৪. তিন মহিলার চিঠি

১৬.

ঘড়ির দিকে একবার তাকালাম। তারপর তিন মহিলার চিঠি পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম না, এমন কি জরুরী ব্যাপার তিন মহিলাই একই সঙ্গে জানতে পারল?

একে একে তিনজনের সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করলাম। কিন্তু কারুর কথাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বোধ হল না।

মিস হার্টনেল বলল, মিঃ প্রথেরো খুন হবার দিন মিসেস লেসট্রেঞ্জ বাড়িতে ছিল না। যদিও পুলিসকে তিনি উল্টো কথাই বলেছেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম, সে এটা জানল কি করে? বলল, সেদিন বারবার বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে পরপর দরজা উঁকি দিয়ে দেখেছে। কাউকেই দেখতে পায়নি।

মিস ওয়েদারবাই, পুরো নাম না বলে কেবল এল অক্ষর উল্লেখ করে জানিয়েছে ওই নামের মহিলাকে খুনের ঘটনার সময় ভিকারেজের আশপাশে দেখতে পেয়েছে।

মিসেস প্রাইস রিডলের কথা একেবারেই হাস্যকর। ওর ঝি নাকি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভিকারেজের কোন একটা ঘর থেকে হাঁচির শব্দ শুনতে পেয়েছে।

বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলাম না। প্রার্থনার সময় এগিয়ে আসছিল দেখে উঠে পড়লাম। পথে নামতেই ডঃ হেডকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ..

এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল। হস-এর মানসিক অবস্থা যা দেখছি, আমার মনে হয়, কিছুদিন তার সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া কিংবা হাওয়া বদলের জন্য বাইরে যাওয়া দরকার।

আমার কথা শুনে ডঃ হেডক চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন। পরে বললেন, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। অনেক সময়ই ওর ব্যবহার কথাবার্তা বড্ড বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। তবু তার জন্য দুঃখবোধ না করে পারি না।

একটু চুপ করে পরে আবার বললেন, প্রথেরোর জন্যও দুঃখ হয়। অন্য অনেকের মতই তাকে আমিও পছন্দ করতাম না। বেচারা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাকে আপনি আগে থেকে চিনতেন নাকি?

-হ্যাঁ। আমি যখন ওয়েসল্যাণ্ডে প্র্যাকটিস করতাম তখন সে ওখানেই থাকতো। সে প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা। যাক সে কথা, এদিকের খবরাখবর কতদূর?

আমি ডাক্তারকে তিন মহিলার কথা সংক্ষেপে জানালাম। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পরে বললেন, সেদিন সন্ধ্যাবেলা মিসেস লেসট্রেঞ্জ আমার বাড়িতেই এসেছিল। ওকে বিদায় জানাবার পরই আপনার বাড়ি থেকে মেরী এসে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। কার সঙ্গে দেখা করবে বলে ও তড়িঘড়ি উঠে চলে গিয়েছিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় দেখা করবার কথা বলেছিল, নিজের বাড়িতে কি?

-না, সেসব কিছু বলেনি।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। জঙ্গলের ভেতরে খুঁজে পাওয়া বাদামী রঙের ক্রিস্টালটা বের করলাম। ডাক্তারকে দেখিয়ে বললাম, এই জিনিসটা কি বলুন তো?

ডাক্তার দেখলেন জিনিসটাকে। মুখে হুম শব্দ করলেন। পরে বললেন, এটা পেলেন কোথায়? মনে হচ্ছে পিকরিক অ্যাসিড।

–জিনিসটা কি?

–একটা বিস্ফোরক।

–তা জানি। কিন্তু অন্য আর কি কাজে লাগে?

ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, অনেক কাজেই লাগে। আগুনের সলিউশন হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পেলেন কোথায়?

আমি হেসে বললাম, ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে একটা অদ্ভুত জায়গা থেকে তা বলতে পারি।

.

১৭.

 আমাদের রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে মিস মারপল এলেন। একটা চেয়ার দখল করে–বললেন, খুনের রহস্যটার সমাধানের জন্য আমাদের সকলেরই সহযোগিতা করা উচিত। কয়েকটা ব্যাপার মাথায় এসেছে সেগুলো বলতেই চলে এলাম।

ঘরে গ্রিসলডা আর ডেনিসও ছিল। ওরা আমাদের ঘিরে বসল। ব্যাপারটা নিয়ে ওরাও খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

মিস মারপল একসময় বললেন, মিঃ ক্লেমেট, আপনার নিশ্চয়ই অবাক লাগছে, এরকম একটা ঘটনার ব্যাপারে আমি উৎসাহিত হলাম কেন ভেবে।

আমি হেসে বললাম, খানিকটা বেখাপ্পা যে লাগছে না তা নয়। কিন্তু…

–দেখুন, সব মানুষেরই কিছু একটা হবি থাকে। যেমন কেউ উল বোনে, কারুর সমাজসেবামূলক কাজ, এমনি আরো কত। আমার হবিটা মানব প্রকৃতি বিষয়ে। একটু অদ্ভুত সন্দেহ নেই। কিন্তু বিষয়টা এমনই যে বিস্ময়ের অবধি থাকে না।

মিস মারপল সবার দিকেই একপলক তাকিয়ে নিলেন। পরে বললেন, যা হোক, এবারে আসল কথায় আসি। খুনের ঘটনাটা ক্রমশই এমন ভাবে জট পাকিয়ে উঠেছে যে, সবাই মিলে চেষ্টা না করলে শেষ পর্যন্ত এর তলায় পৌঁছনো যাবে না।

–কথাটা ঠিক বলেছেন। আমি বললাম, কিন্তু যা দেখছি, মনে হচ্ছে, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু গোপন করে যাচ্ছি। ওটাই আশ্চর্য ঠেকছে আমার কাছে।

এরপর আমি তাকে তিন মহিলার কাছ থেকে ঘুরে আসার কথাটা বললাম।

তাছাড়াও মিসেস প্রথেরোর চিলেকোঠার ছবি আবিষ্কারের কথা, আর ডাক্তার হেডক যে কুড়িয়ে পাওয়া ক্রিস্টালটাকে পিকরিক অ্যাসিড বলেছেন সব কথাই তাকে খুলে জানালাম।

মনোযোগ সহকারে সবকথাই শুনলেন মিস মারপল। পরে বললেন, এর প্রত্যেকটা ঘটনাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে খুনের ঘটনার সত্য উদঘাটনে ওগুলো থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না।

 আমি জিগ্যেস করলাম, পিকরিক অ্যাসিডের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না। ওটা ওই জঙ্গলের ভেতরে এল কি করে?

মিস মারপল গ্রিসলডার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি একটা গোয়েন্দা উপন্যাসে পড়েছিলাম, একটা লোককে ওই অ্যাসিড খাইয়ে মারা হয়েছিল।

–কিন্তু এখানে তো বিষ খাওয়ানোর কোন ঘটনা ঘটেনি।

এরপর খুনের ঘটনা সম্পর্কে আমি যে ছকটা করে রেখেছিলাম, সেটা মিস মারপলের হাতে তুলে দিলাম। বললাম, দেখুন তো চোখ বুলিয়ে, কোন পয়েন্ট বাদ পড়ল কিনা।

আমার ছকটা এই রকম–

বৃহস্পতিবার–কর্নেল প্রথেরোর সঙ্গে আমার কথা বলার সময় সকাল ১২-৩০ থেকে সন্ধ্যা ছটা থেকে ছটা পনেরোতে পরিবর্তন করে।

১২-৪৫ মিঃ–পিস্তলটা যথারীতি বুক সেলফের ওপরেই দেখা গেছে।

 ৫-৫০ মিঃ-কর্নেল প্রথেরো এবং অ্যানা প্রথেরো গাড়ি করে গ্রামে যান।

 ৫-৩০-ওল্ডহলের নর্থলজ থেকে আমার কাছে একটা চোরাফোন আসে।

৬-১৫ (দু-এক মিনিট আগে হতে পারে) কর্নেল ভিকারেজে পৌঁছান। আমি ছিলাম না বলে মেরী তাকে পড়ার ঘরে নিয়ে বসায়।

৬-২০ মিঃ–মিসেস প্রথেরোকে পেছনের রাস্তা ধরে একলা ফিরতে দেখা যায়। এরপর বাগান পার হয়ে তিনি পড়ার ঘরের জানালার কাছে যান। কিন্তু কর্নেলকে ঘরে দেখতে পান না। ।

৫-২৯ মিঃ(এক্সচেঞ্জ জানিয়েছে) লরেন্স রেডিং-এর বাড়ি থেকে মিসেস প্রাইস রিডলকে ফোন করা হয়।

৬-৩০–৬-৩৫ মিঃ–বন থেকে গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। লরেন্স রেডিং, অ্যানা প্রথেরো এবং মিস প্রাইস রিডলের জবানবন্দি থেকে জানা যায় শব্দটা আর একটু আগে শুনতে পাওয়া গেছে। সম্ভবত সেটাই ঠিক।

৬-৪৫-লরেন্স রেডিং ভিকারেজে আসে এবং মৃতদেহ দেখতে পায়।

৬-৪৮–আমার সঙ্গে লরেন্সের দেখা হয়।

৬-৪৯–আমি মৃতদেহ আবিষ্কার করি।

৬-৫৫-হেডক মৃতদেহ দেখতে আসে।

পুনঃ মিস ক্র্যাম এবং মিস লেসট্রেঞ্জ–এই দুজন মহিলাকে মনে হয় সন্দেহের বাইরে রাখা যায়।

মিস ক্র্যাম বলেছে যে, সে তার কাজের জায়গায় ছিল। অবশ্য তার এই কথার কোন সমর্থন মেলেনি। অবশ্য এর সঙ্গে খুনের ঘটনার কোন যোগ নেই। এই কারণেই তাকে সন্দেহের বাইরে রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয়জন মিস লেসট্রেঞ্জ। তিনি কারো সঙ্গে ছটা বাজার পরে দেখা করবার কথা আছে বলে ডাঃ হেডকের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন?

মিস লেসট্রেঞ্জের সেই একজন বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই একজনটি কে? মনে হয় কর্নেল প্রথেরোই সেই ব্যক্তি।

এটা বোঝা যাচ্ছে খুন হবার সময়ে মিস লেসট্রেঞ্জ অকুস্থলের কাছাকাছিই কোথাও ছিলেন।

মিঃ প্রথেরোর খুনের সঙ্গে মিস লেসট্রেঞ্জের কোন রকম যোগাযোগ কল্পনা করা যায় না। তার মৃত্যুতে মিস লেসট্রেঞ্জের লাভবান হবার মত কোন সূত্র নেই।

ইনসপেক্টর ব্ল্যাকমেল করবার যে তত্ত্ব তার সম্পর্কে বলেছিলেন, তা অর্থহীন। মহিলাকে দেখলে সেরকম মনেই হয় না।

আবার লরেন্স রেডিং-এর পিস্তলটা তার ঘর থেকে এই মহিলা সরিয়েছেন, এমন ধারণাও করা যায় না।

খুব মনোযোগ দিয়ে ছকটায় চোখ বোলালেন মিস মারপল। মনে হল খুশি হয়েছেন।

–পর্যালোচনা বেশ ভালই হয়েছে।

আমি জানতে চাইলাম, আশা করি আমার লেখার সঙ্গে আপনি একমত

নীরবে ঘাড় নাড়লেন মিস মারপল।

–নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, একবার আপনি বলেছিলেন, এই ঘটনার ব্যাপারে একসঙ্গে সাতজনকে সন্দেহ করা যায়। ওকথা বলে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন তা পরিষ্কার হয়নি। এখন আপনার সন্দেহের আওতায় কে কে রয়েছেন?

মিস মারপল অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি লোককেই আমি সন্দেহ করি।

প্রত্যেকে যদি সমস্ত কথা খুলে বলে তাহলে ঘটনার সঙ্গে তাদের যোগাযোগের ব্যাপারটা অনেকটাই বেরিয়ে আসবে। তখন একটা তত্ত্ব খাড়া করা সম্ভব হবে। কিন্তু সেই সুযোগ তো পাওয়া যাচ্ছে না। আর ওই চিরকূটটা

-হ্যাঁ, চিরকূট কি হয়েছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

–আগেও আপনাকে আমি জানিয়েছিলাম, চিরকূটটা আমাকে খুবই ধাঁধায় ফেলেছে। আমার ধারণা, কোথাও একটা ভুল রয়ে গেছে।

–আমারও ধারণা, বললাম আমি; চিরকূটটা লেখা হয়েছিল ছটা পঁয়ত্রিশে। লেখাটাও কর্নেলের নয়-অন্য কারো। মনে হয় সে সকলের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই সময় ছটা কুড়ি লিখেছিল।

–যত যাই হোক, সবটাই ভুল বলেই আমার বিশ্বাস। জোরের সঙ্গে বললেন মিস মারপল।

–ভুল কেন?

আমার প্রশ্ন শুনে মিস মারপল এক মুহূর্ত কি ভাবলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, শুনুন ভিকার, আমার গেট পার হয়ে মিসেস প্রথেরো লাইব্রেরী ঘরের জানালার কাছে উপস্থিত হয়। কিন্তু ঘরের ভেতরে কাউকেই তার চোখে পড়েনি।

–না পড়ারই সম্ভব, কেননা কর্নেল থেরো লেখার টেবিলে বসে লিখছিলেন। বললাম। আমি।

ভুল, একেবারে ভুল, বললেন মিস মারপল, সময়টা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। তখন ছটা কুড়ি; আর চিরকূটটাতে কি লেখা ছিল? মিঃ প্রথেরো সাড়ে ছটার বেশি অপেক্ষা করতে পারবেন না। এই কথার যৌক্তিকতা বিচার করলে একথা কি মনে হয় না যে ছটা কুড়ি অবধি বসে থেকে ওই কথা কেউ লিখতে পারে না। যদি আমরা সকলে এ বিষয়ে একমত হই তাহলে মিঃ প্রথেরো চিরকূট লেখার জন্য লেখার টেবিলে বসেছিলেন একথা মনে করছি কেন আমরা?

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, ব্যাপারটা আমি এভাবে ভেবে দেখিনি।

–বেশ, তাহলে ব্যাপারটাকে একবার ভালভাবে ভেবে দেখা যাক।

বলে মিস মারপল কি ভেবে নিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে বললেন, মিসেস প্রথেরো জানালার কাছে এসে ভেতরে উঁকি দেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হন। তারপর সেখান থেকে সোজা স্টুডিও ঘরে চলে যান।

–ঘরে কেউ নেই এ সম্পর্কে মিসেস প্রথেরো সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছিল বলেই মনে করছেন?

–হ্যাঁ। কেননা ঘরটা সেই সময়ে সম্পূর্ণ নীরব ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ভেবে নিয়েছিলেন ঘর ফাঁকা।

–তাহলে বলতে চাইছেন–

-হ্যাঁ, বলছি শুনুন। এই ঘটনাটা থেকে আমরা তিনটে জিনিস ভাবতে পারি। প্রথমে যা মনে হয় সেটা হল, মিসেস প্রথেরো যেই সময়ে জানালা দিয়ে উঁকি মেরেছিলেন, খুনের ঘটনাটা তার আগেই ঘটে গেছে।

তবে আমার ধারণা, সেই সম্ভাবনা কম।

 দ্বিতীয়ত যা মনে হয় তা হল, কর্নেল লেখার টেবিলে বসে চিরকুট লিখছিলেন। আমার ধারণা তিনি যে চিরকূট লিখছিলেন তার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওসব অপেক্ষা না করতে পারার কথা উনি লেখেননি।

মিস মারপল থামলেন কিছুক্ষণের জন্য। চোখবুজে কি ভাবলেন। পরে বলল, তৃতীয় ব্যাপার হল-মিসেস প্রথেরোর কথাই ঠিক। ঘরটা তখন যথার্থই ফাঁকা ছিল।

–তাহলে, আপনার কথামতো দেখা যাচ্ছে, মিঃ প্রথেরো লাইব্রেরী ঘরে একবার ঢুকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে আবার ঘরে ফিরে আসেন। বললাম আমি।

মিস মারপল স্মিতহাস্যে ঘাড় নাড়লেন।

–কিন্তু উনি তা করতে গেলেন কেন?

এর পর আমাদের দুজনের মধ্যে আরো কিছু কথা হল। তাকে বিদায় জানাবার জন্য সদর দরজা অবধি সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে গেলাম। সেই সময় জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তো দেখছি চিরকূটটা সমস্যা হয়েই রয়ে গেল।

চলতে চলতে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন মিস মারপল। বললেন, সমস্যা কেন হতে হবে। ওটা যে আসল চিরকূট তা আমি বিশ্বাস করি না। যা হোক, আজ চলি মিঃ ক্লেমেট।

মিস মারপল চলে গেলেন। কিন্তু আমাকে অতি মাত্রায় বিস্মিত করে রেখে গেলেন। কিছুই যেন মাথায় ঢুকছিল না।

.

১৮.

 ভিকারেজে লাইব্রেরি ঘরে বসেছিলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে কর্নেল মেলচেটের আবির্ভাব ঘটল।

–শহরে একটা কাজে এসেছিলাম। ফেরার পথে ভাবলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। সেই সঙ্গে গলাটাও ভিজিয়ে নেওয়া যাবে।

–ওহো, নিশ্চয় নিশ্চয়। বসুন। অভ্যর্থনা জানালাম আমি।

–অবাক করবার মত খবরও অবশ্য একটা রয়েছে।

বেশতো শোনা যাবে। আগে আপনার গলা ভেজাবার ব্যবস্থাটা করা যাক। আমি উঠে গিয়ে হুইস্কি আর সোডা নিয়ে এলাম। তারপর দুটো গ্লাস দুজনে নিয়ে মুখোমুখি বসলাম।

-হ্যাঁ, আপনার অবাক-করা কথাটা এবারে বলুন। বললাম আমি।

-খবরটা অবাক হবার মতই। সেই চিরকুটটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? মিঃ প্রথেরো খুন হবার আগে যেটা লিখেছিলেন?

-হ্যাঁ, মনে আছে। ঘাড় নেড়ে বললাম আমি।

–একজন এক্সপার্টের কাছে সেটা আমরা পাঠিয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম ছটা কুড়ি লেখাটা অন্য কারোর হাতের কিনা। মিঃ প্রথেরোর হাতের লেখার নমুনাও সেজন্য পাঠানো হয়েছিল।

–রায় কি জানা গেল। আমি উদগ্রীব হলাম।

–এক্সপার্ট কি জানালো জানেন? চিরকূটের কোন লেখাই নাকি মিঃ প্রথেরোর হাতে লেখা নয়।

-তার মানে অন্য কারো হাতের লেখা মিঃ প্রথেরোর বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছিল?

–হ্যাঁ। ওটা জাল। ছটা কুড়ি লেখাটা এবং অন্য লেখাগুলোও ভিন্ন হাতে লেখা। মিঃ প্রথেরো ওই চিরকূট লেখেনইনি। ওরা এ বিষয়ে নিশ্চিত।

আমরা দুজনেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম। পরে ধীরে ধীরে বললাম, আজ সন্ধ্যাবেলা মিস মারপল এসেছিলেন। তিনিও ঠিক ওই একই কথা বলে গেছেন।

–মিস মারপল?

-হ্যাঁ। তিনি বলেছিলেন, চিরকূটের ব্যাপারটাই ভুল। কর্নেল মেলচেট কথাটা শুনে যে খুশি হতে পারলেন না তা তার মুখভাব দেখেই বোঝা গেল।

–যে খুনটা করেছে, এই কথা কেবল সেই বলতে পারে।

ঠিক এমনি সময়ে ফোন বেজে উঠল। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম। বললাম, আমি ভিকারেজ থেকে বলছি। আপনি কে কথা বলছেন?

জবাবে একটা অদ্ভুত ত্রস্ত গলা ভেসে এলো। উন্মত্তের মতো কেউ বলে চলল, হে ঈশ্বর আমি স্বীকারোক্তি দিতে চাই–আমি স্বীকারোক্তি দিতে চাই

কথা শেষ হবার আগেই লাইনটা কেটে গেল। বিস্মিত হয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। চেয়ারে ফিরে এসে মিঃ মেলচেটের দিকে তাকিয়ে বললাম, এবারে আপনার পাগল হবার পালা।

–পাগল? আমার, কেন কি হল? বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন মেলচেট।

পর পর দুজন খুনের স্বীকারোক্তি দেবার পরে বলেছিলেন মনে আছে যে, এর পরে কেউ স্বীকারোক্তি দিতে এলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন?

-হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কি

স্বীকারোক্তি দিতে চেয়ে আর একজন ফোন করেছিল। কিন্তু মাঝপথেই এক্সচেঞ্জ লাইনটা কেটে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে ইনসপেক্টর চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়াল। আমাকে হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিল।

–এক্সচেঞ্জের সঙ্গে আমি কথা বলছি।

বেশ তো দেখুন চেষ্টা করে। আমি ততক্ষণ বাইরে যাচ্ছি। তবে গলার স্বরটা আমি মনে হয় চিনতে পেরেছি।

আমি দ্রুত পায়ে ভিকারেজ থেকে বেরিয়ে পথে নামলাম। রাত তখন এগারোটা। সেন্টমেরী মীড-এর গোটা গ্রামটাই নিঃঝুম হয়ে আছে। রোববার বলে সকলেই আজ আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছে।

হস-এর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। একতলায় কেউ জেগে আছে মনে হল। একটা জানালার ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত হসই জেগে রয়েছে। দরজার সামনে গিয়ে বেল বাজালাম।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ফের যখন বেল বাজাতে যাচ্ছি, দরজা খুলল হস-এর বাড়িউলি।

–জানালায় আলো দেখলাম, মনে হয় হস জেগে আছে। একবার দেখা করে যাই ওর সঙ্গে। বেশ তো যান। রাতের খাবার পরে আমি আর ওর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। ভদ্রমহিলা বলল।

জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে?

না–বাইরের কেউ আসেনি। পুরো সন্ধ্যাটাই ঘরে একা ছিল।

আমি ভেতরে পা বাড়ালাম। এক তলায় দুটো ঘর নিয়ে হস থাকে। একটা শোবার ঘর। দ্বিতীয়টা বসার ঘর। আমি দ্রুতপায়ে সেই ঘরে ঢুকলাম।

বড় একটা চেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে হস। দেখে মনে হল ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল না।

পাশেই টেবিলে একটা ছোট ডালা খোলা বাক্স। আর অর্ধেক জলভর্তি একটা গ্লাস।

ঘরের চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজ চোখে পড়ল ওর পায়ের কাছে।

এগিয়ে গিয়ে পোঁটলা পাকানো কাগজটা তুলে সোজা করে নিয়ে পড়লাম।

পাশেই টেলিফোনটা ছিল। রিসিভার তুলে ভিকারেজে ফোন করলাম। কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না। এনগেজড।

এক্সচেঞ্জে নাম্বারটা জানিয়ে রাখলাম। বলে দিলাম, পরে ফোন করতে।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে চিঠিটা বার করলাম। ইনসপেক্টর মেলচেটকে দরজা খুলে দেবার সময়ে চিঠির বাক্সে পেয়েছিলাম এটা। তখন আর পড়ার সুযোগ হয়নি। এবারে সেটা খুললাম।

হস্তাক্ষর পরিচিতই মনে হল। কিন্তু ভাষার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।

এরকম হস্তাক্ষর কোথায় দেখেছি মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। মুহূর্তের মধ্যেই স্মরণে এসে গেল। হ্যাঁ, হুবহু একই রকম হস্তাক্ষরে লেখা ছিল মিঃ প্রথেরোর মৃতদেহের পাশ থেকে যে চিরকূটটা পাওয়া গিয়েছিল তাতে।

দুর্বোধ্য চিঠিটা আরো কয়েকবার পড়লাম। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হল না। ঠিক এমনি সময়ে ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভারটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে, ইনসপেক্টর মেলচেট কথা বলছেন কি?

-হ্যাঁ, অপর পাশ থেকে জবাব এলোে; আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন? আমি কিন্তু একটু আগের ফোনটার সন্ধান পেয়ে গেছি।

–জানি আমি নাম্বারটা। বললাম।

–তাই বুঝি! তাহলে কি সেই জায়গা থেকেই এখন কথা বলছেন?

–হ্যাঁ, আমি সেখানেই আছি।

–তাহলে স্বীকারোক্তির কি হল?

–স্বীকারোক্তি পেয়েই গেছি বলতে পারেন।

–তার মানে, ইনসপেক্টরের স্বর উত্তেজিত শোনালো, তাহলে কি খুনীকে পেয়ে গেছেন?

আমিও যথেষ্ট উত্তেজনা বোধ করছিলাম। চেয়ারে শায়িত হস-এর দিকে একপলক তাকালাম। তারপর ভাজ খাওয়া চিঠিটা, ডালা-খোলা ছোট্ট বাক্সটা–সব কিছুর ওপরেই দৃষ্টি ঘুরে এলো আমার। বাক্সটার ওপরে সিরুবিম নাম লেখা।

ইনসপেক্টরকে বললাম, এখনো সঠিক বলতে পারছি না। আপনি এখুনি এখানে চলে আসুন।

এরপর ঠিকানাটা দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। দেখি, ইনসপেক্টর আসুক।

হস-এর উল্টো দিকে একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পরেই দরজায় ইনসপেক্টর মেলচেটের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

ঘরে পা দিয়ে ইনসপেক্টর প্রথমে নিদ্রিত হস-এর দিকে তাকালেন। পরে আমার দিকে ফিরে বললেন, কি ব্যাপার? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

আমি হস-এর ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া চিঠিটা বাড়িয়ে দিলাম। চিঠিটা উঁচু গলায় পড়তে লাগলেন তিনি প্রিয় ভিকার,

খুবই অপ্রিয় একটা বিষয় আমাকে বলতে বাধ্য হতে হচ্ছে। তবে লিখেই জানাব ঠিক করেছি। পরে আমরা কোন এক সময়ে এ নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সাম্প্রতিক খুনের ঘটনার সঙ্গে এটার যোগ রয়েছে।

কোন নিযুক্ত যাজককে দোষী করা খুবই যন্ত্রণাদায়ক বলে আমার মনে হচ্ছে। তবে কষ্ট হলেও ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেওয়া আমার কর্তব্য। যেমন ধরুন…

চিঠি থেকে মুখ তুলে ইনসপেক্টর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।

চিঠিটা ওখানেই শেষ হয়েছে। শেষ কথাগুলো খানিকটা আঁকাবাঁকা আঁচড়ের মত, লিখতে লিখতে যেন শরীর এলিয়ে পড়েছে; বোঝা যায়।

ইনসপেক্টর মেলচেট একটা গভীর শ্বাস নিল। হস-এর দিকে তাকাল।

-তাহলে এখানেই শেষ হল রহস্য। অনুশোচনায় জর্জরিত হয়েই হস স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয়েছে।

কথা শেষ করে ইনসপেক্টর হস-এর দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে আলতো করে নাড়া দিল। পরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে লাগলেন।

নেশা করেছে। ঘুম নয়।

বলে ডালা-খোলা বাক্সটার দিকে তাকালেন। ঘুরে সেটা তুলে নিলেন।

–এ কি…

-হ্যাঁ, আমারও ধারণা তাই, বললাম আমি, আগে একদিন আমাকে ওটা দেখিয়েছিল। বলেছিল, ওটা বেশি খাওয়া বিপজ্জনক। নিরাপদ পথ ভেবে ওটা খেয়েই নিজেকে শেষ করেছে।

খুনীকে হাতে পেলে পুলিশ অফিসাররা সম্ভবত সকলেই একরকম ব্যবহার করে থাকে। ইনসপেক্টর মেলচেটও অস্বাভাবিক তৎপর হয়ে উঠলেন। কি করে খুনীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে সেই চিন্তাই মন জুড়ে বসেছে।

দুপা এগিয়ে ঝট করে রিসিভারটা তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর লাইন পেলেন। বললেন, কে ডাঃ হেডক? আপনি এখুনি উনিশ নম্বর হাই স্ট্রীটে চলে আসুন। হ্যাঁ, হস মনে হচ্ছে কোন একটা ওষুধ বেশি খেয়ে ফেলেছে। চটপট চলে আসুন।

চিন্তিত ভাবে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। অস্থিরভাবে ঘরের ভেতর পায়চারী শুরু করলেন।

একসময় আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ওই চিঠিটা কোথায় পেয়েছেন আপনি?

 –মেঝেয় পড়েছিল দোমড়ানো অবস্থায়। সম্ভবতঃ হস-এর হাতেই ছিল–

–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। ভিকারেজের ঝি-টাই দেখছি ঠিক ছিল। যে চিঠিটা আমরা পেয়েছিলাম সেটা জালই ছিল। ভাল বলতে হয় যে ও চিঠিটা নষ্ট করেনি।

একটু থেমে কি ভাবলেন। পরে বললেন, যদি এটা পাওয়া না যেত তাহলে খুনীকে ধরা অসম্ভব হয়ে পড়ত। অবশ্য খুনীরা কোন না কোন সময়ে এরকম একটা ভুল করে থাকে। সেই ভুলটাই তাদের ধরিয়ে দিতে প্রধান ভূমিকা নেয়। কি ব্যাপার মিঃ ক্লেমেট, মনে হচ্ছে আপনি খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।

–হ্যাঁ, তাই, বললাম আমি, অনেক সময় হসকে আমার কেমন সন্দেহজনক মনে হত। কিন্তু এরকমটা কখনো ভাবতে পারিনি…

বাইরে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। ইনসপেক্টর সংক্ষেপে তাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন।

ডাক্তার হেডক ভ্রূ কোচকালেন। হস-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। হাত টেনে নিয়ে নাড়ী দেখলেন। চোখের পাতা টেনে পরীক্ষা করলেন।

আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বললেন, ওকে যদি ফাঁসিতে লটকাতে চাও, তাহলে এখনো ক্ষীণ আশা আছে, চেষ্টা করলে হয়তো বাঁচানো যেতে পারে।

সঙ্গে করে আনা বাক্সটা খুললেন ডাক্তার। ঝটপট একটা ইনজেকশান করলেন হস-এর হাতে।

পরে ইনসপেক্টর মেলচেটকে বললেন, এই মুহূর্তে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। আপনারা হাত লাগান একটু আমি ওকে গাড়িতে তুলে নিচ্ছি।

আমরা দুজনে ধরাধরি করে হসকে ডাক্তারের গাড়িতে তুলে দিলাম। ডাক্তার ড্রাইভারের সিটে বসতে বসতে বললেন, তবে মিঃ মেলচেট, মনে হয় আপনারা ওকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারবেন না।

তার মানে ও আর বাঁচবে না বলছেন? বললেন ইনসপেক্টর।

বাঁচা না বাঁচা দুটোই অনিশ্চিত। আমি সেকথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি, হস যদি বেঁচেও যায়, খুনের জন্য ওকে দায়ী করা যাবে না। দরকার হলে তার জন্য আমি সাক্ষ্য দেব।

ডাক্তার গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমরা আবার ঘরে ফিরে এলাম। ইনসপেক্টর বললেন, ডাক্তারের কথা বলার মানে কি ভিকার?

আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। হস যে এনসিথাইসিস ল্যাথার্জীতে ভুগছে সেকথা ওকে বললাম।

-ওটা তো অনেকটা মানসিক অবসাদের রোগ তাই না? স্লীপিং সিকনেস। ইনসপেক্টর বললেন, ডাক্তার কি মনে করছেন, এখনকার দিনে কুকর্মের পেছনে যুৎসই কারণ দেখাতে পারলেই অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে?

আমি জবাবে কিছু বলবার আগেই হঠাৎ দরজা খুলে গেল। মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন।

–আপনাদের কাজের মধ্যে এসে পড়লাম, দুঃখিত। শুনলাম হস অসুস্থ, তাই চলে এলাম। মনে হল, যদি ওর জন্য কিছু করার দরকার হয়।

–এসে ভালোই করেছেন, বললেন ইনসপেক্টর, তবে আপনার করার মত কিছু নেই আপাতত ডাক্তার হসকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেছেন।

মিস মারপল যেন খুশি হলেন কথাটা শুনে বললেন, যা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। হস হাসপাতালে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু ওর জীবনের আশঙ্কা নেই তো?

–তা বলতে পারছি না। বললেন ইনসপেক্টর।

ডালা-খোলা শূন্য বাক্সটার দিকে চোখ পড়ল মিস মারপলের। বললেন, ওটা বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেছিল মনে হচ্ছে?

আমি এ কথার জবাব না দিয়ে হস-এর অসমাপ্ত চিঠিটা মিস মারপলের দিকে এগিয়ে দিলাম।

চিঠিটা পড়লেন তিনি। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন না।

–এরকম একটা ব্যাপারই নিশ্চয় আপনি অনুমান করেছিলেন? বললাম আমি।

–তা করেছিলাম, বললেন মিস মারপল, আচ্ছা ভিকার, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি

বলে অন্যমনস্কভাবে চিঠিটার দিকে একবার তাকালেন। পরে বললেন, আপনি এখানে এসেছিলেন কেন? এ সময়ে তো আপনার আসার কথা নয়।

ফোনের কথাটা মিস মারপলকে বলতে হল। বললাম, ফোনে হস-এর গলার স্বর ধরতে পেরেছিলাম। তাই ব্যাপারটা কি দেখতে চলে এসেছিলাম।

কিন্তু মারপল চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়ালেন। বললেন, যা বুঝতে পারছি, সেজন্যেই ঠিক সময়ে আপনি এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

–ঠিক সময়? কিসের ঠিক সময়? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

–হস-এর জীবন বাঁচাবার কথাই বলছি আমি। আর দেরি হয়ে গেলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত না।

-হস বেঁচে উঠলে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হয়ে উঠবে। কেবল ওর নিজের জন্য নয়, সবার জন্যই ওর বেঁচে ওঠা দরকার। আমরা এখন সত্যটা জানি। আর…

মিস মারপল অদ্ভুতভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, একথাটাই সে আপনাকে এবং অন্য সকলকে ভাবাতে চেয়েছিল। আপনি ভাবছেন সত্যটা জেনে গেছেন। আপনি তাই ভাবছেন হস-এর বাঁচাটা সবার পক্ষে ভাল। সব কিছুই ঘটনার সঙ্গে খাপ খেয়ে যাচ্ছে। চিঠি, অতিমাত্রায় ওষুধ, হস-এর মানসিক অবস্থা আর তার স্বীকারোক্তি–সবই মনে হচ্ছে একই সূত্রে বদ্ধ–কিন্তু এ সবই ভুল…ভুল।

আমরা দুজনেই চমকে মিস মারপলের দিকে তাকালাম।

মিস মারপল বলে চললেন, হসকে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এতে আমি নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। তার পক্ষে ওই জায়গাটাই নিরাপদ। ওখানে কেউ ওর অনিষ্ট করতে পারবে না।

একটু থেমে ফের বললেন, যদি ঈশ্বরের দয়ায় হস বেঁচে ওঠে তাহলে সত্য রহস্যটা ওর কাছ থেকেই জানা যাবে।

–সত্য রহস্য মানে?

–হ্যাঁ সত্য রহস্য। খুন তো দূরের কথা হস মিঃ প্রথেরোকে ছোঁয়নি পর্যন্ত।

–কিন্তু টেলিফোন, অতিরিক্ত ওষুধ, অসমাপ্ত চিঠি–এসব থেকেই তো আসল রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে।

হাসলেন মিস মারপল। বললেন, সেকথাই তো বলছি। খুনী বড় চতুর, সে একথাটাই আপনাকে বোঝাতে চেয়েছিল।

-খুন বলতে আপনি কাকে বোঝাচ্ছেন? বললাম আমি।

–আমি প্রকৃত খুনীর কথাই বলছি–অর্থাৎ মিঃ লরেন্স রেডিং-এর কথাই বলছি।

.

১৯.

 ভীষণভাবে চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। এমন সরাসরি কি করে নাম বলতে পারছেন মিস মারপল? কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এমন অসংযত কথা নিশ্চয় স্বাভাবিক অবস্থায় বলছেন না ভদ্রমহিলা।

আমি এবং ইনসপেক্টর পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে রইলাম। অবশেষে ইনসপেক্টরই প্রথম কথা বললেন, এ একেবারেই অসম্ভব মিস মারপল। লরেন্স রেডিং সম্পূর্ণ ভাবেই আমাদের সন্দেহের বাইরে।

-খুবই স্বাভাবিক, বললেন মিস মারপল, লরেন্স বরং নিজেকে খুনী প্রমাণ করবার জন্যই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।

-ওটা আমাদের বিভ্রান্ত করার একটা কৌশল ছিল তার, বললেন মিস মারপল, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, লরেন্সের স্বীকারোক্তির কথা শুনে আমি খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই খবর শোনার পর আমার সমস্ত ভাবনা ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। কেননা ওকে বরাবরই আমি নির্দোষ বলে ভেবে এসেছিলাম।

–তাহলে আপনি লরেন্স রেডিংকেই খুনী বলে সন্দেহ করছেন? 

–সত্যিকথা বলতে কি, বইতে প্রায়ই দেখা যায়; সন্দেহভাজন নয় এমন ব্যক্তিই শেষ পর্যন্ত খুনী বলে প্রমাণ হয়। কিন্তু বই-এর কোন কিছুই বাস্তবের সঙ্গে আমি মেলাতে যাই না। মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে আমার খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। 

সব কিছু দেখে শুনে আমি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলাম, ভদ্রমহিলা পুরোপুরি লরেন্সের কবজায় চলে গেছেন। অবশ্য লরেন্স খুব ভালোভাবেই জানত মিসেস প্রথেরো চালচুলোহীন এক মহিলা। এমন এক সঙ্গিনীকে নিয়ে পালিয়ে যাবার মত বোকা লরেন্স কোনকালেই ছিল না।

সেই কারণেই কর্নেল প্রথেরোকে সরিয়ে দেওয়া তার দরকার হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত করেও ছিল তাই।

আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে ওরকম চমৎকার দেখতে একজন মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনা বলতে কিছু ছিল না।

মিস মারপল থামলেন। বোঝা যাচ্ছিল ইনসপেক্টর খুবই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, এ মেনে নেওয়া যায় না। সম্পূর্ণ অসম্ভব। ছটা পাঁচ মিনিট পর্যন্ত লরেন্সের গতিবিধি আমরা খুঁটিয়ে বিচার করে দেখেছি। আর ওই সময়ের মধ্যে কোন মতেই যে মিঃ প্রথেরোকে গুলি করা হয়নি সে-কথা ডাঃ হেডকও বলেছিলেন। একজন ডাক্তারের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমাদের থেকে বেশিই বলা চলে। তা যদি না হয় তাহলে বলতে হয়, ডাক্তার হেডক মিথ্যা কথা বলেছেন।

–ডঃ হেডকের সাক্ষ্য কোথাও ভুল নেই। বললেন মিস মারপল। ভদ্রলোক সম্পূর্ণ নির্ভেজাল। তবে এটাও সত্যিকথা যে লরেন্স নয় মিঃ প্রথেরোকে গুলিটা করেছিল মিসেস প্রথেরোই।

আরও একবার চমকে উঠলাম আমরা। মিস মারপল মাথা নাড়লেন, শালটা কাঁধে জড়িয়ে নিলেন। পরে বললেন, আমার কথা সম্পূর্ণই ঠিক, এখনো পর্যন্ত অবশ্য বলতে পারছি না। এটাও ঠিক যে কেবল বিশ্বাস দিয়ে কোন অভিযোগ খাড়া করা যায় না। তার জন্য দরকার হয় নির্ভুল প্রমাণ। কারো বক্তব্য বা কাজ যদি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে না মেলে তাহলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।

আমার নিজের ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ নয়। একটা বিষয়ে এখনও খটকা লেগে রয়েছে। হঠাৎই সেটা আমার নজরে পড়েছে।

বলে একটু থামলেন মিস মারপল। কি ভাবলেন। পরে বললেন, ভিকারের লাইব্রেরী ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে আচমকা জানলার খোপে একটা কালো মত জিনিস আমার চোখে পড়ে গিয়েছিল।

–অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য সব কথা আপনি শোনাচ্ছেন মিস মারপল। বলে উঠলেন ইনসপেক্টর।

একথায় কান না দিয়ে মিস মারপল বলে চললেন, যা ভেবে বিশ্বাস করেছিলাম তার জন্য আমি দুঃখিত।

কেননা, ওদের দুজনকেই আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু মানুষের বিচিত্র প্রকৃতির কথা তো আপনার অজানা নয়।

ঘটনার শুরুতেই ওদের দুজনকে বোকার মত স্বীকারোক্তি দিতে দেখে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি ভুল বুঝেছিলাম। দোষী হিসেবে অন্য অন্য লোককে নিয়ে ভাবনা শুরু হয়ে ছিল আমার। কর্নেল প্রথেরো খুন হলে কোন না কোন ভাবে তাদের লাভবান হবার কথা এমন সব লোক।

–একারণেই আপনি বলেছিলেন খুনের ব্যাপারে সাতজনকে সন্দেহ করা চলে? বললাম আমি।

-হ্যাঁ, অনেকটাই তাই, হাসলেন মিস মারপল, ধরুন আপনার ওই আর্চার। মদ খেলে লোকটা খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তারপর ধরুন আপনার ওই মেরী। সে অনেকদিন আর্চারের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে। মেয়েটা খুবই বদমেজাজি। সুযোগ এবং উদ্দেশ্যও অনুকূলে। মেরী বাড়িতে একলাই ছিল। আর ওই বুড়ি আর্চার খুব সহজেই লরেন্সের বাড়ি থেকে পিস্তলটা সরিয়ে নিতে পারত।

এরপর ধরুন লেটিসের কথা। টাকা আর স্বাধীনতার জন্য সে সবকিছুই করতে পারে। ওর মত অনেক সুন্দরী মেয়ে আমি দেখেছি যাদের নৈতিক জীবন বলে কিছু নেই।

ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বোধ করলেও আমরা নিঃশব্দে মিস মারপলের কথা শুনে যেতে, লাগলাম।

মিস মারপল বলে চললেন, টেনিস র‍্যাকেটের কথাটাই এবারে ধরা যাক।

–টেনিস র‍্যাকেট?

-হ্যাঁ টেনিস র‍্যাকেট। ভিকারেজের গেটের কাছে পড়ে ছিল সেটা। মিসেস প্রাইস রিডলের বাড়ির ঝি ক্লারা সেটা কুড়িয়ে পেয়েছিল।

এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে–খেলা থেকে ফেরার যে সময়ের কথা ডেনিস বলেছিল; তার আগেই ফিরে এসেছিল।

আপনারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, বছর খোল বয়সের ছেলেদের ব্যবহার স্বভাবতই খানিকটা সন্দেহজনক আর ভারসাম্যহীন হয়ে থাকে।

উদ্দেশ্যহীন ভাবেও ডেনিসের বয়সী ছেলেরা আপনার কিংবা লেটিসের জন্য অনেক কিছু করে ফেলতে পারে। আর উদ্দেশ্য থাকলে তো রীতিমত বেপরোয়া হয়ে ওঠে–সেই কাজের পরিণতি যাই হোক না কেন।

ডেনিস আর লেটিসের মধ্যে যে প্রেমের একটা ব্যাপার চলেছে আশা করি সেটা আপনারও নজরে পড়েছে।

কথা শেষ করে মিস মারপল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

ইনসপেক্টর একপলক আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।

মিস মারপল পুনরায় বলতে শুরু করলেন, এবারে আসি আপনার আর হতভাগ্য হস-এর কথায়।

–আমি! সবিস্ময়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

–হ্যাঁ! ঘাবড়াবার কিছু নেই ভিকার। আপনি যে সত্যই কিছু করেছেন অতটা আমি ভাবছি না। তবে সেই চুরি যাওয়া টাকাটার প্রসঙ্গ আমি মনে করিয়ে দিতে চাইছি।

তার জন্য আপনি অথবা হস দুজনের যে কোন একজন দায়ী।

মিসেস প্রাইস রেডলি কিন্তু আপনাকেই সন্দেহ করেছিল। তার কারণও অবশ্য ছিল। ব্যাপারটা নিয়ে তল্লাসীর কথা যখন সে বলেছিল, একমাত্র আপনিই তখন প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন।

আমি নিজে অবশ্য সন্দেহ করতাম হস-কেই।

যাই হোক, আমার সন্দেহের আওতার সাত জনের মধ্যে পরবর্তী নামটি হল আপনার স্ত্রী গ্রীসলডা।

মিসেস ক্লেমেট অবশ্যই সমস্ত সন্দেহের বাইরে। বাধা দিলেন ইনসপেক্টর মেলচেট, কেননা তিনি ঘটনার অনেক আগেই শহরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন ছটা পঞ্চাশের ট্রেনে।

মিস মারপল হাসলেন। বললেন, সে তো তার নিজের কথা। একজন যা খুশি বলতেই পারে, তাই বলে সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে কি মেনে নেওয়া ঠিক?

আপনারা জানেন কিনা জানি না, সে রাত্রে ছটা পঞ্চাশের ট্রেন প্রায় আধঘণ্টা দেরি করে এসেছিল। তাছাড়াও, আমি নিজের চোখেই গ্রীসলডাকে রাত সওয়া ছটার সময় ওল্ড হলের দিকে যেতে দেখেছি।

তাহলে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিতে পারি ছটা পঞ্চাশের আগের কোন ট্রেনেই গ্রীসলডা শহর থেকে ফিরেছে।

মিস মারপল অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে কেবল জিজ্ঞাসাই ছিল না। আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করলাম। গ্রীসলডা যে নির্ধারিত ট্রেনের আগে ফিরেছে একথা আমাকে জানায়নি।

অস্বস্তি কাটাবার জন্যই কিছুক্ষণ আগে যে বেনামী চিঠিটা খুলেছিলাম সেটা পকেট থেকে বার করে আনলাম।

চিঠিতে লেখা ছিল, লরেন্স রেডিং-এর বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে গ্রীসলডাকে বেরতে দেখা গিয়েছিল ছটা বেজে কুড়ি মিনিটে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য নানা রকম সন্দেহ খেলে গেল মাথায়। মনে হতে লাগল আমি যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি।

একটা দৃশ্য বড় অস্পষ্ট হয়ে উঠল–গ্রীসলডা আর লরেন্স ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর মিঃ প্রথেরো ব্যাপারটা জানতে পেরে গেছেন। তাতে তারা দুজন খুবই ভীত হয়ে পড়েছে।

মিঃ প্রথেরো ঘটনাটা বলে দিতে পারেন সন্দেহ করে দুজনেই মরীয়া হয়ে ওঠে। সেই পথ বন্ধ করার জন্য তারপর গ্রীসলডা মিঃ প্রথেরোকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে এবং লরেন্সের ঘর থেকে তার পিস্তলটা চুরি করে।

সাপের মত জড়িয়ে ফেলবার আগেই এ দুঃসহ ভাবনাটাকে মাথা থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। মিস মারপল, এরকম কোন ভাবনা ভাবছে কিনা বুঝতে পারছি না।

চিঠিটা, মিস মারপলের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়লেন। নীরবেই আমাকে ফেরত দিলেন।

কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থেকে তিনি বলতে শুরু করলেন, এখন এই রহস্য সম্পর্কে আমি যা ভেবেছি তা আপনাদের বলছি। আপনারা আমার কথা মেনে নেবেন এমন কথা আমি বলতে চাই না।

তবে না মানলেও আমার কিছু যায় আসে না। তবে কর্তব্যজ্ঞানেই আমি আমার ভাবনার কথা প্রকাশ করছি।

কথা শেষ করে থামলেন মিস মারপল। চুপ করে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। মনে হয় মনে মনে ঘটনাগুলো সাজিয়ে নিলেন।

-খুনের ঘটনার রহস্য নিয়ে আমি নিজে যে ভাবে ভেবেছি তা এইরকম, মিস মারপল বলতে শুরু করলেন, এই খুনটার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাত্রেই। লরেন্স জানত ভিকার নেই, তবু সে ভিকারের সঙ্গে দেখা করার অছিলা নিয়ে ভিকারেজে আসে। সেই সময় পিস্তলটা সে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল। ফাঁকা লাইব্রেরী ঘরে ঢুকে সে পিস্তলটা জানালার একপাশে লুকিয়ে রেখে দেয়।

ভিকার ফিরে এলে লরেন্স তাকে জানায় যে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখান থেকে চলে যাবে।

এর পর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ লরেন্স নর্থলজ থেকে মেয়েলি গলা নকল করে ভিকারকে ফোন করে।

একটু থেমে গায়ের শালটা ঠিক করে নিলেন মিস মারপল। আমরা যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। নিঃশব্দে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এ তো গেল একদিকের কথা। এবারে অপর দিকটা দেখা যাক। মিঃ এবং মিসেস প্রথেরো গাড়ি করে গ্রামের দিকে বেরিয়ে ছিলেন।

তখন একটা ব্যাপার লক্ষ্য করবার মত ছিল। মিসেস প্রথেরো বেরোবার সময় কোন হাতব্যাগ সঙ্গে নেননি। কোন মহিলা বাইরে বেরুবার সময় হাতব্যাগ সঙ্গে নেয়নি, এ ঘটনাটা যে খুবই অস্বাভাবিক নিশ্চয় আপনারা তা স্বীকার করবেন।

যাই হোক, মিসেস প্রথেরো আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যখন যায় তখন সময় ছটা বেজে কুড়ি মিনিট।

সে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে গল্পও করে। সঙ্গে কোন অস্ত্র যে নেই এটা আমাকে বোঝাবার জন্যই সে এটা করেছিল। আমার দৃষ্টি যে খুব প্রখর তা তার অজানা ছিল না। তাই পরিকল্পনা করেই ব্যাগছাড়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।

এরপর ভিকারেজের বাড়িটা ঘুরে লাইব্রেরী ঘরের পেছনে জানলার দিকে চলে যায়। সে জানত পিস্তলটা কোথায় আছে। সেটা তুলে নেয়।

কর্নেল প্রথেরো সেই সময় লাইব্রেরী ঘরে লেখার টেবিলে বসেছিলেন। ভিকারকে উদ্দেশ্য করে কিছু লিখছিলেন।

আপনারা তো জানেন কর্নেল খানিকটা কানে খাটো ছিলেন। সেই কারণেই তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর স্ত্রী কখন পিস্তল হাতে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

অ্যানা প্রথেরো নির্ভুল নিশায় মাথায় গুলি করে। তারপর পিস্তলটা সেখানেই ফেলে রেখে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। দ্রুতপায়ে বাগানে চলে আসে সে। স্টুডিও ঘরে লরেন্সের সঙ্গে তার দেখা হয়। দুজনে ঘরে ঢুকে যায়।

অ্যানা প্রথেরো যথেষ্ট চতুর। সে জানত আমি বাগানে রয়েছি। আর যতক্ষণ ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে না আসে স্বাভাবিক কৌতূহলের বশেই আমি যে বাগান ছেড়ে নড়ব না তা-ও সে বুঝতে পেরেছিল।

কিছুক্ষণ পরেই ওরা স্টুডিও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের হাবভাব বা ভঙ্গিতে কোনরকম অস্বাভাবিকতা ছিল না। উৎফুল্লভাবেই তারা কথাবার্তা বলছিল।

এ পর্যন্ত সবই ছিল নিখুঁত। কোথাও দৃষ্টিকটু কিছু ছিল না। কিন্তু এর পরেই ওরা পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে চলে না গিয়ে প্রথম ভুলটা করে বসল। স্বাভাবিক দুর্বলতার বশেই খুবই দৃষ্টিকটু ব্যাপার ওরা করে ফেলে।

নিজেদের নির্দোষ দেখাবার জন্য যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গেই ওরা কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গী বজায় রেখে চলছিল।

মিনিট দশেক পরেই লরেন্স হঠাৎ ভিকারেজে ঢুকে পড়ে। সম্ভবত সে দূর থেকেই ভিকারকে আসতে দেখেছিল।

লাইব্রেরী ঘরের মেঝে থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা কুড়িয়ে পকেটে চালান করে দেয়। অন্য কালিতে অন্য হাতে লেখা জাল চিঠিটা তার সঙ্গেই ছিল। সেটা টেবিলের ওপরে রেখে দেয়।

এই সময়েই অপ্রত্যাশিতভাবে তার নজরে পড়ে যায় মিঃ প্রথেরোর ভিকারকে লেখা চিঠিটা। সেটা পড়েই সে বুঝতে পারে, ভবিষ্যতে চিঠিটা তার কাজে লাগতে পারে। লরেন্স অসাধারণ বুদ্ধিমান, সঙ্গে সঙ্গে সে চিঠিটা পকেটে পুরে নেয়। তারপর আধঘণ্টা ফার্স্ট চলে ঘড়িটা জেনেও ত্রস্ত হাতে কাটা সরিয়ে দেয়।

ঠিক সময় হিসাব কষেই ঘর থেকে বেরিয়ে লরেন্স ভিকারেজের সদর দরজার দিকে বেরিয়ে যায় যাতে ভিকারের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। নির্ভুল হিসাব ছিল তার। ঠিক গেটের মুখেই দুজনের দেখা হয়ে গেল। উন্মাদের মত অভিনয় করে ভিকারকে কিছু আঁচ করবার সুযোগই দিল না।

কথা বলতে বলতে মিস মারপল আমার আর ইনপেক্টরের মুখের দিকে তাকালেন পর পর। পরে আবার বলতে শুরু করলেন।

–পাকা বুদ্ধির মানুষ লরেন্স। একজন খুনীর মতই পরিষ্কার মাথা। সেই জন্যই নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখার জন্য স্বেচ্ছায় পুলিসের কাছে স্বীকারোক্তি করতে গেল। সঙ্গে পিস্তলটাও নিয়ে গেল। তবে সাইলেন্সরটা রেখে গেল।

দক্ষ অভিনেতার মত নিজেকে খুনী বলে জাহির করার চেষ্টা করল। বাস্তবিক ওর স্বীকারোক্তি সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছিল।

মিস মারপলের কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, সেদিন রাতে জঙ্গলের মধ্যে একটা শব্দ হয়েছিল, আপনিও তো শুনেছিলেন, সেটা তাহলে কি ছিল? শব্দটা কি আকস্মিক কোন ঘটনা?

না, প্রিয় ভিকার। মিস মারপল বললেন, ওটা অবশ্যই আকস্মিক কোন ঘটনা নয়। সকলকে শোনাবার জন্যই শব্দটা করা হয়েছিল। তা না হলে মিসেস প্রথেরো সন্দেহের মুখে পড়তেন।

–শব্দটা কি কোন

-না, সেটার জন্য লরেন্স কি ব্যবস্থা করেছিল সঠিক বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, পিকরিক এসিডের ওপর ভারি কোন বস্তু ফেললে, ওরকম শব্দ হওয়া সম্ভব। ভিকার, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, আপনি যখন জঙ্গলে ঢুকেছিলেন, লরেন্সের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় একটা পাথর ছিল তার হাতে।

পরে ক্রিস্টালটা আপনি যেখানে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, আপনাদের দেখা হয়েছিল ঠিক সেই জায়গাতেই। চতুর লরেন্স ক্রিস্টালটার ওপরে নিশ্চয় পাথর ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। কুড়ি মিনিট মত সময় লেগেছিল সেটা পুড়ে গলে যেতে। “ এই হিসেব থেকে বোঝা যায় বিস্ফোরণটা হয়েছিল ছটা তিরিশ মিনিট নাগাদ। ঠিক ওই সময়েই তারা দুজন স্টুডিওঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

নিঃসন্দেহে খুবই নির্ঝঞ্ঝাট বিস্ফোরণ ছিল সেটা। বিস্ফোরণের পরে কেবল একটা পাথরই সেখানে পড়েছিল। চতুর লরেন্স এই প্রমাণটাও রাখতে চায়নি সেখানে। পাথরটাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল।

মিস মারপল ঘটনাটার এমন সুন্দর বিশ্লেষণ করছিলেন যে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আমি তাকে সমর্থন জানিয়ে বললাম, মনে হয় আপনি ঠিকই বলছেন। আমার মনে আছে, সেদিন জঙ্গলে আমাকে দেখে লরেন্স চমকে উঠেছিল। সেই সময় ব্যাপারটা আমার খুব স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি…

-হ্যাঁ, আপনাকে ওরকম জায়গায় দেখবে বলে সে আশা করেনি, তাই স্বাভাবিক ভাবেই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওরকম লোকের নার্ভ সহজে ফেল করে না। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল। একটা মিথ্যা গল্প শুনিয়েছিল আপনাকে। বলেছিল, আমার বাগানের জন্য পাথরটা নিয়ে আসছে।

তার এই মিথ্যা গল্প থেকেই আমি রহস্যের একটা সূত্র পেয়ে গিয়েছিলাম।

কথা শেষ করে মিস মারপল থামলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কথা শুনে যাচ্ছিলেন ইনসপেক্টর মেলচেট। মিস মারপল থামলে যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, চমৎকার–অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ।

এর পর পকেট থেকে হস-এর ঘরে আমার কুড়িয়ে পাওয়া দুমড়ানো চিঠিটা বার করে মিস মারপলকে দেখিয়ে বললেন, আপনার যুক্তিতে কোথাও ফাঁক নেই এটা সত্যি কথা। ঘটনার সঙ্গে বিশ্লেষণ খাপ খেয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু হস সম্পর্কে আপনি কি ব্যাখ্যা দেবেন। সে কেন ফোন করতে গেল আর কেনই বা স্বীকারোক্তি দিতে গেল…।

-ওটা ছিল তার ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা, বললেন মিস মারপল, গির্জার ফাণ্ডের টাকাটা সরিয়েছিল হসই। পরে এই দুষ্কর্মের জন্য তার অনুশোচনা হয়। তখন সে ঠিক করে সবকিছু স্বীকার করবে।

এই চিঠিটা পেয়ে লরেন্স লুকিয়ে রেখেছিল। কার জন্য প্রয়োগ করা যায় সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।

অবশ্য পরে সে বুঝতে পেরেছিল, হসকে দিয়েই চিঠিটা ব্যবহার করবে। আমার ধারণা এই মতলব মাথায় নিয়েই লরেন্স গতরাত্রে হস-এর বাড়ি আসে। নানান গল্পে বেশ কিছু সময় তার সঙ্গে কাটায়।

বলতে বলতে একটু থামলেন মিস মারপল। একমুহূর্ত চিন্তা করলেন। পরে বললেন, আমার সন্দেহ হয়, সেই সময় নিজের ক্যাসেট বাক্সের সঙ্গে লরেন্স হস-এর ক্যাসেট বাক্স বদল করে নেয়। তারপর কৌশলে হস-এর ড্রেসিংগাউনের ভেতরে চিঠিটা ঢুকিয়ে দেয়।

হস কিছুই বুঝতে পারে না। সে রাতে বদলা বদলি করা ক্যাসেট থেকে মারাত্মক ক্যাপসুল গলাধঃকরণ করে। লরেন্স দেখাতে চেয়েছিল অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে অতিরিক্ত ওষুধ খেয়ে হস আত্মহত্যা করেছে।

অনুশোচনাটা কর্নেল প্রথেরোকে গুলি করে হত্যা করার জন্য। সকলে অবশ্য সেকথাই ভাবতো।

–আচ্ছা বেশ, এ না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ওই ফোনটার ব্যাখ্যা আপনি কি দেবেন? লরেন্সের বাড়ি থেকে যেটা প্রাইস রিডেলকে করা হয়েছিল?

-হ্যাঁ, ওটা একই সময়ে ঘটে যাওয়া একটা আকস্মিক ঘটনা বলব আমি। ফোনটা করেছিল গ্রীসলডা।

ডেনিস আর গ্রীসল পরিকল্পনা করেই এই কাণ্ডটা করে বলে আমার ধারণা। ওরা শুনছিল যে মিসেস প্রাইস রিডলে ভিকারের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাই তাকে চুপ করাবার জন্যই হুমকি দেবার এই বিপজ্জনক পথটা বেছে নিয়েছিল।

গ্রীসলডা যেই সময়ে ফোনটা করেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই জঙ্গলের ভেতর থেকে গুলি করার মত শব্দ ভেসে আসে। যেহেতু প্রায় একই সময়ে ঘটনা দুটো ঘটে যায় তাই এই দুইয়ের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

ইনসপেক্টর মেলচেট হঠাৎ কেমন নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন, আপনার বিশ্লেষণ চমৎকার। কিন্তু এভাবে যে সাধারণ তত্ত্বটা দাঁড়াচ্ছে তা প্রমাণ করবার মতো তো কোন প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া কিছুই ধোপে টিকবে না।

তা আমি জানি, বললেন মিস মারপল, তবে আমার বিবরণটাকে আপনি সত্য বলেই বিশ্বাস করতে পারেন। আর যদি আরও নিঃসংশয় হতে চান তাহলে একটা ফাঁদ পাতা যেতে পারে।

.

২০.

 –ফাঁদ? কি ধরনের ফাঁদ।

চমকে উঠে ইনসপেক্টর মিস মারপলের দিকে তাকালেন। আমারও একই রকম অবস্থা।

-হ্যাঁ ফাঁদ। ধরুন যদি লরেন্স রেডিংকে ফোন করে সতর্ক করা হয়?

–কি ভাবে সে কাজটা করব বলছেন আপনি?

–যেমন ধরুন, সে যে হস-এর ক্যাসেট বাক্স বদলাবদলি করেছে এই ঘটনা দেখে ফেলেছে এমন একজন ফোনটা করবে এবং বলবে যে সে সব ঘটনা দেখে ফেলেছে। রেডিং যদি নির্দোষ হয় তাহলে কথাগুলোর মানে সে বুঝতে পারবে না। আর যদি না হয় তাহলে নিশ্চয় বোকার মত কিছু একটা করবে।

-হ্যাঁ, এটা তাকে যাচাই করার মোক্ষম ফঁদ। বললেন ইনসপেক্টর, তবে ডাক্তার হেডককে নিয়ে সন্দেহ আছে, তিনি কি এতে রাজি হবেন?

খানিক দূরেই বসেছিলেন ডাক্তার। আমি তার দিকে তাকালাম। মনে হল আমাদের মধ্যে মিস মারপলকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। তাকে খুব ক্লান্তও দেখাচ্ছিল।

ইনসপেক্টর ডাক্তারের দিকে ফিরে বললেন, আমরা কি নিয়ে কথাবার্তা বলছি, আপনি নিশ্চয় শুনেছেন।

এর পর মিস মারপলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ পরিকল্পনার কথাটা তাঁকে জানালেন।

সব শুনে ডাক্তার বললেন, প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ুক সেটা অবশ্যই আমি চাই। হতভাগা হসটার জন্যই আমি ভাবিত। জীবনটাকে কাপুরুষের মত উড়িয়ে দিল।

এর পর ইনসপেক্টর পরিকল্পনা মত যোগাড়যন্ত্র করতে তৎপর হয়ে পড়লেন। মিস মারপল উঠলেন। আমি তাকে এগিয়ে দেবার জন্য ফাঁকা রাস্তা পর্যন্ত বেরিয়ে এলাম। রাত তখন বারোটা।

.

২১.

 এই গল্পের আর সামান্যই বাকি আছে। মিস মারপলের পরিকল্পনা যথাসময়েই কার্যকরী করা হয়েছিল এবং সফলও হয়েছিল। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে লরেন্স রেডিং নির্দোষ ব্যক্তি নয়।

তাকে ফোন করে জানানো হয়েছিল যে হস-এর ক্যাসেটের ক্যাপসুল বদল করার ব্যাপারটা একজনের চোখে পড়ে গেছে। শুনেই, মিস মারপল যেমন বলেছিলেন, তেমনি বোকার মত একটা কাজ করতে এগিয়ে এসেছিল।

আমার কল্পনাশক্তি দিয়েই পরের ঘটনাগুলো কি হতে পারে বুঝতে পারি। ফোন পেয়েই লরেন্স খুন করে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তবে তার আগে সে মিসেস প্রথেরোর সঙ্গে দেখা করবে ঠিক করে।

সেই রাতেই ওল্ড হল-এ ছুটে যায় সে। সেই সময় ইনসপেক্টরের দুজন অফিসারও যে তাকে আড়াল থেকে অনুসরণ করে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না।

জানালা দিয়ে নূড়ি ছুঁড়ে মিসেস প্রথেরোকে জাগায় লরেন্স। ফিসফিসিয়ে তাকে বলে বাইরে আসার জন্য। লেটিসের জেগে থাকার ভয়ে ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলাই নিরাপদ মনে করে।

তারা যখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, অনুসরণকারী অফিসার দুজন আড়াল থেকে সবই শুনে নিয়েছিল। মিস মারপলের প্রতিটি হিসেব এভাবেই মিলে গিয়েছিল।

এর পর লরেন্স রেডিং এবং মিস প্রথেরোর বিচার যথারীতি জনগণের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। ওপ্রসঙ্গে আমি কিছু আর বলতে চাই না। আমি কেবল এটুকুই উল্লেখ করতে চাই যে এই মামলার সমস্ত কৃতিত্বটুকু দখল করেছিলেন ইনসপেক্টর মেলচেট। যার উৎসাহ আর বুদ্ধিমত্তা অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সুযোগ করে দিয়েছিল সেই মিস মারপলের ভাগ্যে কৃতিত্বের ছিটেফোঁটাও জোটেনি। এই ঘটনায় খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন মিস মারপল।

বিচারের ঠিক আগের দিন লেটিস এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে আমার সামনে চেয়ারে বসে সে বলেছিল, সৎমায়ের এই অধঃপতনের কথা সে জানত। বলেছিল, আমি তাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাম।

আমি লেটিসকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখন কি করবে?

লেটিস শান্ত কণ্ঠে বলল, সব যখন শেষ হবে আমি বিদেশে চলে যাব। আমার মায়ের সঙ্গেই যাচ্ছি।

চমকে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। লেটিস বলল, আমার মা কে হতে পারে নিশ্চয় বুঝতে পারছ না তুমি? তোমরা যাঁকে মিস লেসট্রেঞ্জ বলে জান তিনিই আমার মা। সকলে জানে অবশ্য আমার মা মৃত। আমিও তাই জেনে এসেছি।

একমুহূর্ত থেমে সে আবার বলল, মা আমাকে দেখতে এসেছিল। সেজন্যই তাকে অন্য নাম দিতে হয়েছিল। ডাক্তার হেডক অবশ্য তাকে সাহায্য করেছিলেন। উনি মায়ের পুরনো বন্ধু ছিলেন। একসময়ে মায়ের প্রতি ডাঃ হেডকের দুর্বলতা ছিল।

যাইহোক, সেদিন রাতে মা বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। জানিয়েছিল, মরার আগে তার কিছু জিনিস আমাকে দিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমার বাবা ছিল একটা জানোয়ার। বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছিল আমার ওপর তার কোন অধিকার নেই।

লেটিস থামল। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল যেন কোন কেতাবী গল্প শুনছি।

লেটিস বলতে লাগল, বাবা নিষ্ঠুরের মত তাড়িয়ে দিয়েছিল মাকে। কিন্তু তবু ভেঙ্গে পড়েনি মা। আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। টেনিস খেলা শেষ হবার পর সাড়ে ছটায় আমি মার সঙ্গে রাস্তায় দেখা করলাম। কিন্তু বেশি কথা বলার সুযোগ ছিল না।

.

পরে বাবা খুন হবার পর ভীত হয়ে পড়লাম। বাবার প্রতি মায়ের তো একটা বিদ্বেষ ছিলই। সেই জন্য মাকে যাতে সন্দেহের মধ্যে পড়তে না হয় সেজন্য একদিন রাতে চিলেকোঠায় উঠে মায়ের ছবিটা এমনভাবে কেটেকুটে দিলাম যাতে কেউ চিনতে না পারে। আমার আশঙ্কা ছিল, পুলিস ওই ছবির খোঁজ পেলে তারা মাকে চিনে ফেলবে। ডাঃ হেডকও খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।

কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে থামল লেটিস। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে। লেটিস বলতে লাগল মা আর আমার মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু তেমন সম্পর্ক আমার বাবার সঙ্গে ছিল না। যাই হোক, আমি মায়ের সঙ্গে বিদেশে চলে যাচ্ছি, তার সঙ্গেই থাকব এখন থেকে।

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল লেটিস। তার চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ফুটে উঠল। আমি তার হাত টেনে নিয়ে বললাম, ঈশ্বর তোমার মার মঙ্গল করুন। আশা করি তোমরা একদিন সুখী হবে।

–আশীর্বাদ করো তাই যেন হয়।

বলে লেটিস বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল।