যাওয়ার দরজাটা আমার চোখে পড়ল। দরজা বন্ধ। কিন্তু তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কারণ আয়েষাকে উদ্যানে আর পাওয়া যাবে না। প্রাসাদের কোথাও ওকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সুতরাং বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে-ঘুরতে প্রাসাদের এক অন্দরমহলে পৌঁছে গেলাম। অন্দরমহল অথচ কড়া পাহারার ব্যবস্থা সেখানে নেই। এবং তার গঠনও বড় বিচিত্র। ঠিক যেন কোনও হোটেলের মতো সরু অলিন্দ। অলিন্দের দু-পাশে পরপর ছোট-ছোট ঘর। যেন জায়গা বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাসাদের অন্যান্য অংশে যে-বিশাল ঘর-বারান্দা ইত্যাদি দেখেছি, এ-জায়গাটা ঠিক তার উলটোটা।

জানি, আমার অনুসন্ধান হয়তো হাস্যকর, নিছক পাগলামি। অনেকটা খড়ের গাদায় উঁচ খোঁজার মতো। কিন্তু এক অদ্ভুত জেদ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। আয়েষার মিষ্টি মুখটা বারবার ভেসে উঠছে মনের পরদায়। কিছু একটা আমাকে করতেই হবে। ফলে প্রত্যেকটা দরজা আমি খুলে দেখতে চেষ্টা করলাম। কোনও দরজা বন্ধ, কোনওটা খোলা। খোলা দরজায় উঁকি মেরে নজরে পড়ল ছিমছাম ঘর। পরিপাটি বিছানা বালিশ। সম্পূর্ণ খালি। ঘরে কেউ নেই।

হতাশ না হয়ে সরু অলিন্দ ধরে এগিয়ে চললাম। একটার পর একটা দরজা খুলে দেখতে চেষ্টা করছি, কিন্তু আয়েষা কোথাও নেই।

শেষপ্রান্তে পৌঁছে অলিন্দ যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে এসে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালাম। হতাশায় মন ভেঙে পড়তে চাইছে। ঠিক তখনই একটা চাপা গোঙানি আমার কানে এল।

খুব কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে গোঙানিটা আসছে। মনে হল সামনের একটা বন্ধ দরজার পেছন থেকেই। ঝটিতে এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে। হ্যাঁ, এই দরজাটাই। হাতলটা ঘুরিয়ে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল।

দরজা খুলতেই অ্যান্টিসেপটিক আর ইথারের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল। চটপট ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম আমি।

ঘরটা আধো অন্ধকার, কিন্তু তবুও ঘরের কোণে রাখা বিছানাটা আমার অস্পষ্টভাবে নজরে পড়ল। আবার একটা হালকা গোঙানি ভেসে এল বিছানায় দিক থেকে। শব্দটা এখন অনেক জোরে, শোনাল, কারণ এখন আর দরজার আড়াল নেই, দূরত্বও ততটা নয়।

আমি বিছানায় দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলাম। বিছানায় শোয়া মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলাম। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল গলার কাছে। এ আমি কী দেখছি!

আয়েষা বিছানায় শুয়ে আছে। ওর দু-চোখ বোজা।

আমি ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। পরক্ষণে আর একটা আর্ত গোঙানি বেরিয়ে এল ওর ঠোঁট চিরে।

আয়েষা!–ওর কপালে হাত রেখে ফিসফিস করে ডেকে উঠলাম আমি। তাপে আমার হাত যেন পুড়ে যাচ্ছে। কপাল থেকে গালে হাত সরালাম। সেখানেও একই উত্তাপ। আয়েষার জ্বর হয়েছে নাকি।

আয়েষা, চোখ খোলো। আমি হিতেশ। বলেছিলাম না তোমার সঙ্গে দেখা করব দ্যাখো, আমি এসেছি।

ও চোখ খুলল। ওর অপরূপ দৃষ্টি এখন শূন্য। কয়েক মুহূর্ত পরে যেন আমাকে দেখতে পেল। ওর নজর ক্রমে স্পষ্ট হল।

হিতেশ! ওঃ হিতেশ, তুমি কেন এলে?–ওর ঠোঁট কেঁপে উঠল শুধু! অস্পষ্ট ফিসফিস শব্দগুলো বেরিয়ে এল কোনওরকমে।

মনে হল আয়েষাকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ওর চোখের পাতা বুজে আসতে চাইছে বারবার। যেন অসম্ভব ভারী হয়ে উঠেছে।

আমার ভীষণ অবাক লাগল। কী হয়েছে আয়েষার? ও কি অসুস্থ? ঘরটার মধ্যে কেমন যেন একটা হাসপাতাল-হাসপাতাল ভাব। আমি ওর বিছানার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লাম।

তোমার কী হয়েছে, আয়েষা?

আয়েষার শরীর হালকা-নীল চাদরে ঢাকা। অথবা আবছা আলোয় চাদরের রঙটা ওরকম মনে হচ্ছিল।

আমি একটা হাত রাখলাম ওর চাদরে ঢাকা বাহুর ওপর। কিন্তু হাত ঠেকল কোমরে। অবাক হয়ে ওর কাঁধের দিকে নিয়ে এলাম আমার অনুসন্ধানী হাত। সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুতের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা শরীরে। আমার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। আতঙ্কঘন বরফের আঙুল যেন খেলে বেড়াচ্ছে আমার শিরদাঁড়ার ওপর। একটা অস্ফুট আর্তনাদ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে।

আয়েষার কাঁধের কাছে বাহুর কোনও অস্তিত্ব নেই। কাঁধের পর উদ্ধত বুক, পাঁজর, কোমর।

একটানে চাদরটা সরিয়ে দিলাম ওর শরীর থেকে।

স্পর্শের পর চোখে দেখা প্রমাণ পেলাম। আয়েষা এখনও সম্পূর্ণ নগ্ন। কিন্তু ওর যুবতী স্তন বা অন্যান্য দেহসৌষ্ঠব আমার নজর কাড়ল না। প্রচণ্ড অবিশ্বাসে আমি স্থবির হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর কাঁধের দিকে। কাঁধ, গলা ও বুক ঘিরে পুরু ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজে গৌরী স্তনের কিছু অংশও ঢাকা পড়েছে। কিন্তু কাঁধের পাশে বাহুর কোনও অস্তিত্ব নেই।

কাঁধের গা ঘেঁষে ওর অপরূপ হাত দুটো কেটে নেওয়া হয়েছে।

ও..আয়েষা! আমি গভীর শ্বাস ফেলে ডুকরে উঠলাম।

ও ধীরে-ধীরে চোখ খুলল। মাথা তুলতে চেষ্টা করল। ওই আচ্ছন্ন অবস্থাতেও বুঝতে পারল, আমি সব দেখেছি, জেনেছি।

দুর্বল গলায় বিড়বিড় করে আয়েষা বলল, হিতেশ, তুমি এ-অবস্থায় কেন দেখতে এলে আমাকে? বাবাকে শাস্তি দিতে ওরা আমার হাত কেটে নিয়েছে।

ও ক্লান্ত হয়ে আবার এলিয়ে পড়ল বালিশে। কাঁপা হাতে চাদরটা টেনে দিলাম ওর নগ্ন দেহের ওপর। কিছুক্ষণ বসে রইলাম ওর বিছানায় পাশে। অপলকে চেয়ে দেখতে লাগলাম আয়েষার সুন্দুর ঘুমন্ত মুখ। আমার মনে পড়ল। মোহনের সঙ্গিনী মেয়েটির কথা। সেও বোধহয় আশেপাশে কোনও ঘরে একইরকম বিছানায় শুয়ে আছে।

এক সময় ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেলাম দরজায় কাছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম অলিন্দে। তারপর দরজা টেনে বন্ধ করে দিলাম। ঘেন্না ও হতাশায় আমার শরীরের ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে। কিন্তু তার চেয়েও তীব্র হয়ে উঠছে অন্ধ রাগ। কী জঘন্য এই মানুষগুলো। একটা নিরপরাধ মেয়েকে ওরা এরকম পৈশাচিক শাস্তি দিল!

তখন আমার কাণ্ডজ্ঞান বোধহয় লোপ পেয়েছিল, কারণ বিন্দুমাত্রও লুকোনোর চেষ্টা না করে আমি সটান সেই অলিন্দ ধরে ফিরে চলেছি। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, দ্বিতীয় কোনও প্রাণীর সঙ্গে আমার মোলাকাত হল না। মৃত নিস্তব্ধ প্রাসাদ-পুরীতে আমি সম্পূর্ণ একা পথিক।

সামান্য অসুবিধে হলেও ফেরার পথ চিনে নিতে পারলাম। মোহনের ঘরের কাছে এসে দরজায় টোকা মারলাম। একটু পরেই ও দরজা খুলে দিল। গত রাতের সুখশয্যার পর আজ বোধহয় গভীর ঘুমে ডুবে যেতে পারেনি।

ঘরে ঢুকেই তাড়াহুড়ো করে ওকে সব খুলে বললাম। রাগে উত্তেজনায় আমার কথা জড়িয়ে গেল, তেমন করে গুছিয়ে বলতে পারলাম না। কিন্তু মোহন খান্না মোটামুটি সব বুঝতে পারল।

কথা বলতে বলতে আমার কান্না পেয়ে গেল আয়েষার জন্যে।

শেখের লোকগুলো কি মানুষ, না জানোয়ার! তোমাকে তো প্রথমেই বলেছিলাম, কাহরেইন সম্পর্কে যেটুকু খোঁজখবর পেয়েছি তাতে দেশটা সুবিধের নয়।

মোহন আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও। একটু ভাবতে দাও।

কিন্তু বুঝতে পারলাম, বাইরে যতই শান্ত ভাব দেখাক না কেন ভেতরে-ভেতরে মোহনও অস্থির হয়ে উঠেছে, আর সেইসঙ্গে ভয়ও পেয়েছে।

সেই মুহূর্তে হঠাৎ আমার মনে পড়ল রোমিলার কথা।

মোহন! রোমিলাকে যে করে হোক এখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আমি যে সব দেখে ফেলেছি এটা যদি শয়তানগুলো টের পায় তাহলে ওরা কী করবে বিশ্বাস নেই।

মোহন আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে অত ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু আমার মন মানতে চাইল না। মোহন বারবার বলল, দ্যাখো, আমরা এখানে বিদেশি। আমাদের নিয়ে চট করে কিছু করে উঠতে পারবে না শেখের লোকেরা।

কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। কারণ রোমিলা আমার ভীষণ প্রিয়।

অবশেষে মোহন খান্না রাজি হল।

দুজনে মিলে ডাকাডাকি করে রোমিলাকে জাগালাম। বললাম, জলদি সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিতে।

রোমিলার মুখে আতঙ্ক ছায়া ফেলল। ঘুম-ঘুম চোখে তৈরি হয়ে নিতে লাগল ও। তারই মধ্যে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার দাদা?

এখন সময় নেই। পরে সব বুঝিয়ে বলব। আমি ও মোহন প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলাম।

রোমিলার মুখ-চোখ হতবিহ্বল। আমার এবং মোহনের দিকে তাকিয়ে ও বোধহয় বুঝতে পারল সত্যিই ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে আরও দ্রুত ব্যস্ততায় সব গুছিয়ে নিতে লাগল।

মিনিটকয়েক পরেই রোমিলাকে সঙ্গে করে আমরা প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলাম।

রোমিলার ব্যবহারের জন্যে যে-গাড়িটা শেখ হারিদ দিয়েছিলেন সেটা কতকগুলো ফুলগাছের পাশে দাঁড় করানো ছিল। রোমিলা গাড়ি চালাতে জানে। সুতরাং মালপত্র পেছনের সিটে চাপিয়ে ওকে চটপট ড্রাইভারের সিটে ঠেলে বসিয়ে দিলাম। তারপর জানলায় মুখ দিয়ে বললাম, শোন রোমু, সমুদ্রের গা ঘেঁষে যে-রাস্তাটা উত্তরে গেছে সেটা ধরে ছ-সাত মাইল গেলেই কাহরেইন-এর বর্ডার পড়বে। তারপর বাসিরায় দশ মাইল ভেতরে ঢুকলেই রাজধানী আনাম। সুতরাং সেখানে পৌঁছতে তোর বড়জোর ঘণ্টাখানেক লাগবে। তারপর সোজা চলে যাবি ইন্ডিয়াব এমব্যাসিতে। আমাদের কাছ থেকে কোনও খবর না পাওয়া পর্যন্ত সেখানই থাকবি। আমরা দু-একদিনের মধ্যেই তোর সঙ্গে যোগাযোগ করব।

রোমিলা অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু এখন তোমরা কী করবে? তা ছাড়া আমি সরে পড়েছি সেটা টের পেলে শেখ কী ঝামেলা বাঁধবেন কে জানে!

আমি জ্বালাধরা গলায় বললাম, আমি কী ঝামেলা বাঁধাই সেটা আগে দ্যাখ! তাছাড়া গোলমানের সময় তুই এখানে থাকিস তা আমি চাই না। অতএব ঝটপট রওনা হয়ে যা। পথে কোথাও গাড়ি থামাবি না।

গাড়ির ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রোমিলা গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল প্রাসাদের সিংহদুয়ার দিয়ে।

আমি আর মোহন চিন্তায় মশগুল হয়ে প্রাসাদে ফিরে এলাম।

 ঘরে বসে দুজনে যখন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি, তখন মোহন বলল, রোমিলা যে চলে গেল সে ব্যাপারে হারিদকে কী বলবে? মনে রেখো, এখনও আমাদের তেলের বৈঠকে কোনও ফয়সালা হয়নি।

আমি রাগে বিরক্তিতে বলে উঠলাম, তেলের বৈঠক গোল্লায় যাক, আমি শুধু ওই বেচারি মেয়েটার কথা ভাবছি। এখন কী হবে ওর?

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। রোমিলা রওনা হওয়ার পর প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেছে। এতক্ষণে ও নিশ্চয়ই বর্ডার পেরিয়ে গেছে। এখন ওর আর বিপদের ভয় নেই। একথা ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

উঠে দাঁড়িয়ে মোহনকে বললাম, আমি আয়েষার কাছে যাচ্ছি। তুমি কি সঙ্গে আসবে, মোহন?

মোহন আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল। বুঝল, কোনও কিছুতেই আমি নিরস্ত হব না। তখন সে রাজি হল।

বাইরে বেরিয়ে টিমটিমে অলিন্দ ধরে আমরা রওনা হলাম।

.

রোমিলা কাপুর

দাদার কথায় গাড়ি নিয়ে তো বেরিয়ে পড়লাম কিন্তু বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল।

গাড়ি ছুটিয়ে চলেছি জনহীন রাস্তা ধরে। স্টিয়ারিংয়ের ওপরে আমার হাত কাঁপছে। সারা শরীর কাঁপছে। রাতের বাতাসে ঠান্ডা আমেজ গায়ে কাঁটা তুলছে।

বারবার করে ভেবে কোনও অনুমান বা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না, কী এমন বিপদে পড়েছে দাদারা। তবে এটুকু বুঝলাম, বিপদটা সাঙঘাতিক, নইলে আমাকে এভাবে সাত তাড়াতাড়ি রওনা করিয়ে দিত না। আর বিপদের মূলে যে শেখ আবদুল অল হারিদ, সে-ইঙ্গিত তো দাদার কথাতেই পাওয়া গেল।

আমার মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা তোলপাড় করতে লাগল।

হঠাৎই দুটো রাস্তার ক্রসিংয়ে এসে পৌঁছলাম। মনে সামান্য খটকা লাগতেই গাড়ি থামিয়ে দিলাম। দাদা বলেছে, উত্তর দিকের পথ ধরে ছ-সাত মাইল গেলেই কারেই-এর সীমান্তে পৌঁছে যাব। তারপর সীমান্ত পেরিয়ে বাসিরা। বাসিরা থেকে ইন্ডিয়াব এমব্যাসি। তাহলে সামনের ডানদিকমুখী পথটাই কি বাসিরা যাওয়ার পথ?

মনের মধ্যে সন্দেহ ও দ্বিধা উঁকি মারতেই শেখ হারিদের দেওয়া রোড-ম্যাপটার কথা মনে পড়ল। ওটা সবসময় আমি কাছে কাছে রাখি, ঝোলা-ব্যাগের মধ্যে। ঝোলা ব্যাগটা পাশেই সিটের ওপর রাখা ছিল। ওটার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে রোডম্যাপটা বার করে নিলাম। একই সঙ্গে আরও একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল বাইরে। ইলিয়াসের আজকের–উঁহু, বরং বলা ভালো, কাল সকালে দেওয়া গোলাপগুচ্ছ। সময়ে কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে ওদের তাজা জলুস।

ফুলের তোড়াটা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলাম। গন্ধের মাদকতা যেন বেড়ে গেছে সময়ের তালে-তালে। আমার মনে পড়ল ইলিয়াসের কথা।

ইলিয়াসের কাছে গেলে কেমন হয়?

রোড-ম্যাপ দেখে বাসিরার পথ চিনে যেতে আমার অনেক সময় লাগবে। জানি না, শেখের রক্ষীবাহিনী ইতিমধ্যেই আমার পিছু নিয়েছে কিনা। সুতরাং এই মুহূর্তে আমার হাতে যে-জিনিসটা কম তা হল সময়। বাসিরার পথ চিনে যাওয়ার চেয়ে ইলিয়াসের বাড়িতে পৌঁছনো বোধহয় সহজ। কারণ একবার হলেও সেই পথে আমি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেছি।

মন স্থির করতে আর বেশিক্ষণ সময় লাগল না। গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। আমার লক্ষ এখন কানাম, ইলিয়াসের বাড়ি।

স্মৃতিকে ঝালিয়ে পথ চিনে এগোতে শুরু করলাম। যদি বা পথ ভুলে যাই তা হলে সঙ্গে রয়েছে রোড-ম্যাপ। কেন জানি না, ইলিয়াসের কথা মনে পড়তেই দুশ্চিন্তার ভার অনেকটা কমে গেল। শুধু একটা জিনিসই খারাপ লাগছিল, এত রাতে গিয়ে ওদের বিব্রত করা। কিন্তু এই সঙ্গিন বিপদে আমি যে নিরুপায়!

আবছা চেনা রাস্তাগুলো দিয়ে ছুটে চলার সময় দাদা আর মোহনদার কথা মনে পড়ল। ওদের কোনও বিপদ হয়নি তো? আমাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিয়ে ওরা পুরোপুরি নিরাপদ হতে পারল কিনা কে জানে।

ভালো-মন্দ নানান ভাবনা ভাবতে-ভাবতে পথের নিশানা কখন হারিয়ে ফেলেছি জানি না। যখন খেয়াল হল তখন আমি অজানা এক বড় রাস্তায়। শিরা-উপশিরা দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল। মাথার ভেতরে ঝড় উঠল যেন। চিন্তা-স্মৃতি সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। পথের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বিশ্রাম নিলাম। তারপর ড্যাশবোর্ডের আলোর রোড ম্যাপটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম পুরোনো স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার। ইলিয়াসের বাড়ির রাস্তা যেমন করে হোক চিনে নিতেই হবে আমাকে।

আঘণ্টার চেষ্টায় সফলতা এল। সঠিক রাস্তা খুঁজে পেলাম। তারপর অত্যন্ত সতর্কভাবে ধীরে-ধীরে গাড়ি চালিয়ে রাস্তার পর রাস্তা পেরিয়ে যেতে লাগলাম। অবশেষে একসময় পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

এখন আমার চোখের সামনে ইলিয়াসের বাড়ি। রাতের আলো-আঁধারিতে কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে।

আমি গাড়ি থেকে নামতেই নিজেকে কেমন অসহায় মনে হল। এতক্ষণ গাড়ির ভেতরে থাকায় এক ধরনের নিরাপত্তা অনুভব করছিলাম। এখন সেই আড়াল ছেড়ে নির্জন রাতের দুনিয়ায় পা রাখতেই মনে হল, এক বিরূপ পরিবেশে আমি হাজির হয়েছি। আমার চারপাশে বিপদ। যে কোনও মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারি আমি।

আতঙ্ক দ্বিধা ইত্যাদি কাটিয়ে উঠলাম কয়েক পলকেই। এবং সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে গেলাম ইলিয়াসের বাড়ির দরজা লক্ষ করে।

দরজায় পৌঁছতেই বুঝলাম যা আশা করেছিলাম তাই, দরজা বন্ধ!

নিশুতি রাতে দরজা ধাক্কা দিয়ে শোরগোল তুলতে একটু সঙ্কোচ হল। কিন্তু পরক্ষণেই প্রয়োজন ছাপিয়ে গেল সঙ্কোচকে।

ইলিয়াস! ইলিয়াস! বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলাম আমি।

কোনও সাড়া নেই। অন্ধকার বাড়িটা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

ইলিয়াস! ইলিয়াস! আরও জোরে ডেকে উঠলাম আমি। একইসঙ্গে ধাক্কার তীব্রতাও বেড়ে গেল।

সচকিতে চারপাশে তাকালাম। আমাকে অনুসরণ করে কেউ এসে পৌঁছয়নি তো ইলিয়াসের বাড়ির কাছাকাছি? মনে পড়ল, গতকাল আমার আলফা স্পোর্টস অনুসরণ করে এখানে এসে হাজির হয়েছিল আকাশি রঙের ভ্যানটা। ওরা ইলিয়াসের বাড়ি চিনে গেছে। তা হলে…।

কে?

চিন্তায় ছেদ পড়ল। চোখ তুলে দেখি দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। একটা জানলার পরদা সরে গেছে। সেখানে এক পুরুষের সিট। এবং কণ্ঠস্বর ইলিয়াসের।

ইলিয়াস! দরজা খোলো! আমি রোমিলা!–আমার আশঙ্কা কেটে গিয়ে আশ্বাস ভরসা ফিরে এল। চোখে জল এসে গেল আমার। ভাবতে পারিনি পথ চিনে এখানে আমি আসতে পারব, দেখা পাব মহম্মদ ইলিয়াসের।

ছায়ামূর্তিটা দ্রুত জানলা থেকে সরে গেল। তারপর পায়ের শব্দ। অবশেষে সদর দরজা খুলল। আমি ইলিয়াসের দরাজ বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বললাম, ইলিয়াস, ভীষণ বিপদ! আমাকে বাঁচাও।

সবল দু-হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরল ইলিয়াস। বুঝল আমার শরীর ক্লান্তিতে শিথিল হয়ে এলেও উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে।

কী হয়েছে, রোমিলা?–জানতে চাইল ইলিয়াস। কিন্তু পরক্ষণেই কী ভেবে বলল, না, থাক। আগে ওপরে চলো, তারপর কথা হবে।

সদর দরজা বন্ধ করে আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ইলিয়াস। তারপর উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম দুজনে।

যে-ঘরে এসে বসলাম, সে-ঘরটা গতকাল দেখিনি। ছিমছামভাবে সাজানো ইলিয়াসের ঘর। মাঝারি আলোয় ঘরটা কেমন এক রহস্যময় চেহারা নিয়েছে। বিছানার চাদর এলোমেলো। ইলিয়াস নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছিল। এখন ভালো করে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে ঘুম জড়িয়ে আছে। তাতেই মনে হচ্ছে ও আবার কিশোর বয়েসে ফিরে গেছে। এই বিপদের মুহূর্তেও ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে, আদর করতে ইচ্ছে করছে। ও ছাড়া আমার যেন আর কেউ নেই।

আমাকে ধরে বিছানায় বসাল ইলিয়াস। নিজেও বসল। দেখলাম, সামনের একটা কারুকাজ করা টেবিলের ওপর রয়েছে আমার দেওয়া হলুদ ফুলের গুচ্ছ। সযত্নে ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখেছে। ইলিয়াস। মনে পড়ল, ওর লাল গোলাপের ঋণ আমি শোধ করতে পারিনি।

কী হয়েছে রোমিলা? ইলিয়াস নরম স্বরে জানতে চাইল।

আমি যেটুকু জানি ওকে খুলে বললাম, আমার দাদা হিতেশ কাপুর ও তার অফিস কলিগ মোহন খান্না বোধহয় শেখ হারিদের সঙ্গে কোনও বিপদে জড়িয়ে পড়েছে। কারণ, আমাকে ঘোর রাতে ডেকে ওরা গাড়ি নিয়ে রওনা করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তলে-তলে কী কাণ্ড ওরা করছে। তা জানি না। তবে এটুকু জানি, ওরা অন্যায় কোনও কাজে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়বে না। শেখ হারিদের সঙ্গে বোধহয় ওদের কোনও গোলমাল শুরু হবে। দাদার কথায় সেরকমই মনে হয়েছে।

ইলিয়াস একাগ্রমনে সব শুনতে লাগল।

ওকে আরও বললাম, দাদা আমাকে বাসিরায় যেতে বলেছিল। সেখানে গিয়ে ইন্ডিয়াব এমব্যাসিতে আশ্রয় নিতে বলেছিল। কিন্তু রাতবিরেতে আমি সেখানে পথ চিনে যেতে ভরসা পাইনি। সেইজন্যে আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছি, ইলিয়াস! আমাকে তুমি বাঁচাও, বাসিরায় পৌঁছে দাও!

ইলিয়াসের চোয়ালের রেখা ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। বুঝতে পারছি, সংশয় ও দ্বিধার কোনও আলোড়ন চলছে ওর বুকের ভেতরে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইলিয়াস বলল, শেখ হারিদকে তুমি কতটুকু চেনো?

আমি কোনও জবাব দিলাম না। কারণ শেখ হারিদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ইলিয়াস যে যথেষ্ট খবর রাখে সেটা আমি দু-দিনের আলাপেই টের পেয়েছি।

ইলিয়াস অনেক অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কেটে কেটে বলল, রোমিলা, তুমি কাল জানতে চেয়েছিলে আমার বোন আলেয়ার কী হয়েছে ও এখন কোথায়। তখন তোমাকে কোনও উত্তর দিতে পারিনি আমি। কিন্তু এখন, নিজের প্রয়োজনেই সে-উত্তর আমাকে দিতে হবে।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল ইলিয়াস। হাতে হাত ঘষল। মাথার চুলে আলতো করে হাত বোলাল। অবশেষে ভারী গলায় বলল, আলেয়ার কী হয়েছে তা জানি না, তবে ও কোথায় আছে তা জানি। ও শেখ হারিদের কাছে গত পাঁচ মাস ধরে বন্দি।

আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। ঘরটা যেন দুলছে। বুকের ভেতরে ভূমিকম্পের তোলপাড় শুরু হয়েছে যেন। আলেয়া শেখ হারিদের কাছে বন্দি! কী অপরাধে?

সেই কথাটাই ইলিয়াসকে জিগ্যেস করলাম। ও ক্লান্ত স্বরে বলল, অন্যায় আলেয়া করেনি, করেছিলাম আমি। কাগজে একটা লেখা লিখেছিলাম শেখ হারিদের শোষণের বিরুদ্ধে। কাহূরেইন এর জনসাধারণকে সচেতন করতে চেয়েছিলাম শেখের অন্যায়-অবিচার আর শোষণ সম্পর্কে। চেয়েছিলাম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।

কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল ইলিয়াস। ওর ফরসা গাল লাল হচ্ছিল ক্রমে ক্রমে। সামান্য দম নিয়ে ও বলল, সেটাই শেখ জানতে পারেন। কিন্তু আমার গায়ে উনি আঁচড়টি পর্যন্ত কাটেননি। শুধু থাবা বসিয়েছেন আমার মনে। আলেয়াকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল তার লোকেরা। হারিদের প্রাসাদে কোনও অন্তরালে বন্দি করে রাখল।

কিন্তু এ তো অন্যায়! আমি চিৎকার করে উঠলাম। ইলিয়াসদের নিস্তব্ধ বাড়ি কেঁপে উঠল ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে।

আমার কথায় তেতো হাসি হাসল ইলিয়াস ও অন্যায়! এখানে ন্যায়-অন্যায়ের মালিক তো শেখ হারিদ নিজে। তিনি যা করেন সেটাই আইন, সেটাই ন্যায়! একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেওয়াটা তাঁর শখ, যদিও সেটা আসলে একরকম মানসিক বিকৃতি।

আলেয়ার আর কোনও খোঁজ পাওনি?

না, খোঁজ পাইনি। আর কোনওদিন খোঁজ পাব কিনা জানি না। ইলিয়াস বলল, তা ছাড়া শেখ যে-ধরনের শাস্তি দেন বলে শুনেছি..।

আর কিছু বলল না ইলিয়াস। চুপ করে রইল।

আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কী বলব, কী বলা উচিত, তা যেন বুঝে উঠতে পারছি না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম দুজনে। খোলা জানলা দিয়ে দেখছি রাতের আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে।

একসময় আমি বললাম, আমি এখন কী করব, ইলিয়াস?

ইলিয়াস মুখ নীচু করে বসেছিল, সেই অবস্থাতেই বলল, তোমাকে কোনওরকম সাহায্য আমি করতে পারব না, রোমিলা। কারণ শেখের বিচারে সেটা আর-একটা অন্যায় হবে। আর তখন..তখন…ইলিয়াসের শরীর কেঁপে উঠল। মুখে হাত চাপা দিল ও। বিকৃত স্বরে বলল, তখন ওরা আমার ছোট বোনকে ধরে নিয়ে যাবে, নাজমাকে ধরে নিয়ে যাবে!

হঠাৎই মুখ তুলল ইলিয়াস। দু-হাতে আমার কাঁধ চেপে ধরল। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, রোমিলা–আমার রোমিলা, তোমার জন্যে আমি প্রাণ দিতে পারি, কিন্তু নাজমা যে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি। ও ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই। আমি ছাড়া ওরও তো আর কেউ নেই! পিসির তো দিন ফুরিয়ে এল, কিন্তু নামার জীবন যে সবে শুরু।

আমি ইলিয়াসের সজল চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। নিজের বিপদের অনুভব ইলিয়াসের যন্ত্রণার তরঙ্গে কোথায় ভেসে যেতে লাগল। নাজমা–অপরূপ স্বর্গীয় পুতুল-পুতুল মেয়েটা, ওকে নৃশংস শেখ শাস্তি দেবেন একথা ভাবতেই আমার বুক কেঁপে উঠল।

এমন সময় নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুনতে পেলাম গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন। ইলিয়াস বিছানা ছেড়ে উঠল। জানলার কাছে গেল দেখতে।

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। রুমালে চোখ মুছে যখন তাকালাম তখন ইলিয়াস ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর গভীর দুটো চোখে অতল যন্ত্রণার ছায়া।

ওরা এসে গেছে। অস্ফুট স্বরে ইলিয়াস বলল।

আকাশি ভ্যানটা এসে গেছে! আমি জানতাম, ওরা আসবেই।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, নাজমাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

ইলিয়াস আমার কাছে এগিয়ে এল। ছোট্ট করে বলল, চলো।

ওর সঙ্গে নাজমার ঘরে এলাম। আকাশ আরও ফরসা হয়েছে। জানলা খুলে পরদা সরিয়ে দিল ইলিয়াস। ভোরের পবিত্র আলো এসে পড়েছে বিছানায় ঘুমন্ত নাজুমার মুখে। ওর পাশেই শুয়ে বৃদ্ধা পিসিমা। আমি প্রাণভরে নাজমাকে দেখলাম। ও ভালো হয়ে উঠুক।

একসময় ইলিয়াসকে বললাম, চলো, নীচে যাওয়া যাক।

ইলিয়াস আমাকে সঙ্গে করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে আমরা নীচে নামতে লাগলাম।

উঠোনে এসে ইলিয়াস হঠাৎ ডুকরে উঠল। আমাকে জাপটে ধরল দু-হাতে। বলল, না রোমিলা, এ হয় না। চলো, পেছনের দরজা দিয়ে আমরা পালিয়ে যাই!

আমি হাসলাম। ওর মাথার চুল আদর করে ঘেঁটে দিলাম। বললাম, তা হয় না। নাজমাকে আমার ভালোবাসা দিয়ো।

ইলিয়াস আমাকে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল আর বলতে লাগল, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব, রোমিলা! চিরকাল অপেক্ষা করব! একদিন তুমি ফিরে আসবেই। বলো, আসবে না?

আমি হেসে বললাম, রিপোর্টার, তুমি এত সুন্দুর, তোমার চোখ এত সুন্দর, তোমার মন এত সুন্দর…যেখানেই থাকি, ফিরে আমাকে আসতেই হবে।

তারপর ইলিয়াসের বাঁধন ছাড়িয়ে সদর দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম আমি।

ভোরের আলোর দেখলাম, আকাশি ভ্যানটা খানিক দূরে দাঁড়িয়ে, তার দু-পাশে দুজন প্রহরী।

ওদের সঙ্গে ভ্যানে ওঠার আগে গাড়িতে রাখা ঝোলা-ব্যাগ থেকে আমি ইলিয়াসের দেওয়া গোলাপের তোড়াটা নিয়ে নিতে চাই। সেটাই আমার সংক্ষিপ্ত অথচ গভীরতম প্রেমের একমাত্র স্মৃতি।

.

হিতেশ কাপুর

দ্বিতীয়বার পথ চিনে যেতে কোনও কষ্ট হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আয়েষার ঘরের দরজায় সামনে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে উঁকি মারতেই কারণটা পরিষ্কার হল। হাসান বিছানায় পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, জরিপ নজরে দেখছেন আয়েষার শিথিল দেহ। তার সঙ্গে দুজন সশস্ত্র প্রহরী। সকলেই দরজায় দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে।

নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। ঘৃণাভরা স্বর ছিটকে বেরোল আমার মুখ থেকে ও আপনারা মানুষ না পশু? এ জঘন্য কাজ আপনারা কেন করলেন?

বিদ্যুৎগতিতে হাসান ও তার দুজন অনুচর ঘুরে তাকাল। কিন্তু আমাদের দুজনকে দেখামাত্রই ওদের ভাবভঙ্গি সহজ-স্বাভাবিক হয়ে গেল।

হাসান গম্ভীর গলায় বললেন, আপনাদের এখানে আসা উচিত হয়নি, মিস্টার কাপুর। কী করে এ-ঘর আপনারা খুঁজে পেলেন?

আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম, আমার কথার জবাব দিন! দেখুন তো কী অবস্থা করেছেন মেয়েটার!–আঙুল তুলে বিছানায় শোয়া অসহায় মেয়েটিকে দেখালাম।

আপনারা শেখ হারিদের অতিথি, কিন্তু অতিথির সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। হাসান ঠান্ডা স্বরে বললেন, ছিঃ, এ বড়ই লজ্জার কথা! যান, এখনই চলে যান।

কিন্তু ইতিমধ্যে মোহন খান্নার জেদ চেপে গেছে, ও বলল, যাব, কিন্তু তার আগে এই জঘন্য অত্যাচারের কারণ জানতে চাই। আপনাকে বলতেই হবে।

হাসান একই রকম গলায় বললেন, আপনাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই, কিন্তু আপনারা যখন এত পীড়াপীড়ি করছেন তখন শুনুন। তবে তারপর কিন্তু চলে যেতে হবে। আয়েষার দিকে মুখ ফিরিয়ে আঙুল তুললেন হাসান : এই মেয়েটির বাবা মাননীয় শেখ হারিদ সম্পর্কে অসম্মানজনক কিছু মন্তব্য করেন তার পত্রিকায়। সুতরাং তাকে উচিত শাস্তি দিতে তার মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে দেশের আরও দশজন নাগরিক সাবধান হবে। শেখের বিরুদ্ধে যাওয়ার আগে তারা দশবার ভাববে।

কিন্তু এর এ-অবস্থা করলেন কেন?–উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম।

হাসান সহজ সুরে বললেন, সবই আল্লার ইচ্ছে। আমাদের শেখ একজন অতি সাধারণ মানুষ। তাঁর বিশ্বাস এসব ব্যাপারে কোনও উপযুক্ত শাস্তি বেছে দেওয়া তাঁর একার পক্ষে অসম্ভব। তাই তিনি মহান আল্লার শরণাপন্ন হয়েছেন। এই মেয়েটিকে রাখা হল পোষা পাখির বাগানে। সঙ্গে রাখা হল আরও অনেক মেয়েকে। তাদের প্রত্যেকের বন্ধু অথবা আত্মীয়, কেউ না কেউ শেখের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করেছে। পোষা পাখিদের অনেকেই অক্ষত অবস্থায় এক বছর পরে ছাড়া পায়। কিন্তু শেখ হারিদের অতিথিরা যাদের বেছে নেয় তাদের শাস্তি পেতে হয়। প্রত্যেক অতিথিকে বলা হয় শয্যাসঙ্গিনী বেছে নিতে। বেছে নেওয়ার পর প্রত্যেককে জিগ্যেস করা হয়। সঙ্গিনীর দেহের কোন অংশ তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর। তারপর সেই অঙ্গগুলো অস্ত্রোপ্রচার করে বাদ দেওয়া হয় পাখিদের শরীর থেকে অবশ্য অতিথির সঙ্গে সে রাত কাটানোর পর, আগে নয়। পরে যখন মেয়েটি মোটামুটি সেরে ওঠে তখন তাকে পৌঁছে দেওয়া হয় তার বাড়িতে। সেখানে সে হয়ে থাকে আল্লার ন্যায়বিচারের জীবন্ত প্রমাণ।

একটু থেমে হাসান আবার বললেন, মিস্টার কাপুর, আয়েষাকে আপনিই পছন্দ করে বেছে নিয়েছিলেন, শেখ হারিদ নয়। আর ওর সুন্দর হাতের তারিফ আপনি নিজের মুখেই করেছেন, যেমন মিস্টার খান্না করেছেন তার সঙ্গিনীর পায়ের তারিফ। অতএব আল্লার বিচারের বাণী আপনাদের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে। মহামান্য শেখ হারিদকে দয়া করে এর জন্যে দায়ী করবেন না।

আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। চিৎকার করে ফেটে পড়লাম হাসানের ওপর ও নির্লজ্জ শয়তান কোথাকার! তোমরা ওই মেয়েগুলোকে নিয়ে নৃশংস খেলায় মেতেছ আর দায়ী করছ ভগবানকে? এর মাশুল তোমাদের কড়ায় গণ্ডায় গুণতে হবে।

হাসান এবারে সত্যি-সত্যি হাসলেন, নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের হাসি। আমার শরীরে যেন আগুন ধরে গেল।

মাননীয় শেখকে আপনাদের অভিযোগের কথা জানানো হবে এবং তাতে যে তেলের চুক্তির বিশেষ সুবিধে হবে তা মনে হয় না। হাসান তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে লাগলেন, ভারতের আর্থিক অবস্থার কথা সারা দুনিয়ার সবাই জানে। তেলের চুক্তি সফল হওয়াটা আপনাদের পক্ষে খুব জরুরি। সুতরাং এখনও যদি সব হম্বিতম্বি ছেড়ে ক্ষমা চেয়ে নেন তা হলে এ-ব্যাপারটা যাতে বেশিদূর না গড়ায় সেদিকে আমি নজর দিলেও দিতে পারি।

লোকটার স্পর্ধা আর নিশ্চিন্ত ভাব আমাকে জ্ঞানহীন ক্ষিপ্ত করে তুলল। সমস্ত ধৈর্য ও সহ্যশক্তির বাঁধন পলকে ছিঁড়ে গেল। চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম একজন সশস্ত্র রক্ষীর ওপর। চোখের নিমেষে তার রিভলভারটা তুলে নিলাম হোলস্টার থেকে। কিন্তু সেটা উঁচিয়ে ধরার আগেই হাসান লাফিয়ে পড়লেন আমার ওপর। রিভলভারটা কবজার জন্যে শুরু হল দুজনের ধস্তাধস্তি।

জড়াজড়ি হুটোপাটির মধ্যে হঠাৎই গুলি ছুটে গেল–গুড়ুম!

এবং একই সঙ্গে হাসানের মুখে বিস্ময়ের স্থির অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। তারপর বিস্ময় ধীরে ধীরে পরিণত হল অসহ্য যন্ত্রণায়। হাঁটু মুড়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন তিনি।

সর্বনাশ করেছে!–মোহন খান্না আশঙ্কাভরা গলায় বলে উঠল।

 আমি ওকে গুলি করতে চাইনি, কিন্তু যাই বলো ছুঁচোটা উচিত শিক্ষা পেয়েছে।

কথা বলতে-বলতেও আমি রিভলভার তাক করে রেখেছি দুই রক্ষীর দিকে। না, আমার মনে কোনও দুঃখ বা অনুশোচনা জাগেনি! বরং বারবার মনে পড়ছিল আয়েষার কথা।

ওর মালিকটাকে শেষ করতে পারলে আরও খুশি হতাম।

আমাদের এক্ষুনি পালাতে হবে।–মোহন বলল!

 কিন্তু আয়েষার কী হবে?

আমরা যদি ধরা পড়ি তাহলে ওর কোনও উপকারেই আসব না। শিগগির চলো, তর্ক করার সময় নেই।

ভেবে দেখলাম, মোহনের কথায় যুক্তি আছে। সুতরাং রাজি হলাম। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে সেটা বাইরে থেকে লক করে দিলাম। দুই প্রহরী ঘরে বন্দি রইল।

তারপর অলিন্দ ধরে ছুটতে শুরু করেছি দুজনে।

আমাদের কানে আসছিল চিৎকার, কোলাহল, ছুটন্ত পায়ের শব্দ। কারা যেন ক্ষিপ্র পায়ে ছুটে আসছে আমাদের লক্ষ করে। বাইরে যাওয়ার একটা দরজা খুঁজে পেতেই সেদিকে ছুটে গেলাম। দরজা পার হতেই আমরা চলে এলাম প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে। হাঁফাতে-হাঁফাতে বাগান পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রাসাদের ঘেরা পাঁচিলের কাছে। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো নিমেষে পাঁচিল টপকে লাফিয়ে পড়লাম বাইরে।

ছায়া আর অন্ধকারের আড়ালে-আড়ালে সরু রাস্তা ধরে উদভ্রান্তের মতো ছুটে চললাম। ঢালু রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গেছে বন্দরের দিকে। প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে আসার পর পেছনে ছুটন্ত পায়ের শব্দ আর শুনতে পেলাম না। ছুটতে ছুটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম সাগরের কিনারায়।

জলে ছোট-বড় নানান মাপের নৌকো ভাসছে। সেদিকে তাকিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে মোহন খান্না বলল, নৌকো নিয়ে পালানোই সহজ হবে।

আমারও সেইরকমই মনে হল। সুতরাং একটা ছোট্ট পালতোলা নৌকো বেছে নিয়ে আমরা ভেসে পড়লাম।

জলে খানিকটা এগোতেই সমুদ্রের হাওয়া এসে সাদা পালটা ফুলিয়ে দিল। বাতাস আমাদের ঠেলে নিয়ে চলল উপকূল থেকে সাগরে।

এত সহজে পালাতে পারব ভাবিনি। হয়তো সৌভাগ্য আমাদের সহায় ছিল। ধীরে ধীরে তীরের আলোকবিন্দুগুলো আরও ছোট হয়ে মিলিয়ে গেল। ক্রমে মিলিয়ে গেল শেখ হারিদের ছায়াময় বিশাল প্রাসাদ। কিন্তু মনে হল, প্রাসাদের কাছাকাছি অনেকগুলো উজ্জ্বল আলোর ফুটকি ব্যস্তভাবে চলেফিরে বেড়াচ্ছে। অনুসন্ধান কি এখনও চালিয়ে যাচ্ছে ওরা?

চারদিক এখন শূন্য, শান্ত। শুধু ছলছল সাগরের জল চাঁদের আলোর চিকচিক করছে।

উত্তর দিকে যাব ঠিক করেছিলাম, তারপর পাড়ে নৌকো ভেড়াব। কিন্তু ওলটপালট বাতাস সব পরিকল্পনা তছনছ করে দিল। বাতাস আমাদের রাতের আঁধারে ভাসিয়ে নিয়ে গেল দক্ষিণ দিকে–অসহায় ভাবে ছেড়ে দিল থইথই সাগরের অকূল পাথারে।

একদিন একরাত পরে একটা ট্যাঙ্কার আমাদের উদ্ধার করল। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, চেহারা সূর্যের খরতাপে ঝলসে গেছে। দরকারি পরিচর্যার পর ট্যাঙ্কারটা আমাদের পৌঁছে দিল আবাদানে।

রোমিলা! রোমিলা! ওর কথা ভেবে-ভেবে আমি শুধু ছটফট করছি। ও ঠিকমতো পৌঁছতে পেরেছে তো ভারতীয় দূতাবাসে?

আবাদান থেকে অবশেষে আমরা যখন বাসিরায় পৌঁছলাম তখন তিন-তিনটে দিন কেটে গেছে। আমরা সোজা চলে গেলাম ভারতীয় দূতাবাসে।

কিন্তু…।

.

ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেছে। রোমিলার কোনও খবর পাইনি। বহু চেষ্টা করেছি, বহু লেখালিখি করেছি, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। কাহরেইন-এ লোক মারফত খবর নিয়েছি, না, ওই বর্ণনা অনুযায়ী কোনও মেয়েকে কেউ দেখেনি। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব কিছুই করতে বাকি রাখিনি। মোহন খান্নাও আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে, কিন্তু ফলাফল তাতেও শূন্য। আমাদের আদরের ছোট বোনের কোনও হদিস আজও পাইনি।

তাই শুধু ভাবি, এর জন্যে কে দায়ী? নিয়তি, না আমি নিজে?

.

উপসংহার

আকাশি ভ্যান যেখানে এসে থামল সেটা শেখ হারিদের প্রাসাদ।

রোমিলাকে রক্ষীরা ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখল একটা ছোট ঘরে। প্রথমবার প্রাসাদে এসে যে-বিলাসবহুল আপ্যায়ন ও পেয়েছিল এ যেন তার ঠিক বিপরীত।

পরের দিনটা রোমিলার জীবনে এক অতুলনীয় আতঙ্কের দিন।

সকালবেলা শেখ হারিদ এলেন ওর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু আগেকার ভদ্র নম্র ব্যবহারের ছিটেফোঁটাও এখন নেই তার মধ্যে। খুব কর্কশ রুক্ষ ভঙ্গিতে তিনি বললেন, মিস কাপুর, আপনার দাদা অত্যন্ত অন্যায় একটা কাজ করেছেন। যদি তার ভালো চান তাহলে বিনা মতলবে যা বলা হবে অক্ষরে-অক্ষরে শুনবেন। নইলে বিপদে পড়বেন।

শেখ চলে গেলেন। তখন প্রাসাদের ভৃত্যরা এসে রোমিলাকে নিয়ে গেল একটা স্নান ঘরে। ওর পোশাক খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন করা হল, তারপর সুবাসিত সাবানে ওকে স্নান করিয়ে সুগন্ধি ছড়িয়ে দেওয়া হল ওর নগ্ন দেহে। এবং ওই নগ্ন অবস্থাতেই ওকে নিয়ে যাওয়া হল প্রাসাদের পিছনদিকের এক মনোরম উদ্যানে। সেখানে ওরই মতো জনা কুড়ি নগ্ন রূপসী ঘোরাফেরা করছে। ঠিক যেন উর্বশীদের নন্দনকানন।

দুটোদিন রোমিলার স্বচ্ছন্দে কেটে গেল।

তৃতীয় দিন শেখ হারিদ বাগানে এলেন। সঙ্গে দুজন প্রৌঢ় বিদেশি অতিথি এবং একজন অনুচর। ওঁরা চারজন পায়চারি করতে লাগলেন বাগানের মধ্যে।

অতিথি দুজন রোমিলার সামনে এসে বহুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ওর নগ্ন যৌবনসম্পদ।

রোমিলার মুখ লজ্জায় লাল হল।

কিন্তু আরও দুর্ভাগ্য বোধহয় ছিল ওর কপালে।

একটু পরেই ওকে ডাকা হল শেখদের কাছে। ওকে পায়চারি করতে বলা হল তাদের সামনে। সবদিক থেকে পরখ করে দেখা হল ওর দেহসৌষ্ঠব।

অবশেষে মেজাজি গলায় শেখ হারিদ বললেন, আপনার পছন্দের তারিফ করতে হয়, সিনর রোমানি।–শেখ রেমিলার কোমল মসৃণ স্তন স্পর্শ করলেন চঞ্চল আঙুলে? কিন্তু এবারে দয়া করে বলুন, ওর দেহের কোন অংশটা আপনার চোখে সবচেয়ে আকর্ষণীয়?

হারিদের অতিথি হোঁচট খাওয়া ইংরেজিতে বললেন, ওর সব সুন্দর…তবে আমার মনে হয় এরকম লোভনীয় বুক আমি আগে দেখিনি…।

একটু থামলেন সিনর রোমানি।

 আর?–শেখ উৎসাহ দিয়ে জানতে চাইলেন।

 আর ওর টানা-টানা চোখদুটোর কোনও জবাব নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *