০৮. সূর্য উঠেছে মেঘ কেটে গিয়ে

জয়ন্তের মনে শুধু এই ভয়, বাড়ি ফিরলে মা কবে। আর সব ভয়-ডর সে ভুলে গেছে। সে আর তার দশ-বারজন সঙ্গী আজ পৃথিবী জয় করতে পারে। পাড়ার এই ছেলেদের সঙ্গে কত রকম খেলা সে খেলেছে, কত অ্যাডভেঞ্চার করেছে রায় বাবুদের বাড়ির সামনের লোহার গেট ও প্রাচীরঘেরা ছোট্ট বাগানের ফুল চুরি করা থেকে বকলস খুলে ডিকসনের কুকুরটাকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত, বার বছর বয়সের জীবনে আজকের মতো এমন উত্তেজনা এমন উন্মাদনা আর কোনোদিন সে পায় নি। এদিক-ওদিক একটু ঘুরে দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবে বলেই সে বেরিয়েছিল, শিশির, মনা, অশোকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বেলা দুপুর হয়ে এল, এখনো তারা ফিরতে পারে নি। বড় মোড়ে মিলিটারি লরিটাতে আগুন ধরামাত্র ওখানে ছুটে গিয়েছিল দল বেঁধে দেখতে, তারপর চারটে লরি পোড়ানো দেখে এতক্ষণে তারা পাড়ার গলির মোড়ে ফিরে এসেছে। তার আগে কি ফেরা যায়? বাড়িতে নয় একটু বকবেই। হাজার হাজার লোকে যখন রাস্তায় নেমে এসেছে, একটি গাড়ি পর্যন্ত চলতে দেবে না পণ করে, সে কি করে বাড়ি ফেরে।

শিশির জিজ্ঞেস করেছিল, কেন গাড়ি চলবে না ভাই?

জয়ন্ত–তের বছরের জয়ন্ত, ন বছরের ছেলের প্রশ্নে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, জানিস না? গুলি করবে কেন? এটা আমাদের দেশ, আমরা যা খুশি করব। ওরা গুলি করবে কেন?

অশোক বলেছিল, তাছাড়া, আমাদের স্বাধীনতা চাই তো। পরাধীন হয়ে থাকব কেন শুনি?

মনা সায় দিয়েছিল, বাবা বলে, আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করি, তাই স্বাধীনতা পাই না। আমরা তাই এক হয়েছি। দেখছি না? এই দ্যাখ।

বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য শান্তি বাহিনীর একটি গাড়ি তিন দলের পতাকা উড়িয়ে মোড়ের মাথায় থেমেছিল, লাউডস্পিকার থেকে ভেসে এসেছিল : সংযম হারালে, দু-চার খানা গাড়ি পোড়ালে, অন্যায়ের প্রতিকার হবে না, স্বাধীনতা আসবে না। শান্ত হয়ে সকলে বাড়ি ফিরে যান, কিংবা প্রতিবাদ সভায় যোগ দিন। সংঘবদ্ধ আন্দোলনে দাবি আদায় করুন।

জয়ন্ত বলেছিল, তোকে বলি নি চিল ছুডিস না মনা? শুনলি তো?

তারপর তারা ফিরে এসেছে এই গলির মোড়ে। গলা শুকিয়ে গেছে তাদের ইনক্লাব, জয় হিন্দ, বন্দেমাতরম্ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা চেঁচিয়েছে, তারা তো তুচ্ছ নয়। খিদেয় অবসন্ন হয়ে এসেছে শরীর। তবু গলির ভেতরে ঢুকে যে যার বাড়ি চলে যাবে সে ক্ষমতা যেন পাচ্ছে না তারা। তাদের শিশুমনের স্বপ্ন, আর রূপকথা যেন বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। আজ তাদের সামনে শহরের রাজপথে, অফুরন্ত সুযোগ জুটেছে রাজপুত্রের মতো বীরত্ব দেখাবার।

এ মোড়ের অল্প দূরে একটা লরি পুড়ছিল। তাই দেখার জন্য তারা দাঁড়িয়ে থাকে। সৈন্য বোঝাই একটি লরি আসছে দেখা যায়, শব্দও পৌঁছায় এখানে।

জয়ন্ত বলে দৃঢ়স্বরে, সৈন্যবাহিনীর কমাণ্ডারের মতে, এই শেষবার। এদের শুনিয়ে দিয়ে আমরা বাড়ি ফিরব। আমি যা বলব, তোমরা ঠিক তাই বলবে। দু-তিন পা এগিয়ে দাঁড়াই চল। রেডি! ইনক্লাব জিন্দাবাদ। জয় হিন্দ। বন্দেমাতরম। ইনক্লাব–

মনার গায়ে ঢলে জয়ন্ত রাস্তায় আছড়ে পড়ে। উঠবার যেন চেষ্টা করছে এমনি করে নড়েচড়ে কয়েক বার। দুবার কাশে রক্ত তুলে। তারপর নিস্পন্দ হয়ে যায়। তেরটি শিশু তাকে ধরাধরি করে গলির ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির সামনের প্রথম যে বারান্দা মেলে তাতে শুইয়ে দেয়।

অনুরূপা তখন ধৈর্য হারিয়ে ছেলের খোজে গলি দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন।

 

সাড়ে আটটা বাজে, অজয় এখনো স্নান করতে গেল না। বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই যে কথা আরম্ভ করেছিল, সুধীর আর নিরঞ্জনের সঙ্গে বাজার থেকে ফিরে এখনো মশগুল হয়ে কথাই বলে চলেছে। যেন ভুলে গিয়েছে যে দশটায় ওর আপিস, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপিসে পৌঁছতে এক ঘণ্টার কম লাগে না। হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত হেঁটে না গিয়ে আজ ট্রামে বাসে যাবে যদি ভেবে থাকে, তা ও ভাবুক, কারো তাতে কিছু বলার নেই, মাঝে মাঝে দু-একদিন এইটুকু পথ হাঁটার বদলে শখ করে মিছিমিছি ট্রামে বাসে কটা পয়সা বাজে খরচ যদি করতে চায় কেউ তাতে কিছু মনে করে না। কিন্তু এখন স্নান করতে না গেলে ট্রামে বাসে পয়সা নষ্ট করেও যে আপিসে লেট হয়ে যাবে সেটা তো খেয়াল থাকা দরকার ওর।

মৃদু অস্বস্তি বোধ করে বাড়ির লোক, মাধু ছাড়া। ওদের সঙ্গে এত কথাই-বা কিসের সবাই ভাবে, মাধু ছাড়া। ক্লাসফ্ৰেণ্ড ছিল বটে, এখন তো আর নয়। ওরা কলেজে পড়ছে, অজয় চাকরি করছে। এত ভাব ওদের সঙ্গে এখন না রাখাই উচিত।

অনন্ত সইতে না পেরে মেয়েকে বলে, মাধু আরেকবার ডাক।

এই তো ডাকলাম।

আবার ডাক। কটা বাজল? আটটা পঁয়ত্রিশ। ডেকে বল পৌঁনে নটা হয়ে গেছে।

বলেছি তো একবার। দাদার কি হিসেব নেই ভাব? অত খোঁচানো ভালো নয়। মাধু শান্ত গলাতে বলে। আশ্চর্য রকম সে শান্ত হয়ে গেছে আজকাল। সে রকম এলোমেলো মেজাজ আর নেই, একের পর একটা বিয়ের চেষ্টা ফসকে যাবার কবছর যেমন ছিল। সে যেন ওদিকের সব আশা ভরসা মুচড়ে ফেলে হাল ছেড়ে দিয়ে সুস্থ হয়েছে।

কপালে চাপড় মেরে অনন্ত বলে, তুই আর আমাকে উপদেশ দিসনে মাধু, দিসনে। গলায় দড়ি জোটে না তোর?

দাও না জুটিয়ে? মাধু হেসে বলে, দড়ি কিনতেও পয়সা লাগে বাবা। এক ঘণ্টা ধরে চুল ঘষে দিলাম, দত্তবাড়ির বৌটা পয়সা দিলে চার আনা। চার আনায় গলায় দেবার দড়ি হয় না। রোজগার বাড়ুক, দড়িও জুটিয়ে নেব।

অনন্ত কুরিয়ে কুরিয়ে তাকায় মেয়ের দিকে।

তার তাক লেগে যায় নিজের ছেলেমেয়েগুলির রকম দেখে। এত যে তার দুঃখ দুর্দশার। সংসার, শুধু শুধু অশান্তি আর হতাশা, ওরা কেউ যেন তার অস্তিত্ব মানবে না প্রতিজ্ঞা করেছে। লড়াই থামতে না থামতে তাকে বুড়ো বয়সে খেদিয়ে দিল চাকরি থেকে পড়া ছেড়ে চাকরি নিয়ে দুটো পয়সা আনছে ছেলেটা তাই আপেটার হাড়িটা চড়ছে কোনোমতে, যে কাপড় পরে আছে মাধু ওর দিকে তাকানো যায় না, অজয় যে বেশে আপিস যায় যেন কুলি চাষীর ছেলে, আজ বাদে কাল কি হবে ভেবে বুকের রক্ত তার হিম হয়ে আছে, কিন্তু ওরা যেন গ্রাহ্যই করে না কোনো কিছু আগে যখন আরো সহজে সংসার চলত, অজয়ের পড়া চালানো, মাধুর বিয়ে দেওয়া, এসব ব্যবস্থা একরকম করে করা যাবে মরে-বেঁচে এ ভরসা করা চলত, তখন যেন কেমন হতাশ, মনমরা ছিল সকলে, রাগারাগি চুলেচুলি কাদাকাটা অশান্তি লেগেই ছিল ঘরে এখন আরো শোচনীয় অবস্থায় এসে ভবিষ্যতের সব আশা ভরসা হারিয়ে আপেটা খেয়ে ঘেঁড়া কাপড় জামায় দিন চালিয়ে গিয়েও সবাই যেন জীয়ন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভয় নেই ভাবনা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা সব ঠিক করে নেব, এই ভাব সকলের। মায়ের গঞ্জনায় মাধু একদিন মরতে গিয়েছিল ক্ষুর দিয়ে নিজের গলা কেটে, অজয় গিয়ে সময়মতো না ধরলে সর্বনাশ হয়ে যেত। এখনো গলায় সে দাগ আছে মাধুর। আজকাল গালাগাল গঞ্জনা উপহাস কিছুই সে গায়ে মাখে না। রাগ তো করেই না, হেসে উড়িয়ে দেয়।

অথচ আজ ওর গায়ে আঁটা আছে এই সত্যটা যে কাপড় ও পরে আছে, ওর দিকে তাকানো যায় না।

অনন্ত ঝিমোয়। তার সাধ যায় ছেলেমেয়ের কাছে হার মেনে মাপ চেয়ে বলতে যে এই ভালো! এই ভালো!

কিন্তু সে চমকে উঠে গর্জেই বলে, অজয়! আপিস যেতে হবে না আজ? আড দিলেই চলবে সারাদিন?

অজয় ভেতরে এসে বলে, আজ আপিস যাব না বাবা। আজ সব আপিস কারখানায় হরতাল। ট্রাম বাস বন্ধ হয়ে গেছে।

অনন্ত সোজা হয়ে বসে উদ্বেগে, আতঙ্কে, উত্তেজনায়। জোর দিয়ে বলে, শিগগির যা, না খেয়ে চলে যা আপিসে। কিনে খাস কিছু খিদে পেলে। হেঁটে চলে যা, দেরি হলে কিছু হবে না। অন্য দিন কামাই করিস যায় আসে না, আজ আপিসে যেতেই হবে। গিয়ে ম্যানেজার সায়েবকে বলবি, ট্রাম বাস বন্ধ, হেঁটে আসতে হল বলে দেরি হয়েছে। বলবি, কয়েকজন জোর করে তোকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেছিল, তুই অনেক কষ্টে কারো কথা না শুনে আপিসে এসেছিস

অনন্ত কাশতে শুরু করে। কাশতে কাশতে বেদম হয়ে পড়ে। তবু তারই মধ্যে কোনোমতে বলে, সায়েব খুশি হবে, মাইনে বাড়বে, উন্নতি হবে, আপিস যা।

কাশি থামলে গুটলি মুটলি পাকিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে অনন্ত। মাধু হাওয়া করে, অজয় বুকে পিঠে হাত ঘষে দেয়। গোলমাল শুনে নিরঞ্জন ভেতরে এসেছিল, মাথা হেঁট করে সে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ তোলে না। ঘেঁড়া কাপড়ে অনেক যত্নে মাধু যখন নিজেকে মোটামুটি ঢেকে রাখে,

তখনো তার দিকে চাওয়া যায় না। এখন সে ব্যাকুল হয়ে নিজের কথা ভুলেই গেছে।

আধঘণ্টা পরে একটু সুস্থ হয়ে অনন্ত ডাকে, অজয়।

বাবা?

আজ আপিস যে না। সবাই যখন আপিস যাচ্ছে না, তোমার যাওয়া উচিত হবে না। সবাই যা করে, তাই করাই ভালো।

নিরুদা, যেও না। কথা আছে। মাধু তার বাইরে বেরোবার আস্ত শাড়িখানা পরে আসতে যায়।

আপনার একটা ওষুধ খাওয়া দরকার কাশির জন্য। নিরঞ্জন বলে।

দরকার তো অনেক কিছুই বাবা। সব দরকার কি মেটে! ক্ষোভের সঙ্গে বলে অনন্ত।

পাল ডাক্তারকে কতবার ডাকতে চেয়েছি, আপনিই বারণ করেন। অজয় মৃদুস্বরে বলে। অনন্তের মন্তব্যের বিরুদ্ধে অভিমানের নালিশ জানাতে নয়, বাপকে সান্ত্বনা দিতে। অনন্ত নিজেকে সংশোধন করে বলে, ডাকবার দরকার কি? আমি যেতে পারি না?

একখানা মাত্র সম্বল শাড়িখানা পরে এসে মাধু বলে নিরঞ্জনকে, ঘোষেদের বাড়িতে পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছিলে, আজ নিয়ে চল। কাল থেকেই কাজ করব, চায় তো ওবেলা থেকেই। কিন্তু ভাবছি কি–মাধু মৃদু সংশয়ের হাসি হাসে, আমার রান্না কি কুচবে ওদের, এত বড়লোক মানুষ।

অনন্ত অপলক চোখে চেয়ে থাকেন। তার মত নেই, তিনি বারণ করেছেন, তবু তাকে একবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত না করে তারই সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে তার অনায়াসে লোকের বাড়ি রাধুনির কাজে ভর্তি করিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করছে দাদার বন্ধুকে। লজ্জা নেই, সঙ্কোচ নেই, অপমানবোধ নেই। অজয় চোখ পেতে রাখে মেঝেতে। লাল সিমেন্টের মেঝে দুবেলা মুছে মুছে তেল চকচকে করে তুলেছে মাধু। মাধু ঝি হোক বঁধুনি হোক এতে তার লজ্জা নেই। সে থাকতে ওকে রাঁধুনি হতে হয় এমন সে নিরুপায়, এই ক্ষোভে কান দুটি তার ঝাঁ ঝাঁ করে!

আজ তো হবে না মাধু।

রাধুনিদের কাজে যাওয়াও বারণ নাকি আজ?

নিরঞ্জন হাসে।–আমরা এখুনি বেরিয়ে যাব। আজ কি নিশ্বাস ফেলার সময় আছে? দশটায় এখানে একটা মিটিং আছে, তারপর বড় মিটিং, তাছাড়া আরো কত কাজ।

তোমরা মানে? দাদাও যাচ্ছ নাকি? চল তবে আমিও বেরোই তোমাদের সঙ্গে। একটু দেখেশুনে আসি।

মাধুর চোখ জ্বলজ্বল করে। বাড়িতে মন টিকছে না আজ। খালি মনে হচ্ছে কোথায় যাই, কি করি।

 

হাঙ্গামার ভাসা-ভাসা এলোেমলো খবর তারা শোনে গাড়িতেই। কাল থেকে গুলি চলছে। কলকাতায়, চারদিকে লড়াই শুরু হয়েছে সারা শহরে, ভীষণ কাণ্ড। কালকের ঘটনার বিবরণ বেরিয়েছে আজকের ভোরের কাগজে, তাদের গাড়িতেই পাঁচ-সাত জন বাংলা কাগজ কিনে পড়েছে এবং সকলকে পড়ে শুনিয়েছে। আজকের খবর সব ছড়িয়েছে মুখে মুখে। কলকাতার যত কাছে এগিয়ে এগিয়ে স্টেশনে গাড়ি থেমেছে উত ঘন আর ফলাও হয়েছে খবর।

শহরেও হাঙ্গামা, কলকাতা শহরে? গণেশের মা বিচলিত হয়ে বলেছে, গণশার যদি কিছু হয়?

যাদব বলেছে তাকে ভরসা দিয়ে, গণশার কি হবে? লাখো লাখো লোক কলকাতা শহরে, তার মধ্যে তোমার গণশারই কিছু হতে যাবে কি জন্য?

চিঠিটা ঠিক আছে তো? গণশার ঠিকানা লেখা চিঠি? একথা এর মধ্যে কম করে দশ-বার বার শুধিয়েছে গণেশের মা।

বললাম তো ঠিক আছে কত বার। হাঁ দ্যাখ–যাদব ঘেঁড়া কুর্তার পকেট থেকে সন্তৰ্পণে ভাঁজ করা পোস্টকার্ডটি বার করে নিজেও আর একবার দেখে নেয় নিঃসন্দেহ হবার জন্য, যদিও দশ জনকে দিয়ে পড়িয়ে পড়িয়ে ঠিকানাটা তার মুখস্থ হয়ে গেছে, চিঠিখানা হারিয়ে গেলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি নেই।

স্টেশন ও স্টেশনের বাইরের অবস্থা দেখে যাদব একেবারে হকচকিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। দু-চার বার সে কলকাতা এসেছে, প্রতিবার সে স্টেশনে নেমে মানুষের গমগমে ভিড় আর স্টেশনের বাইরে গাড়িঘোড়ার অবিরাম স্রোত দেখেই চকচকিয়ে গেছে ভয়ে বিস্ময়ে, তার তুলনায় ঘুমন্ত পুরীতে যেন পা দিয়েছে মনে হয় তার আজ। স্টেশনে লোক কিছু আছে, এতটুকু ব্যস্ততা কারো নেই, সবার মুখে যেন গুমোটে মেঘ! বাইরে গাড়িঘোড়ার স্রোতটি অদৃশ্য। যাদবের মনে হয়, একদিন ঘুম ভেঙে উঠে তাদের গায়ের পাশের নদীটা অদৃশ্য হয়ে গেছে দেখলেও বোধহয় এমন তাজ্জব লাগত না তার।

হেঁটেই যেতে হবে গণশার মা।

উপায় কি তবে আর? হবে তো যেতে, নাকি?

পথটা শুধধাও কাউকে? রাণী বলে।

পুল পেরোই আগে। তারপর শুখোব।

তবে সাথে চল যারা যাচ্ছে দেরি না করে, একলাটি পড়ে গেলে ভালো হবে শেষে?

মোটঘাট বিশেষ কিছু নেই, সেও রক্ষা। মেটে হাঁড়িতে দুমুঠো সিদ্ধ করার চাল জুটলে যে ভাগ্য বলে মানে তার আবার মোটঘাট। কাঁথা বালিশের বাণ্ডিলটা যাদব বা হাতের বগলে নেয়, গাড়ির আঁকানিতে ডান হাতের ব্যথা বেড়ে অবশ অবশ লাগছে। মনকে কাখে নিয়ে গণেশের মা কাপড়ে বাধা চালের পুঁটলিটা হাতে নেয়, সের চারেক চাল আর দুটো বেগুন আছে। কটা গেলাস বাটি আর জামাকাপড়ের বাঁশের ঝাঁপিটা নেয় রাণী, দুবছরের কালীর হাতটা ধরে। ঘুমকাতুরে খিদেকাতুরে মেয়েটা এত ঘুমিয়ে এত খেয়েও একটানা কেঁদে চলেছে।

কোথা যাবে তোমরা।

রাণী মুখ বাঁকায়। সেই বাবুটা, চশমা কোট পালিশ করা জুতোর সেই বদ মাৰ্কা। যে শুধু তাকাচ্ছিল, তাকাচ্ছিল, তাকাচ্ছিল। চোখ দিয়ে যেন কাপড়ের নিচে তার গা চাটছে।

যাদবের মুখে ঠিকানা শুনে ভদ্রলোক যেন চমকে যায়, সে যে অনেক দূর, যাবে কি করে? এমনি যদিবা যেতে পারতে অন্যদিন, আজ যে রাস্তাই বন্ধ ওদিকের। পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। লোকেরা ইট ছুড়ছে, গাড়ি পোড়াচ্ছে, মারা পড়বে সবাই তোমরা।

ছেলে আছে ওই ঠিকানায়। ছেলের কাছে যাচ্ছি বারু।

আজ যেতে পারবে না, ভদ্রলোক বলে জোর দিয়ে, দ্যা দিকি গা থেকে শহরে এসে কি বিপদে পড়লে।

ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে ভাবে, অনেক ইতস্তত করে, তারপর যেন নিরুপায়ের মতো অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, আজ যেতে পারবে না। এক কাজ কর বরং আমার বাড়ি কাছে আছে, সেখানে আজ থেকে যাও। হাঙ্গামা কমলে কাল-পরশু যেও ছেলের কাছে, আমি না হয় ছেলেকে তোমার একটা খবর পাঠাবার চেষ্টা করব।

রাণী যুঁসে ওঠে। কতটা হাঁটতে হবে, দাঁড়িয়ে থেকো নি বাবা। যেতেই হবে তো দাদার। কাছে আজ। চল এগোই মোরা। চল।

যাদব তাকায় ভদ্রলোকের মুখের দিকে, মুখটা সত্যি সুবিধের নয়! আর তাও বটে, নজরটা বাবুর আটকে আছে রাণীর ওপর।

ছেলের কাছে যেতেই হবে বাবু, মরি আর বাঁচি।

চল না এগগাই? রাণী ধমকের সুরে বলে নিজে চলতে আরম্ভ করে দিয়ে, যাদবও চলতে শুরু করে। মুখ ফিরিয়ে দেখতে পায়, সিগারেট ধরিয়ে পুলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাবু গঙ্গার শোভা দেখছেন একমনে।

পুল পেরিয়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তাতে রীতিমতো খটকা লাগে যাদবের যে, বাবুটি মিছে বলে ভাওতা দিতে চেয়েছিল তাদের, না সত্যি যা ঘটেছে তারই সুযোগ নিতে চেয়েছিল সত্যি কথা বলে। বড় একটা গাড়ি দাউ দাউ করে পুড়ছে মোড়ের মাথায়, এ পাশে পুড়ে কালো হয়ে কঙ্কাল পড়ে আছে দুটো ছোট গাড়ির। ইটপাটকেলে ভরে আছে রাস্তা। এ ধারে এক পাশে কয়েক জন মিলিটারি সায়েব আর একদল গুর্খা সেপাই দাঁড়িয়ে দেখছে, ওধারে মোড়ের মাথা থেকে রাস্তার ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত লোকারণ্য, এমন আওয়াজ তুলেছে তারা যেন অনেক গণ্ডা আহত বাঘ ফুঁসছে এক সাথে।

কি করে কোথা দিয়ে তারা যাবে?

আশপাশের লোকদের মধ্যে ছিটের শার্টের ওপর কমদামি পুরোনো আলোয়ান জড়ানো গরিব গগাছের একটি ভদ্রলোকের ছেলে দাঁড়িয়েছিল। কয়েকবার তার মুখটি খুর নজরে দেখে যাদব গণেশের পোস্টকার্ডখানা বার করে। কিন্তু কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ছেলেটি হটতে আরম্ভ করে দেয়। বায়ে যে দিকের রাস্তার মোড়ে ও ভেতরে ভিড় জমেছে সে দিকে নয়, ডাইনে যে দিকে প্রায় কঁকা রাস্তা মিলিটারি দখল করে আছে, সে দিকে।

হাসপাতালে আহত একটি ছেলের আত্মীয়ের আসবার কথা ছিল, অজয় স্টেশনে এসেছিল। তাকে ছেলেটির খবর জানিয়ে দিয়ে যাবার জন্য। ছেলেটির অবস্থা ভালো নয়। আত্মীয়টি আসেন নি, অথবা এসে থাকলেও চেহারার বর্ণনা শুনে চিনে উঠতে পারে নি। ফিরবার সময় পুল পার হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত অসহনীয় দৃশ্য দেখছিল অজয়। ভিড় সরে এসে জমা হয়েছে এপাশে, ওপাশের রাস্তা দিয়ে তোক চলেছে খুব কম–জরুরি দরকার না থাকলে ওপথে প্রাণ হাতে করে অকারণে কে চলতে চাইবে। ইটপাটকেলে ভর্তি হয়ে আছে রাস্তাটা, সেই রাস্তা সাফ করছে দশবারজন ভদ্রলোক। ওদের ধরে জোর করে রাস্তা সাফ করানো হচ্ছে। সাদা নীল স্ট্রাইপ কাটা শার্ট গায়ে এক ভদ্র যুবককে বেঁটে লালচে গোঁফওলা একজন অফিসার ফুটপাত থেকে টেনে নামিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগিয়ে দিল। ওরা কি জানে না মুখ বুজে এ জুলুম সহ্য করা পাপ? কি বলে ওরা হুকুম পেল আর ইটপাটকেল সরাবার কাজে লেগে গেল? অজয়ের মনে হয়, ওরা যে মুখ বুজে এ অপমান সইছে এ জন্য দায়ী সে। তারও তো এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া বিশেষ দরকার, কিন্তু হাঙ্গামার ভয়েই তো না এগিয়ে এতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে আছে হ করে। লোক চলছে ও রাস্তায়, সবাইকে ধরে রাস্তা সাফের কাজে লাগাচ্ছে না। যদি তাকে ধরে, এই তো তার ভাবনা। সে তো কোনোমতেই হুকুম শুনে ইট-পাটকেল সাফ করার কাজে লেগে যেতে পারবে না ওই ভদ্রলোক কজনের মতো। তাহলেই তখন গোল বাঁধবে!

কিন্তু তাই বলে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায় ভীরু কাপুরুষের মতত? সে হাঙ্গামা করতে আসে নি, কাজে এসেছে। ও রাস্তায় লোক চলা নিষিদ্ধ হয় নি। তার হেঁটে যাবার অধিকার আছে ও রাস্তা দিয়ে। সে যদি অন্যায় না করতে, অধিকার বজায় রাখতে ভয় পায়, ওরা ইটপাটকেল সাফ করতে লেগে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

অজয় এগিয়ে যায়।

হই! বলে লালচে গোঁফওলা অফিসার, কাছে এসে সোজা সহজ হুকুম জারি করে, সাফ করো।

অজয় প্রশ্ন করে, এ রাস্তায় কি ট্রাফিক বন্ধ?

প্রশ্ন শুনেই বোধহয় রেগে যায় লালচে গোপ, আর রেগে যায় বলে ধৈর্য ধরে বলে, সাফ করো। সাফ করো। তুম ইটা ফিকা তুম সাফ করোগে।

ইউ আর ম্যাড। অজয় বলে।

তখন দুহাতে ধাক্কা দিয়ে অজয়কে সে ফেলে দেয় রাস্তায়। মাথায় সামান্য একটু চোট লাগে অজয়ের। ডান হাতের কাছে একটি ইট। মাটি পোড়ানো ইট নয়, শক্ত পাথুরে ইট, যা দিয়ে রাস্তা বাধায়। চোখে অন্ধকার দেখছে অজয়। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে এখন উন্মাদ। হাতে তার জোর আছে। এই ইটটা ছুড়ে মেরে সে মাথার ঘিলু বার করে দিতে পারে লালচে গোপের। তারপর যা। হয় হবে।

না। দাতে দাঁত লাগিয়ে অজয় বলে, না। সে ভদ্রেলোকের ছেলে, কে একজন তাকে অপমান করেছে, এই ব্যক্তিগত আক্ৰোশে অন্ধ হয়ে কিছু তার করা চলবে না। হাসপাতালের আহত ছেলেদের মুখ তার মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে রাস্তায় বসা একদল তরুণের মুখ। নরক থেকে শয়তান এসে তাকে বিগড়োবার চেষ্টা করলেও সে খাঁটি থাকবে। সে সংযত থাকবে।

সে শান্ত থাকবে।

ধীরে ধীরে অজয় উঠে দাঁড়ায়। বাঁ হাতটা কি ভেঙে গেছে? গেছে যদি যাক, এখন তা ভাববার সময় নয়, ভাঙা হাত জোড়া লাগবে।

লাল গোঁপ তাকিয়ে থাকে। সিমেন্টের শক্ত ইটটা সে দেখেছে, অজয় যখন ইটটা নামিয়ে রাখছে। তার মাথায় ছুড়ে মারবার জন্য ইটটা তুলেছিল। মারল না কেন? ও ইট মাথায় লাগলে সে বাচত না। কিন্তু মারল না কেন? লাল গোপ বোধহয় বুঝে উঠতে পারে না, তাই তাকিয়ে থাকে।

উঠে দাঁড়াবার পর অজয় টের পায় একটি গেঁয়ো পরিবারের মেয়েপুরুষ তাকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। ক্রমাগত প্রশ্ন হচ্ছে, লাগে নি তো? বেশি লাগে নি তো বাবু?

না। লাগে নি।

তখন যাদব আবার পোস্টকার্ডটি বার করে সামনে ধরে বলে, বাবু এ ঠিকানায় কোন্ দিকে যাব?

দাঁড়াও বাবু একটু, অজয় বলে তার দিকে বা ঠিকানার দিকে না তাকিয়েই।

খানিক পরে নিজে চলতে আরম্ভ করে অজয় থেমে যায়। যাদবকে বলে, কি বলছিলে তুমি?

ঠিকানা পড়ে বলে, ডালহাউসী স্কোয়ার চেনো? লালদিঘি?

লালদিঘি? চিনি বাবু।

বাঃ, তবে আর ভাবনা কি? লালদিঘি চারকোনা তো, পুবে দুটো কোণ আছে। পুব-উত্তর কোণে একটা, পুব-দক্ষিণ কোণে একটা। যে কোনো কোণ থেকে পুবের রাস্তা ধরে এগোবে বুঝলে?

যাদব মাথা নাড়ে।

কেন, বুঝলে না কেন? দুকোণ থেকে দুটো রাস্তাই পুবে গেছে, দশটা নয়। লালবাজারের সামনে দিয়ে গেলে বৌবাজারের মোড় হয়ে ডাইনে বাকবে–মিশন রোড হয়ে গেলে ট্রামরাস্তা পার হবে, তারপর একজন কাউকে জিজ্ঞেস করলেই

যাদব নীরবে পোস্টকার্ডটি ফিরিয়ে নেয়।

অজয় এবার গম্ভীর মুখে বলে, তবে আমার সঙ্গে এস। আমিও লালদিঘি যাচ্ছি। কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে যাব আমি। অন্য রাস্তা নেই। সঙ্গে এসে ছেলেমেয়ে নিয়ে মুশকিলে পড়তে পার। বুঝে দ্যাখ।

রাণী বলে, চলুন যাই।

জোরে জোরে হেঁটে সে এগিয়ে যায়। লাল গোপের কাছ দিয়েই হাঁটতে থাকে। এবার কিন্তু লাল গোপ তাকিয়েই থাকে শুধু। খানিক দূরে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় যাদবদের জন্য অজয় থেমে দাঁড়ায়। আবার এগোয়, আবার থামে। তার বিরক্তিভরা মুখ দেখে যাদব অস্বস্তি বোধ করে। তবে জাল পেতে বোকা হাবা গেঁয়ো লোক ধরা শহুরে বেদে এ ছোকরা নয়, এটা সে বিশ্বাস করে অনায়াসে।

একবার বলে যাদব কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষায়, মোদের তরে মিছিমিছি হাঁটতে হল বাবু আপনাকে।

না বাপু হাঁটতে আমাকে হতই, একটু বেশি হাঁটা হচ্ছে। কি করি বল, তোমরা তো নাছোড়বান্দা।

জেটি শেড ডাইনে রেখে তারা সোজা এগোতে থাকে। চারিদিকে কর্মহীন স্তব্ধতা উগ্র প্রতীক্ষার মতো। শেডের ফাঁক দিয়ে রাণী মস্ত চোঙালা বিদেশী জাহাজের দিকে তাকায় মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে, ভালো করে না দেখতে দেখতে আড়াল হয়ে যায় সেগুলি।

বিদ্যুৎ লিমিটেড খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই এতখানি রাস্তা হেঁটে গিয়ে খুঁজে বার করার কষ্টটা ছাড়া। কিন্তু দোকান বন্ধ দেখে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। যাদব বলে, কি সৰ্বনাশ!

অজয় রাগ করে বলে, তোমার ঠিকানা ভুল হয়েছে। যা খুশি কর তোমরা, আমি চললাম।

সে অবশ্য যায় না। শোভাযাত্রায় যোগ দিতে মনটা যতই ছটফট করুক, এ বেচারিদের একটা হিল্লে না করে ফেলে যাওয়া যায় কেমন করে। যাদবের কাছ থেকে গণেশের চিঠিখানা চেয়ে। নিয়ে আরেকবার সে ঠিকানা মিলিয়ে দ্যাখে। ঠিকানা ঠিক আছে। এই দোকানেই গণেশ কাজ করে। এখন দোকানের মালিকের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বার করতে হবে। তার কাছে যদি গণেশের খোঁজ মেলে।

অত বড় আঁকাবাঁকা হরফে লেখা চিঠিখানা পড়ে অজানা গণেশকে ভালো লেগেছিল অজয়ের। চিঠির প্রতি ছত্রে অশুদ্ধ গ্ৰাম্য কথাগুলিতে ফুটে উঠেছে মা-বাপ-ভাই-বোনের জন্য গণেশের মমতা, ওদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য শহরে তার প্রাণপণ লড়াইয়ের ইঙ্গিত, কত যে ভরসা দেওয়া আছে চিঠিতে আর তাতেই ধরা পড়ছে অতি কঠিন অবস্থাতেও গণেশের তেজ আর আত্মবিশ্বাস। কিন্তু গণেশের বুদ্ধি বড় কম। যে দোকানে কাজ করে সেখানকার ঠিকানাটা শুধু না দিয়ে, যেখানে

সে থাকে সে ঠিকানাটা তার দেওয়া উচিত ছিল।

বাড়ির দারোয়ানকে প্রশ্ন করে তার জবাব শুনে অজয় স্বস্তি বোধ করে। গণেশের বুদ্ধির ক্ৰটিটাও মাফ করে ফেলে। বিদ্যুৎ লিমিটেডের মালিক এই বাড়িরই ওপরে থাকে এবং গণেশও তার কাছেই থাকে এ খবর জেনে যাদবেরাও নিশ্চিত হয়।

রাণী বলে খুশি হয়ে, মা গো! ভড়কে গিয়েছিলাম একেবারে। বাঁচা গেল।

অজয় বলে, আমি তবে যাই এবার?

যাদব গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, বাবু, আপনি এবার আসুন। অনেক করলেন মোদের জন্য।

সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তার কৃতজ্ঞতাকে গ্রহণ করে অজয় নীরবে বিদায় হয়ে যায়।

যাদব আবেদন জানায় দারোয়ানকে, গণেশকে একবার ডেকে দেবেন দারোয়ানজি?

দারোয়ানজি উদাসভাবে বলে, ও হ্যায় কি বাহার গিয়া মালুম নেই। যাও না, উপর চলা যাও না?

গণেশের বাড়ির লোক তার খোঁজ করতে এসেছে শুনে দাশগুপ্ত বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে আসে। গণেশের কথা কি বলবে মনে মনে তার ঠিক করাই আছে। দোকানের জিনিস নিয়ে গণেশ পালিয়েছে, সে চোর। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, গণেশকে একবার ধরতে পারলে জেল খাঁটিয়ে ছাড়বে। এসব বলে ভড়কে দিতে হবে ওদের, যাতে কোনোরকম হাঙ্গামা করতে সাহস না পায়। দাশগুপ্তের অবশ্য ভয়-ভাবনার কিছু আর নেই, তবু সামান্য হাঙ্গামাও সে পোহাতে চায় না গণেশের বোকার মতো গুলি খেয়ে মরার ব্যাপার নিয়ে। এমনিতেই সর্বদা তাকে কত ঝঞাট নিয়ে থাকতে হয়। তার ওপর আবার গণেশের সম্বন্ধে খোঁজখবর-তদন্তের জন্য দশটা মিনিট সময় দিতে হবে ভাবলেও তার বিরক্তি বোধ হয়।

ফ্ল্যাটের সদর দরজার ঠিক সামনে ঘেঁষাৰ্ঘেষি করে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ভাইকে কাখে নিয়ে রাণী দাঁড়িয়েছে বাকা ও পরিস্ফুট হয়ে। তার দিকে নজর পড়তেই দাশগুপ্তের চোখ পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে কয়েকবার দেখে নেয়, রাণীর মুখে যে মৃদু বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে তাও তার চোখে ধরা পড়ে। চিন্তাধারা সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শুরু করে দাশগুপ্তের। তাই, গোড়াতেই প্ৰেষ্টিজ হারাতে না চেয়ে সে ইচ্ছে করে মস্ত হাই তুলে মুখ-চোখের ভাব বদলে নির্বিকার গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলে।

গণেশকে খুঁজতে এসেছ?

যাদব বলে, আজ্ঞা হ্যাঁ। আছে না গণেশ?

এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে দাশগুপ্ত বলে, তুমি কে গণেশের?

গণেশ চুরি করে পালিয়েছে বলে ওদের ভড়কে দিলে চলবে না, অন্য কিছু বলতে হবে। লাগসই কি বলা যায় দাশগুপ্ত ভাবতে থাকে।

গণেশ আমার ছেলে বাবু। দেশ গাঁ থেকে আসছি আমরা।

ও! দাশগুপ্ত বলে উদাসভাবে, এখন তো গণেশ এখানে নেই।

কখন ফিরবে বাবু?

গণেশ কি জান, ছুটি নিয়ে গেছে কদিনের। কোথায় যেন যাবে বলল, নামটা মনে পড়ছে। না। কারা সব সঙ্গী জুটেছে, তাদের সঙ্গে গেছে। তিন-চার দিনের মধ্যেই ফিরবে।

হাসপাতালে অথবা মর্গে যার মৃতদেহটায় হয়তো এখন পচন ধরেছে, অনায়াসে দাশগুপ্ত তার বাপ-মা-ভাইবোনদের জানায় সে ফিরে আসবে তিন-চার দিনের মধ্যে, এতটুকু বাধে না। তার ভাবভঙ্গিটা শুধু রাণীর কাছে একটু কেমন কেমন লাগে।

তবে তো মুশকিল। আমরা এখন যাই কোথা! যাদব বলে হতাশ হয়ে।

কোনো খবর না দিয়ে কিছু ঠিক না করে এ ভাবে এলে কেন বোকার মতো?

দাশগুপ্ত বলে রাগ আর বিরক্তি দেখিয়ে, কয়েক মুহূর্ত ভাববার ভান করে, তারপর যেন অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, এইখানেই থাক এখনকার মতো, কি আর করা যাবে!

বলে সংযম হারিয়ে রাণীর ওপর একবার নজর না দিয়ে পারে না।

রাণী বলে, বাবা বদ্যি মশায়ের ছেলে তো আছেন। তাঁর কাছে গেলে সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

যাদব ইতস্তত করে। কেশব বদ্যির ছেলে থাকে হাওড়ায়, আবার সেখানে ছুটবে এত পথ হেঁটে! গিয়ে যদি তাকেও না পাওয়া যায়, কি উপায় হবে তখন।

দাশগুপ্ত বলে, কোথায় যাবে আবার, এখানেই থাক। একটা ঘর ছেড়ে দিচ্ছি তোমাদের।

রাণী বলে, বাবা, শোন।

যাদব কাছে এলে চুপিচুপি বলে, না বাবা, এখানে থাকা চলবে না। বারু লোক ভালো না। মোর ভরসা হচ্ছে না মোটে। শেষকালে গোলমাল হবে, চাকরিটা যাবে দাদার।

যাদব তখন বলে দাশগুপ্তকে, আজ্ঞে, দেশের এক ভদ্রলোক পত্র দিয়েছেন, আমরা তার ছেলের ওখানেই যাই। আপনার এখানে হাঙ্গামা করব না বাবু।

যা খুশি তোমাদের! দাশগুপ্ত বলে।

সময়টা তার খারাপ পড়েছে সত্যি দাশগুপ্ত ভাবে।

ধীরে ধীরে আবার তারা পথে নেমে যায়। আবার দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। স্টেশন থেকে এতদূর হেঁটে এসেছে, এবার স্টেশন পার হয়ে অনেক দূরে যেতে হবে। যে পথে এসেছিল সেই পথেই আবার তারা লালদিঘির দিকে চলতে আরম্ভ করে।

গণেশের মা বলে, ছুটি নিয়ে কোথায় বেড়াতে গেল গণেশ? মোদের জানাল না কিছু চিঠিতে, কিছু বুঝি না বাবু ব্যপার স্যাপার।

শহরে এসে স্যাঙাৎ জুটেছে ছেলের। যাদব বলে ঝাঁঝের সঙ্গে।

অমন কথা বোলো না গণশার নামে। সে আমার তেমন ছেলে নয়।

লালদিঘির দিকে বাঁক ঘুরবার মোড়ের কাছাকাছি এলে দূরাগত জনতার কলরব তাদের কানে ভেসে আসে।

লালদিঘির সামনাসামনি পৌঁছে তাদের থামতে হয়। চারিদিক লোকারণ্য, ভিড় ঠেলে এগোন অসম্ভব। বিরাট এক শোভাযাত্রার মাথা লালদিঘির ওদিকের মোড় ঘুরছে, সামনে তিনটি তিন রকম বড় পতাকা উড়ুরে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। শোভাযাত্রার শেষ এখনো দেখা যায় না। ক্ষণে ক্ষণে ধ্বনি উঠছে হাজার কণ্ঠে। এবার যাদবের মনে হয়, বাঘ যেন ডাক দিচ্ছে মনের আনন্দে।

সামনে তারা দেখতে পায় অজয়কে।

মানুষ ঠেলে তারা অজয়ের কাছে যায়। যাদব ডাকে, বাবু!

অজয় ফিরে তাকায় না। যাদব শুনতে পায় সে নিজের মনে বলছে : আমরা এগিয়েছি। ঠেকাতে পারে নি, আমরা এগিয়েছি!

ঘাড় উঁচু হয়ে গেছে অজয়ের, দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে আনন্দে, উত্তেজনায়। যাদব চেয়ে দ্যাখে, সে হাসছে। মুখে যেন তার সূর্য উঠেছে মেঘ কেটে গিয়ে।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *