১. লন্ডন এক্সপ্রেস

মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস (১৯২৩) / আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

লন্ডন এক্সপ্রেসে প্যারিস থেকে লন্ডন ফেরার পথে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল।

জুনের ঝকঝকে দিন। কামরায় আমার সহযাত্রী বলতে ছিল একটি মেয়ে। মুখে পাউডারের প্রলেপ থাকলেও মেয়েটির বয়স সতেরোর নিচে মনে হল না। লাল টকটকে দুটি ঠোঁট সবার আগে নজর কাড়ে। ঘন ঘন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিল সে।

এগিয়ে এসে নিজেই আলাপ করল। কিন্তু আশ্চর্য তার আচরণ আমার গায়ে-পড়া মনে হল না। বরং তার মধ্যে আমি শিশুর সারল্য ও নারীর মাধুর্যের মিশ্রণ পেলাম।

–প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখন আমরা পরস্পর বন্ধু।

এই ভাবেই সে শুরু করেছিল তার আলাপ। তারপর অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সে যা জানাল তা হল, তার জন্ম আমেরিকায়। কিন্তু ইংলন্ডেই সে বড় হয়েছে তার এক বোনের সঙ্গে। পেশায় অভিনেত্রী।

ভালো কিছু করার একটা প্রবল বাসনা তার কথায় প্রকাশ পেয়েছিল যা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় বোধ হয়েছিল।

কথায় কথায়, জানি না কিভাবে সে অনুমান করল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই যুদ্ধে গিয়েছিলে?

তার অনুমান যথার্থ স্বীকার করে আমি বললাম, একবার আহত হয়ে পঙ্গু হবারও উপক্রম হয়েছিল। এখন আমি একজন এম. পির সেক্রেটারি।

–কেবল ছারপোকা মারা কাজ যে তুমি কর না তা দেখেই বুঝতে পেরেছি। কাজের বাইরে আর কি কর? জানতে চেয়েছিল মেয়েটি।

এইভাবেই এসে পড়ল আমার সবচেয়ে গর্বের ও আনন্দের প্রসঙ্গ।

–আমার এক বেলজিয়ান গোয়েন্দা বন্ধুর সঙ্গে একটা ঘরে শেয়ার করে থাকি।

ছোটখাট চেহারার খুব মজাদার মানুষটি। প্রাইভেট গোয়েন্দা হিসেবে লন্ডনে প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছে। সরকারী গোয়েন্দারা যখন কোনো কেসে তল পায় না তখন তারা আমার এই বন্ধুটির শরণাপন্ন হয়। সে অনায়াসে তাদের সমস্যার সমাধান করে দেয়। তার সঙ্গেই আমার দিব্যি কেটে যায়।

–দারুণ! ওহ, দারুণ! অপরাধের গল্প আমার খুব প্রিয়।

স্টাইলস কেস তোমার মনে আছে? আমি জানতে চেয়েছিলাম।

একটু ভেবে নিয়ে সে জানায়, সাসেক্সের সেই বিষ খাইয়ে এক বৃদ্ধাকে হত্যার মামলা তো

মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে গর্বের সঙ্গে জানালাম, সেটাই হল আমার বন্ধু এরকুল পোয়ারোর প্রথম বড় কেস।

এরপর পোয়ারার কীর্তিকাহিনী তাকে সবিস্তারে শোনাতে হয়েছিল। আর সে শুনেছিল তন্ময় হয়ে।

ক্যালাইন স্টেশনে ট্রেন থামলে প্ল্যাটফর্মে নেমে আমার সঙ্গিনী করমর্দন করে বলল, বিদায় বন্ধু। ডোভার থেকে জাহাজে যাওয়া হবে কিনা বলতে পারছি না, তাই এখানেই তোমাকে বিদায় জানাতে হচ্ছে। এখানে আমার বোনের সন্ধান একবার নিতে হবে।

বিদায়ক্ষণে আমার এই নতুন বন্ধুটির নাম জানতে চাইলে সে হেসে জানাল, সিনডেরেলা।

.

০২.

 পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের টেবিলে বসে আছি আমি আর পোয়ারো।

–আজকের ডাকে এই চিঠিটা এসেছে। বলে পোয়ারো চিঠির কাগজটা বাড়িয়ে দিল। বেশ দামি বিদেশী কাগজে হাতে লেখা চিঠিটা সাগ্রহে চোখের সামনে মেলে ধরলাম।

ভিলা জেনেভিয়েভ,
 মারলিনভিল সুরসার
ফ্রান্স

প্রিয় মহাশয়,
যে কোনো মুহূর্তে আমার জীবনের আশঙ্কা নিয়ে দিন গুণছি। তাই এই মুহূর্তে একজন গোয়েন্দা আমার প্রয়োজন। বিভিন্ন সূত্রে আপনার সুখ্যাতি আমার কানে এসেছে। আমি শুনেছি অপরাধ-তদন্ত বিষয়ে আপনি একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি।

আমি নিশ্চিত, আমার বিপদ আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে আমার অনুরোধ, আপনি আপনার হাতের সমস্ত কেস ফেলে রেখে এখুনি একবার ফ্রান্সে চলে আসুন। আমার জীবনরক্ষার স্বার্থে আপনার প্রয়োজনীয় অর্থসহ যাবতীয় কিছুর ব্যবস্থা আমি করব। বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ না করে আমার অনুরোধ রক্ষা করলে বাধিত হব।

আমার জীবনের বেশ কয়েক বছর স্যান্টিয়াগোয় কাটিয়েছি। সেখানেও কিছু সময়ের জন্য আপনাকে যেতে হতে পারে। আপনার পারিশ্রমিক কত জানাবেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী বিবেচনা করবেন।

আপনার তারবার্তা পেলে আমি ক্যালাইনে আপনার জন্য গাড়ি পাঠাব।
আপনার বিশ্বস্ত
পি. টি. রেনাল্ড
 পুনশ্চ : ঈশ্বরের দোহাই আপনি আসুন।

–অদ্ভুত চিঠি। তুমি কি ঠিক করলে?

 চিঠিটা পোয়ারোর হাতে ফেরত দিয়ে জানতে চাইলাম।

–এখুনি রওনা হতে হবে, তুমি সঙ্গে যাবে। ভিক্টোরিয়া থেকে এগারোটায় কন্টিনেন্টাল এক্সপ্রেস ধরব।

ব্যস্ততার সঙ্গেই বলল পোয়ারো।

 ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিনিট দশেকের মধ্যেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে।

-আমি রেডি। কিন্তু মিঃ রেনাল্ড নামটা যেন চেনা মনে হচ্ছে।

–তুমি যার নাম মনে আনবার চেষ্টা করছ তিনি দক্ষিণ আমেরিকার সুপরিচিত কোটিপতি। এই ভদ্রলোকই সেই রেনাল্ড কিনা বুঝতে পারছি না। বললাম আমি।

–একই লোক, বুঝতে পারছি। চিঠিতে স্যান্টিয়াগোর উল্লেখ রয়েছে, জায়গাটা চিলিতে, আর চিলি হল দক্ষিণ আমেরিকায়। মারলিনভিল সুরসার নামটা আমার শোনা।

-বোলোন আর ক্যালাইনের মাঝামাঝি একটা ছোট্ট জায়গা। কোটিপতি মিঃ রেনাল্ডের একটা বাড়ি ইংলন্ডেও আছে বলে শুনেছি। বলল পোয়ারো।

–হ্যাঁ, আমি সায় জানালাম, রুটল্যান্ড গেটে।

তাড়াতাড়ি দুজনের দুটো স্যুটকেসে নিজেদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিলাম। তারপর ট্যাক্সি ধরে এগারোটার ট্রেন ধরবার জন্য ভিক্টোরিয়ায় উপস্থিত হলাম।

ডোভারের পথে সমুদ্রযাত্রায় রওনা হবার আগে আমাদের পৌঁছানর সময় জানিয়ে পোয়ারো মিঃ রেনল্ড কে একটা তারবার্তা পাঠিয়ে দিল।

আবহাওয়া চমৎকার ছিল। তাই সমুদ্রযাত্রাটা উপভোগ্যই হল। তবে পোয়ারোর সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। নিজের ধ্যানে চুপচাপ ছিল।

ক্যালাইনে জাহাজ থেকে নেমে হতাশ হতে হল। আমাদের জন্য কোনো গাড়ি পাঠানো হয়নি।

যাইহোক, সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া ট্যাক্সি নিয়ে মারলিনভিলের দিকে রওনা হয়ে পড়লাম আমরা।

ভিলা জেনেভিয়েভ খুঁজে পেতে অবশ্য একটু বেগ পেতে হল। রাস্তায় কয়েক জনের কাছে পথের নির্দেশ জেনে নিয়ে একসময় আমরা একটা বিরাট গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

এই সময় লক্ষ্য করলাম রাস্তার ডান দিকে একটা সুন্দর ছোট্ট ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে আমাদের দেখছে।

প্রথম দর্শনেই মেয়েটির অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করল। যৌবনের ঢল নামা দীর্ঘাঙ্গী মূর্তিটিকে কোনো দেবীমূর্তি বলে ভ্রম হওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। এই দেবীমূর্তির রূপলাবণ্য আমার আতুর দুই চোখ বার বার তার দিকে আকর্ষণ করছিল।

–এসব কি হেস্টিংস?

পোয়ারোর বিস্মিত স্বর কানে যেতে আমার সম্বিত ফিরল। চোখ ফিরিয়ে আমিও হকচকিয়ে গেলাম।

গেটের সামনে একজন সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে। হাত তুলে সে আমাদের নিরস্ত হবার ইঙ্গিত করল।

-ভেতরে যাওয়া বারণ।

–কিন্তু মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে যে আমাদের দেখা করবার কথা ছিল। এটা তারই ভিলা তো? বলল পোয়ারো।

-হ্যাঁ মঁসিয়েরা। কিন্তু…মঁসিয়ে রেনাল্ড আজ সকালেই খুন হয়েছেন।

.

০৩.

 জানা গেল পুলিস কমিশনার ভিলার ভেতরেই আছেন। পোয়ারো পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে কয়েকটা শব্দ লিখে সার্জেন্টের হাতে দিয়ে পুলিস কমিশনারকে পাঠিয়ে দেবার অনুরোধ জানাল।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছোটখাট বলিষ্ঠ চেহারার গুঁফো একজন অফিসারকে প্রায় ছুটতে ছুটতে আমাদের দিকে আসতে দেখা গেল।

পোয়ারো অস্ফুটে উচ্চারণ করল, মঁসিয়ে রেক্স।

–প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো–আপনাকে পেয়ে বড় আনন্দ হল। নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল।

পোয়ারো হাসিমুখে ভদ্রলোকের সঙ্গে করমর্দন করল। আমার দিকে ফিরে পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি আমার ইংরেজ বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আর ইনি হলেন মঁসিয়ে লুসিয়ান রেক্স।

আমরা মাথা নিচু করে পরস্পরকে অভিবাদন জানালাম।

-১৯০৯ সালের পর এই আমাদের আবার দেখা হল। বললেন কমিশনার, কিভাবে কাজে আসতে পারি বলুন?

বুঝতে পারলাম, পোয়ারোর আগমনের কারণ ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন। তবু বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে পোয়ারো মিঃ রেনাল্ডের চিঠিতে তাঁকে ডেকে পাঠানোর কথা ও কারণ জানিয়ে দিল।

ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে হয়টেটের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে আমরা জানতে পারলাম, আজ সকাল নটা নাগাদ মিঃ রেনাল্ডের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। মাদাম রেনাল্ড এবং ডাক্তারের অনুমান রাত দুটোর সময় খুনটা হয়েছে।

ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হয়টেট যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছেন এবং তদন্তের কাজে ব্যস্ত আছেন।

হলের বাঁদিকে একটা ঘরে মঁসিয়ে রেক্স ও তার সাহায্যকারী অফিসার একটা গোলটেবিলের সামনে বসেছিলেন।

তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাদের আগমনের কারণও তাকে জানিয়ে দিলেন রেক্স। মেন্টালপিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মাঝবয়সী ডঃ ডুরান্ড, তার সঙ্গেও আমরা পরিচিত হলাম।

রোগাটে চেহারার দীর্ঘদেহী ম্যাজিস্ট্রেট, সমস্ত শুনে বিস্মিত স্বরে বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার, মিঃ রেনাল্ড দেখছি আগেই দুর্ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন।

তিনি পোয়ারোর কাছ থেকে মিঃ রেনাল্ডের চিঠিটা চেয়ে নিয়ে পড়লেন।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, এই চিঠিটার জন্য আপনার কাছে আমরা ঋণী। আমাদের ধারণা বদলে গেল। একটা গোপন খবর পেলাম। আশাকরি আপনি ইংলন্ডে ফিরে যাবার কথা ভাবছেন না।

-না মঁসিয়ে, বলল পোয়ারো, আমার নিয়োগকর্তাকে বাঁচাবার সময় আমি পাইনি, কিন্তু তার খুনীকে খুঁজে বার করা আমার কর্তব্য।

মাদাম রোনাল্ডও নিশ্চয় তার স্বামীর নিয়োগ অনুমোদন করবেন। প্যারিস থেকে মঁসিয়ে জিরয়েডও আসছেন।

তদন্তের কাজে আপনারা পরস্পরকে সাহায্য করবেন আশা করি। আমাদের তরফ থেকে প্রয়োজন মতো সবরকম সহযোগিতাই পাবেন।

পোয়ারো মঁসিয়ে হয়টেটকে ধন্যবাদ জানিয়ে এখানকার ঘটনার বিবরণ জানতে চাইল। তাঁর নির্দেশে কমিশনার বলতে শুরু করলেন, আজ সকালে বাড়ির কাজ করার সময় বৃদ্ধা পরিচারিকা ফ্রাঙ্কেইস দেখতে পায় বাড়ি সদর দরজা ভেজানো। মনিব কোথাও বেড়াতে গেছেন ধারণা করে সে এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি।

বাড়ির যুবতী পরিচারিকা লিওনি ওদিকে গৃহকর্ত্রীকে জাগাতে গিয়ে বীভৎস এক ঘটনার মুখোমুখি হয়। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার ঘরে পড়ে ছিলেন অচৈতন্য মিসেস রেনাল্ড।

এদিকে প্রায় একই সময়ে মিঃ রেনাল্ডের মৃতদেহও আবিষ্কার হয় এক গর্তের মধ্যে। ভিলার সীমানার বাইরে কয়েক গজ দূরে উন্মুক্ত কবরের মতো সেই গর্তে মুখ নিচুকরা অবস্থায় পড়েছিল দেহটা।

পেছনে ছোরার আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে তাঁকে।

–কতক্ষণ আগে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? সঙ্কোচের সঙ্গে জানতে চাইল পোয়ারো।

ডঃ ডুরান্ড বললেন, আমার মতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে রাত তিনটের সময়। অবশ্য মাদাম রেনাল্ড জানিয়েছেন সময়টা রাত দুটো। আকস্মিক আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছিল তার। তাই কোনোভাবেই বাধা দিতে পারেননি।

-বুঝেছি। মাথা নাড়ল পোয়ারো।

–বাড়ির পরিচারকরা ছুটে এসে মাদামের বাঁধন খুলে দেয়। বলতে শুরু করলেন কমিশনার, বাড়ির চাকরবাকরদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি দুজন মুখোশধারী লোক আচমকা শোবার ঘরে ঢুকে প্রথমে তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে। পরে তারা তার স্বামীকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সেই সময়ই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার সঙ্গে অবশ্য এখনো পর্যন্ত আমরা কথা বলিনি।

–মঁসিয়ে রেনাল্ড ও মাদাম বাদে বাড়িতে আর কে কে আছে? জানতে চাইল পোয়ারো।

–পরিচারিকাদের মধ্যে বৃদ্ধা ফ্রাঙ্কেইস, যুবতী দুই বোন ডেনিস ও লিওনি অও লমবার্ড। এছাড়া বাড়ির পুরনো মালিকের বহুবছরের পুরনো হাউসকিপার আর সোফার। তাকে মঁসিয়ে রেনাল্ড ইংলন্ড থেকে এনেছিলেন। মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ড–সঁসিয়ে রেনাল্ডের পুত্রও এবাড়িতে থাকেন। বর্তমানে তিনি বাইরে আছেন।

কমিশনারের বিবরণ শেষ হলে মঁসিয়ে হয়টেট জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শুরু করলেন। তার নির্দেশ পেয়ে সার্জেন্ট প্রথম হাজির করল বৃদ্ধা ফ্রাঙ্কেইসকে।

মঁসিয়ে হয়টেটের প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতে জানাল, বাড়ির পূর্বতন মালকিন লা ভিকসটির-এর কাছে এগারো বছর ছিল। গত বসন্তে নতুন ইংরেজ মালিক বাড়িটা কিনে নিলে সে এখানেই থেকে যায়।

-খুব ভালো কথা। এবারে বলল, রাতে সদর বন্ধ করে কে? ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চাইলেন।

প্রতিদিন আমিই দরজা বন্ধ করি মঁসিয়ে। গতকালও রাত সাড়ে দশটায় বন্ধ করেছিলাম।

–তখন বাড়ির অন্যান্যরা কে কোথায় ছিল বলতে পারবে?

-মঁসিয়ে রেনাল্ড তার পড়ার ঘরে ছিলেন। মাদাম কিছুক্ষণ আগেই শোবার ঘরে চলে যান। ডেনিস আর লিওনি আমার সঙ্গেই চলে আসে।

-তাহলে বোঝা যাচ্ছে মঁসিয়ে রেনাল্ডই রাতে দরজা খুলে থাকবেন।

-একাজ তিনি করতে পারেন না সিয়ে। প্রতিবাদ করে উঠল ফ্রাঙ্কেইস, চোর-ডাকাত সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায় বাড়ির বাইরে, তা তিনি ভালোই জানতেন। অত রাতে সেই লেডিকেও তিনি বাড়ির বাইরে যেতে দেননি

–কোনো লেডির কথা বলছ তুমি? তার নাম কি? তীব্র স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিস্ট্রেট।

একটু ইতস্ততঃ করে বৃদ্ধা জানাল, প্রায় সন্ধ্যাতেই তো তিনি আসেন। তাঁর নাম মাদাম ডওব্রেইল।

–ওহো, পাশের ভিলা মারগুয়েরিটে যিনি থাকেন? ঠিক বলছ?

 –হ্যাঁ, মঁসিয়ে, তার কথাই বলছি। আপনি তাকে জানেন দেখছি। খুবই সুন্দরী তিনি।

–অদ্ভুত ব্যাপার, বিস্ময় প্রকাশ করলেন ম্যাজিস্ট্রেট, গত সন্ধ্যায় তাহলে তাঁরা দুজন একসঙ্গে ছিলেন–

কথা থামিয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন বৃদ্ধার দিকে।

দেখা গেল খোঁচাটা ঠিক জায়গাতেই পড়েছে। ফ্রাঙ্কেইস গড়গড় করে বলতে শুরু করল, ওদের দুজনের মধ্যে কি সম্পর্ক তা আমি জানি না। সকলেই জানে মাদাম ডওব্রেয়ুইল অত্যন্ত গরীব, মেয়েকে নিয়ে থাকেন। অসাধারণ সুন্দরী তিনি যদিও এখন আর যুবতী নন। সম্প্রতি গ্রামে অনেক কথাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিনি দেদার খরচপত্র করছেন। অত টাকা কোথা থেকে পাচ্ছেন সেটা সকলের কাছেই রহস্য।

–এঁদের এই বন্ধুত্বের কথা মাদাম রেনাল্ড জানতেন?

–জানতেন সবই মঁসিয়ে। কিন্তু অত্যন্ত নম্র ভদ্র মহিলা তিনি। তাই স্বামীর আচরণে বুক ভেঙ্গে গেলেও মুখ বুজে সয়ে থাকেন। মানসিক যন্ত্রণায় দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছেন তিনি, আমি লক্ষ্য করেছি।

মঁসিয়ে রেনাল্ডও বুঝতেন কিন্তু গ্রাহ্য করতেন না। তিনি নেশাগ্রস্তের মতো হয়ে পড়েছিলেন-সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন তিনি ছটফট করতে থাকতেন।

মঁসিয়ে, আমি জানি, মাদাম ডওব্রেয়ুইল খুবই খারাপ স্বভাবের মহিলা। সে গ্রাস করেছিল মঁসিয়েকে।

-তাহলে তুমি বলছ, কাল সন্ধ্যায় ভদ্রমহিলা যথারীতি এসেছিলেন। তিনি কি রাতে চলে গিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ মঁসিয়ে। পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে মঁসিয়ে তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন আর ভদ্রমহিলা শুভরাত্রি জানিয়েছিলেন। আমি শুনতে পেয়েছিলাম। এরপর মঁসিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন।

–তখন সময় কত হবে?

–তখন রাত দশটা পঁচিশ হবে।

–আচ্ছা, এ ব্যাপারে তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?

–না মঁসিয়ে।

ম্যাজিস্ট্রেট এরপর বিদায় দিলেন বৃদ্ধাকে। তার ডাক পেয়ে ঘরে উপস্থিত হল লিওনি অও লমবার্ড। লিওনি হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতেই ঘরে ঢুকল।

এই যুবতী পরিচারিকাটিই প্রথম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাদাম রেনাল্ডকে দেখতে পেয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের জিজ্ঞাসার উত্তরে সে পুনর্বার সেই বর্ণনা শোনালো। রাতেও কোনো অস্বাভাবিক শব্দ সে শুনতে পায়নি। তার বোন ডেনিসও জানাল তার মনিবের চালচলন ইদানীং কেমন বদলে গিয়েছিল।

ম্যাজিস্ট্রেট ডেনিসকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল রাতে মাদাম ও ডওব্রেয়ুইলকে কি তুমিই দরজা খুলে দিয়েছিলে?

–গতরাতে নয় মঁসিয়ে, তার আগের দিন। গতরাতে তিনি আসেননি।

–ফ্রাঙ্কেইস যে বলল, তিনি গতকাল রাতেও এসেছিলেন?

–না, মঁসিয়ে, গতকাল রাতে অন্য এক মহিলা সিয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

 –অদ্ভুত ব্যাপার! বেশ, আগে কখনো এই মহিলাকে তুমি দেখেছো?

–না, মঁসিয়ে। কাল যিনি এসেছিলেন, আমার মনে হয় তিনি একজন ইংরেজ মহিলা।

 –ইংরেজ?

–হ্যাঁ মঁসিয়ে। তবে তিনি মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে ফরাসি ভাষাতেই কথা বলেছিলেন। তাছাড়া যাবার সময় তিনি ইংরাজিতেই কথা বলেন। আমি ইংরাজিতে ভালোই কথা বলতে পারি। ভদ্রমহিলাকে বিদায় দেবার সময় মঁসিয়ে রেনাল্ড বলেছিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন তুমি বিদেয় হও। ইংরাজি কথাগুলি আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম।

মেয়েটিকে বিদায় দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট দুজন পরিচারিকার পরস্পর বিরোধী সাক্ষ্য নিয়ে খুবই ভাবিত হয়ে পড়লেন।

পোয়ারো এই সময় কমিশনার রেক্সের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, মাপ করবেন, মঁসিয়ে রেক্স, আমার ধারণা মঁসিয়ে রেনাল্ড নিজে গাড়ি চালাতে পারতেন।

পোয়ারোর কুঞ্চিত ভ্রূ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, কোনো চিন্তার গভীরে ডুবে আছে ওর মন।

কমিশনার বললেন, আমি খবর নিয়ে জেনেছি, তিনি নিজে কখনো গাড়ি চালাতেন না।

–একথা মাথায় এলো কেন তোমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম পোয়ারোকে।

-কেন, তিনি তোত চিঠিতে আমার জন্য ক্যালাইনে গাড়ি পাঠাবার কথা লিখেছিলেন, তুমি দেখতে পাওনি?

–তিনি নিশ্চয় ভাড়া গাড়ির কথাই বলে থাকবেন। বললাম আমি।

–আমার তা মনে হয় না। নিজের গাড়ি থাকতে তিনি কেন ভাড়া গাড়ির কথা ভাববেন?

-মঁসিয়ে রেক্স, ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, তাহলে কার কথা বিশ্বাস করব আমরা? ডেনিস না ফ্রাঙ্কেইস?

–নিঃসন্দেহে ডেনিস, তার সিদ্ধান্ত জানালেন কমিশনার, গতকাল সন্ধ্যায় এই মেয়েটিই অতিথিকে দরজা খুলে দিয়েছিল। মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে যে ফ্রাঙ্কেইস পছন্দ করে না তা তার কথাতেই পরিষ্কার। তাছাড়া, আমরা জানি অন্য একটি মহিলার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল মঁসিয়ে রেনাল্ডের।

–ওহো, তাই তো, ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট বলে উঠলেন, মঁসিয়ে পোয়ারোকে তো খবরটা দেওয়াই হয়নি।

বলতে বলতে তিনি টেবিলের ওপরে রাখা কাগজের ভেতর থেকে তুলে একটা কাগজ পোয়ারোর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, এই চিঠিটা মৃতের কোটের পকেটে পাওয়া গেছে।

ভাঁজ করা চিঠিটা খুলে ধরল পোয়ারো :

প্রিয়তম,
অনেকদিন তোমার চিঠি পাচ্ছি না। তুমি আমায় ভুলে গেছ কিংবা ভালোবাসো না–আমি বোকা নই যে এমন অসম্ভব কথা ভাবব। যদি ভালোইবাস তাহলে এমনভাবে নীরব হয়ে আছ কেন? ইদানীংকার চিঠিগুলোতে তোমার ভাষাও কেমন প্রাণহীন নিরস হয়ে আসছিল। এখন আবার চিঠিই বন্ধ করে দিলে। তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা আমি ভাবতে পারি না। যদি সত্যিই আমায় আর ভালো না বাসো, তাহলে নির্ঘাৎ আমি আত্মহত্যা করব, জেনো।

আমার আর তোমার মাঝখানে অন্য কোনো নারীর ছায়া পড়েছে, মাঝে মাঝে এমন কথাও মনে হতে চায় আমার। অন্য নারীর যদি হতে চাও তুমি, তাহলে তার আগে তোমাকেই খুন করে আমি জ্বালা জুড়ব। আমার হাত দিয়ে কী কথা বেরিয়ে গেল প্রিয়? আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাস। হ্যাঁ আমিও ভালোবাসি…ভালোবাসি তোমাকে।
তোমার আদরের
বেলা

ঠিকানা, তারিখবিহীন চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে সেটা ফেরত দিল পোয়ারো।

চিঠিটা একটু রহস্যময়

-ওই বেলা নামে ইংরেজ মহিলার সঙ্গেও সঁসিয়ে রেনাল্ডের ঘনিষ্ঠ প্রেম ছিল বোঝা যাচ্ছে। এখানে এসে মাদাম ডওব্রেয়ুইল-এর সংস্পর্শে আসার পর তিনি বেলা নামের মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

ব্যাপারটা অনুমান করেই চিঠিতে তাকে এরকম একটা হুমকি দেওয়া হয়। কেসটা ক্রমশই বেশ জটিল হয়ে পড়ছে। মঁসিয়ে পোয়ারো, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে যেভাবে পিঠে ছোরা বসিয়ে হত্যা করা হয়, সেটা কোনো মহিলার কাজ হওয়া অসম্ভব নয়।

-কিন্তু সদ্য সদ্য কবর খনন করা কোনো মহিলার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজটা নিঃসন্দেহ কোনো পুরুষের। বলল পোয়ারো।

–হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। বললেন কমিশনার।

–এই বেলার চিঠির সঙ্গে আপনাকে মঁসিয়ে রেনাল্ডের চিঠি লেখা–এ দুয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে যেন। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।

–আপনি বলতে চাইছেন চিঠির হুমকিতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন? আমার তা মনে হয় না। বহু নারী ঘেঁটে বেড়ানো পুরুষরা এমন ভীতু হন বলে আমি মনে করি না।

-মঁসিয়ে রেনাল্ডের অতীত জীবনের ইতিহাস পাওয়া গেলে তার কোনো শত্রু ছিল কিনা, কিংবা প্রেমঘটিত আরো কোনো ব্যাপার সবই জানা সম্ভব হবে–স্যাণ্টিয়াপোর পুলিসকে খোঁজ নিতে অনুরোধ জানাব।

-এই মহিলার অন্য কোনো চিঠি বা অন্য জরুরী নথিপত্র কিছু কি পাওয়া গেছে?

 –প্রয়োজনীয় বলতে মঁসিয়ে রেনাল্ডের একটা দলিল পাওয়া গেছে। এই সেই উইল–

উইলে চোখ বুলিয়ে পোয়ারো বলল, মিঃ স্টোনি ব্যক্তিটি কে? দেখছি এই উইলে তাকে হাজার পাউণ্ড দেওয়া হয়েছে।

–সঁসিয়ে রৈনাল্ডের সেক্রেটারি, বর্তমানে ইংলন্ডে আছেন।

–উইলটা গুরুত্বপূর্ণ–ছেলেকে পুরোপুরি বঞ্চিত রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি পাচ্ছেন তার স্ত্রী এলোইস। ডেনিস ও ফ্রাঙ্কেইস-এর দুই পরিচারিকা উইলের সাক্ষী।

-তারিখটা লক্ষ্য করেছেন? বললেন কমিশনার।

-হ্যাঁ, নজর পড়েছে, বলল পোয়ারো, পনেরো দিন আগের তারিখ রয়েছে। সম্ভবতঃ বিপদের আভাষ পেয়েই তড়িঘড়ি-যাইহোক, ঘটনাস্থল একবার ঘুরে আসা দরকার সঁসিয়ে রেক্স।

হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।

.

ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে মঁসিয়ে রেনাল্ডের পড়ার ঘরে ঢুকল পোয়ারো। পরিপাটি সাজানো একটা ছোটঘর।

ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিলের দুপাশে দুটো চামড়া মোড়ানো হাতলওয়ালা চেয়ার। কিছু বই ও ম্যাগাজিন রাখা আছে টেবিলে।

ঘরটা একপাক ঘুরে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।

–এটা কি বস্তু…দেখো তো হেস্টিংস

 ফায়ারপ্লেসের সামনে পাতা মাদুরের কোণে পড়ে থাকা কয়েকটুকরো ফ্যাকাসে রঙের কাগজ তুলে নিল।

–একটা চেকের ছেঁড়া অংশ, নিজেই বলল পোয়ারো, দু ইঞ্চি পরিমাণ কাগজের টুকরোতে কালি দিয়ে লেখা রয়েছে ডুবিন।

কমিশনার রেক্স বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ডুবিন নামে কোনো ব্যক্তিকে মনে হয় চেকটা দেওয়া হয়েছিল?

–আমারও তাই অনুমান, বলল পোয়ারো, হাতের লেখাটা মঁসিয়ে রেনাল্ডের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

–অদ্ভুতভাবে জিনিসটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে

বলে উঠলেন কমিশনার।

-ঘর যারা সাফ করেছে তারাও লক্ষ্য করেনি, বলল পোয়ারো, সম্ভবতঃ গতকাল রাতে ডুবিন নামে কোনো লোক নিজের নামে চেকটা মঁসিয়ে রেনাল্ডের কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে

গোল টেবিলের ড্রয়ারে সন্ধান করে কমিশনার মঁসিয়ে রেনাল্ডের চেকবই বার করেন। দেখা গেল শেষ চেকের কাউন্টার ফয়েল একেবারে ফাঁকা।

-মাদাম রেনাল্ড হয়তো ডুবিন নামের লোকটির সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারবেন; চলুন তার কাছেই যাওয়া যাক। বললেন কমিশনার।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুখে একটা লম্বা কালো চুল আঙুলে চেপে তুলে ধরল পোয়ারো।

–চামড়া মোড়ানো চেয়ারের পেছনে পাওয়া গেল মঁসিয়ে রেক্স সম্ভবতঃ এই ঘরেই গতকাল রাতে অতিথির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন গৃহস্বামী।

.

মঁসিয়ে রেনান্ডের মৃতদেহ নিয়ে এসে রাখা হয়েছিল বাড়ির পেছনে দেয়াল ঘেঁষে টিনের শেড দেওয়া একটা ঘরে। মঁসিয়ে রেক্স আমাদের সেখানে নিয়ে এলেন।

দেখা গেল মাঝারি উচ্চতার মানুষ ছিলেন আঁসিয়ে রেনাল্ড। তামাটে গায়ের রঙ। মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

পোয়ারো বলল, এ থেকেই বোঝা যায়, পেছন থেকে অতর্কিতে ছোরা মারা হয়েছে। মঁসিয়ে রেক্স, অস্ত্রটা কি ধরনের ছিল?

একটা বড় কাচের ট্রেতে অস্ত্রটা রাখা ছিল। কমিশনার সেটা দেখিয়ে বললেন, পেপার কাটার একটা–ছুরি মতো দেখতে। বাঁট সমেত ইঞ্চি দশেক হবে।

রক্তের দাগ শুকিয়ে ছিল গায়ে, ছুরিটা পরীক্ষা করল পোয়ারো। বলল, খুন করার পক্ষে যথেষ্ট।

-খুনী হাতে গ্লাভস ব্যবহার করেছিল, তাই কোনো হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। বললেন কমিশনার।

–খুবই সতর্ক কাজ-ক্লু রাখতে চায়নি। বলল পোয়ারো, কিন্তু খুঁজে ঠিক বার করব। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখছি, মঁসিয়ে রেনাল্ড তার ওভার কোটের তলায় শুধু আন্ডারওয়ার পরে ছিলেন।

-হ্যাঁ, ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাপারটাকে রহস্যজনক মনে করেছেন।

এই সময় দরজা ঠেলে ফ্রাঙ্কেইস ঘরে ঢুকল। জানাল, মাদাম সুস্থ বোধ করছেন, কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

–আমরা এখুনি আসছি, তুমি সঁসিয়ে হয়টেটকে খবরটা দাও।

ফ্রাঙ্কেইস বিদায় নিলে কমিশনার বললেন, চলুন যাওয়া যাক।

পোয়ারো নিবিষ্ট চোখে মৃতদেহের দিকে তাকিয়েছিল। আচমকা বিড়বিড় করে বলে উঠল, ওভারকোটটা বেমানান লম্বা।

.

ওপরতলায় সিঁড়ির শেষ ধাপে একটা প্যাসেজ, প্রশস্ত করিডর। একপাশে চাকরবাকরদের ঘর। করিডরের শেষ প্রান্তে একটা বড় ঘরে ফ্রাঙ্কেইস আমাদের নিয়ে এলো।

দীর্ঘাঙ্গী মাঝবয়সী মাদাম রেনাল্ড একটা খাটে শুয়েছিলেন। ডাঃ ডুরান্ড তাকে পরীক্ষা করছিলেন।

সম্মানসূচক অভিবাদন জানিয়ে মাদাম আমাদের আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। দু-চার কথার পর ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট তার কাজ শুরু করলেন।

-মাদাম, গতকাল রাতের ঘটনা বিশদভাবে আমাদের বলুন।

–সবই বলব মঁসিয়ে। আমি চাই অপরাধীর শাস্তি হোক। আমার যথাসাধ্য আমি করব।

গতকাল রাতে সাড়ে নটা নাগাদ আমি শুতে যাই। আমার স্বামী পড়ার ঘরে ছিলেন। মনে হয় ঘণ্টাখানেক পরে শুতে আসেন।

অনেক রাতে কেউ হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু চিৎকার করতে পারিনি। দুজন মুখোশপরা লোক ছিল ঘরের ভেতরে।

-তাদের চেহারা আপনার মনে আছে মাদাম?

–একজন অপরজনের বিপরীত একেবারে। ঢ্যাঙা লম্বা লোকটির মুখে কালো দাড়ি, অপরজন বেঁটে গঁট্টাগোট্টা, মুখে লাল দানি। দুজনেরই মাথার টুপি টেনে চোখ আড়াল করা।

বেঁটে লোকটি আমার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলে। অন্য লোকটি আমার স্বামীর বুকের ওপর চেপে কাগজকাটা ছুরিটা উঁচিয়ে ধরেছিল।

এরপর তারা আমার স্বামীকে জোর করে পাশের ড্রেসিংরুমে নিয়ে যায়। প্রচণ্ড ভয় পেলেও সংজ্ঞা হারাইনি তখনো।

পাশের ঘর থেকে অস্পষ্ট চাপা কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। একজন স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছিল, দক্ষিণ আমেরিকার লোকেরা যেমন বলে থাকে। সে আমার স্বামীকে বলছিল, সেই গোপন জিনিসটা আমাদের চাই। কোথায় সেটা?

কথা কাটাকাটি করে ওরা আমার স্বামীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে ড্রয়ার খোলে, দেয়াল আলমারি খোলে। পরে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, আলমারি হাতড়ে সমস্ত টাকা তারা নিয়ে গেছে।

সেই সময় বাইরে একটা আওয়াজ হয়। তখন ওরা আমার স্বামীকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

তিনি তাদের বলেন, আমার সঙ্গে একবার কথা বলতে চান। পরক্ষণে তিনি ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে এসে বলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করোনা। সকাল হওয়ার আগেই আমি ফিরে আসব।

আমাকে অভয় দেবার চেষ্টা করছিলেন বটে, তার নিজেরই চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ছিল। লম্বা লোকটা ঘর থেকে তাকে টেনে নিয়ে যায়। শাসিয়ে বলে, শব্দ করলে, মরবে।

এরপর সম্ভবতঃ আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আবার চোখ মেলে তাকাই দেখতে পাই লিওনি আমাকে ব্র্যাণ্ডি খাওয়াবার চেষ্টা করছে।

-খুনীরা কিসের খোঁজ করছিল বলে আপনার ধারণা?

 –আমার কোনো ধারণা নেই মঁসিয়ে।

ইদানীং আপনার স্বামীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন?

-হ্যাঁ। প্রায় দিন দশেক আগে থেকেই আমি লক্ষ্য করি, তিনি কোনো দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। জিজ্ঞাসা করলেও আমাকে কিছু বলতে চাননি।

–আপনার স্বামী একজন গোয়েন্দার সাহায্য নিতে চেয়েছিলেন, একথা আপনি জানতেন?

 প্রশ্নটা শুনে দারুণ চমকে উঠলেন মাদাম রোনাল্ড। তার ভ্রূ কুঞ্চিত হল।

-গোয়েন্দার সাহায্য?

–হ্যাঁ, এই ভদ্রলোক, মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো

পোয়ারো মৃদুহাস্যে মাথা নুইয়ে তাকে সম্ভাষণ জানালো।

ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট আবার বলতে শুরু করলেন, আপনার স্বামীর চিঠি পেয়ে আজই তিনি এখানে উপস্থিত হয়েছেন। যাইহোক, আপনি সর্বতোভাবে আমাদের সহযোগিতা করবেন, এটাই আমার প্রত্যাশা মাদাম।

আচ্ছা, দক্ষিণ আমেরিকায় আপনার স্বামীর কোনো শত্রু ছিল বলে আপনি মনে করেন?

নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারব না। তবে তার অনেক শত্রু ছিল।

–এই দুর্ঘটনার সময়টা আপনার মনে আছে?

সময়টা-ঘড়িতে ঢং ঢং দুটো আওয়াজ শুনেছিলাম।

এই সময় কমিশনার রেক্স একটা কাচভাঙ্গা হাতঘড়ি মেঝেয় কুড়িয়ে পেলেন।

–অদ্ভুত কাণ্ড! ঘড়িটা হাতে নিয়ে বলে উঠলেন তিনি, আততায়ীরা হয়তো ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এতে যে সাতটা বেজে আছে।

পোয়ারো ঘড়িটা কমিশনারের হাত থেকে নিয়ে কান লাগিয়ে পরীক্ষা করল।

-না, বিকল হয়নি, চলছে। কিন্তু এখন তো পাঁচটা বেজে কয়েক মিনিট, দুঘন্টা ফাস্ট হয়ে আছে এটা। বলে মাদাম রেনাল্ডের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

-ঘড়িটা ফাস্ট যায় বটে কিন্তু এত ব্যতিক্রম তো হয় না। বললেন মাদাম।

যাইহোক, মাদামকে ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন করলেন, শোবার ঘরের দরজাটা ভেজানো অবস্থায় দেখা গেছে, এ সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

–সম্ভবতঃ আমার স্বামী বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।

 কমিশনার বললেন, গোপন একটা জিনিসের খোঁজ করছিল আততায়ীরা, আমার মনে হয়, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে কাছেই কোথাও তারা নিয়ে গিয়ে থাকবে।

–হ্যাঁ, তিনি সকালের আগেই ফিরে আসার কথা বলেছিলেন। সায় জানালেন ম্যাজিস্ট্রেট।

 পোয়ারো জানতে চাইল, মারলিনভিল স্টেশন থেকে শেষ গাড়ি কখন ছাড়ে?

-ডাউনে এগারোটা পঞ্চাশ আর আপে বারোটা সতেরোয়। আমার ধারণা তারা মোটর গাড়িতেই গিয়ে থাকবে।

–হুঁ। মাথা ঝাঁকালো পোয়ারো।

–মাদাম আর একটা প্রশ্ন, ডুবিন নামে কাউকে আপনি জানেন?

 –ডুবিন? ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।

 –বেলা, এই খ্রিস্টান নামের কোনো মহিলাকে?

–না, মঁসিয়ে।

-আপনি কি জানেন, গতকাল রাতে একজন মহিলা অতিথি আপনার স্বামীর কাছে এসেছিলেন?

–তা হবে। নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন তিনি।

নিচে থেকে ছুরিটা নিয়ে আসা হয়েছিল। এবারে সেটা তুলে ধরে ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি চিনতে পারেন মাদাম?

–হ্যাঁ, আমারই ছুরি। আমার ছেলে-ওটা কি রক্তের দাগ?

ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলেন মাদাম রেনাল্ড।

–হ্যাঁ, মাদাম, এটা দিয়েই আপনার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট ছুরিটা সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে বললেন, গতকাল রাতে ছুরিটা আপনার ড্রেসিংটেবিলের ওপরে ছিল।

-হ্যাঁ। আমার ছেলে জ্যাক ওটা যুদ্ধের স্মারক হিসেবে আমাকে উপহার দিয়েছিল। গতযুদ্ধে ও বিমানবাহিনীতে ছিল। ওটা স্ট্রিমলাইন বিমানের স্টিলের পাত থেকে তৈরি।

–আপনার ছেলে এখন কোথায়?

-জ্যাক বুয়েনস আয়ার্সে রওনা হয়ে গেছে। তাকে প্যারিসে পাঠানো হয়েছিল, আমার স্বামী গতকালই আবার তার পাঠিয়ে তাকে দক্ষিণ আমেরিকায় যাওয়ার কথা জানিয়ে দেন। সেখান থেকে তার যাওয়ার কথা স্যান্টিয়াগোয়।

–আবার স্যান্টিয়াগো।

 ম্যাজিস্ট্রেট এবং কমিশনার রেক্স দুজনেই একসঙ্গে শব্দটা উচ্চারণ করে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

এই অবসরে পোয়ারো চেয়ার থেকে উঠে মাদাম রেনাল্ডের কাছে সরে এসে অনুরোধ জানাল, ক্ষমা করবেন মাদাম, আপনার হাতের কব্জিতেই তো ওরা বেঁধেছিল?

-হ্যাঁ, অবাক হয়ে তাকালেন মাদাম, পোয়ারোর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তিনি দুটো হাত বাড়িয়ে ধরলেন।

পোয়ারো উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করল। কব্জির ওপরে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে।

বেশ শক্ত বাঁধনই পড়েছিল, আপনাকে নিদারুণ কষ্টই সইতে হয়েছে।

ধন্যবাদ জানিয়ে পোয়ারো আসনে ফিরে এলো।

–কিন্তু মাদাম, আপনার ছেলের উপস্থিতি খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।

–আমি বুঝতে পারছি সিয়ে, বললেন মাদাম রোনাল্ড, নারী হলেও আমার মন যথেষ্ট শক্ত। আমার স্বামীর মৃতদেহ আমিই সনাক্ত করতে পারব।

ডাঃ ডুরান্ডের হাত ধরেই মাদাম রেনাল্ড নিচে এলেন। কিন্তু মৃতদেহ দেখেই, হায় ঈশ্বর, আমার স্বামী…আর্তনাদ করে জ্ঞান হারালেন তিনি।

পড়েই যাচ্ছিলেন, পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। মাদাম রেনাল্ডের চোখের পাতা পরীক্ষা করে পোয়ারো নিশ্চিত হল।

–মাদাম রেনাল্ডের কণ্ঠস্বরে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। আমার পাশে সরে এসে বলল পোয়ারো, আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হল হেস্টিংস।

.

এরপর আমরা সকলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলাম। বাগান থেকে দোতলার শোবার ঘরের জানালা চোখে পড়েছিল।

জানালার পাশ দিয়েই উঠে গেছে একটা গাছ। পোয়ারো সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ওপরে যাবার সহজতম পথ ওই গাছটা।

গাছটার নিচে অনুসন্ধান করে ফুলের কেয়ারিতে অনেকগুলো পায়ের ছাপ আবিষ্কার হল।

–এগুলো বাগানের মালিরই হওয়া সম্ভব। বললেন কমিশনার রেক্স।

-আমি মনে করি পায়ের ছাপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলল পোয়ারো, ঠিক আছে এগিয়ে চলুন।

কয়েক গজ এগিয়েই সামনে উন্মুক্ত মাঠ। সেদিকে দেখিয়ে কমিশনার বললেন, গলফ খেলার মাঠ তৈরি হচ্ছে, কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।

এখানকার কিছু কাজের লোকই আজ ভোরে সামনের একটা কবরের মতো গর্ত থেকে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছিল।

ডানপাশে মাটিতে পড়েছিল একটি লোক। আমাদের দেখে উঠে বসল।

-আরে মঁসিয়ে জিরয়েড আপনি এখানে? কমিশনার চিৎকার করে উঠলেন; এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট বারবার আপনার খোঁজ নিচ্ছেন–

মঁসিয়ে জিরয়েড, প্যারিসের বিখ্যাত গোয়েন্দা। তাঁর নাম শোনা ছিল। এখন চাক্ষুষ করার সুযোগ হল।

দীর্ঘদেহ যুবা, বয়স তিরিশের বেশি হবে না। সৈনিকের মতো স্বাস্থ্য হাবভাব। চুল গোঁফ পিঙ্গল।

পারস্পরিক অভিবাদন বিনিময়ের পর গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি পায়ের দাগের কথা বলছিলেন কানে এলো, ওগুলো এখানকার শ্রমিকদেরই হওয়া সম্ভব। তারাই মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল।

দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই গোয়েন্দার মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষির আবহাওয়া তৈরি হয়ে যেতে দেখে কিঞ্চিৎ কৌতুক অনুভব করলাম। সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম, পোয়ারোর মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

–সামনেই ঝোপঝাড়ে তিনজন লোকের পায়ের ছাপ আমার নজরে পড়েছে। দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন, মাঝখানের ছাপগুলো মঁসিয়ে রেনাল্ডের জুতোর। তার দুপাশের পায়ের ছাপগুলো শক্ত মাটিতে পড়েনি অথবা মুছে ফেলাও হতে পারে।

সামনেই একটা কোদাল পড়েছিল। পোয়ারো হাঁটুমুড়ে বসে কোদালের পাশে পড়ে থাকা। একটুকরো সীসের পাইপ সাবধানে তুলে আনল।

প্যারিসের গোয়েন্দা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকালো পোয়ারোর দিকে। আমারও মনে হল নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েই পোয়ারো মাথা ঘামাচ্ছে।

–মঁসিয়ে রেক্স, কবরের গর্তটার চারপাশে মোটা সাদা চুনকামের মত লাইনটা কিসের? বলে উঠল পোয়ারো।

-ওটা গলফ কোর্সের লাইন মঁসিয়ে পোয়ারো।

তাহলে বাঙ্কারের মত গর্তটা এখানে কেন? কবর দেবার উপযুক্ত জায়গা তো এটা নয়।

.

০৪.

 মঁসিয়ে জিরয়েড উপস্থিত হয়েছেন, এই খবরটা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাবার জন্য কমিশনার মঁসিয়ে রেক্স চলে গেলে আমি আর পোয়ারো ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম।

শেয়াল খেদানো কুকুর দেখেছো হেস্টিংস? ওই দেখো, ছোঁক ছোঁক করে ব্লু খুঁজে বেড়াচ্ছে।

কবরের মতো গর্তটার কাছে দাঁড়ানো জিরয়েডকে দেখিয়ে বলল পোয়ারো।

–কিছু একটা অবশ্যই করছেন, তোমাকে ওই তুচ্ছ সীসের টুকরো নিয়েই মনে হয় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই খুনের সঙ্গে ওটার কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। বললাম আমি।

–জিরয়েড আমল দেয়নি বলে একথা বলছো? ওকে ওর মতোই কাজ করতে দাও। কেসটা সরল মনে হলেও নিতান্তই সরল বলে আমি মনে করতে পারি না। ভেবে দেখেছো, ওই কাচভাঙা হাতঘড়িটা দুঘন্টা ফাস্ট হয়ে ছিল কেন?

তারপর খুনীদের যদি প্রতিশোধ নেওয়াই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে বিছানাতেই ঘুমন্ত অবস্থায় রেনাল্ডকে খুন করল না কেন তারা?

তারা গোপন কিছু খুঁজতে বা জানতে এসেছিল। মনে করিয়ে দিলাম আমি।

–তাহলে সেই গোপন জিনিসটা কি বাড়ির সীমানার মাত্র কয়েক গজের মধ্যেই ছিল? তাহলে তারা তাকে শোওয়ার পোশাক বদলে নিতে বলেছিল কেন? আবার, ওপরে ওঠার সময় তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো, চাকরবাকরদের কোনো শব্দ শোনা উচিত ছিল। কিন্তু তারা কিছু শুনতে পায়নি কেন? রাতে কি কোনো অতিথি এসেছিল? সামনের দরজা সেই কি ইচ্ছে . করে খোলা রেখেছিল? যদি তাই

কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিলাম। কথা বন্ধ করে পোয়ারো হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ডানদিকের ফুলের কেয়ারি থেকে কিছু পায়ের ছাপ এখন আমি যাচাই করে নিতে চাই।

মঁসিয়ে রেক্স বলেছেন, ওগুলো বাগানের মালির পায়ের ছাপ।

ঠিক এমনি সময়ে দেখা গেল মালি এই দিকেই আসছে। পোয়ারো ডেকে তার সঙ্গে কথা বলল, তার বাগানের কাজের প্রশংসা করল।

বৃদ্ধ অগাস্টিন জানাল, সে গত চব্বিশ বছর এই বাগানে কাজ করছে।

জেরনিয়ামের কিছু নতুন চারা দেখিয়ে পোয়ারো জানাল, একটা কাটিং পেলে সে খুব খুশি হয়।

নিশ্চয় মঁসিয়ে। এখুনি দিচ্ছি।

বৃদ্ধ মালি ফুলের কেয়ারিতে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে একটা চারার ডগা নিয়ে এসে হাসিমুখে পোয়ারোর হাতে তুলে দিল।

বারবার করে ধন্যবাদ জানিয়ে পোয়ারো চমৎকার কাটিংটার প্রশংসা করল। মালি চলে গেল।

এবারে আগের পায়ের ছাপগুলোর সঙ্গে অগাস্টিনের পায়ের ছাপ মেলাতে গিয়ে আমি দেখলাম ফুলের কেয়ারির পুরনো সব ছাপই বুটের।

পোয়ারো হেসে বলল, আমি আগেই তা লক্ষ্য করে বলেছিলাম, এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কমিশনার তা মানতে চায়নি।

একটু থেমে পোয়ারো আবার বলতে শুরু করল, তাহলে নিশ্চয়ই এবার স্বীকার করবে আমি ঠিক পথেই চলেছি। তবে ওই শেয়াল তাড়ানো জিরয়েড এই ছাপগুলো যদি লক্ষ্য না করে, আমি বিস্মিত হব না।

এমনি সময়ে দরজা খুলে বাড়ি থেকে ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট আর কমিশনার বেরিয়ে এলেন।

-আপনারা এখানে। আমরা খুঁজছিলাম, বললেন হয়টেট, মাদাম ডওব্রেয়ুইল-এর বাড়িতে যেতে চাই। মঁসিয়ে রেনাল্ড তার স্ত্রীকে জানাননি এমন কোনো তথ্য তার প্রেমিকাকে জানিয়ে থাকতে পারেন।

পোয়ারো মাথা নাড়ল। আমরা দুই অফিসারকে পেছনে থেকে অনুসরণ করে চললাম।

চলতে চলতে পোয়ারো বলল, ফ্রাঙ্কেইস সত্য কথাই বলেছে। মঁসিয়ে রেনাল্ড মারলিনভিলে আসার পর গত ছয় সপ্তাহে মাদাম ডওব্রেয়ুইল সর্বমোট দু লক্ষ ফ্রাঙ্ক তিন দফায় জমা দিয়েছেন। সিয়ের হৃদয়দৌর্বল্যের বহর একবার ভেবে দেখো হেস্টিংস। কিন্তু তাই বলে আমি মনে করি না, মঁসিয়ে হয়টেট যাই আশা করে থাকুন না কেন, মঁসিয়ে রেনাল্ড তার কোনো গোপন কথাও সেখানে প্রকাশ করেছিলেন।

কথা বলতে বলতে যে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম, আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম এই ভিলা মারগুয়েরিটের সামনেই সেই সুন্দরী অপরূপা মেয়েটিকে আমি দেখেছিলাম।

কমিশনার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, মাদাম ডওব্রেয়ুইল এখানে অনেকদিন থেকেই আছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে এখানে কেউ কিছু জানে না। এমনকি তার স্বামী, তিনি জীবিত কি মৃত, সেসবও না। এখানে তিনি রীতিমত এক রহস্যময়ী নারী।

মঁসিয়ে হয়টেট বেল টিপলেন। দরজা খুলে দাঁড়াল আমার দেখা সেই দেবীমূর্তিটি। মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।

-মাদমোয়াজেল ডওব্রেয়ুইল, আপনার মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলার প্রয়োজন

 মুহূর্তের জন্য চমকে উঠেছিল মেয়েটি। সামলে নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে বসার ঘরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেল।

সেই রহস্যময়ী নারীমূর্তির আবির্ভাব হল কিছুক্ষণের মধ্যেই। গোলগাল ভরাট চেহারা তার। মেয়ের মতো অতটা লম্বা নন। নীল দুটি চোখে বাঙ্য় ঔজ্জ্বল্য। যুবতী নন, কিন্তু যৌবনের আকর্ষণ অটুট।

ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেন, মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনের ব্যাপারে আমরা তদন্তে এসেছি, আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি, যদি কোনো সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।

–খুনের ব্যাপারে আমাকে—

বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত হল তার।

-হ্যাঁ, মাদাম, আমি যতদূর জানি, অন্যান্য দিনের মতে, গতকাল রাতেও আপনি মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায় গিয়েছিলেন।

–মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায়–অসম্ভব,

-মাদাম, আপনি হয়তো জানেন, একটা খুনের তদন্তে অনেক বিষয়ই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করার প্রয়োজন থাকে। আপনাকে আমি কোনো অভিযোগ করছি না, কেবল জানতে চাই, তিনি বিশ্বাস করে আপনাকে কোনো গোপন কথা বলেছেন কিনা। যেমন মনে করুন, তার কোনো শত্রুর কথা, স্যান্টিয়াগোর জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনার কথা–

–না, না, ওসব আমাকে কেন বলতে যাবেন, মাথা ঝাঁকালেন ডওব্রেয়ুইল, এসব প্রশ্ন আমাকে কেন? তার স্ত্রীই তো বলতে পারবেন।

–তিনি যা বলার বলেছেন, বললেন মঁসিয়ে হয়টেট, তাহলে বলছেন মঁসিয়ে রেনাল্ড আপনাকে কোনো গোপন কথা বলেননি?

–এসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করার কোনো কারণ আমি বুঝতে পারছি না।

–কারণ হল, সাধারণত দেখা যায়, স্ত্রীকে বলা চলে না এমন অনেক কথা স্বামীরা তাদের রক্ষিতার কাছে ব্যক্ত করে।

সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল, তার চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠল।

–আমার মেয়ের সামনে আপনি আমাকে অপমান করলেন মঁসিয়ে। আমি আর একটা কথাও আপনাকে বলব না।

এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেই শেষ পর্যন্ত আমাদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হল ভিলা মারগুয়েরিট থেকে।

.

আমাদের আর কিছুই করার ছিল না সেখানে। তাই মঁসিয়ে হয়টেটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা মারলিনভিলের দিকে চলতে লাগলাম।

ভিলা জেনেভিয়েভ থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরেই ডেস বেনস। আপাততঃ সেখানেই আস্তানা নেবার ইচ্ছা আমাদের।

চলতে চলতে পোয়ারো বলল, যাই বল হেস্টিংস, ফরাসি পুলিসের তৎপরতা সত্যিই প্রশংসা করার মতো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখ, মাদাম ডওব্রেযুইলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কবে কত টাকা জমা পড়েছে সব খবর সংগ্রহ করে ফেলেছে।

হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ হতে দুজনেই ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য হলাম দেখে মার্থা ডওব্রেয়ুইল আমাদের দিকেই ছুটে আসছে।

–মাকে না বলে চলে এসেছি, হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে বলল মেয়েটি, শুনলাম মৃত্যুর আগে মঁসিয়ে রেনাল্ড একজন গোয়েন্দাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, আপনি সেই গোয়েন্দা?

–হ্যাঁ, মাদমোয়াজেল, সংযত কণ্ঠে বলল পোয়ারো।

-আমি জানতে চাইছি, কাউকে সন্দেহ করছেন খুনের ব্যাপারে?

গভীর দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখল পোয়ারো। বলল, আপনি একথা জানতে চাইছেন কেন? মেয়েটির সুন্দর চোখ দুটি সহসা ভয়ার্ত হয়ে উঠল।

-মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

–তাই বুঝি, বলল পোয়ারো, আপনি সুন্দরী এবং যুবতী, তাই আপনার কৌতূহল না মিটিয়ে পারছি না।

পোয়ারো মেয়েটিকে জানাল, সে দুজন লোককে সন্দেহ করছে তবে তারা বহিরাগত।

পোয়ারোর প্রশংসায় খুশি হয়েছিল মেয়েটি। এবারে সানন্দে ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটে চলে গেল।

মার্থার চলে যাওয়াটাও ছিল মাধুর্যময়। আমি তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম। চমক ভাঙ্গল পোয়ারোর ডাকে।

আমি জানি, হেস্টিংস, তুমি সৌন্দর্যের পূজারী। কিন্তু বন্ধু ভুল করে যেন মার্থা ডওব্রেয়ুইলকে তোমার হৃদয় দিয়ে বসো না। ও মেয়ে তোমার জন্য নয়।

–এমন নিখুঁত সুন্দর মেয়ে

হেসে উঠলো পোয়ারো। উল্লাসের সঙ্গে বলতে লাগল, সুন্দর মুখ দেখলেই পুরুষের মাথা ঘুরে যায়। কিন্তু এমন অনেক ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আমি জানি যাদের মুখ দেখতে ছিল দেবদূতের মতো।

–তাই বলে এমন নিষ্পাপ একটি মেয়েকেও–তুমি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে পার না।

-ওকে সন্দেহ করি এমন কথা বলিনি, বলল পোয়ারো, কিন্তু তার কেস সম্পর্কে এমন কৌতূহল খুবই অস্বাভাবিক, তাই না?

-মায়ের জন্য মেয়ের দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কি।

–হ্যাঁ, মা, চিন্তিতভাবে বলল পোয়ারো, কিন্তু বন্ধু, এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না, কিন্তু ওই মুখটা মনে হয় পরিচিত–কোথায় দেখেছি। তাই বলছি, হৃদয়ের দুর্বলতা সংযত কর। এটা বন্ধু হিসেবে তোমাকে আমার পরামর্শ।

–মেয়েটির মায়ের মুখ তোমার চেনা বলছ? আমি থমকে গেলাম পোয়ারোর কথা শুনে।

–অনেকদিন আগে যখন বেলজিয়াম পুলিসে কাজ করতাম-হ্যাঁ-একটা কেসের ব্যাপারে আমার মনে হয় ওই মুখের ছবি আমি দেখেছিলাম। একটা খুনের কেস

.

০৫.

 পরদিন সকালে ভিলা জেনেভিয়েভে উপস্থিত হলাম আমরা। পরিচারিকা লিওনি ওপরতলা থেকে নেমে আসছিল।

পোয়ারো তার কাছে মাদাম রেনাল্ডের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিল। মেয়েটা যেন ক্ষোভে টগবগ করে ফুটছিল।

ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল, যে স্বামী অন্য মেয়েমানুষের জন্য স্ত্রীকে ঠকায় তার জন্য আমি হলে একফেঁটা চোখের জল ফেলতাম না।

একটা দুটো খোঁচা দিতেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, প্যারিস যাবার দিন বাপ ছেলেতে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। তবে ঝগড়ার কারণটা সে বলতে পারল না।

খবর নিয়ে জানা গেল খুনের দিন কোনো গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা ম্যাজিস্ট্রেট সেই তদন্তের জন্য গ্যারাজে গেছেন।

পোয়ারো তার জন্য অপেক্ষা করবে জানাল। আমি বললাম, তাহলে ততক্ষণে আমি একবার জিরয়েডের সঙ্গে কথা বলে আসি, দেখি কতদূর এগোলেন তিনি।

পোয়ারো হেসে সম্মতি জানাল।

.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের মনে ঘুরতে ঘুরতে গলফ খেলার মাঠের কাছে এলাম। সহসা চোখে পড়ল, পাশে ফুলের বাগানের কাছে একটি যুবতী দাঁড়িয়ে। তাকে চিনতে পেরে সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, সিনডেরেলা…তুমি?

-আমিও অবাক হয়েছি তোমাকে দেখে, আমার ট্রেনের বান্ধবীটি বলল, আমি পিসীর বাড়ি এসেছি, কিন্তু তুমি?

–আমার সেই গোয়েন্দা বন্ধুর কথা তোমাকে বলেছিলাম। ভিলা জেনেভিয়েভে একটা খুনের ঘটনা ঘটেছে

বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকালো ও।

-তোমরা তদন্তে এসেছো? ওহ, খুব ভালো, ক্রাইম আমার ভালো লাগে। কিন্তু ওসব নিজের চোখে কখনো দেখিনি। তুমি ঘটনাগুলো আমাকে দেখাও।

–কিন্তু প্রিয়, ঘটনাস্থল বাইরের কাউকে দেখানো নিষেধ।

–তুমি আমার বন্ধু। আমি দেখতে চাইলেও—

তোমার এতো আগ্রহ কেন? কি দেখবে বলতো?

–কোনো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হল, কোথায় খুনটা হল, মৃতদেহ, হাতের ছাপ কিংবা এমনি কিছু আবিষ্কার হয়ে থাকলে–এসবই আমি দেখতে চাই।

-কী সর্বনাশ। খুনের ঘটনার মুখোমুখি হতে তোমার ভয় করবে না?

–আমাকে যদি ঘটনাস্থল দেখার সুযোগ দাও তাহলে নিজেই দেখতে পাবে ভয় পাই কিনা। প্লিজ

বলতে বলতে সিনডেরেলা তার কোমল পেলব হাত আমার হাতের ওপরে রাখল।

কি যেন হয়ে গেল মুহূর্তে। আমার অধিকার বোধ সজাগ হয়ে উঠল। বলে উঠলাম, বেশ দেখি চেষ্টা করে।

সিনডেরেলাকে আমি ঘটনাস্থলে নিয়ে চললাম। যে লোকটি পাহারায় ছিল আমাকে স্যালুট করে সম্মান দেখাল; সঙ্গিনীর ব্যাপারে কোনো আপত্তি তুলল না।

ঘটনার বিবরণ শোনাতে শোনাতে তাকে নিয়ে আমি বাড়ির পেছনে শেডের সামনে উপস্থিত হলাম। এর ভেতরেই মঁসিয়ে রেনাল্ডের মৃতদেহ রাখা আছে।

শেডের চাবিটা ছিল সার্জেন্ট ডি. ভিলা মারকয়ডের কাছে। ভিলার ভেতরে গিয়ে তার কাছে চাবি চেয়ে নিয়ে এলাম।

–ওহ, তুমি আমার বন্ধু, প্রেমিক, চাবি দেখে উল্লসিত হয়ে বলে উঠল সিনডেরেলা, তোমার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।

বললাম, মৃতদেহ না দেখাই ভালো, ওই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না তুমি।

কিছু ভেবো না, আমার ওতে কিছু হবে না। চলো বাড়ি থেকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না তো?

নিঃশব্দে তালা খুলে শেডের ভেতরে ঢুকলাম আমরা। এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের মুখ থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলাম।

আঁতকে ওঠার মতো শব্দ করে উঠল মেয়েটি। তাকিয়ে দেখি আতঙ্কে স্থির হয়ে গেছে তার চোখ। মুখ ফ্যাকাসে।

মৃতদেহটা আবার ঢেকে দিলাম।

–পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছিল। বললাম আমি।

–কোনো ছুরি দিয়ে? জানতে চাইল ও।

একটা কাচের ট্রেতে ছুরিটা রাখা ছিল। সেদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।

–ওহ!

অস্ফুট একটা শব্দ করে চোখ বন্ধ করল সে। টলতে লাগল দেহটা। আমি তাকে ধরে ফেললাম।

–অনেক হয়েছে। বাইরে চল।

জল। একটু জল নিয়ে এসো প্রিয়

তাকে শেডের বাইরে ছেড়ে বাড়ির ভেতরে ছুটলাম আমি। তাড়াতাড়ি একগ্লাস জল এনে তাকে দিলাম। এক চুমুকে সবটা জল টেনে নিয়ে স্বাভাবিক হলো সে।

-চল, এখানে আর দাঁড়াব না। বলল মেয়েটি, আমাকে ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য কেন দেখতে দিলে তুমি?

–তুমি তো আমার কথা শুনলে না, আমি তো তোমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছি।

ফুলবাগানের কাছে এসে আমি বললাম, জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে না তো? চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

দরকার হবে না। আমি ঠিক আছি। এবারে যাই। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। বিদায় –

তোমার ঠিকানা তো আমাকে দিলে না। আমি বললাম।

–হোটেল ডু-ফের-এ উঠেছি। কাল আমাকে দেখে যেও।

–হ্যাঁ যাব অবশ্যই। বিদায়।

মেয়েটির গমন পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পরে শেডের তালা বন্ধ করে সার্জেন্টকে চাবি ফিরিয়ে দিলাম।

.

ভিলার ভেতরে গিয়ে দেখলাম সেলুনে সকলেই উপস্থিত হয়েছেন। জিরয়েড তার তদন্তের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন।

একটা পোড়া সিগারেট আর একটা অব্যবহৃত দেশলাই কাঠি টেবিলে ওপর রেখে জিরয়েড বলছেন, খুনীরা কোথা থেকে এসেছে, এই দুটি সামান্য জিনিসই আমাকে বলে দিয়েছে। দেশলাই কাঠিটা এদেশে তৈরি নয়।

আমার ধারণা দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে। পোড়া সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে খুনীদের একজন নতুন একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করেছিল, সেই সময়েই কাঠিটা পড়ে গিয়ে থাকবে।

–তাহলে ব্যবহৃত কাঠিটাও তো পাওয়ার কথা, যেটা দিয়ে সে সিগারেটটা ধরিয়েছিল। বলল পোয়ারো।

–সেটা পাওয়া যায়নি, বললেন জিরয়েড, তবে গুরুত্বপূর্ণ হল পোড়া সিগারেটের টুকরোটা। ওটা দক্ষিণ আমেরিকায় তৈরি।

–এই দুটো বস্তু তাহলে মঁসিয়ে রেনাল্ডের হতে পারে, বললেন কমিশনার, দুবছর আগে তিনি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরেছেন।

জিরয়েড প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, না, আমি অনুসন্ধান করেছি, তিনি অন্য ধরনের বিড়ি ও সিগারেট ব্যবহার করতেন। আমার বক্তব্য হল, আততায়ীরা বহিরাগত ছিল। বাড়ির অথবা বাইরের কেউ তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল। তবে সেটা এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

–আচ্ছা মঁসিয়ে, পোয়ারো অধৈর্যভাবে বলে উঠল, এই কেসের মতো অন্য কোনো কেসের কথা কি আপনি মনে করতে পারছেন?

-সে রকম কিছু থাকলেও আমার মনে পড়ছে না।

-আমার ধারণা, একই ধরনের অপরাধের কোনো ঘটনা স্মরণ করলে অপরাধের মনস্তত্ত্বের দিকটা আমরা বুঝতে পারব। মানুষ স্বভাবতঃ নকলনবিশ। কোনো মানুষ যখন একটা অপরাধ করে, ঠিক একই পদ্ধতি সে পরবর্তী অপরাধগুলোর ক্ষেত্রেও অনুসরণ করে থাকে। কারণ, একটা অপরাধ করে যখন সে সফলতা পায় তখন আবার সফল হবার জন্য সে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে।

এইভাবেই সে বারবার একই পদ্ধতিতে অপরাধ করতে থাকে এবং পদ্ধতির এই ধারাই তাকে পরিণামে পাপের বেতন গুণতে বাধ্য করে।

–আপনার এই বক্তৃতার উদ্দেশ্য? জিরয়েডের গলায় অবজ্ঞার স্বর শোনা গেল।

–মঁসিয়ে জিরয়েড, দুটি অপরাধ যখন একই ধরনের হয়, তখন বুঝতে হবে–পেছনে একটি মস্তিষ্কই কাজ করছে। আমি তাকে বলি মনস্তত্ত্বমূলক-সূত্র। আমি এই সূত্রই অনুসরণ করে থাকি।

মাদাম রেনাল্ডের সেই কাচ ভাঙ্গা হাতঘড়িটার কথা মনে করুন, সেটার সময় দুঘণ্টা এগিয়ে চলেছিল।

কেন ঘড়িটা ফাস্ট করে রাখা হয়েছিল জানেন? ওই দুঘণ্টায় অনেক ঘটনা ঘটানো যায়। তারপর ফুলের কেয়ারিতে ওই পায়ের ছাপগুলো

–কিন্তু আমার চোখে তা কিছু পড়েনি। বলে উঠলেন জিরয়েড।

 –চোখ বন্ধ করে রাখলে কিছুই দেখা যায় না মঁসিয়ে—

চিড়বিড় করে লাফিয়ে উঠলেন জিরয়েড।

ঠিক সেই মুহূর্তেই মারকয়ড ঘরে ঢুকে জানাল, সেক্রেটারি মঁসিয়ে স্টোনর ইংলন্ড থেকে ফিরেছেন।

.

গ্যাব্রিয়েল স্টোনর ইংরেজ যুবক। বেশ আকর্ষণীয় চেহারা। ব্যায়ামপুষ্ট শরীর।

ম্যাজিস্ট্রেটের জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি জানালেন, মঁসিয়ে দুবছর হল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এখানে এসেছেন। সেই সময় থেকেই আমি তার সেক্রেটারির পদে বহাল আছি।

–মঁসিয়ে স্টোনর, স্যান্টিয়াগোয় তার জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনা কিংবা শত্রুভাবাপন্ন কোনো লোকের কথা কি তিনি কখনো বলেছিলেন? :

–না মঁসিয়ে। তার অতীত জীবনের কথা, এমন কি ছেলেবেলার কথাও কখনো তিনি বলতেন না। আমার ধারণা তার জীবন খুবই রহস্যময় ছিল।

-ডুবিন নামে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের সম্পর্কের কথা আপনি শুনেছেন?

–মনে হয় না। তবে নামটা চেনা মনে হচ্ছে।

 –বেলা–এই খ্রিস্টান নামের কোনো বান্ধবীর

 মাথা নাড়ল স্টোনর। বলল, সম্পূর্ণ নামটা কি বেলা ডুবিন? নামটা আমি জানি।

–মঁসিয়ে রেনাল্ডকে লেখা ওই বেলা নামের মেয়েটির একটি প্রেমপত্র আমাদের হাতে এসেছে। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেছেন, মঁসিয়ে রেনাল্ড তাকে অবহেলা করছেন। এছাড়া মাদাম ডওব্রেয়ুইল নামে একজন ফরাসী মহিলার সঙ্গেও যে মঁসিয়ে রেনাল্ডের অবৈধ গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই প্রমাণও আমরা পেয়েছি।

ভদ্রমহিলা কাছেই একটা ভিলায় থাকেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায় আসতেন। আর ভিলা জেনেভিয়েভে মঁসিয়ে রেনাল্ডের আসার পর থেকে বেশ মোটা টাকাই ভদ্রমহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে।

হ্যাঁ মঁসিয়ে, ওই টাকা আমিই কয়েক দফায় ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে দিয়েছি। তবে আমার ধারণা, গুপ্ত প্রণয় নয়, এর পেছনে রয়েছে ব্ল্যাকমেল। মঁসিয়ে রেনাল্ডের রহস্যময় জীবনের কোনো গুপ্ত বিষয় নিশ্চয় ভদ্রমহিলা জানতেন।

–হ্যাঁ, এটা সম্পূর্ণ সম্ভব, বললেন কমিশনার।

 –মঁসিয়ে স্টোনর, মঁসিয়ে রেনাল্ডের উইলের কথা আপনি নিশ্চয়ই জানতেন?

এক পক্ষকাল আগে যে উইল তিনি করেছিলেন তার কথা আমি জানতে চাইছি।

অবাক চোখে তাকালেন স্টোনর। ধীরে ধীরে বললেন, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।

–উইলের শর্ত অনুযায়ী, স্বামীর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির মালিক হবেন মাদাম রেনাল্ড। উইলে তার ছেলে জ্যাক রেনাল্ডের কোনো নাম নেই।

–এটা খুবই দুঃখজনক মঁসিয়ে।

জিজ্ঞাসাবাদ এখানেই শেষ হল। স্টোনর, মাদাম রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট মারকয়ডকে ডেকে নিচু স্বরে কিছু বললেন, তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

.

মঁসিয়ে স্টোনরের হাতে ভর দিয়ে মাদাম রেনাল্ড ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন। স্বামীর মৃত্যুশোকে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন ভদ্রমহিলা।

তাকে বসতে বলে মঁসিয়ে হয়টেট বললেন, মাপ করবেন মাদাম, নিয়মমাফিক কতগুলো কাজ আমাদের করতেই হয়।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, কয়েকটি বিষয় আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার করে নিতে চাই।

আপনার স্বামীর ছেলেবেলার কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আপনি আমাদের জানাতে পারেন?

-না, মঁসিয়ে, এসব বিষয়ে তিনি কখনো কিছু বলতেন না। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ফরাসি-কানাডিও এটুকুই কেবল জানি।

–তার অতীত জীবনে রহস্য ছিল বলে আপনার মনে হয়? কোনো রোমান্টিক ঘটনা?

–আমার কোনো ধারণা নেই।

–মাদাম ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক ছিল বলে আমরা জেনেছি–আপনাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য আমরা লজ্জিত মাদাম।

মাদাম রেনাল্ডের মুখে লাল আভা ফুটে উঠল। তিনি দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। মাথা নেড়ে কোনোমতে উচ্চারণ করলেন, আমি জানতাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন দীর্ঘদেহী এক যুবক। তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। মৃত মঁসিয়ে রেনাল্ডেরই যেন জীবন্ত রূপ।

-জ্যাক! আমার প্রিয় খোকা।

আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলেন মাদাম রেনাল্ড।

এরপর তিনি উপস্থিত সকলের সঙ্গে তার ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

এরপর জানা গেল, দুদিন আগে চেরবর্গ থেকে আনজেরা জাহাজে তার সমুদ্রযাত্রার কথা ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনের গোলযোগ দেখা দেওয়ায় যাত্রার দিন পিছিয়ে গিয়েছিল। গতকাল সান্ধ্যপত্রিকায় পরিবারের বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরে বাড়ি ফিরে এসেছেন।

মঁসিয়ে হয়টেট জ্যাক রেনাল্ডকে বসতে অনুরোধ করে জানতে চাইলেন, আপনার বাবা কি উদ্দেশ্যে আপনাকে এই ভ্রমণে পাঠিয়েছিলেন?

–আমার কোনো ধারণা নেই মঁসিয়ে।

 পকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বার করে টেবিলে রেখে জ্যাক বললেন, এই তারবার্তাটা পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন।

ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চস্বরে তারবার্তাটা পড়লেন–

এখনই চেরবুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে। সেখান থেকে আজ রাতে বুয়েনস আয়ার্সের জাহাজ আনজেরা ধরে স্যান্টিয়াগোয় রওনা হবে। পরবর্তী নির্দেশ সেখানেই পাবে। কোনো অবস্থাতেই ব্যর্থ হবে না রেনাল্ড।

টেলিগ্রামটা পড়া শেষ করে ম্যাজিস্ট্রেট একে একে প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন।

তার উত্তরে জ্যাক রেনাল্ড যা বললেন তা থেকে জানা গেল, এর আগে মঁসিয়ে রেনাল্ড তাকে কখনো এভাবে বাইরে যেতে বলেননি। তার বাবার অপরাধমূলক কোনো কাজের কথা সে জানে না। তার কার্যকলাপেও কখনো সে সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেনি। তবে অকপটে স্বীকার করল, প্যারিস রওনা হবার আগে বাবার সঙ্গে তার প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল।

সেই সময় আমি এতই রেগে গিয়েছিলাম যে চিৎকার করে বলে উঠেছিলাম, আমার ইচ্ছে তুমি মরে যাও, তাহলে আমি স্বাধীনভাবে চলতে পারব।

আমি সেই সময় এমনই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে তাকে খুন করাও অসম্ভব ছিল না। বলল জ্যাক রেনাল্ড।

–সেই ঝগড়ার বিষয়টা আমি শুনতে পারি? জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিস্ট্রেট।

-সেকথা আমি বলতে পারব না।

-কিন্তু আইন আপনি নিজের হাতে নিতে পারেন না আঁসিয়ে, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন ম্যাজিস্ট্রেট, কি নিয়ে আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল আপনাকে বলতে হবে।

থমথমে মুখে নিরুত্তর রইল জ্যাক।

পোয়ারো এই সময় বলে উঠল, আপনি চাইলে আমি বিষয়টা বলতে পারি মঁসিয়ে।

–আপনি জানেন?

–জানি। মাদমোয়াজেল মার্থা উওব্রেযুইলকে কেন্দ্র করেই ঝগড়াটা হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত তরুণ রেনাল্ড স্বীকার করল, সে মাথা ডওব্রেয়ুইলকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু যে মেয়ের বংশপরিচয় জানা নেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার পরামর্শ তার বাবা দিয়েছিলেন ছেলেকে। মা ও মেয়ের চরিত্র সম্পর্কেও তিনি কটুক্তি করেন। ফলে পিতাপুত্রে তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায়। সেই সময় মঁসিয়ে রেনাল্ড ছেলেকে স্মরণ করিয়ে দেন যে সে তার ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।

–এই কথার জবাবেই আমি বলি তুমি মর আমি চাই, তাহলে স্বাধীনভাবে চলতে পারব। বলল জ্যাক রেনাল্ড।

–তাহলে আপনার বাবার উইলের কথা আপনি জানতেন? প্রশ্ন করল পোয়ারো।

–হ্যাঁ, জানতাম তাঁর বিষয় সম্পত্তির অর্ধেক আমার, বাকি অর্ধেকের মালিকানা পাব মায়ের মৃত্যুর পরে।

–বেশ এরপর বলে যান। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।

প্যারিসের ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছিল বলে আমি নিজেকে সংবরণ করি। সংক্ষেপে মার্থাকে সব লিখে জানিয়ে আমি স্টেশনে চলে যাই। আমার চিঠির উত্তরে মার্থা চমৎকার পরামর্শ দিয়েছিল আমাকে।

সব রকম বিরোধিতা এড়িয়ে থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছিল আমাকে। আমি তার পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম।

–মঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনার বাবার এই চিঠিটা পাওয়া গেছে–আপনি পড়ে বলুন কে এই চিঠি তাকে লিখতে পারে।

কোটের পকেট থেকে চিঠিটা বার করে তিনি এগিয়ে দিলেন। জ্যাক চিঠিটা পড়ে ফেরত দিয়ে বলল, না, এসম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।

আর একটা কথা, সঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনি যুদ্ধের স্মারক হিসেবে আপনার মাকে একটা ছুরি উপহার দিয়েছিলেন। আপনি বেদনা পাবেন জেনেও বলতে হচ্ছে খুনী সেই ছুরি দিয়েই মঁসিয়ে রেনাল্ডকে হত্যা করেছে।

মুহূর্তে জ্যাকের মুখ ব্লটিংপেপারের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুষ্ককণ্ঠে বলল, সেটা তো একটা কাগজ-কাটা ছুরি–ছুরিটা কোথায়? আমি সেটা দেখতে চাই।

ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে রেক্সকে অনুরোধ জানালেন শেড থেকে ছুরিটা নিয়ে আসার জন্য। কমিশনার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা অপেক্ষা করেত লাগলাম। মিনিট দুয়েক পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন কমিশনার।

-মঁসিয়ে জর্জ–সেই ছুরিটা কাচের ট্রেতে নেই।

 –অসম্ভব, আমি বলে উঠলাম, আজ সকালেই সেটা আমি দেখে এসেছি—

অবশিষ্ট কথা আমার গলায় আটকে গেল।

–আপনি দেখে এসেছেন, চাবি পেলেন কোথায়?

নিজেকে খুবই অপরাধী বোধ হতে লাগল। সব কথাই অকপটে খুলে জানালাম আমি। ম্যাজিস্ট্রেটের মৃদু ভর্ৎসনাও আমাকে কৃতকর্মের জন্য শুনতে হল। তবে তিনি প্রসঙ্গটা হাল্কা করে দিলেন রোমান্টিক রসিকতার প্রলেপ দিয়ে।

–তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আপনার বান্ধবীকে এগিয়ে দিয়ে এসে শেডের দরজায় তালা লাগাতে কুড়ি মিনিট অন্ততঃ খোলা ছিল ঘরটা–খুবই শোচনীয় ব্যাপার।

-হত্যাকারী বা হত্যাকারীর সহযোগী আশপাশেই ছিল ছুরিটা পুনরুদ্ধারে জন্য। ছুরির বাঁটে হাতের ছাপ পাওয়া যেতে পারে, নিশ্চয়ই এই ভয় ছিল। বললেন কমিশনার।

পোয়ারো বলে উঠলো, আপনি তো বলেছিলেন, ছুরির ওপর কোনো হাতের ছাপ ছিল না।

জিরয়েড বললেন, সম্ভবতঃ সে নিশ্চিত ছিল না।

-খুনী হাতে গ্লাভস পরে ছিল, কাজেই সে নিশ্চিত ছিল বলা যায়। বলল পোয়ারো।

–আমি বলছি খুনীর সহযোগীর কথা। বললেন জিরয়েড।

–আপাততঃ আমাদের তদন্তের কাজ এখানেই শেষ হল। ঘোষণা করলেন মঁসিয়ে হয়টেট, মঁসিয়ে জিরয়েডের হাতেই আমরা কেসের দায়িত্ব তুলে দিলাম। আশা করি তিনি তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবেন, খুনীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। মাদাম, আপনাকে আমার আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছি।

ম্যাজিস্ট্রেটের কেরানী টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিলেন। তারপর কমিশনারসহ তিনজনে প্রস্থান করলেন।

–চল বন্ধু, আমরাও তাহলে হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিই।

বলে আমার হাত ধরে উঠে পড়ল পোয়ারো।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পোয়ারো উদ্ভট কাণ্ড করল। হলের কোণায় হ্যাঁঙ্গারে একটা ওভারকোট ঝোলানো ছিল। মিঃ স্টোনার কিংবা জ্যাক রেনাল্ডেরই হবে। হঠাৎ ভেতরে ঢুকে পোয়ারো কোটের মাপ নিয়ে একটা কাগজে টুকে নিল।

কাজটা আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকলেও দেখলাম, পোয়ারোর মুখে তৃপ্তির হাসি। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, চল, এবারে যাওয়া যাক।