৬.২ মধ্যাহ্নভোজের পরে

মধ্যাহ্নভোজের পরে যোয়ানাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এলাম। আমার অভাবিত আবিষ্কারটা ওকে দেখালাম। দুজনে মিলে ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। পরে বইখানা নিয়ে থানায় রওনা হলাম।

গ্রেভস থানায় ছিলেন না। ন্যাস ও অন্যান্যরা সকলেই আমার আবিষ্কার দেখে আনন্দ প্রকাশ করলেন।

ন্যাস বললেন, যদিও জানি এখন আর কিছু পাওয়া সম্ভব নয়, তবুও একবার বইখানা পরীক্ষা করে আমাদের দেখতে হবে যদি কোন হাতের ছাপ পাওয়া যায়।

আমি বললাম, পারট্রিজ রোজই বইগুলো ঝাড়পোঁছ করত। ওতে আমার হাতের ছাপ পাওয়াই সম্ভব।

একটু পরে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। ন্যাস আমার সঙ্গে এলেন।

 পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি জানতে চাইলাম, আপনাদের কাজ কিরকম এগোচ্ছে?

কাজের সুবিধার জন্য অনেক ঝাড়াইবাছাই করে আমরা গণ্ডীটা ছোট করে এনেছি।

–খুব ভাল কাজ। তাহলে আপনাদের হিসাবে কারা রইল?

–প্রথম নামটি মিস গিনচ। গতকাল বিকেলে কুম্বত্রকার একটা বাড়িতে তার একজন লোকের সঙ্গে দেখা করবার কথা ছিল। সে-বাড়ির রাস্তা সিমিংটনের বাড়ি ছাড়িয়ে গেছে। যাওয়া আসার সময় দুবারই ওই পথে ভার যাবার কথা।

একসপ্তাহ আগে যেদিন মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেন, সেইদিন তিনি বিকেলে বেনামী চিঠিটা পেয়েছিলেন। মিস গিনচ সেই দিনই সিমিংটনের অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি খবর নিয়ে জেনেছি সেদিন মিস গিনচ তিনটে থেকে চারটের মধ্যে অফিস। থেকে বেরিয়ে ডাকঘরে গিয়েছিলেন কিছু ডাকটিকিট কিনবার জন্য। সাধারণত অফিসের বয়ই এসব কাজ করে দেয়। তবে সেদিন মিস গিনচ নিজেই গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাথা ভারি হয়ে আছে, কিছুক্ষণ খোলা হাওয়ায় হাঁটলে মাথাটা ছাড়তে পারে। তবে বেশিক্ষণ বাইরে ছিলেন না তিনি।

তবে ওই সময়টুকুই যথেষ্ট। বললাম আমি।

–হ্যাঁ। গ্রামের অন্য দিকে গিয়ে একটা চিঠি চিঠির বাক্সে ফেলে দিয়ে ফিরে আসার পথে সময়টা যথেষ্ট। তবে প্রশ্নটা হল, মিস গিনচকে সিমিংটনদের বাড়ির আশপাশে দেখেছে এমন একজনকেও খোঁজ করে পাইনি।

তারপর আর কার কার নাম আপনার তালিকায় আছে? জানতে চাইলাম আমি।

–আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কোন একজনকেও আমরা বাদ দিতে চাইনি–যার ক্ষেত্রে সামান্য সম্ভাবনার আভাসও রয়েছে। গতকাল গার্ল গাইডের একটা সভায় যোগ দিতে ব্রেনটনে গিয়েছিলেন মিস গ্রিফিথ। তিনি সেখানে বেশ দেরি করেই পৌঁছেছিলেন।

–আপনি কি ভাবছেন যে

-না, তার ব্যাপারে কিছুই ভাবছি না। কেন না কিছুই জানি ন। মিস গ্রিফিথকে ভাল স্বভাবের বিশিষ্ট মহিলা বলেই বরাবর জেনে এসেছি।

কিন্তু গত সপ্তাহের ব্যাপারটা তার ক্ষেত্রে কি খতিয়ে দেখেছেন? ওর পক্ষে কি চিঠি বাক্সে ফেলা সম্ভব ছিল?

–হ্যাঁ, তা সম্ভব ছিল। বললেন ন্যাস, ওই দিন বিকেলে তিনি শহরে কেনাকাটা করছিলেন। মিস এমিলি বার্টনের সম্পর্কেও একই রিপোর্ট। গতকাল প্রায় একই সময়ে তাঁকে বাজারে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে।

আগের সপ্তাহে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই রাস্তা ধরে সিমিংটনদের বাড়ি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

বুঝতে পারছি। খুব বিশ্রী একটা ব্যাপার নিয়ে পড়তে হয়েছে আপনাকে। অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় নিয়ে মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে।

–ঠিকই বলেছেন, বললেন ন্যাস, যাদের সঙ্গে প্রায় সময়ই মেলামেশা করতে হচ্ছে। তাদের মধ্যেই একজন অধম্মাদ অপরাধী এই ভাবনাটা খুবই পীড়াদায়ক। যাইহোক, এর পর রয়েছেন মিঃ পাই–

–তার কথাও আপনি ভেবেছেন? বললাম আমি।

-হ্যাঁ। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত চরিত্রের মনে হলেও খুব ভালো লোক তিনি নন। তার কোন অ্যালিবাই নেই। দুটো ঘটনার সময়েই তিনি বাগানে ছিলেন–একা।

-তাহলে দেখা যাচ্ছে কেবল মেয়েদেরই আপনি সন্দেহের তালিকায় রাখেননি?

–আমি বা গ্রেভস মনে করি চিঠিগুলোর পেছনে কোন পুরুষের হাত নেই। বরাবরই সেই কারণে আমরা মিঃ পাইকে বাদ দিয়েই ভেবেছি।

গতকালের ব্যাপারে আমরা প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই কথা বলেছি। আপনার এবং আপনার বোনের ব্যাপারটা ঠিক আছে। মিঃ সিমিংটন অফিসে ঢোকার পর আর বেরোননি। ডাঃ গ্রিফিথ রোগী দেখতে অন্যদিকে গিয়েছিলেন। আমি সেসব জায়গাতেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি। আমাদের কাজে যে কোন খুঁত ছিল না নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন।

–আমি ধীরে ধীরে বললাম, আপনাদের সন্দেহভাজন মানুষদের মধ্যে চারজনকে পাওয়া যাচ্ছে–মিস গিনচ, মিঃ পাই, মিস গ্রিফিথ আর মিস এমিলি বার্টন–

–ভাইকারের স্ত্রীও রয়েছেন–এছাড়া আরও কয়েকজনের নাম বলা হয়নি

মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ সম্পর্কে আপনাদের মতামত কি?

–ভাইকারের স্ত্রী খানিকটা খ্যাপাটে ধরনের। তার পক্ষে এসব কাজ করা অসম্ভব নয়। গতকাল বিকেলে তিনি বাগানে ছিলেন।

ন্যাস আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে বাধা পড়ল। থানার ঘরে ঢুকলেন ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ।

-হ্যাল্লো ন্যাস, শুনলাম আমার খোঁজ করেছিলেন?

-ইনকোয়েস্টের দিন ঠিক হয়েছে শুক্রবার। আশা করি তার মধ্যেই আপনার কাজ হয়ে যাবে?

–হ্যাঁ। মোরেসবি আর আমি আজ রাতেই শবব্যবচ্ছেদের কাজটা করব।

–আর একটা ব্যাপার ডাঃ গ্রিফিথ, ন্যাস বললেন, মিসেস সিমিংটন আপনার দেওয়া কিছু ওষুধ খাচ্ছিলেন, পাউডার জাতীয় কিছু

-হ্যাঁ, তাতে কি?

–আপনি তাকে লিখে দিয়েছিলেন ওগুলো বেশিমাত্রায় খেলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

-হ্যাঁ, ঠিক। ওই ওষুধের মাত্রা যাতে তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার তাগিদে বাড়িয়ে না ফেলেন তার জন্যই ওই হুঁশিয়ারি জানানো হয়েছিল। আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন ফেনটিন বা অ্যাসপিরিন বেশিমাত্রায় পড়লে হার্টের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে। যাই হোক, মিসেস সিমিংটনের মৃত্যু যে সায়ানাইডে হয়েছিল এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

-ওহ হ্যাঁ, সেকথা আমি জানি–ব্যাপারটা যে কোন ঘুমের ওষুধ হতে পারে তা আমি ভাবছিলাম। আর বন্ধ নেই। ধন্যবাদ ডাঃ গ্রিফিথ।

গ্রিফিথ বিদায় নিলেন। আমিও প্রায় একই সময়ে থানা থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে বাড়ির দিকে চললাম।

বাড়িতে পৌঁছে যোয়ানাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। কেবল টেলিফোনের পাশে একটা কাগজে লেখা ছিল, ডাঃ গ্রিফিথ টেলিফোন করলে তাকে জানাতে হবে মঙ্গলবার যাওয়ার অসুবিধা আছে–বুধবার বা বৃহস্পতিবার হতে পারে।

ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম। আর তখনই খুব বিরক্তির সঙ্গে মনে পড়ল, গ্রিফিথ এসে পড়ায় আমার আর ন্যাসের আলোচনায় বাধা পড়েছিল।

বাকি দুজন সন্দেহভাজনের নাম শোনা হয়ে ওঠেনি। একা ঘরে বসে ভাববার চেষ্টা করতে লাগলাম বাকি দুজন কারা হতে পারে।

দুজনের একজন যে পারট্রিজই হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেওয়া বইটা এই বাড়িতেই পাওয়া গেছে। তাছাড়া, পরামর্শদাত্রী হিসেবে অ্যাগনেসকে মাথায় আঘাত করা তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাকে কোনভাবেই সে সন্দেহ করত না।

পারট্রিজ বাদে অন্যজন কে হতে পারে? তাকে হয়তো আমি চিনি না। এমন একজন হল মিসেস ক্লিট। গ্রামের লোকেরা তাকেই গোড়ায় সন্দেহ করত।

ধীরে ধীরে ব্যাপারটা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে লাগলাম। যে চারজন সন্দেহভাজনের নাম শুনলাম, এদের কারোর পক্ষেই একাজ করা সম্ভব না।

এমিলি বার্টন অতিশয় শান্ত আর দুর্বল। তাকে সন্দেহের আওতায় আনার একটাই মাত্র কারণ তার একাকীত্ব। ছোটবেলা থেকেই বাধানিষেধের মধ্যে থেকে, খারাপ সবকিছুতেই একটা ভীতি রয়েছে। এটাই কি তার অসুখী মনের ভাব সৃষ্টির কারণ? অবদমিত কিছু?

এমি গ্রিফিথের মধ্যে হাসিখুশি ভাব থাকলেও কিছুটা পুরুষালীও রয়েছে। তবে তার সফল জীবন-কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটে।

কিন্তু তবু জানি না কেন, আমার অবচেতন মনে একটা অস্বস্তি ঘোরাফেরা করতে লাগল। কিছু একটা যেন মনে পড়ে পড়েও পড়ছে না…ডাঃ গ্রিফিথ বলেছিলেন কিছু একটা…হ্যাঁ…মনে পড়েছে, তিনি বলেছিলেন, উত্তরে একজায়গায় প্র্যাকটিস করার সময়ে সেখানে লোকেরা খুব বেনামী চিঠি পেয়েছে।

এমি গ্রিফিথ এখানেও আছে, এখানেও সেই বেনামী চিঠি লোকেরা পেয়ে চলেছে। এটা কি নিছকই সমাপতন?

গ্রিফিথ অবশ্য বলেছিলেন, পুলিস শেষ পর্যন্ত একটা স্কুলের মেয়েকে ধরেছিল। সেই বেনামী চিঠি লিখত।

তবে ব্যাপারটা কি এমন হতে পারে না, পুলিস ভুল লোককে ধরেছিল? আসলে কাজটা ছিল এমি গ্রিফিথের। এখানে আসার পর সে আবার তার পুরনো খেলা শুরু করেছে। ব্যাপারটা ওয়েন গ্রিফিথ জানেন বলেই তাকে এমন চিন্তাগ্রস্ত আর ভেঙ্গে পড়ার মতো লাগছে। কিংবা তিনি হয়তো সন্দেহ করছেন বোনকে।

আর মিঃ পাই–লোকটির চরিত্র কল্পনা করলে তার পক্ষে একাজ অসম্ভব বলে মনে হয় না। কিন্তু…সেই কথাটা আবার মাথায় জেগে উঠল–আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না…ঠিক তাই…আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না…

হঠাৎ কেমন শীত করতে লাগল…অদ্ভুত একটা অনুভূতি…হঠাৎ দেখতে পেলাম আমি আর মেগান হাত ধরাধরি করে চলেছি…আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল সুন্দরী এলসি হল্যাণ্ড…তার গায়ে বিয়ের পোশাক..পথে চলতে চলতে শুনতে পেলাম লোকেরা বলাবলি করছে, ও ডাঃ গ্রিফিথকে বিয়ে করতে চলেছে…ওরা গোপনে অনেক দিন থেকে বাগদত্ত ছিল।

আমরা গির্জায় পৌঁছলাম…দেখতে পেলাম সেখানে ডেন ক্যালথ্রপ লাতিন ভাষায় মন্ত্রপাঠ করছেন।

আমচকা মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ লাফিয়ে উঠে বলতে লাগলেন, এটা বন্ধ করতেই হবে…এটা বন্ধ করতেই হবে।

কেমন একটা ধাক্কা খেলাম যেন। পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমি লিটল ফার্জের ড্রইংরুমে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।

চোখ মেলে দেখতে পেলাম মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ দরজা দিয়ে ঢুকছেন। আমি বিহ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সামনে এসে তিনি বললেন, মিঃ বার্টন, জেনে রাখুন এটা বন্ধ করতেই হবে। এইসব নোংরা চিঠি দেওয়া আর খুন। সহ্য করতে পারছি না–অ্যাগনেস উডের মতো বাচ্চা মেয়েটা চোখের সামনে খুন হচ্ছে।

ততক্ষণে আমি সজাগ হয়ে বসেছি। বললাম, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু কাজটা কিভাবে করবেন বলে ভাবছেন? আমরা এব্যাপারে কি করতে পারি?

–আমাদের এজায়গাটা বড্ড দূষিত হয়ে পড়েছে বুঝতে পারছি। আগে এমন ছিল না। অবিলম্বে সব রহস্যের সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।

–পুলিস তো যথাসাধ্য করে চলেছে। বললাম আমি।

-তাই যদি তারা করতো তাহলে গতকাল অ্যাগনেস খুন হয় কি করে? এসব কাজ পুলিসকে দিয়ে হবে না, আমি ভাল রকম বুঝতে পারছি।

–কিন্তু যা করার তারাই তো করবে।

–না, একজন অভিজ্ঞ দক্ষ কাউকে চাই। জেনে রাখুন আমিই ব্যবস্থা করতে চলেছি।

–আপনি কি করে করবেন? বিরক্তির সঙ্গে বললাম আমি, এসব কাজের দায়িত্ব স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড নিতে পারে না যতক্ষণ না কাউন্টির চিফ কনস্টেবল অনুরোধ করছেন। ইতিমধ্যেই তারা গ্রেভসকে পাঠিয়েছে।

–আমি পুলিসের কারোর কথা বলছি না। কেবল বেনামী চিঠি আর খুনের বিষয়ে অভিজ্ঞ হলেই চলবে না, এমন একজন দরকার যিনি মানুষকে জানেন, বুঝতে পারেন। আমাদের এখন এমন একজনকে দরকার যিনি মানুষের মনের খারাপ দিকটার পরিচয় জানেন।

আমি কিছু বলার আগেই মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ বললেন, আমি নিজেই এব্যাপারে কিছু করতে চলেছি জানবেন।

 কথা শেষ করেই তিনি দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

.

যথাসময়েই অ্যাগনেস উডলফের ইনকোয়েস্ট তদন্ত অনুষ্ঠিত হল। করোনার তার রায়ে জানালেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা খুন।

কদিন যেমন চারদিকেই উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, ইনকোয়েস্টের পর আবার দিনকতকের মধ্যেই সব কেমন শান্ত হয়ে পড়ল।

লিমন্টকের জীবনধারা একই খাতে বয়ে চলতে আরম্ভ করল।

তবে অ্যাগনেসের খুনের ঘটনা, এই জীবনস্রোতে একটা পরিবর্তনের সূচনা করল। সবার মনেই একটা ভয় আর চোখে সন্দেহের আভাস জেগে উঠল।

ইনকোয়েস্টের রায় যাই হোক না কেন, সকলেই জেনে গিয়েছিল, অজানা অচেনা কেউ অ্যাগনেসকে খুন করতে আসেনি। খুনী লুকিয়ে রয়েছে লিমন্টকের জনস্রোতেই। সে হয়তো অন্য সকলের সঙ্গেই হাইস্ক্রিটে, কেনাকাটা করে, নির্ভাবনায় হাঁটাচলা করে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে একটা নিরীহ কিশোরীকে মাথায় আঘাত করে তার ঘাড়ে বিধিয়ে দিয়েছিল ছুঁচলো কিছু।

সকলেই জানে, তার পরিচয় কেউ জানে না, অথচ সে মিশে আছে সকলের সঙ্গেই।

স্বীকার না করে পারছি না, এ নিয়ে অস্বস্তি আমার মনেও ছিল। ব্যাপারটাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার তাগিদ বোধ করছিলাম।

যোয়ানা আর আমার মধ্যে আলোচনা চলছিলই। তার মতে দোষী হল মিঃ পাই। আমার দৃষ্টি পড়ছিল মিস গিনচের দিকে।

যাই হোক, কিছুদিন বেশ নিরুপদ্রবে কাটল। আমাদের চেনাজানা কেউ বেনামী চিঠি পায়নি। ন্যাস বা পুলিস নতুন করে কোন ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করেছে কিনা, সেরকম কোন খবরই আমি পাইনি।

শুনেছি গ্রেভস ফিরে গেছেন। তদন্তের হয়তো ইতিই পড়ে থাকবে।

এমিলি বার্টন একদিন চা খেতে এসেছিলেন। মেগান মধ্যাহ্নভোজে এসেছিল। আমরা একদিন মিঃ পাইয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। গ্রিফিথ তার চিকিৎসার কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

একদিন আমরা গেলাম ভিকারেজে চা খেতে। সেদিন লিটলফার্জ থেকে যে মারমুখী ভাবটা নিয়ে ফিরেছিলেন, তারপর আর তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি।

কিন্তু দেখে ভাল লাগল, তার মধ্যে আগের সেই তীব্র ভাবটা আর নেই। সেটা হয়তো ছিল তার ক্ষণিক অতি উত্তেজনার ব্যাপার। আপাতত তিনি তাঁর বাগান পরিচর্যার কাজে মনোযোগ দিয়েছেন।

ভিকারেজের শান্ত সুখকর পরিবেশে এসে মনটা যেন অনেক হালকা হয়ে গেল।

একজন অতিথিকে দেখলাম ডেন ক্যালথুপের ড্রইংরুমে। বয়স্কা মহিলা, বেশ আলাপী আর অমায়িক। সারাক্ষণ পশম নিয়ে বুনে চলেছেন।

আমাদের কেক সহযোগে চা পানের অবসরে ভিকার এসে মিলিত হলেন। তিনি খুশি হয়ে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন।

এবাড়ির অতিথির নাম মিস মারপল। তিনি আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শুনে দেখলাম বেশ শিহরিত হলেন।

খুনের ঘটনাটাই প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের এসে পড়েছিল।

মিস মারপল মিসেস ডেন ক্যালথ্রপকে বললেন, এই খুনের ব্যাপারটা নিয়ে এই শহরের মানুষজন কি ভাবছে? তারা কি বলছে?

যোয়ানা বলে উঠল, মিসেস ক্লিটের কথাই আমার মনে হয়–

মিসেস ক্লিট কে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

–যোয়ানা জানাল, তাকে গ্রামের সকলে ডাইনি বলেই জানে।

-ডাইনি না ছাই, বলে উঠলেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন।

লোকে তাহলে তাকে খুনের ব্যাপার সন্দেহ করছে না কেন? বললাম আমি, সবাই তো ধরে নিয়েছিল চিঠিগুলো তারই লেখা ছিল।

মেয়েটাকে, শুনেছি খুন করা হয়, বললেন মিস মারপল, এতেই মিসেস ক্লিটের ওপর থেকে সব সন্দেহ কেটে যাচ্ছে।

কারণ তিনি যদি মেয়েটির ক্ষতি করতেন তাহলে সে দিনে দিনে শুকিয়ে গিয়ে একদিন স্বাভাবিকভাবেই মারা যেত। ডাইনিদের ক্ষেত্রে এরকম হতেই শোনা যায়।

–এই সব পুরনো বিশ্বাস মানুষের মন থেকে হেঁটে ফেলার জন্য খ্রিস্টীয় মতবাদ যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে। বললেন ভিকার।

–কিন্তু এক্ষেত্রে কোন কুসংস্কার নয় অতি জঘন্য বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে আমাদের।

বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।

-যথার্থই অপ্রীতিকর ঘটনা এসব। বললাম আমি।

-খুবই ঠিক কথা বলেছেন আপনি মিঃ বার্টন, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মিস মারপল, কিছু যদি মনে করেন, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?

-স্বচ্ছন্দে।

–কথাটা হল, আপনি এখানে সম্পূর্ণ অচেনা, কিন্তু বুঝতে পারছি, জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। এই অপ্রীতিকর ঘটনার রহস্য আপনিই সমাধান করতে পারতেন বলে আমার ধারণা।

আমি স্মিত হেসে তাকালাম মিস মারপলের দিকে। আমার মনে হল, জীবন সম্পর্কে খুবই অভিজ্ঞ এই মহিলা।

–আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান তরুণ; তিনি বলতে লাগলেন, তবে আত্মবিশ্বাস তুলনায় যতটা থাকা দরকার ছিল তা নেই।

সম্পূ অপরিচিত একজন মহিলার মুখ থেকে আমার প্রশংসা শুনে যোয়ানা আমার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকাল।

মিস মারপলের দিকে ফিরে বলল, দয়া করে ওকে আর আকাশে তুলবেন না মিস মারপল, এমনিতেই মাটিতে পা পড়তে চায় না।

মিস মারপল তার হাতের পশমের কাটা বন্ধ রেখে বললেন, আসলে খুন করার ব্যাপারটা অনেকটা যাদুবিদ্যার কৌশলের মতো। কাজটা এমনভাবে করা হয়, যে নোক ভুল জায়গায় ভুল কিছু দেখতে থাকে। খুনীরা এভাবেই লোককে ভুল পথে চালিত করে।

একদম ঠিক কথা। আমাদের খুনীকেও প্রত্যেকেই এখনো পর্যন্ত ভুল জায়গাতেই খুঁজে বেড়িয়েছে। বললাম আমি।

–কারণ হল, বললেন, মিস মারপল, সকলে তাকে একজন উম্মাদ বলেই মনে করেছে। কিন্তু আমার ধারণা একজন অত্যন্ত সুস্থ মস্তিষ্কের কাউকেই খোঁজ করার কথা ছিল।

-ন্যাসও তাই বলেছিলেন। সমাজের অতিমান্য কারুর কথাই তিনি বলেছিলেন। বললাম আমি।

-হ্যাঁ। যথার্থই বলেছেন তিনি। বললেন মিস মারপল।

-ন্যাস আরও ভেবেছেন, বেনামী চিঠি আরও আসবে। আপনি কি এখনও বেনামী চিঠির লেখকের জন্য দুঃখিত মিসেস ক্যালথ্রপ?

-কেনই-বা নয়? বললেন তিনি।

অন্তত এই ঘটনায় আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। বললেন মিস মারপল।

–আপনি কোন চিঠি পেয়েছিলেন মিস বার্টন? প্রশ্ন করলেন মিস মারপল।

–পেয়েছি বইকি–জঘন্য সব কথা লেখা ছিল। বলল যোয়ানা।

বয়সে যারা তরুণ আর সুন্দর, আমার মনে হয় বেনামী চিঠির লেখকরা তাদেরই বেছে নেয়।

-এই কারণেই, আমি বললাম, এলসি হল্যাণ্ড কোন চিঠি না পাওয়ায় আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।

মিস এলসি হল্যাণ্ড, মানে, বললেন মিস মারপল, মিঃ সিমিংটনের সেই নার্সারী গভর্নেসের কথা বলছেন?

-হ্যাঁ।

–ও সত্যিকথা বলেছে আমার মনে হয় না। যোয়ানা বলল।

 –ওর কথা আমি বিশ্বাস করি–মিথ্যা বলেনি। ন্যাসও তাই করেছেন। বললাম আমি।

–এ তো খুবই অদ্ভুত কাণ্ড দেখছি। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার বললেন মিস মারপল।

.

বাড়ি ফেরার পথে যোয়ানা বলল, তোর ওকথাটা ওখানে না বলাই ঠিক ছিল।

–কোন কথাটা? জানতে চাইলাম আমি।

–ন্যাস বলেছিলেন, আরো চিঠি আসতে পারে

––কেন উচিত হয়নি বলছিস?

–কারণ মিসেস ডেন ক্যালথ্রপই অপরাধী কিনা কেউ এখনো জানে না।

–একথাটা তুই বিশ্বাস করিস?

নিশ্চিত নই, তবে এটাও ঠিক, খুব অদ্ভুত ধরনের মহিলা তিনি।

দুদিন পরের কথা। এক বিকেলে হ্যাঁম্পটনে একটা নৈশ ভোজে গিয়েছিলাম। লিমণ্টকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল।

ফেরার পথে গাড়ির আলোকে গোলমাল দেখা দিল। গাড়ি থেকে নেমে একজায়গায় অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আলো।

পথ একদম জনশূন্য। এখানে সন্ধ্যার পরে বড় একটা কেউ পথে বের হয় না।

চলতে চলতে পথের ধারে চোখে পড়ল উইমেনস ইনসটিটিউটের বাড়িটা। তারার আলোয় ছায়ার মতো দেখতে পেলাম বাড়িটাকে।

হঠাৎ জানি না কেন, বাড়িটা একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল আমার। গাড়ি থেকে নামতেই মনে হল যেন গেটের কাছ থেকে ছায়ামূর্তি স্যাৎ করে সরে গেল।

অস্পষ্ট ভাবে হলেও একটা কেউ যে সরে গেল আড়ালে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

 আধখোলা গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যথাসম্ভব নিঃশব্দে আমি ভেতরে ঢুকলাম।

ছোট একটা পথ ধরে কয়েক পা এগিয়ে একটা দরজার সামনে পৌঁছলাম।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হল, কাছেই কোথায় একটা খসখস শব্দ হচ্ছে। মেয়েদের পোশাকে যেরকম শব্দ হয় শব্দটা অনেকটা সেরকম।

বাড়ির কোণের দিক থেকে শব্দটা পেয়েছিলাম। আমি দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালাম।

কিন্তু সেখানে কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল ন। শব্দটাও আর নেই। কোণের দিকে একটা খোলা জানালা চোখে পড়ল।

জানালা গলে কেউ ভেতরে ঢুকেছে কিনা দেখবার জন্য আমি গুটিগুটি পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

আমার পকেটে একটা টর্চ ছিল। এবার সেটা বার করে এনে সামনে আলো ফেললাম।

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার থেকে তীব্র স্বরে কেউ বলে উঠল, আলো নিভিয়ে দিন।

চিনতে ভুল হল না, সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের গলা। আলো নিভিয়ে দিতে দিতেই টের পেলাম তিনি হাতধরে টেনে আমাকে বাড়ির একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।

এই ঘরে কোন জানালা ছিল না। বাইরে থেকে আমাদের উপস্থিতি কারো টের পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ন্যাস একটা সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন।

–ঠিক এই সময়েই আপনি এখানে উপস্থিত হলেন মিঃ বার্টন!

 কেমন হতাশার স্বরে বললেন ন্যাস।

-খুবই দুঃখিত, আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম, গেটের কাছে কিছু একটা দেখেছি বলে সন্দেহ হল আমার,

–আপনি নিশ্চিত, কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?

–অস্পষ্টভাবে দেখা–কেউ মনে হল গেট দিয়ে ঢুকল। তার পরেই বাড়ির কোণের দিকে একটা মৃদু খসখস শব্দ মনে হল।

–আপনি ঠিকই দেখেছেন।

বাড়িটা ঘুরে এসেছিল কেউ একজন। জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তারপর আপনার আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত এগিয়ে যায়।

-ওঃ, খুবই দুঃখিত। কিন্তু সুপারিন্টেন্টে, ব্যাপারটা কি হতে পারে?

–সেই বেনামী চিঠির লেখক যে থেমে থাকবে না তা আমি জানতাম। আমার লক্ষ্যও ছিল সেটা–সে আবার আগের মতো চিঠি লিখুক।

বইয়ের ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলোর অক্ষর কেটে চিঠি লেখার কাজটা সহজেই হয়ে যাবে। কিন্তু খামের ব্যাপারটা ওভাবে করা সে পছন্দ করবে না। সে চাইবে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। তাই একই মেশিনে ঠিকানা টাইপ করতে সে চাইবে।

আমি জানতাম কোন এক সময়ে সেই অজ্ঞাত লোকটি এই ইনসটিটিউটে ঠিকানা টাইপ করতে ঠিক আসবে।

–মিস গিনচ বলে মনে করেন?

–অসম্ভব নয়। বললেন ন্যাস।

–তার মানে এখনো আপনি নিশ্চিত হতে পারেননি।

–হ্যাঁ। তবে যেই হোক, এই নোংরা খেলার কৌশলে রীতিমত অভিজ্ঞ বলতে পারি।

ন্যাসের কথা থেকে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, নানা ভাবেই তিনি তার কাজ করে চলেছেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি তারা যে চিটি লিখছে বা ডাকে দিচ্ছে তা সবই সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

কোন না কোন সময়ে অপরাধী একবার নিশ্চিত ভুল করবেই–যতই সে নিজের কাজ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হোক না কেন।

ন্যাস অনেকটাই এগিয়ে চলেছিলেন। আচমকা উপস্থিত হয়ে আমি বাধার সৃষ্টি করলাম।

আরো একবার আমি ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। ব্যাপারটা যে এরকম হয়ে উঠতে পারে আমার জানা ছিল না।

-ঠিক আছে যেতে দিন, হাল্কা গলায় বললেন ন্যাস, আবার পরে দেখা যাবে।

আমি বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।

.

পরদিন সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের টেলিফোন পেয়ে চমকে উঠলাম।

–শেষ পর্যন্ত তাকে আমরা ধরেছি মিঃ বার্টন।

 রিসিভারটা হাত থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কোন রকমে নিয়ে বললাম, ধরতে পেরেছেন

ন্যাস বললেন, টেলিফোনে সবকথা বলা ঠিক হবে না। আপনার আশপাশে নিশ্চয় কেউ ঘাপটি মেরে আছে। দয়া করে একবার থানায় চলে আসুন।

এখনই আসছি–

খুব তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে পৌঁছলাম। ভেতরের ঘরে বসেছিলেন ন্যাস আর সর্জেন্ট পার্কিনস।

ন্যাস হাসিমুখে বললেন, এতদিনে আমাদের দুর্ভোগের শেষ হল। অনেক হয়রানি হতে হয়েছে। নিন দেখুন

একটা চিঠি টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলেন। তুলে নিয়ে দেখলাম, চিঠিটা পুরোপুরি টাইপ করে লেখা। ভাষাও অনেকটা মোলায়েম।

চিঠিটা ছিল এরকম

মরা বউয়ের জায়গা নেবার চেষ্টা করে বিশেষ লাভ হবে না। তোমার অবস্থা দেখে শহরের সকলে হাসাহাসি করছে। দেরি হবার আগেই কোথাও পালাও-দূরে কোথাও, যত তাড়াতাড়ি পারো। নইলে তোমার অবস্থাও অন্য মেয়েটির মতো হবে।

চিঠি পড়া শেষ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ন্যাসের দিকে তাকালাম।

–মিস হল্যাণ্ড পেয়েছেন চিঠিটা, আজ সকালে।

উনি এত দিন কোন চিঠি পাননি কেন সেকথা ভেবে অবাক লাগছে। পার্কিনস বললেন।

-এটা কে লিখেছে?

জানতে চাইলাম আমি।

ন্যাসকে খুবই হতাশাগ্রস্ত আর ক্লান্ত লাগছিল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, খুবই দুঃখের ব্যাপার যে একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক ব্যাপারটাতে প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন, আমরা নিরূপায়।

–কে লিখেছে চিঠিঠা? আবার জানতে চাইলাম আমি।

 –মিস এমি গ্রিফিথ।

.

সেদিন বিকেলেই পরোয়ানা নিয়ে ন্যাস আর পার্কিনস গ্রিফিথের বাড়ি গেলেন। ন্যাসের অনুরোধে আমাকেও সঙ্গে যেতে হল।

তার ধারণা, ডাক্তার প্রচণ্ড আঘাত পাবেন। আঘাত সামলে নেওয়ার ব্যাপারে আমি তাকে সাহায্য করতে পারব।

আমিও অবশ্য আশান্বিত ছিলাম। কেননা ওয়েন আমাকে পছন্দ করেন।

সদরে ঘণ্টা বাজিয়ে আমরা মিস গ্রিফিথের খোঁজ করলাম। আমাদের ড্রইংরুমে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে তখন মিস এলসি হল্যাণ্ড, মেগান আর মিঃ সিমিংটন চা পান করছিলেন।

আপনার সঙ্গে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে চাই মিস গ্রিফিথ। এমির দিকে তাকিয়ে বললেন ন্যাস।

এমি চায়ের আসর থেকে উঠে আমাদের কাছে এলেন। মনে হল তার চোখে চকিতে ভয়ের ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। তিনি স্বাভাবিক উচ্ছল ভঙ্গীতেই কথা বলতে লাগলেন।

এমি ড্রইংরুম পার হয়ে একটা ছোট ঘরে আমাদের নিয়ে এলেন।

আমি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম, সিমিংটন ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালেন। ন্যাসের হাবভাবে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা ঘটেছে। আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পুলিসের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা একজন সলিসিটর হিসেবে তার না থাকবার কথা নয়। মনে হল তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠবার উদ্যোগ করছেন।

ন্যাস ততক্ষণে তার কর্তব্য শুরু করে দিয়েছেন। অত্যন্ত শান্ত ধীর ভঙ্গিতে মার্জিত স্বরে তিনি এমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মিস গ্রিফিথ, আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। অবশ্য আপনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আমার কাছে রয়েছে।

আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হল, না, না, মিস খুনের নয়, তবে বেনামী চিঠির। এখানে সেসব চিঠি লোকেরা পেয়ে চলেছে, সেগুলো লিখছেন আপনিই।

ন্যাসের কথা শুনে এমি উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন।

-ওসব জঘন্য চিঠি আমি লিখব, আপনি ভাবলেন কি করে? আপনার মাথা ঠিক আছে তো?

তারপর তীব্র শ্লেষের দৃষ্টি হেনে বললেন, না, না, ওসব চিঠি আমি লিখিনি।

ন্যাস এবারে এলসি হল্যাণ্ডকে লেখা চিঠিটা পকেট থেকে বের করে বললেন, এই চিঠিটা আপনি লেখেননি বলছেন?

চকিতের জন্য ইতস্তত করলেও এলসির কণ্ঠস্বরের বদল হল না। বললেন, না, এ চিঠি আমি কোনদিন লিখিনি।

-তাহলে একটু খুলেই বলা যাক মিস গ্রিফিথ, আপনার হয়তো মনে পড়তে পারে। গত পরশু রাত এগারোটার থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে উইমেনস ইনসটিটিউটে সেখানকার টাইপ মেশিনে আপনাকে এই চিঠি টাইপ করতে দেখা গেছে।

গতকাল এই চিঠি সহ অনেকগুলো চিটি নিয়ে আপনি ডাকঘরে ঢুকেছেন–

চিঠিগুলি ডাকে দেবার জন্যই গিয়েছিলাম। কিন্তু এ চিঠি আমি ডাকে দিই নি।

–তা ঠিক, আপনি ডাকে দেননি। কিন্তু চিঠিটা যাতে ডাকবাক্সে ফেলা হয় তার জন্য অত্যন্ত চতুর কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।

ডাক টিকিটের জন্য অপেক্ষা করার সময় আপনি এই চিঠি সকলের অলক্ষ্যে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন, যাতে অন্য কারো চোখে পড়লে ডাকবাক্সে ফেলে দেয়। বস্তুত হয়েছিলও তাই।

এলসি কি বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন মিঃ সিমিংটন।

–এসব কি হচ্ছে? এমি, এমি, তোমার আইনের সাহায্য দরকার মনে করলে, আমি তৈরি আছি–

একথা শুনেই এমি দুহাতে মুখ ঢেকে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। দৃশ্যতই তিনি ভেঙ্গে পড়লেন।

–ডিক, তুমি চলে যাও দয়া করে চলে যাও

–প্রিয় এমি, আমার মনে হচ্ছে তোমার একজন সলিসিটর দরকার

–কিন্তু তুমি নয়। আমি সহ্য করতে পারব না–না–আমি চাই না

সিমিংটন তার আইনী বুদ্ধিতে মনে হয় ব্যাপারটা অনুমান করতে পারলেন। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, তবে আমি এক্সহ্যাম্পটনের মাইল্ডমে-কে ডাকছি–

এমি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সেই অবস্থাতেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

সিমিংটন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তেই ওয়েন গ্রিফিথ দরজার সামনে পৌঁছল, দুজনের প্রায় ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা।

–এসব কি ব্যাপার ন্যাস, আমার বোন—

হ্যাঁ, ডাঃ গ্রিফিথ, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু এছাড়া কোন উপায় ছিল না

–বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ন্যাস।

–আমার বোন এসব চিঠির জন্য দায়ী–আপনি তাই মনে করেন?

 –সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ডাক্তার, বললেন ন্যাস, আমি খুবই দুঃখিত।

পরে এমির দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস গ্রিফিথ, প্রয়োজনে আপনি একজন সলিসিটরের পরামর্শ নিতে পারবেন–এবারে দয়া করে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে

–এমি

ওয়েন গ্রিফিথ বোনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন।

এমি একবারও ওয়েনের দিকে তাকালেন না। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

সকলে চলে গেলে ঘরে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ওয়েন। আমি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

-এমি এ সব করেছে, এ কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না

–কোথাও ভুলও হয়ে থাকতে পারে। আমি বলার চেষ্টা করলাম।

 –তাহলে ও কথাটা এভাবে বলল কেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

থপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ওয়েন। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে একগ্লাস কড়া পানীয় জোগাড় করে আনালাম। একচুমুকে গ্লাসের পানীয়টুকু শেষ করে খানিকটা যেন চাঙা হলেন।

পরে বললেন, ব্যাপারটার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না মিঃ বাৰ্টন। এখন অনেকটা সামলে উঠতে পেরেছি।

আমার কিছু করণীয় থাকলে বলুন, গ্রিফিথ।

কারোরই আর কিছু করার নেই–কিছুই না—

এই সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল যোয়ানা। ওকে অতিশয় বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

ওয়েনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আমাকে বলল, তুই এবারে যেতে পারিস জেরি, এটা আমার কাজ।

আমি উঠে দাঁড়ালাম নীরবে। দরজার মুখে গিয়ে ফিরে তাকালাম একবার। দেখলাম, জেরি ওয়েনের সামনে হাঁটু মুড়ে বসেছে।

.

সেদিন যোয়ানা যখন বাড়ি ফিরল, তাকে দেখে আমি খুশি হতে পারিনি। কেমন ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত লাগছিল ওকে।

ওর মনোভাবটা বুঝবার জন্য হাল্কা স্বরে বললাম, তাহলে তোর দেবদূতকে খুঁজে পেয়েছিস?

-না, জেরি, বেদনাভারাক্রান্ত কণ্ঠ ওয়েনের, ও জানিয়েছে আমাকে গ্রহণ করতে পারবে না। ও খুবই আত্মমর্যাদা সচেতন

আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বললাম, আমার মেয়েবন্ধুটিও আমাকে চায় না…

বলাবাহুল্য, ইতিমধ্যে ঘটনা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমার আর মেগানের সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল। তাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব করেছিলাম। সে প্রত্যুত্তরে গম্ভীরস্বরে আমাকে জানিয়েছিল, তোমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য আমি নই। তুমি আমাকে ভালবাস জানি, কিন্তু আমি ভালবাসার চেয়ে ঘেন্না করতেই শিখেছি।

এভাবেই সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু আমি নিরাশ না হয়ে তাকে জানিয়েছি আমি তার মুখ চেয়ে আশা করেই থাকব।

যোয়ানাকে আমাদের দুজনের সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে যথাসময়েই জানিয়েছিলাম।

এই মুহূর্তে দুজন সমব্যথী মানুষের নীরব হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

কয়েক মিনিট পরে যোয়ানা বলে উঠল, জেরি, এই মুহূর্তে বার্টন পরিবারের বলতে পারা যায় কোনই চাহিদা নেই।

আমি সজীব কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম, তাতে কিছু যায় আসে না যা, এখনো আমরা দুজনে দুজনের জন্য রয়েছি।

-হ্যাঁ, আপাতত এটাই আমাদের সান্ত্বনা। বলল যোয়ানা।

.

পরদিন ডাঃ গ্রিফিথ এলেন। যোয়ানা সম্পর্কে আবেগময় কণ্ঠে অনেক কথা বলতে লাগলেন।

–অতি চমৎকার মেয়ে যোয়ানা। ও যেভাবে নিজেকে আমার কাছে তুলে ধরেছে, তার তুলনা হয় না। কিন্তু, আমার দুর্ভাগ্য, আমি তাকে গ্রহণ করতে পারছি না।

ওয়েন আমাকে বোঝাতে চাইলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, এমিকে নিয়ে, এখবর জানাজানি হবার পর যেরকম নোংরা আলোচনা শুরু হবে, যোয়ানাকে তা স্পর্শ করে তিনি তা চান না।

যোয়ানা যে দুর্বল মনের মেয়ে নয়, বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াবার মতো দৃঢ়তা তার আছে, আমি ভাল করেই জানি। তাই গ্রিফিথের কথাগুলোকে আমার গালভরা বুলি বলেই মনে হল। আমি বিরক্তির সঙ্গেই বলেছিলাম যে, তিনি অনভিপ্রেতভাবেই বড় বেশি মহত্ত্ব দেখিয়ে ফেলছেন।

গ্রিফিথ চলে গেলে হাঁটতে হাঁটতে হাইস্ক্রিটের দিকে গেলাম। দেখলাম ওখানে সকলেই মুখরোচক আলোচনার খোরাক পেয়ে বেশ জমিয়ে তুলেছে।

ন্যাসের সঙ্গে দেখা হল। তিনি জানালেন এমিলি বার্টনের যে বইটা আমি আবিষ্কার করেছিলাম তার ছেঁড়া পাতাগুলো গ্রিফিথের বাড়ির সিঁড়ির নিচে দেয়াল আলমারিতে পাওয়া গেছে। দেয়াল-কাগজে সেগুলো মুড়ে রাখা ছিল। এটা পাওয়াতে তাদের মামলা সাজানোর কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, ওরকম একটা জায়গাতে মালপত্র গুঁজে রাখার ঝোঁক মহিলার বেশিই দেখা যাচ্ছে।

–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। অপরাধী মনস্তত্ত্ব ওরকমই দেখা যায়। আর একটা কথা, মৃত অ্যাগনেস উডের খুনের একটা সূত্রও পাওয়া গেছে।

আমি আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকালাম ন্যাসের দিকে।

-ডাক্তারের ডিসপেনসারী থেকে একটা ভারী নোড়া গোছের পাথরের টুকরো পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিত ওটা দিয়েই ওই মেয়েটার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, বললেন ন্যাস, তার মুখে সাফল্যের হাসি।

–ওরকম একটা অদ্ভুত জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া তো এক ঝক্কির কাজ। বললাম আমি।

–মিস গ্রিফিথের পক্ষে অসুবিধাজনক ছিল না। ঘটনার দিন বিকেলে তিনি গার্ল গাইডের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন।

সেদিন রেডক্রশের অফিসে কিছু সজী দেবার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বেশ বড় একটা ঝুড়ি তার হাতে ছিল।

-বুঝলাম। কিন্তু সেই শিকটা বোধহয় খুঁজে পাওয়া যায়নি?

-না। কোনদিনই পাওয়া যাবে না। উম্মাদ হলেও সেই খুনে হাতের কাছে প্রমাণ রেখে যাওয়ার মতো মতিচ্ছন্ন নয়।

.

ভিকারেজে খবরটা যখন পৌঁছাল, শুনে মিস মারপল খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আগ্রহ নিয়েই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।

মিস মারপল বেশ জোরের সঙ্গেই তার অবিশ্বাসের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন।

-না, মিঃ বার্টন, আমি নিশ্চিত, কথাটা সত্যি নয়, এ হতে পারে না।

-তা বলবার কোন উপায় নেই মিস মারপল, আমি বললাম, পুলিস ফাঁদ পেতে অপেক্ষায় ছিল। এমিকে তারা চিঠিটা টাইপ করতে দেখেছে।

–তা হতে পারে। কিন্তু

-ওখানেই শেষ নয়। পুরনো ছিঁড়ে নেয়া যে পৃষ্ঠাগুলো থেকে অক্ষর কেটে বেনামী চিঠিগুলো লেখা হয়, সেগুলোও তাঁর বাড়ি থেকে পুলিস উদ্ধার করেছে।

যেন আমার কথাগুলো বুঝতে পারলেন না, এমনি হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস মারপল। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এ খুবই খারাপ ব্যাপার মিঃ বার্টন–খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার

এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন মিস ডেন ক্যালথ্রপ।

-কি হয়েছে জেন? তোমার মুখ অমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেন? ব্যস্ত হয়ে বললেন ভিকারের স্ত্রী।

–ওহ, এখন তাহলে কি হবে? বিহ্বল স্বরে বললেন মিস মারপল।

–কি নিয়ে এত ভাবনায় পড়লে জেন?

 –ওহ না…সব ঠিকমতো মনে আসে না…কোথাও কিছু একটা আছে…

 মিস মারপল হঠাৎ এমন ভেঙে পড়লেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ তখনই তার বন্ধুকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।

সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে মিস মারপলের সঙ্গে আবার দেখা হল আমার। তাকে এমনভাবে দেখতে পাব আশাই করতে পারিনি।

গ্রামের শেষে মিসেস ক্লিটের বাড়ির কাছে একটা ছোট ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে মেগানের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

মেগানের সঙ্গে সারাদিনে একবারও আজ দেখা হয়নি। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য খুবই উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম।

এখন মেগানকে দেখতে পেয়ে আমি দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললাম।

কিন্তু কাছাকাছি হবার আগেই মেগান অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল, আর মিস মারপল এগিয়ে এসে আসার পথ আগলে দাঁড়ালেন।

–আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলার ছিল মিঃ বার্টন। বললেন তিনি।

–মেগানের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে ছিল, ও চলে যাচ্ছে কেন? বললাম আমি।

–না, এখন মেগানকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। মেয়েটার সাহস নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আপনি শান্ত হয়ে দাঁড়ান।

মিস মারপলের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে আমার কেমন ভয় জেগে উঠল। কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। মাথা নিচু করে মেগানকে অনুসরণ করা থেকে নিরস্ত হলাম।

.

বাড়িতে কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না। মেগানের সঙ্গে দেখা হলো অথচ কোন কথা বলতে পারলাম না। মিস মারপলই বা তার সঙ্গে অমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কি কথা। বলছিলেন?

তিনি আমার পথ আগলে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?

শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে ধরে রাখা সম্ভব হল না। রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

শহরের পথ পেরিয়ে সিমিংটনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম।

বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ জমেছিল। এখন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। ঝাপসা অন্ধকারে বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। গোটা বাড়িটা অন্ধকারের স্তূপের মতো মনে হচ্ছিল।

একদিকে বাড়ির জানালায় সামান্য আলোর রেখা চোখে পড়ল। মনে হলো ওটা বসার ঘরেরই আলো।

সদর দরজার দিকে যেতে গিয়েও পা টেনে নিলাম। আমি নিচু হয়ে প্রায় হামাগুড়ি দেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে একটা ছোট ঝোপ পার হয়ে জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। জানালার পর্দাটা ভাল করে টেনে দেয়া ছিল না। সেই ফাঁক দিয়ে আলো আসছিল। সেই ফাঁকে চোখ রেখে ভেতরের সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পেলাম।

সিমিংটন একটা বড় আরাম কেদারায় বসেছিলেন। পাশেই এলসি হল্যাণ্ড কিছু সেলাই করে চলেছে। মনে হয় বাচ্চাদের কিছু।

মাথা নিচু করে সেলাই করতে করতে এলসি হল্যাণ্ড বলছিলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ সিমিংটন, বাচ্চাদের স্কুল বোর্ডিং-এ যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু ওদের ছেড়ে যেতে আমার খুবই খারাপ লাগবে।

মিঃ সিমিংটন বললেন, ব্রায়ানের ব্যাপারে আপনার কথাই ঠিক। উনহে তে পরের টার্ম থেকেই ও শুরু করবে। আর কলিনের জন্য আরও একবছর অপেক্ষা করাই ভাল–ওর বয়স এখনও কম।

-হ্যাঁ, কলিন একেবারেই ছোট্ট।

সাধারণ একটা পারিবারিক চিত্র। কোন বৈচিত্র্য ছিল না এর কোথাও। জানালার পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে আমি ভাবতে লাগলাম, এখানে কেন এলাম?

সহসা সামনের দৃশ্যের পট পরিবর্তন হল। চমকে উঠলাম মেগানকে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে দেখে।

বেশ একটা উত্তেজনার ভাব তার চোখে মুখে। সিমিংটনের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে দেখলাম তার চোখ জ্বলছে, মুখের কোথাও শিশুসুলভ ভাব নেই। কিংবা ভয় বা সংশয়ের লেশ।

সিমিংটনকে মেগান কোন সম্বোধন করতে কখনো শুনিনি। এখনো কোন সম্বোধন না করেই সে বলে উঠল, আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

সিমিংটন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। মনে হলো তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

মেগান নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রইল সিমিংটনের দিকে। তার চোয়ালে দৃঢ়তাব্যঞ্জক ভাব ফুটে উঠেছে স্পষ্ট।

ওই অবস্থাতেই সে এলসি হল্যাণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার আপত্তি নেই তো এলসি?

–আপত্তি কেন থাকবে?

বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগলো। মেগান সরে গিয়ে ওকে যাবার পথ করে দিল। দরজার ওপাশে গিয়ে ঠোঁট চেপে এলসি একমুহূর্তের জন্য তাকাল ভেতরে। পরক্ষণে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।

–এবারে বল মেগান, কি বলতে চাইছ। বিরক্তির সঙ্গে বললেন সিমিংটন।

একপা দু পা করে টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো মেগান। সটান সিমিংটনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কিছু টাকার দরকার।

–টাকা। বেশ কড়া স্বর বেরলো সিমিংটনের গলা থেকে, একথা তো কাল সকালেই বলা যেত। তোমার হাতখরচ কম পড়ছে মনে হয়?

–আমি বেশ কিছু টাকা চাই। দৃঢ় স্বরে বলল মেগান।

সিমিংটন এবারে নড়েচেড়ে বসলেন। তীক্ষ্ণস্বরে বললেন, তুমি তো আর কয়েক মাসের মধ্যেই সাবালিকা হবে। তখন তোমার দিদিমার রেখে যাওয়া সব টাকাই তুমি হাতে পেয়ে যাবে।

-জানি, আমি তোমার কাছ থেকেই টাকা চাই। মনে করতে পার এটা একটা ব্ল্যাকমেল। আমি যতদূর শুনেছি, আমার বাবাও এই ব্ল্যাকমেল করার জন্যহ জেলে গিয়েছিল। আমি তারই মেয়ে।

আমি তোমাকে টাকা দিতে বলেছি, কারণ, ওদিন আমার মার ঘরে তার ওষুধের পুরিয়ায় তোমাকে কিছু একটা মেশাতে দেখেছিলাম। টাকা না পেলে একথাটা সকলকে

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে গেল মেগান।

 কর্কশ শুষ্ককণ্ঠে বলে উঠলেন সিমিংটন, এসব তুমি কি বলছ, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

-আমি জানি, সব কথাই তুমি বুঝতে পেরেছ।

শয়তানের হাসি হাসলেন সিমিংটন। হাসতে হাসতেই লেখার টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন।

ড্রয়ার থেকে একটা চেক বই বার করে একটা চেক লিখে নিয়ে ফিরে এসে মেগানের দিকে এগিয়ে ধরলেন।

বললেন, তুমি এখন বড় হয়েছে, তোমার বিশেষ পছন্দের কিছু কেনার ইচ্ছে হতেই পারে, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু তার জন্য ওসব আবোলতাবোল কি বলতে শুরু করলে–কিছুই বুঝতে পারলাম না। যাক গে, এই নাও

চেকটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে মেগান বলল, ধন্যবাদ। এতেই আপাতত চলবে।

মেগান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সিমিংটন দরজার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত কি ভাবলেন। পরে চেয়ারে বসে পড়লেন।

সিমিংটনের মুখের ভাব দেখে আমার বুকের ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল। মনে হল মেগানের সমূহ বিপদ। আমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এসে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

সহসা সামনের দেয়ালের ধারের ঝোপটা যেন অন্ধকারে সচল হয়ে উঠল। সামনে পা বাড়াবার আগেই বুঝতে পারলাম ঝোপের আড়াল থেকে সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের দুটো হাত আমাকে জাপটে ধরল। কানের কাছে তার ফিসফিস কথা শুনতে পেলাম, উত্তেজিত হবেন না মিঃ বার্টন। সঙ্গে আসুন।

আমি স্তম্ভিত হবারও অবকাশ পেলাম না। হামাগুড়ি দিয়ে ন্যাসকে অনুসরণ করতে বাধ্য হলাম।

ওই ভাবেই বাড়ির শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ন্যাস। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছলেন।

–মোক্ষম সময়েই এসে হাজির হয়েছেন। নিচু স্বরে বললেন ন্যাস।

মেগানের কথা ভেবে আমি খুবই অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, মেয়েটা একেবারে বাঘের মুখে পড়েছে–দেরি হলেই মরবে।

ন্যাসকে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললাম, মেয়েটার মুখ লক্ষ করেছিলেন? মেগান নির্ঘাৎ বিপদে পড়বে। ওকে এখুনি এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

–শান্ত হোন, মিঃ বার্টন, ন্যাস আমার হাত চেপে ধরে বললেন, এই সময় এমন অধীর হলে চলবে না। আমি যা বলব, তার বাইরে কিছু করতে যাবেন না, ঈশ্বরের দোহাই।

ন্যাস কি বলতে চাইছিলেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

 কিন্তু এটা আর গোপন ছিল না যে কিছু একটা অনুমান করে তিনি এখানে ফাঁদ পেতে বসেছিলেন। দৈবাৎ এসে পড়ায় আমি দৃশ্যপটে চলে এলাম।

মেগান যে নিরাপদ নয় সেকথা আমার মতো তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। জেনেশুনে নিশ্চয় তাকে তিনি বিপদের মুখে ফেলে রাখবেন না। এই বিশ্বাস থেকেই শেষ পর্যন্ত আমাকে তাঁর কথা মেনে নিয়ে ধৈর্য ধরতে হল।

-বেশ, আপনার কথাই মেনে চলব, কথা দিলাম, বললাম আমি, তবে শেষ না দেখে এখান থেকে নড়ব না।

–বেশ এবারে শুনুন। বললেন ন্যাস।

তিনি জানালেন, পার্কিনস ইতিমধ্যেই বাড়িতে ঢোকার পেছনের দরজা খুলে রেখেছে, আমাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে।

রীতিমত দুঃসাহসিক একটা অভিযানের ইঙ্গিত। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওপরে যেতে না পারলে মেগানের কি হল তা জানার উপায় থাকবে না।

ন্যাসকে অনুসরণ করে এরপর পেছন দিকে এলাম। দরজা খোলাই পাওয়া গেল। পার্কিনস নিখুঁতভাবে কাজ সেরে রেখেছে।

দুজনে মিলে মন্থর পায়ে ওপরে উঠে গেলাম। ওখানে ভেলভেটের পর্দায় ঢাকা জানালার আড়ালে আত্মগোপন করলাম।

রাত দুটো পর্যন্ত ওখানেই কান পেতে বসে থাকতে হলে আমাদের।

একসময় একটা দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। পর্দার আড়াল থেকে চোখে পড়ল সিমিংটন ঘর থেকে বেরিয়ে চাতাল পার হয়ে মেগানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

এক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।

আমার অধীর হওয়ার কারণ ছিল না। ন্যাস আমাকে নিশ্চিন্ত করবার জন্য ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মেগান সম্পূর্ণ নিরাপদ। সার্জেন্ট পার্কিনস মেগানের ঘরে দরজার আড়ালে থেকে মেগানের ওপর নজর রাখছেন।

পার্কিনসের তৎপরতা ও কর্মকুশলতায় সন্দেহ ছিল না আমার। তাই নিশ্চিন্ত ছিলাম, সিমিংটন ঘরে ঢুকলেও মেগান অরক্ষিত অবস্থায় নেই।

তবুও, সত্যিকথা বলতে, একটা বিষম উত্তেজনা আমাকে যেন ক্রমাগত সামনে ছুটে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে চলেছিল।

ওভাবে বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যদিও সদাসতর্ক ন্যাস শক্তহাতে আমার কব্জি চেপে ধরে রেখেছিল।

বুকের ভেতরে তোলপাড় চলেছিল। একটি মুহূর্তকে একঘণ্টা সময় বলে মনে হচ্ছিল। সিমিংটন এতক্ষণ ঘরের ভেতরে কি করছেন?

ন্যাসকে কিছু জিজ্ঞেস করবার উপায় ছিল না। তার অচঞ্চল চোখদুটি মেগানের দরজার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়েছিল।

সহসা চোখে পড়ল, সিমিংটন নিদ্রিত মেগানকে দুহাতের ওপর তুলে ধরে ধীরে ধীরে নিচে নেমে চলেছেন।

ন্যাস আমার হাত ছেড়ে দিল। কিছুটা দূরে থেকে সিমিংটনকে অনুসরণ করে চলল। আমিও চললাম তার পেছনে।

নিচে নেমে সিমিংটন মেগানকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে এনে মাথাটা গ্যাসের উনুনের ওপরে রাখলেন। ধীর হাতে গ্যাস চালু করে দিলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি ন্যাস ঘরের ভেতরে লাফিয়ে ঢুকলাম। সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিলেন ন্যাস।

চকিতে পেছনে ঘুরে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন সিমিংটন। পরক্ষণেই একেবারে ঝিমিয়ে পড়লেন।

–আপনার খেলা শেষ, সিমিংটন। মূর্তিমান শমনের মতো ন্যাস মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন।

 আমি ছুটে গিয়ে মেগানকে কোলে তুলে কল ঘুরিয়ে গ্যাস বন্ধ করে দিলাম।

সিমিংটন বুঝতে পেরেছিলেন, বাধা দেবার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না। খেলাটা নিখুঁত ভাবে শুরু করলেও শেষ করবার আর কোন সুযোগ নেই। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। এভাবে যে হেরে যেতে হবে নিশ্চয় কল্পনা করতে পারেন নি।

.

ওপরে অর্ধচেতন মেগানের বিছানায় বসে তাকে সুস্থ করে তুলবার চেষ্টা করছিলাম।

ন্যাস যে এতবড় একটা ঝুঁকি নেবে স্বপ্নেও ভাবিনি। তার এই দুঃসাহস কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম ন। রাগে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে উঠেছিল।

–এটা আপনারা খুবই অন্যায় কাজ হয়ে গেছে। এতবড় ঝুঁকি নেওয়া আপনার উচিত হয়নি।

–শান্ত হোন মিঃ বার্টন। মিস মেগান এখুনি ঠিক হয়ে যাবেন। বললেন ন্যাস।

-ও আদৌ সুস্থ হবে বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। অধৈর্যের সঙ্গে বলে উঠলাম আমি।

 মিস মেগানের বিছানার পাশে যে দুধের গ্লাস ছিল তাতে বিষ রাখার মত বোকা সিমিংটন ছিলেন না। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ন্যাস, ঘুমের ওষুধই মেশানো ছিল দুধে। মেগানকে বিষ খাওয়ানোটা ওর পক্ষে বড় বেশি ঝুঁকির হয়ে যেত।

মিস গ্রিফিথের গ্রেপ্তারের পর সিমিংটন তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এর পর এখানে বিষপ্রয়োগ বা আঘাতজনিত কোন রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটানো তার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে পড়ত।

মেগানের মৃত্যুটাকে তিনি আত্মহত্যার ঘটনা বলেই দেখাবার মতলব করেছিলেন।

মায়ের আত্মহত্যার শোক সইতে না পেরে একটি অসুখী মেয়ে গ্যাসের উনুনে মাথা রেখে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে–লোকে এটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নিত। বিশেষ করে মেগানকে অস্বাভাবিক মেয়ে বলেই যখন অনেকে মনে করত।

ন্যাসের কথায় যুক্তি থাকলেও মেগানের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।

–কিন্তু ওর জ্ঞান ফিরতে অনেক দেরি হচ্ছে।

মেগানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিতভাবে বললাম আমি।

–ডাঃ গ্রিফিথ তো ভাল করেই পরীক্ষা করে গেলেন। তবু চিন্তা করছেন কেন? হার্ট, নাড়ী সবই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থেকে নিজে থেকেই জেগে উঠবে।

একটু পরেই মেগান একটু নড়াচড়া করল। বিড়বিড় করে কি বলল বোঝা গেল না। সুপারিন্টেন্টে মিনিটখানেক অপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মেগান চোখ মেলে তাকাল।

-জেরি–

-এই তো আমি, মেগান।

–আমার অভিনয় ঠিক ঠিক হয়েছে তো?

–নিখুঁত ছিল। নকল ব্ল্যাকমেল বলে মনেই হয়নি। ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকাল মেগান।

কতটা কি হবে বুঝতে পারছিলাম না। তাই গত রাতে তোমাকে একটা চিঠি লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল বলে শেষ করতে পারিনি। টেবিলেই আছে চিঠিটা

আমি উঠে লেখার টেবিলের কাছে গিয়ে অসম্পূর্ণ চিঠিটা পেলাম।

ও লিখেছে প্রিয় জেরি,
তোমার কথা মন থেকে সরাতে পারছি না। আমার মন-প্রাণ জুড়ে কেবলই তুমি। বুঝতে পারছি, সত্যিই তোমাকে ভালবাসি। তুমি ছাড়া আমি বাঁচার কথা ভাবতে পারছি না…।

.

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। হাওয়ায় কনকনে ভাব। জ্বলন্ত চুল্লীর তাপে ঘরের আবহাওয়া বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে।

ভিকারেজে আমরা সকলে উপস্থিত হয়েছি। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ সোফার কুশনগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, এই কারণেই একজন বিশেষজ্ঞকে ডেকে আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম আমি।

মনে পড়ল, হ্যাঁ, তিনি বলেছিলেন বটে–এসব এখনই বন্ধ করা দরকার…আমি এখনই তার ব্যবস্থা করতে চলেছি।…সেদিন খুবই বেপরোয়া আর উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম…ভদ্রমহিলা কি ব্যবস্থা নেন দেখা যাক।

এখন কথা শুনে বুঝতে পারলাম, সত্যিই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না মিসেস ডেন ক্যালপ।

কিন্তু কাকে ডেকেছিলেন তিনি, বিশেষজ্ঞ এমন কেউ? আর তিনি কতটা কিই বা করেছেন?

-সত্যিই ডেকেছিলেন কাউকে আপনি? জানতে চাইলাম আমি।

-হ্যাঁ। বললেন তিনি, মিস মারপলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ওই তো বসে রয়েছেন আমার সেই বিশেষজ্ঞ। জেন মারপল। ওই বৃদ্ধ মহিলাকে দেখতে বিশেষত্বহীন মনে হলেও এটা সত্যি জানবেন, মানুষের নানা দুরভিসন্ধির কথা তিনি জানেন।

মিস মারপল তার কুরুশের কাঁটা বুনে চলেছিলেন। ডেন ক্যালথ্রপের কথা শুনে তিনি সুতোর গুলি সরিয়ে রাখলেন।

–অতটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না মড, বললেন মিস মারপল।

–কথাটা কিছু মিথ্যে বলিনি। তুমি তাই।

সারা বছর গ্রামে পড়ে থাকি–মানুষের অনেক কাণ্ডকারখানাই চোখে পড়ে–এই যা।

–সত্যিকথা বলতে, প্রথম দিন আলাপ হবার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি একজন অসাধারণ মহিলা।

তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম যখন এখানকার খুনের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন।

আমার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন, এটাও সত্যিকথা। তিনি আমাকে আমার নিজের দিকে তাকিয়ে বিচার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

ডেন ক্যালথ্রপের কথায় স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সকলের আগ্রহ সৃষ্টি মিস মারপলের দিকে পড়ল। সকলের প্রত্যাশা অনুধাবন করতে পেরে তিনি বললেন,অপরাধগুলো সাধারণত খুব একটা জটিল থাকে না। একটু খোলা মন নিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়।

এখানের খুনের ব্যাপারটাও ছিল খুবই সরল। খুবই সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ–যদিও খুবই ভয়াবহ।

ভয়াবহ তো বটেই। আর খুবই রহস্যময়। বললাম আমি।

তবে ততটা অস্পষ্ট কিছু ছিল না। আপনি তা দেখতেও পেয়েছিলেন মিঃ বার্টন।

–মনে হয় না বিশেষ কিছু দেখতে পেয়েছি বলে।

–আপনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন। সমস্ত ব্যাপারটাই আপনি আমাকে ইঙ্গিতও করেছিলেন। ঘটনাগুলোর পারস্পরিক যোগসূত্র আপনার চোখ এড়াতে পারেনি। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকার জন্য আপনার অনুভূতির সঠিক তাৎপর্য ধরতে পারেননি।

আপনিই শুনিয়েছিলেন, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না–কিন্তু ভুল করে ধোয়ার জাল নিয়ে মেতে ওঠার জন্য সবকিছুই ভুল মনে হয়েছিল। এই ভুলটা সকলেই করেছিল। বেনামী চিঠির ব্যাপার নিয়েই মেতে উঠেছিল। অথচ মজার ব্যাপার হল, সত্যিই কোন বেনামী চিঠি ছিল না।

–কিন্তু, মিস, মারপল, ওরকম একটা চিঠি সত্যিই আমি পেয়েছিলাম। বললাম আমি।

–তা পেয়েছিলেন। কিন্তু সে চিঠিগুলো ধোঁয়া ছাড়া কিছুই ছিল না–আসল আগুনকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া।

প্রিয় মড ব্যাপারটা অনেকটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। যাই হোক, যদি ওই বেনামী চিঠির ব্যাপারটা বাদ দেওয়া যায় তাহলেই আসল ঘটনাটা আমাদের চোখে পড়ে যায়।

বেনামী চিঠির প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলেই আমরা একটা মারাত্মক ঘটনার মুখোমুখি এসে পড়ি-মিসেস সিমিংটনের আকস্মিক মৃত্যু–যেটাকে সুকৌশলে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

এই মৃত্যুর ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, এর ফলে কার কি স্বার্থ চরিতার্থ হতে পারে? কার পক্ষে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুকামনা করা সম্ভব ছিল?

সবার আগে দৃষ্টি পড়ে তার স্বামীর ওপরেই। তার দিক থেকে কি ধরনের উদ্দেশ্য থাকা সম্ভব? দ্বিতীয় কোন নারীর আবির্ভাব? যার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা মিঃ সিমিংটনের বয়সী মানুষদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এখানে এসেই শুনেছিলাম, ওই বাড়িতে রূপবতী এক নার্সারী গভর্নেস আছেন। সরল সোজা ব্যাপারটা এখানেই যেন হাতছানি দিয়ে রহস্যের ইঙ্গিত করে।

মিঃ সিমিংটন ছাড়াছাড়া মানসিকতার এক আবেগবর্জিত মানুষ। এক স্নায়বিক বিকাগ্রস্ত স্ত্রীর সঙ্গে জড়িত ছিল তার জীবন। সেই অবস্থাতেই ওই সুন্দরী তরুণীর আবির্ভাব ঘটল।

ধোঁয়ার ব্যাপারটা–ওইসব বেনামী চিঠি–যদি সকলকে ভুল পথে চালিত না করত তাহলে অনিবার্যভাবে ঘটনার এই দিকে আলোকপাত ঘটত।

কিন্তু সুকৌশলে ওই বেনামী চিঠির ব্যাপারটাকেই এখানে কাজে লাগিয়ে সকলকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।

ওইরকম বয়সের কোন ভদ্রলোক যখন প্রেমে পড়েন, তখন তারা খুব বেপরোয়া হয়ে পড়েন। প্রায় সময়েই তাদের উম্মত্তের মতো ব্যবহার করতে দেখা যায়।

এদিকে মিঃ সিমিংটন, যতদূর জানতে পেরেছি, এমন চরিত্রের মানুষ ছিলেন যে মানবিক গুণাবলী বলতে তার কিছুই ছিল না। ফলে উম্মাদনা বোধ করবার মতো মনোবল একেবারেই ছিল না।

কি করে মেয়েটিকে বিয়ে করা যায় এই চিন্তাতেই একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে স্ত্রীর মৃত্যু ছাড়া তার ইচ্ছাপূরণের কোন উপায় ছিল না।

ভদ্রলোক সন্তানদের স্নেহ করেন। তাদের তাই ছাড়তে চাননি। সামাজিক সম্মান বজায় রাখার চিন্তাও মাথায় ছিল। এই সবকিছু বজায় রেখে সুন্দরী গভর্নের্সকে বিয়ে করতে হলে একটা খুনের ঘটনা ঘটানো ছাড়া উপায় ছিল না তার।

ব্যাপারটা যখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, যখন তিনি অত্যন্ত কৌশলী একটা ছক কষলেন।

তার অজানা ছিল না যে কারো স্ত্রী হঠাৎ মারা গেলে স্বামীর ওপরেই প্রথমে সকলের সন্দেহ পড়ে। সে মৃত্যু যদি বিষক্রিয়ায় হয় তাহলে নানারকম পরীক্ষার প্রশ্ন এসে পড়ে। সেক্ষেত্রে নিজেকে আড়ালে রাখা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই তিনি চাইলেন মৃত্যুর ঘটনাকে অন্যকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে সকলকে ভুলপথে চালিত করতে।

এই চিন্তা থেকেই একজন ভুয়ো বেনামী চিঠি লেখকের সৃষ্টি হল।

সাধারণত বেনামী চিঠির ব্যাপারে স্ত্রীলোকদেরই সন্দেহ করা হয়ে থাকে। বেনামী চিঠির লেখক স্ত্রীলোকই বেশি হয়। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রেও তাই হল। তারা ধরে নিল এসব চিঠি কোন স্ত্রীলোকই লিখছে।

সম্ভবত ডাঃ গ্রিফিথের কাছে বেনামী চিঠির গল্প মিঃ সিমিংটন শুনে থাকবেন। গ্রিফিথ উত্তরে থাকার সময়ে ওখানে সকলেই ওরকম চিঠি পেতে শুরু করেছিল। সেই গল্প শোনার পরই তিনি এমন কৌশলে চিঠিগুলো লিখলেন যাতে সকলেই ধরে নিতে বাধ্য হয়–সেগুলো কোন উম্মাদ স্ত্রীলোকই লিখেছে।

উড়ো চিঠির ব্যাপারে একসময়ে যে পুলিস তৎপর হয়ে উঠবে, এও তিনি জানতেন। হাতের লেখা, ডাকঘরের ছাপ, টাইপ মেসিন ইত্যাদি পরীক্ষার কৌশল তারা অবলম্বন করবে। তাই তাদের চোখে ধুলো দেবার ব্যাপারে নিখুঁত চাতুরির আশ্রয় নিলেন।

খুনের লক্ষ্যে তার প্রস্তুতি চলছিল অনেক দিন থেকেই। উইমেন ইনসটিটিউটে টাইপ মেশিনটা দিয়ে দেবার আগেই সম্ভবত সমস্ত খামে ঠিকানা টাইপ করে রেখেছিলেন। আর কাজটা নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ করার জন্য বহু আগেই কোন একসময় মিস এমিলির ঘরে অপেক্ষা করার ফাঁকে বেছে বেছে একটা ধর্মোপদেশের বই থেকে কতগুলো পাতা ছিঁড়ে রেখেছিলেন। এখানেও তিনি চাতুর্য অদ্ভুতভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি জানতেন ধর্মোপদেশের বই কেউ বড় একটা পড়ে না–কেটে নেওয়া পাতার খোঁজও তাই সহজে কেউ জানতে পারবে না।

বেনামী চিঠির ব্যাপারটা যখন বেশ ভাল রকমে জমে উঠল, সকলে তাই নিয়েই মেতে উঠল, সেই সুযোগে তিনি আসল ঘটনার দিকে হাত বাড়ালেন।

খুব সুবিধাজনক একটা সময় এজন্য বেছে নিলেন তিনি। সেদিন চাকরবাকরদের সাপ্তাহিক ছুটি, বিকেলে গভর্নের্স বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে গেছে, মেগানও তার সাইকেল নিয়ে বাড়ির বাইরে গেছে।

নিভৃতে একটা খুনের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার একেবারে প্রশস্ত সময়।

কিন্তু ভাগ্যেরই প্রহসন বলতে হবে তার ক্ষেত্রে, ঘটনাচক্রে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় অ্যাগনেস সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এরকম ব্যাপার যে ঘটতে পারে মিঃ সিমিংটন ভাবতে পারেননি।

–অ্যাগনেস তাহলে কিছু দেখেছিল, বলছেন? যোয়ানা জানতে চাইল।

–সঠিক বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা ও কিছু দেখেনি।

–হয়তো কিছু ধারণা হয়ে থাকতে পারে।

-না, তা নয়। আমার মনে হয় সে ছেলেবন্ধু আসতে পারে এই আশায় সারা বিকেল রান্নাঘরের জানালার ধারে বসেছিল। সত্যিকথা বলতে সেদিন বিকেলে বাড়িতে ডাকপিওন বা অন্য কেউই আসেনি।

–তাহলে মিসেস সিমিংটন কি কোন চিঠি পাননি?

-কখনই না। যাই হোক, রাতের জন্য কিছু পুরিয়া ওষুধ গ্রিফিথ মিসেস সিমিংটনকে দিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি সেটা খেতেন।

মিঃ সিমিংটন ওইদিন সবচেয়ে ওপরের পুরিয়ার মধ্যে সায়ানাইড রেখে দিয়েছিলেন।

 তিনি জানতেন মধ্যাহ্নভোজের পরেই তার স্ত্রী সেটা খাবেন।

এরপর সিমিংটন অফিস থেকে ঠিক সেই সময়ে বাড়ি ফিরে এলেন, যখন এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এলো।

বাড়ি ফিরে তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন, এলসি তা শুনতে পেল, স্ত্রীর সাড়া না পেয়ে তার ঘরে ছুটে গিয়ে জলের গ্লাসে একফোঁটা সায়ানাইড ফেলে দেওয়া, বেনামী চিঠিটা দলা পাকিয়ে চুল্লীতে ফেলে দেওয়া আর এভাবে আর পারছি না লেখা কাগজের টুকরোটা স্ত্রী হাতের কাছে। রেখে দেওয়া–এই সব কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গেই শেষ করলেন তিনি।

–এক টুকরো কাগজ, আমার দিকে ফিরে বললেন মিস মারপল, এই কথাটাও আপনিই আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন মিঃ বার্টন। সাধারণত আত্মহত্যার কথা মানুষ এক টুকরো কাগজে লিখে রাখে না। তার জন্য তারা একখণ্ড কাগজ ব্যবহার করে। অনেক সময় খামও। তাই টুকরো কাগজের ব্যাপারটা আপনার খটকা লেগে ছিল।

–কিন্তু আপনার মতো করে তলিয়ে দেখতে পারিনি আমি।

–আসলে ব্যাপারটা একদম অন্যরকম ছিল। সিমিংটন হয়তো এই ধরনের কিছু কোথাও লিখে থাকবেন। সেটা চোখে পড়ায় লেখা সহ কাগজের টুকরো ছিঁড়ে নিয়েছিলেন মিঃ সিমিংটন। কার্যক্ষেত্রে সেই টুকরোটাই নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

একটু থেমে মিস মারপল আমার দিকে তাকালেন। পরে বললেন, আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন। তা হল–এলসি হল্যাণ্ড কোন বেনামী চিঠি পাননি।

–গতকাল রাতেই আমি ভাবছিলাম, ও নিজেই বেনামী চিঠিগুলো লিখেছিল, তাই নিজে কোন চিঠি পায়নি। আমি বললাম।

–ওহ্ না, বললেন মিস মারপল, বেনামী চিঠি যারা লেখে তারা নিজেদের নামেও লিখে থাকে। এটাই তাদের অপরাধের প্রকৃতি।

ব্যাপারটা আমি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। ওটা ছিল মিঃ সিমিংটনের দুর্বলতা। বলতে পারেন মনুষ্য চরিত্রের এক বিশেষ দুর্বলতা। ভালবাসার মেয়েকে তিনি ওরকম চিঠি দিতে চাননি।

এই একটা ব্যাপারই তার দিকে আমাকে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তুলেছিল। আর তিনি ধরাও পড়লেন।

-কিন্তু অ্যাগনেসকে খুন করার তো কোন প্রয়োজন ছিল না। যোয়ানা বলল।

–প্রয়োজন ছিল না ঠিকই। কিন্তু তার অপরাধী মন তাকে সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল, অ্যাগনেসের ব্যাপারে। তাই তাকে খুন করে সম্ভাব্য পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছিলেন। খুনীর অপরাধী মনোভাব এরকম বিকৃত হওয়া অসম্ভব নয়।

অ্যাগনেস পারট্রিজকে ফোন করছে এই ব্যাপারটা মিঃ সিমিংটন দেখতে পেয়েছিলেন আমি নিশ্চিত, তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, অ্যাগনেস বলছে, মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকে তার খুব চিন্তা হচ্ছে, সে কিছু বুঝতে পারছে না কি করবে।

মিঃ সিমিংটন ওই শুনেই ধরে নিয়েছিলেন অ্যাগনেস কিছু দেখেছে বা শুনেছে। এর পর তিনি আর ঝুঁকি নিতে চাননি।

–সবাই জানে ওই দিন সারা বিকেল তিনি অফিসেই ছিলেন। বললাম আমি।

 ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম। আমার বিশ্বাস, অফিসে যাওয়ার আগেই তিনি মেয়েটিকে খুন করেন।

 মিস হল্যাণ্ড সম্ভবত রান্নাঘরে বা ডাইনিংরুমে ছিলেন। মিঃ সিমিংটন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আভাস দিতে সদর দরজা খুলে আবার শব্দ করে বন্ধ করে দেন। তারপর ছোট্ট পোশাকের ঘরে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন।

এরপর অ্যাগনেস যখন বাড়িতে ছিল তিনি বেরিয়ে এসে সদর দরজায় ঘন্টা বাজান, আবার পোশাকের ঘরে লুকিয়ে পড়েন।

অ্যাগনেস কেউ এসেছে বুঝে সদর দরজা খুলতে এলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পোশাকের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পেছন থেকে ওর মাথায় আঘাত করেন। তারপর অচেতন দেহটা বয়ে নিয়ে সিঁড়ির তলায় দেয়াল আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখেন।

সেদিন সামান্য দেরিতে অফিসে পৌঁছলেও তাকে সন্দেহ করার কোন সুযোগ ছিল না। কেননা কেউই এব্যাপারে কোন পুরুষকে সন্দেহ করেনি।

–জঘন্য এক ভদ্রবেশি শয়তান। বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।

–তাহলে এমি গ্রিফিথকে নিয়ে টানা-হাচড়া কেন? সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের কাছে শুনলাম, পুলিস ডাঃ গ্রিফিথের ডিসপেনসারি থেকে হারানো নোড়া আর সেই শিকটাও পেয়েছে। ওগুলো নাকি রাখা ছিল সিমিংটনের অফিসের দলিলের একটা বাক্সের মধ্যে। বলল যোয়ানা।

–পাগল না হলে ওসব জিনিস এভাবে কেউ রেখে দেয়? বললাম আমি।

–কিন্তু ওই নোড়া দিয়ে সিমিংটন অ্যাগনেসকে মারেনি। বলল যোয়ানা, ওখানে একটা ডার্বিঘড়ি ছিল, তাতে চুল আর রক্ত লেগেছিল। এমি যেদিন গ্রেপ্তার হয়, সেই দিনই তিনি সেটা চুরি করেন। আর ওই ছেঁড়া বইয়ের পাতাগুলোও, সেদিনই তার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কথা হল, পুলিস যে এমিকে গ্রেপ্তার করল, তারা কি সত্যিই তাকে ওই চিঠিটা লিখতে দেখেছিল?

-এমি ওই চিঠি সত্যিই লিখেছিলেন। বললেন মিস মারপল।

 হঠাৎ ওরকম চিঠি লিখতে গেলেন কেন?

-হঠাৎ কেন হবে, এমি বহুদিন থেকেই সিমিংটনের প্রেমে ডুবে ছিলেন।

–হায় কপাল। বললেন মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ।

-দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খুবই নিবিড় ছিল। বললেন মিস মারপল, মিসেস সিমিংটন মারা যাবার পর তাই এমি খুবই আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন লোকমুখে এলসি হল্যাণ্ডকে নিয়ে সম্ভাবনাটার কথা ছড়িয়ে পড়ল, স্বাভাবিক ভাবেই এমির মন ভেঙ্গে পড়ল। সেই হতাশা থেকেই তিনি এলসিকে সরাবর জন্য একটা বেনামী চিঠি লেখার পরিকল্পনা নেন। যাতে ভয় পেয়ে এলসি এখান থেকে সরে পড়ে। নতুন আর একটা চিঠিকেও আগেকার বেনামী চিঠি লেখকের কীর্তি বলেই লোকে ধরে নেবে-নিশ্চয় এরকম ভেবে নিয়েছিলেন তিনি। তবুও যথেষ্ট সতর্ক হয়েই কাজটা করেছিলেন তিনি।

-তারপর? যোয়ানা জানতে চাইল।

-আমি নিশ্চিত যে, বললেন মিস মারপল, এলসি চিঠিটা যখন মিঃ সিমিংটনকে দেখিয়েছিলেন, তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন চিঠিটা কে লিখতে পারে। নিজেকে নিরাপদ করার একটা প্রশস্ত সুযোগও তিনি এই সঙ্গে পেয়ে গেলেন।

সিমিংটন জানতেন, পুলিস বেনামী চিঠির লেখককে ধরবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটা পুলিসের কাছে নিয়ে যান। তারা তাকে জানালেন, এমিকে ওই চিঠি লিখতে তারা দেখেছেন। এভাবেই দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল। সিমিংটন তার ঘটনার এক চমৎকার পরিসমাপ্তি টানার সুযোগ নিলেন।

এমি যেদিন গ্রেপ্তার হন, সেদিন তিনি পরিবারের সকলকে নিয়ে গ্রিফিথের ওখানে চা খেতে গেলেন। ওই সময়েই নিশ্চয় তিনি সঙ্গে করে ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো নিয়ে এসেছিলেন আর সুযোগ বুঝে সিঁড়ির তলার দেয়াল-আমলারিতে গুঁজে রাখলেন।

তার এই আচরণই অ্যাগনেসের মৃতদেহ রাখার ঘটনাটা মনে করিয়ে দেয়। এই কাজটা তার পক্ষে এমন কিছু কঠিনও ছিল না।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে মিস মারপলের প্রতি আমার কিছু ক্ষোভ জমে ছিল। সেকথাটা এবার উত্থাপন না করে পারলাম না।

-সবই বুঝলাম, মিস মারপল, আপনার একটা ব্যাপার আমার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে আছে। বেচারী মেগানকে আপনি এসবের মধ্যে টেনে এনেছেন দেখে আমি সত্যিই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম।

মিস মারপল আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চশমার আড়ালে তার চোখের কঠিন দৃষ্টি আমার চোখ এড়াল না।

–ঘটনার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমাকে কিছু একটা করতেই হত, মিঃ বার্টন। সিমিংটন লোকটা এমনই ধূর্ত যে তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণই ছিল না। তাই সরাসরি তার মোকাবেলা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর এ কাজের জন্য এমন একজনের সাহায্যের দরকার ছিল, যার সাহস ও বুদ্ধি দুইই আছে। তাই মেগানকেই এ কাজের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছিল আমার।

কিন্তু, কাজটা খুবই ঝুঁকির হয়ে গিয়েছিল না কি? বললাম আমি।

–কথাটা ঠিকই বলেছেন। কাজটা নিঃসন্দেহ বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু একজন নিরপরাধ মানুষকে বাঁচাবার জন্য এই ঝুঁকিটুকু না নিয়ে পারিনি আমি। তবে মেগানের উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ছিল মিঃ বার্টন।

-হ্যাঁ, তা অবশ্য ছিল। বললাম, আমি, আপনি সত্যিই অসাধারণ মিস, মারপল, মিস ডেন ক্যালথ্রপকেও তাই অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।