১. সেন্ট মেরী মিডে

নেমেসিস (১৯৭১)আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

সেন্ট মেরী মিডে মিস মারপলের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে দুটো খবরের কাগজ আসে।

সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে একটা কাগজে তিনি চোখ বোলান। দ্বিতীয় কাগজটা নিয়ে বসেন বিকেলের দিকে।

পিঠে বাতের জন্য বিশেষ ভাবে বানানো সোজা একটা আরাম কেদারা বারান্দায় রাখা আছে। দুপুরের আহারের পর এখানে বসেই তিনি মিনিট কুড়ি ঘুমিয়ে নেন।

সেদিনও টাইমস পত্রিকা হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে পাতা ওল্টাচ্ছিলেন।

 একে একে জম্ম, বিবাহ আর মৃত্যুর কলম দেখে নিয়ে তিনি চিঠিপত্রগুলো পড়লেন।

পরে আবার মৃত্যুর কলমে চোখ বোলাতে গিয়ে একটা নাম পড়ে একটু থমকে গেলেন।

র‍্যাফায়েল। জ্যাকসন র‍্যাফায়েল। বেলফোর্ড পার্ক, মেইডস্টোন।

 নামটা কেমন পরিচিত লাগছে। মিস মারপলের মনে হল কোথাও আগে শুনেছেন নামটা।

আজকাল বয়স হয়েছে। সবকিছু ঠিক সময়ে মনে পড়ে না। অনেক কিছু মনেও করতে পারেন না।

কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু র‍্যাফায়েল নামটা কোন্ সূত্রে পরিচিত মনে হয়েছে কিছুতেই মনে করতে পারলেন না।

অন্যমনস্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালেন তিনি। তার কাছে বড় আনন্দের ছিল এই বাগান। একসময় এর পেছনে অনেক পরিশ্রম করেছেন।

ডাক্তারদের নির্দেশ মানতে হয় এখন। চেয়ারে বসেই কেবল তাকিয়ে দেখেন।

অন্যমনস্ক ভাবটা কাটতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল-নীল সমুদ্র-ক্যারিবিয়ান সাগর। হা…মনে পড়ে গেছে…মিঃ র‍্যাফায়েল। ভাইপোর কল্যাণে ক্যারিবিয়ানে তিনি ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেন্ট অনরে দ্বীপ।

সেখানেও খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই বয়স্ক মেজর, তার একটা চোখ ছিল কাচের। বিরক্তিকর গল্প শোনাতেন আর সেই সূত্রেই ক্যারিবিয়ানের দিনগুলো অন্যরকম হয়ে উঠেছিল।

বেচারা মেজর…মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তার নামটা মনে করতে পারলেন না মিস মারপল। কিন্তু মিঃ র‍্যাফায়েল, তার সেক্রেটারী মিসেস–মিসেস ওয়াল্টার্স…এসথার ওয়াল্টার্স আর তার অঙ্গসংবাহক সেই ছোকরা…কি নাম যেন..হা জ্যাকসন…সবই মনে পড়ছে।

বেচারা মিঃ র‍্যাফায়েল…হুইল চেয়ারে ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। তাহলে তিনি মারা গেছেন। অবশ্য তিনি জানতেন যে খুব বেশি দিন তার আয়ু নেই। কথাটা মিঃ র‍্যাফায়েল তাকে জানিয়েও ছিলেন।

অসম্ভব ধনী ছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েল। আর একগুঁয়ে। ধনী বলে অবশ্য সকলেই মানিয়ে নিত। অমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে সহজে ভোলা যায় না। এক বছরের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন।

 মিস মারপলের মন এবারে ক্যারিবিয়ানের সেই দ্বীপেই ঘুরে ফিরতে লাগল। সেই আর্থার জ্যাকসন…সে কি শেষ পর্যন্ত ছিল মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে?

আর এসথার–এসথার ওয়াল্টার্স…তার কি হল? তার তো কিছু অর্থ পাওয়ার কথা ছিল। এত দিনে তা তার পাওয়া হয়ে গেছে নিশ্চয়।

মিস মারপলের মনে পড়ল, এক আঁধার ঘেরা রাতে ছুটে গিয়েছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে। তিনি সেই মুহূর্তে নিয়তি বলে সম্বোধন করেছিলেন তাঁকে।

নিজের মনেই স্বগতোক্তি করলেন তিনি, আশা করি মিঃ রাফায়েল বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেননি।

সেদিন বিকেলে চেয়ারে বসে বহুক্ষণ মিঃ র‍্যাফায়েলের কথা ভাবলেন মিস মারগল। ইংল্যাণ্ডে ফিরে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে, এমনটি অবশ্য তিনি ভাবেননি। দেখাও হয়নি। অথচ প্রায়ই মনে হতো ভদ্রলোকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য যোগসূত্র অনুভব করতেন।

আরো কিছু পরে ধীর পায়ে বাগানে গিয়ে ঢুকলেন মিস মারপল। নিজের মনেই বকবক করছেন। জর্জ আজকাল ঠিকঠিক যত্ন নেয় না ফুলগাছগুলোর। তাকে আবার একটু ধমকে দিতে হবে।

হঠাৎ রেলিঙের বাইরে গলি থেকে কেউ বলে উঠল, আপনার বাগানটা খুব সুন্দর।

বক্তাকে চোখে দেখলেও চিনতে পারলেন না তিনি। মেদবহুল চেহারার এক ভদ্রমহিলা। মজবুত টুইডের স্কার্ট পরা। সবুজ পুলওভার স্কার্ফও আছে।

সেন্ট মেরী মিডের প্রায় সকলকেই চেনেন মিস মারপল। এই মহিলাকে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না।

এখন আর তেমন নেই। জবাব দিলেন মিস মারপল, আজকাল নিজে আর দেখাশোনা করতে পারি না।

–আমি নিজেও বাগান ভালবাসি। নিশ্চয় সবজান্তা বয়স্ক কেউ আপনার বাগান দেখাশোনা করে? জানতে চাইলেন বাগানের বাইরে দাঁড়ানো মহিলা।

আপনি এখানেই থাকেন?

–মিস হেস্টিংস নামে একজনের বাড়িতে আছি। মনে হয় তার কাছেই আপনার কথা শুনেছি। আপনিই তো মিস মারপল, তাই না?

-হ্যাঁ।

-আমি বাগান দেখাশোনা করি। আমার নাম বার্টলেট, মিস বার্টলেট। এখানে বিশেষ কিছু করার নেই বলে মাঝে মাঝে কেনা কাটার কাজও করি। আপনার বাগানের কাজে দরকার হলে দু ঘন্টা করে সময় দিতে পারি।

মিস হেস্টিংসকে মনে করতে পারলেন না মিস মারপল। জিব্রাল্টার রোডের নতুন বাড়িগুলোর কেউ হবে হয়তো মনে করলেন।

তিনি আর কথা বাড়ালেন না। আরও খানিকক্ষণ বাগানে ঘুরে বাড়িতে ফিরে এলেন।

টাইমসের খবরটা আবার মনে পড়ল। মিঃ র‍্যাফায়েলকে নিয়েই মন ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

.

০২.

 মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে মিস মারপল একটা চিঠি পেলেন। চিঠিটা এসেছে ব্লুমসবারীর সলিসিটর কোম্পানি মেসার্স ব্রডরিব ও সুস্টারের কাছ থেকে।

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তারা অনুরোধ জানিয়েছে আগামী সপ্তাহের যে কোন দিন মিস মারপল যেন তাদের অফিসে সাক্ষাৎ করেন।

বিষয়টা নাকি তাঁরই অনুকূলে। অবশ্য বিশেষ ভাবে একটা দিনের কথাও তারা উল্লেখ করেছে–আগামী বৃহস্পতিবার, ৪ঠা তারিখে।

এই চিঠির যোগসূত্র উদ্ধার করতে পারলেন না মিস মারপল। কপালে কুঞ্চন রেখা জাগিয়ে অনেকক্ষণ বসে ভাবলেন। সলিসিটরের চিঠি মানেই মামলাটামলা কিছুর ব্যাপার হবে–এরকম অনুমান করলেন। আবার এমনও হতে পারে, মিঃ র‍্যাফায়েল তাকে স্মৃতি হিসেবে কিছু দান করে গেছেন তার উইলে। বই বা এই জাতীয় কিছু। তবে সেসব ডাকে পাঠিয়ে দেওয়াই তো সম্ভব ছিল।

কিন্তু আগামী বৃহস্পতিবার তার পক্ষে লণ্ডনে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানে মহিলা সমিতির একটা সভায় যোগ দিতে হবে। তিনি পরের সপ্তাহে একটা তারিখ জানিয়ে চিঠি লিখে দিলেন এবং তাদের জবাবে সম্মতিও পেয়ে গেলেন।

জবাবী চিঠিতে সই করেছেন জে. আর. ব্রডরিব। মিস মারপল অনুমান করলেন, সম্ভবত তিনিই কোম্পানির প্রধান অংশীদার।

.

নিজেদের অফিসে বসেছিলেন মিঃ ব্রডরিব আর মিঃ সুস্টার। আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই তারা মিস মারপলকে আশা করছেন। সেরকমই চিঠিতে জানিয়েছিলেন তিনি।

ভদ্রমহিলা কেমন হবেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে তিনি কোন্ সূত্রে পরিচিত এসব কোন কথাই তারা মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছ থেকে শোনেন নি।

নির্দিষ্ট সময়েই মধ্যবয়স্ক কৃশ চেহারার মিঃ ব্রডরিব অভ্যর্থনা জানালেন মিস মারপলকে।

-ইনি আমার অংশীদার মিঃ সুস্টার।

মেদবহুল চেহারার তরুণ ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্রডরিব পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মিঃ সুস্টার একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে আসন গ্রহণ করলেন মিস মারপল।

সৌজন্যমূলক প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পর মিঃ ব্রডরিব আসল প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন।

–মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুসংবাদ সম্ভবত কাগজে দেখেছেন আপনি?

–হ্যাঁ, কাগজেই দেখেছি।

–আমাদের ধারণা তিনি আপনার বন্ধু।

–ওয়েস্ট ইণ্ডিজে প্রথম দেখা হয়েছিল, প্রায় বছরখানেক আগে।

নিশ্চয় ভালভাবেই চিনতেন তাঁকে।

–সেভাবে বলা যাবে না। দুজনে একই হোটেলে উঠেছিলাম। মাঝে মাঝে কথা হতো। আমি থাকি গ্রামের দিকে। কাজেই ইংলণ্ডে ফিরে এসে দেখাসাক্ষাতের প্রশ্ন ছিল না। তিনি খুবই অসাধারণ মানুষ ছিলেন।

-আপনার সম্পর্কে তার খুব উচ্চ ধারণা ছিল, বললেন ব্রডরিব, তার উইলে আপনার জন্য কিছু টাকা রাখা আছে। একবছর পরে তার মালিকানা আপনার হবে। অবশ্য তা হবে তার একটা প্রস্তাবে আপনার সম্মতি-অসম্মতি শর্তসাপেক্ষে।

কথা শেষ করে মিঃ ব্রডরিব টেবিলের ওপর থেকে শীলমোহর আঁটা একটা দীর্ঘ খাম মিস মারপলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

–এটা পড়লেই আপনি সব জানতে পারবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আপনি মনস্থির করার জন্য সময় নিতে পারেন।

সযত্নে খামটা খুলে টাইপ করা কাগজটা বার করলেন তিনি।

–এটা আপনার হাতে তুলে দিয়ে প্রাপ্য অর্থের কথা জানিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আমাকে দেওয়া আছে। অর্থের পরিমাণ হল বিশ হাজার পাউণ্ড ।

-বিশ হাজার পাউণ্ড। এত টাকা।

প্রবল বিস্ময়ে প্রায় চোখ কপালে উঠল মিস.মারপলের।

এবারে তিনি কাগজের লেখায় চোখ বোলালেন। তারপর মিঃ ব্রডরিবকে লক্ষ্য করে বললেন, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। শর্তের কথাটা আপনার নিশ্চয় জানা আছে?

-হ্যাঁ, মিঃ র‍্যাফায়েল আমাকে বলেছিলেন।

–এর ব্যাখ্যা কিছু ।

–আমি তাকে জানিয়েছিলাম, তিনি ঠিক কি বলতে চাইছেন তা বুঝে ওঠা আপনার পক্ষে হয়তো কঠিন হবে। কিন্তু তিনি কোন ব্যাখ্যা করেননি।

–আমাকে এ নিয়ে একটু ভাবতে হবে। বললেন মিস মারপল। আমার বয়স হয়েছে, এক বছর পরে টাকাটা নেবার জন্য আমি বেঁচে না-ও থাকতে পারি। বুঝতে পারছি না এ ধরনের তদন্তের ব্যাপারে আরও যোগ্য লোকের কথা না ভেবে আমার মত একজন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধার কথা তিনি কেন ভাবলেন?

–তিনি আপনাকেই মনোনীত করে গেছেন। যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কোন অপরাধ বা অপরাধের তদন্তের ব্যাপারে আপনি কি কখনো জড়িয়ে পড়েছিলেন?

–সত্যি কথা বলতে গেলে সেটা পেশাদারী কোন ব্যাপার নয়। কোন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কোন কালেই আমি যুক্ত ছিলাম না।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে থাকবার সময় ওখানে ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপারের সঙ্গে মিঃ র‍্যাফায়েল ও আমার যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল।

–আপনারা দুজনে সেটার সমাধান করেছিলেন?

-ঠিক সেরকম বলা চলেনা। কয়েকটা যোগসূত্র আমার নজরে এসেছিল, মিঃ র‍্যাফায়েলের ব্যক্তিত্বের সহায়তায় আমি একটা খুনের ব্যাপার রুখে দিতে পেরেছিলাম। বয়স ও শরীরের কারণে কাজটা আমার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। মিঃ র‍্যাফায়েলও ছিলেন পঙ্গু মানুষ। তার একার পক্ষেও সম্ভব ছিল না। বন্ধুর মত আমরা একসঙ্গে কাজটা করেছিলাম।

বক্তব্য শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মিস মারপল। বললেন, এসম্পর্কে আর কোন নির্দেশ পেলে আমাকে জানাবার অনুরোধ করছি কেন না আমাকে ঠিক কি করবার কথা বলে গেছেন তা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

অবশ্যই। আচ্ছা, মিঃ র‍্যাফায়েলের পরিবারের কারো সঙ্গে কি আপনি পরিচিত?

–না, তেমন সুযোগ ছিল না। আকস্মিকভাবেই বিদেশে আমরা একটা রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম।

মিসেস এসথার ওয়াল্টার্স নামে তার একজন সেক্রেটারী ছিলেন, আমার জানা ছিল, মিঃ র‍্যাফায়েল তার দলিলে তাকে পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড দিয়ে গেছেন।

-হ্যাঁ, তা তিনি পেয়েছেন। তবে মিসেস ওয়াল্টার্স আবার বিয়ে করেছেন। তিনি এখন মিসেস অ্যাণ্ডারসন।

-শুনে খুব খুশি হলাম। বেচারী এক মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন। চমৎকার মহিলা। নিজের বাড়িতে ফিরে এসে সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর নিজস্ব চেয়ারে বসে চিঠিটা খুলে নিয়ে বসলেন।

মিস জেন, মারপল,
সেন্ট মেরী মিড,
আমার মৃত্যুর পর আমার সলিসিটর মিঃ জেমস ব্রডরিবের কাছ থেকে এই চিঠি আপনি পাবেন। তিনি বিশ্বস্ত আইনজ্ঞ। আমার অফিস এবং ব্যক্তিগত আইন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্ব তার হাতে।

তবে বিশেষ কারণে অনেক ব্যাপারেই মিঃ ব্রডরিবের অনুসন্ধিৎসা মেটাইনি। কোন কোন ব্যাপারে বোঝাঁপড়া কেবল আমার আর আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। নিয়তি, আমাদের মধ্যের কাজ হবে সাঙ্কেতিক।

কি অবস্থায় সম্বোধনটা আমি প্রয়োগ করেছিলাম, নিশ্চয় আপনার মনে পড়ছে।

যে মানুষ অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানে সমৃদ্ধ, কাজের প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা যার রয়েছে, দীর্ঘ কর্মময় জীবনে আমি তেমন লোককে দিয়েই কাজ করতে চেয়েছি।

হ্যাঁ, সব যোগ্যতাই আপনার মধ্যে রয়েছে। আর আছে, ন্যায়ের প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ। সেকারণে আপনাকে দিয়ে আমি একটা বিশেষ অপরাধের তদন্ত করাতে চাই।

আমি জানিয়ে রেখেছি, যদি আপনি আমার এই অনুরোধ অনুমোদন করেন আর আপনার তদন্তের ফলে ওই বিশেষ অপরাধের মীমাংসা হয়, তাহলে আপনার জন্য নির্দিষ্ট কিছু টাকা সম্পূর্ণভাবেই আপনার হবে।

আমার এই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করার জন্য একবছর সময় নির্দিষ্ট রেখেছি। অবশ্যই স্বীকার করব যে আপনার বয়সের কথাটা আমি বিস্মৃত হইনি।

যতদূর দেখেছি, আমার ধারণা, তরুণী না হলেও আপনি যথেষ্ট শক্ত ধাতের। আমার বিশ্বাস, ভাগ্য আপনাকে এক বছর অন্তত বাঁচিয়ে রাখবে।

অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে আপনার স্বাভাবিক প্রবণতা ও দক্ষতা রয়েছে। কাজ করবার সময় প্রয়োজনীয় অর্থ আপনাকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থাও করা রয়েছে। আশা করি আমার প্রস্তাব আপনার রুচিবিরুদ্ধ মনে হবে না।

চোখ বুজলে আপনাকে এখনো সেই উলবোনা অবস্থায় অবিকল দেখতে পাই। বিশেষ করে সেই দিনের কথা আমি ভুলতে পারি না, যেদিন আপনার তাড়ায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, আপনার মাথার দিকে গোলাপী রঙের একরাশ পশম জড়ানো ছিল। পশম বোনাটা আপনার প্রাত্যহিক জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে আমি জানি। যদি এই বোনার কাজ চালিয়ে যেতে চান, স্বচ্ছন্দে তা করতে পারেন।

আর যদি ন্যায় ও সত্যের জন্য কাজ করতে উৎসুক হন তাহলে আমার প্রস্তাবিত কাজে নিশ্চয় উৎসাহ পাবেন। —

আপনার প্রিয় বন্ধু
জে. বি. র‍্যাফায়েল

.

০৩.

 পর পর তিনবার বেশ উচ্চস্বরে চিঠিটা পড়লেন মিস মারপল। কাজের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কোন সূত্র বা তথ্য কোথাও পেলেন না। তার মনে হল, মিঃ ব্রডরিবের কাছ থেকে এর পর কিছু খবর আসা উচিত। অবশ্য যদি না মিঃ র‍্যাফায়েল ইচ্ছে করে ব্যাপারটাকে গোলমেলে করে রাখেন এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

সবকিছুতে মজা উপভোগ করতেই চাইতেন তিনি। একারণেই মিঃ ব্রডরিবের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসাও তিনি মেটাননি।

মিঃ র‍্যাফায়েল কোন সূত্রের উল্লেখ না করলেও, মিস মারপল ভাবলেন, তাকে সূত্র আবিষ্কার করতেই হবে। তাকে জানতে হবে কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, বা কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে।

কাজের খরচের ব্যবস্থা যখন রাখা হয়েছে, অনুমান করা যায়, মিঃ র‍্যাফায়েল চেয়েছেন, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ বা দক্ষিণ আমেরিকা বা অন্য কোথাও তিনি যাবেন।

মিস মারপল নিজের মনেই বলে উঠলেন, মিঃ র‍্যাফায়েল, আমি চিরন্তন জীবনে বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি, কোথাও আপনি নিশ্চয় রয়েছেন, আমি জানতে না পারলেও নিশ্চয়ই আপনি আছেন–আমি আপনার ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা যথাসাধ্য করব।

তিনদিন পরে মিঃ ব্রডরিব মিস মারপলের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল–

প্রিয় মিঃ ব্রডরিব,
মিঃ র‍্যাফায়েলের যে প্রস্তাব আপনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, সেসম্পর্কে জানাচ্ছি, তার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করছি। জানি না কতটা সফল হব, তার ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা যথাসাধ্য করব। যদিও জানি না, সফলতা কিভাবে আসবে। কোন সূত্র বা তথ্যই তিনি রেখে যাননি। আপনার কাছেও রেখে গেছেন বলে মনে হয় না। বাস্তবিকই যদি তেমন কিছু থেকে থাকে। আমাকে পাঠাতে অনুরোধ করছি।

একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল নিশ্চয়ই অসঙ্গত মনে হবে না। জীবনের শেষ দিকে ব্যবসায় বা ব্যক্তিগত জীবনে মিঃ র‍্যাফায়েলের কোন অপরাধমূলক ঘটনা কি ঘটেছিল? কোন অন্যায় বিচার বা এই ধরনের কিছু? তার কোন আত্মীয় কি ইদানীংকালে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত বা উৎপীড়িত হয়েছিলেন?

আমার বিশ্বাস, আপনি বুঝতে পারবেন, এই সব কেন আমি জানতে চাইছি।..

 চিঠিটা পড়ে খুশি হলেন মিঃ ব্রডরিব। সেটা এগিয়ে দিলেন সুস্টারকে।

–মনে হয় ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু জানেন ভদ্রমহিলা। বেশ উৎসাহের সঙ্গেই এটা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হচ্ছে।

চিঠি পড়া শেষ করে মন্তব্য করলেন সুস্টার। মনে হয় না জানতেন। সবকিছু এমনি জটিল করে তোলাই স্বভাব ছিল ভদ্রলোকের।

–কিন্তু আমাদের তাহলে করণীয় কি হবে?

 –অপেক্ষা করব। কিছু একটা ঘটবে নিশ্চিত। বললেন ব্রডরিব।

–আচ্ছা, সীলআঁটা কোন নির্দেশ কি কোথাও আছে?

–তেমন হলে আমার অজানা থাকতো না। আমার সততা এবং আইনজ্ঞ হিসেবে আমার দক্ষতার কথা মিঃ র‍্যাফায়েল সর্বদা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন। যথেষ্ট আস্থা ছিল তার আমার ওপর। বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সীলআঁটা নির্দেশ খুলে দেখতে আমার বাধা নেই। কিন্তু সে অবস্থা এখনো আসেনি।

.

ট্রে থেকে কফির কাপ তুলে নিতে নিতে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস হেস্টিংস নামে একজন এখানে কোন বাড়িতে থাকেন জানো? মিস বার্টলেট নামে একজন বোধহয় তার সঙ্গে থাকে।

–হ্যাঁ, গ্রামের শেষে নতুন যে বাড়িতে রঙ হলো, ওখানেই নতুন এসেছেন দুই মহিলা। ওদের নাম জানি না। কেন কি হয়েছে? বলল চেরি।

–ওরা কি আত্মীয়?

-না মনে হয়। বন্ধু হবেন

 –ওহ আচ্ছা। একটা চিঠি লিখব। আমার ডেস্কটা পরিষ্কার করে দাও।

–কাকে লিখবেন? কি ব্যাপার?

–এক পাদ্রীর বোন মিস ক্যানন প্রেসকটকে।

–অ, তার সঙ্গেই তো ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আপনার পরিচয় হয়েছিল তাই না? মনে হয় অ্যালবামে ছবি দেখেছি।

-হ্যাঁ। একটা কাজে হাত দিচ্ছি। বোনের সাহায্য দরকার হতে পারে।

চেরি আর কিছু জানতে চাইল না। সে চলে গেলে মিস মারপল চিঠিটা লিখতে বসলেন। প্রিয় মিস প্রেসকট,

আশা করি আমাকে মনে পড়বে। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের অনরোতে আপনাদের দুই ভাইবোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে চিঠি লিখছি। মিসেস ওয়াল্টার্স অর্থাৎ এসথার ওয়াল্টার্সের ঠিকানাটা আমার দরকার। তিনি মিঃ র‍্যাফায়েলের সেক্রেটারী ছিলেন। ক্যারিবিয়ানেই দেখেছিলেন তাকে।

বাগানের ব্যাপারে উৎসাহী জেনে তিনি কিছু গাছগাছড়ার ঠিকানা আমার কাছে চেয়েছিলেন। তখন সেটা দিতে পারিনি।

শুনেছি এসথার ওয়াল্টার্স আবার বিয়ে করেছেন। আপনি তার বিষয়ে নিশ্চয় খবর রাখেন? তার ঠিকানা জানালে বাধিত হব।

আশা করি বিরক্তির কারণ ঘটালাম না।

প্রীতিসহ
আপনার একান্ত
জেন মারপল

চিঠিটা ডাকে দেবার পর চটজলদি উত্তরও পেয়ে গেলেন মিস মারপল। সুন্দর একটা চিঠির সঙ্গে ঠিকানাটাও জানালেন তিনি।

মিস প্রেসকট জানালেন–

এসথার ওয়াল্টার্স সম্পর্কে বিশেষ কিছু শুনিনি। এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম তার নাম এখন মিসেস স্যাণ্ডারসন বা অ্যাণ্ডারসন। তার ঠিকানা এই সঙ্গে পাঠালাম। অ্যাল্টনের কাছে উইনস্লো লজে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

আমরা ইংলণ্ডের দুই প্রান্তের অধিবাসী। উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের দূরত্ব এমনই যে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ভাগ্যের দাক্ষিণ্য ছাড়া সম্ভব হবার নয়। আশা করি ভবিষ্যতে একদিন অবশ্যই দেখা হবে।

অ্যাল্টন খুব বেশি দূরে নয়। তবে ট্যাক্সিতে গেলে বেশ খরচ পড়বে। মিস মারপল ঠিক করলেন, চিঠি আর লিখবেন না। হয়তো এতদিনে মনেই করতে পারবে না। ওর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়াই বরং ভালো।

অবশ্য এটা ঠিক যে, ক্যারিবিয়ানে এসথারকে খুন হওয়া থেকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। যদিও এসথার তা বিশ্বাস করেনি। এখন তার কাছ থেকে কোন খবর বার করাও নিশ্চয় কষ্টকর হবে। অন্যভাবে সেই চেষ্টা করতে হবে।

.

পরদিন সকালেই ট্যাক্সিকে খবর দিয়ে রাখা হল। সাড়ে এগারটা নাগাদ ট্যাক্সি উপস্থিত হলে মিস মারপল চেরিকে বললেন, একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি এই নম্বরে ফোন করে দেখ মিসেস অ্যাণ্ডারসন আছেন কিনা। তিনি নিজে যদি ফোন ধরেন বলবে এক মিঃ ব্রডরিব তার সঙ্গে কথা বলতে চান। তোমাকে তার সেক্রেটারী বলে পরিচয় দেবে। আর যদি বাড়িতে না থাকেন, কখন ফিরবেন জেনে নিও।

নির্দেশ মতো ফোন করলো চেরি। জানা গেল, মিসেস অ্যাণ্ডারসন বাড়ি নেই। তবে দুপুরে খাওয়ার সময় ফিরে আসবেন।

মিস মারপল বললেন, ব্যাপারটা তাহলে সহজ হয়ে গেল। যাক..আমি ঘুরে আসি। কথা শেষ করে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন তিনি।

.

০৪.

 সুপারবাজার থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়ির দিকে যাবার সময় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আচমকা ধাক্কা লেগে গেল এসথার অ্যাণ্ডারসনের।

–মাপ করবেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইলেন তিনি। অন্য মহিলা সবিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন।

–মিসেস ওয়াল্টার্স না? কি আশ্চর্য। আমি জেন মারপল। ক্যারিবিয়ানে এক হোটেলে আমাদের দেখা হয়েছিল। বছর দেড়েক হবে

মিস মারপল, তাই তো আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল…আশ্চর্য।

খুব আনন্দ হলো দেখে। এদিকে এক বান্ধবীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারতে এসেছি। বিকেলে বাড়িতে থাকবেন তো কথা বলে আনন্দ করা যেত।

–খুব ভাল কথা–তিনটের পর চলে আসুন না।

.

এভাবে দেখা হয়ে যাবার নাটকীয় ব্যাপারটাতে এসথারের সন্দেহ করার কিছু ছিল না। এমন আকস্মিক দেখাসাক্ষাৎ তো পরিচিতদের মধ্যে যে কোন সময় হতেই পারে।

কাঁটায় কাঁটায় বিকেল তিনটেয় মিস মারপল উইনস্লো লজে উপস্থিত হলেন।

–পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কী যে ভাল লাগে। আপনার সঙ্গে লণ্ডনে বা হারডেও তো দেখা হতে পারতো। বললেন মিস মারপল।

-তাই তো। এটা তো আপনার এলাকা নয়–এখানে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে আশাই করিনি।

–এখান থেকে সেন্ট মেরী মিড বেশ দূর নয় অবশ্য, মাত্র পঁচিশ মাইল। আপনি এখানে থাকেন আমার ধারণাই ছিল না।

–বিয়ের পর অল্পদিন হল এখানে এসেছি।

–বিয়ে করেছেন কবে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

 –পাঁচ মাস হল। আমার বর্তমান নাম অ্যাণ্ডারসন।

মিসেস অ্যাণ্ডারসন? আপনার স্বামী?

–একজন ইঞ্জিনীয়ার…আমার চেয়ে বয়স একটু কম। বললেন এসথার।

–তাই ভালো। চমৎকার লাগছে আপনাকে। বাড়িটাও চমৎকার।

 মিস মারপল চারদিকে তাকিয়ে প্রাচুর্যের ছাপ উপলব্ধি করলেন। ঘরে দামী আসবাব, পরদা। মিস মারপল উপলব্ধি করলেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছ থেকে পাওয়া অর্থই নিশ্চয় এই প্রাচুর্যের কারণ।

এসথার জিজ্ঞেস করল, মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুর খবর নিশ্চয় কাগজে দেখেছেন?

–হ্যাঁ, মাসখানেক আগে দেখেছিলাম। খুবই দুঃখ পাই। অসাধারণ মানুষ ছিলেন।

-সত্যিই এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। যথেষ্ট ভালো মাইনে আমাকে দিতেন। তবু বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ আমাকে দিয়ে যান।

–ওরকম মনুষই ছিলেন তিনি, বললেন মিস মারপল, তাঁর সেই লোকটি…কি যেন নাম…

–মিঃ জ্যাকসনের কথা বলছেন।

–হ্যাঁ, হা,–মিঃ র‍্যাফায়েল তাকেও কিছু দিয়ে গেছেন নাকি?

-না, জ্যাকসনকে কিছু দিয়ে যাননি। তবে গতবছর তাকে কিছু চমৎকার উপহার দিয়েছিলেন।

-জ্যাকসনের সঙ্গে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়?

–দ্বীপ থেকে আসার পর হয়নি। মনে হয় ইংলণ্ডে ফিরে মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে ছিল না। শুনেছিলাম জার্সি বা গুয়ের্নসির এক লর্ডের কাছে কাজ করছেন।

–মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে একবার দেখা হলে খুব খুশি হতাম। একটা সময় আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি অথচ কিছুই জানি না তার সম্বন্ধে। তিনি মস্ত ধনী ছিলেন, সকলের মত কেবল একথাই আমিও জানি। ওর ছেলেমেয়ে স্ত্রী এঁরা…

হাসলেন এসথার অ্যাণ্ডারসন। বললেন, উনি বিপত্নীক ছিলেন। সম্ভবত বিয়ের কিছুকাল পরেই তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল।

-খুবই দুঃখের কথা। ওঁর ছেলেমেয়ে ছিল?

–হ্যাঁ, দুই মেয়ে এক ছেলে। এক মেয়ে বিবাহিত, এখন আমেরিকায় আছে। অন্যটি অল্প বয়সেই মারা যায়। ছেলের প্রসঙ্গ মিঃ র‍্যাফায়েল কখনো তুলতেন না। মনে হয় বড় রকমের কোন গোলমাল ছিল। শুনেছি সে বছর কয় আগে মারা গেছে।

-ওহ–খুবই দুঃখের কথা। –

-আমার ধারণা ছেলেটি বিদেশে কোথাও চলে গিয়েছিল…সেখানেই মারা যায়।

–ছেলের সম্বন্ধে তিনি কিছুই বলতেন না? আপনি তো বহুদিন তার সেক্রেটারী ছিলেন

–অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত কোন কথাই প্রায় বলতেন না। সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান ছিল কেবল ব্যবসা আর অর্থ। এডমণ্ডের সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক মাস পরেই আমি তার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম।

-আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় অপরাধ বিষয়ে মিঃ র‍্যাফায়েলের কোন আগ্রহ ছিল?

ক্যারিবিয়ানে যা ঘটেছিল, সেজন্য আপনার কথাটা মনে হয়েছে নিশ্চয়ই?

–ঠিক তা নয়, বললেন মিস মারপল, আমার ধারণা হয়েছিল ন্যায়-অন্যায় বিষয় নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন।

–ওসব বিষয়ে তার মাথা ঘামাবার সময় কোথায়। সেই অনরের ঘটনা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না।

-আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি শুধু তার আগ্রহের বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।

–অর্থকরী বিষয় ছাড়া কোন বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল না।

আরও দু-চার কথার পর মিস মারপল তার ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

–আবার চাকরির কথা ভাবছেন না তো? বললেন তিনি।

–তার প্রয়োজন মিঃ র‍্যাফায়েলই মিটিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি আমাকে যা দিয়ে গেছেন তা আমি উপভোগ করতে চাই।

এরপর বিদায় নিয়ে মিস মারপল রাস্তায় নেমে এলেন। চলতে চলতে সব ব্যাপারটা নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন।

মিঃ র‍্যাফায়েল অদ্ভুত একটা ছকের মধ্যে তাকে গেঁথে ফেলেছেন। তার এই পরিকল্পনা ছকবার সময়ে মনের অবস্থা কেমন ছিল তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাও তার মনে পড়ল। সেখানকার কেউ অথবা কিছু কি এর সঙ্গে জড়িত? কিংবা এখানেই কি কোন যোগসূত্র আছে। নইলে এসথারের কথাই বা হঠাৎ তার মনে হবে কেন? মিঃ রাফায়েল যে তাকে নিয়ে কোন তামাশা করতে চেয়েছেন, এমন মনে হল না তার।

পাম হোটেলের সঙ্গে কোন যোগসূত্রের সম্ভাবনা যাচাই করার উদ্দেশ্যেই এসথার ওয়াল্টার্সের কথা মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না এখানে।…কাজ শুরু করার মত কোন সূত্রই এখনও পর্যন্ত পাননি তিনি।

বাড়ি ফিরে রাতে বিছানায় আশ্রয় নেবার আগে তিনি স্বগতোক্তি করলেন–মিঃ রাফায়েল, আমার ক্ষমতার মধ্যে যা আছে তাই আমি করবার চেষ্টা করছি। অবশিষ্ট যা করণীয় তা আপনার।

.

০৫.

 চারদিন পরে দ্বিতীয় খাম এল মিস মারপলের নামে।

খাম খুলে তিনি চিঠিটা পড়লেন–

প্রিয় মিস মারপল,
আমি নিশ্চিত, এই চিঠি যখন আপনি পড়বেন আমি তখন করবে শায়িত। ভস্মীভূত হলে যে সম্ভাবনা থাকে না অর্থাৎ ছাইয়ের মধ্য থেকে উঠে এসে কাউকে ভয় দেখানো সম্ভব হয় না। কিন্তু সমাধিক্ষেত্র থেকে উঠে এসে ভয় দেখানো খুবই সম্ভব। তা না করতে চাইলেও, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা আমার হতে পারে।

ইতিমধ্যে আমার সলিসিটরের মাধ্যমে আপনি নিশ্চয় আমার বিশেষ প্রস্তাব পেয়ে থাকবেন। আমার বিশ্বাস, আপনি সেটা গ্রহণ করেছেন। অবশ্য এব্যাপারটা আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরেই সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছি।

আমার সলিসিটরদের যেভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে যদি তারা তা যথাযথ সম্পাদন করে তাহলে এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছবার কথা এমাসের ১১ তারিখে। আজ থেকে দুদিন পরে আপনি লণ্ডনের কোন ভ্রমণসংস্থার কাছ থেকে সংবাদ পাবেন। আমার ধারণা ওদের প্রস্তাব আপনার খারাপ লাগবে না। এব্যাপারে আপনি নিশ্চয়ই ভোলা মন রাখবেন। তবে, এটুকুই কেবল আমার বলার যে, নিজের সম্বন্ধে সতর্ক থাকবেন। আপনি বিচক্ষণ, আমি জানি আপনি তা পারবেন।

আপনার শুভ হোক। আর শুভ দেবদূতেরা পাশে থেকে আপনাকে রক্ষা করুন। তা আপনার প্রয়োজন হতে পারে। —
আপনার প্রিয় বন্ধু
জে. বি. র‍্যাফায়েল

 এই চিঠি পাবার ঠিক দুদিন পরেই ডাক বিভাগ গ্রেট ব্রিটেনের ফেমাস হাউসেস অ্যাণ্ড গার্ডেনস-এর একটি চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে দিল।

চিঠিটি এরকম :

প্রিয় মিস মারপল,
প্রয়াত মিঃ র‍্যাফায়েলের কৃত ব্যবস্থা অনুযায়ী আমাদের ৩৭ নং ভ্রমণ সূচীর বিবরণ আপনাকে পাঠালাম। আগামী বৃহস্পতিবার ১৭ই তারিখে লণ্ডন থেকে এই ভ্রমণযাত্রা শুরু হবে।

আপনার পক্ষে যদি আমাদের লণ্ডন অফিসে আসা সম্ভব হয়, এই ভ্রমণের সহযোগী মিসেস স্যাণ্ডবার্ন সকল বিবরণ জানাতে পেরে সুখী হবেন।

আমাদের ভ্রমণের সময়কাল দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে স্থায়ী হয়। মিঃ র‍্যাফায়েলের মতে এই বিশেষ ভ্রমণ আপনার কাছে খুবই গ্রহণীয় হবে। কেননা ইংলণ্ডের যে এলাকা দেখানো হবে সম্ভবতঃ তা আপনার অদেখা। চমৎকার দৃশ্য ও বাগান দেখবার সুযোগ রয়েছে। তিনি আমাদের পক্ষে আনুষঙ্গিক সর্বোত্তম ব্যবস্থারই বন্দোবস্ত করে গেছেন।

আমাদের বার্কলে স্ট্রিটের অফিসে কবে আপনার পক্ষে আসা সম্ভব জানালে বাধিত হব।

চিঠিটা সযত্নে ভাঁজ করে রেখে মিস মারপল সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর দুই বান্ধবীকে ফোন করলেন। তিনি জানতেন তারা আগে ফেমাস হাউসেস অ্যাণ্ড গার্ডেনসের সঙ্গে ভ্রমণে গেছিলেন।

বন্ধুদের দুজনেই জানিয়ে দিলেন এই ভ্রমণসংস্থার ব্যবস্থাদি খুবই ভাল তবে যথেষ্ট ব্যয়বহুল।

এরপর তিনি বার্কলে স্ট্রিটে ফোন করে জানিয়ে দিলেন, সামনের মঙ্গলবারে তিনি তাদের দেখা সঙ্গে করবেন।

.

মঙ্গলবারে নিজের সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে চেরিকে সব বুঝিয়ে দিয়ে মিস মারপল লণ্ডনে গেলেন। সেখানে এক সাধারণ হোটেলে ঘর নিলেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে ট্যাক্সি ধরে বার্কলে স্ট্রিটের অফিসে পৌঁছলেন।

বছর পঁয়ত্রিশ বয়সের এক সুদর্শনা মহিলা তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। মহিলার নাম মিসেস স্যাণ্ডবার্ন। বিশেষ ভ্রমণ তারই তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হবে।

প্রাসঙ্গিক দুচার কথার পরে মিসেস স্যাণ্ডবার্ন জানালেন, মিঃ র‍্যাফায়েল এই বিশেষ ভ্রমণের সমস্ত খরচ মেটানোর ব্যবস্থা করে গেছেন।

-আপনারা জানেন যে তিনি মারা গেছেন? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-হ্যাঁ। কিন্তু এ ব্যবস্থা তিনি মৃত্যুর আগেই করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, তার শরীরের অবস্থা ভাল নয়, তাই বন্ধুর জন্য একটু ভ্রমণের ব্যবস্থা করে যেতে চান।

.

বৃহস্পতিবার দিনে বিশেষ ভ্রমণযাত্রা শুরু হল। খুব আরামপ্রদ আর বিলাসবহুল এক গাড়িতে ভ্রমণার্থীরা উঠে বসলেন। লণ্ডনের বাইরের উত্তর-পশ্চিম দিকের পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল।

নিজের সিটে বসে মিস মারপল যাত্রী তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিতে লাগলেন। ভ্রমণের দর্শনীয় স্থান ও দৈনন্দিন খুঁটিনাটিও তাতে লেখা ছিল।

মিসেস রাইজেল পোর্টার
 মিস জোয়ানা ক্রফোর্ড
কর্নেল ও মিসেস ওয়াকার
 মিঃ ও মিসেস এইচ. টি. বাৰ্টলার
 মিস এলিজাবেথ টেম্পল
প্রফেসর ওয়ানস্টেড
মিঃ রিচার্ড জেমসন
 মিস লুমলি
 মিস বেন্থাম
মিঃ ক্যাসপার
মিস কুক
মিস ব্যারো
মিঃ এমলিন প্রাইস
মিস জেন মারপল

এই হল ভ্রমণার্থী তালিকা। তাদের মধ্যে তাকে নিয়ে চারজন বয়স্ক মহিলা। মিস স্যাণ্ডবার্ন আর তাকে বাদ দিয়ে মোট পনেরো জন যাত্রী।

মিস মারপল ভাবলেন, এই পনেরো জন যাত্রীর কোন ব্যাপারে অবশ্যই গুরুত্ব আছে। সেই কারণেই এই কোচে তার ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়তো কোন খবরের যোগসূত্র কিংবা অপরাধের সূত্র এখানে পেয়ে যেতে পারেন।

খোদ খুনীকে পাওয়াও অসম্ভব নয়। এই হত্যাকারী হয়তো ইতিমধ্যে কোন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিংবা সম্ভাব্য খুনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। মিঃ র‍্যাফায়েল হয়তো এভাবে তার বুদ্ধিবৃত্তির পরীক্ষা করে থাকবেন–অসম্ভব নয় কিছু।

মিস মারপল ভাবলেন, এই লোকগুলো সম্পর্কে তার খাতায় টুকে রাখবেন।

অন্য যে দুজন ভদ্রমহিলা আলাদা ভাবে ভ্রমণ করছেন, তাদের দুজনেরই বয়স ষাটের কাছাকাছি। একজন বেশ সুবেশা। তার সঙ্গে রয়েছে আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ে। মহিলার ভাইঝি। মেয়েটি মহিলাটিকে ডেরালডাইন পিসি বলে সম্বোধন করছে। মেয়েটি সুদর্শনা আর বেশ স্মার্ট।

মিস মারপলের সামনে বসেছিলেন মেদবহুল বড়সড় চেহারার একজন মানুষ। মুখখানা গোলাকৃতি হতে হতে কেমন চৌকো হয়ে গেছে। মাথায় ধূসর ঘন চুল, ঘন লোমশ ভ্র।

ভদ্রলোকের পাশেই বসেছিলেন একজন দীর্ঘাকৃতি বিদেশী। অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাত মুখ নেড়ে অনর্গল কথা বলে চলেছেন সহযাত্রীর সঙ্গে।

কখনো ইংরাজি, কখনো ফরাসী বা জার্মান ভাষা বেরিয়ে আসছ তার মুখ থেকে। মেদবহুল ভুরুর মানুষটি একই ভাবে নানা ভাষায় সঙ্গীর কথার জবাব দিয়ে চলেছেন।

আকার-আকৃতি দেখে মিস মারপলের ধারণা হল মেদবহুল ভদ্রলোক নিশ্চয় প্রফেসর ওয়ানস্টেড হবেন। আর অদ্ভুত বিদেশীটি মিঃ ক্যাসপার। ওই দুজনের সামনে ষাট বছর বয়সী মহিলাটি বেশ দীর্ঘাঙ্গী। এ বয়সেও যথেষ্ট সুন্দরী। বেশ লক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। নিচু কণ্ঠে কথা বলছেন।

কোচে দুজোড়া দম্পতি রয়েছেন। একজন আমেরিকান, মধ্যবয়স্ক, স্ত্রীর অনুগত বোঝা যাচ্ছে। স্ত্রীটি বেশ বাঁচাল।

অন্য দম্পতি ইংরাজ। মধ্যবয়স্ক। ভদ্রলোককে একজন সেনাবাহিনীর মানুষ বলেই মনে হল মিস মারপলের। তিনি তাঁর নোটবইতে এই দুজনকে কর্ণেল আর মিসেস ওয়াকার বলে দাগ দিলেন।

এদের পেছনে দীর্ঘ কৃশ আকৃতির একজন প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ে কথা বলে চলেছিলেন। ইনি একজন স্থপতি হওয়া সম্ভব।

কোচের শেষপ্রান্তে বসেছিলেন দুজন মধ্যবয়স্কা মহিলা–তারা একসঙ্গে ভ্রমণ করছেন। একজনের বেশ আটোসাঁটো চেহারা। এই মহিলাটিকে মিস মারপলের কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। কোথায় দেখেছেন, মনে করতে পারছিলেন না।

অবশিষ্ট যাত্রীটি একজন তরুণ। বয়স কুড়ির বেশি হবে না। ছেলেটি সেই ভাইঝি তরুণীকে আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিল। ভাইঝিটির চোখেও সমান আগ্রহ লক্ষ্য করলেন মিস মারপল।

মধ্যাহ্ন ভোজ সারার জন্য নদীর কাছাকাছি একটা সুন্দর হোটেলে যাত্রার বিরতি ঘটল। বিকেলের ভ্রমণসূচীতে রয়েছে ব্লেনহীম।

হোটেলে পৌঁছনোর পরে যাত্রীরা পরস্পরের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলেন।

মিস মারপল ইতিমধ্যে যাত্রীদের নাম জেনে নিয়েছেন। মেদবহুল লোমশভুরুর মানুষটি প্রফেসর ওয়ানস্টেড–যেরকম তিনি ভেবেছিলেন। বিদেশীটি হলেন মিঃ ক্যাসপার।

কর্তৃত্বব্যঞ্জক চেহারার মহিলাটি মিসেস রাইজেল পোর্টার। আর ভাইঝিটি জোয়ানা ক্রফোর্ড। তরুণটির নাম এমলিন প্রাইস।

ইতিমধ্যে এই দুই তরুণ-তরুণী তাদের পছন্দ অপছন্দ, রাজনীতি, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে মতামত বিনিময় করে পরস্পরের কাছাকাছি হয়ে পড়েছে।

মধ্যবয়স্কা যে দুই মহিলা একসঙ্গে ভ্রমণে এসেছিলেন তারা হলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো। ওই মিস কুককেই মিস মারপলের পরিচিত মনে হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় তাকে দেখেছেন তিনি তা মনে করতে পারছিলেন না।

তিনি লক্ষ্য করলেন, মিস কুকও যেন তাকে কেমন এড়িয়ে চলতে চাইছেন। তবে এটা তাঁর কল্পনাও হতে পারে।

এই পনেরো জন অপরিচিত মানুষের, মিস মারপল ভাবলেন, অন্তত একজন অবশ্যই কোন ব্যাপারে জড়িত।

সুন্দরী মহিলটির পরিচয় জানা গেল, মিস এলিজাবেথ টেম্পল বলে। তিনি এক বিখ্যাত মেয়েদের স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা।

আর কৃশ চেহারার তরুণটি রিচার্ড জেনসন, একজন স্থপতি।

 মিস মারপলের মনে হলো একমাত্র বিদেশী ভদ্রলোক মিঃ ক্যাসপারই এখানে স্বাভাবিক হাসিখুশি মানুষ। অন্য সকলের মুখেই যেন অজ্ঞাত কিছুর অদৃশ্য ক্ষীণ ছায়া লেগে রয়েছে।

.

রাতে শুতে যাবার আগে যাত্রীদের যাচাই করে তার যা যা মনে হয়েছে তা নোটবুকে টুকে নিলেন।

মিস রাইজেল পোর্টার–অতন্ত আত্মকেন্দ্রিক। খুনের সঙ্গে জড়িত থাকা অসম্ভব। তবে কোন সূত্রের সন্ধান তার কাছে থাকা সম্ভব।

ভাইঝি, জোয়ানা ক্রফোর্ড–অত্যন্ত চৌখস।

মিস এলিজাবেথ টেম্পল–আগ্রহ জাগানো ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত সৎ বলেই মনে হয়। এমন একজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটুক–হয়তো মিঃ র‍্যাফায়েলের তাই ইচ্ছা ছিল।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড–কোন বিজ্ঞানী হওয়াই সম্ভব। অথবা ডাক্তার।

মিঃ ও মিসেস বাৰ্টলার–চমৎকার আমেরিকার মানুষ। এদের নাম দুটি কেটে দিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের কারও সঙ্গে এদের কোন যোগসূত্র থাকা সম্ভব মনে হল না তার।

রিচার্ড জেনসন-স্থপতি। এর মধ্যে স্থপতি বিদ্যার স্থান কিভাবে হতে পারে বুঝতে পারলেন না মিস মারপল। কোন গোপন সুড়ঙ্গের অবস্থানের ইঙ্গিত কি পাওয়া সম্ভব তার কাছ থেকে? হয়তো সেটা খুঁজে পেতে তিনি সাহায্য করতে পারেন।

মিস বুক ও মিস ব্যারো–অতি সাধারণ দুজন মানুষ। কিন্তু মিস কুককে আগে কোথাও দেখা গেছে। একসময় ঠিক মনে পড়ে যাবে।

কর্ণেল আর মিসেস ওয়াকার–অবসরপ্রাপ্ত সামরিক মানুষ। এদের কাছে কিছু নেই। মিস বেন্থাম আর মিস মলি–এই দুই বুড়ীকে অপরাধী হিসেবে ভাবা যায় না। তবে বয়স এদের প্রচুর ঘটনার কথা বা বিষয় নিশ্চয় জানিয়েছে। কোন দরকারী সূত্র এদের কাছ থেকে পাওয়া অসম্ভব নয়।

মিঃ ক্যাসপার–অত্যন্ত উত্তেজনাপ্রবণ এক মানুষ। মারাত্মক চরিত্র বলেই মনে হয়। মিস মারপল এই মানুষটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখলেন।

এমলিন প্রাইস–সম্ভবতঃ এখনো ছাত্রজীবন কাটেনি। সময় বিশেষে ছাত্ররাও হিংস্র হতে পারে।

পর্যালোচনার ফাঁকে ফাঁকে কোন হত্যাকারীর কথাই মাথায় ঘুরছিল মিস মারপলের। সম্ভাব্য নিহত ব্যক্তিটি কে হওয়া সম্ভব বা তার ব্যাপার কি হতে পারে–এই কোচের মানুষদের মধ্যে কার পক্ষে সম্ভাব্য শিকার হওয়া সম্ভব?

কাউকেই সেভাবে বেছে নিতে পারলেন না মিস মারপল।

তবে মিস পোর্টার হওয়া অসম্ভব না। তিনি অর্থবতী, ফলে কিছুটা অপ্রিয়ও। ভাইঝিটি উত্তরাধিকার পেতে পারে। কিন্তু তবু খুনের কোন সূত্রের আভাস তাঁর চোখে পড়ল না।

চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। আর বসে থাকতে পারলেন না মিস মারপল। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।