০৯. ইওরোপিয় বাহিনীর সমর-সজ্জা

নবম পর্ব অধ্যায়-১

১৮১১ সালের শেষের দিক থেকেই পশ্চিম ইওরোপিয় বাহিনীর সমর-সজ্জা ও সেনাসমাবেশের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে লাগল, ১৮১২ সালে সেই বাহিনী পশ্চিম থেকে পুবে রুশ সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেল, অবশ্য ১৮১১ সাল থেকে রুশ বাহিনী আগে থেকেই সেখানে জমায়েত হয়েছিল। ১৮১২ সালের ১২ই জুন পশ্চিম ইওরোপিয় সেনাদল রুশ সীমান্ত অতিক্রম করল, শুরু হল যুদ্ধ, অর্থাৎ শুরু হল এমন একটি ঘটনা যা মানুষের বুদ্ধি ও স্বভাবের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। লক্ষ লক্ষ মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অপরাধ, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, চৌর্যবৃত্তি, জালিয়াতি, নকল টাকার প্রচলন, সিধেলচুরি, অগ্নিকাণ্ড ও নরহত্যায় প্রবৃত্ত হল যার উল্লেখ একটা পুরো শতাব্দীকালে সারা জগতের আদালতের ইতিহাসেও মেলে না, অথচ সে কাজ যারা করেছে তারা সেইসময়ে তাকে অপরাধ বলেই গণ্য করে নি।

এই অসাধারণ ঘটনা কিসের ফলশ্রুতি? কি এর কারণ? ইতিহাসকাররা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে এর কারণ ওল্ডেনবুর্গের প্রতি কৃত অন্যায়, ইওরোপিয় নিষেধাজ্ঞাকে (contivental system) লংঘন, নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আলেক্সান্দারের দৃঢ়তা, কূটনীতিকদের ভ্রান্তি, ইত্যাদি।

অতএব মেটারনিস, রুমিয়ান্তসেভ অথবা ট্যালোন্ড যদি দরবার ও সান্ধ্য মজলিসের ফাঁকে একটু কষ্ট স্বীকার করে আরো খোলাখুলিভাবে একটা চিঠি লিখত অথবা নেপোলিয়ন যদি আলেক্সান্দারকে লিখত : শ্রদ্ধেয় ভাই আমার, ওন্ডেনবুর্গের ডিউককে তার জমিদারি ফিরিয়ে দিতে আমি রাজি,-তাহলেই আর যুদ্ধ হত না।

আমরা বুঝতে পারি যে সমসাময়িক লোকদের কাছে ব্যাপারটা এইরকমই মনে হয়েছিল। স্বভাবতই নেপোলিয়ন মনে করেছিল যে ইংলন্ডের ষড়যন্ত্রই এই যুদ্ধের কারণ (বস্তৃত সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নেপোলিয়ন নিজেই এ কথা বলেছিল)। স্বভাবতই ইংলিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা মনে করেছিল যে নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই এ যুদ্ধের কারন, ওল্ডেনবুর্গের ডিউক মনে করেছিল তার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তাই এ যুদ্ধের কারণ, ব্যবসায়ীদের মতে যে ইওরোপিয় নিষেধাজ্ঞা ইওরোপকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল সেটাই এ যুদ্ধের কারণ, সেনাপতি ও প্রধান সৈনিকদের মতে তাদের চাকরি দেবার প্রয়োজনই এ যুদ্ধের কারণ, তৎকালীন কূটনীতিকদের মতে, ১৮০৯ সালের রুশ-অস্ট্রিয়া মৈত্রীর সংবাদটি নেপোলিয়নের কাছ থেকে ভালোভাবে লুকিয়ে না রাখা, এবং ১৭৮নং স্মারকলিপির অদ্ভুত ভাষা এ যুদ্ধের কারণ। এটা খুবই স্বাভাবিক যে এইসব এবং আরো অসংখ্য ও সীমাহীন কারণ তৎকালীন মানুষের মনে দেখা দিয়েছিল, আমরা, উত্তরকালের মানুষরা যারা এই ঘটনাকে তার বিরাট পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পাচ্ছি এবং তার ভয়ংকর তাৎপর্যকে পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারছি, আমাদের কাছে কিন্তু এইসব কারণ মোটেই যথেষ্ট নয়। নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, বা আলেক্সান্দার কঠোর ছিল, অথবা ইংলন্ডের নীতি চাতুর্যপূর্ণ ছিল,-বা ওন্ডেনবুর্গের ডিউকের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল, তাই বলে লক্ষ লক্ষ খৃস্টভক্ত মানুষ পরস্পরকে হত্যা করল, নির্যাতন করল, একথাটা আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। বাস্তবক্ষেত্রে যে নরহত্যা ও হিংসাত্মক ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছিল তার সঙ্গে এইসব ঘটনার কি সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা আমাদের মাথায় আসে না : ডিউকের প্রতি অন্যায় করা হয়েছিল বলে ইওরোপের অপর প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ কেন স্মালেনস্ক-এর অধিবাসীদের হত্যা করল, তাদের ধ্বংস করল এবং তাদের হাতে নিহত হল!

কিন্তু আমাদের মতো তাদের যেসব বংশধর ইতিহাসকরা নই এবং গবেষণার মনোভাবদ্বারা পরিচালিত নই বলে এই ঘটনাটিকে পরিচ্ছন্ন সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি, তাদের কাছে কিন্তু অগণিত কারণ আপনা থেকেই এসে হাজির হয়। সেইসব কারণ অনুসন্ধান করতে আমরা যত বেশি গভীরে প্রবেশ করি ততই তারা বেশি সংখ্যায় প্রকাশ পায, এবং আমাদের কাছে প্রতিটি স্বতন্ত্র কারণ অথবা গোটা কারণ-সমষ্টিকেই মনে হয় সমানভাবে যথার্থ ও ঘটনাবলীর বিরাটত্বের বিচারে সমানভাবে মিথ্যা, এতবড় ঘটনাপ্রবাহকে ঘটাবার পক্ষে একান্তই অনুপযুক্ত। আমাদের কাছে অমুক বা তমুক ফরাসি কর্পোরালের দ্বিতীয়বার চাকরি নেবার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যেমন কারণ বলে গণ্য হতে পারে, তেমনই নেপোলিয়ন কর্তৃক ভিলার ওপারে তার সৈন্য সরিয়ে নেওয়া এবং ওল্ডেনবুর্গের জমিদারি ফিরিয়ে দেওয়ার অনিচ্ছাও কারণ বলে গণ্য হতে পারে, কারণ সে যদি যুদ্ধে যোগ দিতে না চাইত, এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় ও সহস্রতম কর্পোরাল ও সৈনিকও যদি আপত্তি জানাত, তাহলে নেপোলিয়নের বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা অনেক কমে যেত এবং তার ফলে যুদ্ধই হত না।

নেপোলিয়নকে ভিক্ষুলার ওপারে সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে এই দাবি শুনে সে যদি অসন্তুষ্ট না হাত এবং সৈন্যদের অগ্রসর হবার হুকুম না দিত, তাহলেও যুদ্ধ হত না, আবার তার সব সার্জেন্টরা যদি দ্বিতীয়বার যুদ্ধে যোগ দিতে আপত্তি জানাত তাহলেও যুদ্ধটা না ঘটতে পারত। অথবা যদি ইংরেজরা ষড়যন্ত্র না করত, রাশিয়াতে যদি স্বৈরতন্ত্রী শাসন-ব্যবস্থা না থাকত, অথবা ফ্রান্সে যদি বিপ্লব না ঘটত, পরবর্তীকালে একনায়কত্ব ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত না হত, অথবা ফরাসি বিপ্লবের অনুকূল কোনো পরিস্থিতিই দেখা না দিত,-তাহলেও তো যুদ্ধই হত না। এদের প্রতিটি কারণের অনুপস্থিতি ঘটলে কিছুই ঘটত না। কাজেই এইসব কারণ লক্ষ লক্ষ কারণ-এক মিলিত হয়েই যুদ্ধটা ঘটিয়েছে। কাজেই কোনো একটি কারণে এ যুদ্ধ হয় নি, কিন্তু যুদ্ধটা ঘটতে বাধ্য বলেই ঘটেছে। ঠিক যেভাবে কয়েক শতাব্দী আগে দলে দলে তোক পূর্ব থেকে পশ্চিমে এসে মানুষকে হত্যা করেছিল, সেইভাবেই এবারও লক্ষ লক্ষ মানুষ মানবিক অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ খুন করতে এসেছিল পশ্চিম থেকে পূর্বে।

যেসব সৈনিকদের ভাগ্য-পরীক্ষার দ্বারা অথবা বাধ্যতামূলক সৈন্যদলভুক্তির বিধানের দ্বারা এই অভিযানের সামিল করা হয়েছিল তাদের যেমন এ ব্যাপারে কোনোরকম স্বাধীন ইচ্ছা ছিল না, তেমনই যে নেপোলিয়ন এবং আলেক্সান্দারের ঘাড়ে যুদ্ধটাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে তাদেরও কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা ছিল না। যা ঘটেছে তার অন্যথা হতেই পারত না, কারণ নেপোলিয়ন এবং আলেক্সান্দারের মনোবাসনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে এমন অসংখ্য ঘটনার সমাবেশ প্রয়োজন ছিল যাদের যেকোন একটিকে বাদ দিলেই এ ঘটনাটি ঘটতেই পারত না। যে লক্ষ লক্ষ লোকের হাতে ছিল প্রকৃত ক্ষমতা-যে সৈনিকরা গোলাগুলি চালিয়েছিল, অথবা যারা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল রসদ ও কামান-বন্দুকতারাই তো এই দুর্বল ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করেছিল, এবং নানারকমের অসংখ্য জটিল কারণের দ্বারা সেকাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।

বুদ্ধির অতীত ঘটনাবলীর ব্যাখ্যার জন্য আমরা নিয়তিবাদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হই। ইতিহাসের সেইসব ঘটনাকে যতই আমরা বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাই ততই সেগুলি আমাদের কাছে আরো বেশি করে বিচার ও বুদ্ধির অতীত বলে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।

প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে বাঁচে, ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করে, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে এখন সে এ-কাজ বা সে-কাজ করতেও পারে, আবার না করতেও পারে, কিন্তু যেমুহূর্তে কাজটি করা হয়ে গেল তখনই একটি বিশেষ মুহূর্তে সংঘটিত সেই কাজটি হয়ে ওঠে অপরিবর্তনীয় ও ইতিহাসের অধীন, সেখানে সে ঘটনার কোনো স্বাধীন সত্তা নেই, তার তাৎপর্য তখন নিয়তি-নির্ধারিত।

প্রতিটি মানুষের জীবনেই দুটি দিক থাকে, একদিকে তার ব্যক্তিগত জীবন, সেখানে তার স্বার্থ যত বিমূর্ত সেও ততই স্বাধীন, আর একদিকে তার দলগত মৌমাছি-জীবন, সেখানে নিয়তির অনিবার্য বিধানকে মেনে চলতে সে সাধ্য।

মানুষ নিজের জন্য বাঁচে সচেতনভাবে, কিন্তু মানবতার ঐতিহাসিক ও সার্বিক লক্ষ্যসাধনের ক্ষেত্রে সে একটি অচেতন যন্ত্র মাত্র। একটা কাজ একবার করা হয়ে গেলে আর তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না, মহাকালের যাত্রাপথে আরো অসংখ্য মানুষের কর্মধারার সঙ্গে মিলেমিশে সেই কাজটিই একটি ইতহাসিক তাৎপর্য লাভ করে। একটি মানুষ সামাজিক মর্যাদার সোপানের যত বেশি উঁচুতে অধিষ্ঠিত থাকে, যত বেশি মানুষের সঙ্গে সে যুক্ত থাকে, এবং অন্যের উপর তার প্রভাব বেশি থাকে, ততই তার প্রতিটি কাজ হয়ে ওঠে নিয়তি-নির্দিষ্ট ও অনিবার্য।

রাজার হৃদয় তো প্রভুরই হাতে।

রাজা তো ইতিহাসের ক্রীতদাস।

ইতিহাস, অর্থাৎ মানবজাতির অচেতন, সাধারণ, মৌমাছি-জীবন, রাজার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে স্বীয় উদ্দেশ্যসাধনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

যদিও ১৮১২ সালের সেইসময় নেপোলিয়নের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে verser (ou ne pas verser) le sang de ses peuples (জনগণের রক্তপাত করা হবে কি হবে না)-নেপোলিয়নকে লেখা শেষ চিঠিতে আলেক্সান্দার এই ভাষাই ব্যবহার করেছিল–সেটা তার উপরেই নির্ভর করছে, তথাপি তখনো সে ছিল নিয়তির অনিবার্য দৃঢ় মুষ্টিতেই আবদ্ধ, স্বাধীন ইচ্ছামতো কাজ করছি ভাবলেও আসলে তখনো তাকে কাজ করতে হয়েছিল মৌমাছি-জীবনের জন্যই–অর্থাৎ ইতিহাসের তাগিদেই।

পশ্চিমের মানুষরা পুবে এল অন্য মানুষদের হত্যা করতে, আর সহ-অবস্থানের বিধানেই হাজার হাজার ছোট ছোট কারণ এসে তার সঙ্গে মিলে ঘটিয়ে তুলল এই যুদ্ধ : ইওরোপিয় নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থা লংঘনের দরুন তিরস্কার, ওল্ডেনবুর্গের ডিউকের প্রতি অন্যায়, প্রুশিয়াতে সৈন্য চালনা-(নেপোলিয়নের মতো) যেটা করা হয়েছিল অস্ত্রের দ্বারা সন্ধি স্থাপনের উদ্দেশ্যে,–জগণের প্রবণতার সঙ্গে ফরাসি সম্রাটের যুদ্ধপ্রীতি ও যুদ্ধের অভ্যাসের মিল ঘটে যাওয়া, সমরায়োজনের জাকজমকের প্রলোভন, তজ্জনিত ব্যয়বহুলতার ক্ষতিপূরণের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রয়োজন, তজ্জনিত ব্যয়বহুলতার ক্ষতিপূরণের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রয়োজন, ড্রেসডেন-এ প্রাপ্ত প্রভূত সম্মানের নেশা, সেইসব কূটনৈতিক আলোচনা সমকালীনদের মতো যা চালানো হয়েছিল শান্তি স্থাপনের আন্তরিক বাসনায়, কিন্তু আসলে যা উভয় পক্ষের আত্ম-রতিকেই আঘাত করেছিল,-এইসব এবং আরো লক্ষ লক্ষ কারণ একসঙ্গে মিলেমিশে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল।

একটি আপেল যখন পেকে গাছ থেকে পড়ে, তখন সেটা নিচে পড়ে কেন? তার কারণ কি পৃথিবীর আকর্ষণ, না তার বোঁটাটা শুকিয়ে যাওয়া, না কি সূর্যের উত্তাপে রসহীন হওয়া, না কি সেটার ভার বেড়ে যাওয়া, না কি বাতাসের নাড়া খাওয়া, না কি গাছের নিচে দাঁড়ানো ছেলেটির ফল খাবার ইচ্ছা? কোনোটাই কারণ নয়। এইসবই সেইসব শর্তের একত্র সমাবেশ যার ফলে সব গুরুত্বপূর্ণ জৈব ও প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি ঘটে। যে উদ্ভিদবিজ্ঞানী মনে করে যে আপেলের কোষ-তন্তুগুলি নষ্ট হয়ে যাবার ফলেই আপেলটা মাটিতে পড়ে তার কথাও ঠিক, আবার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যে ছেলেটি মনে করে যে সে আপেলটা খাবার ইচ্ছায় প্রার্থনা করেছে বলেই সেটা মাটিতে পড়েছে তার কথাও ঠিক। যে লোক বলে যে ইচ্ছা হয়েছিল বলেই নেপোলিয়ন মস্কো গিয়েছিল, আর যে লোক বলে যে লক্ষ লক্ষ টন ওজনের একটা গুপ্ত পাহাড় ধসে পড়েছে কারণ শেষ মজুরটি তার খন্তা দিয়ে সেটাকে শেষবারের মতো আঘাত করেছে–দুজনের কথাই সমান সত্য বা সমান ভুল। ঐতিহাসিক ঘটনার বেলায় তথাকথিত মহাপুরুষরা ঘটনার নামকরণের জন্য প্রয়োজনীয় লেবেলমাত্র, আর লেবেলের মতোই ঘটনাটির সঙ্গে তাদের যোগসূত্রটিও নামমাত্র।

যে সমস্ত কাজকে তারা তাদের ইচ্ছাধীন কাজ বলে মনে করে তার প্রতিটি কাজই ঐতিহাসিক অর্থে অনিচ্ছাপ্রসূত, ইতিহাসের যাত্রাপথের সঙ্গে যুক্ত এবং অনাদিকাল থেকে পূর্বনির্দিষ্ট।

.

অধ্যায়-২

২৯শে মে নেপোলিয়ন ড্রেসডেন ত্যাগ করল, সেখানে সে তিনটি সপ্তাহ কাটিয়েছে এমন একটি দরবার পরিবৃত হয়ে যার মধ্যে ছিল প্রিন্স, ডিউক, রাজন্যবর্গ, এমনকি একজন সম্রাট পর্যন্ত। ড্রেসডেন ছাড়বার আগে নেপোলিয়ন অনুগ্রহ দেখাল সেইসব রাজা ও প্রিন্সদের যাদের প্রতি সে প্রশ্ন, আর যাদের প্রতি অপ্রসন্ন তাদের ভাগ্যে জুটল তিরস্কার, নিজস্ব মণি-মুক্তো-হীরে-অর্থাৎ যেগুলি সে পেয়েছে অন্য রাজাদের কাছ থেকে উপহার দিল অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্ঞীকে, ইতিহাসকারদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি, যে সম্রাজ্ঞী মারি লুই প্যারিসে নেপোলিয়নে এক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকেই নিজের স্বামী বলে মনে করত। গভীর মমতায় তাকে আলিঙ্গন করে নেপোলিয়ন যখন বিদায় নিল তখন সে দুঃখ ম্রাজ্ঞীর পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। যদিও কূটনীতিবিদরা তখনো দৃঢ়ভাবে সন্ধির সম্ভাবনায় বিশ্বাস করে মহাউৎসাহে সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে, যদিও স্বয়ং সম্রাট নেপোলিয়ন আলেক্সান্দারকে Morisieur mon frzre বলে সম্বোধন করে তাকে চিঠি লিখেছে এবং আন্তরিক আশ্বাস জানিয়েছে যে সে যুদ্ধ চায় না, আর তাকে চিরদিন ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে–তথাপি নেপোলিয়ন তার সেনাদলের সঙ্গে যোগ দিতে যাত্রা করল, আর প্রতিটি ঘাঁটিতে নতুন করে হুকুম জারি করল যাতে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সৈন্য-চলাচল আরো বৃদ্ধি করা হয়। চাকর-বাকর, এড-ডি কং ও একজন পথ-প্রদর্শকে পরিবৃত হয়ে একটা ছয়-ঘোড়ার ভ্রমগোপযোগী গাড়িতে সে যাত্রা করল পোসেন, থর্ন, ডানজিগ ও কোনিগসবের্গ-এর পথে। প্রতিটি শহরে হাজার হাজার মানুষ উত্তেজনা ও উৎসাহসহকারে তার সঙ্গে দেখা করল।

সেনাদল এগিয়ে চলেছে পশ্চিম থেকে পুবে, আর ছয়টি ঘোড়াও বদলাবদলি করে সেই একই দিকে নেপোলিয়নকে নিয়ে এগিয়ে চলল। ১০ই জুন সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হয়ে সে রাত্রিবাস করল ভিল্কাভিস্কি অরণ্যে জনৈক পোলিশ কাউন্টের জমিদারিতে তার জন্য তৈরি একটা বাড়িতে।

পরদিন সেনাদলকে পেরিয়ে একটা গাড়িতে চেপে সে নিয়েমেন-এ হাজির হল এবং পার হবার উপযুক্ত একটা স্থান বেছে নেবার জন্য পোলিশ ইউনিফর্ম পরে নদীর তীরে পৌঁছে গেল।

নদীর অপর তীরে কিছু কসাককে দেখা গেল, আর দূর-বিস্তার তৃণভূমির মাঝখানে দেখা গেল মস্কোর পবিত্র শহর (Moscou, la ville sainte), যে সিথিয়া রাজ্যে একদা মহান আলেক্সান্দার প্রবেশ করেছিল তেমনই এক রাজ্যের রাজধানী–তারপরেই একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে এবং রণ-কৌশল ও কূটনৈতিক বিবেচনাকে উপেক্ষা করে নেপোলিয়ন সেনাদলকে অগ্রসর হবার হুকুম দিল এবং পরদিনই তার সেনাদল নিয়েমেন অতিক্রম করতে আরম্ভ করল।

নিয়েমেন-এর বা তীরের উতরাইতে সেইদিনই তার জন্য যে শিবিরে স্থাপন করা হয়েছিল, ১২ জুন খুব সকালে সেই শিবির থেকে বেরিয়ে এসে নেপোলিয়ন চোখে একটা স্পাই-গ্লাস (ছোট দূরবীন) লাগিয়ে দেখতে পেল, তার সৈন্যরা জলস্রোতের মতো ভিল্কাভিস্কি অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে নদীর উপরকার তিনটি সেতু পথ ধরে ছুটে চলেছে। সৈনিকরা সম্রাটের উপস্থিতির কথা জানত, তাই তাকে খুঁজতে গিয়ে পাহাড়ের উপরে শিবিরের সম্মুখে ওভারকোট ও টুপি পরিহিত একটি মূর্তিকে অন্য সকলের চাইতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা নিজ নিজ টুপি তুলে চিৎকার করে উঠল : VieL Empereur! তারপর যে বিরাট জঙ্গলের মধ্যে তারা আত্মগোপন করেছিল একে একে অবিশ্রাম স্রোতধারার মতো সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিন ভাগে ভাগ হয় তিনটি সেতুর উপর দিয়ে অপর তীর লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।

এবার আমরা যুদ্ধে নামব। আঃ, তিনি নিজে যখন কাজটা হাতে নেন তখন সবকিছুই গরম হয়ে ওঠে..ঈশ্বর সাক্ষী!…ঐ তো তিনি!…Vive L Empereur! তাহলে এই সেই এশিয়ার তৃণভূমি! যাই বল, দেশটা খুব নোরা। অ রিভোয়া, বুচে, তোমার জন্য মস্কোর সেরা প্রাসাদটা রেখে দেব! অ রিভোয়া। শুভেচ্ছা জানাই!…সম্রাটকে দেখেছ? Vive L Empereur!-দেখ জেরার্ড, আমাকে যদি ভারতবর্ষের শাসনকর্তা করা হয়, তাহলে তোমাকে করব কাশ্মীরের মন্ত্রী-কথা একেবারে পাক্কা। Vive L Empereur! হুররা! হুররা! হুররা! কসাকের দল-রাস্কেলরা-দেখ কেমন দৌড়চ্ছে! ViveL Empereur! ঐ তো তিনি, দেখছে পাচ্ছ? ঠিক তোমাকে যেমন দেখছি, এইভাবে দুবার তাকে দেখছি। ছোট্ট কর্পোরাল।…একজন প্রবীণকে তিনি ক্রুশ উপহার দিলেন, তাও দেখেছি।…vive L Empereur! যুবক ও বৃদ্ধ, নানা চরিত্রের ও সামাজিক মর্যাদার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হল একই কথা। সকলেরই চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে দীর্ঘ প্রত্যাশিত অভিযান শুরু করার আনন্দ, আর যে মানুষটি ধূষর কোট গায়ে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতি আবেগমথিত অনুরাগ।

১৩ জুন নেপোলিয়নের জন্য একটা ছোট আরবি ঘোড়া আনা হল। তা পিঠে চেপে সে ছুটল নিয়েমেন এর উপরকার একটা সেতুর দিকে। চারদিকে সৈনিকদের চিৎকার ও জয়ধ্বনিতে কানে তালা লাগবার উপক্রম। যুদ্ধের চিন্তায় মগ্ন মন তাতে বিরক্তি বোধ করলেও নেপোলিয়ন সে চিৎকার সহ্য করেই চলেছে, কারণ সে জানে যে সৈনিকদের এখন থামতে বলা বৃথা। একটা জনাকীর্ণ ভাসমান সেতুকে পার হয়ে সে হঠাৎ বাঁ দিকে মোড় ঘুরে সোজা ঘোড়া ছুটিয়ে দিল কভনোর দিকে। আনন্দে রুদ্ধশ্বাস অশ্বারোহী রক্ষীদল আগে আগে চলেছে ভিড়ের ভিতর দিয়ে তার জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়ে। প্রশস্ত ভিলিয়া নদীর তীরে পৌঁছে সেখানে অবস্থানকারী একটি পোলিশ উহলান রেজিমেন্টের কাছে গিয়ে সে থামল।

তাকে দেখবার জন্য পোলদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, সকলে সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠল, Vivat! (জিন্দাবাদ!)।

নদীটার এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে নেপোলিয়ন ঘোড়া থেকে নেমে নদীর তীরে একটা কাঠের উপর বসল। তার নির্বাক ইশারায় একটা দূরবীন এনে দেওয়া হল। এগিয়ে আসা একটা চাকরের পিঠে সেটাকে রেখে সে নদীর ওপারে দৃষ্টি ফেরাল। তারপর কাঠের উপর মেলে-ধরা একখানা মানচিত্রের মধ্যে ডুবে গেল। মাথা না তুলে দুজনে এড-ডি-কংকে কি যেন বলতেই তারা ঘোড়া ছুটিয়ে পোলিশ উহলানদের কাছে এগিয়ে গেল।

একজন এড-ডি-কং পৌঁছতেই পোলিশ উহলানদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা গেল, কি? তিনি কি বলছেন?

হুকুম হয়েছে, হেঁটে পার হওয়া যায় এরকম একটা জায়গা খুঁজে বের করে নদীটা পার হতে হবে। পোলিশ উহলানদের কর্নেল জনৈক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ উত্তেজনায় রক্তিম হয়ে থেমে থেমে জিজ্ঞাসা করল, সেরকম জায়গার খোঁজ না করে সে কি উহলানদের নিয়ে সাঁতরে নদী পার হতে পারে। এড-ডি-কং উত্তর দিল, এই অতিউৎসাহ দেখে সম্রাট অসন্তুষ্ট নাও হতে পারে।

এড-ডি-কং কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই গোঁফওয়ালা বুড়ো অফিসারটির চোখ-মুখ খুশিতে ঝকমকিয়ে উঠল, হাতের তলোয়ার তুলে চিৎকার করে উঠল, ভাইভাত! তারপর উহলানদের অনুসরণ করতে হুকুম দিয়ে নদীর জলে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। শত শত উহলান তার পিছনে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর, ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে উহলানরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। কিছু ঘোড়া ও সৈনিক ডুবে গেল, কেউবা জিনের উপরে থেকে অথবা ঘোড়ার কেশর ধরে সাঁতরাতে লাগল। মাত্র আধ ভার্ল্ড দূরেই একটা শুকনো খাদ থাকা সত্ত্বেও দূরে কাঠের উপর উপবিষ্ট লোকটির চোখের সামনে নদীর সাঁতরাতে এবং ডুবে যেতে পারায় তারা গর্ববোধ করতে লাগল, যদিও সে লোকটি তাদের এই কার্যকলাপ একবার তাকিয়েও দেখল না। এড-ডি-কং ফিরে এসে যখন সুযোগমতো ম্রাটের প্রতি পোলদের এই অনুরাগের কথা জানাল তখন ধূসর ওভারকোর্ট পরিহিত লোকটি উঠে দাঁড়াল, এবং বের্থিয়ারকে ডেকে এনে নদীর তীরে পায়চারি করতে করতে তাকে নানা নির্দেশ দিতে লাগল, আর মাঝে মাঝে ডুবন্ত উহলানদের দিকে আপত্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল।

আফ্রিকা থেকে মস্কোভির তৃণভূমি পর্যন্ত পৃথিবীর যেকোন স্থানে তার উপস্থিতিই যে মানুষের বাকরোধ করা এবং তাদের উন্মত্ত আত্ম-বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেবার পক্ষে যথেষ্ট-এ সত্য তার কাছে মোটেই নতুন নয়। ঘোড়া আনতে বলে সে নিজের বাসস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।

তাদের সাহায্যের জন্য নৌকা পাঠানো সত্ত্বেও প্রায় চল্লিশ জন উহলান নদীতে ডুবে গেল। বাকি, মধিকাংশ সৈনিক অনেক কষ্টে যে তীর থেকে যাত্রা করেছিল সেখানেই ফিরে এল। শুধু অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কর্নেল স্বয়ং নদী পেরিয়ে কোনোরকমে ওপারে উঠল। তীরে উঠেই ভেজা পোশাকসমেত তারা চিৎকার করে উঠল, ভাইভাত! তারপর সোৎসাহে সেইখানে তাকাল যেখানে নেপোলিয়ন বসেছিল, কিন্তু এখন আর নেই, তবু তারা সেইমুহূর্তে মনে মনে খুশি হল।

সেদিন সন্ধ্যায় নেপোলিয়ন দুটো আদেশ জারি করল : প্রথম, রাশিয়াতে চালাবার জন্য যেসব জাল রুশ নোট বানানো হয়েছে যত শীঘ্র সম্ভব সেগুলো বাজারে ছেড়ে দেওয়া হোক, দ্বিতীয়, যে স্যাক্সনটির কাছে ফরাসি বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রেরিত হুকুম সংক্রান্ত তথ্যসম্বলিত চিঠি পাওয়া গেছে তাকে গুলি করে মারা হোক। আর এই দুই হুকুমের ফাঁকে নেপোলিয়ন আরো নির্দেশ দিল, যে পোলিশ কর্নেল অকারণে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল তাকে সম্মানিত সেনাদল-এর তালিকাভুক্ত করা হোক, সে সেনাদলের প্রধান স্বয়ং নেপোলিয়ন।

Quos vult perdere dementat.(ঈশ্বর যাদের ধ্বংস করতে চান তাদেরই পাগল করে দেন।)

.

অধ্যায়-৩

ইতিমধ্যে রাশিয়ার সম্রাট সেনা পরিদর্শন করতে এবং নানারকম কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করতে একমাসের উপর ভিলনাতে কাটাচ্ছে। প্রত্যাশিত যুদ্ধের কোনোরকম প্রস্তুতিই নেওয়া হয় নি, আর সেই প্রস্তুতির জন্যই সম্রাট চলে এসেছে পিটার্সবুর্গ থেকে। যুদ্ধের কোনো সঠিক পরিকল্পনাই করা হয় নি। বিভিন্ন পরিকল্পনার যেসব প্রস্তাবমাত্র করা হয়েছিল একমাস যাবৎ সম্রাট প্রধান ঘাঁটিতে হাজির হবার ফলে তা বরং আরো বেড়ে গেছে। তিনটি বাহিনীরই নিজ নিজ প্রধান সেনাপতি আছে, কিন্তু সমগ্র রুশবাহিনীর কোনো সর্বাধিনায়ক নেই, আর সম্রাট নিজেও সে দায়িত্বভার গ্রহণ করে নি।

সম্রাট যত বেশিদিন ভিলনায় কাটাল, যুদ্ধের প্রস্তুতি ততই যেন হ্রাস পেতে লাগল। যারা সর্বদা সম্রাটকে ঘিরে রইল তাদের সকলেরই একমাত্র চেষ্টা হল সম্রাটের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা, যুদ্ধ যে আসন্ন সেকথা তারা ভুলেই গেল।

পোলিশ প্রধানগণ, সভাসদগন এবং স্বয়ং সম্রাট কর্তৃক আয়োজিত অনেকগুলি বল-নাচ ও ভোজনোৎসবের পরে জুন মাসে জনৈক পোলিশ এড-ডি-কং-এর খেয়াল হল যে, ম্রাটের সম্মানে এড-ডি কংদের তরফ থেকেও একটা ডিনার ও বল-নাচের আয়োজন করা উচিত। প্রস্তাবটা সকলেরই মনে ধরল। সম্রাটও সম্মতি দিল। চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করা হল। ম্রাটের প্রিয়পাত্রী জনৈক মহিলাকে প্রধান অভ্যর্থনাকারিণী হিসেবে আমন্ত্রণ করা হল। কাউন্ট বেনিংসেন ভিলনা প্রদেশের জমিদার, উৎসবের জন্য সে তার গ্রামের বাড়িটা ছেড়ে দিল। স্থির হল, ১৩ই জুন তারিখে কাউন্ট বেনিংসেনের জমিদারি জাক্রেৎ-এ বল নাচ, ডিনার, নৌকাবাইচ ও আতসবাজি পোড়ানো হবে।

নেপোলিয়ন যেদিন নিয়েমেন নদী পার হবার হুকুম জারি করল এবং তার অগ্রবর্তীবাহিনী কসাকদের তাড়িয়ে রুশ সীমান্ত অতিক্রম করল, সেই সন্ধ্যাটা আলেক্সান্দার কাটাল বেনিংসেনের পল্লীভবনে এড-ডি কংদের সঙ্গে খানাপিনায়।

বড়ই চমৎকার ঝলমলে সে উৎসব। উদ্যোক্তারা জানাল, এক জায়গায় এতগুলি সুন্দরীর সমাবেশ কদাচিৎ ঘটে থাকে। ম্রাটের সঙ্গে যেসব রুশ মহিলারা পিটার্সবুর্গ থেকে ভিলনায় এসেছিল তাদের মধ্যে কাউন্টেস বেজুকভাও ছিল, তার তথাকথিত রুশ সৌন্দর্যের ধাক্কায় রুচিশীলা পোলিশ মহিলাদের সে একেবারে কাৎ করে দিল। ম্রাটের নজরও তার উপর পড়ল, তার সঙ্গে নেচে সম্রাট তাকে সম্মানিত করল।

বরিস দ্রুবেৎস্কয় স্ত্রীকে মস্কোতে রেখে এসেছে, বর্তমানে সে en gracon (অবিবাহিত)-এর মতোই বাস করছে, এড-ডি-কং না হলেও সেও এই উৎসবের ব্যয়বাবদ মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছে। এখন সে একজন ধনী লোক, সম্মানের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত, এখন আর সে কারো অনুগ্রহভিখারী নয়, সমবয়স্কদের মধ্যে যারা উঁচুতে উঠেছে তাদের সঙ্গে সে কারো অনুগ্রহভিখারী নয়, সমবয়স্কদের মধ্যে যারা উঁচুতে উঠেছে তাদের সঙ্গে সে সমানতালে পা ফেলে চলে। অনেকদিন পরে তিলনাতে হেলেনের সঙ্গে তার দেখা হল। হেলেন এখন বড় বড় লোকের সঙ্গে মেলামেশা করছে, বরিসও সম্প্রতি বিয়ে করেছে, তাই অনেকদিনের পুরনো বন্ধুর মতোই তারা চলতে লাগল।

মধ্যরাত। নাচ তখনো চলছে। মনের মতো জুটি না পেয়ে হেলেন বরিসের সঙ্গেই মাজুরকা নাচের প্রস্তা করল। তারাই তৃতীয় জুটি। জরির কাজকরা কালো গাউনের তলা থেকে বেরিয়ে-আসা হেলেনের ঝকঝবে খোলা কাঁধের দিকে তাকিয়ে পূর্ব-পরিচিতদের কথা বলতে বলতে বরিস সারাক্ষণ ম্রাটের দিকেই চো ফিরিয়ে রইল। সম্রাট তখন নিজে নাচছে না, দরজায় দাঁড়িয়ে একের পর এক নাচের জুটিদের থামিয়ে এম মিষ্টি করে কথা বলছে যা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।

মাজুরকা শুরু হলে বরিস লক্ষ্য করল, সম্রাটে অতিপ্রিয় অনুগামীদের অন্যতম অ্যাডজুটান্ট-জেনারে বলাশেভ সম্রাটের দিকে এগিয়ে গেল এবং সম্রাট একটি পোলিশ মহিলার সঙ্গে আলাপনে রত থাকলে শিষ্টাচার-বিরোধীভাবে তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। কথা শেষ করে সম্রাট তার দিকে তাকাল, যখন বুঝ পারল যে কোনো গুরুতর কারণেই সে এ সময়ে এখানে এসেছে, তখন সম্রাট মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঈষৎ দুলিয়ে বলাশেভের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলাশেভ কি যেন বলতে না বলতেই সম্রাটের মুখে ফুটে উঠল অপার বিস্ময়। বলাশেভের হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে সাত গজ চওড়া একটা পথ করে নিয়ে সম্রাট তাকে নিয়ে ঘরটা পার হয়ে গেল। তা দেখে আরাকচিভের উত্তেজিত মুখের ভাবটা বরিসের নজর এড়াল না। ভুরুর নীচে থেকে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে আরাকচিভ লাল নাকটা ঝেড়ে ভিড়ের ভিতর থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেল, মনে আশা, সম্রাট হয় তো তাকে ডেকে কথা বলবে।

কিন্তু আরাকচিভের দিকে না তাকিয়েই সম্রাট ও বলাশেভ আলোকিত বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। তলোয়ার হাতে নিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে আরাকচিভ প্রায় বিশ পা দূর থেকে তাদের অনুসরণ করল।

মাজুরকা নাচের নানা মুদ্রার মাঝেও বরিসের মনে একটা দুশ্চিন্তা দেখা দিল, বলাশেভ কি সংবাদ এনেছে, আর কেমন করে অন্য সকলের আগে সেটা জানা যায়। নাচের মাঝখানেই সে বাগানের দরজার কাছে চলে গেল এবং সম্রাট ও বলাশেভকে বারান্দায় উঠে আসতে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন সরে যাবার আর সময় নেই এমনি ভাব দেখিয়ে সে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল।

ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হবার মতো উত্তেজিত স্বরে সম্রাট তখন এই শেষ কথাগুলি বলছে :

যুদ্ধ ঘোষণা না করেই রাশিয়ার ভিতরে অনুপ্রবেশ! যতদিন একটি সশস্ত্র শত্রুসৈন্য আমার দেশে থাকবে ততদিন আমি কিছুতেই সন্ধি করব না!

বরিসের মনে হল, কথাগুলি বলতে পেরে সম্রাট যেন খুশি হয়েছে, কিন্তু বরিস সেটা শুনে ফেলায় অসন্তুষ্ট হয়েছে।

ভ্রূকুটি করে সম্রাট বলল, একথা যেন কেউ জানতে না পারে!

বরিস বুঝল, শেষের কথাগুলি তাকে লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে। চোখ বুজে সে মাথাটা একটু নোয়ালো। সম্রাট পুনরায় নাচ-ঘরে ঢুকে আরো আধ ঘণ্টা সময় সেখানে কাটিয়ে দিল।

এইভাবে বরিসই প্রথম জানতে পারল যে ফরাসি বাহিনী নিয়েমেন পার হয়েছে। এই ঘটনাটিকে ধন্যবাদ, কারণ এতে প্রমাণ হল যে অন্য কেউ জানে না এমন অনেক খবরই সে রাখে, আর এতে তাদের চোখে বরিসের মর্যাদা আরো বেড়ে গেল।

মাসাধিক কালের অপূর্ণ প্রত্যাশার পরে একটা বল-নাচের আসরে ফরাসি বাহিনীর নিয়েমেন অতিক্রম করার এই অপ্রত্যাশিত সংবাদ সকলকেই চমকে দিল। সংবাদটা প্রথম জানবার পরেই সক্ষোভ প্রতিবাদে সম্রাটের মুখ দিয়ে যে কথাটি উচ্চারিত হল সেটা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। সেদিন রাত দুটোয় বাড়িতে ফিরেই সম্রাট-সচিব শিশকভাকে ডেকে পাঠাল, তাকে বলল সৈন্যদের উদ্দেশ্যে একটি হুকুম-নামা লিখে পাঠাতে এবং ফিল্ড-মার্শাল প্রিন্স সলতিকভকে তার একটি অনুলিপি পাঠিয়ে দিতে, তাকে আরো নির্দেশ দেওয়া হল যে সেই হুকুম-নামায় যেন লেখা থাকে–যতদিন একটি সশস্ত্র ফরাসিও রাশিয়ার মাটিতে থাকবে। ততদিন সম্রাট কোনোরকম সন্ধি করবে না।

পরদিন নিম্নলিখিত চিঠিখানি নেপোলিয়নকে পাঠানো হল :

মঁসিয় প্রিয় ভাই,
গতকাল জানতে পারলাম, ইয়োর ম্যাজেস্ট্রির সঙ্গে আমার যেকথা হয়েছিল একান্ত আনুগত্যের সঙ্গে আমি তা রক্ষা করে চলা সত্ত্বেও, আপনার সৈন্যরা রুশ সীমান্ত অতিক্রম করেছে, আর এইমাত্র পিটার্সবুর্গ থেকে আমি যে চিঠিটা পেয়েছি তাতে কাউন্ট লরিস্তন এই সীমান্ত লংঘনের কারণ হিসেবে আমাকে জানিয়েছে, প্রিন্স কুরাকিন যেদিন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন তখন থেকেই ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি নিজেকে আমার সঙ্গে যুদ্ধরত বলে মনে করে এসেছেন। দুক দ্য বাসানো যেসব কারণে তাকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেছিল তার মধ্যে এমনকিছু ছিল না যাতে আমি মনে করতে পারি যে সেটাকে আক্রমণের একটা অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। বস্তুত সেই রাষ্ট্রদূত নিজেই একথা জানিয়েছেন যে ওটা দাবি করার কোনো অধিকার তার ছিল না, এবং খবরটা জানা মাত্রই আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম যে আমিও এটা সমর্থন করি না, আর তাই তাকে স্বস্থানে থাকারই নির্দেশ দিয়েছিলাম। এরকম একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমার লোকজনের রক্তপাতের বাসনা যদি ইয়োর ম্যাজেস্ট্রির না থাকে, এবং আপনি যদি রুশ অঞ্চল থেকে আপনার সেনাদলকে সরিয়ে নিতে রাজি থাকেন, তাহলে আমি ধরে নেব যে যা ঘটেছে তা মোটেই ঘটেনি, এবং আমাদের মধ্যে একটা সমঝোতা গড়ে তোলা এখনো সম্ভব হবে। অন্যথায়, ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি, আমার দিক থেকে কোনো উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা না থাকা সত্ত্বেও যে আক্রমণ আপনি শুরু করেছেন তাকে প্রতিহত করতে আমি বাধ্য হব। আর একটি যুদ্ধের বিপদ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব ইয়োর ম্যাজেস্ট্রির উপরেই নির্ভর করছে।
(স্বাক্ষর) আলেক্সান্দার।

.

অধ্যায়-৪

১৪ই জুন সকাল দুটোয় বলাশেভকে ডেকে এনে সম্রাট নেপোলিয়নকে লেখা চিঠিটা তাকে পড়ে শোনাল, আদেশ দিল সে যেন নিজেই চিঠিটা নিয়ে গিয়ে ফরাসি সম্রাটের হাতে দেয়। তাকে পাঠাবার সময় সম্রাট আর একবার বলে দিল, যতদিন একটিও সশস্ত্র শত্রু-সৈন্য রাশিয়ার মাটিতে থাকবে ততদিন সে সন্ধি করবে না, তাকে বলে দিল, এই কথাগুলি যেন নেপোলিয়নকে শুনিয়ে দেওয়া হয়। নেপোলিয়নকে লেখা চিঠিতে আলেক্সান্দার এই কথাগুলি লেখেনি, কারণ তার মনে হয়েছে যে মিটমাটের একটা শেষ চেষ্টা যখন করা হচ্ছে তখন এই কথাগুলি লেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কিন্তু স্রাট বলাশেভকে স্পষ্ট নির্দেশ দিল, সে যেন এই কথাগুলি নেপোলিয়নকে অতি অবশ্য জানিয়ে দেয়।

একজন বিউগলবাদক ও দুজন বসাককে সঙ্গে নিয়ে ১৪ তারিখ শেষ রাতে যাত্রা করে বলাশেষ নিয়েমের নদীর রাশিয়ার দিককার রাইকন্তি গ্রামের ফরাসি আঁটিতে পৌঁছল ভোর-ভোর সময়ে। অশ্বারোহী ফরাসি শান্ত্রীরা সেখানেই তাকে থামিয়ে দিল।

লাল ইউনিফর্ম ও লোমশ টুপি পরিহিত জনৈক সনদবিহীন ফরাসি হুজার-অফিসার চিৎকার করে বলাশেভকে থামতে বলল। বলাশেভ সঙ্গে সঙ্গে না থেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলল।

সনদবিহীন অফিসারটির চোখে জকুটি দেখা দিল, অস্ফুটে কিছু গালাগালি ছুঁড়ে দিয়ে তার ঘোড়ার মুখটা বলাশেভের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে তলোয়ারে হাত রেখে রুশ সেনাপতিকে লক্ষ্য করে রুক্ষ গলায় বলে উঠল : সে কি কালা যে যা বলা হচ্ছে তা কানে ঢুকছে না? বলাশেভ নিজের পরিচয় দিল। রুশ সেনাপতির দিকে না তাকিয়ে অফিসারটির সহকর্মীদের সঙ্গে সেনাদলসংক্রান্ত আলোচনা শুরু করে দিল।

উচ্চতম কর্তৃত্ব ও শক্তিতে অধিষ্ঠিত থাকার পরে, মাত্র তিন ঘণ্টা আগেই সম্রাটের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পরে, এবং স্বীয় পদমর্যাদার দরুন সাধারণভাবেই শ্রদ্ধা লাভে অভ্যস্ত থাকার পরে, রাশিয়ার মাটিতেই তার প্রতি এই শত্রুভাবাপন্ন, এমন কি শ্রদ্ধাহীন, পশু-শক্তির প্রয়োগ দেখে বলাশেভ খুবই অবাক হয়ে গেল।

মেঘের আড়াল থেকে সবে সূর্য উঠছে, বাতাস তাজা ও শিশিরস্নাত। গ্রাম থেকে একদল গরু-মোষ রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে, জলের বুকে বুদ্বুদের মতো একটার পর একটা ভরত পক্ষী আকাশের বুকে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলেছে।

 বলাশেভ চারদিকে তাকিয়ে গ্রাম থেকে কোনো অফিসারের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, রুশ কসাক বিউগলবাদক এবং ফরাসি হুজাররা মাঝেমাঝেই একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে।

সবেমাত্র বিছানা ছেড়ে একজন ফরাসি হুজার-কর্নেল একটা সুন্দর ধূষর ঘোড়ায় চেপে দুইজন হুজারকে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম থেকে এসে হাজির হল। অফিসার, সৈনিক ও ঘোড়া সকলকেই বেশ চটপটে ও সুস্থ বলে মনে হল।

যেকোন অভিযানের প্রথমদিকে সৈন্যরা শান্তিকালীন কুচকাওয়াজের মতোই ছিমছাম থাকে, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের একটা যুদ্ধকালীন গমক দেখা দেয়, চলাফেরায় ও মনোভাবে ফুটে ওঠে একটা সানন্দ উৎসাহের লক্ষণ।

ফরাসি কর্নেল কষ্ট করে একটা হাই চাপল, কিন্তু তার আচরণ ভদ্র, সম্ভবত বলাশেভের পদমর্যাদা সে বুঝতে পেরেছে। তাকে নিয়ে ঘাঁটি পেরিয়ে এগিয়ে গেল, বলল, তার ম্রাটের সামনে উপস্থিত হবার বাসনা অবিলম্বেই হয় তো পূর্ণ করা যাবে, কারণ তার বিশ্বাস সম্রাটের বাসস্থান এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

রাইকন্তি গ্রামের ভিতর দিয়ে তারা এগিয়ে চলল। দুপাশ থেকে হুজার, শান্ত্রী ও সৈনিকরা তাদের কর্নেলকে অভিবাদন জানাল, আর রুশ ইউনিফর্মধারীর দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। গ্রামের অপর প্রান্তে তারা পৌঁছে গেল। কর্নেল বলল, সেনাদলের কমান্ডার সেখান থেকে সোয়া মাইল দূরে থাকে, বলাশেভকে সঙ্গে নিয়ে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেবে।

এতক্ষণে সূর্য উঠেছে, উজ্জ্বল বনভূমির উপর তার কিরণরাশি ছড়িয়ে পড়েছে।

সরাইখানাটা পেরিয়ে একটা পাহাড়ের উপর উঠতেই তারা সামনে দেখতে পেল, একদল অশ্বারোহী তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। দলের আগে কালো ঘোড়ায় চেপে আসছে একটি দীর্ঘদেহ মানুষ, তার টুপিতে পালক গোঁজা, কালো কোঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। পরনে একটা লাল আবরণী, পা দুটি ফরাসি কায়দায় সামনের দিকে বাড়ানো। লোকটি কদমে বলাশেভের দিকে এগিয়ে এল, জুন মাসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে তার পালক উড়ছে, মণিমুক্তো ও সোনালি ফিতে ঝলমল করছে।

ব্রেসলেট, পালক, নেকলেস ও জরির পোশাক পরা অশ্বারোহী থেকে মাত্র দুই ঘোড়ার দূরত্বে থাকতেই ফরাসি কর্নেল জুলনার বলাশেভের কানে কানে বলল : নেপলসের রাজা! আসলে লোকটি মুরাৎ, এখন সকলে বলে নেপলসের রাজা! কেন যে তাকে নেপলসের রাজা বলা হয় সেটা বুদ্ধির অতীত হলেও সে কিন্তু নিজেও কথাটা বিশ্বাস করে এবং বেশ একটা গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। সে যে সত্যি নেপলসের রাজা এ বিষয়ে সে এতই নিশ্চিত যে সে শহর থেকে চলে আসার আগে একদিন যখন স্ত্রীকে নিয়ে রাজপথে হাঁটছিল তখন কয়েকজন ইতালিয় তাকে দেখেই বলে উঠল : Viva il ra (রাজা দীর্ঘজীবি হোন!), আর সেও স্ত্রীর দিকে ফিরে বিষ হাসি হেসে বলল : বেচারিরা! ওরা জানে না যে কালই আমি ওদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি!

যদিও সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে সে নেপলসের রাজা, এবং তার চলে যাওয়ার জন্য প্রজাবৃন্দের দুঃখকে করুণার চোখেই দেখত, তবু পরবর্তীকালে যখন সামরিক চাকরিতে ফিরে যাবার হুকুম এল, বিশেষ করে ডানজিগ-এ নেপোলিয়নের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎকারের সময় মহামান্য ভগ্নিপতিটি যখন তাকে বলল : আমি তোমাকে রাজা করে পাঠিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার মতো করে রাজ্য শাসন করে, তেমার মতো করে নয়!–তখন সে আমাদের সঙ্গেই তার পরিচিত কাজে ফিরে গেল এবং যথাসম্ভব দামী ও চিত্র-বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত হয়ে মনের সুখে পোলান্ডের রাজপথে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল-কেন যাচ্ছে বা কোথায় যাচ্ছে তা না জেনেই।

রুশ সেনাপতিকে দেখেই সে রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিল, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ফরাসি কর্নেলের দিকে। কর্নেল বলাশেভের নামটি উচ্চারণ করতে না পারলেও তা আগমনের উদ্দেশ্যটি সসম্মানে হিজ ম্যাজেস্ট্রিকে জানিয়ে দিল।

রাজা বলল, দ্য বল-মাচেভ! আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে মোহিত হলাম সেনাপতি! তার ভঙ্গিতে রাজকীয় করুণা প্রদর্শনের ভাবটাই ফুটে বেরুল।

কিন্তু রাজা যেই উচ্চৈস্বরে তাড়াতাড়ি কথা বলতে শুরু করল, তখনই তার রাজকীয় মর্যাদাটি বিদায় নিল, সেদিকে খেয়াল না করেই সে তার পরিচিত স্বাভাবিক ভালোমানুষী কণ্ঠস্বরে ফিরে গেল। বলল : দেখুন সেনাপতি, দেখে তো ব্যাপারটাকে যুদ্ধ বলেই মনে হচ্ছে।

বলাশেভ জবাব দিল, ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি, আমার প্রভু সম্রাট যুদ্ধ চান না, আর যেহেতু আপনার প্রভু মনে করেন…।

মঁসিয় দ্য বলাশেভ-এর কথা শুনতে শুনতে মুরাৎ-এর মুখ নির্বোধ তুষ্টিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু রাজকীয় দায়িত্ব বলেও তো একটা কথা আছে। তার মনে হল, রাজা হিসেবে আলেক্সান্দারের দূতের সঙ্গে রাজকীয় বিচার নিয়ে আলোচনা করা তার কর্তব্য। ঘোড়া থেকে নেমে বলাশেভের হাত ধরে নিজের দলবল রেখে কিছুটা দূরে এগিয়ে নিয়ে পায়চারি করতে করতে বেশ ভারিকি চালে কথাবার্তা বলতে লাগল। সে জানাল, প্রুশিয়া থেকে সৈন্য অপসারণের যে দাবি করা হয়েছে তাতে সম্রাট নেপোলিয়ন ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে সেই দাবি যখন সাধারণভাবে জানাজানি হয়ে গেছে এবং তার ফলে ফ্রান্সের মর্যাদায় আঘাত লেগেছে।

বলাশেভ উত্তরে জানাল, এই দাবির মধ্যে তো ক্ষুব্ধ হবার মতো কিছু নেই, কারণ…কিন্তু মুরাৎ তাকে বাধা দিল।

সদয় ও নির্বোধ হাসি হেসে সে অপ্রত্যাশিতভাবে বলে উঠল, তাহলে কি আপনি সম্রাট আলেক্সান্দারকে আক্রমণকারী বলে মনে করেন না?

বলাশেভ কি কারণে নেপেলিয়নকেই যুদ্ধের সূচনাকারী বলে মনে করে সেইকথাই সে বুঝিয়ে বলল।

মুরাৎ আবার তাকে বাধা দিয়ে বলল, দেখুন প্রিয় সেনাপতি, সর্বান্তঃকরণে আমি চাই যে দুই সম্রাটের মধ্যে একটা মিটমাট হয়ে যাক, এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেটা শেষ হয়ে যাক!

তারপর সে গ্র্যান্ড ডিউক ও তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিল, নেপলসে থাকাকালে তার সঙ্গে আমোদ আহাদে যে দিনগুলি কেটেছিল তার স্মৃতিরোমন্থন করল। তারপরই যেন সহসা তার রাজকীয় মর্যাদার কথা স্মরণ করে মুরাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল, এবং রাজ্যাভিষেকের সময় যেভাবে দাঁড়িয়েছিল সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা নেড়ে বলতে লাগল :

আপনাকে আর আটকে রাখব না সেনাপতি। আপনাদের উদ্দেশ্যের সাফল্য কামনা করি, এই কথা বলেই কাজ-করা লাল আবরণী, উঁচু পালক ও ঝকমকে অলংকারসহ সে সশ্রদ্ধভাবে দূরে অপেক্ষমান দলের লোকদের কাছে ফিরে গেল।

অচিরেই তাকে স্বয়ং নেপোলিয়নের কাছে হাজির করা হবে, মুরাতের কথাবার্তা থেকে এটাই ধরে নিয়ে বলাশেভ ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কিন্তু তার পরিবর্তে পরবর্তী গ্রামে নাভুৎ-এর পদাতিক বাহিনীর শান্ত্রীরা তাকে আটক করল এবং জনৈক অ্যাডজুটান্ট এসে তাকে মার্শাল দাভুৎ-এর গ্রামে নিয়ে চলল।

.

অধ্যায়-৫

আলেক্সান্দারের যেমন আরাকচিত, নেপোলিয়নের তেমনই দাভুৎ-আরাকচিত-এর মতো ভীরু না হলেও তারই মতো সঠিক, তারই মতো নিষ্ঠুর, এবং তারই মতো নিষ্ঠুরতা ছাড়া সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অন্য কোনো ভাষা জানে না।

প্রকৃতির জীব-রাজ্যে যেমন নেকড়ের প্রয়োজন আছে, তেমনই রাষ্ট্র-দেহেও এ ধরনের লোকের প্রয়োজন আছে, তাদের উপস্থিতি ও ঘনিষ্ঠতা রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে যতই বেমানান হোক, তারা চিরকাল আছে, চিরকাল থাকবে এবং চিরকাল তাদের কাজ করে যাবে। আলেক্সার নিজে উদার, মহৎ ও শান্ত চরিত্রের লোক হওয়া সত্ত্বেও যে নিষ্ঠুর আরাকচিভ নিজের হাতে একজন গোলন্দাজের গোঁফ ছিঁড়ে ফেলতে পারে, স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য যে লোক কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে পারে না, সে শিক্ষিতও নয় সভাসদও নয়, সেই লোক কেমন করে আলেক্সান্দারের পাশে দাঁড়িয়ে এতবড় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে, তার ব্যাখ্যা একমাত্র এই অনিবার্যতার মধ্যেই পাওয়া যায়।

বলাশেভ দেখল, একটি চাষীর কুঁড়ে ঘরে পিপের উপর বসে দাভুৎ কি যেন লিখছে–সে তখন হিসাবপত্র পরীক্ষা করছে। তার জন্য আরো ভালো বাসা পাওয়া যেতে পারত। কিন্তু মার্শাল দাভুৎ তাদেরই একজন যারা গম্ভীর হয়ে থাকার যৌক্তিকতাস্বরূপ ইচ্ছা করেই অত্যন্ত শোচনীয় পরিবেশে বাস করতে চায়। সেই একই কারণে তারা সর্বদাই কর্মব্যস্ত ও তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকে। তার মুখের ভাব যেন সবসময়ই বলতে চায় : দেখতেই তো পাচ্ছ, একটা পিপের উপর বসে এই নোংরা চালার মধ্যে কাজ করছি, এর পরেও জীবনের ভালো দিকের কথা আমি কেমন করে ভাবব? রুশ সেনাপতি ঘরে ঢুকলে সে ইচ্ছা করেই আরো বেশি করে কাজের মধ্যে ডুবে গেল, চশমার ভিতর দিয়ে চোখ তুলে বলাশেভের মুখের দিকে তাকাল, সকাল বেলাকার সৌন্দর্যে আর মুরাৎ-এর সঙ্গে কথাবার্তায় তার মুখে একটা সজীবতা ফুটে উঠেছে, তা দেখে দাভুৎ না উঠে দাঁড়াল, না নড়েচড়ে বসল, বরং ভুরু দুটো আরো বেশি করে কুঁচকে বিদ্বেষবশেই আরো বেশি করে নাকটা সিটকাল।

যখন বলাশেভের মুখ দেখে বুঝল যে এই অভ্যর্থনায় সে অসন্তুষ্ট হয়েছে তখন মাথা তুলে দাভুৎ ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল সে কি চায়।

সে যে সম্রাট আলেক্সান্দারের অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল এবং তার দূর হিসেবেই নেপোলিয়নের কাছে এসেছে, একথা জানে না বলেই দাভুৎ তাকে এভাবে অভ্যর্থনা করেছে মনে করে বলাশেভ তাড়াতাড়ি তাকে নিজ পদমর্যাদা ও কার্যভারের কথা জানিয়ে দিল। কিন্তু ফল হল তার প্রত্যাশার বিপরীত, তার কথা শুনে দাভুৎ আরো রূঢ় ও রুক্ষ হয়ে উঠল।

বলল, আপনার কাগজপত্র কোথায়? সেগুলি আমাকে দিন। আমি সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দেব।

বলাশেভ জবাবে বলল, তার উপর নির্দেশ আছে সেগুলি সম্রাটকে হাতে-হাতে দিতে হবে।

দাভুৎ বলল, আপনার সম্রাটের নির্দেশ আপনাদের সৈন্যদের উপর চলে, কিন্তু এখানে আপনাকে যা বলা হবে তাই আপনাকে করতে হবে।

এবং সে যে বিচারবিহীন শক্তির উপর কতখানি নির্ভরশীল রুশ সেনাপতিকে সে বিষয়ে আরো বেশি করে সচেতন করে তুলবার জন্যই যেন কর্তব্যরত অফিসারকে ডেকে আনবার জন্য দাভুৎ একজন অ্যাডজুটান্টকে পাঠিয়ে দিল।

সম্রাটের চিঠি সম্বলিত প্যাকেটটা বের করে বলাশেভ সেটা টেবিলের উপর রাখল (দুটো পিপে পাশাপাশি রেখে তার উপর কজাসমেত একটা দরজার পাল্লা পেতে টেবিলটা বানানো হয়েছে)। দাভুৎ প্যাকেটটা নিয়ে লেখাটা পড়ল। বলাশেভ আপত্তি জানিয়ে বলল, আমাকে শ্রদ্ধা করা বা না করার পূর্ণ স্বাধীনতা আপনার আছে, কিন্তু দয়া করে এটুকু জেনে রাখুন যে আমি হিজ ম্যাজেস্ট্রি রুশ সম্রাটের অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল…

দাভুৎ নিঃশব্দে তার মুখের দিকে তাকাল, সেখানে উত্তেজিত ও বিব্রত হবার লক্ষণ দেখে যেন খুশিই হল।

আপনার উপযুক্ত ব্যবহারই করা হবে, বলে দাভুৎ প্যাকেটটা পকেটে পুরে চালাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এক মিনিট পরে মার্শালের অ্যাডজুটান্ট দ্য কাস্ত্রে এসে বলাশেভের জন্য নির্দিষ্ট বাসায় তাকে নিয়ে গেল।

 সেদিন পিপের উপর পাতা সেই একই টেবিল সে মার্শালের সঙ্গে খানা খেল।

পরদিন খুব ভোরেই দাভুৎ ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল, হুকুমের সুরে বলাশেভকে কাছে ডেকে বলল সে যেন এখানেই থাকে, হুকুম এলে যেন মাল-গাড়ির সঙ্গে চলে যায়, এবং মঁসিয় দ কাস্ত্রে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে যেন কথা না বলে।

চারদিন ধরে নির্জনতা, অবসাদ ও নিজের অক্ষমতা ও তুচ্ছতার চেতনার ভিতর দিয়ে কাটিয়ে, এবং মার্শালের মালপত্র ও ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে গোটা জেলাটা চষে ফেলে তবে বলাশেভ ভিলনাতে গিয়ে পোঁছল–আর পৌঁছল ঠিক সেই ফটক দিয়ে চারদিন আগে সে যে ফটকটা পার হয়ে গিয়েছিল।

পরদিন রাজকীয় অভ্যর্থনাকারী কোৎ দ্য তুরেন বলাশেভকে জানাল, সম্রাট নেপোলিয়ন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হয়েছে।

যে বাড়িতে বলাশেভকে এনে রাখা হয়েছিল চারদিন আগে সে বাড়ির সামনে মোতায়েন ছিল প্রিয় ব্রাঝেনস্ক রেজিমেন্টের শান্ত্রীরা, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বুক-খোলা নীল ইউনিফর্ম-পরা লোমের টুপি মাথার দুজন ফরাসি গোলন্দাজ, হুজার ও উহলানদের একটি পথপ্রদর্শক দল, এবং এড-ডি-কং-এর চাকর ও সেনাপতিদের একটি বাছাই দল, সকলেই নেপোলিয়নের আগমনের প্রতীক্ষায় তার জিন-কাটা ঘোড়া ও ক্রীতদাস রুস্তানকে ঘিরে গোল হয়ে ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। ভিলনার যে বাড়িটা থেকে আলেক্সান্দার বলাশেভকে দৌত্যকর্মে পাঠিয়েছিল ঠিক সেই বাড়িতেই নেপোলিয়ন তাকে অভ্যর্থনা জানাল।

.

অধ্যায়-৬

রাজকীয় জাকজমকে অভ্যস্ত হলেও নেপোলিয়নের রাজদরবারের বিলাসবাহুল্য ও আড়ম্বর দেখে বলাশেভ অবাক হয়ে গেল।

কেঁৎ দ্য তুরেন তাকে বড় অভ্যর্থনা-কক্ষে নিয়ে বসাল। সেখানে অনেক সেনাপতি, অভ্যর্থনাকারী ও পোল্যান্ডের শীর্ষস্থানীয় লোকজন তাদের কয়েকজনকে বলাশে রুশ ম্রাটের দরবারেও দেখেছে–আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। দুরক জানাল, অশ্বারোহণে যাবার আগেই নেপোলিয়ন রুশ সেনাপতিকে অভ্যর্থনা জানাবে।

কয়েক মিনিট পরে একজন অভ্যর্থনাকারী এসে বিনীতভাবে অভিবাদন করে বলাশেভকে বলল তাকে অনুসরণ করতে।

বলাশেভ ছোট অভ্যর্থনা-ঘরে গেল, সে ঘরের একটা দরজা দিয়ে সেই পড়ার ঘরটাতে যাওয়া যায় যেখান থেকে রুশ সম্রাট তাকে এই দৌত্যকর্মে পাঠিয়েছিল। দুএক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই কেটে গেল। দরজার ওপারে দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল, দরজার দুটো পাল্লাই খুলে দেওয়া হল, সব চুপচাপ, তারপরেই শোনা গেল সদর্প দৃঢ় পদক্ষেপ নেপোলিয়ন আসছে।

সবেমাত্র অশ্বারোহণের সাজসজ্জা শেষ হয়েছে, নীল রঙের ইউনিফর্মের বুকটা ভোলা, তার নিচেকার সাদা ওয়েস্টকোটটা এত লম্বা যে বর্তুলাকার পেটটি তাতে ঢাকা পড়েছে, সাদা চামড়ার ব্রিচেস বেঁটে পায়ের মোটা উরুর উপর চেপে বসেছে, পায়ে হেসিয়ান বুট। ছোট ছোট চুল সবে বুরুশ করা হয়েছে, কিন্তু চওড়া কপালের মাঝখানে একগুচ্ছ চুল ঝুলে আছে। ইউনিফর্মের কালো কলারের উপর দিয়ে মোটা সাদা গলাটা ঠেলে উঠেছে, গায়ে ইউ-ডি-কলোনের গন্ধ। উঁচু চিবুকসহ যৌবন-সুলভ মুখে রাজকীয় অভ্যর্থনার অনুকম্পামিশ্রিত গাম্ভীর্যের প্রকাশ।

প্রতিটি পদক্ষেপে শরীরটাকে ঈষৎ দুলিয়ে মাথাটাকে সামান্য পিছনে ঠেলে দিয়ে দ্রুতপায়ে সে ঘরে ঢুকল। বেঁটে, মোটা শরীর, চওড়া কাঁধ, বুক ও পেট সামনে প্রসারিত, সবকিছু মিলিয়ে আরামে থাকা চল্লিশ বছরের মানুষের চিত্তাকর্ষক, মহিমান্বিত চেহারা। আরো বোঝা গেল, আজ তার মেজাজ খুব ভালো আছে।

বলাশেভের আনত সশ্রদ্ধ অভিবাদনের উত্তরে নেপোলিয়ন মাথাটা নেড়ে তার কাছে এসেই এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যাতে বোঝা যায় যে তার প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান, আর নিজের বক্তব্যকে গুছিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন তার হয় না, কারণ সে জানে যে সঠিক কথাটাই সে বলবে, আর সেটা বেশ ভালোভাবেই বলবে।

সে বলল, শুভদিন সেনাপতি। সম্রাট আলেক্সান্দারের কাছ থেকে যে চিঠি আপনি এনেছেন সেটা আমি পেয়েছি, আর আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় খুব খুশি হয়েছি। বড় বড় চোখ মেলে বলাশেভের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই তার দৃষ্টি তাকে ছাড়িয়ে দূরে চলে গেল।

পরিষ্কার বোঝা গেল, বলাশেভের ব্যক্তিত্বের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই, তার একমাত্র আগ্রহ নিজের মনকে নিয়ে। নিজের বাইরের কোনোকিছুরই কোনো অর্থ তার কাছে নেই, কারণ তার মতে পৃথিবীর সবকিছুই সম্পূর্ণভাবে তার ইচ্ছার উপরেই নির্ভর করে।

সে বলতে লাগল, আমি যুদ্ধ চাই না, কখনো চাইনি, কিন্তু যুদ্ধ আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন কি এখনো (শব্দটার উপর বিশেষ জোর দিয়ে) আপনার যেকোন কৈফিয়ৎ মেনে নিতে আমি প্রস্তুত।

তারপরেই রুশ সরকারের প্রতি তার অসন্তুষ্টির কারণ গুলি সংক্ষেপে ও বিষদভাবে বুঝিয়ে বলতে লাগল। যেরকম শান্ত গলায় মৈত্রীসূচক সুরে ফরাসি সম্রাট কথাগুলি বলল তাতে বলাশেভের দৃঢ় ধারণা হল যে সে শান্তি চায়, এবং আলোচনায় বসতে রাজি আছে।

কথা শেষ করে নেপোলিয়ন যখন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রুশ দূতের দিকে তাকাল তখন বলাশেভ অনেক আগে থেকে তৈরি করা ভাষণটি বলতে শুরু করল : মহাশয়, আমার মনিব সম্রাট… কিন্তু তার উপর ঝুঁকে-পড়া সম্রাটের চোখের দিকে তাকিয়েই সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। বলাশেভের ইউনিফর্ম ও তরবারির দিকে তাকিয়ে প্রায় অদৃশ্য হাসি হেসে সে যেন বলছে : আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন–শান্ত হোন!

বলাশেভের সম্বিত ফিরে এল, সে আবার বলতে শুরু করল। কুরাকিনের পাসপোর্টের দাবিকে সম্রাট আলেক্সান্দার যুদ্ধের যথেষ্ট কারণ বলে মনে করে না, সম্রাটের সম্মতি ছাড়াই কুরাকিন নিজের থেকেই কাজটা করেছে, সম্রাট আলেক্সান্দার যুদ্ধ চায় না, আর ইংলন্ডের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

এখন পর্যন্ত নেই! নেপোলিয়ন বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু পাছে তার রাগ ধরা পড়ে তাই ভুরু কুঁচকে মাথাটা ঈষৎ নেড়ে ইঙ্গিতে বলাশেভকে তার কথা চালিয়ে যেতে বলল।

তাকে যা বলবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেসব কথা শেষ করে বলাশেভ আরো জানাল, সম্রাট আলেক্সান্দার শান্তি চায়, কিন্তু কোনোরকম আলোচনায় বসবার আগে তার একটি শর্ত আছে…এখানে বলাশেভ ইতস্তত করল : সেই কথাগুলি তার মনে পড়ে গেল যেগুলি সম্রাট আলেক্সান্দার তার এই চিঠিতে লেখেনি, কিন্তু সলকিতভকে পাঠানো অনুলিপিত অন্তর্ভুক্ত করেছে, এবং বলাশেভকে বলে দিয়েছে নেপোলিয়নের সামনে সেগুলির পুনরাবৃত্তি করতে। কথাগুলি বলাশেভের মনে আছে : যতদিন পর্যন্ত একটিও সশস্ত্র শত্রু রাশিয়ার মাটিতে থাকবে, কিন্তু কিছু জটিল মনোভাব তাকে বাধা দিল। ইচ্ছা থাকলেও সে কথাগুলি সে বলতে পারল না। ক্রমেই বিচলিত হয়ে বলল : শর্তটি এই যে ফরাসি বাহিনী নিয়েমেনের ওপারে সরে যাবে।

শেষের কথাগুলি বলার সময় বলাশেভের বিমূঢ়ভাবে নেপোলিয়নের নজর এড়াল না : তার মুখটা বেঁকে গেল, আর বাঁ পায়ের গুলিটা তালে তালে কাঁপতে লাগল। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে না সরে সে আরো জোর গলায় আরো দ্রুত কথা বলতে লাগল। কথার ফাঁকে ফাঁকে বলাশেভ চোখ নামিয়ে দেখতে পেল, নেপোলিয়নের গলা যত নড়ছে তার বাঁ পাটা তত বেশি কাঁপছে।

সে বলতে লাগল, শান্তি প্রতিষ্ঠার বাসনা সম্রাট আলেক্সান্দারের চাইতে আমার কম নয়। শান্তির জন্য গত আঠারো মাস ধরে আমি কি সবকিছু করিনি? কৈফিয়তের জন্য আমি আঠারো মাস অপেক্ষা করেছি। কিন্তু আলোচনা শুরু করার জন্য আমার কাছে কি দাবি করা হল?

বলাশেভ জবাব দিল, আপনার বাহিনীকে নিয়েমেনের ওপারে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে মহাশয়।

নিয়েমেন? নেপোলিয়ন কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। তাহলে এখন আপনারা চাইছেন আমাকে নিয়েমেন থেকে সরে আসতে হবে–শুধু নিয়েমেন? বলাশেভের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে নেপোলিয়ন কথাটা আরো একবার বলল।

বলাশেভ সসম্মানে মাথা নোয়াল।

চার মাস আগেকার পোমেরানিয়া থেকে সরে আসার দাবির পরিবর্তে এখন দাবি করা হচ্ছে শুধুমাত্র নিয়েমেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার। নেপোলিয়ন দ্রুত মুখ ফিরিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

আপনি বলছেন, আলোচনা শুরু করার আগে আমাকে নিয়েমেন ছেড়ে আসতে হবে-এটাই আপনাদের দাবি, কিন্তু দুমাস আগে ঠিক এইভাবেই দাবি করা হয়েছিল যে আমাকে ভিক্ষুলা ও ওডার থেকে সরে আসতে হবে, তথাপি আপনারা আলোচনা চালাতে ইচ্ছুক।

নেপোলিয়ন নিঃশব্দে ঘরে এককোণ থেকে অপর কোণে চলে গেল, আবার এসে বলাশেভের সামনে থামল। বলাশেভ লক্ষ্য করল, তার বা পাটা আগের চাইতেও দ্রুততর গতিতে কাঁপছে, তার মুখটা পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে। এইভাবে বাঁ পা কাঁপার ব্যাপারটা নেপোলিয়নও জানত। পরবর্তীকালে সে নিজেই বলেছে, বা পায়ের গুলি কাঁপাটা আমার একটা বড় লক্ষণ।

ভিশ্চলা এবং ওডার থেকে পশ্চাদপসরণের দাবি বাদেনের প্রিন্সের কাছে করা চলতে পারে, আমার কাছে নয়! প্রায় আর্তনাদ করার মতো এমনভাবে নেপোলিয়ন কথাগুলি বলল যে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। আপনারা আমাকে পিটার্সবুর্গ এবং মস্কো দিয়ে দিলেও এমন শর্ত আমি মানতে পারতাম না। আপনারা বলছেন, এ যুদ্ধ আমি শুরু করেছি। কিন্তু কে প্রথম সৈন্যদলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সম্রাট আলেক্সান্দার, আমি নই! আর আমি যখন লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছি, যখন ইংলন্ডের সঙ্গে আপনারা বন্ধুত্ব করেছেন, যখন আপনাদের অবস্থা খুব খারাপ, তখন আপনারা আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আলোচনার প্রস্তাব! ইংলন্ডের সঙ্গে আপনাদের মৈত্রীর উদ্দেশ্য কি? ইংলন্ড আপনাদের কি দিয়েছে? নেপোলিয়ন দ্রুতবেগে কথা বলে চলল। স্পষ্টতই সন্ধির সুবিধা এবং তার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবার কোনো চেষ্টাই সে করছে না, সে শুধু চাইছে নিজের নির্দোষিতা ও শক্তি এবং আলেক্সান্দারের ভ্রান্তি ও চাতুরি প্রমাণ করতে।

গোড়ার দিকে তার কথার মধ্যে নিজের সুবিধাজনক অবস্থা প্রমাণ করা এবং তৎসত্ত্বেও সন্ধির আলোচনার ইচ্ছাই প্রকাশ পেয়েছিল, কিন্তু একবার কথা বলতে শুরু করে সে যত বেশি কথা বলছে ততই কথার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে।

এখন তার বক্তব্যের একমাত্র মর্মার্থ নিজেকে বড় করা এবং আলেক্সান্দারকে অপমান করা–অথচ সাক্ষাৎকারের শুরুতে এ ইচ্ছা তার মোটেই ছিল না।

শুনেছি আপনারা তুরস্কের সঙ্গে সন্ধি করেছেন?

 বলাশেভ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

 বলতে শুরু করল, সন্ধি হয়েছে…

কিন্তু নেপোলিয়ন তাকে কথা বলতে দিল না। সব কথা সে নিজেই বলতে চাইছে। এমন একধরনের উচ্ছ্বাস ও অনিয়ন্ত্রিত আঘাত দিয়ে সে কথা বলতে লাগল যা উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষকেই সাজে।

হ্যাঁ, আমি জানি মলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া না পেয়েই আপনারা সন্ধি করেছেন, যেমন ফিনল্যান্ড দিয়েছি, তেমনই ও দুটো প্রদেশও আপনার সম্রাটকে আমি দিয়ে দিতাম! হ্যাঁ, আমি কথা দিয়েছিলাম, এবং মলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া সম্রাট আলেক্সান্দারকে অবশ্যই দিতাম। কিন্তু এখন অমন দুটি ভালো প্রদেশ তিনি পেলেন না। অথচ ওই দুটি প্রদেশকে তাঁর সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে মাত্র একটি শাসনকালেই রাশিয়ার সীমাকে বোথনিয়া উপসাগর থেকে দানিয়ুবের মোহনা পর্যন্ত প্রসারিত করতে পারতেন। মহীয়সী ক্যাথারিনও এর চাইতে বেশি কিছু করতে পারতেন না। কথা বলতে বলতে ক্রমেই অধিকতর উত্তেজিত হয়ে নেপোলিয়ন ঘরময় পায়চারি করতে করতে সেই কথাগুলিই বলাশেভকে শোনাতে লাগল যা সে তিলজিত-এ সম্রাট আলেক্সান্দারবে শুনিয়েছিল। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে এসবই তার হত! আঃ, সে কী চমৎকার রাজত্ব! কথাটা বারকয়েব উচ্চারণ করে একটু পকেট থেকে সোনার নস্যিদানি বের করল, এবং সেটাকে নাকের কাছে তুলে ধরে সজোরে শ্বাস টানল।

সম্রাট আলেক্সান্দারের রাজত্বকাল কী চমৎকারই না হতে পারত।

করুণার দৃষ্টিতে সে বলাশেভের দিকে তাকাল, কিন্তু যেমনই বলাশেভ কিছু বলতে চেষ্টা করল সঙ্গে সঙ্গেই সে তাকে আবার থামিয়ে দিল।

বিচলিতভাবে দুই কাঁধ ঝাঁপিয়ে প্রশ্ন করল, এমন কি তিনি চাইতে পারতেন যা আমার বন্ধুত্বের সূত্রে পেতে পারতেন না? কিন্তু না, আমার শত্রুদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকাটাই তিনি পছন্দ করলেন। তারা কারা? স্তিন, আর্মফে, বেনিংসেন ও উইজিন-জেবোদদের দল! স্তিন তো নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত একটা বিশ্বাসঘাতক, আর্মফেল্ট, একটা লম্পট ও ষড়যন্ত্রকারী, উইজিন জেরোদ তো পলাতক ফরাসি প্রজা, বেনিংসেন তবু খানিকটা সৈনিকের মতো মানুষ, কিন্তু তাহলেও কোনো কাজের নয়, ১৮০৭ সালে সে তো কিছুই করতে পারে নি, আবার তাকে দেখে তো সম্রাট আলেক্সান্দারের মনে ভয়ঙ্কর স্মৃতি জেগে ওঠা উচিত।…যদি ধরেইনি যে তারা উপযুক্ত লোক, তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে,কিন্তু না, মোটেই তারা তা নয়! যুদ্ধ বা শান্তি কোনোটারই উপযুক্ত তারা নয়! বার্কলে তাদের মধ্যে সবচাইতে সক্ষম লোক একথা বলা হয়, কিন্তু তার প্রাথমিক গতিবিধি দেখে আমি সেকথা বলতে পারি না। আর এরা, এইসব সভাসদরাই বা কি করছে? ফুয়েল এক কথা বলে তো আর্মফেল্ট বলে আর, বেনিংসেন শুধু ভাবে, আর বার্কলেকে কোন কাজ করতে বললে সে যে কি করবে তাই স্থির করতে পারে না, ফলে সময় চলে যায়, ফল কিছুই হয় না। একমাত্র ব্যাগ্রেশনই সামরিক লোক। সে বোকা, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা আছে, দ্রুত দেখার ক্ষমতা আছে, স্থিরসঙ্কল্প আছে…আর এই ভূতদের ভিড়ে আপনাদের তরুণ সম্রাট কোন ভূমিকায় অভিনয় করছেন তারা তো তাকেই অসুবিধায় ফেলেছে, যা কিছু ঘটছে তার সব দায়িত্ব তার কাঁধেই চাপিয়ে দিচ্ছে। সেনাপতি না হয়ে রাজার কখনো সেনাদলের সঙ্গে থাকা উচিত নয়! যেন সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই নেপোলিয়ন কথাগুলি উচ্চারণ করল। রণক্ষেত্রে সেনাপতি হবার বাসনা যে আলেক্সান্দারের খুবই ছিল সেটা সে জানত।

মাত্র এক সপ্তাহ হল অভিযান শুরু হয়েছে, এরই মধ্যে আপনারা ভিলনা রক্ষা করতেও পারেননি। আপনাদের দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন করে পোলিশ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। আপনাদের সৈন্যদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

বলাশেভকে যা বলে দেওয়া হয়েছিল তা সে ভুলে গেল, এই কথার ফুলঝুরি ঠিক বুঝতে না পেরে বলে উঠল, কিন্তু ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি, সৈন্যদল তো উৎসাহে উজ্জীবিত…।

নেপোলিয়ন তাকে বাধা দিল, আমি সব জানি। আমি সব জানি। আপনাদের ব্যাটেলিয়ানের সংখ্যা কত তাও জানি, ঠিক যেমন জানি আমার ব্যাটেলিয়ানের সংখ্যা। আপনাদের তো দুলক্ষ সৈন্যও নেই, আর আমার সৈন্য-সংখ্যা তার তিন গুণ। আমি আপনাকে বলছি, ভিলার এপারেই আছে আমার পাঁচ লক্ষ ত্রিশ হাজার সৈন্য। তুর্কিরা আপনাদের কোনো কাজে লাগবে না, তাদের কোনো মূল্যই নেই, আর আপনাদের সঙ্গে সন্ধি করে তারা সেটাই প্রমাণ করেছে। আর সুইডদের কথা-পাগলা রাজাদের দ্বারা শাসিত হওয়াই তাদের বিধিলিপি। তাদের রাজা ছিল পাগল, তাই তার জায়গায় এনে বসাল আর একজনকে-বার্নাদোতকে -অচিরেই সেও পাগল হয়ে গেল-কারণ পাগল না হলে কেউ রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না।

ঘৃণায় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে নেপোলিয়ন আর একবার নস্যিদানিটা নাকের কাছে তুলে ধরল।

নেপোলিয়ন প্রতিটি মন্তব্যের কি জবাব হয় তা বলাশেভ জানে, বারবার সেকথা বলতে চেষ্টাও করল, কিন্তু প্রতিবারই নেপোলিয়ন তাকে বাধা দিতে লাগল। নেপোলিয়ন এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে সে যা বলছে সেটাই যে ঠিক সেকথা নিজেকে বোঝাবার জন্যই তাকে অনবরত কথা বলে যেতে হচ্ছে। বলাশেভ ক্রমেই অস্বস্তি বোধ করছে : দূত হিসেবে তার আশঙ্কা হচ্ছে যে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, এসব কথার জবাব দেওয়া দরকার, আবার মানুষ হিসেবে নেপোলিয়নের এই অকারণ ক্রোধের সামনে সে যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। সে জানে, নেপোলিয়নের এসব কথার কোনো অর্থই নেই, সম্বিত ফিরে এলে সে নিজেই এজন্য লজ্জাবোধ করবে। বলাশেভ চোখ নিচু করে নেপোলিয়নের শক্ত পা দুটোর গতিবিধি দেখতে লাগল, তার চোখের দৃষ্টিকে এড়িয়ে চলতে চাইল।

নেপোলিয়ন বলতে লাগল, কিন্তু আপনাদের বন্ধুদের তোয়াক্কা আমি করি না। আমারও বন্ধু আছে-পোলরা। তারাও সংখ্যায় আশি হাজার, তারা লড়াই করে সিংহের মতো! অচিরেই তারা সংখ্যায় দুই লক্ষ হবে।

হয়তো নিজের ওই নির্জলা মিথ্যায় নিজেই বিব্রত হয়ে এবং বলাশেভ এখনো ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, হঠাৎ সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে নেপোলিয়ন বলাশেভের মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, এবং সাদা হাত দুটো ঘোরাতে ঘোরাতে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল :

ঠিক জানবেন, আপনারা যদি প্রশিয়াকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন তাহলে সে দেশকে আমি ইওরোপে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে দেব! রাগে নেপোলিয়নের মুখ বিবর্ণ ও বিকৃত, এক হাত দিয়ে আর একটা হাত ঠুকছে। হ্যাঁ, আমি আপনাদের দিনা ও নিপারের ওপারে ছুঁড়ে ফেলে দেব, এবং অন্যায়ভাবে অন্ধের মতো ইওরোপ যে প্রাচীরটাকে (অর্থাৎ একটি বড় পোলিশ রাজ্য) ধ্বংস হতে দিয়েছিল সেটাকে নতুন করে গড়ে তুলব। হ্যাঁ, আপনাদের ভাগ্যে তাই ঘটবে। আমার সঙ্গে শত্রুতা করে এই তো আপনাদের লাভ! নিঃশব্দে সে বারকয়েক ঘরের এদিক থেকে ওদিকে হাঁটতে লাগল।

নস্যিদানিটা ওয়েস্টকোটের পকেটে ভরল, আবার বের করল, বারকয়েক নাকের কাছে তুলে ধরল, তারপর বলাশেভের সামনে থামল। একটু চুপ করে থেকে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে সোজা বলাশেভের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল :

একটা জবাব দেওয়া অবশ্য কর্তব্য মনে করেই বলাশেভ বলল যে, রাশিয়ার দৃষ্টিতে কিন্তু অবস্থাটা এত শোচনীয় বলে মনে হচ্ছে না। রাশিয়া আশা করছে, যুদ্ধের ফল খুব ভালোই হবে। নেপোলিয়ন মাথা নাড়ল, যেন বলতে চাইল, আমি জানি একথা বলা আপনার কর্তব্য, কিন্তু আপনি নিজেই কথাটা বিশ্বাস করেন না। আমি আপনাকে আমার মতেই আনতে পেরেছি।

বলাশেভের কথা শেষ হলে নেপোলিয়ন আবার নস্যিদানিটা বের করল, এক টান নিল, তারপর ইঙ্গিতস্বরূপ দুইবার মেঝেতে পা ঠুকল। দরজা খুলে গেল, জনৈক অভ্যর্থনাকারী সসম্মানে নত হয়ে সম্রাটের টুপি ও দস্তানা তার হাতে তুলে দিল, আর একজন এনে দিল একটা রুমাল। তাদের দিকে না তাকিয়ে নেপোলিয়ন বলাশেভের দিকে ঘুরে দাঁড়াল :

আমার হয়ে সম্রাট আলেক্সান্দারকে আশ্বাস দিয়ে বলবেন যে আমি আগের মতোই তার প্রতি অনুরক্ত আছি, আমি তাকে ভালোভাবেই চিনি, তাঁর মহৎ গুণাবলীকে খুবই শ্রদ্ধা করি। আর আপনাকে আটকে রাখব না সেনাপতি, সম্রাটকে লেখা আমার চিঠি আপনি পাবেন।

নেপোলিয়ন দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অভ্যর্থনা-ঘরের প্রতিটি লোক ছুটে এসে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল।

.

অধ্যায়

যেসব কথা নেপোলিয়ন তাকে বলেছে-সেইসব ক্রুদ্ধ আস্ফালন এবং নীরস গলায় উচ্চারিত শেষ কথাগুলি : আর আপনাকে আটকে রাখব না সেনাপতি, আমার চিঠি আপনি পাবেন, তা থেকে বলাশেভের ধারণা হয়েছিল যে নেপোলিয়ন আর তার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক নয়, একজন অপমানিত দূত হিসেবে তাকে এড়িয়েই চলবে। কিন্তু দুরক-এর মারফৎ সেইদিনই সম্রাটের সঙ্গে ডিনারের নিমন্ত্রণ পেয়ে বলাশেভ খুবই অবাক হয়ে গেল।

বেসিয়েরে, কলাইকুর্ত ও বেথিয়েরও ডিনারে উপস্থিত ছিল।

ভিলনার ভিতর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসার পরে সম্রাটের মেজাজ এখন খুব ভালো। সেখানে জনতা তাকে ভিড় করে সোসাহে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তাকে অনুসরণ করেছে। যে পথ দিয়ে সে এসেছে তার দুই দিককার জানালায় পতাকা ও তার প্রতীক-চিহ্ন প্রদর্শিত হয়েছে, পোলিশ-মহিলারা তাকে লক্ষ্য করে রুমাল উড়িয়েছে।

ডিনারে বলাশেভকে পাশে বসিয়ে নেপোলিয়ন যে তার সঙ্গে মধুর ব্যবহার করল তাই নয়, এমন ব্যবহার করল যেন সে তারই অন্যতম সভাসদ, তার প্রতি সহানুভূতিশীল, এবং তার সাফল্যে আনন্দ করতে প্রস্তুত। আলোচনা প্রসঙ্গে সে মস্কোর কথা উল্লেখ করল, রুশ রাজধানী সম্পর্কে বলাশেভকে নানা প্রশ্ন করল।

মস্কোর অধিবাসী-সংখ্যা কত? কত বাড়িঘর আছে। একথা কি সত্য যে মস্কোকে পবিত্র মস্কো বলা হয়? মস্কোতে কতগুলি গির্জা আছে?

দুশর বেশি গির্জা আছে শুনে বলল, এত গির্জা কেন?

 রুশরা খুব ধার্মিক বলাশেভ জবাব দিল।

কিন্তু মঠ ও গির্জার সংখ্যাধিক্য তো জনসাধারণের অনুন্নত অবস্থারই লক্ষণ, কথাটা বলে প্রশংসা পাবার আশায় নেপোলিয়ন কলাইকুর্তের দিকে তাকাল।

বলাশেভ শ্রদ্ধার সঙ্গে ফরাসি সম্রাটের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করল।

বলল, সব দেশেরই একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে।

কিন্তু ইওরোপের আর কোথাও তো এরকমটা নেই, নেপোলিয়ন বলল।

বলাশেভ পাল্টা জবাব দিল, ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি আমাকে ক্ষমা করবেন, রাশিয়া ছাড়া স্পেনেও অনেক গির্জা ও মঠ আছে।

বলাশেভের এই উক্তির মধ্যে সম্প্রতি স্পেনে ফরাসিদের পরাজয়ের ইঙ্গিত থাকায় উপস্থিত কেউই কথাটা খেয়াল করল না। নেপোলিয়নও তার কথায় কান না দিয়ে শুধাল, সেখান থেকে মস্কো যাবার সোজা রাস্তা কোনটা। ডিনারের সময় বলাশেভ আগাগোড়াই বেশ সতর্ক ছিল, সে জবাব দিল, সব রাস্তা যেমন রোশে যায়, তেমনই সব রাস্তাই মস্কোতে যায় : রাস্তা অনেক আছে, তার মধ্যে পলতার ভিতর দিয়ে যাবার যে রাস্তাটা দ্বাদশ চার্লস বেছে নিয়েছিল সেটাও আছে। মুখের মতো জবাব দিয়ে পারায় খুশিতে বলাশেভের মুখটা লাল হয়ে উঠল। কিন্তু কলাইকুর্ত সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গ তুলে পিটার্সবুর্গ থেকে মস্কো যাবার রাস্তার দুর্গতি এবং তার পিটার্সবুর্গের স্মৃতির কথা বলতে শুরু করে দিল।

ডিনারের পরে কফি খেতে তারা নেপোলিয়নের পড়ার ঘরে গেল। চারদিন আগে এটাই ছিল সম্রাট আলেক্সান্দারের পড়ার ঘর। নেপোলিয়ন বসল, সেভার্স কফি-পেয়ালাটা নাচাতে নাচাতে পাশের চেয়ারটায় বলাশেভকে বসতে বলল। ডিনার-পরবর্তীকালের মৌজে থাকায় এখন বলাশেভকেও তার বন্ধু ও অনুরাগী বলে মনে হল। ঈষৎ ব্যঙ্গাত্মক খুশির হাসি হেসে তাকে বলল, এই ঘরেই নাকি সম্রাট আলেক্সান্দার থাকতেন? কী আশ্চর্য, তাই না সেনাপতি?

বলাশেভ কোনো জবাব দিতে পারল না, নিঃশব্দে মাথাটা নিচু করল।

সেই একই ব্যঙ্গাত্মক আত্মপ্রত্যয়শীল হসির সঙ্গে নেপোলিয়ন বলতে লাগল, হ্যাঁ। চারদিন আগে এই ঘরেই উইন্তনিজেরোদ ও স্তিন আলোচনায় বসেছিল। সম্রাট আলেক্সান্দার কেন যে আমার ব্যক্তিগত শত্রুদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছেন সেটাই আমি বুঝতে পারি না। বুঝতে…পারি না। একথা কি তিনি একবারও ভাবেননি যে আমিও ঠিক তাই করতে পারি? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে বলাশেভের দিকে তাকাল, সকালবেলাকার রাগটা যেন আবার তার মনে পড়ে গেল।

পেয়ালাটা ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নেপোলিয়ন বলল, তিনি জেনে রাখুন যে সেই কাজই আমি করব। তার সব উতেমবেৰ্গ, বাদেন ও উইমারের আত্মীয়দের আমি জার্মেনি থেকে তাড়িয়ে দেব…া। তাড়িয়ে দেব। তিনি যেন রাশিয়াতে তাদের জন্য একটা আশ্রয়-শিবির বানিয়ে রাখেন!

বলাশেভ এমনভাবে মাথাটা নোয়াল যেন সে বলতে চাইল যে এবার সে বিদায় নিতে চায়। কিন্তু নেপোলিয়ন সেটা বুঝতে পারল না। সমানেই কথা বলে চলল।

কেনই বা সম্রাট আলেক্সান্দার নিজের হাতে সৈন্য-পরিচালনার ভার নিয়েছেন। তাতে কি লাভ হবে? যুদ্ধ আমার কাজ, আর কাজ রাজ্যশাসন করা, সৈন্য পরিচালনা নয়! কেন তিনি এ দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছেন?

নেপোলিয়ন আবার নস্যিদানিটা বের করল, নিঃশব্দে বারকয়েক পায়চারি করল, তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ বলাশেভের কাছে এগিয়ে গেল এবং যেন এমন একটা কাজ করছে যেটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বলাশেভের পক্ষে প্রীতিদায়কও বটে এমনিভাবে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি হেসে চল্লিশ বছর বয়সের রুশ সেনাপতির মুখের কাছে হাতটা তুলে তার কানটা ধরে মৃদু টান দিল, ঠোঁটে তখন মৃদু হাসির রেখা।

সম্রাট কারো কান ধরে টানলে ফরাসি রাজ-দরবারে সেটাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও অনুগ্রহের লক্ষণ বলে মনে করা হয়।

ওহে সম্রাট আলেক্সান্দারের ভক্ত ও সভাসদ, আপনি কিছু বলছেন না কেন? নেপোলিয়ন বলল, যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য কারো ভক্ত ও সভাসদ হওয়াটাই হাস্যকর। বলাশেভের অভিবাদনের জবাবে মাথাটাকে ঈষৎ নুইয়ে বলল, সেনাপতির ঘোড়া তৈরি তো? তাকে আমার ঘোড়াটাই দাও। অনেকদূর পথ পাড়ি দিতে হবে!

বলাশেভ যে চিঠিটা নিয়ে গেল আলেক্সান্দারকে লেখা নেপোলিয়নের সেটাই শেষ চিঠি। সাক্ষাৎকারের বিবরণ সবিস্তারেই রুশ সম্রাটকে জানানো হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল…

.

অধ্যায়-

মস্কোতে পিয়েরের সঙ্গে দেখা হবার পরে প্রিন্স আন্দ্রু পিটার্সবুর্গ চলে গেল। বাড়িতে বলে গেল সেখানে কাজ আছে, কিন্তু আসলে গেল আনাতোল কুরাগিনের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে। পিটার্সবুর্গে পৌঁছে সে কুরাগিনের খোঁজ করল, কিন্তু কুরাগিন ততদিনে শহর ছেড়ে চলে গেছে। পিয়ের আগেই শ্যালককে সতর্ক করে দিয়েছিল যে প্রিন্স আন্দ্রু তার খোঁজ করছে। আনাতোল কুরাগিন তখনই সমর দপ্তর থেকে একটা চাকরি পেয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে মলদাভিয়াতে চলে গেছে। পিতার্সবুর্গে তার প্রাক্তন কমান্ডার কুতুজভের সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর দেখা হয়ে গেল। কুতুজভ বরাবরই তাকে সুনজরে দেখে, তাই সে প্রস্তাব করল, প্রিন্স আন্দ্রু তার সঙ্গে মলদাভিয়া চলুক, বর্তমানে সে সেখানকার প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছে।

চিঠি লিখে কুরাগিনকে দ্বৈতযুদ্ধে আহ্বান করাটা প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে সমীচীন বলে মনে হয় নি। সে ভাবল, কোনো নতুন কারণ ছাড়াই যদি সে তাকে যুদ্ধে আহ্বান করে তাহলে কাউন্টেস রস্তভা তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে, কাজেই সে চাইল, নিজে কুরাগিনের সঙ্গে দেখা করে দ্বৈতযুদ্ধের একটা অজুহাত খুঁজে নেবে। কিন্তু তুরষেন ও কুরাগিনের সঙ্গে তার দেখা হল না, প্রিন্স আন্দ্রু সেখানে পৌঁছবার অনতিপরেই সে রাশিয়াতে ফিরে গেছে। নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে, প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে জীবনটা কিছুটা সহনীয় হয়ে উঠল। বাকদত্তা বধূর বিশ্বাসভঙ্গের পরে সেই একই পরিবেশে থাকা তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। অস্তারলিজের রণক্ষেত্রে আকাশের দিকে তাকিয়ে যে চিন্তা তার মনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আজ আর সে চিন্তা তার মনে আসে না, বরং সে চিন্তাকে আজ সে ভয় করে। সুদূর আকাশের যে অসীম চন্দ্রাতপ একদিন তার চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল, সহসা সেটা একটা নিচু নীরেট ভূগর্ভ-প্রকোষ্ঠ হয়ে তাকে যেন চেপে ধরেছে, আজ সেখানে সবকিছুই অত্যন্ত স্পষ্ট, রহ্যসের ছায়ামাত্র সেখানে নেই।

তার সামনে যেসব কাজের সুবিধা তখন ছিল তার মধ্যে সামরিক চাকরিই সবচাইতে সরল ও পরিচিত। কুতুজভের অধীনস্থ কর্তব্যরত সেনাপতি হিসেবে এত উৎসাহ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে সে কাজ করতে লাগল যে কুতুজতও তা দেখে অবাক হয়ে গেল। তুরস্কে কুরাগিনের সঙ্গে দেখা না হলেও প্রিন্স আন্দ্রু তক্ষুণি তার খোঁজে রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কিন্তু সেইসঙ্গে সে এটাও জানত, যত দেরিতেই হোক, কুরাগিনের সঙ্গে যেদিন তার দেখা হবে সেদিন তার মুখোমুখি দাঁড়াবার লোেভ সে সামলাতে পারবে না, ঠিক যেমন একটা ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার সামনে পেলে সেটা ছিনিয়ে নেবার লোভ সামলাতে পারে না। অপমানের প্রতিশোধ এখন নেওয়া হয় নি, সব বিদ্বেষই বুকের মধ্যে জমা হয়ে আছে-এই চেতনাই তার বুকের উপর সারাক্ষণ চেপে বসে আছে, তুরস্কে এসে অবিশ্রাম কাজের টানে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রেরণায় যে কৃত্রিম শান্তির সন্ধান সে পেয়েছে, তাকে সারাক্ষণ বিষাক্ত করে তুলছে।

১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের খবর যখন বুখারেন্টে এসে পৌঁছল–সেইসময় কুতুজভ দুমাস যাবৎ একটি ওয়ালাচিয়ান স্ত্রীলোকের সঙ্গে বুখারেস্টেই রাতদিন কাটাচ্ছিল-তখন প্রিন্স আন্দ্রু কুতুজভকে অনুরোধ করল তাকে পশ্চিম সেনাদলে বদলি করা হোক। কুতুজভ সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল এবং তাকে বার্কলে দ্য তলি-র সেনাদলে পাঠিয়ে দিল।

তখন মে মাস। পশ্চিম সেনাদল শিবির ফেলেছে দ্রিসা-তে। সেখানে যাবার পথেই মাত্র তিন ভাস্ট দূরে বন্ড হিলস পাড়ায় পশ্চিম সেনাদলে যোগ দেবার আগে প্রিন্স আন্দ্রু বল্ড হিলসে গেল। বিগত তিন বছরে তার জীবনে এত বেশি পরিবর্তন এসেছে, এত বেশি কথা সে ভেবেছে, এত বেশি সুখ-দুঃখ অনুভব করেছে, এবং পুবে ও পশ্চিমে এত বেশি দেশ দেখেছে, যে বল্ড হিলসে পৌঁছে যখন দেখল, সেখানকার জীবনযাত্রা ঠিক আগেকার মতোই আছে, তার এতটুকু পরিবর্তন ঘটেনি, তখন এই অভিজ্ঞতা তার কাছে যেমন বিস্ময়কর তেমনই অপ্রত্যাশিত বলে মনে হল। পাথরের থামওয়ালা ফটকের ভিতর দিয়ে ঢুকে তরু-বীথির ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তার মনে হল সে যেন একটা ঘুমন্ত স্বপ্নপুরীতে প্রবেশ করছে। সেই একই গাম্ভীর্য, একই পরিচ্ছন্নতা, সর্বত্র একই নিস্তব্ধতা, বাড়ির ভিতরে সেই একই আসবাবপত্র, একই দেয়াল, শব্দ ও গন্ধ, আর সেই একই ভীরু সব মুখ, শুধু তাদের বয়স কিছু বেড়েছে। প্রিন্সেস মারি যা ছিল তাই আছে, ভয় ও দুঃখভোগের ভিতর দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি কাটিয়ে চলেছে। মাদময়জেল বুরিয়ে সেই একই ছটফটে, আত্মতুষ্ট নারী, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সে আনন্দের ভিতর দিয়ে কাটাচ্ছে, আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও মনে আছে আনন্দের প্রত্যাশা। শুধু তার আত্মবিশ্বাসটা আরো বেড়েছে। যে শিক্ষকটিকে সে নিজে সুইজারল্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছিল সেই দেসাল্লেস নামক ভদ্রলোক রুশ ছটের একটা কোট পরে ভাঙা রুশ ভাষায় চাকরদের সঙ্গে কথা বলছে, সেই একই সংকীর্ণ বুদ্ধির অধিকারী, বিবেকবান ও পণ্ডিতমন্য শিক্ষক। একটা দাঁত পড়ে যাওয়ায় বুড়ো প্রিন্সের চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু চরিত্রে সেই একই আছে, শুধু আরো একটু খিটখিটে ও সন্দেহবাদী হয়ে পড়েছে। একমাত্র পরিবর্তন হয়েছে ছোট্ট নিকলাসের। বড় হয়েছে, আরো গোলাপি হয়েছে, চুল ঘন কালো ও কোকড়া হয়েছে, হাসবার সময় উপরের ঠোঁটটা একটু ঠেলে ওঠে, ঠিক ছোট প্রিন্সেসের মতো। কিন্তু বাইরে আগেকার মতো থাকলেও এইসব মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। গোটা সংসারটা দুটো বিরোধী শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। এক শিবিরে আছে বুড়ো প্রিন্স, মাদময়জেল বুরিয়ে ও স্থপতি, অন্য শিবিরে আছে প্রিন্সেস মারি, দেসাল্লেস, ছোট্ট নিকলাস এবং বুড়ি নার্স ও দাসীরা।

পরিবারের সকলে একসঙ্গেই ডিনারে বসে, কিন্তু সকলেই কেমন যেন অস্বস্তিতে কাটায়। প্রিন্স আন্দ্রু বুঝতে পারল, এখন সে এখানে অতিথি বলেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, আর তার উপস্থিতি সকলকেই অস্বস্তিতে ফেলেছে। প্রথম দিন ডিনারে বসেই এটা বুঝতে পেরে সে চুপ করে গেল, আর সেটা লক্ষ্য করে বুড়ো প্রিন্সও মুখ বুজে ডিনার সেরে সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরে চলে গেল। সন্ধ্যার পরে প্রিন্স আন্দ্রু যখন তার ঘরে গিয়ে কাউন্ট কামেনস্কির অভিযানের কথা বলতে শুরু করল, বুড়ো প্রিন্স তখন অপ্রত্যাশিতভাবে প্রিন্সেস মারির কথা তুলল, এবং তার কুসংস্কার ও মাদময়জেল বুরিয়ের প্রতি বিরূপতার জন্য তার উপর দোষারোপ করতে লাগল অথচ তার মতে একমাত্র সেই মানুষটিই তার প্রতি সত্যি সত্যি অনুরক্ত।

বুড়ো প্রিন্স বলল, তার অসুখের জন্য প্রিন্সেস মারিই দায়ী :ইচ্ছা করে সে তাকে বিরক্ত করে, যন্ত্রণা দেয় এবং বেশি আদর দিয়ে ও আজে-বাজে কথা বলে ছোট্ট প্রিন্স নিকলাসকেও নষ্ট করছে। তারপরই সে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগল কেন মেয়ের অযৌক্তিক আচরণকে সে মেনে নিতে পারছে না।

চোখ না তুলেই প্রিন্স আন্দ্রু বলল (জীবনে এই প্রথম সে বাবার কাজের নিন্দা করছে), এ বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছা আমার ছিল না, কিন্তু তুমি যখন জানতে চাইছ তখন আমার যা মত তা খোলাখুলিই বলব। তোমার ও মারির মধ্যে যদি কোনো ভুল-বোঝাবুঝি ও বিরোধ ঘটে থাকে তবে সেজন্য আমি মোটেই তাকে দোষ দিতে পারি না। আমি জানি সে তোমাকে ভালোবাসে, ভক্তি করে। তুমি জিজ্ঞাসা করলে বলেই বলছি, কোনো ভুল-বোঝাবুঝি যদি ঘটে থাকে তার জন্য দায়ী শুধু ঐ অযোগ্যা স্ত্রীলোকটি–আমার বোনের সহচরী হবার যোগ্যতা তার নেই।

বুড়ো প্রথমে স্থিরদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকাল, একটা অস্বাভাবিক হাসিতে তার ফোকলা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।

কোন সহচরী হে বাপু? অ্যাঁ? তুমি আবার ঐ কথা তুলেছ?

তিক্ত, কঠোর কণ্ঠে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আমি তো বিচার করতে চাইনি বাবা, তুমি আমাকে বলতে বাধ্য করেছ, আর তাই আমি বলছি, চিরদিন বলব, যে মারির কোনো দোষ নেই, কাউকে যদি দোষ দিতে হয়-একজনকেও যদি দোষ দিতে হয়তো সে ওই ফরাসি নারী।

আরে, এও দেখি রায় দিতে বসেছে…রায় দিচ্ছে! বুড়ো মানুষটি নিচু গলায় বলল, প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল তার কণ্ঠে একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠেছে, কিন্তু পরক্ষণেই হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল : চলে যাও, চলে যাও! তোমার চিহ্নমাত্র যেন এখানে না থাকে!…।

প্রিন্স আন্দ্রু তখনই চলে যেতে চাইল, কিন্তু প্রিন্সেস মারির পীড়াপীড়িতে আরো একদিন থেকে গেল। সেদিনটা সে বাবার সঙ্গে দেখা করল না, বুড়ো প্রিন্সও তার ঘর থেকে বের হল না, এবং মাদময়জেল বুরিয়ে ও তিখন ছাড়া আর কাউকে ঘরে ঢুকতে দিল না, তবে ছেলে চলে গেছে কিনা বারকয়েক সে খবর নিল। পরদিন যাবার আগে প্রিন্স আন্দ্রু ছেলের ঘরে গেল। মায়ের মতোই ছেলেটির মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, সুস্বাস্থ্যে উজ্জ্বল। ছেলে তার হাঁটুর উপর বসল, আর সেও ছেলেকে নীল দাড়িওয়ালা-র গল্প বলতে শুরু করল। কিন্তু গল্প শেষ না করেই একটা দিবাস্বপ্নে ডুবে গেল। ছেলের বদলে নিজের কথা ভাবতে লাগল।

ছেলে বলল, তারপর? বলে যাও!

কোনও জবাব না দিয়ে ছেলেকে হাঁটু থেকে নামিয়ে দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তাহলে তুমি যাবেই স্থির করেছ আঃ বোন শুধাল।

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমি যেতে পারছি। কিন্তু আমার দুঃখ যে তুমি তা পারছ না।

প্রিন্সেস মারি বলল, সেকথা বলছ কেন? বাবার এই বুড়ো বয়সে তুমি এই ভয়ংকর যুদ্ধে চলে যাচ্ছ? মাদময়জেল বুরিয়ে বলছে, বাবা তোমার খোঁজ করছিল…

সেকথা বলতে গিয়েই তার ঠোঁট কাঁপতে লাগল, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রু মুখ ঘুরিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

ওঃ, ঈশ্বর! ঈশ্বর! কত তুচ্ছ কারণেই যে মানুষ দুঃখ পেতে পারে সেকথা ভাবাও যায় না! এমন বিদ্বেষভরা গলায় সে কথাগুলি বলল যে প্রিন্সেস মারি শংকিত হয়ে উঠল।

সে বুঝতে পারল, তুচ্ছ বলতে সে শুধু মাদময়জেল বুরির্যের কথাই বলেনি, বলেছে তার কথাও যে তার জীবনের সব সুখ নষ্ট করেছে। পানিতে ভেজা চকচকে চোখে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে তার কনুই ধরে প্রিন্সেস মারি বলল আন্দ্রু! তোমার কাছে আমার একটি ভিক্ষা, একটি মিনতি আছে। তোমাকে আমি বুঝি। কখনো ভেবো না যে দুঃখ মানুষের সৃষ্টি। মানুষ তো তাঁর হাতের যন্ত্রমাত্র। দুঃখ তিনিই পাঠান, মানুষ নয়। মানুষ তার হাতের যন্ত্র, তাদের কোনো দোষ নেই। যদি মনে কর কেউ তোমার প্রতি অন্যায় করেছে, সেকথা ভুলে যাও, তাকে ক্ষমা কর! শাস্তি দেবার অধিকার আমাদের নেই। তাহলেই ক্ষমার যে কী আনন্দ তা তুমি জানতে পারবে।

আমি মেয়েমানুষ হলে এই কথাই বলতাম মারি। ওটা তো নারীর ধর্ম। কিন্তু পুরুষমানুষ ক্ষমা করতে পারে না, ভুলে যেতে পারে না, প্রিন্স আন্দ্রু বলল। যদিও সেই মুহূর্তে কুরাগিনের কথা তার মনে আসেনি, তবু সহসা দুর্বার ক্রোধে তার বুকটা ভরে উঠল।

প্রিন্সেস মারি তাকে আরো একটা দিন থেকে যেতে অনুরোধ করল, বলল, বাবার সঙ্গে একটা মিটমাট না করে সে যদি চলে যায় তাহলে বাবা বড়ই দুঃখ পাবে। কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, হয় তো শিগগিরই সে সেনাদল থেকে ফিরে আসবে, বাবার কাছে নিশ্চয়ই চিঠি লিখবে, কিন্তু এখন যত বেশি দিন সে এখানে থাকবে তাদের সম্পর্ক ততই তিক্ততর হবে। বোনের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় তার এই শেষ কথাগুলিই প্রিন্স আন্দ্রুর কানে এল : বিদায় আন্দ্রু! মনে রেখো, দুর্ভাগ্য আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে, মানুষের কোনো দোষ নেই।

বল্ড হিলসের বাড়ি থেকে যেতে যেতে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, তাহলে তাই হবে!…বেচারি নির্দোষ মানুষটি এখানে থেকে এমন একটি বৃদ্ধের নির্যাতনের শিকার হবে যার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটেছে। বুড়ো জানে যে দোষ তারই, কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারে না। আমার ছেলে বড় হচ্ছে, তার জীবনে আনন্দ আছে, সেও হয় প্রতারণা করবে, আর না হয় প্রতারিত হবে। আর আমি চলেছি সৈন্যদলে। কেন? তা আমি নিজেই জানি না। যে লোকটাকে আমি ঘৃণা করি তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই, আমাকে হত্যা করে আমাকে দেখে হাসবার একটা সুযোগ তাকে দিতে চাই।

জীবনের এই অবস্থাগুলি আগেও ছিল, কিন্তু তখন সব ছিল সুসংবদ্ধ, এখন সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। প্রিন্স আন্দ্রুর মনের সামনে একের পর এক ভেসে আসতে লাগল যতসব অর্থহীন, অসংবদ্ধ ছবি।

.

অধ্যায়-৯

জুনের শেষভাগে প্রিন্স আন্দ্রু সেনাদলের প্রধান ঘাঁটিতে পৌঁছে গেল। স্বয়ং সম্রাটসহ প্রথম সেনাদল তখন দ্রিসার সুরক্ষিত শিবিরে অবস্থান করছে, দ্বিতীয় সেনাদল পশ্চাদপসরণ করছে, একটা বড় ফরাসি বাহিনীদ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা তখন প্রথম সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করছে। রুশ বাহিনীর অবস্থা নিয়ে সকলেই অসন্তুষ্ট, কিন্তু ফরাসিরা মূল রুশ ভূখণ্ড আক্রমণ করবে এ আশংকা তখনো কারো মনে দেখা দেয়নি, কেউ ভাবেনি যে পশ্চিমাঞ্চলের পোলিশ ভূখণ্ড (রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত) ছাড়িয়ে যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে।

দ্রিসার তীরেই বার্কলে দ্য তলির সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর দেখা হয়ে গেল, তার সেনাদলে যোগ দিতেই সে এসেছে। শিবিরের কাছাকাছি কোনো শহর বা বড় গ্রাম না থাকায় সেনাদলের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য সেনাপতি ও সভাসদরা নদীর দুই তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামের ভালো ভালো বাড়িগুলোতে বাস করছে, বার্কলে দ্য তলির বাসস্থানটি সম্রাটের বাসভবনের প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত। বার্কলে কিছুটা রুক্ষ ও নিরাসক্তভাবেই তাকে গ্রহণ করল, বলল, তার চাকরি সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিতে সে সম্রাটকে বলবে, তবে আপাতত সে তার সঙ্গেই থাকবে। আনাতোল কুরাগিনকে এখানেও পাওয়া গেল না। সে পিটার্সবুর্গ চলে গেছে, কিন্তু একথা শুনে প্রিন্স আন্দ্রু খুশি হল। কুরাগিনের চিন্তা থেকে অব্যাহতি পেয়ে এখানকার এই বিরাট যুদ্ধের আয়োজনের মধ্যেই সে ডুবে গেল। প্রথম চারদিন হাতে কোনো কাজ না থাকায় সে সুরক্ষিত শিবিরটাকে ঘুরে ঘুরে দেখল এবং নিজের জ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের কথাবার্তা থেকে এই যুদ্ধ সম্পর্কে একটা নিজস্ব ধারণা গড়ে তুলতে লাগল। সে ধারণাটা নিম্নরূপ।

সম্রাট ভিলনাতে থাকতেই সেনাবাহিনীকে তিনটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম দল বার্কলে দ্য তলির অধীন, দ্বিতীয় দল ব্যাগ্রেশনের অধীন, এবং তৃতীয় দলের কমান্ডার তর্মাসভ। সম্রাট প্রথম দলে থাকলেও প্রধান সেনাপতি হিসেবে ছিল না। প্রচারিত হুকুমনামায় বলা হয়েছিল, সম্রাট সৈন্য পরিচালনার ভার নেবে না, শুধু তাদের সঙ্গে থাকবে। তদুপরি প্রধান সেনাপতির কর্মচারীবৃন্দের পরিবর্তে সম্রাটের সঙ্গে ছিল রাজকীয় কর্মচারীবৃন্দ। তার সঙ্গে আর ছিল রাজকীয় কর্মচারীবৃন্দের প্রধান কোয়ার্টার-মাস্টার-জেনারেল প্রিন্স ভলকনস্কি এবং সেনাপতিগণ, রাজকীয় এড-ডি-কংগণ, কূটনৈতিক কর্মচারীবৃন্দ ও বহুসংখ্যক বিদেশী, শুধু ছিল না সামরিক বিভাগের কর্মচারীবৃন্দ। এছাড়া কোনো বিশেষ পদে নিযুক্ত না হয়েও ছিল : প্রাক্তন সমরমন্ত্রী আরাকচিভ, মর্যাদার প্রধান সেনাপতি কাউন্ট বেনিংসেন, গ্র্যান্ড ডিউক জায়রেভিচ কনস্তান্তিন পাভলভিচ, চ্যান্সেলর কাউন্ট রুমিয়ান্তসেভ, প্রাক্তন প্রুশিয় মন্ত্রী স্তিন, সুইডিস সেনাপতি আর্মফেল্ট, অভিযান-পরিকল্পনার প্রধান রচয়িতা পফুয়েল, সার্দিনিয়া থেকে এসে বসবাসকারী অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল পলুচি, ওলযোগেন এবং আরো অনেকে। এটা বাইরের চিত্র, কিন্তু সম্রাট ও এইসব লোকের উপস্থিতির আসল তাৎপর্য হল এই : প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণ না করেও সম্রাটই সমস্ত সৈন্য পরিচালনা করত, আর এইসব লোক ছিল তার সহকারী। হুকুম তামিল করার ভার ছিল আরাকচিভের উপর, সম্রাটের দেহরক্ষীর কাজও সে করত। বেনিংসেন ভিলনা অঞ্চলের একজন জমিদার, আসলে একজন ভালো সেনাপতি ও পরামর্শদাতা, প্রয়োজন হলে তাকে বার্কলের জায়গায় বসানো যেতে পারে। গ্র্যান্ড ডিউক দলে ছিল নিজেরই প্রয়োজনে। প্রাক্তন মন্ত্রী স্তিন ছিল কারণ তার পরামর্শ খুব দরকারি, আর সম্রাট আলেক্সান্দার তাকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আর্মফেল্ট নেপোলিয়নকে ভীষণভাবে ঘৃণা করে, সেনাপতি হিসেবেও সে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, আর সেই গুণেই সে সম্রাটের প্রিয়পাত্র। পলুচি স্থান পেয়েছে সাহস ও বাগ্মিতার জন্য। অ্যাডজুটান্ট-জেনারেলরা তো সবসময় ম্রাটের সঙ্গে সঙ্গেই ফেরে, আর সকলের শেষে পফুয়েল দলে এসেছে কারণ নেপোলিয়ন-বিরোধী অভিযানের পরিকল্পনাটি তারই রচনা এবং সে ব্যাপারে সেই সরেস।

প্রিন্স আন্দ্রু আরো লক্ষ্য করল যে এই কর্মচঞ্চল প্রকাণ্ড জগৎটাকে নানান ধ্যান-ধারণার নিরিখে সরাসরি আটটা দলে ভাগ করা যায়। তার মধ্যে সাতটি দল গড়ে উঠেছে নানা সেনাপতি ও প্রভাবশালী লোকদের কেন্দ্র করে। প্রতিটি দলই একে অন্যের বিরোধী ও নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু তাদের তুলনায় সবচাইতে বড় হচ্ছে অষ্টম দলটি, অন্য দলের তুলনায় তাদের সংখ্যার আনুপাতিক হার নিরানব্বই জনে একজন : তারা যুদ্ধ বা শান্তি কোনোটাই চায় না, সৈন্যদল অগ্রসর হোক অথবা দ্রিসা বা অন্য কোথাও শিবিরে বসে থাকুক তাতেও তাদের কিছু যায়-আসে না, বার্কলে বা সম্রাট, পফুয়েল বা বেনিংসেন-কাউকে নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই, তাদের একমাত্র লক্ষ্য–নিজেদের জন্য যত বেশি সম্ভব সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করা। পারস্পরিক বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের যে ঘূর্ণি-স্রোত তখন ম্রাটের প্রধান ঘটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল তার ভিতর থেকে ফায়দা তোলা এখন যতটা সম্ভব অন্য সময় তা কল্পনাও করা যায় না। সকলেই না ফন্দি-ফিকিরে যার যার কাজ গুছাতেই ব্যস্ত।

এই দলের লোকজনরা সকলেই রুবল, সামরিক সম্মান ও পদোন্নতি হাতাতেই ব্যস্ত, আর সেই উদ্দেশ্যে সবসময়ই নজর রাখে সম্রাটের দাক্ষিণ্যের বায়ু-পাখির দিকে, সেটা যখন যেদিকে ঘোরে সেনাদলের এই মৌমাছি-দল তখন সে দিকেই সদলে ঝুঁকে পড়ে, আর তার ফলে সেটাকে অন্য কোনোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া সম্রাটের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে। চারদিককার অনিশ্চয়তা, আসন্ন বিপদের আশংকা, ষড়যন্ত্র, স্বার্থপরতা ও ধ্যান-ধারণার সংঘাত, এবং এইসব মানুষের স্বার্থসিদ্ধির দৌড়-এইসবের কেন্দ্রস্থল হিসেবে অষ্টম ও বৃহত্তর দলটাই পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয় তখনই এই দলটি ঝাঁক বেঁধে এসে সেখানে গুন-গুন শুরু করে দেয়, এবং যারা সরল মনে কোনো বিতর্ক তুলতে চায় তাদের কণ্ঠস্বর সেই গুঞ্জনে চাপা পড়ে যায়।

ঠিক যে সময় প্রিন্স আন্দ্রু সেনাদলে গিয়ে পৌঁছল তখন এইসব দলের ভিতর থেকে আরো একটা নবম দল সবে গড়ে উঠে গলা তুলতে শুরু করেছে। সেটা হচ্ছে প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় কর্মপরিচালনায় দক্ষ লোকদের দল, এই সব দলগুলির সঙ্গে যুক্ত না থেকে দলটি প্রধান ঘাঁটির কাজকর্মকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে পারে এবং এই অস্থিরতা, জটিলতা ও দুর্বলতার হ-য-ব-র-ল থেকে উদ্ধারের একটা উপায় বলে দিতে জানে।

এই দলের লোকরা এই কথাই ভাবতে লাগল ও বলতে চাইল যে সামরিক দরবারসহ সম্রাটের সেনাদলে উপস্থিতিই সব দোষের মূল কারণ, এ ধরনের ব্যবস্থা রাজ-দরবারে চলে, কিন্তু সেনাদলের পক্ষে ক্ষতিকর, সম্রাটের কাজ রাজ্য শাসন করা, সৈন্য-পরিচালনা নয়, এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার লাভের একমাত্র পথ সম্রাটের দলবলসহ সেনাবাহিনীকে ছেড়ে চলে যাওয়া, যে পঞ্চাশ হাজার লোক সম্রাটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজন একমাত্র সম্রাটের উপস্থিতির ফলেই তাদের সব কর্মক্ষমতা পঙ্গু হয়ে যায়, এবং সবচাইতে বাজে প্রধান সেনাপতিও যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তাহলে সেও সম্রাটের উপস্থিতি ও কর্তৃত্বের দ্বারা শৃঙ্খলিত একজন সেরা প্রধান সেনাপতির চাইতে ভালোভাবে কাজ চালাতে পারে।

ঠিক যে সময় প্রিন্স আন্দ্রু বেকার হয়ে দ্রিসাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখনই এই দলের একজন প্রধান প্রতিনিধি ও স্বরাষ্ট্রসচিব শিশকভ সম্রাটকে একটা চিঠি লিখল, আরাকচিভ ও বলাশেভও তাতে সই করতে রাজি হল। রাজধানীর লোকদের মধ্যে একটা যুদ্ধকালীন মনোভাব গড়ে তোলা ম্রাটের দিক থেকে খুবই দরকারি কাজ–এই অজুহাত দেখিয়ে ওই চিঠিতে শিশকভ সসম্মানে প্রস্তাব করল যে ম্রাটের উচিত সেনাদল ছেড়ে চলে যাওয়া।

সম্রাট কর্তৃক জনসাধারণকে জাগিয়ে তোলা, তাদের প্রতি দেশ রক্ষার আহ্বান জানানোমস্কোতে জারের ব্যক্তিগত উপস্থিতির ফলে এইভাবে যে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হবে সেটাই রাশিয়ার জয়লাভের প্রধান কারণ হবে-সম্রাট কর্তৃক সেনাদল পরিত্যাগের অজুহাত হিসেবে তার কাছে এই প্রস্তাবই রাখা হল এবং সম্রাটও সে প্রস্তাব মেনে নিল।

.

অধ্যায়-১০

 চিঠিটা তখনো সম্রাটের হাতে দেওয়া হয় নি এমন সময় একদিন ডিনারে বসে বার্কলে বলকনস্কিকে জানাল, সম্রাট স্বয়ং তার সঙ্গে দেখা করতে চায়, তুরস্ক সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় এবং সেদিন সন্ধ্যা ছটায় প্রিন্স আন্দ্রু যেন বেনিংসেনের বাসায় হাজির থাকে।

প্রিন্স আন্দ্রু যথাসময়ে বেনিংসেনের বাসভবনে হাজির হল, নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে জনৈক গ্রাম্য ভদ্রলোকের একটা মোটামুটি আকারের বাড়িতে বেনিংসেনের অস্থায়ী আস্তানা। বেনিংসেন বা সম্রাট কেউ সেখানে নেই, ম্রাটের এড-ডি-কং চের্নিশেভ তাকে অভ্যর্থনা করে জানাল, জেনারেল বেনিংসেন ও মার্কুইস পলুচিকে সঙ্গে নিয়ে সম্রাট দ্বিতীয়বার দ্রিসা শিবিরের রক্ষা-ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে গেছেন, কারণ সেখানকার রক্ষা-ব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

একটা ফরাসি উপন্যাস হাতে নিয়ে চের্নিশেভ প্রথম ঘরের জানালার পাশে বসে ছিল। ঘরটা সম্ভবত গানের ঘর ছিল, এককোণে একটা অর্গান রয়েছে, তার উপর কতকগুলি কম্বল তূপ করে রাখা হয়েছে, আর কোণে আছে বেনিংসেনের অ্যাডজুটান্টের ভাঁজ-করা খাটটা। কাজের ফলে বা ভোজনের ফলে ক্লান্ত হয়ে অ্যাডজুটান্টটি গোল-করা বিছানার উপর বসে ঝিমুচ্ছে। ঘরের দুটো দরজা, একটা দিয়ে বসার ঘরে যাওয়া যায়, ডান দিককার দরজাটা দিয়ে যাওয়া যায় পড়ার ঘরে। প্রথম দরজাটা দিয়ে জার্মান ভাষায় এবং মাঝে মাঝে ফরাসি ভাষায় আলোচনার শব্দ ভেসে আসছে। বসার ঘরে একটা সভা বসেছে, ঠিক সামরিক পরিষদ নয়, এমন কয়েকজন জমায়েত হয়েছে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সম্রাট যাদের মতামত জানতে ইচ্ছুক। এই আধা পরিষদে আমন্ত্রিত হয়েছে সুইডিশ জেনারেল আর্মফেল্ট, অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল ওলযোগেন, উইন্তজেবোদ, মিচদ, তোল, কাউন্ট স্তিন ও পফুয়েল স্বয়ং। প্রিন্স আন্দ্রু আগেই শুনেছে যে এই লোকটিই নাটের গুরু। তাকে ভালো করে দেখবার একটা সুযোগ প্রিন্স আন্দ্রু পেয়ে গেল, কারণ তার ঠিক পরেই সে এসেছে এবং বসার ঘর পার হয়ে যাবার সময় মিনিটখানেক থেকে চের্নিশেভের সঙ্গে কিছু কথা বলে গেছে।

পফুয়েলের শরীরটা বেঁটে ও সরু হলেও তার হাড় মোটা, গড়ন বলিষ্ঠ, উরু চওড়া ও কাঁধ উঁচু। মুখের অনেকগুলো ভাঁজ, চোখ গর্তে বসা। মাথার চুল তাড়াতাড়ি বুরুশ করা, কপালের উপর পরিপাটি, কিন্তু পিছনে এলোমেলো। চঞ্চল ও ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে তাকাতে সে ঘরে ঢুকল, যেন সবকিছুতেই তার ভয়। অদ্ভুতভাবে তলোয়ারে হাত রেখে চের্নিশেভকে ডেকে জার্মান ভাষায় জানতে চাইল সম্রাট কোথায়। চের্নিশেভের জবাব শুনে ব্যঙ্গের হাসি হেসে অস্ফুটে কি যেন বলে উঠল। প্রিন্স আন্দ্রু তার পরিচয় দিয়ে বলল যে প্রিন্স আন্দ্রু তুরস্ক থেকে সবে ফিরেছে, আর সেখানকার যুদ্ধটাও বেশ ভালোভাবেই শেষ হয়েছে। কোনোরকমে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে পুফয়েল হেসে বলল, সেটা অবশ্যই রণকৌশলঘটিত একটি চমৎকার যুদ্ধ, বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সে বসার ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো খুঁতখুঁতে গম্ভীর গলা তার কানে এল।

.

অধ্যায়-১১

প্রিন্স আন্দ্রু পফুয়েলের দিকেই তাকিয়েছিল, এমন সময় দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকল কাউন্ট বেনিংসেন। বলকনস্কিকে দেখে মাথা নাড়ল, কিন্তু দাঁড়াল না, অ্যাডজুটান্টকে কিছু নির্দেশ দিয়ে পড়ার ঘরে ঢুকে গেল। সম্রাট আসছে, তাই বেনিংসেন তাড়াতাড়ি চলে এসেছে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে সম্রাটকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য তৈরি হয়ে নিতে। চের্নিশেভ ও প্রিন্স আন্দ্রু ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। সম্রাট তখন ঘোড়া থেকে নামছে। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মার্কুইস পলুচি বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে কি যেন বলছে, আর সম্রাট মাথাটা বদিকে কাৎ করে অসন্তোষের ভঙ্গিতে তার কথাগুলি শুনছে। কথায় ইতি টানবার জন্যই সম্রাট সামনের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু ইতালিয় ভদ্রলোকটি উত্তেজনাবশে ভদ্রতার রীতিনীতি ভুলে গিয়ে তার পিছন পিছন এগিয়ে অনবরত কথা বলতে লাগল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখে সম্রাট তার অপরিচিত মুখটার দিকে ভালো করে তাকাল, ওদিকে পলুচি তখনো বলেই চলেছে, এই শিবির, দ্রিসার শিবির গড়বার পরামর্শ যে লোক দিয়েছিল স্যার, তার জন্য আমি তো পাগলা গারদ অথবা ফাঁসি-কাঠ ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখি না!

ইতালিয় লোকটির শেষের কথায় কান না দিয়ে, এমন কি সেকথা যেন শুনতেই পায়নি এমনি ভাব দেখিয়ে সম্রাট এবার বলকনস্কিকে চিনতে পেরে বলল :

তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম। যেখানে সকলে অপেক্ষা করছে সেখানে যাও, আমার জন্য অপেক্ষা কর।

সম্রাট পড়ার ঘরে গেল। তার পিছন পিছন ঢুকল প্রিন্স পিতার মিখায়লভিচ বলকনস্কি ও ব্যারণ স্তিন, দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সম্রাটের অনুমতির সুযোগ নিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু পলুচির সঙ্গেই বসার ঘরে ঢুকল। সেখানেই পরিষদের সভা বসেছে।

প্রিন্স পিতর মিখায়লভিচ ভলকনস্কি যে আসনটি দখল করল তাতে মনে হল সেই বুঝি ম্রাটের পরিষদবর্গের প্রধান। কয়েকটা মানচিত্র টেবিলের উপর মেলে ধরে সে নানারকম প্রশ্ন করে উপস্থিত ভদ্রলোকদের মতামত শুনতে চাইল। ঘটনাটা হল : আগের দিন রাতে খবর এসেছে (যদিও পরবর্তীকালে খবরটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে) যে ফরাসিরা দ্রিসা শিবির ভেদ করে অগ্রসর হচ্ছে।

প্রথমে কথা বলল জেনারেল আর্মফেল্ট, অপ্রত্যাশিতভাবে সে প্রস্তাব করল যে এই বিপদের মোকাবিলা করতে পিটার্সবুর্গ ও মস্কোর রাস্তা থেকে দূরে কোথাও নতুন ঘাঁটি করা হোক, আর সেইখানে সব সেনাদল মিলিত হয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করে থাকুক। কেউ তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করল, আবার কেউ বা সমর্থন করল। তরুণ কাউন্ট তল আপত্তি জানিয়ে একটা নতুন পরিকল্পনা পেশ করল। তার জবাবে পলুচি প্রস্তাব করল, অগ্রসর হয়ে আগেই আক্রমণ করা হোক, তাহলেই এই অনিশ্চয়তা ও ফাঁদের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাব। এইসব আলোচনার সময় পফুয়েল ও তার ভাষ্যকার ওলযোগেন চুপ করে থাকল। কাজেই সভাপতি প্রিন্স বলকনস্কি যখন তার মতামত চাইল তখন সে শুধু বলল :

আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? জেনারেল আর্মফেল্ট তো চমঙ্কার প্রস্তাব দিয়েছেন-পিছন অরক্ষিত রেখে নতুন ঘাঁটি বানানো হোক, আর এই ইতালিয় ভদ্রলোকের আক্রমণের প্রস্তাবই বা নয় কেন-সেটাও তো ভালো, অথবা পশ্চাদপসরণ, তাও ভালো! আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আরে, আপনারা তো সবকিছুই আমার চাইতে ভালো জানেন।

কিন্তু বলকনস্কি যখন ভ্রুকুটি করে বলল যে সম্রাটের নামেই সে তার মতামত জানতে চেয়েছে তখন পফুয়েল উঠে দাঁড়িয়ে সহসা উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করল :

সব ভেস্তে গেছে, জগাখিচুরি হয়ে গেছে, সকলেই ভাবল তারা আমার চাইতে বেশি জানে, আর এখন আপনি এসেছেন আমার কাছে! কেমন করে অবস্থা সামাল দেওয়া যায়? সামাল দেবার আর কিছু নেই। হারসর্বস্ব আঙুল দিয়ে টেবিলটা সাজিয়ে সে বলে উঠল, আমি যে বিধান দিয়েছি সেটাকেই কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কিন্তু তাতে অসুবিধা কি? অর্থহীন, ছেলেমানুষ!

মানচিত্রের কাছে গিয়ে দ্রুতলয়ে কথা বলে সে প্রমাণ করতে লেগে গেল যে, কোনো অবস্থাতেই দ্রিসা শিবিরের সুরক্ষা-ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে না, সবকিছুই আগে থেকে খতিয়ে দেখা হয়েছে এবং শত্রুপক্ষ যদি তাকে ভেদ করতে চেষ্টা করে তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য।

পলুচি জার্মান জানে না, সে প্রশ্ন করতে লাগল ফরাসিতে। ওলযোগেন তার প্রধানকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল, সে অত্যন্ত খারাপ ফরাসি বলে। মাঝে মাঝেই পফুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, তাই নয় কি ইয়োর এক্সেলেন্সি? তা শুনে পফুয়েল চটে উঠে বলে, তা তো বটেই, একথা এত বেশি করে বুঝিয়ে বলার কি আছে?

পলুচি ও মিচদ দুজনই একযোগে ওলযোগেনকে ফরাসিতে আক্রমণ করতে লাগল। আর্মফেল্ট পফুয়েলের সঙ্গে কথা বলতে লাগল জার্মান ভাষায়, আর তল বলকনফিকে বোঝাতে লাগল রুশ ভাষায়। প্রিন্স আন্দ্রু চুপচাপ শুনতে লাগল।

আলোচনা চলল অনেকক্ষণ ধরে, যত সময় যেতে লাগল বিতর্ক ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠল, শেষপর্যন্ত হৈ হট্টগোল ও গালাগালিতে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবার সম্ভাবনা ক্রমেই কমতে লাগল। সব কিছু শুনতে শুনতে একটা পুরনো চিন্তাই নতুন করে প্রিন্স আন্দ্রুর মাথায় এল, সামরিক বিভাগে কাজ করতে করতে প্রায়ই তার মনে হয় যে সমরবিজ্ঞান বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না, আর তাই সামরিক প্রতিভা বলেও কিছু নেই, এ চিন্তাটা এখন স্পষ্ট সত্য হয়ে তার কাছে ধরা পড়ল। যে বিষয়ের পরিবেশ ও অবস্থান সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও সংজ্ঞাতীত, এবং বিরোধী শক্তিগুলির কর্মক্ষমতা যখন আগে থেকে নিরূপণ করা যায় না, তখন সে বিষয়ে কোনো মতবাদ এবং বিজ্ঞান কেমন করে গড়ে উঠবে? একটা দিনের মধ্যে আমাদের অথবা শত্রুপক্ষের সেনাদলের অবস্থা কি দাঁড়াবে তাই তো কেউ আগে থেকে বুঝতে পারে না, যেকোন একটি সেনাদলের সত্যিকারের শক্তি নির্ণয়ই তো কেউ করতে পারে না। আর লোকে সামরিক প্রতিভার কথাই বা বলে কেন? যে লোক ঠিকসময়ে রুটি পরিবেশনের হুকুম দিতে পারে, এবং কে ডাইনে যাবে আর কে বায়ে যাবে সেকথা বলে দিতে পারে সেই কি প্রতিভা? বরং আমি যেসব সেরা সেনাপতিদের জানি তারা হয় নির্বোধ, না হয় তো মনভোলা। এদিক থেকে ব্যাগ্রেশন তো সেরা, আর নেপোলিয়ন নিজেই একথা স্বীকার করেছে। আসলে সামরিক ক্রিয়াকলাপের সাফল্য তাদের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে তাদের উপর যারা সেনাদলের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলে আমরা হেরে গেলাম অথবা হুররা! যুদ্ধক্ষেত্রে একমাত্র সেখানে থেকেই কাজের কাজ করা যায়।

সকলের কথাবার্তা শুনতে শুনতে প্রিন্স আন্দ্রু এই কথাই ভাবছিল। সকলে চলে যেতে শুরু করলে পলুচি যখন তাকে ডাকল তখনই তার সম্বিত ফিরে এল।

পরদিন সেনা-পরিদর্শনের সময় সম্রাট জানতে চাইল সে কোথায় কাজ করতে চায়, আর ম্রাটের কাছাকাছি থাকবার প্রার্থনা না জানিয়ে সেনাদলে কাজ করার অনুমতি ভিক্ষা করে প্রিন্স আন্দ্রু রাজদরবারে আসন লাভের সুযোগটা চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলল।

.

অধ্যায়-১২

অভিযান শুরু হবার আগে রস্তভ বাবা-মার কাছ থেকে একটা চিঠি পেল, তাতে সংক্ষেপে নাতাশার অসুখ এবং প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে যাবার কথা জানিয়ে (তারা জানিয়েছে যে নাতাশাই বিয়েটা বাতিল করে দিয়েছে) তাকে সেনাদল থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়েছে। চিঠি পেয়ে নিকলাস ছুটি নেবার অথবা অবসর নেবার কোনো চেষ্টাই করল না, বাবা-মাকে লিখল, নাতাশার অসুখ ও বিয়েটা ভেঙে যাবার সংবাদে সে খুব দুঃখিত হয়েছে, এবং তাদের ইচ্ছামতো কাজ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। সোনিয়াকে আলাদা চিঠি লিখল।

লিখল : আত্মার আত্মীয় বন্ধু আমার! সম্মানের প্রশ্ন না থাকলে আমার বাড়ি ফিরে যাওয়া কেউ রুখতে পারত না। কিন্তু এখন অভিযান শুরুর মুখে আমি যদি পিতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যের চাইতে নিজের সুখটাকেই বড় করে দেখি তাহলে শুধু যে সহকর্মীদের চোখেই আমার সম্মানহানি ঘটবে তাই নয়, আমার নিজের কাছেও আমি ছোট হয়ে যাব। কিন্তু এটাই আমাদের শেষ বিরহ। বিশ্বাস কর, যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্রই, আমি যদি তখন বেঁচে থাকি এবং তোমার ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে, আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তোমার কাছেই উড়ে যাব, চিরদিনের মতো তোমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখব।

বস্তুত, অভিযান শুরু হওয়াতেই রস্তভ কথামতো বাড়ি ফিরতে এবং সোনিয়াকে বিয়ে করতে পারল না। হেমন্তকালে অত্রাদণুতে শিকার, শীতকালে বড়দিনের উৎসব ও সোনিয়ার ভালোবাসা-এই দুইয়ে মিলে পল্লীজীবনের সুখ-শান্তির যে উদার অবকাশ তার সামনে মেলে ধরেছিল তেমনটি সে আগে কখনো দেখেনি, আর তাই সে সুখ-শান্তির স্বপ্ন এখনো তার মনকে টানছে। চমৎকার একটি স্ত্রী, সন্তান, একদল শিকারি কুকুর, কৃষিকাজ, প্রতিবেশী, নির্বাচনে জয়লাভ… এইসব চিন্তাই তার থাকতে হবে। আর থাকতে যখন হবেই তখন নিজের স্বভাবমতোই নিকলাস রস্তভ এই রেজিমেন্ট-জীবনকেই মেনে নিল, এবং সেই জীবনের মধ্যেই সুখের সন্ধান করতে লাগল।

ছুটি থেকে ফিরে এলে সহকর্মীরা তাকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানাল, তাকে ঘোড়া বেছে আনতে পাঠানো হল, আর সেও ইউক্রেন থেকে ভালো ঘোড়া এনে সকলকে তাক লাগিয়ে দিল। এদিকে তার অনুপস্থিতির সময়েই তাকে ক্যাপ্টেনের পদে উন্নীত করা হয়েছিল, এখন যুদ্ধকালীন ব্যবস্থায় রেজিমেন্টের সৈন্যসংখ্যা বাড়াবার ফলে তাকে তার পুরনো স্কোয়াড্রনেই যুক্ত করে দেওয়া হল।

অভিযান শুরু হল। দ্বিগুণ বেতন নিয়ে রেজিমেন্ট পোল্যান্ডে ঢুকল, নতুন অফিসাররা এল, এল নতুন সৈন্য ও ঘোড়া, আর সকলেই যুদ্ধ শুরু হবার সময়কার আনন্দ ও উত্তেজনার ভিতর দিয়ে দিন কাটাতে লাগল।

রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সমর কৌশলগত নানাবিধ কারণে ভিলনা থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হল। পশ্চাদপসরণের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রধান ঘাঁটিতে নানা জটিলতা ও বিতর্ক দেখা দিল, কিন্তু পাভলোগ্রাদ হুজারদের দলে সবকিছুই শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে চলতে লাগল।

১৩ই জুলাই তারিখে পাভলোগ্রাদরা প্রথম একটা বড়রকমের যুদ্ধে অংশ নিল।

যুদ্ধের আগের দিন ১২ই জুলাই বজ্রবিদ্যুৎসহ প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হল। ১৮১২ সালের গ্রীষ্মকালটায় সাধারণভাবেই খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল।

দুটো পাভলোগ্রাদ স্কোয়াড্রন একটা যইয়ের খেতে সাময়িক আস্তানা পাতল। সবে তখন ফসল পাকতে শুরু করেছে, কিন্তু গবাদি পশু ও ঘোড়র পায়ের চাপে সব একেবারে ছত্রখান হয়ে গেল। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রস্তভ ও তার অধীনস্থ ইলিন নামক একটি তরুণ শিক্ষানবীশ অফিসার তাড়াহুড়া করে বানানো একটা চালাঘরে বসে আছে। তাদের রেজিমেন্টের একজন লম্বা গোঁফওয়ালা অফিসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘোড়া নিয়ে তাদের আশ্রয়ে এসে উঠল।

আমি সদর থেকে আসছি কাউন্ট। রায়েভস্কির যুদ্ধজয়ের কথা শুনেছেন কি?

অফিসারটি সালতানভ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে লাগল।

রস্তভ পাইপ টানতে টানতে ছাদ থেকে গড়ানো বৃষ্টির জল এড়াবার জন্য মাথাটা সরিয়ে অন্যমনস্কভাবে তার কথা শুনতে লাগল। ইলিন তার আরো কাছে ঘেঁষে বসল। অফিসারটির বয়স ষোল, সবে রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছে, সাত বছর আগে দেনিসভের সঙ্গে নিকলাসের যে সম্পর্ক ছিল, এখন তারও নিকলাসের সঙ্গে ঠিক সেই সম্পর্ক। সে সব ব্যাপারে রস্তভকে নকল করে, একটি মেয়ের মতো তাকে মনে মনে পূজা করে।

লম্বা গোঁফওয়ালা অফিসারটি সালতানভ বাঁধের যুদ্ধকে রাশিয়ার থার্মোপিলি বলে বর্ণনা করে অনেক বড় বড় কথা বানিয়ে বলতে লাগল। রস্তভ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে যে এর অনেক কথাই মিথ্যা। তাই এসব শুনতে তার মোটেই ভালো লাগছে না।

সেটা লক্ষ্য করে ইলিন বলে উঠল, না, আর টেকা যাচ্ছে না। আমার মোজা আর শার্ট…আর সমানে বৃষ্টি পড়ে সব ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে দেখি কোথাও একটু আশ্রয় পাওয়া যায় কি না। বৃষ্টিটা একটু কমেছে বলে মনে হচ্ছে।

ইলিন বেরিয়ে গেল। গোঁফওয়ালা অফিসারটিও ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

পাঁচ মিনিট পরে কাদার ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে ইলিন ফিরে এল।

হুররা! রস্তভ, তাড়াতাড়ি এস! পেয়ে গেছি! প্রায় দুশ গজ দূরে একটা সরাইখানা আছে, আমাদের লোজন সব সেখানে জমে গেছে। সেখানে গেলে অন্ততপক্ষে একটু গরম তো হতে পারব। তাছাড়া মারি হেন্দ্রিখভনা সেখানে আছে।

মারি হেন্দ্রিখভনা রেজিমেন্টের ডাক্তারের স্ত্রী, সুন্দরী জার্মান তরুণী, পোল্যান্ডে তাদের বিয়ে হয়েছে। কোনো ব্যবস্থা করতে না পারার জন্যই হোক, আর তরুণী বধূকে ছেড়ে থাকতে পারে নি বলেই হোক, ডাক্তারটি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই হুজার রেজিমেন্টের সঙ্গে আগাগোড়া চলাফেরা করছে, আর তার সন্দেহ ও ঈর্ষা নিয়ে তামাশা করাটা হুজার অফিসারদের মধ্যে প্রায় দৈনন্দিন ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেছে।

জোব্বাটা কাঁধের উপর ফেলে এবং লাভ্রুশকাকে জিনিসপত্র নিয়ে তাদের সঙ্গে আসতে বলে রস্তভ সেই পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথে ইলিনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অন্ধকারে দূরে মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।

রস্তভ, তুমি কোথায়?

এখানে! কী বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তারা পরস্পরকে হাঁক দিয়ে কথা বলতে লাগল।

.

অধ্যায়-১৩

সরাইয়ের সামনে ডাক্তারের ঢাকা-গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে আছে পাঁচজন অফিসার।

সামনের কোণে বসে আছে সুন্দরী জার্মান তরুণী মারি হেন্দ্রিখভনা। পরনে ড্রেসিং-জ্যাকেট, মাথায় নৈশ টুপি। তার স্বামী ডাক্তারটি তার পিছনে ঘুমিয়ে আছে। রস্তভ ও ইলিন ঘরে ঢুকতেই সকলে হৈ-হৈ করে পদের অভ্যর্থনা জানাল।

রস্তভ হেসে বলল, আরে, বেশ মজায়ই আছে দেখছি!

তুমিই বা ওখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

কী রকম মুটিয়েছে দেখ! আরে, ওদের গায়ে যে স্রোত বইছে! আমাদের বসার ঘরটাকে ভিজিয়ে দিও না।

অন্যরা চেঁচিয়ে বলল, মারি হেন্দ্রিখভনার পোশাকটা মাটি করে দিও না।

রস্তভ ও ইলিন একটা কোণ বেছে নিল, যাতে মারি হেখিভনার শালীনতায় আঘাত না দিয়েও তারা শুকনো পোশাক পরে নিতে পারে। মারি হেন্দ্রিখভনা নিজের পেটিকোটটা তাদের ধার দিল, সেটাকেই পর্দা হিসেবে ব্যবহার করে রস্তভ ও ইলিন লাভ্রুশকার সাহায্যে ভেজা পোশাক বদলে শুকনো পোশাক পরে নিল।

ইটের ভাঙা স্টোভটায় আগুন জ্বালানো হল। একখানা কাঠ পেতে তার উপর সামোভার ও আধ বোতল রাম রাখা হল। মারি হেন্দ্রিখভনাকে সভানেত্রীর আসনে বসিয়ে সকলে তার চারদিকে গোল হয়ে বসল। সুন্দর হাত দুখানি মুছবার জন্য একজন এগিয়ে দিল একটা রুমাল, যাতে তার পায়ে ঠাণ্ডা না লাগে সেজন্য একজন পায়ের নিচে একটা কুর্তা পেতে দিল, বৃষ্টির ছাঁট আটকাবার জন্য আর একজন তার কোটটা জানালায় ঝুলিয়ে দিল, পাছে তার স্বামীর ঘুম ভেঙে যায় সেজন্য অপর একজন তার মুখের উপর থেকে মাছি তাড়াতে লাগল।

খুশির হাসি হেসে মারি হেন্দ্রিখভনা বলল, ওকে একা থাকতে দাও। সারারাত ঘুম হয় নি, তাই এখন অঘোর ঘুমচ্ছে।

জনৈক অফিসার জবাব দিল, আরে না না, মারি হেন্দ্ৰিখভনা, ডাক্তারের দেখাশোনা তো করতেই হবে। যেদিন আমার পা বা হাত কেটে বাদ দিতে হবে সেদিন হয় তো তিনি একটু দয়াধর্ম করবেন।

গ্লাস আছে মাত্র তিনটে। জল এত ঘোলা যে চাটা কড়া হয়েছে কি পাতলা হয়েছে তা বোঝবার উপায় নেই। সামোভারেও জল ধরে মাত্র ছগ্লাস। প্রবীণতার বিচারে একের পর এক মারি হেন্দ্ৰিখভনার পরিষ্কার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পর পর চা খেতে তাদের যেন খুশির সীমা নেই। সেই সন্ধ্যায় প্রতিটি অফিসারেরই মনে হল সে বুঝি জার্মান মহিলাটির প্রেমে পড়েছে। যে কজন অফিসার বেড়ার ওধারে তাস খেলছিল এবার তারাও এখানে এসে মারি হেন্দ্ৰিখভনার তোয়াজ করতে শুরু করল। এতগুলি বিনীত ও দ্র যুবকের দ্বারা পরিবৃত হয়ে তার চোখ-মুখ খুশিতে ঝলমল করতে লাগল, যতবার তার স্বামী ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠছে ততবারই সে ভয় পাচ্ছে, পাছে তার ঘুম ভেঙে যায়।

চিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও চামচ মাত্র একটা, আর চিনিটা গলতেও অনেক সময় লাগছে, তাই সকলে স্থির করল, মারি হেন্দ্রিখভনাই পর পর সকলের চিনিটা নেড়ে দেবে। রস্তভ তার গ্লাসটা নিয়ে তাতে খানিকটা রাম ঢেলে মহিলাটিকে নেড়ে দিতে বলল।

কিন্তু আপনি চিনি ছাড়াই খান? মহিলাটি হাসতে হাসতে বলল, যেন সে নিজে যা বলছে এবং অন্য সকলে যা বলছে সবই মজার কথা, সবই দ্ব্যর্থবোধক।

আমি তো চিনি চাই না, শুধু চাই আপনার ছোট্ট হাতখানি দিয়ে আমার চাটা নেড়ে দিন।

 মারি হেন্দ্রিখভনা রাজি হয়ে চামচটা খুঁজতে লাগল ও এই ফাঁকে আর একজন সেটা নিয়ে নিয়েছে।

রস্তভ বলে উঠল, আপনার আঙুলটা ব্যবহার করুন মারি হেন্দ্রিখভনা, সেটা আরো ভালো হবে।

খুশিতে লাল হয়ে সে জবাব দিল, বড় বেশি গরম যে!

একবালতি জলে কয়েক ফোঁটা রাম ঢেলে সেটাকে মারি হেন্দ্রিখভনার দিকে এগিয়ে দিয়ে ইলিন বলল, এটাই আমার পেয়ালা, আপনার আঙুলটা এতে ডুবিয়ে দিন, আমি সবটাই খেয়ে নেব।

সামোভার খালি করে রস্তভ এক প্যাক তাস এনে মারি হেন্দ্ৰিখভনাকে নিয়ে রাজা-রাজা খেলার প্রস্তাব করল। তার প্রস্তাব মতোই আরো স্থির হল, যে রাজা হবে সেই মারি হেন্দ্রিখভনার হাতে একটা চুমো খাবার অধিকার লাভ করবে, আর যে বোকা হবে, ডাক্তার ঘুম থেকে উঠলে তার জন্য সামোভারটা গরম করার ভার তাকেই নিতে হবে।

কিন্তু ধর, মারি হেন্দ্রিখভনাই যদি রাজা হন? ইলিন বলল।

এমনিতেই তো তিনি রানী, তার কথাই আইন!

খেলা সবে শুরু হয়েছে এমন সময় ডাক্তারের এলোমেলো মাথাটা মারি হেন্দ্রিখভনার পিছন থেকে উঁকি দিল। কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে, এদের কথাবার্তা সে শুনেছে, কিন্তু তার মধ্যে মজাদার কিছু সে খুঁজে পায়নি। তার মুখটা বিষণ্ণ ও বিমর্ষ। অফিসারদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে তাদের পথটা ছেড়ে দিতে বলল। সে ঘর থেকে চলে যেতেই অফিসাররা সকলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, লজ্জায় লাল হতে মারি হেন্দ্রিখভনার চোখে জল এসে গেল, তাতে তাকে সকলের আরো ভালো লাগল। উঠোন থেকে ফিরে এসে ডাক্তার স্ত্রীকে বলল, বৃষ্টি থেমে গেছে, এখন তাদের ঢাকা-গাড়িতে গিয়েই ঘুমতে হবে, নইলে মালপত্র সব চুরি হয়ে যাবে।

রস্তভ বলল, আমি বরং একজন আর্দালি পাঠিয়ে দিচ্ছি ..দুইজন পাঠাচ্ছি! কি বলেন ডাক্তার!

 আমি নিজেই পাহারা দেব, ইলিন বলল।

না হে ভদ্রমশায়রা, আপনারা তো ভালোভাবে ঘুমিয়েছেন, আমি দুইরাত ঘুমতে পারিনি, এই কথা বলে ডাক্তার বিমর্ষ মুখে স্ত্রীর পাশে বসে খেলা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

তাকে স্ত্রীর দিকে কুটি করতে দেখে অফিসাররা আরো মজা পেয়ে গেল। কেউ কেউ নানা অজুহাত দেখিয়ে হাসতে লাগল। ডাক্তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা-গাড়িতে চলে গেলে অফিসাররা ভিজে জোব্বায় গা ঢেকে সরাইখানাতেই শুয়ে পড়ল, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউ ঘুমল না। কখনো ডাক্তারের অস্বস্তি ও তার স্ত্রীর খুশি-খুশি ভাব নিয়ে মন্তব্য-বিনিময় করল, আবার কখনো বা ফটকে ছুটে গিয়ে সেখানে ঢাকা-গাড়িতে কি হচ্ছে তার বিবরণ দিল। মাথাটা ঢেকে রস্তভ কয়েকবার ঘুমোতে চেষ্টা করল, কিন্তু কারো না কারো কথায় ঘুম ভেঙে যেতে সেও আলোচনায় যোগ দিল, আর অকারণ ফুর্তিতে ছোট শিশুর মতো হাসতে লাগল।

.

অধ্যায়-১৪

প্রায় তিনটে বাজে। এখনো কেউ ঘুমোয়নি। কোয়াটার-মাস্টার এসে হুকুম জানিয়ে গেল, স্কোয়াড্রনকে ছোট শহর অস্ত্রভনায় যেতে হবে।

হেসে হেসে কথা বলতে বলতেই অফিসাররা তৈরি হতে লাগল। সামোভারে আবার ঘোলা জল ফুটতে লাগল। রস্তভ চায়ের জন্য অপেক্ষা না করেই স্কোয়াড্রনে চলে গেল। দিনের আলো ফুটছে, বৃষ্টি থেমেছে, মেঘ কেটে যাচ্ছে। পোশাক তখনো ভিজে থাকায় স্যাঁৎসেঁতে, ঠাণ্ডা লাগছে। ভোরের আবছা আলোয় সরাইখানা থেকে যেতে যতে রস্তভ ও ইলিন ডাক্তারের গাড়ির বৃষ্টিভেজা চামড়ায় চকচকে ঢাকনাটার নিচ দিয়ে দেখতে পেল, ডাক্তারের পা দুটো এপ্রোনের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আছে, আর তার মাঝখানে স্ত্রীর টুপিটা দেখা যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে স্ত্রীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে।

বস্তভ পিছন ফিরে ইলিনকে বলল, সত্যি, মেয়েটি বড় ভালো।

ষোল বছরে ছেলের পক্ষে যতটা সম্ভব গম্ভীর গলায় ইলিন বলল, মনোরমা নারী।

আধ ঘণ্টা পরে গোটা স্কোয়াড্রন রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়াল। ঘোড়ায় চড়ার নির্দেশ শোনা যেতেই সকলে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে ঘোড়ায় চাপল। সকলের সামনে ঘোড়ায় চেপে রস্তভ হুকুম দিল আগে বাঢ়! সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রের ঝনঝন ও মৃদু গুঞ্জন এবং কাদার মধ্যে ঘোড়র ক্ষুরের ছপছপ শব্দ তুলে হুজাররা চারজন করে সারি বেঁধে চওড়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। দুই পাশে বাৰ্চগাছের সারি। সামনে চলেছে পদাতিক বাহিনী ও কামানের গাড়ি।

ছেঁড়া-ছেঁড়া নীল-লাল মেঘের দল পুবের আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে বাতাসের আগে ভেসে চলেছে। ক্রমেই বেশি করে আলো ফুটছে। গ্রাম্য পথের দুধারে রাতের বৃষ্টিতে ভেজা কোঁকড়া ঘাসগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টিতে বাচগাছের ডালগুলি নুয়ে পড়েছে, বাতাসের দোলা লেগে জলের ফোঁটাগুলি ঝরে পড়ছে। সৈন্যদের মুখগুলি ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। ইলিনকে পিছনে নিয়ে রস্তভ এগিয়ে চলেছে বার্চ-বীথির মাঝখান দিয়ে। সে ভাবছে ঘোড়াটার কথা, সকাল বেলাটার কথা, ডাক্তারের স্ত্রীর কথা, কিন্তু আসন্ন বিপদের কথা একবারও ভাবছে না।

আগে যুদ্ধে যাবার সময় রস্তভের ভয় করত, কিন্তু এখন তার মনে এতটুকু ভয় হয় না। গোলাগুলির সম্মুখীন হতে অভ্যস্ত হয়েছে বলে যে সে নির্ভয় হয়েছে তা নয়, তার নির্ভয় হবার কারণ বিপদে পড়ে নিজের চিন্তাকে কেমন করে সংযত রাখতে হয় সেটা সে শিখে ফেলেছে। ইলিনের চোখে-মুখে উত্তেজনা ফুটে উঠেছে, গভীর উত্তেজনায় সে অনবরত কথা বলছে, তার দিকে তাকিয়ে রস্তভের করুণা হল।

একখণ্ড পরিষ্কার আকাশে মেঘের আড়াল থেকে সূর্য দেখা দিতেই বাতাস পড়ে গেল, যেন ঝড়ের পরে গ্রীষ্মের সকাল বেলাকার সৌন্দর্যটাকে মাটি করবার সাহস তার হয় নি, বৃষ্টির ফোঁটাগুলি সোজাসুজি মাটিতে পড়ছে, চারদিক নিস্তব্ধ। দিগন্তে গোটা সূর্যটা একবার দেখা দিয়েই একটা লম্বা, সরু মেঘের ফালির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক মিনিট পরেই সেই মেঘের আঁচল ছিঁড়ে উজ্জ্বলতর দীপ্তিতে সূর্য আবার দেখা দিল। সবকিছুই উজ্জ্বল, জলমল করে উঠল। আর সেই আলোর সঙ্গে সঙ্গে, বুঝি বা তারই প্রত্যুত্তরে সামনে থেকে ভেসে এল বন্দুকের শব্দ।

বন্দুকের শব্দ কতটা দূর থেকে এসেছে সেটা ভাববার এবং স্থির করবার আগেই কাউন্ট অস্তারমান-তলস্তয়ের অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া ছুটিয়ে বিতেবস্ক থেকে এসে হুকুম জানিয়ে দিল, তাদের জোরকদমে এগিয়ে যেতে হবে।

অগ্রবর্তী পদাতিক বাহিনী ও কামানোর গাড়িতে দ্রুতগতিতে পার হয়ে স্কোয়াড্রনটি একটা পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে জনশূন্য পরিত্যক্ত গ্রাম পার হয়ে আবার চড়াই ভেঙে উঠতে লাগল। ঘোড়র গায়ে মুখে ফেনা জমে গেল, মানুষগুলোর মুখ লাল হয়ে উঠল।

থাম! পোশাক ঠিক করে নাও! সামনে শোনা গেল রেজিমেন্ট-কমান্ডারের হুকুম। বদিক ধরে এগিয়ে যাও। হাঁটো, আগে বাঢ়!

হুজাররা আমাদের উহলানদের পাশে থেমে গেল। ডানদিকে ঘন-সন্নিবেশে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পদাতিক বাহিনী : তারা সংরক্ষিত সেনাদল। পাহাড়ের আরো উপরে প্রায় দিগন্তরেখায় প্রাতঃসূর্যের তির্যক কিরণে ঝলসিত আমাদের কামানগুলো চোখে পড়ছে। সম্মুকে একটা খোলা প্রান্তরের ওপারে শত্রু-সেনা ও তাদের কামানও দেখা যাচ্ছে। আমাদের অগ্রবর্তী সৈন্যরা যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, প্রান্তরে অবস্থিত শত্রুদের সঙ্গে নিয়ে তাদের গুলিবিনিময় চলছে।

দীর্ঘদিন অনভ্যস্ত এই শব্দ শুনে খুশির গান শোনার মতো রস্তভের মনটা চনমন করে উঠল। ট্রাপ-টা-টা টাপ! গুলি-গোলা ছুটছে কখনো একযোগে, কখনো অতি দ্রুত একটার পর একটা। আবার সব চুপচাপ। আবার সেই শব্দ, কেউ যেন বিস্ফোরকের উপর পা ফেলে ফেলে সেগুলো ফাটিয়ে দিচ্ছে।

প্রায় এক ঘণ্টা হুজাররা এক জায়গায়ই রইল। কামানের অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ চলল। কাউন্ট অস্তারমান দলবল নিয়ে উপরে উঠে গেল, সেখানে থেমে রেজিমেন্ট-কমান্ডারকে কি যেন বলল, তারপর পাহাড় বেয়ে কামানে কাছে চলে গেল।

অস্তারমান চলে যাবার পরেই উহলানদের লক্ষ্য করে হুকুম ঘোষিত হল : সার বেঁধে দাঁড়াও! কামান দাগতে প্রস্তুত হও!

সামনের পদাতিক বাহিনী অশ্বারোহীদের পথ করে দেবার জন্য দুইদিকে সরে গেল। উহলানদের যাত্রা শুরু হল, তাদের উদ্যত বর্শা ঝিকমিকিয়ে উঠল, ঘোড়া ছুটিয়ে তারা নিচের বাঁ দিকে ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল।

উহলানরা পাহাড় বেয়ে নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে হুজারদের উপর হুকুম হল, পাহাড়ের উপরে উঠে কামানশ্রেণীকে সুরক্ষিত রাখ। তারা যার যার জায়গায় দাঁড়াতেই সম্মুখ থেকে শাশা করে ছুটে এল বুলেট, সেগুলো মাটিতে পড়ল, কিন্তু কিছুই করতে পারল না।

অনেকদিন পরে এইসব শব্দ শুনে রশুভের মন নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। একটা ভালো জায়গা নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে সে সামনে প্রসারিত যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকাল, সমস্ত অন্তর দিয়ে উহলানদের গতিবিধি দেখতে লাগল। তারা সবগে ফরাসি অশ্বারোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, চারদিকে ধোঁয়ায় ঢেকে গেল, পাঁচ মিনিট পরে উহলানরা ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরতে লাগল, যে স্থানটা তারা দখল করেছে সেদিকে নয়, আরো কিছুটা বাঁদিকে, আর বাদামি রঙের ঘোড়র উপর কমলা রঙের উহলানদের মধ্যে এবং তাদের পিছনে একটা বড় দলে ধূসর ঘোড়ার উপর নীল পোশাকের ফরাসি অশ্বারোহীদের দেখা গেল।

.

অধ্যায়-১৫

 খেলোয়াড়সুলভ চোখের দৌলতে আরো কয়েকজনের সঙ্গে রস্তভই প্রথম দেখতে পেল যে নীল পোশাক-পরা ফরাসি অশ্বারোহী সৈন্যরা আমাদের উহলানদের পিছু নিয়েছে। উহলানরা ক্রমেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ছে, আর ফরাসি অশ্বারোহীরা তাদের তাড়া করছে। পাহাড়ের পাদদেশে লোকগুলিকে কত ছোট ছোট দেখাচ্ছে, হাত তুলে বাতাসে তলোয়ার ঘুরিয়ে তারা পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করছে।

শিকারি যেভাবে শিকারকে দেখে রস্তভও সেইভাবে নিচের ঘটনাবলীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে, হুজাররা যদি এখন ঘুরে দাঁড়িয়ে ফরাসি অশ্বারোহীদের আঘাত করে তাহলে সে আঘাত তারা সইতে পারবে না, কিন্তু সে আঘাত এখনই, এই মুহূর্তে করতে হবে, অন্যথায় অনেক দেরি হয়ে যাবে। সে চারদিকে তাকাল। তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন ক্যাপ্টেনও সেই একইভাবে নিচের অশ্বারোহী বাহিনীর দিকে তাকিয়ে আছে।

রস্তভ বলল, আন্দ্রু সেবাস্তিয়ানিচ, আপনি তো বোঝেন, ওদের আমরা পিষে মারতে পারতাম… ।

ক্যাপ্টেন বলল, সে তো খুবই ভালো হত! আর সত্যি… ।

রস্তভ তার কথা শুনবার জন্য অপেক্ষা করল না, ঘোড়ার পিঠে চেপে তার স্কোয়াড্রনের সামনে ছুটে গেল, আর তার হুকুম ঘোষণা শেষ হবার আগেই গোটা স্কোয়াড্রন তারই মতো উদ্বুদ্ধ হয়ে তাকে অনুসরণ করল। কেন বা কেমন করে সে একাজ করছে তা রস্তভ নিজেও জানে না। শিকারের সময়ের মতোই কোনোকিছু না ভেবে, না বিচার করেই সে কাজটা করছে। সে দেখল, ফরাসি অশ্বারোহীরা অনেক কাছে এসে পড়েছে, তারা ছুটছে বিশৃঙ্খলভাবে, সে জানে, আক্রমণ করলে তারা তা সামলাতে পারবে না–সে আরো জানে, একটিমাত্র মুহূর্ত সময় তার হাতে আছে, আর সেটি হাতছাড়া হলে আর ফিরে আসবে না। চারদিকে শাঁ শাঁ করে গোলা গুলি ছুটছে, তার ঘোড়াটাও ছুটে যেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। ঘোড়ার পিঠে হাতটা রাখল, মুখে হুকুম জারি করল, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্কোয়াড্রনের ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পাহাড়ের নিচে ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনীকে লক্ষ্য করে। পাহাড়ের নিচে পৌঁছবার আগেই তাদের গতি ক্রমেই দ্রুততর হতে লাগল। ক্রমেই তারা উহলানদের ও তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারী ফরাসিদের আরো কাছে পৌঁছে গেল। ফরাসিরা একেবারে হাতের কাছে এসে গেল। আমাদের হুজারদের দেখেই যে সকলের আগে ছিল সে ঘুরে দাঁড়াল, আর পিছনের বাকিরা থেমে গেল। যে মনোভাব নিয়ে সে একটা নেকড়ের পথ আটকে দিতে ঘোড়া চুটিয়ে দেয় ঠিক সেইভাবে রস্তভ দোনেৎ-এর রাশ আলগা করে দিয়ে বিশৃঙ্খল ফরাসিদের পথটা আটকে দিল। প্রায় সব ফরাসি অশ্বারোহীই ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে জোর কদমে চুটতে লাগল। জনৈক ধূসর ঘোড়ার সওয়ারকে বেছে নিয়ে রস্তভ তার দিকে ছুটে গেল। পথে একটা ঝোঁপ পড়ল, তার সাহসী ঘোড়াটা একলাফে সেটা পেরিয়ে গেল, পুনরায় নিজের ঘোড়র উপর ভালোভাবে বসেই সে বুঝতে পারল যে এই মুহূর্তেই সে তার আকাক্ষিত শত্ৰুটিকে ধরে ফেলতে পারবে। ফরাসিটির ইউনিফর্ম দেখেই বোঝা যায় সে একজন অফিসার, ঘোড়ার পিঠে উপুড় হয়ে বসে সে তলোয়ার দিয়ে সেটাকে খোঁচা মেরে আরো জোরে ছুটিয়ে নিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে রভের ঘোড়া নিজের বুক দিয়ে ফরাসি অফিসারের ঘোড়ার পাছায় একটা ধাক্কা মেরে সেটাকে প্রায় উল্টে ফেলে দিল, আর ঠিক সেইমুহূর্তে কিছু না বুঝেই রস্তভ তার তলোয়ার তুলে ফরাসি অফিসারটিকে আঘাত করল।

কাজটা করার সঙ্গে সঙ্গেই রভের সব উদ্দীপনা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অফিসারটি পড়ে গেল-তার আঘাতের ফলে যতটা নয়-কারণ আঘাতে হাতের কনুইয়ের উপরে খানিকটা কেটে গেছে মাত্র-যতটা তার ঘোড়ার ধাক্কায় ও ভয়ে। রস্তভ ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল, তার চোখ দুটি তাকাল শত্রুর দিকে, যাকে পরাজিত করেছে তাকে একবার দেখতে। ফরাসি অফিসারটির একটা পা ঘোড়ার রেকাবে আটকে যাওয়ায় সে আর এক পায়ে মাটিতে লাফাচ্ছে। যেকোন মুহূর্তে তলোয়ারের আর একটা কোপ নেমে আসতে পারে এই ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে সে রশুভের দিকে তাকাল। বিবর্ণ কাদামাখা মুখখানি বড় সুন্দর, থুতনিতে একটা টোল, পড়েছে, চোখ দুটি হাল্কা নীল-এ মুখ যেন রণক্ষেত্রের কোনো শত্রুকে মানায় না, অত্যন্ত সাধারণ একখানি পারিবারিক মুখ। রস্তভ তাকে নিয়ে কি করবে স্থির করার আগেই অফিসারটি চিৎকার করে বলল, আমি আত্মসমর্পণ করছি! রেকাব থেকে পাটা ছাড়িয়ে নিতে অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, ভয়ার্ত নীল চোখ দুটোকেও রশুভের মুখের উপর থেকে সরিয়ে নিল না। কয়েকজন হুজার ঘোড়া ছুটিয়ে এসে তার পাটা ছাড়িয়ে দিল, তাকে ঘোড়ার পিঠে চাপতে সাহায্য করল। চারদিকেই হুজাররা ফরাসিদের নিয়ে ব্যস্ত, একজন আহত হয়েছে, মুখ বেয়ে রক্ত ঝরছে, তবু ঘোড়াটা ছাড়ছে না, আর একজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে একজন হুজারের পিছনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর একজনকেও ঘোড়ায় তুলে দেওয়া হচ্ছে। সম্মুখে ফরাসি পদাতিক সৈন্যরা পালাতে পালাতেও যুদ্ধ করে যাচ্ছে। হুজাররা বন্দীদের নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বাকিদের নিয়ে রস্তভ ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, একটা অপ্রীতিকর অনুভূতির কাঁটা বুকের মধ্যে যেন অনবরত ফুটছে। অফিসারটিকে আঘাত করা এবং বন্দী করার পর থেকেই এতটা অস্পষ্ট বিচলিত ভাব তাকে পেয়ে বসেছে, অথচ তার কোনো কারণ সে বুঝতে পারছে না।

হুজাররা ফিরে এলে কাউন্ট অস্তারমান-তলস্তয় তাদের সঙ্গে দেখা করল, রস্তভকে ডেকে আনল, তাকে ধন্যবাদ দিল, আরো বলল যে তার এই দুঃসাহসী কাজের কথা সে সম্রাটকে জানাবে এবং তার জন্য সেন্ট জর্জ ক্ৰশ-এর সুপারিশ করবে। এই আনন্দের সংবাদেও কিন্তু রস্তভের মন থেকে সেই অস্বস্তিকর ভাবটা গেল না। সেনাপতির কাছ থেকে ফিরবার পথে সে ভাবতে লাগল, কেন আমার এরকম অস্বস্তি বোধ হচ্ছেঃ ইলিন? না, সে তো নিরাপদেই আছে। আমি কি নিজের অসম্মান করেছি? না, তাও তো নয়।…হ্যাঁ, হ্যাঁ, থুতনিতে টোল-খাওয়া সেই ফরাসি অফিসারটি। এখন মনে পড়ছে, হাতটা তুলতে গিয়ে কেমন যেন থেমে গিয়েছিল।

রস্তভ তাকিয়ে দেখল, বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। থুতনিতে টোল-খাওয়া ফরাসিটিকে দেখবার জন্য সে তাদের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বিদেশী ইউনিফর্ম পরে একজন হুজারের মালবাহী ঘোড়ার পিঠে চেপে সে উদ্বেগের সঙ্গে চারদিকে তাকাচ্ছে। তার হাতে তলোয়ারের যে কোপ লেগেছিল তাকে ক্ষত বলা যায় না। নকল হাসি হেসে সে রস্তভের দিকে তাকাল, হাত তুলে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। রশুভের মনে তখনো সেই লজ্জাকর অনুভূতি।

সারাটা দিন এবং পরদিনও তার বন্ধু ও সহকর্মীরা লক্ষ্য করল যে রস্তভ কেমন যেন চুপচাপ, চিন্তিত ও অন্যমনস্ক হয়ে আছে। মদ খাচ্ছে অনিচ্ছায়, একলা থাকতে চেষ্টা করছে, আর মনের মধ্যে কি নিয়ে যেন নাড়াচাড়া করছে।

নিজের সেই বিশেষ সাফল্যের কথাই সে সবসময় ভাবে, তারই ফলে সে সেন্ট জর্জ ক্রশ লাভ করেছে, সাহসী হিসেবে তার সুখ্যাতি হয়েছে, এবং আরো কি যে হয়েছে তা সে মোটেই বুঝতে পারে না। সে ভাবে, তাহলে অন্যরা আমার চাইতেও ভীরু! তাহলে একেই বলে বীরত্ব! আর একাজ কি আমার দেশের জন্য করেছি। আর সেই গালে টোল-খাওয়া নীল চোখের লোকটিরই বা দোষ কি? সে কী ভয়ই না পেয়েছিল! ভেবেছিল আমি তাকে মেরে ফেলব। কেন তাকে মারব? আমার হাত কাঁপল। অথচ তারা আমাকে দিল সেন্ট জর্জের ক্রশ। এসব আমি বুঝতে পারি না।

নিকলাস যখন এইসব কথা ভাবছে, আর সমস্যার কোনো মীমাংসা খুঁজে পাচ্ছে না, ওদিকে তখন চাকরি ক্ষেত্রে ভাগ্যের চাকা তার পক্ষেই ঘুরে গেল। অস্ত্রভনার ঘটনার পরে তার উপর সকলের নজর পড়ল, সে একটা হুজার ব্যাটেলিয়নের সেনাপতির পদ পেল, আর সাহসী অফিসারের প্রয়োজন হলেই তাকে মনোনীত করা হতে লাগল।

.

অধ্যায়-১৬

কাউন্টেস এখনো সম্পূর্ণ সেরে ওঠেনি, এখনো বেশ দুর্বল, তবু নাতাশার অসুখের সংবাদ পেয়ে পেতয়া এবং বাকি লোকদের সঙ্গে নিয়ে কাউন্টেস মস্কোতে চলে এল, ফলে গোটা পরিবার মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের বাড়িতে উঠে গেল এবং শহরেই সংসার পেতে বসল।

নাতাশার অসুখটা এতই গুরুতর হয়েছিল যে তার আচরণ, বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে দেওয়া প্রভৃতি অসুস্থতার কারণগুলি চাপা পড়ে গিয়েছে, আর নাতাশা ও তার বাবা-মার পক্ষে সেটা ভালোই হয়েছে। সে তখন এতই অসুস্থ যে এ ব্যাপারে তার দোষ কতটা সে বিচার করাটাই তখন অসম্ভব হয়ে পড়ল। সে কিছু খেতে পারে না, ঘুমতে পারে না, ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে, কাশছে, আর ডাক্তারের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে খুবই বিপদের কথা। এ অবস্থায় তাকে সাহায্য করা ছাড়া আর কোনো কথা কারো মনেই এল না। ডাক্তাররা তাকে দেখতে আসে, কখনো একা, কখনো দল বেঁধে, ফরাসি, জার্মান ও লাতিন ভাষায় অনেক কথা বলে, একে অন্যকে দোষ দেয়, তারা যতরকম রোগের কথা জানে সেসবেরই ওষুধ বাতলে দেয়, কিন্তু এই সহজ কথাটা কখনো তাদের মনে আসে না যে নাতাশা যে রোগে কষ্ট পাচ্ছে তার খবর তারা জানে না, কারণ একজন সুস্থ মানুষ যে রোগে ভোগে তার খবর জানা যায় না, সে রোগ চিকিৎসাশাস্ত্রের অজানা, সে রোগ ফুসফুসের নয়, যকৃতের নয়, ত্বকের নয়, হৃৎপিণ্ডের নয়, স্নায়ুর নয়, চিকিৎসাশাস্ত্রে উল্লেখিত কোনো রোগই নয়, সে রোগ এইসব দেহযন্ত্রের বিকারের অসংখ্য সম্ভাবিত যোগ-বিয়োগের অন্যতম একটি ফলমাত্র। এই সরল কথাটা ডাক্তারদের মাথায় ঢোকে না, কারণ তাদের জীবনের কাজই হচ্ছে রোগ নিরাময় করা, সেজন্য তারা টাকা নেয়, আর সেই কাজেই তারা জীবনের শ্রেষ্ঠ বৎসরগুলি অতিবাহিত করেছে।….

ডাক্তার রোজ আসে, নাড়ি দেখে, জিভ দেখে, তার দুঃখ-জর্জর মুখ দেখেও তার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করে। কিন্তু সে যখনই অন্য ঘরে চলে যায় এবং কাউন্টেস তাড়াতাড়ি তাকে অনুসরণ করে তখনই হঠাৎ তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলে, যদিও বিপদ আছে তবু সে আশা করছে যে এই শেষ ওষুধটাতে কাজ হবে, তবে অপেক্ষা তো করতেই হবে, রোগটা তো প্রধানত মানসিক, কিন্তু…আর কাউন্টেসও তার হাতে একটা স্বর্ণমুদ্রা গুঁজে দিয়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত মনে রোগীর কাছে ফিরে যায়।

নাতাশার রোগের লক্ষণ হল-সে খায় কম, ঘুমোয় কম, কাশে, আর সবসময় মন মরা হয়ে থাকে। ডাক্তাররা বলল, চিকিৎসা চালিয়েই যেতে হবে, কাজেই তাকে শহরের দম-বন্ধ করা আবহাওয়ার মধ্যেই রেখে দেওয়া হল, ১৮১২-র গ্রীষ্মকালে রস্তভ-পরিবার গ্রামে ফিরে গেল না।

নাতাশাকে অনেক বড়ি খেতে হল, ছোট ঘোট বোতল ও বাক্স থেকে অনেক ফোঁটা, অনেক গুড়ো ব্যবহার করতে হল, মাদাম শশাস সেগুলো সংগ্রহ করে রাখল, আর যে পল্লী-জীবন নাতাশার এত প্রিয় তার থেকে তাকে বঞ্চিত করে রাখা হল। তবু যৌবনেরই জয় হল। দৈনন্দিন জীবনের প্রভাবে নাতাশার দুঃখ চাপা পড়তে লাগল, মনের উপর দুঃখের চাপ কমে গেল, ক্রমে সবকিছুই অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল, নাতাশার শরীরও সারতে শুরু করল।

.

 অধ্যায়-১৭

নাতাশা আগের চাইতে শান্ত হয়েছে, কিন্তু সুখী হয় নি। বল-নাচ, প্রমোদ-ভ্রমণ, কনসার্ট, থিয়েটার প্রভৃতি বাহ্যিক আমোদ-প্রমোদ তো ত্যাগ করেছেই, এমন কি যখন হাসে তখন সে হাসিতেও যেন চোখের জলের ছোঁয়া লাগে। গাইতেও পারে না। যখনই হাসতে বা গাইতে চেষ্টা করে তখনই কান্নায় গলা আটকে যায় : বিষাদের কান্না, স্মৃতির কান্না, সুন্দর জীবনকে অকারণে নষ্ট করায় বিরক্তির কান্না। এই দুঃখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসি ও গানকে অন্যায় বলে মনে হয়। সে মুখে বলে, অন্তরেও অনুভব করে, কোনো মানুষই তার কাছে আজ ভাড় নাতাসিয়া আইভানভনার চাইতে বেশি কিছু নয়। কোনো প্রহরী যেন ভিতর থেকে সবরকম আনন্দ থেকে তাকে নিবৃত্ত রাখে।

সে যে পৃথিবীর আর কারো চাইতে ভালো তো নয়ই, বরং অনেক, অনেক বেশি খারাপ–এই চিন্তা থেকেই সে সান্ত্বনা পায়। কিন্তু সেটাই তো যথেষ্ট নয়। সে নিজেকেই প্রশ্ন করে, তারপরে কি? কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো আশাই তো নেই। জীবনে কোনো আনন্দ নেই, অথচ জীবন বয়েই চলেছে। বাড়ির সকলের কাছ থেকে সে দূরে সরে থাকে, শুধু ভাই পেতয়ার কাছেই কিছুটা স্বস্তি পায়। অন্য সকলের চাইতে তার কাছে থাকতেই ভালোবাসে, তার কাছে একা থাকলে কখনো কখনো হাসে। বাড়ি থেকে কদাচিৎ বের হয়, যারা বাড়িতে আসে তাদের মধ্যেও একমাত্র পিয়েরকে দেখেই তার সুখ। কাউন্ট বেজুখভের চাইতে বেশি যত্ন-আত্তি আর কেউ করতে পারে না, আর সেটা বোঝে বলেই তার সঙ্গেই নাতাশা বেশি সুখ পায়। এর কারণ এই নয় যে পিয়ের বিবাহিত, আসল কারণ-কুরাগিনের বেলায় যে নৈতিক ব্যবধানের অভাব ছিল এক্ষেত্রে নাতাশা সেই ব্যবধানটাই খুব বেশি করে বোধ করে, একথা কখনো তার মনে হয় না যে তাদের দুজনের সম্পর্কটা কখনো তার দিক থেকে ভালোবাসার পথ ধরতে পারে, অথবা মমতাময়, আত্ম-সচেতন, রোমান্টিক বন্ধুত্বের সেই পথ ধরতে পারে নর-নারীর যে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা তার জীবনে কয়েকবারই হয়েছে। পিয়েরের দিক থেকে সে সম্ভাবনা তো আরো কম।

সেন্ট পিতরের উপবাসের শেষের দিকে আগ্রাফেনা আইভানভনা বেলোভা নামের জনৈকা গ্রামের প্রতিবেশিনী মস্কো এল মস্কোর সন্তদের উদ্দেশে ভক্তি নিবেদন করতে। সেই পরামর্শ দিল, পবিত্র উৎসব উপলক্ষে প্রস্তুতি নেওয়া ও উপবাস করা নাতাশার পক্ষে ভালো হবে। নাতাশা সানন্দে সে পরামর্শ গ্রহণ করল। ডাক্তার তাকে ভোরে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছে, তবু নাতাশা উপবাস ও প্রস্তুতির জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করল। রস্তভ-পরিবারে নিজেদের বাড়িতেই তিনবার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হয়, নাতাশা কিন্তু তার পরিবর্তে আগ্রাফেনা আইভানভনার মতো এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গির্জায় যেতে লাগল এবং কোনো অনুষ্ঠানই বাদ দিল না।

নাতাশার এই উৎসাহ দেখে কাউন্টেসও খুশি হল, ডাক্তারি চিকিৎসায় ভালো ফল না হওয়ায় কাউন্টেস। মনে মনে এই আশাই পোষণ করত যে চিকিৎসার চাইতে প্রার্থনাতেই তার মেয়ের বেশি উপকার হবে। তাই ডাক্তারকে না জানিয়ে সে নাতাশার ইচ্ছার সঙ্গে একমত হয়ে তাকে বেলোভার হাতে ছেড়ে দিল। আগ্রাফেনা আইভানভনা সকাল তিনটের সময় নাতাশাকে ঘুম থেকে জাগাতে আসে, কিন্তু সাধারণত তাকে জেগে থাকতেই দেখে। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে সবচাইতে বাজে পোশাকটা পরে ভোরের খোলা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে নাতাশা ঊষার পরিষ্কার আলোয় আলোকিত নির্জন পথে নেমে যায়। আগ্রাফেনা আইভানভনার পরামর্শ মতোই তারা নিজেদের পল্লীর গির্জায় না গিয়ে কিছুটা দূরের আর একটা গির্জায় যায়, কারণ আগ্রাফেনা আইভানভনার মতে সেই গির্জার পুরোহিতটি খুব কড়া ও আদর্শবাদী মানুষ। সেখানে যেসব প্রার্থনায় তারা যোগ দেয় সেগুলি প্রায় সবই অনুশোচনামূলক। খুব ভোরে বাড়ি ফিরবার পথে তাদের সঙ্গে দেখা হয় শুধু রাজমিস্ত্রি আর ঝাড় দারদের সঙ্গে দুপাশের বাড়িতে তখন সকলেই ঘুমে অচেতন। সেই পরিবেশে নাতাশার মনের মধ্যে একটা নতুন অনুভূতি জেগে ওঠে, জেগে ওঠে নিজের দোষ সংশোধনের সম্ভাবনার চিন্তা, একটি নতুন, পরিচ্ছন্ন, সুখের জীবনের সম্ভাবনার আশা।

একটি সপ্তাহ সে এইভাবে কাটাল, আর প্রতিটি দিনই এই একই অনুভূতি জাগল তার মনে। খৃস্টের নৈশ ভোজনপর্বে অংশ নেওয়ায় তার মনে এত বেশি আনন্দের ঢেউ খেলে গেল যে নাতাশার মনে হল সে বুঝি পবিত্র রবিবার পর্যন্ত বাঁচবে না।

কিন্তু সেই সুখের দিনটি এল। সেই স্মরণীয় রবিবারে নৈশ ভোজনপর্বে যোগদান করে সে যখন শাদা মসলিনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে বাড়ি ফিরল তখন বিগত কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম সে তার মনের শান্তি ফিরে পেল, ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তার কোনো ভার সেখানে রইল না।

সেদিন তাকে দেখতে এসে ডাক্তার বলল, পক্ষকাল আগে যে ডোটা খাবার ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছিল সেটা আরো কিছুদিন চালিয়ে যেতে হবে।

নিজের সাফল্যে পরিতুষ্ট হয়ে বলল, সকাল-সন্ধ্যা অতি অবশ্য এটা চালিয়ে যেতে হবে। দয়া করে এদিকে বিশেষ নজর রাখবেন।

স্বর্ণমুদ্রাটা হাত পেতে নিয়ে খুশির মেজাজে বলল, মনকে শান্ত করুন। মেয়ে অচিরেই গাইতে ও লাফাতে শুরু করবে। শেষের ওষুধটা খুব ভালো কাজ করছে। মেয়ে তো অনেক তাজা হয়ে উঠেছে।

কাউন্টেসের মুখে হাসি দেখা দিল, নিজের নখের দিকে তাকিয়ে সৌভাগ্যের আশায় একটু থুথু ফেলে (রুশ প্রথা) সে বৈঠকখানায় চলে গেল।

.

অধ্যায়-১৮

জুলাইয়ের শুরুতেই যুদ্ধের নানারকম অস্বস্তিকর খবর মস্কোতে ছড়াতে লাগল, সকলেই বলাবলি করতে লাগল, সম্রাট জনসাধারণের কাছে আবেদন রেখেছে এবং নিজে সেনাদল ছেড়ে মস্কোতে আসছে। কিন্তু ১১ জুলাই পর্যন্ত কোনো ইস্তাহার বা আবেদন না পাওয়ায় সে সম্পর্কে এবং রাশিয়ার অবস্থা সম্পর্কে অতিশয়োক্তি ভরা নানা সংবাদ প্রচারিত হতে লাগল। সকলে বলতে লাগল, সেনাদলের বিপদ বুঝেই সম্রাট তাদের ছেড়ে আসছে, লোলেন আত্মসমর্পণ করেছে, নেপোলিয়নের সৈন্য-সংখ্যা দশ লক্ষে পৌঁছেছে এবং একমাত্র অঘটন ছাড়া রাশিয়ার বাঁচার কোনো আশা নেই।

১১ জুলাই, শনিবার। ইস্তাহার পাওয়া গেল, কিন্তু তাও ছাপানো নয়। পিয়ের তখন রস্তভদের বাড়িতেই ছিল, সে কথা দিল পরদিন রবিবারে সে ডিনারে আসবে এবং কাউন্ট রস্তপচিনের কাছ থেকে ইস্তাহার ও আবেদনের কপি নিয়ে আসবে।

সেই রবিবারে রস্তভরা যথারীতি রাজুমভস্কিদের ভজনালয়ে গেল। জুলাই মাসের গরম দিন। এমন কি বেলা দশটার সময় রস্তভরা যখন গাড়ি থেকে ভজনালয়ের সামনে নামল তখন বাইরের গরম হাওয়া, ফেরিওয়ালাদের চিৎকার, জনসাধারণের গ্রীষ্মকালীন হাল্কা পোশাক, রাজপথে শুকনো পাতার ছড়াছড়ি, ব্যান্ডের তালে তালে শাদা ট্রাউজার পরিহিত সৈন্যদের প্যারেড, পাথুরে রাস্তায় চাকার ঘর্ঘর শব্দ, আর উজ্জ্বল, উত্তপ্ত রোদ-সবকিছুর মধ্যেই সেই গ্রীষ্মকালীন অবসন্নতা, বর্তমানকে নিয়ে সেই সন্তোষ ও অসন্তোষ, যা যে কোনো উজ্জ্বল, উত্তপ্ত দিনে শহরবাসীরা বড় বেশি করে অনুভব করে।…তকমা-পরা পরিচারক ভিড় হটিয়ে পথ করে দিচ্ছে, সেই পথ দিয়ে মার পাশে হাঁটতে হাঁটতে নাতাশার কানে এল একটি যুবক বেশ জোরেই ফিসফিস করে তার কথা বলছে।

ঐ হলেন রস্তভা, যিনি… ।

 অনেক শুকিয়ে গেছেন, কিন্তু তাহলেও কত সুন্দরী!

সে শুনল, অথবা শুনল বলে তার মনে হল, কুরাগিন ও বলকনস্কির নামও উল্লেক করা হল। সে তো সবসময় তাদের কথাই ভাবে। তার মনে হল, তাকে দেখলেই লোকে তাকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে সেই কথাই বলে। একথা মনে হতেই তার মন খারাপ হয়ে গেল। রবিবারের কথা স্মরণ করে সে ভাবতে লাগল : আবার সেই রবিবার এসেছে–একটা সপ্তাহ কেটে গেছে, অথচ সেই একই জীবনে-যেটা কোনো জীবনই নয়, সেই একই পরিবেশ–যেখানে বেঁচে থাকা কত সহজই না ছিল। আমি সুন্দরী, আমি তরুণী, আমি জানি এখন আমি ভালো হয়ে গেছি। খারাপ ছিলাম, কিন্তু আমি তো জানি এখন আমি ভালো হয়েছি, অথচ আমার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি চলে যাচ্ছে, কারো কোনো কাজে লাগছে না। মার পাশে দাঁড়িয়ে সে পরিচিত জনকে দেখলেই মাথা নাড়ছে।

একটি সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে, তার মৃদু গাম্ভীর্য সমবেত ভক্তগণের মনে শান্তির স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। পর্দার ওপাশ থেকে একটি রহস্যময় মৃদু কণ্ঠস্বর কী যেন উচ্চারণ করে চলেছে। অকারণেই উদ্বেলিত অশ্রুধারায় নাতাশার বুকটা ফুলে-ফুলে উঠছে, একটা আনন্দময় অথচ চাপা অনুভূতি তাকে চঞ্চল করে তুলেছে।

সে বলতে লাগল, আমাকে শিখিয়ে দাও আমি কী করব, কেমন করে বাঁচব, কেমন করে চিরকালের মতো ভালো হয়ে উঠতে পারব!

বেদির পর্দার সম্মুখস্থ উঁচু জায়গাটায় এসে দাঁড়াল ডিয়েকন। বুড়ো আঙুলটা বাড়িয়ে বুকের উপর ক্রুশ চিহ্ন এঁকে গম্ভীর উদাত্তকণ্ঠে সে প্রার্থনার বাণী উচ্চারণ করতে লাগল…

আসুন আমরা শান্তিতে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি।

এক সম্প্রদায়রূপে, শ্ৰেণীনির্বিশেষে, কারো প্রতি শত্রুতা পোষণ না করে, ভ্রাতৃপ্রেমে সকলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে–আসুন আমরা প্রার্থনা করি! নাতাশা ভাবল।

ঊর্ধ্বলোক হতে আসে যে শান্তি তার জন্য আর আমাদের আত্মার উদ্ধারের জন্য। দেবদূতদের জগতের জন্য, আর যে ঊর্ধ্বলোকে সব আত্মারা থাকে তার জন্য, নাতাশা প্রার্থনা জানাল।

যখন সকলে যোদ্ধাদের জন্য প্রার্থনা করল তখন নাতাশার মনে পড়ল তার ভাই ও দেনিসভের কথা। স্থলপথে ও জলপথে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের জন্য যখন প্রার্থনা করা হল তখন তার মনে পড়ল প্রিন্স আন্দ্রুকে, সে তার জন্য প্রার্থনা করল, ঈশ্বরকে মিনতি জানাল, প্রিন্স আন্দ্রুর প্রতি যত অন্যায় সে করেছে ঈশ্বর যেন তা ক্ষমা করেন। যারা আমাদের ভালোবাসে তাদের জন্য যখন প্রার্থনা করা হল তখন সে প্রার্থনা করল নিজের পরিবারের লোকজনদের জন্য, বাবা, মা ও সোনিয়ার জন্য, এই প্রথম সে যেন বুঝতে পারল তাদের প্রতি কত অন্যায় সে করেছে। যারা আমাদের ঘৃণা করে তাদের জন্য যখন প্রার্থনা করা হল, তখন নিজের শত্রুদের জন্য প্রার্থনা করতে সে তাদের খুঁজতে লাগল। অন্য অনেকের সঙ্গে তার মনে পড়ল আনাতোলকে। তার জন্যও সে প্রার্থনা করল।

প্রার্থনা-অনুষ্ঠান শেষ করে ডিয়েকন চাদরটা বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রেখে বলল, আসুন, আমাদের সমগ্র জীবনকে প্রভু খৃস্টের কাছে উৎসর্গ করি!

নাতাশা নিজের মনেই আবৃত্তি করতে লাগল, ঈশ্বরের কাছে নিজেদের উত্সর্গ করি। ঈশ্বর, তোমার ইচ্ছার কাছেই নিজেকে নিবেদন করলাম। আমি কিছুই চাই না, আমার কোনো বাসনা নেই, শুধু আমাকে শিখিয়ে দাও-আমি কি করব, কেমন করে আমার বাসনাকে ব্যবহার করব। তুমি আমাকে গ্রহণ কর, গ্রহণ কর!

কাউন্টেস বারকয়েক মেয়ের নরম মুখ ও উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাল তার সাহায্যের জন্য।

অপ্রত্যাশিতভাবে প্রার্থনা-অনুষ্ঠানের ঠিক মাঝখানে ডিয়েকন একটা ছোট টুল নিয়ে এল এবং পর্দার সামনে সেটাকে বসিয়ে দিল। লাল ভেলভেটের পাগড়ি মাথায় দিয়ে পুরোহিত বেরিয়ে এল, মাথার চুল ঠিক করে নিয়ে টুলের সামনে অনেক চেষ্টা করে নতজানু হয়ে বসল। তার অনুকরণ করে প্রত্যেকেই বিস্ময়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। তারপরই শুরু হল সাইনড থেকে সদ্যপ্রাপ্ত প্রার্থনা-অনুষ্ঠান-শত্রুর আক্রমণ থেকে রাশিয়াকে উদ্ধার করার প্রার্থনা।

পুরোহিত প্রার্থনা শুরু করল : হে শক্তিমান ঈশ্বর, আমাদের উদ্ধারকর্তা ঈশ্বর! আজকের দিনে তোমার ক্ষীণ জনগণের দিকে করুণা ও আশীর্বাদের দৃষ্টিতে তাকাও, দয়া করে আমাদের প্রার্থনা শোন, আমাদের রক্ষা কর, আমাদের করুণা কর! সমগ্র পৃথিবীকে ধ্বংস করার বাসনা নিয়ে এই শত্রুরা তোমারই দেশে এসে আমাদের আক্রমণ করেছে, এই আইনবিরোধী লোকগুলি সম্মিলিত হয়েছে তোমার রাজ্যের পতন ঘটাতে, তোমার প্রিয় জেরুজালেমকে, তোমার প্রিয় রাশিয়াকে ধ্বংস করতে, তোমার মন্দিরকে অপবিত্র করতে, তোমার পূজা-বেদিকে উচ্ছেদ করতে, আমাদের পবিত্র তীর্থগুলিকে কলুষিত করতে। হে প্রভু, কতকাল, আর কতকাল দুষ্ট বিজয়ী হবে? কতকাল তাদের হাতে থাকবে বে-আইনী ক্ষমতা?

প্রভু ঈশ্বর! তোমার কাছে আমাদের এই প্রার্থনা তুমি শোন, তোমার শক্তি দিয়ে আমাদের পরম দয়ালু অধিপতি প্রভু সম্রাট আলেক্সান্দার পাভলভিচকে তুমি শক্তিশালী করে তোেল, তার ন্যায়নিষ্ঠা ও স্র স্বভাবের কথা স্মরণ রেখে তাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত কর, যাতে আমরা ও তোমার প্রিয় ইজরায়েল রক্ষা পায়। সম্রাটের উপদেশ, তার প্রচেষ্টা, তার কার্যাবলীকে তুমি আশীর্বাদ কর, তোমার সর্বশক্তিমান হাত বাড়িয়ে তার রাজ্যকে শক্তিশালী কর, আর ঠিক যেভাবে তুমি আমালেকের উপর মোজেসকে, মিদিয়ানের উপর গিদিয়নকে এবং গোলিয়াথের উপর ডেভিডকে বিজয়ী করেছিলে তেমনি করেই শত্রুর উপরে তাকে বিজয়ী করে দাও। তার বাহিনীকে রক্ষা কর, তোমার নাম নিয়ে যারা অস্ত্রসজ্জায় সেজেছে তাদের হাতে তুলে দাও পিতলের ধনুক, যুদ্ধের উপযোগী শক্তি দিয়ে তাদের কটিদেশকে বস্ত্রাবৃত কর। বর্শা ও বর্ম নিয়ে আমাদের সাহায্যে উঠে দাঁড়াও। আমাদের বিরুদ্ধে যারা পাপের হাত তুলেছে তাদের তুমি ব্যর্থ করে দাও, লজ্জার মধ্যে নিক্ষেপ কর, তোমার বিশ্বস্ত যোদ্ধাদের সামনে তারা যেন ঝড়ের মুখে ধুলোর মতো উড়ে যায়, তোমার শক্তিমান দেবদূত যেন তাদের বিহ্বল করে দিয়ে পালাতে বাধ্য করে, নিজেদের অজ্ঞাতেই তারা যেন পাশবদ্ধ হয়, গোপনে যে ষড়যন্ত্র তারা করেছে তা যেন তাদেরই প্রত্যাঘাত করে, তারা যেন তোমার সেবকের পায়ে এসে পড়ে আর আমাদের সৈন্যদের হাতে পর্যদস্ত হয়। প্রভু, তুমি তো ছোট-বড় সকলেরই রক্ষাকর্তা, তুমি তো ঈশ্বর, মানুষ কখনো তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না!

হে আমাদের পিতৃপুরুষের ঈশ্বর! পুরাকাল থেকে তোমার যে প্রভূত করুণা ও সপ্রেম দয়া আমরা পেয়ে এসেছি সেকথা স্মরণে রেখ, আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না, আমাদের অযোগ্যতাকে তুমি ক্ষমা কর, তোমার মহান সততায় ও অসীম করুণায় আমাদের সব ত্রুটি ও বিচ্যুতি ভুলে যেও! আমাদের হৃদয়কে পবিত্র কর, আমাদের অন্তরে সধর্মকে প্রতিষ্ঠা কর, তোমার প্রতি বিশ্বাসে আমাদের শক্তিমান কর, আমাদের আশাকে কর সুরক্ষিত, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাকে কর জাগ্রত, যে উত্তরাধিকার তুমি আমাদের ও আমাদের পিতৃপুরুষকে দিয়েছ তাকে রক্ষা করতে একপ্রাণ করে আমাদের গড়ে তোল, যাদের তুমি পবিত্র করেছ তাদের ভাগ্যের বিরুদ্ধে দুষ্টশক্তির রাজদণ্ডকে বিজয়ী হতে দিও না।

নিজের মতো করে নাতাশাও সে প্রার্থনায় যোগ দিল। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাল, সকলকে ক্ষমা কর, শান্তি দাও, সুখ দাও, তার মন বলল, ঈশ্বর সে প্রার্থনা শুনেছে।

.

অধ্যায়-১৯

নাতাশার সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিকে বুকের মধ্যে নিয়ে রস্তভদের বাড়ি থেকে চলে আসার পরে পিয়ের যেদিন আকাশের একটি স্থির ধূমকেতুর দিকে তাকিয়ে অনুভব করেছিল যে তার নিজের দিগন্তে নতুন কোনো কিছুর আবির্ভাব ঘটতে চলেছে-সেদিন থেকেই পার্থিব সবকিছুর অহংকার ও তুচ্ছতার যে সমস্যা তাকে প্রনিয়ত পীড়িত করছিল তার অবসান ঘটেছে। প্রতিটি কাজের মধ্যে কেন? কোথা হতে? রূপী যে ভয়ংকার প্রশ্ন সবসময় তার সামনে হাজির হত, এবার তার জায়গায় দেখা দিল অন্য আর একটি প্রশ্ন যা সেই প্রশ্নের জবাব নয়, দেখা দিল নাতাশার ছবি। যখনই কোনো তুচ্ছ আলোচনা তার কানে আসে, অথবা সে স্বয়ং তাতে অংশ নেয়, যখনই মানুষের নীচতা বা মূর্খতার কথা পড়ে বা শুনতে পায় তখন আর সে আগের মতো আতংকে শিউরে ওঠে না, নিজেকে প্রশ্ন করে না যে সবকিছুই যখন ক্ষণস্থায়ী ও দুর্বোধ্য তখন তা নিয়ে মানুষ এত লড়াই করে কেন–এখন তার মনে পড়ে যায় নাতাশার শেষবারের মতো দেখা ছবিটি, আর সব সন্দেহ দূরে মিলিয়ে যায়-যে প্রশ্ন তাকে তাড়া করত তার জবাব যে সে পেয়ে গেছে তা নয়, আসলে নাতাশার যে মূর্তি তার মনে গড়ে উঠেছে তাই তাকে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ে যায় আর একটি উজ্জ্বলতর আধ্যাত্মিক কর্মের জগতে যেখানে ভালো-মন্দর বিচার নেই-যে সৌন্দর্য ও প্রেমের জগতে বেঁচে থাকাটাই আসল কথা। যে কোনো জাগতিক নীচতার সম্মুখীন হলেই সে নিজেকে বলে, ধরা যাক, এন. এন. দেশকে ও জারকে ঠকিয়েছে, আর দেশ ও জার তাকেই সম্মানে ভূষিত করেছে, কিন্তু তাতে কি হয়েছে। গতকাল সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে, আমাকে আবার যেতে বলেছে, আর আমি তাকে ভালোবাসি এবং সেকথা কেউ কোনোদিন জানবে না। সঙ্গে সঙ্গে তার মন শান্ত হয়ে যায়।

পিয়ের এখনো সমাজে আসা-যাওয়া করে, আগের মতোই মদ খায়, সেই একই অলস, ইন্দ্রিয়াসক্ত জীবন যাপন করে, কারণ রস্তভদের বাড়িতে যতটা সময় সে কাটায় তারপরেও অনেক সময় তার হাতে থাকে, আর মস্কোতে থেকে যেসব অভ্যাস ও পরিচয় সে গড়ে তুলেছে তাদের স্রোত দুর্বার বেগে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যতই বেশি করে খারাপ সংবাদ আসতে লাগল, আর নাতাশার স্বাস্থ্য যতই ভালো হতে থাকল, ততই তার প্রতি সযত্ন করুণা ও অবিরাম চঞ্চলতায় ভাটা পড়তে লাগল। তার কেবলই মনে হতে লাগল, যে অবস্থায় সে আছে সেটা দীর্ঘদিন চলতে পারে না, এমন একটা দুর্বিপাক আসছে যা তার সমগ্র জীবনটাকেই বদলে দেবে, আর সেই আসন্ন দুর্বিপাকের লক্ষণই সে সর্বত্র খুঁজে বেড়াতে লাগল। একজন গুরুভাই সন্ত জন-এর প্রত্যাদেশ থেকে নেপোলিয়ন সম্পর্কে নিম্নলিখিত ভবিষ্যদ্বাণী পিয়েরের কাছে প্রকাশ করেছে।

(নিউ টেস্টামেন্ট-এর শেষ পর্ব) অ্যাপোক্যালিন্স-এর ১৩ অধ্যায়, ১৮ শ্লোকে বলা হয়েছে :

এই তো জ্ঞানের কথা। যার বুদ্ধি আছে সে পশুর সংখ্যাটা গণনা করুক : কারণ সেটাই তো মানুষের সংখ্যা, আর তার সংখ্যা হল ছয়শত তিনকুড়ি হয়।

আর সেই একই অধ্যায়ের পঞ্চম শ্লোকে আছে :

আর তাকে একটা মুখ দেওয়া হয়েছিল মহৎ বাণী ও অপবিত্র বাণী উচ্চারণ করতে, আর তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল চল্লিশ ও দুই মাস চলবার।

ফরাসি বর্ণমালা যদি হিব্রুদের সংখ্যাগত মূল্য অনুসারে এমনভাবে লেখা যায় যেখানে প্রথম নয়টি অক্ষর একককে বোঝায় এবং বাকিগুলি দশককে বোঝায়, তাহলে তার তাৎপর্য দাঁড়াবে এরকম :

abcdefghiklmn
12345678910203040
opqrstuvwxyz 
5060708090100110120130140150160 

L’Empereur Napoleon শব্দগুলি যদি সংখ্যা দিয়ে লেখা যায় তাহলে তাদের যোগফল দাঁড়াবে ৬৬৬, আর তাহলে নেপোলিয়নই হল সেই পশু যার কথা অ্যাপোক্যালিপ্স-এ আগেই বলে দেওয়া হয়েছে। (Empereur-এর আগেকার Le শব্দ থেকে e অক্ষরের বিলোপ ঘটানোর ফলে তার দরুন ৫ ধরে নিয়ে।) তাছাড়া, যে পশুকে একটা মুখ দেওয়া হয়েছিল মহৎ বাণী ও অপবিত্র বাণী উচ্চারণ করতে তাকে বোঝাবার জন্য যে quarante-deux (বিয়াল্লিশ) শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে তার উপরেও ঐ একই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে সেই একই ৬৬৬ সংখ্যাটাই পাওয়া যায়, তার থেকে এটাই ধরে নেওয়া যায় যে নেপোলিয়নের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার শেষ সীমা সে ই ১৮১২ সাল যখন ফরাসি সম্রাটের বয়স হয়ে বিয়াল্লিশ। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে পিয়ের খুবই খুশি হল, কেমন করে সেই পশু অর্থাৎ নেপোলিয়নের ক্ষমতার অবসান ঘটবে-এই প্রশ্নটা সে প্রায়ই নিজেকে করতে লাগল এবং তাই নিয়েই মেতে রইল।

.

পিয়ের রস্তভদের কথা দিয়েছিল যে জনসাধারণের কাছে আবেদন ও সেনাদলের সর্বশেষ সংবাদ সে কাউন্ট রস্তপচিনের কাছ থেকে এনে দেবে। সেই উদ্দেশ্যে রবিবার সকালে রস্তপচিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সেখানে সেনাদল থেকে সদ্য-আগত একজন সংবাদ-বাহকের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। লোকটি তার পরিচিত, মস্কোর অনেক বল-নাচে সে অংশ নিয়েছে।

 সংবাদ-বাহকটি বলল, ঈশ্বরের দোহাই, দয়া করে আমার কিছু কাজ হাল্কা করে দিন। বাবা-মাদের জন্য আমি এক বস্তাভর্তি চিঠি নিয়ে এসেছি।

সেই চিঠিগুলির মধ্যে একটা চিঠি নিকলাস রস্তভ লিখেছে তার বাবাকে। পিয়ের সে চিঠিটা নিল, রস্তপচিন তাকে দিল সদ্যমুদ্রিত সম্রাটের আবেদনপত্র, সেনাবাহিনীর প্রতি সর্বশেষ হুকুমনামাএবং একেবারে সাম্প্রতিক একটা সংবাদ-বুলেটিন। সেনাবাহিনীর হুকুমনামায় চোখ বুলিয়ে পিয়ের দেখতে পেল, নিহত, আহত ও পুরস্কৃতদের তালিকায় রয়েছে নিকলাস রস্তভের নাম, অস্ত্রভনার যুদ্ধে সাহস প্রদর্শনের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছে চতুর্থ শ্রেণীর সেন্ট জর্জের ক্রশ। সেখানে প্রিন্স আন্দ্রু বলকনস্কির নামও আছে, তাকে অশ্বারোহী রেজিমেন্টের কমান্ডার-পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। রস্তভ-পরিবারে বলকনস্কির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সে চায় না, অবশ্য ছেলের সম্মান লাভের সুখবরটা তাদের না জানিয়ে সে পারবে না। তাই সেনাদলের মুদ্রিত হুকুমনামা এবং নিকলাসের চিঠিটা সে রস্তভদের কাছে পাঠিয়ে দিল, আর আবেদনপত্র, বুলেটিন ও অন্য হুকুমনামাগুলি নিজের কাছেই রেখে দিল, ডিনারে যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।

কাউন্ট রস্তপচিনের সঙ্গে আলোচনাকালে তার কণ্ঠস্বরের উদ্বেগ, সংবাদ-বাহিনীর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে সেনাদলের খারাপ অবস্থা সম্পর্কে তার মন্তব্য, মস্কোতে গুপ্তচর আবিষ্কারের গুজব, এমন একটি বিজ্ঞপ্তির ব্যাপক প্রচার যাতে বলা হয়েছে যে নেপোলিয়ন হেমন্তকালের মধ্যেই রাশিয়ার উভয় রাজধানীতে পদার্পণ করতে কৃতসংকল্প, আর ঠিক পরদিনই সম্রাটের এখানে আসার কথা–এই সবকিছু মিলিয়ে পিয়েরের মনে আবার নতুন করে সেই উত্তেজনা ও প্রত্যাশাকে জাগিয়ে তুলল যা তার সচেতন অন্তরে জেগে আছে ধূমকেতুর আবির্ভাবের দিন থেকে, বিশেষ করে যেদিন যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে সেইদিন থেকে।

অনেকদিন থেকেই সে নিজেও সেনাদলে যোগদানের কথা ভাবছে, হয়তো এতদিনে যোগ দিত যদি না কতকগুলি বাধা এসে দাঁড়াত। প্রথম, যে ভ্রাতৃসঙ্রে সদস্য হিসেবে সে তাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার মূলমন্ত্রই হচ্ছে নিরবধি শান্তি ও যুদ্ধ বর্জন, দ্বিতীয়, ইউনিফর্ম পরিহিত মস্কোপন্থীদের মুখে দেশপ্রেমের বুলি শুনে সেপথে হাঁটতে তার বড়ই লজ্জাবোধ হয়েছে। কিন্তু সে যে সেনাদলে যোগদানের অভিপ্রায়কে কার্যে পরিণত করতে পারেনি তার প্রধান কারণ ঐ পশুর সংখ্যা ৬৬৬, যে পশুটি মহৎ বাণী ও অপবিত্র বাণী উচ্চারণ করতে পারে তার ক্ষমতার একটা সময় সীমা নির্ধারণের মহৎ কর্মে তার ভূমিকা যখন অনাদিকাল থেকেই নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছে, সেই হেতু সে-ব্যাপারে তার কোনো উদ্যোগ নেওয়াই উচিত নয়, যা অবশ্যম্ভাবী তার জন্য অপেক্ষা করে থাকাই তার কর্তব্য।

.

অধ্যায়-২০

সব রবিবারেই যেরকম হয়ে থাকে, সেদিনও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর রস্তদের সঙ্গে ডিনারে যোগ দেবার কথা।

তাই তাদের একলা পাবার জন্য পিয়ের একটু আগেই সেখানে হাজির হল।

 এবছর সে এতই মোটাসোটা হয়েছে যে সে যদি লম্বা না হত তাহলে তাকে অস্বাভাবিক দেখাত।

বিড় বিড় করতে করতে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। তার কোচোয়ান জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করল না সে অপেক্ষা করবে কি না। সে জানে, রস্তভদের বাড়িতে এলে তার মনিবটি মাঝরাত পর্যন্ত সেখানে থাকে। রস্তভদের পরিচারক ছুটে এসে তার জোব্বা, টুপি ও লাঠি হাতে নিল। ক্লাবের অভ্যাস মতো পিয়ের সবসময়ই টুপি ও লাঠি বাইরের ঘরে রেখে যায়।

প্রথমেই দেখা হল নাতাশার সঙ্গে। দেখা হবার আগে জোব্বা খুলবার সময়ই তার গলা সে শুনেছে। গানের ঘরে সে গলা সাধছিল। পিয়ের জানে, অসুখ হবার পর থেকে নাতাশা গান করে না। তাই তার গলা শুনে সে বিস্মিত ও আনন্দিত হল। আস্তে দরোজাটা খুলে তাকে দেখতে পেল, লিলাক-রঙের পোশাক পরে গান গাইতে গাইতে সে ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। দরোজা খোলার সময় নাতাশার পিঠ ছিল পিয়েরের দিকে, কিন্তু দ্রুত ঘুরতে গিয়ে তার বিস্মিত মুখটা দেখেই নাতাশা আরক্ত মুখে তার কাছে ছুটে এল।

কৈফিয়তের সুরে বলল, আমি আবার গান করতে চাই, তবু তো একটা কিছু করা হবে।

চমৎকার কথা!

আপনি আসায় কত খুশি হয়েছি! আজ আমি খুব সুখী। নাতাশার এমন সজীবতা পিয়ের অনেকদিন দেখেনি। আপনি কি জানেন, নিকলাস সেন্ট জর্জের ক্রশ পেয়েছে। তাকে নিয়ে আমার কত গর্ব।

হ্যাঁ, ঘোষণাটা আমিই পাঠিয়েছি। কিন্তু আপনাকে আর বাধা দেব না, বলেই পিয়ের বৈঠকখানা চলে যাচ্ছিল।

নাতাশা তাকে থামাল।

সলজ্জভাবে বলল, কাউন্ট, গান করা কি অন্যায়?

 না…তা কেন হবে? বরং…কিন্তু আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

নাতাশা তাড়াতাড়ি জবাব দিল, আমি নিজে ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু আপনার অমতে কোনো কাজ করতে আমি চাই না। আপনাকে আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আপনি যে আমার কাছে কত বড়, আমার জন্য যে কত করেছেন তা আপনি জানেন না…তাড়াতাড়ি কথাগুলি বলতে থাকায় একথা শুনে পিয়েরের মুখ যে লাল হয়ে উঠেছে সেটা নাতাশার নজরে পড়েনি। সেই সামরিক হুকুমনামা আমি দেখেছি যে সে, বলকনস্কি (অতি দ্রুত ফিসফিস করে সে নামটা বলল) রাশিয়াতেই আছে এবং আবার সেনাদলেই যোগ দিয়েছে। আপনি কী মনে করেন? সে কি কোনোদিন আমাকে ক্ষমা করবে? আমার প্রতি কি সবসময়ই তিক্ত মনোভাব পোষণ করবে না? আপনি কী মনে করেন? আপনি কী মনে করেন?

পিয়ের জবাব দিল, আমি মনে করি…তার ক্ষমা করার কিছু নেই…তার জায়গায় যদি আমি হতাম…

ভাবানুষঙ্গক্রমে পিয়ের তৎক্ষণাৎ সেই দিনটিতে ফিরে গেল যেদিন নাতাশাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সে বলেছিল, সে যদি নিজে না হয়ে পৃথিবীর একজন সেরা লোক হত, স্বাধীন হত, তাহলে নতজানু হয়ে সে তার পাণিপ্রার্থনা করত, সেই একই করুণা, মমতা ও ভালোবাসার অনুভূতি আজও তাকে পেয়ে বসেছে, আর সেই একই কথা তার ঠোঁটের আগায় এসেছে। কিন্তু সে কথাগুলি বলার অবসর নাতাশা তাকে দিল না।

সে বলে উঠল, হ্যাঁ, আপনি…আপনি…সেকথা স্বতন্ত্র। আপনার চাইতে দয়ালু, উদার ও ভালো লোক আমি দেখিনি, কেউ তা হতেও পারে না! সেদিন যদি আপনি না থাকতেন, বা এখনো না থাকতেন, তাহলে আমার যে কী হত তা আমি জানি না, কারণ…।

হঠাৎ তার চোখে জল এসে গেল, মুখটা ঘুরিয়ে গানটাকে চোখের সামনে মেলে ধরে সে আবার গাইতে শুরু করল, আবার ঘরময় হাঁটতে লাগল।

ঠিক সেইসময় পেতয়া বৈঠকখানা থেকে ছুটে এল।

পনেরো বছরের সুন্দর ছেলেটি, মুখখানি গোলাপী, ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল, দেখতে নাতাশার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার জন্য তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সম্প্রতি সে ও তার বন্ধু অবলেনস্কি স্থির করেছে হুজার-বাহিনীতে যোগ দেবে।

এ-বিষয়ে পিয়েরের মতামত জানবার জন্যই সে ছুটে এসেছে।

তার হাতটা ধরে পেতয়া বলল, আচ্ছা, আমার মতলবটা কেমন? ঈশ্বরের দোহাই পিতর কিরিলিচ! আপনি আমার একমাত্র ভরসা!

ওঃ হ্যাঁ, তোমার সেই মতলব। হুজার-বাহিনীতে যোগ দেওয়া তো? আজই বলব, সব কথা তুলব।

বুড়ো কাউন্ট বলল, আচ্ছা বাবা, তোমার কাছে কি ইস্তাহারটা আছে? কাউন্টেস রাজুমভস্কির প্রার্থনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, সেখানেই নতুন প্রার্থনাটা শুনে এসেছে। সে তো বলল খুব ভালো হয়েছে।

পিয়ের বলল, হ্যাঁ, আমার কাছে আছে। সম্রাট কাল এখানে আসছেন।…ভদ্রজনদের একটা বিশেষ সভা হবে, শোনা যাচ্ছে, প্রতি হাজারে দশ জনের যুদ্ধে যোগদান করা বাধ্যতামূলক হবে। ও হ্যাঁ, আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! আচ্ছা, যুদ্ধের সংবাদ কি?

আমরা আবার পশ্চাদপসরণ করছি। শোনা যাচ্ছে, এরমধ্যেই আমরা স্মোলেনস্কের কাছে এসে গেছি, পিয়ের জবাব দিল।

হে প্রভু, প্রভু হে! কাউন্ট বলে উঠল। ইস্তাহারটা কোথায়?

সম্রাটের আবেদন ঠিক আছে।

পিয়ের পকেট হাতড়াতে লাগল, কিন্তু পেল না। সেইসময় কাউন্টেস ঘরে ঢুকল পিয়ের তার হাতে চুমো খেল।

কী মুস্কিল, কোথায় যে সেটা রাখলাম, পিয়ের বলল।

এই এক ছেলে, সবসময় সবকিছু হারায়, কাউন্টেস বলল।

নাতাশা ঘরে ঢুকল। নীরবে পিয়েরের দিকে তাকিয়ে বসল। সে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পিয়েরের বিষণ্ণ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ইস্তাহারটা খুঁজতে খুঁজতেই বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল।

না, সত্যি! এখনই বাড়ি যাচ্ছি, নিশ্চয় সেখানে ফেলে এসেছি। এখনই যাচ্ছি…

কিন্তু তোমার যে খেতে দেরি হয়ে যাবে।

তাই তো! আর আমার কোচোয়ানও তো চলে গেছে।

কাগজপত্র খুঁজতে বাইরের ঘরে গিয়ে সোনিয়া সেগুলি পেয়ে গেছে। পিয়ের সেগুলি যত্ন করে তার টুপির লাইনিংয়ের ভিতর খুঁজে রেখেছিল। ইস্তাহারটা হাতে নিয়ে পিয়ের সেটা পড়তে গেল।

বুড়ো কাউন্ট বাধা দিয়ে বলল, না, ডিনারের পরে। তার ইচ্ছা, বেশ আরাম করে খবরটা শুনবে।

ডিনারের সময় সেন্ট জর্জের নতুন বীরের উদ্দেশ্যে শ্যাম্পেন পান করা হল, শিনশিন সবিস্তারে শহরের সংবাদ পরিবেশন করল : জর্জিয়ার বৃদ্ধা প্রিন্সেসের অসুখ, মস্কো থেকে মেতিভিয়েরের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ফরাসি টিকটিকি সন্দেহে জনৈক জার্মানকে ধরে রন্তপচিনের কাছে নিয়ে আসা, আর রস্তপচিন কর্তৃক তাকে ছেড়ে দিয়ে জনসাধারণকে এই বলে আশ্বাস দেওয়া যে লোকটা মোটেই টিকটিকি নয়, একটা জার্মান হাভাতেমাত্র।

কাউন্ট বলল, লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমি তো কাউন্টেসকে বলে দিয়েছি, অত বেশি ফরাসি বলা ভালো নয়। ওসবের সময় এখন নয়।

শিনশিন শুধাল, আর শুনেছেন কি? রুশ ভাষা শেখার জন্য প্রিন্স গলিৎসিন একজন মাস্টার রেখেছেন। রাজপথে ফরাসিতে কথা বলা এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

বুড়ো কাউন্ট পিয়েরকে সম্বোধন করে বলল, তোমার কি খবর কাউন্ট পিতর কিরিলিচ? তারা যদি বেসরকারি সৈনিকদের ডাক দেয় তাহলে তো তোমাকেও ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হতে হবে।

পিয়ের আপন মনে কি যেন ভাবছিল। কথাটা বুঝতে না পেরে কাউন্টের দিকে তাকাল।

তারপর বলল, ও, হ্যাঁ, যুদ্ধের কথা। না! আমি আর কি যুদ্ধ করব? তবু এখন তো সবকিছুই অদ্ভুত, কী অদ্ভুত! আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমি জানিও না। যুদ্ধ-বিগ্রহ আমার মোটেই ভালো লাগে না। কিন্তু আজকের দিনে কারো নিজের কথা তো চলবে না।

ডিনারের পরে কাউন্ট আরামকেদারায় আরাম করে বসে সোনিয়াকে বলল আবেদনটা পড়তে। সোনিয়া চমৎকার পড়তে পারে।

আমাদের প্রাচীন রাজধানী মস্কোর প্রতি।

অসংখ্য সৈন্য নিয়ে শত্রুপক্ষ রুশ সীমান্তে ঢুকে পড়েছে। সে আসছে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে ধ্বংস করতে। সোনিয়া গলা চড়িয়ে পড়ছে। কাউন্ট চোখ বুজে শুনছে আর মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে।

নাতাশা সোজা হয়ে বসে একবার বাবার দিকে, একবার পিয়েরের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

রাশিয়ার আসন্ন বিপদ, মস্কোর উপর, বিশেষ করে তার সম্ভ্রান্ত সমাজের উপর ম্রাটের ভরসার কথা পড়া শেষ করে সোনিয়া কাঁপা-কাঁপা গলায় শেষের কথাগুলি পড়তে শুরু করল : জনসাধারণের সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং লেডির নির্দেশ জানাতে রাজধানীতে এবং রাজ্যের অন্যসব অঞ্চলে গিয়ে হাজির হতে আমরা বিলম্ব করব না। আমাদের ধ্বংস করবার যে আশা নিয়ে শত্রু আসছে সে ধ্বংস তার নিজের মাথায়ই যেন পড়ে, দাসত্বমুক্ত ইওরোপ যেন রাশিয়ার নামে গৌরব বোধ করে!

কাউন্ট ভেজা চোখ খুলে বার বার নাক ঝেড়ে বলে উঠল, ঠিক, ঠিক তাই! সম্রাট শুধু মুখের কথাটি বলুন, তাহলেই আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করব, কোনো কিছুতেই পিছ-পা হব না।

কাউন্টের দেশপ্রেমের উপর শিনশিন একটা তামাশার কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নাতাশা লাফিয়ে উঠে একদৌড়ে বাবার কাছে গেল।

বাপি কী ভালো! বলে সে বাবাকে চুমো খেল, তারপর নিজের অজান্তেই লাস্যময় চোখে পিয়েরের দিকে তাকাল।

এই যে! এই তোমাদের আর এক দেশভক্ত! শিনশিন বলল।

দেশভক্ত মোটেই নয়, কিন্তু সোজা কথায়… আহত সুরে নাতাশা জবাব দিল। আপনার সবকিছুতেই ঠাট্টা, কিন্তু এটা মোেটই ঠাট্টার ব্যাপার নয়…

কাউন্ট লল, ঠাট্টাই বটে! ওকে ওর কথা বলতে দাও, আমরা সকলেই যাব…আমরা তো জার্মান নই!

 কিন্তু কথাটা লক্ষ্য করেছেন কি? পরামর্শ করতে পিয়ের বলল।

তা সে যেজন্যই হোক…।

এতক্ষণ পেতয়ার দিকে কেউ নজর দেয়নি। এবার সে মুখটা লাল করে বাবার কাছে এগিয়ে গেল, কখনো গম্ভীর, কখনো কর্কশ ভাঙা গলায় বলল, দেখ বাপি, তোমাকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, মামণিকেও বলছি, তোমরা যা খুশি মনে করতে পার, কিন্তু আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমাকে সেনাদলে যেতে দিতেই হবে, কারণ তা না হলে…বাস, আর কিছু না…।

কাউন্টেস দুই হাত জোড় করে সভয়ে আকাশের দিকে তাকাল, তারপর সক্রোধে স্বামীর দিকে মুখ ঘোরাল।

বলল, এই তো তোমার কথাবার্তার ফল!

 কিন্তু ততক্ষণে কাউন্ট তার উত্তেজনা কাটিয়ে উঠেছে।

 বলল, হয়েছে, হয়েছে! একজন যোদ্ধা বটে! না! যতসব বাজে কথা! তোমার এখন লেখাপড়ার বয়স!

মোটেই বাজে কথা নয় বাপি! ফেদিয়া অবলেনস্কি আমার চাইতে বয়সে ছোট, আর সেও তো যাচ্ছে। তাছাড়া, আর যাই হোক, এ সময় আমি তো লেখাপড়া নিয়ে থাকতে পারি না যখন… পেতয়া থেমে গেল, তার মুখ লাল হতে হতে ঘাম ঝরতে লাগল, তবু সে কোনোরকম বলল, যখন আমার পিতৃভূমি বিপন্ন।

খুব হয়েছে, খুব হয়েছে–যতসব…

কিন্তু তুমি তো নিজেই বললে সবকিছু ত্যাগ করবে।

পেতয়া! থাম। আমি বলছি, থাম! স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বলল, বিবর্ণ মুখে কাউন্টেস ছেলের দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আর আমি বলছি–এখানে উপস্থিত পিতর কিরিলিচও তোমাকে বলবেন…

আমি বলছি, সব বাজে কথা। এখনো তোমার মুখ থেকে মায়ের দুধ শুকোয়নি, আর তুমি কিনা যুদ্ধে যেতে চাও! আমি বলছি, ওসব ছাড়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য কাউন্ট উঠে দাঁড়াল। কগজপত্রগুলো নিয়েই গেল, হয়তো পড়ার ঘরে ঘুমোবার আগে আর একবার পড়ার ইচ্ছা আছে।

বলল, ওহে পিতর কিরিলিচ, চল, একটু ধূমপান করা যাক।

পিয়ের উত্তেজিত ও অস্থির। নাতাশার উজ্জ্বল চোখের সাদর আহ্বানই তার এই অবস্থা করেছে।

না, ভাবছি এবার বাড়ি যাব।

 বাড়ি? সেকি, তোমার তো সন্ধ্যাটা এখানেই কাটাবার কথা।…আজকাল তো তুমি আর ঘন ঘন আস না, অথচ তুমি এলেই আমার এই মেয়েটির চোখমুখ ঝলমল করে ওঠে।

পিয়ের তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তা ঠিক, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম…আমাকে বাড়ি যেতেই হবে…কাজ…

আচ্ছা, তাহলে অ রিভোয়া! বলে কাউন্ট ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পিয়েরের চোখের দিকে সদর্পে তাকিয়ে নাতাশা শুধাল, কেন আপনি চলে যাচ্ছেন? কেন এত বিচলিত হয়েছেন?

পিয়ের বলতে চাইল, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি! কিন্তু সেকথা বলল না, মুখটা লাল হতে হতে চোখে জল এসে গেল, সে চোখ নামিয়ে নিল।

কারণ আরো কমদিন আসাই আমার পক্ষে ভালো…কারণ…না, আমার কাজ আছে তাই…

সে কি? না, আমাকে বলুন! দৃঢ়তার সঙ্গে শুরু করেও নাতাশা হঠাৎ থেমে গেল।

 বিষণ্ণ, বিব্রত মুখে তারা পরস্পরের দিকে তাকাল। পিয়ের হাসতে চাইল, কিন্তু পারল না : তার হাসিতে কষ্টই প্রকাশ পেল, নিঃশব্দে নাতাশার হাতে চুমো খেয়ে বেরিয়ে গেল।

পিয়ের মনে মনে স্থির করল, আর কোনোদিন রস্তভদের বাড়ি যাবে না।

.

অধ্যায়-২১

চূড়ান্ত আপত্তির কথা শোনার পর পেতয়া নিজের ঘরে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে অনেক কাঁদল। সে যখন নিঃশব্দে চা খেতে এল তখনো তার মুখ বিষণ্ণ, তাতে চোখের জলের দাগ, প্রত্যেকেই তাকে না দেখার ভান করল।

পরদিন সম্রাট মস্কোয় এল, রস্তভ-বাড়ির কয়েকজন ভূমিদাস তাকে দেখতে যাবার জন্য অনুমতি চেয়ে নিল। সেদিন সকালে পেতয়া অনেকক্ষণ ধরে সাজ-পোশাক পরল, চুল ও কলার ঠিক করল, যাতে তাকে বেশ বয়স্ক দেখায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রুকুটি করল, অঙ্গভঙ্গি করল, কাঁধে ঝাঁকুনি দিল এবং শেষপর্যন্ত কাউকে কিছু না বলে টুপিটা নিয়ে পিছনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে স্থির করেছে, সোজা সম্রাটের কাছে চলে যাবে এবং তার কোনো পারিষদকে বুঝিয়ে বলবে যে, ছেলেমানুষ হলেও সে, কাউন্ট রস্তভ, দেশের সেবা করতে চায়, তার অল্পবয়স রাজভক্তির পথে বাধা হতে পারে না…পোশাক পরতে পরতে পারিষদকে বলবার মতো অনেক কথাই সে মনে মনে ঠিক করে নিল।

পেতয়া যতই ক্রেমলিনের দিকে এগোতে লাগল ততই ভিড় বাড়তে লাগল। ত্রিমূর্তি ফটকের ভিতরে ঢুকবার পরে ভিড়ের চাপে সে এমনভাবে দেয়ালের দিকে সরে গেল যে সে বাধ্য হয়ে থেমে গেল, আর গাড়িগুলো সশব্দে তার পাশ দিয়ে চলে যেতে লাগল। পেতয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল একটি চাষী রমণী, একটি পরিচারক, দুইজন ব্যবসায়ী ও একজন বরখাস্ত সৈনিক। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে পেতয়া আবার এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল এবং কনুই তুলে পথ করতে লাগল। কিন্তু তার ঠিক সামনেই ছিল চাষী রমণীটি, কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে সে রেগে চিৎকার করে উঠল, ধাক্কাধাক্কি করছ কেন ছোটকর্তা? দেখতে পাচ্ছ না আমরা সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি? তাহলে ঠেলছ কেন?

যে কেউই ঠেলতে পারে, এই কথা বলে পরিচারকটি একধাক্কায় পেতয়াকে একটা নোংরা জায়গায় ফেলে দিল।

পেতয়া হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছল, অনেক যত্ন করে পরা ভেজা কলারটা তুলে নিল। সে বুঝতে পারল, এখন তাকে যেরকম দেখাচ্ছে তাতে তাকে সম্রাটের কাছে হাজির করা যাবে না। তার ভয় হল, পারিষদের কাছে যেতে পারলেও এ অবস্থায় সে তাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে যেতে রাজি হবে না। অথচ এই ভিড়ের মধ্যে নিজের সাজপোশাক ঠিক করা বা অন্য কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়। ক্রমে সবগুলি গাড়ি চলে গেলে ভিড়ের সঙ্গে সঙ্গে পেতয়াও ক্রেমলিন স্কোয়ার ঢুকে পড়ল। ক্রেমলিন স্কোয়ার তখন লোকে লোকারণ্য। লোক যে শুধু স্কোয়ারেই ভিড় করেছে তাই নয়, আশপাশের ঢালু জায়গায় ও বাড়ির ছাদেও লোকের পর লোক।

কিছুক্ষণের জন্য ভিড় একটু পাতলা হল। তারপরেই হঠাৎ সকলে মাথার টুপি খুলে একসঙ্গে একই দিকে ছুটতে লাগল। সকলে পেতয়াকে এমনভাবে চেপে ধরল যে তার শ্বাস বন্ধ হয় হয়। সকলেই চেঁচাচ্ছে হুররা! হুররা! পেতয়া গোড়ালির উপরে ভর করে দাঁড়িয়েও চারদিকে শুধু মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

সকলের চোখে-মুখে একই উত্তেজনা ও উৎসাহের প্রকাশ। পেতয়ার পাশে দাঁড়িয়ে একটি বণিক-পত্নী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, তার গাল বেয়ে জল গড়াতে লাগল।

আঙুল দিয়ে চোখের জল মুছে সে বারবার বলছে, বাবা! দেবদূত! মানিক!

একমুহূর্ত চুপ করে থেকে জনতা আবার সামনে ছুটতে লাগল। অন্য সকলের সঙ্গে পেতয়াও দাঁতে দাঁত চেপে, হিংস্রভাবে চোখ ঘুরিয়ে, কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে লাগল হুররা! মনে হল, সেইমুহূর্তে সে বুঝি অন্য সকলকে, এমন কি নিজেকেও খুন করতে প্রস্তুত।

পেতয়া ভাবতে লাগল, তাহলে এই হচ্ছেন সম্রাট! না, তার কাছে আমি নিজে কোনো আবেদন রাখতে পারব না, সেটা হবে খুবই দুঃসাহসের কাজ। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে মরিয়া হয়ে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য লড়াই করতে লাগল। একসময় অপ্রত্যাশিতভাবে পেতয়ার বুকে ও পাঁজরে এত জোরে একটা আঘাত লাগল, আর চারদিককার ভিড় তাকে এমনভাবে চেপে ধরল যে হঠাৎ তার চোখের সামনে সবকিছু কেমন,ধোয়াটে হয়ে গেল, সে জ্ঞান হারাল। যখন সম্বিৎ ফিরে এল তখন সে দেখল, মাথার পিছনে একগুচ্ছ পাকা চুল আর পরনে একটা নোংরা নীল জোব্বা পাদরির মতো দেখতে একটি লোক এক হাতে তাকে তুলে ধরে অন্য হাতে ভিড়ের চাপকে ঠেকিয়ে রাখছে।

পাদরি বলছে, এই ছেলেমানুষ ভদ্রলোকটিকে আপনারা যে পিষে মেরে ফেলছেন! কী করছেন আপনারা? আস্তে!…এরা ওকে পিষে ফেলবে, পিষে ফেলবে!

সম্রাট গির্জায় প্রবেশ করল। ভিড়টা আবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। পাদরি রুদ্ধশ্বাস, বিবর্ণ পেতয়াকে জার-কামানের কাছে বয়ে নিয়ে গেল। পেতয়ার জন্য অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করল। যারা কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল তারা তার সেবা করতে লাগল, কোটের বোতাম খুলে দিল, কামানের উঁচু বেদীর উপর তাকে বসিয়ে দিল, যারা তাকে পিষে ধরেছিল তাদের বকতে লাগল।

এরকম অবস্থায় পড়লে তো মানুষ মরতেই পারে! এসবের অর্থ কি? মানুষকে খুন করা! আহা বেচারি, কাগজের মতো শাদা হয়ে গেছে!–নানা জনে নানা কথা বলতে লাগল।

অচিরেই পেতয়া আত্মস্থ হল, তার মুখের রং ফিরে এল, ব্যথাটা চলে গেল, বরং সেই সাময়িক কষ্টের মূল্যে কামানের পাশে এমন একটা জায়গা পেয়ে গেছে যেখান থেকে ফিরবার পথে সে সম্রাটকে দেখতে পাবে। এখন আর পেতয়া আবেদন পেশ করার কথা ভাবছে না। সম্রাটকে যদি একটিবার দেখতে পায় তাহলেই সে খুশি!…

সহসা নদীর তীর থেকে কামানের গর্জন শোনা গেল। তুর্কীদের সঙ্গে সন্ধি-পত্রে স্বাক্ষর উপলক্ষে উৎসব শুরু হচ্ছে। সে-দৃশ্য দেখতে সকলেই নদীর দিকে ছুটে গেল। হয়তো পেতয়াও যেত, কিন্তু সেই পদারি তাকে থামিয়ে দিল। কামানের গর্জন তখনো চলেছে। অফিসার, সেনাপতি ও পারিষদের দলও গির্জা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল, তাদের পিছনে অন্যরা এল ধীরে সুস্থে : আবার সকলেই মাথার টুপি খুলে সেইখানে ফিরে এল। অবশেষে ইউনিফর্ম ও চাদর গায়ে চারটি লোক গির্জার দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এল। পুনরায় ভিড়ের ভিতর থেকে চিৎকার উঠল হুররা! হুররা!

তিনি কোন জন? কোন জন? অশ্রুসিক্ত গলায় পেতয়া আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কেউ জবাব দিল না, সকলেই সমান উত্তেজিত। আনন্দের অশ্রুতে দুই চোখ ভরে আসায় ভালো করে দেখতে না পেলেও সেই চারজনের একজনের উপর স্থির দৃষ্টি রেখে–যদিও আসলে সে লোকটি সম্রাট নয়-পেতয়া মহা উৎসাহে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল হুররা! মনে মনে সংকল্প করল, যাই ঘটুক না কেন আগামীকাল সে সেনাদলে যোগ দেবেই।

জনতা সম্রাটের পিছনে ছুটতে লাগল, রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত তাকে অনুসরণ করল, তারপর যার যার মতো সরে পড়তে লাগল। বেলা অনেক হয়েছে। পেতয়া কিছুই খায়নি, শরীর ঘামে ভিজে গেছে, তবু সে বাড়ি না ফিরে তখনো প্রাসাদের সামনে যে ভিড় জমেছিল তাদের সঙ্গেই রয়ে গেল। সম্রাট তখন ডিনার খাচ্ছে। সে প্রাসাদের জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কিসের আশায় তা সে নিজেই জানে না। সম্রাটের সঙ্গে ডিনার খেতে বিশিষ্ট ব্যক্তি যারা ফটক দিয়ে ঢুকছে, তাদের দেখে আর দরবারের যেসব পরিচারক খাবার পরিবেশন করছে, জানালাপথে চকিতে তাদের দেখে সমবেত জনতার সঙ্গে পেতয়ার মনেও কেমন যেন ঈর্ষা দেখা দিল।

সম্রাট ডিনার খাচ্ছে। সেইসময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভালুয়েভ বলল : ওরা এখনো ইয়োর ম্যাজেস্টিকে আর একবার দেখবার আশায় রয়েছে।

একটা বিস্কুট চিবুতে চিবুতে সম্রাট উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। পেতয়াসহ ভিড়ের লোকরা সকলেই ব্যালকনির দিকে ছুটল।

দেবদূত! সোনা-মানিক! হুররা! বাবা!…জনতা চিৎকার করে উঠল। পেতয়াও গলা মেলাল। যেসব নরনারী দুর্বলচিত্ত তার আনন্দে আবার কেঁদে ফেলল। পেতয়াও তাদেরই একজন।

বিস্কুটের যে বড় টুকরোটা সম্রাটের হাতে ছিল সেটা ভেঙে প্রথমে ব্যালকনির আলসেতে এবং পরে মাটিতে পড়ে গেল। যে কোচোয়ানটি খুব কাছে দাঁড়িয়েছিল সে একলাফে সামনে গিয়ে সেটা তুলে নিল। ভিড়ের ভিতর থেকে আরো কয়েকজন কোচয়ানের দিকে ছুটে গেল। তা দেখে সম্রাট এক প্লেটভর্তি বিস্কুট আনিয়ে সেগুলো ছুঁড়ে দিতে লাগল। পেতয়ার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল, জনতার চাপে পিষ্ট হবার বিপদের কথা ভেবে আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে সেও বিস্কুটের দিকে ছুটে গেল। কেন যে গেল তা সে জানে না, কিন্তু জারের হাতের একটা বিস্কুট তাকে পেতেই হবে, কোনোমতেই সে হার মানবে না। একটি বুড়ি একটা বিস্কুট ধরতে যাচ্ছিল, এক লাফে এগিয়ে গিয়ে পেতয়া তাকে ফেলে দিল, মাটিতে পড়ে গিয়েও বুড়ি হার মানল না-বিস্কুট নেবার জন্য হাত বাড়াল, কিন্তু তার হাত বিস্কুট পর্যন্ত পৌঁছল না। পেতয়া হাঁটু দিয়ে বুড়ির হাতটা সরিয়ে দিয়ে একটা বিস্কুট আঁকড়ে ধরল এবং পাছে বেশি দেরি হয়ে যায় এই আশংকায় আবার চেঁচিয়ে বলল হুররা! তখন তার গলার স্বর কর্কশ হয়ে উঠেছে।

সম্রাট ভিতরে চলে গেল, ভিড়ও পাতলা হয়ে গেল। হল তো! বলেছিলাম না অপেক্ষা করলেই–আর তাই তো হল! অনেকেই খুশিভরা গলায় বলতে লাগল।

পেতয়াও খুব খুশি। কিন্তু আজকের মতো সব আনন্দ শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে এবং এবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে ভেবে তার মন খারাপ হয়ে গেল। ক্রেমলিন থেকে সে সোজা বাড়ি ফিরে গেল না, বন্ধু অকলনস্কির সঙ্গে দেখা করতে গেল, তার বয়স পনেরো, সেও রেজিমেন্টে যোগ দিচ্ছে। বাড়ি ফিরে পেতয়া দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিল, তাকে যদি সেনাদলে ঢুকতে না দেওয়া হয় তাহলে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। আর পরদিনই কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ-ব্যাপারটা পুরোপুরি মেনে না নিলেও-পেতয়ার চাকরির ব্যবস্থা কোথায় করতে পারলে বিপদের সম্ভাবনা সবচাইতে কম হবে সেই খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

.

অধ্যায়-২২

দুদিন পরে ১২ই জুলাই তারিখে সুবোদা প্রাসাদের বাইরে প্রচুর গাড়ির ভিড় দেখা গেল।

বড় হলটা লোকে ভর্তি। প্রথমত, ইউনিফর্ম পরিহিত সম্ভ্রান্ত ও ভদ্রজনরা, দ্বিতীয়ত, নীল কাপড়ের পুরো স্কুলের কোটপরিহিত, মেডেলশোভিত দাড়িওয়ালা বণিকের দল। সম্ভ্রান্তজনদের হলে অনবরত চলাফেরা ও ওজনন শেহে। অংশ ও গুঞ্জন-ধ্বনি চলেছে। প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা সম্রাটের প্রতিকৃতির নিচে বড় টেবিলটা ঘিরে উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ারগুলোতে বসেছে, কিন্তু দ্ৰজনরা বেশির ভাগই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ক্লাবে অথবা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে এইসব সম্ভ্রান্ত লোকদের সঙ্গে পিয়েরের রোজই দেখা হয়। আজ তারা সকলেই ইউনিফর্মে সজ্জিত-কেউ পরেছে ক্যাথারিনের সময়কার পোশাক, কেউ বা সম্রাট পলের সময়কার, আবার কারো পরিধানে আলেক্সান্দারের সময়কার নতুন ইউনিফর্ম। ক্ষীণদৃষ্টি, দন্তবিহীন, টাকমাথা, হলদে ও ফুলো-ফুলো, অথবা কৃশকায় ও ভাঁজ পড়া চামড়ার বুড়োরাই বেশি করে চোখে পড়ছে। তাদের বেশির ভাগই চুপচাপ আসনে বসে আছে, আর হাঁটাচলা ও কথাবার্তার সময়ও অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদের সঙ্গে মিশছে। তাদের সকলের মুখেই একটা বিচিত্র পরস্পরবিরোধী ভাব : সাধারণভাবে একটা গুরুগম্ভীর ঘটনার প্রত্যাশায়, আবার সেই সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের তাসের বোস্টন-খেলা, রাঁধুনি পিতর, জিনাইদা দিমিত্রিয়েভনার স্বাস্থ্য ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ।

সম্রাটের ইস্তাহার পড়া হল। সকলের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। তারপর শুরু হল আলোচনা। সম্রাট যখন ঢুকবে তখন মার্শালরা কোথায় দাঁড়াবে, সম্রাটের সম্মানে কখন একটা বল-নাচের আয়োজন করা হবে, তারা জেলাওয়ারি ভাগ হবে না, প্রদেশওয়ারি, ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হল। কিন্তু যেই যুদ্ধের কথা উঠল, অমনি আলোচনার জোয়ারে ভাটা পড়ল, সকলেই বক্তা হবার বদলে শ্রোতা হতে চাইল।

পিয়েরের কিছু বলার ইচ্ছা হল। সে সবে মুখ খুলবে এমন সময় জনৈক দন্তবিহীন সেনেটর তাকে বাধা দিয়ে নিচু অথচ স্পষ্ট স্বরে বলতে শুরু করল, জনাব, আমি মনে করি, বর্তমান মুহূর্তে বাধ্যতামূলক সৈন্যকরণ সাম্রাজ্যের পক্ষে ভালো, না বেসরকারি বাহিনী ডাকা হয় নি। আমাদের প্রতি যে আবেদন রেখে মহামান্য সম্রাট আমাদের সম্মানিত করেছেন তার জবাব দিতেই আমাদের ডাকা হয়েছে। বাধ্যতামূলক সৈন্যকরণ না বেসরকারি বাহিনী-এর মধ্যে কোনটা শ্ৰেয় সে বিচার আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতেই ছেড়ে দিতে পারি…।

হঠাৎ পিয়ের তার উত্তেজনা প্রকাশের একটা পথ পেয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে বক্তাকে বাধা দিল। কি বলবে তা সে এখনো জানে না, কিন্তু সাগ্রহে বলতে শুরু করল-কখনো ফরাসিতে, কখনো পুঁথিগত রুশ ভাষায়।

সে বলতে শুরু করল, ক্ষমা করবেন ইয়োর এক্সেলেন্সি। (সেনেটরটি তার পরিচিত হলেও তার মনে হল যে এখানে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্বোধন করাই প্রয়োজন।) যদিও আমি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে একমত নই…তার সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য আমার হয় নি…তবু আমি মনে করি, কেবলমাত্র সহানুভূতি ও উদ্দীপনা প্রকাশের জন্যই এতগুলি সম্ভ্রান্ত মানুষকে এখানে ডাকা হয় নি, সেইসঙ্গে কীভাবে আমরা পিতৃভূমিকে সাহায্য করতে পারি সে উপায়ের কথাও আমাদের বিবেচনা করতে হবে। আমি মনে করি, সম্রাট নিশ্চয়ই চান না যে আমরা শুধু কতকগুলি ভূমিদাসের মালিক হিসেবে ম্রাটের সেবায় তাদের নিয়োজিত করব এবং নিজেদেরও কামানের মুখে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকব, তিনি অবশ্যই চান যে আমরা তাঁকে সুপরামর্শ দেব।

পিয়ের আরো বলল, আমি মনে করি, এইসব প্রশ্ন আলোচনা করার আগে আমাদের সম্রাটকে জিজ্ঞাসা করা উচিত–হিজ ম্যাজেস্টির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করা উচিত-বর্তমানে আমাদের সৈন্য সংখ্যা কত এবং এই মুহূর্তে আমাদের সেনাদল কি অবস্থায় আছে, তারপরে…।

পিয়েরের মুখ থেকে এই কথাগুলি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু হল। সবচাইতে প্রচণ্ড আক্রমণ এল তার একজন পূর্বপরিচিতের কাছ থেকে। এই বোস্টন-খেলোয়াড়টির সঙ্গে আগাগোড়াই তার খুব প্রীতির সম্পর্ক। নাম স্তেপান স্তেপানভিচ আদ্রাকসিন। নিজের বয়স্ক মুখের উপর একটা আকস্মিক বিদ্বেষের ভাব ফুটিয়ে আদ্রাকসিন চিৎকার করে পিয়েরকে বলল, প্রথমত, আমি আপনাকে বলতে চাই যে এ বিষয়ে সম্রাটকে প্রশ্ন করবার কোনো অধিকার আমাদের নেই, দ্বিতীয়ত, রুশ সম্ভ্রান্ত মহলের যদি সে অধিকার থাকেও তবু এ ধরনের প্রশ্নের কোনো জবাব সম্রাট দিতে পারেন না। সৈন্য চলাচল করে শত্রুপক্ষের চলাচলের সঙ্গে তাল রেখে, আর সৈন্য সংখ্যাও বাড়ে-কমে…

এবার ধ্বনিত হল জনৈক সম্ভ্রান্ত লোকের কণ্ঠস্বর। তার বয়স বছর চল্লিশের মতো, উচ্চতা মাঝারি, কোনো একসময় জিপসিদের আড্ডায় তার সঙ্গে পিয়েরের দেখা হয়েছিল, তাস-খেলুড়ে হিসেবে খুবই বাজে। সেই লোকটি পিয়েরের পাশে এসে আদ্রাকসিনের কথায় বাধা দিল।

বলতে লাগল, হ্যাঁ, এটা আলোচনার সময় নয়, কাজের সময় : রাশিয়াতে যুদ্ধ চলেছে! শত্রু এগিয়ে আসছে রাশিয়াকে ধ্বংস করতে, আমাদের পিতৃপুরুষদের সমাধিকে অপবিত্র করতে, আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের অপহরণ করতে। লোকটি বুকে করাঘাত করতে লাগল। আমাদের পিতা জারের পক্ষে আমরা জেগে উঠব, প্রত্যেকে এগিয়ে যাব! রক্তবর্ণ চোখ ঘুরিয়ে সে চিৎকার করে বলল। ভিড়ের ভিতর থেকে সমর্থনসূচক ধ্বনি উঠল। আমরা রুশ, আমাদের ধর্ম আমাদের সিংহাসন, আমাদের পিতৃভূমি রক্ষায় রক্ত ঢেলে দিতে আমরা পশ্চাৎপদ হব না! আমরা যদি পিতৃভূমির সন্তান হই তাহলে প্রলাপ বকা বন্ধ করতে হবে। ইওরোপকে দেখাতে হবে, রাশিয়া কেমন করে পিতৃভূমিকে রক্ষা করে।

পিয়ের জবাব দিতে চাইল, কিন্তু কথা খুঁজে পেল না। সে বলতে চাইল, তার অর্থ, তার লোজন, অথবা নিজেকে উৎসর্গ করতে সে প্রস্তুত, শুধু অবস্থার উন্নতিবিধানের জন্য প্রকৃত অবস্থাটা তার জানা দরকার, কিন্তু কিছুই সে বলতে পারল না। অনেক কণ্ঠস্বর একসঙ্গে সোচ্চার হয়ে ওঠায় কাউন্ট রস্তভও তার সমর্থন জানাবার সময় পেল না। পিয়েরের বক্তৃতা যে বিফলে গেল তাই শুধু নয়, তাকে নির্মমভাবে বাধা দেওয়া হল, ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হল, আর সকলে তার কাছ থেকে দূরে সরে গেল। তার বক্তব্য যে তাদের অখুশি করেছে। তা নয়, আসলে জনতা হাতের কাছে এমন কিছু চায় যাকে ভালোবাসা যায় এবং ঘৃণা করা যায়। পিয়ের শেষের দলে পড়ে গেল। উত্তেজিত লোকটির পরে আরো অনেক বক্তা ওই একই সুরে কথা বলল। অনেকেই বাকপটুতার সঙ্গে নতুন কথাও বলল।

রাশিয়ান মেসেঞ্জারের সম্পাদক বলল, নরক দিয়ে নরককে প্রতিরোধ করতে হবে, বিদ্যুতের চমক দেখে ও বজ্রের গর্জন শুনে সে একটি শিশুকে হাসতে দেখেছে, কিন্তু আমরা সেই শিশু হব না।

ভিড়ের পিছনের সারি থেকে সমর্থনসূচক আওয়াজ উঠল, ঠিক, ঠিক, বজের গর্জনের সামনে!

সকলে এখন বড় টেবিলটার কাছে। সেখানে বসে আছে সত্তর বছরের বৃদ্ধ অভিজাতরা, কারো মাথায় পাকা চুল, কারো টাক, পরনে ইউনিফর্ম, চাদর, তাদের প্রায় সকলকেই পিয়ের তাদের বাড়িতে দেখেছে ভড়দের সঙ্গে, অথবা ক্লাবে দেখেছে বোর্স্টন খেলতে। অবিরাম কলগুঞ্জনের সঙ্গে সেই ভিড় টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ভিড়ের চাপে উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ারের সঙ্গে লেপ্টে গিয়ে বক্তারা একের পর এক বলে যেতে লাগল, কখনো দুইজন একই সঙ্গে বলছে। পিয়েরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। অন্য সকলের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে বলে উঠল, আমি শুধু বলেছি, কি প্রয়োজন সেটা জানা থাকলে ত্যাগের উদ্দেশ্যটা আরো কার্যকরী হতে পারে।

তার কাছাকাছি একটি বৃদ্ধ ঘুরে তাকাল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের অন্য দিক থেকে কে যেন চিৎকার করে ওঠায় তার মনোযোগ সেইদিকে ঘুরে গেল।

একজন চেঁচিয়ে বলল, ঠিক, মস্কো আত্মসমর্পণ করবে। সেই হবে আমাদের প্রায়শ্চিত্ত!

অন্য একজন বলে উঠল, লোকটি মানবজাতির শত্রু! আমাকে বলতে দিন… ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা আমাকে চেপে মেরে ফেলছেন!…

.

অধ্যায়-২৩

সেইমুহূর্তে উঁচু থুতনি ও সতর্ক চোখ নিয়ে কাউন্ট রন্তপচিন ঘরে ঢুকল, ইউনিফর্ম পরা, কাঁধের উপর চাদর। দ্রুতপায়ে সে দ্রজনদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

 বলল, আমাদের সর্বাধীপ সম্রাট এখনই এসে পড়বেন। রাজপ্রাসাদ থেকেই আমি সোজা চলে এসেছি। যে অবস্থার মধ্যে আমরা আছি তাতে আলোচনার কিছুটা প্রয়োজন আছে। সম্রাট অনুগ্রহ করে আমাদের ও বণিকদের এখানে আহ্বান করেছেন। বণিকদের হলটা দেখিয়ে বলল, ওখান থেকে লক্ষ লক্ষ আসবে, কিন্তু আমাদের কাজ মানুষ সরবরাহ করা, তাই বলে নিজেদের রেহাই দেওয়া নয়…এটুকু আমাদের করতেই হবে!

টেবিলে উপবিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটা বৈঠক বসল। আলোচনা পর্ব শান্তিতেই চুকে গেল। এতক্ষণের হৈ-হল্লার পরে তাদের বার্ধক্যজীর্ণ গলায় আমি রাজি অথবা বড় জোর আমারও ঐ একই মত প্রভৃতি কথাগুলি কেমন যেন শোকাবহ শোনাল।

মস্কোর সম্ভ্রান্ত মহল এবং ভদ্রমহল প্রস্তাব নিয়েছে যে, সমালেনস্ক ভদ্রমহলের মতোই তারাও প্রতি এক হাজার ভূমিদাসের দরুন দশজন করে সশস্ত্র সৈনিক সরবরাহ করবে। এই প্রস্তাবটি সচিবকে লিখে নিতে বলা হল। বৈঠক সেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভদ্রমহোদয়রা সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠল এবং জোড়ায় জোড়ায় হাত ধরাধরি করে ঘরময় পায়চারি করতে করতে কথা বলতে লাগল।

সম্রাট! সম্রাট! একটা আকস্মিক চিঙ্কারে হলগুলি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। সকলেই ফটকের দিকে ছুটে গেল।

দুই সারি সম্ভ্রান্তজনের মাঝখান দিয়ে সম্রাট হলে প্রবেশ করল। প্রত্যেকের মুখে সশ্রদ্ধ, ভয়চকিত কৌতূহল। পিয়ের অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, সম্রাটের সব কথা সে শুনতে পেল না। যতটুকু শুনল তাতে বুঝল যে, সাম্রাজ্যের আসন্ন বিপদ এবং মস্কোর সম্ভ্রান্ত মহলের উপর তার ভরসার কথাই সম্রাট বলল। প্রত্যুত্তরে সদ্যগৃহীত প্রস্তাবটির কথা তাকে জানিয়ে দেওয়া হল।

সম্রাট কম্পিত গলায় বলল, ভদ্রমহোদয়গণ! রুশ সম্ভান্তজনের অনুরাগে আমি কখনো সন্দেহ করিনি, কিন্তু আজ তাদের অনুরাগ আমার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে। পিতৃভূমির নামে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি! ভদ্রমহোদয়গণ, আসুন, আমরা কাজে নেমে পড়ি! সময় বড়ই মূল্যবান…।

সম্রাট থামল। সকলে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল। সকলের মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস।

কাউন্ট রস্তভ ফুঁপিয়ে বলে উঠল, হা, বড়ই মূল্যবান…সম্রাটের মতোই কথা। সে পিছনে দাঁড়িয়েছিল। কিছুই শুনতে না পেলেও নিজের মতো করেই সে সবকিছু বুঝে নিয়েছে।

সম্ভ্রান্ত মহলের হল থেকে সম্রাট বণিকদের হলে ঢুকল। সেখানে প্রায় দশ মিনিট কাটাল। অন্য অনেকের সঙ্গে পিয়ের দেখল, বণিকদের হল থেকে বেরিয়ে আসার সময় ম্রাটের চোখ থেকে আবেগে জল ঝরছে। পরে জানা গেল, সেখানে ভাষণ শুরু করতে না করতেই তার চোখে অশ্রু ঝরতে শুরু করে আর কম্পিত গলায় তার ভাষণটি শেষ হয়। পিয়ের যখন সম্রাটকে বেরিয়ে আসতে দেখল তখন তার সঙ্গে ছিল দুইজন বণিক, তাদের একজনকে পিয়ের চেনে–এক পেটমোটা Otkupshchik (মদের দোকানের মালিক)। অপরজন মেয়র-ছুঁচলো পাণ্ডুর মুখ, সরু দাড়ি। দুজনই কাঁদছে। সরু লোকটির দুই চোখ জলে ভরেছে, আর মোটা Otkupshchik শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বারবার বলছে :

আমাদের জীবন, আমাদের সম্পত্তি–সব আপনি গ্রহণ করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি।

সেইমুহূর্তে পিয়েরের মনেও একটিমাত্র বাসনা-সেও দেখাতে চায় যে সবকিছু করতে, সর্বস্ব উৎসর্গ করতে সে প্রস্তুত। নিজের বক্তৃতার নিয়মতান্ত্রিক সুরের জন্য এখন তার লজ্জা হচ্ছে, সুযোগ পেলেই সে তা মুছে ফেলতে চায়। কাউন্ট মামোনভ একটা রেজিমেন্ট পাঠাবে শুনে বেজুখভ সঙ্গে সঙ্গে রস্তপচিনকে জানিয়ে দিল যে সে একহাজার সৈনিক ও তাদের খরচ দেবে।

চোখের জল না ফেললেও তার মনে যে কি হচ্ছে বুড়ো রস্তভ সেকথা তার স্ত্রীকে বলতে পারল না। তক্ষুনি পেতয়ার অনুরোধ মেনে নিয়ে সে নিজে গিয়ে ছেলের নাম লিখিয়ে দিল।

পরদিন সম্রাট মস্কো ছেড়ে চলে গেল। সমবেত স্ক্রান্তজনরা তাদের ইউনিফর্ম খুলে ফেলে যার যার বাড়িতে ও ক্লাবে ফিরে গেল, মনের মধ্যে কিছুটা আর্তনাদ চেপে রেখে নায়েবদের সৈন্যসংগ্রহের হুকুম জারি করল, আর নিজেদের কাজে নিজেরাই অবাক হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *