পায়ের শব্দ নেই

পায়ের শব্দ নেই

০১.

বিদিশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো নিজের সাজগোজ দেখে নিচ্ছিল। আয়না মিথ্যে কথা বলে না। তাই সামনের মেয়েটাকে রীতিমতো সুন্দরী বলে মনে হচ্ছিল বিদিশার। বিধাতাপুরুষ যখন রোজকার দমবন্ধ করা কাজের রুটিন থেকে ছুটি নিয়ে স্বর্গীয় কোনও জায়গায় আলস্যে অবসর যাপন করছিলেন, তখন বেশ ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে বিদিশাকে তৈরি করেছেন তিনি।

নিটোল ফরসা মুখ, স্পষ্ট ভুরু, মায়াজড়ানো টানা-টানা চোখ, গোলাপি ঠোঁট, হাসলে এক গালে টোল পড়ে। ওর মুখের দিকে একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া কঠিন! কত পুরুষ যে ওর সঙ্গে নানান ছলছুতোয় আলাপ জমাতে চায়।

বিদিশার গাঢ় নীল শাড়িতে সূক্ষ্ম জরির কাজ। গত বছর পুজোর সময় মা কিনে দিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিটের ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউস থেকে। বিদিশাও সঙ্গে গিয়েছিল। এত দামি শাড়ি কিনতে ওর মন চায়নি। কিন্তু মা জোর করে কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোর সাজগোজের সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি–।

ছাব্বিশ বছর বয়েসে কি কারও সাজগোজের বয়েস ফুরিয়ে যায়? কিন্তু বিদিশার ভেতরে সবসময়েই একটা অস্থির ঝড় মাথা খুঁড়ে মরতে থাকে।

মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে তেরছা চোখে আয়নার দিকে তাকাল বিদিশা। কোঁকড়া কালো চুলের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে চাইছে পিঠে। চুলের গোড়ায় সাদা সিল্কের সৌন্দর্য বন্ধনী। চুলের ঢঙ বিদিশার পছন্দ হল। আর ঠিক তখনই ওর চোখ গেল বাঁ গালে কানের কাছাকাছি জায়গায়। ইঞ্চিদুয়েক লম্বা একটা কাটা দাগ। রণজয়ের ভালোবাসার চিহ্ন। সেই রাতটার কথা বিদিশা এখনও ভুলতে পারেনি। যেমন ভুলতে পারেনি আরও অনেক দিনরাতের কথা।

সাজগোজ পরখের পালা শেষ করে বিদিশা কবজি উলটে ঘড়ি দেখল ও সওয়া নটা। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে না বেরোতে পারলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে। সল্ট লেকের সি. এ. পি. ক্যাম্প থেকে পার্ক স্ট্রিট–সব মিলিয়ে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো লাগবেই।

আয়নার পাশে দাঁড় করানো একটা সোফায় বিদিশার লম্বা স্ট্র্যাপ দেওয়া হাতব্যাগটা পড়ে ছিল। তার পাশেই বাপ্পার স্কুলের পোশাক। বাপ্পা এখন স্নান করতে বাথরুমে ঢুকেছে। ও দশটায় স্কুলে বেরোয়।

বিদিশা ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরোতে যাবে, মা বসবার ঘরের দরজা থেকে ডাকলেন, মানু, তোর ফোন।

বিদিশা ভুরু কুঁচকে ডাইনিং হলের দিকে এগোল। কে ফোন করল এই অসময়ে?

সবুজ রঙের রিসিভার টেবিলে কাত করে নামানো। সেটা তুলে নিয়ে বিদিশা ছোট্ট করে বলল, হ্যালো–।

মানু, কেমন আছ?

ও-প্রান্তের গলা শোনামাত্রই বিদিশার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। রণজয়।

কেমন আছ, মানু? রণজয় আবার জিগ্যেস করল।

গলা শুকিয়ে কাঠ। অতি কষ্টে জিভে সাড় এনে বিদিশা বলল, ভালো–

বিদিশা রণজয়কে ছেড়ে চলে এসেছে প্রায় নমাস। প্রথম ছমাস রণজয় ওর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও চেষ্টা করেনি। তারপর একদিন ফোন করে বাপির সঙ্গে কথা বলে, মায়ের কথা বলে। তবে সে-সব কথাবার্তাই ছিল লিগাল সেপারেশনের ব্যাপার নিয়ে।

তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, মানু। রণজয় বলল।

দম বন্ধ করে বিদিশা জিগ্যেস করল, কী কথা?

আমি একেবারে বদলে গেছি। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারছি না। রাতগুলো আমাকে হাঁ করে গিলতে আসে। শেষ দিকে রণজয়ের গলা ধরে এল।

বিদিশার ভেতরে একটা কষ্ট সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। ও চোয়াল শক্ত করে সেটাকে চেপে সাধারণ গলায় বলল, আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি পরে ফোন কোরো।

বিদিশা, প্লিজ। আমার কথাটা শোনো একবার–।

সরি, রণজয়। সত্যি ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।

রিসিভার নামিয়ে রাখল বিদিশা।

মা তখনও বসবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। বিদিশা ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মা পিছন থেকে জিগ্যেস করলেন, রণজয় কী বলল?

বিদিশা দায়সারাভাবে জবাব দিল, তেমন কিছু না।

তুই একটু ভেবে দ্যাখ না, যদি…।

বিদিশা ঘুরে তাকাল মায়ের দিকে। মায়ের দু-চোখে অনুনয়, প্রত্যাশা। মা এখনও ভাবে, রণজয়ের সঙ্গে ওর বিয়েটা জোড়া দেওয়া সম্ভব। দু-বছরে ওদের সম্পর্কে এমন কোনও ফাটল ধরতে পারে না যা সারিয়ে নেওয়া যায় না।

কিন্তু বিদিশা কেমন করে মাকে বলবে, মা, ওই লোকটার সঙ্গে দুটো বছর আমি ঘর করেছি, তুমি করোনি। ওর ভেতরে এমন কতকগুলো গোলমাল আছে যা কখনও ঠিক হবে না। তুমি কি আমার বাঁ-গালের কাটা দাগটার কথা ভুলে গেলে!

বিদিশা ছোট্ট করে বলল, আমি বেরোচ্ছি। ফিরতে একটু দেরি হলে চিন্তা কোরো না। দুপুরে খাওয়ার আগে বাবাকে মনে করে ডাইজিনটা দু-চামচ খাইয়ে দিয়ো।

ও যখন দরজা খুলে বেরোচ্ছে তখন পিছন থেকে শোনা গেল বাপ্পার চিৎকার, দিদি, আমার জন্যে আজ একটা ক্যাডবেরি নিয়ে আসবি।

আচ্ছা, নিয়ে আসব।

বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে সদর দরজা টেনে দিল বিদিশা। পালিশ করা ভারী কাঠের দরজা ক্লিক শব্দ করে অটোমেটিক লক হয়ে গেল।

ছোট্ট মোজেইক করা বারান্দায় শেষে দু-ধাপ সিঁড়ি। তারপর খানিকটা জায়গা জুড়ে শান বাঁধানো চাতাল। তার প্রান্তে, পাঁচিলের কিনারা ঘেঁষে, লম্বা মাটির ফালিতে সবুজের বাগান। রিটায়ার করার পর বাবাকে এই নেশায় পেয়েছে। সবসময় এই গাছ নিয়ে পড়ে আছেন। একা-একা কথা বলেন গাছের সঙ্গে। আপনমনে মাথা নাড়েন, বিড়বিড় করেন।

বাবা সারাটা জীবন কলকাতা করপোরেশনে ঘুষ না নিয়ে চাকরি করেছেন। ওদের নিয়ে পাইকপাড়া অঞ্চলে কী কষ্ট করেই না থাকতেন! বিদিশা শুনেছে, বিয়ের আগে মা রমলা গালর্স হাই স্কুলে অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেন বাবার কথায়। কিন্তু পড়ানোর অভ্যেস ছাড়তে বাবা মানা করেননি। তাই বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পড়াতেন মা।

সল্ট লেকের জমি লটারি হওয়ার সময় সেই কোন যুগে বাবা একটুকরো জমি পেয়েছিলেন। তারপর, প্রায় পঁচিশ বছর পর, সেখানে এই ছোট্ট একতলা বাড়ি তৈরি করেছেন। বাবা-মায়ের তিলতিল কষ্ট দিয়ে গড়ে তোলা এই বাড়ি।

তাই বিদিশার আবদার ছিল, বাবা-মায়ের নামেই হোক বাড়ির নাম। অনেক লড়াইয়ের পর জিতেছিল ও।

সদরের গ্রিলের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বিদিশা দেখতে পেল, শোওয়ার ঘরের লাগোয়া গ্রিল-ঘেরা বারান্দায় বসে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। লম্বা তামাটে কাঠামো। মুখে বয়েসের ভজ, চোখে হাই-পাওয়ার চশমা। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় মানুষটা ঘুম থেকে ওঠে, আর রাতে শুয়ে পড়ে নটার মধ্যে। আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ।

বিদিশা ডেকে বলল, বাবা, আমি বেরোচ্ছি।

মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজের আড়াল সরিয়ে তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলেন। সে-হাসির অর্থ বোধহয়, আমার জোয়াল টানার পালা শেষ, এবার তোর পালা।

লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল বিদিশা। একবার পিছন ফিরে দেখল। সদর দরজায় এক পাশে পাথরের ফলকে লেখা বাড়ির নাম : অরুণা-সুধাময়। ছোট্ট সাদা বাড়িটা যেন বাড়ির মানুষগুলোর মতোই সাদাসিধে। এরকম সাদাসিধে জীবনই চেয়েছিল বিদিশা। কিন্তু ওর বিয়েটা গোলমাল হয়ে গিয়ে সবকিছুই কেমন গোলমাল হয়ে গেল।

অথচ বিয়ের আগে ও পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করেছিল রণজয়ের সঙ্গে।

ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক বিয়েবাড়িতে। আঠারো বছর বয়েসেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল কল্পিতা বিদিশার স্কুলের বন্ধু। বরযাত্রীরা এসেছিল দুর্গাপুর থেকে। সবাই মিলে বেশ হইহুল্লোড় করছিল। তারই মধ্যে রণজয়কে লক্ষ করেছিল বিদিশা। ফরসা রোগা চেহারা। মুখে কেমন যেন মেয়েলি ভাব। চোখে চশমা। চোখ দুটো বেশ গভীর আর মিষ্টি।

হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল রণজয়। মাঝে-মাঝে নতুন বউকে তাক করে শাটার টিপছিল।

বরযাত্রী দু-চারজন যুবক বিদিশার সঙ্গে গল্প জুড়েছিল। দুর্গাপুর যে কত ভালো জায়গা সে কথা সবিস্তারে বলছিল। বিদিশা সেই বয়েসেই বেশ বুঝে গিয়েছিল ওকে ঘিরে পুরুষদের কিছু সমস্যা হয়। তাই ও সতর্কভাবে সৌজন্য বজায় রেখে টুকটাক কথা বলছিল।

হঠাৎই তাদের একজন বিদিশাকে বলল, ম্যাডাম, আমাদের সঙ্গে একটা ছবি তুলুন।

সঙ্গে-সঙ্গে আর একজন : এই রনো, আমাদের দিকে তাক করে কটা ফিলিম খরচ করো, বস্।

রণজয় ইতস্তত করে জবাব দিয়েছিল, উনি এখনও ফটো তোলার পারমিশান দেননি।

তখন কে একজন বলে উঠল, রনোটা বড্ড বেরসিক। সবসময় নীতিশিক্ষা ফলায়।

আগের জন্মে ও পাদরি ছিল।

উঁহু, বেচারা নারীজাতিকে শ্রদ্ধা করে।

বিদিশা অস্বস্তি পাচ্ছিল। অথচ রণজয় বেশ স্মার্টভাবে ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল, আজেবাজে কথায় কান দেবেন না। শুধু বলুন, ফটো তুলতে আপনার আপত্তি নেই তো?

বিদিশা বলেছিল, তুলুন–।

রণজয় নরম গলায় আলতো করে বলল, একটা সবার সঙ্গে..আর একটা একা।

ফটো তোলার পর রণজয় বিদিশার ঠিকানা চেয়েছিল। বলেছিল, ফটোর প্রিন্ট ডাকে পাঠিয়ে দেবে। কয়েক সেকেন্ড দোটানার পর ঠিকানা দিয়েছিল বিদিশা।

এমন সময় কনেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ছাদনাতলায়। রণজয় ফটো তোলা নিয়ে কীসব কথা বলছিল গুনগুন করে। আবার মাঝে-মাঝে হঠাৎই চুপ করে যাচ্ছিল। দেখে কেমন যেন অসহায় বলে মনে হচ্ছিল।

একটু পরে ভিড়ের মধ্যে কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছিল রণজয়।

দিন পনেরো পর বিদিশার নামে একটা খাম এসেছিল পাইকপাড়ার বাড়িতে। দুটো ফটোর দু কপি করে পোস্টকার্ড মাপের প্রিন্ট। সঙ্গে একটা চিরকুট। তাতে লেখা : খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের জন্যে কোনও প্রিন্ট রাখিনি। বিশ্বাস করুন। ফটো কেমন লাগল এক লাইন লিখে জানাবেন?

সামান্য নির্দোষ চিঠি। কিন্তু তারই মধ্যে আঠারো বছরের বিদিশা কী যেন খুঁজে পেয়েছিল। এ যেন এক আঁজলা জলে ডুবে মরার গভীরতা।

এক লাইন নয়, বিদিশা এক পৃষ্ঠা লিখে জানিয়েছিল, ফটো কেমন লেগেছে।

নিতান্ত নির্দোষ চিঠি। কিন্তু তারপর থেকে একইরকম নির্দোষ চিঠি আসতে লাগল, যেতে লাগল।

দিন-মাস কাটতে লাগল। আর, অত্যন্ত ধীরে নির্দোষ চিঠিগুলোতে ভালোবাসার দোষ ঢুকতে লাগল।

রণজয় সি. এন. জ্যাকসন কোম্পানির সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার। বি. ই. কলেজ থেকে ইলেকট্রনিক্সে ডিগ্রি নিয়ে বছর আড়াই হল চাকরিতে ঢুকেছে। কোম্পানির হেড অফিস কলকাতার, কিন্তু ফ্যাক্টরি দুর্গাপুর। মাসের মধ্যে অন্তত দুবার কলকাতার আসে রণজয়। তখন বিদিশার সঙ্গে দেখা করতে ওর অসুবিধে নেই।

বিদিশা ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বেথুন কলেজে ভরতি হয়েছিল।

রণজয় ওর সঙ্গে কলেজে এসে দেখা করতে লাগল। একবার দেখা হওয়ার পর চোদ্দো দিন ধরে অপেক্ষা করত বিদিশা। তখন ওর মনে হত, হেদুয়া পার্কের গাছের পাতাগুলো কী সাংঘাতিক সবুজ, ওপরের আকাশটা কী বিপজ্জনক নীল, আর হেদুয়ার জল কী ভীষণ স্বচ্ছ!

জীবনকে আগে কখনও এত রূপসী মনে হয়নি বিদিশার। একটা রোগা ফরসা মুখচোরা চশমা পরা মিষ্টি ছেলে ওর জীবনটাকেই যেন পালটে দিল।

এখন পিছন ফিরে তাকালে বিদিশার মনে হয়, রণজয়ের মধ্যে ছোটখাটো কয়েকটা অস্বাভাবিক ব্যাপার তখন থেকেই দেখা গিয়েছিল। আজ যত স্পষ্টভাবে তার অর্থ বোঝা যায় তখন তা বোঝা যায়নি।

পার্ক স্ট্রিটের বাস স্টপে নেমে ডানদিকের ফুটপাথ ধরে একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটছিল বিদিশা। অফিসে দেরি হয়ে যাবে এই ভয়ে বারদুয়েক হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎই পিছন থেকে, ঠিক ঘাড়ের কাছে, কে যেন বলে উঠল, আগে গেলে বাঘে খায়–।

চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল বিদিশা। ওরই অফিসের সহকর্মী বোসদা-সুধীর বোস। অভিজ্ঞ ড্রাফটসম্যান। মাথায় টাক–শুধু কানের কাছটায় খানিকটা করে চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পানের রসে ঠোঁট লাল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষকে আপন করে নিতে পারেন।

বিদিশা অপ্রস্তুত হেসে বলল, দেরি হয়ে যাবে, তাই তাড়াতাড়ি হাঁটছি।

সুধীর বোস পান চিবোতে-চিবোতে জড়ানো গলায় বললেন, আমার কথাটার ইনার মিনিং আছে, মা জননী।

বিদিশা অপ্রতিভ হয়ে আশেপাশে তাকাল। কেউ শুনতে পায়নি তো! বোসদার কথাবার্তাই এইরকম। বিদিশা জানে এখানে বাঘ বলতে ওদের সেকশনের ম্যানেজার প্রশান্তলাল চক্রবর্তী। ভদ্রলোক কানে কম শোনেন, আর সেইজন্যেই বোধহয় মহিলা-আসক্তি অত্যন্ত প্রবল। কারণ, লোকে বলে, একটা ইন্দ্রিয় কমজোরি হলে অন্য কোনও ক্ষমতা শক্তিশালী হয়ে লোকসান পুষিয়ে দেয়।

বিদিশা স্টেনোগ্রাফারের চাকরি করে। প্রশান্ত চক্রবর্তী নানা ছুতোয় ওকে ডেকে ডিকটেশন দেন। সারাদিনই নির্লজ্জ চোখে ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রথম-প্রথম বিদিশার খুব খারাপ লাগত, কিন্তু ধীরে-ধীরে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে। ও বুঝতে পেরেছে, মেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে এ-অসুবিধেটা থাকবেই। ছমাসের চাকরি বিদিশাকে ছবছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে দিয়েছে। যেমন রণজয়ের সঙ্গে দু-বছরের সংসারটাকে ওর সবসময় দুশো বছর বলে মনে হয়।

সকালের এই সময়টা পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে অসংখ্য অফিসযাত্রী দ্রুত-পায়ে হেঁটে যায়। আর রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে একের পর এক গাড়ি। এই অঞ্চলটার আপাদমস্তক এখন গতি। মাথার ওপরে শ্রাবণের মেঘলা আকাশ যেন অলস ঘুমচোখে এই গতি দেখছে।

বোসদা বিদিশার পাশাপাশি পা ফেলতে-ফেলতে বললেন, ফাঁকা অফিসে আগে-আগে যেয়ো না। প্রশান্ত চক্রবর্তী ওত পেতে বসে আছে।

বিদিশা হেসে বলল, যাঃ, কী যে বলেন! আমাদের চক্রবর্তীসাহেব অতটা ডেঞ্জারাস নন। যাট পেরোনো রোগা-ভোগা মানুষ, দাঁত-টাত নেই, কামড়াবে কেমন করে!

মাড়ি তো আছে! সুযোগ পেলে ওই মাড়ি দিয়েই কিড়মিড় করবে।

বোসদার কথায় বিদিশা জোরে হেসে ফেলল।

প্রথম-প্রথম এসব পুরুষালি রসিকতায় অস্বস্তি পেত বিদিশা। কিন্তু পরে এই ব্যাপারটাকে ও মানিয়ে নিতে পেরেছে। তা ছাড়া ওর অফিস কলিগরা বেশিরভাগই ভীষণ ভালো। একে অপরের সুখে-দুঃখে অংশ নেয়। কারও সম্পর্কে অহেতুক কোনও কৌতূহল নেই।

বিদিশা যখন অফিস বিল্ডিং-এ ঢুকল তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ও আর বোসদা গ্রাউন্ড ফ্লোরের লিফটের কাছে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। দু-চারটে চেনামুখের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছিল বিদিশার। ও সৌজন্যের হাসি হাসল।

আশেপাশের নানান কথাবার্তা কানে আসছিল। কেউ অফিসের সমস্যার কথা বলছে, কেউ বলছে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সমস্যার কথা, কেউ বা পরিবারের সঙ্গে কথা কাটাকাটির কারণ বিশ্লেষণ করছে।

বিদিশার মাথায় রণজয়ের ভাবনাটা আবার ফিরে এল।

আজ মঙ্গলবার। রণজয় বিদিশাকে বাড়িতে ফোন করতে শুরু করেছে রবিবার থেকে। এ পর্যন্ত মোট চারবার ফোন করেছে ও। আর চারবারই একইরকম কথাবার্তা বলেছে। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না ইত্যাদি।

কথাগুলো শুনে বিদিশার কষ্ট হয়। প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে পড়ে, মনে পড়ে ফটো তোলার কথা। আবার অন্য অনেক ঘটনাও মনে পড়ে। দুঃস্বপ্নের স্মৃতির ভারে স্বপ্নের স্মৃতি চাপা পড়ে যায়।

বিদিশার মন বলছে, আজ রাতে ও আবার ফোন করবে। আবার একই কথা বলবে।

ছতলার অফিসের ফ্লোরে পৌঁছে যেন অন্য জগতে ঢুকে পড়ল বিদিশা। নিজের চেয়ার টেবিলে গুছিয়ে বসল। পোস্টাল ফ্যানটা চালিয়ে দিল ফুল স্পিডে। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে নিল। হালকা পারফিউমের গন্ধ টের পেল। আর তখনই দেখল শেখর সেন ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে।

শেখর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বয়েস বত্রিশ-তেত্রিশ। লম্বা শক্তিশালী কাঠামো। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। চোখে চশমা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা।

একসময়ে ট্র্যাকে দৌড়োনোই ছিল শেখরের ধ্যানজ্ঞান। একশো মিটারে ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিল। এখন রোজ ভোরবেলা দেশবন্ধু পার্কে দৌড়োয়।

ম্যাডাম, নিন, এই বইটা পড়ে দেখুন– একটা ইংরেজি পেপারব্যাক বিদিশার দিকে এগিয়ে দিল শেখর, এই বইটা বিদেশে প্রচুর বিক্রি হয়েছে।

বিদিশা বইটা হাতে নিয়ে দেখল। স্টিভ সোয়ানসন নামে একজন সিরিয়াল কিলারের আত্মজীবনী। নাম : মাই লাইফ উইথ নাইফ।

শেখর বইয়ের পোকা। অফিসে কোনও না কোনও বই ওর সঙ্গে থাকবেই। আজ এটা নিয়ে এসেছে। হয়তো আজই বাসে বইটা পড়ে শেষ করেছে। তাই বিদিশাকে পড়তে দিচ্ছে।

শেখর প্রায়ই বই পড়তে দেয় বিদিশাকে। ইংরেজি গল্প-উপন্যাস নিয়ে ফাঁক পেলেই আলোচনা-তর্ক জুড়ে দেয়। আর নিজের দৌড়োনোর দিনগুলোর গল্প করে।

বিদিশা ঠোঁট কুঁচকে বলল, না, না, এসব খুন-জখমের বই আমার ভালো লাগে না।

শেখর বলল, এই সোয়ানসন লোকটা স্যাডিস্ট সাইকোপ্যাথও বলা যায়। মহিলাদের খুন করেই ও আনন্দ পেত। ওর মাথার গণ্ডগোল আছে বলেই ইলেকট্রিক চেয়ার হয়নি। আমেরিকায় যাবজ্জীবন জেল খাটছে।

ওরে বাবা আঁতকে উঠল বিদিশা, এসব বই কেন পড়েন আপনি?

বিদিশার টেবিলে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে পড়ল শেখর। বলল, আপনাকে সত্যি কথাটাই বলি। রোমাঞ্চকর থ্রিলিং ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে। যখন ট্র্যাকে দৌড়োতাম তখন খুব থ্রিলিং লাগত। এখন তো জীবনটা একঘেয়ে হয়ে গেছে।

শেষদিকে মুখটা এমন ব্যাজার করল যে বিদিশা হেসে ফেলল।

হঠাৎই কোথা থেকে ম্যানেজার পি. এল. চক্রবর্তী এসে শেখরের পাশ দিয়ে উঁকি মারল ও বিদিশা, জলদি এসো। অনেকগুলো ইমপরট্যান্ট চিঠি ডিকটেট করার আছে।

বিদিশা চক্রবর্তীসাহেবের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, এখুনি যাচ্ছি।

শেখর হেসে বলল, আপনিও একটা এরকম বই লিখে ফেলুন ম্যাডাম। বইটার নাম দেবেন মাই লাইফ উইথ পি. এল. চক্রবর্তী।

বিদিশা শর্টহ্যান্ড খাতা আর পেন্সিল বের করে নিল ড্রয়ার থেকে। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।

শেখর বলল, লাঞ্চের সময় দেখা হচ্ছে।

বিদিশা ঘাড় নেড়ে মোজাইক করা মেঝেতে পা ফেলে এগিয়ে চলল প্রশান্ত চক্রবর্তীর টেবিলের দিকে।

এর মধ্যেই যে যার কাজে মন দিয়েছে। চায়ের গাড়ি ঢুকে পড়েছে ফ্লোরে। টেবিলে-টেবিলে চা পৌঁছে দিচ্ছে টি-বয়। ছেলেটা বিদিশাকে জিগ্যেস করল ম্যাডাম, আপনার চা কোথায় দেব?

বিদিশা ইশারায় ম্যানেজারের এক্সিকিউটিভ টেবিল দেখিয়ে দিল।

ঠিক তখনই ওদের বেয়ারা বনজারা এসে দাঁড়াল ওর কাছে। বলল, ম্যাডাম, আপনার ফোন। আঙুল তুলে একটা এক্সটেনশন লাইন দেখাল বনজারা।

বিদিশা এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরল।

হ্যালো।

 মানু, কেমন আছ?

বিদিশার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে চাইল। ওর অফিসের ফোন নম্বর কী করে পেল রণজয়!

মানু, কথা বলছ না কেন? আকুল গলায় জানতে চাইল রণজয়, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। একটিবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। বিদিশা…মানু…প্লিজ, একবার আমাকে কথা বলার চান্স দাও।

এটা অফিস। এখানে এভাবে ফোন করাটা ভালো দেখায় না– ঠান্ডা গলায় বলল বিদিশা।

কী বলছ, মানু! আমি তোমাকে ফোন করলে কে কী মনে করবে! আফটার অল আমি তোমার স্বামী।

বিদিশা একটা ধাক্কা খেল। রণজয় ওর প্রাক্তন স্বামী নয়–আইনের হিসেব অনুযায়ী বর্তমান স্বামী। ওর মাথার ভেতরটা কেমন যেন করছিল। কী বলবে এখন রণজয়কে?

অফিসের ফোন নম্বর তুমি কোথায় পেলে? বরফের গলায় জানতে চাইল বিদিশা।

ও-প্রান্তে পাগলের মতো হেসে উঠল বিদিশার স্বামী। হাসতেই লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর সহজ গলায় জবাব দিল, তোমাকে আমি প্রায়ই ফলো করি, তুমি টের পাও না। অফিসের আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে হইহুল্লোড় ফুর্তি করতে করতে আমার কথা তুমি একেবারে ভুলেই গেছ। তোমাকে আমি দূর থেকে রোজ দেখি আর নতুন করে ভালোবাসায় পাগল হয়ে যাই।

অফিসের অপারেটর লাইন ট্যাপ করে যান্ত্রিকভাবে মন্তব্য করল, প্লিজ মেক ইট কুইক, ম্যাম। সো মেনি ইনকামিং কল্স আর ওয়েটিং।

বিদিশার ভয় করছিল। যে-দুঃস্বপ্নটা মুছে গেছে বলে মাসতিনেক ধরে ও নিশ্চিন্ত ছিল। সেই দুঃস্বপ্নটা আবার কুৎসিতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে।

ও ছোট্ট মেয়ের মতো জেদি গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। প্লিজ, গেট লস্ট ফ্রম মাই লাইফ। কথার শেষে কেঁদে ফেলল বিদিশা।

জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল রণজয় : ছিঃ মানু, শুধু-শুধু কাঁদতে নেই। আজ সন্ধেবেলা তোমার সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলব। তখন বুঝবে, একা-একা আমি কী কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। এখন রেখে দিই? টা-টা। আই লাভ য়ু, লাভ।

লাইন কেটে গেল।

অসাড় হাতে রিসিভার নামিয়ে রেখে কোমর থেকে রঙিন রুমাল বের করল বিদিশা। প্রাণপণে। কান্না চেপে চোখ মুছল।

ইন্টারকম টেলিফোনটা আবার বাজতে শুরু করেছে। বিদিশার বুকের ভেতরেও পাগলা ঘণ্টি বাজছে। সত্যিই কি আজ সন্ধেবেলা ওর সঙ্গে দেখা করবে রণজয়? কোথায় দেখা করবে?

যেন অন্য কারও পায়ে ভর দিয়ে চক্রবর্তীসাহেবের টেবিলের দিকে এগোল বিদিশা। লক্ষ করল, নিজের সিট থেকে শেখর উদ্বিগ্ন চোখে ওকে দেখছে। আরও দু-একজন কলিগের চোখে কৌতূহল। এখন কী করবে ও?

কী ব্যাপার, বিদিশা, তোমাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? প্রশান্তলাল চক্রবর্তীর গলায় দরদ উথলে উঠছে? আবার চা দিতে বলি? তোমার চা এতক্ষণে ঠান্ডা জল হয়ে গেছে।

বিদিশা কোনওরকমে বলল, না, চা খাব না। তারপর শর্টহ্যান্ড খাতা আর পেনসিল নিয়ে ডিকটেশন নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসল।

অফিসের দেওয়ালে বড় বড় কাচের জানলা। জানলার বাইরের ভিজে মেঘলা আকাশ মন খারাপ করে দিচ্ছে। হঠাৎই একটা বিদ্যুৎ-রেখা চোখে পড়ল বিদিশার। বিদ্যুতের ঝিলিক দেখলেই ওর সেই ভয়ংকর রাতটার কথা মনে পড়ে যায়। চেনা রণজয়ের ভেতর থেকে একটা অচেনা রণজয় হঠাৎই উঁকি মেরেছিল সেই রাতে।

সেদিনটাও ছিল আজকের মতোই মেঘলা। ঘন-ঘন বৃষ্টি পড়ছিল আকাশ ভেঙে। আর সেই সঙ্গে বিদ্যুতের আলপনা।

রণজয় বৃষ্টিতে ভিজে সপসপে হয়ে বাড়ি ফিরল। তখন রাত কত হবে? বড় জোর নটা। সকালে বেরোনোর সময় ও বলেই গিয়েছিল ফিরতে একটু দেরি হবে। তবে দেরি বলতে বিদিশা ভেবেছিল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। কারণ রোজ ও ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরে।

ওর হেড অফিস বালিগঞ্জে। বছরদুয়েক হল রণজয় হেড অফিসেই আছে। এখানে নতুন একটা রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলাপমেন্ট উইং ভোলা হয়েছে–ও-ই সেটার গ্রুপলিডার। কোনও কোনও দিন অফিসের কাজে আটকে গেলে ও ফোন করে দেয় বাড়িতে।

বাড়িতে শুধু বিদিশা আর রণজয়ের মা। ছোট দোতলা বাড়ির একতলায় মা থাকেন, দোতলায় রণজয়-বিদিশা। ঠিকে কাজের বউ দু-বেলা কাজ করে যায়।

কলিং বেলের ঘণ্টা শুনে বিদিশাই খুলে দিয়েছিল সদর দরজা।

ভিজে সপসপে রণজয় দরজায় দাঁড়িয়ে। রাস্তার মলিন আলো তেরছাভাবে এসে পড়েছে। ওর ভিজে পোশাকে।

আজ ছাতা না নিয়ে ভীষণ ভুল করেছি। রণজয় হেসে বলল।

সদর দরজা বন্ধ করে ওর পিছন পিছন শোয়ার ঘরে এসেছিল বিদিশা। রণজয় অফিস থেকে অন্তত একটা ফোন করতে পারত বিদিশাকে। সারাটা সন্ধে ঘরে বন্দি হয়ে কারই বা টিভি দেখতে ভালো লাগে!

ফিরতে এত দেরি হল?

বিদিশা প্রশ্নটা নির্দোষভাবেই করেছিল, কৈফিয়ত চাওয়ার জন্য নয়।

রণজয় ওর দিকে পিছন ফিরে ভিজে জামা ছাড়ছিল গা থেকে। পলকে ঘুরে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিল বিদিশার গালে। বিদিশা ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে।

কৈফিয়ত দেওয়া আমি পছন্দ করি না। কঠিন গলায় মন্তব্য করেছিল রণজয়।

বিদিশা হঠাৎই যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। গালে হয়তো ব্যথা পেয়ে থাকবে, কিন্তু সেই ব্যথাটা ও টের পাচ্ছিল না। ভালোবাসার পুরুষ রণজয়ের আচরণ ওকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

বাইরে মেঘ ডাকছিল। কিন্তু বিদিশার মনে হচ্ছিল মেঘ ডাকছে ওর বুকের ভেতরে। মেঝেতে আধশোয়া অবস্থায় ওর শরীর কাঁপছিল থরথর করে।

ভিজে জামাটা মেঝেতে একপাশে ফেলে দিয়ে রণজয় এগিয়ে এল বিদিশার কাছে।

বিদিশা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ওর ঠোঁটের কোণ জ্বালা করছিল। বোধহয় কেটে গেছে।

রণজয় ওকে সাবধানে তুলে বসাল বিছানায়। বিদিশা তখন মাথা নীচু করে কাঁদছে। ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছে।

কেঁদো না, মানু, কেঁদো না– ওকে আদর করে বোঝাতে চাইছিল রণজয়, অন্যায় করেছ, তার শান্তি পেয়েছব্যস, মিটে গেছে।

মিটে গেছে! চোখ মুছে অচেনা রণজয়কে দেখতে চাইল বিদিশা। কিন্তু ততক্ষণে চেনা রণজয় আবার ফিরে এসেছে। দু-চোখে ভালোবাসা। আর দু-হাতে আদর করছে বিদিশাকে। বিদিশা কাঠ হয়ে বসেছিল।

কিন্তু রণজয়ের আদর বাড়তেই লাগল।

ওর ভিজে প্যান্ট থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল মেঝেতে। গায়ের ভিজে গেঞ্জিটা একটানে খুলে ফেলল রণজয়। পরক্ষণে প্যান্ট ইত্যাদিও।

বিদিশা প্রথম ধাক্কাটা তখনও সামলে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় ধাক্কাটাও পারল না।

রণজয় খ্যাপা ষাঁড়ের মতো হিংস্রভাবে আদর করতে লাগল ওকে। জামাকাপড় লন্ডভন্ড হয়ে গেল। সেই সঙ্গে বিছানাও।

ঘরের টিউব লাইট নির্লজ্জভাবে জ্বলছে। জ্বলছে বিদিশার শরীরটাও। বাইরে মেঘের ডাক যেন রণজয়ের গর্জন। তীব্র এক জ্বালায় ওর শরীরটা বিদিশাকে আঁকড়ে মরিয়া হয়ে ছটফট করছে।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বিদিশার ভেতরেও।

একসময় মেঘের গর্জন, বৃষ্টি–দুই-ই কমে এল। অসাড় মন নিয়ে বিদিশা এলোমেলোভাবে পড়ে রইল বিছানায়। শুধু ওর ক্লান্ত দুটো চোখ রণজয়কে দেখতে লাগল। এই মানুষটাকে ও ভালোবেসে সাতমাস আগে বিয়ে করেছিল!

রণজয় একটা পাজামা আর গেঞ্জি পরে নিয়ে পাখার বাতাসে চুল শুকোচ্ছিল। মাথার চুলে আঙুল চালাতে-চালাতে ও নির্লিপ্ত গলায় বলল, খেতে দাও। খিদে পেয়েছে।

বিদিশা সেই রাতেই মনে-মনে টের পেয়েছিল ওর বিয়েটা মরে গেছে।

কিন্তু তার পরেও সতেরোটা মাস ওকে সেই লাশটাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। অবশ্য তারপর আর পারেনি।

থ্যাংক য়ু, বিদিশা। তুমি টেবিলে গিয়ে একটু রেস্ট নাও। এই চিঠিগুলো সেকেন্ড হাফে টাইপ করে দিলেও চলবে।

বিদিশা চমকে উঠে খেয়াল করল প্রশান্ত চক্রবর্তী ওর সঙ্গে কথা বলছেন। বিদিশা ওর হাতের শর্টহ্যান্ড খাতার দিকে দেখল। দেখে অবাক হয়ে গেল। পুরোনো কথা ভাবতে-ভাবতেও কী করে যেন যান্ত্রিকভাবে ও ডিকটেশন নিয়ে ফেলেছে।

স্যার, আমি আসছি বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিদিশা।

প্রশান্ত চক্রবর্তী কথাটা বোধহয় শুনতে পাননি, কারণ চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ওর দিকে। কানে খাটো বলে সবসময় ওঁর সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়। এখন বিদিশার চেঁচাতে ভালো লাগছিল না।

যদি দরকার হয় বোলো। ছুটির পর তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। তোমাকে ভীষণ আপসেট দেখাচ্ছে।

বিদিশা কোনও জবাব না দিয়ে ফিরে গেল নিজের সিটে।

ওদের সেকশনে তিনটে এক্সটেনশন লাইন আছে। তিনটে টেলিফোনের দিকেই ভয়ে-ভয়ে দেখছিল বিদিশা। এই বুঝি একটা ফোন বেজে উঠল, আর কেউ ফিসফিসে গলায় বলে উঠল, মানু, কেমন আছ?

টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল বিদিশা। শরীরটা কেমন লাগছে। সেই সঙ্গে ঝিমুনি ভাব। রণজয় বলেছে, আজ সন্ধেবেলা ওর সঙ্গে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলবে। কখন দেখা করবে? দেখা। করে কী বলবে?

অফিস ছুটির সময় যতই কাছে এগিয়ে আসছিল, বিদিশার ভয় ততই বাড়ছিল। রণজয়ের কথা কাকে বলবে ও? শেখরকে? বোসদাকে? নাকি চক্রবর্তীসাহেবকে?

অফিসে কেউ জানে না বিদিশার বিয়ে হয়েছে। কপালে বা সিঁথিতে কোনওরকম সিঁদুরের ছোঁয়া নেই। নামও বিদিশা রায়–সুধাময় রায় ও অরুণা রায়ের মেয়ে। এখন যদি ও হঠাৎ করে কাউকে বলে ওর একটা স্বামী আছে, তাহলে কেমন শোনাবে ব্যাপারটা?

সারাটা দিন এরকম তোলপাড় মন নিয়ে কেটে গেল বিদিশার। বিকেলে হঠাৎই একসময় ওর খেয়াল হল অফিস ছুটি হয়ে গেছে।

ছুটির পর ওরা বেশ কয়েকজন দল বেঁধে পার্ক স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত যায়। তারপর কেউ পাতাল রেল, কেউ বাস কিংবা মিনিবাস, আর কেউবা চার্টার্ড বাসের যাত্রী হয়ে যে যার দিকে চলে যায়।

বিদিশার সঙ্গে শেখর আর বোসদা প্রায় রোজই বেরোন। আজ ওঁরা দুজন ছাড়াও রয়েছে। জুনিয়ার ড্রাফটসম্যান অশোক চন্দ্র, রিসেপশনিস্ট দেবলীনা পাল, টাইপিস্ট অতনু সরখেল আর অ্যাকাউন্টস-এর সুতপা দাস।

সুতপাদি আর দেবলীনা ক্যামাক স্ট্রিটে কীসব কেনাকাটা করবে বলে চলে গেল। অতনু সরখেল রোজই ধর্মতলা পর্যন্ত হেঁটে যায়, তারপর সেখান থেকে হাওড়ার বাস ধরে। তাই ও রাস্তা পার হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দিকে চলে গেল।

শেখর থাকে টালিগঞ্জে। পাতাল রেলে যাতায়াত করে। বোসদা, থাকেন শোভাবাজারে। তিনিও পাতালযাত্রী। অশোক চন্দ্রর বাড়ি রাজাবাজারের কাছে। ও পার্ক স্ট্রিটের মোড় থেকে বাস ধরে।

বিদিশা ভাবছিল, কার সঙ্গে কত বেশিক্ষণ ও থাকতে পারে। রণজয় ওকে প্রায়ই ফলো করে, বিদিশা টের পায় না। এখনও কি ফলো করছে না কি? ঘাড় ঘুরিয়ে বেশ কয়েকবার পিছনে তাকাল বিদিশা। কিন্তু অফিস ছুটির ভিড়, গাড়ির ব্যস্ততার মধ্যে ফরসা রোগা চেহারার কোনও মানুষকে খুঁজে পেল না।

শেখর বলল, কী ব্যাপার, ম্যাডামকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

বিদিশা ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ, একটু ঝামেলা হয়েছে। পরে বলব।

বোসদা পান চিবোতে চিবোতে বললেন, এ কী ধরনের পারশিয়ালিটি, মা জননী? সেনসাহেবকে বলবেন, আর আমি বাদ! আমি কি বুড়ো বলে এজ বারে আটকে গেলাম?

ওরা তিনজনই হেসে উঠল।

 তখন অশোক বলল, ঠিক বলেছেন, বোসদা, আমি ছোট বলে এজ বারে আটকে গেছি।

 এইরকম হাসি-ঠাট্টা করতে করতে ওরা পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে গেল।

তখন বিদিশা আচমকা বলে উঠল, বোসদা, আমি আপনার সঙ্গে মেট্রোতে যাব। শোভাবাজারে নেমে অটো ধরব।

শেখর একটু অবাক হয়ে গেল। কারণ বিদিশা সাধারণত বাসে যায়। কিন্তু কিছু বলল না।

বোসদা শেখরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললেন, সেন মহাশয়, আমাকে তুমি যতটা বুড়ো ভাব ঠিক ততটা বুড়ো আমি নই।

উত্তরে শেখর হাসল।

ওরা তিনজনে কথা বলতে বলতে মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। তখনও বিদিশা পিছন ফিরে শেষবারের মতো রণজয়কে খুঁজল।

.

সল্ট লেকের সি.এ.পি. ক্যাম্প বাস স্টপে যখন নামল, তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।

 ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথায় দিল বিদিশা।

চৌরাস্তার আইল্যান্ডটা জালের বিশাল ঘেরাটোপে ঢাকা। একসময়ে এটা পাখির খাঁচা ছিল। এখন পাখি নেই–শুধু শূন্য খাঁচা পড়ে আছে।

খাঁচাটাকে বাঁ-দিকে রেখে রাস্তা পার হল বিদিশা। বাস স্টপে মাত্র তিন-চারজন মানুষ। প্রত্যেকেরই মাথায় ছাতা। রাস্তার আলোয় ছাতার ভিজে কাপড় চিকচিক করছে।

বিদিশা ঘড়ি দেখল। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। অফিস ছটায় ছুটি হলেও দু-একদিন এমনই

দেরি হয়ে যায়। উলটোডাঙার রেল ব্রিজের নীচটায় জ্যাম থাকে। আজও তাই।

সি.এ.পি. ক্যাম্প স্টপেজে বিদিশা একাই নেমেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা নিরাকার আতঙ্ক বাসা বেঁধে রয়েছে ওর মনে। তাই ভিজে রাস্তায় চটপট পা ফেলে হাঁটা দিল।

ওর বাড়ি সি.ই. ব্লকে। সুইমিং পুলের মোড় ছাড়িয়ে প্রায় আর এক চৌরাস্তার মোড়ের কাছাকাছি। সেখানেও একটা পাখির খাঁচা আছে।

সারাদিন মেঘলা আর বৃষ্টি। তাই রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। কখনও কখনও একটা-দুটো বাস ছুটে যাচ্ছে। সেই শব্দ মিলিয়ে গেলেই এলাকাটা চুপচাপ।

রাস্তায় কয়েকটা নেড়ি কুকুর বৃষ্টির মধ্যেই ঝগড়া করছে। পরদা ঢাকা একটা সাইকেল রিকশা সুইমিং পুলের দিকে চলে গেল। সামনে যতদূর নজর চলে, কোনও মানুষজন নেই। এমনকী সাইকেল রিকশা স্ট্যান্ডেও কোনও রিকশা দাঁড়িয়ে নেই।

বিদিশা পিছন ফিরে একবার দেখল। না, সন্দেহজনক কাউকে নজরে পড়ছে না। রণজয় কি তাহলে মিথ্যে ভয় দেখাল! কিন্তু ভয় দেখানোর প্রশ্ন উঠছে কেন? একজন স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চায়। এর মধ্যে ভয়ের কী আছে! ভয়ের কিছু থাকত না, যদি না বিদিশা রণজয় সম্পর্কে কিছু কথা জেনে ফেলত। যে রাতে ও কথাগুলো জানতে পেরেছিল সেই রাতেই রণজয় ওর বাঁ গালে ভালোবাসায় স্থায়ী চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল।

সুইমিং পুলের মোড়টা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগোতেই বিদিশার নিজেকে আরও একা মনে হল। রাস্তার কোনও আলো জ্বলছে না। তবুও সামনের আইল্যান্ডের প্রকাণ্ড খাঁচাটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগোলেই ডান দিকের সরু গলিটা পেয়ে যাবে বিদিশা। তারপর এক মিনিটেই পৌঁছে যাবে বাড়ির দরজায়।

উলটোদিকের রাস্তায় সি. এফ. ব্লকের বাড়িগুলোর ধার ঘেঁষে একটা মারুতি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির ছাদে আলো পড়ে বৃষ্টির জল চিকচিক করছে। কিন্তু গাড়ির রং ঠিকমতো ঠাহর করা যাচ্ছে না।

রণজয়ের গাড়ি নেই। অন্তত বিদিশা যখন ওকে ছেড়ে চলে আসে, তখন ছিল না। বিদিশার বুক ঠেলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। ওই তো, কাঠগোলাপ গাছটা এসে গেছে। তার পাশ দিয়েই সরু গলিটা চলে গেছে। গলির শেষে পিচের রাস্তা। রাস্তার শেষে বিদিশাদের বাড়ি।

আজকের দিনটা কোনওরকমে তাহলে কাটল। ভাবল বিদিশা।

আর ঠিক তখনই মারুতি গাড়িটার তীব্র হ্যালোজেন হেডলাইট জ্বলে উঠল। বিকট গর্জন করে পাগলের মতো বাঁক নিয়ে গাড়িটা ছুটে এল বিদিশার দিকে।

আপ আর ডাউন লেন–দু-রাস্তার মাঝে সরু একফালি ঘাসে ঢাকা জমি। জমিটা রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। আড়াআড়ি আসতে গিয়ে দ্রুতগতির গাড়িটা উঁচু জমিতে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠল। তার পরেই বিশ্রী গর্জন করে ঠিকরে এল বিদিশাকে লক্ষ করে।

বিদিশা চিৎকার করতে গিয়ে টের পেল ওর গলা দিয়ে কোনওরকমে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো ওকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। হ্যালোজেন বাতির আলোয় বৃষ্টির ঝিরঝিরে ফোঁটাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ও একপাশে সরে যেতে গিয়ে হোর্চট খেল। টাল খেয়ে নিজেকে সামলে নিতে পারলেও ছাতাটা পড়ে গেল হাত থেকে।

গাড়িটা ওর ঠিক পাশ দিয়ে খ্যাপা জন্তুর মতো ছুটে গেল। তারপর বিশ্রী শব্দ তুলে ব্রেক কষে একটা ঝটকা দিয়ে থামল।

পরক্ষণেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ইউ টার্ন নিল গাড়িটা। বিদিশা তখন বৃষ্টিভেজা পিচের রাস্তা ধরে পাগলের মতো ছুটছে।

গাড়িটা এবারে ধেয়ে এল আরও জোরে। বিদিশার গায়ে মরণের বাতাস ছুঁইয়ে ওর ঠিক গাঁ ঘেঁষে ঠিকরে গেল সামনে। কিছুটা গিয়ে আচমকা ব্রেক কষল। তারপর গর্জন তুলে বাঁক নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বিদিশার মুখোমুখি। আবার পাগল করা গতিতে ছুটে এল ওর দিকে।

বেড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলা করে, বৃষ্টিভেজা কালো রাতে গাড়িটা বিদিশাকে নিয়ে ঠিক সেরকম খেলতে লাগল। ইঞ্জিনের গর্জন, হেডলাইটের তীব্র আলো, চাকার শব্দ মেয়েটাকে দিশেহারা করে দিচ্ছিল। এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করতে করতে ও ধাক্কা খেল কাঠগোলাপ গাছটার গুঁড়িতে। পলকের জন্য শরীরটা একটা ভয়ংকর ঝাঁকুনি খেল। তার পরই ও পড়ে গেল মাটিতে।

গাড়িটা ওকে লক্ষ করে ছুটে আসছিল। ওকে পড়ে যেতে দেখেই গাড়িটা থামল। হেডলাইটের উজ্জ্বল চোখ বিদিশার দিকে স্থির।

বিদিশা কেমন অসাড় হয়ে গেলেও চেতনা হারায়নি। ও তাকিয়ে ছিল মারুতি গাড়িটার দিকে। কিন্তু চোখ ধাঁধানো আলোয় স্পষ্ট করে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু বৃষ্টির ফোঁটা ঝিরঝির করে পড়ছে।

গাড়ি থেকে কেউ নামল। কারণ দরজা খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ হল। তারপর হেডলাইটের আড়াল করে একটা রোগা শরীর অলস পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগল বিদিশার দিকে।

বিদিশা চিৎকার করতে চাইছিল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছিল না। ওর চোখ সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল এগিয়ে আসা কালো ছায়াটার দিকে।

এক সময় মানুষটার তীব্র ছায়া এসে পড়ল বিদিশার গায়ে। আর তখনই আলতো গলায় সে বলে উঠল, মানু, কেমন আছ?

বিদিশার শীত শীত করে উঠল। ওর শাড়ি বৃষ্টিতে ভেজা সপসপে। কাঁধের ব্যাগ কোথায় ছিটকে পড়েছে। গলার কাছে একটা পাথরের বল আটকে রয়েছে কিছুতেই ওকে চিৎকার করতে দিচ্ছে না। শুধু চাপা আঁক-আঁক শব্দ বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে। ওর চেতনার জগৎ ঘিরে রয়েছে চোখ ধাঁধানো হেডলাইটের আলো, একটা লিকলিকে কালো ছায়া, আর শ্বাস রোধ করা এক আতঙ্ক।

ওর ফরসা মুখের সৌন্দর্য কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। আতঙ্কে কুঁকড়ে যাওয়া মুখ দেখে ওকে মোটেই চেনা যাচ্ছিল না। জল কাদা মাখা ওর অসহায় শরীরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। বিদিশার সেদিকে কোনও খেয়াল নেই।

অশরীরী ছায়াটা চেনা গলায় আবার কথা বলল, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, মানু। তোমাকে ছেড়ে আমি ভীষণ কষ্টে আছি। এতদিন একষ্ট টের পাইনি, কিন্তু এখন টের পাচ্ছি। তুমি আমার কাছে ফিরে এসো। আমার ফাঁকা জায়গাটা ভরে দাও। নইলে আমি মরে যাব..বিশ্বাস করো। তুমি আমার বাড়িতে উঁহু, আমার বাড়িতে নয়, তোমার বাড়িতে ফিরে এসো, তোমাকে অনেক কথা বলব। আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারো না, মানু। মানুষের কি ভুল হয় না! অনুতাপে অনুতাপে আমি জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দ্যাখো–।

লোকটা শেষ দিকে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বিদিশার আরও কাছে এগিয়ে এল। যখনই সে বিদিশার ওপরে ঝুঁকে পড়তে গেল, তখনই যেন গলার স্বর খুঁজে পেল ও।

কান ফাটানো এক মর্মান্তিক আর্তনাদ করে উঠল বিদিশা। হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়া কোণঠাসা পশু যেভাবে চিৎকার করে, অনেকটা সেইরকম। বৃষ্টি ভেজা রাতে সে-চিৎকারের প্রতিধ্বনিও যেন শুনতে পেল ও। আর একইসঙ্গে শুনতে পেল ছুটে-আসা কয়েকটা পায়ের শব্দ।

রাস্তার ধারের কয়েকটা বাড়ির দরজা-জানলা খুলতে শুরু করেছে। হেডলাইটের আলো পেরিয়ে চৌকো আলোর খোপগুলো আবছাভাবে দেখতে পেল বিদিশা। ওর গলার ভেতরটা জ্বালা করছিল। সেই অবস্থাতেও ও আরও দুবার চিৎকার করে উঠল।

বিদিশা দেখতে পেল, ছায়ামূর্তিটা কয়েক মুহূর্ত দোনামনা করে এদিক-ওদিক পা বাড়াল। তারপর এক ছুটে গাড়িতে গিয়ে উঠল। জোরালো শব্দে বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির দরজা। তারপর তাড়া খাওয়া জানোয়ারের মতো বেপরোয়া বাঁক নিয়ে ছিটকে গাড়িটা গেল দূরে। যাওয়ার সময় রাস্তার কাছ ঘেঁষে রাখা একটা ইটের পাঁজায় গাড়ির বাঁ দিকের হেডলাইটটা ধাক্কা খেল। ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙল, আলো নিভে গেল। চাকায় কাঁচকাঁচ শব্দ তুলে আঁকাবাঁকা পথে ছুট লাগাল গাড়িটা। মিশে গেল রাতের আঁধারে।

বিদিশা বোধহয় কয়েকমিনিটের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ হঠাৎই ও দেখতে পেল, ও দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দু-পাশ থেকে ধরে রয়েছে দুজন পথচারী। একজন কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে ওর ছাতা আর ব্যাগ। আর একজন ওকে জিগ্যেস করছে, কী হয়েছে, দিদি?

লোকগুলোকে এক পলক দেখল বিদিশা। দুজনকে দেখে রাজমিস্ত্রি বা রিকশাওয়ালা বলে মনে হয়। তারাই আজ বিদিশাকে বাঁচিয়েছে।

বিদিশা থরথর করে কাঁপছিল। কোনওরকমে ও বলল, আমি বাড়ি যাব।

 কোথায় বাড়ি বলুন, আমরা এগিয়ে দিয়ে আসছি– একজন বলল।

গাড়িটা কি আপনাকে ধাক্কা মেরে পালাল? আর একজন বলল।

বিদিশা মাথা নেড়ে জানাল, না। তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলে বাড়ির দিকে এগোল। দুজন মানুষ ওর পাশে-পাশে পা ফেলে ওকে এগিয়ে দিয়ে গেল অরুণা-সুধাময় পর্যন্ত।

কলিং বেলের শব্দে দরজা খুললেন অরুণা। বিদিশার মুখ-চোখ-পোশাক দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে রে?

বিদিশা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, আগে এক গ্লাস জল দাও।

অরুণা আর কোনও কথা না বলে ব্যস্ত পায়ে জল আনতে চলে গেলেন।

বিদিশা ক্লান্ত পায়ে ওর ঘরে এল। হাতব্যাগ আলনায় ঝুলিয়ে ছাতাটা খুলে মেলে দিল পাখার হাওয়ায়। ভিজে কাপড়ে একটু-একটু শীত করছিল। আর একইসঙ্গে বিদিশা বুঝতে পারছিল, ওকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটা রণজয়ের মাথায় যখন একবার ঢুকেছে, তখন সহজে ও ছাড়বে না। রণজয়কে বিদিশা যেভাবে চেনে, আর কেউ সেভাবে চেনে না। ওর অনেক ব্যাপার কাউকে খুলে বলেনি বিদিশা–বলতে পারেনি।

মা জল নিয়ে এলেন।

এক ঢোঁকে গ্লাসটা খালি করে দিল ও। তারপর একটা বড় শ্বাস ছাড়ল।

অরুণা আবার জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে বললি না তো!

 রণজয়ের ব্যাপার। ও আবার আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করেছে।

অরুণার ভুরু কুঁচকে গেল। কিন্তু বিদিশা আর কোনও কথা না বলে শুকনো জামাকাপড় নিয়ে চলে গেল বাথরুমের দিকে। অরুণা জানেন, নিজে থেকে না বললে কোনও কথা বের করা যাবে না এই মেয়ের মুখ থেকে।

বারান্দার লাগোয়া ঘরে টিভি চলছে। বাবা টিভি দেখছেন। গাছপালা, টিভি আর খবরের কাগজ–এই নিয়ে বেশ আছেন। তবে ছোটবেলা থেকেই বিদিশা আর বাপ্পাকে শিখিয়েছেন; যদি বাঁচতেই হয়, মাথা উঁচু করে বাঁচবে।

বাথরুমে ঢোকার সময় বিদিশা বাপ্পার গলা শুনতে পেল। ওর ছোট্ট ঘরে মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছে। পড়া শেষ করেই ও ছুটে আসবে বিদিশার কাছে। ক্যাডবেরির খোঁজ করবে। আজ নানান দুশ্চিন্তায় ওর ক্যাডবেরির ব্যাপারটা ভুলেই গেছে বিদিশা।

মা-বাবা আর ছোট ভাইকে নিয়ে কী সুন্দরভাবেই না জীবন কাটাচ্ছিল বিদিশা! কোথা থেকে এক দুঃস্বপ্নের মতো এসে হাজির হল রণজয়। মাসতিনেক আগেও লিগাল সেপারেশন আর ডিভোর্সের ব্যাপারে দিব্যি রাজি ছিল। এখন হঠাৎ মাথা বিগড়ে গেছে।

আর কেউ না জানুক, অন্তত বিদিশা তো জানে, হঠাৎ হঠাৎ মাথা বিগড়ে যাওয়াটাই রণজয়ের অসুখ। তার ওপরে রয়েছে ওর অস্বাভাবিক বড় মাপের অপ্রতিসম করোটির ব্যাপারটা। ওর মাথার খুলিকে নাক বরাবর লম্বালম্বি ভাগ করলে দুটো ভাগ মোটেই সমান পাওয়া যায় না। বাঁ-দিকের ভাগটা ডান দিকের তুলনায় অনেক বড়। ডাক্তারি মতে এটা খুব বিপজ্জনক হতে পারে।

বাথরুমে গা ধুয়ে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে রণজয়ের কথা ভাবছিল বিদিশা। ও মিথ্যে বলেনি। ও নিয়মিত অনুসরণ করছে বিদিশাকে–সে অফিস-পাড়াতেই হোক বা সল্ট লেকেই হোক। ফোন করে ফলো করে রণজয় তো ওকে পাগল করে দেবে।

আচ্ছা, শেখরকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? প্রশ্নটা নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করল বিদিশা। তারপর ঠিক করল, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শেখরকে ফোন করবে। রাতে ও পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মারতে বেরোয়। শেখরই বলেছে। বাড়ি ফেরে সাড়ে দশটা নাগাদ। তারপর নতুন কোনও পেপারব্যাক নিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। অবশেষে বই পড়তে-পড়তে ঘুম।

বেশ আছে মানুষটা! ওকে হিংসে করতে ইচ্ছে হল বিদিশার। কী চমৎকার দুশ্চিন্তহীন সুখী জীবন! রণজয়কে নিয়ে একইরকমই একটা জীবন চেয়েছিল বিদিশা। অথচ সব কীরকম গোলমাল হয়ে গেল।

সেই ভয়ংকর রাতের পর থেকে রণজয়ের অস্বাভাবিক এলোমেলো আচরণ আরও বেশি করে নজরে পড়েছিল। ও খুব সাবধানে কথা বলত রণজয়ের সঙ্গে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও রেহাই পায়নি। রণজয়ের মা ওকে রেহাই পেতে দেননি।

বিয়ের পর সেই মেঘ-বৃষ্টির রাতে প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল বিদিশা। সারাটা রাত ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু নিজের অদৃষ্ট ছাড়া আর কাকে ও দায়ী করবে? ও-ই তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রণজয়কে।

পরদিন রণজয় অফিসে বেরিয়ে গেলে ও দুপুরের দিকে মাকে ফোন করেছিল।

মা, মানু বলছি।

হাঁ, বল, কী খবর? অরুণা সহজ গলায় কথা বলেছেন।

আমি খুব..খুব..ঝামেলায়… চোখে জল এসে গেছে বিদিশার। গলা ধরে গিয়ে কথা আটকে গেছে মাঝপথে।

কী হয়েছে, মানু? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন অরুণা ও কাঁদছিস কেন? রণজয় কিছু বলেছে?

ন-না। একটু চুপ করে থেকে বিদিশা বলেছে, আমি তোমাদের কাছে গিয়ে কদিন থাকব, মা–

মন খারাপ লাগলে তুই আজই চলে আয়। তুই এলে বাপ্পাও খুশি হবে, আমাদেরও ভালো লাগবে।

বিদিশা ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে-মনে ঠিক করেছিল। সেদিনই চলে যাবে সল্ট লেকের বাড়িতে।

রণজয় অফিস থেকে সাড়ে ছটা নাগাদ ফিরে এল। হাত-মুখ ধুয়ে ওর কাছে এসে দু গাল চেপে ধরল দু-হাতে। কয়েকটা আদরের চুমু খেয়ে বলল, চলো, তোমাকে সল্ট লেকে পৌঁছে দিয়ে আসি। তবে চারদিনের বেশি থেকো না। আমি এখানে বের হয়ে যাব।

বিদিশা হতবাক হয়ে গেল। রণজয় কি মন পড়ে নিতে জানে? ও কী করে জানল যে, বিদিশা সল্ট লেকে যাবে বলে মন ঠিক করেছে! কিন্তু গতকাল রাতের কথা ভেবে কোনও প্রশ্ন করল না বিদিশা। কিন্তু মনের ভেতরে একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল।

বেশ মনে পড়ে, ওকে ভালোবেসে অত্যন্ত যত্ন করে সল্ট লেকে পৌঁছে দিয়েছিল রণজয়।

বাপ্পার জন্য একটা ক্যাডবেরি চকোলেট কিনে নিয়ে গিয়েছিল। হেসে-হেসে কথা বলেছিল মা-বাবার সঙ্গে।

বিদিশা অবাক হয়ে দেখেছিল চেনা রণজয়কে। তাই শেষ পর্যন্ত মাকে কোনও কথা বলতে পারেনি ও। ভেবেছে, গতকাল রাতের ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

সল্ট লেকের রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে রণজয় ফিরে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে।

তারপর বেশ কয়েকটা দিন স্বাভাবিকভাবে কেটে গেছে। অচেনা মানুষটা মাথা চাড়া দেয়নি চেনা রণজয়ের ভেতর থেকে। কিন্তু একটা ব্যাপার অবাক হয়ে লক্ষ করত বিদিশা। সারাদিন অফিসে কাটালেও রণজয় ওর অনেক কথা টের পেয়ে যেত।

অনেকদিন ধরেই একটা সন্দেহের কাটা বিঁধছিল বিদিশার মনে। সন্দেহটা ঠিক কি না সেটা যাচাই করতে একদিন ও মাকে ফোন করল। তারপর কথায় কথায় বাপ্পার লেখাপড়ার কথা জিগ্যেস করল। বিদিশা জানে বাপ্পার পড়াশোনার কথা জিগ্যেস করলে মা সাতকাহন জবাব দেয়। তাই মাকে প্রশ্নটা করেই ও রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছে টেবিলে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে নেমে এসেছে একতলায়।

রণজয়ের মায়ের ঘরে সন্তর্পণে উঁকি মেরে বিদিশা দেখল, ও যা ভেবেছে তাই।

এ বাড়িতে টেলিফোনের প্যারালাল লাইন আছে। একটা দোতলায় বিদিশাদের শোয়ার ঘরে, আর একটা রণজয়ের মা তরুবালার ঘরে।

সেই বিধবা ভদ্রমহিলা এখন টেলিফোনের রিসিভার কানে চেপে ধরে একমনে আড়ি পেতেছেন। প্রয়োজন মনে করলে তিনি পরে ফোন করবেন ছেলের অফিসে, গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো ঢেলে দেবেন ওর কানে।

প্যারালাল লাইনে খুব সহজেই আড়ি পাতা যায়। একটা টেলিফোনে কেউ ফোন করলে অন্য টেলিফোনটায় টিকটিক শব্দ হয়।

বিদিশার সামান্য নড়াচাড়া তরুবালা বোধহয় টের পেয়েছিলেন। কারণ চকিতে চোখ ফেরালেন দরজার দিকে। রিসিভার তখনও কানে ধরা।

না, বিদিশাকে দেখে রণজয়ের মা বিশেষ বিচলিত হননি। সবসময় হুকুম করতে অভ্যস্ত এই মহিলা সহজে হার মানেন না। বিয়ের পরেও রণজয়কে ছোট ছেলের মতো নির্দেশ দিয়ে থাকেন। বিদিশার সামনেও এই ধরনের হুকুম করতে তার বাধে না।

রণজয় এমনিতে যতই দাপট দেখাক না কেন, মা তরুবালার কাছে সে বাধ্য শিশু। তরুবালার শরীরে শক্ত বাঁধুনি, মনেও তাই। চোখের দৃষ্টি তীব্র–যেন গভীরতা মাপার যন্ত্র। যে সব শাড়ি জামাকাপড় পরেন তাতে সাদার ভাগ কম। তবে সিঁথি শূন্য।

কিছু বলবে, বিদিশা? অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় জিগ্যেস করলেন তরুবালা। প্যারালাল টেলিফোন লাইনে অকারণে রিসিভার কেন চেপে ধরে আছেন তার কৈফিয়ত ছেলের বউকে দেওয়ার কোনও চিহ্ন নেই।

বিদিশা হেরে গেল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত না, কিছু না বলে ফিরে এসেছিল দরজা থেকে। চলে আসার আগে তরুবালার কৌতুকের স্মিত হাসি নজরে পড়েছিল ওর।

দোতলায় এসে বিদিশা যখন আবার ফোনে কথা বলল তখন অরুণা মেয়েকে নানান প্রশ্ন আর বকাবকি শুরু করলেন। মেয়ে কোনও জবাব দিল না। ওর ক্রমশ নিজেকে বন্দি বলে মনে হচ্ছিল। টেলিফোন রেখে দিয়ে বিছানায় খোলা জানলার কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছিল ও। তখন পাশের বাড়ির প্লাস্টার চটে যাওয়া ফাটল-ধরা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা কচি অশ্বত্থ গাছ ওকে দেখছিল। দুপুরের নির্জন পরিবেশ ট্রামের চাকার ঘরঘর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল বিদিশা। লোহার-লোহার ঘর্ষণ। সেই আঘাতের যন্ত্রণা ও টের পাচ্ছিল। ট্রামটা যেন ওর বুকের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল।

বাথরুমের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল। বিদিশা চমকে উঠে প্রায় ভয়ের গলায় বলে উঠল, কে?

তোর জন্যে চা করেছি–জুড়িয়ে যাচ্ছে। মায়ের গলা।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল বিদিশা। রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে চায়ের কাপ নিল। তারপর ডাইনিং হলের টেলিফোনটার কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শেখর সেনের নম্বর ডায়াল করল ও।

বিদিশাদের বাড়িতেও ফোনের প্যারালাল লাইন। একটা ডাইনিং হলে, আর একটা মা-বাবার শোয়ার ঘরে। কিন্তু টেলিফোনে আড়িপাতার অভ্যেস নিয়ে ওরা মানুষ হয়নি।

হ্যালো, শেখর সেন আছেন? ও-প্রান্তের মহিলা কণ্ঠের হ্যালো শোনামাত্রই প্রশ্নটা করল বিদিশা। গলা শুনে ওর মনে হল বোধহয় শেখরের বউদি ফোন ধরেছেন।

ধরুন। দিচ্ছি।

একটু পরেই চেনা গলার হ্যালো শুনতে পেল বিদিশা।

আমি বিদিশা বলছি।

আরে বলুন, আপনার জন্য কী শিভারি দেখাতে পারি। হাসিখুশি গলায় বলল শেখর।

না, না, বড়সড় কোনও শিভারি দেখাতে হবে না। শুধু কাল অফিসে আধঘণ্টা আগে আসতে হবে–পারবেন?

না পারার কী আছে! কিন্তু কেসটা কী বলুন, তো, ম্যাডাম?

কাল বলব। মন-টন বেশ শক্ত করে আসবেন। নিজের অজান্তেই হাসি-ঠাট্টার মেজাজটা ফিরে পাচ্ছিল বিদিশা। মারুতি গাড়ির ঘটনাটা যেন মুছে গেছে ওর মন থেকে।

কেন, মন শক্ত করব কেন? আমার আপনার ক্লোজ ইয়ের মাঝখানে কোনও উটকো থার্ড পার্টি এসে গেছে নাকি? হেসে জিগ্যেস করল শেখর।

বিদিশাও পালটা ঠাট্টা করে জবাব দিল, সে তো বরাবরই আছে। আমাদের বোসদা। তা ছাড়া ফোর্থ পার্টিকেও তো আপনি চেনেন–মহান মহামান্য প্রশান্তলাল চক্রবর্তী।

ও-প্রান্তে জোর গলায় হেসে উঠল শেখর ও এতগুলো পার্টিকে আমি কেমন করে ঠেকাই বলুন তো, ম্যাডাম?

না, শেখর, সিরিয়াসলি বলছি। কাল আপনাকে অনেকগুলো জরুরি কথা বলব। একটু ইতস্তত করে বিদিশা আরও বলল, কিন্তু ভয় হচ্ছে, আপনি আমার জন্যে না বিপদে জড়িয়ে পড়েন…।

বিদিশার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা বলে উঠল, শেখর, বিপদ! মানে থ্রিল? আপনি তো জানেন, থ্রিলিং ব্যাপার আমার দারুণ লাগে। ঠিক ট্র্যাকে দৌড়োনোর মতো। কিন্তু এমনই কপাল, লাইফটা কেমন একঘেয়ে হয়ে গেছে। যাক, তবু আপনি একটু খ্রিলের ব্যবস্থা করেছেন। আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

কাল তা হলে আধঘণ্টা আগে আসছেন তো?

অতি অবশ্যই।

টেলিফোন সেরে নিয়ে চা শেষ করল বিদিশা। তারপর ক্লান্তভাবে শোয়ার ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। যদি ঘুম এসে যায় আসুক। মা ডেকে খাইয়ে দেবেন।

চোখে ঘুম নেমে আসার সময় বিদিশা রণজয়ের মারুতি গাড়িটা দেখতে পেল। তীব্র হ্যালোজেন হেডলাইট জ্বেলে খ্যাপা চিতাবাঘের মতো ভয়ংকর গতিতে ওকে লক্ষ করে ছুটে আসছে।

.

মঙ্গলবার গভীর রাতের দিকে মেঘের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বিদিশার। তারপর আর ভালো করে ঘুম আসেনি। তখন থেকেই অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই বৃষ্টি থেমেছে ভোর ছটায়। শ্রাবণে-শ্রাবণে ভেজা ভিজে কাকের ডাকে বিদিশা বুঝতে পেরেছে গাঢ় মেঘের আড়ালে ভোর হয়েছে।

বিছানা ছেড়ে ওঠা থেকে অফিসে বেরোনোর আগে পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থেকেছে বিদিশা। এই বুঝি টেলিফোনটা বেজে উঠল। কাল রাতের ভয়ানক পাগলটা এই বুঝি শুরু করল নতুন পাগলামি!

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও ফোন আসেনি।

অফিসে যাওয়ার সময় দিব্যি সহজভাবে অকুস্থলটা পেরিয়ে গেল বিদিশা। গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে হচ্ছিল যেন নিছকই কোনও স্বপ্ন। শুধু কাঠগোলাপ গাছটা থেকে খানিকটা দূরে ইটের পাঁজার সামনে ভাঙা কাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে রয়েছে। সেই চকচকে কাচের টুকরোগুলো বিদিশার স্বপ্নকে সত্যি করে দিচ্ছিল।

ঠিক আটাশ মিনিট আগে অফিসে ঢুকল বিদিশা। দেখল, শেখর নিজের চেয়ার-টেবিলে হাজির।

ওকে দেখে হাসল শেখর। বিদিশাও হাসতে পারল। সত্যি, অফিসটা ওকে বাঁচিয়ে রাখার কোরামিন জোগায়।

বনজারা সাদা ইউনিফর্ম পরে অফিস ফ্লোরে পায়চারি করছিল। বিদিশাকে দেখে সুপ্রভাত জানাল। ওর ডিউটি অফিস-টাইমের একঘণ্টা আগে থেকে। ও অফিস ঝাড়পোঁছের তদারকি করে। দরজা-জানলা ঠিকঠাকমতো খুলে দেয়। ফাইলপত্র আলমারি থেকে বের করে টেবিলে-টেবিলে সাজিয়ে দেয়।

শেখরকে ডেকে নিয়ে নিজের সিটের কাছে চলে গেল বিদিশা। সেখানে গুছিয়ে বসল দুজনে। সামনের টেবিলে টাইপ মেশিন, পাশে শর্টহ্যান্ডের খাতা আর পেনসিল।

বড় কাচের জানলা দিয়ে মেঘলা আলো এসে পড়েছে বিদিশার মুখে। ওকে বড় বিষণ্ণ অথচ সুন্দর লাগছিল।

শেখর, আপনারা কেউই জানেন না…আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বিদিশা এমনভাবে কথাটা বলল, যেন খবরের কাগজের খবর পড়ে শোনাচ্ছে।

শেখর বিদিশার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর কথাটা শোনার পর ভোলা জানলার দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ ধরে মেঘলা আকাশ দেখল। তারপর মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে টেবিলের ল্যামিনেটেড প্লাস্টিকের ডিজাইন দেখল কিছুক্ষণ। এক সময় মুখ তুলে তাকাল বিদিশার দিকেঃ তারপর? বলুন– আমি শুনছি।

বিদিশা বলতে শুরু করলসংক্ষেপে যেটুকু বলা যায় শেখরকে।

রণজয়কে ছেড়ে আসার পর তিনটে মাস এক অদ্ভূত যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছিল বিদিশার। ওর মনের ভেতরে চেনা আর অচেনা রণজয়কে নিয়ে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব চলছিল। হাজারবার জিগ্যেস করা সত্ত্বেও মাকে ও সব কথা খুলে বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল, ওর সঙ্গে আর থাকা যায় না, মা, কিছুতেই থাকা যায় না।

সেই ভয়ংকর রাতটার কথা মাকে বলেনি বিদিশা। কিন্তু মা যখন গালের কাটা দাগটা দেখিয়ে জিগ্যেস করেছিল, এ কী! কী করে কাটল?

বিদিশা কান্না চেপে বলেছিল, রণজয়…।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অরুণা আর কোনও কথা জিগ্যেস করতে পারেননি।

ওর জীবনে চরম ঘটনাটা ঘটেছিল নভেম্বরের শেষ দিকে। শীত তখন চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে।

রণজয় ফোন করেছিল, ওর হেড অফিসে প্রোডাকশন মিটিং না কী যেন আছে। তাই ফিরতে রাত হবে। বিদিশা ছোট্ট করে হুঁ বলেছিল।

তারপর যথারীতি সংসারের কাজ নিয়ে ডুবে গিয়েছিল। সন্ধের মুখে একবার মাকে ফোন করেছিল। বুঝতে পেরেছিল, তরুবালা আড়ি পেতেছিল। তবুও সাধারণ কয়েকটা কথাবার্তা বলেছিল মায়ের সঙ্গে।

রান্নাবান্না ইত্যাদির কাজ সেরে টিভি দেখতে বসেছিল বিদিশা। শুনতে পাচ্ছিল, নীচে তরুবালা টেপ রেকর্ডারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট শুনছেন। রণজয়ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালোবাসে।

তরুবালা এমব্রয়ডারি কাজ খুব ভালো পারেন। তার হাতের কয়েকটা কাজ বাঁধানো রয়েছে একতলা-দোতলার ঘরের দেওয়ালে। রণজয়ও অল্পস্বল্প এমব্রয়ডারির কাজ জানে। মায়ের হাতের কাজে প্রশংসায় ও সবসময় পঞ্চমুখ।

বিদিশা বুঝেছে, রণজয়ের ভেতরের অনেকটাই দখল করে রয়েছেন তরুবালা।

প্রথম-প্রথম বিদিশা নিজের মতামত স্পষ্ট করে জানাত। দরকার হলে তর্কও জুড়ে দিতে স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু ওকে থাপ্পর মারার সেই অস্বাভাবিক ঘটনার পর ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে একমত হওয়ার জন্য সবসময় প্রাণপণ চেষ্টা করত।

টিভি প্রোগ্রামটা ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল বিদিশার। তাই টিভি অফ করে ও চলে এসেছিল দোতলার ছোট্ট ঝুলবারান্দায়। নীচের গলিতে সন্ধেবেলার ব্যস্ততা। গলির মোড়ে তেলেভাজার দোকানে ভিড়। বড় রাস্তা দিয়ে হুসহুস করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।

একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল বিদিশা। ও ঘরে ফিরে এল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎই সাজতে শুরু করল।

তখনই ও লক্ষ করল, ড্রেসিং টেবিলে ধুলোর আস্তরণ।

সাজগোজ সংক্ষেপ করে ড্রেসিং টেবিলের ধুলো ঝাড়তে লেগে গেল বিদিশা। তারপরই ঘরটার অগোছালো অবস্থা চোখে পড়ল ওর। কোণের টেবিলে কয়েকটা ম্যাগাজিন ছড়ানো তার পাশে রণজয়ের এলোমেলো বইপত্র আর ফাইল। বিছানার চাদর অনেকদিন পালটানো হয়নি। পিলো কভারগুলোও বদলানো দরকার। আলনার জামাকাপড়গুলোও কীরকম বিচ্ছিরিভাবে অগোছালো হয়ে রয়েছে।

সুতরাং বিদিশা কাজে নেমে পড়ল।

সব কাজ শেষ করে ও যখন রণজয়ের ফাইলপত্রগুলো সাজিয়ে নিয়ে দেওয়ালের তাকে রাখতে যাচ্ছে তখনই ছোট মাপের মেডিকেল ফাইলটা নজরে পড়ল ওর।

বিদিশা প্রথম ভেবেছিল, ওটা বোধহয় রণজয়ের বাবার মেডিকেল ফাইল। এ-ফাইল এখানে কেন? তিনি মারা গেছেন প্রায় চার বছর। গ্যাসট্রিক, ডায়াবিটিস ইত্যাদি নানান রোগে ভুগতেন ভদ্রলোক। তরুবালার ঘরের দেওয়ালে তার ফটো আছে।

কিন্তু ফাইলের মলাট ওলটাতেই অবাক হয়ে গেল বিদিশা। প্রথম পৃষ্ঠাতেই পাওয়া গেল রোগীর নামঃ রণজয় সরকার।

কী অসুখ হয়েছে রণজয়ের?

ফাইলটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল বিদিশা। মেডিক্যাল রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের মতো একের পর এক ওলটাতে লাগল। বেশিরভাগটাই বুঝতে পারল না। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার জেনে ওর বেশ খটকা লাগল।

রণজয়ের মাথার খুলি সুষম নয়। লম্বালম্বি দুভাগ করলে বাঁ-দিকের অংশটা বেশ বড়। ওর মধ্যে আবেগের জটিলতা রয়েছে। ডাক্তারি ভাষায় লেখা যেসব টুকরো-টুকরো শব্দ বিদিশার নজর কাড়ল সেগুলো হল? মনস্ট্রাস প্যাথোলজিক্যাল ইনটেনসিফিকেশন অফ অ্যাবারেটেড সেনসুয়ালিটি, সাইকোপ্যাথিক স্টেট একসি, সাইকোনিউরোটিক টেন্ডেনসিস, অ্যালার্মিং ডিজঅর্ডার ইন দ্য ফ্রন্ট্রাল লোব অফ দ্য ব্রেইন।

এ কোন অসুখে ভুগছে রণজয়!

বিদিশা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। রণজয়ের মাথার ঠিক নেই, মনেরও ঠিক নেই!

এতদিন যেসব অদ্ভুত আচরণ বিদিশা লক্ষ করেছে, তার আসল কারণ তা হলে এই! এই কারণেই চেনা রণজয়ের ভেতর থেকে হঠাৎ-হঠাৎ অসুস্থ মনের অচেনা রণজয় বেরিয়ে আসে।

ভাবতে-ভাবতে সময় বয়ে যাচ্ছিল। কোনওদিকেই খেয়াল ছিল না বিদিশার। ও রণজয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন থেকে আজ পর্যন্ত সাতটা বছরের কথা ভাবছিল। ওদের গল্পটা কীভাবে শুরু হয়েছিল, আর এখন কীরকম অস্বাভাবিক বাঁক নিয়ে জটিল পথে এগিয়ে চলেছে।

নীচের সদরে কলিংবেলের শব্দ নিশ্চয়ই হয়ে থাকবে। বিদিশা সে শব্দ শুনতে পায়নি। তরুবালা নিশ্চয়ই দরজা খুলে দিয়েছেন। তাই চেনা পায়ের শব্দ উঠে এসেছে ওপরে। কিন্তু অন্যমনস্ক বিদিশা সেই শব্দটাও শুনতে পায়নি।

ব্যাপারটা ও টের পেল যখন রণজয় একেবারে ঘরে এসে ঢুকল।

এ কী! আমার কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছ কেন? বিরক্ত রণজয়ের ভুরু কুঁচকে গেছে। বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে মুখে। টিউব লাইটের আলোয় মুখটা কেমন ফ্যাকাসে রক্তহীন দেখাচ্ছে।

হাতের ব্রিফকেস নামিয়ে রাখল মেঝেতে। দুটো লম্বা পা ফেলে চলে এল বিদিশার কাছে। বাঁ-হাতে নিষ্ঠুরভাবে চেপে ধরল ওর চুলের গোছা। এক হ্যাঁচকায় ওকে চিতপাত করে দিল বিছানায়।

ততক্ষণে অচেনা রণজয় বেরিয়ে এসেছে চেনা রণজয়ের মুখোশের আড়াল থেকে। ওর দু-চোখ পাগলের চোখ হয়ে গেছে। সেই চোখজোড়া এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে মরিয়া হয়ে কী যেন খুঁজছে।

বিদিশার হাত থেকে খসে পড়ে গেছে গোপন মেডিকেল ফাইল। একটা আধো-আধো চিৎকার বোধহয় বেরিয়ে এসে থাকবে ওর ঠোঁট চিরে। এখন ওর চোখ দুটো বড়-বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

রণজয় দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি।

বিদিশার মাথা তখনও কাজ করছিল। ও বুঝল, তরুবালার কাছে অচেনা রণজয় অচেনা নয়।

আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কোনওদিনও তোমার…।

ডান হাতের এক ঘুসি এসে পড়ল বিদিশার মুখের ওপরে।

ঠোঁট কেটে গিয়ে জিভে নোনতা স্বাদ পেল ও। রণজয়ের বাঁ হাত তখনও ওর চুলের মুঠি ধরে রেখেছে। আর অদ্ভুত এক জান্তব শক্তিতে বিদিশাকে কাবু করে রেখেছে।

রণজয়ের পাগল চোখ অবশেষে খুঁজে পেল দরকারি জিনিসটা। বিদিশা লক্ষ করল, রণজয় অবশেষে তাকিয়েছে রান্নাঘরের দরজার দিকে।

চোখের পলকে এক নৃশংস হঁচকা টানে বিদিশাকে মেঝেতে পেড়ে ফেলল রণজয়। তারপর পাগলের মতো ছুটে গেল রান্নাঘরে। দু-এক সেকেন্ড পরেই ও যখন ফিরে এল, তখন ওর হাতে ধরা রয়েছে দশ ইঞ্চি লম্বা ফলার একটা চকচকে কিচেন নাইফ। তার ধারালো দিকটা করাতের মতো দাঁত কাটা।

ঝুঁকে পড়ে আবার বিদিশার চুলের মুঠি চেপে ধরল রণজয়। এক হ্যাঁচকা টানে ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে ছুরি চেপে ধরল ওর বাঁ গালে কানের খুব কাছে।

ফাকিং বিচ! দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল বিদিশার উন্মাদ স্বামী। তারপরই অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দিল।

ওই নোংরা কথাগুলো বলতে-বলতে ছুরিতে টান মারল ওর ডান হাত।

 বিদিশা এবার চিৎকার করে উঠতে পারল।

চিৎকারটা যখন মাঝপথে তখনই ওর টুটি চেপে ধরল রণজয়ের জঙ্গি ডান হাত।

বিদিশার দম আটকে গেল। চোখ বড়-বড় করে ও নিপ্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রণজয়ের বিকৃত মুখের দিকে। ওর চোখে পড়ল করাতের দাঁতওয়ালা ছুরির ফলাটা। চকচকে ফলায় সামান্য রক্ত লেগে আছে।

বিদিশা এইবার ছটফট করতে শুরু করল। কে-ই বা সহজে মরতে চায়। রণজয়ের মুখ ওর মুখের ওপরে অনেকটা নেমে এসেছে। লম্বা-লম্বা চুল ঝরে পড়েছে রণজয়ের কপালে চোখে। ওর দাঁত বেরিয়ে আছে হিংস্রভাবে। ঠোঁটে লালা। চেনা রণজয়ের মুখোশটা একেবারে সরে গেছে। সাইকিয়াট্রিস্ট-এর মন্তব্য মনে পড়ল বিদিশার : মনস্ট্রাস প্যাথোলজিক্যাল ইনটেনসিফিকেশন অফ অ্যাবারেটেড সেনসুয়ালিটি। এবং ওই মন্তব্যের অর্থ বোধহয় এই মুহূর্তে পুরোপুরি বুঝতে পারল ও।

আচমকা ওকে ছেড়ে দিল রণজয়। ছুরিটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগল। তারপর মেডিকেল ফাইলটা তুলে নিল বিছানার কাছ থেকে। ওটা নিজের ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে রেখে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ও। চোখ বুজে নিজের কপালে মাথায় হাত বোলাতে লাগল।

বিদিশা কাশতে কাশতে উঠে বসছে বিছানার। গলায় ভীষণ ব্যথা। বাঁ-গালে অসম্ভব জ্বালা করছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গলায়, কাঁধে, বুকে। তীব্র কান্না উঠে আসতে চাইছিল গলা দিয়ে, কিন্তু বিদিশা কাঁদতে পারছিল না। ওর চোখের সামনে একটা অশরীরী ছায়া উল্লাসে তাণ্ডব নৃত্য করছিল, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছিল, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল বারবার।

কিছুক্ষণ পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রণজয়। বিদিশার কাছে এসে পিঠে হাত রাখল। ক্লান্ত স্বরে বলল, মানু, আমি এক্সট্রিমলি সরি। ব্যাপারটা ভুলে যাও– একটু চুপ করে থেকে তারপর ও আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে খাওয়াও তো।

বিদিশার অবাক হওয়ার ক্ষমতা বোধহয় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই ও অবাক হল না। স্বামীর হুকুম তামিল করতে চলল। তারই ফাঁকে ও আঁচল চেপে ধরেছিল বাঁ-গালে, কিন্তু রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। তখন রান্নাঘরে গিয়ে একমুঠো চিনি চেপে ধরেছে ক্ষতস্থানে। মাথা ঝিমঝিম করলেও বিদিশা কাঠের তাক ধরে নিজেকে সামলে রেখেছিল–টলে পড়ে যায়নি।

তারপর দুটো ঘণ্টা যে কী ভয়ংকর জ্বালা-যন্ত্রণায় কেটেছে তা বিদিশা আজও ভুলতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে রাতের আঁধারে ও ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তখনই কোনও একটা দুর্বল মুহূর্তে ও ঠিক করেছিল, আর নয়। এই বন্দি জীবন আর নয়। সব জ্বালা-যন্ত্রণায় দাঁড়ি টানতে হবে।

অন্ধকারে বিছানা থেকে নেমে এসেছিল বিদিশা। আন্দাজে ভর করে টলতে টলতে চলে গিয়েছিল ওষুধের তাকের কাছে। হাতড়ে-হাতড়ে খুঁজে পেয়েছিল নির্দিষ্ট ওষুধের পাতাগুলো। টেনটেক্স ফোর্ট। চ্যাপটা গোল রুপোলি রঙের ট্যাবলেট। রোজ রাতে রণজয় একটা করে এই ট্যাবলেট খায়। এই ট্যাবলেট খেলে যৌন উত্তেজনা বাড়ে। রণজয়ের এই ট্যাবলেট কেন দরকার হয় তা বিদিশা জানে না। কিন্তু বিয়ের পরে রণজয়ই ওকে খুলে বলেছিল এই রুপোলি ট্যাবলেটের রহস্য। দশটা ট্যাবলেটের একটা পাতার দাম তেরো টাকা মতো।

যে কটা ট্যাবলেট পেল সবকটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল বিদিশা। আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করে মুঠোয় ধরা ট্যাবলেটগুলো অনেকক্ষণ ধরে দেখেছিল ও। পাতা ছিঁড়ে ট্যাবলেটগুলো যখন ও হাতের চেটোয় ঢালল তখন মনে হচ্ছিল ও বিশ-পঁচিশটা ক্যাডবেরি জেম্‌স খাচ্ছে। শুধু এগুলোর রং লাল-নীল নয়, রুপোলি।

বাথরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে ভেউভেউ করে কেঁদেছিল বিদিশা। মা, বাবা, বাপ্পার কথা মনে পড়ছিল। ওদের আর দেখতে পাবে না বিদিশা। কিন্তু একটু পরেই যে-ঘটনা ঘটবে তার জন্য নিজেকে ছাড়া আর কাকে দায়ী করবে ও। রণজয়ের সঙ্গে এই জীবন ও নিজেই বেছে নিয়েছিল। আজ এই মৃত্যু ও নিজেই বেছে নিচ্ছে।

কল থেকে মগে করে জল নিয়ে মুখে ঢালল ও। তারপর একে-একে সবকটা ট্যাবলেট ঢেলে দিল মুখে। বারবার জল খেল।

ট্যাবলেটগুলো খাওয়া শেষ করে বাথরুমের ভেজা মেঝেতে বসে পড়ল বিদিশা। পেটটা ভার লাগছে। গাল জ্বালা করছে। মাথা টং হয়ে আছে।

হঠাৎই বিদিশা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল বাচ্চা মেয়ের মতো। তারই মধ্যে ও টের পাচ্ছিল, বুকের ভেতরে একটা কষ্ট হচ্ছে। আর মাথার ঝিমঝিম ভাবটা যেন বাড়ছে।

খুব আবছাভাবে বিদিশা টের পেরেছিল বাথরুমের বন্ধ দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। সত্যি, না ওর মনের ভুল? এর পর আর কিছুই ওর মনে নেই।

.

দেড়দিন পর বিদিশার জ্ঞান ফিয়েছিল সুকিয়া স্ট্রিটের সিটি নার্সিং হোম-এ। চোখ খুলতেই ও মা-বাবা আর রণজয়কে দেখতে পেয়েছিল। মুহূর্তে বিদিশার চোখে জল এসে গিয়েছিল। অশরীরী ছায়াটা তার নাচ থামিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে।

নার্সিং হোমের চিকিৎসা আর যত্নে আটদিনেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল বিদিশা। মা-বাবাকে বলে ও চলে এসেছিল সল্ট লেকে। অরুণা-সুধাময় তখনকার মতো রণজয়কে বুঝিয়েছিলেন, মানসিক আঘাতটা সামলে উঠলেই ও মানিকতলায় চলে যাবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আয় হয়নি। বিদিশা প্রচণ্ড একরোখা জেদ ধরেছিল, সল্ট লেক ছেড়ে ও কোথাও যাবে না। অরুণার সঙ্গে এ নিয়ে বেশ মন কষাকষি হয়েছিল। কিন্তু বিদিশা সরাসরি সুধাময়কে একদিন প্রশ্ন করেছিল, বাপি, তোমার হাতে বেড়ে ওঠা রক্তকরবী গাছটাকে কেউ যদি রোজ টেনে মুচড়ে ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তুমি কী করবে?

সুধাময় কেঁদে ফেলেছিলেন এ কথায়। তার লম্বা কাঠামো নুয়ে পড়েছিল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, আমি সারাজীবন বহু কষ্ট করেছি, মানু। কখনও ঘুষ নিইনি, কখনও ঘুষ দিইনি। আর তোকে আমি বলব ঘুষ দিয়ে ভালোবাসা আদায় করতে! অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা মানেই তো ঘুষ দেওয়া! তুই আমাদের চোখের সামনে থাকবি। এ বাড়িতে তোর অধিকার কিছু কম নয়।

বাবাকে টপ করে একটু চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল বিদিশার। কিন্তু কী করবে! এখন তো আর ও সেই ছোট্টটি নেই।

সেইদিন থেকে সল্ট লেকে অভয়ারণ্য খুঁজে পেয়েছিল বিদিশা।

বেশ মনে পড়ে, রণজয় দু-চারবার যাতায়াত করেছিল ওদের বাড়িতে। ওকে দেখতে এসেছিল। ওর সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেছিল। মানিকতলায় ফিরে যাওয়ার জন্যে অনুরোধও করেছিল।

কিন্তু বিদিশা টলে যায়নি। রণজয়ের সঙ্গে ওর ভালোবাসার স্মৃতিগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে চাপা দিয়েছিল বিপজ্জনক মারাত্মক সব স্মৃতি। করাতের দাঁতওয়ালা লম্বা ছুরিটা ও সবসময় চোখের সামনে দেখতে পেত।

এর পর রণজয় প্রায় মাসছয়েক চুপচাপ হয়ে যায়। কোনও যোগাযোগ করেনি, কোনও চিঠি দেয়নি, একটা টেলিফোনও করেনি।

তারপর হঠাত্ একদিন ও ফোন করেছে সুধাময়কে। ফোন করে লিগাল সেপারেশন চেয়েছে। একই ব্যাপারে অরুণাকেও ফোন করেছে রণজয়। কথাবার্তা ঢিমে তেতালায় হলেও এগিয়েছে। সেসব শুনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বিদিশা। আর অরুণা মাঝে-মাঝেই জেদী মেয়েকে বোঝাতে চেয়েছেন ধর্মের কথা।

বিদিশা ধর্মের কথা শোনেনি। শোনার মতো মনের অবস্থা ওর ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ও সামলে নিতে পেরেছিল। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শর্টহ্যান্ড আর টাইপ শিখতে শুরু করেছিল। কয়েক বছর আগে বিভিন্ন পরীক্ষার ফাঁকে-ফাঁকে শর্টহ্যান্ড-টাইপ নিয়ে ও বেশ কিছুটা এগিয়েছিল। এখন তীব্র প্রয়োজনে সেই পুরোনো চর্চাটাকে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরল।

সুধাময়ের যোগাযোগ আর চেষ্টায় ইন নামের এই ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্সি ফার্মে স্টেনোগ্রাফার কাম-টাইপিস্টের চাকরি পেয়েছে বিদিশা। আর একইসঙ্গে ওর জীবনের ছবিটা একটু একটু করে বদলে গেছে। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া জীবন আবার স্মিত হেসে তাকিয়েছে ওর দিকে।

এখন, ওর সেই নতুন বাঁচার জায়গায় বসে, শেখরকে নিজের কথা বলছিল বিদিশা।

রণজয়ের সঙ্গে ওর সম্পর্কের সব কথা অরুণা কিংবা সুধাময়কে খুলে বলেনি বিদিশা। তাই শেখরকেও বলল অনেক রেখে-ঢেকে রণজয়ের অস্বাভাবিক মনের কথা বলল, বলল ওর বাঁ-গালের কাটা দাগের ইতিহাস, আর আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টার কথা।

সব কথা বলতে বলতে বিদিশার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সেটা লক্ষ করে শেখর বলল, ম্যাডাম, এখন চোখের জল ফেলার সময় নয়–চোখের জল মুছে নেওয়ার সময়।

বিদিশা চোখ মুখে নিল রুমালে। তারপর গতকাল রাতের ঘটনা বলল।

রণজয় আমাকে ছাড়বে না, শেখর। যেভাবেই হোক, ওর মাথায় এখন ঢুকেছে আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। ও যখন-তখন যা খুশি করে ফেলতে পারে।

অফিসে লোকজন আসতে শুরু করেছে। ম্যানেজার পি. এল. চক্রবর্তী একবার এসে বিদিশাকে গুড মর্নিং বলে গেছেন। চায়ের ট্রলি এসে গেছে ফ্লোরে।

দেবলীনা হঠাৎ এসে দাঁড়াল বিদিশার টেবিলের কাছে। বলল, কাল দারুণ দুটো চুড়িদার কিনেছি। ভীষণ ব্রাইট রং। লাঞ্চের সময় এসো, দেখাব।

দেবলীনার ছিপছিপে ফরসা চেহারা। চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। ছাই রঙের ওপরে সাদা কালোয় কাজ করা একটা চুড়িদারে ওকে বেশ মানিয়েছে। বিদিশাকে ও প্রায়ই শাড়ি ছেড়ে চুড়িদার পরতে বলে। তা হলে নাকি বিদিশাকে আরও সুন্দর দেখাবে।

এই প্রস্তাবের কথা জানতে পেরে বোসদা পান চিবোতে-চিবোতে বলেছিলেন, না, মা জননী, তুমি চুড়িদার পোরো না। তাহলে আমার আর চরিত্র বলে কিছু থাকবে না। এমনিতেই শাড়ি পরে তোমাকে যা ফ্যান্টা লাগে! আমি তো সবাইকে স্পষ্ট করেই বলি? আমি তোমাকে দেখতেই রোজ অফিসে আসি। হাসলেন বোসদা? তা হলেই বোঝে। এর ওপর তুমি যদি চুড়িদার ধরো তাহলে আমাদের মতো বুড়োগুলো কী ধরবে।

বোসদা, প্লিজ… কপট অস্বস্তিতে বলে উঠেছে বিদিশা : ঠোঁটে কুলুপ লাগান।

ঠোঁট থেকে পানের রস মুছে নিয়ে সুধীর বোস মজা করে বলেছিলেন, আমার তো যত রস ঠোঁটেই, মা জননী! সেখানে কী করে গোদরেজের তালা লাগাই!

দেবলীনা রিসেপশন কাউন্টারের দিকে চলে যেতে না যেতেই চায়ের কাপ হাতে বোসদা এসে হাজির। হাসি হাসি মুখ। টাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বোঝা যায়, এই মাত্র অফিসে ঢুকেছেন।

আপনাদের কাছে এগোনো যাবে? না কি কালকের মতো এজ বার আছে?

না, না। আসুন, চেয়ার টেনে নিয়ে বসুন– হাসিমুখে বোসদাকে আমন্ত্রণ জানাল বিদিশা।

বোসদা চোখ সামান্য কুঁচকে বিদিশাকে লক্ষ করেছিলেন। হঠাৎই সিরিয়াসভাবে মন্তব্য করলেন, মা জননী, তোমার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পাচ্ছি। সকাল-সকাল মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল।

এমন সময় সিনিয়ার ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সৌমেন পাল বোসদাকে এসে ডাকলেন, মিস্টার বোস, একটু আসবেন? আজই একটা আরজেন্ট ড্রয়িং পাঠানোর আছে। আপনার সঙ্গে একটু ডিসকাস করতে হবে।

পরে কথা বলব। ছোটভাই, তুমি দ্যাখো, ম্যাডামের প্রবলেম সলভ করতে পারো কি না– বলে বোসদা চায়ের কাপ হাতেই চলে গেলেন।

শেখর বলল, বলুন, ম্যাডাম, আমার থেকে আপনি কী হেল্প চান?

বিদিশা দিশেহারাভাবে বলল, সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

 থানায় ডায়েরি করতে চান?

না, না– চকিতে মাথা নাড়ল বিদিশা, ওতে অনেক জল ঘোলা হবে, স্ক্যান্ডাল হবে।

তা হলে আপনি কী করতে চান?

বিদিশা চিন্তিত গলায় বলল, সেটাই বুঝতে পারছি না। রণজয় সবসময় আমাকে ফলো করছে। সেটা শোনার পর থেকেই আমার ভয় করছে।

এমন সময় বনজারা এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল বিদিশাকে। শেখর দেখল, সাধারণ একটা ইনল্যান্ড লেটার।

এখন তা হলে যাই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শেখর, পরে এ-নিয়ে কথা বলব।

বিদিশা ঘাড় নেড়ে চিঠিটা দেখতে শুরু করল। শেখর রওনা হল নিজের সিটের দিকে।

 চিঠিটা কে পাঠিয়েছে তা ওপরে লেখা নেই। তবে হাতের লেখাটা বেশ চেনা!

ইনল্যান্ড লেটারটা খুলে ফেলল বিদিশা। তিন পৃষ্ঠা জোড়া বিশাল চিঠি। চিঠির শেষে রণজয়ের নাম লেখা রয়েছে।

বিদিশা ওর খুব চেনা বাংলা হরফগুলোর ওপরে চোখ বোলাতে শুরু করল।

রণজয়ের লেখা প্রেমজর্জর চিঠি। অনেক ভালোবাসা, অনেক দুঃখ-কষ্টের কথা বলা আছে। চিঠিতে। নির্লিপ্তিভাবে চিঠিটা পড়ল বিদিশা। ওর রক্তে নতুন কোনও স্রোত তৈরি হল না।

চিঠির শেষ দিকে রণজয় লিখেছে?

…তোমার সন্তান এখনও আমাকে বাবা বলে ডাকতে চায়। আর আমি তোমাকে বউ বলে ডাকতে চাই, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে চাই। এখনও সময় আছে ফিরে এসো। তা না হলে ফল খুব খারাপ হবে। অ্যাকোয়া রিজিয়া-র নাম শুনেছ? না, সুলতানা রিজিয়ার কোনও আত্মীয় নন ইনি। গাঢ় নাইট্রিক অ্যাসিড আর হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড মিশিয়ে তৈরি এক মারাত্মক অ্যাসিড। সোনাও গলিয়ে দিতে পারে অতি সহজে। এই অ্যাসিড ভরা বা তোমার মুখে ছুঁড়ে মারলে তোমার ওই সোনার মতো রঙের কী হাল হবে বুঝতে পারছ?
তাই তোমার পায়ে ধরে বলছি, মানু, ফিরে এসো। আমাকে খারাপ হয়ে যেতে দিয়ো না, লক্ষ্মীটি।

বিদিশার চিঠি ধরা হাত তিরতির করে কাঁপতে লাগল। চিঠিটা কোনওরকমে ড্রয়ারে রেখে দিয়ে ও টেবিলে মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কী করবে এখন ও? কী করা যায়?

জটিল দুশ্চিন্তার মধ্যে অফিসের সময়টা ধীরে-ধীরে কাটতে লাগল। তারই মধ্যে শেখর অন্তত বারতিনেক বলেছে, ম্যাডাম, আমাকে কী করতে হবে বলবেন কিন্তু।

লাঞ্চের পর শেখরের সিটের কাছে বসে ওর সঙ্গে গল্প করছিল বিদিশা। কথা বলতে বলতে ও ভাবছিল, শেখরকে ওর বিপজ্জনক জীবনের সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে কি না।

শেখর ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করল। বিদিশার দিকে বইটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই বইটা পড়ে দেখুন। একটা সাইকোপ্যাথের কাণ্ডকারখানা। ভীষণ থ্রিলিং।

বিদিশা পেপারব্যাকটা হাতে নিয়ে দেখল। বইটার নাম ইয়র্কশায়ার রিপার। ব্যাক কভার পড়ে বুঝল, ছুরি দিয়ে একের পর এক মহিলা খুনের ঘটনা।

আবার সিরিয়াল কিলার? আপনার কি টেস্ট বলে কিছু নেই। বিদিশা বইটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল।

শেখর হেসে জবাব দিল, টিভিতে যেসব বাংলা সিরিয়াল হয় তার চেয়ে সিরিয়াল কিলার ফার বেটার। তাছাড়া, রণজয়বাবুর কেসটাও বোধহয় অনেকটা এই টাইপের। সত্যি, আপনার লাইফটা কী থ্রিলিং!

বিদিশা অবাক হয়ে শেখরকে দেখল ও আমি দিনরাত দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে গেলাম, আর আপনি বলছেন আমার লাইফটা কী থ্রিলিং! আপনি হেল্প করবেন বলছিলেন…আপনি পারবেন আমার এই থ্রিল ট্যাক্স করতে? আমি থ্রিল চাই না–আমি শান্তিতে বাঁচতে চাই।

শেখর বিদিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। বলল, আমি ট্যাক্স করলে আপনার ওই মিস্টার হাজব্যান্ড হুউশ করে হাওয়া হয়ে যাবে। আমি ট্র্যাকে দৌড়োনো স্পোর্টসম্যান। এটা অফিস

তাইনা হলে আপনাকে এখনই বাইসেপ ট্রাইসেপ দেখিয়ে দিতাম।

আমি কিন্তু ইয়ারকি করছি না, সিরিয়াসলি বলছি।

আমিও সিরিয়াসলি বলছি। আজ আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।

সত্যি! বিদিশা শেখরের কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।

সত্যি! আশ্বাসের হাসি হাসল শেখর। সত্যিকারের সহকর্মীর হাসি।

বিদিশাও হাসল–নির্ভর করতে পারার হাসি।

আর তখনই অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে বোসদা এগিয়ে এলেন শেখরের টেবিলের কাছে। যথারীতি পানের রসে ঠোঁট লাল।

জড়ানো গলায় বোসদা বললেন, সেনভায়াকে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?

শেখর হেসে বলল, এত ফরমালিটির কী আছে? বলুন—

বোসদা সামান্য ঝুঁকে পড়লেন শেখরের মুখের কাছে ও বলতে পারো সেনভায়া, সেনসেক্স মানে কী?

শেখর বোসদার অশ্লীল ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। ওটা সেনসিটিভ ইনডেক্স না কী যেন–ঠিক জানি না।

তাই বলো। সেনসেক্স ওয়ার্ডটা শুনে আমি ভাবতাম শুধু বুঝি বদ্যিদেরই সেক্স আছে, আর কারও নেই. চলে যাওয়ার আগে বোসদা বিদিশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, কিছু মনে করলে না তো, মা জননী। সেনভায়া বড় ভালো ছেলে…তবে মাঝে-মাঝে নুন দিয়ে লুচি খায়…।

বোসদা চলে যেতে বিদিশা শেখরের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, নুন দিয়ে লুচি খাওয়ার মানে?

ও কিচ্ছু নয়, বোসদার বাজে ইয়ারকি। শুনুন, আমি তা হলে আজ থেকে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।

বিদিশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। এই মুহূর্ত থেকেই ও যেন অনেকটা ভরসা পাচ্ছে।

শেখরের কাছ থেকে উঠে চলে যাওয়ার আগে বিদিশা বলল, একটু আগে রণজয়ের একটা চিঠি পেয়েছি–অফিসের ঠিকানায়। পরে আপনাকে দেখাব। আমার মুখে অ্যাসিড বা ছুঁড়ে মারার হুমকি দিয়েছে।

শেখর শুধু বলল, ওসবে পাত্তা দেবেন না–আমি আছি।

বিদিশা নিজের টেবিলে ফিরে আসছিল, অশোক চন্দ্র ওকে ডাকল, ম্যাডাম, আপনার ফোন।

বিদিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ডানদিকের দেওয়ালের কাছে অশোক টেলিফোনের রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

বিদিশা ওর কাছে গিয়ে ফোন ধরল।

 হ্যালো।

কেমন আছ, মানু? রণজয়।

রাগে জ্বলে উঠল বিদিশা : তোমাকে বলেছি না যে অফিসে এভাবে ফোন করবে না। তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই, কোনও সম্পর্ক নেই। আমি…।

ও-প্রান্তে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রণজয়। ধরা গলায় বলল, আমার কষ্টটা তুমি কেন বুঝতে চাও না বলো, তো! আমি যে একা-একা শেষ হয়ে গেলাম।

বিদিশা বাঁকা সুরে বলল, একা কেন? তোমার মা তো রয়েছে।

রণজয় কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, সেইজন্যেই তো কষ্ট আরও বেশি। দেখা হলে তোমাকে সব বলব। কাল রাতে তো সে কথাই বলতে চেয়েছিলাম, তুমি হঠাৎ অকারণে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলে। আজ তোমার সময় হবে? অফিস ছুটির পর দেখা করতে পারবে?

বিদিশার কৌতূহল হচ্ছিল। তাই ও দ্বিধায় পড়ে গেল। তরুবালার সঙ্গে কী হয়েছে রণজয়ের? ঝগড়াঝাটি? কী নিয়ে? বিদিশার চলে যাওয়া নিয়ে?

ও-প্রান্ত থেকে রণজয় অধৈর্য হয়ে উঠল, মানু, একটিবার আমার সঙ্গে দেখা করো। তুমি পাশে না থাকলে আমি কেমন করে সেরে উঠব? কেমন করে আবার ভালোবাসব তোমাকে?

বিদিশা ঠিক করল, রণজয়ের সঙ্গে দেখা করবে–তবে শেখর সঙ্গে থাকবে। শেখর সঙ্গে থাকলে ও ওই ভয়ংকর মানুষটার সঙ্গে দেখা করার জোর পাবে।

ঠিক আছে। কোথায় দেখা করবে বলো– বিদিশা ঠান্ডা গলায় বলল।

মানু, মানু, আই লাভ য়ু, লাভ– উত্তেজনায় রণজয়ের গলা কাঁপছে ও সি. এ. পি. ক্যাম্প বাস স্টপে আমি সাতটার সময় তোমার জন্যে ওয়েট করব। তুমি আসবে তো?

আসব– বিদিশা ইচ্ছে করেই শেখরের কথা বলল না। রণজয়কে ও একটা মানসিক ধাক্কা দিতে চায়।

আমি…আমি তোমাকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছি…অফিসের ঠিকানায়…।

জানি। একটা আজ পেয়েছি।

চিঠির খারাপ কথাগুলো ধোরো না, মানু। ওগুলো রাগের মাথায় লিখেছি।

বিদিশা কোনও জবাব দিল না।

রণজয় আবার কথা বলল চাপা গলায়, মানু, চিঠি পড়ে তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না। তোমার সঙ্গে দেখা হলে সব বুঝিয়ে বলব।

ঠিক আছে। এখন তা হলে রাখছি। সন্ধে সাতটায়, সি.এ.পি. ক্যাম্প বাস স্টপে।

টেলিফোন রেখে দিয়ে শেখরের টেবিলের কাছে গেল বিদিশা। অচেনা একজন ভিজিটর ওর টেবিলে বসে টেকনিক্যাল কথাবার্তা বলছিল। বিদিশা ইশারায় ডাকল ওকে।

শেখর উঠে কাছে আসতেই বিদিশা নীচু গলায় বলল, আজ সন্ধে সাতটায় আমার ডেঞ্জারাস এক্স-হাজব্যান্ডের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব। সাবধান থাকবেন…।

শেখর হেসে বলল, দারুণ থ্রিলিং ব্যাপার হবে। আপনার হাজব্যান্ড এক্স হোক আর ওয়াই হোক–আই ডোন্ট মাইন্ড। কিন্তু আপনার কাছে যা শুনেছি, যদি হঠাৎ করে ভদ্রলোক খেপে উঠে আপনাকে অ্যাটাক করেন?

বিদিশা সিরিয়াস চোখে তাকাল শেখরের দিকে আপনি কী করতে চান?

 শেখরও সিরিয়াস গলায় বলল, আপনি যা হুকুম করবেন।

বিদিশা ঠান্ডা স্বরে বলল, দেন হিট হিম–।

আই উইল লাভ টু। সাংঘাতিক থ্রিলিং ব্যাপার হবে।

.

সেই সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার এতটুকু কমেনি। মাঝে-মাঝে খাপছাড়াভাবে দু-তিনবার বৃষ্টি হয়েছে। বিদিশা আর শেখর যখন সি.এ.পি. ক্যাম্প বাস স্টপে এসে নামল তখন বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু আকাশে কোনও চঁদ-তারা নজরে পড়ছিল না। বরং খানিকটা লালচে আভা দেখা যাচ্ছিল।

বাস থেকে নামার আগেই ওরা ঠিক করেছিল ওরা অচেনা লোকের মতো বাসের দুই দরজা দিয়ে নামবে। নেমে শেখর বিদিশার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যাবে। দূর থেকেই ও বিদিশার ওপরে লক্ষ রাখবে। রণজয়ের সঙ্গে বিদিশার ব্যক্তিগত কথাবার্তার মাঝে ও থাকতে চায় না।

শেখর পিছনের দরজা দিয়ে নেমে সোজা রাস্তা পেরিয়ে চলে গেছে উলটো দিকের বাস স্টপে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ-সাতজন মানুষের মাঝে গা-ঢাকা দিয়েছে। ওর হাতঘড়িতে তখন সাতটা বেজে ছমিনিট।

বাসটা চলে যেতেই রাস্তার ওপারে বিদিশাকে দেখতে পেল শেখর। একা-একা দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ দেখছে। রণজয়কে খুঁজছে।

যখন ওরা প্রায় অধের্য হয়ে উঠেছে তখন পাখির খাঁচার পিছন থেকে একটা ছায়ার মতো মানুষ ইতস্তত পায়ে এগিয়ে এল বিদিশার কাছাকাছি।

বিদিশা, আমি এসেছি।

 চমকে বাঁ দিকে মুখ ঘোরাল বিদিশা।

করুণ মুখে ফরসা রোগা চেহারার রণজয় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে কেমন দ্বিধা, ইতস্তত ভাব, যেন কোনও অপরিচিত তরুণীর সঙ্গে আলাপ জমাতে এসেছে।

কী বলবে বলো– বিদিশা পাথরের মতো গলায় বলল।

চারদিকে দেখল রণজয়। এই জায়গাটায় তেমন আলো-টালো নেই। কিন্তু এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

রণজয় বলল, এখানে নয়, মানু…ওদিকটায় চলো। আঙুল তুলে সি. এ. পি. ক্যাম্প স্টপেজ থেকে বাঁ দিকে এ. ই. ব্লকের দিকে চলে যাওয়া নির্জন রাস্তাটা দেখাল ও।

বিদিশার ভেতরে কেমন একটা টেনশন শুরু হল। ওর চোখ রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা শেখরকে খুঁজল।

এমন সময় আচমকা ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। বিদিশা চটপট ছাতা খুলে মাথায় দিল। কিন্তু রণজয়ের সঙ্গে ছাতা ছিল না। ও নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।

রণজয় আরও কাছে এগিয়ে এল। ওর সারা মুখ ভিজে চকচক করছে। চুল লেপটে আছে ফরসা কপালে। বৃষ্টির ফোঁটায় ওর মুখ খানিকটা ঝাপসা দেখাচ্ছে।

ওকে দেখে বিদিশার মায়া হল। ও রণজয়কে ছাতার তলায় ডাকল, বৃষ্টিতে ভিজো না। এসো।

রণজয় ওর লেডিজ ছাতার নীচে চলে এল। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানোমাত্রই ও বিদিশার গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল : মানু..মানু…।

বিদিশা প্রতিক্রিয়ায় গাল সরিয়ে নিল। ও রণজয়কে ছাতার নীচে আসতে বলেছে মানবিকতা বোধ থেকে, ভালোবাসার টানে নয়।

ওর অবাক লাগছিল। কী সহজে ভালোবাসা মরে যায়। এক সময় এই পুরুষটা ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালে বিদিশা ভেতরে-ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেত, শরীর পিচ্ছিল হয়ে উঠত।

আর এখন! ওর প্রতিটি রোমকূপ সতর্ক হয়ে রয়েছে বিপদের আশঙ্কায়।

বৃষ্টির ফোঁটা ছাতায় আছড়ে পড়ার তুমুল শব্দ হচ্ছিল। ছাতার রডের গা দিয়ে জল পড়ছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে। রণজয়ের ভেজা শরীর বিদিশার পোশাক ভিজিয়ে দিচ্ছিল।

রণজয় ওর হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ওদিকটায় চলো।

বিদিশা ওর আঙুলের জোর টের পেল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে শেখরকে শেষবারের মতো খুঁজতে চেষ্টা করল। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটার ধোঁয়াটে পরদা সরিয়ে ও কিছুই দেখতে পেল না।

নির্জন এলাকা থেকে আরও নির্জন এলাকায় ঢুকে পড়েছিল ওরা দুজনে।

সামনেটা বেশ অন্ধকার। বাড়িগুলোও বর্ষার ঘোমটায় মুখ ঢেকেছে। দু-একটা খালি জমিতে বর্ষায় বেড়ে ওঠা গাছপালা আর আগাছার জঙ্গল। বিচিত্র আকারের অর্ধেক তৈরি একটা বাড়ি অন্ধকারে কবন্ধের মতো দাঁড়িয়ে।

মানু, তোমাকে আমি অনেক চিঠি লিখেছি..রোজ তুমি অফিসে গেলেই একটা করে আমার চিঠি পাবে…।

বিদিশা কোনও উত্তর দিল না।

বৃষ্টির তেজ হঠাৎই কমে এল। আর রণজয়ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ।

মানু, মুখটা তুলে আমার দিকে একবার তাকাও।

রণজয়ের কথায় এমন কিছু ছিল যে, বিদিশা ভয় পেয়ে গেল। ও চোখ নামিয়ে বৃষ্টির খই-ফোঁটা ভিজে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল।

আচমকা ছাতাটা টান মেরে ছিটকে ফেলে দিল রণজয়। বিদিশা অসহায়ভাবে ভিজতে লাগল। রণজয় তো আগেই ভিজে স্নান। সেই অবস্থায় ও হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল বিদিশার পায়ের কাছে। জাপটে ধরল বিদিশার ভিজে লেপটে যাওয়া শাড়ি, সেই সঙ্গে বিদিশাকে।

আমি তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, মানু। তোমাকে ফিরে না পেলে আমি মরে যাব। কথা বলতে বলতে রণজয় মুখ ঘষছিল বিদিশার ঊরুতে। টের পাচ্ছিল, বিদিশার কোমল ভিজে শরীর, ভালোবাসার থরথর করে কাঁপছে।

আসলে বিদিশা ভয়ে কাঁপছিল। আর দমবন্ধ করে মরিয়া হয়ে শেখরকে খুজছিল বারবার।

রণজয়ের জড়ানো স্বর তখনও ভেসে আসছিল বিদিশার কোমরের কাছ থেকে : তোমাকে ফিরে না পেলে আমি শেষ হয়ে যাব, মানু…।

বিদিশার গা ঘিনঘিন করছিল। শরীরটা কাঠ। ও কোনওরকমে বলল, সেটা আর কিছুতেই সম্ভব নয়…।

চাবুকের মতো এক ঘটকায় উঠে দাঁড়াল রণজয়। বাঁ হাতের থাবায় চেপে ধরল বিদিশার গলা। ওর চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। মুখ বেঁকেচুরে বদলে গেছে। অচেনা রণজয় বেরিয়ে এসেছে নির্জন বৃষ্টিভেজা রাস্তায়।

চাপা হিংস্র গলায় রণজয় বলে উঠল, ফাকিং বিচ!

বিদিশার গলায় অসহ্য ব্যথা করছিল। মাথায়, মুখে, শরীরে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে ও মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিল। কী বোকার মতোই না ও রণজয়ের কথার ফাঁদে পা দিয়েছে। এই জানোয়ারটা একটুও বদলায়নি, বদলাতে পারে না।

গলার ওপরে আঙুলের চাপ বাড়ছিল। বিদিশার মুখ দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরোনোর উপায় নেই। রণজয় শক্ত হাতে ওর টুটি টিপে ধরেছে।

বৃষ্টি অনেক ফিকে হয়ে এসেছিল। আকুল হয়ে সি. এ. পি. ক্যাম্প স্টপেজের পাখির খাঁচার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিদিশা এক দীর্ঘ ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেল। ছাতা মাথায় লম্বা-লম্বা পা ফেলে সে এগিয়ে আসছে। মাঝে-মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে অন্ধকারে কিছু একটা ঠাহর করতে চাইছে।

বিদিশা বেশ বুঝতে পারছিল, চিৎকার করে কোনও লাভ নেই। আর ওর কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো ওর ভয়ংকর স্বামীকে দেখতে বাধ্য হচ্ছিল।

বাঁ হাতে শক্ত করে ওর গলা খামচে রেখে ডান হাতে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় কষাল রণজয়।

বিদিশা চোখে সরষে ফুল দেখল। তার পরই চোখের সামনে একটা কালো পরদা নেমে এল যেন। মুখের বাঁ দিকটা অসহ্য যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে মাথা ধরে গেল। ঠোঁটে নোনা স্বাদ পেল ও। এই অন্ধকার বৃষ্টিভেজা রাতে ও কি রণজয়ের হাতে খতম হয়ে যাবে?

শেখর সেনের কথা মনে পড়ল : .যদি হঠাৎ করে ভদ্রলোক খেপে উঠে আপনাকে অ্যাটাক করেন?

আপনি কী করতে চান?

আপনি যা হুকুম করবেন।

 দেন হিট হিম–

শেখর সেন যখন স্বামী-স্ত্রীকে দেখতে পেল তখন বিদিশার শরীরটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। আর ফরসা রোগা একটা বদ্ধ উন্মাদ তখনও হিংস্রভাবে বাঁ হাতে খামচে ধরে আছে বিদিশার গলা।

আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। শেখরের মাথার ভেতরেও। অন্ধকার এ. ই. ব্লকের রাস্তাটা চোখের সামনে টালিগঞ্জের ভোরবেলার রাস্তা হয়ে গেল। যে-রাস্তায় শেখর প্রতিদিন ভোরবেলা দৌড়োয়।

অনেক কষ্টে একঘেয়ে জীবনে খ্রিল দেখা দিয়েছে। শেখরের মনে পড়ল মাই লাইফ উইথ নাইফ, ইয়র্কশায়ার রিপার-এর কথা। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে থ্রিল নেমে এসেছে বাস্তবের রাস্তায়। এ-সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

হাতের ছাতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছুটতে শুরু করল শেখর। আবছায়া অবয়বের অমানুষটা তখন বিদিশাকে পেড়ে ফেলেছে পথের ওপরে। দু-হাতে ওর শাড়ি-জামাকাপড় ধরে টানছে। আর আপনমনেই চিৎকার করে কীসব বলছে। শেখরের মাথায় সে-সব তখন একবর্ণও ঢুকছিল না।

ছুটতে ছুটতে লোকটার প্রায় ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল শেখর। সপাটে এক লাথি চালাল লোকটার কোমরে। লোকটা খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ল, কিন্তু বিদিশার শাড়ির আঁচল তখনও তার মুঠোয় ধরা।

শেখর আনন্দে টগবগ করে ফুটছিল। বইয়ের পাতা শেষ পর্যন্ত তা হলে সত্যি হল!

 ও পড়ে যাওয়া রণজয়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে না পড়ে ওর একটা পা চেপে ধরল। তারপর ওর দেহটা হিড়হিড় করে টানতে লাগল পিচের রাস্তায় ওপরে।

শেখরের মাথার ভেতরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছিল বারবার। আর ঝিম্ফাক মিউজিক বাজছিল। রণজয়ের পলকা শরীরটাকে নিয়ে ও দিশেহারার মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল রাস্তার এদিক-সেদিক।

এক সময় ও থামল। হাঁফাতে-হাঁফাতে ঝুঁকে পড়ল রণজয়ের ওপরে। বাঁ-হাতে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল ওকে। তারপর ওর কেটে-ছেড়ে যাওয়া মুখে ডান হাতের এক ভয়ংকর ঘুষি বসিয়ে দিল।

আঁক শব্দ করে উঠল রণজয়। ওর নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। শেখর পর-পর আরও তিনটে ঘুষি চালাল। চুলের মুঠি ধরে থাকা মাথাটা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল তিনবার।

শেখর শুনতে পাচ্ছিল, ওর কানের ভেতরে কে যেন বারবার বলছে, দেন হিট হিম। দেন হিট হিম, দেন হিট হিম… আর শেখর সেই অলৌকিক নির্দেশের প্রতিটি শব্দ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করছিল।

ক্লান্ত শেখর আহত রণজয়কে একসময় ছেড়ে দিল। বৃষ্টি তখন আরও জোরে নেমেছে।

শেখর একপলক অন্যমনস্ক হয়ে ঘুরে তাকিয়েছিল দুরে রাস্তায় পড়ে থাকা বিদিশার দিকে। সেই ফাঁকে রণজয় কোথা থেকে একটা লুকোনো ছুরি বের করে নিমেষে চালিয়ে দিল শেখরের মুখ লক্ষ করে।

ঠিক সেই সময়ে হেডলাইট জ্বেলে একটা গাড়ি বাঁক দিয়েছিল এ. ই. ব্লকের দিকে। গাড়িটার আলো রণজয়ের মুখে এসে পড়েছিল, আর শেখরের পিঠ-কাঁধ গাঢ় ছায়া ফেলেছিল রণজয়ের শরীরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ছুরিটা চালিয়েছিল রণজয়।

নেহাতই প্রতিবর্তী ক্রিয়ার বশে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল শেখর। তাই ছুরির ফলা ওর গলা আর ঘাড়ে রক্তাক্ত আঁচড় টেনে দিল। শেখর আহত জন্তুর মতো গনগনে রাগে রণজয়ের দু-পায়ের ফাঁকে এক মারাত্মক লাথি কষিয়ে দিল।

রণজয় চকিতে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু লাথিটা পুরোপুরি এড়াতে পারল না।

ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসা গাড়িটার হেডলাইটের আলোয় রণজয়ের রক্তমাখা মুখ ফ্যাকাসে লাগছিল। ও গাড়িটার দিকে একবার তাকিয়েই খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ছুটে পালাল অন্ধকারে। ওকে তাড়া করতে গিয়ে শেখর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। ওর গলা বেয়ে তখন দরদর করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ওই জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যেও শেখর থ্রিলের কথা ভাবছিল, বিদিশার কথা ভাবছিল।

জ্ঞান হারানোর আগে শেখর দেখল, গাড়িটা ওর কাছটিতে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেছে। দুজন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। কেউ যেন ওকে বহুদূর থেকে জিগ্যেস করছে, কী ব্যাপার, দাদা? কী হয়েছে?

আর একজন যেন কোথা থেকে বলে উঠল, মনে হয় ছিনতাইয়ের কেস।

কথাবার্তার শব্দ ক্রমেই বাড়ছিল।

কে যেন হুড়হুড় করে খানিকটা ঠান্ডা জল ঢেলে দিল শেখরের মুখে। ও চমকে চোখ মেলে তাকাল। এ কী! ও রাস্তায় পড়ে কেন? এই অন্ধকারে বৃষ্টিতে ও কী করছে? গলার পাশটা জ্বালা করছে। কয়েকটা ছায়া-ছায়া মুখ ঝুঁকে রয়েছে ওর শরীরের ওপরে।

তাড়াতাড়ি উঠে বসল শেখর। আর তখনই ওর রণজয়ের ব্যাপারটা মনে পড়ল। ও পকেট থেকে রুমাল বের করে চেপে ধরল গলায়। কয়েকটা হাত ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল।

উঠে দাঁড়িয়ে বিদিশাকে দেখতে পেল শেখর। ছাতা দুটো কুড়িয়ে নিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেল। নানাজনের প্রশ্নের উত্তরে ছিনতাইয়ের চেষ্টার কথাই বলল শেখর। কেন যেন মনে হল, রণজয়ের ব্যাপারটা বলে ফেলা ঠিক হবে না।

বিদিশাকে কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। দু-চোখে ভয় আর উৎকণ্ঠা। ঠোঁটের কোণে রক্তের দাগ। ও জিগ্যেস করল, আপনার লাগেনি তো, শেখর!

শেখর বলল, চিন্তা করবেন না। তেমন কিছু নয়।

দু-চারজন পরামর্শ দিল একটু ফার্স্ট এইড সেরে নেওয়ার জন্য। কে যেন একটা সাইকেল রিকশা ডেকে ওদের তুলে দিল। বলল, কোয়ালিটি স্টপেজের পাশে ওষুধের দোকান আছে। ওখানে দেখিয়ে নিন। আর পুলিশে একটা ডায়েরি করে দেবেন। এদিকটায় ছিনতাই বড্ড বেড়েছে।

রিকশা যখন চলতে শুরু করেছে তখন পিছন থেকে টুকরো একটা মন্তব্য ওদের কানে এল ও এই অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে কেউ কখনও এখানে প্রেম করতে আসে।

উত্তরে একজন বলল, না, না–ওরা আপনি করে কথা বলছিল…।

 রাখুন, রাখুন। ও-সব লোকঠকানো প্যাঁচ পুরোনো হয়ে গেছে…।

রিকশা কালো রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল।

.

লাঞ্চের পর সুধীর বোস খড়কে দিয়ে দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে শেখরের টেবিলের কাছে এলেন। সেখানে বিদিশা আর দেবলীনা দাঁড়িয়ে ছিল। আর একটা চেয়ারে বসে ছিল অশোক। লাঞ্চের পর আধঘণ্টাটাক অফিসের মেজাজটা একটু ঢিলেঢালা থাকে।

বোসদা এসেই ঘোষণা করলেন, শুনেছ শেখরভায়া, আমাদের অফিসে শক্তিশালী জয়েন করেছে।

শক্তিশালী মানে? একটু অবাক হয়ে শেখর জিগ্যেস করল। ওর গলার বাঁ দিকটায় স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। এখন আর তেমন ব্যথা নেই।

বোসদা হাসলেন : তোমাদের কি সমাস-টমাস কিছুই পড়ানো হয়নি! শক্তিশালীর ব্যাসবাক্য হল, শক্তিপ্রসাদের শালি। আমাদের এম.ডি.-র পি.এ. শক্তিপ্রাসাদের শালি আজ থেকে কোম্পানিতে জয়েন করেছে।

শেখর হাসল। দেবলীনা আর বিদিশাও।

অশোক হেসে বলল, তো আপনার এত হিংসে কেন? আপনিও আপনার শালিকে এখানে ঢুকিয়ে দিন না–।

সুধীর বোস চোখ ছোট করে হেসে বললেন, আমার শালিকে আমি কোথায় ঢোকাব সেটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও না বাবা!

আপনার সঙ্গে না কথা বলা যায় না, বোসদা– বলে হাসি চেপে উঠে চলে গেল অশোক।

বোসদা কপট বিস্ময়ে তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কী খারাপ কথাটা বললাম। তুমিই বলো, জননী বিদিশার দিকে ফিরে বললেন বোসদা।

বোসদা, প্লিজ… প্রায় আবেদনের গলায় বলল বিদিশা।

দেবলীনা বলল, আমি সিটে যাই। নইলে পি. এল. চক্রবর্তী আবার ঝামেলা করবে।

ও চলে যেতেই বোসদা বললেন, দেবলীনা পালের একটাই বড় ডিফেক্ট, বড় লাজুক।, ভাই, তোমরা গপ্পো করো, আমি নীচ থেকে ঝট করে একটা পান খেয়ে আসি বলে দাঁত খুঁটতে-খুঁটতে সুধীর বোস চলে গেলেন।

অশোকের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটা দেখিয়ে শেখর বিদিশাকে বসতে বলল। তারপর জিগ্যেস করল, এখন কেমন আছেন?

সারাদিনে এই প্রথম ওরা আলাদা কথা বলতে পারছে।

বিদিশার ঠোঁটের কোণ, গাল ফুলে আছে। ঠোঁটের কোণে ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ছে। ফরসা গলায় কালচে দাগ। আজ তেমন করে সাজগোজ করেনি ও। চোখে বিষাদ আর অনিশ্চয়তার ছায়া।

আমি ঠিক আছি। একটু থেমে : আপনি?

হাসল শেখর। ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ইংরেজি পেপারব্যাক বের করল। বলল, আমি কাল সকালের মতোই থ্রিল খুঁজে বেড়াচ্ছি। নিন, এই বইটা দেখুন, ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন…।

বিদিশা বইটার নাম দেখল ও ইন্টারভিউ উইথ দ্য ভ্যাম্পায়ার। তারপর মাথা নেড়ে না বলল। তারপর একটু সময় নিয়ে জিগ্যেস করল, সত্যি ঠিক আছেন? আমার খারাপ লাগছে। শুধু শুধু নিজের ঝামেলায় আপনাকে জড়ালাম…।

বিদিশার সাহস শেখরকে হতবাক করে দিয়েছিল। ও চাপা গলায় বলল, ঝামেলার আর কী আছে! কাল হোঁচট খেয়ে ওরকম পড়ে না গেলে আপনার এক্স হাজব্যান্ডকে চন্দ্রবিন্দু করে ছেড়ে দিতাম। একটু থেমে তারপর ও আমার কথা বাদ দিন। আমি তো সবসময় থ্রিল খুঁজে বেড়াই। কিন্তু আপনার ভয় করে না?

বিদিশা কাচের চোখে শেখরের দিকে তাকিয়ে বলল, না। কাল রাতের পর আমার সমস্ত ভয় পাওয়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে।

কথাটা বিদিশা মিথ্যে বলেনি।

কাল রাতে এক ডিসপেনসারি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে ওষুধ নেওয়ার পর বিদিশাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল শেখর।

সারাটা পথ বিদিশা কোনও কথা বলেনি। শুধু একবার বিড়বিড় করে বলেছে, রণজয় আমাকে বাঁচতে দেবে না। হয় ও, নয় আমি–যে-কোনও একজন থাকবে।

শেখর আগে কখনও বিদিশাদের বাড়ি আসেনি। বিদিশা কখনও আসার কথা বলেনি। কারণ, শেখর তখন ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানত না। এখন সবকিছু পালটে গেছে। তাই রাত সাড়ে আটটা নাগাদ যখন ওরা দুজনে অরুণা-সুধাময়-এ পৌঁছোল তখন বিস্ময়, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

অনেক প্রশ্ন, অনেক আলোচনা, অনেক কথা কাটাকাটি। রণজয়ের কাছ থেকে বিপদের ব্যাপারটা যে কত মারাত্মক হতে পারে সেটা অরুণা কিছুতেই বুঝতে চাইছিলেন না। তখন শেখর জামা সরিয়ে নিজের ক্ষতচিহ্নটা দেখাল। অরুণা কথার মাঝখানেই চুপ করে গেলেন। বুঝতে পারলেন, শেখর শেষের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সুধাময় পুলিশে ফোন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অরুণা বললেন, ফোন করে তরুবালাকে সব জানাতে। বদ্ধ পাগল ছেলে কী ভয়ংকর পাগলামিতে মেতে উঠেছে সেটা মায়ের জানা দরকার। বাপ্পা রণজয়কে ফোন করে সরাসরি হুমকি দিতে বলল। বিদিশা হতাশায় কাঁদতে লাগল। আর এ-বাড়িতে প্রথম অতিথি শেখর বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর গলার পাশটা ব্যথা করছে। সামান্য চিনচিনে জ্বালাও করছে।

কী আশ্চর্য! আর-একটু হলেই শেখরের থ্রিল-খোঁজা জীবন খতম হয়ে যেতে পারত, অথচ শেখরের মনে ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। বরং অল্পের জন্য রণজয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ওর আপশোশ হচ্ছিল।

একটু পরেই বিদিশা যখন কথা বলল, তখন ও একেবারে অন্য মানুষ।

 সুধাময়-অরুণা বারবার বলেছিলেন যে, ওর কিছুদিন অফিসে না যাওয়াই ভালো। বিপদটা কেটে যাক, তারপর দেখা যাবে।

উত্তরে বিদিশা রুক্ষ গলায় বলে উঠল, এ-বিপদ কোনওদিন কাটবে না। যেদিন আমি অফিসে যাওয়া শুরু করব সেদিনই আবার বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া বাড়িতে বসে থাকলেই যে কোনও বিপদ হবে না তার কী মানে আছে! যে মানুষটার মাথার গণ্ডগোল সে কখনও সুবিধে-অসুবিধে ভেবে কাজ করে নাকি? আমি কাল অফিসে যাব। আমাকে ভয় পেতে দেখলেই রণজয় আরও পেয়ে বসবে।

বহু তর্কবিতর্ক করেও বিদিশাকে টলানো গেল না। শেখরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল। অরুণা অনেক কান্নাকাটি করলেন, কিন্তু বিদিশার একরোখা জেদকে হারাতে পারলেন না।

বিদিশাদের পারিবারিক ব্যাপারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখরের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। ও বাড়িতে একটা ফোন করে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। এখন দ্বিতীয়বার ফোন করে বলল, এখনই রওনা হচ্ছে।

ও চলে আসার আগে বিদিশা ছোট্ট করে জিগ্যেস করেছিল, কাল অফিসে আসছেন তো?

অফ কোর্স। জবাব দিয়েছিল শেখর, আমি অফিসে না এলে আপনাকে সেলি বাড়িতে পৌঁছে দেবে কে?

উত্তরে ম্লান হেসেছিল বিদিশা। পৃথিবীটা এখনও রণজয়রা কিনে নিতে পারেনি…শেখররাও আছে।

.

শেখর বলল, আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোবেন। আপনাদের বাড়ির কাছটা বেশ অন্ধকার। সন্ধে পার হলেই লোকজন ফিকে হয়ে আসে।

কয়েক মুহূর্ত ভেবে বিদিশা সায় দিল, বলল, তা হলে আধঘণ্টা আগে বেরোব।

ঠিক তখনই পি. এল. চক্রবর্তী কোথা থেকে যেন প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বিদিশার পিঠে হাত দিয়ে তাগাদা দিতে-দিতে বললেন, অ্যাই, বিদিশা, চলো, চলো। খুব জরুরি কয়েকটা ডিকটেশন দেওয়ার আছে।

বিদিশা কুঁকড়ে সরে গেল চক্রবর্তীসাহেবের সুযোগসন্ধানী হাতের আওতা থেকে। উঠে দাঁড়াল চট করে।

প্রশান্ত চক্রবর্তীর স্বভাবটাই এইরকম। সবসময় ছোঁকছোঁক করে বেড়ান। বিদিশার শরীরের যেখানে-সেখানে যৌনতা খুঁজে বেড়ান। বিদিশার গা ঘিনঘিন করে। এই লোকটাও রণজয়ের চেয়ে কম অসুস্থ নয়। শুধু রোগ-লক্ষণগুলো অন্যরকম।

চোখের ইশারায় শেখরকে আসছি বলল বিদিশা। দেখল শেখরের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ও চক্রবর্তীসাহেবের অসভ্যতায় ভেতরে-ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।

পি. এল. চক্রবর্তীর ডিকটেশন আর গায়ে-পড়া গালগল্পের হাত থেকে বিদিশা রেহাই পেল প্রায় ঘণ্টা-দেড়েক পর। নিজের টেবিলে ফিরে ও চিঠিগুলো টাইপ করতে বসবে, দেখল ওর টেবিলে একটা ইনল্যান্ড লেটার পড়ে আছে।

চেয়ারে গুছিয়ে বসে চিঠিটা খুলল বিদিশা।

যা ভেবেছিল তাই। রণজয়ের চিঠি। সেই একঘেয়ে কাঁদুনিঃ তুমি ফিরে এসো। আর চিঠির শেষ দিকে নির্লজ্জভাবে নোংরা ভালোবাসার কথা লেখা রয়েছে। সেই সঙ্গে কঁচা হাতের রেখায় আঁকা নারী-পুরুষের মিলনের ছবি।

রাগে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে লিটার বিনে ফেলে দিল বিদিশা। শরীরে ও কেমন এক অসহ্য জ্বালা টের পাচ্ছিল। ওর শান্তশিষ্ট জীবনটা একটা ভয়ংকর জন্তু কীরকম তছনছ করে দিচ্ছে।

বিদিশা আনমনাভাবে ভোলা জানলার দিকে তাকাল। আকাশে গাঢ় মেঘ। কিন্তু কোথাও কোথাও নীলের আভাস। আর কতদিন থাকবে এই মেঘ? লুকিয়ে থাকা নীলের জন্য আকুল হল বিদিশা।

বিদিশা কতক্ষণ যে ও-ভাবে বসে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎই দেখল, বঞ্জারা ওর টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

ম্যাডাম, আপনার ফোন আছে।

বিদিশা উঠে দাঁড়াল। রোবটের মতো নিপ্রাণ পায়ে এগিয়ে গেল টেলিফোনের দিকে। ও জানে, এই টেলিফোনটা কে করেছে। কিন্তু এত দেরি হল কেন? আরও অনেক আগে এই ফোনটা আসা উচিত ছিল।

হ্যালো টেলিফোনে যান্ত্রিক স্বরে কথা বলল বিদিশা।

কাল রাতের ওই শুয়োরের বাচ্চাটা কে? ক্ষিপ্ত রণজয়ের কথা ফেটে পড়ল রিসিভারে।

বিদিশা একটা ধাক্কা খেল। ভাবল, রিসিভার নামিয়ে রাখবে। কিন্তু তার পরই একটা তীব্র জেদ আর রাগ ফুটতে শুরু করল ওর মাথার ভেতরে। না, হার মানবে না বিদিশা। ও এই অসভ্য পাগলটার মোকাবিলা করবে।

ছোটলোকের মতো কথা বোলো না। এটা অফিস। এখানে ভদ্রলোকেরা কাজ করে। চাপা ধমকের সুরে বলল বিদিশা।

ও-প্রান্তে আসল রণজয়নোংরা হাসি। বলল, তুমি কি ভেবেছ ওই ভাড়া করা জানোয়ারটা তোমাকে বাঁচাতে পারবে! আমি ওটাকে খতম করে দেব। কেটে টুকরো-টুকরো করে ভাসিয়ে দেব মানিকতলার খালে। তারপর তোমাকে চৌরাস্তায় ন্যাংটো করে…।

চুপ করো। বদ্ধ পাগল কোথাকার বিদিশা হিসহিস করে বলল।

মানু, আমি তোমাকে কতবার বলেছি…।

রণজয়ের কথার ওপরে কথা বলল বিদিশা, তুমি একটা আস্ত পাগল। তোমার মাথার ভেতরে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে আছে। তোমার পাগলামি তোমার মা সহ্য করতে পারে–সেখানে গিয়ে পাগলামি করো–আমার সে-দায় নেই।

মানু– মিষ্টি করে বলল রণজয়, তোমাকে আমি ছাড়ব না, কিছুতেই ছাড়ব না। মিষ্টি সুরে বলল, কিন্তু সেই মুহূর্তে রণজয়ের মুখটা দেখলে বিদিশা ভয় পেত।

তুমি আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। নইলে আমি থানা-পুলিশ করতে বাধ্য হব। তোমার মতো ছোটলোক পাগলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আমি রাখতে চাই না। তুমি তোমার মাকে নিয়েই থাকো। তোমরা দুজনেই তো অ্যাবনরমাল-ফলে দিব্যি সুখে থাকতে পারবে…।

একইভাবে রণজয় আবার বলল, মানু, তোমাকে আমি ছাড়ব না…।

 এবং লাইন কেটে দিল।

হঠাৎই বিদিশার শরীরের ভেতরে যেন লোডশেডিং হয়ে গেল। টলে পড়ে যেতে গিয়েও ও একটা থাম ধরে সামলে নিল। তারপর থামটার হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

সুধীর বোস তার ড্রাফটিং টেবিল থেকে ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন। তিনি প্রায় ছুটে এসে বিদিশাকে হাত ধরে কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। কোথা থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে ধরলেন বিদিশার মুখের সামনে। বললেন, মা জননী, একচুমুক জল খেয়ে নাও, ভালো লাগবে…।

বিদিশা চোখ বুজে চেয়ারে গা এলিয়ে ছিল। বোসদার কথায় গ্লাসের জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল। বোসদাকে ওর ভীষণ ভালো লাগছিল। মনে পড়ল, সকালে এই মানুষটাই ওর আর শেখরের আঘাত আর ক্ষতচিহ্ন লক্ষ করে মন্তব্য করেছিলেন, তোমরা কি অফিসের পর ফ্রি স্টাইল কুস্তি লড়তে গিয়েছিলে নাকি? বয়েসকালে আমিও ওরকম অনেক কুস্তি লড়েছি। তা আমাকেও সঙ্গে নিতে পারতেনিদেনপক্ষে না হয় রেফারি হতাম। তারপর দিলখোলা হেসে শেখরকে বলেছেন, শেখর, সত্যি-সত্যি বলো তো, কী করে চোট পেলে?

শেখর মনগড়া একটা সাফাই দিয়েছে। বিদিশাও তাই। কিন্তু এখন চোখ খুলে ও দেখল, বোসদা স্নেহমাখানো উৎকণ্ঠায় ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে।

শেখরও কাছে এগিয়ে এসেছিল। ওর আশেপাশে আরও কয়েকজন।

এত মানুষের ভিড় দেখে বিদিশা কেমন অস্বস্তি পেয়ে গেল। ও আলতো গলায় বলল, এখন অনেকটা ভালো লাগছে… তারপর ধীরে-ধীরে উঠে ফিরে গেল নিজের সিটে।

শেখর, বোসদা ও আরও দুজন সহকর্মী বিদিশার সঙ্গে-সঙ্গে যাচ্ছিল। বিদিশা ক্লান্ত গলায় বলল, আপনাদের আসার দরকার নেই। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল…এখন ঠিক আছি…আমি একটু একা থাকতে চাই…।

ওরা আর এগোল না। শেখর শুধু বলল, ছুটির পর আপনার সঙ্গে বেরোব–।

বিদিশা ফিরে না তাকিয়েই ঘাড় নড়ল–অর্থাৎ, ঠিক আছে।

নিজের সিটে এসে ক্লান্তভাবে টেবিলে মাথা নামিয়ে রাখল বিদিশা। রণজয়ের হিংস্র মুখটা ও দেখতে পেল। কী শান্তভাবেই না বাঁচতে চেয়েছিল বিদিশা। অথচ এই অসুস্থ বিকারগ্রস্ত লোকটা ওর জীবনকে নরক করে তুলেছে। বিদিশা কি পালটা জবাব দিতে পারে না ওকে? তিল-তিল টেনশনের ভয়ংকর বিষ কি ও ছড়িয়ে দিতে পারে না ওই অমানুষটার জীবনেও?

বিদিশার বারবারই মনে হচ্ছিল, রুখে দাঁড়ানো দরকার। এইবার রুখে দাঁড়ানো দরকার।

চোখ বুজে থাকা সেই ঘোরের মধ্যে বিদিশা হিংস্র পশুটার গলা শুনতে পেল : মানু, তোমাকে আমি ছাড়ব না।

.

ভোরবেলা থেকেই মিহিদানার মতো বৃষ্টি পড়ছিল। ভোরের আকাশ আর ঘড়ির কাটায় কোনও মিল ছিল না। কিন্তু রোজকার অভ্যেস মতো সুধাময়ের জৈবিক-ঘড়ি তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল সাড়ে পাঁচটার সময়ে। নিয়মমাফিক কাজ সেরে সুধাময় বেরিয়ে এসেছেন বাইরের বাগানে। কোণের একটা ঘর থেকে বাগান পরিচর্যার দু-একটি যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে এসেছেন তার প্রিয় গাছপালার কাছে। বর্ষার জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা সবুজ পাতার দল তাকে মাথা নেড়ে সুপ্রভাত জানাল। সুধাময় হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন ওদের কাছে।

সুধাময়ের পরনে লুঙি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি। তাঁর কাধ আর বাহু দেখলেই শরীরের শক্ত কাঠামো টের পাওয়া যায়। হাতের পিঠে আর কবজির কাছে দড়ির মতো ফুলে রয়েছে শিরা উপশিরা। মাথার কঁচাপাকা চুলে আর চশমার পুরু লেন্সের কাছে বৃষ্টির মিহি গুঁড়ো লেগে আছে। অথচ সেদিকে কোনও খেয়ালই নেই তার। কারণ, তিনি তখন শ্বেত করবী গাছের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আর একইসঙ্গে গাছ কাটার বড় কাঁচি নিয়ে করবী গাছের বেপরোয়া বেড়ে ওঠা ডালপালা হেঁটে মানানসই করে দিচ্ছিলেন।

একটা সিগারেটের জন্য তার ঠোঁটে গলায় কেমন তেষ্টা জাগছিল, কিন্তু সুধাময় চেষ্টা করে সেটা সামাল দিচ্ছিলেন। কয়েকবছর ধরে হাঁপের টানে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। সেই কারণেই রোজকার সিগারেটের অভ্যাস সাংঘাতিকভাবে কমিয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে আছে, মনের সঙ্গে মোকাবিলায় পেরে না উঠলে এই নেশাটা একেবারে ছেড়েই দেবেন।

এখন তোর ফুলের দিকে মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই–তোর শরীরের দিকে মন দে। শরীর না থাকলে ফুল ফোঁটাবি কী করে? আপনমনে কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সুধাময়ের কঁচি চলছিল।

শ্বেত করবীর পর চারটে দোপাটি গাছ। একটাতেও ফুল নেই, শুধুই সবুজ পাতা। বর্ষায় কোঁকড়া-ঝকড়া হয়ে বেড়ে উঠেছে।

তোরা দেখছি পাতাবাহার গাছ হয়ে গেলি! অবশ্য কী করে ফুল দিবি! এখন তো ঠিক ফুলের সময় নয়।

হাতের কাঁচি রেখে সুধাময় গাছের পাতার ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে লালচে-সবুজ ডালগুলো খুব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। এই সময়ে নজর না রাখলে একরকম সাদা-সাদা পোকা হয়।

পোকা খুঁজতে খুঁজতেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লোহার গেটের দিকে চোখ গেল তাঁর। গেটের বাইরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

গাছের পাতার আড়াল থেকে মাথা বের করে নিয়ে এলেন সুধাময়। সকাল ছটায়। এ কোন অতিথি এসে হাজির হল!

বাতাসে ভেসে বেড়ানো বৃষ্টির কুচির পরদা ডিঙিয়ে অতিথিকে চিনে নিতে অসুবিধে হল না।

রণজয় সরকার–তাঁর জামাই। একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোহার গেটের কাছে। বাঁ হাতের নখ দাঁতে কাটছে।

আরে, তুমি! এসো, এসো–এই সাতসকালে হঠাৎ–।

ভোরবেলাতেই লোহার গেটের তালা খুলে দেন সুধাময়। তাই গেট ঠেলে ভেতর ঢুকতে কোনও অসুবিধে হল না রণজয়ের।

ওর পরনে গাঢ় নীল জিনস্-এর প্যান্ট, হলুদ রঙের ঢোলা টি-শার্ট।

হালকা চালে সুধাময়ের কাছে চলে এল রণজয় ও সাতসকালে গাছের যত্ন নিচ্ছেন?

সুধাময় বসেই ছিলেন। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখছিলেন রণজয়কে। এই কাকভোরে কী জন্য এসেছে ছেলেটা? কোনও বদ মতলব নিয়ে আসেনি তো? হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে না। কে জানে, হয়তো অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছে মানুর কাছে।

রণজয়ের মুখ হঠাৎ বিষণ্ণ হল। দু-হাত একসঙ্গে জড়ো করে মাথা নীচু করে নিজের জুতোর দিকে তাকাল ও। নরম গলায় বলল, কাল সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। আপনাদের কাছে।

আমি মরমে মরে আছি। আপনি…আপনি আমাকে…।

ঠিক আছে..ঠিক আছে…যাও, ভেতরে যাও। মানু বোধহয় এখনও ঘুমোচ্ছে..।

ছেলেটার চোখে জল। ওর রোগা ফরসা মুখে গাঢ় বিষণ্ণতা মাখানো। সুধাময়ের ভীষণ মায়া হচ্ছিল।

আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, বাবা– বলে ঝুঁকে পড়ে সুধাময়ের পায়ের ধুলো নিল রণজয়।

থাক, থাক– ওকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন সুধাময়। কিন্তু তিনি লক্ষ করেননি, রণজয় যখন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন ওর হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটা ধারালো হেঁসো। আগাছা পরিষ্কার করার জন্য সুধাময়ই ওটা নিয়ে এসেছিলেন কোণের ঘর থেকে।

রণজয়ের নিষ্ঠুর বাঁ-হাত চেপে ধরল সুধাময়ের চুলের মুঠি। এক হ্যাঁচকায় তার মাথাটাকে হেলিয়ে দিল পিছনে। পলকের জন্য সুধাময় দেখতে পেলেন মেঘলা আকাশের পটভূমিতে রণজয়ের বিকৃত মুখ ওর দু-চোখের লালসা, আর তীব্র বাঁকা পথে তার গলা লক্ষ করে নেমে আসা হেঁসোটা।

চিৎকার করতে পারলেন না সুধাময়। কিন্তু তার চিৎকারের চেষ্টাটা বুদ্ধুদের মতো বেরিয়ে এল গলার ফাঁক দিয়ে। আর রক্ত ছিটকে গিয়ে ছাপ ফেলল রণজয়ের জিন্স-পরা প্যান্টে।

তার প্রিয় গাছপালার পাশে চিত হয়ে পড়ে গেলেন সুধাময়। তার সামান্য হাঁ হয়ে থাকা মুখে বৃষ্টির কণা ঢুকে পড়ছিল। বাতাসে ছটফট করতে করতে গাছের পাতাগুলো ভীষণ অবাক হয়ে বারবার সুধাময়কে জিগ্যেস করছিল, তোমার কী হল গো? কী হল তোমার? অমন চুপ করে অবাক চোখে তাকিয়ে কী দেখছ? কিন্তু সুধাময় ওদের আর্ত প্রশ্ন শুনতে পাচ্ছিলেন না।

রণজয় হেঁসোটা ফেলে দিল সুধাময়ের দেহের পাশে। তারপর অত্যন্ত সহজ হালকা পায়ে দু-ধাপ সিঁড়ি উঠে চলে এল মোজেইক করা বারান্দায়। সদর দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে ছিল, রণজয় সতর্ক হাতে সেটা ঠেলে ঢুকে পড়ল বিদিশাদের বাড়ির ভেতরে। তারপর দরজা লক করে ছিটকিনি এঁটে দিল।

বাড়ির ভেতরটা নিঝুম…আবছায়া অন্ধকার। একে মেঘলা, তার ওপর সব কটা জানলাতেই পরদা টানা। কিন্তু এ বাড়ির ভূগোল রণজয়ের নিজের হাতের চেটোর মতোই চেনা। তাই ও বেড়ালের মতো পা ফেলে এগিয়ে গেল বিদিশার ঘরের দিকে। মানু কোথায়?

বিদিশার ঘরের দরজাটা বন্ধ। এখনও ও ঘুম থেকে ওঠেনি।

তার পরের ঘরটাই অরুণা-সুধাময়ের। অবশ্য এখন থেকে শুধুই অরুণার। সেই ঘরের দরজা স্বাভাবিকভাবেই ভোলা। সুতরাং শাশুড়ির ঘরে ঢুকে পড়ল রণজয়।

অরুণা তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। তবে হালকা ঘুমের মধ্যে সামান্য এপাশ-ওপাশ করছিলেন। রণজয় ওর ডান হাতটা কলারের পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল পিঠে। তারপর ঢোলা টি শার্টের ভেতর থেকে টেনে বের করে নিয়ে এল খবরের কাগজে ভালো করে মোড়া লম্বা মতো একটা কী যেন। ব্যস্ত হাতে মোড়কের কাগজগুলো খুলে ফেলে দিতেই করাতের দাঁতওয়ালা একটা ঝকঝকে ছুরি দেখা গেল। সেটা ডান হাতে বাগিয়ে ধরে অরুণাকে ধাক্কা মারল রণজয়।

আচমকা রুক্ষ ধাক্কায় চমকে জেগে উঠলেন অরুণা। ঘুম জড়ানো চোখে যা দেখলেন তা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মুখের ভেতরটা কেমন শুকিয়ে গিয়ে জিভটা খসখস করছে। বুঝতে পারলেন, চিৎকারের চেষ্টা করে লাভ নেই, কারণ কোনও শব্দ বেরোবে না তার গলা দিয়ে। আর এ-ও বুঝতে পারলেন, কোন রণজয়কে দেখে বিদিশা এতদিন ভয় পেয়েছে।

রণজয়ের চোখে পাগলের দৃষ্টি, মুখে হাসি, হাতে করাতের দাঁতওয়ালা ছুরি। ও ঠান্ডা গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই। মানুকে ডাকুন।

সুধাময়ের জন্য দুশ্চিন্তা হল অরুণার। মানুষটাতো বাইরে গাছগাছালি নিয়ে থাকার কথা। এখনও সেখানে আছে তো? ওকে কিছু করেনি তো রণজয়!

অরুণাকে এক হ্যাঁচকায় বিছানা থেকে টেনে নামাল রণজয়। তারপর একইরকম শান্ত গলায় বলল, মানুকে ডাকুন।

বিস্রস্ত পোশাক ঠিক করতে করতে বিদিশার ঘরের দরজায় এলেন অরুণা। দরজায় ধাক্কা দিয়ে মেয়েকে নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। অনেকক্ষণ পর ঘুম জড়ানো গলায় সাড়া দিল বিদিশা।

অরুণার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ছিল। সাতসকালের এই অদ্ভুত ঘটনা তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মুখের ভেতরে জিভ নড়ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিলেন কথা বলার চেষ্টা করলে কথা জড়িয়ে যাবে।

বিদিশা দরজা খুলল। রণজয়কে দেখেই ওর ফরসা মুখ পলকে রক্তহীন হয়ে গেল। ও আকুল আর্ত চোখে অরুণার দিকে তাকাল। যেন বোঝাতে চাইল, ওদের আর কিছু করার নেই। একটা ভয়ংকর বিষধর পাগল সরীসৃপ ধারালো দাঁত নিয়ে হাজির হয়েছে পাখির খাঁচায়। কামড় সে দেবেই।

অরুণাকে এক ঝটকায় পাশে ঠেলে দিল রণজয়। অদ্ভুত এক তৎপরতায় বিদিশাকে টেনে নিল কাছে। চাপা গলায় অস্বাভাবিক সুরে হিসহিস করে বলল, মানু, আমার..মানু…।

বিদিশা সিঁটিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। রণজয়ের বাঁ-হাত কিছুক্ষণ অসভ্যের মতো ঘুরে বেড়াল ওর পিঠে। তারপর ওকে পাশে সরিয়ে অরুণাকে ডেকে নিল রণজয়, আপনি এ-ঘরটায় ঢুকুন। আমি আর আপনার মেয়ে ও-ঘরটায় থাকব।

রণজয়ের কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত অরুণা চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন মেয়ে-জামাইয়ের দিক থেকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না কিছুতেই। রণজয় তাকে ডেকে যখন বিদিশার ঘরে ঢুকতে বলল তখন তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল।

বাপ্পা সদর দরজার দিকে ওর ছোট ঘরটায় ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুম থেকে উঠতে এখনও অনেক দেরি। রণজয় কি ওকেও ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলবে নাকি!

অরুণার ঘরের লাগোয়া গ্রিল দেওয়া বারান্দায় গেলে বাগানটা দেখতে পাওয়া যায়। আর একইসঙ্গে লোহার গেট, পিচের রাস্তাও দেখা যায়। সুতরাং বারান্দায় দিকের দরজাটা খুলে চিৎকার চেঁচামেচি করলে রাস্তার লোকজন শুনতে পাবে। কিন্তু এই ভোরে রাস্তায় মানুষজন পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া রণজয় হয়তো সেই সুযোগের কথা আঁচ করেই অরুণাকে বিদিশার ঘরে ঢুকতে বলেছে।

বিদিশার ঘরে ঢুকে অরুণা যখন সুধাময়ের চিন্তায় আর আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে আছেন তখন রণজয় এক চিলতে হেসে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার আগে ছোট্ট করে বলল, প্লিজ, চিৎকার-টিকার করবেন না। করলে আপনার মেয়ের গলা কেটে দেব– কথা শেষ করার সময় হাতের ছুরিটা উঁচিয়ে দেখিয়েছে রণজয়। তারপর বন্ধ দরজার হাঁসকল টেনে দিয়েছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে হাত চালিয়ে কপালে এসে পড়া চুল ঠিক করল রণজয়। তারপর রুক্ষভাবে বিদিশাকে আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলল ডাইনিং হলের দিকে।

বন্ধ ঘরের ভেতরে বন্দি হয়ে অরুণা কাঁদতে শুরু করেছিলেন। রণজয়ের সঙ্গে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যেতে সেই কান্নার গোঙানি শুনতে পেল বিদিশা। ওরও কেমন কান্না পেয়ে গেল। একইসঙ্গে সুধাময়ের চিন্তাটাও চলে এল মাথায় ও বাপি কোথায়?

ডাইনিং হলে এসেই এক অভদ্র ধাক্কায় বিদিশাকে একটা চেয়ারের দিকে ঠেলে দিল রণজয়। বিদিশা বেশ ব্যথা পেল কোমরে, কিন্তু যন্ত্রণায় চিৎকার করতে ভয় পেল।

ছুরি হাতে রণজয় উদভ্রান্ত বিদিশাকে একবার দেখল, তারপর এগিয়ে গেল বাপ্পার ছোট ঘরের দিকে।

বিদিশা এবার চিৎকার করে উঠল, কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ক্ষিপ্ত চিতার মতো ওর দিকে ছিটকে এল রণজয়। এক ধাক্কায় ওকে চেয়ারসমেত কাত করে ফেলে দিল মেঝেতে।

বিদিশার ভয়ের চিৎকারটা মাঝপথে থেমে গিয়ে ব্যথার গোঙানি বেরিয়ে এল।

অগোছালোভাবে পড়ে থাকা বিদিশার দিকে তাকিয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিল রণজয়। বিদিশা ওর ভয়ংকর চোখ-মুখ দেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করল।

সকালবেলাতেই নানারকম শব্দ আর কথাবার্তা বোধহয় বাপ্পার ঘুম হালকা করে দিয়েছিল। কারণ, বাপ্পার ঘরের দরজা খোলার শব্দ হল। রণজয় ছুটে সেই দরজায় কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বাপ্পা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ওর পরনে ডোরাকাটা পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি।

বাপ্পাকে দেখে বিদিশা চিৎকার করে উঠল, শিগগির! ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দে! জলদি।

বুট পরা পায়ে বিদিশার পাঁজরে প্রচণ্ড এক লাথি কষাল রণজয়। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ফাকিং বিচ! তারপর এক লাফে পৌঁছে গেল বাপ্পার ঘরের দরজায়। কিন্তু বাপ্পা ততক্ষণে দিদির কথা মতো ঘরে ঢুকেই দরজায় খিল এঁটে দিয়েছে।

রণজয় বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বাপ্পার ঘরের দরজাতেও হাঁসকল টেনে দিল। ও জানে, বাপ্পার ঘর থেকে পালানোর কোনও উপায় নেই। তা ছাড়া ওর ঘর থেকে চেঁচিয়ে রাস্তার কাউকে ডাকা বেশ কঠিন। কারণ, ওর ঘরের পাশ ঘেঁষে পরপর দুটো খালি প্লট আগাছা আর জঙ্গলে ছেয়ে আছে।

ছুরি হাতে এবার বিদিশার কাছে এসে দাঁড়াল রণজয়। ছুরিটা ডাইনিং টেবিলের একপাশে রেখে দিয়ে ওর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে তেরছাভাবে হাসল, বলল, এসো বউ, আর কোনও লজ্জা নেই–এবারে ফুলশয্যা হয়ে যাক।

বিদিশার ফরসা সুন্দর মুখ ভয়ে বেঁকেচুরে গেছে। কোমরে, পাঁজরে অসহ্য ব্যথা। ডাইনিং হলের এক কোণে রাখা টেলিফোনের দিকে তাকাল ও। যদি কোনওরকমে শেখরকে একটা ফোন করা যেত। কিন্তু ফোন করেই বা কী হত! শেখর টালিগঞ্জ থেকে আসতে-আসতে কম করেও একটি ঘণ্টা। তখন কি আর সাহায্যের কোনও দরকার হবে!

কিন্তু টেলিফোন আর কাউকে করা যায় না? বাড়ির কাছাকাছি কাউকে? পাশের লেনের রমেশবাবুকে, কিংবা ডক্টর সান্যালকে?

হঠাৎ-ই বিদিশা টের পেল, ও বোকার মতন দিবাস্বপ্ন দেখছে। রণজয়ের সামনে এখান থেকে কাউকে ফোন করা অসম্ভব। টেলিফোনের আর-একটা প্যারালাল লাইন রয়েছে সুধাময়-অরুণার ঘরে। সেটা মনে রেখেই বোধহয় রণজয় অরুণাকে বিদিশার ঘরে টেনে এনে বন্দি করেছে। কিন্তু সেখান থেকেও বা ফোন করবে কেমন করে! যদি সুধাময় থাকতেন বাড়িতে, তা হলে…।

কিন্তু বাপি কোথায়? বাইরের বাগানে, নাকি ভোরবেলাতেই বাজারে রওনা দিল? উঁহু, বাজারে। তো যায়নি–ওই তো, রান্নাঘরের দেওয়ালে বাজারের থলে ঝুলছে! বিদিশা হঠাৎ-ই সুধাময়ের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। ও আর কান্না চাপতে পারল না। হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

আর ঠিক তখনই রণজয় ঝুঁকে পড়ে বিদিশাকে এক হ্যাঁচকায় দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর ওকে খুব কাছে টেনে নিয়ে বলল, বউ, কতদিন তোমাকে ভালো করে দেখিনি– ওর গালে ঠোঁটে পরপর কটা চুমু খেল রণজয়। তারপর আদুরে গলায় বলল, নাও, দেখাও।

বিদিশার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। ওর শরীরটা কাঠ হয়ে ছিল রণজয়ের হাতের বাঁধনে। কান্নার দমকে ঝাঁকুনি খেয়ে উঠছিল বারবার। ও চোখ নামিয়ে রেখেছিল মেঝের দিকে। কী হবে এখন! এই বিপজ্জনক পাগলটার হাত থেকে কী করে রেহাই পাবে বিদিশা!

কী হল! দেখাও– ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল রণজয়, নাও, চটপট সব খোলো–।

এতক্ষণে পাগলটার খামখেয়ালি মতলব স্পষ্ট হল বিদিশার কাছে। এই নোংরা লোকটার সঙ্গে ও দু-বছর ঘর করেছে ভাবতেও গা ঘিনঘিন করে উঠল ওর। ও আড়চোখে ডাইনিং টেবিলে রাখা নির্লিপ্ত ছুরিটার দিকে দেখল। পুরোনো কয়েকটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল বিদিশার। এইরকম বিপদ এড়াতেই ও মানিকতলার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল সল্ট লেকে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, লাভ কিছু হয়নি।

রণজয়ের হাত ওর শাড়ি খামচে ধরতেই বিদিশা চমকে উঠল। প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় বাধা দিয়েছিল ভুল করে। ভুল যে হয়েছে সেটা বুঝিয়ে দিল রণজয়ের নৃশংস থাপ্পড়। বিদিশা টলে পড়ে গেল মেঝেতে। পড়ে থাকা চেয়ারটা ওর শরীরকে বাধা দিল। ফলে যন্ত্রণার তির বিধে গেল পিঠে, কোমরে। ও চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।

আর তখনই শুনতে পেল, বন্ধ দরজার পিছন থেকে মা চেঁচিয়ে ডাকছে ওকে? মানু! মানু, কী হল? রনো, দরজাটা খুলে দাও। মাথা গরম কোরো না। কী হয়েছে আমাকে খুলে বলো। মানুকে কিছু কোরো না…।

রণজয় একবার ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল বন্ধ দরজাটার দিকে। তারপর ঝুঁকে পড়ে একমনে বিদিশার শাড়ি ধরে টানতে লাগল।

বিদিশা আর বাধা দিতে পারল না। শাড়ির পাক যতই খুলতে লাগল ওর শরীরটা ততই গড়িয়ে যেতে লাগল পাকে-পাকে।

রণজয় অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে দ্রুত হাতে কাজ সারতে লাগল। খুলে নেওয়া শাড়িটা ও দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল এক কোণে। তারপর পাথরের মতো মুখে বিদিশাকে হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল।

তুমি নিজে খুলবে, না কি আমাকে খুলতে হবে!

রণজয়ের গলার স্বর ভয় পাইয়ে দিল বিদিশাকে। ওর মনে হল, রণজয় বোধহয় বেশ কয়েকটা টেনটেক্স ফোর্ট খেয়ে এসেছে। ও তাড়াতাড়ি ব্লাউজের হুকে হাত দিল।

অরুণা তখনও ইনিয়েবিনিয়ে কেঁদে কেঁদে কীসব বলছিলেন ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না।

রণজয় সরাসরি বিদিশার বুকের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিকে চোখ রেখেই ও ডাইনিং টেবিলে উঠে বসল। বলল, মানু, আমি ফুলশয্যার রাতের মতো এক্সাইটেড হয়ে পড়েছি। কুইক। ওঃ, কাম অন–অত লজ্জা কোরো না। তোমার সবই তো আমার দেখা–শুধু মাঝে ন-দশ মাস দেখিনি। নাও, জলদি।

বিদিশার বোধহয় দেরি হচ্ছিল। অন্তত রণজয়ের সেইরকমই মনে হয়েছে। তাই ও একলাফে নেমে এল বিদিশার খুব কাছে। ওকে জাপটে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল, মুখ ঘষতে লাগল, শরীরে শরীরে ঘষতে লাগল। ওর হাত মাকড়সার মতো হেঁটে বেড়াতে লাগল বিদিশার সারা গায়ে।

বিদিশার প্রায় দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। ও এবার স্পষ্ট টের পেল রণজয়ের অবস্থা। সত্যিই ও টেনটেক্স ফোর্ট খেয়ে এসেছে। বিদিশা কাঁদতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু ওর গলা দিয়ে কেমন একটা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছিল।

ব্লাউজ কখন খুলে গেছে। রণজয়ের লোভাতুর হাতের সামনে কোনও আড়ালই আর নেই। বিদিশা নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে অনুভব করতে লাগল ওর প্রাক্তন স্বামীর নির্লজ্জ আদর। প্রথমে হাত দিয়ে, পরে মুখ দিয়ে। ও দেখতে পাচ্ছিল, ওর ফরসা বুকে রণজয়ের কালো মাথাটা কেমন ঘনিষ্ঠ হয়ে রয়েছে, পাগলের মতো ছটফট করছে এপাশ-ওপাশ।

হঠাৎ-ই রণজয় খ্যাপা কুকুরের মতো বিদিশাকে এক হাচড়ায় কোলে তুলে ফেলল। তারপর বসিয়ে দিল ডাইনিং টেবিলে। ওর শায়ার দড়ি ধরে প্রচণ্ড এক টান মারল। পট করে ছিঁড়ে গেল দড়ি। বিদিশা চোখ বুজে ফেলল। ঘেন্নায় ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।

সেই অবস্থাতেই ও টের পেল শায়াটা ধরে ভয়ংকর এক টান মারল কেউ। শব্দে বুঝল শায়া অনেকটা ছিঁড়ে গেল। তারপর বেশ কয়েকটা হ্যাঁচকা টানে ওটা বিদিশার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হল।

লজ্জা ঢাকতে বিদিশা চোখ বুজেই ছিল। তবু টের পাচ্ছিল রণজয় ওর ইচ্ছে মেটানোর পথে ধাপে-ধাপে এগোচ্ছে। পাঁচ-দশ সেকেন্ড পরেই ডাইনিং টেবিলটা বিছানা হয়ে গেল, আর ডাইনিং হলটা বেডরুম। সেইসঙ্গে দিনটাও বোধহয় রাত হয়ে গেল।

সহবাস যে ধর্ষণের চেয়েও জঘন্য হতে পারে সেটা এই প্রথম উপলব্ধি করল বিদিশা। রণজয়ের ফ্রন্টাল লোবের যত গণ্ডগোল সব ধরা পড়ে গেল এই মিলনেও। উপোসী কোনও অশরীরী শরীর ফিরে পেতে যতটা আকুল হয় রণজয়ের চাহিদাও ছিল ঠিক ততটাই আকুল।

পরিশ্রমের ধকলে হাপরের মতো হাঁফাচ্ছিল রণজয়, আর কাঠ হয়ে পড়ে থাকা বিদিশার কোমল শরীর সেই কম্পন অনুভব করছিল। একইসঙ্গে বিদিশা ভাবছিল, কী করে রুখে দেওয়া যায় এই মারাত্মক অমানুষটাকে।

বাপ্পা চিৎকার করে ডাকছিল, দিদি! দিদি!

অরুণাও কান্না মেশানো গলায় মানু! মানু! করে ডাকছিলেন আর বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলেন।

রণজয় হঠাৎই বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় খিস্তি করে রাগের চোখে ঘুরে তাকাল বিদিশার ঘরের দিকে–যে ঘরে বন্দি আছেন অরুণা। তারপর কয়েক পা এগিয়ে গেল সেদিকে।

বিদিশার চোখে জল, বুকের ভেতরে নাম-না-জানা কষ্ট। ও উঠে বসল ডাইনিং টেবিলে। ব্লাউজ হুকগুলো লাগিয়ে নিল। তারপর লজ্জা ঢাকতে নেমে এল ডাইনিং টেবিল থেকে।

ওকে নামতে দেখেই ক্ষিপ্ত রণজয় এক ঝটকায় ফিরে এল ওর কাছে। এক হাতে টুটি টিপে ধরল ওর।

বিদিশার গলা দিয়ে অস্পষ্ট একটা আঁক শব্দ বেরিয়ে এল। সেই অবস্থাতেই ও চোখের ইশারায় ঘরের কোণে পড়ে থাকা দলা পাকানো শাড়িটা দেখাল। রণজয় বুজতে পারল একটা ছোট্ট ধাক্কায় ওকে ঠেলে দিল সেদিকে।

অরুণা তখনও দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলেন, কান্না জড়ানো গলায় মানু! মানু করে ডাকছিলেন।

রণজয় সাংঘাতিক বিরক্ত হয়ে খ্যাপা কুকুরের মতো ছুটে গেল সেদিকে। দরজায় একটা জোরালো ধাক্কা মেরে অরুণাকে চুপ করতে বলল। তারপর অশ্রাব্য গালিগালাজের ফোয়ারা ছোটাল।

বিদিশা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছিল। তখনই খেয়াল করল, টেলিফোনটা ওর একেবারে হাতের নাগালে।

রণজয় এখন বিদিশার কাছ থেকে অনেকটা দূরে। সুতরাং টেলিফোনটা বিদিশা চট করে একবার ব্যবহার করতে পারে। তবে রণজয় সেটা দেখতে পাবে এবং বিদিশাকে হয়তো অবাধ্যতার জন্য হিংস্র শাস্তি পেতে হবে।

রণজয়ের করাতের দাঁতওয়ালা ছুরিটা এখনও পড়ে আছে ডাইনিং টেবিলে–মাত্র কয়েকহাত দূরে। বিদিশা ইচ্ছে করলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা তুলে নিতে পারে। কিন্তু হাতে পেলেই কি ও জিততে পারবে এই পাগলটার সঙ্গে!

হয় টেলিফোন, নয় ছুরি। যে-কোনও একটা হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে বিদিশা। গায়ে শাড়ি জড়াতে-জড়াতে এই অঙ্কের হিসেবটাই কষছিল ও।

শেষ পর্যন্ত ও টেলিফোনের পক্ষেই গেল। শাড়ি খানিকটা অংশ মেঝেতে ফেলে দিয়ে সেটা ঠিক করা ভান করে ঝুঁকে পড়ল মেঝেতে।

সেই সুযোগে টেলিফোনের রিসিভারটা মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে শেখরের বাড়ির নম্বরটা ঘোরাল ডায়ালে : ফোর সেভেন টু ওয়ান নাইন ওয়ান সেভেন।

বিদিশার পিঠ রণজয়ের নজর আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি মুহূর্তই ও ভাবছিল, এই বোধহয় রণজয় এসে দাঁড়াবে ওর পিঠের কাছে, ধরে ফেলবে ওর অভিসন্ধি। তারপর ওর চুলের মুঠি ধরে এক হ্যাঁচকায় ওকে…।

মেঝেতে পড়ে থাকা রিসিভারে একটি মহিলা কণ্ঠ হ্যালো, হ্যালো করছিল। বিদিশা অতি সন্তর্পণে রিসিভারটা তুলে নিয়ে এল মুখের কাছে। ফিসফিস করে বলল, আমি বিদিশা বলছি। শেখরকে বলুন আমাদের বাড়িতে এক্ষুনি চলে আসতে। ভীষণ বিপদ…।

পিছন থেকে একটা লাথি এসে পড়ল বিদিশার পিঠে। বিদিশা ঠিকরে পড়ল ডাইনিং হলের বড় জানলার কাছে। ওর শাড়ির অর্ধেকটা কোমরে জড়ানো, বাকিটা লুটোপুটি। সেই অবস্থাতেই ও দেখল, রণজয় ডাইনিং টেবিল থেকে ছুরিটা তুলে নিয়েছে। ছুরির এক কোপে কেটে দিল। টেলিফোনের তার। তারপর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে জোরে আছড়ে মারল মেঝেতে। সংঘর্ষের শব্দ হল। চুরমার হয়ে যাওয়া প্লাস্টিক আর ধাতুর টুকরো ছড়িয়ে গেল চারদিকে।

রণজয় হাসল বিদিশার দিকে তাকিয়ে। বলল, কী রে, মানু, ভয় পেলি? তারপরই একরাশ খিস্তিখেউড়।

ছুরির ডগাটা বিদিশার ব্লাউজের মাঝামাঝি ঠেকাল রণজয়। ছুরিটা ফেলে দিয়ে ঝুঁকে পড়ল বিদিশার ওপরে। দাঁত দেখিয়ে হাসল, বলল, মানু, আয়, আরও একবার হয়ে যাক।

বিদিশার গা ঘিনঘিন করে উঠল। আবার! টেনটেক্স ফোর্টের তেজ সহজে কমে না।

কিন্তু আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই রণজয় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বিদিশার ওপরে। চাপা কর্কশ গলায় বলেছে, তোকে আমি ছাড়ব না!

টেলিফোন আছড়ে ফেলার শব্দে ভয় পেয়েছিলেন অরুণা। বাপ্পাও ভয় পেয়েছিল। সুতরাং কান্নার শব্দ আর দরজার ধাক্কা দুটোই কয়েক পরদা বেড়ে গেল।

রণজয় এবারে আর বিরক্ত হল না। কারণ ওর রক্তে তখন খই ফুটতে শুরু করেছে।

একটা নাম-না-জানা ঘৃণায় বিদিশা হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল, বাধা দিতে চাইল হামলে পড়া জন্তুটাকে। কিন্তু তার জবাবে বিদিশার গলা টিপে ধরল রণজয়। আর বিদিশা ডুবে যাওয়া মানুষের মতো এলোমেলোভাবে বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইল।

বিদিশার চোখের সামনে রণজয়ের বিকৃত মুখ, কপালে-নেমে-আসা চুল, আর গরম নিশ্বাস। আর ওর হাত নিতান্ত অকারণেই খড়কুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এরকমই একটা অবস্থায় বিদিশার হাত পড়ল বেগন পাওয়ারের স্প্রে সিলিন্ডারে। জানলার ঠিক নীচেই দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে সিলিন্ডারটা দাঁড় করানো থাকে। মশা মারার জন্য কেনা হয়েছে এই ওষুধটা। ধাতুর লম্বাটে বোতালের মাথায় সাদা রঙের বোতাম। বোতামে চাপ দিলেই বেরিয়ে আসে ধোঁয়ার মতো স্প্রে। কী বিশ্রী দুর্গন্ধ! নাকে এলেই বিদিশার মাথা ঝিমঝিম করে।

এটা রণজয়ের মুখে স্প্রে করলে কি ওকে থামানো যাবে? মশা মারার বিষে মানুষ কি একটুও অবশ হবে না!

বিদিশা আর ভাবতে পারছিল না। ও মরিয়া হয়ে সিলিন্ডারটা খামচে ধরে রণজয়ের মুখ লক্ষ করে বোতাম টিপে দিল। সাদা ধোঁয়ার মতো স্প্রে রণজয়ের মুখ ঝাপসা করে দিল। উকট দুর্গন্ধে বিদিশার গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু ও দাঁতে দাঁত চেপে বোতাম টিপেই রইল।

এইরকম একটা প্রতিরোধের জন্য রণজয় তৈরি ছিল না। মুখে স্প্রে এসে পড়ামাত্রই ও বিদিশাকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে গড়িয়ে গেল একপাশে।

কিন্তু বিদিশা কোণঠাসা বেড়ালের মতো মরিয়া হয়ে উঠেছে। ও স্প্রে করেই চলল। কখনও রণজয়ের মুখে, মাথায়, কানে, গলায় কখনও বা হাতে, পায়ে, গায়ে। তাক কখনও ঠিক হচ্ছিল, কখনও বা ভুল। কিন্তু মরিয়া বিদিশা বোতামের ওপরে আঙুলের চাপ এতটুকু আলগা করেনি।

রণজয়ের মাথা ঝিমঝিম করছিল। কিন্তু সেই অবস্থাতেও ও ছুরিটা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছিল। কোথায় গেল ছুরিটা?

কিছুক্ষণের মধ্যেই সিলিন্ডার প্রায় শেষ হয়ে গেল। খালি বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চারপাশে দেখল বিদিশা। জানলার তাকে টুকিটাকি অনেক জিনিস। একটা তালাচাবি, সাবানকেস, মোমবাতি, ছোট একটা শেকল, দেশলাই, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, আরও কত কী।

দেশলাই! মশা মারার ওই ওষুধে কি সহজে আগুন ধরে? কেরোসিন তেলের মতো? বিদিশার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। ও উদভ্রান্ত নজরে দেখল, রণজয় সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। ওর হাতে সেই ছুরি। সারা গা বেগন পাওয়ারে ভেজা। চোখে খুনির দৃষ্টি।

বিদিশা আর কিছু ভাবতে পারল না। দেশলাইয়ের বাক্সটা তুলে নিয়ে কাঠি বের করে নিল। এক ঘষায় সেটা জ্বেলে ছুঁড়ে দিল রণজয়ের গায়ে।

চোখের পলকে যেন দেওয়ালি শুরু হয়ে গেল। রণজয়ের ছুরি বাগিয়ে ধরা লড়াকু শরীরটায় আগুন ধরে গেল দপ করে। তারপর লকলকে শিখায় এলোপাতাড়ি জ্বলতে লাগল।

আগুন ধরে গেল ঘরের বাতাসে, যেখানে ওষুধের বাষ্পের কণা ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর বিদিশার শাড়িও রেহাই পেল না। কখন যেন বেগন পাওয়ার ছুঁয়ে গেছে ওর শাড়ি।

বিদিশা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। রণজয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল জন্তুর গর্জন। আর বন্ধ দরজা দুটোয় কান ফাটানো শব্দ করছিলেন অরুণা ও বাপ্পা–সেই সঙ্গে তীব্র চিৎকার।

এই তুমুল বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিদিশার দিকে আঁপিয়ে পড়ল রণজয়ের জ্বলন্ত শরীর। ওর টলোমলো ডান হাত আনাড়ির মতো ছুরি চালাল বিদিশাকে লক্ষ করে।

বিদিশা তখন চিৎকার করে ছুটেছিল কলঘরের দিকে, আর পরনের শাড়িটাকে গা থেকে খুলে ফেলতে চেষ্টা করছিল। রণজয়ের ছুরি ওর ডান বাহুতে এসে লাগল, কিন্তু সেই যন্ত্রণা বিদিশা বোধহয় টের পেল না। ও পাগলের মতো ঢুকে পড়ল কলঘরে। শাওয়ারের কল খুলে দিল শেষ পাঁচ পর্যন্ত। তারপর শাওয়ারের নকল বৃষ্টির নীচে কয়েক লহমা দাঁড়িয়ে গোড়া কাটা গাছের মতো ঠাস করে পড়ে গেল কলঘরের মেঝেতে।

নকল বৃষ্টি ওর লজ্জাহীন শরীরকে তখন ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেই অবস্থাতেও বিদিশা শেষবারের মতো দেখল, রণজয়ের দেহটা মেঝেতে পড়ে গিয়েও দাউদাউ করে জ্বলছে।

চেতনা হারানার আগে বিদিশা অনেকগুলো দরজায় একসঙ্গে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেল। মনে হল, বাইরে থেকে কে যেন সদরে কলিংবেলের বোতাম টিপছে।

তারপর আর কিছু ওর মনে নেই।

.

চোখ খুলেই নার্সিং হোমের সাদা দেওয়াল, সাদা পোশাক পরা নার্স। এ ছাড়া সাবানের ফেনার মধ্যে ভাসছে বেশ কয়েকটা পরিচিত রঙিন মুখ। সেই মুখগুলোর মধ্যে মা-বাবা রণজয়কে খুঁজল বিদিশা। কিন্তু শুধু মাকে দেখতে পেল।

মাথার অসহ্য যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ও ভাবতে চেষ্টা করল।

না, এটা সেই প্রথমবারের নার্সিং হোম নয়। টেনটেক্স ফোর্ট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিদিশা এখানে আসিনি। এখানে ও এসেছে অন্য কোনও কারণে।

জলের গভীর থেকে বুদবুদ যেমন ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে আসে ঠিক সেইভাবে বিদিশার অচেতন মন চেতনায় ভেসে উঠছিল। শরীরের জ্বালা যন্ত্রণাগুলো একটু-একটু করে টের পাচ্ছিল ও। আর একইসঙ্গে চোখের নজর স্বচ্ছ হয়ে উঠছিল।

এইবার মুখগুলোকে স্পষ্ট করে চিনতে পারল বিদিশা। মা, বাপ্পা, শেখর, বোসদা, দেবলীনা, সুতপাদি আর অশোক চন্দ্র।

ওকে চেতনায় দেখে সবাই স্বস্তির হাসি ফোঁটাল মুখে।

 বিদিশাও হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু ঠোঁটে বেশ ব্যথা।

অরুণা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করলেন, এখন কেমন আছিস?

বিদিশা সামান্য মাথা নেড়ে বলল, ভালো।

আর তখনই ও মায়ের সাদা শাড়ি খেয়াল করল।

ও সামান্য ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্টভাবে প্রশ্ন করল, বাপি আসেনি?

অরুণা বাপ্পাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। মাথা নীচু করে আঁচলে মুখ গুঁজলেন। শেখর এগিয়ে এসে অরুণাকে আলতো করে ঠেলে সরিয়ে দিল। বিদিশার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনার এখন কথা বলার দরকার নেই–স্ট্রেইন হবে।

সুতপাদি আর দেবলীনা বিদিশার হাত ধরল, হাসল ঠোঁটে।

বিদিশার সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। নার্সিং হোমে ও কতদিন পড়ে আছে? পাঁচ দিন? সাত দিন? দশ দিন?

ও বিড়বিড় করে বলল, রণজয়…।

শেখর বলল, কথা বলতে বারণ করলাম না! আপনার আর কোনও ভয় নেই…আর কেউ কখনও আপনাকে বিরক্ত করবে না। সেরে উঠে পরে সব শুনবেন।

বাপি… ডুকরে কেঁদে উঠল বিদিশা। ওর চোখ ভিজে গেল।

নার্স এগিয়ে এল শেখরের কাছে। বলল, আপনারা এবার যান। পেশেন্টকে এবার ঘুমের ইনজেকশন দেব।

ওরা একে-একে সরে এল বিদিশার কাছ থেকে।

বিছানার পাশের জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে পাচ্ছিল বিদিশা। কোথাও সাদা মেঘ, আর কোথাও নীল আকাশ। কালো মেঘ কোথাও নেই।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সুধীর বোস বললেন, মা জননী, তুমি ঝটপট সেরে উঠে অফিসে জয়েন করো। তুমি অফিসে না এলে আমরা ঠিক কাজে মুড পাচ্ছি না।

অশোক চন্দ্র জিগ্যেস করল, বোসদা, আমরা মানে কারা?

ঘরের দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে শেখরের পিঠে চাপড় মেরে বোসদা বললেন, আমরা মানে আমি আর শেখরভায়া–।

অশোক অবাক হওয়ার ভান করে বলে উঠল, আমি কি সেদিনের মতোই এজ বারে আটকে গেলাম?

সুধীর বোস পান চিবোতে-চিবোতে গম্ভীর গলায় বললেন, ইয়েস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *