১০.৪ সৈন্য আর সৈন্য

অধ্যায়-৩১

যে জেনারেলটিকে পিয়ের অনুসরণ করছিল, পাহাড় থেকে নেমে সে হঠাৎ বাঁদিকে ঘুরে গেল, পিয়ের তাকে আর দেখতে পেল না, অগত্যা সে ঘোড়া ছুটিয়ে কিছু পদাতিক সৈন্যের মধ্যে গিয়ে পড়ল। সে চেষ্টা করল তাদের আগে অথবা বায়ে বা ডাইনে দিয়ে চলে যাবে, কিন্তু সব জায়গায়ই সৈন্য আর সৈন্য, আর সকলেই অত্যন্ত ব্যস্ত। সকলেই সেই একই অসন্তুষ্ট, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শাদা টুপি মাথায় এই শক্ত-সমর্থ মানুষটির দিকে তাকাচ্ছে, সকলেই যেন ভয় পাচ্ছে যে এই লোকটি তার ঘোড়র ক্ষুরের নিচে তাদের মাড়িয়ে চলে যাবে।

একজন চিৎকার করে বলল, ব্যাটেলিয়নের মাঝখান দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দিয়েছেন কেন?

আর একজন তো বন্দুকের কুঁদো দিয়ে তার ঘোড়াকে একটা খোঁচাই দিয়ে বসল, পিয়ের ঘোড়ার পিঠে ঝুঁকে পড়ে সামান্য একটু জায়গা পেয়ে সেই ফাঁক দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

সামনেই একটা সেতু, সৈন্যরা সেখান থেকে গুলি চালাচ্ছে। পিয়ের তাদের দিকে এগিয়ে গেল। না জেনেই সে গোর্কি ও বরদিনোর মধ্যবর্তী জায়গায় কলোচা নদীর সেতুর কাছে এসে পড়েছে, বরদিনো দখল করার পরে যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ফরাসিরা এই সেতুটার উপরেই আক্রমণ চালিয়েছে। পিয়ের দেখল তার সামনেই একটা সেতু, সেতুর দুই পারে এবং মাঠের মধ্যে সৈন্যরা কি যেন করছে, অনবরত গোলাগুলি চলা সত্ত্বেও সে বুঝতেই পারেনি যে এটাই রণক্ষেত্র। হিস-হিস শব্দে অনবরত গুলি ছুটছে, বাঁকা হয়ে গোলা ছুটছে মাথার উপর দিয়ে, কিন্তু তার খেয়ালই নেই, নদীর অপর পারে শত্রুদেরও সে দেখতে পায়নি, আশেপাশে অনেক সৈন্য মাটিতে পড়লেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে নিহত ও আহতদেরও লক্ষ্য করেনি। তার মুখের হাসিটি তখনো লেগেই আছে।

এই লোকটা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? তাকে দেখে কে একজন চেঁচিয়ে বলল।

সৈন্যরা তাকে বলল, বাঁদিকে যান!…ডাইনে যান!

পিয়ের ডানদিকে এগিয়ে গেল, আর অপ্রত্যাশিতভাবে রায়েভস্কির একজন পরিচিত অ্যাডজুটান্টের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। অ্যাডজুটান্ট ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, চিৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে চিনতে পেরে মাথাটা নাড়ল।

আপনি এখানে কেমন করে এলেন? বলেই সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

পিয়ের বুঝল এটা তার জায়গা নয়, এখানে তার কিছু করারও নেই, আর পাছে আবার কারো পথ আগলে দেয় এই ভয়ে অ্যাডজুটান্টের পিছনে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

ওখানে কি হচ্ছে? আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি? সে শুধাল।

এক মুহূর্ত, এক মুহূর্ত! বলে অ্যাডজুটান্ট মাঠের ভিতর দাঁড়ানো জনৈক কর্নেলের কাছে গিয়ে তার হাতে কিছু সংবাদ দিয়ে ফিরে এসে পিয়েরকে বলল, আপনি এখানে কেন এসেছেন কাউন্টা এখনো তেমনি কৌতূহলীই আছেন?

তা ঠিক, পিয়ের স্বীকার করল।

অ্যাডজুটান্ট ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে চলল।

এখানটা তো তবু চলনসই, কিন্তু বাম বহে ব্যাগ্রেশনের দিকে তারা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

সত্যি? পিয়ের বলল। সেটা কোথায়?

 আমার সঙ্গে পাহাড়ের উপরে চলুন। সেখান থেকেই সব দেখতে পাব, আর আমাদের কামানশ্রেণীর অবস্থা এখনো সহ্যের মধ্যেই আছে, যাবেন কি?

হ্যাঁ, যাব, বলে সহিসের খোঁজে সে চারদিকে তাকাল।

এতক্ষণে তার নজরে পড়ল আহত সৈন্যরা হয় টলতে টলতে চলেছে, নয় তো তাদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কাল যে মাঠের উপর দিয়ে সে ঘোড়া চালিয়ে এসেছে সেখানেও একটি সৈন্য বিসদৃশভাবে চিৎ হয়ে পড়ে আছে।

ওকে সরিয়ে নিয়ে যায়নি কেন? পিয়ের প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু অ্যাডজুটান্টের মুখের কঠিন ভাব দেখে নিজেকে সংযত করল।

সহিসের দেখা না পেয়ে পিয়ের অ্যাডজুটান্টের সঙ্গে খাড়ির ভিতর দিয়ে বায়েভস্কি দুর্গের দিকে এগিয়ে চলল। তার ঘোড়াটা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। সেও ঘোড়ার পিঠে বার বার ঠোক্কর খাচ্ছে।

মনে হচ্ছে আপনার ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস নেই কাউন্ট? অ্যাডজুটান্ট বলল।

 পিয়ের বিচলিত গলায় বলল, ঠিক তা নয়, তবে ঘোড়াটা বড়ই হোঁচট খাচ্ছে।

আরে…ঘোড়াটা তো আঘাত পেয়েছে! অ্যাডজুটান্ট বলল। সামনের পায়ের হাঁটুর উপরে। একটা বুলেট যে তাতে সন্দেহ নেই। গুলির প্রথম অভিষেকের জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাই কাউন্ট!

গোলাগুলির শব্দে কানে তালা লাগবার যোগাড়। তারই ভিতর দিয়ে ষষ্ঠ কোরের ধোয়া পেরিয়ে তারা একটা ছোট জঙ্গলে পৌঁছে গেল। সে জায়গাটা শান্ত, ঠাণ্ডা, হেমন্তের আমেজে ভরা। পিয়ের ও অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল।

উপরে উঠে অ্যাডজুটান্ট শুধাল, জেনারেল কি এখানে আছেন?

ডানদিকটা দেখিয়ে একজন উত্তর দিল, একমিনিট আগেও তিনি এখানেই ছিলেন, এইমাত্র ওদিকে গেলেন।

অ্যাডজুটান্ট এমনভাবে পিয়েরের দিকে তাকাল যেন তাকে নিয়ে কি করা যায় সেটা ঠিক বুঝতে পারছে না।

পিয়ের বলল, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। পারলে আমি নিজেই গোল পাহাড়ে উঠে যাব কি?

হ্যাঁ, তাই যান। সেখান থেকে সবকিছুই দেখতে পাবেন, আর সেখানে বিপদও কম। পরে আপনাকে নিতে আসব।

পিয়ের কামানশ্রেণীর দিকে চলে গেল, আর অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া ছেড়ে দিল। তাদের আর দেখা হয়নি, তবে অনেক পরে পিয়ের জানতে পেরেছে যে সেইদিনই তার একটা হাত কাটা গেছে।

যে গোল পাহাড়ে পিয়ের উঠে গেল সেটাই সেই বিখ্যাত পাহাড় যেটাকে পরবর্তীকালে রুশরা বলত গোল পাহাড় কামানশ্রেণী অথবা রায়েভস্কি দুর্গ, আর ফরাসিরা বলত la grande redoute, la fatale red oute, la redoute du centre, তাকে ঘিরেই হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, আর ফরাসিরা তাকেই মনে করে সমস্ত ঘাঁটির চাবিকাঠিস্বরূপ।

এই শিবিরের তিনদিকে পরিখা কাটা হয়েছিল। সেই পরিখার ভিতরে ছিল দশটা কামান, আর মাটির দেয়ালের ভিতরকার ফাঁক দিয়ে সেই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছিল।

 গোল পাহাড়ের একই সারিতে দুই দিকে সাজানো অন্য সব কামান থেকেও অনবরত গোলাবর্ষণ করা হচ্ছিল। কামানের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল পদাতিক বাহিনী। গোল পাহাড় বেয়ে উঠবার সময় পিয়ের ভাবতেই পারেনি যে কয়েকটা পরিখা কেটে যেখানে থেকে মাত্র কয়েকটা কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে সেটাই এই যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

বরং যেহেতু সে নিজে সেখানে উপস্থিত হতে পেরেছে ঠিক সেই কারণেই সেই স্থানটিকে তার মনে হয়েছে সবচাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ।

পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে পিয়ের পরিখার এক প্রান্তে বসে চারদিকে দেখতে লাগল, অকারণেই একটা খুশির হাসি ফুটল তার মুখে। কামান থেকে একটার পর একটা গোলাবর্ষণ অনবরত চলেছে, কানে তালা লেগে যাচ্ছে, বারুদের ধোয়ার চারদিক ঢেকে যাচ্ছে।

সাহায্যকারী পদাতিক বাহিনীর মনে বেশ ভয়ের সঞ্চার হলেও একটা পরিখার দ্বারা তাদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন যে কয়জন সৈনিক কামান দাগতে অতিমাত্রায় ব্যস্ত, তাদের মনে কাজ করছে একটা পারিবারিক প্রীতির উদ্দীপনা।

পিয়েরের শাদা টুপিওয়ালা অসামরিক মূর্তির উপস্থিতিকে প্রথমে তারা ভালো চোখে দেখল না। তার পাশ দিয়ে আসতে-যেতে সৈনিকরা কিছুটা বিস্ময়ে, কিছুটা সভয়ে তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। একজন প্রবীণ গোলন্দাজ অফিসার একেবারে শেষপ্রান্তের কামানটির কাজকর্ম দেখবার জন্য পিয়েরের দিকে এগিয়ে এল। তার একটা পা নেই, মুখময় দাগভর্তি। সে কৌতূহলের সঙ্গে পিয়েরের দিকে তাকাল।

একটি গোল-মুখ তরুণ অফিসার সবে ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়েছে, এখনো একেবারেই ছেলেমানুষ, দুটি কামান চালাবার ভার পেয়ে সে খুবই গর্বিত।

রুক্ষ স্বরে সে পিয়েরকে বলল, স্যার, দয়া করে একটু সরে দাঁড়ান। এখানে আপনার থাকা উচিত নয়।

সৈন্যরাও পিয়েরের দিকে তাকিয়ে আপত্তিসূচকভাবে ঘাড় নাড়তে লাগল। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল যে শাদাটুপিওয়ালা এই লোকটি তাদের কোনো ক্ষতি করছে না, সলজ্জ হাসিমুখে পরিখার পাশে চুপচাপ বসে আছে, বিনীতভাবে সৈন্যদের পথ ছেড়ে দিচ্ছে, যেন কোনো বুলভার্দে হাঁটছে এমনই শান্তভাবে গর্জনমুখর কামানের নিচ দিয়ে হাঁটছে, তখন তাদের সেই বিরূপ মনোভাব ধীরে ধীরে দূর হয়ে তার পরিবর্তে দেখা দিল একধরনের করুণাপরবশ সহানুভূতি যা সৈন্যরা সাধারণতই পোষণ করে তাদের কুকুর, মোরগ, ছাগল ও অন্য সব প্রাণীর প্রতি যারা রেজিমেন্টের সঙ্গেই চলাফেরা করে। সৈন্যরা ক্রমে পিয়েরকে তাদের পরিবারের একজন বলেই মেনে নিল, তাকে একটা ডাক নাম (আমাদের ভদ্রলোক) দিল, এবং তাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাশাও করতে লাগল।

পিয়েরের হাত দুই দূরে একটা গোলা ফাটল, তার ফলে তার পোশাক যে ধুলো-মাটি লাগল সেটা ঝাড়তে ঝাড়তে সে চারদিকে তাকাল।

লালমুখ, চওড়া-কাঁধ একটি সৈনিক পিয়েরকে জিজ্ঞাসা করল, সে কি স্যার এতেও আপনি ভয় পেলেন না? সৈনিকটি একটু হাসল, দুই পাটি শাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ল।

তাহলে কি আপনি ভয় পেয়েছেন? পিয়ের শুধাল।

তাছাড়া আর কি আশা করতে পারেন? সৈনিকটি জবাব দিল। জানেন তো তিনি বড়ই নিষ্ঠুর! তিনি যখন সরবে ধেয়ে আসেন তখন আপনার সব জাড়িজুড়ি উবে যায়! ভয় না পেয়ে উপায় আছেসৈনিকটি হাসতে লাগল।

কয়েকটি সৈনিক পিয়েরের পাশে এসে দাঁড়াল। একজন বলল, এটা আমাদের মতো সৈনিকদের ব্যাপার। কিন্তু একজন ভদ্রলোকের পক্ষে এ আচরণ খুব আশ্চর্যের। একজন ভদ্রলোক বটে!

সেই সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে তরুণ অফিসারটি বলল, প্রত্যেকে যার যার জায়গায় যান!

গোটা যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে কামানের গর্জন ও বন্দুকের শব্দ ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে, বিশেষ করে যেখানে ব্যাগ্রেশনের সেনাদল অবস্থিত, আর পিয়ের যেখানে আছে সে জায়গাটা ধোঁয়ায় এমন ঢেকে গেছে যে কোনো কিছুই ভালো করে দেখাই যাচ্ছে না।

দশটা নাগাদ প্রায় বিশ জনকে কামানশ্রেণীর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, দুটো কামান ধ্বংস হয়েছে, আর কামানের গোলা আরো বেশি সংখ্যায় এসে পড়ছে, হুশ-হুঁশ শব্দে চারদিকে বুলেট উড়ছে। কিন্তু কামানশ্রেণীর সৈনিকদের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই, চারদিকে শোনা যাচ্ছে হাসিখুশি ও ঠাট্টা-তামাশার শব্দ।

একটা গোলা শাঁ শাঁ করে এগিয়ে এলে একটি সৈনিক চেঁচিয়ে বলল, একেবারে তাজা!

গোলাটা পাশ কাটিয়ে সহায়ক পদাতিকদের মধ্যে পড়ায় আর একজন বলে উঠল, এদিকে আসেনি! পদাতিক বাহিনীর দিকে গেছে!

একটা গোলা উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখে একটি চাষী মাথাটা নিচু করায় তাকে ঠাট্টা করে একজন বলে উঠল, তুমি কি বন্ধুকে অভিবাদন করছ নাকি হে?

সামনে কি ঘটছে দেখবার জন্য কয়েকজন সৈন্য এসে পরিখার প্রাচীরের পাশে দাঁড়াল।

তারা বলল, ওরা অগ্রবর্তী দলটাকে সরিয়ে নিয়েছে।

বুড়ো সার্জেন্টটি চেঁচিয়ে বলল, নিজেদের কাজে মন দাও গে। তারা যদি সরে গিয়ে থাকে তো বুঝতে হবে পিছনের দিকে তাদের অনেক কাজ রয়েছে।

সার্জেন্ট একটি সৈনিকের ঘাড় ধরে হাঁটু দিয়ে একটা গুতো মারল। অন্য সকলে হো-হো করে হেসে উঠল।

একদিক থেকে চিৎকার শোনা গেল, পাঁচ নম্বর কামানে যাও। চাকা ঘোরাও।

 এবার সকলে একসঙ্গে, মাঝিদের মতো! যারা কামানটাকে নাড়াচ্ছিল তাদের উত্যুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

লাল-মুখ রসিক লোকটি পিয়েরকে দেখিয়ে দাঁত বের করে বলল, আমাদের ভদ্রলোকের টুপিটা প্রায় উড়িয়ে দিয়েছিল! গোলাটা কামানের চাকা ও একটি সৈনিকের পায়ের উপর পড়ায় সে বলে উঠল, যতসব বাঁচাল মেয়েমানুষ!

আহতদের সরিয়ে নেবার জন্য জনাকয়েক অসামরিক লোক মাথা নিচু করে কামানশ্রেণীর মধ্যে ঢুকে পড়ায় তাদের দেখিয়ে হাসতে হাসতে আর একজন বলল, আরে, এই তো শেয়াল মশাইরা এসে পড়েছে।

একটি সৈনিকের একটা পা উড়ে গেছে। অসামরিক লোকগুলি তার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করায় আর একজন হেসে বলল, আচ্ছা, এখানা তাহলে তোমাদের পছন্দ হচ্ছে না? আঃ, যতসব কাকের দল! তোমরা বয় পেয়েছ!

চাষীদের অনুকরণ করে বলল, এই যে বাছারা…ওঃ, ওঃ! এসব ওদের মোটেই পছন্দ নয়।

 পিয়ের লক্ষ্য করল যতবার শিবিরের উপর গোলা এসে পড়ছে, যতবার কেউ হতাহত হচ্ছে, ততই যেন এদের উদ্দীপনা বেড়ে যাচ্ছে।

বজ্রগর্ভ মেঘ যত এগিয়ে আসে তার ভিতরকার আগুনের শিখা যেমন ততই স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়, ঠিক তেমনি এই সব মানুষের অন্তরে লুকানো আগুনের শিখা ক্রমাগত তীব্রতর হয়ে তাদের চোখে-মুখে জ্বল জ্বল করছে।

পিয়ের এখন আর যুদ্ধক্ষেত্র দেখছে না, সেখানে কি ঘটছে তাতে তার কোনো আগ্রহ নেই, যে আগুন ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলছে, নিজের আত্মার মধ্যে যার প্রতিফলন সে উপলব্ধি করছে, সমস্ত মন দিয়ে এখন সে তাকেই শুধু দেখছে।

যে পদাতিক সেনাদল কামানশ্রেণীর সম্মুখস্থ ঝোঁপের মধ্যে কামেংকা ঝর্ণার তীর বরাবর আস্তানা পেতেছিল তারা পশ্চাৎপসরণ করল। পাহাড়ের উপর থেকেই দেখা গেল আহতদের বয়ে নিয়ে তারা দৌড়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। একজন জেনারেল সদলবলে কামানশ্রেণীর কাছে এসে কর্নেলের সঙ্গে কিছু কথা বলে পিয়েরের দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকাল, গোলাগুলির হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাবার জন্য কামানশ্রেণীর পিছন দিককার সাহায্যকারী পদাতিক সৈন্যদের শুয়ে পড়বার হুকুম দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। তারপরেই কামানশ্রেণীর ডান দিককার পদাতিক সেনাদলের মধ্য থেকে ঢাকের বাজনা ও হুকুমের চিৎকার শোনা গেল, তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলল।

পিয়ের পরিখার দেয়ালের উপর দিয়ে তাকাল, একটি বিবর্ণ তরুণ অফিসার তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তরবারিটা ঝুলিয়ে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে সে অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকাচ্ছে।

পদাতিক সেনাদল ধোয়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু তাদের দীর্ঘায়ত চিৎকার ও বন্দুকের শব্দ তখনো শোনা যাচ্ছে। কয়েক মিনিট পরেই আহত সৈনিক ও স্ট্রেচারবাহকরা দলে দলে সেইদিক থেকে আসতে লাগল। কামানের গোলা অর্ধচক্রাকারে ছুটে এসে আরো ঘন ঘন পড়তে লাগল। কয়েকটি সৈনিক এখানে ওখানে পড়ে আছে, তাদের এখনো সরানো হয়নি। কামানকে ঘিরে লোকজন দ্রুততর গতিতে ছুটাছুটি করছে। এখন আর কেউ পিয়েরকে দেখছে না। দু একবার পথের সামনে পড়ায় তাকে ধমক দেওয়া হয়েছে। ঊধ্বতন অফিসারটি ভ্রুকুটিকুটিল মুখে বড় বড় পা ফেলে একটা কামান থেকে আরেকটা কামানের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা এমনভাবে ছোট ছোট লাফ দিচ্ছে যেন তাদের পায়ের নিচে স্প্রিং লাগানো আছে।

স্যার, আমি জানতে এসেছি যে আর মাত্র আট রাউন্ড গুলি আছে। আমরা কি গুলি চালিয়েই যাব? সে শুধাল।

পরিখার দেয়ালের উপর দিয়ে তাকিয়ে ঊর্ধ্বতন অফিসারটি চিৎকার করে বলল, ছররা গুলি!

হঠাৎ কি যেন ঘটল, তরুণ অফিসারটি একবার ঢোক গিলেই ডানায় গুলি-খাওয়া পাখির মতো উপুড় হয়ে বসে পড়ল। পিয়েরের চোখে সবকিছুই কেমন যেন বিস্ময়কর, গোলমেলে ও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠল।

একটার পর একটা কামানের গোলা হিস-হিস শব্দে ছুটে আসছে, আর মাটি, সৈন্য, অথবা কামানের উপর আছড়ে পড়ছে। পিয়ের আগে কখনো এরকম শব্দ শোনেনি, আর এখন এই শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।

সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা গোলা ঠিক সেখানে পড়ায় কিছুটা মাটি ধ্বসে পড়ল, একটা কালো গোলা তার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে কোনো কিছুর উপর আছড়ে পড়ল। কিছু অসামরিক লোক কামানশ্রেণীর দিকে যাচ্ছিল, তারা ছুটে পালাল।

অফিসারটি চিৎকার করে বলল, সকলেই ছররা চালাও!

একজন সার্জেন্ট অফিসারের কাছে ছুটে এসে ভয়ার্ত গলায় ফিসফিস করে জানাল যে গুলি ফুরিয়ে গেছে।

 বদমায়েশের দল! তারা সব কী করছে! পিয়েরের দিকে ঘুরে অফিসারটি চেঁচিয়ে উঠল।

 অফিসারটির মুখ রক্তবর্ণ, ঘর্মাক্ত, কুটিল ভুরুর নিচে চোখ দুটো জ্বলছে।

পিয়েরের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সে সৈনিকদের হুকুম দিল, রিজার্ভ বাহিনীতে চলে যাও, সেখান থেকে গুলি-গোলার বাক্সগুলো নিয়ে এস!

আমি যাব, পিয়ের বলল।

তার কথার জবাব না দিয়ে অফিসার বিপরীত দিকে এগিয়ে গেল।

 চেঁচিয়ে বলল, গুলি চালিও না…অপেক্ষা কর!

 যে লোকটি গোলাগুলি আনতে যাচ্ছিল পিয়েরের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল।

আঃ, স্যার, এটা আপনার জায়গা নয়, বলেই সে ছুটে নেমে গেল।

তরুণ অফিসারটি যেখানে বসেছিল তাকে এড়িয়ে পিয়ের সৈনিকটির পিছনে ছুটে গেল।

একটার পর একটা কামানের গোলা তার সামনে, পিছনে, দুই পাশে পড়তে লাগল। সবুজ রংয়ের গোলা বারুদের গাড়ির সামনে পৌঁছে হঠাৎ সে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল, আমি কোথায় চলেছি ফিরে যাবে না এগিয়ে যাবে বুঝতে না পেরে সে থেমে গেল। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আঘাত তাকে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক সেইমুহূর্তে একটা আগুনের ঝিলিক তার চোখ ঝলসে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে কানে তালা-লাগানো একটা গর্জনে তার কান দুটো ঝনঝন করে উঠল।

যখন সম্বিত ফিরে এল তখন দুই হাতে ভর দিয়ে সে মাটিতে বসে আছে, গোলা-বারুদের গাড়িটা সেখানে নেই, পোড়া ঘাসের উপর ইতস্তত ছড়িয়ে আছে সবুজ পোড়া কাঠ ও ছেঁড়া কাপড়ের ভূপ। একটা ঘোড়া গাড়ির জোয়ালের ভাঙা টুকরো নিয়েই তার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। আর অন্য ঘোড়াটা পিয়েরের মতোই মাটিতে পড়ে হৃদয়বিদারক স্বরে একটানা চিৎকার করে চলেছে।

.

অধ্যায়-৩২

আতংকে দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে উঠে পিয়ের ছুটতে ছুটতে কামানশ্রেণীর কাছেই ফিরে গেল, চারদিকের ভয়াবহতার মধ্যে সেটাই যেন একমাত্র আশ্রয়স্থল।

মাটির দেয়ালের আড়ালে ঢুকে দেখল, সেখানে লোকজনরা কি যেন করছে, কিন্তু কামান থেকে গোলা ছোঁড়া হচ্ছে না। এই লোকগুলি কারা সেটা বুঝবার মতো সময়ও তার ছিল না। সে দেখল, প্রবীণ অফিসারটি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, যেন নিচের কোনো কিছু পরীক্ষা করছে, একটি সৈনিক ভাইসাব! বলে চিৎকার করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে এবং যারা তার হাত চেপে ধরেছে তাদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করছে। তাছাড়া আরো এমন কিছু সে দেখল যা সত্যি অদ্ভুত।

 কিন্তু এটা বুঝবার সময় তার ছিল না যে কর্নেলটি যুদ্ধে মারা গেছে, যে সৈনিকটি ভাই বলে চেঁচাচ্ছে সে বন্দি হয়েছে, এবং আর একটি সৈনিককে তার চোখের সামনেই বেয়নেট গেঁথে ফেলা হয়েছে, কারণ সে দুর্গে ঢুকবার আগেই একটি ফ্যাকাসে-মুখ, ঘর্মাক্তদেহ, শুটকো লোক নীল ইউনিফর্ম পরে কি যেন বলতে বলতে তলোয়ার হাতে নিয়ে ছুটে এল। পরস্পরকে দেখবার আগেই তারা দুজনই পূর্ণ গতিতে পাশাপাশি ছুটছিল, সেই সুযোগে পিয়ের হাত বাড়িয়ে সেই লোকটির (একজন ফরাসি অফিসার) কাঁধটা চেপে ধরল এবং অন্য হাতে চেপে ধরল তার গলা। অফিসারও তলোয়ার ফেলে দিয়ে পিয়েরের কলার চেপে ধরল।

কয়েক সেকেন্ড তারা দুজনই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পরস্পরের অপরিচিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারা কি করেছে এবং পরে কি করবে তা ভেবে দুজনই বিচলিত বোধ করল। দুজনই ভাবতে লাগল : আমিই কী বন্দি হয়েছি, না কি তাকে বন্দি করেছি? কিন্তু ভয়ের তাড়নায় পিয়ের ফরাসি অফিসারের গলাটা ক্রমেই এত বেশি শক্ত করে চাপতে লাগল যে তার মনে হতে লাগল যে সেই বন্দি হয়েছে। ফরাসিটি কী যেন বলতে যাচ্ছিল এমন সময় একটা কামানের গোলা তাদের মাথার একেবারে উপর দিয়ে এমন ভয়ংকরভাবে হিস-হিস শব্দে ছুটে গেল আর ফরাসি অফিসারটিও এত তাড়াতাড়ি মাথাটা নামিয়ে নিল যে পিয়েরের মনে হল বুঝি তার মাথাটাই উড়ে চলে গেল।

পিয়েরও মাথাটা নিচু করে হাত দুটো নামিয়ে নিল। কে কাকে বন্দি করেছে। তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ফরাসিটি সোজা কামানশ্রেণীর দিকে ছুটে গেল, আর পিয়ের নিহত ও আহত সৈনিকদের ডিঙিয়ে উত্রাই বেয়ে ছুটে নেমে গেল, প্রতি পদক্ষেপে তার মনে হল নিহত আহতরা যেন তার পা টেনে ধরছে। কিন্তু গোল পাহাড়ের নিচে পৌঁছবার আগেই রুশ সৈন্যদের একটা বড় দলের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল, খুশিতে চিৎকার করতে করতে বেপরোয়াভাবে হোঁচট খেতে খেতে তারা পাহাড় বেয়ে উঠছে। (রুশ সেনাদলের এই আক্রমণের পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করেছে এর্মোলভি। তার সাহস ও সৌভাগ্যের বলেই এ কাজ সম্ভব হয়েছে, শোনা যায়, এই আক্রমণের সময় সে নাকি পকেট থেকে বের করে বেশ কয়েকটা সেন্ট জর্জের ক্রুশ কামানশ্রেণীর মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল, যাতে যে সেখানে আগে পৌঁছবে সেই সেটা কুড়িয়ে নিতে পারে।)

যে ফরাসিরা কামানশ্রেণী দখল করেছিল তারা পালিয়ে গেল, আর আমাদের সৈন্যরা হুর-রা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে এতদূর পর্যন্ত তাদের তাড়া করে গেল যে তাদের ডেকে ফেরানো গেল না।

বন্দিদের নিচে নামিয়ে আনা হল, তাদের মধ্যে একজন আহত ফরাসি জেনারেলও আছে, অফিসাররা তাকে ঘিরে ধরল। দলে দলে পিয়েরের পরিচিত ও অপরিচিত রুশ ও ফরাসি আহত সৈনিত বা যন্ত্রণায় বিকৃত মুখে কেউ বা হেঁটে, কেউ বা হামাগুড়ি দিয়ে কামানশ্রেণীর কাছ থেকে নামতে লাগল, অনেককে স্ট্রেচারে করে বয়ে আনা হল। পিয়ের আবার গোল পাহাড়ের মাথায় উঠে গেল, এক পরিবারের মতো যাদের সঙ্গে সে এক ঘণ্টার উপর কাটিয়েছে তাদের কজনকেও সেখানে দেখতে পেল না। যারা মরে পড়ে আছে তাদের সে চেনে না, আবার কয়েকজনকে চিনতেও পারল। তরুণ অফিসারটি রক্তের পুকুরের মধ্যে সেই একইভাবে দেয়ালের একপ্রান্তে উপুড় হয়ে বসে আছে। লাল-মুখ লোকটি তেমনি খাবি খাচ্ছে, কিন্তু কেউ তাকে বয়ে নিয়ে গেল না।

পিয়ের আবার উত্রাই বয়ে ছুটে নেমে গেল।

রণক্ষেত্র থেকে আগত একদল স্ট্রেচার-বাহকের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে এগিয়ে যেতে যেতে সে ভাবল, এবার ওরা এসব থামাবে, এবার ওরা বুঝবে কি ভয়ংকর কাজ করেছে!

ধোঁয়ার আবরণের পিছনে সূর্য তখনো মাথার উপরে, কামানের গর্জন ও বন্দুকের শব্দ তখনো থামেনি, বরং ক্লান্ত মানুষ যেমন অবশিষ্ট সব শক্তি নিয়ে একবার আর্তনাদ করে ওঠে ঠিক তেমনি গোলাগুলি যেন বেপরোয়াভাবে আরো বেড়ে গেছে।

.

অধ্যায়-৩৩

একদিকে বরদিনো আর অন্যদিকে ব্যাগ্রেশনের সৈন্য-সীমান্ত-তার মধ্যবর্তী সাত হাজার ফুট জায়গাতেই বরদিনো যুদ্ধের মূল কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। তার বাইরে একদিকে উভারতের অশ্বারোহী বাহিনীসহ রুশরা কুচকাওয়াজ করেছিল দুপুরবেলা, আর অন্যদিকে উতিৎসার ওপারে পনিয়াতোস্কির একটা সংঘর্ষ হয়েছিল তুচকভের সঙ্গে, কিন্তু যুদ্ধের মূল কেন্দ্রে যা ঘটেছে তার তুলনায় এসব খুবই বিক্ষিপ্ত ও দুর্বল ঘটনা। দিনের আসল যুদ্ধটা জঙ্গলের পাশের যে খোলা জায়গাটাতে হয়েছে সেটা দুদিক থেকেই বেশ ভালোভাবে দেখা যায়, আর যুদ্ধটাও হয়েছে অত্যন্ত সরল ও কৌশলবিহীনভাবে।

দুপক্ষ থেকে কয়েকশো কামানের গোলাবর্ষণ দিয়ে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল।

তারপর যুদ্ধক্ষেত্রটা যখন ধোঁয়ায় ঢেকে গেল তখন ডাইনের ফরাসিদের পক্ষ থেকে এগিয়ে এল কাম্পা ও দেসিয়াস্কের সেনাদল, আর বাঁদিক থেকে এগিয়ে এল মুরাৎ-এর সেনাদল।

নেপোলিয়ন দাঁড়িয়েছিল শেভার্দিনো দুর্গে, সেখান থেকে ব্যাগ্রেশনের ঘাঁটির দূরত্ব এক ভা, আর বরদিনোর দূরত্ব দুই ভা, কাজেই সেখানে যে কি ঘটছে নেপোলিয়ন তা দেখতেই পায়নি, বিশেষত ধোয়া আর কুয়াশা মিলে সমস্ত অঞ্চলটাকেই ঢেকে ফেলেছিল। এই ধোয়ার ভিতর দিয়ে কালো কালো কি যেন দেখা যাচ্ছিল,-হয় তো তারা সৈনিক,মাঝে মাঝে বেয়নেটের ঝিলিকও চোখে পড়েছিল, কিন্তু তারা এগিয়ে চলেছে না স্থির হয়ে আছে, তারা ফরাসি না রুশ, শেভার্দিনো দুর্গ থেকে সেসব কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।

উজ্জ্বল রোদ ছড়িয়ে সূর্য উঠেছে, চোখের উপর হাত রেখে নেপোলিয়ন ঘাটির দিকে তাকিয়েছিল, সূর্যের বাকা রশ্মি সোজা এসে পড়ল তার মুখে। সম্মুখে ধোয়ার আবরণ ছড়িয়ে পড়ছে, কখনো মনে হচ্ছে ধোয়াই এগিয়ে চলেছে, আবার কখনো মনে হচ্ছে সৈন্যরা এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে চিৎকার শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সেখানে কি যে হচ্ছে তা বলা অসম্ভব।

পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে নেপোলিয়ন একটা ছোট দূরবীণে চোখ রাখল, তার বৃত্তের ভিতর দিয়ে চোখে পড়ল ধোয়া আর সৈন্য, কিছু তার নিজের, কিছু রুশদের, কিন্তু পুনরায় যখন খালি চোখে তাকাল তখন আর বুঝতেই পারল না সে যা কিছু দেখছিল তা এখন কোথায়।

পাহাড় থেকে নেমে সেখানেই পায়চারি করতে লাগল।

মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে, গোলাগুলির শব্দ শুনছে, আবার একদৃষ্টিতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকাচ্ছে।

যে সমস্ত অ্যাডজুটান্টদের সে পাঠিয়েছে তারা এবং তার মার্শালদের আর্দালিরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনবরত ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে আর নেপোলিয়নকে যুদ্ধের সর্বশেষ বিবরণ দিচ্ছে, কিন্তু সেসব বিবরণই মিথ্যা, কারণ সেই প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যে কখন কি ঘটছে সেই মুহূর্তে সেটা বলা অসম্ভব, অ্যাডজুটান্টদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে অন্যের কাছে যা শুনেছে তাই এসে বলছে, তাছাড়া, একজন অ্যাডজুটান্ট যতক্ষণে দুই ভা পথ ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে ততক্ষণে অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে এবং যে সংবাদ সে বয়ে আনছে সেটা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। সেইভাবে একজন অ্যাডজুটান্ট মুরাৎ-এর কাছ থেকে খবর নিয়ে এল যে বরদিনো দখল করা হয়েছে, আর কলোচা নদীর সেতু ফরাসিদের হাতে এসে পড়েছে। অ্যাডজুটান্ট নেপোলিয়নকে জিজ্ঞাসা করল, সৈন্যরা নদী পার হবে কি? নেপোলিয়ন হুকুম দিল, সৈন্যরা শেষপ্রান্তে সমবেত হয়ে অপেক্ষা করুক। কিন্তু সে হুকুম দেবার আগেই–আসলে অ্যাডজুটান্টটি বরদিনো ত্যাগ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই-রুশরা সেতুটা পুনরায় দখল করে পুড়িয়ে দিয়েছে।

একজন অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া ছুটিয়ে এসে বিবর্ণ, ভয়ার্ত মুখে জানাল যে তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়েছে, কাম্পা আহত হয়েছে, আর দাভুৎ নিহত হয়েছে, অথচ অ্যাডজুটান্টকে যখন এইসব খবর বলা হয়েছিল ঠিক তখনই ফরাসিরা অপর পক্ষের ঘাঁটি আবার দখল করেছে, আর দাভুৎ বেঁচে আছে তার শরীর সামান্য ছড়ে গেছে মাত্র। এইসব অনির্ভরযোগ্য বিবরণের ভিত্তিতেই নেপোলিয়ন হুকুম জারি করছিল, আর তার ফলে যা হয় হুকুম পাবার আগেই সেকাজটা করা হয়ে গেছে, আর না হয় তো সে হুকুম তামিল করাই সম্ভব হয়নি।

যেসব মার্শাল বা জেনারেলরা যুদ্ধক্ষেত্রের আরো কাছাকাছি ছিল তারাও নেপোলিয়নের মতোই নিজেরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, শুধু মাঝে-মধ্যে বন্দুকের আওতার মধ্যে গেছে, তারাও নেপোলিয়নকে জিজ্ঞাসা না। করেই কোথায় ও কোন দিকে আক্রমণ চালানো হবে, কোথায় অশ্বারোহী বাহিনী ঘোড়া ছুটিয়ে যাবে, আর কোথায় ছুটে যাবে পদাতিক বাহিনী সে সম্পর্কে হুকুম জারি করেছে। কিন্তু নেপোলিয়নের মতোই তাদের হুকুমও কদাচিৎ কার্যকর করা হয়েছে, আর যদি হয়ে থাকে তাও আংশিকভাবে হয়েছে। অধিকাংশক্ষেত্রে হুকুমের বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে। যে সৈন্যদের এগিয়ে যেতে বলা হয়েছে ছররা গুলির মুখে পড়ে তারা পিছু হটেছে, যে সৈন্যদের স্বস্থানে থাকতে বলা হয়েছে তারা অপ্রত্যাশিতভাবে রুশদের সামনে দেখে হঠাৎ হয় ছুটে পিছিয়ে গেছে, নয় তো এগিয়ে গেছে সামনে, আর অশ্বারোহী বাহিনী বিনা হুকুমেই পলায়মান রুশদের পশ্চাদ্ধাবন করেছে। কামানগুলো কখনো, কোথায় সরিয়ে নেওয়া হবে, গুলি করবার জন্য কখনো পদাতিক বাহিনীকে পাঠানো হবে, আর কখনই বা অশ্বারোহীদের পাঠানো হবে রুশ পদাতিক সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করতে-এ-ধরনের সব হুকুমই অফিসাররা যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি থেকে ঘোষণা করেছেনে, অথবা দাভুৎ, অথবা মুরাৎকে জিজ্ঞাসা না করেই-নেপোলিয়নকে জিজ্ঞাসা করার তো কথাই ওঠে না। হুকুম পালন না করার জন্য অথবা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করার জন্য যে বিপদ হতে পারে তাকে তারা মোটেই ভয় করেনি, কারণ যুদ্ধে ঝুঁকি নিতে হয় সবচাইতে প্রিয় বস্তুটির–সেটা নিজের জীবন, কখনো মনে হয় পিছিয়ে যাওয়াই নিরাপদ, আর কখনো মনে হয় এগিয়ে যাওয়াই নিরাপদ, তাই যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে বুকের উপর যারা কর্মরত তারা সেই মুহূর্তের মর্জিমতোই কাজ করেছে। অবশ্য বাস্তবক্ষেত্রে এই এগিয়ে যাওয়া অথবা পিছিয়ে যাওয়ার ফলে সেনাবাহিনীর অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন বা উন্নতি ঘটেনি। একের অপরের দিকে ছুটে যাওয়া অথবা ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়ার ফলে বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি, পঙ্গু হওয়া অথবা মৃত্যু ঘটার যে ক্ষতি সেটা ঘটেছে ছুটে-আসা কামানের গোলা আর বন্দুকের গুলিতে। উড়ন্ত গোলাগুলি যেখানে ছুটছে, যেমুহূর্তে সৈন্যরা সেখান থেকে পালিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন অফিসাররা পিছন থেকে এসে তাদের নতুন করে গড়ে তুলেছে, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে, এবং পুনরায় তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে যুদ্ধের আগুনের মধ্যে, মৃত্যু-ভয়ের তাড়নায় আবার তারা শৃঙ্খলা ভেঙেছে এবং ভিড়ের প্রেরণায় যে যেদিকে পেরেছে ছুটে গেছে।

.

অধ্যায়-৩৪

দাভুৎ, নে ও মুরাৎ-নেপোলিয়নের এই তিন সেনাপতি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের খুব কাছে, অনেকসময় তারা যুদ্ধের মধ্যেও ঢুকেছে, বারবার তারা বড় রকমের সুশৃংখল ও সুগঠিত সেনাদলকে যুদ্ধরত সৈন্যদের সাহায্যার্থে পাঠিয়েছে। কিন্তু আগেকার যুদ্ধগুলিতে যেরকমটা ঘটেছিল এবার ঘটেছে তার বিপরীত ঘটনা, প্রত্যাশামতো শত্রুপক্ষের পলায়নের পরিবর্তে এবার সেই সব সুগঠিত সেনাদলই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছে বিশৃঙ্খল, আতংকিত জনতার রূপ নিয়ে। সেনাপতিরা নতুন করে তাদের সংঘবদ্ধ করেছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা ক্রমাগতই হ্রাস পেয়েছে। দিনের মাঝামাঝি সময়ে মুরাৎ তার অ্যাডজুটান্টকে পাঠাল নেপোলিয়নের কাছে, চেয়ে পাঠাল নতুন সৈন্য-শক্তি।

গোল পাহাড়ের নিচে বসে নেপোলিয়ন পঞ্চ-পানীয়ে চুমুক দিচ্ছে। তখনই মুরাতের অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া ছুটিয়ে এসে নেপোলিয়নকে আশ্বাস দিল যে হিজ ম্যাজেস্ট্রি যদি তাকে আর এক ডিভিশন সৈন্য পাঠায় তাহলে রুশ বাহিনীকে হটিয়ে দিতে পারবে।

নতুন সৈন্য? বিস্ময়ে নেপোলিয়ন বলল। অ্যাডজুটান্ট সুদর্শন তরুণ, মুরাতের মতোই লম্বা কোঁকড়া চুল। যেন তার কথাগুলি বুঝতেই পারেনি এমনিভাবে নেপোলিয়ন তার দিকে তাকাল।

সে নিজের মনেই ভাবল, নতুন সৈন্য! অর্ধেক বাহিনীকে তো ইতিমধ্যেই একটি দুর্বল, পরিখাবিহীন রুশ সেনাদলের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়েছে, তাহলে তাদের নতুন সৈন্য লাগবে কেন?

কঠোর কণ্ঠে বলল, নেপলসের রাজাকে গিয়ে বল এখনো দুপুর হয়নি, আর আমার দাবার ছকটাকেও এখনো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। চলে যাও!…

লম্বা চুল, সুদর্শন, বালক-অ্যাডজুটান্টটি টুপি থেকে হাত না সরিয়েই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে নরমেধ যজ্ঞাগারে ফিরে এল।

নেপোলিয়ন উঠে দাঁড়াল। কলাইকুণ্ঠ ও বেথিয়েরকে ডেকে এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল যার সঙ্গে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই।

আলোচনাটা নেপোলিয়ন বেশ উপভোগ করছে, কিন্তু তার মাঝখানেই বের্থিয়েরের চোখে পড়ল, ঘর্মাক্ত ঘোড়ায় চেপে একটি সেনাপতি পাহাড়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটি বেলিয়ার্দ। ঘোড়া থেকে নেমে সে দ্রুত পদক্ষেপে সম্রাটের দিকে এগিয়ে গেল এবং জোর গলায় আর একদল সৈন্য পাঠাবার স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে লাগল। প্রতিশ্রুতি দিল, সম্রাট যদি আর এক ডিভিশন সৈন্য পাঠায় তাহলে রুশদের একেবারে শেষ করে দিতে পারবে।

নেপোলিয়ন কাঁধে ঝাঁকুনি দিল, কোনো জবাব না দিয়ে পায়চারি করতে লাগল।

একসময় বেলিয়াদের কাছে গিয়ে বলল, তুমি খুব চটে আছ বেলিয়ার্দ। যুদ্ধের উত্তাপের মধ্যে থেকে ভুল করাটা খুবই সহজ। ফিরে গিয়ে আর একবার ভালো করে দেখ, তারপর আমার খাছে এসো।

বেলিয়ার্দ দৃষ্টির বাইরে যাবার আগেই রণক্ষেত্রের আর একপ্রান্ত থেকে আর একটি সংবাদবাহক ঘোড়া ছুটিয়ে এসে হাজির হল।

অনবরত বিরক্ত করায় ক্ষুব্ধ হয়ে নেপোলিয়ন বলল, এই যে, তুমি আবার কী চাও?

স্যার, প্রিন্স… অ্যাডজুটান্টটি বলতে শুরু করল।

ক্রুদ্ধ অঙ্গভঙ্গি করে নেপোলিয়ন বলল, নতুন সৈন্য চান, এই তো?

অ্যাডজুটান্ট সম্মতিসূচকভাবে মাথা নুইয়ে যুদ্ধের সংবাদ বলতে লাগল, সম্রাট তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে কয়েক পা সরে গেল, থামল, ফিরে এসে বের্থিয়েরকে ডাকল।

দুটি হাত ঈষৎ ফাঁক করে বলল, রিজার্ভ বাহিনীতে হাত দিতেই হবে। ওখানে কাদের পাঠানো যায় বল তো? (তার সম্পর্কেই নেপোলিয়ন পরবর্তীকালে বলেছিল, একটা রাজহাঁসের বাচ্চাকে আমি ঈগল পাখি বানিয়েছি।)।

সবগুলি ডিভিশন, রেজিমেন্ট ও ব্যাটেলিয়নের খবর বের্থিয়েরের মুখস্থ, সে বলল, ক্লাপারে ডিভিশনকে পাঠান স্যার।

নেপোলিয়ন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

অ্যাডজুটান্ট ক্লাপারেদ ডিভিশনের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কয়েক মিনিট পরেই পাহাড়ের পিছন থেকে ইয়ং গার্ড ডিভিশন যাত্রা শুরু করল। নেপোলিয়ন নিঃশব্দে সেইদিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ সে বের্থিয়েরকে বলল, না! ক্লাপারেদ ডিভিশনকে পাঠাতে পারি না। ফ্রিয়াতের ডিভিশনকে পাঠাও।

ক্লাপারেদের বদলে ফিয়ৎ-এর ডিভিশনকে পাঠানোর বিশেষ কোনো সুবিধাই ছিল না, আর এই পরিবর্তনের ফলে যথেষ্ট বিলম্ব ও অসুবিধারই সৃষ্টি হল, তবু সেই হুকুমই ঠিক ঠিক তামিল করা হল। নেপোলিয়ন খেয়ালই করল না যে সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে সেই ডাক্তারের ভূমিকায়ই সে অভিনয় করল যে ওষুধ পাল্টাবার ফলে রোগ-নিরাময়কেই বিলম্বিত করে–অথচ এই ভূমিকার কথা সে ভালোই জানত এবং তার নিন্দাও করত।

অন্যসব ডিভিশনের মতোই ফ্রিয়াৎ-এর ডিভিশনও যুদ্ধক্ষেত্রের ধোঁয়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। চারদিক থেকে অ্যাডজুটান্টরা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে যেন সলা-পরামর্শ মতো একই কথা বলতে লাগল। সকলেই নতুন সৈন্য-সাহায্যের প্রার্থনা জানিয়ে বলতে লাগল যে রুশরা তাদের ঘাঁটিতে অটুট থেকে এমন নারকীয় বোমাবর্ষণ শুরু করেছে যে ফরাসি বাহিনী একেবারে জল হয়ে গলে যাচ্ছে।

শিবিরের একটা টুলে বসে নেপোলিয়ন চিন্তায় ডুবে গেল। ভ্রমণপ্রিয় ম. দ্য বুসে সকাল থেকে না খেয়ে আছে, সম্রাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে সশ্রদ্ধভাবে লাঞ্চ খাবার প্রস্তাব করল।

বলল, আশাকরি এখন জয়লাভের জন্য ইয়োর ম্যাজেস্ট্রিকে অভিনন্দন জানাতে পারি?

নেপোলিয়ন নীরবে নেতিবাচকভাবে মাথাটা নাড়ল। লাঞ্চের প্রস্তাবে নয়, শুধু জয়লাভের কথাতেই তার আপত্তি ধরে নিয়ে ম, দ্য বুসে সাহস করে পরিহাসের সুরে বলে বসল যে লাঞ্চ হাতের কাছে এলে সেটা গ্রহণ না করার কোনো মানেই হয় না।

চলে যাও এখান থেকে…হঠাৎ বিষণ্ণ কণ্ঠে কথাটা বলে নেপোলিয়নই সেখান থেকে সরে গেল।

দুঃখ, অনুতাপ ও উচ্ছ্বাসের একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল ম, দ্য বুসের মুখে, সেও ধীর পায়ে অন্য সেনাপতিদের খোঁজে চলে গেল।

একজন চিরভাগ্যবান জুয়াড়ি যখন বেপরোয়াভাবে টাকা ঢেলে সর্বদা জিতে যাবার পরে হঠাৎ যখন দেখে যে তার হারের পর হার হচ্ছে তখন তার মনে যে অবসাদ আসে তেমনি অবসাদ দেখা দিয়েছে নেপোলিয়নের মনে।

সেই একই সৈন্য, একই সেনাপতি, একই প্রস্তুতি, একই বিলি-বন্দোবস্ত, নিজেও তো সেই একই মানুষই আছে, বরং সে এখন আগের চাইতে আরো বেশি অভিজ্ঞ ও রণকুশল হয়েছে। এমন কি শত্রুপক্ষ অস্তারলিজ ও ফ্রিডল্যান্ডে যা ছিল তাই আছে–অথচ কী এক প্রচণ্ড আঘাতে তার ডান হাতটা অলৌকিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছে।

যেসব পুরনো পদ্ধতি অব্যর্থভাবে জয়যুক্ত হয়েছে : কামানশ্রেণীকে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করা, শত্রুর ব্যুহ ভেদ করতে রিজার্ভ বাহিনীর আক্রমণ, লৌহকঠিন সৈন্যদের দিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণ–এইসব পদ্ধতিই তো প্রয়োগ করা হয়েছে অথচ জয়লাভ করা তো দূরের কথা, চারদিক থেকে শুধু একই সংবাদ আসছে-সেনাপতিরা নিহত ও আহত হয়েছে, নতুন সৈন্য দরকার, রুশসৈন্যকে বিতাড়িত করা অসম্ভব, নিজের সৈন্যরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে।

আগে দুটি কি তিনটি হুকুম দেওয়া হলে, মুখের কয়েকটা কথা বের করলেই মার্শাল ও অ্যাডজুটান্টরা ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে খুশি মুখের অভিনন্দনবার্তা নিয়ে, শুনিয়েছে জয়লাভের কথা। কত শত্রু বন্দি হয়েছে তার হিসাব, সঙ্গে এনেছে বস্তা-বোঝাই শত্রুপক্ষের ঈগল-চিহ্ন ও পতাকা, কামান ও খাদ্যভাণ্ডার আর মুরাৎ শুধু চেয়েছে মালগাড়ি সংগ্রহ করে অশ্বারোহী বাহিনী পাঠাবার অনুমতি। লোদি, মারেঙ্গো, আর্কোলা, জেনা, অস্তারলিজ, ওয়াগ্রাম প্রভৃতি সর্বত্র এই একই জিনিস ঘটেছে। কিন্তু এবার তার সৈন্যদের মধ্যে নতুন কিছু ঘটছে।

আক্রমণকারীদল আট ঘণ্টা ধরে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও যখন জয়লাভ করতে পারে না তখন তার অর্থ যে কি দাঁড়াল সেটা যুদ্ধের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে নেপোলিয়ন ভালোই জানে। কে জানে, এখন যে কোনো একটা ছোটখাট দুর্ঘটনাই তার ও তার বাহিনীর ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। 

যখন সে মনে মনে চিন্তা করছে যে এই বিচিত্র রাশিয়া অভিযানে একটা যুদ্ধেও তার জয় হয়নি, দুই মাসের মধ্যে একটা পতাকা, একটা কামান, অথবা একটা সেনাদলও তার দখলে আসেনি, চারদিকের সকলের মুখেই দেখছে একটা চাপা অবসন্নতার ভাব, অনবরত সংবাদ আসছে যে রুশরা এখনো তাদের ঘাঁটি আগলে রেখেছে–তখন দুঃস্বপ্নের মতো একটা ভয়ংকর অনুভূতি তাকে চেপে ধরেছে, যেসব দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার ফলে তার ধ্বংস এগিয়ে আসতে পারে তারাই তার মনকে ঘিরে ধরেছে। রুশরা তার বাম ব্যূহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তার ব্যূহের কেন্দ্রকে ভেদ করতে পারে, একটা বিক্ষিপ্ত কামানের গোলা এসে তাকে মেরে ফেলতে পারে। এসবই তো সম্ভব। আগেকার সব যুদ্ধে সে ভাবত শুধু জয়ের নানা সম্ভাবনার কথা, আর এখন দুর্ভাগ্যের অসংখ্য সম্ভাবনা তার সামনে এসে হাজির হচ্ছে, সে সব কিছুই ঘটতে পারে বলেই তার বিশ্বাস। হ্যাঁ, তার অবস্থা এখন সেই মানুষটির মতোই যে স্বপ্ন দেখছে, একটা গুণ্ডা তাকে আক্রমণ করতে আসছে, গুণ্ডাটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে প্রচণ্ড আঘাত হানতে সে হাত তুলেছে, কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল যে তার উদ্যত হাতটা যেন একখণ্ড জীর্ণ বস্ত্রের মতো অসহায় পঙ্গু হয়ে ঢলে পড়ছে, আর অনিবার্য ধ্বংসের আতংকে তাকে অসহায়ভাবে চেপে ধরেছে।

রুশরা ফরাসি বাহিনীর বাম ব্যূহের উপর আক্রমণ চালিয়েছে-এই সংবাদ নেপোলিয়নকে আতংকিত করে তুলেছে। হাঁটুর উপর কনুই রেখে মাথা নিচু করে সে পাহাড়ের নিচে একটা টুলের উপর চুপচাপ বসে আছে। বের্থিয়ের এগিয়ে এসে প্রস্তাব করল, প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে তাদের একবার সেনাদল পরিদর্শ করতে যাওয়া উচিত।

কী? কি বললে তুমি? নেপোলিয়ন শুধাল। হ্যাঁ, আমার ঘোড়া আনতে বল।

ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে সে সেমেনভঙ্কের দিকে এগিয়ে গেল।

মাথার উপর থেকে বারুদের ধোয়া ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, পায়ের নিচে রক্তের স্রোতে ভাসছে ঘোড়া ও মানুষ,কোথাও একক, কোথাও বা স্তূপ হয়ে। এমন একটা ছোট জায়গায় এত বেশি লোকের মৃত্যু অথবা এমন ভয়ংকর দৃশ্য নেপোলিয়ন অথবা তার কোনো সেনাপতি আগে কখনো দেখেনি। সেমেনভঙ্কের উঁচু জায়গাটাতে উঠে ধোয়ার ভিতর দিয়ে নেপোলিয়ন অপরিচিত রংয়ের ইউনিফর্মধারী অনেক সৈন্য দেখতে পেল। তারা রুশ সৈন্য।

এখন আর যুদ্ধ হচ্ছে না : চলেছে এমন এক অবিরাম হত্যাকাণ্ড যাতে ফরাসি বা রুশ কোনো পক্ষেরই কোনো লাভ নেই। নেপোলিয়ন ঘোড়া থামাল, আবার ডুবে গেল দিবাস্বপ্নের মধ্যে, সে স্বপ্ন ভাঙাল বের্থিয়ের। তার সামনে ও চারদিকে যা ঘটছে তাকে সে থামাতে পারে না, অথচ এ কাণ্ডকারখানা তারই নির্দেশে চলেছে, আর তার উপরেই নির্ভর করছে। এত করেও সাফল্য লাভ করতে না পারায় এই প্রথম তার মনে হল যে, এ ব্যাপারটাই অপ্রয়োজনীয় ও ভয়াবহ।

একজন সেনাপতি নেপোলিয়নের কাছে এগিয়ে এসে সাহস করে প্রস্তাব করল, সে নিজেই যেন ওল্ড গার্ডসকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচালনা করে নিয়ে যায়। নোও বের্থিয়ার নেপোলিয়নের কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সেনাপতিটির অর্থহীন প্রস্তাব শুনে তারা দৃষ্টি-বিনিময় করল, বিদ্রুপের হাসি হাসল।

নেপোলিয়ন মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

ফ্রান্স থেকে আটশো লীগ (১ লীগ=২জত(১,২) মাইল) দূরে এসে আমার গার্ডসকে ধ্বংস হতে আমি দেব না! এই কথা বলে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে সে শেভার্দিনোতে ফিরে গেল।

.

অধ্যায়-৩৫

 যে কম্বল-বিছানো বেঞ্চে কুতুজভকে সকালে দেখেছিল পিয়ের, সেখানেই সে বসে আছে, শাদা মাথাটা ঝুলে পড়েছে, ভারি শরীরটা এলিয়ে পড়েছে। নিজে কোনো হুকুম দিচ্ছে না, শুধু অপরের কথায় সায় দিচ্ছে, নয় তো আপত্তি জানাচ্ছে।

অনেককে বলছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করব, আবার কাউকে বলছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, একবার যাও তো বাপু, গিয়ে দেখে এস, অথবা বলছে, না, তা করো না, বরং অপেক্ষাই করা হোক! যেসমস্ত প্রতিবেদন আসছে সেগুলি মন দিয়ে শুনছে, অধীনস্থ লোকরা কোনো নির্দেশ চাইলে তাও দিচ্ছে, কিন্তু তার আসল আগ্রহ শোনা কথাগুলির দিকে নয়, অন্য কিছুতে-যারা কথা বলছে তাদের মুখের ভাব ও গলার স্বরের দিকে। বহু বছরের সামরিক অভিজ্ঞতায় সে জেনেছে, পরিণত বয়সের জ্ঞানে সে বুঝেছে, হাজার হাজার মানুষ যেখানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে সেখানে একজন মানুষের পক্ষে তাদের পরিচালনা করা অসম্ভব, সে জানে, একজন প্রধান সেনাপতির হুকুম, অথবা সৈন্যসমাবেশের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন, কামানের সংখ্যাধিক্য ও নরহত্যার সংখ্যা দিয়ে একটা যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয় না, ফলাফল নির্ধারিত হয় এমন একটা শক্তির দ্বারা যাকে ধরা-ছোঁয়া যায় না, যাকে বলা হয় সেনাদলের মনোভাব, আর কুতুজভ চেষ্টা করে সেই শক্তির উপর নজর রেখে সাধ্যমতো তাকে পরিচালিত করতে।

কুতুজভের চেহারায় ফুটে উঠেছে একটা সংহত শান্ত মনোযোগ, তার মুখে ফুটে উঠেছে অতিরিক্ত পরিশ্রমের আভাস, যেন বৃদ্ধ বয়স ও দুর্বল শরীরের ক্লান্তিকে সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে।

এগারোটার সময় খবর এল ফরাসিরা যেসব ঘাঁটি দখল করে নিয়েছিল সেগুলি উদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু প্রিন্স ব্যাগ্রেশন আহত হয়েছে। কুতুজভ আর্তনাদ করে মাথাটা দোলাতে লাগল।

একজন অ্যাডজুটান্টকে বলল, ঘোড়া ছুটিয়ে প্রিন্স পিতর আইভানভিচ-এর (ব্যাগ্রেশন) কাছে চলে যাও, সঠিক খবর নিয়ে এস। তারপর পাশে দাঁড়ানো উৰ্তেমবুর্গের ডিউকের দিকে ফিরে বলল, ইয়োর হাইনেস দয়া করে প্রথম বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন কি?

ডিউক চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই–সে হয়তো তখনো সেমেনভঙ্কে পৌঁছেওনি-তার অ্যাডজুটান্ট সেখান থেকে এসে কুতুজভকে জানাল যে ডিউক আরো সৈন্য চেয়ে পাঠিয়েছে।

কুতুজভ মুখটা বেঁকিয়ে দখতুরভের কাছে খবর পাঠাল সে যেন প্রথম বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে, আর ডিউককে অনুরোধ করে পাঠাল সে যেন ফিরে আসে, কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাকে ছেড়ে দেওয়া চলে না। আবার যখন খবর এল যে মুরাৎ বন্দি হয়েছে, আর কর্মচারীরা যখন তাকে অভিনন্দিত করল, তখন কুতুজভ একটু হাসল মাত্র।

বলল, একটু অপেক্ষা করুন মশাইরা। যুদ্ধে যখন জয় হয়েছে তখন মুরাতের বন্দি হওয়াটা কিছু অসাধারণ ব্যাপার নয়। তথাপি আনন্দ করবার আগে আরো একটু অপেক্ষা করা ভালো।

কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে খবরটা প্রচার করে দেবার জন্য সে একজন অ্যাডজুটান্টকে পাঠিয়ে দিল।

কুতুজভ ছিল গোর্কিতে, রুশ ঘাঁটির কেন্দ্রস্থলের নিকটে। আমাদের বাম ব্যূহের উপর নেপোলিয়নের আক্রমণ অনেকবার প্রতিহত হয়েছে। মধ্যস্থলে ফরাসিরা বরদিনোর ওপারে যেতে পারেনি, আর তাদের বাম ব্যূহের উপর আক্রমণ হেনে উভারতের অশ্বারোহী বাহিনী ফরাসিদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

তিনটে নাগাদ ফরাসিদের আক্রমণ বন্ধ হল। যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসেছে আর তার চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের সকলের মুখেই কুতুজভ একটা প্রচণ্ড চাপ লক্ষ্য করল। দিনের সাফল্যে সে খুশি হয়েছে-এ সাফল্য একান্তই আশাতীত, কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটির শক্তিতে আর কুলিয়ে উঠছে না। তার মাথাটা বারকয়েক এমনভাবে ঝুলে পড়ল যে মনে হল সে বুঝি পড়ে যাবে। সে দুলতে লাগল। ডিনার পরিবেশন করা হল।

এমন সময় অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল ওলযোগেন এসে হাজির হল। এই লোকটিই প্রিন্স আন্দ্রুর পাশ দিয়ে যাবার সময় বলেছিল রণক্ষেত্রটাকে আরো ছড়িয়ে দেওয়া উচিত,ব্যাগ্রেশনও এই লোকটিকে অপছন্দ করে। বাম ব্যূহের অবস্থার কথা জানাতেই সে এসেছে বার্কলে দ্য তলির কাছ থেকে। আহত সৈনিকদের ছুটে পিছিয়ে যেতে দেখে এবং সেনাবাহিনীর পিছনের দিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে তীক্ষ্ণবুদ্ধি বার্কলে দ্য তলি সবকিছু বিচার করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে যুদ্ধে হার হয়েছে, আর সেই সংবাদ জানাতেই তার প্রিয় অফিসারটিকে পাঠিয়েছে প্রধান সেনাপতির কাছে।

কুতুজভ অনেক কষ্টে একটুকরো সিদ্ধ মুরগির মাংস চিবুচ্ছিল। ভাঁজ-পড়া চোখের পাতার নিচ দিয়ে ঝকঝকে দুটি চোখ মেলে সে ওলযোগেনের দিকে তাকাল।

কোনোরকমে টুপির মাথাটা ছুঁয়ে ওলযোগেন উদাসভাবে পা দুটো টান টান করে আধা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কুতুজভের দিকে এগিয়ে গেল।

প্রশান্ত মহামহিমের প্রতি কিছুটা ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য দেখিয়ে ওলযোগেন যেন বোঝাতে চাইছে যে একজন সুশিক্ষিত সামরিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সে রাশিয়ার লোকদের সুযোগ দিয়েছে যাতে তারা এই অকর্মণ্য বৃদ্ধ লোকটিকে নিয়ে নাচানাচি করতে পারে, আসলে এই বৃদ্ধের সব পরিচয়ই সে রাখে। ওলযোগেন ভাবল, Der alte Herr (জার্মানরা নিজেদের মধ্যে এই নামেই কুতুজভকে ডাকে) বেশ আরামেই আছে। সাগ্রহে কুতুজভের সামনে রাখা থালাটার দিকে তাকিয়ে বার্কলের হুকুম মতোই বামব্যূহের বিবরণ এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে শোনাতে লাগল।

আমাদের ঘাঁটির সবগুলো প্রান্তই শত্রুপক্ষের হাতে চলে গেছে, সৈন্যের অভাবে তাদের বেদখল করা যাচ্ছে না, সৈন্যরা পালাচ্ছে, তাদের থামানো অসম্ভব।

কুতুজভ চিবুনো বন্ধ করল, লোকটা কি বলছে বুঝতে না পেরে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির বিচলিত ভাব লক্ষ্য করে ওলযোগেন হেসে বলল, আমি যা দেখেছি সেটা প্রশান্ত মহামহিমের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা আমি সঙ্গত মনে করিনি। সৈন্যরা একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে…

আপনি দেখেছেন? আপনি দেখেছেন?… ভুরু কুঁচকে কুতুজভ চিৎকার করে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে ওলযোগেনের দিকে এগিয়ে গেল।

আপনার…আপনার এতবড় সাহস… চিৎকার করতে গিয়ে তার গলা আটকে গেল, কাঁপা হাত তুলে ভয় দেখাবার ভঙ্গি করে বলল, আমার কাছে একথা বললেন কোন সাহসে? এ ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না। আমার এই কথা জেনারেল বার্কলেকে গিয়ে বলুন যে তার সংবাদ ভুল, যুদ্ধের সত্যিকারের খবর তার চাইতে আমি ভালো জানি, আমি প্রধান সেনাপতি।

ওলযোগেন কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কুতুজভ তাকে থামিয়ে দিল।

বাম ব্যূহে শত্রুকে প্রতিহত করা হয়েছে, আর দক্ষিণ ব্যূহে তাকে পরাস্ত করা হয়েছে। দেখুন স্যার, আপনি যদি ভুল দেখে থাকেন, তাহলে যা জানেন না তা আমাকে বলবেন না। ভালো মানুষের মতো জেনারেল বার্কলের কাছে ফিরে যান, আর তাকে আমার এই দৃঢ় অভিপ্রায় জানিয়ে দিন যে আগামীকাল শক্রকে আক্রমণ করা হবে। কঠোর স্বরে কুতুজভ কথাগুলি বল।

সব চুপ। শুধু শোনা যাচ্ছে বৃদ্ধ সেনাপতির ভারি শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।

সর্বত্র তারা প্রতিহত হয়েছে, সেজন্য ধন্যবাদ জানাই ঈশ্বরকে আর আমার সাহসী সৈন্যদের! শত্ৰু পরাস্ত হয়েছে, কাল আমরা তাদের তাড়িয়ে দেব রাশিয়ার পবিত্র মাটি থেকে। বলতে বলতে কুতুজভ ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল, তার দুই চোখ জলে ভরে এল।

দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে, ঠোঁট দুটি বেঁকিয়ে ওলযোগেন নীরবে এক পাশে সরে গেল। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির নির্বোধ আত্মপ্রবঞ্চনা দেখে সে অবাক হয়ে গেছে।

একটি সৌম্য, সুদর্শন জেনারেলকে পাহাড় বেয়ে উঠে আসতে দেখে কুতুজভ বলে উঠল, এই তো, এই তো এসেছে, আমার নায়ক এসেছে!

লোকটি রায়েভস্কি, আজ সারাটাদিন সে কাটিয়েছে বরদিনো যুদ্ধক্ষেত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে।

রায়েভস্কি জানাল, আমাদের সৈন্যরা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘাঁটি আগলে রেখেছে, ফরাসিরা আর আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছে না।

তার কথা শুনে কুতুজভ ফরাসিতে বলল, তাহলে অন্য কারো কারো মতো তুমি মনে কর না যে আমাদের পশ্চাদপসরণ করতেই হবে?

রায়েভস্কি উত্তর দিল, ঠিক উল্টো ইয়োর হাইনেস, চুড়ান্ত যুদ্ধের আগে যারা অনমনীয় থাকে তারাই জয়লাভ করে। আর আমার মতে…

কুতুজভ আর অ্যাডজুটান্টকে ডাকল, কেসারভ! এখানে কালকের হুকুমটা লিখে ফেল। অন্য একজনকে উদ্দেশ করে বলল, আর তুমি ঘোড়া ছুটিয়ে রণক্ষেত্রে চলে যাও, ঘোষণা করে দাও যে কাল আমরা আক্রমণ করব।

কুতুজভ যখন রায়েভস্কির সঙ্গে কথা বলছিল এবং সেদিনের ঘোষণাটা বলে যাচ্ছিল, তখন ওলযোগেন বার্কলের কাছ থেকে ফিরে এসে জানাল, জেনারেল বার্কলে দ্য তলির ইচ্ছা, ফিল্ড-মার্শাল যে হুকুম জারি করেছেন সেটা তাকে লিখিতভাবে জানানো হোক।

ওলযোগেনের দিকে না তাকিয়েই কুতুজভ প্রাক্তন প্রধান সেনাপতির ইচ্ছামতো হুকুমটা লিখে দেবার নির্দেশ দিল। যে রহস্যময় সংজ্ঞাতীত বন্ধন গোটা বাহিনীর মধ্যে একই মনোভাব অক্ষুণ্ণ রাখে, যাকে বলা হয়, সেনাবাহিনীর মনোবল, এবং যেটা যুদ্ধের প্রধান শক্তিস্বরূপ, তারই সাহায্যে কুতুজভের কথাগুলি, পরের দিনের যুদ্ধের হুকুম-নামা, সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত জানাজানি হয়ে গেল।

কিন্তু সেনাবাহিনীর দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত যে একই কথা অথবা একই হুকুম পৌঁছে গেল তা কিন্তু নয়। মুখে মুখে যেকথা নানা প্রান্তে পৌঁছে গেল তার সঙ্গে কুতুজভের কথার কোনো মিলই রইল না, কিন্তু তার যা বক্তব্য সেটা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ল, কারণ তার বক্তব্যটা কোনোরকম সুকৌশল হিসেবের ফল নয়, বরং এমন একটা অনুভূতির ব্যাপার যা প্রধান সেনাপতি থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি রুশ-এর মনে সমানভাবে বিদ্যমান।

আগামীকাল শত্রুকে আক্রমণ করা হবে একথা জেনে, এবং যেটা তাদের মনের কথা উচ্চতম মহল থেকে তারই সমর্থন শুনতে পেয়ে, ক্লান্ত ও অস্থিরচিত্ত সৈনিকরা নতুন করে সান্ত্বনা পেল, উজ্জীবিত হয়ে উঠল।

.

অধ্যায়-৩৬

রিজার্ভ বাহিনীর অন্যতম প্রিন্স আন্দ্রুর রেজিমেন্টটি বেলা একটার পর পর্যন্তও সেমেনবঙ্কের পিছনে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মধ্যেও নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করছিল। দুশোর বেশি সৈন্যকে হারিয়ে হারিয়ে বেলা দুটো নাগাদ সেই রেজিমেন্টকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সেমেনভঙ্ক ও গোল পাহাড় কামানশ্রেণীর মধ্যবর্তী একটা পায়ে পায়ে চষে ফেলা যইয়ের ক্ষেতে। সেদিন একটা থেকে দুটোর মধ্যে শত্রুপক্ষের কয়েক শ কামান থেকে প্রচণ্ডভাবে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, আর হাজার হাজার সৈন্য মারা পড়েছে। সেই জায়গা থেকে না নড়ে এবং একটিও গুলি না চালিয়ে রেজিমেন্টের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য মারা গেল। সম্মুখ থেকে এবং বিশেষ করে ডান দিক থেকে, ধোয়ার ভিতর হতে গর্জে উঠছে কামান, আর সেই রহস্যময় ধোয়ার রাজ্য থেকে দ্রুত শব্দে ছুটে আসছে কামানের গোলা, আর ধীর গতিতে ছুটে আসছে বন্দুকের গুলি। যেন তাদের একটু বিশ্রাম দেবার জন্যই গোলাগুলি ছুটছে মাথার উপর দিয়ে, কিন্তু কখনো কখনো মাত্র এক মিনিটের মধ্যেই বেশ কয়েকজন সৈন্যকে ছিনিয়ে নিচ্ছে রেজিমেন্টের ভিতর থেকে, আর আহতদের বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং নিহতদের টেনে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

রেজিমেন্টের অন্য সকলের মতোই বিবর্ণ, বিষণ্ণ মুখে প্রিন্স আন্দ্রু একটা যইক্ষেতের পার্শ্ববর্তী মাঠের শেষ প্রান্তে পায়চারি করছে। মাথাটা নুয়ে পড়েছে, দুটো হাত রেখেছে পিছনের দিকে। তার কিছুই করার নেই, দেবার মতো হুকুমও কিছু নেই। সবই চলছে আপনা থেকে। নিহতদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আহতদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সৈনিকরা আরো ঘন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোনো সৈন্য পিছিয়ে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এগিয়ে আসছে। প্রথমে প্রিন্স আন্দ্রু মনে করেছিল যে সৈন্যদের মনে সাহস যোগাননা এবং তাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা তার কর্তব্য, তাই সে সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটছিল, কিন্তু অচিরেই সে বুঝতে পারল যে এসবের কোনো দরকারই নেই, সৈন্যদের শেখাবার মতো কিছুই তার আয়ত্তে নেই। পা টেনে টেনে, ঘাসের বুকে খস খস শব্দ তুলে, বুটের উপর জমে ওঠা ধুলোর দিকে তাকিয়ে সে মাঠ ধরে হাঁটতে লাগল। আগের দিনের কোনো চিন্তাই তার মনে নেই। সে কিছুই ভাবছে না। ক্লান্ত শ্রবণে শুধু শুনছে অবিশ্রাম শব্দের স্রোত, অর্ধবৃত্তাকার হিস-হিস শব্দ থেকে বোমার গর্জনকে আলাদা করে চিনতে পারছে। এই একটা আসছে…ঠিক আমাদের দিকেই আসছে।…আবার একটা! আবার! ঠিক আঘাত করেছে। একটু থেমে সৈন্যদের দিকে তাকাল। না, উপর দিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা ঠিক আঘাত করেছে। শো-ও-ও ধপ! তার থেকে পাঁচ পা দূরে পড়ে একটা কামানের গোলা কিছুটা শুকনো ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নামল। আবার সৈন্যদের দিকে তাকাল। সম্ভবত অনেকের আঘাত লেগেছে–দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নের কাছে মস্ত বড় ভিড় জমেছে।

সে চেঁচিয়ে বলল, অ্যাডজুটান্ট! ওদের ভিড় করতে নিষেধ কর।

তার নির্দেশ মতো কাজ করে অ্যাডজুটান্ট প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে এগিয়ে এল। অন্য দিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এল জনৈক জনৈক ব্যাটেলিয়ন-কমান্ডার।

ওই দেখ! একটি ভীত সৈনিক আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, আর একটা গোলা দ্রুতবেগে উড়তে নিচের দিকে নেমে আসা পাখির মতো প্রায় নিঃশব্দে এসে পড়ল প্রিন্স আন্দ্রুর দুই পা দূরে, ব্যাটেলিয়ন-কমান্ডারের ঘোড়াটার একেবারে কাছে। ঘোড়াটা নাকের শব্দ করে এমনভাবে লাফিয়ে একপাশে সরে গেল যে মেজরের ছিটকে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ঘোড়ার ভয় সৈনিকদের মধ্যেও সঞ্চারিত হল।

সপাটে মাটিতে শুয়ে পড়ে অ্যাডজুটান্ট চেঁচিয়ে বলল, শুয়ে পড়।

প্রিন্স আন্দ্রু ইতস্তত করল। ধূমায়মান গোলাটা তার ও শুয়ে-পড়া অ্যাডজুটান্টের মাঝখানে লাটুর মতো ঘুরতে লাগল।

ঘূর্ণায়মান কালো গোলকটা থেকে যে ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে সেদিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, এই কি মৃত্যু? আমি মরতে পারি না, মরতে চাই না। জীবনকে আমি ভালোবাসি ভালোবাসি এই পৃথিবী, এই ঘাস, এই বাতাস… এইসব ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ল যে সকলেই তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অ্যাডজুটান্টকে বলল, এটা লজ্জার কথা! কি…।

তার কথা শেষ হল না। ঠিক সেইমুহূর্তে একই সঙ্গে ভেসে এল একটা বিস্ফোরণের শব্দ, জানালার ভাঙা কাঁচের মতো ছিটকে-আসা বোমার টুকরোর হিস-হিস শব্দ, আর দমবন্ধ-করা বারুদের গন্ধ, হাত তুলে একপাশে সরে গিয়েই প্রিন্স আন্দ্রু উপুড় হয়ে পড়ে গেল। কয়েকজন অফিসার ছুটে এল। তলপেটের ডান দিক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ঘাসের অনেকটা জায়গা লাল করে দিল।

অসামরিক কর্মীরা স্ট্রেচার নিয়ে এসে অফিসারদের পিছনে দাঁড়াল। প্রিন্স আন্দ্রু ঘাসের উপর মুখ খুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ঘর্ঘর শব্দে তার নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে।

অপেক্ষা করছ কিসের জন্য? এগিয়েএস!

চাষীরা এগিয়ে গিয়ে কাঁধ ও পা ধরে তাকে তুলল, সে করুণকণ্ঠে আর্তনাদ করতে লাগল, পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে চাষীরা আবার তাকে নামিয়ে দিল।

কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ওকে ধরে তোলা! যা হতে হোক!

আবার তাকে কাধ করে তুলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দেওয়া হল।

হা ঈশ্বর!–অফিসারদের মুখে নানা কথা শোনা গেল।

একজন অ্যাডজুটান্ট বলল, আমার কানে একেবারে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।

 স্ট্রেচার কাঁধে নিয়ে চাষীরা দ্রুতপায়ে ড্রেসিং-স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল।

একতালে পা ফেলে! আঃ…এই চাষীরা! অসমান পা ফেলে চাষীরা হাঁটার দরুন স্ট্রেচারটা দুলছিল, তাই তাদের কাঁধের উপর হাতের চাপ দিয়ে একজন অফিসার চেঁচিয়ে তাদের সংযত করল।

সামনের দিককার চাষীটি বলল, একতালে পা ফেল ফেদর…আমি বলছি ফেদর!

পিছন থেকে আর একটি চাষী পায়ে পা মিলিয়ে বলল, এবার ঠিক হয়েছে!

দিমোখিন ছুটে এসে স্ট্রেচারের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে উঠল, ইয়োর এক্সেলেন্সি! আঁ, প্রিন্স!

প্রিন্স আন্দ্রু চোখ মেলে তার দিকে তাকাল, আবার তার চোখের পাতা নেমে এল।

অসামরিক কর্মীরা প্রিন্স আন্দ্রুকে জঙ্গলের পাশে অবস্থিত ড্রেসিং-স্টেশনে নিয়ে গেল। বার্চ গাছের জঙ্গলের এক প্রান্তে তিনটি তাঁবু খাঁটিয়ে ড্রেসিং-স্টেশনটা তৈরি করা হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে অনেক গাড়ি-ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়াগুলো চলমান বালতি থেকে যই খাচ্ছে, যে দানাগুলো নিচে পড়ছে চড় ইগুলো উড়ে উড়ে তাই খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। রক্তের গন্ধ পেয়ে কিছু কাক বার্চ গাছের মধ্যে উড়তে উড়তে অধৈর্য হয়ে কা কা করে ডাকছে। তাবুর চারদিকে পাঁচ একরের বেশি জমি জুড়ে নানা পোশাকপরা রক্তমাখা সৈনিকরা শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে আছে। আহতদের ঘিরে স্ট্রেচার-বাহক সৈনিকরা বিন্দু মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। অফিসাররা তাদের বৃথাই সরে যেতে বলছে, তারা দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে আহতদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁবুর ভিতর থেকে কখনো ভেসে আসছে ক্রুদ্ধ চিৎকার, কখনো যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ। মাঝে মাঝে ড্রেসাররা ছুটে বেরিয়ে আসছে, কেউ জল আনতে যাচ্ছে, কেউ বা জানাচ্ছে কে তার পরে যাবে। নিজ নিজ পালার জন্য অপেক্ষমাণ সৈনিকরা আর্তনাদ করছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, কাঁদছে, কাতরাচ্ছে, অভিশাপ দিচ্ছে, আবার ভদকাও চাইছে। কারো বা বিকার দেখা দিয়েছে। প্রিন্স আন্দ্রুর বাহকরা আহত সৈনিকদের ডিঙিয়ে রেজিমেন্ট-কমান্ডার হিসেবে তাকে নিয়ে একটা তাবুর একেবারে কাছে গিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় থেমে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু চোখ মেলল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত বুঝতেই পারল না চারদিকে কি হচ্ছে। তার মনে পড়ল সেই মাঠ, সেই জঙ্গল, সেই ঘূর্ণায়মান কালো গোলক, আর জীবনের প্রতি সেই আকস্মিক উচ্ছ্বসিত ভালোবাসা। তার থেকে দুই পা দূরে গাছের ডালে হেলান দিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ-বাঁধা একজন সুদর্শন, দীর্ঘদেহ নন-কমিশন্ড অফিসার সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে জোর গলায় কথা বলছে। তার মাথায় ও পায়ে বুলেটের আঘাত লেগেছে। সাগ্রহে তার কথা শুনতে আহত সৈনিক ও স্ট্রেচার-বাহকরা তাকে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।

জ্বরের জন্য তার চোখ দুটো চকচক করছে, চারদিকে তাকিয়ে সে বলছে, সেখান থেকে তাকে লাথি মেরে দূর করে দিলাম, স্বয়ং রাজাকেও চেপে ধরেছিলাম। সেইমুহূর্তে যদি রিজার্ভ পৌঁছে যেত, তাহলে তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না হে বাপুরা! আমি সত্যি বলছি…

অনেক সকলের মতোই প্রিন্স আন্দ্রুও চকচকে চোখে তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা পেল। সে ভাবল, এখন কি সবই সমান নয়? সেখানেই বা কি হবে, আর এখানেই বা কি ছিল? জীবনকে ছেড়ে যেতে কেন আমি এত অনিচ্ছুক হয়েছিলাম? এই জীবনে এমন কিছু ছিল যা আমি বুঝিনি এবং এখনো বুঝি না…

.

 অধ্যায়-৩৭

 রক্তমাখা এপ্রন পরে একজন ডাক্তার বেরিয়ে এল। যাতে চুরুটে রক্ত না লাগতে পারে সেইজন্য চুরুটটা ধরা আছে তার এক হাতের বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠার ফাঁকে। আহতদের মাথার উপর দিয়ে সে চারদিকে তাকাতে লাগল। আসলে তার একটু বিশ্রাম দরকার। কিছুক্ষণের জন্য ডান দিক থেকে বাঁ দিকে মাথাটাকে ঘুরিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে নিচে তাকাল।

জনৈক ড্রেসার প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখিয়ে দিলে ডাক্তার বলল, ঠিক আছে, এক্ষুনি। তারপর লোকজনদের বলল তাকে তাবুর ভিতরে নিয়ে যেতে।

অপেক্ষারত আহতদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল।

একজন বলে উঠল, দেখা যাচ্ছে পরপারে যাবার পথেও একমাত্র দ্ৰজনরাই আগে সুযোগ পাবে!

প্রিন্স আন্দ্রুকে ভিতরে নিয়ে সদ্য ধুয়ে-দেওয়া একটা টেবিলে শুইয়ে দেওয়া হল। তাবুর ভিতরে কি আছে প্রিন্স আন্দ্রু ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। চারদিকের করুণ আর্তনাদ, আর নিজের উরু, পাকস্থলী ও পিঠের তীব্র যন্ত্রণার জন্য অন্য কোনোদিকে সে মন দিতে পারছে না। সে যা কিছু দেখতে পেল সব মিলেমিশে একাকার হয়ে তার মনে হল নিচু তাবুটা যেন রক্তাক্ত উলঙ্গ মানবদেহে ভর্তি হয়ে গেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে অগস্ট মাসের এক উত্তপ্ত দিনে ঠিক এই দৃশ্যই সে দেখেছিল স্মোলেনস্ক রোডের পাশে একটা নোংরা পুকুরের মধ্যে।

তাঁবুর মধ্যে তিনটি অপারেশন টেবিল দুটোতে লোক ছিল, তৃতীয়টাতে প্রিন্স আন্দ্রুকে শুইয়ে দেওয়া হল। তার একেবারে কাছের টেবিলে বসে আছে একটি তাতার। পাশে খুলে রাখা ইউনিফর্ম দেখে মনে হল সে একজন কসাক। চারজন সৈনিক তাকে ধরে আছে, আর চশমা চোখে একজন ডাক্তার তার পেশীবহুল বাদামি পিঠে ছুরি চালাচ্ছে।

উঃ, উঃ, উঃ! উঁচু চোয়ালের হাড় ও থ্যাবড়া নাকওয়ালা ফোলা মুখটা তুলে সবগুলো শাদা দাঁত বের করে সে অবিরাম আর্তনাদ করছে আর শরীরটাকে এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে নাড়ছে। আর একটা টেবিলে একটি লম্বা, ভুড়িওয়ালা লোক চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার কোকড়া চুল, মুখের রং ও মাথার আকৃতি দেখে তাকে প্রিন্স আন্দ্রুর বেশ পরিচিত বলে মনে হল। কয়েকজন ড্রেসার বুকের উপর চাপ দিয়ে তাকে ধরে রেখেছে। দুজন ডাক্তার তার একটা রক্তাক্ত পা নিয়ে কি যেন করছে। তাতারটির কাজ শেষ হলে একটা ওভারকোট দিয়ে তাকে ঢেকে রেখে চশমা-চোখে ডাক্তারটি হাত ধুয়ে প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে এগিয়ে এল।

প্রিন্স আন্দ্রুর মুখের দিকে একবার তাকিয়েই সে দ্রুত পায়ে সরে গেল।

ওর পোশাক খুলে ফেল! কিসের জন্য দেরি করছ? কুদ্ধকণ্ঠে সে ড্রেসারদের বলল।

ড্রেসাররা যখন আস্তিন গুটিয়ে অদ্রুিত বোতাম খুলে তার পোশাক খুলতে লাগল তখন প্রিন্স আন্দ্রুর চোখের সামনে ভেসে উঠল শৈশবের দূরতম স্মৃতিগুলি। ডাক্তার ঝুঁকে পড়ে তার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। কাকে যেন ইশারায় কি বলল, আর তলপেটের তীব্র যন্ত্রণায় প্রিন্স আন্দ্রু জ্ঞান হারাল। যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন উরুর ভাঙা হাড়গুলো বের করে ফেলা হয়েছে, ছেঁড়া মাংসটা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাধা হয়ে গেছে। তার চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রিন্স আন্দ্রু চোখ খুলতে ডাক্তার ঝুঁকে পড়ে তাকে নিঃশব্দে চুমো খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

অনেক যন্ত্রণা সহ্য করার পরে এখন প্রিন্স আন্দ্রুর এমন ভালো লাগছে যে দীর্ঘকাল সেরকম সুখের অনুভূতি তার হয়নি। জীবনের সবচাইতে সেরা সুখের মুহূর্তগুলি–বিশেষ করে প্রথম শৈশবের সেই দিনগুলি যখন পোশাক খুলে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হত, তার উপর ঝুঁকে পড়ে নার্স তাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাত, আর বালিশে মাথা ডুবিয়ে দিয়ে জীবনটাকে সে বড় বেশি করে ভালোবাসত-তার স্মৃতিতে ফিরে এল, সে স্মৃতি যেন অতীতের নয়, বর্তমানের ঘটনা।

যে আহত লোকটির মাথাটা প্রিন্স আন্দ্রুর পরিচিত বলে মনে হয়েছিল এবার ডাক্তাররা তাকে নিয়ে পড়ল : তুলে ধরে তারা তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে।

আমাকে ওটা দেখান…ওঃ, উঃ…ওঃ! উঃ! তার ভয়ার্ত আর্তনাদ ও চাপা কান্না কানে এল।

সে কান্নার শব্দ শুনে প্রিন্স আন্দ্রুরও কান্না পেল। অগৌরবে তার মৃত্যু হচ্ছে বলে, অথবা জীবনকে ছেড়ে যেতে তার কষ্ট হচ্ছে বলে, অথবা শৈশবের স্মৃতিগুলি ফিরে এসেছে বলে, অথবা সে যন্ত্রণা ভোগ করছে, অন্যরা যন্ত্রণা ভোগ করছে, আর এই মানুষটি এমন করুণভাবে আর্তনাদ করছে বলে,-কারণ যাই হোক না কেন তারও ইচ্ছা হল শিশুর মতো একটু কাঁদতে।

জমাট রক্তমাখা বুট-পরা কাটা পাটা সেই আহত লোকটিকে দেখানো হল।

ওঃ! ওঃ, উঃ সে মেয়েমানুষের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

পাশে দাঁড়ানো ডাক্তারটি চলে গেল। প্রিন্স আন্দ্রুনিজের মনেই বলল, হা ঈশ্বর! এসব কি? কেন সে এখানে এল?

এইমাত্র যে লোকটির পা কেটে বাদ দেওয়া হল তাকে সে চিনতে পেরেছে। লোকটি আনাতোল কুরাগিন। সকলে কোলে তুলে নিয়ে তাকে এক গ্লাস জল খাওয়াতে চাইছে, কিন্তু তার ফুলে-ওঠা কাঁপা ঠোঁট জলে চুমুক দিতে পারছে না। আনাতোল যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হ্যাঁ, সেই তো বটে! হ্যাঁ, এই লোকটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক বড়ই ঘনিষ্ঠ, বড়ই বেদনার। কিন্তু আমার শৈশবের সঙ্গে, আমার জীবনের সঙ্গে লোকটির কিসের সম্পর্ক নিজেকে প্রশ্ন করে সে কোনো জবাব পেল না। সহসা একটা অপ্রত্যাশিত নতুন স্মৃতি শৈশবের আনন্দময় ভালোবাসার রাজ্য থেকে তার সামনে এসে হাজির হল। ১৮১০-এর একটা বল-নাচের আসরে প্রথম যেদিন নাতাশাকে দেখেছিল সেদিনের কথা মনে পড়ল। এতক্ষণে তার মনে পড়ল এই যে লোকটি অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার সঙ্গে কিসের সম্পর্কে সে বাধা। সবকিছুই তার মনে পড়ে গেল, আর লোকটির প্রতি উচ্ছ্বসিত করুণায় ও ভালোবাসায় তার মনটা ভরে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না, পার্শ্ববর্তী লোকটির জন্য, নিজের জন্য, নিজেরও অন্য সকলের ভুলের জন্য তার দুই চোখ জলে ভরে উঠল।

সহমর্মিতা, ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, যারা আমাদের ভালোবাসে আর যারা আমাদের ঘৃণা করে তাদের প্রতি ভালোবাসা, শত্রুকে ভালোবাসা, হ্যাঁ, যে ভালোবাসার কথা ঈশ্বর পৃথিবীতে প্রচার করেছেন আর প্রিন্সেস মারি আমাকে শিখিয়েছে অথচ আমি বুঝিনি-সেই ভালোবাসার জন্যই জীবনকে ছেড়ে যেতে আমি দুঃখবোধ করেছি, বেঁচে থাকলে সেটাই হবে আমার অবলম্বন। কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তা আমি জানি!

.

অধ্যায়-৩৮

নিহত ও আহতদের দেহে সমাকীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ংকর দৃশ্য, বক্তিগতভাবে পরিচিত জনাবিশেক সেনাপতির নিহত বা আহত হবার সংবাদ এবং নিজের একদা শক্তিমান বাহুর অক্ষমতার চেতনা–সবকিছু মিলিয়ে নেপোলিয়নের উপর একটা অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, অথচ সাধারণত নিহত ও আহতদের দেখতে তার ভালোই লাগে, তার বিচারে তাতে মনের শক্তি-পরীক্ষা হয়। মনের যে শক্তিকে সে তার কৃতিত্ব ও মহত্ত্বের আকর বলে মনে করে, আজ কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ংকর রূপটা তার সেই মনোবলকেই পর্যদস্ত করে তুলেছে। দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শেভার্দিনো গোল পাহাড়ে ফিরে গেল, বিবর্ণ, ফোলা, ফ্যাকাসে। মুখে একটা টুলের উপর বসে পড়ল, চোখ দুটি আবছা, নাকটা লাল, কণ্ঠস্বর কর্কশ, চোখ নিচু করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কান পেতে শুনছে গোলাগুলির শব্দ। বেদনার্ত অবসন্নতায় সে নিজের কাজের পরিণতির জন্যই অপেক্ষা করছে, এ কাজের সেই হোতা, অথচ তার গতিরোধ করতে সে অক্ষম। জীবনের যে কৃত্রিম অপচ্ছায়াকে সে এতকাল সেবা করে এসেছে, মুহূর্তের জন্য হলেও একটা ব্যক্তিগত মানবিক অনুভূতি তার জায়গা দখল করে নিল। যুদ্ধক্ষেত্রে যে যন্ত্রণা ও মৃত্যুকে সে প্রত্যক্ষ করেছে, নিজের মধ্যেই তাকে যেন অনুভব করল। মাথার ও বুকের উপর যে বোঝা চেপে আছে তা যেন নিজের যন্ত্রণা ও মৃত্যুর সম্ভাবনাকেই স্মরণ করিয়ে দিল। সেইমুহূর্তে মস্কো, বা জয়, বা গৌরব-কোনো কিছুই সে কামনা করল না (আরো গৌরবের কী প্রয়োজন তার আছে?) তার একমাত্র কামনা বিশ্রাম, প্রশান্তি ও মুক্তি।

একটি অ্যাডজুটান্ট এসে খবর দিল, তার হুকুমমতো দুশো কামান থেকে একযোগে রুশদের উপর গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে, কিন্তু তবু তারা ঘাঁটি আগলে রেখেছে।

অ্যাডজুটান্ট বলল, আমাদের গোলাবর্ষণে কাটা ফসলের মতো ওরা সারি সারি ঢলে পড়ছে, কিন্তু তবু লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

আরো মৃত্যু তারা চয়! নেপোলিয়ন কর্কশ গলায় বলল।

কথাটা শুনতে না পেয়ে অ্যাডজুটান্ট বল, স্যার?

 ভুরু কুঁচকে নেপোলিয়ন বলল, আরো মৃত্যু তারা চায়! তাই তারা পাবে!

 যারা এই ঘটনাবলীর অংশীদার তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে যার দায়িত্ব সবচাইতে বেশি সেই মানুষটির মন ও বিবেক যে শুধু এই দিনটিতে ও এই সময়েই অন্ধকারে ঢেকে গেল তা কিন্তু নয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে বুঝতে পারেনি সত্য, শিব ও সুন্দর কাকে বলে, বুঝতে পারেনি কি তার এইসব কাজের তাৎপর্য যা একান্তভাবে সত্য ও শিবের বিপরীত, যা সর্বপ্রকার মানবিকতা থেকে এতদূরে অবস্থিত যে তার তাৎপর্য সে কোনোদিন উপলব্ধি করতে পারেনি। অর্ধেক পৃথিবীর দ্বারা প্রশংসিত স্বীয় কর্মধারাকে সে কখনো অস্বীকার করতে পারেনি, আর তাই সত্য, শিব ও মানবতাকেই সে অস্বীকার করেছে।

নিহত ও পঙ্গু মানুষের দেহে আকীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে শুধু সেই একটি দিনই সে হিসাব করেনি যে তাদের মধ্যে প্রতি একজন ফরাসির জন্য কতজন রুশ সেখানে পড়ে আছে, এবং মাত্র সেই একটি দিনই এই হিসেবের মধ্যে মিথ্যা করে আনন্দের কারণ খুঁজতে চেষ্টা করেনি যে প্রতি একজন ফরাসির বিনিময়ে পাঁচজন রুশ সেখানে পড়ে আছে। শুধু সেই একটি দিনই সে প্যারিসে লিখিত চিঠিতে বলেনি যে যুদ্ধক্ষেত্রটি অপূর্ব, কারণ সেখানে পড়ে আছে হাজার হাজার মৃতদেহ, কিন্তু সেন্ট হেলেনা দ্বীপের শান্ত নির্জনতার মধ্যে সে যখন স্থির করল যে জীবনে যেসব মহৎ কর্ম সে করেছে তার বিবরণ লিখেই সে অবসরের দিনগুলি কাটিয়ে দেবে, তখনো সে লিখেছে, এই রুশ যুদ্ধের হওয়ার উচিত ছিল আধুনিক কালের সব চাইতে জনপ্রিয় যুদ্ধ : এ যুদ্ধ শুভবুদ্ধির যুদ্ধ, সত্যিকারের স্বার্থ, শান্তি ও সকলের নিরাপত্তার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণ শান্তিকামী ও রক্ষণশীল।

এ যুদ্ধ একটি মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য যুদ্ধ, অনিশ্চয়তার অবসান ও নিরাপত্তার সূচনার যুদ্ধ। সকলের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ একটি নতুন দিগন্ত উঘাটিত হতে চলেছিল। ইওরোপিয় ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বাকি ছিল শুধু তাকে সংগঠিত করে তোলা।

এইসব বৃহৎ লক্ষ্যকে পূর্ণ করে, সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করে, আমার নিজস্ব কংগ্রেস ও পবিত্র মৈত্রী গড়ে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু সে ভাবনা-চিন্তাগুলি আমার কাছ থেকে চুরি করা হল। বৃহৎ রাষ্ট্র-কর্ণধারদের সেই পুনর্মিলন সভায় এক পরিবারের মতো আমরা আমাদের স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করতাম এবং মনিবের কাছে করণিকের মতো তার বিবরণ জনগণের কাছে পেশ করতাম।

বস্তুত, এইভাবে ইওরোপ একটা জাতি হিসেবে গড়ে উঠত, এবং যে-কোনো মানুষ যে কোনো স্থানে বেড়াতে বের হলে একই পিতৃভূমিতে বাস করার অনুভূতি লাভ করত। আমি অবশ্যই দাবি করব যে সব নদীতে পথ চলবার অধিকার সকলকে দেওয়া হোক, সব সমুদ্র আসুক সকলের অধিকারে, আর এখন থেকে সব বিরাট সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপ্রধানদের রক্ষীতে পরিণত করা হোক।

সেই মহান, শক্তিমান, চমৎকার, শান্তিময় ও গৌরবময় পিতৃভূমির কেন্দ্রস্বরূপ ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে আমি ঘোষণা করতাম যে তার সীমান্ত চর অপরিবর্তনীয়, সব ভবিষ্যৎ যুদ্ধই সম্পূর্ণরূপে আত্মরক্ষামূলক, সবরকম ক্ষমতাবিস্তার জাতীয়তাবিরোধী। সাম্রাজ্যের আসনে বসাতাম আমার ছেলেকে, আমার একনায়কত্বের সূচনা হত।

প্যারিস হয়ে উঠত পৃথিবীর রাজধানী, আর ফরাসি জাতি হত সকল জাতির ঈর্ষার বস্তু।

তারপর আমার ছেলের রাজকীয় শিক্ষানবীশীর আমলে সম্রাজ্ঞীকে সঙ্গে নিয়ে আমার অবসরকাল, আমার বার্ধক্যকে কাটাতাম নিজেদের ঘোড়ায় চেপে সত্যিকারের গ্রাম্য দম্পতির মতো, ধীরে সুস্থে ঘুরে বেড়াতাম সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, শুনতাম সকলের অভাব-অভিযোগ, তার প্রতিকার করতাম, সর্ব দিকে ও সর্বত্র গড়ে তুলতাম বড় বড় বেসরকারি অট্টালিকা, নানা কল্যাণ-ব্যবস্থা।

নরহত্যাকারীর বিষণ্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার বিধি-নির্দিষ্ট নিয়তি সেই নেপোলিয়নও নিজেকে বুঝিয়েছিল যে মানুষের কল্যাণই ছিল তার সব কাজের লক্ষ্য, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের অধিকার ছিল তার হাতে, আর সেই ক্ষমতার বলে সে তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারত আশীর্বাদ ও কল্যাণ।

রুশ যুদ্ধ সম্পর্কে সে আরো লিখেছে : যে চার লক্ষ মানুষ ভিলা নদী অতিক্রম করেছিল তাদের মধ্যে অর্ধেক ছিল অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, স্যাকসন, পোল্যান্ড, ব্যাভেরিয়া, উত্তমবুর্গ, মেকলেনবুর্গ, স্পেন, ইতালি ও নেপলসের মানুষ। সঠিক বলতে গেলে রাজকীয় সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য এসেছিল হল্যান্ড, বেলজিয়াম, রাইন নদীর সীমান্ত অঞ্চল, পিডমন্ট, সুইজারল্যান্ড, জেনেভা, তাস্কান, রোম, বত্রিশতম সামরিক ডিভিশন, ব্রেমেন, হামবুর্গ প্রভৃতি দেশ থেকে, তাদের মধ্যে ফরাসি ভাষায় কথা বলত বড় জোর এক লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষ। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া অভিযানে ফ্রান্স হারিয়েছে পঞ্চাশ হাজারেরও কম সৈন্য, আর ভিলনা থেকে মস্কোতে পশ্চাদপসরণের পথে বিভিন্ন যুদ্ধে রুশ বাহিনী হারিয়েছে তার চার গুণেরও বেশি সৈন্য, মস্কো পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে এক লক্ষ রুশ বনে-জঙ্গলে প্রাণ হারিয়েছে শীতে ও খাদ্যাভাবে, শেষপর্যন্ত, মস্কো থেকে ওডার পর্যন্ত যেতে আবহাওয়ার প্রচণ্ডতায়ও রুশ বাহিনীর অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, ফলে ভিলনা পর্যন্ত পৌঁছতে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল মাত্র পঞ্চাশ হাজার, আর কালিশে আঠারো হাজারেরও কম।

নেপোলিয়ন কল্পনা করেছিল যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা তার ইচ্ছাতেই হয়েছিল, আর সে যুদ্ধের ভয়াবহতা তার অন্তরকে মোটেই বিচলিত করেনি। যা কিছু ঘটেছে তার সব দায়িত্বই সে সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, তার অন্ধকারাচ্ছন্ন মন এই বিশ্বাসের মধ্যেই যুক্তি খুঁজে পেয়েছে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে তাদের মধ্যে হেসে এবং ব্যাভেরিয়ার তুলনায় ফ্রান্সের মানুষ ছিল সংখ্যায় অল্প।

.

অধ্যায়-৩৯

নানা বিচিত্র ভঙ্গিতে ও বিচিত্র ইউনিফর্মে হাজার হাজার মানুষ দাভিদভ পরিবার ও রাজকীয় ভূমিদাসদের মালিকানাভুক্ত সেইসব উপত্যকায় ও প্রান্তরে মরে পড় আছে যেখানে শত শত বৎসর ধরে বরদিনো, গোর্কি, শেভার্দিনো ও সেমেনভঙ্কের চাষীরা ফসল কেটে ঘরে তুলেছে, গরু-ঘোড়া চড়িয়েছে। বিভিন্ন ড্রেসিং স্টেশনকে ঘিরে প্রায় তিন একর জমির ঘাস ও মাটি রক্তে ভিজে গেছে। বিভিন্ন অস্ত্রধারী আহত ও অনাহত মানুষ ভয়ার্ত মুখে দলে দলে নিজেদের টেনে নিয়ে গেল-কেউ একটা সেনাদল থেকে ফিরে গেল মোঝায়েস্কে, কেউ বা অন্য দল থেকে ফিরে গেল ভালুভোতে। অন্যরা ক্লান্ত, ক্ষুধার্থ অবস্থায় অফিসারদের নির্দেশে এগিয়ে গেল সামনে। অন্যরা ঘাঁটি আগলে গোলাগুলি চালাতে লাগল।

যে রণক্ষেত্র ছিল প্রভাত সূর্যে ঝলসিত বেয়নেটের ঝিকিমিকি ও ধোয়ার খণ্ড মেঘের ঝলকানিতে সুন্দর, সেখানে এখন ছড়িয়ে আছে ভেজা কুয়াশা ও ধোয়া, আর সোরা ও রক্তের একটা বিচিত্র গন্ধ। মেঘ জমল, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে লাগল মৃত ও আহতদের উপর, ভয়ার্ত, ক্লান্ত ও সন্ধিগ্ধ মানুষগুলোর উপর, যেন বলতে চাইল : যথেষ্ট হয়েছে। এবার বন্ধ কর…নতুন করে ভাব! কি করছ তোমরা?

খাদ্য ও বিশ্রামের অভাবে পীড়িত উভয় পক্ষের সৈন্যদের মনেই যেন এখন সন্দেহ জেগেছে-এখনো তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে এই হানাহানি করেই চলবে কি না, প্রত্যেকের মুখেই স্পষ্ট দ্বিধার ভাব, প্রত্যেকের অন্তরে একই প্রশ্ন, কিসের জন্য, কার জন্য আমি অপরকে মারব আর নিজে মরব?…তোমরা যাকে খুশি মারতে পার, কিন্তু আমি আর ওকাজ করতে চাই না! সন্ধ্যা নাগাদ এই চিন্তা সকলের মনেই দানা বেঁধে উঠল। যে কোনো মুহূর্তে এইসব মানুষরা নিজেদের কাজে নিজেরাই আতংকিত হয়ে উঠতে পারে, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যে কোনো দিকে চলে যেতে পারে।

কিন্তু হায়, যদিও যুদ্ধের শেষের দিকে সৈন্যরা নিজেদের কাজকে নিজেরাই ভয় করতে লাগল, সেখান থেকে সরে যেতে পারলে তারা সুখীই হত, তবু একটা দুর্বোধ্য রহস্যজনক শক্তি তাদের চালাতে লাগল, তখনো তারা কামান-বন্দুক নিয়ে তৈরি হল, গুলি-বারুদ ভরল, নিশানা ঠিক করল, আগুন ধরাল, অথচ প্রতি তিনজন গোলন্দাজের মাত্র একজন বেঁচে আছে, তারা চলছে টলতে টলতে আর ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে, ঘামে, রক্তে ও বারুদে তাদের সারা শরীর ছেয়ে গেছে। আগের মতোই দ্রুতগতিতেই ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দুই পক্ষ থেকেই কামানের গোলা ছুটছে, মানুষের দেহ বিধ্বস্ত হচ্ছে আর যে ভয়ংকর কাজটি পরিচালিত হচ্ছে কোন মানুষের ইচ্ছায় নয়, মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা ঈশ্বরের ইচ্ছায়, সে কাজ সমানে এগিয়ে চলেছে।

সেই সময় রুশ বাহিনীর বিশৃঙ্খল পশ্চাৎভাগটা দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারত যে ফরাসিরা আর একটু কর্মতৎপর হলেই রুশ বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, আবার ফরাসি বাহনীর পশ্চাঙ্গটা দেখলেও যে কেউ বলে দিতে পারত যে রুশরা আর একটু কর্মতৎপর হলেই ফরাসিরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু ফরাসি বা রুশ কোনো পক্ষই তৎপর হল না, যুদ্ধের আগুন ধিকি ধিকি করেই জ্বলতে লাগল।

রুশ সে চেষ্টা করল না কারণ তারা ফরাসিদের আক্রমণ করেনি। যুদ্ধের সূচনায় তারা মস্কোর পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়েছিল, এবং এখন যুদ্ধের শেষ লগ্নেও তারা সেই একই কাজ করে চলেছে। কিন্তু ফরাসিদের ঘাঁটি থেকে তাড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যও যদি রুশদের থাকত, তাহলেও তারা একবার শেষ চেষ্টা করতে পারত না, কারণ গোটা রুশ বাহিনী তখন ভেঙে পড়েছে, যুদ্ধের ফলে তাদের একটা অংশও অক্ষত নেই, আর নিজেদের ঘাঁটি আগলে রাখলেও তাদের অর্ধেক সৈন্যকে তারা হারিয়েছে।

আর ফরাসিরা–তাদের মনে ছিল পনেরো বছর ধরে শুধু জয়লাভের স্মৃতি, নেপোলিয়নের অপরাজেয়তায় ছিল তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস, তারা জানত যে যুদ্ধক্ষেত্রের একটা অংশ তাদের দখলে এসেছে, তারা হারিয়েছে মোট সৈন্যসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ এবং বিশ হাজার সৈন্যের রক্ষীবাহিনীর সম্পূর্ণ অটুট আছে–তাই তারা অনায়াসেই সে চেষ্টাটা করতে পারত। রুশ বাহিনীকে তাদের ঘাঁটি থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্যই ফরাসিরা তাদের আক্রমণ করেছিল, কাজেই সে চেষ্টা করাই তাদের উচিত ছিল, কারণ রুশরা যতক্ষণ মস্কোর পথ অবরোধ করে রাখতে পারবে ততক্ষণ ফরাসিদের উদ্দেশ্য সফল হবে না, তাদের সব চেষ্টা, সব ক্ষয়-ক্ষতি বিফলে যাবে। কিন্তু ফরাসিরা সে চেষ্টা করল না। অনেক ইতিহাসকার বলে থাকেন, নেপোলিয়ন যদি শুধু আর ওল্ড গার্ডসকে কাজে লাগাত তাহলেই সে যুদ্ধ জয় করতে পারত। কিন্তু নেপোলিয়ন তার গার্ডসকে ব্যবহার করলে কি হত সেকথা বলা আর হেমন্তকালটা বসন্তকাল হলে কি হত সেকথা বলা আর হেমন্তকালটা বসন্তকাল হলে কি হত সেকথা বলা তো একই ব্যাপার। কিন্তু তা হয়নি, ইচ্ছা ছিল না বলে যে নেপোলিয়ন তার গার্ডসকে যুদ্ধে নামায়নি তা তো নয়, আসলে সেটা করা যায়নি। ফরাসি বাহিনীর সব সেনাপতি, কর্মচারী ও সৈনিকরাই জানত যে তা করা যাবে না, কারণ সৈন্যদের ভগ্ন মনোবলই তা করতে দিত না।

নিজের শক্তিমান বাহুটা অক্ষম, পঙ্গু হয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন যে শুধু নেপোলিয়নই দেখেছিল তা নয়, যে শত্রুপক্ষ অর্ধেক সৈন্য হারাবার পরেও যুদ্ধের একেবারে শেষ লগ্নেও তার সূচনাকালের মতোই একই ভয়াবহ মূর্তিতে নিজ ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে, তার নিজের বাহিনীর সব সেনাপতি ও সৈনিকের মনেও পূর্বেকার সব যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও সেই একই আতংকের অনুভূতি বাসা বেঁধে ছিল। আক্রমণকারী ফরাসি বাহিনীর নৈতিক শক্তি তখন ফুরিয়ে গেছে। বরদিনোর রণক্ষেত্রে রুশ বাহিনী সেই জয়লাভ করেনি যার নাম একটি ষষ্ঠিখঞ্জে মাথায় বাধা পতাকা নামক কতকগুলো বস্তুতে দখল করা এবং যে মাটির উপর সৈন্যরা দাঁড়িয়ে ছিল এবং এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাকে দখল করা, কিন্তু যে নৈতিক জয়লাভের ফলে শত্রুপক্ষের মনে এই দৃঢ় ধারণা জন্মে যে প্রতিপক্ষ নৈতিক শক্তিতে তার চাইতে অধিক বলীয়ান এবং সে নিজে অনেক বেশি অক্ষম সেই নৈতিক জয় রুশদের করায়ত্ত হয়েছে। আক্রমণের মুখে মারাত্মকভাবে আহত একটা ক্রুদ্ধ জন্তুর মতোই ফরাসি আক্রমণকারীরা তখন বুঝতে পেরেছে যে ধ্বংস অনিবার্য হলেও এখন আর থামা চলবে না, রুশ বাহিনীর অবস্থাও তথৈবচ, অর্ধেক সৈন্য হারিয়ে তাদেরও আর পিছু হটা চলে না। ফরাসি বাহিনী যে গতিবেগ সঞ্চয় করেছে তার প্রেরণাতেই তারা এখনো মস্কোর দিকে এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সেখানে পৌঁছে রুশদের পক্ষ থেকে কোনোরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই তাদের মরতে হবে বরদিনো যুদ্ধের মারাত্মক ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণের ফলে। তাই বরদিনো যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ নেপোলিয়ন অর্থহীনভাবে মস্কো থেকে পালিয়ে গেল, স্মোলেনস্ক রোড ধরে পশ্চাদপসরণ করল, তার পাঁচ লক্ষ সৈন্য ধ্বংস হয়ে গেল, নেপোলিয়ন শাসিত ফ্রান্সের পতন হল, সর্বপ্রথম বরদিনোতেই অধিকতর মনোবলসম্পন্ন একটি প্রতিপক্ষের হাত তার উপর চেপে বসল।

[দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *