১০.৩ যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখা

অধ্যায়-২১

 পিয়ের গাড়ি থেকে নামল, অসামরিক সৈনিকদের পাশ কাটিয়ে গোল পাহাড়ের মাথায় উঠে গেল, ডাক্তার বলেছে, সেখান থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখা যাবে।

বেলা প্রায় এগারোটা। সূর্য তার কিছুটা বাঁয়ে ও পিছনে পড়েছে, দূরপ্রসারিত প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে।

সেই দৃশ্যপটকে দ্বিখণ্ডিত করে স্মোলেনস্ক বড় রাস্তাটা উপর থেকে বাঁদিকে এঁকেবেঁকে একটা গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে গেছে, গোল পাহাড়ের নিচে শ পাঁচেক পা সামনে একটা শাদা গির্জা দেখা যাচ্ছে। এই গ্রামটাই বরদিনো। গ্রামের নিচে রাস্তাটাই একটা সেতুর উপর নিয়ে নদী পেরিয়ে অনেক চড়াই-উত্রাই কাটিয়ে উপরে উঠতে উঠতে প্রায় চার মাইল দূরবর্তী ভালুভো গ্রামের দিকে চলে গেছে। সেখানেই তখন নেপোলিয়নের ঘাঁটি। ভালুভো পেরিয়ে রাস্তাটা দিগন্তের কোলে একটা হলুদ বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। রাস্তার ডানদিকে অনেক দূরের বার্চ ও ফার গাছের জঙ্গলের মধ্যে কলোচা মঠের ক্রুশ ও ঘণ্টা-ঘরটা সূর্যের আলোয় চকচক করছে। জঙ্গল ও রাস্তার ডাইনে ও বায়ে গোটা নীল প্রান্তর জুড়ে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের ও শত্রুপক্ষের ধূমায়মান শিবিরের আগুন আর অসংখ্য সৈন্য। কলোচা ও মস্কভা নদীর তীর বরাবর ডানদিকের মাঠ ভাঙা-ভাঙা ও পর্বতসংকুল। তার খড়ির ফাঁকে ফাঁকে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে বেজুবভা ও জাখারিনো গ্রাম দুটি। বাঁদিকে মাঠ অনেক বেশি সমতল, সেখানে ফসলের ক্ষেত আছে, অগ্নিদগ্ধ ধূমায়মান সেমেনভঙ্ক গ্রামটাও দেখা যাচ্ছে।

বাঁদিকে অথবা ডানদিকে পিয়ের যা কিছু দেখতে পেল তাতে তার প্রত্যাশা পূর্ণ হল না। যে রণক্ষেত্র দেখার আশা সে করেছিল তা কোথাও দেখা গেল না, শুধুই মাঠ, প্রান্তর, সেনাদল, জঙ্গল, শিবির-আগুনের ধোয়া, গ্রাম, স্তূপ, আর নদী-নালা, অনেক চেষ্টা করেও সেখানে কোনো সামরিক ঘাঁটি তার চোখে পড়ল না, এমনি কি আমাদের ও শত্রুপক্ষের সৈন্যদেরও সে আলাদা করে চিনতে পারল না।

সবকিছু জানে এরকম কাউকে জিজ্ঞাসা করা যাক, এই কথা ভেবে পিয়ের একজন অফিসারের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসারটি তার অসামরিক মূর্তির দিকে সকৌতূহলে তাকিয়ে ছিল।

সামনে ওটা কোন গ্রাম জানতে পারি কি?

একজন সঙ্গীর দিকে ফিরে অফিসারটি বলল, বুদিনোনা, তাই না?

বরদিনো, সঙ্গীটি কথাটা শুধরে দিল।

কথা বলার একটি লোক পেয়ে অফিসারটি খুশি মনে পিয়েরের কাছে এগিয়ে এল।

ওখানে ওরা কি আমাদের সৈন্য? পিয়ের শুধাল।

অফিসার বলল, হ্যাঁ, আর ঐ দূরে আছে ফরাসিরা। ঐ যে অনেক দূরে দেখতে পাচ্ছেন?

 কোথায়? কোথায়? পিয়ের শুধাল।

খালি চোখেই তো দেখা যাচ্ছে…কেন ঐ তো!

বাঁদিকে নদীর ওপারে যে ধোয়া দেখা যাচ্ছে সেইদিকে হাত বাড়িয়ে অফিসারটি বলল।

বাঁদিকের গোল পাহাড়ে কিছু সৈন্য দেখতে পেয়ে পিয়ের বলল, আচ্ছা, তাহলে ওরাই ফরাসি! ঐ যে দূরে?

ওরা আমাদের সৈন্য!

ও আমাদের! আর ওই ওখানে?… দূরে আর একটা গোল পাহাড় দেখিয়ে পিয়ের বলল। পাহাড়টার উপরে একটা বড় গাছ, সেখানেও কিছু শিবির-আগুনের ধোঁয়া ও কালো কালো কি যেন দেখা যাচ্ছে।

অফিসার বলল, ওটা আবার তার হয়ে গেছে। (ওটাই শেভার্দিনো দুর্গ) কালও আমাদেরই ছিল, কিন্তু এখন তার।

তাহলে আমাদের ঘাঁটি কোথায়?

আমাদের ঘাঁটি? আত্মতুষ্টির হাসি হেসে অফিসারটি জবাব দিল। সব আপনাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলছি, কারণ প্রায় সবগুলি পরিখাই আমি কাটিয়েছি। ওই যে, দেখতে পাচ্ছেন? ঠিক ওখানেই বরদিনোতে আমাদের কেন্দ্রীয় ঘাঁটি, সামনের শাদা গির্জাওয়ালা গ্রামটা দেখিয়ে সে বলল। ওখানেই কালোচা নদী পার হতে হয়। নিচে ওই যে একসারি ঘর পড়ে আছে ওখানেই রয়েছে সেতুটা। ওটাই আমাদের কেন্দ্র। আমাদের দক্ষিণ ব্যুহটা ওইদিকে-সে ডান দিকটা দেখাল। ওখানেই আছে মস্ক নদী, ওখানেই আমরা তিনটে দুর্গ গড়েছি–খুব শক্ত-পোক্ত করেই গড়া হয়েছে। আর বাম ব্যহটা… এইখানে অফিসারটি থামল। কি জানেন, এটা বোঝানো একটু শক্ত…গতকাল আমাদের বাম ব্যুহ ছিল ওইখানে শেভার্দিনোতে, ওই যে, যেখানে ওক গাছটা দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু আজ আমাদের বাম ব্যুহটা সরিয়ে আনা হয়েছে-এখন সেটা আছে ওখানে, ওই যে একটা গ্রাম আর ধোয়া দেখতে পাচ্ছেন? ওটাই সোমেনভসক, হ্যাঁ, ওই যে, সে রায়েভস্কি পাহাড়টা দেখাল। কিন্তু যুদ্ধটা ওখানে হবে না, তারা সেনাদল সরিয়ে নেওয়ায় ওটা একটা ফন্দিমাত্র, সে হয়তো ঘুরে মস্কভা নদীর ডান দিকে চলে যাবে। কিন্তু যুদ্ধ যেখানেই হোক, কাল অনেক লোক হারিয়ে যাবে।

একজন বয়স্ক সার্জেন্ট এগিয়ে এসে তার কথাগুলি শুনছিল, এইখানে অফিসারের বক্তব্য মনোমত না হওয়ায় সে তাকে বাধা দিল।

কঠোরকণ্ঠে বলল, মাটির ঝুড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।

অফিসারটি অপ্রস্তুত বোধ করল, সে বুঝতে পারল, কাল কত সৈন্য হারিয়ে যাবে সেটা জানা থাকলেও বলা উচিত নয়।

তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বেশ তো, তিন নম্বর কোম্পানিকে পাঠিয়ে দিন।

 আর আপনি, আপনি কি একজন ডাক্তার?

না, আমি নিজের থেকেই এসেছি, বলে পিয়ের পাহাড় বেয়ে নেমে গেল।

যে লোকগুলি কাজ করছে তাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নাক চেপে ধরে অফিসারটি অস্ফুটে বলে উঠল, আ, যত সব বাজে লোকের ভিড়!

ওরা আসছে…তাকে নিয়ে আসছে…ওই তো দেখা যাচ্ছে…এক মিনিটের মধ্যেই এখানে এসে পড়বে, হঠাৎ নানা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অফিসার, সৈনিক ও অসামরিক লোকজনরা রাস্তায় ছুটে চলল।

বরদিনো থেকে গির্জার একটা শোভাযাত্রা পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে। ধুলোভরা রাস্তায় প্রথমে এল পদাতিক দল। তাদের পিছন থেকে ভেসে এল গির্জার সঙ্গীত।

সৈনিক ও অসামরিক লোকজনরা পিয়েরকে পাশ কাটিয়ে খালি মাথায় শোভাযাত্রার দিকে ছুটে গেল।

ওরা তাঁকে নিয়ে আসছে, আমাদের রক্ষাকারিণীকে!…আইবেরীয় ঈশ্বর-জননী! কে একজন চেঁচিয়ে বলল।

আর একজন তাকে শুধরে দিয়ে বলল, স্মালেনস্ক ঈশ্বর-জননী।

বেসরকারি লোকজন যারা গ্রামে ছিল এবং যারা ঘাঁটিতে কাজ করছিল সকলেই কোদাল ফেলে গির্জার শোভাযাত্রা দেখতে ছুটে গেল। সৈনিকদের পিছন পিছন এল পরিচ্ছদধারী পুরোহিতরা–মাথায় পাগড়ি বাঁধা একটি ছোটখাট বুড়ো মানুষ এল অনুচর ও গায়কদের সঙ্গে নিয়ে। তাদের পিছনে সৈনিক ও অফিসাররা বয়ে নিয়ে এল খোদাই-করা ধাতুর ঢাকনা দেওয়া একটি মস্ত বড় কালো-মুখ দেবমূর্তি। এই দেবমূর্তিটিকেই নিয়ে আসা হয়েছে সমালেনস্ক থেকে এবং সেই থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গেই আছে। পিছনে, সামনে, দুই পাশে অসামরিক লোকগুলো খালি মাথায় হাঁটছে, আর মাটিতে মাথা ঠুকছে।

পাহাড়ের মাথায় উঠে দেবমূর্তিসমেত সকলেই থামল। সূর্যের আতপ্ত রশ্মি তির্যকভাবে মাটিতে এসে পড়ছে, একটা মৃদু বাতাস এসে খোলা মাথাগুলির চুল ও দেবমূর্তির সাজসজ্জার ফিতেগুলো নিয়ে খেলা করছে। গান সমানভাবেই চলেছে। অফিসার, সৈনিক ও অসামরিক লোকজনরা খালি মাথায় দেবমূর্তিকে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়করা ক্লান্তকণ্ঠে গেয়ে চলেছে : হে ঈশ্বর-জননী, তোমার সেবকদের এই বিপদ থকে রক্ষা কর, সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত ও ডিয়েকন সুর ধরল : কারণ ঈশ্বরের পরে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও আশ্রয়স্বরূপ তোমার কাছেই আমরা এসেছি। সকলের মুখেই আর একবার জ্বলে উঠল আসন্ন মুহূর্তের গাম্ভীর্য সম্পর্কে সেই সচেতন ভাব যা পিয়ের একটু আগেই দেখেছে মোঝয়ে পাহাড়ের নিচে অনেক লোকের মুখে এবং ক্ষণিকের জন্য হলেও আজ সকাল থেকে যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে তাদের সকলেরই মুখে।

হঠাৎ দেবমূর্তির চারদিককার ভিড় সরে গিয়ে পিয়েরকে চেপে ধরল। যেরকম দ্রুততার সঙ্গে পথ করে দেওয়া হল তাতেই বোঝা গেল যে একজন খুবই বড় মাপের মানুষ দেবমূর্তির দিকে আসছে।

লোকটি কুতুজভ। ঘাঁটি পরিদর্শন করে তাতারিন ফিরবার পথে সে এখানে একবার থেমেছে। তাকে দেখেই পিয়ের চিনতে পারল, তার চেহারার অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যই তাকে অন্যের থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।

তার বিরাট বৃষষ্কন্ধ দেহটা লম্বা ওভারকোটে ঢাকা, শাদা মাথাটা অনাবৃত, ফোলা মুখের নষ্ট হওয়া চোখের শাদা মণিটা দেখা যাচ্ছে। দুলতে দুলতে ভিড়ের ভিতর দিয়ে হেঁটে কুতুজভ পুরোহিতের পিছনে এসে থামল। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল, ঝুঁকে পড়ে মাটিতে হাত রাখল এবং শাদা মাথাটা নুইয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কুতুজভের পিছনে বেনিংসেন ও দলবল। প্রধান সেনাপতির উপস্থিতি ঊধ্বতন অফিসারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও অসামরিক লোকজন ও সৈনিকরা তার দিকে নজর না দিয়ে তাদের প্রার্থনাতেই মেতে রইল।

অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে কুতুজভ দেবমূর্তির কাছে এগিয়ে গেল, ভারি শরীর নিয়ে নতজানু হয়ে চেপে বসল, আভূমি নত হল, এবং পুনরায় উঠবার জন্য অনেকক্ষণ ধরে বৃথাই চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু দুর্বলতা ও দেহের বোঝার জন্য উঠতে পারল না। উঠবার চেষ্টায় শাদা মাথাটা কাঁপতে লাগল। শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল, শিশুর মতো ঠোঁট ফুলিয়ে দেবমূর্তিকে চুমো খেল এবং পুনরায় মাথা নুইয়ে হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ করল। অন্য সেনাপতিরা তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল, তারপর অফিসাররা, এবং তারপরে সৈনিক ও অসামরিক লোজনরা উত্তেজিত মুখে ঠেলাঠেলি করতে করতে ভিড় করে এগিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-২২

ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে পিয়ের চারদিকে তাকাতে লাগল।

কাউন্ট পিতর কিরিলেভিচ! তুমি এখানে কেমন করে এলে? একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

পিয়ের চারদিকে তাকাল। হাত দিয়ে হাঁটু ঝেড়ে (সম্ভবত দেবমূর্তির সামনে নতজানু হওয়ায় হাঁটুতে ধুলো লেগেছে) বরিস বেঙ্কয় হাসতে হাসতে এগিয়ে এল।বরিসের পরনে রুচিসম্মত পোশাক, তাতে অভিযানের উপযোগী একটা সামরিক কেতার ছোঁয়া লেগেছে। গায়ে একটা লং কোট, কুতুজভের মতোই একটা চাবুক কাঁধ থেকে ঝোলানো।

ইতিমধ্যে কুতুজভ গ্রামে পৌঁছে কাছাকাছি একটা বাড়ির ছায়াতে বসেছে। একজন কসাক দৌড়ে একটা বেঞ্চি এনে দিল, আর একজন তাড়াতাড়ি তার উপর একটা কম্বল বিছিয়ে দিল। চারদিকে থেকে দলবল তাকে ঘিরে ধরল।

ভিড়সহ দেবমূর্তিকে আরো দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বরিসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পিয়ের কুতুজভের কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ পা দূরে থেমে পড়ল।–

যুদ্ধে উপস্থিত থেকে ঘাঁটি দেখবার বাসনা সে জানাল।

বরিস বলল, সেটাই তো তোমার করা উচিত। তোমার থাকার ব্যবস্থা আমিই করে দেব। কাউন্ট বেনিংসেন যেখানে থাকবেন সেখান থেকেই সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পাবে। তুমি তো জান আমি তার দলেই আছি, তাকে তোমার কথা বলব। কিন্তু যদি ঘাঁটিটা ঘুরে দেখতে চাও তো আমাদের সঙ্গে চল। আমরা এখনই বাম ব্যূহে যাচ্ছি। ফিরে এসে রাতটা আমার সঙ্গেই কাটাবে, তাস খেলার ব্যবস্থাও করা যাবে। তুমি তো দিমিত্রি সেগিভিচকে চেন? ঐ তো তার বাসস্থান। আঙুল বাড়িয়ে গোর্কি গাঁয়ের তৃতীয় বাড়িটা দেখিয়ে দিল।

কিন্তু আমি দেখতে চাই দক্ষিণ ব্যুহটা। সকলে বলছে সেটা খুব শক্ত-পোক্ত। আমার ইচ্ছা মস্ক নদী থেকে শুরু করে ঘোড়ায় চেপে চারদিকটা চক্কর দেই।

বেশ তো, সেটা পরেও করতে পারবে, কিন্তু আসল চিজ হচ্ছে বাম ব্যুহটা।

ঠিক, ঠিক। কিন্তু প্রিন্স বলকনস্কির রেজিমেন্টটা কোথায়? সেটা দেখাতে পার কি?

 প্রিন্স আন্দ্রুর তো? আমরা সেখান দিয়েই যাব। তোমাকে তার কাছেও নিয়ে যাব।

 বাম ব্যূহের কি হবে? পিয়ের শুধাল।

গোপন কথা বলার মতো গলা নামিয়ে বরিস বলল, তোমাকে সত্যি কথাটাই বলছি, বাম ব্যূহের অবস্থা যে কি তা শুধু ঈশ্বরই জানেন। কাউন্ট বেনিংসন যা চেয়েছিলেন তা মোটেই ঘটেনি। গোল পাহাড়টাকে তিনি অন্যভাবে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু… বরিস দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিল, কিন্তু প্রশান্ত মহামহিমের তা ইচ্ছা নয়, অথবা অন্য কেউ তাকে সেইরকমই বুঝিয়েছে। দেখ… বরিসের কথা শেষ হবার আগেই। কুতুজভের অ্যাডজুটান্ট কেসারভ পিয়েরের কাছে এসে হাজির হল। কোনোরকম বিচলিত না হয়ে বরিস তাকে বলল, আরে, কেসারভ! আমাদের অবস্থাটা কাউন্টকে বুঝিয়ে বলছিলাম। প্রশান্ত মহামহিম যে কেমন করে আগে থেকেই ফরাসিদের অভিপ্রায় বুঝতে পেরেছিলেন সেটাই আশ্চর্য!

আপনি বাম ব্যূহের কথা বলছেন কি? কেসারভ শুধাল।

হ্যাঁ, ঠিক তাই, এখন তো বাম ব্যুহ খুবই শক্তিশালী।

কুতুজভ সব অপ্রয়োজনীয় কর্মচারীদের বরখাস্ত করলেও বরিস এখনো কায়দা করে প্রধান ঘাঁটিতেই টিকে আছে। কাউন্ট বেনিংসেনের কাছে সে তার আসন পাকা করে নিয়েছে, যখন যার অধীনে কাজ করেছে সেই তরুণ প্রিন্স বেস্কয়কে মহামূল্যবান বলে মনে করেছে।

উপর মহলে এখন দুটো পরিষ্কার আলাদা দল হয়েছে : কুতুজভের দল আর বেনিংসেনের দল। বরিস শেষোক্ত দলের লোক, কিন্তু কুতুজভের প্রতি দাসসুলভ ভক্তি দেখিয়েও সে এরকম একটা ধারণার সৃষ্টি করেছে যে বুড়োটা কোনো কর্মের নয়, বেনিংসেনই সবকিছু করেছে, সেটা সে ছাড়া আর কেউ পারত না। এখন তো যুদ্ধের চরম পর্যায় সমুপস্থিত, এবার কুতুজভের পতন হবে, আর সব ক্ষমতা যাবে বেনিংসেনের হাতে, এমন কি যুদ্ধে কুতুজভের জয় হলেও সকলে মনে করবে যে যা কিছু করার সব বেনিংসেনই করেছে। অবস্থা যাই হোক, কালকের যুদ্ধের জন্য অনেক বড় বড় পুরস্কার দিতে হবে, আর রণক্ষেত্রে আসবে অনেক নতুন মানুষ। কাজেই আজ সারাটাদিন বরিস খুবই খুশি-খুশি।

দূর থেকে পিয়েরকে দেখতে পেয়ে কুতুজভ বলল, ওকে আমার কাছে ডাক।

অ্যাডজুটান্টই প্রশান্ত মহামহিমের ইচ্ছাটা পিয়েরকে জানাল, সেও কুতুজভের বেঞ্চির দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু জনৈক অসামরিক লোক তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেল। লোকটি দলখত।

ও লোকটা এখানে এল কেমন করে? পিয়ের শুধাল।

ও জীবটি সব জায়গাতেই নাক গলাকে পারে! জবাব এল। আপনি তো জানেন, ওর পদাবনতি ঘটেছিল। ও আবার ফুলে উঠতে চাইছে। এটা-ওটা নানারকম ফন্দি-ফিকিরের কথা বলছে, রাতের বেলা শত্রুর পিকেটলাইনেও হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছে…লোকটি সাহসী।

পিয়ের টুপি খুলে সশ্রদ্ধভাবে কুতুজভকে অভিবাদন জানাল।

তখনো দলখভ বলছে, আমি স্থির করলাম, প্রশান্ত মহামহিমের সঙ্গে দেখা করে সব কথা বললে আপনি আমাকে দূরে পাঠিয়ে দিতে পারেন, অথবা এও বলতে পারেন যে আমি যা বলছি তা আপনি আগেই জানতেন, কিন্তু যাই হোক না কেন তাতে আমার তো কোনো ক্ষতি নেই…

ঠিক, ঠিক।

কিন্তু আমার কথা যদি ঠিক হয় তাহলে আমার পিতৃভূমির এমন একটা কাজ করা হবে যার জন্য মরতেও আমি প্রস্তুত।

ঠিক, ঠিক।

আর প্রশান্ত মহামহিমের যদি এমন একটি লোকের প্রয়োজন হয় যে তার জন্য নিজের চামড়া খুলে দিতেও দ্বিধা করবে না তাহলে দয়া করে আমার কথাটা মনে রাখবেন…হয়তো প্রশান্ত মহামহিমের কিছু দরকারে আমি লাগতে পারব।

ঠিক…ঠিক…কুতুজভ বার বার একই কথা বলল, পিয়েরের দিকে তাকিয়ে তার হাস্যময় চোখটা ক্রমেই ছোট হতে লাগল।

ঠিক তখনই পারিষদসুলভ দক্ষতার সঙ্গে বরিস কুতুজভের কাছেই পিয়েরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল এবং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে গলা না চড়িয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন আগেকার কোনো আলোচনারই জের টানছে।

অসামরিক বাহিনী তো শাদা শার্ট পরে জান দিতেও প্রস্তুত। কী বীরত্ব, কাউন্ট।

প্রশান্ত মহামহিম যাতে শুনতে পায় তেমনভাবেই কথাগুলি বলা হল। সে জানতো এই কথাগুলি কুতুজভের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই।

কুতুজভ বরিসকে শুধাল, অসামরিক বাহিনী সম্পর্কে বলছ হে?

প্রশান্ত মহামহিম, পরিষ্কার শাদা শার্ট পরে ওরা কালকের জন্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

ওঃ!…আশ্চর্য, অতুলনীয় মানুষ ওরা! বলে কুতুজভ চোখ বুজে মাথা দোলাতে লাগল। অতুলনীয় মানুষ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা আবার বলল।

তারপর পিয়েরকে বলল, তাহলে তুমিও বারুদের গন্ধ শুঁকতে চাও? ভালো, খুব ভালো গন্ধ। তোমার স্ত্রীর প্রশংসাকারীদের মধ্যে আমিও আছি। সে ভালো আছে তো? আমার বাসস্থানের দরোজা তোমার জন্য খোলাই আছে।

বুড়ো মানুষদের বেলায় যেমন সচরাচর ঘটে থাকে, যা কিছু বলার বা করার ছিল সব ভুলে গিয়ে কুতুজভ অন্যমনস্কভাবে ইতস্তত তাকাতে লাগল।

তারপর হঠাৎ যেন কি মনে পড়ায় অ্যাডজুটান্টের ভাই আন্দ্রু কোরভকে ইশারায় কাছে ডাকল।

সেই কবিতা…মারিনের সেই কবিতা…আহা, কি যেন লাইনগুলো? জেরাকভ সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন : সৈনিকদের জন্য লিখিত ভাষণ…আবৃত্তি কর, সেগুলি আবৃত্তি কর! বলে সে যেন হাসবার জন্য তৈরি হল।

কেসারভ আবৃত্তি করতে লাগল।…কুতুজভ হেসে কবিতার তালে তালে মাথা নাড়তে লাগল।

পিয়ের কুতুজভের কাছ থেকে সরে গেলে দলখভ তার কাছে এসে হাতটা ধরল।

অপরিচিত লোকদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করেই সে উঁচু গলায় বলল, এখানে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় খুব খুশি হয়েছি কাউন্ট। আমাদের দুজনের মধ্যে কে যে বেঁচে থাকবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন, তাই আজকের দিনে তোমাকে বলছি যে আমাদের মধ্যে যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল সেজন্য আমি দুঃখিত, আর আমার ইচ্ছা যে তুমিও আমার প্রতি কোনোরকম বিরূপ মনোভাব পোষাণ করো না। আজ তোমাকে এই কথাটা বলার সুযোগ পেলাম বলেও আমি খুশি। আমার মিনতি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

কি বলবে বুঝতে না পেরে পিয়ের দলখভের দিকে তাকিয়ে হাসল। অশ্রুভেজা চোখে দলখভ তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।

বরিস তার সেনাপতিকে কি যেন বলল, কাউন্ট বেনিংসেন পিয়েরের দিকে ঘুরে তাকেও অশ্বারোহণে তাদের অনুগামী হতে বলল।

তোমার ভালো লাগবে, সে বলল।

হ্যাঁ, খুব ভালো লাগবে, পিয়ের বলল।

আধ ঘণ্টা পরে কুতুজভ তাতারিনভার উদ্দেশে যাত্রা করল, আর বেনিংসেন পিয়েরকে সঙ্গে নিয়ে সদলবলে রণক্ষেত্র বরাবর ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

.

 অধ্যায়-২৩

গোর্কি থেকে বেনিংসেন সেতুর দিকে যাবার বড় রাস্তায় নামল। সেতু পেরিয়ে বরদিনো গ্রামে ঢুকে তার বা দিকে মোড় নিল, অসংখ্য সৈন্য ও কামান পার হয়ে সেই উঁচু গোল পাহাড়টায় পৌঁছল যেখানে অসামরিক লোকজনরা পরিখা খুঁড়ছে। সেটাও একটা দুর্গ, এখনো নামকরণ না হলেও পরবর্তীকালে সেটা রায়েভস্কি দুর্গ নামেই খ্যাত হয়েছিল। পিয়ের সেটার দিকে বিশেষ নজর দিল না। সে তো জানত না যে গোটা বরদিনো প্রান্তরের মধ্যে সে জায়গাটাই একদিন তার কাছে সবচাইতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

একটা খাঁড়ি পার হয়ে তারা সেমেভস্কের পৌঁছল। সেখানে সৈন্যরা কুঁড়েঘর ও গোলাবাড়ি থেকে শেষ কাঠের গুঁড়িগুলোও টেনে বের করছে। তারপর সৈন্যদের পায়ে-পায়ে দুমড়ানো যই-ক্ষেতের ভিতর দিয়ে অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে তারা যেখানে পৌঁছল সেখানে তখনো পরিখা খোঁড়ার কাজ চলছে।

বেনিংসেন পরিখার পাশে থামল, উল্টো দিকের শেভার্দিনো দুর্গের দিকে তাকাল, আগেরদিনও সেটা আমাদেরই ছিল, কয়েকজন অশ্বারোহী সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অফিসাররা বলল, নেপোলিয়ন বা মুরাৎ দুজনের যে কোনো একজন সেখানে আছে। সকলে সাগ্রহে সেদিকে তাকাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অশ্বারোহীরা তূপ থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বেনিংসেন জনৈক সেনাপতিকে আমাদের সৈন্যদের অবস্থান ও গতিবিধি বুঝিয়ে বলতে লাগল। পিয়ের মনোযোগ দিয়ে সব শুনল, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। পিয়ের তার কথা শুনছে দেখে কথা থামিয়ে বেনিংসেন হঠাৎ তাকে বলল, এসব কথা তোমার ভালো লাগছে বলে মনে হয় না।

 মনের কথা না বলে পিয়ের উত্তরে বলল, বরং আমার খুবই ভালো লাগছে।

খাঁড়ি থেকে আরো বাঁ দিকে এগিয়ে তারা যে পথটা ধরল সেটা ছোট ছোট বার্চ গাছের ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। মাইল দেড়েক চলার পরে তারা জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে গেল। সেখানে তুচখভের সেনাদলকে মোতায়েন করা হয়েছে বাম ব্যুহ রক্ষার জন্য।

ব্যূহের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বেনিংসেন খুব উত্তেজিতভাবে অনেক কথা বলে গেল। পিয়েরের মনে হল, সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশও দেওয়া হল। তুচখভের সৈন্যদের সামনে কিছুটা উঁচু জমি রয়েছে, সেখানে কোনো সৈন্য মোতায়েন করা হয়নি। এই ভুলের তীব্র সমালোচনা করে বেনিংসেন বলল, চারদিকে নজর রাখা যায় এরকম একটা উঁচু জায়গাকে অরক্ষিত রেখে তার নিচে সেনা সমাবেশ করা তো পাগলামি। কয়েকজন সেনাপতিও সেই অভিমত প্রকাশ করল। একজন তো সামরিক উত্তাপের সঙ্গে বলে উঠল যে তাদের ওখানে রাখা হয়েছে খুন হরার জন্যই। বেনিংসেন নিজের কর্তৃত্ববলেই হুকুম দিল, ঐ উঁচু। জায়গায় সেনাসমাবেশ করা হোক।

বাম ব্যূহের এইসব ব্যবস্থা দেখে সামরিক বিধি-ব্যবস্থা বুঝবার ব্যাপারে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে পিয়েরের সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। যে লোকটি সৈন্যদের পাহাড়ের নিচে মোতায়েন করেছিল সে যে এতবড় একটা সহজবোধ্য ভুল কেমন করে করেছিল তা সে কিছুতেই বুঝতে পারেনি।

পিয়ের মোটেই জানত না যে বেনিংসেনের অনুমানমতো ঐ সন্যদের ঘাঁটি রক্ষার জন্য সেখানে রাখা হয়নি, তাদের সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল অতর্কিত আক্রমণের জন্য, যাতে কোনো অগ্রসরমান শত্রুকে তারা অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করতে পারে। বেনিংসেন সেটা জানত না, এবং ব্যাপারটা প্রধান সেনাপতির গোচরে না এনেই নিজের ধারণামতো সৈন্যদের সামনের দিকে সরিয়ে দিল।

.

 অধ্যায়-২৪

 সেদিন ২৫ আগস্টের উজ্জ্বল সন্ধ্যায় প্রিন্স আন্দ্রু তার সেনা-শিবিরের একেবারে শেষ প্রান্তে কনিয়াকোভো গ্রামের একটা ভাঙা চালাঘরে কনুইতে ভর দিয়ে শুয়েছিল। ভাঙা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল, ত্রিশ বছরের পুরনো একসারি বার্চ গাছের নিচু ডালগুলি সব কেটে ফেলা হয়েছে, মাঠের বুকে যইয়ের স্তূপগুলো দাঁড়িয়ে আছে, কতকগুলি ঝোঁপ-ঝাড়ের পাশ থেকে সৈনিকদের রান্নাঘরের ধোয়া উঠছে।

এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে জীবনটা সংকীর্ণ, বোঝাস্বরূপ ও প্রয়োজনহীন। সাত বছর আগে অস্তারলিজে যেমন মনে হয়েছিল আজও যুদ্ধের প্রাক্কালে তার তেমনই উত্তেজিত ও বিরক্ত বোধ হচ্ছে।

পরদিনের যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ সে পেয়েছে এবং প্রচার করেছে, এখন আর নতুন করে কিছু করার নেই। কিন্তু নিজের চিন্তার হাত থেকে-সরলতম, স্পষ্টতম ও ভয়ংকরতম চিন্তার হাত থেকে তার নিস্তার নেই। সে জানে, এতদিন যত যুদ্ধে সে যোগ দিয়েছে তার মধ্যে কালকের যুদ্ধই হবে সবচাইতে ভয়ংকর, আর জীবনে এই প্রথম সে মৃত্যুর সম্ভাবনার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে–সে সম্ভাবনা যেমন স্পষ্ট ও ভয়ংকর, তেমনই নিশ্চিত। সহসা সারাটা জীবন ম্যাজিক-লণ্ঠনের ছবির মতো তার সামনে একে একে ভেসে উঠতে লাগল। বিশেষ করে জীবনের তিনটি মহৎ দুঃখ তার সামনে বড় হয়ে ফুটে উঠল : একটি নারীর প্রতি ভালোবাসা, বাবার মৃত্যু, আর অর্ধেক রাশিয়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ফরাসি আক্রমণ। ভালোবাসা!…ছোট্ট মেয়েটি কী রহস্যময় শক্তিতে একেবারে কানায় কানায় ভরে উঠেছিল! হ্যাঁ, আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। তাকে নিয়ে ভালোবাসার ও সুখের কত পরিকল্পনাই করেছিলাম! আঃ, আমি কী ছেলেমানুষই ছিলাম! তিক্তকণ্ঠে সে বলে উঠল। হায়রে! এমন এক আদর্শ ভালোবাসার উপর আমি ভরসা করেছিলাম যা আমার একটি বছরের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাকে আমার প্রতি বিশ্বস্ত রাখবে। উপকথার ভীরু কপোতর মতো আমার বিরহে সে কাঁদবে…কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কত সরল…কত সরল আর কত ভয়ংকর।

বাবা যখন বন্ড হিলস গড়ে তুলেছিল তখন সে ভেবেছিল জায়গাটা তার–তার জমি, তার বাতাস, তার চাষীর দল। কিন্তু নেপোলিয়ন এল, আর পথের খড়কুটোর মতো তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, তার বন্ড হিলস, তার সারাটা জীবন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। প্রিন্সেস মারি বলে, এটা উপরওয়ালার পরীক্ষা। কিন্তু বাবাই যখন রইল না, আর কখনো ফিরে আসবে না, তখন কিসের জন্য এই পরীক্ষা? বাবা তো নেই! তাহলে কার জন্য এই পরীক্ষা? পিতৃভূমি ও মস্কোর ধ্বংস! আর কাল আমি নিহত হব, হয়তো কোনো ফরাসির হাতেও নয়, হয়তো আমাদেরই কোনো সৈনিক আমার কানের পাশ থেকে বন্দুক দাগবে, কাল তো সেই ঘটনাই একটা ঘটেছে, আর পাছে তাদের চোখের সামনে আমি মরে যাই সেই ভয়ে ফরাসিরা এসে হাত-পা ধরে আমাকে একটা গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। গড়ে উঠবে জীবনের নতুন পরিবেশ, অপরের কাছে সেটা খুবই সহজ ও সাধারণ বলে মনে হবে, অথচ সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানব না। আমি তো থাকবই না।

সূর্যকিরণ ঝলসিত বার্চ গাছগুলোর দিকে সে তাকাল, তাদের নিথর সবুজ পাতা ও শাদা বাকল চোখে পড়ল। মরে যাব…কালই মরে যাব…আমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না…এ সবকিছুই থাকবে, থাকব না শুধু আমি…

আলো-ছায়ায় ঘেরা বার্চ গাছেরা, কুণ্ডলি পাকানো মেঘের দল, শিবির-আগুনের ধোঁয়া, চারদিকে যা কিছু আছে, সব যেন মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল, ভয়াল, ভয়ংকর হয়ে দেখা দিল। একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। তাড়াতাড়ি উঠে চালাঘরের বাইরে গিয়ে সে ইতস্তত হাঁটতে লাগল।

আবার ভিতরে এসে শুনতে পেল বাইরে কারা যেন কথা বলছে। কে ওখানে? সে চেঁচিয়ে বলল।

লাল-নাক ক্যাপ্টেন তিমোখিন একজন অ্যাডজুটান্ট ও একজন তবিলদারকে সঙ্গে নিয়ে সলজ্জভাবে ঘরে ঢুকল।

সব কাজের কথা শুনে প্রিন্স আন্দ্রু তাদের আরো কিছু নির্দেশ দিল, এমন সময় ঘরের পিছন থেকে একটা অস্পষ্ট গলা শোনা গেল।

কোনো কিছুতে ঠোক্কর খেয়ে কে যেন বলে উঠল, জাহান্নামে যাও!

ঘর থেকে বেরিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু দেখল একটা কাঠের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পিয়ের প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। পিয়েরকে দেখে প্রিন্স আন্দ্রুর মন অপ্রসন্ন হয়ে উঠল, শেষবারের মস্কো ভ্রমণের বেদনাময় স্মৃতি তার মনে পড়ে গেল।

তুমি? কী আশ্চর্য! তুমি এখানে কেন এসেছ? এ যে অপ্রত্যাশিত।

 বলতে বলতে প্রিন্স আন্দ্রুর চোখে-মুখে যে ভাব দেখা দিল তা নিস্পৃহতারও বেশি–তাতে প্রকাশ পেল বিরূপ মনোভাব, আর সেটা পিয়েরের নজর এড়াল না।

আমি এসেছি…শুধু…কি জান…এসেছি…এসব দেখতে আমার ভালো লাগে…আমি যুদ্ধ দেখতে চাই, পিয়ের বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু ঠাট্টা করে বলল, আচ্ছা, তার যুদ্ধ সম্পর্কে তোমার সংঘভাইরা কি বলে? তারা কোন পথে এ যুদ্ধ থামাতে চায়?…যাকগে, মস্কোর খবর কি বল? আর আমার লোকজনরা? তারা কি মস্কো পৌঁছেছে?

হ্যাঁ, পৌঁছেছে। জুলি দ্রবেস্ক্রয়া আমাকে সেইরকমই বলেছে। তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা হয়নি। তারা তোমাদের মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারিতে চলে গেছে।

.

অধ্যায়-২৫

অফিসারদের বিদায় নেবার সময় হল, কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রু বন্ধুকে নিয়ে একা থাকতে অনিচ্ছুক হওয়ায় তাদের আরো কিছুক্ষণ থেকে চা খেয়ে যেতে বলল। বসার আসন ও চা এল। অফিসাররা অবাক হয়ে পিয়েরের লম্বা চওড়া চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মুখ থেকে মস্কোর কথা এবং সদ্য-দেখা আমাদের ঘাঁটির অবস্থার কথা শুনতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রু চুপচাপ বসে থাকল, তার মুখের বিরূপ ভাব দেখে পিয়ের প্রধানত ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার ভালো মানুষ তিমোখিনকে উদ্দেশ করেই কথা বলতে লাগল।

প্রিন্স আন্দ্রু বাধা দিয়ে বলল, তুমি তাহলে আমাদের সৈন্যদের অবস্থানটা ভালোই বুঝতে পেরেছ?

পিয়ের জবাব দিল, হ্যাঁ–আচ্ছা, তুমি কি বলতে চাও? আমি তো সামরিক বিভাগের লোক নই, কাজেই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝেছি এমন কথা বলতে পারি না, কিন্তু মোটামুটি বুঝে নিয়েছি।

আচ্ছা, তুমি তো তাহলে অন্য অনেকের চাইতে বেশি বুঝেছ, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

বিব্রতভাবে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে পিয়ের বলল, ও! আচ্ছা, কুতুজভের নিয়োগ সম্পর্কে তুমি কি মনে কর?

আমি তো শুধু এই জানি যে তার নিয়োগে আমি খুব খুশি হয়েছি, প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল।

আর বার্কলে দ্য তলি সম্পর্কে তোমার মতামতটাও বল। মস্কোতে তার সম্পর্কে যে কী বলা হচ্ছে তা ঈশ্বরই জানেন…তার সম্পর্কে তুমি কি মনে কর?

অফিসারদের দেখিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, ওদের জিজ্ঞাসা কর।

সপ্রশ্ন হাসির সঙ্গে পিয়ের তিমোখিনের দিকে তাকাল। কর্নেলের দিকে বার বার তাকাতে তাকাতে তিমোখিন ভীরু গলায় বলল, মহামহিমের নিয়োগের ফলে আমরা আবার আলো দেখতে পাচ্ছি।

কী রকম?

দেখুন, কেবল জ্বালানি-কাঠ ও খড়ের ব্যাপারটাই আপনাকে বলছি। আমরা যখন স্বেন্ত সিয়ানি থেকে হটে আসছিলাম, তখন একটা কঞ্চি, বা একটা খড়ের ডাটা, বা কোনো কিছুতে হাত দেবার সাহসই আমাদের ছিল না। কি জানেন, আমরা চলে যাচ্ছিলাম, আর সেসব জিনিসই পড়ছিল তার হাতে (রুশরা শত্রুকে তার বলেই উল্লেখ করে), তাই নয় কি ইয়োর এক্সেলেন্সি তিমোখিন আবার প্রিন্সের দিকে তাকাল। সে সাহসই আমাদের ছিল না। ঐ ধরনের কাজের জন্য আমাদের রেজিমেন্টের দুজন অফিসারকে কোর্ট-মার্শাল করা হয়েছে। কিন্তু মহামহিম যখন সর্বেসর্বা হয়ে এলেন তখন সব ব্যাপারটাই সহজ হয়ে এল। এখন আমরা আলো দেখতে পাচ্ছি..

তাহলে সেটা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কেন? এ-প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে তিমোখিন বিচলিতবে চারদিকে তাকাতে লাগল। সেই একই প্রশ্ন পিয়ের প্রিন্স আন্দ্রুকে করল।

কেন? যে দেশকে আমরা শত্রুর হাতে রেখে যাচ্ছি সেটা যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, তীব্র ব্যঙ্গের সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল। নীতি হিসেবে এটা তো ভালোই, একটা দেশ লুষ্ঠিত হবে এবং সৈন্যরা লুটেরা হয়ে যাবে সেটা তে চলতে দেওয়া যায় না। স্নোলেনস্কেও তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে যেহেতু ফরাসি সেনাবাহিনী ছিল আমাদের চাইতে অনেক বড় তাই তারা হয়তো আমাদের ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এই কথাটা তিনি বুঝতে পারেননি, নিজের অজ্ঞাতেই প্রিন্স আন্দ্রুর কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে উঠল, যে এই প্রথম আমরা রাশিয়ার মাটিতে যুদ্ধ করছিলাম, সৈন্যদের মধ্যে সেদিন যে মনোবল গড়ে উঠেছিল তেমনটি আগে কখনো দেখিনি, দুদিন পর্যন্ত ফরাসিদের আমরা রুখে দিয়েছিলাম, আর সেই সাফল্যের ফলে আমাদের শক্তি দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল। তিনি পশ্চাদপসরণের হুকুম দিলেন, আর আমাদের সব প্রচেষ্টা, সব ক্ষয়-ক্ষতি বিফলে গেল। আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার কথা তিনি ভাবেননি, সাধ্যমতো ভালো করতেই চেষ্টা করেছেন, সবকিছু ভেবেচিন্তেই করেছেন, আর সেই কারণেই তিনি অনুপযুক্ত। এখনো তিনি অনুপযুক্ত, শুধু এই কারণে যে অন্য সব জার্মানের মতোই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ও সঠিকভাবে পরিকল্পনা করেন। কেমন করে যে বোঝাই?…আচ্ছা, ধর তোমার বাবার একজন জার্মান খানসামা আছে, লোকটি খানসামা হিসেবে চমৎকার, তোমার বাবার সব প্রয়োজন তোমার চাইতেও ভালোভাবে মেটাতে পারে, কাজেই তাকে সে কাজ করতে দেওয়াই সমীচীন। কিন্তু তোমার বাবা যদি মারাত্মক অসুখে পড়েন, তখন খানসামাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে অনভ্যস্ত হাতে তুমিই তোমার বাবার সেবা করবে এবং একজন কুশলী অপরিচিত লোকের চাইতে তাকে বেশি শান্তি দিতে পারবে। বার্কলের ব্যাপারটাও সেইরকম। রাশিয়া যখন সুস্থ ছিল তখন একজন বিদেশী তার সেবা করতে পারে, একজন চমৎকার মন্ত্রীও হতে পারে, কিন্তু যেমুহূর্তে রাশিয়া বিপন্ন হয়ে পড়েছে তখন থেকেই তার প্রয়োজন নিজের লোককে। কিন্তু তোমাদের ক্লাবে তাকে বিশ্বাসঘাতক বানানো হচ্ছে। বিশ্বাসঘাতক বলে তাকে নিন্দা করছে, আর তার একমাত্র ফল হবে পরবর্তীকালে এই মিথ্যা অভিযোগের জন্য লজ্জিত হয়ে তারাই তাকে বানাবে নায়ক অথবা প্রতিভাধর, আর সেটাই হবে আরো বেশি অন্যায়। তিনি একজন সৎ ও অত্যন্ত নিষ্ঠাবান জার্মান।

সকলেই বলে যে তিনি একজন কুশলী সেনাপতি পিয়ের যোগ করল।

 প্রিন্স আন্দ্রু বিদ্রুপের সুরে বলল, কুশলী সেনাপতি বলতে কি বোঝায় আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

পিয়ের উত্তরে বলল, কুশলী সেনাপতি কেন, যে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আগে দেখতে পায়…এবং প্রতিপক্ষের অভিপ্রায়ও আগে থেকে ধরতে পারে।

যেন কথাটা নির্ধারিত সত্য এমনভাবে প্রিন্স আন্দ্রু বলে উঠল, কিন্তু সে তো অসম্ভব।

পিয়ের সবিস্ময়ে তার দিকে তাকাল।

মন্তব্য করল, অথচ তারাই বলে যে যুদ্ধ হচ্ছে দাবা খেলার মতো।

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, ঠিক কথা, কিন্তু একটু তফাৎ আছে। দাবা খেলায় একটা চাল নিয়ে তুমি যতক্ষণ খুশি ভাবতে পার, তোমার সময়ের অভাব থাকে।

না, তাছাড়া, মন্ত্রী সব সময়ই বড়ের চাইতে বেশি শক্তিশালী, আর দুটো বড়ে সব সময়ই একটা বড়ের চাইতে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু যুদ্ধের বেলায় একটা ব্যাটেলিয়ন কখনো একটা ডিভিশনের চাইতে বেশি শক্তিশালী, আবার কখনো একটা কোম্পানির চাইতে দুর্বল হতে পারে। সেনাদলের আপেক্ষিক শক্তির কথা আগে থেকে কেউ জানতে পারে না।…বিশ্বাস কর, সবকিছু যদি কর্মচারীদের ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করত, তাহলে আমি সেখানে থেকেই ব্যবস্থা করতাম, কিন্তু তার পরিবর্তে আমি রেজিমেন্টে চলে এসেছি এই ভদ্রলোকদের সঙ্গে কাজ করতে, আ আমি মনে করি যে কালকের যুদ্ধটা নির্ভর করবে আমাদের উপর, সেই সব লোকদের উপর নয়…সৈন্যসমাবেশ, সমরসজ্জা, এমন কি সৈন্য-সংখ্যার উপরেও সাফল্য নির্ভর করে না, ঘাঁটির উপর তো নয়ই।

তাহলে কিসের উপর নির্ভর করে?

তিমোখিনকে দেখিয়ে সে বলল, আমার মধ্যে, ওর মধ্যে এবং প্রতিটি সৈন্যের মধ্যে যে অনুভূতি কাজ করে তার উপর।

প্রিন্স আন্দ্রু তিমোখিনের দিকে তাকাল, সভয়ে ও একান্ত বিহ্বলতায় সে তার কমান্ডারের দিকে তাকাল। প্রিন্স আন্দ্রু এতক্ষণ ছিল সংযত, স্বল্পবাক, এবার সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। সহসা যে চিন্তার স্রোত তার মনে জেগেছে তাকে প্রকাশ না করে সে পারল না।

 যুদ্ধ জয়ের দৃঢ় সংকল্প যারা গ্রহণ করে তারাই যুদ্ধ জয় করে। অস্তারলিজের যুদ্ধে কেন আমাদের হার হল? ফ্রান্সের ক্ষয়-ক্ষতি আমাদের প্রায় সমানই হয়েছিল, কিন্তু গোড়া থেকেই আমরা বলে আসছিলাম যে আমরা হারতে বসেছি, আর সেই হারই আমাদের হল। আর সেকথা আমরা বলেছিলাম কারণ সেখানে যুদ্ধ করবার মতো কিছুই আমাদের ছিল না, যত শীঘ্র সম্ভব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে আসতেই আমরা চেয়েছিলাম। আমরা হেরে গেছি, অতএব ছুটে পালাও, আমরা ছুটে পালিয়েছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি সেকথা আমরা না বলতাম, তাহলে কী না ঘটতে পারত তা ঈশ্বর জানেন। কিন্তু কাল আমরা সেকথা বলব না। তোমরা আমাদের ব্যুহ রচনার কথা বলছ, বলছ যে বাম ব্যুহ দুর্বল, আর দক্ষিণ ব্যুহ বড় বেশি প্রসারিত, সেসবই বাজে কথা, সেরকম কিছুই ঘটেনি। কিন্তু কাল আমাদের কপালে কি আছে? আছে লক্ষ লক্ষ বিচিত্র সম্ভাবনা যেটা নির্ধারিত হবে আমাদের সৈন্য বা তাদের সৈন্যরা পালাবে কি পালাবে না তার দ্বারা, এ-লোক বা সে লোকের মৃত্যু হবে কি না তার দ্বারা, কিন্তু বর্তমানে যা কিছু করা হচ্ছে সবই তো ছেলেখেলা। আসল কথা হল, যাদের নিয়ে তোমরা সবকিছু ঘুরে দেখে এলে তারা আমাদের কাজের সহায়ক না হয়ে বরং বিঘ্নের সৃষ্টি করছে। তারা সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।

এই সংকট-মুহূর্তেও? পিয়ের অনুযোগের সুরে বলল।

এই সংকট-মুহূর্তেও! প্রিন্স আন্দ্রু কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। তাদের কাছে এই মুহূর্তটা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাভূত করে একটা বাড়তি ক্রুশ বা ফিতে পাবার সুযোগ এনে দিয়েছে মাত্র। আর আমার কাছে আগামীকালের অর্থ হল : এক লক্ষ্য সৈন্যের রুশ বাহিনী এবং এক লক্ষ সৈন্যের ফরাসি বাহিনী রণক্ষেত্রে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, দুই লক্ষ সৈন্য যুদ্ধ করবে, এবং যে পক্ষ ন্যূনতম ঝুঁকি নিয়ে অধিকতর তীব্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করবে সেই জিতবে। আর তুমি যদি চাও তো আমি বলছি, যাই ঘটুক না কেন, উপরওয়ালারা যতই ভণ্ডুল করুক না কেন, আগামীকালের যুদ্ধে আমরা জিতবই। যাই ঘটুক না কেন, আগামীকাল আমরা। জিতবই!

তিমোখিন বলে উঠল, ঠিক বলেছেন ইয়োর এক্সেলেন্সি! এটাই সত্য কথা, খাঁটি কথা। আজকের দিনে কে দূরে সরে থাকবে? বিশ্বাস করুন, আমার ব্যাটেলিয়নের সৈন্যরা আজ ভদকা খাবে না। তারা বলছে, ভদকা খাবার দিন আজ নয়!

সকলেই চুপ। অফিসাররা উঠে দাঁড়াল। অ্যাডজুটান্টকে চূড়ান্ত নির্দেশ জানিয়ে প্রিন্স আন্দ্রুও তাদের সঙ্গে চালাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারা চলে গেলে পিয়ের প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে এগিয়ে গেল, তার সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে যাবে এমন সময় অদূরে তিনটে ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ তাদের কানে এল, সেদিকে তাকিয়ে প্রিন্স জনৈক কসাকসহ ওলযোগেন ও ক্লজউইজকে চিনতে পারল। পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে যেতে তারা নিজেদের মধ্যে ফরাসিতে যা বলাবলি করছে আপনা থেকেই প্রিন্স আন্দ্রু তা শুনতে পেল, রণক্ষেত্রকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতেই হবে, একজন বলল।

অপরজন বলল, ঠিক বলেছ, শত্রুপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়াটাই একমাত্র লক্ষ্য, এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ক্ষয় ক্ষতির কথা ভাবলে চলবে না।

তারা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলে প্রিন্স আন্দ্রু তর্জন করে বলে উঠল, রণক্ষেত্রকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে হবে! ওই প্রসারিত করার মধ্যে ছিল আমার বাবা, ছেলে, বোন, বল্ড হিলস। ওর কাছে সবই সমান! এই কথাই তোমাকে বলছিলাম-ওই জার্মান ভদ্রলোকরা কালকের যুদ্ধ জিততে পারবে না, তারা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দেবে, কারণ তাদের জার্মান খুলির মধ্যে তত্ত্ব ছাড়া আর কিছু নেই, আর সে তত্ত্বের মূল্য একটা খালি ডিমের খোলাও নয়, কালকের যুদ্ধে যে বস্তুটির প্রয়োজন, যা তিমোখিনের আছে, তা ওদের হৃদয়ে নেই। ওরা গোটা ইয়োরোপকে তার হাতে সঁপে দিয়ে এখন এসেছে আমাদের শেখাতে। বেড়ে শিক্ষক সব! তার কণ্ঠস্বর আবার কর্কশ হয়ে উঠল।

পিয়ের শুধাল, তাহলে তুমি মনে কর যে কালকের যুদ্ধে আমাদের জয় হবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্রিন্স আন্দ্রু অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল। তারপর বলতে শুরু করল, আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি একটা কাজ করতাম, কাউকে বন্দি করতাম না। কেন বন্দি করব? তাতে বীরত্ব প্রকাশ হতে পারে! কিন্তু ফরাসিরা আমার বাড়ি ধ্বংস করেছে, ছুটে চলেছে মস্কো ধ্বংস করতে, আমাকে অপমান করেছে, প্রতিটি মুহূর্ত অপমান করে চলেছে। তারা আমার শত্রু। আমার মতে তারা সকলেই অপরাধী। তিমোখিন এবং গোটা সৈন্যদলও তাই মনে করে। তাদের হত্যা করতে হবে। তিলজিটে যাই বলা হোক না কেন, যেহেতু তারা আমার শত্র, তাই তারা আমার বন্ধু হতে পারে না।

চকচকে চোখে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে পিয়ের বলল, ঠিক ঠিক। তোমার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।

মোঝায়ে পাহাড়ে এবং সারাটাদিন ধরে যে প্রশ্নটা পিয়েরকে বিব্রত করে তুলেছিল এবার যেন সেটা তার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, প্রশ্নটা মীমাংসাও সে খুঁজে পেয়েছে। এই যুদ্ধের এবং আসন্ন সংঘর্ষের তাৎপর্য ও গুরুত্ব এবার সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। সারাদিন সে যা কিছু দেখেছে, যেতে যেতে নানা জনের মুখে যে অর্থপূর্ণ কঠিন ভাব দেখেছে, সেসব কিছুই একটা নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তার দেখা এইসব লোকদের মধ্যে দেশপ্রেমের যে সুপ্ত উত্তাপ (পদার্থবিদ্যার ভাষায়) রয়েছে তার সন্ধান সে পেয়েছে, আর তার ফলেই বুঝতে পেরেছে কেন তারা সকলেই শান্ত অথচ সহজভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত হতে পেরেছে।

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, কাউকে বন্দি করব না। শুধু তাহলেই গোটা যুদ্ধের চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে, তার নিষ্ঠুরতাও হ্রাস পাবে। এখন যা চলছে সেটা তো যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা–আর সেটাই জঘন্য। আমরা মহত্ত্ব ও অনুরূপ গুণাবলী নিয়ে খেলা করি। এই মহত্ত্ব ও স্পর্শকাতরতা হচ্ছে সেই মহিলাটির মহত্ত্ব ও স্পর্শকাতরতার মতো যিনি একটি গো-বসের মাংস যখন সজিসহকারে পরিবেশন করা হয় তখন বেশ রসিয়ে রসিয়ে খান। তারা তো অনেক কথাই বলে-যুদ্ধের রীতিনীতি, বীরত্ব, সন্ধির পতাকা, দুর্ভাগাদের প্রতি করুণা, কত কি। সবই তো অর্থহীন। এই বীরত্ব ও সন্ধির পতাকা, দুর্ভাগাদের প্রতি করুণা, কত কি। সবই তো অর্থহীন। এই বীরত্ব, সন্ধির পতাকা আমি দেখেছি ১৮০৫-এ তারা আমাদের ধোকা দিয়েছে, আমরা তাদের ধোকা দিয়েছি। তারা অন্য লোকের ঘরবাড়ি লুঠ করে, নকল টাকার নোট ছড়ায়, আর সবচাইতে যেটা খারাপ আমার সন্তান ও পিতাকে হত্যা করে, এবং তারপরে যুদ্ধের রীতিনীতি ও শত্রুর প্রতি উদারতার বুলি আওড়ায়! কাউকে বন্দি করো না, মার এবং মর। আমার মতোই দুঃখ-যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যারা এই সিদ্ধান্তে এসেছে…

হঠাৎ প্রিন্স আন্দ্রুর গলা আটকে গেল। নিঃশব্দে বারকয়েক পায়চারি করল, তার চোখ দুটি চকচক করছে, ঠোঁট কাঁপছে।

যুদ্ধে যদি এই উদারতার ব্যাপারটা না থাকত, তাহলে একমাত্র তখনই আমরা যুদ্ধে যেতাম যখন আজকের মতো বুঝতাম যে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাওয়াটাও অবশ্য কর্তব্য। তাহলে পল আইভানভিচ মাইকেল আইভানভিচকে দুঃখ দিয়েছে বলেই একটা যুদ্ধ বেধে যেত না। আর আজকের মতোই যুদ্ধ হলে সেটা যুদ্ধই হত! তখন সৈন্যদের সংকল্প হত সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেক্ষেত্রে ওয়েস্টফেলিয়া ও হেসিয়ার যেসব মানুষদের নেপোলিয়ন আজ রণক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তারা তার পিছু পিছু রাশিয়াতে ঢুকত না, আর আমরাও কিছু না জেনেশুনেই অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়াতে যুদ্ধ করতে যেতাম না। যুদ্ধ একটা ভদ্রতার ব্যাপার নয়, যুদ্ধ জীবনের এক ভয়ংকর সত্য, আর সেটাই আমাদের বুঝতে হবে, যুদ্ধ নিয়ে ছেলেখেলা করা চলবে না। কঠোরভাবে, গুরুত্বের সঙ্গে এই ভয়ংকর অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নিতে হবে। আসল ব্যাপারটা সেখানেই, মিথ্যার মোহকে ছিঁড়ে ফেল, যুদ্ধটা যুদ্ধই হোক, খেলা নয়। এখন যা চলছে তা তো যুদ্ধ নয়, যেন অলস ও বাকসর্বদের একটা মজার খেলামাত্র। সামরিক চাকরি অত্যন্ত সম্মানজনক পদ।

কিন্তু যুদ্ধ কিযুদ্ধে সাফল্যলাভের জন্য কি দরকার? সামরিক লোকদের কাজ কি? যুদ্ধের লক্ষ্যই তো হত্যা, যুদ্ধের পথ হচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি, বিশ্বাসঘাতকতা, একটা দেশের অধিবাসীদের ধ্বংস, সেনাদলের খাদ্যসংস্থানের জন্য লুট ও চুরি, জালিয়াতি ও মিথ্যাচরণই তো সামরিক কৌশলের অপর নাম। সামরিক লোকদের স্বভাব হচ্ছে স্বাধীনতার অভাব, অর্থাৎ শৃঙ্খলা, আলস্য, অজ্ঞতা, নিষ্ঠুরতা, লাম্পট্য ও মাতলামি। আর এসব সত্ত্বেও তারাই সর্বজনশ্রদ্ধেয় উচ্চতম শ্ৰেণী। একমাত্র চীনারা ছাড়া আর সব রাজারাই সামরিক পোশাক পরেন, যে লোক যত বেশি মানুষ মারতে পারে সেই পায় সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

কাল যেমন আমরা মুখোমুখি হব, তেমনি তারাও পরস্পরের মুখোমুখি হয় একে অন্যকে খুন করতে, তারা হাজার হাজার লোককে খুন করে, পঙ্গু করে, তারপর এত এত মানুষ (এমন কি তারা সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে বলে) খুন করার জন্য ধন্যবাদজ্ঞাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যত বেশি মানুষ তারা খুন করবে ততই তাদের কৃতিত্ব বাড়বে এটা ধরে নিয়েই একটা জয়ের কথা ঘোষণা করা হয়। মাথার উপর থেকে ঈশ্বর তাদের কোন চেখে দেখেন বা তাদের কথা শোনেন? প্রিন্স আন্দ্রুর কণ্ঠস্বর আরো তীক্ষ্ণ ও কর্কশ হয়ে উঠল। হায় বন্ধু, ইদানীং বেঁচে থাকাটাই আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছি যে আমি বড় বেশি বুঝতে শুরু করেছি। পাপ-পুণ্যের জ্ঞান-বৃক্ষের ফল খাওয়া মানুষের পোষায় না।…যাই হোক, আর বেশি দিন নয়!

তারপরেই হঠাৎ বলে উঠল, যাই হোক, তোমার ঘুম পাচ্ছে, আমারও ঘুমের সময় হয়েছে। গোর্কিতে ফিরে যাও।

ভয়ার্ত, সহৃদয় চোখে তার দিকে তাকিয়ে পিয়ের বলল, না, না।

 যাও, যাও। যুদ্ধের আগে ঘুমটা ভালো হওয়া চাই, প্রিন্স আন্দ্রুর আবার বলল।

তাড়াতাড়ি পিয়েরের কাছে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে চুমো খেল।

চেঁচিয়ে বলল, বিদায়, কেটে পড়! আবার আমাদের দেখা হবে কি হবে না…মুখটা ঘুরিয়ে দ্রুত পায়ে সে চালাঘরে ঢুকে পড়ল।

অন্ধকার হয়ে এসেছে, তাই পিয়ের বুঝতে পারল না প্রিন্স আন্দ্রুর মুখে কোন ভাব ফুটেছে–ক্রোধের, না মমতার।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল, তার পিছু নেবে না চলে যাবে। শেষপর্যন্ত স্থির করল, না। সেটা তার ইচ্ছা নয়। আমি জানি, এটাই আমাদের শেষ দেখা। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে গোর্কির দিকে ঘোড়া চালিয়ে দিল।

চালাঘরে ঢুকে প্রিন্স আন্দ্রু একটা কম্বলের উপর শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুমোতে পারল না।

চোখ বুজল। কল্পনায় একটার পর একটা ছবি ভেসে উঠল। একটা ছবি নিয়ে আনন্দের সঙ্গে অনেকক্ষণ কাটাল। পিটার্সবুর্গের একটা সন্ধ্যার কথা খুব স্পষ্ট হয়ে মনে পড়ল। প্রাণবন্ত, উত্তেজিত মুখে নাতাশা তাকে বলেছিল, আগের গ্রীষ্মকালে ব্যাঙের ছাতা কুড়তে গিয়ে কেমন করে সে বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। এলোমেলোভাবে সে বলছিল জঙ্গলের গভীরতার কথা তার অনুভূতির কথা, একজন মৌমাছি-পালকের সঙ্গে দেখা হবার কথা, আর সেসব বলার ফাঁকে ফাঁকে বারবারই বলেছিল : না, আমি পারছি না, ঠিক মতো বলা হচ্ছে না, না, তুমি ঠিক বুঝছ না। নিজের কথায় নাতাশা নিজেই খুশি হতে পারেনিঃ সে বুঝতে পারছিল, সেদিন তার মনে যে আবেগময় কাব্যভাব জেগেছিল সেটাকে সে ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছে না। উত্তেজনায় লাল হয়ে সে বলেছিল, না, আমি ঠিকমতো বলতে পারছি না।…বুড়ো মানুষটি এত ভালো ছিল, আর জঙ্গলের ভিতরটা ছিল এত অন্ধকার…না, ঠিক হচ্ছে না। প্রিন্স আন্দ্রুর মুখে সেদিনকার মতোই খুশির হাসি দেখা দিল। ভাবল, আমি তাকে ঠিক বুঝেছিলাম। শুধু যে বুঝেছিলাম তাই নয়, তার ভিতরকার সেই আত্মিক শক্তি, সেই আন্তরিকতা, আত্মার সেই সংকোচবিহীনতা-তার যে আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ–সেই আত্মাকেই আমি ভালোবেসেছিলাম…কত যে ভালোবেসেছিলাম আর কত যে সুখী হয়েছিলাম…হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল কেমন করে একদিন সে ভালোবাসার অবসান হল। সেই লোকটার তো সেরকম কিছুর প্রয়োজন ছিল না। সে জিনিস সে তো দেখেওনি, বোঝেওনি। সে লোকটা তার মধ্যে দেখেছিল শুধু একটি সুন্দরী, তাজা যুবতাঁকে, কিন্তু সে নিজে তো তার সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়াতে চায়নি। আর আমি…অথচ সেই লোকটা আজও বেঁচে আছে, ফুর্তিতে আছে!

যেন আগুনের ছ্যাঁকা লেগেছে এমনিভাবে লাফিয়ে উঠে প্রিন্স আন্দ্রু চালাঘরটার সামনে পায়চারি করতে শুরু করল।

.

 অধ্যায়-২৬

 বরদিনো যুদ্ধের প্রাক্কালে ২৫শে আগস্ট তারিখে ফরাসি সম্রাটের রাজপ্রাসাদের প্রিফেক্ট ম. দ্য বুসে কর্নেল ফেবিয়েরকে সঙ্গে নিয়ে ভালুভো ঘাঁটিতে নেপোলিয়নের কাছে এসে হাজির হল, প্রথম জন এল প্যারিস থেকে, আর দ্বিতীয়জন মাদ্রিদ থেকে।

দরবারের পোশাকে সজ্জিত ম. দ্য বুসে হুকুম দিল, সম্রাটের জন্য যে বাক্সটা আনা হয়েছে সেটা তার সামনে হাজির করা হোক। নেপোলিয়নের শিবিরের প্রথম ঘরটাতে ঢুকে নেপোলিয়নের এড-ডি-কংদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে বাক্সটা খুলতে লাগল।

ফেবিয়ের শিবিরে না ঢুকে ফটকে দাঁড়িয়েই পরিচিত সেনাপতিদের সঙ্গে আলাপ করতে লাগল।

সম্রাট নেপোলিয়ন তখনো তার শোবার ঘরেই বেশবাস নিয়ে ব্যস্ত। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে কখনো পিঠ, কখনো লোমশ ফোলা বুকটা এগিয়ে দিচ্ছে, আর খানসামা তাকে বুরুশ করছে। আর একটি খানসামা একটা বোতলের মুখে আঙুল রেখে সম্রাটের সারা শরীরে ইউ-ডি-কলোন ছিটিয়ে দিচ্ছে, তার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন একমাত্র সেই জানে ম্রাটের শরীরের কোথায় কতটা ইউ-ডি-কলোন ছিটাতে হবে। নেপোলিয়নের মাথার ছোট ছোট চুলগুলি ভেজা, কপালের উপর চেপে বসানো, ফোলা-ফোলা হলদেটে মুখে দৈহিক তৃপ্তির আমেজ। খানসামাকে বলছে, চালাও, আরো জোরে বুরুশ চালাও! যে এড-ডি-কংটি গতকালের যুদ্ধে বন্দিদের সংখ্যা জানাতে ঘরে ঢুকেছিল, ফিরে যাওয়ার নির্দেশের অপেক্ষায় সে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ভুরু কুঁচকে নেপোলিয়ন তার দিকে তাকাল।

এড-ডি-কংয়ের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলল, কেউ বন্দি হয়নি! ওদের নির্মূল করতে ওরা আমাদের বাধ্য করছে। রুশ সৈন্যদের কপালই মন্দ।…জোরে চালাও…আরো জোরে। পিঠটা কুঁজো করে মোটা গর্দান এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল।

তারপর এড-ডি-কংয়ের দিকে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। মঁসিয় দ্য বুসেকে আসতে বল। ফেবিয়েরকেও।

ঠিক আছে স্যার, এড-ডি-কং শিবিরের দরজা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। দুই খানসামা দ্রুত হাতে হিজ ম্যাজেস্ট্রির প্রসাধন শেষ করল, রক্ষীবাহিনীর নীল ইউনিফর্ম পরে সম্রাট দ্রুতপায়ে অভ্যর্থনাকক্ষে ঢুকল।

সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে যে উপহার নিয়ে এসেছে সেগুলিকে দরজার ঠিক সামনে দুটো চেয়ারে সাজিয়ে রাখার কাজেই তখন দ্য বুসে খুব ব্যস্ত। পোশাক-পরা শেষ করে নেপোলিয়ন এত অপ্রত্যাশিত দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এসেছে যে দ্য বুসে তখনো উপহারগুলি সাজিয়ে শেষ করতে পারেনি।

তাদের কাজকর্ম দেখেই নেপোলিয়ন বুঝতে পারল তারা কি করছে এবং সেকাজ তখনো শেষ হয়নি। তাকে অবাক করে দিয়ে নিজেরা যাকে খুশি হতে পারে সেই সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করতে নেপোলিয়নের মন চাইল না, কাজেই দ্য বুসেকে না দেখতে পাবার ভান করে সে ফেবিয়েরকে কাছে ডাকল এবং ইওরোপের অপর প্রান্তে সালামাংকার যুদ্ধে ফরাসি সেনাদলের বীরত্ব ও আন্তরিকতার কাহিনী শুনতে লাগল। নিঃশব্দে ভুরু কুঁচকে। ফেবিয়ারের মনে একটিই চিন্তা-ম্রাটের উপযুক্ত হওয়া, তার মনে একটিই ভয়-তাকে খুশি করতে না পারা। সে যুদ্ধের ফল হয়েছে শোচনীয়। ফেবিয়ারের বিবরণ শুনতে শুনতে নেপোলিয়ন এমন সব মন্তব্য করতে লাগল যেন তার অনুপস্থিতিতে ব্যাপারটা যে অন্যরকম হতে পারে না তা সে জানত।

বলল, সে ক্ষতি আমি মস্কোতে পূরণ করব। ঠিক আছে, পরে আপনার সঙ্গে দেখা হবে। তারপর দ্য বুসেকে ডাকল। উপঢৌকন সাজানো শেষ করে সেগুলোকে চেয়ারের উপর রেখে একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

দ্য বুসে নিচু হয়ে অভিবাদন জানাল। সেধরনের দরবারি অভিবাদন একমাত্র বুরবনদের আমলের পুরনো কর্মচারীরাই করতে জানে। সে এগিয়ে এসে সম্রাটের হাতে একটা খাম দিল।

 নেপোলিয়ন খুশি হয়ে তার কানটা টেনে দিল। 

তুমি খুব তাড়াতাড়ি এসেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। আচ্ছা, প্যারিস কি বলছে? হঠাৎ তার মুখের কঠোরতা সরে গিয়ে দেখা দিল প্রসন্নতা।

দ্য বুসে জবাব দিল, স্যার, আপনার অনুপস্থিতিতে সারা প্যারিস দুঃখিত।

কথাটা মিথ্যা হলেও দ্য বুসে যে এই কথাই বলবে নেপোলিয়ন তা জানত, তবু তার মুখ থেকে কথাটা শুনে সে খুশি হল, আবার তার কান ছুঁয়ে তাকে সম্মানিত করল।

 বলল, তোমাকে এতদূর টেনে এনেছি বলে আমি খুবই দুঃখিত।

দ্য বুসে উত্তর দিল, আমি তো আশা করেছিলাম মস্কোর ফটকেই আপনার সঙ্গে দেখা হবে।

নেপোলিয়ন হাসল, অন্যমনস্কভাবে মাথাটা তুলে ডাইনে তাকাল। জনৈক এড-ডি-কং এগিয়ে এসে একটা সোনার নস্যদানি তার হাতে দিল।

খোলা নস্যর কৌটোটা নাকের কাছে ধরে বলল, হ্যাঁ, তোমার ভাগ্য ভালো যে সেটাই ঘটছে। তুমি তো ভ্রমণ করতে ভালোবাস, আর তিনদিনের মধ্যেই মস্কো দেখতে পাবে। এশিয়ার সেই রাজধানীটা দেখার আশা তুমি নিশ্চয়ই করনি। তোমার যাত্রাপথটাও সুখেই কাটবে।

ভ্রমণ-অনুরাগের এই গুণগান শুনে (যদিও সে নিজে বিষয়টা সম্পর্কে ঠিক অবহিত ছিল না) দ্য বুসে সকৃতজ্ঞচিত্তে মাথা নোয়াল।

কাপড় দিয়ে ঢাকা কোনো জিনিসের দিকে পারিষদরা সকলেই তাকিয়ে আছে দেখে নেপোলিয়ন শুধাল, আরে, এটা কি?

দ্য বুসে দরবারি কায়দায় অর্ধেকটা ঘুরে কিন্তু সম্রাটের দিকে পিছন না ফিরে দু পা পিছিয়ে গেল এবং কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে বলল, সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে ইয়োর ম্যাজেস্টির জন্য কিছু উপঢৌকন।

একখানি প্রতিকৃতি, জেরার্ড কর্তৃক উজ্জ্বল রঙে আঁকা। অস্ট্রিয়ার সম্রাটের কন্যার গর্ভে নেপোলিয়নের যে ছেলে হয়েছে তারই ছবি, যে কারণেই হোক সকলেই ছেলেটিকে রোমের রাজা বলে ডাকে।

মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল সুন্দর ছেলেটি, চোখে সিস্টাইন ম্যাডোনার আঁকা খৃস্টের দৃষ্টি, লাঠি ও বল নিয়ে ক্রীড়ারত ভঙ্গিতে তাকে আঁকা হয়েছে। বলটি যেন ভূ-ঘোলক, আর অন্য হাতের লাঠির রাজদণ্ড।

তথাকথিত রোমের রাজা-কে লাঠি দিয়ে পৃথিবীকে বিদ্ধকারী ভঙ্গিমায় এঁকে শিল্পী কি বোঝাতে চেয়েছে সেটা স্পষ্ট না হলেও প্যারিসে যারা যারা ছবিটা দেখেছে তাদের মতো নেপোলিয়নের কাছে ছবির রূপকার্যটি খুবই পরিষ্কার ও মনের মতো বলেই মনে হল।

একটা মনোরম ভঙ্গি করে প্রতিকৃতিটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে নেপোলিয়ন বলে উঠল, রোমের রাজা!…প্রশংসনীয়!

ইচ্ছামতো মুখের ভাব বদলাবার সহজাত ইতালিয় ক্ষমতার বলে সে ছবিটার আরো কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখে একটা বিষণ্ণ মমতার ভাব ফুটিয়ে তুলল। সে বুঝতে পেরেছে, এই মুহূর্তে সে যা বলবে বা করবে সেটা ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি লাভ করবে, আর তাই এইমুহূর্তে তার পক্ষে সবচাইতে ভালো হবে রাজকীয় জাকজমকের-যে জাঁকজমক তার সন্তানকে দিয়েছে ভূগোলক নিয়ে খেলা করার শক্তি-পরিবর্তে অতি সহজ, সরল পিতৃসুলভ মমতা দেখানো। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল, কিছুটা এগিয়ে ছবিটার সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তার একটিমাত্র ইঙ্গিতে সকলেই পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, সেখানে রইল শুধু ভাববিহ্বল, মহাপুরুষটি।

কিছুক্ষণ বসে থেকে কিছু না বুঝেই সে ছবির সবচাইতে উজ্জ্বল রংয়ের জায়গাটা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়াল, দ্য বুসে ও কর্তব্যরত অফিসারকে ডেকে পাঠাল। প্রতিকৃতিটিকে শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবার হুকুম হল, শিবিরের চারপাশে মোতায়েন রক্ষীদল যেন তাদের পূজনীয় সম্রাটের পুত্র ও উত্তরাধিকারী রোমের রাজার দর্শন থেকে বঞ্চিত না হয়।

ম. দ্য বুসের সঙ্গে প্রাতরাশে বসেই তারা শুনতে পেল ওল্ড গার্ডের অফিসার ও সৈনিকরা উচ্ছ্বসিত আনন্দে চিৎকার করতে করতে প্রতিকৃতিটি দেখবার জন্য ছুটে যাচ্ছে।

ভি ভেল এম্পেরিয়র! ভি ভে ল রয় দ্য রোম! ভি ভেল এম্পেরিয়র!

প্রাতরাশের পরে দ্য বুসের উপস্থিতিতেই সে সেনাবাহিনীর প্রতি সেদিনকার হুকুমের তলিখনটি বলতে লাগল।

কোনোকরম সংশোধন ছাড়াই সেকাজটা শেষ করে একবার পড়ে সে বলল, সংক্ষিপ্ত ও উৎসাহবর্ধক! হুকুমটা এইরকম :

সৈন্যগণ, এই যুদ্ধের আশাতেই তোমরা এতদিন ছিলে। তোমাদের উপরেই নির্ভর করছে বিজয়-গৌরব। এ যুদ্ধে আমাদের পক্ষে একান্তভাবে প্রয়োজন, আমাদের যা কিছু দরকার সবই এই যুদ্ধ আমাদের দেবে–আরামদায়ক বাসস্থান এবং দ্রুত দেশে প্রত্যাবর্তন। অস্তারলিজ, ফ্রিডল্যান্ড, ভিতের ও মোলেনঙ্কের যে আচরণ তোমরা করেছ, এখনো তাই করবে। আমাদের দূরতম প্রজন্মও যেন তোমাদের আজকের সাফল্যকে গর্বের সঙ্গে স্মরণ করতে পারে। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য তারা যেন বলতে পারে : মস্কোর সম্মুখের মহাযুদ্ধে তিনি ছিলেন।

মস্কোর সম্মুখে! নেপোলিয়ন কথাটা আর একবার উচ্চারণ করল, তারপর ভ্রমণপ্রিয় ম. দ্য বুসেকে অশ্বারোহণে তার সঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানিয়ে সে শিবির থেকে বেরিয়ে গেল।

সম্রাটের সঙ্গী হবার আমন্ত্রণের উত্তরে দ্য বুসে বলল, ইয়োর ম্যাজেস্ট্রির অনেক দয়া! তার তখন ঘুম পেয়েছে, ঘোড়ায় চড়তেও সে জানে না, তাই খুব ভয়ও করছে।

কিন্তু নেপোলিয়নের ইশারায় দ্য বুসেকে ঘোড়ায় চাপতেই হল। নেপোলিয়ন শিবির থেকে বেরিয়ে এলে তার ছেলের ছবির সামনে সমবেত রক্ষীদের চিৎকার আরো উচ্চকণ্ঠ হল। নেপোলিয়নের চোখে ভকুটি দেখা দিল।

রাজকীয় ভঙ্গিতে ছবিটা দেখিয়ে বলল, ওকে সরিয়ে নিয়ে যাও! যুদ্ধক্ষেত্র দেখবার সময় ওর এখনো হয়নি।

সম্রাটের কথাগুলি যে তার কাছে কত মূল্যবান সেটা বোঝাবার জন্য দ্য বুসে চোখ বুজে মাথাটা নুইয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

.

অধ্যায়-২৭

ইতিহাসকারদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি, ২৫ অগস্ট সারাটা দিন নেপোলিয়ন অশ্বপৃষ্ঠেই কাটিয়েছে, গোটা অঞ্চল পরিদর্শন করেছে, মার্শালরা যেসব পরিকল্পনা দাখিল করেছে সেগুলি নিয়ে ভেবেছে, সেনাপতিদের জানিয়েছে ব্যক্তিগত নির্দেশ।

২৪ তারিখে শেভার্দিনো দুর্গ দখলের ফলে কলোচা নদী বরাবর রুশবাহিনীর সীমান্তটি বিপর্যস্ত হয়ে গেছে, আর তার কতকাংশকে–বাম ব্যুহটি–পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে। সীমান্তের সেই অংশটি পরিখাবেষ্টিত নয়, আর তার সম্মুখস্থ মাঠটি অনেকটা ভোলা এবং অন্য জায়গার তুলনায় সমতল। কাজেই সামরিক বা সাধারণ যে কোন লোকের কাছেই এটা স্পষ্ট যে ফরাসিরা সেখান দিয়েই আক্রমণ করবে। স্বভাবতই এটা মনে হতে পারে যে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য কোনো বিশেষ বিচার-বিবেচনার দরকার ছিল না, সম্রাট বা তার মার্শালদেরও এ নিয়ে বিশেষভাবে মাথা ঘামাবার দরকার ছিল না, এবং সাধারণ মানুষ নেপোলিয়নকে যে প্রতিভার অধিকারী বলে মনে করে সেরকম কোনো বিশেষ মহৎ গুণের প্রয়োজনও সেখানে ছিল না, অথচ যে ইতিহাসকাররা পরবর্তীকালে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে, যারা সেইসময় নেপোলিয়নকে ঘিরে ছিল, এমন কি নেপোলিয়ন স্বয়ং কিন্তু অন্যরকমটাই মনে করেছিল।

সমতলভূমিতে ঘোড়া চালাতে চালাতে নেপোলিয়ন গম্ভীর নীরবতার সঙ্গে অঞ্চলটা ঘুরে দেখল, কখনো ঘাড় নাড়ল সম্মতিসূচকভাবে, কখনো বা সন্দিগ্ধচিত্তে, এবং যে গুরুগম্ভীর চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে সে তার সিদ্ধান্তে উপনীত হল সে সম্পর্কে সঙ্গী সেনাপতিদের কিছুমাত্র না জানিয়ে তাদের শুনিয়ে দিল তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলিকে হুকুমের আকারে।

শেভার্দিনো দুর্গের বিপরীত দিককার অঞ্চলটা ভালো করে পরীক্ষা করে নেপোলিয়ন নীরবে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর কয়েকটা জায়গা দেখিয়ে রুশদের পরিখা খননে বাধা দেবার জন্য আগামীকালের মধ্যে সেখানে দুটো কামানশ্রেণী এবং তার সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় গোলন্দাজ বাহিনী সন্নিবেশের নির্দেশ দিল।

এইসব নির্দেশাদি দিয়ে সে শিবিরে ফিরে গেল এবং তার তিলিপি অনুসারেই যুদ্ধের বিলি-ব্যবস্থার বিবরণ লেখা হল।

যে বিলি-ব্যবস্থার বিবরণ ফরাসি ইতিহাসকাররা লিখেছে মহা উৎসাহে এবং অন্য ইতিহাসকাররা লিখেছে গভীর শ্রদ্ধায় তা হল :

প্রিন্স দ্য এককমুহল কর্তৃক অধিকৃত প্রান্তরে রাতের মধ্যেই যে দুটি কামানশ্রেণী স্থাপিত হয়েছে, প্রত্যুষেই বিপরীত দিকে অবস্থিত শত্রুপক্ষের দুটি কামানশ্রেণীর উপর তা থেকে গোলা বর্ষণ করা হবে।

ঠিক একই সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম কোরের কমান্ডার জেনারেল পারনেত্তি কাম্পা ডিভিশনের ত্রিশটি কামান এবং দেসায়িক ও ফ্রিয়াৎ ডিভিশনের হাল্কা কামান নিয়ে অগ্রসর হবে, গোলাবর্ষণ করবে এবং নিম্নলিখিত শক্তি নিয়ে শত্রুপক্ষের কামানের গোলাবর্ষণকে স্তব্ধ করে দেবে :

২৪ কামান-গোলন্দাজ রক্ষী বাহিনীর
 ৩০ কামান-কাম্পা ডিভিশনের
ও ৮ কামান-ফ্রিয়াৎ ও দেসায়িক ডিভিশনের
মোট ৬২ কামান।

গোলন্দাজ বাহিনীর তৃতীয় কোরের কমান্ডার জেনারেল ফুচে তৃতীয় ও অষ্টম কোরের মোট ষোলটি হাল্কা কামানকে রাখবে সেই কামানশ্রেণীর পাশে যা থেকে বাঁ দিকের পরিখা লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করা হবে এবং যার বিরুদ্ধে তাক করে সাজানো রয়েছে চল্লিশটা কামান।

গোলন্দাজ রক্ষীবাহিনীর হাল্কা কামানগুলি নিয়ে যে কোনো একটি পরিখা-খননকারী দলের বিরুদ্ধে প্রথম হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হবার জন্য জেনারেল সোরবিয়েরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

গোলাবর্ষণ চলাকালে প্রিন্স পোনিয়াতোক্সি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে গ্রামে পৌঁছে শত্রুর সেনাসমাবেশের মুখটা ঘুরিয়ে দেবে।

প্রথম রক্ষা-ব্যবস্থাকে দখল করে নেবার জন্য জেনারেল কাম্পা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হবে।

এইভাবে অগ্রসর হবার পরে শত্রুর গতিবিধি অনুসারে নতুন নির্দেশ দেওয়া হবে।

ডানদিককার কামানের গর্জন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বাম ব্যূহের উপর গোলাবর্ষণ শুরু হবে। দক্ষিণ ব্যূহের উপর আক্রমণ শুরু হতে দেখলেই মোরাদ-এর ডিভিশন এবং উপজার ডিভিশনের (মুরাত-এর কথা বলা হচ্ছে) নিপুণ গোলন্দাজরা প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে দেবে।

উপরাজা গ্রামটি (বরদিনো) দখল করবে এবং তিনটি সেতুপথে নদী পেরিয়ে মোরাদ ও জেরার্দ ডিভিশনের সমান উচ্চতায় উঠে যাবে, তার নেতৃত্বে ঐ দুটি ডিভিশনওদুর্গটিকে আক্রমণ করবে এবং অবশিষ্ট সেনাদলের সঙ্গে একসারিতে এসে যোগ দেবে।

এসব কিছুই করতে হবে সেনাদলকে যতদূর সম্ভব রিজার্ভে রেখে অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে।

মোঝায়েস্কের নিকটবর্তী রাজকীয় শিবির,
৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮১২

নেপোলিয়নের প্রতিভার প্রতি একান্ত ভীতি পোষণ না করে যদি এইসব অস্পষ্ট ও গোলমেলে বিলি ব্যবস্থার বিচার করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে নেপোলিয়ন চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে চারটি নির্দেশ দিয়েছিল। তার কোনোটিই কার্যকর করা হয়নি, করা যেত না।

বরদিনো পার হয়ে যাবার পরে উপরাজাকে কলোচা নদী পর্যন্ত হটিয়ে দেওয়া হল, সে আর অগ্রসর হতে পারল না, মোরাদ ও জেরার্দ-এর ডিভিশনগুলিও দুৰ্গটা দখল করতে পারল না, বরং তাদেরও হাটিয়ে দেওয়া হল, অবশ্য যুদ্ধের একেবারে শেষে অশ্বারোহী বাহিনী সেটা দখল করেছিল। (এ ঘটনাটা হয়তো নেপোলিয়ন আগে দেখতেও পায়নি, শোনেওনি। কাজেই তার বিলি-ব্যবস্থার একটি নির্দেশও কার্যকর হয়নি, করা যেতও না। কিন্তু বিলি-ব্যবস্থার মধ্যেই বলা আছে এইভাবে যুদ্ধ শুরু হবার পরে শত্রুর গতিবিধি অনুসারে নতুন নির্দেশ দেওয়া হবে, কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে যুদ্ধ চলাকালীন সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেপোলিয়নই করবে। কিন্তু তার করা হয়নি, করা যেতও না, কারণ গোটা যুদ্ধের সময় নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এত দূরে ছিল যে তার পক্ষে যুদ্ধের গতিবিধি জানাও সম্ভব ছিল না, আর সেইসময়ে তার কোনো নির্দেশও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

.

অধ্যায়-২৮

অনেক ইতিহাসকার বলে থাকে, নেপোলিয়নের সর্দি লেগেছিল বলেই ফরাসিরা বরদিনোর যুদ্ধ জিততে পারেনি, যদি তার সর্দিটা না হত তাহলে যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালে যেসব হুকুম সে জারি করেছিল তাতে তার প্রতিভার স্পর্শ আরো বেশি করে লাগত, রাশিয়া হেরে যেত, আর পৃথিবীর মুখটাই বদলে যেত। যেসব ইতিহাসকাররা বিশ্বাস করে যে রাশিয়া গড়ে উঠেছিল একটিমাত্র লোকের-মহান পিতরের-ইচ্ছাশক্তিতে, এবং একটি মানুষের-নেপোলিয়নের-ইচ্ছাশক্তিতেই ফ্রান্স প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এবং ফরাসি বাহিনী রাশিয়াতে গিয়েছিল, যারা বলে যে ২৪শে অগস্ট নেপোলিয়নের নিদারুণ সর্দি লেগেছিল বলেই রাশিয়া স্বীয় শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাদের কথা যুক্তিসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে বটে।

বরদিনোর যুদ্ধ করা না করা যদি নেপোলিয়নের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে থাকে, যদি এটা-ওটা ব্যবস্থাও তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে থাকে, তাহলে তো স্পষ্টতই তার ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণকারী একটা সর্দিই রাশিয়াকে রক্ষা করেছিল, এবং তদনুসারে যে খানসামাটি ২৪ তারিখে নেপোলিয়নের ওয়াটারপ্রুফ-বুট জোড়াটা তাকে এনে দিতে ভুলে গিয়েছিল সেই ছিল রাশিয়ার ত্রাণকর্তা। এই চিন্তার ধারা অনুসরণ করলে তো এধরনে সিদ্ধান্ত একেবারেই সন্দেহের অতীত, ভলতেয়ার যখন ঠাট্টা করে বলেছিল যে নবম চার্লসের পেটের গোলমালের জন্যই সেন্ট বার্থোলোমিউ-র হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তখন তার সেই সিদ্ধান্তও ছিল অনুরূপভাবেই সন্দেহের অতীত। কিন্তু একথা যারা স্বীকার করে না যে একটি লোকের প্রথম পিতরের-ইচ্ছায় গড়ে উঠেছিল রাশিয়া, অথবা একটি লোকের-নেপোলিয়নের ইচ্ছায় গড়ে উঠেছিল ফরাসি সাম্রাজ্য এবং শুরু হয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, তাদের কাছে এই যুক্তি অসত্য ও বুদ্ধিবিরোধী তো বটেই, উপরন্তু সর্বপ্রকার মানবিক বাস্তবতার বিরোধী। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কিসে ঘটে সে প্রশ্নের আর একটা জবাব হল : মানবিক ঘটনাবলীর গতি নির্ধারিত হয় উপর থেকে–তা নির্ভর করে সেই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার উপরে, এইসব ঘটনার উপর একজন নেপোলিয়নের প্রভাব সম্পূর্ণ বাহ্যিক ও অলীক।

প্রথম দৃষ্টিতে যদিও এটা খুবই বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে নবম চার্লসের ইচ্ছানুসারে সেন্ট বার্থোলোমিউ-র হত্যাকাণ্ডটি ঘটেনি, যদিও সে ঘটনার হুকুমটা সেই দিয়েছিল এবং সে ভেবেছিল যে সেই হুকুম মতোই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, আবার এটাও খুব বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে নেপোলিয়নের ইচ্ছানুসারে বরদিনোতে আশি হাজার মানুষ খুন হয়নি, যদিও যুদ্ধ শুরু ও পরিচালনার হুকুমটা সেই দিয়েছিল এবং ভেবেছিল যে তার হুকুম মতোই কাজটা করা হয়েছে, এইসব ধারণা যত বিস্ময়করই মনে হোক, তথাপি যে মানবিক মর্যাদাবোধ আমাকে শিখিয়েছে যে আমরা কেউই মানুষ হিসেবে মহান নেপোলিয়ন অপেক্ষা বড় না হলেও ছোট নই সেই মানবিক মর্যাদাবোধই দাবি করছে যে সমস্যাটার এই সমাধানই গ্রহণযোগ্য, আর ঐতিহাসিক গবেষণাও সেটাকেই যথাযথভাবে প্রমাণ করেছে।

বরদিনোর যুদ্ধে নেপোলিয়ন কাউকে লক্ষ্য করে একটা গুলিও ছোঁড়েনি একটা মানুষকেও মারেনি। সেকাজ সবটাই করেছে সৈন্যরা। কাজেই সে তো মানুষ মারেনি।

ফরাসি সৈন্যরা যে বরদিনোর যুদ্ধে গিয়েছিল মারতে এবং মরতে সেটা নেপোলিয়নের হুকুমে নয়, নিজের ইচ্ছায়। গোটা বাহিনী-ফরাসি, ইতালিয়, পোলিশ ও ওলন্দাজ–সকলেই তখন ক্ষুধার্ত, ছিন্নবস্ত্রপরিহিত, অভিযানে ক্লান্ত, তারা যখন দেখল যে আর একটা বাহিনী মস্কোর পথ অবরোধ করেছে তখন তাদের মনে হল যে সামনে মদ রয়েছে আর সেটা পান করতেই হবে। তখন যদি নেপোলিয়ন তাদের রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিষেধ করত, তাহলে তারা তাকেই হত্যা করে রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে যেত, কারণ সেটা ছিল অনিবার্য।

যুদ্ধে পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর ক্ষতিপূরণস্বরূপ তারা পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রশংসাবাণী-নেপোলিয়নের এই ঘোষণা শুনে তারা চিৎকার করে উঠেছিল ভি ভেল এম্পেরিয়র! যে বালকটি খেলনা লাঠি দিয়ে ভূ-গোলককে বিদ্ধ করছে তার ছবি দেখেও তারা একইভাবে চিৎকার করেছিল ভি ভেল এম্পেরিয়র! আর তখন তাদের যে কোনো অর্থহীন কথা শোনালেই তারা চিৎকার করে বলত, ভি ভেল এম্পেরিয়র! ভি ভেল এম্পেরিয়র বলে চিৎকার করতে করতে খাদ্য ও আশ্রয় পাবার আশায় বিজয়ীর বেশে মস্কো প্রবেশের জন্য যুদ্ধ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কাজেই তারা যে তাদেরই সমগোত্রীয় ভাইদের হত্যা করেছিল তার কারণ নেপোলিয়নের হুকুম নয়।

আর সে যুদ্ধের গতিও নেপোলিয়নের নির্দেশে চলেনি, কারণ তার কোনো হুকুমই কার্যকর করা হয়নি, আর যুদ্ধ চলাকালে সে জানতও না তার সামনে কি ঘটে চলেছে। কাজেই এই লোকগুলি যেভাবে একে অন্যকে মেরেছে সেটা নেপোলিয়নের ইচ্ছায় স্থির হয়নি, সেটা ঘটেছে তাকে ছাড়াই-যে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সকলের ইচ্ছা অনুসারে। শুধু নেপোলিয়নের মনে হয়েছিল যে সবই তার ইচ্ছামতো ঘটেছে। কাজেই তার সর্দি হয়েছিল কি হয়নি সে প্রশ্নটার কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্বই নেই।

অনেক লেখক একথাও বলে থাকেন যে সর্দি লাগার জন্যই তার এ যুদ্ধের বিলি-ব্যবস্থাগুলি আগেকার যুদ্ধের মতো সুপরিকল্পিত হতে পারেনি। এ কথাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। উপরে যে বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা তো আগেকার এমন অনেক যুদ্ধের বন্দোবস্ত অপেক্ষা অনেক ভালো যেখানে নেপোলিয়ন জয়লাভ করেছিল। যুদ্ধকালে যেসব হুকুম সে প্রচার করেছে সেগুলো তো আগের সব যুদ্ধের হুকুমের চাইতে খারাপ কিছু নয়, একই রকমের। আসলে এইসব হুকুম ও বন্দোবস্ত যে আগেকার চাইতে খারাপ কিছু নয়, একই রকমের। আসলে এইসব হুকুম ও বন্দোবস্ত যে আগেকার চাইতে খারাপ মনে হয়েছে তার কারণ বরদিনোর যুদ্ধই প্রথম যুদ্ধ যেটা নেপোলিয়ন জিততে পারেনি। যে যুদ্ধে পরাজয় ঘটে সে যুদ্ধের অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও চমৎকার বন্দোবস্ত ও হুকুমগুলিও খারাপ বলে মনে হয়, এবং প্রত্যেক সমরবিশেষজ্ঞ পণ্ডিতই গম্ভীরভাবে সেগুলির সমালোচনা করে থাকে, আবার যে যুদ্ধে জয়লাভ ঘটে সে যুদ্ধের অত্যন্ত বাজে বন্দোবস্ত ও হুকুমও খুব ভালো মনে হয়, এবং সেসবের গুণকীর্তন করে পণ্ডিতরা মোটা মোটা বই লিখে ফেলে।

অস্তারলিজ যুদ্ধের বিলি-ব্যবস্থার যে পরিকল্পনা ওয়েরদার রচনা করেছিল সেটা ছিল পূর্ণতার আদর্শস্বরূপ, কিন্তু তবু তার সমালোচনা করা হয়েছিল–তার পূর্ণতা এবং অত্যধিক পুঙ্খানুপুঙ্খতার জন্যই সমালোচনা করা হয়েছিল।

অন্যসব যুদ্ধের মতোই, এমন কি তার চাইতে ভালোভাবেই, নেপোলিয়ন বরদিনের যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। যুদ্ধের অগ্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর কিছুই সে করেনি, যুক্তিসঙ্গত মতামতের দিকেই ঝুঁকেছে, কোনোরকম গোলমাল সৃষ্টি করেনি, স্ববিরোধী কোনো কাজ করেনি, ভয় পায়নি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়নি, বরং তার নিজস্ব নিপুণ কুশলতা ও সামরিক অভিজ্ঞতায় শান্ত মর্যাদার সঙ্গে সেনাপতির কাজ পরিচালনা করেছে।

.

অধ্যায়-২৯

দ্বিতীয়বার সেনাদল পরিদর্শন করে ফিরে এসে নেপোলিয়ন মন্তব্য করল, দাবার খুঁটি সাজানো হয়েছে, কাল খেলা শুরু হবে।

পঞ্চ-পানীয় পাঠাবার নির্দেশ দিয়ে দ্য বুসেকে ডেকে এনে সে প্যারিসের ব্যাপারে এবং সম্রাজ্ঞীর গৃহস্থালিতে কিছু পরিবর্তনের ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলল। দরবার সংক্রান্ত খুঁটিনাটি ব্যাপারে তার স্মৃতিশক্তির বহর দেখে প্রিফেক্টরি অবাক হয়ে গেল।

পঞ্চ-পানীয়ের দ্বিতীয় গ্লাসটি শেষ করে পরের দিনের গুরুতর কাজের আগে সে বিশ্রাম নিতে চলে গেল। সে কাজে অতিআগ্রহের ফলে সে ঘুমোতে পারল না, সন্ধ্যার ভিজে আবহাওয়ায় সর্দিটা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সজোরে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে তিনটের সময় শিবিরের বড় অংশটায় গেল। রুশরা সরে গেছে কিনা প্রশ্ন করায় তাকে বলা হল, শত্রুপক্ষের আগুন একই জায়গায় আছে।

কর্তব্যরত অ্যাডজুটান্ট শিবিরে ঢুকল।

 নেপোলিয়ন শুধাল, আচ্ছা রাপ, তুমি কি মনে কর আজ আমাদের কাজকর্ম বেশ ভালোই চলবে?

সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই স্যার, রাপ জবাব দিল।

 নেপোলিয়ন তার দিকে তাকাল।

রাপ আবার বলল ম্মেলেনস্কে আপনি দয়া করে আমাকে কি বলেছিলেন তা কি আপনার মনে আছে স্যার? মদ তৈরি, পান করতেই হবে।

নেপোলিয়ন ভুরু কুঁচকাল, হাতের উপর মাথা রেখে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।

হঠাৎ বলে উঠল, বেচারা সৈন্যরা! সমালেনঙ্কের পরে তাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সত্যি, ভাগ্য এক বারাঙ্গনা রাপ। কথাটা আমি আগাগোড়াই বলে এসেছি, এখন অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছি। কিন্তু রাপ, রক্ষীবাহিনী তো অটুট আছে?

হ্যাঁ স্যার, রাপ উত্তর দিল।

নেপোলিয়ন একটা লজেন্স নিয়ে মুখে পুরল, তারপর ঘড়ি দেখল। চোখে ঘুম নেই, এখনো সকাল হয়নি। সময় কাটাবার জন্য এখন আর নতুন করে কোনো হুকুম জারি করা অসম্ভব, কারণ সব হুকুমই দেওয়া হয়ে গেছে, এখন সেগুলি তামিল করার পালা।

নেপোলিয়ন রুক্ষ গলায় শুধাল, রক্ষী রেজিমেন্টদের কি বিস্কুট ও চাল দেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ স্যার।

চালও?

রাপ উত্তরে জানাল যে চাল সম্পর্কে সম্রাটের আদেশ সে জারি করেছে। কিন্তু তার সে হুকুম যে তামিল করা হয়েছে সেটা বিশ্বাস না করে নেপোলিয়ন মাথা নেড়ে অসন্তোষ প্রকাশ করল। পঞ্চ-পানীয় নিয়ে একজন অনুচর ঢুকল। রাপের জন্য আর এক গ্লাস আনতে বলে নিঃশব্দে নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগল।

গ্লাসটা শুঁকে বলল, স্বাদ-গন্ধ কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। এ সর্দি বড়ই ক্লান্তিকর। লোকে ওষুধের কথা বলেওষুধে যখন সর্দিই সারে না তখন ওষুধ দিয়ে কি হবে! কর্ভিসার্ট (নেপোলিয়নের বিখ্যাত চিকিৎসক) এই লজেন্সগুলো দিয়েছে, কিন্তু এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ডাক্তাররা রোগ কি সারাবে? কেউ কিছু সারাতে পারে না। আমাদের দেহটাই বাঁচবার যন্ত্র। সেইভাবেই এটাকে গড়া হয়েছে, এর স্বভাবেই আছে বেঁচে থাকার মন্ত্র । জীবনকে অব্যাহতগতিতে চলতে দাও, সে নিজেই নিজেকে রক্ষা করুক, ওষুধ দিয়ে দেহটাকে পঙ্গু করার চাইতে তাতে অনেক বেশি ফল পাওয়া যাবে। একটা ভালো ঘড়ির মতোই আমাদের শরীর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঠিকভাবে চলে, ঘড়িওয়ালা সেটাকে খুলতে পারে না, কাঁপা হাতে অন্ধের মতো কিছুটা ঠিকঠাক করতে পারে মাত্র…হ্যাঁ, আমাদের শরীর বাঁচবার যন্ত্রস্বরূপ, সেটাই শেষ কথা।

কোনো কিছুর সংজ্ঞা দেওয়াটা নেপোলিয়নের প্রিয় কাজ, অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ সে একটা নতুন সংজ্ঞা দিল।

তুমি কি জান রাপ, সমর-কলা কাকে বলে? কোনো একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে শত্রুপক্ষ অপেক্ষা অধিকতর শক্তশালী হওয়াই সমর-কলা। আর কিছু নয়।

রাপ জবাব দিল না।

নেপোলিয়ন বলল, কাল আমাদের লড়তে হবে কুতুজভের সঙ্গে। দেখা যাক! তোমার কি মনে আছে, ব্রাউনাউতে তিনি তিন সপ্তাহ ধরে সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন কিন্তু পরিখাগুলি পরিদর্শন করতে একটিবারও ঘোড়ায় চাপেননি…দেখাই যাক!

আবার ঘড়ি দেখল। সবে চারটে বাজে। ঘুম পাচ্ছে না। পঞ্চ-পানীয় ফুরিয়ে গেছে। করারও কিছু নেই। উঠল, এ-দিক ও-দিক হাঁটল, গরম ওভারকোট ও টুপিটা নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে গেল। রাতটা অন্ধকার, সঁতসেঁতে, প্রায় অলক্ষ্য একটা ভিজে বাতাস উপর থেকে নেমে আসছে। কাছেই ফরাসি রক্ষীদলের শিবির আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে, দূরে রুশদের শিবির-আগুন ধোয়ার ভিতর দিয়ে জ্বলজ্বল করছে। আবহাওয়া শান্ত, যার যার ঘাঁটি নিতে অগ্রসরমান ফরাসি সৈন্যদের পোশাকের খসখস ও পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

শিবিরের সামনে হাঁটতে হাঁটতে নেপোলিয়ন আগুনের দিকে তাকাল, কান পেতে সব শব্দ শুনতে লাগল। লোমশ টুপি-পরা যে লম্বা শান্ত্রীটি শিবিরের সামনে পাহারা দিচ্ছিল, সম্রাটকে দেখে সে একটা কালো স্তম্ভের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। নেপোলিয়ন তার সামনেই থামল।

শুধাল, তুমি কোন বছর চাকরিতে ঢুকেছ?

 লোকটি জবাব দিল।

ওহহ! তুমি তা হলে পুরনো লোকদের একজন। তোমার রেজিমেন্ট চাল পেয়েছে কি?

পেয়েছে ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি।

 নেপোলিয়ন মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল।

সাড়ে পাঁচটায় নেপোলিয়ন ঘোড়ায় চেপে শেভার্দিনো গ্রামে গেল।

আলো ফুটেছে। আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে। শুধু পুবের আকাশে একখণ্ড মেঘ দেখা যাচ্ছে। সকালের ম্লান আলোয় পরিত্যক্ত শিবির-আগুনগুলো নিভে আসছে।

ডানদিকে কামানের একটিমাত্র গম্ভীর শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে হতে চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে মিলিয়ে গেল। কয়েক মিনিট কেটে গেল। কামানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় গর্জনে বাতাস কেঁপে উঠল, তারপরেই ডানদিকে কাছেই গর্জে উঠল চতুর্থ ও পঞ্চমবার।

প্রথম গর্জনের প্রতিধ্বনি থামবার আগেই আরো অনেক কামান গর্জে উঠল, নানা গর্জনের শব্দে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

সদলবলে শেভার্দিনো দুর্গে পৌঁছে নেপোলিয়ন ঘোড়া থেকে নামল। খেলা শুরু হয়ে গেছে।

.

অধ্যায়-৩০

প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে দেখা করে গোর্কিতে পিরে এসে পিয়ের সহিসকে হুকুম করল ঘোড়া তৈরি রাখতে এবং খুব সকালে তাকে ডেকে দিতে। তারপর বেড়ার পিছনে যে কোণটা বরিস তাকে ছেড়ে দিয়েছে সেখানে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ভালোভাবে ঘুম ভাঙবার আগেই অন্য সকলে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। ছোট ছোট জানালার কাঁচের পাল্লায় খট খট শব্দ হচ্ছে, আর সহিস তাকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে।

ইয়োর এক্সেলেন্সি! ইয়োর এক্সেলেন্সি! ইয়োর এক্সেলেন্সি! পিয়েরের ঘুম ভাঙবার সব আশা ছেড়ে দিয়ে তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে সহিসটি নাছোড়বান্দার মতো তাকে ডাকছে।

জেগে উঠে পিয়ের শুধাল, কি হল? শুরু হয়ে গেছে? সময় হয়ে গেল?

বরখাস্ত সৈনিক-সহিসটি বলল, কামানের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন না! ভদ্রলোকরা সকলেই বেরিয়ে গেছেন, প্রশান্ত মহামহিম তো অনেকক্ষণ আগেই ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন।

তাড়াতাড়ি পোশাক পরে পিয়ের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে সবকিছুই উজ্জ্বল, তাজা, শিশিরসিক্ত, আনন্দময়। মেঘের আড়াল থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা সূর্যের কিরণরাশি ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তার ওপারের ছাদের উপর, পথের শিশির-ভেজা ধুলোর উপর, বাড়ির প্রাচীরে, জানালায়, বেড়ায়, এবং সামনে দাঁড়ানো পিয়েরের ঘোড়াগুলোর উপরে। বাইরে কামানের গর্জন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। একজন কসাককে সঙ্গে নিয়ে জনৈক অ্যাডজুটান্ট জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল।

অ্যাডজুটান্ট চেঁচিয়ে বলল, সময় হয়ে গেছে কাউন্ট, সময় হয়ে গেছে!

সহিসকে ঘোড়া নিয়ে পিছনে আসতে বলে পিয়ের পথে নেমে সেই গোল পাহাড়ে গেল যেখান থেকে সে আগের দিন যুদ্ধক্ষেত্রটাকে দেখেছিল। সেখানে একদল সামরিক লোক জড় হয়েছে, কর্মচারীরা ফরাসিতে বলছে, লাল ফিতে লাগানো শাদা টুপি-পরা কুতুজভের শাদা মাথাটা দেখা যাচ্ছে, তার গলার নিচটা কাঁধের মধ্যে ডুবে গেছে। একটা ছোট দূরবীণের ভিতর দিয়ে সে বড় রাস্তাটার উপর দৃষ্টি রেখেছে।

সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে সামনের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্যে পিয়ের মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। গোটা অঞ্চল সৈন্যে ঠাসা, কামানের ধোয়ার মেঘে আচ্ছন্ন, উজ্জ্বল সূর্যের তির্যক কিরণরাশি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দৃশ্যবলীর একেবারে শেষপ্রান্তে অবস্থিত অরণ্যকে মনে হচ্ছে হলুদ-সুবজ মূল্যবান পাথরে খোদাই করা ছবি, তার আন্দোলিত রেখাঁটিকে মনে হচ্ছে দিগন্তের প্রেক্ষাপটে একখানি সিলুয়েট, সৈন্যপরিবৃত স্মোলেন বড় রাস্তাটা ভালুভোর ওপাশে তাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। সম্মুখে, বাঁয়ে, ডাইনে, সর্বত্রই শুধু সৈন্য আর সৈন্য। এসব কিছুই স্পষ্ট, মহনীয়, অপ্রত্যাশিত, কিন্তু পিয়েরের মনকে সবচাইতে বেশি করে আকর্ষণ করল রণক্ষেত্র, বরদিনো এবং কলোচার দুই তীরবর্তী খাড়ির দৃশ্যগুলি।

পুফ!–হঠাৎ একটা ঘন গোলাকার ধোঁয়ার মেঘ বেগুনি থেকে ধূসর ও দুধ-শাদা হয়ে দেখা দিল, আর এক সেকেন্ড পরেই বুম! করে একটা গর্জন শোনা গেল।

পুফ পুফ! দুটো অনুরূপ মেঘ এসে পরস্পরকে ঠেলা মারল, আর চোখের যা দেখা গেল কানে তারই গর্জন শোনা গেল বুম বুম!

পিয়ের প্রথম মেঘটার দিকে তাকাল, একটা ঘন ঘোল বল যেন, পরমুহূর্তেই তার জায়গায় দেখা দিল ভাসমান ধোয়ার বেলুন আর পুফ! পুফ! পুফ–প্রথমে তিনটে ও তারপরে চারটে দেখা দিল এবং তাদের প্রত্যেকটা থেকে একই সময়ের ব্যবধানে-বুমবুমবুম! শব্দে এল তার জবাব। মনে হল, সেই ধোয়ার মেঘগুলো কখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর মাঠ-ঘাট-জঙ্গল আর ঝকঝকে বেয়নেটগুলো তাদের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। বাঁদিকে মাঠ ও ঝোঁপের ভিতর থেকেও ধোঁয়ার বড় বড় বলগুলি অনবরত ছুটে আসছে, আর তাদের পিছন পিছন আসছে গম্ভীর গর্জন, এদিকে আরো কাছে, খাড়ি ও জঙ্গল থেকে আসছে গাদা বন্দুকের ছোট ছোট মেঘ, সেগুলি বলের আকার ধরছে না, কিন্তু ছোট ছোট ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ঠিকই হচ্ছে। ট্রাক-টা-টা-টাট! গাদা বন্দুকের অনিয়মিত শব্দ প্রায়ই আসছে, কিন্তু কামান-গজনের তুলনায় সেগুলি খুবই দুর্বল।

সেই ধোঁয়া, সেই ঝকঝকে বেয়নেট, সেই চলাফেরার মধ্যে থাকতে পিয়েরের ভালো লাগছে। নিজের প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে নেবার জন্য সে কুতুজভ ও তার দলবলের দিকে তাকাল। তারাও তার মতোই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হল, তাদের মনোভাবও তারই অনুরূপ।

যাও বন্ধু, এগিয়ে যাও…খৃস্ট তোমার সহায় হোন! যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চোখ না সরিয়েই কুতুজভ পাশে দাঁড়ানো একজন জেনারেলকে কথাগুলি বলল।

হুকুম শুনে জেনারেলটি পিয়েরের পাশ দিয়ে গোল পাহাড় থেকে নেমে গেল।

সে কোথায় চলেছে এই প্রশ্নের জবাবে জেনারেল কঠিন, ঠাণ্ডা গলায় বলল, মোহনার দিকে!

আমিও সেখানেই যাব, এই কথা ভেবে পিয়ের তার পিছু নিল।

কসাক একটা ঘোড়া এনে দিলে জেনারেল তাতে সওয়ার হল। পিয়ের সহিসের দিকে এগিয়ে গেল, কেন ঘোড়াটা সবচাইতে শান্ত জেনে নিয়ে সেটাতে সওয়ার হল, তার ঘাড়ের লোম চেপে ধরে গোড়ালি দুটো ছড়িয়ে ঘোড়ার পেটে চাপ দিতেই সে ছুটতে শুরু করল। পিয়েরের মনে হল তার চশমা বুঝি খুলে পড়বে, কিন্তু তখন আর ঘোড়ার লোম ও হাতের রাশ কোনোটাই ছাড়া সম্ভব নয়, জেনারেলের পিছনে সেও জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। গোল পাহাড়ের উপর থেকে অফিসাররা তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *