০৭. শিয়ালদার কাছে বস্তির ঘরে

শিয়ালদার কাছে বস্তির ঘরে ভোরে ঘুম ভাঙে ওসমানের। তার আগে অনেকে কারা জেগেছে, কথা বলছে। অনেকের কথার সমগ্র আওয়াজটাই কানে লাগে প্রথম, চেতনায় সে আওয়াজ শব্দ হয়ে ওঠে গণেশের সেই কথা : ওরা এগোবে না? শব্দিত চেতনা হয়েই যেন ছিল প্রশ্নটা তার মনেরও মধ্যে, জেগে উঠে মনে পড়ার বদলে যেন জাগরণটাই পরে এল।

শূন্য ঘরে ঘুম ভেঙে গণেশের ওই প্রশ্নটা মনের ধ্বনির মতো শোনার সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে। দেশের বাড়িতে বৌ ছেলেমেয়ের ভাবনা, তারা কেমন আছে এই জিজ্ঞাসা।

কাজে আজ সে যাবে না। যাওয়া উচিত হবে না। তারও নয়, কারো নয়। এক অফুরন্ত বিশ্বাস ও দৃঢ়তা অনুভব করে ওসমান, সবাই যখন এক হয়ে গেছে এগোবার প্রতিজ্ঞায়, নির্দেশ দিতে হয় নি নেতাদের, এমন অকারণ অর্থহীন অত্যাচারের প্রতিবাদও সবাই করবে এক হয়ে, কাউকে বলে দিতে হবে না। এ সিদ্ধান্তের একটা অদ্ভুত সমর্থন অনুভব করে ওসমান, শুধু তার ভিতরের বিশ্বাসে নয়, বাইরে থেকেও যেন বহু লোকের সমর্থন সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে। প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না। ঘরের বাইরে গিয়ে বস্তির বহু কণ্ঠের কলরব কানে এলে তখন সে বুঝতে পারে। রাত্রি শেষেই বস্তি প্রায় খালি করে যারা কাজে চলে যায়, তারা এখনো কেউ যায় নি। তার মানেই কাজে তারা আজ যাবে না, কাজে যেতে হলে ভোরের আলোয় বস্তিতে বসে উত্তেজিত আলোচনার বৈঠক বসানো চলে না। তার উঠতে দেরি হলে রহমান সিদ্দিক গোলামেরা কেউ বেরোবার সময় তাকে ডেকে দিয়ে যায়, আজ ভোর পর্যন্ত কেউ তাকে ডেকে তোলে নি কেন এতক্ষণে ওসমান বুঝতে পারে। নিজেরা যখন তারা কাজে যাবে না, ওসমান অবশ্যই যাবে না, এটা তারা নিজেরাই ধরে নিয়েছে। সুতরাং কাজ কি অনর্থক ঘুমন্ত মানুষটাকে ডেকে তুলে।

তার কারখানার লোকেদের একতা গড়ে উঠতে উঠতে বার বার ভেঙে যাচ্ছে নানা শয়তানি কারসাজিতে। ট্রামের কাজে ইস্তফা দিয়ে এখানে কাজ নিতে হওয়ায় মনে তার একটা অভাববোধ জেগেছিল। সব সময় মনের মধ্যে সে গভীর ঔৎসুক্য অনুভব করে ভেদহীন বৃহৎ এক সংগঠনের একজন হয়ে থাকতে। এই কারখানায় সে সাধ তার যেন কিছুতেই মিটছে না।

এদিকে সেদিন ট্রামকর্মীদের পরিপূর্ণ একতার পরম প্রমাণ দেখা গেল। সেই থেকে নিজেকে তার যেন বঞ্চিত মনে হয়েছে। অহরহ মনে হয়েছে ট্রামের কাজে থাকলে আজ তো সে নিজেকে ওদেরই একজন ভাবতে পারত, চব্বিশ ঘণ্টা আপনা থেকে অনুভব করত হাতে হাত মেলানো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে সে স্থান পেয়েছে। কালও এ অভাববোধ তাকে পীড়ন করেছে। কাল কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল সব! আজ সকালে বস্তিতে ঘুম ভেঙে উঠে শুধু যে সে অভাববোধ মিটে গেছে তা নয়, আশা পূর্ণ হয়েও অনেক বেশিই যেন সে পেয়েছে। ঘরের কোণে শুধু তার একার মনে সঙ্কল্প জেগেছিল, আজ সে কাজে যাবে না। ঘরের বাইরে এসে সে দেখেছে। শুধু একার নয়, সকলের মনেই আপনা থেকে সেই সঙ্কল্প দেখা দিয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে আর হাজার হাজার কেন, সংখ্যাহীন কত মনের সঙ্গে তার মন হাত মিলিয়েছে কে বলতে পারে।

খলিল বলে, দাদা, কাণ্ড হল। ট্রাম বাস সব বন্ধ।

ওসমান সায় দেয়, তা হবে না? ও তো জানা কথা।

রেজ্‌জাক উত্তেজিত হয়ে বলে, রেলগাড়ি আটকে দিলে হয় না? লাইনের ওপর গিয়ে শুয়ে পড়ে? ইঞ্জিন খালি সিটি দিয়ে যাবে এক ধার থেকে এগোতে পারবে না?

ওসমান বলে, না না, রেলগাড়ি আটকানো ঠিক হবে না।

লাল ইটের লম্বা প্রাচীরের পাশে নোংরা ফাঁকা স্থানটিতে একে একে বহু লোক এসে জড়ো হয়। গায়ে মাথায় দুফেঁটা জল ঢেলে তার টিনের পাত্রটি ভরে একটু জল আনতে কলতলায় গিয়ে ধন্না দেবার জন্য গুটি গুটি চলতে চলতে বয়সের ভারে বাকা নানিও খানিক দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, খুঁটিনাটি আরো বিবরণ জানতে চায়, ঝাঝালো গলায় ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করে। অদম্য ক্রোধ ও ক্ষোভের চাপে অপূর্ব গাম্ভীর্য ও ধৈর্যের ছাপ পড়ে মুখগুলি যেন বদলে গিয়েছে মেয়ে-পুরুষের। প্রতিটি কথা, প্রতিটি সেঁক গেলা, প্রতিটি নিশ্বাস, প্রতিটি দৃষ্টিপাত শুধু প্রতিবাদ। কালকের ঘটনায় আছে যুগ-যুগান্তরের অমানুষিকতা, যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত ক্ষোভ তাদের করে দিয়েছে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। এতে আশ্চর্য কি যে, শান্ত শীতল শীতের সকালে কাপড়ের সামান্য আবরণে ঠাণ্ডায় কেঁপেও কেউ কেউ ভেতরের তাপে পাঁতে দাঁত ঘষবে।

তখন তাদের মধ্যে এসে দাঁড়ায় হানিফ।

কথা বলে সে উত্তেজনাকর মারাত্মক। ক্ষুব্ধ মানুষগুলিকে সে যেন ক্ষেপিয়ে দিতে চায়। বলতে বলতে নিজেও সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে ভয়ানক রকম।

চল যাই সব। আজ হাঙ্গামা হবে ভীষণ। মোরা চুপ করে থাকব? চল যাই সবাই মিলে। বহুত আদমি জড়ো হবে। দোকানপাট ভেঙে সব চুরমার করে ফেলব। মোরা শুরু করে দিলে কাণ্ডটা যা বাঁধবে একচোট–

হানিফের সঙ্গে এসেছিল বুধুলাল, সে বলে ওঠে, শাবাশ! শাবাশ!

কয়েকটি অল্পবয়সী ছোকরা চঞ্চল হয়ে ওঠে কিন্তু অন্য সকলে আরো যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে। মনে হয়। এমন কি যারা দতে দাঁত ঘষছিল তাদের চোয়াল টিল হয়ে যায়।

কি বলছ মিঞা? মাথা খারাপ নাকি? ওসমান বলে।

হানিফ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, কেন?

আমরা গিয়ে দোকানপাট ভাঙব, গুণ্ডাদের লুটপাটের সুবিধা হবে। ও কি একটা কথা হল? ওসমান জোর গলায় পেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলে, দোকানপাট ভাঙার কথা ওঠে কিসে? সভা কর, মিছিল কর, হরতাল কর। দোকান বন্ধ থাক। ব্য।

গুণ্ডা বলছ কাকে? সামনে এগিয়ে রুখে ওঠে হানিফ। হানিফ বাড়াবাড়ি করলে তাকে রুখবার জন্য উপস্থিত কয়েকজন ওসমানের কাছে ঘেঁষে আসে।

কাকে বলব? শহরে গুণ্ডা নেই? আমরা দোকানে হানা দিলে তাদের মজা, এ তো জানা কথা।

বড় বড় বেড়েছে তোমার। হানিফ শাসায়।

হাঙ্গামা কোরো না হানিফ।

সিদ্দিক বলে একপা আরো এগিয়ে হানিফের সামনে গিয়ে। আরো কয়েকজন ওসমানের কাছে ঘেঁষে আসে। সেদিকে চেয়ে একটু ইতস্তত করে হানিফ চলে যায় সঙ্গী কজনকে নিয়ে। বুধুলাল দুবার মুখ ফিরিয়ে ওসমানের দিকে তাকিয়ে যায়। সে দৃষ্টির অর্থ খুব পরিষ্কার, আচ্ছা দেখে নেব। বুধুলাল এ অঞ্চলের বিখ্যাত গুণ্ডা নেতা। হানিফের চেয়েও তার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বেশি।

আধঘণ্টার মধ্যে ওসমান পথে বেরিয়ে পড়ে। গণেশের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে আর একটু বেলা করেই হাসপাতালে যাবে, এত সকালে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। আগে একবার রসুলের বাড়ি যাবে। রসুলের সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলার জন্য মনটা ছটফট করছিল ওসমানের। রসুল তার ছেলের মতো, সাহসে তেজে বুদ্ধি-বিবেচনায় ভুলভ্রান্তি বোকামিতে, সব দিক দিয়ে টান একটা বরাবর ছিল রসুলের দিকে তার, কিন্তু আজকের মতো সে টানে কখন টান পড়ে নি এত জোরে, আগে শুধু ছিল এই পর্যন্ত।

কত ভাবে মনটা আজ তার নাড়া খাচ্ছে, তবু তারি মধ্যে ভেসে ভেসে আসছে পারিবারিক একটা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আবছা চিন্তা। পরীবানু সেয়ানা হয়ে উঠেছে অনেক দিন, এবার তার সাদির ভাবনাটা রীতিমতো গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গা থেকে প্রতি পত্রে তাগিদ আসছে পরীবানুর  মার। এদিক-ওদিক ছেলে খুঁজছে ওসমান, আত্মীয়-বন্ধুর কাছ থেকে সন্ধানও আসছে মাঝে মাঝে। কিন্তু পছন্দ যেন তার হচ্ছে না একজনকেও। হবু জামায়ের কতগুলি রকমারি বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠি যেন আগে থেকে মনের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে, সেই মাপে খাপ খাচ্ছিল না একজনও পুরোপুরি। যে ছেলে তার নেই, জামাই খুঁজছিল সে সেই ছেলের মতো যতদূর সম্ভব সেই ছেলের মতো। এ ধারণা তার কাছে পরিষ্কার নয়, মনের এই খামখেয়ালি আবদার। টের পেলে নিজেকে সে সংযত করে ফেলত সঙ্গে সঙ্গেই। আজো সে বুঝতে পারে নি কিসে কি ঘটেছে মনে। রসুলের সঙ্গে পরীবানুর সাদি হলে তো মন্দ হয় না, এই কথাটা মনে পড়ছে ঘুরেফিরে মনের গভীর তলানো ইচ্ছার ভাসা-ভাসা ইঙ্গিতের মতো।

রসুলের বাড়ি বেশি দূরে নয়। এইটুকু পথ যেতে অনেকটা সময় লাগে ওসমানের। ইতিমধ্যেই মানুষ জড়ো হতে আরম্ভ করে দিয়েছে রাস্তায়, বিক্ষোভ প্রকাশ করতে আরম্ভ করে দিয়েছে মৃদুভাবে। সমবেত কোলাহলের বিশিষ্ট সুরটাই বিক্ষোভের। উৎসব-পার্বণে আরো বড় জনতার কলরব ওসমান শুনেছে, তার সুর একেবারে অন্য রকম। কোনো রকম গাড়ি-ঘোড়াই এক রকম চলছে না রাস্তায়। মোড়ে ওসমানের সামনে একটি মোটর গাড়িকে আটকে জবরদস্তি ফিরিয়ে। দেওয়া হল। পরক্ষণে আর একটি গাড়িকে দাঁড় করানো হল, কিন্তু আরোহীর সঙ্গে দু-একটি কি কথা হবার পর সকলে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দিল, দুজন যুবক দুপাশে হেঁটে মোড়ের ভিড়টা পার করে এগিয়ে দিয়ে এল গাড়িটাকে।

ডাক্তারের গাড়ি। একজন বলল ওসমানের জিজ্ঞাসার জবাবে!

শহরের অন্যান্য জায়গাতেও কি এই রকম শুরু হয়ে গেছে?–ওসমান ভাবে। রাইফেলধারী পুলিশ-বোঝাই গাড়ি চলে যায়। ধ্বনি ওঠে জয় হিন্দ! ইনক্লাব জিন্দাবাদ। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। ওসমান আবার ভাবে, কর্তারা যদি ফের বোকামি করে, লাঠি আর বন্দুক দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করে এই রাগ-দুঃখের প্রকাশ, কি হবে তা হলে?

আমিনা নিজেই দরজা খুলে দেন। তাঁর রাতজাগা চোখ দেখেই ওসমান শঙ্কিত কণ্ঠে বলে, রসুল–?

সে তো হাসপাতালে ফিরে গেছে। আসুন বসুন।

ওসমানকে মোড়া দিয়ে আমি নিজে রসুল যে টুলে বসে কেরোসিন কাঠের টেবিলে পড়াশোনা করে সেটাতে বসেনমোড়ার পাড়ের সুতোয় কাজ-করা কাপড়ের ঢাকনিটি ভারি সুন্দর।

ফিরে গেল কেন?

আমিনার মুখে রসুলের বাড়ি আসা ও হাসপাতালে ফিরে যাবার বিবরণ ও কারণ শুনে ওসমান খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে।

অনেক খুন বেরিয়ে গেছে।

সেটাই ভাবনা এখন। আমিনা ধীরে ধীরে বলেন।

ওসমান বলে, খুন নাকি জমা থাকে বোতলে, গায়ে ঢুকিয়ে দেয়?

তাই দিত ওকে, ও নিজে নিতে চায় নি শুনলাম। বোতলের খুন কম ছিল, অনেকের দরকার ছিল জরুরি, তাইতে।

হ্যাঁ।

আচমকা স্পষ্টতর প্রবলতর হয়ে রসুলকে জামাই করার সাধটা আছড়ে পড়ে ওসমানের মনে।–হাসপাতালে যাই একবার, দেখে আসি ওকে।

এখন ওসব কথা তোলার সময় নয়, আমিনা শুনে হয়তো কি ভাববেন, এ সব জেনেও ওসমান হৃদয়ের তাগিদটা রুখতে পারে না, বলে, এক আরজ আছে আপনার কাছে, জানিয়ে রাখি। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে, পরীবানু। ওকে তো দেখেছেন আপনি?

কতবার দেখেছি।

পরীবানুর কথা কোথা আসে ভেবে আমিনা আশ্চর্য হয়ে যান।

ওর জন্য ছেলে খুঁজছি। তা আমার আরজ রইল আপনার কাছে, রসুল ফিরলে আমার মেয়েকে আপনার নিতে হবে। আমি মজুর বটে, লড়ি হকাই, আমার মেয়ে নিলে ঠকবেন না।

এ তো খুশির কথা। আমিনা বলেন আন্তরিকতার সঙ্গে, তবে কি জানেন, রসুলের মত থাকা চাই।

তা চাই না? রসুলের মত চাই আগে।

আপনার সাথে হাসপাতালে যাব? আমিনা যেন নিছক প্রশ্ন করেন তার ব্যাকুল আগ্ৰহ চেপে রেখে।

যাবেন? ওসমান চিন্তিতভাবে বলে, হেঁটে যেতে হবে। রাস্তায় হাঙ্গামা চলছে। পরে নয়। যাবেন। সেই ভালো। আমি দেখে আসি, ঘরে ফিরবার আগে আপনাকে জানিয়ে যাব কেমন আছে।

সেই ভালো তবে!

আমিনা জানেন ওসমানের ছেলে-হারানোর ইতিহাস, তারই রসুলের মতো জোয়ান ছেলে। দেশ-সেবার পথ নিয়ে কাদেরের সঙ্গে তার মতান্তর ছিল বরাবর। বড় তেজী ছিল ছেলেটা। মানত যা, করত তাই। খান বাহাদুরের শেষ বারের নির্দেশ মানতে তার নাকি দ্বিধা হয়েছিল, ওসমান নিজেই বলেছে আমিনাকে। তারপর হাসপাতালে মরবার তিন দিন আগে বাপের কাছে সে মাপ চেয়েছিল, বলেছিল, এস.ডি.ওর গাড়িতে চেপে আমাদের ফেলে খান বাহাদুর পালালেন, গাড়ির পেছনের চাকা আমার ডান পাটা পিষে দিয়ে গেল, সেজন্য দোষ দিই না। প্রজাদের মারতে আমাদের পাঠিয়েছিলেন তা কি জানতাম? আজ এসে প্রজাদের কজনের নাম করে বললেন কি, ওরা আমাদের মেরেছে বলতে হবে। তখন বুঝলাম ব্যাপারটা। প্রজারা কেউ আমাদের মারে নি। যাদের নাম করলেন, আমি জানি তারা ভিন্ গায়ে কিষাণসভা করছিলেন। তোমার কথাই ঠিক হল। এবার বেরিয়ে তোমার কথা, জিয়াউদ্দীন সাহেবের কথা শুনব, নিজে তলিয়ে বুঝব, তবে কিছু করব। মরবার তিন দিন আগে যে ভাষায় যেভাবে কথাগুলি সে বলেছিল, ওসমানের মুখে শুনে, হয়তো ছেলেহারা ওসমানের মুখে শোনার জন্যই, মনে আমিনার গাঁথা হয়ে আছে মুখস্থ করা ইস্তাহারের মতো। ছেলে বাঁচবে এটাই জানা ছিল ওসমানের। ছেলে মরবে, তিন দিনের মধ্যে। মরবে, জানা ছিল না তার। সমবেদনায় বুক ভরে গিয়ে আমিনার চোখের জল উপচে পড়তে চায়।

তারা কথা বলছে, ওসমান উঠি উঠি করছে, রসুলের খবর জানাতে সীতা আসে। সমস্ত রাস্তা সীতা ভাবতে ভাবতে এসেছে ঠিক কি ভাবে মার কাছে হাসপাতালে ছেলের অবস্থার কথা বলে মার মনে ছেলের সম্বন্ধে কতখানি আশা আর কতটুকু ভয় জাগানো চলে, যা সঠিক। রসুল মোটামুটি ভালো আছে, এবং ভালো সে দু-চার দিনের মধ্যে হয়ে উঠবে, এটাই হল প্রধান কথা।

কিন্তু ভয়েরও কারণ একটু আছে সামান্য, কিন্তু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার মতো নয়। আমিনাকে তা জানানো দরকার। তার কাছে অনায়াসে গোপন করে যাওয়ার মতো তুচ্ছ নয় আশঙ্কাটা। আমিনাকে আজ ভয়ের কিছুই নেই জানিয়ে যাবার পর আবার কাল যদি চরম দুঃসংবাদটা তাকে জানাতে হয়, সেটা তার সঙ্গে বীভৎস শত্ৰুতাই করা হবে শুধু।

পথে মনে মনে কথা সাজিয়েছিল সীতা, এখানে এসেই সেগুলি সে ঘেঁটে ফেলে। সহজ সরলভাবে কথা বলাই সে মনে করে উচিত।

রসুলের খবরটা জানাতে এলাম। রসুল ভালো আছে, ঘুমাচ্ছে।

তবে?

ভয় পাবেন না। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে, তার ওপর রাত্রে আবার বাড়ি এসে ফিরে যাবার হাঙ্গামা করায় খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওকে রক্ত দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। এতক্ষণে বোধহয় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। অল্প সময়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে জানেন তো, খুব দুর্বল অবস্থায় একটু ভয়। থাকেই।

ও! দুজনে একসঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সীতাকে চমকে দিয়ে বলে, ভয় তো আছেই।

সীতা নিজেও স্বস্তি বোধ করে বলে, তাই বলছিলাম। শুধু দুর্বল হতে রক্তক্ষয়ের জন্য, রক্ত দিলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। শ-এর ভয়টুকু আছে। সেটা সব ক্ষেত্রেই থাকে, সাধারণ অপারেশন, ডেলিভারি–

সীতা যেন লজ্জা পেয়েই থমকে থেমে যায় আমিনার দিকে চেয়ে।

আমিনা সায় দিয়ে বলেন, তা ঠিক। ধর নবছর পরের এ জঞ্জালটা দু-তিন মাস পরে বিয়োতে হবে, মরেই যাব হয়তো! দু মাস আগে জেলে গেলেন, তিনখানা চিঠি পেয়েছি আজতক তার। প্রতি চিঠিতে শুধু জিজ্ঞেস করছেন, আমার কি হল, আমি কেমন আছি, কি হল যেন চটপট জানাই, কারণ এই ভয়ে উনি মরছেন। জান মেয়ে, ছেলের চেয়ে আমার জন্য তার ভয় বেশি। ছেলের যা মতামত জানতেন, তাতে কেউ খুন না করলে ছেলের কিছু হবে না ধরাই ছিল। তাছাড়া, উনি ভাবতেন, ছেলের বয়স হয়েছে, ছেলে মরদ। মরদ যদি মরদের মতো মরে–

এর ওর কাছে রসুলের মার কথা সীতা শুনেছিল, এমনটি ভাবতে পারে নি। রসুলকে বাদ দিলে এই অবস্থায় এখন তাঁর দশ বছরের একটি ছেলে মাত্র সম্বল! রসুলের জেল হলে কি করবেন। সে কথাটা কি ভাবছেন না উনি? ভাবছেন নিশ্চয়। ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন এ আত্মবিশ্বাস আছে। যা হাবার হবে ভেবে হাল ছেড়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবার মানুষ তো ওকে মনে হয় না।

সীতা একটা খাপছাড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসে হঠাৎ–

আগে আপনার পর্দা ছিল?

ছিল না? আমিনা বলেন জোর দিয়ে, বাঙালি মেয়ের পর্দা আজো ঘোচে নি–তার আর আগে ছিল কি বল?

ওসমান সায় দেয়, তা ঠিক।

 

হাসপাতালে বিশেষ করে ওসমানের জন্যই যেন চমকপ্রদ এক ধাঁধা তৈরি হয়েছিল।

মাল? মাল ছিল নাকি ওর সঙ্গে?

ছিল না? ওর সঙ্গে যে এল প্যাক করা মালটা?

দাঁড়াও দেখি খোঁজ করে।

আধঘণ্টা পরে—! কই, মাল তো নেই। কিসের মাল? কি ছিল?

তখনো বাঁধা লাগে না ওসমানের। জিনিসটা অবশ্যই সরিয়ে রাখা হয়েছে নিরাপদ জায়গায়, যেখানে সেখানে তো ফেলে রাখা যায় না।

কি ছিল কে জানে, প্যাক করা বাক্সের মতো। কাল টেলিফোন করা হল যদি খোঁজ মেলে কার কাছে মালটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কাল রাতে কিছু জানা যায় নি। কথা ছিল, আজ মালটা খুলে দেখা হবে ভেতরে নাম-ঠিকানার কোনো হদিস মেলে কিনা। কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছে হয়তো

না, না। ওর সঙ্গে মাল ছিল না। সকালে লিস্ট করা হয়েছে। এই তো নাম–গণেশ। বয়সে একুশ বাইশ

নাম-পরিচয় জানা গেছে? ওসমান সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করে।

শুধু নামটা–গণেশ। হাতে উল্কি দিয়ে লেখা ছিল। মালের কথা কিছু নেই।

কি হল মালটা?

ছিলই না মাল, কি হল মালটা! মানে? তোমার নামটা কি? ওসমান? ওর নাম তো গণেশ। তোমার এত মাথা ঘামানো কেন ওর জন্য?

ওসমান একটু চুপ করে থাকে।

কি জানি মাথাটা নিজে থেকে ঘামে।

ভদ্রলোকের মনে অপমানিত বোধ করার ভূকুটি ফুটে উঠতে দেখে ওসমান যেন খুশিই হয় একটু।

সকালে হেমন্ত জামা গায়ে দিচ্ছে বেরোবার জন্য, অনুরূপা সামনে এলেন মুখ ভার করে।

এত সকালে বেরোচ্ছিস যে?

সীতার কাছে যাব একবার।

অনুরূপার মুখ আর একটু লম্বা হয়ে যায়।

চা খাবি না?

সীতার ওখানে খাব।

এসব তোরা কি আরম্ভ করেছিস হেমা? অনুরূপা বলেন, দুরন্ত দুঃখের ভাষায়, খোকা কখন কোথায় চলে গেছে আমাকে কিছু না বলে। তুইও বেরিয়ে যাচ্ছিল। বলে কি যেতে নেই একবার আমাকে? এতই তুচ্ছ হয়ে গেছি আমি?

বেরিয়ে তো যাই নি মা এখনো? বলেই যেতাম তোমাকে।

ভুল-ঘরে লাগানো জামার বোতামটা খুলতে খুলতে হেমন্ত বলে অনুযোগের সুরে। সকালে আবার কি প্রতিক্রিয়া দেখা দিল মার মনে কে জানে। এত সকালেই সংযম হারিয়ে অনুরূপ মান-অভিমানের পালা গাইতে শুরু করবেন হেমন্তের বিশ্বাস হতে চায় না। এমন সোজাসুজি জ্বালা বা দুর্বলতা প্রকাশ করাও তো আর স্বভাব নয়!

আবার বলে হেমন্ত সহজ সুরে, সকালে বেরোব, তোমায় তো বলাই আছে। একটু তাড়াতাড়ি যাচ্ছি, সীতা হয়তো বেরিয়ে যাবে। তাই ভাবলাম, ওখানেই চা খেয়ে নেব। চায়ের জল চাপিয়েছ নাকি? তাহলে খেয়েই যাই।

একা আমি কত দিক সামলাব হেমা? কতকাল সামলাব? হেমন্তের কথা যেন কানেও যায় নি। এমনিভাবে অনুরূপা বলেন, রোজগার করে সংসার চালাব, তোমাদের কার মাথায় হরদম কি পাগলামি চাপবে তাও খেয়াল রাখব, অত আমি পারব না হেমা। এই তোমাকে আমি বলে রাখলাম। বড় হয়েছ, ভাইটার দিকে একটু তাকাতে পার না? না বলে কোন্ ফাঁকে খোকা কোথায় চলে গেছে। কিছু খায় নি পর্যন্ত। খুঁজে ডেকে এনে শাসন করতে পার না একটু ওকে?

কোথায় গেছে, এখুনি আসবে। এতে আবার শাসন কিসের?

তুই কিছু বুঝিস না হেমা। এমনি না বলে একটু এদিক-ওদিক যায়, সে আলাদা কথা। ছোট ছেলে অমন করেই। কাল হৈচৈ করতে যেতে চাইছিল, আমি যেতে দিই নি। সকাল হতে না হতে তাই ইচ্ছে করে কিছু না জানিয়ে চুপিচুপি পালিয়েছে।

বেশি আটকালে এ রকম হয়। পাড়ার সব ছেলে রাস্তায় বেরিয়েছে, খোকা বন্দি হয়ে থাকবে?

বলে যেতে পারত।

কেন বলে নি জান? যদি মানা কর এই ভয়ে। তাহলে তো তুমি আরো বেশি রাগ করতে, মানা করলাম, তবু চলে গেল। তোমার মনে কষ্ট দিতে চায় নি খোকা, বুঝতে পারছ না? আমারও

তো ভয় হচ্ছিল কাল, তুমি যদি বারণ কর, কি করে তোমার মনে কষ্ট দেব।

বুঝেছি। কোনো কথা শুনবে না ঠিক করাই থাকে তোমাদের, আমার সঙ্গে শুধু একটু ভদ্রতা কর।

মার সঙ্গে অভদ্রতা করতে হয় নাকি?

হেমন্ত হাসে। অনুরূপাও এতক্ষণে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছেন মনে হয়।

যাকগে, যা খুশি কর। আমি তো এবার পেনশন নেব সংসার থেকে। তোমাদের ঘাড়েই চাপবে ভাইবোনের ভার।

তোমাদের? তোমাদের কে কে মা? ও। আমি আর তোমার ছেলের বৌ। তুমি এত হিসেব জান মা?

কত দিন এভাবে এড়িয়ে যাওয়া চলবে, ঠেকিয়ে রাখা যাবে? হেমন্ত ভাবে পথে নেমে। এই তো সবে সূচনা, শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়াবে এই মায়ার লড়াই কে জানে! অথবা ক্ৰমে ক্ৰমে ঠিক হয়ে যাবে সব, সময় পেলে সম্ভব হবে মানিয়ে নেওয়া, শান্তি পাওয়া মার পক্ষে তার পক্ষেও? বুঝে উঠতে পারে না হেমন্ত। পরিবেশ গড়ে মানুষকে, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলাই সহজ মানুষের পক্ষে, অতি দরকারি লড়াইও এড়িয়ে চলতে মানুষ তাই এত ব্যাকুল, পলাতক মনোভাব। তাই এত প্রবল। পালিয়ে পালিয়ে এড়িয়ে চলার দিন তার পক্ষে ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কি করতে হবে তাকে আগামী দিনগুলিতে, ঠিকমতো তার জানা নেই। বিশেষ অবস্থায় আজকের দু-চার-দশ দিনের বিশেষ কর্তব্য হয়তো তার জানা আছে, কিন্তু তারপর যখন দৈনন্দিন জীবনকে গড়তে হবে নতুন করে তার নিজের, মার, রমা ও খোকনের, চেনা ও অচেনা সব মানুষের জীবন গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, খাপ খাইয়ে, সম্মুখের দিকে গতি বজায় রেখে, শত শত গ্ৰহণ বৰ্জন নিয়ন্ত্রণ পরিমার্জনের মধ্যে ভীরুতা ও দুর্বলতা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের খেলা ও লড়াইয়ে, বাঁচা ও বাঁচানোর সংগ্রামে, তখন কিভাবে কি করবে ভেবেও পাচ্ছে না সে। আজ অবশ্য ভাবার সময় নয় ও সব।

কেন নয়? সীতা আশ্চর্য হয়ে যায় তার কথা শুনে, ভাববার যা আজ থেকে ভাবতে শুরু করলে দোষটা কি? ওই ভাবনায় মশগুল হয়ে তুমি তো আর সব ভুলে যাচ্ছ না? এক দিনে সব ভাবনা শেষ করে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠছ না? সেটা তাহলে ভাবা হবে না, কাব্য হবে। এক দিনে মানুষ বদলায় না। হঠাৎ বিবাগী হয়ে যে ঘর ছাড়ে, তারও ওই ঘর ছাড়াটাই ঘটে হঠাৎ, বৈরাগ্যটা নয়। আর তুমি তো সংসারে থেকে কাজ করবে। ভাব, মাথা গুলিয়ে ফেল না। একদিনে সব ভাবনা মিটিয়ে দিতে চেয়ো না। রোজকার ভাবনা রোজ ভাবলে, রোজকার কাজ রোজ করলে, দেখবে সব ঠিক ঠিক হয়ে যাচ্ছে।

অর্থাৎ ধীর স্থির শান্ত ভাবে–

নিশ্চয়! ওটা দরকার। বিশেষ করে তোমার পক্ষে। মনকে একটু বশে না আনলে কেউ ভাবতে পারে না, সে এলোমেলো ভাবনার শেষ আছে? রাগ কোরো না, নিজেকে তুমি একা বলে জান। তুমি ভাবতে শেখ নি সংসারে আরো দশ জন আছে, আরো দশ জনে ভাবে, আরো দশ জনে কাজ করে। নিজেকে দশ জনের এক জন বলে জানলে, দশ জনের সঙ্গে ভবতে আর কাজ করতে শিখলে, তোমার ভাবনা চিন্তার আসল গোলমালটা কেটে যাবে। ওটা হঠাৎ হয় না। মানুষ একদিনে বদলায় না হেমন্ত।

কিন্তু মার কি হবে?

সব ঠিক হয়ে যাবে। কেন ভাবছ? সৃষ্টিছাড়া উদ্ভট কিছু তুমি হতেও যাচ্ছ না, করতেও যাচ্ছ। না। যদিও তোমার হয়ত ওই রকম কিছু মনে হচ্ছে। তোমার যেমন নাট্যবোধ, জীবন-নাট্য তেমন নয় হেমন্ত। সীতা একটু থেমে বলে, উপদেশের মতো লাগছে?

হেমন্ত সায় দিয়ে বলে, তা লাগছে কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে।

কথাগুলি কিন্তু আমার উপদেশ নয় হেমন্ত। সীতা জোর দিয়ে বলে, তোমারও কিছুদিন আগে থেকে আমার বেলা যা ঘটতে আরম্ভ করেছে, ঠিক সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছি। এ শুধু পরামর্শ। আস্তে আস্তে আজকাল কি বুঝতে পারছি জান? দেশ কাকে বলে তাই আমি জানতাম না দু বছর আগে, এই ভীষণ সত্যটা। অথচ কি প্রচণ্ড অহঙ্কার ছিল দেশকে ভালবাসি বলে!

চায়ের কাপ মুখে তুলে চুমুক দিতে গিয়ে হেমন্ত চেয়ে থাকে সীতার দিকে। নিজের ভুল আবিষ্কার করতে পারার জন্য সীতা কৃতার্থ, কৃতজ্ঞ। যে বিশ্বাস মুখে এমন দীপ্তি, চোখে এমন উজ্জ্বল স্বচ্ছন্দ দৃষ্টি এনে দিতে পারে, সরল ও নম্রও বুঝি মানুষ হয় সেই বিশ্বাসের জোরেই। সীতাকে নিয়ে বহু দিনের বহু ঈর্ষা ক্ষোভ হতাশার অভিজ্ঞতা তো মুছে যায় নি হেমন্তের হৃদয় থেকে আজ এখানে আসবার সময়েও, এত ঘনিষ্ঠ হয়েও সীতাকে ভালো করে চিনতে না পারার জ্বালাটাই বুঝি তার ছিল বেশি সীতাই যেন নানা কলাকৌশলে ওই দুর্বোধ্যতার ব্যবধান সৃষ্টি করে নিজেকে তার নাগালের বাইরে রেখে দিয়েছিল, দূরে যে সরিয়ে রাখা হয়েছে এটুকু জানতে বুঝতে দেবার দয়াটুকুও দেখায় নি। হৃদয়ে অনেক কাটার অনেক ক্ষতে আজ যেন প্রলেপ পড়ে হেমন্তের। নিজেকে তার ছোট ভাবতে হয়, কিন্তু সেজন্য তার খুব বেশি দুঃখ বা ক্ষোভ হয় না। বরং তৃপ্তির সঙ্গে কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই সে এ জ্ঞানকে মেনে নেয় যে নিজের ছোটমি দিয়েই সে পার্থক্য রচনা করেছিল তাদের মধ্যে, সীতা তাকে ঠেকিয়ে রাখে নি। কৃত্রিম আকর্ষণও সীতা সৃষ্টি করে নি। তার জন্য, কৃত্রিম রহস্যের আব্রণেও নিজেকে ঘিরে রাখে নি। সে-ই তার ছোট মাপকাঠিতে সীতাকে মাপতে গিয়ে, তার গরিবের মূল্য বিচার দিয়ে দাম ঠিক করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে, দুঃখ পেয়েছে। সীতার যে একটা সহজ স্বাভাবিক সরলতার গুণ আছে, তার পুরো দাম দিতে পর্যন্ত সে তো কোনোদিন রাজি হয় নি। সীতার যা আছে সে তা মেনে নিতে পারে নি, কেটেছেটে কমিয়ে নিয়েছে নিজের প্রয়োজনে, তার নিজের অল্পতার সঙ্গে, সৈন্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে। যতই হোক, সীতা তো মেয়ে।

কি ভাবছ? চা-টা খেয়ে নাও। একটু ইতস্তত করে সীতা, যেচে সহজ সরল হতে গিয়ে সেটা অনর্থক হলে বড় বিশ্রী লাগে। নিজের চা সে শেষ করে। ভূমিকা যা করবে ভেবেছিল সেটা বাদ দিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করে, মাসিমা কিভাবে নিলেন?

কাল রাত্রে ভালোভাবেই নিয়েছিলেন। সকালে যেন কেমন দেখলাম। মার মনে একটা খটকা লেগেছে–খটকা কেন বলি, মার খুব হিংসা হয়েছে।

জানি। সীতা চোখ তোলে, কাল তোমায় খুঁজতে এসেছিলেন, বলেই ফেলেছেন আমার কাছে। তোমায় নাকি পুতুল করে ফেলেছি আমি, খুশিমতো নাচাচ্ছি। একেবারে বিশ্বাস জন্মে গেছে।

হেমন্তের কথায় নিরুপায়ের আফসোস ফুটে ওঠে, আমরা কি করব! কাল রাত্রে মার সঙ্গে কথা কয়ে কত খুশি হয়েছিলাম। সকালে পাঁচ মিনিটে মনটা বিগড়ে দিলেন। ঠিক কথাই বলেছ তুমি, মানুষ একদিনে বদলায় না।

না হেমন্ত, সীতা মাথা নাড়ে, আমরা কি করব বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। মাসিমাকে সময় দিতে হবে।

মানে?

মানে মাসিমাকে বুঝে উঠতে, সয়ে নিতে সময় দিতে হবে। কাল আমিও চটে গিয়েছিলাম মনে মনে, ছেলেমেয়েদের পঙ্গু করে রাখতে চায় এ কেমন অন্ধ স্নেহ! কিন্তু চটলেও মনটা খচখচ করছিল, কি যেন ভুল হচ্ছে। ভেবে দেখলাম, মাসিমার স্নেহ অন্ধ হোক, মোহগ্ৰস্ত হোক, তুমি তা উড়িয়ে দিতে পার না হেমন্ত। আমিও পারি না। অবশ্য বিশেষ অবস্থায় বড় দরকারে এসব মেহমমতার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না আমাদের। সে আলাদা কথা। সে কারণ ভিন্ন। বড় ব্যাপারে ঘরোয়া লাভক্ষতির হিসাব বাদ দিতেই হয়। কিন্তু এখানে তো কথাটা ঠিক তা নয়। তোমার আমার বন্ধুত্ব নিয়ে যত গণ্ডগোল। কাজেই, মাসিমা অন্যায় করলেও তার স্নেহকে অবজ্ঞা করা যায় না, তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না। বিশেষ করে আমরা যখন জানি, মাসিমাকে একটু প্রশ্রয়। দিলে, একটু সময় দিলে উনি সামলে উঠতে পারবেন। মাসিমা স্বার্থপর নন, তোমাদের নিয়েই ওঁর স্বার্থ। আমাকে নিয়ে ওঁর হয়েছে মুশকিল। এটা ওঁর দুর্বলতা, অন্যায়, তা বলব। কিন্তু দুর্বলতাটা জয় করার সময় আর সুযোগ ওঁকে না দিলে সেটা আমাদের অন্যায় হবে। তোমাকে তাই একটা কথা বলতে চাই।

বল!

কিছুদিন তুমি আমার সঙ্গে মেলামেশা একেবারে কমিয়ে দাও।

কতদিন?

তোমায় আমি কেড়ে নিয়ে বশ করেছি এ ধারণাটা মাসিমার যদ্দিন না কাটে। শুধু মেলামেশা কমানো নয়, তোমার চালচলন থেকে মাসিমা যেন আবার ধারণা না করে বসেন, মিশতে না পেয়ে আমার জন্য তোমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ওটাও তোমার খেয়াল রাখতে হবে। তাই বলে এমন ভাবও দেখিও না যেন সীতা বলে কেউ ছিল তুমি তা স্রেফ ভুলে গেছ মাসিমা তাহলে ভাববেন একটা খেলা করছি আমরা ওঁর সঙ্গে।

হেমন্ত সংশয় ভরে বলে, ওটা কি মার সঙ্গে ছলনা করা হবে না সীতা?

সীতা জোর দিয়ে বলে, না। কারণ, আমরা স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করলেও মাসিমা সেটাকে এখন বিকৃত দৃষ্টিতে বিচার করবেন, খুঁজে খুঁজে শুধু বার করবার চেষ্টা করবেন আমার জন্য ওঁকে কিসে তুমি অবহেলা করলে, কিসে তুচ্ছ করলে। ওঁর বিকারটাই তাতে জোরালো হবে। শান্ত মনে ভাববার বুঝবার সময় পেলে উনি এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন। মা অসুস্থ, কিছুদিন তুমি তার চিকিৎসা করবে। এতে ছলনার কি আছে?

হেমন্ত চুপ করে ভাবে। তার মুখে মৃদু হতাশা ও অসহায়তার ভাব ফুটে উঠতে দেখে দুঃখের সঙ্গে সীতা ভাবে, তাকে ছেড়ে দূরে দূরে কি করে থাকবে তাই কল্পনা করতে আরম্ভ করেছে কি হেমন্ত নিজের মধ্যে গভীর বেদনা জাগাতে? হেমন্ত কথা কইতে সে স্বস্তি পায়। অত হাল্কা নয় হেমন্ত!

এই সময়টাতেই তোমাকে আমার বেশি দরকার ছিল।

না হেমন্ত, বিনা দ্বিধায় সীতা বলে, এটা তোমার ভুল। আমি সব সময় পেছনে লেগে না থাকলে যদি তুমি ভেস্তে যাও, তবে তাই যাওয়াই ভালো। কিন্তু তা সত্যি নয়, ভেব না। তোমার নতুন বিশ্বাস শিথিল হবে না, মনের জোরে ঘাটতি পড়বে না। এমন অনেককে পাবে, যারা বরং ওদিক দিয়ে আমার চেয়ে বেশি কাজে লাগবে তোমার এ সময়। তা ছাড়া, সীতা স্নিগ্ধ হাসি হাসে, আমাকে একেবারে ত্যাগ করতে তো বলি নি তোমায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *