১০.২ চাষীরা এসেছে

অধ্যায়১১

একঘণ্টা পরে দুনিয়াশা এসে প্রিন্সেসকে জানাল, দ্রোন এসেছে, আর প্রিন্সেসের হুকুমে চাষীরা গোলাবাড়িতে এসে জমা হয়েছে, তারা প্রিন্সেসের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

প্রিন্সেস মারি বলল, কিন্তু আমি তো তাদের আসতে বলিনি। শুধু দ্রোনকে তাদের ফসল দিতে বলেছি।

দুনিয়াশা বলল, ঈশ্বরের দোহাই, লক্ষ্মী প্রিন্সেস, তাদের চলে যেতে বলে দিন। তাদের সঙ্গে দেখা করবেন না। এসবই চালাকি। ইয়াকভ আলপাতিচ ফিরে এলেই আমরা এখান থকে চলে যাব।…দয়া করে যাবেন না…

কিসের চালাকি? প্রিন্সেস মারি অবাক হয়ে শুধাল।

আমি জানি এটা একটা চাল, ঈশ্বরের দোহাই, আমার কথা শুনুন। নার্সকেও জিজ্ঞাসা করুন। ওরা বলছে, আপনার হুকুমমতো ওরা বোচারভো ছেড়ে যাবে না।

তুমি ভুল করছ। আমি তাদের চলে যেতে বলিনি। দ্রোনুশকাকে ডাক।

দ্রোন এসে দুনিয়াশার কথাই সমর্থন করল, প্রিন্সেসের হুকুমেই চাষীরা এসেছে।

প্রিন্সেস বলল, কিন্তু আমি তো ওদের ডাকিনি। তুমি নিশ্চয় আমার কথা ভুল করে বলেছ। আমি শুধু তোমাকে বলেছি ওদের ফসল দিতে।

উত্তরে দ্রোন শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

 বলল, আপনি হুকুম করলে ওরা চলে যাবে।

না, না, আমি বাইরে ওদের কাছে যাব, প্রিন্সেস মারি বলল। নার্স ও দুনিয়াশার বাধা সত্ত্বেও সে ফটকে চলে গেল। দ্রোন, দুনিয়াশা, নার্স ও মাইকেল আইভানভিচ তাকে অনুসরণ করল।

প্রিন্সেস মারি ভাবল, ওরা হয়তো ভেবেছে ফসল ঘুষ দিয়ে ওদের এখানে থাকতে বলে ফরাসিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি নিজে এখান থেকে চলে যাব। মস্কোর জমিদারিতে আমি ওদের জন্য মাসিক রেশন ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দেব। আমি নিশ্চিত জানি আন্দ্রু থাকলে আরো বেশি করত। কথাগুলি ভাবতে ভাবতে গোধূলির আলোয় সে গোলাবাড়ির মাঠে দাঁড়ানো ভিড়ের মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।

লোকগুলি আরো কাছে এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি টুপি খুলে ফেলল। প্রিন্সেস মারি চোখ নামিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ ও যুবকের কত বিচিত্র চোখ তার উপর নিবদ্ধ, আর কত বিচিত্র মুখ, একজন থেকে আর একজনকে আলাদা করা যায় না, তাই সে ঠিক করল সকলকে একসঙ্গে ডেকে কথা বলবে, কিন্তু কি যে বলবে তা জানে না। এবারও সে যে তার বাবার ও দাদার প্রতিনিধি এই চিন্তাই তাকে সাহস দিল, দৃঢ়তার সঙ্গে সে কথা বলতে শুরু করল।

সে চোখ তুলল না, বুকের মধ্যে একটা টিপ টিপ শব্দ হচ্ছে। বলতে লাগল তোমরা আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি। দ্রোনুশকা আমাকে বলেছে, যুদ্ধ তোমাদের সর্বনাশ করেছে। সেটা আমাদের সকলেরই দুর্ভাগ্য, তোমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতে আমি কসুর করব না। এ স্থানটা বিপজ্জনক বলেই আমি নিজে চলে যাচ্ছি..শত্রু কাছে এসে পড়েছে…কারণ…বন্ধুগণ, আমি তোমাদের সবকিছু দিয়ে যাচ্ছি, আমাদের সব ফসল, যাতে তোমাদের কোনো অভাব না হয়। আর যদি তোমাদের কেউ বলে থাকে যে তোমাদের এখানে আটকে রাখার জন্য আমি এই ফসল দিচ্ছি–তো সেটা সত্য নয়। বরং আমি তোমাদের বলছি, সব মালপত্র নিয়ে তোমরা আমাদের মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারিতে চলে যাও, কথা দিচ্ছি, সেখানে তোমাদের যাতে কোনো অভাব না হয় সেটা আমি দেখব। সেখানে তোমরা আহার ও বাসস্থান পাবে।

প্রিন্সেস থামল। ভিড়ের ভিতর থেকে শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল।

সে বলতে লাগল, আমার নিজের পক্ষ থেকে একাজ করছি না, করছি আমার মৃত পিতা, আমার দাদা ও তার ছেলের পক্ষ হয়ে।

সে আবার থামল। কেউ নিস্তব্ধতা ভাঙল না।

সম্মুখের মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সে তার বক্তব্য শেষ করল, এটা আমাদের সকলের দুর্ভাগ্য, সকলেই তা ভাগ করে নেব। আমার যা কিছু আছে সবই তোমাদের।

সকলের চোখ তার উপরেই নিবদ্ধ, সকলের মুখে একই ভাব। সেটা কৌতূহল, অনুরাগ, কৃতজ্ঞতা, না কি আশংকা ও অবিশ্বাস-সে পরিমাপ সে করতে পারল না, কিন্তু সকলের মুখে একই ভাবের প্রকাশ।

ভিড়ের পিছন থেকে একজন বলল, আপনার দানের জন্য আমরা খুবই কৃতজ্ঞ, কিন্তু জমিদারের ফসল আমরা নিতে পারব না।

কেন পারবে না? প্রিন্সেস শুধাল।

কেউ জবাব দিল না। ভিড়ের চারদিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস মারি দেখল, যার চোখে সে চোখ রাখছে সেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।

সে আবার শুধাল, কেন তোমরা নিতে চাও না?

 কেউ জবাব দিল না।

 নিস্তব্ধতা যেন প্রিন্সেসকে চেপে ধরছে, যে কোনো একজনের চোখে চোখ রাখতে সে চেষ্টা করল।

তার ঠিক সামনে লাঠিতে ভর দিয়ে একটা খুব বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়েছিল। প্রিন্সেস তাকেই জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কথা বলছ না কেন? তোমরা যদি মনে কর যে আরো কিছু বেশি চাও তো সেটা বল! সবকিছু করতে আমি প্রস্তুত।

যেন এ কথায় তার রাগ হয়েছে এমনিভাবে মাথাটা আরো নিচু করে সে বিড়বিড় করে বলল, আমরা একমত হব কেন? ফসল আমরা চাই না।

কেন আমরা সবকিছু ত্যাগ করব? আমরা একমত নই। কেউ একমত হয়ো না…আপনার জন্য আমরা। দুঃখিত, কিন্তু আমরা অনিচ্ছুক। আপনি চলে যান, একাকি… ভিড়ের ভিতর থেকে নানা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

ভিড়ের সবগুলি মুখে আর একবার একই ভাব ফুটে উঠল, যদিও এবার সে ভাব কৌতূহল বা কৃতজ্ঞতার নয়, সে ভাব ক্রুদ্ধ সংকল্পের।

বিষণ্ণ হাসি হেসে প্রিন্সেস মারি বলল, কিন্তু তোমরা আমার কথা বুঝতে পারনি। কেন তোমরা যেতে চাইছ না? আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের ঘর দেব, খাওয়াব, আর এখানে শত্রুরা তোমাদের ধ্বংস করবে….

কিন্তু ভিড়ের কণ্ঠস্বরে তার কণ্ঠস্বর ডুবে গেল।

 আমরা ইচ্ছুক নই। তারাই আমাদের ধ্বংস করুক! আপনার ফসল আমরা নেব না। আমরা রাজি নই!

প্রিন্সেস মারি পুনরায় কোনো একজনের চোখে চোখ রাখতে চেষ্টা করল, কিন্তু ভিড়ের ভিতর থেকে একটা চোখও তার দিকে তাকাল না, সকলেই তার চোখকে এড়াতে চেষ্টা করছে। তার কীরকম অদ্ভুত লাগছে।

ভিড়ের ভিতর থেকে নানা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে : হ্যাঁ, খুব চাল চেলেছে! ওর সঙ্গে গিয়ে দাসত্বের খাঁচায় ঢুকি আর কি! নিজেদের ঘরবাড়ি ভেঙে ক্রীতদাস হতে চল! আমি ঠিকই বলছি! উনি বলছেন, তোমাদের ফসল দেব, বটেই তো!

নত মস্তকে ভিড়কে পিছনে রেখে প্রিন্সেস মারি বাড়িতে ফিরে গেল। পরদিন সকালে যাত্রার জন্য ঘোড়া প্রস্তুত রাখতে দ্রোনকে হুকুম দিয়ে সে তার ঘরে ঢুকল, সেখানে একাকি ডুবে গেল নিজের চিন্তায়।

.

অধ্যায়-১২

সেদিন রাতে প্রিন্সেস মারি খোলা জানালার পাশে বসে অনেক সময় কাটিয়ে দিল। অনেক দূরের গ্রাম থেকে চাষীদের গলা কানে আসছে, কিন্তু তাদের কথা সে ভাবছে না। সে বুঝতে পেরেছে, যতই ভাবুক না কেন তাদের সে বুঝতে পারবে না। সে ভাবছে নিজের দুঃখের কথা। বর্তমান দুশ্চিন্তার ফলে সে দুঃখ যেন এখন অতীতের বস্তু হয়ে গেছে। এখন সেকথা মনে করে সে কাঁদতে পারে, প্রার্থনাও করতে পারে।

সূর্যাস্তের পরে বাতাস পড়ে গেছে। রাতটা শান্ত ও সতেজ মনে হচ্ছে। মাঝ রাতের দিকে দূরাগত কণ্ঠস্বর থেমে গেল, মোরগের ডাক ভেসে এল, লেবু গাছের আড়াল থেকে ভরা চাঁদ দেখা দিল, একটা শাদা শিশিরভেজা কুয়াশা সবে উঠতে শুরু করেছে, সমস্ত গ্রাম ও বাড়িটার উপর নেমে এসেছে একটা শান্ত স্তব্ধতা।

নিকট অতীতের ছবিগুলি-বাবার অসুখ ও শেষ মুহূর্তগুলি-একের পর এক স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল।

শোকাকুল আনন্দের সঙ্গে সেই সব ছবি সে দেখতে লাগল। শেষ ছবিটা তার মনকে আঘাত করল–আবার মৃত্যুর ছবি, মনে হল, রাতের এই কুয়াশাচ্ছন্ন স্তব্ধ মুহূর্তে কল্পনায়ও সে ছবি সে আঁকতে পারত না। ছবিগুলি এখন এত স্পষ্ট হয়ে তার কাছে দেখা দিল যে সেগুলিকে কখনো মনে হয় বর্তমানের, কখনো অতীতের, আবার কখনো ভবিষ্যতের।

প্রথম স্ট্রোকের মুহূর্তটা স্পষ্টভাবে তার মনে পড়ল। বল্ড হিলসের বাগানের পথ দিয়ে সকলে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে, অসহায় জিভটা নেড়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, পাকা ভুরু দুটি কুঁচকে গেছে, অস্বস্তি ও ভয়ের সঙ্গে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

সে ভাবতে লাগল, মৃত্যুর দিন বাবা আমাকে যেকথা বলেছিল সেইদিনও সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিল। সেই কথাই সে বরাবর ভেবে এসেছে। সে-রাতে সে ঘুমোতে পারেনি, পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল, দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতেছিল। যন্ত্রণাকাতর ক্লান্ত গলায় তিখনের সঙ্গে কথা বলছিল, বলছিল তাহলে কেন আমাকে ডাকল না? তিখনের বদলে আমাকে কেন ঘরে ঢুকতে দিল না? এই কথাটা প্রিন্সেস মারি অনেকবার ভেবেছে, এখনো ভাবল। তার মনের মধ্যে যে কথা ছিল তা তো এখন আর কাউকে বলতে পারবে না। যেকথা সে বলতে চেয়েছিল সে কথা বলবার মুহূর্তটি তো তার বা আমার জীবনে আর কোনোদিন আসবে না, তিখন পারেনি, কিন্তু আমি তো তার কথা শুনতে পারতাম, বুঝতে পারতাম। তাহলে কেন আমি ঘরে ঢুকলাম না? মৃত্যুর দিন যে কথা আমাকে বলেছিল, হয়তো সেইদিনই সেকথা আমাকে বলত। তিখনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুবার সে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। সে আমাকে দেখতে চেয়েছিল, অথচ দরোজার বাইরে কত কাছে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। মনে পড়ছে, লিজা সম্পর্কে বাবা এমনভাবে কথা বলছিল যেন সে বেঁচে আছে–সে যে মরে গেছে সে কথা বাবা ভুলেই গিয়েছিল–তিখন যখন মনে করিয়ে দিল যে লিজা বেঁচে নেই সে তখন চেঁচিয়ে বলেছিল, মূর্খ! তার খুব কষ্ট হয়েছিল। দয়োজার পিছন থেকে আমি শুনতে পেলাম একটা আর্তনাদ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে চেঁচিয়ে বলেছিল হা ঈশ্বর! কেন তখন ভিতরে গেলাম না? গেলে বাবা আমার কি করত? কি হারাতাম আমি? হয়তো বাবা সান্ত্বনা পেত, সেই কথাটা আমাকে বলত। সোনা আমার-বাবার সেই আদরের কথাটা উচ্চারণ করে প্রিন্সেস মারি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। চোখের জলে তার মন কিছুটা শান্ত হল। বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। শিশুকাল থেকে যে মুখ সে চিনেছে, যে মুখ সে দেখেছে দূর থেকে সে-মুখ নয়, এ সেই ভীরু, দুর্বল মুখ যা সে সেইদিন প্রথম দেখেছিল খুব কাছে থেকে যেদিন তার কথাটা বুঝবার জন্য সে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল বাবার মুখের উপর।

সোনা আমার, কথাটা সে আর একবার বলল।

এই কথাটা বলবার সময় বাবা কি ভাবছিল? এখনই বা সে কি ভাবছে? প্রশ্নটা হঠাত্র তার মনে এল, আর ঠিক তার জবাবেই সে যেন চোখের সামনে বাবাকে দেখতে পেল-শাদা রুমাল দিয়ে থুতনি বাধা অবস্থায় শবাধারে শুয়ে তার মুখে যে ভাব ফুটে উঠেছিল ঠিক সেই ভাব নিয়ে। তখন যে ভয় তাকে পেয়ে বসেছিল এখনো সেই ভয় আবার তাকে চেপে ধরল। অন্য কিছু ভাববার ও প্রার্থনা করবার চেষ্টা সে করল, কিন্তু কোনোটাই করতে পারল না। দুই বিস্ফারিত চোখ মেলে চাঁদের আলো ও ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রতিটি মুহূর্তেই মনে আশা যে বাবার সেই মৃত মুখটা দেখতে পাবে। তার মনে হতে লাগল, যে নিস্তব্ধতা বাড়িটার বাইরে ও ভিতরে ছড়িয়ে আছে তা যেন তাকেও চেপে ধরেছে।

ফিসফিস করে ডাকল, দুনিয়াশা। আর্তনাদ করে বলল, দুনিয়াশা! তারপর সেই নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে ছুটে গেল চাকরদের মহলে বুড়ি নার্স ও দাসীদের সঙ্গে দেখা করতে, তারাও ছুটে এল তার দিকে।

.

অধ্যায়১৩

 ১৭ আগস্ট তারিখে বন্দিদশা থেকে সদ্য খালাস পাওয়া লাভ্রুশকা ও একটি হুজার আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে রস্তভ ও ইলিন বোগুচারভো থেকে দশ মাইল দূরবর্তী ইয়াংকভোর আস্তানা থেকে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল-ইলিন যে নতুন ঘোড়াটা কিনেছে সেটাতেও চড়া হবে, আবার গ্রামে কিছু খড় পাওয়া যায় কি না সে খোঁজও করা হবে।

গত তিন দিন যাবৎ দুটি বিরুদ্ধ সেনাদলের মাঝখানে পড়ে বোগুচারভোর দিন কাটছে, ফলে রুশ বাহিনীর পিছনের অংশ আর ফরাসি বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ দুইয়ের পক্ষেই সেখানে পৌঁছনো সমান সহজ, তাই একজন সতর্ক স্কোয়াড্রন-কমান্ডার হিসেবে রস্তভ ঠিক করেছে ফরাসিদের হাতে পড়বার আগেই সে বোগুচারভোর অবশিষ্ট রসদপত্র সংগ্রহ করে নেবে।

রস্তভ ও ইলিন বেশ খোশ মেজাজে আছে। লাভ্রুশকাকে নেপোলিয়ন সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করে তার গাল গল্প শুনে হাসতে হাসতে তারা ইলিনের ঘোড়াটাকে পরীক্ষা করার জন্য দৌড়-প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল।

রস্তভের কোনো ধারণাই নেই যে তার বোনের সঙ্গে যে বলকনস্কির বিয়ের কথা হয়েছে তাদের গ্রাম ও জমিদারিতেই তারা ঢুকতে যাচ্ছে।

ইলিনকে মেরে দিয়ে রস্তভের ঘোড়াই গ্রামের পথে প্রথম পা ফেলল।

 তুমিই প্রথম, মুখ লাল করে ইলিন বলল।

হ্যাঁ, সবসময়ই প্রথম–কি তৃণভূমিতে, কি এখানে, দোনেতের উত্তপ্ত পিঠে চাপড় দিতে দিতে রস্তভ বলল।

নিজের লোমশ গাড়ি-টানা ঘোড়াটাকে দেখিয়ে লাভ্রুশকা পিছন থেকে বলল, আমার এই ফরাসিনীকে নিয়েই আমি জিততে পারতাম ইয়োর এক্সেলেন্সি, শুধু আপনি দুঃখ পাবেন বলেই তা করিনি।

পায়ে হাঁটা গতিতে তারা গোলাবাড়িতে পৌঁছল, সেখানে অনেক চাষী ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

কেউ কেউ মাথার টুপি খুলল, আবার অনেকে টুপি না খুলে নবাগতদের দেখতে লাগল। বলিরেখায় ভরা মুখ আর পাতলা দাড়িওয়ালা দুই ঢ্যাঙা বুড়ো সরাইখানা থেকে বেরিয়ে হাসতে হাসতে, টলতে টলতে অসংলগ্ন গান গাইতে গাইতে অফিসারদের দিকে এগিয়ে গেল।

রস্তভ হেসে বলল, খাসা লোক সব! এখানে কিছু খড় মিলবে কি?

 দুটি যেন মানিক-জোড়, ইলিন বলল। খুশির হাসি হেসে একটি চাষী গেয়ে উঠল, বড় খু-শি-খুশি আ-জ…

ভিড়ের ভিতর থেকে একজন রশুভের দিকে এগিয়ে গেল।

বলল, আপনারা কোন পক্ষের?

ইলিন তামাশা করে বলল, ফরাসিদের, আর ইনি স্বয়ং নেপোলিয়ন–লাভ্রুশকাকে দেখিয়ে দিল।

তাহলে আপনারা রুশ? চাষীটি আবার শুধাল।

একটি বেঁটে লোক এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনাদের বেশ বড় একটা দল এখানে আছে তো?

খুব বড়, রস্তভ জবাব দিল। কিন্তু তোমরা এখানে জড় হয়েছ কেন? আজ কি ছুটির দিন?

 চাষীটি যেতে যেতে বলল, বুড়োরা সব কমন নিয়ে কথা বলতে জড় হয়েছে।

ঠিক সেইসময় বড় বাড়িটার রাস্তা ধরে দুটি স্ত্রীলোক ও শাদা টুপিধারী একটি পুরুষকে আসতে দেখা গেল।

দুনিয়াশাকে তার দিকেই ছুটে আসতে দেখে ইলিন বলল, যার পরনে পাটল রঙের পোশাক সেটি আমার, অতএব দূর হটো!

আমাদের সকলের, লাভ্রুশকা চোখ টিপে বলল।

ইলিন হেসে বলল, তোমার কি চাই সুন্দরী?

প্রিন্সেস আপনাদের রেজিমেন্টের নাম ও আপনাদের নাম জানতে আমাকে পাঠিয়েছেন।

 ইনি কাউন্ট রস্তভ, স্কোয়াড্রন-কমান্ডার, আর আমি তোমার বশংবদ ভৃত্য।

ইলিনের কথা শুনে স্বর্গীয় হাসি হেসে মাতাল চাষীটি জোর গলায় বলে উঠল, কোম্পানি! দুনিয়াশার পিছন থেকে আলপাতিচ এগিয়ে এসে কিছুটা দূর থেকেই টুপিটা খুলে ফেলল।

বুকের ভিতরে একটা হাত ঢুকিয়ে তরুণ অফিসারটির প্রতি শ্রদ্ধা অথচ ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, আপনাকে একটু বিরক্ত করছি ইয়োর অনার। এ মাসের ১৫ই তারিখে পরলোকগত জেনারেল-ইন-চিফ প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির কন্যা আমার বর্তমান মনিব এইসব লোকদের-চাষীদের দেখিয়ে-অদ্ৰতায় বিপন্ন বোধ করে আপনাদের তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।…আপনারা কি দয়া করে ঘোড়া নিয়ে আর একটু এগিয়ে…কারণ এইসব লোকদের সামনে… ঘোড়র গায়ে মাছির মতো যে দুটি চাষী তার গায়ের কাছে এসে হাজির হয়েছে তাদের দেখিয়ে বলল।

খুশি মনে তার দিকে তাকিয়ে চাষীরা বলে উঠল, আহা!…আলপাতিচ…আহা ইয়াকভ আলপাতিচ…চমৎকার…খৃস্টের দোহাই, আমাদের ক্ষমা কর। কি বল?

মাতাল চাষীদের দিকে তাকিয়ে রস্তভ হাসল।

আলপাতিচ গম্ভীর মুখে বলল, আপনি হয়তো ওদের দেখে একটা মজা পাচ্ছেন ইয়োর অনার?

 না, এখানে মজা পাবার মতো কিছু নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কি?রস্তভ বলল।

যদি অভয় দেন তো বলি, এই দুষ্ট চাষীরা আমাদের কত্রীকে জমিদারি থেকে চলে যেতে দিচ্ছে না, গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে নেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে, তাই সকাল থেকে মালপত্র গাড়িতে বোঝাই করেও হার এক্সেলেন্সি বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না।

অসম্ভব! রস্তভ চেঁচিয়ে বলল।

আমি সত্যি কথাই বলছি, আলপাতিচ বলল।

রস্তভ ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়ার ভার আর্দালির হাতে দিয়ে আলপাতিচের পিছন পিছন বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সমস্ত ব্যাপারটা জেনে নিল। দ্রোন শেষ পর্যন্ত চাবির গোছা ফেরৎ দিয়ে চাষীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, আলপাতিচ ডেকে পাঠানো সত্ত্বেও আসেনি, এবং সকালে প্রিন্সেস যাত্রার জন্য তৈরি হলে চাষীরা সদলবলে গোলাবাড়িতে এসে খবর পাঠিয়েছে যে প্রিন্সেসকে যেতে দেওয়া হবে না; গ্রাম ছেড়ে না যাবার হুকুম এসেছে, তাই তারা গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে নেবে। আলপাতিচ তাদের বকুনি দিতে বেরিয়ে এলে তাকেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে (ভিড়ের মধ্যে দ্রোনকে দেখা যায়নি, কথাবার্তা বলেছে মূলত কার্প) তারা প্রিন্সেসকে যেতে দিতে পারে না, হুকুম এসেছে গ্রামে থাকতে, তবে প্রিন্সেস যদি বাড়িতে থেকে যায় তাহলে তারা আগের মতোই তার কাজ করবে, সব ব্যাপারে তাকে মেনে চলবে।

রস্তভ ও ইলিনকে ঘোড়ার পিঠে আসতে দেখে তাদের ফরাসি সৈন্য মনে করে কোচয়ান গাড়ি ফেলে পালিয়ে গেল, আর বাড়ির মধ্যে মেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে দিল।

রস্তভ যখন বাইরের ঘর পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল তখন নানা কণ্ঠে ধ্বনি উঠ, বাবা! উদ্ধারকর্তা! ঈশ্বরই আপনাকে পাঠিয়েছেন!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অসহায় প্রিন্সেস মারি বড় বসবার ঘরটায় বসে ছিল। রস্তভকে সেখানেই নিয়ে আসা হল। লোকটি কে, কেনই বা এসেছে, তার নিজেরই বা কি হবে-সে কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু তার রুশসুলভ মুখ, তার চলার ভঙ্গি এবং প্রথম কথাগুলি শুনেই বুঝতে পারল সে তারই সমশ্রেণীর মানুষ, গভীর উজ্জ্বল চোখে তার দিকে তাকাল, আবেগকম্পিত গলায় কথা বলতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে এই সাক্ষাৎট রভের কাছে একটি রোম্যান্টিক ঘটনা হয়ে দেখা দিল। প্রিন্সেসের দিকে তাকিয়ে তার ভীরু কাহিনী শুনতে শুনতে সে ভাবতে লাগল : শোকাভিভূত একটি অসহায় মেয়ে উচ্ছঃখল রূঢ় চাষীদের করুণার পাত্রী হয়ে পড়েছে। আর বিচিত্র নিয়তিই আমাকে এখানে এনে ফেলেছে! তার আকৃতি ও প্রকৃতিতে কী শান্ত সুষমা ও মহত্ত্ব!

এ সবকিছুই ঘটেছে বাবার শেষকৃত্যের ঠিক পরের দিন–এই কথাটা বলতে গিয়ে প্রিন্সেসের গলাটা কাঁপতে লাগল। সে চোখ তুলে দেখল রশুভের চোখেও জল। মারির চোখে ফুটে উঠল যে কৃতজ্ঞতার আভাস তাতে তার মুখের সাধারণ ভাবটা চাপা পড়ে গেল।

রস্তভ বলল, ঘটনাক্রমে ঠিক এই সময়ই আমি যে এখানে এসে পড়েছি এবং আপনার কাজে লাগতে পারছি সেজন্য আমি যে কত খুশি হয়েছি তা বোঝাতে পারব না। আপনি যেখানে খুশি চলে যান, আমি কথা দিচ্ছি কেউ আপনাকে বিরক্ত করতে সাহস করবে না, শুধু আমাকে আপনার সঙ্গে থাকবার অনুমতি দিন। যেন কোনো রাজ-পরিবারের মহিলাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে এমনিভাবে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে রভ দরোজার দিকে এগিয়ে গেল।

তার সশ্রদ্ধ কণ্ঠস্বরই বলে দিল, যদিও প্রিন্সেস মারির সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে সে খুবই সুখী হবে, তবু তার দুর্ভাগ্যের সুযোগ নিয়ে সে কোনোরকম জোর খাটাবে না।

প্রিন্সেস মারিও সেটা বুঝতে পেরে খুশি হল।

ফরাসিতে বলল, আপনার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ, কিন্তু আমি আশা করছি যে এ সবটাই ভুল বোঝাবুঝির ফল, এতে কারো কোনো দোষ নেই। হঠাৎ সে কেঁদে ফেলল।

আমাকে ক্ষমা করবেন! সে বলল।

 ভুরু কুঁচকে আর একবার মাথাটা ঈষৎ নুইয়ে রম্ভভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-১৪

আচ্ছা, খুবই সুন্দরী কি? আরে বন্ধু-আমার গোলাপিটি তো উপাদেয় বস্তু, তার নাম দুনিয়াশা…

কিন্তু রস্তভের দিকে চোখ পড়তেই ইলিন থেমে গেল। বুঝতে পারল, তার নায়ক ও কমান্ডারের চিন্তার ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বইছে।

সক্রোধ দৃষ্টিতে ইলিনের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে রস্তভ দ্রুত পা ফেলে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল।

মনে মনে বলল, ওদের দেখিয়ে দেব, শিক্ষা দিয়ে দেব, ডাকাতের দল!

আলপাতিচ অনেক কষ্টে তার গতির সঙ্গে তাল রেখে পাশে পাশে চলল।

একসময় বলল, আপনি কি সিদ্ধান্ত করলেন?

রস্তভ থেমে গেল, হঠাৎ ঘুষি পাকিয়ে আলপাতিচের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

সিদ্ধান্ত? কি সিদ্ধান্ত? অকর্মা বুড়ো!… সে চেঁচিয়ে উঠল। তুমি কি করছিলে? অ্যাঁ? চাষীরা হাঙ্গামা করছে, আর তুমি তার কোনো ব্যবস্থা করতে পারছ না? তুমি নিজেও বিশ্বাসঘাতক! আমি তোমাকে চিনি। জ্যান্ত তোমার চামড়া তুলে নেব।…নিজেই অকারণে রাগ করছে বুঝতে পেরে সে আলপাতিচকে ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে চলল। আলপাতিচ মনের ক্ষোভ চেপে রেখে প্রায় দৌড়বার ভঙ্গিতে তার পাশে পাশে চলতে চলতে কৈফিয়ৎ দিতে লাগল। চাষীরা বড়ই একগুয়ে, আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া ওদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করাটাও যুক্তিযুক্ত নয়, কাজেই সর্বাগ্রে মিলিটারি ডাকাই ভালো নয় কি?

যুক্তিহীন জান্তব ক্রোধে রুদ্ধশ্বাস হয়ে রস্তভ বলে উঠল, সশস্ত্র বাহিনীই দেব ব্যাটাদেব…বাড়াবাড়িই করব!

কী করবে না ভেবেচিন্তেই সে দৃঢ় পদক্ষেপে দ্রুত এগিয়ে চলল ভিড়কে লক্ষ্য করে। যতই তাদের কাছে যাচ্ছে ততই আলপাতিচের মনে হচ্ছে যে এই যুক্তিহীন কাজের ফলটা ভালোই হবে। রস্তভের দৃঢ় পদক্ষেপ ও ভ্রুকুঞ্চিত মুখ দেখে ভিড়ের মধ্যে চাষীদের মন কিছুটা দমে গেল।

হুজাররা গ্রামে আসায় এবং রস্তভ প্রিন্সেসের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ায় চাষীদের মধ্যে কিছুটা গোলমাল ও মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। কিছু চাষী বলল, নবাগতরা নিশ্চয়ই রুশ, আর কত্রীকে আটক করায় তারা রুষ্ট হতে পারে। দ্রোনেরও তাই মত, কিন্তু সেকথা বলামাত্রই কাপ ও অন্য কেউ-কেউ প্রাক্তনগ্রাম-প্রধানের উপর চটে উঠল।

কার্প চেঁচিয়ে বলল, কমনের পয়সায় কত বছর ধরে পেট মোটা করেছ? তোমার আর কি! মাটি খুঁড়ে টাকার ঘড়া তুলবে আর তাই নিয়ে পগার পার হবে।…আমাদের বাড়িঘর থাকল কি গেল তাতে তোমার কি যায়-আসে?

আমাদের হুকুম তামিল করতে বলা হয়েছে, কাউকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বা এক দানা শস্য নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না, ব্যাস, ফুরিয়ে গেল!

একটি ছোটখাট বুড়ো হঠাৎ দ্রোনকে আক্রমণ করে বলল, তোমার ছেলেকে সেনাদলে নেবার পালা ছিল, কিন্তু তোমার ভয় কি! তোমার হোল্কা ছেলেটা পার পেয়ে গেল, আর তারা আমার ভাংকাকে নিয়ে গেল মাথা মুড়িয়ে সৈন্য বানাতে! কিন্তু মরতে আমাদের সকলকেই হবে।

দ্রোন বলল, ঠিক বলেছ, আমাদের সকলকেই মরতে হবে। আমি তো কমুনের বিপক্ষে নই।

হয়েছে-বিপক্ষে নই! নিজের পেট মোটা করেছ…

ঢ্যাঙা চাষী দুটোরও কি যেন বলার ছিল। কিন্তু ইলিন, লাভ্রুশকা ও আলপাতিচকে সঙ্গে নিয়ে রস্তভ কাছে এসে পড়ায় কার্প কোমরবন্ধের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে ঈষৎ হেসে এগিয়ে গেল। দ্রোন সরে গেল পিছনের দিকে। আর জনতা আরো ঘন হয়ে এল।

দ্রুত পায়ে ভিড়ের কাছে এসে রস্তভ চিৎকার করে বলল, এখানে তোমাদের গ্রাম-প্রধান কে? অ্যাঁ?

 গ্রাম-প্রধান? তাকে আপনার কি দরকার?…কার্প জানতে চাইল।

কিন্তু তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই তার মাথার টুপিটা উড়ে গেল, আর একটা প্রচণ্ড ঘুষি লেগে তার মাথাটা একদিকে বেঁকে গেল।

মাথার টুপি খুলে ফেল বিশ্বাসঘাতকের দল! ক্রুদ্ধ কণ্ঠে রস্তভ গর্জে উঠল। গ্রাম-প্রধান কোথায়?

 গ্রাম-প্রধান…গ্রাম-প্রধানকে চাইছেন…দ্রোন জাখারিচ, তুমি! ভিড়ের ভিতর থেকে নানান ভীরু ও ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠ শোনা গেল, সকলেই টুপি খুলে ফেলল।

আমরা তো গোলযোগ করছি না, হুকুম তামিল করছি। কার্প কথাগুলি বলতেই আর কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, বৃদ্ধরা এই সিদ্ধান্তই নিয়েছে–হুঁকুম করার মালিক তো আপনারা অনেকেই।

কথার উপর কথা! বিদ্রোহ!…ডাকাতের দল! বিশ্বাসঘাতক! কার্পের কলার চেপে ধরে রস্তভ এমন অর্থহীনভাবে চিৎকার করে উঠল যেন সে কণ্ঠস্বর তার নিজের নয়। ওকে বেঁধে ফেল! বেঁধে ফেল! লাভ্রুশকা ও আলপাতিচ ছাড়া অন্য কেউ সেখানে নেই জেনেও সে কথাটা বলল।

যাই হোক, লাভ্রুশকা ছুটে গিয়ে পিছন থেকে কার্পের হাত চেপে ধরল।

বলল, পাহাড়ের ওপার থেকে সৈন্যদের ডেকে আনব কি?

চাষীদের দিকে ঘুরে আলপাতিচ হুকুম দিল, দুইজন এসে কাৰ্পকে বেঁধে ফেলুক। তারাও বিনীতভাবে ভিড়ের ভিতর থেকে এগিয়ে এসে নিজেদের কোমরবন্ধ খুলতে শুরু করল।

গ্রাম-প্রধান কোথায়? রশুভের চড়া গলা।

বিবর্ণ ভ্রূকুটির মুখে দ্রোন ভিড়ের ভিতর থেকে এগিয়ে এল।

তুমিই গ্রাম-প্রধান? লাভ্রুশকা, একেও বেঁধে ফেল! রস্তভ চিৎকার করে বলল, যেন এ হুকুমকে বাধা দেবারও কেউ নেই।

সত্যি সত্যি আরো দুটি চাষী দ্রোনকে বাধতে শুরু করল, যেন তাদের সাহায্য করতে দ্রোন নিজের কোমরবন্ধটাই খুলে দিল।

তখন রস্তভ চাষীদের বলল, তোমরা সকলেই শোন! এই মুহূর্তে যার যার বাড়ি চলে যাও, তোমাদের কারো গলা যেন আর না শুনি।

কেন? আমরা তো কোনো ক্ষতি করিনি। স্রেফ বোকার মতো কাজ করেছি। যতসব বাজে ঝামেলা…আমি তখনই বলেছিলাম কাজটা ঠিক হচ্ছে না, পরস্পরের প্রতি দোষারোপের ভাষা শোনা গেল।

এতক্ষণে আলপাতিচ আবার স্বমূর্তি ধারণ করল। বলল, হল তো? আমি কি বলেছিলাম? এটা অন্যায় বাপধনরা!

সবই আমাদের বোকামি আলপাতি, বলতে বলতে সকলে কেটে পড়ল।

যে দুটি লোককে বাঁধা হয়েছে তাদের মনিবের বাড়িতে নিয়ে চলল। মাতাল দুটিও তাদের পিছু নিল।

একজন কাৰ্পকে বলল, আহা, তোমাকে দেখে দুঃখ হচ্ছে!

অপরজন বলল, মনিবের সঙ্গে কখনো ওভাবে কথা বলতে আছে? তুমি কি ভেবেছিলে হে বোকারাম? খাঁটি বোকা!

দুইঘণ্টা পরে। বোগুচারভো ভবনের সামনে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। চাষীরা মালিকের মালপত্র বয়ে এনে গাড়িতে বোঝাই করছে। প্রিন্সেস মারির ইচ্ছানুসারে দ্রোনের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। উঠোনে দাঁড়িয়ে সেও তদারক করছে।

 দাসীর হাত থেকে একটা গহনার বাক্স নিয়ে একটি চাষী বলল, এটাকে এমন হেলাফেলা করে রেখ না। জান এর জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে! ওভাবে দড়ির নিচে যে রাখছ, ওটার গায়ে ঘষা লাগবে না? এরকম কাজ আমি পছন্দ করি না। সব কাজ নিয়মমাফিক কর। এই দেখ, এটা বাকলের মাদুরের নিচে রেখে খড় দিয়ে ঢেকে দাও-এইভাবেই এসব জিনিস রাখতে হয়!

প্রিন্স আন্দ্রুর লাইব্রেরির কার্বার্ডটা এনে আর একটি চাষী বলল, আরে বই, বই! ধাক্কা দিও না। এটা খুব ভারী-বইয়ে একেবারে ঠাসা।

উপরের অভিধানগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে অর্থপূর্ণভাবে চোখ টিপে গোল-মুখ ঢ্যাঙা চাষীটি বলল, হ্যাঁ, ওঁরা তো সারাদিন কাজ করেন, মোটেই খেলাধূলা করেন না!

প্রিন্সেসের সঙ্গে গায়ে পড়ে ভাব করার অনিচ্ছায় রস্তভ বলকনস্কি ভবনে ফিরে না গিয়ে গ্রামেই প্রিন্সেসের যাত্রার জন্য অপেক্ষা করে রইল। প্রিন্সেসের গাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে রস্তভও ঘোড়ায় চেপে বোগুচারভো থেকে আট মাইল পর্যন্ত তার সঙ্গে সঙ্গে গেল। সেখান থেকেই রাস্তাটা আমাদের সেনাদলের দখলে। ইয়ংকভো সরাইখানাতে সে সশ্রদ্ধভাবে প্রিন্সেসের কাছ থেকে বিদায় নিল এবং এই সর্বপ্রথম তার হাতে চুমো খেল।

তাকে উদ্ধার করার জন্য প্রিন্সেস মারির কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উত্তরে রস্তভ রক্তিম মুখে বলল, একথা কেন বলছেন? যে কোনো পুলিশ অফিসারই তো একাজটা করত। আমাদের যদি অনবরত চাষীদের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাহলে শত্রুপক্ষকে এতদূর আসতে দেওয়া উচিত হয়নি। আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়েছি। বিদায় প্রিন্সেস! আপনার সুখ ও সান্ত্বনা কামনা করি, আশা করি মধুরতর পরিবেশে আবার আমাদের দেখা হবে। আমাকে যদি লজ্জা দিতে না চান তো দয়া করে ধন্যবাদ দেবেন না!

কথায় ধন্যবাদ না জানালেও প্রিন্সেস কিন্তু ধন্যবাদ জানাল কৃতজ্ঞতা ও মমতায় উজ্জ্বল মুখের ভাব দিয়ে। তাকে ধন্যবাদ জানাবার কিছু নেই একথা প্রিন্সেস বিশ্বাস করে না, বরং সে নিশ্চিত বোঝে যে রস্তভ না এলে সে বিদ্রোহী চাষী ও ফরাসিদের হাতে মারা পড়ত, তাকে বাঁচাতে এই মানুষটি ভয়ংকর বিপদের ঝুঁকি নিয়েছিল, উচ্চ আদর্শ ও মহৎ অন্তরের এই মানুষটি তার অবস্থা, তার দুঃখকে উপলব্ধি করতে পেরেছে। নিজের ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে সে নিজে যখন কাঁদছিল, তখন এই মানুষটির সদয়, অশ্রুভরা চোখ দুটির স্মৃতি সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

রস্তভের কাছে বিদায় নিয়ে সে যখন একলা দাঁড়িয়েছিল তখন হঠাৎ তার চোখ জলে ভরে এল, আর তখনই এই প্রথম একটা বিচিত্র প্রশ্ন তার মনে দেখা দিল : সে কি রস্তভকে ভালোবেসেছে?

মস্কোর পথে চলতে চলতে প্রিন্সেস মারি ভাবল : আচ্ছা ধরা যাক আমি তাকে ভালোবাসি, তাহলে?

যে মানুষ কোনোদিন তাকে ভালোবাসবে না সে যে তারই প্রেমে পড়েছে এ-কথা নিজের কাছে স্বীকার করাও যে লজ্জার, তবু এই কথা ভেবে সে সান্ত্বনা পেল যে একথা কেউ কোনোদিন জানবে না, এ-কথা কাউকে কোনো দিন না জানিয়েও জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো যাকে সে ভালোবেসেছে তাকে যদি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবেসে যায় তাহলে তো কেউ তাকে দোষ দিতে পারবে না।

মাঝে মাঝে যখনই রস্তভের চাউনি, তার সহানুভূতি, তার কথাগুলি মনে পড়ে, তখনই সুখের আস্বাদন তার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয় না।

সে ভাবতে লাগল, ঠিক সেইমুহূর্তে নিয়তিই কি তাকে বোগুচারভোতে এনে হাজির করেনি? নিয়তির বশেই কি তার বোন আমার দাদাকে প্রত্যাখ্যান করেনি? (নাতাশা যদি প্রিন্স আন্দ্রুকে বিয়ে করত তাহলে সেটা হত মারি ও নিকলাসের বিয়ের পথে বিঘ্নস্বরূপ।) সবকিছুর মধ্যেই প্রিন্সেস মারি বিধাতার নির্দেশ দেখতে পেল।

রশুভেরও প্রিন্সেসকে ভালো লেগেছে। তার কথা মনে হলেই সে আনন্দ পায়। তার বোণ্ডচারভো অভিযানের কাহিনী শুনে সহকর্মীরা যখন বলতে শুরু করল যে খড় খুঁজতে গিয়ে সে রাশিয়ার সবচাই তো ধনবতী উত্তরাধিকারিণীকে খুঁজে পেয়েছে, তখন তার রাগ হল। তার রাগের কারণ, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রিন্সেস মারিকে বিয়ে করার কথা একাধিকবার তার মাথায় এসেছে। নিকলাস ব্যক্তিগতভাবে তার চাইতে ভালো স্ত্রী কামনা করে না : তাকে বিয়ে করলে তার মা কাউন্টেস সুখী হবে, তার বাবার সাংসারিক বিপদ কেটে যাবে, এমন কি প্রিন্সেস মারির সুখও নিশ্চিত হবে।

কিন্তু সোনিয়া? আর তার বাকদান? সহকর্মীদের কথায় এই জন্য রস্তভ রাগ করেছিল।

.

অধ্যায়-১৫

প্রধান সেনাপতির কার্যভার হাতে নিয়েই কুতুজভের মনে পড়ল প্রিন্স আন্দ্রুকে, তাকে খবর পাঠাল প্রধান ঘাঁটিতে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে।

জারেভো-জ্যামেশিতে কুতুজভ যেদিন প্রথম সেনাদল পরিদর্শন করল ঠিক সেইদিনই প্রিন্স আন্দ্রু সেখানে এল। গ্রাম্য পুরোহিতের যে বাড়িটার সামনে প্রধান সেনাপতির গাড়ি দাঁড়িয়েছিল প্রিন্স আন্দ্রু সেই বাড়িতেই থামল, ফটকের বেঞ্চিটাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল প্রশান্ত মহামহিমের জন্য–সকলে এখন ঐ নামেই কুতুজভকে ডাকে। গ্রামের অদূরের মাঠ থেকে কখনো ভেসে আসছে সেনাদলের বাজনার শব্দ, কখনো বা নতুন প্রধান সেনাপতির প্রতি বহু কণ্ঠের হুররা! ধ্বনি। দুইজন আর্দালি, একজন সংবাদবাহক ও একজন প্রধান ভাণ্ডারী কাছেই প্রিন্স আন্দ্রুর দশ পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বেঁটে, মোটা হুজার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ঘোড়া ছুটিয়ে এল, মুখে ঘন গোঁফ ও গালপাট্টা, প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, প্রশান্ত মহামহিম সেখানেই থাকেন কিনা এবং শীঘ্রই ফিরবেন কি না।

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, সে প্রশান্ত মহামহিমের স্টাফের লোক নয়, এখানে নতুন এসেছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল একজন আর্দালির দিকে এগিয়ে গেল। সে জবাব দিল, কে? প্রশান্ত মহামহিম? আশা করছি তিনি অচিরেই এসে পড়বেন। আপনার কি চাই?

হুজার লেফটেন্যান্ট-কর্নেল আর্দালিটির গলার স্বরে গোঁফের নিচে একটুখানি হেসে ঘোড়া থেকে নামল, ঘোড়াটাকে সহিসের জিম্মায় দিয়ে মাথাটা ঈষৎ নুইয়ে বলকনক্কির দিকে এগিয়ে গেল। বলকনস্কি বেঞ্চিতে একটু জায়গা করে দিল, লোকটি তার পাশে বসে পড়ল।

লোকটি বলল, আপনিও প্রধান সেনাপতির জন্য অপেক্ষা করছেন? লোকে বলে তিনি সকলের সঙ্গেই দেখা করেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! ঐ মাংসখেকোদের নিয়েই যত বিপদ! এতদিনে রুশদের একটা হিল্লে হবে। এতদিন যে কি হচ্ছিল তা শুধু শয়তানই জানে। আমরা তো পিছিয়েই চলেছি। আপনি কি অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন?

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, শুধু যে পশ্চাদপসরণে অংশ নেবার সৌভাগ্য হয়েছে তাই নয়, সেই পশ্চাদপসরণের কালে আমার যা কিছু প্রিয় সব হারিয়েছি-শুধু জমিদারি ও জন্ম-ভিটের কথাই বলছি না-হারিয়েছি আমার বাবাকে, শোকের আঘাতেই তিনি মারা গেছেন। আমি মোলেন প্রদেশের লোক।

ওঃ! আপনি প্রিন্স বলকনস্কি? আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভারি খুশি হলাম! আমি লেফটেন্যান্ট-কর্নেল দেনিসভ, ভাস্কো নামেই অধিক পরিচিত, প্রিন্স আন্দ্রুর হাতটা চেপে ধরে বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেনিসভ বলল। হ্যাঁ, আমি শুনেছি।…আর, এই সিদীয় যুদ্ধ। যুদ্ধ ভালো জিনিস–শুধু যাদের গলায় চেপে বসে তাদের পক্ষে তা নয়। তাহলে আপনিই প্রিন্স আন্দ্রু বলকনস্কি? আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভারি খুশি হলাম! বিষণ্ণ হাসির সঙ্গে সে আবার প্রিন্স আন্দ্রুর হাতটা চেপে ধরল।

প্রথম প্রণয়ী সম্পর্কে নাতাশা তাকে যা বলেছে দেনিসভ সম্পর্কে প্রিন্স ততটুকুই জানে। এই স্মৃতি তাকে হর্ষ ও বিষাদে ভরা সেই বেদনাময় দিনগুলিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল যার কথা সে ইদানীং আর ভাবে না, অথচ মন থেকেও মুছে যায়নি। সম্প্রতিকালে এত সব নতুন ও গুরুতর ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে–যেমন মোলেনস্ক থেকে পশ্চাদপসরণ, বন্ড হিলস-এ প্রত্যাবর্তন ও বাবার মৃত্যু-সংবাদ এবং এত বিচিত্র অনুভূতির অভিজ্ঞতা তার হয়েছে যে দীর্ঘদিন সেই সব অতীত স্মৃতি তার মনেই পড়েনি। দেনিসভের দিক থেকেও বলকনস্কির নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে যে অতীত স্মৃতি তা মনে জেগে উঠেছে তাও তো এক দূর অতীতের রোমান্টিক স্মৃতিমাত্রযখন নৈশভোজনান্তে নাতাশার গান শেষ হলে সে যে কি করছে তা না বুঝেই একটি পঞ্চদশী মেয়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল। সেকথা মনে হতেই মৃদু হেসে দেনিসভ বর্তমান অভিযান প্রসঙ্গে তার একটা নতুন পরিকল্পনার কথা তুলল। সমস্ত ব্যাপারটা প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বলল, সবগুলো সীমান্ত তারা রক্ষা করতে পারবে না। সেটা অসম্ভব। তাদের ব্যুহ আমি ভেদ করবই। আমাকে পাঁচশ সৈন্য দিন, আমি ব্যুহ ভেদ করে বেরিয়ে যাব। এটা একেবারে নিশ্চিত কথা! আমাদের সামনে। একটি মাত্র পথ আছে-গেরিলা যুদ্ধ!

দেনিসভ যখন বলকনস্কির কাছে নিজের পরিকল্পনা বোঝাতে গিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে চলেছে, তখনই কানে এল সৈন্যদের হৈ-হল্লা আর গান-বাজনার শব্দ। চেঁচামেচি ও ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ ক্রমেই গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে।

ফটকে দাঁড়ানো একটি কসাক চেঁচিয়ে উঠল, তিনি আসছেন। তিনি আসছেন!

বলকনস্কি ও দেনিসভ ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। তারা দেখতে পেল, একটা ছোট ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে আসছে কুতুজভ। তার পিছনে আসছে অশ্বারোহী সেনাপতির একটা বড় দল। ঠিক পিছনেই আসছে বাকলে। একদল অফিসার ছুটতে ছুটতেই চিৎকার করছে হুররা!

চারদিকের হুররা! হুররা! ধ্বনির মধ্যে কুতুজভ প্রিন্স আন্দ্রু ও দেনিসভের পাশ কাটিয়ে উঠোনে ঢুকল।

প্রিন্স আন্দ্রু যখন তাকে শেষবারের মতো দেখেছিল কুতুজভ এখন তার চাইতেও বেশি মোটা হয়েছে, গায়ের চামড়া আরো ঝুলে পড়েছে। কিন্তু চোখের শাদা তারা, ক্ষতের দাগ ও ক্লান্তির ছাপ আগের মতোই আছে। মাথায় অশ্বরক্ষীর শাদা টুপি ও মিলিটারি ওভারকোট, কাঁধের উপর ঝুলছে সরু ফিতে দিয়ে বাঁধা একটা চাবুক। ছোট ঘোড়াটার পিঠে চেপে বসে দুলে দুলে চলছে।

উঠোনে ঢুকেই শিস দিল হু-হু-হু! মুখে ফুটে উঠল স্বস্তির আভাস। রেকাব থেকে বাঁ পাটা তুলে গোটা শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে মুখটা বেঁকিয়ে অনেক কষ্টে জিনের উপর রেখে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে পিছলে নিচে নেমে গেল, আর অপেক্ষমাণ অ্যাডজুটান্ট ও কত্সকরা তাকে যেন কোলে করে নামিয়ে দিল।

শরীরটাকে সোজা করে চোখ কুঁচকে চারদিকে তাকাতে কুতুজভের নজর পড়ল প্রিন্স আন্দ্রুর উপর, কিন্তু তাকে চিনতে না পেরে দুলতে দুলতে সামনে এগিয়ে গেল। হু…হু…হু শিস দিতে দিতে আর একবার প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল। বুড়ো মানুষদের বেলায় যেমন হয়ে থাকে, তারও প্রিন্স আন্দ্রুকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল।

আরে, কেমন আছ হে প্রিন্স? কেমন আছ বাবা? এস, এস… বলে কুতুজভ বারান্দায় উঠে গেল। তার দেহের ভারে বারান্দাটা ঝাঁকিয়ে উঠল।

কোর্টের বোতাম খুলে সে বারান্দার বেঞ্চিতে বসল।

তোমার বাবা কেমন আছেন?

 প্রিন্স আন্দ্রু সরাসরি জবাব দিল, গতকালই বাবার মৃত্যু-সংবাদ পেয়েছি।

বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে কুতুজভ তার দিকে তাকাল : তারপর টুপি খুলে ক্রুশচিহ্ন আঁকল।

তিনি স্বর্গরাজ্য লাভ করুন! আমাদের সকলের জন্যই ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক! কুতুজভ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, তার বুকটা ওঠা-নামা করতে লাগল, বেশ কিছুক্ষণ সে চুপ করে রইল। আমি তাকে ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম, সমস্ত অন্তর দিয়ে তোমাকে সহানুভূতি জানাচ্ছি।

প্রিন্সকে আলিঙ্গন করে তার স্কুল বুকের উপর তাকে জড়িয়ে ধরল, বেশ কিছুক্ষণ ছেড়ে দিল না। ছাড়া পেয়ে প্রিন্স আন্দ্রু দেখল, তার মোটা ঠোঁট দুটি কাঁপছে, দুই চোখে টলমল করছে অশ্রুর বিন্দু। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াবার জন্য দুই হাতে বেঞ্চির উপর চাপ দিল।

এস, আমার সঙ্গে এস, কথা আছে, কুতুজভ বলল।

ঠিক সেইমুহূর্তে দেনিসভ বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল, অ্যাডজুটান্টদের ক্রুদ্ধ ফিসফিস কথায় বাধা মানল না।

আসনের উপর হাত রেখেই কুতুজভ চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকাল। নিজের নাম ঘোষণা করে দেনিসভ জানাল যে দেশের কল্যাণের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় প্রশান্ত মহামহিমকে জানাতেই সে এসেছে। কুতুজভ ক্লান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিসূচক ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে পরে পেটের উপর ভাঁজ করে রেখে বলল, আমাদের দেশের কল্যাণের জন্য ব্যাপার কি? বল! মুখটা মেয়ের মতো লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেও সে স্নোলেনস্ক ও ভিয়াজমার ভিতর দিয়ে শত্রুপক্ষের ব্যুহভেদ করার পরিকল্পনাটা সাহসের সঙ্গে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল। দেনিসভ এই অঞ্চলেরই মানুষ, কাজেই দেশটাকে সে ভালোই চেনে। তার পরিকল্পনাটা সত্যি ভালো, বিশেষত যেরকম দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সেটাকে সে বুঝিয়ে বলল তাতে সেটাকে সত্যি ভালো মনে হল। কুতুজভ নিজের পায়ের দিকে তাকাল, মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তী ঘরটার দিকেও তাকাতে লাগল, যেন সেখান থেকে অপ্রীতিকর কিছু বেরিয়ে আসার আশংকা আছে তার মনে। দেনিসভের কথার মাঝখানেই সেই কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এল একজন জেনারেল, তার বগলে একটা পোর্টফোলিও।

কুতুজভ বলে উঠল, সে কি? তুমি এত শীঘ্র তৈরি হয়েছ?

সেনাপতি উত্তর দিল, আমি তৈরি প্রশান্ত মহামহিম।

 কুতুজভ এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন বলতে চাইল, একটা মানুষ এত সব সামাল দেবে কেমন করে? তারপর দেনিসভের কথায় মন দিল।

দেনিসভ বলতে লাগল, একজন রুশ অফিসার হিসেবে আমি কথা দিচ্ছি, নেপোলিয়নের যোগাযোগ সূত্রটা আমি ছিঁড়ে ফেলতে পারব।

তার কথায় বাধা দিয়ে কুতুজভ শুধাল, ইন্টেন্ড্যান্টজেনারেল কিরিল আদ্ৰীভিচ দেনিসভ তোমার কে হন?

তিনি আমার খুড়োমশাই প্রশান্ত মহামহিম।

আচ্ছা, আমরা দুইজন তো বন্ধু, কুতুজভ সানন্দে বলল। ঠিক আছে, ঠিক আছে বন্ধু, আজ এখানে থাক, কাল তোমার সঙ্গে কথা হবে।

দেনিসভের দিকে মাথাটা নেড়ে সে কাগজপত্রগুলির জন্য কনভনিৎসিনৈর দিকে হাত বাড়াল।

অসন্তুষ্ট গলায় কর্তব্যরত জেনারেল বলল, প্রশান্ত মহামহিম কি ভিতরে আসবেন? পরিকল্পনাগুলি পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কিছু কাগজপত্রে সই করতে হবে।

একজন অ্যাডজুটান্ট বেরিয়ে এসে জানাল, ভিতরে সবকিছু প্রস্তুত। কুতুজভ কিন্তু কাজ শেষ না করে ভিতরে যেতে চাইল না। মুখটা বিকৃত করল…

না হে বাপু, ওদের বল একটা ছোট টেবিল এখানেই নিয়ে আসুক। এখানে বসেই কাগজপত্রগুলো দেখব। প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি যেয়ো না।

এইসব কথাবার্তা যখন চলছে তখন প্রিন্স আন্দ্রু দরোজার পিছনে নারীকন্ঠের ফিসফিসানি ও রেশমি পোশাকের খসখসানি শুনতে পেল। বারকয়েক সেদিকে তাকিয়ে সে দরোজার পিছনে একটি গোলগাল, গোলাপি সুদর্শনাকে দেখতে পেল, পরনে গোলাপি পোশাক, মাথায় লিলাক-রঙের রুমাল বাঁধা। একটা থালা হাতে নিয়ে প্রধান সেনাপতির জন্য অপেক্ষা করে আছে। কুতুজভের অ্যাডজুটান্ট প্রিন্স আন্দ্রুর কানে কানে বলল, এই মহিলা বাড়ির মালিক পুরোহিতের স্ত্রী, প্রশান্ত মহামহিমকে রুটি ও লবণ দিয়ে অভ্যর্থনা করবে। তার স্বামী প্রশান্ত মহামহিমকে গির্জায় স্বাগত জানিয়েছে ক্রুশ দিয়ে, আর স্ত্রী তাকে স্বাগত জানাবে বাড়িতে। মহিলাটি খুবই সুন্দরী। অ্যাডজুটান্ট ঈষৎ হেসে কথা শেষ করল। কথাগুলো কানে আসতেই কুতুজভ ঘুরে দাঁড়াল। প্রিন্স আন্দ্রু প্রধান সেনাপতির মুখের দিকে ভালোভাবে তাকাল, তার চোখে পড়ল শুধু বিরক্তি, মেয়েদের ফিসফিস কথাবার্তা সম্পর্কে কৌতূহল এবং ভদ্রতা রক্ষা করে চলার বাসনা। জেনারেলের প্রতিবেদনের পাণ্ডিত্য অথবা দেনিসভের পরিকল্পনার দেশাত্মবোধ-কোনোটার প্রতিই তার বিশেষ আগ্রহ দেখা গেল না। প্রতিবেদনের যে জায়গায় রুশ সৈনিকদের লুটতরাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে একমাত্র সে সম্পর্কেই কুতুজভ নিজের থেকে একটা স্পষ্ট নির্দেশ দিল। প্রতিবেদনের শেষে কুতুজভের স্বাক্ষরের জন্য একটা কাগজ জেনারেল তার সামনে মেলে ধরল, সৈন্যরা যেসমস্ত তাজা যই ফসল ক্ষেত থেকে কেটে নিয়ে গেছে, জমির মালিকরা তার দরুন ক্ষতিপূরণ দাবি করে দরখাস্ত করায় সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা যেসব টাকা ব্যয় করেছে কাগজটাতে তারই উল্লেখ করা হয়েছে।

সব ব্যাপারটা শুনে কুতুজভ ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে মাথা নাড়তে লাগল।

মুখে বলল, উনুনে ফেলে দাও…আগুনে পুড়িয়ে দাও! শেষবারের মতো তোমাদের বলে দিচ্ছি, এ সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে দাও! তারা খুশি মতো ফসল কাটবে, কাঠ কেটে আগুন জ্বালাবে! সেরকম কোনো হুকুম আমি দিচ্ছি না, সেধরনের কাজ হোক তাও চাই না, কিন্তু ক্ষতিপূরণের দাবিও চলবে না। এ ছাড়া চলতে পারে না। কাঠ যখন কাটা হবে তখন টুকরো চাকলা তো উড়বেই। সে আবার কাগজটার দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, ওঃ, যত সব জার্মান কেতা।

.

অধ্যায়-১৬

শেষ দলিলটা সই করে কুতুজভ বলল, ব্যাস। সব শেষ! তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গলার ভাঁজগুলো সমান করে খুশি মনে দরোজার দিকে পা বাড়াল।

পুরোহিতের স্ত্রী লজ্জায় আরো লাল হয়ে নিচু হয়ে অভিবাদন করে থালাটা কুতুজভের দিকে এগিয়ে দিল।

কুতুজভ চোখ ঘুরিয়ে একটু হাসল, তার থুতনিটা তুলে ধরে বলল, আরঃ, কী সুন্দর! অনেক ধন্যবাদ মিষ্টি মেয়ে!

ট্রাউজারের পকেট থেকে কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা বের করে থালার উপরে রাখল। তারপর তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দিকে চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সব খবর ভালো তো? পুরোহিতের স্ত্রী হাসল, তার গালে একটা টোল পড়ল, কুতুজভকে অনুসরণ করে সেও ঘরে ঢুকল। অ্যাডজুটান্ট বেরিয়ে এসে প্রিন্স আন্দ্রুকে তার সঙ্গে লাঞ্চ খেতে ডাকল। আধ ঘন্টা পরে আবার কুতুজভের ঘরে প্রিন্স আন্দ্রুর ডাক পড়ল। কুতুজভ একটা হাতল-চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, তখনো সেই বোতাম-খোলা ওভারকোটটাই গায়ে রয়েছে। হাতে একখানা ফরাসি বই। প্রিন্স আন্দ্রু ঘরে ঢুকতে বইটা বন্ধ করে একটা ছুরি দিয়ে জায়গাটা নির্দিষ্ট রাখল। প্রচ্ছদ দেখে প্রিন্স আন্দ্রু বুঝল বইটা মাদাম দ্য জেঁলিসর শেভালিয়ে দু সাই নে।

কুতুজভ বলল, বস হে, এখানে বস। কিছু কথা বলা যাক। দুঃখের, খুবই দুঃখের কথা। কিন্তু মনে রেখ বাবা আমিও তোমার বাবার মতো, দ্বিতীয় পিতা…

বাবার মৃত্যু সম্পর্কে যা জানত, বন্ড হিলস-এর ভিতর দিয়ে আসবার সময় যা কিছু দেখেছে প্রিন্স আন্দ্রু সেসব কথাই কুতুজভকে বলল।

কোথায়…আমাদের ওরা কোথায় নিয়ে এসেছে! কুতুজভ হঠাৎ উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে বলল, রাশিয়ার বর্তমান ছবিটা যেন স্পষ্ট হয়ে তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। কিন্তু আমাকে সময় দাও, সময় দাও! তারপরই এই উত্তেজিত আলোচনায় ইতি টেনে বলল, তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি আমার কাছে রাখব বলে।

অনেক ধন্যবাদ প্রশান্ত মহামহিম, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে দপ্তরে কাজ করার মতো যোগ্যতা এখন আর আমার মধ্যে নেই, উত্তর দেবার সময় প্রিন্স আন্দ্রুর মুখের হাসিটুকু কুতুজভের দৃষ্টি এড়াল না।

সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, কিন্তু সবচাইতে বড় কথা, রেজিমেন্টে থাকাটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, সেখানকার অফিসারদের আমি ভালোবাসি, সৈনিকদেরও আপনজনের মতোই দেখি। রেজিমেন্ট ছেড়ে আসতে আমার কষ্ট হবে। আপনার সঙ্গে থাকতে পারার সম্মানকে যদি ফিরিয়ে দেই, তো বিশ্বাস করুন…

একটা কঠোর, সদয়, অথচ সূক্ষ্ম ব্যঙ্গাত্মক ভাব ফুটে উঠল কুতুজভের ফোলা-ফোলা মুখে। সে বলকনস্কিকে থামিয়ে দিল।

আমি দুঃখিত, কারণ তোমাকে আমার দরকার। কিন্তু তুমি ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ। এখানে মানুষের কোনো দরকার নেই। পরামর্শ দেবার লোক অনেক আছে, কিন্তু মানুষ নেই। ভাবী পরামর্শদাতারা যদি সেনাদলে কাজ করত তাহলে রেজিমেন্ট অন্যরকম হয়ে যেত। অস্তারলিজে তোমাকে আমার মনে আছে…মনে আছে, হ্যাঁ, পতাকা হাতে তোমার সেই মূর্তি আমার মনে আছে! কুতুজভের মুখে কথাগুলি শুনে প্রিন্স আন্দ্রুর মুখটা আনন্দে রক্তিম হয়ে উঠল।

তার হাত ধরে নিচে টেনে নামিয়ে কুতুজভ চুমো খাবার জন্য গালটা বাড়িয়ে দিল, আর একবার প্রিন্স আন্দ্রু দেখল বুড়ো মানুষটির চোখে জল এসেছে। যদিও প্রিন্স আন্দ্রু জানে কুতুজভের চোখে সহজেই জল আসে, তার সাম্প্রতিক ক্ষতির জন্য লোকটি তার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল, তবু অস্তারলিজের কথা মনে করিয়ে দেওয়াটা তার কাছে যেমন আনন্দের, তেমনই গর্বের।

তুমি তোমার পথেই চলে যাও, ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। আমি জানি, সম্মানের পথই তোমার পথ! একটু থেমে কুতুজভ আবার বলল, বুখারেস্টে তোমার অভাব আমি খুবই অনুভব করেছি, কিন্তু পাঠাবার মতো একজন লোকের যে আমার বড়ই দরকার হয়ে পড়েছিল। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য তুর্কি যুদ্ধ ও সন্ধির কথা বলতে শুরু করল। বলল, হ্যাঁ, যুদ্ধ ও সন্ধি দুইয়েরই জন্য আমাকে দোষী করা হয়েছে।…কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক কাজটিই করা হয়েছে। একটা দুর্গ দখল করা কিছু শক্ত কাজ নয়, শক্ত একটা অভিযান জয় করা। আর সেজন্য দরকার–দুর্গ দখল ও আক্রমণ নয়, দরকার ধৈর্য ও সময়। এই দুটোরই আশ্রয় আমি, নিয়েছিলাম, আর তাই কামেনস্কির চাইতে অনেক বেশি দুর্গ দখল করেছি, আর তুর্কিদের ঘোড়ার মাংস খেতে বাধ্য করেছি!…বিশ্বাস কর, ফরাসিদেরও সেই অবস্থা হবে, তাদেরও আমি ঘোড়ার মাংসই খাওয়াব! চোখের জলে আবার তার দৃষ্টি আবছা হয়ে উঠল।

কিন্তু যুদ্ধ তো আমাদের করতেই হবে, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

সকলে যদি চায় তো তাই হবে, কোনো উপায় নেই…কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস কর বাবা, ধৈর্য ও সময়ের চাইতে শক্তিশালী আর কিছু নেই, যা কিছু করার এরাই করে। এ অবস্থায় আমাদের কি করা উচিত? আমি বলছি কি করা দরকার। একটি ফরাসি প্রবাদ উদ্ধৃত করে বলল : সন্দেহ যখন দেখা দেয়, মন চের, তখন কিছুই কর না।

আচ্ছা, তাহলে বিদায়, মনে রেখ, সমস্ত অন্তর দিয়ে আমিও তোমার দুঃখের অংশীদার, আর তোমার কাছে আমি প্রশান্ত মহামহিম নই, প্রিন্স নই, প্রধান সেনাপতিও নই, আমি শুধু পিতা। কখনো কোনো দরকার হলে সোজা আমার কাছে চলে এস। বিদায় বাবা!

আর একবার প্রিন্স আন্দ্রুকে আলিঙ্গন করে তাকে চুমো খেল, কিন্তু সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই কুতুজভ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অসমাপ্ত উপন্যাস মাদাম দ্য জেলিস-এর লে শেভালিয়ে দু সাই নে তে মনোনিবেশ করল।

এটা কেমন করে ঘটল বা কেন ঘটল তা বুঝিয়ে বলতে না পারলেও কুতুজভের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে প্রিন্স আন্দ্রু এই নিশ্চিত ধারণা নিয়ে রেজিমেন্টে ফিরে গেল-যে লোকটির উপর সব ভার পড়েছে সে যোগ্য লোক। সে ভাবল, তিনি নিজের কোনো পরিকল্পনা উপস্থিত করবেন না। কোনো উপায় উদ্ভাবন করবেন না অথবা সেইভাবে কাজও করবেন না। কিন্তু তিনি সব কথা শুনবেন, সব কথা মনে রাখবেন, সবকিছুকেই যথাযোগ্য স্থানে রাখবেন। কোনো দরকারি কাজে বাধা দেবেন না, আবার কোনো ক্ষতিও হতে দেবেন না। তিনি জানেন যে তার নিজের ইচ্ছার চাইতে শক্তিশালী ও গুরুতর কিছু আছে–ঘটনার অনিবার্য গতি, সে গতিকে তিনি বুঝতে পারেন, তার তাৎপর্যকে ধরতে পারেন, এবং ধরতে পারেন বলেই তাতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন।…সবচাইতে বড় কথা, জেঁলিসের উপন্যাস ও ফরাসি প্রবাদ সত্ত্বেও তিনি রুশ বলে লোকে তাকে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে তার আরো কারণ তিনি যখন বললেন : আমাদের ওরা কোথায় নিয়ে এসেছে! তখন তার গলা কাঁপছিল, আর যখন তিনি বললেন : তাদেরও ঘোড়ার মাংস খাইয়ে ছাড়ব! তখনো তাঁর গলা কান্নায় ভিজে উঠেছিল।

এই অনুভূতি কম-বেশি প্রায় সকলেরই, তাই দরবারি প্রভাব সত্ত্বেও সর্বসম্মত সাধারণ স্বীকৃতির সঙ্গেই প্রধান সেনাপতি পদে কুতুজভের নির্বাচনকে গ্রহণ করা হয়েছে।

.

অধ্যায়-১৭

 সম্রাট মস্কো থেকে চলে যাবার পরে সেখানকার জীবনযাত্রা আবার স্বাভাবিক খাতেই বইতে শুরু করেছে, আর সেটা এত বেশি স্বাভাবিক যে সম্প্রতি যে দেশপ্রেমের এতবড় একটা উম্মস ও উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল আজ সেটা মনে করাই শক্ত হয়ে উঠেছে, একথা বিশ্বাস করাও আজ শক্ত যে রাশিয়া আজ সত্য সত্যই বিপন্ন, আর ইংলিশ ক্লাবের সদস্যরা সকলেই দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত পিতৃভূমির সম্মানে। শুধু একটা ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের উন্মাদনা সমান তালেই চলতে লাগল, সেটা হল, সৈন্য ও অর্থ সরবরাহের আহ্বান, যে মুহূর্তে সেইসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তখন থেকেই সেটা আইনগত সরকারি রূপ নিয়ে অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

শত্রু যতই মস্কোর দিকে এগিয়ে আসছে, আসন্ন বিপদ সম্পর্কে মস্কোপন্থীদের হেলাফেলার ভাবটা ততই যেন বেড়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের ইস্তাহার ছাপিয়ে ফরাসিদের সম্পর্কে হাল্কা রসিকতা করা হয়েছে, আর ক্লাবে রেস্তোরাঁতে তাই নিয়ে সরস আলোচনা চলছে। ইংলিশ ক্লাবের কোণের ঘরটাতে সদস্যরা তেমনি একটি ইস্তাহার পড়ে শোনাচ্ছে। রস্তপচিনের ইস্তাহারে জনৈক রুশ নাগরিক ফরাসিদের ঠাট্টা করে বলছে : রাশিয়ার বাঁধাকপি খেয়ে তাদের পেট মোটা হবে, তাদের যবের পরিজ খেয়ে পেট ফাটবে, আর বাঁধাকপির ঝোল খেয়ে দম বন্ধ হবে। তারা তো সব বেঁটে-বামন, একটা চাষী মেয়েই খড়ের কাঁটা দিয়ে তাদের তিনজনকে ঠেঙাবে। কেউ কেউ বা এ সুরটা পছন্দ করছে না, বলছে, এটা বড়ই বোকা-বোকা আর ইতর মনের পরিচায়ক।

জুলি পরদিনই মস্কো ছেড়ে যাবে, সেই উপলক্ষে একটা বিদায়-সভার আয়োজন করা হয়েছে। অন্য অনেক কথার সঙ্গে রস্তভদের প্রসঙ্গও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

জুলি বলল, শুনেছি তাদের অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে। আর লোকটি এত অবিবেচক, মানে আমি সয়ং কাউন্টের কথা বলছি। রাজমভস্কিরা তার মস্কোর উপকণ্ঠস্থ বাড়ি ও জমিদারি কিনতে চেয়েছিল, কিন্তু দরাদরির আর শেষ হচ্ছে না। তিনি বড় বেশি দর হেঁকেছেন।

একজন বলল, না না, আমার তো মনে হয় কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্রি পাকা হয়ে যাবে। যদিও এখন। মস্কোর কোনো কিছু কেনাই পাগলামি।

জুলি শুধাল, কেন? আপনি নিশ্চয়ই মনে করেন না যে মস্কো বিপন্ন?

তাহলে আপনি মস্কো ছেড়ে যাচ্ছেন কেন?

আমি? এটা কি প্রশ্ন হল? আমি যাচ্ছি কারণ…কারণ সকলেই যাচ্ছে, আর তাছাড়া আমি তো জোয়ান অব আর্ক বা আমাজন নই।

বুড়ো মানুষ ভালো, তবে কাজের লোক নয়। আর এত দীর্ঘকাল তারা মস্কোতেই বা আছেন কেন? অনেক আগেই তো তাদের দেশে ফিরে যাবার কথা। নাতালি তো এখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, তাই না? সবজান্তা হাসি হেসে জুলি পিয়েরকে জিজ্ঞাসা করল।

পিয়ের জবাব দিল, তারা ছোট ছেলের জন্য অপেক্ষা করে আছে। ছেলেটি ওবোলেনস্কির কলাকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বেলায়া জেবকভ-এ চলে গেছে, সেখানে একটা রেজিমেন্ট গড়া হচ্ছে। এখন তারা চেষ্টাচরিত্র করে ছেলেটিকে আমার রেজিমেন্টে বদলি করিয়েছে, আশা করছে, যে কোনো সময় সে এসে পড়বে। কাউন্ট অনেক আগেই চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলে না ফেরা পর্যন্ত কাউন্টেস কিছুতেই মস্কো ছেড়ে যাবেন না।

গত পরশু আরখারভদের বাড়িতে তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। নাতালি সুস্থ হয়ে উঠেছে, মুখও অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। একটা গানও গাইল। কত সহজেই মানুষ সবকিছু ভুলে যেতে পারে!

কি আবার ভুলে গেল? অসন্তুষ্ট চোখে পিয়ের শুধাল।

 জুলি হাসল।

কি জানেন কাউন্ট, আপনার মতো নাইটদের শুধু মাদাম দ্য সুজার উপন্যাসেই পাওয়া যায়।

কোন ধরনের নাইট? আপনি কি বলতে চাইছেন? সলজ্জ ভঙ্গিতে পিয়ের শুধাল।

 ঠিক আছে কাউন্ট, ঠিক আছে। আপনি তো সবই জানেন!

আমি কিছু জানি না, পিয়ের বলল।

আমি জানি নাতালির সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব ছিল, আর তাই…কিন্তু আমার বন্ধুত্ব ছিল ভেরার সঙ্গে-আদরের ভেরা।

অসন্তোষভরা গলায় পিয়ের বলতে লাগল, না মাদাম, নাতালি রস্তভার নাইটের ভূমিকা আমি কখনো গ্রহণ করিনি, আর প্রায় এক মাস তাদের বাড়িতেও যাইনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না এই নিষ্ঠুরতা…

কৈফিয়ৎ দেওয়া মানেই দোষ স্বীকার করা। জুলি হাত নেড়ে হেসে বলল। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে শেষ কথাটি বলল, আর আজ কি শুনে এসেছি জানেন? বেচারি মারি বলকনস্কায়া গতকাল মস্কো এসেছেন। আপনি কি জানেন তিনি বাবাকে হারিয়েছেন?

সত্যি? তিনি কোথায় আছেন? তার সঙ্গে একবার অবশ্য দেখা করতে হবে, পিয়ের বলল।

গতকাল সন্ধ্যাবেলাটা তার সঙ্গেই কাটিয়েছি। আজ বা কাল সকালেই ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারিতে যাবেন।

আচ্ছা, তিনি কেমন আছেন? পিয়ের শুধাল।

ভালোই আছেন, তবে মন খারাপ। কিন্তু জানেন কি কে তাকে উদ্ধার করেছে। সে এক রোমান্টিক ব্যাপার। নিকলাস রস্তভ। সকলে তাকে ঘিরে ধরেছিল, খুনই করে ফেলত, তার কিছু লোক আহতও হয়েছে। নিকলাস রস্তভ ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছে।…

বেসরকারি অফিসারটি বলল, আবার একটা রোমাঞ্চ। সত্যি, এই সঠিক পলায়নের সুযোগ সব বয়স্ক কুমারীদেরই বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে কাতিচে, আর ওদিকে প্রিন্সেস বলকনস্কায়া।

আপনি কি জানেন, আমার কিন্তু বিশ্বাস তিনি এই যুবকের কিঞ্চিৎ প্রেমে পড়েছেন?

আবার ফরাসি ভাষা? জরিমানা দিন!

কিন্তু একথা কি রুশ ভাষায় বলা যায়?

.

অধ্যায়-১৮

পিয়ের বাড়ি ফিরলেই সেদিনের আনা রস্তপচিনের দুখানা ইস্তাহার তার হাতে দেওয়া হল।

প্রথম ইস্তাহারে বলা হয়েছে, কাউন্ট রস্তপচিন জনসাধারণকে মস্কো ত্যাগ করতে নিষেধ করেছে বলে যে খবর রটেছে সেটা মিথ্যা, বরং মহিলারা ও ব্যবসায়ীদের স্ত্রীরা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ায় সে খুশিই হয়েছে। ইস্তাহারে বলা হয়েছে, এবার ত্রাস কমে যাবে, গুজবও কম ছড়াবে, কিন্তু আমার জীবনটাকে পণ রেখে বলছি, সেই শয়তান কোনোদিনই মস্কোতে প্রবেশ করতে পারবে না। এই কথাগুলি থেকেই পিয়ের সর্বপ্রথম পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল যে ফরাসিরা মস্কোতে ঢুকবে। দ্বিতীয় ইস্তাহারে বলা হয়েছে, আমাদের প্রধান ঘাঁটি ভিয়াজমাতে সরিয়ে আনা হয়েছে, কাউন্ট উইগেনস্তিন ফরাসিদের হটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু মস্কোর অনেক বাসিন্দাই অসিজ্জত হতে ইচ্ছুক, তাই রাজকীয় অস্ত্রাগারে তাদের জন্য সবরকম অস্ত্র-শস্ত্র মজুত রাখা হয়েছে : তলোয়ার, পিস্তল, বন্দুক সবই কম দামে পাওয়া যাবে। পিয়ের দুটো ইস্তাহার নিয়েই কিছুক্ষণ ভাবল। যে ভয়ংকর ঝড়ো মেঘকে সে সর্বান্তঃকরণে কামনা করছিল সেটা আসন্ন হয়ে উঠেছে।

আমি কি সেনাদলে চাকরি নেব, না অপেক্ষা করব? শততম বারের জন্য সে নিজেকে প্রশ্নটা করল। টেবিলের উপর থেকে তাসের প্যাকেটটা নিয়ে পেশেন্স খেলার আয়োজন করল।

তাসগুলো বেটে হাতে নিয়ে মাথাটা তুলে ভাবল, পেশেন্স খেলাটা যদি মিলে যায় তাহলে বুঝব…কি বুঝব?

এ প্রশ্নের কোনো মীমাংসা করার আগেই বড় প্রিন্সেস দরোজায় দাঁড়িয়ে জানতে চাইল, সে ঘরে ঢুকতে পারে কি না।

তাহলে বুঝব যে আমাকে সেনাদলে যেতেই হবে, নিজের মনে কথাটা বলে সে প্রিন্সেসের উদ্দেশ্যে বলল, এস, এস।

একমাত্র বড় প্রিন্সেসই এখনো পিয়েরের বাড়িতে বাস করছে। উত্তেজিত গলায় সে বলল, তোমার কাছে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। তুমি তো জান, একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। কি ঘটবে কে জানে? সকলেই মস্কো ছেড়ে চলে গেছে। লোকজনরা দাঙ্গা শুরু করেছে। অথচ আমরা এখনো এখানেই বসে আছি কেন?

ঈষৎ ঠাট্টার সুরে পিয়ের বলল, বরং সবকিছু তো ভালোই মনে হচ্ছে দিদি।

ভালোই বটে! খুব ভালো। আমাদের সৈন্যরা যা খেল দেখাচ্ছে সেকথা বারবারা আইভানভনা আজই আমাকে বলেছে। এসবই নিশ্চয় তাদের কৃতিত্বের পরিচায়ক। এদিকে লোকজনরা তো বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে-কেউ কথা শুনছে না, আমার দাসীটি পর্যন্ত রুক্ষ ব্যবহার শুরু করেছে। এরকম চলতে থাকলে অচিরেই তারা আমাদের মার লাগাতে শুরু করবে। রাস্তায় পর্যন্ত বের হওয়া যাচ্ছে না। সবচাইতে বড় কথা, ফরাসিরা যে কোনোদিন এখানে এসে হাজির হবে, তাহলে আমরা এখানে অপেক্ষা করে আছি কিসের জন্য? তোমার কাছে আমার একটিই অনুরোধ ভাই, আমার পিতার্সবুর্গ যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি যেই হই না কেন, বোনাপার্তের শাসনাধীনে বাঁচতে চাই না।

আহা, আমার কথাটাই শোন দিদি। এসব খবর তুমি কোথায় পেলে? বরং…।

নেপোলিয়নের বশ্যতা আমি স্বীকার করব না! অন্যরা যা খুশি করুক…তুমি যদি ব্যবস্থা করে দিতে না চাও…

ব্যবস্থা অবশ্যই করব, এই মুহূর্তে হুকুম দিচ্ছি।

রাগ দেখাবার মতো কাউকে না পাওয়াই যেন প্রিন্সেসের রাগের কারণ। নিজের মনে বিড় বিড় করতে করতে সে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

পিয়ের বলতে লাগল, কিন্তু তুমি ভুল খবর পেয়েছ। শহর এখন খুব শান্ত, তিলমাত্র বিপদ কোথাও নেই। শোন! এইমাত্র পড়ছিলাম… সে ইস্তাহারটা দেখাল। কাউন্ট রস্তপচিন লিখেছেন, শত্রু যাতে মস্কোতে ঢুকতে না পারে সেজন্য তার জীবনটাই তিনি পণ রাখছেন।

প্রিন্সেস বিদ্বেষভরা গলায় বলল, ওঃ, তোমাদের সেই কাউন্ট তো! সে তো একটা ভণ্ড, সেই তো লোকদের দিয়ে দাঙ্গা বাধিয়েছে। এইসব বাজে ইস্তাহারে সে কি একথা লেখেনি যে সে যেই হোক চুলের মুঠি ধরে তাকে হাজতে নিয়ে যেতে হবে? (কী বোকার মতো কথা!) আর তাকে যে গ্রেপ্তার করবে তাকে দেওয়া হবে সম্মান ও গৌরব। তার চাটুবাদই তো আমাদের এত নিচে টেনে নামিয়েছে। বারবারা আইভানভনা আমাকে বলেছে, সে ফরাসিতে কিছু বলেছিল বলে উখল জনতা তাকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল।

ওঃ, কিন্তু অবস্থা তো…তুমি সবকিছুতেই এত ভেঙে পড়, এই কথা বলে পিয়ের পেশেন্স খেলায় মন দিল।

খেলাটা না মিললেও পিয়ের সেনাদলে যোগ দিতে গেল না, সেই একই উত্তেজিত, অস্থিরচিত্ত, শঙ্কিত মনেই জনবিরল পরিত্যক্ত মস্কোতে রয়ে গেল, একটা ভয়ংকর কিছুর সানন্দ প্রতীক্ষায় দিন কাটাতে লাগল।

পরদিন সন্ধ্যায় প্রিন্সেস রওনা হয়ে গেল। বড় নায়েব এসে খবর দিল, একটা জমিদারি না বেচলে তার রেজিমেন্টের সাজ-সরঞ্জাম কেনার পয়সা জুটবে না। সে পরিষ্কার করেই জানিয়ে দিল যে একটা রেজিমেন্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনাই তার সর্বনাশ ডেকে আনবে। পিয়ের কান পেতে শুনল, তবু ঠোঁটের হাসিটা চাপতে পারল না।

বলল, বেশ তো, বেচে দিন। কি আর করা যাবে? এখন তো আর কথা ফেরানো চলে না!

অবস্থা যত খারাপ হতে লাগল, বিশেষ করে তার নিজের অবস্থা, পিয়ের যেন ততই খুশি হয়ে উঠল : ততই সে যেন নিশ্চিত হল যে তার প্রত্যাশিত বিপদটি আসন্ন হয়ে উঠেছে। তার পরিচিত কেউই শহরে নেই। জুলি চলে গেছে, প্রিন্সেস মারিও। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে আছে শুধু রস্তভরা, কিন্তু সে তাদের সঙ্গে দেখা করতেও যায় না।

মনকে অন্যদিকে সরিয়ে নেবার জন্য একদিন সে ভরশোভো গ্রামে গেল, শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য সেখানে লেপপিচ নামক যে বড় বেলুনটা তৈরি হচ্ছে সেটা দেখতে এবং পরদিন যে পরীক্ষামূলক ওড়ানো হবে সেটাও দেখতে। বেলুন তৈরি এখনো শেষ হয়নি, পিয়ের শুনল যে সম্রাটের ইচ্ছানুসারেই সেটা তৈরি হচ্ছে। সম্রাট কাউন্ট রস্তপচিনকে লিখেছে :

লেপপিচ প্রস্তুত হওয়া মাত্রই তার গাড়ির জন্য একদল নির্ভরযোগ্য বুদ্ধিমান লোক যোগাড় করবেন এবং জেনারেল কুতুজভকে খবরটা জানাতে একজন সংবাদবাহককে তার কাছে পাঠাবেন। আমি তাকে ব্যাপারটা জানিয়েছি।

লেপপিচ প্রথম কোথায় অবতরণ করবে সে বিষয়ে যেন সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়, সেটা যেন ভুল করে শত্রুর হাতে না পড়ে। প্রধান সেনাপতির গতিবিধির সঙ্গে তার গতিবিধির মিল থাকা একান্ত দরকার।

ভরন্তশোভো থেকে বাড়ি ফিরবার পথে বলোত্মপ্লেসের পাশ দিয়ে যাবার সময় পিয়ের দেখল লোবনু প্লেসে (মস্কোর মৃত্যুদণ্ড দেবার জায়গা, সেকালে জায়গাটি ছিল ক্রেমলিনের সম্মুখবর্তী রেড স্কোয়ারে। অনেক লোকের ভিড় জমেছে। সে গাড়ি থামিয়ে সেখানেই নেমে পড়ল। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে একজন রাঁধুনিকে চাবুক মারা হচ্ছে। দণ্ডদান শেষ করে জল্লাদ সেই শক্ত-সমর্থ লোকটির বাঁধন খুলে দিচ্ছে। লোকটির মুখে লাল গোঁফ, পরনে নীল মোজা ও সবুজ কুর্তা। সে করুণ স্বরে আর্তনাদ করছে। শুকনো, বিবর্ণ অপর অপরাধী কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখেই বোঝা যায়, দুইজনই ফরাসি।

শুটকো ফরাসি লোকটির মুখের মতো ভয়ার্ত, যন্ত্রণাদীর্ণ ভাব ফুটে উঠল পিয়েরের মুখে। ভিড় ঠেলে অগ্রসর হতে হতে সে প্রশ্ন করতে লাগল : কি হয়েছে? লোকটি কে? কেন এই শাস্তি?

ভিড়ের মধ্যে সমবেত ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সকল ধরনের মানুষই তখন লোবনু প্লেস-এর কার্যকলাপ দেখতে এতই ব্যস্ত যে কেউ তার প্রশ্নের জবাব দিল না। শক্ত-সমর্থ লোকটি উঠে দাঁড়াল, ভুরু কুঁচকাল, কোনোদিকে না তাকিয়ে গায়ের কুর্তাটা খুলতে লাগল, তার পরেই হঠাৎ তার ঠোঁট দুটি কাঁপতে লাগল, সে কাঁদতে শুরু করল। ভিড়ের মানুষরা এতক্ষণে গলা ছেড়ে কথা বলতে লাগল, পিয়েরের মনে হল, নিজেদের করুণার অনুভূতিকে চাপা দেবার জন্যই তারা এমন করছে।

লোকটা কোনো প্রিন্সের রাঁধুনি।

আর সিয়, রুশ সজি ফরাসিদের জিভে টকই লাগে।…একেবারে দাঁতে দাঁত লেগে গেছে! পিছন থেকে একজন করণিক বলে উঠল।

তার কথা শুনে কেউ কেউ হাসল, কেউবা জল্লাদের দিকেই তাকিয়ে থাকল।

পিয়েরের গলা বন্ধ হয়ে আসছে, মুখ কুঁচকে গেছে, তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে গাড়িতে চাপল। যেতে যেতেই তার শরীর শিউরে উঠতে লাগল, আপন মনেই বারকয়েক এত জোরে কথা বলল যে কোচয়ান জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলছেন হুজুর?

কোচয়ানকে লুবিয়াংকা স্ট্রিট ধরে গাড়ি চালাতে দেখে পিয়ের চিৎকার করে বলল, কোথায় চলেছ?

আপনার হুকুম মতো শাসনকর্তার বাড়িতে, কোচয়ান বলল।

মূর্খ! নির্বোধ! পিয়ের চিৎকার করে কোচয়ানকে বকুনি দিল-একাজটা সে কদাচিৎ করে থাকে। তোমাকে তো বলেছি বাড়ি যেতে! আরো জোরে চালাও, মাথামোটা কোথাকার! নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, আজই আমি চলে যাব।

লোব প্লেসে নির্যাতিত ফরাসিটিকে ও ভিড়ের লোকগুলিকে দেখে পিয়ের এতই স্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে আর একদণ্ডও এখানে থাকবে না। সেইদিনই সেনাদলে যোগ দিতে যাত্রা করবে, যেন তার মনে হল হয় সে নিজেই কোচয়ানকে সেকথা বলেছে, অথবা নিজের থেকেই সেটা বুঝতে পারা কোচয়ানের উচিত ছিল।

বাড়ি পৌঁছেই পিয়ের বড় কোচয়ান এভস্তাফেকে হুকুম করল, সেই রাতেই সে মোঝায়েস্কে সেনাদলে যোগ দিতে যাত্রা করবে, কাজেই তার ঘোড়াগুলোকে যেন সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভস্তাফে যখন জানাল যে একটা দিনের মধ্যে এতসব ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, তখন সে বাধ্য হয়ে পরের দিন পর্যন্ত যাত্রা স্থগিত রাখল।

একটানা বৃষ্টির পরে ২৪ তারিখে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। ডিনারের পরে পিয়ের মস্কো ত্যাগ করল। সেদিন রাতে পেশকভোতে ঘোড়া বদল করবার সময় সে জানতে পারল, সেদিন সন্ধ্যায়ই সেখানে একটা বড় রকমের যুদ্ধ হয়ে গেছে। (এটাই শেভার্দিনোর যুদ্ধ।) তাকে বলা হল, গোলাবর্ষণের ফলে পেশকভোর মাটি কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু যুদ্ধে কে জিতেছে এ-প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারল না। পরদিন ভোরেই পিয়ের মোঝায়েস্কের কাছে পৌঁছে গেল।

মোকায়েস্কের প্রতিটা বাড়িতেই সৈন্যরা আস্তানা পেতেছে, যে হোস্টেলে তার সহিস ও কোচয়ানের সঙ্গে পিয়েরের দেখা হল সেখানে একটা ঘরও পাওয়া গেল না। সব ঘরই অফিসারে ভর্তি।

মোঝায়েঙ্কে এবং তাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত সৈন্যরা হয় আস্তানা পেতেছে, নয়তো চলাচল করছে। সর্বত্র চোখে পড়ছে পদাতিক ও অশ্বারোহী কসাক, মালগাড়ি, বারুদের গাড়ি আর কামান। পিয়ের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে চলল, মস্কো যত দূরে সরে যেতে লাগল ততই সে যেন ডুবে যেতে লাগল সেনা সমুদ্রে, আর ততই এমন একটা অশান্ত উত্তেজনা ও সানন্দ অনুভূতি তার মনে জাগতে লাগল যার অভিজ্ঞতা আগে কখনো তার হয়নি। সম্রাটের পরিদর্শনকালে বোদা প্রাসাদে যে অনুভূতি তার হয়েছিল এখনকার অনুভূতি ঠিক তারই অনুরূপ কোনো কিছু করার এবং কোনো কিছু ত্যাগ করার অনিবার্য প্রয়োজনের অনুভূতি। তার মনে এই সানন্দ চেতনা জাগল যে মানুষের সুখের যত কিছু উপকরণ-জীবনের আরাম, অর্থ, এমন কি জীবনটা পর্যন্ত–সবই তুচ্ছ, এমন কিছু আছে যার তুলনায় এসব কিছু ছুঁড়ে ফেলাও আনন্দের…কিন্তু সেটা কি? সেকথা পিয়ের বলতে পারল না, কার জন্য এবং কিসের জন্য সবকিছু ত্যাগ করাতে এই আনন্দ সেটা বুঝতেও সে চেষ্টা করল না। কিসের জন্য এই ত্যাগ স্বীকার সে প্রশ্ন তার মনেই এল না, ত্যাগটাই তাকে এনে দিল সম্পূর্ণ নতুন এক আনন্দময় অনুভূতি।

.

অধ্যায়১৯

২৪ আগস্ট হল শেভার্দিনো দুর্গের যুদ্ধ, ২৫ তারিখে কোনো পক্ষ থেকেই একটিও গুলিবর্ষণ করা হল না, আর ২৬ তারিখে হল বরদিনোর যুদ্ধ।

শেভার্দিনো আর বরদিনোতে কেন যুদ্ধ করা হল, আর কেমন করেই বা সেটা ঘটল? বরদিনের যুদ্ধটাই বা হল কেন? ফরাসি বা রুশ কারো দিক থেকেই এ যুদ্ধের কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না। রুশদের পক্ষে এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল হল–আর সেটাই হতে বাধ্য-মস্কো ধ্বংস হওয়ার আরো কাছাকাছি আমরা এসে পড়লাম, অথচ পৃথিবীতে সেটাকেই আমরা ভয় করেছি সবচাইতে বেশি, আবার ফরাসিদের পক্ষে এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফল হল, তাদের গোটা বাহিনীর ধ্বংসের আরো কাছাকাছি তারা এসে পড়ল–অথচ পৃথিবীতে সেটাকেই তারাও ভয় করেছে সবচাইতে বেশি। ফল যে কি হবে তা জানাই ছিল, তবু নেপোলিয়ন সে যুদ্ধে এগিয়ে এল, আর কুতুজভ সে যুদ্ধের আহ্বানকে গ্রহণ করল।

দুই সেনাপতি যদি মুক্তির দ্বারা পরিচালিত হত তাহলে নেপোলিয়নের পরিষ্কার বোঝা উচিত ছিল যে তেরোশো মাইল ভিতরে ঢুকে মোট সৈন্যের এক-চতুর্থাংশকে হারাবার সম্ভাবনা নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে চলেছে, আবার কুতুজভেরও সমান পরিষ্কারভাবে বোঝা উচিত ছিল যে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এক-চতুর্থাংশ সৈন্য হারাবার ঝুঁকি নিলে সেও নিশ্চিতভাবেই মঙ্কোকে হারাবে। কুতুজভের কাছে এটা তো গাণিতিক হিসেবের মতোই পরিষ্কার, যেমন ড্রাফটস খেলায় (একরকম দাবা খেলা) আমার যদি একটা খুঁটি কম থাকে এবং তারপরেও আমি যদি ক্রমাগত খুঁটি পাল্টা-পাল্টি করি তাহলে শেষ পর্যন্ত আমার হার হবেই, আর তাই পাল্টা-পাল্টি করা আমার পক্ষে উচিত নয়। যখন প্রতিপক্ষের আছে মোলোটি খুঁটি আর আমার আছে চৌদ্দটি, তখন তার তুলনায় আমার দুর্বলতা আট ভাগের এক ভাগ, কিন্তু আমি যদি আরো তেরোটি খুঁটি বদল করি, তাহলে সে হবে আমার চাইতে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী।

বরদিনো যুদ্ধের আগে ফরাসিদের তুলনায় আমাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল মোটামুটি ছয়জনে পাঁচজন, কিন্তু ঐ যুদ্ধের পরে সেটা দাঁড়াল দুজনে একজন : অর্থাৎ যুদ্ধের আগে আমাদের সৈন্য ছিল একশ বিশ হাজারের বিরুদ্ধে একশো হাজার এবং যুদ্ধের পরে সেটা দাঁড়াল একশ হাজারের বিরুদ্ধে পঞ্চাশ হাজার। তথাপি অভিজ্ঞ, ঝানু কুতুজভ সে যুদ্ধকে গ্রহণ করল, আর প্রতিভাদীপ্ত সেনাপতি বলে বর্ণিত নেপোলিয়ন সেই যুদ্ধ করে হারাল এক-চতুর্থাংশ সৈন্য এবং তার যোগাযোগ ব্যবস্থা হল আরো অনেক বেশি দীর্ঘ। বলা হয়ে থাকে, ভিয়েনা দখল করেই যেভাবে আগেকার অভিযানে ইতি টানা হয়েছিল, ঠিক সেইভাবে মস্কো দখল করেই এ অভিযানকে শেষ করার ইচ্ছাই নেপোলিয়নের ছিল। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ অন্য কথাই বলে। নেপোলিয়নের ইতিহাসকাররা নিজেরাই বলেছে, স্মোলেনস্ক পার হবার পর থেকেই নেপোলিয়ন থামতে চেয়েছে, যুদ্ধের পরিধি ব্যাপকতর করার বিপদ সম্পর্কে সে অবহিত ছিল, সে জানত যে মস্কো দখল করলেই অভিযান শেষ হবে না, কারণ স্মোলেনস্ক-এর বেলায়ই তো দেখেছে কীভাবে রুশ শহরগুলিকে তার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, বারবার সন্ধির আলোচনার কথা ঘোষণা করা সত্ত্বেও রুশদের পক্ষ থেকে কোনোরকম সাড়া পাওয়া যায়নি।

 বরদিনোতে যুদ্ধের প্রস্তাব করা এবং সে প্রস্তাবকে গ্রহণ করা–উভয় ক্ষেত্রেই কুতুজভ কাজ করেছে সম্পূর্ণ ইচ্ছাশক্তিরহিতভাবে, যুক্তিবিবর্জিতভাবে। কিন্তু পরবর্তীকালে ইতিহাসকাররা ঘটনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সুকৌশলে সেনাপতিদের দূরদৃষ্টি ও প্রতিভার স্বপক্ষে নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেছে, অথচ ইতিহাসের হাতে অন্যসব অন্ধ যন্ত্রের মতোই তারাও ছিল অতিমাত্রায় শৃঙ্খলিত ও ইচ্ছাশক্তিরহিত।

প্রাচীনকালের মানুষরা আমাদের জন্য এমন অনেক বীরত্বব্যঞ্জক আদর্শ কাব্য-কাহিনী রেখে গেছে যেখানে নায়করাই কাহিনীর মূল কেন্দ্র, আর আমরাও আজ পর্যন্ত এ সত্যকে মেনে নিতে পারিনি যে আমাদের যুগে সে ধরনের ইতিহাস সম্পূর্ণ অর্থহীন।

অন্যদিকে, বরদিনোর যুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী শেভার্দিনোর যুদ্ধ কীভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা আছে তা সুস্পষ্ট ও সুপরিচিত হলেও সম্পূর্ণ মিথ্যা। সব ইতিহাসকারই সে ঘটনার নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছে :

রুশ বাহিনী মোলেনস্ক থেকে পশ্চাদপসরণের পথে যুদ্ধের পক্ষে সবচাইতে উপযুক্ত একটা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে সেটা পেয়ে গেল বরদিনোতে।

মস্কো থেকে স্মালেনস্ক যাবার বড় রাস্তার বাঁ দিকে এবং তার সঙ্গে সমকোণে অবস্থিত বরদিনো থেকে উতিৎসা যাবার পথের পাশে ঠিক সেই জায়গাটাকে আগে থেকেই সুরক্ষিত করে রাখল যেখানে পরে যুদ্ধটা হয়েছিল।

সেই ঘাঁটির ঠিক সামনে শত্রুপক্ষের উপর নজর রাখবার জন্য শেভার্দিনো স্তূপের উপর একটা সুরক্ষিত ফাঁড়ি গড়ে তোলা হল। ২৪ তারিখে নেপোলিয়ন সেই অগ্রবর্তী ঘাঁটিটাকে আক্রমণ করে দখল করে নিল এবং ২৬ তারিখে বরদিনো রণক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষারত গোটা রুশ বাহিনীকেই আক্রমণ করল।

ইতিহাস এই কথাই বলে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল, আর প্রকৃত সত্য জানতে আগ্রহী যে কোনো লোক সহজেই সেটা বুঝতে পারে।

রুশরা কোনো ভালো ঘাঁটিরই খোঁজ করেনি, বরং পশ্চাদপসরণের পথে বরদিনোর চাইতে অনেক ভালো ভালো জায়গা পার হয়ে গিয়েছিল। তারা যে সেসব কোনো জায়গাতেই থামেনি তার অনেকগুলি কারণ : নিজের পছন্দ ছাড়া অন্য কোথাও ঘাঁটি তৈরির ইচ্ছা কুতুজভের ছিল না, জনসাধারণের যুদ্ধের দাবি তখনো যথেষ্ট জোরদার হয়ে প্রকাশ পায়নি, মিলোবাদভিচ তখনো অসামরিক বাহিনী নিয়ে এসে হাজির হয়নি, এরকম আরো অনেক কারণ ছিল। আসলে বরদিনোর ঘাঁটি (যেখানে যুদ্ধটা হয়েছিল) সুরক্ষিত তো ছিলই না, বরং তাকে একটা ঘাটিই বলা যায়নি, রুশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রের বুকে বিনা ভাবনা-চিন্তায় যেখানে একটা পিন ফুটিয়ে দেওয়া যায় সেই স্থানটিকেই ঘাঁটি হিসেবে বারদিনোর চাইতে ভালো বলা যেতে পারে।

বরদিনোর রণক্ষেত্রে রুশরা যে কোনোরকম শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেনি তাই শুধু নয়, ১৮১২-র ২৫ আগস্টের আগে তারা ভাবেইনি যে সেখানে একটা যুদ্ধ হতে পারে। নানা ঘটনা থেকেই এটা বোঝা যায়। প্রথমত, ২৫ তারিখের আগে সেখানে কোনো পরিখাই কাটা হয়নি, আর ২৫ তারিখে যেসব পরিখা কাটা শুরু করা হয়েছিল তাও শেষ করা হয়নি, দ্বিতীয়ত, শেভার্দিনো দুর্গের অবস্থান। যে স্থানটা যুদ্ধের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তার ঠিক সামনে ওরকম একটা দুর্গ গড়া একেবারেই অর্থহীন। অন্য সব ঘাঁটি থেকে সেটাকেই বা বেশি শক্তিশালী করা হয়েছিল কেন? ২৪ তারিখ গভীর রাত পর্যন্ত সেটাকে রক্ষা করতে গিয়ে কেন সব শক্তি নিঃশেষ করা হল? কেনই বা ছ হাজার সৈন্যকে বিসর্জন দেওয়া হল? শত্রুর উপর নজর রাখার জন্য একটা কক রক্ষীদলই তো যথেষ্ট ছিল। তৃতীয়ত, যুদ্ধটা কোথায় হবে সেটা যে আগে থেকে জানা ছিল না এবং শেভার্দিনো দুৰ্গটা যে অগ্রবর্তী ঘাঁটি ছিল না তার প্রমাণস্বরূপ আমরা জানি যে ২৫ তারিখ পর্যন্ত বার্কলে দ্য তলি এবং ব্যাগ্রেশনের ধারণা ছিল যে শেভার্দিনো দুর্গ ছিল সেই ঘাঁটির বাম ব্যুহ, আর যুদ্ধের পরে তাড়াতাড়িতে লিখিত প্রতিবেদনে কুতুজভ নিজেই বলেছে যে শেভার্দিনো দুর্গ ছিল ঘাঁটির বাম ব্যুহ। অনেককাল পরে যখন ধীরে সুস্থে অবসর সময়ে বরদিনো যুদ্ধের প্রতিবেদন লিখিত হল তখন (সম্ভবত অভ্রান্ত প্রধান সেনাপতির ভুল-ভ্রান্তিগুলিকে সমর্থন করার জন্যই) এই মর্মে অসত্য ও অসাধারণ বিবৃতিগুলি আবিষ্কার করা হল যে শেভার্দিনো দুর্গ ছিল একটা অগ্রবর্তী রণক্ষেত্রে, অথচ আসলে যুদ্ধটা হয়েছিল এমন একটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত জায়গায় যেখানে কোনোরকম পরিখাই ছিল না।

আসলে ব্যাপারটা ঘটেছিল এই রকম : কলোচা নদী সেখানে বড় রাস্তাটাকে কেটে বেরিয়েছে সমকোণে নয়, একটা সূক্ষ্ম কোণ সৃষ্টি করে–সেখানে কলোচা নদীর তীর বরাবর একটা জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল, ফলে ঘাঁটির বাম ব্যুহ ছিল শেভার্দিনোতে, দক্ষিণ ব্যুহ ছিল নভু নামক একটা গ্রামের কাছে, আর কেন্দ্র ছিল কলোচা ও ভয়না-নদীর সঙ্গমস্থলে বরদিনোতে।

২৪ তারিখে অশ্বারোহণে ভালুভো-র দিকে যেতে যেতে উতিসা থেকে বরদিনো পর্যন্ত কোথাও রুশদের কোনো ঘাঁটি নেপোলিয়নের চোখে পড়েনি (ইতিহাসের বইতে অবশ্য লেখা হয়েছে যে নেপোলিয়ন তা দেখেছিল), বা কোনো অগ্রবর্তী ঘাটিও সে দেখেনি (দেখা সম্ভব নয় কারণ তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না), কিন্তু পশ্চাত্বর্তী রুশ বাহিনীকে অনুসরণ করে নেপোলিয়ন শেভার্দিনো দুর্গে রুশ ঘাঁটির বাম ব্যূহের সামনে। এসে পড়ে এবং রুশদের পক্ষে একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে কলোচা নদীর তীর বরাবর সৈন্যদের পরিচালিত করে। এদিকে একটা যুদ্ধ শুরু করবার মতো সময় হাতে না থাকায় রুশরা তাদের বাম ব্যুহটাকে সরিয়ে নিয়ে এমন একটা জায়গায় ঘাটি করল যেটা আগে ভাবাই হয়নি এবং ফলে যেখানে কোনোরকম রক্ষা-ব্যবস্থাই ছিল না। কলোচা নদী পার হয়ে বড় রাস্তার বাঁ দিকে পৌঁছে নেপোলিয়ন আসন্ন যুদ্ধটাকেই ডান দিক থেকে বাঁ দিকে (রুশদের দৃষ্টিকোণ থেকে) সরিয়ে উতিৎসা, সেমেনভঙ্ক ও বরদিনোর মধ্যবর্তী এমন একটা প্রান্তরে নিয়ে গেল-রণক্ষেত্র হিসেবে যেটা রাশিয়ার অন্য যে কোনো প্রান্তরের চাইতে সুবিধাজনক কিছু নয়-এবং সেখানেই ২৬ তারিখের পুরো যুদ্ধটা হল। যে যুদ্ধের কথা ভাবা হয়েছিল এবং বাস্তবক্ষেত্রে যেখানে যুদ্ধটা হয়েছিল তার একটা রেখা-চিত্র সংযোজিত হল।

নেপোলিয়ন যদি ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় অশ্বারোহণে কলোচা নদীতীরে না পৌঁছত এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুর্গ আক্রমণের নির্দেশ না দিত, তাহলে হয়তো আমাদের পরিকল্পনা মতোই যুদ্ধটা হত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাদ্বর্তী বাহিনীর পশ্চাদপসরণের পরে সেই সন্ধ্যায়ই আমাদের বাম ব্যূহের উপর আক্রমণ হওয়ায় এবং ২৪ তারিখ সন্ধ্যায়ই একটা যুদ্ধে লিপ্ত হবার মতো বাসনা বা সময় কোনোটাই রুশ সেনাপতিদের না থাকায় ২৪ তারিখেই বরদিনোর যুদ্ধের প্রথম ও প্রধান সংঘর্ষে আমাদের হার হল এবং স্বভাবতই ২৬ তারিখের যুদ্ধেরও সেই একই ফল হল।

শেভার্দিনো দুর্গ হাতছাড়া হবার পরে ২৫ তারিখ সকালে আমাদের বাম ব্যূহের কোনো ঘাঁটি না থাকায় সেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে যে কোনো একটা স্থানে পরিখা কেটে তাড়াতাড়ি সেখানে ঘাঁটি বানানো হল।

২৬ তারিখে রুশ বাহিনী যে অসম্পূর্ণ ও দুর্বল একটা পরিখা দ্বারা রক্ষিত ছিল তাই শুধু নয়, আমাদের সৈন্যদের আরো অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল রুশ সেনাপতিদের অজ্ঞতার জন্য আমাদের বাম ব্যূহের ঘাঁটি যে হাতছাড়া হয়ে গেছে এবং আসন্ন যুদ্ধের গোটা রণক্ষেত্রই যে ডান থেকে বাঁ দিকে স্থানান্তরিত হয়েছে সেটা পুরোপুরি বুঝতে না পারায় তারা নোভু থেকে উতিৎসা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ঘাঁটিটাই রক্ষা করতে চেষ্টা করল এবং তার ফলে যুদ্ধ চলার সময়েই তাদের সৈন্যদের ডান থেকে বাঁ দিকে সরিয়ে নিতে হল। ফল এই দাঁড়াল যে যুদ্ধের সময়ে আগাগোড়াই রুশ বাহিনীকে গোটা ফরাসি বাহিনীর মোকাবিলা করতে হল মাত্র অর্ধেক সৈন্য নিয়ে। কাজেই বরদিনোর যুদ্ধের যে বিবরণ আমরা পাই আসলে যুদ্ধটা মোটেই সেভাবে হয়নি। কাজেই কোনো পূর্ব-নির্বাচিত পরিখা-বেষ্টিত রণক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের তুলনায় সামান্য দুর্বল সৈন্যশক্তি নিয়ে আমরা বরদিনোর যুদ্ধে লড়াই করিনি, শেভার্দিনো দুর্গ হারাবার ফলে রাশিয়াকে সে যুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে ফরাসি সৈন্যসংখ্যার অর্ধেক সৈন্য নিয়ে প্রায়-পরিখাবিহীন একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে, অর্থাৎ লড়াই হয়েছিল এমন পরিস্থিতিতে যাতে দশ ঘণ্টা লড়াই চালানো এবং ফলাফলকে অমীমাংসিত রাখাটা যে অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার তাই শুধু নয়, তিন ঘণ্টার জন্যও একটি সেনাদলকে সম্পূর্ণ বিপর্যয় ও পলায়নের হাত থেকে রক্ষা করাটাও অচিন্ত্যনীয়।

.

অধ্যায়-২০

২৫ সকালে পিয়ের মোঝায়েস্ক থেকে যাত্রা করল। খাড়া পাহাড়টার উত্রাইয়ের মুখে একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা যেখানে গির্জাটাকে ডাইনে রেখে শহর থেকে বাইরের দিকে চলে গেছে সেখানে তখন গির্জায় প্রার্থনা চলছে, ঘণ্টা বাজছে। গাড়ি থেকে নেমে পিয়ের পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল। তার পিছনে একটা অশ্বারোহী রেজিমেন্ট গায়কদের সামনে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসছে। আগের দিনের যুদ্ধে আহত সৈনিকদের নিয়ে একসার গাড়ি তার দিকেই উঠে আসছে। চাষীরা হৈ-হৈ করতে করতে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কসিয়ে রাস্তা পারাপার করছে। প্রতিটি গাড়িতে তিন বা চারজন আহত সৈনিক শুয়ে-বসে আছে। খাড়া উত্রাইয়ের উপর পাথর বিছিয়ে রাস্তার মতো যা তৈরি করা হয়েছে তাতে ঠোক্কর খেয়ে গাড়িগুলো টালমাটাল হয়ে চলেছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে ব্যান্ডেজ বাধা আহত সৈনিকদের গালগুলি বিবর্ণ, ঠোঁটে ঠোঁট চাপা, কুঁচকানো ভুরু দুটো একসঙ্গে জুড়ে আছে। পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি বাঁচাতে তারা গাড়ির পাশগুলো চেপে ধরে আছে। প্রায় সকলেই শিশুসুলভ সরল কৌতূহলে পিয়েরের শাদা টুপি ও সবুজ চাতক-লেজ কোটের দিকে তাকিয়ে দেখছে।

পিয়েরের কোচয়ান রেগে চিৎকার করে আহত সৈনিকদের গাড়িগুলোকে একদিকে সরে যেতে বলল। গায়কবৃন্দসহ অশ্বারোহী রেজিমেন্টটি নেমে এসে পিয়েরের গাড়িটাকে ঘিরে ধরল, রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেল। পিয়ের থামল। আহত সৈনিকদের একটা গাড়ি পিয়েরের ঠিক পাশেই থেমে গেল। বাকলের জুতো পরা গাড়োয়ানটি তখনো হাঁপাচ্ছে, টায়ারবিহীন পিছনের চাকার নিচে একটা পাথর বসিয়ে সে ছোট ঘোড়াটার পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

একটি আহত বৃদ্ধ সৈনিক ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাত নিয়ে গাড়ির পিছন পিছন হেঁটে আসছিল। ভালো হাতটা দিয়ে গাড়িটাকে ধরে সে পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

বলুন তো দেশের মানুষ, এরা কি আমাদের এখানে ছেড়ে দেবে, নাকি মস্কো নিয়ে যাবে? লোকটি শুধাল।

পিয়ের তখন এত বেশি চিন্তামগ্ন যে প্রশ্নটা শুনতে পেল না। সে একবার অশ্বারোহী রেজিমেন্টের দিকে তাকাচ্ছে, আবার পাশের গাড়িটাকে দেখছে। গাড়িতে দুটি আহত লোক বসে আছে ও অপর একজন শুয়ে আছে। যে দুইজন বসে আছে তাদের একজনের গালে আঘাত লেগেছে। মাথাটা ন্যাকড়ায় জড়ানো, আর গালটা ফুলে একটি শিশুর মাথার মতো হয়েছে। তার নাক ও মুখ একপাশে বেঁকে গেছে। সে গির্জার দিকে তাকিয়ে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকছে। অপরটি বয়সে তরুণ, শীর্ণ মুখখানি এত শাদা যে মনে হয় তাতে রক্তের রেশমাত্র নেই। সে হেসে পিয়েরের দিকে তাকাল। যে শুয়ে আছে তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। অশ্বারোহী গায়করা পাশ দিয়ে চলে গেল, হায় হারিয়ে গেলাম। একেবারেই হারিয়ে গেলাম…

মাথায় তীব্র ব্যথা,
যেন বিদেশে বাস করছি…
তারা সৈনিকদের নাচের গান গাইছে।

বুঝিবা সেই গানেরই প্রত্যুত্তরে মাথার উপরে ঘণ্টা বাজছে ধাতব শব্দ করে। সূর্যের আতপ্ত কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে উল্টো দিকের উত্রাইয়ের মাথায়।

গাল-ফোলা সৈনিকটি সক্রোধে অশ্বারোহী গায়কদের দিকে তাকাল। ঘৃণাভরে বিড়বিড় করে বলল, আঃ, ভাঁড়ের দল।

গাড়ির পিছনে দাঁড়ানো সৈনিকটি বিষণ্ণ হাসি হেসে পিয়েরকে উদ্দেশ্য করে বলল, শুধু সৈনিকরাই নয়, আজ আমি চাষীদেরও দেখেছি…চাষীরা-তাদেরও চলে যেতে হচ্ছে। আজকাল কোনো বাছ-বিচার নেই।…তারা চায় যে গোটা জাতি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড় ক, এককথায়, এই তো মঙ্কো! তারা এর অবসান ঘটাতে চায়।

সৈনিকটির কথার অস্পষ্টতা সত্ত্বেও সে যে কি বলতে চায় তা বুঝতে পেরে পিয়ের সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

রাস্তাটা আবার পরিষ্কার হয়েছে। পাহাড়ের নিচে নেমে পিয়ের ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

পরিচিত মুখের সন্ধানে সে পথেরই দুই দিক দেখতে দেখতে চলল। কিন্তু সর্বত্রই নানা বিভাগের সামরিক কর্মীদের মুখই তার নজরে পড়ল। তারা সকলেই সবিস্ময়ে তার শাদা টুপি ও লেজওয়ালা সবুজ কোটের দিকে তাকিয়ে দেখছে।

প্রায় তিন মাইল চলবার পরে একজন পরিচিত লোককে দেখে সাগ্রহে তাকে ডাকল। সমর-বিভাগের একজন বড় ডাক্তার। সে যাচ্ছে। একটা ঢাকা গাড়িতে, তার পাশে বসে আছে একটি যুবক সার্জন, পিয়েরকে চিনতে পেরে সে চালকের আসনে উপবিষ্ট কাককে গাড়ি থামাতে বলল।

ডাক্তার বলল, কাউন্ট! ইয়োর এক্সেলেন্সি, আপনি এখানে এলেন কেমন করে?

আরে, কি জানেন, আমি দেখতে চাই…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখবার মতো কিছু অবশ্যই পাবেন…

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পিয়ের কথাপ্রসঙ্গে ডাক্তারকে তার যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছার কথা জানাল।

ডাক্তার তাকে সরাসরি কুতুজভের কাছে আবেদন করার পরামর্শ দিল।

তরুণ সঙ্গীটির সঙ্গে দৃষ্টি-বিনিময় করে বলল, যুদ্ধের মধ্যে কেন যেখানে-সেখানে ছিটকে পড়বেন? আর যাই হোক, প্রশান্ত মহামহিম তো আপনাকে চেনেন, সাদরেই গ্রহণ করবেন। সেটাই আপনার করা উচিত।

ডাক্তারকে দেখে মনে হল সে ক্লান্ত, তাড়া আছে।

পিয়ের বলল, আপনি তাই মনে করেন?…আচ্ছা, আমি আরো জানতে চাই যে আমাদের ঘাঁটি এখন ঠিক কোথায়?

ডাক্তার বলল, ঘাঁটি? দেখুন, ওটা আমার এক্তিয়ার নয়। তাতারিনভা ছাড়িয়ে চলে যান, অনেক খোঁড়াখুঁড়ি দেখতে পাবেন। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেই সব দেখতে পাবেন।

সেখান থেকে দেখা যাবে?…আপনি যদি…

কিন্তু তার কথায় বাধা দিয়ে ডাক্তার তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নিজের গলা দেখিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে যেতাম, কিন্তু বিশ্বাস করুন, কাজের চাপ আমার গলা পর্যন্ত ঠাসা। একটা কোম্পানির কমান্ডারের কাছে চলেছি অবস্থা কীরকম? আপনি তো জানেন কাউন্ট, আগামীকাল একটা যুদ্ধ হবে। এক লক্ষ সৈন্যের অন্তত বিশ হাজার আহত হবে, অথচ আমাদের হাতে যা স্ট্রেচার, বাংক, ড্রেসার অথবা ডাক্তার আছে তা ছ হাজারের পক্ষেও যথেষ্ট নয়। দশ হাজার গাড়ি আমাদের আছে, কিন্তু অন্যসব জিনিসও তো চাই–যতদূর সম্ভব একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে!

হাজার হাজার যুবক ও বৃদ্ধ যারা অবাক বিস্ময়ে তার টুপিটার দিকে তাকিয়েছিল তাদের মধ্যে বিশ হাজারের অনিবার্য নিয়তি আঘাত ও মৃত্যু–এই চিন্তাই পিয়েরকে বিস্মিত করে তুলল।

তারা তো কালই মরতে পারে, তাহলে মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু তারা ভাবছে কেন? অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়া ছুটিয়ে যুদ্ধে চলেছে, আহতদের দেখেও মুহূর্তের জন্য নিজেদের ভাগ্যের কথা ভাবছে না, আহতদের নিয়তি মৃত্যু, আর তারা কি না টুপি দেখে অবাক হচ্ছে। আশ্চর্য! ভাবতে ভাবতে পিয়ের তাতারিনভার দিকে এগিয়ে চলল।

রাস্তার বাঁদিকে একটি জমিদার বাড়ির সামনে অনেক গাড়ি, মালগাড়ি, আর্দালি ও সেপাই-শান্ত্রীর ভিড়। প্রধান সেনাপতি সেই বাড়িতেই বাসা নিয়েছে, কিন্তু পিয়ের যখন সেখানে পৌঁছল তখন সে ভিতরে ছিল না, পদস্থ কর্মচারীও কেউ নেই-সকলেই গির্জায় গেছে। পিয়ের গোর্কির দিকে গাড়ি চালাল।

পাহাড়ের মাথায় উঠে একটা গ্রাম্য রাস্তায় পড়ে সে এই প্রথম একদল অসামরিক চাষী সৈনিককে দেখতে পেল। শাদা শার্ট পরে টুপিতে ক্রুশ-চিহ্ন এঁটে তারা হেসে গল্প করতে করতে উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত দেহে ঘাসে ঢাকা একটা বড় গোল পাহাড়ের উপর কাজ করছে।

কেউ মাটি কাটছে, কেউ মাটি সরাচ্ছে, কেউ বা কিছুই করছে না।

গোল পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে অফিসার কাজের তদারক করছে। মনে হচ্ছে, সৈনিক জীবনের অভিনবত্বে চাষীরা খুবই মজা পেয়েছে। পিয়েরের মনে পড়ে গেল মোঝয়েন্ধের আহত সৈনিকদের কথা, একটি সৈনিক যে বলেছিল : ওরা চাইছে গোটা জাতিটাই ওদের পিছনে চলুক তার অর্থটা সে এবার বুঝতে পারল। যুদ্ধক্ষেত্রে কর্মরত এইসব দাড়িওয়ালা চাষীদের দেখে, তাদের বিশ্রী নোংরা বুট, ঘর্মাক্ত গলা, বুক খোলা শার্টের ফাঁকে বেরিয়ে পড়া রোদে পোড়া কণ্ঠাস্থি দেখে পিয়েরের মনে এই মুহূর্তটি যেরকম গাম্ভীর্য ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিল তেমনটি সে আগে কখনো দেখেওনি, শোনেওনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *