০৭. বাইবেলের কাহিনী

সপ্তম পর্ব অধ্যায়-১

বাইবেলের কাহিনীতে বলে, মহাপতনের পূর্বে প্রথম মানুষের পরমানন্দের অন্যতম অবস্থাই ছিল পরিশ্রমের অভাব-আলস্য। পতিত মানুষ তাই আজও আলস্যপ্রিয়তাকে বজায় রেখেছে, কিন্তু মানবজাতির মাথায় অভিশাপটি এখনও চেপে বসে আছে, তার কারণ শুধু এই নয় যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের রুটির যোগাড় করতে হয়, আসল কারণ হল আমাদের নৈতিক স্বভাবই এমন যে আমরা যুগপৎ অলস ও সুখী হতে পারি না। ভিতর থেকে কে যেন বলে দেয়, অলস হলেই আমরা অন্যায় করব। মানুষ যদি সেরকম একটা অবস্থা খুঁজে পায় যেখানে সে বুঝতে পারবে যে অলস হয়েও সে তার কর্তব্য পালন করছে, তাহলেই মানুষের আদিম পরমানন্দের একটা অবস্থা সে পেয়ে যাবে। আর এ ধরনের একটা বাধ্যতামূলক ও অনিন্দনীয় আলস্যই এক শ্রেণীর মানুষের নিয়তি–তারা হল সামরিক শ্ৰেণী। এই বাধ্যতামূলক ও অনিন্দনীয় আলস্যই সামরিক চাকরির প্রধান আকর্ষণ এবং তা থাকবে।

১৮০৭ সালের পরে নিকলাস রস্তভ যখন পাভলোগ্রাদ রেজিমেন্টের চাকরিতেই থেকে গেল, তখনই সে এই আনন্দময় অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করল। ততদিনে সে দেনিসভের কাছ থেকে পাওয়া সেনাদলের পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছে।

মস্কোর পরিচিতজনরা রস্তভকে কিছুটা খারাপ মনে করলেও তার সহকর্মীরা, অধীনস্থ কর্মচারী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা তাকে পছন্দ করে, শ্রদ্ধা করে। এ জীবন নিয়ে সে নিজেও সন্তুষ্ট। ইদানীংকালে, ১৮০৯ সালে, সে বাড়ির চিঠিতে প্রায়ই মার কাছ থেকে অভিযোগ পাচ্ছে যে তাদের অবস্থা ক্রমশই গোলমেলে হয়ে উঠছে এবং এবার বাড়িতে ফিরে গিয়ে বুড়ো বাবা-মাকে সুখী করা, তাদের আরাম দেওয়ার সময় এসেছে।

এইসব চিঠি পড়ে নিকলাসের ভয় হয়েছে, জীবনের সবরকম জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে যে পরিবেশে এত শান্তভাবে সে বাস করছে, তারা চাইছে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। সে বুঝতে পারছে, আগে হোক পরে হোক আবার তাকে জীবনের সেই ঘূর্ণি-স্রোতে ঢুকতে হবেসেখানে আছে নানান জটিলতা ও কাজকর্ম, নায়েবদের সঙ্গে হিসাবপত্র করা, ঝগড়া করা, নানারকম ষড়যন্ত্র, বন্ধন, সমাজ, সোনিয়ার ভালোবাসা এবং তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। এসবই ভয়ানক রকমের শক্ত ও জটিল; তাই মার কাছে সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি ভাষায় লেখা চিঠির শুরুতে লিখল প্রিয় মামণি, আর শেষে লিখল তোমার বিশ্বস্ত ছেলে, কিন্তু কবে বাড়ি ফিরবে সে বিষয়ে কিছুই জানাল না। ১৮১০-এ বাবা-মার কাছ থেকে যে চিঠি পেল তাতে তারা জানাল যে বলকনস্কির সঙ্গে নাতাশার বিয়ে পাকা হয়েছে, এবং বুড়ো প্রিন্স বাগড়া দেওয়ায় বিয়েটা বছরখানেক পিছিয়ে গেছে। চিঠি পেয়ে নিকলাস দুঃখ পেল, মর্মাহত হল। সেইবছর বসন্তকালেই সে মার একটা চিঠি পেল; বাবার অগোচরে লেখা সেই চিঠিতে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়েছে। মা লিখেছে, সে যদি বাড়ি এসে সমস্ত ব্যাপারটা হাতে না নেয় তাহলে তাদের সমস্ত সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হয়ে যাবে এবং তাদের সকলকেই ভিক্ষা করতে হবে। কাউন্ট এত দুর্বল, মিতেংকাকে এত বেশি বিশ্বাস করে এবং এতই ভালোমানুষ যে সকলেই তার সুযোগ নিচ্ছে এবং অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে চলেছে। কাউন্টেস লিখেছে, মিনতি করে বলছি, ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে এবং গোটা পরিবারকে যদি বিপাকে ফেলতে না চাও তো অবিলম্বে চলে এস।

চিঠিটা পেয়ে নিকলাসের মন নরম হল। বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সাধারণ বুদ্ধিতেই সে বুঝতে পারল তার কি করা উচিত।

চাকরি থেকে অবসর না নিলেও অন্ততপক্ষে ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাওয়াই এখন তার পক্ষে সঠিক কাজ। কেন যে তাকে যেতেই হবে তা সে জানে না; কিন্তু খাবার পরে একটু ঘুমিয়ে উঠেই সে মার্সকে জিন পরাতে হুকুম দিল এবং ঘর্মাক্ত ঘোড়াটাকে নিয়ে ফিরে এসে লাভ্রুশকাকে (দেনিসভের চাকরটি তার সঙ্গেই রয়ে গেছে) এবং সহকর্মীদের জানাল যে সে ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছে, এবং শীঘ্রই বাড়ি চলে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ পরে তার ছুটি মঞ্জুর হয়ে এল। তার হুজার সহকর্মীরা রস্তভের সম্মানে একটা ডিনারের আয়োজন করল; তাতে জনপ্রতি চাঁদা ধার্য করা হল পনেরো রুবল এবং দুটো ব্যান্ড ও দুই দল গায়কের ব্যবস্থা করা হল। মেজর বাসভের সঙ্গে রস্তভ লেপার্ক নাচল; নেশায় বুঁদ হয়ে অফিসাররা রস্তভকে দোলাল, আলিঙ্গন করল, তারপর নিচে ফেলে দিল; তৃতীয় স্কোয়াড্রনের সৈনিকরাও তাকে দোলাল, হুররা! বলে চিৎকার করল, আর তারপরে তাকে স্লেজে চাপিয়ে প্রথম ডাক-ঘাটি পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

ক্রেমেনচুগ থেকে কিয়েভ পর্যন্ত যাত্রার প্রথম অংশটায় স্বভাবতই সে পিছনে ফেলে আসা সৈনিক জীবনের কথাই ভাবতে লাগল। কিন্তু যতই বাড়ির দিকে এগোতে লাগল ততই বাড়ির কথাই বেশি করে মনে পড়তে লাগল। অত্রানুর আগেকার ডাক-ঘাঁটিতেই কোচয়ানকে তিন রুবল বকশিস দিল এবং গন্তব্যস্থানে পৌঁছেই ছোট ছেলের মতো বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল।

প্রথম মিলনের উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পরে নিকলাস তার পুরনো পারিবারিক জগতে স্থিতু হতে শুরু করল। বাবা ও মা প্রায় সেইরকমই আছে–একটু বুড়ো হয়েছে মাত্র। তাদের মধ্যে যেটা নতুন চোখে পড়ছে সেটা হচ্ছে কিছুটা অস্বস্তি ও সাময়িক বাদবিসম্বাদ; এটা আগে ছিল না, আর নিকলাসও অচিরেই বুঝতে পারল যে আর্থিক অবস্থা খারাপ হবার জন্যই এটা ঘটছে। সোনিয়ার বয়স প্রায় বিশ হতে চলল; সে আগের চাইতে আর বেশি সুন্দরী হয়ে ওঠেনি, যা হয়েছে তার চাইতে বেশিকিছু হবে বলে মনে হয় না, তবে সেটাই যথেষ্ট। নিকলাস আসার পর থেকেই সে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুখ ও ভালোবাসা; এই মেয়েটির বিশ্বস্ত, অপরিবর্তনীয় ভালোবাসা নিকলাসকেও সুখী করেছে। নিকলাসকে সবচাইতে বেশি অবাক করেছে পেতয়া ও নাতাশা। পেতয়া তেরোয় পা দিয়েছে, যেমন চটপটে তেমনই বুদ্ধিমান ও দুই; গলার স্বর এরমধ্যেই ভাঙতে শুরু করেছে। আর নাতাশা, অনেকদিন পর্যন্ত নিকলাস তাকে দেখলেই অবাক হয় আর হাসে।

বলে, তুমি আর আগের মতো নেই।

সে কি? আমি কি আরো কুৎসিত হয়েছি।

বরং অনেক মহিমান্বিতা হয়েছে। ঠিক যেন রাজকুমারি! রস্তভ তার কানে কানে বলল।

ঠিক ঠিক! নাতাশা সানন্দে চেঁচিয়ে উঠল।

 প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে পূর্বরাগের কথা, আর অত্রাদতে আসার কথা সবই তাকে বলল; তার শেষ চিঠিটাও দেখাল।

আচ্ছা, তুমি খুশি তো? নাতাশা বলল। এখন আমি কত শান্তিতে ও সুখে আছি।

 নিকলাস বলল, খুব খুশি। সে তো খুব ভালো ছেলে…খুবই প্রেমে পড়েছ নাকি?

নাতাশা জবাব দিল, কি করে যে বোঝাব? আমি তো বরিস, আমার মাস্টারমশাই এবং দেনিসভের প্রেমেও পড়েছিলাম, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি শান্তিতে আছি, সুখে আছি। আমি জানি তার চাইতে ভালো মানুষ হয় না, আর তাই আমি এখন শান্ত ও সন্তুষ্ট। আগের মতো মোটেই নয়।

বিয়েটা একবছর স্থগিত রাখার ব্যাপারটা নিকলাস সমর্থন করল না, কিন্তু নাতাশা হৈ-হৈ করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করল যে এছাড়া গত্যন্তর ছিল না, আর বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা পরিবারে প্রবেশ করাটাও ঠিক নয়; তাই সে নিজেই এটা চেয়েছিল।

বলল, তুমি মোটেই বুঝতে পারছ না।

নিকলাস চুপ কুরল; তার সঙ্গে একমত হল।

তার দিকে তাকিয়ে দাদা অবাক হয়ে যায়। তাকে দেখে মনেই হয় না সে এই মেয়ে প্রেমে পড়েছে এবং বাগদত্তা স্বামীর বিরহে দিন কাটাচ্ছে। আগের মতোই খোশমেজাজে শান্ত ও হাসিখুশিই আছে। নিকলাস দেখেশুনে অবাক হয়ে গেল; এমন কি বলকনস্কির পূর্বরাগ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠল। তার সবসময়ই মনে হয়, এই প্রস্তাবিত বিয়ের ব্যাপারে কোথায় যেন একটা খটকা আছে।

এই বিলম্ব কেন? বাগদান অনুষ্ঠান হল না কেন? সে ভাবল। এ বিষয়ে মার সঙ্গে কথা বলেও সে বুঝতে পারল যে এই বিয়ের ব্যাপারে তার মনেও সন্দেহ রয়েছে।

প্রিন্স আন্দ্রুর একটা চিঠি দেখিয়ে মা বলল, এই দেখ, সে লিখেছে ডিসেম্বরের আগে সে আসবে না। কিসের বাধা? হয় তো অসুখ! তার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। নাতাশাকে বল না। ও যে এত হাসিখুশি আছে তার উপরেও বেশি গুরুত্ব দিও না; সে এখন বালিকা বয়সের শেষের দিনগুলির ভিতর দিয়ে চলেছে। কিন্তু প্রত্যেকবার ছেলেটির চিঠি পেলে সে যে কি রকম হয়ে যায় তা তো আমি জানি। যাই হোক ঈশ্বর করুন সবই যেন ভালোয় ভালোয় শেষ হয়! (সব সময়ই এই কথাগুলি দিয়ে সে বক্তব্য শেষ করে) ছেলেটি সত্যি চমৎকার!

.

অধ্যায়-২

বাড়ি পৌঁছে প্রথমদিকে নিকলাস গম্ভীর হয়ে থাকত; কোনো কিছু ভালো লাগত না। যেজন্য মা তাকে বাড়িতে ডেকে এনেছে অচিরেই সেই সব বাজে সাংসারিক কাজকর্মে হাত লাগাতে হবে এই চিন্তাই তাকে বিব্রত করে তুলল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বোঝা ঝেড়ে ফেলবার জন্য তৃতীয় দিনেই রেগেমেগে, চেঁচামেচি করে কাউকে কিছু না বলে সে মিতেংকার বাড়ি চলে গেল এবং সবকিছুর হিসাব চেয়ে বসল। কিন্তু সবকিছুর হিসাব বলতে যে কি বোঝায় সে বিষয়ে ভীত ও বিভ্রান্ত মিতেংকার চাইতেও নিকলাসের জ্ঞান অল্প। মিতেকার সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলতে ও হিসাবপত্র দেখতে বেশি সময় লাগল না। বারান্দায় অপেক্ষমাণ গ্রাম-প্রধান, একজন কৃষক প্রতিনিধি ও গ্রাম্য করণিকটি ভয় ও আনন্দের সঙ্গে তরুণ কাউন্টের গলা শুনতে লাগল-প্রথমে গর্জন ও ধমক ক্রমেই উচ্চ হতে উচ্চতর হতে লাগল, তারপরই গালাগালি, ভয়ংকর সব শব্দ একের পর এক ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল।

ডাকাত!…অকৃজ্ঞ হতভাগা!…কুকুরটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলব! আমি বাবা নই!…আমাদের লুঠ করছ!…এমনি আরো অনেক কিছু।

তারপর একইরকম ভয় ও খুশির সঙ্গে তারা দেখল, মিতেংকার গলার নলি ধরে টানতে টানতে ছোট কাউন্ট তাকে বাইরে টেনে নিয়ে এল; তার মুখ লাল, দুই চোখ দিয়ে যেন রক্ত ফুটে বেরুবে; কথার ফাঁকে ফাঁকে সুবিধামতো সময়ে তাকে লাথি ও গুড়ো মারতে মারতে চিৎকার করে বলল, বেরিয়ে যাও! শয়তান, আর কোনোদিন যেন আমাকে তোমার মুখদর্শন করতে না হয়!

মিতেংকা লাফিয়ে ছটা সিঁড়ি পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল। মিতেংকার স্ত্রী ও শালী দরজার ফাঁক দিয়ে ভয়ার্ত মুখ বের করে সব দেখছিল। ছোট কাউন্ট সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দৃঢ় পদক্ষেপে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।

দাসীদের মুখে সব কথা শুনে কাউন্টেস এই ভেবে শান্ত হল যে এবার তাদের বিষয়-সম্পত্তির উন্নতি হবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার একটা দুশ্চিন্তা হল যে এই উত্তেজনার ফলে ছেলের ক্ষতি হতে পারে। পা টিপে টিপে সে বারকয়েক তার দরজায় গিয়ে কান পাতল, আর ওদিকে ছেলে একটার পর একটা পাইপ ধরিয়ে টানতে লাগল।

পরদিন বুড়ো কাউন্ট ছেলেকে একান্তে ডেকে নিয়ে বিব্রত মুখে বলল, কিন্তু বোঝ তো বাবা, এটা খুবই দুঃখের যে তুমি এতটা উত্তেজিত হয়েছিলে! মিতেংকা আমাকে সব কথা বলেছে।

নিকলাস ভাবল, আমি জানতাম এই পাগলা সংসারে আমি কোনোদিন কিছু বুঝতে পারব না।

ঐ সাতশ রুবল খাতায় লেখেনি বলে তুমি রাগ করেছ। কিন্তু সে টাকাটা জের টানা হয়েছিল–আর তুমিও পরের পাতাটা উল্টে দেখনি।

বাপি, ও তো একটা ঠগ ও চোর! আমি ওকে চিনি! আমি যা করেছি তা করেছি; তবে তুমি যদি চাও তো আর কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলব না।

না বাবা, না; আমি তোমাকে কাজকর্ম দেখতে অনুরোধ করছি। আমি বুড়ো হয়েছি। আমি…

না বাপি, আমি যদি তোমার অসন্তোষের কারণ হয়ে থাকি সেজন্য আমাকে ক্ষমা কর। এসব আমি তোমার চাইতে অনেক কম বুঝি।

এইসব চাষীদের ব্যাপার আর টাকাপয়সার ব্যাপার, এক পাতা থেকে আর এক পাতায় জের টানা–সব উচ্ছন্নে যাক, সে ভাবতে লাগল। তাস খেলার টুকিটাকি আমি বুঝি, কিন্তু আর এক পাতায় জের টানাটা বুঝি না। কিছু বুঝি না। সেই থেকে সে আর বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে নাক গলাত না। কিন্তু একদিন কাউন্টেস ছেলেকে ডেকে বলল, আন্না মিখায়লভনার কাছ থেকে সে দুই হাজার রুবলের একটা হাত-চিঠি পেয়েছে; এখন সেটা নিয়ে কি করা যায়।

নিকলাস জবাব দিল, এটা তো! তুমি বলছ এটা আমার উপর নির্ভর করছে। দেখ, আমি আন্না মিখায়লভনাকেও পছন্দ করি না, বরিসকেও পছন্দ করি না, কিন্তু তারা আমাদের বন্ধু, তারা গরিব। বেশ তো, তাহলে এই-বলেই সে হাত-চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল, আর তা দেখে বুড়ো কাউন্টেস আনন্দে কেঁদে ফেলল। তারপর থেকে হোট রস্তভ আর কখনো বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে কোনোরকম অংশ নিত না, কিন্তু পরিপূর্ণ উৎসাহের সঙ্গে একটা নতুন কাজে আত্মনিয়োগ করল-শিকার-সে ব্যাপারে তার বাবা একটা মস্ত বড় ব্যবস্থা সব সময়ই তৈরি রাখত।

.

অধ্যায়-৩

এর মধ্যেই আবহাওয়ায় শীতের ছোঁয়া লেগেছে; হেমন্তের বর্ষণসিক্ত ভোরের কুয়াশা মাটির উপর ঘন হয়ে নেমেছে। মাঠের সবুজ রং আরো ঘন হয়েছে; গোবৎসাদির পায়ে মাড়ানো শীতকালীন ফসলের বাদামি ফালি এবং বসন্তকালীন ফসলের হলদেটে ডাটা ও গমের লালচে ফালির পশ্চাৎপটে মাঠের উজ্জ্বল সবুজের আভা আরো উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। জঙ্গলে ঢাকা খাড়ি ও ঝোঁপঝাড়গুলো আগস্টের শেষভাগে কালো মাঠ ও ডাটাগুলোর মাঝে মাঝে সবুজ দ্বীপের মতো শোভা পাচ্ছে; এখন শীতকালীন গমের সবুজের মাঝখানে সেগুলিকে সোনালি ও উজ্জ্বল লাল রঙের দ্বীপ বলে মনে হচ্ছে। খরগোসরা এর মধ্যেই গ্রীষ্মকালীন আবরণ অর্ধেক পাল্টে ফেলেছে, শেয়ালের বাচ্চাগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে পড়েছে, আর নেকড়ের বাচ্চাগুলো কুকুরের চাইতে বড় হয়ে উঠেছে। শিকারের পক্ষে বছরের এটাই সেরা সময়।

শিকারি কুকুরগুলোকে সারা দিন বাড়িতেই বেঁধে রাখা হল। সন্ধ্যার দিকে আকাশ কুয়াশায় ঢেকে গেল, ধীরে ধীরে বরফ পড়তে শুরু করল। ১৫ তারিখে ছোট রস্তভ ড্রেসিং-গাউন চাপিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেল শিকারের পক্ষে এমন সুন্দর সকাল বুঝি আর হয় না : মনে হল আকাশ যেন গলে গলে পড়ছে আর মাটিতে ডুবে যাচ্ছে। এতটুকু বাতাস নেই; ছোট ছোট তুষারবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে। স্বচ্ছ তুষারবিন্দুগুলির ভারে বাগানের পত্রবিহীন শাখাগুলি হেলে পড়েছে; সদ্য খসে-পড়া পাতার উপর তুষারবিন্দুগুলি টুপটাপ করে ঝরছে। নিকলাস বাইরের স্যাঁৎসেঁতে কর্দমাক্ত ফটকে বেরিয়ে এল। বাতাসে পচা পাতা ও কুকুরের গন্ধ। কালো ফুটকিওয়ালা কুকুর মিলকা মনিবকে দেখে পিছনের পা দুটি ছড়িয়ে দিল, কিছুক্ষণ খরগোসের মতো শুয়ে থাকল, তারপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তার নাক গোঁফ চেটে দিল। আর একটা কুকুর লেজ তুলে ছুটে এসে তার পায়ে গা ঘষতে লাগল।

ও-হয়! ঠিক সেইমুহূর্তে ভেসে এল শিকারিদের অনুকরণীয় ডাক এবং মোড়ের মুখে দেখা দিল প্রধান শিকারি ও প্রধান কুকুর-রক্ষক দানিয়েল; মুখভর্তি বলিরেখা, ইউক্রেনিয় কেতায় কপালের উপর থেকেই চুল ছাঁটা, হাতে একটা লম্বা বাঁকা চাবুক, দুই চোখে শিকারিসুলভ স্বাতন্ত্র্য ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি। মাথার টুপিটা তুলে সে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে মনিবের দিকে তাকাল। মনিব কিন্তু সে তাচ্ছিল্যকে দোষের মনে করল না। নিকলাস জানে, যতই সকলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, যতই নিজেকে সকলের চাইতে বড় মনে করুক, তবু সে তারই ভূমিদাস ও শিকারি।

নিকলাস ডাকল, দানিয়েল!

কি হুকুম ইয়োর এক্সেলেন্সি? গম্ভীর গলায় শিকারি বলল; দুটি জ্বলন্ত কালো চোখ তুলে মনিবের দিকে তাকাল।

দিনটা খুব ভালো, না? শিকার ও ঘোড়দৌড়ের পক্ষে, কি বল? মিলকার কানের পিছনটা চুলকে দিতে দিতে নিকলাস প্রশ্ন করল।

দানিয়েল জবাব দিল না, শুধু চোখ কুঁচকাল।

এক মিনিট চুপ করে থাকার পরে তার গম্ভীর হুংকার শোনা গেল, ভভারেই আমি উভাকাকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, বাচ্চাদের নিয়ে তিনি অত্রানুর জঙ্গলের দিকে গেছেন। সেখানে তারা ডাকাডাকি করছে। (অস্যার্থ : একটা নেকড়ে বাঘিনি বাচ্চাদের নিয়ে অত্রানুর ঝোপে ঢুকেছে–জায়গাটা এ বাড়ি থেকে দুই ভান্টু দূরে।)

আমাদের যাওয়া উচিত; তোমার কি তাই মনে হয় না? নিকলাস বলল। উভাকাকে নিয়ে চলে এস।

আপনার যেমন ইচ্ছা।

তাহলে এখনকার মতো খাওয়ানো বন্ধ রাখ।

ঠিক আছে স্যার।

পাঁচ মিনিট পরেই দানিয়েল ও উভার্কা নিকলাসের বড় পড়ার ঘরে এসে হাজির হল। দানিয়েল বড়-বড় গোছের মানুষ নয়, কিন্তু তাকে একটা ঘরের মধ্যে দেখা মানেই মানুষের ব্যবহার্য আসবাবপত্রের মাঝখানে ও সেই পরিবেশে একটা ঘোড়া বা ভালুককে দেখা। দানিয়েল নিজেও সেটা বোঝে, তাই যথারীতি দরজার ঠিক মুখেই সে দাঁড়িয়েছে, পাছে মনিবের ঘরের কিছু ভেঙে ফেলে এই ভয়ে নড়াচড়া না করে আস্তে কথা বলতে চেষ্টা করছে এবং যাতে ছাদের নিচ থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি খোলা আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে পারে সেইজন্য দরকারি কথাগুলো তাড়াতাড়ি সেরে নিচ্ছে।

কথাবার্তা শেষ করে নিকলাস ঘোড়ার পিঠে সাজ পরাতে বলল। দানিয়েল সবে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে ঠিক সেইসময় নাতাশা দ্রুত পা ফেলে এসে হাজির হল; চুল বাঁধা হয়নি, সাজ-পোশাক শেষ হয়নি, বুড়ি নার্সের বড় শালটা জড়িয়েই চলে এসেছে। সেইসময়ই পেতয়াও দৌড়ে এল।

নাতাশা শুধাল, তুমি যাচ্ছ? আমি জানতাম তুমি যাবে! সোনিয়া বলেছিল তুমি যাবে না, কিন্তু আমি জানতাম আজকের মতো দিনে তুমি কখনো না গিয়ে পারবে না।

হ্যাঁ, আমরা যাচ্ছি, নিকলাস অনিচ্ছাসত্ত্বেও জবাব দিল, কারণ তার ইচ্ছা আজ খুব ভালো করে শিকার করবে, আর তাই নাতাশা ও পেতয়াকে সঙ্গে নেবে না। আমরা যাচ্ছি শুধু নেকড়ে শিকার করতে; সে তোমাদের ভালো লাগবে না।

নাতাশা বলল, তুমি জান ওতেই আমার সবচাইতে বেশি আনন্দ; এটা উচিত হয়নি; তুমি নিজে যাচ্ছ, ঘোড়ার সাজ পরিয়েছ, অথচ আমাদের কিছুই বলনি।

পেতয়া বলল, কোনও বাধাই একজন রুশকে রুখতে পারে না–আমরাও যাব!

নিকলাস নাতাশাকে বলল, কিন্তু তা হয় না। মামণি বলেছে তোমাদের যাওয়া চলবে না।

নাতাশা দৃঢ় গলায় বলল, হ্যাঁ, আমি যাবই। নিশ্চয় যাব। দানিয়েল, ওদের বল আমাদের জন্য ঘোড়া তৈরি করতে। আর মাইকেল চলুক আমার কুকুরগুলো নিয়ে।

দানিয়েলের মনে হল, কোনো ঘরে ঢোকাই তার পক্ষে বিরক্তিকর ও অনুচিত, আর কোনো তরুণীর ব্যাপারে থাকা তো একেবারেই অসম্ভব। চোখ নামিয়ে সে এমনভাবে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল যাতে অসাবধানে তরুণীটি কোনোভাবে আঘাত না পায়।

.

অধ্যায়

বুড়ো কাউন্ট সবসময়ই শিকারের একটা বড় আয়োজন, লোকজন ও জিনিসপত্র তৈরি রাখত; এখন সেগুলো সম্পূর্ণরূপে ছেলের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। আজ ১৫ই সেপ্টেম্বর সে খুব খোশমেজাজে ছিল, তার তাই শিকারিদলের সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।

এক ঘণ্টার মধ্যেই শিকারের পুরো দলটা ফটকে হাজির হল। নাতাশা ও পেতয়া নিকলাসকে কি যেন বলতে চাইল, কিন্তু সেসব বাজে কথা শুনবার সময় এখন নিকলাসের নেই, সে তাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। শিকারের সব আয়োজন একবারও দেখে নিল, শিকারের সন্ধানে একদল কুকুর ও শিকারিকে আগে পাঠিয়ে দিল, বাদামি রঙের, দোনেকসের পিঠে সওয়ার হল এবং শিস দিয়ে ইঙ্গিতে কুকুরগুলোকে এগিয়ে যেতে বলে অত্রানু-র জঙ্গলের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বুড়ো কাউন্টের ঘোটকিটাকে নিয়ে চলল একজন সহিস আর সে নিজে চলল একটা ছোট গাড়িতে চেপে।

তাদের সঙ্গে চলল চুয়ান্নটি শিকারি কুকুর আর ছজন অনুচর ও সহকারী। পরিবারের লোকজন ছাড়া সঙ্গে গেল আটজন কুকুর-রক্ষী এবং চল্লিশ জনের বেশি চাকরবার।

প্রায় এক ভার্স্ট পথ যাবার পরে কুকুরসহ আরো পাঁচটা অশ্বারোহী কুয়াশার ভিতর থেকে বেরিয়ে রস্তভদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তাদের সামনে মস্তবড় সাদা গোঁফওয়ালা একটি সোম্যদর্শন বৃদ্ধ।

বুড়ো মানুষটি আরো কাছে এলে নিকলাস বলল, শুভ সকাল খুড়ো!

তাই বল। এগিয়ে এস!…আমি এটা ঠিক জানতাম, খুড়ো বলতে শুরু করল। (লোকটি রস্তভদের দূর সম্পর্কে আত্মীয়, স্বল্পবিত্ত প্রতিবেশী।) আমি জানতাম এ আকর্ষণ তোমরা এড়াতে পারবে না; ভালোই হল যে তোমরাও চলেছ। তাই বল! এগিয়ে এস! (এই কথাগুলো খুড়োর মুদ্রাদোষ।) এখনই চলে যাও। আমার গিরচিক বলছে, ইলগিনরা কুকুর সঙ্গে নিয়ে কর্নিকিতে পৌঁছে গেছে। তাই বল, এগিয়ে এস!…নইলে তোমাদের নাকের ডগা দিয়ে তারা বাঘের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যাবে।

আমি সেখানেই যাচ্ছি। আমরা তোমার দলে যোগ দেব কি?

সব শিকারি কুকুরগুলোকে একদলে যুক্ত করে দেওয়া হল, আর খুড়ো ও নিকলাস ঘোড়ায় চেপে পাশাপাশি চলতে লাগল। নাতাশা সারা শরীর শালে জড়িয়ে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে তাদের সঙ্গে মিলিত হল। তার পিছন পিছন এল পেতয়া, শিকারি মাইকেল ও তাকে দেখাশুনা করবার জন্য নিযুক্ত একটি সহসি।

খুড়ো মুখটা ঘুরিয়ে অসম্মতিসূচক দৃষ্টিতে পেতয়া ও নাতাশার দিকে তাকাল। শিকারের মতো একটা গুরুতর ব্যাপারকে সে ছেলেমানুষের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে চায় না।

পেতয়া চিৎকার করে বলল, শুভ সকাল খুড়ো! আমরাও যাচ্ছি। 

শুভ সকাল! শুভ সকাল! কিন্তু কুকুরগুলোকে ছাড়িয়ে যেয়ো না, খুড়ো কঠোর স্বরে বলল।

নাতাশা বলল, আমরা তোমার পথের বিঘ্ন হব একথা ভেবো না খুড়ো। আমরা ঠিক আমাদের পথ ধরে চলব, একটু এদিক-ওদিক যাব না।

খুড়ো বলল, খুব ভালো কথা ছোট্ট কাউন্টেস, শুধু খুব সাবধান, ঘোড়ার পিঠ থেকে যেন পড়ে যেয়ো না, কারণ-তাই বল, চলে এস!-ধরবার মতো কিছুই তো হাতের কাছে নেই।

অত্রানুদের জঙ্গলের ভিতরকার মরুদ্যানটি শ দুই গজ দূর থেকেই চোখে পড়ল, শিকারিরা তার কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে। খুড়োর সঙ্গে কথা বলে রস্তভ ঠিক করে ফেলেছে কুকুরগুলোকে কোথায় লেলিয়ে দেবে; তারপর নাতাশা কোথায় দাঁড়াবে সেটা দেখিয়ে দিয়ে সে ঘুরে খাঁড়ির উপরে উঠে গেল।

খুড়ো বলল, দেখ ভাইপো, একটা বড় নেকড়ে ধরতে যাচ্ছ। দেখো যেন পালাতে না পারে!

দেখা যাক কি হয়, রস্তভ জবাব দিল। ক্যারা, এখানে আয়! দুর্দান্ত বুড়ো কুকুরটাকে ডেকেই যেন সে খুড়োর কথার জবাবটা শেষ করল। সকলেই যার যার জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অন্তরের দিক থেকে একজন অনুরাগী শিকারি না হলেও কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ শিকারের আইন-কানুন ভালোই জানে; জঙ্গলের একপ্রান্তে পৌঁছে সে বাঁশ হাতে নিল, ভালো করে আসনে বসল এবং সবরকমে তৈরি হয়ে স্মিত হেসে চারদিকে তাকাল।

তার পাশেই রয়েছে খাস খানসামা সাইমন চেকমান; লোকটির বয়স হয়েছে, মনিব ও তার ঘোড়ার মতোই তার শরীরেও মেদ জমেছে। জঙ্গলের ধার বরাবর শ খানেক পা দূরে রয়েছে কাউন্টের অপর সহিস মিকা; লোকটা দুঃসাহসী ঘোড়সওয়ার এবং শিকারি কুকুরের খুব ভালো পরিচালক। রীতি অনুযায়ী কাউন্ট রুপোর কাপভর্তি ব্র্যান্ডি টেনেছে, অল্পস্বল্প কিছু খেয়েছে, এবং আধ বোতল প্রিয় পানীয় বোর্দু গলায় ঢেলে সেটাকে পাকস্থলীকে পাঠিয়েছে।

মদের প্রভাবে এবং এতটা পত গাড়ি চালিয়ে আসার দরুন কাউন্টের মুখ কিছুটা লাল হয়েছে। চোখ দুটো ভিজে চকচক করছে। লোমের কোট শরীরটা জড়িয়ে জিনে বসা অবস্থায় এখন তাকে বেড়াতে বের-হওয়া ছোট ছেলের মতো দেখাচ্ছে।

সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে গাল-বসা শুটকো চেহারার চেকমার বার বার মনিবের দিকে তাকাচ্ছে। তিরিশ বছর সে এই মনিবের সঙ্গে ঘর করছে, তাই তার হালহকিকৎ সে ভালোই বোঝে; সে জানে, মনিব এখনই একটু গালগল্প শুরু করবে। একটি তৃতীয় ব্যক্তি বনের পথে ঘুরে এসে কাউন্টের পিছনে ঘোড়া থামাল। লোকটি বুড়ো, মুখময় সাদা দাড়ি, পরনে মেয়েদের জোব্বা, মাথায় গাধার টুপি। লোকটি ভাড়, মেয়েদের চলতিনাম নাস্তাসিয়া আইভানভনা বলেই সকলে তাকে ডাকে।

তার দিকে চোখ টিপে কাউন্ট ফিসফিস করে বলল, দেখ নাস্তাসিয়া আইভানভনা, তুমি যদি ভয় দেখিয়ে শিকারকে তাড়িয়ে দাও তাহলে দানিয়েল কিন্তু মজাটা টের পাইয়ে দেবে।

টের পাওয়াতে আমিও একটু-আধটু জানি, নাস্তাসিয়া আইভানভনা বলল।

চুপ! বলেই সাইমনের দিকে ফিরে কাউন্ট শুধাল, ছোট কাউন্টেসকে দেখেছ কি? সে কোথায়?

তিনি ছোট কাউন্ট পিতরের সঙ্গে আছেন, সাইমন হেসে জবাব দিল। মহিলা হলেও তার খুব শিকারের শখ।

কাউন্ট বলল, আর সে কিরকম ঘোড়া চালায় দেখেছ সাইমন? এ ব্যাপারে সে অনেক পুরুষেরই সমকক্ষ!

সে তো বটেই! চমৎকার। যেমন সাহস, তেমনই সহজ।

আর নিকলাস? সে কোথায়? লিয়াদভে কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কোথায় জায়গা নিতে হবে তিনি ভালোই জানেন। ব্যাপারটা তিনি এত ভালো বোঝেন যে দানিয়েল ও আমি অনেক সময় অবাক হয়ে যাই, মনিবকে খুশি করবার জন্যই সাইমন বলল।

ঘোড়ায় চড়তেও ভালোই জানে, কি বল? আর ঘোড়ার পিঠে তাকে দেখায়ও সুন্দর, কি বল?

একেবারে ছবি! সেদিন জাভারিনস্ক ঝোঁপের কাছে একটা শেয়ালকে কিরকম তাড়া করেছিলেন। সেগুলো যখন গর্ত থেকে বেরিয়ে ছুট দিল, সে কী দৃশ্য!…ঘোড়াটার দামই হাজার রুবল, আর সওয়ারটি তো সবরকম দামের উর্ধ্বে!…সত্যি, এরকম চটপটে আর একজনকে খুঁজতে হলে অনেক পথ পার হতে হবে!

যেন সাইমনের প্রশংসটা যথেষ্ট হয়নি এমনিভাবে কাউন্ট বলল, অনেক পথ পার হতে হবে… তারপরই নস্যিদানটা খুঁজতে লাগল।

কি যেন নস্যিদান হাতেই রইল, কাউন্ট সোজা সামনের দিকে তাকাল। কুকুরগুলো চিৎকারের পরেই ভেসে এল দানিয়েলের শিকারি-শিঙার গম্ভীর নেকড়ের ডাক। সবগুলো কুকুর একসঙ্গে মিলে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। সে ডাক শুনে বোঝা গেল ওরা নেকড়েটার পিছু নিয়েছে। কুকুর-রক্ষীরা এবার উল বলে চেঁচাতে লাগল, আর সেসব কিছু ছাপিয়ে ভেসে এল দানিয়েলের কণ্ঠস্বর-কখনো গম্ভীর, কখনো কর্কশ। সে কণ্ঠস্বর সারা জঙ্গলকে ভরে তুলে বাইরের প্রান্তরে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।

চুপচাপ কান পেতে কয়েক মিনিট শুনে কাউন্ট ও তার অনুচররা বুঝতে পারল যে কুকুরগুলো দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে; একদলের শব্দ ক্রমে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, আর একদল কাউন্টদের পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেল; এই দলেই দানিয়েলের গলায় শোনা গেল-উল। দুই দলের আওয়াজ মিশে গিয়ে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল।

সাইমন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। হাতের নস্যদানটার দিকে নজর পড়ায় কাউন্ট সেটা খুলে একটিপ নস্য নিল। একটা কুকুরকে টেনে ধরে সাইমন চিৎকার করে উঠল, ফিরে আয়! কাউন্ট চমকে উঠল; তার হাত থেকে নস্যাদানটা পড়ে গেল। নাস্তাসিয়া আইভানভনা ঘোড়া থেকে নেমে সেটা তুলে দিল। কাউন্ট ও সাইমন তার দিকে তাকাল।

তারপরই অপ্রত্যাশিতভাবে, যদিও এরকমটা প্রায়ই ঘটে থাকে, শিকারিদের শব্দটা হঠাৎ তাদের খুব কাছেই শোনা গেল; মনে হল দানিয়েল উল্যুলু বলে যেন একেবারে সামনেই চেঁচাচ্ছে।

মুখ ফিরিয়ে কাউন্ট দেখল তার ঠিক ডাইনে মিকা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন তার চোখ দুটো মাথা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে; মাথার টুপি খুলে সে অন্য দিকে কি যেন দেখাচ্ছে।

ঐ দেখুন! এমন স্বরে সে চেঁচিয়ে বলল যেন অনেকক্ষণ ধরেই কথাটা বলবার চেষ্টা সে করছিল; এখন কুকুরের বাসাটা ছেড়ে দিয়ে সে কাউন্টের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

কাউন্ট ও সাইমনও ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল; বাঁদিকে তাকিয়েই দেখতে পেল, একটা নেকড়ে ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ করে নিঃশব্দে ঠিক সেইদিকপানে লাফ দিল যেখানে তারা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ক্রুদ্ধ কুকুরটা ছাড়া পেয়ে ঘোড়ার পায়ের ফাঁক দিয়ে নেকড়েটার দিকে ছুটে গেল।

নেকড়েটা থামল, অদ্ভুতভাবে ভারি কপালটা কুকুরগুলোর দিকে ফেরাল, শরীরটাকে বারকয়েক এদিক ওদিকে দোলাল, দুটো লাফ দিল, আর তারপরেই লেজের একটা ঝাপ্টা মেরে বনের প্রান্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর ঠিক সেইমুহূর্তে প্রায় আর্তনাদের মতো সুরে চিৎকার করতে করতে একটার পর একটা কুকুরের গোটা দলটাই বিপরীত দিকের জঙ্গল থেকে এলোপাথাড়িভাবে লাফাতে লাফাতে মাঠ পেরিয়ে ঠিক সেই জায়গাটার দিকে গেল যেখানে থেকে নেকড়েটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হ্যাঁজেলের ঝোঁপকে দুই ভাগ করে ঘামে ভিজে বেরিয়ে এল দানিয়েলের বাদামি ঘোড়াটা। দানিয়েল সামনে কুঁজো হয়ে ঝুঁকে বসে আছে; মাথায় টুপি নেই, ঘর্মাক্ত লাল মুখে ছড়িয়ে পড়েছে এলোমেলো লম্বা সাদা দাড়ি।

চিৎকার করে বলছে, উল্যুলু!…কাউন্টকে দেখেই তার চোখ ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠল।

শাসনের ভঙ্গিতে চাবুকটা কাউন্টের দিকে তুলে চেঁচিয়ে বলল, জাহান্নামে যান! নেকড়েটাকে পালিয়ে যেতে দিলেন!…কীরকম শিকারি! তারপর যেন ভীত, লজ্জিত কাউন্টকে অধিক কথা বলতে ঘৃণাবোধ করেই সক্রোধে ঘোড়র পেটে চাবুক কসিয়ে কুকুরগুলোর পিছন পিছন ছুটে চলে গেল। স্কুলের দণ্ডিত ছাত্রের মতো কাউন্ট চারদিকে তাকাতে লাগল; এই অসহায় অবস্থায় সাইমনের সহানুভূতি পাবার আশায় একটু হাসতে চেষ্টা করল। কিন্তু সাইমনও তখন সেখানে নেই। সেও ঝোঁপঝাড়ের পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে; সকলেই নেকড়েটাকে ধরতে চাইছে, কিন্তু তার আগেই নেকড়েটা জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

.

অধ্যায়

 এদিকে নিকলাস রস্তভ তখনও নেকড়ের অপেক্ষায় তার জায়গায়ই রয়েছে। শিকার যেভাবে এগোচ্ছে ও। পিছিয়ে যাচ্ছে, পরিচিত গলায় কুকুরগুলো যেভাবে ডাকছে, শিকারিদের গলা যেভাবে এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে ও উঠছে, তা থেকেই সে বুঝতে পারছে ঝোঁপের ভিতরে কি ঘটছে। সে বুঝতে পেরেছে, ধাড়ি ও বাচ্চা নেকড়েগুলো সেখানেই আছে, কুকুরগুলো দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে, কোনো এক জায়গায় নেকড়েটাকে তাড়া করা হচ্ছে, আর কোথাও একটা কোনো গোলমাল হয়েছে। সে আশা করছে, যেকোন মুহূর্তে নেকড়েটা তার দিকেই আসবে। কোথায় এবং কোনদিক থেকে জন্তুটা আসবে, আর সেই বা কিভাবে সেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে,-এ নিয়ে হাজার রকমের মতলব তার মাথায় ঘুরতে লাগল। কখনো আশা, কখনো হতাশা। বারকয়েক ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাল, নেকড়েটা যেন তার পথ দিয়েই আসে। ঈশ্বরকে বলল, আমার জন্য এটুকু করা তোমার পক্ষে আর কি? আমি জানি তুমি অনেক বড়, তোমার কাছে এত তুচ্ছ প্রার্থনা জানানো পাপ, কিন্তু দোহাই তোমার, বুড়ি নেকড়েটাকে আমার দিকে এনে দাও আর কারা সেটার উপর লাফিয়ে পড় ক-ওখানে দাঁড়িয়ে খুড়ো তো সবই দেখছে, তাই তার চোখের সামনেই এটা ঘটুক-এবং মরণকামড় দিয়ে সেটার টুটি চেপে ধরুক।

তারপরেই রস্তভ ভাবল, না, সে সৌভাগ্য আমার হবে না, অথচ হলে কী ভালোই না হত! এ হবার নয়! কি তাসে কি যুদ্ধে, সর্বত্রই আমার ভাগ্য খারাপ। অস্তারলিজ ও দলখভের স্মৃতি অতি দ্রুত তার মনের পটে স্পষ্ট ফুটে উঠল। জীবনে শুধু একবার একটা ধাড়ি নেকড়েকে কজা করতে চাই, শুধু এইটুকুই চাই!

আবার সে ডান দিকে তাকাল; পরিত্যক্ত মাঠ পেরিয়ে কি যেন তার দিকেই ছুটে আসছে। না, এ হতে পারে না! দীর্ঘদিনের আশার পরে কিছু পেলে মানুষ যেরকম করে সেইভাবেই একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে রস্তভ ভাবল। চরম চরম সুখের ক্ষণটি সমাগত–কিন্তু এসেছে এত সহজে, কোনোরকম সতর্ক না করে, শব্দ না করে, আড়ম্বর না করে, যে রস্তভ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না, এক সেকেন্ডের উপর সন্দেহেই কাটল। নেকড়েটা ছুটে এল, একলাফে একটা নালা পার হল। নেকড়েটা বুড়ি, তার পিঠটা ধূসর, লম্বা পেটটা লাল। ছুটছে ধীরেসুস্থে সে জানে যে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। দমবন্ধ করে রস্তভ কুকুরগুলোর দিকে তাকাল। সেগুলো কতক দাঁড়িয়ে, কতক শুয়ে আছে; তারা নেকড়েটাকে দেখতে পায়নি, তাই পরিস্থিতিটাও বুঝতে পারছে না। বুড়ো কারা মাথাটা ঘুরিয়ে রেগেমেগে হলদে দাঁত বের করে মাছি ধরবার তাল করছে।

রস্তভ ঠোঁট ফুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, উল্যুলুলু! কুকুরগুলো কান খাড়া করে লাফিয়ে উঠল। কারা পাছা চুলকানো বন্ধ করে কান খাড়া করল, লেজ নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়াল।

জঙ্গলের ভিতর থেকে নেকড়েটাকে আসতে দেখে নিকলাস নিজের মনেই বলল, আমি কি ওগুলোকে ছেড়ে দেব, না ধরব? সহসা নেকড়েটার চেহারাটাই পাল্টে গেল; যা হয় তো আগে কখনো দেখেনি–একটি মানুষ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে-তা দেখে সে কেঁপে উঠল এবং রস্তভের দিকে মাথাটা একটু বাড়িয়ে থেমে গেল।

এগোব না পিছোবঃ আঃ, যা হয় হবে, এগিয়েই যাব। নেকড়েটা যেন মনে মনে এই কথা বলেই চারদিকে না তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগোতে লাগল।

নিকলাস চিৎকার করে উঠল উলল! কিন্তু সে কণ্ঠস্বর যেন তার নিজের নয়; সঙ্গে সঙ্গে তার ঘোড়াটা নিজে থেকেই নালার পর নালা লাফিয়ে পার হয়ে পাহাড় বেয়ে তীরবেগে নামতে লাগল; তার উদ্দেশ্য নেকড়েটাকে এড়িয়ে যাওয়া; কুকুরগুলোও আরো জোরে ছুটতে লাগল। নিজের চিৎকারও নিকলাসের কানে গেল না, সে যে জোর কদমে ছুটছে তাও সে জানে না, কুকুরগুলোকে অথবা যে মাটির উপর দিয়ে সে ছুটছে তাও সে দেখতে পাচ্ছে না : সে দেখছে শুধু নেকড়েটাকে; ক্রমেই দ্রুততর গতিতে নেকড়েটাও সেই একইদিকে ছুটছে। প্রথমেই নিকলাসের চোখে পড়ল, মিলকা ক্রমেই নেকড়েটার দিকে এগিয়ে চলেছে। কাছে, আরো কাছে…মিলকা ক্রমেই নেকড়েটাকে ধরে ফেলছে; কিন্তু নেকড়েটা হঠাৎ মুখটা ঘুরিয়ে রুখে দাঁড়াল, আর মিলকাও হঠাৎ থেমে গিয়ে লেজ তুলে সামনের পা দুটো শক্ত করে ফেলল।

উল্যুলু! নিকলাস চিৎকার করে উঠল।

মিলকার পিছন থেকে ছুটে এল লালচে রঙের লবিয়াম; লাফ দিয়ে নেকড়েটার উপর পড়ে তার পাছাটা কামড়ে ধরল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সভয়ে ছিটকে সরে গেল। নেকড়েটা মাটিতে উপুড় হয়ে বসল, দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগল, তারপরেই আবার উঠে সামনে ছুটতে লাগল। কুকুরগুলো ফুট দুই দূরে থেকে তার পিছনে ছুটতে লাগল।

কর্কশ গলায় চিৎকার করতে করতে নিকলাস ভাবল, ওটা ঠিক বেরিয়ে যাবে! না, এ অসম্ভব!

এখন তার একমাত্র ভরসা বুড়ো কুকুরটা। সেটাকেই সে খুঁজতে লাগল। এই বয়সে যতটা শক্তি এখনও আছে তাই দিয়েই কারা তার শরীরটাকে যথাসম্ভব টান-টান করে নেকড়েটার পাশাপাশি জোরে ছুটছে তার পথটা আটকে দিতে। কিন্তু নেকড়ের দ্রুতগতির তুলনায় কুকুরের শ্লথগতির বিচারে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে কারা হিসেবে ভুল করেছে। নিকলাস দেখতে পাচ্ছে, জঙ্গলটা আর বেশি দূরে নেই; একবার সেখানে পৌঁছতে পারলেই নেকড়েটা নির্ঘা পালিয়ে যাবে। তখনই সে দেখতে পেল, কয়েকটা কুকুর ও একজন শিকারি সোজা ছুটে যাচ্ছে নেকড়েটার দিকে। এখনও আশা আছে। আর একটা হলদেটে কুকুর সামনের দিক থেকে ছুটে এসে নেকড়েটাকে একধাক্কায় প্রায় উল্টে দিল। কিন্তু নেকড়েটাও অপ্রত্যাশিত দ্রুততার সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠেই দাঁত কড়মড় করে কুকুরটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর কুকুরটা তীব্র আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল; তার পেটের পাশ থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।

নিকলাস আর্তকণ্ঠে ডাকল, কারা। বুড়ো বাছারে!…

নেকড়েটা এভাবে বাধা পাওয়ায় বুড়ো কুকুরটা তার পাঁচ পায়ের মধ্যে পৌঁছে গেল। যেন বিপদ বুঝতে পেরেই নেকড়েটা কারার দিকে ঘুরে তাকাল এবং লেজ গুটিয়ে দ্রুততর গতিতে ছুটতে শুরু করল। ঠিক এইসময় নিকলাস শুধু দেখতে পেল, কারার একটা কিছু ঘটেছে-হঠাৎ সে নেকড়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর তারপরই ঠিক তার সামনেই একটা নালার মধ্যে পড়ে দুইজনেই গড়াগড়ি খেতে লাগল।

ঠিক সেইমুহূর্তে নিকলাস যখন দেখতে পেল নেকড়েটা নালার মধ্যে পড়ে কুকুরগুলোর সঙ্গে লড়াই করছে, এবং কুকুরগুলোর তলা থেকে তার ধূসর লোম, টান-টান করা পিছনের পা এবং ভীত রুদ্ধশ্বাস মাথাটা শুধু দেখা যাচ্ছে (কারা নেকড়েটার টুটি চেপে ধরেছে), তখনকার মতো সুখ সে জীবনে কখনও পায়নি। ঘোড়ার জিনে হাত রেখে লাফিয়ে নেমে নেকড়েটাকে ছুরিকাহত করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ নেকড়েটা আবার কুকুরগুলোর মাঝখান থেকে মাথাটা বের করল এবং সামনের দুটো থাবা দিয়ে নালার উপরটা আঁকড়ে ধরল। দাঁতে দাঁত ঘষে (তার গলা থেকে তখন তার দাঁত সরে গেছে) পিছনের পায়ে ভর করে এক লাফে নালার ভিতর থেকে উঠে পড়ল এবং কুকুরগুলোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে লেজ গুটিয়ে আবার সামনের দিকে ছুট দিল। কারার গায়ের নোম এলোমেলো হয়ে গেছে, শরীরটা অনেক জায়গায় কেটে গেছে; অনেক কষ্টে সে নালার ভিতর থেকে উঠে এল।

নিকলাস হতাশায় চেঁচিয়ে উঠল, হায় ঈশ্বর! একি হল?

খুড়োর শিকারি ততক্ষণে অপর দিক থেকে নেকড়েটার পথের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এল, আর তার কুকুরটা আর একবার নেকড়েটাকে বাধা দিল। সেটা আটকা পড়ে গেল।

নিকলাস ও তার অনুচর এবং খুড়ো ও তার শিকারি–সকলেই উল বলে চিৎকার করতে করতে জন্তুটাকে ঘিরে ধরল। বার বার সেটা ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছে জঙ্গলের দিকে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না।

ওদিকে উল্যুলু ধ্বনি শুনে দানিয়েল জঙ্গলের ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। নিঃশব্দে সে ঘোড়া ছুটিয়ে এল; বাঁ হাতে খাপ-খোলা ছুরি, আর ডান হাতের চাবুক অনবরত পড়ছে ঘোড়াটার পেটে।

বাদামি ঘোড়াটা হাঁপাতে হাঁপাতে ভারি নিঃশ্বাস ফেলে তার পাশ দিয়ে চলে যাবার আগে নিকলাস দানিয়েলকে দেখতে পায়নি, তার কথাও কানে যায়নি। এবার একটা শরীরের ধপাস করে মাটিতে পড়ার শব্দ শুনে সে তাকিয়ে দেখল, কুকুরগুলোর মাঝখানে দানিয়েল নেকড়েটার পিঠের উপর চেপে বসে তার কান দুটো পাকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে। কুকুরগুলো, শিকারিরা, এমন কি নেকড়েটাও বুঝতে পেরেছে যে সব শেষ হয়ে গেছে। ভয়ার্ত নেকড়েটা কান দুটো নামিয়ে উঠতে চেষ্টা করল, কিন্তু কুকুরটা তাকে চেপে ধরে আছে। দানিয়েল একটুখানি উঠে এক পা এগিয়ে সমস্ত শরীরের ভর দিয়ে নেকড়েটার উপর শুয়ে পড়ে তার কান দুটো চেপে ধরল। নিকলাস ছুরি দিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছিল, কিন্তু দানিয়েল ফিসফিস করে বলল, ও কাজ করবেন না; আমরা ওটার মুখ বন্ধ করে দিচ্ছি! সে সরে গিয়ে নেকড়েটার গলার উপর পা রাখল। তার চোয়ালের ভিতর দিয়ে একটা লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে একটা চাবুক দিয়ে সেটাকে লাগামের মতো করে বাঁধা হল। পাগুলোকেও একত্র করে বেঁধে দানিয়েল দুই একবার সেটাকে এ-পাশ থেকে ও-পাশ উল্টে দিল।

ক্লান্ত, খুশি মুখে সকলে নেকড়েটাকে জ্যান্ত অবস্থায় একটা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিল; কুকুরগুলো তার দিকে তাকিয়ে ভেউ-ভেউ করতে লাগল; আর সেটাকে এনে হাজির করা হল সকলের সামনে। কুকুরগুলো পাঁচটা বাচ্চাকেই মেরে ফেলেছে। সকলেই যার যার বীরত্বের কাহিনী বলতে লাগল। জোয়ালে বাঁধা অবস্থায় মাথাটা ঝুলিয়ে নেকড়েটা চকচকে চোখ মেলে সকলকে দেখতে লাগল। তাকে ছোঁয়ামাত্রই বাঁধা পাগুলোতে ঝাঁকুনি দিয়ে সে লক্ষ্যহীনভাবে সকলের দিকে তাকাতে লাগল। বুড়ো কাউন্ট রস্তভও এসে নেকড়েটার গায়ে হাত রাখল।

বলল, আঃ, কী দুর্ধর্ষ জীব! কাছে দাঁড়ানো দানিয়েলকে বলল, দুর্ধর্ষ জীব, কি বল?

তাড়াতাড়ি মাথার টুপিটা তুলে দানিয়েল জবাব দিল, হ্যাঁ ইয়োর এক্সেলেন্সি।

নেকড়েটাকে ছেড়ে দেওয়া এবং দানিয়েলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা কাউন্টের মনে পড়ে গেল।

 কিন্তু তুমি বড় কড়া মানুষ হে বন্ধু! কাউন্ট বলল।

 একটি সলজ্জ, শিশুসুলভ, খুশির হাসি দিয়েই দানিয়েল তার জবাব দিল।

.

অধ্যায়-৬

 বুড়ো কাউন্ট বাড়ি চলে গেল; নাতাশা ও পেতয়া কথা দিল শিগগিরই ফিরবে, কিন্তু তখনও সময় থাকতে শিকার চলতে লাগল। দুপুরবেলা কুকুরগুলোকে ছোট ছোট গাছে ঢাকা একটা খাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, আর নিকলাস হলদে মাঠটার মধ্যে দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর রাখল।

তার সামনে শীতকালীন গমে ভর্তি মাঠ; তার নিজের শিকারিটি হ্যাঁজেল ঝোঁপের পিছনে একাকি দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেওয়ামাত্রই একটা কুকুর ডেকে উঠল। অন্য কুকুরগুলোও তাতে যোগ দিল। এক মুহূর্ত পরেই সোরগোল শোনা গেল যে জঙ্গলে ঢাকা খাড়ির মধ্যে একটা মেয়ালকে পাওয়া গেছে। অমনি সকলে সেইদিকে ছুটল। নিকলাস দাঁড়িয়ে রইল।

তার চোখের সামনে দিয়ে লাল টুপি পরা কুকুর-রক্ষীরা খড়ি বরাবর ঘোড়া ছুটিয়ে গেল; সে কুকুরগুলোকেও দেখতে পেল; আশা করে রইল, উল্টো দিকের গমের ক্ষেতে যেকোন মুহূর্তে শেয়ালটার দর্শন পাবে।

শিকারিটি এগিয়ে গিয়ে তার কুকুরটাকে ছেড়ে দিল। নিকলাস দেখতে পেল, একটা ছোট পা-ওয়ালা অদ্ভুত লাল শেয়াল মাঠের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল। কুকুরটা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সবগুলো কুকুর তাকে ঘিরে ধরায় শেয়ালটা এঁকেবেঁকে কুকুরগুলোর মাঝখান দিয়ে গলে যেতে লাগল। এমন সময় একটা অপরিচিত সাদা কুকুর কোথা থেকে ছুটে এল; তার পিছনে এল আর একটা কালো কুকুর; সবকিছুই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হল দুজন শিকারি; একজনের মাথায় লাল টুপি, অপর জনের টুপি সবুজ; সে লোকটি অপরিচিত।

নিকলাস ভাবল, এটা কি হল? এ শিকারি কোত্থেকে এল? এ তো খুড়োর লোক নয়।

শিকারিরা শেয়ালটাকে ধরে ফেলল, কিন্তু সেটাকে নিজের সঙ্গে না বেঁধে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগল। ঘোড়াগুলোও সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল, আর কুকুরগুলো শুয়ে পড়ল। শিকারিরা হাত ঘুরিয়ে শেয়ালটাকে কি যেন করল। তারপরই একটা শিঙার শব্দ শোনা গেল; একটা যুদ্ধ করা স্থির হলেই এধরনের শিঙাধ্বনি করা হয়।

নিকলাসের সহিস বলল, ইলাগিনের শিকারিরা আমাদের আইভানের সঙ্গে একটা গোলমাল বাধিয়েছে।

 নিকলাস একজনকে পাঠিয়ে দিল নাতাশা ও পেতয়াকে ডেকে আনতে; নিজে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।

নাতাশা ও পেতয়াও ঘোড়ায় চড়ে এসে পড়ল। নিকলাস ঘোড়া থেকে নামল। ব্যাপারটা কিভাবে শেষ হয় দেখবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যে শিকারিটি লড়াই করছিল সে ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। ঘোড়ার পিঠে শেয়ালটাকে বেঁধে নিয়ে তরুণ মনিবের পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুটা দূরে থেকেই মাথার টুপিটা খুলে ফেলল, সসম্মানে কিছু বলতেও চেষ্টা করল; কিন্তু তার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে, দম আটকে আসছে, রাগে মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। একটা চোখে কালসিটে পড়ে গেছে, কিন্তু সে হয়তো সেটা বুঝতেও পারছে না।

কি হয়েছে? নিকলাস শুধাল।

যা হয়ে থাকে, আমাদের কুকুর যে শেয়ালটাকে শিকার করেছে তাকেই ওরা মেরে ফেলেছে! অথচ আমার ধূসর রঙের মাদিটাই একটা ধরেছিল! আইন করতে যাব, বটে!…শেয়ালটাকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিল। শেয়ালের সঙ্গে আচ্ছা করে একখানা দিয়েছি! এই তো শেয়ালটা আমার জিনের সঙ্গে বাঁধা! ওটারও একটুখানি স্বাদ পাবার ইচ্ছা আছে কি?… যেন এখনও সে শত্রুর সঙ্গেই কথা বলছে এমনিভাবে ছোরাটা দেখিয়ে শিকারি বলল।

লোকটির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নিকলাস বোন ও পেতয়াকে অপেক্ষা করতে বলে যেখানে শত্রুপক্ষের, অর্থাৎ ইলাগিনের শিকারিরা আছে সেইদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

বিজয়ী শিকারিটি মাঠের মধ্যে সকলের সঙ্গে মিলিত হলে সকলেই তাকে ঘিরে ধরল, আর যুদ্ধ জয়ের কাহিনী শোনাতে লাগল।

ঘটনাটা এইরকম : পুরনো ঝগড়া নিয়ে ইলাগিনের সঙ্গে রস্তভদের মামলা চলছে। চিরাচরিত প্রথা অনুসারে যে সমস্ত জায়গা রস্তভদের মালিকানাধীন ইলাগিন সেইসব জায়গায় শিকার করে থাকে। আজও রস্তভরা যে জঙ্গলে শিকার করতে এসেছে ইলাগিন ইচ্ছা করেই সেখানে তার লোকজনদের পাঠিয়ে দিয়েছে এবং রস্তভদের কুকুরের তাড়াখাওয়া একটা শেয়ালকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

নিকলাস কখনো ইলাগিনকে চোখে দেখেনি, তবু লোকের মুখে তার খাম-খেয়াল ও অত্যাচারের কাহিনী শুনেই সে তাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে এবং তাকে একজন মহাশত্রু বলে মনে করে। রাগে ফুলতে ফুলতে চাবুকটা কঠিন হাতে চেপে ধরে সে এগিয়ে চলল; শত্রুকে কঠোরভাবে শাস্তি দিতে সে কৃতসংকল্প।

জঙ্গলের একটা কোণ পার হবার আগেই কুচকুচে কালো একটা সুন্দর ঘোড়ায় চেপে একজন শক্তসমর্থ ভদ্রলোক তার দিকে এগিয়ে এল; তার মাথায় লোমের টুপি, সঙ্গে দুটি শিকারি-ভৃত্য।

শক্রর পরিবর্তে ইলাগিনের মধ্যে নিকলাস দেখতে পেল একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোককে; হোট কাউন্টের সঙ্গে পরিচিত হতে সে বিশেষ আগ্রহী। নিকলাসের সামনে এগিয়ে এসে ইলাগিন টুপিটা খুলে জানাল যে যা ঘটেছে সেজন্য সে দুঃখিত সামনে এগিয়ে এসে ইলাগিন টুপিটা খুলে জানাল যে যা ঘটেছে সেজন্য সে দুঃখিত এবং যে লোকটি অন্যের কুকুরের শিকারকে ছিনিয়ে নিয়েছে তাকে যথোচিত শাস্তি দেওয়া হবে। কাউন্টের সঙ্গে তার আরো ভালো করে পরিচয় হবে বলেই সে আশা করে।

নাতাশা ভয় পেয়েছিল যে তার দাদা হয় তো ভয়ংকর একটা কিছু করে বসবে; তাই সে উত্তেজিত হয়ে তার পিছু নিয়েছিল। দুই শত্রু পরস্পরকে বন্ধুভাবে অভ্যর্থনা করছে দেখে সে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। নাতাশাকে দেখে ইলাগিন তার বীবর লোমের টুপিটা আরো উঁচুতে তুলে ধরল এবং স্মিত হাসি হেসে বলল যে ছোট প্রিন্সেসের শিকার-প্রীতি ও রূপের কথা সে অনেক শুনেছে; দুই দিকের বিচারেই সে ডায়নার সমতুল্যা।

নিজের শিকারির অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে ইলাগিন রস্তভদের তার নিজস্ব উঁচু জমিতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল; আরো জানাল যে সেখানে অনেক খরগোসের মেলা। নিকলাস রাজি হয়ে গেল; শিকারের দলবল দ্বিগুণ হয়ে এগিয়ে চলল।

মাঠটা পেরিয়ে যেতে হবে। শিকার-ভৃত্যরা দল বেঁধে চলল। খুড়, রস্তভ ও ইলাগিন চলল পাশাপাশি ঘোড়ায় চেপে।

নানারকম মজলিসি কথাবার্তার ফাঁকে একসময় ইলাগিন বলল, কিছু কিছু শিকারি কেন যে শিকার ও কুকুর নিয়ে এত মাতামাতি করে আমি তা বুঝতে পারি না। আমি ভালোবাসি শিকার করতে, তাই নয় কি কাউন্ট? কারণ আমি মনে করি…।

আ–তু! একজন কুকুর-রক্ষীর একটানা ডাক ভেসে এল। ফসলকাটা মাঠের মধ্যে একটা উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে হাতের চাবুকটা তুলে ধরে সে আবার হাঁক দিল,  আতু! (এই ডাক ও তুলে-ধরা চাবুকের অর্থ সে একটা খরগোস দেখতে পেয়েছে!)

আরে, মনে হচ্ছে সে একটা দেখতে পেয়েছে, ইলাগিন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চলল। চলুন, আমরাও এগিয়ে যাই কাউন্ট।

হ্যাঁ, চলুন।

খুড়ো ও ইলাগিনকে সঙ্গে নিয়ে নিকলাস খরগোসটার দিকে এগিয়ে চলল।

তারপর শুরু হল খরগোস শিকার। খুড়ো তার প্রিয় কুকুর গাউশকাকে নিয়ে শিকার থেকে সরে দাঁড়াল। ইলাগিনের কুকুর এরজা ও নিকলাসের কুকুর মিলকা খরগোসটাকে তাড়া করতে লাগল। ইলাগিন, নিকলাস, নাতাশা ও খুড়ো ছুটোছুটি করে কুকুর-খরগোসের দৌড়ঝাঁপ দেখতে লাগল; মুহূর্তের জন্যও তারা এ দৃশ্যটাকে চোখের বাইরে চলে যেতে দিতে চায় না।

নিকলাস সগর্বে ডাকে, মিলাভ্রুশকা, সোনা!

ইলাগিন ডাকে, এরজা মাণিক!

দুই কুকুর প্রাণপণে তাড়া করছে; খরগোসটাও এঁকেবেকে, কখনো থেমে কখনো ছুটে তাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। একসময় খরগোসটা শীতকালীন গমের ক্ষেত ও ফসল-কাটা ছুটছে গাড়ি-টানা ঘোড়ার মতো; কিন্তু কিছুতেই খরগোেসটার সঙ্গে পেরে উঠছে না।

 ঠিক সেইসময় একটা তৃতীয় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, রুগা, রুগাউশকা। ঠিক আছে, ছুটে যাও! আর সঙ্গে সঙ্গে খুড়োর লাল রঙের কুকুরটা পিঠ বেঁকিয়ে আপ্রাণ চেষ্টায় ছুটে সামনের কুকুর দুটোকে পার হয়ে খরগোসটাকে ধরে ফেলল; একধাক্কায় সেটাকে আলের উপর থেকে গমের ক্ষেতের মধ্যে ফেলে দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবিয়ে নিজেও ক্ষেত্রের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। তারপর শুধু দেখা গেল :কুকুর ও খরগোস কাদার মধ্যে গড়াগড়ি যাচ্ছে। চারদিক থেকে কুকুরগুলো এসে তাদের ঘিরে ধরল। মুহূর্তকাল পরে সকলেই এসে সেখানে গোল হয়ে দাঁড়াল। একমাত্র খুড়োই মহানন্দে ঘোড়া থেকে নামল, খরগোসের একটা থাবা কেটে নিল; রক্তাক্ত খরগোসের দেহটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। কাকে বলছে, কেন বলছে, সেসব না বুঝেই খুড়ো বলে উঠল, এই তো চাই! এই তো কুকুরের মতো কুকুর!… হাজার রুবল দাম থেকে শুরু করে এক রুবল দামের কুকুর-সবকটাকে হারিয়ে দিয়েছে।

তারপর খরগোসের কাদামাখা থাবাটাকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, রুগা, এই থাবাটা তোমার জন্য। এটা তোমার পাওনা, ঠিক আছে, চলে এসো!

অনেকক্ষণ ধরে সকলেই লাল রুগাকে দেখতে লাগল। কাদামাখা পিঠটা বেঁকিয়ে খুড়োর ঘোড়র পিছু পিছু চলতে লাগল বিজয়ীর গম্ভীর ভঙ্গিতে।

সে যেন বলতে চাইছে, যতক্ষণ শিকারের প্রশ্ন দেখা না দেয় ততক্ষণ আমি অন্য যেকোন কুকুরেরই মতো, কিন্তু শিকারের সময় হলে, দেখতেই তো পাচ্ছ আমি কি!

আরো বেশ কিছুক্ষণ পরে খুড়ো যখন নিকলাসের কাছে এসে আলাপ করতে শুরু করল তখন এই ভেবে সে গর্ববোধ করল যে এত কাণ্ডের পরেও খুড়ো নিজে এসে তার সঙ্গে কথা বলছে।

.

অধ্যায়-৭

সন্ধ্যার দিকে ইলাগিন নিকলাসের কাছ থেকে বিদায় নিল; নিকলাস যখন বুঝতে পারল যে তারা বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এসে পড়েছে তখন শিকারের দল রাতটা তাদের ছোট গ্রাম মিখায়লভনাতেই কাটিয়ে যাক খুড়োর এই প্রস্তাব সে মেনে নিল।

খুড়ো বলল, আপনারা যদি আমার বাড়িতে থাকেন তো আরো ভালো হয়। ঠিক আছে, তাই চলে আসুন। দেখুন, আবহাওয়াটা স্যাঁতসেঁতে; তাই আপনারা এখানেই বিশ্রাম করুন আর একটা ছোট গাড়িতে ছোট কাউন্টেসকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

ছোট-বড় মিলিয়ে জনা পাঁচেক পাররিবারিক ভূমিদাস মনিবকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য ফটকে এসে হাজির হল। শিশু, যুবতী মিলিয়ে কুড়িখানেক ভূমিদাসী খিড়কি-দরজা দিয়ে উঁকি মেরে শিকারিদের দেখতে লাগল। নাতাশার উপস্থিতি-একটি মেয়ে, একটি মহিলা ঘোড়ায় চড়েছে-তাদের মনে এত বেশি কৌতূহল জাগিয়েছে যে সকলেই এগিয়ে এসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আর এমন সব মন্তব্য করল যেন সে একটি আশ্চর্য দর্শনীয় বস্তু, তাদের কথাবার্তা শুনবার বা বুঝবার মতো মানুষমাত্র নয়।

আরিংকা দেখ, উনি কেমন একদিকে বসেছেন! ঘাঘরা ঝুলে পড়েছে। …দেখ, দেখ, সঙ্গে একটা শিকারি শিঙাও রয়েছে!

কী আশ্চর্য! ওর ছুরিটা দেখছ?

 ঠিক যেন একটি তাতারনি!

একটি সাহসিকা তো নাতাশাকে সোজাসুজিই প্রশ্ন করল, আপনি উল্টে পড়ে না গিয়ে বসে থাকেন কেমন করে?

চারদিকে বাগান দিয়ে ঘেরা ছোট কাঠের কাড়িটার ফটকে এসে খুড়ো ঘোড়া থেকে নামল। দাসদাসীদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় বলল, বাড়তি লোকরা সব কেটে পড়, আর অতিথি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার যথোচিত আয়োজন কর।

ভূমিদাসরা চলে গেল। খুড়ো নাতাশাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে তাকে সঙ্গে করে ফটকের কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। ঘরের কাঠের দেয়ালে পলস্তরা নেই, তাই খুব একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়, কিন্তু তাই বলে চোখে পড়ার মতো নোংরাও নয়। ঘরে ঢুকতেই তাজা আপেলের গন্ধ নাকে এল, চারদিকে নেকড়ে ও শেয়ালের চামড়া ঝোলানো।

সামনের ঘর ও বসবার ঘর পেরিয়ে সকলে খুড়োর নিজস্ব ঘরে ঢুকল। সেখানে রয়েছে একটা ছেঁড়া সোফা, পুরনো কার্পেট, সুভরভের ছবি, গৃহস্বামীর বাবা ও মার ছবি এবং সামরিক পোশাক পরিহিত তার নিজের ছবি। পড়ার ঘরটাকে তামাক ও কুকুরের তীব্র গন্ধ। অতিথিদের সেখানে বসে আরাম করতে বলে খুড়ো ঘরে থেকে বেরিয়ে গেল। পিঠময় কাদা নিয়ে ঘরে ঢুকল রুগা, সোফায় শুয়ে পড়ে জিভ ও দাঁত দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করতে লাগল। পড়ার ঘরের বারান্দার ওধারে দেখা যাচ্ছে একটা ছেঁড়া পর্দার আড়াল। তার পিছন থেকে মেয়েদের হাসি ও ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। নাতাশা, নিকলাস ও পেতয়া চাদর খুলে সোফায় বসে পড়ল। কনুইতে ভর দিয়ে পেতয়া সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। নাতাশা ও নিকলাস চুপচাপ। তাদের মুখ লাল; যেমন ক্ষিধে পেয়েছে, তেমনই হাসিখুশি। পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ দুজনই অকারণে খিলখিল করে হেসে উঠল।

কিছুক্ষণ পরে খুড়ো ঘরে ঢুকল। পরনে কসাক কোট, নীল ট্রাউজার ও টপ-বুট। নাতাশার মনে পড়ল অত্রাদতে এই পোশাকেই খুড়োকে দেখে তার খুব মজা লেগেছিল, কিন্তু এখন তার মনে হল চাতকপাখি-লেজ কোট বা ফ্রক কোটের তুলনায় এটা মোটেই খারাপ পোশাক নয়। খুড়োর মেজাজও খুব শরিফ, ভাই-বোনের এই হাসিতে কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট না হয়ে (তারা যে তার জীবন-যাত্রার নমুনা দেখে হাসতে পারে এটা খুড়োর মাথায়ই আসেনি) নিজেও তাদের হাসিতে যোগ দিল।

এই তো চাই ছোট কাউন্টেস, এই তো চাই; চলে আসুন! এর মতো কোনো মেয়ে আমি আগে দেখিনি, নিকলাসের দিকে একটা পাইপ এগিয়ে দিয়ে সে বলল। সারা দিন একজন পুরুষ মানুষের মতো ঘোড়া ছুটিয়েছেন, অথচ এখনও কেমন তাজা আছেন!

একটু পরেই খালি পায়ের শব্দ শুনে দরজাটা খুলে দেয়া হল, ঘরে ঢুকল বছর চল্লিশ বয়সের একটি সুদর্শনা নারী, তার থুতনিতে ভাঁজ পড়েছে, ঠোঁট দুটি রক্তিম, হাতে খাবার-ভর্তি একটা মস্ত বড় ট্রে। গৃহকত্রীর মর্যাদা ও আতিথেয়তার সঙ্গে সকলের দিকে স্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে সশ্রদ্ধভাবে মাথা নিচু করল। অস্বাভাবিক লম্বা-চওড়া চেহারা সত্ত্বেও স্ত্রীলোকটি হাল্কা পায়ে হেঁটে এল। টেবিলে সকলের জন্য নানা রকম খাদ্য পানীয় সাজিয়ে দিয়ে সে একপাশে সরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। মুখে তখনো হাসিটি লেগেই আছে। রশুভের মনে হল সে যেন বলতে চাইছে, এই তো আমি এসেছি। আমিই সেই! এবার খুড়োকে চিনলেন তো? না চিনে আর উপায় কি? শুধু নিকলাসই নয়, আনিসিয়া ফেদরভনা ঘরে ঢুকতেই তার বাঁকা ভুরু আর ঠোঁটের স্মিত হাসির অর্থ নাতাশাও বুঝতে পেরেছে।

খাদ্য-পানীয় সবই আনিসিয়া ফেদরভনার নিজের হাতে তৈরি; স্বাদে ও গন্ধে সবকিছুতেই আনিসিয়া ফেদরভনার স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে; সেই রসের ছোঁয়া, সেই পরিচ্ছন্নতা ও স্মিত হাসি।

নাতাশাকে একটার পর একটা খাবার পরিবেশন করে সে বার বার বলতে লাগল, এটা নিন ছোট্ট লেডি কাউন্টেস!

নাতাশা সবকিছুই খেল, তার মনে হল এমন খাবার সে কখনো খায়নি। আনিসিয়া ফেদরভনা চলে গেল।

নৈশাহারের পরে রস্তভ ও খুড়ো চেরি ব্র্যান্ডি সামনে নিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের শিকার এবং রুগা ও ইলাগিনের কুকুর নিয়ে গল্প শুরু করে দিল। নাতাশা সোফার উপরে সোজা হয়ে বসে চকচকে চোখ মেলে সব কথা শুনতে লাগল। পেতয়াকে কিছু খাওয়াবার জন্য বারকয়েক তাকে ঘুম থেকে তুলতে চেষ্টা করল, কিন্তু সে শুধু বিড়বিড় করে কি যেন বলল, মোটেই উঠল না। এই নতুন পরিবেশে নাতাশার মনটা এতই হাল্কা ও খুশি হয়ে উঠেছে যে তার ভয় হল গাড়িটা বুঝি বড় বেশি তাড়াতাড়ি এসে পড়বে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুড়ো বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন। এইভাবেই আমার দিন শেষ হয়ে আসছে…মৃত্যু তো আসবেই। ঠিক আছে, আসুক। কিছুই তো থাকবে না। তাহলে মানুষের ক্ষতি করে কী লাভ

কথাগুলি বলতে বলতে খুড়োর মুখটা আরো অর্থবহ, আরো সুন্দর হয়ে উঠল। আপনা থেকেই রভের মনে পড়ে গেল, একজন সম্মানিত ও নিঃস্বার্থ খেয়ালি লোক হিসেবে গোটা প্রদেশ জুড়ে খুড়োর একটা সুনাম আছে।

তুমি চাকরিতে ঢোক না কেন খুড়ো?

একসময় ঢুকেছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি। ঠিক আছে, চলে আসুন। চাকরির মাথামুণ্ডু আমি ভালো বুঝি না। ওসব আপনাদের জন্যে আমার মাথায় যথেষ্ট ঘিলু নেই। আর শিকার একটা আলাদা ব্যাপার-ঠিক আছে। চলে আসুন! …আরে, দরজাটা খুলে দাও। ওটা বন্ধ করেছ কেন?

কারো খালি পায়ে দ্রুত এগিয়ে আসার শব্দ শোনা গেল, একটা অদৃশ্য হাত শিকারি-ভৃত্যদের ঘরের দরজাটা খুলে দিল। ভেসে এল বালালায়কার (স্প্যানিশ গিটারের মতো একটা বাদ্যযন্ত্র) সুর। বাজিয়ের হাতটা খুব ভালো। নাতাশা কিছুক্ষণ ধরেই সুরটা শুনছিল, এবার ভালো করে শোনার জন্য বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

খুড়ো বলল, আমার কোচয়ান মিকা… একটা ভালো বালালায়কা তাকে কিনে দিয়েছি। বাজনাটা আমার বড় প্রিয়।

নিকলাস বলে উঠল, খুব ভালো! সত্যি খুব ভালো!

দাদার গলায় ভাসা-ভাসা প্রশংসার স্বর শুনে নাতাশা ঈষৎ তিরস্কারের সুরে বলল, খুব ভালো? খুব ভালো নয়-যাকে বলে মন-মাতানো!

খুড়োর দেয়া খাদ্য পানীয় যেমন নাতাশার কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীর সেরা, তেমনই এই মুহূর্তে এ বাজনাটা মনে হচ্ছে পরম আনন্দময়।

বালালায়কা থামতেই নাতাশা দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, আরো, আরো বাজাও! মিল্কা নতুন প্রেরণায় বালালায়কার মাই লেডির সুরমূছনা ফুটিয়ে তুলল। সকলেই বার বার সেটা শুনতে লাগল; শুনে যেন কারো ক্লান্তি নেই। আনিসিয়া ফেদরভনা ভিতরে ঢুকে দরজার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

খুড়োর মতো করেই হেসে নাতাশাকে বলল, শুনতে ভালো লাগছে। লোকটা খুব ভালো বাজায়।

খুড়ো হঠাৎ সোৎসাহে বলে উঠল, এই জায়গাটা ঠিক হল না! এখানে একেবারে ফেটে পড়া উচিত–ঠিক আছে, চলে আসুন! ফেটে পড়া উচিত।

তুমিও বাজাও বুঝি? নাতাশা জানতে চাইল।

খুড়ো জবাব দিল না, একটু হাসল।

আনিসিয়া, গিয়ে দেখ তো আমার গিটারের তারগুলো ঠিক আছে কি না। অনেকদিন তো ওটা ছুঁইনি। ঠিক আছে-চলে আসুন! বাজনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।

আনিসিয়া ফেদরভনা সানন্দে হাল্কা পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং গিটারটা নিয়ে ফিরে এল।

কারো দিকে না তাকিয়ে খুড়ো বাদ্যযন্ত্রটার ধুলো ঝাড়ল, শক্ত আঙুলে ঠুকে ঠুকে গিটারের সুর বাঁধল, তারপর হাতল-চেয়ারটায় আরাম করে বসল। আনিসিয়া ফেদরভনার দিকে চোখ টিপে শুরু করল বাজনা; মাই লেডি নয়, বাজাতে লাগল বিখ্যাত গান পথ বেয়ে এস হে সুন্দরী-র সুর।

বাজনা শেষ হতেই নাতাশা চেঁচিয়ে উঠল, মনোরম, মনোরম! বাজাও খুড়ো, বাজিয়ে যাও! লাফিয়ে উঠে খুড়োকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল। দাদার দিকে ঘুরে বলল, নিকলাস, নিকলাস! যেন তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইল : আমি এত চঞ্চল হয়ে উঠেছি কেন?

খুড়োর বাজনা নিকলাসেরও ভালো লেগেছে; খুড়ো সুরটা আর একবার বাজাল। দরজায় আবারও আনিসিয়া ফেদরভনার মুখটা দেখা গেল। তার পিছনে আরো অনেক মুখ…খুড়ো আবার বাজাতে শুরু করল

পরিষ্কার মিষ্টি জল আনছ তুমি কন্যা,
দোহাই তোমার, এ কাজ রাখ, তুমি যে অনন্যা

হঠাৎ ঘাড়টা ঝাঁকি দিয়ে বাজনা থামাতেই নাতাশা যেন আর্তনাদ করে উঠল, বাজিয়ে যাও খুড়ো; যেন এই বাজনার উপর তার জীবনটাই নির্ভর করছে।

খুড়ো উঠে দাঁড়াল। মনে হল তার ভিতরে যেন দুটি মানুষের বাসা : একজন তাকে দেখে গম্ভীরভাবে হাসছে, অপরজন একটা পল্লী-নৃত্যের জন্য তৈরি হচ্ছে।

হাত বাড়িয়ে খুড়ো উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, এবার তাহলে আসুন ভাইঝি।

কাঁধের উপর থেকে শালটা ফেলে দিয়ে নাতাশা ছুটে গিয়ে খুড়োর মুখোমুখি হল, দুই হাত মুড়ে নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়াল।

কবে কোন ফরাসি শিক্ষত্রিয়ীর কাছে সে রুশ পল্লী-নৃত্য শিখেছিল কে জানে, আজ কিন্তু সে চমৎকার নাচতে লাগল। নিকলাস ও অন্য সকলেই তার প্রশংসা করতে লাগল।

নাচ শেষ করে খুড়ো আনন্দে হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা ছোট কাউন্টেস! ঠিক আছে–চলে আসুন! খুব ভালো নেচেছেন ভাইঝি! এবার আপনার জন্য একটি ভালো বর খুঁজতে হবে। ঠিক আছে–চলে আসুন!

নিকলাস হেসে বলল, বর খোঁজা হয়ে গেছে।

আচ্ছা? বলে খুড়ো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাতাশার দিকে তাকাল, খুশির হাসি হেসে সেও মাথা নাড়ল।

খুড়ো আর একটা গান বাজাল, তারপর একটু থেমে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে তার প্রিয় শিকার-সঙ্গীতটি গাইল :

কালকে রাতে আঁধার যখন এল ঘন হয়ে
হাল্কা বরফ ঝরল যখন ঝিরি ঝিরি লয়ে…

খুড়ো গাইল চাষীদের মতো করে, তার দৃঢ় প্রত্যয় যে একটা গানের অর্থ নিহিত থাকে তার বাণীতে, সুর আপনি আসে, বাণী ছাড়া সুর থাকতে পারে না, বাণীকে রূপ দেয়ার জন্যই সুরের অস্তিত্ব। ফলে পাখির গানের মতো তার গানও হল অসাধারণ ভালো। নাতাশা খুড়োর গানেও সমান মোহিত। মনে মনে স্থির করল, সে আর বীণা বাজাবে না, কেবল গিটারই বাজাবে।

নয়টার পরে দুখানা ছোট গাড়ি ও তিনজন অশ্বারোহী এল নাতাশা ও পেতয়াকে নিয়ে যেতে। তারা যে এতক্ষণ কোথায় ছিল তা না জানতে পেরে কাউন্ট ও কাউন্টেস খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

পেতয়াকে কুকুরের মতো তুলে নিয়ে বড় গাড়িটায় শুইয়ে দেওয়া হল। নাতাশা ও নিকলাস উঠল অপর গাড়িতে। খুড়ো নাতাশার গায়ে মালটা জড়িয়ে দিল, একটা নতুন মমতায় তাকে বিদায় দিল। হাঁটতে হাঁটতে সে সেতুটা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গেল, তারপর লণ্ঠন হাতে তিনজন অশ্বারোহী শিকারিকে তাদের সঙ্গে দিল আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে।

বড় রাস্তায় পড়ে নাতাশা বলল, খুড়ো কী ভালো মানুষ!

নিকলাস বলল, সত্যি। তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না তো?

না, আমি খুব, খুব ভালো আছি। এত ভালো লাগছে। নিজের মন নিয়েই সে যেন বিব্রত। অনেকক্ষণ তারা চুপচাপ চলল। রাতটা অন্ধকার, ঠাণ্ডা। ঘোড়াগুলোও চোখে পড়ছে না, শুধু শোনা যাচ্ছে কাদার মধ্যে তাদের পায়ের শব্দ।

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ নাতাশার গলায় কালকে রাতে আঁধার যখন এল ঘন হয়ে গানটার সুর গুনগুনিয়ে উঠল-সারা পথ এই সুরটাই সে ধরতে চেষ্টা করছিল, এতক্ষণে তা ধরা দিল।

তুলতে পারলে তাহলে? নিকলাস বলল।

 নাতাশা শুধাল, এইমুহূর্তে তুমি কি ভাবছিলে নিকলাস?

এ প্রশ্নটা একে-অন্যকে করতে তারা খুব ভালোবাসে।

মনে করবার চেষ্টা করে নিকলাস বলল, আমি? দেখ, প্রথমে ভেবেছিলাম লাল কুকুর রুগা ঠিক খুড়োর মতো, সেটা যদি মানুষ হত তাহলে খুড়োকে সব সময় কাছে কাছে রাখত। খুড়ো কী চমৎকার মানুষ! তোমার কী তাই মনে হয় না? কী বলে?

আমি? দাঁড়াও, দাঁড়াও। হ্যাঁ, প্রথমে ভাবলাম, যে বাড়ির দিকে চলেছি, কিন্তু অন্ধকারে কোথায় যে চলেছি তা শুধু ঈশ্বরই জানেন, হয় তো হঠাৎ আমরা যেখানে পৌঁছে যাব সেটা অত্রাদ নয়, পরীদের দেশ। তারপর ভাবলাম…না, আর কিছু না।

পরে হেসে বলল, আমি জানি তুমি তার কথাই ভাবছিলে।

যদিও সত্যি সত্যি সে প্রিন্স আন্দ্রুর কথাই ভাবছিল, তবু নাতাশা বলল, না। আমি শুধু ভাবছিলাম আনিসিয়া কেমন সুন্দরভাবে সবকিছু চালিয়ে নিচ্ছে। তুমি কি জান, কিন্তু আমি জানি যে আর কখনো আমি আজকের মতো শান্ত ও সুখী হতে পারব না।

বাজে কথা, অর্থহীন কথা, বাগাড়ম্বর। নিকলাস চেঁচিয়ে বলল। তারপর ভাবল, আমার এই নাতাশা কত ভাল! তার মতো বন্ধু আমার কেউ নেই, কোনোদিন হবে না। কেন ও বিয়ে করবে? এমনিভাবেই তো আমরা একসঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে পারি।

নাতাশাও বলল, কত ভালো আমার এই নিকলাস!

রাতের ভেজা-ভেজা চকচকে অন্ধকারের মধ্যে বাড়ির জানালার আলোগুলি দেখিয়ে নাতাশা বলল, আঃ, বসার ঘরে এখনও আলো জ্বলছে!

.

 অধ্যায়-৮

কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ মার্শাল অব দি নবিলিটির পদটা ছেড়ে দিয়েছে, কারণ ঐ পদে থাকার দরুন তার অনেক খরচ হচ্ছিল, অথচ তার বৈষয়িক অবস্থার কোনোরকম উন্নতি হয়নি। নাতাশা ও নিকলাস প্রায়ই লক্ষ্য করে বাবা-মা কি নিয়ে যেন উদ্বেগের সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে; কখনো কখনো শুনতে পায় স্তভদের মস্কোর নিকটবর্তী চমৎকার বাড়ি ও জমিদারি বেচে দেবার প্রস্তাব চলছে। মার্শাল থাকার সময়ে বাড়িতে যেরকম অবাধ জনসমাগম ছিল এখন আর সেটা নেই; অত্রানুর জীবনযাত্রা আগের তুলনায় অনেক চুপচাপ হয়ে এসেছে; কিন্তু তবু মস্তবড় বাড়িটা ও তার ঘরগুলো লোকজনে ভর্তি প্রতিদিন বিশ জনেরও বেশি লোক টেবিলে খেতে বসে। এরা সকলেই আপন জন, পরিবারের লোকদের মতোই এ বাড়িতে বসবাস করছে; আবার কেউ বা বাধ্য হয়ে এখানে রয়েছে। যেমন বাজনাদার ডিমলার ও তার বৌ, বুড়ি মহিলা বেলো, এবং পেতয়ার শিক্ষয়িত্রী, মেয়েদের প্রাক্তন শিক্ষয়িত্রী, প্রভৃতির মতো এমন আরো অনেকে যারা নিজেদের বাড়ির চাইতে কাউন্টের বাড়িতে থাকাটাই অধিকতর সুবিধাজনক বলে মনে করে। আগেকার মতো তত অতিথি সমাগম এখন আর হয় না, কিন্তু জীবনযাত্রার যে পুরনো অভ্যাসগুলি ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থাকার কথাই কাউন্ট ও কাউন্টেস ভাবতেই পারে না সেটা এখনও অভ্যাহতই আছে। শিকারের একটা বড় মাপের আয়োজন এখনও আছে, বরং নিকলাস সেটাকে আরো বাড়িয়েছে, আস্তাবলে সেই পঞ্চাশটা ঘোড়া ও পনেরোটা সহিসই আছে, নামকরণ-দিবসে সেই ব্যয়বহুল ভোজসভা ও উপহারের রেওয়াজই চলেছে; কাউন্টের হুইস্ট ও বোন্টন খেলাও আগের মতোই চলছে; এখনও সকলকে হাত দেখিয়ে সেই একইভাবে ছড়িয়ে তাস মেলে ধরে কাউন্ট প্রতিদিন প্রতিবেশীদের কাছে শয়ে-শয়ে রুবল হারে, আর তারাও উপার্জনের একটা লাভজনক উপায় হিসেবে কাউন্ট রস্তভের সঙ্গে একবার খেলার সুযোগ খুঁজে ফেরে।

বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে কাউন্ট যেন একটা মস্তবড় জালের ভিতরে পড়েছে; সে জালে সে যে আটকে পড়ছে এটা সে যতই বিশ্বাস করতে না চায়, প্রতি পদক্ষেপে ততই বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে; না পারছে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে, না পারছে ধৈর্য ধরে জালের বাঁধন খুলতে। কাউন্টেস মর্মে মর্মে বুঝতে পারছে যে তার ছেলেমেয়েদের সর্বনাশ ঘটছে, কিন্তু সেটা কাউন্টের দোষ নয়, কারণ একদিন সে যা ছিল তার থেকে সরে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়; নিজের ও সন্তানদের আসন্ন সর্বনাশ সম্পর্কে কাউন্ট নিজেও সচেতন। মেয়েলি দৃষ্টিকোণ থেকে এ সমস্যা-সমাধানের একটিমাত্র পথই কাউন্টেসের চোখে পড়ছে, অর্থাৎ নিকলাস যদি কোনো বিত্তশালিনীকে বিয়ে করে। সে বোঝে এটাই তাদের শেষ আশা, আর নিকলাস যদি তার পছন্দকরা মেয়েকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে তাহলে সংসারের অবস্থার উন্নতির আশাই তাকে ছেড়ে দিতে হবে। মেয়েটি হচ্ছে জুলি কুরাগিনা, বাবা-মা যেমন ধার্মিক তেমনই ভালো মানুষ, শিশুকাল থেকেই রস্তভরা মেয়েটিকে চেনে, সম্প্রতি তার সর্বশেষ ভাইটির মৃত্যু ঘটায় সেই এখন প্রভূত বিত্তের উত্তরাধিকারিণী।

ছেলের বিয়ের প্রস্তাব করে কাউন্টেস ইতিমধ্যেই মস্কোতে জুলির মাকে চিঠি লিখেছে; তার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাবও এসেছে। কুরাগিনা জানিয়েছে, তার নিজের এতে মত আছে, তবে সবকিছুই নির্ভর করছে মেয়ের ইচ্ছার উপরে। কুরাগিনা নিকলাসকে মস্কোতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

চোখের জল ফেলে কাউন্টেস বারকয়েক ছেলেকে বলেছে যে এখন তার দুই মেয়েই সংসারী হয়েছে, তাই তার একমাত্র বাসনা ছেলের বিয়ে দেওয়া। সে বাসনা পূর্ণ হলেই সে শান্তিতে কবরে শুতে পারে। আরো বলেছে, একটি চমৎকার মেয়েকে সে চেনে, কাজেই এখন ছেলের মতটা পাওয়া দরকার।

মায়ের কথাগুলো কোনদিকে চলেছে সেটা বুঝতে পেরে একদিন কথাপ্রসঙ্গে সে মাকে সব কথা খোলাখুলি বলতে বলল। মাও জানিয়ে দিল যে, তাদের বৈষয়িক সমস্যা-সমাধানের সবটাই এখন নির্ভর করছে জুলি কুরাগিনের সঙ্গে তার বিয়ের উপরে।

কিন্তু মামণি, ধর আমি এমন একটি মেয়েকে ভালোবাসি যার কোনো বিষয়-সম্পত্তি নেই, তাহলে তুমি কি চাও টাকার জন্য আমি আমার ভালোবাসা ও সম্মানকে বিসর্জন দেব? প্রশ্নটার নিষ্ঠুরতাটুকু উপলব্ধি না করে শুধু নিজের মহানুভবতা দেখাতেই সে মাকে কথাটা বলল।

কি বলবে বুঝতে না পেরে মা বলল, না, তুমি আমার কথা বুঝতে পারনি নিকোলেংকা। তোমার সুখই আমি চাই। কিন্তু সে যে সত্যি কথা বলেনি, এবং তার ফলে নিজেই জড়িয়ে পড়েছে সেটা বুঝতে পেরে মা কাঁদতে লাগল।

কেঁদ না মামণি। তুমি শুধু বল কি চাও; তুমি তো জান, তোমাকে সুখী করতে আমি জীবন দিতে পারি, সবকিছু দিতে পারি। তোমার জন্য আমি সব বিসর্জন দেব-এমন কি আমার ভালোবাসাকেও।

কিন্তু সেভাবে তো কাউন্টেস কথাটা বলতে চায়নি; ছেলের আত্মত্যাগ সে চায় না বরং সে চায় ছেলের জন্য নিজে ত্যাগ স্বীকার করতে।

চোখের জল মুছে বলল, না, তুমি আমাকে বুঝতে পারনি; এ কথা এখন থাক।

নিকলাস নিজের মনে বলল, হতে পারে যে একটি গরিব মেয়েকে আমি ভালোবাসি। টাকার জন্য কি আমার ভালোবাসাকে, আমার সম্মানকে বিসর্জন দেব? মামণি কি করে একথা আমাকে বলতে পারল আমি ভেবে পাই না। সোনিয়া গরিব বলেই আমি তাকে ভালোবাসব না, তার বিশ্বস্ত, আন্তরিক ভালোবাসার প্রতিদান দেব না? অথচ একটা পুতুলের মতো জুলির চাইতে তাকে নিয়েই তো আমি বেশি সুখী হতে পারব। পরিবারের কল্যাণে আমার মনকে বলি দিতে পারি, কিন্তু তার উপর জোর খাটাতে তো পারি না। সোনিয়াকে যদি আমি ভালোবাসি তো সে ভালোবাসা আমার কাছে অন্য সবকিছুর চাইতে শক্তিশালী, সবকিছুর উপরে।

মায়ের প্রস্তাবমতো নিকলাস মস্কো গেল না, আর কাউন্টেসও তার কাছে আর বিয়ের কথা তুলল না। দুঃখের সঙ্গে, কখনো বিরক্তির সঙ্গে, সে লক্ষ্য করতে লাগল সম্পত্তিহীনা সোনিয়ার সঙ্গে তার ছেলের ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

নিকলাস তখন ছুটির শেষের দিনগুলি বাড়িতেই কাটাচ্ছিল। রোম থেকে প্রিন্স আন্দ্রুর লেখা চতুর্থ চিঠিটা তার হাতে এসেছে। সে লিখেছে, গরম আবহাওয়ায় তার ক্ষতস্থানটা অপ্রত্যাশিতভাবে পুনরায় পেকে না উঠলে অনেক আগেই সে রাশিয়ায় ফিরে যেত; বর্তমান অবস্থায় নববর্ষ পর্যন্ত তাকে সেখানেই থাকতে হবে। নাতাশা এখনও তার বাগদত্তার প্রতি সমান অনুরক্ত, সেই অনুরাগই তার জীবনের সান্ত্বনা; কিন্তু তাদের বিরহের চার মাসের শেষের দিকে তার মন মাঝে মাঝেই অবসাদে ভেঙে পড়তে লাগল। নিজের জন্যই তার দুঃখ হতে লাগল; দুঃখ এই জন্য যে বৃথাই সে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, কারো কোনো কাজে লাগছে না–অথচ ভালোবাসবার ও ভালোবাসা পাবার কত শক্তিই না তার মধ্যে আছে।

রস্তভদের বাড়ির আবহাওয়া তখন মোটেই সুখপ্রদ নয়।

.

অধ্যায়-৯

বড়দিন এল। কিছু প্রথামাফিক অনুষ্ঠান, প্রতিবেশী ও চাকরদের কাছ থেকে কিছু গম্ভীর ও ক্লান্তিকর অভিনন্দন, এবং প্রত্যেকের জন্য নতুন পোশাক, এ ছাড়া বিশেষ কোনো উৎসবের আয়োজন করা হল না, যদিও বিশ ডিগ্রি রিউমার (ফারেনহাইট অনুসারে শূন্য তাপাংকের ১৩ ডিগ্রি নিচে) আবহাওয়ার শান্ত বরফপাত, দিনের চোখ-ধাঁধানো রোদ ও শীতের রাতের তারার আলো-এসব কিছুর মধ্যে ছিল বিশেষ আনন্দ-অনুষ্ঠানের আহ্বান।

বড়দিন সপ্তাহের তৃতীয় দিন; মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে বাড়ির লোকজন সকলেই যার যার ঘরে চলে গেছে। দিনের মধ্যে এটাই সবচাইতে, একঘেয়ে সময়। নিকলাস সকালে কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছিল; এখন সে বসবার ঘরের সোফায় শুয়ে ঘুমোচ্ছ। বুড়ো কাউন্ট পড়ার ঘরে বিশ্রাম করছে। সোনিয়া গোল টেবিলটার পাশে বসে একটা সূচি-কর্মের নক্সা নকল করছে। কাউন্টেস পেশেন্স খেলছে। ভাড় নাস্তাসিয়া আইভানভনা দুটি বৃদ্ধা মহিলাকে নিয়ে বিরস বদনে জানালার ধারে বসে আছে। নাতাশা ঘরে ঢুকল, সোনিয়ার কাছে গিয়ে একপলক তার কাজটা দেখল, তারপর মার কাছে গিয়ে কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল ।

মা বলল, একঘরের মতো এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? কি চাও?

তাকে…আমি চাই তাকে…এখনই, এই মুহূর্তে! আমি চাই তাকে! নাতাশা বলল। তার চোখ দুটি ঝকঝক করছে; ঠোঁটে হাসির চিহ্ন নেই।

কাউন্টেস মাথা তুলে মেয়ের দিকে তাকাল।

আমার দিকে তাকিও না মামণি! তাকিও না; আমি কেঁদেই ফেলব।

আমার কাছে একটু বস, কাউন্টেস বলল।

মামণি, আমি তাকে চাই। কেন এভাবে নিজেকে ক্ষয় করব মামণি?

তার গলা ধরে এল, চোখে নামল অশ্রুর প্লাবন, সেটা লুকোতে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।

বসার ঘরে ঢুকে সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর দাসীদের ঘরে গেল। একটি বুড়ি দাসী একটি মেয়েকে বকছিল। এইমাত্র ঠাণ্ডার মধ্যে ভূমিদাসদের বাসা থেকে ছুটে এসেছে বলে মেয়েটি হাঁপাচ্ছে।

বুড়ি বলল, খেলা থামাও–সবকিছুরই একটা সময় আছে।

নাতাশা বলল, ওকে ছেড়ে দাও কাতেনা। যা মাভরুশা, চলে যা।

মাভরুশাকে ছাড়িয়ে দিয়ে নাতাশা নাচ-ঘর পেরিয়ে বারান্দায় গেল। সেখানে এক বুড়ো ও দুটি যুবক চাকর তাস খেলছিল। তাকে ঢুকতে দেখেই তারা উঠে দাঁড়াল।

এদের নিয়ে কি করা যায়? নাতাশা ভাবল।

এই যে, নিকিতা, দয়া করে যাও…একে কোথায় পাঠাই?…ঠিক আছে, যাও তো, উঠোন থেকে একটা মোরগ ধরে নিয়ে এস; আর তুমি মিশা, কিছুটা যই নিয়ে এস।

অনেকটা যই? মিশা খুশি হয়ে বলল।

তাড়াতাড়ি যা, বুড়ো লোকটি বলল।

আর তুমি থিয়োডোর, তুমি আমাকে একটুকরো চক এনে দাও।

খানসামার ভাড়ার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে বলল সামোভারটা উনুনে চাপিয়ে দিতে, যদিও এখনও চায়ের সময় মোটেই হয়নি।

আসলে সকলকে ব্যস্ত করে তুলতেই নাতাশা ভালোবাসে। সবসময়ই কোনো না কোনো কাজে তাদের সে পাঠাবেই। সে যেন যাচাই করে দেখতে চায় তার হুকুম শুনে রাগ করে কি না অথবা বিরক্ত হয় কি না। কিন্তু ভূমি-দাসদাসীরাও তার হুকুমই তড়িঘড়ি পালন করে থাকে। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল, এবার কি করি? কোথায় যাই?

মেয়েলি জামা পরে ভড়কে সেইদিকে আসতে দেখে বলল, বল তো নাস্তাসিয়া আইভানভনা, আমার কিরকম ছেলেপুলে হবে?

ভাঁড় জবাব দিল, কেন, মাছি, ঝিঁঝি পোকা, কাঠ-ফড়িং।

 হা প্রভু, হা প্রভু, এ যে সেই একই মূর্তি! আঃ, কোথায় যে যাই? নিজেকে নিয়ে কি যে করি?

গোড়ালি খুটখুট করে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। সেকানে ভোগেল, তার স্ত্রী ও দুজন শিক্ষয়িত্রীর সঙ্গে দেখা করে চলে গেল ভাই পেতয়ার কাছে। সে তখন একটি চাকরের সঙ্গে বসে রাতে পোড়াবার জন্য বাজি তৈরি করছে।

ভাইকে ডেকে বলল, পেতয়া! পেতয়া! আমাকে পিঠে করে নিচে নিয়ে চল।

সত্যি সত্যি ভাইয়ের পিঠে চেপে সে নিচে নেমে গেল। এইভাবে নিজের গোটা সাম্রাজ্যকে পরিদর্শন করে সে নাচ-ঘরে গিয়ে ঢুকল। একটা গিটার হাতে নিয়ে বুক-কেসটার পিছনে একটা অন্ধকার কোণ বেছে নিয়ে সেখানে বসে গিটারের তারে আঙুল বুলিয়ে পিটার্সবুর্গে প্রিন্স আন্দ্রুর পাশে বসে শোনা অপেরার একটা গানের সুর বাজাতে লাগল। গিটারে যে সুর সে তুলল অন্য কেউ তার মাথামুণ্ড হয় তো কিছুই বুঝত না, কিন্তু সেই শব্দের ঝংকার তার মনে অনেক স্মৃতি বয়ে নিয়ে এল। সেই মুহূর্তগুলি তার মনে পড়ে গেল যখন সে ছিল পাশে, আর তার দিকে তাকিয়েছিল প্রেমিকের দৃষ্টিতে।

আ, সে যদি একটু তাড়াতাড়ি আসত! আমার ভয় হচ্ছে। সে বুঝি কোনোদিনই আসবে না! আরো খারাপ লাগছে, আমি যে বুড়ি হয়ে যাচ্ছি সেটাই তো আসল কথা! আমার মধ্যে আজ যা আছে তা তো থাকবে না। কিন্তু হয়তো সে আজই আসবে, এখনই আসবে। হয়তো সে এসে গেছে, বাইরের ঘরে বসে আছে। হয়তো সে গতকালই এসেছে, আমি সেটা ভুলে গেছি। গিটারটা রেখে দিয়ে সে বসার ঘরে চলে গেল।

শিক্ষক, গভর্নের্স, অতিথি–পুরো পারিবারিক মহলটাই চায়ের টেবিলে হাজির। চাকররা টেবিলটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে,কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রুন্তু সেখানে নেই। জীবন আগেকার মতোই চলেছে।

নাতাশাকে ঢুকতে দেখেই বুড়ো কাউন্ট বলে উঠল, আরে, এই তো এসেছে! বস, আমার পাশে বস। কিন্তু নাতাশা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল; যেন কাউকে খুঁজছে।

নাতাশা বলল, মামণি! তাকে এনে দাও, তাকে এনে দাও মামণি! তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি! আবারও

অনেক কষ্টে সে চোখের জল থামাল। : টেবিলে বসে সে বড়দের আলোচনা শুনতে লাগল। নিকলাসও সেখানে হাজির। হায় ঈশ্বর, সেই একই মুখ, সেই একই কথা! হাতে পেয়ালা নিয়ে বাপি সেই একইভাবে কথা বলে চলেছে! গোটা সংসারের এই একঘেয়েমি লক্ষ্য করে নাতাশা যেন শিউরে উঠল।

চায়ের পরে নিকলাস, সোনিয়া ও নাতাশা বসার ঘরের সেই প্রিয় কোণটাতে গিয়ে বসল যেখানে তাদের সব গোপন আলোচনা হয়ে থাকে।

.

অধ্যায়-১০

 নাতাশা দাদাকে বলল, তোমার কি কখনো এরকম মনে হয় যে আর কিছু পাবার নেই-কিছু না; যা কিছু ভালো সব শেষ হয়ে গেছে? আর ঠিক একঘেয়ে নয়, কেমন যেন বিষণ্ণ লাগে?

নিকলাস জবাব দিল, তা হয় বটে! যখন সবকিছুই ঠিক ঠিক মতো চলছে, সকলেই হাসিখুশি, তখন এ ধরনের ভাব আমারও হয়েছে। মনে হয়েছে আমি যেন বড় ক্লান্ত, আমরা সকলেই মরে যাব। রেজিমেন্টে থাকতে একবার আমি গানের মজলিসে যাইনি…আর হঠাৎ এমন খারাপ হয়ে গেল… ।

নাতাশা বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি! খুব ছোট বেলায় আমার ওরকম হত। তোমার মনে আছে একবার স্কুলের ব্যাপারে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল? তোমরা সকলে নাচছিলে, আর স্কুলের ঘরে বসে আমি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম? সে-কথা আমি কোনোদিন ভুলব না : আমার খুব খারাপ লাগছিল, নিজের জন্য ও অন্য সকলের জন্য কেমন যেন দুঃখ পাচ্ছিলাম। অথচ আমি ছিলাম নির্দোষ-সেটাই তো আসল কথা। তোমার মনে আছে?

নিকলাস জবাব দিল, মনে আছে। পরে তোমার কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেমন যেন লজ্জা করছিল। তখন আমরা ভয়ংকর অবুঝ ছিলাম। আমার একটা মজার পুতুল ছিল, সেটা তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম। তোমার মনে আছে?

বিষণ্ণ হাসি হেসে নাতাশা শুধাল, আর তোমার কি মনে পড়ে, অনেক কাল আগে, যখন আমরা খুব ছোট ছিলাম, তখন কাকা আমাদের পড়ার ঘরে ডেকেছিলেন-সেই পুরনো বাড়িতে–তখন অন্ধকার হয়ে এসেছিল–আমরা ভিতরে ঢুকলাম আর অমনি সেখানে হাজির হল…

খুশির হাসি হেসে নিকলাস গলা মেলাল, একটি নিগ্রো। খুব মনে আছে। অবশ্য আমি এখনও জানি না সত্যি একজন নিগ্রো এসেছিল, না কি আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, না কেউ আমাদের তার কথা বলেছিল।

তোমার নিশ্চয় মনে আছে তার মাথার চুল ছিল সাদা, দাঁতও সাদা; আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে সে আমাদের দিকে তাকাল…

সোনিয়া, তোমার মনে পড়ে? নিকলাস শুধাল।

 সোনিয়া নরম সুরে জবাব দিল, হা, হ্যাঁ, আমারও কিছু কিছু মনে আছে।

 নাতাশা বলল, জান, বাপিকে ও মামণিকে আমি নিগ্রোটার কথা জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, কিন্তু তারা বলল যে কোনো নিগ্রোই সেখানে ছিল না। কিন্তু তুমি তো দেখেছ, তোমার তো মনে আছে?

নিশ্চয় মনে আছে। তার দাঁতগুলো এত স্পষ্ট মনে আছে যেন এইমাত্র দেখলাম।

কী আশ্চর্য! ঠিক যেন একটা স্বপ্ন! আমার খুব ভালো লাগে।

আবার তোমার কি মনে আছে নাচ-ঘরে শক্ত করে সেদ্ধ করা ডিম গড়িয়ে দিয়ে আমরা খেলা করছি, আর হঠাৎ দুই বুড়ি এসে কার্পেটের উপর ঘুরতে লাগল। সেটা কি সত্যি, না স্বপ্ন তোমার মনে আছে কী মজাটাই না হয়েছিল?

হ্যাঁ, তোমার মনে আছে নীল রঙের ওভার কোটটা পরে বাপি একবার ফটকে দাঁড়িয়ে বন্দুক ছুঁড়েছিল?

 এইভাবে হাসিখুশিতে মশগুল হয়ে তারা অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগল।

কথাবার্তার মাঝখানে একটি দাসী অপর দিকের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, মিস, ওরা মোরগটা এনেছে।

ওটার আর দরকার নেই পোলিয়া। ওদের ওটা নিয়ে যেতে বল, নাতাশা বলল।

ঘরে ঢুকল ডিমলার। এক কোণে দাঁড় করানো বীণাটার কাছে গিয়ে কাপড়ের ঢাকনাটা খুলে ফেলল। বীণার তারে একটা কর্কশ আওয়াজ উঠল।

বসার ঘর থেকে বুড়ি কাউন্টেসের গলা শোনা গেল, মি. ডিমলার, দয়া করে আমার প্রিয় সুর নিশীথে প্রান্তরে বাজান।

একটা তারে ঝংকার তুলে নাতাশা, নিকলাস ও সোনিয়ার দিকে ফিরে ডিমলার বলল, তোমরা কত শান্ত।

হ্যাঁ, আমরা দার্শনিক আলোচনা করছি, কথাটা বলে নাতাশা আবার তাদের আলোচনায় যোগ দিল। তারা তখন স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা করছে।

ডিমলার বাজাতে শুরু করল।

নাতাশা ফিসফিস করে বলল, তোমরা কি জান, অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে একসময় লোকের মনে পড়ে যায় সেইসব ঘটনার কথা যা এই পৃথিবীতে আসার আগে ঘটেছিল…।

সোনিয়া লেখাপড়ায় খুব ভাল; সবকিছু তার মনে থাকে। সে বলল, ওটা জন্মান্তরবাদের ব্যাপার। মিশরিয়রা বিশ্বাস করে যে আমাদের আত্মা একসময় জন্তুদের দেহে বাস করত এবং পুনরায় জন্তুদের দেহেই ফিরে যাবে।

নাতাশা বলল, না, আমরা কোনোদিন জন্তু ছিলাম সেটা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এটা আমি নিশ্চিত জানি যে ওই সুদূরে কোথাও আমরা দেবদূত হয়ে ছিলাম, তারপর এখানে এসেছি, আর সেইজন্যই আমাদের মনে পড়ে…

আলোচনায় যোগ দিতে পারি কি? ডিমলার নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এসে তাদের পাশে বসে বলল।

নিকলাস বলল, আমরা যদি দেবদূতই ছিলাম, তাহলে আমাদের পতন ঘটল কেন? না, তা হতে পারে না!

পতন তো হয়নি; কে বলল আমরা নিচে নেমে গেছি?…আগে আমি কি ছিলাম সেটা জানব কেমন করে? নাতাশা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে উঠল। আত্মা অমর-সেক্ষেত্রে আমাকে যদি চিরদিন বাঁচতে হয় তাহলে তো আগেও বাঁচতে হয়, অনন্তকাল ধরেই বাঁচতে হয়।

এবার ডিমলার কথা বলল, ঠিক কথা, কিন্তু অনন্তকালের কল্পনা করা আমাদের পক্ষে কঠিন কাজ।

নাতাশা বলল, অনন্তকালের কল্পনা কঠিন হবে কেন? এখন তো আজ চলছে, আবার কাল হবে, চিরকাল তাই হয়, তারও আগে গতকাল ছিল, তার আগের দিন ছিল…

এইসময় কাউন্টেসের গলা শোনা গেল, নাতাশা! এবার তোমার পালা। আমাদের কিছু গেয়ে শোনাও। ষড়যন্ত্রকারীদের মতো তোমরা ওখানে বসে আছ কেন?

নাতাশা বলল, মামণি, আমার মোটেই গাইতে ইচ্ছা করছে না। তবু সে উঠে পড়ল।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠল। নিকলাসও অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্ল্যাভিকর্ডে গিয়ে বসল। ডিমলারও অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের সঙ্গে যোগ দিল।

যথারীতি হলের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেখান থেকে গলার স্বর সবচাইতে ভালো খুলবে সেই জায়গাটা বেছে নিয়ে নাতাশা মার প্রিয় গানটা শুরু করল।

সে বলেছিল বটে গান গাইতে তার ইচ্ছা করছে না, কিন্তু সে সন্ধ্যায় যে গান সে গাইল তেমন করে অনেক দিন সে গায়নি, এবং অনাগত অনেক দিনের মধ্যেও তেমন করে গাইতে পারবে বলে মনে হয় না। বুড়ো কাউন্ট পড়ার ঘরে বসেই কান পেতে সে গান শুনল; বার বার তার কাজে ভুল হতে লাগল। নিকলাস বোনের উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারল না। বুড়ি কাউন্টেস শুনতে শুনতে সানন্দ অথচ বিষণ্ণ হাসি হাসতে লাগল, তার দুই চোখে জল এল, মাঝে মাঝে মাথা নাড়তে লাগল।

কাউন্টেসের পাশে বসে ডিমলারও চোখ বুজে গান শুনছিল।

অবশেষে বলল, আহা, কাউন্টেস, এ তো এক ইওরোপিয় প্রতিভা, ওর আর শিখবার কিছু নেই–কী সরসতা, কী কমনীয়তা, আর কী বলিষ্ঠতা…

আহা, ওকে নিয়ে আমার কত যে ভয়, কত যে ভয়! কাকে বলছে খেয়াল না করেই কাউন্টেস কথাগুলি বলল। মায়ের মন দিয়েই সে বুঝতে পেরেছে যে নাতাশার মধ্যে অনেক কিছু আছে, আর সেইজন্যই সে সুখী হতে পারবে না।

নাতাশার গান শেষ হবার আগেই চৌদ্দ বছরের পেতয়া ছুটে এসে জানাল যে কয়েকজন বহুরূপী এসে হাজির হয়েছে।

নাতাশা হঠাৎ থেমে গেল।

মূর্খ! ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কথাটা বলেই নাতাশা দৌড়ে গিয়ে একটা চেয়ারে উপুড় হয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে কান্না থামল না।

ও কিছু নয় মামণি, সত্যি কিছু নয়; কেবল পেতয়া আমাকে চমকে দিয়েছিল,হাসবার চেষ্টা করে নাতাশা বলল, কিন্তু তার চোখ দিয়ে তখনও জল গড়িয়ে পড়ছে, চাপা কান্নায় গলা আটকে আসছে।

বাড়ির ভূমিদাসদেরই কয়েকজন বহুরূপী সেজে এসেছে; ভালুক, তুর্কি, সরাইওয়ালা ও মহিলা সেজে সকলকে ভয় পাইয়ে মজা করতেই তারা এসেছে। প্রথমে সলজ্জ পায়ে নাচ-ঘরে ঢুকে ক্রমে ক্রমে খুশিতে ডগমগ হয়ে তারা নাচতে, গাইতে ও বড়দিনের নানা খেলা খেলতে শুরু করে দিল। একটু পরেই তাদের চিনতে পেরে কাউন্টেস বসার ঘরে চলে গেল। কাউন্ট সেখানে বসে থেকেই অভিনেতাদের বাহবা দিতে লাগল। অল্পবয়সীরা ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে।

আধ ঘণ্টা পরে অন্য বহুরূপীদের সঙ্গে নাচ-ঘরে ঢুকল ফোলানো ঘাঘরা-পরা এক বৃদ্ধা মহিলাসে নিকলাস। পেতয়া সেজেছে তুর্কি মেয়ে। ডিমলার সেজেছে ভাঁড়। নাতাশা সেজেছে হুজার। আর পোড়া কর্কের গোঁফ ও ভুরু লাগিয়ে সোনিয়া সেজেছে সিকাসিয় যুবক।

যারা কিছু সাজেনি তাদের বিস্মিত হতে দেখে, তারা চিনতে না পারায় এবং নানাভাবে প্রশংসা করায় অল্পবয়সীরা ভাবল যে তাদের সাজসজ্জা খুব ভালো হয়েছে, আর তাই অন্যত্রও সেটা দেখানো দরকার।

তখন রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব ভাললা; তাই নিকলাস প্রস্তাব করল, আধাডজন ভূমিদাস-বহুরূপীদের সঙ্গে তাদের সব্বাইকে ত্রয়কায় চাপিয়ে খুডোের বাড়িতে নিয়ে যাবে।

কাউন্টেস বলল, না, বুড়ো মানুষটিকে কেন বিরক্ত করবে। তাছাড়া, সেখানে চলাফেরা করার মতো যথেষ্ট জায়গাও তোমরা পাবে না। যদি যেতেই হয় তো মেলিয়ুকভদের বাড়িতে যাও।

মেলিয়ুকভ বিধবা পরিবারের লোকজন ও তাদের শিক্ষক ও গভর্নের্সদের নিয়ে রস্তভদের বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে বাস করে।

তুমি ঠিক বলেছ গো, বুড়ো কাউন্ট সুরে সুর মেলাল। আমি এখনই পোশাক পরে আসছি। ওদের সঙ্গেই যাব। পাশ-এর চোখ খুলে দিয়ে আসব।

কিন্তু কাউন্টেস তার যাওয়ায় বাধা দিল; গত তিনদিন যাবৎ তার পায়ের ব্যথা চলছে। স্থির হল, কাউন্টের যাওয়া হবে না, আর লুইসা আইভানভনা (মাদাম শোস) তাদের সঙ্গে গেলে তবেই ছোট মেয়েরা মেলিয়ুকভদের বাড়ি যেতে পারবে। সোনিয়াও লুইসা আইভানভনাকে ধরে বসল, সে যেন যেতে আপত্তি না করে।

সোনিয়ার সাজটাই হয়েছে সবচাইতে ভালো। তার গোঁফ ও ভুরু অসম্ভব মানিয়েছে। সকলেই বলছে, তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে; ফলে তার মেজাজও বেশ হাসিখুশি হয়ে উঠেছে।

লুইসা আইভানভনা যেতে রাজি হল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ছোট-বড় ঘণ্টা ঝোলানো চারখানা ত্রয়কা-স্লেজ লোকজনসহ ফটকে এসে হাজির হল।

চারখানার মধ্যে দু-খানা এয়কা বাড়ির সাধারণ স্লেজ; তৃতীয়খানা বুড়ো কাউন্টের নিজস্ব গাড়ি; আর চতুর্থখানা নিকলাসের নিজের গাড়ি। নাতাশা, সোনিয়া, মাদাম শোস ও দুটি দাসী উঠল নিকলাসের স্লেজে; ডিমলার, তার বৌ ও পেতয়া উঠল বুড়ো কাউন্টের স্লেজে, আর বাকি বহুরূপীরা অপর দুটি স্লেজে চেপে বসল।

তুমি এগিয়ে যাও জাখার! নিকলাস বাবার কোচয়ানকে চেঁচিয়ে বলল; তার ইচ্ছা, পিছন থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তাকে মেরে বেরিয়ে যাবে।

চারটে স্লেজ ব্যাংব্যাং শব্দে বরফের উপর দিয়ে ছুটে চলল।

একটা খরগোসের চলার পথ, অনেক পথের দাগ! তুষার-ভেজা বাতাসে নাতাশার গলা ভেসে এল।

কী চমৎকার আলো, নিকলাস! সোনিয়ার গলা শোনা গেল।

নিকলাস মুখ ঘুরিয়ে সোনিয়ার দিকে তাকাল; তার মুখটা আরো ভালো করে দেখবার জন্য মাথাটা নিচু করল। কালো ভুরু ও গোঁফে একখানি নতুন মিষ্টি মুখ যেন চাঁদের আলোয় তার দিকে তাকাল–এত কাছে, অথচ এত দূরে।

এই তো সোনিয়া, নিকলাস তার দিকে তাকিয়ে হাসল।

কি দেখছ নিকলাস?

কিছু না, বলেই নিকলাস আবার ঘোড়ার দিকে মুখ ফেরাল।

নিকলাস প্রথম স্লেজটাকে ধরে ফেলল। পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে নামতে নামতে তারা নদীর ধারে মাঠের ভিতরে একা চওড়া পায়ে-চলা পথে এসে পড়ল।

মনে মনে বলল, আমরা কোথায় এসেছি। মনে হচ্ছে এটাই কসয় মাঠ। কিন্তু না–এটা তো নতুন জায়গা; এটাকে তো আগে কখনো দেখিনি। এটা কসয় মাঠ নয়, দেমকিন পাহাড়ও নয়; ঈশ্বরই শুধু জানেন এটা কি! এটা নতুন এবং মনোমুগ্ধকর। যাকগে, যা হয় হোক… ঘোড়াগুলোর উদ্দেশ্যে হাঁক দিয়ে সে প্রথম স্লেজটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।

ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে জাখার মুখ ফেরাল; সাদা বরফে তার ভুরু পর্যন্ত ঢেকে গেছে।

নিকলাস লাগামে ঢিল দিতেই জাখারও হাত বাড়িয়ে গলায় একটা শব্দ করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

 চেঁচিয়ে বলল, এবার তাকিয়ে দেখুন মনিব!

 দুটো এয়কা পাশাপাশি থেকে আরো দ্রুত ছুটতে লাগল। নিকলাস একটু এগিয়ে যাচ্ছে।

লাগামশুদু একটা হাত তুলে জাখার বলল, না, আপনি পারবেন না মনিব।

নিকলাস সবগুলো ঘোড়াকে জোর কদমে ছুটিয়ে জাখারকে ছাড়িয়ে গেল। ঘোড়ার পা থেকে ছিটকে আসা বরফের টুকরো যাত্রীদের মুখেচোখে লাগতে লাগল।

পুনরায় ঘোড়ায় গতি সংযত করে নিকলাস চারদিকে তাকাল। তারকাখচিত আকাশের নিচে জ্যোৎস্লাবিধৌত রহস্যময় প্রান্তর চারদিকে প্রসারিত।

নিকলাস ভাবল, জাখার বলছে বাঁদিকে যেতে, কিন্তু বাঁদিকে কেন? আমরা কি মেলিয়ুকভদের বাড়ির কাছে এসে গেছি? এটাই কি মেলিয়ুকভকা? ঈশ্বরই জানেন আমরা কোথায় চলেছি, ঈশ্বরই জানেন আমাদের কপালে কি আছে, কিন্তু যাই হোক না কেন জায়গাটা বড় সুন্দর। মুখ ঘুরিয়ে সে স্লেজের ভিতরে চোখ ফেরাল।

সুন্দর ভুরু ও গোঁফওয়ালা অপরিচিত লোকটি বলে উঠল, দেখ, দেখ, ওর গোঁফ ও চোখের পাতা সব একেবারে সাদা হয়ে গেছে!

নিকলাস ভাবল, মনে হচ্ছে এই নাতাশা, আর উনি মাদাম শোস, কিংবা তা নাও হতে পারে; আর এই। গোঁফওয়ালা সির্কাসিয় যুবকটিকে আমি চিনি না, কিন্তু ভালোবাসি।

তোমাদের ঠাণ্ডা লাগছে না তো? সে প্রশ্ন করল।

কেউ জবাব দিল না; হাসলে লাগল। পিছনের স্লেজ থেকে ডিমলার কিছু একটা বলল–হয় তো কোনো মজার কথা–কিন্তু তারা কেউ সেকথায় মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না।

কয়েকজন হেসে বলে উঠল, ঠিক, ঠিক!

নিকলাস ভাবছে, এ তো দেখছি এক রূপকথার অরণ্য; কালো কালো ছায়ারা চলাফেরা করছে, হীরাগুলি ঝিকমিক করছে, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে; রূপকথার বাড়িতে রুপোর ছাদ, আর কতরকম জন্তুর কর্কশ ডাক। আর এটা যদি সত্যি মেলিয়ুকভা হয় তাহলে তো কাহা কাহা মুল্লুক ঘুরে শেষপর্যন্ত আমরা মেলিয়ুকভাতেই পৌঁছে গেছি।

জায়গাটা সত্যি মেলিয়ুকভা; দাস-দাসীরা হাসিমুখে মোমবাতি হাতে নিয়ে ফটকে দাঁড়িয়েছে।

 এরা কারা? কে একজন শুধাল।

কাউন্টের বাড়ি থেকে বহুরূপীরা এসেছে। ঘোড়া দেখেই আমি চিনতে পেরেছি, কে একজন জবাব দিল।

.

 অধ্যায়-১১

পেলাগেয়া দানিলনা মেলিয়ুকভা বেশ শক্তসমর্থ কর্মক্ষম মহিলা; চোখে চশমা। একটা ঢিলে পোশাক পরে মেয়েদের নিয়ে বাইরের ঘরে বসে ছিল। মেয়েরা চুপচাপ বসে মোম গলিয়ে বরফের উপর ফোঁটা ফেলছিল এবং দেয়ালের উপর তার ছায়াগুলি দেখছিল। এমন সময় বারান্দার নবাগতদের পায়ের শব্দ ও গলার স্বর তাদের কানে এল।

অশ্বারোহী, মহিলা, ডাইনি, ভাড় ও ভালুকের দল মুখ থেকে বরফের টুকরো ঝেড়ে ফেলে গলা খাকারি দিয়ে বসার ঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি সবগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। ভাড়-ডিমলার-একটি মহিলা–নিকলাস-সকলেই নাচতে শুরু করে দিল। ছোট ছেলেমেয়েরা চেঁচামেচি শুরু করে দিল; বহুরূপীরা মুখ ঢেকে, গলার স্বর পাল্টে ফেলে গৃহকত্রীকে অভিবাদন জানাতে জানাতে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী ব্যাপার! কাউকে যে চিনতেই পারা যাচ্ছে না! আরে নাতাশা! দেখ, ওকে যেন কার মতো দেখাচ্ছে। সত্যি, ওকে দেখে আমার যেন কার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু হের ডিমলার-ইনিও ভালো সেজেছেন! আমি একে চিনি না! আর কী সুন্দর নাচছেন! আর, এ যে এক সির্কাসিয় যুবক। সত্যি, সোনিয়াকে কী সুন্দর মানিয়েছে। আর ও কে? খুব আনন্দ দিলে আমাদের। নিকিতা ও ভানিয়া-টেবিলটা পরিষ্কার করে ফেল। আরে, আমরা এত চুপচাপ কেন? হা, হা, হা!….হুজার, হুজার। ঠিক যেন একটি ছেলে। আর পা গুলি!…আমি তো তার দিকে তাকাতেই পারছি না… নানাজনে নানা মন্তব্য করতে লাগল।

যুবক মেলিয়ুকভের প্রিয়জন নাতাশা সকলকে নিয়ে পিছনের ঘরে চলে গেল। সেখানে নানারকম ড্রেসিং গাউন ও পুরুষের পোশাক আনা হল। দশ মিনিট পরে মেলিয়ুকভ পরিবারের ছেলেমেয়েরাও এসে বহুরূপীদের দলে যোগ দিল। অতিথিদের জন্য ঘরগুলো পরিষ্কার করে দেবার এবং সকলের জন্য জলযোগের ব্যবস্থা করার হুকুম দিয়ে পেলাগেয়া দানিলভনা চশমা না খুলেই বহুরূপীদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল; চাপা হাসির সঙ্গে তাদের মুখের উপর তীক্ষ্ণ নজর দিয়েও তাদের কাউকেই চিনতে পারল না। শুধু যে ডিমলার ও রস্তভদের চিনতে পারল না তাই নয়, নিজের মেয়েদের এবং পরলোকগত স্বামীর ড্রেসিং-গাউন ও সামরিক পরিচ্ছদ পর্যন্ত চিনতে পারল না।

একটি মেয়ে কাজান-তাতারের সাজে সেজেছে; তার মুখের দিকে নজর করে মহিলা গভর্নেন্সকে শুধাল, এটি কে? আমার তো মনে হয় রস্তভদের বাড়ির কেউ হবে! আচ্ছা, মি. হুজার, তুমি কোন্ রেজিমেন্টে আছ? সে নাতাশাকে শুধাল। খাদ্য পরিবেশনরত খানসামাকে বলল, এখানে, এই তুর্কিকে খানিকটা ফলের জেলি দাও। ওদের আইনে ওটা নিষিদ্ধ নয়।

তারপর হাসতে হাসতে বলল, আমার ছোট সাশা! সাশাকে দেখ!

রুশ পল্লী-নৃত্য ও সমবেত নৃত্যের পরে পেলাগেয়া দানিলভনা ভূমিদাস ও দ্রজনদের একসঙ্গে গোল করে দাঁড় করিয়ে দিল : একটা চাকা, একটুকরো দড়ি ও একটা রৌপ্য রুবল আনিয়ে দেবার পরে সকলে একসঙ্গে খেলা শুরু করল।

 এক ঘণ্টার মধ্যেই সাজপোশাকগুলি এলোমেলো হয়ে পড়ল, পোড়া কর্ক লাগানো ভুরু ও গোঁফ ঘামে গলে যেতে লাগল। তখন পেলাগেয়া দানিলভনা বহুরূপীদের চিনতে পারল, তাদের বহুরূপী সাজার কৌশলের প্রশংসা করল, এবং এমন সুন্দরভাবে সকলকে আনন্দ দেবার জন্য ধন্যবাদ জানাল। অতিথিদের বসার ঘরে নৈশ-ভোজে আমন্ত্রণ করা হল, আর ভূমিদাসদের খাবার দেওয়া হল নাচ-ঘরে।  

খাবার সময় মেলিয়ুকভদের এক বুড়ি দাসী বলল, জনশূন্য স্নান-ঘরে কারো ভাগ্য বলে দেওয়াটা খুব ভয়ের ব্যাপার।

মেলিয়ুভকদের বড় মেয়ে শুধাল, কেন?

তোমরা যেতেই চাইবে না, খুব সাহস থাকা দরকার…

আমি যাব, সোনিয়া বলল।

 মেজ মেয়ে বলল, সেই তরুণীটির কি হল তা বল!

দাসী বলতে লাগল, একবার এক তরুণী বাইরে গিয়ে একটা মোরগ ধরে এনে দুজনের মতো একটা টেবিল পেতে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে হঠাৎ সে শুনতে পেল কে যেন আসছে…ঘণ্টার শব্দ করতে করতে একটা স্লেজ এসে দাঁড়াল; একজনের পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ঠিক পুরুষের আকৃতিতে, ঠিক একজন অফিসারের মতো সে ভিতরে এল-ভিতরে এসে টেবিলে বসল।

ভয়ে চোখ গোল-গোল করে নাতাশ চেঁচিয়ে উঠল, আ! আ!

সত্যি? কেমন করে…সে কি কথা বলল?

হ্যাঁ, ঠিক মানুষের মতো। সব ঠিকঠাক চলতে লাগল; লোকটি তাকে প্রভাবিত করতে লাগল; তরুণীটির উচিত ছিল মোরগ ডাকা পর্যন্ত লোকটিকে দিয়ে কথা বলানো, কিন্তু সে ভয় পেয়ে গেল, ভয় পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকল। আর তখনি সে তরুণীটিকে জড়িয়ে ধরল। ভাগ্য ভালো ঠিক সেই সময় দাসীরা সব ছুটে এল…

পেলাগেয়া দানিলভনা বলল, কেন ওদের ভয় দেখাচ্ছে?

 মেয়ে বলল, মামণি, তুমিও তো ভাগ্য জানবার চেষ্টা করেছ… ।

সোনিয়া শুধাল, আচ্ছা, গোলাবাড়িতে এ কাজটা কিভাবে করা হয়?

এই ধর না, তুমি গোলাবাড়িতে গিয়ে কান পাতলে। তুমি কি শুনতে পাও তার উপরেই সবকিছু নির্ভর করে; হাতুড়ির শব্দ ও দরজার ধাক্কার শব্দ যদি শোন-সেটা খারাপ; ফসল চালার শব্দ শোনাটা ভালো; অনেকসময় তাও শোনা যায়।

মামণি, গোলাবাড়িতে তোমার কি ঘটেছিল আমাদের বল।

পেলাগেয়া দানিলভনা হাসল।

আরে, সেসব ভুলেই গেছি।…কিন্তু তোমরা কেউ সেখানে যাবে না তো?

হ্যাঁ, আমি যাব পেলাগেয়া দানিলনা। আমাকে যেতে দিন। আমি যাব। সোনিয়া বলল।

 বেশ তো, তুমি যদি ভয় না পাও…

লুইসা আইভানভনা, আমিও যেতে পারি কি? সোনিয়া শুধাল।

খেলা-ধূলা যখন যাই চলতে থাকুক, নিকলাস কিন্তু সোনিয়ার সঙ্গ ছাড়ল না; একটা নতুন চোখে তাকে দেখতে লাগল। তার মনে হল, পোড়া কর্কের গোঁফকে ধন্যবাদ, এই প্রথম সে সোনিয়াকে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে। সত্যি, সেদিন সন্ধ্যায় সোনিয়াকে যত উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ও সুন্দরী, দেখাচ্ছিল তেমনটি নিকলাস আগে কখনো দেখেনি।

সোনিয়ার চোখ দুটি ঝলমল করছে, গোঁফের নিচে ঠোঁট দুটির উচ্ছ্বসিত হাসির ফলে দুই গালে টোল পড়েছে; এমন হাসি সে আগে কখনো দেখেনি। তার দিকে তাকিয়ে নিকলাস ভাবল, এই তো তার আসল রূপ; এতদিন আমি কী বোকাই ছিলাম!

সোনিয়া বলল, আমি কোনো কিছুতেই ভয় পাই না। আমি কি এখনই যেতে পারি? সে উঠে দাঁড়াল।

তারা বলে দিল, গোলাবাড়িটা কোথায়, কেমন করে তাকে কান পেতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, এবং একটা লোমের জোব্বা তার হাতে তুলে দিল। জোব্বাটা মাথা ও কাঁধের উপর ফেলে সে নিকলাসের দিকে তাকাল।

নিকলাস ভাবল, আহা, মেয়েটি কত আপন! অথচ আজ পর্যন্ত আমি কী ধারণা নিয়েই না ছিলাম?

গোলাবাড়িতে যাবার জন্য সোনিয়া বারান্দায় গেল। নিকলাসও তাড়াতাড়ি সামনের ফটকে চলে গেল; বলল, ঘরের মধ্যে বড়ই গরম লাগছে। ভিড়ের জন্য ঘরটা সত্যি গুমোট হয়ে উঠেছে।

বাইরে সেই একই শান্ত নিস্তব্ধতা, সেই একই চাঁদ, বুঝি বা আগের চাইতে উজ্জ্বলতর। আলো এত বেশি এবং তারার আলো পড়ে বরফ এত বেশি ঝিকমিক করছে যে আকাশের দিকে তাকাতে কারো ইচ্ছা করছে না; সত্যিকারের তারাগুলো কারো চোখে পড়ছে না। আকাশ কালো ও বিষণ্ণ, অথচ পৃথিবী আনন্দময়।

আমি বোকা! বোকা! কিসের জন্য অপেক্ষা করে আছি। নিকলাস ভাবল। ফটক থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে বাড়িটা ঘুরে সে খিড়কির ফটকে চলে গেল। সে জানত, সোনিয়া এই পথেই যাবে।

খিড়কির ফটক থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামবার হাল্কা পায়ের শব্দ এল। একেবারে নিচের ধাপে বরফ জমেছিল; তার উপর পা পড়ে মচমচ শব্দ হল। সে শুনতে পেল বুড়ি দাসীটা বলছে, সোজা, সোজা পথ ধরে মিস। শুধু পিছন ফিরে তাকিও না।

আমি ভয় পাইনি, সোনিয়া জবাব দিল; পায়ের হাল্কা জুতোর আওয়াজ তুলে সোনিয়া নিকলাসের দিকেই এগিয়ে আসছে।

সোনিয়ার শরীর জোব্বায় ঢাকা। মাত্র দু-পা দূর থেকে সে নিকলাসকে দেখতে পেল; তারও মনে হল যে নিকলাসকে সে চিনত, যাকে সব সময়ই একটু ভয় করত, এ সে নিকলাস নয়। তার পরনে মেয়েদের পোশাক, চুলে বেণি বাধা, মুখে ঈষৎ হাসি। সোনিয়ার কাছে এ সবই নতুন। সে দ্রুত নিকলাসের দিকে এগিয়ে গেল।

চাঁদের আলো পড়েছে সোনিয়ার সারা মুখে; সে মুখ দেখে নিকলাস ভাবল, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অথচ সেই এক। সোনিয়ার জোব্বার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে নিকলাস তাকে জড়িয়ে ধরল, কাছে টেনে নিল, তার ঠোঁটে চুমো খেল; তার গোঁফে পোড়া কর্কের গন্ধ। সোনিয়াও নিকলাসের ঠোঁট ভরে চুমো খেল, ছোট হাত দু-খানি বের করে নিকলাসের গালের উপর চেপে ধরল।

সোনিয়া!…নিকলাস!…তাদের মুখে শুধু এই দুটি নামই উচ্চারিত হল। তারা গোলাবাড়িতে ছুটে গেল, আবার ফিরে এল; একজন বাড়িতে ঢুকল সামনের ফটক দিয়ে, আর একজন ঢুকল খিড়কির ফটক দিয়ে।

.

অধ্যায়১২

সবসময় সবকিছুর উপর নাতাশার নজর থাকে। তাই পেলাগেয়া দানিলভনার বাড়ি থেকে ফিরবার পথে ব্যবস্থা করল যে সে নিজে ও মাদাম শোস ফিরবে ডিমলারের সঙ্গে একটা স্লেজে, আর অন্য দাসীদের নিয়ে সোনিয়া ও নিকলাস ফিরবে অন্য স্লেজে।

ফিরবার সময় খুব জোরে না চালিয়ে নিকলাস ধীরেসুস্থে গাড়ি চালাতে লাগল, আর বার বার সেই সব ভুলানো আশ্চর্য আলোয় সোনিয়ার মুখের দিকে তাকাতে লাগল এবং ভুরু ও গোঁফের অন্তরালবর্তী সেই সোনিয়াকে খুঁজতে লাগল যার কাছ থেকে আর কোনো দিন সে দূরে সরে যাবে না বলে মনস্থির করে ফেলেছে। দেখতে দেখতে একসময় সে পুরনো ও নতুন দুই সোনিয়াকেই চিনতে পারল, এবং পোড়া কর্কের গন্ধে চুম্বনের পুলকানুভূতির কথা মনে পড়ায় তুষার-ভেজা বাতাসকে বুক ভরে টেনে নিল; পায়ের নিচের অপসৃয়মান মাটি ও মাথার উপরকার ঝকমকে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল আবার সে রূপকথার দেশে ফিরে এসেছে।

মাঝে মাঝেই জিজ্ঞাসা করতে লাগল, সোনিয়া, তুমি ভালো আছ?

হ্যাঁ; আর তুমি? সোনিয়া শুধাল।

বাড়ির অর্ধেক পথে পৌঁছে লাগামটা কোচয়ানের হাতে দিয়ে নিকলাস একমুহূর্তের জন্য ছুটে গিয়ে নাতাশার স্লেজের পাশে দাঁড়াল। ফরাসিতে ফিসফিস করে বলল, নাতাশা! তুমি কি জান যে সোনিয়ার ব্যাপারে আমি মনস্থির করে ফেলেছি!

আনন্দে উল্লসিত হয়ে নাতাশা জানতে চাইল, ওকে বলেছ কি?

আঃ, ওই গোঁফ ও ভুরুতে তোমাকে কিরকম অদ্ভুত দেখাচ্ছে!…নাতাশা-তুমি খুশি হয়েছ?

 খুব, খুব খুশি হয়েছি! তোমাকে নিয়ে আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তোমাকে বলিনি, কিন্তু ওর সঙ্গে তুমি খারাপ ব্যবহার করছিলে। নিকলাস, কী অন্তর ওর! সোনিয়া সুখী নয়, অথচ আমি সুখী, এতে মাঝে মাঝে আমি খুব লজ্জা বোধ করতাম। এখন আমি কত খুশি হলাম! যাও, ওর কাছে ছুটে যাও।

না, একটু সবুর কর…আঃ, তোমাকে কী মজার দেখাচ্ছে! নিকলাস চেঁচিয়ে বলল; বোনের মুখে আজ সে এমনকিছু নতুন, অস্বাভাবিক ও আকর্ষণীয় দেখতে পেয়েছে যা আগে কখনো দেখেনি। নাতাশা, এ যে যাদুর খেলা, তাই নয়?

নাতাশা জবাব দিল, হ্যাঁ। তুমি চমৎকার খেলা দেখিয়েছ।

নিকলাস ভাবল, এই মূর্তিতে ওকে যদি আগে দেখতে পেতাম তাহলে অনেক আগেই ওকে জিজ্ঞাসা করতাম আমার কি করা উচিত, আর ও যা বলত আমি তাই করতাম, তাতে সকলেরই ভালো হত।

তাহলে তুমি খুশি হয়েছ? আমি ঠিক কাজই করেছি?

এক্কেবারে ঠিক! কিছুদিন আগে এ নিয়ে মামণির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। মামণি বলেছিল, ও তোমাকে খেলাচ্ছে। মামণি যে কেমন করে একথা বলতে পারল! আমি তো মামণির উপর রাগে একেবারে ফেটে পড়েছিলাম। সোনিয়ার সম্পর্কে কেউ খারাপ কিছু বললে আমি তা সহ্য করব না, কারণ ওর মধ্যে খারাপ কিছুই নেই।

তাহলে তো সব ঠিকই হয়েছে। এই বলে সে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। তার পায়ের নিচে বরফ মচমচ করে উঠল। একদৌড়ে স্লেজে গিয়ে উঠল। সির্কাসিয় যুবকটি গোঁফ নাচিয়ে তেমনই হাসছে; ওড়নার নিচ থেকে চোখ দুটো তেমনই জ্বলছে; ঐ সির্কাসিয় যুবকই তো সোনিয়া, আর ওই সোনিয়াই তো তার সুখী ও প্রেমিময়ী ভাবী স্ত্রী। বাড়িতে পৌঁছে মেলিয়ুকভদের বাড়িতে কিরকম কাটিয়েছে সেকথা মাকে বলে মেয়েরা তাদের শোবার ঘরে চলে গেল। পোশাক খুলল, কিন্তু কর্কের গোঁফ তখনই ধুয়ে ফেলল না; বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের সুখের কথাই বলতে লাগল। বিয়ের পরে তারা কিভাবে চলবে, তাদের স্বামীদের মধ্যে কিরকম বন্ধুত্ব হবে, তারা কত সুখী হবে-তাই নিয়েই যত কথা। নাতাশার টেবিলে দুটো আয়না রাখা ছিল; দুনিয়াশা আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

আয়নার কাছে যেতে যেতে নাতাশা বলল, সেদিন যে কবে আসবে? আমার তো ভয় হয় কোনোদিন আসবে না…এত ভালো কি সইবে!

বসে পড় নাতাশা; হয় তো তাকেই দেখতে পাবে, সোনিয়া বলল।

আয়নার প্রত্যেক দিকে একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে নাতাশা সেটার সামনে বসল।

নিজের মুখটা দেখতে পেয়ে বলল, আমি তো গোঁফওয়ালা একজনকে দেখছি।

দুনিয়াশা বলল, হেসো না মিস।

অনেকরকম করে তাকিয়েও কিছু না দেখতে পেয়ে নাতাশা চোখ মিট মিট করে আয়নার কাছ থেকে সরে গেল।

বলল, অন্যরা দেখতে পায়, অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? তুমি বস সোনিয়া। আজ রাতে তোমাকে বসতেই হবে! অন্তত আমার খাতিরে….আজ আমার বড় ভয় করছে!

সোনিয়া আয়নার সামনে গিয়ে বসল; ঠিক জায়গামতো বসে তাকাতে লাগল।

দুনিয়াশা ফিসফিসিয়ে বলল, এবার মিস সোনিয়া নিশ্চয় কিছু দেখতে পাবে। আর তুমি তো খালি হাসতেই পার।

সোনিয়া এ কথাটা শুনতে পেল। নাতাশার ফিসফিস কথাও তার কানে এল :

আমি জানি সে দেখতে পাবে। গতবছরও সে কিছু দেখেছিল।

প্রায় তিন মিনিট সকলেই চুপচাপ।

ও নিশ্চয় দেখতে পাবে! নাতাশা ফিসফিস করে বলল, কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না… সহসা হাতের আয়নাটা সরিয়ে রেখে সোনিয়া দুই হাতে চোখ ঢেকে ফেলল।

ওঃ নাতাশা! সে কেঁদে ফেলল।

আয়নাটা তুলে নিয়ে নাতাশা বলে উঠল, দেখতে পেয়েছ? দেখতে পেয়েছ? কি দেখলে?

সোনিয়া কিছুই দেখতে পায়নি। সেও চোখ মিটমিট করতে চাইল, কিন্তু দুনিয়াশা বা নাতাশা কাউকেই সে হতাশ করতে চায়নি, অথচ এভাবে চুপচাপ বসে থাকাও শক্ত। চোখ দুটো ঢাকবার সময় কেন যে সে চেঁচিয়ে ওঠেনি তা সে নিজেই জানে না।

তার হাতটা চেপে ধরে নাতাশা শুধাল, তাকে দেখেছ

হ্যাঁ, একটু সবুর কর…আমি…তাকে দেখেছি, সোনিয়া কথাটা না বলে পারল না, যদিও তাকে বলতে নাতাশা কাকে বুঝিয়েছে-নিকলাসকে, না প্রিন্স আন্দ্রুকে-তাও সে এখনো জানে না।

কিন্তু কেন আমি বলব না যে কিছু দেখেছি। অন্যরা তো দেখতে পায়! তাছাড়া, আমি কিছু দেখেছি কি দেখিনি তাই বা কে বলতে পারে? এই সব কথাই সোনিয়ার মনের সামনে ভাসতে লাগল।

হ্যাঁ, আমি তাকে দেখেছি, সোনিয়া বলল।

 কেমন দেখলে? বসা, না শোয়া?

না, আমি দেখলাম…প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না, তারপর দেখলাম সে শুয়ে আছে।

 আন্দ্রু শুয়ে আছে? সে কি অসুস্থ? ভয়ার্ত দুটি চোখ বন্ধুর মুখের উপর রেখে নাতাশা শুধাল।

 না, না, ঠিক উল্টো, ঠিক উল্টো! তার মুখটা প্রফুল্ল, আমার দিকে ফিরে তাকাল।কথাগুলো বলতে গিয়ে তার কেমন যেন মনে হল সে যা বলছে সত্যি সত্যি তাই দেখেছে।

তারপর সোনিয়া… ?

তারপর কি যে দেখলাম বুঝতেই পারলাম না, কিছু নীল, লাল…

সোনিয়া! সে কবে ফিরে আসবে? কবে তাকে দেখতে পাব? হে ঈশ্বর, তাকে নিয়ে আমাকে নিয়ে, সবকিছু নিয়েই যে আমার ভয়ের অন্ত নেই!…. নাতাশা বলতে লাগল, সোনিয়ার সান্ত্বনার কথার কোনো জবাব না দিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল, মোমবাতিটা নিভিয়ে দেবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ শুয়ে থেকে তুষার-ঢাকা জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে চাঁদের আলোর দিকে খোলা চোখে তাকিয়ে রইল।

.

অধ্যায়-১৩

বড়দিনের ছুটির কিছুদিন পরেই সোনিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা এবং তাকে বিয়ে করার দৃঢ়সংকল্পের কথা নিকলাস মাকে জানাল। কাউন্টেস অনেকদিন ধরেই তাদের ব্যাপার লক্ষ্য করেছে এবং এইরকম একটা ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করেই ছিল, সে ছেলেকে জানিয়ে দিল, যাকে খুশি সে বিয়ে করতে পারে, তবে সে নিজে বা নিকলাসের বাবা এ বিয়েতে আশীর্বাদ জানাবে না। প্রথমে নিকলাসের মনে হল মা তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং তাকে যত ভালোই বাসুক কিছুতেই নিজের মত পাল্টাবে না। অত্যন্ত নির্বিকারভাবে ছেলের দিকে একবারও না তাকিয়ে সে স্বামীকে ডেকে পাঠাল এবং স্বামী এলে ছেলের সামনেই সবকথা তাকে সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু নিজেকে সংযত রাখতে না পেলে বিরক্তিতে কেঁদে ফেলে ঘর থেকে চলে গেল। বুড়ো কাউন্ট নিকলাসকে বকুনি দিয়ে এই সংকল্প ত্যাগ করতে বলল। নিকলাস জবাবে জানাল, সে কথার খেলাপ করতে পারবে না, তখন বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল, তারপর কাউন্টেসের কাছে চলে গেল। ছেলের সঙ্গে যখনই কোনো বাদ-বিসম্বাদ দেখা দেয় তখনই বুড়ো কাউন্ট নিজের দোষ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, কারণ তার হাতেই তো পারিবারিক সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, কাজেই একটি ধনী কন্যাকে বিয়ে না করে ছেলে যদি যৌতুকহীনা সোনিয়াকে পছন্দ করে তো সেজন্য তার প্রতি সে রাগ করতে পারে না। এক্ষেত্রে তো কাউন্ট আরো বেশি সচেতন যে তার বৈষয়িক অবস্থায় এই গোলযোগ দেখা না দিলে নিকলাসের জন্য সোনিয়ার চাইতে ভালো মেয়ের কথা তো তারা ভাবতই না, আর পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্গতির জন্য তো সে নিজেই দোষী।

বাবা-মা কেউই আর এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে কোনো কথা বলল না, কিন্তু কয়েকদিন পরেই কাউন্টেস সোনিয়াকে ডেকে পাঠাল এবং অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এই বলে তাকে বকতে লাগল যে সোনিয়াই নিকলাসকে ধরবার জন্য জাল পেতেছে, পরিবারের প্রতি সে অকৃতজ্ঞ। সোনিয়া নীরবে আনত চোখে কাউন্টেসের নিষ্ঠুর কথাগুলি শুনল, কিন্তু সে যে কি করবে তা বুঝে উঠতে পারল না। যারা তার উপকার করেছে তাদের জন্য সবকিছু ছাড়তে সে প্রস্তুত। আত্মত্যাগই তো তার চিরদিনের আদর্শ, কিন্তু এক্ষেত্রে সে বুঝতে পারছে না কি ত্যাগ করবে, কার জন্য ত্যাগ করবে। কাউন্টেসকে, গোটা রস্ত পরিবারকে সে ভালো না বেসে পারে না, আবার নিকলাসকে ভালো না বেসেও তো তার উপায় নেই, সে তো জানে এই ভালোবাসার উপরেই নির্ভর করছে নিকলাসের সব সুখ। বিষণ্ণ চিত্তে সে চুপ করে রইল, কথা বলল না। এই অসহ্য অবস্থার একটা বোঝাঁপড়া করতে নিকলাস মার সঙ্গে দেখা করতে গেল। প্রথমে তাকে ও সোনিয়াকে ক্ষমা করে এ বিয়েতে সম্মতি জানাতে অনুরোধ করল, তারপর ভয় দেখিয়ে বলল, মা যদি সোনিয়ার উপর অত্যাচার করে তাহলে সে এক্ষুণি গোপনে সানিয়াকে বিয়ে করবে।

কাউন্টেস নির্বিকার গলায় বলল, তার বয়স হয়েছে, প্রিন্স আন্দ্রু যেমন বাবার মত ছাড়াই বিয়ে করছে তেমনই সেও তাই করতে পারে, কিন্তু কাউন্টেস কখনো সেই ষড়যন্ত্রকারিণীকে মেয়ে বলে গ্রহণ করবে না।

ষড়যন্ত্রকারিণী কথাটা শুনেই নিকলাস রাগে ফেটে পড়ল, গলা চড়িয়ে বলল, সে কখনো ভাবতে পারেনি যে মা তাকে ভালোবাসা বিক্রি করতে বাধ্য করবে, আর তাই যদি হয় তাহলে এই শেষবারের মতো সে বলে দিচ্ছে..কিন্তু তার মুখের যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মা সভয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, যার স্মৃতি চিরদিনের মতো দুই জনের কাছেই এক নিষ্ঠুর স্মৃতি হয়ে থাকত, সেকথা বলার সময় তার হল না। সময় হল না তার কারণ বিবর্ণ কঠিন মুখে নাতাশা ঘরে ঢুকল। দরজায় দাঁড়িয়ে সে সবই শুনেছে।

নিকলাস, তুমি বাজে বক! শান্ত হও, শান্ত হও, আমি বলছি শান্ত হও!… নিকলাসের গলা ছাপিয়ে নাতাশা আর্তকণ্ঠে বলে উঠল।

মাকে বলল, মামণি, লক্ষ্মীটি, ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়…মিষ্টি মামণি আমার। মা বুঝতে পারছিল যে তারা বিচ্ছেদের একেবারে তীরে এসে দাঁড়িয়েছে, তাই সভয়ে সে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ মনে মনে সেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে কিছুতেই হার মানবে না।

নাতাশা বলল, নিকলাস, পরে সব তোমাকে বুঝিয়ে বলব। এখন চলে যাও! শোন মামণি সোনা।

নাতাশার কথাগুলি অসংলগ্ন হলেও তার উদ্দেশ্য সফল হল।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাউন্টেস মেয়ের বুকে মুখ লুকাল, আর নিকলাস মাথাটা চেপে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নাতাশা একটা মিটমাটের চেষ্টায় লেগে গেল এবং এতটা পর্যন্ত করতে পারল যে, মা নিকলাসকে কথা দিল সোনিয়ার উপর কোনোরকম অত্যাচার করা হবে না, আর নিকলাসও কথা দিল যে বাবা-মার অজ্ঞাতসারে সে কিছু করবে না।

.

রেজিমেন্টে নিজের ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করবে এবং বাড়ি ফিরে সোনিয়াকে বিয়ে করবে–এই দৃঢ়সংকল্প নিয়ে বাবা-মার সঙ্গে মতান্তরের জন্য দুঃখিত ও গম্ভীর চিত্তে নিকলাস জানুয়ারির গোড়ার দিকেই রেজিমেন্টে যোগ দিতে চলে গেল।

নিকলাস চলে যাবার পর থেকে রস্ত পরিবারের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠল, মানসিক উত্তেজনার ফলে কাউন্টেস অসুস্থ হয়ে পড়ল।

নিকলাসের বিরহে সোনিয়ার মনে সুখ নেই, তার উপরে কাউন্টেসের গলার স্বর তার ব্যাপারে মোটেই নরম হয়নি। বিষয়সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে কাউন্ট আগের থেকেও বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছে, যাহোক একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। মস্কোর নিকটবর্তী শহরের বাড়ি ও সম্পত্তি বেচে দেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে, আর সেজন্য তাদের মস্কো যেতেই হবে। কিন্তু কাউন্টেসের স্বাস্থ্যের জন্য দিনের পর দিন তাদের যাত্রা পিছিয়ে যেতে লাগল।

প্রথম দিকে বাগদত্তা স্বামীর বিরহকে নাতাশা কিছুটা হাল্কাভাবে হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিল, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই সে উত্তেজিত ও অধৈর্য হয়ে উঠছে। জীবনের যে শ্রেষ্ঠ দিনগুলিকে সে স্বামীর ভালোবাসায় কাটিয়ে দিতে পারত, বৃথাই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে-এই চিন্তাই তাকে অহরহ যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার চিঠি পেলেও নাতাশা বিরক্ত হয়ে ওঠে। একথা ভাবতেও তার কষ্ট হয় যে সে যখন স্বামীর চিন্তাকে সম্বল করেই বেঁচে আছে তখন তার স্বামী সত্যিকারের জীবন কাটাচ্ছে, নতুন নতুন জায়গা দেখছে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশছে। চিঠিগুলি যত বেশি মজাদার হয় ততই সে অধিকতর বিরক্তি বোধ করে। স্বামীর চিঠি তাকে সান্ত্বনা তো দেয়ই না, পরন্তু সেগুলিকে তার মনে হয় ক্লান্তিকর ও কৃত্রিম এক দায়ভাগ। সে চিঠিপত্রও লিখতে পারে না, কারণ কথায়, হাসিতে ও চাউনিতে যা সে প্রকাশ করতে পারে তার হাজার ভাগের একভাগও চিঠিতে প্রকাশ করার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। সে তাকে লেখে একঘেয়ে, শুকনো, প্রথামাফিক চিঠি, সে চিঠির উপর সে নিজেই কোনো গুরুত্ব দেয় না, তার চিঠির খসড়াতে যেসব বানান ভুল থাকে কাউন্টেসই সেগুলো শুধরে দেয়।

কাউন্টেসের স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতিই হল না, অথচ মস্কো যাত্রা আর পিছিয়ে দেওয়া চলে না। নাতাশার বিয়ের পোশাক তৈরি করতে দেওয়া হবে, বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে হবে। তাছাড়া, বুড়ো প্রিন্স বলকনস্কি মস্কোতেই শীতকালটা কাটাচ্ছে, কাজেই প্রিন্স আন্দ্রুরও সেখানেই থাকবার কথা, নাতাশার নিশ্চিত বিশ্বাস, এর মধ্যেই সে এসে গেছে।

কাজেই কাউন্টেস দেশের বাড়িতে রয়ে গেল, আর সোনিয়া ও নাতাশাকে সঙ্গে নিয়ে জানুয়ারির শেষ দিকে কাউন্ট মস্কো চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *