১০.১ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ

দশম পর্বঅধ্যায়-১

নেপোলিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে কারণ সে ড্রেসডেনে না গিয়ে পারেনি, যে সম্মান সে পেয়েছে তাতে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, একটা পোলিশ ইউনিফর্ম গায়ে না চড়িয়ে পারেনি, জুন মাসের সকালবেলাকার উত্তেজক প্রভাবকে এড়াতে পারেনি এবং কুরাকিন ও পরে বলাশেভের উপর রাগে ফেটে না পড়ে পারেনি।

আলেক্সান্দার আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেছে কারণ সে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত বোধ করেছে। বার্কলে দ্য তলি সাধ্যমতো সৈন্যপরিচালনা করতে চেষ্টা করেছে কারণ স্বীয় কর্তব্য পালন করে সেনাপতি হিসেবে সুনাম অর্জন করতে চেয়েছে। রস্তভ ফরাসিদের আক্রমণ করেছে কারণ সমতল মাঠের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাবার লোভ সে সামলাতে পারেনি। ঠিক সেই একইভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য মানুষ প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, অভ্যাস, পরিবেশ ও উদ্দেশ্য অনুসারে কাজ করেছে। তারা কাজ করেছে ভয় অথবা অহংকারের বশে, কখনো উল্লসিত হয়েছে বা ক্ষুব্ধ হয়েছে, মনে মনে কল্পনা করেছে যে নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি মতো স্বাধীনভাবেই তারা কাজ করেছে, কিন্তু আসলে তারা সকলেই ইতিহাসের হাতের পুতুল, যে কাজ তারা করেছে তার আসল চেহারা তাদের কাছে ছিল লুকনো, আর আজ আমাদের কাছে স্পষ্ট ও পরিষ্কার। কর্মবীর মানুষদের এটাই অনিবার্য নিয়তি; সাময়িক মর্যাদার যত উঁচু ধাপে তারা অধিষ্ঠিত থাকে ততই তাদের স্বাধীনতা কমতে থাকে।

১৮১২-র অভিনেতারা অনেকদিন হল রঙ্গমঞ্চও ছেড়ে চলে গেছে, তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেছে, একমাত্র ঐতিহাসিক ফলাফল ছাড়া সেকালের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

যে মানুষগুলো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসাধনে ব্রতী হয়েছিল বিধাতাপুরুষ তাদের বাধ্য করেছে এমন একটি প্রচণ্ড উদ্দেশ্য সাধন করতে যা তারা কেউ আশা করেনি-নেপোলিয়ন নয়, আলেক্সান্দার নয়, এমন কি সত্যিকারের যুদ্ধ যারা করেছিল তারাও নয়।

১৮১২-তে ফরাসি বাহিনী কেন বিধ্বস্ত হয়েছিল তার কারণ আজ আমাদের কাছে পরিষ্কার। এ-কথা কেউ অস্বীকার করবে না যে সে কারণ একদিকে যেমন একটা যুদ্ধকালীন অভিযানের কোনোরকম প্রস্তুতি না নিয়ে রাশিয়ার একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়া, অন্যদিকে তেমনই রাশিয়ার সব শহরগুলি জ্বালিয়ে দিয়ে রুশ জনসাধারণের মনে শক্রর প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা জাগিয়ে তুলে যুদ্ধের চরিত্রটাকেই বদলে দেওয়া। কিন্তু সেসময় এটা কেউই বুঝতে পারেনি (এখন সেটা খুবই পরিষ্কার) যে একমাত্র এই পথেই শ্রেষ্ঠ সেনাপতির দ্বারা পরিচালিত পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আট লক্ষ সৈন্য নিয়ে গঠিত একটি বাহিনী তার অর্ধেক সৈন্য নিয়ে গঠিত এবং অনভিজ্ঞ সেনাপতিদের দ্বারা পরিচালিত রুশ বাহিনীর কাছে বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। শুধু যে কেউ এটা বুঝতে পারেনি তাই নয়, রাশিয়ার দিক থেকে একমাত্র যে পথে রাশিয়া বাঁচতে পারত সেই পথ রোধ করবার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করা হয়েছিল, আর ফ্রান্সের দিক থেকে নেপোলিয়নের অভিজ্ঞতা এবং তথাকথিত সামরিক প্রতিভা সত্ত্বেও গ্রীষ্মের শেষে মস্কোর দিকে অগ্রসর হবার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, অর্থাৎ ঠিক সেই কাজটি করা হয়েছিল যার ফল অনিবার্য ধ্বংস হতে বাধ্য।

১৮১২ সাল সম্পর্কে লিখিত নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থে ফরাসি লেখকরা বলে যে নেপোলিয়ন সীমান্ত সম্প্রসারণের বিপদ বুঝতে পেরেছিল, সে যুদ্ধই চেয়েছিল, তার মার্শালরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল সোলেনস্কে থেমে যেতে, এই ধরনের আরো অনেক কথা বলে তারা প্রমাণ করতে চায় যে রুশ অভিযানের বিপদ তারা তখনই বুঝতে পেরেছিল। রুশ লেখকরাও আমাদের বোঝাতে ব্যগ্র যে নেপোলিয়নকে রাশিয়ার একেবারে ভিতরে টেনে আনবার মতো একটা সিদীয় রণ-পরিকল্পনার রচয়িতা হিসেবে পফুয়েলের নাম করে, কেউ বা একজন বিশেষ ফরাসি ভদ্রলোকের, কেউ তলের, আবার কেউ বা স্বয়ং আলেক্সান্দারের নাম উল্লেখ করে–এমন সব মন্তব্য, প্রকল্প ও চিঠিপত্রের কথা বলে যাতে এ ধরনের কর্মপন্থার ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু ফ্রান্স ও রাশিয়া উভয় তরফ থেকেই এই সব ইঙ্গিতের উল্লেখ করা হয় যেহেতু সেগুলো ঘটনার সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে। কিন্তু সেই ঘটনাটি না ঘটলে সেসব ইঙ্গিতের কথা লোকে ভুলে যেত, ঠিক যেমন ভুলে গেছে অন্য সম্ভাবনা সংক্রান্ত হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মন্তব্য ও প্রত্যাশা যা সেসময় প্রচলিত থাকলেও এখনো লোকে ভুলে গেছে কারণ ঘটনাক্রমে সেগুলি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

সীমান্ত সম্প্রসারণের বিপদ সম্পর্কে নেপোলিয়ন সচেতন ছিল এবং (রাশিয়ার দিক থেকে) শত্রুপক্ষকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল-এসব ভাবনা-চিন্তা ঐ একই ধরনের, নেপোলিয়ন ও তার মার্শালদের উপর ঐসব চিন্তা-ভাবনা আরোপ করতে অথবা রুশ সেনাপতিদের উপর ঐসব পরিকল্পনা আরোপ করতে হলে ঐতিহাসিকদের কল্পনাকে বড় বেশি টানতে হবে। যা কিছু ঘটেছে সবই ও ধরনের অনুমানের ঘোর বিরোধী। যতদিন যুদ্ধ চলেছিল ততদিন ফরাসিদের রাশিয়ার ভিতরে টেনে আনবার কোনো বাসনা তো রাশিয়ার ছিলই না বরং রাশিয়ার ভিতরে ফরাসি বাহিনীর প্রথম পদক্ষেপের সময় থেকেই তাদের থামিয়ে দিতে সবরকম চেষ্টা করা হয়েছিল। আর নেপোলিয়নও তার অগ্রবর্তী সীমান্ত সম্প্রসারণে ভয় পাওয়া দূরে থাক, প্রতিটি পদক্ষেপকেই জয়ের লক্ষণ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে, যুদ্ধের উদ্যোগ নিয়ে থাকলেও সেটা নিয়েছে আলস্যভরে, পূর্বেকার অন্য অভিযানের মতো আগ্রহের সঙ্গে নয়।

যুদ্ধের শুরুতে আমাদের সেনাদল ছিল বিভক্ত, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা, যদি পশ্চাদপসরণ করে শত্রুকে দেশের ভিতরে প্রবেশ করতে প্রলুব্ধ করাই আমাদের লক্ষ্য হত তাহলে সেদিক থেকে সেনাদলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করায় কোনোরকম সুবিধা হবার কথা নয়। পশ্চাদপসরণ না করে রাশিয়ার মাটির প্রতিটি ইঞ্চিকে রক্ষা করার কাজে উৎসাহ যোগানোর জন্যই আমাদের সম্রাট স্বয়ং সেনাদলে যোগ দিয়েছিলেন। পফুয়েলের পরিকল্পনা মতোই প্রকাণ্ড দ্রিসা শিবির গড়ে তোলা হয়েছিল, তখনো পশ্চাদপসরণের এতটুকু অভিপ্রায় ছিল না। পশ্চাদপসরণের প্রতিটি ধাপে সম্রাট প্রধান সেনাপতিদের তিরস্কার করেছে। শত্রুসৈন্যকে স্নোলেনঙ্কে ঢুকতে দেবার চিন্তাই ছিল তার কাছে অসহ্য, মস্কোকে জ্বালিয়ে দেবার কথা তো সে ভাবতেই পারে না, আর আমাদের বিচ্ছিন্ন সেনাদলগুলি যখন সম্মিলিত হল তখন বিনা যুদ্ধে স্মালেন ছেড়ে আসায় ও তাকে অগ্নিদগ্ধ হতে দেওয়ায় সম্রাট খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল।

সম্রাটের চিন্তার ধারাটা এইরকমই ছিল, আমাদের সৈন্যরা ক্রমেই দেশের ভিতরে সরে যাচ্ছে দেখে রুশ সেনাপতিরা এবং সৈন্যরা আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

আমাদের সেনাদলকে বিচ্ছিন্ন করে নেপোলিয়ন দেশের অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেল, যুদ্ধ বাধাবার বেশ কয়েকটা সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে গেল। অগস্টে সে ছিল মোলেনস্কে, তখন তার একমাত্র চিন্তা কেমন করে আরো এগিয়ে যাওয়া যায়, যদিও এখন আমরা জেনেছি যে এই অগ্রাভিযানই তার ধ্বংস ডেকে এনেছিল।

ঘটনাবলীর ধারা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে মস্কোর দিকে অগ্রসর হবার বিপদ সম্পর্কে নেপোলিয়ন মোটই অবহিত ছিল না, আর আলেক্সান্দার অথবা রুশ সেনাপতিরাও তখন তাকে ভুলিয়ে ভিতরে নিয়ে আসার কথা ভাবেনি, বরং সবটাই ছিল তার বিপরীত। নেপোলিয়নকে ভুলিয়ে দেশের ভিতরে নিয়ে আসাটা কোনো পরিকল্পনার ফলশ্রুতি নয়, কারণ তখন কেউই এটাকে সম্ভব বলে মনে করত না, যুদ্ধে যারা যোগদান করেছিল অথচ অনিবার্য পরিণাম সম্পর্কে অথবা রাশিয়াকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় সম্পর্কে কোনো ধারণাই যাদের ছিল না, তাদের ষড়যন্ত্র, উচ্চাভিলাষ ও অভিপ্রায়ের জটিল ঘাত-প্রতিঘাতই তার প্রকৃত কারণ। সবকিছুই ঘটেছে আকস্মিকভাবে, অভিযানের গোড়ায় রুশ বাহিনী ছিল নানা দলে বিভক্ত। যুদ্ধ শুরু করবার। উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা বিভক্ত সেনাদলকে একত্র করতে চেষ্টা করলাম, শত্রুপক্ষের অগ্রগতিকে বাধা দিতে চাইলাম, কিন্তু অধিকতর শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধকে এড়িয়ে আমাদের সেনাদলকে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় তাদের একটা সূক্ষ্ম কোণে সরিয়ে নিতে গিয়ে ফরাসিদের স্মোলেনস্ক যাওয়ার পথকে আমরাই পরিষ্কার করে দিলাম। ফরাসিরা আমাদের দুটো সেনাদলের মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হল বলেই যে আমরা একটা সূক্ষ্ম কোণে সরে গেলাম তা কিন্তু নয়, সে কোণটি ক্রমেই সূক্ষ্মতর হতে লাগল এবং আমরা আরো পিছনে সরে গেলাম, কারণ একজন অবাঞ্ছিত বিদেশী হিসেবে বার্কলে দ্য তলি ছিল ব্যাগ্রেশন-এর না-পছন্দ লোক (ব্যাগ্রেশনকে তার অধীনে থাকতে হত), আর ব্যাগ্রেশনও দ্বিতীয় সেনাদলের অধিনায়ক হিসেবে যতদিন সম্ভব সেনাদলকে যুক্ত করা ও তার নিজের বার্কলের অধীনস্থ হওয়াটাকে ঠেকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকল। তার কার্যকলাপ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে বাঞ্ছিত বিদেশী বার্কলের অধীনস্থ না হবার সবরকম ফন্দি-ফিকিরই সে করেছিল, কারণ পদমর্যাদায় বার্কলে ছিল তার নিচে।

সম্রাট সেনাবাহিনীতে এসেছিল তাকে উৎসাহ দিতে, কিন্তু কোন পথে যাওয়া উচিত সে সম্পর্কে তার অজ্ঞতা এবং পরিকল্পনা ও পরামর্শদাতার আধিক্যের ফলে প্রথম সেনাদলের উৎসাহে ভাটা পড়ল, তারা সরে গেল।

ইচ্ছা ছিল দ্রিসা শিবিরে ঘাঁটি করা হবে, কিন্তু নিজে প্রধান সেনাপতি হবার বাসনায় পলুচি অপ্রত্যাশিতভাবে আলেক্সান্দারকে এমনভাবে প্রভাবিত করল যে পফুয়েলের গোটা পরিকল্পনাই পরিত্যক্ত হল, আর সেনাপতিত্বের ভার পড়ল বার্কলের উপর। কিন্তু বার্কলের উপর ততটা ভরসা না থাকায় তার ক্ষমতা রইল সীমিত। সেনাবাহিনীকে ছোট ঘোট দলে ভাগ করা হল, নেতৃত্বের ঐক্য রইল না, আর বার্কলে জনপ্রিয়তা হারাল, কিন্তু সেই ডামাডোল, সেনা-বিভাজন ও বিদেশী প্রধান সেনাপতির জনপ্রিয়তার অভাবের যা স্বাভাবিক পরিণতি তাই ঘটল, একদিকে, স্থির সিদ্ধান্তের অভাব ও যুদ্ধ পরিহার এবং অন্যদিকে, বিদেশীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও স্বাদেশিকতার উচ্ছ্বাসবৃদ্ধি।

শেষ পর্যন্ত সম্রাট সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে গেল, তার এই ফিরে যাওয়ার একমাত্র সুবিধাজনক অজুহাত হিসেবে স্থির করা হল যে দেশের জন্য এই যুদ্ধে রাজধানীর লোকদের অনুপ্রাণিত করা এবং গোটা জাতিকে জাগ্রত করে তোলা তার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। সম্রাটের মস্কো পরিদর্শনের ফলে রুশ বাহিনীর শক্তি তিনগুণ : বেড়ে গিয়েছিল।

সেনাবাহিনীর উপর প্রধান সেনাপতির অবিভক্ত নিয়ন্ত্রণ যাতে বাধা না পায় সেই উদ্দেশ্যে এবং যুদ্ধের স্বপক্ষে আরো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাতে সম্ভব হয় এই আশায়ই সম্রাট চলে গেল, কিন্তু সৈন্যপরিচালনার ক্ষেত্রে আরো বিশৃঙ্খলা, আরো বেশি দুর্বলতা দেখা দিল। বেনিংসন, জারেভিচ এবং একগাদা অ্যাডজুটান্ট জেনারেল থেকেই গেল প্রধান সেনাপতির উপর নজর রাখতে ও তাকে উৎসাহ দিতে, আর সম্রাটের এইসব চক্ষুর সামনে থাকার দরুন বার্কলের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হতে লাগল, কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সে আরো সতর্ক হয়ে উঠল, আর তার ফলে সেও যুদ্ধকে এড়িয়ে চলল।

বার্কলে সতর্কতার প্রতিমূর্তি। জারেভিচ বিশ্বাসঘাতকতার ইঙ্গিত করে সর্বাত্মক যুদ্ধের দাবি জানাল। লুবোমিল্কি, ব্রনিৎক্কি, ব্রনিৎস্কি, হলকি এবং ঐ দলের অন্য সবাই মিলে এমন গোলমাল পাকিয়ে তুলল যে সম্রাটের কাছে গোপন কাগজপত্র পাঠাবার অছিলায় বার্কলে এইসব পোলিশ অ্যাডজুটান্ট-জেনারেলদের পিটার্সবুর্গে পাঠিয়ে দিল এবং বেনিংসেন ও জারেভিচের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংঘাতে অবতীর্ণ হল।

ব্যাগ্রেশন যতই অপছন্দ করুক, শেষপর্যন্ত গেঁলেনঙ্কে সেনাদলগুলি একত্রিত হল।

একটা গাড়ি নিয়ে ব্যাগ্রেশন বার্কলের বাসা-বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। চাদর জড়িয়ে বার্কলে বাইরে এসে ঊধ্বতন অফিসার হয়েও উদারতার এই প্রতিযোগিতায় ব্যাগ্রেশন বার্কলের নির্দেশ গ্রহণ করল, কিন্তু এই পর্যন্তই, এরপর থেকে সে কখনো বার্কলের সঙ্গে একমত হয় নি। সম্রাটের হুকুমেই ব্যাগ্রেশন সরাসরি তার কাছে এসেছিল। সম্রাটের বিশ্বাসভাজন আরাকচিভকে সে লিখল, আমার সম্রাটের যেমন অভিরুচি তাই হবে, কিন্তু এই মন্ত্রীটির (অর্থাৎ বার্কলে) সঙ্গে আমি কাজ করতে পারব না। ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে অন্য কোথাও পাঠান, যদি কোনো রেজিমেন্টের সেনাপতি হিসেবে হয় তবু। এখানকার পরিবেশ আমার সহ্য হচ্ছে না। প্রধান ঘাঁটিতে এত বেশি জার্মানদের ভিড় যে কজন রুশও এখানে টিকতে পারে না, এখানে সবকিছুই অর্থহীন। ভেবেছিলাম, আমার সম্রাট ও পিতৃভূমির সেবা করতেই এখানে এসেছি, কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে সেবা করছি বার্কলের। আমি কবুল করছি, এ সেবা করতে আমি চাই না।

ব্রনিৎস্কি ও উইন্ডসিন জেরোদদের দলবল প্রধান সেনাপতির সঙ্গে সম্পর্কটাকে তিক্ততর করে তুলল, ফলে ঐক্য বিঘ্নিত হল। স্মোলেনঙ্কের আগেই ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সেখানকার অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য একজন সেনাপতিকে পাঠানো হল। বার্কলের প্রতি ঘৃণাবশত সেই সেনাপতি ঘোড়ায় চেপে তার জনৈক কোর-কম্যান্ডার বন্ধুর কাছে চলে গেল এবং সারাটাদিন তার কাছে কাটিয়ে ফিরে এসে বার্কলেকে জানাল, রণক্ষেত্র হিসেবে সে জায়গাটা সবদিক থেকেই অনুপযুক্ত, যদিও জায়গাটা সে চোখেও দেখেনি।

এইভাবে ভবিষ্যৎ রণক্ষেত্র নিয়ে যখন বিতর্ক ও ষড়যন্ত্র চলছে, ফরাসিদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না রেখে আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছি, তখন ফরাসিরা নেভেরভস্কির সেনাদলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে স্মোলেনঙ্কের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

আমাদের যোগাযোগের পথগুলোকে রক্ষা করার জন্যই এই অপ্রত্যাশিত যুদ্ধে আমাদের নামতে হল। যুদ্ধ হল, আর উভয় পক্ষেরই হাজার হাজার লোক মারা গেল।

সম্রাটের এবং দেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই স্মোলেনস্ক পরিত্যক্ত হল। কিন্তু শাসনকর্তা কর্তৃক ভুল বোঝানোর ফলে স্মোলেনস্কের অধিবাসীরাই শহরটা জ্বালিয়ে দিল। আর সেইসব সর্বান্ত অধিবাসীরা রুশদের সামনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মস্কো চলে গেল, শুধু নিজেদের ক্ষতির কথা ভেবেই তারা সকলের মনে শত্রুর প্রতি বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে তুলল। নেপোলিয়ন যতই এগিয়ে আসতে লাগল, আমরা ততই পিছিয়ে যেতে লাগলাম এবং শেষপর্যন্ত যে পরিণতি ঘটল তাতেই তার ধ্বংস হল।

.

অধ্যায়-২

ছেলে চলে যাবার পরদিন প্রিন্স নিকলাস প্রিন্সেস মারিকে তার পড়ার ঘরে ডেকে পাঠাল।

বলল, এবার? খুশি হয়েছ তো? ছেলের সঙ্গে আমার ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছ! এখন খুশি তো? এই তো তুমি চেয়েছিলে! খুব সন্তুষ্ট?…কিন্তু আমি কষ্ট পাচ্ছি, খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমি বুড়ো, আমি দুর্বল, আর এই তো তুমি চেয়েছিলে। বেশ তো, এবার প্রাণভরে দেখ! প্রাণভরে দেখ!

তারপর থেকে একটা পুরো সপ্তাহ প্রিন্সেস মারি বাবার সঙ্গে দেখা করেনি। বাবা অসুস্থ, পড়ার ঘর থেকে বের হয় না।

প্রিন্সেস মারি সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল, এই অসুখের সময় বুড়ো প্রিন্স যে শুধু তাকেই ঘর থেকে দূরে রেখেছে তাই নয়, মাদময়জেল বুরিয়েকেও ঘরে ঢুকতে দেয়নি। শুধু তিখনই তার দেখাশুনা করেছে।

একসপ্তাহ পরে প্রিন্স আন্দ্রুবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল এবং আগেকার জীবনযাত্রা শুরু করল, বাড়িঘর তৈরি ও বাগানের কাজ নিয়েই মেতে রইল। মাদময়জেল বুরিয়ের সঙ্গেও সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। মেয়ের প্রতি তার দৃষ্টি, তার নিরাসক্ত কণ্ঠস্বর যেন বলতে চাইছে : দেখলে তো? তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলে, ফরাসি মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে প্রিন্স আন্দ্রুকে মিথ্যা কথা বলেছ, তার সঙ্গে আমার ঝগড়া বাধিয়েছ, কিন্তু এখন দেখছ তো আমার কাউকে দরকার নেই–তাকেও না, তোমাকেও না!

