১-৫. লিমন্টকের শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ

দ্য মুভিং ফিংগার / আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

লিমন্টকের শান্ত গ্রামীণ পরিবেশেই শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ি পছন্দ হল আমাদের।

বাড়িটার নাম লিটল ফার্জ। যোয়ানা খুব খুশি বাড়ি দেখে। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম।

লিমন্টকের আধমাইল বাইরে জলাভূমির দিকে যাওয়া রাস্তার ওপরেই। সুন্দর সাদা রঙের বাড়ি। সামনে ভিক্টোরীয় যুগের হালকা সবুজ রঙ করা বারান্দা। মিস বার্টন নামে এক অবিবাহিত মহিলা বাড়িটার বর্তমান মালিক।

এরকম একটা অজানা অচেনা পরিবেশে আসার উৎসাহ দিয়েছিলেন আমার ডাক্তার মার্কাস কেন্ট।

 তিনি বলেছিলেন, আপনার স্নায়ু আর পেশী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে নিশ্চিত, তবে একটু সময় লাগবে। খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্য ব্যস্ত হবেন না। দীর্ঘদিন ওষুধের ওপর রয়েছেন, স্বাভাবিক ভাবেই স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই শরীরের সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুকেও সেরে ওঠার সময় দিতে হবে। বোনকে নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যান।

একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার চেষ্টা করুন। আপনাকে চিকিৎসক হিসেবে এটাই আমার পরামর্শ।

বিমান ভেঙ্গে পড়ে জবরদস্ত জখম হয়েছিলাম। নার্সিংহোমে টানা পাঁচ মাস চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে। এখন ডাক্তার কেন্টের পরামর্শ মতো লিমন্টকের ভাড়া বাড়িতে নতুন আস্তানা হল আমার আর যোয়ানার।

বয়সে আমি যোয়ানার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।

লিটল ফার্জ ভাড়া নেওয়া হল ছমাসের জন্য। চুক্তিতে আরও তিন মাসের সংস্থান রাখা হয়েছে।

এমিলি বার্টন ছোটখাট চেহারার চমৎকার মহিলা। বাড়িটা ভাড়া দেবার ইচ্ছা ছিল না। আমাদের সঙ্গে কথা বলে তার ভাল লেগেছিল, তাছাড়া আমার অবস্থার কথাও শুনেছিলেন, তাই খুশি হয়েই বাড়িটা আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন।

এমিলি বার্টন জানিয়েছিলেন, তার পনেরো বছরের পার্লারমেইড ফ্লোরেন্স সম্প্রতি বিয়ে করেছে। ওদের হাই স্ট্রীটে একখানা চমৎকার বাড়ি আছে। সেখানে একেবারে ওপরের তলাতেই তিনি থাকবেন।

ওখানে আমাদের নতুন পরিচারিকার সন্ধান করতে হয়নি। এমিলি বার্টনের পরিচারিকা পারট্রিজ আমাদের কাছেই কাজ করতে রাজি হয়ে গেল।

তাকে সাহায্য করবার জন্য একটা মেয়েও রইল-বিট্রিস নাম তার। রোজ সকালে এসে সে পারট্রিজকে সাহায্য করবে।

পারট্রিজ কেমন একটু রুক্ষ প্রকৃতির তবে তার রান্নার হাত প্রশংসনীয়। আমার শরীর সেরে ওঠার জন্য যে ভাল খাবারদাবার দরকার এবিষয়েও সে যথেষ্ট সচেতন ছিল।

আমার বোন যোয়ানা খুবই সুন্দরী আর হাসিখুশি মেয়ে। নাচগান, হৈ হুল্লোড় করেই থাকতে ভালবাসে। প্রেম করে বেড়ানো ওর একটা বাতিক। তবে পল নামে একটা প্রতিভাবান ছেলেকে ও সত্যিই ভালবেসেছিল। কিন্তু সে ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াতে পারেনি। খুবই আঘাত পেয়েছিল যোয়ানা। মনের মেরামতির জন্য তারও একটু নির্জনতার দরকার ছিল।

গ্রামের নতুন জীবনে একদিন একদিন করে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলাম। আমার সুন্দরী বোনের কাছেও গ্রামের জীবন বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছিল।

বেশ চটকদার পোশাক পরেই সে ঘোরাঘুরি করে বেড়ায়। লিমণ্টকের হাই স্ট্রিটে লোকেরা ওর দিকে কেমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বেশ রসিয়ে রসিয়ে সেই গল্প সে করে আমাকে।

এসব নিয়ে আমি অবশ্য তাকে পরিবেশের অনুকূল পোশাক ও মেকআপের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেই। আমার কথা শুনে যোয়ানা খুব মজা পায়, হেসে লুটিয়ে পড়ে।

লিমন্টকে এক সপ্তাহের জীবনেই আমরা মিস এমিলি বার্টন সহ নতুন কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম। এরা হলেন এখানকার একজন উকিলের স্ত্রী মিসেস সিমিংটন, ডাক্তারের বোন মিস গ্রিফিথ, ভাইকারের স্ত্রী মিসেস ভেন ক্যালথ্রপ আর প্রিয়রস এণ্ডের মিঃ পাই।

মেলামেশার নতুন সঙ্গীদের পেয়ে যোয়ানা মন্তব্য করল, এই বেশ হলো, বেশ একটা সুখী পরিবারের মত। জানিস জেরি, আমার মনে হচ্ছে জায়গাটা সত্যিই ভাল। এখানে খারাপ কিছু ঘটে বলে মনে হয় না।

আমিও কথাটা স্বীকার করলাম। লিমণ্টকের মতো জায়গায় খারাপ কিছু ঘটতে পারে ভাবা যায় না। আমরা শান্তিতেই থাকতে পারব।

আমাদের ধারণাটা যে কত হাস্যকর এক সপ্তাহ পরেই হাড়ে হাড়ে বুঝে গেলাম। প্রথম চিঠিটা পেয়েই আমাদের সেই বোবোদয় হল।

.

লিমণ্টক জায়গাটা একটু খোলামেলা। পরিচয় না দিলে আমার এই কাহিনী ঠিক বুঝতে পারা যাবে না।

এই অঞ্চলের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। নর্মান বিজয়ের সময় প্রধানত গির্জার জন্য লিমক বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। একটা বিখ্যাত প্রায়রি এখানে ছিল। কয়েকজন ক্ষমতাশালী প্রিয়রও ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা ভোগ করেছেন। ঈশ্বর সেবার উদ্দেশে ক্ষমতাবান লমবার্ড ও ব্যারনেরা অনেক জমিও দান করেন।

এসব কারণে লিমণ্টক কয়েক শতাব্দী ধরে বেশ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে।

অষ্টম হেনরীর আমলেই সমসাময়িক অনেক গির্জার মতো লিমন্টকের গির্জারও গুরুত্ব খর্ব করা হয়েছিল।

তখন থেকেই ক্ষমতা অর্থ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে এক দুর্গ এখানে প্রধান শক্তির কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

ক্ষমতার সেই দুর্গও ভেঙ্গে পড়ে অষ্টাদশ শতকের আধুনিকতার ছোঁয়ায়। চূড়ান্ত অবহেলার কবলে পড়ে লিমণ্টক। রেলপথ, সড়কপথ-অগ্রগতির কোন স্পর্শই লিমণ্টকের ভাগ্যে জোটেনি। অতীতের সমস্ত গুরুত্ব হারিয়ে এক অবহেলিত জনপদ রূপেই থেকে যায়। বিস্তীর্ণ পতিত জমি, জলাভূমি আর কিছু চাষবাসের খেত খামার নিয়েই বেঁচে থাকে লিমণ্টক। পুরনো আমলের একটা গীর্জা, স্যাক্সন আমলের কিছু ধ্বংসাবশেষ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ আর একটা হাই স্ট্রিট–এসবের মধ্যেই কেবল অতীত গৌরবের কিছু পরিচয় এখানে ধরা রয়েছে।

হাই স্ট্রিটের দুপাশে সম্ভ্রান্ত কিছু বাড়িঘর এখনো রয়েছে। কিন্তু দোকান, ডাকঘর, ডাক্তারখানা, সলিসিটর অফিস, আর সাপ্তাহিক বাজার আর এসবের সঙ্গে রয়েছে একটা নতুন স্কুল আর পাঠশালা।

আমরা তো এখানে চিরকাল থাকার জন্য আসিনি, ডাক্তারের উপদেশে কিছুদিনের অবকাশ যাপনই হল উদ্দেশ্য।

তবু যাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল, সেই পাড়াপড়শীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আগ্রহ আমাদের কিছু কম ছিল না।

চিঠিটা এসেছিল প্রাতরাশের সময়। লণ্ডন ডাকঘরের কোন ছাপ ছিল না। বুঝতে পারলাম স্থানীয় চিঠি। টাইপ করে ঠিকানা লেখা।

খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে আনলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, কিছু ছাপা অক্ষর কাঁচি দিয়ে কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। বিষয়বস্তু পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

অত্যন্ত কদর্য ভাষায় কেউ লিখেছে, যোয়ানা আর আমি ভাই বোন নই।

–কার চিঠি? কে লিখেছে?

আমার মুখভাব দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল যোয়ানা।

এই জঘন্য চিঠিটা পড়ে ওর নরম মনে আঘাত লাগতে পারে, ঘটনার আকস্মিকতায় সেই কথাটা একদম মনে পড়ল না। স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিখানা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম।

–নোংরা–জঘন্য একটা চিঠি। কোন বেনামী চিঠি এমন হয় কখনো শুনিনি। বলল। যোয়ানা।

-আমিও এই প্রথম দেখছি। বললাম।

-আমার পোশাক নিয়ে তুই ঠিকই বলেছিস জেরি। যে লিখেছে চিঠিটা, সে ভেবে নিয়েছে আমি কারও বাতিল হওয়া প্রেমিকা।

–আমরা দু ভাইবোন দেখতেও একরকম নই, এটাও আর একটা কারণ হতে পারে। সেকারণেই ভাই বোন ভাবতে পারেনি।

কথা শেষ করে আমি চিঠিটা চুল্লীর আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

–একদম ঠিক করেছিস। যোয়ানা বলল, কিন্তু ভাবছি, চিঠিটা কে লিখতে পারে?

–সে রহস্য বোধহয় কোন দিনই জানা যাবে না।

–কোন উম্মাদ গোছের লোকই হবে।

প্রাতরাশ শেষ করে যোয়ানা বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বিশ্রী ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলাম।

যোয়ানার ঝলমলে পোশাক আর সৌন্দর্য কেউ একজন নিশ্চয় ভাল মনে মেনে নিতে পারেনি সেই জন্যই আমাদের আঘাত দিতে চেয়েছে। কেননা এর মধ্যে মজা করার কিছু নেই।

নানান ভাবনা মাথায় ঘুরছে বলে বিশ্রী চিঠিটার কথা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছিলাম না।

একটু পরেই ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ এলেন। এখানে আসার পর প্রতি সপ্তাহে একবার আমাকে। পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাঁকেই অনুরোধ করেছিলাম।

মানুষটাকে আমার বেশ ভালই লাগে। একটু ঝাঁকুনি দিয়ে কথা বলেন, একটু লাজুক ভঙ্গী।

আমাকে রুটিন মাফিক পরীক্ষা শেষ করে গ্রিফিথ বললেন, ভালই উন্নতি করছেন। কিন্তু মুখভাব এমন বিরস কেন?

অশ্লীল বেনামী চিঠিটার কথা জানালাম তাঁকে। বললাম, চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে খুব মুষড়ে পড়েছি।

-আপনিও এরকম চিঠি পেয়েছেন?

বেশ উত্তেজিত স্বরে বললেন গ্রিফিথ।

–এখানে এরকমই চলছে নাকি। আগ্রহের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম।

–হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। আপনার বোন ভেঙ্গে পড়েনি তো?

–যোয়ানা খুবই আধুনিকা আর খুবই মনের জোর। ও বেশ মজাই পেয়েছে।

–সে রকম ভাবে নেওয়াই ভাল। খুবই জঘন্য কাজ।

–কিন্তু এসব কাণ্ড কে করতে পারে, আপনার কোন ধারণা আছে?

–না, সবই দুর্বোধ্য। তবে এসব বেনামী চিঠির ব্যাপারে দুরকম কারণ থাকে। কারো যদি বিশেষ কারো প্রতি রাগ বা বিদ্বেষ থাকে সে ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ঘৃণ্য পথ বেছে নিতে পারে।

কোন চাকর, ঈর্ষাপরায়ণ স্ত্রীলোক–এরাই এসব করে থাকে। তবে এদের খুঁজে বার করা খুব কঠিন কাজ নয়।

কিন্তু বিশেষ কাউকে না লিখে যখন ইচ্ছেমতো যাকে তাকে বেনামী চিঠি লেখা হতে থাকে, সেটাই হয় মারাত্মক। মানসিক বিকারগ্রস্ত, হতাশ লোকেরাই তেমন নোংরা কাজ করে থাকে। এদের খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়। তবে কখনো সন্ধান পাওয়া গেলে দেখা যায়, যাদের কথা ভাবা যায় না। তেমনি কেউ একজন সে।

গতবছর গ্রামের অন্যদিকে এরকম একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছে। খুবই রুচিসম্পন্না এক মহিলা, খুবই শান্ত ভদ্র, বেশ কয়েক ওখানে আছেন, এমন বিশ্রী চিঠি লিখেছিলেন।

গ্রামের উত্তর দিকেও এরকম একটা কাণ্ড ঘটেছিল। অবশ্য সেটা ছিল ব্যক্তিগত আক্রোশের কাজ।

–এসব তাহলে অনেকদিন থেকেই চলছে? জানতে চাইলাম আমি।

–ওহ, হ্যাঁ। বিশেষ করে স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক নিযে। ডাক্তার হেসে বললেন, সলিসিটর সিমিংটনকে অভিযোগ করা হয়েছিল তার লেডি টাইপিস্ট মিস গিনচের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে। বেচারি মিস গিনচ সোজা পুলিসের কাছে গিয়েছিল।

আমাকে অভিযোগ করা হয়েছে, আমি নাকি আমার মহিলা রোগীদের সঙ্গে অনৈতিক ব্যবহার করে চলেছি।

এসমস্ত কিছুই অবাস্তব আর পাগলামো ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এটাও ঠিক মন বড় বিষিয়ে তোলে। বড় ভয় পাই আমি এসবে।

–সত্যিই তাই। বললাম আমি।

-যতই বলি না কেন নোংরা ছেলেমানুষি, কোন এক সময় যে কোন একটা ঠিক সত্যি হয়ে উঠতে পারে।

অশিক্ষিত সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মানুষের মন এসবের প্রতিক্রিয়া সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এরফলে নানা ধরনের বিপদ ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়।

–আমার চিঠিটা যে লিখেছে, তাকে অশিক্ষিত বলেই তো ভাবছি।

 –তাই হবে হয়তো।

এরপর ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথ বিদায় নিলেন।

.

০২.

 ব্যাপারটাকে আমি তাড়াতাড়ি ভুলে যাবারই চেষ্টা করতে লাগলাম। কেন না এরকম একটা বাজে ব্যাপারের কোন গুরুত্ব থাকতে পারে বলে আমার মনে হল না। হয়তো কোন ছিটগ্রস্ত স্ত্রীলোকের বিকারজনক কাজ।

কিন্তু আমার মোহভঙ্গ হল পরের সপ্তাহেই।

সেদিন পারট্রিজ গম্ভীর মুখে এসে আমাকে জানাল প্রতিদিনের কাজের মেয়েটি, বিট্রিজ আজ কাজে আসবে না।

–ওর হয়তো শরীর খারাপ হতে পারে। বললাম আমি।

–শরীর ঠিক আছে স্যর, ও খুবই ভেঙ্গে পড়েছে।

এরপরই মারাত্মক কথাটা শোনাল পারট্রিজ, আমাকে জড়িয়ে খুব খারাপ ইঙ্গিত করে একটা চিঠি তাকে লেখা হয়েছে।

শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। মেয়েটাকে আমি ভাল করে এখনো পর্যন্ত লক্ষই করিনি। শহরে হঠাৎ দেখলে চিনতেই পারব না। তাছাড়া আমি একজন লাঠিতে ভর দিয়ে চলা অসুস্থ মানুষ।

–এসব কি আজেবাজে কথা। খুবই বিরক্তির সঙ্গে বললাম আমি।

–বিট্রিসের মাকে আমি বলেছি সবই স্যর। এ বাড়িতে আমি যতক্ষণ আছি, এরকম কিছু ঘটবে না। তবে অন্য কোথাও কিছু হয়ে থাকলে আমি বলতে পারব না।

আমি জানি স্যর, বিট্রিসের এক বন্ধু আছে, সে গ্যারাজে কাজ করে। সেও এই রকম খারাপ একটা চিঠি পেয়েছে।

কেমন গোলমাল মনে হচ্ছে আমার স্যর, আমি বলি মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দেওয়াই ভাল। কিছু একটা আছে এর মধ্যে, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না।

.

সেদিন সকালে বেশ তেজী রোদ ছিল। বাতাসে কেমন বসন্তের আমেজ মাখানো। রাস্তায় একটু হাঁটবো বলে দুটো লাঠি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কিছু কাজও অবশ্য ছিল। সিমিংটনদের অফিসে যাব, কিছু শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করতে হবে। রুটিওয়ালা শক্ত রুটি দিয়েছিল, তাকেও কথাটা বলতে হবে। তাছাড়া ব্যাঙ্কেও যেতে হবে একবার।

যাতে দেরি না হয় মধ্যাহ্ন ভোজে যোয়ানা আমাকে পাহাড়ের কাছ থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসবে। তার সঙ্গে সেরকম কথা থাকল।

লিমন্টকের হাই স্ট্রীট এমন জায়গা যেখানে গেলে সকলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। খবরাখবর আদান-প্রদান হয়। আমিও আশা করলাম পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

শহরের পথে কিছুটা এগিয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে সামনে হাজির হল মেগান হান্টার। ও হল উকিল সিমিংটনের সৎ মেয়ে, মিসেস সিমিংটনের প্রথম বিয়ের সন্তান।

এখানে আসার পরে শুনেছি, ক্যাপ্টেন হান্টার মিসেস সিমিংটনের প্রতি খুবই খারাপ ব্যবহার করতেন। বিয়ের পর দুবছরও মহিলা তার সঙ্গে থাকতে পারেন নি। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। অনেক পরে তিনি এখানকার এক অবিবাহিত ভদ্রলোককে বিয়ে করেন। তিনিই রিচার্ড সিমিংটন।

এই বিয়েতে তাদের দুটি ছেলে হয়। তারা বাপমায়ের খুবই আদরের। মিসেস সিমিংটনকে সুন্দরী বলা চলে। তবে কেমন ফ্যাকাসে চেহারা। মেগানের সঙ্গে তার চেহারার মিল নেই একদম। ও বেশ লম্বা, মাথায় একরাশ বাদামী চুল, পাতলা সুশ্রী মুখ। সব সময় হাসিখুশি।

মেগানের বয়স প্রায় কুড়ি। কিন্তু দেখলে মনে হয় ষোল বছরের স্কুলের মেয়ে।

-ল্যাসার্সের খামারে গিয়েছিলাম হাঁসের ডিম যদি পাওয়া যায়। সাইকেল থেকে নেমে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল মেগান, দেখলাম আপনি একা চলেছেন

একটু থেমে মুখ ভরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে মেগান ফের বলল, আপনার বোন খুব সুন্দর, একদম আপনার মতো নয়।

-ভাইবোনেরা সব সময় একইরকম দেখতে হয় না। আমি বললাম।

–ঠিকই বলেছেন, আমিও ব্রায়ান বা কলিনের মতো নই। কেমন অদ্ভুত, তাই না?

আমি নিঃশব্দে হাসলাম। খানিকটা পাশাপাশি হেঁটে যাবার পর মেগান বলল, আপনি প্লেনে ওড়েন, তাই না।

-হ্যাঁ।

–তা করতে গিয়েই আহত হন?

–হ্যাঁ, প্লেন ভেঙ্গে পড়েছিল।

 –হায় ভগবান। আমার ট্রেনে উঠতেই ভয় করে।

–সারাদিন তুমি কি কর মেগান? আমি জানতে চাইলাম।

-এখন আর কি করব, এক বছর আগে স্কুল ছেড়েছি। এখানে তেমন মেয়েও নেই যে তাদের সঙ্গে মিশব। এমনি ঘোরাঘুরি করেই কেটে যায় দিন। কথা বলতে বলতে আমরা হাই স্ট্রিটে এসে পড়েছিলাম। হঠাৎ মেগান তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ, মিস গ্রিফিথ এদিকে আসছেন।

-কেন, ওকে তুমি পছন্দ কর না?

–একদম না। দেখা হলেই ওর সেই বিচ্ছিরি গার্ল গাইডে যোগ দেবার কথা বলেন। ওই ব্যাপারটা আমার একদম অপছন্দ।

মেগানের কথা শেষ হতে না হতেই ডাক্তারের বোন মিস এমি গ্রিফিথ এসে পড়লেন।

মহিলার চেহারায় কিছুটা পুরুষালী ভাব থাকলেও সৌন্দর্যময়। কণ্ঠস্বর মিষ্টি ও জোরালো।

মেগান তার সঙ্গে দু-একটা মন রাখা কথা বলে সাইকেলটা রাস্তার ধারে রেখে ইন্টারন্যাশনাল স্টোর্সে ঢুকে পড়ল।

-অদ্ভুত কুঁড়ে মেয়ে, বললেন মিস গ্রিফিথ, কেবল ঘুরে ঘুরে কাটাবে। ওর মা মিসেস সিমিংটন, কিছু শেখানোর জন্য বলে বলে হার মেনেছেন। মেয়েটা ওর বাবার মতোই হয়েছে।

আমি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে কথা শোনার ফাঁকে তাকে লক্ষ্য করছিলাম। সব কথা কানেও যাচ্ছিল না।

হঠাৎ রাস্তার অন্য দিকে কাউকে দেখতে পেয়ে মিস গ্রিফিথ সেদিকে ছুটলেন। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মহিলার জোরালো ব্যক্তিত্ব কেমন অস্বস্তি ধরায়।

আমি প্রথমে ব্যাঙ্কের কাজটা মেটালাম। তারপর গেলাম উকিল সিমিংটনের অফিসে। একজন গ্রামীণ আইনজ্ঞের অফিস যেমন হওয়া উচিত অফিসটা তেমনি, বেশ সুন্দর। ঘরের চারপাশেই দলিলের বাক্স সাজানো। বাক্সের গায়ে নানা নামের লেবেন লাগানো।

রিচার্ড সিমিংটনের বাইরের চেহারাটা আপাত রুক্ষ মনে হলেও বেশ সদাশয় মানুষ।

আমার আনা কাগজপত্র দেখে অল্প সময়ের মধ্যেই কাজটা সেরে দিলেন। আমিও যাওয়ার জন্য উঠলাম।

–আপনার সৎ মেয়ে মেগানের সঙ্গে পথে আজ দেখা হল।

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কথাটা বললাম।

মিঃ সিমিংটন কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরে হেসে বললেন, ওহ, মেগানের কথা বলছেন? সবে স্কুল ছেড়ে এসেছে। ভাবছি কোন একটা কাজে লাগিয়ে দেব। অবশ্য বয়সও খুব বেশি নয়।

বাইরের অফিসে একমাথা কোকড়ানো চুল, মাঝবয়সী এক মহিলা দ্রুত টাইপ করে চলেছেন। তাকে দেখে ডাঃ গ্রিফিথের কথা আমার মনে পড়ল। ইনিই নিশ্চয় মিস গিনচ।

ওকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে কোন গোপন সম্পর্ক থাকা একেবারেই অসম্ভব।

এরপর রুটিওয়ালার দোকান হয়ে রাস্তার ধারে এসে যোয়ানা আর তার গাড়ির খোঁজে চারপাশে তাকালাম। যোয়ানকে কোথাও চোখে পড়ল না।

আচমকা সামনে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। মনে হল কোন ভাসমান দেবীমূর্তি রাস্তার পাশ দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টি যেন আটকে গেল। নিখুঁত গড়ন। এমন চমৎকার মানানসই চেহারা, চলার ভঙ্গী, কুঞ্চিত সোনালী কেশগুচ্ছ, কোন দেবীমূর্তি ছাড়া সম্ভব নয়।

আশ্চর্য মহিমান্বিত তরুণীকে দেখে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে আমার হাতের কিসমিসের রুটি রাস্তার ওপরে খসে পড়ে গেল। ওটা ধরতে গিয়ে, ভারসাম্য হারিয়ে লাঠি সমেত আমিও পড়ে গেলাম।

সেই দেবীমূর্তিই এগিয়ে এসে শক্ত দুই হাতে আমাকে টেনে তুলল। রুটি আর লাঠিও তুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল।

আমি অস্ফুটস্বরে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমার যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

-ধন্যবাদের কিছু হয়নি, ও কিছু না। নিতান্তই সাদামাটা কণ্ঠের কথা আমার কানে ভেসে এলো।

আমারও মোহভঙ্গ হল। বেশ স্বাস্থ্যবতী চটপটে একটি মেয়ে ছাড়া বেশি কিছু মনে হল না তাকে।

এমন বিসদৃশ সহাবস্থান যে সম্ভব আমার ধারণা ছিল না। ওই রূপের পাশাপাশি নিরুত্তাপ অতি সাধারণ কণ্ঠস্বর বড় বেশি বেমানান।

যোয়ানা কখন আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল বুঝতে পারিনি। ও জানতে চাইল কিছু ঘটেছে কিনা।

না কিছু না, ওর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি, একটা বিচ্ছিরি রকমের ধাক্কা খেলাম। ও কে বলতে পারিস?

একটা গর্বিত হংসিনীর মতো অনেকটা সাঁতার কাটার ভঙ্গীতে এগিয়ে চলা মূর্তিটির দিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।

-ওহ, ও হল সিমিংটনদের নার্সারী গভর্নের্স। ওকে দেখেই তোর এমন বেসামাল অবস্থা? দেখতে সুন্দর তবে বড়ই নিরুত্তাপ।

–হ্যাঁ, বললাম আমি। বাইরের সৌন্দর্যটা করুণভাবে অপচয়িত হয়েছে।

যোয়ানা গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিল। আমি উঠে বসলাম।

.

০৩.

 প্রাচীন ভাঙ্গা গির্জার এলাকায় প্রিয়রস লজে বাস করেন মিঃ পাই। সেদিন বিকেলে আমরা তাঁর ওখানে গেলাম চা পান করতে।

ছোটখাট গোলগাল চেহারার মানুষ মিঃ পাই। নিজে যেমন ছিমছাম তেমনি বাড়ির প্রতিটি জিনিস সাজানো গোছানো আর বেশ ঝকঝকে। অনেক প্রাচীন জিনিস তিনি অতি যত্নের সঙ্গে মিউজিয়মের মতো সাজিয়ে রেখেছেন। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের সব দেখালেন।

একথা সেকথার পর একসময় মিঃ পাই বললেন, আপনারা বেশ সুন্দর বাড়িই পেয়েছেন। এমিলি বার্টনদের অনেকদিন থেকেই আমি জানি। আমি যখন এখানে আসি, তখন ওদের বৃদ্ধা মা বেঁচে ছিলেন। বিশাল চেহারা ছিল তার। পাঁচপাঁচটা মেয়েকে নিয়ে দারুণ দাপটে চলতেন। সবচেয়ে বড় মেয়েটির বয়সই ছিল তখন ষাটের কাছাকাছি। মায়ের সেবা করার জন্য তটস্থ থাকতো সকলে।

অদ্ভুত কি জানেন, বাড়িতে বাইরের লোকের আনাগোনা একদম পছন্দ করতেন না মহিলা। মেয়েদের বন্ধুদের কাউকে আনার উপায় ছিল না। এই করে মেয়েরা অবিবাহিতই থেকে গেল।

আমরা নিবিষ্টভাবে মিঃ পাইয়ের কথা শুনছিলাম। যোয়ানা বলল, এ যে একেবারে কোন উপন্যাসের কাহিনী বলে মনে হচ্ছে।

-হ্যাঁ, সেরকমই বলতে পারেন। ওদের বাড়িতে আছেন তো, ওই পরিবারের কথা আপনাদের জানা দরকার। প্রায় সাতানব্বই বছরে মারা যান মহিলা। মেয়েদের বিয়ে করার বয়সও পার হয়ে গেছিল ততদিনে। তাদের সহ্যশক্তিও বেশি ছিল না, একের পর এক মারা গেলেন। নানা অসুখে ভুগে। বেচারি ম্যাকেল দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, এমিলি সাধ্যমতো সেবা করেছেন তার। চমৎকার মহিলা। তবে অর্থকরী সমস্যায় পড়েছেন বলে বোধহয়।

–শুনেছিলাম, ভাড়া দেবার ইচ্ছে ছিল না–যোয়ানা বলল।

–তবুও, উনি নিজেই আমাকে বলেছেন ভাল ভাড়াটিয়া পেয়ে খুশি হয়েছেন।

–বাড়িটা খুবই নিরিবিলি। বললাম আমি।

–আপনার ওরকমই লাগছে? অবাক হবার মত কথাই বটে। বললেন মিঃ পাই।

–কিছু কি বলতে চাইছেন মিঃ পাই? যোয়ানা জানতে চাইল।

অন্য কিছু না। আমার ধারণা মানুষের চিন্তা আর ধারণা বাড়ির আবহাওয়ার মধ্যে উপলব্ধি করা যায়। অবশ্য এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আরও কিছু কথাবার্তার পর আমরা শুভরাত্রি জানিয়ে উঠে পড়লাম।

.

দুদিন পরে শনিবারের বিকেলে আমরা সিমিংটনদের বাড়িতে ব্রিজখেলার আসরে যোগ দিলাম।

সেখানে খেয়োলাড় হিসেবে পেয়েছিলাম আমরা দুজন, সিমিংটন দম্পতি, মিস গ্রিফিথ, মিঃ পাই, মিস বার্টন আর কর্নেল অ্যাপলটন।

কর্নেলের সঙ্গে সেদিনই পরিচিত হলাম। তিনি থাকেন সাতমাইল দূরের কুম্বত্রকার নামে এক গ্রামে। ভদ্রলোক ব্রিজ খেলতে খুবই ভালবাসেন। বয়স ষাটের কাছাকাছি। যোয়ানাকে দেখে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে খেলার ফাঁকে ফাঁকেই ওর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। আমার সুদর্শনা বোন যে তার মন হরণ করেছে, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।

সিমিংটনদের নার্সারী গভর্নেস সেই এলসি হল্যাণ্ডকে সেদিন কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। তবে তার রূপের সম্মোহন আগের মত প্রভাবিত করতে পারেনি। তার রূপ আর সুগঠিত দেহের অপচয় খুবই অসহনীয় ঠেকছিল।

মেয়েটির কথাই যে নিরুত্তাপ আর সাদামাটা তাই নয়, দাঁত প্রায় সমাধি প্রস্তরের মতো আর হাসলে মাড়ি বেরিয়ে পড়ে। এসব দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি।

আমরা যখন খেলতে বসেছি, তার কিছু পরেই বাচ্চাদের নিয়ে লঙব্যারেজে বেড়াতে চলে গেল। মিসেস সিমিংটনকে বলে গেল–অ্যাগনেসকে বলে গেছি, পাঁচটায় চা দিতে।

আমাদের সম্মানেই খেলার আয়োজন হয়েছিল। তাই আমি আর যোয়ানা বসেছিলাম, মিসেস সিমিংটন মিঃ পাইয়ের বিপক্ষে।

ঠিক পাঁচটাতেই ডাইনিংরুমে একটা বড় টেবিলে আমাদের চা পরিবেশন করা হয়েছিল। আমাদের চা পানের ফাঁকেই হাসিখুশি দুটি বাচ্চা লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকল। সিমিংটন দম্পতি বেশ আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচয় দিলেন।

একটু পরেই মেগান এসে ঘরে ঢুকল। ও আমাদের সঙ্গে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে করমর্দন করল। তাকে দেখে মিসেস সিমিংটন বলে উঠলেন, এই তো মেগান এসে গেছে। তোর চা বাচ্চারা আর মিস হল্যাণ্ড নিয়ে নিয়েছে।

-ঠিক আছে, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।

মেগান ঘর ছেড়ে চলে গেল। আজও চোখে পড়ল, সেদিনের মতোই অপরিচ্ছন্ন পোশাক মেগানের গায়ে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কি জানি কেন মিসেস সিমিংটনের দিকে তাকিয়ে আমার মন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। মহিলাকে আমার খুবই নির্দয় আর স্বার্থপর বলে মনে হল।

বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসে যোয়ানা একসময় বলল, মেয়েটার জন্য আমার খুবই দুঃখ হয়। বড় অবহেলিত।

-তুই লক্ষ্য করেছিস তাহলে?

-হ্যাঁ। ওর মা ওকে পছন্দ করে না, বোঝা গেল। ওকে যে পরিবার থেকে আলাদা ভাবা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা মেগানের বুঝতে না পারার কথা নয়। খুবই সবেদনশীল মেয়ে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে খুবই অসুখী–বাইরের হৈচৈ দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।

–ঠিকই বলেছিস, আমারও তাই মনে হয়। বললাম আমি।

পাহাড়ী পথে গাড়ি ছুটে চলেছে। যোয়ানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, একটা ব্যাপার আমার খুব ভাল লাগল দেখে। জীবনীশক্তি ফিরে আসার লক্ষণ তোর মধ্যে ফুটে উঠেছে।

–বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছিস। বললাম আমি।

-নার্সিংহোমে থাকার সময় এক সুন্দরী নার্স তোর সেবা করত। তুই তার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখিসনি। কিন্তু আজ দেখলাম, যতবার গভর্নেস মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিস, ততবারই তার মুখে পুরুষসুলভ খুশির ভাব ফুটে উঠছিল। মেয়েটা দেখতে ভাল, সন্দেহ নেই। তবে তার মধ্যে যৌন আবেদন বলে কিছু নেই। খুবই অদ্ভুত।

–তুই নিজের কথা ভাব, যোয়ানা। বললাম আমি।

–কেন আমি আবার কি করলাম?

করিসনি। তবে যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, পলের কথা ভুলে গিয়ে তোকে ডাঃ ওয়েন গ্রিফিথের দিকেই হাত বাড়াতে হবে। কর্নেল ভদ্রলোকের বয়সটা নেহাই বেশি, নইলে যেভাবে ক্ষুধার্ত ব্লাড হাউণ্ডের মতো তোর দিকে তাকাচ্ছিলেন

তাই করছিলেন বুঝি, হেসে উঠল যোয়ানা, এমিও তার দিকে বন্দুক তাগ করতে চাইবে আমার ধারণা।

ভুলে গেলে চলবে না যোয়ানা, আমরা এখানে এসেছি নিরিবিলিতে অবকাশ যাপন করতে। আমাদের তা বজায় রাখতে হবে।

.

নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ভোগ করার ভাগ্য নিয়ে আমরা যে লিমন্টকে আসিনি দিনে দিনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

সপ্তাহ খানেক পরে আমাদের ছাড়িয়ে দেওয়া কাজের মেয়েটি, বিট্রিসের মা মিসেস বেকার এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।

তাকে আমার চেনার কথা নয়। পারট্রিজই তাকে নিয়ে এল আমার কাছে।

ভদ্রমহিলা বেশি বিনয় প্রকাশ করতে গিয়ে তার বক্তব্য এমন গুলিয়ে ফেলছিলেন যে তার সারোদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল আমার পক্ষে।

যোয়ানা কি কাজে বাইরে গিয়েছিল। তাই আমাকেই সামাল দিতে হচ্ছিল ব্যাপারটা।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মোদ্দা কথাটা বোঝা গেল, মিসেস বেকার আমার পরামর্শ নিতে এসেছেন। তার ধারণা, আমরা লণ্ডনের শিক্ষিত ভদ্রমানুষ, তার মেয়ের ব্যাপারটা কি করা উচিত আমিই ভাল বলতে পারব।

সেই বেনামী চিঠি পাবার পর মেয়েকে তিনিই কাজটা ছাড়ার কথা বলেছিলেন তাই করেছিল সে। এখন আর এক মুশকিলে পড়েছে ব্রিট্রিস।

খামারে কাজ করে, জর্জ নামে একটি ছেলের সঙ্গে বিট্রিসের ভাব আছে। সেই ছেলেটিও ইতিমধ্যে একটি চিঠি পেয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে বিট্রিস নাকি কোন এক ফ্রেড লেডবেটারের ছেলে টমের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে।

চিঠি পাবার পর জর্জ ক্ষেপে আগুন হয়ে গেছে। সে বলেছে বিট্রিস অন্য ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা সে সহ্য করবে না।

বিট্রিস বারবার জর্জকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, চিঠির কথা একেবারে মিথ্যা। তাতে জর্জ আরও ক্ষেপে আগুন হয়েছে। এরপরই নিরুপায় হয়ে মিসেস বেকার আমার কাছে ছুটে এসেছেন।

আমি খুবই দুঃখিত হলাম ঘটনাটা শুনে। মিসেস বেকারকে পরামর্শ দিলাম পুলিসের কাছে। যেতে। পুলিস ছাড়া এসব নোংরা চিঠি লেখা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

–ও বাবা। পুলিসের কাছে যেতে পারব না স্যর। কোনদিন যাইনি আমরা কেউই। বললেন মিসেস বেকার।

পরে তিনি আবার বললেন, খুবই খারাপ ব্যাপার হচ্ছে স্যর এসব। ব্ল বোরের মিঃ আর মিসেস বিডলও এরকম চিঠি পেয়েছেন। খুবই সুখী মানুষ ছিলেন তারা। কিন্তু ওই চিঠি পাবার পর ভদ্রলোক কেমন যেন হয়ে গেছেন।

আমি এই সুযোগে জানতে চাইলাম, এসব ভয়ানক নোংরা চিঠি কে লিখছে এ বিষয়ে তার কোন ধারণা আছে কিনা।

-ধারণা বেশ ভালরকমেই আছে স্যর। বললেন, মিসেস বেকার, মিসেস ক্লিটের কাজ, আমরা সবাই তাই জানি।

সন্দেহ ভাজন মিসেস ক্লিটের পরিচয়ও তার কাছ থেকে জানা গেল। মহিলা একজন মালীর স্ত্রী। কারখানায় যাওয়ার রাস্তাতেই তার বাড়ি।

কি কারণে মিসেস ক্লিটকে সন্দেহ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্য কিছুই জানা গেল না মিসেস বেকারের কাছ থেকে।

তিনি শুধু বললেন, এসব করার মতোই লোক তিনি।

যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আর একবার পুলিসের কাছে যাবার পরামর্শ দিয়ে মিসেস বেকারকে বিদায় করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুবই ভাবনা দেখা দিল আমার। ক্লিট নামের স্ত্রীলোকটির বিষয়ে খবরাখবর নিতে হবে স্থির করলাম। গ্রামের সবাই যখন তাকে দায়ী ভাবছে, কথাটা কতটা সঠিক একবার অনুসন্ধান করা দরকার।

ডাঃ গ্রিফিথ ওই মিসেস ক্লিটকে অবশ্যই চিনতে পারবেন। ঠিক করলাম তার কাছেই জানতে চাইব। তেমন মনে করলে ব্যাপারটা পুলিসের গোচরে আনতে হবে।

আমি যখন ডাঃ গ্রিফিথের সার্জারিতে ঢুকলাম তখন তিনি শেষ রোগীটিকে দেখছেন।

কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি তাকে মিসেস বেকারের সঙ্গে আমার কথাবার্তার বিষয় সংক্ষেপে জানালাম। মিসেস ক্লিট সম্পর্কে গ্রামের সকলের ধারণার কথাও বললাম।

-ব্যাপারটা এত সহজ নয় মিঃ বারটন। ক্লিট নামের স্ত্রী লোকটি ওসব চিঠি চাপাটির পেছনে আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

আমাকে হতাশ করে বললেন গ্রিফিথ।

পরে তিনি জানালেন, মিসেস ক্লিট হলেন স্থানীয় ডাইনী। আজকালকার যুগেও কোন বিশেষ লোক বা বিশেষ পরিবার সম্পর্কে নানা কারণেই মানুষের মনে একটা অন্ধ কুসংস্কার গেঁথে যায়। লোকেরা এমন বিশেষ মানুষ বা পরিবারকে এড়িয়ে চলবারই চেষ্টা করে, তারা ভাবে এদের কোনভাবে অসন্তুষ্ট করলে নিজেদের ক্ষতি হবে।

মিসেস ক্লিট এক অদ্ভুত প্রকৃতির স্ত্রীলোক। গ্রামে কারোর কোন অমঙ্গল বা ক্ষতি হলে তিনি আগ বাড়িয়ে জাহির করেন, কবে তার গাছ থেকে আপেল ছিঁড়েছিল কিংবা তার বেড়ালের লেজ ধরে টেনেছিল, সেজন্যই এমনটি ঘটল। এমনি সব কারণেই সকলে তাকে খানিকটা বিদ্বেষের চোখে দেখে।

আর এসব চিঠির পেছনেও সে আছে, এমনটাও এই কারণ থেকেই সকলে ভাবছে। তবে ব্যাপারটা আমার মোটেও ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে এই চিঠির ঘটনা থেকে শিগগিরই কোন ক্ষতি হতে চলেছে।

.

বাড়ি ফিরে দেখলাম মেগান বারান্দায় বসে আছে। আমাকে দেখে বললো, হ্যাল্লো, আমি কি আজ মধ্যাহ্নভোজে আসতে পারি?

–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আমি বললাম।

আমি ওকে বসতে বলে ভেতরে গিয়ে পারট্রিজকে তিন জনের মতো খাবার তৈরি করতে বলে এলাম।

–সব ঠিক আছে তো? যদি কিছু তৈরি করতে অসুবিধা হয়, আমিও হাত লাগাতে পারি।

–কোন দরকার হবে না। তুমি শান্ত হয়ে বোস, আইরিশ স্টু বানানো হচ্ছে।

–আপনি খুব ভাল।

একটু থেমে পরক্ষণেই আবার বলল, আপনিও কি সকলের মতোই ভাবেন আমি অদ্ভুত রকমের একটা মেয়ে?

-কেন তা ভাবব কেন?

কারণ আমি যে তাই। তবে আমি বোকা নই। ওরা জানে না আমার ভেতরটাও ওদেরই মতো আর আমি ওদের মন থেকে ঘেন্না করি।

–ঘেন্না কর? কিন্তু কেন?

 –আমার জায়গায় থাকলে আপনিও তাই করতেন। আপনি ঘেন্না না করে পারতেন না। মেগানের ভেতরের বঞ্চিত বিষণ্ণ সভা ধীরে ধীরে আমার কাছে প্রকাশিত হয়ে আমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে লাগল।

বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

–জানেন, আমাকে কেউ চায় না। আমি তা বেশ ভালই বুঝতে পারি। মা আমাকে মোটেই পছন্দ করে না। কেন তাও আমি জানি। আমাকে দেখে মার মনে পড়ে যায় বাবার কথা। আমি শুনেছি বাবা মার প্রতি খুব নিষ্ঠুর ব্যবহার করতেন। মুখে তিনি ওসব বলতে পারেন না, কিন্তু আমাকে এভাবে ভুগতে হয়। আমি বুঝতে পারি, মা কেবল চান তার বাচ্চাদের আর সৎ বাবাকে নিয়ে থাকতে।

–তুমি কোথাও গিয়ে নিজের মতো থাকলেই তো পার। বললাম আমি।

–তাহলে তো আমাকে রোজগারের জন্য কোন কাজ করতে হয়। কিন্তু কি করব?

–কেন, শর্টহ্যাণ্ড, টাইপ এমনি কিছু শিখে নিতে তো পার।

 –ওসব আমার ভাল লাগে না। কিন্তু—

কিন্তু কি–

দুটি জলে ভরা চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল মেগান। ধীরে ধীরে বলল, আমি কেন সরে যাব? ওরা কেন আমাকে চাইবে না? আমি ওদের সঙ্গেই থাকব আর ওদের দুঃখ দিয়ে যাব।

একটু পরেই যোয়ানা ফিরল। গায়ের স্কার্ফ খুলে আমার পাশে বসতে বসতে বলল, গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আজ বেশ কয়েক মাইল হাঁটলাম। কি ব্যাপার, মেগানের মুখ অমন থমথমে কেন?

আমি মেগানকে বললাম, তুমি ভেতরে যাও, ওপরের বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নাও।

 মেগান অতিবাধ্য বালিকার মতো উঠে ভেতরে চলে গেল।

-মেগান আজ আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে আসছে। বললাম আমি।

-তাই নাকি, খুব ভাল কথা। তাহলে আমিও ভেতরে যাই–হাতমুখ ধুয়ে আসি।

আমি একা বারান্দায় বসে বেচারী মেগানের কথাই ভাবতে লাগলাম।

.

০৪.

 ভাইকার ডেন ক্যালথ্রপ আর মিসেস ক্যালথুপের কথা এতক্ষণ কিছু বলা হয়নি। অথচ তারা উভয়েই বিশিষ্ট ব্যক্তি।

ডেন ক্যালথ্রপ মানুষ হিসেবে চমৎকার, সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যেই প্রায় ডুবে থাকেন। গির্জার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান।

অন্যদিকে মিসেস ক্যালথ্রপও দৃঢ় চরিত্রের এক অসাধারণ মহিলা। তিনি সাধারণত অন্যের ব্যাপারে নাক গলান না। কিন্তু সব ব্যাপার জেনে নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। গ্রামের সকলেই তাকে কেমন যেন ভয় পায়।

মেগান যেদিন আমাদের এখানে মধ্যাহ্নভোজে আসে তার পরদিন মিসেস ক্যালগ্রুপের সঙ্গে হাই স্ট্রিটে আমার দেখা হয়।

–ওহ মিঃ বারটেন, আপনাকে একটা ব্যাপার জিজ্ঞাসা করবার ছিল। বেনামী-চিঠির কি এক গল্প চালু করেছেন শুনলাম।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি চালু করিনি কিছু, আগে থেকেই ব্যাপারটা ছিল।

-আগে থেকেই ছিল বলছেন? কিন্তু এখানে এসব করবার মতো কেউ আছে বলে তো জানি না।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি। তারপর আকাশেৰ দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কি দেখতে দেখতে বললেন, হাস্যকর সব চিঠি–একেবারেই অবাস্তব।

আমি ইতস্তত করে বললাম, আপনিও কি–ইয়ে–মানে–এরকম চিঠি পেয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, তিনটে চিঠি পেয়েছি। হাস্যকর সব কথা লেখা ছিল–ক্যালের আর স্কুলের শিক্ষিকাকে নিয়ে কিন্তু আমি ভাল রকমই জানি ক্যালেরে ওরকম কাজ করা কোন কালেই সম্ভব নয়। তবে ওরা যা লিখছে–এসব যে গ্রামে কিছু হচ্ছে না তা নয়

-তার মানে আপনি বলছেন ওরা সত্য কথাগুলো জানে?

-হ্যাঁ। এখানে যে ব্যাভিচার বা লজ্জাজনক কিছু ঘটনা তা তো নয়। অনেক ব্যাপারই গোপনে ঘটে চলেছে। আপনার চিঠিতে কি লিখেছিল?

–লেখা ছিল আমি আর যোয়ানা ভাই বোন নই।

–কিন্তু ও তো আপনার বোন

 –হ্যাঁ, যোয়ানা আমার বোন।

–তবে অন্য কিছু থাকা অসম্ভব নয়।

 ঠিক এই সময়ে চোখে পড়ল এমি গ্রিফিত ইন্টারন্যাশনাল স্টোর্সে ঢুকছেন।

মিসেস ক্যালথ্রপও তাকে দেখলেন, অনুকম্পাসূচক মন্তব্য করলেন বেচারি। পরক্ষণে আমার দিকে ফিরে বললেন, কিন্তু এসব ব্যাপার মোটেই ভাল না। একেবারে অন্ধ ঘৃণা…জেনে রাখবেন এ হলো দারুণ ঘৃণার ব্যাপার।

মিসেস ক্যালথ্রপ সেদিন যে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তার প্রমাণ পেতে একদিনও দেরি হল না আমাদের।

বেদনাদায়ক ঘটনাটার কথা পারট্রিজই প্রথমে আমাদের জানাল।

সকালে চায়ের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে ও বলল, ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বিকেলে বেচারি মিসেস সিমিংটন মারা গেছেন?

মারা গেছেন? কি বলছ? যোয়ানা শঙ্কিত কণ্ঠে জানতে চাইল।

–হ্যাঁ। মারা গেছেন। তবে আত্মহত্যা করেছেন। কথাটা সত্যিই, মিস।

–ওহ। যোয়ানা স্তম্ভিত হয়ে গেল, মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেছেন, এতো ভাবাই যায় না।

সেই বিচ্ছিরি চিঠি, পারট্রিজ বলল, কিন্তু যতই জঘন্য হোক এসব, এর জন্য একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করবে? সত্যি কিছু না থাকলে এমন হয় না মিস।

বেশ কিছুদিন আগে ওয়েন গ্রিফিথের বলা কথাটা আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, শিগগিরই এসব নিয়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। দেখছি তাই সত্যি হল।

–মেগান মেয়েটার এখন কি হবে? ওর জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে–একমাত্র অবলম্বন ছিল মা। যোয়ানা বলল।

অন্য বাচ্চাদের তাদের গভর্নেসই সামলে রাখতে পারবে। কিন্তু মেগানের পক্ষে মানিয়ে চলা এখন খুবই কষ্টকর হবে। বললাম আমি।

 প্রাতরাশের পরে আমরা দু ভাইবোন মিলে মিঃ সিমিংটনের বাড়ি গেলাম। সেখানে ডাঃ গ্রিফিথের সঙ্গেও দেখা হল। মিঃ সিমিংটন একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন দেখলাম। মিস হল্যাণ্ড যথাসাধ্য করে বাচ্চাগুলোকে সামলাচ্ছেন।

জানা গেল, গতকাল বিকেলের ডাকে চিঠিটা এসেছিল। অভিযোগ ছিল, তাদের দ্বিতীয় ছেলেটি নাকি সিমিংটনের নয়।

এই চিঠি পেয়েই একেবারে ভেঙ্গে পড়েন মিসেস সিমিংটন। তিনি একটা কাগজে লিখে রেখে গেছেন, এভাবে আর চালাতে পারছি না।

–এসব বিষ মাখানো চিঠি–এবারে ঠিক লক্ষভেদ করেছে। বলল যোয়ানা।

গ্রিফিথ বললেন, উনি অবশ্য কিছুদিন থেকে ভুগছিলেন। আমিই চিকিৎসা করছিলাম। এটা অসম্ভব নয়, এমন একটা চিঠি পাবার পর মানসিক আঘাতটা সামলাতে পারেননি। নিজেকে শেষ করে দেবার পথই বেছে নেন। হয়তো ভেবেছিলেন, স্বামী তার কথা বিশ্বাস নাও করতে পারেন। যে কোন মহিলার পক্ষেই এই ধরনের অভিযোগ খুবই লজ্জার।

ডাঃ গ্রিফিথ বিদায় নিলে আমি আর যোয়ানা মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জবুথবু হয়ে একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। এলসি হল্যাণ্ড প্রায় জোর করে এক কাপ চা তার হাতে ধরিয়ে দিল।

-সকাল থেকে কিছু মুখে দেননি। এভাবে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এই চাটুকু খেয়ে নিন।

–আপনি খুবই দয়ালু মিস হল্যান্ড। আপনি যা করছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

বললেন মিঃ সিমিংটন।

ওসব কথা থাক। আমি আমার কর্তব্য করছি মাত্র। বাচ্চাদের জন্য ভাববেন না, আমি ওদের দেখে রাখছি। চাকর বাকরদের ব্যাপারটাও দেখছি। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। নিজেকে শক্ত করে তুলুন।

এলসি হল্যাণ্ডকে দেখে বেশ ভাল লাগল। খুবই বাস্তবমুখী আর দয়ালু।

মেগানকে পাওয়া গেল ওপরের বসার ঘরে। চোখমুখ দেখে বোঝা গেল, খুব কেঁদেছে। ওকে বললাম, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, আমাদের ওখানে কয়েকদিন থেকে আসবে চল।

মেগান খুশিই হল। ও তার কয়েকটা পোশাক আর টুকিটাকি জিনিস একটা সুটকেসে গুছিয়ে নিল।

যোয়ানা মিঃ সিমিংটন ও মিস হল্যাণ্ডকে কথাটা জানিয়েছিল। তারাও কেউ কোন আপত্তি করলেন না মেগানকে আমাদের বাড়িতে নিতে চাইছি বলে।

এরপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেগানকে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম।

.

০৫.

করোনারের তদন্তের অনুষ্ঠান হলো তিনদিন পরে।

মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর সময় সম্পর্কে জানানো হলো বিকেল তিনটে থেকে চারটের মধ্যে।

ঘটনার দিন তিনি বাড়িতে একাকী ছিলেন। মিঃ সিমিংটন অফিসেই ছিলেন, পরিচারিকা তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল বলে বাইরে গিয়েছিল।

এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল।

আর মেগান যেমন করে থাকে, সাইকেল নিয়ে বাইরে গিয়েছিল।

চিঠিটা এসেছিল সেদিন বিকেলের ডাকেই। মিসেস সিমিংটনই নিশ্চিত চিঠিটা বাক্স থেকে বের করেছিলেন। সেটা পড়ার পরই তার মানসিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

ঘাস আর বোলতার চাকের জন্য বাগানে সায়ানাইড রাখা ছিল। তাই তিনি জলে মিশিয়ে পান করে ফেলেন। তার আগে তিনি একটা কাগজে তাঁর অন্তিম বক্তব্য লিখে রেখে যান-এভাবে আর চলতে পারছি না।

করোনার ভদ্রলোক, খুবই ভদ্র আর বিবেচক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জানালেন, যারা এই ধরনের জঘন্য বেনামী চিঠি লিখে থাকে তাদের নৈতিক চেতনা বলে কিছু থাকে না, তাদের সব কথাই কদর্য মিথ্যায় পূর্ণ।

নৈতিক বিচারে এরা হত্যার অপরাধে অপরাধী। সকলেরই তাদের নিন্দা করা উচিত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, পুলিশ অবিলম্বেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার ও যথাযথ শান্তির ব্যবস্থা করবে। আইন অনুসারে, এই সব সামাজিক অপরাধীদের চরম শাস্তি হওয়া দরকার।

জরিরাও করোনারের বক্তব্য সমর্থন করে তাদের রায় জানালেন–সাময়িক ভাবে মানসিক বিভ্রান্তির পরিণতিতেই আত্মহত্যার-ঘটনা ঘটেছে।

তদন্তের পরদিন সকালে এমি গ্রিফিথ এলেন আমাদের বাড়িতে। আমি একাই ছিলাম। যোয়ানা আর মেগান বাইরে গিয়েছিল।

-সুপ্রভাত মিঃ বার্টন। এমি গ্রিফিথ বললেন, শুনলাম, মেগান হান্টার আপনাদের এখানে এসে আছে?

বললাম, হ্যাঁ, তাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি।

-খুবই ভাল কাজ করেছেন। আমি বলতে এসেছিলাম, ও ইচ্ছে করলে আমাদের কাছেও এসে থাকতে পারে। ওকে আমি কাজকর্মের মধ্যে আটকে রাখতে পারব।

–আপনার অনেক দয়া। ও আমাদের সঙ্গে বেশ ভালই আছে।

কথায় কথায় মিস এলসি তার নিজের বিষয় গার্ল গাইডের প্রসঙ্গে চলে এলেন। মেগান মেয়েটা চূড়ান্ত অলস হয়ে পড়ছে। এতদিনে ওর পক্ষে কোন কাজ নিয়ে থাকা উচিত ছিল। গাইডের কাজও মেয়েদের পক্ষে অনেক ভাল।

আমি হ্যাঁ হু করে কোন রকমে সায়কেটে যেতে লাগলাম।

একসময় মিস এমি গ্রিফিথ বললেন, মিসেস সিমিংটন সম্পর্কে ভাল ধারণা আমার কোন কালেই ছিলনা। আর আসল সত্যটা নিয়ে আমার একবারও সন্দেহ হয়নি।

–আসল সত্য মানে? আমি তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলাম।

–তদন্তের সময় যেসব কথা জানা গেল অর্থাৎ মিঃ সিমিংটন যা বললেন।

–কিন্তু তিনি তো বারবারই বলেছেন বেনামী চিঠির কোন কথাই সত্য নয়।

–তা অবশ্য বলেছিলেন। স্ত্রীর হয়ে সব ভদ্রলোককেই ওরকম বলতে হয়। মিঃ সিমিংটনকে আমি অনেক দিন ধরেই চিনি। অহঙ্কারী আর খুবই চাপা মানুষ। তার পক্ষে ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া অসম্ভব নয়।

–তাহলে তো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে মিসেস সিমিংটন কেন চিঠির বিষয় স্বামীকে জানাতে ভয় পেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ হওয়ায়, মিঃ সিমিংটন তার কোন কথা মেনে নেবে না।

মিস গ্রিফিথ মনে হলো আমার কথা শুনে চটে গেলেন। তিনি বললেন, তাহলে কি আপনি মনে করেন, একটা মিথ্যা অভিযোগের জন্য তিনি সায়ানাইড গিলে মরে গেলেন?

করোনারও তো তাই বললেন। চরম মানসিক আঘাতের ফলেই

-বাজে কথা রাখুন। কোন নির্দোষ মহিলা এরকম মিথ্যা ভরা বেনামী চিঠি পেলে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতো না। আমি হলে তো হেসেই উড়িয়ে দিতাম।

এবারে আমি হেসে বললাম, বুঝতে পেরেছি, আপনিও তাহলে একখানা বেনামী চিঠি পেয়েছিলেন?

এক মিনিট চুপ করে রইলেন এমি গ্রিফিথ। পরে ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে–হ্যাঁ, পেয়েছি। কোন উম্মাদেরই কাণ্ড হবে। দু-চার লাইন পড়ার পরেই বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিই।

–আপনার পুলিসকে ব্যাপারটা জানানো উচিত ছিল।

আমাদের কথাবার্তা খুবই একঘেয়ে হয়ে পড়েছিল। তাই ইচ্ছে করেই মেগানের প্রসঙ্গ তুললাম।

–ভালকথা, মেগানের নিজের খরচপত্র মেটানোর ব্যাপারে কি ব্যবস্থা আছে, আপনার কোন ধারণা আছে?

-বাইরের কারো সাহায্য ওর না হলেও চলবে। যতদূর জানি, ওর ঠাকুমা, মিঃ হান্টারের মা, মেগানকে কিছু মাসোহারা দিয়ে গেছেন। তাছাড়া মিঃ সিমিংটনও নিশ্চয় হাতখরচা বাবদ কিছু ব্যবস্থা করে থাকবেন। তবে ও যেরকম বেয়াড়া, ওর জীবনটা কাজে লাগাতে পারবে বলে সন্দেহ হয়।

আরও দু-চার কথা বলে মিস এমি গ্রিফিথ বিদায় নিলেন। মহিলার ওই পল্লবগ্রাহী স্বভাব আর মেগান সম্পর্কে হতাশার মনোভাব আমার খুবই খারাপ লাগল।

সেই দিনই একটু বেলায় মিঃ সিমিংটনের সঙ্গে আমার দেখা হলো।

আমি নিজেই উপযাচক হয়ে মেগানের কথাটা পাড়লাম।

-ও আমাদের কাছে কদিন থাকুক। নিশ্চয়ই আপনার অসুবিধে হবে না। যোয়ানাও একজন সঙ্গী পেয়ে খুশি হয়েছে।

-মেগান, ও হ্যাঁ হ্যাঁ-আপনারা সত্যিই খুব ভাল।

 মনে হল, মেগানের কথা যেন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, আমি বলতে মনে পড়ল। ভদ্রলোকের প্রতি মনটা আমার বিরূপ হয়ে পড়ল। স্ত্রীর প্রথম স্বামীর সন্তানকে তিনি যে ভাল চোখে দেখেন না, তা বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না আমার।

বললাম, ওর সম্পর্কে কি করবেন বলে ভাবছেন? মেগানকে নিয়ে?

ইয়ে…ও তো বাড়িতেই থাকবে…এ বাড়ি তো ওরও।

.

বিকেলে এলেন মিস এমিলি বার্টন। আমি তখন বাগানে ছিলাম। সেখানেই আমার সঙ্গে কথা বললেন।

দু-এক কথার পরেই বললেন, বেচারা মেয়েটা, মেগানের কথা বলছি, খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল।

–ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? আমি আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলাম। ব্যাপারটা সত্যি বলে মনে করেন?

–কখনোই না। একদম বাজে। মিসেস সিমিংটন এরকম একটা কাজ–না, না, অসম্ভব। তবে এটাকে ঈশ্বরের একটা বিচারই বলতে পারেন।

–ঈশ্বরের বিচার? আমি অবাক হলাম।

-হ্যা! এই যে সব নোংরা চিঠি–তার ফলে মানসিক যন্ত্রণা,-এ সব কিছুরই পেছনে একটা উদ্দেশ্য কাজ করেছে নিশ্চয়।

-কোন হীন উদ্দেশ্য যে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বললাম আমি।

–আপনি আমার কথা ঠিক ধরতে পারেননি মিঃ বার্টন, চিঠিগুলো যে লিখছে, সেই নীচমনা লোকের কথা আমি বলছি না, আমি বলছি, এরকম ঘটনা হয়তো ঈশ্বরের অভিপ্রেত–আমাদের দোষত্রুটির কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য।

–মানুষ নোংরা কাজ নিজের ইচ্ছেতেই করে মিস বার্টন, কিন্তু আশ্চর্য হল, তার এই কাজের দায়ভাগ ঈশ্বরের ওপরে চাপিয়ে দিতেই অভ্যন্ত। এভাবে আমরা নিজেরাই শাস্তির ব্যবস্থা করে রাখি–বুঝতে পারি না। এসবের মধ্যে ঈশ্বরকে টেনে আনার প্রয়োজন করে না।

–আমিও স্বীকার করি মিঃ বার্টন।

 তারপর গলার স্বর খাটো করে এনে বললেন, সবাই বলছে, এসব কাজ করছে মিসেস ক্লিট। তবে আমি এসব বিশ্বাস করি না। আগে এখানে এসব কিছু ছিল না। সুন্দর সুখী একটা গ্রামীণ সমাজ ছিল। এখন এসব দেখে খুবই খারাপ লাগছে।

–আপনি–এধরনের কিছু পাননি?

ওহ না! রক্ষে করুন।

মুখচোখ লাল হয়ে উঠল তার। আমি দ্রুত ক্ষমা চাইলাম।

এরপর বাইরে থেকেই তিনি বিদায় নিলেন। তাকে বেশ চিন্তিতই মনে হল আমার।

বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। ড্রইংরুমে চুল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে যোয়ানা। চোখে পড়ল তার হাতে একখানা খোলা চিঠি।

-জেরি, এসেছিস, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল যোয়ানা, এই চিঠিটা বাক্সে পেলাম, কেউ হাতে করে ফেলে গিয়েছে।

-কি আছে, ওতে? তিক্ত স্বরে বললাম আমি।

–সেই একই নোংরা কথা।

কথা শেষ করে চিঠিখানা আগুনে ছুঁড়ে দিল ও। আমি চকিতে ঝাঁকুনি দিয়ে নুয়ে পড়ে সেটা টেনে নিয়ে এলাম–আগুনে ধরে উঠবার আগেই।

–বোকার মতো কাজ করছিস কেন? এটা আমাদের দরকার হবে। পুলিসকে দিতে হবে।

স্থানীয় থানার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ন্যাস পরদিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। খুবই যোগ্য অফিসার। সামরিক অফিসারের মতো দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা। চিন্তাশীল চোখ। প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে আমার ভাল লাগল।

প্রাথমিক সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর তিনি বললেন, সেই বেনামী চিঠির ব্যাপারে এসেছিলাম। শুনেছি, এরকম একটা চিঠি আপনিও পেয়েছেন।

-হ্যাঁ। এখানে আসার কিছু দিন পরেই।

 –কি লেখা ছিল ওতে?

আমি সংক্ষেপে সেই চিঠির বিষয়বস্তুর কথা খুলে বললাম। ধৈর্য ধরে সবকথা শুনলেন ন্যাস।

–চিঠিটা কি আপনি

–দুঃখিত মিঃ ন্যাস, চিঠিটা সঙ্গে সঙ্গেই নষ্ট করে ফেলি। আসলে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তখন, ভেবেছি, কোন ঈর্ষাপরায়ণ লোক আমাদের এখানে আসা মেনে নিতে না পেরে লিখেছে।

-ওরকম চিঠি আমাদের হাতে পৌঁছন দরকার। বললেন ন্যাস।

–তবে আমার বোন গতকালই একটা চিঠি পেয়েছে। ও পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। আমি দিইনি।

-ধন্যবাদ, মিঃ বার্টন। খুবই বুদ্ধির কাজ হয়েছে এটা।

আমি ড্রয়ার খুলে চিঠিটা বার করে ন্যাসের হাতে দিলাম।

চিঠিটা পড়লেন ন্যাস। মাথা ঝাঁকালেন। তার কপালে বিরক্তির ছাপ পড়ল। চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে চালান করলেন।

–এটা কি আগের চিঠির মতোই আপনার মনে হচ্ছে–মানে খামের সঙ্গে আসল চিঠির তফাৎ।

-হ্যাঁ, এক রকমই তো মনে হচ্ছে আমার। বললাম আমি, খামের ওপরে নাম টাইপ করা আর ছাপা অক্ষর কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে চিঠিটা লেখা হয়েছে–একই রকমে।

–আমরা কয়েকজনকে নিয়ে একটা আলোচনা করতে চাই। কোন অসুবিধা না হলে, আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় আসতে অনুরোধ করব। এতে আমাদের হয়রানি কিছুটা কমবে মনে হয়।

–নিশ্চয়ই আসব, বললাম আমি, আমার অসুবিধার কিছু নেই।

এরপর পুলিসের গাড়িতেই আমরা থানায় রওনা হলাম।

আমি বললাম, এই বেনামী চিঠি-রহস্যের গোড়ায় পৌঁছতে পারবেন বলে আপনি মনে করছেন?

নিশ্চয়ই পারব, বললেন ন্যাস, কিছু সময় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। আসলে দরকার আমাদের কাজের ক্ষেত্রে গণ্ডী ছোট করে আনা।

তার মানে, কিছু বাদ দেবার কথা ভাবছেন?

-হ্যাঁ। তারপর পদ্ধতি মাফিক এগনো। যেমন ডাকবাক্সের ওপর নজর রাখা, হাতের ছাপের পরীক্ষা, টাইপরাইটারের খোঁজ নেওয়া–এইসব।

থানায় পৌঁছে দেখলাম মিঃ সিমিংটন আর ডাঃ গ্রিফিথ আগেই উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল সাধারণ পোশাক পরা ইন্সপেক্টর গ্রেভসকে।

শুনলাম ইনি লণ্ডন থেকে এসেছেন আমাদের এব্যাপারে সাহায্য করতে। বেনামী চিঠির ব্যাপারে ইনি একজন বিশেষজ্ঞ।

ব্লাড হাউণ্ডের মতো গলার স্বর গ্রেভসের। তিনি বললেন, এইসব চিঠির ভাষা, বক্তব্য, প্রায় একই ধারা মেনে চলতে দেখা যায়।

ন্যাস বললেন, বছর দুয়েক আগে একই ধরনের একটা কেস আমাদের হাতে এসেছিল। ইনসপেক্টর গ্রেভস তখন আমাদের সাহায্য করেছিলেন।

কিছু বেনামী চিঠি গ্রেভসের সামনে টেবিলে বিছিয়ে রাখা ছিল। তিনি সেগুলো পরীক্ষা করছিলেন বলে মনে হলো।

ন্যাস বলতে লাগলেন, চিঠিগুলো হাতে পাওয়ার ব্যাপারটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণত এসব পুড়িয়ে ফেলা হয়। অনেকে আবার স্বীকার করতেই চায় না যে কোন চিঠি তারা পেয়েছে। আসলে পুলিসের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার ভয়। এখানকার লোক দেখছি খুবই পিছিয়ে আছে।

-তবু, কাজ শুরু করার মতো কিছু চিঠি আমাদের হাতে এসেছে গ্রেভস বললেন।

আমার চিঠিখানা পকেট থেকে বার করে ন্যাস গ্রেভসকে দিলেন। তিনি সেটা দেখে, অন্য চিঠিগুলোর পাশে রেখে দিলেন।

–খুবই চমৎকার। তারিফ করার মতো করে তিনি বললেন, ভদ্রমহোদয়েরা, এই সুযোগে আপনাদের অনুরোধ করছি, এধরনের চিঠি পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নজরে আনবেন। কেউ পেয়েছে যদি শোনেন, তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদের পরামর্শ দেবেন।

আমি যে চিঠিগুলো হাতে পেয়েছি, তার মধ্যে একখানা রয়েছে–মিঃ সিমিংটন দুমাস আগে পেয়েছিলেন, একখানা পান ডাঃ গ্রিফিথ, একখানা মিস গিনচ, একটা পেয়েছেন মাংসওয়ালার স্ত্রী মিসেস মাজ, একটা পান মিসেস সিমিংটন। শেষ চিঠি যেটা এই মাত্র হাতে এলো সেটা পেয়েছেন মিস বার্টন। ওহহ, আর একটা রয়েছে, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পেয়েছিলেন।

গ্রেভস চিঠিগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলতে লাগলেন বিভিন্ন ধরনের চিঠি হলেও একটার সঙ্গে অন্যটার তফাৎ ধরা কষ্টকর। আগেও আমি এধরনের বহু চিঠি দেখেছি। কিন্তু এসবের মধ্যে কোন নতুনত্বের সন্ধান পাচ্ছি না। সবই কেমন একই ধারায় চলেছে।

–এই সব চিঠির লেখক সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পেরেছেন আপনারা? সিমিংটন বললেন।

গ্রেভস সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। পরে বলতে লাগলেন, কয়েকটা বিষয় আমি আপনাদের কাছে পরিষ্কার করে দিতে চাই।

যেমন ধরুন, এসব চিঠি লেখা হয়েছে কোন ছাপানো বইয়ের অক্ষর কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে।

বেশ পুরনো আমলের বই থেকেই অক্ষরগুলো নেওয়া হয়েছে, ১৮৩০ সালের ছাপা বই হলেও আশ্চর্য হব না।

হাতের লেখা আড়াল করার উদ্দেশ্যেই যে এটা করা হয়েছে, সহজেই বোঝা যায়। তবে আজকালকার যুগে বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় সবই ধরা পড়ে যায়।

খামের ওপরেও বিশেষ কোন লোকের হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। যেসব ছাপ পাওয়া গেছে তা হল, প্রাপক, আর ডাকঘরের কর্মী ও বাড়ির অন্যলোক দু-একজনের। বোঝা যায় লেখক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে ভুল করেনি–দস্তানা ব্যবহার করেছিল।

খামের ওপরে ঠিকানা লেখা হয়েছে উইণ্ডসর-৭ টাইপরাইটার মেসিনে। সেই মেসিনের টি আর এ ছোট অক্ষর দুটো ক্ষয়ে যাওয়া।

বেশিরভাগ চিঠিই হাতে করে চিঠির বাক্সে ফেলা হয়েছে। কিছু স্থানীয় ডাকে ফেলা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এসব চিঠির লেখক একজন স্ত্রীলোক–মধ্যবয়স্কা, সম্ভবত অবিবাহিতা।

-লিমন্টকের মতো জায়গায় টাইপরাইটার মেশিনটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে না বলে মনে হয়। বললাম আমি।

গ্রেভস দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে সুপারিন্টেন্টে ন্যাসের দিকে তাকালনে।

–টাইপরাইটারের ব্যাপারটা খুবই সহজ, বললেন ন্যাস, এটা মিঃ সিমিংটনের অফিসের একটা পুরনো মেসিন। তিনি এটা উইমেনস ইন্সটিউটে দান করেছিলেন। যে কেউই সেটা ব্যবহার করতে পারে।

গ্রেভস বললেন, খামের ওপরের নাম ঠিকানা থেকে এটা আন্দাজ করা যাচ্ছে, এক আঙুলে টাইপ করা হয়েছে।

–তাহলে কি অনভিজ্ঞ কেউ টাইপ করেছে? বললাম আমি।

–তা হয়তো নয়, গ্রেভস বললেন, বরং আমি বলব এমন কেউ টাইপ করেছে, যে জানাতে চায় না টাইপ করতে জানে। এ লাইনের অন্ধিসন্ধি তার জানা আছে।

আর একটা কথা, চিঠিগুলো লিখেছে একজন শিক্ষিতা স্ত্রীলোক। নিশ্চিতভাবেই কোন গ্রাম্য স্ত্রীলোক নয়। এখানে যারা আছে, তারা নেহাতই অশিক্ষিত–বানান করার বিদ্যাটাও অনেকের নেই।

কথাটা একটু অন্যরকম শোনাল আমার কানে। আমি তাই নানা কথা কল্পনা করতে লাগলাম।

 সিমিংটন বললেন, তাহলে তো অনুসন্ধানের গণ্ডি অনেকটাই খাটো হয়ে গেল। যেরকম স্ত্রীলোকের কথা বললেন, ডজনখানেক মানুষই এখানে পাওয়া যেতে পারে।

–কথাটা ঠিকই বলেছেন। বললেন গ্রেভস।

–কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, সিমিংটন বললেন, আমার স্ত্রী যে ধরনের চিঠি পেয়েছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা। সম্পূর্ণ মিথ্যা। যা তার কাছে অত্যন্ত মানসিক আঘাতের কারণ হয়ে উঠেছিল।

আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন স্যর। এইসব চিঠিতে দেখা যাচ্ছে কেবল অন্ধ অভিযোগ–অন্তরঙ্গ কিছু জানার প্রতিফলন পাওয়া গেলে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা বলা যেত। যা পাওয়া যাচ্ছে তা হলো অবদমিত কাম আর ঈর্ষার প্রকাশ। এ থেকেই এসব চিঠির লেখক সম্পর্কে আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারছি।

সিমিংটন অনেকটা উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, আমার স্ত্রীকে খুন করা হয়েছে, তাকে প্রায় ছোরা মারা হয়েছে। চিঠি লিখে যে শয়তান এই জঘন্য কাজ করেছে, আপনারা তাকে ধরতে পারবেন আমি তাই আশা করছি। সে হয়তো ব্যাপারটা উপভোগই করছে-ওহ।

কথা শেষ করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন সিমিংটন।

–সে কি ভাবতে পারে গ্রিফিথ?

সিমিংটনের বলে যাওয়া শেষ কথাটাই আমি জানতে চাইলাম ডাক্তারের কাছে। কেন না, মনস্তত্ব ব্যাপারটা ওরই আওতায় পড়ে।

অনুতপ্ত হওয়া অসম্ভব নয়। নিজের ক্ষমতা দেখে আনন্দও হতে পারে। বিকৃত মনের উম্মাদনা কিছুটা শান্ত হতে পারে। বললেন গ্রিফিথ।

কিন্তু, আমার মনে হয় মিসেস সিমিংটনের মৃত্যু তাকে ভীতই করে থাকবে, সে আবার চেষ্টা করবে বলে মনে হয় না।

–মানুষ জলের জন্য বারবার কুয়োর কাছে যায়, বললেন, ন্যাস, আমাদের কাছে সেটা অত্যন্ত কাজের হবে। মনে রাখবেন সে আবার চেষ্টা করবে। বললেন ন্যাস।

তা যদি হয়, তাকে পাগলই বলব। বললাম আমি।

–একাজ সে না করে পারে না, গ্রেভস বললেন, একধরনের পাপবোধ তাকে দিয়ে এ কাজ করাবে।

–আমাদের আলোচনার শেষে একটা অনুরোধ আপনাদের করছি। দয়া করে চোখ-কান খোলা রাখবেন। বেনামী কোন চিঠি কেউ পেলে তা পুলিসকে জানাবার কথা বুঝিয়ে বলবেন।

এরপর গ্রিফিথের সঙ্গে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় চলতে চলতে বললাম, নিরিবিলি শান্ত সুন্দর জায়গা ভেবে স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে এলাম এখানে, এখন দেখছি ভুলই করেছিলাম চিনতে। এমন বিষাক্ত জায়গা–আপনার কি মনে হয় গ্রিফিথ, ওরা কি কিছু বুঝতে বা জানতে পেরেছে?

-পুলিসের কাজের পদ্ধতি যা তাতে কিছু নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। মনে হয় ওরা সরলভাবে সব বলছে, আসলে ওরা কোন কথাই জানায় না।

–এখানে এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত পাগল কেউ থাকলে আপনারই তো জানা উচিত। আমি বললাম।

মুখে কোন কথা বললেন না গ্রিফিথ। কেবল হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকালেন।

আমরা হাইস্ট্রিট ধরে হাঁটছিলাম। বললাম, যোয়ানকে নিয়ে এখান থেকে সরে পড়তে পারলেই হয়তো ভাল হত। কিন্তু আমি যাব না। শেষ দেখে যেতে চাই।

সামনেই আমার বাড়ির এজেন্টের অফিস। দ্বিতীয় দফায় টাকাটা জমা দেবার জন্য একবার যাওয়া দরকার। গ্রিফিথকে কথাটা জানিয়ে অফিসের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।

একজন স্ত্রীলোক টাইপ করছিলেন। তিনি উঠে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মহিলার মাথার কোঁকড়ানো চুলের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আগে কোথায় যেন দেখেছি। একটু চিন্তা করতেই মনে পড়ে গেল আচমকা। মিঃ সিমিংটনের মহিলা কেরানী ছিলেন, মিসেস গিনচ। কথাটা তাকে বললামও।

–আপনাকে মনে হয় গলব্রেথ আর সিমিংটনের অফিসে দেখেছিলাম।

-হ্যাঁ। আগে ওখানে ছিলাম, বললেন মহিলা, টাকা কিছু কম হলেও এখানে চলে আসাই ভাল মনে হল। টাকাই তো সব নয়।

–নিঃসন্দেহে। বললাম আমি।

–মিঃ সিমিংটন আর আমাকে জড়িয়ে লেখা বিশ্রী একটা চিঠি আমি পাই। কী জঘন্য ভাষায় লেখা! আমি অবশ্য সেটা পুলিসের হাতে দিয়ে এসেছি। নিরূপায় হয়েই কাজটা আমাকে করতে হয়েছে।

–আপনি ঠিক কাজই করেছেন। বললাম।

–জানি লোকে এটা নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু এটা সত্যি বলেই জানবেন মিঃ বার্টন, সিমিংটন আর আমার মধ্যে খারাপ কিছু ছিল না।

অপ্রীতিকর হলেও কথাটা আমাকে এভাবে বলতে হচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবি মানুষের মন কত কদর্যতায় ভরা।

মিসেস গিনচের কথার সুরে অস্বস্তির ভাব থাকলেও আমার কেন যেন মনে হল, তিনি ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছেন। তার এই অস্বস্তির ভাবটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই যেন মনে হল।