০১. বেলা তিনটার সময় রাজকুমার টের পাইল

বেলা তিনটার সময় রাজকুমার টের পাইল, তার মাথা ধরিয়াছে। এটা নূতন অভিজ্ঞতা নয়, মাঝে মাঝে তার ধরে। কেন ধরে সে নিজেও জানে না, তার ডাক্তার বন্ধু অজিতও জানে না। তার চোখ ঠিক আছে, দাঁত ঠিক আছে, ব্লডপ্রেসার ঠিক আছে, হজমশক্তি ঠিক আছে–শরীরের সমস্ত কলকজাগুলিই মোটামুটি এতখানি ঠিক আছে যে, মাঝে মাঝে মাথাধরার জন্য তাদের কোনোটিকেই দায়ী করা যায় না। তবু মাঝে মাঝে মাথা ধরে।

অজিত অবশ্য এক জোড়া কারণের কথা বলিয়াছে : আলসেমি আর স্বাস্থ্যরক্ষার রীতিনীতিতে অবহেলা। রাজকুমার তার এই ভাসা ভাসা আবিষ্কারে বিশ্বাস করে না। প্রথম কারণটা একেবারেই অর্থহীন, সে অলস নয়, তাকে অনেক কাজ করিতে হয়। দ্বিতীয় কারণটা যুক্তিতে টেকে না, স্বাস্থ্যরক্ষার রীতিনীতি না মানিলে স্বাস্থ্য খারাপ হইতে পারে, মাথা ধরিবে কেন?

অজিত খোঁচা দিয়ে বলিয়াছেন, তোর স্বাস্থ্য খুব ভালো, না?

অসুখে ত ভুগি না।

মাথাধরাটা–

মাথাধরা অসুখ নয়।

মাথা খারাপ হওয়াটা?

আজ গোড়াতেই মাঝে মাঝে সাধারণ মাথাধরার সঙ্গে আজকের মাথাধরার তফাতটা রাজকুমার টের পাইয়া গেল। দু-চার মাস অন্তর তার এরকম খাপছাড়া মাথাধরার আবির্ভাব ঘটে। নদীতে জোয়ার আসার মতো মাথায় একটা ভোঁতা দুর্বোধ্য যন্ত্রণার সঞ্চার সে স্পষ্ট অনুভব করিতে পারে, তারপর বাড়িতে বাড়িতে পরিপূর্ণ জোয়ারের মতো যন্ত্রণাটা মাথার মধ্যে থমথম করিতে থাকে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত ঘুম আসে না। মাথাধরা কমানোর ওষুধে শুধু যন্ত্রণার তীব্রতা বাড়ে, ঘুমের ওষুধে যন্ত্রণাটা যেন আরো বেশি ভোঁতা আর ভারি হইয়া দম আটকাইয়া দিতে চায়।

খাটের বিছানায় তিনটি মাথার বালিশের উপর একটি পাশবালিশ চাপাইয়া আধশোয়া অবস্থায় রাজকুমার বসিয়া ছিল। তৃষ্ণায় মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। মাথা ধরিলে রাজকুমারের এরকম হয়। সাধারণ জল, ডাবের জল, শরবৎ কিছুতেই তার তৃষ্ণা মেটে না। এটাও তার জীবনের একটা দুর্বোধ্য রহস্য। শুকনো মুখের অপ্রাপ্য রস গিলিবার চেষ্টার সঙ্গে চাষার গরু তাড়ানোর মতো একটা আওয়াজ করিয়া সে সোজা হইয়া উঠিয়া বসিল।

চারকোনা মাঝারি আকারের ঘর, আসবাব ও জিনিসপত্রে ঠাসা। এই ঘরখানাই রাজকুমারের শোয়ার ঘর, বসিবার ঘর, লাইব্রেরি, গুদাম এবং আরো অনেক কিছু। অনেক কালের পুরোনো। খাটখানাই এক-চতুর্থাংশ স্থান–আরো একটু নিখুঁত হিসাব ধরিলে ৪৫৭/১৭৭৬, স্থান, রাজকুমার একদিন খেয়ালের বশে মাপিয়া দেখিয়াছে–দখল করিয়া আছে। বই বোঝই তিনটি আলমারি ও একটি টেবিল, দাড়ি কমানোর সরঞ্জাম, ওষুধের শিশি, কাচের গ্লাস, চায়ের কাপ, জুতোপালিশের কৌটা, চশমার খাপ প্রভৃতি অসংখ্য খুঁটিনাটি জিনিসে বোঝাই আরেকটি টেবিল, তিনটি চেয়ার, একটি ট্রাঙ্ক এবং দুটি বড় ও একটি ছোট চামড়ার সুটকেস, ছোট একটি আলনা, এ সমস্ত কেবল পা ফেলিবার স্থান রাখিয়া বাকি মেঝেটা আত্মসাৎ করিয়াছে।

তবে রাজকুমার কোনোরকম অসুবিধা বোধ করে না। এ ঘরে থাকিতে তার বরং রীতিমতো আরাম বোধ হয়। ঘরখানা যেমন জিনিসপত্রে বোঝই, তেমনি অনেক দিনের অভ্যাস ও ঘনিষ্ঠতার স্বস্তিতেও ঠাসা।

এই ঘরে মাথাধরার যন্ত্ৰণা সহ্য করিবার মধ্যেও যেন মৃদু একটু শান্তি আর সান্ত্বনার আমেজ আছে। জগতের কোটি কোটি ঘরের মধ্যে এই চারকোনা ঘরটিতেই কেবল নির্বিকার অবহেলার সঙ্গে গা এলাইয়া দিয়া সে মাথার যন্ত্রণায় কাবু হইতে পারে।

মাথাধরা বাড়িবার আগে এবং স্থায়ীভাবে গা এলানোর আগে কয়েকটি ব্যবস্থা করিয়া ফেলা দরকার। মনে মনে রাজকুমার ব্যবস্থাগুলির হিসাব করিতে লাগিল। রসিকবাবুর বাড়ি গিয়া গিরীন্দ্রনন্দিনীর মাকে বলিয়া আসিতে হইবে, আজ রাত্রে তাদের বাড়ি খাওয়া অসম্ভব। অবনীবাবুর বাড়ি গিয়া মালতীকে বলিয়া আসিতে হইবে, আজ সে তাকে পড়াইতে যাইতে পারিবে না। স্যার কে. এল-এর বাড়ি গিয়া রিণিকে বলিয়া আসিতে হইবে, আজ তার সঙ্গে কারো পাটিতে যাওয়া বা জলতরঙ্গ বাজনা শোনানোর ক্ষমতা তার নাই। কেদারবাবুর বাড়ি গিয়া সরসীকে বলিয়া আসিতে হইবে, সমিতির সভায় গিয়া আজ সে বক্তৃতা দিলে, সকলে শুধু উঃ আঃ শব্দই শুনিতে পারবে। রাজেনকে একটা ফোন করিয়া দিতে হইবে, কাল সকালে কাজে ফাঁকি না দিয়া তার উপায় নাই।

এই কাজগুলি শেষ করিতে বেশিক্ষণ সময় লাগিবে না, গিরি, মালতী, রিণি আর সরসী চার জনের বাড়িই তার বাড়ির খুব কাছে, একরকম পাশের বাড়িই বলা যায়। পশ্চিমে বড় রাস্তার ধারে স্যার কে. এল-এর প্রকাণ্ড বাড়ির পিছনে তার বাড়িটা আড়ালে পড়িয়া গিয়াছে, স্যার কে. এল-এর বাড়ির পাশের গলি দিয়া ঢুকিয়া তার বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছিতে হয়। উত্তরে গলির মধ্যে তার বাড়ির আর দিকে কেদারবাবুর বাড়ি। পুবে গলির মধ্যে আর একটু আগাইয়া গেলে ডান দিকে যে আরো ছোট গলিটা আছে তার মধ্যে ঢুকিলেই বাঁ দিকে অবনীবাবুর বাড়ি। দক্ষিণে ছোট গলিটা ধরিয়া খানিক আগাইয়া ডান দিকে হঠাৎ মোড় ঘুরিবার পর রসিকবাবুর বাড়ি এবং গলিটারও সেইখানে সমাপ্তি। রিণি আর সরসী দুজনের বাড়িতেই ফোন আছে, রাজেনকে ফোন করিতেও হাঙ্গামা হইবে না।

কতকটা পাঞ্জাবি এবং কতকটা শার্টের মতো দেখিতে তার নিজস্ব ডিজাইনের জামাটি গায়ে দিয়া রাজকুমার ঘরের বাহিরে আসিল।

বাড়ির দোতলার অর্ধেকটা দখল করিয়া আছে স্বামী-পুত্র এবং স্বামীর দুটি ভাইৰােনসহ মনোরমা নামে রাজকুমারের এক দূর সম্পর্কের দিদি। প্রথমে তারা ভাড়াটে হিসাবেই আসিয়াছিল। এবং প্রথম মাসের বাড়ি ভাড়াও দিয়াছিল ভাড়াটে হিসাবেই। কিন্তু সেই এক মাসের মধ্যে প্রায়-সম্পর্কহীন ভাইবোনের সম্পর্কটা একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়ানোয় মনোরমা একদিন বলিয়াছিল, দ্যাখ ভাই রাজু, তোমার হাতে ভাড়ার টাকা তুলে দিতে কেমন যেন লজ্জা করে।

শুনিয়া রাজকুমার ভাবিয়াছিল, সেরেছে। এই জন্য সম্পর্ক আছে এমন মানুষকে ভাড়াটে দিতে অজিত বারণ করেছিল।

মনোরমা আবার বলিয়াছিল, ভাড়া নেওয়ার সম্পর্ক তো তোমার সঙ্গে আমাদের নয়। রাজকুমার কথা বলে নাই। বলিতে পারে নাই।

–তার চেয়ে এক কাজ করা যাক না? একলা মানুষ তুমি, ঠাকুর চাকর রেখে হাঙ্গামা পোয়াবার তোমার দরকার? আমি থাকতে ঠাকুরের রান্নাই বা তোমাকে খেতে হবে কেন?

গজেন মন্দ রাঁধে না।

আহা, কি রান্নাই ব্ৰাধে! কদিন খেয়েছি তো এটা ওটা চেয়ে নিয়ে। জিভের স্বাদ তোমার নষ্ট হয়ে গেছে রাজু ভাই, দুদিন আমার রান্না খেলে ওর ডাল তরকারি মুখে দিতে পারবে না।

প্রস্তাবটা প্রথমে রাজকুমারের ভালো লাগে নাই। একে নিজের জন্য ঠাকুর চাকর রাখিয়া। সংসার চালানোর যত হাঙ্গামাই থাক, যে ভাবে খুশি সংসার চালানো এবং যা খুশি করা, যখন খুশি আর যা খুশি খাওয়ার সুখটা আছে। কিন্তু এখন মনোরমা আর অজানা অচেনা প্রায়-সম্পর্কহীন। আত্মীয়া নয়, এক মাসে সে প্রায় আসল দিদিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে। তার এ ধরনের প্রস্তাবে না-ই বা বলা যায় কেমন করিয়া?

সেই হইতে মনোরমা ভাড়ার বদলে রাজকুমারকে চার বেলা খাইতে দেয়, তার ঘরখানা। গুছানো ছাড়া দরকারি অন্য সব কাজও করিয়া দেয়। রাজকুমার তার ঘর গুছাইতে দিলে যে মনোরমা নিজেই হোক বা তার ননদকে দিয়াই হোক এ কাজটা করিয়া দিত, তাতেও কোনো সন্দেহ নাই।

রাজকুমার বাহিরে যাইতেছে টের পাইয়া মনোরমা ডাকিল, কে যায়? রাজু? একবারটি শুনে যাবে রাজু ভাই, শুধু একটিবার?

দিনের মধ্যে রাজকুমারকে সে অন্তত আট-দশবার ডাকে কিন্তু প্রত্যেকবার তার ডাক শুনিয়া মনে হয়, এই তার প্রথম এবং শেষ আহ্বান, আর কখনো ডাক দিয়া সে রাজকুমারকে বিরক্ত করিবে না। দক্ষিণের বড় লম্বাটে ঘরখানার মেঝেতে বসিয়া মনোরমা সেলাই করিতেছিল। এ ঘরে আসবাব খুব কম। খাট, ড্রেসিং টেবিল আর ছোট একটি আলমারি ছাড়া আর যা আছে সে সবের জন্য বেশি জায়গা দিতে হয় নাই। পরিষ্কার লাল মেঝেতে গরমের সময় আরামে গড়াগড়ি দেওয়া চলে।

এত শিগগিরি যাচ্ছ কেন রাজু ভাই?

সেখানে যাচ্ছি না।

কোথায় যাচ্ছ তবে?

একটা ফোন করে আসব।

ও, ফোন করবে। পাঁচটার সময় ওখানে যেও, তা হলেই হবে। কালী সেজেগুজে ঠিকঠাক হয়ে থাকবে, বলে দিয়েছি।

আজ যেতে পারব না দিদি।

মনোরমা হাসিমুখে বলিল, পারবে না? একটা কাজের ভার নিয়ে শেষকালে ফ্যাসাদ বাধানোর স্বভাব কি তোমার যাবে না, রাজুভাই? কালীকে আজ আনাব বলে রেখেছি, কত আশা করে আছে মেয়েটা, কে এখন ওকে আনতে যাবে?

আমার মাথা ধরেছে–ধরেছে।

আবার মাথা ধরেছে? কতবার বললাম একটা মাদুলি নাও–না না, ওসব কথা আর আরম্ভ কোরো না রাজু ভাই, ওসব আমি জানি, আমি মুখ গেঁয়ো মেয়ে নই। মাদুলি নিলে মাথাধরা সেরে না যাক, উপকার হবে।

ছাই হবে।

কিছু উপকার হবেই। ভূতেও তো তোমার বিশ্বাস নেই, কিন্তু রাতদুপুরে একা একা শ্মশান ঘাটে গিয়ে দেখ তো একবার ভয় না করলেও দেখবে কেমন কেমন লাগবে। অবিশ্বাস করেও তুমি একটা মাদুলি নাও, আমার কথা শুনে নাও, মাথার যন্ত্রণা অন্তত একটু কম হবেই।

মনোরমা হঠাৎ গম্ভীর হইয়া গেল।

মাথা ধরুক আর যাই হোক, কালীকে তোমার আনতে যেতে হবেই রাজু ভাই। না গেলে কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব না।

বেশ বোঝা যায়, মনোরমা রাগ করে নাই, শুধু অভিমানে মুখ ভার করিয়াছে। স্নেহের অভিমান, দাবির অভিমান।

রাজকুমার মৃদু হাসিয়া বলিল, আচ্ছা দেখি। যেতে পারলে যাবখন।

গিরীন্দ্রনন্দিনীর মা ঘরে ঘুমাইতেছিল। গিরি নিজেই দরজা খুলিয়া দিল। রোগা লম্বা পনের-ষোল বছরের মেয়ে, তের বছরের বেশি বয়স মনে হয় না। রাজকুমারের পরামর্শে রসিকবাবু মেয়েকে সম্প্রতি একটি পুষ্টিকর টনিক খাওয়াইতে আরম্ভ করিয়াছেন। টনিকের নামটা রাজকুমার অজিতের কাছে সংগ্রহ করিয়াছিল।

অজিত বলিয়াছিল, এমন টনিক আর হয় না রাজু। ভুল করে একবার একটা সাত বছরের মেয়েকে খেতে দিয়েছিলাম, তিন মাস পরে মেয়েটার বাবা পাগলের মতো তার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে আরম্ভ করল।

গিরি মাসখানেক টনিকটা খাইতেছে কিন্তু এখনো কোনো ফল হয় নাই। তবু সেমিজ ছাড়া শুধু ড়ুরে শাড়িটি পরিয়া থাকার জন্য গিরি যেন সঙ্কোচে একেবারে কাবু হইয়া গেল। যতই হোক, বাঙালি গৃহস্থ ঘরের মেয়ে তো, পনের-ষোল বছর বয়স তো তার হইয়াছে। ড়ুরে শাড়ি দিয়া ক্রমাগত আরো ভালোভাবে নিজেকে ঢাকিবার অনাবশ্যক ও খাপছাড়া চেষ্টার জন্য গিরির মতো অল্প অল্প বোকাটে ধরনের সহজ সরল হাসিখুশি ছেলেমানুষ মেয়েটাকে পর্যন্ত মনে হইতে লাগিল বয়স্কা পাকা মেয়েমানুষ।

ছোট উঠান, অতিরিক্ত ঘষা থাকায় ঝকঝকে, তবু যেন অপরিচ্ছন্ন। কলের নিচে ছড়ানো এঁটো বাসন, একগাদা ছাই, বাসন মাজা ন্যাতা, ক্ষয় পাওয়া ঝাঁটা, নালার ঝাঁঝরার কাছে পানের পিকের দাগ, সিঁড়ির নিচে কয়লা আর ঘুটের ভূপ, শুধু এই কয়েকটি সঙ্কেতেই যেন সযত্নে সাফ করা উঠানটি নোংরা হইয়া যাইতেছে।

কোথা পালাচ্ছ? শুনে যাও?

একধাপ সিঁড়িতে উঠিয়া গিরি দাঁড়াইল এবং সেইখানে দাঁড়াইয়া রাজকুমার যা বলিতে আসিয়াছে শুনিল। তারপর কাতরভাবে অভিমানের ভঙ্গিতে খোঁচা দেওয়ার সুরে বলিল, তা খাবেন কেন গরিবের বাড়িতে!।

আমার ভীষণ মাথা ধরেছে গিরি।

মাথা আমারও ধরে। আমি তো খাই!

তুমি এক নম্বরের পেটুক, খাবে বৈকি!

আমি পেটুক না আপনি পেটুক? সেদিন অতগুলো ক্ষীরপুলি–গিরি খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। ড়ুরে শাড়ি সংক্রান্ত কুৎসিত সঙ্কেতের বিরক্তি সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারের মন হইতে মিলাইয়া গেল রোদের তেজে কুয়াশার মতো। একটু গ্লানিও সে বোধ করিতে লাগিল। নিজের অতিরিক্ত পাকা মন নিয়া জগতের সরল সহজ মানুষগুলিকে বিচার করিতে গিয়া হয়তো আরো কতবার সে অমনি অবিচার করিয়াছে। নিজের মনের আলোতে পরের সমালোচনা সত্যই ভালো নয়।

কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করিয়া সে বলিল, সন্ধ্যা থেকে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকব। কিনা, তাই খেতে আসতে পারব না।

খেয়ে গিয়ে বুঝি শুয়ে থাকা যায় না?

খেলে মাথার যন্ত্রণা বাড়ে। আজ উপোস দেব ভাবছি।

গিরি গম্ভীর হইয়া বলিল, না খেলে মাথাধরা আরো বাড়বে। শরীরে রক্ত কম থাকলে মাথা ধরে। খাদ্য থেকে রক্ত হয়।

রাজকুমার হাসিয়া বলিল, তোমার সেই ডাক্তার বলেছে বুঝি যে তোমার নাড়ি খুঁজে পায় নি?

কয়েক মাস আগে গিরির জ্বর হইয়াছিল, দেখিতে আসিয়া ডাক্তার নাকি তার কজি হাতড়াইয়া নাড়ি খুঁজিয়া পান নাই। হয়তো নাড়ি খুব ক্ষীণ দেখিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন, গিরির পা নাই। সেই হইতে গিরি সগর্বে সকলের কাছে গল্প করিয়া বেড়ায়, সে এমন আশ্চর্য মেয়ে যে তার পাস পর্যন্ত নাই। সকলের যা আছে তার যে তা নাই, এতেই গিরির কত আনন্দ, কত উত্তেজনা। রাজকুমারের কাছেই সে যে কতবার এ গল্প বলিয়াছে তার হিসাব হয় না। রাজকুমার অনেকবার তাকে বুঝাইয়া বলিয়াছে, কিভাবে মানুষের হার্টের কাজ চলে, কিভাবে শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল করে–অনেক কিছু বুঝাইয়া বলিয়াছে। বোকা মেয়েটাকে নানা কথা বুঝাইয়া বলিতে তার বড় ভালো লাগে। কিন্তু গিরি বুঝিয়াও কিছু বুঝিতে চায় না।

সত্যি আমার নাড়ি নেই। আপনার বুঝি বিশ্বাস হয় না?

বাঁচিয়া থাকার সঙ্গে নাড়ির স্পন্দন বজায় থাকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথাটা রাজকুমার অনেকবার গিরিকে বুঝাইয়া বলিয়াছে, কোনোদিন তার হাত ধরিয়া নাড়ির অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে নাই। আজ সোজাসুজি গিরির ডান হাতটি ধরিয়া বলিল, দেখি কেমন তোমার নাড়ি নেই।

গিরি বিব্রত হইয়া বলিল, না না, আজ নয়। এখন নয়।

রাজকুমার হাসিমুখে বলিল, এই তো দিব্যি টি্প্‌টিপ্‌ করছে পাল্‌স।

গিরি আবার বলিল, থাক না এখন, আরেকদিন দেখবেন।

গিরির মুখের ভাব লক্ষ করিলে রাজকুমার নিশ্চয় সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ছাড়িয়া দিয়া তফাতে সরিয়া যাইত এবং নিজের পাকা মনের আলোতে জগতের সহজ সরল মানুষগুলিকে বিচার করিবার জন্য একটু আগে অনুতাপ বোধ করার জন্য নিজেকে ভাবিত ভাবপ্রবণ। কিন্তু গিরির সঙ্গে তামাশা আরম্ভ করিয়া অন্যদিকে তার মন ছিল না।

হাসির বদলে মুখে চিন্তার ছাপ আনিয়া সে বলিল, তোমার পালস্ তো বড় আস্তে চলছে গিরি। তোমার হার্ট নিশ্চয় খুব দুর্বল। দেখি

ড়ুরে শাড়ির নিচে যেখানে গিরির দুর্বল হার্ট স্পন্দিত হইতেছিল, সেখানে হাত রাখিয়া রাজকুমার স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করিতে লাগিল। গিরির মুখের বাদামি রং প্রথমে হইয়া গেল পশুটে, তারপর হইয়া গেল কালেটে। একে আজ গায়ে তার সেমিজ নাই, তারপর চারিদিকে নাই মানুষ। কি সৰ্বনাশ!

ছি ছি! এসব কি!

রাজকুমার আশ্চর্য হইয়া বলিল, কি হয়েছে?

গিরি দমক মারিয়া তার দিকে পিছন ফিরিয়া, একবার হোঁচট খাওয়ার উপক্রম করিয়া তরতর করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল। রাজকুমার হতবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। একি ব্যাপার?

ব্যাপার বোঝা গেল কয়েক মিনিট পরে উপরে গিয়া। গিরির মা পাটিতে পা ছড়াইয়া হাতে ভর দিয়া বসিয়া আছেন। দেখিলেই বোঝা যায়, সবে তিনি শয়নের আরাম ছাড়িয়া গা তুলিয়াছেন–বসিবার ভঙ্গিতেও বোঝা যায়, মুখের ভঙ্গিতেও বোঝা যায়। মানুষটা একটু মোটা, গা তোলার পরিশ্রমেই বোধহয় একটু হাঁপও ধরিয়া গিয়াছে।

রাজকুমার বলিতে গেল, গিরি—

গিরির মা বাধা দিয়া বলিলেন, লজ্জা করে না? বেহায়া নচ্ছার কোথাকার।

এমন সহজ সরল ভাষাও যেন রাজকুমার বুঝিয়া উঠিতে পারি না, হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। গিরির মা আবার বলিলেন, বেরো হারামজাদা, বেরো আমার বাড়ি থেকে।

গিরির মার রাগটা ক্রমেই চড়িতেছিল। আরো যে কয়েকটা শব্দ তার মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়িল সেগুলি সত্যই অশ্ৰাব্য।

রাজকুমার ধীরে ধীরে রসিকবাবুর বাড়ি ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল, ক্ষুব্ধ আহত ও উদ্ভ্রান্ত রাজকুমার। ব্যাপারটা বুঝিয়াও সে যেন ভালো করিয়া বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। হঠাৎ যেন একটা যুক্তিহীন ভূমিকাহীন আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। তার কেবলই মনে হইতে লাগিল, দামি জামাকাপড় পরিয়া খুব উৎসাহের সঙ্গে সে বাড়ির বাহির হইয়াছিল, হঠাৎ কিভাবে যেন পচা পাক ভরা নর্দমায় পড়িয়া গিয়াছে। এইরকম একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার পর্যায়ে না ফেলিয়া এ ব্যাপারটা যে সত্য সত্যই ঘটিয়া গিয়াছে এ কথা কল্পনা করাও তার অসম্ভব মনে হইতেছিল।

নিছক দুর্ঘটনা–কারো কোনো দোষ নাই, দোষ থাকা সম্ভব নয়। ভুল বুঝিবার মধ্যে তো যুক্তি থাকে মানুষের, ভুল বুঝিবার সপক্ষে ভুল যুক্তির সমর্থন? গায়ে কেউ ফুল ছুড়িয়া মারিলে মনে হইতে পারে ফাজলামি করিয়াছে, সহানুভূতির হাসি দেখিয়া মনে হইতে পারে ব্যঙ্গ করিতেছে, কিন্তু ফুল আর হাসির আঘাতে হত্যা করিতে চাহিয়াছে একথা কি কোনোদিন কারো মনে হওয়া সম্ভব? কতটুকু মেয়েটা! বুকের স্পন্দন পরীক্ষা করিবার সময় বুকটা তার বালকের বুকের মতো সমতল মনে হইয়াছিল। যে মেয়ের দেহটা পুরুষের উপভোগের উপযুক্ত হইতে আজো পাঁচ-সাত বছর বাকি আছে সেই মেয়ের মনে তার সহজ সরল ব্যবহারটির এমন ভয়াবহ অর্থ কেমন করিয়া জাগিল?

মাথাধরার কথাটা কিছুক্ষণের জন্য রাজকুমার ভুলিয়া গিয়াছিল, বাকি যে কয়েকটা কর্তব্য পালন করিবে ঠিক করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল, সেগুলির কথাও মনে ছিল না। নিজের বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছিয়া মাথাধরা আর দরকারি কাজের কথা একসঙ্গে মনে পড়িয়া গেল। কিন্তু ফিরিতে আর সে পারিল না, নিজের ঘরখানার জন্য তার মন তখন ছটফট করিতেছে। জিনিসপত্রে ঠাসা ওই চারকোনা ঘরে যেন তার মাথাধরার চেয়ে কড়া যে বর্তমান মানসিক যন্ত্ৰণা তার ভালো ওষুধ আছে।

কে যায়? রাজু? একবারটি শুনে যাবে রাজু ভাই, এক মিনিটের জন্যে?

এবার দেখা গেল, মনোরমা তার দেড় বছরের ছেলেকে কোলে করিয়া ঘুম পাড়াইতেছে। কচি কচি হাত দিয়া থোকা তার আঁচলে ঢাকা পরিপুষ্ট স্তন দুটিকে জোরে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে। রাজকুমারের দৃষ্টি দেখিয়া মনোরমা মৃদু একটু হাসিয়া বলিল, এমন দুষ্ট হয়েছে ছেলেটা! খায় না কিন্তু ঘুমোনোর আগে ধরা চাই। মনে মনে খাওয়ার লোভটা এখনো আছে আর কি?

তুমিই ওর স্বভাবটা নষ্ট করছ দিদি। ধরতে দাও কেন? মনোরমা আবার মৃদু হাসিল।

দ্যাখ না ছাড়াবার চেষ্টা করে?

সরল সহজ আহ্বান, একান্ত নির্বিকার। পঞ্চাশ বছরের একজন স্ত্রীলোক যেন তার কাঁচা পাকা চুলে ভরা মাথা হইতে দুটি পাকা চুল তুলিয়া দিতে বলিতেছে দশ-বার বছরের এক বালককে। গিরীন্দ্রনন্দিনীর বাড়ি ঘুরিয়া আসিবার আগে হইলে হয়তো রাজকুমার কিছুমাত্ৰ সঙ্কোচ বা অস্বস্তি বোধ করিত না, এখন মনোরমার প্রস্তাবে সে যেন নিজের মধ্যে কুঁচকাইয়া গেল।

মনোরমা একটু অসন্তুষ্ট হইয়া বলিল, খোকাকে ছোঁয়ার নামেই ভড়কে গেলে! ছোট ছেলেপিলেকে ছুঁতেই তোমার এত ঘেন্না কেন বল তো রাজু ভাই?

রাজকুমার বিব্রত হইয়া বলিল, না না, ঘেন্না কে বললে, ঘেন্না কিসের!

তারপর অবশ্য মনোরমার স্তন হইতে খোকার হাত দুটি ছাড়াইয়া দিবার চেষ্টা তাকে করিতে হইল। মনোরমা স্নেহের আবেশে মুগ্ধ চোখ মেলিয়া দেখিতে লাগিল তার আধ ঘুমন্ত খোকার নির্বিকার প্রশান্ত মুখে কান্না-ভরা প্ৰচণ্ড প্রতিবাদের দ্রুত আয়োজন আর জগতের অষ্টমাশ্চর্য দেখিবার মতো বিস্ময়ভরা চোখ মেলিয়া রাজকুমার দেখিতে লাগিল মনোরমার মুখ! খোকার কচি হাত আর মনোরমার কোমল স্তনের স্পর্শ যেন অবিস্মরণীয় সুগন্ধী অনুভূতিতে ভরা তেজস্কর রসায়নের মতো তার মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করিতে লাগিল। তার আহত মনের সমস্ত গ্লানি মুছিয়া গেল।

খোকার হাত বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখা গেল না, তীক্ষ্ণ গলার প্রচণ্ড আৰ্তনাদে কানে তালা ধরাইয়া সে তখন প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়িবার জন্য ছটফট করিতেছে।

মনোরমা বলিল, দেখলে?

রাজকুমার মেঝেতে বসিয়া বলিল, হুঁ, ছোঁড়ার সত্যি তেজ আছে!

মনোরমা হাসিভরা মুখখানা মুহুর্তে অন্ধকার হইয়া গেল। ভুরু বাকাইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বলিল, ছোঁড়া বলছ কাকে শুনি?

রাজকুমার থতমত খাইয়া গেল।–আহা এমনি বলেছি, আদর করে বলেছি–

মনোরমার রাগ ঠাণ্ডা হইল না।–বেশ আদর তো তোমার! আমার ছেলেকে যদি আদর করে ছেড়া বলতে পার, আমাকেও তো তবে তুমি আদর করে বেশ্যা বলতে পার অনায়াসে। এ আবার কোন্ দেশী আদর করা, এমন কুচ্ছিৎ গাল দিয়ে!

ছোঁড়া কথাটা তো গাল নয় দিদি!

নয়? ছোঁড়া কাদের বলে শুনি? যারা নেংটি পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, পকেট মারে, মদ-গাজা-ভাং খায়, মেয়েদের দেখলে শিস্ দেয়, বিচ্ছিরি সব ব্যারামে ভোগে–আমি জানি না ভেবেছ!

অনেক প্রতিবাদেও কোনো ফল হইল না, আহতা অভিমানিনী মনোরমার মুখের মেঘ স্থায়ী হইয়া রহিল! নিজেই অবশ্য সে কথাটা চাপা দিয়া দিল, বলিল, সে যাকগে, থাক, ওকথা বলে। আর হবে কি, আচ্ছা আচ্ছা, তোমার কথাই রইল রাজু ভাই, তুমি কিছু ভেবে কথাটা বল নি–কিন্তু বেশ বোঝা যাইতে লাগিল, মনে মনে সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া আছে।

ফোন করেছ?

না, এইবার যাব।

ফোন করতেই না গেলে?

না, গিরিদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ফোন করার কথাটা মনে ছিল না।

খেয়ালখুশির বাধা অপসারিত হওয়ায় একটু পরেই খোকা আবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। গম্ভীর। মুখে অকারণে খোকার মুখে একটা চুমা খাইয়া মনোরমা বলিল, গিরিদের বাড়ি কেন?

গিরির মা রাত্রে খেতে বলেছিল, তাই বলতে গিয়েছিলাম, আজ আর খেতে যেতে পারব না।

কে কে ছিল বাড়িতে? গিরি কি করছিল?

গিরি মার কাছে শুয়েছিল। ওরা দুজনেই বাড়িতে ছিল, এ সময় আর কে বাড়ি থাকবে?

দরজা খুলল কে?

এ রীতিমতো জেরা। মনোরমার মুখের গাম্ভীর্য যেন একটু কমিয়াছে, গলার সুরে বেশ আগ্ৰহ টের পাওয়া যায়।

রাজকুমারের একবার ক্ষণেকের জন্য মনে হইল, মনোরমাকে সব কথা খুলিয়া বলে। গিরি আর গিরির মা তাদের অসভ্য গেঁয়ো মনোবৃত্তি নিয়া অকারণে বিনা দোষে তাকে আজ কি অপমানটা করিয়াছে আর মনে কত কষ্ট দিয়াছে, সবিস্তারে জানাইয়া মনোরমার সহানুভূতি আদায় করিয়া একটু সুখ ভোগ করে। খোকাকে ছেড়া বলার জন্য মনোরমা এমন খাপছাড়া ভাবে ফোঁস করিয়া না উঠিলে সে হয়তো বিনা দ্বিধাতেই ব্যাপারটা তকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইয়া দিত। এখন ভরসা পাইল না। খোকাকে উপলক্ষ করিয়া অসাধারণ ধীরতা, স্থিরতা, সরলতা আর সুবিবেচনার পরিচয় দিয়া মনোরমা তার মনে যে অগাধ শ্রদ্ধা সৃষ্টি করিয়াছিল, কয়েক মিনিট পরে খোকাকে উপলক্ষ করিয়াই মনোরমা নিজেই আবার সে শ্ৰদ্ধা নষ্ট করিয়া দিয়াছে। সব কথার ঠিক মানেই যে মনোরমা বুঝিবে, সে ভরসা রাজকুমারের আর নাই। কে জানে নিজের মনে ব্যাপারটার কি ব্যাখ্যা করিয়া সে কি ভাবিয়া বসিবে তার সম্বন্ধে!

তাই সে বিরক্ত হওয়ার ভান করিয়া জবাব দিল, গিরি দরজা খুলল, কে আবার খুলবে?

মনোরমা কতক্ষণ কি যেন ভাবিল। মুখের গাম্ভীর্য ক্রমেই তার কমিয়া যাইতেছিল।

একটা কথা তোমায় বলি ভাই, রাগ কোরো না কিন্তু। তোমার ভালোর জন্যই বলা। আমি কিছু ভেবে বলছি না কথাটা, শুধু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। জেনেশুনে যদি দরকার মতো তোমায় সাবধান করেই না দিলাম, আমি তবে তোমার কিসের দিদি? অত বেশি যখন তখন গিরিদের বাড়ি আর যেও না।

কেন?

আহা, কেমন ধারা মানুষ ওরা তা তো জান? গেঁয়ো অসভ্য মানুষ ওরা, কুলি মজুরদের মতো ছোট মন ওদের, সব কথার বিচ্ছিরি দিকটা আগে ওদের মনে আসে। বড় হলে ভাইৰােন যদি নির্জনে বসে গল্প করে, তাতেও ওরা ভয় পেয়ে যায়। বড়সড় একটা মেয়ে যখন বাড়িতে আছে, কি দরকার তোমার যখন তখন ওদের বাড়ি যাবার? বিপদে পড়ে যাবে একদিন।

ওইটুকু একটা মেয়ে–

মনোরমা বাধা দিয়া বলিল, ওইটুকু মেয়ে মানে? আজ মেয়ের বিয়ে দিলে ওর মা একবছর পরে নাতির মুখ দেখবার আশায় থাকবে। ওরা তো আর তোমাদের মতে মানুষ নয় রাজু ভাই যে ওইটুকু দেখায় বলেই ভাববে আজো মেয়ের ফ্ৰক পরে থাকার বয়েস আছে। যেমন ধর ও বাড়ির রিণি, গিরির চেয়ে বয়সেও বড় এমনিও বড় দেখায় ওকে। সেদিন রিণিকে একা নিয়ে তুমি বায়োস্কোপ দেখাতে গেলে, একদিন গিরিকে নিয়ে যাবার কথা বলে দেখ তো ওর বাপ-মা কি বলে?

মনোরমার মুখের গাম্ভীর্য একেবারেই উবিয়া গিয়াছে, তার সুন্দর মুখখানিতে থমথম করিতেছে। কথা বলার আবেগ।

তারপর ধর সরসী। ওর বাড়ন্ত গড়ন দেখলে আমারই ভয় করে, সে দিন তুমি ওর হাত ধরে টানছিলে—

তামাশা করছিলাম।

তামাশাই তো করছিলে। কিন্তু একদিন তামাশা করতে গিয়ে ওমনি ভাবে গিরির হাত ধরে টেনো দিকি কি কাটা হয়! সরসীর বাপ-মা হাসছিল, গিরির বাপ-মা তোমায় জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। তুমি তো আর সামলে সুমলে চলতে জান না নিজেকে, তাই বলছিলাম, নাইবা বেশি মেলামেশা করলে ওদের সঙ্গে?

খোকাকে শোয়াইয়া দিয়া নিজেও মনোরমা কাত হইয়া তার পাশে শুইয়া পড়িল।

কালীকে আনতে যাবে না রাজু ভাই?

যাব।

ঘরে গিয়া রাজকুমার বিছানায় শুইয়া পড়িল। মাথাধরার কথাটা আবার সে ভুলিয়া গিয়াছে। শুইয়া শুইয়া চোখ বুজিয়া সে আকাশপাল ভাবিতে থাকে আর থাকিয়া থাকিয়া মনে হয়, তবে, তবে কি গিরি আর গিরির মার কোনো দোষ ছিল না, সে-ই বোকার মতো একটা অসঙ্গত কাজ করিয়া তার স্বাভাবিক ফল ভোগ করিয়াছে? মনোরমা পর্যন্ত জানে যে গিরির হাত ধরিয়া টানার অপরাধে তাকে জ্যান্ত পুড়াইয়া মারাটাই গিরির বাপ-মার পক্ষে স্বাভাবিক হইবে। তাই যদি হয়, এমনি সব রীতিনীতি চালচলনের মধ্যে এমনি সব মনের সাহচর্যে গিরি যদি বড় হইয়া থাকে আর দশটি মেয়ের মতো, তবে তো সে খাপছাড়া কিছুই করে নাই, ও অবস্থায় তার মতো আর দশটি মেয়ে যা করিত সেও তাই করিয়াছে। এবং মনোরমার কথা শুনিয়া তো মনে হয় ওরকম আর দশটি মেয়ের অভাব দেশে নাই।

বুঝিয়া চলিতে না পারিয়া সে-ই কি তবে অন্যায় করিয়াছে? কিন্তু রাজকুমারের মন সায় দিতে চায় না। ব্যাপারটা যদি সংসারের সাধারণ নিয়মের বহির্ভূত খাপছাড়া একটা দুর্ঘটনা নাও হয়, অসাধারণ কোনো কারণে ভুল করার বদলে আর দশটি মেয়ের মতো নিজের রুচিমাফিক সঙ্গত কাজই গিরি করিয়া থাকে, গিরির মার গালাগালিটাও যদি সংসারের সাধারণ চলতি ব্যাপারের পর্যায়ে গিয়া পড়ে তবে তো সমস্ত ব্যাপারটা হইয়া দাঁড়ায় আরো কদর্য! এমন বীভৎস মনের অবস্থা কেন হইবে মানুষের? এমন পারিপার্শ্বিকতাকে কেন মানুষ মানিয়া লইবে যার প্রভাবে মানুষের মন এতখানি বিকারগ্রস্ত আর কুৎসিত হইয়া যায়?

মাথাটা আবার ভার মনে হইতে লাগিল। সত্যই কি আজ তার মাথা ধরিবে, না, অনেক চিন্তা আর উত্তেজনার ফলে আজ মাথাটা এরকম করিতেছে? একবার স্যার কে. এল-এর বাড়ি গেলে হয় না, সে যে আজ তার পার্টিতে যাইতে পারিবে না এই কথাটা রিণিকে বলিয়া আসিতে? এবং একবার রিণির হাত ধরিয়া টানিয়া আসিতে?

রাজকুমারের মনে হইতে লাগিল, একবার রিণিদের বাড়ি গিয়া খেলার ছলে রিণির হাত ধরিয়া টানিয়া আর ব্লাউজের একটা বোতাম পরীক্ষা করিয়া সে যদি আজ প্রমাণ না করে যে ভদ্র মানুষ সব সময় সব কাজের কদর্য মনে করিবার জন্যই উদ্গ্রীব হইয়া থাকে না, তবে তার মাথাটা ধীরে ধীরে বোমায় পরিণত হইয়া ফাটিয়া যাইবে। তাড়াতাড়ি সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *