৩. ইলিয়ার মৃত্যুর পর

তৃতীয় পর্ব

০১.

ইলিয়ার মৃত্যুর পর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এমন অভাবিত ঘটনা আমাকে মানসিকভাবে বিবশ করে ফেলল। ফলে পরবর্তী সব ঘটনাই আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে লাগল। অনেক কিছুই ঘটে চলল আমাকে কেন্দ্র করে।

সব ঘটনাই আমার স্পষ্ট মনে আছে। তাই লিখতে কোন কষ্ট হচ্ছে না।

ইলিয়ার মৃত্যুতে সকলেই আমাকে সমবেদনা জানালেন। আমি বিমূঢ় বিভ্রান্ত। কি করব কি বলব কিছুই স্থির করতে পারছিলাম না। 

গ্রেটাই এগিয়ে এসে আমার হয়ে সবকিছু সামাল দিল। প্রিয় বান্ধবীকে হারিয়ে সে-ও শোকগ্রস্ত। কিন্তু নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখতে পেরেছিল সে।

খুব দ্রুত ইলিয়ার মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। আমি ফিরে এলাম বাড়িতে। আমার সঙ্গে এসেছিলেন ডাক্তার শ।

তিনি অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গেই পরবর্তী কর্তব্যগুলো যেমন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন, তার জন্য তোকজনের ব্যবস্থা, করোনারের বিচার ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে একসময় বিদায় নিয়েছিলেন।

.

করোনারের বিচার সভায় সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমাকে আমার নিজের পরিচয় জানাতে হল। পরে ইলিয়ার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎকারের বিবরণ তিনি মনোযোগ সহকারে শুনলেন। জর্জ হোটেলে যে সেদিন আমার সঙ্গে ইলিয়ার লাঞ্চ খাবার কথা ছিল সে-কথাও জানালাম। ইলিয়ার শারীরিক সুস্থতা এবং অন্যান্য অনেক বিষয়েই আমাকে অনেক রকম প্রশ্ন করা হল।

ডাক্তার শ-ও সাক্ষ্য দিলেন। ইলিয়ার শরীরে কোন রকম আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কেবল ডান কাঁধের হাড় সামান্য মচকে গিয়েছিল। আর ঘোড়া থেকে পড়ে যাবার জন্য শরীরে সামান্য কাটা-ছেঁড়ার চিহ্ন ছিল। সবমিলিয়ে এটাই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল–ইলিয়ার মৃত্যু হয়েছিল খুবই আকস্মিকভাবে। ডাঃ শয়ের মতে, আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই ইলিয়ার মৃত্যু ঘটেছিল।

গ্রেটা তার সাক্ষ্যে জানাল, বছর তিন-চার আগে ইলিয়া একবার গুরুতর হার্টের অসুখে ভুগেছিল সে তার আত্মীয়-স্বজনের মুখে শুনেছিল। সে বেশ জোরের সঙ্গেই জানাল ইলিয়ার হার্টের অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। তবে অসুখটা কি ধরনের সে সম্পর্কে সে বিশেষ কিছু বলতে পারল না।

যে সমস্ত গ্রামবাসী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়েছিল, একে একে তাদের সাক্ষ্যও নেওয়া হল। তাদের অনেকেই শেটল গ্রামের মিঃ ক্যারী নামের ঘোড়াটার মালিককে চিনত। তিনিই ছিলেন ইলিয়ার ঘোড়ার প্রাক্তন মালিক।

গ্রামবাসীরা জানাল, ঘোড়াটা ছিল খুবই শান্তশিষ্ট। যে কোন মহিলাই নিশ্চিন্তে তার সওয়ার হতে পারত।

করোনার পুলিসের কাছে জানতে চেয়েছিলেন জিপসি বুড়ি বলে পরিচিত মিসেস লীকে কোর্টে কেন হাজির করা হয়নি।

পুলিসের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, তার কোন খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। ঝুপড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে সে কোথায় গেছে সেকথাও কেউ জানাতে পারেনি। তবে প্রায়ই নাকি সে এভাবে বেপাত্তা হয়ে যায় কিছুদিনের জন্য।

দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই নাকি বুড়ির কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না।

বুড়ি লী সম্পর্কে করোনার আমাকেও প্রশ্ন করেছিলেন। সে যে আমার স্ত্রীকে নানাভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতো, আমি স্পষ্ট ভাবেই সেকথা জানালাম। অথচ আমার স্ত্রীর ওপর তার রেগে যাবার মত কোন ঘটনাই কখনো ঘটেনি।

সাক্ষীসাবুদের কাজ শেষ হলে সেদিনের মত আদালতের কাজ শেষ করে করোনার ঘোষণা করেছিলেন দু-সপ্তাহ পরে আবার শুনানী হবে। ইতিমধ্যে মিসেস লীর সন্ধান করবার জন্য তিনি পুলিসকে নির্দেশ দিলেন।

.

০২.

 মেজর ফিলপট অনেক দিন থেকেই জিপসি বুড়িকে জানতেন। গ্রামে তার বসবাসের ব্যবস্থা তিনিই করে দিয়েছিলেন।

করোনারের বিচারের পরদিন আমি মেজরের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে আমার সন্দেহের কথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, অন্ধ ঘৃণার বশে বুড়ি লী কি এরকম একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মেজর বললেন, ইলিয়ার মত শান্তশিষ্ট মেয়ের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে হলে খুব জোরালো কারণ থাকা উচিত। তুমি নিজেই ভেবে দেখো না, সে-রকম কোন কারণ কি ঘটেছিল?

আমি বললাম, সে-রকম কিছু পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তো আমি অনেক চিন্তা করেও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।

অথচ বুড়ি যে মাঝে মাঝেই যাতায়াতের পথে হাজির হয়ে ইলিয়াকে ভয় দেখাতে, তাকে এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতো তার সাক্ষী আমি নিজেই।

ইলিয়া এখানে সম্পূর্ণ নবাগত। তার প্রতি বুড়ির ব্যক্তিগত কোন বিদ্বেষ থাকাও সম্ভব নয়।

মেজর বললেন, ব্যাপারটা একারণেই রহস্যময়। এমন একটা রহস্য ঘটনার পেছনে কাজ করছে যার হদিস এখনো আমরা পাইনি।

আচ্ছা, বিয়ের আগে তোমার স্ত্রী কখনো এই অঞ্চলে বাস করতে এসেছিল কিনা সে সম্পর্কে তোমার কিছু জানা আছে?

মেজরের প্রশ্নটা শুনে আমি অকস্মাৎ অদ্ভুতভাবে অট্টহাস্য করে উঠলাম। সেই হাসি আমাকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল। সাময়িকভাবে আমি যেন আমার ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আমার এই অস্বাভাবিক আচরণেও মেজরের প্রশান্ত মুখে কোন ভাবান্তর ঘটেনি। তিনি ছিলেন যথার্থই দয়ালু ব্যক্তি। সহৃদয়তার সঙ্গেই আমাকে বিবেচনা করছিলেন।

সামলে ওঠার পরে আমি মেজরকে বললাম, এই জিপসি একরেই ইলিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল।

নিলামের নোটিশ থেকে টাওয়ার নামের প্রাচীন সৌধটা বিক্রির কথা জানতে পেরেছিলাম। হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম।

জায়গাটা নিজের চোখে দেখার জন্যই একদিন হাঁটতে হাঁটতে জিপসি একরে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম।

একটা ছায়ায় ঢাকা অন্ধকার পথে গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল ইলিয়া–তখনই আমার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়।

পরে সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠ হলে আমরা জিপসি একরে নিরিবিলি বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করেছিলাম। আমার মত ইলিয়াও সেই প্রথম জিপসি একরে এসেছিল।

–জায়গাটা যে অভিশপ্ত একথা নিশ্চয় তুমি শুনেছিলে? তুমি সেকথা বিশ্বাস করতে?

–শুনেছিলাম, এখানে পা দেবার আগেই। কিন্তু এ সম্পর্কে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা আমি নিজেই জানি না। তবে ব্যাপারটাকে একটা অন্ধ কুসংস্কার বলে প্রাণপণে বিশ্বাস করবার চেষ্টা করতাম।

আমার মানসিক অবস্থার কথা হয়তো ইলিয়া বুঝতে পেরেছিল। একটা আশঙ্কার ছায়া ওর মনেও রেখাপাত করেছিল।

সেকথা, জানতে পেরে, আমার বিশ্বাস, ইচ্ছাকৃতভাবেই কেউ ওকে আতঙ্কিত করে তোলার চেষ্টা করেছিল।

–কে তাকে ভয় দেখাতে পারে বলে তুমি মনে কর?

 –একথা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তবে জিপসি বুড়ি মাঝে মাঝেই সুযোগ বুঝে ইলিয়ার পথের ওপরে এসে দাঁড়াত, জিপসি একর ছেড়ে যাবার জন্য তাকে ভয় দেখাত।

মেজর বললেন, তোমার কাছ থেকে এই ঘটনার কথা জানার পর আমি বুড়িকে ডেকে বেশ কড়া করে ধমকেও দিয়েছিলাম।

–কিন্তু বুড়ির এরকম আচরণের পেছনে কারণটা কি হতে পারে, সেসম্পর্কে আপনার ধারণাটা কি?

-দেখ রজার, বুড়িকে আমি খুব ভালভাবে জানি। নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করার একটা ঝোঁক ওর মধ্যে বরাবর কাজ করত। ওর আচার-আচরণের মধ্যে সেই ভাবটা প্রকাশ পেত।

কাউকে অকারণে শঙ্কিত করে তুলে, কাউকে আশার কথা শুনিয়ে, কাউকে ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নের কথা বলে এমন একটা ভাব প্রমাণ করবার চেষ্টা করত যেন মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ সবই সে পরিষ্কার দেখতে পায়।

–শুনেছি বুড়ি নাকি খুবই অর্থলিলু। এমনও তো হতে পারে, কেউ হয়তো টাকার প্রলোভন দেখিয়ে বুড়িকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে।

আমার কথায় সায় দিয়ে মেজর বললেন, হ্যাঁ, বুড়ির খুব অর্থলালসা ছিল। তোমার আশঙ্কাটাকে একারণেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এরকম সম্ভাবনার কথা তোমার মাথায় এলো কেন?

আমি বললাম, সার্জেন্ট কীন একবার কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। তা থেকেই এই ভাবনাটা আমার মাথায় এসেছে।

-কিন্তু রজার, দ্বিধাগ্রস্তভাবে মাথা নেড়ে মেজর বললেন, বুড়ি এন্তার ভয় দেখানোর ফলে তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটল, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

–বুড়ি হয়তো ভাবতেই পারেনি এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে হয়তো ভেবেছিল, পথের মাঝখানে ঘোড়াটাকে আচমকা চমকে দিয়ে খানিকটা মজা করবে। আর একটা ঘোড়াকে অনেক রমক ভাবেই চমকে দেওয়া সম্ভব।

একটু থেমে আমি আবার বললাম, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, ইলিয়ার ওপরে বুড়ির কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল। কিন্তু বিদ্বেষের কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে এ জায়গাটা তো ইলিয়ার ছিল না, খরিদ করে দখল নিয়েছিল।

তা নিয়েছিল। এটাও সত্য কথা এককালে জিপসিদের এ-অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পছন্দমত ফাঁকা জমি পেলেই ওরা ডেরা বেঁধে বসবাস শুরু করতো। জমির মালিকের অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করত না। এখানেও সেভাবেই আস্তানা গেড়েছিল। কিন্তু পরের জমি থেকে উৎখাত হয়ে যে বরাবরের মত কোন রাগ পুষে রাখবে–এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

আমি বললাম, একথা আমিও ভেবে দেখেছি। তবে টাকা দিয়ে বশ করে বুড়িকে লেলিয়ে দেওয়া কষ্টকর বলে মনে হয় না। আমার মনে হচ্ছে এরকমই কিছু ঘটে থাকবে।

মেজর বললেন, কিন্তু কোন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বুড়িকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে যদি ধরেও নেওয়া হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে বলে তুমি মনে কর?

আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলাম। পরে মেজরকে বললাম, কারণ হিসেবে অনেক সম্ভাবনার কথাই তো মনে করা যেতে পারে।

সার্জেন্ট কীন যে ইঙ্গিতটা করেছিলেন,-এ-অঞ্চল থেকে আমাদের যদি কেউ উৎখাত করতে চায় তাহলে তার পক্ষে ইলিয়াকেই বেছে নেওয়া স্বাভাবিক।

কারণ আমার চেয়ে ইলিয়াকে ভয় পাইয়ে দেওয়া অনেক সহজ। আর আমরা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে গেলে জমিটা আবার নিলামে উঠবে। অজ্ঞাতনামা সেই ব্যক্তি হয়তো বিশেষ কোন কারণে জায়গা কিনে নিতে চায়।

সম্ভাবনাটার পেছনে যুক্তি আছে ঠিকই তবে আমার কাছে কেমন কষ্টকল্পনা মনে হচ্ছে।

–এমনও তো হওয়া অসম্ভব নয়, ধরুন জমিটার নিচে কোন মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে। আর এই সংবাদ সেই ব্যক্তি ছাড়া অপর কেউ জানে না। তাছাড়া কোন গুপ্তধন হয়তো পোঁতা আছে।

মেজর ফিলপট কোন মন্তব্য না করে কেবল গম্ভীর ভাবে হুঁ, শব্দ উচ্চারণ করলেন।

–অথবা, আমি পুনরায় বললাম, এমনও হতে পারে, যে বুড়িকে পরিচালিত করেছে সে হয়তো ইলিয়ারই কোন আত্মপক্ষ।

–সেই শত্রুপক্ষ কে হতে পারে সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই।

-না। কেননা আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এ অঞ্চলের কারুর সঙ্গেই ইলিয়ার পূর্বে কোন সম্পর্ক ছিল না।

এরপর মেজরকে তাঁর সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।

পরক্ষণেই একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে আবার চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বললাম, সার্জেন্ট কীনের কাছেই জিনিসটা নিয়ে যাচ্ছিলাম। তদন্তের ব্যাপারে হয়তো তার কাজে লাগতে পারে। আপনাকেও দেখিয়ে নিয়ে যাই।

আমি পকেট থেকে কাগজমোড়া একটুকরো পাথর বের করে টেবিলের ওপরে রাখলাম।

–এই কাগজ সমেত পাথরটা সকালে প্রাতঃরাশের সময় সার্শি ভেঙ্গে ঘরের মধ্যে এসে পড়েছিল। আমরা যেদিন এখানে প্রথম আসি সেদিনও এমনও ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন অবশ্য পাথরে কাগজ মোড়া ছিল না। কাজটা একই লোকের কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

বলতে বলতে পাথরে মোড়া কাগজটা খুলে আমি মেজরের দিকে এগিয়ে দিলাম। কাগজের গায়ে এক লাইনের একটা কথা টাইপ করা ছিল।

মেজর চোখে চশমা লাগিয়ে কাগজটা চোখের ওপর তুলে ধরলেন। পড়লেন ধীরে ধীরে–যে আপনার স্ত্রীকে খুন করেছে সে একজন স্ত্রীলোক।

মেজরের ভ্রূজোড়া কুঞ্চিত হল। কপালের রেখায় ভাঁজ পড়ল। চিন্তিতভাবে তিনি বললেন, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার দেখছি।

আচ্ছা, এর আগে মরা পাখির গায়ে বিদ্ধ ছুরির ডগায় লাগানো যে চিরকুটটা তুমি পেয়েছিলে সেটাও কি টাইপ করা ছিল?

বললাম, এখন আমার ঠিক মনে নেই। চিরকুটের বয়ানটাও ভুলে গেছি। তবে এটুকু মনে আছে, আমাদের এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল।

সেটা স্থানীয় কোন গুণ্ডাশ্রেণীর লোকের কাজ বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বক্তব্য সম্পূর্ণ আলাদা।

–এটা যে ছুঁড়েছে, বোঝা যাচ্ছে সে বর্তমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তাই না?

–ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সেকারণেই সার্জেন্ট কীনের নজরে আনার কথা ভেবেছি। চিরকুটটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে মেজর বললেন, তুমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ। এ ব্যাপারে সার্জেন্ট কীনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।

মেজর ফিলটনের কাছ থেকে সরাসরি থানায় চলে এলাম। সার্জেন্টকেও পাওয়া গেল। ঘটনাটা শুনে তিনিও যথেষ্ট আগ্রহান্বিত হয়ে উঠলেন।

বললেন, এতদিনের শান্ত নিরুপদ্রব এই জায়গাতেও বেশ অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে দেখছি।

–এর পেছনের উদ্দেশ্যটা কি বলে মনে হয় আপনার?

–সঠিক বলা কঠিন। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সাহায্যকারীর ছদ্ম পরিচয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবেই সন্দেহটা বিশেষ কারুর দিকে টেনে নিতে চাইছে।

–সেই বিশেষ কেউ কি মিসেস লী?

-না, অত সাদামাটা বলে আমার মনে হয় না। এমন হতে পারে, বড়জোর বুড়ি হয়তো বিশেষ কিছু দেখে বা শুনে থাকতে পারে। কিন্তু চিরকূটের লেখার উদ্দেশ্য জিপসি বুড়ি নয়। কেন না অনেকেই এটা জেনে গেছে যে এই ঘটনার ব্যাপারে আমাদের সন্দেহের তালিকায় জিপসি বুড়ির নাম রয়েছে। মনে হচ্ছে চিরকূটের পেছনের অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি অন্য কোন মহিলাকে বোঝাতে চাইছে।

আমি জানতে চাইলাম, জিপসি বুড়ির কোন খবর এর মধ্যে পাওয়া গেছে?

সার্জেন্ট কীন বললেন, জিপসি বুড়ি এখান থেকে কোথায় কোথায় যেত সে সংবাদ আমরা সংগ্রহ করেছি। সাধারণতঃ পূর্ব অ্যাঙ্গোলিয়া বা কাছাকাছি অঞ্চলে যে সব জিপসি আস্তানা আছে, সেখানেই সে যাতায়াত করত।

সেখানে তার পরিচিত অনেকেই বাস করে। তবে সে অঞ্চলের জিপসিরা জানিয়েছে এবারে সে সেখানে যায়নি।

আমরা বিশেষ ভাবে সংবাদ নিয়ে জেনেছি, জিপসি বুড়ির মত দেখতে এমন কাউকেও সে অঞ্চলে দেখা যায়নি। আমার ধারণা বুড়ি এবারে অন্য কোন দিকে গেছে।

আমার মনে হল সার্জেন্ট কীন অন্য কিছু ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করছেন। আমি তাই জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বক্তব্য আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার হল না।

সার্জেন্ট সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ঘটনাটা একবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখুন। বুড়ি আপনার স্ত্রীকে ভয় দেখিয়েছিল, শাসিয়েছিল। এখন এই দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরে তার ওপরে যে সন্দেহটা পড়বে এটা বুড়ি বুঝতে পেরেছে এবং যথেষ্ট ভয় পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

পুলিস যে তাকে খোঁজ করবে এটা অনুমান করে অজ্ঞাত কোন স্থানে গা-ঢাকা দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব নয়। পুলিসের চোখ এড়াবার জন্য সে সরকারী যানবাহন এড়িয়ে চলবে সেটাও স্বাভাবিক।

আমি বললাম, আমার বিশ্বাস,বুড়ি আপনাদের চোখে বেশিদিন ধুলো দিয়ে থাকতে পারবে না। বুড়ির চালচলন চেহারার বৈশিষ্ট্য এমন, যে সাধারণ পাঁচজনের মধ্যে থেকে তাকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়।

-তা ঠিক। আজ থেকে, দুদিন পরে হোক, মিসেস লীর সন্ধান আমরা ঠিক পেয়ে যাব। অবশ্য যদি ঘটনাটা সেরকম হয়ে থাকে।

–তাহলে কি অন্য কোন সম্ভাবনার কথাও…

-হ্যাঁ। গোড়া থেকে সমস্ত ব্যাপারটা পর্যালোচনা করলে একটা প্রশ্ন উঠে আসে–তা হল, গোপনে টাকা দিয়ে বশ করে বুড়িকে দিয়ে কেউ এসমস্ত কাজ করিয়ে নিয়েছে কিনা।

আমি বললাম, সে ক্ষেত্রে তো বুড়িকে খুঁজে পাওয়াই দুঃসাধ্য হবে।

-তা ঠিক। তবে সেই সঙ্গে আরও একজনেরও যে দুশ্চিন্তা কিছু কম হবে না, সে কথাটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।

–বুড়িকে দিয়ে যে এসব কাজ করিয়ে নিচ্ছে, তার কথা বলছেন?

–হ্যাঁ।

–আচ্ছা…এই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিটি কি কোন মহিলা হতে পারেন?

–অসম্ভব নয়। আবার এমনও হতে পারে যে মিসেস রজারের মৃত্যু ঘটানো তার অভিপ্রেত ছিল না। হঠাৎ করেই এই মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে গেছে। হয়তো সে শুধু চেয়েছিল, জিপসি বুড়িকে দিয়ে বারবার ভয় দেখিয়ে আপনার স্ত্রীকে এখান থেকে বিতাড়িত করবে।

বললাম, সিদ্ধান্তটা অযৌক্তিক নয়। যেভাবে ইলিয়াকে ভয় দেখানো হয়েছে, তাতে একথা সহজেই মনে হয়।

ঘটনার পরিণতি যা ঘটল তার ফলে অন্তরালের সেই অজ্ঞাতনামা মহিলা সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে। কারণ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে ভয় পাবে বুড়ি এন্থারও। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার জন্য সে আসল ষড়যন্ত্রকারিণীর নামও ফাস করেও দিতে পারে।

–তাহলে আপনার বক্তব্য–কোন অজ্ঞাতনামা মহিলাকে আমি অথবা ইলিয়া আমাদের অজ্ঞাতসারে শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছি–

–কেবল নারীর কথাই আমি বলিনি। নারী বা পুরুষ যে কেউই সেই অদৃশ্য চক্রান্তকারী হতে পারে।

আর সে যেই হোক, তার প্রধান উদ্দেশ্য হবে যে কোন প্রকারে তোক বুড়ি এম্বারের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। এই কাজটা সে যত দ্রুত সম্ভব করার চেষ্টা করবে।

-বুড়ি এন্থার মারা গেছে, এমন কোন ইঙ্গিতই কি আপনি করছেন?

ধীরে ধীরে ঘাড় দোলালেন সার্জেন্ট কীন। পরে বললেন, সবই সম্ভব। হঠাৎই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তিনি বললেন, জঙ্গলের ভেতরে আপনাদের যে নির্জন ঘরটা আছে, সেটা খুবই চমৎকার। আশপাশে যখন আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছিলাম, সেই সময় সেটা আমাদের নজরে আসে।

–ঘরটা ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় পড়েছিল। আমি আর ইলিয়া সেটা সারিয়ে বাসযোগ্য করে তুলেছিলাম। মাঝে মধ্যে সেখানে গিয়ে আমরা সময় কাটাতাম। অবশ্য হালে বেশ কিছুদিন সেখানে যাওয়া হয়নি।

দেখলাম ঘরটা খোলা রয়েছে।

-হ্যাঁ। ওটাতে তালা লাগাবার ব্যবস্থা করিনি আমরা। মূল্যবান জিনিসপত্র তো বিশেষ কিছু নেই।

–আমরা সন্দেহ করেছিলাম, বুড়ি লী হয়তো সেখানেই আত্মগোপন করে রয়েছে। কিন্তু তার কোন অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। তবে অন্য একটা জিনিস পেয়েছি।

কথা বলতে বলতে টেবিলের টানা খুলে একটা স্বর্ণখচিত মূল্যবান লাইটার বার করে এনে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

এ ধরনের লাইটার সাধাণত মেয়েরাই ব্যবহার করে। সোনার জল দিয়ে লাইটারের গায়ে সি অক্ষরটা খোদাই করা।

-এ লাইটার আপনার স্ত্রী নিশ্চয় ব্যবহার করতেন না? জানতে চাইলেন সার্জেন্ট।

-না। তার লাইটারে সি-অক্ষর খোদাই করা থাকবে কেন? তাছাড়া, এ জিনিসটা ওর হাতেও কখনো দেখিনি আমি। ইলিয়ার সেক্রেটারী মিস গ্রেটারও নয় এটা।

সি অক্ষরটা আমাদের পরিচিতের মধ্যেকার কারোর নামের আদ্য অক্ষর হতে পারে মনে মনে আমি চিন্তা করলাম। মনে পড়ল ইলিয়ার সম্মা মিসেস কোরার নাম সি দিয়ে শুরু।

কিন্তু ভদ্রমহিলা যে এরকম জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ীপথ ভেঙ্গে এমন একটা জায়গায় উপস্থিত হতে পারেন এমন সম্ভাবনা একেবারেই অবিশ্বাস্য। তিনি আমাদের এখানে এসে মাসখানেকের বেশি ছিলেন না।

সেই সময় এ ধরনের কোন লাইটার তাকে ব্যবহার করতে আমি দেখিনি। তবে এটা হয়তো অজানা থাকতে পারে।

সার্জেন্টকে আমি সবকথাই খুলে জানালাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। পরে লাইটারটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তাহলে এটা নিয়ে গিয়ে আপনি তাকে একবার দেখান।

বললাম, তা দেখানো যেতে পারে। কিন্তু ধরুন যদি সত্যিই লাইটারটা মিসেস কোরার হয়, তাহলে তিনি চলে যাবার পরেও তো আমরা সেই নির্জন ঘরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তো এটা আমাদের কারোর চোখে পড়েনি।

-এটা পাওয়া গেছে কিন্তু ডিভানের কাছে। আমার ধারণা, ঘরটা সময় সুযোগ মত অন্য কেউ ব্যবহার করত। জঙ্গলের মাঝামাঝি অবস্থানে বেশ মনোরম জায়গাটা প্রেমিক-প্রেমিকাদের গোপন অভিসার স্থল হিসেবে একেবারে আদর্শ।

কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে এমন দামী লাইটার ব্যবহার করবার মত কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমি বললাম, ইলিয়ার এক বান্ধবীর নাম ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল। আপনিও নিশ্চয় তাকে চেনেন।

কিন্তু ক্লডিয়ার এমন দামী লাইটার ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, ওই জঙ্গলের মধ্যে তো তার যাবার কথা নয়।

–ক্লডিয়ার সঙ্গে কি আপনার স্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল?

–তা ছিল। এই অঞ্চলে ক্লডিয়াই ছিল ওর একমাত্র বন্ধু। সে যদি কখনো সেখানে যেতে চায়, ক্লডিয়া যে কোন আপত্তি করবে না, তাও সে জানতো। আমি কঠিন দৃষ্টিতে সার্জেন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ক্লডিয়াকে ইলিয়ার শত্রুপক্ষ মনে করা হলে সেটা হবে সম্পূর্ণই এক অবাস্তব কল্পনা।

-হ্যাঁ, আমিও মনে করি না, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ক্লডিয়ার কোনরকম শত্রুতা থাকতে পারে। তাহলেও, বুঝতেই পারছেন, স্ত্রীলোকের মতিগতির কথা কখনোই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না।

–শুনেছি, এক আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে ক্লডিয়ার বিয়ে হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম মিঃ লয়েড।

মিঃ স্ট্যানফোর্ড লয়েড নামে আমার স্ত্রীর এক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। অবশ্য দুই লয়েড যে একই ব্যক্তি আমি সেই কথা বলছি না। লয়েড নাম দুনিয়ায় অনেকেরই থাকা সম্ভব।

আর তা যদি হয়ও, আপনার উল্লেখিত দুই লয়েড একই ব্যক্তি, তাতেই বা কি এসে যায়?

–আমার একটা সন্দেহের কথা আপনাকে জানাচ্ছি। ওই দুর্ঘটনার দিন আমার মনে হচ্ছে যে মিঃ স্ট্যানফোর্ড লয়েডকে বাটিংটনের জর্জ হোটেলে লাঞ্চ খেতে দেখেছি।

–অথচ সেদিন তিনি আপনাদের ওখানে যাননি?

–না। তাছাড়া মিঃ লয়েডের গাড়িতে সেদিন এক মহিলাকেও চোখে পড়েছিল। ক্লডিয়ার চেহারার অনেকটাই মিল আছে সেই মহিলার সঙ্গে। অবশ্য আমি দেখেছিলাম রাস্তার অপর ধার থেকে–আমার চোখের ভুলও হতে পারে। তবে আমাদের এই নতুন বাড়িটা যিনি তৈরি করেছেন তিনি ছিলেন ক্লডিয়ারই এক জ্ঞাতিভাই।

সার্জেন্ট কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। পরে বললেন, আচ্ছা, আপনাদের বাড়িটার ওপরে ক্লডিয়ার বিশেষ আগ্রহ আছে, এমন কি কখনো মনে হয়েছে আপনার?

-না-না–তা কেন। ক্লডিয়া তার দাদার তৈরি কোন বাড়িই সুনজরে দেখে না।

এরপর আরো দু-চারটে কথা বলে আমি সার্জেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। চলে আসার আগে বুড়ি লীর সন্ধান পেলে আমাকে জানাতে অনুরোধ করে এলাম।

থানা থেকে বেরিয়ে এসেই দৈবাৎই দেখা হয়ে গেল ক্লডিয়া হার্ডক্যাসলের সঙ্গে। একেবারে মুখোমুখি।

ক্লডিয়া সবে পোস্ট অফিস থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সদ্য সদ্য আমি তার সম্পর্কেই সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। তখনো পর্যন্ত চিন্তার রেশ মন থেকে মুছে যায়নি।

এই অবস্থায় অভাবিতভাবে চোখের সামনে তাকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে গেলাম। ক্লডিয়াও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার চোখে মুখে কেমন বিব্রত, কুণ্ঠিত ভাব।

ইলিয়ার ব্যাপারটা একেবারেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না মাইক। ওই পরিণতি যে এমন মর্মান্তিক হবে–বুঝতে পারছি এই বেদনাদায়ক বিষয়টা এখন উত্থাপন করা খুবই অস্বস্তিকর, তবু না বলে তো পারছি না ।

–সবই বুঝতে পারি ক্লডিয়া। এই নির্জন গ্রামে তুমিই ছিলে তার একমাত্র বন্ধু। তুমি তাকে এমন আপন করে নিয়েছিলে যে গ্রামটাকে সে সহজেই নিজের বলে মনে করতে পেরেছিল। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

ক্লডিয়া এর পরে ঘনিষ্ঠভঙ্গিতে বলল, তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলব ভেবেছিলাম।

আমি আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, অসুবিধা কি আছে–স্বচ্ছন্দে বলতে পার।

-শুনলাম তুমি নাকি শিগগিরই আমেরিকা যাচ্ছ?

–হ্যাঁ। খুব শিগগিরই একবার যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তোমার কথা…

-হ্যাঁ বলছি। তুমি যদি এই বাড়িটা বিক্রি করে দেবার কথা চিন্তা করে থাকো, তাহলে তোমার আমেরিকা রওনা হবার আগেই এ বিষয়ে কথাবার্তা বলা যেতে পারে।

স্তম্ভিত আহত দৃষ্টিতে ক্লডিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমন একটা প্রস্তাব ওর মত মেয়ের কাছ থেকে আসতে পারে, এ আমার কল্পনাতেও ছিল না।

সংযত কণ্ঠে বললাম, বাড়িটা তুমি কিনতে চাও? কিন্তু আমি তো জানতাম এ ধরনের আধুনিক বাড়িঘর তোমার অপছন্দ।

–হ্যাঁ, কথাটা আমি বলেছিলাম বটে। কিন্তু দাদা রুডলফের মুখে শুনেছি, ওটাই নাকি তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি।

বাড়িটার জন্য যে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে তা আমি আন্দাজ করতে পারি। সব দিক ভাবনাচিন্তা করেই কথাটা তোমাকে বললাম।

ব্যাপারটা কেবল অস্বস্তিকর নয় অস্বাভাবিকও মনে হল আমার। ইতিপূর্বে অনেকবারই ক্লডিয়া আমাদের বাড়িতে গেছে। তার কথাবার্তা হাবভাবে কখনো প্রকাশ পায়নি, বাড়িটার প্রতি তার কোন বিশেষ আকর্ষণ আছে।

তাছাড়া ক্লডিয়ার দাদা স্যানটনিক্সের শিল্পীসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবশত বাড়িটার প্রতি যে সে আকর্ষণ বোধ করবে তেমনও নয়। স্যানটনিক্স সম্পর্কে যে সব মন্তব্য সে করেছে তাতে তার প্রতি বিরূপ মনোভাবই বরাবর প্রকাশ পেয়েছে। কি জানি হয়তো আমার ধারণায় ভুল ছিল।

আমি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললাম, আমি যে বাড়িটা বিক্রি করতে চাই এমন ধারণা তোমার হল কি করে ক্লডিয়া? এ জায়গাটা ইলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত। এ জায়গা ছেড়ে আমি অন্য কোথাও যাব না।

একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ঠেলে। পরে আবার বললাম, জিপসি একরকে আমরা দুজনেই ভালবেসেছিলাম, এখানে বাস করব বলে এসেছিলাম।

তার স্মৃতি বুকে আঁকড়ে আমি এখানেই পড়ে থাকতে চাই। জায়গা বিক্রি করার কথা যেন ভুলেও আমার মনে উদয় না হয়।

ক্লডিয়া নীরবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমারও আর কোন কথা বলার প্রবৃত্তি হল না।

কিন্তু হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই আমাকে কথা বলার শক্তি সঞ্চয় করতে হল।

ধীরে ধীরে বললাম, কিন্তু যদি মনে কর, একটা প্রশ্ন করব। নেহাৎই ব্যক্তিগত প্রশ্ন, জবাব দেওয়া না দেওয়া তোমার ইচ্ছা।

ক্লডিয়া গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে আমার দিকে তাকাল। বললাম, তোমার সঙ্গে যে আমেরিকান ভদ্রলোকের বিবাহ হয়েছিল তার নাম কি স্ট্যানফোর্ড লয়েড?

নির্বাক ক্লডিয়া কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য আঁচ করবার চেষ্টা করল সম্ভবত পরে হঠাৎই হ্যাঁ, বলে মাথা নেড়ে ধীর পায়ে আমার সামনে থেকে সরে গেল। আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করবার সুযোগ দিল না।

.

০৩.

 আমাদের ধারণা ছিল ইলিয়ার আত্মীয় স্বজন সকলেই আমেরিকা ফিরে গেছে। কিন্তু পরে অবাক হয়ে জানলাম, তারা প্রায় সকলেই বর্তমানে ইংলণ্ডে উপস্থিত।

মিসেস কোরা অবশ্য এমনিতেই সর্বক্ষণ চরকির মত দুনিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার কথা আলাদা।

তবুও চমৎকৃত না হয়ে পারলাম না যখন শুনতে পেলাম, ইলিয়ার মৃত্যুর দিন কোরা এই পাহাড়ী গ্রামের পাশেই ছিল। ঘটনার মাত্র দুদিন আগে সে লণ্ডনে এসে পৌচেছে।

কোরার সঙ্গে একই প্লেনে স্ট্যানফোর্ড লয়েডও ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আমেরিকা থেকে লণ্ডনে হাজির হয়েছে। এরা দুজনেই দুঃসংবাদটা জানতে পারে দৈনিক সংবাদপত্রের সান্ধ্য সংস্করণের খবর পড়ার পরে।

যাই হোক, একটা বিরাট হৈ চৈ, আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যেতে হয়েছিল আমাকে। সাংবাদিকরা ঝাঁক বেঁধে এসে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে, সাক্ষাৎকার চাইছে। ওদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য চিঠি আসছে, তার আসছে, দর্শনার্থীর সংখ্যাও নগণ্য নয়।

অবাক হলাম দেখে গ্রেটা একা হাতেই আশ্চর্য নিপুণতায় সবদিক সামাল দিচ্ছে। আমাকে খুব একটা বিব্রত হতে হয়নি।

একটা বিশ্রী অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, ইলিয়াকে কোথায় সমাহিত করা হবে সেই ব্যাপার নিয়ে। আমার ধারণা ছিল জিপসি একরেই তার অন্তিম শয়নের ব্যবস্থা করা হবে। কেন না, এই জায়গাটাকে ভালবেসে আমরা দুজনেই এখানে বাস করতে এসেছিলাম।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ইলিয়ার আত্মীয়স্বজন ইলিয়ার মৃতদেহ আমেরিকায় নিয়ে যাবারই পক্ষপাতী। তার পূর্বপুরুষদের যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে তারও সমাধি রচনা করা হবে।

আপত্তি করার বিশেষ কারণ ছিল না বলে আমি এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার দায়িত্ব আত্মীয় স্বজনের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।

ইলিয়ার এনড্রুকাকা অর্থাৎ মিঃ লিপিনকট একসময় আমাকে জানিয়েছিলেন, ব্যবসা সংক্রান্ত জরুরী কিছু কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য আমাকেও এই সময় একবার আমেরিকা যেতে হবে।

এসব ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকতো না। তাই কখনো মাথা ঘামাবার চেষ্টা করতাম না। ইলিয়া নিজেই সব সামলাত। তাই বললাম, ওসব ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো কোনকালে ছিল না।

লিপিনকট বললেন, আগে না থাকলেও এখন বর্তেছে। তুমি নিশ্চয়ই জান, ইলিয়ার যাবতীয় বিষয়সম্পত্তির তুমিই এখন একমাত্র উত্তরাধিকারী। ইলিয়া সেরকমই উইল করে গেছে।

–এরকম কোন উইল যে ইলিয়া করেছে তা আমি জানি না।

লিপিনকট বললেন, হ্যাঁ সে উইল করে গেছে। তোমাদের বিয়ের কিছুদিন পরেই পাকা বৈষয়িক মানুষের মত সে একটা উইল করে।

লণ্ডনের আইনজীবীদের কাছে সে উইলটা জমা রাখা আছে। ইলিয়ার ইচ্ছানুসারেই উইলের একটা কপি আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমি লিপিনকটের মুখের দিকে তাকালাম। এই ঝানু আইনজ্ঞ লোকটিকে আমার ভীষণ ভয়। সবসময় তার সব কথার অর্থ বুঝে ওঠা যায় না। মুখ দেখে ভদ্রলোকের মনোভাব আঁচ করা দুঃসাধ্য।

লিপিনকট সামান্য ইতস্তত করে বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তোমার একবার আমেরিকা যাওয়া প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। বিষয় সম্পত্তি এখন তোমার, এসব দেখাশোনার দায়দায়িত্ব তুমি তোমার পছন্দমত সেখানকার কোন আইনজ্ঞের হাতে তুলে দিয়ে আসতে পার।

–তার কি প্রয়োজন?

কারণ, বিশাল সম্পত্তির দায়দায়িত্ব কিছু কম নয়। সবকিছু ঠিকভাবে তদারকি করতে হলে তোমাকে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ মেনেই চলতে হবে।

কিন্তু এসব তো আমি কিছুই বুঝি না। অকপটে স্বীকার করলাম আমি।

সহানুভূতির সুরে লিপিনকট শান্তভাবে বললেন, তোমার অবস্থাটা আমি উপলব্ধি করতে পারছি।

–ইলিয়ার বর্তমানে যেমন ছিল, এখনও তো আপনিই সমস্ত কিছুর তত্ত্বাবধান করতে পারেন।

–তা অবশ্য পারি। –

-তাহলে অন্য কাউকে এর মধ্যে জড়াতে যাব কেন?

-বলছি একারণে যে, ইলিয়ার পরিবারের আরো কয়েকজনের দায়িত্ব ইতিপূর্বেই আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। তাদের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে তা আমার দেখা কর্তব্য। অবশ্য তুমি যদি আমাকেই দায়িত্ব দিতে চাও তাহলে তোমার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থাও আমাকে যথাযথ ভাবে করতে হবে।

আমি লিপিনকটকে বারবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বললাম, আপনি সত্যিই দয়ালু।

–তাহলে তোমাকে কয়েকটা পরামর্শ আমার এখুনি দেওয়া উচিত।

আমি সবিনয়ে বললাম, বলুন।

–সইসাবুদের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। বিশেষত ব্যবসা সংক্রান্ত কোন নথিপত্রে। ভাল করে খুঁটিয়ে না দেখে কোথাও কোন সই করবে না।

কিন্তু এসব বৈষয়িক নথিপত্র কি একবার দুবার পড়েই আমি বুঝতে পারব?

-বুঝতে কোথাও অসুবিধা বোধ করলে, সই করবার আগে তোমার আইনজ্ঞের পরামর্শ নেবে।

আমি কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, বিশেষ কারুর সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যেই কি আপনি আমাকে এই কথা বলছেন?

–তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলেই আমি মনে করি, আমার কথা বুঝতে পারবে। তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে যুক্তিযুক্ত নয়।

তবে এটুকু বলতে পারি, যেখানে অর্থকড়ির প্রশ্ন জড়িত, সেখানে কাউকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিত নয়।

লিপিনকট নির্দিষ্ট করে কোন ব্যক্তির নাম না করলেও তিনি যে বিশেষ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করে দিতে চাইছেন, তা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। সেই বিশেষ ব্যক্তিটি কোরা কিংবা স্ট্যানফোর্ড অথবা ইলিয়ার ফ্রাঙ্কপিসে হওয়াও বিচিত্র নয়–আমি চিন্তা করলাম।

সব দেখেশুনে আমার মনে হতে লাগল আমি যেন চারপাশে শ্বাপদ বেষ্টিত হয়ে পড়েছি। যে কোন মুহূর্তে এরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।

লিপিনকট আমার মনের কথাটাই যেন উচ্চারণ করলেন, এই পৃথিবীটা খুব একটা ভাল জায়গা নয় মোটেও।

আমি জানতে চাইলাম, ইলিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে আমি ছাড়া আর কেউ কি লাভবান হচ্ছে?

লিপিনকট আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন তোমার মনে উদয় হল কেন বলতো?

বললাম, কোন কারণ নেই। হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হল, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।

 লিপিনকট কয়েকমুহূর্ত কি ভাবলেন। তারপর বললেন, ইলিয়া তার উইলে অনেককেই অনেক কিছু দিয়ে গেছে। মিস অ্যাণ্ডারসনের কথাও সে ভোলেনি। তবে তার সঙ্গে যে দেনাপাওনার ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেছিল বেশ মোটা অঙ্কের চেকের মাধ্যমে, তা তুমি হয়তো জানো।

-হ্যাঁ, ইলিয়া নিজেই আমাকে বলেছে।

–ইলিয়ার নিকট আত্মীয় বলতে একমাত্র তুমিই নিশ্চয় আমাকে একথা বলতে চাওনি?

–আমি কিছু বোঝাবার চেষ্টা করিনি। কিন্তু মিঃ লিপিনকট, আপনিই কিন্তু আমার মনটাকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলছেন। কাকে সন্দেহ করব, কেন সন্দেহ করব না, এসব কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।

–সেটাই স্বাভাবিক। তবে কারুর মৃত্যু ঘটলে, সেই মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটা হিসেব নিকেশের প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ব্যাপারটার নিষ্পত্তি যে সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায় এমন নয়, অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে তার জের চলতে থাকে।

–আপনি কি ইলিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে ইঙ্গিত করতে চাইছেন? এব্যাপারেও কি কোন অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন?

-না তেমন কোন আশঙ্কা আমি করছি না। তবে ইলিয়ার অকাল মৃত্যুর বিষয়ে কারুর মনে প্রশ্ন জাগাটাও অস্বাভাবিক নয়।

ইলিয়ার মৃত্যুতে কেউ না কেউ তো নিশ্চয় লাভবান হবে। এখন সে যদি খুবই সাধারণ কেউ হয় তাহলে তার দিকে সহজে কারুর নজরে পড়বে না। সেক্ষেত্রে নিজের অপকর্মের চিহ্ন প্রমাণ খুব সহজেই সে লোপাট করে দেবার সুযোগ পাবে।

একটু থেমে পরে বললেন, তুমি তোমার নিজের কথাই এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে ধরতে পার। তবে এ বিষয়ে আর কোনরকম আলোচনা না করাই আমার পক্ষে বাঞ্ছনীয়। নিরপেক্ষতা রক্ষা করা আমার কর্তব্য।

ইলিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে স্থানীয় একটা গীর্জায়। আমার দুরে সরে থাকবার উপায় ছিল না।

গীর্জার বাইরে যারা সমবেত হয়েছিল, তাদের অনেকেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। গ্রেটাই আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখল। তার ব্যবস্থাপনাতেই সমস্ত ব্যাপারটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল।

এখানকার সমস্ত কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে গ্রেটাকে আমি নতুন ভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পেলাম। তার মত করিৎকর্মা মেয়ে খুব কমই আমার চোখে পড়েছে। বুঝতে পারছি এই কারণেই ইলিয়া তার ওপরে এমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।

গীর্জায় উপস্থিত হয়েছিল আমাদের প্রতিবেশীদের প্রায় সকলেই। সকলকে আমি চিনি না। তবে একজনকে দেখে মুখটা খুব পরিচিত বলে মনে হল। তবে কোথায় দেখেছি স্মরণে আনতে পারলাম না।

একসময় ক্লান্ত অবসন্ন মনে বাড়িতে ফিরে এলাম। একটু পরেই পরিচারক কার্সন এসে জানাল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কে একজন বৈঠকখানা ঘরে বসে আছে।

খুবই বিরক্ত হলাম। বললাম, আজ কারুর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয় জানিয়ে দাও। আর অচেনা কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া তোমার উচিত হয়নি।

কার্সন সবিনয়ে জানাল, ভদ্রলোক নাকি বলেছেন তিনি আমার আত্মীয়। একটা কার্ড আমার হাতে দিল। উইলিয়াম আর পার্ডো-নামটা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। এরকম নামের কাউকে চিনি বলেও মনে হল না। অগত্যা কার্ডটা গ্রেটাকে দিলাম।

গ্রেটা একপলক দেখেই চিনতে পারল। বলল, হ্যাঁ, ভদ্রলোককে চিনি। ইলিয়ার জ্ঞাতিভাই। ইলিয়া তাকে রুবেন কাকা বলে ডাকতো।

এতক্ষণে মনে পড়ল, গীর্জায় সমবেত লোকজনের মধ্যে কেন একজনকে আমার চেনা মনে হয়েছিল। ইলিয়ার বসার ঘরে তার আত্মীয় পরিজনের একটা গ্রুপ ফোটো টাঙানো ছিল। মিঃ পার্ডোর ছবিও ছিল তার মধ্যে।

বাধ্য হয়েই খবর পাঠিয়ে দিয়ে মিনিট দুয়েক পরে আমাকে বৈঠকখানা ঘরে উপস্থিত হতে হল। মিঃ প্রার্ডো উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সুপ্রভাত জানালেন।

-তুমি নিশ্চয় মাইকেল রজার। আমি হচ্ছি ইলিয়ার জ্ঞাতিভাই। বয়সে অনেক বড় বলে ও আমাকে রুবেনকাকা বলে ডাকত। আমার কথা নিশ্চয় তুমি ইলিয়ার মুখে শুনে থাকবে। এই প্রথম আমাদের চাক্ষুষ পরিচয় হল।

-সাক্ষাৎ না হলেও আপনাকে চিনতে অসুবিধে হয়নি আমার।

–এমন অকালে ইলিয়াকে আমরা হারাব স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। কতটা যে আঘাত লেগেছে আমার তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ।

আমি ধীরে ধীরে বললাম, আপাতত এই প্রসঙ্গ না উঠলেই আমি স্বস্তি পাব।

–হ্যাঁ, আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারি।

ভদ্রলোক আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা পড়ল কফির সরঞ্জাম নিয়ে গ্রেটা ঘরে ঢোকায়। আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সুযোগ পেলাম।

–মিস অ্যাণ্ডারসনের সঙ্গে নিশ্চয় আপনার পরিচয় আছে?

নিশ্চয়ই। গ্রেটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কেমন আছো গ্রেটা?

–খুব একটা খারাপ নেই। আপনি কতদিন দেশ ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছেন?

–হপ্তা দুয়েক হবে। শেষ পর্যন্ত লণ্ডনে এসে পৌচেছি।

 হঠাৎ করেই একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল। বললাম, দিন কতক আগে আপনাকে আমি দেখেছি।

পার্ডো আমার দিকে ফিরে বললেন, কোথায় দেখেছ?

বাটিংটন ম্যানরের এক নিলাম ঘরে।

–ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তোমাকেও সেদিন আমার চোখে পড়েছিল। বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে ছিলেন।

-হ্যাঁ, মেজর ফিলপট।

 –তোমরা দুজনেই মনে হল খুব খোশমেজাজে ছিলে।

–তা ঠিক।

-তোমরা নিশ্চয়ই তখনো দুর্ঘটনার কথা কিছুই জানতে না। সেদিনই তো দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, তাই না?

-হ্যাঁ। আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে যোগ দেবার কথা ছিল ইলিয়ার। তার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম।

–সত্যিই ভাবতে পারছি না ঘটনাটা।

–আপনিও যে সেসময় লণ্ডনে থাকতে পারেন এমন সম্ভাবনা আমার মনে উদয় হয়নি।

–জানবে কি করে, ইলিয়াকে আমি কোন চিঠিপত্র দিইনি। ব্যবসা সংক্রান্ত একটা কাজে হঠাৎ করে চলে আসতে হয়েছিল।

কতদিন ইংলণ্ডে থাকতে হবে নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু কাজটা চটপট মিটে গিয়েছিল বলে সেদিন নিলামে উপস্থিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম।

ইচ্ছে ছিল নিলাম শেষ হলে তোমাদের এখানে ঘুরে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।

–নিজের ব্যবসার কাজেই কি আপনি ইংলণ্ডে এসেছিলেন?

–অনেকটা সেরকমই। কোরাই আমাকে একটা জরুরী তার পাঠিয়েছিল। ইংলণ্ডে নাকি একটা বাড়ি কিনবে মনস্থ করেছে, তাই আমার পরামর্শ চায়।

কোরার ইংলণ্ডে উপস্থিতির কথা সেদিন মিঃ পাৰ্ডোর কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারলাম। সেকথা ভদ্রলোককে জানাতেও দ্বিধা করলাম না।

-কোরা সেদিন এই অঞ্চলেই ছিল।

–এই অঞ্চলে? বিস্মিত হলাম আমি, তিনি কি কোন হোটেলে উঠেছিলেন?

–না, তার এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিল।

 –বন্ধুর বাড়ি… কিন্তু এখানে তার কোন বন্ধু আছে বলে তো আগে কখনো শুনিনি।

-হ্যাঁ আছে, ভদ্রমহিলার নাম…হা মনে পড়েছে মিসেস হার্ডক্যাসল।

–ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল? আমি হতচকিত হলাম শুনে।

-হ্যাঁ। কোরার অনেক দিনের বন্ধু। মহিলা অনেকদিন আমেরিকায় ছিলেন, তখনই দুজনের বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু তুমি কি এখবর জানতে না?

গ্রেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ক্লডিয়ার সঙ্গে মিসেস কোরার বন্ধুত্বের বিষয়ে তুমি কি কিছু জানতে?

–ওহ না। আমি তার মুখে কখনো মিসেস হার্ডক্যাসলের নাম শুনিনি। ক্লডিয়া সেদিন কেন যে আমার সঙ্গে লণ্ডনে যায়নি এখন বুঝতে পারছি।

-সে কি! কডওয়েল স্টেশনে তো তোমাদের দুজনের দেখা হবার কথা ছিল। ঠিক ছিল সেখান থেকে লণ্ডনে গিয়ে কি সব কেনাকাটা করবে?

হ্যাঁ। কিন্তু ক্লডিয়া যেতে পারেনি। তুমি বেরিয়ে যাবার পরেই আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল হঠাৎ ওর এক বন্ধু আমেরিকা থেকে এসে পড়েছে বলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারবে না।

–আমেরিকার সেই বন্ধু নিশ্চয়ই মিসেস কোরা?

–নিশ্চয়ই, মিঃ পার্ডো বললেন, সবই দেখছি কেমন গোলমেলে। ওদিকে করোনারের বিচারও নাকি কিছুদিনের জন্য মূলতবী রাখা হয়েছে।

এরপর আর আমাদের বেশি কথা হল না। কফির পেয়ালা নামিয়ে রেখে মিঃ পাৰ্ডো বললেন, আজকের মত ওঠা যাক। আমি মার্কেট কডওয়েলের ম্যাজেস্টিক হোটেলে উঠেছি। যদি কোন প্রয়োজন হয়, আমাকে খবর দিতে দ্বিধা করো না।

মিঃ পার্ডো বিদায় নিলে আমি তার কথাগুলো মনে মনে পুনরাবৃত্তি করতে লাগলাম।

গ্রেটা বলল, ভদ্রলোকের মতলবটা ঠিক বোঝা গেল না। হঠাৎ এখানে এসময় হাজির হয়েছেই বা কেন? বুঝতে পারছি না এরা নিজেদের জায়গায় ফিরে না গিয়ে এখানে এসে জড়ো হচ্ছে কেন?

–সেদিন জর্জ হোটেলে স্টানফোর্ড লয়েডকেই দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। দূর থেকে দেখা বলে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।

ক্লডিয়ার মতো দেখতে একটা মেয়েকেও তো তার সঙ্গে চোখে পড়েছিল বলে বলেছিলে। মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক গোপনে ক্লডিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

আর মিঃ পার্ডো এসেছিল কোরার সঙ্গে দেখা করতে এখন সব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। যোগাযোগগুলো খুবই অদ্ভুত।

–কিন্তু এই যোগাযোগের ব্যাপারটা খুব ভাল বোধ হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে সেদিন সকলেই এই অঞ্চলের আশপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

আমার নিজের উদ্বেগ হলেও গ্রেটা বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হল না। সহজ ভাবেই বলল, এমন ঘটনা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

.

০৪.

 ইলিয়ার মরদেহ নিউইয়র্কে নিয়ে যাবার আয়োজন সম্পূর্ণ হল। সমাধিক্ষেত্রে আমাকেও উপস্থিত থাকতে হবে।

এদিকে, জিপসি একরে আমার কোন কাজ ছিল না। তাই ভাবলাম এই সুযোগে ব্যবসা সংক্রান্ত ঝামেলাও একসঙ্গে মিটিয়ে আসা যাবে। গ্রেটার ওপরে এদিককার দায়িত্ব দিয়ে আমি যথাসময়ে নিউইয়র্ক রওনা হলাম।

বাড়ি থেকে বেরুবার আগে গ্রেটা আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, একটা কথা মনে রেখো ওখানে তোমার মিত্রপক্ষ কেউ নেই, সকলেই শত্রুপক্ষ। একেবারে হিংস্র জন্তুর মত দাঁত নখ বার করে অপেক্ষা করে রয়েছে।

সর্বদা নিজের সম্পর্কে সচেতন থাকবে। সামান্য সুযোগ পেলেই কিন্তু তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।

নিউইয়র্ক পৌঁছে বুঝতে পারলাম, গ্রেটা মোটেই ভুল আন্দাজ করেনি। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়েই অনুভব করতে পারলাম একেবারে জঙ্গলের রাজত্বে এসে পড়েছি।

আমি এখানে শিকার শিকারীরা সকলে লোলুপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছে আর জিব দিয়ে থাবা চাটছে।

মিঃ লিপিনকট আমাকে এক আইনজীবীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। খনি সংক্রান্ত সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করবার পরামর্শানুসারে তার প্রয়োজনীয় দলিলপত্রগুলো ভদ্রলোককে দিয়ে দেখিয়ে নেবার দরকার হয়েছিল।

আইনজীবী ভদ্রলোক আমার পরামর্শদাতার নাম জানতে চাইলেন। আমি স্ট্যানফোর্ড লয়েডের নাম করলাম।

নামটা শুনেই গম্ভীরভাবে তিনি বললেন, আমরা যে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা না করে কোন মতামত দেব না মিঃ লয়েডের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তির তা জানা উচিত।

পরে তিনি জানিয়েছিলেন, দলিলের শর্ত যা আছে তাতে মালিকানার ব্যাপারে কোন গণ্ডগোল নেই। এমন পরামর্শও তিনি দিলেন, খনিজসম্পদ বিশিষ্ট ওই জমি এখুনি হস্তান্তর করা অনুচিত। ধরে রাখলে পরে অনেক বেশি দাম পাওয়া যাবে।

এই ঘটনা থেকে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে নিরীহ হরিণ শিশুর মতই শিকারের জন্য আমার চারদিকে সকলে ভিড় করে আছে।

সকলেই বুঝতে পেরে গেছে বিষয় সম্পত্তির লাভ লোকসানের হিসাব নিকেশের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ ভাবেই অজ্ঞ।

এদিকে শবানুগমনের অনুষ্ঠান বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই সম্পন্ন হল। নানা রঙের ফুলে স্তূপ জমে গেল সমাধিস্থলে।

এই প্রাণহীন আড়ম্বর কিছুই যে ইলিয়া পছন্দ করত না, আমি তা নিশ্চিত ভাবে জানি। কিন্তু আত্মীয়স্বজনের মনস্তুষ্টির এ ব্যাপার আমাকেও মেনে নিতেই হল।

নিউইয়র্কে পৌঁছবার চারদিনের মাথায় কিংসটন বিশপ গ্রামের খবর এল মেজর ফিলপটের চিঠিতে। পুলিস অনেক অনুসন্ধানের পরে জঙ্গলাকীর্ণ এক পাহাড়ী খাদের মধ্যে থেকে বুড়ি লীর মৃতদেহ উদ্ধার করতে পেরেছে।

বুড়ি ওখানে বেশ কয়েক দিন ধরে মরে পড়েছিল। বুড়ি লীর ঘর অনুসন্ধান করে এক গোপন জায়গা থেকে তিনশোখানা পাউণ্ডের নোটও উদ্ধার হয়েছে।

চিঠির শেষে তিনি আরও একটা খবর জানিয়েছেন। লিখেছেন, তুমি দুঃখ পাবে জেনেও লিখতে হচ্ছে, গতকাল ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এক্ষেত্রে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েই দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

দুসপ্তাহের মধ্যেই পরপর দুজনের একইভাবে আকস্মিক মৃত্যু ঘটল ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে। এমন সংবাদের পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়–এসব কি নিতান্তই আকস্মিক, না অন্য কিছু?

.

রাতারাতি আমি ফকির থেকে বাদশা বনে গেছি। এই কথাটা প্রতি মুহূর্তে আমায় মনে করিয়ে দিয়েছে ইলিয়ার পরিবারের অসংখ্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন। সারাক্ষণই আমার মনে হতো এদের মধ্যে আমি কোন ভিনগ্রহের আগন্তুক। চলাফেরায় কথা বলায় একচুল অসতর্ক হবার উপায় নেই।

কতদিন ছিলাম, এখন আর মনে করতে পারি না। তবে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম যে তাতে সন্দেহ নেই।

যার সুবাদে আমার এখানে আসা–সেই ইলিয়া, একান্ত আমার ইলিয়া আর নেই। কিন্তু তার স্মৃতি এখনো তরতাজা রয়েছে জিপসি একরে। সেখানেই ছুটে যাবার জন্য প্রাণটা আইঢাই করতে লাগল।

কিন্তু যেতে চাইলেই কি আর যাওয়া যায়। আমি এখন আর কেবল সামান্য মাইকেল রজার নই। ইলিয়ার উইলের দৌলতে এখন আমি আমেরিকার অন্যতম ক্রোড়পতি। আমার টাকা অসংখ্য জায়গায় লগ্নি করা, নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে সেই বিশাল অর্থনৈতিক জগৎ। তার দায়দায়িত্বও কম নয়–অন্তত খবরাখবর রাখাটুকুও।

যেদিন ইংলণ্ডে ফিরব তার আগের দিন মিঃ লিপিনকট এলেন। তাকে জানালাম স্ট্যানফোর্ড লয়েডকে আমার বিষয় সম্পত্তির লগ্নি সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে চাই।

কথাটা শুনে মিঃ লিপিনকটের ভ্র কুঞ্চিত হল। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মুখের রেখায় কোন পরিবর্তন ঘটল না। উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইলাম, কাজটা যুক্তিযুক্ত হবে বলে কি আপনি মনে করেন?

–তুমি কি তার সম্পর্কে কোন কারণ খুঁজে পেয়েছ?

বললাম, না। তেমন চেষ্টাও করিনি। আমার একরকম অনুভূতির বশেই মনে হয়েছে ভদ্রলোক সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।

–হুঁ। লিপিনকট এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। পরে বললেন, তোমার এই অনুভূতির প্রশংসা করতে হয়। তোমার অনুমান যে যথার্থ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

পরিষ্কারই হয়ে গেল, ইলিয়ার লগ্নি সংক্রান্ত ব্যাপারে স্ট্যানফোর্ড লয়েড দীর্ঘদিন থেকেই যথেষ্ট কারচুপির কর্ম করে চলেছেন।

আমি আর কাল বিলম্ব না করে বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব মিঃ লিপিনকটের হাতে তুলে দিলাম।

মিঃ লিপিনকট আমাকে কথা দিলেন, ইলিয়ার সম্পত্তির স্বার্থরক্ষার চেষ্টা তিনি করবেন।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সইসাবুদ হয়ে যাবার পর আমার এদিককার কাজকর্ম আপাততঃ সাঙ্গ হল। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

মিঃ লিপিনকট জানতে চাইলেন, তুমি কি প্লেনে ফিরছ?

–না। জাহাজেই যাচ্ছি। সমুদ্রযাত্রায় খানিকটা মনের সুস্থিরতা ফিরে পাব বলেই আমার বিশ্বাস।

–ফিরে গিয়ে কোথায় উঠছ?

–কেন, জিপসি একরে।

–তাহলে ওখানেই থেকে যাবে সিদ্ধান্ত করেছ?

–হ্যাঁ। জিপসি একর ছেড়ে আমি কোন দিনই যেতে পারব না। তাছাড়া ওখানে গ্রেটা রয়েছে, তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ইলিয়ার জন্য যথেষ্ট করেছে।

-হ্যাঁ, সেকথা তুমি বলতে পার।

–গ্রেটা সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা ভেঙ্গেছে। বাইরে থেকে দেখে তাকে ঠিক বোঝা যায় না। ইলিয়ার মৃত্যুর পর ও যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছে, সে বিষয়ে বাইরের কারুরই ধারণা করা সম্ভব নয়। বুঝতেই পারছেন, সঙ্গতভাবেই তার প্রতি আমার একটা কর্তব্যও বর্তেছে।

মেয়েটি যে কর্মনিপুণা তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বিদায় নেবার আগে মিঃ লিপিনকট শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, জিপসি একরের ঠিকানায় তোমার নামে ছোট্ট একটা চিঠি পাঠিয়েছি। এয়ার মেলে যাবে–তোমার পৌঁছবার আগেই চিঠি পৌঁছে যাবে।…তোমার সমুদ্রযাত্রা শুভ হোক।

.

০৫.

 সুদীর্ঘ সংগ্রামের অবসান হয়েছে। এবার আমি আমার নিজের ঘরে ফিরে চলেছি। সমুদ্র যাত্রার অবসান হলেই আমি আমার প্রার্থিত সাম্রাজ্যে অধিষ্ঠিত হব। আর কোন বাধাবন্ধ নেই।

জাহাজে বিলাসবহুল কেবিনে শুয়ে শুয়ে সমুদ্রের অনন্ত বিস্তারের দিকে চোখ মেলে কেবল ভেবেছি, আমার অন্তহীন চাওয়ার এতদিনে অবসান হল। ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি এতদিনে তা সার্থক হল।

ইলিয়ার মুখও বারবার ভেসে উঠল চোখের সামনে। সে যেন অন্য এক জন্মের কাহিনী। জিপসি একরে তার সঙ্গে প্রথম দেখা। রিজেন্ট পার্কের নিভৃত কোণে দেখা সাক্ষাৎ, রেজিস্ট্রারের অফিসে অনাড়ম্বর বিবাহ অনুষ্ঠান, তারপর জিপসি একরে স্থাপত্য কৌশলের নব নিদর্শন নয়নাভিরাম প্রাসাদ নির্মাণ–সবই যেন অতি দ্রুত ঘটে গেল।

কিন্তু ওই প্রাসাদ-ওটা সৃষ্টি হয়েছে একান্ত ভাবেই আমার জন্য। এখন এই প্রাসাদপুরীর মালিক আমি। যা হতে চেয়েছিলাম তাই হয়েছি–সুদীর্ঘ সংগ্রামের পরে।

নিউ ইয়র্ক থেকে যাত্রা করার আগে মেজর ফিলপটকে আমার যাত্রার সংবাদ জানিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এয়ার মেলে। আমার পৌঁছবার আগেই তিনি চিঠি মারফত আমার সবকথা জেনে যাবেন।

একমাত্র মেজরকেই আমার অবস্থাটা বোঝানো সহজ বলে মনে হয়েছে। একদিন সকলেই জানতে পারবে, কিন্তু সহজভাবে নিতে পারবে না। কিন্তু মেজর সকলের মত নন, তিনি খুব কাছে থেকে ইলিয়া ও গ্রেটাকে দেখেছেন। সবই জানেন, আমার বিশ্বাস তিনি সহজভাবেই মেনে নিতে পারবেন।

মেজর বিজ্ঞ ব্যক্তি। গ্রেটার ওপরে ইলিয়ার নির্ভরশীলতার বিষয়টি তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এখন ওই ইলিয়া বিহীন প্রাসাদপুরীতে একা আমাকে জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু তা যে কতটা দুরূহ নিশ্চয় তিনি অনুভব করতে পারবেন।

ইলিয়ার বদলে একজন কেউ না হলে, আমাকে সাহায্য করবার কেউ না থাকলে, আমি একা বাঁচব কি করে।

আমার একান্ত বক্তব্য যথাসাধ্য বুঝিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি মেজর ফিলপটকে। আমার বিশ্বাস আমি গুছিয়ে লিখতে পেরেছি।

আমার চিঠির কথাগুলো ছিল এরকম

আমাদের প্রতি আপনার সহৃদয়তার কথা স্মরণে রেখেই কথাটা আপনাকেই প্রথম জানাবার প্রেরণা পেয়েছি। আমার সমস্যাটা একমাত্র আপনিই ভাল করে বুঝতে পারবেন। আমেরিকায় যে কটা দিন কাটিয়েছি, প্রতি মুহূর্তে একটা চিন্তাই ঘুরে ফিরে আমার মনে উদয় হয়েছে, একা একা জিপসি একরে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি করে?

অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করেছি, ফিরে গিয়ে গ্রেটার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখব। ইলিয়ার কথা গ্রেটার কাছে ছাড়া আর কাউকে প্রাণ খুলে বলা সম্ভব নয়। গ্রেটা আমাকে বুঝতে পারবে।

আমার বিশ্বাস গ্রেটা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে না। যদি এই বিয়েটা সম্ভব হয়, তাহলে মনে করতে পারব, বরাবরের মত আমরা তিনজনই একসঙ্গে রয়েছি।…

এয়ার মেলের চিঠি নিশ্চয় মেজর আমার পৌঁছবার দিন কয়েক আগেই পেয়ে যাবেন।

.

আজ আমি একজন সার্থক মানুষ। আমার সমস্ত পরিকল্পনা, সমস্ত কর্মকুশলতা, যা আমি চেয়েছিলাম, সবই আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এখন আমি বিজয়ী পুরুষ। বিজয় অভিযান সম্পূর্ণ করে ফিরে চলেছি আমার গৃহে।

দুটো আকাঙ্ক্ষাই আমার জীবনের সমস্ত স্বপ্নকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। সেই দুটোই আজ আমার করায়ত্ত।

চেয়েছিলাম নিজের জন্য মনের মতো একটা প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের কল্পনা বিলাস জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। আর চেয়েছিলাম আশ্চর্য সুন্দর এক নারী-মনে প্রাণে একান্তভাবেই সে হবে আমার।

মনে মনে বিশ্বাস করতাম, দুনিয়ার কোথাও না কোথাও সেই নারী আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে, কোন না কোনদিন তার সাক্ষাৎ আমি পাব।

তা স্বপ্নের সেই সঙ্গিনীর সন্ধান একদিন পেয়ে গেলাম। দেখা মাত্রই আমরা অচ্ছেদ্য হৃদয়-বন্ধনে আবদ্ধ হলাম–পরস্পরকে আপন করে নিলাম।

আজ সেই প্রণয়িনীর কাছেই ফিরে চলেছি আমি। জাহাজ থেকে নামার পর থেকে তারই ধ্যানে বিভোর হয়ে আছি।

সন্ধ্যার মুখে মুখে ট্রেন থেকে নামলাম। তারপর অপেক্ষাকৃত নির্জন পথ ধরে হেঁটেই রওনা হলাম বাড়ির দিকে।

আমার আসার খবর জানিয়ে গ্রেটাকে আগেই একটা তার করে দিয়েছিলাম। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি স্বপ্নের প্রাসাদপুরীতে গ্রেটা সেজেগুজে আমারই অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে।

যেই দিনটির জন্য এতদিন আমরা উভয়ে প্রতীক্ষায় দিন গুনেছি, সেই বহুবাঞ্ছিত দিনটি আজ। এই দিনটির জন্য কী কঠিন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে হয়েছে আমাদের। নিপুণ অভিনেতার মত অভিনয় করতে হয়েছে আমাদের দুজনকেই। এখন আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে আমার অদ্ভুত ভূমিকার কথা মনে করে। গ্রেটার প্রতি আমার বিরূপ মনোভাব যে কপট, ঘুণাক্ষরেও তা কেউ সন্দেহ করতে পারেনি। সবাই জেনেছে গ্রেটাকে আমি সহ্য করতে পারি না, মনে মনে দারুণ ঘৃণা করি।

আমার আর ইলিয়ার মাঝখানে গ্রেটার উপস্থিতিও যে কোনভাবেই আমার অভিপ্রেত নয় ইলিয়াকেও সেকথা নিপুণভাবে বোঝাতে পেরেছি।

আমার মনে যে গ্রেটার প্রতি দুরন্ত ঘৃণা চাপা রয়েছে তা বোঝবার জন্য ইলিয়ার সামনে সেদিন কপট ঝগড়াও বাধিয়েছিলাম।

গ্রেটার মানসিক গঠনও ছিল আমারই মত। তাই প্রথম দর্শনেই সে আমাকে চিনে নিতে ভুল করেনি। আমারই মত তারও বুক জুড়ে ছিল পৃথিবীটাকে ভোগ করবার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

দুজনের চাওয়া একদিন এক হয়ে গেল। হামবুর্গে প্রথম দর্শনের দিনেই আমি তাকে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা অকপটে খুলে বলেছিলাম। গ্রেটাও তার কামনা-বাসনা আমার কাছে গোপন করেনি।

তারপর সেই মনে করিয়ে দিয়েছিল, মনোবাসনাকে সার্থক করে তুলতে হলে চাই অর্থ–অপর্যাপ্ত অর্থ।

অর্থের পেছনেই ছুটে চলেছি সেই ছেলেবেলা থেকে। স্কুল ছাড়বার পরদিন থেকেই। বছরের পর বছর অক্লান্ত ভাবে কাজ করে গেছি–কিন্তু আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোন সম্ভাবনা দেখতে পাইনি। এভাবেই হয়তো জীবন উপভোগের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবন চলে যেত–জাগতিক কামনা-বাসনা পূরণের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত যদি গ্রেটার সঙ্গে দেখা না হত।

গ্রেটা আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, ইচ্ছানুরূপ অর্থ লাভ করার উপায় তোমার হাতেই আছে। মেয়েদের মন কাড়ার মত সম্পদ যার থাকে তার কি অর্থের অভাব হতে পারে? তুমি দেখছি নিজেকেই নিজে চেন না।

-মেয়েদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাব কেন? তারপর গ্রেটাকে দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে বলেছি, পৃথিবীতে একটি নারীই কেবল আমার কাম্য–আর সে হচ্ছে তুমি। আমি একান্তভাবেই তোমার–কেবল তোমারই।

আমি জানতাম দুনিয়ার কোথাও না কোথাও আমার স্বপ্নের নায়িকা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য–তোমাকে আমি ঠিক চিনে নিতে পেরেছি।

গ্রেটা বলেছে, কী আশ্চর্য, তোমাকে দেখার পর আমারও একই কথা মনে হয়েছে।

স্বপ্ন সফল করার সহজ পথ গ্রেটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, অঢেল বিষয় সম্পত্তি রয়েছে এমন কোন ধনী মহিলাকে বিয়ে করতে হবে।

-তেমন বিত্তবান মেয়ে পাব কোথায় আমি?

গ্রেটা হেসে বলেছিল, যদি চাও, তেমন একজনের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিতে পারি।

–কিন্তু তাতে কতটা লাভ হবে। ধনবতী মহিলাদের স্বামী হওয়াটা কিছু মাত্র সুখের বলে মনে হয় না আমার। সারাজীবন পরমুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটানো সহ্য হবে না আমার।

বরাবর থাকতে যাবে কেন? মতলব হাসিল করতে হলে কিছুদিনের জন্যে তো থাকতেই হবে। স্ত্রী তো একদিন মারা যেতে পারে-কেউ তো আর চিরজীবী হয়ে পৃথিবীতে জন্মায় না।

এতটা আমি ভাবতে পারিনি। স্তম্ভিত হয়ে গ্রেটার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।

ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে গ্রেটা বলল, কথাটা শুনে তুমি খুব বিচলিত হয়ে পড়লে মনে হচ্ছে

–বিচলিত ঠিক না, তবে

–আমি জানতাম তুমি বিচলিত হবে না। এবং অবিচলিত থেকেই তোমাকে কাজ করে যেতে হবে। একজন আমেরিকান ক্রোড়পতি যুবতীর দেখা শোনা আমি করি। তার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তার ওপর আমার কিছুটা প্রভাব রয়েছে।

বড় বড় ধনীর দুলাল থাকতে আমাকে সে পছন্দ করতে যাবে কেন? তাকে বিয়ে করার যোগ্যতাও সেই সব ধনী-পুত্রদের আমার চাইতে অনেক বেশি।

-তা ঠিক। তবে তোমার মধ্যে যা আছে তা অনেক পুরুষের মধ্যেই থাকে না। তোমাকে দেখে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হবে। একজন মেয়ে হিসেবে আমার তাই ধারণা।

গ্রেটার মুখের স্তুতি শুনে আমি আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলাম।

তাছাড়া, সেই মেয়ে অন্য দশটা মেয়ের মত নয়। সারাক্ষণ তাকে অদ্ভুত এক গণ্ডীবদ্ধ জীবনের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয়।

বিশেষভাবে বাছাই করে ধনকুবের যুবকদের সঙ্গেই কেবল তাকে মিশতে দেওয়া হয়। তোমার মত পুরুষ দেখার সুযোগ সে কোনদিন পায়নি।

তার প্রকৃতি কিছুটা অন্যরকম। আড়ম্বর কৃত্রিম জীবন সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না। সে চায় স্বাভাবিকভাবে অন্য পাঁচজনের সঙ্গে মিশতে, পরিচিত গণ্ডীর বাইরের জগৎটাকে জানতে।

তোমাকে যা করতে হবে তা হলো নিপুণ প্রেমের অভিনয়। তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে প্রথম দর্শনেই তুমি তার প্রেমে ডুবেছ।

তোমার এই অভিনয়ই তাকে আকৃষ্ট করবে–সে বাইরের জগতের মুক্ত হাওয়ার স্বাদ নিতে চাইবে। এর ফলে গণ্ডীবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত মেয়েটি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। কেন না, ইতিপূর্বে কোন পুরুষের কাছ থেকে সে ঘনিষ্ঠ প্রেমের আহ্বান পায়নি। তুমিই হবে তার জীবনের প্রথম পুরুষ। …কি পারবে না?

গ্রেটার তুলনা হয় না। নিখুঁত পরিকল্পনাটি সে আমার মাথায় নিপুণভাবে ঢুকিয়ে দিল। আমি দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বললাম, একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজন কি ব্যাপারটা মেনে নেবে?

গ্রেটা দৃঢ়কণ্ঠে জানাল, তেমন সুযোগই তারা পাবে না। বিয়ের আগে পর্যন্ত তাদের এব্যাপারে কোনকিছুই জানতে দেওয়া হবে না। বিয়েটা সারতে হবে গোপনে–তারপর সকলে জানতে পারবে।

এরপর পরিকল্পনাটা নিয়ে দুজনে অনেক সময় ধরে আলোচনা করলাম। তারপর কিভাবে এগুতে হবে সেই সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেললাম।

গ্রেটা ছুটিতে এসেছিল। সে আবার যথাসময়ে আমেরিকা ফিরে গেল। তবে চিঠিপত্রে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখল।

ইতিমধ্যে আমিও ফিরে গেলাম আমার জীবনে-রুজিরোজগারের ধান্দায়।

একসময় ঘুরতে ঘুরতে জিপসি একরে উপস্থিত হয়েছিলাম। জায়গাটা খুবই পছন্দ হয়ে গেল। গ্রেটাকে চিঠিতে সে কথা জানালাম।

এরপর সব ঘটনাই ঘটে চলল ছক বাঁধা পথ ধরে। পরিকল্পনা মতই জিপসি একরেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ হল ইলিয়ার সঙ্গে।

গ্রেটা তার আগেই ইলিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিল, কিভাবে সে আত্মীয়স্বজনের কঠিন অনুশাসনের বাইরে গিয়ে স্বাধীন জীবন উপভোগ করতে পারে।

সেই পরামর্শ মতই ইলিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার একুশ বছর বয়স হলে, ইংলণ্ডে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে।

নিখুঁতভাবে পরিকল্পনাটা ছকে ছিল গ্রেটা। এবিষয়ে তার মাথা যে খুব ভাল খেলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সমস্ত খুঁটিনাটি বজায় রেখে এমন একটা পরিপাটি ফন্দি কখনোই আমার মাথায় খেলত না।

তবে নিজের ভূমিকাটুকু নিয়ে আমার কোন উদ্বেগ ছিল না। বিশ্বাস ছিল, সুষ্ঠুভাবেই তা সম্পন্ন করতে পারব।

আমাদের পরিকল্পিত পথেই ইলিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা থেকে পরবর্তী ঘটনাবলী এগিয়ে চলল।

আশপাশের কারোর মনে যাতে আমার ও গ্রেটার সম্পর্কে কোন সন্দেহ উঁকি দিতে না পারে সেজন্য আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, আগাগোড়া আমরা পরস্পরের মধ্যে একটা। রেষারেষির ভাব বজায় রেখে চলব।

রঙ্গমঞ্চে গোটা পরিকল্পনাটাকে বাস্তবায়িত করা খুবই ঝুঁকির কাজ ছিল। কিন্তু আমাদের দুজনের নিপুণ অভিনয় গোটা ব্যাপারটাকে নির্বিঘ্নে উৎরে দিয়েছিল।

ইলিয়া এমনই নরম স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে ছিল যে তার সঙ্গে প্রেম করা ছিল খুবই সহজ ব্যাপার। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমাকে ভালবেসে ফেলেছিল।…বলতে বাধা নেই…মাঝে মাঝে আমারও সন্দেহ হয়, আমিও হয়তো ওকে ভালবাসতাম। তার সঙ্গ আমার খুবই ভাল লাগত।

তবে গ্রেটা ছিল আমার হৃদয়েশ্বরী। তার পাশে আমি অপর কাউকেই ভাবতে পারি না। সে ছিল আমার সকল কামনা-বাসনার শরীরী প্রতিমূর্তি।

আমি আজ সর্ব অর্থেই একজন সফল পুরুষ। মনের মত নারী, মনের মত বাড়ি এবং অগাধ বিত্ত-সম্পদ আমার করায়ত্ত। ইলিয়ার এক উইলের দৌলতে আমি এখন আমেরিকার ক্রোড়পতিদের একজন।

এই সবকিছু এসেছে খুব সোজা পথে নয়। কেবল ছাল-চাতুরী নয়, খুনও আমাকে করতে হয়েছে, তবে আজ আমি সাফল্যের চূড়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।

আমেরিকা থেকে ফিরে সেদিন সন্ধ্যায় এমনি অনেক কথাই আমার মনে উদয় হয়েছিল। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় এটাই ছিল আমাদের দুজনের, গ্রেটার এবং আমার সত্যিকার পরিচয় বা উদ্দেশ্য বাইরের কেউ বিন্দুমাত্রও আঁচ করতে পারেনি। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাবার মত কোন প্রমাণ কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।

এতদিন কিছুটা উদ্বেগ আশঙ্কা যদিও বা মনে ছিল, আজ আর তার লেশমাত্র নেই। বিপদের সব রকম সম্ভাবনাই আজ মুছে গেছে।

এখন আমি আমার চির আকাঙ্ক্ষিত নারীকে বিবাহ করে নিঃশঙ্ক মনে স্বপ্নপুরীর অধিপতি হয়ে ভোগ-বিলাসের জীবনে ভেসে পড়ব। আমাদের জয় নিঃশেষে উপভোগ করব।

.

 বাড়ির গেটের সামনে আলো জ্বলছিল। সদরে চাবি ছিল না। জুতোর শব্দে বেশ জানান দিয়েই ভেতরে ঢুকলাম।

লাইব্রেরী ঘর পার হয়ে দেখতে পেলাম পাশের ঘরে জানালার ধারে পরী সেজে দাঁড়িয়ে আছে গ্রেটা। আমার জন্যই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তার সেই আগুনজ্বলা রূপ বুকের ভেতরে ঝড় তুলল।

কতদিন তার নীল পদ্মের মত আয়ত চোখে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারিনি, পেলব দেহবল্লরীর সুবিন্যস্ত ভাজ, চড়াই-উৎরাই পেষণসুখে আমাকে আবিষ্ট করেনি।

উন্মত্তের মত ছুটে গিয়ে গ্রেটাকে জড়িয়ে ধরলাম। একটা ঝড় যেন দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেলল খাটের ওপরে।

.

অনেকক্ষণ পরে দুজন শান্ত হলাম। পরিতৃপ্তির আবেশ কেটে গেলে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। গ্রেটা কিছু চিঠি আমার দিকে এগিয়ে দিল। মিঃ লিপিনকটের খামটাই আগে বেছে নিলাম।

ভদ্রলোক আমার উপস্থিতিতেই পাঠিয়েছিলেন। কি এমন কথা থাকতে পারে যা তিনি মুখে না জানিয়ে চিঠিতে লিখতে বাধ্য হলেন?

গ্রেটা বলল, আমরা আজ বিজয়ী–সার্থক। বাইরের কোন প্রাণীই কিছু জানতে পারেনি।

দুজনেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে হেসে উঠলাম। দুজনেই চুম্বন বিনিময় করলাম।

গ্রেটা জানতে চাইল, মাইক এই বাড়িতেই কি আমরা বরাবর বাস করব?

-অবশ্যই। সারাজীবন যেই বাড়ির স্বপ্ন দেখেছি, সেখানে বাস করবারই তো ইচ্ছে আমার। কেন, তুমি কি বলছ?

–আমার ইচ্ছে, এখন তো ইচ্ছে মত খরচ করবার মত অর্থের অভাব নেই আমার, পৃথিবীটা মনের সুখ ঘুরে দেখব। খুশিমতো কেনাকাটা করব। পাহাড় জঙ্গল মরুভূমি কোথাও বাদ দেব না

–তবে সবসময়েই আবার এখানেই ফিরে আসব।

গ্রেটা মাথা নেড়ে সায় জানাল। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুকের মধ্যে যেন একটা অস্বস্তি মোচড় দিয়ে উঠল।

এই রাজকীয় প্রাসাদ, অগাধ বিত্ত–তাতেও সন্তুষ্ট নয় গ্রেটা! আরও কিছু পেতে চায় সে। কিন্তু…কিন্তু তার চাওয়ার কি এখানেই নিবৃত্তি হবে? কিন্তু মানুষের চাওয়ার তো শেষ হয় না–গ্রেটার চাওয়াও যে দিন দিন বেড়ে চলবে।

প্রচণ্ড ক্রোধে মাথার ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। তীব্র আক্রোশে হাত পা কাঁপতে শুরু করল। জোর করে মনটাকে অন্যদিকে নেবার চেষ্টা করলাম। এমন কেন হল হঠাৎ?

লিপিনকটের চিঠিটা টেনে নিলাম। খামের ভেতর থেকে বেরুলো পুরনো খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া একটা ছবি।

ছবিটা কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না–হ্যামবুর্গের একটা কর্মব্যস্ত পথের দৃশ্য। ক্যামেরামেনের সামনেই ছিল কয়েকজন নরনারী। মুখোমুখি এগিয়ে আসছে তারা। প্রথম দুজনকে আমার চিনতে কষ্ট হল না।

পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাসিখুশি ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে। দুই তরুণ তরুণী। তাদের একজন গ্রেটা, দ্বিতীয় জন স্বয়ং আমি।

সমস্ত শরীর যেন মুহূর্তে নিথর হয়ে গেল। মিঃ লিপিনকট তাহলে আমাদের চিনতে পেরেছেন।

গ্রেটা আর আমি দুজনেই যে পূর্বপরিচিত এ তথ্যও তার অজানা ছিল না?

কেউ নিশ্চয় গ্রেটাকে আগে চিনতে পেরেছিল এবং লিপিনকটকে কাগজের কাটিংটা পাঠিয়ে দিয়েছিল।

হয়তো এর পেছনে কোন অভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু ছবিটা হাতে পেয়েই লিপিনকট আমাদের দুজনকে গোড়া থেকেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।

মনে পড়ল, অনেকবারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে তিনি জানতে চেয়েছিলেন গ্রেটার সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কিনা। আমি বরাবরই অস্বীকার করে গেছি।

এখন বুঝতে পারছি, আমার কথা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল, তা তিনি ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। আর তখন থেকেই তাঁর সন্দেহের দৃষ্টি আমার ওপরে ছিল।

প্রচণ্ড একটা ভয় আমাকে ক্রমশ কুঁকড়ে ফেলছিল। হাত-পা শিথিল হয়ে আসতে লাগল। ইলিয়াকে যে আমিই সুকৌশলে খুন করেছি–এমন সন্দেহ না করলেও এধরনেরই কিছু একটা আঁচকরা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। পাকা বুদ্ধির ঝানু মাথা তার।

গ্রেটাও ঝুঁকে ছবিটা দেখল। তাঁরও মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, গ্রেটা, বুঝতেই পারছ, আমরা যে পরস্পরের পরিচিত এবং বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়েই যে নিজেদের পরিচয়ের কথা গোপন করে আমাদের ইলিয়ার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিলাম, প্রথম দিন থেকেই ওই ধূর্ত শেয়ালটা জানতে পেরেছিল।…কিন্তু আসল উদ্দেশ্যটা ধরতে পারেনি। আমি যদি এখন তোমাকে বিয়ে করি, তাহলে তা আর তার কাছে অস্পষ্ট থাকবে না।

গ্রেটা বলল, মাইক, তুমি একটা ভীরু খরগোশের মত হয়ে যাচ্ছ কেন? তোমার সাহসের জন্যই আমি তোমাকে পছন্দ করি। কিন্তু এখন তুমি নিজের ছায়া দেখেই যেন ভয় পাচ্ছ।

আমি বিড়বিড় করে বললাম–এসব কথার আর সময় নেই গ্রেটা। সামনে অসীম অন্ধকার। রাত–অন্তহীন গভীর কাল রাত

–পাগলের মত বকবক করবে না। তুমি কি কাপুরুষ হয়ে পড়ছ–ভয়ে ভেঙ্গে পড়ছ–

–গ্রেটা, অভিশপ্ত জিপসি একরের অভিশাপ থেকে আমরাও মুক্ত থাকতে পারিনি। সত্যিই এ জায়গাটা অভিশপ্ত।

–এসব কুসংস্কার তুমি বিশ্বাস কর মাইক?

আমার ভেতরে কিছুক্ষণ আগের দুরন্ত ক্রোধটা আবার জেগে উঠল। একটা বিদ্বেষ জিঘাংসা।

প্রচণ্ড ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে তাকালাম গ্রেটার মুখের দিকে। আর ধৈর্য রক্ষা করা সম্ভব হল না। কেউ যেন আমাকে জোর করে টেনে তুলল চেয়ার থেকে। ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরলাম গ্রেটাকে। দু হাতে তার কণ্ঠনালী চেপে ধরলাম সজোরে…

তারপর…তারপর…