১. দরজায় সশব্দে ঠক ঠক

দ্য বডি ইন দ্য লাইব্রেরি – আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

দরজায় সশব্দে ঠক ঠক আওয়াজ হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল মিসেস ব্যান্ট্রির। ভাবলেন মেরি প্রভাতী চা নিয়ে এসেছে প্রতিদিনের মত। বিছানায় থেকেই বলে উঠলেন–ভেতরে এসো।

সঙ্গে সঙ্গে পর্দা কুঁড়ে শোনা গেল মেরির আর্ত কণ্ঠস্বর-মাদাম-শিগগির উঠুন। মাদাম-লাইব্রেরী ঘরে একটা লাশ পড়ে আছে।

কান্না চাপার চেষ্টা করে মেরি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

একটা লাশ কথাটা যেন এক ধাক্কায় বিছানা থেকে তুলে দিল মিসেস ব্যাস্ট্রিকে। লাইব্রেরিতে একটা লাশ-এ কি করে সম্ভব?

স্থির হয়ে বসে এক মিনিট ভেবে নিলেন। তারপর তার পাশে নিদ্রিত স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে তুললেন।

–আর্থার, আর্থার ওঠো শিগগির।

 কর্নেল ব্যান্ট্রি ঘুম ভেঙ্গে পাশ ফিরে তাকালেন।

–কি বলছ–অত হৈ চৈ কিসের?

–মেরি বলে গেল লাইব্রেরিতে একটা লাশ দেখে এসেছে।

–অ্যাঁ–কি বলছ?

লাইব্রেরিতে একটা লাশ।

 গজগজ করতে করতে বিছানা ছেড়ে নামলেন কর্নেল ব্যান্ট্রি। দ্রুত হাতে ড্রেসিংগাউনটা গায়ে চাপিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

সিঁড়ির শেষ ধাপের সামনে বাড়ির চাকরবাকর কজন জটলা করছিল। বাড়ির কর্তাকে দেখে সবাই শশব্যস্ত হয়ে উঠল। কয়েকজন যুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

–কি ব্যাপার? কোথায় কি হয়েছে?

 বাটলার এগিয়ে এসে বলল, একবার পুলিসে খবর দেওয়া দরকার স্যার। রোজকার মত ঢুকেছিল মেরি আর অমনি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল একটা লাশের ওপরে।

-আমার লাইব্রেরি ঘরে লাশ রয়েছে? চল দেখা যাক।

.

জেলার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে টেলিফোন পেল থানার পুলিস কনস্টেবল পক।

আজ সকাল সওয়া সাতটা নাগাদ গামিংটন হলে এক তরুণীর লাশ পাওয়া গেছে কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরি ঘরে। তাকে কেউ গলা টিপে মেরেছে। বাড়ির কেউ মেয়েটিকে চেনে না।

টেলিফোনে খবরটা পেয়েই পক সঙ্গে সঙ্গে তার উধ্বতন অফিসার ইনসপেক্টর স্ল্যাককে টেলিফোন করে জানিয়ে দিল।

.

মিস মারপল রাতের পোশাক পাল্টাছিলেন এমন সময় তার বান্ধবী মিসেস ব্যান্ট্রির টেলিফোন পেলেন।

–ভীষণ ব্যাপার ঘটে গেছে জেন। আমাদের লাইব্রেরিতে একটা লাশ পাওয়া গেছে। সোনালী চুল অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে। মাদুরের ওপর সটান মরে পড়ে আছে। মনে হয় কেউ মেয়েটাকে গলা টিপে খুন করেছে।

তুমি শিগগির এসো-খুনীকে খুঁজে বের করে রহস্যটা উদ্ধার করো–আমি তোমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

.

ব্যান্ট্রিদের গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সিঁড়ির মুখে কর্নেল ব্যান্ট্রির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মিস মারপলের।

–ওহ মিস মারপল। খুশি হলাম।

–আপনার স্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। ঠিক তখনই মিসেস ব্যান্ট্রি সেখানে হাজির হলেন। স্বামীকে প্রাতরাশ খেতে যাবার জন্য তাড়া দিয়ে মিস মারপলের হাত ধরে বললেন, চল জেন দেখাবে।

লম্বা বারান্দা দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন তিনি। তার পেছনে মিস মারপল।

লাইব্রেরির দরজায় পাহারা দিচ্ছিল কনস্টেবল পক। তার ওপরে হুকুম রয়েছে, কেউ যেন ঘরে ঢুকে কোন কিছু স্পর্শ না করে।

কিন্তু মিস মারপলকে সে বিলক্ষণ জানে। কাজেই সে মহিলা দুজনকে দরজা ছেড়ে দিল।

–কোন কিছু স্পর্শ করছি না।

 মিস মারপল লাইব্রেরি ঘরে ঢুকলেন মিসেস ব্যান্ট্রিকে সঙ্গে নিয়ে।

বিশাল ঘর। অগোছালো ভাবে সাজানো, ছড়ানো ছিটানো একরাশ বইপত্র, দলিল দস্তাবেজের সঙ্গে পাইপ ইত্যাদি নানা জিনিস।

দেয়াল জুড়ে ঝুলছে পূর্বপুরুষদের কয়েকটা তৈলচিত্র, কিছু বিবর্ণ জলরঙের ছবি। সারাঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন।

–ওই দেখ।

পুরনো চুল্লীর কাছে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে একদিকে নির্দেশ করলেন মিসেস ব্যান্ট্রি।

.

মেঝের ওপরে পড়েছিল অগ্নিশিখার মত একটি মেয়ের মৃতদেহ। থোকা থোকা কোকড়া চুল কপালের দুপাশে ছড়িয়ে আছে। কৃশ দেহে শুভ্র সার্টিনের সান্ধ্যপোশাক। স্ফীত মৃত্যু নীল মুখে উগ্র প্রসাধনের চিহ্ন।

চোখের কাজল লেপ্টেছে দুপাশের গালে, লাল লিপস্টিকে রঞ্জিত মুখ। হাত আর ওপরের নখেই রক্তিম রঙ মাখানো। পায়ে সস্তা রুপোলী চপ্পল।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখে শান্ত স্বরে মিস মারপল বললেন, খুবই অল্প বয়স।

এই সময় বাইরে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। কনস্টেবল পক গলা বাড়িয়ে বলল, বোধ হয় ইনসপেক্টর এলেন।

মিসেস ব্যান্ট্রি সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাকে অনুসরণ করলেন মিস মারপল।

.

গাড়ি থেকে নেমে এলেন এলাকার চিফ কনস্টেবল কর্নেল মেলচেট আর ইনসপেক্টর স্ল্যাক। মেলচেট কর্নেল ব্যান্ট্রির বন্ধু।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে বাইরে আসতে এদের সঙ্গে দেখা হল কর্নেলের। তিনি হাঁক ছেড়ে বন্ধুকে সুপ্রভাত জানালেন।

–একটা অস্বাভাবিক কাণ্ডের কথা শুনে নিজেই চলে এলাম। বললেন কর্নেল মেলচেট।

–একেবারেই অস্বাভাবিক।

–মেয়েটিকে পরিচিত মনে হয়?

–একদম না। জীবনে কোন দিন দেখিনি।

–বাটলার কি বলছে, কিছু জানে? স্ল্যাক বললেন।

–লরিমার আমার মতই হতবাক হয়ে গেছে।

–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। স্ল্যাক বললেন।

এই সময় বাইরে পরপর দুটো গাড়ি থামবার শব্দ শোনা গেল। প্রথম গাড়ি থেকে নেমে এলেন বিশালদেহী ডক্টর হেডক। তিনি পুলিসেরও সার্জন।

দ্বিতীয় গাড়ি থেকে নামল সাদা পোশাকের দুজন পুলিস। তাদের একজনের হাতে ক্যামেরা।

সবাই এসে গেছে। এবার তাহলে লাইব্রেরি ঘরে যাওয়া যাক। বললেন কর্নেল মেলচেট।

লাইব্রেরি ঘরের দিকে যেতে যেতে কর্নেল ব্যান্ট্রি বললেন, সকালে আমার স্ত্রী বলল, মেরি লাইব্রেরি ঘরে একটা লাশ দেখেছে। আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।

-আশাকরি তোমার স্ত্রী তেমন দুশ্চিন্তায় পড়েননি।

-না, সুন্দর সামলে নিয়েছেন। আমাদের গ্রামের সেই মহিলা মিস মারপল রয়েছেন ওর সঙ্গে।

মিস মারপল। ভুরু কুঁচকে উঠল কর্নেল মেলচেটের, তাকে আবার ডেকে পাঠিয়েছেন নাকি তোমার স্ত্রী? মহিলা তো এই এলাকার স্থানীয় গোয়েন্দা বলা চলে। একবার আমাদের খুব টেক্কা দিয়েছিলেন।

কথা বলতে বলতে তারা লাইব্রেরি ঘরের সামনে উপস্থিত হলেন।

.

ইতিমধ্যে ডাইনিং রুমে বসে মিসেস ব্যান্ট্রি আর মিস মারপল প্রাতরাশ সেরে নিয়েছেন।

মিসেস ব্যান্ট্রি এলাকায় বিশেষ পরিচিতা। ঘটনার জট খোলা এবং কার্যকারণ খুঁজে বের করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার–একথা এলাকার সকলেই বিশ্বাস করে।

-ওই অল্পবয়সী মেয়েটার এখানে আসার কথাই আমি ভাবছি। সেন্ট মেরী মিড এমন কোন বেড়াবার জায়গা নয় যে লণ্ডন থেকে কেউ এখানে আসবে। বেসিল ব্লেকের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার ওখানে মাঝে মাঝে পার্টি হয়।

–মেয়েটার পোশাকও কোন নাচের আসরে যাওয়ার মত। কিন্তু বেসিল ব্লেক–আমি তো তার মাকে চিনি। সেলিনা ব্লেক–আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি।

–বেসিল ব্লেকের পার্টিতে লণ্ডন থেকে অনেকেই আসে। বৃদ্ধা মিসেস বেরীর কাছে শুনেছি যে, সপ্তাহের শেষে মাঝে মাঝেই এক সোনালী চুল তরুণী তার ওখানে এসে থাকে।

-তুমি কি তাহলে মেয়েটাকে সে রকম কেউ ভাবছ?

–মেয়েটিকে অবশ্য সেরকম ভাবে খুঁটিয়ে দেখিনি। একবার মাত্র কটেজের বাগানে . দেখেছিলাম একফালি জাঙ্গিয়া আর কাঁচুলি পরে সূর্যস্নান করছিল।

তুমি যে রকম ভাবছ, তা হতেও পারে।

.

০২.

 কর্নেল ব্যান্ট্রি আর কর্নেল মেলচেট–দুই বন্ধুও ওই সময় আলোচনা করছিলেন। কর্নেল মেলচেট সতর্ক দৃষ্টি চারপাশে বুলিয়ে নিয়ে বললেন, তুমি তাহলে বলছ মেয়েটাকে একদম চেনো না।

–একই কথা বারবার কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছ বুঝছি না। তুমি কি

–মেজাজ গরম করো না বন্ধু। এটা খুনের ঘটনা–ভেতরের সমস্ত কথাই একসময় প্রকাশ হয়ে পড়বে। পাছে তুমি বিসদৃশ অবস্থায় পড়ে যাও আমি সেকথাই ভাবছি। মেয়েটার সঙ্গে তোমার কোন রকম যোগাযোগ থাকলে সেকথা এখনই বলে দেয়া ভাল। আমি জানি, তুমি কখনও মেয়েটাকে গলা টিপে মারতে পার না। কিন্তু মেয়েটা যে এবাড়িতে এসেছিল–হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যই এসেছিল–এরকম হওয়া অসম্ভব নয়। তুমি ভেবে দেখ।

–মেয়েটাকে জীবনে কখনও দেখিনি।

–তাহলে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে মেয়েটা তোমার বাড়িতে কেন ঢুকেছিল। সে যে এলাকার কেউ নয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমার লাইব্রেরিতে সে কি করছিল?

–সে কথা তো আমার জানবার কথা নয়। আমি তাকে ডেকে পাঠাইনি।

–তুমি কোন বেয়াড়া ধরনের চিঠি বা ওরকম কিছু পেয়েছিলে?

–না, ওসব কিছু পাইনি।

–গতরাত্রে তুমি কি করছিলে?

হাল্কা ভাবেই প্রশ্নটা করলেন কর্নেল মেলচেট।

–একটা সভায় গিয়েছিলাম রাত নটার সময়–কেনহ্যামে।

বাড়ি ফিরেছ কটায়?

-ওখান থেকে বেরিয়েছিলাম রাত দশটার পরে। পথে গাড়ির গোলমালে পড়তে হয়েছিল বাড়ি ফিরতে পৌনে বারোটা হয়ে গিয়েছিল।

–সে সময় লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলে?

–না।

লাইব্রেরি কে বন্ধ করে?

লরিমার। এ সময়ে সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই বন্ধ করে দেয়।

–বুঝেছি। তোমার স্ত্রী?

–আমি বাড়ি ফেরার সময় গভীর ঘুমে ছিল। সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে গিয়েছিল কিনা জিজ্ঞাসা করিনি।

–চাকরদের মধ্যে কেউ এর সঙ্গে জড়িত বলে তোমার মনে হয়?

–না-না, ওরা সবাই অত্যন্ত ভদ্র বংশের মানুষ। এ বাড়িতে বহু বছর ধরে আছে।

কর্নেল মেলচেটও মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ওদের কাউকে আমারও সন্দেহভাজন মনে হয় না। মেয়েটি সম্ভবতঃ কোন তরুণের সঙ্গে শহর থেকেই এসেছিল।

লণ্ডন-হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা। দাঁড়াও, মনে পড়েছে–বেসিল ব্লেক

–কে সে?

–সিনেমা জগতের সঙ্গে জড়িত এক ছোকরা। আমার স্ত্রীর পরিচিত। ছেলেটির মা তার সঙ্গে পড়াশোনা করেছে। একেবারে বকে যাওয়া ছেলেটি…স্ল্যানসহ্যাম রোডে একটা কটেজ নিয়েছে। মাঝে মাঝে সে এখানে পার্টি দেয়। খুবই হৈ-হুঁল্লোড় আমোদ হয়। শুনেছি সপ্তাহের শেষে সে শহর থেকে সুন্দরী মেয়েদেরও নিয়ে আসে।

-মেয়ে?

–হ্যাঁ। ওই রকম সোনালী চুল একটি মেয়েকে সে গত সপ্তাহের শেষে নিয়ে এসেছিল। কর্নেলকে খুব চিন্তিত মনে হল।

–স্বর্ণকেশী। কর্নেল মেলচেটের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ল। হ্যাঁ, একটা সম্ভাবনা আঁচ করা যাচ্ছে…।

কি যেন নাম বললে…তার সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার।

তারপর কর্নেল মেলচেট বিদায় নিলেন।

.

সেন্ট মেরী মিডের অধিবাসীদের কাছে বেসিল ব্লেকের কটেজ বুকারের নতুন বাড়ি বলেই পরিচিত। গ্রামের নতুন বাড়ির এলাকায় ওটা কিনেছিলেন মিঃ বুকার। মূল গ্রাম থেকে কটেজের দূরত্ব সিকি মাইলের মত।

কটেজের সামনের অংশটা গ্রামের পথের দিকেই।

প্রথমে শোনা গিয়েছিল একজন চিত্রতারকা বাড়িটা কিনেছেন। গ্রামের লোক উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল রুপোলী পর্দার কোন নায়ককে দেখতে পাবে বলে। পরে অবশ্য তারা হতাশ হয়েছিল।

জানা গিয়েছিল বেসিল ব্লেক কোন চিত্রতারকা নয়, এক ফিল্ম কোম্পানির স্টুডিও মঞ্চসজ্জার সাহায্যকারী কর্মী।

কটেজের মরচে ধরা লোহার গেটের সামনে পুলিসের গাড়ি এসে থামলে চিফ কনস্টেবল মেলচেট গাড়ি থেকে নামলেন।

এক তরুণ এগিয়ে এসে দরজা খুলল। তার কাঁধ অবধি লম্বা কালো চুল।

–কি ব্যাপার? এখানে কি চাই?

–আপনিই কি মিঃ বেসিল ব্লেক? বললেন মেলচেট।

–অবশ্যই আমি। 

–আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই।

–আপনি কে?

–আমি…আমি কর্নেল মেলচেট, এই কাউন্টির চিফ কনস্টেবল।

–তা আমার সঙ্গে কি বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন?

-শুনেছি আপনার এখানে গত সপ্তাহের শেষে একজন মানে তরুণী…ইয়ে স্বর্ণকেশী তরুণী এসেছিলেন?

–অ। আমার নৈতিকচরিত্র নিয়ে গ্রামের বুড়িগুলি বুঝি চিন্তায় পড়ে গেছে। কিন্তু…

তাকে বাধা দিয়ে কর্নেল মেলচেট বলে উঠলেন, একজন সুন্দরী তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে…তাকে খুন করা হয়েছে

-তাজ্জব ব্যাপার, কোথায়?

গ্যামিংটন হলের লাইব্রেরিতে।

–গ্যামিংটনে-সেই বুড়ো ব্যান্ট্রির বাড়িতে কর্নেল মেলচেট ব্লেকের চাচাছোলা কথাবার্তায় ক্রমশই মেজাজ হারিয়ে ফেলছিলেন। অনেক কষ্ট করে ক্রোধ সংবরণ করে রেখেছিলেন।

এবারে আর চড়া স্বরে উত্তর না দিয়ে পারলেন না।

দয়া করে সংযত ভাষায় কথা বললে খুশি হব। আমার জানার ব্যাপার ছিল, এই ব্যাপারে আপনি কোন আলোকপাত করতে পারেন কি না।

–অর্থাৎ আমার এখান থেকে কোন স্বর্ণকেশী খোয়া গেছে কিনা-এটাই আপনি জানতে এসেছেন–আরে হ্যাল্লো-কি ব্যাপার, আবার এসে জুটেছ?

সেই মুহূর্তে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে এলো এক সোনালী চুলের সুন্দরী তরুণী। ঢোলা সাদাকালো ডোরাকাটা পাজামা, লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁট, আর কাজল মাখা চোখে মেয়েটিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল।

ক্রুদ্ধভঙ্গিতে কটেজের দরজা ঠেলে সে চিৎকার করে বলল, তুমি আমাকে ফেলে পালিয়ে এলে কেন? বেশতো ওই স্পেনীয় মেয়েটার সঙ্গে ফুর্তি লুটছিলে।

-তুমিও তো ওই নোংরা রোজেনবার্গের সঙ্গে ছিলে।

-ও, তুমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিলে। কিন্তু তুমি বলেছিলে পার্টি থেকে দুজনে এখানে চলে আসব।

–সেই কারণেই তোমাকে বলে এসেছিলাম।

–একেবারে দেখছি বিনয়ী ভদ্রলোক।

 প্রায় খেঁকিয়ে উঠল মেয়েটি, আমি তোমার হুকুম তামিল করে চলবো–তুমি ভাবলে কি করে?

–আমার ওপরে কর্তৃত্ব ফলাবার স্পর্ধা তুমি দেখিও না খুকি।

দুজনে দুজনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে একমুহূর্ত নীরব হল।

এই সময় কর্নেল মেলচেটের কাশির শব্দ শোনা গেল। বেসিল ব্লেক দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল।

–আহা, আপনার কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই…ডিনা লী–কাউন্টি পুলিসের সবজান্তা কর্নেল…তাহলে কর্নেল আমার স্বর্ণকেশী সশরীরেই উপস্থিত দেখতেই পাচ্ছেন…সুপ্রভাত।

চিফ কনস্টেবল মুখ লাল করে দ্রুত পায়ে তার গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।

.

০৩.

 মাচ বেনহ্যামের অফিস কামরায় বসে অধঃস্তন কর্মচারীদের তদন্তের রিপোর্টে চোখ বোলাচ্ছিলেন মেলচেট। সামনে বসে ইনসপেক্টর স্ল্যাক বলে চলেছেন, সবই বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে স্যার…নৈশভোজের পর মিসেস ব্যান্ট্রি লাইব্রেরিতে বসেছিলেন, তারপর রাত দশটা নাগাদ শুতে চলে যান। চাকরবাকররা রাত সাড়ে দশটার মধ্যে শুতে যায়। রাতের কাজকর্ম শেষ করে লরিমার শুতে যায় পৌনে এগারোটায়।

রিপোর্ট দেখতে দেখতে কর্নেল মেলচেট বললেন, চাকরবাকরদের কেউ কিছু জানে মনে হয় না।

এই সময়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন ডাঃ হেডক।

–ময়না তদন্তের বিষয়টা জানিয়ে যেতে এলাম।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধন্যবাদ, এটারই দরকার এখন। বললেন কর্নেল মেলচেট।

বলার মত বেশি কিছু নেই। শ্বাসরোধের ফলেই মৃত্যু ঘটেছে। মেয়েটির পোশাকের কোমর বন্ধ গলায় ফাঁস লাগিয়ে পেছনে টেনে এনে হত্যা করা হয়েছে। ধস্তাধস্তির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

-মৃত্যুর সময়টা কখন মনে হয়।

–সেভাবে বলতে গেলে বলতে হয় রাত দশটার আগে না, আর মধ্যরাত্রির পরে নয়।

–আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু?

-না তেমন কিছু নেই। মেয়েটির কুমারীত্ব অটুট ছিল। বয়স আঠারোর মধ্যে–চমৎকার স্বাস্থ্য।

কথা শেষ করে ডাঃ হেডক বিদায় নিলেন।

কর্নেল মেলচেট ইনসপেক্টর স্ল্যাকের দিকে তাকালেন। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা লণ্ডন থেকেই এই এলাকায় এসেছিল। কোন সূত্র তো চোখে পড়ছে না। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকে জানানোই ভাল মনে হচ্ছে।

শহর থেকে এলেও, স্ল্যাক বললেন, মেয়েটির আসার উদ্দেশ্য কর্নেল আর মিসেস ব্যান্ট্রি কিছু জানেন বলে আমার মনে হয়। অবশ্য আমি জানি তারা আপনার বন্ধু।

এ কথায় কর্ণপাত না করে কর্নেল মেলচেট কি বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি উঠে গিয়ে রিসিভার কানে তুলে নিলেন।

হ্যাঁ, ম্যাচ বেনহ্যাম পুলিস সদর দপ্তর…হ্যাঁ, একমিনিট…টুকে নিচ্ছি…বলুন…রুবি কীন… বয়স আঠারো…পেশাদার নৃত্য শিল্পী…পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতা…সোনালী চুল, পাতলা চেহারা…সাদা সান্ধ্য পোশাক পরণে…পায়ে রুপোলি চপ্পল…ঠিক আছে…মিলে যাচ্ছে…হা… এখুনি আমি স্ল্যাককে পাঠিয়ে দিচ্ছি…ওকে।

রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কর্নেল মেলচেট।

–সঠিক সন্ধানটা পাওয়া গেল। গ্লেনসায়ার পুলিসের কাছ থেকে ফোন এসেছিল। ডেনমাউথের ম্যাজেস্টিক হোটেল থেকে একটি মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল।

-ও তো জলা ভূমিতে ঘেরা একটা জায়গা। বললেন ইনসপেক্টর স্ল্যাক।

–হ্যাঁ, এখান থেকে আঠারো মাইলের পথ। ওই ম্যাজিস্টিক হোটেলেই মেয়েটি নৃত্য শিল্পী ছিল। গতরাতে কাজে উপস্থিত হয়নি বলে হোটেল কর্তৃপক্ষ পুলিসকে জানিয়েছে। তুমি এখনই রওনা হয়ে যাও। সেখানে সুপারিন্টেন্টে হার্পারের সঙ্গে দেখা করে যা দরকার করবে।

.

০৪.

 এরপর যথাসম্ভব দ্রুত গাড়ি হাঁকিয়ে স্ল্যাক ডেনমাউথে পৌঁছেছেন, সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, আর হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।

এরপর তিনি রুবি কীনের এক বোনকে সঙ্গে নিয়ে মাচ ব্যানহামে ফিরে এলেন।

কর্নেল মেলচেট স্ল্যাকের অপেক্ষাতেই ছিলেন। স্ল্যাকের সঙ্গে ঘরে ঢুকে তরুণীটি জানাল, পেশাদারী জগতে আমি জোসি নামেই পরিচিত। আমার আসল নাম অবশ্য জোসেফাইন টার্নার। আমার সহকারী রেমণ্ড নামে পরিচিত।

কর্নেল মেলচেটের ইঙ্গিতে মিস টার্নার একটা চেয়ারে বসল। মেয়েটি রূপসী, বয়স তিরিশের বেশি হয়নি। সৌন্দর্যের অনেকটাই প্রসাধনের সহায়তায় বাড়ানো। মেলচেটের মনে হল বেশ বুদ্ধিমতি আর নম্রস্বভাবা। উদ্বিগ্ন মনে হলেও শোকগ্রস্ত মনে হচ্ছিল না মোটেই।

আরও দু-একটি কথার পরে সকলে মর্গের দিকে পা বাড়ালেন।

মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করে বেরিয়ে এসে মিস, টার্নার কম্পিত গলায় বলল, হ্যাঁ, রুবির মৃতদেহ, কোন সন্দেহ নেই। ওঃ আমার শরীর কেমন করছে।

অফিসে ফিরে এলে কর্নেল মেলচেট বললেন, মিস টার্নার, আপনার কাছ থেকে রুবি সম্পর্কে সব কথা আমাদের জানা দরকার।

-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি গোড়া থেকেই বলছি। একটু দম নিল জোসি। পরে বলতে শুরু করল, ওর নাম রুবি কীন। অবশ্য ওটা পেশাদারী নাম। আসল নাম রোজি লেডা। ওর মা ছিল আমার মায়ের মাসতুতো বোন। ওকে আমি ছেলেবেলা থেকেই চিনি। বাইরে থেকে যতটা সম্ভব অবশ্য। রুবি নিজেকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে তৈরি করেছিল। দক্ষিণ লন্ডনের রিক্সওয়েলের প্যালে দ্য ভাস প্রতিষ্ঠানে নৃত্যশিল্পীর জুড়ি হিসেবে কাজ করছিল।

আমি ডেনমাউথের ম্যাজেস্টিক হোটেলে তিন বছর ধরে কাজ করে আসছি।

গত গ্রীষ্মকালে একটা দুঘর্টনায় আমার পায়ের গোড়ালি মচকে যায়। ফলে হোটেলে নাচ বন্ধ রাখতে বাধ্য হই। আমার বদলে রুবিকে নিয়ে আসার জন্য আমি তখন ম্যানেজারকে বলি, টেলিগ্রাম করে তাকে নিয়ে আসা হয়।

–এ ঘটনা কতদিন আগেকার? জিজ্ঞেস করলেন কর্নেল মেলচেট।

–তা এক মাস হল রুবি জয়েন করেছে। ওর সবই ভাল ছিল, দেখতেও সুন্দরী। কিন্তু তেমন মিশুকে ছিল না আর কেমন বোকা-সোকা ধরনের। অল্প বয়সীদের চাইতে বয়স্কদের সঙ্গেই ভাল মানিয়ে নিতে পারত।

-ওর বিশেষ কোন বন্ধু ছিল? জানতে চাইলেন মেলচেট।

–তা বলতে পারব না। আমাকে বলেনি কখনো।

–আপনার মাসতুতো বোনকে শেষ কখন দেখেছিলেন?

–গতরাত্রেই। ও আর রেমণ্ড দুটো প্রদর্শনী নাচে অংশ নিয়েছিল। প্রথমবার নেচেছিল রাত সাড়ে দশটায়। দ্বিতীয়টা মাঝরাতে হবার কথা ছিল। প্রথম নাচটা শেষ করার পর আমি দেখতে পাই হোটেলে থাকে এমন একজনের সঙ্গে নাচছে। আমি তখন লাউঞ্জে কয়েকজনের সঙ্গে ব্রিজ খেলছিলেন।

ওকে ওই শেষবার দেখি। মাঝরাতের পর রেমণ্ড হঠাৎ ছুটে এসে জানায় রুবিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। ওদিকে নাচেরও সময় হয়ে গেছে।

আমি তখনই রেমণ্ডকে নিয়ে রুবির ঘরে গেলাম। ঘরে সে ছিল না। যে পোশাক পরে নেচেছিল–হাল্কা গোলাপী স্কার্ট চেয়ারের ওপরে পড়েছিল।

হেড কনস্টেবল কর্নেল মেলচেট নীরবে বসে মিস টার্নারের কথা শুনে যাচ্ছিলেন।

রুবি ফেরেনি দেখে আমিই বাধ্য হয়ে রেমণ্ডের নাচের জুড়ি হয়েছিলাম। খুবই কষ্ট হয়েছিল। সকালে দেখলাম পা বেশ ফুলে উঠেছে। রুবির জন্য বেলা দুটো পর্যন্ত বসে রইলাম।

তারপর আপনি পুলিসে খবর দিলেন?

–না আমি দিইনি। আমার ধারণা ছিল, বোকার মত নিশ্চয়ই কোন ছেলের পাল্লায় পড়েছে, ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত

–মিঃ জেফারসন বলে কে একজন পুলিসে খবর দিয়েছিল। তিনি কে?

–হোটেলের অতিথিদের একজন। তিনিই পুলিসে খবর দিয়েছিলেন।

–কিন্তু তিনি হঠাৎ খবর দিতে গেলেন কেন?

–ভদ্রলোক পঙ্গুমানুষ। সামান্য কিছু ঘটলেই অস্থির হয়ে পড়েন।

–আপনার বোনকে যে তরুণের সঙ্গে শেষ নাচতে দেখেন সে কে?

তার নাম বার্টলেট। গত দশ দিন ধরেই সে হোটেলে আছে।

–এদের মধ্যে কি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল?

 –এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। কথাটা শুনে কর্নেল মেলচেটের মনে হল, জোসি ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছু চেপে যাচ্ছে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এসম্পর্কে ছেলেটির কি বক্তব্য?

–সে বলেছে নাচের পরে রুবি তার ঘরে গিয়েছিল।

–এর পরেই কি সে-

-হ্যাঁ, অদৃশ্য হয়ে যায়।

–সেন্ট মেরী মিডে মিস কীন কাউকে চিনতেন বলে জানেন?

–আমার জানা নেই।

–কখনো তাকে গ্যামিংটন হলের নাম করতে শুনেছিলে?

–না, ও নামটা এই প্রথম শুনলাম।

কর্নেল মেলচেট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিস টার্নারকে লক্ষ্য করে বললেন, গামিংটন হলেই মিস কীনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।

–গ্যামিংটন হলে? আশ্চর্য কাণ্ড।

–কর্নেল ব্যান্ট্রি বলে কাউকে আপনি চেনেন? কিংবা মিঃ বেসিল ব্লেক বলে কাউকে?

 –বেসিল ব্লেক নামটা শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। তবে এসম্বন্ধে কিছু জানি না।

এই সময় ইনসপেক্টর স্ল্যাক তার নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে চিফ কনস্টেবলের দিকে এগিয়ে দিলেন। তিনি কাগজে চোখ বুলিয়ে দেখলেন, পেন্সিলে লেখা রয়েছে, কর্নেল ব্যান্ট্রি গত সপ্তাহে ম্যাজেস্টিক হোটেলে নৈশ ভোজ সেরেছিলেন।

কর্নেল মেলচেট মুখ তুলে স্ন্যাকের চোখে চোখ রাখলেন। তার বন্ধু কর্নেল ব্যান্ট্রি সম্পর্কে স্ল্যাকের মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি নীরব রইলেন। পরে জোসির দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস টার্নার, আমার ইচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে একবার গ্যামিংটন হলে যান, তাহলে কাজের কিছু সুবিধা হয়।

-আমার আপত্তি নেই।

.

০৫.

 গ্যামিংটন হলেন ব্যাপারটা চিরকুমারী ওয়েদারবেরী বেশ রসালো করে রটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন।

মিস মারপলকেও যে গ্যামিংটন হলের গাড়ি এসে নিয়ে গেছে সে খবরও সেন্ট মেরী মিডের অনেকেরই জানা হয়ে গেল।

ঘটনাটা বেশ মুখরোচক এবং কলঙ্কজনক রূপ নিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল।

মিসেস প্রাইস রিডলে খবরটা পেলেন তাঁর পরিচালিকা ক্লারার মুখে। তিনি আবার ঘটনাটা পৌঁছে দিলেন গ্রামের যাজক রেভারেণ্ড মিঃ ক্লিমেন্টকে।

মিসেস প্রাইস রিডলে গত এক বৃহস্পতিবারে লণ্ডন যাবার পথে কর্নেল ব্যান্ট্রিকে দেখতে পেয়েছিলেন। প্যাডিংটনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেন্ট জনস উডের একটা ঠিকানায় যাচ্ছেন–এরকম তার কানে এসেছিল। যাজক ভদ্রলোককে বেশ সন্দেহের সুরেই এই বিবরণও জানিয়েছিলেন।

মিঃ ক্লিমেন্ট অবশ্য এতে কিছুই বুঝতে পারেন নি। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এতে কি প্রমাণ হয়?

.

লাইব্রেরী ঘর থেকে ইতিমধ্যে মৃতদেহটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিসের লোক যারা আঙুলের ছাপ আর ছবি নিতে এসেছিল, তারাও চলে গিয়েছিল।

মিসেস ব্যান্ট্রি আর মিস মারপল বসার ঘরে এসে বসেছিলেন।

–জানো জেন, আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে পারে। ভালো লাগছে না। তুমি বসো। কর্নেল মেলচেট ফোন করে জানিয়েছেন, যে মেয়েটি মারা গেছে তার এক মাসতুতো বোনকে নিয়ে আসছেন এখানে। তুমি কিছু বুঝতে পারছ?

–মেয়েটাকে এখানে কেন আনা হচ্ছে বুঝতে পারছি না, বললেন মিস মারপল, তবে এমন হতে পারে কর্নেল মেলচেটের ইচ্ছে কর্নেল ব্যান্ট্রিকে মেয়েটা একবার দেখুক।

-ওকে চিনতে পারে কিনা সে জন্য? বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি। ওরা কি আর্থারকে সন্দেহ। করছে?

-আমারও সেরকম ধারণা।

 –আর্থার এই ঘটনায় জড়িত! আশ্চর্য।

 –এ নিয়ে চিন্তা করো না, ডলি।

–আর্থারও বেশ ভেঙ্গে পড়েছে।

এই সময় বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। একটু পরেই কর্নেল মেলচেট সেই মেয়েটিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

–ইনি হলেন মিস টার্নার, মিসেস ব্যান্ট্রি। নিহত মেয়েটির মাসতুতো বোন।

মিসসে ব্যান্ট্রি তার সঙ্গে করমর্দন করে মিস মারপলকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর তাকে নিয়ে লাইব্রেরী ঘরে এলেন।

কর্নেল মেলচেট আর মিস মারপল তাকে অনুসরণ করলেন।

–ও ওখানে পড়েছিল।

 কার্পেটটা দেখিয়ে বললেন মিস ব্যান্ট্রি।

-ওহ। বড় অদ্ভুত লাগছে–এমন একটা জায়গায়

ব্যাপারটা নিয়ে মিস মারপল নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন? বললেন কর্নেল মেলচেট।

মিস মারপল কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে রইলেন। পরক্ষণেই সকলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের সঙ্গে মিলিত হবেন কর্নেল ব্যান্ট্রি। কর্নেল মেলচেট তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। পরে তাকে মিস টার্নারের পরিচয় জানালেন। তিনি লক্ষ্য করলেন দুজনের কারো মুখেই পরস্পরকে চিনতে পারার কোন ভাব জাগল না। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

মিস টার্নারের মুখে রুবী কীনের অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা শুনলেন।

মিস মারপল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তার পরেই আপনি পুলিসে খবর দিলেন?

–ওহ না। খবরটা দিয়েছিলেন মিঃ জেফারসন। তিনি হোটেলের বাসিন্দা। মানুষটা পক্ষাঘাতে পঙ্গু।

–মিঃ জেফারসন? মিসেস ব্যান্ট্রি বললেন।

–কনওয়ে জেফারসন কি?

–হ্যাঁ।

–তিনি তো আমাদের বহুকালের পুরনো বন্ধু। তিনি ম্যাজেস্টিক হোটেলে আছেন? আর্থার, এতো দেখছি রীতিমত এক সমাপতন।

এরপর মিস টার্নারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিনি আজকাল কেমন আছেন? তাঁর পরিবারের আর সকলেও কি সেখানেই আছেন?

-হ্যাঁ মিঃ গ্যাসকেন, ছোট মিসেস জেফারসন আর পিটার–ওরা সবাই রয়েছেন। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন, মিঃ জেফারসন সম্পর্কে মেয়েটি যখন কথা বলছিল, তার গলায় কিছুটা যেন কৃত্রিম রয়েছে।

আরও দু-চারটি কথা বলার পর কর্নেল মেলচেট বিদায় নিলেন।

–লক্ষ্য করেছ ডলি, জেফারসনদের কথা উঠতেই মেয়েটি কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল? বললেন মিস মারপল।

–ব্যাপারটা কি হতে পারে জেন? মেয়েটি বোনের জন্য দুঃখ পেয়েছে বলে কিন্তু মনে হল না আমর।

-হ্যাঁ, রুবী কীনের কথা বলতে গিয়ে কেমন রেগে উঠছিল, আমারও নজরে পড়েছে। কারণটা কি হতে পারে সেটাই আগ্রহের বিষয়।

এক মুহূর্ত কি ভাবলেন মিসেস ব্যান্ট্রি। পরে বললেন, ব্যাপারটা জানতে হবে। আমরা আজ ডেনমাউথে খাব আর ম্যাজেস্টিক হোটেলে থাকব–তুমিও থাকবে আমাদের সঙ্গে। জেফারসনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব-দেখবে খুবই ভাল মানুষ। মানুষটা বড় দুঃখী। এক ছেলে আর এক মেয়ে ছিল তার–দুজনেই বিবাহিত। একবার ফ্রান্স থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় ওরা সকলেই মারা যায়।–মিসেস জেফারসন রোজামণ্ড আর ফ্র্যাঙ্ক। কনওয়ের পা দুটো কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। অসাধারণ মনের জোরে নিজেকে সামলে রেখেছেন। পুত্রবধূটি এখন ওঁর সঙ্গেই থাকে। ফ্র্যাঙ্ক জেফারসনের সঙ্গে বিয়ের আগে ও ছিল বিধবা। প্রথম পক্ষের এক ছেলে আছে তার পিটার কারমোডি। ওরা দুজন ছাড়া সৰ্ক গ্যামকেল, রোজামণ্ডর স্বামীও থাকে কনওয়ের সঙ্গে। ওদের কথা ভাবতে গেলে বুক ফেটে যায়।

–তার ওপরে ঘটল আর একটা দুঃখজনক ঘটনা। বললেন মিস মারপল।

–এ ঘটনার সঙ্গে কি সম্পর্ক?

–নেই বলছ? মিঃ জেফারসনই তো পুলিসে খবরটা দিয়েছিলেন।

.

.

০৬.

 গ্রেনসায়ার পুলিসের সুপারিন্টেন্টে হার্পার আর ইনপেক্টর ক্ল্যাককে নিয়ে কর্নেল মেলচেট কথা বলছিলেন হোটেলের ম্যানেজার মিঃ প্রেসকটের সঙ্গে।

কর্নেলের প্রশ্নের উত্তরে মিঃ প্রেসকট বললেন, মেয়েটির সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তাকে এনেছিল যোসি

–যোসি এখানে কতদিন আছে?

বছর তিনেক।

 –মেয়েটিকে আপনি পছন্দ করেন?

-হ্যাঁ। ও খুব কাজের মেয়ে। আমাদের পক্ষে সবদিক থেকেই উপযুক্ত। ব্যবহারও বেশ মনোরম। ওর ওপর যথেষ্ট নির্ভর করি আমি।

–গোড়ালির চোট পাওয়ার পরেই কি সে তার মাসতুতো বোনটিকে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল?

-হ্যাঁ। আমি মেয়েটির বিষয়ে কিছুই জানতাম না। যোসিই তাকে নিজের খরচে নিয়ে এসেছিল। মাইনের ব্যাপারটাও ওরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিয়েছিল।

এরপর রুবী কীনের সম্পর্কে জানাতে গিয়ে হোটেল ম্যানেজার জানালেন মিঃ জেফারসন তাকে খুবই পছন্দ করতেন। মাঝেমাঝে গাড়ি করে বেড়াতেও নিয়ে যেতেন। তিনি পঙ্গু মানুষ, হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করেন। অল্পবয়সী মেয়েদের তিনি খুবই স্নেহ করেন। তাদের জন্য মাঝে মধ্যে এখানে পার্টি দিয়ে থাকেন।

–পুলিসে ফোনটা তো তিনিই করেছিলেন? জানতে চাইলেন সুপারিন্টেন্টে হার্পার।

–হ্যাঁ। আমার ঘরে বসেই ফোন করেছিলেন।

এরপর মিঃ জেফারসনের সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন কর্নেল মেলচেট। মিঃ প্রেসকট তাদের নিয়ে মিঃ জেফারসনের সুইটে উপস্থিত হলেন।

মিসেস এডিলেড জেফারসন জানালেন তার শ্বশুর প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন। ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠলেই তার সঙ্গে কথা বলা ভাল।

সুপারিন্টেন্টে হার্পার কর্নেল মেলচেটকে বললেন, তাহলে ততক্ষণে তরুণ জর্জ বার্টলেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসা যাক।

কর্নেল মেলচেট তার এই প্রস্তাবে সায় দিলেন।

.

০৭.

 কৃশ চেহারার ছিপছিপে তরুণ জর্জ বার্টলেট। তার সঙ্গে কথা বলে কিন্তু বিশেষ কিছুই জানা গেল না।

রাত এগারটা নাগাদ সে রুবী কীনের সঙ্গে নেচেছিল। তারপর সে তার নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। সেই সময় তাকে কিছুটা ক্লান্ত আর বিমর্ষ মনে হয়েছিল তার।

এরপর খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এসে একমাত্র পানীয় পান করেছিল। সেই সময় তার চোখে পড়েছিল যোসি টেনিস খেলে যে ভদ্রলোক তার সঙ্গে নাচছিল।

যোসির গোড়ালিতে চোট লেগেছিল সে জানত, এই অবস্থায় তাকে নাচতে দেখে সে খুব বিস্মিত হয়েছিল।

কর্নেল মেলচেট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোন গাড়ি আছে?

–হ্যাঁ, আমার গাড়ি আছে। বলল বার্টলেট।

 –গাড়িটা নিয়েই ঘুরতে বেরিয়েছিলেন কি?

–না। ওটা চত্বরেই ছিল।

–একেবারে মাথামোটা গর্দভ।

বার্টলেটের সঙ্গে কথা বলার পর কর্নেল মেলচেটের এই ছিল সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া

.

হোটেলের নাইটগার্ড ও বারম্যানদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। রুবী কীন যে সদর দরজা দিয়ে বাইরে যায়নি সে রাত্রে সে কথা বেশ জোর দিয়েই জানাল নাইটগার্ড। তবে সেই সঙ্গে একথাও জানাল, দোতলার ঘর থেকে বেরিয়েই যে ঘোরানো সিঁড়ি সেটা দিয়ে বেরিয়ে গেলে তাকে চোখে পড়বার কথা নয়।

রাত দুটোয় নাচ বন্ধ হওয়ার আগে সেই দরজা বন্ধ করা হয় না।

বারম্যানের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়েই নয় বছরের একটি বালকের সামনে পড়ে গেলেন কর্নেল মেলচেট ও তার সঙ্গরী।

ছেলেটি বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি গোয়েন্দা? আমি পিটার কার মেসি। আমার দাদু মিঃ জেফারসনই রুবীর জন্য পুলিসে ফোন করেছিলেন। আমি ডিটেকটিভ গল্প খুব পছন্দ করি। গোয়েন্দাদের আমার ভাল লাগে।

ছেলেটির চটপটে কথাবার্তা শুনে সুপারিন্টেন্টে হার্পার খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তিনি তার সঙ্গে কথায় কথায় বেশ ভাব জমিয়ে নিলেন।

শেষ পর্যন্ত এই সাক্ষাৎকার থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র তারা পেয়ে গেলেন।

–রুবী কীনকে খুব ভাল লাগত। কিন্তু মা আর মার্ক কাকা ওকে একদম দেখতে পারত না। কেবল দাদু ওকে ভালবাসতো…ও যে মরে গেছে এজন্য তারা খুব খুশি…

পিটার কারমেসির কথা শুনে কর্নেল মেলচেট আর হার্পার পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

এরপর তারা কনওয়ে জেফারসনের সুইটে উপস্থিত হলেন। সেই সময় দীর্ঘকায় অস্থির চিত্ত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন কনওয়ের পুত্রবধূ এডিলেড।

পুলিস কর্তাদের দেখে সেই ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমার শ্বশুর আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল নয়।

ডাক্তার বলে দিয়েছেন কোন অবস্থাতেই যেন তাকে উত্তেজিত হতে দেওয়া না হয়।

-হ্যাঁ। ওঁর হার্ট খুবই খারাপ। এডিলেড জেফারসন মার্ক গ্যাসকেলকে সমর্থন করার চেষ্টা করলেন।

লোকটি দুঃসাহসী, অবিবেচক আর বিবেকবর্জিত। এমন চরিত্রের মানুষ যে কোন কাজই নির্বিকারে করতে সক্ষম–এরকমই ধারণা হল তার।

শোবার ঘরেই জানালার সামনে তার হুইল চেয়ারে বসেছিলেন মিঃ জেফারসন। প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায় মানুষটি প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। লাল চুলে সাদা ছোপ পড়েছে। নীলাভ চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে দীর্ঘ যন্ত্রণার ছায়া। শরীরে রোগ বা দুর্বলতার কণামাত্র ছাপও নজরে পড়েনা।

প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনি অতিথিদের সামনের সোফায় বসতে ইঙ্গিত করলেন।

-আমরা এসেছি মৃত মেয়েটি সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে। কর্নেল মেলচেট বললেন।

-আমার মনে হয়, সমস্ত কথা আপনাদের খোলাখুলিই জানানো দরকার।

কোনরকম ভূমিকা না করেই মিঃ জেফারসন বলতে শুরু করলেন, আটবছর আগে একটা বিয়োগান্ত ঘটনা আমার জীবনে ঘটে। এক বিমান দুর্ঘটনায় আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে ও মেয়েকে হারাই। জীবনের অর্ধেকটাই আমার এভাবে হারিয়ে যায়। আমিও পঙ্গু দেখতেই পাচ্ছেন।

এখন আমার পুত্রবধূ আর জামাই আমার সঙ্গে থাকেন। তারা আমার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারই করেন। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে অল্পবয়স্কদের ভাল লাগে। তাদের আমি উপভোগ করি।

যে বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল গত একমাস যাবৎ তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মেয়েটি স্বাভাবিক ও সরল। বড় নিষ্পাপ। কোন রকম অশ্লীলতা তার মধ্যে ছিল না। আমি ঠিক করেছিলাম আইনসিদ্ধভাবেই তাকে দত্তক নেব।

আশা করি এ থেকে আপনারা বুঝতে পারবেন সে হারিয়ে গেছে শুনে কেন আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।

–এ ব্যাপারে আপনার পুত্রবধূ আর জামাইয়ের বক্তব্য জানতে পারি কি? বললেন হাপার।

তাদের এতে বলার কিছু নেই। তবে এটা ঠিক তেমন ভালভাবে নেয়নি। আমার ছেলে ফ্র্যাঙ্ককে তার বিয়ের পরে আমার সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেকটাই দিয়ে দিয়েছিলাম।

মেয়ে রেজামণ্ড এক দরিদ্রকে বিয়ে করেছিল। তাকেও আমি অনেক টাকা লিখে দিয়েছিলাম। তার মৃত্যুর পরে সে টাকার মালিক হয় তার স্বামী। অর্থকরীর দিক থেকে এদের কোন অভিযোগই আমি রাখিনি।

যাই হোক বুঝতেই পারছেন মিঃ গ্যাসকেল আর মিসেস জেফারসন আমার পরিবারে থাকলেও রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়।, আমি মানুষের চরিত্র বিচার করতে জানি। বুঝতে পেরেছিলাম কিছুটা শিক্ষা পেলে রুবি কীন সঠিক ভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে।

-বুঝতে পারছি, বললেন কর্নেল মেলচেট, মেয়েটির দায়িত্ব আপনি নিতে চাইছিলেন, তার নামে টাকাও রাখতে চাইছিলেন–কিন্তু কাজটা আপনি

-আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পেরেছি, মেলচেট, মেয়েটির মৃত্যুতে লাভবান হবার সম্ভাবনা কারো ছিল না। কেন না, দত্তক গ্রহণের প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা তখনো সম্পূর্ণ করা হয়নি।

–কিন্তু আপনার দিক থেকে তো আশঙ্কা

-না সেই সম্ভাবনা নেই। ডাক্তাররা যাই বলুক না কেন আমি তখনও টগবগে ঘোড়ার মতই শক্তিশালী তবে এব্যাপারেও আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। দশ দিন আগে একটা নতুন উইল করেছি আমি।

-নতুন উইল করেছেন। সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন হার্পার।

রুবি কীনের জন্য ট্রাস্টি করে পঞ্চাশ হাজার টাকা তাদের হাতে দিয়েছি।

–এ যে অনেক টাকা। হার্পার যেন সামনে পথ দেখতে পেলেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের পরিচয়ের সূত্রে আপনি একজনকে এতটাকা দিচ্ছেন, এ খুবই আশ্চর্য।

–কারুর কিছু বলার নেই। এ টাকা আমার উপার্জন করা। কাজেই এ টাকা খরচ করার ব্যাপারে আমার পূর্ণ স্বাধীনতাই রয়েছে।

যাই হোক, এই ভয়ঙ্কর ঘটনা সম্পর্কে আমি সবকিছু জানতে চাই। আমি শুনেছি এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে একটা বাড়িতে রুবিকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে।

-হ্যাঁ, গ্যামিংটন হলে। কর্নেল ব্যান্ট্রির বাড়ি

মিঃ জেফারসন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, ব্যান্ট্রি..আর্থার ব্যান্ট্রি? তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আমার পরিচিত। আমার ধারণা ছিল না তারা এই এলাকায় থাকেন। ব্যাপারটা

-কর্নেল ব্যান্ট্রি এই হোটেলেই গত সপ্তাহের মঙ্গলবারে নৈশভোজ সেরেছিলেন, আপনার নজরে পড়েনি? বললেন হার্পার।

মঙ্গলবার…না আমরা হার্ডেন হেড-এ গিয়েছিলাম। পথেই নৈশভোজ সারতে হয়েছিল।

রুবি কীন আপনার কাছে ব্যান্ট্রিদের সম্পর্কে কখনো উল্লেখ করেছিলেন?

–না, কখনও না। ব্যান্ট্রি এব্যাপারে কি বলেছেন?

–তিনি জানিয়েছেন মেয়েটিকে কখনও দেখেননি।

–গোটা ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

মিনিট দুই নীরবতার মধ্যে কাটল। পরে হার্পার বললেন। একাজ কে করে থাকতে পারে, এ সম্পর্কে আপনার কি কোন ধারণা আছে?

–সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ব্যাপার এটা আমার কাছে। এরকম কিছু ঘটতে পারে আমার কখনই মনে হয়নি।

–তার অতীত জীবনের পরিচিত কেউ

–না। তেমন কেউ থাকলে অবশ্যই আমাকে বলত। তাছাড়া তার নিয়মিত কোন ছেলে বন্ধুও ছিল না। তবে রুবীর পেছনে কেউ যদি ঘোরাঘুরি করে থাকে তার কথা যোসিই ভাল জানবে।

–সে বলছে, কেউ তেমন ছিল না।

এরপর আর দু-একটা কথা বলে হার্পার আর মেলচেট বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

কনওয়ে জেফারসন তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারক এডওয়ার্ডসকে ডাকলেন। ডাক শুনে সে পাশের কামরা থেকে সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকল।

বলুন স্যার।

–স্যার হেনরি ক্লিদারিংকে এখুনি যোগাযোগ কর। তিনি মেলবোর্ন অ্যাবাসে রয়েছেন। বলবে, জরুরী প্রয়োজন। যেন আজই এখানে আসেন।

.

০৮.

 –পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড। খুনের একটা কারণ মনে হয় খুঁজে পাওয়া গেল স্যার। বললেন। সুপারিটেণ্ডেন্ট হার্পার।

-হ্যাঁ, তা গেছে। তবে সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখা দরকার, বললেন কর্নেল মেলচেট, গ্যাসকেট লোকটিকে আমার সুবিধার মনে হয়নি। তবে খুনটা সেই করেছে। এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়।

–ওদের দুজনের কেউই খুশি বলে মনে হল না আমরা তবে, অন্য এক সম্ভাবনার কথাই আমার মনে হচ্ছে।

রুবি কীনের সেই ছেলে বন্ধু?

–হ্যাঁ, স্যার। এখানে আসার আগে থেকেই হয়তো রুবি তাকে জানতো।

–কিন্তু রুবির দেহ কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরী ঘরে গেল কি করে?

–ধরুন নাচের শেষে রুবি তার সঙ্গেই গাড়িতে বাইরে গিয়েছিল। কোন বিষয়ে কথা কাটাকাটিতে মেজাজ হারিয়ে সে রুবিকে খুন করে বসে। সেই সময় তারা একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। লোকটি নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য রুবির দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছিল। গাড়িতে একটা বাটালি ছিল। সেটা দিয়ে জানালা খুলে

-তোমার কথা অসম্ভব বলে মনে হয় না। তবে তার আগে আরও একটা কাজ করার আছে।

রুরি কীনের ঘরে তদন্ত করে তার পরিচারিকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন স্ল্যাক। মেলচেট তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

এমনি সময়ে জর্জ বার্টলেট ঘরে ঢুকল। সে দুজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাইল।

মেলচেট তরুণটিকে আগেই ভালচোখে দেখেননি। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন কি ব্যাপার–কি হয়েছে?

–আমার গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না স্যার।

–মানে, আপনি বলতে চাইছেন আপনার গাড়ি চুরি গেছে? বললেন হার্পার।

কেমন কুঁকড়ে গেল বার্টলেট। দুপা পিছিয়ে গিয়ে সে ইতস্তত করে বলল, মানে…ইয়ে…ঘটনাটা সেরকমই…

–গাড়িটা শেষ কোথায় দেখেছিলেন আপনি? গতরাত্রে হোটেল চত্বরে রাখা ছিল এরকমই তো বলেছিলেন।

-হ্যাঁ। কিন্তু একটু বেরুবো ভেবে গিয়ে গাড়িটা সেখানে দেখতে পেলাম না।

 –কি ধরনের গাড়ি?

–মিনোয়ান চোদ্দ। মধ্যাহ্নভোজের আগে গাড়িটা নিয়ে এসেছিলাম। বিকেলে একপাক ঘুরে আসব ভেবেছিলাম মানে…আর যাওয়া হয়নি…পরে নৈশভোজের পরেও বেরুবো ভালোম…কিন্তু গাড়িটা দেখতে পেলাম না।

–গাড়িটা সেখানেই ছিল?

–হ্যাঁ, সেটাই তো স্বাভাবিক।

হার্পার কর্নেল মেলচেটকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনার সঙ্গে আমি ওপরে দেখা করব স্যার। মিঃ বাৰ্টলেটের কথাগুলো লিখে নেবার জন্য একবার সার্জেন্ট হিগিনসকে বলে আসি।

–ঠিক আছে। বললেন মেলচেট।

ক্ষীণস্বরে ধন্যবাদ দেবার চেষ্টা করে বার্টলেট বিদায় নিল।

.

যোসেফাইন টার্নার আর রুবি কীন হোটেলের দোতলায় বারান্দার শেষ প্রান্তে ছোট্ট নোংরা একটা ঘরে থাকতো। ঘরটা হোটেলের পেছনের অংশে।

মেলচেট আর হার্পার উত্তরমুখো ঘরটায় ঢুকে বুঝতে পারলেন ঘরটার অবস্থান এমন জায়গায় যে এখান থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবার সময় হোটেলের কারোরই নজরে পড়ার কথা নয়।

গতরাতের পর থেকে ঘরটা একইভাবে পড়েছিল। ইতিমধ্যে গ্লেনসায়ার পুলিস ঘরে আঙুলের ছাপ খুঁজে গেছে। ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল রুবি, যোসি আর দুজন পরিচারিকার হাতের ছাপ। এছাড়া কয়েকটা ছাপ পাওয়া গেছে রেমণ্ডস্টারের। সে জানিয়েছিল, রাতে নাচের সময় হলে রুবিকে খুঁজতে এ ঘরে এসেছিল।

ঘরের কোণের দিকে রাখা ছিল মেহগিনি কাঠের বিরাট একটা ডেস্ক। তার খোপে পাওয়া গেছে বেশ কিছু চিঠি। স্ল্যাক চিঠিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন এগুলো কোন কাজে আসবে না।

চিঠিগুলোতে কয়েকটা নাম পাওয়া গেল–লিল, (প্যালেস দ্য ডান্সে থাকে), মিঃ ফাইণ্ডিসন, বার্নি, বুড়ো গ্রাউসার, অ্যাড প্রভৃতি। স্ল্যাক সবকটি নাম তার খাতায় লিখে নিলেন। এদের সকলের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে।

ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে রাখা ছিল একটা ফোমের গোলামী নাচের ফ্রক। রুবি এটাই পরেছিল সন্ধ্যার দিকে। মেঝের ওপরে পড়েছিল একজোড়া উঁচু হিলের জুতো। দেখেই বোঝা গিয়েছিল, অযত্নে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সিল্কের দুটো মোজা রাখা ছিল মেঝের ওপর।

মেলচেটের মনে পড়ল, মৃতের পায়ে কোন মোজা ছিল না।

আলমারির পাল্লা খোলাই ছিল। ভেতরে সাজানো ছিল কিন্তু ঝলমলে সান্ধ্য পোশাক। নিচের র‍্যাকে সাজানো রয়েছে একসার জুতো।

রুবি খুব দ্রুত উপরে এসে জামাকাপড় বদলে আবার দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোথায় যাবার জন্য বেরিয়েছিল সে?

স্ল্যাক বললেন, পঙ্গু ভদ্রলোক রুবিকে যেরকম জেনেছিলেন, তাতে তার কোন ছেলে বন্ধু থাকতে পারে, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই তার ছিল না। তাছাড়া যোসিও কোন অবাঞ্ছিত লোকের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে পড়তে দিতে রাজি ছিল না। এসব জেনেই সে তার কোন পুরনো বন্ধুকে আড়ালে রাখতে চেয়ে থাকতে পারে। রুবি তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য বেরিয়েছিল। আর সম্ভবতঃ দত্তকের ব্যাপারে মতভেদের জন্যই তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়।

স্ল্যাক নিজের বক্তব্য এমন অপ্রীতিকরভাবে জাহির করছিল যে মেলচেট খুবই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তবু নিজেকে সংযত রেখে তিনি বললেন, তাহলে তো রুবীর সেই বন্ধুর পরিচয় বার করা আমাদের মোটেই কষ্টকর হবে মনে হয় না।

ব্যাপারটা আমার হাতেই ছেড়ে দিন স্যার। আসল সত্য জানা যাবে প্যালেস দ্য ডান্সের ওই লিল বলে মেয়েটিকে জেরা করলেই–আমি ঠিক বুঝতে পারছি।

একটু থেমে স্ল্যাক আবার বললেন, নৃত্য শিল্পী ওই রেমণ্ড ছোকরার কাছ থেকেও কিছু সাহায্য পেতে পারেন স্যার। পরিচারিকাদের আমি ভালভাবেই জেরা করেছি। তারা কিছুই জানে না। আর ওই বার্টলেটকে আপনার কেমন মনে হয় স্যার?

–হ্যাঁ, ওই ছোকরার ওপর নজর রাখা ভাল। বললেন মেলচেট।

তারপর তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।

.

০৯.

 দুটো কাউন্টির পুলিস মিলে মিশে কাজ আরম্ভ করেছে। সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হার্পার জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পেয়ে খুশি হয়েছেন।

নৃত্য শিল্পী রেমণ্ডস্টারকে তিনি আগে থেকেই জানতেন। সুদর্শন চেহারার দীর্ঘকায় ক্ষিপ্রগতি মানুষটির ব্যবহার খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি হোটেলে সকলেরই প্রিয়।

হাপারের প্রশ্নের জবাবে রেমণ্ডস্টার বললেন, রুবিকে আমি ভালভাবেই জানতাম। এখানে একমাসের ওপরে ছিল। খুবই ভাল স্বভাবের মেয়ে।

–তার ছেলে বন্ধুদের সম্পর্কে আমাকে বলুন। বললেন হাপার।

–এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। তবে জেফারসন পরিবারই তাকে প্রায় দখল করে রেখেছিল।

–আপনি জানতেন যে মিঃ জেফারসন রুবি কীনকে দত্তক নেবার ব্যবস্থা করেছিলেন?

–ওরেব্বাস। বুড়োর যদি তেমন ইচ্ছাই থাকতো তাহলে নিজের শ্রেণীর কাউকেই তো, নেওয়া ভাল ছিল।

–আর যোসি? সে জানত বলে মনে হয় আপনার?

যোসি কোন আঁচ পেলেও পেতে পারে। ও খুবই চালাক-চতুর মেয়ে।

-রুবির আগের জীবনের কোন বন্ধু কি এখানে তার সঙ্গে কখনো দেখা করতে আসছিল

–এরকম কারুর কথা জানি না।

–গত সন্ধ্যায় আপনি কি করছিলেন?

–আমরা দুজনে একসঙ্গে রাত সাড়ে দশটার নাচে অংশ নিয়েছিলাম।

–সে সময় তার মধ্যে কোন চঞ্চলতা নজরে পড়েছিল?

–তেমন কিছু চোখে পড়েনি। নাচের পরে কি হয়েছিল লক্ষ্য করিনি। তবে বলরুমে তাকে দেখিনি। আমাদের দ্বিতীয় নাচের সময় হয়ে আসছিল দেখে যোসির কাছে ওর খোঁজ করি। যোসি সেই সময় জেফারসনদের সঙ্গে ব্রিজ খেলছিল। রুবি নেই শুনে চমকে উঠেছিল সে। বেশ উদ্বিগ্নভাবে মিঃ জেফারসনের দিকে একবার তাকিয়েছিল। তারপর আমাকে নিয়ে যোসি রুবির ঘরে আসে।

–যোসি কিছু বলেছিল?

-ও খুবই রেগে উঠেছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল রুবির সঙ্গে কেউ ছিল কি না। তারপর নিজেই বলে উঠেছিল–সেই ফিল্মের লোকটার কাছে যায়নি তো?

–ফিল্মের লোক? কে তিনি? হার্পার উত্তেজিতস্বরে বলে উঠলেন।

–লোকটার নাম আমি জানি না। কালো চুল, হাবভাব নাটুকে। শুনেছি লোকটার ফিল্মের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সে দু-একবার নৈশভোজে এসেছে। রুবির সঙ্গে নেচেও ছিল।

-তারপর?

–আমরা রুবির ঘরে গিয়ে তাকে দেখতে পেলাম না। তার নাচের পোশাক একটা চেয়ারের ওপরে পড়েছিল। রুবিকে না পেয়ে যোসি ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠল যদি সব গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয় তাহলে সে রুবিকে ক্ষমা করবে না।

-তারপর আপনারা কি করলেন?

রুবির বদলে যাসিই আমার সঙ্গে নেচে ছিল। পরে সে আমাকে বলে, জেফারসনদের একটু বুঝিয়ে বলতে–আমি যতটা সম্ভব তাকে সাহায্য করি।

এরপর রেমণ্ডস্টারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন হার্পার। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট হিগিনস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হল।

–হেড কোয়ার্টার থেকে এই মাত্র আপনার জন্য খবর এসেছে স্যার। ভেনস খাদের কাছাকাছি–এখান থেকে প্রায় মাইল দুই দূরে একটা পোড়া গাড়ি নোকজন দেখতে পায়। গাড়ির ভেতরে ঝলসে যাওয়া একটা দেহও রয়েছে।

হার্পার উত্তেজিত ভাবে নড়েচড়ে বসলেন। বলে উঠলন, কি আরম্ভ হয়েছে বল তো? গাড়ির নম্বরটা জানা গেছে?

-না স্যার। ইঞ্জিনের নম্বর মিনোয়ান ১৪ বলেই অনেকে মনে করছে।

.

১০.

 স্যার হেনরি ক্লিদারিং মেট্রোপলিটন পুলিসের কমিশনার। সম্প্রতি তিনি অবসর নিয়েছেন। কনওয়ে জেফারসনের পুরনো বন্ধু তিনি। তাই জরুরী তলব পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাজেস্টিক হোটেলে এসে পৌঁছলেন।

লাউঞ্জ পার হয়ে যাবার সময় উপস্থিত অতিথিদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন।

 মিঃ জেফারসন বন্ধুকে দেখে অভ্যর্থনা করে বসালেন। তারপর সরাসরি প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন।

–একটা খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছি হেনরি, তার সঙ্গে তোমার বন্ধু সেই ব্যান্ট্রিরাও।

আর্থার আর ডলি ব্যান্ট্রি? ব্যাপারটা খুলে বল।

এরপর জেফারসন সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। সব শুনে ক্লিদারিং চিন্তিত হলেন।

–আমাকে এব্যাপারে কি করতে বলছ? জানতে চাইলেন তিনি।

–ব্র্যাডফোর্ডশায়ারের চিফ কনস্টেবল মেলচেট কেসটা দেখছে। কোথাও গিয়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপারটা কিভাবে পরিষ্কার জানা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

ক্লিদারিং-এর মনে পড়ে গেল লাউঞ্জ পেরিয়ে আসার সময় একটা পরিচিত মুখ তার নজরে পড়েছিল। তিনি বন্ধুকে বললেন, আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত। বুঝতেই তো পারছ, বেসরকারী গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে ততটা স্বচ্ছন্দবোধ করব না। তুমি জানতে চাও, মেয়েটিকে কে খুন করেছে, এই তো?

-হ্যাঁ, ঠিক তাই।

 –এসম্পর্কে তোমার নিজের কোন ধারণা আছে?

–কিছু মাত্র না।

-ঠিক আছে, শোন। আসার পথে লাউঞ্জে উপস্থিত এমন একজনকে দেখে এলাম। এ ধরনের রহস্য সমাধানে যার দক্ষতা প্রশ্নাতীত।

–তুমি কার কথা বলছ?

–তার নাম মিস মারপল। একমাইল দূরে সেন্ট মেরী মিড গ্রামে থাকেন। গ্যামিংটন থেকে দূরত্ব আধমাইল। তিনি ব্যান্ট্রিদেরও বন্ধু। কোন অপরাধের তদন্তের ব্যাপারে তার চেয়ে যোগ্যব্যক্তি আর কেউ নেই।

-কিন্তু রুবির মত মেয়ের বিষয়ে তিনি কতটুকু জানবেন?

–আমার মনে হয় তার ধারণা নিশ্চয়ই থাকবে। বললেন ক্লিদারিং।

.

স্যার হেনরিকে দেখে মিস মারপল উজ্জ্বল আনন্দে অভিবাদন জানালেন।

চেয়ার টেনে পাশে বসে দু-চারটে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পরে মিস মারপল বললেন-আপনি নিশ্চয়ই সেই ভয়ানক ঘটনার কথা শুনেছেন?

-হ্যাঁ। শুনেছি।

–মিসেস ব্যান্ট্রিও এসেছেন আমার সঙ্গে।

–ওহো। ওর স্বামীও আছেন? আপনাকে তাহলে ইতিমধ্যেই ফিল্ডে নামিয়ে দিয়েছেন?

–একরকম তাই বলতে পারেন। বললেন মিস মারপল।

স্যার হেনরি এরপর সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিলেন। মিস মারপল মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলেন। পরে আক্ষেপের সুরে বললেন, খুবই দুঃখজনক কাহিনী। কিন্তু ওই মেয়েটার ওপরে হঠাৎ তিনি এমন স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠলেন কেন? কোন বিশেষ

–সম্ভবতঃ তেমন কিছু নয়। বললেন স্যার হেনরি। তিনি চাইছিলেন এমন একটি ছোট সুন্দর মেয়ে যে তারই মেয়ের স্থান নিতে পারে, আর মেয়েটি সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে নিজেকে যোগ্য করার চেষ্টা করে চলেছিল।

–সবই বুঝতে পারছি। রুবি কীনের মাসতুতো বোনকে আজ সকালেই গ্যামিংটন হলে দেখেছি আমি। বেশ ভাল মেজাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণী বলেই মনে হয়েছে তাকে। কিন্তু যাই হোক, আমার ধারণা জটিলতা গড়ে উঠেছিল মিঃ জেফারসনের নিজের ঘরেই।

-আপনি কি বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।

দেখুন, ওরা তিনজন শোকার্ত মানুষ একই বাড়িতে বাস করে চলেছেন। তাদের মধ্যে যোগসূত্রও একটি বিয়োগান্ত ঘটনা। তবু, দেখুন, সময় হল সবচেয়ে বড় আঘাত নিবারক। এই অবস্থায় মিঃ গ্যাসকেল এবং মিসেস জেফারসন হয়তো কিছু অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। তাদের দুজনেরই বয়স কম। আর এই ধরনের কিছু উপলব্ধি করে মিঃ জেফারসনও কিছু অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তার পক্ষে নিজেকে অবহেলিত ভাবা অবাস্তব মনে করি না। সেকারণেই আমার মনে হয়, এই ঘটনার মধ্যে এমন কোন এক সম্ভাবনা রয়েছে যে এই অপরাধের সমাধান হয়তো কোনদিনই সম্ভব হবে না।

তবু আমি চাই সত্য প্রকাশ হওয়া দরকার। মৃতদেহটা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার কর্নেল ব্যান্ট্রির লাইব্রেরী ঘরে পাওয়া গিয়েছিল। তিনি অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। ইতিমধ্যেই চারপাশের গুজবের প্রভাব তার ওপর পড়তে শুরু করেছে। তাই অবিলম্বে সত্য প্রকাশ হওয়া দরকার। আর এই জন্যেই আমি ডলির সঙ্গে এখানে আসতে রাজি হয়েছি।

মৃতদেহটা ওদের বাড়িতে কেন পাওয়া গেল, এসম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার কোন ব্যাখ্যা আছে?

-আমার ধারণা একটা গভীর গোপন পরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়েছিল। আর পরিকল্পনা মাঝ পথে ভেস্তে গিয়েছিল।

স্যার হেনরি অবাক হলেন। তিনি কয়েক মুহূর্ত মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কেন?

–অদ্ভুত শোনালেও এমন ঘটনা কখনও কখনও ঘটে–মানুষের ভুলপ্রবণতাই যার কারণ হয়। ওইতো মিসেস ব্যান্ট্রি এসে গেছেন।