১.২ অ্যাডেল ফর্টেস্কুর চিঠি

০৬.

অ্যাডেল ফর্টেস্কুর চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না মিঃ ডুবয়। দেশলাই ধরিয়ে টুকরোগুলো ছাই করে ফেললেন।

চিঠিটা পাবার পর খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। মেয়েরা এরকম বোকামির কাজই বরাবর করে থাকে। এটা তার অতীতের অভিজ্ঞতা। তাই এবারে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে চাইছেন।

বাড়িতে জানিয়ে রেখেছেন, মিসেস ফর্টেষ্ণু টেলিফোন করলে উনি বাইরে গেছেন যেন জানিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে তিনবার টেলিফোন করেছেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু। তারপর এই চিঠি। চিঠির ব্যাপারটাও বন্ধ করা দরকার। এটা খুবই ঝুঁকির কাজ।

মিসেস ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথা বলার জন্য উঠে গিয়ে টেলিফোন তুললেন মিঃ ডুবয়।

ওপাশ থেকে অ্যাডেলের গলাই শুনতে পেলেন তিনি।

–ভিভিয়ান, শেষ পর্যন্ত এলে?

–হ্যাঁ, অ্যাডেল। কথা বলা দরকার। কাছে ধারে কেউ নেই তো?

–না, আমি লাইব্রেরী থেকে বলছি।

–অ্যাডেল, আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে।

–নিশ্চয়, প্রিয় ভিভিয়ান।

–উঁহু, টেলিফোনে আর প্রিয় বলবে না–এটা নিরাপদ নয়। মনে রেখো তোমরা–এবং আমিও এখন পুলিসের নজরে রয়েছি।

-হ্যাঁ, তা জানি। কিন্তু তুমি একটু বেশি ভয় পাচ্ছ ভিভিয়ান।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ…সাবধান হতে চাই। শোন এখন আমাকে চিঠি টেলিফোন সব বন্ধ রাখো।

–কিন্তু ভিভিয়ান…

–আমাদের সতর্ক থাকতে হবে অ্যাডেল। এটা কেবল সাময়িক ব্যবস্থা

–ঠিক আছে, ওহ

 –আর শোন, অ্যাডেল, আমার লেখা চিঠিগুলো—হ্যাঁ

, বলেছি তো পুড়িয়ে ফেলব।

–শিগগিরই কাজটা করবে। ঠিক আছে, খেয়াল রেখো চিঠি লিখবে না…টেলিফোন করবে ….যথাসময়েই আমার কাছ থেকে খবর পাবে।

রিসিভার নামিয়ে রেখেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না মিঃ ডুবয়। অ্যাডেলকে লেখা তার চিঠিগুলোর জন্য খুবই দুর্ভাবনা হচ্ছে।

সব মেয়ের চরিত্রই একরকম। ব্যক্তিগত চিঠি তারা সহজে নষ্ট করতে চায় না। অথচ নিজেরা চিঠি লিখতে পারলেই বেশি খুশি হয়।

তাঁর লেখা চিঠিগুলোতে কি লিখেছিলেন এই মুহূর্তে ঠিক ঠিক মনে করতে পারছিলেন না তিনি। তবে পুলিশের পক্ষে অসম্ভব নয়, কোন শব্দের কদৰ্থ বার করা। নিরীহ বয়ানের চিঠিও তারা ভয়াবহ করে তুলতে পারে।

ক্রমেই অস্বস্তি বেড়ে চলল। অ্যাডেল যদি চিঠিগুলি পুড়িয়ে না থাকে? যদি সেগুলো পুলিসের হাতে গিয়ে পড়ে? নাঃ অসম্ভব!

মিঃ ডুবয় অস্থির ভাবে উঠে দাঁড়ালেন। ভাবতে চেষ্টা করলেন, অ্যাডেল চিঠিগুলো কোথায় রাখতে পারে?…ওপরের বসার ঘরের ডেস্ক…সেকেলে এই ডেস্কে গোপন ড্রয়ার আছে বলেছিল অ্যাডেল। গোপন ড্রয়ার…পুলিসের চোখ এড়াবার জন্য নিশ্চয় তার মধ্যেই গোপন চিঠিগুলো রাখবে সে…নিশ্চয় তাই।

বিষ কোথা থেকে এলো পুলিস তাই খোঁজ করছে। প্রতিটি ঘর নিশ্চয় এখনো দেখেনি। এখনো সময় আছে…হা…দেরি হবার আগেই কাজটা করে ফেলতে হবে…

পরিকল্পনা ছকতে গিয়ে মনে মনে বাড়ির গঠনটা ভাবতে চেষ্টা করলেন ডুবয়।

বেলা শেষ হয়ে আসছে। একটু পরেই অন্ধকার থেমে আসবে…সেই সুযোগেই সকলের অগোচরে কাজটা হাসিল করতে হবে।

এই সময় চায়ের জন্য সকলেই নিচে থাকবে। হয় লাইব্রেরীতে বা বসার ঘরে। চাকরবাকররাও নিজেদের ঘরে চা পানে ব্যস্ত থাকবে।

এটাই মোক্ষম সুযোগ। দোতলায় কেউ থাকবে না..ইউ ঝোপের মধ্য দিয়ে গেলে সকলের চোখের আড়ালে থাকা যাবে।…বারান্দার শেষে একটা দরজা…ওতে তালা থাকে না…স্বচ্ছন্দে দোতলায় উঠে যাওয়া যাবে।

পরিকল্পনা সতর্কভাবে মনে মনে যাচাই করে নিলেন মিঃ ডুবয়। মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক হলে এসব কিছুই দরকার হত না। কিন্তু এখন বাড়ির চারপাশে বিপদ…তার থেকে নিজেকে দূরে রাখাই নিরাপদ।

.

সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখেই বড় জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়ল মেরী ডাভের। আবছা অন্ধকার নেমেছে বাগানে। কে একজন যেন হঠাৎ ইউ ঝোপের পাশ দিয়ে মিলিয়ে গেল। মূর্তিটিকে পুরুষ বলে চিনতে পারলেন।

চকিতে মিস ডাভের মনে হলো, তবে কি মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেঙ্কু ফিরে এলেন? হয়তো গেটের কাছে গাড়ি রেখে বাগানে ঢুকেছেন। বাড়ি থেকে কেমন অভ্যর্থনা পাবেন সেটাই হয়তো দেখবার ইচ্ছা।

মিস ডাভের ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। তিনি দ্রুতপায়ে নিচে নেমে এলেন।

গ্ল্যাডিস টেলিফোনের কাছে দাঁড়িয়েছিল। মিস ডাভকে দেখে সে কেমন ঘাবড়ে গেল।

–এই মাত্র টেলিফোনের শব্দ শুনলাম গ্ল্যাডিস, কে করল?

–ভুল নম্বর ছিল মিস, লোকটা লন্ড্রী খোঁজ করছিল। তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগল গ্ল্যাডিস, তার আগে মিঃ ডুবয় ফোন করেছিলেন। মাদামের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।

-বুঝেছি। চায়ের সময় হয়ে গেছে অনেকক্ষণ…।

 বলতে বলতে মেরী হলঘরে ঢুকলেন। সেখান থেকে লাইব্রেরীতে এলেন। অ্যাডেল ফর্টেস্কু একটা সোফায় চুল্লীর পাশে বসে আছেন।

মেরীর সাড়া পেয়ে অ্যাডেল বললেন, চা কোথায়?

এখনই আসছে।

চারটেয় চায়ের সময়। এখন সময় পাঁচটা বাজতে কুড়ি। গ্ল্যাডিস তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের সরঞ্জাম গুছাতে শুরু করল।

মিসেস ক্রাম্প একটা গামলায় প্যাস্ট্রি মেশাচ্ছিল। বিরক্তমুখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল মেয়ে, চা কখন নিয়ে যাবে, লাইব্রেরী থেকে ঘন্টা কতক্ষণ ধরে বেজে যাচ্ছে

–এখুনি যাচ্ছি–মিসেস ক্রাম্প।

রান্নাঘরে কেতলিতে চায়ের জল চাপিয়ে পাশের ভাঁড়ার ঘরে ঢুকল গ্ল্যাডিস। কেক, বিস্কুট, প্যাস্ট্রি আর মধু ট্রেতে নিয়ে নিল।

হুড়োহুড়ি করে না মেপেই আন্দাজ মতো কিছু চায়ের পাতা নিয়ে রুপোর পটে ঢেলে দিল। তারপর রান্নাঘরে ফিরে এসে পটে গরম জল ঢেলে নিয়ে লাইব্রেরী ঘরের দিকে ছুটল।

সোফার পাশে টেবিলে চায়ের পট নামিয়ে রেখে, ফের রান্নাঘর থেকে খাবারের ট্রে নিয়ে এল।

মেরী ডাভ যখন লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেই সময় ঘরে ঢুকল ইলেইন ফর্টেস্কু। চুল্লীর পাশে বসে হাত সেঁকতে লাগলেন।

হলঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিলেন মেরী ডাভ। এই সময় তার মনে হল কেউ ওপরে হাঁটছে। বোধহয় জেনিফার ফর্টেস্কু। কেউ অবশ্য নিচে এল না।

মেরী ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেলেন।

.

বাড়ির একপাশে একটা আলাদা সুইটে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন পার্সিভাল ফর্টেস্কু। মেরী এসে বসার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

–চা দেওয়া হয়েছে ।

জেনিফার ফর্টেব্দুর পরণে বাইরে যাওয়ার পোশাক দেখে আশ্চর্য হলেন মেরী। তিনি উটের লোমের কোটটা খুলবার চেষ্টা করছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে মেরী ফের বললেন, আপনি বাইরে গিয়েছিলেন জানতাম না।

-একটু বাগানে গিয়েছিলাম কিন্তু থাকতে পারলাম না, বড্ড ঠাণ্ডা, মিস ডাভ। আগুনের কাছে যেতে হবে।

কোটটা গা থেকে খুলে রেখে জেনিফার মিস ডাভের পেছনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আগে আগে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন।

মেরী হলঘরে এলে, সেই সময়েই সদরে ঘণ্টা বেজে উঠল। এই শব্দটার জন্যই যেন তিনি উৎসুক হয়েছিলেন। ভাবলেন, নিশ্চয় গৃহত্যাগী ছেলেকে দেখতে পাবেন।

দরজা খুলতেই চোখে পড়ল, মুখে স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক।

–মিঃ ল্যান্স ফর্টেস্কু?

–বিলক্ষণ।

মেরী পাশে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, আপনি একা? মালপত্র

হাতের জিপ লাগানো ব্যাগটা দেখিয়ে বললেন ল্যান্স এই আমার সব, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছি।

-আপনার স্ত্রী আসেননি?

–তিনি আপাতত আসছেন না।

বুঝেছি। আসুন আমার সঙ্গে। সকলেই লাইব্রেরী ঘরে আছেন।

সুদর্শন ল্যান্সকে কাছে থেকে দেখলেন মেরী। তারপর তাকে লাইব্রেরীতে পৌঁছে দিলেন।

.

ইলেইন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন ল্যান্সকে। অনেকদিন পরে গৃহত্যাগী ভাইকে দেখে তিনি যেন স্কুলের মেয়ের মতো হয়ে গেলেন।

ল্যান্স অবাক হল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।

–উনি জেনিফার?

 জেনিফার ফর্টেস্কু তাকালেন। তার চোখে আগ্রহের দৃষ্টি। বললেন, ভ্যাল, শহরে কাজে আটকে গেছে। সবই তো ওকে একা সামাল দিতে হচ্ছে। কী যে যাচ্ছে আমাদের ওপর দিয়ে।

সোফায় বসে অ্যাডেল, হাতে একটা কেক, তাকিয়ে দেখছিলেন ল্যান্সকে।

-অ্যাডেলকে তুমি চেনো নিশ্চয়ই, তাই না? বললেন জেনিফার।

–হ্যাঁ…চিনি বইকি। মৃদু হেসে বললেন ল্যান্স, এগিয়ে এসে অ্যাডেলের হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন।

–আমার পাশে সোফায় বসে ল্যান্স। বললেন অ্যাডেল। তারপর এক কাপ চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন।

-তুমি আসাতে খুশি হয়েছি। বাড়িতে আর একজন পুরুষের উপস্থিতির অভাব আমরা বোধ করছিলাম। বাড়িতে পুলিস এসেছিল, জান নিশ্চয়ই। ওরা ভাবছে–

গলা ভারী হয় এলো অ্যাডেলের, মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলেন, বড় ভয়ঙ্কর…

-আমি সবই জানি, সহানুভূতির স্বরে বললেন ল্যান্স, আমার সঙ্গে ওরা লণ্ডন এয়ারপোর্টে দেখা করেছিল।

পুলিস তোমাকে কি বলেছে?

–যা ঘটেছে, সবই বলেছে।

–তাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে, নিশ্চয় এরকম বলেছে? আমাদের মধ্যেই যে কেউ বিষপ্রয়োগ করেছে, একথাই ওরা ভাবছে।

ল্যান্স শুষ্ক হাসি হাসল। তার চোখে শীতল দৃষ্টি।

যাই ভেবে থাকুক, সবই প্রমাণ করার বিষয়। ওরা ওদের কাজ করুক। এনিয়ে আমাদের ভাববার কিছু নেই।…অনেক দিন পরে মনে হচ্ছে সত্যিকার চা মুখে তুললাম–চমৎকার চা।

-তোমার স্ত্রী? তাকে আনলে ভালো হতো।

–প্যাট…প্যাট লণ্ডনেই আছে…অবস্থা বুঝে পরে…আঃ কেক দেখে লোভ হচ্ছে… ল্যান্স একখণ্ড কেক কেটে মুখে তুলল।

–আমাদের এফি মাসি? এখনো বেঁচে আছেন তো? বললেন ল্যান্স।

–ও হ্যাঁ, তিনি ভালই আছেন। তিনি নিচে আসতে চান না বড় একটা…কেমন যেন হয়ে পড়েছেন।

-তার সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। আচ্ছা, আমাকে যিনি ঢুকতে দিলেন সেই গম্ভীরমুখ মহিলাটি কে?

নিশ্চয় মেরী ডাভ হবে। আমাদের বাটলার-ক্রাম্প তো আজ ছুটি নিয়েছে। মেরী আমাদের বাড়ি দেখাশোনা করে। খুবই কাজের মেয়ে।

-ওহ, তাই বুঝি। আমারও মনে হল খুব বুদ্ধিমতী।

 –তাহলে অচল পেনির মতো তুই আবার ফিরে এলি? মিস র‍্যামসবটম বললেন ল্যান্সকে।

–হ্যাঁ, এলাম এফি মাসি। ল্যান্স হাসল।

সময়টা ভালই বেছে নিয়েছিস। বাড়িতে পুলিস, গতকাল তোর বাবা খুন হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে দেখছি, ওরা সব জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোর বউকে এনেছিস?

–প্যাটকে আপাতত লণ্ডনেই রেখে এসেছি।

–বুদ্ধির কাজ করেছিস। এখানে কখন কি ঘটে কেউ বলতে পারে না।

–এসব যা শুনছি, তোমার কোন ধারণা আছে এফি মাসি?

–ঠিক এরকম প্রশ্নই একজন ইনসপেক্টর কাল এখানে এসে আমাকে করেছিল। লোকটার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে মনে হল।

এদিকে কি চলছিল, আমি তো জানি না কিছুই। বাবাকে এই বাড়িতেই বিষপ্রয়োগ করা হয়, পুলিস একথা কেন বলছে?

–পাপের রাজত্ব, বুঝলি।

একটু থেমে মিস র‍্যামসবটম আকাশের দিকে তাকালেন।

 –ব্যাভিচার আর খুন–দুটো এক ব্যাপার নয়। ওর কথা আমি ভাবতে চাই না ল্যান্স।

 –অ্যাডেল, বলছ?

 সতর্ক কণ্ঠে জানতে চাইলেন ল্যান্সলট ফর্টেস্কু।

–আমার মুখ বন্ধ।

 –তুমি আমাকে খুলে বলো তো এফি মাসি। অ্যাডেলের একজন ছেলে বন্ধু আছে, তাই না? তারা দুজনে যোগসাজসে বাবাকে চায়ের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিল, তুমি কি তাই বলতে চাইছ?

–ওসব নিয়ে ঠাট্টা তামাশার ইচ্ছে নেই আমার। তবে মনে হয় ওই মেয়েটা কিছু জানে।

কোন মেয়েটা। ল্যান্স উৎকণ্ঠ হল।

-ওই যে মেয়েটা, ওরা বলছে ছুটি নিয়েছে…আমার চা এনে দেবার কথা ছিল তার। সে যদি ছুটির নাম করে পুলিসের কাছে যায়, আমি অবাক হব না। তোকে দরজা খুলে দিয়েছে কে?

চুপচাপ শান্ত চেহারার একজন। ওরা বলল নাম মেরী ডাব। সেই পুলিসের কাছে গেছে বলছ?

–সে যাবে না। আমি বলছি পার্লারমেইডের কথা। ও কথায় কথায় একবার আমাকে বলে ফেলেছিল, কাউকে সে ঝামেলায় ফেলতে চায় না। আমি তাকে পুলিসের কাছে যেতে বলেছিলাম। সে আজেবাজে বকতে বকতে জানালো, পুলিস তার কথা বিশ্বাস করবে না। পরে ফের বলল, ও কিছুই জানে না। মেয়েটা কেবলই উল্টোপাল্টা বকছে। মনে হয় ভয় পেয়েছে। নিশ্চয় কিছু ও দেখেছিল বা শুনেছিল, কিন্তু গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারছে না।

-তোমার ধারণা ও পুলিসের কাছে যেতে পারে? সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ল্যান্সলট, বলছ–ও কিছু দেখে থাকতে পারে? কিন্তু…।

–জানিস, পার্সিভলের বউ একজন নার্স।

 প্রসঙ্গ পাল্টে একেবারে অন্য প্রসঙ্গ তুললেন হঠাৎ মিস র‍্যামসবটম। ল্যান্সলট বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।

-হাসপাতালের নার্সরা ওষুধ নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত। বললেন, র‍্যামসবটম।

–ওই যে কি নাম ট্যাকসিন…ওটা কি ওযুধে ব্যবহার করা হয়?

মনে হয় ওই জিনিসটা পাওয়া যায় ইউগাছের ফল থেকে। বাচ্চারা ওগুলো খেয়ে অনেক সময় বিপদ ঘটায়।

ল্যান্সের ভুরু উঠে গেল। তীব্র দৃষ্টিতে সে তাকাল এফি মাসির দিকে।

-সত্যি কথা, আমি স্নেহবৎসল। সকলেই তা জানে। কিন্তু তাই বলে আমি বদ কাজ বরদাস্ত করতে পারব না।

.

মেরী ডাভ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মিসেস ক্রাম্পের অভিযোগ শুনছিলেন। প্যাস্ট্রি বেলতে বেলতে বেচারীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল।

–একবার আপনি ভাবুন মিস, বাড়ির কর্তা মারা গেছেন, বহুদিন পরে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন মিস্টার ল্যান্স…তার ওপরে তার সঙ্গে রয়েছে স্ত্রী…অভিজাত ঘরের মেয়ে… নৈশভোজের ব্যবস্থাটা তো আমি নমঃ নমঃ করে অন্যদিনের মতো সারতে পারি না। অত করে বোঝালাম যে আজ ছুটি নেবার দরকার নেই… কে শোনে কার কথা–আমাকে শুনিয়ে গেল, আজ আমার ছুটি…আমি সে ছুটি নিচ্ছি। তা চুলোয় যাক ক্রাম্প…তার তো আর আমার মতো নিজের কাজ নিয়ে গর্ব নেই।…তা এদিকে দেখুন, গ্ল্যাডিসকে বললাম, রাত্তিরে আমার কাজে একটু হাত লাগিও মেয়ে…বলল, ঠিক আছে, আমি আছি। তারপর সেই যে বেরুলো আর দেখা নেই। আজ রাত্তিরে একা আমি কি করে সামাল দেব…তবু ভাগ্য ভাল মিঃ ল্যান্স তার স্ত্রীকে সঙ্গে আনেননি।

-ঠিক আছে, মিসেস ক্রাম্প, আমি আছি। আর মেনুটা একটু সাধারণ করে নিলেই হবে। সান্ত্বনার সুরে বললেন মিস মেরী ডাভ।

–আপনি নিজে টেবিলে থাকবেন বলছেন, মিস?

–গ্ল্যাডিস সময় মতো ফিরে যদি না আসে–

মেরী ডাভকে বাধা দিয়ে মিসেস ক্রাম্প বলে উঠলেন, ও ফিরে আসবে না, আমি জানি। ও গেছে তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। ছোকরার নাম অ্যালবার্ট। সামনের বসন্তে ওরা বিয়ে করবে বলেছে ও আমাকে।

-চিন্তার কি আছে আমিই চালিয়ে নেব-ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।

মেরী ডাভ ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। ঘরে এখনো আলো জ্বালানো হয়নি। অ্যাডেল ফর্টেস্কু তখনো চায়ের ট্রের পেছনে সোফায় বসেছিলেন।

–একি আলো জ্বালানো হয়নি। আলোটা দেব, মিসেস ফর্টেস্কু?

বলতে বলতে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিলেন মেরী ডাভ। পর্দা টেনে দিতে গিয়ে তার চোখ পড়ল অ্যাডেলের মুখের দিকে, থমকে গেলেন তিনি

কুশনের ওপরে কাৎ হয়ে এলিয়ে পড়েছে দেহটা…পাশেই পড়ে রয়েছে আধখাওয়া একটুকরো কেক আর মধু…কাপের চা-ও সম্পূর্ণ খাওয়া হয়নি।…আচমকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু।

.

–সম্ভবত পটাসিয়াম সায়ানাইড, ইনসপেক্টর, চায়ের সঙ্গে ছিল। ডাক্তার বললেন।

–সায়ানাইড? অধৈর্যভাবে বলে উঠলেন নীল। অথচ ওঁকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল।

–হুম তাহলে তো এবারে আপনাকে ছক পাল্টে নিতে হবে।

–হুম।

রেক্স ফর্টেস্কুর কফিতে প্রয়োগ করা হয়েছিল ট্যাকসিন। আর সায়ানাইড দেওয়া হল অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে চায়ের সঙ্গে।…এবারে একেবারে চোখের ওপরে। ব্যাপারটা যে একান্তভাবেই পারিবারিক তা বুঝতে কষ্ট হল না ইনসপেক্টর নীলের।

ওরা চারজন একসঙ্গে লাইব্রেরীতে বসে বিকেলের চা পান করছিলেন। অ্যাডেল ফর্টে, জেনিফার ফর্টেস্কু, মিস ইলেইন ফর্টেস্কু আর বাইরে থেকে নতুন আসা ল্যান্সলট ফর্টেস্কু।

মিস র‍্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ল্যান্স, জেনিফার নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে চিঠি লিখতে বসেছিলেন। সকলের শেষে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে ছিলেন ইলেইন।

ইলেইন জানিয়েছে, যাবার সময়ও অ্যাডেলকে সুস্থ অবস্থায় দেখে গেছেন। শেষ এককাপ চা ঢেলে নিচ্ছিলেন।

ওই শেষকাপই তাঁর জীবনের শেষ চা হল।

এরপর মেরী ডাভ ঘরে ঢুকেছিলেন সম্ভবত কুড়ি মিনিট পরে। তিনিই আবিষ্কার করেন মৃতদেহ।

অজানা ওই বিশ মিনিটের মধ্যেই ঘটে গেছে যা কিছু। মাত্র বিশ মিনিট।

দ্রুত সিদ্ধান্ত স্থির করে নিলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

চুপসে যাওয়া বেলুনের মত বিশাল বপু নিয়ে একটা টেবিলের পাশে বসেছিলেন মিসেস ক্রাম্প।

–সেই মেয়েটি এখনো ফিরে আসেনি? জানতে চাইলেন নীল।

–কে গ্ল্যাডিস? না, আসেনি। এগারোটার আগে ও আসছে না—

চা সেই করে দিয়ে গিয়েছিল বলছেন?

-হ্যাঁ। আমি ওটা ছুঁইনি পর্যন্ত–শপথ করে বলছি। তাছাড়া গ্ল্যাডিস এরকম কাজ করতে পারে আমি তা বিশ্বাস করি না স্যর। মেয়েটা বোকা–তবে ভালো মেয়ে

নীলেরও অবশ্য তাই ধারণা। কেন না চায়ের পটে সায়ানাইড পাওয়া যায়নি।

–ওর কি আজ ছুটি ছিল?

–না, স্যর, আগামীকাল ওর ছুটির দিন।

–ক্রাম্প-সেও কি

মিসেস ক্রাম্প এবার উদ্ধত ভঙ্গীতে ঘাড় ঘোরালেন।

–এসব নোংরামোর মধ্যে ক্রাম্প নেই, তার ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করবেন না স্যর। সে বেরিয়েছে তিনটের সময়–মিঃ পার্সিলের মতোই সে এসবের বাইরে–

আশ্চর্য সমাপতন এই যে সবেমাত্র লণ্ডন থেকে ফিরে এসেই ল্যান্সলট ফর্টেঙ্কু বাড়ির দ্বিতীয় বিয়োগান্ত ঘটনার কথাটা শুনতে পান।

নীল বললেন, আমি সেকথা ভাবছি না মিসেস ক্রাম্প। গ্ল্যাডিসের কথা সে কিছু জানে কিনা তাই আমি জানতে চাইছিলাম।

–আমি ভাল করেই জানি। ভাল জামাকাপড় পরে বেরিয়েছে। নিশ্চয়ই কোন মতলবে বেরিয়ে থাকবে। একবার ফিরে আসুক

নীল রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় অ্যাডেল ফর্টের ঘরে গেলেন।

নিখুঁত সাজানো গোছানো বিলাসবহুল ঘর। একদিকে একটা দরজা; পাশে স্নানঘর। দরজায় পোর্সেলিনের আয়না বসানো। স্নানঘরে একটু দূরে একটা দরজা, ড্রেসিংরুমে যাওয়া যায় সেই দরজা দিয়ে।

নীল চারপাশটা দেখে শয়নঘরের দরজা দিয়ে বসার ঘরে এলেন।

গোলাপী কার্পেটে সাজানো এঘরটা। এঘরে দেখার কিছু ছিল না। কেননা, আগেরদিনই খুঁটিয়ে দেখে গেছেন। ছোট চমৎকার ডেস্কটা তার নজরে পড়েছিল।

সহসা নীলের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। গোলাপী কার্পেটের ওপরে পড়েছিল ছোট একটুকরো মাটি।

এগিয়ে গিয়ে টুকরোটা তুলে নিলেন। মাটি তখনো ভিজে।

সতর্ক চোখে চারপাশ দেখলেন নীল–না, কোন পায়ের ছাপ নেই কোথাও। কেবল এই একটুকরো ভিজা মাটি।

এবারে এলেন গ্ল্যাডিস মার্টিনের শোবার ঘরে। সে অনুপস্থিত। এগারোটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। ক্রাম্প ফিরে এসেছে আধাঘন্টা আগে। কিন্তু গ্ল্যাডিসের পাত্তা নেই।

অগোছালো ঘরে গ্ল্যাডিসের স্বভাবের পরিচয় খুঁজছিলেন। বিছানা যে কখনো সাফ করা হয় না, তা বোঝা যাচ্ছিল। জানলাগুলোও বন্ধ।

গ্ল্যাডিসের ব্যক্তিগত কিছু জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার মধ্যে ছিল সস্তাদরের কিছু গয়না।

আলমারীর দেরাজে চোখে পড়ল কয়েকটা ছবির পোস্টকার্ড; খবরের কাগজের কাটা টুকরো। সেলাইয়ের নকসা, আর সাজসজ্জার, পোশাকের ফ্যাসনের কথা ছিল টুকরোগুলোতে।

ছবির পোস্টকার্ডগুলো নানা জায়গায়। তিনখানা পোস্টকার্ড বেছে নিলেন নীল। এগুলোতে বার্ট নামে কেউ সই করেছিল। মিসেস ক্রাম্প যে তরুণের কথা বলেছেন, সম্ভবত এই সে।

প্রথম পোস্টকার্ডে লেখা, বুকভরা ভালবাসা জানাচ্ছি, তোমারই বার্ট।

 দ্বিতীয় পোস্টকার্ডে–এখানে অনেক সুন্দরী মেয়ে তবে তোমার পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। সেদিনের কথাটা ভুলে যেও না। শিগগিরই দেখা হবে। দারুণ সুখের দিন আসছে আমাদের। ভালবাসা নিও। বার্ট।

তৃতীয় পোস্টকার্ডটা, তাতে কেবল লেখা, ভুলে যেও না, তোমার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। ভালবাসা রইল। বার্ট।

লেখা দেখে বোঝা যায় অনভ্যস্ত হাতে অশিক্ষিত কারও লেখা।

খবরের কাগজের কাটা টুকরোগুলোর নানা জিনিসপত্রের খবরগুলো আগ্রহের সঙ্গে পড়লেন নীল।

পোশাক, রূপচর্চা, রুপোলী পর্দার বিভিন্ন তারকার কথা ছড়িয়ে আছে এগুলোতে। একজায়গায় পাওয়া গেল উড়ন্ত পিরিচ সম্পর্কে কিছু লেখা।

আর একটা অংশে রয়েছে আমেরিকার ডাক্তারদের আবিষ্কার করা ওষুধের কথা, রুশডাক্তারদের আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা।

হতাশ হলেন নীল। এসব জিনিসের মধ্যে গ্ল্যাডিসের হঠাৎ অদৃশ্য হবার কোন সূত্র পাওয়া গেল না। রেক্স ফর্টেস্কুর মৃত্যুর বিষয়ে কোন কিছু গ্ল্যাডিস দেখে থাকবে, এরকম বলা হচ্ছে। কিন্তু সন্দেহ করবার মতো তেমন কোন সূত্রও পাওয়া গেল না কোথাও।

চায়ের ট্রেটা বিকেলে সে লাইব্রেরী থেকে এনে হলঘরে ফেলে গিয়েছিল। রান্নাঘরে ফিরে যায়নি।

গ্ল্যাডিসের এরকম ব্যবহার করার কোন কারণ আন্দাজ করা যায়নি। আচমকাই সে গা-ঢাকা দিয়েছিল। ঘরে এসবের কোন সূত্রই কোথাও পেলেন না নীল।

হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন নীল। তারপর ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

শেষ ধাপে নামতেই সার্জেন্ট হে উত্তেজিত ভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হলেন।

–স্যর, ওকে খুঁজে পেয়েছি স্যর—

কাকে খুঁজে পেয়েছ? সচকিত হলেন নীল।

–স্যর সেই হাউসমেইড…এলেনই ওকে দেখতে পেয়েছে। খিড়কির দরজার পিছনে তার জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া ছিল। সেগুলো তুলে আনা হয়নি, তাই একটা টর্চ নিয়ে এলেন গিয়েছিল সেখানে। মেয়েটার লাশের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল–কেউ তাকে গলা টিপে মেরে রেখে গিয়েছিল। একটা মোজা জড়ানো ছিল মেয়েটার গলায়। আমার মনে হয়, স্যর, অনেকক্ষণ আগে মারা গেছে। তাছাড়া স্যর, অত্যন্ত কদর্য তামাশা করেছে। খুনী–মেয়েটার নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকে রেখেছে

.

০৭.

 ভোরের ট্রেনেই মেরী মিড ছেড়ে রওনা হয়েছিলেন মিস মারপল। তারপর জংশনে ট্রেন বদল করে চক্ররেল ধরে লণ্ডন হয়ে বেডন হীথ স্টেশনে পৌঁছালেন।

ট্রেনে আসতে আসতেই সকালের সংস্করণের তিনটি দৈনিক পড়া শেষ করেছেন। খবরটা সব কাগজেই প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। ইউট্রি লজের তিনটি বিয়োগান্ত ঘটনার বিবরণ।

বেডন হীথ স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে ইউট্রি লজে পৌঁছে সদর দরজায় বেল বাজালেন বৃদ্ধা মহিলাটি।

সাবেকী ধরনের টুইডের কোট আর স্কার্ট তার পরণে, একটা স্কার্ফ আর মাথায় ফেল্টের পালক বসানো টুপি। তার সঙ্গে মালপত্র বলতে একটা ভাল জাতের সুটকেস আর একটা হাতব্যাগ।

-বলুন মাদাম। বাটলার ক্রাম্প দরজা খুলে দাঁড়াল।

–গ্ল্যাডিস মার্টিন নামে যে মেয়েটি মারা গেছে, আমি এসেছি তার সম্পর্কে কথা বলতে।

–ওহো, মাদাম–এই যে

ঠিক সেই মুহূর্তে লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মিসেস ল্যান্স ফর্টেস্কু-কথা শেষ না করে তার দিকে তাকাল ক্রাম্প।

-উনি গ্ল্যাডিসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন মাদাম। বলল ক্রাম্প।

দয়া করে আসুন আমার সঙ্গে মাদাম।

প্যাট মিস মারপলকে সঙ্গে করে লাইব্রেরীতে এসে বসলেন।

–আপনি কি বিশেষ কারু সঙ্গে কথা বলবেন বলে এসেছেন? বললেন প্যাট, আমি আর আমার স্বামী কয়েকদিন হল আফ্রিকা থেকে এসেছি–এব্যাপারে কিছুই প্রায় জানি না

মিস মারপল প্যাট্রিসিয়া ফর্টেস্কুকে লক্ষ্য করছিলেন। তার গাম্ভীর্য আর সরলতায় তিনি মুগ্ধ হলেন। মুখভাবে কেমন অসুখী ভাব।

হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে মিস মারপল বললেন, ওই গ্ল্যাডিস নামের মেয়েটি খুন হওয়ার খবরটা খবরের কাগজে পড়লাম। মেয়েটিকে আমি ভালভাবেই জানি। বলতে গেলে তাকে আমিই বাড়ির কাজকর্ম শিখিয়েছি। তাই দুঃসংবাদটা পড়ে ছুটে না এসে পারলাম না–যদি কিছু করার থাকে।

-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। ওর সম্পর্কে এখানে কেউই বিশেষ কিছু জানে না। আপনি আসাতে ভালই হয়েছে।

–মেয়েটি ছিল অনাথ–একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে। সতেরো বছর বয়সে আমার কাছে এসেছিল। সেন্ট মেরী মিডে অনাথ মেয়েদের শিক্ষাদানের একটা ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে। আমার কাছেই ঘরের কাজকর্ম শিখেছে ও। পরে অবশ্য কাফেতে কাজ নিয়ে চলে আসে।

–আমি মেয়েটিকে কখনো দেখিনি। দেখতে কেমন ছিল বলতে পারব না।

–ওহ একেবারেই দেখতে ভাল ছিল না। বুদ্ধিও একটু ভেঁতা। আর খানিকটা পুরুষঘেঁষাও ছিল। তবে পুরুষরা বিশেষ পাত্তা দিত না ওকে–অন্য মেয়েরাও তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতো।

-আহা বেচারি। প্যাট সহানুভূতি প্রকাশ করল।

–সত্যিই দুর্ভাগ্য মেয়েটির। হয়তো একটু বেশি স্বাধীনতা ভোগ করবে বলে কাফেতে কাজ নিয়েছিল। কিন্তু রেস্তোরাঁর জীবনে সুখকর কিছু ঘটেনি সম্ভবত তাই বাড়ির কাজ বেছে নেয়। এ বাড়িতে ও কতদিন ছিল?

–শুনেছি, মাস দুয়েক এখানে কাজ করেছিল। আর এর মধ্যেই কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল ওর জীবনে। আমার মনে হয় ও কোন কিছু শুনে বা দেখে থাকতে পারে…তারই জের–

–আমাকে সবচেয়ে আঘাত করেছে ওই নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকানো ব্যাপারটা। বড় নিষ্ঠুর কাজ। মনুষ্যত্বের অপমান।

-আপনার কথা বুঝতে পারছি মাদাম। প্যাট বললেন, আপনি বরং ইনসপেক্টর নীলের সঙ্গে কথা বলুন। তিনি এই তদন্তের দায়িত্বে আছেন। তিনি খুবই মানবিক।

.

এক বাড়িতে পরপর তিনটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা…সারা দেশের খবরের কাগজগুলো পুলিসের কাজের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। ফলে খুবই অস্বস্তি দেখা দিয়েছিল পুলিস মহলে।

অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিস কমিশনার অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, প্রথমে স্বামী তারপরে স্ত্রী–দুজনকে পর পর খুন করা কোন বাইরের লোকের কাজ নয়, নীল। আমার মনে হয়, উন্মাদের মত এই খুন যে করেছে, সে বাড়িরই কেউ। মিঃ ফর্টেস্কুর কফিতে ট্যাকসিন মিশিয়ে দিয়েছে কোন সুযোগে। তারপর সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়েছে মিসেস অ্যাডেল ফর্টেস্কুর চায়ের কাপে।

পরিবারের বিশ্বাসভাজন এমন কারোর পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব। তুমি কি ভেবেছ–নীল, বাড়ির লোকেদের মধ্যে কে হতে পারে?

-একটা ব্যাপার, স্যর, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দুটি ঘটনাতেই পার্সিভাল ফর্টেস্কুর নাম অনুপস্থিতের তালিকায় রয়েছে।

হ্যাঁ, তুমি কি বলতে চাইছ, চিন্তিতভাবে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বললেন, সে নিজেকে সরিয়ে রেখে কৌশলে কাজ সমাধা করেছে? কিন্তু কিভাবে তার পক্ষে এটা সম্ভব?

–লোকটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্যর।

-বাড়ির মেয়েদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করছ না তুমি? অথচ সমস্ত ব্যাপারটা পর্যালোচনা করলে, বোঝা যায় এই কাজে মেয়েদের হাত রয়েছে।

ইলেইন ফর্টেঙ্কু আর পার্সিভালের স্ত্রী, এরা দুজনেই প্রাতরাশের সময় উপস্থিত ছিলেন। আবার দেখ, বিকেলে চা পানের সময়েও তারা। এদের দুজনের যে কেউ একজনের পক্ষেই কাজটা করা সম্ভব। ওদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করোনি?

ইনসপেক্টর নীল কোন জবাব দিলেন না। তিনি তখন ভাবছিলেন মিস মেরী ডাভের কথা। তাকে অতিমাত্রায় স্বাভাবিক দেখা গেছে বরাবর।

আর কেমন একটা হালকা খুশির ছোঁয়া রয়েছে কথায় ও কাজে। গোটা ব্যাপারটাই নীলের চিন্তা তাই মিস ডাভের দিকে প্রবাহিত করতে চাইছিল।

আর ওই গ্ল্যাডিস মার্টিন–তার সম্পর্কে নিজেকেই দায়ী ভাবতে চাইছিলেন তিনি।

তার মধ্যে পুলিস সম্পর্কে স্বাভাবিক ভীতি লক্ষ্য করেছিলেন তিনি। এখন তার মনে হচ্ছে ওটা ছিল তার চাপা অপরাধবোধ।

গ্ল্যাডিস নিশ্চয় কিছু দেখেছিল বা শুনেছিল। হয়তো সামান্য কিছু–কিন্তু তার সন্দেহ জেগে উঠেছিল। কিন্তু তা নিয়ে সে মুখ খুলতে চায়নি। এখন আর কিছুই জানা যাবে না তার কাছ থেকে।

.

ইউট্রি লজে প্রথম সাক্ষাতেই বেশ উদারতার সঙ্গে মিস মারপলকে গ্রহণ করলেন মিস ডাভ। বৃদ্ধাকে সৎ আর কর্তব্যনিষ্ঠ বলেই তার মনে হল।

–মেয়েটির সম্পর্কে এখানে কেউই বিশেষ কিছু জানত না। আপনি এখানে আসায় আমাদের কাজের অনেক সুবিধা হল।

-কর্তব্যবোধেই আমাকে আসতে হল ইনসপেক্টর। মেয়েটি আমার বাড়িতেই একসময়ে ছিল। বড্ড বোকা মেয়ে তাই তার জন্য দুঃখবোধ না করে পারছি না।

–গ্ল্যাডিসের জীবনে কি কোন পুরুষের ব্যাপার ছিল?

–আহা বেচারি, একজন পুরুষবন্ধু পাওয়ার জন্য ও বড় ব্যাকুল ছিল। সেজন্যেই সে, আমার ধারণা, রেস্তোরাঁর কাজে চলে এসেছিল। যাই হোক, মনে হয় শেষ পর্যন্ত একজন তরুণকে সে জোগাড় করেছিল।

-আমারও তাই মনে হয়। সম্ভবত তরুণটির নাম অ্যালবার্ট ইভান্স। কোন হলিডে হোমে ওদের পরিচয় হয়েছিল–গ্ল্যাডিস রাঁধুনীকে বলেছিল ছেলেটি নাকি একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার।

-না, এমনটি সম্ভব নয়, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মিস মারপল, ছেলেটি নিশ্চয় ওকে এরকমই বুঝিয়েছিল। সহজেই ও সবকিছু বিশ্বাস করে বসত। আপনি কি ছেলেটিকে এব্যাপারে জড়িত বলে মনে করছেন?

না, ওরকম কিছু মনে হয়নি আমার। যতদূর জেনেছি, ছেলেটি এখানে কখনো আসেনি। সে নানান সামুদ্রিক বন্দর থেকে মাঝেসাঝে একখানা ছবির কার্ড পাঠাতো। মনে হয় কোন জাহাজের নিম্নতম ইঞ্জিনিয়ার গোছের ছিল সে।

–অসুখী মেয়েটির জীবনে এই ছেদ বড় মর্মান্তিক ইনসপেক্টর–আমি ভুলতে পারছি না ওর নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকানো ছিল নিদারুণ নিষ্ঠুরতার কাজ

একটু থেমে আবার বললেন মিস মারপল, যাইহোক, ইনসপেক্টর, আমি আমার সামান্য মেয়েলি শক্তি দিয়ে যদি এই ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে চাই আপনার আপত্তি আছে? এমন নৃশংস একটি খুনের পর আসামী যেন কিছুতেই শাস্তি এড়াতে না পারে।

–আপনার সহযোগিতা আমার কাম্য মিস মারপল।

–এখানে স্টেশনের কাছে একটা গলফ হোটেল রয়েছে দেখলাম, আর মনে হয়, বিদেশী মিশন সম্বন্ধে আগ্রহী একজন বৃদ্ধাও আছেন এই বাড়িতে–মিস র‍্যামসবটম তার নাম।

-হ্যাঁ, সঠিক ক্ষেত্রই বেছে নিয়েছেন আপনি, সচকিত হয়ে বললেন নীল, ওই বৃদ্ধা মহিলার কাছে আমি গিয়েছিলাম–কিন্তু কোন কথা বার করতে পারিনি।

কাজের ক্ষেত্রে আপনার উদারতার পরিচয় পেয়ে আমি খুশি ইনসপেক্টর। খবরের কাগজ পড়ে সঠিক ঘটনা জানা যায় না আজকাল। বড় বেশি ফেনানো-ফাপানো থাকে। মূল বিষয়গুলো যদি জানা যেত

–এখানে যা ঘটেছিল তা এরকম–মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণু তাঁর নিজের অফিসে ট্যাকসিন নামের বিষের ক্রিয়ায় মারা যান। ইউগাছের ফল বা পাতা থেকে বিষ পাওয়া যায় জানেন নিশ্চয়ই।

-হ্যাঁ–খুবই সহজলভ্য। মিসেস ফর্টেস্কুর ঘটনা

-হ্যাঁ, তিনি পরিবারের অনেকের সঙ্গে লাইব্রেরীতে চা পান করছিলেন। তার সৎ মেয়ে মিস ইলেইন সবার শেষে লাইব্রেরী ছেড়ে বেরিয়ে যান। তিনি বলেছেন, মিসেস ফর্টে আর এক কাপ চা পট থেকে ঢালছেন, দেখে গেছেন তিনি।

এর পর প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে বাড়ির হাউসকীপার মিস ডাভ চায়ের ট্রে আনার জন্য লাইব্রেরীতে ঢোকেন। তিনিই মৃত অবস্থায় সোফায় বসে থাকা মিসেস ফর্টেস্কুকে আবিষ্কার করেন। তখনো তার পাশে ছিল অর্ধেকপূর্ণ চায়ের কাপ। চায়ের ওই তলানিতেই পটাসিয়াম সায়ানাইড পাওয়া যায়।

–বিষক্রিয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হয়। ওই মারাত্মক বিষ লোকে বোলতার চাক ভাঙার কাজে ব্যবহার করে।

–ঠিকই বলেছেন। এখানে এক প্যাকেট পাওয়া গেছে বাগানে মালীর ঘরের শেডের মধ্যে ।

-মিসেস ফর্টেস্কু চা ছাড়া আর কিছু খাচ্ছিলেন?

 –হ্যাঁ, সঙ্গে চকোলেট কেক, সুইস রোল ইত্যাদি ছিল।

জ্যাম আর মধুও ছিল সম্ভবত? বললেন মিস মারপল।

–হ্যাঁ, মধু ছিল। পটাসিয়াম সায়ানাইড ছিল চায়ে।

–হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। এবারে তৃতীয় মৃত্যুটার সম্পর্কে বলুন, ইনসপেক্টর।

–এই ঘটনাটিও খুব পরিষ্কার। গ্লাডিস লাইব্রেরীতে চায়ের ট্রে নিয়ে আসে। খাবারের ট্রে সে হলঘরে ফেলে রেখেই চলে যায়। তারপর থেকে মেয়েটিকে আর কেউ দেখেনি।

সারাদিন মেয়েটি একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই রাঁধুনী মিসেস ক্রাম্প অনুমান করেন, সে তার কোন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যাটা কাটাতে গেছে। তার এমন মনে করার কারণ হল মিসেস ক্রাম্প দেখেছিলেন, গ্ল্যাডিস সুন্দর একজোড়া নাইলন মোজা আর সবচেয়ে দামী জুতো পরেছিল।

অবশ্য মিসেস ক্রাম্পের অনুমান ঠিক হয়নি। মেয়েটির হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, বাইরে জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া ছিল, তুলে আনা হয়নি। সে খাবারের ট্রে হলঘরে ফেলে রেখে ছুটে যায় দেয়ালের কাছে–অর্ধেক জামাকাপড়ও তুলেছিল–ঠিক সেই সময়েই কেউ লুকিয়ে তার গলায় মোজা জড়িয়ে টানে। গ্ল্যাডিসের ঘটনা এই।

-বাইরে থেকে কেউ এসেছিল মনে হয়?

–অসম্ভব কিছু নয়, ভেতরের কেউ হতে পারে। পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই হোক, ওকে পাওয়ার জন্যই অলক্ষিতে অপেক্ষা করছিল।

যখন আমরা মেয়েটিকে জেরা করি, খুবই নার্ভাস মনে হয়েছিল তাকে। তার মধ্যে কোন গোপন উদ্বেগ বা অপরাধবোধ ছিল–আমরা সেটা ধরতে পারিনি।

–পুলিসের জেরায় বেশির ভাগ মানুষই ভীত বিব্রত হয়ে পড়ে–স্বাভাবিক ভাবেই।

–এক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মিস মারপল। আমার ধারণা গ্ল্যাডিস এমন কাউকে কিছু একটা করতে দেখেছিল, যার গুরুত্ব সে বুঝতে পারেনি। তেমন মনে হলে সে অবশ্যই জানাত আমাদের। আমার মনে হয়, সেই অজ্ঞাত আততায়ী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেয়েটিকে বিপজ্জনক মনে করেছিল।

-কিন্তু কেবল এই কারণে তাকে খুন করে নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকে দিয়েছিল? সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন মিস মারপল।

-ওটা একটা হীন বীরত্ব দেখানো ছাড়া কি হতে পারে?

–না, ইনসপেক্টর–এটাকে অকারণ মনে করতে পারছি না। এর মধ্যে একটা ছক ধরা পড়ছে।

–ছক? অবাক হলেন ইনসপেক্টর। তিনি ইঙ্গিতটা ধরতে পারছিলেন না।

–হ্যাঁ, ঘটনাটাকে আমার একটা নির্দিষ্ট ছকের পরম্পরা বলেই মনে হয়।

–ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিস মারপল।

–দৃশ্যপটটা কল্পনায় আনার চেষ্টা করুন। মিঃ ফর্টেস্কু–কোথায় খুন হলেন? না, তার অফিসে। তারপরেই মিসেস ফর্টেস্কু–লাইব্রেরীতে বসে চা পানরত অবস্থায়। চায়ের সঙ্গে খাবার ছিল কেক আর মধু।

এরপর হতভাগ্য গ্ল্যাডিস, তাকে পাওয়া গেল নাকে কাপড়ের ক্লিপ লাগানো অবস্থায়।

পর পর ঘটনাগুলো খুবই অর্থবহ মনে হচ্ছে আমার কাছে। নির্দিষ্ট একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। আমি।

–কিন্তু, আমি তো

বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন ইনসপেক্টর নীল।

–ছেলেবেলায় মাদার গুজ ছড়াটা নিশ্চয় পড়া ছিল আপনার ইনসপেক্টর নীল? ছড়ার কথাগুলো মনে করলে একটা পরিচিত চিত্র পাবেন আপনি।

–আপনি খুলে বলুন দয়া করে, মিস মারপল।

–আপনি আশ্চর্য মানুষ–চমৎকার সরলতা। আমি আপনাকে মনে করাবার চেষ্টা করছি। ব্ল্যাকবার্ডস বা কালো পাখির কথা।

নিদারুণ এক হেঁয়ালির গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। বৃদ্ধা মহিলাটির মাথায় গোলমাল আছে এমন কথা ভাবা ঠিক হবে কিনা কেবল এই কথাই তিনি ভাবতে লাগলেন।

–ব্ল্যাকবার্ডস-ব্ল্যাকবার্ডস

অনেক পরে বিহ্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন নীল।

–হ্যাঁ, মিস মারপল বললেন, ছড়ার কথাগুলো ছিল…

গান তোক ছয় পেনি একমুঠো রাই
কালোপাখি চার ও কুড়ি ভাজা হল পাই
খোলা হলো পাই যেই গায় গান পাখি
রাজার জবর খানা কেউ বলে নাকি?
মোহর গোণেন রাজা রাজকোষে বসি
মধু খান মহারানি দিনভর খুশি।
তার দাসী শাড়ি মেলে বাগানের ফাঁকে
উড়ে এসে পাখি এক ঠোকরালো নাকে।

–যাব্বাবা। ইনসপেক্টর নীল যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

–অবাক হবার কিছু নেই মনে হয়; বললেন মিস মারপল। মিলটা বড় অদ্ভুত। দেখুন, রাই পাওয়া গেল মিঃ ফর্টের পকেটে। নানান কাগজে অবশ্য নানান ধরনের শস্যদানার কথা। বলেছে। তবে ছিল ভুট্টার দানাটানা নয়, রাই, তাই না?

হ্যাঁ, মাদাম।

–তাহলে মিলিয়ে নিন, তাঁর নামের প্রথম শব্দটা হল রেক্স–মানে হল, রাজা। তিনি তার কর্মক্ষেত্রে খাসকামরায় ছিলেন–বলা চলে কোষাগারে ছিলেন।

ওদিকে মিসেস ফর্টেন্ডু অর্থাৎ রানি লাইব্রেরীতে কেক মধু খাচ্ছিলেন। খুনীকে তাই পার্লারমেইড গ্ল্যাডিসের নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকাতেই হল।

–আপনার ওই উদ্ভট ছড়ার সঙ্গে যখন এভাবে মিলে যাচ্ছে তাহলে তো মানতে হয় সব কিছুই অর্থহীন–অকারণ–

-ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে ওই কালোপাখি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।

আমার বিশ্বাস কালোপাখির একটা যোগাযোগ এর মধ্যে কোথাও না কোথাও ঠিক পাওয়া যাবে। কাজেই ব্ল্যাকবার্ডস বা কালোপাখির কথাটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।

স্যর, স্যর ।

ঠিক সেই মুহূর্তে সার্জেন্ট হে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। কিছু বলার জন্যই সে এসেছিল। কিন্তু মিস মারপলকে লক্ষ করে থেমে গেল।

–আমি মনে রাখব মিস মারপল, অবস্থাটা সামাল দিতে চেষ্টা করলেন নীল আপনি যখন এভাবে বলছেন। আপনিও ওই মেয়েটির বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে থাকুন।

 ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে মিস মারপল ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

-বুঝলে কালোপাখি—ব্ল্যাকবার্ডস

 সার্জেন্ট হে-র দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে আওড়ালেন নীল।

–আঁ স্যর—

না..কিছু না..কি বলতে চাইছিলে তুমি?

রুমালে জড়ানো হাতের জিনিসটা এগিয়ে ধরে হে বলল, এই জিনিসটা স্যর…ঝোপের মধ্যে পড়েছিল। মনে হল পেছনের জানালা দিয়ে কেউ ছুঁড়ে ফেলেছিল।

রুমাল থেকে বের করে টেবিলের ওপরে জিনিসটা রাখতেই নীল চমকে উঠলেন। একটা মারমালেডের কৌটো-সামান্য একটু-মাত্ৰ ওপর থেকে খরচ করা হয়েছে।

কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে নীল কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে রইলেন। তাঁর মন সেই মুহূর্তে একটা দৃশ্য কল্পনা করবার চেষ্টা করছিল।

নতুন এক কৌটো মারমালেড–ওপর থেকে খানিকটা তুলে নেওয়া…মারমালেডে ট্যাকসিন মিশিয়ে সকলের অজ্ঞাতেই আসল কাজটা তাহলে সেরে রাখা হয়েছিল…পরে কৌটোর ঢাকনা বন্ধ করে–

–স্যর, সার্জেন্ট হে বলল, সেদিন প্রাতরাশে মিঃ ফর্টেঙ্কু শুধু মারমালেড নিয়েছিলেন, অন্যরা নিয়েছিলেন জ্যাম আর মধু

সম্বিত ফিরে পেলেন নীল। বললেন, ব্যাপারটা দেখছি খুবই সহজ হয়েছিল–কফির কাপে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার চাইতে এই কাজটা অনেক কম ঝুঁকির ছিল। মিঃ ফর্টেস্তু নিজের হাতেই কৌটো খুলে ওপর থেকে এক চামচ মারমালেড তুলে টোস্টের ওপর লাগিয়ে নিয়েছিলেন। বিষপ্রয়োগের খুবই নির্ভুল উপায়

–হ্যাঁ স্যর।

সার্জেন্ট হে-ও কল্পনায় দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছিল। উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল ইনসপেক্টর নীলের দিকে।

তার মানে, কোন অদৃশ্য হাত কৌটো খুলে সমান মাপে খানিকটা মারমালেড সরিয়ে নিয়ে আবার ঢাকনা এঁটে যথাস্থানে সেটা রেখে দিয়েছিল। তারপর…তারপর আগের মারমালেডের কৌটোটা, যেটায় ট্যাকসিন মেশানো ছিল সেটা জানালা গলিয়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। হা…কিন্তু ওই অদৃশ্য হাতের মালিকটি কে হতে পারে…বুঝেছ হে, এই কৌটোর মধ্যে ট্যাকসিন পাওয়া গেলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

-ঠিক স্যর। আঙুলের ছাপও পাওয়া সম্ভব।

-না হে, সেই অদৃশ্য হাত এমন অসতর্ক কাজটা নিশ্চয়ই করবে না। এতে যদি আঙুলের ছাপ থেকে থাকে…সে হয়তো মিঃ ফর্টেস্কু…কিংবা ক্রাম্প বা গ্ল্যাডিসের। যাই হোক, পরীক্ষার পরেই সব পরিষ্কার বোঝা যাবে।

আচ্ছা, এ বাড়িতে মারমালেড কিভাবে আনা হয়, কোথায় রাখা হয় এসব খবর নিয়েছ?

–হ্যাঁ স্যর। জ্যাম আর মারমালেড ছখানা করে কৌটো একসঙ্গে আনা হয়। পুরনো কৌটো শেষ হয়ে এলে নতুন কৌটো রান্নাঘরে পাঠানো হয়।

-তাহলে ঠিকই অনুমান করেছি, বললেন নীল, বাড়ির কোন লোক অথবা এখানে যাতায়াত আছে এমন কেউই কারচুপির কাজটা করে রেখেছিল। তারপর প্রাতরাশের টেবিলে ঠিক হিসেব মতোই….

নীল সহসা নিজের কথায় নিজেই সজাগ হয়ে উঠলেন। তিনি ভাবলেন, মারমালেডে বিষ মেশানোর কাজটা যদি আগেই হয়ে থাকে তাহলে একটা বিষয় একদিক থেকে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, ওই দিন প্রাতরাশের টেবিলে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা কেউই দায়ী নন।

একটা গুরুত্বপূর্ণ নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত যেন পেলেন নীল। সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে নতুনভাবে পর্যালোচনা করার কথা তার মনে হল।

মিস মারপলের ছেলেভুলানো ছড়ার সেই ব্ল্যাকবার্ডস-এর কথাটাও এই সঙ্গে মনে পড়ে গেল তার। ছড়ার কথার সঙ্গে ঘটনার পরম্পরা অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছে–কাজেই উপেক্ষা করা যায় না সেই পাই আর ব্ল্যাকবার্ডস।

-ও. কে, হে, তুমি তোমার কাজে যাও।

.

দোতলার একটা শোবার ঘরে এলেন বিছানা গোছাচ্ছিল। মিস মেরী ডাভ তদারক করছিলেন। ইনসপেক্টর তার খোঁজে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

এলেন বিছানায় নতুন চাদর পাতছিল। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নীল জানতে চাইলেন, কোন অতিথি আসছেন মনে হচ্ছে?

মেরী স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, মিঃ জেরাল্ড রাইটের আসবার কথা ছিল। কিন্তু তার আসা নাকচ হয়ে গেছে

–জেরাল্ড রাইট? উনি কে?

 সামান্য হাসলেন মেরী। কিন্তু সংযতকণ্ঠে বললেন, মিস ইলেইন ফর্টেস্কুর একজন বন্ধু।

-এখানে তার কখন আসার কথা ছিল?

–আমি শুনেছি তিনি গলফ হোটেলে উঠেছিলেন-মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুর পরের দিন। মিস ইলেইন তার জন্য ঘরটা তৈরি রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু পর পর মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ায় মিঃ রাইট হোটেলেই থেকে যাওয়া স্থির করেন।

–গলফ হোটেলে বললেন?

–হ্যাঁ।

চাদর আর তোয়ালে গুছিয়ে নিয়ে এলেন ঘর ছেড়ে চলে গেল। মেরী ডাভ ইনসপেক্টরকে বললেন, আপনি কি কোন কারণে আমাকে খুঁজছিলেন?

-হ্যাঁ। আসলে সময়ের ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে নিতে চাইছিলাম আপনার কাছ থেকে।

-হ্যাঁ, বলুন, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন মেরী ডাভ।

–আমার জানার বিষয় সময় আর স্থান নিয়ে। চা পানের আগে আপনি শেষবার গ্ল্যাডিসকে দেখেছিলেন হলঘরে, তাই না?

-হ্যাঁ, আমি ওকে চা আনার কথা বলেছিলাম।

–তখন সময় পাঁচটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি

–হ্যাঁ, তাই হবে।

–আপনি কোথা থেকে আসছিলেন?

–ওপর থেকে নিচে একটা টেলিফোনের আওয়াজ শুনেছিলাম

–টেলিফোন ধরেছিল কি গ্ল্যাডিস?

–হ্যাঁ। রঙ নাম্বার ছিল। কে লন্ড্রীর খোঁজ করছিল।

–সেই শেষবার আপনি তাকে দেখেছিলেন?

–এর মিনিট দশ-পনেরো পরেই ও চায়ের ট্রে লাইব্রেরীতে নিয়ে এসেছিল।

–মিস ফর্টেঙ্কু কি সেই সময়েই ঢোকেন?

–দু-তিন মিনিট পরেই। আমি তখন মিসেস পার্সিভালকে চায়ের কথা জানাতে যাই।

–আপনি বলেছিলেন, ওপরে কারও পায়ের শব্দ শুনেছিলেন

-হ্যাঁ। মনে হয়েছিল মিসেস পার্সিভাল আসছেন–কিন্তু কেউ নিচে নেমে না আসায় আমি উঠে যাই।

-মিসেস পার্সিভাল কোথায় ছিলেন?

তিনি তাঁর শোবার ঘরে ছিলেন। সবে এসেছিলেন, বাগানে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলেন।

-হাঁটতে বেরিয়েছিলেন? তখন সময় কত?

সময়…মনে হয় পাঁচটা।

–মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেস্কু কখন আসেন?

মিসেস পার্সিভালকে চা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে নিচে নেমে আসি। তার কয়েক মিনিট পরেই। আমার ধারণা হয়েছিল, তিনি আগেই এসেছিলেন কিন্তু

–তিনি আগে এসেছিলেন এরকম ধারণা হয়েছিল কেন আপনার?

-কারণ…টেলিফোনের শব্দ পেয়ে নিচে নামার সময় সিঁড়ির জানালা দিয়ে তাকে যেন চোখ পড়ল।

–বাগানে তাকে দেখেছেন বলে মনে হয়েছে?

–হ্যাঁ। ইউ ঝোপের আড়ালে কাউকে যেন একঝলক চোখে পড়ল–তাই মনে হয়েছিল তিনিই হবেন।

বাগানে কাউকে দেখেছেন, এবিষয়ে আপনি নিশ্চিত মিস ডাভ? চিন্তিতভাবে বললেন, নীল।

আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ইনসপেক্টর। এই কারণেই দরজায় বেল বাজাতে তাকে দেখে অবাক হয়ে যাই।

ইনসপেক্টর নীল ধীর সংযতকণ্ঠে বললেন, না মিস ডাভ, বাগানে আপনি কোনমতেই মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেস্কুকে দেখে থাকতে পারেন না। তার ট্রেন বেডন হীথ স্টেশনে পৌচেছিল চারটে সাঁইত্রিশ মিনিটে–নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট দেরিতে। ট্রেনে খুবই ভিড় ছিল। সেসব সামলে ট্যাক্সি ধরা-কয়েক মিনিট অন্তত দেরি হয়ে থাকে, স্টেশন থেকে বেরুতে বেরুতে পৌনে পাঁচটা হয়ে যাবার কথা।

ট্যাক্সি খুব তাড়াতাড়িও যদি এসে থাকে–তিনি যখন ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছেন, তখন সম্ভবতঃ পাঁচটা কি পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। না…আপনি যাকে বাগানে দেখেন তিনি মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেন্ধু হতে পারেন না।

–তবে আমি যে কাউকে দেখেছি, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মাথা ঝাঁকালেন ইনসপেক্টর নীল। ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, আপনি দেখেছিলেন কাউকে। তবে আবছা অন্ধকারে লোকটাকে নিশ্চয় স্পষ্টভাবে দেখতে পাননি?

–মুখ দেখতে পাইনি। আবছাভাবে দেখলেও মনে আছে বেশ লম্বা আর ছিপছিপে চেহারার মানুষ…আমরা সকলে তো ল্যান্সলট ফর্টেস্কুর অপেক্ষাই করছিলাম, তাই মনে হয়, উনিই হবেন।

–লোকটা কোনদিকে যাচ্ছিল বলে মনে হল?

 –ইউগাছের ঝোপের পেছন দিয়ে বাড়ির পুবদিকে।

–ওই দিকে তো একটা দরজা আছে–সেটা তালাবন্ধ থাকে?

রাত্রে সব দরজা বন্ধ করার পরে তালা লাগানো হয়।

–তা হলে তো ওই পাশ-দরজা দিয়ে যে কেউ বাড়ির ভেতরে অজান্তে ঢুকে যেতে পারে!

–তা অসম্ভব নয়। তাহলে ওই লোকটাই কি গা-ঢাকা দিয়ে ওপরে গিয়েছিল তারই পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম বলে আপনার মনে হচ্ছে?

–এরকম হতে পারে।

–কিন্তু লোকটা তাহলে কে?

–আমিও তাই ভাবছি–

আর একটা কথা মিস ডাভ, ব্ল্যাকবার্ডস বিষয়ে আপনি কিছু জানেন?

আচমকাই প্রশ্নটা করে ফেললেন নীল। কিন্তু মেরী ডাভ কথাটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না। তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

–ব্ল্যাকবার্ডস মানে কালোপাখি সম্পর্কে জানতে চাইছি।

 ক্রমশ মুখভাব পরিবর্তিত হল মিস ডাভের। তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, ওহ, আপনি গত গ্রীষ্মের সেই অদ্ভুত ঘটনার বিষয়ে বলছেন? কিন্তু…

ইনসপেক্টর নীল বাধা দিয়ে বললেন, ভাসাভাসা কিছু কানে এসেছে, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বলতে পারবেন।

ব্যাপারটা, আমার মনে হয়, কেউ তামাশা করতেই করেছিল। চারটে মরা কালোপাখি মিঃ ফর্টেস্কুর লাইব্রেরী ঘরের টেবিলে কেউ রেখে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম মালীর ছেলেরই কাণ্ড। জানালা তো খোলা ছিল।

ছেলেটা অবশ্য পরে বলেছিল সে একাজ করেনি। কালোরঙের পাখিগুলোকে মালী ফলের গাছের ডালে গুলি করে মেরেছিল।

-তারপর কেউ ওগুলো মিঃ ফর্টেস্কুর টেবিলে রেখে দিয়েছিল?

–হ্যাঁ।

–মিঃ ফর্টেঙ্কু ব্যাপারটা কিভাবে নিয়েছিলেন। তিনি বিরক্ত হন?

–বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক।

–বুঝেছি।

–আচ্ছা, ধন্যবাদ মিস ডাভ। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।

মেরী ডাভ একটু ইতস্তত করলেন। তারপর ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। নীলের মনে হল, হয়তো তার কিছু জানার উদ্দেশ্য ছিল।

ওই কালো পাখির ব্যাপারটা মিস মারপল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ইনসপেক্টর নীলের মাথায়। তিনি আশ্চর্য হলেন জেনে যে কালোপাখির একটা যোগাযোগ এসবের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ঘটনার স্রোতের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক এখনো তিনি জানেন না। আর সংখ্যাটা চার আর কুড়ি নয়। প্রতীক হিসেবেই যেন কালোপাখির উপস্থিতি রয়েছে বাস্তবে।

ঘটনাটা যদিও আগের–গত গ্রীষ্মকালের। তবু নীলের মনে হলো খুনীর অপরাধের সঙ্গে এর যোগসূত্রের সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখতে হবে।

.

০৮.

 মিস মেরী ডাভের পর নীল মিস ইলেইন ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথা বলতে এলেন।

–আমি দুঃখিত মিস ফর্টেস্কু, আর একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে আপনাকে। আসলে ব্যাপারটা আমরা পরিষ্কার করে নিতে চাইছি–আপনিই সম্ভবত শেষ জন যিনি মিসেস ফর্টেস্কুকে জীবিত অবস্থায় দেখেছেন? সময়টা সম্ভবত পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিট

-মনে হয়। সারাক্ষণ তো আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সংযতকণ্ঠে বললেন ইলেইন ফর্টেস্কু।

-তা ঠিকই বলেছেন। তবে অন্যরা চলে যাওয়ার পর আপনিই মিসেস ফর্টেন্ধুর সঙ্গে থেকে যান?

-হ্যাঁ।

–আপনাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল জানতে পারি?

–আমরা কি নিয়ে কথা বলেছিলাম, তা কিছু এসে যায় না, ইনসপেক্টর।

–সম্ভবত না, তবে শুনলে সেসময়ে মিসেস ফর্টেস্কুর মানসিকতা কি রকম ছিল তা আন্দাজ করা যাবে।

–মানসিকতা–আপনার কি ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন?

–সবরকম সম্ভাবনার কথাই আমাদের খতিয়ে দেখতে হয় মিস ফর্টেস্কু। আশাকরি আপনি আমার বক্তব্য বুঝতে পারছেন।

ইলেইন ফর্টেঙ্কু একটু ইতস্তত করলেন। পরে বললেন, আলোচনা হয়েছিল আমার বিষয়েই

-আপনার বিষয়ে বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

–আমরা একজন বন্ধু…তার কথাই অ্যাডেলকে বলছিলাম আমি। জানতে চাইছিলাম, আমার এক বন্ধুকে বাড়িতে থাকার জন্য আসতে বলতে তার কোন আপত্তি আছে কিনা?

-আপনার এই বন্ধুটি কে?

–তার নাম জেরাল্ড রাইট। একজন স্কুলশিক্ষক। উনি গলফ হোটেলে উঠেছেন।

–আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিশ্চয়ই?

–আমরা বিয়ের কথা ভাবছি।

–কথাটা বলতে গিয়ে মিস ফর্টেস্কুর মুখে লালের আভা পড়ল। নীল তা লক্ষ্য করলেন।

-খুব আনন্দের কথা। আমার অভিনন্দন রইল। মিঃ রাইট গলফ হোটেলে কতদিন উঠেছেন?

-বাবা মারা যাওয়ার পর আমি তাকে তার পাঠিয়েছিলাম।

–তারপরেই উনি চলে আসেন?

–তার এবাড়িতে থাকার কথায় মিসেস ফর্টেস্কু কি বলেছিলেন?

–তিনি কোন আপত্তি করেননি। মনে হয়, ভাল মনেই নিয়েছিলেন।

–শুনেছি আপনার বাবা মিঃ রাইট সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন।

-বাবা খুবই অন্যায় ব্যবহার করেছিলেন। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিস ফর্টেস্কুর কণ্ঠস্বর, জেরাল্ড খুবই বুদ্ধিমান আর প্রগতিশীল ধ্যানধারণার মানুষ। বাবার ব্যবহারে জেরাল্ড খুবই আঘাত পেয়েছিল। তখনই সে চলে যায় আর বহুদিন ওর খবরাখবর পাইনি।

-বোঝা গেল।

মোটা অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় জেরাল্ট রাইটের পুনরায় আবির্ভাব হয়েছে, এরকম ভাবনাই ইনসপেক্টর নীলের মাথায় খেলে গেল।

–আপনার আর মিসেস ফর্টেস্কুর মধ্যে আর কোন বিষয়ে কথা হয়েছিল?

–সেরকম কিছু নয়।

–আপনারা যখন কথা বলেন, তখন সময় পাঁচটা বেজে পঁচিশ। আর মিসেস ফর্টেস্কুকে মৃত অবস্থায় দেখা যায় ছটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে। মাঝখানের সময় আধঘণ্টা–ওই সময়ের মধ্যে আপনি কি আর ঘরে ঢুকেছিলেন?

না।

–ঘর থেকে বেরিয়ে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

–একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।

–গলফ হোটেলের দিকে কি?

–হ্যাঁ। কিন্তু জেরাল্ড সেখানে ছিল না।

–ঠিক আছে, আপাতত এটুকুই। ধন্যবাদ। মিস ইলেইন ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার মুখে নীল বলে উঠলেন, একটা কথা, আপনি কি কালোপাখি বিষয়ে কিছু জানেন?

-ওহ, কালোপাখি-বুঝেছি, পাইয়ের মধ্যে যেগুলো ছিল, তার কথা বলছেন?

নীলের মনে পড়ল, ব্ল্যাকবার্ডস তো পাইয়ের মধ্যেই থাকার কথা।

–পাই-হ্যাঁ, কবে এ ব্যাপার হয়েছিল?

–সে তো তিন চার মাস আগের কথা–কয়েকটা বাবার টেবিলের ওপরেও ছিল?

–আপনার বাবা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েছিলেন। কিন্তু কে এগুলো রেখেছিল আমরা জানতে পারিনি।

–আর একটা কথা। আপনার সৎমা কি কোন উইল করেছিলেন?

ইলেইন একমুহূর্ত চুপ করে থাকল। পরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কোন ধারণা নেই ইনসপেক্টর। আজকাল তো অনেকেই করে শুনেছি।

–আপনি কোন উইল করেছেন?

-না-না–আমি করিনি। উইল করবার মতো কিছু তো ছিল না এতদিন। এখন অবশ্য

–হ্যাঁ, আপনি এখন পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ডের মালিক–দায়িত্ব বড় কম নয়।

ইলেইন ফর্টেস্কু চলে গেলেন। কিন্তু নতুন ভাবনা আলোড়ন তুলল নীলের মনে। মেরী ডাভের কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

বাগানে একজনকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল–চারটে পঁয়ত্রিশের সময়। মেরী ডাভ মিথ্যা কথা বলে তাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে–এমন মনে হল না নীলের।

নতুন একটা সম্ভাবনার পথ দেখতে পেলেন নীল। ওই সময়ে বাগানে নিশ্চয়ই কেউ একজন ছিল–তাকে দেখে ল্যান্সলট ফর্টেন্ধু হতে পারেন–মনে হয়েছিল মেরী ডাভের। তার মনে অজ্ঞাত পরিচয় লোকটির চেহারা আর শরীরের গড়নের সঙ্গে ল্যান্সলট ফর্টেস্কুর চেহারার মিল ছিল।

ইউ ঝোপের আড়ালে এমন একজন গা ঢাকা দিয়েছিল ব্যাপারটা একেবারে নতুন কিছু।

আর একটা বিষয়-এর সঙ্গেই যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলেন নীল। মেরী ডাভ ওপরে কার পদশব্দ শুনেছে। তার মানে, কেউ ওপরে ছিল বোঝা যাচ্ছে–অথচ তাকে কেউ দেখতে পায়নি।

নীল একটুকরো ভেজা মাটি অ্যাডেল ফর্টেস্কুর ঘরে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। এই দুই বিষয়ে সম্পর্ক না থেকে পারে না–নীল ভাবলেন।

একটা সাবেকী আমলের চমৎকার ডেস্ক রাখা আছে সেই ঘরে। তার মধ্যে গোপন দেরাজ ছিল। তাতে তিনখানা চিঠি পাওয়া গেছে। অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে ভিভিয়ানের লেখা।

এরকম উদ্ভ্রান্ত প্রেমের চিঠিচাপাটি নীলের সারা কর্মজীবনে আরো অনেক হাতে পড়েছে। প্যাঁচপ্যাঁচে আবেগের বোকামি ভরা সব প্রেমপত্র।

তবে অ্যাডেল ফর্টেস্কুর লুকনো ডেস্কে যে তিনখানা চিঠি পাওয়া গিয়েছিল–সেগুলোর লেখা ছিল সতর্কতায় ভরা। নিষ্কাম প্রেমের চিঠি বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। যদিও নীল জানেন, এগুলা মোটেই তা ছিল না।

চিঠিগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পেরে নীল সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটারের অফিসে।

এই চিঠিগুলো থেকে একটা যোগসাজসের ইঙ্গিত স্পষ্টতই পাওয়া যায়ভিভিয়ান ডুবয় আর অ্যাডেল ফর্টেস্কুর।

মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুকে বিষপ্রয়োগের ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন তার স্ত্রীই নিজে থেকে অথবা ভিভিয়ান ডুবয়ের যোগসাজসে।

যদিও চিঠিগুলোতে খুনের কোনরকম ইঙ্গিত ছিল না। তা অবশ্য থাকবার কথাও নয়-নীল বুঝতে পেরেছেন ভিভিয়ান অতিশয় সাবধানী মানুষ।

আর তার পক্ষে যা সম্ভব, নীল আন্দাজ করতে পারলেন, ভিভিয়ান নিশ্চয় চিঠিগুলো নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে।

অ্যাডেল নিশ্চয়ই তাকে জানিয়েছিলেন তার কথামতোই তিনি কাজ করেছেন। যদিও তা করেননি।

ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে একের পর এক ঘটনায় প্রবেশ করে চলল নীলের সন্ধানী মন।

অ্যাডেল ফর্টেষ্ণু তার স্বামীকে বিষপ্রয়োগ করেছেন এই সন্দেহ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেল তার মৃত্যুতে। তার পরও একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটল ইউট্রি লজে।

এভাবেই এক নতুন সম্ভাবনার মুখোমুখি হয়ে পড়লেন ইনসপেক্টর নীল।

ভিভিয়ান ডুবয়কে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু। কিন্তু ভিভিয়ান অ্যাডেলকে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তার একলক্ষ পাউণ্ড। স্বামীর মৃত্যুর পর যা অ্যাডেলের হাতে আসতো।

ভিভিয়ান মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়ে থাকবেন। হৃদপিণ্ডের গোলযোগ জাতীয় কিছু। যদিও পরে প্রমাণিত হয়েছে মিঃ ফর্টেস্কুকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।

ইনসপেক্টর নীল ঘটনাটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। যদি এমন ঘটেই থাকে, মিঃ ফর্টেষ্ণুর মৃত্যুর জন্য অ্যাডেল ফর্টেষ্ণু আর ভিভিয়ান ডুবয়ই দোষী, তাহলে তাদের পরিকল্পনা কি রকম হতে পারে?

ভিভিয়ান ডুবয় নিশ্চয় ভয় কাটিয়ে উঠতে পারতেন না–অ্যাডেলের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত প্রকাশ পেতে।

উল্টোপাল্টা কিছু বলা বা করে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল। ঘন ঘন ডুবয়কে টেলিফোনও করে ফেলতে পারতেন। হয়তো তার ঘাবড়ে যাওয়ার কথাবার্তা ইউট্টি লজের কেউ শুনে ফেলতেও পারতো।

অতিশয় সতর্ক আর সাবধানী ডুবয় নিশ্চিত এসব আশঙ্কা করতেন। তিনি নিশ্চয় চুপচাপ থাকতেন না। সেক্ষেত্রে ডুবয় কি করতেন?

নীল ভাবলেন…এ প্রশ্নের উত্তর অনেক কিছুই হওয়া সম্ভব। যাই হোক না কেন…তিনি স্থির করলেন একবার গলফ হোটেলে খোঁজ নেওয়া দরকার…ডুবয় ওইদিন বিকেল চারটে থেকে ছটার মধ্যে হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছিলেন কিনা।

ভিভিয়ান ডুবয়ের চেহারাটা মনে করবার চেষ্টা করলেন নীল। ল্যান্স ফর্টেস্কুর মতোই দীর্ঘকায় তিনি। আবছা অন্ধকারে বাগানে গাছের আড়ালে তাকে ল্যান্স ফর্টেস্কু বলে ভয় ভুল হওয়া অসম্ভব নয়।

বাড়ির পাশ-দরজা দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। সহজেই তা করে থাকতে পারেন।

নিজের নিরাপত্তার তাগিদেই একাজটা তাকে করতে হতো। ওপরে গিয়ে চিঠিগুলোর খোঁজ করতেন অবশ্যই।

কিন্তু যখন দেখতেন, সেগুলো বেপাত্তা, তখন নিশ্চয় মরিয়া হয়ে উঠলেন। আশপাশে কেউ নেই দেখে এরপর লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে যেতে পারতেন।

সেখানে তখন অ্যাডেল ফর্টেন্ধু একা বসে আছেন-চা-পর্ব শেষ।–এমনটা কি নিতান্তই অসম্ভব?

মেরী ডাভ আর ইলেইন ফর্টেস্কুকে জেরা করা হয়েছে। এবারে একবার মিসেস পার্সিভালের সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার খোঁজে গিয়ে দোতলার বসার ঘরেই দেখা পেয়ে গেলেন নীল।

-মাপ করবেন মিসেস পার্সিভাল, কয়েকটা প্রশ্ন করব বলে এলাম।

নিশ্চয়ই, আসুন।

–দুজনেই পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসলেন। এবারে মহিলাকে কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ হল।

নীলের মনে হল, খুবই সাধারণ এক মহিলা। মনের অসুখী-ভাবটা মুখ দেখে আঁচ করা যায়। হাসপাতালের একজন নার্স অর্থবান মানুষকে বিয়ে করেও মানসিক শান্তি পাননি।

–অনেক জটিল বিষয় পরিষ্কার করবার জন্য আমাদের বারবার নানা প্রশ্ন করতে হয়। ব্যাপারটা ক্লান্তিকর মনে হতে পারে–আসলে সময়ের বিষয়েই কয়েকটা কথা জানতে হবে।

সেদিন বিকেলের চা-পর্বে শুনেছি, একটু দেরিতেই আপনি যোগ দিয়েছিলেন। মিস ডাভ ওপরে এসে আপনাকে ডেকেছিলেন।

-হ্যাঁ, তাই। আমি চিঠি লিখছিলাম,–ও এসে জানায় চা দেওয়া হয়েছে।

–ওহ্, আমি ভেবেছিলাম আপনি একটু হাওয়ায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন।

–মেরী ডাভ বলেছেন? ঠিক তাই…চিঠি লিখতে লিখতে মাথাটা একটু ধরেছিল, তাই বাগানে খোলা হাওয়ায় একটু পায়চারি করব বলে বেরিয়েছিলাম।

-ওখানে কারও সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

-কার সঙ্গে দেখা হবে? আশ্চর্য হলেন মিসেস পার্সিভাল, আপনার একথা বলার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম না।

-আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হল, বাগানে আপনার সঙ্গে কারোর দেখা হয়েছিল কিনা। অথবা হাঁটবার সময় আপনাকে কেউ দেখেছিল কিনা?

-না, এসব কিছুই হয়নি। তবে একটু দূরে মালীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।

–এরপর আপনি ঘরে ফিরে আসেন–আর মিস ডাভ এসে বলেন চা দেওয়া হয়েছে?

-হ্যাঁ। এত দেরি হয়েছিল বুঝতে পারিনি। আমি নিচে নেমে যাই।

–লাইব্রেরী ঘরে কারা ছিলেন?

–অ্যাডেল আর ইলেইন। দু-এক মিনিট পরে আমার দেওর ল্যান্সও আসে।

–তারপর সকলে একসঙ্গে বসে চা পান করেন?

–হ্যাঁ।

–তারপর?

-ল্যান্স ওপরে এফি মাসির সঙ্গে দেখা করতে চলে যায়, আমিও অর্ধেক লেখা চিঠিটা শেষ করার জন্য ঘরে চলে আসি। ওরা দুজন ঘরে রইল।

-হ্যাঁ, মিস ইলেইন আরও পাঁচ-দশ মিনিটের মতো ছিলেন মিসেস ফর্টেন্ধুর সঙ্গে। আপনার স্বামী এখনো ফেরেননি?

-ওহ, না। শহরে কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে সাধারণত সাতটা হয়ে যায়।

–আপনার স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মিসেস ফর্টেস্কু কোন উইল করেছিলেন কিনা। উনি জানিয়েছেন, সম্ভবত করেননি। এবিষয়ে আপনি কিছু জানেন?

নীল লক্ষ্য করলেন, জেনিফার ফর্টেঙ্কু বেশ আগ্রহের সঙ্গে তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

-হ্যাঁ, অ্যাডেল একটা উইল করেছিল, ও নিজেই আমাকে একথা বলেছিল।

–এটা কতদিন আগের কথা?

-বেশি দিন আগের নয়–একমাস মতো হবে হয়তো। ভ্যাল কথাটা জানতো না। ঘটনাচক্রে আমিই জেনে ফেলি।

–খুবই আগ্রহ জাগানো ব্যাপার। বললেন নীল।

–সেদিন দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম ফেরার পথে চোখে পড়ল অ্যাডেল এক সলিসিটারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। হাইস্ট্রিটের অ্যানসেল ওয়ারেলের অফিস।

-তারপর?

–অ্যাডেলকে জিজ্ঞেস করি, ও সলিসিটরের অফিসে এসেছিল কেন? ও আমাকে বলে, কথাটা কাউকে যেন প্রকাশ না করি তখন, আমাকেই কেবল জানাচ্ছে–ও একটা উইল তৈরি করেছে।

ও বলে, প্রত্যেকেরই উইল করা উচিত। তবে লণ্ডনে পারিবারিক সলিসিটর বিলিংলের অফিসে ইচ্ছে করেই যায়নি। বুড়ো তাহলে বাড়ির সবাইকে কথাটা জানিয়ে দেবে। ও বলেছিল, আমি আমার নিজের পথেই চলতে চাই। আমি অ্যাডেলকে বলেছিলাম, কাউকে কিছু জানাব না। বলিওনি কাউকে।

–আপনার এই মনোভাব প্রশংসার যোগ্য মিসেস পার্সিভাল।

–ধন্যবাদ, যথেষ্ট সাহায্য পেলাম আপনার কাছ থেকে।

–সব ব্যাপারটাই বড় ভয়ানক ইনসপেক্টর–বড় ভয়ানক। আচ্ছা, সকালে যে বৃদ্ধা মহিলা এসেছেন, উনি কে বলতে পারেন?

–ওঁর নাম মিস মারপল। গ্ল্যাডিস মার্টিন ওঁর কাছে কিছুদিন ছিল। তার সম্পর্কেই খোঁজখবর করতে এসেছেন তিনি।

-তাই। আশ্চর্য ঘটনা।

–আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব মিসেস পার্সিভাল। ব্ল্যাকবার্ডস বা কালো পাখি বিষয়ে আপনি কিছু জানেন?

নীল আশ্চর্য হলেন দেখে, কথাটা শোনামাত্র জেনিফার ফর্টেস্কু যেন কেঁপে উঠলেন। তার হাতব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেল। সেটা তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ব্ল্যাকবার্ডস? কালো পাখি? কি রকম কালোপাখি?

–শুধুই কালোপাখি–জ্যান্ত বা মরাও হতে পারে—

আপনি কি বলছেন কিছু বুঝতে পারছি না। তীব্র স্বরে বলে উঠলেন জেনিফার।

–ওহ, তাহলে বলছেন, কালোপাখির বিষয়ে আপনি কিছু জানেন না?

–আপনি কি গত গ্রীষ্মকালে পাইয়ের মধ্যে যেগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার কথা বলছেন? সে তো এক হাস্যকর ঘটনা।

কয়েকটা লাইব্রেরীর টেবিলের ওপরেও ছিল

–হ্যাঁ। একটা বিশ্রী তামাশার ব্যাপার। এজন্য মিঃ ফর্টেষ্ণু খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন।

 –শুধুই বিরক্ত হয়েছিলেন বলছেন? আর কিছু না?

-না, মানে, বুঝতে পারছি আপনি কি বলতে চাইছেন। উনি জানতে চেয়েছিলেন, কে এরকম কাজটা করেছিল–কাছাকাছি এরকম কাউকে দেখা গিয়েছিল কি না।

-অচেনা কেউ–একথা উনি বলেছিলেন?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, একথাই তিনি বলেছিলেন। সতর্ক দৃষ্টিতে জেনিফার তাকালেন নীলের দিকে।

–অচেনা কেউ..নীল বললেন চিন্তিত ভাবে, তাকে কি ভয় পেয়েছেন মনে হয়েছিল? মানে অচেনা কারো সম্পর্কে…

অত ভাল মনে নেই, তবে তেমনই মনে হয়েছিল। ওরকম বিশ্রী তামাশা ক্রাম্পই মনে হয় পানাসক্ত অবস্থায় করে থাকবে, ও অনেকটা অন্যরকম। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে মিঃ ফর্টেস্কুর ওপরে ওর কোন রকম রাগ ছিল কিনা। আপনার কি মনে হয় ইনসপেক্টর?

–সবই সম্ভব মনে হয়।

এরপর ওখান থেকে বিদায় নিলেন নীল।

.

লাইব্রেরীতে এসে নীল দেখতে পেলেন ল্যান্সলট স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে দাবা খেলছেন।

খেলায় বাধা দেয়ার জন্য যথারীতি দুঃখ প্রকাশের পর নীল বললেন, মিঃ ল্যান্সলট, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম। আপনি কি ব্ল্যাকবার্ডস মানে কালোপাখি সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?

–ব্ল্যাকবার্ডস? ল্যান্স যেন একটু মজাই পেলেন, কি ধরনের কালো পাখি? যারা দাসব্যবসা করে তাদেরও তো ব্ল্যাকবার্ডস বলা হয়।

ইনসপেক্টর সহজ কণ্ঠে হেসে উঠলেন। বললেন, সত্যিকথা বলতে আমি নিজেই ব্যাপারটা জানি না। ব্ল্যাকবার্ডস সম্বন্ধে কথাটা উঠেছে বলেই জানতে চাইলাম।

ল্যান্স সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করবার চেষ্টা করলেন ইনসপেক্টর নীলকে।

–ওহ, তাহলে নিশ্চয় ব্ল্যাকবার্ডস খনি সম্বন্ধে নয়?

 –ব্ল্যাকবার্ডস খনি? যেন জোর একটা ধাক্কা খেলেন নীল, ব্যাপারটা কি?

–ওই ব্যাপারটা আমি নিজেও ভাল করে জানি না ইনসপেক্টর। ছেলেবেলায় শোনা। যতদূর মনে পড়ে, এটা বাবার জীবনের একটা অসাধু লেনদেনের ঘটনা। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলেরই কোন খনি হবে এটা। এফি মাসি সম্ভবত একবার বাবাকে এনিয়ে খুব কথা শুনিয়েছিলেন।

–এফি মাসি মানে মিস র‍্যামসবটন?

–হ্যাঁ।

–তাহলে তো ওঁর কাছে জিজ্ঞেস করলে পরিষ্কারভাবে জানতে পারব। কিন্তু ওই জাঁদরেল মহিলার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমি কেমন দুর্বল হয়ে পড়ি।

–উনি ওরকমই বরাবর। তবে ইনসপেক্টর, ঠিকভাবে চলতে পারলে ওঁর কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য আপনি পাবেন। বয়স হলেও ওঁর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অতীতের কোন কিছুই ভোলেন নি।

একটু থামলেন ল্যান্সলট। তারপর আবার বললেন, এবারে এখানে আসার পরেই ওঁর সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন লাইব্রেরীতে চা পানের একটু পরেই। এফি মাসির ধারণা গ্ল্যাডিস এমন কিছু জানত যা সে পুলিসকে জানায়নি। অবশ্য, আমরা জানতাম না যে ইতিমধ্যে সে মারা গেছে।

উনি ঠিকই বলেছিলেন, আমরাও এখন বুঝতে পারছি, বললেন নীল, তবে এখন তো সে বেচারী সব কিছুর বাইরে

-এফি মাসি নাকি ওকে পুলিসের কাছে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মেয়েটা অবশ্য সে-কথা শোনেনি।

ল্যান্সলট ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথা শেষ করে নীল এক দুঃসাহসিক কাজই করলেন। তিনি মিস র‍্যামসবটমের ঘরে উপস্থিত হলেন।

মিস মারপল তখন সেই ঘরে বেশ জাঁকিয়ে বসে গল্প করছিলেন। ওঁদের গল্পের বিষয় ছিল বিদেশী মিশন।

ইনসপেক্টর নীল ঘরে ঢুকতেই মিস মারপল উঠবার উপক্রম করলেন, নীল তাকে বাধা দিলেন।

-আপনি বসুন মাদাম। আপনার সামনে কথা বলতে কোন আপত্তি নেই।

–আমিও মিস মারপলকে এবাড়িতে এসে থাকতে বলেছি। ওই গলফ হোটেলে থাকা মানে মিছেমিছি কতগুলো টাকার শ্রাদ্ধ। আমার পাশের ঘরটাই খালি পড়ে আছে। আপনার কি কোন আপত্তি আছে ইনসপেক্টর?

–আমার দিক থেকে আপত্তির কিছু নেই মাদাম। বললেন নীল।

–অশেষ ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞস্বরে বললেন মিস মারপল, তাহলে হোটেলে একটা টেলিফোন করে আসি বুকিং বাতিল করতে হবে।

মিস মারপল চলে গেলেন। মিস র‍্যামসবটম নীলকে উদ্দেশ করে বললেন, এবারে আপনার কথা শোনা যাক।

–ব্ল্যাকবার্ডস খনি সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু শুনব বলে এসেছিলাম।

–তাহলে সন্ধানটা পেয়ে গেছেন, সহসা অট্টহাস্য করে উঠলেন মিস র‍্যামসবটন, তবে খুব বেশ কিছু বলতে পারব বলে মনে হয় না।

-কতদিন আগেকার ব্যাপার এটা মাদাম? জানতে চাইলেন নীল।

–তা প্রায় বছর পঁচিশ তো হবে। পূর্ব আফ্রিকার কোনও অঞ্চলে হবে-খনিটা লিজ নেবার কথা হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে ম্যাকেঞ্জি নামে এক ভদ্রলোককে নিয়ে আমার ভগ্নীপতি সেখানে যান।

কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না, ম্যাকেঞ্জি সেখানেই জ্বর হয়ে মারা যান। রেক্স বাড়ি ফিরে সকলকে জানিয়েছিল খবরটা ছিল ভুয়ো। আমার জানার মধ্যে এটুকুই ইনসপেক্টর।

-কিন্তু মাদাম, আমি শুনেছি, এর চেয়েও বেশি কিছু আপনি জানেন। বললেন নীল।

–সেসব শোনা কথা। আপনি আইনের মানুষশোনা কথা আইনে গ্রাহ্য নয় বলেই তো শুনেছি।

-কিন্তু মাদাম আমরা এখনো আদালতে যাইনি।

–বেশ। তাহলে যেটুকু যা শুনেছি আপনাকে শোনাতে পারি।

একটু থামলেন মিস র‍্যামসবটম। এরপর বললেন, সেই সময়ে ম্যাকেঞ্জি পরিবার বলেছিল, রেক্স ম্যাকেঞ্জিকে ঠকিয়েছিল। আমার ভগ্নীপতিকে জানতাম বলে আমি তাদের কথাটা অবিশ্বাস করতে পারিনি।

লোকটা তো ছিল ধূর্তের শিরোমণি। বিবেক বলে কিছু ছিল না তার। যেখানেই যা করত, আইনের দিক থেকে কোন ট্র্যাক রাখতো না। তাই ওরা কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি।

মিসেস ম্যাকেঞ্জি স্বভাবতই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তিনি এখানে এসে রেক্সকে হুমকি দিয়ে যান প্রতিশোধ নেবেন বলে। তিনি বলেন রেক্সই ম্যাকেঞ্জিকে খুন করেছে।

এ ঘটনার পরে শুনেছি ভদ্রমহিলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। মানসিক রোগের হাসপাতালেও কিছুদিন ছিলেন।

–মিসেস ম্যাকেঞ্জি কি একাই এসেছিলেন এখানে? বললেন নীল।

–সঙ্গে ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে এসেছিলেন। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা বাচ্চাদের দেখিয়ে তিনি চিৎকার করে বলেন, এদের দিয়েই প্রতিশোধ নেওয়াবেন। খুবই বোকার মতো কাজটা করেছিলেন, সন্দেহ নেই।

এর বেশি আর কিছু জানা নেই আমার ইনসপেক্টর। তবে কি জানেন, ওই ব্ল্যাকবার্ডস খনির মতো অনেক জোছুরি কাজই রেক্স সারাজীবন ধরে করে গেছে। তা হঠাৎ ব্ল্যাকবার্ডের ওপর আপনার নজর পড়ল কেন? ম্যাকেঞ্জির খোঁজ পেয়েছেন নাকি?

-ওই পরিবারের কি হয়, কিছু জানেন মাদাম?

-না ইনসপেক্টর কিছু আর কানে আসেনি। ঈশ্বরের বিচার সময় সাপেক্ষ বটে, তবে তা কেউ এড়াতে পারে না। রেক্স তার উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছে আমি মনে করি। আপনাকে আর কিছু বলার নেই আমার–আপনি এবারে আসুন।

অনেক ধন্যবাদ মাদাম।

বলে নীল উঠে দাঁড়ালেন।

–মিস মারপলকে একটু পাঠিয়ে দেবেন। দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান কিভাবে চালাতে হয় এবিষয়ে মহিলার অগাধ জ্ঞান।

ইনসপেক্টর নীল ঘর ছেড়ে নিচে এসে প্রথমে টেলিফোন করলেন অ্যানসেল ও ওয়ারেলে। পরে গলফ হোটেলে। পরে সার্জেন্ট হেকে ডেকে বললেন, তিনি কিছু সময়ের জন্য বাইরে যাচ্ছেন।

জরুরী কোন দরকার পড়লে গলফ হোটেলেই আমাকে পাবে। আর শোন, ব্ল্যাকবার্ডস সম্পর্কে কিছু জানতে পারো কিনা দেখো।

-ঠিক আছে স্যর।

.

সলিসিটর অ্যানসেলের সঙ্গে কথা বলে নীলের মনে হলো তিনি পুলিসকে সাহায্য করতে আগ্রহী।

নীল তার কাছ থেকে জানতে পারলেন, সপ্তাহ পাঁচ আগে অ্যাডেল ফর্টেস্কুর জন্য একটা উইল তিনি করে দিয়েছেন। ভদ্রমহিলা নিজেই অফিসে এসেছিলেন।

মিঃ অ্যানসেল আরও জানালেন ইতিপূর্বে তিনি ফর্টেন্ধু পরিবারের কারও জন্য কোন আইন সংক্রান্ত কাজকর্ম করেননি।

মিসেস ফর্টেস্কুর উইলের বিষয়টাও জানা গেল। তিনি তার মৃত্যুর পর সমস্ত কিছুই দিয়ে গেছেন মিঃ ভিভিয়ান ডুবয়কে।

খবরটাতে অভিনবত্ব ছিল, তবে ইনসপেক্টর নীলের কাছে একেবারে অভাবিত ছিল না। তবু তিনি একটু চিন্তিতই হলেন।

সব শেষে মিঃ অ্যানসেল বললেন, তবে, আমি যতদূর জানি, মিসেস ফর্টেঙ্কু বিশেষ কিছু রেখে যেতে পারেননি।

নীল জানেন, মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর মৃত্যুর পর অ্যাডেল ফর্টেস্কুর অবস্থাটা অনেক বদলে গিয়েছিল। স্বামীর উইল অনুযায়ী তিনি একলক্ষ পাউণ্ডের মালিক হয়েছিলেন। মৃত্যুকর ইত্যাদি বাদ দিয়ে যে অর্থ থাকবে তা আসবে ভিভিয়ান ডুবয়ের হাতে।

সলিসিটর অফিস থেকে বেরিয়ে নীল এলেন গলফ হোটেলে। নীলের টেলিফোন পাবার পর তিনি অপেক্ষা করেছিলেন।

ডুবয় বললেন, জরুরী কাজে হোটেল ছেড়ে চলে যাওয়ার মুখেই আপনার টেলিফোন পাই ইনসপেক্টর। এভাবে আটকে থাকায় খুবই অসুবিধায় পড়তে হবে।

–আমাদের হাত পা বাঁধা, বুঝতেই পারছেন। বুঝতে পারছি মিসেস ফটেন্ধুর মৃত্যুতে আপনি খুবই আঘাত পেয়েছেন। আপনাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, তাই না?

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, আমরা প্রায়ই একসঙ্গে গলফ খেলতাম। চমৎকার মহিলা।

–আচ্ছা মিঃ ডুবয়, তার মৃত্যুর দিন বিকেলে আপনি তাকে টেলিফোন করেছিলেন?

–ঠিক মনে পড়ছে না। টেলিফোন কি করেছিলাম?

–যতদূর জেনেছি-চারটে নাগাদ আপনি টেলিফোন করেছিলেন।

–ও হ্যাঁ হ্যাঁ-মনে পড়েছে। ওর কুশলবার্তা জানতে চেয়েছিলাম। নিতান্ত মামুলী কথাবার্তা।

-এরপর একটু ঘুরে আসার জন্য আপনি হোটেলে ছেড়ে বেরিয়েছিলেন।

–মানে..হ্যাঁ…ইয়ে..ঠিক বেড়ানো নয়…দু-এক কোর্স গলফ খেলেছিলাম।

-মনে হচ্ছে ঠিক তা আপনি করেননি মিঃ ডুবয়। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি এখানকার পোর্টার আপনাকে ইউট্রিলজের দিকে যেতে দেখেছিল।

তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন নীল। তার চোখে চোখ পড়তেই মাথা নত করলেন মিঃ ডুবয়।

-ইয়ে…মানে..আমার ঠিক মনে পড়ছে না ইনসপেক্টর।

ইতস্তত করে বললেন মিঃ ডুবয়।

–আপনি সম্ভবত মিসেস ফর্টেস্কুর সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলেন?

কখনোই নয়। আমি এই বাড়ির কাছেই যাইনি।

–তবে কোথায় গিয়েছিলেন জানতে পারি কি?

–হাঁটতে হাঁটতে আমি থ্রি পিজিয়ন পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তারপর আবার ফিরে আসি।

–আপনি নিশ্চিত যে ইউট্রিলজে যাননি?

–আমি নিশ্চিত ইনসপেক্টর।

নীল এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনি বুদ্ধিমান, মিঃ ডুবয়। আসল সত্যটা আমাদের কাছে খুলে বললেই ভালো করবেন। খুব সামান্য কারণেই হয়তো আপনাকে ইউট্রিলজে যেতে হয়েছিল।

-না, না, ইনসপেক্টর, ওইদিন আমি মিসেস ফর্টেস্কুর কাছে আদৌ যাইনি।

–তাহলে মিঃ ডুবয়, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন ইনসপেক্টর নীল, এ বিষয়ে একটা লিখিত বক্তব্য আপনার কাছ থেকে নেওয়ার দরকার হবে। অবশ্য সেই সময় একজন উকিল সঙ্গে রাখার অধিকার আপনার আছে।

মিঃ ডুবয় যেন একটা ঝাঁকুনি খেলেন একথায়। তাঁর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল।

-আপনি…আপনি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন

–একেবারেই না মিঃ ডুবয়। আপনার যে কিছু আইনগত অধিকার আছে আমি সেকথাই বলতে চেয়েছি।

আপনাকে আমি আবারো বলছি, আমি ওদের কোন কিছুর মধ্যেই থাকিনি।

থাকেননি। তাহলে স্বীকার করুন, ওইদিন বিকেল চারটের সময় আপনি ইউট্রিলজে গিয়েছিলেন। বাড়ির জানালার দিকে একজন আপনাকে বাগানে দেখেছিল।

–ঢোকেননি? তাহলে আমিই বলছি শুনুন। বাগানের পাশ দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে আপনি দোতলায় ওঠেন। তারপর মিসেস ফর্টেস্কুর বসার ঘরে ঢুকে তাঁর ডেস্কে; বলছেন কিছু খোঁজেননি?

-তাহলে সেগুলো আপনার হাতেই পড়েছে? রুক্ষস্বরে বলে উঠলেন মিঃ ডুবয়, ও আমাকে বলেছিল ওগুলো পুড়িয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ইনসপেক্টর, ওই চিঠিগুলো থেকে আপনি যে কি অর্থ করেছেন তা বুঝতে পারছি। তবে তা একেবারেই সত্যি নয়।

-আপনি মিসেস ফর্টেস্কুর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, নিশ্চয় তা অসত্য নয়?

–তা অস্বীকার করি কি করে, আমার লেখা চিঠি যখন আপনি পেয়েছেন। তবে একটা অনুরোধ আপনাকে করব, ওগুলো থেকে কোন ভয়ানক ধারণা আপনি করবেন না। আমি বা অ্যাডেল কখনো মিঃ ফর্টেস্কুকে খুন করতে চাইনি। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আমার মানসিকতা তেমন নয়।

–মিসেস ফর্টেঙ্কু হয়তো এরকম মানুষই ছিলেন।

–একথা ঠিক নয়। সেও কি খুন হয়নি?

–সেকথা অবশ্য ঠিক। বললেন নীল।

 –আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন একই লোক ওদের দুজনকে খুন করেছে।

–অসম্ভব নয়। তবে অন্য সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। মিঃ ডুবয়, এমন তো হতে পারে, মিসেস ফর্টেস্কুই তার স্বামীকে হত্যা করেন। কিন্তু এই কাজের জন্য তিনি বিশেষ একজনের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। সেই লোক তাকে এই কাজে সহায়তা হয়তো করেনি, তবে প্ররোচনা জুগিয়েছিল। এবং এর জন্যেই সেই লোকের কাছে মিসেস ফর্টেঙ্কু বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন।

-না, না, ইনসপেক্টর, এভাবে আমার বিরুদ্ধে আপনি অভিযোগ আনতে পারেন না।

-মিসেস ফর্টেস্কু একটা উইল করেছিলেন। তিনি মৃত্যুর পরে তার সমস্ত কিছু, মায় টাকাকড়ি, আপনাকে দিয়ে গেছেন।

–আমি এসবের এক কপর্দকও চাই না।

–আপনি অবশ্য যা পাবেন তা খুবই সামান্য। কিছু অলঙ্কার আর লোমের পোশাক। নগদ অর্থ খুবই কম। মিঃ ডুবয় যেন বোকা হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। পরে বললেন, কিন্তু ওর স্বামী-আমি ভেবেছিলাম

–তাহলে আপনি ভেবেছিলেন, কঠিন স্বরে বলে উঠলেন নীল, কিন্তু রেক্স ফর্টেস্কুর উইলের বিষয়বস্তু আপনি জানতেন না—

.

এরপর ইনসপেক্টর নীল গলফ হোটেলেই সাক্ষাৎ করলেন মিঃ জেরাল্ড রাইটের সঙ্গে। তাকে দেখে নীলের মনে হল, চেহারার দিক থেকে দুজনের মিল অনেক।

জেরাল্ড রাইটের ছিপছিপে গড়ন। কিন্তু ভাবভঙ্গী বুদ্ধিজীবীসুলভ।

–ইউট্রিলজে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর আপনি দিতে পারবেন আশা করছি মিঃ জেরাল্ড। বললেন নীল।

-খবরের কাগজ থেকেই যা জানার জেনেছি; মিষ্টি হেসে বললেন জেরাল্ড। আজকাল তো দেখছি নৃশংস সব খুনখারাবির খবরই কাগজগুলোর উপজিব্য হয়ে উঠেছে। যাই হোক, ইনসপেক্টর, ইউট্রিলজের ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। মিঃ রেক্স ফর্টেঙ্কু যখন মারা যান, আমি তখন আইল অব ম্যান-এ ছিলাম।

-হ্যাঁ। মিস ফর্টেস্কুর একটা টেলিগ্রাম পেয়ে আপনি সঙ্গে সঙ্গেই এসে পড়েন, নয় কি?

–আমাদের পুলিস দেখছি খুবই করিতকর্মা–সবই জানে। ইলেইনের তার পেয়ে আমি চলে আসি।

–আপনারা শিগগির বিয়ে করছেন বলে শুনেছি। বললেন নীল।

–আপনি ঠিকই শুনেছেন ইনসপেক্টর।

–ও বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই, ওটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাদের পরিচয় সম্ভবত খুব অল্পদিনের–ছয় কি সাত মাস

–একদম ঠিক।

–মিঃ ফর্টেস্কু আপনাদের বিয়েতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর অমতে বিয়ে হলে তিনি মিস ফর্টেস্কুকে কোন টাকাকড়ি দেবেন না, একথাও তিনি আপনাকে জানিয়েছিলেন। এরপর আপনি বাগদান ভেঙ্গে দিয়ে চলে যান–

-আপনার সব কথাই ঠিক ইনসপেক্টর। আসল কথা হল রাজনৈতিক মতবাদ সহ্য করতে পারেননি মিঃ ফর্টেস্কু।

তিনি ছিলেন অতি জঘন্য ধরনের পুঁজিবাদী মানুষ। আমি কেবল টাকার জন্য আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ বিসর্জন দিতে চাইনি।

তবে এখন আপনি উপস্থিত হয়েছেন এমন একজন মেয়েকে বিয়ে করতে যিনি সম্প্রতি ৫০,০০০ পাউণ্ডের মালিক হচ্ছেন।

জেরাল্ড রাইট মিষ্টি হাসলেন। বললেন, না, ইনসপেক্টর এখন তাকে বিয়ে করতে একদম আপত্তি নেই। সমাজের সকলের উন্নতির জন্য এ টাকাটা ব্যয় করা হবে। ওসব আলোচনা থাক ইনসপেক্টর-আপনি যা জানতে এসেছেন সেই কথাই বলুন।

-হ্যাঁ, মিঃ রাইট সেই প্রশ্নই আপনাকে করছি। গত ৫ই নভেম্বর বিকেলে সায়ানাইডের বিষক্রিয়ায় মিসেস ফর্টেঙ্কু মারা যান–এ খবর নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। ওই দিন বিকেলে আপনি ইউট্রিলজের কাছাকাছি ছিলেন বলেই জানতে চাইছি, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা সম্ভব এমন কিছু কি আপনার চোখে পড়েছিল–

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ইনসপেক্টর ওই দিন বিকেলে আমি ইউট্রিলজের কাছাকাছি ছিলাম। এমন ধারণা আপনার জন্মাল কি করে?

–মিঃ রাইট, ওই দিন বিকেলে সাড়ে চারটের সময় আপনি হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছিলেন এবং ইউট্রিলজের দিকে হাঁটছিলেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মনে করা যেতে পারে আপনি সেখানে গিয়েছিলেন।

-হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, সেরকম ভেবেই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হল কাজটা ঠিক হবে না। তাছাড়া সন্ধ্যা ছটায় মিস ইলেইনের আমার হোটেলে আসার কথা ছিল। তাই আমি কিছুক্ষণ বেড়িয়ে একটা গলির মধ্য দিয়ে হোটেলে ফিরে আসি ছটার মধ্যেই। ইলেইন অবশ্য আসেনি। ওই পরিস্থিতিতে অবশ্য সম্ভবও ছিল না।

–আপনি যখন হাঁটছিলেন, তখন আপনাকে কেউ দেখেছিল?

–তা তো খেয়াল করিনি। সরু গলিটার ভেতর দিয়ে কয়েকখানা গাড়ি অবশ্য পাশ দিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে চেনাজানা কেউ ছিল কিনা খেয়াল করিনি।

-বেশ। এই হোটেলেই আছেন মিঃ ভিভিয়ান ডুবয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?

-ডুবয়? আলাপ নেই। মনে হয় লম্বা চেহারা, গাঢ় রঙ, আর সোয়েডের জুতো পছন্দ তিনিই হবেন।

-হ্যাঁ। ওই দিন বিকেলে উনি ইউট্রিলজের দিকে গিয়েছিলেন। রাস্তায় তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?

-না, তাঁকে দেখেছি বলে মনে হয় না। ওই কর্দমাক্ত গলি দিয়ে কে হাঁটতে যাবে—

বুঝতে পারলাম। বললেন নীল।

 ইউট্রিলজে ফিরে আসতেই সার্জেন্ট হে এসে উৎসাহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালো ইনসপেক্টর নীলকে।

–আপনার সেই কালোপাখি আবিষ্কার করেছি স্যার।

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ, স্যর, ওগুলো পাইয়ের মধ্যে ছিল। নৈশভোজের জন্য রবিবারে ঠাণ্ডা পাই রাখা ছিল। কেউ অজান্তে ভাড়ার ঘরে ঢুকে পাত্রের ঢাকনা খুলে শূকরের মাংস বের করে নিয়ে ছিল। আর তার মধ্যে রেখে দিয়েছিল কয়েকটা পচা কালো পাখি। পাখিগুলো মালির চালাঘরে ছিল। এ কিরকম ঠাট্টা বুঝতে পারছি না স্যর।

ইনসপেক্টর নীল অন্যমনস্কভাবে বলে উঠলেন, হা, রাজার এমন খানা অদ্ভুতই বটে-সার্জেন্ট হে কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। নীল বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।

.

০৯.

–তুমিই তাহলে ল্যান্সের স্ত্রী?

পেসেন্স খেলায় নিমগ্ন মিস র‍্যামসবটম মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন।

–হ্যাঁ। প্যাট উত্তর দিল।

মিস র‍্যামসবটম তার সঙ্গে আলাপ করতে চান জেনে প্যাট তার ঘরে এসেছিলেন।

-তোমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই দেখছি। বোসো আরাম করে। ল্যান্সের সঙ্গে কোথায় আলাপ হয়?

-কেনিয়াতেই পরিচয় হয়েছিল।

–শুনেছি, তোমার আগেও বিয়ে হয়েছিল?

–হ্যাঁ, দুবার।

 –ওহ, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়?

-না। প্যাট মাথা নত করলেন, আমার প্রথম স্বামী ফাইটার প্লেনের পাইলট ছিলেন। তিনি যুদ্ধে মারা যান।

–আর দ্বিতীয় স্বামী? তিনি শুনলাম গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, তাই কি?

–হ্যাঁ।

–তোমার কোন দোষ ছিল?

–না, আমার কোন দোষ ছিল না। রেস খেলতেন।

–হুঁ। বাজিধরা, তাস খেলা এসব শয়তানের কাজ। এই বাড়িটাও শয়তানের আখড়া হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরই তাদের শাস্তি দিয়েছেন।

প্যাট অপ্রতিভ অবস্থায় বসে রইলেন। কথা শুনে ল্যান্সের এফি মাসিকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।

–এ বাড়ির সম্পর্কে কিছু জান তুমি? মিস র‍্যামসবটম জানতে চান।

–বিয়ের আগে সবাই যেমন শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে জানে আমিও সেটুকুই জেনেছি।

-হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই বলেছ। তোমাকে একটা কথা বলছি, আমার বোন ছিল বোকার হদ্দ, আর ভগ্নীপতি এক শয়তান, পার্সিভাল ছিঁচকে। তোমার স্বামী ল্যান্স, সে এই পরিবারের সব চেয়ে মন্দ ছেলে।

–আমার মনে হয় আপনার একথা ঠিক নয়। প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন প্যাট।

–যাই মনে কর বাপু, একটা কথা মনে রেখো, পার্সিভালকে কখনো বোকা ভেবে নিও না। ও বোকার ভান করে থাকে কিন্তু মহা ধুরন্ধর।

আর একটা কথা, ল্যান্সের কাজকর্মও আমি ভাল মনে করি না। কিন্তু আবার ওকে কেন যেন পছন্দ না করেও পারি না। ওটা চিরকালই কেমন বেপরোয়া গোছের। তোমাকে ওর ওপর নজর রাখতে হবে যেন বাড়াবাড়ি না করে।

ওকেও বলো, পার্সিভালকে যেন সমঝে চলে। ওকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। এবাড়ির সবাই জঘন্য মিথ্যাবাদী।

কথা শেষ করে খুশি খুশি মুখে প্যাটের দিকে তাকালেন বৃদ্ধা।

.

ইনসপেক্টর নীল স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন।

ওপাশ থেকে অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার বললেন, মনে হয় সে মারা গিয়ে থাকবে। তবু বেসরকারী স্যানাটোরিয়ামগুলোয় খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তুমি খবর পেয়ে যাবে। তোমার ওই কালোপাখির থিওরিটা অভাবিত।

-তবুও ওটাকে অবহেলা করা ঠিক হবে না মনে হচ্ছে স্যার। সব কিছুই কেমন মিলে যাচ্ছে।

–তাই দেখছি–রাই…কালো পাখি…লোকটির নাম–রেক্স

–আমি স্যর ডুবয় আর রাইটের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি আপাতত। এদের কাউকেই হয়তো গ্ল্যাডিস নামের মেয়েটি দরজার পাশে দেখে থাকবে। ওরা ওখানে কি করছে দেখার জন্যই হয়তো হলঘরে ট্রে নামিয়ে রেখে দেখতে গিয়েছিল। মেয়েটাকে ওখানেই কেউ শ্বাসরুদ্ধ করে মারে। পরে দেহটা বাগানে যেখানে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যায় আর নাকে ক্লিপ এঁটে দেয়।

জঘন্য কাজ। একেবারেই উম্মাদের মতো–

-নাকে ক্লিপ লাগানোর ব্যাপারটা ওই বৃদ্ধা মহিলা মিস মারপলকে খুব নাড়া দেয়। খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা। উনি ওই বাড়িতেই আপাতত থাকছেন বৃদ্ধা মিস র‍্যামসবটমেরও তাই ইচ্ছা।

–তোমার বর্তমান কর্মসূচী কি নীল?

-লণ্ডনের সলিসিটরের সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব। রেক্স ফর্টেস্কুর ব্যাপারে আরো কিছু জানা দরকার। তাছাড়া, পুরনো সেই ব্ল্যাকবার্ড সম্পর্কেও খোঁজখবর করতে চাই।

.

বিলিংসলে, হর্সথর্প ও ওয়াল্টার্স প্রতিষ্ঠানের মিঃ বিলিংসলেকে যে ইউট্রিলজের তিনটি মৃত্যুর ঘটনা যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে, দ্বিতীয়বারের সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ইনসপেক্টর নীল। পুলিসকে সাহায্য করার জন্যই তিনি উদগ্রীব ছিলেন।

-এমন অস্বাভাবিক কাণ্ড আমার সারা কর্মজীবনে আর দেখিনি। এব্যাপারে সবরকম সাহায্যই আপনি আমার কাছ থেকে আশা করতে পারেন। বললেন মিঃ বিলিংসলে।

-আপনিই বলতে পারবেন মিঃ ফর্টেষ্ণুর প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থাটা কেমন। তাছাড়া মানুষটির সম্পর্কেও।

-কাজকর্মের সূত্রে মিঃ ফর্টেস্কুর সঙ্গে আমার সোল বছরের পরিচয়। তবে অন্য সলিসিটরের সঙ্গেও তার কাজকর্ম হত। আপনাকে তো উইলের বিষয়ে আগেই বলেছি। বর্তমানে মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুই তার সম্পত্তির অবশিষ্ট অংশের উত্তরাধিকারী।

মিঃ বিলিংসলে, আমি এখন মিসেস ফর্টেস্কুর উইলের সম্পর্কেই আগ্রহী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তো একলক্ষ পাউণ্ডের উত্তরাধিকারী হন, তাই না?

-হ্যাঁ। কিন্তু..আপনাকে বিশ্বাস করে বলা যায়, অত টাকা এই মুহূর্তে দেওয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অসম্ভব হত।

–তাহলে প্রতিষ্ঠান কি লাভজনক ছিল না?

–গত দেড় বছর থেকেই অবস্থা টলমল।

–এমন অবস্থা হল–বিশেষ কোন কারণ নিশ্চয় থাকবার কথা।

–আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন ইনসপেক্টর। আমার ধারণা মিঃ রেক্স নিজেই দায়ী প্রতিষ্ঠানের এ অবস্থার জন্য।

একটু থামলেন মিঃ বিলিংসলে। পরে বললেন, গত একবছর খুবই বেপরোয়া ভাবে কাজ করেছেন মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু। কারুর পরামর্শে কান দেন নি। ভাল স্টক বিক্রি করে ফাটকা শেয়ারে একেবারে পাগলের মতো লগ্নী করছিলেন। তবু নিজের কাজের বড়াই করে বড় বড় কথা বলতেন।

মিঃ পার্সিভাল তার বাবাকে বোঝনোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রেক্স ফর্টেস্কু কোন কথা শোনেন নি।

মিঃ পার্সিভাল আমার কাছেও এসেছিলেন তার বাবার ওপর আমার প্রভাব খাটানোর অনুরোধ নিয়ে। আমি যথাসাধ্য করেছিলাম। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল রেক্স ফর্টেস্কু একেবারে পাগলের মতো ব্যবহার করছিলেন।

ইনসপেক্টর নীল মাথা ঝাঁকালেন। তাঁর মনে হল, পিতা পুত্রের মনোমালিন্যের ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে।

-তবে আপনি মিসেস ফর্টেস্কুর উইলের বিষয়ে যা জানতে চাইছেন, আমি তার কিছুই বলতে পারব না। তার কোন উইল আমি করিনি।

–আমি সেটা জানি মিঃ বিলিংসলে। আমি কেবল জানতে চাইছিলাম, স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি একলক্ষ পাউণ্ড পাচ্ছেন কিনা?

–না…তা পাচ্ছেন বলা যাবে না। বাধা দিয়ে বললেন মিঃ বিলিংসলে।

–তাহলে কি তিনি খোরপোষ বাবদ সারা জীবন টাকাটা পেতেন?

–না, তাও নয়। তার একলক্ষ পাউণ্ড সম্পর্কে উইলে একটা শর্ত ছিল।

–শর্ত? বিস্মিত হলেন নীল।

-হ্যাঁ। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাস জীবিত থাকলে তবেই সরাসরি মিঃ ফর্টেস্কুর স্ত্রী টাকাটা পেতেন। এরকম শর্ত আজকাল বেশ চালু হয়েছে, আকাশপথে ভ্রমণের অনিশ্চয়তার জন্য।

–তাহলে দেখা যাচ্ছে, মিসেস ফর্টেস্কু একলক্ষ পাউণ্ড রেখে যাননি? একলক্ষ পাউণ্ড তাহলে কে পাচ্ছেন?

-প্রতিষ্ঠানেই থাকছে। সেই হিসেবে বলা যায়, সম্পত্তির অবশিষ্ট অংশের উত্তরাধিকারী মিঃ পার্সিভালই টাকাটার মালিক হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থায় টাকাটা তার খুবই প্রয়োজন।

.

ইনসপেক্টর নীলের প্রশ্নের উত্তরে তার ডাক্তার বন্ধু বললেন, তোমাদের পুলিসদের মাথায় কি ঘোরে বলো তো। অদ্ভুত সব কথা জানার জন্য হন্যে হয়ে পড়।

ধানাইপানাই বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলোতো।

–তাই বলছি। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। ব্যাপারটা যতদূর মনে হয় বুদ্ধিভ্রষ্টতা। ওই অবস্থায় মানুষ বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, সবসময় একটা হামবড়া ভাব, কথায় কথায় বিরক্তি আর রাগারাগি। কোন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এই রোগে ভুগলে লালবাতি জ্বলতে দেরি হয় না।

মিঃ ফর্টেস্কুর ব্যাপারটা তার পরিবারের লোকেরা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁকে ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তার মৃত্যুটা তোমার বন্ধুদের ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে।

-ওরা কেউ আমার বন্ধু নয়, বব, বললেন নীল, ওরা একদল বিরক্তিকর মানুষ।

.

১০.

 ইউট্রিলজের ড্রইংরুমে পরিবারের সকলেই সেদিন জমায়েত হয়েছেন। পার্সিভাল ফর্টেস্কু সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে চলেছেন, এ একেবারে অসহনীয় অবস্থা। পুলিসের পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনো পর্যন্ত চলছে, খুশিমত তারা বাড়িতে যাওয়া আসা করছে। এসবের মধ্যে কোন পরিকল্পনা করা বা ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। বাড়ি ছেড়ে যে কেউ নড়বে, তারও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

তবুও মনে হয় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারি। ইলেইন, তোর কথা শোনা যাক। সেই জেরাল্ড রাইট না কি যেন নাম–তাকেই নাকি বিয়ে করছিস? তোরা কবে বিয়ে করছিস?

–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ইলেইন বলল।

–মাস ছয়েক অন্তত সময় নিচ্ছিস?

–না, অত দেরি করতে যাব কেন? মাসখানেকের মধ্যেই

 –বিয়ের পর কোন পরিকল্পনা আছে তোদের?

–পরিকল্পনা মানে ভাবছি একটা স্কুল খুলব।

–কথাটা শুনতে ভাল–কিন্তু আজকালকার দিনে বড় ঝুঁকির ব্যাপার। আমার মনে হয় ভাল করে ভাবনা চিন্তা করে একাজে হাত দেওয়া উচিত।

-বাধা তো থাকবেই। জেরাল্ড বলে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতি সঠিক শিক্ষার ওপরেই নির্ভর করে।

তোর টাকাটার ব্যাপারে মিঃ বিলিংসলে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, ভবিষ্যতে তোর ছেলেমেয়েদের জন্যই টাকাটা কোন ট্রাস্টের হাতে রাখা ভাল। একটা নিরাপত্তা থাকে।

–আমার ইচ্ছা অন্যরকম, ইলেইন বললেন, স্কুলটা চালু করার জন্য টাকার দরকার। কর্নওয়ালে একটা বাড়িও দেখা হচ্ছে। ওটা হলে কিছু বাড়তি ঘর তৈরি করে নিতে হবে।

–ইলেইন…তাহলে তুই ব্যবসা থেকে টাকাটা তুলে নিবি বলছিস? কাজটা মনে হয় ঠিক হবে না।

ব্যবসার অবস্থার কথা তো তুমিই বলেছিলে–বাবা মারা যাওয়ার আগে। তাই টাকা তুলে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলেই মনে করি।

–ইলেইন, ওরকম বলতে হয়। আমার পরামর্শ যদি শুনিস, আমি বলব এভাবে সবটাকা তুলে নিয়ে স্কুলের আসবাব কিনে খরচ করাটা ঠিক কাজ হবে না। যদি স্কুল না চলে, তুই একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবি।

ইলেইন জোর দিয়ে বলল, স্কুল ঠিক চলবে।

-আমি তোর পক্ষে ইলেইন, চেয়ারে ঘুরে বসে বললেন ল্যান্সলট, কাজে না নামলে আগাম কিছু বোঝা যায় না। তোরা নেমে পড় ইলেইন। তোর টাকা যদি নষ্টও হয়, সান্ত্বনা থাকবে যা করতে চেয়েছিস তা করেছিস।

-তুই তোর উপযুক্ত কথাই বলেছিস, বললেন পার্সিভাল, তোর পরিকল্পনাটা এবার শোনা যাক ল্যান্স। তুই নিশ্চয়ই আবার কেনিয়া পাড়ি জমাবার কথা ভবাছিস? নাকি একটা আশ্চর্য কাজ করার জন্য এভারেস্টের চুড়ায় উঠবি?

এরকম ভাবছ কেন? ল্যান্স বলল।

 –ইংলণ্ডের ঘরোয়া জীবনে তো কোনদিন সুস্থির হতে চাসনি না, তাই বলছি।

-বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবর্তনও আসে। এবারে আমি ভেবেছি পাকা ব্যবসাদার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করব।

তার মানে তুই…

–হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করব। তুমি তো সিনিয়র পার্টনার। তবে সামান্য জুনিয়র পার্টনার হিসেবে আমার যে অংশ ও অধিকার আছে, তাই কাজে লাগাব, ভাই পার্সি।

–সবই ঠিক আছে, পার্সি বলল তবে মুশকিল হল, তুই দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠবি। সত্যিই কি তুই ঠিক করেছিস ব্যবসাতে ঢুকবি?

-হ্যাঁ, তাই করছি। বলতে পারি পিঠেতে ভাগ বসাচ্ছি।

ব্যবসার অবস্থাটা মোটেই সুবিধার নয়। বড় জোর আমরা ইলেইনের টাকাটা দিতে পারব–যদি ও সেরকম চাপ দেয়। তাই ভাবছি–

–তাহলে কি বললাম ইলেইন, ল্যান্স বলল, সময় মতো টাকাটা তুলে নেওয়াই ভাল।

জেনিফার আর প্যাট, একটু দূরে জানালার পাশে বসে ওদের তিন ভাই বোনকে লক্ষ্য করে চলেছেন।

–এই যদি তোর মনের ইচ্ছা হয়ে থাকে, পার্সিভাল বললেন, তাহলেও বলব, আনন্দ পাবি না, দেখে নিস।

–আমার তা মনে হয় না ভাই পার্সি। প্রতিদিন শহরে অফিস করতে যাওয়া…কর্মচারীদের মধ্যে, বিশেষ করে স্বর্ণকেশী সেক্রেটারী মিস গ্রসভেনরের সান্নিধ্য…ইয়েস স্যার…হাঁ স্যর…শোনা…চমৎকার একটা পরিবর্তন ভাল না লেগে পারে?

–বোকার স্বর্গে বাস করা একেই বলে। ঈষৎ উত্তপ্ত কণ্ঠে বললেন পার্সিভাল, ব্যবসায় যে ঝামেলা পাকিয়ে উঠেছে সেই সম্বন্ধে কোন ধারণাই তোর নেই।

নেই তা জানি। তুমি তো রয়েছে–আমাকে তৈরি করে নেবে।

–দেখ, গত এক দেড় বছর বাবা নিজের মতো করে এমন সব অযৌক্তিক ঝুঁকি নিয়েছেন যে প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ভিত একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বোকার মত ভাল স্টক সব হাত ছাড়া করে ফাটকা খেলেছেন।

-তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, তার চায়ে যে ট্যাকসিন ছিল তা পরিবারের পক্ষে অশুভ হয়নি।

–কথাটা শুনতে খারাপ হলেও বাস্তব তাই। এখন যদি অন্তত কিছুদিন সাবধানে চলা যায় তাহলে অনেকটা সামলে ওঠা যাবে।

–কেবল সতর্কতায় কাজ হয় না, ঝুঁকিও নিতে হয়।

–তুই যাই বলিস, আমি যা বুঝি তা হল সতর্কতা আর মিতব্যয়িতা। বললেন পার্সিভাল।

–আমি ঝুঁকি নিতেই পছন্দ করি।

-দেখ ল্যান্স, ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন পার্সিভাল, আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি দুরকম, এই অবস্থায় একসঙ্গে চলতে পারব বলে মনে হয় না। হলেই বা মন্দ কি। বললেন লান্স।

–আমার মনে হয় অংশীদারী ব্যাপারটা বাতিল করে দেওয়াই ভাল হবে।

তার মানে আমার অংশটা তুমি কিনে নিতে চাইছ?

–অগত্যা। দৃষ্টিভঙ্গি যখন দুজনের দুরকম

-তাহলে আমার অংশের টাকা তোমাকে মেটাতে হবে। কিন্তু এই তো বলছিলে ইলেইনের টাকাটাই বড় জোর দেওয়া সম্ভব হবে। বাড়তি চাপ তাহলে মেটাবে কিভাবে?

-মানে…ইয়ে…আমি নগদ টাকার কথা বলছি না। স্থাবর সম্পত্তি আর বাড়িখানা আমরা ভাগ করে নিতে পারি।

–কথাটা নেহাৎ মন্দ বলনি। আমাকে ফাটকার অংশ দিয়ে নিজে নিরাপদ সম্পদ ভোগ করতে চাইছ। তবে কি জান…এক্ষেত্রে প্যাটের কথাটাও আমাকে ভেবে দেখতে হবে।

একটু থেমে আবার ল্যান্স বললেন, আমাকে তুমি একেবারেই বোকা ঠাউরে নিয়েছ, পার্সি। ভুয়ো হীরের খনি…ভুয়ো তেলের খনির ইজারা…এগুলোকে তুমি খুবই লাভজনক ভাবতে বলছ আমাকে

–এগুলোর সবই ফাটকাবাজি নয় ল্যান্স। কোন কোনটা খুবই লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।

–তুমি বাবার সেই পুরনো দিনের ব্ল্যাকবার্ড মাইনের মতো বাবার ফাটকা খেলার হালের মালগুলো আমাকে গছাতে চাইছ। হ্যাঁ, ভাল কথা পার্সি, ইনসপেক্টর কি তোমার কাছে ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা জানতে চেয়েছিলেন?

পার্সির ভ্রূ কুঞ্চিত হল। তিনি কি ভাবলেন।

–হ্যাঁ, জানতে চেয়েছিলেন। আমি বিশেষ কিছুই বলতে পারিনি। তখনতো তুই আর আমি দুজনেই ছেলেমানুষ ছিলাম। আমার যেটুকু মনে আছে, বাবা ওখান থেকে ফিরে এসে বললেন, সব ব্যাপারটাই বাজে।

–ওটা মনে হয়–সোনার খনি ছিল, তাই না? বলল ল্যান্স।

–মনে হয় তাই। বাবা নিশ্চিত ছিলেন ওখানে কোন সোনা ছিল না।

–ম্যাকেঞ্জি নামে একজন লোক মনে হয় বাবাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল।

–হ্যাঁ। ম্যাকেঞ্জি সেখানে মারা গিয়েছিলেন।

–আমার যেন ভাসা ভাসা মনে পড়ছে–ম্যাকেঞ্জি মারা যাবার পরে খুব একটা ঝামেলা : হয়েছিল…মনে হয় মিসেস ম্যাকেঞ্জি এখানে এসেছিলেন। বাবাকে দোষ দিয়ে অভিশাপও দিয়েছিলেন। আমার মনে আছে তিনি বলেছিলেন বাবাই তার স্বামীকে খুন করেছেন।

–এরকম কিছু হয়েছিল কিনা আমার ঠিক মনে পড়ে না।

–ওই ব্ল্যাকবার্ড খনিটা কোথায়? পশ্চিম আফ্রিকাতে কি?

–সম্ভবত তাই।

–অফিসে গেলে, ওই ইজারার ব্যাপারটা একবার দেখব।

–বাবাকে তো জানিস, পার্সি বললেন, তার ভুল হবার কথা নয়।

–মিসেস ম্যাকেঞ্জি আর যে দুটো বাচ্চাকে তিনি এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের কি হল কে জানে। ছেলেমেয়ে দুটোর এতদিনে তো বেশ বড় হবার কথা।

.

পাইউড প্রাইভেট স্যানাটোরিয়াম।

ইনসপেক্টর নীল ভিজিটার্স রুমে একজন বয়স্কা মহিলার মুখোমুখি বসে কথা বলছেন। ইনি হলেন হেলেন ম্যাকাঞ্জি। বয়স ষাট পার হয়েছে। মুখভাবে দুর্বলতার চিহ্ন। চোখে শূন্য দৃষ্টি। তার কোলের ওপর একখানা বই।

স্যানাটোরিয়ামের অধিকর্তা ডাঃ ক্রসবি রোগিনী সম্পর্কে জানিয়েছেন, তাকে পুরোপুরি মানসিক রোগগ্রস্ত বলা চলে না। বেশির ভাগ সময়েই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেন।

মিসেস ম্যাকেঞ্জির সামনে বসে ডঃ ক্রসবির কথাটাই স্মরণ করবার চেষ্টা করলেন নীল।

মাদাম, আমি এক মিঃ ফর্টেস্কুর সম্পর্কে কিছু কথা আপনাকে বলতে এসেছিলাম। ভদ্রলোকের পুরো নাম মিঃ রেক্স ফর্টেঙ্কু। আপনি নামটা শুনেছেন বলেই আমার ধারণা।

মিসেস ম্যাকেঞ্জি বইয়ের ওপরে চোখ ধরে রেখেই বললেন, না, ওই নাম কখনোই শুনিনি।

–আমার ধারণা, বেশ কয়েক বছর আগে তাকে আপনি চিনতেন।

–সে তো গতকালের কথা।

ডঃ ক্রসবির কথা ইনসপেক্টর নীলের মনে পড়ল। তিনি হতাশ না হয়ে বললেন, আপনি বেশ কয়েক বছর আগে ইউট্টি লজে তার বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

–হ্যাঁ, খুব সাজানো গোছানো বাড়ি।

-মিঃ ফর্টেস্কু পশ্চিম আফ্রিকায় একটা খনির ব্যাপারে আপনার স্বামীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেটা হল ব্ল্যাকবার্ড খনি।

-বইটা পড়ে শেষ করতে হবে–বেশি সময় নেই।

–নিশ্চয়ই মাদাম; নীল বললেন, মিঃ ম্যাকেঞ্জি আর মিঃ ফর্টেঙ্কু একসঙ্গে আফ্রিকা গিয়েছিলেন খনিটা দেখবেন বলে।

–আমার স্বামীই খনিটা আবিষ্কার করেছিলেন, বললেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি, আর তার দাবী জানিয়েছিলেন। খনি চালু করবার মতো টাকা তার ছিল না, তাই মিঃ ফর্টেস্কুর কাছে গিয়েছিলেন। অতসব আগে জানতে পারলে আমি তাকে কিছুতেই যেতে দিতাম না।

–হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। মিঃ ম্যাকেঞ্জি আফ্রিকায় গিয়ে জ্বর হয়ে মারা যান। নীল বললেন।

–ওহঃ, বইটা আমাকে পড়তে হবে। বইয়ের ওপর থেকে চোখ না তুলেই বললেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি।

–আপনার কি মনে হয় ওই ব্ল্যাকবার্ড খনির ব্যাপারে মিঃ ফর্টেস্কু আপনার স্বামীকে ঠকিয়েছিলেন?

–আপনি বড় বোকা।

–মানে বলছি… অনেক দিন আগের ঘটনা তো…এতদিনে সব মিটে গেছে…

 –মিটে গেছে, কে বলেছে?

 –তাহলে মেটেনি? নীল বললেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল—

ওসব বাজে কথা। সে জ্বর হয়ে মরেছে।

–আমি মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর কথা বলছি। বললেন নীল।

এবারে হালকা নীলাভ চোখ তুলে মিসেস ম্যাকেঞ্জি নীলের দিকে তাকালেন।

–আমিও তাই বলছি। সে নিজের বিছানায় শুয়ে মরেছে।

–উনি মারা যান সেন্ট জিউডস হাসপাতালে।

–কিন্তু আমার স্বামী কোথায় মারা যান কেউই তা জানে না। কোথায় তাকে কবর দেওয়া হয় তাও কেউ জানে না। রেক্স ফর্টেঙ্কু যা বলেছে সকলে তাই জানে। অথচ লোকটা জঘন্য মিথ্যাবাদী।

-আপনার কি মনে হয় মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু আপনার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী?

আজ সকালে তো ডিম খেয়েছিলাম, বলে উঠলেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি, তবু মনে হয় এই তো মাত্র ত্রিশ বছর আগের ঘটনা।

নীল একটু থমকে গেলেন। বুঝতে পারলেন, এভাবে চললে আসল কথায় পৌঁছনো যাবে না। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন।

–এক মাস আগে, চাপ দিয়ে বলতে লাগলেন নীল, কে যেন মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর টেবিলের ওপরে কয়েকটা মরা কালো পাখি রেখে দিয়েছিল।

–দারুণ ব্যাপার দেখছি।

–আপনার কোন ধারণা আছে মাদাম, এরকম কাজটা কে করে থাকতে পারে?

-ধারণা দিয়ে কি কাজ। আসল কথাটাই হল, আমি ওদের এই কাজ করার জন্যই মানুষ করে তুলেছিলাম, বুঝলেন?

–আপনার ছেলেমেয়েদের কথা বলছেন?

–হ্যাঁ। ডোনাল্ড আর রুবিওদের যখন মাত্র নয় আর সাত বছর বয়স তখন ওরা ওদের বাবাকে হারায়। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাতে আমি ওদের শপথ করিয়েছি।

ইনসপেক্টর নীল এবারে নড়েচড়ে বসলেন।

–আপনি ওদের কি শপথ করিয়েছিলেন?

–তারা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে–তাকে খুন করবে।

–ওহ, কাজটা ওরা করতে পেরেছিল?

–জেরাল্ড ডেনমার্ক গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ওরা তার করে জানিয়েছিল জেরাল্ড যুদ্ধে মারা গেছে।

-খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আপনার মেয়ের কি হয়?

–কোন মেয়ে তো আমার নেই।

 –আপনার মেয়ে রুবির কথা বলছি।

–ওহ রুবি? তাকে আমি বাতিল করে দিয়েছি। সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি। কথাটা আপনি জানেন।

-আপনার মেয়ে এখন কোথায়, মাদাম?

 –আমার কোন মেয়ে নেই, আপনাকে তো আগেই বলেছি। রুবি ম্যাকেঞ্জি বলে আর কেউ নেই।

–আপনি বলছেন সে মারা গেছে?

–মারা গেলে বরং ভালই হত, আচমকা হেসে উঠলেন মিসেস ম্যাকেঞ্জি, নাঃ বড্ড সময় নষ্ট হচ্ছে আপনার সঙ্গে কথা বলে। বইটা আমাকে পড়তে হবে।

আবার থমকে গেলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি আরও কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিসেস ম্যাকেঞ্জি কোন উত্তর করলেন না। তিনি পুনঃ পুনঃ বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন।

বাধ্য হয়েই উঠে পড়লেন নীল। সুপারের ঘরে এলেন।

-ওর সঙ্গে দেখা করবার জন্য কেউ আসেন?

–আমি দায়িত্ব নিয়ে আসার পরে কেউ আসেন নি। শুনেছি, আমার আগে যিনি ছিলেন, তার সময়ে মহিলার মেয়ে দেখা করতে আসতেন। কিন্তু মেয়েকে দেখলেই তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। বারবার এমন হওয়ায় তাকে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়।

–ওঁর মেয়ে রুবি ম্যাকেঞ্জি এখন কোথায় থাকতে পারেন, আপনার কোন ধারণা আছে?

–না, একেবারেই না।

এখন সবকিছু সলিসিটারের মাধ্যমেই হয়। আপনি তার সঙ্গে দেখা করলে হয়তো কিছু জানতে পারেন।

ইনসপেক্টর নীল আগেই সলিসিটরের সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেনি।

বেশ কয়েক বছর আগেই মিসেস ম্যাকেঞ্জির জন্য একটা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল। তারপর থেকে তারা আর মিস ম্যাকেঞ্জিকে দেখেননি। এখন ট্রাস্টই তার ব্যাপারটা দেখেন।

রুবি ম্যাকেঞ্জির চেহারার সঠিক বর্ণনাও কারোর কাছ থেকে জানা সম্ভব হয়নি। একজন মেট্রন জানালেন, ছোটখাট, ছিপছিপে চেহারা। অন্য একজন বলেন, চেহারা ভারিক্কী–গোলগাল। একরকম হতাশ হয়েই নীল দপ্তরে ফিরে এলেন।