প্রিন্সেস মারি দিনের অর্ধেকটা সময় কাটায় ছোট্ট নিকলাসের সঙ্গে, তার পড়াশুনা দেখে, নিজেই রুশ ভাষা ও গান শেখায়, দেসাল্লেসের সঙ্গে গল্প করে, দিনের বাকি সময়টা কাটায় বই নিয়ে, বুড়ি নার্সের সঙ্গে অথবা তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে।

যুদ্ধ সম্পর্কে প্রিন্সেস মারির ভাবনা-চিন্তা অন্যসব স্ত্রীলোকদেরই মতো। তার যত ভয় যুদ্ধরত ভাইয়ের জন্য, যে বিস্ময়কর নিষ্ঠুরতায় একজন মানুষ আর একজন মানুষকে খুন করে তা দেখে সে স্তম্ভিত হয়, আতংকিত হয়, কিন্তু আগেকার অন্যসব যুদ্ধের মতোই এ যুদ্ধেরও কোনো অর্থ সে খুঁজে পায় না। দেসাল্লেস তার সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করে, তীর্থযাত্রীটি এসে যুদ্ধ সংক্রান্ত নানারকম গুজব শোনায়, জুলি (এখন প্রিন্সেস বেস্কয়া) মাঝেমাঝেই তাকে দেশাত্মবোধক চিঠি লেখে মস্কো থেকে।

জুলি তার ফরাসি-প্রভাবিত রুশ ভাষায় লিখেছে, প্রিয় বান্ধবী, আমি তোেমাকে রুশ ভাষাতেই লিখছি, কারণ ফরাসিদের আমি ঘৃণা করি, আর সেই একই ঘৃণাবশত ফরাসি ভাষা শোনাটাও সমর্থন করি না…আমাদের পূজ্যপাদ ম্রাটের জন্য মস্কোতে আমরা সকলেই উচ্ছ্বসিত আনন্দ বোধ করি।

আমার বেচারা স্বামীটি ইহুদিদের সরাইখানায় কষ্ট ও ক্ষুধা সহ্য করছে, কিন্তু তার যে সংবাদ আমি পাই তাতেই আমি অনুপ্রাণিত হয়ে উঠি।

তুমি হয়তো রায়েভস্কির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা শুনেছ, দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সে বলেছে : এদের নিয়ে আমি মরব, তবু আমরা এতটুকু কাপৰ না। সত্যি তো, শত্রুপক্ষ আমাদের চাইতে দ্বিগুণ শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আমরা স্থির, অচঞ্চল রয়েছি। অন্যসময় আমরা যেমন খুশি চলি, কিন্তু যুদ্ধের সময় যুদ্ধের মতো! প্রিন্সেস আলিন ও সোফি সারাদিন আমার কাছেই বসে থাকে, আর জীবন্ত মানুষদের অসুখী বিধবা ও আমরা নানারকম আলোচনায় মেতে থাকি, শুধু তোমার মতো বন্ধুকেই কাছে পাই না… ইত্যাদি।

প্রিন্সেস মারি যে এই যুদ্ধের পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে পারে না তার কারণ বুড়ো প্রিন্স কখনো যুদ্ধের কথা বলে না, যুদ্ধকে স্বীকারই করে না, আর ডিনারের সময় দেসালুেস যুদ্ধের কথা তুললেও হেসে উড়িয়ে দেয়। প্রিন্সেস কণ্ঠস্বর এতই শান্ত ও আত্মপ্রত্যয়শীল যে প্রিন্সেস মারি অসংকোচেই তার কথা বিশ্বাস করে।

সারা জুলাই মাস বুড়ো প্রিন্স অতিমাত্রায় কর্মতৎপর, এমন কি উজ্জীবিতভাবে কাটাল। আরো একটা বাগানের পরিকল্পনা নেওয়া হল, পারিবারিক ভূমিদাসদের জন্য একটা নতুন বাড়ি তৈরি শুরু হল। কিন্তু একটা ব্যাপারে তাকে নিয়ে প্রিন্সেস মারি উদ্বেগ বোধ করতে লাগল, আজকাল বুড়ো প্রিন্স খুব অল্প সময় ঘুমোয়, আর আগেকার মতো পড়ার ঘরে না ঘুমিয়ে প্রতিদিন ঘুমের জায়গা পাল্টে নেয়। একদিন হয়তো হুকুম করল, তার শিবির-শয্যা পেতে দিতে হবে কাঁচ-ঘরে, আর একদিন হয়তো বৈঠকখানার কোচে বা লাউঞ্জ-চেয়ারেই পোশাক না ছেড়ে ঝিমুতে লাগল, আর মাদময়জেল বুরিয়ের বদলে একটি ভূমিদাস বালক এখন তাকে পড়ে শোনায়। আবার কখনো হয়তো খাবার ঘরেই রাতটা কাটায়।

প্রিন্স আন্দ্রুর দ্বিতীয় চিঠি এল ১লা আগস্ট। বাড়ি থেকে চলে গিয়েই সে প্রথম যে চিঠিটা লিখেছিল তাতে সে যা বলেছিল তার জন্য বাবার ক্ষমা চেয়ে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছিল। বুড়ো প্রিন্স একান্ত স্নেহে সে চিঠির জবাব দিয়েছে এবং সেই থেকেই ফরাসি মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। প্রিন্স আন্দ্রু দ্বিতীয় চিঠিটা লিখেছিল ভিতেবস্ক শহরের কাছাকাছি জায়গা থেকে, শহরটা তখন ফরাসিরা দখল করে নিয়েছে। সেই চিঠিতে গোটা অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ তার নিজের আঁকা একটা মানচিত্র পাঠিয়েছে এবং যুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুটা পূর্বাভাস দিয়েছে। চিঠিতে সে আরো লিখেছে, যেহেতু বন্ড হিলস রণাঙ্গনের অত্যন্ত কাছে এবং সৈন্যদের যাতায়াতের একেবারে পথের উপর অবস্থিত সেইজন্য সেখানে থাকাটা এখন বিপজ্জনক, আর তাই সে তাকে মস্কো চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছে।

সেদিন ডিনারের সময় দেসাল্লেস যখন জানাল যে ফরাসিরা ভিতেব শহরে ঢুকে পড়েছে, তখন ছেলের চিঠির কথা বুড়ো প্রিন্সের মনে পড়ে গেল।

প্রিন্সেস মারিকে বলল, আজ প্রিন্স আন্দ্রুর একটি চিঠি এসেছে, তুমি কি চিঠিটা পড়নি?

না বাবা, মেয়ে ভীত গলায় জবাব দিল।

 পড়া তো দূরের কথা, চিঠি যে এসেছে তাই তো সে জানে না।

যুদ্ধের কথা বলতে গেলেই বিদ্রুপের হাসি হাসাটা প্রিন্সের একটা অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। তেমনই হাসির সঙ্গে সে বলল, এই যুদ্ধের কথাই সে লিখেছে।

দেসাল্লেস বলল, চিঠিটা নিশ্চয়ই খুব মনোগ্রাহী হবে। প্রিন্স আন্দ্রুর তো সবই জানবার কথা…

হ্যাঁ, খুবই মনোগ্রাহী। মাদময়জেল বুরিয়ে বলল।

বুড়ো প্রিন্স তাকেই বলল, যাও তো, চিঠিটা নিয়ে এস। জানই তো-ছোট টেবিলে কাগজ-চাপাটার নিচেই আছে।

মাদময়জেল বুরিয়ে তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠল।

না, যেয়ো না! বুড়ো প্রিন্সের চোখে ভ্রুকুটি।… তুমি যাও মাইকেল আইভানভিচ।

মাইকেল আইভানভিচ পড়ার ঘরে চলে গেল। কিন্তু সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বুড়ো প্রিন্স অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকিয়ে তোয়ালেটা ছুঁড়ে দিয়ে নিজেই উঠে পড়ল।

বিড় বিড় করে বলল, এরা কিছু করতে পারে না…সবসময় তালগোল পাকিয়ে ফেলে।

সে বেরিয়ে যেতেই প্রিন্সেস মারি, দেসাল্লেস, মাদময়জেল বুরিয়ে, এমন কি ছোট্ট নিকলাস পর্যন্ত নিঃশব্দে দৃষ্টি-বিনিময় করল। চিঠি ও মানচিত্রটা নিয়ে মাইকেল আইভানভিচকে সঙ্গে করে বুড়ো প্রিন্স দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকল। সেগুলোকে নিজের পাশেই রেখে দিল-ডিনারের সময় কাউকে পড়তে দিল না।

বৈঠকখানায় গিয়ে চিঠিটা প্রিন্সেস মারির হাতে দিল, নতুন বাড়ির প্ল্যানটা মেলে ধরে সেটার উপর চোখ রেখে প্রিন্সেস মারিকে চিঠিটা পড়তে বলল। চিঠি পড়া শেষ করে প্রিন্সেস মারি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল। বুড়ো প্রিন্স তখন প্ল্যানটা পরীক্ষা করে দেখতেই ব্যস্ত।

এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন প্রিন্স দেসাল্লেস সাহস করে জিজ্ঞাসা করল।

আমি? আমি?… বাড়ির প্ল্যান থেকে চোখ না সরিয়েই প্রিন্স অসন্তুষ্ট গলায় বলল।

 খুব সম্ভব রণক্ষেত্র আমাদের এত কাছে সরে আসবে যে…।

হা হা হা! রণক্ষেত্র! প্রিন্স বলল। আগেও বলেছি, এখনো বলছি, রণক্ষেত্র হচ্ছে পোল্যান্ড, আর শত্রু কখনো নিয়েমেন পেরিয়ে আসবে না।

শত্রু যখন নীপারের তীরে পৌঁছে গেছে তখনো নিয়েমেনের কথা বলায় দেসাল্লেস অবাক হয়ে প্রিন্সের দিকে তাকাল। প্রিন্সেস মারি নিয়েমেনের ভৌগোলিক অবস্থান ভুলে গিয়ে ভাবল যে তার বাবার কথাই ঠিক।

বরফ যখন গলবে তখন পোল্যান্ডের জলাভূমিতেই তারা ডুবে মরবে। শুধু তারা সেটা বুঝতে পারছে না, সম্ভবত ১৮০৭ সালের অভিযানের কথা ভেবেই প্রিন্স বলতে লাগল। বেনিংসেনের উচিত ছিল আরো আগে প্রাশিয়াতে ঢোকা, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটাই অন্যদিকে মোড় নিত…।

দেসাল্লেস ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু প্রিন্স, চিঠিতে তো ভিতেরঙ্কের কথা বলা হয়েছে…।

ওঃ, চিঠি? হ্যাঁ… প্রিন্স রেগে জবাব দিল। হা…হা… হঠাৎ তার মুখটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। থামল। হ্যাঁ, সে লিখেছে, ফরাসিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে…কোথায়…কি যেন নদীটা?

দেসাল্লেস চোখ নিচু করল।

 সবিনয়ে বলল, প্রিন্স তো সেসম্পর্কে কিছু লেখেননি।

লেখেনি? কিন্তু আমি তো মন থেকে ওটা বানাইনি।

অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।

হঠাৎ মাথাটা তুলে বাড়ির প্লানটা দেখিয়ে প্রিন্স বলে উঠল, হা…হা…আচ্ছা মাইকেল আইভানভিচ, বল তো কীভাবে এটাকে তুমি বদলাতে চাও…

মাইকেল আইভানভিচ প্ল্যানটার দিকে এগিয়ে গেল। প্রিন্স নতুন বাড়ি সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা বলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে প্রিন্সেস মারি ও দেসাল্লেসের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

সন্ধ্যাবেলা মাইকেল আইভানভিচ প্রিন্সেস কথামতো প্রিন্সেস মারির কাছে এসে প্রিন্স আন্দ্রুর চিঠিটা চাইল। চিঠিটা তার হাতে দিয়ে কাজটা অপ্রীতিকর হলেও জানতে চাইল, তার বাবা এখন কি করছে।

 সবসময়ই তো ব্যস্ত, সশ্রদ্ধ অথচ বিদ্রুপের হাসি হেসে মাইকেল আইভানভিচ বলল, তা দেখে প্রিন্সেস মারির মুখটা কালো হয়ে গেল। নতুন বাড়িটা নিয়ে খুবই চিন্তায় আছেন। একটু-আধটু পড়াশুনা করেন, তবে এখন-গলা নামিয়ে বলল–এখন ডেস্কেই বসেছেন, মনে হচ্ছে উইল করতে ব্যস্ত আছেন।

আর আলপাতিচকে ঘোলেনকে পাঠানো হচ্ছে? প্রিন্সেস মারি শুধাল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো যাত্রা করার জন্যই অপেক্ষা করছে।

.

 অধ্যায়-৩

মাইকেল আইভানভিচ যখন চিঠিটা নিয়ে পড়ার ঘরে ফিরে গেল তখন বুড়ো প্রিন্স চশমা পরে চোখের উপর একটা ঢাকা দিয়ে দেরাজ-খোলা টেবিলের সামনে বসে ছিল। টেবিলে একটা ঢাকা-দেওয়া মোমবাতি জ্বলছে। হাতে একটা কাগজ নিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা পাণ্ডুলিপি পড়ছে। তার ভাষায় এটা তার মন্তব্য। তার মৃত্যুর পরে এটাকে সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে।

যে কাগজটা সে পড়ছে সেটা যেসময়ে লেখা হয়েছিল তখনকার স্মৃতি মনে পড়ায় প্রিন্সের দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে। মাইকেল আইভানভিচের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পকেটে রাখল, কাগজটা ভাজ করল, তারপর আলপাতিচকে ডাকল, সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছে।

স্মোলেনস্ক থেকে অনেকগুলো জিনিস কিনে আনতে হবে। আলপাতিচ দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, আর প্রিন্স ঘরময় হাঁটতে হাঁটতে তাকে নির্দেশ দিচ্ছে।

প্রথমত, চিঠির কাগজ-শুনতে পাচ্ছ? আট দিস্তে, ঠিক এইরকম, পাশে সোনালি জল লাগানো…ঠিক যেন এই নমুনা কাগজটার মতো হয়। বার্নিশ, মোহর করার মোম, যেমন যেমন মাইকেল আইভানভিচের ফর্মে লেখা আছে।

হাঁটতে হাঁটতেই হাতের চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর দলিসংক্রান্ত চিঠিটা স্বয়ং শাসনকর্তার হাতে দেবে।

তারপর নতুন বাড়ির জন্যে ছিটকিনি কিনতে হবে, তার নিজের আঁকা নক্সার মতো হওয়া চাই। আর উইল রাখবার জন্য একটা বাঁধানো খাপ তৈরি করতে দিতে হবে।

এতেই দুঘণ্টার উপর কেটে গেল, তবু প্রিন্স তাকে রেহাই দিল না। প্রিন্স বসে পড়ে চিন্তায় ডুবে গেল, তার চোখ বুজে এল, সে ঢুলতে লাগল। আলপাতিচ একটু নড়াচড়া করল।

আরে, চলে যাও, চলে যাও! যদি আর কিছু দরকার হয় পরে লোক পাঠাব।

আলপাতিচ বেরিয়ে গেল। প্রিন্স টেবিলে ফিরে গিয়ে টানার ভিতরে কাগজটা নাড়াচাড়া করল, আবার সেটা বন্ধ করে শাসনকর্তাকে চিঠি লিখতে টেবিলে বসল।

চিঠি সিল করে যখন উঠল তখন রাত অনেক হয়েছে। ঘুমোবার ইচ্ছা হল, কিন্তু প্রিন্স জানে যে ঘুম আসবে না, বিছানায় শুলেই যত রাজ্যের বিষণ্ণ চিন্তা এসে মাথার মধ্যে ভিড় করবে। তিখনকে ডেকে তাকে নিয়ে কোথায় রাতের মতো বিছানা করতে হবে সেটা দেখিয়ে দিতে ঘরের পর ঘর পার হতে লাগল। সব জায়গাই তার না-পছন্দ। বিশেষ করে খারাপ লাগল যে কোচটাকে সে সাধারণত শোয়। সেটা ভয়ংকর মনে হবার কারণ হয়তো সেটাতে শুয়েই যত রাজ্যের দুশ্চিন্তা তার মাথায় ভিড় করেছিল। কোনো জায়গাই তার পছন্দ হয় না, কিন্তু বৈঠকখানার পিয়ানোর পিছনকার কোণটা তবু কিছুটা ভালো মনে হল, কারণ সেখানে সে আগে কখনো ঘুমোয়নি।

একজন পরিচারককে নিয়ে তিখন খাটটা সেখানে নিয়ে এসে বিছানা পাততে লাগল।

ঠিক হচ্ছে না! ঠিক হচ্ছে না! বলে প্রিন্স নিজেই সেটাকে কোণ থেকে কয়েক ইঞ্চি টেনে এনে আবার ঠেলে দিল।

যাহোক, শেষপর্যন্ত কাজটা হয়েছে, এবার বিশ্রাম করব। প্রিন্স চুপ করে দাঁড়াল, তিখন তার পোশাক খুলতে লাগল।

কোট ও ট্রাউজার খুলতে শরীরে যেটুকু টান লাগল তাতেই ভুরু কুঁচকে প্রিন্স ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল এবং নিজেই শুকিয়ে যাওয়া হলদে পা দুটোর দিকে তাকিয়ে যেন ধ্যান করতে লাগল। পা দুটো টেনে বিছানায় ভোলাই শক্ত কাজ। উঃ, কী শক্ত কাজ! আঃ, কবে যে এ কষ্টের শেষ হবে! কবে যে তুমি আমাকে মুক্তি দেবে! ভাবতে ভাবতে দুই ঠোঁট চেপে ধরে বিশ হাজারতমবার সেই একই চেষ্টা করে কোনোরকমে শুয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিছানাটা সামনে-পিছনে দুলতে লাগল, যেন বিছানাটাই জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে আর ঝাঁকুনি দিচ্ছে। প্রায় প্রতি রাত্রেই এই একই ঘটনা ঘটে। চোখ দুটো সবে বুজে আসছে এমন সময় আবার চোখ মেলল।

শান্তি নেই! সব উচ্ছন্নে যাক! সে বিড়বিড় করতে লাগল, কার উপর যে রাগ করছে তা সে নিজেই জানে না। যা, কি যেন দরকারি কাজের কথা বাকি আছে। সিটকিনি? না, সেকথা তো তাকে বলেছি। না, কি যেন একটা বৈঠকখানা ঘরেরই কিছু। প্রিন্সেস মারি বাজে বকছিল। আর সেই গাধা দেসাল্লেসও কি যেন বলল। আমার পকেটের কিছু–ঠিক মনে করতে পারছি না। তিখন, ডিনারের সময় আমরা কি নিয়ে কথা বলছিলাম?

প্রিন্স মাইকেল…

চুপ কর! চুপ কর! প্রিন্স টেবিলের উপর একটা থাপ্পড় মারল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, প্রিন্স আন্দ্রুর চিঠি! প্রিন্সেস মারি চিঠিটা পড়ল। দেসাল্লেস ভিতের সম্পর্কে কি যেন বলল। এবার আমি সেটা পড়ব।

পকেট থেকে চিঠিটা বের করিয়ে আনল। একগ্লাস লেমোনেড ও ঘোরানো মোমবাতি সমেত টেবিলটা বিছানার আরো কাছে আনল, তারপর চশমাটা পরে চিঠি পড়তে লাগল। রাত্রির এই নিস্তব্ধতার মধ্যে সবুজ ঢাকনার নিচে আবছা আলোয় যেন মুহূর্তের জন্য চিঠিটার অর্থ সে ধরতে পারল।

ফরাসিরা ভিতেরঙ্কে এসে গেছে, আর চার দিনের মধ্যে স্নোলেনকে এসে পড়তে পারে, হয়তো ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। তিখন! তিখন লাফ দিয়ে উঠল। না, না, আমার কিছু চাই না! প্রিন্স চেঁচিয়ে বলল।

মোমবাতিদানের নিচে চিঠিটা রেখে সে চোখ বুজল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল উজ্জ্বল মধ্যাহ্নের দানিয়ুব নদী : শরবন, রুশ শিবির, আর নিজের যৌবনদীপ্ত সেনাপতির মূর্তি, রক্তিম মুখে একটাও ভাঁজ পড়েনি, সদর্প, সতর্ক পা ফেলে সে ঢুকল পোতমেকিনের রঙিন তাবুতে, সেদিনের মতোই এই প্রিয় মানুষটির প্রতি একটা ঈর্ষার শিখা যেন আজও তার মনে জ্বলে উঠল। তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে যে কথাগুলি বলেছিল তাও মনে পড়ে গেল। তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল মোটাসোটা, ঈষৎ পাংশু মুখ, বলিষ্ঠ একটি নারী, সাম্রাজ্ঞী-জননী, মুখে প্রথম সাদর অভ্যর্থনার মধুর হাসি ও বাণী, তারপরেই ভেসে উঠল কাঠের সমাধিতে শায়িত সেই একই মুখ এবং তার হাতে চুমো খাবার অধিকার লাভের জন্য তারই শবাধারকে ঘিরে জুবভ এর সঙ্গে তার যুদ্ধের দৃশ্য।

ওঃ, দ্রুত, আরো দ্রুত ফিরে চল সেইকালে, যা কিছু বর্তমান সব শেষ হয়ে যাক! দ্রুত, আরো দ্রুত–তারা আমাকে শান্তিতে থাকতে দিক।

.

অধ্যায়-

প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির জমিদারবাড়ি বন্ড হিলস স্মোলেনস্ক থেকে চল্লিশ মাইল পূর্বে এবং মস্কো যাবার বড় সড়কের দুমাইল দূরে অবস্থিত?

যে সন্ধ্যায় প্রিন্স তার নির্দেশাদি দিয়ে আলপাতিচকে পাঠাল সেই সন্ধ্যায়ই দেসাল্লেস প্রিন্সেস মারির সঙ্গে দেখা করে বলল, প্রিন্সেস শরীর ভালো যাচ্ছে না, আর নিজের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাও করছে না, এদিকে প্রিন্স আন্দ্রুর চিঠি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বল্ড হিলসে কথাটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, কাজেই আলপাতিচকে দিয়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তার কাছে একটা চিঠি পাঠিয়ে তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হোক যুদ্ধের অবস্থা কি এবং বল্ড হিলসের বিপদের সম্ভাবনা কতখানি। শাসনকর্তার কাছে চিঠিটা দেসাক্সেসই লিখে দিল, প্রিন্সেস মারি তাতে সই করল, আর আলপাতিচের হাতে চিঠিটা দিয়ে তাকে বলে দেওয়া হল, সে যেন চিঠিটা শাসনকর্তার হাতে দেয় এবং কোনোরকম বিপদ বুঝলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসে।

সবরকম হুকুম নিয়ে আলপাতিচ সপরিবারে বেরিয়ে পড়ল। মাথায় শাদা রঙের বীভার-লোমের টুপি-প্রিন্সের দেওয়া উপহার–আর হাতে প্রিন্সের মতোই একটা ছড়ি।

গাড়ির বড় ঘন্টার শব্দ কমিয়ে রাখা ছিল, আর ছোট ঘণ্টাগুলি ছিল কাগজ দিয়ে জড়ানো। প্রিন্স কাউ-ে কই ঘণ্টা বাজিয়ে গাড়ি চালাতে দিত না, কিন্তু এই দীর্ঘ ভ্রমণে আলপাতিচের ঘণ্টাগুলি বাজাবার শখ হল। তার অনুরাগীবৃন্দ-যেমন বড় করণিক, হিসাব ঘরের করণিক, বাসন ধোয়ার ঝি, বঁধুনি, বাচ্চা চাকর, কোচোয়ান ও পারিবারিক ভূমিদাসরা-সকলেই এসে তাকে বিদায় দিল।

তার মেয়ে এনে দিল ছিট-কাপড়ের ওড়-লাগানো দুটি কুশন-একটা বসার, একটা হেলান দেবার। তার বুড়ি শ্যালিকা এনে দিল একটা ছোট পুঁটুলি, আর একজন কোচোয়ান তাকে গাড়িতে তুলে দিল।

এই তো! এই তো! মেয়েরাই যত গণ্ডগোল বাধায়! মেয়েরা! মেয়েরা! প্রিন্সের মতোই দ্রুতগতিতে কথাগুলি বলে আলপাতিচ গাড়িতে উঠে বসল।

করণিককে কাজের নির্দেশাদি দিয়ে আলপাতিচ টাক মাথা থেকে টুপিটা তুলে তিনবার কুশ-চিহ্ন আঁকল।

যুদ্ধ ও শত্রুপক্ষের গুজবের কথা উল্লেখ করে তার স্ত্রী চেঁচিয়ে বলল, যদি সেরকম কিছু দেখ…তো ফিরে এস। খৃস্টের দোহাই, আমাদের কথা মনে রেখ।

মেয়েরা মেয়েরা! মেয়েরাই যত গণ্ডগোল বাধায় বিড় বিড় করতে করতে আলপাতিচ যাত্রা শুরু করল।

যেতে যেতে দুই পাশের চমৎকার ফসলের দিকে খুশিমনে তাকিয়ে সে মনে মনে হিসাব কষতে লাগল কীরকম বীজ বোনা হয়েছিল আর ফসল কীরকম পাওয়া যাবে। প্রিন্স যেসব জিনিসের হুকুম করেছে সেসব মনে আছে কিনা তাও একবার ভেবে নিল।

পথে ঘোড়াগুলিকে দুইবার দানা-পানি দিয়ে ৪ঠা আগস্ট সন্ধ্যার দিকে সে শহরে পৌঁছল।

পথে মালগাড়ি ও সৈন্যদের সঙ্গে তার অনেকবারই দেখা হয়েছে। মোলেনক্ষের কাছাকাছি আসতে অনেক দূরে কামানের শব্দও কানে এসেছে। কিন্তু সেসবকে সে বিশেষ আমল দেয়নি। যেটা খুব বেশি করে তার নজরে পড়েছে সেটা হল, একটা চমৎকার যবের ক্ষেতে তার খাটানো হয়েছে, আর সৈন্যরা ঘোড়ার খাবার জন্য সব ফসল কেটে ফেলছে। কিন্তু নিজের কাজের কথায় মন দিতে গিয়ে অচিরেই সে-দৃশ্যটা সে ভুলে গেল।

ত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে তার জীবনের সব স্বার্থ ও আগ্রহই প্রিন্সেস ইচ্ছার দড়িতে বাঁধা, কখনো সে সীমানা সে পার হয়ে যায়নি। প্রিন্সের হুকুমের সঙ্গে যে জিনিসের সম্পর্ক নেই তার প্রতি তারও কোনো আগ্রহ নেই।

৪ঠা আগস্ট সন্ধ্যায় গেঁলেনঙ্কে পৌঁছে সে নীপার নদী পার হয়ে গাচিনা শহরতলিতে ফেরাপভের সরাইখানায় উঠল। গত ত্রিশ বছর ধরে সেখানেই সে ওঠে। বছর ত্রিশেক আগে আলপাতিচের পরামর্শেই ফেরাপত্তভ প্রিন্সের কাছ থেকে একটা জঙ্গল কিনে ব্যবসা শুরু করেছিল, আজ সেখানে তার একটা বাড়ি, একটা সরাইখানা ও একটা ফসল কেনাবেচার দোকান হয়েছে। শক্ত শরীর, লাল মুখ, বছর চল্লিশ বয়স, পুরু ঠোঁট, থ্যাবড়া নাকের উপর একটা আব, কালো ভুরুর উপর আরো কয়েকটা আব, পেটটি নাদা।

সুতির শার্টের উপর ওয়েস্টকোট পরে ফেরাপত্তভ দোকানের সামনে রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়েছিল। আলপাতিচকে দেখে এগিয়ে গেল।

বলল, এস, এস ইয়াকভ আলপাতিচ। সকলে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, আর তুমি শহরে এলে।

শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে কেন? আলপাতিচ শুধাল।

 আমিও তাই বলি। লোকগুলো বোকার ডিম! ফরাসিদের ভয়েই মরে।

 মেয়েরাই যত গণ্ডগোল বাধায় আলপাতিচ বলল।

আমিও তাই মনে করি ইয়াকভ আলপাতিচ। আমি বলি : হুকুম হয়ে গেছে তাদের ঢুকতে দেওয়া হবে না, বাস, সব ঠিক হ্যায়। আর চাষীরা সব গাড়ির ভাড়া হাঁকছে তিন রুবল–এটা খৃস্টানের মতো কাজ নয়!

ইয়াকভ আলপাতিচ কথাগুলি শুনল, কিন্তু মন দিল না। নিজের জন্য একটা সামোভার আর ঘোড়ার জন্য খড় চাইল, তারপর চা খেয়ে শুয়ে পড়ল।

সারারাত সরাইখানার পাশ দিয়ে সৈন্য চলতে লাগল। পরদিন সকালে গায়ে জ্যাকেট চড়িয়ে আলপাতিচ কাজে বেরিয়ে গেল। সকালেই রোদ উঠেছে, আটটা বাজতেই বেশ গরম বোধ হতে লাগল। আলপাতিচ ভাবল, ফসল কাটার পক্ষে বড় ভালো দিন।

খুব সকাল থেকেই শহর থেকে দূরে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আটটা বাজতেই বন্দুকের গুলির সঙ্গে যুক্ত হল কামানের গর্জন। রাস্তায় লোকজনের ব্যস্ত চলাফেরা, অনেক সৈন্যও চলছে, আবার গাড়ি ঘোড়াও ছুটছে, দোকানি দোকানে বসেছে, গির্জায়-গির্জায় যথারীতি প্রার্থনা হচ্ছে। আলপাতিচ দোকানে গেল, সরকারি আপিসে গেল, ডাকঘরে গেল, শাসনকর্তার ভবনে গেল। আপিসে, দোকানে, ডাকঘরে সর্বত্রই লোক সৈন্যদের কথা ও আক্রমণকারী শত্রুদের কথাই বলাবলি করছে, কি করা উচিত জানতে চাইছে, আর পরস্পরকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে।

শাসনকর্তার বাসভবনের সামনে আলপাতিচ দেখতে পেল অনেক লোকের ভিড়, কসাকরাও আছে শাসনকর্তার দূরপাল্লার গাড়িটিও দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফটকে দুইজন ভূস্বামীর সঙ্গে তার দেখা হল। তাদের একজনকে সে চেনে। পুলিশের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন সেই লোকটি রেগে বলছে :

জানেন এটা ঠাট্টার কথা নয়। আপনি যদি একা হন তো কোনো কথা নেই। কথায় বলে, একজনের বিপদ হলে একজনই যাবে, কিন্তু এ যে তেরোজনের একটা পরিবার ও সমস্ত সম্পত্তির ব্যাপার।…এরা আমাদের সর্বনাশ করে দিল! কেমনধারা শাসনকর্তা এরা সব? এদের ফাঁসি দেওয়া উচিত-ডাকাতের দল!…

হয়েছে, হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর একজন বলল।

শুনুক না! আমি কার তোয়াক্কা করি? আমরা তো কুকুর নই, কথাগুলি বলে পুলিশের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন মুখ ঘোরাতেই আলপাতিচকে দেখতে পেল।

আরে, ইয়াকভ আলপাতি, তুমি কি জন্য এসেছ?

হিজ এক্সেলেন্সির হুকুম, শাসনকর্তার সঙ্গে দেখা করতে হবে, কোটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে আলপাতিচ সগর্বে জবাব দিল। …তিনি হুকুম করেছেন, আসল অবস্থাটা জেনে যেতে হবে।

তাই যাও, জেনে এস, কুদ্ধ ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বলল। এরা সব এমন হাল করে তুলেছে যে না আছে একটা গাড়ি, না কিছু!…ওই যে আবার শুনতে পাচ্ছ? যেদিক থেকে গুলির শব্দ ভেসে এল সেইদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল।

আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়ল…ডাকাতের দল! বলতে বলতে সে ফটকের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।

আলপাতিচ মাথা দুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। প্রতীক্ষা-ঘরে ব্যবসায়ী স্ত্রীলোক ও কর্মচারীরা নিঃশব্দে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। শাসনকর্তার ঘরের দরোজা খুলল, সকলেই এগিয়ে গেল। জনৈক কর্মচারী দৌড়ে বেরিয়ে এসে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলল, গলায় ক্রুশ-ঝোলানো একজন কর্মচারী ভিতরে আসতে বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আলপাতিচ সামনে এগিয়ে গেল এবং কর্মচারীটি আবার বেরিয়ে আসতেই একটা হাত বোতাম-আঁটা কোটের উপর রেখে তাকে ডেকে দুটো চিঠি তার হাতে দিল।

প্রধান সেনাপতি প্রিন্স বলকনস্কির কাছ থেকে হিজ অনার ব্যারন আশকে, এমন গম্ভীরভাবে সে কথাগুলি বলল যে কর্মচারীটি তার দিকে ঘুরে চিঠি দুখানা নিল।

কয়েক মিনিট পরেই আলপাতিচকে ভিতরে ডেকে শাসনকর্তা তাড়াতাড়ি করে তাকে বলল :

প্রিন্স ও প্রিন্সেসকে জানিও যে আমি কিছুই জানতাম না, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতোই আমি কাজ করেছি-এই নাও… একটা কাগজ আলপাতিচের হাতে দিল। তবু প্রিন্স যখন অসুস্থ তখন আমার পরামর্শ হল, তাদের মস্কো চলে যাওয়াই উচিত। আমিও এখনই রওনা হচ্ছি। তাদের বলে দিও…

শাসনকর্তার কথা শেষ হল না, ধূলিধূসরিত, ঘর্মাক্তদেহে জনৈক কর্মচারী ছুটে ঘরে ঢুকে ফরাসিতে শাসনকর্তাকে কি যেন বলল। শাসনকর্তার মুখে ত্রাসের চিহ্ন ফুটে উঠল।

আলপাতিচের দিকে মাথা নেড়ে চলে যাও বলেই সে কর্মচারীটিকে প্রশ্ন করতে শুরু করল।

 আলপাতিচ বেরিয়ে আসতে সকলেই উৎসুক, ভয়ার্ত, অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। গুলি-গোলার শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। আলপাতিচ দ্রুতগতিতে সরাইখানায় ফিরে গেল। শাসনকর্তা তাকে যে কাগজখানা দিয়েছে তাতে লেখা আছে, আপনাকে নিশ্চিত করে বলছি, এখনো পর্যন্ত স্মোলেনঙ্কের তিলমাত্র বিপদ নেই, আর কোনোরকম বিপদ ঘটবার সম্ভাবনাও নেই। একদিক থেকে আমি আর অন্যদিক থেকে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন এগিয়ে আসছে স্মোলেনঙ্কের আগেই একত্রে মিলিত হবে, ১১ তারিখেই সে মিলন ঘটবে, যে প্রদেশের নিরাপত্তার ভার আপনার উপর ন্যস্ত আছে সেখানকার সহকর্মী বন্ধুদের রক্ষা করতে সেনাদলের সম্মিলিত শক্তি ততদিন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে যতদিন শত্রুসৈন্য আমাদের পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত না হবে, অথবা আমাদের সাহসী সেনাদলের শেষ যোদ্ধাটির মৃত্যু না হবে। এর থেকেই বুঝতে পারবেন যে আলেঙ্কের অধিবাসীদের আশ্বাস দেবার সম্পূর্ণ অধিকার আপনার আছে, কারণ এমন দুটি সাহসী সেনাদলের দ্বারা সুরক্ষিত থেকে তারা জয়লাভ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। (১৮১২ সালে স্মোলেনস্কের অসামরিক শাসনকর্তা ব্যারন আশকে প্রেরিত বার্কলে দ্য তলির নির্দেশ।)

লোকজন উদ্বেগের সঙ্গে রাজপথে ঘুরছে।

গৃহস্থালির বাসনপত্র, চেয়ার ও কাবার্ডে বোঝাই গাড়িগুলো উঠোনের ফটক দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা বরাবর এগিয়ে চলেছে। ফেরাপন্তভের পাশের বাড়ির সামনেও মালপত্র বোঝাই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, বিদায় নেবার কালে মেয়েরা হা-হুঁতাশ করে কাঁদতে লাগল। একটা ছোট কুকুর ঘেউ-ঘেউ করতে করতে ঘোড়ার সামনে ছুটে চলল।

আলপাতিচ দ্রুততর পায়ে সরাইখানার উঠোনে ঢুকে যেখানে তার ঘোড়া ও গাড়ি রয়েছে সেখানে গেল। কোচোয়ানটি ঘুমিয়ে আছে। তাকে ডেকে তুলে ঘোড়া জুড়তে বলে বারান্দায় উঠে গেল। গৃহকর্তার ঘর থেকে ভেসে এল একটি শিশুর কান্না, একটি স্ত্রীলোকের হতাশ চাপা আর্তনাদ, আর ফেরাপভের ক্রুদ্ধ চিৎকার। আলপাতিচ ঢুকতেই রাঁধুনিটি ভয়ার্ত মুরগির মতো ছুটাছুটি করতে লাগল।

লোকটি বৌকে মেরে ফেলল। কত্রীকে মেরে ফেলল।…খুব মারছে…এইভাবে টানতে টানতে নিয়ে গেছে!… ।

কিসের জন্য? আলপাতিচ শুধাল।

এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। মেয়েমানুষ তো! সে বলছে, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল, ছোট ছোট বাচ্চাগুলি সমেত আমাকে মেরে ফেলো না। সকলেই তো চলে যাচ্ছে, তাহলে তুমি যাবে না কেন? আর অমনি কর্তা তাকে মারতে মারতে এইভাবে টানতে টানতে নিয়ে গেল!

একথা শুনে আলপাতিচ এমনভাবে ঘাড় নাড়ল যেন কাজটা সে সমর্থনই করছে। লোকটার কথায় কান দিয়ে সে সরাইওয়ালার ঘরের উল্টো দিকের ঘরের দরোজার দিকে এগিয়ে গেল, যেসব জিনিস সে কিনেছে সব সেখানেই রাখা হয়েছে।

তুমি পশু, তুমি খুনী, বলতে বলতে একটি শুকনো, বিবর্ণ স্ত্রীলোক দরোজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে এল। তার কোলে একটি বাচ্চা, মাথার রুমাল ছেঁড়া।

তার পিছন পিছন বেরিয়ে এল ফেরাপন্তভ, কিন্তু আলপাতিচকে দেখে ওয়েস্টকোটটা টেনে তুলে মাথার চুল ঠিক করে একটা হাই তুলল, তারপর আলপাতিচকে অনুসরণ করে উল্টো দিকের ঘরটাতে ঢুকল।

এরই মধ্যে যাচ্ছ?

তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে আলপাতিচ জানতে চাইল তার কত পাওয়া হয়েছে।

হিসাব করে দেখতে হবে। আচ্ছা, তুমি তো শাসনকর্তার বাড়ি গিয়েছিলে? কি স্থির হল? ফেরাপভ শুধাল।

আলপাতিচ জবাব দিল, শাসনকর্তা স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।

ফেরাপভ বলল, এইসব ব্যবসাপত্তর গুটিয়ে আমরা কেমন করে চলে যাব বল? দরগোবুঝ পর্যন্ত একটা বোঝাই গাড়ি নিতে দিতে হবে সাত রুবল। আমিও বলে দিয়েছি, যারা এত টাকা দাবি করে তারা খৃষ্টান নয়। এদিকে গত বৃহস্পতিবারে সেলিভানভ আচ্ছা একটা দাও মেরেছে-বস্তাপ্রতি নয় রুবল দামে সেনাদলের কাছে ময়দা বিক্রি করে দিয়েছে। একটু চা খাবে তো?

চা খেতে খেতে তারা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করল। তৃতীয় কাপ শেষ করে উঠতে উঠতে ফেরাপন্তভ বলল, আচ্ছা, এখন যেন অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। আমাদের নিশ্চয় একহাত নিয়েছে। হুকুম ছিল, শত্রুকে যেন ঢুকতে দেওয়া না হয়। কাজেই মনে হচ্ছে…লোকে বলছে, এই তো সেদিন ম্যাথু আইভনিচ প্লাতভ তাদের একেবারে মারিনা নদী পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে একদিনে আঠারো হাজারকে ডুবিয়ে মেরেছে।

পোটলা-পুঁটলি একত্র করে আলপাতিচ সেগুলি কোচয়ানের হাতে তুলে দিল, তারপর সরাইওয়ালার সঙ্গে হিসাব করতে বসল। একটা ছোট গাড়ি ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেল, তার চাকা, ক্ষুর ও ঘন্টার শব্দ শোনা গেল।

বেলা পড়ে এসেছে। রাস্তার অর্ধেকটার উপর ছায়া পড়েছে, বাকি অর্ধেকটা রোদে ঝলমল করছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আলপাতিচ দরোজার কাছে গেল। হঠাৎ অনেক দূর থেকে একটা বিচিত্র শিসের শব্দ ভেসে এল, শোনা গেল ধপধপ শব্দ, তার ঠিক পরেই শোনা গেল কামানের গর্জন, ঘরের জানালাগুলো খট-খট করে উঠল।

সে বাইরে গিয়ে পথে নামল। দুটি লোক ছুটতে ছুটতে তার পাশ দিয়ে সেতুর দিকে চলে গেল। নানা দিক থেকে সেই শিস এবং কামানের গোলা ফাটার ও গোলার টুকরোগুলো শহরের উপর ছিটকে পড়ার শব্দ আসতে লাগল। কিন্তু শহরের বাইরে গোলাগুলির যে শব্দ হচ্ছে তার তুলনায় এ শব্দ এতই অস্পষ্ট যে তা লোকজনের কানেই গেল না। নেপোলিয়নের হুকুমে চারটের পর থেকে যে একশ ত্রিশটা কামান আনা হয়েছে তা থেকেই শহরের উপর বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। লোকজনরা প্রথমে এই গোলাবর্ষণের অর্থ বুঝতে পারেনি।

প্রথমে গোলা ও বোমা পড়ার শব্দে লোকজন শুধু কৌতূহলই বোধ করছিল। চালার নিচে দাঁড়িয়ে ফেরাপভের বৌ এতক্ষণ পর্যন্ত কান্নাকাটি চালিয়ে এবার চুপ করল, বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ফটকের কাছে গিয়ে নীরবে লোকজনদের দিকে তাকিয়ে সেই শব্দ শুনতে লাগল।

রাধুনি ও দোকানের সহকারীটিও ফটকে এসে দাঁড়াল। মাথার উপর দিয়ে যে গোলাগুলিগুলো ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে উড়ে যাচ্ছে, একান্ত কৌতূহলের সঙ্গে সকলেই সেগুলোকে একবার দেখতে চেষ্টা করছে। কয়েকটি লোক মোড় ঘুরে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এল।

একজন বলল, কী শক্তি দেখেছ! বাড়ির ছাদ ও সিলিং উড়িয়ে একেবারে ছাতু করে দিল।

 আর একজন বলল, মাটিটাকে খুঁড়ে ফেলল শুয়োরের মতো।

প্রথম লোকটি হেসে উঠল, ভারি চমৎকার, এতে মনে সাহস আসে! ভাগ্য ভালো যে তুমি লাফ দিয়েছিলে, নইলে তো তোমাকে একেবারে সাফ করে দিত!

আরো লোক এসে জড় হল। নানা আলোচনা হতে লাগল। ইতিমধ্যে আরো বেশি সংখ্যায় কামানের গোলা ও খোল শোঁ শোঁ শব্দে মাথার উপর দিয়ে অনবরত উড়ে যেতে লাগল, কোনোটাই তাদের কাছাকাছি পড়ল না, সবই উড়ে চলে গেল, আলপাতিচ গাড়িতে উঠছে। সরাইওয়ালা ফটকে দাঁড়িয়ে আছে।

রাধুনিটি লাল ঘাঘরা পরে আস্তিন গুটিয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে সকলের কথাবার্তা শুনছিল। তাকে ধমক দিয়ে সরাইওয়ালা বলল, ওখানে হাঁ করে কি দেখছ?

কী আশ্চর্য ব্যাপার! বলে চেঁচিয়ে উঠেই মনিবের গলা শুনে আস্তিন নামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

আবার সেই শিসের শব্দ, কিন্তু এবার খুব কাছে, একটা ছোট পাখির মতো শো করে নিচে নেমে এল, রাস্তার মাঝখানে একটা আগুনের শিখা ঝিলিক দিল, একটা কিছু ফাটল, রাস্তাটা ধোয়ায় ঢেকে গেল।

হারামজাদী! ওখানে কি হচ্ছে? সরাইওয়ালা রাঁধুনির দিকে ছুটে গেল।

ঠিক সেইমুহূর্তে নানাদিক থেকে নারীকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ ভেসে এল, বাচ্চাটা ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে দিল, ভিড়ের লোকজনরা, পাংশুমুখে রাঁধুনিকে ঘিরে দাঁড়াল। তার চিৎকারই সবচাইতে জোরে শোনা যাচ্ছে।

ও-হো-হো! বাছারা আমার, বাবারা আমার! আমাকে মেরে ফেলো না! বাবারা আমার!…।

পাঁচ মিনিট পরে রাস্তায় একটি লোকও রইল না। বোমার টুকরো লেগে রাঁধুনিটির উরু ভেঙেছে। তাকে রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আলপাতি, তার কোচোয়ান, ফেরাপভের বৌ ও ছেলেমেয়েরা, বাড়ির কুলি–সকলেই মদের ঘরে বসে কান পেতে আছে। কামানের গর্জন, উড়ন্ত গোলার ফুলকি, রাঁধুনিটির করুণ আর্তনাদ,-একমুহূর্তও এসবের বিরাম নেই।

সন্ধ্যার দিকে কামানের গর্জন থেমে এল। আলপাতিচ ঘর থেকে বেরিয়ে দরোজায় দাঁড়াল। সন্ধ্যার পরিষ্কার আকাশ ধোয়ায় ঢেকে আছে, তার ভিতর দিয়ে অনেক উঁচুতে কাস্তের মতো নতুন চাঁদটাকে আশ্চর্য দেখাচ্ছে। গোলাগুলির শব্দ থেমে যাওয়ায় শহরটা কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে, শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ, আর্তনাদ, দূরাগত চিৎকার, আর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া আগুনের ফট-ফট শব্দ। রাধুনিটির আর্তনাদও কমেছে। নানারকম পোশাকধারী সৈন্যরা পথে পথে হাঁটছে বা ইতস্তত ছুটছে-ভাঙা পিঁপড়ের ঢিবি থেকে পিঁপড়েগুলো যেভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক সেইভাবে। আলপাতিচের চোখের সামনেই কয়েকটি সৈনিক ফেরাপভের উঠোনে ঢুকে গেল। আলপাতিচ ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। একটা পশ্চাদপসরণকারী রেজিমেন্ট এসে ভিড় করে রাস্তাটাই আটকে ফেলল।

আলপাতিচকে দেখে একজন অফিসার বলল : শহর পরিত্যক্ত হচ্ছে। পালাও, পালাও! তারপর সৈন্যদের দিকে ফিরে বলল : লোকের উঠোনে ঢোকার মজাটা দেখাচ্ছি।

আলপাতিচ বাড়ির ভিতর ফিরে গিয়ে কোচোয়ানকে ডেকে তখনই যাত্রা করতে বলল। ফেরাপভের গোটা পরিবারটিও তাদের পিছন পিছনই বেরিয়ে এল। মেয়েরা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, হঠাৎ গোধূলির অস্পষ্ট আলোয় আগুন ও ধোয়া দেখতে পেয়ে নতুন করে কান্না জুড়ে দিল, আর যেন তারই জবাব দিতে রাজপথের নানাদিক থেকে ভেসে এল আর্ত কণ্ঠস্বর। চালার ভিতর আলপাতিচ ও কোচোয়ান কাঁপা হাতে ঘোড়াগুলোকে গাড়িতে যুততে লাগল।

ফটক দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আলপাতিচ দেখতে পেল, জনাদশেক সৈন্য ফেরাপভের খোলা দোকানে ঢুকে গলা ছেড়ে কথা বলছে আর তাদের থলেয় ও বস্তায় ভরছে ময়দা আর সূর্যমুখীর বীচি। ঠিক তখনই ফেরাপভ বাইরে থেকে ফিরে দোকানে ঢুকল। সৈন্যদের দেখে চিৎকার করতে গিয়েও হঠাৎ সে থেমে গেল, তারপর নিজের মাথার চুল টেনে ধরে একই সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে ও হাসতে হাসতে বলল, লুট কর, সব লুট কর বাছারা! ঐ শয়তানরা যেন কিছু না পায়! বলতে বলতে সে নিজেই কয়েকটা বস্তা রাস্তায় ফেলে দিল।

কয়েকটি সৈনিক ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল, অন্যরা থলেভর্তি করার কাজেই ব্যস্ত রইল। আলপাতিচকে দেখতে পেয়ে ফেরাপভ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে বলল :

রাশিয়ার হয়ে গেল! আমি নিজেই জ্বালিয়ে দেব। আমরাও শেষ হয়ে গেলাম!… ফেরাপত্তভ উঠোনের দিকে ছুটে গেল।

সৈন্যরা জলস্রোতের মতো এগিয়ে চলেছে, ফলে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ আটকে গেছে, বের হতে না পেরে আলপাতিচ অপেক্ষা করতে লাগল। ফেরাপভের বৌ ও ছেলেমেয়েরাও একটা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে, কতক্ষণে পথ খুলবে কে জানে।

রাত হল। আকাশে তারা ফুটল। ধোয়ার আড়াল থেকে নতুন চাঁদ উঁকি দিল। সারি সারি সৈন্য ও অন্য যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে এসে আলপাতিচের গাড়ি এবং সরাইওয়ালার বৌয়ের গাড়ি নীপার নদীর উত্রাইয়ের মুখে পৌঁছে থেমে গেল। চৌমাথার মোড়ের কাছে একটা গলিতে একটা বাড়ি ও কয়েকটা দোকান পুড়ছে। আগুন প্রায় নিভে এসেছে। সেখানে অনেক মানুষের ভিড় ও হৈ-হল্লা। গাড়িটা বেশ কিছুক্ষণ এগোতে পারবে না বুঝতে পেরে আলপাতিচ গাড়ি থেকে নেমে অগ্নিকাণ্ড দেখতে এগিয়ে গেল। সৈনিকরা অনবরত যাওয়া-আসা করছে। দুটি সৈনিক ও পশমী কোট-পরা একটি লোক একটা জ্বলন্ত কড়ি-কাঠকে টানতে টানতে রাস্তার ওপারের উঠোনে নিয়ে যাচ্ছে, অন্যরা নিয়ে যাচ্ছে আঁটি-আঁটি খড়।

ওদিকে একটা উঁচু গোলাবাড়ি জ্বলছে। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। আলপাতিচ সেইদিকে এগিয়ে গেল। দেয়ালগুলো জ্বলছে, পিছনের দেয়ালটা ভেঙে পড়েছে, কাঠের ছাদটা পড়-পড়, বরগাগুলিও জ্বলছে। ভিড়ের লোকজন ছাদটা ভেঙে পড়ার জন্যই অপেক্ষা করছে, আলপাতিওঁ তাই দেখছে।

আলপাতিচ। হঠাৎ পরিচিত গলায় কে যেন বুড়ো মানুষটিকে ডাকল।

ছোট প্রিন্সের গলা চিনতে পেরে আলপাতিচ সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমাদের বাঁচান! ইয়োর এক্সেলেন্সি!

ভিড়ের পিছনে ঘোড়ার পিঠে বসে প্রিন্স আন্দ্রু আলপাতিচের দিকে তাকিয়ে ছিল।

তুমি এখানে কেন? সে শুধাল।

আপনার…ইয়োর এক্সেলেন্সি, বিড়বিড় করে কথা বলতে গিয়েই আলপাতিক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সত্যি কি আমাদের সর্বনাশ হয়েছে? কথা!…

প্রিন্স আন্দ্রু আবার বলল, তুমি এখানে কেন?

ঠিক সেইসময় আগুনটা জ্বলে ওঠায় তরুণ মনিবের ক্লান্ত, বিবর্ণ মুখটা সে দেখতে পেল। কেন সে এখানে এসেছে, আর এখন যেতে পারছে না সেই কথাই সে বুঝিয়ে বলল।

তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু একটা নোট-বই বের করল, একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে হাঁটুটা উঁচু করে তার উপর রেখে পেন্সিল দিয়ে লিখতে লাগল। বোনকে লিখল :

ম্মেলনস্ক আত্মসমর্পণ করতে চলেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই শত্রুরা বন্ড হিলস দখল করে নেবে। অবিলম্বে মস্কো যাত্রা কর । কখন রওনা হচ্ছ আমাকে জানাও। বিশেষ দূত মারফৎ উসভিয়াঝ-এ খবর দাও।

লেখা শেষ করে কাগজটা আলপাতিচের হাতে দিয়ে প্রিন্সেস, তার ছেলে ও ছেলের শিক্ষকের যাত্রার কি ব্যবস্থা করতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে কোথায় তাকে জানিয়ে দিতে হবে সব কথা প্রিন্স আন্দ্রু তাকে বুঝিয়ে বলে দিল। কথা শেষ করার আগেই সেনাদলের জনৈক প্রধান কর্তা দলবলসহ ঘোড়ায় এসে হাজির হল।

প্রধান কর্তাটি জার্মান উচ্চারণে চেঁচিয়ে বলল, আপনি না একজন কর্নেল? দলের আর একজন বলল, আপনার চোখের সামনে বাড়িঘর পুড়ছে, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন! এর অর্থ কি? আপনাকে এর কৈফিয়ৎ দিতে হবে! কথাগুলি বলল বের্গ, সে এখন প্রধান কর্তার সহকারী হয়েছে, বের্গের মতে পদটি মনের মতো আর সকলের নজরে পড়বার মতোও বটে।

প্রিন্স আন্দ্রু চোখ তুলে তাকাল, কোনো জবাব না দিয়ে আলপাতিচের সঙ্গেই কথা বলতে লাগল।

তাদের বল, ১০ই পর্যন্ত তাদের খবরের জন্য অপেক্ষা করব, যদি ১০ইর মধ্যে তাদের যাত্রার খবর না পাই তাহলে সব ফেলে রেখে আমি নিজেই বল্ড হিলসে চলে যাব।

প্রিন্স আন্দ্রুকে চিনতে পেরে বের্গ বলল, প্রিন্স, কথাগুলি আমাকে বলতে হল কারণ আমাকে হুকুম মেনে চলতে হয়, কারণ আমি সবসময়ই ঠিক ঠিক মতো হুকুম মেনেই চলি…তুমি আমাকে মাফ কর।

আগুনের মধ্যে কি যেন ফাটল। মুহূর্তের জন্য আগুনটা কমে গেল, ছাদের নিচ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠতে লাগল। আর একটা শব্দ করে একটা ভারি কিছু ভেঙে পড়ল।

গোলাবাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ার শব্দের প্রতিধ্বনি করে সকলে চেঁচিয়ে উঠল : উ-রু-রু! পোড়া ফসলের একটা পিঠে-পিঠে গন্ধ পাওয়া গেল। আবার আগুনের শিখা জ্বলে উঠল, উজ্জীবিত, আনন্দিত, ক্লান্ত মুখগুলি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

পশমী কোট-পরা লোকটি দুই হাত তুলে চিৎকার করে বলল, ভালোই হল হে বাছারা! আবার জ্বলে উঠছে। চমৎকার!

আরে, এ যে মালিক স্বয়ং, কয়েকজন চেঁচিয়ে বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু আলপাতিচকে বলল, আচ্ছা, তাহলে যেমন যেমন বললাম তেমনটি তাদের বলে দিও। বের্গ চুপচাপ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে একটি কথাও না বলে সে গলি-পথ ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

.

অধ্যায়-৫

স্মোলেনস্ক থেকে সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করছে, পিছন থেকে তাড়া করছে শত্রু। ১০ আগস্ট প্রিন্স আন্দ্রুর নেতৃত্বাধীন সেনাদলটি বল্ড হিলসে যাবার পথকে পাশ কাটিয়ে বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। তিন সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল গরম ও অনাবৃষ্টি সমানে চলেছে। প্রত্যেকদিন পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আকাশে ভেসে বেড়ায়, মাঝে মাঝে সূর্যকে ঢেকে ফেলে, কিন্তু সন্ধ্যার দিকে আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে যায়, লাল-বাদামি কুয়াশার মধ্যে সূর্য অস্ত যায়। রাতের ভারি শিশিরপাতে ধরণি সতেজ হয়ে ওঠে। মাঠের ফসল রোদে পুড়ছে, বীজগুলি ঝরে পড়ছে। বিল-বাওর শুকিয়ে গেছে। রোদে-পোড়া মাঠে খাবার না খেয়ে গরু-মোষরা ক্ষিধেয় হাম্বা-হাম্বা ডাকছে। একমাত্র রাতের বেলা যখন জঙ্গলে শিশির পড়ে তখন একটা সতেজ ভাব চোখে পড়ে, কিন্তু যে বড় রাস্তা ধরে সৈন্যরা মার্চ করে চলেছে সেখানে তিলমাত্র সজীবতা চোখে পড়ে না : ছ ইঞ্চিরও বেশি ধুলোয় ঢাকা পথে সজীবতার চিহ্নমাত্র নেই, দিনের শুরু হতেই মার্চ শুরু হয়ে যায়। কামানবাহী গাড়ি ও মালবাহী গাড়িগুলো সেই ঘন ধুলোর ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলে, গাড়ির চাকা পর্যন্ত ধুলো ওড়ে, পদাতিক বাহিনী সেই গরম, দমবন্ধ করা গরম ধুলোর ভিতর গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে এগিয়ে চলে, ধুলোর সে গরম রাতেও ঠাণ্ডা হয় না। সূর্য যত উপরে উঠতে থাকে, সেই ধুলোর মেঘও ততই উপরে উঠতে থাকে, গরম ধুলোর পর্দার ভিতর দিয়ে খালি চোখেও সূর্যের দিকে তখন তাকানো যায়, মেঘহীন আকাশে সূর্যটাকে দেখায় একটা রক্তবর্ণ গোলকের মতো। বাতাস নেই, সেই নিশ্চল আবহাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে। নাক ও মুখের উপর রুমাল বেঁধে সৈন্যরা এগিয়ে গেল। যখনই কোনো গ্রামের পাশে পৌঁছয় তখন সকলে কুয়োর ধারে ছুটে যায়, জলের জন্য মারামারি করে, জলে টান পড়ে কাদা পর্যন্ত নেমে যায়।

একটা রেজিমেন্টের ভার প্রিন্স আন্দ্রুর ঘাড়ে, তাদের বিধি-ব্যবস্থা করা, ভালো-মন্দের দিকে লক্ষ রাখা, হুকুম নেওয়া ও হুকুম দেওয়া–এই নিয়েই সে ডুবে থাকে। স্মোলেনস্ক জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে ছেড়ে আসা তার জীবনের একটা যুগান্তকারী ঘটনা। শত্রুর প্রতি এক বিচিত্র ক্রোধের অনুভূতি তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে নিজের দুঃখ। রেজিমেন্টের কাজেই সে নিবেদিত প্রাণ, নিজের সৈন্য ও অফিসারদের প্রতি সে সুবিবেচক ও সদয় । রেজিমেন্টে সকলে তাকে বলে, আমাদের প্রিন্স, তার জন্য গর্ববোধ করে, তাকে ভালোবাসে। কিন্তু রেজিমেন্টের তিমোখিনদের মতো শুধু সেইসব লোকদের প্রতিই সে সদয় ও ভদ্র যারা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন, অন্য জগতের মানুষ, যারা তার অতীতকে জানে না এবং বোঝে না। কিন্তু যেই কোনো পরিচিত লোকের সঙ্গে অথবা কর্মচারীদের কারো সঙ্গে তার দেখা হয়, সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ে যেন কাঁটা ফুটে ওঠে, তার মনে দেখা দেয় বিদ্বেষ, বিদ্রূপ, আর ঘৃণা। যা কিছু অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাই তার কাছে অবাঞ্ছিত, কাজেই পূর্ব পরিচিতদের সঙ্গে ব্যবহারে সে চেষ্টা করে শুধু নিজের কর্তব্যটুকু পালন করতে, তাদের প্রতি অসঙ্গত ব্যবহার না করতে।

বস্তুত, প্রিন্স আন্দ্রুর চোখে সবকিছুই অন্ধকার ও বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে সেইদিন থেকে যেদিন ৬ আগস্ট তারিখে সে ম্যালেনস্ক ছেড়ে এসেছে। (তার ধারণা শহরটা রক্ষা করা যেত এবং রক্ষা করাই উচিত ছিল) এবং যেদিন তার নিজের হাতে গড়া বড় আদরের বন্ড হিলস-কে লুণ্ঠনকারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তার রুগ্ন বাবাকে মস্কো পালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রেজিমেন্টকেই ধন্যবাদ যে অন্তত তার ভাবনা নিয়েই সে সময় কাটাতে পারছে। দুদিন আগেই সে খবর পেয়েছে যে তার বাবা, ছেলে ও বোন মস্কো রওনা হয়ে গেছে। তাই বল্ড হিলসে কিছু করার না থাকলেও যেন নিজের দুঃখকে বাড়িয়ে তুলতেই প্রিন্স আন্দ্রু স্থির করল, তাকে একবার সেখানে যেতেই হবে।

ঘোড়াকে জিন পরাতে বলে এবং রেজিমেন্টকে মার্চ করার হুকুম দিয়ে সে তার বাবার সেই বাড়ির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল যেখানে সে জন্মেছে, শৈশব কাটিয়েছে। পাথরের ফটকে একটাও লোক দেখতে পেল না, দরোজাটা খোলা পড়ে আছে। বাগানের পথে এর মধ্যেই ঘাস গজিয়েছে, কাঁচ-ঘরের কিছু কিছু কাঁচ ভেঙেছে, গাছের টবগুলি কিছু উল্টে পড়েছে, কিছু শুকিয়ে গেছে। মালি তারাসকে ডাকল, কেউ সাড়া দিল না। ছেলেবেলায় প্রিন্স আন্দ্রু একটা বুড়ো চাষীকে প্রায়ই ফটকে বসে থাকতে দেখত, এখন সে বাগানের একটা সবুজ আসনে বসে বাকলের জুতো তৈরি করছে।

লোকটা কালা, তাই প্রিন্স আন্দ্রুর ঘোড়ার শব্দ শুনতে পায়নি। যে আসনে বুড়ো প্রিন্স বসতে ভালোবাসত লোকটা সেই আসনটিতেই বসেছে, তার পাশে ম্যাগনোলিয়ার একটা ভাঙা শুকনো ডালে অনেকগুলো বাকলের টুকরো ঝুলছে।

প্রিন্স আন্দ্রু বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পুরনো বাগানের বেশ কয়েকটা গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, একটা ছিট-ছিট ঘোড়া ও তার বাচ্চা সামনের গোলাপ বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাত্র একটা খোলা জানালা ছাড়া অন্য সব খড়খড়ি বন্ধ। একটি ভূমিদাস ছেলে তাকে দেখেই বাড়ির মধ্যে ছুটে গেল। পরিবারের সকলকে পাঠিয়ে দিয়ে আলপাতিচ একাই বল্ড হিলসে আছে, ভিতরে বসে সন্ত জীবনী পড়ছে। প্রিন্স আন্দ্রু এসেছে শুনে নাকের উপর চশমা ঝুলিয়ে কোটের বোম আঁটতে আঁটতে সে সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এল, একটা কথাও না বলে কাঁদতে কাঁদতে প্রিন্স আন্দ্রুর হাঁটুতে চুমো খেতে লাগল।

তারপর নিজের দুর্বলতায় নিজেই বিরক্ত হয়ে সব কথা খুলে বলতে শুরু করল। মূল্যবান সামগ্রী যা কিছু সবই বোগুচারভোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্তর কোয়ার্টার (১ কোয়ার্টার=একের চার হর) ফসলও গাড়ি বোঝাই করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বছর ফসল খুবই ভালো হয়েছিল, কিন্তু পাকবার আগেই সৈন্যরা এসে সব কেটে নিয়ে গেছে। চাষীদের সর্বনাশ হয়েছে, অনেকেই বোণ্ডচারভোতে চলে গেছে, কয়েকজন মাত্র এখানে আছে।

তার কথা শেষ হবার আগেই প্রিন্স আন্দ্রু শুধাল, আমার বাবা ও বোন কবে গেল? সে মস্কো যাবার কথাই বলল। কিন্তু আলপাতিচ সেটাকে বোগুচারভো যাবার দিন বলে ধরে নিয়ে জানাল যে তারা ৭ তারিখে গেছে এবং তারপরে জমিদারি সংক্রান্ত কথাতেই ফিরে গেল।

জানতে চাইল, একটা রসিদ নিয়ে সবই কি সৈন্যদের দিয়ে দেব? এখনো ছয়শো কোয়ার্টার রয়েছে।

বুড়ো মানুষটির টাকের উপর সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে, তার মুখের ভাব দেখেই বোঝা যায়, এসব প্রশ্নের সময় যে এখন নয় এবং নিজের দুঃখ লাঘব করার জন্যই সে কথাগুলি বলছে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে। তাই প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, একে কী বলি?

মুখে বলল, হ্যাঁ, তাই দাও।

আলপাতিচ বলল, বাগানে কিছু বিশৃঙ্খলা আপনার চোখে পড়েছেই, কিন্তু ওটা বন্ধ করা অসম্ভব। তিন রেজিমেন্ট সৈন্য এখানে রাত কাটিয়ে গেছে, তাদের অধিকাংশই অশ্বারোহী। তাদের কমান্ডিং অফিসারের নাম ও পদমর্যাদা আমি টুকে রেখেছি, একটা নালিশ পেশ করতে হবে।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আচ্ছা, তুমি এখন কি করবে? সৈন্যরা যদি জায়গাটা দখল করে নেয় তাহলেও কি এখানেই থাকবে?

আলপাতিচ প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে মুখ ফেরাল, হঠাৎ গম্ভীরভাবে দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলল। সোচ্চারে বলল, তিনিই আমার আশ্রয়! তার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক!

একদল চাষী খালি মাথায় মাঠ পার হয়ে প্রিন্সের দিকেই আসছে।

আলপাতিচের উপর ঝুঁকে পড়ে প্রিন্স আন্দ্রুর বলল, আচ্ছা, বিদায়! তুমি চলে যাও, যা নিতে পার সঙ্গে নিয়ে যাও, আর ভূমিদাসদের বল রিয়াজান জমিদারিতে অথবা মস্কোর নিকটস্থ জমিদারিতে চলে যেতে।

প্রিন্স আন্দ্রুর পা জড়িয়ে ধরে আলপাতিচ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার হাত থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়র পেটে খোঁচা মেরে ছায়াবীথি ধরে জোরকদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

বুড়ো মানুষটি তখনো সাজানো বাগানেই বসে আছে। দুটি ছোট মেয়ে কাঁচ-ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। তাদের ঘাঘরার কোঁচড়ে কতকগুলি কুড়ানো কুল। তারা প্রিন্স আন্দ্রুর একেবারে সামনে পড়ে গেল। ছোট মনিবকে দেখে বুড়ো লোকটি ভয়ার্ত চোখে মেয়ে দুটিকে টেনে নিয়ে একটা বার্চ গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

সে যে তাদের দেখতে পেয়েছে সেটা বুঝতে না দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু চকিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। ভীত ছোট মেয়েটির জন্য তার দুঃখ হল, তার দিকে তাকাতেও ভয় পেল, তবু তাকে দেখবার একটা দুর্বার বাসনা তাকে পেয়ে বসল। মেয়ে দুটিকে দেখে সে যেন অনুভব করল, তার স্বার্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মানবিক স্বার্থও জগতে আছে, আর সেগুলির দাবি তার নিজের স্বার্থের দাবির মতোই সঙ্গত, সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তি ও সান্ত্বনার একটা নতুন অনুভূতি জাগল তার মনে। সে আর একবার তাদের দিকে ফিরে তাকাল। নিজেদের বিপদ কেটে গেছে বুঝে লুকোবার জায়গা থেকে একলাফে বেরিয়ে এসে তারা কিচির-মিচির করতে করতে ঘাঘরা তুলে মাঠের ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে।

এতক্ষণে ধূলি ধূসরিত বড় রাস্তা ছেড়ে চলবার জন্য প্রিন্স কিছুটা আরাম বোধ করছে। বল্ড হিলসের অদূরেই বড় রাস্তায় পড়ে কিছুটা এগিয়ে একটা ছোট পুকুরের বাঁধের পাশে বিশ্রামরত সৈন্যদের সে ধরে ফেলল। একটা বেজে গেছে। লাল বলের মতো সূর্যটা কালো কোটের ভিতর দিয়ে এসে তার পিঠটাকে যেন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। গুঞ্জনরত সৈন্যদের মাথার উপরে ধুলোর মেঘ যেন নিশ্চল হয়ে ঝুলে আছে। বাতাস নেই। বাধটা পার হতেই পুকুরের তাজা সোঁদা গন্ধ প্রিন্স আন্দ্রুর নাকে এল। যত নোরাই হোক তবু তার ইচ্ছা হল জলে নামে, সে পুকুরের চারদিকটা ভালো করে তাকিয়ে দেখল। সৈনিকদের বিবস্ত্র, শাদা শরীর, তাদের ইট-লাল হাত, গলা ও মুখ জলের মধ্যে হুটোপাটি করায় পুকুরের ঘোলা সবুজ জল বাঁধ উপচে ফুট খানেকের বেশি উঠে গেছে। হাসি ও হুল্লোড়ে উন্মত্ত এই সব শাদা, বিবস্ত্র মানুষগুলি নোংরা পুকুরের জলে বোতলে ভর্তি মাছের মতো এমনভাবে হুটোপাটি করছে যে তার নিজের ফুর্তির ইচ্ছাটাকে কেমন যেন শোচনীয় মনে হতে লাগল।

নদীর তীরে, বাঁধের উপরে, পুকুরের মধ্যে–সর্বত্রই সুস্থ, সবল, শ্বেতকায় নরদেহের মেলা। অফিসার তিমোখিন বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে গা মুছছিল, প্রিন্সকে দেখে কিছুটা বিব্রত হলেও তাকেডেকে কথা বলাটাই সে স্থির করল।

বলল, ভারি সুন্দর ইয়োর এক্সেলিন্সি, চলে আসুন না!

মুখ বেঁকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, বড় নোংরা!

আপনার জন্য এক মিনিটের মধ্যেই পরিষ্কার করে দিচ্ছি, বলে তিমোখিন সেই অবস্থায়ই এগিয়ে গেল।

 প্রিন্স স্নান করতে চাইছেন।

কোন প্রিন্স? আমাদের বলেই সকলে এত তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে পড়ল যে প্রিন্স তাদের বাধা দেবারও সময় পেল না। সে স্থির করল, গোলাবাড়িতেই গাটা ধুয়ে নেবে।

মাংস, দেহ, কামানের খাদ্য! কথাগুলি ভেবে নিজের বিবস্ত্র দেহের দিকে তাকিয়ে সে নিজেই শিউরে উঠল, ঠাণ্ডায় নয়, নোংরা পুকুরের জলে হুটোপাটি করতে ব্যস্ত এইসব মানুষগুলিকে দেখে তার মনে কেমন যেন একটা দুর্বোধ্য বিরক্তি ও আতংকের ভাব দেখা দিল।

.

৭ আগস্ট গোলেন সড়কের উপর তার বাসস্থান থেকে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন এইরকম লিখল :

প্রিয় কাউন্ট আলেক্সিস আন্দ্রিভিচ,-(চিঠিটা আরাকচিভকে লিখলেও সে জানে যে সম্রাট চিঠিটা পড়বে, তাই প্রতিটি শব্দ সে সাধ্যমতো মেপে মেপে বসাতে লাগল।)

আশাকরি মন্ত্রীটি (বার্কলে দ্য তলি) ইতিমধ্যেই শক্রর হাতে স্মালেনস্ক তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে আসাটা খুবই করুণ ও দুঃখদায়ক, এতে গোটা বাহিনীই হতাশ হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম, শেষপর্যন্ত চিঠিও লিখেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই তাকে সম্মত করতে পারলাম না। আমার সম্মানের দোহাই দিয়ে বলছি, এর আগে নেপোলিয়ন কখনো এরকম বিপদে পড়েনি, তার অর্ধেক সৈন্য খুইয়েও সে মোলেনস্ক দখল করতে পারত না। আমাদের সৈন্যরা যেভাবে যুদ্ধ করেছে, এখনো করছে, তেমন যুদ্ধ তারা আগে কখনো করে নি। পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে আমি পঁয়ত্রিশ ঘণ্টা শত্রুকে ঠেকিয়ে রেখেছি, তাকে পরাস্ত করেছি, কিন্তু তিনি চৌদ্দ ঘন্টাও যুদ্ধ করতে রাজি হলেন না। এটা লজ্জাকর, আমাদের সৈন্যদের পক্ষে কলংকস্বরূপ, আর আমার তো মনে হয় এরপরেও তার বেঁচে থাকাই উচিত নয়। তিনি যদি জানিয়ে থাকেন যে আমাদের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তো সেটা সত্যি নয়, হয়তো চার হাজার, তার বেশি নয়, এমন কি তাও নয়, কিন্তু যদি দশ হাজারই হত, তাতেই বা কি, এটা তো যুদ্ধ! কিন্তু শত্রুপক্ষের ক্ষতি হয়েছে স্থূপাকার… ।

আর দুদিন যুদ্ধ চালালে তার কী এমন ক্ষতি হত? তারা নিজেরাই পিছিয়ে যেত, কারণ তাদের কাছে জলই ছিল না–সৈন্যদের নয়, ঘোড়ারও নয়। তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন পশ্চাদপসরণ করবেন না, কিন্তু হঠাৎ হুকুম পাঠালেন, সেই রাতেই পিছু হটবেন। এভাবে যুদ্ধ চালানো যায় না, হয়তো অচিরেই আমরা শত্রুকে মস্কো পর্যন্ত ডেকে নিয়ে আসব…।

একটা গুজব রটেছে যে আপনি সন্ধির কথা ভাবছেন। আমাদের এত ত্যাগ, এই পাগলের মতো পশ্চাদপসরণের পরেও আপনি সন্ধি করবেন-ঈশ্বরের ইচ্ছায় তা যেন না ঘটে! গোটা রাশিয়া তাহলে আপনার উপর ক্ষেপে যাবে, সৈনিকের পোশাক পরতে আমরা প্রত্যেকে লজ্জাবোধ করব। এই যদি অবস্থা হয়ে থাকে-রাশিয়া যতদিন পারবে, যতদিন রাশিয়ার একটি মানুষেরও দাঁড়াবার শক্তি থাকবে ততদিন আমরা যুদ্ধ করব।

সৈন্য পরিচালনার ভার একজনের উপর থাকা উচিত, দুজনের উপর নয়। আপনাদের মন্ত্রীটি মন্ত্রী হিসেবে ভালো হতে পারেন, কিন্তু সেনাপতি হিসেবে তিনি যে খারাপ তাই শুধু নয়, তিনি জঘন্য, অথচ তাঁর হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গোটা দেশের ভাগ্য।…সত্যি, বিরক্তিতে আমি পাগল হয়ে গেছি : আমার এই দুঃসাহসিক লেখার জন্য ক্ষমা করবেন। একথা খুবই পরিষ্কার, যে লোক সন্ধির কথা বলছে, মন্ত্রীর উপর সৈন্য পরিচালনার ভার দিতে বলছে, সে লোক আমাদের সম্রাটকে ভালোবাসে না, সে চায় আমাদের সকলের সর্বনাশ। তাই আমি খোলাখুলি লিখছি : বেসরকারি বাহিনী (militia) কে ডাকুন। কারণ মন্ত্রীটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই আগন্তুকদের মস্কোর পথে নিয়ে চলেছেন। সম্রাটের এড-ডি-কং উলযোগেন সম্পর্কে প্রতিটি সৈন্যের মনে সন্দেহ জেগেছে। আমি যে তার প্রতি ভদ্র ব্যবহার করি তাই শুধু নয়, তার চাইতে প্রবীণ হয়েও কর্পোরালের মতো আমি তাকে মান্য করি। এটা আমার পক্ষে বেদনাদায়ক, তবু আমার আশ্রয়দাতা ও সম্রাটকে ভালোবেসেই আমি তাকে মান্য করি। শুধু আমাদের মতো এমন একটা সৈন্যবাহিনীকে তার মতো লোকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন বলে সম্রাটের জন্য আমার দুঃখ হয়। ভেবে দেখুন, পশ্চাদপসরণের পথে মোট পনেরো হাজারের বেশি সৈনিককে আমরা হয় হারিয়েছি, না হয়তো হাসপাতালে রেখে এসেছি, অথচ আমরা যদি আক্রমণ করতাম তাহলে এমনটি ঘটত না। ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে বলুন এরকম ভয় পাবার জন্য রাশিয়া, জননী রাশিয়া আমাদের কী বলবে? এরকম একটা ইতর লোকের হাতে কেন আমাদের সৎ ও সাহসী পিতৃভূমিকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি? কেন আমাদের প্রজাদের মনে বিদ্বেষ ও লজ্জার বীজ বপন করছি। আমাদের এত ভয়, এত ত্রাস কাকে? এই অস্থিরমতি মন্ত্রীকে আমি দোষ দেই না, সে তো ভীরু, পুরু চামড়া, দীর্ঘসূত্রী-সর্বপ্রকার বদগুণের আধার। সমস্ত বাহিনী আজ শোকমগ্ন, সকলেই তাকে অভিশাপ দিচ্ছে ..

.

অধ্যায়-৬

মানুষের জীবনকে যে অসংখ্য নীতি অনুযায়ী ভাগ করা চলে তার মধ্যে একটি হল-যাদের মধ্যে বস্তুর প্রাধান্য আর যাদের মধ্যে আকারের প্রাধান্য। গ্রাম, মফস্বল, প্রদেশ, এমন কি মস্কোর জীবন থেকেও আলাদা করে এই শেষের শ্রেণীতে ফেলা যেতে পারে পিটার্সবুর্গের জীবনকে, বিশেষ করে তার অভিজাত জীবনকে। সে জীবনের কোনো পরিবর্তন নেই। ১৮০৫ সাল থেকে আমরা বোনাপার্তের সঙ্গে সন্ধি করেছি আবার লড়াইও করেছি, শাসনতন্ত্র রচনা করেছি আবার বাতিল করেছি, কিন্তু আন্না পাভলভনা ও হেলেনের অভ্যর্থনা কক্ষগুলির চেহারা যেমন ছিল একটি সাত বছর আগে, অপরটি পাঁচ বছর আগে-তেমনই আছে। আন্না পাভলভনার অভ্যর্থনা-কক্ষে সকলে আগের মতোই দুশ্চিন্তার সঙ্গে বোনাপার্তের সাফল্য নিয়ে আলোচনা করে এবং সবকিছুর মধ্যেই রাজ-দরবার মহলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ ষড়যন্ত্রের ছায়া দেখতে পায়। আবার হেলেনের অভ্যর্থনা-কক্ষে ১৯১২-তেও ১৯০৮ সালের মতোই সেই মহান জাতি ও মহান পুরুষটি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত আলোচনা চলে, ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়াতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

সম্প্রতি সেনাবাহিনী থেকে ম্রাটের ফিরে আসার পর থেকে এই দুই পরস্পরবিরোধী মহলে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, পরস্পরের প্রতি বিদ্রূপতার কিছু কিছু প্রকাশও ঘটেছে, কিন্তু প্রতিটি মহলই স্বীয় বৈশিষ্ট্যে অটল রয়েছে। আন্না পাভলভনার মহলে শুধু সেইসব ফরাসিদেরই প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় যারা গোঁড়া রুশভক্ত, যারা মনে করে যে কারোরই ফরাসি থিয়েটারে যাওয়া উচিত নয়, কারণ একটা ফরাসি শিল্পীদলকে পুষতে যে খরচ হয় তা একটা সেনাদল পোষর খরচেরই অনুরূপ। তারা আগ্রহের সঙ্গে যুদ্ধের অগ্রগতির উপর নজর রাখে এবং যেসব প্রতিবেদনে আমাদের প্রশস্তি থাকে শুধু সেইগুলিই প্রচার করে। ওদিকে হেলেন ও রুমিয়ান্তসেভের ফরাসি মহলে শত্রুপক্ষের এবং যুদ্ধের নিষ্ঠুরতার প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করা হয়, আর নেপোলিয়নের সন্ধি-প্রচেষ্টাগুলির আলোচনা করা হয়।

প্রিন্স ভাসিলি এখনো নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আছে : এই দুটি মহলের মধ্যে সেই একমাত্র যোগসূত্র। সে প্রিয় বন্ধু আন্না পাভলভনার সঙ্গে যেমন দেখা করতে চায়, তেমনই মেয়ের কূটনৈতিক অভ্যর্থনা-কক্ষেও তার যাতায়াত আছে। অবশ্য অনবরত দুই শিবিরে যাতায়াতের ফলে অনেকসময় সে সব ব্যাপারটাই গুলিয়ে ফেলে এবং আন্না পাভলভনার মহলে যেটা বলা উচিত সেটাই বলে ফেলে হেলেনের সভায়, আবার তার উল্টোও ঘটে।

সম্রাটের ফিরে আসার অনতি পরেই প্রিন্স ভাসিলি আন্না পাভলভনার বাড়িতে যুদ্ধসংক্রান্ত আলোচনা প্রসঙ্গে কঠোর ভাষায় বার্কলে দ্য তলির নিন্দা করলেও কাকে যে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা উচিত সে বিষয়ে কিছু বলল না। বহুগুণের আধার বলে বর্ণিত জনৈক অতিথি কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তাব করল যে কুতুজভই একমাত্র উপযুক্ত লোক।

আন্না পাভলভনা বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, সম্রাটকে বিরক্ত করা ভিন্ন আর কিছুই কুতুজভ করেনি।

 প্রিন্স ভাসিলি তাকে বাধা দিয়ে বলল, পরিষদের সভায় আমি বার বার বলেছি, কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি। আমি বলেছি, অসামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে কুতুজভের নির্বাচনে সম্রাট খুশি হবেন না। তারা আমার কথা শোনেনি।

সে বলতে লাগল, রাশিয়ার প্রবীণতম সেনাপতি হলেও কুতুজভের পক্ষে ট্রাইবুনালের সভাপতিত্ব করাটা কি ঠিক হবে? এত কষ্টের বিনিময়ে তিনি তো কিছুই পাবেন না! যে লোক ঘোড়ায় চড়তে জানে না, পরিষদে বসে ঘুমিয়ে পড়ে, যার নৈতিক চরিত্র অতীব খারাপ, সেরকম লোককে কেমন করে প্রধান সেনাপতি করা যেতে পারে! বুখারেস্টে তার কী সুখ্যাতি হয়েছিল! সেনাপতি হিসেবে তার যোগ্যতার বিষয় আমি কিছু বলছি না, কিন্তু আজকের মতো দিনে একটি নজদেহ, অন্ধ, সত্যিকারের অন্ধ, বৃদ্ধ মানুষকে কেমন করে ওই পদে নিয়োেগ করা চলতে পারে? অন্ধ সেনাপতি ব্যাপারটা মন্দ নয়। তিনি তো চোখেই দেখেন না। এ কি কানামাছি খেলা? তিনি তো দেখতেই পান না!

তার কথার কেউ কোনো জবাব দিল না।

২৪ জুলাই তারিখে কথাটা ঠিকই ছিল। কিন্তু ২৯ জুলাই তারিখে কুতুজভ প্রিন্স উপাধি পেল। এরমধ্যে তাকে বাতিল করার একটা ইঙ্গিত থাকতেও পারে, কাজেই প্রিন্স ভাসিলির কথাটা সেদিনও ঠিকই ছিল, যদিও সেকথা সে সাততাড়াতাড়ি বলে বেড়ায়নি। কিন্তু ৮ আগস্ট তারিখে যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনার জন্য ফিল্ড-মার্শাল সালতিকভ, আরাকচিভ, ভিয়াজমিতিনভ, লপুখিন ও কচুবেকে নিয়ে গঠিত কমিটির একটা বৈঠক বসল। কমিটিতে সিদ্ধান্ত হল, নেতৃত্বের ঐক্যের অভাবই আমাদের পরাজয়ের কারণ, আর কুতুজভের প্রতি সম্রাটের বিরূপ মনোভাব সম্পর্কে কমিটির সদস্যগণ সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও তারা প্রধান সেনাপতি পদে কুতুজভের নিয়োগের ব্যাপারে সুপারিশ করতে একমত হল। আর সেইদিনই সেনাদলের উপর এবং অধিকৃত সমস্ত অঞ্চলের উপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্বসহ কুতুজভ প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হল।

৯ আগস্ট তারিখে আন্না পাভলভনার বাড়িতে সেই বহুগুণের আধার লোকটির সঙ্গে আবার প্রিন্স ভাসিলির দেখা হয়ে গেল। তরুণীদের একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হবার বাসনায় সে ভদ্রলোক তখন আন্না পাভলভনার সঙ্গে খুবই দহরম-মহরম চালাচ্ছে। স্বীয় বাসনার সিদ্ধিতে বিজয়ীর ভঙ্গিমায় প্রিন্স ভাসিলি ঘরে ঢুকল।

আরে, মস্ত সংবাদটা আপনারা শুনেছেন কি? প্রিন্স কুতুজভ এখন ফিল্ড-মার্শাল! সব প্রতিবাদের অবসান ঘটেছে! আমি খুব খুশি, খুব আনন্দিত! শেষপর্যন্ত একটা মানুষ হওয়া গেল!

ডিরেক্টরের পদপ্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও বহু গুণাধার লোকটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ছাড়ল না যে আগে প্রিন্স ভাসিলির মতটা অন্যরকম ছিল। প্রিন্স ভাসিলির নিজের কথায়ই সে বলল, কিন্তু প্রিন্স, লোকে যে বলে তিনি অন্ধ।

এঃ! বাজে কথা! তিনি চোখে বেশ ভালোই দেখেন, একটু কেশে গম্ভীর গলায় ভাসিলি বলল, বুঝি গলার স্বর ও কাশি দিয়েই সে তার অস্বস্তিকে চাপা দিতে চায়। তিনি চোখে বেশ ভালোই দেখেন। আমি আরো খুশি হয়েছি এইজন্য যে সম্রাট তাকে সব সেনাদল এবং সমগ্র অঞ্চলের উপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছেন–আগে কোনো প্রধান সেনাপতির এত ক্ষমতা ছিল না। তিনি হলেন দ্বিতীয় সর্বময় কর্তা, বিজয়ীর হাসি হেসে সে কথা শেষ করল।

ঈশ্বর করুন তাই যেন হয়! তাই যেন হয়! আন্না পাভলভনা বলল।

বহু গুণাধার লোকটি দরবার-মহলের রীতিনীতিতে এখনো অনভিজ্ঞ, এ ব্যাপারে আন্না পাভলভনার পূর্বেকার অভিমতকে সমর্থন করে তার প্রশস্তি-কীর্তনের উদ্দেশ্যে সে বলল : লোকে বলছে, কুতুজভকে এইসব ক্ষমতা দেবার ইচ্ছা সম্রাটের ছিল না। লোকে বলে, কোনো কুমারীর কাছে ফোকোঁদ (অশ্লীল কাব্যগ্রন্থ) পড়লে সে যেরকম লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠে সম্রাটও তেমনইভাবে হেসে কুতুজভকে বলেছেন : তোমার সম্রাট ও পিতৃভূমি এই সম্মান তোমাকে দিচ্ছে।

আন্না পাভলভনা বলল, হয়তো অন্তর থেকে তিনি কথাটা বলেননি।

 প্রিন্স ভাসিলি সসাৎসাহে বলে উঠল, ওঃ, না, না! সেটা অসম্ভব, কারণ আমাদের সম্রাট তো আগেও তার গুণের প্রশংসা করেছেন।

আন্না পাভলভনা বলল, ঈশ্বর করুন প্রিন্স কুতুজভ যেন সত্যিকারের ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন, কেউ যেন তার কাজের মধ্যে নাক গলাতে না পারে।

মহিলা কার কথা বলতে চাইছে সেটা বুঝতে পেরে প্রিন্স ভাসিলি চুপি চুপি বলল : আমি ভালো করেই জানি, কুতুজভ এ ব্যবস্থা একেবারেই পাকা করে নিয়েছেন যে জারেভিচ সেনাদলের সঙ্গেই থাকবে না। আপনি কি জানেন, সম্রাটকে তিনি কি বলেছেন?

কুতুজভ সম্রাটকে যে কথাটা বলতে পারে সেটা অনুমান করেই প্রিন্স ভাসিলি তার পুনরাবৃত্তি করল। তিনি অন্যায় করলেও আমি শাস্তি দিতে পারব না, আবার ঠিক কাজ করলেও পারব না পুরস্কৃত করতে।

ওঃ, প্রিন্স কুতুজভ খুবই জ্ঞানী লোক! আমি তাকে অনেকদিন থেকেই চিনি।

বহু গুণাধার লোকটি মন্তব্য করল, লোকে আরো বলছে, হিজ এক্সেলেন্সি আরো একটি শর্ত করিয়ে নিয়েছেন যে সম্রাট নিজেও সেনাদলের সঙ্গে থাকতে পারবেন না।

তার এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই প্রিন্স ভাসিলি ও আন্না পাভলভনা তার পাশ থেকে সরে গিয়ে লোকটির এই অতিসরলতায় বিষণ্ণ চোখে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

.

অধ্যায়-৭

 পিটার্সবুর্গে যখন এইসব ঘটছে ততক্ষণে ফরাসি বাহিনী স্মোলেনস্ক পার হয়ে ক্রমাগত মস্কোর দিকে এগিয়ে চলেছে। নেপোলিয়নের অপরাপর ইতিহাসকারের মতো ইতিহাসকার থিয়েও তার নায়কের সমর্থনে লিখেছে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নেপোলিয়নকে মস্কো প্রাচীরের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার মধ্যে যারা ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজে, থিয়ের্সের অভিমতও তাদের মতোই সত্য, যে রুশ ইতিহাসকাররা লিখেছে যে রুশ সেনাপতিদের কৌশলের ফলেই নেপোলিয়ন মস্কোর দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল, থিয়ের্সের অভিমত তাদের মতোই সত্য। একজন দাবাড় যখন একটা খেলায় হারে তখন সে একান্তভাবে বিশ্বাস করে যে নিজের ভুলের জন্যই তার হার হয়েছে, আর সেই ভুলকে সে খোঁজে খেলার গোড়ার দিকে, কিন্তু সে ভুলে যায় যে খেলার প্রতিটি ধাপেই সে আরো ভুল করেছে এবং তার কোনো চালটাই সঠিক হয় নি। যেহেতু প্রতিপক্ষ তার ভুলের সুযোগটাই নিয়েছে তাই শুধু সেই ভুলটাই তার নজরে পড়ে। যুদ্ধের খেলা তো দাবা খেলার চাইতে অনেক বেশি জটিল, সে খেলা ঘটে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে, সেখানে কোনো একটিমাত্র ইচ্ছাশক্তি নির্জীব পদার্থকে পরিচালিত করে না, নানা ইচ্ছাশক্তির অসংখ্য সংঘাতেরই ফলশ্রুতি একটি যুদ্ধ।

স্মলেনস্কের পরে প্রথমে দরগগাবুঝ ছাড়িয়ে ভিয়াজমাতে এবং পরে জারেডভা-জেমিশেতে নেপোলিয়ন একটা যুদ্ধ ঘটাতে চেয়েছিল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অসংখ্য ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে রুশরা সেখানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারেনি, ফরাসি বাহিনী মস্কো থেকে সত্তর মাইল দূরবর্তী বরদিনোত পৌঁছে গেল। ভিয়াজমা থেকে নেপোলিয়ন সরাসরি মস্কো-অভিযানের হুকুম জারি করল।

মহান সাম্রাজ্যের এশিয়াস্থ রাজধানী মস্কো, আলেক্সান্দারের প্রজাদের পবিত্র নগরী মস্কো, চৈনিক প্যাগোডার মতো অসংখ্য গির্জা শোভিত মস্কো–এই মস্কোর স্বপ্ন নেপোলিয়নের কল্পনাকে থামতে দিল না। ভিয়াজমা থেকে জারেভো-জেমিশে অভিযানে রক্ষীদল, দেহরক্ষী, অনুচরবৃন্দ ও এড-ডি-কংদের সঙ্গে নিয়ে । নেপোলিয়ন এগিয়ে চলল তার লেজ-ছাঁটা হাল্কা রঙের ঘোড়ায় চেপে। তার কর্মচারী-প্রধান বের্থিয়ের পিছনে থেমে রইল অশ্বারোহী বাহিনীর হাতে বন্দি জনৈক রুশ বন্দিকে জেরা করার জন্য। পরে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে সে নেপোলিয়নকে ধরে ফেলল।

কি খবর? নেপোলিয়ন শুধাল।

প্লাতভের অধীনস্থ জনৈক কসাক বলছে, তভের সেনাদল মূল বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আর কুতুজভ প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছে। লোকটি খুবই বিচক্ষণ আর অতিভাষী।

নেপোলিয়ন হেসে বলল, একটি ঘোড়া দিয়ে কসাকটিকে তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সে নিজে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কয়েকজন অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। একঘণ্টা পরে আর্দালির কুর্তা গায়ে লাভ্রুশকা এসে হাজির হল। এই ভূমিদাসটিকেই দেনিসভ দিয়েছিল রস্তভকে। নেপোলিয়ন তাকে পাশাপাশি ঘোড়া চালাবার নির্দেশ দিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করল।

তুমি একজন কসাক?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি কসাক ইয়োর অনার।

এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বিয়ের্স লিখেছে, নেপোলিয়নের শাদাসিধে পোশাকে সম্রাটের উপস্থিতিজ্ঞাপক কোনো লক্ষণ না থাকায় তাকে চিনতে না পেরে কসাকটি সরল মনে যুদ্ধের বর্ণনা দিতে লাগল। আসলে আগের দিন মদের নেশায় বেহুশ হয়ে মনিবকে ডিনার না খাইয়েই সে মুরগির খোঁজে একটা গ্রামে গিয়ে সেখানে লুটতরাজ শুরু করে এবং শেষপর্যন্ত ফরাসিদের হাতে বন্দি হয়।

লাভ্রুশকা ভালো করেই জানত যে এই নেপোলিয়ান, কিন্তু তাকে দেখে সে মোটই ভয় পেল না, বরং নতুন মনিবকে খুশি করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে লাগল। এই লোকটিই যে নেপোলিয়ন সেটা ভালোভাবে বুঝেও সে মোটেই ভয় পেল না, ঠিক যেরকম সে রস্তভকে বা অন্য কোনো সার্জেন্ট-মেজরের লাঠিকেও ভয় করত না, কারণ তার তো এমন কিছুই নেই থেকে কি নেপোলিয়ন আর কি সার্জেন্ট-মেজর কেউই তাকে বঞ্চিত করতে পারে।

কাজেই সে অবিরাম বকবক করে চলল, আর্দালিদের কাছে যত গুজব শুনেছে সব ঢালতে লাগল। তার অনেকটাই সত্য। কিন্তু নেপোলিয়ন যখন জানতে চাইল, বোনাপার্তকে পরাজিত করতে পারবে কি না সে বিষয়ে রুশরা কি ভাবছে, তখন লাভ্রুশকা ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল।

এই প্রশ্নটার মধ্যে সে সূক্ষ্ম চাতুরির আভাস পেল, তার মতো লোকরা সবকিছুর মধ্যেই চাতুরির আভাস পেয়ে থাকে, তাই সে ভুরু কুঁচকাল, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না।

চিন্তিতভাবে বলল, ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, অচিরেই যদি কোনো যুদ্ধ হয়তো আপনার জয় হবে। সেটা ঠিক। কিন্তু যদি তিনটে দিন পার হয়ে যায়, তো তার পরে, মানে সেক্ষেত্রে সেই যুদ্ধই সহজে শেষ হবে না।

মেজাজ ভালো থাকা সত্ত্বেও এ কথায় নেপোলিয়ন হাসল না, কথাগুলি আর একবার বলতে বলল।

সেটা লক্ষ্য করে তাকে খুশি করতে এবং নেপোলিয়নকে না চেনার ভান করে লাভ্রুশকা বলল, আপনি তো জানেন যে আপনাদের নেপোলিয়ন আছেন, আর তিনি তো পৃথিবীর সকলকেই পরাজিত করেছেন, কিন্তু আমরা তো ভিন্ন ধাতুতে গড়া…–এটুকু দেশাত্মবোধের গর্ব যেন কেমন করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল তা সে নিজেই জানে না।

নেপোলিয়ন হাসল। থিয়ের্স লিখেছে, তরুণ কসাকটি তার শক্তিমান প্রশ্নকর্তাকে হাসিয়ে ছাড়ল। কয়েক কদম নিঃশব্দে এগিয়ে বের্থিয়ের-এর দিকে ঘুরে নেপোলিয়ন বলল, সে দেখতে চায় এই ডন-শাবক যদি জানতে পারে যে সে স্বয়ং নেপোলিয়নের সঙ্গে কথা বলছে, কথা বলছে সেই সম্রাটের সঙ্গে যার অবিস্মরণীয় দিগ্বিজয়ী নাম পিরামিডের গায়ে-গায়ে খোদাই করা হয়েছে, তাহলে তার অবস্থাটা কি দাঁড়ায়।

তাকে বিচলিত করে তুলবার জন্যই যে কথাটা তাকে বলা হয়েছে এবং নেপোলিয়ন যে আশা করছে সে খুব ভয় পেয়ে যাবে সেটা বুঝতে পেরে লাভ্রুশকা নতুন মনিবকে খুশি করতে ভীত ও বিস্মিত হবার ভান করল, দুচোখ বিস্ফারিত করে মুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তুলল যেটা সে সাধারণত করে থাকে চাবুক খাবার আগের মুহূর্তে। থিয়ের্স লিখেছে, যে মুহূর্তে নেপোলিয়নের দোভাষী কথাগুলি বলল তৎক্ষণাৎ কসাকটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল, একটা কথাও না বলে ঘোড়া চালাতে চালাতে সেই দিগ্বিজয়ীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যার খ্যাতি প্রাচ্যের তৃণাঞ্চলকে পেরিয়ে তার কানে এসে পৌঁছেছে। তার সব প্রগলভতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, দেখা দিল একটা অতি সরল, নীরব বিস্ময়ের অনুভূতি। কসাকটিকে একটি উপহার দিয়ে নেপোলিয়ন তাকে ছেড়ে দিল-বন্দি বিহঙ্গ যেন মুক্তি পেল তার নিজস্ব প্রান্তরে।

যে মস্কো নেপোলিয়নের কল্পনাকে উদ্দীপিত করে তারই স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে এগিয়ে চলল, যে পাখিটি তার নিজস্ব প্রান্তরে মুক্তি পেল সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল আমাদের সীমান্ত-ঘাটির দিকে, আর মনে মনে এমন সব কাহিনীর জাল বুনতে লাগল যা আদপেই না ঘটে থাকলেও সে তার সহকর্মীদের শোনাবে বলে স্থির করেছে। যা ঘটেছে তা তো আর বলার মতো কিছু নয়, কাজেই সে কথা সে বলতেও চায় না। কসাকদের সঙ্গে দেখা হতে খোঁজ-খবর করতে করতে সন্ধ্যা নাগাদ মনিব নিকলাস রশুভের খোঁজ পেল, সে তখন ইয়াংকভোতে বাস করছে। রস্তভ তখন ইলিনকে সঙ্গে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি ঘুরে দেখবার জন্য ঘোড়া নিয়ে বের হবার জন্য প্রস্তুত, লাভ্রুশকাকে আর একটা ঘোড়া দিয়ে সে তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-৮

প্রিন্সেস মারির বিপদ কেটে গেছে এবং প্রিন্স আন্দ্রুর ধারণা এখন সে মস্কোতে নেই।

আলপাতিচ ঘোলেনস্ক থেকে ফিরে আসার পরেই বুড়ো প্রিন্স যেন সহসা স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল। বিভিন্ন গ্রামের বেসরকারি সৈনিকদের প্রতি রণসাজে সাজবার আহ্বান জানিয়ে প্রধান সেনাপতিকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিল, শেষমুহূর্ত পর্যন্ত বল্ড হিলসে থেকে তাকে রক্ষা করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, প্রধান সেনাপতি বন্ড হিলস রক্ষার কোনো ব্যবস্থা করবে কি না, রাশিয়ার অন্যতম বৃদ্ধ সেনাপতি গ্রেপ্তার বা খুন হবে কি না, সেটা প্রধান সেনাপতিরই বিচার্য বিষয়, পরিবারের সকলকেও সে জানিয়ে দিল যে সে নিজে বল্ড হিলসেই থেকে যাবে।

নিজে থেকে গেলেও প্রিন্সেস, দেসাল্লেস ও ছোট্ট প্রিন্সকে বোগুচারভোতে এবং সেখান থেকে মস্কো পাঠাবার সব ব্যবস্থাই সে করে দিল। আগেকার বীতরাগের পরে বাবার এই বিন্দ্ৰি কঠোর পরিশ্রম দেখে প্রিন্সেস মারি ভয় পেয়ে গেল, বাবাকে একলা রেখে যেতে তার ভরসা হল না, আর জীবনে এই প্রথম সে বাবার অবাধ্য হল। সে চলে যেতে অস্বীকার করায় বাবার রাগ প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে তার উপর ভেঙে পড়ল। সবরকম অন্যায় নির্যাতন চলল তার উপর। মেয়েকে শাস্তি দেবার জন্য বাবা তাকে জানিয়ে দিল, তার জন্যই সে জ্বলেপুড়ে মরছে, সেই ছেলের সঙ্গে তার ঝগড়া বাধিয়েছে, তার জীবনকে বিষময় করে তুলবার জন্য তার বিরুদ্ধে হীন সন্দেহ পোষণ করেছে, এই বলে মেয়েকে পড়ার ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল যে সে যাক বা না যাক তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। বাবা আরো বলল, মেয়ের অস্তিত্বের কথাও সে তার মনে রাখতে চায় না, আর মেয়েও যেন তাকে আর মুখ না দেখায়। প্রিন্সেস মারির আশঙ্কা ছিল, বাবা হয়তো তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেবে, তা না করে বাবা যে শুধু তার মুখ দেখতে চাইল না তাতেই প্রিন্সেস মারি খুশি হল। সে বুঝতে পারল, দূরে চলে না গিয়ে সে যে বাড়িতেই থেকে গেল এতে মনের গভীরে বাবা যে খুশিই হয়েছে এটাই তার প্রমাণ।

ছোট্ট নিকলাস চলে যাবার পরদিন সকালে বুড়ো প্রিন্স পুরো ইউনিফর্ম চাপিয়ে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্তুত হল। দরোজায় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। প্রিন্সেস মারি দেখল, ইউনিফর্ম ও সম্মানসূচক পদকাদি পরে বাবা পায়ে হেঁটে বাগানের দিকে গেল সশস্ত্র চাষীদের ও পারিবারিক ভূমিদাসদের পরিদর্শন করতে। জানালায় বসেই বাগানে বাবার কথাবার্তা শুনবার জন্য সে কান পেতে রইল। হঠাৎ কয়েকটি লোব ভয়ার্ত মুখে বাগানের পথ ধরে ছুটে এল।

ফুলের কেয়ারি করা পথ পেরিয়ে তরুবীথির পথ ধরে প্রিন্সেস মারি ফটকের দিকে ছুটে গেল। বেসরকারি সৈনিক ও পারিবারিক ভূমিদাসদের একটা বড় দল তার দিকেই এগিয়ে আসছে, তাদের মাঝখানে কয়েকজন লোক ইউনিফর্মধারী, পদকাদি সজ্জিত একটি ছোটখাট বৃদ্ধকে বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে টানতে টানতে নির আসছে। প্রিন্সেস মারি ছুটে গেল, তরুবীথির ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে যেসব বৃত্তাকার ছোট ছোট আলোর ফুটবি এসে পড়েছে তাতে বাবার মুখের পরিবর্তনটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সে শুধু এইটুকু দেখতে পেল, আগেকা কঠোর, স্থিরপ্রতিজ্ঞ মুখে দেখা দিয়েছে ভীরুতা ও আত্মসমর্পণের ভঙ্গি। মেয়েকে দেখে সে অসহায় ঠোঁট দুfি নাড়ল, একটা কর্কশ শব্দ বেরিয়ে এল। সে যে কি চাইছে তা বোঝা অসম্ভব। তাকে তুলে নিয়ে পড়ার ঘ যাওয়া হল, যে কোচটাকে ইদানীং সে এত ভয় পেতোর উপরেই তাকে শুইয়ে দেওয়া হল।

সেই রাতেই ডাক্তার ডাকা হল, রক্তমোক্ষণ করা হল, ডাক্তার বলল, প্রিন্সের হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হওয়ায় তা দক্ষিণ অঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছে।

বল্ড হিলসে থাকা ক্রমেই অধিকতর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, পরদিনই প্রিন্সকে বোগুচারভোতে স্থানান্তরি করা হল। ডাক্তারও সঙ্গে গেল।

তারা বোগুচারভো পৌঁছবার আগেই দেসাল্লেস ও ছোট্ট প্রিন্স মস্কো রওনা হয়ে গেছে।

প্রিন্স আন্দ্রু বোণ্ডচারভোতে যে নতুন বাড়ি তৈরি করেছিল, পক্ষাঘাতড়গ্রস্ত হয়ে বুড়ো প্রিন্স তিন সপ্তাহ সেখানেই শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটাল, তার অবস্থার কোনো হেরফের ঘটল না। অচৈতন্য অবস্থায় একটা বিকৃত শবদেহের মতো সে পড়ে রইল। অনবরত বিড়বিড় করছে, ভুরু ও ঠোঁট কুঁচকে যাচ্ছে, চারদিকে যা কিছু ঘটছে তা বুঝতে পারছে কি না তাও বলা শক্ত। একটা জিনিস খুবই নিশ্চিত-সে খুব কষ্ট পাচ্ছে, আর কি যেন বলতে চাইছে। কিন্তু সেটা যে কি কেউ বলতে পারে না : একটি রুগ্ন, আধপাগল মানুষের কোনো খেয়াল হতে পারে, সরকারি কাজকর্মের কথা হতে পারে, অথবা পারিবারিক ব্যাপারও হতে পারে।

ডাক্তার বলল, এই অস্থিরতা থেকে কিছুই বোঝা যায় না, শারীরিক কারণেই এটা ঘটছে, কিন্তু প্রিন্সেস মারির ধারণা, বাবা তাকে কিছু বলতে চাইছে, সে উপস্থিত থাকলেই যে বাবার অস্থিরতাটা বাড়ে তাতেই তার ধারণা সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। দেহ ও মন দুদিক থেকেই সে অসুস্থ। নিরাময়ের কোনো আশাই নেই। তাকে নিয়ে দেশভ্রমণে যাওয়া অসম্ভব, লোকটিকে তো পথের মধ্যে মরতে দেওয়া যায় না। প্রিন্সেস মারি অনেকসময় ভাবে, শেষের দিনটা একটু তাড়াতাড়ি এলেই কি ভালো হয় না? দিনরাত সে বাবার উপর নজর রাখে। ঘুমায় কদাচিৎ। শুনতে খারাপ লাগলেও বাবার শরীরে উন্নতির লক্ষণ দেখার আশা সে করে না, বরং শেষ পরিণতির লক্ষণই সে আশা করে।

নিজের মনের এই বিচিত্র অনুভূতিকে স্বীকার করতে না চাইলেও সেটা কিন্তু সত্য। তার কাছে যেটা আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে দেখা দিচ্ছে সেটা হল–যেসব ব্যক্তিগত কামনা-বাসনার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল, অথবা তার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল, বাবার অসুখের সময় থেকেই সেগুলি যেন নতুন করে জেগে উঠেছে। যেসব চিন্তা অনেক বছর ধরে তার মনেও আসে নি-বাবার ভয় থেকে মুক্ত স্বাধীন জীবনের চিন্তা, এমন কি ভালোবাসা ও পারিবারিক জীবনের সম্ভাবনার চিন্তা-তারাই যেন শয়তানের প্রলোভনের মতো অনবরত তার কল্পনায় ভাসতে শুরু করেছে। মন থেকে যতই সরিয়ে দিতে চেষ্টা করুক, সেই ঘটনা ঘটে যাবার পরে কেমন করে সে তার জীবনকে চালাবে সেই চিন্তাই বার বার তার মনে আসছে। এসবই যে শয়তানের প্রলোভন প্রিন্সেস মারি তা জানে। সে জানে এর বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র প্রার্থনা, আর তাই সে প্রার্থনা করতেই চায়। কিন্তু সে প্রার্থনা করতে পারে না, কাঁদতে পারে না, জাগতিক দুশ্চিন্তা তার মনকে চেপে ধরেছে।

বোগুচারভোতে বাস করা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। চারদিক থেকে ফরাসিদের অগ্রগতির সংবাদ আসছে, বোগুচারভো থেকে দশ মাইল দূরে একটা গ্রামে ফরাসি লুঠেরা একটা বাড়ি লুঠ করেছে।

ডাক্তার প্রিন্সকে সরিয়ে দিতে বলছে, প্রাদেশিক মার্শাল অব দি নবিলিট প্রিন্সেস মারিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে বলছে, গ্রাম্য পুলিশের বড়কর্তা বোগুচারভোতে এসেও সেই কথাই বলে গেছে, বলেছে, ফরাসিরা মাত্র পঁচিশ মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে, গ্রামে গ্রামে ফরাসিদের ফরমান জারি করা হচ্ছে, প্রিন্সেস যদি ১৫ই তারিখের মধ্যে তার বাবাকে এখান থেকে সরিয়ে না নেয় তো ফলাফলের জন্য সে দায়ী থাকবে না।

প্রিন্সেস স্থির করল ১৫ তারিখে চলে যাবে। সারাটাদিন তারই উদ্যোগ-আয়োজনে ব্যস্ত থাকল। ১৪ই রাতটাও একইভাবে কাটল। যে ঘরে প্রিন্স শুয়ে থাকে পোশাক না ছেড়েই তার পাশের ঘরে সে রাতটা কাটাল। বারকয়েক ঘুম ভেঙে সে শুনতে পেল বাবা আর্তনাদ করছে, বিড়বিড় করে কথা বলছে, বিছানায় নড়াচড়ার শব্দ হচ্ছে, তিখন ও ডাক্তার ঘরে এসে তাকে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছে। প্রিন্সেস ঘুমতে পারে না, বারবার দরোজার কাছে গিয়ে কান পাতে, ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করে, কিন্তু ঢুকবে কি না বুঝতে পারে না। সে জানে, রাত করে তার ঘরে ঢুকলে বাবা বিরক্ত হবে।

কিন্তু আগে কখনো সে বাবার জন্য এত কষ্টবোধ করেনি, তাকে হারাবার ভয় এমন করে তাকে পেয়ে বসেনি। বাবার সঙ্গে কাটানো সারাটা জীবনের কথা তার মনে পড়ে যায়, তার প্রতিটি কথা ও কাজের মধ্যে আজ সে দেখতে পায় তার ভালোবাসার প্রকাশ। মাঝে মাঝে এইসব স্মৃতির ভিতর থেকে শয়তানের প্রলোভন কল্পনায় উত্তাল হয়ে ওঠে : বাবার মৃত্যুর পরে কি ঘটবে, তার নতুন মুক্ত জীবন কীভাবে চলবে-এমনি সব চিন্তা। একান্ত বিরক্তির সঙ্গে সেসব চিন্তাকে সে মন থেকে ঝেড়ে ফেলল। সকালের দিকে মন শান্ত হয়ে এলে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙল। তখনই মনে পড়ল, বাবার অসুস্থতাই তার প্রধান চিন্তার বিষয়। দরোজার কাছে গিয়ে কান পেতে শুনল বাবা তখনো গোঙাচ্ছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, অবস্থা একরকমই আছে।

কিন্তু আর কি ঘটতে পারত? আমি কী চেয়েছি? আমি কি তার মৃত্যু চাই! নিজের প্রতি ঘৃণায় সে চেঁচিয়ে বলল।

হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক বদলে, প্রার্থনা সেরে সে ফটকের দিকে গেল। ফটকের সামনে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাতে মালপত্র বোঝাই করা হচ্ছে।

আতপ্ত, ধূসর সকাল। প্রিন্সেস মারি ফটকে থামল। নিজের আধ্যাত্মিক দীনতায় নিজেই শিউরে উঠল, বাবার কাছে যাবার আগে নিজের চিন্তাকে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করল।

ডাক্তার নিচে নেমে তার পাশে এসে দাঁড়াল।

বলল, আজ তিনি একটু ভালো আছেন। আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। তাঁর কথার অর্থ যেন কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। আজ তাঁর মাথা অনেকটা পরিষ্কার আছে। ভিতরে চলুন, তিনি আপনার খোঁজ করছেন…

একথা শুনে প্রিন্সেস মারির বুকের ভিতরটা এত প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠল যে তার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল, পাছে পড়ে যায় সেই ভয়ে দরোজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তার সমস্ত সত্তা যখন সেইসব ভয়ঙ্কর অশুভ চিন্তায় ডুবে আছে ঠিক তখনই বাবাকে দেখতে হবে, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, তার চোখ দুটি স্থিরনিবদ্ধ থাকবে তার উপরে-এ যে হর্ষ ও বিষাদের এক যুগপৎ যন্ত্রণা।

আসুন, ডাক্তার বলল।

প্রিন্সেস মারি বাবার ঘরে ঢুকে তার বিছানার পাশে গেল। বালিশের উপর পিঠটা উঁচু করে হেলান দিয়ে সে শুয়ে আছে, দুখানি শীর্ণ, হাড় বের করা, জট-পাকানো রক্তিম শিরা ভর্তি হাত বালিশের উপর এলিয়ে পড়ে আছে, ডান-চোখটা একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, ডান চোখটা টেরা হয়ে আছে, ভুরু ও ঠোঁট দুটি নিশ্চল। তাকে কত শীর্ণ, কত ছোট, কত করুণ দেখাচ্ছে। প্রিন্সেস মারি এগিয়ে গিয়ে তার হাতে চুমো খেল। বাবার বাঁ হাত তার হাতটাকে চেপে ধরল, প্রিন্সেস মারি বুঝতে পারল, তার আসার জন্যই বাবা অপেক্ষা করেছিল। সে মেয়ের হাতটা মুচড়ে দিল, তার ভুরু ও ঠোঁট রাগে কাঁপতে লাগল।

বাবা কি চায় তা বুঝতে চেষ্টা করে সে বিপন্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। সে যখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়াল যেখানে বাবার বাঁ চোখটা তাকে দেখতে পায় তখনই বাবার মুখটা শান্ত হয়ে এল, কয়েক সেকেন্ড সে চোখটা সরাল না। তারপরই তার ঠোঁট ও জিভ নড়তে লাগল, শব্দ বেরিয়ে এল, অনুরোধ-ভরা ভীরু দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে এমনভাবে কথা বলতে লাগল যেন তার মনে যথেষ্ট আশঙ্কা আছে যে মেয়ে হয়তো তার কথা বুঝতে পারবে না।

সব শক্তি এক করে প্রিন্সেস মারি তার দিকে তাকাল। বাবার জিভ নাড়ার হাস্যকর প্রচেষ্টা দেখে সে চোখ নামিয়ে নিল, উপাত অশ্রুকে অনেক কষ্টে চেপে রাখল। একই কথা বারবার উচ্চারণ করে প্রিন্স কিছু একটা বলল। প্রিন্সেস তা বুঝতে পারল না, তবু অনুমান করতে চেষ্টা করল এবং তার কথাগুলিই আর একবার উচ্চারণ করল।

Mmm…ar…ate…ate এই কথাগুলিই প্রিন্স বারকয়েক বলল।

এই কয়টি শব্দ থেকে কিছুই বোঝা গেল না। ডাক্তার একটা অনুমান করে তাকেই প্রশ্ন করল : Mary, are you afraid? (মারি, তুমি ভয় পেয়েছ?) প্রিন্স মাথা নেড়ে ঐ একই শব্দের পুনরাবৃত্তি করল।

প্রিন্সেস মারি প্রশ্ন করল, My mind, my mind aches? (আমার মনে, আমার মনে বড় কষ্ট)

এবার প্রিন্স একটা সমর্থনসূচক শব্দ করে প্রিন্সেস মারির হাতটা নিয়ে বুকের নানা জায়গায় চেপে ধরতে লাগল, যেন সঠিক জায়গাটা খুঁজতে চেষ্টা করছে।

মেয়ে যে তার কথা বুঝতে পেরেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে এবার বুড়ো প্রিন্স স্পষ্টতর কণ্ঠে বলল, শুধু ভাবনা…তোমাকে নিয়ে…ভাবনা…

উদাত চাপা কান্না ও চোখের জল লুকোবার চেষ্টায় প্রিন্সেস মারি বাবার হাতের উপর মাথাটা চেপে ধরল

 বুড়ো প্রিন্স মেয়ের চুলে হাত বুলোতে লাগল।

সারারাত তোমাকে ডেকেছি, কোনোরকমে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।

চোখের জলে ভেসে মেয়ে বলল, আমি যদি একটু বুঝতে পারতাম…ঘরে ঢুকতে আমার ভয় হচ্ছিল…

বাবা মেয়ের হাতটা চেপে ধরল।

তুমি কি ঘুমোও নি?

মাথা নেড়ে মেয়ে জবাব দিল, না, ঘুমোতে পারিনি।

নিজের অজ্ঞাতেই সে বাবার অনুকরণে যথাসম্ভব আকারে-ইঙ্গিতে নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে চেষ্ট করল, তারও যেন জিভটা নাড়তে কষ্ট হচ্ছে।

সোনা…লক্ষ্মী সোনা…বাবার কথার অর্থ বুঝতে না পারলেও তার গলার সোহাগের সুরটা ধরতে তা অসুবিধা হল না। কেন তুমি আমার ঘরে এলে না?

প্রিন্সেস ভাবল, আর আমি, আমি এই মানুষের মৃত্যু কামনা করেছি!

বুড়ো প্রিন্স কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

ধন্যবাদ…সোনা মেয়ে!…সকলের জন্য, সকলের জন্য…ক্ষমা!… ধন্যবাদ!… ক্ষমা!… ধন্যবাদ… তা দুই চোখে জল ঝরতে লাগল। হঠাৎ সে বলে উঠল, আন্দ্রুকে ডাক! শিশুসুলভ ভীরু সন্দেহের একটা আভা ফুটে উঠল তার মুখে।

সে যা বলছে তা যে অর্থহীন সেকথা বুড়ো প্রিন্স নিজেও জানে। অন্তত প্রিন্সেস মারির তাই মনে হল।

বলল, তার একটি চিঠি পেয়েছি।

অবাক হয়ে বাবা তার দিকে তাকাল।

সে কোথায় আছে?

সেনাবাহিনীতে আছে বাবা, সমালেনস্কে।

বুড়ো প্রিন্স চোখ বুজে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। অবশেষে যেন সবকিছু বুঝতে পেরেছে, সবকিছু মনে পড়েছে এমনিভাবে মাথা নেড়ে আবার চোখ মেলল। মৃদু স্পষ্ট গলায় বলল, ঠিক। রাশিয়ার মৃত্যু হয়েছে। ওরা তাকে ধ্বংস করেছে।

সে আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, দুই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রিন্সেস মারি তার নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল।

বুড়ো প্রিন্স আন্দ্রুবার চোখ বুজল। কান্না থামিয়ে সে চোখ দুটো দেখাল। তার অর্থ বুঝতে পেরে তিখন চোখের জল মুছিয়ে দিল। সে আবার চোখ মেলে তাকাল, কী যেন বলল, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার কোনো অর্থই বুঝতে পারল না। অবশেষে তিখন কথাটা বুঝতে পেরে পুনরায় উচ্চারণ করল। প্রিন্সেস মারির মনে হল, সে হয়তো রাশিয়া, প্রিন্স আন্দ্রু, তার নিজের কথা, নাতি, অথবা বুড়োর নিজের মৃত্যুর কথাই বলতে চেয়েছে।

আসলে সে বলেছে, তোমার শাদা পোশাকটা পর। আমার খুব ভালো লাগে।

কথাটা বুঝতে পেরে প্রিন্সেস মারি আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডাক্তার হাত ধরে তাকে বারান্দায় নিয়ে সান্ত্বনা দিল, যাত্রার জন্য তৈরি হতে বলল। মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে প্রিন্স আন্দ্রুবার কথা বলতে শুরু করল। ভুরু কুঁচকে কর্কশ গলা চড়িয়ে নিজের ছেলে, যুদ্ধ ও সম্রাট সম্পর্কে কথা বলতে বলতেই তার দ্বিতীয় ও চরম স্ট্রোকটা হল।

প্রিন্সেস মারি তখন বারান্দায়। আবহাওয়া পরিষ্কার হয়েছে, দিনটা গরম ও রোদে ভরা। সে কিছুই বুঝতে পারছে না, ভাবতে পারছে না, অনুভব করতে পারছে না, তার সারা মন জুড়ে আছে বাবার প্রতি এক তীব্র ভালোবাসা যা এইমুহূর্তের আগে সে এখনো বোধ করেনি। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে ছুটে বাগানে চলে গেল, প্রিন্স আন্দ্রুর হাতে লাগানো লেবুবীথির ভিতর দিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে হাজির হল।

হ্যাঁ…আমি…আমি…আমি তার মৃত্যু কামনা করেছিলাম! হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম শেষের দিনটা যেন তাড়াতাড়ি আসে!…শান্তি পেতে চেয়েছিলাম…আর এখন আমার কি হবে? বাবাই যদি না থাকে তো আমি শান্তি দিয়ে কি করব? বুকটা চেপে ধরে দ্রুতপায়ে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে প্রিন্সেস মারি অফুটে কথাগুলি বলল। চাপা কান্নার আবেগে তার বুকটা ঢিপঢিপ করছে।

হাঁটতে হাঁটতে সে আবার বাড়িতে ফিরে এল। দেখল, একজন অপরিচিত লোককে সঙ্গে নিয়ে মাদময়জেল বুরিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটি জেলার মার্শাল অব দি নবিলিটি, প্রিন্সেসের যে অবিলম্বে যাত্রা করা দরকার সেটা বলবার জন্য সে নিজেই এসেছে। প্রিন্সেস মারি সবই শুনল, পাশে বসে কথা বলল। তারপর ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বুড়ো প্রিন্সেস দরোজার দিকে এগিয়ে গেল। উত্তেজিত মুখে ডাক্তার বেরিয়ে এল, তাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করল।

চলে যান প্রিন্সেস! চলে যান…চলে যান!

প্রিন্সেস মারি বাগানে ফিরে গেল। পুকুরের পাড়ে ঢালুতে গিয়ে বসল, সেখান থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কতক্ষণ সেখানে বসেছিল তা সে জানে না। দ্রুত এগিয়ে আসা একটি স্ত্রীলোকের পায়ের শব্দে তার খেয়াল হল। উঠে দাঁড়িয়েই সে দাসী দুনিয়াশাকে দেখতে পেল, সে তাকেই খুঁজছে। তাকে দেখেই দাসীটি সভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শিগগির চলুন প্রিন্সেস…প্রিন্স…দুনিয়াশা ভাঙা গলায় বলল।

এক্ষুনি যাচ্ছি, এক্ষুনি! কথা বলেই প্রিন্সেস মারি বাড়ির দিকে দৌড়তে লাগল।

বাড়ির দরোজায় তাকে দেখতে পেয়ে মার্শাল বলল, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রিন্সেস! সবকিছুর জন্যই আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রিন্সেস রেগে বলল, আমাকে একা থাকতে দিন, এ হতে পারে না!

ডাক্তার তাকে থামাতে চেষ্টা করল। তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে বাবার দরোজার দিকে ছুটে গেল। মনে মনে বলল, এই লোকগুলি ভয়ার্ত মুখে আমাকে থামাতে চাইছে কেন? তাদের কাউকে আমি চাই না! এখানে তারা কি করছে? দরোজা খুলে ফেলল, যে ঘরটাকে অন্ধকার করে রাখা হয়েছিল সেটাকে আলোকোজ্জ্বল দেখে সে চমকে উঠল। ঘরে তার নার্স ও অন্য মেয়েরা রয়েছে। সকলে বিছানার কাছ থেকে সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিল। বুড়ো প্রিন্স আন্দ্রুগের মতোই বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু তার শান্ত মুখের কঠোর ভঙ্গি দেখেই প্রিন্সেস মারি চৌকাঠের উপর থেমে গেল।

না, বাবা মরেনি,এ অসম্ভব! নিজের মনে কথাগুলি বলে সে এগিয়ে গেল, মনের আতংক চেপে রেখে তার গালের উপর ঠোঁট রাখল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে অন্তরের সব মমতা কোথায় হারিয়ে গেল, সেখানে দেখা দিল একটা আতংকের অনুভূতি। না, সে আর নেই। সে নেই, কিন্তু কোথায় গেছে তা কেউ জানে না, সে এক ভয়ংকর, ভয়াবহ রহস্য! দুই হাতে মুখ ঢেকে প্রিন্সেস মারি ডাক্তারের হাতের মধ্যেই এলিয়ে পড়ল। ডাক্তার তাকে তুলে ধরল।

তখন ও ডাক্তারের উপস্থিতিতে মেয়েরা প্রিন্সের গা ধুইয়ে দিল, হাঁ-করা মুখটা যাতে শক্ত হয়ে না যায় সেজন্য একটা রুমাল দিয়ে মাথাটা বেঁধে দিল, আর একটা রুমাল দিয়ে দুটো পাকে একত্র করে বেঁধে দিল। তারপর সম্মান-পদকাদিসহ ইউনিফর্ম পরিয়ে তার কোঁকড়ানো হোট শরীরটাকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিল। এসব যে কখন কীভাবে করা হল তা ঈশ্বরই জানেন, কিন্তু সবই যেন আপনা থেকেই করা হয়ে গেল। রাতের দিকে শবাধারের চারদিকে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হল, একটা আবরণ বিছিয়ে দেওয়া হল, সবুজ জুনিপারে মেঝেটা ছেয়ে গেছে, একটা ছাপানো ফিতে খুঁজে দেওয়া হয়েছে মাথার নিচে, আর ঘরের কোণে বসে পুরোহিত মন্ত্র পড়ে চলেছে।

একটা মরা ঘোড়াকে ঘিরে ঘোড়ার দল যেমন সলজ্জ ভঙ্গিতে নাক ঝাড়ে, ঠিক তেমনই বৈঠকখানায় শবাধারকে ঘিরে ভিড় করেছে বাড়ির লোকজন ও অতিথিরা-মার্শাল, গ্রাম-প্রধান, চাষী মেয়েরা–সকলেই ভীত চোখে ক্রুশ-চিহ্ন এঁকে মাথা নুইয়ে বুড়ো প্রিন্সের ঠাণ্ডা, শক্ত হাতে চুমো খাচ্ছে।

.

অধ্যায়-৯

প্রিন্স আন্দ্রু বোগুচারভোতে বসবাস করার আগে তার মালিকরা সেখানে থাকতই না, আর সেখানকার চাষীরাও ছিল বল্ড হিলসের চাষীদের চাইতে সম্পূর্ণ পৃথক চরিত্রের লোক। কথাবার্তায়, পোশাক পরিচ্ছদে এবং স্বভাবে তারা ছিল আলাদা। তাদের বলা হয় তৃণাঞ্চল-চাষী। ফসল কাটা অথবা পুকুর ও নালা কাটার সময় তারা যখন বল্ড হিলসে আসত তখন তাদের কাজের অধ্যবসায়ের জন্য বুড়ো প্রিন্স তাদের পছন্দ করত, কিন্তু তাদের অদ্র আচরণ তার মনঃপূত ছিল না।

সর্বশেষ বোচারভোতে থাকার সময় প্রিন্স আন্দ্রু সেখানে স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিল, চাষীদের খারিজ-করহ্রাস করে দিয়েছিল, কিন্তু তাতে তাদের স্বভাবের পরিবর্তন না হয়ে বরং বুড়ো প্রিন্স যাকে অভদ্রতা বলত তাদের স্বভাবের সেই বৈশিষ্ট্যটাই আরো জোরদার হয়ে উঠেছিল। সবসময়ই কতকগুলো অস্পষ্ট গুজব তাদের মধ্যে চলিত থাকত : কখনো গুজব রটত তাদের সকলকেই কাক-তালিকাভুক্ত করা হবে, কখনো বলা হত একটা নতুন ধর্মে তাদের দীক্ষিত করা হবে, কখনো বা গুজব রটত জারের সেই ঘোষণার এবং ১৭৯৭ সালে জার পলের কাছে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতির কথা যে প্রসঙ্গে গুজব রটনা করা হত যে তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হলেও ভূস্বামীরাই সেটা আটকে দিয়েছে, কখনো বলা হত, সাত বছরের মধ্যেই পিতর ফেদরভিচ সিংহাসনে ফিরে আসবে এবং সকলকেই মুক্তি দেওয়া হবে, কারো উপর কোনো বিধি-নিষেধ থাকবে না। বোনাপার্টের সঙ্গে যুদ্ধ এবং তার আক্রমণের গুজবের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকত খৃস্টবিরোধী ধারণা, পৃথিবীর অবলুপ্তি ও সার্বিক মুক্তির যত অস্পষ্ট ধারণা।  বুড়ো প্রিন্সের মৃত্যুর কিছুদিন আগেই আলপাতিচ বোণ্ডচারভোতে এসেছে। এসেই সে বুঝতে পারল, এখানকার চাষীদের মধ্যে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে। বন্ড হিলস জেলার ষাট ভার্ল্ড ব্যাসার্ধের অন্তর্ভুক্ত সব চাষীরাই তাদের গ্রামগুলোকে কসাকদের হাতে ধ্বংসের মুখে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, অথচ গুজব শোনা যাচ্ছে যে বোগুচারভোর চতুম্পার্শ্বস্থ তৃণাঞ্চলের চাষীরা ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, তাদের ইস্তাহার হাতে হাতে বিলি হচ্ছে, কেউ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে না। বিশ্বস্ত পারিবারিক ভূমিদাসদের কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে, গ্রাম-সভার প্রভাবশালী সদস্য চাৰী কাৰ্প সম্প্রতি সরকারি গাড়ির চালক হিসেবে বাইরে থেকে সংবাদ এনেছে যে কসাকরা পরিত্যক্ত গ্রামগুলি ধ্বংস করছে, কিন্তু ফরাসিরা তাদের কোনোই ক্ষতি করছে না। আলপাতিচ আরো জেনেছে, আগের দিন ফরাসিদের দ্বারা অধিকৃত গ্রাম ভিসলুখভো থেকে জনৈক চাষী ফরাসি সেনাপতির একখানা ইস্তাহার পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, তাতে বলা হয়েছে, অধিবাসীদের কোনোরকম ক্ষতি করা হবে না এবং তারা যদি গ্রামেই থেকে যায় তো তাদের সবরকম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। প্রমাণস্বরূপ চাষীটি ভিসলুখবো থেকে তার খড়ের আগাম বাবদ একশো রুবলের নোটও নিয়ে এসেছে (সে জানে না যে নোটগুলো সবই জাল)।

আরো গুরুত্বপূর্ণ খবরও আলপাতিচ পেয়েছে। যেদিন সে গ্রামপ্রধানকে হুকুম দিয়েছে যে প্রিন্সেসের মালপত্র নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি যোগাড় করতে হবে, সেইদিনই গ্রামের সভায় স্থির হয়েছে যে কেউ গ্রাম ছেড়ে যাবে না, সকলেই অপেক্ষা করে থাকবে। অথচ আর সময় নষ্ট করা চলে না। বুড়ো প্রিন্সের মৃত্যুর দিন ১৫ই তারিখে মার্শাল এসে প্রিন্সেস মারিকে তৎক্ষণাৎ যাত্রা করতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, কারণ পরিস্থিতি ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সে আরো বলল, ১৬ তারিখের পরে যদি কিছু ঘটে তো সেজন্য সে দায়ী থাকবে না। বুড়ো প্রিন্সের মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় ফিরে যাবার সময় সে বলে গেল, শোকানুষ্ঠানে যোগ দিতে সে পরদিন আবার আসবে। কিন্তু সে আর আসতে পারল না, কারণ সে খবর পেল যে ফরাসিরা অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে এসেছে, কাজেই নিজের পরিবার ও মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলার মতো সময়ও তার হাতে ছিল না।

গত ত্রিশ বছর ধরে গ্রাম-প্রধান দ্রোনই বোগুচারভো গ্রামটিকে চালিয়ে এসেছে। বুড়ো প্রিন্স তাকে আদর করে ডাকত দ্রোনুশকা বলে।

 দ্রোন শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে কর্মক্ষম সেইসব চাষীদের অন্যতম যারা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বড়। বড় দাড়ি রাখে এবং ষাট কি সত্তর বছর পর্যন্ত যাদের কোনোরকম পরিবর্তন ঘটে না, একটাও চুল পাকে না, একটাও দাঁত পড়ে না, ষাট বছরেও ত্রিশ বছরের মতোই খাড়া ও শক্ত থাকে।

বুড়ো প্রিন্সের শোভাযাত্রার দিনই বিধ্বস্ত বন্ড হিলস জমিদারি থেকে এসে আলপাতিচ দ্রোনকে ডেকে পাঠাল এবং প্রিন্সেসের গাড়ির জন্য বারোটা ঘোড়া এবং বোণ্ডচারভো থেকে মালপত্র সরাবার জন্য আঠারোখানা গাড়ি যোগাড় করতে বলল। আলপাতিচ ভেবেছিল, তার এই হুকুম তামিল করায় কোনো অসুবিধা হবে না, কারণ বোগুচারভোতে ত্রিশটি পরিবার বাস করে, আর চাষীরা সকলেই বেশ সম্পন্ন। কিন্তু তার হুকুম শুনে দ্রোন চোখ নামিয়ে চুপ করে রইল। আলপাতিচ এমন কয়েকজন চাষীর নামও করল যাদের কাছ থেকে সে গাড়ি নিতে পারবে।, দ্রোন জবাব দিল, সেইসব চাষীর ঘোড়াগুলো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আলপাতিচ অন্যদের নাম করল, কিন্তু দ্রোনের মতে তাদের ঘোড়াও পাওয়া যাবে না। কতকগুলি সরকারি গাড়িতে ভাড়া খাটতে গেছে, বাকিগুলি খুবই দুর্বল, আর অন্যগুলি দানাপানির অভাবে মরে গেছে। সব শুনে মনে হল, গাড়ির জন্যই ঘোড়া পাওয়া যাবে না, মালের জন্য তো নয়ই।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দ্রোনের দিকে তাকিয়ে আলপাতিচ ভুরু কুঁচকাল। দ্রোন যত বড় আদর্শ গ্রাম-প্রধানই হোক না কেন, আলপাতিচও বৃথাই বিশ বছর ধরে প্রিন্সের জমিদারি চালায়নি। দ্রোনের দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারল যে জবাবগুলো তার নিজস্ব নয়, বোণ্ডচারভো গ্রাম-পঞ্চায়েতের অভিমতেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। কিন্তু সে জানে, অনেক সম্পত্তি করেছে বলে গ্রাম-পঞ্চায়েত দ্রোনকে ঘৃণা করে, আর তাই মালিকপক্ষ ও ভূমিদাস পক্ষ এই দুই শিবিরের মধ্যে সে টালবাহানা করছে। দ্রোনের চোখে এই ইতস্তত ভাব লক্ষ্য করে সে ভুরু কুঁচকে তার আরো কাছে এগিয়ে গেল।

বলল, শোন হে দ্রোনুশকা, আমাকে বাজে কথা বল না। হিজ এক্সেলেন্সি প্রিন্স আন্দ্রু আমাকে হুকুম করেছেন সব্বাইকে সরিয়ে দিতে হবে, শত্রুর মুখে তাদের রাখা চলবে না, এই মর্মে জারের হুকুম-নামাও আছে। যে এখানে থেকে যাবে সেই হবে জারের প্রতি বিশ্বাসঘাতক। শুনছ?

শুনছি, চোখ না তুলেই দ্রোন বলল।

এ জবাবে আলপাতিচ খুশি হল না।

মাথা নেড়ে বলল, উঁহু, এর ফল কিন্তু খারাপ হবে।

 দ্রোন বিষণ্ণ গলায় বলল, তোমার হাতে তো ক্ষমতা আছেই।

বুকের কাছ থেকে হাতটা তুলে দ্রোনের পায়ের কাছে মেঝেটা দেখিয়ে আলপাতিচ বলল, দেখ দ্রোন, এসব ছাড়! তোমার ভিতরটা তো বটেই, তোমার পায়ের তলাকার মাটির তিন গজ পর্যন্ত আমি দেখতে পাই।

দ্রোন বিচলিত বোধ করল, বাঁকা চোখে আলপাতিচের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামাল।

 এসব বাজে মতলব ছাড়, লোকজনদের বল বাড়িঘর ছেড়ে মস্কো যাবার জন্য প্রস্তুত হোক এবং প্রিন্সেসের জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য কাল সকালেই গাড়ি ঠিক করুক। আর নিজে কোনো সভায় যেও না, বুঝলে?

দ্রোন হঠাৎ তার সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়ল।

ইয়াকভ আলপাতি, তুমি আমাকে বরখাস্ত কর! আমার কাছ থেকে সব চাবি নিয়ে নাও, খৃস্টের দোহাই, আমাকে বরখাস্ত কর!

থাম! আলপাতিচ রুক্ষ কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল। তুমি এবং তোমার পায়ের তলাকার তিন গজ মাটি আমার নখদর্পণে। সে জানে, মৌমাছি পালনের কলাকৌশল, যই ফসল বোনার ঠিক-ঠিক সময়ের জ্ঞান, বিশ বছর ধরে বুড়ো প্রিন্সের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকার দক্ষতা–এ সবকিছু মিলিয়ে অনেকদিন থেকেই সে যাদুকরের খ্যাতি অর্জন করেছে, আর মাটির তিন গজ নিচে পর্যন্ত দেখতে পারার ক্ষমতা যাদুকরদেরই একটা বিশেষ গুণ।

দ্রোন উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, আলপাতিচ তাকে বাধা দিল।

 তোমার মাথায় কি ঢুকেছে বল তো?…তুমি কি ভেবেছ হে?

দ্রোন বলল, এইসব লোকদের নিয়ে আমি কি করব? তারা যে খেই হারিয়ে ফেলেছে। আমি তাদের বলেছি…

তুমি বলেছ তা আমি জানি, আলপাতিচ বলল। তারপরই সে হঠাৎ প্রশ্ন করল, আচ্ছা, তারা কি মদ খাচ্ছে?

একেবারেই আত্মহারা হয়ে পড়েছে ইয়াকভ আলপাতিচ, আরো এক পিপে আনিয়েছে।

ঠিক আছে, তাহলে শোন। আমি পুলিশ অফিসারের কাছে যাচ্ছি, তুমি তাদের সেকথা বল, তারা যেন এসব বন্ধ করে গাড়ি নিয়ে তৈরি থাকে।

বুঝেছি।

আলপাতিচ আর কিছু বলল না। অনেককাল ধরে সে মানুষ চড়াচ্ছে, সে জানে, তারা যে দরকার হলে আদেশ অমান্য করতেও পারে সে সন্দেহকে প্রকাশ না করাই হচ্ছে তাদের আজ্ঞাধীন করে রাখার প্রধান উপায়। যদিও সে জানে যে সৈন্যদের সহায়তা ছাড়া গাড়ি-ঘোড়া আসবে না, তবু দ্রোনের মুখ থেকে বুঝেছি কথাটা বের করেই সে আপাতত সন্তুষ্ট থাকল।

আসলেও তাই ঘটল, সন্ধ্যাবেলায় কোনো গাড়ি এল না। গ্রামে মদের দোকানের বাইরে আর একটা সভা বসল, আর সেখানে স্থির হল যে ঘোড়াগুলোকে জঙ্গলে তাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং গাড়ি পাঠানো হবে না। এ ব্যাপারে প্রিন্সেসকে কিছু না বলে বন্ড হিলস থেকে যেসব গাড়ি এসেছে তার ভিতর থেকে আলপাতিচ নিজের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রাখল এবং প্রিন্সেসের গাড়িগুলোর জন্য সেই ঘোড়াগুলোকে কাজে লাগাল। ইতিমধ্যে সে নিজে চলে গেল পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে।

.

অধ্যায়-১০

বাবার শেষকৃত্যের পরে প্রিন্সেস মারি নিজের ঘরের দরোজা বন্ধ করে দিল, কাউকে ঢুকতে দিল না। দাসী দরোজায় এসে জানাল, আলপাতিচ যাত্রার হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছে। (এটা দ্রোনের সঙ্গে কথা বলার আগের ঘটনা)। প্রিন্সেস মারি সোফার উপর উঠে বসে বন্ধ দরোজায় ওপাশ থেকেই জবাব দিল যে সে এখান। থেকে যাবে না, আর তাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেওয়া হোক।

যে ঘরে সে শুয়েছিল তার জানালাগুলো পশ্চিমমুখো। দেয়ালের দিকে মুখ করে সোফায় শুয়ে সে চামড়ার কুশনের বোতামগুলি নাড়াচাড়া করছে, কুশনটা ছাড়া অন্য কোনোদিকেই তার দৃষ্টি নেই, এলোমেলো চিন্তাগুলো একই বিষয়ের উপর কেন্দ্রীভূত-মৃত্যুর অপরিহার্যতা এবং তার আত্মিক নীচতা, যে নীচতার সন্দেহ কোনোদিন তার মনে জাগেনি, অথচ বাবার অসুখের সময় যা তার কাছে প্রকট হয়ে উঠেছিল। প্রার্থনা করবার ইচ্ছা হল, কিন্তু সাহস হল না, মনের বর্তমান অবস্থায় ঈশ্বরকে ডাকবার সাহস তার হল না। একইভাবে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল।

সূর্য বাড়িটার অপর দিকে চলে গেছে, তার বাঁকা রশ্মিগুলো খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরটাকে এবং মরক্কো চামড়ার কুশনটাকে আলোকিত করে তুলেছে। হঠাৎ তার চিন্তার স্রোত থেমে গেল। নিজের অজ্ঞাতেই উঠে বসল, চুল ঠিক করে দাঁড়াল, জানালার কাছে গিয়ে সন্ধ্যার তাজা বাতাস টেনে নিল প্রশ্বাসের সঙ্গে।

হ্যাঁ, এবার তুমি সন্ধ্যাটা উপভোগ করতে পার! সে তো চলে গেছে, আর কেউ তোমাকে বাধা দেবে না, নিজের মনেই কথাগুলি বলে সে একটা চেয়ারে বসে পড়ল, মাথাটা এলিয়ে পড়ল জানালার গোবরাটে।

বাগান থেকে কে যেন নরম মমতাভরা গলায় তার নাম ধরে ডাকল, তার মাথায় চুমো খেল। চোখ তুলে তাকাল। মাদময়জেল বুরিয়ে। পরনে কালো পোশাক ও শোকজ্ঞাপক শাদা পট্টি। আস্তে প্রিন্সেস মারির কাছে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তাকে চুমো খেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে শুরু করল। প্রিন্সেস চোখ তুলে তাকাল। দুজনের মধ্যে আগেকার সব বিবাদ ও নিজের ঈর্ষার কথা মনে পড়ে গেল। আরো মনে পড়ল, মাদময়জেল বুরিয়ের প্রতি সেই মানুষটির মনোভাব কীরকম বদলে গিয়েছিল, তাকে একেবারেই দেখতে পারত না, তাতেই তো বোঝা যায় যে এই মেয়েটির প্রতি মনে মনে যত তিরস্কার সে করেছে সবই কত অন্যায়। তাছাড়া, যে আমি তার মৃত্যু কামনা করেছি তার পক্ষে কি কাউকে নিন্দা করা সাজে?

মাদময়জেল বুরিয়ের জন্য তার দুঃখ হল, শান্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে হাতটা বাড়িয়ে দিল। মাদময়জেল বুরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার কাঁদতে শুরু করল, তার হাতে চুমো খেল, প্রিন্সেস মারির দুঃখের কথা বলে তার অংশীদার হতে চাইল। বলল প্রিন্সেস যদি নিজের দুঃখের ভাগ তাকে নিতে দেয় তবেই সে সান্ত্বনা পাবে, এই চরম দুঃখের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাদের ভুল-বোঝাবুঝি যেন তুচ্ছ হয়ে যায়, উপরে বসেই তিনি তার অনুরাগ ও কৃতজ্ঞতা দেখতে পাচ্ছেন। প্রিন্সেস কথাগুলি শুনল।

একটু থেমে মাদময়জেল বুরিয়ে বলল, প্রিয় প্রিন্সেস, তোমার অবস্থা তো দুদিক থেকে ভয়ংকর। আমি জানি, তুমি নিজের কথা ভাবতে পারতে না, ভাবতে জান না, কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি বলে সে কাজ আমাকেই করতে হবে।…আলপাতিচ কি তোমার কাছে এসেছিল? এখান থেকে চলে যাবার কথা কি সে কিছু বলেছে?

প্রিন্সেস মারি কোনো জবাব দিল না। কে যাবে, কোথায় যাবে তাই যেন সে বুঝতে পারেনি। এখন কি কোনো কিছু ভাবা সম্ভব? এখন কি সবই সমান নয়? এই কথা ভেবে সে কোনো জবাব দিল না।

মাদময়জেল বুরিয়ে বলল, চেরে মারি, তুমি তো জান যে আমাদের খুব বিপদ-ফরাসিরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এখন বের হওয়াও বিপজ্জনক। বের হলেই আমরা বন্দি হয়ে যাব, আর ঈশ্বর জানেন…।

সঙ্গিনীর কথা বুঝতে না পেরে প্রিন্সেস মারি তার দিকে তাকাল।

বলল, হায়, এখন যে আমার কোনোকিছুতেই ক্ষতিবৃদ্ধি নেই তা যদি কেউ বুঝত! অবশ্য, কোনো কারণেই আমি বাবার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই না…আলপাতিচ যাবার কথা কি যেন বলেছিল…তাকে বলে দিও, আমি কিছুই করতে পারব না, কিছু না, আর আমি চাই না।…

মাদময়জেল বুরিয়ে বলল, তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে আশা করছে, আমরা আগামীকাল যাত্রা করার জন্য তৈরি হতে পারব, কিন্তু আমি মনে করি এখানে থাকাই আমাদের পক্ষে ভালো। কারণ তুমিও নিশ্চয়। স্বীকার করবে চেরে মারি যে সৈন্যদের হাতে অথবা উচ্ছল চাষীদের হাতে পড়লে অবস্থা খুবই খারাপ হবে।

মাদময়জেল বুরিয়ে তার থলে থেকে জেনারেল রামু-র একখানা ইস্তাহার (সাধারণ রুশ কাগজে ছাপা নয়) বের করল। তাতে বলা হয়েছে, জনসাধারণ যেন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে না যায়, ফরাসি কর্তৃপক্ষ তাদের রক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা করবে। ইস্তাহারখানা প্রিন্সেসের হাতে দিল।

বলল, আমি মনে করি সেনাপতির কাছে আবেদন করাটাই সবচাইতে ভালো, আমার নিশ্চিত ধারণা : তোমার প্রতি যোগ্য সম্মান দেখানো হবে।

প্রিন্সেস মারি কাগজটা পড়ল, চাপা কান্নার আবেগে তার মুখটা কাঁপতে লাগল।

কার কাছে এটা পেলে?

 মাদময়জেল বুরিয়ে সলজ্জ ভঙ্গিতে জবাব দিল, আমার নাম শুনেই তারা হয়তো চিনতে পেরেছে যে আমি একজন ফরাসি।

প্রিন্সেস মারি ইস্তাহারটা হাতে নিয়ে জানালা থেকে উঠল, মান মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রিন্স আন্দ্রুর পড়ার ঘরে ঢুকল।

বলল, দুনিয়াশা, আলপাতিচ বা দ্রোনুশকা বা অন্য কাউকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। মাদময়জেল বুরিরে গলা শুনতে পেয়ে বলল, মাদময়জেল বুরিয়েকে বলে দাও সে যেন আমার কাছে না আসে। ফরাসিদের হাতে পড়বার ভয়ে আঁতকে উঠে বলল, আমাদের এক্ষুনি চলে যেতে হবে, এক্ষুনি!

প্রিন্স আন্দ্রু যদি শোনে যে আমি ফরাসিদের খপ্পরে পড়েছি! আমি, প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির মেয়ে, জেনারেল রামুর কাছে আশ্রয়ভিক্ষা করেছি, তার অনুগ্রহ নিয়েছি। এই চিন্তা তাকে আতংকিত করে তুলল, সে শিউরে উঠল, লজ্জা পেল, আর ক্রোধ ও অহংকার এমনভাবে তার মাথায় চড়ে গেল যা আগে কখনো হয়নি। নানা দুঃখকর ও অসম্মানকর চিন্তা তার মাথায় বাসা বাধল। তারা, ঐ ফরাসিরা এই বাড়িতে বাস করবে : ম. ল জেনারেল রামু প্রিন্স আন্দ্রুর পড়ার ঘরটা দখল করবে, তার চিঠি ও কাগজপত্র পড়ে মজা করবে। মাদময়জেল বুরিয়ে তাকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করবে। করুণা করে আমাকে একটা ছোেট ঘর দেওয়া হবে, সৈন্যরা বাবার ক্রুশ ও তারকা চুরি করার জন্য তার নতুন সমাধিকে তচনচ করবে, রুশদের উপর তাদের জয়লাভের কাহিনী শোনাবে, আমার দুঃখে সহানুভূতি দেখাবার ভান করবে।

উত্তেজনায় লাল হয়ে সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল, কখনো মাইকেল আইভানভিচকে, কখনো তিখনকে বা দ্রোনকে ডেকে পাঠাতে লাগল। মাদময়জেল বুরিয়ের কথা কতটা ঠিক তা দুনিয়াশা বা অন্য দাসীরা কেউই বলতে পারল না। আলপাতিচ বাড়ি নেই, থানায় গেছে। স্থপতি মাইকেল আইভানভিচও ঘুম ঘুম চোখে এসে কিছুই বলতে পারল না। পুরনো খানসামা তিখনের চোখ দুটো বসে গেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে, সে মুখে সান্ত্বনাবিহীন দুঃখের ছাপ। প্রিন্সেস মারির সব প্রশ্নের একটিমাত্র জবাবই সে দিতে পারল : হ্যাঁ প্রিন্সেস, আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

অবশেষে গ্রাম-প্রধান দ্রোন ঘরে ঢুকল। আভূমি নত হয়ে দরোজার পাশেই থেমে গেল।

 প্রিন্সেস মারি হেঁটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।

দ্রোনুশকা, আমাদের এই দুর্ভাগ্যের দিনে… সে আর বলতে পারল না।

দ্রোন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সবই ঈশ্বরের হাত।

 কিছুক্ষণ দুইজনই চুপচাপ।

দ্রোনুশকা, আলপাতিচ কোথায় যেন গেছে, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার মতো কেউ নেই। তারা যে বলছে আমি এখন চলে যেতেও পারব না সে কথা কি ঠিক?

দ্রোন বলল, কেন যেতে পারবেন না ইয়োর এক্সেলেন্সি? নিশ্চয় যেতে পারবেন।

আমাকে বলছে যে পথে শত্রুর দিক থেকে বিপদ ঘটতে পারে। দেখ বন্ধু, আমি তো কিছুই করতে পারছি না। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কেউ নেই। আজ রাতে অথবা কাল ভোরেই আমি চলে যেতে চাই।

দ্রোন চুপ করে রইল। প্রিন্সেস মারির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বলল, কোনো ঘোড়া পাওয়া যাচ্ছে না, সেকথা আলপাতিচকে বলেছি।

পাওয়া যাচ্ছে না কেন? প্রিন্সেস মারি শুধাল।

দ্রোন বলল, সবই ঈশ্বরের অভিশাপ। যা ঘোড়া আমাদের ছিল হয় সেনাবাহিনী নিয়ে গেছে, নয় তো মরে গেছে–এ বছরটাই এইরকম! ঘোড়াকে খাওয়াব কি-নিজেরাই হয়তো না খেতে পেয়ে মরে যাব! যা দিনকাল, কেউ হয়তো তিন দিন না খেয়ে আছে। আমাদের কিছু নেই, সব শেষ হয়ে গেছে।

প্রিন্সেস মারি মন দিয়ে তার কথা শুনল।

জানতে চাইল, চাষীরা শেষ হয়ে গেছে? তাদের রুটিও নেই?

 দ্রোন বলল, তারা অনাহারে মরছে। গাড়ি চালাবে কি।

এ কথা আমাকে বলনি কেন দ্রোনুশকা? তাদের কি কোনোরকম সাহায্য করা যায় না? আমি সাধ্যমতো যা পারি তা করব… ।

এই মুহূর্তে তার অন্তর যখন দুঃখে ভারাক্রান্ত তখনো যে ধনী-গরিব থাকতে পারে, তখনো যে ধনীরা গরিবকে সাহায্য না করে থাকতে পারে সেটাই প্রিন্সেস মারির কাছে আশ্চর্য মনে হল। সে শুনেছে জমিদারের ফসল বলে একটা জিনিস আছে, আর সেটা কখনো কখনো চাষীদের দেওয়া হয়। সে জানে, তার বাবা বা দাদা কেউই দরকারের সময় চাষীদের সাহায্য করলে তাতে আপত্তি করত না। সে দ্রোনের কাছে চাষীদের প্রয়োজনের কথা এবং বোণ্ডচারভোতে জমিদারের ফসল কি আছে তা জিজ্ঞাসা করতে লাগল।

দ্রোন সগর্বে বলল, জমিদারের ফসল সবটাই নিরাপদে আছে। আমাদের প্রিন্স তা বেচতে দেননি!

সেগুলি চাষীদের দিয়ে দাও, যার যা দরকার সব নিক। দাদার নামে আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম।

দ্রোন কিছু বলল না, গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু।

যথেষ্ট ফসল জমা থাকলে তা দিয়ে দাও। সব বিলিয়ে দাও। দাদার নামে আমি হুকুম দিলাম, তাদের বল, আমাদের যা কিছু আছে সবই তাদের। তাদের সবকিছু দিতেও আমাদের আপত্তি নেই। একথা তাদের বলে দাও।

প্রিন্সেস যখন কথাগুলি বলছে তখন দ্রোন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

ঈশ্বরের দোহাই ছোটমা, আমাকে বরখাস্ত করুন! আমার কাছ থেকে সব চাবি নিয়ে নেবার হুকুম দিন। তেইশ বছর ধরে চাকরি করছি, কখনো কোনো অন্যায় করিনি। ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে রখাস্ত করুন!

তার কাছে লোকটি কি চাইছে, কেনই বা সে বরখাস্ত হতে চাইছে, কিছুই প্রিন্সেস মারি বুঝতে পারল না। বলল, তার সেবায় সে কখনো সন্দেহ করেনি, তার জন্য এবং চাষীদের জন্য সবকিছু করতে সে প্রস্তুত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *