০৮. বিয়ের কথা

অষ্টম পর্ব অধ্যায়-১

নাতাশার সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর বিয়ের কথা পাকা হবার পরেই পিয়ের হঠাৎ যেন অকারণেই অনুভব করতে লাগল যে আগের মতো জীবনযাপন করা একেবারেই অসম্ভব। উপকারী লোকটি তার কাছে যে সত্য প্রকাশ করেছে সে সম্পর্কে তার প্রত্যয় যথেষ্ট দৃঢ়, নিজের ভিতরকার মানুষটিকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলার কাজে যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গেই আত্মনিয়োগ করে সে সুখও পাচ্ছে–তথাপি আন্দ্রু ও নাতাশার বাগদানের পর থেকেই সে জীবনের সব রস যেন শুকিয়ে গেছে, বিশেষ করে ঠিক সেইসময়ে জোসেফ আলেক্সিভিচের মৃত্যু-সংবাদ তাকে আরো বিচলিত করে তুলেছে। এখন অবশিষ্ট রয়েছে জীবনের একটি কঙ্কাল মাত্র : নিজের বাড়ি, জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তির প্রণয়ভাজন সুন্দরী স্ত্রী, গোটা পিটার্সবুর্গের সঙ্গে পরিচয়, আর রাজদরবারের চাকরির একঘেয়ে গতানুগতিকতা। সহসা এ জীবন পিয়েরের কাছে অপ্রত্যাশিত রকমের ঘৃণ্য মনে হতে লাগল। সে দিনপঞ্জি রাখা ছেড়ে দিল, গুরুভাইদের কাছে যাওয়া বন্ধ করল, আবার ক্লাবে যেতে শুরু করল, প্রচুর মদ খেতে লাগল এবং অবিবাহিতদের দলে ভিড়ে এমন সব কাণ্ডকারখানা শুরু করে দিল যে কাউন্টেস হেলেন তা নিয়ে কটু কথা শুনানো প্রয়োজন বোধ করল। পিয়ের বুঝল তার স্ত্রী ঠিকই বলেছে, আর তাই তার অসুবিধা না ঘটিয়ে মস্কোতে সরে পড়ল।

মস্কো পৌঁছে সে নিজেদের বিরাট বাড়িটাতে ঢুকল, ম্লান হতে স্নানতর হয়ে যাওয়া প্রিন্সেসরা সখী-দলবল নিয়ে তখনো সেখানে বাস করছে, শহরের ভিতর দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে যখন দেখতে পেল আইবেরিয় তীর্থে দেবমূর্তিগুলির সামনে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে, ক্রেমলিন স্কয়ারের বরফ গাড়ির চাকায় ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে না, বা সিভৎসেভ ভ্রাঝকের (মস্কোর বস্তি-অঞ্চল) ভাঙা-চোরা বাড়িগুলো তার শান্তি বিঘ্নিত করছে না, যখন সে নতুন করে দেখল মস্কোর প্রাচীন মহিলাদের, দেখল মস্কোর বল-নাচ ও ইংলিশ ক্লাব, তখন যেন একটি নিরাপদ আশ্রয়ে এসে সে বড়ই আরাম বোধ করতে লাগল। মস্কোতে পৌঁছে সেই শান্তি ও আরাম সে পেল যা পাওয়া যায় একটা পুরনো ড্রেসিং-গাউন গায়ে জড়িয়ে, যেটা একাধারে গরম ও নোংরা।

মস্কো সমাজের বৃদ্ধা থেকে ছেলেমেয়ে পর্যন্ত সকলেই পিয়েরকে দীর্ঘপ্রত্যাশিত অতিথি হিসেবেই স্বাগত জানাল। মস্কো সমাজের পক্ষে পিয়েরই সবচাইতে সুন্দর, দয়ালু, বুদ্ধিমান, হাসিখুশি ও দিলখোলা মানুষ : প্রাচীন রুশ ভদ্রসমাজের প্রতিভূস্বরূপ। তার টাকার থলে সর্বদাই শূন্য থাকে, কারণ সেটা সকলের জন্যই খোলা।

জনকল্যাণমূলক অনুষ্ঠান, বাজে ছবি, মূর্তি, জনসেবক প্রতিষ্ঠান, জিপসিদের নাচ, বিদ্যালয়, চাঁদা তোলার ভোজসভা, কৌতুক-অনুষ্ঠান, ভ্রাতৃসংঘ, গির্জা, পুঁথিপত্র-কাউকে বা কোনো কিছুতেই সে ফিরিয়ে দেয় না, দুটি বন্ধু যদি তার কাছ থেকে মোটা টাকা ধার করে তাকে নিজেদের হেপাজতে না রাখত তাহলে হয় তো সব টাকাই সে বিলিয়ে দিত। তাকে ছাড়া কোনো ভোজসভা বা আমোদ-আহ্লাদ অনুষ্ঠিত হয় না। কি বিবাহিতা, কি অবিবাহিতা সব মহিলাই তাকে পছন্দ করে, কারণ কাউকে ভালোবাসা না জানালেও সকলের প্রতিই সে সমান উদারতা দেখিয়ে থাকে, বিশেষ করে নৈশভোজনের পরে। সকলেই বলে, সে কী মনোরম, তার কাছে নারী-পুরুষ ভেদ নেই।

সাত বছর আগে সে যখন প্রথম বিদেশ থেকেই এসেছিল তখন যদি তাকে বলা হত যে কোনো খুঁজে বেড়াবার অথবা কোনো পরিকল্পনা করার কোনো দরকারই তার নেই, চিরন্তন এক পূর্বনির্দিষ্ট পথ তার জন্য অনেক আগেই কাটা হয়ে আছে, শরীরটাকে যতই এদিক-ওদিক করুক না কেন, তাকেও অন্য সকলের মতোই হতে হবে, তাহলে কী সন্ত্রস্তই না সে হত। সে-কথা সে বিশ্বাসই করতে পারত না! একসময় সে সর্বান্তকরণে রাশিয়াতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি, চায়নি নেপোলিয়ন হতে, একজন দার্শনিক ও কূটনীতিক হতে, এবং তারপরে নেপোলিনবিজয়ী হতে? সে কি একান্তমনে কামনা করেনি পাপী মানবজাতির পুনরভ্যুত্থান এবং নিজের জন্য পরিপূর্ণতা অর্জন? সে কি বিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেনি? তার ভূমিদাসদের মুক্তি দেয়নি?

কিন্তু সেসব কিছুর পরিবর্তে–আজ সে কি হয়েছে? এক অবিশ্বাসিনী স্ত্রীর ধনী স্বামী, জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রলোক, পানে ও ভোজনে বিলাসী, মস্কো ইংলিশ ক্লাবের একজন সদস্য এবং মস্কো সমাজের একজন সর্বজনপ্রিয় মানুষ। সাত বছর আগে যেধরনের মানুষকে সে এত ঘৃণা করত আজ যে সে নিজেই মস্কোর সেই অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রজনদের একজন হয়েছে এ-সত্যটাকে সে অনেকদিন পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি।

কখনো কখনো এই বলে সে নিজেকে সান্তনা দিত যে মাত্র সাময়িকভাবেই সে এ জীবন কাটাচ্ছে, কিন্তু তার পরেই যখন তার মনে পড়ে যেত যে তারই মতো আরো যারা এই জীবনযাত্রার পথে ও ইংলিশ ক্লাবে সাময়িকভাবে ঢুকেছিল সবগুলো দাঁত ও চুল নিয়ে, তারাই যখন এখান থেকে বিদায় নিয়েছে তখন কারো না ছিল একটা দাঁত, আর না ছিল একগুলি চুল।

যাই হোক, এ নিয়ে গম্ভীর হতাশা, বিষণ্ণতাবোধ ও জীবনবিতৃষ্ণায় না ভুগলেও আত্ম-অনুসন্ধিৎসার কতকগুলো প্রশ্ন নিয়তই তাকে বিব্রত করে। কিসের জন্য? কেন? এ পৃথিবীতে কি সব চলছে? দিনের মধ্যে অনেকবারই সে নিজেকে এই প্রশ্নগুলি করে এবং জীবনের তাৎপর্য নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে যখন বুঝতে পারে যে এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যাবে না, তখনই সেসব চিন্তাভাবনা ছেড়ে একটা বই নিয়ে বসে, অথবা ক্লাবের দিকে পা চালিয়ে দেয়, অথবা শহরের নানা গুজব নিয়ে অ্যাপলোন নিকলায়েভিচের সঙ্গে আলোচনা করতে বসে।

সে সবরকম সমাজে যাতায়াত করে, প্রচুর মদ খায়, ছবি কেনে, বাড়ি তৈরি করে এবং সবসময় পড়ে।

সে পড়ে, যা হাতে আসে তাই পড়ে। বাড়ি ফিরলে খানসামারা যখন তার পোশাক খুলতে থাকে তখনো সে একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। পড়া শেষ করে ঘুমতে যায়, ঘুম থেকে উঠে ক্লাব-ঘরের গল্প গুজবে মেতে ওঠে, গাল-গল্প শেষ করে মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে মেতে ওঠে, তারপর আবার মদ থেকে গাল গল্প, পড়া। মদ্যপান ক্রমেই তার পক্ষে দৈহিক ও নৈতিক প্রয়োজন হয়ে উঠল। ডাক্তাররা যত সাবধান করছে, ততই তার মদ খাওয়া বাড়ছে।

সকালে যতক্ষণ পর্যন্ত পেটে কিছু পড়ে না ততক্ষণই পুরনো প্রশ্নগুলিকে মীমাংসার অতীত ও ভয়ংকর বলে মনে হয়, তখন পিয়ের তাড়াতাড়ি একটা বই টেনে নেয়, আর তখন কেউ দেখা করতে এলে খুশি হয়।

কখনো তার মনে পড়ে, কোথায় যেন শুনেছে যুদ্ধরত সৈন্যরা যখন শত্রুর গোলাবর্ষণের মুখে ট্রেঞ্চে আটকা পড়ে তখন কোনো কিছু করার না থাকলে সেই বিপদকে সহ্য করতে একটা কাজ খুঁজে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। পিয়েরের মনে হয় সব মানুষই সেই সৈন্যদের মতে, জীবন থেকে সরে এসে একটা আশ্রয় খোঁজে : কেউ উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, কেউ তাস খেলায়, কেউ আইন প্রণয়নে, কেউ মেয়েমানুষ, কেউ খেলায়, কেউ ঘোড়ায়, কেউ রাজনীতিতে, কেউ খেলাধুলায়, কেউ মদে, আর কেউ সরকারি কাজকর্মে। পিয়ের মনে করে, কিছুই তুচ্ছ নয়, কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সব সমান–শুধু যথাসম্ভব আত্মরক্ষা করে চলা। শুধু জীবনকে, সেই ভয়ংকর জীবনকে না দেখা!

.

অধ্যায়-২

শীতের গোড়াতেই প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কি ও তার মেয়ে মস্কোতে এল। সেসময়ে সম্রাট আলেক্সান্দারের রাজত্বের প্রতি উৎসাহে ভাটা পড়েছে, চারদিকে ফরাসিবিরোধী দেশপ্রেমের হাওয়া বইছে, তার সঙ্গে তার অতীত ইতিহাস, বুদ্ধির প্রখরতা ও মৌলিকতা মিলিয়ে প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কি মস্কোতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সকলের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র এবং সরকারবিরোধী মস্কোপন্থীদের কেন্দ্রমণি হয়ে উঠল।

এক বছরেই প্রিন্স অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়া, সাম্প্রতিক ঘটনাকে ভুলে যাওয়া ও দূর অতীতের ঘটনাকে মনে রাখা, এবং শিশুসুলভ গর্বের সঙ্গে মস্কোর সরকারবিরোধী দলের প্রধানের ভূমিকা গ্রহণ করা প্রভৃতি বার্ধক্যের সব লক্ষণই তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বৃদ্ধ লোকটি সকলেরই সশ্রদ্ধ অনুরাগের পাত্র হয়ে উঠল। বড় বড় আয়না, প্রাকবিপ্লব যুগের আসবাবপত্র ও সুসজ্জিত পরিচারকদলসহ এই সেকেলে প্রকাণ্ড বাড়ি, এবং মনোরমা কন্যা ও শ্রদ্ধাশীলা সুন্দরী ফরাসি নারীপরিবৃত এই কঠোরদর্শন তীক্ষ্ণবুদ্ধি বৃদ্ধ ভদ্রলোক (সে নিজেও বিগত শতাব্দীর এক ধ্বংসস্তূপ) সকলের চোখেই একটি মহৎ ও প্রীতিপ্রদ দর্শনীয় বস্তু হয়ে দেখা দিল। অতিথিরা একবারও ভাবত না, যে দু-ঘন্টা কাল মাত্র তারা এই গৃহস্বামীটিকে দেখতে পেত, তার বাইরেও প্রতিদিন বাইশটি ঘণ্টা এ বাড়িতে আরো একটি ঘনিষ্ঠ পারিবারিক জীবনধারা বয়ে চলে।

সম্প্রতি সেই পারিবারিক জীবন প্রিন্সেস মারির পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। বল্ড হিলসে থাকতে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় ও সেখানকার নির্জনতায় তার মন বেশ তাজা থাকত, মস্কোতে এসে জীবনের সেই শ্রেষ্ঠ আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে, অথচ শহর-জীবনের কোনো সুখ-সুবিধাই তার নেই। সে সমাজে যায় না, সকলেই জানে, নিজের সঙ্গে ছাড়া প্রিন্স মেয়েকে কোথাও যেতে দেবে না, আর নিজের ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য প্রিন্সের পক্ষে বাইরে যাওয়াও সম্ভব নয়, কাজেই কেউই প্রিন্সেস মারিকে ডিনারে এবং সান্ধ্য মজলিসে আমন্ত্রণ করে না। বিয়ের আশাও সে ছেড়ে দিয়েছে। তার সম্ভাবিত পাণিপ্রার্থী যেসব যুবক মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসে তাদের প্রতি বুড়ো প্রিন্সের উদাসীনতা ও বিরূপ মনোভাব সে লক্ষ্য করেছে। তার কোনো বান্ধবীও নেই, এবারকার মস্কো ভ্রমণে এসে দুটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুই তাকে হতাশ করেছে। মাদময়জেল বুরিয়েকে এখন আর তার ভালো লাগে না, নানা কারণেই প্রিন্সেস মারি তাকে এড়িয়ে চলে। যে জুলির সঙ্গে গত পাঁচ বছর ধরে তার পত্রালাপ চলছিল, মস্কোতে দেখা হবার পরে সেও কেমন যেন তার প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েছে। ভাইদের মৃত্যুর ফলে জুলি এখন মস্কোর ধনবতী উত্তরাধিকারিণীদের অন্যতমা, সে এখন উঁচু মহলের সুখের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সবসময়ই সে যুবকদলপরিবৃত হয়ে থাকে, তার নিজের ধারণা এই যুবকরা এতদিনে তার মূল্য বুঝতে শিখেছে। ফলে মস্কোতে প্রিন্সেস মারির কথা বলার মতো কেউ নেই, চিঠি লিখবার মতো কেউ নেই, দুঃখের কথা বলবার মতো কেউ নেই, আর ঠিক এই সময়েই অনেক দুঃখ নেমে এল তার কপালে, প্রিন্স আন্দ্রুর ফিরে আসা ও বিয়ের সময় ক্রমেই এগিয়ে আসছে, কিন্তু সেজন্য বাবাকে প্রস্তুত রাখতে সে যে অনুরোধ জানিয়েছিল তা তো এখনো কার্যে পরিণত করা হয়নি, বস্তুত অবস্থা খুবই নৈরাশ্যজনক, কারণ কাউন্টেস রপ্তভার কথা উঠলেই বুড়ো প্রিন্স একেবারে ক্ষেপে যায়। সম্প্রতি তার সঙ্গে আর একটা নতুন দুঃখ যোগ হয়েছে। ছয় বছর বয়সের ভাইপোকে পড়াতে বসে সে সভয়ে লক্ষ্য করেছে যে ছোট নিকলাস সম্পর্কে তার মনেও তার নিজের বাবার খিটখিটে মেজাজের লক্ষণগুলি প্রকাশ পাচ্ছে। যতবারই সে মনে করে যে ভাইপোকে পড়াবার সময় কিছুতেই মেজাজ খারাপ করে বসে, ছেলেটির হাত ধরে তাকে ঘরের এককোণে বসিয়ে দেয়। কিন্তু প্রিন্সেস মারির সবচাইতে বেশি দুঃখ বাবার খিটখিটে মেজাজ নিয়ে। বুড়ো প্রিন্স চিরদিনই তার উপর চটা, কিন্তু সম্প্রতি সে মেজাজ যেন নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাবা যদি সারা রাত তাকে মাটিতে শুইয়ে রাখত, তাকে মারধর করত, তাকে দিয়ে জল ও কাঠ বইয়ে আনত, তাহলেও সে নিজের অবস্থাকে কষ্টকর মনে করত না, কিন্তু এই স্বেচ্ছাচারী প্রিয়জনটি শুধু যে তাকে আঘাত করতে ও অপমান করতে জানে তাই নয়, প্রতিটি ব্যাপারে একমাত্র সেই যে দোষী সেটা সাব্যস্ত করতেও জানে। সম্প্রতি বাবার আচরণে এমন একটা লক্ষণ দেখা দিয়েছে যেটা প্রিন্সেস মারিকে সবচাইতে বেশি কষ্ট দিচ্ছে, সেটা হচ্ছে মাদময়জেল বুরিয়ের সঙ্গে বাবার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা। ছেলের বিয়ের অভিপ্রায় জানবার প্রথম মুহূর্তে যে ধারণাটা পরিহাসের সূত্রে তার মনে এসেছিল–অর্থাৎ আন্তু যদি বিয়ে করে তাহলে সেও বুরিয়েকে বিয়ে করবে–সেই ধারণা যেন ক্রমেই সুখের মূর্তি ধরে তার কাছে দেখা দিচ্ছে, সম্প্রতি বুড়ো প্রিন্স বুরিয়ের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে এবং বুরিয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে যেন মেয়ের প্রতি অসন্তোষকেই প্রকাশ করতে চাইছে। অন্তত প্রিন্সেস মারির তাই ধারণা।

মস্কোতে একদিন প্রিন্সেস মারির সামনেই বুড়ো প্রিন্স মাদময়জেল বুরিয়ের হাতে চুমো খেল এবং তাকে কাছে টেনে নিয়ে সাদরে আলিঙ্গন করল। প্রিন্সেস মারির মুখ লাল হয়ে উঠল, সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পরে মাদময়জেল বুরিয়ে হাসতে হাসতে প্রিন্সেস মারির ঘরে ঢুকে সুললিত স্বরে মজার মজার কথা বলতে লাগল। প্রিন্সেস মারি অতি চোখের জল মুছে ফেলল, কি করছে না বুঝেই ভাঙা গলায় তারস্বরে চিৎকার করে উঠল : তার দুর্বলতার সুযোগড় নিয়ে…কী সাংঘাতিক, নিচ, অমানুষিক…সেকথা শেষ করতে পারল না, আমার ঘর থেকে চলে যাও, বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

পরদিন প্রিন্স মেয়ের সঙ্গে একটা কথাও বলল না, কিন্তু মেয়ে লক্ষ্য করল যে ডিনারের সময় সে হুকুম দিল, মাদময়জেল বুরিয়েকে সকলের আগে খাবার পরিবেশন করা হোক। ডিনারের পরে কফি পরিবেশন করতে এসে পরিচারক যখন অভ্যাসবশত প্রিন্সেসকে দিয়ে শুরু করল, তখন প্রিন্স হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে ফিলিপকে লক্ষ্য করে হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মারল এবং তক্ষুণি নির্দেশ দিল যে তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে।

প্রিন্স চিৎকার বলে বলল, লোকটা কথার অবাধ্য…দুইবার বলেছি…কিন্তু সে শোনেনি! এ-বাড়িতে এই মহিলাই প্রধানা, সেই আমার শ্রেষ্ঠ বান্ধবী। তারপর এই প্রথম প্রিন্সেস মারিকে সম্বোধন করে বলল, কাল যেমন করেছ আর কখনো যদি ওর সামনে নিজের অবস্থার কথা ভুলে যাও তাহলে আমিই তোমাকে বুঝিয়ে দেব এ-বাড়ির কর্তা কে। চলে যাও! আর যেন তোমাকে দেখতে না হয়, ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও!

প্রিন্সেস মারি মাদময়জেল বুরিয়ের কাছে ক্ষমা চাইল এবং নিজের জন্য ও পরিচারক ফিলিপের জন্য বাবার কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিল।

সেই সব মুহূর্তে ত্যাগের একটা গর্বের ভাব প্রিন্সেস মারির মনে সঞ্চিত হল। আর হঠা হয় তো সেই বাবা তারই সামনে জোড়া খুঁজেতে লাগল, চশমার কাছেই হাতড়েও সেটাকে দেখতে পেল না, অথবা দুর্বল পায়ে ভুল করে পা ফেলল, অথবা তার চাইতেও যা খারাপ, হয়তো ডিনারে বসে সঙ্গীসাথীর অভাবে সেখানেই হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল, তোয়ালেটা নিচে পড়ে গেল, আর মাথাটা কাঁপতে কাঁপতে প্লেটের উপরেই এলিয়ে পড়ল। সেইসব মুহূর্তে নিজের উপরেই রাগ করে সে ভাবল, মানুষটি বুড়ো হয়েছে, দুর্বল হয়েছে আর আমি কিনা তাকেই শাস্তি দিচ্ছি।

.

অধ্যায়-৩

১৮১১ সালে মস্কোতে একজন ফরাসি ডাক্তার-মেতিভিয়ের-বাস করত। তখন তার খুব নামডাক। লোকটি অত্যন্ত দীর্ঘকায়, সুদর্শন, ফরাসিদের মতোই অমায়িক, এবং মস্কোসুদ্ধ লোক বলে সে অসাধারণ চতুর। সব বড় বড় বাড়িতেই তার ডাক পড়ে, শুধু ডাক্তার হিসেবেই নয়, সমপর্যায়ের একজন মানুষ হিসেবে।

প্রিন্স নিকলাস চিরকাল শুষুধপত্রকে ঠাট্টা করে এসেছে, কিন্তু ইদানীং মাদময়জেল বুরির্টের পরামর্শক্রমে এই ডাক্তারটিকে তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার অনুমতি দিয়েছে এবং তার সঙ্গে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। মেতিভিয়ের সপ্তাহে দুইদিন প্রিন্সকে দেখতে আসে।

৬ই ডিসেম্বর-সেন্ট নিকলাস দিবস এবং প্রিন্সের নামকরণ দিবস উপলক্ষে গোটা মস্কো প্রিন্সের সদর ফটকে এসে হাজির হল, কিন্তু সে কাউকে ঢুকবার অনুমতি দিল না, শুধু অল্প কয়েকজনকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করার অনুমতি দিল, আর তাদের নামের একটা তালিকা প্রিন্সেস মারির হাতে তুলে দিল।

মেতিভিয়ের সকালেই প্রিন্সকে শুভকামনা জানাতে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে গেল। ঘটনাক্রমে নামকরণ দিবসের সেই সকালবেলাটায় প্রিন্সের মেজাজ ছিল ভয়ানক তিরিক্ষি। সারাটা সকাল বাড়িময় ঘুরে ঘুরে প্রিন্স কেবলই সকলের দোষ খুঁজে বেড়াতে লাগল। প্রিন্সেস মারি বাবার এ মেজাজকে ভালোরকমই চেনে-একটা ঝড়ের পূর্বাভাস : যে-কোনো সময় ঝড় উঠতে পারে। সারাটা সকাল প্রিন্সেস মারি যেন একটা গুলি-ভরা কামানের মুখে অনিবার্য বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কাটাতে লাগল। ডাক্তার না আসা পর্যন্ত সকালটা ভালোয়-ভালোয়ই কাটল। ডাক্তারকে স্বাগত জানিয়ে প্রিন্সেস মারি একটা বই নিয়ে বসার ঘরের দরজার কাছেই বসল, পড়ার ঘরের সব কথাবার্তাই সেখান থেকে শোনা যায়।

প্রথমে শোনা গেল শুধু মেতিভিয়েরের গলা, তারপর বাবার গলা, তারপর একসঙ্গে দুজনের গলা, দরজাটা হাঁ-হাঁ করে খুলে গেল, আর চৌকাঠের উপর দেখা গেল ভয়ার্ত মেতিভিয়েরের সুদর্শন মূর্তি এবং ড্রেসিং-গাউন ও ফেজ পরা প্রিন্সকে, রাগে তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে, চোখের মণি দুটো নিচের দিকে ঘুরছে।

প্রিন্স চিৎকার করে বলছে, তোমরা কেন বুঝতে পার না? কিন্তু আমি সব বুঝি! ফরাসি গুপ্তচর, বোনাপার্টের কেনা গোলাম, গুপ্তচর, বোনাপার্টের কেনা গোলাম, গুপ্তচর, আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও! আমি বলছি, চলে যাও… সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

চিৎকার শুনে মাদময়জেল বুরিয়ে পাশের ঘর থেকে একটা ছুটে এসেছে। কাঁধ ঝাঁকুনি দিতে দিতে মেতিভিয়ের তার দিকে এগিয়ে গেল।

বলল, প্রিন্সের শরীরটা ভালো নেই : পিত্তাধিক্য ও রক্তের চাপ। চুপচাপ থাকুন, কাল আমি আবার আসব। ঠোঁটের উপর আঙুল তুলে সে দ্রুত প্রস্থান করল।

পড়ার ঘর থেকে ভেসে এল চটি পায়ে হাঁটার শব্দ ও চিৎকার : গুপ্তচর বিশ্বাসঘাতক, সর্বত্র বিশ্বাসঘাতক। বাড়িতে একমুহূর্তের জন্য শান্তি নেই!

মেতিভিয়ের চলে যাবার পরে প্রিন্স মেয়েকে তার ঘরে ডাকল, আর সব রাগ গিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে। একটা গুপ্তচরকে বাড়িতে ঢোকাবার দোষ তো তারই। সে কি মেয়েকে বলেনি, হ্যাঁ, বলেনি যে একটা তালিকা তৈরি করতে হবে, এবং সে তালিকার বাইরে কাউকে ডাকা চলবে না? তাহলে ওই শয়তানটাকে ঢুকতে দেওয়া হল কেন? সব দোষ তার। এই মেয়েটার জন্যই তার একমুহূর্তও শান্তি নেই, সে শান্তিতে মরতেও পারছে না।

নাম ম্যাম’ম! এবার আমাদের আলাদা হতে হবে, হতেই হবে! সেটা বুঝতে পেরেছ, এটা বুঝতে পেরেছ! আমি আর সইতে পারছি না, এই কথা বলে প্রিন্স ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে শান্ত ভাব দেখাবার চেষ্টা করে বলল, মনেও করো না যে কথাটা আমি রাগের মাথায় বলেছি। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তেই বলেছি, আর সেইভাবেই কাজ হবে-এবার আমাদের ছাড়াছাড়ি হতেই হবে, কাজেই নিজের জন্য একটা জায়গা দেখে নাও।…কিন্তু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না, হাতের মুঠি পাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে-সে তীক্ষ্ণতা শুধু যে ভালোবাসে, ভালোবেসে দুঃখ পায়, তার কণ্ঠেই ফুটতে পারে বলে উঠল : আঃ, যে-কোনো মূর্খও যদি ওকে বিয়ে করত। তারপরেই দরজা বন্ধ করে মাদময়জেল বুরিয়েকে ডেকে পাঠাল।

দুটোর সময় ছজন মনোনীত অতিথি ডিনারের জন্য হাজির হল।

অতিথিরা–বিখ্যাত কাউন্ট রস্তপচিন, প্রিন্স লোপুখিন ও তার ভাইপো, প্রিন্সের সামরিক জীবনের সহকর্মী জেনারেল চাতরভ এবং তরুণদের মধ্যে পিয়ের ও বরিস বেস্কয়–সকলেই প্রিন্সের জন্য অপেক্ষা করছে।

অল্প কয়েকদিন হল বরিস ছুটি নিয়ে মস্কো এসেছে। প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনা তার খুবই প্রবল, আর সেই উদ্দেশ্যে নানা ছুতোয় প্রিন্সের এত কাছাকাছি আসতে পেরেছে যে নিজের বাড়িতে অবিবাহিতদের আমন্ত্রণ না করার যে নীতি বুড়ো প্রিন্স সর্বদা মেনে চলে তার বেলায় সে নীতির ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছে।

ডিনারে বসে সর্বশেষ রাজনৈতিক সংবাদ নিয়ে আলোচনা চলল : নেপোলিয়ন কর্তৃক ওল্ডেনবুর্গের ডিউকের রাজ্য দখল করা এবং তার বিরুদ্ধে যে রুশ মন্তব্য সব ইওরোপিয় রাজদরবারে পাঠানো হয়েছে তার কথা।

ইতিপূর্বে আরো অনেকবার উচ্চারিত একটি মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে কাউন্ট রস্তপচিন বলল, কোনো জলদস্যু একটা জাহাজ দখল করলে তার প্রতি যে আচরণ করে, নেপোলিয়ন ইওরোপকে নিয়ে সেইরকমই আচরণ করছে। শুধু অবাক হতে হয় মুকুটধারীদের দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা ও অন্ধত্ব দেখে। এবার পোপের পালা এসেছে, ক্যাথলিক গির্জার প্রধানকে গদিচ্যুত করতেও নেপোলিয়নের বিবেকে বাঁধেনি-অথচ সকলেই চুপচাপ! একমাত্র আমাদের সম্রাটই ওন্ডেনবুর্গের ডিউকের রাজ্য দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন…এমন কি, এর বেশি আর কিছু বলা ঠিক হবে না বুঝতে পেরে কাউন্ট রস্তপচিন থেমে গেল।

প্রিন্স বলকনস্কি বলল, ওন্ডেনবুর্গ রাজ্যের পরিবর্তে অন্য রাজ্য দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি যেরকম আমার ভূমিদাসদের বল্ড হিলস থেকে বগুচাবোত অথবা আমার রিয়াজান জমিদারিতে বদলি করতে পারি তেমনই বোনাপার্টও ডিউকদের ইচ্ছামতো বদলি করতে চায়।

সসম্মানে আলোচনায় যোগ দিয়ে বরিস বলল, ওল্ডেনবুর্গের ডিউক কিন্তু প্রশংসনীয় চারিত্রিক দৃঢ়তার সঙ্গে তার এই দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছেন।– প্রিন্স বলকনস্কি যুবকটির দিকে তাকাল, যেন কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তাকে বড় বেশি ছেলেমানুষ মনে করে সে ইচ্ছা ত্যাগ করল।

ওল্ডেনবুর্গের ব্যাপার নিয়ে আমাদের প্রতিবাদ-পত্রটা আমি পড়েছি। চিঠিটার শব্দ-প্রয়োগ এতই খারাপ যে আমি অবাক হয়ে গেছি, যেন একটা অতিপরিচিত বিষয় নিয়ে কথা বলছে এমনই সুরে কাউন্ট রস্তপচিন মন্তব্য করল।

পিয়ের অবাক বিস্ময়ে রস্তপচিনের দিকে তাকাল, চিঠির খারাপ শব্দপ্রয়োগ নিয়ে তার এত মাথাব্যথা কেন সেটা তার মাথায় ঢুকল না।

মুখে বলল, দেখুন কাউন্ট, চিঠিটার বক্তব্য যখন বেশ জোরালো তখন তার শব্দ-প্রয়োগে কি যায় আসে?

কাউন্ট রস্তপচিন জবাব দিল, না হে মশাই, আমাদের সৈন্যসংখ্যা যখন পাঁচ লক্ষ তখন একজন ভালো লিখিয়ে পাওয়া আরো সহজ হওয়া উচিত।

চিঠির শব্দ-প্রয়োগ নিয়ে কাউন্টের অসন্তুষ্টিটা এবার পিয়ের বুঝতে পারল।

বুড়ো প্রিন্স বলল, ভালো কলমচি গজিয়ে ওঠা উচিত তো ছিলই। পিটার্সবুর্গে তারা তো সর্বদাই লিখে চলেছে–শুধু চিঠিপত্র নয়, নতুন নতুন আইন পর্যন্ত। আমার আন্দু তো সেখানে রাশিয়ার জন্য আইনের একটা গোটা বইই লিখে ফেলেছে। এখন তো তারা সব সময়ই লেখে! কাউন্ট অস্বাভাবিকভাবে হেসে উঠল।

আলোচনায় সাময়িকভাবে ছেদ পড়ল, সেই ফাঁকে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে বুড়ো সেনাপতি গলাটা পরিষ্কার করে নিল।

পিটার্সবুর্গে সেনা-পরিদর্শন কালের শেষ ঘটনাটা শুনেছেন কি? নতুন ফরাসি রাজদূতের আচরণটি বড়ই শোচনীয় হয়েছিল।

অ্যাঁ? হ্যাঁ, কিছুটা শুনেছি : সম্রাটের উপস্থিতিতে তিনি বোধহয় অদ্ভুত কিছু বলেছিলেন।

সেনাপতি বলতে লাগল, সম্রাট বোমারু বাহিনীর প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, কিন্তু মনে হল রাজদূতটি সেটা খেয়াল না করে হুট করে বলে ফেললেন; ফ্রান্সে আমরা এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মনোযোগ দেই না। সম্রাট কোনো কথাই বললেন না। পরবর্তী সেনা-পরিদর্শনকালে সম্রাট তার সঙ্গে একটা কথাও বলেননি।

 সকলেই চুপচাপ। ব্যক্তিগতভাবে সম্রাটকে নিয়ে যেখানে কথা সেখানে কোনোরকম মতামত প্রকাশ করাই অসম্ভব।

প্রিন্স বলল, বেয়াদবের দল! মেতিভিয়েরকে চেনেন তো? আজ সকালেই তাকে আমার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। রাগত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তাদের যেন ঢুকতে না দেওয়া হয় এ অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল।

ফরাসি ডাক্তারটির সঙ্গে তার যেসব কথা হয়েছিল সব সবিস্তারে বর্ণনা করে মেতিভিয়ের যে একজন গুপ্তচর সে ধারণার স্বপক্ষে তার যুক্তিগুলোও শুনিয়ে দিল। যদিও যুক্তিগুলো খুবই অসার এবং অপ্রতুল, তবু তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করল না।

খাবার পরে শ্যাম্পেন পরিবেশন করা হল। অতিথিরা দাঁড়িয়ে বুড়ো প্রিন্সকে অভিনন্দিত করল। প্রিন্সেস মারিও তার কাছে এগিয়ে গেল।

ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুড়ো প্রিন্স চুমো খাওয়ার জন্য তার পরিষ্কার কামানো বলিরেখায় ভর্তি গালটা এগিয়ে দিল। বাবার মুখের ভাব দেখেই মেয়ে বুঝতে পারল, সকালের কোনো কথাই সে ভোলেনি, তার সিদ্ধান্ত বলবই আছে, শুধু অতিথিদের উপস্থিতির জন্য এখন সে-কথাগুলি বলতে পারল না।

সেখান থেকে সকলে বসার ঘরে গেল, সেখানে কফি দেওয়া হল।

 প্রিন্স নিকলাস অধিকতর উৎসাহভরে আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশ করল।

বলল, অস্ট্রিয়ার স্বপক্ষে বা বিপক্ষে আমাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়। আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থ সবটাই পূর্বাঞ্চলে, আর বোনাপার্টের ব্যাপারে আমাদের একমাত্র কাজ হল একটা সশস্ত্র সীমান্ত রক্ষা করা এবং একটা দৃঢ় নীতি অনুসরণ করা, তাহলে আর ১৮০৭ সালের মতো রুশ সীমান্ত লংঘন করার সাহস তার হবে না!

কাউন্ট রস্তপচিন বলল, কিন্তু প্রিন্স, ফরাসিদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করব কেমন করে? আমাদের শিক্ষক ও ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে কি আমরা যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে পারি? আমাদের যুবকদের দিকে তাকান, মহিলাদের দিকে তাকান! ফরাসিরা তো আমাদের ভগবান : প্যারিস তো আমাদের স্বর্গরাজ্য!

প্রত্যেককে শোনাবার জন্য সে ক্রমেই গলা চড়িয়ে কথা বলতে লাগল।

ফরাসি পোশাক, ফরাসি ভাবধারা, ফরাসি অনুভূতি! এই তো, আপনি মেতিভিয়েরকে ঘাড় ধরে বের করে দিলেন কারণ সে একটি ফরাসি শয়তান, কিন্তু আমাদের মহিলারা তো নতজানু হয়ে তার পিছনে ছোটেন! গত রাতে আমি একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম, সেখানে প্রতি পাঁচজন মহিলার মধ্যে তিনজন রোম্যান ক্যাথলিক, তারা প্রতি রবিবার উল বোনার জন্য পোপের অনুগ্রহ পেয়ে থাকেন। অথচ যদি অনুমতি করেন তো বলি, তারা সকলেই বসে ছিলেন সাধারণ মান-ঘরের সাইনবোর্ডের মতো প্রায় উলঙ্গ হয়ে। উঃ, আমাদের যুবকদের দেখলে কি মনে হয় জানেন প্রিন্স, মনে হয় যাদুঘর থেকে মহান পিতরের পুরনো মুগুরটা তুলে এনে তাদের সবাইকে রুশ পদ্ধতিতে এমন ধোলাই দিই যাতে এইসব দুর্বুদ্ধি তাদের মাথা থেকে পালিয়ে যায়!

সকলেই চুপ। বুড়ো প্রিন্স রস্তপচিনের দিকে তাকিয়ে সমর্থনসূচক ঘাড় নাড়তে লাগল।

রপচিন উঠে দাঁড়াল, প্রিন্সের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা, তাহলে বিদায় ইয়োর এক্সেলেন্সি, ভালোভাবে থাকবেন!

…বিদায় বন্ধু… তার কথাগুলি যেন সঙ্গীত, তার কথা শুনলে কদাপি ক্লান্তি আসে না! হাতটা চেপে ধরে গালটা এগিয়ে দিয়ে বুড়ো প্রিন্স বলল।

রস্তপচিনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যরাও উঠে পড়ল।

.

অধ্যায়-৪

 প্রিন্সেস মারি বসে বসে বুড়ো মানুষগুলির কথাবার্তা ও অন্যের দোষ ধরার ব্যাপারগুলি শুনছিল, কিন্তু যা শুনল তার কিছুই বুঝল না, তার একমাত্র চিন্তা, তার প্রতি বাবার এই বিরূপ মনোভাব অতিথিদের চোখে পড়েছে কি না। ডিনারের সময় বরিস বেস্কয় যে তার দিকে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছিল তাও সে খেয়াল করেনি। বরিস বেস্কয় ইতিমধ্যেই তিনবার তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

 বুড়ো ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। অতিথিরাও চলে গেছে। ঘরে শুধু প্রিন্সেস মারি ও পিয়ের। টুপিটা হাতে নিয়ে হাসিমুখে পিয়ের বলল, আমি আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারি কি? বলতে বলতেই সে পাশের হাতল চেয়ারটায় বসে পড়ল।

প্রিন্সেস মারি বলল, নিশ্চয়। তার চোখের দৃষ্টি যেন বলতে চাইল, আপনি কি কিছুই দেখেননি?

তখন পিয়েরের মেজাজ খুব ভালো। সোজা সামনে তাকিয়ে একটু হেসে শুধাল, ওই যুবকটি কি আপনি অনেকদিন থেকে চেনেন প্রিন্সেস?

কে?

দ্রুবেৎস্কয়।

না, বেশি দিন নয়…

ওকে আপনার ভালো লাগে?

হ্যাঁ, বেশ ভালো লোক। কিন্তু সে-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

কারণ আমি লক্ষ্য করে দেখেছি কোনো যুবক যখন ছুটি নিয়ে পিটার্সবুর্গ থেকে মস্কোতে আসে তখন সাধারণত কোনো ধনবতী উত্তরাধিকারিণীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে নিয়েই আসে।

আপনি তাও লক্ষ্য করেছেন? প্রিন্সেস মারি বলল।

পিয়ের হেসে জবাব দিল, হ্যাঁ। এই যুবকটিকেও দেখছি যেখানেই কোনো ধনবতী উত্তরাধিকারিণী সেখানেই তিনি। বইয়ের পাতার মতোই তার মনের কথা আমি পড়তে পারছি। বর্তমানে কাকে পাকড়াও করবে তাই নিয়ে সে ইতস্তত করছে-আপনাকে, না মাদময়জেল জুলি কারাগিনাকে। তার দিকেও যুবকটির কড়া নজর পড়েছে।

তিনি সেখানেও যান?

 হ্যাঁ, প্রায়ই যান। পূর্বরাগের নতুন বিধির খবর কিছু রাখেন কি? মজার হাসি হেসে পিয়ের বলল।

না, প্রিন্সেস মারি জবাব দিল।

মস্কোর মেয়েদের খুশি করতে হলে আজকাল খুব মন-মরা ভাব দেখাতে হয়! মাদময়জেল কারাগিনার কাছে সে খুবই বিষণ্ণচিত্তে ঘুরে বেড়ায়। পিয়ের বলল।

পিয়েরের সদয় মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, মনের কথা কাউকে বলতে পারলে স্বস্তি পেতাম। সবকিছুই পিয়েরকে বলা দরকার। সে খুব দয়ালু ও উদার। কিছুটা স্বস্তি পাব। সে আমাকে সদুপদেশ দেবে।

আপনি কি তাকে বিয়ে করবেন?

হায় ঈশ্বর, কাউন্ট, এমন অনেক মুহূর্ত আসে যেন মনে হয় যে কোনো লোককে বিয়ে করে ফেলি, অশ্রুসিক্ত গলায় উচ্চস্বরে কথাটা বলে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলতে লাগল, হায়রে, আপনজন কাউকে ভালোবেসেও যদি বোঝা যায় যে তার জন্য আমি কিছুই করতে পারি না, শুধু তাকে দুঃখ দিতেই পারি, কোনো কিছুই বদলাতেও পারি না, সে যে কী কষ্ট! তখন তো একটিমাত্র পথই খোলা থাকে-কোথাও চলে যাওয়া, কিন্তু আমি যাবই বা কোথায়?

ব্যাপার কি প্রিন্সেস? কি হয়েছে?

 কথা শেষ না করেই প্রিন্সেস মারি কেঁদে ফেলল।

আজ যে আমার কি হয়েছে তা আমি নিজেই জানি না। এসব মনে রাখবেন না-যা বলেছি ভুলে যান।

পিয়েরের মনের প্রফুল্লতা সম্পূর্ণ উবে গেল। সাগ্রহে প্রিন্সেসকে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগল, সব কথা খুলে বলে মনের দুঃখ অকপটে জানাতে অনুরোধ করল, কিন্তু প্রিন্সেস মারি বার বার শুধু একই কথা বলতে লাগল : সে যা বলেছে তা যেন পিয়ের ভুলে যায়, সে যে কি বলেছে তাও তার মনে নেই, একটিমাত্র বিপদ ছাড়া আর কোনো বিপদ তার নেই–সেটা হচ্ছে, প্রিন্স আন্দ্রুর বিয়েকে কেন্দ্র করে পিতা-পুত্রে একটা সংঘাতের আশংকা দেখা দিয়েছে।

আলোচনার বিষয় পাল্টাবার জন্য প্রশ্ন করল, রস্তভঙ্গের কোনো খবর জানেন কি? শুনেছিলাম তারা শীঘ্রই আসছে। আমিও আশা করছি, আন্তু যে-কোনো দিন এসে পড়বে। এখানে সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হোক সেটাই আমি চাই।

বুড়ো প্রিন্স সম্পর্কে পিয়ের জানতে চাইল, তিনি এখন ব্যাপারটাকে কি চোখে দেখছেন?

প্রিন্সেস মারি মাথা নাড়ল।

কি যে করি? কয়েক মাসের মধ্যেই তো বছর শেষ হয়ে যাবে। এ যে অসম্ভব। আমি শুধু চাই প্রথম ধাক্কাটা থেকে দাদাকে বাঁচাতে। আমি চাই তারা তাড়াতাড়ি এসে পড় ক। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। আপনি তো তাদের অনেক দিন থেকে চেনেন। সব কথা আমাকে সত্যি করে বলুন তো : মেয়েটি কেমন, আর তার সম্পর্কে আপনার ধারণাই বা কি-প্রকৃত সত্যই জানতে চাই, কারণ আপনি তো জানেন, বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক ঝুঁকি নিয়েই আন্তু এ কাজ করছে, আর তাই আমি জানতে চাই…

অকারণেই লজ্জায় লাল হয়ে পিয়ের বলল, আপনার প্রশ্নের কি জবাব যে দেব বুঝতে পারছি না। আমি সত্যি জানি না তিনি কি রকম মেয়ে, তাকে বিশ্লেষণ করা তো দূরের কথা। তবে তিনি মনোহারিণী, কিন্তু কিসের জন্য মনোহারিণী তাও জানি না। তার সম্পর্কে শুধু এইটুকুই বলতে পারি।

প্রিন্সেস মারি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার মুখের ভাবই বলল : হ্যাঁ, আমিও এই আশা করেছিলাম, এই আশংকা করেছিলাম।

মেয়েটি কি চালাক-চতুরঃ প্রিন্সেস মারি শুধাল।

 তা মনে করি না, তবে-তাও বটে।…না, না, তিনি শুধুই মনোহারিণী।

প্রিন্সেস মারি পুনরায় অসম্মানিসূচক ঘাড় নাড়ল।

আঃ, তাকে পছন্দ করাটাই তো আমি চাই! আমার আগেই যদি তার সঙ্গে আপনার দেখা হয় তো এই কথাটা তাকে বলবেন।

পিয়ের বলল, শুনেছি তারা খুব শিগগিরই এসে পড়বেন।

প্রিন্সেস মারি পিয়েরকে তার পরিকল্পনার কথা জানাল, রস্তভরা পৌঁছবার পরেই সে ভাবী বৌদির সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলবে এবং বুড়ো প্রিন্সকে তার প্রতি সদয় করে তুলতে চেষ্টা করবে।

.

অধ্যায়-৫

 পিটার্সবুর্গে কোনো ধনী যোগাড় করতে না পেরে সেই উদ্দেশ্য নিয়েই বরিস মস্কোতে এসেছে। সেখানে দুই ধনবতী উত্তরাধিকারিণী জুলি ও প্রিন্সেস মারিকে নিয়ে সে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেছে। শাদাসিদে আচরণ সত্তেও জুলির তুলনায় প্রিন্সেস মারিকেই তার বিশেষ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে, অথচ যে কারণেই হোক তার সঙ্গে ঠিকমতো পূর্বরাগ জাগিয়ে তুলতে সে পারেনি। বুড়ো প্রিন্সের নামকরণ-দিবসে তাদের সর্বশেষ সাক্ষাতের দিনেও বরিস যতই আবেগের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেছে, প্রিন্সেস মারি যেন তা শুনতেই পায়নি, আর শুনতে পেলেও কালে-ভদ্রে জবাব দিয়েছে।

আর একটু অদুতভাবে হলেও জুলি সঙ্গে সঙ্গেই তার মনোযোগকে স্বাগত জানিয়েছে।

জুলির বয়স সাতাশ বছর। ভাইদের মৃত্যুর পরে সে এখন প্রচুর সম্পত্তির মালিক। দশ বছর আগে সে যখন ছিল সপ্তদশী বালিকামাত্র তখন যে কেউ প্রত্যহ সে বাড়িতে যেতে ভয় পেত পাছে মেয়েটি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং সে নিজেও বাঁধা পড়ে যায়, কিন্তু এখন সে সাহসে ভর করে প্রতিদিনই সেবাড়িতে যেতে পারে এবং তাকে ভাবী বিয়ের কনে হিসেবে না দেখে তার সঙ্গে যৌনসম্পর্কহীন পরিচয় গড়ে তুলতে পারে।

সেই শীতকালটা কারাগিনদের বাড়িটাই ছিল মস্কো শহরের সবচাইতে প্রীতিপদ ও আতিথেয়তার কেন্দ্র। আনুষ্ঠানিক ভোজসভা ছাড়াও অনেক মানুষ, প্রধানত পুরুষ, প্রতিদিন সেখানে জমায়েত হয়, মধ্যরাত পর্যন্ত খানা-পিনা করে এবং সকাল তিনটে পর্যন্ত কাটায়। জুলি কখনো কোনো নাচের আসর, প্রমোদ-ভ্রমণ বা নাটক বাদ দেয় না। তার পোশাকও একেবারে হালফ্যাশনের। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তার মনে কোনো মোহ নেই, সকলকেই সে বলে বেড়ায় যে বন্ধুত্বে বা ভালোবাসায় অথবা জীবনের অন্য কোনো আনন্দে সে বিশ্বাস করে না, তার একমাত্র প্রত্যাশা ওপারের শান্তি। ফলে বাড়িতে যত অতিথি আসে সকলেই তার এই জীবন বৈরাগ্যের গুণকীর্তন করে এবং তার পরে নানা রকম গল্প-গুজব, নাচ-গান, বুদ্ধির খেলা ও কবিতার লড়াইয়ে মেতে ওঠে। কারাগিন-পরিবারে এই শেষোক্ত ব্যবস্থাটির খুব প্রচলন। একমাত্র বরিস এবং অপর কয়েকটি যুবকই জুলির এই বিষণ্ণতাবাদী মনোভাব নিয়ে কথা বলে, জুলিও জাগতিক ব্যাপারের তুচ্ছতা নিয়ে দীর্ঘ সময় তাদের সঙ্গে আলোচনা করে, নানা শোকসূচক রেখাচিত্র, প্রবাদ-বচন ও কবিতায় ভরা অ্যালবামগুলো তাদের দেখায়।

বরিসের প্রতি জুলি একটু বিশেষ রকমের সদয় : জীবনের প্রথম পর্বেই যেভাবে তার স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে তা নিয়ে জুলি দুঃখপ্রকাশ করল, নিজে অনেক দুঃখ পেয়েছে বলে সাধ্যমতো বন্ধুত্বপূর্ণ সান্ত্বনা দেবার প্রস্তাব করল এবং নিজের অ্যালবামটা তার হাতে তুলে দিল। বরিস অ্যালবামে দুটো গাছের ছবি এঁকে তার নিচে লিখল : পল্লীবৃক্ষ, তোমার কালো কালো শাখা আমার উপর ছড়িয়ে দিয়েছে বিষণ্ণ অন্ধকার।

আর একটা পাতায় একটা সমাধি একে তাতে লিখল :

মৃত্যু স্বস্তি দেয়, মৃত্যু শান্তিময়।
 যন্ত্রণার হাত থেকে অন্য আর কি আছে আশ্রয়!

জুলি বলল, এটা চমৎকার হয়েছে।

একটা বই থেকে লিখে রাখা একটি অনুচ্ছেদের আক্ষরিক পুনরাবৃত্তি করে জুলি বলল, বিষাদের হাসিতে আছে এক মনোহারিণী শক্তি। সে যেন অন্ধকারে আলোর শিখা, দুঃখ ও নৈরাশ্যের মধ্যে ক্ষণিকের অবসর, যা দেখায় সান্ত্বনার সম্ভাবনা।

উত্তরে বরিস নিচের পংক্তিগুলি লিখল :

 প্রিয় বিষাদ, স্পর্শকাতর মনের কাছে তুমি বিষময় পুষ্টি,
 তোমাকে না পেলে আমার কাছে সুখ হত অসম্ভব,
হায়, তুমি আমাকে সান্ত্বনা দাও,
আমার ছায়াচ্ছন্ন অবসরের যন্ত্রণাকে তুমি শান্ত কর,
আমার চোখের জলের স্রোতে মিশিয়ে দাও এক ফোঁটা গোপন মাধুর্য।

আন্না মিখায়লভনা প্রায়ই কারাগিনদের বাড়িতে যায়। জুলির মায়ের সঙ্গে তাস খেলতে বসে হাসতে হাসতে জুলির যৌতুক সম্পর্কে কৌশলে খোঁজখবর নেয় (সে পাবে পেঞ্জার দুটো জমিদারি এবং নিঝেগোরদের জঙ্গল)।

মেয়েকে বলল, প্রিয় জুলি, তুমি সর্বদাই মনোরমা ও বিষাদময়ী। মাকে বলল, বরিস বলে, আপনার বাড়িতে এলে তার আত্মা শান্তি পায়। জীবনে সে অনেক ব্যর্থতা সহ্য করেছে। তার মনটা বড়ই নরম। ছেলেকে বলল, দেখ বাবা, জুলিকে আমি যে কতখানি ভালোবেসে ফেলেছি তা বলতে পারি না। কিন্তু তাকে

ভালোবেসে কি থাকা যায়? সে যে দেবদূত! আহা, বরিস, বরিস! একটু থেমে আবার শুরু করল, তার মাকে দেখে আমার বড় কষ্ট হয়। আজ তিনি আমাকে পেঞ্জা থেকে আসা হিসাব ও চিঠিপত্র দেখালেন। আহা বেচারি, তাকে সাহায্য করবার কেউ নেই, সকলেই তাকে কত ঠকাচ্ছে।

মার কথা শুনতে শুনতে বরিস তার অলক্ষ্যে হাসল। মাঝে মাঝে পেঞ্জা ও নিঝেগোরদ জমিদারি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করল।

জুলি আশা করেছিল, বরিস নিজেই তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করবে, আর করলেই সে প্রস্তাব সে গ্রহণ করবে, কিন্তু নানা কারণে বরিস মুখ খুলল না। এদিকে তার ছুটি ফুরিয়ে আসছে। প্রতিটি দিন সারাক্ষণই সে কারাগিনদের বাড়িতে কাটায়, আর প্রতিদিনই মনে মনে সমস্ত বিষয়টা ভেবে নিয়ে নিজেকেই বলে, আগামীকাল বিয়ের প্রস্তাব করবে। কিন্তু জুলির সামনে দাঁড়িয়ে তার লাল মুখ ও থুতনি, তার ভেজা-ভেজা চোখ, বিবাহিত জীবনের উচ্ছ্বসিত আনন্দের মধ্যে ঝাঁপ দেবার উদগ্র বাসনা-এসবকিছু দেখে বরিস কিছুতেই শেষ কথাটি উচ্চারণ করতে পারে না, যদিও অনেক দিন আগে থেকেই সে কল্পনায় নিজেকে পেঞ্জা ও নিঝেগোরদের জমিদারির মালিক বলে ভেবে রেখেছে, এবং তার থেকে আয়ের টাকা কীভাবে কোন কোন খাতে খরচ করবে তাও ঠিক করে রেখেছে। বরিসের এই ইতস্তত ভাব জুলির নজর এড়াল না, কখনো কখনো এ চিন্তাও তার মাথায় এল যে সে বরিসকে আকর্ষণ করতে পারছে না, কিন্তু নারীর সহজাত আত্ম-প্রতারণা সঙ্গে সঙ্গে তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে তার প্রতি ভালোবাসার জন্যই কথাটা বলতে বরিস লজ্জা বোধ করছে। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল ততই সে বিরক্ত হয়ে উঠল, তাই বরিসের যাত্রার কিছু দিন আগেই সে একটা সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা স্থির করে ফেলল। বরিসের ছুটি ফুরোবার ঠিক আগেই আনাতোল কুরাগিন মস্কোতে এসে হাজির হল এবং কারাগিনদের বসার ঘরেও দর্শন দিল, আর জুলিও হঠাৎ সব বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে হাসিখুশিভাবে কুরাগিনের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে উঠল।

আন্না মিখায়লভনা ছেলেকে বলল, দেখ বাবা, আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি, জুলির সঙ্গে বিয়ে দিতেই প্রিন্স ভাসিলি ছেলেকে মস্কো পাঠিয়েছেন। জুলিকে আমি এত ভালোবাসি যে তার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। তুমি কি বল বাবা?

তাকে এভাবে বোকা বানানো হচ্ছে, একটা মাস জুলির পিছনে ঘোরাটা এভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, পেঞ্জার জমিদারির সব আয় হাতছাড়া হয়ে গিয়ে উঠছে সেই বোকা আনাতোলের হাতে-এতে বরিসের কষ্টও কম নয়। সে তখনই কারাগিনদের বাড়িতে ছুটে গেল বিয়ের প্রস্তাব করতে। জুলি কেমন যেন গা-ছাড়াভাবে তার সঙ্গে কথা বলল, বরিস কবে রওনা হচ্ছে সে সম্পর্কে খোঁজখবর করল। যদিও নরম সুরে ভালোবাসার কথা বলার ইচ্ছা নিয়েই বরিস এসেছে, তবু বিরক্তিভরা গলায় মেয়েদের চরিত্রের চটুলতার কথাই বার বার বলতে লাগল। জুলিও অসন্তুষ্ট হয়ে জবাব দিল, মেয়েরা সত্যি সত্যি বৈচিত্র্যের পক্ষপাতী, একই জিনিসের পুনরাবৃত্তিতে তারা ক্লান্তি বোধ করে।

জুলিকে আঘাত করার ইচ্ছা মনে জাগলেও বরিস নিজেকে সংযত করে নিল। বলল, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আমি আসিনি। বরং…

বরিস জুলির মুখের দিকে তাকাল। তার মুখ থেকে কখন সরে গেছে বিরক্তির ছায়া, লোভাতুর প্রত্যাশায় সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বরিসের দিকে। তার মুখের দিকে চোখ তুলে বরিস বলল, তোমার প্রতি আমার মনের কথা তো তুমি জান।

আর কিছু বলার দরকার হল না : জয়ের আনন্দে ও আত্মতুষ্টিতে জুলির মুখখানি জ্বলজ্বল করে উঠল, কিন্তু এক্ষেত্রে যা কিছু বলা হয়ে থাকে সব সে বরিসের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিল-বরিস তাকে ভালোবাসে, অন্য কোনো নারীকে সে কোনোদিন তার মতো করে ভালোবাসেনি। জুলি জানে, পেঞ্জার জমিদারি ও নিঝেগোরদের জঙ্গলের বিনিময়ে এটুকু দাবি সে মিটিয়েই নিল।

বাগদত্তা দুই তরুণ-তরুণী এখন আর বলে না যে গাছেরা তাদের জীবনে অন্ধকার বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দেয়, পিটার্সবুর্গে একটা চমৎকার বাড়ি নেবার পরিকল্পনায় তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকছে, নানা নোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছে, আর একটি সাড়ম্বর বিয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

.

অধ্যায়-৬

 জানুয়ারির শেষের দিকে বুড়ো কাউন্ট রস্তভ নাতাশা ও সোনিয়াকে নিয়ে মস্কো চলে গেল। কাউন্টেস তখনো অসুস্থ, বিদেশে চলাফেরা করতে অক্ষম, অথচ তার সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করাও অসম্ভব। প্রিন্স আন্দ্রু যে কোনোদিন মস্কো পৌঁছে যাবে, বিয়ের পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে, মস্কোর নিকটস্থ জমিদারিটা বিক্রি করে দিতে হবে, তাছাড়া বুড়ো প্রিন্স বলকনস্কি মস্কোতে থাকতে থাকতেই ভাবী পুত্রবধূটিকে একবার দেখিয়ে দেবার সুযোগটাও হাতছাড়া করা যায় না। সেবার শীতকালে রস্তভদের মস্কোর বাড়িটা গরম রাখার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি, আর যেহেতু তারা খুব অল্প দিনের জ্যই এসেছে এবং কাউন্টেসও তাদের সঙ্গে আসেনি, তাই কাউন্ট স্থির করল মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা অখরসিভার বাড়িতেই উঠবে, অনেকদিন ধরে মহিলা এ নিয়ে পীড়াপীড়ি করছিল।

একদা সন্ধ্যায় রস্তভদের চারখানি স্লেজ মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার পুরনো কোনিউশেনি স্ট্রিটের বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা একলাই থাকে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, আর ছেলেরা সকলেই চাকরি করে।

মহিলাটি এখনো বেশ খাড়া আছে, নিজের মতামত সকলকেই স্পষ্ট ভাষায় সোচ্চারে শুনিয়ে দেয়, কারো কোনোরকম দুর্বলতা, আবেগ বা প্রলোভনকে কখনো ক্ষমা করে না।

রস্তভরা যখন এসে পৌঁছল তখনো মহিলাটি শুতে যায়নি। নাকের উপর চশমাটা ঝুলিয়ে মাথাটাকে পিছন দিকে হেলিয়ে হল-ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে কঠোর, কঠিন দৃষ্টিতে নবাগতদের দিকে তাকাল। তাকে দেখে যে কেউ ভাবতে পারত যে যাত্রীদের উপর সে খুব রেগে গেছে এবং এখনই তাদের তাড়িয়ে দেবে, কিন্তু দেখা গেল সে চাকরদের ডেকে অতিথিদের থাকবার ও তাদের জিনিসপত্র রাখবার ব্যবস্থা করে দেবার নির্দেশ দিল।

কাউকে কোনোরকম স্বাগত না জানিয়ে পোর্টম্যান্টোটা দেখিয়ে বলল, কাউন্টের মালপত্র? ওগুলো এখানে নিয়ে এস। ছোট মেয়েরা তাদের বাঁ দিকে নিয়ে যাও। দাসীদের বলল, এখানে ঘোরাঘুরি করছ কেন? যাও, সামোভারটা তৈরি কর! নাতাশাকে কাছে টেনে বল, তুমি তো বেশ মোটাসেটা হয়েছ, আরো সুন্দরী হয়েছ। কাউন্টকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, ফুঃ! আপনি দেখছি ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন! তাড়াতাড়ি পোশাক ছেড়ে নিন! এ যে দেখছি অর্ধেক জমে গেছেন। চায়ের সঙ্গে দেবার জন্য খানিকটা রাম নিয়ে এস!…সোনিয়া সোনা, বুজুর!

পোশাক-আশাক পাল্টে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে সকলে যখন চা খেতে এল তখন মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা পর পর সকলকেই চুমো খেল।

নাতাশার দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, তোমরা যে এখানে এসেছ এবং আমার বাড়িতেই থাক সেজন্য আমি আন্তরিক খুশি হয়েছি। এই আসার মতো সময়!…বুড়ো মানুষটি এসেছেন, তার ছেলেও যে কোনো দিন এসে পড়বে। তার সঙ্গেও তো পরিচয় করতে হবে। এই সময় সোনিয়ার দিকে চোখ পড়ায় তার সামনে এবিষয়ে কথা বলা ঠিক নয় বুঝতে পেরে বলে উঠল, যাক গে, এসব কথা পরে হবে।…কাউন্ট, এবার আপনি শুনুন। কাল আপনি কি চান? কাদের ডাকতে চান? শিনশিন? সে একটা আঙুল বাকাল। নাকে-কাঁদুনি আন্না মিখায়লভনা? তাহলে হল দুই। সঙ্গে তার ছেলেটিও আছে। তার তো বিয়ে! তারপর বেজুখভ, কি বলেন? সেও সস্ত্রীক এখানে এসেছে। সে তত বৌয়ের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল, কিন্তু বৌও পিছু পিছু এসে হাজির। বুধবারে সে আমার সঙ্গে ডিনার খেয়েছে। তারপর মেয়েদের দেখিয়ে বলল, আর ওরা–ওদের আমি প্রথমে নিয়ে যাব ঈশ্বর-জননীর আইবেরিয় তীর্থে এবং সেখান থেকে মহাবাটপাড়দের (সম্ভবত দর্জির কথা বলা হয়েছে) যানে। তোমার তো সবকিছুই নতুন চাই। আমাকে দেখে বিচার করো না : আজকাল আস্তিন এই মাপেরই হয়! এই তো সেদিন তরুণী প্রিন্সেস আইরিনা ভাসিলেনা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, সে একখানা দৃশ্য বটে–দেখে মনে হল যেন দুই হাতে দুটো পিপে পরেছে। তোমরা তো জান, প্রতিদিনই একটা না একটা নতুন ফ্যাশান দেখা দিচ্ছে। তারপর কাউন্টকে জিজ্ঞাসা করল, আর আপনি নিজে কি করবেন?

কাজের উপর কাজ চেপে আছে :কাউন্টেসের জন্য কম্বল কিনতে হবে, এদিকে আবার মস্কোর জমিদারি ও বাড়ির একজন ক্রেতা এসে হাজির। আপনি যদি অনুমতি করেন তো মেয়েদের আপনার কাছে রেখে আমি একটা দিনের জন্য জমিদারি থেকে ঘুরে আসব।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমার কাছে তারা নিরাপদেই থাকবে। যেখানে তাদের যাওয়া দরকার সেখানে নিয়ে যাব, একটু-আধটু বকুনি দেব, আবার ভালোও বাসব।

পরদিন মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা মেয়েদের নিয়ে ঈশ্বর-জননীর পবিত্র স্থানে গেল এবং সেখান থেকে গেল মহাবাটপাড়ের দোকানে, সে লোকটি মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকে এতই ভয় করে যে তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য লোকসান দিয়েও তার পোশাক বানিয়ে দেয়। বিয়ের পুরো পোশাকটাই সেখানে বানাতে দেওয়া হল। বাড়ি ফিরে অন্য সকলকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মারিয়া দিমিত্রয়েভনা নাতাশাকে নিজের কাছে রেখে দিল, তারপর নিজের হাতল-চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিয়ে বলল, এবার আমরা কথা বলি। তোমার ভাবী বরের জন্য তোমাকে অভিনন্দন জানাই। একটি ভালো ছেলেকেই বঁড়শিতে গেঁথেছ! তোমাকে নিয়ে আমি খুশি, এই এতটুকু বয়স থেকে তাকে আমি চিনি। মাটি থেকে ফুট দুই উঁচুতে হাত রেখে সে বলল। নাতাশার মুখ সুখে আরক্তিম হয়ে উঠল। তাকে এবং তার পরিবারের সকলকেই আমি পছন্দ করি। এবার শোন! তুমি তো জান, বুড়ো প্রিন্স নিকলাস ছেলের বিয়েটা পছন্দ করছে না। বুড়ো একটু গোলমেলে মানুষ! অবশ্য প্রিন্স আন্দ্রু ছেলেমানুষ নয়, তাকে ছাড়াই সে চলতে পারে, কিন্তু বাবার অমতে কোনো পরিবারে ঢোকাটা তো ভালো কথা নয়। লোকে শান্তিতে, ভালোবাসার ভিতর দিয়েই সে কাজটা করতে চায়। তুমি তো বুদ্ধিমতী মেয়ে, কীভাবে কি করতে হয় তাও জান। দয়ালু হও, বুদ্ধি খরচ কর। সব ঠিক হয়ে যাবে।

নাতাশা চুপ করে রইল, প্রিন্স আন্দ্রুকে ভালোবাসার ব্যাপারে অপর কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটা সে পছন্দ করে না।

দেখ, প্রিন্স আন্দ্রুকে আমি অনেকদিন থেকে জানি, তোমার ভাবী-ননদ মারিও আমার প্রিয়। ননদিরা কুটিলাই হয়ে থাকে, কিন্তু এটি একটা মাছির গায়েও কখনো হাত তুলবে না। সেই আমাকে বলেছে তোমাদের দুজনকে দেখা করিয়ে দিতে। কাল বাবাকে সঙ্গে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করো : তুমি তো বয়সে তার থেকে ছোট। পরে সে এসে দেখবে তার বোন ও বাবার সঙ্গে তোমার আগেই পরিচয় হয়েছে, আর তোমাকে তারা পছন্দ করেছে। ঠিক বলছি কি না? সেটাই কি ভালো হবে না?

হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে, নাতাশা অনিচ্ছাসত্ত্বেও জবাব দিল।

.

অধ্যায়

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার পরামর্শমতো কাউন্ট রস্তভ পরদিনই নাতাশাকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কি সঙ্গে দেখা করতে গেল। কাউন্ট কিন্তু খুশিমনে বাড়ি থেকে বের হল না, তার মনে যথেষ্ট ভয় ছিল। সৈন্যদল ভুক্তিকরণের সময় বুড়ো প্রিন্সের সঙ্গে তার সর্বশেষ যে সাক্ষাৎ হয়েছিল তখনকার কথা তার খুব ভালোই মনে আছে, প্রিন্সকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানালে তার জবাবে তার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের নাম না পাঠানোর জন্য তাকে প্রিন্সের সক্রোধ বকুনি শুনতে হয়েছিল। নাতাশার মেজাজ কিন্তু খুব খুশি, সব-সেরা গাউনটি পরে মনে মনে ভাবছে : তারা আমাকে পছন্দ না করেই পারে না, সকলেই তো সবসময় আমাকে পছন্দ করে, তারা যা চাইবে আমি তাই করব : তার বাবাকে ভালোবাসব, তার বোনকে ভালোবাসব, কাজেই তাদের তো আমাকে পছন্দ না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না…

পুরনো বাড়িটার গাড়ি-বারান্দায় ঢুকেই কাউন্ট আধা রসিকতা ও আধা আন্তরিকতার সঙ্গে বলে উঠল, প্রভু আমাদের করুণা করুন। কিন্তু নাতাশা লক্ষ্য করল, তার বাবা কেমন যেন ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়েছে, অত্যন্ত ভীরু গলায় জিজ্ঞাসা করল, প্রিন্স ও প্রিন্সেস বাড়ি আছে কি না।

তাদের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। পরপর কয়েকজন পরিচারকের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের পরে শেষপর্যন্ত একটি বিরূপদর্শন বুড়ো পরিচারক রস্তভদের জানিয়ে দিল যে প্রিন্স কারো সঙ্গে দেখা করছে না, তবে তাদের এগিয়ে যেতে অনুরোধ করেছে। অতিথিদের প্রথম অভ্যর্থনা করল মাদময়জেল বুরিয়ে। বাবা ও মেয়েকে বিশেষ ভদ্রতা সহকারে স্বাগত জানিয়ে তাদের প্রিন্সেসের ঘরে নিয়ে গেল। প্রিন্সেসকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, মুখের এখানে-ওখানে লালের ছোপ ধরেছে, ছুটে এসে অতিথিদের সঙ্গে দেখা করল। প্রথম দৃষ্টিতে নাতাশাকে প্রিন্সেস মারির ভালো লাগল না। মনে হল, মেয়েটির পোশাক বড় বেশি কেতাদুরস্ত, আচরণ বড় বেশি উচ্ছ্বসিত, একটু বা দাম্ভিকও। নাতাশার রূপ, যৌবন ও সুখের প্রতি নারীসুলভ ঈর্ষা ছাড়াও এই মুহূর্তে তার প্রতি প্রিন্সেস মারির মনোভাব প্রসন্নও ছিল না। কারণ তাদের আসার কথা শুনেই বুড়ো প্রিন্স চিৎকার করে বলে দিয়েছে সে তাদের সঙ্গে দেখা করতে চায় না, প্রিন্সেস মারির ইচ্ছা হলে সে দেখা করতে পারে, কিন্তু তাদের যেন কোনোমতেই হাজির করা না হয়। সে দেখা করাই স্থির করেছে, কিন্তু তার মনে সর্বক্ষণই আশংকা রয়েছে, প্রিন্স রস্তভদের আগমনে এতই চটে আছে যার ফলে যে-কোনো সময়ে সে একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসতে পারে।

লক্ষ্মী প্রিন্সেস, এই নাও, আমার গায়ক পাখিটিকে তোমার কাছে এনে দিলাম, পাছে বুড়ো প্রিন্স এসে হাজির হয় এই ভয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে মাথা নুইয়ে কাউন্ট বলল। তোমাদের যে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় হতে চলেছে এতে আমি কত যে খুশি হলাম…বড়ই দুঃখের কথা যে প্রিন্স এখনো অসুস্থ। এই ধরনের আরো কিছু মামুলি কথা বলে সে উঠে দাঁড়াল। প্রিন্সেস, তুমি যদি অনুমতি কর তো নাতাশাকে মিনিট পনেরোর জন্য তোমার কাছে রেখে যাই। আমি গাড়িটা নিয়ে একবার আন্না সেমেনভনার সঙ্গে দেখা করে আসব, এই কাছেই, ডগস স্কয়ারে, তারপর ফিরে এসে ওকে নিয়ে যাব…

পরে কাউন্ট মেয়েকে বলেছিল যে তাদের দুইজনকে মন খুলে কথাবার্তা বলার সুযোগ করে দিতেই সে এই চালটি চেলেছিল, কিন্তু আসলে সে যে বুড়ো প্রিন্সের সঙ্গে দেখা হবার ভয়েই কেটে পড়েছিল সে সত্যি কথাটা মেয়ের কাছে বলেনি। যাই হোক, প্রিন্সেস কাউন্টকে জানাল যে আনন্দের সঙ্গে সে নাতাশাকে তার কাছে রাখবে, আর কাউন্ট যেন যতক্ষণ ইচ্ছা আন্না সেমেনভনার সঙ্গে কাটিয়ে আসে। কাউন্ট চলে গেল।

প্রিন্সেস মারি নাতাশার সঙ্গে একটু নিভৃতেই কথাবার্তা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু মাদময়জেল বুরিয়ে সেই ঘরেই বসে রইল এবং মস্কোর আমোদ-প্রমোদ ও থিয়েটার নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। নাতাশার মনে হল প্রিন্সেস যেন দয়া করে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তাই তাকে তার মোটেই ভালো লাগল না। হঠা সে যেন নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে গেল, আর তাতে প্রিন্সেস মারির মেজাজও খিঁচড়ে গেল। মিনিট পাঁচেক বিরক্তিকর আলোচনার পরেই তারা শুনতে পেল চটি পরা পায়ের জোরালো শব্দ। প্রিন্সেস মারি ভয় পেয়ে গেল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল বুড়ো প্রিন্স, পরনে ড্রেসিং-গাউন, মাথায় শাদা নৈশ-টুপি।

ঢুকেই সে বলতে শুরু করল, আহা, মাদাম!…মাদাম, কাউন্টেস…কাউন্টেস রস্তভা, অবশ্য আমার যদি না হয়ে থাকে…দয়া করে আমাকে ক্ষমা কর…আমি জানতাম না মাদাম। ঈশ্বর সাক্ষী, তুমি যে দর্শন দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছ তা আমি জানতাম না, এ পোশাকে এসেছি শুধু আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে…অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর…ঈশ্বর সাক্ষী, আমি জানতাম না ঈশ্বর শব্দটার উপর এমন অস্বাভাবিক ও অপ্রীতিকরভাবে জোর দিয়ে সে বার বার কথা বলতে লাগল যে প্রিন্সেস মারি আনত চোখে দাঁড়িয়ে রইলনা পারল বাবার দিকে তাকাতে, না নাতাশার দিকে।

নাতাশা দাঁড়িয়ে অভিবাদন, জানাল বটে, কিন্তু তারপর যে কি করবে তা বুঝতে পারল না। শুধু মাদময়জেল বুরিয়ের মুখে স্মিত হাসির রেখা দেখা দিল।

দয়া করে আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর! ঈশ্বর সাক্ষী, আমি জানতাম না, বলতে বলতে নাতাশাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বুড়ো কাউন্ট বেরিয়ে গেল।

মাদময়জেল বুরিয়েই প্রথম এই ভূত-দেখার আতংক কাটিয়ে উঠতে পারল। সে প্রিন্সের অসুস্থতার কথা বলতে লাগল। নাতাশা ও প্রিন্সেস মারি নিঃশব্দে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল, আর যা বলতে চাইছে তা বলতে না পেরে যত বেশিক্ষণ সেভাবে থাকল ততই পরস্পরের প্রতি বিরূপতা বেড়েই চলল।

কাউন্ট ফিরে এলে নাতাশা চলে যাবার জন্য দৃষ্টিকটু রকমের তাড়াতাড়ি করতে লাগল, সেইমুহূর্তে বয়স্কা প্রিন্সেসটির প্রতি তার মনে ঘৃণা দেখা দিল, আধ ঘণ্টার আলোচনার মধ্যে সে একবারও প্রিন্স আন্দ্রুর নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করল না। নাতাশা ভাবল, এই ফরাসি মহিলাটির সামনে আমি তো তার কথা তুলতে পারি না। সেই একই চিন্তা প্রিন্সেস মারিকেও বিঁধছিল। নাতাশাকে কি বলা উচিত ছিল তা সে জানে, কিন্তু সেকথা সে বলতে পারেনি, কারণ মাদময়জেল বুরিয়ে তাতে বাদ সেধেছে। যে কারণেই হোক, বিয়ের কথাটা সে তুলতে পারেনি।

কাউন্ট যখন ঘর থেকে চলে যাচ্ছে তখন প্রিন্সেস মারি তাড়াতাড়ি নাতাশার কাছে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল :

দাঁড়াও, আমি বলতে চাই…

অকারণেই নাতাশা বিদ্রুপের চোখে তার দিকে তাকাল।

প্রিন্সেস মারি বলল, প্রিয় নাতালি, আমি তোমাকে বলতে চাই, দাদা যে তোমাকে পেয়ে সুখী হয়েছে তাতে আমি খুশি…

সে থামল, তার মনে হল, সে সত্যি কথা বলছে না। নাতাশা সেটা লক্ষ্য করল, তার কারণও অনুমান করল।

চোখের জলে গলা আটকে এলেও বাহ্যিক মর্যাদার গুরুত্বের সঙ্গে নির্বিকার স্বরে সে বলল, আমি মনে করি প্রিন্সেস, সেকথা বলার মতো সময় এটা নয়।

কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই তার মনে হল, এ আমি কি বললাম–কি আমি কি করলাম?

.

সেদিন ডিনারের সময় সকলেই নাতাশার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। নিজের ঘরে বসে সে শিশুর মতো কাঁদছে, নাক ঝাড়ছে আর ফেঁপাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে সোনিয়া তার চুলে চুমো খাচ্ছে।

সে শুধাল, নাতাশা, কেন এমন করছ? তাদের নিয়ে তোমার কি যায়-আসে? এসব কেটে যাবে নাতাশা।

কিন্তু তুমি যদি জানতে সেটা কতবড় দোষের ব্যাপার…আমি যেন…

ও কথা বলো না নাতাশা। সেটা তো তোমার দোষ নয়, তাহলে তুমি কেন ভাবছ? আমাকে চুমো খাও, সোনিয়া বলল।

নাতাশা মুখ তুলে বন্ধুর ঠোঁটে চুমো খেয়ে নিজের ভেজা মুখটা তার মুখের উপর চেপে ধরল।

বলল, আমি বলতে পারছি না, আমি জানি না। কারো দোষ নেই, সব দোষ আমার। কিন্তু এ আঘাত যে ভয়ংকর। ওঃ, কেন সে আসছে না?… ।

চোখ লাল করে সে ডিনারে এল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা সবই জানত, তবু সে এমন ভান করতে লাগল যেন নাতাশার এই বিপর্যস্ত ভাব তার চোখেই পড়েনি, সে গলা ছেড়ে কাউন্ট ও অন্য অতিথিদের সঙ্গে হাসি তামাশা শুরু করে দিল।

.

অধ্যায়-৮

সেদিন সন্ধ্যায় রস্তভরা অপেরায় গেল, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা আগে থেকেই একটা বক্সের ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

নাতাশা যেতে চায়নি, কিন্তু মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারল না। সেজেগুজে নাচ ঘরে এসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বড় আয়নাটার দিকে তাকিয়ে দেখল সে তো সুন্দরী, খুব সুন্দরী, সঙ্গে সঙ্গে তার দুঃখ আরো বেড়ে গেল, কিন্তু সে দুঃখ বড় মধুর, বড় মিষ্টি।

হে ঈশ্বর, সে যদি এখানে থাকত তাহলে আমি ওরকম আচরণ করতাম না, ভিন্ন রকম আচরণ করতাম। বোকার মতো সবকিছুতে ভয় পেতাম না, শুধু তাকে আলিঙ্গন করতাম, তাকে জড়িয়ে ধরতাম, জিজ্ঞাসু চোখ মেলে সে আমাকে দেখত, আর আগেকার মতোই হাসত। আর তার চোখ দুটি–সে চোখ যেন আমি দেখতে পাচ্ছি! নাতাশা ভাবতে লাগল। তার বাবা ও বোনকে নিয়ে আমার কিসের মাথাব্যথা? আমি শুধু তাকেই ভালোবাসি, তাকে, তাকে, সেই মুখ, সেই চোখ, সেই হাসি, পুরুষসুলভ অথচ শিশুর মত।…না, না, তার কথা এখন ভাবব না, শুধু ভাবব না নয়, তাকে ভুলে থাকব, আপাতত সম্পূর্ণ ভুলে থাকব। এই অপেক্ষা করে থাকা আর সহ্য করতে পারছি না, এখনই কেঁদে ফেলব! অনেক কষ্টে কান্না চেপে সে আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

গাড়িতে বাবার পাশে বসে বিষণ্ণ চিত্তে সে দেখতে লাগল রাস্তার বাতিগুলো বরফ-ঢাকা জানালার উপর ঝিকমিক করছে, দেখতে দেখতে তার দুঃখ আরো বেড়ে গেল, ভালোবাসার চিন্তায় আরো বেশি করে ডুবে গেল, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যাচ্ছে তাও ভুলে গেল। অন্য সব গাড়ির মাঝখানে পড়ে তাদের গাড়িটাও বরফের উপর দিয়ে খচ-মচ করে এগিয়ে চলল। থিয়েটারে পৌঁছে নাতাশা ও সোনিয়া পোশাক উঁচু করে তাড়াতাড়ি লাফিয়ে নেমে পড়ল। পরিচারকরা কাউন্টকে ধরে নামিয়ে দিল। বারান্দা পার হয়ে অন্য দর্শকদের সঙ্গে তারা তিনজনও প্রথম সারির বক্সগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বাজনার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে।

একটি পরিচারক তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বক্সের দরজা খুলে দিল। বাজনা উচ্চতর হল। এখনো যবনিকা ওঠেনি, বাজনা বাজছে।

সোনিয়া বলল, ঐ দেখ, আলেনিয়া ও তার মা, তাই না?

কাউন্ট বলল, আরে, মাইকেল কিরিলভিচ দেখছি আরো শক্ত-সমর্থ হয়েছে!

আন্না মিখায়লভনাকে দেখ-চুল বাঁধার কী ছিরি!

ওই তো কুরাগিনরা, জুলি–আর তাদের সঙ্গে বরিস। দেখলেই বোঝা যায় যে ওদের পূর্বরাগ চলছে…

দ্রুবেৎস্কয় কি বিয়ের প্রস্তাব করেছে?

হ্যাঁ, আজই তো শুনলাম, রস্তভদের বক্সে এসে শিনশিন বলে উঠল।

একটি লম্বা, সুন্দরী নারী পাশের বক্সটাকে ঢুকল। তার মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ চুলের বিনুনি, ফোলা-ফোলা শাদা গলা ও ঘাড়ের অনেকখানি খোলা, তাতে দুই লহর বড় বড় মুক্তোর মালা জড়ানো। ভারি রেশমি পোশাকের খস খস আওয়াজ তুলে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সে তার বক্সে জাঁকিয়ে বসল।

নাতাশার দৃষ্টি আপনা থেকেই মহিলাটির গলা, ঘাড় ও মুক্তোগুলোর উপর পড়ল। দ্বিতীয়বার সেদিকে তাকাতেই মহিলাটিও ঘাড়টা ফেরাল, এবং কাউন্টের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় মাথা নেড়ে হাসল। মহিলাটি পিয়েরের স্ত্রী কাউন্টেস বেজুখভা। কাউন্ট সমাজের সকলকেই চেনে, ঝুঁকে পড়ে মহিলার সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

কাউন্টেস কি এখানে অনেক দিন এসেছেন? যাব, যাব, আপনার হাতে চুমো খেতে যাব! এখানে একটা কাজে এসেছি, সঙ্গে আমার মেয়েরাও এসেছে। ওরা বলল, সেমেনভনা আশ্চর্য অভিনয় করেন। কাউন্ট পিয়ের তো কখনো আমাদের কথা ভোলেন না। তিনিও কি এখানে এসেছেন?

হ্যাঁ, তারও আসার কথা, জবাবটা দিয়ে হেলেন মনোযোগর সঙ্গে নাতাশার দিকে তাকাল।

 কাউন্ট রস্তভ ভালোভাবে আসনে বসল।

নাতাশার কানে কানে বলল, সুন্দরী, তাই না?

নাতাশা জবাব দিল, আশ্চর্য! এমন নারীর সঙ্গে সহজেই প্রেমে পড়া যায়।

ঠিক সেই সময়ে বাজনা থেমে গেল। বিলম্বে আগত দর্শকরা তাড়াতাড়ি আসনে বসে পড়ল। যবনিকা উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে বক্সের ও স্টলের সকলেই একেবারে চুপ হয়ে গেল। যুবক ও বৃদ্ধ, ইউনিফর্মধারী ও সান্ধ্য পোশাকে সজ্জিত সকল পুরুষ, এবং খালি গলায় ও বুকে মণিমুক্তা ছড়ানো সকল নারী সাগ্রহ কৌতূহলে। মঞ্চের উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করল। নাতাশাও সেইদিকেই দৃষ্টি ফেরাল।

.

অধ্যায়-৯

রঙ্গমঞ্চের মেঝেটা মসৃণ বোর্ড দিয়ে তৈরি, দুই পাশেও গাছপালা আঁকা কার্ডবোর্ড, আর পিছনে বোর্ডের উপর পর্দা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মঞ্চের মাঝখানে লাল বডিস ও শাদা স্কার্ট পরা কতকগুলি মেয়ে বসে আছে। শাদা রেশমি পোশাক পরা একটি মোটাসোটা মেয়ে একপাশে একটা নিচু বেঞ্চিতে বসে আছে, বেঞ্চিটার পিছনে একটুকরো সবুজ কার্ডবোর্ড আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। তারা সকলে কি যেন গাইছে। গান শেষ হলে শ্বেতবসনা মেয়েটি প্রম্পটারের বক্সের দিকে এগিয়ে গেল, আর আঁটোসাটো রেশমি ট্রাউজার পরা একটা লোক পালক ও ছুরি হাতে নিয়ে মেয়েটির কাছে এসে হাত দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইতে লাগল।

প্রথমে লোকটি একা গাইল, তারপর মেট গাইল, তারপর দুজনই থামল আর অর্কেস্ট্রা বাজতে লাগল। তারপর দুজনে একসঙ্গে গাইতে লাগল, আর থিয়েটারের প্রতিটি লোক হাততালি দিয়ে হৈ-চৈ করে উঠল, পুরুষ ও মেয়েটি হাসতে হাসতে দুই হাত ছড়িয়ে অভিবাদন জানাল।

 নাতাশা একে গ্রাম থেকে এসেছে, তার উপর বর্তমানে তার মনের যা অবস্থা, তাতে এসব কিছুই নাতাশার কাছে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর মনে হল। সে অপেরাটা বুঝতেই পারল না, বাজনাও তার কানে গেল না, সে শুধু দেখতে লাগল বিচিত্র পোশাক পরা কিছু নরনারী মঞ্চের উজ্জ্বল আলোয় চলাফেরা করছে। রঙিন কার্ডবোর্ডগুলোও তার চোখে পড়ল। সে তো জানে এ সবই মিথ্যা ও অস্বাভাবিক, তাই প্রথমে অভিনেতা অভিনেত্রীদের জন্য লজ্জা বোধ করলেও পরে তার বেশ মজা লাগল।

একসময়ে গান শুরু হবার আগে সকলেই যখন চুপচাপ এমন সময় রস্তভদের বক্সের কাছাকাছি দিকের স্টলে ঢুকবার দরজাটা ক্যাচ-ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল, আর একজন বিলম্বে আগত দর্শকের পায়ের শব্দ শোনা গেল। শিনশিন ফিসফিস করে বলল, ঐ কুরাগিন এলেন! কাউন্টেস বেজুখভা নবাগতের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, নাতাশা তাকিয়ে দেখল, একজন অসাধারণ সুদর্শন অ্যাডজুটান্ট তাদের বক্সের দিকেই এগিয়ে আসছে। অনেকদিন আগে পিটার্সবুর্গের একটি বল-নাচের আসরে নাতাশা আনাতোল কুরাগিনকে দেখেছে। এখন তার পরিধানে অ্যাডজুটান্টের ইউনিফর্ম, তাতে একটি স্কন্ধত্রাণ ও একটি স্কন্ধ-গিট বসানো। তখন অভিনয় চলছে, তরবারি ও জুতোর ক্ষুরের শব্দ তুলে কার্পেট-পাতা পথের উপর দিয়ে সে এগিয়ে এল। নাতাশার দিকে একবার তাকিয়ে সে তার বোনের কাছে গেল, দস্তানা-পরা হাতটা তার বক্সের কোণায় রেখে মাথাটা নেড়ে নাতাশাকে দেখিয়ে কি যেন জিজ্ঞাসা করল। তারপর স্টলের প্রথম সারিতে দলখভের পাশে বসে বন্ধুর মতো কনুই দিয়ে তাকে একটা গুতো মারল।

কাউন্ট বলল, বোন আর ভাই ঠিক একরকম দেখতে। দুইজনই কী সুন্দর!

প্রথম অঙ্ক শেষ হল। স্টলের দর্শকরা নড়াচড়া শুরু করে দিল, কেউ বাইরে গেল, কেউ ঢুকল। বরিস রস্তভদের বক্সে এল, তাদের অভিনন্দনকে সহজভাবে গ্রহণ করল, ভুরু দুটো তুলে অন্যমনস্ক হাসির সঙ্গে নাতাশা ও সোনিয়াকে বিয়েতে তার বাগদত্তার আমন্ত্রণ জানিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। যে বরিসের সঙ্গে নাতাশা একদিন প্রেমে পড়েছিল তারই আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে নাতাশা তাকে অভিনন্দন জানাল। স্বল্পবাসপরিহিতা হেলেন তার পাশেই বসে প্রত্যেককে দেখে একই হাসি হাসছে, বরিসকেও সেই একই হাসি সে উপহার দিল।

দ্বিতীয় অঙ্কে একটা কবরখানার দৃশ্য দেখা গেল। ক্যানভাসের মধ্যে একটা গোল গর্ত করে চাঁদের আদল আনা হয়েছে, পাদপ্রদীপের আলোগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে, শিঙার গম্ভীর শব্দের তালে তালে কালো জোব্বা পরা একদল লোক ছুরি হাতে নিয়ে দুইদিক থেকে মঞ্চে ঢুকল। তারপর আরো কিছু লোক এখন হাল্কা নীল পোশাক পরা সেই শ্বেতবসনা সুন্দরীকে টানতে টানতে ছুটে এল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই তাকে টেনে নিয়ে গেল না, অনেকক্ষণ ধরে তার সঙ্গে গান করল, তারপর তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। দৃশ্যের অন্তরালে তিনবার ধাতব শব্দ হল এবং প্রত্যেকে নতজানু হয়ে প্রার্থনা-সঙ্গীত গাইতে লাগল। আর এসব কিছুর মাঝে মাঝেই শোনা গেল শ্রোতাদের সোৎসাহ চিৎকার।

দ্বিতীয় অঙ্ক শেষ হবার পরে কাউন্টেস বেজুখভা রস্তভদের বক্সের কাছে এগিয়ে গেল–তার বুকটা সম্পূর্ণ খোলা-বুড়ো কাউন্টকে দস্তানা-পরা আঙুলে ইশারা করে অন্য কারো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে লাগল। বলল, আপনার মনোরমা কন্যাদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিন। সারা শহর তো তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, অথচ আমি তাদের চিনিও না।

নাতাশা দাঁড়িয়ে কাউন্টেসকে অভিবাদন জানাল। এই সুন্দরীর প্রশংসায় তার মুখটা খুশিতে লাল হয়ে উঠেছে। হেলেন বলল, এখন তো আমিও মস্কোপন্থী হতে চাই। কিন্তু এমন সব মণিমুক্তোকে গ্রামের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন এতে আপনার লজ্জা করে না?

আকর্ষণীয় নারীত্বের খ্যাতি কাউন্টেস বেজুখভার আছে। যা তার মনের কথা নয়–বিশেষত সেটা স্তুতিবচন হয়–সেটাকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে সে বলতে পারে।

প্রিয় কাউন্ট, আমি কিন্তু আপনার মেয়েদের দেখাশুনার ভার নিলাম। যদিও এ যাত্রায় আমি এখানে বেশিদিন থাকছি না-আপনারাও থাকছেন না–তবু তাদের খুশি রাখতে চেষ্টা করব। চিরাচরিত মধুর হাসি হেসে নাতাশাকে বলল, পিটার্সবুর্গে তোমার কথা অনেক শুনেছি, তখন থেকেই তোমার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা। তোমার কথা বেস্কয়ার কাছেও শুনেছি। তুমি কি শুনেছ সে বিয়ে করছে? তাছাড়া, আমার স্বামীর বন্ধু, বলকনস্কি, প্রিন্স আন্দ্রু বলকনস্কির কাছেও শুনেছি।

তৃতীয় অংকে একটি রাজপ্রাসাদের দৃশ্য : অনেক মোমবাতি জ্বলছে, আর দেয়ালে ছোট দাড়িওয়ালা অনেক নাইটের ছবি ঝুলছে। মাঝখানে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা সম্ভবত রাজা ও রানী। ডান হাত দুলিয়ে খারাপ সুরে একটা গান গেয়ে রাজা লাল রঙের সিংহাসনে বসে পড়ল। যে কন্যাটি প্রথমে শাদা পোশাক ও পরে হাল্কা নীল পোশাক পরেছিল, এখন তার পরনে শুধু একটা ঢিলে জমা। চুল ছড়িয়ে দিয়ে সে সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রানীকে উদ্দেশ করে সে একটা করুণ গান করল, কিন্তু রাজা কঠোরভাবে হাত নাড়তেই দুইদিক থেকে ছুটে এল নরনারীর দল, এবং সকলে একসঙ্গে নাচতে লাগল। তারপর কর্কশ সুরে বেহালা বেজে উঠল, আর মোটা পা ও শুকনো হাতওয়ালা একটি স্ত্রীলোক হঠাৎ উইংসের পাশে চলে গেল, এবং বডিসটা ঠিক করে নিয়ে আবার মঞ্চের মাঝখানে এসে এক পায়ের উপর আরেক পা ঠুকে লাফাতে শুরু করে দিল। স্টলের প্রতিটি লোক হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, সাবাস! তখন একটি লোক মঞ্চের এককোণে চলে গেল। অর্কেস্ট্রার করতাল ও শিঙা আরো উচ্চ নিনাদে বাজতে লাগল, আর সেই লোকটি খালি পায়ে লাফ দিয়ে অনেক উঁচুতে উঠতে অতি দ্রুত পা দুটো দোলাতে লাগল। লোকটি দুপোর্ত, এই খেলাটা দেখাবার জন্য বছরে সে ষাট রুবল পায়।) স্টলে, বক্সে ও গ্যালারিতে সকলেই হাততালি দিয়ে প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল, আর লোকটি থেমে হাসতে হাসতে সকলকে অভিনন্দন জানাল। তারপর রাজা বাজনার তালে তালে চিৎকার করে উঠতেই সকলে গান ধরল। কিন্তু তখনই হঠাৎ ঝড় উঠল, অর্কেস্ট্রায় ভীষণ-মধুর সুর বাজতে লাগল, সকলে ছুটে চলে গেল, যবনিকা নেমে এল। শ্রোতাদের মধ্যে আবার হৈ-হট্টগোল শুরু হল, সকলের মুখেই উচ্ছ্বসিত চিৎকার : দুপোর্ত! দুপোর্ত! দুপোর্ত! নাতাশার কাছে এখন আর এসব বিস্ময়কর মনে হচ্ছে না। আনন্দে হাসতে হাসতে খুশি মুখে সে চারদিকে তাকাতে লাগল।

দুর্পোত খুব মজাদার নয়? হেলেন জানতে চাইল।

 হ্যাঁ, নাতাশা জবাব দিল।

.

অধ্যায়-১০

 বিরতির সময় হেলেনের বক্সে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এল, দরজাটা খুলে গেল, ঘরে ঢুকল আনাতোল।

অস্বস্তির সঙ্গে নাতাশার উপর থেকে চোখ সরিয়ে আনাতোলের দিকে তাকিয়ে হেলেন বলল, আমার ভাইয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।

নাতাশা মুখ ঘুরিয়ে সুন্দর যুবক অফিসারটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তার পাশেই বসে পড়ে আনাতোল জানাল, এই পরিচয়ের সৌভাগ্যের জন্য অনেকদিন থেকেই সে অপেক্ষা করে ছিল। অভিনয় সম্পর্কে নাতাশার অভিমত জানতে চেয়ে কুরাগিন আরো জানাল, আগের একটা অভিনয়কালে সেমেনভনা মঞ্চের উপর পড়ে গিয়েছিল।

তারপরই হঠাৎ পুরনো পরিচিত বন্ধুর মতো সুরে বলে উঠল, জানেন কাউন্টেস, আমরা একটা সাজগোজ-প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি, আপনাকে তাতে অবশ্যই যোগ দিতে হবে! খুব মজা হবে। আমরা সবাই কারাগিনদের বাড়িতে মিলিত হব। দয়া করে আপনিও আসুন না!

কথা বলার সময় সে কিন্তু একটি মুহূতের জন্যও নাতাশার মুখ, গলা ও খোলা বাহুর উপর থেকে সহাস্য চোখ দুটি সরাল না। নাতাশা নিশ্চিত জানে, তাকে দেখে আনাতোল মুগ্ধ হয়েছে। এতে সে খুশি হল, কিন্তু তার উপস্থিতিতে কেমন যেন বিব্রতবোধ করতে লাগল।

কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ। সেই নীরবতা ভাঙতে নাতাশাই জিজ্ঞাসা করল, মস্কো তার কেমন লাগছে। প্রশ্নটা করেই সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সারাক্ষণই তার মনে হল যে এই লোকটির সঙ্গে কথা বলে সে অনুচিত কাজ করছে। আনাতোল কিন্তু তাকে উৎসাহ দেবার জন্য হাসতে লাগল।

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে নাতাশার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগেনি, কারণ একটা শহর তো ভালো লাগে তার সুন্দরীদের জন্য, তাই নয় কি? সাজগোজ-প্রতিযোগিতায় আসছেন তো কাউন্টেস? অবশ্যই আসবেন। তারপর গলা নামিয়ে বলল, সেখানে আপনিই হবেন সুন্দরীশ্রেষ্ঠা। প্রিয় কাউন্টেস, অবশ্যই আসবেন, আর প্রতিশ্রুতি হিসেবে আপনার ফুলের স্তবকটা আমাকে দিন!

তার কথাগুলি নাতাশা ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু এটা বুঝল যে তার এই দুর্বোধ্য কথাগুলির একটা অশুভ অভিপ্রায় আছে। কি বলবে বুঝতে না পেরে যেন কথাগুলি শুনতেই পায়নি এমনিভাবে সে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু মুখ ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হল, লোকটি তো সেখানেই আছে, তার পিছনেই আছে, খুব কাছেই আছে।

এখন তার মনের কি ভাব? সে কি বিচলিত? ক্রুদ্ধ? আমার কি উচিত শুধরে নেওয়া? নিজেকেই প্রশ্নগুলি করে সে আবার মুখটা না ফিরিয়ে পারল না। সে সোজা আনাতোলের চোখের দিকে তাকাল, আর তার নৈকট্য, আত্ম-প্রত্যয় ও মধুর হাসি নাতাশাকে জয় করে নিল। আনাতোলের মতো নাতাশাও তার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। আর পুনরায় সে সভয়ে অনুভব করল যে তাদের মধ্যে আর কোনো ব্যবধান রইল না।

আবার যবনিকা উঠল। শান্ত, খুশি মনে আনাতোল চলে গেল। যে পৃথিবীতে সে এখন আছে তাকে মেনে নিয়ে নাতাশা বাবার পাশে আর একটা বক্সে গিয়ে বসল। তার মনে হল, এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে যা ঘটছে সেটাই একান্ত স্বাভাবিক, কিন্তু অপরদিকে তার বাগদত্তা প্রণয়ী, প্রিন্সেস মারি, বা গ্রামের জীবনের আগেকার চিন্তা-ভাবনাগুলি মোটেই তার মনে পড়ল না, বরং তার মনে হল সেসব যেন কোনো দূর অতীতের ঘটনা।

চতুর্থ অংকে একটা শয়তান এসে হাত দুলিয়ে নাচতে লাগল এবং শেষপর্যন্ত পায়ের নিচ থেকে বোর্ডটা সরিয়ে নেওয়া হলে সে মঞ্চের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। চতুর্থ অংকের মাত্র এই অংশটাই নাতাশা দেখতে পেল, সে তখন উত্তেজনায় ও যন্ত্রণায় অভিভূত, আর তার কারণ কুরাগিন, নাতাশা তার দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারছিল না। থিয়েটার থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আনাতোল এগিয়ে এসে গাড়ি ডেকে দিল, তাদের গাড়িতে উঠতে সাহায্য করল। নাতাশাকে তুলে দেবার সময় সে নাতাশার কনুইয়ের উপর বাহুতে চাপ দিল। উত্তেজিত ও লজ্জিত হয়ে নাতাশা ঘুরে দাঁড়াল। আনাতোল মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে চকচকে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বাড়িতে ফিরে তবে নাতাশা সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার করে ভাবতে পারল। হঠাৎ প্রিন্স আন্দ্রুর কথা স্মরণ করে সে আতংকিত হয়ে উঠল। অপেরা থেকে ফিরে সকলেই চা খেতে বসেছিল। নাতাশা হঠাৎ চিৎকার করে উঠে মুখ লাল করে ছুটে বেরিয়ে গেল।

নিজের মনেই বলল, হা ঈশ্বর! আমার সর্বনাশ হয়েছে! কেমন করে তাকে আস্কারা দিলাম? দুই হাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ বসে রইল। কিন্তু তার মাথায় কিছুই আসছে না। সবকিছুই অন্ধকার, অস্পষ্ট, ভয়ংকর। উজ্জ্বল আলোকিত থিয়েটারে বসে দুপোর্তের অভিনয় দেখতে দেখতে যাকে মনে হয়েছিল সহজ, সরল, এখন একাকি বসে তাকেই মনে হচ্ছে দুর্বোধ্য। এটা কি? তার সম্পর্কে যে আতংক আমি বোধ করেছিলাম সেটাই বা কি? এখন এই যে বিবেকের দংশন অনুভব করছি এটাই বা কি? সে ভাবতে লাগল।

রাতে বিছানায় শুয়ে মনের সব কথা শুধু মাকেই খুলে বলা যায়। সোনিয়াকে বলে কোনো লাভ নেই, হয়, সে কিছুই বুঝবে না, আর না হয় তো সব কথা শুনে আতংকে শিউরে উঠবে। কাজেই নাতাশা নিজের এই যন্ত্রণার কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করতে লাগল।

নিজেকে কি আর ভালোবাসার অনুপযুক্ত করে তুলেছি? নিজেকে প্রশ্নটা করেই সান্ত্বনা খুঁজতে আবার নিজেই জবাব দিল : আমি কি বোকা যে এই প্রশ্ন করছি। আমার কি হয়েছে? কিছু হয়নি। আমি কিছুই করিনি, তাকে মোটেই আস্কারা দেইনি। কেউ কিছু জানবে না, আমিও আর কখনো তার সঙ্গে দেখা করব না।…কাজেই একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে কিছুই ঘটেনি, অনুশোচনা করবারও কিছু নেই, আর আন্দু এখনো আমাকে ভালোবাসতে পারে। কিন্তু এখনো কথাটা বলছি কেন? হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর, সে কেন এখানে নেই? মুহূর্তকাল নিজেকে শান্ত রাখলেও পুনরায় কে যেন তাকে বলতে লাগল যে এসব কিছু সত্য হলেও, কিছু না ঘটে থাকলেও, প্রিন্স আন্দ্রুর প্রতি তার ভালোবাসার সেই পবিত্রতার মৃত্যু ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার যেন সে কল্পনায় কুরাগিনের সঙ্গে তার কথাবার্তার সবটাই শুনতে পেল, এবং সেই সাহসী সুদর্শন মানুষটি যখন তার বাহুতে চাপ দিয়েছিল তার তখনকার সেই মুখ, সেই ভঙ্গি, সেই মিষ্টি হাসি সবই সে আবার দেখতে পেল।

.

অধ্যায়-১১

আনাতোল কুরাগিন এখন মস্কোতে বাস করছে কারণ তার বাবাই তাকে পিটার্সবুর্গ থেকে এখানে পাঠিয়েছে। পিটার্সবুর্গে সে বছরে নগদে খরচ করছিল বিশ হাজার রুবল, এবং সমপরিমাণ আরো যেসব ধার-কর্জ করছিল, ঋণদাতারা সে টাকাটা তার বাবার কাছেই দাবি করছিল।

বাবা তাকে জানিয়ে দিয়েছে, এই শেষবারের মতো তার ঋণের অর্ধেক টাকা সে শোধ করে দেবে, তবে এক শর্তে যে প্রধান সেনাপতির অ্যাডজুটান্ট হয়ে তাকে মস্কো চলে যেতে হবে-এ চাকরিটাও বাবাই যোগাড় করে দিয়েছে এবং সেখানে একটি ভালো মেয়ের খোঁজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাবা প্রিন্সেস মারি ও জুলি কারাগিনের নামও উল্লেখ করেছে।

বাবার কথা মেনে নিয়ে আনাতোল মস্কো চলে এসেছে এবং পিয়েরের বাড়িতে উঠেছে। পিয়ের প্রথমে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে স্বাগত জানিয়েছিল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, এমন কি । কখনো কখনো তার সঙ্গে পান-ভোজন করতেও যায়, এবং ঋণের নামে তাকে টাকাও যোগায়।

শিনশিন তো আগেই বলেছে, এখানে এসেই আনাতোল মস্কোর মহিলাদের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে তাদের অবজ্ঞা করে এবং তাদের পরিবর্তে জিপৃসি মেয়েদের ও ফরাসি অভিনেত্রীদের সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়ে-শোনা যায় অভিনেত্রী-প্রধানা মাদময়জেল জর্জেসের সঙ্গে তার সম্পর্কটা নাকি একটু বেশি ঘনিষ্ঠ। কোনো পান-ভোজনের আসর সে বাদ দেয় না, সারা রাত মদ খায়, উঁচু মহলের সব বল-নাচের আসরে ও পার্টিতে সর্বদা হাজির থাকে। কোনো কোনো মহিলার সঙ্গে তার গোপন মেলামেশার কথাও উঠেছে। কিন্তু সে কখনো অবিবাহিতা মেয়েদের, বিশেষ করে ধনবতী উত্তরাধিকারিণীদের পিছনে ছোটে না। তার একটা বিশেষ কারণও আছে। দুবছর আগেই তার একটা বিয়ে হয়েছিল-ঘটনাটা জানে শুধু তার অতিঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। সে সময় রেজিমেন্টের সঙ্গে পোল্যান্ডে থাকাকালে স্বল্পবিত্ত এক পোলিশ জোতদার তাকে বাধ্য করেছিল তার মেয়েকে বিয়ে করতে। আনাতোল অবশ্য অচিরেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছে এবং শশুরকে একটা টাকা পাঠাতে রাজি হয়ে এমন বন্দোবস্ত পাকা করে নিয়েছে যাতে সে নিজেকে অবিবাহিত বলে চালিয়ে যেতে পারে।

আনাতোল সবসময়ই নিজের অবস্থা নিয়ে, নিজেকে নিয়ে, অন্য সবাইকে নিয়ে সন্তুষ্ট। এটা তার সহজতা দৃঢ়বিশ্বাস যে সে যেভাবে কাটাচ্ছে তাছাড়া অন্য কোনোভাবে জীবন কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব, আর জীবনে কোনোদিন সে কোনো নিচ কাজ করেনি। তার একান্ত ধারণা, হাস যেমন জলে বাস করতে বাধ্য তেমনি ঈশ্বর তাকে এমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন যে বছরের ত্রিশ হাজার রুবল খরচ করতে এবং সমাজে একটা গণ্যমান্য আসবে অধিষ্ঠিত হতে সে বাধ্য। এত দৃঢ়তার সঙ্গে সে একটা বিশ্বাস করে যে তার দিকে তাকিয়ে অন্যরাও সেটা বিশ্বাস করে এবং সমাজে তাকে একটা গণ্যমান্য আসন দিতে অথবা টাকা ধার দিতে আপত্তি করে না, আর সেও যত্রতত্র টাকা ধার করে বেড়ায়, কিন্তু কোনোদিন শোধ করে না।

সে জুয়াড়ি নয়, অন্তত টাকা জেতার দিকে তার নজর নেই। সে অহংকারীও নয়। উচ্চকাতক্ষার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আনা যাবে না। সে নিচ নয়, কেউ কিছু চাইলে তাকে ফিরিয়ে দেয় না। সে চায় শুধু আমোদ-প্রমোেদ আর মেয়েমানুষ, আর যেহেতু তার বিবেচনায় এর মধ্যে অসম্মানের কিছু নেই, সেইহেতু তার এই বাসনাপরিতৃপ্তির ফলে অন্যের কি হল না হল তা সে ভাবেই না, সে সত্যি নিজেকে অনিন্দনীয় বলে মনে করে, শয়তান ও খারাপ লোকদের আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে এবং শান্ত বিবেক নিয়ে মাথা উঁচু করে চলে।

দেশ থেকে নির্বাসন এবং পারস্য দেশে দুঃসাহসিক কার্যকলাপের পরে দলখভ সেই বছরই মস্কো ফিরে এসেছে এবং পিটার্সবুর্গের পুরনো দোস্ত কুরাগিনের সঙ্গে মিশে বিলাস, জুয়া ও লাম্পট্যের জীবন চালিয়ে যাচ্ছে, আর তার জন্য কুরাগিনকেই দোহন করে চলেছে।

কুরাগিনের উপর নাতাশার প্রভাব খুব বেশি করেই পড়েছে। অপেরার পরে চা খেতে বসে দলখভের কাছে। নাতাশার বাহু, কাঁধ, পা ও চুলের বর্ণনা দিয়ে বলল যে সে তার সঙ্গে প্রেম করবে। এ ধরনের ভালোবাসাবাসির ফল কি দাঁড়াবে সে বিষয়ে কোনো ধারণাই আনাতোলের নেই, কারণ কখও কোনো কাজের ফলাফল নিয়ে সে মাথা ঘামায় না।

দলখভ বলল, ও মেয়ে প্রথম শ্রেণীর ভায়া, কিন্তু আমাদের জন্য নয়।

আনাতোল বলল, আমার বোনকে বলব তাকে ডিনারে ডাকতে, কি বল?

ওর বিয়েটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে পারতে…

আনাতোল বলল, তুমি তো জান ছোট মেয়েদের আমি ভালোবাসি, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মুণ্ডু ঘুরে যায়।

দলখভ কুরাগিনের বিয়ের খবরটা জানত, বলল, এর মধ্যেই কিন্তু একটি ছোট মেয়ের ফাঁদে পড়েছিলে। খুব সাবধান।

দিল-খোলা হাসি হেসে আনাতোল বলল, আরে, সে জিনিস দু-বার ঘটতে পারে না! কি বল?

.

অধ্যায়১২

 অপেরার পরের দিন রস্তভরা কোথাও বের হল না, তাদের সঙ্গে দেখা করতেও কেউ এল না। নাতাশাকে লুকিয়ে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা কাউন্টের সঙ্গে কি নিয়ে যেন কথাবার্তা বলল। নাতাশা অনুমান করল, তারা বুড়ো প্রিন্স সম্পর্কে কথা বলছে এবং একটা কোনো মতলব আঁটছে, এতে সে মনে মনে অসন্তুষ্ট হল। সে আশা করছে প্রিন্স আন্দ্রু যে-কোনো সময় এসে পড়বে, সে এসেছে কি না জানবার জন্য দুইবার সে চাকরটাকে ভজদভিজেংকা পাঠিয়েছে। সে আসেনি। মস্কোর প্রথম দিনগুলোর তুলনায় এখন সে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। প্রিন্স আন্দ্রুর জন্য অধৈর্য প্রতীক্ষা ছাড়াও প্রিন্সেস মারি ও বুড়ো প্রিন্সের সঙ্গে সাক্ষাতের অপ্রীতিকর স্মৃতি তাকে কষ্ট দিচ্ছে। সে কেবলই ভাবছে, হয় প্রিন্স আন্দ্রুন্তু আসবেই না, আর নয় তো তার আসার আগেই নাতাশার নিজের একটা কিছু ঘটে যাবে। প্রিন্স আন্দ্রুর কথা ভাবতে গেলেই তার মনে পড়ে যায় বুড়ো প্রিন্স, প্রিন্সেস মারি, থিয়েটার ও কুরাগিনের কথা। বার বার সেই একই প্রশ্ন তার সামনে এসে হাজির হচ্ছে : সে কি দোষী নয়, সে কি প্রিন্স আন্দ্রুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকটির প্রতিটি কথা, প্রতিটি ভঙ্গি, মুখের প্রতিটি ভাব তার মনে পড়ে যাচ্ছে। পরিবারের সকলেই নাতাশাকে আগের চাইতে চটপটে ভাবলেও আসলে তার মনের সুখ ও শান্তি আগের চাইতে অনেক কমে গেছে।

 একদিন মাদাম মহাবাটপাড়ের কাছ থেকে একজন দর্জি এল রস্তভদের বাড়ি। নাতাশা মহা খুশি হয়ে বসার ঘরের পাশের ঘরটাতে ঢুকল নতুন পোশাক পরীক্ষা করে দেখতে। হাতাবিহীন একটা বডিস গায়ে দিয়ে পিঠের দিকটা মাপসই হয়েছে কিনা দেখার জন্য আয়নার দিকে মুখ ঘোরাতেই তার কানে এল বাবা ও অন্য একটি স্ত্রীলোকের উচ্ছ্বসিত গলা। স্ত্রীলোকটি হেলেন। নাতাশা বডিসটা খুলে ফেলবার আগেই দরজাটা খুলে গেল, আর লাল ভেলভেটের উঁচু কলারের একটা গাউন পরে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল কাউন্টেস বেজুখভা।

লজ্জারাঙা নাতাশাকে দেখেই চেঁচিয়ে বলল, হায় মায়াবিনী! চমৎকার! না, এর তুলনা হয় না প্রিয় কাউন্ট।কাউন্ট রস্তভ তার সঙ্গেই ঘরে ঢুকেছে। আপনারা মস্কোতে আছেন, অথচ কোথাও যাচ্ছেন না কেন? না, আমি আপনাদের ছাড়ছি না! আজ রাতে মাদময়জেল জর্জেস আমার বাড়িতে আবৃত্তি করে শোনাবেন, কিছু লোকজনও আসবে, আপনি যদি আপনার এই সুন্দর মেয়েদের-এরা তো মাদময়জেল জর্জেসের চাইতেও সুন্দরী নিয়ে না আসেন, তো আপনার সঙ্গে আমার আড়ি! আমার স্বামী এখন ভিতরে আছে, নইলে আপনাদের নিয়ে যেতে তাকে পাঠাতে পারতাম। আপনাকে আসতেই হবে। অতি অবশ্য আসবেন। আটটা থেকে নটার মধ্যে।

দর্জিটি হেলেনের পরিচিত, তার দিকে একবার মাথাটা নাড়ল, দর্জিও সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাল। হেলেন অনবরত কথা বলে চলল, বিশেষভাবে নাতাশার রূপ-কীর্তন। নাতাশার নতুন পাশাকের প্রশংসা করে ধাতুবন্ত্রের তৈরি নিজের পোশাকের প্রশংসা করে জানাল, পোশাকটা প্যারিস থেকে এসেছে, আর নাতাশাকেও ঐরকম একটা পোশাক আনবার পরামর্শ দিল।

বলল, অবশ্য তোমাকে তো সবকিছুতেই মানায় গো মায়াবিনী!

নাতাশার মুখে খুশির হাসি খেলে গেল। কাউন্টেস বেজুখভার প্রশংসার ছোঁয়ায় সে যেন নতুন করে ফুটে উঠেছে।

আমার ভাই কাল আমার সঙ্গে ডিনার খেয়েছে-হাসতে হাসতে মরি আর কি-সে তো কিছু খেল না, শুধু তোমার জন্যই হা-হুঁতাশ করল গো মায়াবিনী! তোমার প্রেমের সে তো একেবারে পাগল হয়ে গেছে সোনা!

একথা শুনে নাতাশার মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল।

হেলেন বলল, আহা, কতই লজ্জা তোমার সুন্দরী! তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে। একজনকে ভালোবাস বলেই ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকতে হবে তার কি মনে আছে। যদি বিয়ের কথাও হয়ে থাকে, তাহলেও তোমার মনের মানুষটি নিশ্চয় চাইবে ঘরের একঘেয়েমি ছেড়ে তুমি সমাজে একটু চলাফেরা কর।

তাহলে আমাদের বিয়ের কথাও এ জানে, ইনি ও আমার স্বামী-ভালোমানুষ পিয়ের-তা নিয়ে কথা বলেছে, হাসাহাসি করেছে। তাহলে তো সবই ঠিক আছে। দুটি বিস্মিত চোখ মেলে নাতাশা হেলেনের দিকে তাকাল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা গম্ভীর মুখে চুপচাপ এসে ডিনারে বসল, বোঝাই যাচ্ছে বুড়ো প্রিন্সের কাছে সে হেরে গেছে। এখনো তার উত্তেজনা কাটেনি, শান্তভাবে কথা বলতেও পারছে না। কাউন্টেসের প্রশ্নের জবাবে জানাল, সব ঠিক আছে, কাল সব বলবে। কাউন্টেস বেজুখভার আগমন ও সন্ধ্যার আমন্ত্রণের সংবাদ শুনে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল :

বেজুখভার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমি রাখতে চাই না, তোমাকেও সেই পরামর্শই দিচ্ছি, যাই হোক, তুমি যখন কথা দিয়েছ-যাও। এতে তোমার মনটাও অন্য দিকে যাবে, সে নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

.

অধ্যায়-১৩

কাউন্ট রস্তভ মেয়েদের নিয়ে কাউন্টেস বেজুখভার বাড়ি গেল। সেখানে বেশ লোকজন এসেছে, কিন্তু প্রায় সকলেই নাতাশার অপরিচিত। যেসব স্ত্রী-পুরুষ এসেছে তাদের প্রায় সকলেরই স্বাধীনভাবে চলাফেরার খ্যাতি আছে–এটা দেখে কাউন্ট রস্তভের মন বিরূপ হয়ে উঠল। মাদময়জেল জর্জেস যুবকবৃন্দ পরিবৃত হয়ে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। মেতিভিয়েরসহ বেশ কয়েকজন ফরাসি ভদ্রলোকও সেখানে হাজির। হেলেন মস্কো আসার পর থেকেই মেতিভিয়ের তার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। কাউন্ট স্থির করল, তাস খেলতে বসবে না, বা মেয়েদের চোখের বাইরে যেতে দেবে না, এবং মাদময়জেল জর্জেসের আবৃত্তি শেষ হওয়ামাত্রই চলে যাবে।

রস্তভদের খোঁজেই আনাতোল দরজায় দেখা দিল। কাউন্টকে অভ্যর্থনা জানিয়েই সে নাতাশাকে অনুসরণ করল। তাকে দেখামাত্র অপেরার সেই মনোভাব নাতাশাকে পেয়ে বসল-আনাতোলের প্রশংসায় পরিতুষ্ট অহংকার এবং দুজনের মধ্যে একটা নৈতিক ব্যবধানের অনুপস্থিতিজনিত আতংক।

হেলেন সানন্দে নাতাশাকে স্বাগত জানিয়ে তার রূপ ও পোশাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। পোশাক বদলাবার জন্য মাদময়জেল জর্জেস পাশের ঘরে চলে গেল। বসার ঘরের চেয়ারগুলো সাজিয়ে নিয়ে সকলে বসে পড়ল। নাতাশার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে এসে আনাতোল নিজে তার পাশেই বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু কাউন্টের নজর ছিল মেয়ের উপর, সে তাড়াতাড়ি এসে তার পাশে বসে পড়ল। আনাতোল বসল তার পিছনে।

কঠোর বিষণ্ণ দৃষ্টিতে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে মাদময়জেল জর্জেস কিছু ফরাসি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল, সে কবিতায় ছেলের প্রতি নিষিদ্ধ প্রেমের বর্ণনা। কখনো তার গলা চড়ছে, কখনো বা অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, কখনো সগৌরবে মাথাটা তুলে ধরছে, আবার কখনো থেমে গিয়ে চোখ পাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে আবৃত্তি করছে।

চারদিক থেকে রব উঠল, প্রশংসনীয়! স্বর্গীয়! মনের মতো!

 নাতাশা মোটা অভিনেত্রীটির দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু তার সামনে যা ঘটছে তার কিছুই সে দেখল না, শুনল না, বুঝল না। তার শুধু মনে হল এমন একটা আশ্চর্য অর্থহীন জগতে সে এসে পড়েছে যে জগৎ তার পুরনো জগৎ থেকে অনেক দূরে-যে জগতে কি ভালো আর কি মন্দ, কি যুক্তিপূর্ণ আর কি যুক্তিহীন তা জানা অসম্ভব। তার পিছনেই বসে আছে আনাতোল, তার সান্নিধ্য সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে তার মনে জেগেছে প্রত্যাশার একটা শংকিতবোধ।

প্রথম একক আবৃত্তির পরে সকলেই এগিয়ে মাদময়জেল জর্জেসকে ঘিরে উৎসাহ প্রকাশ করতে লাগল।

কাউন্টও ভিড়ের ভিতর দিয়ে অভিনেত্রীটির দিকেই এগিয়ে চলল। নাতাশা তাকে বলল, উনি কী সুন্দরী!

পিছন থেকে আনাতোল বলল, আপনাকে দেখলে কিন্তু তা মনে হয় না! কথাটা সে এমনভাবে বলল যে শুধু নাতাশাটাই সেটা শুনতে পেল। আপনি মনোহারিণী…যে মুহূর্তে আপনাকে দেখেছি তখন থেকেই…

চলে এস নাতাশা, মুখ ফিরিয়ে কাউন্ট বলল।

কয়েকটা আবৃত্তি করে মাদময়জেল জর্জেস চলে গেলে কাউন্টস বেজুখভা অতিথিদের নাচ-ঘরে আমন্ত্রণ জানাল।

কাউন্ট বাড়ি ফিরতে চাইল, কিন্তু হেলেন অনুরোধ করল তারা যেন আজকের বল-নাচটা মাটি করে না দেয়, অগত্যা রস্তভরা থেকে গেল। আনাতোল ভালস-নাচে নাতাশাকে ডাকল এবং নাচের সময় তার কোমরে ও হাতে চাপ দিয়ে বলল, সে একটি কুহকিনী, তাকে সে ভালোবাসে। পরে দুইজনে একটা একোসাসও নাচল, তখন কিন্তু আনাতোল কিছুই বলল না, শুধু নাতাশার দিকে তাকিয়ে রইল। নাতাশা ভীরু চোখ তুলে তার দিকে তাকাল, কিন্তু যা বলতে চেয়েছিল তা বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল।

তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমাকে ওসব কথা বলবেন না। আমি বাগদত্তা, অন্যকে ভালোবাসি। সে আবার আনাতোলের দিকে তাকাল।

তার কথায় আনাতোল বিচলিত হয়নি, দুঃখও পায়নি।

আনাতোল বলল, আমাকে ওকথা বলবেন না। আমি কি করব? শুধু বলতে পারি, আপনার ভালোবাসায় আমি পাগল, পাগল হয়ে গেছি! আপনি যে এত মায়াবিনী সেটা কি আমার দোষ?…এবার আমাদের পালা।

নাতাশা উত্তেজিত, উজ্জীবিত, ভীত চোখ মেলে চারদিকে তাকাতে লাগল, খুশিতে ভরপুর। সে সন্ধ্যায় যা ঘটল তার কিছুই সে বুঝল না। একত্রে তারা একোসাস নাচল, গ্রোসভাতের নাচল। বাবা বলল, বাড়ি চল, কিন্তু সে আরো থাকতে চাইল। সে যেখানে যায়, যার সঙ্গেই কথা বলে, আনাতোলের চোখ দুটি সর্বদাই তার উপর স্থিরনিবদ্ধ।

সাজঘর থেকে পোশাক ঠিক করে বেরিয়ে আসার পরে তার হাতখানি ধরে নরম গলায় আনাতোল বলল, আমি তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি না, কিন্তু আর কোনো দিন আপনাকে দেখতে পাব না তাও কি সম্ভব? আপনার ভালোবাসায় আমি পাগল। আমি কি কোনো দিন…? পথ আটকে দিয়ে আনাতোল নিজের মুখটা তার মুখের খুব কাছাকাছি নিয়ে এল।

আনাতোলের বড় বড় চকচকে দুটি পুরুষসুলভ চোখ নাতাশার চোখের এত কাছাকাছি এসেছে যে সেই দুটি চোখ ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না।

নাতালি? আনাতোল ফিসফিস করে বলল, কিন্তু নাতাশা বুঝতে পারল তার হাতের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে : নাতালি?

আমি জানি না। আমার কিছু বলার নেই, নাতাশার চোখ দুটি বলল।

জ্বলন্ত ঠোঁটের চাপ পড়ল তার ঠোঁটে, আর ঠিক সেইমুহূর্তে সে মুক্তি পেল, হেলেনের পায়ের শব্দ ও পোশাকের খসখস শব্দ শোনা গেল। নাতাশা মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর লাল হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ার্ত চোখে আনাতোলের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।

একটা কথা, শুধু একটা, ঈশ্বরের দোহাই! আনাতোল চেঁচিয়ে বলল।

 নাতাশা থামল। তার একটা কথাই সে শুনতে চায়।

নাতালি, শুধু একটা কথা, শুধু একটা! আনাতোল বার বার বলতে লাগল। কি বলবে বুঝতে না পেরে হেলেন তাদের কাছে না আসা পর্যন্ত আনাতোল একই কথা বলতে লাগল।

হেলেন নাতাশাকে নিয়ে বসার ঘরে ফিরে গেল। নৈশভোজনের জন্য অপেক্ষা না করেই রস্তভরা চলে গেল।

বাড়িতে পৌঁছে নাতাশা সারা রাত ঘুমতে পারল না। সে কাকে ভালোবাসে- আনাতোলকে, না প্রিন্স আন্দ্রুকে, এই মীমাংসার অতীত প্রশ্নই তাকে যন্ত্রণা দিতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রুকে সে ভালোবাসে-গভীরভাবে ভালোবাসে। কিন্তু আনাতোলকেও যে ভালোবাসে তাতেও তো কোনো সন্দেহ নেই। না হলে এসব ঘটল কেমন করে? এরপরেও যদি বিদায় নেবার সময় তার হাসি আমি ফিরিয়ে দিয়ে থাকি, ব্যাপারটাকে এতদূর পর্যন্ত গড়াতে দিয়ে থাকি, তার অর্থ গোড়া থেকেই আমি তাকে ভালোবেসেছি। তার অর্থ, সে দয়ালু, মহৎ, চমৎকার, তাকে ভালো না বেসে আমি পারিনি। আমি যদি তাকে ভালোবেসে থাকি, এবং আর একজনকেও ভালোবেসে থাকি, তাহলে আমি কি করব? এইসব ভয়ংকর প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে সে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল।

.

অধ্যায়-১৪

নানা চিন্তাভাবনা ও কর্মব্যস্ততা নিয়ে সকাল এল। সকলে ঘুম থেকে উঠল, চলাফেরা শুরু করল, কথা বলতে লাগল। দর্জিরা আবার এল, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা হাজির হল। প্রাতরাশে সকলের ডাক পড়ল।

প্রাতরাশের পরে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তার হাতল-চেয়ারটায় বসে নাতাশা ও কাউন্টকে ডেকে আনাল।

তারপর বলতে শুরু করল, শুনুন, সমস্ত ব্যাপারটা আমি ভালো করে ভেবে দেখেছি আর এই আমার পরামর্শ। আপনি জানেন, কাল আমি প্রিন্স বলকনস্কির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে কিছু কথাও হয়েছে…হঠাৎ কি মাথায় ঢুকল তিনি চিৎকার করলেন, কিন্তু চিৎকার শুনে ঘাবড়াবার বান্দা আমি নই। আমার যা বলার ছিল তা বলেছি!

আচ্ছা, আর তিনি? কাউন্ট জিজ্ঞাসা করল।

তিনি? তিনি তো আধা পাগল…আমার কোনো কথাই শুনবেন না। কিন্তু কথা বাড়িয়ে লাভ কি? মেয়েটা তো এদিকে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল। আমার পরামর্শ শুনুন, এখানকার কাজ শেষ করে অত্রানুর বাড়িতে চলে যান…সেখানে অপেক্ষা করুন।

না, না। নাতাশা জোর গলায় বলে উঠল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, হ্যাঁ, ফিরে যাও, সেখানেই অপেক্ষা কর। তোমাদের ভাবী বর যদি এখানে আসে-তাহলে একটা ঝগড়াঝাটি কিছুতেই এড়ানো যাবে না। কিন্তু বুড়োকে একা পেলে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে তারপর সে তোমাদের কাছে যেতে পারবে।

কাউন্ট রস্তভ এ পরামর্শের যুক্তিবত্তার প্রশংসা করে এটাকে মেনে নিল। বুড়োর মতিগতি যদি ফেরে তো তখন মস্কোতে অথবা বল্ড হিলসে তার সঙ্গে দেখা করাই ভালো হবে, আর তা যদি না হয়, তার অমতেই যদি বিয়েটা হয়, তাহলে তো সে বিয়ে একমাত্র অত্রাদণুতেই হতে পারে।

বুড়ো কাউন্ট বলল, খুব সত্যি কথা। মেয়েকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম বলে আমি দুঃখিত।

না, না, দুঃখ করছেন কেন? এখানে যখন এসেছেন তখন তাকে শ্রদ্ধা জানানো আপনার কর্তব্য। কিন্তু তিনি যদি তা না চান-সেটা তার ব্যাপার, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল। তাছাড়া, বিয়ের পোশাক তৈরি হয়ে গেছে, কাজেই আর কিসের জন্য এখানে অপেক্ষা করবেন, যা এখনো তৈরি হয়নি, সেগুলো আমি পরে পাঠিয়ে দেব। আপনাদের ছেড়ে দিতে মন চাইছে না, তবু এটাই সেরা ব্যবস্থা। কাজেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে চলে যান।

হাতের থলের ভিতর থেকে একটা চিঠি বের করে নাতাশার হাতে দিল। প্রিন্সেস মারির চিঠি।

তোমাকে লিখেছে। বেচারি, নিজেকে কত কষ্ট দিচ্ছে। তুমি হয় তো ভেবেছ সে তোমাকে পছন্দ করেনি-তাই নিয়েই তার যত ভয়।

কিন্তু সে তো আমাকে সত্যি পছন্দ করে না, নাতাশা বলল।

বাজে কথা বলো না, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা চেঁচিয়ে উঠল।

আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, আমি জানি সে আমাকে পছন্দ করে না, চিঠিটা নিয়ে নাতাশা সাহসের সঙ্গে বলল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, লক্ষ্মী মেয়ে, ওভাবে কথার জবাব দিতে নেই। আমি যা বলছি সেটাই ঠিক। চিঠির একটা জবাব লিখে দাও!

নাতাশা কোনো জবাব দিল না, প্রিন্সেস মারির চিঠিটা পড়বার জন্য নিজের ঘরে চলে গেল।

প্রিন্সেস মারি লিখেছে, তাদের দুজনের মধ্যে যে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে সেজন্য সে খুব হতাশ হয়ে পড়েছে। তার বাবার মনোভাব যাই হোক, নাতাশা যেন বিশ্বাস করে যে তার দাদা যাকে পছন্দ করেছে তাকে সে ভালোবাসবেই, কারণ দাদার সুখের জন্য সে সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

লিখেছে, অবশ্য মনে করো না যে আমার বাবা তোমার প্রতি বিরূপ। তিনি এখন বৃদ্ধ, অথর্ব, কাজেই ক্ষমার্হ, কিন্তু তিনি ভালো মানুষ, উদার হৃদয়, এবং তার ছেলেকে যে সুখী করতে পারবে তাকেই তিনি ভালোবাসবেন। প্রিন্সেস মারি অনুরোধ করেছে, নাতাশা যেন এমন একটা সময় ঠিক করে দেয় যখন সে এসে নাতাশার সঙ্গে আবার দেখা করতে পারে।

চিঠি পড়া শেষ করে নাতাশা তার জবাব লিখতে লেখার টেবিলে গিয়ে বসল। প্রিয় প্রিন্সেস, যান্ত্রিকভাবে তাড়াতাড়ি ফরাসিতে এটুকু লিখেই সে থামল। আগের দিন সন্ধ্যায় যা সব ঘটেছে তারপরেও সে তার আর কি লিখবে? চিঠিটা সামনে নিয়ে বসে সে ভাবতে লাগল, হ্যাঁ, হ্যাঁ! যা কিছু ঘটেছে, আর এখন তো সবই বদলে গেছে।…তার সঙ্গে কি সব সম্পর্কে ছিঁড়ে ফেলব? সত্যি ফেলব? সে যে ভয়ংকর… এইসব ভয়াবহ চিন্তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য সে সোনিয়ার কাছে গেল।

ডিনারের পরে নাতাশা আবার তার ঘরে গিয়ে প্রিন্সেস মারির চিঠিটা হাতে নিল। ভাবতে লাগল, এও কি হতে পারে যে সব শেষ হয়ে গেছে? এ কি হতে পারে যে এত তাড়াতাড়ি এই ঘটনাগুলো ঘটার ফলে আগেকার সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে? আগেকার সবটুকু অন্য তীব্রতা নিয়েই প্রিন্স আন্দ্রুর প্রতি ভালোবাসার কথা তার মনে পড়ল, আবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝল যে সে কুরাগিনকে ভালোবাসে। সে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নিজেকে দেখতে পেল প্রিন্স আন্দ্রুর স্ত্রীরূপে, তার সঙ্গে যে সুখের ছবিগুলি সে এতদিন কল্পনায় এঁকেছে সেসবই তার মনে পড়ল, আবার সেইসঙ্গে গতকাল আনাতোলের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠল।

সম্পূর্ণ বিমূঢ় হয়ে সে নিজেকেই প্রশ্ন করল, সেটাই ভালো হতে পারে না কেন? একমাত্র তাহলেই আমি সম্পূর্ণ সুখী হতে পারতাম, কিন্তু আমাকে যে বেছে নিতে হবে, অথচ তাদের যে-কোনো একজনকে বাদ দিয়ে আমি সুখী হতে পারি না। কিন্তু যা ঘটেছে সেকথা প্রিন্স আন্দ্রুকে বলা বা তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা দুটোই সমান অসম্ভব। সেই একজনকে পেলে কিছুই হারায় না। কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রুর যে ভালোবাসার মধ্যে আমি এতকাল বেঁচেছিলাম তার আনন্দ কি আমাকে সত্যি সত্যি চিরদিনের মতো বিসর্জন দিতে হবে?

একটা রহস্যময় ভঙ্গি করে ঘরে ঢুকে একটি দাসী ফিসফিস করে বলল, শুনুন মিস, একটি লোক এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলল। দাসী চিঠিটা নাতাশার হাতে দিল।

নাতাশা কোনো কিছু না ভেবে যন্ত্রচালিতের মতো চিঠির সিল ভেঙে যা পড়ল সেটা আনাতোলের প্রেম পত্র, চিঠির একটা শব্দও না বুঝেই সে এটুকু বুঝতে পারল যে এ চিঠি যার কাছ থেকে এসেছে তাকে সে ভালোবাসে। হ্যাঁ, তাকে সে ভালোবাসে, অন্যথায় যা ঘটেছে তা ঘটল কেমন করে? তার প্রেমপত্রই বা তার হাতে এল কেমন করে?

আনাতোলের হয়ে দলখভ কর্তৃর্ক খসড়া করা সেই আবেগ-ভরা প্রেম-পত্র কম্পিত হাতে তুলে ধরে পড়তে পড়তে সে তার মধ্যে নিজের মনের কথার প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পেল।

গতকাল সন্ধ্যা থেকে আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে : তোমার ভালোবাসা পাওয়া অথবা মৃত্যুকে বরণ করা। আমার সামনে আর কোনো পথ নেই, এইভাবে চিঠি শুরু হয়েছে। তারপর লিখেছে, সে জানে নাতাশার বাবা-মা তাকে তার হাতে তুলে দেবেন না-এমন কিছু গোপন কারণ আছে যা শুধু নাতাশার কাছেই সে বলতে পারে–কিন্তু নাতাশা যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে সে শুধু একবার বলুক হ্যাঁ, তাহলে কোনো মানুষের শক্তি নেই তাদের সুখে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। প্রেম সর্বজয়ী। সে নাতাশাকে চুরি করে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে নিয়ে যাবে।

চিঠিটা বিশবার পড়ে, প্রতিটি শব্দের মধ্যে একটা গভীর অর্থ আবিষ্কার করে নাতাশা ভাবল, হ্যাঁ, যা, আমি তাকে ভালোবাসি!

সেদিন সন্ধ্যায় মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার আখারভদের বাড়ি যাবার কথা, মেয়েদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করতে নাতাশা মাথা ধরার কথা বলে বাড়িতেই থেকে গেল।

.

অধ্যায়-১৫

সন্ধ্যার পরে একটু দেরি করে বাড়ি ফিরে সোনিয়া নাতাশার ঘরে গেল। নাতাশা তখনো পোশাক-পরা অবস্থায়ই সোফার উপর ঘুমিয়ে আছে দেখে সে অবাক হল। তার পাশেই টেবিলের উপর আনাতোলের চিঠিটা খোলা পড়ে আছে। সোনিয়া চিঠিটা তুলে পড়ল।

পড়তে পড়তেই ঘুমন্ত নাতাশার দিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করল সে যা পড়ছে তার কোনো আভাস নাতাশার মুখে আছে কি না, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। মুখখানি শান্ত, নম্র, সুখী। পাছে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে বুকটা চেপে ধরে বয়ে ও উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে হাতল-চেয়ারটায় বসে পড়েই সোনিয়া হু হু করে কেঁদে উঠল।

কিছুই আমার চোখে পড়েনি? এতদূর গড়ালই বা কেমন করে? সে কি আর প্রিন্স আন্দ্রুকে ভালোবাসে না? আর কুরাগিনকেই বা সে এতটা আস্কারা দিল কেমন করে? সে যে একটা প্রতারক, শয়তান সেটা তো পরিষ্কার! একথা শুনলে নিকলাস, মহৎ নিকলাস কি করবে? আচ্ছা, গত পরশু, গতকাল ও আজ তার চোখে মুখে যে উত্তেজিত, কঠিন, অস্বাভাবিক ভাব দেখেছি এটাই তার অর্থ। সোনিয়া ভাবতে লাগল। কিন্তু সেই লোকটাকে নাতাশা ভালোবাসে এ তো হতেই পারে না! সম্ভবত কার চিঠি না জেনেই সে চিঠিটা খুলেছে। হয় তো চিঠি পড়ে মনে আঘাত পেয়েছে। একাজ সে করতেই পারে না!

চোখের জল মুছে সোনিয়া পা টিপে টিপে নাতাশার দিকে এগিয়ে গেল।

কোনওমতে শোনা যায় এমনভাবে ডাকল, নাতাশা!

 নাতাশা জেগে উঠেই সোনিয়াকে দেখতে পেল।

 আচ্ছা, তোমরা ফিরে এসেছ?

তারপরই সোনিয়ার বিমূঢ় ভাব দেখে তার মনেও সন্দেহ দেখা দিল।

জানতে চাইল, সোনিয়া, তুমি চিঠিটা পড়েছ?

হ্যাঁ, সোনিয়া মৃদু গলায় বলল।

 নাতাশা উচ্ছ্বসিতভাবে হেসে উঠল।

না সোনিয়া, আমি আর পারছি না। তোমার কাছ থেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারছি না। জান, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি! সোনিয়া, সোনা, সে লিখেছে…

যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না এমনিভাবে সোনিয়া চোখ বড় বড় করে নাতাশাকে দিকে তাকাল।

আর বলকনস্কি? সে শুধাল।

নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, আঃ, সোনিয়া, যদি জানতে আমি এখন কত সুখী! ভালোবাসা যে কি জিনিস তা তুমি জান না…

কিন্তু নাতাশা, সেসবই কি শেষ হয়ে যেতে পারে?

যেন প্রশ্নটা বুঝতে পারছে না এমনিভাবে বিস্ফারিত চোখে নাতাশা সোনিয়ার দিকে তাকাল।

তুমি কি তাহলে প্রিন্স আন্দ্রুকে প্রত্যাখ্যান করছ? সোনিয়া বলল।

 আঃ, তুমি কিছু বোঝ না! বাজে কথা বলো না, শোন। সাময়িক বিরক্তির সঙ্গে নাতাশা বলল।

সোনিয়া তবু বলতে লাগল, কিন্তু এ যে আমি বিশ্বাস করতেই পারছি না। বুঝতেও পারছি না। এ কি করে হতে পারে যে তুমি একটা বছর ধরে একজনকে ভালোবাসলে, আর হঠাৎ…আর, তাকে তো তুমি মাত্র তিন দিন দেখেছ! নাতাশা, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করি না, তুমি ঠাট্টা করছ! তিন দিনে সব ভুলে গিয়ে…

নাতাশা বলল, তিন দিন? মনে হচ্ছে একশ বছর ধরে তাকে আমি ভালোবেসেছি। মনে হচ্ছে তার আগে কাউকে ভালোবাসিনি। তুমি এসব বুঝতে পারবে না। সোনিয়া, একটু সবুর কর, এখানে বস। নাতাশা তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।

এরকম যে ঘটে তা আমি শুনেছি, তুমিও নিশ্চয় শুনেছ, কিন্তু এই প্রথম এ ভালোবাসার স্বাদ পেলাম। এ ভালোবাসা আগেকার মতো নয়। তাকে দেখামাত্রই মনে হল সে আমার প্রভু আর আমি তার দাসী, তাকে না ভালোবেসে থাকতে পারলাম না। হ্যাঁ, তার দাসী! সে যা হুকুম করবে আমি তাই করব। সেসব তুমি বুঝতে পারবে না। আমি কি করতে পারি সোনিয়া? আমি কি করতে পারি? চোখে-মুখে সুখের অথচ ভয়ের ভাব ফুটিয়ে নাতাশা বলতে লাগল।

সোনিয়াও উঁচু গলায় বলল, কিন্তু তুমি কি করছ সেটা ভেবে দেখ। আমি তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। এই গোপন চিঠিপত্র…তাকে এতদূর যেতে দিলে কেমন করে?

নাতাশা জবাব দিল, বলেছি তো আমার নিজের কোনো ইচ্ছা নেই। তুমি কেন বুঝতে পারছ না? আমি তাকে ভালোবাসি!

তাহলে আমি এ হতে দেব না।…আমি বলে দেব! চোখের জল ফেলে সোনিয়া বলল।

কি বলতে চাও তুমি? ঈশ্বরের দোহাই…যদি বলে দাও তো তুমি আমার শত্রু! নাতাশা ঘোষণা করল। তুমি চাও আমি দুঃখ পাই, তুমি চাও আমাদের ছাড়াছাড়ি হোক…

নাতাশার এই ভীতি লক্ষ্য করে সোনিয়া বন্ধুর জন্য লজ্জায় ও করুণায় কেঁদে ফেলল।

 প্রশ্ন করল, কিন্তু তোমাদের দুজনের কি হয়েছে? সে তোমাকে কি বলেছে সে কেন এ বাড়িতে আসে না?

এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নাতাশা দিল না। মিনতি করে বলল, ঈশ্বরের দোহাই সোনিয়া, কাউকে কিছু বলল না, আমাকে কষ্ট দিও না। মনে রেখো, এসব ব্যাপারে অন্যের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়! তোমাকে বিশ্বাস করে সব বললাম…

তবু সোনিয়া বলল, কিন্তু এই গোপনীয়তা কেন? কেন সে এ বাড়িতে আসে না? কেন প্রকাশ্যে তোমার পাণিপ্রার্থনা করছে না? তুমি তো জান প্রিন্স আন্দ্রুন্তু তোমাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে–তাই যদি সত্য হয়, কিন্তু আমি একথা বিশ্বাস করি না! নাতাশা, তুমি কি ভেবে দেখেছ এই গোপন কারণগুলি কি হতে পারে?

নাতাশা অবাক হয়ে সোনিয়ার দিকে তাকাল। এই প্রথম এ প্রশ্নটা তার মনে এসেছে, কি জবাব দেবে তা সে জানে না।

কারণগুলি কি তা আমি জানি না। কিন্তু নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে!

সোনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল।

যদি কোনো কারণ থাকে… সোনিয়া বলতে শুরু করল।

 তার সন্দেহটা বুঝতে পেরে নাতাশা সভয়ে তাকে বাধা দিল।

 সোনিয়া, তাকে সন্দেহ করা যায় না! যায় না, যায় না! বুঝতে পারছ না?

সে তোমাকে ভালোবাসে?

বন্ধুর বুদ্ধির অভাব দেখে করুণার হাসি হেসে নাতাশা তার কথাটারই পুনরাবৃত্তি করল, সে আমাকে ভালোবাসে কি না? সে কি, তুমি তো এই চিঠিটা পড়েছ, তাকে দেখেছ।

কিন্তু সে যদি সম্মানবোধহীন হয়?

সে! সম্মানবোধহীন? শুধু যদি জানতে! নাতাশা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।

সে যদি সম্মানিত লোক হয় তো তার উচিত মনের কথা প্রকাশ্যে বলা, অথবা তোমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করা, আর তুমি যদি একাজ না কর তো আমি করব। আমি তাকে চিঠি লিখব, বাপিকে বলব! সোনিয়া দৃঢ়কণ্ঠে বলল।

কিন্তু তাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না! নাতাশা বলল।

নাতাশা, আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না। আর তুমি এসব কি বলছ! তোমার বাবার কথা, নিকলাসের কথা ভাব।

আমি কাউকে চাই না, তাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসি না। তাকে সম্মান-জ্ঞানহীন বলবার সাহস তোমার হল কেমন করে? নাতাশা আর্তনাদ করে উঠল।

চলে যাও সোনিয়া। আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না, কিন্তু তুমি চলে যাও, ঈশ্বরের দোহাই, চলে যাও! দেখছ আমি কত কষ্ট পাচ্ছি! নাতাশা সক্রোধে চেঁচিয়ে বলল, হতাশা ও চাপা বিরক্তি তার গলায়। সোনিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে ছুটে চলে গেল।

নাতাশা টেবিলে গিয়ে বসল এবং মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে সারা সকাল যে কথা লিখতে পারেনি প্রিন্সেস মারির চিঠির জবাবে সেই কথাই লিখে ফেলল। চিঠিতে সে লিখল, তাদের মধ্যে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে, বিদেশে যাবার সময় তার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে গেছে তারই সুযোগ নিয়ে সে প্রিন্সেস মারিকে মিনতি করছে, সে যেন সবকিছু ভুলে যায়, তার প্রতি সে যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তো তাকে যেন ক্ষমা করে, কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রুর স্ত্রী হতে সে পারবে না। সেইমুহূর্তে নাতাশার কাছে এসবকিছুই একান্ত সহজ, সরল, স্পষ্ট বলে মনে হল।

শুক্রবারে রস্তভদের দেশে ফিরে যাবার কথা, কিন্তু বুধবারেই একজন ভাবী ক্রেতাকে সঙ্গে নিয়ে কাউন্ট তার মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারিতে চলে গেল।

কাউন্ট যেদিন চলে যায় সেইদিনই কারাগিনদের বাড়ির একটা বড় ডিনার-পার্টিতে সোনিয়া ও নাতাশার নিমন্ত্রণ হল, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা দুজনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেল। সেই পার্টিতে আনাতেলের সঙ্গে নাতাশার আবার দেখা হল। সোনিয়া লক্ষ্য করল, তারা এমনভাবে কথা বলছে যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়, আর আগাগোড়াই নাতাশাকে আগের চাইতেও বেশি উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বাড়ি ফিরে নাতাশা নিজের থেকেই প্রসঙ্গটা তুলল।

ছেলেমানুষি আত্মতুষ্টির স্বরে বলল, এই তো সোনিয়া, তার সম্পর্কে কত আজেবাজে কথাই তুমি বলেছ। আজ সব বোঝাঁপড়া হয়ে গেল।

আচ্ছা, কি হল? সে কি বলল? তুমি যে আমার উপর রাগ করনি সেজন্য আমি খুশি হয়েছি নাতাশা! আমাকে সব কথা বল-পুরো সত্যটা বল। সে কি বলেছে?

নাতাশা চিন্তিত হল।

আঃ, সোনিয়া, আমার মতো করে তুমি যদি তাকে জানতে! সে বলেছে…সে আমার কাছে জানতে চাইল, বলকনস্কিকে আমি কি কথা দিয়েছি। তাকে প্রত্যাখ্যান করার স্বাধীনতা যে আমার কাছে তাতে সে খুশি হয়েছে।

সোনিয়া সখেদে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বলল, কিন্তু তুমি তো বলকনস্কিকে প্রত্যাখ্যান করনি?

হয় তো করেছি। হয় তো আমার ও বলকনস্কির মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমাকে এত খারাপ ভাবছ কেন?

আমি কিছুই ভাবছি না, শুধু এটা বুঝতে পারছি না…।

একটু সবুর কর সোনিয়া, সব বুঝতে পারবে। সে যে কী মানুষ তা দেখতে পাবে! আমাকে বা তাকে খারাপ ভেব না। আমি কাউকে খারাপ ভাবি না : সকলকেই আমি ভালোবাসি, করুণা করি। কিন্তু আমি কি করব?

নাতাশার মিষ্টি কথায় সোনিয়া ভুলল না। নাতাশার মুখ যত বেশি আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠল, সোনিয়ার মুখ তত বেশি গম্ভীর ও কঠিন হয়ে উঠল।

বলল, নাতাশা, তুমিই আমাকে বলেছিলে তোমার সঙ্গে কথা না বলতে, কিন্তু এখন তুমিই কথাটা তুলেছ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না নাতাশা। এই গোপনীয়তা কেন?

আবার! আবার! নাতাশা বাধা দিল।

নাতাশা, তোমার জন্য আমার ভয় হয়!

কিসের ভয়?

ভয় হচ্ছে তুমি নিজের সর্বনাশ করতে চলেছ, দৃঢ়কণ্ঠে সোনিয়া বলল, আর নিজের কথায় নিজেই আতংকিত হয়ে উঠলে।

নাতাশার মুখে পুনরায় ক্রোধের প্রকাশ দেখা দিল।

সর্বনাশের পথেই আমি যাব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাব! সেটা তোমার ব্যাপার নয়! কষ্ট তো তুমি পাবে না, পাব আমি। আমাকে একা থাকতে দাও, একা থাকতে দাও! তোমাকে আমি ঘৃণা করি!

সোনিয়ার সঙ্গে নাতাশা আর একটি কথাও বলল না, তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। সেই একই ক্ষুব্ধ বিস্ময় ও অপরাধবোধ নিয়ে সে বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগল, এই একটা কাজে হাত দেয়, আবার আর একটা কাজে হাত দেয়, তারপর সেটাও ছেড়ে দেয়।

এ অবস্থা সোনিয়ার পক্ষে কষ্টদায়ক, সে বন্ধুর উপর নজর রাখল, কখনো তাকে চোখের আড়ালে যেতে দিল না।

কাউন্ট ফিরে আসার আগের দিন নাতাশা সারা সকালবেলাটা বসার ঘরের জানালার পাশে বসে রইল, যেন কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে, বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় জনৈক অফিসারকে কিছু ইঙ্গিতও করল, সোনিয়ার ধারণা লোকটি আনাতোল।

সোনিয়া বন্ধুর উপর আরো কড়া নজর রাখল, লক্ষ্য করল, ডিনারের সময় এবং সারাটা সন্ধ্যা নাতাশা একটা অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে কাটাল। কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে কদাচিৎ জবাব দেয়, কথা শুরু করে শেষ করে না, সবকিছুতেই হাসতে থাকে।

চায়ের পরে সোনিয়া দেখল, একটি দাসী। ভিতরে ঢুকবার অপেক্ষায় সভয়ে নাতাশার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নাতাশা দরজা খুলে দাসীকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিল। সোনিয়া দরজায় কান পেতে বুঝতে পারল, আরো একটা চিঠি দেওয়া হল।

সহসা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, সেদিন সন্ধ্যায় নাতাশা একটা কোনো ভয়ংকর মতলব এঁটেছে। সে দরজায় টোকা দিল। নাতাশা দরজা খুলল না।

সোনিয়া ভাবল, ওরা পালিয়ে যাবে! নাতাশা সব পারে। আজ তার মুখটা অতিশয় করুণ ও কঠোর দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিক তাই, সে আনাতেলের সঙ্গে পালিয়ে যাবে, কিন্তু এখন আমি কি করি? কাউন্ট বাইরে গেছেন। আমি কি করি? কুরাগিনকে চিঠি লিখে কৈফিয়ৎ চাইব? কিন্তু তাকে জবাব দিতে বাধ্য করব কি দিয়ে? পিয়েরকে চিঠি লিখব? প্রিন্স আন্দ্রু তো বলে গিয়েছে কোনো দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটলে তাকেই জানাতে।…কিন্তু সে হয় তো ইতিমধ্যেই বলকনস্কিকে প্রত্যাখ্যান করেছে–গতকালই সে প্রিন্সেস মারিকে চিঠি লিখেছে। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকে একথা জানানোও সোনিয়ার কাছে ভয়ংকর বলে মনে হল। অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সোনিয়া ভাবতে লাগল : যাই হোক না কেন, এই পরিবারের উপকারের কথা যে আমার মনে আছে, নিকলাসকে যে আমি ভালোবাসি, সেকথা যদি আজ প্রমাণ করতে না পারি তো আর কোনোদিনই পারব না। হ্যাঁ, তিনটে রাতও যদি ঘুমুতে না পারি তবু এই বারান্দা ছেড়ে যাব না। তাকে জোর করে ধরে রাখব, পরিবারের মুখে কলংক লাগতে দেব না।

.

অধ্যায়-১৬

আনাতোল ইদানীং দলখভদের সঙ্গেই আছে। কয়েকদিন আগেই নাতালি রস্তভাকে অপহরণের মতলব ভাজা হয়েছে, আর দলখভই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি করেছে, নাতাশার দরজায় কান পেতে সব কথা শুনে সোনিয়া যেদিন সংকল্প নিল যে তাকে রক্ষা করবেই, সেইদিনই ওই মতলব হাসিল করার কথা। নাতাশা কথা দিয়েছে রাত দশটার সময় সে খিড়কির দরজায় কুরাগিনের সঙ্গে মিলিত হবে। কুরাগিন একটা এয়কা প্রস্তুত রাখবে এবং নাতাশাকে তাতে চড়িয়ে চল্লিশ মাইল দূরের কামেংকা গ্রামে পৌঁছবে, আর সেখানেই তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য একজন পুরোহিতকে হাজির করা হবে। কামেংকা থেকে পর পর ঘোড়া পালটিয়ে তারা ওয়ারস এর বড় রাস্তায় পৌঁছবে এবং সেখান থেকে ডাক-ঘোড়ায় চেপে দ্রুত বিদেশে পাড়ি দেবে।

আনাতোলের একটা পাসপোর্ট আছে, ডাক-ঘোড়ার হুকুম-নামা আছে, বোনের দেওয়া দশ হাজার রুবল আছে, এবং দলখভের সাহায্যে কর্জ-করা আরো দশ হাজার আছে।

এই নকল বিয়ের দুই সাক্ষী খভস্তিকভ ও মাকারিন দলখভের সামনের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। খভস্তিকভ একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্ষুদে কর্মচারী, দলখভের জুয়াখেলার সহযোগী, আর মাকারিন একজন অবসরপ্রাপ্ত হুজার, দুর্বলচিত্ত ভালো মানুষ, কুরাগিনের প্রতি তার অসীম স্নেহ।

দলখভ বড় পড়ার ঘরটাকে একটা খোলা ডেস্কের সামনে বসেছিল। ঘরের দেয়াল জুড়ে ঝুলছে পারসিক কম্বল, ভালোকের চামড়া ও অস্ত্রশস্ত্র। দলখভের পরনে ভ্রমগোপযোগী জোব্বা ও উঁচু বুট। ডেস্কের উপরে রয়েছে একটা গণনা-ফলক ও কয়েক বান্ডিল নোট। ইউনিফর্মের বোম খোলা অবস্থায়ই আনাতোল তিনটে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে : এক ঘরে সাক্ষীরা বসে আছে, পড়ার ঘর, এবং পিছনের ঘর যেখানে তার ফরাসি খানসামা ও অন্যরা মিলে তার শেষ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।

দলখভ বলল, তাহলে, খভস্তিকভকে দিতে হবে দু-হাজার।

তাহলে দিয়ে দাও, আনাতোল বলল। মাকার্কা (মাকারিনের ডাক-নাম) বিনা পারিশ্রমিকেই তোমার জন্য যে-কোনো বিপদকে বরণ করতে প্রস্তুত। কাজেই আমাদের সব হিসাব মিটে গেল। দলখভ কাগজটা দেখিয়ে বলল। ঠিক আছে তো?

নিশ্চয় আছে, দলখভের কথায় কান না দিয়েই আনাতোল হাসিমুখে বলল, সে হাসিটি তার মুখে লেগেই আছে।

দলখভ সশব্দে ডেস্কের ডালাটা বন্ধ করে আনাতোলের দিকে ফিরে বলল, বুঝে দেখ। এসব ঝামেলা না করাই ভালো। এখনো সময় আছে।

আনাতোল পাল্টা জবাব দিল, মূর্খ! বাজে কথা বল না! শুধু যদি জানতে…শয়তানই শুধু জানে!

দলখভ বলল, না, সত্যি বলছি, এ মতলব ছেড়ে দাও। আমি মন থেকেই বলছি। যে মতলব আমরা ভেঁজেছি সেটা তামাশার ব্যাপার নয়।

আনাতোল মুখ ভেংচে বলল, আবার বিরক্ত করছ? তুমি উচ্ছন্নে যাও। তোমার এইসব বোকা তামাশার সময় এটা নয়। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দলখভের মুখে ঘৃণা ও করুণার হাসি দেখা দিল।

আনাতোলকে ডেকে বলল, একটু অপেক্ষা কর। আমি ঠাট্টা করছি না। কাজের কথাই বলছি। এখানে এস, এখানে এস।

আনাতোল ফিরে এল। দলখভের দিকে তাকিয়ে রইল।

এবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। এই শেষবারের মতো বলছি। এ নিয়ে ঠাট্টা করব কেন? আমি কি তোমাকে বাধা দিয়েছি। সব ব্যবস্থা কে করেছে? কে পুরোহিত খুঁজে এনেছে, কে পাসপোর্ট পাইয়ে দিয়েছে? কে টাকা তুলেছে? সব আমি করেছি।

বেশ তো সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। তুমি কি মনে কর আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ নই? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনাতোল দলখভকে আলিঙ্গন করল।

আমি তোমাকে সাহায্য করছি, কিন্তু তবু তোমাকে সত্য কথাটা বলা দরকার। এ বড় বিপজ্জনক কাজ, একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে-কাজটা বোকামি। দেখ, তুমি যদি তাকে হরণ করে আন–ঠিক আছে! কিন্তু তারা কি সেখানেই ব্যাপারটাকে থামকে দেবো তোমার যে আগেই বিয়ে হয়েছে সেটাও জানাজানি হয়ে যাবে। তাহলে, তারা তোমাকে ফৌজদারি আদালতে নিয়ে তুলবে…।

আঃ, যত বাজে কথা, বাজে কথা! আনাতোল আর একবার মুখ ভেংচাল। আমি কি তোমাকে সব কথা বুঝিয়ে বলিনি? একটা আঙুল বাঁকিয়ে সে বলে চলল, তোমাকে কি বুঝিয়ে বলিনি যে এই সিদ্ধান্তে আমি এসেছি : এই বিয়ে যদি অসিদ্ধ হয়, তাহলে আমার কৈফিয়ৎ দেবার কিছুই থাকবে না, কিন্তু বিয়েটা যদি সিদ্ধ হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই! বিদেশে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানতে পারবে না। তাই নয় কি? কাজেই এ নিয়ে আমাকে কিছু বলল না, বলো না, বলো না!

সত্যি বলছি, এ মতলব ছেড়ে দাও! এর ফলে তুমি অনেক গোলমালে জড়িয়ে পড়বে।

তুমি উচ্ছন্নে যাও! চিৎকার করে উঠে মাথা চুল চেপে ধরে আনাতোল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আবার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে দলখভের সামনেকার হাতল চেয়ার দুই পা মুড়ে বসে পড়ল। স্বয়ং শয়তান বাসা বেঁধেছে। কি বুঝছ? দেখ, কেমন ঢিপঢিপ করছে! দলখভের হাতটা নিজের বুকে রাখল। ভাইরে, কী সে পা! কী চাউনি! দেবী! সে ফরাসিতে বলল। কী?

দলখভ নিরাসক্ত হাসি হেসে দুটি সুন্দর চোখ মেলে তার দিকে তাকালযেন তার কাছ থেকে আরো কিছুটা মজা পেতে চাইছে।

বেশ তো, কিন্তু যখন টাকা ফুরিয়ে যাবে তখন?

তখন আবার কি? অ্যাঁ? ভবিষ্যতের চিন্তায় আনাতোল বিব্রত বোধ করল। তখন কি হবে?…তখন, আমি জানি না।…কিন্তু কেন বাজে কথা বলছ! সে ঘড়ি দেখল! সময় হয়ে গেছে!

আনাতোল ভিতরের ঘরে চলে গেল।

চাকরদের ধমক দিয়ে বলল, এতক্ষণে! প্রায় তৈরি? তোমরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছ?

দলখভ টাকাটা সরিয়ে রেখে একটি পরিচারককে পাঠাল যাত্রার আগে কিছু খাদ্য-পানীয় আনতে। তারপর যে ঘরে খভস্তিকভ ও মাকারিন বসে আছে সেখানে গেল।

কনুইতে ভর দিয়ে আনাতোল একটা সোফায় শুনে আছে। মুখে বিষণ্ণ হাসি, সুন্দর ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে আপন মনেই কি যেন বলছে।

পাশের ঘর থেকে দলখভ হাঁক দিল, এস, কিছু খেয়ে নাও। একচুমুক পান কর।

আনাতোল হেসে জবাব দিল, আমার ইচ্ছা করছে না।

এস! বলগা এসেছে।

আনাতোল উঠে খাবার ঘরে গেল। বলগা একজন বিখ্যাত ব্ৰয়তা চালক। দলখভ ও আনাতেলের সঙ্গে তার ছবছরের পরিচয়, এয়তা নিয়ে তাদের অনেক সেবা সে করেছে। আনাগোলের রেজিমেন্ট যখন তিভারে ছিল তখন একাধিকবার সে তাকে রাতে তিভার থেকে বয়কায় তুলে ভোরে মস্কো পৌঁছে দিয়েছে, আবার পরদিন রাত্রে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে। কেউ পিছু নিলে একাধিকবার সে দলখভকে পালাতে সাহায্য করেছে। তাদের নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে মস্কোর রাজপথে অনেকবার সে পদযাত্রীদের চাপা দিয়েছে, অনেক গাড়ি উল্টে দিয়েছে, আর সবসময়ই আমার ভদ্রলোকদের দ্বারা ফলাফলের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। তাদের সেবায় তার একাধিক ঘোড়া নষ্ট হয়েছে। একাধিকবার তারা তাকে প্রহার করেছে, আবার একাধিকবার তাকে শ্যাম্পেন ও মদিরাও খাইয়েছে। আবার দুজনের প্রত্যেকেরই এমন একাধিক কথা সে জানে যা যে কোনো সাধারণ মানুষকে অনেককাল আগেই সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে ছাড়ত। তারাও প্রায়ই বলগাকে তাদের নরকে ডেকে আনে, মদ গেলায়, জিপসিদের সঙ্গে নাচায়, তাদের একাধিক হাজার রুবল তার হাত দিয়েই খরচ হয়েছে। তাদের সেবায় বছরে বিশবার করে তার গায়ের চামড়া ও জীবনকে বিপন্ন করেছে, আর এত বেশি ঘোড়া নষ্ট করেছে যা তাদের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় কিনতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের দুজনকে সে ভালোবাসে, ঘণ্টায় বারো মাইল বেগে পাগলের মতো এয়কা চালাতে ভালোবাসে, অন্য চালককে উল্টো দিতে, কোনো পদযাত্রীকে চাপা দিতে এবং মস্কোর রাজপথে জোরকদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিতে ভালোবাসে। তাদের দুজনকে সে সত্যিকারের ভদ্রলোক বলে মনে করে।

আনাতোল ও দলখভও বলগাকে পছন্দ করে তার চমৎকার এয়কা চালানোর জন্য, তাছাড়া আরো একটা কারণ আছে-তারা যা পছন্দ করে বলগারও তাই পছন্দ। অন্যদের বেলায় বলগা দরদাম করে, দু-ঘণ্টার পথ যেতে পঁচিশ রুবল ভাড়া হাঁকে, নিজে বড় একটা চালায় না, যুবকদের ক্রয়কায় বসিয়ে দেয়। কিন্তু তার ভদ্রলোকদের বেলায় সবসময় নিজে চালায়, কাজের জন্য কখনো কিছু দাবি করে করে না। শুধু বছরে দুইবার-যখন খানসামাদের কাছ থেকে খবর পায় যে তাদের হাতে টাকা আছে–তখন একদিন সকালে বহালতবিয়তে আসে, অনেকটা মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে কিছু সাহায্য ভিক্ষা করে। ভদ্রলোকরাও সবসময়ই তাকে আদর করে আসতে দেয়।

সে বলে, এ বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করুন আইভনিচ স্যার, অথবা বলে ইয়োর এক্সেলেন্সি, বড়ই ঘোড়ার অনটন চলছে। মেলায় যাবার জন্য যা পারেন কিছু দিন।

আর আনাতোল ও দলখভও হাতে টাকা থাকলে এক হাজার বা দু হাজার রুবল দিয়ে দেয়।

বলগার মাথায় সুন্দর চুল, বেঁটেখাটো, চ্যাপ্টা নাক, লাল মুখ, সরু লাল গলা, চকচকে ছোট চোখ, ছোট দাড়ি, বছর সাতাশ বয়সের একজন চাষী। পরনে রেশমি পাড় বসানো গাঢ় নীল রংয়ের সুন্দর সুতীর কোট, তার নিচে একটা ভেড়ার চামড়া।

এখন ঘরে ঢুকে সে প্রথমে ক্রুশ-চিহ্ন আঁচল, তারপর ছোট কালো হাতটা বাড়িয়ে দলখভের দিকে এগিয়ে গেল।

অভিবাদন করে বলল, থিয়োদর আইভানিচ!

কেমন আছ হে বন্ধু? এই যে, তুমিও এসে পড়েছ?

আনাতোল ঘরে ঢুকল। তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলগা বলল, শুভদিন, ইয়োর এক্সেলেন্সি!

লোকটির কাঁধে হাত রেখে আনাতোল বলল, আচ্ছা, বলগা, আমার কথা কি তুমি ভাব, না ভাব না? আঁ দেখ, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে…কোন কোন ঘোড়া নিয়ে এসেছ?

আপনার লোক যেমন হুকুম করেছে, আপনার বিশেষ দুই জন্তু, বলগা জবাব দিল।

শোন বলগা। তিনটে ঘোড়াকেই ছুটিয়ে মেরে ফেললেও তিন ঘণ্টার মধ্যে আমাকে সেখানে পৌঁছে দিতেই হবে। বুঝেছ?

বলগা চোখ টিপে বলল, ওরা মরে গেলে আমি কাকে চালাব?

হঠাৎ চোখ ঘুরিয়ে আনাতোল চেঁচিয়ে উঠল, মনে থাকে যেন, তোমার মুখ ভেঙে দেব! ঠাট্টা করো না!

চালকটি হেসে বলল, ঠাট্টার কি হল? আমার ভদ্রলোকদের কোন কাজটা না করে দিয়েছি! ঘোড়ার পক্ষে যত তাড়াতাড়ি ছোটা সম্ভব তত তাড়াতাড়িই আমরা ছুটব!

আনাতোল বলল, আঃ! ঠিক আছে, বস।

দলখভও বলল, হ্যাঁ, বস!

আমি দাঁড়িয়েই থাকব থিয়োদর আইভানিচ।

বসে পড়, যত বাজে কথা! একটু নেটে নাও! বলে একটা বড় গ্লাসে মদিরা ভর্তি করে আনাতোল তার দিকে এগিয়ে দিল।

মদ দেখেই কোচয়ানের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ভব্যতার খাতিরে একটু আপত্তি জানিয়ে সবটা শেষ করে পকেট থেকে একটা লাল রেশমি রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিল।

কখনো রওনা হতে হবে ইয়োর এক্সেলেন্সি?

তা… আনাতোল ঘড়ি দেখল। এখনই রওনা হব। মনে রেখ বলগা। ঠিক সময়ে পৌঁছনো চাই। বুঝলে?

বলগা জবাব দিল, সেটা কপালের উপর নির্ভর করে, অন্যথায় ঠিক সময়ে পৌঁছব না কেন? সাত ঘণ্টায় আপনাকে কি তিভার পৌঁছে দেইনি? আশা করি সে-কথা ইয়োর এক্সেলেন্সির মনে আছে?

সেকথা মনে পড়ায় হেসে মাকারিনের দিকে ফিরে আনাতোল বলল, একবার বড়দিনের সময় আমি তিভার থেকে গাড়িতে যাচ্ছিলাম। আপনি কি বিশ্বাস করবেন মাকাকা, এত জোরে গাড়িটা ছুটছিল যে দম বন্ধ হবার উপক্রম। একসারি বোঝাই স্লেজ সামনে পড়ায় দুটোর উপর দিয়েই ত্রয়কা চালিয়ে দিয়েছিলাম।

বলগা শেষটা বলে দিল, সে ছিল ঘোড়ার মতো ঘোড়া! দলখভের দিকে ঘুরে বলল, আপনি কি বিশ্বাস করবেন থিয়োদর আইভানিচ, ঘোড়াগুলো ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল ছুটেছিল? আমি তাদের ধরে রাখতে পারছিলাম না, তুষারপাতের ফলে আমার হাত অবশ হয়ে আসছিল, শেষপর্যন্ত লাগাম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠলাম-আপনি লাগাম ধরুন ইয়োর এক্সেলেন্সি! ঘোড়াগুলোকে ছোটাবার কোনো ব্যাপারই ছিল না, গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার আগে তাদের ধরে রাখাই যায়নি। শয়তানরা তিন ঘণ্টায় আমাদের সেখানে পৌঁছে দিয়েছিল! সেযাত্রায় শুধু একটা মারা গিয়েছিল।

.

অধ্যায়-১৭

আনাতোল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আবার কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এল। এখন তার পরনে লোমের কোট, রুপোর বেল্ট দিয়ে আঁটা, একটা লোমের টুপি কাৎ করে মাথার একপাশে বসানো, সুন্দর মুখের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে।

আয়নায় মুখটা দেখে সেই একই ভঙ্গিতে দলখভের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে একটা মদের গ্লাস তুলে নিল।

বলল, আচ্ছা, তাহলে বিদায় থিয়োদর। সবকিছুর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। মাকারিন ও অন্যদের দিকে ফিরে একমুহূর্ত কি ভেবে বলল, আমার যৌবনের সহকর্মী ও বন্ধুগণ, বিদায়!

যদিও সকলেই তার সঙ্গেই যাচ্ছে, তবু আনাতোল সহকর্মীদের প্রতি ভাষণের ভিতর দিয়ে মর্মস্পর্শী ও গম্ভীর একটা কিছু করতে চাইল। বুকটাকে সামনে ঠেলে দিয়ে একটা পা দোলাতে দোলাতে উঁচু গলায় ধীরে ধীরে কথাগুলি বলল।

সকলেই গ্লাস তুলে নিন, বলগা, তুমিও নাও। হে আমার যৌবনের সহকর্মী ও বন্ধুরা, আমরা একসঙ্গে অনেকদিন কাটিয়েছি, ফুর্তি করেছি। না কি? এবার, কতদিনে আবার দেখা হবে? আমি তো বিদেশে যাচ্ছি। অনেকদিন সুখে কাটিয়েছি-এবার বিদায় বাছারা! আমাদের স্বাস্থ্য পান করছি! হুররা!… চিৎকার করে বলে গ্লাসটা খালি করে আনাতোল সেটাকে মেঝেতে ছুঁড়ে দিল।

আপনার স্বাস্থ্য পান করছি, বলে বলগাও তার গ্লাসটা খালি করে রুমালে মুখ মুছল।

 সাশ্রু নয়নে মাকারিন আনাতোলকে আলিঙ্গন করল।

আহা প্রিন্স, আপনাকে বিদায় দিতে আমার কত কষ্ট হচ্ছে!

 এবার যাওয়া যাক! যাওয়া যাক! আনাতোল চেঁচিয়ে বলল।

 বলগা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

আনাতোল বলল, না, থাম! দরজাটা বন্ধ করে দাও, আগে সকলকে একসঙ্গে বসতে হবে। সেটাই প্রথা।

দরজা বন্ধ করে সকলেই বসে পড়ল। (এটা একটা রুশ প্রথা।)

আনাতোল দাঁড়িয়ে বলল, এবার দ্রুত যাত্রা শুরু, বাছারা!

খানসামা জোসেফ কোষবদ্ধ তরবারি তার হাতে তুলে দিল, সকলে বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

দলখভ শুধাল, লোমের জোব্বাটা কোথায়? হেই ইগনাকা! মাত্রেনা মাত্রেভনার কাছ থেকে লোমের জোব্বাটা চেয়ে আন। চোখ টিপে বলতে লাগল, পালিয়ে যাওয়া যে কী জিনিস তা অনেক শুনেছি। আরে, সে তো পড়িমরি করে যা পরা থাকবে তাই নিয়েই ছুটে বেরিয়ে আসবে, যদি একটু দেরি করেছ কি অমনি শুরু হবে চোখের জল, আর বাপি ও মামণি, আর সেও এক মিনিটেই জমে বরফ হয়ে ফিরে যাবে–কিন্তু প্রথম সুযোগেই লোমের জোব্বা দিয়ে ঢেকে তাকে একেবারে স্লেজে এনে তুলে দাও।

খানসামা মেয়েদের ব্যবহারের শেয়ালের চামড়ার পটি দেওয়া একটা জোব্বা এনে দিল।

মূর্খ! বললাম না লোমের জোব্বা! হেই মানো, লোমের জোব্বা! তার কণ্ঠস্বর ঘরে ঘরে ধ্বনিত হতে লাগল।

একটি ক্ষীণ তনু, সুদর্শনা জিপসি মেয়ে কালো চোখ ও নীল-কালো চুল নাচিয়ে একটি লাল শাল পরে ছুটে বেরিয়ে এল, তার হাতে একটি লোমের জোব্বা।

দলখভ কোনো কথা না বলে জোব্বাটা মাত্রেনার গায়ে জড়িয়ে দিল। তারপর বলল, এইভাবে, আর তার পরে এইভাবে, কলারটা মাত্রেনার মাথা পর্যন্ত তুলে দিয়ে শুধু মুখের একটুখানি খোলা রাখল। আর তার পরে এইভাবে, দেখতে পাচ্ছ? আনাতোলের মাথাটাকে সে এমনভাবে এগিয়ে ধরল যাতে কলারের ফাঁক দিয়ে মানোর উজ্জ্বল হাসিটুকু দেখা যায়।

মাত্রেনাকে চুমো খেয়ে আনাতোল বলল, আচ্ছা, বিদায় মাত্রেনা। এখানকার লীলা-খেলা তো সাঙ্গ হল। স্তেশকাকে আমার কথা বলো। তাহলে বিদায়! বিদায় মাত্রেনা, আমার সৌভাগ্য কামনা করো!

জিপসি-উচ্চারণে মাত্রেনা বলল, প্রিন্স, ঈশ্বর আপনাকে পরম সৌভাগ্য দান করুন!

ফটকের সামনে দুটো এয়কা দাঁড়িয়ে আছে, দুটি যুবক কোচয়ান ঘোড়াগুলোকে ধরে আছে। বলগা সামনের এয়কাতে উঠে বসল, হাত উঁচু করে লাগাম তুলে নিল। আনাতোল ও দলখভ তার গাড়িতে উঠল। মাকারিন, খডস্তিকভ ও একটি খানসামা উঠল অপ স্লেজটাতে।

তোমরা প্রস্তুত? বলগা শুধাল।

চালাও। হাতের লাগাম ঘুরিয়ে সে চেঁচিয়ে বলল, নিকিৎস্কি বুলভার্দ ধরে এয়কা তীরবেগে ছুটল।

তপ্রু! তফাৎ যাও! হাই!…ত!…বলগার গলা আর বক্সে উপবিষ্ট জোয়ানটির গলা ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না। আবাৎ স্কোয়ারে ত্রয়কাটা একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগাল, একটা কিছু ভাঙার শব্দ হল, হৈচৈ শোনা গেল, বয়কাটা আর্বাৎ স্ট্রিট ধরে উড়ে চলল।

পদনভিনস্কি বুলভার্দ বরাবর মোড় ঘুরে বলগা লাগামে টান দিল, পিছন ফিরে পুরনো কোনিউশেনি স্ট্রিটের মোড়ে এয়কা থামাল।

জোয়ানটি বক্স থেকে লাফিয়ে নেমে ঘোড়াগুলোকে ধরল। আনাতোল ও দলখভ পথ ধরে এগিয়ে গেল। ফটকে পৌঁছে দলখভ শিস দিল। শিসের জবাব শোনা গেল, একটি দাসী ছুটে বেরিয়ে এল।

বলল, উঠোনে ঢুকে পড় ন, নইলে ওরা আপনাদের দেখে ফেলবে, তিনি এখুনি এসে পড়বেন।

দলখভ ফটকেই রইল, আনাতোল দাসীকে অনুসরণ করে উঠোনে পড়ে মোড় ঘুরে দৌড়ে বারান্দায় উঠে পড়ল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার ষণ্ডামার্কা পরিচারক গ্রেবিয়েলের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।

পালাবার পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেব্রিয়েল বলল, দয়া করে কত্রীঠাকরুণের কাছে চলুন।

কোন কর্ত্রীঠাকরুণ? তুমি কেন? রুদ্ধশ্বাস অস্পষ্ট স্বরে আনাতোল বলল।

 দয়া করে ভিতরে চলুন। আপনাকে ভিতরে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে।

 দলখভ চিৎকার করে বলল, কুরাগিন! ফিরে এস! বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে! ফিরে এস!

আনাতোল ভিতরে ঢুকে যাবার পরে দলখভ ছোট দরজাটার কাছে দাঁড়িয়েছিল, দারোয়ান দরজায় তালা লাগাবার চেষ্টা করতেই সে তার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করে দিল। প্রাণপণ চেষ্টায় দলখভ দরোয়ানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতেই আনাতোলও ছুটে বেরিয়ে এল আর দলখভ তার হাতটা চেপে ধরে ছোট দরজাটার ভিতরে দিয়ে টানতে টানতে এয়কাটার কাছে ছুটে গেল।

.

অধ্যায়-১৮

সোনিয়াকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তার মুখ থেকে সব কথা জেনে নিয়ে নাতাশার চিঠিটা পড়ে সেটা হাতে নিয়েই নাতাশার গরে গেল।

বলল, নিলাজ অকর্মার ধাড়ি! তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।

নাতাশা অশ্রুহীন বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকাল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তাকে ঘরের মধ্যে তালাবন্ধ করে রেখে দরোয়ানকে হুকুম দিল, সন্ধ্যাবেলা যারা আসবে তাদের যেন ঢুকতে দেয়, কিন্তু আর বের হতে না দেয়, তারপর পরিচারককে তাদের তার কাছে নিয়ে আসার হুকুম করে বসার ঘরে অপহরণকারীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

গ্রেবিয়েল এসে যখন খবর দিল যারা এসেছিল তারা পালিয়ে গেছে, তখন সে ভুরু কুঁচকে উঠে দাঁড়াল, দুই হাত পিছনে জুড়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে কি করবে তাই ভাবতে লাগল। মাঝরাতে পকেটের মধ্যে চাবিটা নাড়তে নাড়তে নাতাশার ঘরে ঢুকল। সোনিয়া বারান্দায় বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বলল, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা, ঈশ্বরের দোহাই আমাকে ওর কাছে যেতে দিন! তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল।… বিরক্তিকর, শোচনীয়…আমার বাড়িতে…ভয়ংকর মেয়ে, পাজি মেয়ে! আমার দুঃখ শুধু ওর বাবার জন্য!…যত শক্তই হোক, সকলকেই জিভ বন্ধ রাখতে বলে দেব, কাউন্টের কাছে সবকিছু লুকিয়ে রাখতে হবে। দৃঢ় পদক্ষেপে সে ঘরে ভিতরে ঢুকল। দুই হাতে মুখ ঢেকে নাতাশা সোফায় শুয়ে আছে, একটুও নড়ল না। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তাকে যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেইভাবেই আছে।

ভালো মেয়ে! খুব ভালো! মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল। আমার বাড়িতে প্রেমিকের সঙ্গে মুলাকাত! ভান করে পড়ে থেক না, আমি যা বলছি কান পেতে শোন। নাতাশার হাতে হাত রাখল। আমার কথাগুলি শোন! অত্যন্ত বাজে মেয়ের মতো তুমি নিজের অসম্মান ডেকে এনেছ। তোমাকে টিট করতে পারতাম, কিন্তু তোমার বাবার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে, তাই তার কাছ থেকে সব কথা গোপন রাখব।

নাতাশা একটুও নড়ল না, নিঃশব্দ চাপা কান্নায় তার সমস্ত শরীর ফুলে ফুলে উঠছে, গলা আটকে আসছে। সোনিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা নাতাশার পাশে সোফায় বসল।

কঠিন স্বরে বলল, তার ভাগ্য ভালো যে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছে, কিন্তু আমি তাকে খুঁজে বের করবই!…আমি যা বলছি তা কি কানে যাচ্ছে, না যাচ্ছে না?

নাতাশার মুখের নিচে হাত রেখে মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। নাতাশার মুখের দিকে তাকিয়ে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ও সোনিয়া দুজনই চমকে উঠল। শুকনো চোখ দুটো চকচক করছে, ঠোঁট দুটো চেপে আছে, গাল বসে গেছে।

একঝটকায় মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার সোফায় এলিয়ে পড়ে নাতাশা বলে উঠল, যা হয় হোক!…তাতে আমার কি…আমি মরে যাব!

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, নাতালি, আমি তোমার ভালোই চাই। চুপচাপ শুয়ে থাক, আমি তোমাকে ছোঁব না। কিন্তু আমার কথা শোন। তুমি যে কত বড় দোষ করেছ তা তোমাকে বলব না। সেটা তুমি নিজেই জান। কিন্তু কাল যখন তোমার বাবা ফিরে আসবেন–তাকে আমি কি বলব? অ্যাঁ?

চাপা কান্নায় আবার নাতাশার শরীরটা দুলে উঠল।

ধর তিনি যদি জানতে পারেন, আর তোমার দাদা, তোমার ভাবী স্বামী?

আমার কোনো স্বামী নেই, আমি তাকে প্রত্যাখান করেছি! নাতাশা চেঁচিয়ে বলল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, একই কথা। একথা শুনে তারা কি চুপ করে বসে থাকবে? তাকে, তোমার বাবাকে আমি চিনি…তিনি যদি তাকে দ্বৈতযুদ্ধে আহ্বান করেন, সেটা কি ভালো হবে? কি বল?

আঃ, আমাকে একা থাকতে দিন। আপনি নাক গলাচ্ছেন কেন? কেন? কেন? কে আপনাকে ডেকে এনেছে? সোফার উপর উঠে বসে ঘৃণার দৃষ্টিতে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার দিকে তাকিয়ে নাতাশা বলল।

এবার মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাও রেগে গেল, জোর গলায় বলল, কিন্তু তুমিই বা কি চেয়েছিলে? তোমাকে কি তালা-চাবি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল? কে তাকে এ বাড়িতে আসতে বাধা দিয়েছিল? কেন জিপসি গাইয়ে মেয়েদের মতো তোমাকে হরণ করতে এসেছিল? তুমি কি ভেবেছ তারা তোমাকে খুঁজে পেত না? তোমার বাবা, দাদা, বাকদত্ত স্বামী? আর সে তো একটা শয়তান, হতভাগা–তা তো সকলেই জানে!

নাতাশা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, সে আপনাদের মতো যেকোন লোকের চাইতে ভালো! আপনি বাধা না দিলে…ওঃ, ঈশ্বর! এসব কি হল? কি হল? সোনিয়া, তুমি কেন…? চলে যাও!

নিজের হাতে-গড়া বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ যেভাবে আর্তনাদ করে সেইরকম হতাশাভরা তীব্রতায় নাতাশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা পুনরায় কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নাতাশা চিৎকার করে উঠল :

চলে যান! চলে যান! চলে যান! আপনারা সকলেই আমাকে ঘৃণা করেন, তুচ্ছ মনে করেন! সে আবার সোফায় শুয়ে পড়ল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা আরো কিছুক্ষণ ধরে তাকে বকল, তারপর বলল, নাতাশা যদি সব কথা ভুলে যায় এবং হাবভাবে কাউকে বুঝতে না দেয় যে একটা কিছু ঘটেছে, তাহলে সবকথাই তার বাবার কাছ থেকে গোপন রাখা হবে এবং কেউ কিছু জানতে পারবে না। নাতাশা কোনো জবাব দিল না, কাঁদলও না, কিন্তু কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল, শরীরটা কাঁপতে লাগল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তার মাথার নিচে একটা বালিশ খুঁজে দিল, দুটো লেপ চাপা দিল, নিজেই কিছুটা লেবুর জল এনে দিল, কিন্তু নাতাশা কোনো রকম সাড়া দিল না।

নাতাশা ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ঠিক আছে, ওকে গুমোতে দাও।

নাতাশা কিন্তু ঘুমোয়নি, বিবর্ণ মুখে খোলা চোখের সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সারারাত সে ঘুমোল না, কাঁদল না, সোনিয়া বারকয়েক তার ঘরে গেলে তার সঙ্গেও কথা বলল না।

পরদিন কাউন্ট রস্তভ কথামতোই লাঞ্চের আগে মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারি থেকে ফিরে এল। তার মেজাজ খুব ভালো, ক্রেতার সঙ্গে কথাবার্তা ভালোভাবেই এগিয়েছে, কাউন্টেসকে ফেলে তাকে আর বেশিদিন মস্তোতে থাকতে হবে না। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তার সঙ্গে দেখা করে জানাল, গতকাল নাতাশা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, ডাক্তারকে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু এখন সে অনেকটা ভালো আছে। সকালে নাতাশা ঘর থেকে বের হল না। শুকনো ঠোঁট চেপে ধরে, শুকনো স্থির দৃষ্টি মেলে জানালায় বসে বাইরের লোকজনের চলাফেরা দেখতে লাগল। কেউ ঘরে ঢুকলে চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকে দেখছে। তার মনে আশা, আনাতোলের খবর পাবে, হয় নিজে আসবে, না হয় চিঠি লিখবে।

কাউন্ট তার সঙ্গে দেখা করতে এলে পায়ের শব্দ শুনেই সে সাগ্রহে মুখ ফেরাল, কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখে ফুটে উঠল নিরাসক্ত, হিংস্র ভাব। বাবাকে অভ্যর্থনা জানাতে উঠেও দাঁড়াল না।

তোমার কি হয়েছে সোনা মেয়ে? তুমি কি অসুস্থ? কাউন্ট শুধাল।

একমুহূর্ত চুপ করে থেকে নাতাশা জবাব দিল : হ্যাঁ, অসুস্থ।

কাউন্ট উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করল, তাকে এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন, তার বাকদত্ত স্বামীর কি কিছু হয়েছে, নাতাশা শুধু বলল, কিছুই হয় নি, বাবা যেন কোনোরকম চিন্তা না করে। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাও নাতাশার কথা সমর্থন করে বলল, কিছুই হয় নি। কিন্তু অসুস্থতার ভান, মেয়ের মনমরা ভাব, সোনিয়া ও মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার বিব্রত মুখ–এসব কিছু দেখে কাউন্ট পরিষ্কার বুঝতে পারল যে তার অনুপস্থিতিতে কিছু অঘটন ঘটেছে, কিন্তু তার আদরের মেয়ের গায়ে কলঙ্ক লাগতে পারে সেরকম কিছু ভাবা তার পক্ষে এতই ভয়ঙ্কর, আর নিজের আনন্দময় প্রশান্তিকে সে এতই বড় করে দেখে, যে আর কোনো প্রশ্ন না করে নিজেকে সে এটাই বোঝাতে চেষ্টা করল যে বিশেষ কিছুই ঘটেনি, শুধু মেয়ের অসুস্থতার জন্য তাদের দেশে ফেরাটা যে পিছিয়ে গেল তাতেই তার মন অখুশি হয়ে উঠল।

.

অধ্যায়-১৯

স্ত্রী মস্তোতে আসার পর থেকেই তার কাছাকাছি না হবার জন্যই পিয়ের কোথাও চলে যাবার কথা ভাবছিল। রস্তভরা মস্কোতে আবার কিছুদিন পরেই নাতাশা তার মনের উপর যে প্রভাব ফেলেছে তার ফলেই সে আরো তাড়াতাড়ি মনের সে ভাবনাকে কার্যে রূপায়িত করে ফেলল। জোসেফ আলেক্সিভিচের বিধবার সঙ্গে দেখা করার জন্য সে তিভারে চলে গেল, বিধবাটি অনেকদিন আগেই তাকে কথা দিয়েছিল, পরলোকগত স্বামীর কিছু কাগজপত্র তার হাতে তুলে দেবে।

মস্কোতে ফিরে এসেই মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার একটা চিঠি তার হাতে এল, আন্দ্রু বলকনস্কি ও তার বাকদত্তার সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাকে দেখা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। পিয়ের নাতাশাকে এড়িয়েই চলছিল, কারণ তার মনে হয়েছে, বন্ধুর প্রেমিকার প্রতি একজন বিবাহিত পুরুষের মনোভাব যা হওয়া উচিত, নাতাশার প্রতি তার অনুরাগ তার চাইতে অনেক বেশি হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ ভাগ্য বারবার তাদের দুজনকে একত্রে ঠেলে দিচ্ছে।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার কাছে যাবার জন্য পোশাক পরতে পরতে সে ভাবল : কি ঘটে থাকতে পারে? আমাকে দিয়ে তাদের কি দরকার হতে পারে? প্রিন্স আন্দ্রু যদি তাড়াতাড়ি এসে বিয়েটা করে ফেলত! পথে যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল।

তিরস্কয় বুলভার্দে একটি পরিচিত কণ্ঠ তাকে ডাকল।

কে যেন চেঁচিয়ে বলল, পিয়ের! অনেকদিন হল ফিরেছ নাকি? পিয়ের মাথাটা তুলল। দুই ঘোড়ার একটা স্লেজে চেপে আনাতোল ও তার চিরসঙ্গী মাকারিন দ্রুত তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আনাতোল সোজা হয়ে বসে আছে সামরিক বাবুদের চিরাচরিত ভঙ্গিতে, বিভার-কলারের মুখের নিচের দিকটা ঢাকা পড়েছে, মাথাটা ঈষৎ হেলানো। মুখটা তাজা ও গোলাপি, সাদা পালক লাগানো টুপিটা একদিকে বাঁকানো, তার ফাঁক দিয়ে চূর্ণ বরফ ছিটানো কোঁকড়া পমেড-মাখানো চুলগুলি দেখা যাচ্ছে।

পিয়ের ভাবল, হ্যাঁ, এই সত্যিকারের সন্ন্যাসী। ক্ষণিকের সুখ ছাড়া আর কোনোদিকে তার নজর নেই, কোনোকিছুতেই সে দুঃখ পায় না, কাজেই সে সর্বদাই হাসিখুশি, সন্তুষ্ট, প্রশান্ত। ওর মতো হবার জন্য আমি তো সব কিছু ছাড়তে রাজি!

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার বাইরের ঘরে তার লোমের কোটটা খুলতে সাহায্য করে পরিচারক জানাল, কত্রীঠাকরুণ তাকে নিজের শোবার ঘরেই ডেকেছে।

নাচ-ঘরের দরজা খুলতেই পিয়ের দেখতে পেল, নাতাশা বিষণ্ণ, ঘৃণাভরা মুখে জানালায় বসে আছে। পিয়েরের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে উদাস মর্যাদার ভঙ্গিতে নাতাশা ঘর থেকে চলে গেল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার ঘরে ঢুকে পিয়ের শুধাল, কি হয়েছে?

খুব ভালো কাজ! মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা জবাব দিল, পঞ্চাশ বছর এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, কিন্তু এরকম লজ্জার কথা কখনো শুনিনি।

তাকে যা বলা হবে তা নিয়ে সে কারো কাছে মুখ খুলবে না-পিয়েরের কাছ থেকে এই কথা আদায় করে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তাকে জানাল, বাবা-মার অজ্ঞাতসারেই নাতাশা প্রিন্স আন্দ্রুকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এসবের কারণ আনাতোল কুরাগিন, পিয়েরের স্ত্রীও তাদের সমাজেই ভিড়েছে, আর গোপনে বিয়ে করার জন্য বাবার অনুপস্থিতিতে নাতাশা বাড়ি থেকে পালাবার চেষ্টা করেছিল।

পিয়ের হাঁ করে সব কথা শুনল, কিন্তু নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না। যে বাকদত্তা স্ত্রীকে প্রিন্স আন্দ্রু গত গভীরভাবে ভালোবাসে সে-সেই মনোরমা নাতাশা রস্তভাবলকনস্কিকে ছেড়ে বিয়ে করবে সেই মূৰ্থ আনাতোলকে যে ইতিমধ্যেই গোপনে বিয়ে করেছে (পিয়ের কথাটা জানে), তাকে সে এতই ভালোবেসেছে যে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতেও সম্মত হয়েছে-এসব কথা পিয়ের যেন ভাবতেও পারছে না, কল্পনাও করতে পারছে না।

তার মনে পড়ে গেল নিজের স্ত্রীর কথা। খারাপ মেয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার মতো দুর্ভাগ্য শুধু তার একারই হয় নি একথা চিন্তা করে সে নিজের মনেই বলল, এরা সব সমান! তবু প্রিন্স আন্দ্রুর প্রতি করুণায় তার চোখে জল এসে গেল, তার আহত গর্বের প্রতি মনে সহানুভূতি দেখা দিল, আর বন্ধুকে যতই করুণা করতে লাগল ততই নাতাশার প্রতি ঘৃণা ও বিরক্তি বেড়ে চলল। এইমাত্র নাচ-ঘর থেকে চলে যাবার সময় নাতাশার চোখে সে দেখেছে উদাস মর্যাদার দৃষ্টি। সে জানত না যে নাতাশার অন্তর তখন হতাশা, লজ্জা ও পরাজয়ের গ্লানিতে ভরে উঠেছে, তার মুখের সেই উদাস মর্যাদা ও কঠোরতার দোষও তার নয়!

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার কথার জবাবে পিয়ের বলল, কিন্তু বিয়ে হবে কেমন করে? সে তো বিয়ে করতে পারে না–সে যে বিবাহিত!

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা সক্ষোভে বলে উঠল এ যে প্রতি ঘণ্টায় অবস্থা আরো ঘোরালো হয়ে উঠেছে। চমৎকার ছেলে! কী শয়তান! আর ও কি না তারই আশায় বসে আছে-বসে আছে গতকাল থেকে! সব ওকে বলতে হবে। তাহলে অন্তত তার আশা ছেড়ে দেবে!

পিয়েরের মুখে আনাতোলের বিয়ের বিস্তারিত বিবরণ শুনে, আনাতোলকে অনেকরকম বকুনি দিয়ে মনের ঝাল মিটিয়ে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা কেন পিয়েরকে ডেকে এনেছে সেকথা জানাল। তার ভয় হচ্ছে, কাউন্ট বা বলকনস্কি-যেকোন মুহূর্তে সে এসে পড়তে পারে–যদি এ ব্যাপারে জানতে পারে (যদিও তাদের কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে পারবে বলেই সে আশা করে) তাহলে আনাতোলকে হয় তো দ্বৈতযুদ্ধে আহ্বান করে বসবে, সুতরাং পিয়ের যেন তার নাম করে তার শ্যালককে মস্কো ছেড়ে চলে যেতে বলে, যাতে আর কোনোদিন আনাতোলের মুখ তাকে দেখতে না হয়। এতক্ষণে বুড়ো কাউন্ট, নিকলাস ও প্রিন্স আন্দ্রুর বিপদটা উপলব্ধি করে পিয়ের কথা দিল সে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার ইচ্ছামতো কাজই করবে।

নিজের ইচ্ছার কথা পিয়েরকে সংক্ষেপে ও সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে সে তাকে বসার ঘরে যেতে দিল।

বলল, মনে রেখ, কাউন্ট কিছুই জানেন না। এমন ভাব দেখাবে যেন তুমিও কিছুই জান না। এদিকে আমি গিয়ে মেয়েকে বলছি যে তার জন্য অপেক্ষায় থেকে কোন লাভ নেই! মন চায় তো ডিনার পর্যন্ত থেকে যেয়ো!

কাউন্টের সঙ্গে পিয়েরের দেখা হল। তাকে খুবই বিচলিত ও দুর্বল মনে হল। সকালেই নাতাশা তাকে বলে দিয়েছে যে সে বলকনস্কিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

সে পিয়েরকে বলল, গোলমাল, বড়ই গোলমাল হে বাপু! মা কাছে না থাকলে মেয়েদের নিয়ে যে কত গোলমালই পোয়াতে হয়। এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে। তোমার কাছে খোলাখুলিই সব বলছি। তুমি কি শুনেছ, কারো সঙ্গে পরামর্শ না করেই সে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে? একথা সত্য যে এ বিয়েতে আমার খুব মত ছিল না। অবশ্য ছেলেটি খুব ভালো, কিন্তু তাহলেও বাবার অমতে বিয়ে করে তারা সুখী হত না, আর নাতাশার তো বরের অভাব হত না। তথাপি ব্যাপারটা তো অনেকদিন ধরে চলে আসছে, আর এখন বাবা মার সম্মতি ছাড়াই এরকম একটা কাজ! এখন তো তার মাও অসুস্থ, কি যে হবে ঈশ্বরই জানেন! কি জান কাউন্ট, মায়ের অনুপস্থিতিতে মেয়েদের নিয়ে চলা বড়ই শক্ত…।

পিয়ের বুঝল, কাউন্ট খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছে, সে প্রসঙ্গটা বদলাতে চাইল, কিন্তু কাউন্ট তার নিজের বিপদের কথাই বলতে লাগল।

উত্তেজিত মুখে সোনিয়া ঘরে ঢুকল।

নাতাশার শরীর ভালো নয়, সে তার ঘরেই আছে, আপনাকে একবার দেখতে চাইছে। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তার কাছেই আছেন। তিনিও আপনাকে যেতে বলেছেন।

হ্যাঁ, তুমি তো বলকনস্কির বড় বন্ধু, নিশ্চয়ই সে তাকে একটা খবর পাঠাতে চাইছে। হায়রে! তাহলে কী সুখের ব্যাপারই না হত!

কপালের অল্প কয়েকগাছি পাকা চুল মুঠো করে ধরে কাউন্ট ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা যখন নাতাশাকে বলল যে আনাতোল বিবাহিত, তখন নাতাশা সেকথা বিশ্বাস করতে চায়নি, বার বার বলল, পিয়ের নিজে এসে কথাটা বলুক। নাতাশার ঘরের দিকে যেতে যেতে সোনিয়া সংবাদটা পিয়েরকে জানাল। বিবর্ণ, রুক্ষ নাতাশা মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার পাশেই বসেছিল, দুটি চোখ জ্বরতপ্ত উজ্জ্বলতা। পিয়ের ঘরে ঢুকতেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। হাসল না, মাথা নাড়ল না, শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তার দৃষ্টি শুধু একটি জিজ্ঞাসা : সে কি আনাতোলের বন্ধু, না কি অন্য সকলের মতোই তার শত্রু? তার কাছে পিয়েরের যেন কোনো অস্তিত্বই নেই।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা পিয়েরকে দেখিয়ে নাতাশাকে বলল, ইনি সব জানেন। আমি সত্যি কথা বলেছি কিনা ওঁর মুখেই শোন।

পশ্চাদ্ধাবনকারী কুকর ও শিকারির দিকে আহত জন্তু যেভাবে তাকায় সেই দৃষ্টিতে নাতাশা একের পর অন্যের দিকে তাকাতে লাগল।

করুণায় আনত চোখে পিয়ের বলতে শুরু করল, নাতালিয়া ইলিনিচনা, এটা সত্য কি মিথ্যা তাতে আপনার কিছু যায় আসে না, কারণ…

তাহলে সে বিবাহিত একথা সত্য নয়?

হ্যাঁ, সত্য।

 বিয়েটা কি অনেকদিন আগে হয়েছে? আপনার দিব্যি…

পিয়ের দিব্যি করেই বলল।

 নাতাশা তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করল, সে কি এখনো এখানে আছে?

হ্যাঁ, এইমাত্র আমি তাকে দেখেছি।

নাতাশা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল, হাত দিয়ে ইশারা করে জানিয়ে দিল, তাকে যেন একলা থাকতে দেওয়া হয়।

.

অধ্যায়-২০

পিয়ের ডিনারের জন্য অপেক্ষা করল না, ঘর থেকে বেরিয়ে তখনই চলে গেল। সে শহরময় আনাতোল কুরাগিনকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। তার কথা মনে হতেই সব রক্ত হৃৎপিণ্ডে ছুটে এল, শ্বাস টানতে কষ্ট হতে লাগল। কুরাগিন বরফ-পাহাড়ে নেই, জিপসিদের আড্ডায় নেই, কোমোনেনোদের কাছেও নেই। পিয়ের ক্লাবে গেল। ক্লাবে সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলেছে। একে একে সদস্যরা সকলেই এসে হাজির হল। সে জনে জনে আনাতোলের কথা জিজ্ঞাসা করল। কেউ বলল এখনো আসেনি, কেউ বলল ডিনারে আসবে। কিন্তু আনাতোল এল না। অগত্যা ডিনারের জন্য অপেক্ষা না করে পিয়ের বাড়ি ফিরে গেল।

সেদিন আনাতোল ডিনার খেল দলখভের সঙ্গে। এই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপারটা কি প্রতিকার করা যায় তাই নিয়ে আলোচনা করল। তার মনে হল, নাতাশার সঙ্গে একবার দেখা করা একান্ত দরকার। সন্ধ্যায় সে বোনের কাছে গেল, নাতাশার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে। সারা মস্কোতে ফুঁ মেরে পিয়ের যখন বাড়ি ফিরল তখন খানসামা খবর দিল, প্রিন্স আন্দ্রুনাতোল কাউন্টেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কাউন্টেসের বসার ঘর তখন অতিথিতে ভর্তি।

ফিরে আসার পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে তার দেখাই হয় নি। এখনো তার সঙ্গে দেখা না করেই সে বসার ঘরে ঢুকল এবং আনাতোলকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।

স্বামীর কাছে এগিয়ে এসে কাউন্টেস বলল, আরে, পিয়ের, তুমি তো জান না আমাদের আনাতোলের কি অবস্থা…

পিয়ের স্ত্রীকে বলল, যেখানে তুমি সেখানেই অধর্ম ও পাপ! তারপর ফরাসিতে আনাতোলকে বলল, আনাতোল, আমার সঙ্গে এস, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

আনাতোল মুখ ফিরিয়ে বোনের দিকে তাকাল, তারপর পিয়েরকে অনুসরণ করতে উঠে দাঁড়াল। পিয়ের তার হাতটা ধরে কাছে টেনে এনে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম করল।

হেলেন ফিসফিস করে বলল, যদি আমার বসার ঘরে যেতে চাও…, কিন্তু কোনো জবাব না দিয়ে পিয়ের বেরিয়ে গেল।

আনাতোল স্বাভাবিক পটুতার সঙ্গে পা ফেলে তার পিছু নিল, কিন্তু তার মুখে উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠল।

পড়ার ঘরে ঢুকে পিয়ের দরজাটা বন্ধ করে দিল, তারপরে আনাতোলের দিকে না তাকিয়েই তাকে উদ্দেশ করে বলল :

তুমি কাউন্টেস রস্তভাকে কথা দিয়েছিলে তাকে বিয়ে করবে এবং তাকে হরণ করে আনার উদ্যোগও করেছিলে, এ কথা ঠিক?

প্রিয় বন্ধু, আনাতোল জবাব দিল (পুরো সংলাপটাই ফরাসিতে হল), এরকম সুরে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।

পিয়েরের বিবর্ণ মুখ ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠল। আনাতোলের ইউনিফর্মের কলারটা চেপে ধরে তাকে এ পাশ থেকে ও-পাশে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। ক্রমে আনাতোলের চোখে-মুখে আতংক ফুটে উঠল।

যখন বলেছি তোমার সঙ্গে কথা বলব, তখন বলবই!…পিয়ের আবার বলল।

ছাড়, কি বোকামি করছ! কি হয়েছে? একটুকরো কাপড়সহ কলারের একটা বোম ঝুলে পড়ায় সেটা নাড়তে নাড়তে আনাতোল বলল।

তুমি একটা শয়তান, একটা বদমাস, এটা দিয়ে কেন যে তোমার মাথাটা গুঁড়িয়ে দিচ্ছি না তা জানি না, পিয়ের ফরাসিতেই বলল।

একটা ভারি কাগজ-চাপা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দেবার ভঙ্গিতে সেটাকে তুলে ধরে আবার যথাস্থানে রেখে দিল।

তাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিলে?

আমি…আমি…আমি সেকথা ভেবে দেখিনি। কখনো কোনো কথা দেইনি, কারণ…

পিয়ের বাধা দিল।

আনাতোলের দিকে এগিয়ে বলল, তার কোনো চিঠি তোমার কাছে আছে? কোনো চিঠি?

তার দিকে তাকিয়ে আনাতোল তৎক্ষণাৎ পকেটে হাত ঢুকিয়ে নোটবইটা টেনে বের করল।

 আনাতোলের দেওয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে টেবিলটাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে পিয়ের সোফায় গিয়ে বসল।

আনাতোলকে ভয় পেতে দেখে পিয়ের বলল, ভয় পেয়ো না, আমি হিংসার আশ্রয় নেব না। প্রথমত, চিঠিগুলো, এমনভাবে বলল যে পড়া মুখস্থ করছে। দ্বিতীয়ত, কিছুক্ষণ থেমে সে বলল, আবার দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারি করে বলল, কাল তুমি অবশ্যই মস্কো ছেড়ে চলে যাবে।

কিন্তু তা কি করে…?

তার কথায় কান না দিয়ে পিয়ের বলেই চলল, তৃতীয়ত, তোমার ও কাউন্টেস রস্তভার মধ্যে যা ঘটেছে ঘুণাক্ষরেও কখনো কারো কাছে তা বলবে না। আমি জানি, তোমার বলা বন্ধ করতে আমি পারব না, কিন্তু বিবেকের কণামাত্রও যদি তোমার মধ্যে থাকে… পিয়ের নিঃশব্দে বারকয়েক ঘরময় ঘুরে বেড়াল।

আনাতোল একটা টেবিলের পাশে বসে ভুরু কুঁচকে ঠোঁট কামড়াতে লাগল।

যাই বল না কেন, তোমাকে এটা বুঝতেই হবে যে তোমার সুখ ছাড়াও অন্য মানুষের সুখ ও শান্তি বলে একটা কথা আছে, অথচ নিজের ফুর্তির জন্য তুমি একটা গোটা জীবন বরবাদ করতে চলেছ! ফুর্তি করতে হয় আমার স্ত্রীর মতো মেয়েমানুষদের নিয়ে ফুর্তি কর,-সেখানে তোমার অধিকার স্বীকৃত, কারণ তারা জানে তাদের কাছে তুমি কি চাও। তোমার মতো একই লাম্পট্যের অভিজ্ঞতার বর্মে তারাও সুসজ্জিত, কিন্তু একটি কুমারীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া…তাকে প্রতারিত করা, হরণ করা…তুমি কি বুঝতে পারছ না যে একটি বৃদ্ধ বা শিশুকে প্রহার করার মতোই এটা অতীব নিচ কাজ?…।

পিয়ের থামল, আনাতোলের দিকে তাকাল, তার চোখে এখন রাগের বদলে জিজ্ঞাসার প্রকাশ।

পিয়ের ক্রোধ সংবরণ করেছে দেখে আনাতোল কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। সে বলল, অতকথা আমি জানি না, জানতে চাইও না, কিন্তু আমার প্রতি তুমি এমন সব শব্দ ব্যবহার করেছ-নিচ ইত্যাদি–যেটা একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে আমি কাউকে ব্যবহার করতে দিতে পারি না।

আনাতোল কি চায় বুঝতে না পেরে পিয়ের অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

আনাতোল বলতে লাগল, যদিও এটা নিভৃত আলোচনা, তবু না…

পিয়ের বিদ্রূপ করে বলল, তুমি কি ক্ষতিপূরণ চাও?

অন্তত তোমার কথাগুলো তো ফিরিয়ে নিতে পার। কি বল? আমি তোমার ইচ্ছামতো কাজ করি সেটাই যদি চাও, তা হলে?

পিয়ের বলে উঠল, কথা ফিরিয়ে নিলাম, ফিরিয়ে নিলাম! তোমার কাছে ক্ষমাও চাইছি।…আর তোমার যাত্রার জন্য যদি টাকার প্রয়োজন হয়…

আনাতোল হাসল। সেই নিচ, তোষামুদে হাসি স্ত্রীর কল্যাণে যা পিয়ের খুব ভালোই চেনে, সে হাসি দেখে পিয়ের ক্ষেপে গেল।

আঃ, নিচ, হৃদয়হীন পশু! আর্তকণ্ঠে কথাটা বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পরদিন আনাতোল পিটার্সবুর্গ যাত্রা করল।

.

অধ্যায়-২১

পিয়ের মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার বাড়িতে গেল তাকে খবর দিতে যে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে, আনাতোলর মস্কো থেকে নির্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমস্ত বাড়িটা আতংকে ও উত্তেজনায় থমথম করছে। নাতাশা খুবই অসুস্থ, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা তাকে গোপনে জানাল, আনাতোল যে বিবাহিত এ খবর জানবার পরে সেইরাতেই নাতাশা গোপনে আর্সেনিক সংগ্রহ করে সেই বিষ খেয়েছিল। কিছুটা খেয়েই সে খুব ভয় পেয়ে যায় এবং সোনিয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে সবকথা খুলে বলে। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করায় বিপদ কেটে গেলেও এখন সে এত দুর্বল যে তাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, আর তাই কাউন্টেসকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানো হয়েছে। বিপর্যস্ত কাউন্ট ও সোনিয়ার সঙ্গেও পিয়েরের দেখা হল, তখনো তাদের মুখে চোখের জলের দাগ লেগে আছে, কিন্তু সে নাতাশার সঙ্গে দেখা করতে পারল না।

সেদিন পিয়ের ক্লাবেই ডিনার খেল। সেখানে সর্বত্রই রস্তভার অপহরণের গুজব শোনা গেল। সে অবশ্য গুজবের তীব্র প্রতিবাদ করে প্রত্যেককে জানিয়ে দিল যে, তার শ্যালক নাতাশার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু তা গৃহীত হয় নি। এর বেশি কিছুই ঘটেনি। পিয়েরের মনে হল, সমস্ত ব্যাপারটা চাপা দিয়ে নাতাশার সুনামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা তার কর্তব্য।

সে অত্যন্ত ভয়ের সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, তার খবরের জন্য প্রতিদিনই একবার করে বুড়ো প্রিন্সের কাছে যেতে লাগল।

বুড়ো প্রিন্স বলকনস্কি শহরে প্রচারিত সব গুজবই মাদময়জেল বুরিয়ের কাছ থেকে শুনতে পেল, প্রিন্সেস মারির কাছে লেখা যে চিঠিতে নাতাশা বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে সেটাও সে পড়েছে। এতে তার মন-মেজাজ বেশ খুশি হয়ে উঠল, গভীর অধৈর্যের সঙ্গে সে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

আনাতোল চলে যাবার কয়েকদিন পরে পিয়ের প্রিন্স আন্দ্রুর একটা চিঠি পেল, তাতে নিজের যাবার কথা জানিয়ে তাকে দেখা করতে বলেছে।

প্রিন্স আন্দ্রু মস্কোতে পৌঁছনোমাত্রই বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে দিয়ে নাতাশা প্রিন্সেস মারিকে যে চিঠিটা লিখেছিল সেই চিঠি বাবা তার হাতে তুলে দিল (মাদময়জেল বুরিয়ে প্রিন্সেস মারির কাছ থেকে চিঠিটা চুরি করে বুড়ো প্রিন্সকে এনে দিয়েছিল এবং কিছু ডালপালা ছড়িয়ে নাতাশার অপহরণের কাহিনীও তাকে শুনিয়ে দিল।

প্রিন্স আন্দ্রু পৌঁছল সন্ধ্যায়, আর পিয়ের তার সঙ্গে দেখা করতে এল পরদিন সকালে। বসার ঘরে ঢুকেই সে শুনতে পেল প্রিন্স আন্দ্রু পড়ার ঘরে উত্তেজিত চড়া গলায় পিটার্সবুর্গের কোনো ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলছে। বুড়ো প্রিন্সের গলা এবং অপর একজনের গলা মাঝে মাঝেই তাকে বাধা দিচ্ছে। প্রিন্সেস মারি পিয়েরের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে এল। যে ঘরে প্রিন্সেস আন্দ্রু ছিল তার দরজার দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মুখ দেখেই পিয়ের বুঝতে পারল, যা ঘটেছে তা নিয়ে এবং নাতাশার বিশ্বাসহীনতার সংবাদটাকে তার দাদা যেভাবে নিয়েছে তা নিয়েও সে যেন বেশ খুশিই হয়েছে।

প্রিন্সেস মারি বলল, দাদা বলেছে সে এইরকমই আশা করেছিল। আমি জানি, আত্মগর্বই তাকে তার মনের আসল কথা প্রকাশ করতে দেবে না, তু সে যেরকম ভালোভাবে খবরটাকে নিয়েছে ততটা আমি আশা করিনি। স্পষ্টতই এই রকমটাই ঘটার কথা…।

কিন্তু এও কি সম্ভব যে সবকিছু সত্যি শেষ হয়ে গেছে পিয়ের প্রশ্ন করল।

প্রিন্সেস মারি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। এরকম একটা প্রশ্ন যে পিয়ের কেমন করে করল তাই সে বুঝতে পারে নি। পিয়ের পড়ার ঘরে ঢুকল। প্রিন্স আন্দ্রু অনেক বদলে গেছে। স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, কিন্তু দুই ভুরুর মাঝখানে একটা সমান্তরাল ভাঁজ পড়েছে। অসামরিক পোশাকে সে তার বাবা ও প্রিন্স মেশচেরেস্কির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আলোচনা চলছিল স্পেনষ্কিকে নিয়ে-তার আকস্মিক নির্বাসন এবং রাজদ্রোহের অভিযোগের সংবাদ সবেমাত্র মস্কোতে পৌঁছেছে।

প্রিন্স আন্দ্রু বলছে, একমাস আগেও তাকে নিয়ে যারা নাচানাচি করছিল তারাই আজ তার নিন্দা করছে, তাকে অভিযুক্ত করছে। অনুগ্রহবঞ্চিত কোনো লোককে বিচার করা এবং অন্য লোকের ভুলের সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা খুব সোজা, কিন্তু আমি বলতে চাই যে এই শাসনকালে যদি কোনো ভালো কাজ হয়ে থাকে তো সেটা তিনিই করেছেন–আর কেউ নয়।

পিয়েরকে দেখে সে থামল। তার মুখটা কেঁপে উঠল, সেখানে একটা প্রতিহিংসার ভাব দেখা দিল।

উত্তরপুরুষ তার প্রতি ন্যায়বিচার করবে, এই বলে বক্তব্য শেষ করে সে সঙ্গে সঙ্গে পিয়েরের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

আরে, কেমন আছ? আরো মোটাসোটা হয়েছ দেখছি? চটপট কথাগুলি বললেও তার কপালের নতুন ভাঁজটা গভীরতর হল। হ্যাঁ, আমি ভালো আছি, পিয়েরের প্রশ্নের উত্তরে কথাটা বলে সে হাসল।

পিয়েরের মনে হল সে হাসি যেন স্পষ্ট করে বলছে : আমি ভালো আছি, কিন্তু আমার স্বাস্থ্য তো এখন আর কারো কোনো কাজে লাগবে না।

 পোলিশ সীমান্তের খারাপ রাস্তা, সুইজারল্যান্ডে পিয়েরের পরিচিত যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে ও মঁসিয় দেসাল্লে যাকে সে ছেলের গৃহশিক্ষকরূপে বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে-এইসব বিষয় পিয়েরের সঙ্গে অল্প কয়েকটি কথা বলেই আবার সে স্পেরানস্কি-প্রসঙ্গের আলোচনায় সাগ্রহে যোগ দিল।

সে বলতে লাগল, যদি রাজদ্রোহ থেকে থাকে, নেপোলিয়নের সঙ্গে গোপন সম্পর্কের কোনো প্রমাণ যদি থাকে, তাহলে সেগুলো সাধারণের কাছে প্রকাশ করা উচিত ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি স্পেরানস্কিকে পছন্দ করি না, কখনো করতাম না, কিন্তু আমি চাই ন্যায়বিচার!

এতক্ষণে পিয়ের বন্ধুর একটি অতি পরিচিত প্রয়োজনের কথা বুঝতে পারল : তার মনের মধ্যে অতিশয় যন্ত্রণাদায়ক যে চিন্তাগুলি ঘোরাফেরা করছে তাদের চাপা দেবার জন্য বাইরের ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত আলোচনায় মেতে থাকা তার পক্ষে এখন বড় দরকারি।

প্রিন্স মেশচেরেস্কি চলে যাবার পরে প্রিন্স আন্দ্রু পিয়েরের হাত ধরে তাকে নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটাকে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বিছানা পাতা হয়েছে, আর আছে কয়েকটা ভোলা পোর্টমেন্টো। তারই একটার ভিতর থেকে একটা বাক্স বের করে তার ভিতর থেকে প্রিন্স আন্দ্রু কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট তুলে নিল। নিঃশব্দে বেশ তাড়াতাড়ি কাজটা করল। উঠে দাঁড়িয়ে একটু কাশল। তার মুখটা বিষণ্ণ, ঠোঁট দুটি চাপা।

তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য আমাকে ক্ষমা কর…

পিয়ের বুঝল প্রিন্স আন্দ্রু এবার নাতাশার প্রসঙ্গ তুলবে, তার মুখে করুণা ও সহানুভূতির চিহ্ন ফুটে উঠল। তা দেখে প্রিন্স আন্দ্রু বিরক্ত হল, কঠিন, কর্কশ, অপ্রীতিকর স্বরে সে বলতে লাগল :

কাউন্টেস রস্তভার কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছি, তাতে সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আর তোমার শ্যালক যে তার পাণিপ্রার্থনা করেছে বা ঐরকম একটাকিছু ঘটেছে তার বিবরণও আমি শুনেছি। কথাগুলি কি সত্য?

সত্যও বটে, অসত্যও বটে, পিয়ের বলা শুরু করতেই প্রিন্স তাকে বাধা দিল।

এই তার সব চিঠি ও একটা প্রতিশ্রুতি, সে বলল।

টেবিল থেকে প্যাকেটটা তুলে পিয়েরের হাতে দিল।

 এটা কাউন্টেসকে দিও…যদি তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়।

সে খুব অসুস্থ, পিয়ের বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, তাহলে সে কি এখনো এখানেই আছে? সঙ্গে সঙ্গে যোগ করল, আর প্রিন্স কুরাগিন?

কুরাগিন অনেক আগেই চলে গেছে। কাউন্টেস তো যমের দুয়ার পর্যন্ত গিয়েছিল।

তার অসুস্থতার জন্য আমি দুঃখিত, বলে প্রিন্স আন্দ্রু তার বাবার মতোই নিরাসক্ত, বিদ্বেষপূর্ণ হাসি হাসল।

তাহলে মঁসিয় কুরাগিন কাউন্টেস রস্তভার পাণিগ্রহণ করে তাকে সম্মানিত করেননি বলে প্রিন্স আন্দ্রু বারকয়েক নাক ঝাড়ল।

পিয়ের বলল, সে বিয়ে করতে পারে নি, কারণ আগেই তার বিয়ে হয়েছে।

প্রিন্স আন্দ্রু পুনরায় এমনভাবে হেসে উঠল যাতে তার বাবার কথাই মনে পড়ে যায়।

 তোমার শ্যালকটি এখন কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? সে বলল।

সে চলে গেছে পিটার্স…কিন্তু আমি ঠিক জানি না, পিয়ের বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, ঠিক আছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। কাউন্টেস রস্তভাকে বলে দিও, সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল এবং আছে, আর আমি তার কল্যাণই চাই।

বিয়ের প্যাকেটটা নিল। আরো কিছু বলবার আছে কি না স্মরণ করতে চেষ্টা করে প্রিন্স আন্দ্রু তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

পিয়ের বলল, আমি বলি কি, পিটার্সবুর্গে আমাদের যে আলোচনা হয়েছিল তা কি তোমার মনে আছে?

প্রিন্স আন্দ্রু অতি জবাব দিল, হা, আমি বলেছিলাম পতিতা মেয়েমানুষকে ক্ষমা করা উচিত, কিন্তু ওকে ক্ষমা করতে পারব একথা তো বলিনি। আর পারবও না।

পিয়ের বলল, কিন্তু এ তুলনা করা কি চলে?… ।

 প্রিন্স আন্দ্রু তাকে বাধা দিয়ে চিৎকার করে বলল :

হ্যাঁ, আবার তার পাণিপ্রার্থনা করি, উদারতা দেখাই, এই তো?…হা, সেটা খুবই মহান ব্যাপার হত, কিন্তু সেই ভদ্রলোকের পদাংক অনুসরণ করতে আমি পারব না। যদি আমার বন্ধুত্ব চাও তো আর কখনো একথা আমাকে বলো না…কোনও কথা নয়! আচ্ছা, বিদায়। তাহলে প্যাকেটটা তাকে দিচ্ছ?

ঘর থেকে বেরিয়ে পিয়ের বুড়ো প্রিন্স ও প্রিন্সেস মারির কাছে গেল।

বুড়ো মানুষটিকে আগের চাইতে হাসিখুশি মনে হল। প্রিন্সেস মারি সর্বদাই একরকম, তবু দাদার প্রতি সহানুভূতির অন্তরালে পিয়েরের নজরে পড়ল যে এই বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় সে খুশিই হয়েছে। তাদের দিকে তাকিয়ে পিয়ের বুঝতে পারল, রস্তদের প্রতি তাদের সকলের মনেই কী ঘৃণা ও বিরূপতা বাসা বেঁধেছে। সে আরো বুঝতে পারল, যে মেয়ে অন্য কারো জন্য প্রিন্স আন্দ্রুকে ত্যাগ করতে পারে এদের সামনে তার নাম। উচ্চারণ করাও অসম্ভব।

ডিনারের সময় আসন্ন যুদ্ধ নিয়েই আলোচনা চলল। প্রিন্স আন্দ্রু অনবরত কথা বলতে লাগল, কখনো বাবার সঙ্গে তর্ক করছে, কখনো বা সুইস শিক্ষক দেল্পের সঙ্গে, তার সব কথাতেই একটা অস্বাভাবিক উত্তেজনার প্রকাশ, আর তার কারণটা পিয়ের খুব ভালোই জানে।

.

অধ্যায়-২২

 তার উপর যে কাজের ভার দেওয়া হয়েছে সেটা শেষ করার জন্য সেদিন সন্ধ্যায়ই পিয়ের রস্তভদের বাড়িতে গেল। নাতাশা বিছানায় শুয়ে, কাউন্ট ক্লাবে গেছে, চিঠিগুলো সোনিয়াকে দিয়ে পিয়ের মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার কাছে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু খবরটাকে কীভাবে নিয়েছে সেটা জানতে সে খুবই আগ্রহী। দশ মিনিট পরে সোনিয়া মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার কাছে এল।

বলল, কাউন্ট পিতর কিরিলোভিচের সঙ্গে দেখা করার জন্য নাতাশা পীড়াপীড়ি করছে।

কিন্তু তা কি করে হয়? ওকে কি করে তার কাছে নিয়ে যাব? ঘরটা যে এখনো পরিষ্কার করা হয় নি।

সোনিয়া বলল, না, সে পোশাক বদলে বসার ঘরে চলে গেছে।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা শুধু কাঁধ ঝাঁকুনি দিল।

ওর মা যে কবে আসবেন! আমাকে তো জ্বালিয়ে মারছে! পিয়েরকে বলল, দেখুন, ওকে যেন সব কথা বলবেন না! ওকে দেখলে বড়ই করুণা হয়, ওকে বকুনি দিতেও মন সায় দেয় না।

নাতাশা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক শুকিয়ে গেছে, মুখটা কঠিন, বিবর্ণ, কিন্তু পিয়ের যেরকম আশা করেছিল মোটেই সেরকম লজ্জায় সংকুচিত নয়।

পিয়েরই তার দিকে এগিয়ে গেল। ভাবল, নাতাশা যথারীতি হাতটা এগিয়ে দেবে, কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই সে থামল, দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল, দুটো হাত মড়ার মতো দুই পাশে ঝুলে পড়ল।

তারপর তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, পিতর কিরিলোভিচ, প্রিন্স বলকনস্কি আপনার বন্ধু ছিলেন-বন্ধু আছেন। একসময় সে আমাকে বলেছিল আপনাকে…

তার দিকে তাকিয়ে পিয়ের নাকটা টানল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। তখনো পর্যন্ত তার মনে ছিল নাতাশার প্রতি তিরস্কার, সে চেষ্টা করেছে তাকে ঘৃণা করতে, কিন্তু এইমুহূর্তে নাতাশার জন্য সে এত বেশি দুঃখ বোধ করল যে তাকে তিরস্কার করার মনই রইল না।

সে তো এখন এখানেই আছে, তাকে বলবেন…মানে…আমাকে যেন ক্ষমা করে!

 কি যে বলবে পিয়েরের মাথায় এল না।

নাতাশা তাড়াতাড়ি বলতে লাগল, না, আমি জানি সব শেষ হয়ে গেছে। শুধু তার প্রতি যে অন্যায় করেছি সেই যন্ত্রণাই আমাকে দগ্ধ করছে। তাকে বলবেন, তার কাছে আমার একটি ভিক্ষা, সে যেন সবকিছুর জন্য আমাকে ক্ষমা করে, ক্ষমা করে, ক্ষমা করে…

নাতাশার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। সে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

একটা অজ্ঞাতপূর্ব করুণায় পিয়েরের অন্তর উসিত হয়ে উঠল।

বলল, বলব, সব কথাই তাকে আর একবার বলব। কিন্তু…একটা কথা আমি জানতে চাই…

কি জানতে চান? নাতাশার চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল।

আমি জানতে চাই আপনি কি ভালোবাসতেন সেই… পিয়ের বুঝতে পারছে না আনাতোলের কথাটা কীভাবে তুলবে, তার কথা মনে হতেই পিয়েরের মুখ লাল হয়ে উঠেছে-আপনি কি ভালোবাসতেন সেই খারাপ লোকটিকে?

নাতাশা বলল, তাকে খারাপ লোক বলবেন না! কিন্তু আমি জানি না, কিছুই জানি না…

নাতাশা কেঁদে ফেলল, আর করুণা, মমতা ও ভালোবাসার অনুভূতি যেন পিয়েরের অন্তরে আরো বেশি করে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল তার চশমার নিচ দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে, তবু আশা করল যে তা কারো নজরে পড়বে না।

এ নিয়ে আমরা আর কোনো কথা বলব না, পিয়ের বলল, তার দরদী, নরম কণ্ঠস্বর সহসা নাতাশার কাছে অদ্ভুত ঠেকল।

এ নিয়ে আমরা আর কথা বলব না–তাকে সব কথাই বলব, কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা মিনতি, আমাকে বন্ধু বলেই মনে করবেন, যদি কোনো সাহায্য বা পরামর্শ চান, যদি কারো কাছে মনের কথা খুলে বলতে চান–এখন নয়, পরে যখন আপনার মন পরিষ্কার হবে–তখন আমার কথা মনে করবেন! নাতাশার হাতখানি টেনে নিয়ে সে তাতে চুমো খেল। আমার ক্ষমতায় যদি কোনো কিছু করা সম্ভব হয় তাহলে খুশি হব।

ওভাবে কথা বলবেন না, আমি তার উপযুক্ত নই! বলেই নাতাশা ঘর থেকে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল, কিন্তু পিয়ের তার হাতটা ধরে ফেলল।

সে জানত তার আরো কিছু বলার আছে। কিন্তু সেকথা যখন বলা হল তখন নিজের কথায় সে নিজেই। অবাক হয়ে গেল।

পিয়ের নাতাশাকে বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান! সারাটা জীবন আপনার সামনে পড়ে আছে।

আমার সামনে? না! আমার সব শেষ হয়ে গেছে, লজ্জা ও আত্মধিক্কারের সুরে সে বলল।

সব শেষ? পিয়ের কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। আমি যদি এই আমি না হতাম, যদি হতাশ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর, বুদ্ধিমান ও শ্রেষ্ঠ মানুষ, যদি আমার স্বাধীনতা থাকত, তাহলে এইমুহূর্তে আমি নতজানু হয়ে আপনার হাত ও আপনার ভালোবাসা প্রার্থনা করতাম!

অনেকদিন পরে এই প্রথম নাতাশার দুই চোখ বেয়ে কৃতজ্ঞতা ও মমতার ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল, পিয়েরের দিকে তাকিয়ে সে ঘর থেকে চলে গেল।

সে চলে যাওয়ামাত্রই পিয়েরও ছুটে পাশের ঘরে চলে গেল, মমতা ও আনন্দের উদগত অশ্রুতে কোনোরকমে সংযত করল, এবং জোব্বার আস্তিন খুঁজে না পেয়ে সেটাকে কাঁধের উপর ফেলেই স্লেজে উঠে পড়ল।

কোচয়ান জানতে চাইল, এবার কোথায় যাব ইয়োর এক্সেলেন্সি?

পিয়ের নিজেকে শুধাল, কোথায় যাব? এখন কোথায় যেতে পারি? নিশ্চয়ই ক্লাবে যাব না, কারো সঙ্গে দেখা করতেও নয়? মমতা ও ভালোবাসার যে অভিজ্ঞতা তার হয়েছে, চোখের জলের ভিতর দিয়ে নাতাশা যে নরম, মমতাময় শেষ দৃষ্টি তাকে উপহার দিয়েছে, তার সঙ্গে তুলনায় সব মানুষকেই এখন করুণার পাত্র বলে মনে হচ্ছে।

বাড়ি! পিয়ের জবাব দিল, তারপর দশ ডিগ্রি তুষারপাত সত্ত্বেও চওড়া বুকের উপর থেকে ভালোকের চামড়ার জোব্বাটা সরিয়ে সানন্দে খোলা বাতাসে শ্বাস টানতে লাগল।

আবহাওয়া পরিষ্কার, তুষার পড়ছে। স্বল্পালোকিত নোংরা রাস্তার আর কালো কালো ছাদের উপরে অন্ধকার তারকাখচিত আকাশ বহুদূরে প্রসারিত। এইমাত্র তার আত্মা যে ঊর্ধ্বলোকে বিচরণ করছে তার সঙ্গে তুলনায় পার্থিব সবকিছু কত নিচ ও তুচ্ছ-এই চিন্তাই এতক্ষণ পিয়েরকে পেয়ে বসেছিল, এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে সে অনুভূতি তার মন থেকে দূর হয়ে গেল। আবাত স্কোয়ারে ঢোকার মুখে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত একটা অন্ধকার তারকাখচিত আকাশ তার সামনে দেখা দিল। ঠিক তার মাঝখানে, প্রেশিস্তেংকা বুলভার্দের উপরে, চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তারাদলের ভিতরে থেকেও পৃথিবীর নৈকট্য, তার সাদা আলো ও দীর্ঘ ঊর্ধ্বায়িত পুচ্ছের দরুন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ পৃথক ১৮১২ সালের প্রকাণ্ড ও উজ্জ্বল ধূমকেতুটি জ্বলজ্বল করছে–সকলেই বলেছে, এই ধূমকেতুটি সবরকম দুঃখ-দুর্দশা ও পৃথিবীর ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করে এনেছে। কিন্তু দীর্ঘ উজ্জ্বল পুচ্ছসমন্বিত এই ধূমকেতুটি পিয়েরের মনে কোনো ভয়ের অনুভূতি জাগাল না। বরং এই উজ্জ্বল ধূমকেতুটির দিকে সে আনন্দের সঙ্গে অশ্রুজলে ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল : ধারণার অতীত দ্রুতগতিতে অপরিমেয় মহাশূন্যের ভিতর দিয়ে স্বীয় কক্ষপতে চলতে চলতে এই মুহূর্তে সহসা ধূমকেতুটিকে মনে হচ্ছে–পৃথিবীবিদ্ধকারী একটা তীরের মতো–সে যেন একটা বিশেষ স্থানে এসে স্থির হয়ে গেছে, অসংখ্য ঝিকিমিকি তারাদলের মাঝখানে স্বীয় পুচ্ছটিকে সবেগে উচ্চে তুলে তার সাদা আলোর শিখাগুলিকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পিয়েরের মনে হল, তার নিজের দয়ার্দ্র উৰ্বায়িত যে আত্মা এখন একটা নতুন জীবনের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে, এই ধূমকেতু যেন তারই পরিপূর্ণ প্রতিধ্বনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *