রুদ্ধশ্বাস

রুদ্ধশ্বাস

০১.

হেডলাইটের আলো বাচ্চা মেয়েটার মুখের ওপরে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ফরসা ফুটফুটে অথচ ভয় পাওয়া মুখ। গাড়ির ঝাঁজালো হ্যালোজেন আলোয় একেবারে যেন ঝলসে যাচ্ছে।

চোয়াল শক্ত করে প্রাণপণে ব্রেক কষল শমিত। কালো পিচের ওপরে ঘষটে গেল গাড়ির চাকা। রবার পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। শমিতের পাশে বসা পাপিয়া এই-ই-ই বলে চেঁচিয়ে উঠে ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। ওর শরীরটা সামনের উইন্ডশিল্ডের দিকে ছিটকে যেতে চাইছিল, কিন্তু সিট বেল্ট ঠিকমতো বাঁধা থাকায় সেটা এড়ানো গেল।

পিছনের সিটে বাপ্পার বসে থাকার কথা কিন্তু ও বসে ছিল না। ও দাঁড়িয়ে বাবা আর মা-কে সাতকাহন করে শোনাচ্ছিল, ও কটা লুচি খেয়েছে, কটা ফিশ বাটার ফ্রাই, কটুকরো মাটন আর কটা রসগোল্লা। ওর ফর্দ শোনানোর মাঝখানে ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় ওর থুতনিটা সামনের সিটের একপাশে ঠুকে গেল।

বারাসাতে বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছিল শমিত, পাপিয়া আর বাপ্পা। শমিত গাড়ি চালাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য অ্যাকসিলারেটরে পায়ের চাপ একটু বাড়িয়েই দিয়েছিল। ফ্ল্যাটে ওদের পোষা কুকুর চ্যাম্প একা রয়েছে। যদিও ওর ঘণ্টা চার-পাঁচ একা থাকার দিব্যি অভ্যেস আছে, তা হলেও দুশ্চিন্তা একটা থাকেই।

এমনিতে ভি.আই.পি. রোডে গাড়ি-টারি একটু জোরেই যায়। তার ওপর রাত এখন প্রায় সাড়ে দশটা। সুতরাং রাস্তা সুনসান। শমিত বেশ মেজাজেই গাড়ি চালাচ্ছিল।

পাপিয়া একবার সাবধান করে বলে উঠেছিল, এত জোরে চালানোর কী হয়েছে। বাড়ি ফিরতে না হয় একটু দেরিই হল…।

শমিত পাপিয়ার কথার জবাব না দিয়ে ছেলেকে লক্ষ করে হেসে মন্তব্য করেছে, বাপ্পা, তোর মা ভয় পেয়ে গেছে। যো ডর গয়া।

সমঝো মর গয়া। বাবার অর্ধেক কথাটা শেষ করল বাপ্পা।

শমিত মাঝে-মাঝেই ঠাট্টা করে এই কথাটা বলে। তাই শুনে-শুনে বাপ্পার কথাটা মুখস্থ হয়ে গেছে।

সুতরাং রাত সাড়ে দশটার ভি.আই.পি. রোডের ওপরে শমিতের মারুতি আটশো বলতে গেলে বেপরোয়াভাবে উড়ছিল।

দমদম পার্ক পেরোনোর পরেই ঘটনাটা ঘটেছে। রাস্তার বাঁদিকের গাছপালার আড়াল থেকে বলতে গেলে আচমকাই ছুট্টে বেরিয়ে এসেছে মেয়েটা। শমিত পোড়খাওয়া ড্রাইভার না হলে মেয়েটাকে নির্ঘাত ধাক্কা মেরে বসত।

কিন্তু মেয়েটা ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। স্টিয়ারিং-এ বসে ওর একটা পা শুধু দেখতে পাচ্ছিল শমিত। তা হলে কি ওর গায়ে ধাক্কা লেগেছে? গাড়ির ব্রেক কষার তীব্র শব্দে সংঘর্ষের কোনও শব্দ শমিতের কানে আসেনি। আর গাড়িতে বসে ঠিক বোঝাও যায়নি ধাক্কা লেগেছে কি না।

সিট বেল্ট খুলে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়ল শমিত। বাপ্পাও সর্দারি করে নামতে যাচ্ছিল, কিন্তু পাপিয়া ওকে ধমকে উঠল। বাপ্পা বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ও ক্লাস এইটে পড়ে। এমন কিছু কচি খোকা নয় যে, বাবাকে একটু সাহায্য করতে পারবে না! কিন্তু মা সেটা বুঝলে তো!

মেয়েটা চিত হয়ে পড়ে ছিল রাস্তায়। গাড়ির হেডলাইটের আলো ওকে ভাসিয়ে দিয়েছে। বয়েস কত হবে? বড়জোর নয় কি দশ। পুতুল-পুতুল মিষ্টি মুখটাকে ঘিরে রেখেছে একরাশ কেঁকড়া চুল। দু-চোখ বোজা হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে।

মেয়েটির পরনে লম্বা ফ্রক–তাতে হালকা রঙের কাপড়ে চড়া রঙের সস্তা প্রিন্ট। দুকানে রুপোর মাকড়ি, গলায় সরু ইমিটেশন চেন।

ওকে দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কোথাও সেরকম চোট পেয়েছে কি না।

কেমন একটা ঘোরের মধ্যে এপাশ-ওপাশ দেখল শমিত। রাস্তা ফঁকা। কেউ নেই। শুধু কখনও কখনও ছুটন্ত গাড়ির জ্বলজ্বলে দুটো চোখ হুউস করে উড়ে যাচ্ছে।

ঝুঁকে পড়ে মেয়েটাকে শমিত তুলে নিল। ছিপছিপে হালকা শরীর–তেমন একটা ওজন নেই। শমিতের দু-হাতের ওপরে দেহটা ছোট্ট কোলবালিশের মতো নিথর হয়ে পড়ে আছে।

চটপট গাড়ির কাছে ফিরে এল ও। ওর মাথার মধ্যে ডাক্তার-হাসপাতাল-নার্সিংহোম– এইসব শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল।

বাপ্পা তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু দেখছিল। বাবাকে গাড়ির দিকে আসতে দেখেই ও গাড়ির দরজা খুলে ধরল। সুইচ টিপে গাড়ির ভেতরের আলোটা জ্বেলে দিল।

বাপ্পা আর শমিত যখন মেয়েটাকে পিছনের সিটে কসরত করে শুইয়ে দিচ্ছে তখন পাপিয়া কাঁপা গলায় জিগ্যেস করল, মেয়েটার সঙ্গে আর কেউ নেই! এত রাতে ভি.আই.পি. রোডে ও একা…।

শমিত সংক্ষেপে বলল, দেখছি তো আর কেউ নেই…।

ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্ট বাঁধল শমিত। তারপর ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। বাপ্পা গাড়ির ভেতরের আলোটা নিভিয়ে দিল। কেমন একটা ভয় ওদের আঁকড়ে ধরতে চাইছিল।

গাড়ি খানিকটা এগিয়ে যেতেই পাপিয়ার চোখে পড়ল, রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে গাছগাছালির গায়ে একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে রয়েছে–তার পিছনের লাল লাইট দুটো জ্বলছে।

বাবা, ওর সিরিয়াসলি লাগেনি তো? বাপ্পা আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করল।

শমিত ঠান্ডা গলায় বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে লাগেনি। চলো, ওকে ডক্টর চৌধুরীর কাছে নিয়ে যাই…উনি ভালো করে দেখে কনফার্ম করবেন।

পাপিয়া প্রায় আঁতকে উঠে বলল, পাগলের মতো কী বলছ তুমি! ডক্টর চৌধুরীর কাছে নিয়ে গেলেই উনি ব্যাপারটা পুলিশে ইনফর্ম করতে বলবেন। তারপর টানাহ্যাঁচড়া, পুলিশ-কেস…ওঃ, আমি আর ভাবতে পারছি না…।

পাপিয়া, তুমি ভুলে যাচ্ছ, ডক্টর চৌধুরী আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। তুমি যা ভাবছ ওসব কিচ্ছু হবে না।

বাই চান্স যদি হয় তখন কে বাঁচাবে? ভাগ্যিস, ভি.আই.পি.-র পুলিশ প্যাট্রল আমাদের দেখতে পায়নি!

হঠাৎই শমিতের মনে হল, পাপিয়ার কথা নিতান্ত আজগুবি নয়। ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশের ঝাট হলেও হতে পারে। তাই ও পাপিয়াকে হাত নেড়ে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আগে তো ওকে বাড়িতে নিয়ে যাই..।

শমিতের গাড়ির সিট কভারের সঙ্গে জলের বোতল রাখার ব্যাগ আছে। সেখানে সবসময় একটা প্লাস্টিকের বোতলে জল রাখা থাকে। বাপ্পা চুপ করে মা-বাবার কথাবার্তা শুনছিল। কিন্তু একইসঙ্গে ওর হাত কাজ করছিল।

জলের বোতলটা ব্যাগ থেকে বের করে নিয়ে ও ছিপি খুলল। কিছুটা জল হাতে ঢেলে নিয়ে ছিটিয়ে দিল মেয়েটির চোখে-মুখে। তারপর ভিজে হাতটা আলতো করে বুলিয়ে দিল মেয়েটির কপালে।

বোতলটা আবার জায়গামতো রেখে দিয়ে একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল বাপ্পা। কিন্তু না–গাড়ির ঝাঁকুনির জন্য মেয়েটার শরীর যেটুকু নড়াচড়া করছে তার বাইরে বাড়তি কোনওরকম আলোড়ন দেখা গেল না।

ওকে নিয়ে তখনও আলোচনা করছিল শমিত আর পাপিয়া।

কার মেয়ে? কোথায় থাকে? বাড়ির লোকজনকে ঠিকমতো খবর দেওয়া যাবে কি না! ওর জ্ঞান ফিরলেই হয়তো ওর বাড়ির ঠিকানা কি ফোননম্বর জানা যাবে। তখন…।

এইসব নানান কথার মাঝে ওরা পৌঁছে গেল বাড়িতে।

অরবিন্দ সরণি থেকে রাজা দিনেন্দ্র স্ট্রিটে খানিকটা ঢুকেই গোলাপি রঙের একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। শমিতরা এ-বাড়িরই তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকে। বাড়ির নীচতলাটা গ্যারেজ। শমিতের গাড়ি সেখানে থাকে।

শমিত হর্ন দিতেই বড় লোহার দরজা খুলল দারোয়ান ভজনচাঁদ।

পাপিয়া চাপা গলায় বলল, গাড়িটা গ্যারেজে ঢোকানোর দরকার নেই। গাড়ি এখানে রেখে আগে ফ্ল্যাটে চলো। আমি মেয়েটাকে কোলে নিয়ে এতটা সিঁড়ি ভাঙতে পারব না।

শমিত ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, কেন? গ্যারেজে গাড়ি রেখে তারপরেও তো ওই কাজগুলো করা যায়।

মেয়েটাকে এই অবস্থায় দেখলে ভজন সন্দেহ করতে পারে…।

এখন গাড়ি থেকে নামলেও তো দেখতে পাবে সন্দেহও করতে পারে যে, আমরা একটা বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করে এনেছি।

শমিতের ঠাট্টায় পাপিয়া মুখ বেঁকাল: আমার বুদ্ধি কখনও তুমি নেবে না।

তখন বাপ্পা বলল, বাবা, মা যা বলছে তাই করো। আমরা এখানেই নেমে যাই। তুমি পরে নীচে এসে গাড়ি গ্যারেজ করে দিয়ো–

অগত্যা শমিত রাজি হল।

ওরা সবাই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। শমিত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ওর মাথাটা শুইয়ে দিল নিজের ডানকাঁধের ওপরে। তারপর সদর দরজা দিয়ে ঢুকে গ্যারেজের পাশের পথ ধরে হাঁটা দিল ফ্ল্যাটবাড়ির দরজার দিকে।

ভজনচাঁদ লোহার গেটের একটা পাল্লার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কখন শমিতের মারুতি গ্যারেজে ঢুকবে। তার বদলে ওদের হেঁটে যেতে দেখে সে বেশ একটু অবাক হল। ভাবল, শমিতবাবু বোধহয় গাড়ি নিয়ে আবার বেরোবে।

তাই ও ডেকে উঠল পিছন থেকে, স্যার, আপনি কি আবার বেরোবেন?

শমিত মুখ না ফিরিয়েই জবাব দিল, না। আমি ওপর থেকে এসে গাড়ি তুলে দিচ্ছি।

পাপিয়া তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল, সেইসঙ্গে বাপ্পাকেও হাত ধরে টানছিল। কিন্তু বাপ্পা ঠিক বুঝতে পারছিল না ভজনচাঁদকে ভয় পাওয়ার কী আছে।

ভজনচাঁদ কৌতূহল চাপতে পারল না। পিছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, এ-লড়কিকে কোথা থেকে নিয়ে এলেন, স্যার? ওর কি বোখার হয়েছে?

পাপিয়ার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল।

শমিত কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তাই পাপিয়ার দিকে তাকাল।

 আর বাপ্পা পিছন ফিরে ভজনচাঁদকে দেখছিল।

মাঝবয়েসি বোকা-বোকা মুখ। মাথায় কদমছাঁট চুল। মুখে বসন্তের দাগ। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর পায়ে খাকি হাফ প্যান্ট। এমনিতে লোকটা বড়ই সাদাসিধে সরলমতি। শখ কিংবা নেশা বলতে দুটি জিনিস খইনি আর সিনেমা।

পাপিয়া ভজনচাঁদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে অকারণেই হাসল। তারপর বলল, আমার বোনের ছোট মেয়ে, ভজন। তুমি ঠিকই ধরেছ, ওর জ্বর হয়েছে। ওর বাবা-মা কদিনের জন্যে দিল্লি গেছে– তাই ও এখন আমাদের কাছে দু-চারদিন থাকবে।

ভজনচাঁদকে এরকম সাতকাহন কৈফিয়ত দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু বানানো গল্পটা বলতে পেরে পাপিয়ার ভালো লাগল। কারণ, এই মেয়েটি সম্পর্কে অনেকেই অনেক প্রশ্ন করবে। তাদের মুখ বন্ধ করতে এই গল্প তৈরি করাটা খুব জরুরি। এই গল্পটা বারবার বলতে-বলতে এর ফাঁকফোকরগুলো ঠিকঠাক করে নেওয়া যাবে–অনেকটা নাটকের রিহার্সালের মতো। তখন এই বানানো গল্পটাই সত্যি ঘটনার মতো শোনাবে।

ওরা সিঁড়ি উঠে চলে এল তিনতলার।

পাপিয়া ব্যাগ থেকে চাবির গোছা বের করল। কোলাপসিবল গেটের তালা খুলল। তারপর পালিশ করা কাঠের দরজার নাইটল্যাচে চাবি ঢোকাল।

বাপ্পা মেয়েটার মুখ দেখার চেষ্টা করছিল। ওর মনে হচ্ছিল, ডাক্তার আঙ্কেলকে খবর দিলেই বাবা ভালো করত। কিন্তু মায়ের যতসব উলটোপালটা ভয়!

ফ্ল্যাটের দরজায় শব্দ হতেই ভেতর থেকে চ্যাম্পের চাপা ডাক শোনা গেল কয়েকবার। আর ওরা ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ডোবারম্যান কুকুরটা কোথা থেকে বেরিয়ে এসে শমিত আর বাপ্পার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে লাগল। বাপ্পা চ্যাম্প, চ্যাম্প বলে কয়েকবার ডাকল, ওর ঘাড়ে আলতো চাপড় মেরে হাত বুলিয়ে দিল।

বসবার ঘরের রট আয়রন সোফায় মেয়েটাকে খুব সাবধানে শুইয়ে দিল শমিত। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে পাপিয়াকে বলল, ভালো করে দ্যাখো ওর কোথাও চোট লেগেছে কিনা। আর চোখে-মুখে একটু জলের ছিটে দাও…হয়তো সেন্স ফিরে আসবে। আমি গাড়িটা গ্যারেজে তুলে আসছি।

বাপ্পা বলে উঠল, গাড়িতেই আমি জল দিয়েছিলাম…।

আর-একবার দিয়ে দ্যাখ– বলে শমিত ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

পিছন থেকে পাপিয়া ডেকে বলল, ভজনচাঁদের সঙ্গে এ-নিয়ে আর কোনও কথা বলবে না।

মিনিট দশেক পরেই ফ্ল্যাটে ফিরে এল শমিত।

এসে দ্যাখে মা আর ছেলে ফ্যাকাসে মুখে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা দুজনেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।

শমিত অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

শমিতের কথার জবাব দিল না কেউ। শুধু পাপিয়া আঙুল তুলে মেয়েটার ফ্রকের দিকে দেখাল।

শমিত তাকাল সেদিকে, কিন্তু তেমন কিছু ঠাহর করতে পারল না।

 তখন পাপিয়া কাঁপা গলায় বলল, রক্ত–ওর ফ্রকে রক্তের ছোপ লেগে রয়েছে।

 এইবার বুঝতে পারল শমিত। মেয়েটার কাছে গিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল ও।

সত্যিই তো! ফ্রকের ওপরে যে চড়া রঙের সস্তা প্রিন্ট ও দেখেছিল তার মধ্যে নীল আর সবুজ রংটায় কোনও গোলমাল নেই। তবে লালের ছোপগুলো মোটেই রং নয়–রক্ত। কোনওভাবে ওর ফ্রকে ছিটকে গিয়ে ছোট-বড় ফোঁটা মিলিয়ে একটা এলোমেলো নকশা তৈরি করেছে।

রক্তের দাগগুলো আলতো করে পরখ করল শমিত। এগুলো কি মানুষের রক্ত, না কি অন্য কোনও পশুপাখির রক্ত? না কি মেয়েটা অ্যাক্সিডেন্টে চোট পেয়ে আহত হয়েছে? হয়তো ওর পায়ে টায়ে কোথাও কেটে গেছে।

সে কথাই পাপিয়াকে বলল ও।

তুমি ওকে একটু বাপ্পার বেডরুমে নিয়ে যাও। ভালো করে চেক করে দ্যাখো উন্ডেড হয়েছে কি না। আর ওর ড্রেসটা ছাড়িয়ে ওকে বাপ্পার একটা ড্রেস পরিয়ে দাও। কিছুক্ষণ চিন্তা করল শমিত। তারপর বিড়বিড় করে বলল, মনে হচ্ছে আমাদের কপালে পুলিশের হেনস্থা লেখা আছে।

পুলিশ! আঁতকে উঠে বলল পাপিয়া।

শমিত ক্লান্তভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।

আর ঠিক তখনই মেয়েটার মাথাটা সামান্য নড়ে উঠল। ওর ঠোঁট ফাঁক হল।

বাপ্পা চেঁচিয়ে উঠল, বাবা, দ্যাখো…দ্যাখো…!

মেয়েটা ততক্ষণে চোখ মেলে তাকিয়েছে।

ও চোখ মেলে তাকাতেই ওর মিষ্টি মুখটা আরও মিষ্টি হয়ে গেল। তখন বোঝা গেল, চোখেরও একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে।

মেয়েটিকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই বাপ্পার মুখে হাসি ফুটে উঠল। একই সঙ্গে একটা স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুকের ভেতর থেকে। যাক, আর ভয় নেই।

সামান্য হাসি পাপিয়াকেও ছুঁয়ে গেল। ও নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁফ ছাড়ল। আর থানা-পুলিশ নার্সিংহোমের ঝামেলা নেই। মেয়েটার মুখ থেকে ঠিকানা-ফোননম্বর জানামাত্রই ওর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যাবে।

ও শমিতের দিকে তাকিয়ে হাসল। শমিত ওর হাসি ফিরিয়ে দিল।

ঠিক তখনই মেয়েটা উঠে বসল। ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমার নাম মিষ্টু। তোমরা কে?

নতুন অতিথিকে প্রথম থেকেই বেশ ভালোরকম জরিপ করছিল চ্যাম্প। এখন, মিষ্টু উঠে বসামাত্রই, চ্যাম্প এগিয়ে এল ওর কাছে। চাপা গলায় কয়েকবার ডেকে উঠল।

.

০২.

সকালে পাপিয়ার ঘুম ভাঙতেই একটা গানের সুর কানে এল। খুব মিষ্টি গলায় কেউ গাইছেঃ

ভোরের আলো।
ভোরের বাতাস
 ভোরের পাখির গান,
 নয়ন মেলে
দেখ না মাগো
জুড়াবে তোর প্রাণ…

প্রথমটা পাপিয়া ভাবল, বাপ্পা বোধহয় ভোরবেলা উঠেই ফুল ভলিয়ুমে এফ.এম. চ্যানেল শুনছে। ওর মনে পড়ল, বাপ্পা ও-ঘরে শুয়েছে–ওর বাবার সঙ্গে। ও-ঘরে ট্রানজিস্টর রেডিয়ো চললে এ-ঘরে শুনতে পাওয়ার কথা নয়। তবুও…

তখনই পাপিয়া চোখ খুলল।

চোখ খুলেই যে-ছবিটা দেখল তাতে ওর মনটা কেমন হয়ে গেল। ওর মনে হল, এরকম সুন্দর ভোর ওর জীবনে আগে কখনও আসেনি।

রাস্তার ধারের একটা জানলার পাশে বসে বাইরের দিকে চোখ মেলে চেয়ে আছে মিষ্টু। আর অদ্ভুত তৈরি গলায় সুর করে গান গাইছে–যে-গান পাপিয়া এফ.এম. চ্যানেলের গান বলে ভুল করেছিল।

বিছানায় উঠে বসল পাপিয়া। মিষ্টুকে দেখতে লাগল। মিষ্টু মুখ ফিরিয়ে পাপিয়াকে একপলক দেখল, কিন্তু গান থামাল না। একচিলতে হাসল শুধু।

মেয়েটার গায়ে বাপ্পার নীল আর খয়েরি প্রিন্টের হাফশার্ট, পায়ে বাপ্পার হাফপ্যান্ট হাফপ্যান্টের রং হালকা বিস্কুট, আর তাতে একগাদা পকেট।

পাপিয়াদের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে নীচের রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার ওপারে একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ, আর তার পিছনেই টিনের চাল দেওয়া একটা মোটর গ্যারেজ। গ্যারেজের পাশে অনেকটা লম্বা জায়গা জুড়ে টিনের কৌটো তৈরির একটা কারখানা। তার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একটা কাঠগোলাপ গাছ।

বর্ষা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই, কিন্তু দুটো গাছ ঋতুর কথা না ভেবে এখনও ফুল ফুটিয়ে চলেছে। গাছ দুটোর মাঝখান দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নজর চলে যায়। দেখা যায় বিশাল আকাশ। আকাশের নীচে খুচরো বাড়ির জঙ্গলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা চিমনি। ওটা দিয়ে কখনও ধোঁয়া বেরোতে দেখেনি পাপিয়া।

মিষ্টু গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে এসবই দেখছিল বোধহয়, আর গান গাইছিল।

কাল সারারাত পাপিয়ার ভালো ঘুম হয়নি। নানান চিন্তা ওকে কুরেকুরে খেয়েছে। তারপর, শেষরাতের দিকে, নেহাত ক্লান্ত হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।

পাপিয়ার দুশ্চিন্তার কারণ মিষ্টু। কাল রাতে ওর জ্ঞান ফিরে আসার পর ওরা সবাই নিশ্চিন্ত হয়েছিল। ভেবেছিল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে।

মিষ্টুর জ্ঞান ফেরার পরই পাপিয়া ওর পাশটিতে বসে পড়েছে। একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

মিষ্টু, এই হল তোমার শমিত আঙ্কল, এ হল বাপ্পা-তোমার দাদা, আমি হলাম পাপিয়া আন্টি। আর এই যে সুন্দর ডোবারম্যান কুকুরটা দেখছ–ওর নাম চ্যাম্প।

মিষ্টু হাসিমুখে পরিচয়ের পালা সারছিল। একে-একে ও হাত বাড়িয়ে দিল শমিতের দিকে, বাপ্পার দিকে, পাপিয়ার দিকে। আর সবশেষে চ্যাম্পের ঘাড়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমার ডোবারম্যান ভালো লাগে। আমি ডোবারম্যান আগেও দেখেছি।

শমিত অধৈর্য হয়ে পড়ছিল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। কারণ, ও জানে, পাপিয়ার বাস্তব বুদ্ধি অনেক বেশি। অনেক সময় ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা জেদ ধরে বসে–তখন ওদের কাছ থেকে কোনও কথা বের করা যায় না। মিষ্টুর বেলায় কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চায় না পাপিয়া। ওর সঙ্গে সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহার করে সব কথা জানতে হবে।

তোমার ভালো নাম কী? পাপিয়া মিষ্টুর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করল।

ভালো নাম জানি না। আমার নাম মিষ্টু।

একটু অবাক হলেও পাপিয়া হাল ছাড়ল না।

তোমার বাড়ি কোথায়?

জানি না। পা দোলাতে-দোলাতে নির্বিকার মুখে বলল মিষ্টু।

সে কী! বাড়ি কোথায় জানো না? শমিত জানতে চাইল এবার।

না, আঙ্কল, জানি না। শমিতের দিকে সরল চোখে তাকিয়ে বলল মেয়েটা।

 তোমাদের বাড়ির ফোন নাম্বার মনে আছে? পাপিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে নরম করে জানতে চাইল।

না, মনে নেই।

বাবার নাম, মায়ের নাম?

এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে না বোঝাল মিষ্টু।

তোমার জামায় রক্ত লাগল কীভাবে? প্রশ্নটা করে শমিত আবার হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। মিষ্টুর কাছে।

রক্ত? কোথায়? মাথা নীচু করে গায়ের ফ্রকের দিকে তাকাল মিষ্টু। লাল ছোপগুলোয় বারতিনেক আঙুল ছুঁইয়ে মুখ বেঁকাল ও এ ম্যা! আমার ফ্রকটা শিগগির পালটে দাও। ওটা কাচতে হবে।

পাপিয়া ফ্যালফেলে চোখে শমিতের মুখের দিকে তাকাল।

 বাপ্পা জিগ্যেস করল, কোন স্কুলে পড়ো তুমি?

মিষ্টু পালটা জানতে চাইল, তুমি কোন স্কুলে পড়ো?

ক্যালকাটা বয়েজ..। আর, তোমার স্কুল?

মিষ্টু ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে মনে করার খুব চেষ্টা করল। তারপর মাথা নাড়ল : নাঃ, মনে পড়ছে না। ভুলে গেছি।

শমিত আর পাপিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। বাপ্পাও হতাশ হয়ে মা-বাবার দিকে দেখল।

মিষ্টু পাপিয়াকে বলল, আমার এই নোংরা ড্রেসটা চেঞ্জ করে দাও, আন্টি।

পাপিয়া কেমন অসহায়ভাবে শমিতের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।

শমিত বিড়বিড় করে বলল, ওর কোনও কথা মনে নেই। মনে হয় কোনও শক-টক পেয়ে পুরোনো সব কথা পুরোপুরি ভুলে গেছে।

শকটা পেল কী করে? তোমার গাড়িতে চোট পেয়েছে বলে তো মনে হয় না।

পাপিয়ার কথার জবাবে ঠোঁট ওলটাল শমিত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না, আমার গাড়িতে চোট পায়নি। অন্য কোনও প্রবলেম হবে। যাও, ওকে বাপ্পার ঘরে নিয়ে যাও। যদি সেরকম কোনও চোট না থাকে তা হলে ডাক্তারের ব্যাপারটা কাল ভাবা যাবে।

না, মিষ্টুর শরীরে কোনওরকম আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়নি পাপিয়া। ওকে বাপ্পার ড্রেসটা পরিয়ে দেওয়ার পর ওর ফ্রকটা হালকা গরম জলে ভিজিয়ে দিয়েছে। রক্তের দাগগুলো তুলে ফেলা দরকার। কাল সকালে পাপিয়া নিজে জামাটা কেচে ফেলবে। ঠিকে কাজের লোককে এটা কাচতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

রাতে মিষ্টু পাপিয়ার সঙ্গে শুয়েছে। তার আগে পাপিয়া ওকে এগ চাউমিন তৈরি করে খাইয়েছে। খাওয়া দেখে মনে হয়েছে, ওর খুব খিদে পেয়েছিল।

কথায় কথায় পাপিয়া ওকে অনেক কিছু জিগ্যেস করেছে, কিন্তু মিষ্টু সেরকম কোনও উত্তর দিতে পারেনি। ওর স্মৃতির স্লেটটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে কেউ যেন তাড়াহুড়ো করে মুছে দিয়েছে। ফলে দু-একটা খাপছাড়া স্মৃতির টুকরো ছাড়া মিষ্টুর কাছে বাকি সব আঁধার হয়ে গেছে।

প্রথমে শমিত ভেবেছিল মিষ্টুকে ডাক্তার দেখাতে হবে শরীরের ডাক্তার। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, শরীরের নয়–মনের ডাক্তার দেখাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিষ্টুর স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

অ্যামনেশিয়া বা স্মৃতিবিলোপের ঘটনা এর আগে শমিত বইয়ে পড়েছে, সিনেমায় দেখেছে। কখনও কখনও খবরের কাগজেও এরকম দু-একটা খবর চোখে পড়েছে। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেনি, কোনও অ্যামনেশিয়ার রুগি ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে।

মিষ্টুকে নিয়ে পাপিয়াও কম ভাবেনি।

অন্ধকার ঘরে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে কত না আকাশ-পাতাল ভেবেছে!

যদি মিষ্টুর খবরটা থানায় জানানো হয়, তা হলে পুলিশ নিশ্চয়ই ওকে লিলুয়ার উদ্ধার আশ্রম কিংবা ওরকম কোনও জায়গায় পাঠিয়ে দেবে। তারপর কবে মিষ্টুর বাড়ির লোকের খোঁজ পাওয়া যাবে কে জানে! ততদিন ওসব আশ্রমে কী কষ্টই না পাবে মেয়েটা! তার চেয়ে এখানে থাকলে ক্ষতি কী! বাপ্পার ছোটবোনের মতো থাকবে, হাসবে, খেলবে–এমনকী ওকে স্কুলেও ভরতি করে দেবে পাপিয়া। কেউ ওর সম্পর্কে কোনও কথা জিগ্যেস করলে ভজনচাঁদের গল্পটাই বলবে– মিষ্টু ওর বোনের ছোট মেয়ে। এমনিতে পাপিয়ার কোনও বোন নেই। না-ই বা থাকল। মিষ্টুর জন্য এরকম মিথ্যে বলা যায়। কাল রাতে শমিতের সঙ্গে এ নিয়ে ওর কথা হয়ে গেছে।

সকালের আলো বাড়ছিল। রাস্তার ওপারের কৃষ্ণচূড়া গাছটার মাথায় রোদ পড়েছে। কয়েকটা পাখি গাছের ডালে, পাতার আড়ালে, চঞ্চলভাবে ঘোরাফেরা করছে। মিষ্টু বোধহয় সেদিকেই তাকিয়ে ছিল, কারণ, গান শেষ করেই ও পাপিয়ার দিকে ফিরে বলল, ওই দ্যাখো, আন্টি, পাখিরা গাছে খেলা করছে…।

পাপিয়া বিছানা থেকে নেমে ওর কাছে এগিয়ে গেল। ওর মুখটা দু-হাতের পাতায় ধরে মাথায় চুমো খেল। তারপর জিগ্যেস করল, তুই এত সুন্দর গান শিখলি কোথায়?

মিষ্টু হেসে বলল, সে জানি না–আমার গান ভালো লাগে।

তুই কখন উঠেছিস রে? আমি তো একটুও টের পাইনি!

আমি তো সবসময় ভোরবেলা উঠি।

ফুটফুটে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পাপিয়া ভাবছিল, ওর সামনে এখন অনেক কাজ।

সকাল নটা বাজলেই শমিত অফিসে বেরোবে। আর দশটা বাজলেই পাপিয়া বাপ্পাকে নিয়ে স্কুলে যাবে। শমিত অফিসে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ফলে পাপিয়াকে বেশিরভাগ সময় বাসেই যাতায়াত করতে হয়। অবশ্য কখনও কখনও শমিতের সময় থাকলে বাপ্পাকে স্কুলে দিয়ে আসে, কিংবা নিয়ে আসে। বাপ্পার স্কুলের কার পুলের কোনও গাড়ি এদিকটায় এখনও আসে না বলেই যত ঝঞ্জাট।

পাপিয়া ঠিক করল, বাপ্পাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় মিষ্টুকে সঙ্গে নিয়ে বেরোবে। ফেরার পথে মানিকতলা বা হাতিবাগান থেকে মিষ্টুর জন্য কয়েকটা জামা-টামা কিনে নেবে। তারপর দুপুরবেলাটা গল্প করবে মিষ্টুর সঙ্গে। যদি আচমকা কোনও দরকারি সূত্র বেরিয়ে আসে।

সন্ধেবেলা শমিত অফিস থেকে ফিরলে ওরা ঠিক করবে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে মিষ্টুকে দেখাতে নিয়ে যাবে কি না। শমিত বলেছে, অফিস থেকে ও ভালো কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজখবর জোগাড় করে নিয়ে আসবে। অফিসে বেরোনোর সময় কথাটা ওকে আর-একবার মনে করিয়ে দিতে হবে।

মনে করিয়ে দিতেই শমিত বলল, ভুলে যাব মানে! এখন মিষ্টুর ব্যাপারটাই আমার একমাত্র চিন্তা।

অফিসে ওর কথা কাউকে আবার গল্প কোরো না যেন। শমিতকে সাবধান করে দিল পাপিয়া।

 শমিত হাত নেড়ে বলে উঠল, আরে না, না–পাগল!

বাপ্পাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একইভাবে সাবধান করে দিল পাপিয়া। বাপ্পা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা যে গোপন রাখাই ভালো সেটা ও ভালো করেই বুঝতে পেরেছে।

পাপিয়া শুধু বলল, আমাদের পাড়াপড়শি কেউ জিগ্যেস করলে ভজনচাঁদকে যে-গল্পটা বলেছি, সেটাই বলবি। বলবি মিষ্টু তোর মাসির মেয়ে। মাসি নৈহাটিতে থাকে।

শমিতকেও পাপিয়া বারবার করে সাবধান করল, তিনজনের বলা গল্প যেন একরকম হয়– নইলে লোকে সন্দেহ করবে।

পাপিয়ার পরিচালনায় সবকিছু ঠিকমতোই চলল।

বাপ্পাকে স্কুলে দিয়ে ফেরার সময় মিষ্টুর জন্য তিনরকম পোশাক কিনল পাপিয়া। ফ্রক, চুড়িদার, নাইটি। আর কয়েকটা প্যান্টি। তারপর বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে ওর সঙ্গে গল্প করতে বসল। কথায় কথায় জানতে চেষ্টা করল অনেক কিছু। কিন্তু কোনও লাভ হলো না। এমন কোনও কথা মিষ্টু বলতে পারল না যা থেকে ওর বাড়ির লোকদের কোনও হদিস পাওয়া যেতে পারে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ অফিস থেকে ফিরল শমিত।

প্রথমে মিষ্টুর খবর নিল পাপিয়ার কাছে। তারপর বলল, একজন সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজ পাওয়া গেছে। ডক্টর চিত্রলেখা দাশগুপ্ত। তিনি পার্ক সার্কাসে বসেন–সোম, বুধ, শুক্র। আজ মঙ্গলবার। সুতরাং আগামীকাল মিষ্টুকে নিয়ে ডক্টর দাশগুপ্তের কাছে যাওয়া যেতে পারে।

সন্ধেবেলা হোমওয়ার্ক করতে বসে বাপ্পা মিষ্টুকে পাশে নিয়ে বসল। মাকে ডেকে বলল, কয়েকটা ইংরেজি আর বাংলা গল্পের বই দিতে মিষ্টু ওগুলো পড়বে।

পাপিয়া লক্ষ করল, কয়েকটা বই বেশ সুন্দর পড়তে পারছে মেয়েটা। আবার অন্য কয়েকটা বই পড়তে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে বিশেষ করে ইংরেজিগুলো।

ব্যাপারস্যাপার দেখে পাপিয়ার মনে হল, মিষ্টু বোধহয় ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ে। ও ঠিক করল, ফোর-ফাইভের কয়েকটা বই জোগাড় করে মিষ্টুকে রোজ পড়াবে। হয়তো এইরকম একটা স্বাভাবিক জীবন শুরু করলেই মেয়েটার স্মৃতি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

বাপ্পার মিষ্টুকে খুব পছন্দ হয়েছিল। পাপিয়াকে বারবার বলছিল, মা, বোনটাকে কী সুন্দর দেখতে। ওইটুকু মেয়ে কী ফ্যান্টাস্টিক গান গায়…।

পাপিয়া আর শমিত বুঝতে পারছিল, মিষ্টুকে পাওয়ার পর মোটামুটি একটা দিন নিশ্চিন্তে গড়িয়ে যাওয়ায় ওদের টেনশন অনেক কমে এসেছে। ভয় আর উৎকণ্ঠা সরে গিয়ে মিষ্টুর জন্য একটা সরল মায়া সেখানে জায়গা করে নিচ্ছিল।

কিন্তু তখনও ওরা বুঝতে পারেনি আগামী কয়েক ঘণ্টায় ওদের জীবনটা বদলে যাবে।

টেলিফোনটা এল রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ।

মিষ্টু আর বাপ্পা তখন যে-যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ফোনটা ধরেছিল পাপিয়া। শমিত তখন ড্রইং-ডাইনিং-এ বসে টিভি দেখছিল।

হ্যালো।

মিস্টার শমিত রায়চৌধুরী আছেন?

একমিনিট ধরুন–দিচ্ছি। বলে পাপিয়া গলা তুলে শমিতকে ডাকল : তোমার ফোন…।

টেলিফোনটা শমিতদের বড় বেডরুমে। কর্ডলেস ফোন না থাকায় মাঝে-মাঝে ফোন ধরতে বেশ অসুবিধেই হয়। বাপ্পাও বাবার কাছে মাসকয়েক ধরে কর্ডলেসের বায়না করছে, কিন্তু এখনও বায়নার কোনও সুরাহা হয়নি।

শমিত এসে পাপিয়ার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে হ্যালো বলল।

পাপিয়া ঘরের টুকিটাকি গোছগাছ করছিল–তাতেই মন দিল আবার।

শমিত রায়চৌধুরী বলছেন? ও-প্রান্ত থেকে মিহি গলায় প্রশ্ন ভেসে এল।

 হ্যাঁ, বলছি।

গতকাল রাতে আপনি ভি.আই.পি. রোডে একটা মেয়েকে পিক আপ করেছেন?

 পিক আপ…মানে…ইয়ে…মেয়েটা আমাদের গাড়ির সামনে হঠাৎ এসে পড়েছিল..তারপর…।

ব্যাপারটা যে মিষ্টুকে নিয়ে সেটা বুঝতে পারামাত্রই পাপিয়া হাতের কাজ ছেড়ে শমিতের কাছে এসে দাঁড়াল। ওর কথা শুনতে লাগল মন দিয়ে।

আমরা সবই দেখেছি। ঠান্ডা গলায় শমিতকে থামিয়ে দিল লোকটি।

শমিতের বুকের ভেতরে মেঘ ডেকে উঠল। লোকটা কী করে সব দেখল? এ কি পুলিশের লোক, নাকি অন্য কেউ? শমিতকে ফোন করেছে কেন? লোকটা কি ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে?

লোকটি তখন কথা বলছিল ও মেয়েটাকে যে আপনারা পেয়েছেন সেটা পুলিশে না জানিয়ে ভালোই করেছেন। ইন ফ্যাক্ট জানানোর কোনও দরকার নেই–ভুলেও আর জানাবেন না।

না, না, জানানোর কোনও প্রশ্নই নেই। তাড়াহুড়ো করে সায় দিয়ে বলল শমিত।

 দ্যাটস গুড। তারিফের সুরে বলল লোকটা।

মেয়েটা পুরোনো কথা সব ভুলে গেছে–টোটালি ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেছে। উত্তেজিতভাবে বলল শমিত, আমরা ওর বাড়ির লোকের খোঁজ করব। দরকার হলে নিউজ পেপারে অ্যাড দেব। যতদিন কোনও খোঁজ না পাই ও আমাদের কাছেই থাকবে।

টেলিফোনের ও-প্রান্তে হাসল লোকটা অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা হাসি। তারপর থেমে-থেমে বলল, ওসবের কোনও দরকার নেই। বাড়ির লোকের খোঁজ করবেন না, কাগজে অ্যাড দেবেন না…আর মেয়েটাকেও আপনাদের কাছে রাখবেন না।

শমিত হতভম্ব হয়ে বলে উঠল, এ আবার কী ধরনের কথা! তা হলে কী করব ওকে নিয়ে? রাস্তায় আবার বের করে দেব? তা কখনও হয় না কি!

না, না, তা কেন করবেন। আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি! আবার একটু হাসল লোকটা : আপনারা মেয়েটাকে মেরে ফেলুন–তা হলেই সব প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে। ওকে মেরে ফেলাটা খুব জরুরি…কারণ, মেয়েটা অনেক কথা জানে। সেসব কথা মনে পড়ে গেলেই আমাদের বিপদ হবে–বহত ভারি মুসিবত। সো কিল দ্য গার্ল!

যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে কেঁপে উঠল শমিত। টেলিফোনের রিসিভারটা ওর হাত থেকে খসে পড়ে গেল মেঝেতে।

পাপিয়া ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল। শমিতকে আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো জিগ্যেস করতে লাগল, কী হল? কী হল?

শমিত মোমের মূর্তির মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু বুকের ভেতরে একটা কেউটে সাপের নড়াচড়া ও টের পাচ্ছিল।

.

০৩.

রোজ বিকেলে বাপ্পা চ্যাম্পকে নিয়ে বেরোয়।

ওদের বাড়ির কাছাকাছি একটা মাঝারি মাপের পার্ক আছে। এই পার্কটায় পাড়ার দুর্গাপুজো হয়। এ ছাড়া সারাবছর পাড়ার ছেলেরা ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ভলিবল নিয়ে মেতে থাকে।

 পার্কের রেলিং জং ধরা–বহুদিন তাতে রং পড়েনি। মেন গেটের স্তম্ভে ফাটল ধরেছে। গোটাপাঁচেক ল্যাম্পপোস্টের মধ্যে একটা কি দুটোয় বাতি জ্বলে। পার্কের একপাশে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা হাফডজন বকুল, কৃষ্ণচূড়া আর দেবদারু গাছ আছে। তার কাছাকাছি দুটো দোলনা আর একটা টেকিকল। তাতে ছোট-ছোট বাচ্চারা খেলা করে।

পার্কের মেন গেট দিয়ে ঢুকে দোলনার দিকটায় চলে আসে বাপ্পা। এদিকটায় ঘাস-ছাওয়া জমি আছে অনেকটাই। তার প্রান্ত ঘেঁষে তিনটে সিমেন্টের বেঞ্চি। বাচ্চারা যখন ছুটোছুটি করে খেলা করে তখন তাদের গার্জেনরা এই বেঞ্চিগুলোতেই বসে থাকেন।

পার্কের বাকি অংশটায় শুধু ধুলো আর কাকড় ঘাসের ছিটেফোঁটাও থাকে না। এখন বর্ষায় ছবিটা সামান্য বদলেছে। বড়দের ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি সেখানেই চলে। বড় মাঠের দু-প্রান্তে লোহার পাইপ দিয়ে দুটো গোলপোস্ট তৈরি করা আছে।

আজ চ্যাম্পকে নিয়ে বেরোনোর সময় মিষ্টুকেও সঙ্গে নিতে চাইল বাপ্পা। কিন্তু পাপিয়া যে বারণ করতে পারে সেটা ও স্বপ্নেও ভাবেনি।

আসলে পাপিয়া কাল রাতের টেলিফোনের কথাগুলো ভুলতে পারছিল না। শমিতের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার সময় পাপিয়া ভয়ে শিউরে উঠেছে। এত নৃশংস হতে পারে কেউ! মিষ্টুর মতো ফুটফুটে মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চায়! তাও আবার ওদের দিয়েই!

মিষ্টুকে ভালো করে দেখল পাপিয়া।

পরনে গোলাপি-সাদা চুড়িদার, মাথার লম্বা চুলে দুটো বিনুনি–তাতে রঙিন ব্যান্ড আঁটা। কপালে কালো টিপ। গলায় পাউডারের আবছা ছাপ।

এ-মেয়েকে দেখলেই গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে করে।

পাপিয়া ফোনের কথাগুলো বাপ্পাকে বলতে পারছিল না। ও ভয় পাচ্ছিল, মিষ্টু রাস্তায় বেরোলেই যদি কোনও বিপদ হয়! কী অনেক কথা জানে মিষ্টু, যার জন্য ওকে খুন করতে বলছে।

কিন্তু বাপ্পা কিছুতেই ওর জেদ ছাড়বে না। ও বারবার জিগ্যেস করছে, কেন তুমি বারণ করছ তোমাকে বলতেই হবে। নইলে বাবা অফিস থেকে ফিরলে আমি তোমার নামে কমপ্লেন। করব।

বাপ্পার সঙ্গে-সঙ্গে মিষ্টুও বায়না করছিল। সুতরাং কোনও উপায় না দেখে পাপিয়া নিমরাজি হলো। তবে সাবধানের মার নেই–একথা ভেবে ও বাপ্পাকে বলল, চল, আজ আমিও তোদের সঙ্গে যাব।

বাপ্পা একটু অবাক হলেও কিছু বলল না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওরা দিব্যি ফুর্তিতে হাঁটা দিল পার্কের দিকে। চ্যাম্প দুলকি চালে বাপ্পার পাশে-পাশে চলতে লাগল।

চ্যাম্পের দিকে তাকিয়ে মিষ্টু বাপ্পাকে জিগ্যেস করল, আচ্ছা, বাপ্পাদাদা, ডোবারম্যানদের লেজ কাটা থাকে কেন?

বাপ্পা বিজ্ঞের মতো ভঙ্গি করে জবাব দিল, ডোবারম্যানের লেজ ঠিক টিকির মতো দেখতে। তাতে কুকুরের শো নষ্ট হয় বলে ডোবারম্যানের লেজ কাটা একেবারে মাস্ট। একদম ছোটবেলায় ওটা কেটে ফেলতে হয়। চ্যাম্পের লেজ আমাদের ডক্টর আঙ্কল কেটে দিয়েছে।

কথা বলতে বলতে ওরা চলে এল পার্কে।

দোলনাগুলোর কাছাকাছি একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল পাপিয়া।

সকালে দু-একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর রোদ উঠলেও পার্কের মাটি ভিজে সঁতসেঁতে। কিন্তু সেসব হৃক্ষেপ না করেই বাচ্চারা কলকলিয়ে ছুটোছুটি করছিল। মিষ্টু আর বাপ্পা একটা রবারের বল ছোঁড়াছুড়ি করে খেলতে লাগল। আর চ্যাম্প সেই বল ধাওয়া করে ওদের হুল্লোড়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। দু-একটা দিশি কুকুর চ্যাম্পকে লক্ষ করে ঘেউঘেউ করছিল, কিন্তু চ্যাম্প ওদের মোটেও পাত্তা দিচ্ছিল না।

তিনটে বেঞ্চিতে বেশ কয়েকজন পুরুষ-মহিলা বসে ছিলেন। এ ছাড়া দু-চারজন বয়স্ক মানুষ গল্প করতে করতে পায়চারি করছিলেন। আর কয়েকটা বেওয়ারিশ দিশি কুকুর এপাশ-ওপাশ ঘোরাঘুরি করছিল।

আকাশে বর্ষার কালো মেঘের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছিল। সূর্যের আলো সেখানে সোনালি জরির পাড় বসিয়ে দিয়েছে। আর পার্কের মাঠে, গাছের পাতায়, ঝকঝকে রোদ্দুর। একঘেয়ে বৃষ্টির ফাঁকে এই সুন্দর বিকেলটা সবাই উপভোগ করছিল।

খেলাধুলো ছুটোছুটিতে প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল। চ্যাম্পকে অনেকেই লক্ষ করছিল, ওকে নিয়ে মজা করছিল। ওর পিছনে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মিষ্টু। বাপ্পা ওর কাছে ছুটে যাওয়ার আগেই শার্ট-প্যান্ট পরা রোগা মতন একজন লোক মিষ্টুকে ধরে তুলল, ওর জামা কাপড় হাত দিয়ে ঝেড়ে দিল। তারপর সামান্য হেসে পকেট থেকে জাম্বো সাইজের একটা ক্যাডবেরি চকোলেট বের করে মিষ্টুর হাতে দিল।

পাপিয়া দূর থেকে মিষ্টুর পড়ে যাওয়াটা লক্ষ করেছিল। ও বেঞ্চি ছেড়ে উঠে হাঁটা দিল মিষ্টুর দিকে।

বাপ্পা আর চ্যাম্প মিষ্টুর কাছে পৌঁছোতেই লোকটি বাপ্পাকে হেসে বলল, ভয় নেই, সেরকম কিছু লাগেনি। তারপর মিষ্টুর থুতনি ধরে আদর করে বলল, ক্যাডবেরিটা তুমি পুরোটা একা-একা খেয়ো না দাদাকে দু-এক কামড় দিয়ো। টা-টা…।

লোকটি অলস পায়ে পায়চারি করতে করতে চলে গেল।

মিষ্টু আর দেরি করল না। চকচকে চোখে ক্যাডবেরি চকোলেটটার মোড়ক ছিঁড়তে লাগল। বাপ্পার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, বলল, বাপ্পাদাদা, আমি কিন্তু বেশি খাব–তোমাকে দুটো ব্লক দেব। আর আঙ্কল-আন্টির জন্যে..।

আচমকা মিষ্টুর হাত ফসকে ক্যাডবেরিটা পড়ে গেল মাটিতে।

কথা বলতে-বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ও। আর তখনই একটা ছুটন্ত বাচ্চা ওকে আলতো ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। ফলে চকোলেটটা আর সামলাতে পারেনি।

মিষ্টু ঝুঁকে পড়ে চকোলেটটা তুলে নিতে গেল। ততক্ষণে পাপিয়া ওর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। পাপিয়া চেঁচিয়ে বলে উঠল, মিষ্টু, ওটা তুলবে না–খাবার জিনিস পড়ে গেলে কক্ষনও তুলতে নেই।

কিন্তু পাপিয়ার বারণ করার কোনও দরকার ছিল না। কারণ, চকোলেটটা পড়ে যাওয়ামাত্রই ঘুরঘুর করা দুটো দিশি কুকুর ওটার ওপরে বলতে গেলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দুটোর মধ্যে যেটা গায়েগতরে বেশ মোটাসোটা সেটাই জিতে গেল। চকোলেটটা মুখে নিয়ে রাংতার মোড়কসমেত আয়েশ করে চিবোতে লাগল।

আসল ঘটনাটা ঘটল তার পরেই।

মিনিটখানেকের মধ্যেই কুকুরটা হঠাৎ কাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পা দাপিয়ে লেজ নেড়ে সরু গলায় ককিয়ে উঠল দুবার। তারপরই সব চুপচাপ।

কুকুরটার চোয়াল ঝুলে পড়ল। জিভ বেরিয়ে এল বাইরে। তার সঙ্গে খানিকটা সাদা ফেনা। ছিন্নভিন্ন রাংতার মোড়কটা ওর মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল ঘাসের ওপরে।

ভয়ে পাপিয়ার মুখ দিয়ে একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল। বাপ্পা আর মিষ্টু অবাক হয়ে মরা কুকুরটাকে দেখতে লাগল। ছোট-বড় তিনটে নেড়িকুকুর কান্নার কুঁইকুঁই শব্দ তুলে মৃতদেহটা শুঁকতে লাগল বারবার। আর চ্যাম্প চাপা গর্জন করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মরা কুকুরটাকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা তৈরি হয়ে গেল। পাপিয়া আর দেরি না করে বাপ্পা আর মিষ্টুর হাত চেপে ধরে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। চ্যাম্পও ওদের সঙ্গে পা মিলিয়ে রওনা হল।

পাপিয়া টের পেল ওর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।

মায়ের সঙ্গে যেতে-যেতে বাপ্পা এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেই রোগা মতন লোকটাকে খুঁজতে লাগল, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না।

মিষ্টু পাপিয়াকে বারবার জিগ্যেস করতে লাগল, আন্টি, কুকুরটা হঠাৎ মরে গেল কেন? চকোলেট খেয়ে কি ওর অসুখ করেছে?

পাপিয়া অবোধ মেয়েটার দিকে তাকাল। ওর কান্না পেয়ে গেল। আর-একটু হলে কী হত, সেকথা ভেবে ও শিউরে উঠল। যারা টেলিফোন করেছিল, তারা তা হলে হাত গুটিয়ে বসে নেই! তারা পাপিয়াদের ওপরে নজর রাখছে, সুযোগ পেলে মিষ্টুকে খতম করার চেষ্টাও করছে! কিন্তু কেন?

আন্টি, বলো না, চকোলেট খেয়ে কুকুরটার কি অসুখ করেছিল?

 মিষ্টুর প্রশ্নে বিব্রত হল পাপিয়া। কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না।

বাপ্পা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, হ্যাঁ, অসুখ করেছিল।

যদি চ্যাম্প ওটা খেত তা হলে কী সাংঘাতিক কাণ্ড হত বলো, বাপ্পাদাদা!

পাপিয়া আর থাকতে পারল না। মিষ্টুকে একহাতে জাপটে ধরে কেঁদে ফেলল ও। কান্না ভাঙা গলায় বলল, তুই ওটা খেলে কী সর্বনাশটা হতো সেটা একবার ভেবে দেখেছিস! এখনও বুঝিসনি চকোলেটটায় বিষ ছিল!

মিষ্টু অবাক চোখে পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। পাপিয়া হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছল।

বাপ্পা জিগ্যেস করল, পুলিশে খবর দেবে, মা?

পাপিয়া মাথা নাড়ল? না, এখন না। আগে তোর বাবা অফিস থেকে ফিরুক, তারপর আলোচনা করে ঠিক করা যাবে।

মিষ্টু, বাপ্পা আর চ্যাম্পকে নিয়ে খুব সাবধানে রাস্তা পার হল পাপিয়া। সন্ধের আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। গাড়ি, বাস, মিনিবাস হেডলাইট জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে। চারপাশের ব্যস্ততা আর হর্নের শব্দ পাপিয়াকে যেন পাগল করে দিচ্ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও ফ্ল্যাটের নিরাপদ ঘেরাটোপে পৌঁছোতে চাইছিল।

ফ্ল্যাটে ফিরে হাঁফ ছাড়ল পাপিয়া। শমিত কখন বাড়ি ফিরবে এই চিন্তায় বারবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল। আজ আবার মিন্ধুকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার কথা। পার্কের ঘটনাটা শোনার পর শমিত কী বলবে কে জানে!

.

ডক্টর চিত্রলেখা দাশগুপ্তের চেম্বারে ঢুকতেই ফিনাইল কিংবা স্পিরিটের মতো একটা গন্ধ পাপিয়ার নাকে এল। অথচ ও ভালো করেই জানে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে এরকম ওষুধপত্রের গন্ধ পাওয়ার কথা নয়। হয়তো এটা মনেরই কোনও কারসাজি।

ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বারটা খুঁজে পেতে তেমন কষ্ট হয়নি। পার্ক সার্কাসের গোলচক্করের একপাশে বেশ বড় একটা মিষ্টির দোকান। তার ঠিক পাশেই একটা পুরোনো বাড়ির দোতলায় ডক্টর দাশগুপ্ত বসেন সন্ধে সাতটা থেকে দশটা।

ফুটপাথে ঘেঁষাঘেষি করে বসা ফলের দোকানদারদের পাশ কাটিয়ে বাড়িটার ছোট্ট সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি এবড়োখেবড়ো, ভাঙাচোরা। দেওয়ালে ড্যাম্পের কালচে ছোপ। সিঁড়ির আলো বলতে একটা বালব।

ওপরে ওঠার সময় বেশ কয়েকজন ওদের পাশ দিয়ে নীচে নেমে গেল।

চেম্বারে যদি পেশেন্টের খুব ভিড় থাকে তা হলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এত লোককে নামতে দেখে পাপিয়াকে বিড়বিড় করে বলল শমিত।

উত্তরে পাপিয়া শুধু মাথা নাড়ল।

বাড়ির বাইরের চেহারার তুলনায় চেম্বারটা দারুণ ঝকঝকে। চেম্বার দেখলেই ডাক্তারের ওপরে ভক্তি বেড়ে যায়। শমিত আর পাপিয়া কেমন যেন স্বস্তি পেল। বাপ্পা আর মিষ্টুর দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা ওদের খোশগল্পে মশগুল।

পেশেন্টের ভিড় বেশ ভালোই ছিল, কিন্তু আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল বলে আধঘণ্টা মতন অপেক্ষা করার পরই ডাক পেল শমিত।

কাচের সুইংডোর ঠেলে ডক্টর দাশগুপ্তের ঘরে ঢুকল ওরা।

ভদ্রমহিলা রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। গায়ে হালকা সবুজ জমিতে বাদামি পাড়-বসানো তাঁতের শাড়ি। চোখে রিমলেস চশমা। ফরসা লম্বাটে মুখ। বয়েস বোধহয় পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে, কিন্তু মুখের মেকআপ তাকে প্রাণপণে পিছনদিকে টানছে। চোখের চাউনি আর চোয়ালের রেখা বলছে, ডক্টর দাশগুপ্তের অভিজ্ঞতা কিছু কম নেই।

ওঁর চেয়ার থেকে একটু দূরে ছোটমাপের চেয়ার-টেবিল নিয়ে একজন সেক্রেটারিগোছের মেয়ে বসে আছে। বয়েস কুড়ি কি বাইশ। ছিপছিপে, ফরসা, চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। একটা নোটবই আর পেন নিয়ে লেখালিখির জন্য তৈরি।

ডক্টর দাশগুপ্তের রিভলভিং চেয়ারটার পিছনে ঘষা কাচের প্যানেল। তার ওপরে নানান সুন্দর সুন্দর পোস্টার লাগানো। তার ঠিক মাঝখানে একটা পোস্টারে বড়-বড় হরফে লেখা রয়েছে?

শরীর ভালো রাখবেন অবশ্যই,
 কিন্তু মনের কথাটা ভুলে যাবেন না।
মন ভালো রাখা খুব জরুরি।

ছিমছামভাবে সাজানো ঘরে চারটে ছোট-ছোট চেয়ার আর একটা কাউচ। কাউচে কোনও রুগি আধশোওয়া হয়ে শুতে পারে। কে জানে, একটু পরেই মিষ্টুকে হয়তো ওখানে শুতে হবে। তারপর ডক্টর দাশগুপ্তের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

ডক্টর দাশগুপ্ত বললেন যে, প্রথমে তিনি শমিত আর পাপিয়ার সঙ্গে আলাদা কথা বলবেন। তখন পাপিয়া বাপ্পা আর মিষ্টুকে বাইরের ঘরে পেশেন্টদের মাঝে বসিয়ে দিয়ে গেল। বাপ্পাকে চাপা গলায় বলল, কারও সঙ্গে কথা বলবি না…কেউ কিছু দিলে খাবি না। আর কোনওরকম প্রবলেম দেখলেই চেঁচাবি–চেঁচিয়ে আমাদের ডাকবি। আমাদের বড়জোর পাঁচ-দশ মিনিট লাগবে।

সত্যি-সত্যি দশ মিনিটের কমেই ব্যাপারটা মিটে গেল।

ওদের কাছ থেকে সব শুনলেন ডক্টর দাশগুপ্ত। পাপিয়া ওঁকে মিষ্টুর গল্পটা একটু ঘুরিয়ে বলেছে। বলেছে, মিষ্টু ওরই মেয়ে…আচমকা এরকম হয়ে গেছে। তাই ও মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছে।

এরপর মিষ্টুর সঙ্গে চিত্রলেখা দাশগুপ্ত কথা বললেন।

যেসব প্রশ্ন তিনি করলেন, তার সবগুলোই গত দু-দিনে পাপিয়া আর শমিত করে ফেলেছে।

প্রায় আধঘণ্টা মিষ্টুকে স্টাডি করার পর ডক্টর দাশগুপ্ত বললেন, দেখুন, আপনাদের মেয়ের কেসটা পিয়োরলি অ্যামনেশিয়ার কেস। তবে ওর টাইপটা হচ্ছে সাইকোজিনিক অ্যামনেজিয়া। যেহেতু ও মাথায় কোনও চোট পায়নি বলছেন সেহেতু বলতে পারেন ব্যাপারটা ততটা মারাত্মক নয়। সেরকম হলে ওর মগজ স্মৃতি ধরে রাখতে পারত না। কিংবা কোনও ঘটনা স্মৃতি হিসেবে ওর স্মৃতিকোষে ঢুকতেই পারত না। মানে, ওর ব্রেইনে রিটেনশন ফেইলিয়োর হত…কিংবা কোনও ইনফরমেশন ওর ব্রেইনে রেজিস্টারই করত না। যে-স্মৃতি ওর হারিয়ে গেছে সেটা চিরকালের জন্যে হারিয়ে যেত।

একটু দম নিয়ে বড় করে শ্বাস ফেললেন চিত্রলেখা দাশগুপ্ত। টেবিল থেকে একটা বলপয়েন্ট পেন তুলে নিয়ে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন, সাইকোজিনিক অ্যামনেশিয়ায় খুব ভয়ের কিছু নেই। ওর মেমোরি সব ঠিকঠাক আছে–মানে পুরোনো কোনও স্মৃতি ওর হারায়নি– শুধু ওর রিকল মেকানিজমটা ফেইল করছে। আরও এক্সপ্লেইন করে বলতে গেলে, দরকার মতো পুরোনো কথা ওর মনে পড়ছে না। অথচ ওর সাবকনশাস লেভেলে…মানে, অবচেতন স্তরে…সব স্মৃতিই পারফেক্ট রয়েছে। একমাস পর ওকে নিয়ে আসুন…একটু হিপনোটাইজ করে দেখব পুরোনো কথা কিছু বের করা যায় কিনা। এখন শুধু একটা স্টিমুল্যান্ট লিখে দিলাম…একটা ফাইল খাওয়ান…।

শমিত অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল, একটু ফাঁক পেতেই জিগ্যেস করে বসল, আচ্ছা, ডক্টর দাশগুপ্ত, মিষ্টুর এরকম হল কী করে?

চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন ডক্টর দাশগুপ্ত। চেয়ারে আয়েশ করে হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ও বোধহয় সাংঘাতিক একটা শক পেয়েছে–মেন্টাল শক–যেটাকে ট্রমা বলে। হতে পারে, আবার সেরকম একটা শক পেলে সাডেনলি ওর স্মৃতি ফিরে আসবে। তবে সেটা পিয়োরলি চান্সের ব্যাপার। টেবিলের দিকে ঝুঁকে এলেন ডক্টর দাশগুপ্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওয়েল, লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট।

শমিতরা যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। ফুটপাথের দোকানগুলো তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে। দুটো দিশি কুকুর জিভ বের করে বৃষ্টিতে বসে ভিজছে।

পাপিয়া ছাতা খুলল, তার নীচে মিষ্টুকে ডেকে নিল। শমিত আর ছাতা খুলল না। ও আর বাপ্পা একছুটে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে।

বাপ্পা শমিতের পাশে বসল। আর পিছনের সিটে মিষ্টুকে নিয়ে পাপিয়া। গাড়ি স্টার্ট দিল শমিত। ওয়াইপার চালু করে হেডলাইট জ্বেলে দিল। গাড়ি ছুটল সি.আই.টি. রোড ধরে।

জলে ভেজা রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম। বাস, মিনিবাসের কাচ তোলা–যাচ্ছেও বেশ ধীরে ধীরে। বাসস্টপের শেড আর গাড়িবারান্দার নীচে পথচারীর জটলা। ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম-বাতির অস্পষ্ট ছায়া পড়েছে ভেজা রাস্তায়।

তিন-সাড়ে তিন কিলোমিটার পেরোনোর পরই ব্যাপারটা ঘটে গেল।

মিষ্টু তখন শমিতকে জিগ্যেস করেছে, আঙ্কল, আমার কী হয়েছে? আমি কি পুরোনো কথা সব ভুলে গেছি? হিপনোটাইজ মানে কী?

বাপ্পা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, হিপনোটাইজ মানে সম্মোহন। অনেকটা ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার মতন…।

পাপিয়া মন্তব্য করল, হিপনোটাইজ করলে লোকে ঘুমিয়ে কথা বলে। ডাক্তারের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। যেমন ধর…।

পাপিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর কোথা থেকে ছুটে এসে শমিতের মারুতির পিছনে ধাক্কা মারল।

সংঘর্ষের শব্দ হল। ব্যাকলাইটের কভার ভেঙে মারুতির পিছনটা তুবড়ে গেল। শমিতের গাড়িটা ধাক্কার চোটে আচমকা এগিয়ে গেল সামনে।

মিষ্টু আর বাপ্পা চিৎকার করে উঠল। পাপিয়া ভয়ের চোখে মারুতির পিছনের কাচ দিয়ে অ্যাম্বাসাডরটাকে দেখল। শমিত রিয়ারভিউ মিরারে একপলক তাকিয়েই গাড়ি থামিয়ে নামতে যাচ্ছিল। ভেবেছিল, অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভারকে দেখে নেবে। কিন্তু ঠিক তখনই গাড়িটা ছুটে এসে শমিতের মারুতিকে আবার ধাক্কা মারল। সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাকসিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়িয়ে দিল শমিত। কারণ, বুঝতে পারল, এটা মোটেই অ্যাক্সিডেন্ট নয়। অ্যাম্বাসাডরটা ইচ্ছে করেই ধাক্কা মেরেছে ওর গাড়ির পিছনে। বিশেষ করে বিকেলে পার্কের বিষাক্ত চকোলেটের ঘটনাটার পর এটাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক।

অফিস থেকে ফিরে পাপিয়ার কাছে সবই শুনেছে শমিত। শুনে পাপিয়ার কথাটাই মনে হয়েছে ওর : যারা ফোন করে মিষ্টুকে খুন করতে বলেছিল, তারা হাত গুটিয়ে বসে নেই! বাপ্পা কয়েকবার পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু পাপিয়া আর শমিত ওর পরামর্শে কান দেয়নি। কারণ, পুলিশে গেলেই আরও পাঁচকথা উঠবে। ওদের নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হবে। তার চেয়ে মিষ্টুকে আগলে-আগলে রাখাই ভালো। শমিত তখন বলেছিল, আজ সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পর মিষ্টুকে আর বাড়ির বাইরে বের করার দরকার নেই। যদি কোনওরকমে ওর পুরোনো সবকথা মনে পড়ে যায় তা হলে তখন নতুন করে ভাবা যাবে।

কিন্তু এই বিপদটা শমিত আশা করেনি। ও বুঝতে পারল, ওর হিসেবে ভুল ছিল।

মারুতি গাড়িটা শমিতের খুব প্রিয়। নিজের হাতে গাড়ির যত্ন নেয় ও। সব-সময় ঝাড়পোঁছ করে গাড়ি টিপটপ রাখে। এ-নিয়ে পাপিয়া প্রায়ই ওকে ঠাট্টা করে, কিন্তু শমিত সে-ঠাট্টা গায়ে মাখে না।

শমিত বুঝল, মারুতির পিছনদিকটা ভালোই তুবড়ে গেছে। তাতে প্রথমটায় ওর মনখারাপ হল, কিন্তু তারপরই রাগ হল।

আর ঠিক তখনই অ্যাম্বাসাডরটা খ্যাপা বুনো শুয়োরের গোঁ নিয়ে তেড়ে এল, প্রচণ্ড শব্দে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা মারল আবার। মারুতির পিছনের কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল।

পাপিয়া মিষ্টুকে জাপটে ধরে চিৎকার করে উঠল। মিষ্টুও ভয়ে আঁকড়ে ধরল ওকে। আচমকা ধাক্কায় বাপ্পার মাথার পিছনটা ঠুকে গেল হাইব্যাক সিটে। ও চেঁচিয়ে বলল, বাবা, কেয়ারফুল!

বৃষ্টির তেজ এখন অনেকটা বেড়ে গেছে। রাস্তায় ঠিকরে পড়ে লাফিয়ে উঠছে জলের কণা। ওয়াইপার প্রাণপণে কাজ চালাচ্ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সামনে ভালো করে নজর চলে না। রিয়ারভিউ মিরারে শমিত অ্যাম্বাসাডরটার হেডলাইটের আলো দেখতে পাচ্ছিল। বৃষ্টির ফোঁটার আড়ালে গাড়িটাকে গোঁ-গোঁ করে ছুটে আসা একটা অপার্থিব জন্তু বলে মনে হচ্ছিল।

শমিতের রাগটা পালটে গেল অন্ধ রাগে।

ওরা তো কারও কোনও ক্ষতি করেনি। বরং স্মৃতি-হারানো একটা মেয়েকে আপন করে নিয়েছে। কোনও অন্যায় না করেই এরকম নিগ্রহ সইতে হচ্ছে ওদের! বিচার বলে সত্যি কি কিছু নেই?

অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে ওটা মেঝেতে মিশিয়ে দিল শমিত। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়ে দিল মারুতি। আয়নায় দেখল অ্যাম্বাসাডরটাও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।

সিঙ্গল লেন রাস্তায় সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল শমিতের গাড়ি। অ্যাম্বাসাডরটাও প্রায় ছায়ার মতো আঁকাবাঁকা পথ ধরেই মারুতিটার পিছন পিছন ছুটে চলল।

হঠাৎ একটা পেট্রল পাম্প দেখতে পেল শমিত। তক্ষুনি ওর মাথায় খুন চেপে গেল।

পনেরো বছর বয়েস থেকেই ও গাড়ি চালায়। সেটা ছিল ওর বাবার অ্যাম্বাসাডর। তারপর যতই দিন গেছে ততই ধারালো আর নিখুঁত হয়েছে ওর গাড়ি চালানোর হাত। ওর হাতে পড়লে গাড়ি কথা বলে। এখন গাড়িকে দিয়ে কথা বলাতে ইচ্ছে করল ওর।

আচমকা মারুতিটাকে পেট্রল পাম্পে ঢুকিয়ে দিল শমিত। স্টিয়ারিং কাটিয়ে তেল নেবার মেশিন দুটোকে দুরন্ত গতিতে একটা পাক মেরে দিল।

পাম্পে গোটা চার-পাঁচেক গাড়ি গ্যারেজ করা ছিল। দুজন কর্মী কাচের প্যানেল দেওয়া অফিসঘরের মধ্যে বসে ছিল। কাচের ওপর দিয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে একটা অদ্ভুত লেন্স তৈরি করেছিল। ফলে লোক দুটোকে ঝাপসা বিকৃত দেখাচ্ছিল।

মারুতিটাকে মারাত্মক স্পিডে ঢুকতে দেখেই অফিসঘর থেকে একজন লোক ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে। হাত দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করে ব্যাপারটা বুঝতে চাইল। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

শমিতের মারুতি একটা পাক মেরেই সাপের মতো পিছলে বেরিয়ে গেছে সামনের রাস্তায়। সেই গতিপথ অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভার হুবহু আঁচ করতে পারেনি। ফলে ঝড়ের বেগে পাম্পের ভেতরে ছুটে এসে স্টিয়ারিং কাটাতে গিয়েই বেচারি ধাক্কা মেরেছে তেল নেবার মেশিন দুটোকে। তারপর গাড়িটা মুখ উঁচিয়ে শূন্যে লাফিয়ে ছিটকে গেছে অফিসঘর লক্ষ্য করে। তবে কাচ ভাঙার শব্দের পর বাকি শব্দ আর শোনা যায়নি।

কারণ, প্রবল এক বিস্ফোরণ গোটা এলাকা কাঁপিয়ে দিল। হলদে-লাল আগুনের বিশাল একটা বল লাফিয়ে উঠল শূন্যে। পেট্রল পাম্পটা নিমেষে নেই হয়ে গেল।

শমিতের গাড়ি তখন অনেক দূরে চলে গেছে।

রিয়ারভিউ মিরারে আগুনের ছায়াটা দেখতে পেল শমিত। ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। কপালের পাশে একটা শিরা দপদপ করছিল।

পাপিয়া মিষ্টুকে আঁকড়ে ধরে রীতিমতো কাঁদছিল। কান্না-ভাঙা গলায় বারবার বলতে লাগল, আস্তে চালাও, আস্তে চালাও…।

শমিত চোয়াল শক্ত করে চুপ করে রইল। ভাগ্যিস, আশেপাশে কোনও পুলিশ ছিল না। যদি থাকত তা হলে…।

বাপ্পা জানলার কাচ নামিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই গলা বাড়িয়ে আগুনের তাণ্ডবলীলা দেখতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু শমিত এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল যে, ছবিটা খুব তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে যাচ্ছিল।

বাড়ি ফিরে গাড়ি গ্যারেজ করার সময় গাড়িটার শোচনীয় অবস্থা দেখতে পেল ভজনচাঁদ।

 কেমন করে অ্যাক্সিডেন্ট হল, স্যার? কৌতূহলী ভজনচাঁদ জানতে চাইল।

শমিত বিড়বিড় করে একটা দায়সারা উত্তর দিল।

বাপ্পা আর মিষ্টুকে নিয়ে পাপিয়া ওপরে রওনা হতেই ভজনচাঁদ শমিতকে বলল, পুলিশে রিপোর্ট করেছেন, স্যার?

করেছি।

বহত আচ্ছা কিয়া। বদমাস গাড়ির পাইলটকে এবার ভারী কমপেনশন দিতে হবে।

শমিতের এতই ক্লান্ত লাগছিল যে, ও ভজনচাঁদের কমপেনশন-কে আর শুধরে কমপেনসেশান করল না। গাড়ি গ্যারেজ করে ভজনচাঁদকে দশটাকা বকশিশ দিল।

ভজনচাঁদ ভক্তিভরে সেলাম ঠুকতেই শমিত রওনা হল সিঁড়ির দিকে।

শমিত অথবা ফ্ল্যাটের অন্যান্য মালিক ভজনচাঁদকে সময়ে-অসময়ে বকশিশ দেয়, বিনিময়ে সেলামও পায়। কিন্তু আজ শমিতের নিজেকে কেমন অপরাধী লাগছিল।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মিষ্টু আর বাপ্পা যে-যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু শমিত আর পাপিয়ার ঘুম আসছিল না কিছুতেই।

শমিত একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে গা ঢেলে দিল। ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল, এবার ব্যাপারটা পুলিশে জানানো দরকার…।

পাপিয়া গম্ভীর থমথমে মুখে একটা ডিভানের ওপরে বসে ছিল, শমিতের কথার উত্তরে বলল, পুলিশে গিয়ে তুমি কী বলবে?

প্রথম থেকে যা-যা হয়েছে তা-ই বলব– বাচ্চা ছেলের মতো বলল শমিত।

বলবে যে, একটু আগে তুমি কয়েকটা লোককে খুন করেছ? ধারালো গলায় জিগ্যেস করল পাপিয়া।

তার মানে?

তার মানে, ওই অ্যাম্বাসাডরের ভেতরে যারা ছিল তারা কেউ আর বেঁচে আছে মনে করেছ! সব শুনলে পুলিশ তো তোমাকেই আগে অ্যারেস্ট করবে।

এখন তো আর না বলে উপায় নেই। ক্লান্ত গলায় শমিত বলল, কাল-পরশুর মধ্যে পুলিশ আমাদের বাড়িতে আসবেই। এত বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট…পুলিশ খোঁজ করবেই। খোঁজ করতে করতে যদি ওরা…। কথা শেষ না করেই থেমে গেল শমিত।

যদি ওরা কী? জিগ্যেস করল পাপিয়া।

শমিত সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে সেটাই বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই টেলিফোন বেজে উঠল।

পাপিয়া আর শমিত এ-ওর দিকে তাকাল।

 তারপর শমিতই উঠে গিয়ে ফোন ধরল।

হ্যালো…।

শমিত রায়চৌধুরী বলছেন?

মিহি গলাটা ভালো করেই চিনতে পারল শমিত। ওর হাত-পা হঠাৎই ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করল। ও কোনওরকমে বলল, হ্যাঁ বলছি।

অ্যাম্বাসাডর গাড়িটার দুজন লোক ছিল–বিনোদ আর সুধীর। সুধীর ড্রাইভ করছিল– ও মারা গেছে। একটু থামল নোকটা। তারপরঃ আর বিনোদ নার্সিংহোমে–মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে।

শমিত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার কোনও দোষ নেই ওরা আমার গাড়িতে আগে ধাক্কা মেরেছে–একবার নয়, তিন-তিনবার। আমি ভয় পেয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছি…আমাকে ফলো করতে গিয়ে অ্যাম্বাসাডরটা পেট্রল পাম্পে ঢুকে মেশিনে ধাক্কা মারে…তাতে…।

আমি খোঁজ নিয়েছি..সবই আমি জানি..কিন্তু সবকিছুর গোড়ায় তো ওই মেয়েটা মিষ্টু। ওকে আপনি মেরে ফেলুন…তা হলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। আর আমরা যদি ট্রাই করি তাহলে বহত খুন-খারাবা হতে পারে।

ওইটুকু একটা ফুলের মতো মেয়েকে আপনি মারতে চাইছেন কেন? অনুনয়ের সুরে জিগ্যেস করল শমিত, ওকে আপনারা ছেড়ে দিন…।

উত্তরে নোংরাভাবে হাসল লোকটা। তারপর বলল, যদি আপনারা মিষ্টুকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন তাহলে সেটা খুব কস্টলি হবে। অনেক দুঃখ অনেক পরেশানি হবে আপনাদের…।

আমরা ওকে…ওকে…ওকে…।

তোতলামি ছাড়ুন! লোকটা ধমক দিয়ে বলল, কালকের মধ্যে কাজটা সেরে ফেলুন…নইলে আপনাদের যে কী হাল হবে, রাম জানে। রাম রাম। বলে ফোন ছেড়ে দিল লোকটা।

পাপিয়া সব শোনার পর ভয় পেয়ে বলল, এখন কী হবে?

শমিত সিগারেটের শেষটুকু একটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল, আমি ডিসিশান নিয়ে ফেলেছি–পুলিশে আমাদের খবর দিতেই হবে। আর কোনও পথ নেই।

কেন, পথ নেই কেন?

শমিত থেমে থেমে বলল, আমার গাড়ির পিছনের নাম্বার প্লেটটা দেখতে পাচ্ছি না। বোধহয় অ্যাম্বাসাডরের ধাক্কায় ওটা রাস্তাতেই খুলে পড়ে গেছে। অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে খোঁজ করতে করতে যদি পুলিশ আমাদের গাড়ির নাম্বার প্লেটটা খুঁজে পায় তা হলে ওরা দু-চারদিনের মধ্যেই এই ফ্ল্যাটে এসে হাজির হবে। কথা বলতে বলতে হতাশায় মুখে হাত চাপা দিল শমিত। বড়-বড় শ্বাস টেনে বলল, এই টেনশন আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

আমিও আর পারছি না। পাপিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, কিন্তু মিষ্টুর কোনও ক্ষতি করতে পারব না। ওকে যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি! কেঁদে ফেলল পাপিয়া : ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। তুমি দ্যাখো, ওর গায়ে যেন কোনও আঁচ না লাগে। তুমি যা ভালো বোঝো করো–আমি আর পারছি না, আর পারছি না।

শমিত পাপিয়ার কাছে এসে ওর হাত ধরল, মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, কেঁদো না। আমাকে একটু ভাবতে দাও…।

.

০৪.

শুক্রবার সাতসকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল শমিত। ও মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করে। তাই সেই ধরনের খবরগুলোয় খুঁটিয়ে চোখ বোলাচ্ছিল।

পাপিয়া চ্যাম্পকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছিল। আর রাস্তার দিকের ছোট্ট ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে মিষ্টু গান শোনাচ্ছিল বাপ্পাকে।

পাপিয়ার কান পড়ে ছিল মিষ্টুর গানের দিকে। ও শমিতকে বলল, শুনছ, তোমার মেয়ে গাইছে…।

শমিত কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে দেখল পাপিয়ার দিকে। অবাক হয়ে বলল, মেয়ে!

পাপিয়া হেসে ইশারা করে মিষ্টুকে দেখাল।

ভোরের আলোয় মেয়েটাকে দেখে শমিত কেমন যেন হয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল মেয়ে-র গান।

শুন লো শুন লো বালিকা,
রাখ কুসুমমালিকা,
 কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি,
শ্যামচন্দ্র নাহি রে।
 দুলই কুসুমমুঞ্জরি, ভমর ফিরই গুঞ্জরি,
অলস যমুন বহয়ি যায়…

ওইটুকু পুঁচকে মেয়ে, অথচ কী অসামান্য সুরের দখল! অবহেলায় সুরকে খেলাচ্ছে!

শমিতের চোখ আবেশে বুজে আসছিল।

আশ্চর্য! পুরোনো সবকথা ভুলে গেলেও গানটাতো ও ভোলেনি! এরকম কি হয়?

পাপিয়া শমিতের পাশটিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল–খবরের কাগজের হেড-লাইনগুলো আনমনাভাবে পড়তে চেষ্টা করছিল। হঠাৎই ও চমকে উঠল।

কাগজের দুইয়ের পাতায় মিষ্টুর ছবি ছাপা হয়েছে।

ও এক ঠেলা মারল শমিতকে। বলল, শিগগির দ্যাখো! মিষ্টুর ছবি দিয়েছে কাগজে। ছবিটায় আঙুল ছোঁয়াল পাপিয়া। নীচু গলায় জিগ্যেস করল, এটা মিষ্টু না?

শমিতের আবেশ-টাবেশ তখন ছুটে গেছে। কারণ, ও ততক্ষণে ছবির নীচের চার-ছলাইন লেখাটাও পড়ে ফেলেছে:

আমাদের দশ বছরের মেয়ে মিষ্টু, ভালো নাম সঙ্গীতা, গত সোমবার বাগুইআটি বাসস্টপ থেকে নিখোঁজ। একটা শক পেয়ে পুরোনো সব কথা ও ভুলে গেছে। কোনও সহৃদয় বন্ধু দয়া করে ওর সন্ধান দিলে আমরা সাধ্যমতো পুরস্কার দেব, প্রাণে বাঁচব।
তন্ময় ও মালিনী হাজরা ফোন ৯৮৩১১০৪২৩২

বারবার মির ফটোগ্রাফটা দেখল শমিত।

 নাঃ, ভুল হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।

সঙ্গে-সঙ্গে ওর বুকটা স্বস্তিতে হালকা হল, কিন্তু তারপরই ভারী হয়ে উঠল আবার। মিষ্টুর বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। ওঁরা এবার নিয়ে যাবেন ওঁদের আদরের মেয়েকে।

শমিতের বুকের ভেতরে একটা পাথর গড়াতে লাগল। ওর সেঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছিল। এই চারদিনে ছোট্ট মেয়েটা ওদের সঙ্গে এত জড়িয়ে গেছে যে, এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে গেলে বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ হবেই।

পাপিয়ার মুখের দিকে তাকাল শমিত। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে মিষ্টুর ফটোটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও। শমিত বুঝতে পারল পাপিয়ার বুকের ভেতরে ঢেঁকির পাড় পড়ছে।

মিষ্টুর মা-বাবার কষ্টটা একবার ভেবে দ্যাখো…। আলতো করে বলল শমিত।

 পাপিয়া চুপ করে রইল। ভাবল, আজকের সকালটা না হলেই ভালো হত।

শমিত বলল, কাগজটার কিছু একটা ব্যবস্থা করো…মিষ্টু বা বাপ্পা যেন ছবিটা না দ্যাখে। আমাকে একটু ভাবতে দাও।

চা খাওয়া ছেড়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল শমিত। চোখ বন্ধ করে ডান হাতটা ভাঁজ করে রাখল চোখের ওপরে। ওর চা ঠান্ডা হতে লাগল।

পাপিয়া মিষ্টুর দিকে অপলকে তাকিয়ে খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে লাগল।

মিষ্টুর গান শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন বাপ্পা ওকে অনভ্যস্ত গলায় দু-চারলাইন হিন্দি গান শোনাচ্ছিল। এরপরই হয়তো দুজনে অন্তাক্ষরী খেলা শুরু করে দেবে। তারপর অনেক বকাঝকা করলে বাপ্পা একটু বই নিয়ে বসবে।

শমিত গতকালের কথা ভাবছিল। গতকালটা খুব ঝামেলার মধ্যে কেটেছে শমিতের।

ওর দিনের প্রথম কাজ ছিল গাড়িটাকে গ্যারেজে পাঠানো। কিন্তু তার আগেই বেশ কয়েকজন প্রতিবেশীর সমবেদনা ওকে শুনতে হয়েছে।

কলকাতার মতো বিচ্ছিরি ট্র্যাফিক ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোনও শহরে নেই।

দেখুন গিয়ে, ড্রাইভারটা হয়তো নেশা-টেশা করে গাড়ি চালাচ্ছিল।

গ্যারেজে তো আপনার প্রায় পাঁচ-সাত হাজার টাকা লেগে যাবে।

ওই গাড়িটার কাছ থেকে কত টাকা আদায় করতে পারলেন?

গাড়ি সারানোর খরচা আপনার অফিস দেবে না? আপনার তো মশাই সাহেব-কোম্পানি!

শমিত মামুলি উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে।

গ্যারেজে গাড়িটাকে জমা করে দিয়ে এসে পুলিশের ব্যাপারটা নিয়ে পড়ল শমিত। অফিসে বেরোনোর সময় পাপিয়াকে ও বলল, আমাদের অফিসের প্রজেক্ট ম্যানেজার চন্দ্রদেও আগরওয়ালের পুলিশে কিছু জানা-চেনা আছে। আজ ওর সঙ্গে কথা বলে ওর চেনা কোনও অফিসারের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করব। তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে সেই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে যাব। তাঁকে সব বলে দেখি কী সাজেশান দেন…।

কী হয় আমাকে ফোন করে জানিয়ো…নইলে খুব টেনশন হবে। পাপিয়া বলল।

শমিত মাথা নেড়ে বলল, করব। শোনো, আজ ফিরতে আমার একটু দেরি হতে পারে। তুমি ওদের নিয়ে খুব সাবধানে থাকবে। বাপ্পাকে স্কুলে দিয়ে আসা বা নিয়ে আসার সময় অ্যালার্ট থাকবে। আনোন কোনও লোককে ফ্ল্যাটের দরজা খুলবে না। বিকেলে পার্কে বেরোলে চ্যাম্পকে তো সঙ্গে নেবেই, তা ছাড়া লোকজনের মাঝে থাকবে..ফাঁকা জায়গায় একা-একা তোমরা ঘুরবে না। আর কোনও প্রবলেম হলেই আমাকে মোবাইলে ফোন করে দেবে।

শমিত অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাপিয়া বাপ্পাকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে। বলেছে, অচেনা কোনও লোকের কাছে যাবি না, কথা বলবি না…আর কিছু দিলেও নিবি না।

চকোলেটের ঘটনাটা বাপ্পার মাথায় আছে। সুতরাং হেসে মাকে আশ্বস্ত করল ও, বলল, ডোন্ট উয়ারি, মা, আমি কেয়ারফুল থাকব।

এরপর পাপিয়া যখনই রাস্তায় বেরিয়েছে তখনই বাজপাখির চোখে চারদিকে নজর রেখেছে। আর বাপ্পাও কম যায় না! সবসময় মাকে আর মিষ্টুকে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চলাফেরার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বিকেলে পার্কে বেড়াতে যাওয়ার সময়েও ওরা যথেষ্ট সাবধান ছিল।

রাতে প্রায় পৌনে আটটার সময় শমিত অফিস থেকে ফিরেছে।

পাপিয়া সারাটা দিন ওর বাড়ি ফেরার প্রহর গুনেছে, বারদুয়েক ফোনও করেছে শমিতকে। এখন ও বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসামাত্রই পাপিয়া ওকে চেপে ধরেছে : অফিসের কনট্যাক্টে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা কিছু হল?

শমিত বলল, কথা হয়েছে, তবে ফোনে। সেই অফিসার বলেছেন, মিষ্টুর ব্যাপারটা আর অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা সেপারেটলি ট্রিট করতে। ভদ্রলোক আগরওয়ালের খুবই ক্লোজ। উনি বলেছেন, লালবাজারের মিসিং পারসন্স স্কোয়াডে একবার কথা বলবেন। আর একটা ইমপরট্যান্ট অ্যাডভাইস দিয়েছেন : পুলিশ যদি কখনও মিষ্টুর ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করে তাহলে যেন সত্যি কথাই বলা হয়।

এরপর ওরা চারজন লুডো খেলতে বসেছে ড্রইং-ডাইনিং-এ। আর চ্যাম্প মেঝেতে শুয়ে একমনে টিভি দেখছিল। অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট কিংবা ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেলে পশুপাখির ছবি দেখালেই চ্যাম্প একমনে সেগুলো দ্যাখে। তখন টিভি অফ করলেই ও চিৎকার শুরু করে দেয়। চ্যাম্পের এই অদ্ভুত নেশাটা বাপ্পার আবিষ্কার।

লুডো খেলতে খেলতে যখন ওরা মশগুল, পাকা ঘুঁটি-কাঁচা ঘুঁটির দান নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-চেঁচামেচি করছে, ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল।

শমিত উঠে গিয়ে ফোন ধরল। তার আগে আড়চোখে তাকাল দেওয়াল-ঘড়ির দিকে : সাড়ে নটা পেরিয়ে মিনিটদশেক হয়েছে।

হ্যালো।

শমিত রায়চৌধুরী? সেই মিহি গলা, তবে গলায় বিরক্ত ওপরওয়ালার সুর।

হ্যাঁ, বলছি…।

মিষ্টু এখনও বেঁচে আছে কেন?

এ-প্রশ্নের কী জবাব দেবে শমিত ঠিক বুঝতে পারল না। ও আমতা-আমতা করতে লাগল।

 এখনও কেন বেঁচে আছে মেয়েটা? রুক্ষ অধৈর্য সুরে বুলেটের মতো ছুটে এল প্রশ্নটা।

শমিত আমতা-আমতা করে বলল, আমরা ওকে…ওকে..মারতে পারব না..আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়…প্লিজ… আপনি একটু বুঝতে চেষ্টা করুন…।

 শমিত টেলিফোনে কাঁপা গলায় এইসব বলছিল আর তিনজন লুডো-খেলোয়াড় হাঁ করে ওর কথাগুলো গিলছিল।

বড় বেডরুমের দরজার কাছেই টেলিফোন। ফলে শমিতকে ওরা যেমন দেখতে পাচ্ছিল তেমন শুনতে পাচ্ছিল ওর কথা। শুনতে-শুনতে পাপিয়ার চোখ-মুখ কেমন যেন বদলে যাচ্ছিল।

ওসব বাজে বকওয়াস ছেড়ে কান খুলে শুনুন। এই সপ্তাহের মধ্যে কাজটা ফিনিশ করে দিন…দরকার হয় পাঁচ-দশ হাজার টাকাও দেব আপনাকে…গাড়িটা ভালো করে রিপেয়ার করিয়ে নিতে পারবেন। আর যদি এই উইকের মধ্যে কাজটা ফিনিশ করতে না পারেন, তাহলে মেয়েটাকে রাস্তায় একা বের করে দিন, আমরা কাজ ফিনিশ করে দেব। আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েও আমরা কাজটা করতে পারি, কিন্তু তাতে মিষ্টুর সঙ্গে-সঙ্গে আরও দু-চার পিস জান বেহুদা খরচা হয়ে যাবে। সেটা তো ভালো হবে না…।

ঠিক আছে, ঠিক আছে…আমি দেখছি কী করা যায়…প্লিজ, আমাদের একটু ভাববার সময় দিন…প্লিজ…।

কিন্তু ততক্ষণে ও-প্রান্তের লোকটা ফোন রেখে দিয়েছে।

শমিত ঘামতে শুরু করেছিল। পাপিয়া, বাপ্পা আর মিষ্টু ওকে জরিপ করছিল। শমিতের ভয় হচ্ছিল, ওরা বোধহয় ওর বুকের ধড়াস ধড়াস আওয়াজগুলো শুনতে পাবে। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, এই শহরে সাধারণ মানুষ কত অসহায়।

শমিত রিসিভার নামিয়ে রাখল।

কী হয়েছে, বাবা! কে ফোন করেছে? বাপ্পা জিগ্যেস করল।

আঙ্কল, তুমি এত ঘামছ কেন? মিষ্টু জানতে চাইল।

পাপিয়া ওদের প্রশ্নগুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠল, চল তো, তোরা এখন খেতে চল। চট করে হাত-মুখ ধুয়ে নে…। উঠে দাঁড়িয়ে ওদের তাড়া লাগাল পাপিয়া।

শমিত বেডরুমের দরজা থেকে ধীরে-ধীরে পা ফেলে ড্রইং-ডাইনিং-এ এল।

ওরা কাকে মেরে ফেলতে বলছে, আঙ্কল?

মিষ্টু প্রশ্নটা করতেই পাপিয়া ডুকরে কেঁদে উঠল। ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না চাপতে-চাপতে বলল, ওটা পাগলের ফোন..ওসব কথা তোরা শুনিস না…।

ব্যাপারটা তখনকার মতো মিটে গেলেও বাপ্পা আর মিষ্টুর মনে খটকা লেগেই রইল।

রাতে বাপ্পা আর মিষ্টু ঘুমিয়ে পড়লে শমিত আর পাপিয়া ড্রইং-ডাইনিং-এ টিভি দেখতে বসেছে। কিন্তু টিভির ছবি কিংবা কথা ওদের মাথায় ঢুকছিল না। ঘরের আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে ছিল ওরা দুজনে। টিভির পরদার আলো ওদের থমথমে মুখে হাইলাইট তৈরি করেছে। শমিত একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছিল। আর পাপিয়া বারবার ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছিল যেন তিনি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ বলে দেন।

মিষ্টুকে কী করে খুন করবে ওরা! কী করে রাস্তায় বের করে দেবে মেয়েটাকে! মানুষ কখনও এমন কাজ পারে না। এমন কাজ করতে হলে অমানুষ হতে হয়–টেলিফোন করা ওই লোকটার মতো। যার বাইরের চেহারাটা মানুষের মতো–ভেতরটা নয়।

এক অদ্ভুত দোটানায় দুলতে-দুলতে কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে থেকেছে পাপিয়া আর শমিত। ভেবেছে, এখন ওদের কী করা উচিত। ভাবতে-ভাবতে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু পথের হদিশ মেলেনি। সারাটা রাত প্রায় জেগে কাটিয়ে হঠাৎই শমিত দ্যাখে আকাশ কখন যেন ফরসা হয়ে গেছে।

তারপর আজ সকালের খবরের কাগজ ওদের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। পুলিশের ভয় আর নেই। টেলিফোনে হুমকির ভয়ও আর থাকবে না। ভগবান নিশ্চয়ই পাপিয়ার আকুল প্রার্থনা শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাপিয়া বা শমিত খুশি হতে পারছে না কেন!

পাপিয়া খবরের কাগজটা ভাঁজ করে শোবার ঘরের আলমারির মাথায় তুলে রাখতে যাচ্ছিল, শমিত হঠাৎই চেয়ারে সোজা হয়ে বসল, ওকে ডাকলঃ কাগজটা দাও।

কেন?

মিষ্টুর বাড়িতে ফোন করব। এভাবে আমি আর পারছি না…এখন এটাই একমাত্র পথ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শমিত, বড় বেডরুমটার দিকে দু-পা এগিয়ে গেল।

পাপিয়া শমিতকে দেখল। ওর চোখে প্রতিজ্ঞা, চোয়াল শক্ত। সত্যিই ও আর পারছে না। এই কদিনেই চোখের কোল কেমন বসে গেছে।

হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে শমিতের কাছে এল পাপিয়া। শমিতের দিকে না তাকিয়ে কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। ধরা গলায় অস্পষ্টভাবে বলল, যা ভালো বোঝো করো…।

শমিত কোনও কথা বলল না। রোবটের মতো আবেগহীনভাবে চলে গেল টেলিফোনের কাছে। খবরের কাগজ দেখে মোবাইল নম্বরটা ডায়াল করল।

পাপিয়া পাথরের মূর্তি হয়ে শমিতকে দেখতে লাগল। ওর সবরকম বোধ কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিল।

হ্যালো, মিস্টার তন্ময় হাজরা বলছেন?

হ্যাঁ বলছি। ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে এল।

লাইনটা একটু ডিসটার্ব করছিল। তাই শমিত একটু গলা তুলেই বলল, আপনাদের দেওয়া অ্যাডটা দেখে ফোন করছি। আমার নাম শমিত রায়চৌধুরী। আপনাদের মেয়ে মিষ্টু আমাদের কাছে আছে…।

সত্যি? সত্যি বলছেন? ভদ্রলোক আকুল গলায় জিগ্যেস করলেন।

হ্যাঁ, সত্যি… কথা বলতে গিয়ে মনের আবেগ চাপতে পারছিল না শমিত। তাই সংক্ষেপে কথা শেষ করার জন্য বলল, আজ সন্ধেবেলা সাতটা নাগাদ আপনারা আমাদের বাড়িতে আসুন…এলে ডিটেইলসে সব জানতে পারবেন…।

তারপর শমিত ওঁদের ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিল। কীভাবে এই ফ্ল্যাটে আসতে হবে তাও বলে দিল।

তন্ময় হাজরা শমিতকে বারবার ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, মেয়েকে হারিয়ে ওঁর স্ত্রী মালিনীর প্রায় পাগলের মতো অবস্থা। এরকম অবস্থায় আরও এক-দু-সপ্তাহ কেটে গেলে ওঁর কী হত বলা যায় না। আজ সন্ধে সাতটার সময় তিনি অবশ্যই স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন।

ফোনটা করা হয়ে গেলে শমিত কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পাপিয়াকে দেখল, দেখল মিষ্টু আর বাপ্পাকেও। শমিতকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, মনে-মনে ও কিছু একটা ভাবছে।

মিনিটখানেক পরেই ও বাপ্পা আর মিষ্টুকে কাছে ডাকল। ওরা আসতেই শমিত হেসে বলল, শোন, তোদের একটা দারুণ খবর দেব। আজ আমি অফিস ছুটি নিচ্ছি। আর, বাপ্পা, তুই আজ স্কুলে যাবি না…।

কেন, বাবা?

আজ সারাটা দিন আমরা হইহই করে ছুটি কাটাব। ট্যাক্সি নিয়ে গোটা কলকাতা ঘুরব। তাজ বেঙ্গলে লাঞ্চ খাব। দুপুরের শো-তে একটা সিনেমা দেখব…তারপর ময়দানে হাওয়া খাব, ভিক্টোরিয়ায় বেড়াব, তোদের জন্যে নতুন ড্রেস কিনব, মিষ্টুর জন্যে খেলনা কিনব..যা খুশি তাই করব। বলো, দারুণ জমবে না?

শেষ প্রশ্নটা শমিত করেছে পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে।

পাপিয়া মানুষটার ভেতরের কষ্ট বুঝতে পারছিল। ওর মন ঝলসে যাওয়ার গন্ধ পাচ্ছিল নাকে। শমিতের বাইরেটা হাসিখুশিতে টগবগে, কিন্তু ওর চোখের কোণে জলের ফোঁটা চিকচিক করছিল।

পাপিয়া কষ্ট করে হাসল, উজ্জ্বল হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল, সত্যি, দারুণ হবে। আজকের দিনটা মিষ্টুর বহুদিন মনে থাকবে।

তারপরই সাজ-সাজ রব পড়ে গেল ওদের ফ্ল্যাটে। শমিত অফিসে ফোন করে বলে দিল, আজ ও ছুটি নিচ্ছে। পাপিয়া দশভুজা হয়ে রোজকার কাজ সারতে লাগল। তারপর কোনওরকমে ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা চারজন বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। চ্যাম্পকে ওরা জমা রেখে গেল পাশের ফ্ল্যাটের নিরঞ্জনবাবুর কাছে। খুব বেশি সময়ের জন্য বাইরে বেরোলে শমিত আর পাপিয়া চ্যাম্পকে নিরঞ্জনবাবুর জিম্মায় দিয়ে যায়।

সত্যি, আজ ওদের চারজনের যেন স্বাধীনতা দিবস।

শুধু ট্যাক্সিতে ওঠার সময় পাপিয়া চাপা গলায় শমিতকে মনে করিয়ে দিল, সাড়ে ছটার মধ্যে কিন্তু আমাদের ফিরতে হবে। ওঁরা সাতটার সময় আসবেন…।

শমিত ছোট্ট করে হুঁ বলল।

.

০৫.

ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল ঠিক সাতটায়।

বেলের আওয়াজে পাপিয়া চমকে উঠল।

শমিত তাকাল মিষ্টুর দিকে।

মেয়েটা এখনও কিছু জানে না। অনেকবার বলতে চেয়েও শমিত কিংবা পাপিয়া ওকে কিছু বলতে পারেনি। শুধু কয়েকবার ওকে সঙ্গীতা বলে ডেকে দেখেছে, কিন্তু মিষ্টু সে-ডাকে সাড়া তো দেয়ইনি, উলটে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে, কে সঙ্গীতা? কাকে সঙ্গীতা বলে ডাকছ?

সারাদিন উদ্দামভাবে বেড়ানোর পর ওরা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে সওয়া ছটা নাগাদ ফিরেছে। কিন্তু বাপ্পা আর মিস্তুর উৎসাহে ভাটা পড়েনি। ওরা নতুন কিনে আনা ড্রেস আর খেলনা নিয়ে ড্রইং-ডাইনিং-এ বসে পড়েছে। প্রতিটি জিনিস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চকচকে চোখে দেখছে, তারিফ করছে।

শমিত পাশের ফ্ল্যাট থেকে চ্যাম্পকে নিয়ে আসামাত্রই ও কুঁইকুঁই করে বাপ্পাকে ঘিরে ঘুরপাক খেতে লাগল, বারবার নাক ছোঁয়াল বাপ্পার গায়ে।

শমিত একটা চেয়ারে বসে একের পর এক সিগারেট খাচ্ছিল আর মিষ্টুকে দেখছিল। পাপিয়া নানান কাজে এ-ঘর সে-ঘর করছিল বটে, কিন্তু শমিত লক্ষ করল ওর সারা মুখে বর্ষার মেঘ।

বিকেল থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। একটু আগে সেটা কয়েক ডিগ্রি বেড়েছে। কোথায় যেন ছড়ছড় করে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে।

কলিংবেল বাজতেই শমিত উঠে গিয়ে দরজা খুলল।

 দরজায় দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা।

ভদ্রলোক আমতা-আমতা করে বললেন, আমরা শমিতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমাদের…আই মিন..সাতটায় সময় আসার কথা ছিল..মানে…।

আপনার নাম? শমিত বুঝতে পারছিল প্রশ্নটা অবান্তর, কিন্তু ও এতটুকুও সন্দেহের ফাঁক রাখতে চাইল না। কারণ, টেলিফোনের ভয়-দেখানো কথাগুলো ওর কানে ভাসছিল।

আ-আমি তন্ময় হাজরা। থতিয়ে বললেন ভদ্রলোক। পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, আমার ওয়াইফ..মালিনী। আমরা…আই মিন…মিষ্টুর…মানে, ইয়ে…সঙ্গীতার খোঁজে এসেছি…।

কোথায়? আমার মেয়ে মিষ্টু কোথায়? কাঁপা গলায় জানতে চাইলেন মালিনী।

শমিত ওঁদের ভেতরে আসতে বলল।

তন্ময় হাজরার গায়ের রং ময়লা। চেহারা বেঁটেখাটো। মাথায় টাক। চোখে সাধারণ চশমা। পরনের জামা-প্যান্টও মামুলি। বয়েস বড়জোর চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ–শমিতের কাছাকাছি। কথাবার্তায় কেমন একটা মিনমিনে সঙ্কুচিত ভাব।

কিন্তু মালিনীকে দেখে একটু অবাক হলো শমিত।

ফরসা ছিপছিপে ধারাল রূপসি। পরনে দামি সিল্কের শাড়ি। বয়েস খুব বাড়িয়ে বললে সাতাশ কি আঠাশ। নাক-মুখ-চোখ এত সুন্দর যে, মালিনী সহজেই টিভি সিরিয়ালের নায়িকা হতে পারেন। তন্ময়ের স্ত্রী হিসেবে ওঁকে কেন যেন বেশ বেমানান লাগছিল।

তন্ময়ের হাতে বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট ছিল। সেটা শমিতের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। মালিনীর হাতে এক বিশাল মাপের পলিথিনের ঝোলা–তাতে বেশ কয়েকটা রঙিন বাক্স চোখে পড়ছে। ওঁর চোখ চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল–মিষ্টুকেই খুঁজছিল বোধহয়। কিন্তু একটু আগেই মিষ্টু উঠে টয়লেটে গেছে। তাই মালিনী আকুলভাবে শমিতের দিকে তাকালেন, তারপর তাকালেন স্বামীর দিকে।

চ্যাম্প তন্ময় আর মালিনীকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছিল, বারবার নাক ঠেকাচ্ছিল ওঁদের পোশাকে।

শমিত ওঁদের সোফায় বসতে বলল। তারপর অন্দরের দিকে তাকিয়ে একটু উঁচু গলায় হাঁক পাড়ল, পাপিয়া, তন্ময়বাবুরা এসেছেন…।

বাপ্পা হাঁ করে মিষ্টুর মা-বাবাকে দেখছিল। আজ সারাদিন ধরে বেড়ানোর সময় পাপিয়া ওকে সবকথা বলেছে। বলেছে, আজ মিষ্টুর মা-বাবা মিষ্টুকে নিতে আসবেন।

বাপ্পার ভীষণ মনখারাপ লাগছিল। মিষ্টু চলে যাবে ওদের বাড়ি ছেড়ে!

এমন সময় মিষ্টু আর পাপিয়া একসঙ্গে ড্রইং-ডাইনিং-এ এল। ওদের নজর সরাসরি গিয়ে পড়ল অতিথি দুজনের দিকে। শমিত লক্ষ করল মিষ্টুর চোখে কৌতূহল।

মালিনী হঠাৎ সোফা ছেড়ে ছিটকে উঠে পড়লেন। মিষ্টু– বলে এক তীব্র হাহাকার তুলে ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলেন মিষ্টুকে। চুমোয়-চুমোয় ওকে অস্থির করে তুললেন।

মিষ্টু…আমার মিষ্টু সোনা! তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে, মা-মণি? তোমার জন্যে কেঁদে কেঁদে আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম! মা-মণি আমার…। মালিনীর গলা কান্নায় জড়িয়ে গেল।

তন্ময়ও সোফা ছেড়ে উঠে চলে গেলেন মিষ্টুর কাছে। ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।

শমিত লক্ষ করল তন্ময়ের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে।

পাপিয়া আকুল বাবা-মাকে দেখছিল আর চোখ মুছছিল। হারানো-সন্তানকে ফিরে পাওয়া মানে শরীর আর প্রাণের মিলন। এ-দৃশ্য এত আনন্দের যে, আবেগকে ধরে রাখা যায় না।

এরপর যেন উৎসব শুরু হয়ে গেল শমিতদের ফ্ল্যাটে।

মালিনী ওঁর পলিথিনের ঝোলা থেকে রঙিন বাক্সগুলো বের করলেন। বাক্সগুলো খুলতেই বেরোল রং-বেরঙের খেলনা। সেগুলো দিয়ে ফিরে-পাওয়া মেয়েকে একেবারে মুড়ে দিলেন। বাবা মায়ের আদরে-আদরে মিষ্টু একেবারে অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু মেয়েটা সবসময়েই মালিনীকে অপরিচিতের চোখে দেখতে লাগল।

সারাদিন বাইরে ঘুরবে বলে কাজের লোককে শমিতরা ছুটি দিয়েছিল। তাই তন্ময়দের জন্য মিষ্টি কিনতে শমিত নিজেই বেরোল। তন্ময়দের কোনও আপত্তি শুনল না।

মালিনী আর তন্ময় বাপ্পার সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একটা খেলনা ওকে দিয়ে মালিনী বললেন, এই অটোমেটিক রিভলভারটা তুমি নাও মিষ্টু খুশি হবে।

ওদের কথাবার্তায় মাঝেই ফিরে এল শমিত। ওর হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে তন্ময় আর মালিনীর আপ্যায়ন সারল পাপিয়া।

তারপর সবাই মিলে গোল হয়ে বসে দুনিয়ার গল্প শুরু হয়ে গেল।

শমিত বলল, কীভাবে মিষ্টুকে ওরা রাস্তায় পেয়েছে। তবে ভয়-দেখানো ফোনের কথাও বলল না, আর অ্যাম্বাসাডরের অ্যাক্সিডেন্টের কথাটাও বলল না। শুধু বলল, মিষ্টুর স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার কথা। ওকে নিয়ে গিয়ে যে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছে সে কথা জানাল। আর সবশেষে বলল, নানান সাত-পাঁচ ভেবে ওরা মিষ্টুকে পেয়ে পুলিশে কোনও খবর দেয়নি। তখন পাপিয়া পুলিশে খবর না দেওয়ার কারণগুলোও বলল।

তন্ময় হঠাৎই একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। নীচু গলায় বললেন, আমরাও ওকে ডাক্তার…আই মিন…সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছিলাম। কিন্তু ইমপ্রুভমেন্ট তো সেরকম কিছু হল না। ডক্টর বলেছেন, চেষ্টা করতে করতে কোনদিন হঠাৎই ওর মেমোরি ফিরে আসবে…আই মিন…সব কথা মনে পড়ে যাবে।

তন্ময়ের কথা শুনতে-শুনতে আঁতকে উঠল পাপিয়া। মিষ্টুর যদি সবকথা মনে পড়ে যায় তা হলেই তো সর্বনাশ! টেলিফোনে ওই লোকটা বলেছিল, মিষ্টু অনেক কথা জানে। সেসব কথা মনে পড়ে গেলে ওদের যাচ্ছেতাই বিপদ হবে।

তন্ময় ও মালিনীর সঙ্গে চায়ের পালা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল শমিত। টেলিফোনের কথাগুলো ওর মনেও একইসঙ্গে খোঁচা মারছিল। তন্ময় আর মালিনীকে কি টেলিফোনের ব্যাপারটা জানানো উচিত? কিন্তু সেটা বলতে গেলেই তো আরও অনেক কথা বলতে হবে। তারপর যে-জিনিসটা ওরা সবচেয়ে বেশি এড়াতে চাইছে, সেটাই ঘুরেফিরে এসে পড়বে : পুলিশ।

শমিত পাপিয়ার দিকে তাকাল। চোখে-চোখে কথা হল ওদের। পাপিয়া ছোট্ট করে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল–যার মানে, না, বোলো না।

শমিত তখন তন্ময়দের জিগ্যেস করল, কিন্তু হঠাৎ করে ওর মেমোরি লস হলো কী করে? ও কি কোনও শক-টক পেয়েছিল?

তন্ময় হাজরাও চায়ের পর সিগারেট ধরিয়েছিলেন। শমিতের কথার উত্তরে মালিনী কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তন্ময় সিগারেটসমেত হাত শূন্যে তুলে ইশারায় ওঁকে বাধা দিলেন। তারপর আড়চোখে তাকালেন মিষ্টুর দিকে।

মিষ্টু তখন বাপ্পার সঙ্গে ক্রিকেট খেলা শুরু করে দিয়েছে।

মালিনীর আদরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েই মিষ্টু চলে গেছে বাপ্পার কাছে। বাপ্পা কোথা থেকে একটা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে এসেছিল, সেটা দেখেই মিষ্টু একটা বল নিয়ে ওর সঙ্গে মেতে উঠেছে। বাবা-মায়ের সম্পর্কে ওর কোনওরকম আগ্রহ আছে বলে মনে হল না।

ওর দিকে ইশারা করে তন্ময় বললেন, দেখেছেন, আমাদের নিয়ে মিষ্টুর কোনওরকম মাথাব্যথা নেই! এটা আমাদের কাছে কত পেইনফুল ভাবুন তো! ভাবুন তো, আপনার ছেলে আপনাকে…আই মিন…চিনতে পারছে না! কেমন লাগবে সেটা! ওঃ! মাথা নীচু করলেন তন্ময় ও আসলে কী জানেন? ওর এই মেমোরি লসের জন্য আমরাই ইনডিরেক্টলি দায়ী।

কেন, আপনারা দায়ী কেন? পাপিয়া প্রশ্ন করল।

মালিনী আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তন্ময় ওঁকে বাধা দিয়ে বললেন, মালিনী, প্লিজ, আমাকে বলতে দাও। আমার যদি কোথাও গ্যাপ পড়ে যায়…আই মিন ভুল-টুল হয়, তখন তুমি আমাকে শুধরে দিয়ো।

সিগারেটে বারদুয়েক টান দিলেন তন্ময়। চ্যাম্পকে একবার দেখলেন। তারপর খানিকটা আনমনাভাবে বললেন, সবই আমাদের কপাল, মিস্টার রায়চৌধুরী! আমাদের বাড়ি তালতলা অঞ্চলে…আই মিন…এস.এন.ব্যানার্জি রোডে। মাসখানেক আগে আমরা মিষ্টুকে বউবাজারে ওর এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাই। পরদিন ওর ফিরে আসার কথা। শ্রেয়া…আই মিন ওর বন্ধু…বলেছিল, আঙ্কল, সঙ্গীতা আমাদের বাড়িতে দু-তিনদিন থাকুক, তারপর বাপি ওকে বাড়ি দিয়ে আসবে। আমরা..আই মিন আমি আর মালিনী…রাজি হইনি। মিষ্টু আমাদের এমনই একটা জ্যান্ত খেলার পুতুল যে, ওকে ছেড়ে আমরা একটুও থাকতে পারি না। যাই হোক, পরদিন বিকেলে মিষ্টুকে দিয়ে আসার জন্যে শ্রেয়ার বাপি…আই মিন সুদেববাবুকে..আমি বারবার করে রিকোয়েস্ট করলাম। তিনি রাজি হলেন। আমরা চলে এলাম…।

কিন্তু পরদিন বিকেলে মিষ্টু এল না। তখন আমি ওদের বাড়িতে ফোন করলাম। ফোন বেজেই চলল–কেউ ধরল না। তখন আমার আর মালিনীর খুব দুশ্চিন্তা হল। বুঝতেই পারছেন, কোয়াইট ন্যাচারাল। মালিনী তো কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ওকে অনেক কষ্টে শান্ত করে সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি শ্রেয়াদের বাড়ি রওনা হলাম। পথে ভাবতে-ভাবতে গেলাম যে, শ্রেয়ার বাপিকে…আই মিন সুদেববাবুকে…আচ্ছা করে দু-চারকথা শুনিয়ে দেব। বলব যে, মশাই, এই আপনার কাণ্ডজ্ঞান! এদিকে চিন্তায়-চিন্তায় আমরা মরছি!

ওদের বাড়ি পৌঁছে দেখি ভারী অদ্ভুত ব্যাপার। বাড়ি একেবারে খাঁ-খাঁ…আই মিন বাড়িতে কেউ নেই। শ্রেয়াদের ছোট একতলা বাড়ি–নিজেদের বাড়ি, কোনও ভাড়াটে নেই। তাই সদরের ভেজানো দরজা ঠেলতেই খুলে গেল দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল।

গোটা বাড়ি অন্ধকার। আমার তো বেশ ভয়-ভয় করছিল। শ্রেয়া আর মিষ্টুর নাম ধরে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়া পেলাম না। তবুও সাহসে ভর করে শুধুমাত্র মিষ্টুর জন্যে আমি সবকটা ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু ওর কোনও হদিস না পেয়ে আমার কান্না পেয়ে গেল। অন্ধকার ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে কপাল চাপড়াতে লাগলাম। কী করে বাড়ি ফিরে আমি মালিনীকে মুখ দেখাব!

বেশ কিছুক্ষণ পর…আই মিন প্রায় আধঘণ্টামতন হবে…নিজেকে ধীরে-ধীরে সামলে নিলাম। আর ঠিক তখনই একটা চাপাকান্নার শব্দ আমার কানে এল। একটা ছোট ছেলে বা মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

কে? মিষ্টু না! আমি ওর নাম ধরে ডেকে উঠলাম : মিষ্টু! মিষ্টু! আর সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া পেলাম। কান্না থামিয়ে কে যেন বলে উঠল, এই যে, আমি.. এখানে…। একলাফে উঠে দাঁড়ালাম আমি। অন্ধকার ঘরে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলাম। একটু পরেই ওকে পেলাম। খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এল। আমি ওকে জাপটে ধরলাম। টের পেলাম, ও বাচ্চা খরগোশের মতো ভয়ে কাঁপছে।

ওকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে। তারপর সোজা রওনা হলাম বাড়ির দিকে। শ্রেয়াদের ব্যাপার নিয়ে একটিবারের জন্যেও ভাবলাম না। হয়তো আমার পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু…।

তন্ময় হাজরা থামলেন। হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল–এটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন।

শমিত আর পাপিয়া একমনে তন্ময়ের কথা শুনছিল। শমিত আনমনাভাবে সিগারেটে টান দিচ্ছিল আর ভাবছিল, শ্রেয়াদের হঠাৎ উধাও হওয়ার ব্যাপারটা তন্ময় পুলিশে জানাননি। শমিতরাও তা হলে মিষ্টুর ব্যাপারটা থানায় না জানিয়ে খুব একটা অন্যায় করেনি!

মালিনী বললেন, ও আমাকে ফোন করে সব বলেছিল..তখন আমিও পুলিশে খবর দিতে বারণ করেছি। কারণ, থানা-পুলিশ হলেই আবার সতেরো ঝামেলা…।

কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে মিষ্টু আবার হারিয়ে গেল কেমন করে? তন্ময়কে জিগ্যেস করল শমিত। ফিলটার পোড়া গন্ধ পেতেই ও সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে।

তন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে আর-এক অদ্ভুত গল্প। লাস্ট সোমবার ওকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আমি আর মালিনী বাগুইআটি থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। বাগুইআটির বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসের জন্যে। আমাদের চারপাশে লোকজনের বেশ ভিড় ছিল। খিদে পেয়েছে বলাতে মিষ্টুকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দিয়েছিলাম। ও প্যাকেট ছিঁড়ে বিস্কুট খাচ্ছিল আর বাসস্টপে ঘুরে বেড়ানো কয়েকটা নেড়ি কুকুরকে মাঝে-মাঝে বিস্কুটের টুকরো ছুঁড়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই দেখি মিষ্টু আমাদের সঙ্গে নেই। আমরা আশপাশের লোকজনকে জিগ্যেস করাতে তারা বলল, মেয়েটা তো দুটো কুকুরের উৎপাতে তাড়া খেয়ে ওদিকটায় চলে গেল! ও আপনাদের সঙ্গে ছিল?

তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমে গেছে। তারই মধ্যে আমরা দুজনে কাকভেজা হয়ে মিষ্টুকে খুঁজতে লাগলাম। এ-রাস্তা সে-রাস্তা আর অলিগলি করে আমরা হন্যে হয়ে পড়লাম। কোত্থাও মেয়েটাকে পেলাম না। হতাশায় মাথা নাড়লেন তন্ময়। তারপর শমিত আর পাপিয়ার দিকে পালা করে তাকিয়ে বললেন, আমাদের অবস্থাটা একবার বুঝুন! মালিনীর পাগলের মতো কান্নাকাটি দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম…ও আবার না উলটোপালটা কিছু করে বসে…আই মিন সুইসাইড টাইপের কিছু।

একটু থামলেন তন্ময়। চোয়ালে বার-দুয়েক হাত বুলিয়ে বললেন, এবার তো থানা-পুলিশ করতেই হল। তারপর পুলিশের ভরসায় থাকতে না পেরে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম। সত্যি, ঈশ্বরের লীলার কোনও জবাব নেই। শেষ পর্যন্ত তিনিই মেলালেন। ওপরদিকে মুখ তুলে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন তন্ময়।

মালিনীও চোখের জল মুছে প্রণাম জানালেন ভগবানকে। তবে ওঁর বেলায় এই ভক্তিটা শমিতের কাছে কেমন যেন বেমানান ঠেকল। সেটা বোধহয় ওঁর সাজপোশাকের জন্য।

হঠাৎই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তন্ময় হাজরা বলে উঠলেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আর রাত করব না–নটা বেজে গেছে, এবার আমরা উঠব। আপনারা আমাদের যা উপকার করলেন…জীবনে কখনও ভুলব না। আপনারা..আই মিন…আমাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন।

মালিনী দু-হাতে পাপিয়ার হাত চেপে ধরলেন : আপনাদের কী পুরস্কার দেব জানি না…।

পাপিয়া ঘন-ঘন চোখ মুছছিল। মাথা নেড়ে বলল, পুরস্কারের কী আছে! এ তো যে-কোনও মানুষের কর্তব্য।

মিষ্টু বোধহয় ওই এরিয়াতেই পথ হারিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আপনারা ওকে খুঁজে না পেলে কী হত ভাবুন তো! এবার একটু মিষ্টুকে ডাকুন…।

তন্ময় আর মালিনী একইসঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন।

মিষ্টু আর বাপ্পা খেলতে-খেলতে কখন যেন বড় বেডরুমটায় ঢুকে পড়েছিল। পাপিয়া গলা তুলে মিস্তুকে ডাকল।

ডাক শুনে মিষ্টু আর বাপ্পা ড্রইং-ডাইনিং-এ এল। আর তারপরই শুরু হল সাংঘাতিক কাণ্ড।

মিষ্টু জেদ ধরে বসলঃ কিছুতেই ও তন্ময় আর মালিনীর সঙ্গে যাবে না–ও আঙ্কল আর আন্টির কাছেই থাকবে।

পাপিয়া আর শমিত মিলে ওকে অনেক করে বোঝাল। বলল যে, ওঁরা ওর বাবা-মা। মিষ্টু ওঁদের সঙ্গে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলে সবাই খুশি হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওর মুখে সেই এক বুলি : আমি আঙ্কল আর আন্টি আর বাপ্পাদাদাকে ছেড়ে অন্যলোকের সঙ্গে কিছুতেই যাব না। আমাকে তোমরা তাড়িয়ে দিয়ো না…তা হলে আমি মরে যাব..প্লিজ..।

তন্ময় আর মালিনীও অনেক চেষ্টা করলেন। মিষ্টুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর-টাদর করে বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু কিছু করা গেল না। মালিনীর প্রবল কান্নাকাটিতেও মিষ্টুর মন নরম হল না।

শেষে বাপ্পাও ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল। বলল, তুই তোর বাবা-মায়ের সঙ্গে এখন যা কাল আবার আমাদের বাড়িতে আসিস..আমরা একসঙ্গে পার্কে গিয়ে খেলব।

উত্তরে মিষ্টু বলল যে, সেরকম হলে তন্ময় আর মালিনী রোজ এ-বাড়িতে মিষ্টুর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন, কিন্তু মিষ্টু কিছুতেই বাপ্পাদের ছেড়ে যাবে না।

সব মিলিয়ে তখন রীতিমতো একটা হইচই চলছে। চ্যাম্প ব্যাপার-স্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে বারবার এর-ওর দিকে তাকাচ্ছে আর ঘেউঘেউ করছে। মিষ্টু পাগলের মতো মাথা নেড়ে না-না বলছে, কাঁদছে। আর বাকি পাঁচজন ওকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করছে।

এইসব কারণেই টেলিফোনটা যে বাজছে সেটা প্রথমটায় কেউ খেয়াল করেনি।

 ব্যাপারটা প্রথম খেয়াল করল বাপ্পা। ও শমিতকে ডেকে বলল, বাবা, টেলিফোন।

শমিত তাড়াতাড়ি টেলিফোন ধরতে ছুটল।

আজ ও অফিসে যায়নি। তাই অফিস থেকেই কোনও কলিগ হয়তো ফোন করে থাকতে পারে। সামনের মাসে একটা বড়সড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের সতেরোজন এক্সিকিউটিভকে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে খুব জোর কথাবার্তা চলছে। হয়তো সেই ব্যাপারেই মদনলাল জানা কিংবা শংকর ভাসওয়ানি ফোন করে থাকতে পারে। যদি…।

হ্যালো।

হ্যালো, রায়চৌধুরীসাহেব, মুন্নাকা সমাচার কেয়া? সেই মিহি গলা। তবে তাতে বেশ খানিকটা ধারালো ব্যঙ্গ মিশে রয়েছে।

কে মুন্না? কে বলছেন আপনি? ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেও প্রশ্নগুলো করল শমিত।

আহারে আমার ন্যাকাগঙ্গারাম! মেয়েলি ঢঙে বলল লোকটা। তারপর রীতিমতো শাসানি দিয়ে বলল, মিষ্টুর ব্যাপারটা কী হল? আর মাত্র দু-দিন টাইম আছে। তারপর একদম ঘড়ি বন্ধ…পাক্কা বন্ধ..বুঝতে পারলেন কিছু, নাকি…।

বুঝেছি…বুঝেছি।..আ-আমি..আমরা কিছু একটা করব। এখন ঘরে সব গেস্টরা রয়েছে..প্লিজ..।

বাই সানডে করতেই হবে। ওটাই ডেডলাইন…নইলে ডেড.. মুখে গুলি ছোঁড়ার শব্দ করল লোকটা। তারপর ফোন রেখে দিল।

শমিতের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ও অদ্ভুত এক স্লো মোশনে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। তারপর পাপিয়াদের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল।

ওরা সবাই হাঁ করে শমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় টেলিফোনের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছে।

শমিত তক্ষুণি কোনও কথা বলতে পারল না।

পাপিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তন্ময়দের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা কিছু মাইন্ড করবেন না। মানে…একজনের কাছ থেকে ও টাকা লোন নিয়েছিল…ভীষণ বাজে লোক। তো সেই লোকটা যখন-তখন ফোন করে হুমকি দেয়…যা-তা বলে। অথচ ও ঠিক মাসে-মাসে অল্প-অল্প করে পোন শোধ করে যাচ্ছে…।

পাপিয়াকে মনে-মনে নোবেল প্রাইজ দিয়ে দিল শমিত। কী দারুণভাবে ব্যাপারটা সামলে দিল!

তন্ময় আর মালিনী অপ্রস্তুত হয়ে হাসলেন। মালিনী সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ, যা বলেছেন! উলটোপালটা পাবলিকের থেকে লোন নিলে এই মুশকিল…।

কিন্তু মিষ্টুর ব্যাপারে তন্ময় আর মালিনী হাল ছেড়ে দিলেন। শত চেষ্টা করেও মেয়েটাকে একটুও টলানো গেল না। তন্ময় একবার ওর হাত ধরে টানার চেষ্টা করতেই মিষ্টু খেপে গিয়ে এমন চিৎকার করে উঠল যে, তন্ময় আঁতকে উঠে ওর হাত ছেড়ে দিলেন।

সুতরাং, শেষ পর্যন্ত মিষ্টুর সমস্যাটা থেকেই গেল। শমিত আর পাপিয়া কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না নিয়তি ওদের সঙ্গে এ কোন নিষ্ঠুর খেলা খেলছে!

তন্ময়রা চলে যাওয়ার সময় পাপিয়াদের বলে গেলেন যে, ওঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। মিষ্টু একটু ধাতস্থ হয়ে এলেই ওঁরা এসে ওকে নিয়ে যাবেন।

পাপিয়া আর শমিত বেশ চিন্তিতভাবে ওঁদের বিদায় দিল। ওঁরা চলে যেতেই শমিত দরজা বন্ধ করে পাপিয়ার দিকে তাকাল, বলল, এবার কী করবে? ওই লোকগুলো ফোন করেছিল…।

পাপিয়া শমিতের দিকে একপলক তাকিয়েই ছুটে চলে গেল মিষ্টুর কাছে। হাঁটুগেড়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল ওকে। ওর জামায় মুখ গুঁজে বলে উঠল, তুই কে সত্যি করে বল! এ কোন মায়ায় তুই আমাদের জড়ালি!

বাপ্পা অবাক হয়ে মাকে দেখতে লাগল। মিষ্টু থেকে যাওয়াতে ও কম খুশি হয়নি। কিন্তু মা কাঁদছে কেন? আনন্দে?

সেটা বোঝা গেল বাবার কথা শুনে।

শমিত সোফায় এসে বসল আবার। মিষ্টুকে ডেকে বলল, মিষ্টু, তুই চলে গেলে ফ্ল্যাটটা ফাঁকা হয়ে যেত, বুঝলি! এবার নে, মিষ্টি করে একটা গান শুনিয়ে দে তো…তা নইলে তোর আন্টির কান্না থামবে না।

পাপিয়া মিষ্টুর গালে চুমু খেয়ে শমিতের দিকে তাকাল। শমিত দেখল, পাপিয়ার চোখে জল অথচ হাসছে। না, শমিত আর টেলিফোনের লোকটাকে ভয় পাবে না। ওই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছু করা যায়।

শমিত এখন মিষ্টুর জন্য মানুষ খুন করতে পারে।

.

০৬.

গণ্ডগোলটা বাধল শমিত অফিস থেকে ফেরার পথে।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জোরালো বৃষ্টি গোটা কলকাতাকে নাজেহাল করে দিয়েছে। তার ওপরে বীভৎস ট্রাফিক জ্যাম।

সুতরাং বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা থেকেই শমিত বাড়িতে ফোন করল দুবার। বাপ্পা, মিষ্টু আর পাপিয়ার সঙ্গে কথা বলল। শমিতের দেরি দেখে ওরা চিন্তা করতে শুরু করে দিয়েছিল। পাপিয়ার মনটা তো কু-ডাক ডেকে উঠেছে বেশ কয়েকবার।

ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছিল শমিত। সঙ্গের ব্রিফকেসটা পাশে রেখে ও সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল। কতক্ষণে বাড়ি ফিরবে সে-কথাই ভাবছিল। শেয়ালদার পর রাস্তা ফাঁকা পেতেই ও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জোরে চালাতে বলল।

সুকিয়া স্ট্রিট থেকে রাজা দিনেন্দ্র স্ট্রিটে গাড়িটা ঢুকতেই রাস্তাঘাট বেশ নির্জন ঠেকল। রাত সাড়ে আটটা সবে পেরিয়েছে…এর মধ্যেই সব কেমন ঘুমপাড়ানি মাসি পিসির কাছে বশ মেনেছে। রাস্তার আলোগুলো ক্লান্তভাবে জ্বলছে। দোকানপাট বেশিরভাগই ঝপ বন্ধ করে ফেলেছে।

ঘটনাটা ঘটল মানিকতলা মেন রোড পেরোনোর পরই।

শমিত বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল, একটা মোটরবাইক হেডলাইট জ্বেলে ওর ট্যাক্সির পিছন পিছন আসছে। এখন সেই বাইকটা কোনওরকম হর্ন-টন না দিয়ে সাপের মতো স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে পিছলে গিয়ে শমিতের ট্যাক্সির সামনে এসে আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ট্যাক্সির ড্রাইভারও ব্রেক কষল। কুৎসিত শব্দ করে ট্যাক্সিটা থামল। তবে রাস্তা ভিজে থাকায় ব্রেক কষার পরেও বেশ কয়েক হাত এগিয়ে গেল ট্যাক্সিটা।

ততক্ষণে সামনের মোটরবাইক থেকে দুজন লোক নেমে পড়েছে। হাত দুলিয়ে ওরা এগিয়ে আসতে লাগল শমিতের ট্যাক্সিটার দিকে।

শুক্রবার রাতের পর থেকে শমিত প্রতিমুহূর্তেই বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল। রাস্তায় বেরোলেই ও সতর্ক নজর রাখছিল চারপাশে। সকালে অফিসে বেরোনোর সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ও একটি মুহূর্তের জন্যও নজরদারিতে ঢিলে দেয়নি। আর সেইজন্যই ও মোটরবাইকটাকে অনেক আগে থেকেই লক্ষ করেছে।

শুক্রবার রাতে ফোন করে লোকটা কী যেন বলেছিল?

বাই সানডে করতেই হবে। ওটাই ডেডলাইন…নইলে ডেড…।

গতকাল সেই ডেডলাইন পেরিয়ে গেছে। শমিত আর পাপিয়া অসহায়ভাবে শুধু দিনটা গড়িয়ে যেতে দেখেছে। মিষ্টুকে মেরে ফেলার বদলে চোখের জল ফেলেছে আর আদর করেছে।

তাই আজ সকালে রাস্তায় বেরোনোর পর থেকেই শমিতের বুকের ভেতরে মেঘ ডাকছিল। কখন বাজ পড়বে কে জানে!

এখন বোধহয় সেই সময় এসে গেছে।

লোক দুটোকে ওরকমভাবে এগিয়ে আসতে দেখেই ওর ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, সামনে বিপদ! জলদি পালাও!

শমিত বুঝতে পারল, ট্যাক্সির ভেতরে বসে থাকলে নড়াচড়ার জায়গা পাওয়া যাবে না, আর পালানোর স্বাধীনতাটাও বোধহয় থাকবে না। তাই ট্যাক্সি-ড্রাইভারের হাতে ঝটপট একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে ও একঝটকায় দরজা খুলে নেমে পড়ল রাস্তায়। ব্রিফকেসের হাতলটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল। আর তারপরই দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুট।

শমিতের আচমকা দৌড়ের জন্য লোক দুটো মোটেই তৈরি ছিল না। কিন্তু তৈরি হতে ওদের খুব একটা সময় লাগল না। ওদের একজন ছুটতে ছুটতেই কোমরে হাত দিয়ে কী-একটা বের করে নিল। অন্ধকারে জিনিসটাকে ঠিকমতো চেনা না গেলেও তার লম্বাটে ভাব আর চকচকে চেহারা ভালো করেই বুঝিয়ে দিল জিনিসটা কী।

শমিত রাস্তা পার হয়ে দিগভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল। কোনও একটা দোকানঘর কি বাড়ির দরজা খোলা পেলেই ও সটান ঢুকে পড়বে। তারপর দেখবে লোক দুটো কেমন করে ওকে কজা করে!

কিন্তু শমিতের কপাল খারাপ। কোনও বাড়ি বা দোকানের দরজা ও খোলা পেল না।

রাস্তার ভাঙা ফুটপাথে কয়েকটা বড়-বড় গাছ। সেগুলোর অন্ধকার পাতা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। তারই একটা গাছের নীচে একটা চায়ের স্টল। তার মাথায় পলিথিনের চাদর। চা তৈরির উনুনের পাশে হ্যারিকেন জ্বলছে। রোগা টিংটিঙে দোকানি ছাড়া ভাঙা বেঞ্চিতে বসে আছে ছায়া-ছায়া একজন খদ্দের।

পাগলের মতো ছুটে যাওয়ার সময় শমিত খেয়াল করেনি। পলিথিন টাঙানোর একটা দড়ি ওর বুকের কাছটায় আটকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দড়িটা ছিঁড়ে গেল বটে, কিন্তু শমিত লাট খেয়ে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল চায়ের দোকানটার ওপরে। ওর ব্রিফকেস ছিটকে গেল হাত থেকে।

এতক্ষণ শমিত চিৎকার করেনি। কিন্তু এইবার চিৎকার করল। যন্ত্রণার আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে।

দড়ি ছিঁড়ে পলিথিনের শিটটা ঝুলে পড়ল দোকানের ওপরে। তার একটা কোনা বোধহয় উনুনে ঠেকে গিয়েছিল, কারণ প্লাস্টিক-পোড়া গন্ধ শমিতের নাকে এল।

ও টাল খেয়ে পড়েছিল বেঞ্চির লোকটার ঘাড়ে, সেখান থেকে পাক খেয়ে উনুনের মুখের কাছে। একপাশে রাখা কয়লার টুকরোগুলো ওর শরীরের নানা জায়গায় খোঁচা মারছিল, আর অসহ্য তাপে ওর মুখ ঝলসে যেতে চাইল।

ওই অবস্থাতেই শমিত দেখল, চায়ের দোকানদার ও তার একমাত্র খদ্দের পড়িমড়ি করে ছুটে পালাচ্ছে। কারণ, ওরা হিংস্রভাবে ধেয়ে আসা দুটো লোককে দেখতে পেয়েছে। দেখতে পেয়েছে সামনের লোকটির হাতে বাগিয়ে ধরা চকচকে ভোজালিটাও।

একমুহূর্তের মধ্যে শমিত বুঝে গেল ওকে বাঁচাতে কেউ আর আসবে না। কারণ, এই শহরের বেশিরভাগ মানুষ শান্তিপ্রিয় অশান্তিতে জড়াতে কেউ চায় না।

অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে তোক দুটো ঝুঁকে পড়ল শমিতের ওপরে। শমিত চিত হয়ে শুয়ে অসহায়ভাবে ওদের ভয়ংকর মুখের দিকে চেয়ে রইল। ওর মুখ দিয়ে অর্থহীন চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল।

সামনের লোকটা হাসতে-হাসতে ভোজালি তুলল। তার শাকরেদ মন্তব্য করল, একটু-আধটু পালিশ দিয়ে ছেড়ে দে। দু-চার পোঁচড়া–ব্যস। জানে খতম করলে বস খেপে যাবে–সেরকম হুকুম নেই।

ভোজালি হাতে লোকটা দাঁত বের করে হাসল, শমিতের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল, ব্যাটা কেমন কুত্তার মতো কুঁইকুঁই করছে দেখ। এখানে হাজার চিল্লালেও কুত্তাভি আসবে না।

সবকিছুই খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল, অথচ শমিত যেন দেখছিল স্লো-মোশনে।

ভোজালিটা নেমে আসছে। শমিত তা হলে কুত্তারও অধম–চ্যাম্পেরও অধম।

মিষ্টুর মুখটা মনে পড়ছে বাপ্পার মুখ, পাপিয়ার মুখও। আর কি ওদের সঙ্গে দেখা হবে? কিন্তু শমিত যে ওদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। মিষ্টুকে ও আদর করতে চায় প্রাণভরে।

যো ডর গয়া, সমঝো কে মর গয়া।

মানুষ মরার আগে কখনও মরে না।

শমিতের বাঁ-হাত একগাদা কয়লার টুকরো খুঁজে পেল।

উনুনের তাপে মুখ জ্বলছে।

ওর ডানহাত একটা কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় অন্ধের মতো খামচাচ্ছিল, হঠাৎই উনুন খোঁচানোর বাঁকানো শিকটা পেয়ে গেল।

ভোজালির প্রথম কোপটা নেমে এল ওর বাঁ-হাত লক্ষ্য করে। কিন্তু শমিত ততক্ষণে বাঁ হাতে মুঠো করা কয়লার টুকরোগুলো ছুঁড়ে দিয়েছে লোকটার মুখে। একইসঙ্গে কবজি আর কনুইয়ের মাঝামাঝি ভোজালিটা কেটে বসল।

জন্তুর মতো দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল শমিত। ওই অবস্থাতেই উঠে বসার চেষ্টা করল। এবং ডানহাতে ধরা লোহার শিকটা অলৌকিক এক শক্তিতে ঢুকিয়ে দিল ভোজালিওয়ালার পেটে।

ক্ষমা সবসময় পরম ধর্ম নয়। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনও প্রয়োজন। দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ।

সামনের লোকটা ভোজালি আবার তুলেছিল শূন্যে, কিন্তু শমিতের কয়লার গুঁড়ো আর শিক ওর সব অঙ্ক গোলমাল করে দিল। ওর হাত থেকে ভোজালি খসে পড়ল। ও চোখ কচলাতে কচলাতে মাথা নীচু করে অবাক হয়ে তাকাল পেটের দিকে। সেখান থেকে শিকের খানিকটা অংশ বেরিয়ে আছে দেখেও ব্যাপারটা ও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। শিকটা এত সহজে ঢুকে গেল পেটে!

ওর সঙ্গের লোকটা ভয় পেয়ে গেল। সঙ্গীর হাত ধরে টান মারল। শমিত কাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভোজালিটার ওপরে। অবশ হয়ে আসা রক্তাক্ত বাঁ-হাত আর ডানহাত একসঙ্গে জড়ো করে অতিকষ্টে ভোজালির বাঁট খামচে ধরল। পাগলের মতো চিৎকার করে ভোজালি উঁচিয়ে ধরল। ওকে অবাক করে দিয়ে গালাগালির স্রোত বেরিয়ে আসতে লাগল ওর মুখ থেকে। বোঝা গেল, দাঁত নখের লড়াইয়ে ওর ভেতরের আদিম মানুষটা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ও অন্ধরাগে ভোজালিটা শুন্যে এপাশ-ওপাশ চালাতে লাগল, আর একই সঙ্গে আহত জন্তুর মতো গর্জন করতে লাগল।

পলিথিন-শিটটায় কখন যেন আগুন ধরে গেছে। কটু গন্ধে ভরে যাচ্ছে চারদিক। শমিতের মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছিল। হাত-পা কাঁপছিল থরথর করে। বাঁ-হাতে অসহ্য যন্ত্রণা।

সেই অবস্থাতেই ও দেখল, লোক দুটো পালিয়ে যাচ্ছে। একজন খোঁড়াচ্ছে, আর-একজন তাকে জাপটে ধরে হাঁটছে।

ওরা মোটরবাইকে উঠে রওনা হয়ে গেল। আহত লোকটা পিছনে বসে সামনের সঙ্গীর গায়ে এমনভাবে এলিয়ে পড়ে আছে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।

শমিতের ক্লান্ত হাত থেকে ভোজালিটা খসে পড়ল।

দু-চারজন করে লোকের ভিড় জমতে শুরু করল। শমিতকে ধরে তুলল সবাই। কেউ একজন ওর হাতের কাটা জায়গাটা একটা রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। শমিতের ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্রিফকেসটা খুঁজতে লাগল।

দু-তিনজন লোক তখন জল ঢেলে পলিথিনের আগুন নেভাতে চেষ্টা করছে। কয়েকজন ট্যাক্সি! ট্যাক্সি! করে হাঁক পেড়ে ছুটন্ত ট্যাক্সি দাঁড় করাতে চাইছে। দু-চারজন শমিতকে ঘিরে নানান প্রশ্ন করছে।

এরই মধ্যে কে যেন বলে উঠল, দাদাকে মানিকতলা থানায় নিয়ে চল।

 আর-একজন বলল, তার আগে দত্ত মেডিকেল থেকে হাতটা ব্যান্ডেজ করিয়ে নে।

শমিত কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু ওর ঠোঁট কাঁপছিল..মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না।

তিন-চারজন লোক ওকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠল। শমিত লক্ষ করল, একজনের হাতে ওর ব্রিফকেসটা রয়েছে, আর-একজনের হাতে রক্তমাখা ভোজালিটা। তবে ভোজালির বাঁটটা লোকটি খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে নিয়েছে।

শমিতের হাতে ওষুধপত্র লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করা হল। কী একটা ইনজেকশনও যেন দিয়ে দিল দোকান থেকে। তারপর ট্যাক্সি চলল মানিকতলা থানার দিকে।

শমিত মিনমিন করে বলল, আমি বাড়িতে একটা ফোন করব…।

আর তখনই ওর মোবাইল ফোনটার কথা খেয়াল হল।

ফোনটা সবসময় ওর বাঁ-পকেটে থাকে। দু-পকেট ছুঁয়ে দেখল শমিত। না, ফোনটা নেই। হয়তো কোথাও ছিটকে পড়ে গেছে।

মানিকতলা থানা খুব কাছেই–পৌঁছোতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগল না।

একজন পুলিশ অফিসার ওদের কাছ থেকে সব জেনে নিয়ে জেনারেল ডায়েরি লিখলেন। শমিতদের অনেক প্রশ্নও করলেন।

মোটরবাইকের নম্বরটা কেউ দেখেছেন কি?

না।

 লোকগুলো কীরকম দেখতে?

শমিত যথাসাধ্য বর্ণনা দিল।

আপনাকে হঠাৎ অ্যাটাক করতে গেল কেন?

কী জানি! হয়তো ছিনতাইয়ের মতলব ছিল। আমার সেলফোনটা তো পাচ্ছি না…।

অফিসার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহু প্রশ্ন করা সত্ত্বেও শমিত মিষ্টুর ব্যাপারে একটি কথাও বলল না।

অফিসার ভোজালিটা জমা নিলেন। একজন সাদা-পোশাক পুলিশকে বললেন অকুস্থলটা দেখে আসতে। শমিতের সঙ্গীদের কাউকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।

থানা থেকে বাড়িতে ফোন করার সুযোগ পেল শমিত।

পাপিয়া ফোন ধরতেই ও বলল, পাপিয়া, একটুও চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক আছি। আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছোচ্ছি…।

পাপিয়া ধরা গলায় বলল, আমরা এদিকে ভেবে-ভেবে মরছি। মোবাইলে ফোন করলে শুধু রিং হয়ে যাচ্ছে। তুমি শিগগির চলে এসো…মিষ্টু আর বাপ্পা মনখারাপ করে বসে আছে…।

শমিত ফোনটা ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। ও-প্রান্ত থেকে মিষ্টু হঠাৎ আঙ্কল বলে শমিতকে ডেকে উঠেছে।

মেয়েটার গলা শুনতে পাওয়া মাত্রই শমিতের বুকের ভেতরটা কেমন হু-হু করে উঠল। আর একই সঙ্গে বাঁ-হাতের যন্ত্রণাটা কোন এক ম্যাজিকে মিলিয়ে গেল।

মিষ্টুসোনা, আমি এক্ষুণি বাড়ি যাচ্ছি…তুমি মনখারাপ কোরো না, লক্ষ্মীটি…।

আঙ্কল, তোমার কিছু হয়নি তো?

না, মা-মণি, কিচ্ছু হয়নি। বাপ্পাদাদা কী করছে?

ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর শমিতের টেনশনটা কমে এল। রিসিভার নামিয়ে রেখে ও অফিসারের সঙ্গে ফর্মালিটি মিটিয়ে নিল চটপট। কয়েকটা জায়গায় সই করে দিল। গোটা-গোটা হরফে নাম-ঠিকানা-ফোননম্বর লিখে দিল।

শমিতের সঙ্গী লোকজনও দরকারমতো সইসাবুদ করে দিল। তারপর ওরা দল বেঁধে থানা থেকে বেরিয়ে এল।

ওরাই শমিতকে ট্যাক্সি ডেকে তুলে দিল। গার্জেনি ঢঙে সাবধান করে দিল বারবার। ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও সতর্ক করে দিল।

বাড়ি ফেরার পথে শমিত ভাবছিল, এই শহরের মানুষ শান্তিপ্রিয় বটে, তবে তারা অসময়ে বড় আপনজন, তাদের আদর-যত্নের কোনও জবাব নেই। ওদের কথা শমিতের বহুদিন মনে থাকবে।

.

মঙ্গলবার সকালবেলা শমিত তৈরি হয়ে অফিসে বেরোতে যাবে, ঠিক তখনই ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল।

পাপিয়া ম্যাজিক আই-তে চোখ রেখেই ঘুরে তাকাল, শমিতকে ডাকল ইশারায়। শমিত কাছে এলে চাপা গলায় বলল, দুজন লোক..চিনি না…।

শমিতও একচোখ দিয়ে দেখল। ভারী চেহারার দুজন লোক। একজনের হাতে সিগারেট।

 দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে ফ্ল্যাটের কলিংবেল পরপর আরও দুবার বেজে উঠল।

শমিত পাপিয়াকে পিছিয়ে যেতে বলল। তারপর কাঠের পাল্লাটা সামান্য ফাঁক করে উঁকি মারল। তালাবন্ধ কোলাপসিবল গেটটা শমিতকে ভরসা জোগাচ্ছিল। গেটের লোহার গরাদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের একজন কথা বললেন।

শমিত রায়চৌধুরী?

হ্যাঁ– সায় দিয়ে মাথা নাড়ল শমিত।

আপনার মারুতি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে? গত বুধবার?

হ-হ্যাঁ… ইতস্তত করে শমিত বলল। ওর গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছিল।

আমরা লালবাজার থেকে আসছি। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসার। পকেট থেকে ফটোওয়ালা একটা আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখালেন ভদ্রলোক : আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ে যাবে…।

শমিত আমতা-আমতা করে বলল, আ-আমি এখন তো অফিসে বেরোচ্ছি। মানে…।

 ভদ্রলোক হাসলেনঃ পুলিশ তো আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসবে না…খুলুন।

শেষ শব্দটায় আদেশের সুর ছিল। শমিত আর দেরি না করে দরজা হাট করে খুলে দিল। কোলাপসি গেটও খুলে দিল।

ভদ্রলোক দুজন এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে ফ্ল্যাটের চারপাশটা জরিপ করতে লাগলেন। তারপর দুটো সোফায় দুজনে বসে পড়লেন। চ্যাম্প কোথা থেকে এসে হাজির হল। ওঁদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল আর গন্ধ শুঁকতে লাগল। দুজনের মধ্যে যার বয়েস একটু বেশি তিনি চ্যাম্পের মাথায়-ঘাড়ে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিলেন। হেসে বললেন, আমি কুকুর পুষি। আমার গায়ে কুকুরের গন্ধ পাচ্ছে বলে ও চেঁচামেচি করছে না।

পাপিয়া মিষ্টু আর বাপ্পাকে ভেতরে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বারকয়েক আশঙ্কার নজরে শমিতকে দেখল।

পরিচয়ের পালা শেষ হল।

প্রথমজন যিনি এতক্ষণ কথাবার্তা চালিয়েছেন–প্রফুল্ল পান। বয়েস পঞ্চাশের ওপাশে। রং ময়লা। মাথায় কদমছাঁট কাঁচা-পাকা চুল। বাঁ-গালে একটা আঁচিল। মুখে অনেক ভাঁজ। চোয়ালে সাদা দাড়ির খোঁচা উঁকি মারছে।

ভদ্রলোকের বোধহয় নস্যি নেওয়ার অভ্যেস আছে। কারণ, ওঁর নীল-রঙা হাফ শার্টের বেশ কয়েক জায়গায় নস্যির দাগ।

দ্বিতীয়জনের নাম যোগেশ দাশগুপ্ত। বয়েস পঁয়তাল্লিশের এদিক-ওদিক। মাথায় টাক তাকে ঘিরে চুলের ঝালর। ঠোঁটের ওপরে মোটা গোঁফ। চোখে গোল-গোল কাচের চশমা–অনেকটা পাচার চোখের মতন। শরীরের কাঠামো বেশ শক্তপোক্ত। মাথায় প্রফুল্ল পানের চেয়ে খাটো। আর মুখে সবসময় কেমন একটা হাসি-হাসি ভাব।

যোগেশের সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। ওটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে তিনি ভুরু উঁচিয়ে আলতো করে জিগ্যেস করলেন, হাতে ব্যান্ডেজ কীসের?

শমিত থতমতো খেয়ে বলল, কাল একটু চোট পেয়েছি…।

উত্তর শুনে প্রফুল্ল পান হাসলেন, বললেন, অত তাড়াহুড়ো করে বানিয়ে বলার দরকার নেই। ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে বলুন। কারণ, আমরা আপনার গল্পটার প্রতিটি ভাঁজ চেক করে দেখব গাদাগাদা প্রশ্ন করব। তখন আপনার গল্পটা লালবাতি জ্বেলে বসে থাকবে। যাই হোক, টেক ইয়োর টাইম…।

যোগেশ পকেট থেকে একটা ছোট নোটবই বের করে তার দু-চারটে পাতা উলটে দেখে তারপর প্রশ্ন করলেন, ডব্লিউ বি জিরো টু সিটু ওয়ান টু নাইন…এই নম্বরের মারুতি গাড়িটা আপনার?

হ্যাঁ–।

অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা আমাদের খুলে বলুন…।

শমিত পালা করে দুজন অফিসারের দিকে তাকাচ্ছিল আর নখ খুঁটছিল। তারপর হোঁচট খেয়ে কথা বলতে শুরু করল, অ্যাক্সিডেন্ট…মানে…সেদিন…।

হাত তুলে ওকে ভরসা দিলেন প্রফুল্ল পান, বললেন, আপনি মিছিমিছি নার্ভাস হচ্ছেন। রুদ্রদা..মানে, রুদ্রপ্রতাপ সেনের সঙ্গে তো এ-ব্যাপারে আপনার আগেই কথা হয়েছে…।

শমিত যেন অকুল সমুদ্রে লাইফবোট খুঁজে পেল। তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ– হ্যাঁ।

রুদ্রপ্রতাপ সেন লালবাজারের সিনিয়র ইন্সপেক্টর–চন্দ্রদেও আগরওয়ালের বন্ধু। ওঁর সঙ্গেই ফোনে কথা বলেছিল শমিত।

ও আর থাকতে পারল না। সরাসরি প্রফুল্ল পানের হাত চেপে ধরল। অনুনয় করে বলল, আমাদের আপনারা বাঁচান! এভাবে আমরা আর পারছি না!

ভরসা খুঁজতে চেয়ে শমিতের চোখে জল এসে গেল।

প্রফুল্ল ওর হাতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, একটুও আপসেট হবেন না, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমরা কিন্তু আপনাকে হেল্প করতেই এসেছি। রুদ্রদা আপনার সম্পর্কে আমাদের বলেছেন। আপনি নির্ভয়ে আমাদের সব খুলে বলুন। আমরা আপনার বন্ধু…।

শমিত কাঁপা হাতে পকেট থেকে সিগারেট বের করে যোগেশকে অফার করল। যোগেশ মাথা নেড়ে না বলায় নিজে একটা ধরাল। সিগারেটে বড়মাপের একটা টান দিয়ে ধাতস্থ হয়ে পাপিয়াকে চেঁচিয়ে ডাকল।

পাপিয়া ড্রইং-ডাইনিং-এ এলে শমিত ওকে বসতে বলল। অফিসার দুজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ওঁরা আমাদের বন্ধু। আমাদের বিপদে হেল্প করতে চান…।

শমিত আর পাপিয়া পালা করে গোটা গল্পটা ওঁদের শোনাল।

প্রফল্ল পান আর যোগেশ দাশগুপ্ত চুপটি করে শুনলেন, দু-একবার হুঁ-হাঁ ছাড়া একটি কথাও বললেন না। তবে যোগেশ একটা বলপয়েন্ট পেন দিয়ে তার নোটবইতে যথেচ্ছ নোট নিচ্ছিলেন।

ওদের বলা শেষ হলে শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফুল্ল, পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করে শব্দ করে নস্যি নিলেন। শমিত লক্ষ করল, পাপিয়া ঘেন্নায় একটু শিউরে উঠল।

ব্যাপারটা প্রফুল্লর নজর এড়ায়নি। তিনি হেসে বললেন, সরি ম্যাডাম, আমার নেশাটা বড় বাজে। তা ছাড়া ডিউটির সময়ে নেশা করা ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের দুজনের নেশার অভ্যেসটা ডিপার্টমেন্ট জানে। যোগেশ স্মোকার আর আমি স্নাফার…।

স্নাফার? অবাক হয়ে বলল শমিত।

হ্যাঁ, স্নাফ মানে নস্যি, আর স্নাফার মানে আমি। অবশ্য স্নিফারও বলতে পারেন নস্যি সিফ করি তাই! শব্দ করে হাসলেন প্রফুল্ল পান।

যোগেশ বললেন, আপনাকে একবার আমাদের দপ্তরে আসতে হবে। তখন আপনার ডিটেইলড স্টেটমেন্ট রেকর্ড করে নেব। এবারে কাজের কথা শুনুন…আপনার কাছে আমরা যে জন্যে এসেছি…।

এই পর্যন্ত বলে প্রফুল্ল পানের দিকে তাকালেন যোগেশ। ভাবটা এমন যেন অনুমতি চাইছেন। প্রফুল্ল ছোট্ট করে মাথা হেলিয়ে ইশারা করলেন, যার অর্থ বলো। তখন যোগেশ শমিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, যে-অ্যাম্বাসাডরটার সঙ্গে আপনার গাড়ির ক্র্যাশ হয় তাতে দুজন হার্ড বয়েলড ক্রিমিনাল ছিল সুধীর পাণ্ডে আর বিনোদ শর্মা। ওদের নামে প্রায় গোটাদশেক করে কেস ঝুলছে –তাতে মার্ডার, কিডন্যাপিং থেকে শুরু করে সবই আছে। সুধীর মারা গেছে, কিন্তু বিনোদ শর্মা বেঁচে আছে–এখনও। তবে ওর অবস্থা ভালো নয়…এখনও আমরা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে উঠতে পারিনি। লোকাল থানা ব্যাপারটা আমাদের রিপোর্ট করেছিল। পরে আমরা খতিয়ে দেখি যে, সুধীর আর বিনোদের বেশ কয়েকটা কেস আমাদের কাছে আছে। তখন ব্যাপারটা আমরা টেক আপ করি।

যাই হোক, আমাদের ধারণা সুধীর আর বিনোদের গ্যাং-ই আপনাদের ফোন করে থ্রেট করছিল…কী বলেন, প্রফুল্লদা? প্রফুল্ল পানের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন যোগেশ।

হতে পারে, তবে ওই গ্যাং-এ আরও লোক আছে। নইলে সুধীর আর বিনোদ বসে যাওয়ার পরও ভয় দেখানো ফোন আসবে কেন! আর একটা বাচ্চা মেয়ের পেছনে এত বড় একটা গ্যাং লেগে পড়েছে… চিন্তার সুরে বললেন প্রফুল্ল পান, তারও তো একটা বড়সড় মোটিভ থাকতে হবে…।

পাপিয়া সায় দিয়ে বলল, আমরাও তো সেকথাই ভাবছি।

 যোগেশ বললেন, মিষ্টুকে একবার ডাকুন তো।

 পাপিয়া উঠে দাঁড়াল, বলল, ডাকছি। আর আপনাদের জন্যে একটু চায়ের ব্যবস্থা করি…।

ও চলে যাওয়ার পর যোগেশ আর প্রফুল্ল শমিতের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।

যোগেশ তন্ময় হাজরার মোবাইল নম্বর জানতে চাইলেন।

শমিত নম্বরটা বলল। তারপর বলল যে, মিষ্টুর মা-বাবা রোজই আসছেন, ওঁদের মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু মেয়েটার এখানে ভীষণ মায়া পড়ে গেছে–পুরোনো কথা কিছুই ওর মনে নেই তাই ও জেদ করছে, যেতে চাইছে না। এতে শমিতদের ভীষণ অস্বস্তি আর লজ্জার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।

প্রফুল্ল জিগ্যেস করলেন, মিষ্টুর বাবা-মা বিপদের কথা শুনে কী বলছেন?

শমিত বলল যে, ওঁদের অ্যাক্সিডেন্ট কিংবা টেলিফোনে হুমকির কথা কিছুই জানানো হয়নি।

কেন, জানাননি কেন?

শুধু-শুধু কমপ্লিকেশন বাড়াতে চাইনি, তাই।

যোগেশ আর প্রফুল্ল কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন, মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর যোগেশ বললেন, আজ দুপুর থেকে আপনাদের টেলিফোন লাইনটা আমরা ট্যাপ করব। যদি থ্রেট করে আবার ফোন আসে আমাদের ধারণা আসবেই তা হলে আমরা কলটা ট্রেস করে সেই বেসিসে খোঁজখবর করতে পারব। কিন্তু সবচেয়ে আগে মেয়েটার সেফটির একটা ব্যবস্থা করা দরকার। সুধীর আর বিনোদের গ্যাং খুব ডেঞ্জারাস। ওদের দল পারে না এমন কোনও কাজ নেই। হতে পারে মেয়েটাকে ওরা কিডন্যাপ করেছিল, তারপর মেয়েটা কোনও এক ফাঁকে ওদের আস্তানা থেকে সটকে পড়েছে…।

কিন্তু মিষ্টুর বাবা-মা তো সেরকম কিছু বলেননি!

হু, কেস বেশ পিকিউলিয়ার। গালে হাত বোলাতে বোলাতে প্রফুল্ল বললেন, কিন্তু মেয়েটার সেফটির ব্যবস্থা করাটা খুব জরুরি। ও বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গেলেও হয়তো এই গ্যাং ওর জানের পিছনে পড়ে থাকবে। আচ্ছা, মিষ্টুর বাবা-মা কি আপনাদের বাড়িতে আজ আসবেন?

শমিত সায় দিয়ে মাথা নাড়লঃ হ্যাঁ, আসার কথা।

ওঁরা এলে একটু আমাদের জানাবেন। ওঁদের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা দরকার। এই নিন, আমাদের কনট্যাক্ট নাম্বার নিন– প্রফুল্ল একটা কাগজে দুটো মোবাইল নম্বর লিখে শমিতকে দিলেন। তারপর বললেন, আসলে মিষ্টুর মেমোরি ফিরে আসাটা খুব ভাইটাল…।

হঠাৎই প্রফুল্ল পান লক্ষ করলেন একটা ফুটফুটে মেয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ওঁদের দেখছে। আর তার থেকে হাত পাঁচ-ছয় পিছনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে–উঁকি মেরে কৌতূহলী চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে।

প্রফুল্ল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ওকে কাছে ডাকলেন, এদিকে এসো। তোমার নাম কী?

আমার নাম মিষ্টু। বলে দিব্যি প্রফুল্লর কাছে চলে এল মিষ্টু, সরল চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, তোমার নাম কী?

নাম বললেন প্রফুল্ল। তারপর হাত বাড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলেন, তুমি কখন এলে? আমরা তো খেয়ালই করিনি!

তোমরা তো আমাকে নিয়ে গল্প করছিলে…।

এরপর কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বললেন প্রফুল্ল আর যোগেশ। মিষ্টু বেশ সহজভাবেই ওঁদের সঙ্গে কথা বলল। তারপর বাপ্পাকে ডেকেও ওঁরা আলাপ করলেন। হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলেন দুই বালক-বালিকার সঙ্গে। তখন শমিতের মনেই হচ্ছিল না ওঁরা পুলিশের লোক।

চা-পর্ব সেরে আরও আধঘণ্টা পর প্রফুল্ল আর যোগেশ উঠে দাঁড়ালেন।

দরজায় ওঁদের এগিয়ে দেওয়ার সময় শমিত বলল, মিষ্টুকে যে-করে-হোক বাঁচান আপনারা। ওর কিছু একটা হয়ে গেলে আমরা সইতে পারব না।

ডোন্ট উয়ারি, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমরা যা করার করছি। প্রফুল্ল বললেন।

শমিত কৃতজ্ঞতায় ওঁর হাত চেপে ধরল আবার।

.

০৭.

সন্ধে পার করে তন্ময় আর মালিনী শমিতদের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন। ওঁদের সঙ্গে নতুন একজন অতিথিও এসেছেন। বছর তিরিশ-বত্রিশের এক যুবক। স্মার্ট টানটান চেহারা। গায়ে রিংকলড কটনের রংচঙে শার্ট, পায়ে ফেডেড জিনস। ডানহাতে অদ্ভুত নকশার একটা চকচকে বালা, বাঁ-হাতে বেঢপ মাপের স্পোর্টস-ওয়াচ।

তন্ময় শমিতদের সঙ্গে নতুন অতিথির পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিকেলেই তিনি ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, ছোট ভাইকে নিয়ে আসবেন। সে নর্থ বেঙ্গলে থাকে। মিষ্টুকে পাওয়া গেছে শুনে কলকাতায় এসেছে।

আমার ছোটভাই..মৃন্ময়…।

মৃন্ময় সৌজন্য দেখিয়ে শমিতদের নমস্কার জানালেন। শমিত লক্ষ করল, পাপিয়া বেশ জরিপ নজরে মৃন্ময় হাজরাকে দেখছে।

তন্ময় শমিতের হাতের ব্যান্ডেজ দেখে কী ব্যাপার জানতে চাইলেন। শমিত ছোট্ট করে বলল, সামান্য কেটে গেছে সিরিয়াস কিছু না।

তন্ময় বোধহয় সিগারেট বেশি খেতে ভালোবাসেন। কারণ, কয়েক সেকেন্ড উশখুশ করেই তিনি সিগারেট বের করলেন। শমিতকে একটা অফার করলেন। শমিত গাঁইগুই করছিল, কিন্তু তন্ময় ওর কোনও আপত্তি শুনলেন না। একরকম জোর করেই সিগারেটটা শমিতের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর নিজে একটা নিলেন।

লাইটার বের করে শমিতের সিগারেটটা ধরিয়ে দেওয়ার সময় তন্ময় হেসে বললেন, কীভাবে আপনার ঋণ শোধ দেব জানি না, মিস্টার রায়চৌধুরী…আপনারা আমার আর মালিনীর জীবনদাতা।

না, না, এভাবে বলে লজ্জা দেবেন না… শমিত বিনয় করে বলল।

মালিনী তখন মিষ্টুকে আদর-আহ্লাদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মিষ্টুকে বেশ সহজভাবেই ওঁর সঙ্গে মিশতে পারছে বলে মনে হল। শুক্রবারের পর থেকে তন্ময়রা রোজ এই ফ্ল্যাটে এসেছেন। মিষ্টুকে ভোলাতে চেষ্টা করেছেন। ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করেছেন। এঁদের মনে হয়েছে, এর ফলে মেয়েটা ধীরে-ধীরে সহজ হয়ে আসবে, ওঁদের সঙ্গে বাড়ি যেতে রাজি হবে।

কিন্তু আসলে তা হয়নি। খেলাধুলো কিংবা গল্পের সময় মিষ্টুকে দিব্যি সহজ-স্বাভাবিক মনে হলেও শমিতদের ছেড়ে যাওয়ার কথা উঠলেই মেয়েটা জেদ ধরে বেঁকে বসছে। পাপিয়া বা শমিত অনেক করে বুঝিয়ে-সুঝিয়েও ওকে রাজি করাতে পারেনি।

তন্ময় কিংবা মালিনী রোজ তিন-চারবার করে মিষ্টুকে ফোন করেন। তখন ও বেশ সুন্দর করে কথা বলে। জিগ্যেস করে, তোমরা কখন আসবে? কিন্তু শমিতদের ফ্ল্যাট ছেড়ে যাওয়ার কথা বললেই ওর কী যে হয়!

সেইজন্যই তন্ময়রা আজ মৃন্ময়কে নিয়ে এসেছেন। মৃন্ময় নর্থ বেঙ্গলে চাকরি করেন। মিষ্টুর সমস্যা মেটানোর জন্যই তন্ময় ওঁকে ফোন করে কলকাতায় ডেকে এনেছেন। কারণ, মিষ্টু যখন ছোট ছিল মৃন্ময়ের খুব ন্যাওটা ছিল। সবসময় মেয়েটা কাকুর পিছন পিছন ছুটে বেড়াত। ওর যখন পাঁচ বছর বয়েস তখন মৃন্ময় চাকরি নিয়ে নর্থ বেঙ্গলে চলে যান। এখন ওঁকে দেখে মিষ্টুর মন যদি কিছুটা বদলায়! যদি পুরোনো কথা কিছু মনে পড়ে!

মৃন্ময় মিষ্টুকে ডেকে নিয়ে ওর সঙ্গে হুটোপাটি করতে শুরু করলেন। ছোটবেলায় যেমন করতেন সেরকমভাবে ওকে দু-হাতে শুন্যে তুলে ধরে দোল খাওয়ালেন কয়েকবার। তারপর ওকে নামিয়ে দিয়ে লুকোচুরি খেলার প্রস্তাব দিলেন। নিজে বাচ্চা ছেলের মতো ছুটোছুটি করে ঘরে, বারান্দায়, আলমারির পিছনে লুকিয়ে বারবার মিষ্টুকে টুকি দিতে লাগলেন।

বাকি সবাই বেশ কৌতূহল নিয়ে মৃন্ময়ের চেষ্টা দেখছিল। বাপ্পাও বেশ অবাক হয়ে নতুন এই বুড়ো খোকাটির কাণ্ডকারখানা দেখছিল। দেখে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু বাবা আর মায়ের ভয়ে অতিকষ্টে ও হাসি চেপে রেখেছিল।

চেষ্টা করতে করতে মৃন্ময় গলদঘর্ম হয়ে গেলেন, কিন্তু মিষ্টুর মধ্যে নতুন কোনও আগ্রহের লক্ষণ দেখা গেল না। ও কেমন যেন নিষ্প্রাণভাবে মৃন্ময়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছিল। মৃন্ময় অনেক করে বলা সত্ত্বেও মিষ্টু একটিবারও মৃন্ময়কে কাকু বলে ডাকতে চাইল না।

হতাশায় মৃন্ময়ের চোখে জল এসে গেল। তিনি হাঁপাতে-হাঁপাতে বসে পড়লেন দাদার পাশে। মাথা নীচু করে জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন। ভাঙা গলায় বললেন, এরকম ভাবতে পারিনি। খুব কষ্ট হচ্ছে।

তন্ময় ছোটভাইয়ের পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মনখারাপ করিস না। আসলে যাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছিস সে চিনতে না পারলে কষ্ট তো হবেই! অ্যামনেশিয়া বড় ডেঞ্জারাস জিনিস।

ঠিক তখনই টেলিফোন বেজে উঠল।

পাপিয়া ফোনটা ধরতে এগোচ্ছিল, কিন্তু শমিত ওকে ইশারায় বারণ করল। কারণ, ও জানে ফোনটা কার।

বড় বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে একপলক পাপিয়ার দিকে তাকাল শমিত। তারপর রিসিভার তুলে কথা বলল।

হ্যালো।

হাত কেমন আছে? আপনজনের সুরে মিহি গলায় কেউ প্রশ্নটা করল।

প্রশ্নটা শুনেই শমিতের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। কিন্তু ও সময় নিয়ে রাগটাকে ঠান্ডা করল।

ফোনটা কারা করেছে বুঝতে পেরেও শমিত ভয় পেল না মোটেই। কারণ, লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট এখন ওর পাশে আছে।

হঠাৎই ওর মনে পড়ে গেল, প্রফুল্ল পান বলেছিলেন, তন্ময় হাজরা এলে ওঁদের খবর দিতে। নানান ডামাডোলে শমিত ব্যাপারটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিল।

কেমন আছে হাত? প্রশ্নের সুরটা এবার আগের চেয়ে রুক্ষ হয়েছে।

ভালো—

আসরাফ বেঁচে গেছে। মানে, বেঁচে যাবে।

কে আসরাফ?

ওই যে, যার পেটে লোহার শিক ঢুকিয়ে দিলেন, মনে নেই! চাপা হাসি হাসল লোকটা। তারপর একইরকম মোলায়েম গলায় বলল, সেরে উঠেই ও আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আপনার পেছনে ফুলস্টপ বসিয়ে দেবে। বুঝলেন কি? একদম খাল্লাস! একটা আনচাক্কা বাচ্চা মেয়ের জন্যে এত তকলিফ কেন করছেন?

শমিতের গলার স্বর কয়েক পরদা চড়ে গেল। ও কেটে-কেটে বলল, শুনুন, মিষ্টুকে আমরা ওর বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে দিচ্ছি। ওর কোনও ক্ষতি আমরা করতে পারব না। বরং কেউ যদি ওর ক্ষতি করতে চায় তা হলে বাধা দেব। আমি পুলিশে সব জানিয়েছি…।

ও-প্রান্ত কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপরঃ পুলিশে সব জানিয়ে দিয়েছেন! আপনি কি পাগল? এখন আপনার ফ্যামিলিকে কে সেভ করবে? আপনি সেকেন্ড-মিনিট গুনতে থাকুন…তিনদিনের মধ্যে আমরা কাজ খতম করে দিচ্ছি। আর শুনুন, মিস্টার বুরবাক, মিষ্টুর বাবা-মাকেও আমরা ছাড়ছি না। পথের মাঝে যে এসে দাঁড়াবে তাকেই..ফুস… মুখ দিয়ে গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ নকল করল লোকটা। তারপরই লাইন কেটে দিল।

শমিত রিসিভার নামিয়ে রেখে চটপট প্রফুল্ল পানের দেওয়া নম্বরটা ডায়াল করতে শুরু করল।

ওদিকে তন্ময় আর মালিনীর মুখ তখন শুকিয়ে গেছে।

টেলিফোনে শমিতের বলা কথাবার্তা যে টুকু ওঁরা শুনেছেন তাতে ভালোই বুঝতে পেরেছেন। মিষ্টুকে নিয়ে বড় রকমের গণ্ডগোল কিছু একটা বেধেছে। ওঁরা ফ্যাকাসে মুখে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। পাপিয়া ওঁদের লক্ষ করতে লাগল।

শমিত ফোন ছেড়ে তন্ময় আর মালিনীর কাছে আসতেই তন্ময় নাছোড়বান্দার মতো শমিতকে চেপে ধরলেন।

কী ব্যাপার, মিস্টার রায়চৌধুরী? মিষ্টুকে নিয়ে কী প্রবলেম হয়েছে? আপনাকে খুলে বলতেই হবে…প্লিজ…।

মালিনীও অনুনয়-বিনয় করে জোর করতে লাগলেন। অগত্যা শমিত পাপিয়ার দিকে একবার তাকাল। তারপর বলতে শুরু করল। মিষ্টু আর বাপ্পা তখন নিজেদের খেলায় মত্ত। আর চ্যাম্পও ওদের কাছে ঘুরঘুর করছে।

শমিত ধীরে-ধীরে কথা বলছিল। মিষ্টুকে ওরা পেয়েছে সোমবার, আর মঙ্গলবার রাত থেকেই টেলিফোনে হুমকি শুরু হয়েছে। লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে ওরা মোটেই ঠাট্টা করছে না।

এরপর শমিত ওর হাতের ব্যান্ডেজটার আসল কারণ জানাল তন্ময়কে। বলল, কীভাবে ওকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।

শমিতের কথা শুনতে-শুনতে তন্ময়দের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কেমন একটা হতভম্ব ভাব ফুটে উঠল তন্ময়ের মুখে। বেশ খানিকক্ষণ তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন শমিতের মুখের দিকে।

মালিনী আর মৃন্ময়ের অবস্থাও অনেকটা একইরকম। হতাশায় মাথা নেড়ে শমিত বলল, কীভাবে যে আমরা দিন কাটাচ্ছি সে আমরাই জানি।

পাপিয়া বলল, মিষ্টুকে আমরা এত ভালোবেসে ফেলেছি যে, ওকে বাঁচানোর জন্যে যে কোনও স্টেপ নিতে রাজি আছি।

তন্ময় বললেন, না, মিস্টার রায়চৌধুরী, মিষ্টুকে আর আপনাদের এখানে রাখাটা ঠিক হবে …আই মিন, রিস্কি হয়ে যাবে। আজ ওকে আমরা নিয়ে যাব।

মৃন্ময় মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, না, না–এখানে রাখার আর কোনও প্রশ্নই নেই। ওর কিছু একটা হয়ে গেলে দাদা-বউদিকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে। এরকম ঝুঁকি নেওয়া যায় না।

পাপিয়া মিনমিন করে বলল, আপনারা যা ভালো মনে করেন। মিষ্টুর ওপরে টান যতই থাক, ওর সেফটিটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি।

টেনশন কাটাতে শমিত একটা সিগারেট ধরাল। তন্ময়কে অফার করল, কিন্তু তিনি নিলেন না–ছোট্ট করে থ্যাংকস বললেন।

মালিনী তন্ময়কে বললেন, চলো, তা হলে আর রাত করব না। বলা যায় না, পথে আবার প্রবলেম হতে পারে…। মিষ্টু! মিষ্টুকে ডেকে উঠলেন মালিনী।

মিষ্টু খেলতে খেলতে মালিনীর দিকে ঘুরে তাকাল। মালিনী ওকে ইশারায় কাছে ডাকলেন, চলো, বাড়ি যাব। এরপর রাত হয়ে যাবে। মিষ্টু অমনি বিগড়ে গেল। বায়নার সুরে বলল, না, আমি এ-বাড়ি ছেড়ে যাব না…। মালিনী মৃন্ময়কে বললেন, ছোড়দা, তুমি একটু দ্যাখো।

মৃন্ময় লম্বা-লম্বা পা ফেলে মিষ্টুর কাছে পৌঁছে গেলেন। ওকে আদর করে বললেন, লক্ষ্মী মা-মণি, বায়না করে না, চলো, তোমাকে ক্যাডবেরি কিনে দেব…।

মিষ্টু মাথা ঝাঁকাতে লাগল বারবার।

তখন শমিত পাপিয়াকে বলল মিষ্টুকে বোঝানোর জন্য। পাপিয়া উঠে মিষ্টুর কাছে গেল। কিন্তু বোঝাবে কী! ওরই মন চাইছে না এ-ফ্ল্যাট ছেড়ে মেয়েটা চলে যাক।

শমিত সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল, তন্ময়কে বলল, ব্যাপারটা আমরা লালবাজারে জানিয়েছি–ওদের সি.আই.ডি. ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা একটু পরেই হয়তো এসে পড়বেন। আপনাদের সঙ্গে ওঁরা কথা বলতে চান…।

তন্ময় হাসলেন, বললেন, সেটাই তো ন্যাচারাল! আমার মেয়েকে যে এভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে সেটা তো আর জানতাম না! যাই হোক, আমরা তো এখন চলে যাচ্ছি…আপনি ওঁদের..আই মিন, সি.আই.ডি. অফিসারদের বলবেন আমাদের সঙ্গে ফোনে কনট্যাক্ট করে নিতে।

এদিকে মৃন্ময় মিষ্টুকে কোলে তুলে নিয়েছেন। মিষ্টু জেদ করে হাত-পা ছুড়ছিল, চাঁচাচ্ছিল, আর মৃন্ময় ওকে আদর করে ক্যাডবেরির লোভ দেখিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছিলেন। মালিনী আর পাপিয়া ওদের কাছে দাঁড়িয়ে কাকু-ভাইঝির লড়াই দেখছিল।

মিষ্টুকে ভোলানোর জন্য পাপিয়া ওকে বলল, অ্যাই, একটা গান শুনিয়ে দে তো।

আর গান! মেয়েটা তখন আপত্তি জানাতেই ব্যস্ত।

কী হল, একটা গান শোনাবি না তো? আর-একবার চেষ্টা করল পাপিয়া। তারপর মালিনীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আপনার মেয়ে কার কাছে গান শেখে? দারুণ গায় কিন্তু!

 মালিনী অবাক বিব্রত চোখে পাপিয়ার দিকে তাকালেন : গান? মিষ্টু? কই, না তো! ও তো কখনও গান শেখেনি!

এবার পাপিয়ার চোখ কপালে তোলার পালা। মেয়ে গান শেখে মা জানে না। কারণ, গান না শিখলে তো অমন গলা হতে পারে না!

তন্ময় ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন। তিনি বউকে একরকম ঝাজিয়ে উঠলেন : তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! সত্যেনবাবু যে মিষ্টুকে গান শেখাতে আসেন সেকথা ভুলে গেলে! তুমি ভীষণ ফরগেটফুল। আই মিন…।

ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ, মনে পড়েছে! বিব্রত ভাবটা সামলে নিয়ে মালিনী একগাল হেসে ফেললেন, আমারও দেখি মিষ্টুর মতো অ্যামনেশিয়া হয়ে যাচ্ছে..।

কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

পাপিয়া সবাইকে অবাক করে দিয়ে হিংস্র থাবা বসিয়ে দিল মালিনীর গলার কাছটায়। শাড়ি আর ব্লাউজ খামচে ধরে অলৌকিক এক শক্তিতে মালিনীকে পাগলের মতো আঁকাতে লাগল। মনে হল যেন পাপিয়ার ওপরে কোনও অপদেবতা ভর করেছে।

শিগগিরই বল, তুই কে? তুই মিষ্টুর মা না! শয়তান ডাইনি! বল তুই কে? মিষ্টু তোর মেয়ে না! বল!

পাপিয়ার ওইরকম রুদ্রাণী রূপ দেখে সবাই কেমন স্তম্ভিত হয়ে গেল। চ্যাম্প উত্তেজিত হয়ে ঘেউঘেউ শুরু করে দিল।

মালিনীর রোগা ছিপছিপে শরীরটা পাপিয়ার প্রবল ঝাঁকুনিতে পেন্ডুলামের মতো এপাশ ওপাশ দুলছিল।

মিষ্টু ব্যাপারটা খেয়াল করামাত্রই ওর জেদ পাঁচগুণ বেড়ে গেল। ও ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। মৃন্ময় ওকে থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মিষ্টু আচমকা মৃন্ময়ের হাতে কামড় বসিয়ে দিল।

মৃন্ময় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। মিষ্টুকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন মেঝেতে এবং সঙ্গে-সঙ্গে মিষ্টু আরও একবার দাঁত বসিয়ে দিল মৃন্ময়ের ঊরুতে।

রাগে অন্ধ হয়ে মৃন্ময় মিষ্টুর বাঁ গালে খোলা হাতে সপাটে এক চড় কষিয়ে দিলেন।

মেয়েটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। কংক্রিটের মেঝেতে ওর মাথা ঠুকে যাওয়ার বিশ্রী শব্দ হল।

বাপ্পা ছুটে গেল মিষ্টুর কাছে। ওর ওপরে ঝুঁকে পড়ল। মিষ্টু! মিষ্টু! বলে ডাকতে লাগল।

দৃশ্যটা দেখে পাপিয়া সত্যি-সত্যি বোধহয় পাগল হয়ে গেল। ও চোখে আগুন জ্বেলে মালিনীকে এক ধাক্কা দিল। মালিনী ছিটকে গিয়ে পড়লেন মৃন্ময়ের গায়ে। টাল সামলাতে না পেরে ওঁরা দুজনেই কাত হয়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে।

এসব ঘটনা খুব দ্রুত ঘটছিল। শমিতের মাথার ভেতরে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। যুক্তি-বুদ্ধি সব জট পাকিয়ে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল।

তন্ময় কিন্তু সব বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন যে, ওঁরা পাপিয়ার কাছে ধরা পড়ে গেছেন। তাই ম্যাজিশিয়ানের মতো এক ভেলকিতে কোথা থেকে একটা ছোট্ট পিস্তল বের করে পাপিয়াকে লক্ষ করে গুলি করলেন।

গুলি কোথায় গিয়ে লাগল বুঝে ওঠার আগেই দুটো ঘটনা ঘটল। চ্যাম্প চোখের পলকে লাফিয়ে পড়ল তন্ময়ের ওপরে।

আর শমিত একটা হিংস্র চিৎকার করে হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা তন্ময়ের গালে চেপে ধরে রগড়ে দিল।

যন্ত্রণায় উঃ! শব্দ করে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে তন্ময় ছিটকে পড়লেন টিভির ওপরে। ঝনঝন শব্দ করে টিভিটা ভেঙে পড়ল মেঝেতে। চ্যাম্পের ধারালো দাঁত তখন ওঁর হাত কামড়ে ধরে আঁকাচ্ছে।

গুলি পাপিয়ার কোথাও একটা লেগেছিল। কারণ, ওর হালকা রঙের শাড়িতে রক্তের ছোপ দেখা গেল। ওর ভারী শরীরটা আচমকা খসে পড়ল মেঝের ওপরে। তারপর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল।

মৃন্ময় মেঝেতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন। ওঁর হাত ধরে মালিনীও।

বাপ্পা ভয়ে ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছিল আর চ্যাম্পকে লেলিয়ে দেওয়ার জন্য ছু-ছু শব্দ করছিল। তার মধ্যে বারকয়েক ও ঝুলবারান্দার দিকে ছুটে গিয়ে অন্ধকার রাত লক্ষ করে বাঁচাও! বাঁচাও বলে চিৎকার করল। কেউ ওর আর্তচিৎকার শুনতে পেল কি না কে জানে! হতাশায় বাপ্পা কাঁদতে শুরু করল।

মিষ্টু হঠাৎই উঠে বসল। ঘুম-ভেঙে-ওঠা চোখে ঘরের দৃশ্য অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ওর কপালের একপাশটা ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছিল। যন্ত্রণার শব্দ করে কাটা জায়গাটায় হাত দিল ও। হাতটা চোখের সামনে নিয়ে আসামাত্রই ও পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল।

কারণ, রক্ত দেখার সঙ্গে-সঙ্গে তন্ময় হাজরাকেও ও দেখতে পেয়েছে। এবং চিনতে পেরেছে।

মৃন্ময় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মিষ্টুর দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন। সেটা শমিত আর সইতে পারল না। ও একলাফে রট আয়রনের একটা সোফা তুলে নিল। ওর বাঁ-হাতের ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে গেল। হাতটা অসহ্য যন্ত্রণায় কনকন করে উঠল। সোফাটা খসে পড়তে চাইল হাত থেকে।

কিন্তু মেয়ের বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে বাবারা অসাধ্য সাধন করতে পারে। অন্তত শমিত তাই করল।

মেয়ে বলেই তো ডেকেছিল পাপিয়া, তাই না! সেই পাপিয়া এখন গুলি খেয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। কাতরাচ্ছে। আর শমিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখবে! কখনও তাই হয়?

মিষ্টুর জন্য ও না মানুষ খুন করতে পারে। সেখানে মৃন্ময় তো একটা তুচ্ছ অমানুষ! মাত্র দুটো পা ফেলে মৃন্ময়ের কাছে পৌঁছে গেল শমিত।

মৃন্ময় ততক্ষণে মিষ্টুর একটা হাত চেপে ধরেছেন। এইবার এক হ্যাঁচকায় ওকে টেনে তুলবেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

রোবটের মতো আবেগহীনভাবে শমিত রট আয়রন সোফাটা সপাটে মৃন্ময়ের মাথায় আছড়ে দিল। চোখ কপালে তুলে মৃন্ময় চিৎ হয়ে পড়লেন মেঝেতে। ওঁর গল্প শেষ হয়ে গেল কি না ঠিক বোঝা গেল না।

কাতর চিৎকার করে বাঁ-হাতের ব্যান্ডেজ চেপে ধরল শমিত। যন্ত্রণায় ওর বাঁ-হাতটা খসে পড়তে চাইছিল। চোখ বুজে মুখ কুঁচকে ও উবু হয়ে বসে পড়ল মেঝেতে।

ওঃ ভগবান! এই দুঃস্বপ্ন কি শেষ হবে না?

মালিনী ঘরের এককোণে ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এইবার হিস্টিরিয়ার রুগির মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার শুরু করে দিলেন। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর দৃশ্যগুলো তিনি আর সইতে পারছিলেন না।

এদিকে চ্যাম্পের আক্রমণ এড়িয়ে তন্ময় উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন। ওঁর গালে জডুলের মতো পোড়া দাগ। একনাগাড়ে নোংরা গালিগালাজ ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন তন্ময়। এই ফ্ল্যাট থেকে তিনি এখন কোনওরকমে পালাতে চাইছেন। কিন্তু পিস্তলটা কোথায় গেল! এইখানেই কোথায় যেন খসে পড়েছিল মেশিনটা!

তন্ময় পাগলের মতো পিস্তলটা খুঁজতে লাগলেন। ওটা খুঁজে পেলেই তিনি শয়তান কুকুরটার দফারফা করবেন। কোথায়…কোথায়…?

মিষ্টু তন্ময়ের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল।

হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে ও বুলেটের মতো ছুটে গেল তন্ময়ের দিকে, আর একইসঙ্গে কান্না ভাঙা গলায় পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে লাগল, তুমি খুনি! খুনি! আমার মাম আর বাবুকে খুন করেছ। মাম আর বাবুকে তুমি মেরে ফেলেছ! তুমি খুনি!..।

তন্ময়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র চিতার মতো খেপে উঠল মিষ্টু। আঁচড়ে কামড়ে ওঁকে অস্থির করে তুলল। এদিকে চ্যাম্প চাপা গর্জন করার সঙ্গে-সঙ্গে ওর কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

খুনি! তুমি খুনি! তুমি খুনি…!

মিষ্টুর পাগল করা চিৎকারের মাঝখানেই ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল।

.

০৮.

গত কদিন ধরে একফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাতায়-পাতায় সূর্য খেলা করছিল। মাথার ওপরে আকাশ ছবির মতো নীল। মেঘের দল বোধহয় ছুটি নিয়েছে। হতেও পারে। কারণ, আজ রবিবার।

সবমিলিয়ে মনে হচ্ছিল, পুজোর সাজের ছোঁয়া লেগেছে।

প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে পাপিয়ার মনেই হচ্ছিল না মিষ্টুকে পাওয়ার পর থেকে সাত-আটটা দিন ওদের কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেটেছে। ভগবান বোধহয় মাঝে-মাঝে এরকম পরীক্ষা নেন। কিন্তু তারপরে যা পাওয়া যায় সুখ, শান্তি, আনন্দ–তার কোনও তুলনা নেই।

মিষ্টু গান গাইছিলঃ

দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম
 আজব কারখানা।
 কেউ বুঝল কেউ বুঝল না।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে,
সেই বাড়িতে চোর লেগেছে,
 ছয়জনাতে সিঁদ কেটেছে,
চুরি করে একজনা।…

সেই গান শুনছিল ওরা সবাই।

সবাই বলতে পাপিয়া, শমিত, বাপ্পা–আর দুজন অতিথি ও প্রফুল্ল পান এবং যোগেশ দাশগুপ্ত।

ওঁরা যে আজ সকালবেলা আসবেন সেটা ফোন করে জানিয়েছিলেন প্রফুল্ল। হেসে বলেছিলেন, ম্যাডাম, পুলিশ কখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসে না। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট যখন করছি তখন পুলিশ হিসেবে আসছি না–আসছি বন্ধু হিসেবে…চা খেতে। কী, আপত্তি নেই তো?

পাপিয়া উত্তরে বলেছে, আপত্তি করব আমি! আপনারা আমাকে একটা মিষ্টি মেয়ে দিয়েছেন–এ কথা কি কখনও ভুলতে পারব।

সেই ভয়ংকর ঘটনার পর আঠেরো দিন কেটে গেছে, কিন্তু পাপিয়ার এখনও মনে হয় ব্যাপারটা এই একটু আগেই শেষ হল।

সেদিন কলিংবেল বেজে ওঠার পর বাপ্পা ছুটে গিয়ে দরজা খুলেছিল। খুলেই দ্যাখে কোলাপসিবল গেটের বাইরে পড়শিদের ভিড়, গুঞ্জন, কৌতূহলী মুখের মিছিল।

দরজার পাশেই একটা শো-কেসের ওপরে কোলাপসিবল গেটের চাবিটা রাখা থাকে। কাঁপা হাতে সেটা নিয়ে পড়শিদের কারও হাতে দিয়েছিল বাপ্পা।

ব্যস, তারপরই ওরা জলস্রোতের মতো ঢুকে পড়েছিল ফ্ল্যাটের ভেতরে। আর জনাছয়েক লোক দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে একটা দুর্ভেদ্য ব্যারিকেড তৈরি করে দিয়েছিল।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাসপাতাল আর পুলিশে ফোন করা হয়ে গেল। তন্ময়, মৃন্ময় আর মালিনী কড়া পাহারায় ঘেরাও হয়ে গেলেন। পাপিয়া আর শমিতের যত্ন-আত্তি শুরু হয়ে গেল একইসঙ্গে।

এর মিনিট কুড়ি পরেই প্রফুল্ল পান আর যোগেশ দাশগুপ্ত এসে পৌঁছেছিলেন। চমকে দেওয়া পুলিশি তৎপরতায় ওঁরা পরিস্থিতির দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলেন।

পাপিয়া এসবের কিছুই জানে না কারণ, ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তন্ময়ের গুলি লেগেছিল ওর পেটের কাছে। আর চার-পাঁচ ইঞ্চি এদিক-ওদিক হলেই ব্যাপারটা বিপজ্জনক হতে পারত।

তারপর আঠেরোটা দিন যে কীভাবে কেটেছে! পাপিয়া পরে শমিতের কাছে শুনেছে। কারণ, সাতদিন ও নার্সিংহোমে ছিল মাইনর অপারেশন করে ওর গুলিটা বের করতে হয়েছে।

ও মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর শুরু হয়েছে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ।

সেই ধকলটা কেটে গেলে পর শমিত আর পাপিয়া প্রফুল্ল আর যোগেশের কাছে মিষ্টুর আসল গল্পটা জানতে চেয়েছে। ওঁরা বলেছিলেন, একদিন এসে গল্পটা শোনাবেন।

মিষ্টু একটি দিনের জন্যও শমিতদের ফ্ল্যাট ছেড়ে যায়নি। যখনই দরকার হয়েছে, পুলিশ ফ্ল্যাটে এসে ওর সঙ্গে কথা বলে গেছে। প্রফুল্ল আর যোগেশই সে-ব্যবস্থা করেছিলেন।

শমিত আর পাপিয়া ধীরে-ধীরে জানতে পেরেছে ওইটুকু মেয়ের ওপর দিয়ে কী সাংঘাতিক ঝড় বয়ে গেছে।

এখন সেই ঝড়কপালি মেয়েটা মনভোলানো গান গাইছে।

মিষ্টুর গান শেষ হয়ে গেলে প্রফুল্ল আর যোগেশ ওকে দারুণ তারিফ করলেন। যোগেশ হেসে বললেন, গানের ক্লু দিয়েই শেষ পর্যন্ত খুনি ধরা পড়ল, কী বলেন।

উত্তরে শমিত আর পাপিয়া সায় দিয়ে হাসল। তখন দু-টিপ নস্যি নাকে গুঁজে দিয়ে প্রফুল্ল পান মিষ্টুর গল্পটা ওদের শোনালেন।

মিষ্টুর বাবা-মায়ের নাম সত্যি-সত্যিই তন্ময় আর মালিনী হাজরা। তবে ওঁদের বাড়ি মোটেই তালতলায় নয়–তেঘরিয়ায়। এবং ওঁরা আর বেঁচে নেই। মিষ্টুর চোখের সামনেই ওঁদের নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখামাত্রই মিষ্টু কেমন যেন হয়ে যায়–সেই শকই বোধহয় ওর অ্যামনেশিয়ার কারণ।

পুরো ঘটনাটা শুরু হয় সুপারলোটোর একটা টিকিট নিয়ে।

লটারির টিকিট কাটা তন্ময়ের বহু পুরোনো অভ্যেস ছিল। মানুষটি ভাগ্যে খুব বিশ্বাস করত। হঠাৎই, জীবনে এই প্রথমবার, সুপারলোটোর জ্যাকপট জুটে যায় তন্ময়ের কপালে। তার টাকার অঙ্কটাও অবিশ্বাস্য রকমের : সাতানব্বই লক্ষ টাকা। তন্ময় আর মালিনীর হার্ট নিশ্চয়ই শক্তপোক্ত ছিল, কারণ, এই মারাত্মক আনন্দের খবরটা শুনেও ওঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েননি।

কিন্তু গণ্ডগোল শুরু হল তন্ময়ের ভাই মৃন্ময়কে নিয়ে। মৃন্ময় অল্প বয়েস থেকেই আজেবাজে বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়েছিলেন। তাই সবসময়েই খরচের টাকায় টান পড়ত। সময়ে-অসময়ে দাদাকে ফোন করে হোক বা এসে হোক তিনি টাকা ধার চাইতেন–এবং সেই ধার আর কোনওদিনই ফেরত দিতেন না। এইসব কারণেই তন্ময় ছোটভাইকে কখনও নিজের কাছে রাখেননি।

সুপারলোটোর পুরস্কার পাওয়ার খবরটা পাঁচকান হয়ে মৃন্ময়ের কানে পৌঁছোয়। তখন তিনি ফোন করে দাদাকে ভয় দেখান–ওই টাকার অর্ধেক দাবি করেন।

স্বাভাবিক কারণেই তন্ময় রাজি হননি। এই নিয়েই দুই ভাইয়ের মন কষাকষি শুরু।

মৃন্ময়ের ক্রমাগত হুমকিতে তন্ময় ভয় পেয়ে যান। টিকিটটা তিনি বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে ফেলেন। মৃন্ময় ইতিমধ্যে কুখ্যাত একটা মাফিয়া গ্যাং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছেন। মৃন্ময় তাদের বলেন, যেভাবে হোক টিকিটটা ওঁর চাই।

একদিন রাতে সেই গ্যাং নিয়ে মৃন্ময় তন্ময়দের বাড়িতে চড়াও হন। তারপর নানানভাবে তন্ময় আর মালিনীকে টরচার করেন। কিন্তু কিছুতেই টিকিটটার হদিশ না পেয়ে মিষ্টুর চোখের সামনে দাদা আর বউদিকে কুপিয়ে খতম করেন। সেই সময় রক্ত ছিটকে লেগেছিল মিষ্টুর ফ্রকে। আর প্রচণ্ড শক পেয়ে মিষ্টু স্মৃতি খুইয়ে বসে।

মিষ্টু কিন্তু জানত টিকিটটা ওর মাম আর বাবু কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। তন্ময়দের খুন করার আগে কথায় কথায় মৃন্ময় সেটা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু মিষ্টু স্মৃতি হারিয়ে ফেলায় মৃন্ময় ফ্যাসাদে পড়ে যান। ওকে চাপ দিয়ে টিকিটের হদিশটা আর বের করতে পারেননি। ফলে তক্ষুণি কোনও উপায় ভেবে না পেয়ে মিষ্টুকে কিডন্যাপ করে গাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়ে যান।

পথে একরকম অলৌকিকভাবেই মিষ্টু শমিতদের আওতায় চলে আসে।

দমদম পার্ক পেরিয়ে ভি.আই.পি. রোডের ধারে মৃন্ময়রা গাড়ি থামিয়েছিলেন। কারণ, ওঁর দুজন সঙ্গীর তখন টয়লেটে যাওয়ার দরকার হয়েছিল। সেই সুযোগে হতবুদ্ধি মিষ্টু ফাঁক পেয়েই বেপরোয়া ছুট লাগায়–শমিতদের গাড়ির সামনে এসে পড়ে। তারপর…।

..তারপর তো গোটা গল্পই আপনি জানেন। শমিতের দিকে তাকিয়ে গল্প শেষ করলেন। প্রফুল্ল পান।

টেলিফোন করে আমাদের ভয় দেখাত কে? পাপিয়া জানতে চাইল।

একটা সিগারেট ধরিয়ে যোগেশ দাশগুপ্ত বললেন, সুধীর আর বিনোদের গ্যাং-এর হরিরাম নামের একটা লোক। কাশীপুর থানায় ওর নামে তিনটে মার্ডার চার্জ রয়েছে। তন্ময় আর মালিনী যে-দিন মার্ডার হন সেদিন হরিরাম মৃন্ময়ের সঙ্গে ছিল।

প্রফুল্ল পান রুমাল দিয়ে নাক মুছে নিয়ে বললেন, মিষ্টুকে নিয়ে মৃন্ময়ের বেশ দুশ্চিন্তা ছিল। এক তো মিষ্টুই শুধু সুপারলোটোর টিকিটটার হদিশ জানত। এ ছাড়া মিষ্টুই ছিল তন্ময় আর মালিনীর খুনের একমাত্র সাক্ষী। তাই মৃন্ময় একবার চাইছিলেন মিষ্টুকে বাঁচিয়ে রাখতে, আর একবার চাইছিলেন ওকে মেরে ফেলতে। এই দোটানায় পড়ে শেষ পর্যন্ত মৃন্ময় শেষের পথটাই বেছে নিয়েছিলেন– তিনি ভেবেছিলেন, লটারির টিকিটটা পাওয়ার আর কোনও আশা নেই। তাই ছলে বলে কৌশলে মিষ্টুকে আপনাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চাইছিলেন।

তারপর…ঘটনাচক্রে সব প্ল্যানই তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। তখন মৃন্ময় দাদার নাম করে মিষ্টুর ছবি দিয়ে নিউজপেপারে বিজ্ঞাপন দেন। তারপর তন্ময় সেজে আপনাদের ফ্ল্যাটে আসেন।

সবিতা ঘোষ নামের একটা নাটকের মেয়েকে মালিনী সাজিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসেন…।

শেষদিন ওঁদের সঙ্গে মৃন্ময় সেজে কে এসেছিল? পাপিয়া জিগ্যেস করল।

যোগেশ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আনোয়ার–সুধীর আর বিনোদের এক চ্যালা। ছেলেটা পড়াশোনা জানে, কথাবার্তায় ভদ্র…ওদের দলের বেশ কয়েকটা ডাকাতির বুদ্ধি জুগিয়েছে।

বদমাইশ লোকগুলোর সাজা হবে তো?

হবে না মানে! আমাদের চার্জশিটে কোনও ফাঁক থাকবে না। যোগেশ ভুরু উঁচিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বললেন, আমি আর প্রফুল্লদা সহজে হার মানার পাত্র নই…।

প্রফুল্ল হাতে হাত ঘষে হাসলেন : কেস মিটে গেলে সুপারলোটোর টিকিটটা আপনারা হাতে পাবেন। তখন প্রাইজ মানিটার যা হয় একটা ব্যবস্থা করবেন।

ওটা তো আমাদের টাকা নয়, মিষ্টুর টাকা! শমিত বলল।

 এখন আপনারা ছাড়া ওর আর কে আছে?

পাপিয়া মিষ্টুকে কাছে টেনে নিল। ওর গালে, মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, সত্যি, এই মেয়েটা আমাদের গুণ করেছে।

গুণ কী, আন্টি? গুণ অঙ্ক? অবাক চোখে পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টু জানতে চাইল।

না রে, গুণ অঙ্ক নয়। এই গুণ মানে জাদু, বুঝলি! এখন থেকে তুই সত্যি-সত্যি আমাদের মেয়ে। তোকে আর কেউ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে না। মিষ্টুর চুলে মুখ গুঁজে দিল পাপিয়া।

শমিত, বাপ্পা আর চ্যাম্প অপলকে পাপিয়া আর মিষ্টুকে দেখছিল।

আর ঠিক তখনই জোরালো এক বাতাসে কৃষ্ণচূড়া গাছটার রোদ-চকচকে পাতাগুলো ঝলমলিয়ে নেচে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *