১১.৩ মুরাৎ-এর সৈন্যরা

অধ্যায়-২৬

বিকেল চারটে নাগাদ মুরাৎ-এর সৈন্যরা মস্কোতে ঢুকতে শুরু করল। সকলের আগে অশ্বপৃষ্ঠে উতেমবের্গ হুজারদের একটা দল, তাদের পিছনে অসংখ্য দলবল নিয়ে নেপলস-এর রাজা স্বয়ং।

আর্বাত স্ট্রিটের মাঝামাঝি সেন্ট নিকলাসের অলৌকিক দেবমূর্তির গির্জার কাছে পৌঁছে মুরাৎ থামল; লে ক্রেমলিন দুর্গের অবস্থা জানবার জন্য যে অগ্রবর্তী সেনাদলকে পাঠানো হয়েছে তাদের খবরের জন্যই সে অপেক্ষা করতে লাগল।

যারা মস্কোতেই থেকে গেছে তাদের একটা দল মুরাতের চারপাশে ভিড় করল। পালক ও সোনার পোশাকে সজ্জিত লম্বা-চুল এই বিচিত্র সেনাপতিটিকে দেখে তারা বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে তার দিকে তাকাতে লাগল।

নিচুগলায় তাদের বলতে শোনা গেল, ইনিই কি ওদের জার না কি? তা লোকটি মন্দ নয়?

 একজন অশ্বারোহী দোভাষী তাদের দিকে এগিয়ে গেল।

মাথার টুপি খুলে ফেল…সব টুপি খুলে ফেল। ভিড়ের মধ্যে একজনের মুখ থেকে আরেকজনের মুখে মুখে কথাটা ফিরতে লাগল। দোভাষী বুড়ো দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করল ক্রেমলিন অনেক দূরে কি না। অনভ্যস্ত পোলিশ উচ্চারণে বিব্রত দারোয়ান বুঝতেই পারল না যে দোভাষী রুশ ভাষাতেই কথা বলছে তার কথা কিছুই বুঝতে না পেরে সে ভিড়ের মধ্যে সরে পড়ল।

মুরাৎ দোভাষীর কাছে এগিয়ে এসে বলল, ওদের জিজ্ঞাসা কর রুশসৈন্যরা কোথায় আছে। একজন রুশ কথাটা বুঝতে পারল, আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই একযোগে দোভাষীর প্রশ্নের জবাব দিতে লাগল। অগ্রবর্তী সেনাদল থেকে ফিরে এসে একজন ফরাসি অফিসার জানাল, দুর্গের ফটকে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে, আর সম্ভবত সেখানে একদল সৈন্য লুকিয়ে ওৎ পেতে আছে।

ভালো কথা! বলে মুরাৎ দলের একজনের দিকে ফিরে হুকুম দিল, ফটকের উপর গোলাবর্ষণের জন্য চারটে হাল্কা কামান সেইদিকে নিয়ে যাওয়া হোক।

মুরাতের পিছন পিছন কামানগুলি এগিয়ে চলল; আৰ্বাত পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ভজদভিঝেংকা স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তারা থেমে গেল; স্কোয়ারের মধ্যে সৈন্য সমাবেশ করল। কয়েকজন ফরাসি অফিসার কামান বসানোর কাজের তত্ত্বাবধান করতে করতে ছোট দুরবীণে চোখ লাগিয়ে ক্রেমলিনকে দেখতে লাগল।

ক্রেমলিনে সান্ধ্য-উপাসনার ঘণ্টা বাজছে; সে শব্দ শুনে ফরাসিরা সচকিত হয়ে উঠল; তারা ধরে নিল ওটা সৈন্যদের প্রতি সংকেত-ধ্বনি। কয়েকজন পদাতিক সৈনিক কুতাফিয়েভ ফটকের দিকে ছুটে গেল। সেখানে কড়িকাঠ ও কাঠের পর্দা বসানো হয়েছে, আর অফিসার ও সৈন্যরা সেদিকে ছুটে যেতেই ফটকের নিচ থেকে দুটো বন্দুকের গুলি ছোঁড়া হল। কামানের পাশে দণ্ডায়মান একজন সেনাপতি অফিসারকে কিছু নির্দেশ দিতেই সে আবার তার সৈন্যদের নিয়ে সেখানে ছুটে গেল।

ফটক থেকে আরো তিনটে গুলির শব্দ এল। একটা গুলি লাগল জনৈক ফরাসি সৈনিকের পায়ে, আর পর্দার পিছন থেকে কয়েকটি গলার অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে যেন কোনো হুকুম এসেছে এমনিভাবে ফরাসি সেনাপতি, অফিসার ও সৈনিকদের মুখের আনন্দ-প্রশান্তির পরিবর্তে দেখা দিল সগ্রাহ ও কষ্ট সহ্য করার সংহত প্রস্তুতির দৃঢ়তা। মার্শাল থেকে সাধারণ সৈনিক পর্যন্ত প্রত্যেকের কাছেই এ জায়গাটা আর ভজদভিঝেংকা, বা মখাভায়া, বা কুতাফিয়েভ স্ট্রিট, অথবা ত্রয়স্তা ফটক নয়, এটা একটা নতুন রণক্ষেত্র যা হয়তো অচিরেই রক্তক্ষয়ী হয়ে দেখা দেবে। সকলেই সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। ফটক থেকে ভেসে আসা চিৎকার থেমে গেল। কামানগুলো এগিয়ে চলল, গোলন্দাজ সৈনিকরা মশালের ছাই ঝেড়ে ফেলল, একজন অফিসার হুকুম দিল : কামান দাগ! তারপরই শোনা গেল দুটো গোলা ছুটে আসার শোঁ-শোঁ শব্দ। গোলা দুটি আছড়ে পড়ল ফটকের পাথরে ও কাঠের কড়ি ও পর্দার উপর; স্কোয়ারের উপর দেখা দিল দুটো ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

সেই গোলার শব্দের প্রতিধ্বনি পাথরে-গড়া ক্রেমলিনের মাথার উপর থেকে মিলিয়ে যাওয়ার কয়েকমুহূর্ত পরেই ফরাসিরা তাদের মাথার উপরে একটা বিচিত্র শব্দ শুনতে পেল। হাজার হাজার কাক প্রাচীরের উপর দিয়ে উড়ে এসে বাতাসে পাক খেতে লাগল, আর কর্কশ গলায় ডাকতে ডাকতে সশব্দে পাখা ঝাঁপটাতে লাগল। সেই শব্দের সঙ্গে মিশে ফটক থেকে ভেসে এল একটি মাত্র মানুষের চিৎকার, এবং ধোয়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল চাষীর কোট-পরা খোলা মাথার একটি মূর্তি। একটা বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে ফরাসিদের দিকে তাক করল। ফরাসি অফিসার আর একবার হুকুম দিল, কামান দাগ! আর একই সঙ্গে শোনা গেল একটা বন্দুকের ও দুটো কামানের শব্দ। ফটকটা আবার ধোঁয়ায় ঢেকে গেল।

পর্দার ওপাশে কিছুই নড়ছে না; ফরাসি পদাতিক সৈন্য ও অফিসাররা ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। ফটকের পথের উপর তিনজন আহত হয়ে ও চারজন মরে পড়ে আছে। চাষীর কোট-পরা দুটি লোক প্রাচীরের নিচ থেকে জনামেংকার দিকে ছুটে গেল।

এসব সরিয়ে ফেল! কড়িকাঠ ও মৃতদেহগুলি দেখিয়ে একজন অফিসার হুকুম করল, আর ফরাসি সৈন্যরা আহতদের পাঠিয়ে দিয়ে মৃতদেহগুলিকে আলিসার উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এই লোকগুলি কারা তা কেউ জানল না। ওদের সরিয়ে ফেল! ওদের সম্পর্কে শুধু এইটুকুই বলা হল। আর আলিসার উপর দিয়ে তাদের ছুঁড়ে ফেলা হল, এবং পরে যাতে দুর্গন্ধ ছড়াতে না পারে সেজন্য পরে সেখান থেকেও সরিয়ে দেওয়া হল। একমাত্র থিয়েই তাদের স্মৃতির প্রতি কয়েকটি উচ্ছ্বসিত পংক্তি উৎসর্গ করেছে : এই হতভাগ্যরা পবিত্র দুর্গ দখল করেছিল, অস্ত্রাগার থেকে নিজেরাই বন্দুক সগ্রহ করে ফরাসিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল। তাদের অনেকেই তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল; ক্রেমলিনকে মুক্ত করা হয়েছিল তাদের উপস্থিতি থেকে।

মুরাৎকে জানানো হল, রাস্তা পরিষ্কার। ফরাসিরা ফটকের ভিতর ঢুকে পড়ল, সেনেট স্কোয়ারে তার খাটাল। সেনেট ভবনের জানালা দিয়ে সৈনিকরা জ্বালানির জন্য চেয়ার ছুঁড়ে ফেলতে লাগল স্কোয়ারের মধ্যে, আর তাই দিয়ে সেখানে আগুন জ্বালানো হল।

অন্য সেনাদলগুলি ক্রেমলিনের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে মরসেকা, লুবিয়াংকা ও পক্ৰোভকা স্ট্রিট বরাবর শিবির ফেলল। অন্যরা আস্তানা পাতল ভজদভিঝেংকা, নিকোলস্কি ও তিরস্কয় স্ট্রিটে। কোনো বাড়ির মালিককে খুঁজে না পাওয়ায় শহরে স্বাভাবিক ব্যবস্থামতো ফরাসিদের কোথাও অধিবাসীদের কাঁধে চাপানো গেল না; সকলেই তাঁবুতে বাসা বাঁধল।

ফরাসিরা ছিন্নবাস, ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত এবং মূল সংখ্যার তিনভাগের একভাগে পরিণত হলেও সুন্দর শোভাযাত্রা সহকারেই মস্কোতে প্রবেশ করল। সেনাদল শ্রান্ত ও ক্ষীণবল, তবু সংগ্রামশীল ও ভয়ংকর। কিন্তু বিভিন্ন আস্তানায় চলে যাবার আগে পর্যন্তই তারা ছিল সৈনিক। কিন্তু যে মুহূর্তে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সৈন্যরা ঐশ্বর্যবানদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে ছড়িয়ে পড়ল তখন থেকেই সেনাবাহিনী কোথায় হারিয়ে গেল, তার জায়গায় দেখা দিল এমন কিছু জীব যারা পরিচয়হীন,না নাগরিক না সৈন্য, তাদের বলা চলে লুঠেরার দল। পাঁচ সপ্তাহ পরে সেই মানুষগুলিই যখন মস্কো ছেড়ে চলে গেল তখন আর তারা একটা সেনাদল হয়ে গড়ে উঠতে পারল না। তারা তখন একদল উচ্ছল লুঠেরা, যার কাছে যা মূল্যবান বা দরকারি মনে হল সেই জিনিসই হাতিয়ে নিয়ে তারা চলে গেল। মস্কো ছেড়ে যাবার সময় কারো লক্ষ্যই আর জয় করা নয়, তাদের একমাত্র লক্ষ্য যে যা পেয়েছে সেটাকে হাতে রাখা। একটা বাঁদর যেমন সরু গলা কলসির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মুঠোভর্তি বাদাম পেয়ে সেগুলো হারাবার ভয়ে কিছুতেই মুঠি খোলে না এবং মারা যায়, সেইরকম ফরাসিরা যখন মস্কো ছেড়ে গেল তখন তাদেরও মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠল, কারণ লুঠের মাল সঙ্গে নিয়েই তারা চলল, আর যা তারা চুরি করেছে তা ফেলে যাওয়াও বাদরের বাদাম ফেলে যাওয়ার মতোই অসম্ভব। প্রতিটি রেজিমেন্ট মস্কোর একটা অঞ্চলে ঢুকবার দশ মিনিট পরেই একটি সৈনিক বা অফিসারের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। সামরিক ইউনিফর্ম ও চটের বুটপরা লোকগুলিকে দেখা গেল এ ঘর থেকে ও ঘরে হেসে হেসে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মদের ঘরে এবং ভাড়ার ঘরেও সকলকে খাবারদাবার নিয়ে ব্যস্ত দেখা গেল, কেউবা ভাঙছে গাড়ি ঘরের তালা। কেউ বা আস্তাবলের দরোজা, কেউ বা রান্নাঘরে আগুন জ্বালিয়ে আস্তিন গুটিয়ে ময়দা মাখছে, রুটি সেঁকছে, আবার মেয়েদের ও বাচ্চাদের কখনো ভয় দেখাচ্ছে, কখনো তাদের নিয়ে মজা করছে, আদর করছে। দোকান ও বাড়িগুলোতে এধরনের মানুষ অনেক আছে, কিন্তু একটিও সৈনিক কোথাও নেই।

ফরাসি কমান্ডাররা হুকুমের পর হুকুম জারি করল, সৈন্যদের শহরে ছড়িয়ে পড়া নিষিদ্ধ করা হল, অধিবাসীদের উপর অত্যাচার-উৎপীড়ন অথবা লুঠতরাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হল, সেই সন্ধ্যায় সৈন্যদের নাম-ডাকবার কথাও ঘোষণা করা হল। কিন্তু এতসব ব্যবস্থা সত্ত্বেও যেসব মানুষ একটু আগে পর্যন্তও ছিল একটা সেনাদল তারাই প্রচুর আরাম ও জিনিসপত্র সমন্বিত ঐশ্বর্যশালী পরিত্যক্ত শহরটার বুকে জলস্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। একদল ক্ষুধার্ত গরু-মোষ যখন ফসলহীন মাঠ পার হয় তখন তাদের সহজেই বাগে রাখা যায়, কিন্তু যেই তারা একটা ফসলভরা মাঠে পৌঁছয় অমনি তারা হাতের বাইরে চলে যায়, ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে; ফরাসি সৈন্যরা সেইভাবেই সমৃদ্ধ শহরটার বুকে ছড়িয়ে পড়ল।

মস্কোর অধিবাসীরা কেউ নেই; জল যেরকম বালির ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে নিচে পড়ে, সৈন্যরাও সেইরকম ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে দুর্বার গতিতে শহরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। একটা অশ্বারোহী সেনাদল কোনো ব্যবসায়ীর বাড়িতে ঢুকে সেখানে ঘোড়া রাখবার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অন্য আর একটা বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। কারণ সেটাকে আরো একটু ভালো বলে মনে হল। অনেকেই কয়েকটা বাড়ি দখল করে নিয়ে খড়ি দিয়ে তাদের নাম লিখে রাখল, আর তাই নিয়ে অন্য দলের সঙ্গে ঝগড়া করল, এমন কি লড়াই পর্যন্ত করল। বাসস্থান ঠিক করার আগেই সৈন্যরা শহর দেখতে পথে বেরিয়ে পড়ল; যখন শুনল যে সবকিছুই পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে তখন তারা সেইসব জায়গার উদ্দেশ্যে ছুটল যেখানে মূল্যবান জিনিসপত্র মিলবে। অফিসাররা ছুটল সৈন্যদের বাধা দিতে, কিন্তু তারাও সেই একই কাজে লেগে গেল। সামান্য কিছু অধিবাসী যারা মস্কোতেই ছিল তারা লুঠের হাত থেকে বাঁচবার জন্য কমান্ডিং অফিসারদের নিজ নিজ বাড়িতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এল। প্রচুর ঐশ্বর্য; তার কোনো সীমা নেই; ফরাসিরা যেসব অঞ্চল দখল করেছে তার চারপাশে রয়েছে আরো কত অনাবিষ্কৃত বেদখল অঞ্চল; তারা ভাবল সেখানে হয়তো আরো ধনরত্ন পাওয়া যাবে। মস্কো যেন ক্রমেই সেনাদলকে পাকে পাকে বেশি করে ঘিরে ধরল। শুকনো মাটিতে যখন জল ঢালা হয় তখন জল ও মাটি দুইই অদৃশ্য হয়ে যায়, দেখা দেয় কাদা; ঠিক সেইরকম একটা সমৃদ্ধ পরিত্যক্ত শহরে ক্ষুধার্ত সেনাদলের প্রবেশের ফলে দেখা দিল অগ্নিকাণ্ড ও লুঠতরাজ; সেনাদল ও সমৃদ্ধ শহর দুইই ধ্বংস হল।

ফরাসিরা বলে, রস্তপচিনের হিংস্র দেশপ্রেমই মস্কোর অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী, রুশরা বলে দায়ী ফরাসিদের বর্বরতা। আসলে কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দায়ী করে মস্কোর অগ্নিকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। মস্কোকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সেখানকার যে অবস্থা হয়েছিল তাতে একশ ত্রিশটি নিম্নমানের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকুক আর নাই থাকুক, কাঠের তৈরি যে কোনো শহরই পুড়তে বাধ্য। খড়কুটোর তূপের উপর কয়েক দিন ধরে অনবরত আগুনের ফুলকি পড়লে সেটা যেমন পুড়তে বাধ্য ঠিক তেমনই পরিত্যক্ত মস্কোর অগ্নিদগ্ধ হওয়াও ছিল অনিবার্য। বাড়ির মালিকরা যখন বাড়িতে বাস করে এবং একটা পুলিশ বাহিনী উপস্থিত থাকে তখনো যে কাঠের তৈরি শহরে অগ্নিকাণ্ড ছাড়া একটা দিনও কাটে না, সেই শহরের অধিবাসীরা যখন ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, সেসব দখল করেছে সৈন্যরা, তারা পাইপ টানছে, সেনেট ভবনের চেয়ার দিয়ে সেনেট স্কোয়ারেই আগুন জ্বালাচ্ছে, দিনে দুইবার করে খানা পাকাচ্ছে, তখন কি সে শহরে আগুন না লেগে পারে! রস্তপচিনের হিংস্র দেশপ্রেম এবং ফরাসিদের বর্বরতাকে এ ব্যাপারে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। মস্কোতে আগুন লাগিয়েছিল সৈন্যদের পাইপ, রান্নাঘরের ও শিবিরের আগুন, আর পরের বাড়ি দখল করেছিল যে শত্রু সৈন্যরা তাদের অসতর্কতা। গৃহদাহের ঘটনা যদি ঘটেও তাকে তবু সেটাকেই কারণ বলে ধরা চলে না, কারণ গৃহদাহের কোনো ঘটনা না ঘটলেও মস্কো অগ্নিদগ্ধ হতই।

ফরাসিদের পক্ষে রস্তপচিনের হিংস্রতাকে দায়ী করা এবং রুশদের পক্ষে শয়তান বোনাপার্তকে দায়ী করা যতই লোভনীয় হোক, একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে অগ্নিকাণ্ডের সেরকম কোনো প্রত্যক্ষ কারণ ছিল না, কারণ মালিকরা যখন কোনো গ্রাম, কারখানা, বা বাড়ি ছেড়ে যায় এবং অপরিচিত লোকদের সেখানে বাস করতে ও পরিজ রান্না করতে দেওয়া হয়, তখন সেই গ্রাম, কারখানা বা বাড়িতে যেমন আগুন লাগতে বাধ্য, তেমনই মস্কোর অগ্নিকাণ্ডও ছিল অনিবার্য। একথা সত্য যে অধিবাসীরাই মস্কোকে পুড়িয়েছিল, কিন্তু পুড়িয়েছিল সেই অধিবাসীরা যারা মস্কো ছেড়ে চলে গিয়েছিল, মস্কোতে যারা তখনো ছিল তারা নয়। বার্লিন, ভিয়েনা এবং অন্যসব শহরের মতো শকবলিত মস্কো যে অক্ষুণ্ণ থাকল না তার সহজ কারণ তার অধিবাসীরা শহরকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল, শহরে থেকে তারা রুটি ও নুন দিয়ে ফরাসিদের অভ্যর্থনা করেনি, শহরের চাবি তাদের হাতে তুলে দেয়নি।

.

অধ্যায়২৭

মস্কোর জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলেমিশে ফরাসিরা একসময় এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যেখানে ২রা সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পিয়ের নিজেও বাস করছিল।

অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একান্ত নির্জনে দুটো দিন কাটাবার পরে পিয়েরের মনের অবস্থা তখন প্রায় পাগলামির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। একটিমাত্র চিন্তাই তাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই চিন্তাটি কখন কীভাবে তার মাথায় ঢুকেছে তা সে জানে না, কিন্তু অতীতের কিছুই তার মনে নেই, বর্তমানের কথাও কিছুই সে বোঝে না, যা কিছু দেখে আর যা কিছু শোনে সবই তার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হয়।

জীবনের দাবির যে জটিল জালে সে বাঁধা পড়েছে, বর্তমান অবস্থায় যার হাত থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না, তার কবল থেকে পালাবার জন্যই সে বাড়ি ছেড়েছে। জোসেফ আলেক্সিভিচের বাড়িতে সে এসেছিল স্বৰ্গত মানুষটির বই ও কাগজপত্রের বিলি-ব্যবস্থা করার অছিলায়, কিন্তু আসলে সে এসেছিল জীবনের গোলযোগের কবল থেকে শান্তির সন্ধানে, কারণ তার মনে জোসেফ আলেক্সিভিচের স্মৃতি যে শাশ্বত, গম্ভীর, শান্ত চিন্তার সঙ্গে জড়িত সেটা তার নিজের তৎকালীন অশান্ত জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে তখন খুঁজছিল একটি শান্ত আশ্রয়, সেই আশ্রয়ই সে পেয়ে গেল জোসেফ আলেক্সিভিচের পড়ার ঘরে। পড়ার ঘরের মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতার মধ্যে সে যখন ধূলিমলিন লেখার টেবিলের উপর কনুই রেখে বসে থাকে তখনই একের পর এক বিগত কয়েকদিনের স্মৃতি, বিশেষ করে বরদিনো যুদ্ধের স্মৃতি-কল্পনায় তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বড়ই তুচ্ছ ও অর্থহীন বলে মনে হয়। গেরাসিম যখন তাকে দিবাস্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলল তখনই তার মনে হল যে জনসাধারণ কর্তৃক মস্কোকে রক্ষার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে সেও অংশ নেবে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই সে গেরাসিমকে বলল তাকে একটা চাষীর কোট ও একটা পিস্তল যোগাড় করে দিতে। তাকে আরো জানাল যে নিজের নাম গোপন করে সে জোসেফ আলেক্সিভিচের বাড়িতেই থাকবে।

তারপর মস্কো রক্ষার কাজে জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে কোটটা কিনবার পরেই যখনই রস্তভদের সঙ্গে পিয়েরের দেখা হয়ে গেল এবং নাতাশা তাকে বলল : আপনি কি মস্কোতেই আছেন?…কী চমৎকার! তখনই চকিতে তার মনে হল যে সত্যি তো, মস্কো যদি বেদখল হয়েও যায় তবু তার পক্ষে এখানে থেকে নিয়তিনির্দিষ্ট কাজে আত্মনিয়োগ করাই তো সবচাইতে ভালো কাজ।

কোনো কিছুতেই পিছ-পা হবে না এই ধারণা নিয়েই পরদিন সে তিনপাহাড় ফটকে গেল। কিন্তু সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে যখন তার মনে স্পষ্ট ধারণা হল যে মস্কোকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হবে না তখনই হঠাৎ তার মনে হল, যে কাজকে আগে সে একটা সম্ভাবনামাত্র বলে মনে করেছিল সেটাই এখন হয়ে উঠেছে একান্ত প্রয়োজনীয় ও অনিবার্য। নাম ভাড়িয়ে তাকে মস্কোতে থাকতেই হবে, নেপোলিয়নের সঙ্গে দেখা করে তাকে হত্যা করতে হবে, হয় নিজে মরবে আর না হয় সারা ইওরোপের সব দুঃখের অবসান করবে–তার ধারণা একমাত্র নেপোলিয়নের জন্যই ইওরোপের এত দুঃখ।

১৮০৯ সালে একটি জার্মান ছাত্র যখন ভিয়েনাতে নেপোলিয়নের প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ সবই পিয়ের জানে। সে জানে যে ছাত্রটিকে গুলি করে মারা হয়েছিল। নিজের পরিকল্পনা মতো কাজ করতে হলে নিজের জীবনের যে ঝুঁকি নিতে হবে সেই চিন্তাই তাকে আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলল।

দুটি প্রবল অনুভূতি দুর্বার বেগে পিয়েরকে এই উদ্দেশ্যের দিকে টানছে। প্রথম অনুভূতিটি হচ্ছে-সকলের আসন্ন বিপদের মুখে ত্যাগ ও কষ্ট ভোগের প্রয়োজনীয়তা; এই একই অনুভূতি তাকে ২৫ তারিখে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মোঝায়েস্ক-এ, আর সেখান থেকে যুদ্ধের একেবারে ঘন আর্বতের মাঝখানে এবং এখনো তাকে নিজের বাড়ি থেকে বের করে এনেছে, চিরাভ্যস্ত বিলাস ও আরামের পরিবর্তে তাকে শুতে দিয়েছে শক্ত সোফায় আর খেতে দিচ্ছে গেরাসিমের সঙ্গে একই খাদ্য। অপর অনুভূতিটি হচ্ছে যা কিছু গতানুগতিক, কৃত্রিম ও মানবিক-যাকে অধিকাংশ মানুষ জাগতিক পরমার্থ বলে মনে করে–তার প্রতি রুশ মনের স্বাভাবিক অস্পষ্ট বিরাগ।

এদিকে আজ যদি সে অন্য সকলের মতো মস্কো ছেড়ে চলে যায় তাহলে তার বাড়ি থেকে পলায়ন, এই চাষীর কোট, এই পিস্তল, রস্তভদের কথা, তার ঘোষণা যে সে মস্কোতেই থাকবে,-সবই যে অর্থহীন হয়ে পড়বে; শুধু তাই নয়, সবই হবে ঘৃণাৰ্হ ও হাস্যকর, আর সেটাই পিয়েরের পক্ষে অসহ্য।

যেমন হয়ে থাকে, পিয়েরের শারীরিক অবস্থাও তার মানসিক অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। অনভ্যস্ত মোটা খাবার, কদিনের অনবরত ভদকা পান, মদ ও চুরুটের অভাব, নোংরা পোশাক, শয্যাবিহীন ঘোট সোফায় প্রায় নিদ্রাহীন দুটি রাত যাপন-সব কিছু মিলে তাকে এমন একটা উত্তেজনার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে যেটা পাগলামিরই নামান্তর।

.

দুপুর দুটো। ফরাসিরা মস্কোতে ঢুকে পড়েছে। পিয়ের তা জানে, তবু কাজের পথে না গিয়ে সে শুধু মনে মনে তার পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ নিয়েই চিন্তা করছে। কল্পনায় আঘাত হানবার কথা অথবা নেপোলিয়নের মৃত্যুর কথা যত না ভাবছে তার চাইতে অনেক বেশি করে, অসাধারণ স্পষ্টতা ও বিষণ্ণ আনন্দের সঙ্গে কল্পনা করছে নিজের ধ্বংস ও বীরত্বপূর্ণ কষ্টসহিষ্ণুতার কথা।

ভাবছে, হ্যাঁ, একাকি, সকলের জন্য, আমি হয় এ কাজ করব, নয়তো মরব। হ্যাঁ, এগিয়ে যাব…তারপর সহসা…পিস্তল, না ছুরি?…একই কথা! বলব, আমি নই, বিধাতার হাতই তোমাকে শাস্তি দিল…সে কল্পনা করল, নেপোলিয়নকে মারবার সময় এই কথাগুলি তাকে বলবে। এবার আমাকে ধর, মৃত্যুদণ্ড দাও! মাথাটা নুইয়ে বিষণ্ণ অথচ কঠিন মুখে সে নিজেকেই বলতে লাগল।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পিয়ের যখন এইভাবে নিজের সঙ্গেই কথা বলছিল তখন পড়ার ঘরের দরোজা খুলে দ্বারপথে দেখা দিল মকার আলেক্সিভিচের মূর্তি; আগে সে ছিল কত ভীরু, কিন্তু এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

ড্রেসিং-গাউনটা বাঁধা হয়নি, মুখটা রক্তিম ও বিকৃত। মনে হয় মদ খেয়েছে। পিয়েরকে দেখে প্রথমে কিছুটা বিচলিত হল, কিন্তু পিয়েরের মুখের বিমূঢ় ভাব লক্ষ্য করে সঙ্গে সঙ্গে সাহস ফিরে পেল; স্খলিত পায়ে ঘরের মাঝখানে এগিয়ে গেল।

দৃঢ় কর্কশ গলায় বলল, ওরা ভয় পেয়েছে। আমি বলছি, আমি আত্মসমর্পণ করব না, আমি বলছি…ঠিক বলিনি স্যার?

সে থামল; হঠাৎ টেবিলের পিস্তলটা চোখে পড়ায় অপ্রত্যাশিত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেটা তুলে নিয়ে ছুটে বারান্দায় চলে গেল।

গেরাসিম ও দারোয়ান মকার আলেক্সিভিচের পিছন পিছনই এসেছিল; তারা তাকে থামিয়ে পিস্তলটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করল। বারান্দায় বেরিয়ে এসে পিয়ের এই আধপাগল বুড়ো লোকটার দিকে করুণা ও বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল। মকার আলেক্সিভিচ ভুরু কুঁচকে পিস্তলটা আঁকড়ে ধরে কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল; তার মাথায় নিশ্চয় কোনো বীরত্বপূর্ণ কাজের ছবি ঢুকেছে।

অস্ত্র নাও! আটক কর! না, এটা তোমরা পাবে না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভালো মানুষের মতো-দয়া করুন স্যার, ওসব যেতে দিন! দয়া করে…কনুই দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে মকার আলেক্সিভিচকে দরোজার দিকে নিয়ে যেতে যেতে গেরাসিম বলতে লাগল।

কে তুমি? বোনাপার্ত!…মকার আলেক্সিভিচ চেঁচিয়ে বলল।

কথাটা ঠিক হল না স্যার। দয়া করে আপনার ঘরে চলুন, বিশ্রাম নিন। পিস্তলটা আমাকে দিন।

সরে যা হীন ক্রীতদাস! আমাকে ছুঁস না! এটা দেখছিস? মকার আলেক্সিভিচ পিস্তলটা ঘুরিয়ে বলল।

 গেরাসিম ফিসফিস করে দারোয়ানকে বলল, ধরে ফেল!

তারা দুইজনে মকার আলেক্সিভিচের হাতে ধরে টানতে টানতে দরোজার দিকে নিয়ে চলল।

 একটা ধস্তাধস্তির বিশৃঙখল শব্দ ও একটা কর্কশ মাতালের কণ্ঠস্বরে বারান্দাটা ভরে উঠেছে।

সহসা আরো একটা শব্দ, একটা মর্মভেদী নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ধ্বনিত হল, আর রাঁধুনিটি ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এল।

তারা এসে পড়েছে! হা ভগবান! হে প্রভু, তারা চারজন, অশ্বারোহী! রাঁধুনি চেঁচিয়ে বলল।

গেরাসিম ও দারোয়ান মকার আলেক্সিভিচকে ছেড়ে দিল; নিস্তব্ধ বারান্দায় শোনা যেতে লাগল সামনের দরোজায় কয়েকটি হাতের খটখট শব্দ।

.

অধ্যায়-২৮

 পিয়ের স্থির করেছে যতদিন তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয় ততদিন নিজের পরিচয় গোপন রাখবে এবং সে যে ফরাসি জানে সেটাও প্রকাশ করবে না।

ফরাসিরা ঢোকামাত্রই যাতে লুকিয়ে পড়তে পারে সেজন্য সে আধখোলা দরোজার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ফরাসিরা ঢোকার পরেও পিয়ের সরে গেল না-একটা দুর্বার কৌতূহল তাকে সেখানেই আটকে রাখল।

তারা দুইজন এসেছে। একজন অফিসার–দীর্ঘদেহ, সুদর্শন, সৈনিকসুলভ চেহারা–অপরজন সম্ভবত আর্দালি, রোদে পোড়া, বেঁটে, সরু, তোবড়ানো গাল, ভাবলেশহীন মুখ। একটা লাঠিতে ভর দিয়ে ঈষৎ খুঁড়িয়ে অফিসারটি সামনে এগিয়ে এল। কয়েক পা এগিয়ে থামল, বুঝল যে বাসাটা ভালোই, ফটকে দাঁড়ানো সৈন্যদের দিকে ফিরে চড়া গলায় ঘোড়াগুলো রাখবার হুকুম দিল। তারপর একঝটকায় কনুইটা তুলে গোঁফে তা দিল, আস্তে টুপিটা স্পর্শ করল।

চারদিকে তাকিয়ে হেসে ফরাসিতে বলল, সকলকে জানাই শুভদিন।

 কেউ কোনো জবাব দিল না।

অফিসারটি গেরাসিমকে শুধাল, তোমার মনিব বাড়িতে আছে?

ভীত সপ্রশ্ন চোখে গেরাসিম অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইল।

করুণার হাসি হেসে অফিসার বলল, বাসা, বাসা, বাসাবাড়ি! ফরাসিরা ভালোমানুষ। আরে, হল কি! দেখ, আমাদের চটিও না হে বুড়ো! ভয়ার্ত নিঃশব্দ গেরাসিমের কাঁধে চাপড় দিয়ে সে বলল।

আচ্ছা, এ বাড়িতে কি কেউ ফরাসি বলতে পারে না?

চারদিকে তাকিয়ে পিয়েরের চোখে চোখ পড়তে সে আবার ফরাসিতে প্রশ্ন করল। পিয়ের দরোজা থেকে সরে গেল।

অফিসার পুনরায় গেরাসিমের দিকে ঘুরে ঘরগুলি দেখাতে বলল।

মনিব বাড়ি নেই-বুঝতে পারছি না…আমাকে, আপনি… কথাগুলিকে বোধগম্য করার জন্য আরো বিকৃত করে গেরাসিম বলল।

ফরাসি অফিসারটি গেরাসিমের নাকের কাছে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হেসে হেসে জানাল যে সেও তার কথা বুঝতে পারছে না, তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে পিয়েরের দিকে এগিয়ে গেল। পিয়েরের ইচ্ছা সরে গিয়ে লুকিয়ে পড়বে, কিন্তু সেইমুহূর্তে সে দেখতে পেল মকার আলেক্সিভিচ পিস্তলটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের খোলা দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাগলের মতো ধূর্ত চোখে ফরাসি লোকটির দিকে তাকিয়ে মকার আলেক্সিভিচ পিস্তল তুলে তার দিকেই তাক করল।

ঘোড়া টিপবার চেষ্টা করে মাতাল লোকটি চিৎকার করে উঠল, ওদের খতম কর! সে চিৎকার শুনে অফিসারটি ঘুরে দাঁড়াল, আর ঠিক সেইমুহূর্তে পিয়ের মাতালটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিয়ের যখন পিস্তলে হাত রেখে সেটা চেপে ধরল, তখনই মকার আলেক্সিভিও বন্দুকের ঘোড়র উপর আঙুল রাখল। কানে তালা লাগানো একটা শব্দ হল, কালো ধোয়ায় সবকিছু ঢেকে গেল। ফরাসি লোকটি বিবর্ণ মুখে দরোজার দিকে ছুটে গেল।

ফরাসি ভাষার জ্ঞান লুকিয়ে রাখার ইচ্ছা ভুলে গিয়ে পিয়ের পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অফিসারের দিকে ছুটে গেল এবং তার সঙ্গে ফরাসিতেই কথা বলল।

আপনি আঘাত পাননি তো?

মনে তো হয় না। দেয়ালের ভাঙা পলস্তরা দেখিয়ে বলল, কিন্তু ভাগ্যগুণে আজ খুব বেঁচে গিয়েছি। লোকটি কে? কঠোর দৃষ্টিতে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে অফিসারটি বলল।

নিজের অভিসন্ধির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে পিয়ের তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সত্যি, যা ঘটে গেল সেজন্য আমি হতাশ হয়ে পড়েছি। লোকটি এক হতভাগ্য পাগল; ও যে কি করেছে তা নিজেই জানে না।

অফিসারটি মকার আলেক্সিভিচের কাছে গিয়ে তার কলারটা চেপে ধরল।

মকার আলেক্সিভিচ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে; দেয়ালে হেলান দিয়ে এমনভাবে দুলছে যেন এখনই ঘুমিয়ে পড়বে।

তাকে ছেড়ে দিয়ে ফরাসিটি বলল, গুণ্ডা! এর দাম তোমাকে দিতে হবে। আমরা ফরাসিরা জয়লাভের পরে দয়া দেখাই, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের আমরা ক্ষমা করি না।

তার চোখে বিষণ্ণ মর্যাদার অভিব্যক্তি।

পিয়ের ফরাসিতেই তাকে বার বার অনুরোধ জানাল, অক্ষম মাতালটাকে যেন শাস্তি না দেওয়া হয়। মুখে সেই একই বিষণ্ণতার আভাস এনে ফরাসিটি নীরবে তার কথাগুলি শুনল, তারপর হঠাৎ হেসে পিয়েরের দিকে মুখ ফেরাল। একটা অতি নাটকীয় ভদ্রতার প্রকাশ ফুটে উঠল তার মুখে; সে হাতটা বাড়িয়ে দিল।

বলল, আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন। আপনি ফরাসি?

একজন ফরাসির পক্ষে এ অনুমান সন্দেহাতীত। একমাত্র ফরাসির পক্ষেই কোনো মহৎ কাজ করা সম্ভব, আর তার জীবনতেরশো লাইট রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ম. রাম্বেলের জীবন রক্ষা করা নিঃসন্দেহে একটা : মহৎ কাজ।

কিন্তু সিদ্ধান্তটি এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত অফিসারের দৃঢ় ধারণাটি যতই সন্দেহাতীত হোক, তার এই ভুল ভাঙিয়ে দেওয়া দরকারি বলেই পিয়েরের মনে হল।

সে তাড়াতাড়ি বলল, আমি একজন রুশ।

ফু, ফু, ফু। ও কথা অন্যদের বলবেন, তার নাকের কাছে আঙুল ঘুরিয়ে অফিসারটি হেসে বলল। অচিরেই আপনি আমাকে সব কথা বলবেন। একজন সহযোগীর সঙ্গে দেখা হয়ে খুব খুশি হলাম। আচ্ছা, এই লোকটাকে নিয়ে কি কা যায় বলুন তো? ভাইয়ের মতো পিয়েরকে সম্বোধন করে বলল।

শেষ প্রশ্নের জবাবে আর একবার মকার আলেক্সিভিচের পরিচয় দিয়ে পিয়ের জানাল, তাদের আসার ঠিক আগেই এই পাগলা বুড়োটা গুলিভরা পিস্তলটা হাতিয়ে নেয়, তার কাছ থেকে সেটা ছিনিয়ে নেবার সময় তারা পায়নি; কাজেই একাজের জন্য অফিসার যেন তাকে শাস্তি না দেয়।

ফরাসিটি বুক ফুলিয়ে দু হাতে একটা গম্ভীর অঙ্গভঙ্গি করল।

আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন। আপনি একজন ফরাসি। আপনি বলছেন ওকে ক্ষমা করতে? আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর। লোকটাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি সোৎসাহে কথাগুলি বলে পিয়েরের হাত ধরে তাকে নিয়ে অফিসার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

গুলির শব্দ শুনে সৈন্যরা উঠোন থেকে বারান্দায় ছুটে এসেছে; কি হয়েছে শুনে নিয়ে তারা অপরাধীকে শাস্তি দিতে উদ্যত হল, কিন্তু অফিসার কড়া গলায় তাদের বাধা দিল।

দরকার হলেই তোমাদের ডাকা হবে, সে বলল।

সৈন্যরা বেরিয়ে গেল। আর্দালিটি ইতিমধ্যেই রান্নাঘরে ঢুকেছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে বলল, ক্যাপ্টেন, রান্নাঘরে ঝোল ও পাঁঠার ঠ্যাং আছে। আপনাকে খেতে দেব কি?

হ্যাঁ, আর কিছু মদ, ক্যাপ্টেন জবাব দিল।

.

অধ্যায়-২৯

ফরাসি অফিসার যখন পিয়েরকে নিয়ে ঘরে ঢুকল তখন পিয়ের আবার ভাবল, সে যে ফরাসি নয়-সেটা তাকে নিশ্চিত করে বলে দেওয়া তার কর্তব্য, কিন্তু অফিসার তার কথায় কানই দিল না। লোকটি এত বিনয়ী, ভদ্র, ভালো মানুষ, এবং তার প্রাণরক্ষা করার জন্য পিয়েরের প্রতি এমন আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ যে পিয়ের তার কথা না রেখে পারল না, তার সঙ্গে গিয়ে বৈঠকখানায় বসল। পিয়ের যখন বারবার বলতে লাগল যে সে ফরাসি নয়, তখন ক্যাপ্টেন খুব অবাক হয়ে গেল; এত বড় একটা সুখ্যাতিকে মানুষ কেমন করে অগ্রাহ্য করতে পারে তা সে বুঝতেই পারল না; যাহোক, সে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, পিয়ের যদি একান্তই রুশ পরিচয়ে থাকতে চায় তো তাই থাকুক, কিন্তু তার প্রাণ রক্ষার জন্য সে পিয়েরের প্রতি চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে।

পিয়েরের ভালো অথচ নোংরা পোশাক এবং তার আঙুলের আংটির দিকে তাকিয়ে অফিসার বলল, ফরাসিই হোন আর ছদ্মবেশী রুশ প্রিন্সই হোন, আপনার জন্যই আমি জীবনে বেঁচে আছি, আর তাই আপনার কাছে বন্ধুত্বের প্রস্তাব করছি। অপমান কিংবা উপকার, একজন ফরাসি কোনোদিন এর কোনোটাই ভোলে না। আপনি আমার বন্ধু হোন। এই আমার একমাত্র বলার কথা।

অফিসারের কণ্ঠস্বরে, তার মুখের ভাবে ও ভঙ্গিতে এমন সৎস্বভাব ও আভিজাত্য প্রকাশ পেল যে তার হাসির জবাবে ঈষৎ হেসে পিয়ের নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল।

৭ই সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের জন্য মহাবীর পদকপ্রাপ্ত, তেরশো লাইট রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রাম্বেল, সে আত্মপরিচয় ঘোষণা করল; গোঁফের নিচেকার ঠোঁট দুটি আত্মতুষ্টির অপ্রতিরোধ্য হাসিতে বেঁকে গেল। এবার আপনি দয়া করে বলবেন কি, একটা পাগলের বুলেট শরীরে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে থাকার পরিবর্তে কার সঙ্গে এমন মধুর আলাপনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে?

পিয়ের জবাবে জানাল, নিজের নামটা সে তাকে বলতে পারছে না; তারপর মুখ লাল করে একটা নাম খুঁজে নেবার এবং নামটা লুকোবার কারণ সম্পর্কে একটা কিছু বলবার চেষ্টা করতেই ফরাসিটি তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিল।

আহা, ঠিক আছে! আপনার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি একজন অফিসার…হয়তো ঊর্ধ্বতন অফিসার। আমাদের বিরুদ্ধে আপনি অস্ত্র ধরেছেন। সেটা আমার দেখার কথা নয়। আমার জীবনের জন্য আমি আপনার কাছে ঋণী। সেটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। আপনার সেবায় আমি সদাপ্রস্তুত। আপনি কি দ্র শ্রেণীর গলায় একটা প্রশ্নের সুর এনে সে কথা শেষ করল। পিয়ের মাথা নিচু করল। আপনার নামটি যদি বলেন। আর কিছুই জানতে চাই না। মঁসিয় পিয়ের…চমৎকার! শুধু ওইটুকুই জানতে চাই।

যখন মাংস ও ওমলেট পরিবেশন করা হল, সামোভার ও ভদকা আনা হল, আর সেই সঙ্গে খানিকটা মদ, তখন রাম্বেল পিয়েরকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাল, আর নিজে একটি স্বাস্থ্যবান ক্ষুধার্ত লোকের মতো অতি গোগ্রাসে গিলতে লাগল; শক্ত দাঁত দিয়ে চিবুতে চিবুতে অনবরত ঠোঁট চাটতে চাটতে বারবার বলতে লাগল-চমৎকার! সুস্বাদু! তার মুখটা লাল হয়ে উঠল, ঘাম ঝরতে লাগল। পিয়েরও ক্ষুধার্ত, সানন্দে ডিনারে যোগ দিল। আর্দালি মোরেল একটা গরম জলের পাত্র এনে এক বোতল ক্লারেট তার মধ্যে বসিয়ে দিল। পরিতৃপ্তিসহকারে পান-ভোজনের ফলে ক্যাপ্টেন আরো ফুর্তিবাজ হয়ে সারাক্ষণ বক বক করতে লাগল।

প্রিয় মঁসিয়ে পিয়ের, ঐ পাগলাটার হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য আমার কাছে একটা প্রতিশ্রুত মোমবাতি আপনার প্রাপ্য হয়েছে…কি জানেন, আমার দেহে ইতিমধ্যেই অনেক বুলেট ঢুকেছে। এখানে একটা ঢুকেছে ওয়াগ্রামে (সে পার্শ্বদেশ স্পর্শ করল) আর দ্বিতীয়টা স্মোলেনস্কে-গালের ক্ষতটা দেখাল-আর এই যে পাটা দেখছেন একেবারেই নড়তে-চড়তে চায় না, এটা ঢুকেছে ৭ তারিখের লা মস্কোয়ার মহাযুদ্ধে (ফরাসিরা বরদিনোর যুদ্ধকে বলত লা মস্কোয়া)। পবিত্র ঈশ্বর! সে এক চমৎকার ব্যাপার! সেই গোলাগুলির প্রবল বন্যা একটা দেখার মতো দৃশ্য। সত্যি বলছি, সেখানে আপনারা আমাদের মহামুস্কিলে ফেলেছিলেন। সে যুদ্ধের জন্য আপনারা গর্ব করতে পারেন। আর আমার কথা যদি বলেন, যদিও সেখান থেকেই আমি কাশিটা বাধিয়েছি, তবু সেখানে আরো একবার যেতে আমি প্রস্তুত। সেদৃশ্য যারা দেখেনি তাদের জন্য আমার করুণা হয়।

আমি সেখানে ছিলাম, পিয়ের বলল।

বাঃ, সত্যি? তাহলে তো আরো ভালো! সত্যি, আপনারা সাহসী শত্রু বটে। আমার পাইপের দোহাই, বড় দুৰ্গটা থেকে লড়াই ভালোই হয়েছিল, ফরাসিটি বলতে লাগল। তার জন্য আমাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। তিনবার সেখানে হানা দিয়েছিলাম–আমি যে এখানে বসে আছি এটা যেমন সত্য, সেটাও তেমনই সত্য। তিনবার আমরা কামানের সামনে হাজির হলাম, আর তিনবারই কার্ডবোর্ডের মূর্তির মতো পিছু হটে গেলাম। সত্যি, সে বড়ই সুন্দর মঁসিয় পিয়ের! ঈশ্বর সাক্ষী, আপনাদের বোমারুরা খুব ভালো। দুবার আমি তাদের খুব কাছে থেকে দেখেছি। চমৎকার লোক! আমাদের নেপলসের রাজা তো সবই জানেন, তিনিও বলে উঠলেন শাবাশ! হ্যাঁ, হ্যাঁ! তাহলে আপনিও আমাদের মতোই একজন সৈনিক। একটু থেমে সে হেসে বলল। খুব ভালো কথা, আরো ভালো কথা মঁসিয় পিয়ের! যুদ্ধের ভয়ংকর…নারীঘটিত ব্যাপারে…মহাবীর (সে চোখ টিপে হাসল), এই তো ফরাসিদের পরিচয় মঁসিয় পিয়ের, তাই নয় কি?

ক্যাপ্টেন এতই সরল ও আমুদে মানুষ, এবং নিজেকে নিয়ে এতই তুষ্ট যে খুশি মনে তার দিকে তাকিয়ে পিয়েরও বুঝি চোখ টিপল। সম্ভব মহাবীর কথাটা থেকেই মস্কোর কথা ক্যাপ্টেনের মনে পড়ে গেল।

ভালো কথা, দয়া করে বলুন তো, মেয়েরা সবাই মস্কো ছেড়ে চলে গেছে একথা কি সত্যি? অদ্ভুত কথা তো! এখানে থাকতে তাদের কিসের ভয়?

রুশরা প্যারিসে প্রবেশ করলে কি ফরাসি মহিলারা প্যারিস ছেড়ে চলে যেতেন না? পিয়ের শুধাল। হা, হা, হা! পিয়েরের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে ফরাসিটি মুচকি হেসে বলল। কথার মতো কথা বটে! প্যারিস!…কিন্তু প্যারিস প্যারিস…।

প্যারিস-পৃথিবীর রাজধানী, পিয়ের তার কথাটা শেষ করে দিল।

ক্যাপ্টেন পিয়েরের দিকে তাকাল। কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে চোখে হাসি ফুটিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা তার অভ্যাস।

দেখুন, আপনি যদি না বলে দিতেন যে আপনি রুশ তাহলে আমি বাজি ধরে বলতাম যে আপনি একজন প্যারিসীয়! আপনার মধ্যে সেই জিনিসটি আছে…সেটা যে কি তা ঠিক জানি না, তবে সেই… গুণের কথাটা বলে সে আবার নিঃশব্দে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে রইল।

পিয়ের বলল, আমি প্যারিসে গিয়েছি। সেখানে তিন বছর কাটিয়েছি।

তা বটে, দেখলেই সেটা বোঝা যায়। প্যারিস! যে লোক প্যারিসকে চেনে না সে তো বর্বর। দু লীগ দূর থেকেও একজন প্যারিসিয়কে দেখে আপনি বলে দিতে পারেন। প্যারিস হচ্ছে তালমা, লা দুচেনয়, পোতিয়ের, সর্বোন, রাজপথ। আগের কথার তুলনায় পরের কথাগুলি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে দেখে সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল : পৃথিবীতে মাত্র একটি প্যারিসই আছে। প্যারিসে কাটিয়েও আপনি রুশই রয়ে গেছেন। দেখুন সেজন্য আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা একটুও কমেনি!

পেটে কিছুটা মদ পড়েছে, নানা দুশ্চিন্তায় অনেকগুলি দিনও কেটেছে, তাই এই আমুদে স্বভাবের লোকটির সঙ্গে কথা বলতে পিয়েরের ভালোই লাগছে।

মহিলাদের কথাতেই যাওয়া যাক–শুনেছি তারা খুবই মনোরমা। ফরাসি বাহিনী মস্কোতে এসেছে বলই তাদের তৃণভূমিতে গিয়ে মাথা গুঁজে থাকতে হবে, এটা বড়ই দুঃখের কথা। মেয়েরা কী সুযোগই না হারালেন! আপনাদের চাষীরা, অবশ্য তাদের কথা আলাদা, কিন্তু আপনাদের মতো সভ্য মানুষদের তো আমাদের ভালোভাবেই জানা উচিত। ভিয়েনা, বার্লিন, মাদ্রিদ, নেপলস, রোম, ওয়ারস, পৃথিবীর সবগুলি রাজধানী আমরা দখল করেছি…সকলে আমাদের ভয় করে, কিন্তু ভালোবাসে। যারা জানে তাদের কাছে আমরা তোক ভালো। তারপর সম্রাট… এখানে পিয়ের তাকে বাধা দিল।

সম্রাট, পিয়ের আর একবার কথাটা উচ্চারণ করল, সহসা তার মুখটা বিষণ্ণ ও বিব্রত হয়ে উঠল, সম্রাটও কি…?

সম্রাট? তিনি তো উদারতা, করুণা, ন্যায়, শৃঙ্খলা, প্রতিভার প্রতিমূর্তি–এই তো ম্রাটের পরিচয়! আমি রাম্বেল একথা বলছি…স্থির জানবেন, আট বছর আগে আমি ছিলাম তার শত্রু। আমার বাবা ছিলেন বিদেশ থেকে আগত একজন কাউন্ট।…কিন্তু এই মানুষটি আমাকে জয় করেছেন। তিনি আমাকে হাত করে ফেলেছেন। যে জাঁকজমক ও গৌরব দিয়ে তিনি ফ্রান্সকে মুড়ে দিয়েছেন সেদৃশ্য তো আমি ভুলতে পারি না। যখন বুঝতে পারলাম তিনি কি চান-যখন দেখলাম যে তিনি আমাদের জন্য একটা ফুলের বিছানা পাতার আয়োজন করছেন, তখন নিজেকে বললাম : এই তো রাজা, আর তার সেবায় আত্মনিয়োগ করলাম! বুঝেছেন! হা প্রিয় বন্ধু, অতীত-বর্তমান সর্বযুগের তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ।

অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে পিয়ের তো-তো করে বলল, তিনি কি মস্কো এসেছেন?

ফরাসিটি তার অপরাধীসুলভ মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল।

না, তিনি কাল আসবেন, বলে সে আবার নিজের কথায় ফিরে গেল।

ফটকে কিছু লোকের চেঁচামেচিতে তাদের কথায় বাধা পড়ল। মোরেল এসে জানাল, কিছু উর্তেবের্গ হুজার এসে এ-বাড়ির উঠোনে ঘোড়া রাখতে চাইছে। এই গোলযোগটি দেখা দিয়েছে তার কারণ ফরাসিতে তাদের যা বলা হয়েছে হুজাররা তা বুঝতে পারেনি।

ক্যাপ্টেন তাদের বড় সার্জেন্টকে ডেকে এনে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, সে কোন রেজিমেন্টের লোক, তার কমান্ডিং অফিসার কে, আর কোন অধিকারে পূর্বেই দখল-করা একটা বাসা বেদখল করতে সে এসেছে। জার্মানটি ফরাসি ভাষা যৎসামান্য জানে; প্রথম দুটি প্রশ্নের জবাবে রেজিমেন্টের নাম ও কমান্ডিং অফিসারের নাম বলে দিল, কিন্তু তৃতীয় প্রশ্নটি ঠিক-ঠিক বুঝতে না পেরে নিজের জার্মান ভাষার সঙ্গে ভাঙা-ভাঙা ফরাসি মিশিয়ে বলল যে সে তার রেজিমেন্টের কোয়ার্টার-মাস্টার, আর তার কমান্ডারই একটার পর একটা বাড়ি দখল করার হুকুম দিয়েছে। পিয়ের জার্মান ভাষা জানে; সে জার্মানটির কথা ভাষান্তর করে ক্যাপ্টেনকে শোনাল, আর ক্যাপ্টেনের জবাব জার্মান ভাষায় উৰ্তেমবের্গ হুজারকে শুনিয়ে দিল। প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরে জার্মানটি নতি স্বীকার করে তার সৈন্যদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেল। ক্যাপ্টেন বারান্দায় বেরিয়ে হাঁক দিয়ে কিছু হুকুম জারি করল।

ঘরে ফিরে এসে দেখল দু হাতের মধ্যে মাথা রেখে পিয়ের সেই একই জায়গায় বসে আছে। তার মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন। সেইমুহূর্তে সত্যি সে যন্ত্রণাক্লিষ্ট। ক্যাপ্টেন বেরিয়ে গেলে সে যখন ঘরের মধ্যে একা, তখন হঠাৎ সে যেন নিজেকে ফিরে পেল, নিজের অবস্থা বুঝতে পারল। মস্কো বেদখল হয়েছে, আনন্দিত বিজয়ী পক্ষ মস্কোর প্রভু হয়ে বসেছে এবং তার উপর মাতব্বরী করছে, আসল কথা সেটা নয়। সে অবস্থাটাও বেদনাদায়ক, তবু এই মুহূর্তে পিয়েরের যন্ত্রণার কারণ সেটা নয়। নিজের দুর্বলতার বোধই তাকে কষ্ট দিচ্ছে। যে গভীর বিষণ্ণতার মধ্যে তার বিগত দিনগুলি কেটেছে, তার পরিকল্পনামতো কাজ হাসিল করার পক্ষে যে বিষণ্ণতা একান্ত প্রয়োজন, কয়েকপাত্র মদ আর এই সৎস্বভাবের মানুষটির সঙ্গে আলোচনা তার মন থেকে সেই বিষণ্ণতাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পিস্তল, ছুরি ও চাষীর কোট প্রস্তুত। পরদিনই নেপোলিয়ন শহরে ঢুকবে। পিয়ের এখনো মনে করে যে এই দুষ্কৃতকারীকে হত্যা করা দরকার, করা উচিত, কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে যে সেকাজ সে করতে পারবে না। কেন তা সে জানে না, কিন্তু কেমন একটা আভাস সে পেয়েছে যে অভিপ্রায় মতো কাজটি সে করবে না। এই দুর্বলতা স্বীকার করতে তার বাধছে, কিন্তু অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে যে এই দুর্বলতাকে জয় করতে সে পারবে না; প্রতিহিংসা, হত্যা ও আত্মোৎসর্গের যে মানসিক বিষণ্ণতা তাকে পেয়ে বসেছিল, প্রথম মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ফলেই তা ধুলোর মতো মিলিয়ে গেছে।

ঈষৎ খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা শিস দিতে দিতে ক্যাপ্টেন ঘরের মধ্যে ঢুকল।

ফরাসি লোকটির যে বকবকানি শুনে এতক্ষণ সে মজা পাচ্ছিল, এখন তাতে তার বিরক্তি দেখা দিল। তার শিস, চালচলন, গোঁফে চাড়া দেবার ভঙ্গি, সবই আপত্তিকর মনে হতে লাগল। আমি এখনই চলে যাব, তার সঙ্গে আর একটি কথাও বলব না, পিয়ের ভাবল। একথা ভাবলেও সে কিন্তু সেখানেই বসে রইল। একটা আশ্চর্য দুর্বলতা তাকে যেন সেখানে বেঁধে রেখেছে; উঠে চলে যেতে চাইল, কিন্তু পারল না।

অপরদিকে ক্যাপ্টেন তখন খুব খুশি। দুবার সে ঘরময় পায়চারি করল। যেন কোনো চিন্তায় বেশ মজা পেয়েছে এমনিভাবে চোখ দুটি চকচক করছে, গোঁফটা হাসিতে বেঁকে যাচ্ছে।

হঠাৎ সে বলে উঠল, ঐ উৰ্তেমবেগারদের কর্নেলটি খুব মজার লোক। লোকটি জার্মান, কিন্তু তবু বেশ ভালো লোক।…কিন্তু জার্মান তো। পিয়েরের দিকে মুখ করে বসে বলল, ভালো কথা, আপনি তাহলে জার্মান ভাষা জানেন?

পিয়ের নীরবে তার দিকে তাকাল।

 আচ্ছা, আশ্রয়ের জার্মান প্রতিশব্দ কি?

পিয়ের বলল, আশ্রয়? ওটার জার্মান প্রতিশব্দ unterkunft.

কীভাবে কথাটা উচ্চারণ করেন? সন্ধিগ্ধ গলায় ক্যাপ্টেন তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল। Unterkunft, পিয়ের পুনরায় বলল।

ওন্তেরকফ, বলে হাসি-হাসি চোখে ক্যাপ্টেন কয়েক সেকেন্ড পিয়েরের দিকে তাকিয়ে রইল। এই জার্মানরা পাক্কা বুদ্ধ, আপনিও কি তাই মনে করেন না সিয় পিয়ের?

তারপরেই খুশি মনে বলল, আচ্ছা, বরং এই মস্কো বোর্দু আর এক বোতল নেওয়া যাক। শরীরটা গরম করতে মোরেল আর একটা ছোট বোতল অবশ্যই দেবে। মোরেল! সে হাঁক দিল।

মোরেল একটা মোমবাতি ও মদের বোতল এনে দিল। মোমবাতির আলোয় পিয়েরের দিকে তাকিয়ে তার মুখের বিপর্যস্ত ভাব দেখে ক্যাপ্টেন বিস্মিত হল। আন্তরিক সহানুভূতির সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে রাষেল তার উপর ঝুঁকে দাঁড়াল।

পিয়েরের হাতটা ছুঁয়ে বলল, এই যে, আমরা এখনো বিষণ্ণ। আমি কি আপনাকে বিচলিত করেছি? না, সত্যি আমার বিরুদ্ধে আপনার কিছু বলার কাছে কি? হয়তো বর্তমান পরিস্থিতিই এরজন্য দায়ী।

পিয়ের জবাব দিল না, সাদর দৃষ্টিতে ফরাসিটির চোখে চোখ রাখল; তার সহানুভূতিপূর্ণ চাউনি তাকে খুশি করেছে।

সত্যি বলতে কি, আমার ঋণের কথা না তুলেও বলতে পারি, আপনাকে আমি বন্ধু বলেই মনে করি। আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন? এটা জীবন-মরণের সম্পর্ক। বুকে হাত রেখে একথা বলছি, বুকে আঘাত করে সে বলল।

আপনাকে ধন্যবাদ, পিয়ের বলল।

তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ক্যাপ্টেনের মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

 সেক্ষেত্রে আমাদের বন্ধুত্বের জন্য পান করছি, খুশিমনে দুটি গ্লাসে মদ ঢেলে সে চেঁচিয়ে বলল।

পিয়ের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে সেটা খালি করে ফেলল। রাম্বেলও তার গ্লাসটা খালি করে আবার পিয়েরের হাতে চাপ দিল; টেবিলের উপর কনুই রেখে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বসে রইল।

তারপর বলতে শুরু করল, হ্যাঁ প্রিয় বন্ধু, ভাগ্যের এমনি খেয়ালীপনা। কে বলতে পারত যে আমি একদিন সৈনিক হব, বোনাপার্তের অধীনে একটা অশ্বারোহী বাহিনীর ক্যাপ্টেন হব? অথচ আমি তারই সঙ্গে মস্কো এসেছি। আপনাকে বলা দরকার বন্ধু যে আমাদের বংশ ফ্রান্সের অন্যতম প্রাচীন বংশ।

ফরাসিসুলভ সহজ, সরল, দিলখোলাভাবে ক্যাপ্টেন পিয়েরকে শোনাল তার পূর্বপুরুষ, তার শৈশব, যৌবন ও পরিণত জীবনের কথা, তার আত্মীয়স্বজন এবং আর্থিক ও পারিবারিক অবস্থার কথা।

কিন্তু এসবই তো জীবনের পরিবেশ, আসল কথা তো ভালোবাসা-ভালোবাসা। ঠিক বলিনি মঁসিয় পিয়ের? ক্রমেই সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। আর এক গ্লাস দেব?

পিয়ের আবারো গ্লাসটা খালি করে তৃতীয়বার ভরে নিল।

চকচকে চোখে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন তার ভালোবাসার কাহিনী বলতে শুরু করল, আঃ, নারী, নারী!

অফিসারটির সুদর্শন আত্মতৃপ্ত মুখ দেখে এবং যে সাগ্রহ উৎসাহ নিয়ে সে নারীঘটিত ব্যাপার বলতে শুরু করল তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে এধরনের ব্যাপারের কিছু ঘাটতি ছিল না। ভালোবাসার যে ইন্দ্রিয়জ বৈশিষ্ট্যকে ফরাসিরা ভালোবাসার বিশেষ আকর্ষণ ও কাব্যময়তা বলে মনে করে যদিও তার কোনো অভাব রাম্বেলের ভালোবাসার গল্পগুলিতে ছিল না, তবু তার কাহিনীকে এমন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সে বলতে লাগল যেন একমাত্র সেই ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং তার আকর্ষণকে অনুভব করেছে। তাছাড়া, এমন আকর্ষণীয় করে সে নারীর বর্ণনা দিতে লাগল যে পিয়ের আগ্রহের সঙ্গেই তার সব কথা শুনতে লাগল।

একটা কথা পরিষ্কার–যে প্রেম ফরাসিদের এত প্রিয় সেটা একদিকে যেমন সেই নিচ, সরল অনুভূতি নয় যা একসময় পিয়ের তার স্ত্রীর প্রতি অনুভব করত, আবার অন্যদিকে সেই রোমান্টিক ভালোবাসাও নয় যা সে নাতাশার বেলায় অনুভব করেছে; যে প্রেমকে ফরাসিরা পূজা করে তা হচ্ছে প্রধানত নারীর প্রতি একটা অস্বাভাবিক সম্পর্ক এবং পরস্পরবিরোধী অনুভূতির এমন একটা সঙ্গম যা প্রেমকে করে তোলে মোহময়।

তাই ক্যাপ্টেন অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্কা মার্কুইস-পত্নীর প্রতি ভালোবাসার কাহিনী বলল। আবার তারই নিষ্পাপ যোড়শী কন্যার প্রতি ভালোবাসার কাহিনীও শোনাল। মাতা ও কন্যার মধ্যে উদারতার দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত যেভাবে মা নিজে ত্যাগ স্বীকার করে মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিল সেকথা দূর অতীতের স্মৃতি হলেও আজও তা ক্যাপ্টেনকে শিহরিত করে তুলল। তারপর সে এমন একটি ঘটনা বলল যেখানে স্বামী নিয়েছিল প্রেমিকের ভূমিকা আর সে-অর্থাৎ প্রেমিক-নিয়েছিল স্বামীর ভূমিকা; তাছাড়া যে জার্মেনিতে আশ্রয়কে বলে Unterkunft এবং যেখানে স্বামীরা খায় সোরক্রোত (বাঁধাকপির ঝোল) আর তরুণীরা হয় অতি সুন্দরী সেই দেশের স্মৃতি থেকে বেশ কয়েকটি মজার গল্পও শোনাল।

অবশেষে দ্রুত অঙ্গভঙ্গি সহকারে জ্বলজ্বলে মুখে পোল্যান্ডের সেই সাম্প্রতিক কাহিনীটি সে বলে গেল যা আজও ক্যাপ্টেনে স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে : সে জনৈক পোলের জীবন রক্ষা করলে সেই পোল নিজে যুদ্ধের চাকরি নিয়ে চলে যাবার সময় মোহময়ী স্ত্রীকে রেখে গেল তারই আশ্রয়ে। ক্যাপ্টেনের সুখের অন্ত নেই, মোহিনী পোলিশ মহিলা তার সঙ্গেই পালিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু উদারতার অনুপ্রেরণায় ক্যাপ্টেন স্ত্রীকে স্বামীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল : আমি আপনার জীবন রক্ষা করেছি, এবার আপনার সম্মান রক্ষা করলাম! কথাগুলি বলে ক্যাপ্টেন চোখ মুছল, একবার কেঁপে উঠল, যেন এই মর্মস্পর্শী স্মৃতির ফলে তার মনে যে দুর্বলতা জেগেছে তাকেই দূর করে দিল।

একটু রাত হলে মদের প্রভাবে প্রায়ই যেমনটি হয়ে থাকে, পিয়ের বেশ মনোযোগ দিয়ে ক্যাপ্টেনের কাহিনীগুলি শুনল, সবই বুঝতেও পারল, আর কেন কে জানে সহসা নিজের স্মৃতিগুলো একের পর এক তার মনের সামনে ভিড় করে এল। এইসব ভালোবাসার গল্প শুনতে শুনতে অপ্রত্যাশিতভাবে নাতাশার প্রতি ভালোবাসার কথা তার মনে পড়ে গেল; কল্পনায় সেই ভালোবাসার ছবিগুলোকে সে রাম্বেলের কাহিনীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে লাগল। ভালোবাসা ও কর্তব্যের সংঘাতের কাহিনী শুনতে শুনতে পিয়ের যেন চোখের সামনে দেখতে পেল সুখারেভ জল-গম্বুজের নিচে প্রেমিকার সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাতের বিস্তারিত দৃশ্যাবলী। সাক্ষাতের সময়ে কিন্তু তার মনে কোনো প্রভাব পড়েনি,-সেসব কথা সে একবারও মনে করেনি। অথচ এখন তার মনে হচ্ছে সেই সাক্ষাতের মধ্যে অত্যন্ত গুরুতর ও কাব্যময় কিছু ছিল ।

পিতর কিরিলভিচ, এখানে আসুন! আমরা আপনাকে চিনতে পেরেছি, এই মুহূর্তে যেন সেই কথাগুলি সে শুনতে পাচ্ছে, চোখের সামনে তাকে দেখতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে তার চোখ, তার হাসি, তার ভ্রমণসঙ্গী ওড়না, তার একগুচ্ছ কুন্তল…তার মনে হল এ সবকিছুই যেন বিষণ্ণতা দিয়ে মোড়া।

মোহিনী পোলিশ মহিলার কাহিনী শেষ করে ক্যাপ্টেন জানতে চাইল, প্রেমের জন্য ত্যাগস্বীকার এবং প্রকৃত স্বামীর ঈর্ষার কোনো অভিজ্ঞতা কোনদিন পিয়েরের হয়েছে কি না।

এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পিয়ের মাথাটা তুলল, নিজের মনের কথা প্রকাশ করবার একটা প্রয়োজনীয়তা বোধ করল। বলতে লাগল, নারীর প্রতি ভালোবাসাকে সে বোঝে স্বতন্ত্রভাবে। বলল, সারাজীবন সে একটিমাত্র নারীকেই ভালোবেসেছে এবং এখনো ভালোবাসে, আর সে নারী কখনো তার হবে না।

ক্যাপ্টেন বলল, Tiens!

পিয়ের তখন বুঝিয়ে বলল, এই নারীকে সে প্রথম জীবনেই ভালোবাসত, কিন্তু তখন সে তার কথা ভাবতেও সাহস করত না, কারণ সে নারী তখন ছিল খুবই ছোট, আর সে নিজেও তখন ছিল নামগোত্রহীন এক অবৈধ সন্তান। তারপর বংশ-মর্যাদা ও সম্পত্তি লাভের পরেও তার কথা ভাবতে সাহস করল না, কারণ তাকে সে বড় বেশি ভালোবাসত, তাকে স্থান দিয়েছিল পৃথিবীর সবকিছুর উপরে, বিশেষ করে নিজেরও উপরে।

এই পর্যন্ত বলে পিয়ের ক্যাপ্টেনকে শুধাল, ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে কি না।

ক্যাপ্টেন এমন একটা ভঙ্গি করল যার অর্থ–সে বুঝুক আর নাই বুঝুক, পিয়ের তার কাহিনী চালিয়ে যাক।

আধ্যাত্মিক প্রেম, মেঘের মতো… সে তো-তো করে বলল।

মদের প্রভাবে হোক, অথবা খোলাখুলি বলার ঝেকে হোক, বা এই লোকটি যে তার কাহিনীর নায়ক নায়িকাদের জানে না এবং কোনোদিন জানবেও না এই চিন্তার ফলেই হোক, অথবা এ সবকিছু মিলিয়েই হোক, একটা কিছু পিয়েরের জিভকে খুলে দিয়েছে। বহু দূরে দৃষ্টিকে প্রসারিত করে সে তার জীবনের সমগ্র কাহিনী বলতে লাগল : তার বিয়ে, তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর প্রতি নাতাশার ভালোবাসা, তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, এবং তার সঙ্গে তার নিজের সরল সম্পর্কের কথা। রাষেলের নানা প্রশ্নের জবাবে যেকথা প্রথম লুকিয়েছিল তাও বলে ফেলল–নিজের পদমর্যাদা, এমন কি নামটা পর্যন্ত।

পিয়েরের কাহিনীর মধ্যে যা ক্যাপ্টেনকে সবচাইতে বেশি মুগ্ধ করল তা হল-পিয়ের খুব ধনী, মস্কোতে তার দুটো প্রাসাদোপম বাড়ি আছে, সে সবকিছু ছেড়েছে কিন্তু শহর ছাড়েনি, নাম ও বাসস্থান লুকিয়ে সেখানেই থেকে গেছে।

অনেক রাত হলে দুজন একসঙ্গে পথে বেরিয়ে এল। রাতটা আতপ্ত ও হাল্কা। পক্ৰোভকার উপরে বা দিকের বাড়িটায় আগুন জ্বলছে-মস্কোতে এই প্রথম আগুনের সূত্রপাত। ডানদিকে আকাশের বুকে কাস্তের মতো ক্ষীয়মান চাঁদ, তার বিপরীতদিকে ঝুলে পড়েছে সেই উজ্জ্বল ধূমকেতুটি যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিয়েরের অন্তরের ভালোবাসা। গেরাসিম, রাধুনি ও দুটি ফরাসি সৈনিক ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাসি, দুটি ভিন্ন ভাষায় পরস্পরের কাছে দুর্বোধ্য ভাষায় তাদের কথাবার্তা কানে আসছে। শহরের আলোর আভার দিকে তারা তাকিয়ে আছে।

এত বড় শহরে অনেক দূরের একটিমাত্র ছোটখাট অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ভয়ের কিছু থাকতে পারে না।

অনেক উপরের নক্ষত্রখচিত আকাশ, চাঁদ, ধূমকেতু ও আগুনের আভার দিকে তাকিয়ে পিয়েরের মন আনন্দের আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। এই তো, এই তো ভালো, এর বেশি আর কি চাই? সে ভাবল। সহসা নিজের অভিপ্রায়ের কথা মনে পড়ায় তার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল, এত দুর্বল লাগল যে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য সে বেড়াটায় গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।

নতুন বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই অস্থির পদক্ষেপে ফটক ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল; সোফায় শুয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল।

.

অধ্যায়-৩০

 ২ সেপ্টেম্বর যে প্রথম অগ্নিকাণ্ডটি শুরু হল, পলাতক মস্কোবাসীরা এবং পশ্চাদপসরণকারী সৈনিকরা ভিন্ন ভিন্ন পথ থেকে বিভিন্ন মনোভাব নিয়ে সেটা দেখতে দেখতে চলল।

রস্তভ পরিবার সে রাতটা কাটাল মস্কোর চোদ্দ মাইল দূরবর্তী মিতিশচিতে। ১লা সেপ্টেম্বর এত দেরি করে তারা যাত্রা করল, গাড়ি-ঘোড়া ও সৈন্যরা এমনভাবে পথঘাট আটকে রেখেছে, এতবেশি জিনিসপত্র ভুল করে ফেলে আসার দরুন চাকরদের আবার ফেরৎ পাঠাতে হল, তারা স্থির করল মস্কো থেকে তিন মাইল দূরের একটা জায়গায় রাত কাটাবে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল দেরিতে, আর পথেও বারবার এমন বিলম্ব ঘটতে লাগল যে তারা মাত্র বড় মিতিশচি পর্যন্তই পৌঁছতে পারল। সেদিন সন্ধ্যা দশটায় রস্ত পরিবারের লোকজন এবং তাদের সঙ্গে ভ্রমণরত আহতদের সেই বড় গ্রামটার উঠোনে ও বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হল। রস্তভ পরিবারের চাকর ও কোচয়ান এবং আহত অফিসারদের আর্দালিরা মনিবদের সেবা-শুশ্রষা শেষ করে রাতের খাবার খেল, ঘোড়াগুলোকে দানাপানি দিল, তারপর বারান্দায় বেরিয়ে এল।

পার্শ্ববর্তী একটা কুটিয়ে ভাঙা কব্জি নিয়ে শুয়েছিল রায়েভস্কির অ্যাডজুটান্ট। তীব্র যন্ত্রণায় সে করুণস্বরে অনবরত আর্তনাদ করছে; হেমন্ত রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে সে আর্তনাদ ভয়ংকর হয়ে বাজতে লাগল। প্রথম রাতটা সে রস্তভদের সঙ্গে একই উঠোনে কাটিয়েছে। কাউন্টেস বলল, তার কাতরানির শব্দে সে চোখের পাতা বুজতে পারেনি। তাই আহত লোকটির কাছ থেকে দূরে থাকবার জন্য কাউন্টেস মিতিশচিতে আরো খারাপ একটা কুটিরে উঠে গেল।

রাতের অন্ধকারে একটি চাকরের নজরে পড়ল, বারান্দার সামনে দাঁড়ানো একটু উঁচু গাড়ির মাথার উপরে আর একটা আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। একটা আভা অনেক আগে থেকেই চোখে পড়েছিল; সকলেই জানত ঘোট মিতিশচি পুড়ছে–মামোনভের কসাকরা সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

দেখ, দেখ ভাইসব, ওই একটা আগুন! জনৈক আর্দালি বলে উঠল।

সকলেরই দৃষ্টি সেই আগুনের দিকে পড়ল।

কিন্তু ওরা তো বলল মামোনভের কসাকরা ছোট মিতিশচিতে আগুন লাগিয়েছে।

 কিন্তু ওটা তো মিতিশচি নয়, সেখান থেকে অনেক দূরে।

দেখ, দেখ, মনে হচ্ছে ওটা নির্ঘাৎ মস্কো!

যারা দেখছিল তাদের দুজন ঘুরে গাড়ির অপর পাশে গিয়ে পাদানিতে বসে পড়ল।

এটা তো আরো খানিকটা বাঁদিকে; আরে, ছোট মিতিশচি তো ওই দূরে, এটা তো ঠিক তার বিপরীত দিকে।

আরো কয়েকজন এসে প্রথম দুজনের সঙ্গে যোগ দিল।

একজন বলল, কি রকম জ্বলছে দেখ। আগুনটা লেগেছে মস্কোতে, হয় সুশচেভস্কি নয় তো রঘোঝস্কি অঞ্চলে।

একথার কোনো জবাব কেউ দিল না; বেশ কিছু সময় সকলেই নীরবে অনেক দূরের সেই দ্বিতীয় অগ্নিকাণ্ডের লেলিহান শিখার দিকে তাকিয়ে রইল।

কাউন্টের খানসামা বুড়ো দানিয়েল তেরেন্তিচ সেখানে এসে মিশকাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠল।

হাঁ করে কি দেখছ অকর্মার ধাড়ি…? কাউন্ট তো ডাকতে পারেন, আর সেখানে কেউ নেই; যাও, পোশাক-পত্তরগুলো গুছিয়ে নাও।

জনৈক পরিচারক বলল, তুমি কি মনে কর দানিয়েল তেরেন্তিচ? আগুনটা মস্কোতে বলে মনে হচ্ছে না?

দানিয়েল তেরেন্তিচ জবাব দিল না। আবার অনেকক্ষণ পর্যন্ত সকলেই চুপচাপ। আগুনের আভা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে, কখনো উঠছে কখনো পড়ছে, ক্রমেই দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

আর একজন বলল, ঈশ্বর দয়া করুন…কী বাতাস, আর সবই তো শুকনো…।

ওদিকে দেখ! কী কাণ্ডকারখানাই চলছে। হে প্রভু! ঐ যে দেখতে পাচ্ছ কাকগুলিও উড়ে পালাচ্ছে। প্রভু পাপীদের করুণা করুন!

ওরা আগুন নিভিয়ে ফেলবে। কোনো ভয় নেই!

 কে নেভাবে? এতক্ষণ চুপ করে থেকে এবার দানিয়েল তেরেন্তিচ বলল। তার কণ্ঠস্বর শান্ত, বিবেচক। ভাইসব, ওই তো মঙ্কো…জননী মস্কো, তার শাদা… তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল; শোনা গেল একটি বৃদ্ধের চাপা কান্না।

ঐ আগুনের আভার তাৎপর্য বুঝবার জন্য তারা সকলেই যেন এরজন্যই অপেক্ষা করে ছিল। দীর্ঘশ্বাস, প্রার্থনার বাণী, আর কাউন্টের বুড়ো খানসামার চাপা কান্না শোনা যেতে লাগল।

.

অধ্যায়-৩১

কুটিরে ফিরে গিয়ে খানসামা কাউন্টকে জানাল, মস্কো জ্বলছে। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চড়িয়ে কাউন্ট বাইরে গেল দেখতে। সোনিয়া ও মাদাম শোস তখনো পোশাক ছাড়েনি; তারাও সঙ্গে গেল। শুধু নাতাশা ও কাউন্টেস ঘরে রইল। পেতয়া পরিবারের সঙ্গে নেই; সে এখন রেজিমেন্টের সঙ্গে ত্ৰয়েস্তার পথে।

মস্কোতে আগুন জ্বলছে শুনে কাউন্টেস কাঁদতে শুরু করল। নাতাশা বিবর্ণ মুখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেঞ্চিতেই বসে রইল, বাবার কথায় কানই দিল না। তিনটে বাড়ি দূরে অ্যাডজুটান্টের অবিশ্রাম আর্তনাদই সে শুনছে।

শীতার্ত, ভীত হয়ে উঠোন থেকে ফিরে এসে সোনিয়া বলল, ওঃ, কী ভয়ংকর! আগুনের আভা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মনে হচ্ছে গোড়া মস্কোই পুড়বে! নাতাশা, চেয়ে দেখ! এখন জানালা থেকেই দেখতে পাবে।

কিন্তু নাতাশা এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন কিছুই বুঝতে পারেনি; ঘরের কোণের স্টোভটার দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। যে কারণেই হোক সোনিয়া সকালেই নাতাশাকে বলে দিয়েছে যে প্রিন্স আন্দ্রু আহত অবস্থায় তাদের সঙ্গেই যাচ্ছে; সেই থেকেই নাতাশা কেমন যেন অর্ধচেতন অবস্থায় আছে। ওদিকে কাউন্টেস সোনিয়ার উপর ভীষণ রেগে গেছে। সোনিয়া কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে এবং যেন সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতেই এখন সে দিদির প্রতি অখণ্ড মনোযোগ দিচ্ছে।

সে বলল, দেখ নাতাশা, কী ভয়ংকরভাবে আগুন জ্বলছে!

কি জ্বলছে? নাতাশা শুধাল। ওঃ, হ্যাঁ, মস্কো।

সোনিয়া পাছে দুঃখ পায় তাই সে জানালার দিকে মুখটা ফেরাল, এমনভাবে মুখটা বাড়াল যে কিছুই দেখতে পেল না, তারপর আবার আগের মতোই বসে পড়ল।

কিন্তু তুমি কি কিছুই দেখলে না!

হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি, নাতাশা জবাব দিল।

কাউন্টেস ও সোনিয়া দুজনই বুঝতে পারল যে এখন নাতাশার কাছে মস্কো, বা মস্কোর অগ্নিকাণ্ড, বা অন্য কোনো কিছুরই কোনো গুরুত্ব নেই।

কাউন্ট ফিরে এসে বেড়ার ওপাশে শুয়ে পড়ল। কাউন্টেস মেয়ের কাছে এগিয়ে গেল, তার অসুখ করলে যেরকম করে থাকে সেইভাবে হাতের পিঠটা দিয়ে নাতাশার মাথাটা স্পর্শ করল, জ্বর হয়েছে কি না বুঝবার জন্য তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল, শেষপর্যন্ত তাকে চুমো খেল।

বলল, তুমি যে ঠাণ্ডা হয়ে গেছ। তোমার সারা শরীর কাঁপছে। তুমি বরং শুয়ে পড় গে।

শুয়ে পড়ব? ঠিক আছে, শুয়ে পড়ব। এখনই শুয়ে পড়ব, নাতাশা বলল।

গুরুতর আহত অবস্থায় প্রিন্স আন্দ্রু তাদের দলের সঙ্গেই যাচ্ছে-সকালে একথা শোনার পরেই নাতাশার মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল : সে কোথায় যাচ্ছিল? কেমন করে আহত হল? আঘাত কি গুরুতর? সে কি তাকে একবার দেখতে পারে না? কিন্তু তাকে যখন বলা হল যে প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখতে পাবে না, তার আঘাত গুরুতর, কিন্তু জীবনের কোনো আশঙ্কা নেই, তখন সে প্রশ্ন করা ছেড়ে দিল, কথা বলা বন্ধ করল; অপরের কোনো কথাতেই তার বিশ্বাস নেই; তার ধারণা হল সে যত যাই বলুক ওই একই জবাব তাকে শুনতে হবে। সারা পথ সে গাড়ির এক কোণে চোখ বড় বড় করে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। মনে মনে সে একটা মতলব আঁটছে, একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে, অথবা নিয়ে ফেলেছে। কাউন্টেস মেয়ের হাবভাব ভালোই জানে; কিন্তু তার মতলবটা যে কি সেটা না জানায় আরো শঙ্কিত হয়ে যন্ত্রণা পেতে লাগল।

নাতাশা, লক্ষ্মী মেয়ে, পোশাক ছেড়ে ফেল; আমার বিছানায়ই শুয়ে পড়।

খাটে কেবল কাউন্টেসের জন্যই বিছানা পাতা হয়েছে। মাদাম শোস দুটি মেয়েকে নিয়ে মেঝেতে খড়ের উপর শোবে।

না মামণি, আমি এখানে মেঝেতেই শোব, বিরক্ত হয়ে জবাব দিয়ে নাতাশা জানালার কাছে গিয়ে সেটা খুলে দিল। খোলা জানালা দিয়ে অ্যাডজুটান্টটির আর্তনাদ আরো স্পষ্ট হয়ে কানে আসছে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে সে মাথাটা বাড়িয়ে দিল। কাউন্টেস দেখল, তার সরু গলাটা চাপা কান্নার আবেগে কাঁপছে, জানালার ফ্রেমের উপর দপ দপ করছে। নাতাশা জানে এ আর্তনাদ প্রিন্স আন্দ্রুর নয়; সে আছে তাদের একই উঠোনের মধ্যে বারান্দার ওপাশের একটা ঘরের একাংশে। কিন্তু এই অবিশ্রাম ভয়ংকর আর্তনাদ শুনে তার কান্না পাচ্ছে। কাউন্টেস ও সোনিয়া দৃষ্টি-বিনিময় করল।

আস্তে নাতাশার কাঁধে হাত রেখে কাউন্টেস বলল, শুয়ে পড় লক্ষ্মীটি; শুয়ে পড় সোনা। এস, শোবে এস।

 ওঃ, হা…এখনই শুয়ে পড়ব, বলে নাতাশা তাড়াতাড়ি পোশাক ছাড়তে লাগল।

পোশাক ছেড়ে ড্রেসিং-জ্যাকেটটা পরে মেঝের বিছানায় বসে সে চুল বাঁধতে লাগল। অভ্যস্ত আঙুল চালিয়ে চুল বাঁধা শেষ করে সে খড়ের উপর পাতা চাদরের উপর শুয়ে পড়ল দরজার দিকটাতে।

সোনিয়া বলল, নাতাশা, তুমি বরং মাঝখানে শোও।

নাতাশা বলল, আমি এখানেই থাকব। তুমি শুয়ে পড়। সে বালিশে মুখ ঢাকল।

কাউন্টেস, মাদাম শোস এবং সোনিয়াও তাড়াতাড়ি পোশাক ছেড়ে শুয়ে পড়ল। দেবমূর্তির সামনেকার বাতিটাই ঘরের একমাত্র আলো। কিন্তু উঠোনে এসে পড়েছে মাইল দেড়েক দূরের হোট মিতিশচির আগুনের মালো; মামোনভের কত্সকরা পথের উপর যে মদের আড্ডা বসিয়েছে সেখান থেকে ভেসে আসছে লোকজনের হল্লার শব্দ; অ্যাডজুটান্টের অবিশ্রাম আর্তনাদ তখনো শোনা যাচ্ছে।

চুপচাপ শুয়ে থেকে নাতাশা ঘরের ভিতর-বাইরের সব শব্দই শুনতে লাগল। মার প্রার্থনা, দীর্ঘশ্বাস ও বিছানায় নড়াচড়ার শব্দ, মাদাম শোসের পরিচিত নাকডাকার শিস, আর সোনিয়ার মৃদু নিঃশ্বাস। কাউন্টেস একবার নাতাশাকে ডাকল। নাতাশা সাড়া দিল না।

মনে হচ্ছে ও ঘুমিয়ে পড়েছে মামণি, সোনিয়া বলল।

একটু চুপ করে থেকে কাউন্টেস আবার কথা বলল; এবার কেউ সাড়া দিল না।

তার একটু পরেই নাতাশা মার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। তার হোট খালি পাটা লেপের ভিতর থেকে বেরিয়ে খালি মেঝেতে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, তবু নাতাশা একটুও নাড়ল না।

যেন সকলের উপর জয়লাভের উৎসব পালন করতে দেয়ালের ফাটলের ভিতর থেকে একটা ঝিঁঝি পোকা ডেকে উঠল। অনেক দূরে একটা কাক ডাকল, কাছে আর একটা কাক তাতে সাড়া দিল। মদের আড্ডার হৈচৈ থেমে গেছে, শুধু অ্যাডজুটান্টের আর্তনাদ এখনো শোনা যাচ্ছে। নাতাশা উঠে বসল।

সোনিয়া ঘুমিয়েছ? মামণি? সে ফিসফিস করে বলল। কেউ সাড়া দিল না। নাতাশা সাবধানে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কুশ-চিহ্ন আঁকল, ঠাণ্ডা নোংরা মেঝেতে পা ফেলে সাবধানে হাঁটতে লাগল। বিড়ালছানার মতো পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ঠাণ্ডা হাতলটা চেপে ধরল।

দরজা খুলে চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দার ঠাণ্ডা মাটির মেঝেতে পা ফেলল। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছে। একটি ঘুমন্ত লোকের গায়ে পা লাগতেই সে তাকে ডিঙিয়ে গেল; কুটিরের যে অংশে প্রিন্স আন্দ্রু শুয়ে আছে সেদিককার দরজাটা খুলল। অন্ধকার। ঘরের এক কোণে বিছানায় কে যেন শুয়ে আছে; পাশের বেঞ্চিটার উপর একটা লম্বা ফিতেওয়ালা চর্বিবাতি ধিকিধিকি জ্বলছে।

সেদিন সকালে যেমুহূর্তে সে শুনেছে যে আহত প্রিন্স আন্দ্রু সেখানেই আছে তখনই সে স্থির করেছে তাকে দেখতে যাবে। কেন যাবে তা সে জানে না, তাকে দেখলে নিজে কষ্ট পাবে তাও জানে, তবু তার মনে হয়েছে যে দেখা করা দরকার।

রাতে তার সঙ্গে দেখা করার আশা নিয়েই সে সারাটা দিন কাটিয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তটি যখন সমাগত তখন তার মন আশঙ্কায় ভরে উঠেছে-না জানি কি দেখবে। কীভাবে সে পঙ্গু হয়েছে? কতটা অক্ষত আছে। তার অবস্থাও কি অবিরাম আর্তনাদকারী অ্যাডজুটান্টের মতো? হ্যাঁ। ঠিক সেই রকমই হবে। কল্পনায় সে যেন তাকে মূর্তিমান আর্তনাদরূপেই দেখতে পেল। একটা দুর্বার আবেগে সামনে এগিয়ে গেল। অতি সাবধানে এক পা এক পা করে এগিয়ে হোট ঘরটার মাঝখানে পৌঁছে গেল। ঘরে একটা তল্পিও রয়েছে। আর একটি লোক–তিমোখিন-দেবমূর্তির নিচে বেঞ্চিটার এক কোণে শুয়ে আছে। অন্য দুজন–ডাক্তার ও খানসামা-শুয়ে আছে মেঝেতে।

উঠে বসে খানসামা ফিসফিস করে কি যেন বলল। আহত পায়ের ব্যথায় তিমোখিন জেগেই ছিল; শাদা সেমিজ, ড্রেসিং-জ্যাকেট ও রাত-টুপি পরা একটি মেয়ের বিচিত্র ছায়ামূর্তি দেখে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। খানসামা ঘুম-ঘুম ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, তুমি কি চাও? ব্যাপার কি? তখন নাতাশা দ্রুতপায়ে এক কোণে শুয়ে থাকা বস্তুটির দিকে এগিয়ে গেল। তাকে দেখতে মোটেই মানুষের মতো নয়, তবু সে তাকে দেখবেই। খানসামাকে পার হয়ে এগিয়ে গিয়ে মোমবাতির আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেল দু হাত লেপের বাইরে রেখে প্রিন্স আন্দ্রুই শুয়ে আছে–ঠিক যেরকমটি সে তাকে অনেকবার দেখেছে।

সে আগেকার মতোই আছে, কিন্তু তার মুখের জ্বরতপ্ত বর্ণ, তার দিকে উসের সঙ্গে ফেরানো চোখের ঝিকিমিকি দৃষ্টি, বিশেষ করে শিশুর মতো নরম গলা তার মধ্যে এমন একটা নিষ্পাপ শিশুসুলভ ভাব ফুটিয়ে তুলেছে যা সে আগে কখনো দেখেনি। প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে এগিয়ে গিয়ে যৌবনসুলভ দ্রুত ও নমনীয় ভঙ্গিতে তার সামনে নতজানু হল।

প্রিন্স আন্দ্রু হেসে তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল।

.

অধ্যায়-৩২

বরদিনোর প্রান্তরে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঘাঁটিতে আশ্রয় পাবার পরে প্রিন্স আন্দ্রুর সাতটা দিন কেটে গেছে। ডাক্তাররা বলেছিল, জ্বর-জ্বর ভাব ও আঘাতপ্রাপ্ত পাকস্থলীর প্রদাহের ফলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু সপ্তম দিনে সে বেশ মৌজ করে চা ও পাউরুটি খেল, আর ডাক্তারও দেখল যে তার শরীরের উত্তাপ নেমে গেছে। সকালেই তার জ্ঞানও ফিরে এসেছে। মস্কো ছাড়বার পরে প্রথম রাতটা বেশ গরমই ছিল, আর সেও ছিল একটা কালিচে-গাড়িতে কিন্তু মিতিশচিতে পৌঁছে আহত লোকটি নিজেই বলল, তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে একটু চা খেতে দেওয়া হোক। কুটির স্থানান্তরের দরুন যন্ত্রণায় সে আবার আর্তনাদ করতে লাগল; জ্ঞানও হারাল। শিবির-শয্যায় শুইয়ে দেবার পরে অনেকক্ষণ সে চোখ বুঝে চুপচাপ পড়ে রইল। তারপর চোখ মেলে ধীরে ধীরে বলল : আমার চা? প্রাত্যহিক জীবনের এই তুচ্ছ কথাটা তার মনে আছে দেখে ডাক্তার অবাক হয়ে গেল। প্রিন্স আন্দ্রুর নাড়ি দেখে অবস্থার উন্নতি হয়েছে বুঝতে পেরে ডাক্তার যেমন বিস্মিত হল, তেমনই অসন্তুষ্টও হল। অসন্তুষ্টির কারণ অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, রোগী যদি এখন মারা না যায় তাহলে পরে আরো অনেক বেশি কষ্ট পেয়ে মরবে। প্রিন্স আন্দ্রুর রেজিমেন্টের লাল-নাক মেজর তিমোখিন মস্কোতেই তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে; বরদিনের যুদ্ধে একটা পা আহত হওয়ায় সেও প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গেই চলেছে। তাদের সঙ্গে আছে একটি ডাক্তার, প্রিন্স আন্দ্রুর খানসামা, তার কোচয়ান ও দুটি আর্দালি।

প্রিন্স আন্দ্রুকে একটু চা দেওয়া হল। সাগ্রহে সেটা খেয়ে সে জ্বরো জ্বরো চোখে সামনের দিকে তাকাল; যেন কোনো কিছু মনে করতে ও বুঝতে চেষ্টা করছে।

আর চাই না। তিমোখিন কি এখানে আছেন? সে শুধাল।

তিমোখিন বেঞ্চিটা ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল।

আমি এখানেই আছি ইয়োর এক্সেলেন্সি।

আপনার ঘাটা কেমন আছে?

আমার স্যার? ভালো আছে। আপনার অবস্থা কেমন?

 প্রিন্স আন্দ্রু আবার কি যেন মনে করতে চেষ্টা করল।

একটা বই কি পাওয়া যাবে না? সে শুধাল।

 কি বই?

সুভাষিতাবলী; আমার কাছে নেই।

 ডাক্তার তাকে কথা দিল, একটা বই যোগাড় করে দেবে; তারপর সে কেমন আছে জানতে চাইল। প্রিন্স আন্দ্রু অনিচ্ছাসত্ত্বেও যথাযথভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিল; তারপর একটা তাকিয়া দিতে বলল, কারণ বিছানায় শুয়ে সে আরাম পাচ্ছে না, কষ্ট বোধ হচ্ছে। যে আলখাল্লাটা দিয়ে তার শরীর ঢাকা ছিল ডাক্তার ও খানসামা সেটাকে তুলে দিল; ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসা পচা মাংসের দুর্গন্ধে মুখ বিকৃত করে তারা সেই ভয়ংকর জায়গাটা পরীক্ষা করতে লাগল। ডাক্তার খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে ড্রেসিংটা বদলে দিতে গিয়ে আহত লোকটিকে পাশ ফিরিয়ে দিল, আর তাতেই যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করতে করতে সে আবার অজ্ঞান হয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করল। বার বার বলতে লাগল, বইটা এনে তার বিছানার নিচে রাখা হোক।

বলল, তাতে আপনাদের অসুবিধাটা কোথায়? বইটা আমার সঙ্গে নেই। দয়া করে একখানা বই এনে মুহূর্তের জন্য বিছানার নিচে রেখে দিন, সে করুণ সুরে অনুরোধ জানাল।

ডাক্তার হাত ধুতে বারান্দার চলে গেল।

খানসামা তার হাতে জল ঢেলে দিল। সেইসময় ডাক্তার তাকে বলল, তোমাদের তো বিবেক বলে কিছু নেই। একমুহূর্ত আমি নজর রাখিনি…এ যে কী যন্ত্রণা জান তো; উনি যে কি করে সহ্য করছেন ভেবে পাই না।  

খানসামা বলল, প্রভু যীশু খৃস্টের দোহাই, বিছানার নিচে কিছু রাখা হোক!

মিতিশচিতে কালিচে-গাড়িটা থাকবার পরে প্রিন্স আন্দ্রু যখন তাকে কুটিরে নিয়ে যেতে বলল, তখনই সে প্রথম বুঝতে পারল সে কোথায় আছে, তার কি হয়েছে, সে আঘাত পেয়েছে এবং কেমন করে পেয়েছে। কুটিরে নিয়ে যাবার সময় সে আবার যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় পুনরায় জ্ঞান ফিরে পাবার পরে চা খেতে খেতে সব কথা তার নতুন করে মনে পড়ে গেল। একটা নতুন ধরনের চিন্তা এসে তার মনে সুখের ভরসা যোগাল। মনে হল, সুখের একটা নতুন উৎস সে খুঁজে পেয়েছে, আর সে সুখ সুভাষিতাবলির সঙ্গে জড়িত। সেইজন্যই একখানা বই সে চেয়েছে। পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দেবার সময় আবার সব গোলমাল হয়ে গেল। তৃতীয় বারের মতো যখন জ্ঞান ফিরে পেল তখন চারদিকে রাতের নিস্তব্ধতা। কাছাকাছি সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বারান্দা থেকে একটা ঝিঁঝি ডেকে উঠল; রাস্তায় কে যেন চেঁচিয়ে গান করছে; টেবিলে, দেবমূর্তির উপরে ও দেয়ালে আরশুলাগুলো খসখস করে চলাফেরা করছে; বিছানার মাথার কাছে এবং পাশের মোমবাতিটাকে ঘিরে একটা বড় মাছি ফরফর করে উড়ছে; মোমবাতির পলতেটা পুড়ে গিয়ে ব্যাঙের ছাতার আকার নিয়েছে।

তার মনের অবস্থাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। একটি সুস্থ মানুষ সাধারণত একই সঙ্গে অসংখ্য বিষয় ভাবতে পারে, অনুভব করতে পারে, স্মরণ করতে পারে; কিন্তু দরকার হলে একটি চিন্তাধারাকে বেছে নিয়ে সমস্ত মনোযোগকে তার উপর নিবদ্ধ করার ক্ষমতাও সে রাখে। একটি সুস্থ মানুষ গভীরতম চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে একজন আগন্তুকের সঙ্গে দু-একটা ভদ্রতার কথা বলে আবার নিজের চিন্তায় ফিরে যেতে পারে। কিন্তু সে ব্যাপারে প্রিন্স আন্দ্রুর মনটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার মনের সব ক্ষমতাই আগের চাইতে বেশি সক্রিয় ও পরিচ্ছন্ন, কিন্তু সে ক্ষমতা কাজ করে তার ইচ্ছার বাইরে। একই সঙ্গে বহু বিচিত্র বিষয় নিয়ে সে ভাবতে পারে; কিন্তু কাজ করতে করতেই সহসা একটা অপ্রত্যাশিত ধারণা এমনভাবে তার মনে বাসা বাধে যে সেটাকে সরিয়ে দেবার কোনো শক্তিই তার থাকে না।

নিস্তব্ধ কুটিরের আধো অন্ধকারে শুয়ে রতপ্ত বিস্ফারিত চোখ মেলে সামনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে ভাবতে লাগল, হ্যাঁ, এমন একটা নতুন সুখ আমার কাছে প্রকাশ পেয়েছে যা থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখা যায় না। সে সুখের আসন জড়বস্তুর বাইরে, সে সুখ একমাত্র আত্মার, সে সুখ ভালোবাসার। সব মানুষই তাকে বুঝতে পারে, কিন্তু তাকে সম্যক ধারণা করা, তার ব্যবস্থা করা একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু ঈশ্বরই বা কীভাবে সে বিধানের প্রয়োগ করলেন? আর কেনই বা ঈশ্বরপুত্র…?

সহসা তার চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল, প্রিন্স আন্দ্রু শুনতে পেল (সেটা বাস্তব না স্বপ্ন তা সে জানে না) একটা মৃদু ফিসফিস স্বর অনবরত তালে তালে বলছে পিতি-পিতি-পিতি, তারপর তিতি, তারপর আবার পিতি পিতি-পিতি, এবং আবার তি-তি। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, মুখের উপর, ঠিক মাঝখানটাতে সেই ফিসফিস শব্দের তালে তালে অতি সূক্ষ্ম সূচ ও ভাঙা কুঁচি দিয়ে একটা আশ্চর্য বায়বীয় কিছু গড়ে উঠেছে। মনে হল তাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে যাতে এই বায়বীয় জিনিসটা ভেঙে না পড়ে; কিন্তু তবু সেটা ভেঙে যেতে লাগল এবং সেই তালবদ্ধ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আবার ধীরে ধীরে গড়ে উঠল; প্রিন্স আন্দ্রু নিজের মনেই বলতে লাগল–সেটা বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে, বড় হচ্ছে। সেই ফিসফিসানি শুনতে শুনতে এবং সূচীশিল্পের গলা জিনিসটাকে দেখতে দেখতে সে চকিতে আরো দেখতে পেল মোমবাতিটাকে ঘিরে একটা লাল আলোর বৃত্ত, শুনতে পেল আরশোলাদের ফরফর শব্দ, এবং তার বালিশে মুখের উপর উড়ন্ত একটা মাছির গুনগুনানি। মাছিটা যতবার মুখের উপর পড়ছে ততবার সেখানটায় জ্বালা করছে, অথচ কী আশ্চর্য, মাছিটা সেই বায়বীয় জিনিসটাকে আঘাত করা সত্ত্বেও সেটা ভেঙে যাচ্ছে না। কিন্তু এসব ছাড়া আরো একটা বড় ব্যাপার সেখানে ছিল। দরজার কাছে একটা শাদামতো কিছু একটা স্কিনস্ক-এর মূর্তি; সেটাও তাকে পীড়া দিতে লাগল।

সে ভাবল, ওইতো টেবিলের উপর আমার শার্টটা, ওই তো আমার পা দুটো, ওই তো দরজা, কিন্তু ওটা অনবরত বড় হচ্ছে কেন, ছড়িয়ে পড়ছে কেন, আর কেনই বা পিতি-পিতি-পিতি আর তি-তি…? যথেষ্ট হয়েছে, দয়া করে চলে যাও! যন্ত্রণাকাতর গলায় প্রিন্স আন্দ্রু কাকে যেন মিনতি জানাল। আর সহসা চিন্তা ও অনুভূতিগুলি আবার তার মনের উপরে ভেসে উঠল বিশেষ স্পষ্টতায় ও শক্তিতে।

পরিষ্কারভাবে সে আবার ভাবল, হা-ভালোবাসা। কিন্তু সে ভালোবাসা নয় যা ভালোবাসে কোন কিছুর জন্য, গুণের জন্য, উদ্দেশ্যের জন্য, আর অন্য কোনো কারণের জন্য, কিন্তু সেই ভালোবাসা যা আমি–সুখের মুখে দাঁড়িয়ে–প্রথম জেনেছি যখন আমার শত্রুকে দেখেও তাকে ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে যা আত্মারই একান্ত সত্তা, যার কোনো পাত্রের দরকার হয় না। সেই আনন্দের অনুভূতি আমি আবার লাভ করেছি। প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, শত্রুকে ভালোবাসা, সব কিছুকে ভালোবাসা, তার সব আত্মপ্রকাশের মধ্যে ঈশ্বরকে ভালোবাসা। প্রিয়জনকে তুমি ভালোবাসতে পার মানবিক ভালোবাসা দিয়ে, কিন্তু শত্রুকে ভালোবাসা যায় একমাত্র ঐশ্বরিক ভালোবাসা দিয়ে। তাই তো শত্রুকে ভালোবেসে এত আনন্দ আমি পেয়েছি। তার কি হয়েছে? সে কি বেঁচে আছে…?

মানবিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে ভালোবাসা থেকে ঘৃণায় যাওয়া যায়, কিন্তু ঐশ্বরিক ভালোবাসার পরিবর্তন নেই। না, মৃত্যু বা অন্য কিছুই তাকে ধ্বংস করতে পারে না। সেটাই তো আত্মার মূল ধর্ম। অথচ এ জীবনে কত মানুষকেই না ঘৃণা করেছি? আর যত ভালোবেসেছি ও ঘৃণা করেছি তাকে যত আর কাউকে নয়। সঙ্গে সঙ্গে নাতাশার ছবি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল তার সামনে। নাতাশার অনুভূতি, তার যন্ত্রণা, তার লজ্জা, তার অনুতাপ সবই সে বুঝতে পারল। এই প্রথম সে বুঝতে পারল নাতাশাকে প্রত্যাখ্যান করার নিষ্ঠুরতা, তার সঙ্গে বিরোধের নিষ্ঠুরতা। যদি আর একটিবার তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হত! শুধু একবার, সেই দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে যদি বলতে পারতাম…

পিতি-পিতি-পিতি, তিতি, পিতি-পিতি-পিতি বুম! মাছিটা উড়ছে…আর সহসা তার মন চলে গেল আর এক জগতে-বাস্তব ও বিকারের এক জগতে যেখানে ঘটে চলেছে একটি বিশেষ ঘটনা। সেই জগতে একটা কিছু এখনো গড়ে উঠছে, ভেঙে পড়ছে না, একটা কিছু ক্রমেই বড় হচ্ছে, লাল বৃত্তসহ মোমবাতিটা এখনো জ্বলছে, দরজার কাছে সেই শার্টের মতো ফিনটা পড়ে আছে : কিন্তু এ সবকিছু ছাড়া আরো একটা কিছুর কাঁচ-কাঁচ শব্দ হল, একঝলক তাজা বাতাস ঘরে ঢুকল, আর দরজায় দেখা দিল আর একটি নতুন শাদা স্কিনস্ক। আর যে নাতাশার কথা সে এইমাত্র ভাবছিল তারই বিবর্ণ মুখ ও চকচকে চোখ বসানো এই নতুন ফিন-এর মূর্তিতে।

কল্পনা থেকে সেই মুখটাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টায় প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, ওঃ, এই অবিরাম বিকার কী যন্ত্রণাদায়ক! কিন্তু সে মুখ বাস্তব রূপ নিয়ে থেকেই গেল, আরো কাছে এগিয়ে এল। সেই বিচিত্র মুখখানি তার একেবারে সামনে। নিজের বুদ্ধিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় প্রিন্স আন্দ্রু সব শক্তি একত্র করল, একটু সরে গেল, আর সহসা তার কানে কি যেন বেজে উঠল, চোখের উপর নেমে এল আবছায়া, জলে ডুবন্ত মানুষের মতো সে চেতনা হারাল। যখন সম্বিত ফিরে পেল তখন নাতাশা, সেই জীবন্ত নাতাশা যাকে সে সবার চাইতে ভালোবাসতে চেয়েছে তার নবলব্ধ পবিত্র ঐশ্বরিত ভালোবাসা দিয়ে, সেই নাতাশা তার সামনে নতজানু হয়ে  আছে। সে বুঝল এ নাতাশা প্রকৃতই জীবন্ত; সে বিস্মিত হল না, বরং সুখী হল। নতজানু হয়ে নিশ্চলভাবে বসে ভয়ার্ত দুটি চোখ তার মুখের উপর রেখে নাতাশা কোনোক্রমে কান্না চেপে রেখেছে। তার মুখ বিবর্ণ, কঠিন। শুধু নিচের দিকটা কাঁপছে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে প্রিন্স আন্দ্রু হাসল; হাতটা বাড়িয়ে দিল।

 তুমি? সে বলল। কী ভাগ্য!

নতজানু অবস্থাতেই নাতাশা দ্রুত অথচ সাবধানে তার আরো কাছে এগিয়ে গেল, সযত্নে তার হাতটা টেনে নিল, ঝুঁকে পড়ে আলতো করে ঠোঁট দুটি ছুঁইয়ে হাতের উপর চুমো খেল।

মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমাকে ক্ষমা কর! আমাকে ক্ষমা কর!

আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

 ক্ষমা…!

কিসের ক্ষমা? প্রিন্স আন্দ্রু শুধাল।

আমি যা করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা কর! প্রায় অশ্রুত ভাঙা-ভাঙা গলায় নাতাশা বলল; কোনোরকমে ঠোঁট ছুঁইয়ে তার হাতে চুমো খেতে লাগল।

নাতাশার মুখটা তুলে ধরে তার চোখে চোখ রেখে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, তোমাকে আমি আগের চাইতে আরো বেশি ভালোবাসি।

আনন্দের অশ্রুভরা দুটি চোখ তুলে ভীরু দৃষ্টিতে নাতাশা প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল। তার শীর্ণ বিবর্ণ মুখ, ফোলা ঠোঁট দুটি বড়ই সাধারণ-দেখলে ভয় করে। কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রু তা দেখল না, সে দেখল তার সুন্দর দুটি চকচকে চোখ। পিছন থেকে অনেকের কণ্ঠস্বর দুজনই শুনতে পেল।

খানসামা পিতর জেগে উঠে ডাক্তারকে জাগিয়েছে। পায়ের ব্যথার জন্য তিমোখিন মোটেই ঘুমোয়নি; বেঞ্চির উপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে একটা চাদর দিয়ে শরীরটাকে ঢেকে সে অনেকক্ষণ ধরেই সবকিছু দেখছিল।

বিছানা থেকে উঠে ডাক্তার বলল, এটা কি? দয়া করে চলে যান মাদাম।

সেইমুহূর্তে একটি দাসী এসে দরজায় টোকা দিল; মেয়েকে না দেখতে পেয়ে কাউন্টেস তাকে পাঠিয়েছে।

সদ্য ঘুম ভেঙে ওঠা স্বপ্নাচ্ছন্ন রোগীর মতো নাতাশা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল; ঘরে ফিরে নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগল।

.

সেদিন থেকে রস্তভদের অবশিষ্ট ভ্রমণকালে প্রতিটি বিরামস্থলে এবং যেখানেই তারা রাত কাটিয়েছে, নাতাশা কখনো আহত বলকনস্কির কাছছাড়া হয়নি; আর ডাক্তারকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে একটি তরুণীর কাছ থেকে এতটা মানসিক দৃঢ়তা অথবা একটি আহত মানুষকে সেবা করবার এতটা নিপুণতা সে আশা করেনি।

পথের মধ্যেই প্রিন্স আন্দ্রু যদি তার মেয়ের হাতের উপরেই মারা যায়–ডাক্তারের কথামতো তা তো সহজেই ঘটতে পারে-কাউন্টেসের কাছে সেটা যত ভয়াবহই মনে হোক না কেন, তবু সে নাতাশাকে বাধা দিতে পারল না। যদিও আহত মানুষটি ও নাতাশার মধ্যে এখন যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে তাতে সকলেরই মনে হল যে প্রিন্স আন্দ্রু সেরে উঠলে তাদের বিয়ের প্রস্তাবটি নতুন করে তোলা হবে, তবু কেউই মুখে একথা বলল না-নাতাশা ও প্রিন্স আন্দ্রু তো নয়ই : জীবন-মৃত্যুর যে অমীমাংসিত প্রশ্নটি তখন শুধু বলকনস্কির মাথার উপরে নয়, সারা রাশিয়ার উপরেই ঝুলে আছে, সেটাই এখন অন্য সব বিচার-বিবেচনার পথকে রোধ করে দাঁড়িয়েছে।

.

অধ্যায়-৩৩

৩ সেপ্টেম্বর অনেক দেরিতে পিয়েরের ঘুম ভাঙল। মাথাটা ধরে আছে, পোশাক না ছেড়েই যে বিছানায় শুয়েছিল সেটা বড়ই অস্বস্তিকর লাগছে, আগের দিন একটা লজ্জাজনক কাজ করার অস্পষ্ট চেতনা মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। সেই লজ্জাজনক কাজটা ক্যাপ্টেন রাম্বেলের সঙ্গে গতকালের আলোচনা।

ঘড়িতে এগারোটা বাজে, কিন্তু বাইরেটা বেশ অন্ধকার মনে হচ্ছে। পিয়ের উঠে চোখ মুছল; কুঁদোতো খোদাই-করা যে পিস্তলটা গেরাসিম লেখার টেবিলে রেখে গেছে সেটা চোখে পড়তেই পিয়েরের মনে পড়ে গেল সে কোথায় আছে, আর সেইদিনই তার ভাগ্যে কি আছে।

আমার কি অনেক দেরি হয়ে যায় নি? সে ভাবল। হয়তো সে দুপুরের আগে মস্কোতে ঢুকবে না।

ভবিষ্যতের চিন্তায় মাথা না ঘামিয়ে সে তাড়াতাড়ি কাজে লেগে গেল।

পোশাক ঠিক করে পিস্তলটা নিয়ে বেরিয়ে যাবে, এমন সময় এই প্রথম তার মনে হল যে এভাবে পিস্তলটা হাতে নিয়ে রাজপথ ধরে সে চলতে পারে না। এতবড় একটা পিস্তলকে কোটের নিচে লুকিয়ে রাখাও শক্ত। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে এটাকে বেল্টের নিচে অথবা বগলের নিচে লুকিয়ে রেখেও চলা সম্ভব নয়। তাছাড়া এটা থেকে গুলি ছোঁড়া হয়ে গেছে, নতুন করে গুলি ভরার আর সময় হয়ে ওঠেনি। ঠিক আছে, ছুরিতেই কাজ চলবে, নিজের মনেই বলল, যদিও পরিকল্পনা করার সময় সে একাধিকবার স্থির করেছে যে ১৮০৯ সালে একটা ছুরি নিয়ে নেপোলিয়নকে হত্যা করার চেষ্টা করেই ছাত্রটি মস্তবড় ভুল করেছিল। তবু পিয়ের তাড়াতাড়িতে পিস্তলের সঙ্গে সবুজ খাপে ভরা একটা খাজ-কাটা ভোতা ছুরিও সঙ্গে নিল। পিস্তলের সঙ্গে ছুরিটাও সে কিনেছিল সুখারেভ বাজার থেকে। সেটাকে ওয়েস্টকোটের নিচে লুকিয়ে রাখল।

কোটের উপর একটা কটিবন্ধ বেঁধে টুপিটাকে কপালের উপর টেনে দিয়ে কোনোরকম শব্দ না করে ক্যাপ্টেনকে এড়িয়ে বারান্দাটা পার হয়ে পিয়ের রাস্তায় পা দিল।

আগের সন্ধ্যায় যে অগ্নিকাণ্ডকে সে উদাসীন চোখে তাকিয়ে দেখেছে আজ রাতে সেটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে। মস্কোর বিভিন্ন স্থান আগুনে পুড়েছে। নদীর ওপারে ক্যারেজ রোর দালানগুলো, বাজার ও পোয়, মভা নদীর উপরকার বজরা আর দরগমিলভ সেতুর পার্শ্বস্থ কাঠের গোলা–সব জ্বলছে।

পিয়ের গলিপথ ধরে পোয় গেল, সেখান থেকে গেল আর্বাতে অবস্থিত সেন্ট নিকলাস গির্জায়; অনেক আগেই সে স্থির করেছে ওখানেই কাজটা সমাধা করা উচিত। অধিকাংশ বাড়িরই ফটকে তালা, খড়খড়ি তোলা। রাজপথ ও গলি জনশূন্য। মাঝে মাঝে কিছু রুশকে দেখতে পেল; তাদের মুখে উৎকণ্ঠা ও ভয়। কিছু ফরাসি সৈন্য রাস্তার মাঝখান দিয়ে এমনভাবে চলেছে যেন এটা শহর নয়, সেনা-শিবির। রুশ ও ফরাসি সকলেই পিয়েরকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। তার উচ্চতা ও মজবুত চেহারা ছাড়াও তার মুখে ও সারা দেহে এমন একটা বিচিত্র যন্ত্রণার ভাব ফুটে উঠেছে যে রুশরা তার দিকে তাকিয়ে ভাবছে সে কোন জাতের মানুষ। ফরাসিরা অবাক চোখে তাকে দেখছে কারণ অন্য রুশরা যেখানে ফরাসিদের দেখছে ভয় ও কৌতূহলের সঙ্গে, সেখানে পিয়ের তাদের একেবারেই আমল দিচ্ছে না। একটা বাড়ির ফটকে তিনজন ফরাসি রুশদের কি যেন বুঝিয়ে বলছে, কিন্তু তারা কিছুই বুঝতে পারছে না দেখে ফরাসিরা পিয়েরকে থামিয়ে জানতে চাইলে সে ফরাসি জানে কি না।

পিয়ের মাথা নেড়ে চলে গেল। চারদিকে যা কিছু ঘটছে তার দিকে না আছে তার কান, না আছে তার দৃষ্টি। নিজের সংকল্পকে মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে সে সভয়ে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল। কিন্তু উদ্দেশ্য সাধন করা তার কপালে নেই। পথে আর কোনো বাধা না পেলেও তার অভিপ্রায় সফল করা যেত না, কারণ দরগমিলভ শহরতলি থেকে ক্রেমলিন যাবার পথে নেপোলিয়ন চার ঘণ্টারও বেশি সময় আগে আৰ্বাত পার হয়ে গেছে; এখন সে অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে ক্রেমলিনের রাজকীয় পাঠকক্ষে বসে অগ্নিনির্বাপন ও লুঠতরাজ বন্ধ করা এবং অধিবাসীদের আশ্বস্ত করার ব্যাপারে অবিলম্বে যে সব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তসংক্রান্ত বিস্তারিত ও সঠিক হুকুম জারি করছে। কিন্তু পিয়ের এ সবকিছুই জানে না : নিজের আসন্ন কর্তব্যের মধ্যেই সে ডুবে আছে; তার একমাত্র দুশ্চিন্তা পাছে চরম মুহূর্তে দুর্বলতা এসে তাকে ঘিরে ধরে এবং তার আত্মমর্যাদা হারিয়ে যায়।

কোনো কিছু না শুনলে ও না দেখলেও সহজাত প্রবৃত্তিতেই সে পথ চিনে এগিয়ে চলল; পোভাস্কয়ের গলিপথে যেতে সে কোনোরকম ভুল করল না।

সেই রাস্তা ধরে যত এগোচ্ছে ততই ধোয়া ঘনতর হচ্ছে–আগুনের তাপ পর্যন্ত তার গায়ে লাগছে। মাঝে মাঝে বাড়ির ছাদ থেকে আগুনের লেলিহান জিহ্বা উঠতে দেখা যাচ্ছে। যদিও বুঝতে পারছে যে তার চারদিকে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে, তবু সে যে অগ্নিকাণ্ডের দিকেই এগিয়ে চলেছে সেটা পিয়ের বুঝতে পারেনি। একদিকে পোভায় আর অন্যদিকে প্রিন্স গ্রুজিনস্কির বাড়ির বাগান সংলগ্ন একটা প্রশস্ত খোলা জায়গার ভিতরকার ফুটপাত ধরে যেতে যেতে হঠাৎ পিয়ের শুনতে পেল খুব কাছেই একটি স্ত্রীলোক অসহায়ভাবে কাঁদছে। স্বপ্নোত্থিতের মতো পিয়ের মাথাটা তুলল।

পথের পাশে ধুলো ঢাকা শুকনো ঘাসের উপর নানারকম গৃহস্থালির জিনিসপত্র স্তূপীকৃত হয়ে আছে : পালকের বিছানা, সামোভার, দেবমূর্তি, ট্রাংক, কত কি। ট্রাংকের পাশে একটি শুকনো চেহারার স্ত্রীলোক মাটিতে বসে আছে; স্ত্রীলোকটি বয়স্কা, উপরের পাটির দাঁতগুলো উঁচু, পড়নে কালো জোব্বা ও টুপি। কি যেন বলতে বলতে চাপা কান্নার আবেগে তার শরীরটা দুলছে। দশ ও বারো বছরের দুটি মেয়ে নোংরা খাটো ফ্রক ও জোব্বা পরে ভয়ার্ত, বিমূঢ় মুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে। বছর সাতেকের হোট ছেলেটি অন্য কারও ওভারকোট ও বড় মাপের একটা টুপি পড়ে বুড়ি নার্সের কোলে চড়ে চিৎকার করছে। একটা নোংরা দাসী খালি পায়ে ট্রাংকের উপর বসে আছে। স্ত্রীলোকটির স্বামীর পরনে সহকারী কর্মচারীর পোশাক, বাঁকানো গোঁফ, মাথায় চৌকো টুপি; ভাবলেশহীন মুখে ট্রাংকগুলো সরিয়ে তার ভিতর থেকে পোশাকপত্র টেনে বার করছে।

পিয়েরকে দেখামাত্রই স্ত্রীলোকটি তার পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ল।

ভালো মানুষরা, ভালো খৃস্টানরা, আমাকে বাঁচান, আমাকে সাহায্য করুন, প্রিয় বন্ধুরা…যে কেউ আমাদের সাহায্য করুন…চাপা কান্নার ফাঁকে ফাঁকে সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল। আমার মেয়ে…আমার মেয়ে! আমার ছোট যে পড়ে রইল। আগুনে পুড়ে গেল! উঃ! এইজন্যই কি তাকে মানুষ করলাম…উঃ!

নিচু গলায় স্বামী বলল, কেঁদ না মারি নিকলায়েভনা! নিশ্চয় দিদি তাকে নিয়ে গেছে, নইলে সে যাবে কোথায়?

হঠাৎ কান্না থামিয়ে স্ত্রীলোকটি সক্রোধে গর্জে উঠল, রাক্ষস! পাষণ্ড! তোমার তো হৃদয় বলে কিছু নেই, নিজের সন্তানের জন্যও কোনো মমতা নেই। অন্য পুরুষ হলে তাকে আগুনের ভিতর থেকে উদ্ধার করে আনত। কিন্তু এ তো রাক্ষস, মানুষ নয়, বাপও নয়! চাপা কান্নার ফাঁকে সে পিয়েরকে ডেকে বলল, আপনি তো স্যার একজন সম্মানিত লোক। আশেপাশে আগুন লাগল, আমার বাড়ির দিকে ধাওয়া করল, দাসী চেঁচিয়ে উঠল আগুন! আর আমরা জিনিসপত্র গুছাতে গেলাম। যে অবস্থায় ছিলাম সেইভাবেই বেরিয়ে এলাম…এই তো মাত্র সঙ্গে আনতে পেরেছি…দেবমূর্তি, আমার যৌতুকের বিছানা, আর সবই তো গেছে! বাচ্চাদের ধরে নিয়ে এলাম। কিন্তু কাতিকে আনতে পারলাম না! উঃ! হে প্রভু!… আবার সে ফোঁপাতে শুরু করল। আমার বাছা, আমার সোনা! পুড়ে গেল! পুড়ে গেল!

কিন্তু তাকে কোথায় ফেলে এসেছেন? পিয়ের শুধাল।

তার দৃপ্ত মুখ দেখে স্ত্রীলোকটির মনে হল, এ হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারে।

পা ধরে চেঁচিয়ে বলল, ওঃ, প্রিয় মহাশয়! আমার রক্ষাকর্তা, আমার বুকটাকে শান্ত করুন!…আনিস্কা, এই মেয়েটা, যা না, ওকে পথটা দেখিয়ে দে! রেগে হাঁ করে দীর্ঘ দাঁতের পাটি বের করে সে চেঁচিয়ে দাসীটিকে বলল।

পিয়ের তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমাকে রাস্তাটা দেখিয়ে দাও, দেখিয়ে দাও…আমি ঠিক করে দেব।

নোংরা দাসীটি ট্রাংক থেকে নেমে চুল ঠিক করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খালি পায়ে পথ দেখিয়ে চলল। পিয়েরের মনে হল, গভীর মূৰ্ছার পরে সে যেন আবার বেঁচে উঠেছে। মাথাটা খাড়া করল, জীবনের আলোয় দুচোখ জ্বলতে লাগল, দ্রুত পায়ে দাসীকে অনুসরণ করে পোয়তে পৌঁছে গেল। কালো ধোয়ার মেঘে সারাটা রাস্তা ঢেকে গেছে। সেই মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আগুনের জিহ্বা উঁকি মারছে। অনেক লোক জড় হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের সামনে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জনৈক ফরাসি জেনারেল চারপাশের লোকজনদের কি যেন বলছে। দাসীকে সঙ্গে নিয়ে পিয়ের জেনারেলের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু ফরাসি সৈনিকরা তাকে বাধা দিল।

ওদিকে যেতে পারবেন না, একজন বলল।

মেয়েটি বলল, এদিকে আসুন খুড়ো। গলি ধরে নিকুলিন্সকে পাশ কাটিয়ে আমরা চলে যাব।

পিয়ের মুখ ঘুরিয়ে লাফিয়ে দাসীর সঙ্গে ছুটতে লাগল। মেয়েটি ছুটে রাস্তা পার হয়ে বাঁদিকে একটা গলিতে ঢুকল; তিনটে বাড়ি পেরিয়ে ডানদিকের একটা উঠোনে ঢুকল।

এই তো কাছেই, বলে মেয়েটি দৌড়ে উঠোন পার হয়ে কাঠের বেড়ার ফটকটা খুলে ফেলল। সেখানে দাঁড়িয়েই বাড়িটার ছোট কাঠের অংশটা আঙুল দিয়ে দেখাল; সেটা তখন দাউদাউ করে জ্বলছে। একটা দিক ভেঙে পড়েছে, অপর দিকটা জ্বলছে, জানালার ফাঁকে ও ছাদের ভিতর দিয়ে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে।

বেড়ার ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে গরম বাতাস গায়ে লাগতে পিয়ের আপনা থেকেই থেমে গেল।

কোনটা? তোমাদের বাড়ি কোনটা? সে শুধাল।

একটি দিক দেখিয়ে মেয়েটি আর্তনাদ করে বলল, উঃ! ঐ তো, ঐ তো আমাদের বাসা। হায় সোনা, তুমি পুড়ে মরলে! কাতি, সোনা-মানিক আমার! উঃ!

পিয়ের সেদিকটায় ছুটে গেল, কিন্তু আগুনের হল্কার জন্য এগোতে পেরে ঘুরে বড় বাড়িটার সামনের দিকে চলে গেল। সে বাড়ির ছাদের নিচটা শুধু জ্বলছে আর একদল ফরাসি সেখানে ভিড় করেছে। লোকগুলি কি করছে সেটা প্রথমে পিয়ের বুঝতে পারেনি; কিন্তু যখন সে দেখল একজন ফরাসি তোতা তলোয়ার দিয়ে একটি চাষীকে আঘাত করছে আর তার কাছ থেকে একটা শেয়ালের লোমের কোট ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করছে, তখনই সে বুঝল যে সেখানে লুঠতরাজ চলছে; কিন্তু তা নিয়ে ভাববার মতো সময় তার নেই।

দেয়াল ও ছাদ ভেঙে পড়ার শব্দ, আগুনের শিখার হিস-হিস শব্দ, উত্তেজিত জনতার চেঁচামেচি ও আগুনের কুণ্ডলি–সবকিছু মিলিয়ে পিয়েরের মনে একটা উদ্দীপনার সৃষ্টি হল। বাসাটার অন্যদিকে ছুটে গিয়ে ভিতরে ঢুকবার মুখেই মাথার উপরে অনেকের চিৎকার শুনতে পেল, আর তখনই একটা ভারি জিনিস হুড়মুড় করে তার পাশেই এসে পড়ল।

পিয়ের মুখ তুলে দেখল, বড় বাড়িটার জানালায় কয়েকজন ফরাসি দাঁড়িয়ে আছে। তারাই ধাতুর জিনিসপত্র ভর্তি একটা দেরাজ এইমাত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নিচে দাঁড়ানো অপর কয়েকজন ফরাসি দেরাজটার দিকে এগিয়ে গেল।

পিয়েরকে দেখিয়ে তাদের একজন বলে উঠল, এই লোকটা কি চায়?

পিয়ের চিৎকার করে বলল, ওই বাড়িতে একটি শিশু আছে? তোমরা কি একটি শিশুকে দেখেছ?

কি বলছে লোকটা এগিয়ে চল! কয়েকজন বলল; পাছে পিয়ের দেরাজের কিছু প্লেট ও ব্রোঞ্জের জিনিস চেয়ে বসে এই ভয়ে একটি সৈনিক সদর্পে তার দিকে এগিয়ে এল।

উপর থেকে একজন ফরাসি চেঁচিয়ে বলল, একটি শিশু বাগানে কার যেন কান্না শুনেছি। এ লোকটি নিশ্চয় সেই বাচ্চাটাকেই খুঁজছে। যাই হোক না কেন, তোমাকে তো মানুষের মতো আচরণ করতে হবে…

কোথায় সে? কোথায়? পিয়ের বলল।

বাড়ির পিছন দিককার বাগানটা দেখিয়ে ফরাসিটি জানালা থেকে চেঁচিয়ে বলল, ওখানে! ওখানে! একটু অপেক্ষা কর-আমি নেমে আসছি।

দু-এক মিনিট পরেই কালো চোখ ও গালে তিল একটি ফরাসি সত্যি সত্যি একতলার জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমে এল এবং পিয়েরের কাঁধটা চেপে ধরে বাগানের দিকে ছুটে গেল।

সহকর্মীদের ডেকে বলল, তোমরা সকলেই তাড়াতাড়ি নেমে এস। ক্রমেই গরম বাড়ছে।

বাড়ির পিছনে কাঁকর বিছানো পথে পৌঁছে ফরাসিটি পিয়েরের হাত ধরে টেনে দেখিয়ে দিল, কাকর বিছানো গোলাকার জায়গায় আসনের নিচে গোলাপি পোশাক পরা একটি তিন বছরের মেয়ে শুয়ে আছে।

ওই তোমার শিশু! আরে, এ যে একটা মেয়ে, তাহলে তো আরো ভালো! ফরাসিটি বলল। বিদায় হে। মোটা! আমাদেরও মানুষের মতোই ব্যবহার করতে হয়; কি জান, আমরা সকলেই তো মরণশীল। কথাগুলি বলে লোকটি তার সহকর্মীদের দিকে ছুটে গেল।

আনন্দে রুদ্ধশ্বাস পিয়ের ছুটে গিয়ে ছোট মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে গেল। কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষকে দেখে রুগ্ন, গলা ফোলা মেয়েটি চিৎকার করে ছুটতে আরম্ভ করল। পিয়ের অবশ্য তাকে ধরে কোলে তুলে নিল। মেয়েটি বেপরোয়াভাবে চেঁচাতে চেঁচাতে পিয়েরের হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্য তাকে আঁচড়াতে-কামড়াতে শুরু করে দিল। কোনো নোংরা জন্তুকে ছোঁবার মতোই পিয়েরের মনে আতঙ্ক ও বিরক্তি দেখা দিল। তবু মেয়েটিকে ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে তাকে নিয়ে বড় বাড়িটার দিকে ছুটে গেল। অবশ্য যেপথে সে এসেছিল এখন সেপথে ফিরে যাওয়া অসম্ভব; দাসী আনিস্কা সঙ্গে নেই; করুণা ও বিরক্তির মিশ্র অনুভূতিতে ক্রন্দনরত ভেজা মেয়েটিকে যথাসম্ভব আদরের সঙ্গে বুকে চেপে ধরে পিয়ের আর একটা পথের খোঁজে বাগানের ভিতর দিয়ে ছুটতে লাগল।

.

অধ্যায়-৩৪

নানা উঠোন ও গলি দিয়ে ছুটতে ছুটতে ছোট বোঝাটি নিয়ে পিয়ের পোভাস্কয়ের এক কোণে অবস্থিত গ্রুজিনস্কি বাগানে ফিরে এল। প্রথমে সে জায়গাটা চিনতেই পারেনি, কারণ বিভিন্ন বাড়ি থেকে টেনে বের করা মালপত্রে ও লোকজনের ভিড়ের জায়গাটা এখন ভিড়ে ভিড়াক্কার। মালপত্রসহ অনেক রুশ পরিবার ছাড়া বিচিত্র পোশাক পরা কিছু ফরাসি সৈন্যও সেখানে ভিড় করেছে। পিয়ের তাদের দিকে ফিরেও চাইল না। মেয়েটিকে মার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি অন্য কাউকে বাঁচাতে যাবার জন্য সেই সরকারি কর্মচারীর পরিবারটিকেই সে খুঁজতে লাগল। এখনো তার অনেক কিছু করার আছে, আর সেটা তাড়াতাড়িই করতে হবে। আগুনের তাপে ও ছুটে আসার জন্য তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে; এইমুহূর্তে তার মধ্যে যেন ফিরে এসেছে যৌবনের শক্তি, উদ্দীপনা ও সংকল্পের দৃঢ়তা। মেয়েটি এখন শান্ত হয়েছে; ছোট ছোট হাত দিয়ে পিয়েরের কোটটা চেপে ধরে একটা ছোট বন্য পশুর মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। পিয়ের মাঝে মাঝে হেসে তার দিকে তাকাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, সেই ভয়ার্ত, রুগ্ন ছোেট মুখখানিতে সে যেন একটা সকরুণ নিষ্পাপ কিছু দেখতে পাচ্ছে।

সরকারি কর্মচারী অথবা তার স্ত্রীকে কোথাও খুঁজে পেল না। বড় বড় পা ফেলে ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সে সকলেরই মুখটা ভালো করে দেখতে লাগল। আপনা থেকেই একটি জর্জীয় বা আর্মেনীয় পরিবারের দিকে তার নজর গেল। পরিবারে মোট তিনটি মানুষ; একটি অতীব সৌম্যদর্শন প্রাচ্য দেশীয় বৃদ্ধ; পরনে কাপড়ে-ঢাকা ভেড়ার চামড়ার নতুন কোট ও নতুন বুট; অনুরূপ চেহারার একটি বৃদ্ধা ও একটি যুবতী। যুবতীটির কালো বাঁকা ভুরু, লম্বা, সুন্দর, ভাবলেশহীন মুখে অসাধারণ উজ্জ্বলতা। পিয়েরের মনে হল সে যেন প্রাচ্য সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। খোলা জায়গায় ইতস্তত ছড়ানো জিনিসপত্র ও লোকজনের মাঝখানে দামি সাটিনের জোব্বা ও উজ্জ্বল লিলাক রঙের শাল পরে সে বসে আছে; দেখে মনে হচ্ছে যেন একটি সুন্দর, সতেজ স্পষ্টতই বিদেশী গাছকে এনে বরফের বুকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্টতই নিজের রূপ সম্পর্কে সে সচেতন এবং সেজন্য ভীতও বটে। তার মুখটা পিয়েরের বড় ভালো লাগল, বেড়ার পাশ দিয়ে দ্রুত পায়ে যেতে যেতেও বারকয়েক সে তার দিকে ফিরে তাকাল। বেড়ার ধারে পৌঁছেও যাদের খুঁজছে তাদের না পেয়ে সে থেমে চারদিকে তাকাল।

মেয়েটি কোলে থাকায় সকলেরই দৃষ্টি পড়ছে তার উপর। একদল রুশ নরনারী তার চারদিকে ভিড় করে দাঁড়াল।

তারা শুধাল, আপনার কি কেউ হারিয়েছে? আপনি তো একজন ভদ্ৰশ্রেণীর লোক, তাই না? এটি কার মেয়ে?

জবাবে পিয়ের ব্যাপারটা খুলে বলে জানতে চাইল তারা কেউ সেই স্ত্রীলোকটিকে চেনে কি না।

একটি বুড়ো ডিয়েকন বলল, আরে, নিশ্চয় আনফেরভরা হবে। প্রভুর অনেক দয়া, প্রভুর অনেক দয়া!

একটি স্ত্রীলোক বলল, আনফেরভরা? না। তারা তো সকলেই চলে গেছে। এটি নিশ্চয় মারি নিকলায়েভনা অথবা আইভানভনাদের মেয়ে হবে!

একজন গৃহ-ভৃত্য বলল, উনি বলছেন একটি স্ত্রীলোক, কিন্তু মারি নিকলায়েভনা তো একটি মহিলা।

পিয়ের বলল, তোমরা তাকে চেন? শুটকো চেহারা, লম্বা দাঁত।

নিশ্চয় মারি নিকলায়েভনা! ওই নেকড়ের দল যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন তারা বাগানের ভিতরে চলে এসেছিল, ফরাসি সৈন্যদের দেখিয়ে স্ত্রীলোকটি বলল।

হে প্রভু, দয়া কর! ডিয়েকন বলল।

ওদিকে চলে যান, ওরা সেখানেই আছে। নিশ্চয় সে। সে তো অনবরত হা-হুঁতাশ করছে আর কাঁদছে। স্ত্রীলোকটি বলতে লাগল। নিশ্চয় সেই হবে। এই যে, এদিকে!

কিন্তু তার কথা পিয়েরের কানে গেল না। কয়েক পা দূরে যে কাণ্ডটা ঘটছে কয়েক সেকেন্ড ধরে সেটাই সে দেখছে। সেই আর্মেনীয় পরিবার ও দুটি ফরাসি সৈনিককেই সে দেখছে। সৈনিকদের একজন ছোটখাট, চটপটে, পরনের নীল কোটটা কোমরের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা, মাথায় রাত-টুপি, খালি পা। অপর জনের চেহারাটাই বিশেষ করে পিয়েরের নজরে পড়েছে; লোকটি লম্বা, লিকলিকে, গোল কাঁধ, ভালো চুল, ধীর গতি, আর মুখে একটা বোকা-বোকা ভাব। পরনে মেয়েদের ঢিলে পশমি ঘাঘরা, নীল ট্রাউজার ও বড়, ছেঁড়া চটের বুট। খালি পা, ছোটখাট, নীলকোট পরা ফরাসিটি আর্মেনীয়দের কাছে গিয়ে কি যেন বলেই বুড়ো মানুষটির পা চেপে ধরল, আর সেও সঙ্গে সঙ্গে বুট জোড়া খুলতে শুরু করল। পশমি ঘাঘরাপরা অপর ফরাসিটি সুন্দরী আর্মেনীয় মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত পকেটে ঢুকিয়ে নীরব ও নিশ্চলভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ বাচ্চাকে সেই স্ত্রীলোকটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পিয়ের বলল, এই যে, মেয়েটিকে নাও? ওর বাপ মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিও! ক্রন্দনরতা মেয়েটিকে মাটিতে নামিয়ে রেখে পিয়ের আবার সেই ফরাসি সৈনিক ও আর্মেনীয় পরিবারের দিকে ফিরে তাকাল।

বুড়ো লোকটি ইতিমধ্যেই খালি পা হয়ে বসে আছে। ছোটখাট ফরাসিটি দ্বিতীয় বুটটা হাতিয়ে নিয়ে দুটো বুটে ঠোকাঠুকি করছে। বুড়ো লোকটি কান্না-ভাঙা গলায় কি যেন বলছে, কিন্তু পিয়ের একনজর সেদিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল; তার সমস্ত মনোযোগ তখন পশমী ঘাঘরাপরা ফরাসিটির উপর নিবদ্ধ; সে তখন ঈষৎ দুলতে দুলতে যুবতীটির আরো কাছে এগিয়ে গেছে। পকেট থেকে হাত দুটি বের করে মেয়েটির গলা চেপে ধরেছে।

আর্মেনীয় সুন্দরীটি তখনো নিশ্চল হয়ে একই ভঙ্গিতে বসে আছে; চোখের দীর্ঘ পাতা দুটি নেমে এসেছে; যেন সৈনিকটি তাকে নিয়ে কি করছে তা সে দেখছেও না, বুঝছেও না।

পিয়ের তাদের কাছে ছুটে যেতেই পশমী ঘাঘরাপরা লম্বা লুঠেরাটা আর্মেনীয় যুবতীর গলার নেকলেস ধরে টান দিয়েছে, আর যুবতীটি গলাটা চেপে ধরে তারস্বরে চিৎকার করছে।

ঘাড় ধরে সৈনিকটিকে একপাশে ঠেলে দিয়ে পিয়ের কর্কশ গলায় বলে উঠল, মেয়েটিকে ছেড়ে দাও!

সৈনিকটি মাটিতে পড়েই উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তার বন্ধুটি বুটজোড়া ফেলে দিয়ে তলোয়ার বের করে রুদ্র মূর্তিতে পিয়েরের দিকে এগিয়ে গেল।

চিৎকার করে বলল, এদিকে তাকাও, একটিও বাজে কথা নয়!

পিয়ের তখন এত রেগে গেছে যে সে সবকিছু ভুলে গেল, তার শক্তি যেন দশগুণ বেড়ে গেল। খালি পা ফরাসিটির দিকে ধেয়ে গিয়ে সে তলোয়ার তুলবার আগেই একঘুষিতে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ঘুষির পর ঘুষি চালাতে লাগল। ভিড়ের ভিতর থেকে তার সহর্ষ জয়ধ্বনি উঠল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ফরাসি উহলানদের একটি অশ্বারোহী পাহারা-বাহিনী মোড় ঘুরে সেখানে এসে হাজির হল। উহলানরা জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে পিয়ের ও ফরাসি সৈনিকটিকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর কি হল কিছুই পিয়েরের মনে নেই। শুধু মনে আছে, সে যেন কাকে মারল, আর নিজেও তার হাতে মার খেল, এবং শেষপর্যন্ত তার হাত দুটি বেঁধে ফেলা হল, এবং একদঙ্গল ফরাসি সৈনিক তাকে ঘিরে ধরে তার শরীরটা খুঁজে খুঁজে দেখছে।

লেফটেন্যান্টের কাছে একখানা ছুরি আছে, সর্বপ্রথম এই কথাগুলিই পিয়ের বুঝতে পারল।

অ্যাঁ, একটা অস্ত্র? এই কথা বলে অফিসার খালি পা সৈনিকটির দিকে মুখ ফেরাল; তাকেও পিয়েরের সঙ্গেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঠিক আছে, তোমার যা বক্তব্য তা সামরিক আদালতেই বল। সে পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তুমি ফরাসি বলতে পার?

রক্তবর্ণ চোখ তুলে পিয়ের চারদিকে তাকাল, কোনো জবাব দিল না। তার মুখটা নিশ্চয় ভয়ংকর দেখাচ্ছে কারণ অফিসার ফিসফিস করে কিছু বলতেই আরো চারজন উহলান দল ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে পিয়েরের দু পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

পিয়েরের বেশ কিছুটা দূরে থেকে অফিসার আবার শুধাল, তুমি ফরাসি বলতে পার?…দোভাষীকে ডাক।

অসামরিক রুশ পোশাক পরা একটি ছোট-খাট মানুষ সেনাদলের ভিতর থেকে ঘোড়ায় চড়ে সামনে এগিয়ে এল। তার পোশাক ও কথা বলার ভঙ্গি দেখে পিয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারল-লোকটি মস্কোর কোনো দোকানের ফরাসি দোকানদার।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিয়েরকে লক্ষ্য করে দোভাষী বলল, একে তো দেখে সাধারণ লোক বলে মনে হচ্ছে না।

আরে, একে তো দেখতে অবিকল ঘর জ্বালানিয়া লোকেরই মতো। ওকে জিজ্ঞাসা কর ও কে।

বাজে রুশ ভাষায় লোকটি শুধাল, আপনি কে? বড় কর্তার প্রশ্নের জবাব দিন।

পিয়ের হঠাৎ ফরাসিতেই জবাব দিল, আমি কে তা আপনাকে বলব না। আমি আপনার বন্দি-নিয়ে চলুন।

অফিসার ভ্রুকুটি করে তো-তো করে বলল, ও, ও! বেশ, তাহলে অগ্রসর হও।

উহলানদের ঘিরে একটা ভিড় জমে উঠেছে। পিয়েরের একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে একটি চাষী স্ত্রীলোক, সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে। সৈন্যরা সদলে রওনা হলে সে সামনে এগিয়ে গেল।

বলল, ওরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বাবা? কিন্তু এই ছোট মেয়েটা, এই ছোট মেয়েটা যদি তার না হয় তাহলে একে নিয়ে আমি কি করব?

ওই স্ত্রীলোকটি কি চায়? অফিসার জানতে চাইল।

পিয়ের যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যে ছোট মেয়েটিকে সে উদ্ধার করেছে তাকে দেখে তার বড়ই আনন্দ হল।

সে অস্ফুট গলায় বলল, ও কি চায়? ও আমার মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে; এইমাত্র তাকে আমি আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়েছি।…বিদায়! এই উদ্দেশ্যহীন, মিথ্যা কথাটা কেমন করে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল তা বুঝতে না পেরে সে বিজয়ীর দৃঢ় পদক্ষেপে ফরাসি সৈন্যদের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলল।

লুঠতরাজ থামাবার জন্য এবং বিশেষ করে যারা এই অগ্নিকাণ্ডের নায়ক-জনসাধারণের মতে তাদের বেশির ভাগই সেদিন এসেছিল ঊধ্বতন ফরাসি অফিসারদের ভিতর থেকেই তাদের ধরবার জন্য দুরোসনেলের হুকুমে মস্কোর বিভিন্ন রাস্তায় যেসব প্রহরীদল পাঠানো হয়েছিল, এই ফরাসি প্রহরীদল তাদেরই একটি। অনেক রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রহরীদল সন্দেহক্রমে আরো পাঁচজন রুশকে গ্রেপ্তার করল : একটি ছোট দোকানদার, দুটি ছাত্র, একজন চাষী ও একজন গৃহ-ভৃত্য; তাছাড়া কিছু লুঠেরাও ছিল। কিন্তু এইসব নানা ধরনের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে পিয়েরকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল সবার চাইতে সন্দেহভাজন বলে। সেই রাতে তাদের সকলকে যখন নিয়ে আসা হল জুবভ প্রাচীরের উপরে অবস্থিত সেই বড় বাড়িটাতে যেটাকে রক্ষীনিবাস রূপে ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন কড়া পাহারায় পিয়েরকে রাখা হল সকলের থেকে আলাদা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *