হীরা চুনি

হীরা চুনি

ঘটনাটা আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনা, দুটোর একটা মনে হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কোনওটাই নয়। পরিষ্কার খুন।

খুনের পর অকুস্থলে সবার আগে হাজির হওয়ার সুযোগ খুব কম ডিটেকটিভই পায়, কিন্তু এক্ষেত্র ঈশ্বর করুণাময়। আমিই প্রথমে এসে উপস্থিত হয়েছি।

সি.আই.টি. রোডের একটা শরিকী সংঘর্ষ মেটাতে আমি আর আমার সঙ্গী, সার্জেন্ট সুরেশ নন্দা, জিপ ছুটিয়ে যাচ্ছিলাম, ফুলবাগানে মোড় ঘুরতেই একটা বাচ্চা ছেলে ব্লু স্টার হোটেলের পেছনের গলিটা থেকে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে বলতে লাগল, গলিতে একটা লোক মরে পড়ে আছে।

ছেলেটা ছুটে চলে গেলেও নন্দা গাড়ি ঘুরিয়ে গলিটায় ঢুকল।

ছ’টা বেজে এখন কয়েক মিনিট। জুনের ভ্যাপসা গরম। তারই মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি দামি পোশাক-পরিচ্ছদ পরা এক যুবকের মৃতদেহ রাস্তায় অসহায়ভাবে পড়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েকমিনিট আগেই সে হোটেলের অন্তত তিন কি চারতলার জানলা দিয়ে পড়েছে। ওপরে তাকিয়ে মেপে নিলাম–হোটেলটা ছ’তলা।

ফরসা দেহটা হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। এত ওপর থেকে পিচের রাস্তায় এসে পড়লে যে পরিমাণ রক্তপাত হওয়ার কথা তা হয়নি। যুবকের দু-চোখের মাঝে নাকের ওপরটা কালচে হয়ে ফুলে আছে এবং মুখের বাঁ দিকে, বাঁ হাতে ও বাঁ কবজিতে কেমন গোলাপি আভা।

পুলিশের ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা না করা পর্যন্ত হয়তো আমাদের ছোঁওয়া উচিত নয়, কিন্তু প্রয়োজন ও কৌতূহল বেশিরভাগ সময়েই জিতে যায়। সুতরাং আঙুলের ডগা মৃতদেহের চোয়ালে ঠেকিয়ে আস্তে ঠেলা মারলাম। মাথাটা খুব সহজেই একপাশে ঘুরে গেল।

রাইগর মর্টিস শুরু হয়নি এখনও না? সুরেশ প্রশ্ন করে।

না, আমি বলি। লোকটার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে খুললাম। চারশো তিপ্পান্ন টাকা, কয়েকটা সংখ্যা ও ঠিকানা লেখা চিরকুট, আর সাতটা একইরকম আইভরি কার্ড। কার্ডগুলো সম্ভবত মৃত ব্যক্তির। তাতে লেখা : বিশ্বনাথ শিভালকর, এজেন্ট। সতেরো, এলগিন রোড, কলকাতা ৭০০০২০।

নাম-ঠিকানা সুরেশকে পড়ে শোনালাম। ব্যাগটা আবার ফিরিয়ে রাখলাম পকেটে, উঠে দাঁড়ালাম। ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে গেলে আরও খুঁটিয়ে সব কিছু পরীক্ষা করে দেখব।

বডির বাঁ দিকটায় পোস্টমর্টেম লিভিডিটি দেখা যাচ্ছে। সুরেশ সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, অতটা লালচে হতে অন্তত ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে, কী বলেন?

হ্যাঁ, তা লাগবে।

মেঝের কাছাকাছি মৃতদেহের যে-অংশ থাকে সেখানে রক্ত জমে গিয়েই পোস্ট মর্টেম লিভিডিটি হয়। অর্থাৎ, কেউ বিশ্বনাথ শিভালকরকে ওপরের জানলা দিয়ে ফেলে দেবার আগে সে বাঁ কাত হয়ে অন্তত ঘণ্টাখানেক পড়ে ছিল।

মরার আগে কষে মাল টেনেছে–গন্ধ পাচ্ছি, একটু অবাক হয়ে সুরেশ বলল।

অল্পেতে অবাক হওয়া সুরেশের স্বভাব। ওর চেহারা ছিপছিপে, লম্বা। বয়েস কম, কথাবার্তা নরম। আর লোক ঠকানো, মোলায়েম আচার-ব্যবহার। ফলে এমনিতে বোঝা মুশকিল, ও দরকার পড়লে বেশ শক্ত হতে পারে। এ ছাড়া সুরেশ খিদিরপুরে বালসারার ক্লাবে নিয়মিত মার্শাল আর্ট-এর চর্চা করে। খালি হাতের লড়াইয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ওর জুড়ি নেই এবং ভয় নামক অনুভূতি ওর ইন্দ্রিয়ের আওতার বাইরে।

দু-চোখের মাঝে যে-আঘাত পেয়েছে তাতেই মনে হয় শেষ হয়ে গেছে, প্রশ্নের রেশ টেনে কথাটা শেষ করল সুরেশ।

হতে পারে। খুনি হয়তো ভেবেছে ওপর থেকে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়লে ওই আঘাতের আর চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কিন্তু খুনির দুর্ভাগ্য–।

সুরেশ আমার কথা শুনে হাসল, বলল, তা এখন কী করবেন?

ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত তুমি এখানে থাকো। আমি হোটেল থেকে হেডকোয়ার্টারে ফোন করছি। তারপর সবাইকে একটু নাড়াচাড়া দিয়ে দেখি।

গলি থেকে বেরিয়ে পথ ঘুরে ব্লু স্টার-এর সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল কাচের দরজা পাঠানপুঙ্গব শোভিত।

দরজা পেরোলেই এয়ারকন্ডিশন্ড রিসেপশন–অনিবার্যভাবেই উগ্র আধুনিকাখচিত।

সোজা গিয়ে রিসেপশন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে আই.ডি.-টা বের করে সুন্দরীকে দেখালাম। তারপর ফোন তুলে হেডকোয়ার্টারে ডায়াল করলাম। ও.সি. অজিত বোসকে খুনের ঘটনাটা জানিয়ে এই কেসে ফুলটাইম ডিউটি চাইলাম। উনি ডি.সি.ডি.ডি.-কে জানিয়ে দেবেন বলে অনুমতি দিলেন। এবং বললেন, শিগগিরই অ্যাম্বুলেন্স ও ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্টের দুজন লোক পাঠাচ্ছেন।

ব্লস্টার হোটেলের স্টারের সংখ্যা পাঁচ না হলেও তিনের কম নয়। লবিটা প্রয়োজনের তুলনায় ছোট এবং এলিভেটরটা সম্ভবত খোদ ওটিস সাহেবের হাতে তৈরি। রিসেপশনিস্ট-এর কাছে ম্যানেজারের খোঁজ করলাম। উত্তর পেতে দেরি হচ্ছে দেখে কাউন্টারে খটখট করে দুবার শব্দ করলাম।

কাউন্টারের পেছনের দরজা খুলে মধ্যবয়স্ক, বেঁটে, টাক মাথা এবং বেশ স্বাস্থ্যবান জনৈক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বেশবাস পরিপাটি। হাসিমুখে নকল দাঁতের বিজ্ঞাপন।

বলুন, সার্জেন্ট, আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?’ তার গলার স্বর আমার অনুমানের চেয়েও ভরাট, গম্ভীর।

সার্জেন্ট নয়, ইন্সপেক্টর ইন্সপেক্টর বরাট, আইডেন্টিটি কার্ডটা ওঁর চোখের সামনে একবার নাচালাম। বললাম, বিশ্বনাথ শিভালকর আপনার বোর্ডার?

ডেস্কে রাখা ভোলা খাতার দিকে আড়চোখে একবার তাকালেন তিনি। বললেন, হ্যাঁ, আজই সকালে এসে উঠেছেন।

সঙ্গে কেউ ছিল?

পকেট থেকে নোটবই ও বলপেন বের করে নিলাম : আপনার নামটা বলুন–।

অ্যাডভানি। প্রতাপ অ্যাডভানি।

শিভালকরের সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?

না। কিন্তু কেন বলুন তো? কী হয়েছে?

হোটেলের পেছনের গলিতে শিভালকর শুয়ে আছে। মারা গেছে। কেউ ওকে বোধহয় চারতলার জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

চমকে উঠলেন প্রতাপ অ্যাডভানি, আত্মহত্যা নয় তো?

তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে জিগ্যেস করলাম, শিভালকরকে আপনি চিনতেন?

না, কিন্তু আমি ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন অ্যাডভানি, আমার হোটেলে এসব কাণ্ড কখনও হয়নি।

কারণ বিশ্বনাথ শিভালকর কখনও আসেনি, কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, কাউন্টারে আপনি সবসময় থাকেন না?

না। দরকার হলে আসি।

শিভালকর কোন ঘরে ছিল?

এক মিনিট, আড়চোখের নজর আবার ছুটে গেল খাতার দিকে : টু-ও-নাইন।

তার মানে তিনতলা। তিনতলার জানলা দিয়েই নীচে পড়েছে শিভালকর।

খাতায় ওর নাম-ঠিকানা লেখা আছে?

হ্যাঁ, সেটাই হোটেলের নিয়ম। সেভেনটিন এলগিন রোড, ক্যালকাটা টুয়েন্টি।

শিভালকর কটার সময় আপনার হোটেলে এসে ওঠে?

সাড়ে দশটা নাগাদ।

নোটবই পকেটে রাখলাম।

ওর ঘরের চাবিটা আমাকে দিন, মিস্টার অ্যাডভানি। আর কাউন্টারেই থাকুন। অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা এক্ষুনি এসে পড়বেন।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন অ্যাডভানি নিশ্চয়ই। আমি আছি।

একটা বড় চাবির গোছা থেকে একটা চাবি বের করে আমার হাতে দিলেন তিনি, কোনওরকম দরকার হলেই বলবেন, ইন্সপেক্টর, আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।

সো কাইন্ড অফ ইউ। হাসলাম। তারপর পা বাড়ালাম এলিভেটরের দিকে।

এলিভেটরের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। প্রাগৈতিহাসিক এলিভেটরকে আমার ভীষণ ভয়। সুতরাং ওটিস সাহেবকে এলিভেটর আবিষ্কারের জন্যে মনে-মনে নমস্কার জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠতে শুরু করলাম।

বাইরের জাঁকজমকের তুলনায় হোটেলের ঘরগুলো সর্বহারা। এর চেয়ে ছোট ঘর অনেক দেখেছি, তবে উষ্ণতা ও অস্বস্তিতে দুশো ন’নম্বর কামরা আমার স্মৃতিকে হার মানাল। ঘরে পাখা ও প্রয়োজনীয় সমস্ত আসবাবপত্রই যে যথেষ্ট পুরোনো তা একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়।

ঘরে ধ্বস্তাধ্বস্তির কোনও চিহ্ন নেই। তবে কেউ একজন যে বিশ্বনাথ শিভালকরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার চিহ্ন পাওয়া যায়। ঘরের এক পাশে রাখা টেবিলে হুইস্কির বোতল, থামস আপ এবং দুটো গেলাস। একটা গেলাসের কানায় হালকা গোলাপি লিপস্টিকের ছাপ। এ ছাড়া একটা অদ্ভুত সেন্টের গন্ধ গোটা ঘরটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

বিছানার নীচে ধুলো ছাড়া কিছু পেলাম না। আলমারিতে দুটো হ্যাঁঙার এবং একটা মাকড়সার জাল চোখে পড়ল। বাথরুমেও কিছু নেই।

ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা ভি.আই.পি. অ্যাটাচি কেস পেলাম। সেটা সাবধানে বিছানার রেখে খুললাম। আমি চাই না কোনও হাতের ছাপ আমার অসাবধানতার জন্যে নষ্ট হোক।

অ্যাটাচিতে ডায়েরি, কাগজপত্র, কিছু টাকা ও একটা পেপারব্যাক ছাড়া একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করলাম। শ্যাময় লেদারের সুন্দর একটা পাউচ। মুখটা চেন টেনে বন্ধ করা। ওপরে সোনালি মনোগ্রাম : বি.এস.।

পাউচটা খুললাম। ভেতরে কিছু নেই। না, কিছু নেই বললে ভুল হবে–শুধু কয়েক টুকরো টিসু ও তুলো পেলাম। একটু চিন্তিতভাবেই পাউচটা অ্যাটাচি কেসে ঢুকিয়ে রাখলাম। আর তখনই আমার নজরে পড়ল ছোট্ট লেন্সটা।

এ ধরনের লেন্স সাধারণত জহুরিরা ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং শ্যাময়-পাউচ, টিস্যু পেপার, তুলো এবং লেন্স যোগ করে যে উত্তরটা পাওয়া যায় তা হল, বিশ্বনাথ শিভালকর দামি পাথরের লেনদেন করত। সেই কারণেই ওর কার্ডে এজেন্ট শব্দটা লেখা আছে।

সব জিনিস অ্যাটাচি কেসে আবার গুছিয়ে ওটা আগের জায়গায় রেখে দিলাম। তারপর বিছানাটা তছনছ করে দেখতে শুরু করলাম। তখনই দু বালিশের ফাঁকে লিপস্টিকটা খুঁজে পেলাম।

লিপস্টিকটা জাত এবং চরিত্রে অসাধারণ। সস্তার জিনিসও অনেক সময় ভীষণ দামি দেখায়। এটা তা নয়। একেবারে খাঁটি সোনার তৈরি। চারপাশে আলপনার কাজ করা এবং ঢাকনার ওপর সুন্দর মনোগ্রামে এল.সি. লেখা। আজকের দিনটা বোধহয় মনোগ্রামের দিন।

এ ধরনের লিপস্টিক মেয়েরা নিজেদের জন্যে কেনে না। কেউ উপহার দিলে নেয়। তা ছাড়া জিনিসটা এত দামি এবং কারুকার্য খচিত যে, স্বর্ণকারের গোপন চিহ্ন খোদাই করা থাকলেও থাকতে পারে। সেই গোপন চিহ্ন থেকে আমরা সহজেই এর স্বর্ণকার এবং মালকিনকে খুঁজে বের করতে পারব।

নিজের রুমাল ও শিভালকরের লেন্সের সাহায্য নিয়ে চিহ্নটা খুঁজে পেলাম। ওটা ঢাকনার ভেতর দিকে ছিল ৪ দুটো ছোট বৃত্ত পরস্পরকে ছেদ করে রয়েছে, এবং তাদের একটার মধ্যে ছোট্ট করে ইংরেজি ‘এ’ অক্ষরটা খোদাই করা।

লিপস্টিকটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে বিছানা সার্চ করা শেষ করলাম। চাদরটা আবার ঠিকমতো ঢেকে দিচ্ছি, দরজায় কেউ নক করল। তারপরই ঘরে ঢুকল দুজন ফোরেনসিক এক্সপার্ট ও একজন ফটোগ্রাফার।

প্রথম দুজনের একজনকে প্রশ্ন করলাম, গলির কাজ শেষ?

ওখানে কিছুই করার নেই–শুধু ফটো তোলা ছাড়া। বিশ্বাস সেসব তুলেছে।

ফটোগ্রাফার বিশ্বাস গলির দিকের জানলার কাছে এগিয়ে গেল । জানলা দিয়ে গলির কয়েকটা ফটো বরং তুলে নিই।

ডক্টর আসেনি? আমি জিগ্যেস করলাম।

দ্বিতীয়জন উত্তর দিল, এইমাত্র এসেছেন ডক্টর হুসেন।

ঠিক আছে। আপনারা এবার হাত লাগান। আমার কাজ শেষ। শুধু যাওয়ার আগে নীচে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে।

দুশো ন’নম্বর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

নীচে নামার আগে দুশো নয়ের দুপাশের ঘরের দরজায় টোকা মারলাম। কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম না।

লবিতে এসে অ্যাডভানিকে কাউন্টারে পেলাম না। কিন্তু কাউন্টারের পেছনের দরজাটা সামান্য ভোলা। সুতরাং রিসেপশনিস্টকে হতভম্ব করে কাউন্টারের পেছনে গেলাম। দরজা ঠেলে সটান ঢুকে গেলাম অ্যাডভানির ঘরে।

শিভালকরের ঘরের সঙ্গে এ-ঘরের খুব একটা তফাত নেই। অতিরিক্তের মধ্যে একটা টিভি সেট এবং জানলায় গ্রিল বসানো। অ্যাডভানি বিছানার শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছেন। যন্ত্রণায় তার চোখ কুঁচকে গেছে।

কী হল, মিস্টার অ্যাডভানি? আমি প্রশ্ন করলাম।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে হাসতে চেষ্টা করলেন। বললেন, আলসার। তার ওপর সুইসাইডের ব্যাপারটায় বেশ আপসেট হয়ে পড়েছি।

বুঝলাম না শিভালকরের মৃত্যুকে তার আত্মহত্যার লেবেল লাগানোর এত বেঁক কেন। সে কি নিজের হোটেলকে বদনামের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে?

অতিকষ্টে বিছানায় উঠে বসলেন অ্যাডভানি : কিছু বলবেন, ইন্সপেক্টর?

যদি আপনার কষ্ট না হয়, তাহলে—

কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি : প্রয়োজন যখন তখন উপায় কী। বলুন, কী জানতে চান।

শিভালকরের ঘরে কোন বেয়ারার ডিউটি ছিল?

আবদুলের। কেন, ওকে পেলেন না?

খোঁজ করিনি। নিস্পৃহ স্বরে উত্তর দিলাম, শিভালকর যখন আসে তখন আবদুল কি ওকে ওপরে পৌঁছে দিয়েছিল?

না। আবদুল তখন কাছাকাছি ছিল না। মিস্টার শিভালকর চাবি নিয়ে নিজেই ওপরে গিয়েছিলেন।

শিভালকরের ঘরে একটা মেয়ে এসেছিল। তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। কোনও মেয়েকে আপনি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখেছেন?

একটা মেয়েকে দেখেছি–খুব সুন্দর দেখতে। সোজা লিফটে গিয়ে উঠেছিল।

তাকে চেনেন?

না। তবে মেয়েটা একেবারে বিউটি কুইন। কাঁধ পর্যন্ত চুল, চোখে টিন্টেড গ্লাসের চশমা, পরনে সোনা রং সাউথ ইন্ডিয়া সিল্ক–দাম কম করেও তিন হাজার টাকা হবে।

তখন কটা বাজে?

এই..চারটে হবে। কিংবা সোয়া চারটে।

এ ছাড়া আর কোনও মেয়েকে দ্যাখেননি?

না। মিস্টার বরাট, একটু কষ্ট করবেন? আমি একদম উঠতে পারছি না। কাউন্টারের ভেতরের তাকে একটা পিচবোর্ডের বাক্স আছে। কয়েকদিন আগে একটা জেলুসিল ট্যাবলেটের পাতা ওখানে রেখেছিলাম। দেখুন তো আছে কি না, থাকলে আমাকে দুটো এনে দিন, ট্যাবলেট দুটো খেলে পেটের যন্ত্রণাটা হয়তো একটু কমবে।

কাউন্টারে গেলাম। বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করে ট্যাবলেটের পাতাটা খুঁজে পেলাম। দুটো ট্যাবলেট ছিঁড়ে এনে অ্যাডভানিকে দিলাম।

থ্যাংকু ইউ। ভগবান না করুন, কখনও যেন আপনার আলসার না হয়।

আর একটা কথা–তারপরই আপনার ছুটি। হোটেলে টেলিফোন এলে কে ধরে? রিসেপশনিস্ট?

না, আমি। আমি না থাকলে সুজি ধরে সুজি গোমেজ। ইশারায় কাউন্টারের দিকে দেখালেন অ্যাডভানি।

শিভালকরের কোনও ফোন এসেছিল?

ওঃ—হো–।

কী হল?

একদম ভুলে গেছি। ওঁর একটা ফোন এসেছিল। যে ফোন করেছিল তার কথা শুনে। মনে হয়েছে মিস্টার শিভালকরের ওপর বেশ রেগে আছে। তার ধমকের উত্তরে শিভালকর খালি বলছিলেন, শুধু-শুধু রাগ করছ কেন, প্যাটেল? আগে আমাকে বলতে দাও। আহা, শোনই না, এইরকম সব কথা।

এসব ধমক ছাড়া লোকটা আর কী বলেছে?

কিচ্ছু না। তারপর হঠাৎই মিস্টার শিভালকর ফোন নামিয়ে রাখেন।

প্যাটেল আর ফোন করেছিল?

না।

ও ফোন করেছিল কখন?

সময়টা ঠিক খেয়াল নেই। তবে চারটের এদিক ওদিক হবে। হঠাৎই তিনি যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। আপনমনেই বললেন, ওঃ, আমার শত্রুরও যেন আলসার না হয়।

নোটবইতে আরও কয়েকটা কথা টুকে নিয়ে প্রতাপ অ্যাডভানিকে সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ জানালাম। তারপর হোটেলের লাগোয়া পথ ঘুরে ফিরে গেলাম পেছনের গলিতে। পুলিশ ডক্টর ও সুরেশ নন্দার কাজ কদ্দূর এগোল কে জানে!

ঘটনাস্থলে এখন আরও দুটো পুলিশের গাড়ি ও একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে অনিবার্যভাবে শতখানেক দর্শক।

আমাকে দেখে সুরেশ কাছে এগিয়ে এল। আমি ততক্ষণে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকেছি।

ডক্টর হুসেন খুনের সময়টা মোটামুটি ঠিক করেছেন, স্যার। বলছেন, চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে।

দ্যাটস রাইট, মৃতদেহের পাশে হাঁটুগেড়ে বসেছিলেন ডক্টর হুসেন, আমাদের দিকে চোখ তুলে বললেন, চারটে থেকে পাঁচটা। আগে নয়, পরে নয়।

দু-চোখের মাঝে ওই চোটটা কীসের, ডক্টর?’ নন্দা প্রশ্ন করল, ওতেই কি ভদ্রলোক মারা গেছে?

হতে পারে, তবে অটন্সি না করা পর্যন্ত শিয়োর হয়ে বলা যাবে না। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি অ্যাম্বুলেন্সের দিকে একপলক তাকালেন, আমার কাজ শেষ, মিস্টার বরাট। যদি গাড়ি ছেড়ে দেন তা হলে আমি বডি নিয়ে যেতে পারি।

শিভালকরের পকেট থেকে সব কিছু বের করে নিয়েছ, সুরেশ? আমি প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ, প্যান্টের উঁচু হয়ে থাকা পাশপকেট চাপড়ে বলল সুরেশ, তবে তাতে কাজের কিছু নেই। শুধু ওই কার্ড আর টাকা।

বডি রিলিজ অর্ডার ডক্টর হুসেনের হাতে দিয়ে আমি আর নন্দা ভিড় ঠেলে বাইরে এলাম। উঠে বসলাম জিপে।

ও, শিভালকর তা হলে হীরে জহরতের দালালি করত? আমার কাছ থেকে হোটেল ঘর অনুসন্ধানের ইতিহাস ও অ্যাডভানির জবানবন্দি শোনার পর নন্দা বলল, কিন্তু কয়েক শো লোক হয়তো আজ সারাদিন এই হোটেলে যাতায়াত করেছে, আর আমরা খবর পেলাম শুধু সোনালি সিল্কের শাড়ি পরা ওই মেয়েটার। এ দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য, ঈশ্বর জানেন।

বেয়ারাকে জিগ্যেস করলে হয়তো আরও অনেকের খোঁজ পাওয়া যাবে। ইঞ্জিন চালু করে জিপটা গলি থেকে ব্যাক করতে শুরু করলাম আমি শিভালকরের কার্ডের ঠিকানায় যাচ্ছি, সুরেশ। তুমি–।

জানি, হাসল সুরেশ নন্দা, আমি গিয়ে ওই চারতলার হোটেল-ঘর পাহারা দেব আর যতরকম কায়দায় সম্ভব পুলিশি তদন্ত চালাব।

সুরেশকে আমি ভীষণ স্নেহ করি এবং অনাবশ্যক প্রশ্রয় দিই। তাই সান্ত্বনা দিতে বললাম, কাউকে তো এ কাজ করতেই হবে। তুমি ছাড়া আর কাকে ভরসা করব?

সুরেশের মুখ সহজ হল।

আমি বলে চললাম, প্রথমে বেয়ারা আবদুলকে ধর। খোঁজ করে দ্যাখো শিভালকরের ঘরের আশপাশের বোর্ডাররা কেউ কিছু শুনেছে বা দেখেছে কি না। তা ছাড়া রাস্তার কোণায় একটা পানের দোকান আছে। সেই দোকানদারও হয়তো কিছু দেখে থাকতে পারে।

মোড় ঘুরে হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। সুরেশকে বললাম, আর একটা কথা, কাউকে লিপস্টিকটা দিয়ে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দাও। জহুরিদের চিহ্ন খুঁজে ওটা কার দোকানে তৈরি হয়েছে বের করতে বলো।

আচ্ছা, স্যার, তাহলে আপনি রওনা হন। সুরেশ নন্দা জিপ থেকে নেমে পড়ল। আমি একটা আশ্বাসের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম।

.

সতেরো এলগিন রোড প্রথম নজরে বড়লোকের ফ্ল্যাটবাড়ি। অথচ ভেতরটা ছমছমে এবং টিমটিমে আলোয় আলোকিত। অন্তত গোটাদশেক ডাকবাক্স সিঁড়ির নীচের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। ডাকবাস্কের লেখা পড়বার মতো আলো যথেষ্ট নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। দুদিকের দুই ফ্ল্যাটের নেমপ্লেট পড়তে কোনও অসুবিধে হল না। না, শিভালকর বলে কেউ দোতলায় থাকে না।

তিনতলায় এসে অনুসন্ধান শেষ হল। কিন্তু অবাক হলাম ফ্ল্যাটের নেমপ্লেটে দুটো নাম দেখে : বি. শিভালকর এবং এস. সরজানা–এজেন্টস। ভাবলাম, এক জাতের পাখি, দল বেঁধেছে নাকি? কিন্তু মানুষের অবাক হওয়ার শেষ নেই। নিজের মৃত্যুতে পর্যন্ত সে অবাক হয়। সুতরাং বেল না টিপে দরজায় জোরে নক করলাম।

একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ঘরের উজ্জ্বল আলো মাথার পেছনে জ্যোতির মতো ধরে রেখে দরজায় যিনি আবির্ভূত হলেন সম্ভবত সে-ই সরজানা। দু-হাত বুকে রেখে বিবেকানন্দ ভঙ্গীতে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে। চেহারা শক্ত-সমর্থ, মাথায় ঘন চুল, ছোট অথচ তীক্ষ্ণ চোখ।

আমাকে দেখে রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল, আপনিই দরজায় নক করেছেন?

আমি চারপাশে তাকিয়ে যেন কাউকে খুঁজলাম। বললাম, নক করার মতো আর কাউকে তো দেখছি না।

আবার একটা রুক্ষ উত্তর দিতে প্রস্তুত হচ্ছিল সরজানা, আমি আই.ডি.-টা বের করে ওর চোখের সামনে তুলে ধরলাম। বললাম, ইন্সপেক্টর বরাট, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট লালবাজার।

সরজানার মুখের রেখা নরম হয়ে এল।

আপনি বিশ্বনাথ শিভালকরের বন্ধু?’ওকে প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ, আমরা দুজনেই এখানে থাকি। কী হয়েছে?

দরজায় দাঁড়িয়ে কথা হয় না, ভেতরে চলুন।

সরজানা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল। অবশেষে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাকে ভেতরে আহ্বান জানাল।

বসবার ঘরটা বেশি বড় নয়, তবে তার সাজগোজ অমিতব্যয়িতার ইঙ্গিত দেয়। আমি একটা ফোমের চেয়ার বসবার জন্যে বেছে নিয়ে সরজানাকে ইশারা করলাম মুখোমুখি সোফাটায় বসতে।

এবার কাজের কথা হোক। বলে পকেট থেকে নোটবই ও বলপেন বের করে নিলাম আমি, আপনার পুরো নামটা বলুন।

সরজানার কপাল এখনও করোগেটেড অ্যালুমিনিয়াম। তবে ও সোফাটায় গিয়ে বসল, বলল, শ্যাম সরজানা।

মিস্টার শিভালকর আপনার অনেকদিনের বন্ধু?

না। তবে বেশ কিছুদিন আমরা একসঙ্গে আছি। একটু থেমে সরজানা প্রশ্ন করল, কেন?

একটা খারাপ খবর আছে, মিস্টার সরজানা। বিশ্বনাথ শিভালকর খুন হয়েছে।

ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই সিদ্ধান্ত পালটাল। স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বসে রইল যেন বুঝতে চাইছে আমি সত্যি কথা বলছি কি না।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কী করে? শ্যাম সরজানা প্রশ্ন করল।

এখনও আমরা ঠিক জানি না। কেউ ওঁকে তিনতলা বা চারতলার জানলা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ব্যাপারটাকে হয় সুইসাইড নয় অ্যাকসিডেন্ট বলে দেখাতে চেয়েছে কিন্তু পুলিশ এত বোকা নয়।

কেউ মানে? তার মানে খুনিকে আপনারা এখনও ধরতে পারেননি?

এখনও পারিনি।

হঠাৎই সরজানা উঠে দাঁড়াল। ঘরের একপ্রান্তের তাক থেকে একটা হুইস্কির বোতল তুলে নিয়ে একটা গেলাসে কিছুটা ঢালল। বলল, আপত্তি নেই তো?

নেভার মাইন্ড। আপনি খান।

গেলাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে ধীরে-ধীরে সোফার কাছে ফিরে এল সরজানা, বসল।

শিভালকর মারা গেছে বিশ্বাস হতে চায় না। ও বলল।

মিস্টার শিভালকর বিয়ে করেননি?

না।

তার আত্মীয়স্বজন কাউকে চেনেন? আমরা তাঁদের খবর দিতে চাই।

না, চিনি না। ও কখনও কারও কথা বলেনি। তবে শিভালকরের বাবা-মা অনেকদিন মারা গেছেন। আমি জানি।

ওঁর আয় কেমন ছিল?

ভালোই। মোটামুটি আমার মতো। মাসে তিন-চার হাজার টাকার মতো। আপনিও পাথর কেনাবেচা করেন?

পাথর বলতে হীরে আর চুনি। শুধু বেচি। শিভালকরও তাই করত।

শিভালকরকে খুন করতে পারে এমন কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?

তেতো হাসি হাসল সরজানা। বলল, দুতিনজনের নাম এখুনি বলতে পারি।

কে কে?

প্রথমত কবিতা পারেখ। এই মেয়েটাকে শিভালকর বিয়ে করবে বলে সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু আর একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে ও কবিতাকে ছেড়ে দেয়। তখন কবিতা বারবার করে

চেঁচিয়ে বলেছিল, বিশ্বনাথকে ও খুন করবে।

উনি নিশ্চয়ই সে-কথায় আমল দেননি?

না, প্রথমটা ঠিক দেয়নি। কিন্তু পরে ভয় পেতে শুরু করেছিল। সবসময় সতর্ক থাকতে চেষ্টা করত। শেষের দিকে তো কবিতার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেই বসেছিল।

করার চুমুক দিল শাশ, মতো দামি পাথর

মতো হয়ে গেছে

কবিতা পারেখ কোথায় থাকে জানেন?

দমদম। তিনের এক, এম.সি. গার্ডেন রোড।

আর কার কথা যেন বলছিলেন?

গেলাসে আর একবার চুমুক দিল শ্যাম সরজানা।

হ্যাঁ–নৃপেন দত্তর কথা। সেও আমাদের মতো দামি পাথর বিক্রি করে। ওর ধারণা বিশ্বনাথ বারকয়েক ওর খদ্দের ছুটিয়ে নিয়েছে। ব্যাপারটা ওর কাছে ম্যানিয়া মতো হয়ে গেছে। একবার তো ওদের হাতাহাতি মারপিট শুরু হয়ে গিয়েছিল, আমিই কোনওরকমে থামিয়ে দিয়েছিলাম। একটু থেমে সরজানা আবার বলল, আসলে নৃপেন দত্ত ভালো সেলসম্যান নয়। না আছে টাকা, না আছে কথা। শিভালকরকে ও হিংসে করত।

নৃপেন দত্ত কোথায় থাকে?

খিদিরপুরে শুনেছি। তবে ঠিকানা জানি না।

পাতা উলটে নোটবইয়ের নতুন পাতায় এলাম।

দুজন হল, আমি বললাম, আর কেউ?

না–অন্তত আমি জানি না।

মিস্টার শিভালকরকে প্যাটেল নামে একজন ফোন করেছিল। উনি এই প্যাটেলকে ভীষণ ভয় করতেন। এ নামে কাউকে চেনেন?

শ্যাম সরজানার ভুরু কিছুক্ষণের জন্যে কুঁচকে গেল। তারপর ও মাথা নাড়ল না, চিনি না।

মিস্টার শিভালকর কোনওরকম বিপদে পড়েছিলেন? ধরুন কারও কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া, কিংবা কোনও মামলায় জড়িয়ে পড়া, বা জুয়ার বোর্ডে সর্বস্বান্ত হওয়া–এরকম কিছু?

না। অন্তত আমি যদুর জানি।

আপনি বললেন, অন্য একটা মেয়ের জন্যে মিস্টার শিভালকর কবিতা পারেখকে ছুটি দিয়েছিলেন। কে সে মেয়ে?

যমুনা সরকার। বাঙালি। ইশারায় অদূরে টেবিলে রাখা একটা ফটোর দিকে দেখাল সরজানা : ওই যে–ওর ফটো।

ফটোটা পরীক্ষা করতে কাছে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটার বয়েস কম, এবং দেখতে সত্যিই সুন্দর। কিন্তু ওর সৌন্দর্যে রয়েছে কেমন এক অদ্ভুত শীতল দীপ্তি। তা ছাড়া ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেশ টানা-টানা দুটো চোখকে সংক্রামিত করতে পারেনি।

ফিরে এসে আবার বসলাম, সরজানার মুখোমুখি।

ওঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার, আমি বললাম, ঠিকানা জানেন?

না।

মিস্টার শিভালকর দেখছি মেয়েদের মধ্যমণি ছিলেন, কী বলেন?

ঠিক তা নয়। মেয়েরা ওর কাছে ভিড় করত, কিন্তু ও একসঙ্গে একজনের বেশি কাউকে পাত্তা দিত না। একটু থামল শ্যাম সরজানা, তারপর বলল, এই যমুনা মেয়েটা বিশ্বনাথকে যেন জাদু করেছিল। বেচারা ওর প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আসলে কবিতা পারেখকে ও বিয়ে করবে বলে সব ঠিক ছিল। কিন্তু ওই যমুনা মেয়েটা কোত্থেকে যে এসে উদয় হল, ব্যস, বিশ্বনাথ কবিতা ভুলে নিছক গদ্যে মনোযোগ দিল। যমুনার প্রেমে হতভাগা একেবারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

যমুনা সরকারের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?

না। কখনও দেখিনি, আর মাঝে-মাঝে মনে হত, শিভালকরও ওকে কোনওদিন না দেখলে ভালো হত। দিনরাত্তির ওর মুখে খালি যমুনার কথা, আর কাজকর্ম ফেলে মেয়েটার পেছনে ঘুরঘুর করত। বললাম তো, না দেখলে বিশ্বাস হবে না।

চেয়ারে নড়েচড়ে বসে নোটবইয়ে একটা নতুন পয়েন্ট লিখে নিলাম।

মিস্টার শিভালকর কার হয়ে কাজ করতেন?

কারও হয়ে নয়। খাতায় সই করে পাথর নিত।

খাতায় সই করে?

হ্যাঁ, ধারে। প্রায় আধডজন জহুরির কাছ থেকে ও খাতায় সই করে হীরে চুনি এসব নিত। তারপর পাথর বিক্রি হলে তাদের টাকা শোধ করত।

তাহলে বাজারে তাঁর সুনাম ছিল বলতে হবে?

তার চেয়েও বেশি।

বিশ্বনাথ শিভালকরকে আপনি শেষ কখন দেখেন, মিস্টার সরজানা?

চকিতে আমার দিকে তাকাল শ্যাম সরজানা। তারপর গেলাস তুলে চুমুক দিল। অবশিষ্ট তরলটুকু শেষ করতে করতে গেলাসের ওপর দিয়ে আমাকে স্থির চোখে লক্ষ করতে লাগল।

আমাকে সন্দেহ করছেন? ও বলল।

জাস্ট রুটিন, মিস্টার সরজানা, আশ্বাস দিয়ে বললাম, কখন দেখেছেন?

টেবিলের এক কোণে গেলাসটা নামিয়ে রাখল ও, বলল, আজ সকালে। তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল। ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।

কী হয়েছিল?

শিভালকরের ঘরেই আমাদের কমন একটা ফোন রয়েছে। আজ ভোরে, প্রায় ছটা নাগাদ, আচমকা টেলিফোন বেজে ওঠে। আমার ঘুম ভেঙে যায়। সুতরাং আমি বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে চা করতে যাই। কয়েক মিনিট পরেই দেখি বিশ্বনাথ অ্যাটাচি কেস হাতে জামাকাপড় পরে হাজির। ওকে দেখে মনে হল যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে। জানি না, তার কারণ ওই টেলিফোন কি না।

তখন উনি আপনাকে কী বললেন?

কিচ্ছু না। আমি জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে, কিন্তু ও কোনও উত্তর দিল না। সোজা আমাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে হুইস্কির বোতল তুলে নিয়ে বারদুয়েক চুমুক দিল। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। কারণ, গত কয়েকবছরে ওকে কখনও মদ খেতে দেখিনি। মদ ও মোটেই পছন্দ করত না। কিন্তু আজ হঠাৎ কী অদ্ভুত ব্যাপার!

উনি কিছুই বলেননি?

টুঁ শব্দ পর্যন্ত নয়। আমার মনে হয়, আমি যে সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটাই ও টের পায়নি। আমি জিগ্যেস করলাম এত সকাল সকাল কে ফোন করেছিল, কিন্তু মনে হয়নি ও আমার কথা শুনতে পেয়েছে। মাত্র আধ মিনিট-টাক ও ফ্ল্যাটে ছিল।

তারপরই কি ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন?

হ্যাঁ।

ফোনে তার সঙ্গে কী কথা হয় কিছু শুনতে পেয়েছিলেন?

না। সরজানা উঠে দাঁড়াল। গেলাসটা হাতে নিয়ে আবার এগিয়ে চলল সেটা ভরতি করতে।

ওকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করতে লাগলাম। শ্যাম সরজানার কী একটা আচরণ যেন আমার মনে খটকা জাগিয়ে তুলছে। একমাত্র মদের গেলাসে চুমুক দেওয়া ছাড়া ওকে বিন্দুমাত্রও উত্তেজিত মনে হচ্ছে না। না, বিশ্বনাথ শিভালকরের মৃত্যু ওকে উচিতমতো অবাক করতে পারেনি। কিন্তু ও ফিরে এসে সোফায় বসতেই এই প্রথম টের পেলাম, ওর সমস্ত নিরুত্তাপ নির্লিপ্ত আচরণ শুধুমাত্র ওপর-ওপর। শ্যাম সরজানার বুকের ভেতরে উত্তাল কালবৈশাখী।

সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে ও বসল। মুখে ক্লান্তি ও বিরক্তির যুগপৎ ছাপ, কিন্তু মদের গেলাসটাকে যে শক্তিতে ও আঁকড়ে ধরেছে তাতে আঙুল থেকে সমস্ত রক্ত সরে গেছে।

নোটবইয়ের পাতা উলটেপালটে উঠে দাঁড়ালাম। আমার অনুসন্ধান এখন ত্রিমুখী ও কবিতা পারেখ, নৃপেন দত্ত ও যমুনা সরকার। সুতরাং তার প্রথম ধাপ হিসেবে এগিয়ে গেলাম ছোট টেবিলটার কাছে। যমুনা সরকারকে তুলে নিলাম। বললাম, মিস্টার সরজানা, হোপ ইউ উডুন্ট মাইন্ড-ফটোটা আমাদের দরকার।

আমি কেন মাইন্ড করতে যাব, তেতো হাসি ফুটে উঠল শ্যাম সরজানার ঠোঁটে : যে মাইন্ড করত–আর কখনও করবে না।

আপনার সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ। দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি : নতুন কোনও ডেভালাপমেন্ট হলে খবর দেব।

শিভালকরের খুনিকে খুঁজে বের করুন। সহজভাবে বলল সরজানা।

করব। সরজানা ও শিভালকরের ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

এলগিন রোড এখন স্বভাবসিদ্ধ শান্ত এবং অন্ধকার। কিন্তু চোখ বুজলে উষ্ণতা ও আদ্রর্তার কারণে দুপুর বলে ভুল হতে পারে। রাস্তার আলো যথারীতি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ জ্বলছে।

জিপে উঠে রওনা হলাম। আমি এখন কবিতা পারেখের সঙ্গে কথা বলতে চাই। যার খুনের হুমকি শুনে মহিলাপ্রিয় বিশ্বনাথ শিভালকর পর্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিল।

.

তিনের এক, এম.সি. গার্ডেন রোডের সঙ্গে কবিতা পারেখকে যোগ করলে যোগফল জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়। সুতরাং চিন্তিতভাবেই দরজার কলিংবেলে চাপ দিলাম।

দরজা খুলল সুপুরুষ সুদর্শন এক যুবক। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। আমাকে দেখে সপ্রসন্ন চোখে প্রশ্ন করল, কাকে চাই?

আমি পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখালাম।

হোমিসাইড। লালবাজার।

যুবকের ফরসা মুখে অবাধ্য রক্তের ঝলক দেখা দিল। তবুও চেষ্টাকৃত রুক্ষ গলায় বলল, হোয়াট ফর?

কবিতা পারেখ আপনার কে হয়?

বোন। ছোট বোন। হাসলাম। বললাম, আপনার ছোট বোনের প্রাক্তন প্রেমিক খুন হয়েছে।

যুবকের মুখ থেকে এবার রক্ত বিদায় নেওয়ার পালা। তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দিয়ে আমাকে ভেতরে ডাকল, আসুন–ভেতরে আসুন।

বসবার ঘরে ছিমছাম পরিচর্যার ছাপ। রবীন্দ্রনাথের খ্রিস্ট ভঙ্গিমার ছবি বাঙালিপ্রীতির ইঙ্গিত দেয়। সুন্দরীর থুতনিতে বিউটি স্পটের মতো ঘরের মধ্যমণি সানমাইকা লাগানো টেবিলে রজনীগন্ধাগুচ্ছ শোভা পাচ্ছে।

একটা চেয়ার বেছে নিয়ে বসলাম। যুবককে উদ্দেশ্য করে বললাম, মিস পারেখকে একবার পাঠিয়ে দিন।

যুবক ইতস্তত করছে দেখে বললাম, উনি বাড়ি নেই ছাড়া আর যা কিছু বলবেন শুনতে রাজি আছি।

যুবক নিস্ক্রান্ত হল।

একটু পরেই গদ্যময় রুক্ষ কবিতা পারেখ ঘরে এসে ঢুকল। অভিজ্ব্যক্তি বলে দেয়, দাদা অনেক কিছুই ওকে খুলে বলেছে।

কবিতার চুল কাঁধ ছুঁয়ে থেমেছে, গাল সামান্য ভাঙা, নাক-চোখ তীক্ষ্ণ, কপালে সবুজ টিপ।

আমার খুব কাছে এসে বসল কবিতা। বলল, কী চাই বলুন?

বিশ্বনাথ শিভালকরকে কেউ তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছে। সহজ সুরে ওকে জানালাম।

ও চকিতে শ্বাস টানল, তারপর স্বাভাবিক হল। চোখ ফিরিয়ে দেখি, কবিতার দাদা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। সুতরাং তাকে লক্ষ্য করে বললাম, মিস্টার পারেখ, কাজ যখন নেই তখন খই ভাজুন গিয়ে।

পারেখ সলজ্জে অদৃশ্য হল।

আপনার দাদা কী করেন? কবিতাকে প্রশ্ন করলাম।

লোহার ব্যাবসা। ও অসন্তুষ্টভাবে উত্তর দিল।

দোকান কোথায়?

এখানেই।

এবার কবিতা পারেখের মতো তুঙ্গ আধুনিকার দমদমবাসের উত্তর খুঁজে পেলাম। দাদার কর্মস্থল–বারাণসীর চেয়েও পুণ্যধাম। সুতরাং বিশ্বনাথ প্রসঙ্গে ফিরে এলাম।

মিস্টার শিভালকরকে কেউ খুন করেছে। ন্যাস্টি বিজনেস। ওকে বললাম।

তো কী করব? কবিতা পারেখের চোখে আগুন জ্বলে উঠল : কেঁদে ঘর ভাসাব, না সহমরণে যাব?

তার দরকার নেই। গোটাকয়েক প্রশ্নের উত্তর দিলেই কাজ হবে।

অবাধ্য চুলের গোছা কপাল থেকে সরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসল ও। বলল, আপনি তো ধরেই বসে আছেন আমি ওকে খুন করেছি, তাই না?

আমি সেকথা বলিনি, মিস পারেখ।

বলতে হয় না, আপনার কুৎসিত মুখে সে কথা স্পষ্ট লেখা রয়েছে।

আমাদের লালবাজারে কুৎসিত হাজত-ঘরও আছে। হয়তো সেখানেই আপনার উত্তর দিতে সুবিধে হবে।

সত্যি কথা বলতে গেলে, আমি খুন করিনি এবং আরও সত্যি কথা বলতে গেলে, খুনটা করতে পারলে আমি খুশিই হতাম।

অথচ আপনিই একদিন মিস্টার শিভালকরকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়েছিলেন।

শ্যাম সরজানা তা হলে কিছুই বলতে বাকি রাখেনি দেখছি!

মিস পারেখ, আপনি সময় কাটান কী করে?

ডিজাইনারের কাজ করি। লিপস্টিক, বেল্টের বাল, চশমার ফ্রেম, পারফিউমের শিশি, গয়নাগাটি–এইসব।

আজ বিকেলে আপনি কোথায় ছিলেন? চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে?

ও–ওই সময়েই বুঝি বিশ্বনাথ খুন হয়? কবিতা পারেখ বলল।

প্রশ্নের উত্তর দিন।

সারাদিন বাড়িতে বসে কাজ করছিলাম। ইচ্ছে হলে দাদাকে জিগ্যেস করতে পারেন। যদুর শুনেছি, মিস্টার শিভালকরকে আপনি খুন করবেন বলে ভয় দেখিয়েছিলেন।

সরজানা নিশ্চয়ই এটাও বলতে বাকি রাখেনি! সোজা হয়ে বসল কবিতা। হাঁটুর কাছে শাড়িটা টেনে ঠিক করল।

শুধু বিয়ে করতে রাজি হয়নি বলে কোনও মেয়ে তার প্রেমিককে খুন করবে বলে শাসিয়েছে, এমনটা বেশি শোনা যায় না।

শুধু বিয়ে করতে রাজি হয়নি বলে! আপনি এমনভাবে বলছেন যেন ব্যাপারটা অনেকটা সিনেমায় যেতে রাজি না হওয়ার মতো তুচ্ছ। কবিতা পারেখের মুখ লাল হল। ওর কথার সুরে অহঙ্কার উঁকি মারল? তা ছাড়া আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো নই। এ ধরনের ফাজলামি আমি বরদাস্ত করি না।

আর কিছু!

কবিতার কালো চোখের তারায় আগুন জ্বলে উঠল সত্যি, আপনার তুলনা নেই! এ ছাড়া আর কী ও করবে? আমায় ফাঁসি দেবে?

যমুনা সরকার বলে কাউকে চেনেন?

না। একটু থেমে ও বলল, কেন, চেনা উচিত?

প্যাটেল নামটা আগে শুনেছেন?

না। যদি অবশ্য বল্লভভাই প্যাটেল না হন।

ব্যঙ্গের খোঁচাটা গায়ে মাখলাম না। জিগ্যেস করলাম, ব্লু স্টার হোটেলে কখনও গেছেন?

নামই শুনিনি।

আপনার সাউথ ইন্ডিয়া সিল্কের কোনও শাড়ি আছে? সোনালি রঙের?

না।

মিস্টার শিভালকরের মৃত্যুতে খুশি হয় এমন কারও নাম বলতে পারেন?

হ্যাঁ। আমি।

মিস পারেখ, এবার অন্তত একটু নরম হন।

উত্তরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কবিতা। গালে হাত দিয়ে পায়চারি করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর ধীরে-ধীরে বলল, এক নম্বর হল, ওই অপদার্থটা। শ্যাম সরজানা। ও বিশ্বনাথকে দেখতে পারত না। ভীষণ ঘেন্না করত।

কেন?

আমার জন্যে। শ্যামের কাছ থেকে বিশ্বনাথ আমাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। একথা নিশ্চয়ই ও বলেনি, কী বলেন? অর্থবহভাবে একটু থামল কবিতা, তারপর বলল, ব্যাপারটা শ্যামের মনে খুব লেগেছিল। ও একেবারে ভেঙে পড়েছিল। কাজে বেরোনো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাল কবিতা। একটু ভুরু উঁচিয়ে হাসল ও এবার বুঝেছেন?

এরপরেও ওঁরা একসঙ্গে থাকতেন?

তাতে কী?

কবিতা পারেখকে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করলাম কিন্তু কাজে লাগার মতো কোনও উত্তর পেলাম না। সুতরাং যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম।

সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, মিস পারেখ, আমি বললাম, দরকার হলে আপনার সঙ্গে আবার দেখা করতে আসব।

নিশ্চয়ই আসবেন। আর সুসংবাদ শোনানোর জন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ—

.

হোমিসাইড স্কোয়াডে যখন ফিরলাম, অফিসের বড় দেওয়ালঘড়িতে তখন নটা চল্লিশ। সুরেশ নন্দা ইতিমধ্যে ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্টটা টাইপ করিয়ে নিয়েছে। একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে সেটাতেই চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল, আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। ঠিক পাখার নীচে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমি ধপ করে বসে পড়লাম। ওকে প্রশ্ন করলাম, হোটেলে কেমন গেল?

সব শান্তি মতো মিটে গেছে। শিভালকরের ঘরে সিল মেরে দিয়েছি।

কিছু পেলে?

না, ঘরে কিছু পাইনি। কাচের গেলাস, হুইস্কির বোতল, থাস আপের বোতল, কোনওটাতেই কোনও ছাপ নেই। কেউ পরিষ্কার করে ওগুলো মুছে রেখে গেছে। তবে অন্য জিনিসের সঙ্গে ওগুলোও ল্যাবে পাঠিয়েছি।

ভালো। আর লিপস্টিকটা? ওটা কার দোকানে তৈরি জানা গেল?

সুরেশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল : একটু আগেই জানতে পেরেছি। বউবাজারে খবর নিতেই সব বেরিয়ে পড়েছে। ওটা অরিন্দম জুয়েলার্স-এর তৈরি। কিন্তু আমরা যখন গেলাম, তখন দোকান বন্ধের সময়। তাই মালিককে দোকানে পাইনি। ফলে কে ওটা তৈরি করিয়েছে, তার নামও জানতে পারিনি। কাল সকালেই জানা যাবে।

আবদুলের সঙ্গে কথা বলেছ?

শুধু আবদুল কেন, সব চাকর-বেয়ারার সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা কিছুই দ্যাখেনি, শোনেনি। আর শিভালকরের আশপাশের ঘরের লোকেরাও কিছু জানে না। মোড়ের মাথার পানওয়ালা বলেছে যে, সোনালি শাড়ি পরা মেয়েটিকে সে দেখেছে। মেয়েটি নাকি চারটে নাগাদ ব্লু-স্টারে ঢুকেছিল। না, ওকে সে বেরিয়ে আসতে দ্যাখেনি।

আর কিছু পাওনি?

পেয়েছি, স্যার। হাসল সুরেশ নন্দা ও প্রায় জনাপাঁচেক জহুরির ফোন পেয়েছি। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে বিশ্বনাথ শিভালকর তাদের কাছ থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকার হীরে আর চুনি ধারে বেচতে নিয়েছিল–আজ সকালেই। একটু থেমে ও বলল, হয়তো ওই পাথরগুলোর জন্যেই শিভালকর খুন হয়েছে। নয় এও হতে পারে, পাথরগুলো নিয়ে ও পালানোর মতলব করেছিল। কে জানে আসলে কী হয়েছে। হতাশভাবে কথা শেষ করল সুরেশ।

সুরেশকে শ্যাম সরজানা ও কবিতা পারেখের ইন্টারভিউ সংক্ষেপে শোনালাম। তারপর বললাম, শ্যাম সরজানা, কবিতা পারেখ, যমুনা সরকার, নৃপেন দত্ত এবং বিশ্বনাথ শিভালকরের নামে পার্সোনাল ফাইল খুলতে। আর প্রথম চারজন সম্পর্কে অপারেশনাল অ্যাক্টিভিটিজ যেন এই মুহূর্তে শুরু হয়।

আই ওয়ান্ট দ্য ফাইলস টু বিকাম থিক বাই টুমরো নুন–শার্প।

পরদিন সন্ধ্যায় সব খবরই পাওয়া গেল।

অন্য তিনজন আইনের চোখে নিষ্পাপ নাগরিক সার্টিফিকেট পেলেও যমুনা সরকার আমাদের অবাক করল। তদন্তে জানা গেছে, ও বিবাহিতা, এবং ওর স্বামী এক জেল খাটা দাগি আসামি। তার নাম রূপেন সরকার। মাত্র চারদিন আগে সে ক্রিমিনাল মেন্টাল হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েছে।

রূপেন সরকারের কীর্তির ইতিহাস খুলে দেখা গেল, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, কিডন্যাপিং ইত্যাদি সে-ইতিহাসের প্রথম পরিচ্ছেদ। এবার সে ধরা পড়েছিল সশস্ত্র ডাকাতির অভিযোগে। তার অপরাধের একমাত্র সঙ্গী নরেশ রাও। রূপেনের বর্তমান ঠিকানা জানা যায়নি, তবে নরেশ রাও বর্তমানে আছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের আট নম্বর বাড়িতে। ওটাই তার বরাবরের ডেরা।

ফাইলগুলো আমার পড়া শেষ হলে সুরেশ বলল, শিভালকর কি জানত, ওর গার্লফ্রেন্ডের একটা স্বামী আছে?

আর সেই স্বামী পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে মাত্র চারদিন আগে! নাটক দারুণ জমে উঠেছে, সুরেশ।

উঠে গিয়ে ফোন তুলে নিলাম। অপারেশন ডিভিশনকে বললাম রূপেন সরকারকে যেখান থেকে তোক পিক আপ করতে। তারপর বেরোনোর জন্যে তৈরি হলাম।

সুরেশকে বললাম, চল, মিসেস যমুনা সরকারকে একবার দর্শন দিয়ে আসি। অনেকক্ষণ ওকে বঞ্চিত করে রেখেছি।

.

কিন্তু ঘটনাচক্রে মিসেস যমুনা সরকার সত্যিই বঞ্চিত থেকে গেল, কারণ ও বাড়ি ছিল না।

তদন্তে জানা গেছে, যমুনা সরকার রূপেন সরকারের সঙ্গে থাকে না, এবং স্বামীর গুণের কথা চিন্তা করেই হয়তো নিজেকে এখনও কুমারী বলে ঘোষণা করে চলেছে। ওর পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম তালা বন্ধ। সুরেশের দিকে এক পলক তাকালাম ও অর্থাৎ ঠিকানা জানতে ও ভুল করেনি তো! ও আমার নীরব সংশয় বুঝতে পেরে বলল, এই ফ্ল্যাটেই উনি থাকেন। নো মিসটেক।

নরেশ রাওয়ের ফ্ল্যাটে গিয়েও একই ফল হল। রাও বাড়িতে নেই। তা হলে কি ও রূপেনের সঙ্গে দেখা করতে গেছে?

সিঁড়ি নামতে নামতে সুরেশকে বললাম, এই রেটে যদি তদন্ত এগোতে থাকে তা হলে আমাদের রিটায়ার করতে আর বেশি দেরি নেই।

ধর্মতলা পোস্ট অফিস থেকে ডিপার্টমেন্টে ফোন করলাম। বললাম, যমুনা সরকার কিংবা নরেশ রাওকে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে থানায় হাজির করতে। এ ছাড়া দুজন সাদা পোশাক ডিটেকটিভকে ওদের ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখতে বললাম। তারপর আমরা গাড়িতে উঠলাম।

আমি চালাচ্ছি, ড্রাইভারের সিটে উঠে বসল সুরেশ, জিগ্যেস করল, কোথায় যাবেন এখন?

নিয়ের এক জগন্নাথ সরকার লেন। খিদিরপুর।

নৃপেন দত্ত? সুরেশই ঠিকানাটা খুঁজে বের করেছে, তাই ও জানে।

হ্যাঁ। শিভালকরের রক্তের প্রতিদ্বন্দ্বী। ওকে বললাম।

সুরেশ না দীর্ঘশ্বাস ফেলল : বেচারা শিভালকর। এই শহরে কে যে ওর বন্ধু ছিল তা শুধু ঈশ্বরই জানেন!

নৃপেন দত্তর বয়েস প্রায় পঁয়তাল্লিশ। মাথার দুপাশের চুলে পাক ধরেছে। দীর্ঘকায় বলেইহয়তো শরীরের কাঠামো কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। ঠিকরে আসা চোখের ওপর রিমলেস চশমা। প্রত্যেক প্রশ্নেরই চটপট উত্তর দিল সে–শুধু একটা প্রশ্ন ছাড়া ও চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে সে কোথায় ছিল। সে বলল, ওই সময়টা সে গঙ্গার ধারে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল। এবং হীরে কেনাবেচার কথা ভাবছিল।

আর বিশ্বনাথ শিভালকরের সঙ্গে তার মন কষাকষির ব্যাপারটা? না, না, ওটা নিছকই ভুল বোঝাবুঝি। তার বেশি কিছু নয়। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে শিভালকরের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। আর সেইখানেই ওই ঘটনার ইতি।

হেডকোয়ার্টারে ফোন করে জানতে চাইলাম নতুন কোনও খবর আছে কি না। জানা গেল, আছে।

নরেশ রাওয়ের ফ্ল্যাটের ওপর যাকে নজর রাখতে বলেছিলাম একটু আগে সে ফোন করে বলেছে, নরেশ রাওয়ের সঙ্গে চেহারার বিবরণ মেলে এমন একটি লোককে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখা গেছে।

.

রাওয়ের বাড়িটা আকৃতিতে পাঁচতলা, প্রকৃতিতে ধর্ষিতা কুমারী। একতলার প্রতিটি কাচের জানলায় আঠা দিয়ে কাগজের টেপ লাগানো। বাড়ির দরজায় আবর্জনার স্তূপ। বারান্দার রেলিং কোথাও আছে কোথাও নেই, এবং এককালে বাড়িটার কী রং ছিল এ প্রশ্ন তুলে অনেকের সঙ্গেই বাজি লড়া যায়।

দরজা খোলাই ছিল, সুতরাং ভেতরে ঢুকতে কোনও অসুবিধে হল না। নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে নক করলাম। সাড়া নেই।

কিন্তু ভেতরে যেন কারও নড়াচড়ার শব্দ পেলাম।

দরজায় ধাক্কা দিলাম।

কেউ সাড়া দিল না, আর নড়াচড়ার শব্দটাও যেন হঠাৎ থেমে গেল।

দরজা খুলুন! পুলিশ! আমি বললাম।

ভদ্রভাষায় দরজা খুলবে না, সুরেশ বলল, তারপর এগিয়ে এসে দরজায় একটা মাঝারি লাথি কষিয়ে দিল। একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ওপেন আপ! পুলিশ!

প্রায় পনেরো সেকেন্ড কেটে গেল।

সুরেশকে দরজার কাছ থেকে সামান্য সরিয়ে এনে বললাম, এখানে দাঁড়াও। আমি পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা দিয়ে রাওয়ের ফ্ল্যাটে ঢুকছি। যদি সেরকম কোনও শব্দ পাও সটান দরজা ভেঙে ঢুকে পড়বে।

পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা দিয়ে কার্নিশ বেয়ে পা টিপে টিপে রাওয়ের ফ্ল্যাটের দিকে এগোলাম। যেন দীর্ঘ কয়েক বছর পর ফ্ল্যাটের পেছনের কাচের জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আর একটু এগোলেই বারান্দার ভাঙা রেলিং।

কিন্তু জানলার পরদায় সামান্য ফাঁক ছিল। সুতরাং ঘরের ভেতর উঁকি মারলাম।

শ্যাম সরজানার ফ্ল্যাটে দেখা ছবির সেই মেয়েটি তার শীতল সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় সেই বাঁকা হাসির রেখাঁটি ওর ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেছে। কারণ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আলুথালু বেশে ঘরের বিছানায় ও পড়ে আছে মুখে কাপড় গোঁজা থাকায় টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছে না।

সুতরাং মিসেস যমুনা সরকারের দেখা পেলাম।

বাঁধন নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করার ফলে ওর সোনালি সিল্কের শাড়ি অনেকটা উঠে গেছে। এবং প্রকাশিত হয়ে পড়েছে পায়ের গোছ, ফরসা ঊরু ইত্যাদি।

জানলাটা চেষ্টা করেও খুলতে পারলাম না। ভেতর থেকে বন্ধ। কোমরের হোলস্টার থেকে ৩৮ পুলিশ স্পেশাল বের করে জানলার কাঁচে আঘাত করলাম। ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে পড়ল ঘরের ভেতর। একলাফে ঘরে ঢুকলাম। ছুটে গেলাম শোবার ঘরের দরজার দিকে।

ফ্ল্যাটের দরজা টেনে খুলতে যাব, দড়াম করে দরজা ভেঙে লাফিয়ে ঘরে ঢুকল সুরেশ নন্দা, হাতে উদ্যত রিভলভার।

কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনে ও আর দেরি করেনি।

শুন্য ঘরে আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কথা নেই।

কিসের আওয়াজ হল? আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সুরেশ, শুনতে পাননি?

শোবার ঘরে যমুনা সরকার হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে, আমি বললাম, আমরা ওর ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনেছি। বাঁধন খোলার চেষ্টা করছিল।

যমুনা সরকার? এখানে?

হ্যাঁ। মাথা নেড়ে বললাম, পরনে চোখ-ধাঁধানো সোনালি সাউথ ইন্ডিয়া সিল্ক। ব্লু স্টারে যে-মেয়েটি শিভালকরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তারও পরনে একই শাড়ি ছিল।

ইতিমধ্যে হট্টগোলের শব্দে অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা চারপাশে এসে ভিড় জমিয়েছে। এখন তারা হাঁ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে।

তাদের আমি বললাম, আপনারা দয়া করে চলে যান। এ পুলিশের ব্যাপার।

মিসেস যমুনা সরকার আতঙ্কে উত্তেজনায় হিস্টিরিয়াগ্ৰস্তা হয়ে পড়েছেন। শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে ওর মিনিটদশেক সময় লাগল। তারপর আমাদের শোনাল ওর কাহিনি। মাঝেমধ্যে অবশ্য খেই হারিয়ে ফেলতে লাগল। অবশেষে, বহু জোড়াতালি দিয়ে গোটা গল্পটা আমরা উদ্ধার করলাম।

ওর কথা অনুযায়ী, এক ঝুটো কিডন্যাপিংয়ের ঘটনায় জোর করে ওকে রাজি করানো হয়েছে। ক্রিমিনাল মেন্টাল হসপিটালে থাকাকালীন যমুনার স্বামী রূপেন সরকার বিশ্বনাথ শিভালকরের সঙ্গে ওর গোপন প্রেমের ব্যাপারটা জানতে পারে। রূপেন সরকারকে যমুনা ভীষণ ভয় করে। কারণ, তাকে ছেড়ে আসার পর থেকেই যমুনার প্রতি রূপেনের আক্রোশ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সুতরাং, চারদিন আগে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে সে নরেশ রাওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে, এবং দুজনে মিলে ঠিক করে, যমুনার প্রতি শিভালকরের দুর্বলতার চরম দাম তুলবে। আর একইসঙ্গে যমুনার ব্যভিচার-এর শোধ নেবে।

শিভালকরের মৃত্যুর আগের দিন রাতে রূপেন ও নরেশ যমুনাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়, নরেশ রাওয়ের ফ্ল্যাটে নিয়ে তোলে। তারপর খুনের হুমকি দেখিয়ে পরদিন ভোরবেলা ওকে দিয়ে বিশ্বনাথকে ফোন করায়। এই ফোনের কথা আমরা সরজানার কাছে শুনেছি। যমুনা বিশ্বনাথকে বলে যে, ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে, এবং সে যদি সহজে বিক্রি করা যাবে এমন কতকগুলো ছোট ছোট মণিরত্নের ব্যবস্থা করতে পারে, তা হলেই যমুনাকে বাঁচাতে পারবে, নয়তো নয়। পাথরগুলোর দাম অন্তত দেড় লাখ টাকা হওয়া চাই। বিশ্বনাথের নিজেরও তেমন ক্ষতি হওয়ার ভয় নেই। কারণ তার ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি থেকেই সে পাথরের দাম পেয়ে যাবে। বিশ্বনাথকে শুধু বানিয়ে বলতে হবে যে, দুজন সশস্ত্র লোক রিভলভার নিয়ে তাকে অন্ধকারে আক্রমণ করে ও পাথরগুলো কেড়ে নেয়। তারপর একটা নীল মারুতি করে পালিয়ে যায়। না, অপরাধীদের সে চিনতে পারেনি।

এই দেড়লাখ টাকার পাথর একটা শ্যাময়-লেদার ব্যাগে ভরে বিশ্বনাথ শিভালকর সি. আই. টি. রোডের ব্লু স্টার হোটেলে গিয়ে উঠবে। না, ছদ্মনামে নয়, নিজের নামে সেখানে সে একটা ফোন পাবে। সেই ফোনেই বলে দেওয়া হবে পাথরগুলো কোথায় কীভাবে সে পৌঁছে দেবে। কিন্তু রূপেন সরকার ব্লু-স্টারে ফোন করে কথামতো শিভালকরকে পায়নি। তখন সে ভীষণ খেপে যায়।

যমুনা সরকার উত্তেজিত গলায় বলল, আমি যে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিছু একটা করতে হবে–শুধু এটাই মনে হচ্ছিল। তারপর হঠাৎই ফ্ল্যাটের বাইরে বেরোনোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। ব্যস, বেরিয়ে পড়লাম।

তারপর? সুরেশ নন্দা প্রশ্ন করল।

আমার স্বামী যখন ব্লু-স্টারে বিশ্বনাথের রুম নাম্বারটা নরেশ রাওকে বলে, তখন আমি শুনতে পেয়েছিলাম। সুতরাং একটা ট্যাক্সি ধরে ব্লু-স্টারে গেলাম। হাজার ধাক্কা মেরেও বিশ্বনাথের ঘরের দরজা কেউ খুলল না। এমন সময় পেছনে কারও পায়ের শব্দ পেলাম–তাকিয়ে দেখি আমার স্বামী দাঁড়িয়ে, তার হাতে একটা রিভলভার। ভাবলাম, ও বোধহয় আমাকে তক্ষুনি খুন করবে কারণ ওর দু-চোখে তখন খুনের আগুন জ্বলছে। কিন্তু দেখলাম, ও রিভলভারটা পকেটে রেখে চাপা গলায় বলল, যেভাবেই হোক পাথরগুলো আমার চাই। বলে একটা প্লাস্টিকের পাত বের করে বিশ্বনাথের ঘরের দরজা ও খুলে ফেলল। দরজার হাতলের কাছে ফ্রেম ও দরজার ফাঁকে পাতটা ও ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর কী যেন একটা করতেই

আর বলতে হবে না। ও কায়দা আমরা জানি। তারপর কী হল? সুরেশ বলে উঠল।

যাই হোক, দরজা খুলে গেল। আমরা ভেতরে ঢুকলাম, আর তখনই দেখি–দেখি বিশ্বনাথ বিছানায় পড়ে আছে। স্পষ্ট বুঝলাম, ও মারা গেছে। আমি হয়তো চিৎকার করে উঠছিলাম, কারণ রূপেন ঠাস করে আমাকে এক চড় মেরে খিঁচিয়ে বলে উঠল, চুপ করো!

তারপর পাথরগুলো ও অনেক করে খুঁজল, কিন্তু বৃথাই। তখন রাগে আমার ওপর মারধোর শুরু করল। তারপর শাড়ির আড়ালে রিভলভার ধরে আমাকে ট্যাক্সি করে আবার নিয়ে এল এখানে।

আপনাকে বেঁধে রেখেছিল কেন? সুরেশ জানতে চাইল।

ওরা আমাকে খুন করবে ঠিক করেছে। রূপেনকে আমি সে কথা বলতে শুনেছি। ওদের মতলব আমি ফঁস করে দিই তা ওরা কোনওরকমে চায় না। তা ছাড়া রূপেনের ধারণা আমি ওদের মতলবের খবর কোনও না কোনওভাবে বিশ্বনাথকে জানিয়ে দিয়েছি।

ওরা এখন কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম।

জানি না। মিনিট কুড়ি আগে ওরা কোথায় যেন গেছে। হঠাৎই যমুনার দু-চোখ জলে ভরে উঠল। কান্না মেশানো গলায় ও বলল, ওরা আমাকে দিয়ে জোর করে এসব করিয়েছে। ওদের কথা না শুনলে ওরা আমাকে খুন করত। তা ছাড়া এমনিতেই তো আমাকে খুন করতে যাচ্ছিল। বিশ্বাস করুন, বিশ্বনাথকে আমি সত্যি ভালোবাসতাম!

সুরেশ এবং আমি অপলকে ওর দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বিশ্বাস করুন প্লিজ। যমুনার চোখে যমুনা, মনে যমুনা : যা যা আপনাদের বলেছি তার প্রতিটি অক্ষর সত্যি।

বিশ্বাস করলাম।

তারপর ফোন করে রাওয়ের বাড়িটার নজর রাখার জন্যে আরও কয়েকজন লোক লাগিয়ে দিলাম এবং বললাম, রূপেন সরকার ও নরেশ রাওকে যেখান থেকে হোক, যে-কোনও

অবস্থায় তোক, হেডকোয়ার্টারে তুলে আনতে। তারপর মিসেস সরকারকে নিয়ে আমি ও সুরেশ রওনা হলাম লালবাজার অভিমুখে।

.

ও.সি.-র কাছে রিপোর্ট করতে যাওয়ার আগে নিজের টেবিলটায় একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। দেখি ট্রেতে একটা রিপোর্ট পড়ে আছে। তুলে নিয়ে দেখি, শিভালকরের ঘরে পাওয়া কাচের গ্লাসের লিপস্টিক ছাপের রিপোর্ট। বলছে, শিভালকরের বিছানায় পাওয়া এল.সি. লেখা লিপস্টিক ও গ্লাসের লিপস্টিক একই। এ ছাড়া একটা অদ্ভুত খবরও আছে? গ্লাসের লিপস্টিকের ছাপ কোনও মেয়ের ঠোঁট থেকে লাগেনি, বরং মনে হয়, হাতের বুড়ো আঙুল বা তর্জনী দিয়ে কেউ গ্লাসের ওপর সেই ছাপ দিয়েছে। অটন্সি থেকে জানা গেছে, বিশ্বনাথ শিভালকর যখন মারা যায় তখন তার রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ ছিল পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট। এবং ডাক্তারি রিপোর্ট বলছে, কোনও ভেঁতা অস্ত্র দিয়ে নাকের গোড়ায় আঘাত করার ফলেই শিভালকর মারা গেছে।

রিপোর্টে চোখ বোলানো শেষ হতেই সুরেশ নন্দা ঘরে এসে ঢুকল। বলল, স্যার, ওদিকে মিসেস সরকারের স্টেটমেন্ট নেওয়া কমপ্লিট। আর আশু চক্রবর্তী লিপস্টিকের জহুরি ছাপের খবর এনেছে। সুখবরই বলতে হবে। কারণ শুধু যে ও জহুরির নামই পেয়েছে তা নয়, লিপস্টিকের মালকিকেও খুঁজে বের করেছে। ললিতা চৌধুরি, বালিগঞ্জ প্লেসে থাকে।

এ.এস.আই. আশু চক্রবর্তীকে সুরেশই বোধহয় লিপস্টিক তদন্তে লাগিয়ে থাকবে। সুতরাং প্রশ্ন করলাম, চক্রবর্তী মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছে?

হ্যাঁ। ললিতা চৌধুরির বক্তব্য, লিপস্টিকটা তার বয়ফ্রেন্ড অসীম সরকারের উপহার। অসীম সরকার বড়লোকের ছেলে, কন্সট্রাকশনের বিজনেস। তা ছাড়া লিপস্টিকটা ললিতাকে গিফট সার্টিফিকেট করে দেওয়া আছে।

চক্রবর্তী ললিতা চৌধুরিকে আগে থাকতে না ঘাঁটালেই পারত। যদি সত্যিই মেয়েটা অপরাধী হয় তা হলে এখন সতর্ক হয়ে যাবে। যাই হোক, দুশ্চিন্তা ছেড়ে প্রশ্ন করলাম, ললিতা চৌধুরি ব্লু-স্টার হোটেলে কবে গিয়েছিল?

আর বলবেন না। হাসল নন্দা ও মেয়েটা নাকি এক নম্বরের মিথ্যেবাদী। আশু চক্রবর্তীকে প্রথমে ও বলে, ও কোনওদিন ব্লু-স্টার হোটেলে যায়নি। কিন্তু অনেক সময় নষ্টের পর স্বীকার করে যে, ও গিয়েছিল প্রায় মাসখানেক আগে। কিন্তু কার সঙ্গে সেটা বলতে চাইছে না। তারপর নাকি ওই হোটেলের ছায়াও আর মাড়ায়নি। ওঃ, গল্প বটে একখানা!

ঠিক আছে, মেয়েটার সঙ্গে আমি পরে একবার কথা বলব। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম, টেবিলে টোকা মেরে একটা তাল বাজিয়ে চললাম। মনে চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। মিথ্যে কথা যে কেউ একজন বলছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে সেই একজন ললিতা চৌধুরি নয়। তা হলে কে?

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সুরেশকে বললাম, মিসেস সরকারের জন্যে একজন উকিলের ব্যবস্থা করতে।

ও অবাক হল। বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

বললাম, মিথ্যে কথার ধাঁধায় কেউ একজন আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। একটু থেমে আরও যোগ করলাম : মিসেস সরকার ও.সি.-র ঘরে আছেন। দেখো যেন কোনওরকম অসুবিধে না হয়।

সুরেশ নন্দা প্রথমটা অবাক হল, তারপর সামলে নিয়ে বলল, আমি আপনার সঙ্গে যাব?

ভয়ের কোনও কারণ নেই, সুরেশ। রিভলভারটা ঠিকমতো আছে কি না পরীক্ষা করে নিলাম। তারপর বললাম, তা ছাড়া একজনের এখানে থাকা দরকার। বলা যায় না, হঠাৎ যদি রূপেন সরকার বা নরেশ রাওয়ের খবর আসে।

একতলায় নেমে এলাম। একটা প্রাইভেট কার বেছে নিয়ে রওনা হলাম। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম বিশ্বনাথ শিভালকরের লাশটা চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে।

.

ব্লু-স্টার হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন রিসেপশন কাউন্টার সুজি গোমেজ-শূন্য। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। রাত বেশি না হলেও হোটেলের পরিবেশে কেমন এক অদ্ভুত নীরবতা থমথম করছে। তার কারণ কি বেমরসুম? কী জানি, জানি না।

কাউন্টারের ওপাশে প্রতাপ অ্যাডভানির ঘরে আলো জ্বলছে। দরজার তলা দিয়ে সেই আলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে। ঘরের ভেতরে কারও চলাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চুপি চুপি কাউন্টারের ওপারে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আস্তে হাতের চাপ দিয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করলাম। ঘরের দৃশ্য দেখার পক্ষে ইঞ্চি তিনেকই যথেষ্ট।

প্রতাপ অ্যাডভানি অত্যন্ত ব্যস্তভাবে একটা সুটকেস গোছগাছ করছেন। পরনের পোশাক দেখে মনে হয় এক্ষুনি বাইরে কোথাও বেরোবেন। একবার ছুটে আসছেন বিছানার ওপর রাখা খোলা সুটকেসের কাছে, আর একবার ছুটে যাচ্ছেন আলমারির কাছে। যেন হাতে অনেক কাজ, কিন্তু তুলনায় সময় অনেক কম।

আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, মিস্টার অ্যাডভানি? ঘরের ভেতরে পা রেখে হালকা স্বরে বললাম।

বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন অ্যাডভানি। আমার মুখোমুখি। মুহূর্তে ওঁর চোয়াল ঝুলে পড়ল, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন। রুক্ষভাবে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? কারও ঘরে যে নক করে ঢুকতে হয় সেটুকুও জানা নেই?

আছে। আমি বললাম, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের কথা ভেবে সেটা প্রয়োজন মনে করিনি।

একটা প্লেনের টিকিট বাঁ-পাশের একটা টেবিলে পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে নামটা পড়লাম। জনৈক অমৃত নাথানির নামে একটা বম্বের টিকিট।

শুধু যাওয়ার টিকিট? আমি মন্তব্য করলাম।

হোটেলের একজন গেস্টের। কিন্তু এসবের মানে কী, ইন্সপেক্টর?

আর যে-সুটকেসটা গোছগাছ করছেন ওটাও বোধহয় সেই গেস্টেরই?

যারই হোক, আপনার জানার কোনও দরকার নেই। ইচ্ছে হলে কোথাও যেতে পারব না এমন কোনও আইন এ দেশে আছে কি?

থাকতে পারে। বিশেষ করে পুলিশি তদন্তে যারা বাধার সৃষ্টি করে তাদের জন্যে তো বটেই।

বাধার সৃষ্টি? সে আবার কী? আপনার কাজে কোথায় বাধা দিয়েছি আমি?

মিথ্যে কথা বলে আমাকে ভুল পথে চালানোর চেষ্টা করে। আপনি বলেছেন, চারটে নাগাদ বিশ্বনাথ শিভালকরকে প্যাটেল নামে কেউ ফোন করেছিল।

তাতে কী হয়েছে?

প্যাটেল বলে কেউ নেই, মিস্টার অ্যাডভানি। আর বিশ্বনাথ শিভালকর সেদিন ফোনে কোনও কথাই বলেননি। মদ খাওয়া তার অভ্যেস ছিল না, কিন্তু সেদিন হোটেলের ঘরে বসে তিনি প্রচুর মদ খেয়েছিলেন। আর মরবার সময় তার রক্তে অ্যালকোহল ছিল পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট। চারটের সময় তিনি যে শুধু মদে চুর ছিলেন তা নয়, কথা বলবার জন্যে মুখ হাঁ করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। একটু থামলাম। তারপর বললাম, আপনি মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন, মিস্টার অ্যাডভানি?

না–আমি–মানে—আমি–।

তারপর ধরুন ওই লিপস্টিকের ব্যাপারটা। ওটা আপনি মিস্টার শিভালকরের বালিশের ফাঁকে রেখে দিয়েছিলেন। মাসখানেক আগে ললিতা চৌধুরি নামে একটি মেয়ে এই হোটেলে এসে ওই লিপস্টিকটা হারায়। আপনি সেটা পেয়ে আপনার টুকিটাকি রাখার পিচবোর্ডের বাক্সে রেখে দেন–যে-বাক্স থেকে আপনাকে আমি জেলুসিল ট্যাবলেট বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু যেটাকে আপনি আট-দশ টাকাওয়ালা গোল্ড প্লেটেড অ্যালুমিনিয়াম লিপস্টিক ভেবেছিলেন, সেটা সত্যিই ছিল সোনার তৈরি, গায়ে সুন্দর খোদাইয়ের কাজ করা।

আমাকে বাধা দিয়ে প্রতাপ অ্যাডভানি বললেন, বুঝেছি, আপনি আমাকে ওই খুনের দায়ে ফাঁসাতে–।

খুন বলছেন কেন? মোলায়েম সুরে বললাম, আপনার তো দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বিশ্বনাথ শিভালকর আত্মহত্যা করেছে।

প্রতাপ অ্যাডভানির মুখে ঘাম, চোখ চঞ্চল। কিন্তু কোনও উত্তর দিলেন না।

আমি বললাম, আরও একটা কথা। হাতে করে কিছুটা লিপস্টিক আপনি একটা গেলাসের কানায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে আমরা ভাবি, মিস্টার শিভালকরের ঘরে কোনও মেয়ে দেখা করতে এসেছিল। এতেই আমি একটু অবাক হয়েছি, মিস্টার অ্যাডভানি। আপনি কেন এত কষ্ট করতে গেলেন?

আমি–কথা শুরু করেও থমকে গেলেন অ্যাডভানি। চোখে আগুন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে রইলেন।

বিছানার কাছে এগিয়ে গেলাম। খোলা সুটকেস থেকে জামাকাপড়ের প্রথম থাকটা তুলে ফেললাম। হ্যাঁ, জায়গামতোই জিনিসটা পেলাম। কালো চামড়ার ছোট পাউচ একটা। আমার বিশ্বনাথ শিভালকরের কথা মনে পড়ল। পাউচটা চোখে পড়ার মুহূর্তেই পিঠে অ্যাডভানির রিভলভারের খোঁচা অনুভব করলাম। আমরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় দশ সেকেন্ড সব চুপচাপ। আমরাও নিশ্চল। তারপর…।

বাথরুমে গিয়ে ঢুকুন, অ্যাডভানি আদেশ দিলেন।

আমি বললাম, কী লাভ? গুলির শব্দ এ-হোটেলের প্রতিটি বোর্ডার শুনতে পাবে।

পাক। ক্ষতি নেই। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, এগোন, মিস্টার বরাট।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে খুব ধীরে একটা পা ফেললাম বাথরুমের দিকে আর পরমুহূর্তেই মেঝেতে শুয়ে পড়লাম এবং গড়াতে-গড়াতে নিজের রিভলভারটা বের করে নিতে চেষ্টা করলাম।

অ্যাডভানির প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল, কিন্তু দ্বিতীয়টা আমার বাঁ-হাতের বাইসেপ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর আমার রিভলভার সক্রিয় হল। এবং পেটে লাগা গুলির ধাক্কায় প্রতাপ অ্যাডভানির শরীরটা হাতচারেক পেছনে ছিটকে পড়ল।

মন্থরগতি চলচ্চিত্রের মতো পুরো ঘটনাটা দেখতে পেলাম। একটু একটু করে অ্যাডভানির ডান হাতটা নেমে এল। অবশেষে রিভলভারটা খসে পড়ল হাত থেকে। ওর দু-হাত একে একে ভাঁজ হয়ে এসে জড়ো হল পেটের কাছে। ওর শরীরটা সামনে পেছনে কয়েক সেকেন্ড ধরে দুলতে লাগল। তারপর খুব ধীরে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মেঝেতে।

এক লাথিতে অ্যাডভানির রিভলভারটা খাটের তলায় ঠেলে দিলাম। আমারটা আবার ঢুকিয়ে রাখলাম হোলস্টারে, এবং সুটকেস থেকে দুটো পরিষ্কার গেঞ্জি বের করে নিলাম।

প্রতাপ অ্যাডভানির মনোযোগ এখন শুধু নিজের তলপেটের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে বেরিয়ে আসা রক্তের দিকে। একটা গেঞ্জি ওর বেল্টের নীচে ক্ষতস্থানে গুঁজে দিলাম–যদি রক্তপাত একটু বন্ধ হয়। অন্য গেঞ্জিটা আমার বাঁ-হাতের বাইসেপে বেঁধে নিলাম। প্রতাপ অ্যাডভানি আচ্ছন্ন চোখে আমাকে লক্ষ করতে লাগলেন। ওঁকে ওই অবস্থায় রেখে বেরিয়ে এলাম কাউন্টারে। ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলাম। ইতিমধ্যে হোটেলের বহু গেস্টই নীচের লবিতে এসে হাজির হয়েছে, কিন্তু তাদের কৌতূহলী নজরকে কোনও আমল দিলাম না।

দশ মিনিটের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে এল। স্ট্রেচারে করে অ্যাডভানিকে পেছনের তোলা হল। আমি উলটোদিকে লম্বা সিটে মাথা নীচু করে বসলাম। অ্যাম্বুলেন্স অ্যাটেনড্যান্ট আমার পাশে এসে বসল। পরমুহূর্তেই একটা আলতো কঁকুনি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা চলতে শুরু করল।

জড়ানো গলায় অ্যাডভানি বললেন, মিস্টার বরাট, আপনি আমাকে খুন করলেন? আমি—আমি–।

অ্যাম্বুলেন্স-অ্যাটেনড্যান্ট অ্যাডভানির কথা শুনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি পা দিয়ে ওর পা চেপে ধরলাম। ও চুপ করে গেল। আমি জানি, অ্যাটেনড্যান্ট ছেলেটা বলতে যাচ্ছিল যে, অ্যাডভানির মরার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আর সেটা আমিও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কোনও মানুষ যদি সত্যি-সত্যি বিশ্বাস করে যে, সে মারা যাচ্ছে, তা হলে তার যে কোনও স্বীকারোক্তির দাম তখন মৃত্যুকালীন স্বীকারোক্তির সমান। এখন আমার কাজ হল অ্যাডভানিকে ভুল ধারণার মধ্যে থাকতে দিয়ে যে করে তোক একটা ডাইং ডিক্লেয়ারেশন আদায় করা।

সুতরাং আমি বললাম, আপনার কিছু বলার থাকলে এখনই বলতে পারেন, মিস্টার অ্যাডভানি। পরে আর হয়তো সময় পাবেন না।

প্রতাপ অ্যাডভানি চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন। আমার কথায় নিষ্পলক চোখে অসহায়ভাবে তাকালেন। তারপর চোখ সরিয়ে নিলেন। অ্যাম্বুলেন্সের দোলানিতে ওর মাথাটা এপাশ-ওপাশ নড়তে লাগল।

কিছুক্ষণ পর আপনমনেই বললেন অ্যাডভানি, ক্যারাটে শেখাই আমার কাল হয়েছে, নইলে বিশ্বনাথ শিভালকর আজ বেঁচে থাকতেন, আর…আর আমাকেও এভাবে মরতে হত না। ওঁর গলার স্বর নিস্পৃহ, দুর্বল অথচ তিক্ততায় ভরা।

মিস্টার শিভালকর ক্যারাটে চপ-এর আঘাতে মারা গেছেন? আমি নীচু স্বরে প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ, ওই হীরে আর চুনিগুলো দেখে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। মিস্টার শিভালকরের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দরজাটা অর্ধেক ভোলা ছিল। দেখলাম, উনি হুইস্কির বোতল হাতে বিছানার বসে আছেন। ভাবলাম, মদ খেয়ে ওঁর শরীর ঠিক নেই। তাই দরজাটা ভেজিয়ে দিতে গেলাম। তখনই দেখলাম সাদা আর লাল পাথরগুলো বিছানার ছড়িয়ে পড়ে আছে। ব্যস– একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অ্যাডভানির বুক ঠেলে।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।

একটু পরেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, লোভ সামলাতে পারলাম না। এই হোটেল-ম্যানেজারি করে কপয়সাই বা পাই! সারাজীবন আমাকে পয়সার জন্যে কষ্ট করতে হয়েছে। ভাবলাম, পাথরগুলো সরিয়ে নিলে মিস্টার শিভালকর এ অবস্থায় টেরও পাবেন না। তাই করলাম। আমার পকেটে একটা ছোট পাউচ ছিল, পাথরগুলো তাতে ভরে ফেললাম। চলে আসতে যাব, ঠিক তখনই মিস্টার শিভালকর আমার দিকে ফিরে তাকালেন…।

আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। অতগুলো জহরত হাতছাড়া হয়ে যাবে এ যেন ভাবতেই পারলাম না। চকিতে আমার ক্যারাটে ব্লো ছুটে গেল মিস্টার শিভালকরের কপাল লক্ষ করে। তারপর…বললাম তো, ক্যারাটে শেখাই আমার কাল হল। প্রতাপ অ্যাডভানি থামলেন।

আমি বললাম, তারপর ওঁকে জানলা দিয়ে ফেলে দিলেন?

না, তখন ফেলিনি। অনেক পরে ওই মতলবটা আমার মাথায় আসে। অ্যাডভানির শ্বাস-প্রশ্বাস এখন আরও দ্রুত হয়ে এসেছে, কণ্ঠস্বরও অনেক দুর্বল বাকিটা তো আপনি জানেন। লিপস্টিক, টেলিফোন, প্যাটেল…নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরাতে গিয়ে আমি সব গোলমাল করে ফেলেছি। তার ওপর পেটের এই আলসারের যন্ত্রণা। আমার মাথার ঠিক ছিল না…আমি ভেবেছিলাম…।

কী ভেবেছিলেন? উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করলাম।

দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন অ্যাডভানি। বিড়বিড় করে বললেন, আমার চেয়ে বোকা আর কেউ নেই।

অ্যাম্বুলেন্সটা ততক্ষণে হসপিটালের কাছাকাছি এসে গেছে। হঠাৎই ভীষণ ক্লান্ত লাগল। না, এখন প্রতাপ অ্যাডভানির ভুল ধারণাটা ভেঙে দেওয়া দরকার। তাই পাশে বসা অ্যাটেনড্যান্টকে বললাম, এবার সত্যি কথাটা ভদ্রলোককে বলতে পারো।

অ্যাডভানির ওপর ঝুঁকে পড়ল ছেলেটা। একটা চোখের পাতা উলটে দেখল, তারপর অভ্যাসগত সুরে বলল, লাভ নেই, স্যার। মারা গেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *