১. আর কত ঘুমাবি

থ্রি টেন এএম
জনপ্রিয় ‘হেনরি বিনস সিরিজ’-এর দ্বিতীয় বই
মূল : নিক পিরোগ / অনুবাদ : সালমান হক

অনুবাদকের কথা

ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে পাওয়ার সাথে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। থ্রি এএম যখন অনুবাদ করছিলাম তখনও জানতাম না বইটার কাজ আদৌ শেষ করতে পারবো কিনা। কিন্তু একজন গৃলারভক্ত হিসেবে বইটা পড়ার পর মনে হয়েছিল, বাঙলা ভাষাভাষি গ্লারপ্রেমিদের সাথে সিরিজটার পরিচয় না করালেই নয়। আমার ওপর আস্থা রাখার জন্যে লেখক, অনুবাদক এবং বাতিঘর প্রকাশনীর প্রকাশক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনভাইকে ধন্যবাদ। আর সৈয়দ মোহাম্মদ রেজওয়ান ভাইয়াকে ধন্যবাদ আমাকে ক্রমাগত উৎসাহ দেয়ার জন্যে।

সবশেষে পাঠক, ধন্যবাদটা আপনাদেরই প্রাপ্য বইটি সাদরে গ্রহণ করার জন্যে। সবাই ভালো থাকবেন।

সালমান হক
ঢাকা,
১৪/০৪/২০১৬

.

উৎসর্গ :
মিতুন দাদাকে…

.

অধ্যায় ১

“উঠে পড়, আর কত ঘুমাবি?”

এক চোখ খুলল ল্যাসি, তারপর মাথাটা আস্তে করে দুলিয়ে আবার আমার বুকের উপর শুয়ে পড়ল। ওর নাকের কাছে কী যেন একটা লেগে আছে। এক হাত দিয়ে মুছে দিলাম জায়গাটা।

“আরে ব্যাটা, আমাদের তো অনেক কাজ পড়ে আছে। এখন ঘুমালে চলবে?”

মিয়াও।

“আরো দশ মিনিট ঘুমাতে দেব?! কিন্তু গত তেইশ ঘন্টা ধরেই তো ঘুমাচ্ছি আমরা।”

আসলে আমি নিজে গত তেইশ ঘন্টা ধরে ঘুমাচ্ছিলাম, এই সময়ে ল্যাসি কি করেছে সেটা বলা আমার জন্য একটু মুশকিলই। কিন্তু ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না এই তেইশ ঘন্টা আমার বুকের উপর থেকে একচুলও নড়েছে ব্যাটা।

ওকে হাত দিয়ে বুকের উপর থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার পাশের ঘড়িটার দিকে নজর গেল আমার। আজকের জন্য বরাদ্দ সময় থেকে। এক মিনিট এরইমধ্যে চলে গেছে।

বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ইনগ্রিডের মেসেজটা পড়লাম। আজকে ও আসতে পারবে না। মাত্রই একটা খুনের তদন্তের কাজ শেষ করেছে, খুব ক্লান্ত এখন। আজকের দিনটা বাসায় একটু বিশ্রাম নেবে, তবে কালকে নাকি অবশ্যই আসবে আমার বাসায়।

কাল অক্টোবরের সাত তারিখ। আমার আর ইনগ্রিডের সম্পর্কটার ছয় মাস পূর্ণ হবে।

মাত্র দু-দিন আগেই দেখা করেছিলাম আমরা, তারপরও আমার কাছে মনে হচ্ছে কত যুগ ধরে ওর চেহারাটা দেখি না। আমি ভাবছি ওকে বলবো একেবারে আমার বাসায় চলে আসতে। দু-মাস আগেই আমার অ্যাপার্টমেন্টের একটা বাড়তি চাবি বানিয়ে ওকে দিয়ে দিয়েছি, তাই আমি ঘুমিয়ে থাকলেও সপ্তাহে এক-দুবার সে যখন আসে তখন ভেতরে ঢুকতে কোন সমস্যা হয় না।

কিন্তু এই দু-এক ঘন্টায় আমার পোষায় না। আমি তাকে সপ্তাহে পুরো সাতঘন্টার জন্যেই চাই।

রান্নাঘরে গিয়ে ইসাবেল আমার জন্যে যে নাস্তার বাটিটা তৈরি করে রেখে গেছে সেটা ফ্রিজ থেকে বের করলাম। ইসাবেল খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। তার আরেকটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে, সে সবসময় চেষ্টা করে ছোটোখাটো এমন কিছু করে রাখতে যাতে আমার সময় কিছুটা হলেও বেঁচে যায়। এই যেমন ঘুম থেকে উঠে দেখবো, ব্রাশটায় টুথপেস্ট লাগানোই আছে কিংবা আমার দৌড়ানোর জুতো আর হেডফোনটা দরজার পাশের টেবিলে সুন্দমত গুছিয়ে রাখা। অন্য সবার কাছে হয়ত এই এক-দুই মিনিট বেঁচে যাওয়াটা তেমন বড় কোন ব্যাপার বলে মনে হবে না, কিন্তু আমার কাছে এই সামান্য একটা মিনিটও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার থেকেও বেশি দামি।

নাস্তা খেতে খেতে চার মিনিট গেম অব থ্রোনস দেখলাম। বাবা প্রায় আট মাস আগে আমাকে এই টিভি সিরিজটা এনে দিয়েছিলেন। এখন আমি চার নম্বর সিজনের দুই নম্বর পর্বে আছি।

তিনটা সাতের সময় শেয়ার মার্কেটে আমার স্টকগুলোর অবস্থা দেখলাম একবার। একটা উঠতি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনলাম। ঝুঁকি আছে একটু ব্যাপারটাতে কিন্তু বলা যায় না, অনেক লাভও হয়ে যেতে পারে।

এই সময় আমার স্কাইপ অ্যাকাউন্ট থেকে একটা নোটিফিকেশন এল। বাবা ভিডিও কল করেছেন।

“কি খবর তোমার? কেমন আছো?”

“এই তো, আপনার পিঠের ব্যথার কি অবস্থা?”

“আর বলো না, মনে হয় আরো বেড়েছে ব্যথাটা। আজকে আর না আসি তাস খেলতে, কেমন?”

বাবার ইদানিং যেন কী হয়েছে। একটু অন্যরকম আচরন করছেন তিনি আজকাল। এর আগের দু-সপ্তাহেও আসেননি। বাধ্য হয়ে অনলাইনেই পোকার খেলতে হয়েছে আমাদের। আর গত বুধবার তো খেলায় পুরোই ভুত হয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে হেরে। তাই আশায় ছিলাম আজ সেটার শোধ তুলবো।

“একটা পেইনকিলার খেয়ে নিলেই তো হয়।”

“আরে, ওসব ওষুধে আমার কিছু হয় না। ডাক্তার, ওষুধগুলো দেয় সেগুলো খেলে সারাদিন খালি ঘুম আসে,” বললেন তিনি।

বেচারার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি, খুব কষ্টে আছেন পিঠের ব্যথাটা নিয়ে। নিজেকে একটু হলেও দোষি মনে হলো উনার এই পিঠের ব্যথাটার জন্য। কয়েক বছর আগে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে করে তিনতলায় ওঠাতে গিয়েই পড়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই এই ব্যথাটা।

“যান, পেইনকিলারগুলো খেয়ে নেন। এরপর না-হয় আরো দু-এক মিনিট কথা বলা যাবে।”

মাথা নেড়ে পর্দার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। তার জায়গায় একটা বড় বাদামি রঙের মাথা পর্দা দখল করলো-আমার বাবার একশ ষাট পাউন্ড ওজনের ব্রিটিশ কুকুরটা।

“কিরে মার…”

লাইনটা শেষ করার আগেই ল্যাসি লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে পড়ল। ওদের দুজনের সামনাসামনি শেষ দেখা হয়েছে প্রায় তিনসপ্তাহ আগে। মারডক গর্দভটা বুঝলো না, ল্যাসি আসলে বাবার বাসার টেবিলের উপরে বেস নেই, ওকে ল্যাপটপের পর্দায় দেখা যাচ্ছে। সে তার বিশাল থাবা দিয়ে পর্দায় থাবা মারতেই স্কাইপের কানেকশন চলে গেল। একটু পরই বাবা ফোন করে জানালেন মারডক তার ল্যাপটপটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তিনি এখন একটু ঘুমোতে যাবেন, আর জেগে থাকতে পারছেন না।

এখন বাজে তিনটা নয়। বাকি সময়টা আমি একা একাই কার্ড খেলতে লাগলাম আর চিন্তা করতে থাকলাম, কী করা যায় আজকের বাকি সময়টাতে। সপ্তাহে শুধু এই বুধবারেই আমি ব্যায়াম করি না। একবার ভাবলাম, বাইরে থেকে দৌড়ে আসি একটু। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। আলেক্সান্দ্রিয়ায় এবার অক্টোবর মাসে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচক করছে বাইরের ভেজা রাস্তা। সেই রাস্তার উল্টো দিকের বাড়িটার দিকে চোখ গেল একবার। জেসি ক্যালোমেটিক্সের চিৎকারটা শুনেছিলাম আজ থেকে প্রায় ছয় মাস আগে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এক নির্দোষ ব্যক্তিকে খুনের দায়ে ফাঁসানোর মধ্য দিয়ে আর শেষ হয় আরেকজনের কপালের মাঝখানে একটা বুলেট ঢুকে।

শেষজন, মানে জেসির আসল বাবা তো মারাই গেল মাথায় বুলেট লেগে। আরেকজন এখনও বহাল তবিয়তে এই দুনিয়া শাসন করে যাচ্ছেন, মানে আমাদের প্রেসিডেন্টসাহেবের কথা বলছি আর কী।

কনর সুলিভান জেসির খুনের কেসটাতে নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার প্রায় দুই মাস পরে আমার ফোনটা একবার বেজে উঠেছিল। তখন বাজছিল তিনটা তেত্রিশ। প্রেসিডেন্ট নিজেই ফোন দিয়েছিলেন। ওনার নাকি ঘুম আসছিল না রাতে, জানতেন এই সময়ে আর কেউ না হোক অন্তত আমি জেগে থাকবো। ঐদিন এটা ওটা নিয়ে প্রায় দশ মিনিট আলাপ হয় আমাদের। এর এক মাস পরে আবার ফোন দিয়েছিলেন তিনি। আর এর দু-সপ্তাহ পরে তো একেবারে আমার বাসায় এসেই হাজির হলেন। হাতে ছিল ছয়টা বিয়ারের ক্যান। আমি, বাবার সাথে প্রতি বুধবার রাতে পোকার খেলি এটা ওনার জানা ছিল। আমাদের সাথে খেলতেই এসেছিলেন তিনি।

এর পর প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে কিন্তু আর কোন ফোন পাইনি উনার কাছ থেকে। ঠিক করলাম, আরো মিনিট পনেরোর মতো গেম অব থ্রোক্স দেখে ল্যাসিকে নিয়ে বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসব।

প্লে বাটনে টিপ দিতে যাব ঠিক তখনই আমার ইমেইল অ্যাড্রেসে নতুন একটা মেইল আসার নোটিফিকেশন এল।

এখন বাজে তিনটা দশ। [email protected] ঠিকানায় তেমন কিছু আসে । এটা ওটার বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত মেইলই আসে বলতে গেলে। আর আমি জেগে থাকা অবস্থায় ইমেইল খুব কমই আসে।

খুলে দেখলাম মেইলটা এসেছে অ্যাডভান্সড সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড ট্র্যাকিং, অর্থাৎ এএসটি থেকে। কারো ওপর নজরদারি করার জন্যে এটি খুবই কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান।

ইমেইলটাতে শুধু চারটা শব্দ লেখা :

তাকে খুঁজে পেয়েছি আমরা।

মনে হলো যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে আমার।

ওরা আমার মাকে খুঁজে পেয়েছে!

*

অধ্যায় ২

মাকে নিয়ে আমার সর্বশেষ স্মৃতিটা আমার ষষ্ঠ জন্মদিনের সময়কার। আমার এখনো মনে আছে, সেদিন আমি আগে থেকেই অনেক বেশি আশাবাদি ছিলাম তার দেখা পাব, কারণ এর আগের দুটো জন্মদিনে আমি তাকে কাছে পাইনি। তাই চোখ খুলেই সবার আগে তাকে খুঁজি, কিন্তু বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না ঘরে।

“মা কোথায়?”

“অফিসের একটা কাজে…”

বাক্যটা সবসময় একইভাবে শেষ হতো।

“…একটু ব্যস্ত আছে সে।”

আমার মার চাকরিটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর চাকরিগুলোর মধ্যে একটি। অন্তত পিচ্চি থাকতে আমি এমনটাই ভাবতাম, একজন ভূতাত্ত্বিকের চেয়ে ফালতু কাজ আর নেই। কিন্তু এটা মনে হওয়ার পেছনে আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল। আমার মনে হতো যে পাথরগুলো নিয়ে মা সারাক্ষন মেতে থাকতেন সেগুলো আমার প্রতিদ্বন্দ্বি। মা’র মনোযোগ আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখত ওরা। কী এমন বিশেষত্ব ছিল ওগুলোর যে, একজন মা তার সন্তানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে ওদের? মাসের পর মাস দূরে থাকবেন? কিন্তু আরেকটু বড় হলে বুঝেছিলাম, গুরুত্ব অবশ্যই আছে। কারণ মা আসলে পাথর নিয়ে শুধু গবেষণাই করতেন না, তার কাজ ছিল তেলের খনি অনুসন্ধান করা। এরজন্য কোম্পানিগুলো তাকে মাস শেষে মোটা অঙ্কের বেতন দিত, ফলে বাবাকে আলাদাভাবে আর কোন কাজ করতে হতো না। আমার দেখাশোনা করে আর টুকটাক লেখালেখি করেই দিন চলে যেত তার।

কিন্তু ঐদিন বাক্যটা শেষ হয়েছিল অন্যভাবে।

“…মোটেও ব্যস্ত নয় সে।”

সাথে সাথেই মা একটা মিকি মাউসের কেক নিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। কেকের উপরে একটা নীল রঙের মোমবাতি। মোমবাতির আলোটা গিয়ে পড়ছিলে তার মুখের উপর। মা’র সবুজ চোখদুটো আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল তখন।

তবে তাকে কেমন যেন একটু গম্ভিরও লাগছিল।

আমার মনে হয়, তিনি হয়ত ততোদিনে ঠিক করে ফেলেছিলেন, আমাদের সাথে আর থাকবেন না।

ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নেভানোর পর বাবা আর মা আমার উপহারটা হাজির করলেন আমার সামনে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি।

লাল রঙের একটা সাইকেল। ঠিক যেমনটা আমি চেয়েছিলাম মনে মনে।

“বাবা, আমি এখনই সাইকেল চালানো শিখতে চাই।”

স্বভাবতই আমি ভেবে নিয়েছিলাম বাবাই হয়ত আমাকে শেখাবেন কিভাবে সাইকেল চালাতে হয়। কারণ প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর তিনিই আমাকে বিশ মিনিট করে ইতিহাসের নানান বিষয় পড়ান, কিংবা শেখান। কিভাবে বানান করে পড়তে হয়। এরপর হয়ত আমরা বিশমিনিট ফুটবল খেলা প্র্যাকটিস করি, শিখি কিভাবে বেসবল খেলার সময় ব্যাট ঘোরাতে হয়। সত্যি বলতে, স্বাভাবিক জীবন-যাপনের প্রতিটি জিনিস বাবাই আমাকে শিখিয়েছেন।

“আসলে এ ব্যাপারে আমার চেয়ে তোমার মার অভিজ্ঞতাই বেশি,” তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন সেদিন।

বাবা ততদিনে নিশ্চয়ই আঁচ করতে পেরেছিলেন, মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। কারণ মার ঐ সবুজ চোখজোড়ার দিকে তাকালেই তিনি সব বুঝে যেতেন।

“ছোটবেলায় আমারও এরকম একটা সাইকেল ছিল,” মা বলেছিলেন আমাকে।

এরপরের ত্রিশ মিনিট ধরে মা আমাকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় শিখিয়েছিলেন কিভাবে সাইকেল চালাতে হয়। বাবা এখনও মারডককে নিয়ে সেই রাস্তার পাশের বাড়িটাতেই থাকেন।

মা আমাকে সাইকেলের সিটটা ধরে ঠেলে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি শিখে যাই কিভাবে সাইকেলের ভারসাম্য রাখতে হয়। মা শেষবারের মতো সাইকেলের সিটটা সামনের দিকে একবার ঠেলে দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আসলে সাইকেলটা ছাড়ার সাথে সাথে তিনি আমাদেরও যে ছেড়ে দিচ্ছিলেন সেটা আমি তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।

সাইকেলটা নিয়ে এক চক্কর দেয়ার পর আমি যখন ফিরে আসি তখন দেখি মা নেই, বাবা আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

“মা কোথায় গেল?”

“একটা জরুরি ফোন এসেছিল,” বাবা ক্লান্তস্বরে জবাব দিয়েছিলেন।

ওটাই ছিল মা’র সাথে আমার শেষ দেখা।

.

এরপরের বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার আমি মায়ের ব্যাপারে বিভিন্ন কথা জানতে চেয়েছি বাবার কাছে কিন্তু কিছুই বের করতে পারিনি তার কাছ থেকে।

“আরে, রাখো তো তার কথা, যে গেছে সে গেছে। তার কথা ভেবে ভেবে সময় নষ্ট কোরো না”–এভাবেই জবাব দিতেন বাবা আমার প্রশ্নগুলোর। একদিক দিয়ে তার কথা ঠিকই ছিল, কারণ একবার মা সম্পর্কে চিন্তা করা শুরু করলে আমি একরকম ঘোরের মধ্যে চলে যেতাম। ঘোর কাটতে কাটতে দেখতাম এক ঘণ্টা (আমার জন্যে পুরো একটা দিন) পার হয়ে গেছে। আমি যদি স্বাভাবিক কেউ হতাম তাহলে শুধু একদিন কেন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মার কথা ভাবলেও কোন ক্ষতি হতো না। বরং আমার বয়সি অন্য কেউ হলে এ কাজই করত। কিন্তু আমি যে স্বাভাবিক কেউ না। প্রতিদিন আমার জন্যে মাত্র ষাট মিনিট বরাদ্দ থাকে, আর এই ষাট মিনিট আমি কিভাবে কাটাবো তা একমাত্র আমিই ঠিক করি, অন্য কারোর অধিকার নেই আমার কাছ থেকে এগুলো ছিনিয়ে নেয়ার-তা সে যে কেউই হোক না কেন। তাই আমি আমার চারদিকে গড়ে তুলেছি অদৃশ্য এক দেয়াল। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমার কাছে আসার সাধ্য এমনকি মারও নেই।

অন্তত এতদিন আমি এমনটাই ভেবেছিলাম।

পাঁচ বছর আগে শেয়ার মার্কেটে কিছু স্টক কিনতে গিয়ে হঠাৎ আমার চোখে পড়ে যায় একটা পেট্রোলিয়াম কোম্পানির নাম।

জিজিইউ (GGU)।

আমি যখনই মাকে জিজ্ঞেস করতাম, তিনি কোন্ কোম্পানিতে চাকরি করেন, তিনি বলতেন গ্লোবাল জিওলোজিস্ট আনলিমিটেড। সংক্ষেপে জিজিইউ।

কোন কোম্পানির স্টক কেনার আগে আমি সবসময়ই সেই কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেই। কিন্তু এই কোম্পানির ওয়েবসাইটে খোঁজ নিতে গিয়ে একটা বড়সড় ধাক্কা খেলাম। কারণ সেখানে লেখা ছিল ১৯৮৭ সালে কোম্পানিটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অথচ আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন ১৯৮৪ সালে!

ওদের কোম্পানির সাথে কয়েকবার ইমেইল চালাচালি আর কয়েকটা ফোনকলের পরে আমি নিশ্চিত হই, ওখানে স্যালি বিনস (আমার মায়ের নাম) নামে কেউ কোনদিন চাকরিই করত না।

এরপর আমি যোগাযোগ করি জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে মা বিয়ের আগে ভর্তি হয়েছিলেন স্যালি পেট্রিকোভা হিসেবে (বংশগতভাবে মা’র পরিবার চেক প্রজাতন্ত্রের ছিল)। ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মা ভূ-বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। অন্তত আমি এমনটাই জানতাম। কিন্তু তাদের কাছে স্যালি। পেট্রিকোভা নামে কোন ছাত্রির রেকর্ডই ছিল না।

মা আমাকে বলেছিলেন, তার বাবা মারা গিয়েছিল বহু আগেই, কিন্তু তার মা বেঁচে আছেন, চেক প্রজাতন্ত্রেই বাস করছেন। নাম ডেনিজা পেট্রিকোভা। আমি ওখানে খোঁজ নিয়ে দু-জন ডেনিজা পেট্রিকোভা সম্পর্কে জানতে পারি, কিন্তু তাদের মধ্যে কারোরই কোন কন্যা সন্তান ছিল না।

তখনই আমি অ্যাডভান্সড সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড ট্র্যাকিং, মানে এএসটির সাথে যোগাযোগ করি, আর প্রতি মাসে তাদের অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার ডলার করে দিতে থাকি স্যালি বিনকে খুঁজে বের করার জন্যে।

তারা আমার মা আর বাবার আগের সব কাগজপত্র-বিবাহ নিবন্ধনপত্র, জন্মসনদ, ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির বিলের রশিদ এসব-ঘেটে প্রাথমিক যে রিপোর্টটা দেয় সেটা দেখে আমি পুরো হা হয়ে গেছিলাম। স্যালি বিনস নামে কারো কোন অস্তিত্বই নেই!

.

বাবার সাথে মার প্রথম দেখা হয়েছিল একটা কফিশপে। বাইরের দুনিয়ার জন্যে ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিক, কিন্তু আমার জন্যে মোটেও সেরকম নয়। কারণ আমার সাথে যেখানে যেখানে মেয়েদের দেখা হয়েছে তার কোনটাই স্বাভাবিক ছিল না। এই যেমন ম্যাচ ডটকম নামের ওয়েবসাইটে কিংবা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। আর ইনগ্রিডের সাথে তো দেখা হলো একটা খুনের তদন্তের সময়।

যে কফিশপটাতে তাদের দেখা হয়েছিল সেটার নাম ছিল মাইটি বিনস। বাবার আর্লিংটনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তিন মাইল দূরে ছিল ওটা। ঠিক পটোম্যাক নদীর পশ্চিমতীর ঘেষে। ঐ কফিশপের একটা নির্দিষ্ট টেবিলে বসে বাবা ঘন্টার পর ঘন্টা তার কাজে ডুবে থাকতেন। সাথে চলতো কফি। বাবার কাজ ছিল ওয়াশিংটনের বিভিন্ন সরকারি অফিসের জন্যে এটা ওটা লেখালেখি করা। বরাবরই চুপচাপ ধরণের ছিলেন তিনি।

আমার মনে হয় না সেই দিনগুলোতেও খুব একটা অন্যরকম ছিলেন। হয়ত তার চুলগুলো আরো একটু বেশি ঘন আর কালো ছিল তখন। আর শার্টগুলোও বোধহয় আরো রঙচঙে ছিল। কিন্তু এতটাও নয় যে, হঠাৎ করে কোন সুন্দরির চোখে পড়ে যাবেন। আমি তাকে যতটা চিনি, ঐ সরকারি লেখালেখির কাজগুলোতেই ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগতো তার। এজন্যেই বোধহয় একজন সুন্দরি মহিলা যে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছিল পাশের টেবিল থেকে সেটা এড়িয়ে যায় তার চোখ।

“কী এত জরুরি কাজে ব্যস্ত আপনি?” মা’র মতে প্রথমবার যখন তিনি বাবাকে প্রশ্নটা করেছিলেন তিনি কোন রকম প্রতিক্রিয়াই পাননি তার কাছ থেকে। তাই আবার করতে হয়েছিল প্রশ্নটা।

অবশেষে বাবা যখন মার দিকে তাকালেন তখন তার চশমাটা পড়ে যায় চোখ থেকে। কিন্তু একদৃষ্টিতে মা’র দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। চোখই ফেরাতে পারছিলেন না। আমার মা জানতেন তিনি কতটা সুন্দরি ছিলেন, তাই পুরুষদের এরকম দৃষ্টি তার কাছে মোটেও অপরিচিত ছিল না। সেদিন কোনধরণের মেকআপই করেননি তিনি, বাবার ওরকম তাকিয়ে থাকা দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন। এরপরের ছয়ঘন্টা সেখানেই আলাপ হয় তাদের দুজনের।

এর তিন মাস পরে বিয়ে করে ফেলেন তারা।

আর এক বছর পরেই জন্ম হয় আমার।

বাচ্চাদের জন্ম হওয়ার পর তারা সারাক্ষনই ঘুমায়, তাই আমি যখন প্রথম দিনটা পুরোই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই তখন তাদের মনে কোন ধরণের প্রশ্ন জাগেনি। তারা ভেবেছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে চুপচাপ বাচ্চাটিকে জন্ম দিয়েছে। আমি রাত তিনটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে এরপর জেগে উঠেই কান্না শুরু করে দেই। মা আমার দেখাশোনা করেন তখন। আমি একঘন্টা তার কোলে আ-উ করে এরপর ঠিক চারটার সময় আবার ঘুমিয়ে পড়ি। পরের দিন সকালে যখন আমাকে জেগে ওঠানো যাচ্ছিলো না তখন তারা আমাকে নিয়ে ছোটেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।

তারা আমার উপর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় রাত তিনটার সময় আবার জেগে উঠি আমি। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তখন।

অন্তত একঘন্টার জন্যে আর কি।

আমি চারমাস হাসপাতালে ছিলাম, এর মাঝে যত প্রকারের পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্ভব তারা করেছিল আমার উপর। দিনের বেলা আমাকে নলের মাধ্যমে খাওয়ানো হতো আর রাতে একঘন্টা মা আমার দেখাশোনা করতেন। আমার ওজন যখন চৌদ্দ পাউন্ড হলো তখন কেবলমাত্র এই অদ্ভুত ঘুমের অভ্যাসটা ছাড়া আমার অন্য সবকিছু আর দশটা বাচ্চার মতই স্বাভাবিক ছিল। তখন অবশেষে বাবা-মা আমাকে বাসায় নিয়ে আসেন। দিনের বেলা আমাকে তারা নলের মাধ্যমেই খাওয়াতে থাকেন, আর রাতের ঐ এক ঘণ্টা মা আমার দেখাশোনা করতেন। তাদের আমি নিশ্চয়ই অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম।

তারা অপেক্ষা করতে থাকেন, আশা করতে থাকেন, একসময় হয়তো আমার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি।

বাবা আমাকে নিয়ে ছয়টা অঙ্গরাজ্য আর তিনটা দেশের প্রায় বিশজন বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করেন। কিন্তু আমি যে দেশেই থাকতাম না কেন, ঠিক তিনটার সময় জেগে উঠে আবার চারটার সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। প্রায় বারো বছরের নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও কেউ এটা বের করতে পারেনি, আমি কেন ঠিক ঐ একঘন্টার জন্যেই জেগে উঠি। তা-ও নির্দিষ্ট একটা সময়ে। তারা শুধু খুঁজে পেয়েছিল, আমার রক্তে মেলাটোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। মেলাটোনিন হরমোন একজন ব্যক্তির ঘুমসংক্রান্ত যাবতিয় কাজের জন্যে দায়ি। এটা নিঃসৃত হয় মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে। আর আমার পিনিয়াল গ্রন্থি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তিনগুণ বড়।

চৌদ্দ বছর বয়সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আমার পিনিয়াল গ্রন্থি অপসারণ করে নেয়া হয়। কিন্তু এতেও কিছু হয় না।

আমার আর এই অদ্ভুত মেডিক্যাল কন্ডিশনটার নাম দেয়া হয় হেনরি বিনস।

.

যে ইমেইলটা আমার কাছে পাঠানো হয়েছে সেটার সাথে একটা পিডিএফ ফাইলও আছে। ওটাতেই আছে পুরো রিপোটটা। ডাউনলোড করে সেটা খুললাম আমি।

প্রথম প্যারায় ছোট করে রিপোর্টটার সারাংশ তুলে দিয়েছে এএসটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মাইক ল্যাং। তিনি লিখেছেন :

মি. বিনস, অত্যন্ত দুঃখের সাথে আপনাকে জানাতে হচ্ছে, আপনি আমাদের নমুনা হিসেবে যে আঙুলের ছাপটা সরবরাহ করেছিলেন সেটা আলেক্সান্দ্রিয়ায় অক্টোবরের চৌদ্দ তারিখে পটোম্যাক নদী থেকে উদ্ধার করা অজ্ঞাত এক মহিলার লাশের সাথে ম্যাচ করেছে।

আমি জানি, খবরটা পড়ে আমার ভেঙে পড়া উচিত। কিন্তু আমি সেরকম কোন কিছুই অনুভব করলাম না। মা’র সাথে আমার খুব কমই স্মৃতি আছে। তার সম্পর্কে যা কিছু জানি তার সবই বাবার কাছ থেকে শোনা। আর তিনি বেশিরভাগ সময়ই এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতেন। গত ত্রিশবছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। বিগত দশ বছর ধরে আমি বাবার সামনে মার সম্পর্কে একটা কথাও উচ্চারন করিনি।

আমার মাথায় নানা বিষয় ঘুরতে থাকে। মনে হতে থাকে, মা পানিতে লাফ দেয়ার আগে কি ভাবছিলেন। তিনি হয়ত আমার কথা ভাবছিলেন-শ্যার সাথে তার দেখা হয় না ত্রিশ বছর ধরে। হয়ত চিন্তা করছিলেন, আমি কত বড় হয়েছি, কিংবা আমার অসুখটা হয়ত সেরে গেছে।

রিপোর্টে এক মর্গের ফোন নম্বর দেয়া আছে, ওখানে মা’র মৃতদেহ রাখা আছে এখন।

এরপরের পৃষ্ঠায় সরকারি আঙুলের ছাপের যে ডাটাবেস রয়েছে সেটার একটা স্ক্রিনশট। বামদিকের ছাপটা আমার সরবরাহ করা-যেটা আমি উদ্ধার করেছিলাম বাবা-মার ঘরের একটা পুরনো ফুলদানি থেকে। আর ডানদিকের ছাপটা হচ্ছে অজ্ঞাতনামা সেই মহিলার। এর নিচে নানা হিবিজিবি সংখ্যা লেখা। কিন্তু যে জিনিসটা আমি খুঁজছিলাম সেটা একদম নিচে।

দুটো আঙুলের ছাপ একশ ভাগ মিলে গেছে।

এরপরের পৃষ্ঠায় গিয়ে আমি আসলেও অবাক হয়ে গেলাম। এএসটির নিশ্চয়ই খুব বড় পর্যায়ের সাথে যোগাযোগ আছে, নইলে এত তাড়াতাড়ি

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তারা কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারতো না।

রিপোর্টটা আমি দ্রুত পড়তে থাকি। ধরেই নিয়েছিলাম, মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা থাকবে পানিতে ডুবে মারা গেছে-দুর্ঘটনা কিংবা আত্মহত্যা। তাই এই শব্দগুলোই খুঁজতে লাগলাম।

কিন্তু এরকম কিছুই লেখা নেই রিপোর্টে।

কারণ মা আত্মহত্যা করেননি।

তাকে খুন করা হয়েছে।

*

ধ্যায় ৩

মিয়াও।

“না, আমি ওকে ফোন দেব না এখন।”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, আমি জানি আমার মাকে আলেক্সান্দ্রিয়াতে খুঁজে পাওয়া গেছে আর আমার গার্লফ্রেন্ড আলেক্সন্দ্রিয়ার পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই কাজ করে।”

মিয়াও। “উফ! বুঝলাম, সে একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর।”

মিয়াও।

“এটা আমি ভালো করেই জানি, হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটররা খুনের তদন্তের জন্যেই কাজ করে আর আমার মা খুন হয়েছেন। আচ্ছা, তুই আগের বাসাটাতে সারাদিন কি করতি, বল তো? খুব ক্রাইম পেট্রোল দেখতি নাকি?”

মিয়াও।

“কি? ক্রিমিনাল মাইন্ডস?”

মিয়াও।

“তোকে একবার বললাম না, এখন ফোন দেব না ওকে। কাল তো দেখা হবেই আমাদের। এখন চুপ করে বসে থাক।”

মিয়াও।

“না, তোকে কোল্ড কফি খাওয়াতে পারবো না এখন।”

ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখন বাজে তিনটা তেইশ।

গত সাত মিনিট ধরে আমি ইন্টারনেটে আমার মা’র খুন সম্পর্কে কোন খবর আছে নাকি সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, কিন্তু এই পর্যন্ত এমন কিছু খুঁজে পাইনি যেখানে লেখা আছে, মাথার পেছনে গুলিবিদ্ধ কোন মহিলার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে পটোম্যাক নদী থেকে। আসলে কোন কিছু যে খুঁজে পাবো এমনটা আশাও করিনি অবশ্য। কারণ আলেক্সান্দ্রিয়া ওয়াশিংটন ডিসি থেকে মাত্র পনের মিনিটের দূরত্বে, তাই রাজনীতিবিদদের বাইরে অন্য কারো সম্পর্কে কোন খবর খুব কমই গুরুত্ব পায় এখানকার নিউজ পোর্টালগুলোতে।

মিয়াও।

“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা..করছি ফোন।”

ফোনটা হাতে নিয়ে ইনগ্রিডের নম্বরে ডায়াল করলাম। তিনবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল সে।

“কি খবর, হেনরি?” গলা শুনেই বুঝতে পারলাম সে কতটা ক্লান্ত।

“তোমাকে এত রাতে জাগানোর জন্য দুঃখিত।”

“আরে, ব্যাপার না। তোমার সকাল কেমন গেল আজকে?”

ইনগ্রিডের মতে আমার জেগে ওঠার পর প্রথম বিশ মিনিট হলো সকাল। এর পরের বিশ মিনিট বিকেল। আর শেষ বিশ মিনিট হচ্ছে রাত।

“আজকের সকালটার তুলনায় অনেক বেশি ভালো সময় কাটিয়েছি আমি আগে।”

ফোনের এই প্রান্ত থেকেও বুঝতে পারলাম, ওর চোখদুটো বড় হয়ে গেছে।

“কিছু হয়েছে নাকি আবার?”

এর আগে আমি আমার মার সম্পর্কে কোন কথা খুলে বলিনি ওকে। তাই এরপরের চারমিনিটে ওর কাছে সবকিছু ব্যাখা করে গেলাম। মার চাকরির কথা, এএসটির রিপোর্ট আর অজ্ঞাত পরিচয়ের এক মহিলার সাথে মার আঙুলের ছাপ মিলে যাওয়ার ঘটনা-কিছুই বাদ দিলাম না।

ফোনে ইনগ্রিডের চাদরের খসখসানির শব্দ শুনে বুঝলাম, সে উঠে বসছে।

“আমি দুঃখিত, জান্টু।”

“আরে, আমি অতোটা দুঃখিত নই। তাকে তো আমি ভালোমত চিনতামও না,” বললাম তাকে। আর যতটুকু চিনতাম তার পুরোটাই মিথ্যে।”

“তবুও তিনি তো তোমার মা।”

কিন্তু আমি এসব নিয়ে চিন্তা করতে চাচ্ছিলাম না। তাই কথা ঘোরানোর জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, মাকে তো আলেক্সান্দ্রিয়াতেই খুঁজে পাওয়া গেছে, তুমি কি কিছু শুনেছ তোমার অফিসে?”

“না, আমি অন্য একটা কেস নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত এখন। কারো সাথে কথা বলার সময়ও নেই আমার আর রবির।”

ইনগ্রিডের আগের সহযোগি প্রেসিডেন্টকে খুনের দায়ে ফাঁসিয়েছিল। মাথায় গুলি খেয়ে সে এখন সবকিছুর উর্ধ্বে। রবি হচ্ছে তার নতুন সহযোগি।

“আচ্ছা, আমাকে কয়েক জায়গায় ফোন করতে দাও। সব কিছু খুঁজে বের করছি। আমি কিছু করতে বলার আগেই ইনগ্রিড বলল।

“তোমার কোনো তুলনা হয় না।”

“জানি।”

ফোনটা রেখে দিলাম। এখন বাজে তিনটা একত্রিশ।

.

ল্যাসির গলায় লাগানো দশ ফিট লম্বা চেইনটা টানটান হয়ে আছে। ব্যাটা একটা গাছ বেয়ে ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে এখন। আমি ওকে টেনে নামালাম গাছটা থেকে।

“আজকে তুই ব্যথা পেলে তোকে সেবা করার মতো সময় নেই। আমার।”

ল্যাসির একটা বদভ্যাস হচ্ছে ওর সমান অন্য কোন জীব-জন্তু দেখলেই তার সাথে মারামারি শুরু করে দেয়। এই যেমন, অন্য কোন বিড়াল কিংবা বেজি। মাঝে মাঝে কাঁটাগাছের সাথেও লেগে যায় ওর। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই হেরে ভুত হয়ে যায় ব্যাটা। আর বাকি সময়টা আমার কাটাতে হয় ওকে পরিস্কার করতে করতে কিংবা ওর গা থেকে কাঁটাগুলো টেনে বের করার কাজে।

অবশেষে সে গাছে ওঠার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে আবার রাস্তায় ফিরে আসলে আমরা পূর্বদিকে হাটা দিলাম।

আমি একটা রেইনকোট পরে আছি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে। কিন্তু ল্যাসির গায়ে কিছু না থাকায় ওর লোমগুলো ভিজে চকচক করছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় জমে আছে পানি। এরকম বড়সড় একটা গর্ত দেখে মহানন্দে ওটাতে লাফ দেয়ার আগেই কোনমতে চেইন ধরে ল্যাসিকে থামালাম আমি রাস্তা পার হওয়ার সময়। নইলে ভিজে পুরো চুপচুপে হয়ে যেত ও।

মিয়াও।

“কি? আমার সাথে হেঁটে কোন মজা নেই? আচ্ছা, এটা তোকে জানিয়ে রাখি, ঘুম থেকে উঠে যখন দেখি তুই তোর ভেজা শরীরটা নিয়ে আমার উপর শুয়ে আছিস, আমিও কোন মজা পাই না, বুঝলি?”

আমি জানি, ও পানিতে গড়াগড়ি খেতে কতটা ভালোবাসে। আর সেজন্যে বেশিরভাগ সময় একটু গড়াগড়ি করতেও দেই ব্যাটাকে। কিন্তু আজকে তাড়া আছে আমার।

এক মিনিট পরে আমরা পটোম্যাক নদীর ওপর একটা ব্রিজে উঠে গেলাম। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর পানি। সোয়া মাইল দূরে আরেকটা পাথরের ব্রিজ দেখা যাচ্ছে নদীর উপরে। তিনটা গাড়ি সাই সাই করে চলে গেল ওটার ওপর দিয়ে। আচ্ছা, মার লাশটা, গাড়িটা নিয়ে এসেছিল সেটাও কি এই ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়েছিল? নাকি ব্রিজের ওপর গাড়িটা পার্ক করার পর তার লাশটা গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্ক থেকে বের করে ওপর থেকে ফেলে দিয়েছিল ওরা? হয়ত তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল এখান থেকে অনেক দূরে কোন জায়গায়। কে জানে, পটোম্যাক নদী কতদূর থেকে ভাসিয়ে এনেছে তার লাশটাকে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে লেখা ছিল, মা’র মৃত্যু হয় তার লাশটা খুঁজে পাওয়ার প্রায় চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘন্টা আগে। সোমবারে পাওয়া যায় তার লাশ। তার মানে সপ্তাহের শেষদিকে তাকে খুন করা হয়।

উত্তরদিকে আরো কিছু দূর হেঁটে গেলাম ল্যাসি আর আমি। অভ্যাসবশত একটা ড্রেইন-পাইপের উপরে এসে থেমে নিচের দিকে উঁকি দিলাম। পাইপটা প্রায় ছয়ফুটের মতো লম্বা হবে। বৃষ্টির পানি স্রোতের মতো বের হচ্ছে ওটা থেকে এখন।

ছয়মাস আগে একদল গুন্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য এই পাইপটার ভেতর প্রায় বিশমিনিট কাটাই আমি। ধরা পড়লে আমার অবস্থা মা’র মতোই হতো।

আচ্ছা, মা কি ভয় পেয়েছিলেন মারা যাওয়ার আগে? যেমনটা আমি পেয়েছিলাম সেই রাতে? তিনি কি এটা জানতেন, কেউ তার পিছু নিয়েছে? তার সম্পর্কে আমি হয়ত বেশি কিছু মনে করতে পারি না কিন্তু তার বুদ্ধিদীপ্ত সবুজ চোখজোড়ার কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার এখনও। তাকে খুন করতে নিশ্চয়ই বেগ পেতে হয়েছে খুনিকে।

আমার ফোনটা বেজে উঠলো এ সময়।

ইনগ্রিড ফোন দিয়েছে।

ফোনটা কানে ঠেকাতে ঠেকাতে ল্যাসিকে নিয়ে বাড়ির পথে হাটা দিলাম।

এতক্ষণে তিনটা ছেচল্লিশ বেজে গেছে।

.

“কেসটা ওয়াকারের হাতে পড়েছে।”

চার্লি ওয়াকার হচ্ছে একজন হোঁতকা পুলিশ অফিসার। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে তার পরিচিত কেউ আছে, না-হলে এখনও তাকে ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাজ করতে হতো। অন্তত ওর সম্পর্কে ইনগ্রিডের ধারণা এরকমই। ওয়াকারের অভ্যাস হচ্ছে সবকিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা।

“এই রাত তিনটার সময় ঘুম থেকে উঠে কথা বলার ব্যাপারে প্রথমে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না তার। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে যে ডিপার্টমেন্টে অবৈধ বেটিং ধরার গুঞ্জন উঠেছে সেটা মনে করিয়ে দিতেই কথা বলার ব্যাপারে হঠাৎ আগ্রহি হয়ে ওঠে সে।”

মাথা নেড়ে সামনে হাঁটতে লাগলাম আমি ল্যাসিকে নিয়ে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে।

“কিন্তু কথা হচ্ছে, ওর কাছে বেশিক্ষন ছিল না কেসটা। ও ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই স্যুট পরা একজন এসে কাঁধে টোকা দেয়।”

“এফবিআই’র লোক?”

“না, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি।”

আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। ল্যাসির গলার চেইনে টান লাগায় সে-ও থমকে গেলো। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি হচ্ছে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা সংস্থা। দেশকে যেকোন প্রকারের হুমকি আর সন্ত্রাসবাদি কার্যক্রম থেকে বাঁচানোই ওদের কাজ।

“হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোক?!”

“হ্যাঁ। সে ওয়াকারকে বলেছে, বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে যেন তার সব জিনিসপত্র নিয়ে ওখান থেকে বিদায় হয়। ওয়াকারও আর কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ে।”

আমার মাথার ভেতরে চিন্তার ঝড় বইতে লাগলো। ল্যাসি ঘুরে তাকালো আমার দিকে। ও এখন বসে আছে পেছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে।

“আমি হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাথে কয়েক বছর কাজ করেছি। ওদের পেট থেকে কথা বের করা খুব কঠিন কাজ। অন্য কোন ডিপার্টমেন্টকে ওরা খুব একটা সাহায্যও করে না। কিন্তু ওদের ভেতরে একজন চেনা-জানা লোক আছে আমার, এক সময় ওর বড় একটা উপকার করেছিলাম আমি।”

এদিকে আমি ভাবছি অন্য একটা কথা। প্রেসিডেন্টকে ঐ খুনের মামলা থেকে বাঁচানোর পর তিনি আমাকে একটা কার্ড দিয়েছিলেন। ঐ কার্ডটার মাধ্যমে এ দেশে যেকোন কিছু করা যাবে-একবারের জন্যে অবশ্য। আমার ড্রয়ারে এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে ওটা।

“তো, আরেকজনকে ফোন করে ঘুম থেকে ডেকে তুলি আমি,” ইনগ্রিড বলতে থাকলো। “ওকে আমি তোমার মার কথা জিজ্ঞেস করি। মানে, যার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সোমবার পটোম্যাক নদী থেকে। কিন্তু সে অস্বীকার করে বলে, সে নাকি এ ব্যাপারে কিছুই শোনেনি। তখন আমি তাকে আগের কথাটা মনে করিয়ে দেই।”

“সত্যি? নিশ্চয়ই খুব বড়সড় কোন উপকার করেছিলে লোকটার?”

“হ্যাঁ। যাই হোক, তখন ওর গলার সুর বদলে যায়। একটু পরে অন্য একটা ফোন থেকে কল দেয় আমাকে, যেটাতে কেউ আড়ি পাততে পারবে না। তখন সে আমাকে বলে, কিভাবে সোমবার সকালে চার নম্বর রেড অ্যালার্ট পায় তারা।”

“চার নম্বর রেড-অ্যালার্ট?”

“হ্যাঁ, এটা আমাদের ডিপার্টমেন্টগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত হওয়া একটি সংকেত। চার নম্বরটা হচ্ছে সর্বোচ্চ বিপদের জন্যে। আর রেড হচ্ছে

আমি জানি ও কি বলতে যাচ্ছে। তা-ও কথাটা শুনে কষ্ট না পেয়ে থাকতে পারলাম না।

“সন্ত্রাসবাদের জন্যে।”

*

অধ্যায় ৪

ইনগ্রিডকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।

ল্যাসি চেইনে টান দিতে লাগলো।

“আরে, যাচ্ছি তো বাসায়। এক সেকেন্ড!”

মিয়াও।

আমি পাত্তা দিলাম না ওকে।

নিজেকে আগে কখনও এতটা অসহায় মনে হয়নি। মনে হচ্ছে যেন দৌড়াতে শেখার আগেই কেউ আমাকে উসাইন বোল্টের সাথে অলিম্পিকের ময়দানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

একজন সন্ত্রাসি।

আমার মা একজন সন্ত্রাসি ছিলেন?

নাইন ইলেভেনের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন রাত তিনটায় ঘুম থেকে ওঠার পরে আমি আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিল না, আঠারো ঘন্টা আগে টুইন টাওয়ারে দুই-দুইটা প্লেন আছড়ে পড়েছে। যদি সেটা অন্য কোন সপ্তাহে হতো তাহলে বাবা আমাকে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে রাখতেন আক্রমনটার ব্যাপারে। কিন্তু বাবা সেসময় বাহামাতে ছুটি কাটাতে ব্যস্ত ছিলেন। আর ওখানে তখন ফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করতো না। তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন, বাহামা থেকে ফিরে আসতে তাকে কতটা বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসি হামলার সময় ছিল ওটা। তাকে বাহামার বিমানবন্দরে তিন রাত কাটাতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটা প্লেনে করে মায়ামিতে পৌঁছান তিনি। সেখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে অবশেষে ভার্জিনিয়ায় ফিরে আসেন।

টুইন টাওয়ার আক্রমনের খবরটা আমি কোন টিভি চ্যানেলেও দেখিনি, কারণ আমার হাতে এত সময় নেই। আমি সেটা জানতে পারি আমার ই ট্রেড অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করার পর। কারণ শেয়ার মার্কেটে বড়সড় ধস নামে ঐ ঘটনার কারণে। একদিনেই প্রায় পাঁচ হাজার ডলার হারাই আমি।

ঐদিন বাকি সময়টা আর এর পরের চারদিন নাইন ইলেভেনের ব্যাপারে বিভিন্ন খবর ঘেঁটে কাটাই। আমি ইনগ্রিডকেও একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাইন ইলেভেনের ঘটনাটা টিভিতে দেখার জন্যে সে কত সময় কাটিয়েছিল। উত্তরে সে বলেছিল, প্রথম সপ্তাহেই প্রায় পঞ্চাশ ঘন্টা বসে ছিল টিভি সেটের সামনে।

পঞ্চাশ ঘন্টা!! আমার জন্যে পঞ্চাশ দিনের সমান। আমি জানি, ওরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না, আর ঘটলেও সেটা সরাসরি ক্যামেরায় রেকর্ড করা থাকে খুব কমই। তাই টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়ার ভিডিওটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে হুল্লোড় পড়ে গেছিল। কিন্তু চারদিন টিভিতে একই জিনিস দেখার পর আমি অন্যদিকে মনোযোগ দেই। আমার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট।” যদিও অন্য সবার মতো আমিও ঐ সন্ত্রাসিদের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। মানসিকভাবে কষ্টও পেয়েছিলাম অনেক। টুইন টাওয়ারের লোকগুলোর তো কোন দোষ ছিল না। না জানি কতজন ছেলে মেয়ের বাবা-মা আর ফিরে যায়নি ওদের কাছে।

কিন্তু এখন এটা আমি কি শুনলাম!

আমার মা-ও একজন সন্ত্রাসি ছিলেন!

আমার মা-ও ঐ হারামিদেরই একজন!

মিয়াও।

মিয়াও।

মিয়াও।

“কি হয়েছে আবার!”

মিয়াও।

আমি আমার ঘড়ির দিকে তাকালাম।

এখন বাজে তিনটা সাতান্ন।

ল্যাসির দিকে তাকালাম।

“দৌড় দে!”

দু-জনেই প্রাণপণে দৌড়ানো শুরু করলাম।

আমার বাসা থেকে প্রায় সোয়া মাইল দূরে আছি এখন। এক মাইল দৌড়াতে আমার সময় লাগে অন্তত সাতমিনিট। যদি রাস্তার মাঝখানে ঘুমাতে চাই তাহলে আমাকে এখন এর চেয়েও জোরে দৌড়াতে হবে।

কংক্রিটের শক্ত রাস্তা ধরে দৌড়াতেই থাকলাম। ঘড়ির দিকে এক নজর বুলিয়ে দেখি তিনটা আটান্ন বাজে।

আমার বাসার রাস্তাটার কাছে পৌঁছে গেছি প্রায়, ল্যাসিও আমার সাথে সমান তালে দৌড়াচ্ছে। ওর দিকে না তাকিয়েও এটা বুঝতে পারলাম ওর চোয়ালও আমার মতো শক্ত হয়ে আছে রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয়াতে।

একটা কফিশপ আর একটা লন্ড্রি পার হয়ে গেলাম।

আমার বাসাটা দেখা যাচ্ছে আধক দূরে।

ভাবলাম, একবার ইনগ্রিডকে ফোন দিয়ে জানিয়ে রাখি আমি সময়মতো বাসায় পৌঁছাতে পারিনি, সে যাতে এখানে এসে আমাকে খুঁজে বের করে। কিন্তু সে সময়ও নেই এখন।

ঘড়ির মিনিটের ঘরটা আটান্ন থেকে ঊনষাট হয়ে গেল।

এখনও সময় আছে। মনে হচ্ছে, আমি পারবো।

পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে আরো পঞ্চাশ কদম দৌড়াতে হবে। এরপর তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমার দরজাটাও খুলতে হবে।

বিশ সেকেন্ড পর আমি আর ল্যাসি সিঁড়ি বেয়ে উপরে ছুটছি। আশেপাশে তাকিয়ে শোবার মতো জায়গাও খুঁজতে লাগলাম। আমি চাই না ঘুম থেকে উঠে নিজেকে আবার হাসপাতালে আবিষ্কার করতে।

যখন জরুরি বিভাগের নার্সরা আপনাকে ক্রিসমাসের সময় শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো শুরু করে তখন বুঝবেন, আপনার আসলেও সমস্যা আছে।

এর আগে ছয়বার মাথা ফেটেছে, দু-বার ভেঙেছে হাত, আর একবার পাঁজরের হাড় ভেঙে ফুসফুসের সাথে লেগে গেছিল আমার। অসংখ্য সেলাইর কথা না-হয় বাদই দিলাম। এসবই গত আট বছরের হিসেব মাত্র।

তিনতলার হলওয়েতে পৌঁছে গেছি। আমরা পারবো!

চাবিটা এরমধ্যেই আমার হাতের মুঠোয় উঠে এসেছে।

তালায় চাবিটা ঢুকিয়ে দরজার হ্যাঁন্ডেল ধরে মোচড় দিলাম।

.

আসলে দরজাটা না খুলে গেলেই বোধহয় ভালো হতো, তাহলে আমি হলওয়ের কার্পেটের উপরেই ঢলে পড়তাম। কিন্তু দরজাটা আধখোলা হয়ে থাকলে আমি ভেতরের শক্ত কাঠের মেঝের উপর মুখ থুবড়ে পড়তাম আড়াআড়িভাবে।

অন্তত মনে মনে এই দৃশ্যের কথাই কল্পনা করে রেখেছিলাম। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমি কাঠের মেঝেতে নয়, আমার লিভিংরুমের কার্পেটের উপর পড়ে আছি। মাথার নিচে একটা বালিশ আর শরীরটা কম্বল দিয়ে মোড়ানো। পাশেই কফি টেবিলের উপর এক গ্লাস পানি আর তিনটা অ্যাডভিল রাখা।

একসাথে তিনটা অ্যাডভিলই মুখের ভেতর চালান করে দিয়ে গ্লাসের পাশে রাখা কাগজের টুকরোটা হাতে তুলে নিলাম।

ঘুমকুমার,

তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসে দেখি, তুমি দরজার কাছে মেঝের উপর ঘুমাচেছা। কালকে রাতে আমার সাথে কথা বলার পরে নিশ্চয়ই আবার তোমার মাকে নিয়ে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলে, তাই না? এজন্যে আর সময়মত বাসায় ফিরে আসতে পারোনি। যেভাবে দরজার চৌকাঠের উপর পড়ে ছিলে আমার মনে হয়, আরেকটু সময় পেলে বাসায় ঢুকে যেতে পারতে।

মাঝে মাঝে ভুলে যাই, আমি একজন গোয়েন্দার সাথে প্রেম করছি। পড়তে থাকলাম বাকি লেখাটা :

আমি তোমাকে ভালোমত পরীক্ষা করে দেখেছি। কোথাও বড় ধরণের কোন ব্যথা পাওনি বলেই মনে হচ্ছে। তোমার বাম কাঁধের কাছটা অবশ্য ফুলে উঠতে শুরু করেছিল। ঘুম থেকে উঠেই বরফ লাগাবে সেখানে। তোমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, তোমার নাকটা থেতলে যায়নি (আসলে আমার ভাগ্যও ভালো, না-হলে আমাকেই তো সারাজীবন তোমার নাক ডাকার আওয়াজ সহ্য করতে হতো, হা হা হা)। আমি তোমার পা ধরে টেনে ভেতরে ঢুকিয়েছি। পিঠে একটু ছিলে গেছে বোধহয়, তোমার শার্ট টা বার বার উপরে উঠে যাচিছল।

কোমরের একটু উপরে হাত বোলালাম। আসলেও লাল হয়ে আছে। জায়গাটা।

আর তোমার মা’র সম্পর্কে ও খোঁজ-খবর নিয়েছি। যদিও কালকের তুলনায় তেমন বেশি কিছু জানতে পারিনি। অনেককেই ফোন দিয়েছি সারাদিনে, কিন্তু কেউই মুখ খুলছে না এ ব্যাপারে। মর্গেও ফোন করেছিলাম, কিন্তু ওরা বলল, লাশটা নাকি ম্যাকলিনের ফেডারাল মর্গে স্থানান্তর করা হয়েছে। ওখানেও যখন ফোন দিলাম, তখন হালকা-পাতলা কিছু জানতে পারলাম। কিন্তু এখন সেটা বলতে পারবো না। খুবই জরুরি একটা মিটিং আছে সকালে, তাই থাকতেও পারলাম না। কিন্তু কালকে এসে সবকিছু খুলে বলবো তোমাকে।

তোমার ইনগ্রিড

বি.দ্র : তোমার জন্যে যে থাই খাবারগুলো এনেছিলাম ল্যাসি সেগুলোতে ভাগ বসিয়ে দিয়েছে। আগেভাগেই তোমাকে সাবধান করে দিলাম। বি.দ্র : হ্যাপি অ্যানিভার্সেরি।

হাসিমুখেই চিঠিটা পড়ে শেষ করলাম। কাঁধের ব্যথাটা এখনও কমেনি। ল্যাসিকে খোঁজার জন্য আশেপাশে তাকালাম। ভেবেছিলাম, ব্যাটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখবো সোফার উপর। কিন্তু না, সে ওখানে নেই। নবাবজাদা আমার ঘরে বড় বিছানাটার উপরে ঘুমাচ্ছে। কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে ঘরে ঢুকলাম।

বিছানার পাশের ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে তিনটা তিন।

“ল্যাসি!”

ও চোখটা একবার পিটপিট করল, নাকটা কুঁচকাল শুধু।

“বাহ্, আমার জন্যে অনেক টেনশনে ছিলি দেখা যাচ্ছে!”

মিয়াও।

“তুই কি করবি মানে? অন্তত আমার পাশে তো ঘুমাতে পারতি?”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, আমি জানি তুই একটা কুকুর না।”

মিয়াও।

“তাই না? তুই বিছানায় না শুলে ওটার প্রতি অসম্মান জানানো হতো?”

মিয়াও।

“আচ্ছা, বাদ দে।”

ঘুরে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলাম। অনেক ক্ষিদে পেয়েছে। ফ্রিজটা খোলা রেখেই গোটা দুই স্যান্ডউইচ আর একটা প্রোটিন শেক পেটের ভেতর চালান করে দিলাম।

ল্যাসি হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম।

“না, আমার নাস্তা থেকে কোন ভাগ পাবি না আজকে।”

মিয়াও।

“কারণ ইনগ্রিড আমার জন্য যে থাই খাবারগুলো এনেছিল সেগুলো তুই একাই সাবাড় করে দিয়েছিস।”

মিয়াও।

“কি? খাসনি তুই? এদিকে আয় দেখি।”

আমি নিচু হতেই ব্যাটা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

“হুহ, জানতাম।”

একবার ভাবলাম ঘাড়ে বরফ লাগাই। কিন্তু পরমুহূর্তেই বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা। এত সময় নেই হাতে।

এখন বাজে তিনটা ছয়।

স্কাইপ অন করে বাবাকে ভিডিওকল দিতে গিয়ে মনে পড়ল, মারডক তার ল্যাপটপের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, তাই তার মোবাইলফোনেই কল দিলাম।

চারবার রিং হওয়ার পর ফোনটা তুললেন তিনি।

“হেনরি, কি খবর তোমার?”

“এই তো বাবা।”

“কালকে রাতের জন্যে কিছু মনে করো না।”

“আরে, বাদ দেন। এরকম হয় মাঝে মাঝে। মারডক কি এখনও বাইরে? (বাবা রাগ করলে মাঝে মাঝে মারডককে বাইরে ওর আলাদা ঘরে পাঠিয়ে দেন)।”

“নাহ, ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই না, মারডক?”

ফোনের এপাশ থেকেই মারডকের হুটোপুটির আওয়াজ শুনতে পেলাম।

ল্যাসিও সেটা শুনতে পেয়ে লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে ফোনে থাব দিতে লাগলো।

আরও কিছুক্ষন পর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “গতকাল কেমন কাটলো তোমার?”

‘মা মারা গেছেন।”

“কি?!”

পরের তিন মিনিটে আমি তাকে সবকিছু খুলে বললাম। আমার কথা বলার শেষ করার পরও ওপাশে নীরবতা বজায় থাকলো।

“বাবা?”

“আছি আমি।”

“আপনি কি জানতেন?”

“না।”

“কিন্তু এবার তো সবকিছু মিলে যাচ্ছে, তাই না? মা’র ঐ অদ্ভুত ট্রগুলো কিংবা ওরকম অদ্ভুত সময়ে ফোন আসা…আর কেনই বা তিনি আমাদের ওভাবে ছেড়ে চলে গেলেন। সবকিছুর উত্তরই পেয়ে গেছি। আপনার কি মনে হয়? মা কি আসলেও কোন বড় সন্ত্রাসি সংগঠনের সাথে । যুক্ত ছিলেন?”

কিন্তু বাবার কাছ থেকে কোন জবাবই পেলাম না। ফোনের ওপাশে শুধুই নীরবতা। তিনি নিশ্চয়ই তার নয় বছরের বিবাহিত জীবনের কথা চিন্তা করছেন এখন।

ল্যাসির দিকে তাকালাম। ব্যাটা একটা থাই মুরগির পা চিবোচ্ছে।

“কিরে? তোকে কার্পেটের ওপর খেতে না বলেছি না?”

“ল্যাসি আবার কি করল?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

কালকের ইনগ্রিডের সাথে ফোনকলের পরের ঘটনাটা বললাম তাকে।

“খুব ভালো একটা মেয়ে ইনগ্রিড। ওকে কখনও দূরে সরে যেতে দিয়ো না।”

মনে হয় বাবার এই কথা বলার পেছনে মাকে ধরে রাখতে না পারার আক্ষেপ কাজ করছে। তিনিও নিশ্চয়ই সারাজীবন মা’র সাথে সংসার করতে চেয়েছিলেন। আচ্ছা, ইনগ্রিডের অতীতেও যদি এরকম গোপন কিছু থাকে? আমি কি পারবো মানিয়ে নিতে?

‘কখনোই দেব না,” বললাম তাকে। “আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দিলেন না এখনও। আপনার কি মনে হয়, মা আসলেও একজন সন্ত্রাসি ছিলেন?”

“না, তোমার মা কোনভাবেই কোন সন্ত্রাসি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকতে পারে না।”

উনি এতটা নিশ্চিত গলায় কথাটা বললেন যে, আমি অবাক হয়ে গেলাম।

“আপনি এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে?”

“কারণ তোমার মা সিআইএ’র হয়ে কাজ করতেন,” বোমাটা ফাটিয়ে একটু থামলেন তিনি। “একজন স্পাই ছিল।”

*

অধ্যায় ৫

আমি বাবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার জন্যে অপেক্ষা করছি আমাকে এত সহজেই বোকা বানানোর জন্য। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। ফোনের ওপাশটা নীরবই রইল।

“আপনি বলতে চাচ্ছেন, মা একজন গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন?”

“হ্যাঁ।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান-আপনি যদি এটা আগে থেকেই জানতেন তাহলে সেটা আমার কাছ থেকে এতদিন গোপন করে রেখেছেন কেন?”

“আমি তোমার মাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমাকে এটা কখনও বলবো না।”

“তাতে কি? সেটা তো আজ থেকে প্রায় ত্রিশবছর আগের কথা। এতদিনে সেটা আমাকে জানাতেই পারতেন!”

“আমি দুঃখিত, হেনরি, কিন্তু আমার পক্ষে এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা সম্ভব ছিল না।”

আমি আজ পর্যন্ত বাবার কোন কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি, কিন্তু এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। তিনি এখনও মা’র হয়ে কথা বলে যাচ্ছেন! ফোনটা শক্ত করে গালের সাথে চেপে ধরলাম। “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, এত বড় একটা ব্যাপার আপনি আমার কাছ থেকে গোপন করলেন! আর এতদিন আমি ভেবেছি, মা যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এর জন্যে আমিই দায়ি। কিন্তু সিআইএ’র হয়ে কাজ করলে তো তাকে ওসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হবে, এটাই স্বাভাবিক। আপনি যদি একবার বলতেন, তাহলেই হতো!”

“সে কি কাজ করে এটার সাথে তোমাকে ব্যাপারটা না বলার কোন সম্পর্ক নেই। তোমাকে এটা বুঝতে হবে, সে যে কাজই করুক না কেন, তার কাছে ওটার গুরুত্ব আমাদের চেয়ে বেশি। সেই কাজের জন্যে আমাকে আর তোমাকে এভাবে ফেলে দিয়ে চলে যাবে এটা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। তার উচিত ছিল চাকরি বাদ দিয়ে তোমার দেখাশোনা করা,” বাবাও চড়া গলায় বললেন।

একটু শান্ত হলাম আমি। আমাকে বাবা ব্যাপারটা খুলে বলেননি কারণ তিনি ভেবেছেন, আমি কষ্ট পাবো। আমি হয়ত এটা ভাববো, আমার মা আমাকে ফেলে পুরো পৃথিবী উদ্ধার করতে ব্যস্ত। গলার সুর পাল্টে প্রশ্ন করলাম, “আপনি এটা জানতে পারলেন কিভাবে? মা-ই আপনাকে বলেছিল?”।

“তোমার বয়স ছিল তখন দুই বছর,” অনেকক্ষন চুপ থাকার পর তিনি জবাব দিলেন। “সে কেবলই একটা ট্যুর করে ফিরেছিল তখন। আমি তো ভেবেছিলাম, সে তার কোম্পানির কাজে উত্তর-আফ্রিকার কোন দেশে গেছিল।”

“আচ্ছা, মা যখন অফিসের কাজের নাম করে বাইরে থাকতেন তখন কি আপনাকে সেখান থেকে ফোন করতেন?”

“তোমাকে এটা বুঝতে হবে, আমি আশির দশকের কথা বলছি। তখন সবার হাতে হাতে মোবাইলফোন ছিল না। আর তোমার মায়ের প্রজেক্টগুলোও হতো দুর্গম সব এলাকায়। সুযোগ পেলে হঠাৎ হঠাৎ ফোন করত সে। তা-ও বেশি কথা বলতো না। তুমি কেমন আছো কিংবা ‘হেনরিকে আমার আদর দিও,’ এসব কথা আর কি।”

মা যে আমার কথা তিরিশ বছর আগে ফোন করে জানতে চাইতেন এটা ভেবে একটু হলেও ভালো লাগলো। “বলতে থাকেন।”

“তোমার মা কেবলই আফ্রিকার ট্যুর থেকে ফিরেছেন, আর তুমিও জেগে ছিলে সে সময়। পুরো ঘর জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলে। এটা ওটা নাড়াচাড়া করছিলে। আমি আর তোমার মা সোফার উপর বসে ছিলাম। এদিকে তুমি হঠাৎ করে তোমার মা’র হ্যান্ডব্যাগ থেকে সবকিছু ঢেলে ফেললে। সব মানে সব। লিপস্টিক, মানিব্যাগ, খুচরা পয়সা, এমনকি পাসপোর্টও।” বলে একটু থামলেন তিনি। “তোমার মার পাসপোর্টের ছবিটাও ছিল একটা মজার জিনিস। ছবিতে খুবই অদ্ভুত দেখাতো তাকে। আমি প্রায়ই ক্ষেপাতাম ওকে এটা নিয়ে। কিন্তু সেবার পাসপোর্টটা হাতে নিয়েই জমে গেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে তোমার মা হয়ত নতুন ছবি তুলেছেন আমাকে না জানিয়েই। কিন্তু তখন ছবির নিচের নামটাতে চোখ গেল আমার। এখনও মনে আছে, নামটা লেখা ছিল-রেবেকা হালগে।”

আমি একটা প্যাডে নামটা টুকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এ ব্যাপারে মা কি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন?”

“কোন কৈফিয়তই দেয়নি। সরাসরি আমাকে বলে, সিআইএ’র হয়ে কাজ করে সে।”

“আর আপনি সেটা বিশ্বাস করেছিলেন?”

“আমি যে কি বিশ্বাস করবো আর কি বিশ্বাস করবো না, এটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন সে আমাকে বেজমেন্টের একটা গোপন আলমারি দেখায়। ঠিক সিনেমার মতো ব্যাপার। পাঁচটা পাসপোের্ট, অনেকগুলো দেশের মুদ্রা আর একটা পিস্তল।”

“কি বলেন!!”

“আসলেই!”

“আপনাকে আর অন্য কিছু জানাননি?”

“না, এর বেশি আর একটা শব্দও বের করতে পারিনি ওর মুখ থেকে। ওকে নাকি কী-সব প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলতে হয়। আমাকে কথা দিতে হয়েছিল, ব্যাপারটা যাতে কাউকে না জানাই। এমনকি তোমাকেও না। সঠিক সময় আসলে সে নিজেই তোমাকে সব জানাতে চেয়েছিল।”

“আর আপনি চুপচাপ এটা মেনে নিয়েছিলেন?”

“তো, আর কি করতাম আমি? ওটা তার চাকরি ছিল, তাই না?”

“তিনি যে আপনাকে এতদিন ধরে মিথ্যেগুলো বললেন?”

“দেখো বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি যখন কাউকে মন থেকে ভালোবাসবে তখন এসব জিনিসের সাথে তোমাকে মানিয়ে নিতেই হবে। তোমার মা যতক্ষন আমার সাথে ছিল ততক্ষন তার পরিচয় ছিল স্যালি বিনস। আমার আর তোমার প্রতি তার ভালোবাসাটা তো মিথ্যা ছিল না। কিন্তু চাকরিক্ষেত্রে প্রয়োজনে যদি তাকে অন্য কোন বেশ ধারন করতে হয়, সেখানে আমি কী বলতে পারি।”

“কিন্তু এরপর তিনি যখন আমাদের ফেলে চলে গেলেন? তিনি তো স্যালি বাদ দিয়ে রেবেকা নামটা বেছে নিলেন।”

“হ্যাঁ, এটা তার একটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।”

ক্ষমার অযোগ্য।

আমার ইচ্ছা করছে, পাঁচঘণ্টা ধরে বাবার সাথে ফোনে কথা বলি কিন্তু সেটা করা আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমার অসুখটা নিয়ে সহজে কোন আক্ষেপ করি না। কিন্তু অনেক বছর পর আজকে এই হেনরি বিনস কন্ডিশনের উপর আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

“আচ্ছা বাবা, আজকে আর কথা বলতে পারবো না। কিন্তু কালকে আমি বেআবার ফোন দেব। তখন সবকিছু আমাকে খুলে বলবেন, সব।”

বাবাও আস্তে করে সম্মতি জানালেন ফোনের ওপাশ থেকে। যদিও আমার মনে হয় না তার কাছে বলার মতো খুব বেশি কিছু আর বাকি আছে।

.

এখন বাজে তিনটা তেইশ।

ইন্টারনেট খুলে বসেই ‘রেবেকা হালগেভস’ লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। হালগেভস নামে অনেককে খুঁজে পেলাম সার্চ রেজাল্টে। রেবেকা নামেও

অনেককে খুঁজে পেলাম, কিন্তু শুধু রেবেকা হালগেভস নামের কেউ নেই।

ল্যাসি লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে বসলো। ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে আপনমনে চিন্তা করতে লাগলাম।

আমার মা একজন সন্ত্রাসি নয়, গুপ্তচর। এখন তার বয়স হতে ষাট পয়ষট্টি। এই বয়সে এসে তো আর গুপ্তচরগিরি করতেন না। নাকি করতেন?

আমি এতদিন ভাবতাম, মা হয়ত তার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে পেনশনের টাকায় কোথাও শান্তিতে বসবাস করছেন। কিন্তু সেটা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ তিনি এখন মৃত।

একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে জমা হলো আমার মাথায়।

মা কিভাবে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির রাডারে ধরা পড়লেন? তিনি যদি আসলেও একজন গুপ্তচর হয়ে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে চার নম্বরের বিপদ সংকেত জারি করা হলো কেন? তা-ও আবার লাল রঙের? মা কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন?

আমার মা’র জন্মস্থান যে ঠিক কোথায় এটা এখনও জানি না আমি। কিন্তু আমেরিকা যে নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তার কথায় পূর্ব-ইউরোপের একটা টান থাকতো। নাকি ওটাও মেকি ছিল?

সিআইএ’তে তিনি কি স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যোগদান করেছিলেন? নাকি সিআইএ’র গুপ্তচরের বেশে রাশিয়া কিংবা ইউক্রেনের হয়ে কাজ করে আসছিলেন এতদিন?

প্রেসিডেন্ট সুলিভান অবশ্য ইউক্রেনের সাথে ঝামেলা নিয়ে কথা বলেছিলেন একবার। মা’র মৃত্যু কি কোনভাবে এটার সাথে সম্পর্কযুক্ত?

উফ! সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মাথা নেড়ে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসার চেষ্টা করলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা সাইত্রিশ বাজে।

ল্যাসি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝে গেলাম, ব্যাটা কি বলতে চাইছে।

“আচ্ছা, দিচ্ছি।”

উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বিড়ালের খাবারের প্যাকেটটা বের করে একটা বাটিতে ঢেলে ওর সামনে দিয়ে আমার নিজের জন্য একটা সালাদের বাটি নিয়ে আবার কম্পিউটারের সামনে বসে গেলাম।

.

ভাবলাম, একবার ম্যাকলিনের ফেডারাল মর্গে ফোন দিয়ে মার লাশটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু ওরা ইনগ্রিডকেই কিছু বলেনি, আমাকে তো পাত্তাই দেবে না।

যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসে, মার নাম কি? কি বলবো তখন? স্যালি বিনস নাকি রেবেকা হালগেভস? এ দুটো ছাড়াও তার যে আর কত নাম আছে তা আল্লাহমালুম।

এএসটি আমাকে যে রিপোর্টটা পাঠিয়েছিল সেটা আবার খুললাম। একটা জিনিস এই প্রথম চোখে পড়ল। যদিও ধারণা করা হচ্ছে মা’র মৃত্যু হয়েছে। তার লাশটা খুঁজে পাওয়ার চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘন্টা আগে কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার একটা নির্দিষ্ট সময়ও উল্লেখ করে দিয়েছেন-শনিবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে। ঐদিন ছিল অক্টোবরের দুই তারিখ।

নিয়তির খেলা কতই না অদ্ভুত! এত সময় থাকতে মা কিনা মারা গেলেন এমন সময়ে যখন আমি জেগে থাকি। আচ্ছা, মার মাথায় যখন গুলিটা ঢুকছিল তখন আমি কি করছিলাম? শনিবারের রুটিন তো একদমই সাদামাটা। এই একটু গেম অব থ্রোন্স দেখেছি, খাওয়া-দাওয়া করেছি, কিছুক্ষণ দৌড়ে এসে স্টক মার্কেটে ঢু মেরেছিলাম। অন্যরকম কোন কিছু তো ঘটেনি সে রাতে। কিন্তু…? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এ ব্যাপারটাই খোঁচাচ্ছে। এতক্ষণ আমাকে।

সেদিন যখন দৌড়াতে যাওয়ার জন্যে দরজাটা খুলি তখন একটা প্যাকেট পড়ে ছিল সামনে। এটা অবশ্য তেমন অদ্ভুত কিছু না। কারণ আমাজনে প্রায়ই আমি জিনিসপত্র অর্ডার দেই। কিন্তু প্যাকেটগুলো আমার চোখে পড়ে না, কারণ আমার হয়ে ইসাবেলই সব ডেলিভারি নেয় আর সবকিছু খুলেও দেখে। সেটা জামাকাপড় কিংবা বইপত্র যাই হোক না কেন।

কিন্তু শুক্র আর শনিবার ইসাবেলের ছুটি। এ দুইদিন সে আসে না। এই সময়ের মধ্যে কিছু আসলে সেটা বাইরেই পড়ে থাকে, আর আমাকেই সব কিছু খুলে দেখতে হয়। তাই আমি চেষ্টা করি সবকিছু রোববারে অর্ডার করতে, তাহলে শুক্রবারের আগেই বাসায় পৌঁছে যায় জিনিসগুলো।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেদিন প্যাকেটে করে যে ডিভিডিটা এসেছিল সেটা আমি অর্ডার করিনি।

আমি ভেবেছিলাম বাবা হয়ত আমার হয়ে অর্ডার করে দিয়েছেন। এটা তিনি আগেও করেছেন। যদিও আমি বেশ কয়েকবার তাকে বলেছি ইন্টারনেট থেকে সিনেমা ডাউনলোড করে নিতে পারি। তারপরও তিনি ডিভিডি পাটাতেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ব্যাপারে তখন বলেছিলেন, তিনি মোটেও আমার জন্যে ঐ ফালতু এলিয়েনদের সিনেমাটা অর্ডার করেননি।

আমার কাছে মনে হয়েছিল তিনি মজা করছেন।

কারণ এ ওয়াক টু রিমেমবার নামে একটা সিনেমা যখন বের হয়েছিল তখনো তিনি এ কাজটা করেন। নিজে অর্ডার করে পরে এমন ভাব নেন যেন কিছুই জানেন না এ ব্যাপারে।

আমিও গেম অব থ্রোন্স দেখা নিয়ে অনেক ব্যস্ত। আর মাত্র দুই সিজন বাকি আছে। তাই এর মাঝে অন্য কিছু দেখার কথা মাথায়ই আসেনি। তাছাড়া, বাবা আমাকে এর আগে যে দুটো সিনেমা পাঠিয়েছিলেন-শশাঙ্ক রিডেম্পশন আর মিডনাইট এক্সপ্রেস-ও দুটোও দেখা হয়নি তখনও। তাই পাঁচদিন আগে নতুন ডিভিডিটা বুকশেলফের একদম নিচে রেখে ওটার কথা ভুলেই গেছিলাম।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বাবা হয়ত আসলেই ডিভিডিটা পাঠাননি।

অন্য কেউ কি পাঠাতে পারে?

মা?

.

মাকে সন্ত্রাসি আখ্যা দেয়ার পেছনে একটা কারণ হতে পারে, তিনি হয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতেন অথবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুরি করেছিলেন। আচ্ছা, উনি কি জাতীয় পর্যায়ের কোন তথ্য চুরি করেছিলেন? যার কারণে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তার পেছনে লাগে?

ইনগ্রিড কালকে কালো স্যুট পরা এক লোকের কথা বলেছিল, যে নিজেকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বলে দাবি করে।

আমি দৌড়ে গিয়ে বুকশেলফের একদম নিচ থেকে ডিভিডিটা বের করে হাতে তুলে নিলাম : মেন ইন ব্ল্যাক।

ডিভিডির কেসটা খুলে দেখলাম ভেতরে কিছু লেখা আছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না। এবার ডিভিডিটা কম্পিউটারের উপর রেখে দৌড়ে ময়লা ফেলার বাক্সটার সামনে গেলাম এই আশায়, ভেতরে হয়ত আমাজনের প্যাকেটটা থাকবে। কিন্তু না, ময়লার বাক্সটা একদম খালি। আচ্ছা, ঐ বাদামি রঙের কার্ডবোর্ডের প্যাকেটটায় কি কিছু লেখা থাকতে পারে?

এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে, মা’র মৃত্যুর সময় সম্পর্কে ডাক্তারদের ধারণা হয়ত আসলেও সঠিক। মার পক্ষে এটা খুবই সম্ভব, তিনি আমাজনের একটা প্যাকেট নকল করে আমার দরজার সামনে রেখে যেতে পারেন। কারণ বহুদিন ধরে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি করে আসছেন।

মার লাশটাও পাওয়া গেছে আমার বাসা থেকে মাত্র ছয়মাইল দূরে। এটা কি কাকতালিয় ঘটনা? নাকি তিনি আসলেও আমার বাসার সামনে এসেছিলেন?

এখন বাজে তিনটা উনপঞ্চাশ।

কম্পিউটারের সামনে বসে সিনেমাটা ছেড়ে দিলাম।

অপেক্ষা করছি, পর্দায় হয়ত যেকোন মুহূর্তে ভেসে উঠবে কোন গোপন পারমাণবিক বোমার ছবি কিংবা রাশিয়ার গুপ্তচরদের কোন তালিকা। এমনটাও হতে পারে, প্রেসিডেন্টের কোন রগরগে ভিডিও প্লে হওয়া শুরু করবে এখনই।

কিন্তু পর্দায় যেটা শুরু হলো সেটার কথা আমি কল্পনাও করিনি।

বালের সিনেমাটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *