৩. প্রাতঃকালীন চা পান

১১.

পরদিন সকালে মিস মারপল প্রাতঃকালীন চা পান করছেন। একটু পরেই তাঁকে গুছিয়ে নিতে হবে।

এমনি সময় উদ্বিগ্ন মুখে ক্লোটিলডা ঘরে ঢুকলেন।

–এমলিন প্রাইস বলে একটি ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। ওদের নাকি কি একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

–দুর্ঘটনা! আমাদের কোচে কিছু হয়েছে? অবাক হয়ে তাকালেন মিস মারপল।

–কোচে নয়। বোনাভেঞ্চারের খাড়াই পথ বেয়ে সকলে উঠছিলেন। সেই সময় পাথর গড়িয়ে পড়ে কাউকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে–

-ওঃ! খুব দুঃখ পেলাম। কিন্তু কে আঘাত পেলেন কিছু বলেছে?

–কে একজন মিস টেম্পল বা টেণ্ডারটন বলল–

-এলিজাবেথ টেম্পল, বললেন মিস মারপল, কোচে ওঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। একজন অবসরপ্রাপ্তা স্কুল শিক্ষিকা–খুবই নামী মানুষ ছিলেন।

–আমি তাকে চিনতাম, বললেন, ক্লোটিলডা। ব্যাপারটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সবকথা এখনো শুনিনি।

সুটকেসের ঢাকনা আটকে মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন।

–যাওয়া যাক। নিচে গিয়ে মিঃ প্রাইসের সঙ্গে কথা বলি।

ক্লোটিলডা সুটকেসটি তুলে নিয়ে মিস মারপলের সঙ্গে নিচে নেমে এলেন।

এমলিন প্রাইস তার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। তাকে খুবই এলোমেলো দেখাচ্ছিল।

–ওরা আপনাকে খবরটা দিতে পাঠিয়ে দিলেন। মিস টেম্পলের দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওপর থেকে পাথরের চাই গড়িয়ে পড়েছিল। মাথায় আঘাত পেয়েছেন মিস টেম্পল–গতরাতেই তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আজকের ভ্রমণ বন্ধ থাকছে। আগামীকালের গ্র্যাং-মেরিং যাওয়াও হবে না।

-মিসেস স্যাণ্ডবার্ন কোথায়? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

–তিনি সকালেই হাসপাতালে চলে গেছেন। এগারোটায় গোল্ডেনবোরে আমাদের সঙ্গে কফি পানে যোগ দেবেন।

ক্লোটিলডা আর মিসেস গ্লাইনকে বিদায় জানিয়ে এমলিন প্রাইসের সঙ্গে গোল্ডেনবোরে এসে উঠলেন।

যাত্রীরা সকলেই তখন কফি ঘরে উপস্থিত ছিল। কফি আর প্যাস্ট্রি দেওয়া চলছিল।

মিস টেম্পলের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ব্যাপার নিয়েই সকলে আলোচনা করছিলেন। মস্তিষ্কের আঘাত খুবই গুরুতর। বিশেষ ডাক্তার তার দেখাশোনা করছেন। সকলেই এখন সংবাদ শোনার আশায় রয়েছে।

অনেকেই সকালের দিকে সময়টা একটু ঘুরে আসার কথা ভাবলেন। কিছুক্ষণ পরেই সকলেই দল বেঁধে বেরিয়ে গেলেন। কেবল রয়ে গেলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড আর মিস মারপল।

–চলুন, হোটেলের বাইরে কোথাও গিয়ে বসা যাক। মিস মারপলকে বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

দুজনে হোটেলের দরজা অতিক্রম করে কোণের দিকের বাগানে পেতে রাখা বাস্কেট চেয়ারে বসলেন।

–আপনি নিশ্চয়ই মিস জেন মারপল? বললেন প্রফেসর।

–হ্যাঁ, আমিই জেন মারপল। অবাক হলেন মিস মারপল, কিন্তু

–আপনার কথা শুনেছিলাম মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে। বলে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রফেসর ওয়ানস্টেড যেন পর্যবেক্ষণ করতে চাইলেন মিস মারপলকে।

–আমার সম্পর্কে কবে তার সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল?

তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে।

তিনি জানতেন, এই ভ্রমণদলে আপনি থাকবেন?

–হ্যাঁ। আপনার জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি একথাও জানিয়েছিলেন।

–এটা তাঁর সদাশয়তা। এমন খরচসাপেক্ষ ভ্রমণ আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না। আর তাতেই এমন করে বাধা পড়ল।

–হ্যাঁ, খুবই দুঃখের কথা।

একটু থেমে প্রফেসর ওয়ানস্টেড পুনরায় বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েল আপনার সম্পর্কে আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। এই ভ্রমণে আমি আপনার সঙ্গে থাকি এটাই তার ইচ্ছা ছিল। অর্থাৎ আপনার ওপর যেন একটু নজর রাখি।

-একথার অর্থ?

–আমি যেন লক্ষ্য রাখি আপনার যাতে কোন কিছু না ঘটে।

–আমার কি ঘটবে?

–সম্ভবত মিস এলিজাবেথ টেম্পলের যা ঘটেছে–আপনার কি মনে হয়, ওটা দুর্ঘটনা?

–আমি এর কিছুই বলতে গেলে জানি না। বললেন মিস মারপল। আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।

–আমার বক্তব্য হল, আপনি নিজের সম্পর্কে সাবধান থাকবেন। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

–আপনার সম্পর্কে আমি এখনো কোন সূত্র পাইনি। আপনি কি মৃত মিঃ র‍্যাফায়েলের একজন বন্ধুস্থানীয়?

-না, তার সঙ্গে আমার দু-একবারই দেখা হয়েছে। আমি নিজের সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি, আমার কাজের জগতে আমি একজন খ্যাতিমান মানুষ।

–খুব সম্ভব আপনি একজন চিকিৎসক।

-হ্যাঁ, আপনার অনুমান যথার্থ। আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। বিশেষ বিশেষ অপরাধী মস্তিষ্ক সম্পর্কে আমি আগ্রহী। এ নিয়েই বহুবছর গবেষণা করে চলেছি।

বুঝতে পেরেছি, বললেন মিস মারপল, মিঃ র‍্যাফায়েল আমাকে এমন একটা কাজে নামতে বলে গেছেন যার সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা রেখে যাননি।

–আপনি সে কাজ গ্রহণ করেছেন?

–হ্যাঁ, আমি গ্রহণ করেছি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আমরা দুজনে ওখানে একটা কাজ করেছিলাম।

-হ্যাঁ, আমাকে সেকথা বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, অপরাধমূলক ব্যাপারে সমাধানে আপনার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে। আমি মনে করি মিঃ র‍্যাফায়েল অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন।

একটু থেমে তিনি বললেন, এখানে আপনার সঙ্গে বিশেষ আলোচনার জন্যই আমি মিলিত হয়েছি। এখন আশপাশে আড়ি পাতবার মত কেউ নেই। করলেও আমাদের কথা শুনবার সুবিধা নেই। অতএব আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারি।

মিস মারপল বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েল আমার কাজের ব্যাপারটা কি চেয়েছিলেন এ ব্যাপারে আমি এখনো অন্ধকারে।

–তিনি চেয়েছিলেন, নির্দিষ্ট ঘটনার দিকে আপনি এগিয়ে যাবেন। এসম্পর্কে অন্য কোন লোকের মতামত গ্রাহ্যে আনবেন না।

-এ কোন ব্যাখ্যা হলো বলে মনে হয় না।

-আপনার সঙ্গে আমি একমত। তবে আমি কতগুলো ঘটনার কথা আপনাকে জানাবো, তাতে ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর এসম্পর্কে আপনার জানা তথ্যও আমাকে জানাতে পারবেন।

–বেশ, কিছু বলুন তাহলে।

-সংক্ষেপেই আমার কথা বলবার চেষ্টা করব। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের হয়ে আমাকে মাঝে মাঝে উপদেষ্টার কাজ করতে হয়। তাছাড়া বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আমি জড়িত। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা যাদের বিশেষ ধরনের অপরাধী বলে সন্দেহ করা হয় অথচ তাদের বয়স কোন বিশেষ বয়সের কম, তাদের বেশ কিছু সময়ের জন্য নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখে।

-হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।

–সাধারণতঃ অপরাধ সংঘটিত হবার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়–রোগ নির্ণয় করা, নিরাময়ের সম্ভাব্যতা বিচার করা–এসবই আমাকে করতে হয়। এই ব্যাপারে আমার কাছে আহ্বান আসে স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে।

এমনি এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আমার বন্ধু। তিনি বিশেষ একজন তরুণ অপরাধী সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিলেন। ঘটনাটা বেশ কয়েকবছর আগেকার। ছেলেটি তার কৈশোরকাল থেকেই সম্পূর্ণ অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সে ডাকাত দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, ডাকাতি, চুরি, জালিয়াতি সবকিছুতেই সে অংশ নেয়।

-বুঝতে পেরেছি, আপনি মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলের কথাই বলছেন।

–হ্যাঁ, তার সম্পর্কে আপনি কি জেনেছেন?

–বিশেষ কিছুই না। মাত্র গতকালই শুনেছি মিঃ র‍্যাফায়েলের এক অযোগ্য ছেলে আছে যে অপরাধী তালিকাভুক্ত।

–সে মিঃ রাফায়েলের একমাত্র পুত্র। তাঁর আরও দুটি মেয়ে ছিল। একজন চোদ্দ বছর বয়সে মারা যায়, অন্য মেয়েটি বিয়ে করে সুখেই আছে। ওঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সেই।

ছেলের জন্য সবরকম করণীয়ই তিনি করেছিলেন। স্কুলে থাকাকালীনই ছেলেটি তার যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছিল। তবু তিনি সবরকম গোলমাল থেকে ছেলেকে বাঁচিয়েছেন। আদালতের ঝামেলাও সামলেছেন। একটি ধর্ষণের অভিযোগে ছেলেটিকে জেল খাটতেও হয়েছিল। পরে যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল তা খুবই গুরুতর

–সে একটি মেয়েকে খুন করেছিল শুনেছি। বললেন মিস মারপল।

–মেয়েটিকে বাড়ি থেকে ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন পরে মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। তাকে গলা টিপে মেরে ভারি পাথর বা লোহা দিয়ে মুখ মাথায় আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়। সম্ভবত মেয়েটির পরিচয় গোপন করার জন্যই এরকম করা হয়েছিল।

–এরকম অপরাধী মানসিকতার কাউকে আমি সহ্য করতে পারি না। বললেন মিস মারপল।

-ওটাকে বংশানুক্রম বলেই আমি মনে করি। জন্মের সঙ্গেই যে চরিত্র বা বংশধারা নিয়ে তারা জন্মায় তার ওপর তাদের কোন হাত থাকে না।

যাইহোক, ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বন্ধুটি—অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ তিনি। তার বিশ্বাস হয়েছিল–ছেলেটি আদৌ খুনী নয়। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ছেলেটি কোন মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল।

তিনি দৃঢ় নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তার সম্পর্কে যে রায় দেওয়া হয়েছিল, তা ভুল ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন, ছেলেটির সব অপরাধই সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ প্রমাণিত।

স্বভাবতঃই আমার বন্ধুটি খুবই অসুখী হয়ে পড়েছিলেন। প্রকৃত সত্য জানার জন্য তিনি উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, ছেলেটিকে দেখে, পেশাদারী পদ্ধতিতে ব্যাপারটা অনুধাবন করে আমার মতামত জানাই।

–আপনার ওই পরিচালক বন্ধুটি যথার্থই অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তার ন্যায়ের প্রতি আগ্রহ প্রশংসনীয়। বললেন মিস মারপল। আপনি নিশ্চয় তার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন?

–হ্যাঁ। আমি ছেলেটির কাছে বন্ধুর মত গিয়েছিলাম এবং আমার সাধ্যমত বাস্তব পরীক্ষাও করি। একটু থেমে প্রফেসর ওয়ানস্টেড আবার বললেন, মাইকেল র‍্যাফায়েল একজন খুনী একথা আমি মানতে পারিনি।

আগ্রহ বশে আমি নিজেও কিছু অনুসন্ধান চালাই। সে একটি মেয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল সত্য কথা, কিন্তু সে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত মেয়েটির আরও অনেক ছেলেবন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের বাইরেও তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

তবে ওই খুনের ঘটনাটি–ধর্ষণ করে হত্যা–শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক–সবরকম পরীক্ষা করেই দেখেছি, কোনদিক থেকেই খুনের ঘটনাটির সমর্থন পাইনি।

-আপনি আপনার বন্ধুকে সেকথা জানিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ। তার মতামতের সঙ্গে যে আমিও একমত সেকথা জানিয়েছিলাম। আবেদন করার মত কোন প্রমাণ আমাদের হাতে ছিল না। অথচ আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলাম বিচারে কোথাও বড় রকমের ফাঁক থেকে গিয়েছিল। এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, প্রমাণ হয়তো কোথাও পাওয়া যেতে পারে, তবে তা বার করে আনা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এবং খরচসাপেক্ষ।

–মিঃ র‍্যাফায়েল তার ছেলের সম্বন্ধে কি ভেবেছিলেন?

এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার খোলাখুলি আলোচনা হয়েছিল। তিনি ন্যায়পরায়ণ মানুষ ছিলেন সত্য, তবে বলব, নির্মমও ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার ছেলেটি বিকৃত–সংশোধনের অযোগ্য। তবু, অসুস্থ মৃগী রোগাক্রান্ত ভেবে তার জন্য যা দরকার তাই করব। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি তাকে কি করতে বলছি।

ছেলেটির অপরাধের যথার্থ দিকটারই বিচার হোক, আন্তরিকভাবেই তিনি তা চেয়েছিলেন। বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে সে তার নিজের পছন্দমত জীবনযাপন করুক তা-ও তিনি চাইছিলেন।

আমাকে স্পষ্টই বলেছিলেন, অন্য কেউ যদি মেয়েটিকে হত্যা করে থাকে, তাহলে আমি চাই সে ঘটনা প্রকাশিত হয়ে সকলে জানুক। আমি একজন অশক্ত মানুষ-জীবনের মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার পক্ষে যা ব্যবস্থা করা সম্ভব তা করে যাব। এজন্য খরচের কোন বাধা আমি রাখব না।

সবশেষে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনাকেই আমার প্রধান সাহায্যকারী বলে আমি মনে করছি। আর আপনাকে সাহায্য করবার জন্য একজনকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করব।

পরে তিনি মিস জেন মারপল নামটি আমাকে লিখে দেন। তবে ঠিকানা দেননি। বলেছিলেন, আমি চাই আমার পছন্দমত পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আপনার সঙ্গে তার স্বাভাবিকভাবে দেখা হোক।

এরপর তিনি এই ভ্রমণের কথা উল্লেখ করেন। এই ভ্রমণে আপনাকে আমি সহযাত্রী হিসেবে পাব একথা জানিয়েছিলেন।

আপনার সম্বন্ধে মিঃ রাফায়েল কেবল জানিয়েছিলেন, আপনি বয়স্ক, আর মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা অতি স্বচ্ছ। আর…আর…অশুভ কিছু অনুধাবন করার অসাধারণ ক্ষমতা আপনার আছে। নিশ্চয়ই তিনি ভুল বলেননি?

–সম্ভবতঃ তাই। চারপাশের গণ্ডির মধ্যে কাছাকাছি অশুভ কিছু বা কেউ থাকলে আমি অনুভব করতে পেরেছি–এমন ঘটনা নানা সময়ে ঘটেছে বটে।

–এটা হলো অশুভ জানার শক্তি। যদি তেমন কিছুর আভাস পান তাহলে আমাকে জানাবেন। আমার বক্তব্য এখানেই শেষ। এবার আপনার কথা আমি শুনতে চাই।

মিস মারপল বললেন, কিভাবে এব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম আপনাকে সংক্ষেপে জানাচ্ছি।

এরপর, মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুর সংবাদ জানা, তার আইনজ্ঞদের চিঠি–সাক্ষাৎকার, তাদের দেওয়া প্রস্তাব…মিঃ র‍্যাফায়েলের চিঠি…ভ্রমণসংস্থার চিঠি প্রভৃতি সব ঘটনা খুলে জানালেন।

পরে বললেন, ভ্রমণের আসন সংরক্ষণের সংবাদ জানবার পরেই আমি বুঝতে পারি আমাকে যে কাজ করার প্রস্তাব মিঃ র‍্যাফায়েল করেছেন, ভ্রমণের ব্যাপারটা তার প্রথম পদক্ষেপ। এই ভ্রমণের মধ্যেই নিশ্চয় কোন সূত্র আমার দৃষ্টিগোচর হবে। আমার ধারণা তা হয়েছে।

একমুহূর্ত থেমে পুনরায় তিনি বললেন, গতকালের আগের দিন, এখানে পৌঁছবার পরেই তিনজন মহিলা এসেছিলেন আমাকে অভ্যর্থনা করতে। কাছেই পুরনো জমিদার ভবনে তারা থাকেন। তারা তাদের গৃহে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন।

–তারা কি মিঃ র‍্যাফায়েলের পরিচিত? জানতে চাইলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ। তারা জানালেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে শুনেছিলেন তার এক পুরনো বন্ধু ভ্রমণে আসবেন, তারা যেন তাকে দুই বা তিনদিন বাড়িতে আশ্রয় দেন। কারণ তার পক্ষে পাহাড়ে চড়া সম্ভব হবে না। আমাদের গতকালের ভ্রমণ সেখানেই ছিল।

–এটাকে আপনি কিভাবে গ্রহণ করছেন?

–এই যোগাযোগ আমার করণীয় কাজের সঙ্গেই যুক্ত বলে আমি মনে করি। মিঃ র‍্যাফায়েল চেয়েছিলেন আমি ওখানে যাই।

-আপনি সেখানে গিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, তবে তিন বোনকে দেখে খুবই সাধারণ বলেই মনে হলো। তারা যে বাড়িতে বসবাস করছে তার মালিক ছিলেন তাদের এক কাকা। তার মৃত্যুর পর বছর কয়েক আগে সেখানে এসেছে। তাদের অবস্থা খুব ভাল নয়, তবে খুবই অমায়িক।

ওদের দেখে মিঃ রাফায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিল বলে মনে হল না। তিন বোনের মধ্যে তফাতও যথেষ্ট।

-ওখানে থাকার সময়ে কিছু জানতে পেরেছেন?

–আপনি যে ঘটনা শোনালেন কিছুক্ষণ আগে সেই ঘটনাই শুনেছি। ওদের এক বয়স্ক পরিচারিকার কাছ থেকে। সে তাদের কাকার আমল থেকে ওই বাড়িতে আছে। মিঃ র‍্যাফায়েলের নামটাই শুধু সে শুনেছে।

মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলে মাইকেল এখানে বেড়াতে আসার সময় থেকে ব্যাপারটার সূত্রপাত হয়। খুবই খারাপ ছেলে ছিল সে। মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছিল, সে তাকে গলা টিপে মেরেছিল।

আরও কি সব ও বলেছিল। জানিয়েছিল, পুলিসের ধারণা ছেলেটি এরকম খুন আগে আরও করেছে।

-এই ঘটনার সঙ্গে ওই তিন বোনের কোন যোগ আছে বলে মনে হয়নি আপনার?

–না। যোগাযোগ এটুকুই কেবল, মেয়েটি ওদের কাছেই প্রতিপালিত হয়েছিল। তারা মেয়েটিকে ভালবাসতো।

–অন্য কোন মানুষের কথা ওদের জানা অসম্ভব মনে হয় না। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ, এটাই জানতে হবে আমাদের। এমন একজন মানুষ যে ঈর্ষায় উন্মাদ হয়ে মেয়েটিকে হত্যা করে মুখ ক্ষতবিক্ষত করেছে।

-পুরনো ওই ম্যানর হাউসে আর কোন ঘটনা

–তেমন কিছু না। নজরে পড়ার মত কেবল ছোট বোনটি-বারবার বাগান সম্বন্ধে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি, বাগান বা গাছলতা সম্পর্কে ও কিছুই জানে না।

-ওই বাগানের ব্যাপারটাই আপনার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে?

-হ্যাঁ। ঠিক তাই। আচ্ছা, এই ভ্রমণে দুজন মাঝবয়সী মহিলাকে আপনার নজরে পড়েছে। মিস ব্যারো আর মিস কুক?

–হ্যাঁ, দুজন একসঙ্গেই ভ্রমণ করছেন।

–ওই মিস কুক–ভ্রমণের তালিকায় দেখলাম ওই নামই রয়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ এই মহিলাই-সেন্ট মেরী মিডে আমি যে গ্রামে থাকি সেখানে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমার বাগান দেখে খুশি হয়ে কথা বলেছিলেন। নাম বলেছিলেন বার্টলেট-বলেছিলেন ওই গ্রামেই নতুন এক বাড়িতে বাগানের কাজ করতে এসেছেন। আমার মনে হয়, সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছিলেন।

কেন না, তখন তার চুল অন্যভাবে আঁচড়ানো ছিল, রঙও আলাদা ছিল। পোশাকের ধরনও অন্যরকম ছিল। ভ্রমণের প্রথম দিনেই দেখে চিনতে পেরেছিলাম। কোথায় দেখেছি বলাতে, না চেনার ভান করেছিলেন।

এখন বুঝতে পারছি, এই মিস কুক সেন্ট মেরী মিডে গিয়েছিলেন আমাকে দেখে নিতে যাতে পরে আমাকে চিনতে পারেন,

–আপনার এরকম মনে হল কেন?

-তা ঠিক বলতে পারব না। তবে ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।

আমারও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এলিজাবেথ টেম্পলের যা ঘটেছে তা-ও ভাল ঠেকছে না। ওঁর সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন?

-হ্যাঁ। ওই নিহত মেয়েটি সম্পর্কে তিনি আমাকে কিছু বলেছিলেন। মেয়েটি ওরই স্কুলের ছাত্রী ছিল।

মাইকেল র‍্যাফায়েল মেয়েটিকে বিয়ে করবে ঠিক হয়েছিল কিন্তু বিয়ে করেনি। মেয়েটি মারা গিয়েছিল।

মেয়েটির মারা যাবার কারণ আমি জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন ভালবাসা। স্রেফ একটি শব্দ প্রয়োগ করেছিল। প্রথমে আমার ধারণা হয়েছিল আত্মহত্যা। কিন্তু এটা ছিল হত্যা।

ঈর্ষা বশে হত্যা–এবং দ্বিতীয় একজনের উপস্থিতিও স্পষ্ট। আমাদের এখন সেই মানুষটিকেই খুঁজে বার করতে হবে। মিস টেম্পল ভাল হয়ে উঠলেই তার সঙ্গে এনিয়ে আবার কথা বলব, তিনি সম্ভবত সেই অজানা লোকটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন।

–আর কোন সম্ভাবনা কোথাও আছে বলে আপনার মনে হয়?

–সম্ভাবনা কোচের যাত্রীদের মধ্যেও থাকা অসম্ভব নয়। আবার পুরনো ম্যানর বাড়িতে কারোরও থাকা সম্ভব। ওই তিন বোনের কেউ ওই মেয়েটি বা মাইকেলের বলা কথা হয়তো মনে রাখতে পারে।

ক্লোটিলডা মেয়েটিকে নিয়ে বিদেশেও গেছেন। বিদেশে কোথাও কিছু ঘটে থাকলে, সেটা তার পক্ষে জানা সম্ভব।

ওদের দ্বিতীয় বোন মিসেস গ্লাইন, বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে বহুদিন ভারতবর্ষ ও আফ্রিকায় ছিলেন। তিনিও তার স্বামী বা আত্মীয়স্বজণের কারো কাছ থেকে নিহত মেয়েটির বিষয়ে কিছু শুনে থাকতে পারেন।

তৃতীয় বোনটি, যার বাগান সম্পর্কে খুব আগ্রহ, সে একটু বেশিমাত্রায় চঞ্চল। তবু আশা করা যেতে পারে নিহত মেয়েটির সম্ভাব্য প্রেমিক বা ছেলেবন্ধুর কথা জেনে থাকতে পারে।

কথা বলতে বলতে সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ওই যে সেই মেয়েটি হোটেলের পাশ দিয়ে চলেছে। একটা বড় পার্শেল দেখছি হাতে-মনে হয় মোড়ের মাথায় ডাকঘরে যাচ্ছে।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড মেয়েটিকে দেখলেন।

–কেমন একটু ক্ষ্যাপা ধরনের মনে হচ্ছে।

–আমারও তাই মনে হয়েছিল প্রথম যখন দেখি। আমার কথা এই পর্যন্তই। এখন আমি এক সমস্যায় পড়েছি–দুদিন এই হোটেলেই থাকবো না কোচে চেপে ভ্রমণে যাব–বুঝতে পারছি না।

.

১২.

 মধ্যাহ্নভোজের আগে মিসেস স্যাণ্ডবার্ন হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে জানা গেল, মিস টেম্পলের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তার সুস্থ হয়ে উঠতে কয়েকদিন লাগবে।

এই পরিস্থিতিতে তিনি ভ্রমণার্থীদের জানিয়ে দিলেন, দু-এক দিন পরে কাছাকাছি দ্রষ্টব্য ভাড়া গাড়িতে দেখানো হবে। ইতিমধ্যে যদি কেউ লণ্ডনে ফিরতে চান তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেবেন।

ডাইনিং হল থেকে বেরুবার মুখে প্রফেসর ওয়ানস্টেড মিস মারপলকে একপাশে ডেকে এনে বললেন, কাছাকাছি একটা গির্জা আছে, যদি বিকেলে যেতে চান আমার সঙ্গে আসতে পারেন।

–ভালই তো হয়। বললেন মিস মারপল।

.

বিকেলের আগেই ভাড়াগাড়িতে করে দুজনে বেরিয়ে পড়লেন। গ্রাম ছেড়ে গাড়ি অন্য রাস্তায় ঢুকলে প্রফেসর ওয়ানস্টেড বললেন, আমরা কিন্তু কোন গির্জা দেখতে যাচ্ছি না মিস মারপল।

–হ্যাঁ, আমি তা অনুমান করেছিলাম। বললেন মিস মারপল। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি আমরা?

–ক্যারিসটাউনের এক হাসপাতালে। মিস টেম্পল ওখানেই আছেন। মিসেস স্যাণ্ডবার্নের হাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার নামে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম।

–তাঁর অবস্থা এখন কেমন?

-খুব ভাল নয়। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে আসছে–সেই সময় তিনি আপনার খোঁজ করছেন।

-বুঝতে পারছি না, তিনি কেন আমাকে ভাবছেন। তিনি মেয়েদের বিখ্যাত স্কুল ফেলোফিল্ডের প্রধান শিক্ষিকা-খুবই নামী মহিলা। তিনি যদি মারা যান সেটা খুবই দুঃখের হবে। কিন্তু ওই দুর্ঘটনার বিষয়ে আমাদের কিছু আলোচনা করা দরকার।

–হ্যাঁ, আমারও তাই ইচ্ছে। দুর্ঘটনার কথাটা আমাকে প্রথম জানিয়েছিল দুজন তরুণ-তরুণী। যোয়ান ক্রফোর্ড আর এমলিন প্রাইস।

তারা কি বলেছিল?

–যোয়ান জানাল সে আর এমলিন নিচের পথ ধরে পাহাড়ে উঠছিল। সেই সময় তারা কাউকে দেখেছিল। তবে মানুষটা পুরুষ বা স্ত্রীলোক বুঝতে পারেনি। সে বিরাট একখণ্ড পাথর ঠেলে দিতে চেষ্টা করছিল। সেই পাথরেই আহত হয়েছিলেন মিস টেম্পল।

-লোকটার সম্পর্কে যোয়ান আর কি জানিয়েছিল?

–জিনস বা ট্রাউজার পরা ছিল লোকটার। আর ছিল গলাবন্ধ লালকালো নক্সাআঁকা পুলওভার। মূর্তিটি সঙ্গে সঙ্গেই সরে যায়।

–তাহলে কি ইচ্ছাকৃতভাবেই মিস টেম্পলের ওপর আক্রমণ হয়েছিল?

-বুঝতে পারা যাচ্ছে না। আমাদের কোন সহযাত্রী অথবা অজানা কেউ সুযোগ বুঝে জায়গাটা বেছে নিয়ে থাকতে পারে।

–প্রচ্ছন্ন শত্রুর কথা বলছেন?

-হ্যাঁ। কিন্তু এমন একজন প্রখ্যাত শিক্ষয়িত্রীকে কে হত্যা করতে চাইবে? মিস টেম্পল মূর্তিটিকে চিনতে পেরেছিলেন কিনা তার কাছ থেকে জানা যেতে পারে।

–আপনি কি কোন বিশেষ ঘটনার কথা ভাবছেন?

–না, শুধু সম্ভাবনার কথাই ভাবছি। কোন ব্যক্তিগত শত্রুর কথা আমি বাদ দিচ্ছি। এমন হতে পারে মিস টেম্পল এমন কোন কিছু হয়তো জানতেন, যা প্রকাশ হয়ে পড়লে কারও পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।

-হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস ব্যাপারটা তাই। আমাদের কোচেও এমন কেউ থাকা সম্ভব যে মিস টেম্পলকে চিনতে পেরেছিল, অথচ তিনি তাকে চিনতে পারেননি।

–কিন্তু ওই পুলওভার, যোয়ান যা উল্লেখ করেছিল–

টকটকে লাল-কালো রঙ-যা সহজেই চোখে পড়বার কথা…সেটা ইচ্ছাকৃতভাবেই দেখানো হয়েছিল বলে আমার ধারণা। সেই ব্যক্তি, পুরুষই হোক আর স্ত্রীলোকই হোক, ওই পোশাক খুলে যদি ডাক মারফত পার্সেল করে কোন ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়, কিংবা ফেলে দেয় বা পুড়িয়ে ফেলে নষ্ট করে ফেলে আর সাধারণ পোশাকে থাকে তাহলে কারোর সন্দেহের দৃষ্টিই তার দিকে পড়বে না।

–হ্যাঁ। অসাধারণ চাতুরি বলতে হবে।

–এমন হতে পারে মিস টেম্পলের কোন প্রাক্তন ছাত্রী বা তার অভিভাবক শ্রেণীর কেউ, মিস টেম্পল তার সম্পর্কে মারাত্মক কিছু জানতেন, তা প্রকাশ হবার সম্ভাবনা সে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। বললেন মিস মারপল।

-হ্যাঁ, আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড, এখন দেখা যাচ্ছে মিঃ র‍্যাফায়েল ইচ্ছাকৃতভাবেই আপনার ভ্রমণের বিরতি ঘটিয়েছিলেন যাতে এখানেই আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে। আর–

আর আমাদের অজানা এমন কোন তথ্য জানতে পারি।

–অনেককাল আগে কয়েকটা খুনের ঘটনা পর পর ঘটে গিয়েছিল। জেসলিন সেন্ট মেরী থেকে দুটি মেয়ে অদৃশ্য হয় জানানো হয়েছিল। ছমাস পরে বেশ কয়েক মাইল দূরে একজনের দেহ পাওয়া যায়। তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল মাইকেল র‍্যাফায়েলের সঙ্গে।

–দ্বিতীয়জন?

 –মেয়েটির নাম নোরা ব্রড। তার অনেক ছেলেবন্ধু ছিল শোনা যায়। তার দেহ পাওয়া যায়নি। কথা বলতে বলতে ক্যারিসটাউনের হাসপাতালের সামনে গাড়ি পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমে প্রফেসরের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলেন মিস মারপল। একজন তাকে সিস্টার বার্কারের ঘরে নিয়ে গেল। তাঁর সঙ্গেই প্রফেসর ফোনে কথা বলেছিলেন।

লম্বা কৃশকায় মহিলা সিস্টার বার্কার। মিস মারপলের সঙ্গে পরিচিত হবার পরে বললেন, হ্যাঁ, আপনার কথাই আমি জানিয়েছিলাম। কি ব্যবস্থা করা হয়েছে আপনাকে জানাচ্ছি।

এরপরে তিনি জানালেন, মিস টেম্পল প্রায় কোমার অবস্থায় রয়েছেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরলে তিনি আপনার নাম করছেন–প্রফেসর ওয়ানস্টেড নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন। এবারে একটু ধৈর্য ধরে তার ঘরে একটু অপেক্ষা করতে হবে। জ্ঞান ফিরে উনি কিছু বললে আপনি তা লিখে নেবেন। অবশ্য এমনও হতে পারে জ্ঞান না ফিরে তিনি মারাও যেতে পারেন। একজন নার্স কাছাকাছিই পর্দার আড়ালে থাকবে। মিস টেম্পলের কথা লিখে নেবার জন্য একজন পুলিস অফিসারও ওখানে আছেন। তাকেও যাতে মিস টেম্পল দেখতে না পান ডাক্তার সেভাবেই ব্যবস্থা করেছেন। মিস টেম্পল আপনাকে যা বলতে চান নিশ্চয়ই তা বলবেন। আশা করি আপনার এতে অসুবিধা হবে না।

মিস মারপলকে নিয়ে সিস্টার বার্কার একটা ছোট কামরায় এলেন। ঘরে মৃদু আলো, জানালার পর্দা টানা। খাটে মিস টেম্পল শায়িতা।

সিস্টার বার্কার রোগিনীকে পরীক্ষা করে মিস মারপলকে পাশে একটা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

পর্দার আড়াল থেকে নোটবুক হাতে এক তরুণ এগিয়ে এল। সিস্টার বার্কার বললেন, ডাক্তার এরকমই বলেছেন মিঃ কেকিট।

একজন নার্সও এগিয়ে এল। সিস্টার বার্তার বললেন, দরকার হলে আমাকে ডেকো। আর মিস মারপলের দিকেও খেয়াল রেখো।

সিস্টার বার্কার চলে গেলেন। মিস মারপল চেয়ারেই বসে রইলেন। তার চোখ মিস টেম্পলের দিকে। মনে মনে বললেন, যথার্থ সুন্দরী মহিলা।

দশ, কুড়ি, ত্রিশ করে মিনিট এগিয়ে চলল। প্রায় একঘণ্টা পর আচমকা একটা শব্দ শোনা গেল–মিস পারপল।

চোখ খুলে এলিজাবেথ টেম্পল মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ সে দৃষ্টি।

মিস মারপল। আপনি জেন মারপল?

 আবার শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর।

–হ্যাঁ, আমিই জেন মারপল?

 –হেনরি আপনার কথা প্রায়ই বলত।

–হেনরি?

–হেনরি ক্লিদারিং, আমার পুরনো বন্ধু।

 –হেনরি ক্লিদারিং আমারও পুরনো বন্ধু। বললেন মিস মারপল।

-হেনরি থাকলেও একই কথা বলতো–আপনি অনুসন্ধান করতে পারেন। খুব জরুরী অনেক দিন আগের

মিস টেম্পলের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। নার্স উঠে এসে তাঁকে এক চুমুক জল খাইয়ে দিয়ে চলে গেল।

–সম্ভব হলে আমি সাহায্য করব। বললেন মিস মারপল।

–এক মিনিট চোখ বুজে রইলেন মিস টেম্পল। তারপর আবার বললেন, দুজন–দুজনের মধ্যে কে তাই খুঁজে দেখতে হবে।

–একজন নোরা ব্রড–যে মারা গেছে?

-না না, অন্য মেয়েটি–ভেরিটি হান্ট। চুপ করলেন মিস টেম্পল। খানিক পরে আবার বললেন, মিস মারপল, আপনি…আপনার বয়স হয়েছে, তবুও আপনি পারবেন খুঁজে পার করতে।

আবার একটু থামলেন তিনি। এক মিনিট নীরবতা।

-বলুন, আপনি পারেন, তাই না? আমার আর বেশি সময় নেই…বুঝতে পারছি। ওদের দুজনের মধ্যে একজন তাকেই খুঁজে বার করতে হবে। আপনার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে–

–আমি করবো…অবশ্যই করবো…ঈশ্বর আমার সহায় হবেন।

–আঃ।

শান্তিতে দুচোখ বুজলেন মিস টেম্পল। মলিন ঠোঁটে যেন একটু হাসির রেখা ফুটল।

–ওপর থেকে এলো বিরাট পাথরের চাঙর।

–কে ঠেলে দেয় পাথরটা?

–বলতে পারব না। ওসব যাক–কেবল ভেরিটি–সত্যের আরেক নাম ভেরিটি। মিস টেম্পলের শরীর কেমন শ্লথ হয়ে এলো। অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল–বিদায়…যতটুকু পারেন করবেন…

নার্স উঠে এলো। নাড়ি দেখলো। মিস মারপলকে ইঙ্গিত করলো। তিনি উঠে বাইরে চলে এলেন।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড এগিয়ে এলেন। দুজনে পায়ে পায়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন।

-কিছু পেলেন?

 –পেলাম একটা নাম, বললেন মিস মারপল, ভেরিটি–মেয়েটির কি ওই নাম ছিল?

–হ্যাঁ, ভেরিটি হান্ট।

এলিজাবেথ টেম্পল জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান আর ফেরেনি। দেড় ঘণ্টা পরেই তিনি মারা গেলেন।

.

১৩.

 ভ্রমণে বেরুবার আগে তাদের বাড়িতে দুদিন থাকার জন্য মিস মারপলকে অনুরোধ করে নিয়ে এসেছিলেন মিসেস গ্লাইন।

কোচ ভ্রমণ শুরু হবে মিস টেম্পলের স্মৃতি অনুষ্ঠানের পরে। পরদিন হবে ইনকোয়েস্ট। কোচের যাত্রীরা তাতে অংশ নিতে রাজি হয়েছেন।

মিস মারপল সেই প্রাচীন ম্যানর হাউসের বসবাস ঘরে বসে একটা স্কার্ফ বুনছিলেন।

বোনার কাঁটা নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় নিজের মনেই তিনি বলে উঠলেন–ভেরিটি

নামটা শুনে তার গৃহকর্ত্রীদের কার কি প্রতিক্রিয়া হয়, তা লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যেই তিনি ওই নামটি অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন।

এলিজাবেথ টেম্পলের সর্বশেষ কথা ছিল এটাই–ভেরিটি।

-এরপর যখন তিনি কোচের যাত্রীদের সঙ্গে সান্ধ্যভোজে মিলিত হবেন, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া একবার দেখবেন ঠিক করেছেন।

সামনেই বসেছিলেন তিন বোন। চশমার আড়াল থেকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তিন বোনকে লক্ষ্য করছিল।

মিসেস গ্লাইনের হাতে একটা বই ছিল। বইটা সহসা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে মিস মারপলের দিকে তাকালেন।

ক্লোটিলডা কিন্তু মিস মারপলের দিকে না তাকিয়ে মাথা উঁচিয়ে জানালার দিকে তাকাল। তার দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ হল।

চোখের কোণে মিস মারপল দেখলেন, ক্লোটিলডার চোখ জলে ভরে উঠেছে। গাল বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে নামছে।

অ্যানথিয়ার প্রতিক্রিয়া হল সম্পূর্ণ অন্য রকম। সে খুশিভরা গলায় বলে উঠল, ভেরিটি? আপনি তাকে জানতেন? ভেরিটি হান্টকে?

মিস মারপল বললেন, এ নামে আমি কাউকে জানতাম না। আমি দুঃখিত…আপনারা দুঃখ পাবেন জানলে আমি বলতাম না।

-না তা নয়, মিসেস গ্লাইন বললেন, নামটা আমাদের জানা, ওর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল।

হঠাৎ মনে এসে গেল, বললেন মিস মারপল, গতকাল বিকালে দেখা করতে গেলে মিস টেম্পল নামটা বলেছিলেন। নামটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। হয়তো ওই নামের কথা তিনি ভেবেছিলেন। আবার হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সত্য–ভেরিটির অর্থও তো মনে হয় তাই, তাই না?

মিস মারপলের সতর্ক দৃষ্টি পর পর তিন বোনের মুখভাব ছুঁয়ে গেল।

-নামটা আমাদের পরিচিত এক মেয়ের, তাই চমকে গিয়েছিলাম। বললেন মিসেস গ্লাইন।

 –ওর মৃত্যুটা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। অ্যানথিয়া বললেন।

–অ্যানথিয়া, অত বর্ণনা দেবার কি আছে? ধরা গলায় বললেন ক্লোটিলডা।

–সকলেই তো জানে, বললেন অ্যানথিয়া, মিঃ র‍্যাফায়েল নিশ্চয়ই আপনাকে তার সম্বন্ধে বলেছেন, তাই না?

–কোন ব্যাপারটা বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বললেন মিস মারপল।

–ওর দেহটা ওরা একটা নালায় পড়ে থাকতে দেখেছিল। বললেন অ্যানথিয়া।

 ক্লোটিলডা রুমাল বের করে চোখের জল মুছলেন। তার দুচোখে গভীর বিষাদ মাখানো।

–ভেরিটিকে আমরা খুবই ভালবেসেছিলাম, বললেন ক্লোটিলডা, সে এখানেই কিছুদিন ছিল।

–সেও তোমাকে খুব ভালবাসতো। বললেন ল্যাভিনিয়া।

–ওর বাবা-মা আমার বন্ধু ছিলেন। তারা এক প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমি তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলাম।

–ভেরিটি ফেলোফিল্ডের স্কুলে পড়ত। সেই জন্যেই হয়তো মিস মারপল তাকে মনে রেখেছিলেন। বললেন ল্যাভিনিয়া।

মিস টেম্পল শুনেছি সেখানে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। বললেন মিস মারপল।

হ্যাঁ আমার কাছেই মানুষ হয়েছিল। বললেন ক্লোটিলডা, খুব ভাল মেয়ে ছিল। পড়াশুনায়ও চমৎকার মাথা ছিল। মিস টেম্পল ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা বলেছিলেন। ওর কথা বলতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে।

-না না, থাক, বললেন মিস মারপল, আমি দুঃখিত, না জেনে দুঃখ জাগিয়ে তুলেছি, আমি অত সব শুনিনি…

.

সেইদিনই সন্ধ্যায় মিস মারপল হোটেলের সকলের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য পোশাক পরিবর্তন করছিলেন। এমন সময় মিসেস গ্লাইন ঘরে ঢুকলেন।

দু-একটা অন্য কথার পর বললেন, ভেরিটি হান্টকে আমার বোন ক্লোটিলডা দারুণ ভালবাসতো। তার মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।

মিস মারপল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।

–আসলে বছর ষোল বয়সে ভেরিটি একটা বদ ছেলের পাল্লায় পড়েছিল। ছেলেটা ছিল অপরাধী। আপনাকে সব কথাই বলছি…আসলে মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলে…

-ওঃ হ্যাঁ, মনে পড়ছে একবার শুনেছিলাম তার একটি ছিল ছিল…তেমন ভাল নয়…

–খুবই বদ ছেলে-খুব অল্প বয়সেই একটা মেয়েকে অত্যাচারের জন্য জেল খেটেছিল…। চেক জাল করা, চুরি কোন কিছুই বাদ ছিল না তার। ওর মায়ের বন্ধু ছিলাম আমরা।

মিঃ র‍্যাফায়েল ছেলের জন্য সবই করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি তার কাছে একটা বড় আঘাত হয়ে উঠেছিল।

এখান দিয়ে যাবার সময় একবার সে এখানে আসে। সেই সময় এই জেলায় পর পর অনেকগুলো খুনের ঘটনা ঘটেছিল।

ভেরিটি একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। আমরা পুলিসকে জানিয়েছিলাম। কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। পুলিস জানতে পেরেছিল তাকে মাইকেল র‍্যাফায়েলের সঙ্গে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল।

আগে থেকেই কিছু অপরাধের জন্য মাইকেলের ওপর পুলিসের নজর ছিল। অবশ্য সেসবের তেমন প্রমাণ ছিল না।

দুমাস পরে একটা জঙ্গলের কাছে নালায় ভেরিটির দেহ পাওয়া গিয়েছিল। ক্লোটিলডাকেই সনাক্ত করতে যেতে হয়েছিল। বেচারী ভেরিটি। তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওর কাপড়জামা, হাতব্যাগ সবই ছিল। মিস টেম্পল ভেরিটিকে খুবই স্নেহ করতেন, তাই মৃত্যুর আগে তার কথাই ভেবেছিলেন।

গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন মিস মারপল।

–আমি সত্যই দুঃখিত। আপনার বোনকে বলবেন, আমি কিছুই জানতাম না।

.

১৪.

 ইনকোয়েস্ট বসবে মার্কেট প্লেসের কাছে একটা পুরনো জর্জিয়ান আমলের বাড়িতে। কারফিউ আর্মস বাড়িটার নাম।

মিস মারপল গ্রামের রাস্তা ধরে সেদিকে চলেছিলেন। এখনো কুড়ি মিনিট বাকি…তাই ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন তিনি।

পথের পাশে দোকানের সারি। একটা পশমের দোকান দেখতে পেয়ে দাঁড়ালেন। কাউন্টারের সামনে একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন।

মিস মারপল ব্যাগ থেকে একটুকরো পশম বার করে পশমের রঙ মেলাতে মেলাতে বয়স্ক মহিলার সঙ্গে কথা শুরু করলেন।

জানা গেল মহিলার নাম মিসেস মেরীপিট। মিস টেম্পলের দুর্ঘটনার খবরও জানেন। জানালেন একবছরে ওরকম তিনটে পাথর গড়িয়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

-খুবই দুঃখের কথা। বললেন মিস মারপল।

-আজ করোনার হয়তো এসব বিষয়ে কিছু বলবেন। রাস্তা সারাবার ব্যাপারে করোনারের কোন দায়িত্ববোধই নেই।

মিস মারপল পুলওভার নিয়ে কথা বললেন। খুব উজ্জ্বল রঙের। মিথ্যা করে জানালেন, তাঁর এক নাতির জন্য।

বিদায় নেবার আগে মিস মারপল এ অঞ্চলের আগের খুনের ঘটনাগুলোর প্রসঙ্গ তুললেন।

–পুলিস সেই খুনে লোকটিকে গ্রেপ্তার করেছে, বললেন মিসেস মেরীপিট, চমৎকার সুন্দর ছেলে, ওর বাবা নাকি মস্ত ধনী। দুটি মেয়েকে নাকি খুন করেছিল। আমার মনে হয় ও মানসিক রোগগ্রস্ত। চুরিডাকাতি, চেক জালকরা এমনি অনেক অভিযোগই ছিল তার নামে।

-একটা মেয়ের দেহ তো শুনেছি পাওয়া গিয়েছিল।

–হ্যাঁ। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ওটা নোরা ব্রড। সে হল মিসেস ব্রডের ভাইঝি। ছেলে পাগল মেয়ে। একইরকম ভাবে বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তাই ছমাস পরে যখন দেহটা পাওয়া গেল সকলে নোরা ব্রড বলেই মনে করেছিল।

–তবে কি অন্য কেউ

-হ্যাঁ, অন্য একজন। ওর কোন সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। ওরা বলে ওর মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, নয়তো মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। কে বলবে কি হয়েছে।

–যে মেয়েটি খুন হয়েছে সে তো এই অঞ্চলেই থাকতো শুনেছি। বললেন মিস মারপল।

-ও হ্যাঁ, যার দেহ প্রথমে নোরা ব্রডের মনে করেছিল পুলিস? মেয়েটার নামটা ভুলে গেছি…হোপে না ভেরিটি…এমনি কিছু হবে। ম্যানর হাউসে থাকতো।

–ওর বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল?

-হ্যাঁ। মেয়েটি ওখানেই থাকতো। সম্ভবত মিসেস গ্লাইন মেয়েটির মায়ের বন্ধু ছিলেন। সবচেয়ে বড় বোন ক্লোটিলডা মেয়েটিকে খুব ভালবাসতেন। সে উধাও হলে তিনিই খুব ভেঙ্গে পড়েন।

–তিন বোনের ছোট সম্ভবত অ্যানথিয়া তাই না।

-হ্যাঁ, উনি একটু অন্যরকম। লোকে বলে কেমন নাকি একা একা ঘুরে বেড়ান…কথা বলতে বলতে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকান হঠাৎ হঠাৎ। আমি অবশ্য জানি না। গ্রামের লোকের মুখেই শোনা যায়। ওই মেয়েটির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে নাকি ওর মধ্যে খুশির ভাব জেগেছিল। অদ্ভুত কাণ্ড।

বিদায় জানিয়ে মিস মারপল পথে নামলেন। এখনো দশ মিনিট হাতে আছে। তিনি ডাকঘরের দিকে চললেন। সেটা মার্কেট স্কোয়ারের পাশেই।

মধ্যবয়স্কা এক মহিলা কাউন্টারের পেছনে ছিলেন তাঁর কাছ থেকে কিছু ডাকটিকিট কিনলেন মিস মারপল।

দু-একজন আরো লোক ছিল। তারা কাজ সেরে চলে গেল। মিস মারপল তাকিয়ে দেখলেন, চারদিক খালি। তিনি সন্তর্পণে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন।

–মাপ করবেন, একটু বিরক্ত করব আপনাকে। আমি মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছি। আসলে যত বয়স বাড়ছে ততই সব কেমন ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে দেখছি। দানের জন্য কিছু কাপড় পার্সেল করে পাঠিয়েছিলাম…ঠিকানাও লিখেছিলাম…আজ সকালেই দেখলাম ভুল ঠিকানা লেখা হয়ে গিয়েছিল।

আপনারা পাঠানো পার্শ্বেলের তালিকা রাখেন কিনা জানি না…তবে ঠিকানাটা যদি মনে থেকে থাকে। আসলে আমি লিখতে চেয়েছিলাম দি ডকইয়ার্ড অ্যাণ্ড টেমসসাইড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন।

পোস্ট মিস্ট্রেস মিসেস ভিনিগার সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালেন মিস মারপলের দিকে। বয়স্ক মানুষের ভুলভ্রান্তির ব্যাপারটা তার অজানা নয়।

–আপনি নিজে এসেছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন।

-না, ওদের একজন কেউ এসেছিল। আমি ম্যানর হাউসে আছি। মিসেস গ্লাইন বলেছিলেন, তার এক বোনকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন।

-ও, হ্যাঁ, আচ্ছা…মঙ্গলবারে, তাই না? মনে পড়েছে…ওদের সবচেয়ে ছোট বোনটি মিস অ্যানথিয়া নিয়ে এসেছিল পার্সেলটি।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই দিনই হবে।

–আমার মনে পড়ছে। বেশ ভারিই ছিল…কিন্তু যেরকম বললেন ঠিকানা তো তা ছিল না। ওতে লেখা ছিল রেভারেণ্ড ম্যাথুজ-দি ইস্টহ্যাম উইমেন অ্যাণ্ড চিলড্রেন উলেন ক্লোদীং অ্যাপীল।

–হ্যাঁ, হা, দু হাত জড়ো করে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিস মারপল এমনি ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ঠিক মনে রেখেছেন দেখছি, বড়দিনের সময় কিছু জামাকাপড় আমি ওদের পাঠিয়েছিলাম। ওদের ঠিকানাটাই ভুল করে লিখে ফেলেছিলাম। দয়া করে ঠিকানাটা আর একবার বলুন।

মিস মারপল তাঁর নোটবই বার করে ঠিকানাটা টুকে নিলেন।

 মিসেস ভিনিগার বললেন, কিন্তু পার্সেলটা তো পাঠানো হয়ে গেছে।

-আমি ওদের ভুলের কথা লিখে পার্সেলটা ডকইয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলতে পারব। ওঃ অনেক উপকার করলেন…অজস্র ধন্যবাদ।

মিস মারপল ডাকঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামলেন।

.

ইনকোয়েস্টে ডঃ স্টোকস একে একে সকলের সাক্ষ্য নিলেন। মস্তিষ্কের আঘাতের ফলেই মিসেস টেম্পেলের মৃত্যু হয়েছিল পুলিসের ও ডাক্তারি সাক্ষ্যে একথা জানানো হলো। মিসেস স্যাণ্ডবার্ন কোচ ভ্রমণের সব ব্যবস্থা, আর বিকেলে কিভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেকথা জানালেন।

এরপর যোয়ান ক্রফোর্ডের আহ্বান এলো। তার নাম বয়স জেনে নেবার পর ডাঃ স্টোকস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দলের সকলের সঙ্গে হাঁটছিলেন।

-না, আমরা রাস্তা ছেড়ে অন্য দিকে ঘুরে ওপরে উঠছিলাম।

–আপনার একজন সঙ্গী ছিল?

 –হ্যাঁ, মিস এমলিন প্রাইস।

–আপনারা মিস টেম্পলকে দেখতে পেয়েছিলেন?

-বাঁক ঘোরার সময় মনে হয় তাকে দেখেছিলাম। এরপর পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়ায় আর দেখতে পাইনি।

–আপনাদের সামনে পাহাড়ের উঁচুতে কাউকে দেখেছিলেন?

–হ্যাঁ, পাহাড়ের ওদিকে অনেক পাথরের চাঁই ছিল।

–আপনি ওখানে কাউকে দেখেছিলেন?

–হ্যাঁ, কেউ পাথরের চাঁই ঠেলছিল।

–যাকে আপনি দেখেছিলেন সেকি পুরুষ ছিল?

–অত উঁচুতে ঠিক বুঝতে পারা যায়নি। তবে পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই ঠেলে থাকুক, পাথরটা আলগা হয়েছিল।

–আসলে ওখানে কে ছিল ভাবছেন, কোন পুরুষ না স্ত্রীলোক?

–যেই হোক, তার গায়ে ট্রাউজার আর পুলওভার ছিল। পোশাকটা পুরুষেরই যোগ্য।

–পুলওভারের রঙ কি রকম ছিল?

–গাঢ় লাল আর কালো নকশা। লম্বা কিছু দাগও ছিল–ওরকম পুলওভার পুরুষেরই হওয়া সম্ভব।

-এরপর কি হলো?

-এরপর পাথরটা গড়াতে শুরু করল। আমি আর এমলিন একটা আর্তনাদ শুনতে পেলাম।

-তারপর?

–আমরা বাঁকটা ঘুরে ছুটে গেলাম কি হল দেখতে।

–কি দেখলেন?

–পাথরের নিচে একটা দেহ–আর অন্য সকলে ছুটে আসছে।

–আর্তনাদ কি মিস টেম্পলই করেছিলেন?

–আমার ধারণা তাই। তবে বাঁক ঘুরে যারা এসেছিলেন তাদের কেউও হতে পারেন। ওঃ কী মর্মান্তিক।

–সেই লাল আর কালো পুলওভার পরা ওপরের মূর্তির কি হল? সে কি তখনও ওই পাথরের চাঁইগুলোর কাছেই ছিল?

–তা বলতে পারিনি। সেদিকে আর তাকাইনি মনে হয়।

–ওই মূর্তি আপনাদের যাত্রীদলের কেউ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

–ওঃ না, আমি নিশ্চিত। আমাদের মধ্যে ওরকম লাল-কালো পুলওভার পরা কেউ ছিলেন না।

-ধন্যবাদ মিস ক্রফোর্ড।

এরপর সাক্ষ্য দিতে উঠল এমলিন প্রাইস। তার কাহিনী যোয়ানারই মত।

সবার সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হলে করোনার ঘোষণা করলেন মিস টেম্পলের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হবার মত যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তাই ইনকোয়েস্ট মুলতবী রইল।

.

১৫.

 ইনকোয়েস্ট থেকে সকলে গোল্ডেনবোর হোটেলে ফেরার পথে চলতে চলতে মিস মারপল প্রফেসর ওয়ানস্টেডকে জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কি হবে?

পুলিসের তদন্ত হবে আরো। ওই দুজনের সাক্ষ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ।

করোনার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তদন্ত চলবে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এমন রায় করোনার দিতে পারবেন না আশা করি।

–সেটা কেউই আশা করে না। ওদের দুজনের সাক্ষ্য সম্বন্ধে আপনার কি মনে হল?

প্রফেসার ওয়ানস্টেড পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন মিস মারপলের দিকে। বললেন, এব্যাপারে আপনার কি কোন ধারণা আছে? ওরা কি বলবে তা অবশ্য আগেই আমরা জানতাম।

–ওদের বলা ওই লাল-কালো পুলওভার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বললেন মিস মারপল।

–আমারও তাই ধারণা।

–আমি মনে করছি, একটা মূল্যবান সূত্রের সন্ধান এ থেকে আমরা পেতে পারি।

কথা বলতে বলতে ওঁরা হোটেলে পৌঁছে গেলেন। ততক্ষণে অন্যান্যরাও পৌঁছে গিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের আগে সকলকেই টম্যাটোর রস, শেরী ও অন্যান্য সুরা পরিবেশন করা হয়েছিল।

মিসেস স্যাণ্ডবার্ন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি করোনার এবং পুলিস ইনপেক্টরের পরামর্শ নিয়েছি, আপনাদের সেকথা জানাচ্ছি। মেডিক্যাল সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সেইকারণে আগামীকাল সকাল এগারোটায় গির্জায় স্মৃতিবাসর অনুষ্ঠিত হবে।

একটু পরেই আমি স্থানীয় ভিকার মিঃ কোর্টনির সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি। স্মৃতিবাসরের পরদিনই আমাদের ভ্রমণ শুরু করতে চাই।

ইতিমধ্যে দু একজন লণ্ডন ফিরে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সন্দেহ নেই এই মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি বিশ্বাস করি, মিস টেম্পলের মৃত্যু দুর্ঘটনার ফলেই ঘটেছে। অবশ্য এব্যাপারে এখনো পুলিসি তদন্ত হবে।

কোন ভ্রমণকারী খেলাচ্ছলেও ওই পাথরটা ঠেলে থাকতে পারেন। সেকথা তার এগিয়ে এসে বলা উচিত। এটা আমরা সকলেই বিশ্বাস করি যে মিস টেম্পলের মত মহিলার কোন শত্রু ছিল না। যাইহোক, এই দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে আমরা আর কোন আলোচনা করব না…আমাদের মন ভাল রাখার জন্যই।

কিছুক্ষণ পরেই মধ্যাহ্নভোজ শেষ হল। মিস টেম্পলের মৃত্যু নিয়ে কেউই আর কোন কথা বললেন না।

–আপনি কি ভ্রমণে যাবেন?

প্রফেসার ওয়ানস্টেড মিস মারপলকে জিজ্ঞেস করলেন।

-না। এখানেই আরও কয়েকদিন থাকা দরকার বলে আমি মনে করছি। বললেন মিস মারপল।

–থাকবেন কোথায়? গোল্ডেনবোরে না ওই জমিদার বাড়িতে?

-সেই সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমি অপেক্ষা করছি ম্যানর হাউস থেকে আর কোন আমন্ত্রণ পাই কিনা। আগে আমাকে দুদিনের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অবস্থা বুঝে দরকার মত গোল্ডেনবোরেই থেকে যাব না হয়।

–সেন্ট মেরী মিডে আপাতত ফিরতে চাইছেন না?

–এখানে থেকে দু-একটা কাজ আমাকে করতে হবে। একটা অবশ্য ইতিমধ্যে করেও ফেলেছি। আপনি কি সকলের সঙ্গেই যাচ্ছেন?

–আপনার কোন প্রয়োজনে লাগতে পারি বলে মনে করছেন আপনি?

–যদি যান তাহলে আপনাকে একটা তদন্তের কথা বলব। তাতে আমার খুবই উপকার হবে। এখানে আমার থাকার বিশেষ কারণ হল স্থানীয়ভাবে কিছু খোঁজখবর নিতে চাই। ফলাফল কি হবে তা অনিশ্চিত বলেই এখন কিছু বলতে চাইছি না আপনাকে।

-লণ্ডনে কিছু জরুরী কাজের জন্য আমার ফিরে যাওয়া দরকার। তবে এখানে আপনার কোন কাজে লাগলে থেকে যাবো।

–এখনই কোন সাহায্যের দরকার পড়বে মনে করছি না। এদিকে আপনারও নিজস্ব কোন কাজ আছে আমার মনে হয়।

–আমি কেবল আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যই এই ভ্রমণে এসেছিলাম।

-আমার সঙ্গে তো দেখা হল আপনার। আমি যা জানি তা-ও এখন আপনার আর অজানা নেই। আপনার নিজের ক্ষেত্রেও যে কিছু খোঁজ করার রয়েছে তা আমি বুঝতে পারি। তবে এখান থেকে যাওয়ার আগে মনে হয় আপনাকে দিয়ে কিছু সাহায্য হতে পারে।

–আপনার কি কিছু ধারণা হয়েছে? সেই অশুভ কিছুর গন্ধ পেয়েছেন?

–এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না।

–আর মিস টেম্পলের মৃত্যুও যে দুর্ঘটনা নয় তাও বুঝতে পারছেন?

–এটা দুর্ঘটনা নয়। একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন।

–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। তীর্থযাত্রা কোথায় বা কার কাছে, আপনাকে কি তা জানিয়েছিলেন?

-না, মিস মারপল বললেন, আমার বিশ্বাস দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু না হলে তিনি আমাকে বলতেন।

–কিছু কি অনুমান করতে পেরেছেন?

–না। তবে বুঝতে পারছি তার এই তীর্থযাত্রা মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি যেখানে যেতে চেয়েছিলেন বা যার সঙ্গে দেখা করতে চলেছিলেন, তা তাঁকে করতে দেওয়া হয়নি। দৈবানুগ্রহ না হলে তা আর জানার উপায় নেই।

এজন্যেই কি এখানে থেকে যাচ্ছেন?

–আরও একটি বিষয় আছে। নোরা ব্রড নামে একটি মেয়ের সম্পর্কেও খোঁজখবর নিতে হবে।

–নোরা ব্রড! চিন্তিত হলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ, এই মেয়েটি ভেরিটি হান্টের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে অদৃশ্য হয়। কথাটা আপনিই আমাকে বলেছিলেন, নিশ্চয় আপনার মনে আছে। মেয়েটির অনেক ছেলেবন্ধু ছিল। ওর সম্পর্কে আরও কিছু জানতে পারলে আমার তদন্তের সুবিধা হতে পারে।

–বেশ, তাহলে নিজের পথেই চলুন। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

.

পরদিন যথাযযাগ্য মর্যাদা সহকারে মিস টেম্পলের স্মৃতিবাসর অনুষ্ঠিত হল। ভ্রমণ দলের সকলেই উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনেকের সঙ্গে মিসেস গ্লাইন ও তার বোন মিস ক্লোটিলডাও ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন একজন শুভ্রকেশ বয়স্ক পাদ্রী।

গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে মিস মারপল জানতে পারলেন অনেকে ফিরে যাওয়া মনস্থ করলেও যেকজন থাকবেন তাদের নিয়েই ভ্রমণ-কর্মসূচী চলবে।

মিস মারপল নিজের মনেই গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললেন। তিনি হাতব্যাগ থেকে একটুকরো কাগজ বার করে দেখে নিলেন। তাতে দুটো ঠিকানা লেখা ছিল।

প্রথম ঠিকানা হল এক মিসেস ব্ল্যাকেটের রাস্তার শেষে ছোট বাগানবাড়িতে তিনি থাকেন।

তাকে বাড়িতে পাওয়া গেল। মিস মারপলকে সাদরে বসার ঘরে নিয়ে বসলেন মিসেস ব্ল্যাকেট।

মিসেস মারপল একগ্লাস জল চেয়েছিলেন। স্মৃতিবাসর থেকে ফেরার পথে অসুস্থ বোধ করছেন বলে তিনি জানান।

একগ্লাস জল অতিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে মিসেস ব্ল্যাকেট বললেন, মহিলাটি তাহলে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন? আমারও তাই ধারণা অবশ্য। করোনার সবকিছুর মধ্যেই অপরাধের গন্ধ পায়।

–হ্যাঁ, বরাবরই এরকম হয়। আমি একটা মেয়ের কথা শুনেছিলাম, নোরা ব্রড

-হ্যাঁ, নোরা! সে আমার পিসতুতো বোনের মেয়ে। বড় উছুঙ্খল–আমি বারবার বলেছি। আমার বোন ন্যানসি ব্রডকে। অমন করে ছেলেদের পেছনে লেগে থাকলে গণ্ডগোল না হয়ে পারে? শেষে হলও তাই।

–আপনি বলতে চাইছেন

–হ্যাঁ, ছেলেটি এখানেই বাস করছিল। নোরা চলে গেলে বেচারি খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল।

–নোরা চলে গিয়েছিল?

–একজন অচেনা লোকের গাড়িতে তাকে দেখা গিয়েছিল। লোকে বলে ওই গাড়িতে চড়ার পরেই সে খুন হয়। আমার মনে হয় না এরকম কিছু ঘটেছে, তাহলে এতদিনে তার দেহ পাওয়া যেত।

–তাই মনে হয়। বললেন মিস মারপল।

–অনেকদিন হয়ে গেল, সাত আট বছর প্রায়, আমার ধারণা ও ফিরে আসবে।

–আপনার বোন ছাড়া সে কি আর কোথাও যেত?

-হ্যাঁ, ওই পুরনো জমিদার বাড়ির বোনেদের কাছে যেত। মিস ক্লোটিলডা তাকে খুব ভালবাসতেন। পড়াশুনায় মনোযোগী হবার জন্য অনেক বোঝাতেন। সে কোন কথাই কানে তোলেনি। তবু ভাল বলব, ম্যানর বাড়ির সেই…নামটা ভুলে গেছি, মেয়েটির মতো তাকে খুন হতে হয়নি।

এমনি আর দু-চার কথা বলার পর মারপল শরীর ঠিক হয়ে গেছে বুঝতে পেরে মিসেস ব্ল্যাকেটকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন।

মিস মারপলের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ওঃ নোরা ব্রড, সে তো অনেক দিন গ্রামে নেই। কারও সঙ্গে চলে গিয়েছে–ছেলেদের সঙ্গেই তো রাতদিন ঘুরে বেড়াতো। আপনি কি কোন দরকারে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন?

-হ্যাঁ, আমার এক বন্ধুর চিঠি পেয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তুমি ওর সঙ্গেই স্কুলে পড়তে, তাই না?

-হ্যাঁ, আমরা এক ক্লাসেই পড়তাম। কিন্তু বরাবর ছেলেপাগল ছিল। যে-ই ওকে ডাকতো, তার সঙ্গেই গাড়িতে উঠত। ওরকম একটা গাড়িতে ওঠার পরেই তাকে আর দেখা যায়নি। তবে রক্ষা এটাই যে ওকেও খুন হতে হয়নি।

যাইহোক, তাহলে আর দেখা হল না।

নিজের মনে বলতে বলতে বিদায় নিলেন মিস মারপল।