১১.১ গতির পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতা

তৃতীয় খণ্ড – একাদশ পর্ব – অধ্যায়-১

গতির পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতা মানুষের পক্ষে বোধগম্য নয়। গতির যে কোনো নিয়ম মানুষের কাছে তখনই বোধগম্য হয়ে ওঠে যখন গতির যে কোনো একটা নির্বাচিত অংশকে বেছে নিয়ে সেটাকে সে জানতে চেষ্টা করে। প্রাচীন মানুষদের একটা সুপরিচিত ধাঁধা প্রচলিত আছে যে, একটা কচ্ছপ অপেক্ষা দশ গুণ দ্রুতগতিতে ছুটতে পারা সত্ত্বেও আকিলিস কখনো সেই কচ্ছপটাকে অনুসরণ করে তাকে ধরে ফেলতে পারবে না। আকিলিসি যতক্ষণে তার ও কচ্ছপটার মাঝখানের ব্যবধানটাকে পার হবে ততক্ষণে কচ্ছপটা আরো দশ ভাগের একভাগ দূরত্ব এগিয়ে যাবে : আকিলিস যতক্ষণে সেই দশম ভাগটি পার হবে ততক্ষণে কচ্ছপটা এগিয়ে যাবে আরো একশো ভাগের এক ভাগ, এবং এইভাবে অনন্তকাল ধরেই ব্যবধানটা থেকেই যাবে। প্রাচীনকালের মানুষদের কাছে এ সমস্যাটা ছিল সমাধানের অতীত। আকিলিস যে কোনো দিনও কচ্ছপটাকে ধরতে পারবে না এই অবাস্তব সিদ্ধান্তের কারণটা নিম্নরূপ : গতিকে ইচ্ছাকৃতভাবে কতকগুলি খণ্ড খণ্ড অংশে ভাগ করে দেখা হত, অথচ আকিলিস ও কচ্ছপ দুজনের গতিই আসলে ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন।

গতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে আমরা সমস্যার একটা সমাধানের কাছাকাছি যেতে পারি মাত্র, কখনো সেখানে পৌঁছতে পারি না। যখন আমরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতমের ধারণা, একদশমাংশের সমানুপাতিক জ্যামিতিক হ্রাস-বৃদ্ধি ধারণা, এবং অনন্ত পর্যন্ত সেই হ্রাস-বৃদ্ধির যোগফলের ধারণা করতে পারব তখনই এ সমস্যার সমাধানও আমরা পেয়ে যাব।

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতমকে নিয়ে আলোচনার কৌশল অর্জন করার ফলে গণিতশাস্ত্রের একটি আধুনিক শাখা এখন গতিসংক্রান্ত এমন সব জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে যাকে একদিন সমাধানের অতীত বলে মনে করা হত।

প্রাচীনকালে অজ্ঞাত গণিতশাস্ত্রের এই আধুনিক শাখা গতিসংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনার সময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতমের ধারণাকে স্বীকার করে, সমর্থন করে গতির পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতাকে এবং তার ফলে ধারাবাহিক গতির আলোচনা না করে গতির স্বতন্ত্র অংশ নিয়ে আলোচনা করার দরুন যে অনিবার্য ভুলকে মানুষ এড়িয়ে চলতে পারে না তাকে সংশোধন করতে সক্ষম হয়েছে।

ঐতিহাসিক অগ্রগতির নিয়মকে খুঁজতে গিয়েও সেই একই ব্যাপার ঘটে। অসংখ্য মানুষের ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত মানবতার গতিপথও ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন।

এই ধারাবাহিক অগ্রগতির নিয়মকে জানাই ইতিহাসের লক্ষ্য। সকল মানুষের ইচ্ছার যোগফল থেকে উদ্ভূত সেইসব নিয়মকে জানবার চেষ্টায় মানুষের মন কতকগুলি ইচ্ছাকৃত, বিচ্ছিন্ন একককে ধরে নেয়। ইতিহাসের প্রথম পদ্ধতিই হল ধারাবাহিক ঘটনাবলী থেকে একটি নির্বাচিত অংশকে বেছে নিয়ে অন্য ঘটনা থেকে আলাদা করে তাকে বিচার করা, যদিও ঘটনার সূচনা বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না, কারণ একটা ঘটনা নিরবচ্ছিন্নভাবে অপর একটি ঘটনা থেকেই প্রবাহিত হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় পদ্ধতি হল কোনো একজন মানুষের-রাজা অথবা সেনাপতির কার্যাবলীকে বহু মানুষের ইচ্ছার যোগফলের সমান বলে বিবেচনা করা, অথচ যে কোনো একটি ঐতিহাসিক ব্যক্তির কাজের ভিতর দিয়ে বহু মানুষের ইচ্ছার যোগফল কখনো প্রকাশিত হয় না।

সত্যের কাছাকাছি পৌঁছবার চেষ্টায় ইতিহাস-বিজ্ঞান ক্রমাগত ছোট ছোট একককে নিয়ে পরীক্ষা করে। কিন্তু সে এককটি যত ছোটই হোক, আমরা মনে করি যে একটি একককে অন্যগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করা, অথবা কোনো ঘটনার সূচনা আছে বলে ধরে নেওয়া, অথবা এ কথা বলা যে কোনো একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপের ভিতর দিয়ে বহু মানুষের ইচ্ছা প্রকাশিত হয়–আসলে এসবই মিথ্যা।

ইতিহাসের যে কোনো সিদ্ধান্তকে ধুলায় লুটিয়ে দিতে কোনোরকম কঠিন বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন হয় না। যে কোনো একটি বড় একককে বেছে নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতম একককে গ্রহণ করলে এবং তাদের সংগঠিত করে তোলার কৌশলটি অধিগত করতে পারলেই আমরা ইতিহাসের নিয়মে পৌঁছতে পারব বলে আশা করতে পারি।

.

ইওরোপে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পনেরটি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের এক অসাধারণ আন্দোলন নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মানুষ তাদের চিরাচরিত কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছে, ইওরোপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গেছে, পরস্পরকে লুঠ করেছে ও হত্যা করেছে, কখনো জয়লাভ করেছে আবার কখনো নিরাশায় ডুবে গেছে, আর বেশ কয়েক বছর ধরে জীবনের গতিটাই পাল্টে গেছে, একটা ব্যাপক গতি কখনো দ্রুত হয়েছে, কখনো হয়েছে মন্থর। এই আন্দোলনের কারণ কি, কোন নিয়মে এটা পরিচালিত হয়েছে? সে প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে।

এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ইতিহাসকাররা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে প্যারিস নগরীর একটি ভবনের কয়েক ডজন মানুষের বাণী ও কার্যাবলী, আর সেই বাণী ও কার্যাবলীর নাম দিয়েছে বিপ্লব, তারপর তারা আমাদের দিয়েছে স্বয়ং নেপোলিয়নের এবং তার সমর্থক ও বিরোধী কিছু মানুষের বিস্তারিত জীবনী, আর অন্যদের উপর এইসব মানুষের প্রভাবের কথা শুনিয়ে আমাদের বলেছে : এই কারণেই এই আন্দোলন ঘটেছে, এবং এগুলিই তার কারণ।

কিন্তু মানুষের মন শুধু যে এ ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করতে চায়নি তাই নয়, বরং পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে এ ব্যাখ্যা ভ্রান্ত, কারণ এখানে একটি দুর্বলতর ঘটনাকে একটি অধিকতর শক্তিশালী ঘটনার কারণ বলে ধরা হয়েছে। বহু মানুষের ইচ্ছা থেকেই জন্ম নিয়েছে নেপোলিয়ন ও বিপ্লব, আর সেই মানবিক ইচ্ছার যোগফলই প্রথমে তাদের সহ্য করেছে এবং পরে তাদের ধ্বংস করেছে।

ইতিহাসে লেখা হয়েছে, যখনই কোনো বিজয়-অভিযান হয়েছে, তখনই দেখা দিয়েছে দিগ্বিজয়ী, যখনই কোনো রাজ্যে কোনো বিপ্লব ঘটেছে, তখনই মহাপুরুষরা দেখা দিয়েছে। কিন্তু মানুষ বিচার-বুদ্ধি বলে, একথা ঠিক যে যখনই দিগ্বিজয়ীরা দেখা দেয় তখনই যুদ্ধ হয়ে থাকে, কিন্তু তাতে একথা প্রমাণ হয় না যে বিজয়ী বীররাই যুদ্ধ ঘটায় এবং কোনো একটি মানুষের ব্যক্তিগত ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যুদ্ধের নিয়মগুলি খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি যখনই আমার ঘড়ির দিকে তাকাই আর তার কাঁটাটা থাকে দশটার ঘরে, তখনই পার্শ্ববর্তী গির্জার ঘণ্টা শুনতে পাই, কিন্তু তার থেকে আমি এটা ধরে নিতে পারি না যে যেহেতু ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে গেলেই ঘণ্টাটা বাজতে শুরু করে, সেই হেতু ঘড়ির কাঁটার অবস্থানের ফলেই ঘণ্টাটা বাজে।

যখনই একটা যন্ত্র-যানকে চলতে দেখি তখনই একটা হুইসেল শুনতে পাই এবং দেখতে পাই যে ভালভগুলো খুলছে আর চাকাগুলি ঘুরছে, কিন্তু তাই বলে আমি অনুমান করতে পারি না যে হুইসেলের শব্দ ও চাকার ঘূর্ণনই এঞ্জিনটার চলার কারণ।

চাষীরা বলে থাকে, ওক গাছে ফুল ফোটে বলেই শেষ বসন্তে ঠাণ্ডা বাতাস বয়, আর বাস্তবক্ষেত্রেও ওক গাছে ফুল ফুটতে শুরু করলেই বসন্তকালের ঠাণ্ডা বাতাস বইতে থাকে। কিন্তু ওক-কুঁড়িরা পাপড়ি মেললেই কেন যে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করে তা না জানলেও আমি কিন্তু চাষীদের সঙ্গে একমত নই যে ওক কুঁড়িদের ফুটে ওঠাই ঠাণ্ডা বাতাসের কারণ। জীবনের অন্য সব ঘটনার মতোই সেখানেও আমি দেখতে পাই ঘটনার আকস্মিক যোগাযোগমাত্র। ঘড়ির কাঁটা, ইঞ্জিনের ভালভ ও চাকা, এবং ওক গাছের দিকে যত সতর্কতার সঙ্গেই দৃষ্টিপাত করি না কেন, কোনোমতেই কিন্তু ঘণ্টা বাজবার, ইঞ্জিন চলবার ও বসন্ত-বাতাস বইবার কারণকে আবিষ্কার করতে পারব না। সেটা করতে হলে আমার দৃষ্টিকোণকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে অংকুরের, ঘণ্টার ও বাতাসের গতির নিয়মকে। ইতিহাসকেও তাই করতে হবে। আর সেই দিকেই প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

ইতিহাসের নিয়মকে জানতে হলে আমাদের পর্যবেক্ষণের বিষয়বস্তুকে সম্পূর্ণ পাল্টাতে হবে, রাজা, মন্ত্রী ও সেনাপতিদের ছেড়ে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে সেইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের দিকে যা জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করে। এই পথে ইতিহাসের নিয়মকে বুঝবার পথে মানুষ কতদূর অগ্রসর হতে পারবে তা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু একথা ঠিক যে একমাত্র এই পথেই ইতিহাসের নিয়ম আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে, এবং রাজা, সেনাপতি ও মন্ত্রীদের কার্যকলাপের বর্ণনায় এবং সে সম্পর্কে তাদের ভাবনাচিন্তার কথা বলতে ইতিহাসকাররা যতটা মানসিক প্রচেষ্টা নিয়োগ করেছে, তার লক্ষ ভাগের এক ভাগও এইদিকে প্রয়োগ করা হয়নি।

.

অধ্যায়-২

 ইওরোপের একডজন দেশের সৈন্যদল রাশিয়াকে লক্ষ্য করে ছুটে এসেছে। তারা স্মোলেনস্কে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত এবং পরে স্মোলেনস্ক থেকে বরদিনো পর্যন্ত রুশ বাহিনী ও জনগণ ওরকম সংঘর্ষকে এড়িয়েই চলছে। ফরাসি বাহিনী তাদের লক্ষ্য মস্কোর দিকে এগিয়ে চলেছে, একটা পতনশীল বস্তু যত পৃথিবীর দিকে নেমে আসে ততই তার গতিবেগ যেরকম বেড়ে যায়, সেই রকম ফরাসি বাহিনীও যতই তাদের লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়েছে ততই তাদের গতিবেগ বেড়েছে। পিছনে পড়ে আছে ক্ষুধায় কাতর একটি শক্ত-দেশের হাজার ভার্ল্ড জমি, সম্মুখে লক্ষ্যস্থল থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে মাত্র কয়েক ভা জমি। নেপোলিয়নের সেনাদলের প্রতিটি সৈনিক সেকথা উপলব্ধি করছে, আর নিজের আবেগেই অভিযান এগিয়ে চলেছে।

রুশ বাহিনী যত পিছিয়ে যাচ্ছে, শত্রুপক্ষের মনে ঘৃণার আগুন ততই তীব্র হিংস্রতায় জ্বলে উঠছে, এরা যত পিছিয়ে যাচ্ছে, ওদের সৈন্যসংখ্যা তত বাড়ছে, তত বেশি সংহত হচ্ছে। সংঘর্ষ বাধল বরদিনোতে। কোনো দলই ছত্রভঙ্গ হয়নি, কিন্তু অধিকতর গতিবেগ সমন্বিত কোনো গোলকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে অপর গোলকটি যেরকম অনিবার্যভাবে ছিটকে ফিরে আসে, ঠিক তেমনিভাবেই সংঘর্ষের সঙ্গে সঙ্গেই রুশ বাহিনী পশ্চাদপসরণ করল, আর ওদিকে সংঘর্ষের ফলে সব শক্তি নিঃশেষিত হওয়া সত্ত্বেও সেই গতিবেগের টানেই অভিযানের গোলকটিও সেই একই অনিবার্যতায় বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল।

রুশরা মস্কো থেকেও আশি মাইল পিছিয়ে গেল, আর ফরাসিরা মস্কো পৌঁছে সেখানেই থেমে গেল। তারপর পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে একটি যুদ্ধও হয়নি। ফরাসিরা একটুও নড়ল না। মারাত্মক আহত রক্তাক্ত জন্তু যে রকম ক্ষতস্থান চাটতে থাকে, ঠিক সেইভাবে তারা পাঁচটি সপ্তাহ মস্কোতে চুপচাপ কাটিয়ে দিল, তারপর কোনো নতুন কারণ ছাড়াই হঠাৎ পালাতে শুরু করল : কালুগা রোড পর্যন্ত ছুটে গেল এবং কোনোরকম গুরুতর যুদ্ধ ছাড়াই অধিকতর গুরুতর গতিতে ফিরে গেল শ্মলেনস্কে, স্মোলেনস্ক বেরেজিনা ছাড়িয়ে, ভিলনা ছাড়িয়ে, আরো অনেক দূরে।

২৬শে অগস্ট সন্ধ্যায় কুতুজভ ও রুশ বাহিনী ঠিক ঠিক বুঝতে পারল যে বরদিনোর যুদ্ধে তাদের জয় হয়েছে। সেই সংবাদই কুতুজভ সম্রাটকে পাঠাল। শত্রুকে একেবারে খতম করতে সে নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে সেনাদলকে নির্দেশ দিল, কাউকে ঠকাবার জন্য সে একাজ করেনি, কিন্তু এই যুদ্ধে যোগদানকারী অন্য সকলের মতোই সেও জানত যে শত্রুপক্ষ পরাস্ত হয়েছে।

কিন্তু সেদিন সারা সন্ধ্যায় এবং পরের দিন একের পর এক অশ্রুতপূর্ব ক্ষতির সংবাদ আসতে লাগল, খবর এল যে অর্ধেক সৈন্য নষ্ট হয়েছে, কাজেই নতুন করে যুদ্ধ করা একেবারেই অসম্ভব।

যতক্ষণ পর্যন্ত না আরো সংবাদ পাওয়া হচ্ছে, আহতদের এক জায়গায় করা হচ্ছে, নতুন করে রসদ সরবরাহ করা হচ্ছে, নিহতদের সংখ্যানিরূপিত হচ্ছে, নিহত অফিসারদের জায়গায় নতুন অফিসার নিয়োগ করা হচ্ছে, এবং সৈনিকদের উপযুক্ত খাদ্য ও ঘুমের ব্যবস্থা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করা অসম্ভব। এদিকে যুদ্ধের ঠিক পরদিন সকালেই ফরাসি বাহিনী নিজের গতিবেগের তাগিদেই রুশ বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল, কুতুজভের মনেও আক্রমণের ইচ্ছা জাগল, আর গোটা বাহিনীরও সেই একই ইচ্ছা। কিন্তু একটা আক্রমণের জন্য ইচ্ছাটাই তো যথেষ্ট নয়, আক্রমণ করতে হলে তার সম্ভাবনাটা অন্তত থাকা চাই, কিন্তু সেই সম্ভাবনা তখন ছিল না। একটি দিনের পশ্চাদপসরণ স্থগিত রাখা তখন অসম্ভব, ঠিক সেই একইভাবে তার পরের দিন এবং তৃতীয় দিনও পশ্চাদপসরণ স্থগিত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল, এবং শেষপর্যন্ত ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে সেনাবাহিনী যখন মস্কোর কাছাকাছি পৌঁছল, তখনো সেনাদলের সর্বস্তরের মনোবল যতই শক্ত থাকুক, ঘটনার চাপে তাকে মস্কো ছাড়িয়ে সরে যেতে হল। সেনাদল আরো একটা দিন পিছু হটে মস্কোকে শক্রর হাতে ফেলে দিয়ে সরে গেল।

যে সমস্ত লোক ভাবতে অভ্যস্ত যে অভিযান ও যুদ্ধের নক্সা সেনাপতিরাই তৈরি করে থাকে–যেমন পড়ার ঘরে একটা মানচিত্র সামনে নিয়ে আমরাও কল্পনা করতে পারি একজন সেনাপতি এ-যুদ্ধ অথবা সে-যুদ্ধের কি ব্যবস্থা করবে তাদের সামনে কিন্তু এই প্রশ্নগুলি দেখা দেয় : পশ্চাদপসরণের কালে কুতুজভ এটা বা ওটা করল না কেন? ফিলিতে পৌঁছবার আগেই কেন সে একটা ঘাঁটি স্থাপন করল না? মস্কোকে ফেলে রেখে কেন সে সঙ্গে সঙ্গেই কালুগা রোড ধরে হটে গেল না? ইত্যাদি। সেরকম ভাবতে অভ্যস্ত লোকরা ভুলে যায়, অথবা জানেই না, যে একজন প্রধান সেনাপতির কর্মধারা কতকগুলি অনিবার্য পরিস্থিতির দ্বারা সীমিত। আমরা মনে করি যে কোনো একটি বিশেষ ঘটনা থেকেই একজন প্রধান সেনাপতির কাজ শুরু হয়, কিন্তু সেটা ঠিক নয়। প্রধান সেনাপতিকে সবসময়ই থাকতে হয় নিয়ত পরিবর্তনশীল একটি ঘটনাস্রোতের মাঝখানে, কাজেই কোনো একটি মুহূর্তের ঘটনা পরিপূর্ণ তাৎপর্যকে সে ধরতে পারে না। প্রতিমুহূর্তে আমাদের অগোচরে ঘটনাটির রূপ বদলায়, আর সেই পরিবর্তনশীল ঘটনাস্রোতের মাঝখানে প্রতিটি মুহূর্তে প্রধান সেনাপতিকে কাটাতে হয় ষড়যন্ত্র, দুশ্চিন্তা, জরুরি অবস্থা, কর্তৃপক্ষ, পরিকল্পনা, ভীতি-প্রদর্শন ও প্রবঞ্চনার এক জটিল আবর্তের মধ্যে, পরস্পরবিরোধী অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর তাকে অনবরত দিতে হয়।

সামরিক পণ্ডিতরা বলে থাকেন, ফিলি পৌঁছবার আগেই তার সেনাদলকে কালুগা রোডে সরিয়ে নেওয়াই কুতুজভের উচিত ছিল, কেউ নাকি সেরকম প্রস্তাবও তার কাছে করেছিল। কিন্তু একজন প্রধান সেনাপতির কাছে তো একটি মাত্র প্রস্তাব থাকে না, থাকে ডজনখানেক প্রস্তাব, বিশেষ করে কোনো সংকট-কালে তো কথাই নেই। আবার সেসব প্রস্তাবও সমর-কৌশলের দিক থেকে পরস্পরবিরোধীই হয়ে থাকে।

মনে হতে পারে যে সেই সব প্রস্তাবের ভিতর থেকে একটি বেছে নেওয়াই প্রধান সেনাপতির কাজ। কিন্তু তাও সে করতে পারে না। ঘটনা ও সময় তো বসে থাকে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ২৮ তারিখে তাকে বলা হল যে কালুগা রোড পার হয়ে যাওয়া হোক, কিন্তু ঠিক সেইমুহূর্তে একজন অ্যাডজুটান্ট মিলরাদভিচ থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে জানতে চাইল, সে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না পিছু হটে যাবে। সেইমুহূর্তেই তাকে একটা জবাব দিতে হবে। আর পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেওয়া মানেই কালুগা রোড পার হয়ে সরে যাওয়া। সেই অ্যাডজুটান্টের পরেই রসদ-সরবরাহ-অধ্যক্ষ এসে শুধাল, খাদ্য-ভাণ্ডারকেও সঙ্গে নেওয়া হবে কিনা, হাসপাতালের প্রধান এসে জানতে চাইল, আহতদের কোথায় রাখা হবে, সংবাদবাহক পিটার্সবুর্গ থেকে সম্রাটের যে চিঠি নিয়ে এল তাতে দেখা গেল মস্কো ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব, প্রধান সেনাপতির যে প্রতিদ্বন্দ্বীটি সব সময় তাকে প্যাঁচে ফেলতে চেষ্টা করছে (মাত্র একটি নয়, সেরকম লোক বেশ কয়েকজন আছে) সে এমন একটা নতুন পরিকল্পনা এনে হাজির করল যেটা কালুগা রোডের দিকে যাবার সম্পূর্ণ বিপরীত, তাছাড়া নিজের শক্তি বজায় রাখবার জন্য প্রধান সেনাপতির নিজেরও তো আহার-নিদ্রার প্রয়োজন আছে। আছে আরো হরেক রকম ঝামেলা। একজন মাননীয় সেনাপতি এসে পুরস্কার-বিতরণের ব্যাপারে তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে নালিশ জানাল, জেলার অধিবাসীরা তাদের জন্য রক্ষা-ব্যবস্থার আবেদন করল, স্থানীয় অঞ্চল পরিদর্শন করে এসে জনৈক ইন্সপেক্টর যে প্রতিবেদন পেশ করল সেটা পূর্ববর্তী আর এক অফিসারের প্রতিবেদনের সম্পূর্ণ বিপরীত, আর পর্যবেক্ষণরত গুপ্তচর কয়েদি, ও সেনাপতি এসে শত্রুপক্ষের সেনাদলের অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দাখিল করল। একজন প্রধান সেনাপতির কাজের সমালোচনা করার সময় সাধারণ মানুষ এইসব অনিবার্য পরিস্থিতিকে ভুল বোঝে, অথবা ভুলেই যায়। তাই তারা বলতে পারে যে ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে প্রধান সেনাপতি স্বাধীনভাবেই স্থির করতে পারত মস্কো ত্যাগ করে যাওয়া হবে, না তাকে রক্ষা করা হবে। অথচ মস্কো থেকে চার মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত রুশ বাহিনীর সামনে সে রকম কোনো প্রশ্নই ছিল না। সে প্রশ্নের মীমাংসা হল কখন? দ্রিসাতে, স্মোলেনঙ্কে সবচাইতে স্পষ্টভাবে ২৪শে অগস্ট শেভার্দিনোতে আর ২৪ তারিখে বরদিনোতে এবং বরদিনো থেকে ফিলিতে পশ্চাদপসরণের কালে প্রতিটি দিনে, প্রতিটি ঘণ্টায় ও প্রতিটি মিনিটে।

.

অধ্যায়-৩

কুতুজভ এমোলভকে পাঠিয়েছিল ঘাঁটি পরিদর্শনে, সে যখন ফিরে এসে ফিল্ড-মার্শালকে জানাল যে মস্কোর আগে সেখানে যুদ্ধ করা অসম্ভব, তাদের পশ্চাদপসরণ করতেই হবে, তখন কুতুজভ নীরবে তার দিকে তাকাল।

তোমার হাতটা দাও তো, বলে তার নাড়ি দেখে কুতুজভ বলল, তুমি তো সুস্থ নও হে। কি বলছ ভালো করে ভেবে দেখ।

বিনা যুদ্ধে মস্কো থেকে পিছু হটে যাবার সম্ভাবনাকে কুতুজভ মেনে নিতে পারল না।

মস্কোর দর্গমিলভ ফটক থেকে চার মাইল দূরবর্তী পকলোনি পাহাড়ের উপর কুতুজভ গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। সেনাপতিদের এক বড় দল তাকে ঘিরে ধরল, মস্কো থেকে এসে কাউন্ট রস্তপচিন তাদের সঙ্গে যোগ দিল। দলে দলে ভাগ হয়ে তারা বর্তমান পরিস্থিতির সুবিধা ও অসুবিধা, সেনাদলের অবস্থা, বিভিন্ন পরিকল্পনা, মস্কোর অবস্থা, এবং সাধারণভাবে যুদ্ধসংক্রান্ত সমস্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। যদিও এই উদ্দেশ্যে তাদের ডাকা হয়নি, যদিও কোনো সভাও ডাকা হয়নি, তবু তাদের সকলেরই এটাকে একটা সমর-পরিষদ বলেই মনে হল। সবকিছু নিয়েই প্রকাশ্য আলোচনা চলল। কেউ কোনো ব্যক্তিগত সংবাদ দিলে বা চাইলে তা ফিসফিস করে শেষ করেই আবার সাধারণ আলোচনায় ফিরে গেল। কারো মুখে তামাশার কথা নেই, উচ্চহাসি নেই, এমন কি মৃদু হাসিও নেই। অবস্থানুযায়ী সকলেই বেশ গম্ভীর। আলোচনার সময় বিভিন্ন দল প্রধান সেনাপতির বেঞ্চিটার কাছাকাছিই রইল, যাতে সব কথা সে শুনতে পায়। প্রধান সেনাপতিও মন দিয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল, মাঝে মাঝে তাদের কথাগুলি আবার বলতে লাগল, কিন্তু নিজে কোনো আলোচনায় অংশ নিল না, অথবা কোনো মতামতও প্রকাশ করল না।…কুতুজভের মুখের ভাব ক্রমেই গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে উঠতে লাগল। এইসব আলোচনা থেকে একটা কথাই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল : একেবারে আক্ষরিক অর্থেই মস্কো রক্ষা করা অসম্ভব, অর্থাৎ কোনো বুদ্ধিহীন সেনাপতি যদি যুদ্ধের হুকুম দেয় তাহলে গোলমালের সৃষ্টি হবে, কিন্তু যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব জেনেও সেনাপতি কেমন করে তাদের সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাবে। যদিও বেনিংসেন তখনো মঙ্কো রক্ষার পক্ষপাতী এবং অন্যরা তাই নিয়ে আলোচনা করছে, তবু সমস্যাটা বিরোধ ও ষড়যন্ত্রের একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয়। কুতুজভ সেটা ভালোই জানে।

বেনিংসেন রুশ দেশপ্রেমের প্রকাশ হিসেবে তখনো মস্কো রক্ষার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। তার উদ্দেশ্যটা কিন্তু কুতুজভের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার : প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে বিনা যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে স্প্যারো হিলস পর্যন্ত নিয়ে আসার সব দোষ কুতুজভের মাথায় চাপিয়ে দেবে, যদি সফল হয় তাহলে কৃতিত্বটা সে নিজেই দাবি করবে, আর যদি যুদ্ধটা একেবারেই না হয় তাহলে মস্কো ছেড়ে যাবার অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে। কিন্তু সে ষড়যন্ত্রের কথা এখন বুড়ো মানুষটার মনে স্থান পেল না।

একটিমাত্র ভয়ংকর প্রশ্ন তার মনকে আচ্ছন্ন করে আছে, কিন্তু কারো কাছ থেকেই সে প্রশ্নের জবাব সে শুনতে পায়নি। তার প্রশ্নটি হল : সত্যি কি আমিই নেপোলিয়নকে মস্কো আসতে দিয়েছি, কিন্তু সে কখনো? কখন সে সিদ্ধান্ত নিলাম? গতকাল যখন প্রাতভকে পিছু হটবার হুকুম দিয়েছিলাম, তখন কি? অথবা আগের দিন সন্ধ্যায় যখন বেনিংসেনকে হুকুম জারি করতে বলে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখন? নাকি আরো আগে?…এই ভয়ংকর ব্যাপারটা কখন স্থির হয়েছিল? মস্কো ছেড়ে চলে যেতেই হবে। সেনাবাহিনীকে পিছু হঠতে হবেই। আর সে হুকুম দিতেই হবে। কিন্তু এই ভয়ংকর হুকুম দেওয়া তো সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করারই সামিল। কিন্তু তা তো করা যায় না। তার দৃঢ় বিশ্বাস একমাত্র সেই পারবে রাশিয়াকে রক্ষা করতে, আর তাই সম্রাটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং জনগণের ইচ্ছায় তাকে প্রধান সেনাপতি মনোনীত করা হয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কঠিন পরিস্থিতিতে একমাত্র সেই পারে সেনাবাহিনীকে পরিচালনার দায়িত্ব নিতে এবং সারা বিশ্বে একমাত্র সেই পারে নির্ভয়ে অপরাজেয় নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, আর তাই সেই হুকুমটা জারি করার কথা ভাবতেই সে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটা কিছু তো করতেই হবে, আর তার চারদিকের আলোচনা যেরকম নিরঙ্কুশ হয়ে উঠছে তাতে এখনই এসব থামাতে হবে।

কয়েকজন জাদরেল সেনাপতিকে সে কাছে ডাকল।

ভালো হোক মন্দ হোক আমার মাথাটাকে নিজের উপরেই নির্ভর করতে হবে। বেঞ্চি থেকে উঠে এই কথা বলে সে ফিলির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, সেখানেই তার গাড়ি অপেক্ষা করছে।

.

অধ্যায়-৪

 আন্দ্রু সাভস্তিরানভের কুঁড়েঘরের একটা অপেক্ষাকৃত ভালো ও বড় অংশে দুটোর সময় সমর-পরিষদের সভা বসল। মস্ত বড় চাষী-পরিবারের পুরুষ, নারী ও বাচ্চারা বারান্দার ওপারে পিছনের ঘরটাতে ভিড় করল। শুধু আর ছয় বছরের নাতনি-প্রশান্ত মহামহিম নিজেই যার পিছে হাত বুলিয়ে দিয়েছে এবং চা খাবার সময় যাকে একটুকরো চিনিও দিয়েছে-সেই মলাশা রইল বড় ঘরটার ইটের উনুনের উপর। উনুনটার উপর থেকেই মলাশা সলজ্জ আনন্দের সঙ্গে সেনাপতিদের মুখ, ইউনিফর্ম ও নানারকম সম্মান-ভূষণের দিকে তাকাতে লাগল, তারা সকলেই ঘরের কোণে দেবমূর্তির নিচে চওড়া বেঞ্চিগুলোতে বসেছে। আর বুড়ো দাদু স্বয়ং মলাশা মনে মনে কুতুজভকে ওই নামেই ডাকে–আলাদা হয়ে বসেছে উনুনের পিছনে অন্ধকারের মধ্যে। একটা ভাঁজ–করা হাতল-চেয়ারে সে একেবারে ডুবে বসেছে, অনবরত গলা ঝাড়ছে, আর বোম খোলা কলারটা টানছে। যারা ঘরে ঢুকছে তারাই একে একে ফিল্ড-মার্শালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে কারো হাতটা চেপে ধরছে, আবার কারো দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছে। তার অ্যাডজুটান্ট কেসারভ কুতুজভের সামনেকার জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে রেগে হাতটা নাড়াতেই কেসারভ বুঝতে পারল প্রশান্ত মহামহিম চান না যে তার মুখটা দেখা যাক।

একে একে সভায় হাজির হল-এর্মোলাভ, কোরভ ও তল, সকলের সামনে কসেছে বার্কলে দ্য তলি। তার গলায় ঝুলছে সেন্ট জর্জের ক্রশ, মুখটা ম্লান ও অসুস্থ, দুদিন যাবৎ জ্বর হচ্ছে, এখানে শীতে কাঁপছে। তার পাশেই উভরভ ও ছোটখাট দখতুরভ। অপরদিকে বসে আছে কাউন্ট অস্তারম্যান তলস্তয়, নিজের চিন্তায়ই মগ্ন। রায়েভস্কি একবার কুতুজভের দিকে একবার দরজার দিকে অধৈর্য হয়ে তাকাচ্ছে। কনভনিৎসিনের মুখে একটা নরম ধূর্ত হাসি। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট মলাশার মুখেও হাসি দেখা দিল।

সকলেই বেনিংসেনের জন্য অপেক্ষা করছে। ঘাটি-পরিদর্শনের অজুহাতে সে আচ্ছা খানাটা শেষ করতে ব্যস্ত রয়েছে। চারটে থেকে ছটা পর্যন্ত সকলে তার জন্য অপেক্ষা করল, কোনোরকম আলোচনা শুরু হল না।

বেনিংসেন কুঁড়েঘরে ঢুকলে তবে কুতুজভ তার কোণটা ছেড়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে এল, কিন্তু পাছে মোমবাতির আলো মুখে পড়ে তাই বেশি কাছে এল না।

একটি প্রশ্ন দিয়েই বেনিংসেন পরিষদের সভা শুরু করল : আমরা কি বিনা যুদ্ধের রাশিয়ার প্রাচীন ও পবিত্র রাজধানী ছেড়ে যাব, না কি তাকে রক্ষা করব? অনেকক্ষণ সকলেই চুপচাপ। সকলেরই মুখ ভ্রূকুটিকুটিল, শুধু কুতুজভের ঘোৎ ঘোৎ শব্দ ও কাশির দমক সে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে। সকলের চোখই তার উপর নিবদ্ধ। মলাশাও বুড়ো দাদুর দিকে তাকাল।

বেনিংসেনের কথাগুলির ক্রুদ্ধ প্রতিধ্বনি করে হঠাৎ সে বলে উঠল, রাশিয়ার প্রাচীন ও পবিত্র রাজধানী। আপনার অনুমতি নিয়ে আমি বলতে চাই ইয়োর এক্সেলেন্সি যে একজন রুশের কাছে এ প্রশ্নের কোন অর্থই নেই। (শরীরটাকে সে সামনের দিকে একটু ঝুঁকিয়ে দিল।) এ প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে না, এটা অর্থহীন। যে প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনার জন্য এই ভদ্রলোকদের এখানে ডেকেছি সেটা সামরিক প্রশ্ন। রাশিয়াকে রক্ষা করার প্রশ্ন। বিনা যুদ্ধে মস্কো ছেড়ে দেওয়াই ভালো, না কি একটা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সেনাবাহিনী এবং মস্কো দুটোই হারাবার ঝুঁকি নেওয়া ভালো? সেই প্রশ্ন সম্পর্কে আমি আপনার অভিমত চাই। কুতুজভ আবার চেয়ারে ডুবে গেল।

আলোচনা শুরু হল। বেনিংসেন তখন ভাবেনি যে খেলায় তার হার হয়েছে। ফিলিতে একটা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ যে অসম্ভব বার্কলে ও অন্যান্যদের এই অভিমত স্বীকার করে নিয়েও রুশ দেশপ্রেম ও মস্কো-প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে প্রস্তাব করল, রাতারাতি সৈন্যদের ডান দিক থেকে বাঁ দিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, আর পরদনি ফরাসিদের দক্ষিণ ব্যুহকে আক্রমণ করা হোক। দেখা দিল মতবিরোধ, স্বপক্ষে ও বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেখানো হল। সবকিছু দেখে শুনে মলাশা কিন্তু পরিষদ কথাটার একটা ভিন্ন অর্থই বুঝল। তার মনে হল এটা যেন বুড়ো দাদু ও লম্বাকোটের (অর্থাৎ বেনিংসেনের) মধ্যে একটা ব্যক্তিগত ঝগড়ামাত্র। কথা বলতে বলতে তারা পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠছে, অবশ্য মনে মনে সে বুড়ো দাদুর পক্ষেই রইল।

কুতুজভ বলল, দ্ৰজন, কাউন্টের এই পরিকল্পনা আমি সমর্থন করতে পারি না। শত্রুপক্ষের খুব কাছাকাছি থেকে সৈন্য পরিচালনা করাটা সবসময়ই বিপজ্জনক, সামরিক ইতিহাসে এই মতের সমর্থন মিলবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ… দৃষ্টান্তের খোঁজে কুতুজভ একটু থেমে কিছু ভাবল, তারপর বেনিংসেনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হয়েছে, ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধের কথাই ধরা যাক, কাউন্টের নিশ্চয় স্মরণ আছে যে সে যুদ্ধটা…যে পুরোপুরি সফল হয়নি তার একমাত্র কারণ আমাদের সৈন্যকে নতুন করে সাজানো হয়েছিল শত্রুপক্ষের বড় বেশি নিকটে…

তারপর ক্ষণিকের নীরবতা, কিন্তু সকলেরই মনে হল সে নীরবতা বড়ই দীর্ঘ। আলোচনা নতুন করে শুরু হল, কিন্তু মাঝে মাঝেই থেমে গেল, সকলেই বুঝল যে আর বেশি কিছু বলার নেই। একটা বিরতির সময় যেন কথা বলার জন্য প্রস্তুত হতেই কুতুজভ বড় করে একটা শ্বাস টানল। সকলে তার দিকে তাকাল।

দেখুন ভদ্ৰজন, দেখছি যে ভাঙা বাসনপত্রের দাম আমাকেই দিতে হবে। কথাটা বলে সে ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ভদ্রজন, আপনাদের অভিমত শুনলাম। আপনারা কেউ কেউ আমার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু আমার সরকার ও আমার দেশ আমাকে যে কতৃত্ব দিয়েছে তার বলে আমি পশ্চাদপসরণের হুকুম দিলাম।

একথার পরে যে গাম্ভীর্য ও নীরবতার সঙ্গে সেনাপতিরা সেখান থেকে সরে পড়তে লাগল তা দেখে মনে হল যেন একটা শোকযাত্রা শেষ হয়েছে।

মলাশা অনেকক্ষণ থেকেই রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিল, উনুনের পিছন দিক দিয়ে সতর্কভাবে নেমে সেনাপতিদের পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সেনাপতিদের বিদায় দিয়ে টেবিলের উপর কনুই দুটো রেখে কুতুজভ অনেকক্ষণ বসে রইল, তার মনে সেই একই ভয়ংকর চিন্তা : কখন, কখন মস্কো ছেড়ে যাওয়াটা অনিবার্য হয়ে উঠল? এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা কখনো নেওয়া হল? এজন্য কে দোষী?

অনেক রাতে অ্যাডজুটান্ট শ্লিদার এলে তাকে বলল, আমি তো এটা আশা করিনি, এরকম যে ঘটবে তা তো ভাবিনি।

আপনার একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিত প্রশান্ত মহামহিম, শিদার বলল।

কিন্তু না! তুর্কিদের মতো এখনো যে তাদের ঘোড়ার মাংস খাওয়াটা বাকি আছে? মোটামুঠি দিয়ে টেবিলের উপর সজোরে আঘাত করে কুতুজভ সোচ্চারে বলে উঠল। তাই তাদের খেতে হবে, শুধু যদি…

.

অধ্যায়-৫

ঠিক সেই সময়ে বিনাযুদ্ধে পশ্চাদপসরণের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ মস্কো থেকে লোকাপসরণ ও মস্কো-দহন যখন চলছে সেই ঘটনার মূল উস্কানিদাতা হয়েও রস্তপচিনের আচরণ কিন্তু তখন চলেছে কুতুজভ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে।

বরদিনোর যুদ্ধের পরে বিনাযুদ্ধে মস্কো থেকে সৈন্য অপসারণ যেমন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, ঠিক ততখানি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মস্কো পরিত্যাগ ও মস্কো-দহন।

কোনোরকম যুক্তি দিয়ে নয়, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এবং আমাদের পিতৃপুরুষের মধ্যে যে অনুভূতি নিহিত রয়েছে তার অনুপ্রেরণাতেই প্রতিটি রুশ এটা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারত।

মস্কোতে যা ঘটেছে স্মোলেনস্ক থেকে শুরু করে রাশিয়ার সব শহরে ও গ্রামেও তাই ঘটেছে, অথচ রস্তপচিন তার ইস্তাহার নিয়ে কোথাও যুদ্ধে নামেনি। নিরাসক্তভাবেই সাধারণ মানুষ শত্রুর জন্য অপেক্ষা করেছে, কোনোরকম হাঙ্গামা করেনি বা পরস্পর খেয়োখেয়ি করেনি, সংকট-মুহূর্তেও ভাগ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। শত্রু কাছাকাছি এসে পড়লেই ধনীরা বিষয়-সম্পত্তি ফেলে পালিয়েছে আর গরীবরা সেখানেই থেকে গেছে এবং যা কিছু ছিল সব পুড়িয়ে দিয়েছে, ধ্বংস করেছে।

এটাই যে ঘটবে, চিরকালই ঘটবে, প্রতিটি রুশ মানুষের মনে সেই ধারণাই ছিল এবং আজও আছে। এই চেতনা এবং মস্কো বেদখল হবার একটা আশংকা ১৮১২ সালের মস্কোর রুশ সমাজের মনে ছিল। জুলাইতে এবং অগস্টের শুরুতে যারা মস্কো ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারাই প্রমাণ করেছে যে এরকম একটা আশংকা তাদের ছিল।

তাদের বলা হয়েছিল, বিপদ থেকে পালিয়ে যাওয়া লজ্জার ব্যাপার, একমাত্র ভীরুরাই মস্কো থেকে পালাচ্ছে। রস্তপচিন তার সৈন্যদের বুঝিয়েছে যে মস্কো ছেড়ে যাওয়াটা লজ্জার ব্যাপার। ভীরু বদনাম নিতে তারা লজ্জা বোধ করত, মস্কো ছেড়ে যেতে তারা লজ্জা পেত, তবু তারা মস্কো ছেড়ে গিয়েছিল কারণ তারা জানত যে তাছাড়া উপায় নেই। কেন তারা গেল? একথা মনে করা অসম্ভব যে বিজিত দেশসমূহে নেপোলিয়ন যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে তার বিবরণ শুনিয়ে রস্তপচিন তার সৈন্যদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। সর্বপ্রথম যারা মস্কো ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা সকলেই শিক্ষিত ও ধনী মানুষ, তারা তো ভালো করেই জানত যে ভিয়েনা ও বার্লিন এখনো অক্ষতই রয়েছে, নেপোলিয়নের দখলে থাকার সময় সেখানকার অধিবাসীরা তো মনোহর ফরাসিদের সঙ্গে মিলেমিশে বেশ মনের সুখেই দিন কাটিয়েছে, রুশরা, বিশেষ করে রুশ মহিলারা তো তখন ফরাসিদের খুবই পছন্দ করত।

তারা চলে গিয়েছিল কারণ মস্কোতে ফরাসি শাসন চললে অবস্থা ভালো হবে কি মন্দ হবে সে প্রশ্নই তাদের মনে আসেনি। ফরাসি শাসনাধীনে থাকার প্রশ্নই ওঠে না, সেটাই তো সবচাইতে শোচনীয় অবস্থা। বরদিনোর যুদ্ধের আগেই তারা চলে গিয়েছিল, যুদ্ধের পরে তো তাদের গতি আরো বেড়ে গিয়েছিল, যদিও রস্তপচিন মস্কোর রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেছিল যে আইবেরিয় ঈশ্বর-জননীর অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেবমূর্তিকে সঙ্গে নিয়েই যুদ্ধযাত্রা করা হবে, এমন একটা বেলুন আকাশে ওড়ানো হবে যা ফরাসিদের ধ্বংস করে ফেলবে, এছাড়া আরো অনেক আজেবাজে কথাই তার ইস্তাহারে লেখা হয়েছিল। তারা জানত যুদ্ধ যা করবার সৈন্যরাই করবে, আর তারা যদি সফল না হয় তাহলে তরুণী মহিলাদের ও গৃহভৃত্যদের মস্কোর তিন পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করালে তাতে কোনো লাভ হবে না, কাজেই তাদের সব বিষয়-সম্পত্তি শত্রুর হাতে ফেলে যেতে যত দুঃখই হোক, যেতে তাদের হবেই। এত বড় একটা সম্পদশালী নগরীকে ধ্বংস হবার জন্য শত্রুর হাতে ফেলে যাবার ভয়ংকর তাৎপর্যের কথা তারা একবারও ভাবল না, কারণ কাঠের অট্টালিকায় সমৃদ্ধ এত বড় একটা নগরী শত্রুর হাতে পরিত্যক্ত হলে তাকে তো অতি অবশ্যই পুড়িয়ে ফেলা হবে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিচার-বিবেচনা মতোই চলে গেল, অথচ তারা চলে গিয়েছিল বলেই এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে পেরেছিল যেটা চিরকালের মতো রুশ জনগণের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবের স্মারক হয়ে থাকবে। পাছে কাউন্ট রস্তপচিনের হুকুমে আটকা পড়ে যেতে হয় এই ভয়ে যে মহিলাটি জুন মাসেই তার নিগ্রো দাসদাসী ও নারী-ভড়াদের সঙ্গে নিয়ে এই ভেবে মস্কো থেকে তার সরাতভ জমিদারিতে চলে গিয়েছিল যে সে তো নেপোলিয়নের চাকরানি নয়, আসলে কিন্তু সেই মহিলাটি সত্যি সত্যি এমন একটা মহৎ কর্ম করেছিল যার ফলে বেঁচে গিয়েছিল সারা রাশিয়া দেশটা। আর কাউন্ট রস্তপচিন তো এই যারা মস্কো ছেড়ে যাচ্ছে তাদের ঠাট্টা করছে, আবার নিজেই সরকারি আপিস সরিয়ে নিচ্ছে, একবার যত রাজ্যের মাতালদের ধরে এনে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে যত সব অকেজো অস্ত্রশস্ত্র, আবার দেবমূর্তিসহ শোভাযাত্রা বের করছে, নয় তো ফাদার অগাস্তিনকে দেবমূর্তি এবং সন্তদের স্মৃতিচিহ্ন সরাতে নিষেধ করছে, মস্কোর সব ব্যক্তিগত গাড়ি আটক করে যে স্মৃতিচিহ্ন সরাতে নিষেধ করছে, মস্কোর সব ব্যক্তিগত গাড়ি আটক করে যে বেলুনটা লেপপিচ তৈরি করছে, একশো ছত্রিশটা গাড়িতে করে সেটাকে বয়ে আনছে, কখনো বা মস্কোতে আগুন ধরিয়ে দেবার ইঙ্গিত করে বলছে যে সে তার নিজের বাড়িতে আগুন ধরিয়েছে, কখনো বা তার অনাথ আশ্রমটি ধ্বংস করার জন্য তীব্র নিন্দা করে ফরাসিদের কাছে চিঠি লিখছে, আবার কখনো মস্কো পুড়িয়ে দেবে বলে বড়াই করে পরক্ষণেই সে কাজের নিন্দা করছে, কখনো হুকুম দিচ্ছে সব গুপ্তচরদের তার কাছে এনে হাজির করা হোক, আবার কখনো সেকাজ করার জন্য লোকজনদের তিরস্কার করছে, একবার সব ফরাসি অধিবাসীদের মস্কো থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার মস্কোতে গোটা ফরাসি উপনিবেশের কেন্দ্রমণি মাদাম অবার্ত চামেকে থাকবার অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু পরক্ষণেই শ্রদ্ধেয় প্রবীণ পোস্টমাস্টার ক্লিউচারভেকে বিনা দোষে গ্রেপ্তার করে নির্বাসিত করার হুকুম দিচ্ছে, এই ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোকজনদের তিন পাহাড়ে সমবেত করছে, আবার একটি লোককে খুন করবার জন্য তাদের হাতে তুলে দিয়ে পিছনের ফটক দিয়ে নিজেই সরে পড়ছে, একবার ঘোষণা করছে যে মস্কোর পতন হলে সেও আর বেঁচে থাকবে না, আবার যুদ্ধের ব্যাপারে তার নিজের মনোভাব নিয়ে অ্যালবামে কবিতা লিখছে ফরাসি ভাষায় (জন্মেছিলাম তাতার হয়ে/হতে চেয়েছিলাম রোমান/ফরাসিরা আমাকে বলত বর্বর,/আর রুশরা–জর্জেস দা)-(জর্জেস দা মলিয়েরের নাটকের একটি প্রধান চরিত্র)–কি যে ঘটছে তার কিছুই এই লোকটি বুঝত না, সে শুধু চাইত এমন কিছু করতে যাতে লোককে অবাক করে দেওয়া যায়, চাইত দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ কোনো বীরত্বপূর্ণ কাজ করতে, ছোট ছেলের মতোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনিবার্য ঘটনা নিয়ে ছেলেখেলা করতে–মস্কো ত্যাগ করে তাকে জ্বালিয়ে দিতে–আর সর্বদা চেষ্টা করত তার দুর্বল হাতে জনমতের প্রচণ্ড স্রোতকে কখনো দ্রুততর করতে, আবার কখনো আটকে দিতে, অথচ নিজেই ভেসে যেত সেই স্রোতের টানে।

.

অধ্যায়-৬

দরবারের সঙ্গে ভিলনা থেকে পিটার্সবুর্গে ফিরে হেলেন খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ল। পিটার্সবুর্গে থাকতে সাম্রাজ্যের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত জনৈক গণমান্য ব্যক্তির বিশেষ অনুগ্রহ সে পেত। ভিলনাতে থাকার সময় একজন তরুণ বিদেশী প্রিন্সের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। সে যখন পিটার্সবুর্গে ফিরে এল তখন সেই গণ্যমান্য ব্যক্তিটি এবং প্রিন্স দুজনই সেখানে উপস্থিত, আর দুইজনই নিজ নিজ অধিকারে অটল। হেলেনের সামনে দেখা দিল নতুন সমস্যা-কাউকে আঘাত না দিয়ে কেমন করে দুজনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা যায়।

অন্য যে কোনো নারীর পক্ষে যেটা কঠিন, এমন কি অসম্ভব বলে মনে হতে পারত, কাউন্টেস বেজুখভা কিন্তু তাতে মোটেই বিচলিত বোধ করল না, অত্যন্ত চতুরা নারী হিসেবে তার যে খ্যাতি আছে সেটা আকরণে নয়। সে যদি লুকোছাপা করত, অথবা কৌশলে এই অসুবিধাজনক অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইত, তাহলে পরোক্ষে নিজের দোষ স্বীকার করে সে নিজেরই বিপদ ডেতে আনত। কিন্তু যে কোনো মহাপুরুষের মতোই হেলেনও খুশি মতো কাজ করতে পারে, তাই সে এমন একটা ভাব দেখাতে শুরু করল যেন সে ঠিক কাজই করছে, আর দোষ যা কিছু তা অন্যরা করছে।

তরুণী বিদেশীটি যেদিন প্রথম তাকে তিরস্কার করল সেইদিনই সুন্দর মাথাটি তুলে একটুখানি ঘুরে দৃঢ়স্বরে বলল : পুরুষের উপযুক্ত কথাটা বটে–যেমন স্বার্থপর, তেমনই নিষ্ঠুর! অন্য কিছু আমি আশাও করিনি। একটি নারী আপনার জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে, কষ্ট ভোগ করছে, আর তাই তার পুরস্কার! আমার অনুরাগ ও বন্ধুত্বের জবাবদিহি দাবি করবার কি অধিকার আপনার আছে সিয়? সেই মানুষটি আমার কাছে বাবার চাইতেও বেশি!

প্রিন্স কি যেন বলতে যাচ্ছিল, হেলেন তাকে বাধা দিল।

বলল, দেখুন, হতে পারে তিনি পিতৃসুলভ মনোভাব ছাড়াও আমার প্রতি অন্য কোনো মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু সেজন্য তো তার সামনে আমার বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না। আমি তো পুরুষ নই যে অকৃতজ্ঞতা দিয়ে দয়ার ঋণ শোধ করব! একটা কথা জেনে রাখুন মঁসিয়, আমার অন্তরে যেসব গভীর কথা আছে তার জন্য একমাত্র ঈশ্বর ও বিবেকের কাছেই আমি জবাবদিহি করে থাকি, আকাশের দিকে চোখ রেখে নিজের সুন্দর, উদ্ধত বুকের উপর হাত রেখে সে কথা শেষ করল।

কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই, আপনি আমার কথাটাও শুনুন।

আমাকে বিয়ে কর, আমি তোমার দাস হয়ে থাকব!

কিন্তু সে তো অসম্ভব!

আমাকে বিয়ে করে আপনি নিজেকে ছোট করতে পারেন না, আপনি… হেলেন কেঁদে ফেলল।

প্রিন্স তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু হেলেন হতবুদ্ধির মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল যে তার বিয়ের পথে তো কোনো বাধা থাকতে পারে না, এরকম ঘটনা তো আগেও ঘটেছে (তৎকালে এরকম ঘটনা খুব কমই ছিল, কিন্তু সে নেপোলিয়ন ও আরো কয়েকজন পদস্থ লোকের নাম করল), সে কখনো তার স্বামীর স্ত্রী হতে পারেনি, তাকে একেবারে বলি দেওয়া হয়েছে।

প্রায় বশংবদ হয়েই প্রিন্স বলল, কিন্তু আইন, ধর্ম…

আইন, ধর্ম…এই ব্যবস্থাটাই যদি তারা না করতে পারে তাহলে কিসের জন্য তাদের আবিষ্কার করা হয়েছে? হেলেন বলল।

এইরকম একটা সহজ কথা তার মনে আসেনি দেখে প্রিন্স অবাক হয়ে গেল, যীশু সমিতির পবিত্র দাদাদের কাছে সে পরামর্শ চাইল, তাদের সঙ্গে তার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল।

কয়েকদিন পরে হেলেন তার স্টোন আইল্যান্ডের পল্লীভবনে যে চমৎকার ভোজ-উৎসবের আয়োজন করল সেখানে এসে হাজির হল মঁসিয় দ্য যোবার্ত। যৌবনোত্তর এই মনোরম মানুষটির মাথাভর্তি বরফ-শাদা চুল, চোখ দুটি উজ্জ্বল কালো, পরনে ভ্রমণের পোশাক। আলোকিত বাগানে বাজনা শুনতে শুনতে যেসুইট ভদ্রলোকটি হেলেনকে বোঝাল ঈশ্বরের প্রতি, খৃস্টের প্রতি, পবিত্র অন্তরের প্রতি ভালোবাসার কথা, এবং এ জগতে ও পরলোকে একমাত্র ক্যাথলিক ধর্ম যে সান্ত্বনা দিতে পারে তার কথা। হেলেন অভিভূত হল, একাধিকবার তার চোখে এবং মঁসিয় দ্য যোবার্তের চোখে জল এল, তাদের গলা কাঁপতে লাগল। এমন সময় নৃত্য-সঙ্গীটি এসে পড়ায় হেলেনের ভবিষ্যৎ বিবেক-রক্ষকের সঙ্গে আলোচনায় ছেদ পড়ল, কিন্তু পরদিন সন্ধ্যায় সিয় দ্য যোবাৰ্ত আবার এল হেলেনের সঙ্গে নিভৃতে দেখা করতে, এবং তারপরে প্রায়ই আসতে লাগল।

একদিন সে কাউন্টেসকে একটা রোমান ক্যাথলিক গির্জায় নিয়ে গেল, সেখানে সে বেদীর সামনে নতজানু হয়ে বসল। মধ্যবয়সী মনোরম ফরাসি ভদ্রলোকটি তার মাথায় হাত রাখল, আর-পরবর্তীকালে হেলেনই বলেছে–তার মনে হল একটা মৃদু হাওয়া যেন তার অন্তরকে স্পর্শ করল। তাকে বলা হল যে এটাই মহতী করুণা।

তারপরে একজন লম্বা ফ্রক-পরা পাদরিকে তার কাছে আনা হল। তার কাছে হেলেন সব অপরাধের কথা বলল, আর পাদরিও তাকে সব পাপ থেকে মুক্তি দিল। কয়েকদিন পরেই হেলেন জেনে খুশি হল যে আসল ক্যাথলিক গির্জায় তাকে ভর্তি করে নেওয়া হয়েছে, আর কয়েকদিনের মধ্যেই পোপ স্বয়ং তার কথা শুনতে পাবে এবং তাকে একটা বিশেষ দলিল পাঠিয়ে দেবে।

কিন্তু চাতুরির খেলায় যেমন সর্বদাই ঘটে থাকে যে একজন বোকাও চতুরতর লোকের উপর টেক্কা মারে, তেমনই হেলেনও বুঝতে পারল যে এসব কিছুরই প্রধান উদ্দেশ্য হল তাকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করে যেসুইট প্রতিষ্ঠান সমূহের জন্য অর্থ আদায় করা, আর তাই সেও জিদ ধরে বসল যে টাকা-পয়সা দেবার আগেই স্বামীর কাছে থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি নেওয়া হোক। তার মতে, মানুষের কামনা-বাসনাকে পরিতুষ্ট করে কতকগুলি সম্পত্তি রক্ষা করাই হল সব ধর্মের লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যকে মনে রেখেই একদা তার ধর্ম-পিতার সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে সে প্রশ্ন করে বসল, তার বিয়েটা তার পক্ষে কতটা বাধ্যতামূলক?

গোধূলির আলোয় তারা দুজন বসে ছিল বৈঠকখানার জানালার ধারে। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। হেলেন যে শাদা পোশাকটি পরে আছে তার ভিতর দিয়ে তার কাঁধ ও বুক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভালো ভালো খাওয়া-পরার ফলে পাদরিটির চেহারার বেশ গোলগাল, চিবুকটি পরিষ্কার করে কামানো, মনোরম কঠিন মুখ, দুইখানি শাদা হাত হাঁটুর উপর ভাঁজ করা, সে হেলেনের খুব কাছাকাছি বসেছে, ঠোঁটে ফুটে উঠেছে সূক্ষ্ম হাসির রেখা, শান্ত ও সানন্দ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে হেলেনের রূপ, আর আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে নিজের মতামত বোঝাতে বোঝাতে মাঝে মাঝেই তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। হেলেনও একটা অস্বস্তিকর হাসির সঙ্গে তাকিয়ে আছে তার কোঁকড়া চুল ও পরিষ্কার করে কামানো ফোলা-ফোলা ঈষৎ কৃষ্ণাভ থুতনির দিকে, আর প্রতিমুহূর্তেই আশা করছে যে আলোচনাটা একটা নতুন মোড় নেবে। কিন্তু সঙ্গিনীটির রূপ-সুধা পান করতে থাকলেও পাদরিটি কিন্তু নিজের আলোচনার মধ্যেই ডুবে রইল।

সেসব কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে হেলেন হঠাৎ মোহময়ী হাসি হেসে বলে উঠল : কিন্তু আমি মনে করি, একটি মিথ্যা ধর্ম যে বন্ধন আমার উপর আরোপ করেছিল, সৎ ধর্মকে বরণ করার পরে তা আর আমাকে বেঁধে রাখতে পারে না।

এইভাবে কলম্বাসের ডিমের মতো সরলতার সঙ্গে ব্যাপারটাকে তার সামনে উপস্থিত করায় হেলেনের বিবেক-রক্ষকটি অবাক হয়ে গেল। ছাত্রীটির এই অপ্রত্যাশিত দ্রুত উন্নতি দেখে সে খুশি হল, কিন্তু অনেক পরিশ্রম করে বিতর্কের যে সৌধটি সে গড়ে তুলেছে তাকেও পরিত্যাগ করতে পারল না।

আগে আমাদের পরস্পরকে বুঝতে দিন কাউন্টেস, হেসে কথাটা বলে পাদরি আবার তার মানসকন্যার যুক্তিকে খণ্ডন করতে শুরু করল।

.

অধ্যায়-৭

হেলেন বুঝতে পারল, যাজকীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটা খুবই সরল ও সহজ, তার পরিচালকরা যে অসুবিধার সৃষ্টি করছে তার একমাত্র কারণ অযাজকীয় কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে সে বিষয়ে তাদের মনে সংশয় আছে।

তাই সে স্থির করল, এ ব্যাপারে সমাজের উপর মহলের মনোভাবটা প্রস্তুত তরা প্রয়োজন। বয়স্ক গণ্যমান্য লোকটির মনে ঈর্ষা জাগাতে সে অপর প্রণয়প্রার্থীকে যেকথা বলেছে সেই কথাই তাকেও বলল, অর্থাৎ সে তাকেও বোঝাল যে হেলেনের উপর যদি কোনো অধিকার পেতে হয় তাহলে তাকে বিয়ে করতেই হবে। যে নারীর স্বামী এখনো বেঁচে আছে তার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব শুনে তরুণতর প্রণয়প্রার্থীর মতোই এই গন্যমান্য ব্যক্তিটিও প্রথমে খুবই হকচকিয়ে গেল, কিন্তু হেলেন যত দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে বোঝাল যে ব্যাপারটা যে কোনো কুমারী মেয়েকে বিয়ে করার মতোই সরল ও স্বাভাবিক তখন সেও কিছুটা প্রভাবিত হল। হেলেন যদি তিলমাত্র ইতস্তত ভাব, লজ্জা, বা গোপনীয়তার লক্ষণ দেখাত তাহলেই তার খুঁটি কেঁচে যেত, কিন্তু গোপনীয়তা বা লজ্জার কোনোরকম লক্ষণ না দেখিয়ে সে পিটার্সবুর্গময় তার বন্ধুদের বলে বেড়াতে লাগল যে প্রিন্স ও গন্যমান্য ব্যক্তিটি উভয়েই তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছে, কিন্তু সে দুজনইকেই ভালোবাসে বলে কারো মনে আঘাত দিতে ভয় পাচ্ছে।

ফলে সঙ্গে সঙ্গে পিটার্সবুর্গময় যে গুজবটা ছড়াল সেটা হেলেনের স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা নয়, কথাটা হল হতভাগিনী সুন্দরী হেলেন সন্দেহের দোলায় দুলছে যে দুজনের মধ্যে কাকে তার বিয়ে করা উচিত। কাজটা মোটেই সম্ভবপর কিনা সেটা আর এখন কোনো সমস্যা নয়, একমাত্র সমস্যা হচ্ছে কোন বিয়েটা অধিক বাঞ্ছনীয় এবং আদালত সেটাকে কি চোখে দেখবে। এক স্বামী জীবিত থাকতে পুনর্বিবাহ ভালো কি মন্দ তা নিয়ে সাধারণ মানুষ কোনো আলোচনাতেই গেল না, তারা বলতে লাগল, তোমার-আমার চাইতে জ্ঞানী গুণী লোকরা নিশ্চয়ই সে ব্যাপারের একটা মীমাংসা করে ফেলেছে, কাজেই এখন সে সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা মানেই নিজের নির্বুদ্ধিতা এবং সমাজে বসবাসের অনুপযুক্ততা প্রকাশ করা।

একমাত্র মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা আখসিমভাই সরাসরি একটা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করে বসল। ভদ্রমহিলা পিটার্সবুর্গে এসেছে তার এক ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। একটা বল-নাচের আসরে হেলেনকে দেখতে পেয়ে তাকে ঘরের ঠিক মাঝখানে থামিয়ে সে রুক্ষস্বরে বলে উঠল : আজকাল দেখছি জীবিত পুরুষের স্ত্রীরাও আবার বিয়ে করছে! আপনি হয়তো ভাবছেন যে একটা নতুন কিছু করলেন। কিন্তু একথা লোকে অনেক আগেই ভেবেছে। সব বেশ্যালয়েই একাজ চলে। কথাকটি বলেই মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ভয়-দেখানো ভঙ্গিতে হাতের আস্তিন গুটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সকলে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকে ভয় করলেও পিটার্সবুর্গে তাকে একটি ভাঁড় বলেই মনে করা হয়। কাজেই সকলে তার কথা শুনলেও বিশেষ কোনো গুরুত্ব দিল না।

মেয়ের সঙ্গে দেখা হলেই প্রিন্স ভাসিলি তাকে বলে : হেলেন, তোমাকে একটা কথা বলার আছে, তাকে এককোণে টেনে নিয়ে যায়। কিছু কিছু কথা আমার কানে এসেছে…বুঝতেই পারছ। দেখ সোনা, তোমার ভালো শুনলে তোমার বাবার মনটা যে আনন্দে নেচে ওঠে তা তো তুমি জান…অনেক কষ্ট তুমি পেয়েছ…কিন্তু সোনা, নিজের মনের সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নিও। এইটুকুই আমার বলার কথা। নিজের আবেগকে গোপন রেখে মেয়ের গালে গাল রেখে প্রিন্স ভাসিলি সেখান থেকে সরে গেল।

বিলিবিন হেলেনের সেইসব পুরুষ বন্ধুদের একজন যারা কখনো প্রেমিক হতে চায়নি। একটা ছোট ঘরোয়া বৈঠক সে একদিন তার মতামতটা হেলেনকে শুনিয়ে দিল।

হেলেন বলল, শোন বিলিবিন, শাদা আংটি-পরা আঙুলগুলি দিয়ে সে বিলিবিনের কোটের আস্তিন স্পর্শ করল। বোনের মতো ভেবেই আমাকে বলে দাও, আমার কি করা উচিত। দুজনের কাকে?

চোখের পাতায় ভাঁজ ফেলে বিলিবিন একটু চিন্তা করল, তার ঠোঁটে হাসি ফুটল।

বলল, তুমি তো জান এ বিষয়ে আমি একেবারে অপ্রস্তুত নই। সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে তোমার এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক অনেক ভেবেছি। কি জান, তুমি যদি প্রিন্সকে বিয়ে কর, সে একটি আঙুল বেঁকাল, তাহলে অপরটিকে বিয়ে করার সযোগ চিরদিনের মতো হারাবে, তাছাড়া, আদালতকেও অসন্তুষ্ট করবে। কিন্তু তুমি যদি বুড়ো কাউন্টটিকে বিয়ে কর তাহলে তার শেষের দিনগুলিকে তুমি সুখী করতে পারবে, এবং সেই মহাযানের বিধবা হলেও…প্রিন্স আন্দ্রুর তোমাকে বিয়ে করবে না। বিলিবিন তার কপালটা ঘষতে লাগল।

আনন্দে উচ্ছল হয়ে পুনরায় তার আস্তিনটা ছুঁয়ে হেলেন বলল, এই তো সত্যিকারের বন্ধুর কথা। কিন্তু তুমি তো জান, আমি দুজনকেই ভালোবাসি, কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। তাদের দুজনের সুখের জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।

সেক্ষেত্রে তো তার আর কিছু করার নেই এমনি ভঙ্গিতে বিলিবিন দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিল।

মহীয়সী নারী! সোজা কথায় বললে তো এই কথাই বলতে হয়। এ দেখছি একই সঙ্গে তিনজনকেই বিয়ে করতে চায়। সে ভাবল।

স্পষ্ট কথা বলার খ্যাতি বিলিবিনের আছে। সে প্রশ্ন করল, কিন্তু আমাকে বল দেখি, তোমার স্বামী ব্যাপারটাকে কি চোখে দেখবে? সে কি এতে রাজি হবে?

হেলেন বলল, ওঃ, সে আমাকে কত ভালোবাসে! আমার জন্য সে সব করবে।

এমনকি তোমার সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদও করবে? বিলিবিন রসিকতা করে জিজ্ঞেস করল।

হেলেন হেসে উঠল।

আর একটি মানুষ এই প্রস্তাবিত বিয়ের যুক্তিত্তায় সন্দেহ প্রকাশ করল; সে হেলেনের মা প্রিন্সেস কুরাগিনা। বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং স্বামী বেঁচে থাকতে পুনর্বিবাহের সম্ভাবনা সম্পর্কে সে জনৈক রুশ পুরোহিতের পরামর্শ চাইল। পুরোহিত জানাল যে সেটা অসম্ভব এবং ধর্ম-পুস্তকের একটা অংশ দেখিয়ে দিল যেখানে স্বামী বর্তমানে পুনর্বিবাহকে পরিষ্কার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এই সব অখণ্ডনীয় যুক্তিতে সুসজ্জিত হয়ে প্রিন্সেস কুরাগিনা একদিন খুব সকালে মেয়ের কাছে গিয়ে হাজির হল।

 মনোযোগ দিয়ে মার আপত্তিগুলো শুনে নিয়ে হেলেন ব্যঙ্গের হাসি হেসে ফেলল।

বুড়ি প্রিন্সেস বলল, কিন্তু এখানে তো পরিষ্কার বলা আছে : বিবাহ-বিচ্ছিন্নাকে যে বিয়ে করবে…

হেলেন এবার রুশ ছেড়ে ফরাসি ভাষায় বলে উঠল, আঃ, মামন, বাজে কথা বল না! তুমি কিছু বোঝ না। আমার অনেকরকম দায়-দায়িত্ব আছে।

কিন্তু সোনা…

আঃ মামণি, কেন যে তুমি বুঝতে পারছ না, যে পবিত্র পিতার সবরকম বিধান দেবার অধিকার আছে…।

ঠিক সেইসময় হেলেনের জনৈক সহচরী এসে জানাল, হিজ হাইনেস নাচ-ঘরে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

না, তাকে বলে দাও তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই না; তিনি তাঁর কথা রাখেননি, তাই আমি তাঁর উপর প্রচণ্ড চটে গেছি।

কাউন্টেস, সব পাপেরই তো মার্জনা আছে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুকেশ এক যুবক বলে উঠল; তার মুখ ও নাক দুইই লম্বা।

বুড়ি প্রিন্সেস সসম্মানে উঠে অভিবাদন করল। যুবকটি কিন্তু তার দিকে নজরই দিল না। মেয়ের দিকে মাথা নেড়ে প্রিন্সেস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হ্যাঁ, মেয়ে তাহলে ঠিকই বলেছে, বুড়ি প্রিন্সেস মনে মনে বলল। হিজ হাইনেসের আবির্ভাবেই তার সব বিশ্বাস উধাও হয়ে গেল। মেয়েই ঠিক, কিন্তু আমাদের যে যৌবন আর ফিরে আসবে না সেই যৌবনকালে আমরা কেন একথা জানলাম না? অথচ কথাটা কত সহজ। ভাবতে ভাবতে বুড়ি প্রিন্সেস গাড়িতে উঠে বসল।

.

অগস্টের গোড়ার দিকেই হেলেনের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল; স্বামীকে একখানা চিঠি লিখে জানিয়ে দিল–সে স্থির করেছে এন. এন. কে বিয়ে করবে, সত্যধর্মকে অবলম্বন করেছে, আর তাই অনুরোধ জানাচ্ছে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলি যেন সুসম্পন্ন করা হয়; পত্রবাহকই সব ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলবে।

বন্ধু আমার, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তাঁর পবিত্র ও শক্তিমান আশ্রয় তিনি তোমাকে দান করুন–তোমার বন্ধু হেলেন।

এই চিঠি যখন পিয়েরের বাড়িতে পৌঁছল সে তখন বরদিনোর যুদ্ধক্ষেত্রে।

.

অধ্যায়-৮

বরদিনোর যুদ্ধের শেষের দিকে দ্বিতীয়বার রায়েভস্কি কামানশ্রেণী থেকে নেমে এসে পিয়ের একদল সৈন্যের সঙ্গে একটা নালার ভিতর দিয়ে এগিয়ে ড্রেসিং-স্টেশনে পৌঁছল এবং সেখানকার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ও আর্তনাদ-চিৎকার শুনে চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে একদল সৈন্যের দঙ্গলের মধ্যে আটকে গেল।

এখন তার মনের একমাত্র বাসনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারাদিনের এই মর্মন্তুদ অনুভূতি থেকে বেরিয়ে জীবনের সাধারণ পরিবেশে ফিরে যাওয়া এবং ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকা। তার মনে হল, একমাত্র জীবনের স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে গেলেই সে নিজেকে এবং সারাদিন যা দেখেছে ও অনুভব করেছে তাকে বুঝতে পারবে। কিন্তু সে স্বাভাবিক পরিবেশ তো কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।

যদিও যেপথ ধরে সে চলেছে সেখানে গোলাগুলির হিস-হিস শব্দটা নেই; কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশই চারদিকে ছড়িয়ে আছে। সেই একই যন্ত্রণা, ক্লান্তি, মাঝে মাঝেই অদ্ভুত নিরাসক্ত সব মুখ, একই রক্ত, একই সৈনিকদের ওভারকোট, একই গোলাগুলির শব্দ, দূরাগত হলেও এখনো তারা ত্রাসের সৃষ্টি করে, আর তাছাড়া সেই একই দুর্গন্ধ বাতাস ও ধুলো।

মোঝইস্ক রোড ধরে মাইল দুই হেঁটে পিয়ের পথের পাশে বসে পড়ল।

গোধূলি নেমে এসেছে; কামানের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে চলমান ছায়ার দিকে তাকিয়ে পিয়ের অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল। সর্বক্ষণই সে কল্পনা করছে যেন একটা কামানের গোলা প্রচণ্ড শব্দ করে তার দিকে ছুটে আসছে, আর সঙ্গে সঙ্গে সে শিউরে উঠে বসছে। কতক্ষণ যে এইভাবে কাটল তা সে জানে না। মাঝরাতে তিনটি সৈনিক কিছু জ্বালানি কাঠ এনে তার পাশে বসে আগুন জ্বালাতে শুরু করল।

পিয়েরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সৈনিক তিনটি আগুন জ্বালিয়ে একটা লোহার পাত্র তার উপর বসিয়ে দিল এবং কিছু শুকনো পাউরুটি ছিঁড়ে পাত্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা জল ঢেলে দিল। সেই চটচটে খাবারের মধুর গন্ধ ধোয়ার গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল। পিয়ের উঠে বসে নিঃশ্বাস ছাড়ল। তার দিকে তাকিয়েই সৈনিক তিনজন খেতে খেতে গল্প করতে লাগল।

হঠাৎ তাদের একজন পিয়েরকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে বলুন তো? সে যেন বলতে চাইল : আপনি খেতে চাইলে কিছুটা খাদ্য আপনাকে দিতে পারি, শুধু আপনি একজন সৎলোক কি না সেটা আমাদের জানা দরকার।

সামাজিক দিক থেকে সৈনিকদের যতটা কাছাকাছি আসা যায় যাতে তারা তাকে ভালো করে বুঝতে পারে সেই চেষ্টা করাই দরকার মনে করে পিয়ের বলল, আমি, আমি…আমি একজন অসামরিক অফিসার, তবে আমার লোকজনরা এখানে নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে এসে আমি তাদের হারিয়ে ফেলেছি।

তাই তো! একটি সৈনিক বলল।

অন্য একজন মাথা নাড়ল।

একটু জাবনা খাবেন না কি? বলে প্রথম সৈনিক একটা কাঠের চামচ পরিষ্কার করে মুছে পিয়েরের হাতে দিল।

আগুনের পাশে বসে সেই জাবনা খেতে খেতে পিয়েরের মনে হল আজ পর্যন্ত যত খাবার সে খেয়েছে এটাই তার মধ্যে সবচাইতে স্বাদু। সে লোভীর মতো উপুড় হয়ে খেতে লাগল। আগুনের আলো পড়েছে তার মুখে। সৈন্যরা নীরবে তার দিকে তাকাল।

একজন বলল, আপনি কোথায় যাবেন? আমাদের বলুন!

মোঝইস্ক-এ।

আপনি একজন ভদ্রলোক, তাই না?

হ্যাঁ।

আপনার নাম?

 পিতর কিরিলিচ।

ঠিক আছে পিতর কিরিলিচ, আমাদের সঙ্গে আসুন, আমরাই আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব।

ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে সৈন্যরা পিয়েরকে সঙ্গে নিয়ে মোঝইক-এর দিকে হাঁটতে লাগল।

মোঝইস্ক-এর কাছাকাছি পৌঁছে খাড়া পাহাড় বেয়ে শহরে উঠবার মুখেই মোরগ ডাকতে শুরু করল। তার সরাইখানাটা যে পাহাড়ের নিচে এবং সে যে সেটা পার হয়ে এসেছে সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়ে পিয়ের সৈন্যদের সঙ্গেই উপরে উঠতে লাগল। তার মনের ভুলো অবস্থাটা তখন এতই বেড়ে গেছে যে মাঝপথে তার সহিসের সঙ্গে দেখা না হলে সরাইখানার কথাটা তার মনেই পড়ত না। পিয়েরের শাদা টুপি দেখেই সহিস তাকে অন্ধকারেও চিনতে পারল।

বলে উঠল, ইয়োর এক্সেলেন্সি! আরে, আমরা তো আপনার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম! আপনি হেঁটে যাচ্ছেন কেন? আর যাচ্ছেনই বা কোথায়?

তাই তো! পিয়ের বলল।

সৈনিকরা থেমে গেল।

একজন বলল, আপনার লোকদের তাহলে পেয়ে গেছেন? আচ্ছা, তাহলে বিদায় পিতর কিরিলিচ-তাই তো?

আর একজনও সেই কথাই বলল, বিদায় পিতর কিরিলিচ।

 বিদায়। বলে পিয়ের সহিসকে নিয়ে সরাইখানার দিকে পা বাড়াল।

ওদের কিছু দেওয়া উচিত, এই কথা ভেবে সে পকেটে হাত দিল। কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন বলল, না, না দেওয়াই ভালো।

সরাইখানায় একটা ঘরও পাওয়া গেল না; সবগুলিই ভর্তি। পিয়ের উঠোনে নেমে গেল; আপাদমস্তক ঢেকে গাড়ির মধ্যেই শুয়ে পড়ল।

.

অধ্যায়-৯

বালিশে মাথা রাখতে না রাখতেই পিয়ের ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু হঠাৎ যেন বাস্তবেই ঘটছে এমনই স্পষ্টভাবেই তার কানে এল কামানের বুমবুমবুম, অর্ধবৃত্তাকার গোলার শিস, আর্তনাদ ও চিত্তার, নাকে লাগল রক্ত ও বারুদের গন্ধ, আর আতঙ্ক ও মৃত্যু-ভয় তাকে চেপে ধরল। সভয়ে চোখ খুলে জোব্বার ভিতর থেকে মাথাটা বের করল। উঠোনটা চুপচাপ। শুধু কে একজন আর্দালি কাদার ভিতর দিয়ে ফটক পার হয়ে এসে সরাইওয়ালার সঙ্গে কি যেন কথা বলল। তার উঠে বসার শব্দে চমকিত হয়ে কয়েকটা পায়রা পিয়েরের মাথার উপর থেকে উড়ে গেল। দুটো চালাঘরের কালো ছাদের মাঝখান দিয়ে পরিষ্কার তারাভরা আকাশটা দেখা যাচ্ছে।

আবার মাথাটা ঢেকে সে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সেসব কিছুই নেই। হায়রে, ভয় কী ভয়ংকর চিজ, আর কীরকম লজ্জাজনকভাবে আমি তার কাছে ধরা দিলাম। কিন্তু তারা…তারা তো সারাক্ষণই ধীর, স্থির ছিল…শেষ পর্যন্ত…।

পিয়েরের মনে তারা মানে সেইসব যারা কামানশ্রেণীতে কর্মরত ছিল, যারা তাকে আহার্য দিয়েছে। তারা, পূর্বে অপরিচিত সেইসব সৈন্যদের মুখ স্পষ্ট হয়ে তার সামনে ভেসে উঠল।

ঘুমিয়ে পড়তে পড়তেই পিয়ের ভাবতে লাগল : যদি সৈনিক হতাম, স্রেফ একজন সৈনিক! সম্পূর্ণভাবে সকলের সঙ্গে মিশে যাওয়া, তাদের মতোই চিন্তা-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া। কিন্তু আমার বাইরের মানুষটার এই অকারণ খোলসটা, এই শয়তানি বোঝাটা ঝেড়ে ফেলব কেমন করে? একসময় ছিল যখন এসবই করতে পারতাম। বাবার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম অথবা দলখভের সঙ্গে দ্বৈতযুদ্ধের পরে আমাকে সৈনিকের কাজ দিয়ে পাঠানোও হতে পারত। পুরনো দিনের অনেক স্মৃতি তার মনের মধ্যে ভিড় করে এল।

ঘোড়ার সাজ পরানোর সময় হয়েছে ইয়োর এক্সেলেন্সি! ইয়োর এক্সেলেন্সি! এখনই ঘোড়ার সাজ পরাতে হবে। সময় হয়ে গেছে ইয়োর এক্সেলেন্সি!…

সহিস তাকে ডাকছে। সূর্যের আলো এসে পড়েছে পিয়েরের মুখে। সরাইখানার নোংরা উঠোনটার দিকে সে তাকাল। মাঝখানে পাম্পের কাছে সৈনিকরা তাদের শুটকো ঘোড়াগুলোকে জল খাওয়াচ্ছে, গাড়িগুলো ফটক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে চোখ বুঝে সে আবার গাড়ির মধ্যেই বসে পড়ল। না, এসব আমি চাই না, এসব দেখতে ও বুঝতেও চাই না। স্বপ্নে যে দেখেছিলাম তাকে আমি বুঝতে চাই। আর এক সেকেন্ড স্বপ্নটা চলতে থাকলেই তো সব বুঝতে পারতাম।

সহিস, কোচয়ান ও সরাইওয়ালা এসে পিয়েরকে বলল, একজন অফিসার খবর এনেছে যে ফরাসিরা মোঝায়েস্ক-এর কাছে পৌঁছে গেছে, আর আমাদের সৈন্যরা সেখান থেকে সরে যাচ্ছে।

পিয়ের উঠল; ঘোড়ার সাজ পরিয়ে পথে তাকে তুলে নিতে বলে সে পায়ে হেঁটে শহরের পথে বেরিয়ে পড়ল।

প্রায় দশ হাজার আহতকে পিছনে ফেলে সৈন্যরা এগিয়ে চলেছে। সব বাড়ির উঠোনে আহত সৈন্য, জানালায় আহত সৈন্য, রাস্তাভর্তি আহত সৈন্য। কিছু গাড়িতে আহতদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে; পথে পথে সেইসব গাড়িকে ঘিরে শোনা যাচ্ছে চেঁচামেচি, শাপশাপান্ত, আর ঘুমোঘুষি। নিজের গাড়িটা এসে পড়ায় একজন পরিচিত আহত জেনারেলকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পিয়ের মস্কোর পথ ধরল। পথেই পিয়ের শুনতে পেল তার শ্যালক আনাতোল ও প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যু-সংবাদ।

.

অধ্যায়-১০

৩০ আগস্ট পিয়ের মস্কো পোঁছল। নগরের ফটকের কাছেই দেখা হল কাউন্ট রস্তপচিনের অ্যাডজুটান্টের সঙ্গে।

অ্যাডজুটান্ট বলল, আমরা তো সর্বত্র আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কাউন্ট আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁর ইচ্ছা, একটা গুরুতর কাজের ব্যাপারে আপনি অবিলম্বে তার সঙ্গে দেখা করুন।

বাড়িতে না গিয়ে সেখান থেকেই একটা গাড়ি নিয়ে পিয়ের সোজা চলে গেল মস্কোর প্রধান সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে।

কাউন্ট রস্তপচিন সেইদিন সকালেই তার সকোলনিকির গ্রীষ্মবাস থেকে মস্কো ফিরেছে। বাড়ির প্রথম ঘরটা এবং অভ্যর্থনা-ঘরটা সরকারি কর্মচারীতে ভর্তি। ভাসিলচিকভ ও প্লাতভ ইতিমধ্যেই কাউন্টের সঙ্গে দেখা করে তাকে বুঝিয়েছে যে মস্কো রক্ষা করা অসম্ভব, তাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিতেই হবে। যদিও মস্কোর অধিবাসীদের কাছে সংবাদটা গোপন রাখা হয়েছে, তবু অফিসাররা–বিভিন্ন সরকারি বিভাগের প্রধানরা–জানে যে অচিরেই মস্কো শত্রুর হাতে পড়বে, কাউন্ট রস্তপনি নিজেও তা জানে; শুধু নিজ নিজ বিভাগের কি ব্যবস্থা তারা করবে সে সম্পর্কে ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব এড়াবার জন্যই তারা শাসনকর্তার কাছে এসেছে।

পিয়ের অভ্যর্থনা-ঘরে ঢুকতেই একজন সামরিক বার্তাবহ রস্তপচিনের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

 নানাবিধ প্রশ্নের জবাবে হাত নেড়ে মাত্র একটা হতাশাব্যঞ্জক ভঙ্গি করে সে ঘরটা পার হয়ে গেল।

অভ্যর্থনা-ঘরে বসে পিয়ের ক্লান্ত চোখে বৃদ্ধ ও তরুণ, সামরিক ও অসামরিক, সব অফিসারদেরই দেখতে লাগল। দেখে মনে হল, তারা সকলেই অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত। পিয়ের একটা দলের দিকে এগিয়ে গেল। তাদের একজনকে সে চেনে।

পিয়েরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তারা আবার গল্প করতে লাগল।

তাদের যদি এখন বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে পরে ফিরিয়ে আনা হয় তাতে তো কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে কেউ কিছু বলতে পারে না।

হাতের একটা ছাপানো কাগজ দেখিয়ে আর একজন বলল, কিন্তু এতে কি লিখেছে সেটা দেখ…

ওটা অন্য ব্যাপার। ওটা জনসাধারণের জন্য দরকার, প্রথম জন বলল।

ওটা কি? পিয়ের শুধাল।

 ওঃ, এটা একটা নতুন ইস্তাহার।

পিয়ের সেটা নিয়ে পড়তে লাগল।

প্রশান্ত মহামহিম (কুতুজভ) তাঁর দিকে অগ্রসরমান সেনাদলের সঙ্গে যোগ দিতে মোঝায়েস্ক-এর ভিতর দিয়ে এগিয়ে এমন একটা জায়গায় শক্ত ঘাঁটি গেড়েছেন, যেখানে শত্রুপক্ষ তাকে শীঘ্র আক্রমণ করতে পারবে না। এখান থেকে আটচল্লিশটি কামান ও গোলাবারুদ তাঁকে পাঠানো হয়েছে; প্রশান্ত মহামহিম বলেছেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তিনি মস্কোকে রক্ষা করবেন, এমন কি পথে পথে যুদ্ধ করতেও তিনি প্রস্তুত। ভাইসব, আদালত বন্ধ হয়ে গেলেও আপনারা বিচলিত হবেন না; শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করতে হবে; শয়তানদের সঙ্গে শয়তানি ব্যবহারই আমরা করব। সময় হলে শহর ও গ্রামের সব ছেলেদেরই আমার দরকার হবে, দুই একদিন আগেই আমি ডাক পাঠাব, কিন্তু এখনই তাদের দরকার হচ্ছে না। তাই আমি চুপ করে আছি। সেদিন একটা কুড় লও দরকার হবে, একটা বর্শাও কাজে লাগবে, কিন্তু সবচাইতে ভালো একটা তিন-ফলা ত্রিশূল : একটা ফরাসি এক আঁটি যইয়ের চাইতে বেশি ভারি নয়। কাল ডিনারের পরে ঈশ্বর-জননীর আইবেরিয় মূর্তি নিয়ে আমি ক্যাথারিন হাসপাতালে আহতদের কাছে যাব, সেখানে তাদের জন্য সংগ্রহ করব আশীর্বাদী জল। সেই জল তাদের দ্রুত আরোগ্যলাভ করতে সাহায্য করবে। আমি নিজেও এখন ভালো আছি; একটা চোখে ঘা হয়েছিল, কিন্তু এখন দুই চোখেই দেখতে পাচ্ছি।

পিয়ের বলল, কিন্তু সৈন্যরা আমাকে বলেছে যে শহরে যুদ্ধ করা অসম্ভব; অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে…

বটেই তো! আমরাও তো সেই কথাই বলছিলাম। প্রথম বক্তা বলল।

পিয়ের শুধাল, আমার একটা চোখে ঘা হয়েছিল, এখন দুই চোখেই দেখতে পাচ্ছি–একথার মানে কি?

 অ্যাডজুটান্ট হেসে বলল, কাউন্টের চোখে অঞ্জনি হয়েছিল; আমি যখন তাকে বললাম যে লোকজনরা ব্যাপারটা। জানতে চাইছে তখন তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভালো কথা কাউন্ট, হঠাৎ একটু হেসে সে পিয়েরকে বলল, আমরা শুনেছি আপনার একটা পারিবারিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে, কাউন্টেস মানে আপনার স্ত্রী…

পিয়ের নিরাসক্ত গলায় বলল, আমি কিছু শুনিনি; কিন্তু আপনারা কি শুনেছেন?

 দেখুন, মানুষ তো অনেক সময় অনেক কিছু বানিয়েও বলে। আমি যা শুনেছি তাই বলছি।

কিন্তু আপনি কি শুনেছেন?

সেই একই হাসি হেসে অ্যাডজুটান্ট বলল, দেখুন, লোকে বলছে, কাউন্টেস, মানে আপনার স্ত্রী নাকি বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। আমি অবশ্য আশা করি যে কথাটা একদম বাজে…

অন্যমনস্কভাবে চারদিকে তাকিয়ে পিয়ের বলল হয়তো তাই। আচ্ছা, ওই লোকটি কে? একটি বেঁটে বুড়ো লোককে দেখিয়ে সে বলল। লোকটির পরনে একটা পরিষ্কার নীল রঙের চাষীদের ওভারকোট, বরফ শাদা লম্বা দাড়ি ও ভুরু, লালচে মুখ।

ওই লোকটি? ও তো একজন ব্যবসায়ী, মানে ওই তো রেস্তোরাঁওয়ালা ভেরেশচাগিন। সেই ইস্তাহারের ঘটনাটা আপনি হয়তো শুনেছেন।

বৃদ্ধ লোকটির কঠিন শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো লক্ষণ সেখানে আছে কি না দেখে পিয়ের বলল, ওঃ, তাহলে এই সেই ভেরশচাগিন!

অ্যাডজুটান্ট বলল, না, এ লোকটি সে নয়; যে ইস্তাহারটি লিখেছিল এ তার বাবা। যুবকটি এখন কারাগারে; মনে হয় তার কপালে দুঃখ আছে।

তারকা পরিহিত একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং গলায় ক্রুশ ঝোলানো একজন জার্মান অফিসার বক্তার দিকে এগিয়ে এল।

অ্যাডজুটান্ট বলল, জানেন তো, ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। ইস্তাহারটি প্রকাশিত হয় দুমাস আগে। কাউন্টকে খবরও দেওয়া হয়। তিনি তদন্তের আদেশ দেন। এখানে গেব্রিয়েল আইভানভিচ তদন্ত করে। ইস্তাহারটি ঠিক তেষট্টি জনের হাত ঘুরেছে। তিনি একজনকে শুধালেন, আপনি এটা কার কাছে পেলেন? অমুকের কাছ থেকে। তিনি আর একজনের কাছে গেলেন। আপনি কার কাছে পেলেন? এইভাবে শেষপর্যন্ত তিনি পৌঁছে গেলেন একজন অর্ধশিক্ষিত ব্যবসায়ী ভেরেশচাগিনের কাছে। অ্যাডজুটান্ট হেসে ফেলল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তোমাকে এটা কে দিয়েছে? আসলে কিন্তু সে যে ওটা কার কাছ থেকে পেয়েছে সেটা আমরা জানতাম। পোস্টমাস্টার ছাড়া আর কার কাছে পাবে? কিন্তু তাদের মধ্যেও একটা বোঝাপড়া ছিল। সে জবাব দিল : কারো কাছ থেকে নয়; আমি নিজেই লিখেছি। তারা তাকে ভয় দেখাল। জেরা করল, কিন্তু তার এক কথা : আমি নিজেই লিখেছি। কাউন্টকে সেই কথাই বলা হল। তিনি লোকটিকে ডেকে পাঠালেন। এ ইস্তাহার তুমি কার কাছে পেয়েছ? আমি নিজেই লিখেছি। দেখুন, কাউন্টকে তো আপনারা চেনেন, গর্বের হাসি হেসে অ্যাডজুটান্ট বলতে লাগল, তিনি ভয়ংকর রেগে গেলেন,আর লোকটির ধৃষ্টতা, মিথ্যাচার ও একগুয়েমির কতা একবার ভাবুন তো।

পিয়ের বলল, কাউন্ট চেয়েছিলেন সে বলুক যে ক্লচারেভের কাছে পেয়েছে? আমি তো তাই জানি!

অ্যাডজুটান্ট হতাশ হয়ে বলল, মোটেই না। এছাড়া আরো অনেক পাপকর্মের কৈফিয়ত ক্লচারেভের দেবার ছিল, আর সেই কারণেই তার নির্বাসন হয়েছে। কিন্তু আসল কথা হল কাউন্ট বড়ই বিব্রত হলেন। বললেনও তুমি নিজে কি করে এটা লিখতে পারলে? টেবিলের উপর থেকে তিনি হাম্বুর্গ গেজেটখানা তুলে নিলেন। এই তো সেটা! তুমি নিজে এটা লেখনি, অনুবাদ করেছ মাত্র, আর জঘন্য অনুবাদ করেছ, কারণ তুমি ফরাসি ভাষাটাও জান না, মূর্খ কোথাকার! আর কি মনে করছেন? লোকটি বলল, না, আমি অন্য কোনো কাগজপত্র দেখিনি, নিজেই এটা লিখেছি। আর সেখানেই ইতি ঘটল। কাউন্ট তার বাবাকে ডেকে আনলেন, কিন্তু যুবকটি একতিল নড়ল না। যতদূর মনে হয় তাকে বিচারের জন্য পাঠানো হয় এবং কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি হয়। এখন বাবা এসেছে তার হয়ে উমেদারি করতে। কিন্তু ছেলেটা আসলে অকর্মার ধাড়ি! এ ধরনের ব্যবসায়ীর ছেলে যেরকম হয়ে থাকে-নারীঘাতক ফুলবাবুটি। কোথায় কতকগুলি বক্তৃতা শুনেই ভেবে নিয়েছে যে শয়তানও তার সমকক্ষ নয়। ছোকরা ওইরকমই বটে। এখানে স্টোনব্রিজের পাশে তার বাবা একটা খাবারের দোকান চালায়। জানেন তো, সেখানে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের একটা বড় মূর্তি আঁকা আছে; তার এক হাতে রাজদণ্ড, আর অন্য হাতে একটি গোলক। তারপর, কয়েকদিনের জন্য সেই দেবমূর্তিটিকে বাড়ি নিয়ে এল, আর এনে কি করল জানেন? একটা বদমায়েশ চিত্রকরকে খুঁজে পেতে নিয়ে এল…

.

অধ্যায়-১১

এই নতুন কাহিনীর মাঝখানে প্রধান সেনাপতির কাছ থেকে পিয়েরের ডাক এল।

সে যখন ঘরে ঢুকল কাউন্ট রস্তপচিন তখন মুখটা কুঁচকে হাত দিয়ে কপাল ও চোখ ঘষছিল। একটি বেঁটে লোক কি যেন বলছিল, কিন্তু পিয়ের ঘরে ঢুকতেই সে কথা থামিয়ে বেরিয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে রস্তপচিন বলে উঠল, এই যে মহাবীর, কেমন আছ? তোমার সাহসিকতার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু সেকথা নয়। নিজেদের মধ্যেই বলছি বাপু, তুমি কি ভ্রাতৃসংঘের লোক? পিয়ের চুপ করে রইল। আমি সঠিক খবরই রাখি বন্ধু, কিন্তু এও জানি ভ্রাতৃসংঘে তো কত লোকই যায়, আর যারা মানুষকে বাঁচাবার নামে রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চায়, আশা করি তুমি তাদের দলের নও।

হ্যাঁ, আমি ভ্রাতৃসংঘী, পিয়ের জবাব দিল।

তাহলেই ব্যাপারটা বোঝ হে বাপু! আশা করি তুমি জান যে মেসার্স স্পেনস্কি ও ম্যাগনিস্কিকে যথাস্থানে পাঠানো হয়েছে। মিঃ ক্লচারভেরও সেই দশাই হয়েছে। অন্য যারা সলোমনের মন্দির গড়ার অজুহাতে পিতৃভূমির মন্দিরকে ধ্বংস করতে চেয়েছে তাদেরও সেই একই দশা হয়েছে। এসব কাজের স্বপক্ষে যে যথেষ্ট যুক্তি আছে তা তুমি নিশ্চয় বোঝ, আর ক্ষতিকর লোক না হলে পোস্টমাস্টারটিকে আমি নির্বাসনে পাঠাতাম না। এখন আমি জানতে পেরেছি যে তার শহর ছেড়ে যাবার ব্যাপারে তোমার গাড়িটা তুমি তাকে ধার দিয়েছ। এবং নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার জন্য তার কাগজপত্রগুলি নিয়েছ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না; আর-যেহেতু তুমি আমার অর্ধেক বয়সের ছেলে-তাই বাবার মতোই তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি এধরনের লোকের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাও।

কিন্তু ক্লচারভ অন্যায়টা কি করেছে কাউন্ট? পিয়ের জিজ্ঞাসা করল।

 রস্তপচিন চেঁচিয়ে বলল, সেটা আমার জানবার কথা, কিন্তু তোমার প্রশ্ন করবার কথা নয়।

রস্তপচিনের দিকে না তাকিয়েই পিয়ের বলল, নেপোলিয়নের ইস্তাহার প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে, কিন্তু কাজটা যে সেই করেছে তা তো প্রমাণ হয়নি। আর ভেরেশচাগিন…

তাই নাকি? হঠাৎ ভুরু কুঁচকে রস্তপচিন চেঁচিয়ে বলল। ভেরেশচাগিন একটা দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক; তার উপযুক্ত শাস্তি সে পাবে। কিন্তু আমার কাজের সমালোচনা করার জন্য আমি তোমাকে ডাকিনি, ডেকেছি পরামর্শ দিতে ইচ্ছা করলে আদেশও বলতে পার। আমার অনুরোধ, তুমি শহর ছেড়ে চলে যাও, ফ্লচারেভের মতো লোকদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন কর। যে কোনো লোকের মাথার পোকা আমি বের করে দেবই-হঠাৎ তার খেয়াল হল যে বিনা দোষেই সে বেজুখভকে ধমকাচ্ছে; তাই বন্ধুর মতো পিয়েরের হাতখানা হাতে নিয়ে বলল, একটা চরম বিপর্যয়ের মুখে আমরা দাঁড়িয়েছি; যাদের নিয়ে আমাকে কাজ করতে হয় তাদের প্রতি ভদ্রতা দেখাবার মতো সময় আমার নেই। আমার মাথার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় চলছে। আচ্ছা বাপু, বল তো, ব্যক্তিগতভাবে তুমি কি করছ?

চোখ না তুলে, অথবা মুখের চিন্তিত ভাবটা না বদলেই, পিয়ের জবাব দিল, কেন, কিছুই করছি না।

কাউন্টের চোখে ভ্রূকুটি।

বন্ধু হিসেবে একটা উপদেশ দিচ্ছি বাপু। যত তাড়াতাড়ি পার কেটে পড়। এছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই। শুনবার মতো কান যার আছে সেই তো সুখী। বিদায়। ওহো, ভালো কথা, দরোজার দিকে তাকিয়ে পিয়েরকে চেঁচিয়ে বলল একথা কি সত্যি যে কাউন্টেস যীশু সমিতির পবিত্র পিতাদের খপ্পরে পড়েছেন?

পিয়ের জবাব দিল না, ঘর থেকে চলে গেল; এত কষ্ট ও কুদ্ধ সে আগে কখনো হয়নি।

যখন বাড়ি ফিরল তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। সেদিন সন্ধ্যায় জনা আষ্টেক লোক তার সঙ্গে দেখা করতে এল; একজন কমিটির সেক্রেটারি, তার ব্যাটেলিয়নের একজন কর্নেল, তার নায়েব ও তারও কিছু খাতক। সকলেই কোনো না কোনো কাজ নিয়ে তার কাছে এসেছে। কিন্তু কোনো কথাই পিয়েরের ভালো লাগছে না, ভালো করে বুঝতেও পারছে না, শুধু তাদের হাত এড়াবার জন্যই কোনোরকমে জবাব দিতে লাগল। সকলে চলে গেলে যখন একলা হল তখন স্ত্রীর চিঠিটা খুলে পড়ল।

তারা, কামানশ্রেণীর সৈন্যরা, প্রিন্স আন্দ্রু নিহত…সেই বুড়ো মানুষটি…সরলতাই ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ। কষ্টভোগ করাও দরকার…সব কিছুর অর্থ…প্রস্তুত থাকতে হবে…আমার স্ত্রী বিয়ে করতে যাচ্ছে .ভুলতে হবে, বুঝতে হবে… পোশাক না ছেড়েই সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই নায়েব এসে খবর দিল, কাউন্ট রস্তপচিনের বিশেষ দূত হিসেবে একজন পুলিশ অফিসার এসে জানতে চাইছে, কাউন্ট বেজুখভ শহর ছেড়ে চলে গেছে কি না, অথবা যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে কি না।

নানা কাজে ডজনখানেক লোক বৈঠকখানায় পিয়েরের জন্য অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি পোশাক পরে তাদের সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে পিয়ের পিছনের বারান্দা দিয়ে ফটক পেরিয়ে বেরিয়ে গেল।

সেইসময় থেকে মস্কোর ধ্বংস শেষ হওয়া পর্যন্ত বেজুখভ পরিবারের লোকজনরা অনেক খোঁজখবর করেও পিয়েরকে আর কখনো দেখতে পেল না, বা সে কোথায় আছে তাও জানতে পারল না।

.

অধ্যায়-১২

১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ শত্রুপক্ষ শহরে ঢোকার আগে পর্যন্ত রস্তভরা মস্কোতেই রইল।

অবলেনস্কির কসাক রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে পেতয়া বেলায়া জারক-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পর থেকেই কাউন্টেসের মনে ভয় ধরল। জনৈক পরিচিতের দুই ছেলেই যুদ্ধে গেছে, দুইজনই তার আশ্রয় থেকে দূরে চলে গেছে, আজ হোক কাল হোক তিন ছেলের মতোই তারা দুজনই বা যে কোনো একজন মারা যেতে পারেএই চিন্তা সেই গ্রীষ্মকালেই সর্বপ্রথম নিষ্ঠুর সত্যের মতো তার মনে এল। সে নিকলাসকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করল, নিজেই পেতয়ার কাছে চলে যেতে চাইল, বা পিতার্সবুর্গের কাছাকাছি কোথাও তার জন্য একটা চাকরির চেষ্টা করল, কিন্তু কোনোটাই সম্ভব হল না। কাউন্টেস রাতে ঘুমতে পারে না, অথবা ঘুমলেও স্বপ্ন দেখে তার ছেলেরা মরে পড়ে আছে। অনেক শলা-পরামর্শ ও আলাপ-আলোচনার পরে কাউন্ট তাকে শান্ত করার একটা উপায় বের করল। পেতয়াকে অবলেনস্কির রেজিমেন্ট থেকে বদলি করিয়ে মস্কোর কাছে ট্রেনিংরত বেজুখভের রেজিমেন্টে আনার ব্যবস্থা করল। সামরিক চাকরিতে থাকলেও এই বদলির ফলে কাউন্টেসের মনে এইটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে তার একটি ছেলে অন্তত তার পক্ষছায়ায় থাকবে এবং এখান থেকে তার যুদ্ধে যোগদান করার সম্ভাবনাটা অনেক কম। পেতয়ার ফিরে আসার সময় যতই কাছে আসতে। লাগল কাউন্টেস ততই অস্থির হয়ে উঠল। তার কেবলই মনে হতে লাগল যে এত সুখ তার কপালে সইবে না। সোনিয়া, প্রিয় নাতাশা, এমন কি স্বামী কাছে এলেও সে বিরক্ত হয়। ভাবে, তাদের দিয়ে আমি কি করব? পেতয়া ছাড়া অন্য কাউকে আমি চাই না।

অগস্টের শেষ দিকে রস্তভরা নিকলাসের একটা চিঠি পেল। ঘোড়া কিনতে ভরোনেজ প্রদেশে গিয়ে সেখান থেকেই সে চিঠি লিখেছে। কিন্তু চিঠি পেয়েও কাউন্টেসের অস্থিরতা গেল না। একটি ছেলে এখন বিপদমুক্ত হয়েছে জেনে পেতয়ার জন্য তার উদ্বেগ আরো বেড়ে গেছে।

২০শে আগস্ট নাগাদ রস্তভদের পরিচিত প্রায় সকলেই মস্কো ছেড়ে চলে গেল; সকলে অনেক পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও তার সোনা-মানিক পেতয়া ফিরে না আসা পর্যন্ত কাউন্টেস কিছুতেই মস্কো ছেড়ে যেতে রাজি হল না। সে এল ২৮শে আগস্ট। যে গভীর মমতায় মা তাকে কাছে টেনে নিল তাতে যোব বছরের অফিসার খুশি হল না। ছেলেকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখার বাসনা গোপন করে রাখলেও পেতয়া মার মনের কথা বুঝতে পারল এবং পাছে সে নিজেও আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, পাছে তার আচরণে মেয়েলিপনা প্রকাশ পায়, এই আশংকায় সে মাকে এড়িয়ে চলতে লাগল, এবং যে কটা দিন মস্কোতে থাকল সে সময়টা নাতাশাকে নিয়েই কাটাতে লাগল; নাতাশার প্রতি চিরদিনই একটা প্রায় প্রেমিকসুলভ ভ্রাতৃস্নেহ সে পোষণ করত।

কাউন্টের চিরাচরিত অব্যবস্থার ফলে ২৮ তারিখে তাদের যাত্রার কোনো আয়োজনই করা হয়নি। সংসারের মালপত্র বয়ে নেবার জন্য রিয়াজান ও মস্কোর জমিদারি থেকে যেসব গাড়ি আসার কথা তারা ৩০ তারিখের আগে এসে পৌঁছল না।

২৮শে থেকে ৩১শে পর্যন্ত সারা মস্কো হৈ-হল্লায় তোলপাড় হয়ে উঠল। প্রতিদিন হাজার হাজার আহত সৈন্যকে বরদিনো থেকে দরগমিলভ ফটক দিয়ে এনে মস্কোর নানা অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল আর হাজার হাজার গাড়ি অধিবাসীদের ও তাদের মালপত্র নিয়ে অন্য সব ফটক দিয়ে মস্কো থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। রস্তপচিনের ইস্তাহার সত্ত্বেও, সেগুলির জন্যই হোক অথবা ছাড়াই হোক, পরস্পরবিরোধী বিস্ময়কর সব গুজব শহরময় ছড়াতে লাগল। কেউ বলছে, কাউকে শহর ছেড়ে যেতে দেওয়া হবে না; আবার কেউ বলছে, সব দেবমূর্তিগুলিকে গির্জা থেকে বের করে আনা হয়েছে এবং সকলকেই মস্কো ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। কেউ বলছে, বরদিনোর পরে আর একটা যুদ্ধ হয়েছে এবং সেখানে ফরাসিরা হটে গেছে; আবার কেউ বলছে উল্টো কথা-রুশ বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু গুজব যাই রটুক, একটা কথা সকলেই বুঝতে পেরেছে যে মস্কো ছেড়ে যেতেই হবে; কাজেই যত তাড়াতি সম্ভব সরে গিয়ে নিজ নিজ জিনিসপত্র বাঁচাবার চেষ্টা করাই কর্তব্য।

মস্কো দখলের আগের তিনটে দিন রস্তভ পরিবারের সকলেই নানা কাজে ব্যস্ত থাকল। পরিবারের কর্তা কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ অনবরত শহরময় ঘুরে সবরকম গুজব সংগ্রহ করে এনে বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি যাত্রার আয়োজন শেষ করার হুকুম চালাতে লাগল।

কাউন্টেস মালপত্র বাছাধা করা দেখছে, সবকিছুতেই খুঁতখুঁত করছে, সবসময় পেতয়ার পিছন পিছন ঘুরছে, আর সে সর্বদা নাতাশার সঙ্গে থাকছে দেখে ঈর্ষায় জ্বলছে। কাজের কাজ যা সেটুকু করছে সোনিয়া। কিন্তু ইদানীং সেও খুব বিষণ্ণ ও চুপচাপ হয়ে গেছে। নিকলাসের চিঠিতে প্রিন্সেস মারির সঙ্গে তার দেখা হওয়ার সংবাদ পড়ে কাউন্টেস সোনিয়ার সামনেই খুশিমনে বলেছিল যে প্রিন্সেস ও নিকলাসের এই দেখা সাক্ষাতে করুণাময় ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।

কাউন্টেস বলেছিল, নাতাশার সঙ্গে বলকনস্কির বিয়ের প্রস্তাবে আমি কোনোদিনই খুশি হইনি; আমি সবসময়ই চেয়েছি নিকলাস প্রিন্সেসকে বিয়ে করুক, আর আমি এও জানতাম যে সেটাই ঘটবে। তাহলে কী ভালোই না হয়!

সোনিয়া বোঝে যে সেটাই ঠিক : নিকলাস একটি ধনবতী মহিলাকে বিয়ে করলে তবেই রস্তভদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে, আর সেদিক থেকে প্রিন্সেসই যোগ্য পাত্রী। কিন্তু তার পক্ষে ব্যাপার বড়ই তিক্ত। তবু নিজের সব দুঃখ-কষ্ট-সত্ত্বেও সারাদিন সেই যাত্রার উদ্যোগ-আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। কাউন্ট আর কাউন্টেস তো হুকুম করেই খালাস। পেতয়া ও নাতাশা তো সারাদিন ছুটোছুটি করেই বেড়াচ্ছে; কাজে সাহায্য করার বদলে তারা বরং বাধার সৃষ্টি করছে। মনে মনে তারা দুজনই খুব খুশি। তাদের খুশির একটা বড় কারণ যুদ্ধটা মস্কোর দিকে এগিয়ে আসছে, শহরের ফটকে-ফটকেই যুদ্ধ হবে, সকলকেই অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হচ্ছে, সকলেই পালাচ্ছে কোথাও না কোথাও চলে যাচ্ছে; মোটকথা একটা অসাধারণ কিছু ঘটতে যাচ্ছে আর সেটা সব সময়ই উত্তেজক, বিশেষত যুবক-যুবতীদের কাছে।

.

অধ্যায়-১৩

 ৩১ আগস্ট শনিবার রস্তভদের বাড়ির সে এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা। দরোজাগুলো হাট করে খোলা, আসবাসপত্র হয় বের করে নেওয়া হচ্ছে নয়তো এ-ঘর থেকে ও-ঘর করা হচ্ছে, আয়না ও ছবিগুলো সব নামিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘরময় ট্রাংক ভর্তি, খড়, প্যাকিংয়ের কাগজ ও দড়ি ইতস্তত ছড়ানো। চাষী ও গৃহ-ভৃত্যরা মালপত্র নিয়ে ভারি কার্পেটের উপর দিয়ে থপথপ করে হাঁটছে। উঠোনে চাষীদের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে; কতকগুলি উঁচু করে বোঝাই হয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে গেছে, কতকগুলি এখনো খালি।

কাউন্ট সকালেই বেরিয়ে গেছে। হৈ-হট্টগোলে কাউন্টেসের মাথা ধরেছে; ভিনিগারের পট্টি মাথায় লাগিয়ে সে নতুন ঘরে শুয়ে আছে। পেতয়া বাড়ি নেই; বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে; তার সঙ্গে একযোগে অসামরিক বিভাগ থেকে সোজা সামরিক বিভাগ বদলির জন্য চেষ্টা করছে। সোনিয়া নাচঘরে কাঁচের ও চীনেমাটির বাসনপত্র প্যাক করার তদারকি করছে। চারদিকে ছড়ানো পোশাক, ফিতে ও স্কার্ফের মধ্যে একটা পুরনো বল-নাচের পোশাক হাতে নিয়ে নাতাশা মেঝেতে বসে আছে।

সকলেই কাজে ব্যস্ত অথচ সে নিজে কিছুই করছে না-এতে নাতাশা লজ্জা বোধ করছে; সকাল থেকে বারকয়েক কাজ করতে চেষ্টাও করেছে, কিন্তু তাতে মন দিতে পারেনি, আর সমস্ত মন দিয়ে সাধ্যমতো কাজ করতে না পারলে কোনো কাজ করা তার পক্ষে সম্ভবই নয়। চীনামাটির বাসন বাধা-ছাদার সময় সে কিছুক্ষণ সোনিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করল, কিন্তু একটু পরেই সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। পুরনো পোশাক ও ফিতেগুলি দাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে প্রথমটায় বেশ মজাই লাগল, কিন্তু সেকাজটা শেষ হয়ে গেলে তার আর কাজে উৎসাহ রইল না।

দুনিয়াশা, তুমি সব গুছিয়ে বেঁধে ফেল! কি বল সোনা? দুনিয়াশা রাজি হতেই নাতাশা মেঝের উপর বসে পড়ে পুরনো বল-নাচের পোশাকটা হাতে নিয়ে এমন একটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে ডুবে গেল যার সঙ্গে তার বর্তমান চিন্তাধারার কোনো সম্পর্কই নেই। পাশের ঘরে দাসীদের কথাবার্তায় তার দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, তারা সকলেই বারান্দায় ছুটে যাচ্ছে। নাতাশা উঠে জানালা দিয়ে তাকাল। আহত মানুষে বোঝাই গাড়ির একটা লম্বা সারি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

দোকানি, বুড়ি নার্স, রাঁধুনি, কোচয়ান, পরিচারক, গাড়োয়ান ও খানসামার দল ফটকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আহতদের দেখছে।

একখানা পরিষ্কার ছোট রুমাল মাথার উপর ফেলে দুই হাতে তার দুটো কোণ ধরে নাতাশা রাস্তায় নেমে গেল।

আগেকার গৃহকত্রী মাভ্রা কুজমিনিচনা ভিড় ঠেলে বাকলের মাদুরে তৈরি ছইওয়ালা একটি গাড়ির কাছে গিয়ে ভিতরে শায়িত একটি বিবর্ণ তরুণ অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। নাতাশা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সলজ্জভাবে থেমে গেল এবং তার কথাগুলি মন দিয়ে শুনতে লাগল; রুমালটা তখনো তার হাতেই ধরা আছে।

সে তখন বলছে, তাহলে মস্কোতে আপনার কেউ নেই? কোনো একটা বাড়িতে থাকতে পারলেই আপনার পক্ষে ভালো হয়…ধরুন আমাদের বাড়িতে…বাড়ির লোকেরা চলে যাচ্ছেন।

অফিসারটি ক্ষীণ গলায় বলল, সে অনুমতি মিলবে কি না জানি না। ঐ আমাদের কমান্ডিং অফিসার আসছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করুন, বলে সে একজন মজবুত গড়নের মেজরকে দেখিয়ে দিল।

ভয়ার্ত চোখে আহত অফিসারটির দিকে তাকিয়ে নাতাশা তৎক্ষণাৎ মেজরের দিকে এগিয়ে গেল।

 শুধাল, আহত লোকরা কি আমাদের বাড়িতে থাকতে পারে?

মেজর একটু হেসে টুপিতে হাত রাখল।

 চোখ কুঁচকে হেসে বলল, আপনি কোনটিকে চান মাদময়জেল?

নাতাশা শান্তভাবে প্রশ্নটারই পুনরাবৃত্তি করল; তার মুখের গম্ভীর ভাব ও চালচলন দেখে মেজরের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, একটু ভেবে নিয়ে ইতিবাচক জবাব দিল।

বলল, হ্যাঁ, কেন পারবে না? নিশ্চয় থাকতে পারে।

ঘাড়টা ঈষৎ কাৎ করে নাতাশা দ্রুতপায়ে মাভ্রা কুজমিনিচনার কাছে ফিরে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওরা থাকতে পারে। উনি বললেন থাকতে পারে।

যে গাড়িতে অফিসারটি শুয়েছিল সেটাকে রস্তভদের উঠোনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাকি গাড়িগুলোকে প্রোভাস্কায়া স্ট্রিটের অধিবাসীদের আমন্ত্রণে হয় তাদের উঠোনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, নয়তো তাদের ফটকের সামনে থামিয়ে দেওয়া হল। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন-বাধা কাজের বাইরে নতুন লোকদের নিয়ে একটা কিছু করার সুযোগ পেয়ে নাতাশা খুব খুশি। সে ও মাদ্ৰা কুজমিনিচনা দুজনে মিলে যত পারল তত বেশি আহত সৈনিকদের তাদের উঠোনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করল।

মাভ্রা কুজমিনিচনা বলল, আপনার বাবাকে কিন্তু বলা উচিত।

ওসব কথা রাখুন। অসুবিধার কি আছে? একটা দিনের জন্য আমরা বৈঠকখানায় চলে যেতে পারি। আমাদের বাড়ির অর্ধেকটাই ওরা পেতে পারে।

কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখুন। এদের যদি একটা কোণের অংশে চাকরদের ঘরে অথবা নার্সদের ঘরেও রাখি, তাহলেও তো অনুমতির দরকার।

বেশ তো, আমি অনুমতি আনছি।

নাতাশা ছুটে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। বৈঠকখানার আধখোলা দরোজা দিয়ে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল। ঘরটা ভিনিগার ও হফম্যান ড্রপ-এর গন্ধে ভর্তি।

মামণি কি ঘুমিয়েছ?

আরে, ঘুম আবার কোথায়?–ঝিমুনি কাটিয়ে জেগে উঠে কাউন্টেস বলল।

মায়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের মুখটা তার মুখের কাছাকাছি নিয়ে নাতাশা বলল, লক্ষ্মী মামণি! আমি দুঃখিত, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, একাজ আর কখনো করব না। তোমার ঘুমটাই ভাঙিয়ে দিলাম! মাদ্রা কুজমিনিচনা আমাকে পাঠিয়ে দিল : ওরা কয়েকজন আহত অফিসারকে এখানে নিয়ে এসেছে। তুমি কি তাদের থাকতে দেবে? কোথাও তাদের যাবার জায়গা নেই। আমি জানতাম তুমি তাদের থাকতে দেবে… এক নিঃশ্বাসে সে কথাগুলি শেষ করল।

কোন অফিসার? কাদের নিয়ে এসেছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কাউন্টেস বলল।

নাতাশা হেসে উঠল; কাউন্টেসের মুখেও মৃদু হাসি।

আমি জানতাম তুমি অনুমতি দেবে…তাহলে ওদের বলি গে, মাকে চুমো খেয়ে নাতাশা দরোজার দিকে এগিয়ে গেল।

হল-এ বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কাউন্ট খারাপ খবর নিয়ে এসেছে।

বিরক্তিভরা গলায় বলল, আমাদের বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে! ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে; পুলিশও চলে যাচ্ছে।

বাপি, কয়েকজন আহত লোককে আমি বাড়িতে ডেকে এনেছি–ঠিক করিনি বাপি? নাতাশা বলল।

কাউন্ট অন্যমনস্কভাবেই জবাব দিল, তা তো বটেই। কিন্তু সেটা তো কথা নয়। ও সব আজেবাজে কাজে মন দেবার সময় এখন নয়, গোছগাছে হাত লাগাও, কাল আমাদের যেতেই হবে, অবশ্য যেতে হবে!…

বড় নায়েব ও চাকরবাকরদেরও কাউন্ট সেই একই হুকুম দিল।

ডিনারের সময় বাড়িতে ফিরে পেতয়া বাইরে যেসব খবর শুনে এসেছে তাই বলল। ক্রেমলিন-এ সকলকে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হচ্ছে; যদিও রস্তপচিনের ইস্তাহারে বলা হয়েছে যে দু তিনদিন আগেই সকলকে ডাক দেওয়া হবে তবু ইতিমধ্যেই হুকুম জারি হয়ে গেছে যে সকলকেই সশস্ত্র হয়ে আগামীকাল তিনপাহাড়ে সমবেত হতে হবে; সেখানে একটা বড় রকমের যুদ্ধ হবে।

ছেলের আগ্রহে উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে কাউন্টেসের বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝল, এখন যদি ছেলেকে যুদ্ধে না যাওয়ার কথা বলা হয় তাহলে সে সৈনিক, মর্যাদা, পিতৃভূমি প্রভৃতি এমন সব অর্থহীন, পুরুষসুলভ, একগুয়ে কথা বলতে শুরু করবে যার প্রতিবাদ করা যায় না; কাজেই তার আগেই যাত্রার আয়োজন শেষ করে পেতয়াকে তাদের দেখাশুনা করার দায়িত্ব দিয়ে সঙ্গে নিয়ে যাবার আশায় কাউন্টেস তার কথার কোনো জবাব দিল না; ডিনারের পরেই কাউন্টকে একপাশে ডেকে নিয়ে চোখের জল ফেলে তাকে মিনতি করল, অতিদ্রুত, সম্ভব হলে সেই রাতেই যেন তাদের সকলকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে না পারলে আতঙ্কেই সে মারা যাবে। এখন যে সে সবকিছুতেই ভয় পাচ্ছে সেকথা লুকোবার কোনো চেষ্টাই করল না।

.

অধ্যায়-১৪

মাদাম শোস তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে বাইরে গিয়েছিল। মিয়াসনিৎস্কি স্ট্রিটে একটা মদের দোকানে সে যা দেখে এসেছে সে বিবরণ শুনে কাউন্টেসের ভয় আরো বেড়ে গেল। সেই রাস্তা দিয়ে ফিরবার সময় দোকানের সামনে মাতালদের হৈ-হুঁল্লোড়ের জন্য সে পথ দিয়ে হাঁটতে পারেনি। একটা গাড়ি নিয়ে গলির পথ ধরে বাড়ি ফিরেছে। গাড়ির চালক তাকে বলেছে, সরকারি হুকুম পেয়ে লোকজনরা মদের দোকানের পিপে ভেঙে মদ গিলছে।

ডিনারের পরে রস্ত পরিবারের সকলেই মহা উৎসাহে জিনিসপত্র বাধা-ঘঁদার কাজে লেগে পড়ল। বুড়ো কাউন্টও হঠাৎ কাজে লেগে গেল। সে একবার উঠোন থেকে ঘরে ঢুকছে, আবার ঘর থেকে উঠোনে নামছে, আর সারাক্ষণ এলোমেলো হুকুম চালাচ্ছে আর দাপাদাপি করছে। পেতয়া উঠোনের কাজের তদারকি করছে। কাউন্টের এলোমেলো হুকুমদারির ফলে সোনিয়ার মাথাই গুলিয়ে গেছে, সে যে কি করবে তাই বুঝতে পারছে না। চাকরবাকররা ঘরে ও উঠোনে ছুটোছুটি করছে আর তর্কাতর্কি করছে। নাতাশা সব দেখেশুনে কাজে হাত লাগাল।

কাউন্ট অনেক মূল্যবান বুটিদার ফরাসি পর্দা ও পারসিক কার্পেট দিয়ে ঘর সাজিয়েছিল। নাতাশা কাজে নেমেই দেখল নাচঘরে দুটো বাক্স খোলা পড়ে আছে, একটা বাসনপত্রে প্রায় ভর্তি, আর একটাতে বোঝাই করা হয়েছে কার্পেট। এখন টেবিলের উপর অনেক জিনিস পড়ে আছে এবং ভাড়ার ঘর থেকে আরো জিনিস আনা হচ্ছে। ফলে চাকরদের আরো একটা বাক্স আনতে পাঠানো হয়েছে।

নাতাশা বলল, সোনিয়া, একটু সবুর কর-এই দুটো বাক্সেই সব ভরা যাবে।

 পারবেন না মিস, আমরা চেষ্টা করে দেখছি, খানসামার সহকারীটি বলল।

না, এক মিনিট সবুর কর।

 নাতাশা দ্রুত হাতে কাগজে মোড়া ডিস-প্লেটগুলো বাক্সের ভিতর থেকে বের করতে লাগল।

বলল, ডিসগুলো কার্পেটের সঙ্গে এখানে যাবে।

সে কি! শুধু কার্পেটগুলোকে তিনটে বাক্সে ধরাতে পারাই তো মহাভাগ্যের কথা, খানসামার সহকারীটি বলল।

আঃ, দয়া করে থাম! নাতাশা দ্রুত হাতে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে জিনিসগুলো সাজাতে শুরু করল। এগুলোর কোনো দরকার নেই, কিছু কিয়েভের থালা সে একপাশে সরিয়ে রাখল। এগুলো-হ্যাঁ, এগুলো কার্পেটের মধ্যেই যাবে, চীনেমাটির স্যাক্সনি ডিসগুলি দেখিয়ে বলল।

সোনিয়া তিরস্কারের সুরে বলল, ছাড় তো নাতাশা! আমরাই সব প্যাক করছি!

কিন্তু নাতাশা তার কথা শুনল না। সবকিছু বের করে নতুন করে প্যাক করতে বসল; স্থির করল, কমদামি রুশ কার্পেট ও অপ্রয়োজনীয় চীনেমাটির বাসনগুলি মোটেই নেবে না। বাক্স থেকে সব জিনিস বের করে তারা যখন নতুন করে প্যাক করতে শুরু করল তখন সস্তা দামের জিনিসপত্রগুলো প্রায় সব বাদ দিয়ে দেখা গেল যে মূল্যবান জিনিসগুলো প্রায় সবই দুটো বাক্সেই ধরে গেল। শুধু কার্পেটের বাক্সের ডালাটা কিছুতেই পড়ছে না। আরো কিছু জিনিস হয়তো বাদ দেওয়া যেত, কিন্তু নাতাশা নিজের ইচ্ছামতোই কাজ করতে লাগল। জিনিসগুলো নতুন করে সাজিয়ে বসিয়ে পেতয়া ও খানসামার সহকারীকে বলল ডালাটাকে চেপে ধরতে। নিজেও সাধ্যমতো চাপ দিতে লাগল।

সোনিয়া বলল, যথেষ্ট হয়েছে নাতাশা। দেখছি তোমার কথাই ঠিক, কিন্তু উপর থেকে আর একটা জিনিস বের করে নিলেই তো হয়।

না, কিছুই বের করব না! নাতাশা চেঁচিয়ে বলল। এক হাতে ঘর্মাক্ত মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে অন্যহাতে কার্পেটগুলোকে চেপে ধরে বলল, এবার চাপ দাও পেতয়া! চাপ দাও ভাসিলিচ, জোরে চাপ দাও!

কার্পেটগুলো একটু বসে গেল, আর ডালাটাও বন্ধ হল। নাতাশা খুশিতে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, তার চোখ দুটি জলে ভরে গেল। কিন্তু মুহূর্তমাত্র। সে আবার নতুন করে কাজে হাত দিল, আর এবার সকলেই তার উপর পুরোপুরি ভরসা পেল। এমন কি কাউন্টকে যখন বলা হল যে নাতাশা তার অনেক হুকুম বাতিল করে দিয়েছে তখনো সে মোটেই রাগ করল না।

কিন্তু সকলে মিলে অনেক রাত পর্যন্ত যথেষ্ট খেটেও সব জিনিস প্যাক করে শেষ করা গেল না। কাউন্টেস আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কাউন্টও পরদিন সকাল পর্যন্ত যাত্রা স্থগিত রেখে শুতে চলে গেল।

সোনিয়া ও নাতাশা পোশাক না ছেড়ে বসার ঘরেই ঘুমিয়ে পড়ল।

সেই রাতেই পোভাস্কায়ার পথ ধরে আরো একটি আহত লোককে নিয়ে আসা হল। মাভ্রা কুজমিনিচনা ফটকেই দাঁড়িয়েছিল; সেই তাকে রস্তভদের বাড়ির উঠোনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করল। মাভ্রা কুজমিনিচনার মনে হল সে একটি জাদরেল লোক। একটা ভালো ঢাকা গাড়িতে করে তাকে আনা হয়েছে; তার শরীরটা আগাগোড়া এপ্রন দিয়ে ঢাকা। চালকের বক্সের পাশে বসেছিল একটি সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ পরিচারক। গাড়ির পিছন পিছন এল একজন ডাক্তার ও দুটি সৈনিক।

বুড়ি গৃহকত্রী বুড়ো পরিচারকটিকে বলল, দয়া করে এখানে আসুন। মনিবরা চলে যাচ্ছেন, কাজেই পুরো বাড়িটাই খালি হয়ে যাবে।

বুড়ো লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বেশ তো তাই হোক। ওকে যে জীবিত অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব সে আশা আর করি না! মস্কোতে আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি আছে, কিন্তু সেটা তো এখান থেকে অনেক দূরে, আর সে বাড়িতে এখন কেউই নেই।

মাভ্রা কুজমিনিচনা বলল, দয়া করে ভিতরে আসুন, আমার মনিবের বাড়িতে সবকিছুই পাবেন।…উনি কি খুবই অসুস্থ?

পরিচারকটি হতাশার ভঙ্গি করল।

ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব বলে আর আশা নেই! ডাক্তার ডাকতে হবে!

বুড়ো বক্স থেকে নেমে পিছনের গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।

ডাক্তার বলল, ঠিক আছে।

 বুড়ো আবার তাদের গাড়িতে ফিরে এল; ভিতরে তাকিয়ে হতাশভাবে ঘাড় নাড়ল, কোচয়ানকে উঠোনে ঢুকতে বলে মাভ্রা কুজমিনিচনার পাশে দাঁড়াল।

বুড়ি বলল, হা প্রভু যিশুখৃস্ট।

 আহত লোকটিকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে বলল। মনিবরা কোনোরকম আপত্তি করবেন না…

আহত লোকটিতে দোতলায় তোলা যাবে না। কাজেই নিচের যে ঘটা মাদার শোসকে দেওয়া হয়েছে সেখানেই তাকে তোলা হল।

আহত লোকটি প্রিন্স আন্দ্রু বলকনস্কি।

.

অধ্যায়-১৫

মস্কোর শেষের দিনটি এসে পড়ল। হেমন্তের একটি উজ্জ্বল রবিবার। প্রতি রবিবারের মতোই সর্বত্র গির্জায় ঘণ্টা বাজল। শহরের কপালে কি যে আসছে তা এখনো কেউ বুঝতে পারছে না।

শুধু দুটো জিনিস থেকে মস্কোর সামাজিক অবস্থাটার হদিস পাওয়া যাচ্ছে-দরিদ্র জনসাধারণ আর জিনিসপত্রের দাম। কারখানার শ্রমিক, গৃহ-ভৃত্য ও চাষীদের একটা মস্ত বড় দল-কিছু অফিসার, ধর্মীয় মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র ও ভদ্রলোকও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে-খুব সকালেই তিনপাহাড়ে চলে গেছে। সেখানে তারা রস্তপচিনের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল, কিন্তু সে এল না; তখন তাদের দৃঢ় ধারণা হল যে মস্কো পরিত্যাগ করা হবে, আর তারাও শহরের নানা মদের দোকানে ও খাবার দোকানে ছড়িয়ে পড়ল। সেদিনকার দ্রব্যমূল্য থেকেও অবস্থাটা বোঝা গেল। অস্ত্রশস্ত্র, সোনা ও গাড়ি-ঘোড়ার দাম বাড়ছে, আর নোটের মূল্যমান ও নাগরিক প্রয়োজনের জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত কমছে; ফলে দুপুর নাগাদ দেখা গেল, কাপড় ইত্যাদি মূল্যবান জিনিস গাড়িভর্তি করে নিয়ে গিয়ে তার বিনিময়ে দাম পেল গাড়িভাড়ার অর্ধেক; ওদিকে চাষীদের ঘোড়া প্রতি ভাড়া উঠল পাঁচশ রুবল, আর আসবাবপত্র, আয়না ও ব্রোঞ্জের জিনিস বিনামূল্যে বিলিয়ে দেওয়া হতে লাগল।

রস্তভদের সেকেলে বাড়িতে কিন্তু সাবেকি জীবনযাত্রা ভেঙে পড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। শুধু দেখা গেল, ভূমিদাসদের মস্তবড় দলের মধ্যে তিনজন রাতারাতি উধাও হয়ে গেল, কিন্তু কোনো কিছু চুরি হয়নি; আর জমিদারি থেকে যে ত্ৰিশখানা চাষীদের গাড়ি এসেছিল সেগুলোর দাম অত্যন্ত বেড়ে গেল।

সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ আস্তে পা ফেলে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সবে ভোরের দিকে কাউন্টেস একটু ঘুমিয়েছে, পাছে তার ঘুম ভেঙে যায় তাই এই সতর্কতা। লিলাক-রঙের ড্রেসিং-গাউন পরে কাউন্ট বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মালবোঝাই গাড়িগুলো উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রী গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে সামনের ফটকে। বড় নায়েব বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি বুড়ো আর্দালি ও হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন তরুণ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে। কাউন্টকে দেখতে পেয়ে বড় নায়েব অর্থপূর্ণ কঠোর অঙ্গভঙ্গি করে তাদের দুজনকেই চলে যেতে বলল।

আরে ভাসিলিচ, সব প্রস্তুত তো? কাউন্ট শুধাল; তারপর টাক মাথায় টোকা দিতে দিতে খুশিমনে অফিসার ও আর্দালিটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। (কাউন্ট নতুন নতুন মুখ দেখতে ভালোবাসে।)

এক্ষুনি ঘোড়া যুততে পারি ইয়োর এক্সেলেন্সি।

আচ্ছা, ঠিক আছে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় কাউন্টেসের ঘুম ভাঙলেই আমরা যাত্রা করব। অফিসারটির দিকে ফিরে বলল, কি ব্যাপার মশায়? আপনারা কি আমার বাড়িতেই আছেন না কি?

অফিসারটি আরো কাছে এগিয়ে গেল; হঠাৎ তার মুখটা লাল হয়ে উঠল।

 কাউন্ট, আপনি যদি দয়া করে…ঈশ্বরের দোহাই, আপনার গাড়ির এককোণে আমাকে একটু জায়গা দেন। আমার সঙ্গে জিনিসপত্র কিছু নেই…একটা বোঝাই গাড়িতে যেতে পারলে আমি সুস্থ থাকতে পারব…

অফিসারের কথা শেষ হবার আগেই তার আর্দালিও মনিবের হয়ে ওই একই অনুরোধ জানাল।

কাউন্ট তাড়াতাড়ি বলে উঠল, নিশ্চয়, নিশ্চয়! আমি খুশি হব, খুব খুশি হব! ভাসিলিচ, একটা ব্যবস্থা কর তো। দু একটা গাড়ির মাল নামিয়ে ফেল। আরে, তাতে আর কি হল…যা কিছু দরকার করে ফেল।

কাউন্ট একবার চারদিকে তাকাল। উঠোনে, ফটকে, বাড়ির বাইরের অংশের জানালায় আহত অফিসার ও তাদের আর্দালিদের ভিড়। সকলেই কাউন্টের দিকে তাকিয়ে আছে, বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে।

বড় নায়েব বলল, গ্যালারিতে চলে আসুন ইয়োর এক্সেলেন্সি। এবার বলুন, ছবিগুলোর কি করা হবে?

আহতদের মধ্যে যারা গাড়িতে যেতে চায় তাদের যেন ফিরিয়ে দেওয়া না হয় এই কথা বলতে বলতেই কাউন্ট বড় নায়েবের সঙ্গে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।

পাছে তার কথা কেউ শুনে ফেলে এই ভয়ে কাউন্ট গলা নামিয়ে বলল, আরে, কোনো অসুবিধা নেই, কিছু জিনিস নামিয়ে নিলেই হবে।

নটার সময় কাউন্টেসের ঘুম ভাঙল; তার পুরনো সহচরী মাত্রিনা তিমোফীভনা এসে জানাল, মাদাম শোস খুব রেগে গেছে, কারণ তার ট্রাংকটা গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর কাউন্টের হুকুমমতো আহত সৈন্যদের জায়গা করে দিতে গাড়িতে বোঝাই করা অনেক মালপত্র নামিয়ে ফেলা হচ্ছে। কাউন্টেস স্বামীকে ডেকে পাঠাল।

এসব কি শুনছি গো? শুনলাম গাড়ি থেকে সব মাল নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে?

কি জান সোনা, তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম…প্রিয় কাউন্টেস…একজন অফিসার এসে আহতদের জন্য কয়েকটা গাড়ি চাইলেন। যাই বল, আমাদের যা জিনিসপত্র তা তো আবার কিনে নেওয়া যাবে, কিন্তু আহতদের ফেলে গেলে তাদের কি দশা হবে সেটা ভেবে দেখ!…সত্যি তো, আমাদেরই উঠোনে-আর আমরাই তাদের ডেকে এনেছি, তাদের মধ্যে অফিসাররাও আছেন…বুঝতেই তো পারছ গো…তাই আমি মনে করি যে তাদের তুলে নেওয়া হোক…তাড়াতাড়ির কি আছে?

টাকাপয়সার ব্যাপারে কাউন্ট সবসময়ই ভয়ে ভয়ে কথা বলে থাকে। ওদিকে কাউন্টেসও সব সময়ই এ ধরনের ভীরু-ভীরু কথার প্রতিবাদ করে থাকে; এটাকে সে তার কর্তব্য বলেই মনে করে।

কাউন্টেস বলল : শোন কাউন্ট, তুমি এমন বন্দোবস্তই করেছ যে বাড়িটার জন্য আমরা কিছুই পাচ্ছি না, আর এখন তুমি কি না আমাদের-তোমার ছেলেমেয়েদের সব সম্পত্তি ফেলে দিতে চাইছ! তুমি তো নিজেই বলেছ যে আমাদের বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে তার দাম এক লাখ রুবল। এতে আমার মত নেই, মোটেই মত নেই! তোমার যা খুশি কর! আহতদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব সরকারের; সেটা তারাও জানে। লোপুখিনদের বাড়ির দিকে চেয়ে দেখ, দুদিন আগেই সে বাড়ি থেকে সবাইকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। অন্য সকলে তাই তো করে। আর আমরাই বোকার মতো কাজ করি। আমাকে তুমি দয়া দেখাতে না পার, কিন্তু ছেলেমেয়েদের প্রতি কিছুটা সদয় হও।

হতাশভাবে দুই হাত ঘুরিয়ে কাউন্ট কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 তার পিছন পিছন এসে নাতাশা বলল, তুমি এসব কি করছ বাপি?

কিছু না! তা দিয়ে তোমার কি দরকার? কাউন্ট রেগে বলল।

নাতাশা বলল, কিন্তু আমি শুনেছি। মামণি আপত্তি করছে কেন?

তা দিয়ে তোমার কি দরকার? কাউন্ট চেঁচিয়ে উঠল।

নাতাশা জানালা পর্যন্ত এগিয়ে এসে ভাবতে লাগল।

বাপি! বের্গ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *