১.১ কনসোলিডেটেড ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট অফিসে

পকেট ফুল অফ রাই (১৯৫৩) / আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

প্রথম পর্ব

০১.

কনসোলিডেটেড ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট অফিসে এই সময় চা তৈরির পালা এক এক জনের। আজ নতুন টাইপিস্ট মিস সোমার্স চা তৈরি করে সকলকে দিল।

অফিসের কর্তা মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি মিস গ্রসভেনর। তিনিই বিশেষ চা’টা তৈরি করে মিঃ ফর্টেস্কুর কামরায় ঢুকলেন।

স্বর্ণকেশ এই সুন্দরী মহিলার চলা বলা সমস্ত কিছুই আকর্ষণীয়। বেশবাস ও প্রসাধনে সে নিজেকে আরও মোহনীয় করে তুলবার চেষ্টা করে।

অফিসে এ নিয়ে অনেকেই কানাঘুষা করে। তবে তা ঠিক নয়। মিঃ ফর্টেঙ্কু সম্প্রতি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীটিও যথেষ্ট সুন্দরী। কাজেই অফিসের কোন সুন্দরীর দিকে তার নজর পড়বার কথা নয়।

রাজহংসীর ভঙ্গিতে চায়ের ট্রে হাতে মিস গ্রসভেনর কামরায় ঢুকে কর্তার টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। মিষ্টি স্বরে বললেন, আপনার চা মিঃ ফর্টেস্কু।

বেলা এগারোটা দশ মিনিট। খানিকক্ষণ আগে চা দেওয়া হয়েছে।

সহসা মিস গ্রসভেনরের টেবিলের কলিংবেল তীব্রস্বরে বেজে উঠল।

জরুরী ডাকের ইঙ্গিত পেয়ে চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন মিস গ্রসভেনর। ধীর ছন্দে মিঃ ফর্টেস্কুর কামরার সামনে এসে তিনি টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

মুহূর্তে যেন এক তীব্র ধাক্কা খেলেন তিনি। যে দৃশ্য চোখের সামনে দেখলেন তা তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল।

মিঃ ফর্টেস্কু ডেস্কের পেছনে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। শরীর জুড়ে ভয় জাগানো আক্ষেপ।

–ওহ্ মিঃ ফর্টেস্কু..আপনি কি অসুস্থ

কোনরকমে বলবার চেষ্টা করলেন মিস গ্রসভেনর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন কিন্তু তাঁর পৌঁছবার আগেই মিঃ ফর্টেস্কুর দেহ যন্ত্রণায় প্রায় ধনুকের মতো বেঁকে গেল।

–ওই চা–কি দিয়েছ–একজন ডাক্তার

যন্ত্রণাকাতর শব্দ কয়টি অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলেন তিনি।

মিস গ্রসভেনর সন্ত্রস্ত কপোতর মতো ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে টাইপিস্টদের ঘরে ঢুকলেন। চিৎকার করে বললেন, মিঃ ফর্টেঙ্কু বোধহয় মরতে চলেছেন…অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন…এখুনি একজন ডাক্তার ডাকতে হবে…তার অবস্থা সংকটজনক।

মুহূর্তে সমস্ত অফিসে তোলপাড় শুরু হল।

ষোল বছরের পুরনো কর্মী, অফিসের প্রধান টাইপিস্ট মিস গ্রিফিথ অফিসের ছোকরা বয়কে একজন ডাক্তার ডেকে আনতে পাঠিয়ে দিলেন।

অপর একজন, মিঃ ফর্টেস্কুর ব্যক্তিগত ঠিকানা লেখা বই খুঁজতে শুরু করলেন। তাতে খুঁজে পাওয়া গেল হার্লে স্ট্রীটের স্যর এডউইন স্যাণ্ডেম্যালের ঠিকানা।

মিস গ্রসভেনর ততক্ষণে একটা চেয়ারে এলিয়ে পড়েছেন। কাতর স্বরে বলছেন, রোজকার মতোই চা বানিয়েছিলাম…ওতে তো কোন গোলমাল থাকতে পারে না–

মিস গ্রিফিথ ডাক্তারকে টেলিফোন করছিলেন। রিসিভার হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একথা বলছ কেন?

–মিঃ ফর্টেঙ্কু বললেন,…চায়ের মধ্যে ছিল….

কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসের ছোকরা বয়ের চেষ্টায় আর মিস গ্রিফিথের টেলিফোনে দুজন ডাক্তার আর দুটো আলাদা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল অফিসের সামনে।

মিঃ ফর্টেস্কুকে সেন্ট জিউড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

ডঃ আইজ্যাক্স বেথনাল গ্রিন আর হার্লে স্ট্রীটের স্যর এডুইন স্যাণ্ডেম্যাল মিঃ ফর্টেস্কুর আকস্মিক অসুস্থতাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে মনে করেননি।

ইনসপেক্টর নীল ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিয়মমাফিক তদন্তের কাজ শুরু করেছিলেন।

তিনি মিস গ্রসভেনরের কাছ থেকে সকালে মিঃ ফর্টেস্কুর চা পর্বের সমস্ত বর্ণনা শুনে নিয়েছেন।

আনুপূর্বিক ঘটনার বর্ণনা মিস গ্রিফিথের কাছ থেকেও শুনেছেন আলাদা ভাবে।

অফিসের কাপ ডিস, চায়ের পাত্র ইত্যাদি সরঞ্জাম সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের জন্য যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ইনসপেক্টর জানতে পারলেন এসব বাসনপত্র কেবল মিস আইরিন গ্রসভেনরই হাতে নিয়েছিলেন। কেবল কেটলিটা সকলের চায়ের জন্যই ব্যবহার করা হয়েছিল।

মিস গ্রসভেনরের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হলে সেন্ট জিউস হাসপাতাল থেকে ফোন এল। ধরলেন ইনসপেক্টর নীল।

ওপাশ থেকে আবেগবর্জিত গলায় শোনা গেল, পাঁচ মিনিট আগে মিঃ ফর্টেস্কু মারা গেছেন।

ইনসপেক্টর নীল নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে ব্লটিং কাগজে লিখে রাখলেন বারোটা তেতাল্লিশ।

সেন্ট জিউস হাসপাতালের ডঃ বার্নসডর্ফ বছর খানেক আগে একটি বিষপ্রয়োগের ঘটনায় ইনসপেক্টর নীলের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

ডঃ বার্নসডর্ফ স্বয়ং ইনসপেক্টর নীলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললেন।

–হ্যাল্লো নীল, বুড়ো শকুন, বিষের লাশ নিয়ে পড়েছ আবার?

–হ্যাল্লো ডাক্তার, আমাদের রোমী মারা গেছে শুনলাম।

–হ্যাঁ। আমাদের কিছুই করার ছিল না।

–মৃত্যুর কারণ জানা গেছে?

–ময়না তদন্তের আগে কিছু বলা ঠিক হবে না। এটুকু বলতে পারি, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়–কথাটা অবশ্য ব্যক্তিগত।

–নিশ্চয়ই…নিশ্চয়ই…তাহলে বলছেন বিষপ্রয়োগের ঘটনা?

–অবশ্যই। বেসরকারীভাবে আর একটা কথা জানাচ্ছি, ভায়া, বিষটা ছিল ট্যাকসিন –

ট্যাকসিন–সে আবার কি রকম বিষ…কোন দিন তো নাম শুনিনি–

-খুবই স্বাভাবিক। খুব কম লোকেই নামটা জানে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই এরকম একটা কেস আমার হাতে আসে। একটা বাচ্চা খেলার সময় ইউ গাছের ফল খেয়ে বিভ্রাট বাঁধিয়েছিল…একই কেস

–ইউ গাছের ফল?

-ফল বা পাতা। সমান বিষাক্ত। এর উপক্ষার হল ট্যাক্সিন। এসব কাজে ট্যাক্সিন একেবারে মোক্ষম। অবশ্য আমারও ভুল হতে পারে…তবে তোমাকে ব্যক্তিগত ভাবে জানালাম। কাজটা খুবই আগ্রহ জাগাবার মতো–ভদ্রলোকের জন্য দুঃখ হয়।

–মারা যাবার আগে তিনি কিছু বলেছিলেন?

–তোমার লোক পাশেই ছিল, লিখে নিয়েছে। তার কাছ থেকে জানতে পারবে সব কিছু। অফিসে চায়ের মধ্যে কিছু দেওয়া হয়েছিল এরকম কথা তিনি বলেছিলেন–অবশ্য এটা ঠিক নয় একেবারে।

–ঠিক নয় বলছ কেন?

–কারণ হল, এই বিষটা দ্রুত কাজ করতে পারে না। আমার বিশ্বাস, বিষের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তিনি চা পান করার পরেই।

–হ্যাঁ, অফিসের লোকরা এরকমই জানিয়েছে।

–সায়ানাইড আর মাত্র কয়েক ধরনের বিষই আছে যা দ্রুত কাজ করে।

–এক্ষেত্রে সায়ানাইড জাতীয় কিছু নয় বলছ?

-না, ভায়া, ওরকম বিষের কোন সম্ভাবনাই নেই। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছবার আগেই তিনি মারা যান। বেসরকারী ভাবেই তোমাকে বলছি, আমি বাজি রেখে বলতে পারি বিষটা ছিল ট্যাকসিন।

–এই বিষের প্রতিক্রিয়া হতে কত সময় লাগে?

–ধর, এক থেকে তিন ঘণ্টা। সময়টা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। মৃতব্যক্তির প্রাতরাশটা ভালই করা ছিল মনে হয়। তাই বিষের ক্রিয়া একটু সময় নিয়ে হয়েছে।

–প্রাতরাশ? চিন্তিত ভাবে বললেন ইনসপেক্টর নীল।

–তোমার শিকার সফল হোক ভায়া…তাহলে রাখছি।

–ধন্যবাদ ডাক্তার। ফোনটা দয়া করে একটু সার্জেন্টকে দিন। তার সঙ্গে কথা বলব।

একটু পরেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে সার্জেন্ট হে’র গলা ভেসে এল।

-বলুন স্যর

–নীল বলছি। আমাকে শোনাবার মতো কিছু কি আছে–মৃত ব্যক্তি কি বলেছিলেন?

-উনি বলেছিলেন চায়ে কিছু ছিল–অফিসে খেয়েছিলেন। তবে মেডিক্যাল অফিসার অন্য কথা বলেছেন।

-হ্যাঁ, সেকথা শুনেছি। আর কিছু?

–একটা অদ্ভুত ব্যাপার স্যর। উনি সে স্যুট পরেছিলেন তার পকেট পরীক্ষা করে আমি রুমাল, চাবি, পকেটব্যাগ, খুচরো টাকা–সাধারণত যা থাকে তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত জিনিস পেয়েছি।

–কি জিনিস?

–তার জ্যাকেটের ডানদিকের পকেটে কিছু শস্যের দানা ছিল।

–শস্যদানা? কি শস্য? প্রাতরাশের কোন খাবার কি? বার্লি, গম বা ভুট্টার দানা—

ওটা রাই বলেই মনে হল স্যর, বেশ কিছুটা পরিমাণেই ছিল–

–আশ্চর্য ব্যাপার…ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু হবে সম্ভবত–কোন নমুনা—

আমারও তাই ধারণা–তবে জানানো উচিত মনে হল–তাই –

ঠিক কাজই করেছ।

চিন্তিত ভাবে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ইনসপেক্টর নীল। অফিসেই বিষপ্রয়োগ হয়েছে–এরকম সন্দেহটা মাথা জুড়ে ছিল। সন্দেহ থেকে এবারে নিশ্চিত অবস্থায় এলেন।

রেক্স ফর্টেস্কুকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে লক্ষণ প্রকাশ হবার অন্তত এক থেকে তিন ঘন্টা আগে।

সুতরাং একটা দিকে নিশ্চিত হওয়া গেল যে অফিসের কর্মচারীরা এ ব্যাপারে নির্দোষ।

মিঃ ফর্টেস্কুর খাস কামরায় বসে এতক্ষণ কাজ করছিলেন ইনসপেক্টর নীল। তার সঙ্গে একজন অধস্তন পুলিস কর্মচারীও ছিল।

এবার সেখান থেকে উঠে তিনি অফিসের বাইরের ঘরে এলেন। সেখানে টাইপিস্টরা টাইপরাইটারে কাজ করছিলেন। কিন্তু তাদের কাজে কোন গতি ছিল না।

মিস গ্রিফিথকে ডেকে হাসপাতাল থেকে পাওয়া দুঃসংবাদটা জানালেন নীল।

–মিঃ ফর্টেস্কু বারোটা তেতাল্লিশে মারা গেছেন।

মিস গ্রিফিথ আশ্চর্য হলেন না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন মনে হয় তিনি অসুস্থ ছিলেন।

কোন রকম ভূমিকা না করে নীল এরপর সরাসরি মিস গ্রিফিথকে বললেন, মিঃ ফর্টেস্কুর পরিবারের কিছু খবরাখবর আমার জানা দরকার। আপনি নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করবেন?

নিশ্চয়ই ইনসপেক্টর।

এরপর এসম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে যা জানা গেল তা এরকম।

মিঃ ফর্টেস্কু সপরিবারে বেডন হীথ অঞ্চলে অভিজাত পাড়ায় নিজস্ব বাড়িতে বাস করেন। লণ্ডন থেকে এই অঞ্চলের দূরত্ব মাত্র কুড়ি মাইল। ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা খুবই ভাল।

বছর দুয়েক আগে মিঃ ফর্টেঙ্কু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। প্রথম মিসেস ফর্টেষ্ণু বহুদিন আগে মারা যান। দ্বিতীয়া স্বামীর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।

প্রথম পক্ষের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা হল পার্সিভাল ও ল্যান্সলট। মেয়ে ইলেইন।

মেয়ে বাড়িতেই থাকে। বড় ছেলেও। তিনি ব্যবসার একজন অংশীদার। সম্প্রতি ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে ইংলণ্ডের উত্তরাঞ্চলে গেছেন। আগামীকাল তার ফিরে আসার কথা।

মিঃ ফর্টেস্কুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর মিঃ পার্সিভালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে, হোটেলে পাওয়া যায়নি। তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের হোটেল ছেড়ে আজ সকালেই অন্যত্র চলে গেছেন।

মিঃ ফর্টেস্কুর দ্বিতীয় ছেলে মিঃ ল্যান্সলট, বাবার সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি বিদেশে থাকেন।

দুই ছেলেই বিবাহিত। মিঃ পার্সিভাল বছর তিন আগে বিয়ে করেছেন। তিনি ইউটি লজেই আলাদা ফ্ল্যাটে থাকেন। তবে শিগগিরই বেডন হীথেই নিজেদের বাড়িতে উঠে যাবেন।

আজ সকালে বেডন হীথেও টেলিফোন করা হয়েছিল। মিসেস ফর্টেস্কুকে পাওয়া যায়নি, তিনি গলফ খেলতে গেছেন।

মিসেস পার্সিভালকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। তিনি সারাদিনের জন্য লণ্ডনে গেছেন।

ছোট ছেলে মিঃ ল্যান্সলট বছর খানেক হল বিয়ে করেছেন। তিনি বিয়ে করেছেন লর্ড ফ্রেডরিক অ্যানটিসের বিধবাকে। তাদের বিয়ের ছবি কাগজে ছাপা হয়েছিল।

প্রয়াত লর্ড ফ্রেডরিক অ্যানটিসের নামটি ইনসপেক্টর নীলের জানা। খেলাধুলার জগতে খুব দুর্নাম ছিল ভদ্রলোকের। একটা ঘোড়া দৌড়াবার আগে তিনি নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

তার স্ত্রীর সম্পর্কেও একটি ঘটনা নীলের জানা। তিনি এর আগে বিয়ে করেছিলেন এক বৈমানিককে। ব্রিটেনের যুদ্ধে তিনি মারা যান।

এরপর নীল ফোন করলেন বেডন হীথে ইউট্টি লজে। কিন্তু এব্যাপারে কথা বলার মতো সেই সময় বাড়িতে ফর্টেন্ধু পরিবারের কেউই উপস্থিত ছিলেন না।

বাড়ির হাউসকিপার মিস ডাভের সঙ্গেই অগত্যা কথা বললেন নীল। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি জানালেন মিঃ ফর্টেস্কুকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তার মৃত্যু হয়েছে।

এধরনের আকস্মিক মৃত্যুতে নিয়মমাফিক কিছু তদন্ত পুলিসকে করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি সেকাজেই বাড়িতে আসছেন।

.

–মিস গ্রিফিথ, এবারে আর কিছু, যা আপনি জানেন, আমাকে জানালে খুশি হব। আচ্ছা মিঃ পার্সিলের সঙ্গে তার বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল? প্রশ্ন করলেন নীল।

ইদানীং তাদের বনিবনা হচ্ছিল না। মিঃ পার্সিভাল তার বাবার অনেক কথাই মেনে নিতে পারছিলেন না। এই নিয়েই কথা কাটাকাটি হতো।

পিতা পুত্রের এসব ঝগড়াঝাটি আপনারাও শুনেছিলেন?

-হ্যাঁ, শুনেছিলাম। মিঃ ফর্টেস্কু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ল্যান্সকে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন। সে ভাল ঘরে বিয়ে করেছেন, তার বুদ্ধিও বড় ছেলের চেয়ে অনেক বেশি চোখা।

এরপর অফিসের অন্য কর্মী মিস গ্রসভেনরের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলেন নীল।

মিস গ্রিফিথ বিদায় নিলে ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ওয়েট তার ঊধ্বর্তন অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ ফর্টেস্কু যে ধরনের ব্যবসা করতেন, তাতে বাজারে তার অনেক শত্রু থাকা অসম্ভব নয়।

–হ্যাঁ, শক্ত নিশ্চয়ই ছিল, বললেন নীল, তবে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল বাড়িতে, অফিসে নয়। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে আমি একটা পরিচিত নক্সা দেখতে পাচ্ছি, ওয়েট। দেখ, ভদ্রলোকের দুই ছেলে, বড়টি ভাল। ছোট ল্যান্স বদ। এদিকে স্ত্রীর বয়স স্বামীর চেয়ে ঢের কম। স্ত্রীটির আবার গলফের মাঠে যাতায়াত আছে। খুবই পরিচিত একটা ছক।

এই সময় মিস গ্রসভেনর ঘরে প্রবেশ করলেন। ইনসপেক্টর তাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

পরে সরাসরিই প্রশ্ন করলেন, মৃত মিঃ ফর্টেস্কু সম্পর্কে আপনাকে দু-একটি প্রশ্ন করতে চাই। ইদানীং তার মধ্যে কোন পরিবর্তন কি আপনি লক্ষ্য করেছিলেন?

পরিবর্তন, মিস গ্রসভেনর বললেন, ঠিক পরিবর্তন কিনা বলতে পারব না, তবে হঠাৎ করেই কেমন রেগে উঠতেন। বিশেষ করে মিঃ পার্সিভাল সম্পর্কে।

–আর একটা প্রশ্ন কেবল আপনাকে করছি মিস গ্রসভেনর। মিঃ ফর্টেস্কুর কি পকেটে শস্যের দানা নিয়ে ঘোরার অভ্যাস ছিল?

-শস্যের দানা? পকেটে? অত্যন্ত বিস্মিত হলেন মিস গ্রসভেনর, এরকম কেন হবে… না না…

ধরুন বার্লি, রাই বা এই জাতীয় কিছু ব্যবসাসংক্রান্ত লেনদেন বা নমুনা হিসেবে

-ওহ না। এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য তিনি প্রতীক্ষা করছিলেন। আর আসার কথা ছিল এট্ৰিকাস বিল্ডিং সোসাইটির প্রেসিডেন্টের

মিস গ্রসভেনরের কাছ থেকে আর কিছু জানার ছিল না। ইনসপেক্টর নীলের সামনে ব্যাখ্যাহীন প্রশ্ন হয়ে রয়ে গেল এক পকেট রাই।

.

ইউট্টি লজের সামনে গাড়ি থেকে যখন নামলেন ইনসপেক্টর নীল আর ডিটেকটিভ কনস্টেবল ওয়েট–মিস ডাভ জানালা দিয়ে দুজনকে আগেই দেখতে পেলেন।

ইউট্রি লজ নামের বিশাল বাড়িটা লাল ইটের তৈরি। অনেকটা লম্বাটে ধরনের। মাঝে মাঝে টালিবসানো ত্রিকোণ আর শার্সিলাগানো জানালা।

সামনে বিস্তীর্ণ বাগান। সেখানে চোখে পড়ে গোলাপ ফুলের গাছের সঙ্গে নানা জাতের লতা। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ইউ গাছের ঝোপ।

বাড়ির ডানপাশে বিশাল এক ইউ গাছ খোলা আকাশে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে বেড়ে উঠেছে। তার তলায় অজস্র সেই বিষফল।

যে কেউ এসব ফল দিয়ে ইচ্ছে মতো ট্যাকসিন তৈরি করে নিতে পারে–চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবলেন নীল।

অস্বস্তিকর ভাবনাটা মাথায় নিয়েই সদর দরজার ঘণ্টা বাজালেন তিনি। দরজা খুলে তাকে অভ্যর্থনা করল মধ্যবয়স্ক একজন লোক।

নিজের আর সঙ্গীর পরিচয় দিয়ে নীল জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস ফর্টেস্কু ফিরেছেন?

-না, স্যর।

–মিঃ পার্সিভাল বা মিস ফর্টেস্কু?

–না, স্যর।

–তাহলে আমি মিস ডাভের সঙ্গেই কথা বলতে চাই।

–ওই যে উনি আসছেন। একপাশে সরে গিয়ে বলল লোকটি।

এইসময় সিঁড়ি দিয়ে কৃশ চেহারার একজন মহিলাকে নিচে নেমে আসতে দেখা গেল। তার পরণে হালকা রঙের পোশাক। নিখুঁত ভাবে চুল বাঁধা। ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট রহস্যময় হাসির রেখা।

মিস ডাভ নিজের পরিচয় দিয়ে পুলিস অফিসার দুজনকে অভ্যর্থনা জানালেন।

ইনসপেক্টর নীল বললেন, যতদূর জানা গেছে সকালে প্রাতরাশের সঙ্গেই মিঃ ফর্টেঙ্কু এমন কিছু গ্রহণ করেছিলেন, যা তার আকস্মিক মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সার্জেন্ট হে যাতে রান্নাঘরে গিয়ে যেসব খাবার দেওয়া হয় সেগুলো পরীক্ষা করতে পারেন আপনি দয়া করে তার ব্যবস্থা করে দিন।

-ওহ, নিশ্চয়ই, বললেন মিস ডাভ। পরে পাশে দাঁড়ানো বাটলারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ক্রাম্প, তুমি সার্জেন্ট হে-কে রান্নাঘরে নিয়ে যাও। তিনি যা যা দেখতে চান দেখিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর।

দুজনে বিদায় নিলে মিস ডাভ ইনসপেক্টরকে একটা ছোট ঘরে নিয়ে এলেন। দুজনে মুখোমুখি একটা টেবিলে বসলেন।

–এই মুহূর্তে বাড়িতে পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের কথা। তবে মিসেস ফর্টেস্কু যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারেন। মিসেস পার্সিভালও তাই। আমি অবশ্য মিঃ পার্সিভালের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে চলেছি।

–ধন্যবাদ মিস ডাভ। বললেন নীল।

-প্রাতরাশের কিছু খাবার পেয়ে মিঃ ফর্টে অসুস্থ হয়েছেন আপনি বলছেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব?

–বাড়ি থেকে বেরনোর আগে প্রাতরাশে তিনি কি শস্যদানার মতো কিছু খেয়েছিলেন?

–না, ওসব কিছু তার পছন্দ নয়।

 –সকালে তিনি কোনরকম ওষুধ খেতেন? হজমের ওষুধ বা টনিক জাতীয় কিছু?

–না, এ ধরনের কিছু খেতেন না।

–প্রাতরাশে কে কে উপস্থিত ছিলেন?

মিসেস ফর্টেস্কু, মিস ফর্টেস্কু, মিসেস ভাল ফর্টেস্কু। মিঃ পার্সিভাল বাইরে ছিলেন।

কথাটা শুনে একটু চিন্তিত হলেন ইনসপেক্টর নীল। স্ত্রী, আর পুত্রবধূ মাত্র দুজন ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির সঙ্গে প্রাতরাশ করেছিলেন। এদের মধ্যে যে কোন একজনের পক্ষে কফিতে ট্যাকসিন মিশিয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কফির সঙ্গে ট্যাকসিনের কটুস্বাদ ধরা পড়বার কথা নয়।

মিস ডাভ নিবিষ্ট চোখে নীলকে দেখছিলেন। তার চোখে চোখ পড়তেই মিস ডাভ বলে উঠলেন, কোন বিষক্রিয়ার ঘটনায় কখনো জড়িয়ে থাকিনি।

-কাজটা কে করতে পারে আপনার কোন ধারণা আছে মিস ডাভ?

 প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন নীল।

-কোন ধারণা নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন মিস ডাভ, তবে কি জানেন, সত্যি কথা বলতে তিনি এমন বিরক্তিকর মানুষ ছিলেন যে, বাড়ির কোন মানুষ তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না।

ব্যাপারটা আরো গভীরের মিস ডাভ। এই বাড়ির সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে নিশ্চয় আপনার আপত্তি নেই?

নির্লিপ্ত মুখে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করলেন মিস ডাভ।

–আমার বক্তব্য যদি আদালতে বলা না হয় তাহলে ব্যক্তিগত ভাবে যা জানি বলতে পারি।

–তাহলে নিশ্চিন্তে বলুন আপনি। আমার কাজে সাহায্য হবে।

একটু ঝুঁকে বসলেন মিস ডাভ। একমুহূর্ত চুপ করে কি ভাবলেন। পরে বলতে শুরু করলেন।

-দেখুন ইনসপেক্টর, আমাকে যাতে আপনি ভুল না বোঝেন তাই শুরুতেই একটা কথা বলে নেই। আমার মনিবের প্রতি বিদ্বেষ বা আনুগত্য কোনটাই নেই। আমি টাকার জন্য কাজ করি। প্রয়োজনে আমি সব কাজ যেমন করতে পারি তেমনি, টাকা খরচ করে পাকা লোকদেরই কাজে লাগাই।

এই বাড়িতে টাকা খরচ করতে কেউ কার্পণ্য করে না। তাই মিসেস ক্রাম্পের মত পাকা রাঁধুনি রয়েছে এখানে। আর বাটলার ক্রাম্পও তার কাজ ঠিকঠাকই করে।

বাড়ির লোকদের সম্পর্কে আমার ধারণার কথাই নিশ্চয় আপনি জানতে চেয়েছেন; তাই না ইনসপেক্টর।

-যদি কিছু মনে না করেন। বললেন নীল।

–আমাদের মনিব প্রয়াত মিঃ ফর্টেস্কুর প্রশংসা করা সম্ভব নয়। কেননা, প্রায়ই তিনি তার চতুর শঠতার বিষয় বাড়িতে গল্প করতেন। তাছাড়া এমন কটুভাষী ছিলেন যে…তাছাড়া বাড়ির সকলেই বলতে গেলে সমান বিরক্তিকর।

মিসেস ফর্টেস্কু–অ্যাডেল, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, বয়সে তিনি স্বামীর চেয়ে প্রায় ত্রিশ বছরের ছোট। দেখতে সুন্দরী…যৌনআবেদনময়ী, তবু যে তিনি মিঃ ফর্টেস্কুকে বিয়ে করেছিলেন, তা কেবল টাকার লোভে। অসম্ভব টাকার নেশা তার।

এই বিয়েতে মিঃ ফর্টেস্কুর দুই ছেলেমেয়ে পার্সিভাল ও ইলেইন মোটেও খুশি হতে পারেনি। তাদের অশোভন ব্যবহার মিসেস বুদ্ধিমতীর মতই অগ্রাহ্য করেন।

প্রথমে মিঃ পার্সিভালের কথাই শোনা যাক।

–পার্সিভালের কথা? ওর স্ত্রী তাকে ভ্যাল বলে ডাকে। নিজেও ওই নাম পছন্দ করেন। পিতার মতই শঠ আর ধূর্ত। সবসময় নিজের কাজ হাসিল করার মতলবে থাকেন। তবে বাবার

মত খরচে নয়, বরং খুব বিপরীত।

পার্সিভালের স্ত্রী বিয়ের আগে হাসপাতালের নার্স ছিল। খুব ভীরু প্রকৃতির আর খানিকটা বোকাটে। তাদের প্রেমের বিয়েতে মিঃ ফর্টেঙ্কু খুশি হতে পারেননি। বাপ ছেলে পরস্পরকে ঘৃণার চোখেই দেখতেন বলতে পারেন।

মিসেস ভ্যালও শ্বশুরকে অপছন্দ করত।

-মেয়ে ইলেইন কিরকম?

মেয়েটি অতটা খারাপ নয়। তার জন্য আমার দুঃখ হয়। খেলাধূলায় ভাল, পড়াশোনাতেও। এক হতাশ তরুণ স্কুলমাস্টারের সঙ্গে তার একবার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাপ টের পেয়ে সম্পর্কের ইতি ঘটান। মেয়েটি দেখতে তেমন ভাল নয়। তারও লক্ষ্য বাপের টাকার দিকে।

–অন্য ছেলেটি–মিঃ ল্যান্সলট?

–শুনেছি খুবই সুপুরুষ তবে বদ চরিত্রের। তাকে কখনো দেখিনি আমি। অতীতে একটা চেক জাল করার ঘটনা ঘটিয়েছিল। সে এখন বিদেশে–পূর্ব আফ্রিকায়।

-বাবার সঙ্গে কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল?

-তা ঠিক হয়নি। তবে বহু বছর তার সঙ্গে তিনি কোন যোগাযোগ করেননি। ল্যান্সের নাম একেবারেই শুনতে পারতেন না। তবে টাকাকড়ি থেকে বঞ্চিত করতে পারেননি। কারণ আগেই তাকে কোম্পানির জুনিয়র অংশীদার করে নিয়েছিলেন।

তবে যতদূর মনে হয় ল্যান্স হয়তো আবার ফিরে আসবে।

–এরকম কোন আভাস কি পাওয়া গেছে?

–কিছুদিন আগে সম্ভবত পার্সিভাল গোপনে কিছু একটা করে ফেলেছিলেন। সেটা বাপ জানতে পেরে প্রচণ্ড রেগে যান। সেইসময় ছোট ছেলেকে আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। তারপর থেকে পার্সিভালও কেমন ভীত হয়ে থাকতেন সব সময়।

-বাড়ির চাকরবাকরদের মধ্যে ক্রাম্পের কথা তো বলেছেন। অন্য চাকরবাকররা কিরকম?

-এবাড়িতে পার্লারমেড মানে ওয়েস্ট্রেস হিসেবে আছে গ্ল্যাডিস মার্টিন। সে ঘর গুছানোর কাজকর্মের সঙ্গে ক্রাম্পকেও সাহায্য করে। মেয়েটি ভাল। তবে বড্ড বেশি সরল।

এলেন কার্টিস হল হাউসমেড। কাজের মানুষ, তবে ভয়ানক বদমেজাজী।

এছাড়া বাইরের কিছু বুড়ি আসে বাড়িতে কাজের জন্য। বাড়িতে আর একজন আছেন–তিনি মিস র‍্যামসবটম।

–তিনি কে? নীল জানতে চান।

–মিঃ ফর্টেস্কুর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর দিদি। সেই স্ত্রী বয়সে মিঃ ফর্টেস্কুর চেয়ে বড় ছিলেন। দিদিটি তার চেয়েও বড়। এখন প্রায় সত্তরের মতো বয়স।

তিনতলায় একখানা ঘরেই তিনি থাকেন। খুব একটা নিচে নামেন না। রান্নাবান্না, অন্যান্য কাজ নিজেই করে নেন। একজন কাজের মেয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।

এই বৃদ্ধা কোনদিন তার ভাগ্নীপতিকে সহ্য করতে পারেননি। বোন বেঁচে থাকতে এখানে এসেছিলেন, তার মৃত্যুর পরেও থেকে যান। মিস ফর্টেস্কু ও ছেলেরা তাকে ডাকে এফি মাসি বলে।

বাড়ির লোকজন বলতে এই সব?

–হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, এরাই সব।

 –এবারে আপনার কথা কিছু বলুন মিস ডাভ।

–আমি..আমি একজন অনাথা। সেন্ট অ্যালফ্রেড সেক্রেটারিয়েল কলেজে সেক্রেটারি কোর্স পাস করেছি। কিছুদিন এক অফিসে কাজও করেছি। এখানে আসার আগে মোট তিন জায়গায় আমি কাজ করেছি। কিন্তু এক দেড় বছরের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠতে থাকি। তাই, একটু বেশি স্বাধীনতা নিয়ে থাকব বলে এই ইউট্টি লজে চলে এসেছি। এখানে আছি একবছরের কিছু বেশি।

কথা বলতে বলতে মিস ডাভ সম্বন্ধে একটা ছবি মনে মনে এঁকে নিয়েছিলেন নীল। তার কথা শেষ হতেই বললেন, এবারে আমি ওই পার্লারমেড গ্ল্যাডিস আর পরিচারিকা এলেনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আর একটা কথা মিস ডাভ, মিঃ ফর্টেঙ্কু কি কোন কারণে পকেটে শস্যের দানা রাখতে পারেন?

–শস্যদানা? আমার কোন ধারণা নেই ইনসপেক্টর। অবাক হয়ে বললেন মিস ডাভ।

–তার পোশাক কে দেখাশোনা করতেন?

–ক্রাম্প।

–আর একটা কথা–মিসেস ফর্টেস্কু কি স্বামীর সঙ্গে একই ঘরে থাকেন?

–হ্যাঁ। মনে হয় তাঁর আসার সময় হয়েছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন মিস

–তিনি তো বললেন গলফ খেলতে গেছেন। কাছাকাছি তত তিনটে গলফের মাঠ রয়েছে। তবুও এখনও পর্যন্ত তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না দেখে আশ্চর্য হচ্ছি।

-এটা আশ্চর্যের কিছু নয় ইনসপেক্টর। গলফ ক্লাব নিয়েই অবশ্য বেরিয়ে গেছেন গাড়ি নিয়ে, তবে গলফ আদৌ নাও খেলতে পারেন।

নীল তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন মিস ডাভের দিকে। একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে খেলেন জানেন?

–সম্ভবত তার সঙ্গী মিঃ ডিকিয়াল ডুবরে। আমি গ্লাডিসকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটা কথা ইনসপেক্টর, আপনাকে যেসব কথা বললাম, তা নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি না করার জন্যই আপনাকে পরামর্শ দেব।

মিস ডাভ বিদায় নিলেন। তিনি যে কথাগুলো তাকে বললেন, তার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে নীলের অসুবিধা হল না। ইউট্টি লজের অভ্যন্তরীণ ছবিটা বেশ পরিষ্কার হয়েই উঠেছে তার কাছে। যদিও কথাগুলো বিদ্বেষমূলকভাবে বললেন কিনা মিস ডাভ, তা তার কাছে স্পষ্ট নয়।

এই বাড়ির যা হালচাল, তাতে মিঃ ফর্টেস্কুকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষপ্রয়োগের মোটিভের কোন অভাব নেই।

নিজের ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন ইনসপেক্টর নীল। ঘরে প্রবেশ করল ভয়ে জড়োসড়ো একটি মেয়ে–গ্ল্যাডিস মার্টিন।

ঘরে ঢুকেই সে বলতে শুরু করল, আমি কিছু করিনি–আমি এসবের কিছুই জানি না।

 মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানা সম্ভব হল না।

নতুন কথা যা সে জানালো তা হল সে আগে বিভিন্ন কাফেতে কাজ করেছে। সবে দুমাস হয়েছে এসেছে ইউট্টি লজে।

জিজ্ঞাসাবাদের শেষ দিকে নীল জিজ্ঞেস করলেন, আজকে মিঃ ফর্টেঙ্কু যে স্যুট পরেছিলেন, সেটা কে ব্রাশ করেছিল, বলতে পার?

–ওনার তো অনেক স্যুট আছে, আজ কোনটা পরেছিলেন বলতে পারব না।

–তার পকেটে কোনদিন শস্যের দানা দেখেছ?

–শস্যের দানা? শস্যের দানা কি? অবাক হল গ্ল্যাডিস।

–রাই দানা। কালো রঙের রুটি হয়, জানো তো–এই দানা তোমার মনিবের স্যুটের পকেটে পাওয়া গেছে।

-রাই দানা-

-হ্যাঁ, ওগুলো কি করে পকেটে এলো তুমি কিছু বলতে পার?

–আমি ওসব দেখিনি, কিছু বলতে পারব না।

গ্ল্যাডিসকে বিদায় দিয়ে ইনসপেক্টর রান্নাঘরে এলেন। বিশাল চেহারার লাল মুখ এক স্ত্রীলোক রান্নার কাজ করছিল।

রাঁধুনী মিসেস ক্রাম্পের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে কোনরকমে পালিয়ে বাঁচলেন নীল। পুলিস দেখে এতটুকু টসকায়নি সে। এবাড়িতে যে কখনো বাজে বাজে খাবার দেওয়া হয়েছে, এমন কথা সে কারোর মুখে শুনতে রাজি নয়।

ইনসপেক্টর নীলের অবস্থা দেখে সার্জেন্ট হে দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন।

নীল হলঘরে ফিরে এলেন। মেরী ডাভ তখন টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরে রেখে একটা কাগজে কিছু লিখে নিচ্ছিলেন।

রিসিভার নামিয়ে রেখে মিস ডাভ নীলকে বললেন, একটা টেলিগ্রাম। এই যে—

কাগজটা এগিয়ে দিলেন তিনি। নীল দেখলেন প্যারী থেকে এসেছে বার্তাটা।

 ফর্টেস্কু ইউট্টি লজ বেডন হীথ, সারে, দেরিতে তোমার চিঠি পেয়েছি। আগামীকাল চা পানের সময় উপস্থিত হব। রোস্টকরা ভীল নৈশভোজে আশা করছি। ল্যান্স।

কাগজটা টেবিলে রেখে ভ্রু কুঁচকে নীল বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিতাড়িত ছেলেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।

.

০২.

 মিঃ রেক্স ফর্টেষ্ণু যখন তাঁর জীবনের শেষ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন খাস কামরায় বসে, সেই সময় তাঁর ছোট ছেলে ল্যান্স ফর্টেস্কু আর তার স্ত্রী সাঁজ এলিজে হোটেলের বাগানে গাছের নিচে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। আসলে স্বামীর কাছ থেকে মিসেস ল্যান্স অর্থনৈতিক জগতের শঠতার গল্পই শুনছিলেন।

যে শ্বশুরকে তিনি কখনো চোখে দেখেননি, তার সম্পর্কে তার ধারণা তিনি সবসময়ে কৌশলে আইন বাঁচিয়ে চলা মানুষ। সতোর অভাব ছিল না তার মধ্যে।

মিসেস ল্যান্স সুন্দরী না হলেও স্বাস্থ্যবতী ও দীর্ঘাঙ্গী হওয়ায় তাকে অসুন্দর দেখায় না। মাথায় একরাশ বাদামী চুল, চলার গতিও ছন্দময়। মনটাও উদার, ব্যক্তিত্বময়।

বাবাকে পছন্দ করি না এটা ঠিক, কিন্তু তার ডাকে আবার ফিরে না গিয়েও পারছি না। একবার যখন বুড়ো মত বদলেছে, তখন সুযোগটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না, বুঝলে প্যাট।

একটু থেমে ল্যান্স আবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবার চিঠিটা পেয়ে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, পার্সি তাকে চূড়ান্ত হতাশ করেছে। এটা চিরকালই মহাধূর্ত–নিজের মতলব ছাড়া কিছু বোঝে না

প্যাট্রিসিয়া বললেন, তোমার ভাইকে মনে হয় না আমার পছন্দ হবে।

-না, না প্যাট, তুমি তোমার মতো থাকবে। আমার কথায় প্রভাবিত হয়ো না। পার্সির সঙ্গে আমি মানিয়ে চলতে পারতাম না, তোমাকে আমি সেকথাই বলতে চাইছি। হাতখরচের টাকা আমি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উড়িয়ে দিতাম কিন্তু ও সব জমিয়ে রাখতো। আমি ভাল মন্দ সবার সঙ্গেই মিশতে অভ্যস্ত ছিলাম। পার্সি বেছে বেছে বন্ধুত্ব করতো। আমি বুঝতে পারতাম ও মনে মনে আমাকে ঘৃণা করে। তবে কারণটা জানতাম না।

–আমি জানি কেন। বলল প্যাট্রিসিয়া।

-তুমি বুদ্ধিমতী, হয়তো বুঝতে পার। ওকে ওই চেকের ঘটনাটা কিন্তু পার্সিভালই ঘটিয়েছিল। আমি যে চেক জাল করিনি একথা অবশ্য বিশ্বাস করবে না।

ইতিমধ্যেই অবশ্য আমি কোম্পানির একজন অংশীদার হয়েছিলাম। ঘোড়ার পেছনে লাগাবার জন্য যে টাকাটা দেরাজ থেকে নিয়েছিলাম, সত্যিকথা বলতে সেটা আমারই ছিল। তবু ভেবেছিলাম, টাকাটা ফেরত দিতে পারব। তবে চেকের ব্যাপারটা পার্সিই করেছিল, আর শাস্তি পেয়ে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল আমাকে।

তুমি বলতে চাও, কোম্পানি থেকে তোমাকে হঠাবার জন্য সে একাজটা করেছিল? বলল প্যাট্রিসিয়া।

–হতেও পারে। তবে ওসব আমি কিছু আর মনে রাখতে চাই না। এখন ভাবছি, এতদিন পরে আমাকে দেখে ও কি ভাববে।

-কিন্তু তোমার বাবা তার ওপরে এমন খেপে গেলেন কেন?

–সেটা জানতেই ইচ্ছে হচ্ছে। যেভাবে বুড়ো আমাকে চিঠি লিখেছে তাতে মনে হয়েছে গুরুতর কোন অপরাধই হবে

-তোমার বাবার প্রথম চিঠি কবে পেয়েছিলে?

-তা মাস চার-পাঁচ হবে। ওই চিঠি পেয়েই আশ্বস্ত হয়েছিলাম। লিখেছিলেন, পার্সি খুবই অসন্তোষজনক হয়ে উঠেছে। আরও লিখেছিলেন, অর্থকরী দিক থেকে তোমার সুব্যবস্থা করব, তোমার স্ত্রীকেও সাদরে গ্রহণ করব। বুঝলে প্রিয়া, অভিজাত ঘরে বিয়ে করায় বুড়ো খুবই খুশি হয়েছিল।

–অভিজাতদের ওই আবর্জনা কেউ পছন্দ করে? হেসে বললেন প্যাট্রিসিয়া।

–অভিজাতরা আবর্জনা কিনা বলতে পারব না, তবে তোমাকে যে বিয়ে করেছি, তার আহ্বান হয়তো এজন্যেই। পার্সিভালের স্ত্রী কেমন হয়েছে দেখা যাক।

-তোমার বোনের কথা তো বললে না।

চিন্তিত ভাবে বলল প্যাট্রিসিয়া। যে পরিবারের বউ তিনি হয়েছেন, সেখানকার মেয়েদের কথাই হয়তো তার মাথায় ঘুরছিল।

-ইলেইনের কথা বলছ, বলল ল্যান্স, ও খুবই ভাল মেয়ে। আমি যখন বাড়ি ছেড়ে আসি তখন ও খুবই ছোট ছিল।

–তোমাকে ও কোন চিঠি লিখেছিল? বলল প্যাট।

–কি করে লিখবে? কোন ঠিকানা তো দিয়ে আসিনি। আমাদের পরিবারের পারস্পরিক হৃদ্যতাও তেমন ছিল না কোন দিন।

প্যাট বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল ল্যান্সের দিকে। তা লক্ষ করে ল্যান্স বললেন, এসব জেনে আর কি হবে, আমরা তো ওদের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছি না। নিজেদের অন্য আলাদা একটা বাড়ি কোথাও নিয়ে নেব, সেখানেই আমরা থাকব।

–তোমার মায়ের কথা বিশেষ ভাবতে চাও না, তাই না? প্যাট জানতে চাইল।

–আমাদের মা ছিলেন বৃদ্ধ। ইলেইনের যখন জন্ম হয় তখন তার বয়স পঞ্চাশ। ছেলেবেলায় মনে পড়ে তিনি আমাকে নাইট আর রানির গল্প শোনাতেন। আমার সেসব একদম ভাল লাগত না।

–তুমি কাউকেই তেমন ভালবাসতে না।

–আমি তোমাকে ভালবাসি, প্যাট। বলে তিনি স্ত্রীর হাত নিজের মুঠোয় নিলেন।

.

০৩.

 বড় হলঘরে ইনসপেক্টর নীল যখন টেলিগ্রামের কাগজটা টেবিলে রাখছেন ঠিক সেই সময়েই বাইরে একটা গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ শোনা গেল।

কিছুক্ষণ পরেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন যে মহিলা তার মোহিনী মূর্তি যে কোন পুরুষের কাছেই আকর্ষণীয়। ইনিই অসামান্য সুন্দরী মিসেস ফর্টেস্কু। তার পেছনের গলফ ক্লাব হাতে পুরুষটিকে দেখে নীল অনুমান করলেন, যেমন শুনেছেন, মিঃ ভিভিয়ানই হওয়া সম্ভব।

বয়স্ক ধনী মানুষের যুবতী স্ত্রীদের যেসব পুরুষমানুষ বন্ধুত্বের জন্য বেছে নেয় তাদের চরিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রয়েছে ইনসপেক্টর নীলের।

বাড়িতে পুলিস অফিসারের উপস্থিতি এবং তার মুখে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অ্যাডেল ফর্টেস্কু একটু টলে গেলেন। একটা আরাম কেদারায় তার শরীর এলিয়ে পড়ল, দু হাতে চোখ চেপে ধরলেন তিনি।

ক্রাম্প দৌড়ে গিয়ে একগ্লাস ব্র্যাণ্ডি নিয়ে এসে এগিয়ে দিল। একচুমুক খেয়ে তিনি তা। সরিয়ে দিলেন।

-বেচারি রেক্স। কোনরকমে উচ্চারণ করলেন অ্যাডেল ফর্টেস্কু।

একজন ডিটেকটিভ ইনসপেক্টরের উপস্থিতিতে মিঃ ডুবয় স্বভাবতই ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অপ্রস্তুত স্বরে কোনরকমে দুঃখপ্রকাশ করে বিশেষ কাজের অজুহাত দেখিয়ে কোনরকমে গা বাঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করতে বিলম্ব করলেন না।

নীল সবই বুঝলেন। তিনি অ্যাডেল ফর্টেস্কুকে দুঃখের সঙ্গে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর কারণ জানালেন।

–আপনি বলছেন তাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল? এ আমি কখনো বিশ্বাস করি না—

নিশ্চয় খাদ্যে বিষক্রিয়া..কিন্তু সকালেই তো আমরা একই খাবার খেয়েছি–

বাড়ির সকলেই কি খেয়েছিল? নীল প্রশ্ন করলেন।

-না…তা অবশ্য বলতে পারব না।

–আপনার এখানে দেখছি প্রচুর ইউগাছ রয়েছে। এই গাছের পাতা বা ফল কোন ভাবে খাবারে মিশে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

–ইউফল? এগুলো কি বিষ?

–এসব খেয়ে বাচ্চারা প্রায়শই বিপদ ঘটায় মাদাম।

–আর সহ্য হচ্ছে না ইনসপেক্টর, দু হাতে মাথা টিপে ধরলেন মিসেস ফর্টেস্কু, আমি কিছু পারব না, সব ব্যবস্থা করবেন মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কু।

–আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি মাদাম, তিনি তো এখন উত্তর ইংলণ্ডে কোথাও রয়েছেন।

–ওহ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম।

–এই অবস্থায় আপনাকে আর বিরক্ত করব না। কেবল একটা কথা, আপনার স্বামীর পকেটে কিছু শস্যদানা পাওয়া যায়, এর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন?

-না, আমার কোন ধারণা নেই। মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ফর্টেস্কু।

চোখে রুমাল চাপা দিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে চললেন। নীলের মনে হল এ কান্না অভিনয় নয়।

চোখে রুমাল চেপে রেখেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা অতিক্রম করে চলে গেলেন।

ইনসপেক্টর নীলের চোখ এড়িয়ে গেল, রুমালের ফাঁকে মিসেস ফর্টেস্কুর ঠোঁটে ঠোঁটে জেগে উঠেছিল সূক্ষ্ম একটা হাসি।

.

ইতিমধ্যে সার্জেন্ট হে রান্নাঘর থেকে মারমালেড, হ্যাম, চায়ের নমুনা, কপি, চিনি ইত্যাদি যা প্রয়োজনীয় মনে করেছেন কিছুটা করে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়েছেন।

তার অভিযানের সংবাদ জানিয়ে সার্জেন্ট হে নীলকে বললেন, কিন্তু স্যর, ইউ ফল বা পাতা কোথাও চোখে পড়েনি। আর তার পকেটের শস্যদানার কথাও কেউ কিছু বলতে পারল না।

ঠিক সেই সময়েই টেলিফোন বেজে উঠল। নীল ধরলেন। সদর দপ্তর থেকে জানানো হলো মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে, তিনি লণ্ডনে ফিরে আসছেন।

রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতেই বাড়ির সদরের সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেলেন নীল।

একটু পরেই নানা প্যাকেট হাতে এক মহিলা এসে ঘরে ঢুকলেন। ক্রাম্প প্যাকেটগুলো হাতে নিল। নীলের দিকে ফিরে বলল, ইনি মিসেস পার্সিভাল, স্যর।

গোলগাল চেহারার মহিলা, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। অসন্তোষ মাখানো মুখভাব। নীলের মনে হল মহিলা অত্যন্ত ক্লান্ত।

মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর আকস্মিক মৃত্যুর খবর তাকেও জানানো হলো।

–সত্যিই অদ্ভুত খবর, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন মিসেস পার্সিভাল, নিজের অর্ধেক বয়সের মেয়েকে বিয়ে করে মারাত্মক ভুল করেছিলেন–এবারে যা হবার তাই হলো…

নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাকে দেখতে লাগলেন। তার মনে হলো, ব্যাপারটা মহিলার খারাপ লাগেনি।

-মৃত্যুর কারণ নিশ্চয় আপনারা জেনেছেন, না হলে এখানে আসতেন না।

–হ্যাঁ, খাদ্যে বিষক্রিয়া। প্রাতরাশে তিনি এমন কিছু খেয়েছিলেন, যার প্রতিক্রিয়াতেই…

–প্রাতরাশ। কিন্তু..বুঝতে পারছি না ও কিভাবে বিষটা—

এই সময় পাশ থেকে কে বলে উঠল, আপনার চা লাইব্রেরীতে দিয়েছি মিসেস ভ্যাল।

–ওহ, চা, ধন্যবাদ মিস ডাভ, যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, চা বড্ড দরকার—

বলতে বলতে বিদায় নিলেন মিসেস ভ্যাল।

–মিস ডাভ, হাউসমেড এলেনকে একবার দরকার।

–আসুন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। দুজনে ওপরে উঠে এলেন। এলেনকে মোটেই বিমর্ষ বা ভীত মনে হল না।

এলেনের কথায় বিষের ঝাঁঝ মেশানো ছিল। সে গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে একপ্রস্থ বিষ উদগার করল।

এখানে সবাই জানে…ওদের সর্বত্রই দেখা যায়…টেনিস বা গলফ ওসব সবই ধাপ্পা…আমি নিজের চোখে অনেক কিছু দেখেছি। লাইব্রেরীর দরজা খোলা ছিল…দুজনে…উনি আর ওই লোকটা…আমাদের মনিব সবই টের পেয়েছিলেন…নজর রাখার জন্য একজনকে লাগিয়েও ছিলেন…শেষ পর্যন্ত মনিব মরলেন…জানতাম….

নীল আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে কখনো ইউফল দেখেছ?

–ইউ…ওগুলো তো বিষাক্ত। ওই ফল ওরা দিয়েছিল নাকি স্যর?

–আমরা এখনো ঠিক জানি না, কি দেওয়া হয়েছিল। একটু চিন্তা করল এলেন। পরে বলল, আমি অবশ্য ওঁকে কখনো ইউফল ঘাঁটতে দেখিনি..না…কখনো দেখিনি।

তার কাছ থেকেও মিঃ ফর্টেস্কুর পকেটে শস্যদানা থাকার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন না নীল।

এলেনকে বিদায় দিয়ে নীল এলেন তিন তলার ছোট্ট ঘরে মিস র‍্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করতে।

ঘরে ঢোকার মুখেই নীল জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন নিচে সার্জেন্ট হে ইউ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। লোকটাকে বাগানের মালী বলেই তার মনে হল।

মালপত্রে ঠাসা ছোট্ট ঘরটা। গ্যাসের আগুনের পাশে এক বৃদ্ধা টেবিলে বসে পেসেন্স খেলছেন। পরণে হালকা বেগুনী রঙের পোশাক। মাথায় এলোমেলো পাকাচুল।

মুখ না তুলেই তিনি বললেন, আসুন, ইচ্ছে হয় বসতে পারেন।

কিন্তু বসার প্রতিটি চেয়ারই নানা ধর্মীয় পত্রপত্রিকায় বোঝাই। ওসব সরিয়ে কোন রকমে একটা চেয়ারে নীল জায়গা করে নিলেন।

–বলুন, কি ব্যাপার। মুখ তুললেন মিস র‍্যামসবটম।

 নীল যথারীতি দুঃখপ্রকাশ করে মিঃ ফর্টেস্কুর মৃত্যুসংবাদ জানালেন।

–অহঙ্কার আর পাপের পরিণতি। কোনরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মন্তব্য করলেন মিস র‍্যামসবটম।

-আশাকরি ভগ্নীপতির মৃত্যুতে আঘাত পাননি আপনি। বললেন নীল।

-ঠিকই বলেছেন আপনি। দুঃখ না হওয়াই স্বাভাবিক। রেক্স ফটেন্ডু চিরকালই পাপী মানুষ ছিলেন। তাকে আমি পছন্দ করতে পারিনি।

-তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।

 বৃদ্ধা একথার কোন উত্তর না দিয়ে তাস হাতে তুলতে লাগলেন।

নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলেন। কিন্তু হতাশ হলেন।

–আমি কি বলব আশা করেছিলেন?

 এটুকু বলতে পারি, আমি তাকে বিষ খাওয়াইনি।

–কাজটা কে করে থাকতে পারে এরকম কোন ধারণা আপনার আছে?

–প্রশ্নটা অসঙ্গত। আমার মৃত বোনের দুই ছেলে এবাড়িতে রয়েছে। র‍্যামসবটমের রক্ত যাদের শরীরে রয়েছে তারা খুনের মতো কোন জঘন্য কাজ করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

–আমি সেকথা বলতে চাইনি মাদাম।

–রেক্স খুবই অসৎপ্রকৃতির মানুষ ছিল। বহু লোকই আছে যারা তাকে খুন করতে চেয়েছে।

–বিশেষ কারো কথা কি আপনি ভাবছেন?

মিস র‍্যামসবটম এবার তাস ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শান্ত ধীর কণ্ঠে বললেন, আমার মতামত যদি জানতে চান তাহলে বলব, বাড়ির চাকরবাকরদের মধ্যেই কেউ একাজ করেছে। ওই বাটলারকে আমার সুবিধার লোক মনে হয় না। আর পার্লারমেইড মেয়েটাও যেন অন্যরকম। আচ্ছা…শুভসন্ধ্যা।

কিছুই বার করা গেল না বৃদ্ধার মুখ থেকে। অগত্যা নীল চুপচাপ নিচে নেমে এলেন।

হলঘরে ঢুকতেই দীর্ঘাঙ্গী গাঢ় বর্ণের এক তরুণীর মুখোমুখি হলেন নীল।

–আমি এই মাত্র ফিরেছি ইনসপেক্টর ওরা বলছে…বাবা নাকি মারা গেছে?

–খুবই দুঃখের হলেও কথাটা ঠিক। বললেন নীল। মেয়েটি একটা চেয়ারের পিঠ চেপে ধরল। চোখ বুজে ধীরে ধীরে বসে পড়ল।

–ওহ,…না-না।

দু গাল বেয়ে চোখের জল নেমে এলো মেয়েটির।

-বাবাকে পছন্দ করতাম একথা বলতে পারব না। তবু…তবু…আমি মেনে নিতে পারব না…কখনও না…

দরদর ধারায় অশ্রু নামতে লাগল। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করতে লাগল সে।

ইনসপেক্টর নীল বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ইলেইন ফর্টেস্কুর দিকে। তার মনে হল ইউট্রি লজে এই প্রথম মৃতমানুষটির জন্য একজন সত্যিকার শোকপ্রকাশ করল।

.

০৪.

 ইনসপেক্টর নীলের কাছ থেকে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ শোনার পর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বললেন, কমবয়সী সুন্দরী স্ত্রী–তাকেই তো আমার সন্দেহ হচ্ছে।

–এরকম ক্ষেত্রে এটাই সাধারণত দেখা যায়। বললেন নীল।

–কিন্তু মোটিভ তো খুঁজে বার করা দরকার।

–তাও আছে স্যর…মিঃ ডুবয় অবশ্যই।

 –সে এর মধ্যে ছিল বলে তোমার মনে হয়?

–তা অবশ্য মনে হয় না স্যর। লোকটা খুবই সাবধানী–গা বাঁচাতে চায়। তবে মতলবটা মনে হয় মহিলার মাথাতেই ছিল।

-যাইহোক, আমাদের উচিত হবে ভোলা মনে কাজ করা। আর যে দুজনের সুযোগ থাকা সম্ভব, তাদের অবস্থা কিরকম বুঝছ?

–মিঃ ফর্টেস্কুর মেয়ে আর পুত্রবধূ! মেয়েটি একজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবার আপত্তি ছিল। লোকটার টাকার দিকেই নিশ্চয় চোখ রেখেছিল। এটাই তার মোটিভ হতে পারে।

তবে পুত্রবধূ–মিসেস পার্সিলের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। এই তিনজনের যেকোন একজনের পক্ষেই বিষপ্রয়োগ সম্ভব বলে মনে হয়। অন্য কারও পক্ষে কতটা সম্ভাবনা ছিল তা অনুসন্ধান সাপেক্ষ।

প্রাতরাশ গুছিয়ে ছিল পার্লারমেইড, বাটলার আর রাঁধুনি। নিয়েও গিয়েছিল এরাই। মিঃ ফর্টেস্কুর খাবারেই যে কেবল ট্যাকসিন মেশানো থাকতে পারে এটা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। অবশ্য যদি বিষটা ট্যাকসিনই হয়ে থাকে।

–প্রাথমিক রিপোর্টে ট্যাকসিন বলেই উল্লেখ করা হয়েছে দেখলাম।

–তাহলে নিশ্চিত হওয়া গেল। আমরা এবারে এগিয়ে যেতে পারব। নীল বললেন।

–চাকরবাকরদের মধ্যে কিছু পাওয়া যায়নি বলছ?

–না স্যর। ওদের ব্যবহারে কোনরকম অস্বাভাবিকতা নেই। –আর কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?

-না স্যর, তেমন কেউ নেই। তবে এবারে সাক্ষ্যপ্রমাণ কিছু পাওয়া যেতে পারে–ট্যাকসিন যখন তৈরি বা জোগাড় হয়েছে, তার কিছু প্রমাণও থাকবার কথা।

বেশ তুমি তোমার মতোই এগিয়ে যাও। ওহো, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কু এখানেই আছেন। তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য অপেক্ষা করছেন।

অন্য ছেলের সঙ্গেও প্যারিতে আমরা যোগযোগ স্থাপন করেছি। সে আজই রওনা হচ্ছে–তুমি তার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা করতে পার।

–হ্যাঁ, স্যর, আমিও ওরকম ভেবে রেখেছি। তাহলে আমি স্যর পার্সিভাল ফর্টেস্কুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিই।

-হ্যাঁ তাই কর।

.

বছর ত্রিশের যুবা পার্সিভাল ফর্টেস্কু। মাথায় হালকা রঙের চুল। পোশাকপরিচ্ছদে নিখুঁত।

ইনসপেক্টর নীলের মুখ থেকে বাবার মৃত্যুর বিবরণ শোনার পর পার্সিভাল স্বাভাবিক ভাবেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

-বলছেন ট্যাকসিন বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল…কিন্তু ওরকম কোন বিষের কথা তো শুনিনি।

–কমই শোনা যায় এ বিষের কথা। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া আচমকা হয়–আর তা মারাত্মক।

–আপনি বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই বাবাকে কেউ বিষ খাইয়েছিল? খুবই ভয়ানক কথা।

–আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে।

এব্যাপারে, কারো সন্দেহ করার মতো আপনার কোন ধারণা

–আমাদের তদন্ত এখনো চলছে, স্যর। আমাদের কাজের পক্ষে সুবিধা হবে যদি আপনি আপনার বাবার সম্পত্তি বিলিব্যবস্থার ব্যাপারে আমাদের কিছু ধারণা দেন। আপনি আপনার বাবার সলিসিটরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন।

সলিসিটর হলেন বিলিংসবি, হর্সথর্প ও ওয়াল্টার্স। বেডফোর্ড স্কোয়ারে ওদের অফিস। উইলের ব্যাপারে আমি মোটামুটি আপনাকে জানাতে পারব।

–এটা যদিও আমাদের রুটিন মাফিক কাজ, তবে আমাদের কাজে সুবিধা হবে।

–দুবছর আগে বিয়ের পরে একটা নতুন উইল করেন বাবা। তাতে তিনি তার স্ত্রীকে ১,০০,০০০ পাউণ্ড সরাসরি দিয়েছিলেন, আর ৫০,০০০ পাউণ্ড দিয়েছেন আমার বোন ইলেইনকে। বাকি অংশের অধিকার দিয়েছেন আমাকে। অবশ্য আমি প্রতিষ্ঠানের একজন অংশীদারও।

–আপনার ভাই ল্যান্সলট ফর্টেস্কু, তিনি তাহলে কি পাচ্ছেন? জানতে চাইলেন নীল।

-বাবা তাকে কিছু দিয়ে যাননি। ওদের দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন আগের এক মনোমালিন্যের জেরই এটা বলতে পারেন।

-তাহলে দেখা যাচ্ছে, উইল অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে আপনারা তিনজনই লাভবান হচ্ছেন–মিসেস ফর্টেস্কু, আপনি আর মিস ইলেইন?

–আমার ক্ষেত্রে কতটা কি থাকবে বলতে পারি না। কেননা, অর্থকরী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাবা ইদানীং কিছু ভুল করে ফেলেছিলেন। তাছাড়া মৃত্যুকর ইত্যাদিও আমাকে দিতে হবে।

ইনসপেক্টর নীল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললেন মিঃ পার্সিভাল ফর্টেস্কুর দিকে।

সম্প্রতি ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আপনি আর আপনার বাবা একমত হতে পারেননি, তাই না স্যর?

–আমার মতামত তাকে জানিয়েছিলাম কেবল

–ওই নিয়ে আপনাদের মধ্যে বচসাও হয়েছিল?

–না, ইনসপেক্টর কোন বচসা হয়নি।

–যাক, কিছু এসে যায় না। তবে আপনার বাবা আর ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতোই বিরূপ ছিল, এটা নিশ্চয়ই ঠিক?

-হ্যাঁ, কথাটা ঠিক।

–যদি তাই হয় তাহলে এটা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা।

মেরী ডাভের দেয়া টেলিগ্রামের বয়ান লেখা কাগজটা নীল এবারে এগিয়ে দিলেন।

পার্সিভাল পড়লেন। তার মুখভাব বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল। তিনি বেশ রাগতভাবেই বললেন, ব্যাপারটা কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

–এটা যে সত্যি তার প্রমাণ আপনার ভাই আজই প্যারি থেকে আসছেন। আপনার বাবা আপনাকে এসম্পর্কে কি কিছু জানিয়েছিলেন?

–কখনোই না। আমার কাঁধে সমস্ত কাজের দায়িত্ব চাপানো আর এভাবে ল্যান্সকে ডেকে পাঠানো–এ সম্পূর্ণ অসঙ্গত।

–আপনার বাবা কেন এরকম একটা কাজ করলেন এসম্পর্কে নিশ্চয় আপনার কোন ধারণা নেই?

–অবশ্যই নেই। এ তার নিছক পাগলামি ছাড়া আর কি। ইদানীংকালে তার এমন অনেক অদ্ভুত কাজেরই কোন কারণ খুঁজে পেতাম না। যে করেই হোক এটা বন্ধ করতে হবে

পর মুহূর্তেই তিনি বলে উঠলেন, কিছু মনে করবেন না ইনসপেক্টর, মনেই ছিল না যে বাবা মারা গেছেন।

ইনসপেক্টর নীল সহানুভূতির সঙ্গে মাথা নাড়লেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন পার্সিভাল নিজে থেকে আর কি বলেন শুনবার জন্য।

–ইনসপেক্টর…আমি ভাবতে পারছি না এরকম একটা ঘটনা ঘটবে।

 বলতে বলতে মিঃ পার্সিভাল দরজার দিকে এগোলেন।

–কোন প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকতে পারেন। অফিসের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় ইউট্রি লজেই ফিরব।

–আমি সেখানে একজনকে রেখে এসেছি স্যর। আশাকরি আবার দেখা হবে।

পার্সিভাল ফর্টেস্কু বেরিয়ে গেলেন।

–কিরকম বুঝলেন স্যর?

–সার্জেন্ট হে জানতে চাইলেন।

–এখনো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একদল বিরক্তিকর মানুষ–খুবই অদ্ভুত।

.

০৫.

 ল্যান্স ফটেন্ডু আর তার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া আকাশ পথে বাড়ির পথে। হিথরো বিমান বন্দরের দিকে উড়ে চলেছে তাদের আকাশযান।

লে বুর্জে ছেড়ে আসার পাঁচ মিনিট পরে ডেইলি স্মেলের পৃষ্ঠায় বাবার মৃত্যুর খবরটা দেখতে পেলেন ল্যান্স।

–তিনি মারা গেছেন! বাবা

অস্ফুটে কথাকটা উচ্চারণ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন ল্যান্স।

-তোমার বাবা মারা গেছেন

–হ্যাঁ, প্রিয় প্যাট। অফিসেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেন্ট জিউস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানেই তিনি মারা যান।

উঃ অদ্ভুত ঘটনা, সত্যিই আমি দুঃখিত। ঠিক তুমি যখন বাড়ি ফিরতে চলেছ–কি হয়েছিল, স্ট্রোক?

–তাই মনে হয় আমার। বুড়ো মানুষটাকে যে আমি পছন্দ করতাম তা বলব না, কিন্তু এখন তো তিনি নেই…ভাল হতে গিয়েও আমার ভাগ্যটা আবার খারাপ হয়ে গেল, প্যাট।

–হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। ঘটনাটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

প্লেন থেকে নামার কিছুক্ষণ আগে একজন অফিসার উঠে এলেন। ঘোষণা করলেন, মিঃ ল্যান্সলট ফর্টেঙ্কু প্লেনে আছেন?

 ল্যান্সলট সাড়া দিলেন।

দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।

 অন্য যাত্রীরা প্লেন থেকে নামার আগেই ল্যান্সলট আর প্যাট অফিসারটির সঙ্গে নেমে এলেন।

আশপাশে যাত্রীরা সন্দেহ আর কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

–এমন একটা উদ্ভট কাণ্ড আমি একেবারে মেনে নিতে পারছি না ইনসপেক্টর। অসম্ভব। ইনসপেক্টর নীলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ল্যান্সলট। পরে আবার বললেন, ট্যাকসিন ইউফল, আমাদের পরিবারে এসব বিষ প্রয়োগ হবে–নাঃ নাঃ–

-তাহলে বলছেন আপনার কোন ধারণা নেই, কে আপনার বাবাকে বিষপ্রয়োগ করতে পারে?

-না, ইনসপেক্টর, না। ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকেই তার ওপরে চটা ছিল…যথেষ্ট শই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিষ খাইয়ে হত্যা করবে…না…আমি বাইরেই থাকতাম…বাড়িতে কি চলছে, আমার জানার কথা নয়

ইনসপেক্টর নীল বললেন, আপনার ভাইয়ের কাছে শুনেছি, অনেক বছর আগে আপনার সঙ্গে মিঃ ফর্টেস্কুর মনোমালিন্য ঘটেছিল এবং তা বজায় ছিল। এই অবস্থায় আপনার বাড়ি ফিরে আসার ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন?

–তাহলে আপনাকে খুলেই বলি ইনসপেক্টর। মাস দুয়েক আগে, আমার বিয়ের ঠিক পরেই, বাবার একটা চিঠি আমি পাই। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, অতীতকে নতুন করে আর ভাবতে চান না তিনি। আমি ইচ্ছে করলে বাড়ি ফিরে এসে ব্যবসাতে যোগ দিতে পারি।

তার এই প্রস্তাবের পরে আমি ইংলন্ডে ফিরে আসা স্থির করে ফেলি।

মাস তিনেক আগে, গত অগাস্টে, ইউট্টি লজে এসে বাবার সঙ্গে আমি দেখা করি। সেই সময়ে তিনি চমৎকার একটা প্রস্তাব আমাকে দেন।

–আমি তাকে জানাই স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ইংলণ্ডে ফিরে আসার দিন জানিয়ে দেব।

তারপর আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যাই এবং প্যাটকে সব কথা বলি। আমাদের দুজনের কাছেই বাবার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তারপরই আমরা ওখানকার কাজ কারবার গুটিয়ে ইংলণ্ডে চলে এলাম।

–আপনি ইংলণ্ডে ফিরে এসেছেন, এই খবরে আপনার ভাই আশ্চর্য হয়েছেন।

তির্যক দৃষ্টিতে নীল তাকালেন ল্যান্সলটের দিকে। তার দিকে চোখ তুলে হাসলেন ল্যান্স।

-আশ্চর্য হবারই কথা পার্সির। ও ছুটি কাটাতে নরওয়েতে গিয়েছিল, বাবা সেই সময়টাই বেছে নিয়েছিলেন। সব কিছু পার্সির অজান্তে করাই তার ইচ্ছে ছিল বলে আমি মনে করি।

পার্সি নিজেকে ভ্যাল বলতেই পছন্দ করে। তার সঙ্গে বাবার দারুণ বচসা হয়। সে বাবাকে কোন ঝামেলায় জড়াতে চেয়েছিল বলেই আমার ধারণা। ঠিক কি নিয়ে গণ্ডগোলটা তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। তবে এটা বুঝেছিলাম, তিনি তার ওপরে প্রচণ্ড চটে গিয়েছিলেন। আমার ধারণা, বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারলে পার্সিকে রুখে দিতে পারবেন।

আপনি কতদূর কি জেনেছেন, আমি জানি না ইনসপেক্টর। আমাদের পরিবারের সকলেই জানে বাবা পার্সির স্ত্রীকে বিশেষ সুনজরে দেখতেন না। যদিও আমার বিয়েতে মনে মনে খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার সেটাও একটা কারণ বলে আমি মনে করি।

–গত অগাস্টে আপনি ইউট্রি লজে এসেছিলেন বললেন, ওই সময়ে কতদিন ছিলেন?

–ঘন্টা দুয়েকের বেশি নয়। চাকরবাকররাও সম্ভবত একথা জানতে পারেনি। তিনি জানিয়েছিলেন, তার প্রস্তাবটা নিয়ে প্যাটের সঙ্গে আলোচনা করে আমার সিদ্ধান্তের কথা তাকে যেন লিখে জানিয়ে দিই। আমি তার কথামতোই কাজ করি। আমি এখানে আসার আনুমানিক দিন ও সময় লিখে জানিয়ে দিই। গতকালই একটা টেলিগ্রাম করেছি।

-হ্যাঁ, সেটা আমি দেখেছি, মাথা নেড়ে সায় দিলেন নীল, সেটা দেখে আপনার ভাই খুবই আশ্চর্য হয়ে যান।

-তা হওয়াই স্বাভাবিক। দীর্ঘশ্বাস মোচন করে পার্সিভাল বললেন, এবারেও ভাগ্য পার্সিকে জিতিয়ে দিল–আমার আসতে দেরি হয়ে যায়।

–গত অগাস্টে পরিবারের কারোর সঙ্গেই কি আপনার দেখা হয়নি?

–হয়েছিল। আমার সম্মা চায়ে উপস্থিত ছিলেন।

–আপনার সঙ্গে কি তার আগেই পরিচয় হয়েছিল?

-না। হেসে উঠে বললেন ল্যান্সলট, বুড়োর চেয়ে অন্তত ত্রিশ বছরের ছোট আমার সৎমা।

–প্রশ্নটার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন মিঃ ল্যান্সলট, আপনার বাবার দ্বিতীয়বার বিয়েতে আপনি বা আপনার ভাই কি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন?

–অসন্তুষ্ট কিনা ঠিক জানি না, তবে আমি খুবই আশ্চর্য হয়ে যাই, পার্সিও তাই। আমাদের যখন দশ বারো বছর বয়স, সেই সময় আমাদের মা মারা যান। এতদিন পরে কেন বাবা বিয়ে করলেন, কেন আগে করেননি–এসব ভেবে আমরা খুবই অবাক হয়েছিলাম।

-বয়সের এরকম ব্যবধানে কাউকে বিয়ে করায় বেশ ঝুঁকি থেকে যায়, এটা অবশ্য ঠিকই। বললেন নীল।

 –কথাটা নিশ্চয় আপনি পার্সির মুখ থেকে শুনে থাকবেন। কাউকে এরকম দোষারোপ করতে অভ্যস্ত। আমার সম্মাই বাবাকে বিষ খাইয়েছেন, আপনিও কি এরকম ভাবছেন নাকি, ইনসপেক্টর?

–এরকম কোন সিদ্ধান্তে আসার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি মিঃ ল্যান্সলট। আর একটা কথা, এখন আপনার পরিকল্পনা কি, জানতে পারি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভাবলেন ল্যান্সলট। পরে বললেন, নতুন করে ভাববার দরকার হয়ে পড়েছে। বাড়ির সবাই কি ইউট্রি লজেই রয়েছে?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমার সেখানেই এখন যাওয়া ভাল। আর তুমি, স্ত্রীর দিকে তাকালেন ল্যান্সলট, বরং সাময়িক ভাবে একটা হোটেলেই যাও প্যাট।

–আমি তোমার সঙ্গেই থাকতে চাই ল্যান্স।

–অবুঝ হয়ো না প্যাট, ইউট্রি লজে আমার অভ্যর্থনাটা কেমন হবে আমি কিছুই জানি না। বাবার মৃত্যুর পরে পার্সি বা অ্যাডেল যে কেউ একজনের দখলে এসেছে বাড়িটা–এই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে অবস্থাটা বুঝে আসতে দাও। প্যাট, বিষপ্রয়োগের ঘটনা পর্যন্ত ওই বাড়িতে ঘটছে–কোন রকম ঝুঁকি আমি নিতে চাই না।