১.৩ ইউট্রি লজের বাগানে

১১.

 ল্যান্সলট তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ইউট্রি লজের বাগানে বেড়াচ্ছিলেন।

–এই ইউগাছগুলো বড় ভয়ঙ্কর। এসব গাছ বাগানে রাখা সত্যিই রুচিহীনতার পরিচয়। আমি হলে হলিহক্স লাগাতাম।

কথাটা শুনে ল্যান্স চঞ্চল চোখে ইউগাছের দিকে তাকায়।

-যারা বিষ খাওয়ায় তারা বড় ভয়ানক। এসব লোকের মন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। বললেন প্যাট।

–আমি ঠিক ওরকম ভাবি না, ল্যান্স বললেন, এসব খুবই ঠাণ্ডা মাথার কাজ।

–তিন তিনটে খুন…এমন কাজ উন্মাদ ছাড়া কে করবে?

–আমারও তাই মনে হয় প্যাট। হঠাৎ তীব্রস্বরে বলে উঠে ল্যান্স, তুমি এখান থেকে চলে যাও–অন্য যে কোন জায়গায় চলে যাও, তোমাকে নিয়ে আমার প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা

প্যাট চলতে চলতে শান্ত গলায় বললেন, তুমি বুঝতে পেরেছ, তাই না–এই কাজটা কে করেছে

-না, আমার জানা নেই।

-বুঝতে পারছি, সে কারণেই তুমি আমার জন্য ভয় পাচ্ছ। কথাটা আমাকে জানাবে ভেবেছিলাম।

–আমি সত্যিই কিছু জানি না প্যাট..তবু মনে হয় তুমি এখানে না থাকলেই নিশ্চিন্ত থাকব।

–প্রিয় ল্যান্স, ভালমন্দ যাই ঘটুক, আমি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছি না। আমি এ-ও জানি খারাপটাই ঘটবে।

–তার মানে? তুমি একথা বলছ কেন প্যাট?

–আমার অভিশপ্ত ভাগ্যের কথাই বলছি ল্যান্স, দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্যাট, আমি যার সঙ্গেই থাকি তার ক্ষতি ছাড়া ভাল হয় না।

–প্রিয় প্যাট, তুমি আমার কোন দুর্ভাগ্য বয়ে আনননি। তোমাকে বিয়ে করার পরেই তো বাবা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

কিন্তু কি হল এতে? এখানে এসে চরম দুর্বিপাকের মধ্যে পড়লে। এ আমার ভাগ্যেরই অভিশাপ।

–এ সব তোমার মনের বিকার প্যাট।

–ওকথা বলো না ল্যান্স। আমি সত্যিই অভিশপ্ত।

–না, প্যাট, না। আমার সৌভাগ্য যে তোমাকে বিয়ে করতে পেরেছি। সে কারণেই দুর্ভাবনা তোমাকে নিয়ে। যদি এখানে সত্যিই কোন উন্মাদ থেকে থাকে, আমি চাই না তুমি বিষ মেশানো কিছু পান কর কিংবা গুলির শিকার হও।

একটু থেমে ল্যান্সলট আবার বলতে লাগল, আমি না থাকলে, ওই বৃদ্ধা মহিলা…কি যেন নাম…হ্যাঁ, মিস মারপল…তার কাছাকাছি থেকো। আমি জানি এফি মাসী তাকে কেন এখানে থাকতে বলেছেন।

-ল্যান্স, আমাদের এখানে কতদিন থাকতে হবে?

–এখনো ঠিক জানি না।

–এ বাড়ি এখন তোমার ভাইয়ের। আমার মনে হয় না আমাদের এখানে থাকা তিনি পছন্দ করছেন।

-ও যাই ভাবুক, আপাতত তাকে মেনে নিয়েই আমাদের এখানে থাকতে হবে।

–আমরা কি তাহলে আর পূর্ব আফ্রিকায় ফিরে যাব না?

–তুমি তাই চাও, বুঝতে পারি। আমারও তাই ইচ্ছা, এদেশ একদম ভাল লাগে না আমার।

ল্যান্সের চোখে হঠাৎ শয়তানী ঝিলিক খেলে গেল। একটু ঝুঁকে বলল, আমাদের মতলবের কথা কাউকে বোলো না প্যাট। পার্সিকে আর একটু কড়কে দেওয়া আমার ইচ্ছে।

–কিন্তু তুমি সাবধানে থেকো ল্যান্স। আমার বড় ভয় হয়।

-হ্যাঁ, ভেবো না, প্যাট, আমি সাবধানেই থাকব। পার্সিকে এত সহজে সব কিছু হাতিয়ে নিতে দেয়া যায় না।

.

ড্রইংরুমের সোফায় বসে মিস মারপল মশগুল হয়ে মিসেস পার্সির সঙ্গে গল্প জমিয়েছিলেন। তাঁর উল্টো দিকে আরাম কেদারায় বসে অনর্গল বকবক করে চলেছেন মিসেস পার্সিভাল।

মিস মারপল বুঝতে পারছিলেন, মনের মতো শ্রোতা পেয়ে মনের যত জমানো ক্ষোভ উজাড় করে দিতে চাইছেন মহিলা।

জীবনে অনেক কিছুই ঘটে, কত ভাল কত মন্দ। মাঝে মাঝে মনের কথা কাউকে বলতে না পারলে শান্তি পাওয়া যায় না। অফিসের কাজে সারাটাদিনই আমার স্বামীকে শহরে কাটাতে হয়। বাড়ি যখন ফেরেন, তখন এত ক্লান্ত থাকেন যে কথা বলার আর উৎসাহ তার থাকে না। সারাদিন নিঃসঙ্গই থাকতে হয় আমাকে।

খাওয়া দাওয়া আর আরাম করা–এর মধ্যে আনন্দ কোথায় বলুন। সামাজিক মেলামেশার কোন সুযোগ নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু থামলেন মিসেস পার্সিভাল। পরে বললেন, মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলতে নেই জানি, তবু না বলে পারছি না আমার শ্বশুর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে মোটেই বুদ্ধির পরিচয় দেননি।

আমার শ্বাশুড়ির বয়স ছিল আমারই সমান। ছিলেনও বড় বেশি পুরুষ ঘেঁষা। দুহাতে টাকা খরচ করতেন। শ্বশুর এত হিসেবি মানুষ ছিলেন, কিন্তু স্ত্রীকে বাধা দিতেন না।

এসব দেখে পার্সি বিরক্ত হত। এত অমিতব্যয়িতা একদম পছন্দ নয় ওর। শেষ দিকে শ্বশুর ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। ঝুঁকির কাজে যেন ইচ্ছে করেই জলের মতো টাকা খরচ করতেন।

–হ্যাঁ বুঝতে পারি, আপনার স্বামীর চিন্তায় পড়াই স্বাভাবিক।

গতবছর খুবই দুর্ভোগ গেছে পার্সির। সব দিক সামাল দিতে গিয়ে নিজেও কেমন বদলে গিয়েছিল। প্রায় সময়ই গুম হয়ে থাকতো–ডাকলে সাড়া দিত না।

আমার ননদ ইলেইন, বড় অদ্ভুত মেয়ে। মিশুকে কিন্তু বড় সহানুভূতিহীন।

পরিবারের লোকজনের কথা এভাবে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত কারো কাছে বলছি ভেবে নিশ্চয়ই আপনি অবাক হচ্ছেন। কিন্তু জানেন, প্রচণ্ড মানসিক উদ্বেগে আমি যেন কেমন হয়ে গেছি। কারো সঙ্গে কথা বললে যেন একটু স্বস্তি পাই। আপনাকে দেখে বড় স্নেহপ্রবণ মনে হয়েছে।

–আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।

চোখের কোণে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, কথাটা খারাপ শোনাবে হয়তো, মনে হয় আপনার সদ্য প্রয়াত শ্বশুর খুব ভাল মানুষ ছিলেন না।

-না তা কখনওই ছিলেন না। বললেন জেনিফার, আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি, অনেকেরই সর্বনাশের কারণ হয়েছেন। সন্দেহ হচ্ছে, সেই কারণেই কেউ প্রতিহিংসা নিল কিনা।

প্রশ্নটা করা হয়তো উচিত হচ্ছে না, একটু ইতস্তত করে বললেন মিস মারপল, কে এমন কাজ করতে পারে আন্দাজ করতে পারেন?

কে হতে পারে?

–ওহ, ওই লোকটা আমার বিশ্বাস, ওই ক্রাম্প। খুবই দুর্বিনীত স্বভাব। লোকটাকে কখনোই পছন্দ হয়নি আমার।

–লোকটার উদ্দেশ্য কি থাকতে পারে বলে মনে করেন? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-লোকটা যে রকম বদ, আর এত বেশি মদ খেতো যে কোন দুষ্কর্মের জন্য তার কোন মোটিভ দরকার হয় না। আমার ধারণা মিঃ ফর্টেন্ধু তাকে কখনো বকাঝকা করেছিলেন। তবে কি জানেন, প্রথমে ভেবেছিলাম অ্যাডেলই আমার শ্বশুরকে বিষ খাইয়েছিল। কিন্তু পরে অবাক হয়ে যাই দেখে সেও বিষ খেয়ে মারা গেল।

আপনাকেই বলছি বিশ্বাস করে, অ্যাডেল হয়তো ক্রাম্পকে দোষারোপ করেছিল। আর তাতে ক্ষেপে গিয়ে সে স্যাণ্ডউইচে কিছু মিশিয়ে দেয়। খুব সম্ভব গ্ল্যাডিসের সেটা চোখে পড়ে গিয়েছিল, ক্রাম্প তাই তাকেও খুন করে বসে।

বাড়িটা বড় ভয়ঙ্কর লাগছে আমার; পুলিসরা যদি বাধানিষেধ না রাখতো আমি অন্য কোথাও চলে যেতাম। জানি না, কোন দিন হয়তো পালিয়েই চলে যাব।

–না, এরকম কাজ ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বললেন মিস মারপল। পুলিস ঠিক আপনাকে খুঁজে বার করবে।

–জানি। তবু আমার কেবলই মনে হয় এ বাড়িতে থাকা বড় বিপজ্জনক।

–আপনার পক্ষে বিপজ্জনক মনে করছেন?

–ইয়ে..মানে…হ্যাঁ—তাই।

–তার মানে আপনি কিছু একটা জানেন?

-ওহ, না, চমকে উঠলেন জেনিফার, আমি কিছু জানি না…কি আবার জানব…আমি কেবল…কেমন নার্ভাস হয়ে পড়েছি… ওই ক্রাম্প লোকটা… কথা বলতে বলতে জেনিফার ফর্টেঙ্কু বারবার হাত মুঠো করতে চাইছেন, মিসেস মারপল লক্ষ্য করলেন। তার বুঝতে অসুবিধা হল না, বিশেষ কোন কারণেই জেনিফার অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছেন। অনেক চেষ্টা করেও মনের ভাব তিনি গোপন করতে পারছেন না।

.

১২.

 বাইরে অন্ধকার নামছে। লাইব্রেরীতে জানালার সামনে বসে উল বুনছেন মিস মারপল। প্যাট ফর্টেস্কু ঘরে ঢুকলেন।

বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। আপনাকে দেখে চলে এলাম। চুল্লীর সামনে বসে আপনি সেলাই করছেন দেখে ইংলণ্ডের ঘরোয়া আরামের জীবন বলেই মনে হচ্ছে।

-হ্যাঁ, ইংলণ্ডের মতই। বললেন মিস মারপল। তবে ইউট্টি লজের মতো আর কটা বাড়ি আছে।

–এ বাড়ির কথা আর না বলাই ভাল। টাকাকড়ি কেউ কম খরচ করে না। কিন্তু মনে হয় কোনদিন এ বাড়িতে সুখ ছিল।

–কথাটা আমারো সত্য বলেই মনে হয়।

তবে অ্যাডেল মনে হয় সুখী ছিল, প্যাট বলল, আমি অবশ্য তাকে দেখিনি। জেনিফার যে অসুখী তা বুঝতে পারি। ইলেই তো তার সেই মনের মানুষটিকে নিয়েই ডুবে আছে। ওহ আর মন ধরে রাখতে পারছি না এখানে।

কথা বলতে বলতে মিস মারপলের দিকে তাকাল। পরে বলল, ল্যান্স আমায় কি বলেছে, জানেন? আমি যেন আপনার কাছাকাছি থাকি। তাহলেই নিরাপদে থাকব। তার ধারণা এ বাড়িতে কোন উন্মাদ রয়েছে। কখন কি করে বসবে কেউ বলতে পারে না।

–আপনার অবস্থা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। বললেন মিস মারপল।

 –আপনার স্বামী ফাইটার পাইলট ছিলেন, তাই না?

-হ্যাঁ। চুল্লীর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন প্যাট, আমার বিয়ের মাত্র একমাস পরেই সেই সাংঘাতিক ঘটনাটা ঘটেছিল। পৃথিবীটাকে বড় নিষ্ঠুর মনে হয়, জানেন? আমারও তখন মরার ইচ্ছা হয়েছিল। বড় ভাল ছিল ডন। খুবই হাসিখুশি। দেশের জন্য শেষ পর্যন্ত বীরের মতো প্রাণ দিল।

–আপনার দ্বিতীয় স্বামী?

–ওঃ সে বড় বেদনাদায়ক। বড় সুখী ছিলাম আমরা। কিন্তু বিয়ের দুবছরের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলাম ফ্রেডি সহজ পথে চলে না। তাকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা ছিল না আমার।

না, কেউ কাউকে বদলাতে পারে না। বললেন মিস মারপল।

–সবই বুঝতে পারতাম, দেখতে পেতাম। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। এরপর ফ্রেডি নিজেই একদিন বেসামাল হয়ে গেল। নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করল।

চেনাজানা লোকের কাছে যাতে মুখ দেখাতে না হয়, সেই জন্য আমি ইংলণ্ড ছেড়ে কেনিয়ায় চলে যাই। সেখানেই ল্যান্সের সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

আচমকা মিস মারপলের দিকে মুখ ফেরালেন প্যাট। বললেন, আচ্ছা মিস মারপল, পার্সিভালকে আপনার কি রকম মনে হয়?

ভদ্রলোককে তেমন ভাবে দেখার সুযোগ হয়নি, মনে হয় আমার এখানে থাকাটা তিনি পছন্দ করছেন না।

প্যাট হেসে উঠল। তারপর সামান্য ঝুঁকে বলল, ও বড় নীচ। বিশেষ করে টাকাকড়ির ব্যাপারে। ও নাকি বরাবরই এরকম, ল্যান্স বলে। জেনিফারও একই কথাবলে। সংসার খরচের ব্যাপার নিয়ে মিস ডাভের সঙ্গে তো নিত্য খিটিমিটি লেগে আছে। অথচ মিস ডাভ কত কাজের। আপনারও তাই মনে হয় না।

–হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা।

–আর ওই মিস র‍্যামসবটম। উনি আমাকে বড্ড ভয় ধরিয়ে দেন।

–ভয় ধরিয়ে দেন? কেন?

-কেমন ক্ষ্যাপাটে মনে হয় তাকে। ঘরে বসে সব সময় কেবল মানুষের পাপ নিয়ে ভাবেন। কোনদিন কি করে বসেন

–আপনার সত্যিই এরকম মনে হয়?

-ল্যান্স বলে এ বাড়িতে কোন উম্মাদ আছে। পরিবারেরই কেউ। আমিও তাই ভাবি। বাইরের কেউ কি এভাবে খুন করতে পারে? জানেন, আমার সবসময় ভয় হয়। আবার না কিছু ঘটে–

-না সে ভয় আর নেই বলেই আমার মনে হয়। বললেন মিস মারপল।

নিশ্চিতভাবে কিছু কি বলা যায়?

–মৃত্যুভয় অন্তত এবাড়িতে নেই আমার বিশ্বাস, খুনী লোকটির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে।

–কোন পুরুষ খুনী?

প্যাট চোখ বড় করলেন। যেন অদ্ভুত কিছু শুনছেন।

–পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই হোক, তার আর খুনের উদ্দেশ্য নেই।

–কোন উদ্দেশ্যের কথা বলছেন আপনি?

মিস মারপল মাথা ঝাঁকালেন। ধীরে ধীরে বললেন, সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।

.

১৩.

কনসোলিডেটেড ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টের অফিসে অন্যান্য দিনের মতো যথারীতি কাজ চলছে।

মিস সোমার্স সবার টেবিলে চা দিয়ে গেছেন। এমনি সময় ল্যান্স ফর্টেস্কু অফিসে ঢুকলেন। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চারপাশে তাকিয়ে জরিপ করে নিলেন। দেখলেন সবই প্রায় আগের মতোই রয়েছে।

টাইপিস্টদের ঘরে কর্মব্যস্ততার খটাখট শব্দ উঠছে। অনেক দিন পরে ল্যান্সকে দেখে পুরনো কর্মীদের অনেকেই উদগ্রীব হয়ে তাকাতে চাইছিল।

মিস গ্রিফিথ এগিয়ে এসে ল্যান্সের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।

–আমার ভাই অফিসে আছেন? জানতে চাইলেন ল্যান্স।

–বোধহয় ভেতরের দিকের অফিসে আছেন। সহজভঙ্গিতে বললেন মিস গ্রিফিথ।

ল্যান্স ভেতরের অফিসের সামনে এসে দেখলেন মাঝ বয়সী এক মহিলা ডেস্কে বসে আছেন।

মিস গ্রসভেনর খুব রূপসচেতন তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু সামনের মহিলাকে দেখে তা মনে হল না।

ল্যান্স নিজের পরিচয় দিলেন। জানতে পারলেন, ইনি মিসেস হার্ডক্যাসল। মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুর পার্সোনাল সেক্রেটারি। আগেকার রূপসী সেক্রেটারী মিস গ্রসভেনর গত সপ্তাহে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন।

ল্যান্স একটু গম্ভীর হলেন। বুঝতে পারলেন না পার্সিভাল তার সেক্রেটারি পরিবর্তন করল নিরাপদ থাকার জন্য না খরচ কমাবার জন্য।

ল্যান্স এগিয়ে গিয়ে তার বাবার ব্যক্তিগত কামরার দরজা খুলে ধরলেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, পার্সিভাল কামরায় নেই। ডেস্কের পেছনে তার বদলে বসে আছেন ইনসপেক্টর নীল। একরাশ কাগজ ঘাঁটাঘাটি করছেন। শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন তিনি।

–সুপ্রভাত মিঃ ফর্টেস্কু। আপনি নিশ্চয়ই কাজকর্ম বুঝে নিতে এসেছেন?

–পার্সি তাহলে আপনাকে বলেছে আমি অফিসে ফিরে আসছি?

–হ্যাঁ বলেছেন।

–পার্সি নিশ্চয়ই খুশি হতে পারেনি। ও ভাবছে আমি ওর পিঠেয় ভাগ বসাতে চাইছি। ভয়ও পাচ্ছে, পাছে ব্যবসার টাকা নষ্ট করব বলে।

তবে কি জানেন ইনসপেক্টর, আমি মুক্ত বাতাসের মানুষ অফিসের ধরাবাঁধা জীবন আমার সইবে না। দম বন্ধ হয়ে যাবে। তবে কথাটা দয়া করে পার্সিকে জানাবেন না। ওকে নিয়ে একটু মজা করতে হবে। পুরনো পাওনা মেটাতে হবে।

–আপনার পুরনো পাওনা? কথাটা কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে? নীল বললেন।

–সে পুরনো কাহিনী

–হ্যাঁ, চেক নিয়ে কিছু একটা ঘটেছিল শুনেছি। আপনি কি এর কথাই বলছেন?

–আপনি অনেক কিছুই জানেন ইনসপেক্টর। আমার বাবা আমাকে এই নিয়ে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

নীল এবারে অন্যভাবে কথা শুরু করলেন। আমার মনে হয়, আপনার ভাই আপনার বাবার ছায়াতেই ছিলেন।

-বাইরে থেকে তাই মনে হয়। কিন্তু আমি জানি পার্সি বরাবর নিজের পথেই চলেছে। কেউ সেটা বুঝতে পারেনি।

নীল ডেস্কের কাগজপত্র হাতড়ে একটা চিঠি বার করে এগিয়ে ধরলেন।

-এই চিঠিটা আপনিই লিখেছিলেন, তাই না মিঃ ফর্টেস্কু?

ল্যান্স চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলেন। পরে ফেরত দিলেন।

প্রিয় বাবা,
প্যাটের সঙ্গে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তোমার প্রস্তাবে রাজি হতে আমার আর কোন আপত্তি নেই। এখানে সব গুছিয়ে নিতে নিতে একটু সময় লাগবে। আগামী অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ বা নভেম্বরের গোড়ার দিকে রওনা হতে পারব। সময়টা চিঠিতে জানাব। আশাকরি আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালই হবে। সাধ্যমত আমি সেরকম চেষ্টাই করব। শরীরের দিকে লক্ষ্য রেখো। —
তোমার ল্যান্স

–গত গ্রীষ্মে কেনিয়ায় পৌঁছে লিখেছিলাম। বাবা এটা রেখে দিয়েছিলেন বুঝি? কিন্তু অফিসের কাগজপত্রে কেন?

-না, মিঃ ফর্টেষ্ণু। এটা ইউট্টি লজের কাগজপত্রে পাওয়া গেছে। চিঠিটা আপনি কোন ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেন?

ল্যান্স একটু ভাবতে চেষ্টা করলেন। পরে বললেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে, তিনমাস আগের কথা ততা–চিঠিটা অফিসেই পাঠাই। কিন্তু ইনসপেক্টর, একথা জানতে চাইছেন কেন?

–দেখলাম যে আপনার বাবা এটা এখানে ব্যক্তিগত ফাইলে রাখেন নি। ইউট্রি লজে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সেটা ডেস্কের মধ্যে পেয়েছি। ভাবছি, তিনি এরকম করলেন কেন?

-মনে হয় পার্সির চোখের আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন। হেসে বললেন ল্যান্স।

–তাহলে আপনার বাবার ব্যক্তিগত কাগজপত্র দেখার সুযোগ আপনার ভাইয়ের ছিল, বলছেন?

-না, ঠিক তা বলছি না, ইতস্তত করলেন ল্যান্স, তবে পার্সি বরাবর এ ধরনের কাজ করে এসেছে।

-বুঝতে পারলাম। বললেন নীল।

ঠিক এই সময়েই পার্সিভাল ফর্টেস্কু দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন। ল্যান্সকে দেখে তিনি অবাক হলেন।

–হ্যাল্লো, তুই এসে গেছিস?

–হ্যাঁ, কাজের জন্য তৈরি হয়েই এসেছি। আমার করার কি কাজ আছে দাও।

পার্সিভাল তিক্ত হাসলেন। বললেন, আপাতত কোন কাজ তো দেখছি না। তবে মনে হয় আগে আমাদের ঠিক করে নেওয়া দরকার, ব্যবসার কোন দিকটা দেখা তোর পক্ষে সম্ভব। একটা অফিস কামরাও তোর জন্য ঠিক করতে হবে।

-ভালকথা, মৃদু হাসলেন ল্যান্স, রূপসী মিস গ্রসভেনরকে সরালে কেন? বড় বেশি জেনে ফেলেছিল বলে?

–কি সব আজেবাজে কথা বলছিস, ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন পার্সিভাল। মিস গ্রসভেনরের কাজের ওপর আর আস্থা রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। মিসেস হার্ডক্যাসল খুবই কাজের : তাছাড়া মাইনেও কম।

-মাইনে কম? কিন্তু ওই অজুহাতে, মনে হয়, অফিস কর্মচারীদের বাছাই করে সরিয়ে দেওয়া ঠিক কাজ নয়। তাছাড়া আমাদের এই দুঃসময়ে অফিস কর্মচারীরা যেভাবে সবদিক সামলেছে, তাতে তাদের সকলের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়াই উচিত বলে মনে করি আমি।

–আমি এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। অযথা খরচ করার মতলব সবসময় তোর মাথায় ঘোরে। ব্যবসার যা বর্তমান অবস্থা, এখন খরচ না কমালে সামাল দেওয়া যাবে না।

ইনসপেক্টর নীল সামান্য কাশলেন। তারপর বললেন, মাপ করবেন মিঃ ফর্টেস্কু, এই ব্যাপারেই আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

-হ্যাঁ, বলুন ইনসপেক্টর। বললেন পার্সিভাল।

–যা দেখছি, গত একবছর ধরে আপনার বাবার কাজকর্ম প্রতিষ্ঠানের খুবই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছিল।

–হ্যাঁ। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

–আপনি বারবার ডাক্তার দেখাবার কথা বলেও তাকে রাজি করাতে পারেননি তাই না?

–ঠিক তাই, ইনসপেক্টর। আমার বাবা ব্যবসার প্রচণ্ড ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছিলেন।

-খুবই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা। বললেন নীল। তবে ব্যবসার দিকে থেকে তার মৃত্যু। মঙ্গলজনক হয়েছে বলতে হবে।

পার্সিভাল বললেন, হ্যাঁ, তা হয়েছে, বলা চলে।

–আর একটা কথা মিঃ ফর্টেস্কু, আপনি বলেছিলেন যে আপনার ভাই ইংলণ্ড ছেড়ে যাওয়ার পর তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি–

–অবশ্যই তাই।

–কিন্তু, গত বসন্তকালে আপনি আপনার ভাইকে বাবার কাজকর্ম সম্পর্কে আপনার দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছিলেন। আপনি চাইছিলেন, আপনার ভাই যেন আপনার সঙ্গে যোগ দিয়ে বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাই নয় মিঃ ফর্টেস্কু?

–একরকম–হ্যাঁ, মনে হয় তাই। ভীতস্বরে বললেন। পার্সিভাল।

 নীল এবার ল্যান্সের দিকে তাকালেন।

আপনি চিঠি পেয়েছিলেন।

 ল্যান্স মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

–কি উত্তর দিয়েছিলেন আপনি?

–আমি পার্সিকে লিখেছিলাম, ওসব ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আর বুড়োকে নিজের পথে চলতে দেওয়াই ভাল। কেন না, উনি কি করছেন, ভালই জানেন।

ইনসপেক্টর নীল পার্সিভালের দিকে তাকালেন।

–আপার ভাইয়ের কাছ থেকে ওরকম উত্তর পেয়েছিলেন?

–মনে হয় মোটামুটি তাই ছিল।

-ইনসপেক্টর নীল, একটা ধারণা আপনার পরিষ্কার হওয়া দরকার। ল্যান্স বললেন, সম্ভবত এরকম একটা কারণেই বাবার কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। তারপরই নিজের চোখে সবকিছু দেখার জন্য আমি আসি। বাবার সঙ্গে সামান্যই কথা হয়েছিল আমার। আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। নিজের সবকিছু সামলাবার মতো ক্ষমতা তার ছিল। যাই হোক, কেনিয়ায় ফিরে গিয়ে প্যান্টের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক করি বাড়ি ফিরে আসব আর সব যাতে ঠিক ভাবে চলে দেখব।

কথা শেষ করে ল্যান্স চকিতে পার্সিলের দিকে তাকালেন।

–তোর কথাটা আপত্তিকর। বললেন পার্সিভাল, তুই ইঙ্গিত করতে চাইছিস, আমিই বাবাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলাম।

কিন্তু প্রকৃত সত্য তা নয়-তার স্বাস্থ্যের অবস্থাই আমার দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। আর ভাবনা হয়েছিল  

পার্সিভালকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ল্যান্স বলে উঠলেন, তুমি তোমার পকেটের কথাটাই ভেবেছিলে। ঠিক আছে–

বলে উঠে দাঁড়ালেন ল্যান্স। তার মুখের ভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।

–এখানে থাকতে চাই বলে তোমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। তুমি একা সব লুটেপুটে খাবে তা আর হতে দেব না ভেবেছিলাম। কিন্তু…যাইহোক তোমার সঙ্গে একজায়গায় কাজ করা আমার পোষাবে না। তুমি চিরকালই নোংরা, ধূর্ত। মিথ্যা ছাড়া কিছু বোঝ না।

আর একটা কথাও বলব, অবশ্য প্রমাণ করতে পারব না। তবু বলছি, অতীতে যে চেক জাল করার ঘটনা নিয়ে আমাকে বাড়িছাড়া হতে হয়েছিল, আমার বিশ্বাস সেই জঘন্য কাজটা তুমিই করেছিলে।

তোমার মতো এমন নীচমনা জঘন্য প্রবৃত্তির মানুষকে আমি সহ্য করতে পারি না।

তুমি তোমার সাম্রাজ্য নিয়ে থাক। আমি, যেমন বলেছি, আমার ভাগের যা কিছু নিয়ে প্যাটের সঙ্গে অন্য কোন দেশে চলে যাবো। এদেশে আর নয়।

তোমার ইচ্ছে হলে সিকিউরিটিগুলো বাঁটোয়ারা করতে পার। যেগুলোতে ঝুঁকি নেই এমন সব কিছুই তুমি রাখতে পার, আমি কোন প্রতিবাদ করব না। বাবার যেসব ঝুঁকির লগ্নী ছিল, আমি মনে করি, তার শতকরা দু-তিন ভাগই আমার ভাগ্য ফিরিয়ে দিতে পারে। বাবার বুদ্ধির ওপর আমি আস্থাহীন নই।

ল্যান্সের রুদ্রমূর্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মনে হচ্ছিল বুঝি তিনি এখুনি পার্সিভালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। পার্সিভাল দ্রুত নীলের পেছনে কয়েক পা সরে দাঁড়ালেন।

না, পার্সি তোমার গায়ে হাত দেব না। ল্যান্স বললেন, তুমি যা চাইছিলে, তাই হলো, আমি এখান থেকে চলে যাব। তোমার খুশি হওয়া উচিত।

দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ল্যান্স বললেন, আর একটা কথা বলে যাই, ওই ব্ল্যাকবার্ড খনির ব্যাপারটাও ইচ্ছে হলে আমাকে দিতে পার। এসব খুনখারাবির পেছনে কোন ম্যাকেঞ্জি থাকলে তাদের আমি আফ্রিকায় নিয়ে যাব।

এতবছর বাদে কেউ প্রতিশোধ নিতে এসেছে, এসব আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু সম্ভবত ইনসপেক্টর নীলও ওটাকেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন,

–এ একেবারেই অসম্ভব। বললেন পার্সিভাল।

–অসম্ভব হলে উনি কালোপাখি আর বাবার পকেটের রাই নিয়ে এত খোঁজখবর করছেন কেন? কি বলেন ইনসপেক্টর?

–গত গ্রীষ্মের সেই ব্ল্যাকবার্ড বা কালোপাখির ব্যাপারটাই উনি বলছেন মিঃ ফর্টেস্কু। এ বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নিতে হয়েছে।

-ওসব বাজে ব্যাপার। ম্যাকেঞ্জিদের কথা অনেককাল সবাই ভুলে গেছে। -কিন্তু আমি শপথ করেই বলতে পারি, একজন ম্যাকেঞ্জি আমাদের মধ্যে রয়েছে। ইনসপেক্টরও মনে হয় এরকম সন্দেহই করছেন।